০৪.১ ১৮০৬ সালের গোড়ার দিকে

চতুর্থ পর্ব – অধ্যায়-১

১৮০৬ সালের গোড়ার দিকে নিকলাস রস্তভ ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। দেনিসভ তার বাড়ি ভরোনেঝেই যাচ্ছিল, রস্তভ অনেক বলে কয়ে তার সঙ্গে মস্কো পর্যন্ত যেতে এবং সেখানে তার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাতে রাজি করাল। মস্কোর আগে শেষ ডাক ঘাঁটির আগেকার ঘাঁটিতে জনৈক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হওয়ায় দেনিসভ তার সঙ্গে বসে তিন বোতল মদ গিলেছিল, তাই বরফঢাকা পথের ঝাঁকুনি সত্ত্বেও মস্কোর পথে একটি বারের জন্যও তার ঘুম ভাঙল না, রস্তভের পাশে স্লেজের তলাতে শুয়েই কাটিয়ে দিল, মস্কোর যত কাছাকাছি এগোতে লাগল রস্তভ ততই অধৈর্য হয়ে উঠল।

শহরের ফটকে তাদের ছুটির অনুমতিপত্র পাশ হবার পরে মস্কোতে ঢুকতেই রস্তভ ভাবতে লাগল, আর কতদূর? আঃ, যতসব অসহ্য রাস্তাঘাট, দোকানপাট, রুটিওয়ালাদের সাইনবোর্ড, রাস্তার বাতি আর স্লোজগাড়ি!

পুরো শরীরটা নিয়ে সামনে ঝুঁকে সে বলে উঠল, দেনিসভ! আমরা এসে পড়েছি! ও দেখছি ঘুমিয়ে পড়েছে।

দেনিসভ জবাব দিল না।

ওই তো চৌমাথার মোড়, ওখানেই তো কোচয়ান জাখারের আস্তানা, ওই তো জাখার স্বয়ং, আর সেই ঘোড়াটাই আছে! ওই তো সেই ছোট দোকানটা যেখান থেকে আমরা আদার বিস্কুট কিনতাম! তাড়াতাড়ি। চলতে পারছ না? এই তো!

কোন বাড়িটা? কোচয়ান জিজ্ঞেস করল।

কেন, ওই যে ডানদিকে শেষ বাড়িটা, দেখতে পাচ্ছ না? ওটাই আমাদের বাড়ি, রস্তভ বলল।

অবশ্যই ওটা আমাদের বাড়ি। দেনিসভ, দেনিসভ, আমরা পৌঁছে গেছি!

দেনিসভ মাথা তুলে কাশল, কথা বলল না।

কোচবাক্সের উপর বসে থাকা খানসামাকে ডেকে রস্তভ বলল, দিমিত্রি, ওই আলোগুলো তো আমাদের বাড়ির, তাই না?

হ্যাঁ স্যার, আর ওই আলোটা আপনার বাবার পড়ার ঘরের।

তাহলে তারা এখনো শুতে যায়নি? তোমার কি মনে হয়? ভালো কথা, আমার নতুন কোটটা বের করতে ভুলো না কিন্তু, নতুন গোঁফে আঙুল বুলিয়ে রস্তভ বলল। তারপর কোয়ানকে হাঁক দিয়ে বলল, আরে, চালাও। দেনিসভের দিকে ফিরে বলল, উঠে পড়ো ভাস্কা! তাদের দরজার তিনটে বাড়ি আগে পৌঁছতেই রস্তভ আবার হেঁকে বলল চালাও-ভদকার জন্য তিন রুবল পাবে। তার মনে হল, ঘোড়াগুলো মোটেই নড়ছে না। শেষপর্যন্ত স্লেজটা ডাইনে ঘুরে একটা ফটকের সামনে থামল, রস্তভ মাথার উপরে দেখতে পেল খানিকটা প্লাস্টার ভাঙা পরিচিত কার্নিসটা, ফটকটা, ফুটপাথের থামটা। স্লেজটা থামার আগেই সে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে হলঘরে ঢুকল। বাড়িটা নির্বিকার, নিশ্চুপ, যেন কে এসেছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। হলে কেউ নেই। হা ঈম্বর! সকলে ভালো আছে তো? মুহূর্তের জন্য থেমে সে ভাবল, আর পরক্ষণেই পরিচিত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। দরজার অতি-পরিচিত সেই পুরনো হাতলটা তেমনই সহজেই ঘুরে গেল। ছোট ঘরটাতে একটিমাত্র চর্বি-বাতি জ্বলছে।

বুড়ো মাইকেল সিন্দুকের উপর ঘুমিয়ে আছে। পরিচারক প্রকফি খোলা দরজার দিকে তাকাল, আর অমনি তার মুখের ঘুমন্ত উদাসীনতার বদলে সেখানে ফুটে উঠল সানন্দ বিস্ময়।

তরুণ মনিবকে চিনতে পেরে সে চেঁচিয়ে উঠল, হায় ঈশ্বর! ছোট কাউন্ট যে! এও কি হতে পারে? মানিক আমার! উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সে বসার ঘরের দরজার দিকে ছুটে গেল, সম্ভবত তার আসার কথা জানাতেই, কিন্তু সে ইচ্ছা ত্যাগ করে ফিরে এসে যুবকটির কাঁধে চুমো খাবার জন্য ঝুঁকে দাঁড়াল।

সকলে ভালো তো? রস্তভ জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! হা! এইমাত্র সকলের খাওয়া শেষ হয়েছে। আপনাকে একবার ভালো করে দেখি ইয়োর এক্সেলেন্সি।

সত্যি, সকলে ভালো আছে তো?

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সকলেই ভালো।

দেনিসভের কথা রস্তভ একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। তার আসার কথাটা অন্য কেউ আগে থেকে জেনে ফেলুক এটা সে চায় না, তাই লোমের কোটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে বলনাচের ঘরটার ভিতর দিয়ে পা টিয়ে টিপে ছুট দিল। সবকিছু আগের মতোই আছে : সেই পুরনো তাসের টেবিল, সেই ঢাকনাদেওয়া ঝাড়লণ্ঠন, কিন্তু একজন এর মধ্যেই নতুন মনিবটিকে চিনে ফেলেছে, সে বসার ঘরে পৌঁছবার আগেই পাশের দরজা দিয়ে কে যেন ঝড়ের গতিতে ছুটে এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে লাগল। তারপর আর একজন, আরো একজন দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল, আরো বেশি করে আদর, বেশি করে চুমো খাওয়া, হৈ-চৈ, আনন্দাশ্রু। রস্তভ বুঝতেই পারছে না কে বাপি, কে নাতাশা, আর কে পেতয়া। সকলেই এক সঙ্গে হৈচৈ করছে, কথা বলছে, চুমো খাচ্ছে। তার খেয়াল হল, শুধু মা আসেনি।

আমি কি জানতাম না… নিকলাস… সোনা আমার…!

এই তো এসেছে… আমাদের আপনজন… কলিয়া, সোনা… ও কেমন বদলে গেছে!…মোমবাতিগুলো কোথায়?… চা!…

আর আমি, আমাকে চুমো খাও!

সোনারে… আর আমি!

সোনিয়া, নাতাশা, পেতয়া আন্না মিখায়লভনা, ভেরা ও বুড়ো কাউন্ট সকলেই তাকে আদর করতে লাগল, ভূমিদাস, চাকর-বাকর, দাসীরা সকলেই ঘরের মধ্যে ভিড় করে হৈ-চৈ শুরু করে দিল।

পেতয়া অনবরত চেঁচাচ্ছে, আর আমাকেও!

চারদিকে ভালোবাসা মাখা চোখগুলি আনন্দের অশ্রুজলে চিকচিক করছে, চারদিকে সবগুলি ঠোঁটেই চুম্বনের আহ্বান।

গোলাপরাঙা সোনিয়াও হাত চেপে ধরে একদৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বয়স এখন ষোল, সে সুন্দরী, বিশেষত এই আনন্দঘন মুহূর্তে। বুড়ি কাউন্টেস এখনো আসেনি। দরজায় পায়ের শব্দ শোনা গেল, সে শব্দ এত দ্রুত যে তার মায়ের পায়ের শব্দ হতে পারে না।

কিন্তু মাই এসেছে, পরনে একটা নতুন গাউন, এটা সে দেখে যায়নি। তার চলে যাবার পরে তৈরি করা হয়েছে। রস্তভ মার কাছে ছুটে গেল। মা তার বুখে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মা মুখ তুলতেও পারছে না, ছেলের হুজার জ্যাকেটের উপর মুখটা চেপে ধরে আছে। সকলের অলক্ষ্যে দেনিসভ সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, এই দৃশ্য দেখে সেও চোখ মুছতে লাগল।

কাউন্টের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির উত্তরে আত্মপরিচয় দিয়ে দেনিসভ বলল, আমি ভাসিলি দেনিসভ, আপনার ছেলের বন্ধু।

দেনিসভকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে কাউন্ট বলল, এ বাড়িতে তুমি সুস্বাগত! আমি জানি, আমি জানি। নিকলাস আমাদের লিখেছিল ।… নাতাশা, ভেরা, দেখ! এই দেনিসভ!

খুশিতে ডগমগ মুখগুলি দেনিসভের দিকে ঘুরে গেল।

একলাফে দেনিসভের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে নাতাশা আনন্দে অধীর হয়ে বলল, প্রিয় দেনিসভ! তার এই দুরন্তপনায় সকলেই বিব্রত বোধ করল। দেনিসভ লজ্জা পেলেও হেসে নাতাশার হাতটা ধরে তাতে চুমো খেল।

দেনিসভকে তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটা দেখিয়ে দেওয়া হল, আর রস্ত পরিবারের সকলেই বসবার ঘরে গিয়ে নিকলাসকে ঘিরে বসল।

বুড়ি কাউন্টেস ছেলের হাতটা ধরেই আছে, প্রতি মুহূর্তে তাতে চুমো খাচ্ছে। ভাই-বোনরা তার কাছাকাছি বসবার জন্য ঠেলাঠেলি করছে, কে তার জন্য চা, রুমাল ও পাইপ এনে দেবে তাই নিয়ে ঝগড়া করছে।

সকলের এই ভলান্ত যাত্রী দুজন বেলা দাগ ছড়িয়ে আছে। দুজোড়াকামাবার গরম পানিও

পরদিন সকালে পথশ্রান্ত যাত্রী দুজন বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাল। পাশের ঘরে তলোয়ার, থলে, তলোয়ারের খাপ, খোলা পোর্টম্যান্টো, নোংরা জুতা সব ছড়িয়ে আছে। দুজোড়া নতুন পালিশ-করা জুতো এইমাত্র দেয়ালের পাশে এনে রাখা হয়েছে। চাকররা হাজির হল জগ ও বেসিন, দাড়ি কামাবার গরম পানিও ব্রাশ-করা পোশাক নিয়ে। ঘরময় তামাকেও গন্ধ।

ভাসিলি দেনিসভের ফাসফেঁসে গলা শোনা গেল, আরে, গয়িশকা–আমার পাইপ! হেই রস্তভ, উঠে পড়!

রস্তভ চোখ রগড়াতে রগড়াতে গরম বালিশের উপর থেকে এলোমেলো মাথাটা তুলল।

আরে, অনেক দেরি হয়ে গেছে না কি?

দেরি! এখন তো প্রায় দশটা বাজে, নাতাশার গলা শোনা গেল। পাশের ঘর থেকে ভেসে এল মাড় দেওয়া পেটিকোটের খসখস ও অনেক মেয়ের হাসি ও ফিস ফিস শব্দ। সশব্দে দরজাটা খুলে গেল, নীল ফিতে, কালো চুল ও হাসি মুখের ঝিলিক দেখা দিল দরজা। দুজন ঘুম থেকে উঠেছে কিনা তাই দেখতে এসেছে নাতাশা, সোনিয়া ও পেতয়া।

নাতাশার গলা আবার শোনা গেল, নিকলাস! উঠে পড়!

এক্ষুণি উঠছি!

এদিকে বাইরের ঘরে তরবারি দেখে সেটা হাতে নিয়ে পেতয়া শোবার ঘরের দরজাটা খুলে ফেলল, পোশাক ছাড়ার সময় মেয়েদের যে পুরুষদের দেখতে পাওয়াটা শোভন নয় সে-কথা সে একেবারেই ভুলে গেল। হাঁক দিয়ে বলল, এটা কি তোমার তলোয়ার?

মেয়েরা লাফ দিয়ে একপাশে সরে গেল। সাহায্যের জন্য ভীত মুখে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেনিসভ তাড়াতাড়ি তার লোমশ পা দুটি কম্বলের নিচে লুকিয়ে ফেলল। পেতয়া ঘরে ঢুকতেই দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। ওপার থেকে হাসির হররা উঠল।

নিকলাস! ড্রেসিং-গাউনটা পরে বেরিয়ে এস। নাতাশার গলা শোনা গেল।

পেতয়া বলল, এটা কি তোমার তলোয়ার? না কি তোমার? পরের প্রশ্নটা করল কালো গোঁফওয়ালা দেনিসভকে।

রস্তভ তাড়াতাড়ি একটা কিছু পায়ে গলিয়ে ড্রেসিং-গাউনটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে এল। সকলে মিলে বসবার ঘরে গিয়ে আড্ডা জমাল। হাজার তুচ্ছ কথা নিয়ে চলল প্রশ্ন আর উত্তরের পালা। প্রতিটি কথায় উছলে পড়তে লাগল নাতাশার হাসি। যা শোনে তাতেই সে বলে, আঃ, কী সুন্দর, কী চমৎকার!

ভালোবাসার এই উষ্ণ আলোর প্রভাবে রস্তভ মনে মনে বুঝতে পারল, বাড়ি থেকে চলে যাবার পর থেকে যে শিশুসুলভ হাসি একদিনের জন্যও ফোটেনি তার মুখে, আঠারো মাস পরে এই প্রথম সে হাসি আবার তার অন্তরকে, তার মুখকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে।

নাতাশা বলল, না, আমার কথা শোন। তুমি তো এখন একটা পুরুষ মানুষ হয়ে উঠেছ, না কি বল? তুমি আমার দাদা এ-কথা ভাবতেও ভালো লাগছে। নাতাশা তার গোঁফ জোড়া স্পর্শ করল। তোমরা পুরুষরা কী রকম হয়ে ওঠ জানতে ইচ্ছা করে। আমাদের মতোই কি না?

সোনিয়া পালিয়ে গেল কেন? রস্তভ জিজ্ঞেস করল।

তাই তো! সে অনেক কথা! ওকে তুমি কী বলে ডাকবে–তুই, না তুমি? রস্তভ বলল, সে যা হয় হবে।

না, ওকে তুমি বলে ডেক, বুঝলে! পরে তোমাকে সব বলব। না, এখনই বলছি। তুমি তো জান, সোনিয়া আমার প্রিয়তম বন্ধু। এমন বন্ধু যে তার জন্য আমার হাতটাই পুড়িয়েছি। এই দেখ।

মসলিনের আস্তিনটা তুলে নাতাশা দেখাল, সুন্দর হাতটার কনুইয়ের উপরে একটা লাল দাগ।

ওকে যে ভালোবাসি সেটা প্রমাণ করতেই হাতটা পুড়িয়ে দিয়েছি। একটা রুল-কাঠি আগুনে গরম করে এখানে চেপে ধরেছিলাম!

রস্তভ ব্যাপারটা বুঝতে পারল, মোটেই অবাক হল না। প্রশ্ন করল, বাস, এই সব?

আমরা দুজন এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু! রুল-কাঠির ব্যাপারটা অবশ্য খুবই বাজে, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব চিরদিনের। ও যদি কাউকে ভালোবাসে তো সারা জীবনের জন্যই ভালোবাসে, কিন্তু আমি ও ব্যাপারটা বুঝি না, তাড়াতাড়িই ভুলে যাই।

বেশ তো, তারপর?

দেখ, আমাকে ও তোমাকে ও সেইভাবেই ভালোবাসে।

নাতাশা হঠাৎ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল।

কেন, চলে যাবার আগের কথা তো তোমার মনে আছে?… দেখ, ও বলছে তুমি যেন সে-সব ভুলে যাও।… ও বলে : আমি তাকে চিরদিন ভালোবাসব, কিন্তু সে মুক্ত থাকুক। এটা কি মধুর ও মহৎ নয়! সত্যি, খুব মহৎ, কী বল?

রস্তভ ভাবতে লাগল।

বলল, আমি কখনো কথার খেলাপ করি না। তাছাড়া, সোনিয়া এতই মনোহারিণী যে একমাত্র কোনো নির্বোধই সে সুখ বিসর্জন দেবে।

নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, না, না। আমরা দুজন এ-কথা আলোচনা করেছি। আমরা জানতাম, তুমি এই কথাই বলবে। কিন্তু তা চলবে না, কারণ ভেবে দেখ, তুমি যদি এ-কথা বল–তুমি যদি মনে কর যে তুমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ–তাহলে মনে হবে যে এটা সোনিয়ার মনের কথা নয়। এতে মনে হবে যে বাধ্য হয়েই তুমি তাকে বিয়ে করছ, কিন্তু সেটাই চলবে না।

রস্তভ বুঝল, ব্যাপারটা নিয়ে এরা ভালোভাবেই ভাবনা-চিন্তা করেছে। আগেরদিন সোনিয়ার রূপ দেখে সে মুগ্ধ হয়েছে। আজ এক ঝলক দেখেই তাকে আরো মনোরমা মনে হয়েছে। সে এখন ষোড়শী সুন্দরী, তাকে একান্তভাবে ভালোবাসে (এ বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই) আজ কেন সে তাকে ভালোবাসবে না, বিয়ে করবে না? কিন্তু এই মুহূর্তে তার সামনে রয়েছে আরো অনেক সুখ, অনেক আকর্ষণ! সে ভাবল, হ্যাঁ, ওরা যথাযথ সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আমাকে মুক্ত থাকতেই হবে।

বলল, বেশ তো, তাই ভালো। পরে এ বিষয়ে কথা হবে। আঃ, তোমাদের কাছে পেয়ে কী ভালো যে লাগছে!

তারপর বলল, আচ্ছা, বরিসের প্রতি এখনো তোমার সেই মনোভাব আছে তো?

নাতাশা হেসে উঠল, আঃ, যত বাজে কথা! তার কথা, বা অন্য কারো কথাই আমি ভাবি না, ওরকম কোনো ব্যাপারেই আমি নেই।

তাই বুঝি! তাহলে এখন তোমার মনটা কোথায় আছে?

এখনো? নাতাশার মুখে খুশির হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। তুমি দুপোর্তকে দেখেছ?

না।

বিখ্যাত নতশিল্পী দুপোর্তকে দেখনি? তাহলে বুঝবে না। আমার মনটা সেখানেই আছে।

হাত দুটি দুলিয়ে নাতাশা ঘাঘড়াটাকে নাচিয়েদের মতো তুলে ধরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল, ঘুরে দাঁড়াল, নাচের ভঙ্গিতে ছোট পা দুটোকে একত্র জুড়ে একেবারে আঙুলের ডগায় ভর করে কয়েক পা এগিয়ে গেল।

বলল, দেখ, কেমন দাঁড়িয়ে আছি! দেখ! আমার মন এখন এতেই পড়ে আছে! কাউকেই আমি বিয়ে করব না, আমি হব নৃত্যশিল্পী। এ-কথা কাউকে বল না যেন।

রস্তভ হো-হো করে হেসে উঠল, নাতাশাও সে হাসিতে যোগ না দিয়ে পারল না। সে পুনরায় বলল, না, কিন্তু ব্যাপারটা বেশ মজার নয় কি?

মজা! তাহলে এখন আর তুমি বরিসকে বিয়ে করতে চাও না?

নাতাশা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। কাউকেই আমি বিয়ে করতে চাই না। তার সঙ্গে দেখা হলে তাকেও এই কথাই বলে দেব।

বেচারী! রস্তভ বলল।

নাতাশার মুখে কথার ফোয়ারা, যত সব বাজে! দেনিসভ খুব ভালো, তাই না?

হ্যাঁ, সত্যি ভালো।

ও, ঠিক আছে, চলি : যাও, পোশাক পরে এস। সে কি খুব ভয়ংকর, মানে দেনিসভ?

নিকলাস বলল, ভয়ংকর কেন? না, ভাস্কা চমৎকার মানুষ।

তুমি তাকে ভাস্কা বল? মজার তো! সে কি খুব ভালো!

খুব।

ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি কর। আমরা একসঙ্গে প্রাতরাশে বসব।

নাতাশা উঠল, ব্যালে-নর্তকীর মতো আঙুলের উপর ভর দিয়ে বেরিয়ে গেল, তার মুখে সেই হাসি যা একমাত্র সুখী পঞ্চদশীরাই হাসতে পারে। বসবার ঘরে সোনিয়ার সঙ্গে দেখা হতেই রভের মুখ লাল হয়ে উঠল। সোনিয়ার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে বুঝতে পারছে না। কাল সন্ধ্যায় প্রথম দর্শনের খুশির মুহূর্তে পরস্পরকে চুমো খেয়েছিল, কিন্তু এখন তার মনে হল, সেটা করা যাবে না। সে সোনিয়ার হাতে চুমো খেল, তাকে তুমি বলে সে সম্বোধন করল। কিন্তু তাদের চোখে-চোখে মিলন হল, চোখের ভাষা বলল তুই, চোখে-চোখেই হল চুম্বন-বিনিময়। নাতাশার মারফৎ সে রস্তভকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, চোখের চাউনি দিয়েই সে ক্ষমা চেয়ে নিল, তাকে ভালোবাসার জন্য রস্তভকে ধন্যবাদও জানাল। রস্তবও তার চাউনি দিয়ে নিজের মুক্তির জন্য সোনিয়াকে ধন্যবাদ জানাল, তাকে জানিয়ে দিল যেভাবেই হোক সে কোনোদিন তাকে ভালোবাসা থেকে বিরত হবে না, কারণ সেটা অসম্ভব।

সকলে চুপ করলে একসময় ভেরা সুযোগ বুঝে বলে উঠল, কী আশ্চর্য যে সোনিয়া ও নিকলাস আজ পরস্পরকে বলছে তুমি, আর মিলিত হচ্ছে অপরিচিতের মতো।

অন্য সবসময়ের মতোই এখনো ভেরা খাঁটি কথাটিই বলল, কিন্তু তাতে সকলেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল, শুধু সোনিয়া, নিকলাস ও নাতাশাই নয়, বুড়ি কাউন্টেস পর্যন্ত ভয় পেল যে এই প্রেমের ব্যাপারটা হয় তো নিকলাসের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাই ছোট মেয়ের মতো সেও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

রস্তভকে অবাক করে দিয়ে দেনিসভ ঘরে ঢুকল, তার চুলে পমেড মাখানো, শরীরে আতর ছিটানো, পরনে নতুন ইউনিফর্ম। যুদ্ধযাত্রার সময় যেমন চটপটে ছিল এখনো তাকে তেমন দেখাচ্ছে, উপস্থিত মহিলা ও ভদ্রজনদের সঙ্গে সে এমন অমায়িক ব্যবহার শুরু করল যা রস্ত তার কাছ থেকে আশাই করেনি।

*

অধ্যায়-২

সেনাবাহিনী থেকে মস্কো ফিরে এলে নিকলাস রশুভকে নানাভাবে স্বাগত জানানো হল। বাড়ির লোকরা তাকে স্বাগত জানাল শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর ও তাদের প্রিয় নিকোলেংকারূপে, আত্মীয়-স্বজনরা স্বাগত জানাল একটি মনোহর, আকর্ষণীয় ভদ্র যুবকরূপে, আর পরিচিতজনরা স্বাগত জানাল একজন সুদর্শন হুজার-লেপটেন্যান্ট, ভালো নাচিয়ে ও শহরের শ্রেষ্ঠ ভাবী বররূপে।

রস্তভরা মস্কোতে সকলেই চেনে। সব সম্পত্তি নতুন করে মর্টগেজ রাখায় বুড়ো কাউন্টের হাতে যথেষ্ট টাকা এসেছে। তাই দিয়ে মনের মতো একটা ঘোড়া কিনে, অতি আধুনিক ছাটকাটের পোশাকপত্র বানিয়ে নিকলাস বেশ ফুর্তিতেই দিন কাটাতে লাগল। পুরোনো জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে কিছুদিন কাটাবার পরেই বাড়িতে বাস করাটা তার কাছে আবার বেশ প্রীতিপদ হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, তার বয়স বেড়েছে, চরিত্রে পরিপক্কতা এসেছে। সে এখন একজন হুজার-লেফটেন্যান্ট, গায়ে রুপো ফিতে বসানো কুর্তা, যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য প্রদত্ত সেন্ট জর্জ ক্রশ লাগানো বুকের উপর, এখন সে নিজের ঘোড়া নিয়ে রেসের শিক্ষানবিশী করছে পরিচিত, প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় রেসুড়েদের কাছে। কোনো মহিলার সঙ্গে রাজপথে পরিচয় হলে সে একদা সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আর্থারভদের বল-নাচে সে মাজুকা নেচেছে, ফিল্ড-মার্শাল কামেনস্কির সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছে, ইংলিশ ক্লাবে গিয়েছে, দেনিসভের পরিচিত চল্লিশ বছরের জনৈক কর্নেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছে।

মস্কোতে আসার পরে ম্রাটের প্রতি অনুরাগে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবু প্রায়ই সে সম্রাটের কথা ও তার প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা বলে। মস্কোতে এখন সকলেই সম্রাটকে দেবদূতের অবতার বলে থাকে, সে মনোভাবের সেও একজন অংমীদার।

সোনিয়ার সঙ্গে এখন আর সে বেশি মেলামেশা করে না, বরং একটু দূরে দূরেই থাকে। তার কতা মনে হলেই সে নিজেকে বোঝায়, আঃ, এরকম মেয়ে তো কোথাও না কোথাও আরো অনেক আছে, আরো অনেক থাকবে। ইচ্ছা যখন হবে তখন ভালোবাসার কথা ভাববার অনেক সময় পাওয়া যাবে, কিন্তু এখন আমার সময়। নেই। তাছাড়া, তার ধারণা মহিলাদের সমাজ তার মনুষ্যত্বের পক্ষে অসম্মানকর। সে যে বল-নাচে বা মহিলাদের মহলে যাতায়াত করে সেটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই করে। অবশ্য ঘোড়দৌড়, ইংলিশ ক্লাব, দেনিসভের সঙ্গে গিয়ে ফুর্তিকরা, কোনো একটি বিশেষ বাড়িতে যাতায়াত–সেসব অন্য ব্যাপার, একজন উঠতি হুজারের পক্ষে সেগুলি দরকার।

মার্চের গোড়াতে প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের সম্মানে ইংলিশ ক্লাবে একটা ডিনারের ব্যবস্থাপনার কাজে বুড়ো কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ড্রেসিং-গাউনটা পরে হলঘরে পায়চারি করতে করতে কাউন্ট ক্লাবের ভাণ্ডারী ও প্রধান রাঁধুনিকে ডিনারের খাদ্যতালিকার নির্দেশ দিচ্ছে। রাঁধুনি ও ভাণ্ডারীও খুশি মনে মনোযোগসহকারে সব শুনছে, কারণ তারা জানে যে কয়েক হাজার রুবল ব্যয় করে কাউন্ট যে ডিনার দেবে এবং তাতে তাদের যে মোটা অংকের লাভ হবে, অন্য কোথাও তেমনটি হবে না।

এমন সময় দরজায় হাল্কা পায়ের শব্দ ও বুটের খটখট আওয়াজ শোনা গেল। ঘরে ঢুকল ছোট কাউন্ট। সুদর্শন চেহারা, গোলাপি রং, কালো ছোট গোঁফ : মস্কোর নিরুপদ্রব জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন।

ছেলের সামনে কিছুটা বিব্রত বোধ করে স্মিত হাসির সঙ্গে বুড়ো কাউন্ট বলল, এস বাবা, আমার মাথাটা ঘুরছে! তুমি যদি একটু সাহায্য কর। গায়কদের ব্যবস্থাও তো আমাকে করতে হবে। আমার অর্কেস্ট্রা তো থাকছেই, কিন্তু জিপসি গায়কদের আনা কি উচিত নয়? তোমরা মিলিটারি মানুষরা তো আবার ওসবই পছন্দ কর।

ছেলেও হেসে বলল, সত্যি বাপি, আমার তো বিশ্বাস তোমাকে এখন যতটা চিন্তিত দেখছি, শোন গ্ৰেবার্ন যুদ্ধের আগে স্বয়ং প্রিন্স ব্যাগ্রেশনও ততটা চিন্তিত হননি।

বুড়ো কাউন্ট রাগের ভান করল।

হ্যাঁ, মুখেই বলা যায়, একবার চেষ্টা করে দেখ না!

কাউন্ট রাঁধুনির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, আজকালকার ছেলেরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখছ ফিয়োকতিস্তা খালি বুড়োদের নিয়ে ঠাট্টা!

যা বলেছেন হুজুর, ওদের কাজ শুধু ভালো বাল খানা খাওয়া, কিন্তু সে সবের ব্যবস্থা করা, পরিবেশন করা, সেটা ওদের কাজ নয়!

কাউন্ট চেঁচিয়ে বলল, ঠিক, ঠিক! তারপর দুই হাতে ছেলেকে ধরে খুশিভরে বলল, এবার তোমাকে পেয়েছি, এখনই স্লেজ ও ঘোড়া ঠিক কর, বেজুখভের বাড়িয়ে গিয়ে তাকে বলবে, কাউন্ট ইলিয়া তোমাকে পাঠিয়েছে স্ট্রবেরি ও তাজা আপেলের জন্য। অন্য কারো কাছ থেকে ওগুলো নেওয়া চলবে না। তিনি এখন বাড়ি নেই, কাজেই তোমাকে ভিতরে গিয়ে প্রিন্সেসকে বলতে হবে। সেখান থেকে যাবে রাসগুল্যায়-কোচয়ান ইপাকা সব জানে-জিপসি ইলিউশকাকে খুঁজে বের করবে, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে শাদা কসাক কোট পরে সে কাউন্ট অর্লভ-এর বাড়িতে নেচেছিল, তাকে সঙ্গে করেই নিয়ে আসবে।

নিকলাস হেসে বলল, জিপসি মেয়েগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে আসব না কি? কী যে বল তুমি…

ঠিক সেই সময় নিঃশব্দ পায়ে ঘরে ঢুকল আন্না মিখায়লভনা। আস্তে চোখ বুঝে সে বলল, কিছু ভাববেন না কাউন্ট। আমি নিজে যাব বেজুখভের বাড়ি। পিয়ের এসে পড়েছে, এখন আমরা তার সজি-ঘর থেকে সব কিছুই পাব। তার সঙ্গে তো আমাকে দেখা করতেই হবে। বরিসের একটা চিঠি সে আমাকে পাঠিয়েছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তার এখন পদোন্নতি হয়েছে।

আন্না মিখায়লভনা একটা কাজের ভার নেওয়ায় কাউন্ট খুশি হল, তার জন্য ছোট ঢাকা গাড়িটা আনতে বলে দিল।

বেজুখভকে আসতে বলে দেবেন। তার নামটা লিখে নিচ্ছি। তার স্ত্রীও কি সঙ্গে এসেছে?

আন্না মিখায়লভনা চোখ তুলে তাকাল, গভীর বিষণ্ণতা আঁকা তার মুখে।

বলল, কি জানেন, সে বড়ই দুর্ভাগা। যা শুনেছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো ভয়ংকর কথা। তার সুখে আমরা যখন নৃত্য করছিলাম তখন তো এ-কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। আর তরুণ বেজুখভের মতো এমন দেবদূতের মতো মহৎ যার মন। সত্যি, তার জন্য আমার করুণা হয়, সাধ্যমতো সান্ত্বনা তাকে দেব।

চোট ও বড় রস্তভ দুজনেই জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি?

আন্না মিখায়লভনা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল।

অস্ফুট রহস্যময় স্বরে বলল, সকলে বলছে, মারি আইভানভনার ছেলে দলখভ মেয়েটিকে সম্পূর্ণ কজা করে ফেলেছে। পিয়ের তাকে সঙ্গে করে পিটার্সবুর্গে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল, আর এখন…মেয়েটি এখানে এসেছে আর সেই দুঃসাহসী লোকটাও তার পিছু নিয়েছে। আন্না মিখায়লভ কথাগুলি বলল পিয়েরের প্রতি সহানুভূতি জানাতে, কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই তার কথায় প্রকাশ পেল দুঃসাহসী দলখভের জানাতে, কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই তার কথায় প্রকাশ পেল দুঃসাহসী দলখভের প্রতি সহানুভূতি। লোকে বলছে, এই দুর্ভাগ্যের ফলে পিয়ের একেবারেই ভেঙে পড়েছে।

আহা, আহা! কিন্তু তবু তাকে ক্লাবে আসতে বলবেন-ওসব কিছু উড়ে যাবে। যা দারুণ একটা ভোজসভা হবে না!

পরদিন ৩ মার্চ একটা পর থেকেই ইংলিশ ক্লাবের আড়াইশো সদস্য ও পঞ্চাশজন নিমন্ত্রিত অতিথি অস্ট্রিয়া অভিযানের নায়ক ও সম্মানিত অতিথি প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল।

অস্তারালিজ যুদ্ধের খবর যখন প্রথম এল তখন মস্কো একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সেসময় রুশ জনসাধারণ জয়লাভে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে অনেকে পরাজয়ের খবরটা বিশ্বাসই করল না, আবার অনেকে এরকম একটা অদ্ভুত খবরের নানা রকম অসাধারণ ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। রাশিয়ার পরাজয়ের এই অবিশ্বাস্য, অশ্রুতপূর্ব ও অসম্ভব ঘটনার কারণ খুঁজে বের করা হল, সকলেই সবকিছু বুঝে ফেলল, আর মস্কোর মোড়ে মোড়ে একই কথা বলা হতে লাগল। সে কারণগুলি হল অস্ট্রিয়দের বিশ্বাসঘাতকতা, কমিসারিয়েটের ত্রুটি-বিচ্যুতি, পোল সেনাপতি প্রেবিজেউস্কি ও ফরাসি লাগারোর বিশ্বাসঘাতকতা, কুতুজভের অক্ষমতা, এবং (এ কথাটা বলা হল চুপি চুপি) সম্রাটের অল্প বয়স ও অভিজ্ঞতার অভাব-যার ফলে সে যত সব অযোগ্য ও তুচ্ছ লোকদের উপর বড় বেশি ভরসা করেছিল। কিন্তু একটা কথা সকলেই সমস্বরে ঘোষণা করল-সেনাদল-রুশ সেনাদল–অসাধারণ, তাদের সাহস অঘটন ঘটিয়েছে। কি সৈনিক, কি অফিসার, কি সেনাপতি, সকলেই বীর। কিন্তু সব বীরের সেরা বীর প্রিন্স ব্যাগ্রেশন, শোন গ্রেবার্নের ঘটনা এবং অস্তারলিজ থেকে পশ্চাদপসরণ তাকে বিখ্যাত করেছে। ভলতেয়ারের উক্তির নকল করে রসিক শিনশন বলল, ব্যাগ্রেশন নামে যদি কেউ না থাকত তো একজন ব্যাগ্রেশকে আবিষ্কার করা দরকার হত। কুতুজভের নাম কেউ মুখেই আনল না, শুধু কেউ কেউ চুডপ চুপি গালাগাল দিয়ে তাকে বলল চঞ্চলমতি এক ভ্রষ্টচরিত্র যক্ষবিশেষ।

সারা মস্কো জুড়ে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল দলগরুকভের উক্তি : অনবরত যদি মূর্তি গড়া চলতে থাকে তাহলে তো হাতে কাদামাটি লাগবেই। অস্তারলিজে আমাদের অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত সাহসিকতার নতুন নতুন ঘটনার কথা শোনা যেতে লাগল। একজন পতাকাকে রক্ষা করেছে, একজন মেরেছে পঁচজন ফরাসিকে, কেউ বা এক হাতে পাঁচটা কামানে বারুদ ঠেসেছে। বেৰ্গকে যারা চেনে না তারা বলতে লাগল, ডান হাতে আঘাত লাগলে সে বাঁ হাতে তরবারি নিয়ে সামনে ছুটে গিয়েছিল। বলকনস্কির কথা কিছুই শোনা গেল না, শুধু যারা তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানত তারা দুঃখ করতে লাগল-আসন্নপ্রসবা স্ত্রীকে ছিটগ্রস্ত বাবার কাছে রেখে বেচারি বড় অকালেই মারা গেল।

*

অধ্যায়-৩

৩ মার্চ ইংলিশ ক্লাবের সবগুলি ঘর বসন্তকালের মৌমাছিদলের গুঞ্জনের মতো নানা মানুষের কলগুঞ্জনে ভরে উঠল। ক্লাবের সদস্য ও অতিথিরা এখানে-ওখানে ঘুরছে, বসছে, দাঁড়াচ্ছে, একত্র হচ্ছে। আবার সরে যাচ্ছে, কারো পরনে ইউনিফর্ম, কারো বা সান্ধ্যপোশাক, আবার এখানে-ওখানে কেউ বা চুলে পাউডার মেখে গায়ে রুশ কাফতান চড়িয়েছে। উপস্থিত লোকদের মধ্যে অধিকাংশই প্রবীণ সম্ভ্রান্ত মানুষ, আত্মবিশ্বাসে ভরা চওড়া মুখ, মোটা আঙুল এবং দৃঢ় অঙ্গভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর। কিছু কিছু সামরিক অতিথিও এসেছে, তারা অধিকাংশই যুবক, যেমন দেনিসভ, রস্তভ ও দলখভ।

নেসভিস্কি সেখানে এসেছে ক্লাবের পুরোনো সদস্য হিসেবে। স্ত্রীর হুকুমে পিয়ের বড় বড় চুল রেখেছে, চশমা পরা ছেড়ে দিয়েছে। তোমাফিক পোশাক পরে সে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে বড়াই বিষণ্ণ ও নির্জীব দেখাচ্ছে।

কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ ব্যস্তসমস্ত হয়ে নরম জুতো পায়ে একবার খাবার ঘর একবার বসবার ঘর করছে, সাধারণ ও অসাধারণ সকল পরিচিত জনকেই সমানভাবে সাদরে অভ্যর্থনা করছে, আর বার বার ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপছে। ছোট রস্তভ দলখভকে নিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, সম্প্রতি দলখভের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, আর সে পরিচয়কে সে যথেষ্ট মূল্যবান মনে করে। বুড়ো কাউন্ট তাদের কাছে এগিয়ে এসে দলখভের হাতটা চেপে ধরল।

দয়া করে আমাদের বাড়িতে এস…আমার সাহসী ছেলেকে তুমি তো চেন…সেখানে তো একসঙ্গে ছিলে…দুজনই তো বীর…আরে, ভাসিলি ইগনাভিচ যে…কেমন আছেন? একটি বুড়ো মানুষকে দেখে কথাটা বলতে না বলতেই সকলে চঞ্চল হয়ে উঠল, আর পরিচারক ভীত মুখে ঘোষণা করল : তিনি এসে গেছেন!

ঘণ্টা বেজে উঠল, নায়েব-গোমস্তারা ছুটে বেরিয়ে গেল, নানা ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অতিথিরা বড় বসবার ঘরে এসে নাচ-ঘরের দরজার কাছে ভিড় করল।

দ্বারপথে ব্যাগ্রেশনের আবির্ভাব হল, মাথায় টুপি নেই, হাতে তলোয়ার নেই, ক্লাবের রীতি অনুসারে সেগুলি দরোয়ানের হাতে দিয়ে এসেছে। তার পরনে একটা নতুন আঁটসাট ইউনিফর্ম, তাতে রুশ ও বিদেশী সম্মান-স্মারক এবং সেন্ট জর্জ তারকা লাগানো। দেখেই বোঝা যায় ডিনারে আসবার আগে সে চুল ও জুলফি হেঁটেছে, তাতে তাকে আরো খারাপই দেখাচ্ছে। অদ্ভুত সলজ্জ ভঙ্গিতে সে অভ্যর্থনা-কক্ষের কাঠের কাজ করা মেঝের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল, হাত দুটোকে নিয়ে যে কি করবে বুঝে উঠছে না, শোন গ্রেবার্নে কুন্ঠ রেজিমেন্টের প্রধান হিসেবে যেমন গোলাবর্ষণের ভিতর দিয়ে চষা ক্ষেত পেরিয়ে তাকে ছুটতে হয়েছিল তেমন চলাতেই সে অভ্যস্ত-সেটাই তার পক্ষে সহজতর। কমিটির সদস্যরা দরজাতেই ব্যাগ্রেশকে ঘিরে ধরল, এমন একজন মহামান্য অতিথিকে দেখতে পেয়ে তারা তাদের আহ্লাদের কথা শোনাতে লাগল। এদিকে কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ হাসতে হাসতে বারবার পথ ছেড়ে দাও বাবা! পথ ছাড়! পথ ছাড়! বলতে বলতে সোৎসাহে ভিড় ঠেলে অতিথিদের ভিতরে ঢুকিয়ে মাঝখানের সোফাটায় তাকে বসিয়ে দিল। তারপরেই কাউন্ট ইলিয়া ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল এবং এক মিনিট পরে একটা মস্ত বড় রুপোর থালা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে থালাটা প্রিন্স ব্যাগ্রেশনকে উপহার দিল। সেই থালায় রয়েছে বীরের সম্মানে রচিত ও মুদ্রিত কয়েকটি কবিতা। রুপোর থালার দিকে তাকিয়ে ব্যাগ্রেশন সভয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল, যেন কারো সাহায্য খুঁজছে। কিন্তু সকলের চোখেই এক কথা-ওটা গ্রহণ করা হোক। অগত্যা দুই হাত বাড়িয়ে সে থালাটা নিল এবং সেটা উপহার দেবার জন্য কঠোর তিরস্কারের দৃষ্টিতে কাউন্টের দিকে তাকাল। একজন কেউ থালাটা তার হাত থেকে নিয়ে কবিতাগুলোর দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওঃ, এগুলো তাহলে পড়তে হবে! মুখে না বললেও ব্যাগ্রেশনের ভাবভঙ্গিতে এইরকমই মনে হল। কিন্তু কবি স্বয়ং কবিতাগুলি তুলে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে পড়তে শুরু করল। ব্যাগ্রেশন মাথা নিচু করে শুনতে লাগল :

আলেক্সান্দারের শাসনকালকে তুমি গৌরবে ভরিয়ে তোল,
সিংহাসনে রক্ষা কর আমাদের টাইটাসকে,
পাত্ররূপে তুমি ভয়ংকর, আবার মানুষ হিসেবে দয়ার অবতার,
স্বদেশে তুমি হৃফিউস, আর রণক্ষেত্রে তুমি সিজার!
এমন কি ভাগ্যবান যে নেপোলিয়ন।
সেও অভিজ্ঞতায় তোমাকে চিনেছে ব্যাগ্রেশন,
তাই তো হারকিউলিস সদৃশ রুশদের ঘাটাতে সে সাহস করে না…

পড়া শেষ হবার আগেই ঘোষণা করা হল, ডিনার তৈরি! দরজা খুলে গেল, আর খাবার ঘর থেকে ভেসে এল পলোনেসের সুর :

জয়ের আনন্দের বজ্রনিনাদে তোমরা জাগো,
বীর রুশগণ, জয়-গৌরবে হও অগ্রসর!…

কবির দিকে সক্রোধে তাকিয়ে কাউন্ট রস্তভ ব্যাগ্রেশনকে অভিবাদন করল। কবিতার চাইতে ডিনার অধিক মূল্যবান–এটা বুঝতে পেরে সকলেই উঠে পড়ল। ব্যাগ্রেশন সকলের আগে আগে খাবার ঘরে ঢুকল।

ডিনারের ঠিক আগে কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ ছেলেকে ব্যাগ্রেশনের সামনে উপস্থিত করল। ব্যাগ্রেশন তাকে চিনতে পেরে কয়েকটা অসংলগ্ন কথা বলল, আর কাউন্ট ইলিয়া সানন্দে ও সগর্বে চারদিকে তাকাতে লাগল।

দেনিসভ ও নবপরিচিত দলখভকে সঙ্গে নিয়ে নিকলাস রস্তভ বসল টেবিলের প্রায় মাঝখানে। তাদের মুখোমুখি প্রিন্স নেসভিৎস্কির পাশে বসল পিয়ের। কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ বসল ব্যাগ্রেশনের দিকে মুখ করে এবং মস্কো-আতিথেয়তার মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রিন্সের প্রতি সম্মান দেখাতে লাগল।  

তার প্রচেষ্টা বৃথা গেল না। ডিনারটা চমৎকার হল, তবু খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন তার স্বস্তি নেই। সবই ভালোয় ভালোয় শেষ হল। অবশেষে পরিচারক গ্লাসে গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালতে শুরু করল। কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে নিজের গ্লাসটা হাতে নিয়ে কাউন্ট উঠে দাঁড়াল। তার কথা শুনবার জন্য সকলেই চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল।

আমাদের সার্বভৌম সম্রাটের স্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে, চেঁচিয়ে কথাগুলি বলতে গিয়ে আনন্দে ও উৎসাহে তার চোখ দুটি ভিজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ড বেজে উঠল জয়ের আনন্দের বজ্রনিনাদে তোমরা জাগোর সুরে। সকলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, হুররা! ব্যাগ্রেশনও উঠে দাঁড়াল, যে কণ্ঠস্বরে শোন গ্রেবার্নের রণক্ষেত্রে চিৎকার করেছিল সেই স্বরেই বলে উঠল হুররা! তিনশো মানুষের গলাকে ছাপিয়ে শোনা গেল হোট স্তভের উচ্ছ্বাসপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তার প্রায় কেঁদে গলাকে ছাপিয়ে শোনা গেল ছোট রস্তভের উচ্ছ্বাসপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তার প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হল। সগর্জনে বলল, আমাদের সার্বভৌম ম্রাটের স্বাস্থ্যের উদ্দেশে! হুররা! এক চুমুকে নিজের গ্লাসটা খালি করে সেটাকে মেঝেতে ছুঁড়ে দিল। অনেকেই তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল, হৈ-চৈ চিৎকার চলল অনেকক্ষণ পর্যন্ত। সেটা থামলে পরিচারক মেঝে থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরো সরিয়ে নিল, সকলে আবার আসনে বসে পড়ল। বুড়ো কাউন্ট আবার উঠে দাঁড়াল, থালার পাশে রাখা কাগজের দিকে তাকাল, তারপর বলল, আমাদের বিগত অভিযানের নায়ক প্রিন্স পিতর আইভানভিচ ব্যাগ্রেশনের স্বাস্থ্যের উদ্দেশে। তার নীল চোখ দুটো আবার ভিজে উঠল। তিনশো কণ্ঠস্বরে আবার ধ্বনি উঠল হুররা! এবার কিন্তু ব্যান্ড বাজল না, তার পরিবর্তে একদল গায়ক পল আইভানভিচ কুতুজভের (প্রধান সেনাপতি কুতুজভ নয়) রচনা একটি গীত-কাব্য গাইতে শুরু করল :

রুশগণ! সব বাধাতে পায়ে দলে চল এগিয়ে!
সাহসই তো জয়ের প্রতিশ্রুতি,
আমাদের কি ব্যাগ্রেশন নেই?
তার সম্মুখে শত্রু চিরপদানত… ইত্যাদি।

গান শেষ হতেই একের পর এক স্বাস্থ্য পানের প্রস্তাব হতে লাগল। আর কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ ক্রমেই অধিকতর চঞ্চল হতে লাগল, বেশি করে গ্লাস ভাঙা হল, চিৎকার হতে লাগল উচ্চ থেকে উচ্চতর। উপস্থিত সকলেরই স্বাস্থ্য পান করা হল, আর শেষপর্যন্ত ভোজসভার উদ্যোক্তা হিসেবে আলাদাভাবে স্বাস্থ্যপান করা হল কাউন্ট ইলিয়া রশুভের। সেইসময়ে কাউন্ট তার রুমালটা বের করে মুখ ঢেকে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল।

*

অধ্যায়-৪

পিয়ের বসেছে দলখব ও নিকলাস রস্তভের উল্টোদিকে। যথারীতি যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে সে প্রচুর ভোজ্য ও পানীয় খেয়েছে। কিন্তু যারা তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানে তারা বুঝতে পারল যে সেদিন তার মধ্যে একটা মস্তবড় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সারাক্ষণ সে নীরবে চারদিকে তাকাল, অথবা স্থির দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অন্যমনস্কভাবে নাকের নিচু জায়গাটা ঘষতে লাগল। তার মুখ বিষণ্ণ, গম্ভীর। চারদিকে যা কিছু চলছে তার কিছু যেন তার চোখেও পড়ছে না, কানেও ঢুকছে না। মনে হল, যেন একটা দুঃখদায়ক অমীমাংসিত সমস্যার মধ্যেই সে ডুবে আছে।

মস্কোতে আসার পরে তার বোন প্রিন্সেস তার স্ত্রীর সঙ্গে দলখভের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছে, এবং আজই সকালে একটা বেনামী চিঠি সে পেয়েছে যাতে বেনামী চিঠির স্বাভাবিক নিচ রসিকতার সঙ্গে বলা হয়েছে যে চশমার ভিতর দিয়ে দেখে বলে সে ঠিকমতো না দেখতে পেলেও দলখভের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্কটা একমাত্র তার কাছে ছাড়া আর কারো কাছেই গোপন নেই–এটাই হচ্ছে সেই অমীমাংসিত সমস্যা যা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রিন্সেসের ইঙ্গিত এবং বেনামী চিঠি দুটোকেই পিয়ের সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করছে, কিন্তু এখন দলখভের দিকে তাকাতে তার ভয় করছে। যতবার দলখভের সুন্দর উদ্ধর চোখ দুটির দিকে চোখ পড়ছে ততবারই একটা ভয়ংকর দানবিয় কিছু তার মনের মধ্যে মাথা তুলছে, আর অতি দ্রুত সে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। তার স্ত্রী অতীত জীবন এবং দলখভের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা স্মরণ করে পিয়ের পরিষ্কার বুঝতে পারল যে চিঠিতে যা বলা হয়েছে তা সত্যি হতেও পারে, অন্তত তার স্ত্রীর ব্যাপার না হলে সত্যি বলে মনে হতে পারত।

পিয়ের ভাবতে লাগল, হা, সে খুবই সুদর্শন, আমি তাকে চিনি। যেহেতু আমি তার উপকার করেছি, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি, তাকে সাহায্য করেছি, তাই আমার নামে কলঙ্ক লেপন করতে, আমাকে পরিহাসের পাত্র করে তুলতে তার তো মজা লাগবেই। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাকে ঠকাবার আনন্দটা যে কত মশলাদার হবে সেটা তো আমি জানি, বুঝি। হ্যাঁ, যদি এটা সত্যি হয়, কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করার কোনো অধিকার আমার নেই, বিশ্বাস করতে আমি পারি না। রস্তভ বারবার পিয়েরের দিকে তাকাচ্ছিল এবং তার অন্যমনস্কতা ও তাকে না চনিতে পারার জন্য পিয়েরের উপর বিরক্ত হচ্ছিল। এমন কি যখন সম্রাটের স্বাস্থ্য পান করা হচ্ছিল তখনো পিয়ের চিন্তায় ডুবে ছিল, উঠে দাঁড়াল না, গ্লাসটাও তুলে ধরল না।

বেপরোয়া হয়ে রস্তভ চেঁচিয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে? শুনতে পাচ্ছ না হিজ ম্যাজেস্টি সম্রাটের। স্বাস্থ্যপান করা হচ্ছে।

পিয়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল, গ্লাসটা শেষ করল, তারপর সকলে বসে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে সদয় হাসি হেসে রস্তভের দিকে মুখ ফেরাল।

বলল, আরে আমি তো তোমাকে চিনতেই পারিনি! কিন্তু রস্তভ তখন অন্য কাজে ব্যস্ত, সে হুররা বলে চেঁচাচ্ছে।

দলখভ রশুভকে বলল, পরিচয়টা নতুন করে ঝালিয়ে নাও না কেন?

লজ্জা পাবে, ও একটা মুখখু! রস্তভ বলল।

সুন্দরী রমণীদের স্বামীর সঙ্গে দহরম-মহরম রাখা উচিত, দেনিসভ বলল।

এই সব কথাবার্তা ধরতে না পারলেও পিয়ের বুঝল যে তার কথাই হচ্ছে। মুখ লাল করে সে সরে গেল।

আচ্ছা, এবার তাহলে সুন্দরী নারীদের স্বাস্থ্যের উদ্দেশে, মুখখানা গম্ভীর হলেও ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে দলখভ গ্লাসটা নিয়ে পিয়েরের দিকে এগিয়ে গেল।

বলল, পিতারকিন, এ গ্লাস মনোরমা নারীদের স্বাস্থ্যের উদ্দেশে–আর তাদের প্রেমিকদেরও!

দলখভের দিকে না তাকিয়ে বা তার কথার জবাব না দিয়ে পিয়ের চোখ নামিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল। পরিচারক কুতুজভের গীতি-কাব্যের পুস্তিকাটি বিলি করছিল, অন্যতম প্রধান অতিথি হিসেবে পিয়েরের সামনেও একখানা রাখল। পিয়ের হাত বাড়াবার আগেই দলখভ ঝুঁকে পড়ে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিল। দলখভের দিকে তাকিয়ে পিয়ের চোখ নামাল। যে ভয়ংকর দানবীয় কিছু এতক্ষণ তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল সেটা আবার মাথা তুলে তাকে পেয়ে বসল। টেবিলের উপর সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, কোন সাহস তুমি ওটা নিলে?

সে চিৎকার শুনে এবং কাকে বলা হচ্ছে বুঝতে পেরে নেসভিৎস্কি ও পার্শ্ববর্তী ভদ্রলোক সভয়ে বেজুকভের দিকে মুখ ঘোরাল।

ভীত গলায় ফিসফিস করে বলল, ওরকম করবেন না! করবেন না! আপনার হল কি?

নিষ্ঠুর খুশি-খুশি চোখে দলখভ পিয়েরের দিকে তাকাল, তার সেই বিশেষ হাসিটি যেন বলতে চাইছে, আহা! এই তো আমি চাই!

পরিস্কার গলায় বলল, এটা তুমি পাবে না!

পিয়েরের মুখ কালো হয়ে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে, পুস্তিকাটি সে একটানে ছিনিয়ে নিল।

হুংকার দিয়ে বলল…, তুমি…! তুমি…তুমি শয়তান। আমি তোমাকে দ্বৈত যুদ্ধে আহ্বান করছি! চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল।

ঠিক সেই মুহূর্তে কথাগুলি বলার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর দোষের যে প্রশ্নটা সারা দিন তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে তার একটা চরম ও নিঃসন্দেহে সমর্থনসূচক উত্তর যেন সে পেয়ে গেল। মনে জাগল স্ত্রীর প্রতি ঘৃণা, চিরদিনের মতো তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তখনকার মতো পিয়ের বাড়ি ফিরে গেল, কিন্তু দলখভ ও দেনিসভকে নিয়ে রস্তভ আরো অনেক সময় ক্লাবেই থাকল, জিপসি ও অন্যান্যদের গান শুনল।

ক্লাবের ফটকে রভের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় দলখভ বলল, আচ্ছা, তাহলে কাল দেখা হচ্ছে সকোলনিকিতে।

তোমার মন বেশ শান্ত আছে তো? রস্তভ জিজ্ঞেস করল।

দলখভ একটু চুপ করে থেকে তারপর কথা বলল।

দেখ, দুটো কথায় তোমাকে দ্বৈত যুদ্ধের সব গোপন তথ্য বলে দিচ্ছি। দ্বৈত যুদ্ধে না মরবার আগে তুমি যদি একটা উইল কর, বাবা-মাকে মমতাভরা চিঠি লেখ, যদি মনে কর তুমি মারা যাবে, তাহলে তুমি একটা মূর্খ, তোমার পরাজয় অনিবার্য। তুমি যুদ্ধে যাবে এই দৃঢ় অভিপ্রায় নিয়ে যে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তুমি প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলবে, বাস, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কমায় আমাদের ভালুক-শিকারী বলত, সকলেই ভালুককে ভয় করে, কিন্তু ভালুককে সামনাসামনি দেখামাত্রই তোমার সব ভয় চলে যাবে, তোমার একমাত্র চিন্তা হবে সেটাকে ছেড়ে না দেওয়া! আমিও ঠিক তাই বলি। A demain, mon cher. (প্রিয় বন্ধু কাল দেখা হবে।)

পরদিন সকাল আটটায় পিয়ের ও নেসভিৎস্কি ঘোড়ায় চড়ে সকোলনিকি বনে পৌঁছে দেখল, দলখভ, দেনিসভ ও রস্তভ আগেই সেখানে হাজির হয়েছে। পিয়েরের বিপর্যস্ত মুখটা হলদে হয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, রাতে সে ঘুমোতে পারেনি। দুটো চিন্তায় সে সম্পূর্ণ ডুবে আছে : এক, তার স্ত্রীর দোষ-বিদ্রি রাত কাটাবার পরে এ সম্পর্কে তার মনে তিলমাত্র সন্দেহ নেই, আর দুই, দলখভের নির্দোষিতা। পিয়ের ভাবছে, তার জায়গায় হলে আমিও তো এই করতাম। তাহলে কেন এই দ্বৈতযুদ্ধ, এই হত্যা! হয় আমি তাকে হত্যা করব, না হয় সে আমার মাথায়, কনুইতে বা হাঁটুতে আঘাত করবে। আমি কি এখান থেকে চলে যেতে পারি, দৌড়ে পালাতে পারি, কোথাও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারি? আবার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও করছে, আর কত দেরি? সব প্রস্তুত তো?

যখন সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, সীমানা-নির্ধারণের জন্য বরফের মধ্যে তরবারি পোতা, হল, পিস্তলে গুলি ভরা হল, তখন নেসভিৎস্কি গেল পিয়েরের কাছে।

ভীরু গলায় সে বলল, এই সংকটকালে, অতীব সংকট-মুহূর্তে আপনাকে যদি পুরো সত্য কথাটা না বলি তাহলে আমার কর্তব্যে ত্রুটি ঘটবে, আমাকে আপনার সমর্থক নির্বাচন করে যে বিশ্বাস ও সম্মান আপনি আমাকে দেখিয়েছেন তার প্রতি অবিচার করা হবে। এই ব্যাপারের, এবং এ নিয়ে রক্তপাত ঘটাবার যথেষ্ট কারণ নেই বলেই আমি মনে করি।…আপনি ঠিক কাজ করেননি…আবেগের বশে আপনি…

সত্যি, খুবই বোকার মতো কাজ করেছি, পিয়ের বলল।

নেসভিৎস্কি বলল, তাহলে আপনার এই আক্ষেপের কথাটা প্রকাশ করার অনুমতি দিন, আমার বিশ্বাস আপনার প্রতিপক্ষও সেটা মেনে নেবেন। আপনি তো বোঝেন কাউন্ট, কোনো ব্যাপার সংশোধনের অতীত হয়ে যাবার আগেই ভুলটাকে স্বীকার করা অনেক বেশি সম্মানজনক। তাতে কোনো পক্ষেরই অপমান নেই। তাহলে অনুমতি করুন, ওদের বলি…

পিয়ের বলে উঠল, না! বলাবলির কি আছে? সবই সমান…সব প্রস্তুত তো? শুধু বলে দাও কোথায় যেতে হবে, কোথায় গুলি ছোঁড়া হবে? অস্বাভাবিক শান্ত হাসির সঙ্গে সে বলল।

পিস্তলটা হাতে নিয়ে সে ঘোড়া টেপার ব্যাপারে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কারণ এর আগে সে কখনো হাত দিয়ে পিস্তল ধরেনি–অথচ সে কথাটা স্বীকার করার ইচ্ছা নেই।

ওঃ, হ্যাঁ, এইভাবে, আমি জানি, তবে ভুলে গিয়েছিলাম, সে বলল।

ক্ষমা চাইবার প্রশ্নই ওঠে না, দেনিসভের মিটমাটের প্রস্তাবের উত্তরে এই কথা বলে দলখভও নির্দিষ্ট জায়গার দিকে এগিয়ে গেল।

দ্বৈত যুদ্ধের স্থান নির্বাচিত হয়েছে রাস্তা থেকে আমি পা দূরে। পাইনের বনের মধ্যে একটা পরিষ্কার ছোট জায়গা, বরফে ঢাকা, গত কয়েকদিন হল বরফ গলতেও শুরু করেছে। পরিষ্কার জায়গাটার একপ্রান্তে গিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চল্লিশ পা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। বরফ গলার ফলে জায়গাটা কুয়াশায় ঢেকে গেছে, চল্লিশ পা দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তিন মিনিট হয়ে গেল সকলেই প্রস্তুত, কিন্তু সকলেই দেরি করতে লাগল, সকলেই নিশ্চুপ।

*

অধ্যায়-৫

দলখভ বলল, তাহলে শুরু হোক!

ঠিক আছে, একইভাবে হেসে পিয়ের বলল।

বাতাসে একটা ত্রাসের অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে, হাল্কাভাবে শুরু হলেও ব্যাপারটাকে এখন আর এড়ানো যাবে না, মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর না করে ঘটনা এখন নিজের পথেই এগিয়ে চলেছে। দেনিসভই প্রথম সীমানায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল :

প্রতিপক্ষরা যখন মিটমাট করতে রাজি হলেন না তখন কাজ শুরু হোক। আপনাদের পিস্তল তুলে নিন, আর তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হোন।

এক, দুই, তিন! চিৎকার করে বলেই সে একপাশে সরে গেল।

দুই প্রতিপক্ষ এগিয়ে চলল, ক্রমাগতই একে অপরের কাছাকাছি হতে লাগল, কুয়াশার ভিতর দিয়ে পরস্পরকে দেখতে পেল। সীমানার কাছে পৌঁছে যে কোনো সময় গুলি ছুঁড়বার অধিকার তাদের আছে। দলখভ পিস্তল না তুলেই ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, তার উজ্জ্বল ঝকঝকে নীর চোক একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখের দিকে।

তাহলে আমি যখন খুশি গুলি করতে পারি? পিয়ের বলল। তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে গিয়ে তার পা পড়ল পুরু বরফের মধ্যে। ছয় পা এগিয়ে সে আবার বরফের মধ্যে পা ফেলল, নিজের পায়ের দিকে তাকাল, তারপরেই অতি দলখভের দিকে তাকিয়ে আঙুল বাঁকিয়ে ঘোড়া টিপল। পিস্তলের শব্দ যে এত বেশি হবে তা সে বুঝতে পারেনি, শব্দ শুনে কেঁপে উঠে পরমুহূর্তেই সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কুয়াশার আরো বেশি ঘন হওয়া ধোয়ার ভিতর দিয়ে প্রথমে সে কিছুই দেখতে পেল না, যে দ্বিতীয় গুলির শব্দটা সে আশা করেছিল তাও শোনা গেল না। শুধু শুনতে পেল দলখভের দ্রুত পায়ের শব্দ, ধোয়ার ভিতর দিয়ে তার মূর্তিটা চোখে পড়ল। এক হাতে বাঁ দিকটা চেপে ধরেছে, অন্য হাতে ধরে আছে হেলেপড়া পিস্তলটা। মুখটা বিবর্ণ। রস্তভ ছুটে গিয়ে কী যেন বলল।

না-আ-আ! দলখভ দাঁতের ফাঁক দিয়ে কথাটা উচ্চারণ করল, না, এখনো শেষ হয়নি! টলতে টলতে আরো কয়েক পা এগিয়ে একেবারে তলোয়ারের কাছে পৌঁছে সে বরফের উপর এলিয়ে পড়ল। বাঁ হাতটা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে, হাতটাকে কোটের উপর মুছে তার উপরেই শরীরের ভার রাখল। ভ্রুকুঞ্চিত বিবর্ণ মুখখানা কাঁপছে।

দয়া… দলখভ কথাটা পুরো উচ্চারণ করতে পারল না।

অনেক চেষ্টার পর বলল, দয়া কর।

কোনোরকমে কান্না চেপে পিয়ের দলখভের দিকে ছুটে গেল, কিন্তু সীমানা পেরিয়ে যাবার আগেই দলখভ চিৎকার করে উঠল, তোমার সীমানায় ফিরে যাও!

তার কথার অর্থ বুঝতে পেরে পিয়ের নিজের তরবারির কাছেই থেমে গেল। দুজনের মাঝখানে মাত্র দশ পায়ের ব্যবধান। দলখভ বরফের উপর মাথাটা নিচু করল, লোভীর মতো তাতে কামড় বসল, তারপর মাথাটা তুলে কোনোরকমে উঠে বসল। চুষে চুষে ঠাণ্ডা বরফটা গিলে ফেলল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল, কিন্তু দুই চোখে তখনো হাসির ঝিলিক। অবশিষ্ট শক্তি একত্র করে পিস্তলটা তুলে নিশানা স্থির করল।

পাশে সরে যান। নিজেকে পিস্তল দিয়ে আড়াল করুন! নেসভিকি চেঁচিয়ে বলল।

করুণা ও অনুতাপের মৃদু হাসি হেসে, হাত ও পা অসহায়ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে, পিয়ের তার চওড়া বুকটা দলখভের দিকে সোজা করে মেলে ধরে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। দেনিসভ, রস্তভ ও নেসভিৎস্কি চোখ বুজল। ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের কানে এল গুলির আওয়াজ ও দলখভের কুদ্ধ চিৎকার।

ফস্কে গেল! বলেই দলখভ অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে বরফের উপর পড়ে গেল। পিয়ের নিজের কপাল চেপে ধরে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে ঘন বরফের উপর দিয়ে বনের দিকে ছুটতে ছুটতে অসংলগ্নভাবে বলতে লাগল :

বোকামি…বোকামি!…মিথ্যা কথা…

নেসভিৎস্কি তাকে থামিয়ে বাড়ি নিয়ে গেল।

আহত দলখভকে নিয়ে রস্তভ ও দেনিসভও ফিরে গেল।

দলখভ চোখ বুজে নীরবে স্লেজের মধ্যে শুয়ে রইল, কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিল না। কিন্তু মস্কোতে ঢুকেই সহসা সে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল, একটু চেষ্টা করে মাথাটা তুলে রভের হাতটা চেপে ধরল।

রভ বলল, আচ্ছা? কেমন বোধ করছ?

খারাপ! কিন্তু সেকথা থাক বন্ধু– হাঁপাতে হাঁপাতে দলখভ বলল। আমরা এখন কোথায়? মস্কোতে তা জানি। আমার কি হল তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু তাকে আমি মেরে ফেললাম, মেরে ফেললাম…এ আঘাত সে সইতে পারবে না! সে বাঁচবে না…

কে রস্তভ জিজ্ঞেস করল। আমার মা! আমার মা, আমার স্বর্গের দেবী, আমার আরাধ্যা জননী!রস্ততের হাতে চাপ দিয়ে দলখভ কেঁদে ফেলল।

একটু শান্ত হয়ে সে রস্তভকে বুঝিয়ে বলল, সে এখন মার কাছেই আছে, তাকে এভাবে মরতে দেখলে মা বাঁচবে না। রশুভকে অনুরোধ করল, সে যেন আগেই গিয়ে তার মাকে প্রস্তুত করে তোলে।

সেই কথামতো কাজ করতে রস্তভ এগিয়ে গেল। আর সবিস্ময়ে জানতে পারল যে ঝগড়াটে দলখভ, ষণ্ডামার্কা দলখভ মস্কোতে থাকে তার বুড়ি মা ও কুঁজী বোনের সঙ্গে, তার মতো স্নেহময় সন্তান ও ভাই দ্বিতীয়টি হয় না।

*

অধ্যায়-৬

ইদানীং স্ত্রীর সঙ্গে নির্জনে পিয়েরের বড় একটা দেখাসাক্ষাৎ ঘটে না। কি পিটার্সবুর্গে, কি মস্কোতে, তাদের বাড়িটা সব সময়ই অতিথি সমাগমে ভরে থাকে। দ্বৈত যুদ্ধের পরে সে-রাতে সে তার শোবার ঘরে গেল না, অন্য অনেক দিনের মতোই তার বাবার ঘরেই রইল–সেই বড় ঘরটা যেখানে কাউন্ট বেজুখভ মারা গিয়েছিল।

সোফায় শুয়ে পড়ল, ভাবল, ঘুমিয়ে পড়লেই সবকিছু ভুলে যাবে, কিন্তু ঘুমতে পারল না। এতসব ভাব, চিন্তা ও স্মৃতি ঝড়ের বেগে সহসা মনের মধ্যে ঢুকতে লাগল যে সে ঘুমতে পারল না, এমন কি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতেও পারল না, লাফ দিয়ে উঠে ঘরময় অতিদ্রুত পায়চারি করতে লাগল।

নিজেকে প্রশ্ন করল, কি ঘটেছে? তার প্রেমিককে, আমার স্ত্রীর প্রেমিককে আমি খুন করেছি। হ্যাঁ, ঠিক তাই! কিন্তু কেন? কেন এ কাজ করলাম?–ভিতর থেকে কে যেন জবাব দিল, কারণ তুমি তাকে বিয়ে করেছ।

কিন্তু আমার দোষটা কোথায়? সে জিজ্ঞেস করল। ভালো না বেসে তাকে বিয়ে করায়, নিজেকে ও তাকে ঠকানোতে। প্রিন্স ভাসিলির বাড়িতে নৈশভোজনের ঠিক পরের সেই মুহূর্তটি স্পষ্টভাবে তার মনে পড়ে গেল যখন কোনোরকমে সে বলতে পেরেছিল : আমি তোমাকে ভালোবাসি। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, সেখান থেকেই শুরু, তখনই এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বুঝতে পেরেছিলাম এটা ঠিক হচ্ছে না, একাজ করার কোনো অধিকার আমার ছিল না। আর আজ সেটাই সত্য হয়ে উঠেছে।

আনাতোল প্রায়ই আমার স্ত্রীর কাছে আসত টাকা ধার করতে, তার খোলা কাঁধে চুমো খেতে। সে তাকে টাকা দিত না, কিন্তু চুমো খেতে দিত। তার বাবা ঠাট্টা করে তার মনে ঈর্ষা জাগাতে চাইত, কিন্তু সে শান্ত হাসির সঙ্গে জবাব দিত যে ঈর্ষান্বিত হবার মতো বোকা সে নয় : তার যা ইচ্ছা করুক, আমার সম্পর্কে সে বলত। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, গর্ভাবস্থার কোনো লক্ষণ সে বুঝতে পারছে কি না। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সে জবাব দিল, সন্তান কামনা করবার মতো বোকা সে নয়, আমার সন্তানকেও সে গর্ভে ধারণ করবে না।

তখনই তার মনে পড়ে গেল স্ত্রীর নিচু স্তরের চিন্তার কথা, তার ভাষার গ্রাম্যতার কথা, অথচ বেশ উঁচু মহলেই সে লালিত-পালিত হয়েছিল।

আমি তেমন বোকা নই।…চেষ্টা করেই দেখা না।…তুমি এ ব্যাপারে নাক গলাতে এস না, সে প্রায়ই বলত। যুবক, বৃদ্ধ ও নারীদের সঙ্গে স্ত্রীর চালচলনের সাফল্য দেখে পিয়ের কিছুতেই বুঝতে পারত না কেন সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসে না।

সে নিজেকে বলতে লাগল, হা, আমি তাকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, আমি জানতাম সে চরিত্রহীনা, তবু নিজের কাছে সেটা স্বীকার করার সাহস আমার ছিল না। আর এখন জোরকরা হাসির সঙ্গে বরফের উপর বসে দলখভ মরতে বসেছে, আর নকল সাহসিকতার সঙ্গে আমার মনস্তাপকে উপভোগ করছে।

সব, সব আমার স্ত্রীর দোষ, কিন্তু তাতে কী হল? তার ব্যাপারে আমি কেন অন্ধ হয়ে ছিলাম? না, দোষ আমার, আমাকেই ভুগতে হবে।… কি? আমার নামে কলঙ্ক লাগবে? আমার জীবনে দুর্ভাগ্য দেখা দেবে? আঃ, যত সব বাজে কথা।

পিয়েরের মাথায় নতুন চিন্তা দেখা দিল : মোড়শ লুইর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল কারণ লোকে বলে সে ছিল সম্মানের অযোগ্য ও অপরাধী, আর তাদের দিক থেকে তারা ঠিকই বলে, আবার যারা তাকে মহাপুরুষ বলে মনে করে তার জন্য শহীদের মৃত্যু বরণ করেছিল তারাও তো ঠিকই বলে। পরে রোবেস পিয়েরের মাথা কাটা গেল সে স্বেচ্ছাচারী বলে। কে ঠিক, আর কার ভুল? কেউ না! যতক্ষণ বেঁচে আছবেঁচে থাক, কালই তো তুমিও মরে যেতে পার, যেমন একঘণ্টা আগে আমিও মরতে পারতাম। অনন্তকালের তুলনায় মানুষ যখন মাত্র একটি মুহূর্তের জীবনের অধিকারী তখন অনুশোচনার যন্ত্রণায় সময় কাটানো চলে কি?

সেই রাতেই খানসামাকে ডেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, সে পিটার্সবুর্গে চলে যাবে। স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার কথা সে ভাবতেই পারল না। স্থির করল, পরদিনই সে চলে যাবে, একটা চিঠি লিখে তাকে জানিয়ে যাবে যে চিরদিনের মতো সে তাকে ত্যাগ করতে চায়।

পরদিন সকালে কফি নিয়ে ঘরে ঢুকে খানসামা দেখল, একখানা খোলা বই হাতে নিয়ে পিয়েরের অটোমানের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। জেগে উঠে অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল, সে যে কোথায় আছে সেটাই বুঝতে পারছে না।

খানসামা বলল, কাউন্টেস আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বাড়িতে আছেন কি না।

পিয়ের স্ত্রীকে কী বলে পাঠাবে সেটা স্থির করার আগেই রুপোর কাজকরা শাদা সাটিনের ড্রেসিং-গাউন পরে কাউন্টেস নিজেই ঘরে ঢুকল। তার শান্ত, গম্ভীর মুখের মর্মরসদৃশ ভুরুর উপর একটা ক্রোধের ভাঁজ পড়েছে শুধু। খানসামার সামনে সে কোনো কথা বলল না। দ্বৈত যুদ্ধের খবর সে জেনেছে, আর তা নিয়ে কথা বলতেই এসেছে। খানসামা কফির সরঞ্জাম সাজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে রইল। পিয়ের চশমার ফাঁক দিয়ে ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকাল, শিকারি কুকুরপরিবৃত খরগোসের মতো সে বই পড়াটাই চালিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে কাজটা যেমন অর্থহীন তেমনই অসম্ভব বুঝতে পেরে সে পুনরায় ভীরু চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। স্ত্রী কিন্তু বসল না, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তার দিকে তাকিয়ে খানসামার চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

তারপর কঠিন স্বরে বলল, আচ্ছা, এসব কী হচ্ছে? আমি জানতে চাই তুমি এসব কী করে বেড়াচ্ছ?

আমি? আমি কি… পিয়ের তো তো করে বলল।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে তুমি এখন মহাবীর, কী বল? শোন, কী নিয়ে এ দ্বৈতযুদ্ধ হল? কী প্রমাণ করতে চাও? তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি।

অটোমানের উপর ঘুরে পিয়ের মুখ খুলল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না।

হেলেনই আবার কথা বলল, তুমি যদি জবাব না দাও তো আমিই বলি।… লোকে যা বলে তুমি তাই বিশ্বাস কর। লোকে বলল… হেলেন হেসে উঠল, …দলখভ আমার প্রেমিক আর তুমি তাই বিশ্বাস করলে। আচ্ছা, তুমি কি প্রমাণ করলে? এই দ্বৈত যুদ্ধে কী প্রমাণ হল? প্রমাণ হল যে তুমি একটা বোকা, কিন্তু সে কথা তো সকলেই জানে। এর ফল কী হবে? সারা মস্কো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, সকলেই বলবে যে মাতাল হয়ে, কী করছ না বুঝেই বিনা কারণে একটা মানুষের প্রতি ঈর্ষাবশত তুমি তাকে দ্বৈত যুদ্ধে আহ্বান করেছ।

হেলেনের গলা ক্রমেই চড়তে লাগল, সে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠল, অথচ সে মানুষটি সব দিক থেকে তোমার চাইতে অনেক ভালো…

তার দিকে না তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে পিয়ের গরগর করে শুধু বলল, হুম…হুম…

আর তুমিই বা কী করে বিশ্বাস করলে যে সে আমার প্রেমিক? কেন? কারণ তার সঙ্গ আমার ভালো লাগে? তুমি যতি আরো বুদ্ধিমান হতে, আরো প্রীতিপ্রদ হতে, তাহলে তো তোমার সঙ্গই আমার ভালো লাগত।

আমাকে কিছু বলল না… তোমাকে মিনতি করছি, কর্কশ গলায় পিয়ের তো তো করে বলল।

কেন বলব না? আমার যা খুশি তাই বলব, তোমাকে খোলাখুলিই বলছি, তোমার মতো স্বামীর স্ত্রীর হয়েও অন্য প্রেমিকে আসক্ত হয়নি এরকম স্ত্রীর সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু সে কাজও আমি করিনি।

পিয়ের কী যেন বলতে চাইল, এমন চোখ তুলে তাকাল যার অর্থ হেলেন বুঝতে পারল না, তারপর আবার শুয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে তার শারীরিক কষ্ট হচ্ছে, বুকের উপর যেন একটা বোঝ চেপে বসেছে, শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে।

ভাঙা গলায় তো-তো করে বলল, আমাদের আলাদা হওয়াই ভালো।

আলাদা! খুব ভালো, অবশ্য তুমি যদি আমাকে সম্পত্তি দিয়ে দাও, হেলেন বলল। আলাদা! এই কথা শুনিয়ে আমাকে ভয় দেখাতে চাও!

লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে পিয়ের টলতে টলতে তার দিকে ছুটে গেল।

টেবিলের উপর থেকে শ্বেতপাথরের কাগজ-চাপাটাতে সজোরে চেপে ধরে সেটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে আরো কয়েক পা এগিয়ে পিয়ের চেঁচিয়ে বলল, আমি, তোমাকে খুন করব!

হেলেনের মুখটা ভয়ংকর হয়ে উঠল, আর্তনাদ করে সে লাফিয়ে একপাশে সরে গেল। পিয়েরের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল তার বাবার প্রকৃতি। সে অনুভব করল বিকৃত মনের আকর্ষণ ও উল্লাস। পাথরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, সেটা টুকরো-টুকরো হয়ে গেল, দুই হাত বাড়িয়ে হেলেনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভয়ংকর স্বরে চিৎকার করে বলল বেরিয়ে যাও! যে সারা বাড়িটাই সড়য়ে সে কথাটা শুনতে পেল। হেলেন যদি ঘর থেকে পালিয়ে না যেত তাহলে সেই মুহূর্তে সে যে কি করে বসত তা ঈশ্বরই জানেন।

.

এক সপ্তাহ পরে তার সম্পত্তির বড় অংশ বৃহত্তর রাশিয়ার সব জমিদারির পূর্ণ কর্তৃত্ব স্ত্রীকে দিয়ে পিয়ের একাকি পিটার্সবুর্গ যাত্রা করল।

*

অধ্যায়-

অস্তারলিজের যুদ্ধ ও প্রিন্স আন্দ্রুর নিখোঁজ হবার খবর বন্ড হিলসে পৌঁছার পরে দুই মাস কেটে গেছে, দূতাবাসের মারফত চিঠিপত্র পাঠানো এবং নানাবিধ খোঁজখবর সত্ত্বেও তার কোনো খবরই পাওয়া যায়নি, বন্দির তালিকাতেও তার নাম নেই। তার আত্মীয়স্বজনের পক্ষে যেটা সব চাইতে খারাপ সেটা হল, এখনো এমন একটা সম্ভাবনা আছে যে স্থানীয় লোকরা হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে তাকে তুলে নিয়ে গেছে এবং সে হয়তো এখনো অপরিচিত লোকদের মধ্যে শয্যাশায়ী হয়ে হয় ভালো হয়ে উঠছে আর না হয়তো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে, অথচ নিজের কোনো খবর পাঠাতে পারছে না। যে গেজেট থেকে বুড়ে প্রিন্স অস্তারলিজে পরাজয়ের খবর প্রথম জেনেছিল তাতে যথারীতি খুব সংক্ষেপে ও অস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে চমৎকার যুদ্ধ করার পর রুশদের পশ্চাদপসরণ করতে হয় এবং তারা সুশৃঙ্খলভাবে সরে যেতে পেরেছে। এই সরকারি প্রতিবেদন থেকেই বুড়ো প্রিন্স বুঝতে পারে যে আমাদের বাহিনী পরাজিত হয়েছে। অস্তারলিজের যুদ্ধর গেজেট প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরে কুতুজভের কাছ থেকে পাওয়া একটা চিঠিতে বুড়ো প্রিন্স ছেলের ভাগ্যবিপর্যয়ের কথা জানতে পেরেছে।

কুতুজভ লিখেছে, একটি রেজিমেন্টের প্রধান হিসেবে পতাকা হাতে নিয়ে আপনার পুত্র আমার চোখের সামনেই মাটিতে পড়ে গেল-পিতা ও পিতৃভূমির উপযুক্ত সন্তান হিসেবে একটি বীরের মতোই মাটিতে পড়ল। আমার পক্ষে এবং সমগ্র বাহিনীর পক্ষে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে সে বেঁচে আছে কিনা সেটাই এখনো অনিশ্চিত। আমার ও আপনার কাছে এই আশাই একমাত্র সান্ত্বনা যে আপনার পুত্র জীবিত আছে, কারণ অন্যথায় সন্ধির পতাকার সঙ্গে রণক্ষেত্রে প্রাপ্ত অফিসারদের যে তালিকা আমাকে পাঠানো হয়েছে তাতে তার উল্লেখ অবশ্যই থাকত।

সন্ধ্যার কিছু পরে এই সংবাদ যখন আসে বুড়ো প্রিন্স তখন তার পড়ার ঘরে একাই ছিল, পরদিন সকালে সে যথারীতি বেড়াতে বের হল, কিন্তু নায়েব, মালী ও স্থপতির কাছে চুপ করেই থাকল, তাকে খুব গম্ভীর দেখালেও কাউকে কিছুই বলল না।

প্রিন্সেস মারি যখন নির্দিষ্ট সময়ে তার ঘরে গেল তখনো সে লেদতেন্ত্র কাজে ব্যস্ত ছিল, এবং যথারীতি মুখ ঘুরিয়ে তাকে চেয়েও দেখেনি।

হঠাৎ বাটালিটা ফেলে দিয়ে অস্বাভাবিক গলায় ডাকল, আঃ, প্রিন্সেস মারি!

মারি তার কাছে এগিয়ে গেল, তার মুখের দিকে তাকাল, বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। বাবার মুখের ভাবে দুঃখ নয়, ভেঙে পড়ার লক্ষণ নয়, ছিল শুধু ক্রোধ ও অস্বাভাবিকতা। সেই মুখ দেখেই মারি বুঝতে পারল, একটা ভয়ংকর দুর্ভাগ্য তার মাথার উপর ঝুলছে, তাকে বিচূর্ণ করতে উদ্যত হয়েছে, তার জীবন এসেছে সেই চরমতম দুর্ভাগ্য যা আগে কখনো তার অভিজ্ঞতায় ধরা দেয়নি, যা অপূরণীয় ও সকল বোধের অতীত–প্রিয়জনের মৃত্যু।

বাবা! আন্দ্রু! এমন অবর্ণনীয় দুঃখ ও আত্মবিস্মৃতির সঙ্গে বিচলিত প্রিন্সেস কথা দুটি বলল যে তার বাবা মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে দূরে সরে গেল।

দুঃসংবাদ! বন্দিদের মধ্যেও তার নাম নেই, নিহতদের মধ্যেও নেই! কুতুজভ লিখেছেন… এমন মর্মন্তুদ স্বরে সে আর্তনাদ করে উঠল যেন সেই আর্তনাদের দ্বারাই সে প্রিন্সেসকে জানিয়ে দিতে চাইল…নিহত।

প্রিন্সেস মাটিতে পড়ে গেল না বা মূৰ্ছিত হল না। তার মুখ আগেই বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এই কথাগুলো শোনার পরে তার মুখটা বদলে গেল, সুন্দর চোখ দুটিতে কী যেন ঝলমল করে উঠল। যেন কোনো আনন্দ-জাগতিক সুখ-দুঃখের অতীত এক পরম আনন্দ-তার অন্তরের চরম দুঃখকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বাবাকে ঘিরে যত ভয় সব সে ভুলে গেল, তার কাছে এগিয়ে গেল, তার হাত ধরল, তাকে নিচু করে দুই হাতের শীর্ণ অস্থির গলাটা জড়িয়ে ধরল।

বলল, বাবা, আমাকে দূরে ঠেলে দিও না, এসো আমরা একসঙ্গে কাঁদি।

পাজির দল! বদমাসের দল! মেয়ের কাছ থেকে মুখটা ঘুরিয়ে বুড়ো আর্তনাদ করে উঠল। সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করল, মানুষগুলোকে মারল! কিন্তু কেন? যাও, যাও, লিজেকে বলল।

অসহায়ভাবে পাশের হাতল-চেয়ারটায় বসে পড়ে প্রিন্সেস কাঁদতে লাগল। দাদা যখন তার ও লিজার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল ঠিক সেই চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল : চোখের দৃষ্টি কোমল অথচ সগর্ব।

চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সে বলল, বাবা, কেমন করে এটা ঘটল আমাকে বলো।

যাও! যাও! যুদ্ধে মারা গেছে, সেই যুদ্ধে যেখানে রাশিয়ার সব সেরা মানুষদের আর রাশিয়ার গৌরবকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যাও প্রিন্সেস মারি। যাও, লিজেকে বলল। আমি পরে যাচ্ছি।

প্রিন্সেস মারি যখন বাবার কাছ থেকে ফিরে গেল, ছোট প্রিন্সেস তখন বসে বসে কাজ করছিল। প্রিন্সেস মারির দিকে না তাকিয়ে সে তাকিয়ে ছিল মনের মধ্যে… নিজের মধ্যে… সেখানে আনন্দময় ও রহস্যময় যা ঘটে চলেছে সেইদিকে।

সেলাইটা সরিয়ে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, তোমার হাতটা দাও। তারপর ননদের হাতটা ধরে কোমরের নিচে রাখল।

তার চোখে প্রত্যাশার হাসি, লোমশ ঠোঁটটা একটু তুলল, শিশুর মতো হাসি ফুটিয়ে তেমনই তুলেই রাখল।

প্রিন্সেস মারি তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে তার পোশাকের ভাজের মধ্যে মুখ লুকাল।

এখানে, এখানে! বুঝতে পারছ? আমার এমন অদ্ভুত লাগে। তুমি কি জান মারি, ওকে আমি খুব ভালোবাসব। খুশি ভরা উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে লিজা বলল।

প্রিন্সেস মারি মাথা তুলতে পারল না, সে কাঁদছে।

কি হয়েছে মারি?

কিছু না…আমার বড় খারাপ লাগছে…আন্দ্রুর জন্য মন কেমন করছে, চোখের পানি মুছে মারি বলল।

সারাটা সকাল প্রিন্সেস মারি বার কয়েক চেষ্টা করল লিজার মনটাকে প্রস্তুত করতে, কিন্তু প্রতিবারই শুধু কাঁদতে লাগল। হোট প্রিন্সেসের খেয়াল কিছু কম, তবু কারণ না বুঝলেও এই কান্না দেখে সেও বিচলিত বোধ করল। মুখে কিছুই বলল না, কিন্তু চারদিকে কি যেন খুঁজে বেড়াতে লাগল।

ডিনারের আগে বুড়ো প্রিন্স তার ঘরে এল। লিজা তাকে সবসময়ই ভয় পায়। কেমন যেন অস্থিরভাবে সে ঘরে ঢুকল। আবার কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে গেল। দেখে শুনে হতভম্ব হয়ে ছোট প্রিন্সেস হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।

বলল, আন্দ্রুর কোনো খবর এসেছে কি?

না, তুমি তো জান খবর আসার সময় এখনো হয়নি। কিন্তু আমার বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েছে, আর তাই আমারও ভয় করছে।

তাহলে কোনো খবর আসেনি?

না, প্রিন্সেস মারি একদৃষ্টিতে লিজার দিকে তাকিয়ে বলল।

সে স্থির করেছে সন্তান প্রসবের আগে এই দুঃসংবাদ তাকে জানাবে না, বাবাকেও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করেছে সব কথা গোপন রাখতে। প্রিন্সেস মারি ও বুড়ো প্রিন্স নিজের মতো করে তাদের দুঃখ সহ্য করতে লাগল। বুড়ো প্রিন্স মনের মধ্যে কোনো আশাই পোষণ করে না, সে স্থির বুঝে নিয়েছে যে প্রিন্স আন্দ্রু নিহত হয়েছে, ছেলের খোঁজ করতে একজন কর্মচারীকে অস্ট্রিয়ায় পাঠালেও এদিকে মস্কোতে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির নির্দেশও পাঠিয়ে দিয়েছে, ছেলের স্মৃতিরক্ষার্থে সেটাকে তার নিজের বাগানে প্রতিষ্ঠা করবে, সকলকেই সে বলে বেড়াতে লাগল যে তার ছেলে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। সে চেষ্টা করতে লাগল যাতে তার আগেকার জীবনযাত্রার কোনো পরিবর্তন না ঘটে, কিন্তু শক্তিতে কুলোল না। তার বেড়ানো কমে গেল, আহার কমে গেল, ঘুম কমে গেল, দিন-দিন শরীর দুর্বল হতে লাগল। প্রিন্সেস মারির মনে তবু আশা। জীবিত দাদার জন্যই সে প্রার্থনা করে চলল, তার প্রত্যাবর্তনের সংবাদের জন্য অপেক্ষা করে রইল।

*

অধ্যায়-৮

১৯ মার্চ সকালে প্রাতরাশের সময় ছোট প্রিন্সেস ডাকল, সোনা আমার! পুরনো অভ্যাসবশেই ছোট ঠোঁটটা উপরে ঠেলে উঠল, কিন্তু যেহেতু সেই দুঃসংবাদ আসার পর থেকে এ বাড়ির প্রতিটি কথায়, এমনকি প্রতিটি পায়ের শব্দে ফুটে উঠছে দুঃখের আভাস, তাই হোট প্রিন্সেসের হাসিও সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই একই দুঃখের স্মৃতি।

সোনা আমার, আমার ভয় হচ্ছে আজ সকালের ফ্রুস্তিক (কথাটা আসলে ফ্রহুস্তকু=প্রাতরাশ)–রাঁধুনি ফুকা যেভাবে বলে আর কি–আমার ঠিক সহ্য হয়নি।

ছুটে তার কাছে গিয়ে প্রিন্সেস মারি সভয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে সোনা আমার? তোমাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। আঃ, তুমি খুব ফ্যাকাসে হয়ে গেছ।

একটি দাসী কাছেই ছিল, সে বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সি, মারি বগদানভনাকে কি ডেকে পাঠানো উচিত নয়? (মারি বগদানভনা একজন ধাত্রী, পাশের শহরে থাকে, গত পক্ষকাল ধরে বল্ড হিলসে আছে।)

প্রিন্সেস মারি সম্মতি জানাল, হা, হয়তো সেই ব্যাপারই হবে। আমি যাই। মনে সাহস আন পরি আমার। লিজাকে চুমো খেয়ে সে যাবার জন্য পা বাড়াল।

না, না, না! বিবর্ণতা ও শারীরিক যন্ত্রণা ছাড়াও ছোট প্রিন্সেসের মুখে ফুটে উঠল অপরিহার্য যন্ত্রণার একটা শিশু সুলভ ভীতি।

না, এটা বদহজম মাত্র…। তুমি বল যে এটা বদহজম, বল মারি! বল…যন্ত্রণাকাতর শিশুর মতো ছোট প্রিন্সেস নিজের খেয়ালেই কাঁদতে শুরু করে দিল। প্রিন্সেস মারি বগদানভনাকে আনার জন্য দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

যেতে যেতেই তার কানে এল, ঈশ্বর আমার! ঈশ্বর আমার! ওঃ!

ধাত্রী ছোট মোটা দুটি হাত ঘষতে ঘষতে নিজের থেকেই আসছিল। তাকে দেখেই প্রিন্সেস মারি সভয়ে বলল, মারি বগদানভনা, মনে হচ্ছে শুরু হয়ে গেছে।

একইভাবে হাঁটতে হাঁটতে মারি বগদানভনা বলল, আচ্ছা, প্রভুকে ধন্যবাদ দিন প্রিন্সেস। তবে আপনাদের মতো তরুণীদের তো এসব জানবার কথা নয়।

কিন্তু মস্কো থেকে ডাক্তার এখনো এলেন না কেন? প্রিন্সেস বলল।

ঠিক আছে প্রিন্সেস, ঘাবড়াবেন না। ডাক্তার ছাড়াই আমরা ভালোভাবে সামাল দিতে পারব।

পাঁচ মিনিট পরে তার ঘর থেকেই প্রিন্সেস মারি একটা ভারি কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। সে বাইরে তাকাল। প্রিন্স আর পড়ার ঘরের বড় চামড়ার সোফাটাকে চাকররা শোবার ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখ শান্ত ও গম্ভীর।

প্রিন্সেস মারি নিজের ঘরে একলা বসে বাড়ির নানারকম শব্দ শুনতে পাচ্ছে, আর কেউ সেখান দিয়ে গেলেই দরজা খুলে দেখছে। হঠাৎ তার দরজাটা আস্তে খুলে গেল, আর তার বুড়ি নার্স প্রাস্কোভয়া সাবিশনা মাথায় একটা শাল জড়িয়ে চৌকাঠের উপর দেখা দিল। বুড়ো প্রিন্স নিষেধ করায় আজকার সে এ-ঘরে বড় একটা আসে না।

বুড়ি বলল, তোমার কাছে একটু বসতে এলাম মাশা, প্রিন্সের সন্তের সামনে জ্বালিয়ে দেবার জন্যে তার বিয়ের মোমবাতিগুলো নিয়ে এসেছি। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ওঃ, নার্স, আমি খুব খুশি হলাম!

+ছোট্ট পাখিটি, ঈশ্বর করুণাময়।

নার্স দেবমূর্তির সামনে মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল, তারপর সেলাই নিয়ে দরজার পাশে বসল। প্রিন্সেস মারি একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। কোনো পায়ের শব্দ বা গলার স্বর শুনলেই তারা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে, প্রিন্সেস উৎকণ্ঠার সঙ্গে নানা প্রশ্ন করছে, আর নার্স তাকে সাহস দিচ্ছে।

দাসীদের বড় হল-ঘরে হাসির শব্দ নেই। চাকরদের হলে সকলেই নীরবে সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করে বসে আছে। বাইরে ভূমিদাসদের ঘরে ঘরে মশাল ও মোমবাতি জ্বলছে, কেউ ঘুমোয়নি। বুড়ো প্রিন্স পড়ার ঘরে পা টিপে টিপে পায়চারি করছে, সংবাদ জানবার জন্য তিখোনকে পাঠাল মারি বগদানভনার কাছে গিয়ে শুধু বলবি প্রিন্স আমাকে জানতে পাঠিয়েছেন তারপর সে কি জবাব দেয় আমাকে এসে বলবি।

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মারি বগদানভনা বলল, প্রিন্সকে গিয়ে বল, প্রসব-বেদনা শুরু হয়েছে।

তিখোন সে-কথা প্রিন্সকে জানাল।

খুব ভালো! বলে প্রিন্স দরজাটা বন্ধ করে দিল, তারপরে পড়ার ঘর থেকে এতটুকু শব্দ আর তিখোন শুনতে পেল না।

কিছুক্ষণ পরে মোমবাতির পলতে কেটে দেবার জন্য তিখোন আবার ঘরে ঢুকে দেখল প্রিন্স সোফায় শুয়ে আছে, তার ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে তিখোন মাথাটা নাড়ল, তার কাছে গিয়ে নিঃশব্দে তার কাঁধে চুমো খেল, তারপর সলতে না কেটে বা কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্র রহস্য তার পথেই এগিয়ে চলল। সন্ধ্যা পার হল, রাত নামল, সেই অতলস্পর্শের মুখোমুখি হয়ে কারো অন্তরের উৎকণ্ঠা ও দুর্বলতা এতটুকু হ্রাস পেল না, বরং বেড়েই চলল। কারো চোখে ঘুম নেই।

.

এ রাতটাও মার্চ মাসের সেইসব রাতের অন্যতম যখন মনে হয় শীত বুঝি নতুন করে শাসনক্ষমতা হাতে নিয়েছে, প্রচণ্ড বেগে ছড়িয়ে দিয়েছে তার শেষ বরফ ও ঝড়। বড় রাস্তার বিভিন্ন ঘাঁটিতে পরপর পাঠানো হয়েছে অনেকগুলো ঘোড়া মস্কো থেকে আগত জার্মান ডাক্তারকে আনবার জন্য, যে কোনো মুহূর্তে তার এসে পড়ার কথা, লণ্ঠন হাতে ঘোড়সওয়ারদের পাঠানো হয়েছে গ্রামের ছোট রাস্তার কানাখন্দ ও বরফ-ঢাকা ডোবা পেরিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে।

প্রিন্সেস মারি অনেকক্ষণ হল বই রেখে চুপচাপ বসে আছে। নার্স সাবিশনা বলল, ঈশ্বর করুণাময়, কখনো ডাক্তারের দরকার হয় না।

হঠাৎ একটা বাতাসের ঝাপ্টা প্রচণ্ড বেগে এসে জানালার পাল্লার উপর আছড়ে পড়ল। জানালা থেকে ডবল ফ্রেমগুলো খুলে ফেলা হয়েছে, বুড়ো প্রিন্সের হুকুমে ভরত পাখির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি ঘরের একটা করে জানালার ফ্রেম খুলে ফেলা হয়েছে। (রাশিয়ার বাড়িতে শীতকালে ডবল জানালা থাকে। যেহেতু তাতে হাওয়া চলাচলে বাধা হয় সেজন্য আবহাওয়া একটু ভালো হলেই দুটোর একটা ফ্রেম খুলে ফেলাই ভালো।) হাওয়ার দাপটে ঢিলে ছিটকানিটা খুলে যাওয়ায় ঠাণ্ডা বাতাসে ঘরের দামাস্কাস পর্দাগুলো উড়তে লাগল, মোমবাতিগুলো নিভে গেল। প্রিন্সেস মারি শিউরে উঠল, তার নার্স সেলাইটা রেখে জানালার কাছে গেল এবং বাইরে ঝুঁজে পড়ে জানালার পাল্লাটা ধরতে চেষ্টা করল। ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার মাথার রুমালের কোণ ও শাদা চুল উড়তে লাগল।

পাল্লাটা ধরে বন্ধ না করেই সে বলল, সোনা প্রিন্সেস, পথে কে যেন গাড়ি ছুটিয়ে আসছে। সঙ্গে লণ্ঠন। খুব সম্ভব ডাক্তার।

হে ঈশ্বর! তোমাকে ধন্যবাদ! প্রিন্সেস মারি বলল। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তো রুশ ভাষা জানেন না।

মাথার উপর একটা শাল জড়িয়ে নবাগতের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রিন্সেস মারি ছুটে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতেই সামনের ঘরের জানালা দিয়ে দেখাল, লণ্ঠনসহ একটা গাড়ি ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। সে সিঁড়ির দিকে গেল।

সিঁড়ির বাঁকে নামতেই পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পরিচিত একটা গলার স্বরও যেন কানে এল।

কণ্ঠস্বর বলছে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আর বাবা?

নায়েব দেমিয়ানের গলায় জবাব শোনা গেল, শুতে গেছেন।

তখন সেই কণ্ঠস্বর আরো কিছু বলল, দেমিয়ান তার জবাব দিল, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ দ্রুততর হল।

এ কি আন্দ্রু! প্রিন্সেস মারি ভাবল। না, তা হতে পারে না, সেটা বড় বেশি অসাধারণ ব্যাপার হয়ে যাবে। এই চিন্তায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ির চাতালে দেখা দিল প্রিন্স আর মুখ ও মূর্তি। বরফে ঢাকা মোটা কলারের একটা লোমের জোব্বা তার গায়ে। মোমবাতি হাতে জনৈকি পরিচারক সেখান দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, এই তো সেই মুখ, বিবর্ণ, শীর্ণ, ঈষৎ পরিবর্তিত। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে সে বোনকে জড়িয়ে ধরল।

তোমরা আমার চিঠি পাওনি? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে অপেক্ষা করলেও উত্তর পেত না, কারণ প্রিন্সেসের তখন কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না–সে ঘুরে দাঁড়াল এবং ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে (শেষ ডাক ঘাঁটিতে তাদের দেখা হয়েছিল) আবার দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে হল-ঘরে ঢুকল। সেখানে বোনকে আর একবার আলিঙ্গন করল।

কী বিচিত্র ভাগ্য রে মাশা! জোব্বা ও বুট ছেড়ে সে ছোট প্রিন্সেসের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

*

অধ্যায়-৯

ছোট প্রিন্সেস বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছে। মাথায় একটা ছোট টুপি (ব্যথাটা সবেমাত্র চলে গেছে), ঘামে ভেজা গালের উপর কালো চুল ছড়িয়ে পড়েছে, সুন্দর গোলাপি মুখের উপর ঠোঁটটি খোলা, খুশির হাসি মুখে লেগে রয়েছে। প্রিন্স আন্দ্রু ঘরে ঢুকল, সোফাটার পায়ের কাছে থেমে স্ত্রীর দিকে তাকাল। শিশুর মতো ভয় ও উত্তেজনায় ভরা দুটি চোখ মেলে সেও স্বামীর দিকে তাকাল। সে চোখ যেন বলছে, আমি তো তোমাদের সব্বাইকে ভালোবাসি, কারো কোনো ক্ষতি করিনি, তাহলে আমি এত কষ্ট পাচ্ছি কেন? আমাকে বাঁচাও! প্রিন্স আন্দ্রু সোফাটা ঘুরে গিয়ে তার কপালে চুমো খেল।

সোনা আমার! সে বলল-এ কথাটি সে আগে কখনো বলেনি। ঈশ্বর করুণাময়…

ছোট প্রিন্সেস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, তার চোখে শিশুসুলভ তিরস্কার।

তোমার কাছে আমি সাহায্য পাব আশা করেছিলাম, কিছুই পাইনি! তার চোখ যেন বলতে চাইছে। প্রিন্স আর আগমনে সে অবাক হয়নি, সে যে এসেছে এটাই বুঝতে পারছে না। প্রিন্স আন্দ্রুর আসার সঙ্গে তার যন্ত্রণার বা তার উপশমের কোনো সম্পর্কই নেই। আবার ব্যথা শুরু হল, মারি বগদানভনা প্রিন্স আন্দ্রুকে ঘর থেকে চলে যেতে বলল।

ডাক্তার ঢুকল। প্রিন্স আন্দ্রু বেরিয়ে গেল। প্রিন্সেস মারির সঙ্গে দেখা হওয়ায় দুজনে ফিসফিস করে কথাবার্তা বলতে লাগল, কিন্তু মাঝে মাঝেই কথা থামিয়ে তারা কান পেতে অপেক্ষা করতে থাকল।

প্রিন্সেস মারি বলল, তুমি যাও দাদা।

প্রিন্স আন্দ্রু গিয়ে স্ত্রীর পাশের ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। একটি স্ত্রীলোক ভয়ার্ত মুখে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু দু হাতে মুখটা ঢেকে কয়েক মিনিট সেইভাবেই কাটাল। দরজা দিয়ে ভেসে আসছে করুণ, অসহায়, জান্তব আর্তনাদ। প্রিন্স আন্দ্রু উঠে দরজার কাছে গেল, দরজাটা খুলতে চেষ্টা করল। কে যেন সেটাকে আটকে ধরে আছে।

ভিতর থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠে কে যেন বলল, আপনি ভিতরে আসবেন না! আসবেন না!

সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। আর্তনাদ থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেল। তারপর একটা ভয়ংকর চিৎকার ভেসে এল শোবার ঘর থেকে–এ চিৎকার তো তার হতে পারে না, এরকম চিৎকার করতে সে পারে না। প্রিন্স আন্দ্রু দরজার কাছে ছুটে গেল, আর্তনাদ থেকে গেছে, সে শুনতে পেল শিশুর কান্না।

প্রথম সেকেন্ডে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, একটি শিশুকে ওরা এখানে এনেছে কিসের জন্য? একটি শিশু? কোন শিশু…? ওখানে শিশু কেন? অথবা শিশুটি কি জন্ম নিল?

তখনই সহসা সেই কান্নার আনন্দময় অর্থটি তার হৃদয়ঙ্গম হল, তার স্বর অশ্রুরুদ্ধ হল, জানালার গোবরাটে কনুই রেখে সে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দরজা খুলে গেল। ডাক্তার বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার গায়ে কোট নেই, হাতের আস্তিন গোটানো, মুখ বিবর্ণ, চোয়াল কাঁপছে। প্রিন্স আন্দ্রু তার দিকে মুখ ঘোরাল, কিন্তু ডাক্তার বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে চলে গেল। একটি স্ত্রীলোক ছুটে বেরিয়ে এসে প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখে ইতস্তত করে চৌকাঠের উপরেই দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রিন্স আন্দ্রু স্ত্রীর ঘরে ঢুকল। পাঁচ মিনিট আগে যে অবস্থায় দেখে গিয়েছিল তার মৃত স্ত্রী সেইভাবেই শুয়ে আছে, দৃষ্টি স্থির এবং গাল দুটি নিষ্প্রভ হলেও মনোরম শিশুর মতো মুখখানিতে সেই একই ভাব ফুটে আছে।

তার সুন্দর, করুণ, মরা মুখখানি যেন বলছে, আমি তো তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি, কারো কোনো ক্ষতি করিনি, আর তুমি আমার জন্য কি করেছ?

ঘরের এককোণে মারি বগদানভনার কাঁপা দুটি শাদা হাতের মধ্যে একটা লাল ক্ষুদে কি যেন তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে।

দুই ঘণ্টা পরে আস্তে পা ফেলতে ফেলতে প্রিন্স আন্দ্রু তার বাবার ঘরে গেল। ইতিমধ্যে বুড়ো মানুষটি সবই জানতে পেরেছে। সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল, দরজা খুলতেই তার কর্কশ বার্ধক্যজীর্ণ হাত দুটি সাঁড়াশির মতো ছেলের গলা জড়িয়ে ধরল, কোনো কথা না বলে সে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

.

তিন দিন পরে ছোট প্রিন্সেসকে কবর দেওয়া হল। তাকে বিদায়-চুম্বন দিতে প্রিন্স আন্দ্রু শবাধারের কাছে উঠে গেল। শবাধারের মধ্যে সেই একই মুখ, যদিও চোখ দুটি বোজা। সে চোখ যেন বলছে, আঃ, আমার প্রতি তুমি কি ব্যবহার করেছ? প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল, তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে, এমন একটা পাপ সে করেছে যার কোনো প্রতিকার সে করতে পারবে না, যা সে ভুলতেও পারবে না। কাঁদতেও পারল না। বুড়ো মানুষটিও উঠে এসেছে, বুকের উপর স্থির হয়ে থাকা দুইখানি মোমের মতো ছোট হাতে সেও চুমো খেল, সেই মুখ যেন তাকেও বলল : আঃ, তুমি আমার কি করেছ, কেন করেছ? আর সে দৃশ্য দেখে বুড়ো মানুষটি রেগে সেখান থেকে চলে গেল।

আরো পাঁচদিন কেটে গেল, ছোট্ট প্রিন্স নিকলাস আন্দ্রীভিচ-এর দীক্ষা হল। দাই তার থুতনি দিয়ে ঢাকনাটা চেপে ধরল, আর পুরোহিত একটা হাঁসের পালক দিয়ে বালকের লাল পায়ের পাতায় ও হাতের তালুতে তেল মাখিয়ে দিল।

ঠাকুর্দাই হল তার ধর্মাপ, পাছে শিশুকে ফেলে দেয় এই ভয়ে কাঁপা হাতে শিশুকে ঘুরিয়ে এনে ধৰ্মমা প্রিন্সেস মারির হাতে তুলে দিল। প্রিন্স আন্দ্রু আর একটা ঘরে অনুষ্ঠানের সমাপ্তির অপেক্ষায় বসে রইল। নার্স তাকে নিয়ে এলে সে খুশি হয়ে তার দিকে তাকাল, আর নার্স যখন বলল যে শিশুর চুলের মোম জলে ডুবে না গিয়ে ভেসেই ছিল। (জলে ডুবে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ) তখন সে ধীরে ধীরে মাথাটা নাড়তে লাগল।

*

অধ্যায়-১০

বুড়ো কাউন্টের চেষ্টায় বেজুখভের সঙ্গে দলখভের দ্বৈত যুদ্ধে রশুভের অংশগ্রহণের ব্যাপারটা চেপে দেওয়া হল, এবং তার পদাবনতি ঘটবে বলে যে আশংকা করা হয়েছিল তার পরিবর্তে সে মস্কোর গভর্নর-জেনারেলের অ্যাডজুটান্টের পদে নিযুক্ত হল। ফলে পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে সে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারল না, নতুন কর্তব্যের খাতিরে সারা গ্রীষ্মকালটা তাকে মস্কোতেই কাটাতে হল। দলখভ সুস্থ হয়ে উঠল, আর ভালো হয়ে ওঠার সময়টাকে রস্তভের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। অসুস্থ অবস্থায় দলখভ তার মায়ের কাছেই ছিল, আদরের ফেদিয়ার বন্ধু হিসেবে রস্তভও মারি আইভানভনার খুব প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল। প্রায়ই তার সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে অনেক কথা হয়।

মা বলে, সত্যি কাউন্ট, আজকের চরিত্রভ্রষ্টতার যুগে ছেলে আমার বড় ভালো, পবিত্র হৃদয়, এখন কেউ গুণের আদর করে না, সকলের কাছেই সেটা যেন দোষের ব্যাপার। তুমিই বল কাউন্ট, বেজুখভের পক্ষে কাজটা কি ঠিক হয়েছে, সম্মানজনক হয়েছে? আর ফেদিয়া তো এখনো তাকে ভালোবাসে, তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলে না। পিটার্সবুর্গে একজন পুলিশকে নিয়ে ওরা যখন মজা করেছিল, তখনো কি দুই জনে মিলেই সে কাজ করেনি? আর দেখ! বেজুখভ বেকসুর খালাস পেয়ে গেল, আর যত দোষ চাপল ফেদিয়ার ঘাড়ে। একবার ভাব তো, তাকে কত হুজুতি পোয়াতে হয়েছিল! একথা সত্যি যে সে তার স্বপদেই বহাল হয়েছিল, কিন্তু তা না করে কি তাদের উপায় ছিল? তার মতো এমন সাহসী দেশভক্ত ছেলে তো বেশি মেলে না। আর এখন–এই দ্বৈত যুদ্ধ! এ মানুষগুলোর কি মনের বালাই নেই? সম্মান বলে কিছু নেই। একমাত্র ছেলে জেনেও তাকে দ্বৈত যুদ্ধে আহ্বান করা হল, সোজা গুলি করা হল। তবু রক্ষা যে ঈশ্বর আমাদের করুণা করেছেন। আর এসব কিসের জন্য? একটু-আধটু গোপন প্রেম আজকাল কে না করে? আরে, তার মনে যদি এতই ঈর্ষা তো সেটা আগে দেখালেই হত, তা নয়, মাসের পর মাস সেটা চলতে দিয়ে তারপর একেবারে যুদ্ধের ডাক। ফেদিয়া তার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিল, কাজেই সে যে যুদ্ধ করবে না এটা তো জানাই ছিল। কী নিচতা! প্রিয় কাউন্ট, আমি জানি তুমি ফেদিয়াকে ঠিক বুঝতে পার। কিন্তু লোকে তাকে বোঝে না। সে এত মহৎ, তার অন্তর এত স্বর্গীয়!

দলখভও মাঝে মাঝে রস্তভের কাছে এমন সব কথা বলে যা কেউ তার কাছ থেকে আশা করে না।

সে বলে, আমি জানি লোকে আমাকে খারাপ বলে! বলুক! যাদের আমি ভালোবাসি তারা ছাড়া আর যে যাই বলুক তাতে আমার কিছুই যায়-আসে না। আমি যাদের ভালোবাসি তাদের জন্য প্রাণ দিতে পারি, বাকিরা আমার পথের বাধা হলে তাদের আমি পায়ে দলি। আমার মা আছে, তাকে আমি পূজা করি, সে আমার অমূল্য রত্ন, আর আছে দু-তিনটি বন্ধু-তাদের মধ্যে তুমি একজন, বাকিদের নিয়ে আমি কথা ঘামাই কারণ আমার পক্ষে হয় তারা ক্ষতিকর, আর না হয় উপকারী। আর বেশির ভাগই ক্ষতিকারক, বিশেষত স্ত্রীলোকরা। সত্যি হে বাপু, স্নেহশীল, মহৎ, উচ্চ অন্তঃকরণের পুরুষ আমি দেখেছি, কিন্তু এমন একটি মেয়েমানুষও দেখিনি-কাউন্টেস থেকে রাধুনি পর্যন্ত–যে দুশ্চরিত্রা নয়। মেয়েদের মধ্যে যে স্বর্গীয় পবিত্রতা ও আন্তরিকতা আমি খুঁজে বেড়াই আজ পর্যন্ত তার দেখা পাইনি। যদি পেতাম তার জন্য জীবন দিতেও রাজি হতাম। কিন্তু ওরা!… সে একটা ঘৃণাসূচক অঙ্গভঙ্গি করল। কিন্তু বিশ্বাস কর, আজও যে আমার কাছে জীবনের মূল্য আছে তার কারণ আমি এখনো আশা রাখি যে এমন কোনো স্বর্গীয় প্রাণীর সঙ্গে আমার দেখা হবেই যে আমাকে নতুন করে গড়ে তুলবে, পবিত্র করবে, উন্নত করবে। কিন্তু আমার কথা তুমি বুঝতে পারবে না।

ওঃ, হ্যাঁ, তোমাকে খুব বুঝতে পারি, রস্তভ বলল, নতুন বন্ধুটির প্রভাব পড়েছে তার মনে।

.

হেমন্তকালে রস্তভ-পরিবার মস্কোতে ফিরে এল। শীতের গোড়ায় দেনিসভও ফিরে এল তাদের কাছে। ১৮০৬ সালের শীতের অর্ধেকটা সময় রস্তভ মস্কোতে কাটাল। তার কাছে এবং গোটা পরিবারের কাছে এ সময়টা অত্যন্ত সুখের, অত্যন্ত আনন্দের দিন। নিকলাসের সঙ্গে অনেক যুবক তাদের বাড়িতে আসত। ভেরা যখন বিশ বছরের সুন্দরী, সোনিয়া ষোল বছরের ফুটন্ত ফুলটি, নাতাশা অর্ধেক তরুণী, অর্ধেক বালিকা।

যেসব যুবকদের রস্তভ এ বাড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল তাদের প্রথম সারির একজন হল দলখভ, নাতাশা ছাড়া বাড়ির আর সকলেরই তাকে ভালো লাগল। দলখভকে নিয়ে সে তো দাদার সঙ্গে প্রায় ঝগড়া করে আর কি। নাতাশা বার বার বলতে লাগল, সে খারাপ লোক, বেজুখভের সঙ্গে দ্বৈত যুদ্ধের ব্যাপারে পিয়ের নির্দোষ, দোষ দলখভের, তাছাড়া সে কেমন যেন বিরক্তিকর ও অস্বাভাবিক।

দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সে চেঁচিয়ে বলে, আমার, বোঝবার কিছু নেই, লোকটি দুষ্ট, হৃদয়হীন। বরং তোমার দেনিসভকে আমি পছন্দ করি, লম্পটই হোক আর যাই হোক, তবু তাকে আমি পছন্দ করি, তাহলেই দেখতে পাচ্ছ আমি সব বুঝি। কথাটা কীভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না…এই লোকটি সবকিছুতেই হিসেব মাফিক চলে, আর সেটাই আমি পছন্দ করি না। কিন্তু দেনিসভ…

নিকলাস বলে উঠল, ওঃ, দেনিসভ অন্য ধরনের মানুষ, দলখভের মধ্যে যে একটা মন আছে সেটা তোমাকে বুঝতে হবে, তোমার উচিত তার মায়ের সঙ্গে তাকে দেখা। কী হৃদয়!

দেখ, ওসব আমি জানি না, কিন্তু তার সঙ্গ আমার কাছে অস্বস্তিকর। আর তুমি কি জান সে সোনিয়ার প্রেমে পড়েছে?

কী বাজে কথা…

আমি ঠিকই বলছি, দেখে নিও।

নাতাশার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হল। দলখভ সাধারণত মেয়েদের এড়িয়েই চলে, কিন্তু এ-বাড়িতে সে প্রায়ই আসতে লাগল, আর কেউ মুখে না বললেও সে যে কার জন্য আসে সেটাও অচিরেই বোঝা গেল। সোনিয়ার জন্যই সে আসে। মুখে না বললেও সোনিয়াও সেটা জানে, আর দলখভকে দেখলেই তার মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে।

বোঝা গেল এই বিচিত্র চরিত্রের শক্তিমান লোকটি এই মনোরমা মেয়েটির দুর্নিবার আকর্ষণে বাঁধা পড়েছে, তারা পরস্পরকে ভালোবাসে।

১৮০৬-এর হেমন্তকালে নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের কথা আবার নতুন করে সকলের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। নতুন করে সৈন্য সংগ্রহের হুকুম জারি হয়ে গেছে, নিয়মিত সেনাদলে প্রতি হাজারে দশজন, আর স্বদেশ রক্ষী সেনাদলে (militia) প্রতি হাজারে নয়জন। সর্বত্র বোনাপার্তকে শাপশাপান্ত করা হতে লাগল, আর সারা মস্কো জুড়ে আসন্ন যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো কথা রইল না। এই যুদ্ধায়োজনে রস্ত পরিবারের একমাত্র চিন্তা নিকলাসকে নিয়ে, সে তো কারো কথায়ই মস্কোতে থাকবে না, বড়দিনের পরে দেনিসভের ছুটি ফুরিয়ে গেলেই তাকে নিয়ে রেজিমেন্টে ফিরে যাবে। কিন্তু আসন্ন বিদায়ের জন্য তার হাসিখুশিতে কোনোরকম বাধা হল না, বরং সে আরো প্রাণ খুলে আসর জমাতে লাগল। ডিনারে, পার্টিতে ও বল-নাচেই সে বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে কাটাতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *