০৪.২ বড়দিনের পর

অধ্যায়-১১

বড়দিনের পরবর্তী তৃতীয় দিনে নিকলাস বাড়িতেই ডিনার খেল, ইদানীং এ কাজটা সে বড় একটা করেনি। একটা বড় মাপের বিদায়-ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল, কারণ এপিফেনি পর্বের পরেই সে ও দেনিসভ রেজিমেন্টে যোগ দিতে যাত্রা করবে। দেনিসভ ও দলখভ সহ প্রায় বিশজন তাতে উপস্থিত হয়েছিল।

এবারকার ছুটির সময়টাতে বাতাসে যেভাবে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছিল, রস্তভদের বাড়িতে প্রেমের যে জোরালো আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনটি আগে কখনো হয়নি। সুখের মুহূর্তটাকে আঁকড়ে ধরে, ভালোবাস, ভালোবাসা পাও! পৃথিবীতে এটাই তো একমাত্র সত্য। আর সবই বোকামি। এখানে এটাই তো আমাদের একমাত্র আকর্ষণ-এই বাণীই যেন সর্বত্র শোনাতে লাগল।

নানান জায়গায় দেখা সাক্ষাৎ উপলক্ষে ছুটোছুটি করে খুবই ক্লান্ত নিকলাস সেদিন বাড়ি ফিরল ডিনারের ঠিক আগে। বাড়িতে ঢুকে বাড়ির প্রেমের আবহাওয়ায় কেমন যেন একটা টান-টান ভাব লক্ষ্য করল। সোনিয়া, দলখভ এমন কি বুড়ি প্রিন্সেস এবং কিছুটা নাতাশাকেও যেন বিচলিত মনে হল। সে বুঝতে পারল, সোনিয়া ও দলখভের মধ্যে একটা কিছু ঘটেছে। সেদিন সন্ধ্যায়ই একটা বল-নাচের আসর বসবে, নৃত্যশিক্ষক ইয়োগেল ছুটির মধ্যে তার ছাত্রছাত্রীর জন্য এই নাচের আয়োজন করেছে।

নাতাশা বলল, নিকলাস, তুমি ইয়োগেলের ওখানে যাচ্ছ তো? দয়া করে যেও! সে তোমাকে যেতে বলেছে, ভাসিলি দিমিত্রিচও (দেনিসভ) যাচ্ছে।

দেনিসভ বলে উঠল, কাউন্টেসের হুকুম হলে আমি কোথায় না যেতে পারি! এমন কি pas de chale নাচতেও রাজি আছি।

নিকলাস জবাব দিল, যদি সময় পাই। কিন্তু আমি যে আর্থারভদের কথা দিয়েছি, তাদের একটা পার্টি আছে।

আর তুমি? সে দেনিসভকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু প্রশ্নটা করেই তার মনে হল কাজটা ঠিক হয়নি।

সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে দলখভ রাগত নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল, হয়তো।

নিশ্চয় একটা কিছু ঘটেছে, নিকলাস ভাবল। তার এই সিদ্ধান্ত আরো পাকা হল যখন ডিনারের পরেই দলখভ সেখানে থেকে চলে গেল। নাতাশাকে ডেকে জানতে চাইল ব্যাপারটা কি।

ছুটে এসে নাতাশা বলল, আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম। বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বলল, আমি তো বলেছিলাম, তুমি বিশ্বাস করনি। সে সোনিয়ার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছে।

নিকলাস ইদানীং সোনিয়াকে নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায় না, তবু খবরটা শুনে তার মনের কোথায় যেন একটা ধাক্কা লাগল। একটি যৌতুকহীনা, বাপ-মা-হারা মেয়ের পক্ষে দেনিসভ তো সত্যি উপযুক্ত এবং কোনো কোনো বিষয়ে খুবই ভালো বর। বুড়ি কাউন্টেস ও সমাজের দিক থেকেও সোনিয়ার পক্ষে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই খবরটা শুনে প্রথমেই নিকলাসের মনে সোনিয়ার প্রতি রাগ দেখা দিল।…সে বলতে চাইল এ তো চমৎকার, ছেলেমানুষী প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে এ প্রস্তাব গ্রহণ করাই তো তার উচিত, কিন্তু সে-কথা বলার আগেই নাতাশা আবার শুরু করে দিল।

আর ভাব তো! সে পরিষ্কারভাবে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে! একটু থেমে আবার বলল, তাকে বলে দিয়েছে ও নাকি আর কাউকে ভালোবাসে।

ঠিক, আমার সোনিয়া এ ছাড়া আর কিছু করতে পারে না! নিকলাস ভাবল।

মামণি এত পীড়াপীড়ি করল, সে কিছুতেই শুনল না, আমি জানি, সে যখন একবার না বলেছে তখন আর মত বদলাবে না…

মামণি তাকে চাপ দিয়েছিল? নিকলাসের গলায় তিরস্কারের সুর।

নাতাশা বলল, হ্যাঁ। তুমি কি জান নিকলাস-রাগ করো না কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি যে তুমি তাকে বিয়ে করবে না।

নিকলাস বলল, না, সেকথা তুমি মোটেই জান না। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। সোনিয়া কত ভালো মেয়ে! সে হেসে বলল।

আঃ, সত্যি সে বড় ভালো মেয়ে! আমি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার কাছে। দাদাকে চুমো খেয়ে নাতাশা ছুটে বেরিয়ে গেল।

এক মিনিট পরে সোনিয়া এল, তার চোখে-মুখে ভয় ও অপরাধের ভাব। নিকলাস এগিয়ে গিয়ে তার হাতে চুমো খেল। ফিরে আসার পরে এই প্রথম তারা নির্জনে তাদের ভালোবাসার কথা বলতে লাগল।

প্রথমে ভীরু গলায় তারপর ক্রমাগত সাহসের সঙ্গে নিকলাস বলতে লাগল, সোফি, যে লোকটি শুধু যে ভালো ও সুবিধাজনক বর তাই নয়, যে অত্যন্ত চমৎকার ও মহান…সে আমার বন্ধু…তাকে যদি তুমি ফিরিয়ে দিতে চাও…

সোনিয়া বাধা দিল।

তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমি তো আগেই ফিরিয়ে দিয়েছি।

যদি আমার জন্য ফিরিয়ে দিয়ে থাক তো আমার আশংকা হচ্ছে আমি…

সোনিয়া আবার বাধা দিল। ভয়ার্ত, মিনতি ভরা চোখে তার দিকে তাকাল।

নিকলাস, ও কথা আমাকে বল না, সোনিয়া বলল।

না, আমাকে বলতেই হবে। এটা আমার অহংকার বলে মনে হতে পারে, তবু একথা বলাই ভালো। আমার জন্য যদি তুমি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে থাক তাহলে সব কথা আমাকে বলতেই হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর আমি মনে করি অন্য সকলের চাইতে তোমাকে আমি বেশি ভালোবাসি…

আমার কাছে সেটাই যথেষ্ট, লজ্জায় লাল হয়ে সোনিয়া বলল।

না, কিন্তু আমি হাজারবার প্রেমে পড়েছি, আবারও প্রেমে পড়ব, কিন্তু তোমার মতো এমন করে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ও ভালোবাসার বাঁধনে আর কারো সঙ্গে বাঁধা পড়িনি। তাছাড়া আমার বয়স অল্প। মামণির এটা ইচ্ছা নয়। এক কথায়, আমি কোনো কথা দিতে পারছি না। আমি মিনতি করছি, দলখভের প্রস্তাবটা তুমি আর একবার বিবেচনা করে দেখ, অনেক কষ্টে বন্ধুর নামটি উচ্চারণ করে সে বলল।

আমাকে ও-কথা বল না! আমি কিছু চাই না। তোমাকে আমি দাদার মতো ভালোবাসি, চিরদিন তাই বাসব। এর বেশি কিছু চাই না।

তুমি একটি দেবদূত : আমি তোমার উপযুক্ত নই, কিন্তু আমার ভয় হয় পাছে তোমাকে ভুলপথে নিয়ে যাই।

নিকলাস আর একবার তার হাতে চুমো খেল।

.

অধ্যায়-১২

মস্কোতে ইয়োগেলের নাচের আসর খুবই উপভোগ্য হল। ছেলেমেয়েদের নতুন-শেখা নাচ দেখে মায়েরা সে কথা বলল, যারা অক্লান্তভাবে নেচে গেল সেই তরুণ-তরুণীরাও সে-কথা বলল, আর যেসব বয়স্ক যুবক যুবতীরা যেন কৃপা করেই নাচের আসরে এসেছিল তাদেরও খুবই ভালো লাগল। বেজুখভের বাড়ির নাচ ঘরটাই ইয়োগেল নিয়েছিল, আর সকলেই বলল যে আসরটা খুবই সফল হয়েছে। যেসব সুন্দরী সেখানে হাজির হয়েছিল, রস্ত পরিবারের দুই মেয়েই তাদের মধ্যে সেরা সুন্দরী।

নাচ-ঘরে ঢুকেই নাতাশা যেন প্রেমে পড়ে গেল। বিশেষ করে কোনো এক জনের প্রেমে নয়, সকলের প্রেমে। যাকে দেখছে সেই মুহূর্তের জন্য তারই প্রেমে পড়ছে।

সোনিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে বলল, আঃ, কী মজা!

পৃষ্ঠপোষকের সদয় দৃষ্টিতে নাচিয়েদের দেখতে দেখতে নিকলাস ও দেনিসভ ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল।

দেনিসভ বলে উঠল, কী মিষ্টি দেখতে,-বড় হলে সত্যিকারের রূপসী হবে!

কে?

কাউন্টেস নাতাশা, দেনিসভ জবাব দিল। একটু থেমে বলল, আর কী নাচে! কী কমনিয়তা!

কার কথা বলছ?

তোমার বোনের, দেনিসভ রেগে জবাব দিল ।

রস্তভ হাসল।

নিকলাসের কাছে এসে ইয়োগেল বলল, কাউন্ট, তুমি ছিলে আমার সেরা ছাত্রদের একজন,-তোমাকে নাচতেই হবে। দেখ, কত সব সুন্দরী মেয়ে এসেছে- দেনিসভকেও সে ওই একই অনুরোধ জানাল, সেও তার প্রাক্তন ছাত্র।

না বাবা, আমি কাগজের ফুল, দেনিসভ বলল। আপনার কি মনে নেই আপনার শিক্ষার কি হাল আমি করেছি

আরে না, না, তুমি একটু অমনোযোগী ছিলে এই যা, কিন্তু তোমার ক্ষমতা ছিল,-আরে হ্যাঁ, তোমার মধ্যে ক্ষমতা ছিল!

সদ্য প্রচলিত মাজুকার সুরে ব্যান্ড বেজে উঠল। নিকলাস ইয়োগেলের প্রস্তাব ফেরাত পারল না। সোনিয়াকে তার সঙ্গে নাচতে বলল। দেনিসভ বয়স্কা মহিলাদের দলে ভিড়ে তলোয়ারে ভর দিয়ে পায়ে তাল দিতে দিতে নানা মজার কথা বলতে লাগল। ইয়োগেল ও তার গর্বের সেরা ছাত্রী নাতাশাই নাচের প্রথম জুটি হল। দেনিসভ তার উপর থেকে চোখ ফেরাল না, তলোয়ার ঠুকে এমনভাবে তাল দিতে লাগল যেন সে বোঝাতে চাইছে সে যে নাচছে না সেটা সে নাচতে পারে না বলে নয়, নাচতে চায়নি বলে। নাচের ফাঁকে একসময় সে রস্তভকে ডেকে বলল, এ তো মোটেই হচ্ছে না। এটা কী ধরনের পোলিশ মাজুকা? নাতাশা কিন্তু চমৎকার নাচে।

নিকলাস জানে, পোল্যান্ডেও মাজুকা নাচে দেনিসভের খুব নাম আছে, নাতাশার কাছে ছুটে গিয়ে বলল, এবার দেনিসভকে জুটি কর। সে সত্যিকারের নাচিয়ে, অপূর্ব!

জুটি নির্বাচনের সময় এলে নাতাশা পায়ে পায়ে দেনিসভের কাছে এগিয়ে গেল। নিকলাস দেখল, দেনিসভ ও নাতাশা হেসে হেসে কথা কাটাকাটি করছে, দেনিসভ আপত্তি করলেও খুশিতে হাসছে। সে তাদের কাছে ছুটে গেল। নাতাশা বলছে, ভাসিলি দিমিত্রিচ, দয়া করে আসুন।

না, না, আমাকে ছেড়ে দিন কাউন্টেস, দেনিস জবাবে বলছে।

এবার ভাস্কা, নিকলাস বলল।

দেনিসভ তামাশা করে বলল, এরা আমাকে এমনভাবে পিঠ চাপড়ায় যেন আমি একটা বিড়ালছানা ভাসকা!

নাতাশা বলল, আমি আপনাকে সারা সন্ধ্যা গান শোনাব।

আঃ, স্বর্গের পরি! আমাকে নিয়ে এ দেখছি যা খুশি তাই করতে পারে!

দেনিসভ তলোয়ার খুলে ফেলল। চেয়ারের পিছন থেকে এগিয়ে এসে শক্ত করে সঙ্গিনীর হাতটা চেপে ধরে সে নাচের তালে ফেলবার অপেক্ষায় পাটা তুলল। দেখতে ছোটখাট হলেও ঘোড়ার পিটে আর মাজুকার আসরে দেনিসভকে মোটেই ছোট মনে হয় না, তখন সে সুদর্শন যুবাপুরুষটি।

যদিও ইয়োগেল তাদের নাচকে আসল মাজুকা বলে স্বীকার করল না, তবু দেনিসভের কলাকৌশল দেখে সকলেই খুশি হল, বারবার তার কাছে নাচের জুটি হবার ডাক এল, আর বুড়োরা হেসে হেসে পোল্যান্ড ও পুরোনো সুদিনের কথা বলতে লাগল। মাজুকার শেষে পরিশ্রমে লাল হয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দেনিসভ নাতাশার পাশে গিয়ে বসল, বাকি সময়টা একবারও তাকে ছেড়ে গেল না।

*

অধ্যায়-১৩

তারপর দুই দিন পর্যন্ত রস্তভ দলখভের দেখাই পেল না-না তা বাড়িতে, না দলখভের বাড়িতে। তৃতীয় দিনে তার কাছ থেকে একটা চিঠি পেল :

যেহেতু তোমাদের বাড়িতে এখন আর আমি যেতে চাই না-কারণটা তুমি জান-এবং যেহেতু আমি রেজিমেন্টেই ফিরে যাচ্ছি, তাই আজ রাতে বন্ধুদের জন্য একটা বিদায়-ভভাজের আয়োজন করেছি–ইংলিশ হোটেলে এসো।

পরিবারের লোকজন ও দেনিসভকে নিয়ে রস্তভ থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল। প্রায় দশটা নাগাদ সেখান থেকে সোজা চলে গেল ইংলিশ হোটেলে। তাকে সবচাইতে ভালো ঘরটা দেখিয়ে দেওয়া হল। একটা টেবিলকে ঘিলে জনবিশেক লোক একত্র হয়েছে, দুটো মোমবাতির মাঝখানে দলখভ বসে আছে। টেবিলের উপর একগাদা স্বর্ণমুদ্রা ও নোট, সবটাই তার হেপাজতে। তার বিয়ের প্রস্তাব সোনিয়ার প্রত্যাখ্যানের পরে তার সঙ্গে রস্তভের দেখা হয়নি, তাই রস্তভের কিছুটা অস্বস্তি হতে লাগল।

দলখভ কিন্তু রস্তভ ঘরে ঢুকতেই নির্বিকার চোখে তার দিকে তাকাল।

বলল, অনেকদিন আমাকে দেখা হয়নি। এসেছ বলে ধন্যবাদ। তাসটা এখনই শেষ হবে, তারপরই শুরু হবে ইলিউশকার সমবেত সঙ্গীত।

রস্তভ একটু লাল হয়ে বলল, দুই একবার তোমার বাড়িতেও ঢুঁ মেরেছি।

দলখভ কোনো জবাব দিল না।

শুধু বলল, তুমিও খেলতে পার।

সেই মুহূর্তে দলখভের একটা আশ্চর্য কথা রশুভের মনে পড়ে গেল, সে বলেছিল, একমাত্র বোকারা ছাড়া আর কেউ তাদের ভাগ্যে বিশ্বাস করে না।

যেন রশুভের মনের কথাটা ধরতে পেরেই দলখভ এবার বলল, নাকি আমার সঙ্গে খেলতে তোমার ভয় করছে?

রস্তভ অস্বস্তি বোধ করল। দলখভের কথার জবাবে একটা ঠাট্টা করতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। কিন্তু সে কিছু ভেবে উঠবকার আগেই দলখভ বলল, ঠিক আছে, তোমার না খেলাই ভালো। এক প্যাকেট নতুন তাস শাফল করে বলল : মশাইরা, টাকা ছাড় ন!

সে তাস বাটতে শুরু করল। রস্তভ তার পাশে বসল, প্রথমে খেলায় যোগ দিল না। দলখভ বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল।

আর কি আশ্চর্য, নিকলাসও একটা তাস তুলে নিয়ে অল্প কিছু বাজি রেখে খেলতে শুরু করল।

বলল, আমার সঙ্গে টাকা নেই।

তোমাকে আমি বিশ্বাস করি।

রস্তভ একটা তাসের উপর পাঁচ রুবল বাজি ধরে হেরে গেল, আবার বাজি ধরল, আবার হেরে গেল। রস্তভের দশখানা তাস দলখভ মেরে দিল।

খেলা চলতে লাগল, ওয়েটারও শ্যাম্পেন পরিবেশন করে চলল।

রস্তভের সব তাস মার খেল, তার হিসেবে লেখা পড়ল আটশো রুবল। একটা তাসের উপর সেও লিখল ৮০০ রুবল, কিন্তু ওয়েটার তার গ্লাসটা ভর্তি করে দিতেই সে মত পাল্টে বিশ রুবল বাজির কথাটাই লিখল।

রস্তভের দিকে না তাকিয়েই দলখভ, ওটা ছেড়ে দাও, অচিরেই তুমি সবটাই জিততে পারবে। আমি অন্যের কাছে হারি, কিন্তু তোমার কাছে জিতে যাই। না কি তুমি আমাকে ভয় কর? প্রশ্নটা সে আর একবার করল।

রস্তভ তার কথা শুনল। আটশো বাজি ধরাই স্থির করল। কোণ ছেঁড়া একটা হরতনের সাতকরা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে সে টেবিলের উপর রাখল। এই সাতকরাটার কথা তার অনেককাল পর্যন্ত মনে ছিল। একটুকরো ভাঙা চক দিয়ে সেই সাতকরার উপরে সে পরিষ্কার অক্ষরে লিখল ৮০০ রুবল। হাতের শ্যাম্পেনের গ্লাসটা খালি করে দলখভের কথায় একটু হাসল, তারপর একখানা সাতকরা দেখার আশায় দলখভের হাতের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে ভগ্নহৃদয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এই হরতনের সাতকরার হার জিতের উপর রস্তভের অনেক কিছু নির্ভর করছে। আগের রবিবারে বুড়ো কাউন্ট ছেলেকে দু হাজার রুবল দিয়ে বলেছে, মে মাসের আগে আর কোনো টাকা সে দিতে পারবে না, কাজেই রস্তভ যেন হিসেব করে চলে। নিকলাস তখন বলে দিয়েছে, এই টাকাই এখন যথেষ্ট, বসন্তকালের আগে সে আর টাকা চাইবে না। সে টাকার মাত্র বারোশো রুবল অবশিষ্ট আছে : কাজেই তার কাছে এই হরতনের সাতকরার অর্থ এখন শুধু ষোলোশো রুবল হার নয়, নিজের কথারও খেলাপ।

দলখভ আর একবার বলল, তাহলে আমার সঙ্গে খেলতে তোমার ভয় নেই। তারপর যেন একটা ভালো কথা শোনাতে যাচ্ছে এমনিভাবে তাসটা নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে ইচ্ছা করেই একটু হেসে বলতে শুরু করল, দেখুন ভদ্রজনরা, আমি শুনেছি মস্কোতে জোর গুজব যে আমি একজন তাসের জুয়াড়ি, কাজেই আপনাদের আমি সতর্ক করে দিচ্ছি।

এবার তাসটা বাট! রস্তভ হুংকার দিল।

ওঃ, যতসব মস্কোই গুজব! বলে দলখভ হেসে তাস তুলে নিল।

আ-আ! দুই হাত মাথায় তুলে রস্তভ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। যে সাতকরাটা তার দরকার সেটা রয়েছে সকলের উপরে-প্যাকেটের প্রথম তাস। যতটা দেবার ক্ষমতা আছে তার বেশি সে হেরেছে।

তাস বাটতে বাটতে বাঁকা চোখে রশুভের দিকে তাকিয়ে দলখভ বলল, এখনো সময় আছে, নিজের সর্বনাশ করো না।

*

অধ্যায়-১৪

ঘণ্টা দেড়েক পরে অধিকাংশ খেলুড়ের নিজেদের খেলায় কোনো আগ্রহ রইল না।

সমস্ত আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হল রস্তভের উপর। ষোলোশো রুবলের পরিবর্তে তার নামে টাকার অংকের একটা লম্বা ফিরিস্তি বসে গেল, তার দশ হাজার পর্যন্ত সে গুনেছিল, কিন্তু তার ধারণা এখন সেটা পনেরো হাজার দাঁড়িয়েছে। আসলে অংকটা ইতিমধ্যেই বিশ হাজার রুবল ছাড়িয়ে গেছে। দলখভ এখন আর কোনো গল্প শুনছেও না বলছেও না, সে শুধু লক্ষ্য রাখছে রশুভের হাতের উপর, আর মাঝে মাঝে তার নামের পাশে লেখা টাকার অংকগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। স্থির করেছে, অঙ্কটা তেতাল্লিশ হাজারে না ওঠা পর্যন্ত সে খেলা চালিয়ে যাবে। এই সংখ্যাটা বেছে নেবার কারণ, তেতাল্লিশ হচ্ছে তার ও সোনিয়ার বয়সের যোগফল। দুই হাতের উপর মাথা রেখে রস্তভ টেবিলের পাশে বসে আছে, টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে নানা সংখ্যা, ছিটনো রয়েছে মদ, আর ছড়িয়ে আছে তাস। একটা যন্ত্রণাদায়ক চিন্তা কিছুতেই তার মন থেকে যাচ্ছে না : যে দুটি চওড়া-হাড়ের লালচে হাত যার লোমশ কব্জি শার্টের আস্তিনের নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, যে হাত দুটিকে সে ভালোবাসে, ঘৃণা করে, তার কবল থেকে সে মুক্তি পাবে না।

রস্তভ বসে বসে ভাবতে লাগল : সে তো জানে আমার কাছে এই হারের অর্থ কি। আমার সর্বনাশ হোক সেটা নিশ্চয় সে চায় না। একসময় সে কি আমার বন্ধু ছিল না? আমি কি তাকে ভালোবাসতাম না? কিন্তু এটা তো তার দোষ নয়। ভাগ্য এত খারাপ হলে সেই বা কি করবে?…আবার আমারও তো দোষ নয়। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। আমি কি কাউকে খুন করেছি, কারো ক্ষতি করতে চেয়েছি? তাহলে আমার এই ভয়ংকর দুর্ভাগ্য হল কেন? কখন এর শুরু? আমি তো এই কথা মনে করেই টেবিলে বসেছিলাম যে মামণির নামকরণ দিবসের উপহার হিসেবে একটা অলংকারের বাক্স কিনবার জন্য একশো রুবল জিতেই এখান থেকে বাড়ি চলে যাব। আমি কত সুখী ছিলাম, কত স্বাধীন ছিলাম, মেজাজ কত হাল্কা ছিল! কখন তা শেষ হয়ে গেল, আর কখনই বা শুরু হল এই ভয়ংকর অবস্থা? এখনো তো আমি সুস্থ ও সবল আছি, তবু তো এভাবে এখানেই বসে আছি। না, এ হতে পারে না! নিশ্চয় এ সব কিছুই বৃথা হয়ে যাবে!

ঘরটা মোটেই গরম নয়, তবু সে ঘেমে নেয়ে উঠল। তার মুখটা ভয়ংকর ও করুণ হয়ে উঠেছে।

তার নামে পাশের অঙ্কটা দুর্ভাগা তেতাল্লিশ হাজারে পৌঁছে গেল। আর অমনি তাসের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দলখভ তাড়াতাড়ি রস্তভের ঋণের অঙ্কটা যোগ করতে বসল, এবং মোটা মোটা অক্ষরে লিখতে গিয়ে চকটাই ভেঙে ফেলল।

রাতের খাবার, রাতের খাবারের সময় হয়েছে। আর এই যে জিপসিরাও এসে পড়েছে। জিপসি ভাষায় কি যেন বলতে বলতে কতকগুলি কালো কালো পুরুষ ও নারী ঘরে ঢুকল। নিকলাস বুঝল, সব শেষ হয়ে গেল, নির্বিকার গলায় বলল, আর খেলবে না? আমার হাতে যে একটা চমৎকার তাস এসেছিল।

সে ভাবল, সব শেষ! আমার সর্বনাশ হয়েছে। এখন শুধু মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে একটা বুলেট চলে যাবে–এছাড়া আমার জন্য আর কিছুই বাকি নেই!

অথচ সঙ্গে সঙ্গেই সে খুশির সুরে বলে উঠল, আরে এসো, শুধু এই ছোট তাসটা!

যোগটা শেষ করে দলখভ বলল, ঠিক আছে! একুশ রুবল! যোগফলের অঙ্কটা তেতাল্লিশ হাজার থেকে একুশ রুবল বেশি হয়েছে। সে তাসের প্যাকেটটা হাতে নিল। যদিও রশুভের ইচ্ছা ছিল ছয় হাজার লিখবে, তবু দলখভের কথামতো তাসটার একটা কোণ বাঁকিয়ে স্পষ্ট করে লিখল একুশ রুবল।

বলল, আমার কাছে সবই সমান। আমি শুধু দেখতে চাই তুমি আমাকে এই দশকরাটা জিততে দাও কি না।

দলখভ গম্ভীরভাবে তাস বাটতে শুরু করল ।… দশকরাটা তার ভাগ্যেই পড়ল।

তুমি আমার কাছে তেতাল্লিশ হাজার ধার কাউন্ট, বলে দলখভ শরীরটা টান টান করে টেবিল থেকে উঠল। এতক্ষণ বসে থাকলে বড়ই ক্লান্ত লাগে।

হ্যাঁ, আমিও খুব ক্লান্ত, বস্তভ বলল।

দলখভ তাকে থামিয়ে দিল, যেন তাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে তার পক্ষে এটা ঠাট্টা করার সময় নয়।

টাকাটা কখন পাচ্ছি কাউন্ট?

লজ্জায় লাল হয়ে রস্তভ টানতে টানতে দলখভকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।

সবটা তো এক্ষুনি দিতে পারছি না। তুমি কি একটা I.Q.U. নেবে? সে বলল।

হেসে রস্তভের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে দলখভ বলল, তুমি তো প্রবাদটা জানো– ভালোবাসার ভাগ্য যার ভালো, তার তাসের ভাগ্য খারাপ। আমি জানি সোনিয়া তোমাকে ভালোবাসে।

তোমার সম্পর্কিত বোন…দলখভ কথাটা শুরু করতেই নিকলাস তাকে বাধা দিল। হিংস্র কণ্ঠে বলে উঠল, আমার সে বোনের সঙ্গে এ সবের কোনো সম্পর্ক নেই, আর তার নাম উল্লেখেরও কোনো প্রয়োজন দেখি না?

তাহলে টাকাটা কখন পাচ্ছি?

কাল, বলেই রস্তভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

*

অধ্যায়-১৫

আত্মর্যাদার অনুকূল সুরে কাল বলাটা শক্ত নয়, কিন্তু একাকি বাড়ি ফিরে যাওয়া, বোন, ভাই, মা ও বাবার সঙ্গে দেখা করা, সব কথা স্বীকার করা, এবং কথা দেবার পরেও টাকা চাওয়া-সে বড় ভয়ংকর।

বাড়িতে তখনো কেউ শুতে যায়নি। ছোটরা থিয়েটার থেকে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে ক্ল্যাভিকর্ডকে ঘিরে জমে গেছে। এবার শীতকালে রস্তভ-পরিবারে ভালোবাসার যে কাব্যিক আবহাওয়া ছড়িয়ে আছে, ঘরে ঢোকামাত্রই সেই আবহাওয়া রস্তভকে ঘিরে ধরল, কিন্তু এখন দলখভের বিয়ের প্রস্তাব ও ইয়োগেলের নাচের আসরের পরে সেই আবহাওয়া ঝড়ের আগেকার বাতাসের মতো সোনিয়া ও নাতাশাকে ঘিরে ঘন হয়ে নেমেছে। তারা দুজন ক্ল্যাভিকর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে খুশিতে হাসছে। বসবার ঘরে ভেরা শিনশিনের সঙ্গে দাবা খেলছে। স্বামী ও পুত্রের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় বুড়ি কাউন্টের আর একটি বুড়ির সঙ্গে পেশেন্স খেলছে। ঝিলমিল চোখ ও এলোমেলো চুল নিয়ে দেনিসভ ক্ল্যাভিকর্ডে বসে তারে আঙুল নাড়ছে আর যাদুকরী শীর্ষক নিজের রচিত কবিতায় সুর দিয়ে গাইতে চেষ্টা করছে।

বল যাদুকরী, আমার পরিত্যক্ত বীণায়
কোন যাদু শক্তি আজও আমাকে ডাকে?
কোন শিখা আগুন জ্বেলেছে আমার অন্তরে,
আর কোন সে আনন্দে শিউরে উঠছে আমার অঙ্গুলি?

ভীত ও আনন্দিত নাতাশার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবেগের সঙ্গে সে গেয়ে চলেছে।

নাতাশা বলে উঠল, অপূর্ব! চমৎকার! আর একটা কবিতা হোক। নিকলাসের উপস্থিতি তার নজরে পড়েনি।

নিকলাস ভাবল, এরা সকলেই আগের মতোই আছে।

আরে, নিকলাস এসেছে! বলতে বলতে নাতাশা তার কাছে ছুটে গেল।

বাপি বাড়ি ফিরেছে? সে জিজ্ঞেস করল।

তার কথার জবাব না দিয়ে নাতাশা বলল, তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি। আমরা কত মজা করছি! ভাসিলি দিমিত্রি আমার জন্যই একদিন বেশি থাকছে! তুমি জানতে?

না, বাপি এখনো ফেরেনি, সোনিয়া বলল।

বসবার ঘর থেকে বুড়ি কাউন্টেস ডেকে বলল, নিকলাস এসেছ? এখানে এস সোনা!

নিকলাস মার কাছে গেল, তার হাতে চুমো খেল, পাশে বসে নীরবে হাতের তাসগুলো দেখতে লাগল। নাচ-ঘর থেকে ভেসে এল হাসির হররা, সকলে নাতাশাকে গাইতে বলছে।

দেনিসভ চেঁচিয়ে বলছে, ঠিক আছে। ঠিক আছে! অজুহাত দেখালে চলবে না। এবার তোমার গাইবার পালা-আমি মিনতি করছি!

কাউন্টেস ছেলের দিকে তাকাল।

ব্যাপার কি? সে জিজ্ঞেস করল ।

অনবরত একই প্রশ্ন শুনে ক্লান্ত হয়ে নিকলাস বলল, ও কিছু না। বাপি কি শিগগিরই ফিরবে?

আশা তো করছি।

এরা সেইরকমই আছে। এ ব্যাপারে কিছুই জানে না! আমি কোথায় যাই? ভাবতে ভাবতে নিকলাস আবার নাচের ঘরেই ফিরে গেল।

সোনিয়া ক্ল্যাভিকর্ডে বসে দেনিসভের একটা প্রিয় সুর বাজাচ্ছে। নাতাশা গানের জন্য তৈরি হচ্ছে। মুগ্ধ চোখে দেনিসভ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

নিকলাস পায়চারি করতে লাগল।

ওরা কেন ওকে গাইতে বলছে? ও কেমন করে গাইবে? খুশি হবার তো কোনো কারণ নেই, নিকলাস ভাবতে লাগল।

সোনিয়ার হাতে প্রথম সুর বেজে উঠল।

হে ঈশ্বর, আমি তো সর্বস্বান্ত, সম্মানহীন একটা মানুষ! আমার জন্য তো আছে শুধু মাথাটাকে বুলেটে বিদ্ধ করা-গান নয়! তার চিন্তার গতি দ্রুততর হল। চলে যাও! কিন্তু কোথায় যাব? সব সমান–ওদের গাইতে দাও!

বিষণ্ণ চোখে দেনিসভ ও মেয়েদের দিকে তাকিয়ে সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

সোনিয়ার চোখ তার উপর নিবদ্ধ, সে যেন জানতে চাইছে : নিকোলেংকা, ব্যাপার কি? আর সঙ্গে সঙ্গে সোনিয়া বুঝতে পারল তার একটা কিছু ঘটেছে।

নিকলাস তার কাছ থেকে সরে গেল। নাতাশাও নিজের থেকেই বুঝতে পারল তার দাদার অবস্থা। কিন্তু ব্যাপারটা খেয়াল করলেও তার নিজের মন-মেজাজ তখন খুশির এতই উচ্চগ্রামে বাধা যে অন্যের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তার নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে বোঝাল : না, আমারই ভুল, সেও নিশ্চয় আমার মতোই খুশি।

নাতাশা গাইতে শুরু করল, তার গলাটা ফুলে উঠল, বুক দুলে উঠল, চোখের দৃষ্টিতে গাম্ভীর্য দেখা দিল। সেই শীতকালেই নাতাশা প্রথম আন্তরিকতার সঙ্গে গাইতে শুরু করল, কারণ তার গান দেনিসভের বড় ভালো লাগে। এখন আর সে শিশুর মতো গায় না, তার গানে আগেকার মতো ছেলেমানুষী হাস্যকর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না, কিন্তু তাই বলে সে যে এখন ভালো গায় তাও নয়, সঙ্গীতজ্ঞ যে মানুষই তার গান শোনে সেই বলে : গলায় কাজ নেই কিন্তু স্বরটা বড় ভালো, তালিম নেওয়া দরকার।

চোখ মেলে তার গান শুনতে শুনতে নিকলাস ভাবল, এটা কি ব্যাপার? ওর হয়েছে কি? আজ কী সুন্দর গাইছে! আর সহসা সারা জগৎ যেন তার সঙ্গে এক হয়ে পরবর্তী সুরলহরীর জন্য প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে উঠল, সারা জগৎ যেন তিনটে তালে ভাগ হয়ে গেল : এক, দুই, তিন…এক, দুই, তিন! নিকলাসের মনে হল, আঃ, আমাদের জীবন কত অর্থহীন! এই দুঃখকষ্ট, এই টাকাপয়সা, আর দলখভ, ক্রোধ, সম্মান–সবই অর্থহীন!…কিন্তু এই তো সত্য…এই নাতাশা…আদরের নাতাশা!

তারের কি রণণ-ঝনন, আর রস্তভের অন্তরের মধ্যে যা কিছু সূক্ষ্ম তার কী আলোড়ন! আর এই যা কিছুই তো পৃথিবীর অন্য সবকিছু থেকে আলাদা, সবকিছুর উপরে। হার-জিত, দলখভ, প্রতিশ্রুতি-সে সবের কী মূল্য?…সব অর্থহীন! খুন করে, ডাকাতি করেও মানুষ সুখী হতে পারে…

*

অধ্যায়-১৬

সেদিন রস্তভ সঙ্গীত থেকে যে সুখ পেল অনেকদিন তা পায়নি। কিন্তু নাতাশার মুখে নৌকোর গান শেষ হতে না হতেই আবার মাথা তুলল কঠিন বাস্তব। কোনো কথা না বলে সে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে নেমে গেল। পনেরো মিনিট পরে বুড়ো কাউন্ট ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরল খুশি মন নিয়ে। তার গাড়ির শব্দ শুনে নিকলাস তার সঙ্গে দেখা করতে গেল।

আনন্দে ও গর্বে হাসতে হাসতে বুড়ো কাউন্ট বলল, এইবেশ ভালো কাটল তো?

নিকলাস হ্যাঁ বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, প্রায় কেঁদে ফেলবার মতো অবস্থা হল তার। কাউন্ট তখন পাইপটা ধরাচ্ছিল, ছেলের অবস্থা তার চোখে পড়ল না।

প্রথম ও শেষবারের মতো নিকলাস ভাবল, না, একথা এড়ানো যাবে না! আর যেন কথা প্রসঙ্গে হঠাৎই বলে উঠল, বাপি, আমি একটা কাজে এসেছি। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার কিছু টাকার দরকার।

বাবার মেজাজ বেশ খুশ ছিল, বলল, বাপু হে, আমি তো বলেছিলাম ওতে হবে না। কত চাই?

অনেক, নিকলাস লজ্জায় লাল হয়ে বোকার মতো হেসে বলল, আমি কিছু টাকা হেরেছি, মানে বেশকিছু, অনেক টাকা তেতাল্লিশ হাজার।

কী! কার কাছে?…যতসব! কাউন্ট চেঁচিয়ে বলল, বুড়োদের যেমন হয়ে থাকে, হঠাৎ তার গলা ও ঘাড়ের নিচটা লাল হয়ে উঠল।

আমি কথা দিয়েছি কাল টাকাটা দেব, নিকলাস বলল।

দুই হাত ছড়িয়ে অসহায়ভাবে সোফার উপর বসে পড়ে বুড়ো কাউন্ট বলল, বটে!…

কোনো উপায় ছিল না! সকলেরই এরকম ঘটে, জোরালো সহজ সুরে ছেলে কথাটা বলল, যদিও মর্মে মর্মে সে বুঝতে পারছে যে সে একটা অক্ষম শয়তান, সারা জীবনেও এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত সে করতে পারবে না। তার ইচ্ছা হল বাবার হাতে চুমো খায়, নতজানু হয়ে তার মার্জনা ভিক্ষা করে, কিন্তু উদাসীন রুক্ষ গলায় বলে ফেলল, এমন তো সকলেরই ঘটে!

ছেলের কথা শুনে বুড়ো কাউন্ট চোখ নামাল, ব্যস্ত হয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল।

তো-তো করে বলে উঠল, ঠিক, ঠিক, কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে এত টাকা যোগাড় করা শক্ত হবে…সকলেরই ঘটে! ঠিক, এ কাজ কে না করেছে।

ছেলের মুখের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাউন্ট ঘর থেকে বেরিয়ে গেল…নিকলাস একটা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিল, এটা সে আশা করেনি।

বাপি! বা–পি! ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ডাকতে ডাকতে সে বাবার পিছু নিল, আমাকে ক্ষমা কর! বাবার হাতটা চেপে ধরে নিজের ঠোঁটের উপর ছুঁইয়ে সে কেঁদে ফেলল।

বাবা ও ছেলের মধ্যে যখন বোঝাঁপড়া চলছে, তখন মা ও মেয়ের মধ্যেও চলছে আর একটা গুরুতর ব্যাপার।

মামণি!..মামণি!…সে আমার কাছে…

তোমার কাছে কী?

আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেছে মামণি! মামণি! মেয়ে বলল।

কাউন্টেস নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। দেনিসভ বিয়ের প্রস্তাব করেছে। কার কাছে? এই ছেলেমানুষ নাতাশার কাছে যে এই সেদিনও পুতুল নিয়ে খেলেছে, যে এখনো লেখাপড়া শিখছে।

মেয়ে তামাশা করছে ভেবে সে বলল, ও-কথা বলো না নাতাশা! যত সব বাজে কথা!

বাজে কথা! বটে! আমি খাঁটি কথাই বলছি, নাতাশা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল।

তোমার কাছে এলাম আমি কী করব তা জানতে, আর তুমি বলছ বাজে কথা!

কাউন্টেস কাঁধ ঝাঁকুনি দিল।

মঁসিয়ে দেনিসভ যদি তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে থাকে তো তাকে বলে দিও সে একটি মূর্খ, বাস!

না, সে মূর্খ নয়! নাতাশা ক্ষোভের সঙ্গে জবাব দিল।

বেশ তো, তুমি কী চাও? আজকাল দেখছি তোমরা সকলেই প্রেম করছ। বেশ তো, তুমি যদি তাকে ভালোবেসে থাক তো বিয়ে করে ফেল! বিরক্তিকর হাসি হেসে কাউন্টেস বলল। তোমার ভাগ্য প্রসন্ন হোক!

না মামণি, আমি তার প্রেমে পড়িনি, আমার মনে হয় আমি তার প্রেমে পড়িনি।

বেশ তো, সেই কথা তাকে বলে দাও।

মামণি, তুমি রাগ করেছ? রাগ করো না! এটা কি আমার দোষ?

না, কিন্তু ব্যাপারটা কি সোনা? তুমি কি চাও যে আমি গিয়ে তাকে বলি? কাউন্টেস হেসে বলল।

না, যা করার আমিই করব, তুমি শুধু বলে দাও কি বলব। নাতাশাও হেসে বলল, তুমি কত ভালো মামণি। সে যে কীভাবে কথাটা বলেছে সেটা তুমি দেখলে ভালো হত। আমি জানি এ-কথা সে বলতে চায়নি, হঠাৎই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

সে যাই হোক, তুমি তাকে ফিরিয়ে দাও।

না, তা পারব না। তার জন্য আমার দুঃখ হয়। সে কত ভালো! বেশ তো, তার প্রস্তাব গ্রহণ কর। তোমার তো বিয়ের বয়সই হয়েছে, কঠিন ড্রিপের সুরে কাউন্টেস বলল।

মামণি, তার জন্য আমি দুঃখিত। কি করে তাকে কথাটা বলব আমি জানি না।

তোমার বলার কিছু নেই। আমি নিজেই তাকে বলব। ছোট্ট নাতাশার সঙ্গে ওরা প্রাপ্তবয়স্কার মতো ব্যবহার করেছে দেখে কাউন্টেস ক্ষুব্ধ হয়েছে।

না। কোনো মতেই না! আমি নিজেই তাকে বলব, আর তুমি দরজা থেকে শুনবে।

নাতাশা একদৌড়ে বসবার ঘর পেরিয়ে নাচ-ঘরে ঢুকল। দেনিসভ তখনো দুই হাতের উপর মাথা রেখে ক্লাভিকর্ডের পাশে চেয়ারে বসে আছে।

হাল্কা পায়ের শব্দ শুনে সে লাফিয়ে উঠল।

দ্রুত পায়ে নাতাশার দিকে এগিয়ে বলল, নাতালী, আমার ভাগ্য স্থির কর। সবই তোমার হাতে।

ভাসিলি দিমিত্রিচ। তোমার জন্য আমি দুঃখিত!…না, তুমি এত ভালো…কিন্তু এ হয় না…না…কিন্তু বন্ধু হিসেবে আমি চিরদিন তোমাকে ভালোবাসব।

দেনিসভ তার হাতের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল, নাতাশার কানে এমন সব বিচিত্র শব্দ এল যায় অর্থ সে বুঝল । দেনিসভের কোঁকড়া কালো চুলে ভর্তি মাথায় সে চুমো খেল। সেই মুহূর্তে তারা কাউন্টেসের পোশাকের খসখস শব্দ শুনতে পেল। কাউন্টেস দুজনের দিকে এগিয়ে গেল।

ভাসিলি দিমিত্রিচ, এই সম্মান দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, বিব্রত গলায় কাউন্টেস বলল, যদিও দেনিসভের কানে তা কঠোর শোনাল, কিন্তু আমার মেয়ের বয়স এত অল্প, আর আমি মনে করি আমার ছেলের বন্ধু হিসেবে প্রস্তাবটা আগে আমার কাছে পেশ করাই তোমার উচিত ছিল। তাহলে আর তোমাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান জানাবার সুযোগ আমাকে দিতে হত না।

অপরাধীর মতো মুখ করে চোখ নামিয়ে দেনিসভ বলল, কাউন্টেস…। সে আরো কিছু বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না।

তার এই অবস্থা দেখে নাতাশা শান্ত থাকতে পারল না, ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

অস্থির গলায় দেনিসভ বলতে লাগল, কাউন্টেস, আমি অন্যায় করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনার মেয়েকে ও আপনাদের পরিবারের সকলকে আমি শ্রদ্ধা করি যে দরকার হলে দুবার জীবন দিতেও… সে কাউন্টেসের দিকে তাকাল, কিন্তু তার কঠোর মুখ দেখে বলল, আচ্ছা, তাহলে বিদায় কাউন্টেস, কাউন্টেসের হাতে চুমো খেয়ে দেনিসভ স্থির দ্রুত পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, নাতাশার দিকে ফিরেও তাকাল না।

পরদিন রস্তভ দেনিসভকে বিদায় দিল। আর একটা দিনও দেনিসভ মস্কোতে থাকতে চাইল না। তার সব মস্কোর বন্ধুরা তাকে একটা বিদায় সম্বর্ধনা জানাল জিপসিদের আস্তানায়, আর তার ফলে কীভাবে তাকে স্লেজে তুলে দেওয়া হল অথবা যাত্রাপথের প্রথম তিনটে ঘাঁটি কীভাবে পার হল-সে সবকিছুই সে পরবর্তীকালে মনে করতে পারত না।

দেনিসভ চলে যাবার পরে রস্তভ আরো এক পক্ষকাল মস্কোতে কাটাল, কখনো বাড়ি থেকে বের হল না, বাবা টাকাটা সঙ্গে সঙ্গে যোগাড় করতে না পারায় টাকাটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল, এবং বেশির ভাগ সময় কাটাতে লাগল মেয়েদের ঘরে।

তার প্রতি সোনিয়ার আদর ও অনুরাগ আগের চাইতেও বেড়েছে। সে যেন রস্তভকে বোঝাতে চার তার অনেক ক্ষতি হয়েছে বলেই সোনিয়া তাকে আরো বেশি ভালোবাসছে, কিন্তু নিকলাস ভাবছে এখন সে সোনিয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য।

কবিতায় ও গানে সে মেয়েদের অ্যালবামগুলি ভরে দিল, এবং শেষপর্যন্ত পুরো তেতাল্লিশ হাজার রুবল দলখভকে পাঠিয়ে দিয়ে একটা রসিদ নিয়ে নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পরিচিত কারো কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে সে তার রেজিমেন্টটাকে ধরার জন্য যাত্রা করল। রেজিমেন্ট ইতিমধ্যেই পোল্যান্ডে পৌঁছে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *