০২.২ রাজ-দরবারে

অধ্যায়-১১

পরদিন অনেক দেরিতে তার ঘুম ভাঙল।

প্রথমেই মনে পড়ল, আজ তাকে সম্রাট ফ্রান্সিসের কাছে হাজির হতে হবে; মনে পড়ল যুদ্ধমন্ত্রী, ভদ্র অস্ট্রিয় অ্যাডজুটান্ট বিলিবিন ও গত রাতের আলোচনার কথা। রাজ-দরবারে হাজির হবার জন্য কুচকাওয়াজের উপযুক্ত পুরো ইউনিফর্ম পরল; অনেকদিন এ পোশাক সে পরে নি। সেজেগুজে ব্যান্ডেজ-বাধা হাত নিয়ে বিলিবিনের পড়ার ঘরে ঢুকল। কূটনীতি বিভাগের চারটি ভদ্রলোক সেখানে হাজির। তার মধ্যে দূতাবাসের সচিক প্রিন্স হিপোলিং কুরাগিনের সঙ্গে বলকনস্কির আগে থেকেই পরিচয় ছিল। বিলিবিন অন্যদের সঙ্গে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

বিলিবিনের ঘরে সমবেত সকলেই যুবক, ধনী, হাসিখুশি, উঁচুসমাজের লোক; ভিয়েনার মতো এখানেও তারা একটা বিশেষ গোষ্ঠী তৈরি করেছে। আর তাদের নেতা বিলিবিন গোষ্ঠীটার নাম দিয়েছে Les notres. এই গোষ্ঠীর প্রায় সকলেই কূটনীতিক; যুদ্ধ: বা রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই; তাদের সম্পর্ক উঁচু সমাজ, বিশেষ বিশেষ মহিলা ও পদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে। এই দ্ৰজনরা প্রিন্স আন্দুকে নিজেদের একজন হিসেবেই গ্রহণ করল; এ সম্মান তারা বেশি লোককে দেয় না। ভদ্রতাবশত এবং আলোচনার সূত্র হিসেবে তারা সৈন্য ও যুদ্ধ সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন তাকে করল; তারপরেই শুরু হল রসিকতা, হাসিঠাট্টা ও গল্পগুজব।

সহযোগী কূটনীতিকের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে গিয়ে একজন বলল, কিন্তু সবচাইতে বড় কথা হল, চ্যান্সেলার তাকে সরাসরি বলে দিল যে লন্ডনে তাকে পাঠানো হচ্ছে প্রমোশন দিয়ে, আর তাকেও এটা সেইভাবেই নিতে হবে। তখন যে তার মুখের অবস্থাটা কেমন হল সে কথা ভাবতে পার…?

কিন্তু মশাইরা, এ ব্যাপারে সবচাইতে শোচনীয় কথা হল-কুরাগিনকে লক্ষ্য করেই বলছি–সেই লোকটা কষ্ট ভোগ করল, আর এই দুষ্টু ডন জুয়ান ভোগ করছে তার সুবিধাটুকু!

প্রিন্স হিপোলিং লাউঞ্জ-চেয়ারের হাতলে পা তুলে দিয়ে আরামে শুয়েছিল। সে হেসে উঠল।

বলল, সে ব্যাপারটা শুনিয়ে দাও।

আরে, তুমি ডন জুয়ান! তুমি বিছু! কয়েকজন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।

প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বিলিবিন বলল, তুমি তো জান না বলকনস্কি, এই লোকটি মেয়েদের মহলে যা করে বেড়াচ্ছে তার তুলনায় ফরাসি বাহিনীর (প্রায় রুশ বাহিনী বলে ফেলেছিলাম আর কি) নৃশংসতা তো কিছুই না।

নারী তো পুরুষের সঙ্গিনী, ফরাসিতে কথাটা বলে হিপোলিং তার পায়ের দিকে তাকাতে লাগল।

বিলিবিন ও দলের অন্য সকলে হিপোলিৎতের মুখের উপর হো-হো করে হেসে উঠল; স্ত্রীর ব্যাপারে প্রিন্স আন্দ্রু হিপোলিৎকে কিছুটা ঈর্ষাই করত; সে বুঝতে পারল, এখানে সকলেই এই লোকটার পিছনে লাগছে।

বিলিবিন ফিসফিস করে বলকনস্কিকে বলল। দেখ না, কিরকম মজা করি! কুরাগিন যখন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে তখন সে অপূর্বতার গাম্ভীর্য দেখবার মতো।

সে হিপোলিৎতের পাশে গিয়ে বসল। কপালে ভাঁজ ফেলে তার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করল। প্রিন্স আন্দ্রু ও অন্যরা দুইজনকে ঘিরে বসল।

একটা কেউ-কেটা ভঙ্গিতে চারদিকে তাকিয়ে হিপোলিৎ শুরু করল, বার্লিন মন্ত্রিসভা মৈত্রীর কথা বলতেই পারে না…যদি না…যেমন সর্বশেষ মন্তব্যে বলা হয়েছে…বুঝতে পারলে…তাছাড়া, মহামান্য সম্রাট যদি আমাদের মৈত্রীর মূলনীতি থেকে সরে না যান…।

দাঁড়ান, আমি এখনো শেষ করি নি… প্রিন্স আর হাতটা চেপে ধরে সে তাকে বলল, আমি বিশ্বাস করি, হস্তক্ষেপই অ-হস্তক্ষেপ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। আর… একটু থেমে, শেষ কথা হল, আমাদের ১৮ নভেম্বরের চিঠি না পাওয়ার অভিযোগ তো করা চলবে না। এইভাবেই ব্যাপারটা শেষ হবে। এবার সে বলকনস্কির হাতটা ছেড়ে দিল। বোঝা গেল, এবার তার বক্তব্য সম্পূর্ণ হয়েছে।

বিলিবিন বলল, ডেমস্থিনিস, তোমার সোনার মুখে যে নুড়ি ঝরছে তা থেকেই তোমাকে আমি চিনি! তার মাথার চুল খুশিতে নড়তে লাগল।

সকলেই হেসে উঠল; হিপোলিৎতের হাসি সকলের চাইতে জোরদার। সে যে কষ্ট পেয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে, কারণ তার শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে, তবু সে অট্টহাসি না হেসে থাকতে পারল না।

বিলিবিন বলল, দেখ মশাইরা, এই ঘরে, এমন কি ব্রুনেও বলকনস্কি আমার অতিথি। এখানকার জীবনযাত্রায় যতরকম সুখের আয়োজন আছে সে সবকিছু দিয়ে যথাসাধ্য আমি তার আনন্দ বিধান করতে চাই। আমরা যদি ভিয়েনায় থাকতাম, ব্যাপারটা সহজ হত, কিন্তু এখানে, মোরাভিয়ার এই হতভাগা গর্তের মধ্যে সেটা খুবই শক্ত। তাই আপনার সকলের কাছেই আমি সাহায্য চাইছি। ব্রুনের যা কিছু আকর্ষণীয় সব তাকে দেখাতে হবে। তুমি থিয়েটার দেখাবে, আমি এখানকার সমাজটা দেখাব, আর তুমি হিপোলিৎ, তুমি অবশ্য দেখাবে মেয়েমহলটা।

আঙুলের ডগায় চুমো খেয়ে দলের একজন বলল, এমিলিকে অবশ্যই দেখাতে হবে–সে যে পরমা সুন্দরী!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, মশাইরা, আপনাদের এই আতিথেয়তার সুযোগ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, আমার যাবার সময় হয়ে গেছে।

কোথায় যাবেন?

সম্রাটের কাছে।

ওঃ! ওঃ! ওঃ!

আচ্ছা, au revoir, বলকনস্কি! au revoir, প্রিন্স! সকাল সকাল ডিনারে চলে আসবেন, কয়েকজন বলল। আপনাকেও দলে ভিড়িয়ে নেব।

বলকনস্কিকে হল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বিলিবিন বলল, ম্রাটের সঙ্গে কথা বলার সময় খাদ্য-সরবরাহ ব্যবস্থা ও পথ-নির্দেশ ব্যবস্থার যতটা সম্ভব প্রশংসা করতে চেষ্টা কর।

সেসবের প্রশংসা করাই উচিত কিন্তু আসল ঘটনা যা তাতে প্রশংসা করা যায় না, বলকনস্কি হেসে জবাব দিল।

যাই হোক, যত বেশি পর কথা বল। তিনি কথা বলতে ভালোবাসেন, কিন্তু নিজে কথা বলা পছন্দ করেন, আর কথা বলতেও পারেন না; সে তুমি নিজেই দেখতে পাবে।

*

অধ্যায়-১২

রাজদরবারে প্রিন্স আন্দ্রু অস্ট্রিয় অফিসারদের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল; সেই রকম নির্দেশই তাকে দেওয়া হয়েছিল। সম্রাট ফ্রান্সিস স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে লম্বা মাথাটা ঈষৎ দোলাল। দরবার শেষ হয়ে গেলে আগের দিনের সেই অ্যাডজুটান্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে বলকনস্কিকে জানাল যে সম্রাট তার কথা শুনবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সম্রাট তাকে অভ্যর্থনা জানাল। আলোচনা শুরু হবার আগেই প্রিন্স আন্দ্রু অবাক হয়ে দেখল, যেন কি বলতে হবে বুঝতে না পেরেই সম্রাট বিব্রত হয়ে পড়ল, তার মুখ লাল হয়ে উঠল।

সে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করল, বলুন তো, যুদ্ধ কখন শুরু হয়েছিল?

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল। তারপর আবার তেমনি সরল আর একটি প্রশ্ন : কুতুজভ ভালো ছিলেন তো? কখন তিনি ক্রেমস ছেড়ে গেলেন? ইত্যাদি। সম্রাট এমনভাবে কথা বলতে লাগল যেন কতকগুলি প্রশ্ন করাই তার আসল উদ্দেশ্য, সে সব প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহই নেই।

ঠিক কয়টার সময় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল? সম্রাট শুধাল।

ঠিক কয়টার সময় রণক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাতে ইয়োর ম্যাজেস্টিকে আমি জানাতে পারব না, তবে আমি যে ডুরেনস্টিনে ছিলাম সেখানে আমরা আক্রমণ শুরু করেছিলাম বিকেল পাঁচটার পরে, জবাব দিতে গিয়ে বলকনস্কি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল; তার আশা হল, সে যা কিছু জেনেছে, যা কিছু দেখেছে সে সবের যে বিবরণ তার মনের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে, এবার তাকে প্রকাশ করবার একটা সুযোগ সে পাবে। কিন্তু সম্রাট মৃদু হেসে তাকে বাধা দিল।

কত মাইল?

কোন জায়গা থেকে কোন জায়গা ইয়োর ম্যাজেস্টি?

ডুরেনস্টিন থেকে ক্রেমস পর্যন্ত।

সাড়ে তিন মাইল ইয়োর ম্যাজেস্টি।

ফরাসিরা কি বাম তীর ছেড়ে চলে গেছে।

স্কাউটদের সংবাদ অনুসারে তার শেষ সৈনিকটিও রাতারাতি ভেলায় চড়ে পার হয়ে গেছে।

অশ্বাদির জন্য যথেষ্ট খাবার ক্রেমসে আছে তো?

যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটা খাদ্য সরবরাহ…

সম্রাট তাকে বাধা দিল।

ঠিক কয়টার সময় সেনাপতি শমিড নিহত হয়?

আমার বিশ্বাস, সাতটার সময়।

সাতটার সময়? বড়ই দুঃখের কথা, বড়ই দুঃখের কথা।

প্রিন্স আন্দ্রুকে ধন্যবাদ জানিয়ে সম্রাট মাথা নোয়াল। সেকান থেকে সরে যেতেই সভাসদরা চারদিক থেকে প্রিন্স আল্লুকে ঘিরে ধরল। সর্বত্রই বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ কথা। গতকালের অ্যাডজুটান্টটি প্রাসাদে না থাকার জন্য তাকে তিরস্কার করল; নিজের বাড়িতে থাকবার প্রস্তাব করল। যুদ্ধমন্ত্রী এগিয়ে এসে তৃতীয় শ্রেণীর মারিয়া থেরেসা অর্ডার লাভের জন্য তাকে অভিনন্দন জানাল। সম্রাট তাকে ঐ সম্মানে ভূষিত করেছে। সম্রাজ্ঞীর পরিচারক এসে তাকে আমন্ত্রণ জানাল হার ম্যাজেস্টির সঙ্গে দেখা করতে। আর্চডাচেসও তার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক। কার কথার জবাব দেবে বুঝতে না পেরে সে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিল। তখন রুশ রাষ্ট্রদূত কাঁদে হাত রেখে তাকে জানালার কাছে নিজে গিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

বিলিবিন যাই বলুক না কেন, যে সংবাদ নিয়ে সে এসেছে সকলেই সেটাকে সানন্দে গ্রহণ করল। একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল, কুতুজভকে মারিয়া থেরেসা গ্র্যান্ড ক্রশ দেওয়া হল : এবং গোটা বাহিনীকে পুরস্কৃত করা হল। সব জায়গা থেকে বলকনস্কিকে আমন্ত্রণ করা হল; অস্ট্রিয়ার গন্যমান্য লোকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতেই তার সারা সকালটা কেটে গেল। দেখাসাক্ষাতের পালা শেষ করে বিকেল চারটে-পাঁচটা নাগাদ সে বিলিবিনের বাসায় ফিরে যাচ্ছিল। যুদ্ধ ও ব্রুন দর্শনের একটি বিবরণ বাবাকে পাঠাবার জন্য সে মনে মনে একটা চিঠির খসরা তৈরি করছিল। দরজায় পৌঁছে দেখল, মালপত্রে অর্ধেক বোঝাই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বিলিবিনের চাকর ফ্রাঞ্জ সামনের দরজা দিয়ে একটা পোের্টম্যান্টোকে অনেক কষ্টে টেনে বের করছে।

বিলিবিনের বাসায় পৌঁছবার আগে অভিযানের জন্য কয়েকটা বই সংগ্রহ করতে প্রিন্স আন্দ্রু একটা বইয়ের দোকানে গিয়েছিল, এবং সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়েছিল।

এ সব কী? সে জিজ্ঞেস করল।

অনেক কষ্টে পোর্টম্যাটোটাকে গাড়িতে তুলতে তুলতে ফ্রাঞ্জ বলল, ওঃ ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমাদের আরো দূরে সরে যেতে হবে। স্কাউলেটা আবার আমাদের পিছু নিয়েছে।

অ্যাঁ? কী বললে?

বিলিবিন বেরিয়ে এল। তার স্বভাব-শান্ত মুখে উত্তেজনার আভাস।

এই যে এসেছ! এবার স্বীকার কর যে এটা খুব মজার, সে বলল। ভিয়েনার টাবর সেতুর ব্যাপার হে…বিনা আঘাতেই তারা পার হয়েছে।

প্রিন্স আন্দ্রু বুঝতে পারল না।

তুমি কোত্থেকে এলে হে? শহরের প্রতিটি কোচয়ান যা জানে সে কথাটা তুমি জান না?

আমি আসছি আচড়াচেসের কাছ থেকে। সেখানে তো কিছু শুনলাম না।

সকলেই যে বাঁধাছাদা করছে তাও কি চোখে পড়েনি?

না, পড়ে নি।…ব্যাপার কি? অধৈর্য হয়ে প্রিন্স আন্দ্রু জানতে চাইল। ব্যাপার কি? আর কি, অয়েসপার্গ যে সেতুটা রক্ষা করছিল ফরাসিরা সেটা পার হয়েছে, আর সেতুটা উড়িয়েও দেওয়া হয় নি; কাজেই মুরাৎ এখন ব্রুনের পথ ধরে ছুটে আসছে, আর দুই এক দিনের মধ্যেই এখানে হাজির হবে।

কি? এখানে? কিন্তু মাইন যখন পাতা ছিল তখন তারা সেতুটা উড়িয়ে দিল না কেন?

সেই প্রশ্নটা তো আমিও তোমাকে করছি। এ কেন-র উত্তর কেউ জানে না, এমন কি বোনাপার্তও না।

বলকনস্কি ঘাড় ঝাঁকুনি দিল।

বলল, কিন্তু সেতুটা পার হওয়া মানে তো সেনাবাহিনীও ধ্বংস হয়েছে। তারা তো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

ঠিক তাই হয়েছে, বিলিবিন জবাব দিল। শোন! তোমাকে তো বলেছি, ফরাসিরা ভিয়েনায় ঢুকেছে। ভালো কথা। পরদিন, অর্থাৎ গতকাল, ঐ ভদ্রলোকরা, মুরাৎ, লাগেস ও বেলিয়ার্দ ঘোড়ায় চেপে সেতুর কাছে এল। (লক্ষ্য কর যে এরা তিনজনই গ্যান) একজন বলল, মশাইরা, আপনারা কি জানেন যে টাবর সেতুতে মাইন পাতা আছে, ভবল মাইন; সেতুমুখটা সাংঘাতিক রকম শক্ত করে তৈরি, আর পনেরো হাজার সৈন্যর একটি বাহিনীকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে তারা সেতুটা উড়িয়ে দেবে, তবু আমাদের সেতু পার হতে দেবে না? কিন্তু আমরা যদি সেতুটা দখল করতে পারি তো আমাদের সম্রাট নেপোলিয়ন খুশি হবেন; সুতরাং চলুন, আমরা তিনজন এগিয়ে গিয়ে সেতুটা দখল করি। অন্যরা বলল, হ্যাঁ, তাই চলুন। আর অমনি তারা এগিয়ে এসে সেতুটা দখল করল, পার হয়ে এল, এবং এখন গোটা বাহিনীটা নিয়ে দানিয়ুবের এপারে এসে পৌঁছেছে,–ছুটে আসছে আমাকে, তোমাকে, এবং তোমার সরবরাহ-ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে।

ঠাট্টা রাখ, প্রিন্স আন্দ্রু গম্ভীরভাবে বলল। সংবাদটা তাকে দুঃখ দিয়েছে। আবার সে খুশিও হয়েছে।

যেই সে জানল রুশ বাহিনী এখন একটা অসহায় অবস্থায় পড়েছে, তখনই তার মনে হল যে, সে বাহিনীকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের দায়িত্ব ভাগ্যই তার হাতে তুলে দিয়েছে; এই সেই তুলো (তুলোর যুদ্ধেই নেপোলিয়ন প্রথম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল) যা তাকে একজন তুচ্ছ অফিসারের পদ থেকে খ্যাতির প্রথম সোপানে প্রতিষ্ঠিত করবে! বিলিবিনের কথা শুনেই সে কল্পনা করে নিয়েছে, সেনাবাহিনীতে ফিরে গিয়েই সে সমর-পরিষদের কাছে এমন একটা প্রস্তাব পেশ করবে একমাত্র যার দ্বারাই রুশ বাহিনী রক্ষা পেতে পারে, আর তার ফলে সেই পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করবার দায়িত্বও একমাত্র তার হাতেই তুলে দেওয়া হবে।

সে বলল, এসব ঠাট্টা রাখ।

বিলিবিন বলতে লাগল, আমি ঠাট্টা করছি না। এর চাইতে সত্য, এর চাইতে দুঃখের আর কিছু নেই। এই ভদ্রলোকরা একাকি ঘোড়ায় চেপে সেতুর উপর উঠল, শাদা রুমাল নাড়ল : কর্তব্যরত অফিসারকে নিশ্চিত করে বলল যে তারা মার্শাল, প্রিন্স অয়েসমপার্গের সঙ্গে আলোচনা করতে চলেছে। অফিসারও তাদের সেতুর উপরে উঠতে দিল। তারাও হাজার করম আস্ফালনে তাকে জড়িয়ে ফেলল, বলল-যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, সম্রাট ফ্রান্সিস বোনাপার্টের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করছেন আর তাই তারা প্রিন্স অয়ের্সপার্গের সঙ্গে দেখা করতে চায়, ইত্যাদি। অফিসার অযেসপার্গকে খরব পাঠাল; এই ভদ্রলোকরা অফিসারদের সঙ্গে কোলাকুলি করল, হাসি-ঠাট্টা শুরু করল, কামানের উপর বসে পড়ল, আর ওদিকে এক ব্যাটেলিয়ন ফরাসি সৈন্য সকলের অলক্ষ্যে সেতুর কাছে চলে আসে, বিস্ফোরক পদার্থ বোঝাই বস্তাগুলিকে জ্বলে ফেলে দিল, এবং মোক্ষম মুহূর্তে পৌঁছে গেল। অবশেষে এমন লেফটেন্যান্ট-জেনারেল, আমাদের প্রিয় প্রিন্স অয়ের্সপার্গ ভন মাতান স্বয়ং। প্রিয়তম শত্রু! অস্ট্রিয় বাহিনীর সেরা ফুল! তুর্কি যুদ্ধের নায়ক! যুদ্ধ তো শেষ হয়েছে, এবার আমরা পরস্পর করমর্দন করতে পারি…সম্রাট নেপোলিয়ন প্রিন্স অয়ের্সপার্গের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। এককথায়, এই ভদ্রলোকরা, প্রকৃতই তারা গ্যান, মিষ্টি কথায় তাকে এতই অভিভূত করে ফেলল, আর সেও ফরাসি মার্শালদের সঙ্গে দ্রুত ঘনিষ্ঠতার ফলে এতই ফুলে ফেঁপে উঠল, আর মুরাতের পরিচ্ছদ ও উটের পালকের স্বপ্নে এতই বিভোর হয়ে পড়ল যে তার চোখ ঝলসে গেল, শত্রুপক্ষকে যে গোলাবর্ষণের দ্বারা অভ্যর্থনা জানাতে হয় সেকথাই সে ভুলে গেল। সকলে যাতে তার এই সরস উক্তিকে উপভোগ করতে পারে সেজন্য এ পর্যন্ত বলে বিলিবিন একটু থামতে ভুল করল না। ফরাসি ব্যাটেলিয়ান বন্দুক উঁচিয়ে সেতুর মুখে ছুটে এল, সেতু দখল করে নিল! কিন্তু সবচাইতে মজার ব্যাপার হল, কামানের ভারপ্রাপ্ত যে সার্জেন্টটির মাইনে আগুন লাগাবার সংকেত দেবার এবং সেতুটা উড়িয়ে দেবার নির্দেশ দেবার কথা, সে ফরাসি সৈন্যদের সেতুর দিকে ছুটে যেতে দেখে কামান দাগতে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু লানেস তার হাতটা থামিয়ে দিল। সার্জেন্টটি তার সেনাপতির চাইতে বেশি বুদ্ধিমান; সে অয়ের্সপার্গের কাছে গিয়ে বলল : প্রিন্স, আপনি প্রতারিত হচ্ছেন, এরা যে ফরাসি! মুরাৎ দেখল, সার্জেন্টটি যদি সব কথা বলে দেয় তাহলে তো সর্বনাশ; তাই নকল বিস্ময়ে (সে যে সত্যিকারের গ্যাঙ্কন) অয়েসপার্গের দিকে ফিরে বলল : আপনি যদি একজন অধীনস্থ কর্মচারীকে এভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলতে দেন তাহলে অস্ট্রিয়ার বিশ্ববিখ্যাত শৃঙ্খলাবোধ কোথায় থাকে তা তো আমি বুঝতে পারছি না! প্রতিভার এক মোক্ষম আঘাত। প্রিন্স অয়েসপার্গের মনে হল যে তার মর্যাদা তো বিপন্ন; তাই সে সার্জেন্টকে বন্দি করার হুকুম দিল। বুঝলে হে, তোমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে টাবর সেতুর এই ব্যাপারটা বড়ই মজাদার! এটা ঠিক বোকামি নয়, পেজোমিও নয়…।

প্রিন্স আর চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভাসতে লাগল ধূসর ওভারকোট, আঘাত, বারুদের ধোয়া, কামানের গর্জন, তার তার আসন্ন গৌরবের দৃশ্য।

সে বলল, এটা বিশ্বাসঘাতকতাও হতে পারে।

বিলিবিন জবাব দিল, তাও নয়। তাতে যে রাজপরিবারের গায়ে বড় বেশি খারাপ আলো পড়ে। এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়, পেজোমি নয়, বোকামিও নয়; এটা ঠিক উলমে যা ঘটেছিল…এটা…-সে একটা সঠিক ভাষা খুঁজতে চেষ্টা করল। এটা…এটা…খানিকটা ম্যাকের মতো।…আমরা ম্যাকায়িত হয়েছি। একটা অলংকারসম্মত ভালো শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে ভেবে সে কথা শেষ করল। খুশিতে তার কপালের ভাঁজগুলি মিলিয়ে গেল; ঈষৎ হেসে সে নিজের নখগুলি পরীক্ষা করতে শুরু করে দিল।

হঠাৎ প্রিন্স আন্দ্রু উঠে তার ঘরের দিকে পা বাড়াল। তা দেখে সে বলল, তুমি কোথায় চললে? আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায়?

সেনাবাহিনীতে।

কিন্তু তোমার তো আরো দুটো দিন থাকার কথা ছিল?

কিন্তু আমি এখনই চলে যাচ্ছি।

ফিরে যাবার নির্দেশাদি দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু তার ঘরে চলে গেল।

তাকে অনুসরণ করে বিলিবিন বলল, তুমি কি জান প্রিয় বন্ধু যে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। কেন তুমি চলে যাচ্ছ?

তার কথার চূড়ান্ত প্রমাণস্বরূপ তার মুখ থেকে সবগুলো ভাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

প্রিন্স আন্দ্রু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল; কোনো জবাব দিল না।

তুমি কেন যাচ্ছ? আমি জানি, যেহেতু তোমার সেনাদল এখন বিপন্ন তাই ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে ফিরে যাওয়াটাকে তুমি তোমার কর্তব্য বলে মনে কর। সেটা আমি বুঝি। প্রিয় বন্ধু, এই তো বীরত্ব!

মোটেই না, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

কিন্তু তুমি একজন দার্শনিক, আগাগোড়া তাই থাক, সমস্যাটার অন্য দিকটাও দেখ; তাহলেই দেখতে পাবে যে তোমার কর্তব্য হচ্ছে নিজের কথা ভাবা। যারা আর কোনো কাজের উপযুক্ত নয়, সব তাদের হাতে ছেড়ে দাও।…তোমার তো ফিরে যাবার হুকুম দেওয়া হয় নি, আর এখান থেকেও ছুটি দেওয়া হয় নি; সুতরাং তুমি এখানেই থাকতে পার, আর দুর্ভাগ্য আমাদের যেখানে নিয়ে যাবে, আমাদের সঙ্গে সেখানেই যেতে পার। ওরা বলছে, আমরা অলমুজে যাচ্ছি; অলমুজ খুব সুন্দর শহর। তুমি আর আমি আমার গাড়িতে আরাম করে । যাব।

দয়া করে ঠাট্টা থামাও বিলিবিন, কলকনস্কি চিৎকার করে উঠল।

বন্ধুর মতো আন্তরিকভাবেই আমি কথা বলছি। ভেবে দেখ! তুমি যখন এখানেই থাকতে পার, তুমি কেন চলে যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ? দুটোর যে কোনো একটা পথ তোমার সামনে খোলা আছে, তার বাদিকের কপালে আবার ভাজ পড়ল, হয় সন্ধি হবার আগে তুমি তোমার রেজিমেন্ট পৌঁছতে পারবে না, অথবা কুতুজভের গোটা বাহিনীর সঙ্গে পরাজয় ও অসম্মান বরণ করবে।

এ উভয়-সংকটের কোনো সমাধান নেই বুঝতে পেরে বিলিবিনের কপালের ভাজগুলো আবার মুছে গেল।

প্রিন্স আন্দু ঠাণ্ডা গলায় বলল, এ নিয়ে আমি তর্ক করতে চাই না; কিন্তু মনে মনে বলল, কিন্তু সেনাদলকে বাঁচাতে আমি যাবই।

প্রিয় বন্ধু, তুমি সত্যি বীর! বিলিবিন বলল।

*

অধ্যায়-১৩

সেই রাতেই যুদ্ধমন্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বলকনস্কি সেনাদলের সঙ্গে যোগাড় দিতে যাত্রা করল; অবশ্য সে জানে না কোথায় তাদের সঙ্গে দেখা হবে; আর মনেও ভয় আছে যে ক্রেমসের পথে ফরাসিদের হাতে সে বন্দি হতেও পারে।

ব্রুনে দরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই জিনিসপত্র বাধাদা করতে ব্যস্ত; ইতিমধ্যেই বড় বড় মালগুলি অলমুজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হেজেলডফের কাছে প্রিন্স আন্দ্রু বড় রাস্তায় পড়ল। রুশ বাহিনীও সেই পথেই চলেছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আর অত্যন্ত বিশৃঙ্খলভাবে। রাস্তাটা মালগাড়িতে এতই বোঝাই হয়ে গেছে যে গাড়ি চেপে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। জনৈক কসাক কমান্ডারের কাছ থেকে একজন কসাক ও একটা ঘোড়া নিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু মালগাড়িগুলিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল। ক্ষুধার্ত ও শ্রান্ত অবস্থায় সে খুঁজতে চলল প্রধান সেনাপতি ও তার নিজের মালপত্র। যেতে যেতেই সেনাবাহিনী সম্পর্কে খুব খারাপ খবর তার কানে আসতে লাগল; আর বিশৃঙ্খলভাবে পলায়নমান সৈন্যদল সেসব গুজবকে সমর্থনই করল।

ইংরেজদের সোনার বিনিময়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকে যে রুশ বাহিনীকে আনা হয়েছে, আমাদেরও সেই দশাই হবে(উলমের বাহিনীর দশা।)। যুদ্ধের একেবারে শুরুতে বোনাপার্ত তার সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে যে ভাষণ দিয়েছিল তার এই কথাগুলি প্রিন্স আর মনে পড়ল। ফলে তার মনে দেখা দিল তার নায়কের প্রতিভার প্রতি বিস্ময়, একটা আহত গর্ববোধ এবং গৌরবের আশা। সে ভাবল, তাহলে কি মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই? বেশ তো, দরকার হলে অন্য কারো চাইতে হীন কাজ আমি করব না।

লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া, কামান-বন্দুক, মালগাড়ি ও সব রকম যানবাহনের এক বিশৃঙ্খল সীমাহীন শোভাযাত্রার দিকে সে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল; একজন আর একজনকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টায় কাদামাখা পথটাকেই বন্ধ করে দিচ্ছে; কখনো বা তিনজন ও চারজনও একসঙ্গে পাশাপাশি যাবার চেষ্টা করছে। সামনে, পিছনে, চারদিকেই যতদূর চোখ যায় শুধু চাকার ঘর্ঘর, মালগাড়ি ও কামান-টানা গাড়ির কাঁচর-ক্যাচর, গোড়ার ক্ষুরের শব্দ, চাবুকের হিস-হিস, আর সৈনিক আর্দালি ও অফিসারদের বকবকানি। পথের দুধারে আগাগোড়া কত মরা ঘোড়া পড়ে আছে; কতক ছাল-ছাড়ানো, কতক আস্ত; ভাঙা গাড়ির পাশে কিসের অপেক্ষায় একটি মাত্র সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে; কোথাও বা কিছু সৈন্য দল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আশপাশের গ্রামে ঢুকে পড়ছে, অথবা ভেড়া, মুরগি, খড় ও পেটমোটা বস্তা ঘাড়ে করে গ্রাম থেকে ফিরছে। রাস্তার প্রতিটি চড়াই বা উত্রাইয়ের মুখে আরো বেশি ঘন হয়ে ভিড় জমছে, আর অবিরাম হৈ-চৈ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। সৈনিকরা হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে নিজেরাই কামান ও গাড়ি ঠেলছে। চাবুকের সপাসপ শব্দ হচ্ছে, ক্ষুর পিছলে যাচ্ছে, ঘোড়ার দড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে, অবিরাম চিৎকারে বুকে হাঁপ ধরছে। অফিসাররা এগিয়ে যাবার পথ করে দিতে গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে ঘোড়া নিয়ে ছুটাছুটি করছে। চারদিকের হৈ-হট্টগোলের মধ্যে তাদের গলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই বিশৃঙ্খলা শুধরে দেবার আশাই তারা ছেড়ে দিয়েছে।

বিলিবিনের কথাগুলি মনে পড়ায় বলকনস্কি ভাবল, এই তো আমাদের আদরের গোঁড়া রুশ বাহিনী।

প্রধান সেনাপতিকে খুঁজে বের করার আশায় সে একটা কনভয়ের কাছে গিয়ে হাজির হল। ঠিক তার উল্টো দিক থেকে একটা অদ্ভুত-দর্শন একঘোড়ায় টানা গাড়ি এল। হাতের কাছে মাল-মশলা যা পাওয়া গেছে তাই দিয়েই সৈনিকরা গাড়িটা বানিয়েছে বলে মনে হয়। একটি সৈনিক গাড়িটা চালাচ্ছে, আর গাড়ির কামড়ার · ছইয়ের নিচে শালে গা মুড়ে বসে আছে একটি স্ত্রীলোক। প্রিন্স আন্দ্রু এগিয়ে এসে একটি সৈনিকের কাছে খোঁজ নিতে যাবে এমন সময় সেই গাড়ির ভিতর থেকে স্ত্রীলোকটির তীব্র চিৎকার তার কানে এল। সেই গাড়িটা অন্য সকলকে ছড়িয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করায় যানবাহনের ভারপ্রাপ্ত একজন অফিসার গাড়ির চালককে মারছে; তার চাবুকের ঘা গিয়ে পড়ছে স্ত্রীলোকটির এপ্রনের উপর। স্ত্রীলোকটি মর্মভেদী আর্তনাদ করছে। প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখে স্ত্রীলোকটি এপ্রনের ভিতর থেকে ঝুঁকে মুখ বের করে গরম শালের নিচে থেকে সরু সরু হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বলল :

মি. এড-ডি-কং! এড-ডি-কং!…ঈশ্বরের দোহাই…আমাকে বাঁচান। আমাদের কি হবে? আমি সপ্তম…ডাক্তারের স্ত্রী। এরা আমাদের এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না, আমরা পিছনে পড়ে গেছি, আমাদের লোকজনদের হারিয়ে ফেলেছি…।

ক্রুদ্ধ অফিসার সৈনিকটিকে বলছে, পিটিয়ে তোমাকে তক্তা বানিয়ে দেব! ভাঙা গাড়ি নিয়ে পিছিয়ে যাও!

ডাক্তারের স্ত্রী আর্তকণ্ঠে বলল, মি. এড-ডি-কং! আমাকে সাহায্য করুন!…এসবের অর্থ কি?

প্রিন্স আন্দ্রু অফিসারটির কাছে গিয়ে বলল, দয়া করে এই গাড়িটাকে যেতে দিন। দেখছেন না স্ত্রীলোক রয়েছে?

অফিসার তার দিকে তাকাল; কথার জবাব না দিয়ে আবার সৈনিকটির দিকে মুখ ফেরাল। এগিয়ে আসার শিক্ষা তোমাকে দেব।…পিছিয়ে যাও।

ঠোঁট ঠোঁট চেপে প্রিন্স আন্দ্রু আবার বলল, ওদের যেতে দিন। আমি বলছি!

রেগে লাল হয়ে অফিসার তার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল, আপনি কে? আপনি কি এখানকার কমান্ডার? অ্যাঁ? এখানে আমি কমান্ডার, আপনি নন! পিছিয়ে যাও, নইলে পিটিয়ে তোমাকে তক্তা করে দেব, সে আবারও বলল। এই কথাগুলি তার খুব মনের মতো।

পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, খোকা এড-ডি-কংকে খুব রগড়ে দিয়েছেন।

প্রিন্স আন্দ্রু বুঝতে পারল, অফিসারটি রাগে এতই বেঁহুশ হয়ে পড়েছে যে কি বলছে তার অর্থও বুঝতে পারছে না। সে আরো বুঝতে পারল, ঐ অদ্ভুত গাড়ির আরোহিণী ডাক্তারের স্ত্রীর পক্ষ সমর্থন করলে তাকে এমন একটা অবস্থায় পড়তে হবে যাবে সে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ভয় করে–অর্থাৎ উপহাস; তবু অন্তরের প্রেরণা তাকে সম্মুখে ঠেলে দিল। অফিসারের কথা শেষ হবার আগেই প্রিন্স আন্দ্রু রাগে ফুলতে ফুলতে ঘোড়া ছুটিয়ে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতের চাবুকটা তুলল।

দয়া–করে ওদের–যেতে দিন?

অফিসার হাত তুলে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

স্টাফের এইসব লোকদের জন্যই যতসব ঝামেলা দেখা দেয়, সে বিড় বিড় করে বলল। যা ইচ্ছা করুন।

প্রিন্স আন্দ্রুও চোখ না তুলেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। ডাক্তারের স্ত্রী পিছন থেকে তাকে রক্ষাকর্তা বলে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল; কিন্তু সে তাতে কান দিল না। এই অবমাননাকর দৃশ্যটির কথা মনে করে তীব্র বিতৃষ্ণায় সে গ্রামের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল; তাকে বলা হয়েছে, প্রধান সেনাপতি সেখানেই আছে।

গ্রামে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নেমে সে সবচাইতে কাছের বাড়িটাতে ঢুকল। মনের ইচ্ছা, কিছু সময় বিশ্রাম নেবে, কিছু খাবে এবং যেসব হুল ফোঁটানো যন্ত্রণাদায়ক চিন্তা তাকে বিচলিত করে তুলেছিল তাকে কিছুটা শান্ত করে নেবে। প্রথম বাড়িটার জানালার দিকে যেতে যেতে সে ভাবল, এ তো সেনাদল নয়, এটা পাজির দঙ্গল, এমন সময় পরিচিত গলায় কে যেন তার নাম ধরে ডাক দিল।

সে ঘুরে দাঁড়াল। ছোট জানলাটা দিয়ে নেসভিৎস্কির সুন্দর মুখখানি দেখা দিল। যেন কিছু চিবুচ্ছে এমনিভাবে ভেজা ঠোঁট দুটো নাড়তে নাড়তে হাত ঘুরিয়ে নেসভিকি তাকে ভিতরে ঢুকতে বলল।

বলকনস্কি! বলকনস্কি!…শুনতে পাচ্ছ না? এই তাড়াতাড়ি এস!… সে চেঁচাতে লাগল।

ঘরে ঢুকে প্রিন্স আন্দ্রু দেখল, নেসভিৎস্কি ও অপর একটি অ্যাডজুটান্ট কি যেন খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তার দিকে ঘুরে জানতে চাইল, কোনো খবর আছে কি না। তাদের চোখে-মুখে সে যেন উত্তেজনা ও আতংকের চিহ্ন দেখতে পেল। নেসভিৎস্কির স্বভাবত হাসিখুশি মুখে সেটা যেন আরো স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল।

প্রধান সেনাপতি কোথায়? বলকনস্কি শুধাল।

এই তো, ঐ বাড়িটাতে, অ্যাডজুটান্ট জবাব দিল।

আচ্ছা, এটা কি সত্যি যে শান্তি ও সন্ধি স্থাপিত হতে চলেছে? নেসভিৎস্কি শুধাল।

আমিই তো তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইছি। আমি যে কোনোরকমে এখানে এসে পৌঁছেছি, এর বেশি কিছুই আমি জানি না।

আর আমরা! আরে বাবা, সে তো ভয়ংকর ব্যাপার! ম্যাককে দেখে হেসে খুব ভুল করেছিলাম, আমাদের অবস্থা আরো খারাপ, নেসভিৎস্কি বলল, কিন্তু আগে এখানে বস, কিছু খেয়ে নাও।

অ্যাডজুটান্টটি বলল, এখন আপনার মালপত্র বা অন্য কোনো কিছুই পাবেন না প্রিন্স। আর আপনার চাকর পিটার যে কোথায় তা এক ঈশ্বর জানেন।

হেড-কোয়ার্টার এখন কোথায়?

আমাদের রাত কাটাতে হবে জনাইমে।

নেসভিৎস্কি বলল, দেখ, আমার দরকারী জিনিসপত্র সব দুটো ঘোড়ার মতো করে প্যাক করা হয়েছে। খুব ভালোভাবে প্যাক করেছে–তা নিয়ে বোহেমিয় পর্বতমালাও পার হয়ে যাওয়া যাবে। অবস্থা বড়ই খারাপ হে বাপু। কিন্তু তোমার কি হল? এমন কাপছ কেন অসুস্থ লোকের মতো? প্রিন্স আন্দুকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো কাঁপতে দেখে সে বলল।

ও কিছু না, প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল।

ডাক্তারের স্ত্রী ও কনভয়-অফিসারের ঘটনাটা হঠাৎ তার মনে পড়ে গিয়েছিল। প্রধান সেনাপতি এখানে কি করছেন? সে শুধাল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, নেসভিৎস্কি বলল।

দেখ, আমি কিন্তু বুঝতে পারছি যে সবকিছুই ন্যাক্কারজনক, ন্যাক্কারজনক, অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক! এই কথা বলে প্রিন্স আন্দ্রু প্রধানমন্ত্রী যে বাড়িতে আছে সেইদিকে এগিয়ে গেল।

কুতুজভের গাড়ি ও ক্লান্ত ঘোড়াগুলিকে পাশ কাটিয়ে সে এগিয়ে চলল। ঘোড়র কসাকরা জোর গলায় কথাবার্তা বলছে। সে বারান্দায় উঠল। সে শুনেছে, প্রিন্স ব্যাগ্রেশন ও ওয়েরদারসহ কুতুজভ স্বয়ং এখানেই আছে। ওয়েরদার অস্ট্রিয় সেনপতি শমিডির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। বারান্দায় ছোট্ট কজলভস্কি জনৈক করণিকের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। একটা টবকে উল্টো করে পেতে তার উপর কাগজ রেখে করণিকটি হাতের আস্তিন গুটিয়ে তাড়াতাড়ি কি যেন লিখছে। কজলভস্কির মুখটাও শুকনো দেখাচ্ছে–স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সেও সারারাত ঘুমোয় নি। সে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল, কিন্তু মাথাটাও, নাড়ল না।

দ্বিতীয় ব্যূহ…লিখেছ? সে করণিককে বলল। কিয়েফ পদাতিক সৈন্যগণ, পোদোলিয়ান…।

এত তাড়াতাড়ি কেউ লিখতে পারে না, ইয়োর অনার, ক্রুদ্ধ অশ্রদ্ধার দৃষ্টিতে কজলভস্কির দিকে তাকিয়ে করণিক বলল।

দরজা দিয়ে শোনা গেল কুতুজভের উত্তেজিত, অসন্তুষ্ট গলা; একটি অপরিচিত গলা তাকে বাধা দিচ্ছে। এইসব কণ্ঠস্বর, উদাসীনভাবে কজলভস্কির তার দিকে তাকানো, ক্লান্ত করণিকটির অশ্রদ্ধার ভাব, প্রধান সেনাপতির এত কাছে করণিক ও কজলভস্কির একটা টবের পাশে বসে থাকা, জানালার কাছেই ঘোড়াগুলোকে ধরে কসাকদের জোরে জোরে হাসা–এসব কিছু দেখে শুনে প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল একটা গুরুতর রকমের বিপজ্জনক কিছু ঘটতে চলেছে।

কজলভস্কির দিকে ফিরে সে জরুরি প্রশ্ন করতে লাগল।

কজলভস্কি বলল, এই মুহূর্তেই প্রিন্স ব্যাগ্রেশনকে নিয়োগ করা হচ্ছে।

সন্ধির খবর কি?

সেরকম কিছুই হয় নি। যুদ্ধের হুকুমই তো ঘোষণা করা হচ্ছে।

যেখানে থেকে কথা শোনা যাচ্ছিল প্রিন্স আন্দ্রু সেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা খুলতে যাবে এমন সময় শব্দ থেমে গেল, দরজাটা খুলে গেল, আর ঈগল পাখির মতো নাক ও ফোলা মুখ নিয়ে কুতুজভ দ্বারপথে দেখা দিল। প্রিন্স আন্দ্রু কুতুজভের একেবারে সম্মুখে দাঁড়িয়ে, কিন্তু প্রধান সেনাপতির একটি ভালো চোখের দৃষ্টি দেখেই মনে হল, চিন্তা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সে এতই ডুবে আছে যে তার উপস্থিতিটাই সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। নিজের অ্যাডজুটান্টের মুখের দিকে সোজা তাকিয়েও সে তাকে চিনতে পারে নি।

জলভস্কিকে বলল, আচ্ছা, তুমি শেষ করেছ?

আর একটু সময়, ইয়োর এক্সেলেন্সি।

প্রধান সেনাপতির পিছনেই বেরিয়ে এল ব্যাগ্রেশন; মাঝারি উচ্চতার শক্তপোক্ত মধ্যবয়স্ক মানুষ, প্রাচ্যসুলভ কঠিন, গম্ভীর মুখ।

কুতুজভের হাতে একটা খাম এগিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু একটু জোরেই আর একবার বলল, আমি আপনার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছি।

ওঃ, ভিয়েনা থেকে খুব ভালো। পরে, পরে!

ব্যাগ্রেশনকে নিয়ে কুতুজভ ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।

আচ্ছা, তাহলে বিদায় প্রিন্স, সে ব্যাগ্রেশনকে বলল। তোমার এই মহৎ প্রচেষ্টায় রইল আমার আশীর্বাদ খৃষ্ট তোমার সহায় হোন!

হঠাৎ তার মুখটা নরম হয়ে গেল, চোখ জলে ভরে উঠল। বাঁ হাতে ব্যাগ্রেশনকে কাছে টেনে এনে আংটি পরা ডান হাতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার মাথার উপর ক্রুশ-চিহ্ন এঁকে ফোলা-ফোলা গালটা তার দিকে এগিয়ে দিল, কিন্তু ব্যাগ্রেশন চুমো খেল তার গলায়।

খৃস্ট তোমার সহায় হোন! কথাটা আর একবার বলে কুতুজভ তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বলকনস্কিকে বলল, আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়।

ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমি এখানেই কাজ করতে চাই। আমাকে প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের সেনাদলের সঙ্গে থাকবার অনুমতি দিন।

উঠে পড়ো, কুতুজভ বলল, তবু বলকনস্কি দেরি করছে দেখে সে বলল, আমি নিজেও ভালো অফিসার চাই, নিজের জন্যই চাই!

দুজন গাড়িতে উঠল। কয়েক মিনিট নিঃশব্দেই চলতে লাগল।

যেন একটি বৃদ্ধের সহজ বুদ্ধিতে বলকনস্কির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সে বলল, আমাদের সামনে এখনো অনেক কিছু আছে। তারপর যেন নিজেকেই বলছে এমনিভাবে বলে উঠল, তার সেনাদলের দশ ভাগের একভাগও যদি ফিরে আসে তো আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাব।

মাত্র এক ফুট দূর থেকে প্রিন্স আন্দ্রু কুতুজভের মুখের দিকে তাকাল, তার কপালের যেখানটায় একটা বুলেট ঢুকে খুলি ভেদ করে চলে গিয়েছিল সেই জায়গায় সযত্নে থোয়া সেলাইয়ের ক্ষত-চিহ্ন এবং তার চোখের শূন্য কোটরের দিকে আপনাথেকেই প্রিন্স আন্দ্রুর দৃষ্টি পড়ল। সে ভাবল, হ্যাঁ, মানুষের মৃত্যুর কথা এত সহজে বলার অধিকার তার আছে।

সে বলল, সেইজন্যই তো সেই সেনাদলের সঙ্গে আমি যেতে চাইছি।

কুতুজভ জবাব দিল না। যেন কী বলছিল সেটা ভুলে গিয়ে সে চিন্তায় ডুবে বসে রইল। পাঁচ মিনিট পরে গাড়ির নরম স্প্রিংয়ে দুলতে দুলতে সে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে মুখ ফেরাল। তার মুখে উত্তেজনার চিহ্নমাত্র নেই। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের সুরে সে প্রিন্স আন্দ্রুকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল সম্রাটের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণের কথা, ক্রেমসের ব্যাপার সম্পর্কে রাজদরবারে যে-সব মন্তব্য শুনেছে তার কথা এবং উভয়ের পরিচিত কিছু মহিলার কথা।

*

অধ্যায়-১৪

১ নভেম্বর কুতুজভ একটি গুপ্তচর মারফত খবর পেল যে তার অধীনস্থ বাহিনী অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে। গুপ্তচরটি জানিয়েছে, রাশিয়া থেকে যে বাহিনী এগিয়ে আসছে তার ও কুতুজভের বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে ফরাসি বাহিনী ভিয়েনার সেতু পার হয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে। এরপরেও যদি কুতুজভ ক্রেমসে থেকে যায় তাহলে নেপোলিয়নের এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের বাহিনী এসে তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, তার চল্লিশ হাজার সৈন্যের বাহিনীকে ঘিরে ফেলবে, এবং তারও অবস্থা হবে উলমে ম্যাকের মতো। কুতুজভ যদি স্থির করে থাকে যে রাশিয়া থেকে আগত সৈন্যদলের সঙ্গে তার যোগাযোগরক্ষাকারী রাস্তাটা সে পরিত্যাগ করবে, তাহলে তাকে যাত্রা করতে হবে বোহেমির পর্বতমালার এমন অজ্ঞাত অঞ্চলে যেখানে কোনো পথ নেই, পদে পদে তাকে আত্মরক্ষা করতে চলতে হবে শত্রুপক্ষের অধিকতর শক্তিশালী সেনাদলের সঙ্গে সংগ্রাম করে, এবং বাক্সহোডেনের সঙ্গে মিলিত হবার সব আশা ছেড়ে দিয়ে। আর কুতুজভ যদি স্থির করে যে, ক্রেমস থেকে অলমুজ যাবার পথ ধরে পশ্চাদপসরণ করবে, রাশিয়া থেকে আগত সৈন্যদলের সঙ্গে মিলিত হবে, তাহলে তাকে মস্ত বড় ঝুঁকি নিতে হবে, ভিয়েনা সেতু পার হয়ে ধেয়ে আসা ফরাসি বাহিনী তার আগেই সে পথে হানা দেবে, তার নিজের মালপত্র ও যানবাহনেই তো সেপথ আটকে আছে, যাত্রাপথেই তার চাইতে তিনগুণ অধিক শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে তাকে যুদ্ধে নামতে হবে, আর তারা দুদিক থেকে তাকে চেপে ধরবে।

কুতুজভ শেষের পথটাই বেছে নিল।

গুপ্তচর সংবাদ দিয়েছে, ফরাসি বাহিনী ভিয়েনা সেতু পার হয়ে জোর কদমে এগিয়ে চলেছে জনাইমের দিকে, কুতুজভের পশ্চাদপসরণের পথ থেকে সেটা শ-খানেক ভা দূরে অবস্থিত। সে যদি ফরাসিদের আগেই জনাইম পৌঁছতে পারে তাহলে বাহিনীটির বাঁচার যথেষ্ট আশা থাকবে, কিন্তু ফরাসি বাহিনী তার আগে সেখানে পৌঁছনো মানেই হয় গোটা বাহিনীকেই উলমের মতো অসম্মান ভোগ করতে হবে, আর না হয়তো সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে হবে। কিন্তু ফরাসিদের আগে সসৈন্যে সেখানে পৌঁছনো অসম্ভব। ক্রেমস থেকে জনাইম পর্যন্ত রাশিয়ানদের যে রাস্তা সেটার তুলনায় ফরাসিদের ভিয়েনা থেকে জনাইম পর্যন্ত যাবার রাস্তা অনেক সংক্ষিপ্ত ও ভালো।

খবরটা পাবার পরে সেই রাতেই কুতুজভ চার হাজার সৈন্য নিয়ে গড়া ব্যাগ্রেশনের অগ্রবর্তী বাহিনীকে পাঠিয়ে দিল পাহাড় ডিঙিয়ে ক্রেমস জনাইম থেকে ভিয়েনা জনাইম পথের দিকে। কোনোরকম বিশ্রাম না নিয়ে ব্যাগ্রেশনকে মার্চ করে এগিয়ে যেতে হবে, এবং জনাইমকে পিছনে রেখে ভিয়েনার দিকে মুখ করে থামতে হবে। এইভাবে সে যদি ফরাসিদের আগে পৌঁছতে পারে তাহলে যত বেশি সম্ভব তাদের সেখানে আটকে রাখবে। আর কুতুজভ স্বয়ং সব যানবাহন সঙ্গে নিয়ে জনাইমের পথ ধরবে।

ছেঁড়া জুতো পরা ক্ষুধার্ত সৈনদের নিয়ে সেই ঝড়ের রাতে পথহীন পাহাড় ডিঙিয়ে ত্রিশ মাইল পথ চলতে গিয়ে এক তৃতীয়াংশ সৈনকে পথেই ফেলে রেখে ব্যাগ্রেশন ভিয়েনা জনাইম পথেল হলোব্রুনে পৌঁছল ফরাসি বাহিনীর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, তারাও তখন ভিয়েনা থেকে হলোব্রুনের দিকেই এগিয়ে আসছে। যানবহানসহ আরো কয়েকদিনের পথ চললে তবে কুতুজভ ভিয়েনায় পৌঁছতে পারবে। কাজেই শত্রুসৈন্য হলোব্রুনে পৌঁছার পরে চার হাজার ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত সৈন্য নিয়ে ব্যাগ্রেশনের কাজ হবে দিনের পর দিন তাদের আটকে রাখা, আর সে কাজটা একান্তই অসম্ভব। কিন্তু ভাগ্যের খেয়ালে সেই অসম্ভবই সম্ভব হল। যে চালাকির সফলতার ফলে ফরাসিরা বিনা যুদ্ধে ভিয়েনা সেতুকে হাতের মুঠোয় পেয়েছিল, মুরাৎ সেই একই চালাকির দ্বারা কুতুজভকে ঠকাতে চেষ্টা করল। ব্যাগ্রেশনের দুর্বল সেনাদলকে জনাইম রাস্তায় দেখে মুরাত সেটাকে কুতুজভের গোটা বাহিনী বলে ধরে নিল। তাই সেই সেনাদলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার আশায় তার বাকি যে সৈন্যরা ভিয়েনা থেকে আসছিল তাদের জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল, আর সেই উদ্দেশ্যে এই শর্তে একটা তিন দিনের সন্ধির প্রস্তাব করল যে উভয় পক্ষের সৈন্যরাই যে যেখানে আছে সেখান থেকে নড়বে না। মুরাৎ জানাল, শান্তি স্থাপনের আলোচনা শুরু হয়ে গেছে, আর তাই অকারণ রক্তপাত বন্ধ করার জন্যই সে এই সন্ধির প্রস্তাব করছে। অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে মোতায়েন অস্ট্রীয় সেনাপতি কাউন্ট নস্টিজ মুরাতের দূতের এই কথায় বিশ্বাস করে ব্যাগ্রেশনের সেনাদলকে অরক্ষিত রেখে রণক্ষেত্র থেকে বিদায় নিল। আর একটি দূত গেল রুশ সেনাদের কাছে শান্তি আলোচনার কথা জানিয়ে তিন দিনের সন্ধির প্রস্তাব করতে। ব্যাগ্রেশন জবাব দিল, সন্ধির প্রস্তাব স্বীকার করার অথবা বাতিল করার ক্ষমতা তার নেই, কাজেই প্রস্তাবটি কুতুজভের কাছে পেশ করার জন্য সে একজন অ্যাডজুটান্টকে পাঠিয়ে দিল।

কিছু বেশি সময় হাতে পাবার পক্ষে সিন্ধই কুতুজভের একমাত্র ভরসা। সময় পাওয়া গেলে ব্যাগ্রেশনের ক্লান্ত সৈনিকরা কিছুটা বিশ্রাম পাবে, আবার যানবাহনসহ যে বিরাট কনভয়টির অগ্রগতির খবর ফরাসিদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তারাও অন্তত আরো কিছুটা বেশি পথ জনাইমের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। তাই সন্ধির প্রস্তাব তার কাছে এনে দিল বাহিনীটিকে বাঁচার একান্ত অপ্রত্যাশিত একমাত্র সুযোগ। সংবাদ পাওয়া মাত্রই সে সহযাত্রী অ্যাডজুটান্ট জেনারেল উত্তিজিনগেরোদকে পাঠাল শত্রুপক্ষের শিবিরে। উইজিনগেরোদ সন্দির প্রস্তাব তো মানবেই, উপরন্তু আত্মসমর্পণের শর্ত সম্পর্কেও একটা প্রস্তাব রাখবে। এদিকে কুতুজভ তার অ্যাডজুটান্টদের ফেরত পাঠিয়ে দিল, তারা যেন গোটা বাহিনীর মালপত্রবাহী গাড়িগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্রেমস-জনাইম রাস্তা ধরে ছুটিয়ে নিয়ে আসে। ব্যাগ্রেশনের যে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সেনাদল ছিল গোটা বাহিনী ও যানবাহনের রক্ষায় নিযুক্ত শুধু তারাই আটগুণ বেশি শক্তিশালী শত্রুপক্ষের সামনে স্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

কুতুজভ আশা করেছিল, আত্মসমর্পণের প্রস্তাব (যেটা মোটেই বাধ্যতামূলক নয়) যানবাহনের একাংশকে আরো এগিয়ে যাবার সময় দেবে এবং মুরাতের ভুলটাও অচিরেই ধরা পড়বে। তার সে আশা সত্য প্রমাণিত হল। যে মুহূর্তে বোনাপার্ত (সে তখন ছিল হলোন থেকে ষোল মাইল দূরবর্তী শত্রুনে) সন্ধি ও আত্মসমর্পণের প্রস্তাবসহ মুরাতের চিঠি পেল তখনই সে ফন্দিটা ধরে ফেলল এবং মুরাতকে নিম্নমতো চিঠি লিখল :

শব্ৰুন, ২৬শে মেয়ার, ১৮০৫
সকাল আটটা।

প্রিয় মুরাত,

তোমার কাছে আমার অসন্তোষকে প্রকাশ করবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি তো শুধু আমার অগ্রবর্তী বাহিনীকে পরিচালনা করছ, কাজেই আমার হুকুম ছাড়া কোনো যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা করার কোনো অধিকার তোমার নেই। তোমার জন্য আমি একটা গোটা অভিযানের ফলকে হারাতে বসেছি। অবলিম্বে যুদ্ধ বিরতি ভেঙে দাও এবং শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়। তাকে জানিয়ে দাও, যে সনাপতি আত্মসমর্পণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে সে কাজ করার কোনো অধিকার তার নেই, এবং রাশিয়ার সম্রাট ছাড়া অন্য কারো সে অধিকার নেই।

অবশ্য রাশিয়ার সম্রাট যদিও চুক্তি সমর্থন করেন তাহলে আমি একটা সমর্থন করব, কিন্তু এটা একটা চালাকি মাত্র। এগিয়ে যাও, রুশ বাহিনীকে ধ্বংস কর…সে বাহিনীর মালপত্র ও গোলাবারুদ তো তোমার মুঠোর মধ্যে।

রুশ সম্রাটের এড-ডি-কং একটি জোচ্চোর। ক্ষমতাহীন অফিসাররা তো কিছুই নয়, এই অফিসারটির কোনো ক্ষমতাই ছিল না… ভিয়েনা সেতু পার হবার সময় অস্ট্রিয়ারা তোমাদের চালাকির হাতে ধরা দিয়েছিল, তুমিও ম্রাটের এড-ডি-কংয়ের চালাকির হাতে ধরা দিয়েছ।

নেপোলিয়ন।

এই ভয়ঙ্কর চিঠি নিয়ে নেপোলিয়নের অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল মুরাতের কাছে। পাছে তৈরি। শিকার হাতছাড়া হয়ে যায় এই ভয়ে সেনাপতিদের উপর ভরসা না করে রক্ষীবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নেপোলিয়ন স্বয়ং চলল যুদ্ধক্ষেত্রে। আর ব্র্যাতশেনের চার হাজার সৈনিক মনের আনন্দে শিবিরে আগুন জ্বালাল, হাত পা গরম করে আরাম করল, তিন দিনের মধ্যে এই প্রথম পরিজ রান্না করল, অথচ তাদের একজনও জানল না বা কল্পনা করল না তাদের ভাগ্যে কী আছে।

*

অধ্যায়-১৫

কুতুজভের কাছে অনবরত অনুরোধ জানানোর পরে বিকেল তিনটে থেকে চারটের মধ্যে প্রিন্স আন্দ্রু গ্রুন্থে পৌঁছে ব্যাগ্রেশনের সঙ্গে দেখা করল। বোনাপার্তের অ্যাডজুটান্ট তখনো মুরাতের কাছে পৌঁছয় নি, আর যুদ্ধও শুরু হয় নি। ব্যাগ্রেশনের সেনাদলের কেউই প্রকৃত অবস্থার কোনো খবরই রাখে না। তারা মুখে শান্তির কথা বললেও শান্তি স্থঅপনের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করে না, যারা যুদ্ধের কথা ভাবছে তারাও বিশ্বাস করে না যে অবিলম্বেই কোনো যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হবে। ব্যাগ্রেশন জানে বলকনস্কি একজন প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসী অ্যাডজুটান্ট, তাকে সে বিশেষ মর্যাদা ও অনুগ্রহের সঙ্গে স্বাগত জানাল, বুঝিয়ে বলল যে সেইদিন অথবা তার পরদিনই একটা সংঘর্ষ হতে পারে, যুদ্ধকালে সে ইচ্ছা করলে তার সঙ্গেও থাকতে পারে, অথবা পশ্চাদ্বর্তী বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলে পশ্চাদপসরণকারীদের উপরেও নজর রাখতে পারে, আর সে কাজটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তারপরেই যেন প্রিন্স আন্দুকে নিশ্চিত করার জন্যই আর একবার বলল, অবশ্য আজই কোনো সংঘর্ষ হবার সম্ভাবনা খুবই কম।

ব্যাগ্রেশন মনে মনে ভাবল, সে যদি একজন সাধারণ ফুলবাবু অফিসারের মতো একটা মেডেল গলায় পরবার জন্য এখানে এসে থাকে তাহলে পশ্চাৎ রক্ষীবাহিনীতে থেকেও সে পুরস্কারটা বাগাতে পারবে, কিন্তু সে যদি আমার সঙ্গে থাকতে চায় তো থাকুক… একজন সাহসী অফিসার হলে সে এখানে অনেক কাজে লাগবে। প্রিন্স আন্দ্রু কোনো জবাব দিল না, শুধু চারদিকটা ঘুরে সেনাদলের অবস্থানটা একবার দেখে নেবার অনুমতি চাইল, যাতে যদি কখনো তাকে কোনো হুকুম তামিল করতে পাঠানো হয় তখন নিজের অবস্থাটা সে ভালোভাবে বুঝে নিতে পারে। কর্তব্যরত একজন অফিসার প্রিন্স আন্দুকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানোর ভার নিল। অফিসারটি সুদর্শন ও সুসজ্জিত, অনামিকায় একটা হীরের আংটি আর ফরাসিতে কথা বলতে খুব ভালোবাসে, যদিও সে ভাষাটা খুব ভালো বলতে পারে না।

চারদিকে তারা দেখতে পেল, বৃষ্টিভেজা অফিসাররা ক্লান্ত মুখে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর সৈন্যরা গ্রাম থেকে দরজা, বেঞ্চি ও বেড়া টেনে নিয়ে আসছে।

সৈন্যদের দেখিয়ে স্টাফ অফিসারটি বলল, ওই দেখুন প্রিন্স। ওই লোকগুলোকে আমরা থামাতে পারছি না। অফিসাররা তো ওদের কথা ভাবেই না। আর ওই যে, একটা খাবারওয়ালার তাঁবু দেখিয়ে সে বলল, ওখানেই সকলে ভিড় করে বসে আছে। আজ সকালেই সবগুলোকে বের করে দিয়েছিলাম, আর এখন দেখুন, আবার ভর্তি হয়ে গেছে। আমাকে একবার যেতেই হবে প্রিন্স, একটু বকুনি দিয়ে আসি। মোটেই সময় লাগবে না।

প্রিন্স আন্দ্রু এখনো কিছু খাবার সময় করে উঠতে পারেনি, সে বলল, হ্যাঁ, চলুন ভিতরে যাই, আমিও একটা রুটি ও কিছু পনির কিনব।

এ কথা আগে বলেননি কেন প্রিন্স? আমি আপনাকে কিছু খেতে দিতাম।

ঘোড়া থেকে নেমে তারা তাবুতে ঢুকল। কয়েকজন অফিসার লালচে ক্লান্ত মুখে টেবিলে বসে পান-ভোজন করছিল।

একই কথা বারবার বলার মতো ভঙ্গিতে তিরস্কারের সুরে স্টাফ-অফিসার বলল, আচ্ছা, এসবের অর্থ কী সাহেবরা? আপনারা জানেন, এভাবে ঘাঁটি ছেড়ে আসতে আপনারা পারেন না। প্রিন্স তো হুকুম জারি করেছেন যে কেউ তার ঘাটি ছাড়বে না। আর আপনি, কাপ্টেন?-একটি শুটকো, নোংরা, ছোটখাট গোলন্দাজ অফিসারের দিকে ফিরে সে বলল। অফিসারটির পায়ে বুট নেই, শুধু মোজা (বুট জোড়া খাবারওয়ালাকে দিয়েছে শুকোবার জন্য), তারা ঘরে ঢুকলে সে একটু হেসে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল।

স্টাফ-অফিসার বলতে লাগল, আচ্ছা, আপনার কি লজ্জা নেই ক্যাপ্টেন তুশিন? সকলেই মনে করে যে একজন গোলন্দাজ-অফিসার হিসেবে আপনি একটা সৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, অথচ বিনা বুটে আপনি এখানে এসেছেন। বিপদ-সংকেত বেজে উঠলেই তো বিনা জুতোয় আপনি খুব অসুবিধায় পড়ে যাবেন! (স্টাফ অফিসার হাসল) আরে সাহেবরা, আপনারা সবাই দয়া করে যার যার ঘাঁটিতে চলে যান! আদেশের সুরে সে কথা শেষ করল।

গোলন্দাজ অফিসার তুশিনের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু হেসে ফেলল। নিঃশব্দে হাসতে হাসতে অফিসারট মোজাপরা এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ মেলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে একবার প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে, একবার স্টাফ-অফিসারের দিকে তাকাতে লাগল।

সৈনিকরা বলে, বুট ছাড়াই বেশি আরাম হয়, অসুবিধাজনক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন তুশিন সলজ্জ হাসির সঙ্গে বলল। তার ইচ্ছা ছিল কথায় একটু ঠাট্টার সুর আনে, কিন্তু কথা শেষ করার আগেই সে বুঝতে পারল যে তার পরিহাসকে কেউ মেনে নিচ্ছে না, আর তার কথায়ও সে সুরটি বাজেনি। সে কিছুটা বিব্রত বোধ করল।

নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করে স্টাফ অফিসার বলল, দয়া করে যার যার ঘাঁটিতে ফিরে যান।

প্রিন্স আন্দ্রু আর একবার গোলন্দাজ-অফিসারটির ছোটখাট চেহারার দিকে তাকাল। চেহারাটা যেমন যেন অদ্ভুত, একজন সৈনিকের পক্ষে সম্পূর্ণ বেমানান, বরং কিছুটা ভাড়ের মতো। অথচ অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

স্টাফ অফিসার ও প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে চলল।

গ্রাম ছাড়িয়ে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সৈনিক ও অফিসারদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ছেড়ে আরো এগিয়ে তারা এক জায়গায় দেখতে পেল, বাঁদিকে একটা খাদ কাটা হচ্ছে আর তার থেকে যে নতুন কাটা মাটি ফেলা হচ্ছে সেটা দেখতে লাল। ঠাণ্ডা বাতাস সত্ত্বেও কয়েক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য শার্ট গায়ে দিয়ে সেই মাটির বাঁধের উপর সাদা পিঁপড়ের মতো ভিড় করে আছে, বাঁধের পিছন থেকে কতকগুলি অদৃশ্য হাত অনবরত কোদাল ভর্তি করে লাল কাদা উপরে ছুঁড়ে ফেলছে। প্রিন্স আল্লু আর অফিসারটি ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে খাদগুলো দেখে আবার চলতে লাগল। ঠিক তার পিছনেই তারা দেখতে পেল কয়েক ডজন সৈন্য অবিরাম দলের পর দল খাদ থেকে ছুটে এসে সেখানে হাজির হচ্ছে। এইসব পায়খানার বিষাক্ত আবহাওয়ার হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য তারা দুজন নাক চেপে ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

স্টাফ অফিসার ফরাসিতে বলল, শিবির-জীবনের এও একটা সুখ প্রিন্স।

বিপরীত দিকের পাহাড় বেয়ে তারা উঠতে লাগল। সেখান থেকে ফরাসিদের বেশ দেখা যায়। প্রিন্স আন্দ্রু একটু থেমে জায়গাটা ভালো করে দেখতে লাগল।

সব চাইতে উঁচু জায়গাটা দেখিয়ে স্টাফ-অফিসার বলল, ওই আমাদের কামান। এগুলো সেই বুটহীন অদ্ভুত লোকটির অধীন। ওখান থেকে আপনি সবকিছু দেখতে পাবেন। চলুন প্রিন্স, ওখানে যাওয়া যাক।

স্টাফ অফিসারের সঙ্গ এড়াবার জন্য প্রিন্স বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমি একাই যাব। দয়া করে আপনি আর কষ্ট করবেন না।

স্টাফ অফিসার সেখানেই থেকে গেল, প্রিন্স আলু একাই এগিয়ে গেল।

যে যত শত্রুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, সৈন্যরা ততই সুশৃঙখল আর খুশি হয়ে উঠতে লাগল। ফরাসি বাহিনীর কাছ থেকে সাত মাইল দূরে অবস্থিত জনাইম রোডে আজ সকালে সে যখন মালবাহী গাড়িগুলিকে পার হয়ে আসছিল তখন সেখানেই দেখেছিল সর্বাধিক বিশৃঙ্খল ও অবসাদ। গ্রন্থেও কিছুটা আতঙ্ক ও বিপদের শংকা বোঝা গিয়েছিল, কিন্তু প্রিন্স যতই ফরাসি বাহিনীর দিকে এগোতে লাগল, আমাদের সৈন্যদের মনে ততই আত্মবিশ্বাস জাগতে লাগল। গ্রেট-কোট পরিহিত সৈন্যরা সব সার দিয়ে দাঁড়াল, সার্জেন্ট-মেজর ও কোম্পানি অফিসাররা তাদের গুনতে লাগল, প্রতিটি দলের শেষ সৈনিকটির পাঁজড়ে খোঁচা মেরে তাকে হাত তুলতে বলল। ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে সৈন্যরা কাঠের গুঁড়ি ও ঝোঁপ-জঙ্গল টেনে এনে হাসিমুখে গল্পগুজব করতে করতে ছাউনি ফেলছে, কেউ-বা আগুনের পাশে বসে শার্ট ও পায়ের পটি শুকোচ্ছে আবার অনেকেই বয়লার ও পরিজ-কুকুরের পাশে জড়ো হয়ে বুট ও ওভারকোট মেরামত করছে। এক দলের ডিনার তৈরি হয়ে গেছে, সৈন্যরা সতৃষ্ণ নয়নে ধূমায়িত রান্নার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আছে, কোয়ার্টার মাস্টার সার্জেন্ট একটা কাঠের বাটি হাতে নিয়ে চলেছে জনৈক অফিসারের কাছে, সে বসে আছে ছাউনির সামনে একটা কাঠের গুঁড়ির উপর, সে খাবারটা চেখে দেখবে তবে সেটা সৈন্যদের পরিবেশন করা হবে।

আর এক কোম্পানির সৈন্যর ভাগ্য খুব ভালো, কারণ সব কোম্পানির ভাগ্যে ভদকা জোটে না। মুখে দাগওয়ালা চওড়া কাঁধ একজন সার্জেন্ট-মেজরকে ঘিরে তারা বসেছে। আর একটা ছোট পিপে কাত করে তার দিকে এগিয়ে ধরা, ক্যান্টিনের কৌটোগুলোকে সে একে এসে ভরে দিচ্ছে। সৈন্যরা ভক্তির সঙ্গে সেই কৌটোকে ঠোঁটের কাছে তুলে মুখের মধ্যে ভদকা ঢেলে কৌটো খালি করে দিয়ে খুশি মুখে ঠোঁট চাটতে। চাটতে আর গ্রেটকোটের আস্তিনে মুখ মুছতে মুছতে সার্জেন্ট মেজরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। সকলেরই চোখে মুখে এত গভীর প্রশান্তি যেন শান্তিপূর্ণ শিবির জীবন শুরু করার আগে তারা বাড়িতে বসে এসব করছে, তাদের দেখে মনেই হয় না যে এমন একটা আসন্ন যুদ্ধে তারা শত্রুর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে যাতে তাদের অন্তত অর্ধেক সৈন্য সেই রণক্ষেত্রেই পড়ে থাকবে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু এক প্লাটুন গোলন্দাজ সৈন্যের সামনে এসে পৌঁছল, তাদের সামনে একটি উলঙ্গ লোক পড়ে আছে। দুটি সৈন্য তাকে ধরে আছে, আর অন্য দুজন ছোট লাঠি ঘুরিয়ে তার খোেলা পিঠে আঘাত করে চলেছে। লোকটি অস্বাভাবিক রকমের চিৎকার করছে। একজন মেজর তাতে কোনোরকম কান না দিয়ে পায়চারি করছে, আর বার বার চেঁচিয়ে বলছে, একজন সৈন্যের পক্ষে চুরি করা অত্যন্ত লজ্জার কথা, একজন সৈন্যকে হতে হবে সৎ, সম্মানিত ও সাহসী, কিন্তু সে যদি তার সহকর্মীদের জিনিস চুরি করে তাহলে তো তার কোনো সম্মানই থাকতে পারে না, সে তো একটা বদমাশ। চালাও! চালাও!

কাজেই লাঠির হিস হিস শব্দ আর অসহায় তীব্র চিৎকার চলতেই লাগল।

চালাও, চালাও! মেজর বলল।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটি অফিসার বেদনার্ত মুখে সেখান থেকে এগিয়ে এসে অশ্বারোহী অ্যাডজুটান্টের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

অগ্রবর্তী প্রথম সারিতে পৌঁছে প্রিন্স আরো এগিয়ে বলল। ডান ও বাঁদিকে আমাদের সৈন্যদল ও শত্রুসৈন্যের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব থাকলেও আমাদের যে মধ্যবর্তী সেনাদলের ভিতর থেকে সেদিন সকালেই সন্ধির পতাকা নিয়ে একদল সৈন্য এগিয়ে গিয়েছিল তাদের অবস্থান ও শত্রুসৈন্যের অবস্থান এতই কাছাকাছি যে তারা পরস্পরের মুখ দেখতে পারে, কথাও বলতে পারর। তাছাড়া উভয় পক্ষেরই প্রহরী সেনাদল ছাড়াও কিছু কৌতূহলী দর্শক সেখানে জমা হয়েছিল যারা হাসি-ঠাট্টা করতে করতে অপরিচিত বিদেশী সৈন্যদের তাকিয়ে দেখছিল।

যদিও খুব সকাল থেকেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে যে কেউই প্রহরারত সেনাদলের কাছে যেতে পারবে না, তবু অফিসাররা উৎসুক দর্শকদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। আর প্রহরী সেনাদলও সঙ্গের দলের লোকদের মতো ফরাসিদের উপর নজর না রেখে কৌতূহলী দর্শকদেরই দেখছে, এবং কখন তাদের বদলি সেনাদল আসবে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। ফরাসিদের ভালো করে দেখার জন্য প্রিন্স আন্দ্রু সেখানে থামল।

একজন রুশ বন্দুকধারী জনৈক অফিসারের সঙ্গে প্রহরী সেনাদলের কাছে গিয়ে একটি ফরাসি গোলন্দাজ সৈনিকের সঙ্গে উত্তেজিতভাবে দ্রুত কথা বলছিল। তাকে দেখিয়ে একজন সৈনিক অপরজনকে বলল, দেখ! ওদিকে দেখ! ওর বকবকানিটা শোন! খুব ভালো, তাই না? ফরাসিরা ওর সঙ্গে শুধু কথার বেলায়ই তাল রাখতে পারে। এদিকে দেখ সিদরভ!

থাম, মন দিয়ে শোেন। চমৎকার! সিদরভ বলল, তাকে ফরাসি ভাষায় খুব পটু বলে মনে করা হয়।

যে সৈনিকটির কথা বলে ওরা হাসছিল সে দলকভ। প্রিন্স আন্দ্রু তাকে চিনতে পেরে তার বক্তব্য শুনবার জন্য থামল। তাদের রেজিমেন্টকে বাঁদিকের সারিতে মোতায়েন করা হয়েছে, সেখান থেকেই সে তার ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এসেছে।

অফিসারটি তার কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছিল না, তবু যাতে একটি কথাও হারিয়ে না যায় এমনিভাবে সামনে ঝুঁকে অফিসারটি তাকে উস্কে দিয়ে বলল, আরে চালাও, চালিয়ে যাও। আরো কথা বল : আরো! ও কি বলছে?

দলকভ ক্যাপ্টেনের কথার জবাব দিল না, ফরাসি গোলন্দাজটির সঙ্গে তখন তার খুব বচসা চলছে। স্বভাবতই তারা যুদ্ধ নিয়েই কথা বলছে! অস্ট্রিয় ও রুশদের মধ্যে গোলমাল করে ফরাসিটা প্রমাণ করতে চাইছে যে রুশরা আত্মসমর্পণ করে উলম থেকে পালিয়ে গেছে, আর দলকভ বলছে যে রুশরা আত্মসমর্পণ করে নি, উপরন্তু ফরাসিদের হারিয়ে দিয়েছে।

দলকভ বলল, তোমাদের এখান থেকেও তাড়াবার হুকুম আমরা পেয়েছি, আর তোমাদের তাড়িয়ে দেবও।

ফরাসি গোলন্দাজটি বলল, তবে খেয়াল রেখো, কসাকসহ তোমরা সকলে না বন্দি হও!

ফরাসি শ্রোতা ও দর্শকরা হেসে উঠল।

দলকভ বলল, সুভরভের নেতৃত্বে যেমন করেছিলাম, তেমনি তোমাদের নাচিয়ে ছাড়ব।

জনৈক ফরাসি জিজ্ঞেস করল, ও আবার কি সুর ধরেছে?

সে হয়তো আগেকার কোনো যুদ্ধের কথা বলছে তাই মনে করে আর একজন বলল, সে তো প্রাচীন ইতিহাস। সম্রাট অন্যদের যেমন শিক্ষা দিয়েছেন তেমনি তোমাদের সুভরভকেও শিক্ষা দেবেন।

বোনাপার্ত… দলকভ কথাটা বলতেই ফরাসি লোকটি তাকে বাধা দিল।

বোনাপার্ত নয়। তিনি সম্রাট! পবিত্র নাম…। সে রেগে বলল।

শয়তান তোমার সম্রাটের ছাল ছাড়িয়ে নিক।

সৈনিকদের কড়া রুশ ভাষায় একটা খিস্তি করে দলকভ বন্দুক কাঁধে নিয়ে সরে গেল।

ক্যাপ্টেনকে বলল, আইভান লুকিচ, চলে এস।

প্রহরী সৈন্যরা বলল, ফরাসি ভাষা এইভাবেই বলতে হয়। সিদরভ, এবার তুমি একটু চেষ্টা করে দেখ! ফরাসিদের দিকে ঘুরে সিদরভ একবার চোখ টিপল, তারপর খুব তাড়াতাড়ি কতকগুলি অর্থহীন হ-য-ব র-ল বিশেষ সুর করে আউড়ে যেতে লাগল : কারি, মালা, তাফা, সাফি, মুতের, কাসকা।

হো! হো! হো! হা! হা! হা! হা! ওঃ ওঃ! সৈন্যরা সকলে মিলে এমন অট্টহাসি হেসে উঠল যে তার ছোঁয়াচ ফরাসিদের মনেও ঢেউ তুলল, তারা আর কি করে, গাদাবন্দুকের বারুদ বের করে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল, এবং অতি দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করল।

বন্দুকগুলি কিন্তু গোলাবারুদ-ভরাই রয়ে গেল, প্রাচীরের ফোকড় ও পরিখাগুলি তাকিয়ে রইল তেমনি ভয়ংকর চোখে, আর কামানগুলি আগের মতোই পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

*

অধ্যায়-১৬

ঘোড়ার পিঠে চেপে সারিবদ্ধ সেনাদলের ডান দিক থেকে বাঁদিক পর্যন্ত আগাগোড়া চক্কর দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু সোজা এগিয়ে গেল কামান-মঞ্চের দিকে, স্টাফ-অফিসার বলে দিয়েছিল, সেখান থেকেই গোড়া রণক্ষেত্রটা দৃষ্টিগোচর হবে। সেখানে ঘোড়া থেমে নেমে চারটি কামানের একেবারে সবশেষ কামানটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কামানগুলির সামনে গোলন্দাজ বাহিনীর একজন শান্ত্রী এদিক-ওদিক পায়চারি করছিল, অফিসারকে দেখে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু একটা ইঙ্গিতেই আবার সেই একঘেয়ে পদচারণা শুরু করল। কামানগুলির পিছনে ছিল কয়েকটা রসদবাহী গাড়ি, আর তারও পিছনে সৈনিকদের বহুস্তব। তার বাঁদিকে কিছুটা দূরেই বাঁশের কঞ্চি ও বাখারি দিয়ে সদ্য তৈরি একটা চালাঘর, সেখান থেকে অফিসারদের সাগ্রহ আলোচনার শব্দ ভেসে আসছে।

কামান-মঞ্চটার উপর থেকে যে গোটা রুশ বাহিনীর অবস্থিতি এবং শত্রুপক্ষের অবস্থানেরও অনেকটাই চোখে পড়ে সে কথা সত্য। ঠিক সম্মুখেই বিপরীত দিককার পাহাড়ের মাথায় শোন গেবার্ন গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, এবং তার বাঁ ও ডান দিকে তিনটি স্থঅনে ক্যাম্প-ফায়ারের ধোঁয়ার মধ্যে ফরাসি বাহিনীকে দেখা যাচ্ছে। ওই গাঁয়ের বাঁদিকে ধোঁয়ার মধ্যে কামান-মঞ্চের মতো একটা কিছু আছে বলেই মনে হয়, কিন্তু এতদূর থেকে খালি চোখে সেটাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। আমাদের বাহিনী একটা চড়াইয়ের উপর ঘাঁটি গেড়েছে, সেখান থেকে ফরাসি বাহিনীকে আক্রমণ করা সহজ। সেখানে জমায়েত হয়েছে আমাদের পদাতিক বাহিনী এবং একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে অশ্বারোহী দল। ঠিক মাঝখানে রয়েছে তুশিনের কামান-মঞ্চ, সেখানে দাঁড়িয়েই প্রিন্স আন্দ্রু সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে, যে ছোট নদীটা শোন গ্রেবান থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তাতে নামা-ওঠা কারার সবচাইতে সুবিধাজনক স্থানও সেটাই। বাঁদিকে আমাদের সেনাদলের খুব কাছেই একটা জঙ্গল, সৈন্যরা সেখানে গাছ কাটছে, তাদের জ্বালানো আগুনের ধোয়াও চোখে পড়ছে। ফরাসি সেনা-ব্যুহ আমাদের চাইতে অনেক বেশি প্রশস্ত, পরিষ্কার বোঝা যায় যে দুদিক থেকেই তারা সহজেই আমাদের কাবু করতে পারে। আমাদের পিছনেই একটা খাড়া উত্রাই, ফলে আমাদের গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনীর পক্ষে পিছু হটাও খুব শক্ত একটা কামানের উপর হেলান দিয়ে নোট-বই বের করে প্রিন্স আন্দ্রু সেনা অবস্থানের একটা রেখাচিত্র এঁকে ফেলল। ব্যাগ্রেশনকে বোঝাবার জন্য দুটো বিষয়ে কিছু মন্তব্যও লিখে রাখল। সে ভেবে নিয়েছে, প্রথমে গোলন্দাজ বাহিনীকে মাঝখানে একত্র করবে, তারপর অশ্বারোহী বাহিনীকে উত্রাইয়ের অপর পারে সরিয়ে নেবে। প্রিন্স আন্দ্রু সর্বদা প্রধান সেনাপতির কাছাকাছিই থাকে, কাজেই নিজের অজান্তেই আসন্ন যুদ্ধের একটা মোটামুটি খসড়া সে মনে মনে ছকে ফেলল আর সেই চিন্তায়ই মশগুল হয়ে পড়ল। কামানের পাশে দাঁড়িয়ে অফিসারদের সব কথাই সে শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু সাধারণত যা হয়ে থাকে তাদের সেসব কথার অর্থ সে কিছুই ধরতে পারছিল না। হঠাৎ চালাঘর থৈকে ভেসে-আসা একটা কণ্ঠস্বর শুনে সে সজাগ হয়ে উঠল, সে কণ্ঠস্বর এতই আন্তরিকতায় পূর্ণ যে সে ভালো করে কান পাতল।

প্রিন্স আর মনে হল সেই মধুর কণ্ঠস্বর তার পরিচিত। কণ্ঠস্বর বলে উঠল, না বন্ধু, আমি বলতে চাই মৃত্যুর পরে কি আছে তা জানা যদি সম্ভব হত তাহলে আমরা কেউই মৃত্যুকে ভয় করতাম না। এটাই ঠিক কথা বন্ধু।

আর একটি অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী কণ্ঠস্বর তাকে বাধা দিল :

ভয় পাও আর নাই পাও, তার হাত থেকে কিন্তু পরিত্রাণ পাবে না।

তাদের দুজনকেই বাধা দিয়ে একটি তৃতীয় পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠস্বর বলল, যাই বলো না কেন, ভয় কিন্তু আছেই! তোমরা খুব চালাক ছেলে। অবশ্য তোমরা গোলন্দাজ সৈন্যরা খুব বুদ্ধিমান, কারণ তোমরা তো ভদকা আর খাবারদাবার সবই সঙ্গে নিতে পার।

পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠের অধিকারী পদাতিক বাহিনীর অফিসারটি হেসে উঠল।

পরিচিত কণ্ঠের প্রথম বক্তা বলল, হ্যাঁ, মানুষ ভয় পায়। আসলে কী জান, অজানাকেই লোকে ভয় করে। আমরা যতই বলি না কেন যে আত্মা আকাশে চলে যায়… আমরা তো জানি, যে আকাশ বলে কিছু নেই, আছে শুধু হাওয়া।

পৌরুষ কণ্ঠটি আবার গোলন্দাজ অফিসারকে বাধা দিল।

বেশ তো, তোমার ওই কবরেজি ভদকা আমাদের খানিকটা খাওয়াও না তুশিন।

প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, আরে, এ তো সেই ক্যাপ্টেন যে ভাণ্ডারীর দোকানে পায়ে বুট ছাড়াই দাঁড়িয়ে ছিল। তার মধুর দার্শনিক কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে তার খুব ভালো লাগল।

তুশিন বলল, একটু কবরেজি-ভদকা? নিশ্চয়!… কিন্তু তবুও, পরজন্মের কথা…।

তার কথা শেষ হল না। ঠিক সেইসময় বাতাসে একটা শিস শোনা গেল, কাছে–আরো কাছে, আরো দ্রুতগতিতে আর উচ্চশব্দে একটা কামানের গোলা অমানুষিক শক্তিতে ছুটে এসে চালাঘরটার কাছে ফাটল।

অনেকটা মাটি ছড়িয়ে পড়ল। সেই প্রচণ্ড আঘাতে মাটি যেন আর্তনাদ করে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখের কোণে ছোট পাইপটা নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানাকে বিবর্ণ করে তুশিন চালাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। চটপটে পদাতিক অফিসারটিও কোটের বোম আটকাতে আটকাতে তাকে অনুসরণ করল।

*

অধ্যায়-১৭

পুনরায় ঘোড়ায় চেপে প্রিন্স আন্দ্রু কামানের পাশে থেকেই দূরের কামানের ধোয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। সম্মুখের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্রুত চোখ বুলিয়ে শুধু দেখতে পেল, যে ফরাসি সৈন্যরা এতক্ষণ নিশ্চল হয়ে ছিল, এবার তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তাদের বাঁদিকে সত্যি সত্যি একটা কামান-মঞ্চ রয়েছে। তার উপর থেকে কামানের ধোয়া এখনো মিলিয়ে যায়নি। প্রথম গোলার ধোয়া মিলিয়ে না যেতেই আর একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল তার গর্জন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে! প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের খোঁজে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল গ্রন্থের দিকে। তার পিছন থেকে মুহুর্মুহু কামানের শব্দ ভেসে আসছে। স্পষ্টতই আমাদের কামানগুলোও জবাব দিতে শুরু করেছে। উত্রাইয়ের নিচে যেখানে সৈনিকদের বৈঠক বসেছিল সেখান থেকেও বন্দুকের শব্দ আসছে।

বোনাপার্তের কড়া চিঠি নিয়ে লেমায়র ঘোড়া ছুটিয়ে সবে এসে হাজির হয়েছে, আর পর্যদস্ত মুরাত স্বীয় ত্রুটির প্রায়শ্চিত্ত করতে সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে গেছে ঠিক মাঝখানে আক্রমণ করে রুশ বাহিনীকে দুদিক থেকে গুটিয়ে আনবার উদ্দেশ্যে, তবে মনের আশা সন্ধ্যায় সম্রাট এসে পৌঁছার আগেই তার সম্মুখস্থ তুচ্ছ বাহিনীটিকে সে ধ্বংস করে ফেলতে পারবে।

শুরু হয়ে গেছে। এই তো শুরু! প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, তার বুকের মধ্যে রক্ত উত্তাল হয়ে উঠল। কিন্তু কখন, কীভাবে আমার তুলো নিজেকে উপস্থিত করবে?

সৈন্যদলগুলির ভিতর দিয়ে চলতে চলতে সে দেখল, যেসব সৈন্যরা পনেরো মিনিট আগেই পরিজ ও ভদকা খাচ্ছিল, তারাই এখন দ্রুতগতিতে দলে দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, বন্দুক তুলে নিচ্ছে, যে আগ্রহ জেগেছে তার নিজের বুকের মধ্যে তারই প্রকাশ চোখে পড়ছে তাদের প্রত্যেকের মুখে। প্রতিটি সৈনিক, প্রতিটি অফিসারের মুখ যেন একই কথা বলছে! শুরু হয়ে গেছে! এই তো যুদ্ধ-ভয়ংকর হলেও উপভোগ্য!

নদীর তীরে পৌঁছবার আগেই হেমন্ত সন্ধ্যার ম্লান আলোয় সে দেখতে পেল, কয়েকজন অশ্বরোহী তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সকলের আগে কসাক জোব্বা গায়ে ভেড়ার চামড়ার টুপি মাথায় সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসছে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন। তার এগিয়ে আসার জন্যই প্রিন্স আন্দ্রু থেকে গেল, প্রিন্স ব্যাগ্রেশন ঘোড়ার রাশ টেনে প্রিন্স আন্দ্রুকে চিনতে পেরে মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টি তখন সামনের দিকে প্রসারিত, প্রিন্স আন্দ্রু যা কিছু দেখতে পেয়েছে সবই তাকে বলল।

শুরু হয়েছে। এই তো যুদ্ধ!–প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের আধ-বোজা ঘুম-ঘুম চোখে ও কঠিন বাদামি মুখেও এই একই অনুভূতির আভাস। প্রিন্স আন্দ্রু সাগ্রহ কৌতূহলের সঙ্গে তার অবিচলিত মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল, তার মনের বাসনা-এই মুহূর্তে এই মানুষটি কি ভাবছে। কি অনুভব করছে তা যদি সে বলতে পারত। এই অবিচলিত মুখের আড়ালে কোনো কথা কি লুকনো আছে? প্রিন্স আন্দ্রু নিজেকেই প্রশ্ন করল। তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে মাথা নেড়ে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন বলল, খুব ভালো। এমন সুরে সে কথাটা বলল যেন যা কিছু ঘটেছে, যা কিছু সে শুনেছে সে সবই সে আগে থেকেই জানত। দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আসার জন্য দম ফুরিয়ে যাওয়ায় প্রিন্স আন্দ্রু কথা বলছে তাড়াতাড়ি। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন প্রতিটি শব্দের উপর জোর দিয়ে খুবই ধীরে ধীরে কথা বলছে, যেন বোঝাতে চাইছে যে তাড়াহুড়া করার কিছু নেই। যাইহোক, সে তুশিনের কামানশ্রেণীর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। প্রিন্স আন্দ্রু সেই দলকেই অনুসরণ করল। প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের পিছনে চলেছে তার ব্যক্তিগত অ্যাডজুটান্ট, ঝেরকভ, একজন আর্দালি-অফিসার কর্তব্যরত স্টাফ-অফিসার ও জনৈক অসামরিক কর্মচারী, সে একজন হিসাবরক্ষক, কৌতূহলের বশতবী হয়ে যুদ্ধে আসার অনুমতি সংগ্রহ করেছে।

হিসাবরক্ষককে দেখিয়ে ঝেরকভ বলকনস্কিকে বলল, ইনি যুদ্ধ দেখতে চান, অথচ এর মধ্যেই তাঁর পাকস্থলীতে একটা ব্যথা বোধ করছেন।

আহা, যেতে দিন! চতুর হাসির হেসে হিসাবরক্ষক বলল, ইচ্ছা করেই সে যেন এটা বোকা-বোজা ভাব দেখাল।

স্টাফ-অফিসার বলল, সবই বিচিত্র সিয় প্রিন্স।

ততক্ষণে সকলেই তুশিনের কামানশ্রেণীর কাছে পৌঁছে গেছে, তাদের ঠিক সামনেই একটা গোলা পড়ে ফাটল।

সরল হাসির সঙ্গে হিসাবরক্ষক জিজ্ঞেস করল, ওটা কি পড়ল?

একখানি ফরাসি পিঠে, ঝেরকভ জবাব দিল।

হিসাবরক্ষক বলল, তাহলে এই দিয়েই ওরা আঘাত হানে? কী ভীষণ!

যে যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছে। তার কথা শেষ হতে না হতেই আর একটা প্রচণ্ড শিস শোনা গেল, মার সেটাও হঠাৎই একটা নরম কিছুর মধ্যে সশব্দেগ ফেটে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ডাইনে ও হিসাবরক্ষক কসাকটির সামনে থেমে গিয়ে তাকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল, লোকটি মারা গেছে, কিন্তু তার ঘোড়াটা তখনো ছটফট করছে।

প্রিন্স ব্যাগ্রেশন চোখ কুঁচকে চারদিকে তাকাল, গোলমালের কারণটা বুঝতে পেরে নির্বিকারভাবে চোখ ফিরিয়ে নিল, যেন বলতে চাইল, এসব তুচ্ছ জিনিসের প্রতি নজর দিয়ে কি হবে? কুশলী সওয়ারের মতো

অতিসহজে ঘোড়ার রাশ টেনে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে সে নিজের তরবারি কোষমুক্ত করল। তরবারিখানা সেকেলে ধরনের, আজকাল কেউ বড় একটা ব্যবহার করে না। প্রিন্স আন্দ্রুর মনে পড়ে গেল, সুভরভই ইতালিতে ব্যাগ্রেশনকে এই তরবারি দিয়েছিল, এই মুহূর্তে কথাটা তার বড়ই ভালো লাগল। ততক্ষণে তারা কামান মঞ্চের কাছে পৌঁছে গেছে।

বারুদের গাড়ির পাশে দাঁড়ানো একটি গোলন্দাজ সৈনিককে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন জিজ্ঞেস করল, এটা কার কোম্পানি?

মুখে বলল, এটা কার কোম্পানি? কিন্তু আসলে সে জানতে চাইল, তুমি কি এখানে ভয় পেয়েছ? গোলন্দাজটি তার কথা বুঝতে পারল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখবর্তি দাগওয়ালা লাল-চুল গোলন্দাজটি খুশির সুরে বলল, ক্যাপ্টেন তুশিনের ইয়োর এক্সেলেন্সি।

কি যেন ভাবতে ভাবতেই ব্যাগ্রেশন বিড় বিড় করে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপরই কামানশ্রেণীর পাশ দিয়ে একেবারে শেষ কামানটির দিকে এগিয়ে গেল।

কাছাকাছি যেতেই একটা গোলার শব্দ তাদের সকলেরই কানে তালা লাগিয়ে দিল, ধোঁয়ার কুণ্ডলি হঠাৎ কামানটাকে ঢেকে ফেললেও তার ভিতর দিয়েই দেখা গেল, একনম্বর গোলন্দাজটি কামানটাকে আঁকড়ে ধরে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে, আর দুনম্বর কাঁপা হাতে কামানের মুখে বারুদ ভরছে। চওড়া-কাঁধ, ছোটখাট ক্যাপ্টেন তুশিন কামানবাহী শকটের পিছন থেকে লাফিয়ে সামনে এসে সেনাপতির উপস্থিতি খেয়াল করেই ছোট হাতটা চোখের উপর তুলে সামনে তাকাল।

তার শরীর দুর্বল, গলার স্বরও দুর্বল, তবু যথাসাধ্য কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে সে হাঁক দিয়ে বলল, আরো দুটো ধাপ তুলে দাও, তাহলেই ঠিক হবে। দুনম্বর! মেদভেদেভে কামান দাগো।

ব্যাগ্রেশন তুশিনকে ডাকল, তুশিনও এমন সলজ্জ অদ্ভুত ভঙ্গিতে তিনটে আঙুল টুপিতে ছোঁয়াল যে সামরিক অভিবাদনের বদলে সেটাকে পুরোহিততের আশীর্বাদ বলেই মনে হল। যদিও উপত্যকা লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করাই ছিল তুশিনের কামানগুলির উদ্দেশ্য, আসলে সে কিন্তু আগুনে বোমা ছুঁড়ছিল ঠিক সামনের দিককার শোন ঘেবার্ন গ্রামটিকে লক্ষ্য করে, সেই গ্রামের সামনে দিয়েই একটা মস্ত বড় ফরাসি বাহিনী এগিয়ে আসছে।

কোথায় ও কাকে লক্ষ্য করে কামান দাগা হবে সে হুকুম কেউ তুশিনকে দেয় নি, সার্জেন্ট-মেজর জাখারচেংকোকে সে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, তার সঙ্গে পরামর্শ করেই তুশিন স্থির করেছে গ্রামটাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়াটাই ভালো হবে। অফিসারের বিবরণ শুনে ব্যাগ্রেশন বলল, খুব ভালো, তারপর সম্মুখে প্রসারিত রণক্ষেত্রটাকে ভালো করে দেখতে লাগল। আমাদের ডানদিকে ফরাসিরা বেশ এগিয়ে এসেছে। সে উঁচু জায়গাটাতে কিয়েভ সেনাদলকে মোতায়েন করা হয়েছে তার নিচে যে খাদের ভিতর দিয়ে ছোট নদীটা বয়ে চলেছে সেখান থেকে বন্দুকের ফট ফট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এবং ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে, একটা ফরাসি বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করছে। বাঁ দিকে একটা জঙ্গলে দিগন্ত ঢাকা পড়েছে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন হুকুম দিল, ডান দিকের শক্তিবৃদ্ধি করতে মধ্য ভাগ থেকেই দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য সেখানে পাঠানো হোক। দলের অফিসারটি সাহস করে প্রিন্সকে বলল, দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য পাঠিয়ে দিলে এখানকার কামানগুলি অরক্ষিত হয়ে পড়বে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন অফিসারটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে অর্থহীন চোখ মেলে নিঃশব্দে তার দিকে তাকাল। প্রিন্স আর মনে হল যে অফিসারটি ঠিক কথাই বলেছে, সত্যি তার কথার কোনো জবাব নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে নিচের খাদে মোতায়েন সেনাদলের অধিনায়ককের চিঠি নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এল একজন অ্যাডজুটান্ট, জানাল, একটা মস্ত বড় ফরাসি বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে নেমে আসছে, তাদের সেনাদলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তারা কিয়েভ গোলন্দাজদের দিকে সরে যাচ্ছে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন দেখা দিয়েছে, তারা কিয়েভ গোলন্দাজদের দিকে সরে যাচ্ছে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। ডান দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একজন অ্যাডজুটান্টকে অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে হুকুম জানাল, তারা যেন ফরাসিদের আক্রমণ করে। কিন্তু আধ ঘণ্টা পরে সেই অ্যাডজুটান্টটি ফিরে এসে খবর দিল, শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মুখে অকারণে সৈন্যরা মারা পড়ছিল বলে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ইতিমধ্যেই খাদ পেরিয়ে সরে গেছে এবং গুলি চালাবার জন্য কিছু সৈন্যকে জঙ্গলের ভিতর পাঠিয়ে দিয়েছে।

খুব ভালো, ব্যাগ্রেশন বলল।

সেখান থেকে চলে আসবার সময় বাঁদিক থেকেও গোলগুলির শব্দ শোনা গেল, নিজে সেখানে যেতে না পারায় প্রিন্স ব্যাগ্রেশন ঝেরকভকে পাঠিয়ে হুকুম দিল, সেখানকার অধিনায়ক যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাদের পিছন দিকে সরে যায়, কারণ ব্যূহের দক্ষিণ অংশও আর বেশি সময় শক্রপক্ষের আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তুশিন ও তার কামানরক্ষী সেনাদলের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। সবকিছু দেখে শুনে প্রিন্স আন্দ্রু অবাক হয়ে গেল, সে বুঝল, কোনো কিছুই সেনাপতির ইচ্ছানুসারে ঘটছে না, ঘটছে ঘটনাচক্রে, অথচ ব্যাগ্রেশন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন তার উপস্থিতি অত্যন্ত মূল্যবান। অফিসাররা বিচলিত হয়ে তার সামনে এসে শান্ত হয়ে যাচ্ছে, সৈনিক ও অফিসাররা তাকে সানন্দে অভিনন্দিত করছে, তার উপস্থিতিতে উত্যু হয়ে উঠছে, তার সামনে নিজেদের সাহসের পরিচয় দিতে উদগ্রীব হয়ে উঠছে।

*

অধ্যায়-১৮

প্রিন্স ব্যাগ্রেশন আমাদের দক্ষিণ ব্যূহের সর্বোচ্চ পৌঁছবার পর এবার নিচে নামতে শুরু করল। সেখান থেকে বন্দুকের আওয়াজ আসছে, কিন্তু ধোয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারা খাদের দিকে যত এগোচ্ছে ততই সবকিছু ধোঁয়ায় বেশি করে ঢেকে যাচ্ছে। আর ততই তারা বেশি করে বুঝতে পারছে যে সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্র আরো কাছে এগিয়ে আসছে। এবার আহত সৈনিকদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, একজনের মাথা বেয়ে রক্ত পড়ছে, মাথায় টুপি নেই, অন্য দুটি সৈনিক তাকে জড়িয়ে দরে টেনে নিয়ে চলেছে। তার গলার মধ্যে ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে, রক্ত-বমি হচ্ছে। তার গলায় অথবা মুখে গুলি লেগেছে। আর একজন নিজেই হেঁটে যাচ্ছে, হাতে বন্দুক নেই, একটা হাত বুলিয়ে আর্তনাদ করতে করতে চলেছে, ওই হাতটাতেই গুলি লেগেছে, যেন খোলা : বোতলের ভিতর থেকে রক্ত বেরিয়ে তার গ্রেটকোট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। এইমাত্র সে আহত হয়েছে, যন্ত্রণা অপেক্ষা ভয়ই তার মুখে বেশি করে ফুটে উঠছে। একটা রাস্তা পার হয়ে খাড়া উড়াই বেয়ে নামতে নামতে তারা দেখল, কয়েকজন মাটিতে শুয়ে আছে, একদল সৈনিকের সঙ্গেও তাদের দেখা হল, সৈনিকদের কেউ কেউ অক্ষত দেহেই আছে। অনেক কষ্টে শ্বাস টানতে টানতে তারা পাহাড় বেয়ে উঠছে, সেনাপতির উপস্থিতি সত্ত্বেও তারা জোর গলায় কথা বলছে, নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছে। তাদের সামনে ধোয়ার ভিতর দিয়ে সারি সারি ধূসর জোব্বা চোখে পড়ল। একজন অফিসার ব্যাগ্রেশনকে দেখতে পেয়ে পশ্চাদপসরণকারী সৈনিকদের ডাকতে ডাকতে তাদের দিকে ছুটে গিয়ে তাদের ফিরে দাঁড়াবার হুকুম দিল। ব্যাগ্রেশন ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল, এখানে-ওখানে গোলাগুলির শব্দে সৈন্যদের চেঁচামেচি ও হুকুমের শব্দ চাপা পড়ে গেল। বাতাসে ধোয়ার গন্ধ। ধোয়া লেগে সৈনিকদের মুখগুলো কালো হয়ে গেছে। কেউ কামানে বারুদ ভরছে, কেউ শিক দিয়ে বারুদ ঠাসছে, কেউ বা গোলা ছুঁড়ছে, যদিও কাকে লক্ষ্য করে কামান দাগছে, ধোয়ার জন্য সেটাই দেখতে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই একটা মধুর গুঞ্জন ও বুলেটের শনশন শব্দ শোনা যাচ্ছে। সৈন্যদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, এটা কি? এটা তো আক্রমণ হতে পারে না, কারণ সৈনিকরা নড়ছে না, এটা কোনো বাগানও হতে পারে না, কারণ সৈন্যদের সেভাবে জমায়েত করা হয় নি।

রেজিমেন্টের অধিনায়ক একহারা চেহারার দুর্বলদর্শন এক বৃদ্ধ, মুখে স্মিত হাসি, চোখের পাতা নেমে এসে চোখের প্রায় অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে। ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে গিয়ে সে ব্যাগ্রেশনকে স্বাগত জানাল–ঠিক যেন কোনো গৃহস্বামী স্বাগত জানাল তার সম্মানিত অতিথিকে। সে জানাল, ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনী তার রেজিমেন্টকে আক্রমণ করেছিল, সে আক্রমণ এখন প্রতিহত হয়েছে, কিন্তু তার অর্ধেকেরও বেশি সৈন্য যুদ্ধে মারা গেছে। সে মুখে বলল বটে আক্রমণ প্রতিহত হয়েছে, কিন্তু আসলে এই আধ ঘণ্টা সময়ে তার সৈন্যদের কি হাল হয়েছে তা সে নিজেই জানে না, আর আক্রমণ প্রতিহত হয়েছে না কি তার সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়েছে সে কথাও সে নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সে শুধু এইটুকই জানে যে, যুদ্ধের শুরুতে তার রেজিমেন্টের মাথায় গোলাগুলি সমানে উড়তে আরম্ভ করেছিল, আঘাতের পর আঘাত হানছিল, তারপরেই একজন চেঁচিয়ে বলল অশ্বারোহী বাহিনী! আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরাও কামান দাগতে শুরু করে দিয়েছিল। তারা এখনো গোলাগুলি ছুঁড়ছে, কিন্তু অশ্বারোহী বাহিনীকে লক্ষ্য করে নয়, কারণ তারা সরে গেছে, এখন গুলির লক্ষ্য ফরাসি পদাতিক বাহিনী যারা খাদে নেমে আমাদের সৈন্যদের দিকে গুলি ছুড়ছে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন এমনভাবে মাথাটা নিচু করল যেন ঠিক এটাই ছিল তার বাসনা ও প্রত্যাশা। অ্যাডজুটান্টের দিকে ফিরে সে– আদেশ দিল, ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনীকে (Chasseur) এখানে নামিয়ে আনা হোক। এই মুহূর্তে প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের মুখের ভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করে প্রিন্স আল্লু অবাক হয়ে গেল। গ্রীষ্মের দিনে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে শেষ বারের মতো দৌড়বার সময় কোনো লোকের মুখে যে ভাব ফুটে ওঠে সেই সংহত আনন্দিত সিদ্ধান্তের ভাবটি ফুটে উঠেছে তার মুখে। তার মুখে তখন না আছে সেই ঘুমঘুম ভাব, না আছে গভীর চিন্তার প্রকাশ। যদিও তার পদক্ষেপ এখনো ধীর ও মাপা, তবু কোনো কিছুর পর ভয় না রেখেই বাজপাখির মতো স্থির দৃষ্টি মেলে সে সাগ্রহে এবং ঘৃণার সঙ্গে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

রেজিমেন্টের অধিনায়ক প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের দিকে ঘুরে তাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করল, কারণ জায়গাটা খুবই বিপজ্জনক। সে বলল, ঈশ্বরের দোহাই ইয়োর এক্সেলেন্সি, দয়া করে এখানে থাকবেন না! চারদিক থেকে ছুটে আসা বুলেটের হিস-হিস শনশন শব্দের প্রতি তার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল, ওই দেখুন! কোনো ভদ্রলোক তার কুড়লটা হাতে নিলে ছুতোর যে অনুনয় ও তিরস্কারের সুরে বলে, আমরা এতে অভ্যস্ত সাহেব, কিন্তু আপনার হাতে ফোস্কা পড়বে, ঠিক তেমনই সুরে সে কথাগুলি বলল। এমনভাবে বলল যেন বুলেটে তার মৃত্যু হতে পারে না, তার আধবোজা চোখ দুটি বুঝি বা তার কথাগুলিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। স্টাফ-অফিসারও কর্নেলের সঙ্গে সুর মেলাল, কিন্তু ব্যাগ্রেশন কোনো জবাব দিল না, শুধু গোলাবর্ষণ বন্ধ করার হুকুম দিয়ে সৈন্যদের এমনভাবে নতুন করে সাজাতে বলল যাতে নতুন দুটি ব্যাটেলিয়নকে জায়গা করে দেয়া যায়। কথা বলতে বলতেই বাতাসের বেগে ধোয়ার পর্দাটা ডান থেকে বায়ে সরে যেতে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত পর্দাটাকে সরিয়ে দিল, আর বিপরীত দিককার পাহাড়ের উপর ফরাসিদের গতিবিধ চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠল। সৈনিকদের লোমের টুপিগুলি দেখা যাচ্ছে, অফিসার ও সৈনিকদের পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে, দণ্ডের মাথায় পতাকাটিকেও উড়তে দেখা যাচ্ছে।

ব্যাগ্রেশনের দলের একজন বলে উঠল, ওদের মাৰ্চটা চমৎকার।

সেনাদলের মাথার দিকটা ইতিমধ্যেই খাদের মধ্যে নেমে গেছে। খাদের এপাশেই সংঘর্ষ ঘটত…

আমাদের যুদ্ধরত রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সৈন্যরা তাড়াতাড়ি নতুন করে নিজেদের সাজিয়ে নিয়ে ডানদিকে এগিয়ে গেল, পিছন থেকে শৃঙ্খলার সঙ্গে এগিয়ে এল ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনী। বাঁদিক থেকে ব্যাগ্রেশনের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল সেই কোম্পানি কম্যান্ডারটি যে চালাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেনাপতির পাশ দিয়ে যাবার সময় নিজেকে যতদূর সম্ভব করিৎকর্মা লোক হিসেবে প্রমাণিত করাই এই মুহূর্তে তার একমাত্র চিন্তা।

নবাগত ব্যাটেলিয়নের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন বলল, বহুত আচ্ছা, ছেলেরা!

সৈনিকদের ভিতর থেকে একজন বলে উঠল, সাধ্যমতো কাজ করতে পেরে আমরাও খুশি ইয়োর এক্স-লেন-সি! একটি বিমর্ষ সৈনিক মার্চ করতে করতেই ব্যাগ্রেশনের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, আমরাও সেটা জানি! অপর একজন চোখ না ফিরিয়েই মুখটা হাঁ করে জয়ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে গেল।

থেমে গিয়ে কাঁধের গাঁঠরি নামার আদেশ দেয়া হল।

সেনাদলকে ভালো করে দেখে নিয়ে ব্যাগ্রেশন ঘোড়া থেকে নামল। হাতের রাশটা একজন কসাকের হাতে দিয়ে ফেল্ট কোটটা খুলে সেটাও তার হাতে দিল, তারপর পা দুটো টান করে টুপিটা ঠিকমতো মাথায় বসিয়ে নিল। অফিসারবৃন্দ পরিচালিত ফরাসি বাহিনীর মাথার দিকটা পাহাড়ের নিচ থেকে বেরিয়ে এল।

মুহূর্তের জন্য প্রথম সারির দিকে মুখ ফিরিয়ে ব্যাগ্রেশন বলল, আগে বাঢ়! ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন! তারপর দুই হাত ঈষৎ দোলাতে দোলাতে অশ্বারোহীর অদ্ভুত ভঙ্গিতে সে অসমান মাঠের উপর দিয়ে এগিয়ে চলল। প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল, একটি অদৃশ্য শক্তি তাকে সামনের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সে মনে মনে খুব খুশি হল।

ফরাসিরা ইতিমধ্যেই যেন এগিয়ে এসেছে। প্রিন্স আন্দ্রু ব্যাগ্রেশনের পাশে পাশেই হাঁটছে, ফরাসি সৈন্যদের চামড়ার কোমরবন্ধ, তাদের লাল স্কন্ধত্রাণ, এমন কি তাদের মুখগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন আর কোনোরকম হুকুম না দিয়ে সৈন্যদের আগে আগে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। হঠাৎ ফরাসিদের একটার পর একটা গুলি এসে পড়তে লাগল, চারদিক ধোয়ায় ঢেকে গেল, বন্দুকের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। আমাদের কয়েকজন মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু প্রথম গুলি শব্দ শোনামাত্রই ব্যাগ্রেশন চারদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল হুররা!

সৈনিকদের ভিতর থেকেও উঠল তার দীর্ঘায়ত প্রতিধ্বনি হুররা–অ–আ!

ব্যাগেশনকে পার হয়ে তারা মহা উৎসাহে দলে দলে বিশৃঙ্খল শত্রুবাহিনীর দিকে ছুটে চলল।

*

অধ্যায়-১৯

ষষ্ঠ পদাতিক বাহিনীর আক্রমণের ফলে আমাদের ব্যূহের দক্ষিণ প্রান্তবর্তী সৈন্যরা পশ্চাদপসরণের সুযোগ পেল। মাঝখানে তুশিনের যে গোলন্দাজ বাহিনী শোন গ্ৰেবার্ন গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তারা ফরাসিদের অগ্রগতিক বিলম্বিত করে দিল। বাতাসের বেগে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ছে দেখে ফরাসি সৈন্যরা আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আর তার ফলে আমাদের সৈন্যরা পশ্চাদপসরণের সময় পেয়ে গেল। কেন্দ্রস্থ সৈন্যরা অতি দ্রুত খাদের অপর পারে সরে গেল, কিন্তু একদল অন্য দলের সঙ্গে মিশে গেল না। কিন্তু আমাদের বাঁ দিকে আজভ ও পদল পদাতিক বাহিনী এবং পাভলোগ্রাদ অশ্বারোহী বাহিনী লানেসের অধীনস্থ বিরাট ফরাসি বাহিনীর যুগপৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ল। অবিলম্বে পশ্চাদপসরণের হুকুম দিয়ে ব্যাগ্রেশন সেখানে পাঠিয়ে দিল ঝেরকভকে।

টুপি থেকে হাত না সরিয়ে ঝেরকভ ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কিন্তু ব্যাগেশনের কাছ থেকে সরে যেতে না যেতেই তার সাহসে ভাটা পড়ল। ভয় তাকে পেয়ে বসল, বিপদ যেখানে ঘন হয়ে উঠেছে সেখানে যাবার সাহসই তার হল না।

ব্যূহের বাঁ দিকে পৌঁছে সে গোলাগুলির ভয়ে সামনের সারির দিকে না এগিয়ে অধিনায়ক ও তার সহকারীদের যেখানে থাকবার কথা নয় সেখানেই তাদের খুঁজতে লাগল এবং স্বভাবতই সেনাপতির হুকুমটা জানাতেই পাল না। ব্রাউনাউতে কুতুজভ যে রেজিমেন্টটা পরিদর্শন করেছিল এবং যার সঙ্গে যুক্ত ছিল দলখভ, তার অধিনায়কের উপরেই পড়েছে বহের বাঁ দিককার বাহিনীর পরিচালনাভার। কিন্তু বাঁ দিককার একেবারে শেষ প্রান্তবর্তী সেনাদলটির পরিচালনভার পড়েছে পাভলোগ্রাদ রেজিমেন্টের অধিনায়কের উপর, আর সেই রেজিমেন্টেই আছে রস্তভ। ফলে দুই রেজিমেন্টের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টিহল। দুই অধিনায়কই একে অন্যের উপর চটে গেল এবং দক্ষিণ ব্যূহে আক্রমণ চালিয়ে ফরাসিরা যখন বেশ এগিয়ে এসেছে তখনো তারা আলোচনায় মেতে উঠে একে অপরকে আঘাত করতেই ব্যস্ত। অশ্বারোহী এবং পদাতিক কোনো রেজিমেন্টই আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় নি। সাধারণ সৈনিক থেকে অধিনায়ক পর্যন্ত কেউ যুদ্ধের কথা ভাবছেই না, তারা শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে, অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়াদের দানাদানি খাওয়াচ্ছে, আর পদাতিক সৈন্যরা কাঠ যোগাড় করছে।

কিন্তু তখন আর নষ্ট করবার মতো সশয় নেই। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। কামান ও বন্দুক একযোগে দক্ষিণ ও মধ্যভাগে আক্রমণ শুরু করেছে, লানেসের এসে ঘাঁটি গেড়েছে। পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ঘোড়ায় চেপে পাভলোগ্রাদ অধিনায়কের কাছে গেল। দুই অধিনায়কই বিনম্র অভিবাদন জানাল, কিন্তু তাদের মনের মধ্যে তখনো ফুঁসছে গোপন বিদ্বেষ।

অধিনায়ক বলল, আর একবার বলছি কর্নেল, অর্ধেক সৈন্যকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখে আমি এখান থেকে সরে যেতে পারি না। আপনাকে মিনতি করছি, যথাযথভাবে সেনাসমাবেশ করে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হোন।

অশ্বারোহী বাহিনীর জার্মান কর্নেল বিরক্ত হয়ে বলল, আমিও আপনাকে অনুরোধ করছি, যেটা আটনার কাজ নয় তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আপনি যদি অশ্বারোহী বাহিনীতে থাকতেন…

আমি অশ্বারোহী বাহিনীর লোক নই, কিন্তু আমি একজন রুশ অধিনায়ক, আর আপনি যদি এ বিষয়ে

সচেতন না হয়ে থাকে বাহিনীর লোক নই, কিন্তু যদি অশ্বারোহী বাহিৰূপনাকে অনুরোধ করা প্রস্তুত হোন।

ঘোড়ার পিঠে হাত রেখে মুখটা লাল করে কর্নেল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, আমি খুব সচেতন ইয়োর এক্সেলেন্সি। আপনি কি দয়া করে সামনে এগিয়ে একবার নিজের চোখে দেখে আসবেন যে এ জায়গাটা মোটেই ভালো নয়? আপনার সুখের জন্য আমার লোকগুলোকে তো আমি মেরে ফেলতে পারি না।

আপনি নিজেকে ভুলে যাচ্ছেন কর্নেল। আমি নিজের সুখের কতা ভাবছি না, আর সে কথা কেউ বললে তা সহ্য করব না।

কর্নেলের কথাগুলিকে তার সাহসের প্রতি কটাক্ষ বলে ধরে নিয়ে অধিনায়কটি বুক ফুলিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, যেন বুলেটের ভিতর দিয়েই তাদের বিরোধের মীমাংসা হবে। দুজনই সামনের সারিতে পৌঁছে গেল, কয়েকটা বুলেটও তাদের উপর দিয়ে উড়ে গেল। নীরবেই তারা থামল। সেখান থেকে নতুন কিছু দেখবর ছিল না, কারণ ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ও অসমান জমিতে অশ্বারোহীদের পক্ষে কিছু করা অসম্ভব, তাছাড়া ফরাসিরা বাঁ দিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। সংঘর্ষের জন্য অপেক্ষমাণ দুটো লড়াইয়ে মোরগের মতো অধিনায়ক ও কর্নেল অর্থপূর্ণ কঠোর দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকাল, বৃথাই একে অন্যের চোখে ভীরুতার চিহ্ন খুঁজতে লাগল। দুজনই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। কারো কিছু বলার নেই, গুলির পাল্লার ভিতর থেকে আগে সরে যাবার অপবাদ কেউ মাথায় নিতে রাজি নয়, কাজেই একজন অপরজনের সাহসকে পরীক্ষা করার জন্য তারা হয়তো দীর্ঘ সময় সেখানেই অপেক্ষা করে থাকত, কিন্তু ঠিক সেই সময় তাদের পিছনে জঙ্গলের ভিতর থেকে বন্দুকের গুলির আওয়াজ ও একটা হল্লার শব্দ কানে এল। যে সৈন্যরা জঙ্গলের মধ্যে কাঠ যোগাড় করছিল ফরাসিরা তাদের আক্রমণ করেছে। পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করা এখন আর হুজার-বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। ফরাসির বাঁ দিক থেকে এসে তাদের পশ্চাদপসরণের পথটা কেটে দিয়েছে। জায়গাটা ঘাঁটি হিসেবে যতই অসুবিধাজনক হোক না কেন, নিজেদের বেরিয়ে যাবার একটা পথ করে নেবার জন্য এখন আক্রমণ করতেই হবে।

রস্তভ যে অশ্বারোহী সেনাদলের সঙ্গে যুক্ত তারা ঘোড়ায় চড়ারও সময় পেল না, তার আগেই তাদের শত্রু সৈন্যের মুখোমুখি হতে হল। এনস সেতুর মতোই আর একবার এই সেনাদল ও শত্রুপক্ষের মধ্যে আর কোনো বাধাই নেই, আর একবার তাদের মাঝখানে আছে শুধু অনিশ্চয়তা ও ভয়ের এক ভয়ংকর সীমারেখা-জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সীমারেখারই মতো। সেই অদৃশ্য সীমারেখার কথা সকলেই জানে, সে সীমারেখা পার হবে কি হবে না, এবং কেমন করেই বা পার হবে, এই চিন্তাই তাদের বিচলিত করে তুলেছে।– ঘোড়া ছুটিয়ে কর্নেল সকলের সামনে এগিয়ে গেল, সক্রোধে অফিসারদের প্রশ্নের জবাব দিল এবং একগুয়ে লোকের মতো একটা হুকুম জারি করল। মুখে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলল না, কিন্তু আক্রমণের গুজব সেনাদলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। শ্রেণীবদ্ধ হবার হুকুম ঘোষিত হল, আর কোষমুক্ত তরবারি ঝনঝনিয়ে উঠল। তবু কেউ এগিয়ে গেল না। পদাতিক ও হুজার বাম প্রান্তের সকল সৈন্যই বুঝতে পারছে যে অধিনায়ক নিজেই জানে না কি করতে হবে, তার এই অস্থির মানসিকতা সৈনিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।

এতকাল হুজার-বন্দুকের মুখে প্রত্যক্ষ আক্রমণের আনন্দময় অভিজ্ঞতার যেসব কথা সে শুনে এসেছে এই প্রথম সে সুযোগ তার সামনে এসেছে এ কথা মনে করে রস্তভ ভাবল, এরা যদি আর একটু তাড়াতাড়ি করত!

দেনিসভের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হল, এগিয়ে যাও! ঈশ্বর তোমাদের সহায় বাছারা! এগিয়ে যাও কদমে!

সামনে ডান দিকে তাকিয়ে রস্তভ তার হুজারদের প্রথম সারিটা দেখতে পেল, আরো সামনে একটা কালো রেখা চোখে পড়লেও সেটাকে সে পরিষ্কার দেখতে পেল না, তবু সেটাকেই শত্রুপক্ষের সৈন্য বলে ধরে নিল। গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, তবে বেশ কিছুটা দূর থেকে।

হুকুম হল আরো জোরে! রস্তভ সবেগে আর ঘোড়া রুককে কদমে ছুটিয়ে দিল।

ঘোড়ার তীব্র গতিবেগ রস্তভকে ক্রমেই উল্লসিত করে তুলল। তার সামনে একটা নির্জন গাছ ছিল। যে রেখাটা অত্যন্ত ভয়ংকর মনে হয়েছিল গাছটা ছিল তার ঠিক মাঝখানে–এবার সেই গাছটাকে সে পেরিয়ে গেল, সেখানে ভয়ংকর কিছু তো চোখে পড়লই না, বরং সমস্ত কিছুই ক্রমেই আরো আনন্দময় ও উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হতে লাগল। তরবারির হাতল চেপে ধরে রস্তভ ভাবল, আঃ, তাকে একখানা মারা যা মারব!

হুররা-আ-আ-আহ! বহু কণ্ঠের গর্জন উঠল। আসুক না কেউ আমার সামনে-এই কথা ভেবে রস্তভ জোর কদমে রুককে ছুটিয়ে অন্য সকলকে ছাড়য়ে চলে গেল। সামনে শত্রুপক্ষকে এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সহসা বাৰ্চগাছের ঝাটার মতো একটা কিছু সৈন্যদলের মাথার উপর দিয়ে উড়ে এল। রস্তভ আঘাত করার জন্য তরবারি তুলল, কিন্তু সেই মুহূর্তে অশ্বারোহী নিকিতেংকো তীরগতিতে তাকে ছাড়িয়ে চলে গেল, আর রস্তভের মনে হল স্বপ্নের ঘোরে সে যেন অস্বাভাবিক ক্ষিপ্র গতিতে সম্মুখে ছিটকে এগিয়ে গেল, অথচ যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। আর এক পরিচিত হুজার বন্দারচুক পিছন থেকে এসে তার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। বন্দারচুকের ঘোড়া পাশ কাটিয়ে জোর কদমে ছুটে গেল।

একি? আমি এগোচ্ছি না কেন? আমি পড়ে গেছি, আমি মরে গেছি! প্রশ্ন করে রস্তভ নিজেই সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব দিল। মাঠের মধ্যে সে একা। চলন্ত আর খড়ের নাড়া। তার বগলের নিচে গরম রক্তের স্পর্শ।

, আমি আহত হয়েছি, আর আমার ঘোড়াটা মারা গেছে। সামনের পায়ে ভয় দিয়ে রুক উঠে দাঁড়াতে চেষ্ট করল, কিন্তু সওয়ারের পায়ের উপর চেপে পড়ে গেল। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে, অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু উঠতে পারল না। রস্তভও উঠতে চেষ্টা করল, কিন্তু পড়ে গেল, তার তরবারির চামড়ার কোষ ঘোড়ার জিনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৈন্যরা কোথায় আছে, কোথায়ই বা আছে ফরাসিরা, সে কিছুই জানে না। কাছাকাছি কেউ কোথাও নেই।

পাটা ছাড়িয়ে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কোথায় কোনদিকে সেই রেখাঁটি যা দুটি বাহিনীকে পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে? সে প্রশ্ন করল, কিন্তু জবাব দিতে পারল না। আমার কি খারাপ কিছু হয়েছে? উঠে দাঁড়িয়ে সে ভাবল, আর সেই মুহূর্তে তার মনে হল, তার অবশ বাঁ হাত থেকে একটা অপ্রয়োজনীয় কিছু ঝুলছে। মনে হল, কব্জিটা বুঝি তার নিজের নয়। হাতটা ভালো করে দেখল, কিন্তু তাতে রক্তের দাগ দেখতে পেল না। কিন্তু লোককে তার দিকে দৌড়ে আসতে দেখে সে সানন্দে ভাবল, আঃ, ওই তো লোকজন আসছে। ওরা আমাকে সাহায্য করবে। প্রথমে এগিয়ে গেল শাকো টুপি ও নীল জোব্বা পরা একটি লোক, মোটাসোটা শরীর, রোদে পোড়া মুখ, বাঁকা মুখ, বাঁকা নাক। পরে আরো দুজন এল, তাদের পিছনে আরো অনেকে দৌড়ে এল। তাদের একজন অদ্ভুত কিছু বলল, ভাষাটা অবশ্যই রুশ নয়। পিছনদিকার শাকো পরিহিত আরো অনেকের মধ্যে একজন রুশ হুজারও রয়েছে। দুই হাত ধরে তাকে নিয়ে আসা হচ্ছে, তার ঘোড়াটাকেও পিছনে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।

ও নিশ্চয়ই আমাদের কেউ, বন্দি হয়েছে। হ্যাঁ তাহলে এরা কি আমাকেও বন্দি করবে? এরা কারা? রস্তভ ভাবতে লাগল, নিজের চোখ সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওরা কি ফরাসি? সে আর একবার এগিয়ে-আসা ফরাসিদের দিকে তাকাল। ওরা কারা? ওরা ছুটে আসছে কেন? ওরা কি আমার দিকে আসছে। কিন্তু কেন? আমাকে মেরে ফেলতে? অথচ আমাকে তো সকলেই কত ভালোবাসে? মায়ের ভালোবাসা, পরিবারের লোকজনদের ভালোবাসা, বন্ধুদের ভালোবাসার কথা তার মনে পড়ল, তার মনে হল, শত্রুপক্ষ তাকে মেরে ফেলতে চাইবে এটা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু হয়তো তাই তারা করবে! পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে দশ সেকেন্ডেরও বেশি সময় সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। বাঁকা-নাক ফরাসিটি ততক্ষণে এত কাছে এসে পড়েছে যে তার মুখের ভার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। লোকটির উত্তেজিত বিরূপ মুখ, পাশে ঝোলানো বেয়নেট, তার রুদ্ধশ্বাস গতি-এসব দেখে রস্তভ ভয় পেল। সে পিস্তলটা চেপে ধরল, কিন্তু গুলি না করে সেটাকে ফরাসি লোকটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে জঙ্গলের দিকে ছুটে গেল। এনস সেতু ধরে দৌড়বার সময় তার মনে যে সন্দেহ ও সংঘাত ছিল এখন সেসবের কিছুই নেই, এখন সে ছুটছে শিকারি কুকুরের তাড়া খাওয়া খরগোসের মতো। শুধুমাত্র নিজের সুখী তরুণ জীবনকে হারাবার আতঙ্কই তার সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সে প্রাণপণে মাঠ ভেঙে ছুটছে আর মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। তার শরীরের ভিতর দিয়ে ত্রাসের একটা শিহরণ বয়ে গেল, না, পিছনে না তাকানোই ভালো। তবু জঙ্গলের কাছে পৌঁছে সে আর একবার পিছন ফিরে তাকাল। ফরাসিরা পিছিয়ে পড়েছে, সকলের আগের লোকটি দৌড়ানোর বদলে এবার হাঁটতে শুরু করেছে, মুখ ফিরিয়ে চিৎকার করে আরো পিছনের জনৈক সহকর্মীকে সে যেন কি বলল। রস্তভ থামল। ভাবল, না তো, কিছু ভুল হয়েছে। ওরা আমাকে খুন করতে চায় নি। কিন্তু সেইসঙ্গে তার এটাও মনে হল যে তার বাঁ হাতটা এত ভারি বোধ হচ্ছে যেন একটা পাঁচ স্টোন ওজনের বোঝা তাতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সে আর দৌড়াতে পারছে না। ফরাসিরাও থেমে গিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বন্দুক তুলল। রশুভ চোখ বুজে উপুড় হল। প্রথমে একটা বুলেট, তারপর আর একটা হিস করে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। অবশিষ্ট শক্তিতে ভর করে ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতটাকে চেপে ধরে সে জঙ্গলে পৌঁছে গেল। তার ঠিক পিছনেই আছে কিছু রুশ বন্দুকধারী।

*

অধ্যায়-২০

যেসব পদাতিক সেনাদল জঙ্গলের বহিঃপ্রান্তে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়েছিল তারা ছুটে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, বিভিন্ন কোম্পানির সৈন্য একসঙ্গে মিশে গিয়ে বিশৃঙ্খলভাবে পশ্চাদপসরণ করেছে। একটি সৈন্য আতংকে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি! রণক্ষেত্রে এ আতংক বড় সাংঘাতিক, অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ল সব সৈন্যদের মনে।

আমাদের ঘিরে ফেলেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি! আমাদের সর্বনাশ উপস্থিত! পলায়নপর সৈন্যরা চিৎকার করতে লাগল।

পিছন থেকে গুলির শব্দ ও চিৎকার কানে আসা মাত্রই সেনাপতি বুঝতে পারল তার রেজিমেন্টে একটা ভয়ংকর কিছু ঘটেছে, সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, অনেক বছর ধরে অফিসার হিসেবে তার কার্যকলাপ একটি দৃষ্টান্তস্থল, তার কোনো কাজে কখনো কোনো ত্রুটি হয় নি, অথচ এবার হয়তো কর্তব্যে অবহেলা বা অযোগ্যতার দরুণ হেড-কোয়ার্টারে তাকেই দোষী করা হবে। এই চিন্তা তাকে এতই বিচলিত করে তুলল যে অশ্বারোহী বাহিনীর অবাধ্য কর্নেলের কথা ভুলে গিয়ে, সেনাপতি হিসেবে স্বীয় মর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে, এমনকি সমূহ বিপদ ও আত্মরক্ষার কথা পর্যন্ত ভুলে গিয়ে সে তার রেজিমেন্টের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। চারদিকে মুষলধারে গুলিবর্ষণ চলছে, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কোনো গুলিই তার গায়ে লাগে নি। তার একমাত্র বাসনা প্রকৃত অবস্থা জেনে নিয়ে নিজের কোনো ভুল হয়ে থাকলে তাকে সংশোধন করা বা তার প্রতিকার করা, যাতে বাইশ বছরের চাকরি জীবনে যে কখনো নিন্দিত হয় নি সেই অফিসার হয়েও তাকে কোনোরকম দোষের ভাগী না হতে হয়।

ফরাসিদের ভিতর দিয়ে নিরাপদে ঘোড়া ছুটিয়ে সে জঙ্গলের পশ্চাদবর্তী একটা মাঠে পৌঁছে দেখল, সব হুকুমকে উপেক্ষা করে সৈন্যরা ছুটছে, উপত্যকার দিকে নেমে যাচ্ছে। সে নৈতিক সংকল্প-শিথিলতা একটা যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে সেই মুহূর্তটা সমাসন্ন। এই বিশৃঙ্খল সৈন্যরা কি তাদের অধিনায়কের কথা শুনবে, না কি তাকে উপেক্ষা করেই পালাতে থাকবে তার অবিরাম চিৎকার, তার কুদ্ধ, বিকৃত, রক্তাভ মুখছবি, হাতের কোষমুক্ত উদ্যত তরবাদি–সবকিছু সত্ত্বেও সৈনিকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে সব হুকুম অমান্য করে পালাতেই থাকল। যুদ্ধের ভাগ্য-নির্ধারক নৈতিক সংকল্প-শিথিলতা পরিণত হয়েছে সর্বগ্রাসী আতংকে।

অবিরাম চিৎকার ও বারুদের ধোয়ার ফলে কাশতে কাশতে সেনাপতি হতাশ হয়ে থেমে গেল। সবই বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আক্রমণকারী ফরাসিরা হঠাৎ যেন বিনা কারণেই পশ্চাদপসরণ করে জঙ্গলপ্রান্ত থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একদল বন্দুকধারী। এরা তিমোখিনের অধীনস্থ সেনাদল, একমাত্র এরাই জঙ্গলের মধ্যে সুশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল এবং একটা নালার মধ্যে আত্মগোপন করে থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে ফরাসিদের উপর আক্রমণ হেনেছে। একখানি মাত্র তরবারি হাতে নিয়ে তিমোখিন এমন বেপয়োরা চিৎকার ও উন্মত্ত সংকল্পের সঙ্গে শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে যে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে ফরাসিরা বন্দুক ফেলেই পালিয়েছে। তিমোখিনের পাশে ছুটে গিয়ে দলখভ খুব কাছে থেকে একজন ফরাসিকে হত্যা করল এবং আত্মসমর্পণকারী ফরাসি অফিসারের কলার চেপে ধরল। আমাদের পলায়নপর সৈন্যরা ফিরে এল, ব্যাটেলিয়নগুলিকে নতুন করে সাজানো হল, আর যে ফরাসিরা আমাদের বা দিককার বৃহটাকে প্রায় ভেদ করে ফেলেছে তাদের তখনকার মতো পর্যদস্ত করা হল। আমাদের সংরক্ষিত সেনাদলও এসে যোগ দিল, যুদ্ধ শেষ হল। রেজিমেন্ট-কমান্ডার ও মেজর একনমভের দিকে মুখ ফেরাল।

দলখভ কিন্তু চলে গেল না, মাথায় বাঁধা রুমালখানার গিট খুলে নামিয়ে নিয়ে চুলের ভিতর জমাট-বাঁধা রক্তের তাহ দেখাল।

বেয়নেটের আঘাত। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম। মনে রাখবেন ইয়োর এক্সেলেন্সি!

তুশিনের গোলন্দাজ বাহিনীর কথা সকলেই ভুলে গিয়েছিল, যুদ্ধের একেবারে শেষকালে তখনো ব্যূহের মধ্যভাগে কামান-গর্জনের শব্দ শুনে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন প্রথমে স্টাফ-অফিসার ও পরে প্রিন্স আন্দুকে পাঠিয়েছিল তার সৈন্যগণকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পশ্চাদপসরণের হুকুম জানাতে। তুশিনের কামানগুলোর রক্ষক সৈনিকদের যখন কারো হুকুমে ব্যূহের মধ্যভাগে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল, তখনো কামানগুলো থেকে সমানে গোলা ছোঁড়া চলতে লাগল। তাদের বন্দি করা দূরে থাক, ফরাসিরা ভাবতেই পারে নি যে সম্পূর্ণ অরক্ষিত চারটি কামান থেকে গোলাবর্ষণের দুঃসাহস কারো হতে পারে। উপরন্তু তাদের গোলাবর্ষণের রকম দেখে ফরাসিরা ধরে নিয়েছিল যে এখানে-ব্যহের মধ্যভাগে-মূল রুশ সেনাপতির সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। দুবার তারা এই অংশটার উপর আঘাত হানবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাহাড়ের উপরকার চারটিমাত্র কামানোর ছররা গোলার আঘাতে প্রতিবারই প্রতিহত হয়ে ফিরে গেছে।

প্রিন্স ব্যাগ্রেশন তাকে ছেড়ে যাবার পরেই তুশিন শোন গ্রেবার্নে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

দেখ, ওরা ছুটে পালাচ্ছে। গ্রামটা জ্বলছে! ওই দেখ ধোয়া! চমৎকার! সাবাস! ওই দেখ ধোয়া, ধোঁয়া! মহা উৎসাহে গোলন্দাজরা চিৎকার করে উঠেছিল।

হুকুমের জন্য অপেক্ষা না করেই সবগুলো কামান থেকে সেই জ্বলন্ত গ্রাম লক্ষ্য করে গোলা ছোঁড়া অপেক্ষা না করেই সবগুলো কামান থেকে সেই জ্বলন্ত গ্রাম লক্ষ্য করে গোলা ছোঁড়া চলতে লাগল। প্রতিটি গোলার সঙ্গে সঙ্গেই একজন সৈনিক অপর জনকে লক্ষ্য করে বলে উঠল : সুন্দর! খুব ভালো!…তাকিয়ে দেখ।…চমৎকার! বাতাসে ভর করে আগুন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল। যে ফরাসি সেনাদলটি গ্রাম ছাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল তারা ফিরে গেল, কিন্তু হয় তো এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্যই শত্রুপক্ষ দশটা কামানকে গ্রামের ডান দিকে বসিয়ে তুশিনের কামান লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়তে লাগল।

দুর্বল পায়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ছুটে ছুটে ছোট্ট তুশিন বারবার আর্দালিকে বলছে, আমার পাইপটায় তামাক ভরে দাও, তারপর পাইপ থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে ছোট হাতটা চোখের উপর তুলে ফরাসিদের দিকে দৃষ্টি রেখে সে সামনে ছুটে গেল। কামানের চাকা চেপে ধরে নিজেই ইস্ক্রপ ঘুরিয়ে বলতে লাগল, পেটাও হে। বাছারা, পেটাও!

এমন সময় তার মাথার উপর থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর হাঁক দিল : ক্যাপ্টেন তুশিন! ক্যাপ্টেন!

তুশিন ঘুরে দাঁড়াল। এ সেই স্টাফ-অফিসারের কণ্ঠস্বর যে তাকে গ্রন্থের ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। ধরা গলায় সে হাঁক দিয়ে বলল :

আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আপনাকে দুবার পিছিয়ে যেতে বলা হয়েছে, আর আপনি…

ঊর্ধ্বতন অফিসাকে দেখতে পেয়ে তুশিন সভয়ে ভাবল : এরা আমাকে নিয়ে পড়ল কেন?

দুটো আঙুল টুপি পর্যন্ত তুলে সে তো-তো করে বলল, আমি…জানতাম না…আমি…

কিন্তু স্টাফ-অফিসার তার বক্তব্য শেষ করতে পারল না, একটা গোলা খুব কাছ দিয়ে উড়ে আসায় সে ঘোড়ার পিঠেই মাথা নামিয়ে গোলাটাকে এড়িয়ে গেল। একটু থেমে আবার কিছু বলবার চেষ্টা করতেই আর একটা গোলা এসে তাকে থামিয়ে দিল। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সে কদমে ছুটল।

দূর থেকে হাঁক দিল, পিছিয়ে এস! সকলে পিছিয়ে এস!

সৈন্যরা হেসে উঠল। মুহূর্তকাল পরে সেই একই হুকুম নিয়ে এল জনৈক অ্যাডজুটান্ট।

প্রিন্স আন্দ্রু তুশিনের কামানগুলো যেখানে বসানো ছিল সেখানে পৌঁছে প্রথমেই তার চোখে পড়ল, জিন খোলা পা-ভাঙা একটা ঘোড়া মাটিতে পড়ে কাতড়াচ্ছে। তার পা থেকে ফোয়ারার মতো রক্ত বেরুচ্ছে। কামান-শকটগুলোর মাঝে মাঝে কয়েকজন মরে পড়ে আছে। একটার পর একটা গোলা ছুটে যাচ্ছে, তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ নেমে গেল। কিন্তু ভয়ের চিন্তাই তাকে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে তুলল। আমি ভয় পেতে পারি না এই কথা ভেবে সে ধীরে ধীরে ঘোড়া থেকে নামল। হুকুম জারি করেও সেখান থেকে নড়ল না। স্থির করল, সে উপস্থিত থেকেই কামানগুলিকে সেখান থেকে সরিয়ে বসাবার ব্যবস্থা করবে। ফরাসিদের প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যে তুশিনকে সঙ্গে নিয়ে সে কামানগুলি সরাবার কাজের তদারিক করতে লাগল।

জনৈক গোলন্দাজ প্রিন্স আন্দুকে বলল, একজন স্টাফ-অফিসার এক মিনিট আগে এখানে এসেই পালিয়ে গেছেন। তিনি আপনার মতো নন!

প্রিন্স আন্দ্রু তুশিনকে কিছুই বলল না। দুজনই এত ব্যস্ত যে কেউ কারো দিকে নজরই দিচ্ছে না। চারটি কামানের মধ্যে অক্ষত দুটোকে ঠিকমতো বসিয়ে তারা পাহাড় বেয়ে নামতে লাগল। তখন প্রিন্স আন্দ্রু ঘোড়া ছুটিয়ে তুশিনের কাছে গেল।

তুশিনের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা, আবার দেখা হবে…

তুশিন বলল, বিদায় বন্ধু। বিদায় হে প্রিয় বন্ধু। কি এক অজ্ঞাত কারণে তার দুই চোখ হঠাৎ জলে ভরে গেল।

*

অধ্যায়-২১

বাতাস পড়ে গেছে, কালো মেঘের দল বারুদের ধোয়ার সঙ্গে মিশে যুদ্ধক্ষেত্রের দিগন্তের উপর নিচু হয়ে ঝুলে আছে। অন্ধকার হয়ে আসছে, দুটো অগ্নিকান্দ্রে আলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কামনের গর্জন ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পিছনে ও ডান দিকে মাঝে মাঝেই বন্দুকের শব্দ ক্রমেই কাছে শোনা যাচ্ছে। গুলির পাল্লায় বাইরে চলে গিয়ে তুশিন খাদের মধ্যে নেমে গেল, আর সেখানেই স্টাফ-অফিসার ও ঝেরকভের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। তাদের দুজনকেই দুবার তুশিনের কামানের কাছে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছতে পারে নি। যে পদাতিক অফিসারটি যুদ্ধের ঠিক আগে তুশিনের চালাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল, পেটে বুলেটবিদ্ধ হয়ে সে এখন একটা কামান-শকটে শুয়ে আছে। পাহাড়ের পাদদেশে এক হাত দিয়ে আর একটা হাত চেপে ধরে জনৈক। বিবর্ণ হুজারশিক্ষার্থী তুশিনের কাছে এসে একটা আসনের জন্য প্রার্থনা জানাল।

ভীরু গলায় বলল, ঈশ্বরের দোহাই ক্যাপ্টেন! আমার হাতে আঘাত লেগেছে। ঈশ্বরের দোহাই…আমি হাঁটতে পারছি না। ঈশ্বরের দোহাই।

বোঝা গেল, শিক্ষার্থীটি গাড়িতে একটা জায়গার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিফল হয়েছে। তাই সকরুণ ইতস্তত গলায় সে অনুরোধ করছে।

ঈশ্বরের দোহাই, ওদের বলুন আমাকে একটু জায়গা দিতে।

তুশিন বলল, ওকে একটা আসন দাও। বসবার জন্য একটা জোব্বা বিছিয়ে দাও। আহত অফিসারটি কোথায়?

তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি মারা গেছেন, কে যেন জবাব দিল।

ওকে উঠতে সাহায্য করো। বসে পড়ো বাপু, বসে পড়ো। আন্তনভ, জোব্বাটা বিছিয়ে দাও।

শিক্ষার্থীটি রস্তভ। এক হাত দিয়ে আর একটা হাত ধরে আছে, মুখটা ফ্যাকাশে, চোয়াল কাঁপছে, সারা শরীরে যেন জ্বরের খিচুনি। মৃত অফিসারকে যে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল সেখানেই তাকে জায়গা দেয়া হল। জোব্বাটা রক্তে ভিজে থাকায় তার ব্রিচেস ও হাতে রক্তের ছোপ লাগল।

রস্তভের দিকে এগিয়ে এসে তুশিন বলল, আরে, তুমিও আহত হয়েছ নাকি বাপু?

না, একটু মচকে গেছে।

তাহলে কামান শকটে এ রক্ত কিসের? তুশিন জিজ্ঞেস করল।

কোটের আস্তিন দিয়ে রক্তটা মুছে দিয়ে গোলন্দাজ সৈনিকটি বলল, ইয়োর অনার, সেই অফিসারটির শরীর থেকে রক্ত পড়েছে।

পদাতিক বাহিনীর সহায়তায় কামানগুলোকে উপরে ঠেলে তুলে গ্রুার্সদ গ্রামে পৌঁছে তারা থামল। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে, দশ পা দূরের সৈনিককেও দেখা যাচ্ছে না, গুলির শব্দও মিলিয়ে আসছে। সহসা ডান দিকে খুব কাছে পুনরায় হৈচৈ ও গুলির শব্দ শোনা গেল। অন্ধকারে দেখা গেল গুলির ঝিলিক। এটাই ফরাসিদের শেষ আক্রমণ, গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে যে সৈনিকরা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই সে আক্রমণের মোকাবিলা করল। তারা আবার গ্রাম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল, কিন্তু তুশিনের কামানের চাকা অচল হয়ে পড়েছে, তাই গোলন্দাজ সৈনিকরা, তুশিন ও শিক্ষার্থীটি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করে রইল। গুলির শব্দ থেমে গেল, সাগ্রহে কথা বলতে বলতে সৈনিকরা গলি পথ থেকে ছুটে বেরিয়ে এল।

তুমি আঘাত পাওনি তো পেত্রভ? একজন জিজ্ঞেস করল।

আরে বাবা, আচ্ছা ঠেঙানি ওদের দিয়েছি। ওরা আর এদিকে পা বাড়াবে না, একজন একজন বলল।

একটা জিনিস তোমরা দেখনি। নিজেদের দিকেই ওরা কীরকম গুলি ছুড়ছিল। কিছুই তো দেখা যাচ্ছিল । গাঢ় অন্ধকার রে ভাই! গলা ভেজাবার কিছু আছে কি?

ফরাসিদের আক্রমণ শেষবারের মতো প্রতিহত হল। গল্পত পদাতিকবাহিনী পরিবৃত হয়ে তুশিনের কামানগুলো একটু একটু করে সামনে এগোতে লাগল।

অন্ধকারে সকলে এগিয়ে চলল। মনে হল, ফিসফিস গুঞ্জন ও ঘোড়র ক্ষুর ও গাড়ির চাকার শব্দের সঙ্গে একটা অদৃশ্য বিষণ্ণ নদী যেন একই দিকে বয়ে চলেছে। তারই মধ্যে শোনা যাচ্ছে আহতদের আর্তনাদ ও কণ্ঠস্বর। কিছুক্ষণ পরে সেই চলমান জনতা বিচলিত হয়ে উঠল, সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে কে একজন সদলে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল, যেতে যেতেই বলল : তিনি কী বললেন? এখন কোনো দিকে? বিরতি কি? তিনি কি আমাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন? নানা দিক থেকে এমনি সব সাগ্রহ প্রশ্ন শোনা গেল। চলমান জনতা ক্রমেই কাছাকাছি এগিয়ে এল, একটা সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে তাদের যাত্রাবিরতির হুকুম জারি হয়েছে, সামনের সারির সৈনিকরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। কর্দমাক্ত রাস্তার মাঝখানে যে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল।

আগুন জ্বালানো হয়েছে। কথাবার্তা আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সৈন্যদের যথাযথ নির্দেশাদি দিয়ে ক্যাপ্টেন তুশিন একজন সৈনিককে পাঠাল শিক্ষার্থীটির জন্য কোনো ড্রেসিং স্টেশন অথবা ডাক্তারের খোঁজে। তারপর রাস্তার উপরে সৈন্যরা যেখানে আগুন জ্বেলেছে সেইখানে গিয়ে বসল। রস্তভও নিজেকে টেনে নিয়ে সেখানেই গেল। যন্ত্রণায়, ঠাণ্ডায় ও স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়ায় তার সারা শরীর কাঁপছে। একটা অনিবার্য তন্দ্রার ভাব যেন তাকে পেয়ে বসেছে, শুধু বাহুতে একটা সঁচ বেঁধার মতো যন্ত্রণায় ফলেই সে জেগে আছে, হাতটাকে কোনোভাবে রেখেই স্বস্তি হচ্ছে না। একবার চোখ বুজছে, আবার আগুনের দিকে ও তুশিনের চাওড়া কাঁধ মূর্তির দিকে তাকাচ্ছে। তুশিনের বুদ্ধিদীপ্ত দুট বড় বড় চোখ সহানুভূতি ও সমবেদনায় রস্তভের উপর নিবদ্ধ, রস্তভও বুঝতে পারছে যে সমস্ত অন্তর দিয়ে তুশিন তাকে সাহায্য করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না।

চারদিকেই পদাতিকবাহিনীর পায়ের শব্দ ও আলোচনা শোনা যাচ্ছে, তারা কেউ হাঁটছে, কেউ ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ বসে আছে। নানা কণ্ঠস্বর, কাদার ভিতর দিয়ে চলমান ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ, জ্বলন্ত কাঠের ফটফট আওয়াজ–সব মিলেমিশে একটা ঐকতান গড়ে তুলেছে।

সেনাদলকে এখন আর অন্ধকারে একটি অদৃশ্য প্রবহমান নদী বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে, একটা উদ্বেলিত অন্ধকার সমুদ্র ঝড়ের পরে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। রস্তভ উদাসীনভাবে চারদিকে তাকাল, কান পেতে সবকিছু শুনতে লাগল। একটি পদাতিক সৈন্য আগুনের কাছে এসে গোড়ালির উপর বসে আগুনের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

তুশিনকে বলল, কিছু মনে করছেন না তো ইয়োর অনার? আমার কোম্পানিটা হারিয়ে ফেলেছি। কোথায়

যে আছে তাও জানি না…মন্দ ভাগ্য আর কি!

সৈনিকটির সঙ্গে গালে ব্যান্ডেজ-বাঁধা একটি পদাতিক অফিসারও আগুনের কাছে এসে তুশিনকে বলল, কামানগুলোকে একটু সরিয়ে তাদের গাড়িটাকে যাবার মতো জায়গা যেন করে দেওয়া হয়। তারা চলে যাবার পরে দুটি সৈন্য আগুনের কাছে ছুটে এল। দুজনই একটা বুটকে চেপে ধরে সেটাকে ছিনিয়ে নেবার জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করছে।

তুমি এটা কুড়িয়ে পেয়েছ?…আমি বলছি! তুমি খুব চালাক! একজন কর্কশগলায় চেঁচিয়ে বলল।  তারপরই রক্তাক্ত পায়ের পট্টি দিয়ে গলায় ব্যান্ডেজবাধা একটি ফ্যাকাশে, শুটকো সৈনিক এসে রাগত গলায় গোলন্দাজ সৈন্যদের কাছে পানি চাইল, বলল, এইভাবে কুকুরের মতো মরতে হবে না কি?

তুশিন লোকটিকে ঝল দিতে বলল। তারপর একটি হাসি খুশি সৈনিক এসে পদাতিক বাহিনীর জন্য একটা আগুন চাইল।

একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে অন্ধকারে যেতে যেতে সে বলল, পদাতিক বাহিনীর জন্য সুন্দর একটা জ্বলন্ত মশাল পেয়েছি। আগুনের জন্য ধন্যবাদ-সুদসমেত একদিন ফিরিয়ে দেব।

তারপর একটা জোব্বার উপরে ভারি কিছু বয়ে নিয়ে চারটি সৈনিক আগুনের পাশ দিয়ে চলে গেল। একজন হোঁচট খেল।

কোনো শয়তান পথের মাঝখানে কাঠ ফেলে রেখেছে সে খেঁকিয়ে উঠল।

এ তো মরে গেছে–কেন বয়ে নিয়ে যাচ্ছি? আর একজন বলল।

থাম!

বোঝা নিয়ে তারা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তুশিন ফিসফিস করে রস্তভকে বলল, এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে?

হ্যাঁ।

একজন গোলন্দাজ এসে তুশিনকে বলল, ইয়োর অনার, সেনাপতি আপনাকে ডাকছেন। তিনি ওই কুঁড়ে ঘরে আছেন।

যাচ্ছি বন্ধু।

তুশিন উঠল, গ্রেট-কোটের বোম লাগিয়ে শরীরটাকে টান টান করে আগুনের কাছ থেকে চলে গেল।

গোলন্দাজ বাহিনীর জ্বালানো আগুনের অনতিদূরে প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের জন্য একটা কুঁড়েঘর তোলা হয়েছে। সেখানেই সে ডিনারে বসেছে, সমাগত কয়েকজন অধিনায়ক অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে। ছোটখাট বৃদ্ধটি চোখ অর্ধেক বুজে সাগ্রহে একটা হাড় চিবুচ্ছে, বাইশ বছর ধরে নিখুঁতভাবে চাকরি করা সেনাপতিটি এক গ্লাস ভদকা খেয়ে লাল হয়ে উঠেছে, সেখানে আর আছে মোহরাঙ্কিত আংটি হাতে স্টাফ-অফিসারটি, ঝেরকভ অস্বস্তির সঙ্গে সকলকে দেখছে, প্রিন্স আন্দ্রু ঝকঝকে চোখ মেলে ঠোঁট দুটো চেপে ধরেছে।

ঘরের কোণে দাঁড় করানো রয়েছে ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করা একটা পতাকা, সরল-মুখ হিসাবরক্ষকটি হাত দিয়ে সেটার বুনট পরীক্ষা করে দেখে বিচলিতভাবে ঘাড় নাড়তে লাগল–হয়তো পতাকাটা তার ভালো লেগেছে, হয়তো নিজে ক্ষুধার্ত হয়েও চিনারে অংশ নিতে না পারায় সেই সব ভোজ্যদ্রব্য দেখা তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। পাশের কুঁড়ে ঘরে আছে একজন বন্দি ফরাসি কর্নেল। আমাদের অফিসাররা সেখানে ভিড় করেছে। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন প্রতিটি অধিনায়ককে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ ও আমাদের হিসেবে নিচ্ছিল। যে অধিনায়কের রেজিমেন্টটি ব্রাউনাউতে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল সে প্রিন্সকে জানাল, যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্রই সে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে, তার যেসব সৈন্য কাঠ কাটছিল তাদের একত্রে ডেকে আনে, এবং ফরাসিদের পাশ কাটিয়ে যেতে দিয়ে দুই ব্যাটেলিয়ন বেয়নেটধারী সৈন্য নিয়ে তাদের আক্রমণ করে হটিয়ে দেয়।

ইয়োর এক্সেলেন্সি, যখন দেখলাম তাদের প্রথম ব্যাটেলিয়নটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন রাস্তার উপর থেমে গিয়ে ভাবলাম, ওদের এগিয়ে আসতে দিয়ে গোটা ব্যাটেলিয়ন নিয়ে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব-আর তাই আমি করেছি।

আসলে অধিনায়ক সেটাই করতে চেয়েছিল, আর সেটা করতে না পারায় সে এত বেশি দুঃখিত হয়েছে যে তার হচ্ছে হচ্ছে বুঝি সেই কাজটিই সে করতে পেরেছে। নাকি সত্যি সত্যি কি তাই ঘটেছিল। কী ঘটেছিল আর কী কী ঘটে নি–এই ডামাডোলের মধ্যে তা কি কেউ ঠিক ঠিক জানে?

সে আরো বলল, ভালো কথা ইয়োর এক্সেলেন্সি, আপনাকে জানাতে চাই যে, দলখভ নামক যে অফিসারটির পদাবনতি ঘটেছিল, আমার উপস্থিতিতেই সে একজন ফরাসি অফিসারকে বন্দি করে নিজেকে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য করে তুলেছে।

প্রিন্স ব্যাগ্রেশন বৃদ্ধ কর্নেলের দিকে ঘুরে বলল : মহাশয়গণ, আপনাদের সকলকেই ধন্যবাদ, পদাতিক, অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ–সব সৈন্যই সাহসের পরিচয় রেখেছেন। কিন্তু ব্যূহের মাঝখানে দুটো কামান পরিত্যক্ত হল কেমন করে? যেন কোনো একজনের খোঁজ করেই সে প্রশ্নটা করল। তারপর কর্তব্যরত স্টাফ অফিসারের দিকে ফিরে বলল, মনে হচ্ছে আপনাকেই আমি পাঠিয়েছিলাম?

স্টাফ-অফিসার জবাব দিল, একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, অন্যটার কথা আমি জানি না। সারাক্ষণই আমি সেখানে দাঁড়িয়েই হুকুম জারি করছিলাম, আর সবেমাত্র স্থানত্যাগ করেছি… একথা ঠিক যে জায়গাটা তখন বেশ গরম হয়ে উঠেছিল, সে বিনীতভাবে যোগ করল।

একজন জানাল, ক্যাপ্টেন তুশিন গ্রামের কাছেই কোথাও রাত কাটিয়েছে, তাকে ডাকতে লোক গেছে।

প্রিন্স আন্দ্রুকে লক্ষ্য করে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন বলল, ওঃ, কিন্তু তুমি তো সেখানে ছিলে?

সকলেই চুপচাপ। দরজায় তুশিনকে দেখা গেল। ভীরু পায়ে সে অধিনায়কদের পিছন থেকে এগিয়ে এল। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সামনে সে সবসময়েই বিব্রত বোধ করে, এখনো তাই হল, খেয়ালের অভাবে পতাকা দণ্ডটাতে পায়ে মাড়িয়ে দিল। কয়েকজন হেসে উঠল।

যারা হাসল তাদের মধ্যে সব চাইতে উচ্চকণ্ঠ ছিল ঝেরকভ। যত না ক্যাপ্টেনের দিকে তার চাইতে বেশি যারা হেসেছিল তাদের দিকে ভুকুটি করে ব্যাগ্রেশন প্রশ্ন করল, একটা কামান পরিত্যক্ত হল কেমন করে?

কঠোর কর্তৃপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কামান ফেলে এসেও এখনো বেঁচে থাকার অপরাধ ও লজ্জা এই প্রথম তুশিনের কাছে অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে দেখা দিল। সে এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে এ কথাটা এতক্ষণ তার মনেই পড়েনি। ব্যাগ্রেশনের সামনে দাঁড়িয়ে তার নিচের চোয়াল কাঁপতে লাগল, কোনোরকমে তো-তো করে বলল :

আমি জানি না… ইয়োর এক্সেলেন্সি… আমার সৈন্য ছিল না… ইয়োর এক্সেলেন্সি।

সাহায্যকারী সৈনিকদের ভিতর থেকে কয়েকজনকে তুমি নিতে পারতে।

সত্য হলেও এ কথাটা তুশিন বলতে পারল না যে সাহায্যকারী কোনো অফিসার বিপদে পড়ে যায়। ভুল করে স্কুলের ছাত্র যেভাবে পরীক্ষকের দিকে তাকায় তেমনিভাবে সে একদৃষ্টিতে ব্যাগ্রেশনের দিকে তাকিয়ে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ সকলেই চুপচাপ। প্রিন্স ব্যাগ্রেশন কঠোর হতে চায়নি, তারও আর কিছু বলার ছিল না, অন্য কেউ কিছু বলতে সাহস করল না। প্রিন্স আন্দ্রু ভুরুর নিচে দিয়ে তুশিনের দিকে তাকাল, তার আঙুলগুলো আপনা থেকেই কুঁকড়ে আসছে।

সেই নীরবতা ভেঙে প্রিন্স আন্দ্রু দুম করে বলে উঠল, ইয়োর এক্সেলেন্সি! আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে ক্যাপ্টেন তুশিনের কামান-মঞ্চে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম, দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য ও ঘোড়া মারা গেছে, দুটো কামান নষ্ট হয়েছে, আর কোনোরকম সাহায্যই পাওয়া যায়নি।

চাপা উত্তেজনার সঙ্গে বলকনস্কি কথাগুলি বলে গেল, প্রিন্স ব্যাগ্রেশন ও তুশিন সমান আগ্রহে শুনতে লাগল।

সে বলতে লাগল, আর ইয়োর এক্সেলেন্সি যদি আমার কথা শোনেন তো বলি, ওই কটি কামান এবং ক্যাপ্টেন তুশিন ও তার দলের সাহসিকতাপূর্ণ কাজই আজকের জয়লাভের প্রধান কারণ। কথা শেষ করে কোনো জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই প্রিন্স আন্দ্রু টেবিল ছেড়ে উঠল।

তুশিনের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স ব্যাগ্রেশন মাথাটা নুইয়ে বলল, সে যেতে পারে। তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্স আ বেরিয়ে গেল।

তুশিন বলল, তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি আমাকে রক্ষা করেছ প্রিয় বন্ধু!

প্রিন্স আন্দ্রু চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু না বলেই চলে গেল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। সব কিছুই যেন অদ্ভূত, যেমনটি সে আশা করেছিল তেমনিট ঘটল না।

ওরা কারা? এরা এখানে কেন? এরা কি চায়? কতক্ষণে এ সবকিছু শেষ হবে? সামনের চলমান ছায়াগুলোর দিকে তাকিয়ে রস্তভ ভাবতে লাগল। তার বাহুর যন্ত্রণা ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। একটা দুর্বার তার ভার তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, লাল বৃত্তগুলি নাচছে চোখের সামনে, শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে একটা নির্জনতাবোধ। আহত ও অক্ষত এইসব সৈনিকরাই তার পেশীগুলোকে চেপে ধরে মুচড়ে দিচ্ছে, তার মচকে যাওয়া হাত ও ঘাড়ের মাংস ঝলসে দিচ্ছে। এদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য সে চোখ বুজল।

মুহূর্তের জন্য সে ঝিমতে লাগল, কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই অসংখ্য জিনিস স্বপ্নের মধ্যে তার সামনে হাজির হল, মায়ের মুখ ও লম্বা সাদা হাত, সোনিয়ার ছোট কাঁধ, নাতাশার চোখ ও হাসি, দেনিসভের কণ্ঠস্বর ও গোঁফ আর তেলিয়ানিন এবং বগদানিচের যত সব কাণ্ড কারখানা।

সে চোখ মেলে তাকাল। কাঠকয়লার আগুনের গজখানেক উপরে নেমে এসেছে রাতের কালো চন্দ্রাতপ। সে আগুনে পড়ন্ত বরফের টুকরোগুলো ঝলসে উঠছে। তুশিন ফিরে আসেনি, ডাক্তার আসেনি। এখন সে একা, শুধু একটি সৈনিক আদুল গায়ে আগুনের ওপাশে বসে তার সরু হলুদ শরীরটাকে গরম করছে।

রস্তভ ভাবল, কেউ আমাকে চায় না! আমাকে সাহায্য করবার, একটু করুণা দেখাবার কেউ নেই। অথচ একদিন আমি সুস্থ ছিলাম, আমার শক্তি ছিল, সুখ ছিল, সকলে আমাকে ভালোবাসত। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে আপনা থেকেই সে আর্তনাদ করে উঠল।

এই, তোমার কষ্ট হচ্ছে কি? সৈনিকটি জিজ্ঞেস করল, তারপর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই অসন্তুষ্ট গলায় বলল, কত লোক যে আজ পঙ্গু হয়েছে–ভয়াবহ!

রস্তভ তার কথায় কান দিল না। আগুনের উপরে ঝলসানো বরফের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে গেল রাশিয়ার শীতকালের একটি আতপ্ত উজ্জ্বল গৃহকোণের কথা, তার পুরু লোমের কোট, দ্রুতগতি স্লেজ-গাড়ি, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহ এবং পরিবারের সকলের স্নেহ ও যত্নের কথা। অবাক হয়ে ভাবল, কেন আমি এখানে এলাম?

ফরাসিরা পরদিন আর নতুন করে আক্রমণ করল না। ব্যাগ্রেশনের অবশিষ্ট সৈন্যরা কুতুজভের বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *