০২.১ ১৮০৫ সালের অক্টোবর মাস

দ্বিতীয় পর্বঅধ্যায়-১

১৮০৫ সালের অক্টোবর মাসে একটি রুশ বাহিনী অস্ট্রিয়ার একটি অঞ্চলের গ্রাম ও শহর দখল করে বসেছিল; আরো কয়েক রেজিমেন্ট সৈন্য সদ্য সদ্য রাশিয়া থেকে এসে ব্রাউনাট দুর্গের কাছে শিবির ফেলে স্থানীয় লোকজনদের ঘাড়ে চেপে বসছিল। ব্রাউনা প্রধান সেনাপতি কুতুজভের মূল ঘাঁটি।

১৮০৫ সালের ১১ অক্টোবর একটি পদাতিক রেজিমেন্ট সবেমাত্র ব্রাউমাউ পৌঁছে শহর থেকে আধা মাইল দূরে প্রধান সেনাপতির পরিদর্শনের জন্য অপেক্ষা করছিল। জায়গাটা এবং তার পরিবেশ-ফলের বাগান, পাথরের বেড়া, টালির ছাদ, দূরে দূরে পাহাড়ের সারি–সবকিছুই দেখতে অ-রুশীয়; যে সব স্থানীয় অধিবাসী। সকৌতুকে সৈন্যদের দেখছিল তারাও রুশীয় নয়; তবু রেজিমেন্টটিকে দেখতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে পরিদর্শনের জন্য প্রতীক্ষারত যে কোনো রুশ রেজিমেন্টেরই মতো।

অভিযানের শেষ দিন সন্ধ্যায় হুকুম এসেছে, যাত্রাপথেই প্রধান সেনাপতি রেজিমেন্টটি পরিদর্শন করবেন। যদিও হুকুম-নামার কথাগুলি রেজিমেন্ট-কমান্ডারের কাছে খুব পরিষ্কার নয়, এবং সৈন্যরা অভিযানরত অবস্থায়ই থাকবে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছিল, তবু বিভাগীয় সেনাপতিদের মধ্যে পরামর্শক্রমে স্থির হয়েছে, কিছুটা নিচু হয়ে অভিবাদন জানানোর চাইতে বেশি নিচু হয়ে অভিবাদন জানানোই ভালো-এই নীতি। অনুসরণ করে রেজিমেন্টকে অভিযানরত অবস্থায় উপস্থিত করাই শ্রেয়। কাজেই বিশ মাইল মার্চ করে আসার পরেও সৈন্যরা চোখের পাতা না বুজিয়ে সারারাত ধরে পোশাক-আশাক মেরামত ও পরিষ্কার করল, অ্যাডজুটান্ট ও কোম্পানি-কমান্ডাররা নানা রকম হিসেব-নিকাশ করল, এবং সকাল বেলা দেখা গেল, আগের দিন শেষ অভিযানের পরে রেজিমেন্টটি যে রকম বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়েছিল তার পরিবর্তে দেখা দিয়েছে দু হাজার মানুষের একটি সুশৃঙ্খল সমাবেশ-তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, প্রতিটি বোম ও প্রতিটি পেটি যথাস্থানে রক্ষিত হয়ে পরিচ্ছন্নতায় ঝকঝক করছে। সবকিছু যে বাইরে থেকেই দেখতে সুশৃঙখল তাও নয়, প্রধান সেনাপতি যদি ইউনিফর্মের ভিতরটাও পরীক্ষা করে দেখতে চায় তাহলে দেখতে পাবে, প্রতিটি লোকের গায়ে পরিষ্কার শার্ট, আর তাদের কাঁধের প্রতিটি ঝোলায় নির্দিষ্ট সংখ্যক সব জিনিস-সৈনিকদের ভাষায় যাকে বলে জুতো সেলাইয়ের কাঁটা, সাবান ও সব–মজুত আছে। কেবল একটা বিষয়ে সকলের মনেই অস্বস্তি রয়েছে। সেটা সৈন্যদের বুটের অবস্থা। অর্ধেকের বেশি সৈন্যের বুটে ফুটো হয়ে গেছে। কিন্তু এর কারণ রেজিমেন্ট-কমান্ডারদের কোনোরকম ত্রুটি নয়; বারবার জানানো সত্ত্বেও অস্ট্রিয় রসদ সরবরাহ বিভাগ বুট পাঠায় নি, আর রেজিমেন্টটি মার্চ করে এসেছে সাতশো মাইলের মতো।

রেজিমেন্ট-কমান্ডার লোকটি বয়স্ক, কোপণস্বভাব, মজবুত গড়ন, অভিজ্ঞ; ভুরু ও জুলফি ধূসর, এবং ঘাড়-গর্দান অপেক্ষা বুক ও পিঠের দিকটা বেশি চওড়া। পরনে তকতকে নতুন ইউনিফর্ম, তার প্রতিটি ভজ চোখে পড়ে, সোনার মোটা স্কন্ধত্রাণ চওড়া কাঁধের উপর এলিয়ে না পড়ে খাড়া হয়ে আছে। তার ভঙ্গিখানাই এমন যেন মনের হরষে জীবনের একটি গভীর কর্তব্য সে পালন করছে। সে সৈন্যদের সামনে দিয়ে চলাফেরা করছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপে পিঠটাকে ঈষৎ বেঁকিয়ে নিজেকে সোজা করে রাখছে। পরিষ্কার বোঝা যায়, কমান্ডার তার রেজিমেন্টকে প্রশংসা করে, তাকে নিয়ে তার মন খুব খুশি, সারাটা মন তাকে নিয়েই মেতে আছে; কিন্তু তার গর্বিত চলন দেখে মনে হয়, সামরিক বিষয়াদি ছাড়া সামাজিক স্বার্থ এবং সুন্দরী নারীরাও তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে।

একজন ব্যোটেলিয়ান-কমান্ডার হাসি মুখে এগিয়ে যাচ্ছিল (দেখে বোঝা যায়, এরা দুজনই বেশ সুখী); তাকে লক্ষ্য করে রেজিমেন্ট-কমান্ডার বলল, আরে, মাইকেল মিত্রিচ, স্যার? কাল রাতে তো হাতে অনেক কাজ ছিল। যাহোক, রেজিমেন্টটা মন্দ নয়, কি বলেন?

ব্যাটেলিয়ান-কমান্ডার হাস্যকর ব্যঙ্গটি ধরতে পেরে হেসে উঠল।

জারিৎসিন প্রান্তরে একে রণক্ষেত্র থেকে হটিয়ে দেওয়া যাবে না।

কি বললেন? কমান্ডার প্রশ্ন করল।

ঠিক সেই মুহূর্তে শহরের দিক থেকে আসবার যে রাস্তায় সংকেত-প্রেরকদের বসানো হয়েছিল সেই রাস্তায় দুটি অশ্বারোহীকে দেখা গেল। তাদের একজন এড-ডি-কং, তার পিছনে একজন কসাক।

আগের দিনের হুকুম-নামায় ভাষার গোলমাল ছিল বলে আজ এড-ডি-কংকে পাঠিয়ে পরিষ্কার করে জানানো হচ্ছে যে, রেজিমেন্টটি যেভাবে মার্চ করে আসছিল, প্রধান সেনাপতি ঠিক সেই অবস্থাতেই সেটাকে পরিদর্শন করতে ইচ্ছুক : পরনে থাকবে গ্রেট-কোট, কাঁধে ঝোলা; কোনো রকম তৈরি হওয়া চলবে না।

আগের দিন হফক্রিগসরাথের জনৈক সদস্য ভিয়েনা থেকে এসে কুতুজভের কাছে প্রস্তাব ও দাবি রেখেছে, সে যেন আর্চডিউক ফার্ডিনান্ড ও ম্যাকের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়, আর কুতুজভ এই যোগ দেওয়াটাকে যুক্তিযুক্ত বিবেচনা না করায় অন্যান্য যুক্তির সঙ্গে এটাও স্থির করেছে যে রাশিয়া থেকে আসতে এই সৈন্যদের অবস্থা যে কতদূর শোচনীয় হয়েছে সেটাও অস্ট্রিয় সেনাপতিকে দেখিয়ে দেওয়া হোক। এই উদ্দেশ্য নিয়েই সে রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসতে চেয়েছে; কাজেই রেজিমেন্টের অবস্থা যত শোচনীয় হবে, প্রধান সেনাপতি ততই খুশি হবে। এড-ডি-কং এসব কথা জানত না; তবু সে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিল, সৈন্যদের পরনে গ্রেট-কোট থাকবে, আর তারা অভিযানরত অবস্থায় থাকবে; অন্যথায় প্রধান সেনাপতি অসন্তুষ্ট হবেন। এ কথা শুনে রেজিমেন্ট-সেনাপতি মাথা নিচু করল, নীরবে কাঁধ ঝাঁকুনি দিল, সক্রোধে হাত দুটো ছড়িয়ে দিল।

বলে উঠল, সবই তো তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি! তিরস্কারের সুরে ব্যাটেলিয়ান-কমান্ডারকে বলল, এখন বুঝুন! আমি বলি নি মাইকেল মিত্রি যে অভিযানরত অবস্থা মানেই গায়ে গ্রেট-কোট থাকবে? কয়েক পা এগিয়ে আবার বলল, হা ঈশ্বর! তারপর হুকুমে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁক দিল, কোম্পানি-কমান্ডারগণ! সার্জেন্ট মেজরগণ!…কতক্ষণে তিনি এখানে পৌঁছবেন? সসম্মানে সে এড-ডি-কংকে জিজ্ঞাসা করল।

তা বলা যায় এক ঘণ্টার মধ্যেই। পোশাক বদলাবার সময় পাব তো? আমি জানি না, জেনারেল…।

রেজিমেন্ট-কমান্ডার স্বয়ং সৈনিকদের কাছে গিয়ে প্রত্যেককে গ্রেট-কোট পরে নিতে বলল। কোম্পানি কমান্ডাররা তাদের সেনাদলের কছে ছুটল, সার্জেন্ট মেজররা হৈ-চৈ শুরু করে দিল (গ্রেট-কোটগুলোর অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না), আর সঙ্গে সঙ্গে সেনাদলের মধ্যে যে শৃঙ্খলা ও নীরবতা ছিল তার জায়গায় দেখা দিল ছুটাছুটি আর কলরব। সৈন্যরা চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করল, কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে মাথার উপর দিয়ে পট্টি গলিয়ে থলে তুলে নিল, ওভার-কোটের পট্টি খুলে নিয়ে হাত তুলে পট্টির আস্তিন পরতে লাগল।

আধঘণ্টার মধ্যে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। রেজিমেন্ট-কমান্ডার ঝুঁকে পা ফেলে সেনাদলের সামনে হাঁটতে হাঁটতে দূর থেকে সবকিছু দেখে নিল।

এটা কি হয়েছে? এটা! চিৎকার করে উঠে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তৃতীয় কোম্পানির কমান্ডার!

সেনাপতি তৃতীয় কেম্পানির কমান্ডারকে চাইছেন।…কমান্ডার দেখা করুন সেনাপতির সঙ্গে-তৃতীয় কোম্পানি দেখা করুন কমান্ডারের সঙ্গে। কথাগুলি সেনাদলের মারফৎ পাঠানো হল, আর অ্যাডজুটান্ট নিখোঁজ অফিসারকে খুঁজতে ছুটল।

কথাগুলি যথাস্থানে পৌঁছবার পর নিখোঁজ অফিসারটি তার কোম্পানির পিছন থেকে বেরিয়ে এল। লোকটি মাঝ-বয়সী; দৌড়নো অভ্যাস নেই; তবু হোঁচট খেতে খেতে হাস্যকরভাবে সেনাপতির দিকে ছুটতে লাগল। স্কুলের ছেলেকে না-শেখা পড়া বলতে বললে তার মুখের যে রকম ভাব হয় সেই ভাব ফুটে উঠেছে ক্যাপ্টেনটির মুখে। নাকের উপর দাগ পড়েছে; অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে নাকটা লাল হয়ে উঠেছে; মুখটা বেঁকে-বেঁকে যাচ্ছে। কাছাকাছি এসে আস্তে পা ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হলে সেনাপতি মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্যাপ্টেনকে দেখতে লাগল।

আপনি তো অচিরেই আপনার সৈন্যদের পেটিকোট পরাবেন দেখছি! এ সব কি? তৃতীয় কোম্পানির নীল কাপড়ের গ্রেট-কোট পরা একটি সৈনিককে দেখিয়ে চোয়াল বের করে রেজিমেন্ট-কমান্ডার চিৎকার করে বলল। কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? প্রধান সেনাপতির আসবার কথা, আর আপনি নিজের জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন? অ্যাঁ? প্যারেডে সৈন্যদের কীভাবে ফ্যান্সি কোটে সাজাতে হয় আপনাকে শিখিয়ে দেব।… অ্যাঁ…?

কোম্পানি-কমান্ডার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দুটো আঙুলে টুপিটাকে এমনভাবে চাপতে লাগল যেন সেই চাপের উপরেই তার রক্ষা পাবার একমাত্র আশা নির্ভর করছে।

কি হল, কথা বলছেন না কেন? হাঙ্গেরিয় পোশাক পরা লোকটাকে কোথা থেকে জোটালেন? গম্ভীর বিদ্রুপের সুরে কমান্ডার বলল।

ইয়োর এক্সেলেন্সি…

ইয়োর এক্সেলেন্সি কি? ইয়োর এক্সেলেন্সি! ইয়োর এক্সেলেন্সির ব্যাপারটা কি?…কেউ জানে না।

ক্যাপ্টেন নরম গলায় বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সি, এই অফিসার দলখভকে সাধারণ সৈনিকের পদে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আচ্ছা? তা–তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে কি ফিল্ড-মার্শালের পদে, না কি একজন সৈনিকের পদে সৈনিক হলে তো অন্য সকলের মতোই নিয়মমাফিক ইউনিফর্মই তারও পরা উচিত।

ইয়োর এক্সেলেন্সি, মার্চের সময় সে অনুমতি তো আপনি নিজেই দিয়েছিলেন।

অনুমতি দিয়েছিলাম? অনুমতি? আপনার মতো যুবকদের মতো কথাই বটে, একটু নরম হয়ে রেজিমেন্ট কমান্ডার বলল। অনুমতিই বটে…একজন কি বলল আর আপনিও…কি বলেন? অধিকতর বিরক্ত হয়ে সে বলে উঠল, মিনতি করে বলছি, আপনার সৈন্যদের একটু ভালোভাবে পোশাক পরাবেন।

অ্যাডজুটান্টকে দেখবার জন্য মুখ ঘুরিয়ে কমান্ডার সেই দিকে পা চালিয়ে দিল। এতটা রাগ দেখাতে পেরে সে নিজেই বেশ খুশি হয়েছে; আরো রাগ দেখাবার একটা অজুহাত পাবার জন্য সে সৈন্যদলের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। ব্যাজটা অপরিষ্কার থাকার জন্য একজন অফিসারকে এবং লাইনটা সোজা না থাকার জন্য অপর একজনকে বকুনি দিয়ে সে তৃতীয় কোম্পানির কাছে গিয়ে হাজির হল।– নীল-ধূসর ইউনিফর্ম পরা দলখভের কাছ থেকে পাঁচটি সৈন্যের আগে পৌঁছেই যন্ত্রণাকাতর গলায় কমান্ডার চেঁচিয়ে উঠল, কে-মন ভাবে দাঁড়িয়ে আছ? তোমার পা কোথায়?

পরিষ্কার উদ্ধত দুটি চোখ সোজা সেনাপতির মুখের উপর রেখে দলখভ ধীরে ধীরে তার বাঁকা হাঁটুটাকে সোজা করল।

নীল কোট কেন? ওটা খুলে ফেল…সার্জেন্ট-মেজর! ওর কোটটা পাল্টে দিন…রাস… কথাটা সে শেষ করল না।

সেনাপতি, হুকুম মানতে আমি বাধ্য, কিন্তু অপমান… দলখভ তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিয়ে বলল।

কোনো কথা নয়।…কোনো কথা নয়, কোনো কথা নয়!

অপমান সহ্য করতে বাধ্য নই, ঝাঁঝালো উচ্চগ্রামে দলখভ তার কথাটা শেষ করল।

সেনাপতি ও সৈনিকের চোখে চোখ পড়ল। সেনাপতি চুপ করে গেল; রেগে আঁটো গলাবন্ধটাকে টেনে নামিয়ে দিল।

মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, তোমাকে অনুরোধ করে বলছি, কোটটা বদলে ফেল।

*

অধ্যায়-২

সেই মুহূর্তে সংকেত-জ্ঞাপন হাঁক দিল, তিনি আসছেন!

মুখটা লাল করে রেজিমেন্ট-কমান্ডার ছুটে ঘোড়র কাছে গিয়ে কম্পিত হাতে পা-দানিটা ধরে জিনের উপর উঠে ঠিক হয়ে বসল, তলোয়ারখানা খুলল, এবং খুশি-খুশি দৃঢ় মুখে হাঁক দেবার জন্য প্রস্তুত হল। পরিষ্কার পাখনা-মেলা পাখির মতো একবার ঝটপটিয়েই গোটা রেজিমেন্ট একেবারে চুপ করে গেল।

আত্ম-কাঁপানো গলায় রেজিমেন্ট-কমান্ডার হাঁক দিল, …! সে হাঁকে একযোগে ফুটে উঠল তার নিজের আনন্দ, রেজিমেন্টের কঠোরতা, আর আগতপ্রায় প্রধানের প্রতি অভ্যর্থনা।

চওড়া গ্রাম্য পথের দুধারে গাছের সারি; সেই পথ ধরে এগিয়ে আসছে ছয় ঘোড়ায় দুলকি চালে টানা একটা উঁচু হাল্কানীল রঙের ভিয়েনা-গাড়ি। তার পিছনে একদল অশ্বারোহী ও অন্যান্য সৈনিক। কুতুজভের পাশে বসে আছে একজন অস্ট্রিয় সেনাপতি; রুশদের কালো ইউনিফর্মের মধ্যে তার শাদা ইউনিফর্মটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। রেজিমেন্টের সামনে এসে গাড়িটা থামল। কুতুজভ ও অস্ট্রিয় সেনাপতি নিচু গলায় আলাপ করছিল; কুতুজভ ঈষৎ হেসে ভারী পা ফেলে এমনভাবে গাড়ি থেকে নামল যেন এই যে দুহাজার লোক রুদ্ধনিঃশ্বাসে তাকে দেখছে, তাদের এবং রেজিমেন্ট-কমান্ডারের কোনো অস্তিত্বই নেই।

সামরিক নির্দেশ ধ্বনিত হল; সৈন্যদের অস্ত্রের ঝনঝনার সঙ্গে গোটা রেজিমেন্ট আর একবার দুলে উঠল। তারপর মৃত্যু-স্তব্ধতার মধ্যে শোনা গেল প্রধান সেনাপতির দুর্বল কণ্ঠস্বর। রেজিমেন্ট যেন গর্জে উঠল, ইয়োর এক্স-এ-লেন্সি, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি! তারপর আবার সব নিশ্চুপ। রেজিমেন্ট চলতে শুরু করল। কুতুজভ তখনো নিশ্চল দাঁড়িয়ে; তারপর শাদা ইউনিফর্মধারী সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে সেও সদলবলে সৈন্যদের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে লাগল।

রেজিমেন্ট-কমান্ডার যে ভাবে চাটুকারের মতো এগিয়ে গিয়ে প্রধান সেনাপতিকে অভিবাদন জানাল ও দুই চোখ মেলে তাকে যেন গিলতে লাগল, যে ভাবে ঝুঁকে ঝুঁকে টলতে টলতে এগিয়ে গেল, প্রধান সেনাপতির প্রতিটি কথা ও ভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে ছুটে সামনে গেল, তা থেকেই বোঝা গেল যে কমান্ডার হিসেবে তার কর্তব্যের চাইতেও একজন অধীনস্থ কর্মচারীর মতোই অতি উৎসাহে সে কাজগুলি করছে। রেজিমেন্ট কমান্ডারের কঠোরতা ও প্রগাঢ় মনোযোগকে ধন্যবাদ, সেই সময়ে অন্য যে সব রেজিমেন্ট ব্রাউনাইতে পৌঁছেছিল তাদের তুলনায় এই রেজিমেন্টটির অবস্থা ছিল চমৎকার। অসুস্থ ও পিছিয়ে-পড়া সৈন্য ছিল মাত্র ২১৭ জন। একমাত্র বুট ছাড়া আর সবকিছুই ঠিক ঠিক অবস্থায় ছিল।

কুতুজভ সৈন্যদের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলল; কখনো তুরস্কের যুদ্ধে পূর্ব-পরিচিত অফিসারদের সঙ্গে দু চারটি বন্ধুত্বপূর্ণ কথা বলল, কখনো বা কথা বলল সৈনকিদের সঙ্গে। তাদের বুটের দিকে তাকিয়ে বার কয়েক দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ল; মুখের এমন ভাব করে সেদিকে অস্ট্রিয় সেনাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করল যেন বলতে চাইল যে সে কাউকেই দোষ দিচ্ছে না, আবার এই শোচনীয় অবস্থাটা লক্ষ্য না করেও পারছে না। পাছে তার রেজিমেন্ট সম্পর্কে একটি কথাও তার কানকে এড়িয়ে যায় এই ভয়ে সেরূপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই রেজিমেন্ট-কমান্ডার ছুটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কুতুজভের প্রতিটি কথা যাতে শোনা যায় ততটা দূরত্ব বজায় রেখে দলের প্রায় বিশ্ব জন তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। প্রধান সেনাপতির সবচাইতে কাছাকাছি চলেছে একজন সুদর্শন অ্যাডজুটান্ট। সেই প্রিন্স বলকনস্কি। তার পরেই রয়েছে তার বন্ধু নেসভিৎস্কি; লম্বা একজন স্টাফ-অফিসার, খুব শক্ত-সমর্থ, সময় হাসি-ভরা সুন্দর মুখ, আর ভেজা-ভেজা চোখ। তার পাশেই হেঁটে চলেছে একজন কালো-কালো হুজার অফিসার; লোকটির ভাবভঙ্গি দেখে নেসভিৎস্কি হাসি সামলাতে পারছে না। হুজারের মুখটা গম্ভীর, হাসি নেই, স্থির, দৃষ্টিতে ভাবের কোনো পরিবর্তন নেই; রেজিমেন্ট-কমান্ডারের পিঠের দিকে তাকিয়ে সে অনবরত তার চলাফেরার নকল করে চলেছে। কমান্ডার যতবার ছুটে গিয়ে সামনে ঝুঁকছে, ততবারই হুজারটি অবিকল সেইভাবে ছুটে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াচ্ছে। নেসভিৎস্কি হাসছে আর অন্যদের খোঁচা মেরে ভাঁড়ামিটা দেখাচ্ছে।

কুতুজভ ধীরে ধীরে আলস্যভরে হেঁটে চলেছে; তাদের প্রধানকে দেখবার জন্য হাজার হাজার চোখ যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে। তৃতীয় কোম্পানির কাছে পৌঁছে সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। দলের লোকেরা এটা আশা; তাই তারা আপনা থেকেই তার অনেকটা কাছে এসে পড়ল।

নীল গ্রেটকোটের জন্য যাকে তিরস্কার করা হয়েছিল সেই লাল-নাক ক্যাপ্টেনকে চিনতে পেরে সে বলল, আরে, তিমখিন!

রেজিমেন্ট-কমান্ডার যখন তিরস্কার করেছিল তখন তিমখিন যতটা টান-টান হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার চাইতে টান-টান হওয়া কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয় বলেই মনে হয়েছিল; কিন্তু এখন প্রধান সেনাপতি যখন তার সঙ্গে কথা বলল তখন সে এত বেশি টান-টান হল যাতে মনে হল যে প্রধান সেনাপতি কথা চালিয়ে গেলে সে আর তাল রাখতে পারত না। কুতুজভও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এবং তার ভালো ছাড়া মন্দ চায় না বলে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেল; তার ক্ষত-চিহ্নিত ফোলা মুখে একটুকরো হাসি খেলে গেল।

সে বলল, আর একটি ইসমাইলের বন্ধু। একটি সাহসী অফিসার। আপনি কি ওকে নিয়ে সন্তুষ্ট? সে রেজিমেন্ট-কমান্ডারকে জিজ্ঞাসা করল।

হুজার অফিসার যে পিছন থেকে তাকে আয়নার মতো নকল করছে সেটা না বুঝতে পেরে রেজিমন্ট কমান্ডার সামনে এগিয়ে গিয়ে জবাব দিল : অত্যন্ত সন্তুষ্ট ইয়োর এক্সেলেন্সি!

চলে যেতে যেতে কুতুজভ হেসে বলল, আমাদের সকলেরই ত্রুটি-বিচ্যুতি আছেই। এক সময়ে ব্যাকস (রোমের সুরা-দেবতা)-এর প্রতি ওর বিশেষ টান ছিল।

রেজিমেন্ট-কমান্ডারের ভয় হল, এ দোষে সেও তো দোষী; তাই কোনো জবাব দিল না। ঠিক সেই সময়েই হুজারটি লাল-নাক ক্যাপ্টেনের মুখ ও পেটের দিকে লক্ষ্য করে তার ভাবভঙ্গির এমন অবিকল নকল করতে লাগল যে নেসভিৎস্কি না হেসে পারল না। কুতুজভ ঘুরে দাঁড়াল। নিজের মুখের উপর অফিসারটির সম্পূর্ণ দখল ছিল; তাই কুতুজভ মুখ ফেরাবার আগেই সে একবার মাত্র ভেংচি কেটে মুখে একটা গম্ভীর, শ্রদ্ধাশীল ও সরল ভাব জাগিয়ে তুলতে পারল।

তৃতীয় কোম্পানিটিই শেষ। যেন কোনোকিছু মনে করতে চেষ্টা করছে এমনিভাবে কুতুজভ চুপ করে ভাবতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রু দলের ভিতর থেকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ফরাসিতে আস্তে বলল :

অফিসার দলখভের কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে বলেছিলেন; এই রেজিমেন্টেই সেই লোকটির পদাবনতি ঘটানো হয়েছে।

দলখভ কোথায়? কুতুজভ জানতে চাইল।

দলখভ ইতিমধ্যেই সৈনিকের ধূসর গ্রেট-কোট গায়ে চড়িয়েছে। সে ডাকের অপেক্ষায় রইল না। পরিষ্কার নীল চোখ ও সুন্দর চুল সহ একটি সুগঠিত মূর্তি সেনাদলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রধান সেনাপতির কাছে গিয়ে সশস্ত্র অভিবাদন জানাল।

তোমার কি কোনো নালিশ আছে? কুতুজভ ঈষৎ ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল।

এই দলখভ, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

ওঃ! কুতুজভ বলল। আশা করি এতেই তোমার শিক্ষা হবে। কর্তব্য করে যাও। সম্রাট উদার, আর তুমি উপযুক্ত হলে আমিও তোমাকে ভুলব না।

পরিষ্কার নীল দুটি চোখ যে ভাবে রেজিমেন্ট-কমান্ডারের দিকে তাকিয়েছিল, ঠিক তেমনি সাহসের সঙ্গে তাকাল প্রধান সেনাপতির দিকেও; চিরাচরিত প্রথার যে যবনিকাটা প্রধান সেনাপতি ও একটি সাধারণ সৈনিকের মধ্যে এত বড় ব্যবধান সৃষ্টি করে, তার চোখের সেই দৃষ্টি যেন তাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল।

ইচ্ছা করেই দৃঢ়, অনুরণিত স্বরে দলখভ বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সির কাছে আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবার একটা সুযোগ আমি চাই; মহামান্য সম্রাট ও রাশিয়ার প্রতি আমার অনুরাগ প্রমাণ করতে চাই।

কুতুজভ সেখান থেকে সরে গেল। চোখের যে হাসি হেসে সে ক্যাপ্টেন তিমখিনের কাছ থেকে সরে গিয়েছিল, সেই একই হাসি খেলে গেল তার মুখে। মুখটা বেঁকিয়ে সে সরে গেল; যেন বলতেই চাইল, তাকে দলখভের যা কিছু বলার আছে এবং সে দলখভকে যা কিছু বলতে পারে সে সবই তার জানা আছে, সে সব শুনে শুনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর শুনতে চায় না। মুখ ফিরিয়ে সে গাড়িতে উঠে বসল।

রেজিমেন্ট নানা দলে ভাগ হয়ে ব্রাউনাউয়ের নিকটবর্তী যার যার নির্দিষ্ট বাসাবাড়িতে চলে গেল। আশা আছে, সেখানে তারা বুট পাবে, পোশাক পাবে, কঠোর অভিযানের পরে বিশ্রাম পাবে।

তৃতীয় কোম্পানি বাসাবাড়ির দিকে চলেছে। ঘোড়ায় চেপে তাদের ধরে ফেলে ক্যাপ্টেন তিমখিনের কাছে পৌঁছে রেজিমেন্ট-কমান্ডার বলল, তুমি আমার উপর রাগ করো নি তো প্রোখর ইগনাতিচ? (পরিদর্শন ভালোভাবে শেষ হওয়ায় রেজিমেন্ট-কমান্ডারের মুখটা অদম্য খুশিতে জলমল করছে।) সম্রাটের চাকরির রীতিই এই।…কোনো উপায় নেই…প্যারেডের সময় কখনো কখনো কিছুটা তাড়াহুড়া করতেই হয়…আমিই প্রথম ক্ষমা চাইছি, তুমি তো আমাকে চেন!…তিনি খুব খুশি হয়েছেন! ক্যাপ্টেনের দিকে সে হাতটি বাড়িয়ে দিল।

ও কথা বল না সেনাপতি; অতটা সাহস আমার হত না! ক্যাপ্টেন জবাব দিল। তার নাকটা আরো লাল হয়ে উঠল; ইসমাইলে বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে তার সামনের যে দুটো দাঁত উড়ে গিয়েছিল, হেসে ওঠায় সে জায়গাটা বেরিয়ে পড়ল।

আর মি. দলখভকে বল তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি তাকে ভুলব না। দয়া করে আমাকে জানিও-আমি নিজেই জানতে চাই–তার আচার-ব্যবহার কেমন থাকে; আর সাধারণভাবে…

তিমখিন বলল, চাকরির ক্ষেত্রে লোকটি খুবই খুঁতখুঁতে ইয়োর এক্সেলেন্সি; কিন্তু তার চরিত্র…।

চরিত্রের বিষয়ে কি জানতে চাও? রেজিমেন্ট-কমান্ডার জিজ্ঞাসা করল।

ক্যাপ্টেন জবাব দিল, সে এক একদিন এক এক রকম। একদিন বেশ বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, সৎস্বভাব। আবার পরের দিনই একটা বুনো জন্তু।…পোল্যান্ডে তো একজন ইহুদিকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।

আহা, ঠিক আছে, ঠিক আছে! রেজিমেন্ট-কমান্ডার বলে উঠল। তথাপি একটি যুবক বিপদে পড়লে তাকে তো দয়া করতেই হবে। তুমি তো জান, অনেক ভালো ভালো লোকের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে।…অতএব তুমি শুধু…।

তা করব ইয়োর এক্সেলেন্সি, তিমখিল বলল; হাসিটা দিয়েই সে বুঝিয়ে দিল যে কমান্ডারের মনের ইচ্ছা সে বুঝতে পেরেছে।

আরে, সে তো বটেই, সে তো বটেই!

রেজিমেন্ট-কমান্ডার সৈন্যদের ভিতর থেকে দলখভকে খুঁজে বের করে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে তাকে বলল :

পরবর্তী ব্যাপারের পরেই…স্কন্ধত্ৰাণ।

দলখভ চারদিকে তাকাল, কিছু বলল না, আবার ঠোঁটের বিদ্রুপের হাসিটিও বদলাল না।

রেজিমেন্ট-কমান্ডার বলতে লাগল, আচ্ছা, তাহলে সব ঠিক হয়ে গেল। তারপর যাতে সৈন্যরা সকলেই শুনতে পায় সেইভাবে বলল, প্রত্যেক সৈন্যকে এক পেয়ালা ভদকা আমি দেব। সকলকে ধন্যবাদ। ঈশ্বরের জয় হোক! ঘোড়া ছুটিয়ে সে কোম্পানিকে পার হয়ে সে পরেরটাকে ধরল।

পাশের অধীনস্থ সাব-অল্টার্নকে তিমখিন বলল, দেখ হে, লোকটি সত্যি ভালো; ওর অধীনে কাজ করা চলে।

এক কথায়, রাজা লোক… সাব-অল্টার্ন হেসে বলল (সকলে রেজিমেন্ট-কমান্ডারকে হরতনের রাজা বলে ডাকে)।

পরিদর্শনের পরে অফিসারদের খুশির মেজাজ সৈন্যদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। সৈন্যরা মনের আনন্দে এগিয়ে চলল।

অথচ তারা বলেছিল, কুতুজভের এক চোখ কানা?

তাই তো! একেবারে কানা!

না বন্ধু, তার চোখ তোমার চাইতে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। বুট, পায়ের পড়ি…সব তার নজরে পড়ে।…

তিনি যখন আমার পায়ের দিকে তাকালেন বন্ধু,…আরে, ধরেই ফেললেন যে আমি…

আর তার সঙ্গী অপর লোকটি, সেই অষ্ট্রিয় ভদ্রলোক, দেখলেই মনে হয় যেন খড়ির গুঁড়ো মাখানো–একেবারে ময়দার মতো শাদা! আমার মনে হয়, লোকে যেমন বন্দুক পালিশ করে তেমনি তাকেও ঠেসে পালিশ করে।

আমি বলি, ফেডেশন!…তিনি কি বললেন যুদ্ধ কখনো শুরু হবে? তুমি তো কাছেই ছিলে। সকলেই বলছে, বোনাপার্ত স্বয়ং ব্রাউনাউতে ছিল।

বোনপার্ত স্বয়ং! ওই বোকার কথা তুমি শুনছ! তিনি তো কিছুই জানেন না! এখন প্রাশিয়া যুদ্ধে নেমেছে। অস্ট্রিয়া তাদের ঘায়েল করছে। তারা ঘায়েল হলে তবে বোনাপার্তের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে। আর তিনি বলছেন বোনাপার্ত ব্রাউনাউতে হাজির! বোঝা যাচ্ছে, তুমিও মুখখু। আরো ভালো করে শোনা উচিত ছিল!

এই তদারককারী লোকগুলো কী শয়তান! দেখ, পঞ্চম কোম্পানিটি এর মধ্যেই গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।…আমরা বাসাবাড়িতে পৌঁছবার আগেই ওদের সব রান্নাবান্না শেষ হয়ে যাবে।

তুমি শয়তান, একটা বিস্কুট তো দাও!

কাল কি আমাকে তামাকু দিয়েছিলে? এই রকমই হয় বন্ধু। ঠিক আছে, এই নাও।

এখানেই তো থামালে পারত; নইলে তো না খেয়ে আরো চার মাইল ছুটতে হবে।

ঐ জার্মানরা যখন আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়েছিল তখন কী মজাই হয়েছিল! চুপচাপ বসে থাক, আর হুটহুট চলে যাও।

আরে বন্ধু, এখানকার লোকগুলো একেবারে ভিখারি। সেখানে তারা ছিল পোল–সবাই রাশিয়ার রাজার অধীন–কিন্তু এখানে সকলেই খাস জার্মান।

ক্যাপ্টেনের হুকুম শোনা গেল : গায়করা সামনে এস!

অমনি বিভিন্ন দল থেকে প্রায় বিশজন সামনে এগিয়ে গেল। তাদের নেতা একজন ভেরীবাদক; গায়কদের দিকে মুখ করে সবেগে হাত নেড়ে সে একটা লম্বা সৈনিক-সঙ্গীত শুরু করে দিল। গানের শুরুতে : সকাল হল, সূর্য উঠল আর শেষে : এবার ভাই হো, চল গৌরবের পথে; সামনে মোদের আছে ফাদার কামেনস্কি। গানটি রচনা করা হয়েছিল তুর্কি অভিযানের সময়; এখন গাওয়া হচ্ছে অস্ট্রিয়াতে; পরিবর্তনের মধ্যে শুধু ফাদার কামেনস্কির জায়গায় বসানো হয়েছে ফাদার কুতুজভ।

শেষের কথাগুলি একসঙ্গে ছুঁড়ে দিয়ে এবং যে কোনোকিছু মাটিতে ছুঁড়ে দিচ্ছে এমনিভাবে হাতটা দুলিয়ে ভেরীবাদক কড়া চোখে গায়কদের দিকে চোখ গোল-গোল করে তাকাল। যখন বুঝল যে সকলে একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে তখন সে হাত দুটিকে এমনভাবে তুলল যেন কোনো অদৃশ্য মূল্যবান জিনিসকে সযত্নে তুলছে, আর তার পরেই হঠাৎ সেটাকে নিচে ছুঁড়ে দিয়ে গান ধরল :

কুঞ্জবন, আমার কুঞ্জবন…।

আমার নতুন কুঞ্জবন…! আরো বিশ জন তাতে সুর মেলাল; আর মন্দিরাবাদকটি তার ভারি যন্ত্র নিয়ে ছুটে সকলের সামনে এগিয়ে গেল, আর এমনবাবে ঘাড় ঝাঁকি দিয়ে যন্ত্রটা ঘুরাতে লাগল যেন কাউকে ভয় দেখাচ্ছে। সৈন্যরা দুই হাত দুলিয়ে তালে তালে পা ফেলে চলতে লাগল। সৈন্যদের পিছনে চাকার শব্দ, স্প্রিংয়ের কাঁচ-কাঁচ, আর ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ শোনা যেতে লাগল। কুতুজভ ও তার দলবল শহরের পথ ধরল। প্রধান সেনাপতি ইশারায় জানালা, সৈন্যরা আরামে মার্চ করে চলুক; গান শুনে ও সৈন্যদের নাচ ও মার্চ দেখে তারা সকলেই সন্তোষ প্রকাশ করল। ডানদিকে দ্বিতীয় সারিতে একটি নীল-চোখ সৈন্য সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে দলখভ। গানের তালে তালে সুষম ভঙ্গিতে সে সদর্পে পা ফেলে চলেছে, আর যারা সৈন্যদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে না এগিয়ে গাড়িতে চড়ে চলে যাচ্ছে তাদের সকলকেই করুণার চোখে দেখছে। কুতুজভের দলের যে কর্নেটবাদক হুজার রেজিমেন্ট-কমান্ডারকে নকল করছিল সে ঘোড়া নিয়ে পিছিয়ে এসে দলখভের কাছে হাজির হল।

হুজার কর্নেটবাদক ঝেরকভ একসময় পিটার্সবুর্গ-এ দলখভের বাউণ্ডুলে দলে ছিল। এর আগেও বিদেশে দলখভের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, কিন্তু তখন তাকে চিনতে পারাটা সে সমীচীন মনে করে নি। কিন্তু যেহেতু এখন কুতুজভ স্বয়ং ভদ্রলোক-সৈনিকটির সঙ্গে কথা বলছে, তাই সেও পুরোনো বন্ধুর মতোই তার সঙ্গে ডেকে কথা বলল।

আরে ভাই, কেমন আছ? ঘোড়াটাকে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে সে বলল।

দলখভ ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল, কেমন আছি? যেমন তুমি দেখছ।

অফিসারদের সঙ্গে কেমন চালাচ্ছ? ঝেরকভ শুধাল।

ভালো। সকলেই লোক ভালো। আর তুমি তাদের মধ্যে ঢুকে পড়লে কেমন করে? আমাকে নিয়ে নিল; এখন আমি কর্তব্যরত।

দুজনই চুপ করে গেল।

ডান হাতের চওড়া আস্তিনের ভিতর থেকে সে আকাশে উড়িয়ে দিল বাজপাখিটাকে,–এই গানের সুরে সৈন্যদের মনে স্বতই জাগছে সাহস ও প্রফুল্লতা। এই গানটি না থাকলে তাদের আলোচনা হয়তো অন্যরকম হতো।

একথা কি সত্যি যে অস্ট্রিয়রা পরাজিত হয়েছে? দলখভ শুধাল ।

একমাত্র শয়তানই জানে। ওরা তো তাই বলছে।

গানের সঙ্গে তাল রেখে দলখভ সংক্ষেপে বলল, আমি খুশি।

ঝেরকভ বলল, আমি বলি কি, যে কোনোদিন সন্ধ্যায় চলে এস; ফারো খেলা যাবে।  

সে কি, তোমার কি অনেক টাকা হয়েছে নাকি?

এসো তো।

আমি যেতে পারব না। প্রতিজ্ঞা করেছি। যতদিন পুনর্বহাল না হব ততদিন মদ খাব না, কোনোকিছু খেলব না।

আবার দুজন চুপ করল।

কোনোকিছু দরকার হলে এস। অফিসাররা অনেক সময়ই কাজে লাগে।

দলখভ হাসল। কিছু ভেবো না। আমার যদি কিছু দরকার হয়, তাহলে ভিক্ষা চাইব না–জোর করে নেব।

আরে, কিছু মনে করো না; আমি শুধু…

আর আমিও শুধু…

বিদায়।

তোমার সুস্বাস্থ্য…

দূর–আরো দূর পথ,
হে মোর স্বদেশ…

পায়ের জুতোর কাঁটা দিয়ে ঝেরকভ ঘোড়ার পেটে খোঁচা দিল; ঘোড়া জোর কদমে গানের তালে তালে ছুটল; সেনাদলকে পার হয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল।

*

অধ্যায়-

সৈন্য-পরিদর্শন থেকে ফিরে এসে কুতুজভ অস্ট্রিয় সেনাপতিকে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল; এবং অ্যাডজুটান্টকে ডেকে পৌঁছবার পরে সৈন্যদের অবস্থা সংক্রান্ত কাগজপত্র ও অগ্রবর্তী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আর্চডিউক ফার্দিনান্দের কাছ থেকে যে সব চিঠিপত্র এসেছে তাও চেয়ে পাঠাল। সে সব কাগজপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল প্রিন্স আন্দ্রু বলকনস্কি। কুতুজভ ও হফক্রিগসরাথের অস্ট্রিয় সদস্যটি একটা টেবিলের পাশে বসেছিল। টেবিলের উপর একটা পরিকল্পনার নক্সা খোলা।

বলকনস্কির দিকে তাকিয়ে কুতুজভ বলল, ওঃ! এই একটি শব্দের সাহায্যেই অ্যাডজুটান্টকে অপেক্ষা করতে বলে সে ফরাসি ভাষায় আলাপ চালিয়ে যেতে লাগল।

অদ্ভুত উচ্চারণে চোস্ত ভাষায় সে বলল, আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি সেনাপতি, ব্যাপারটা যদি আমার । ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর নির্ভর করত তাহলে হিজ ম্যাজেস্টি সম্রাট ফ্রান্সিসের মনোবাসনা অনেক আগেই পূর্ণ হত। অনেক আগেই আমি আর্চডিউকের সঙ্গে যোগ দিতাম। আমার কথা বিশ্বাস করুন, সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালনা-ভার কোনো বিজ্ঞতর ও অধিকতর কুশলী সেনাপতির–সে রকম সেনাপতি অস্ট্রিয়ায় অনেকে আছেন-হাতে তুলে দিয়ে এই গুরুদায়িত্ব হতে অব্যাহতি পেলে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই খুশি হাতম। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনেক সময়ই আমাদের চাইতে বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে সেনাপতি।

কুতুজভ এমনভাবে হাসল যেন বলতে চাইল, আমার কথা বিশ্বাস না করবার অধিকার তোমার অবশ্যই আছে, আর তুমি বিশ্বাস কর আর না কর তাতে আমার কিছুই যায় আসে না; কিন্তু সে কথা বলবার কোনো কারণ তুমি পাও নি। আর সেটাই মোদ্দা কথা।

অস্ট্রিয় সেনাপতিকে দেখে অসন্তুষ্ট মনে হল, কিন্তু সেই একই সুরে জবাব দেওয়া ছাড়া তার উপায় ছিল না।

এমন উন্মা ও প্রতিবাদের সুরে সে কথা বলল যা তার স্তুতিবাচক কথাগুলির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। সে বলল, বরং এ যুদ্ধে সম্মিলিত উদ্যোগে ইয়োর এক্সেলেন্সির যোগদানকে হিজ ম্যাজেস্টি খুবই মূল্য দিয়ে থাকেন; কিন্তু আমরা মনে করি, বর্তমানের এই বিলম্বের ফলে রুশ বাহিনী ও তাদের সেনাপতি সেই জয়ের মালা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন যুদ্ধে যে মালা লাভ করতেই তারা চিরকাল অভ্যস্ত, পূর্ব-চিন্তিত এই পংক্তিটি দিয়েই সে তার বক্তব্য শেষ করল।

কুতুজভ সেই একই হাসি হেসে মাথা নিচু করল।

বলল, কিন্তু এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস; হিজ হাইনেস আর্চডিউক ফার্দিনানন্দ সর্বশেষ যে চিঠিখানি লিখে আমাকে সম্মানিত করেছেন সে চিঠিকে বিচার করে আমি আশা করি যে, সেনাপতি ম্যাকের মতো একজন কুশলী নেতার পরিচালনায় অস্ট্রিয় বাহিনী ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত জয়লাভের অধিকারী হয়েছে, এবং আমাদের সাহায্যের কোনো প্রয়োজনই তাদের আর নেই।

সেনাপতি ভুরু কুঁচকাল। যদিও অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের কোনো নির্দিষ্ট সংবাদ এখনো আসে নি, তবু চারদিকে যে সব প্রতিকূল গুজব ছড়িয়েছে তার সমর্থনসূচক কিছু কিছু ঘটনার কথা জানা গেছে; কাজেই অস্ট্রিয়ার জয়লাভের যে আশা কুতুজভ প্রকাশ করল সেটা অনেকটা ব্যঙ্গের মতোই শোনাল। কিন্তু কুতুজভ সেই একইভাবে খোলাখুলি হাসতে লাগল; যেন সে বলতে চায়, এ কথা মনে করবার অধিকার তার আছে। বস্তুত, ম্যাকের বাহিনীর কাছ থেকে সর্বশেষ যে চিঠিটা সে পেয়েছে তাতে একটা জয়লাভের কথা জানানো হয়েছে; আরো বলা হয়েছে যে, রণ-কৌশলের দিক থেকে সে বাহিনীর অবস্থান বেশ অনুকূল।

প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে কুতুজভ বলল, সেই চিঠিটা দাও। দয়া করে এদিকে একটু দৃষ্টি দিন-মুখের কোণে ব্যঙ্গের হাসি ফুটিয়ে কুতুজভ জার্মান ভাষায় লেখা আর্চডিউক ফার্দিনান্দের চিঠির নিম্নলিখিত অংশটুকু পড়তে লাগল।

শত্রুপক্ষ যদি লেচ অতিক্রম করে আসে তাহলে তাকে আক্রমণ করে পরাস্ত করবার জন্য প্রায় সত্তর হাজার সৈন্যের একটা গোটা বাহিনী আমরা সমাবেশ করেছি। তার উপরে, যেহেতু উলম আমাদের দখলে, সেজন্য দানিয়ুব নদীর উভয় তীরের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার সুবিধা আমরা অবশ্যই পাব; ফলে শত্রুপক্ষ যদি লেচ অতিক্রম না করে তাহলেও আমরা দানিয়ুব পার হয়ে তাদের সরবরাহ-ব্যবস্থার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব, আরো ভাটিয়ে গিয়ে পুনরায় নদী পার হতে পারব, এবং শত্রুপক্ষ যদি সর্বশক্তি নিয়ে আমাদের বিশ্বস্ত মিত্রপক্ষকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করে তবে তাদের সে বাসনাকেও বানচাল করে দিতে পারব। সুতরাং রুশ সাম্রাজ্য বাহিনী যতদিন সম্পূর্ণ সুসজ্জিত হয়ে না ওঠে ততদিন আমরা গভীর আত্ম-প্রত্যয়ের জন্য অপেক্ষা করব, আর সেই মুহূর্তটি এলেই তাদের সঙ্গে সহযোগিতায় শত্রুপক্ষের যথোচিত ভাগ্য-নির্ধারণের আয়োজন করব।

অনুচ্ছেদটি পড়া শেষ করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুতুজভ মনোযোগ সহকারে হক্ৰিগসরাথের সদস্যটির দিকে তাকাল।

অস্ট্রিয় সেনাপতিটি এসব ঠাট্টা-বিদ্রুপের ধার ধারে না; সোজা কাজের কথায় যেতে সে বলল, কিন্তু ইয়োর এক্সেলেন্সি, এই সুবচনটি তো আপনি জানেন, সর্বদাই খারাপ অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকা ভালো। আপনা থেকেই সে একবার এড-ডি-কং-এর দিকে তাকাল।

কুতুজভ তাকে বাধা দিয়ে বলল, মাফ করবেন সেনাপতি। তারপর প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ হে, কসলভস্কির কাছ থেকে আমাদের স্কাউটদের সব রিপোর্ট নিয়ে এস। এই দুটো কাউন্ট নস্তিজের চিঠি, এটা হিজ হাইনেস আর্চডিউক ফার্দিনাদের চিঠি, আর এগুলিও নাও। এই সবগুলি পড়ে অস্ট্রিয় বাহিনীর চলাচলের যে সব খবর আমরা পেয়েছি সে সমস্ত উল্লেখ করে ফরাসিতে একটা পরিস্কার স্মারকলিপি তৈরি কর, এবং সেটা হিজ এক্সেলেন্সিকে দিয়ে দাও।

প্রিন্স আলু মাথা নোয়াল, কুতুজভ যা বলল তা সে ভালোভাবেই বুঝেছে; এমনকি কুতুজভ তাকে আরো যা বলতে পারত তাও সে বুঝেছে। কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে দুজনকেই অভিবাদন জানিয়ে আস্তে আস্তে কার্পেটের উপর পা ফেলে সে প্রতীক্ষালয়ে চলে গেল।

প্রিন্স আন্দ্রু রাশিয়া ছেড়ে এসেছে খুব বেশি দিন হয় নি, কিন্তু এরই মধ্যে সে অনেক বদলে গেছে। মুখের ভাবে ও হাঁটা-চলায় আগেকার সেই আলস্য ও উদাসীনতার লেশমাত্র নেই। তাকে নিয়ে অন্যে কি ভাবছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন তার নেই; সদাসর্বদাই সে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে ও আশপাশের লোকজনদের নিয়ে সে যে সন্তুষ্ট তারই আভাস তার চোখে-মুখে; তার হাসি ও চাউনি আগের চাইতে অনেক বেশি উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়।

পোল্যান্ডে এসে সে কুতুজভের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কুতুজভ তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে, কথা দিয়েছে তাকে ভুলবে না, অন্য অ্যাডজুটান্টদের তুলনায় তাকে উপরে তুলছে, সঙ্গে করে ভিয়েনায় নিয়ে এসেছে, এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়েছে। ভিয়েনা থেকে কুতুজভ তার পুরনো বন্ধু প্রিন্স আর বাবাকে চিঠিতে লিখেছে : তোমার ছেলে যে একজন বিশিষ্ট অফিসার হতে পারবে, তার শ্রমশীলতা, দৃঢ়তা ও কর্মে প্রবৃত্তিতেই তা বুঝতে পারছি। আমার পাশে এরকম একটি সহকারীকে পেয়ে নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করছি।

পিটার্সবুর্গের সমাজে যেমন ছিল, এখানেও কুতুজভের কর্মচারীদের মধ্যে, তার সহকর্মী অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যেও, প্রিন্স আন্দুকে নিয়ে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মত গড়ে উঠেছে। একদল–তারা সংখ্যায় অল্প–তাকে নিজেদের থেকে আলাদা বলে মনে করে, এবং তার কাছ থেকে অনেক বড় কিছু প্রত্যাশা করে, তার কথা মন দিয়ে শোনে, তাকে প্রশংসা করে, অনুকরণ করে; তাদের সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রু বেশ স্বাভাবিকভাবে, খুশি মনে দিন কাটায়। আর একদল-তারা সংখ্যায় বেশি–তাকে অপছন্দ করে,-অহংকারী, উদাসীন ও অপ্রীতিকর মনে করে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করতে হবে প্রিন্স আন্দ্রু তা জানে; তাই তারাও তাকে শ্রদ্ধা করে, এমন কি ভয়ও করে।

কাগজপত্র নিয়ে প্রতীক্ষালয়ে ঢুকতেই বন্ধু কজলভস্কির সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। কজলভস্কি একজন কর্তব্যরত এড-ডি-কং। একটা বই নিয়ে সে জানালায় বসেছিল।

আরে, প্রিন্স যে? কজলভস্কি বলল।

আমরা কেন অগ্রসর হচ্ছি না তার কারণ ব্যাখ্যা করে একটা স্মারকলিপি লেখার হুকুম পেয়েছি।

কারণটা কি?

প্রিন্স আন্দ্রু কাঁধ ঝাঁকুনি দিল।

ম্যাকের কাছ থেকে কোনো খবর এসেছে?

না।

তার পরাজয়ের খবর সত্যি হলে অবশ্যই আসত।

বাইরের দরজার দিকে যেতে যেতে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, সম্ভবত।

ঠিক সেই মুহূর্তে একজন লম্বা অস্ট্রিয় সেনাপতি সশব্দে দরজাটা ঠেলে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকল। তার পরনে গ্রেটকোট, গলায় মারিয়া থেরেসা সামরিক চিহ্ন, মাথায় একটা কালো ব্যান্ডেজ জড়ানো। বোঝা গেল সে সবেমাত্র পৌঁছেছে। প্রিন্স আন্দ্রু মাঝপথে থেমে গেল।

প্রধান সেনাপতি কুতুজভ? দুজনের দিকেই তাকিয়ে ভিতরের দরজার দিকে সোজা এগিয়ে সদ্য আগত সেনাপতিটি কড়া জার্মান উচ্চারণে তাড়াতাড়ি প্রশ্নটা করল।

অতি দ্রুত অপরিচিত সেনাপতির কাছে এগিয়ে তার পথরোধ করে কজলভস্কি বলল, প্রধান সেনাপতি ব্যস্ত আছেন।

এরা তাকে চিনতে পারে নি দেখে বিস্মিত হয়ে অপরিচিত সেনাপতি খর্বকায় কজলভস্কির দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল।

জলভস্কি শান্ত গলায় আবার বলল, প্রধান সেনাপতি ব্যস্ত আছেন।

সেনাপতির মুখে মেঘ নামল, তার ঠোঁট কাঁপতে লাগল। একটা নোটবই বের করে তাড়াতাড়ি পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখে পাতাটা একটানে ছিঁড়ে কজলভস্কিকে দিল; দ্রুত পায়ে জানালার কাছে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে ঘরের লোকদের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন বলতে চাইল, এরা সব আমাকে দেখছে কেন? তারপর মাথাটা তুলে ঘাড় সোজা করে যেন কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পরমুহূর্তেই গুনগুন করতে শুরু করে দিল। ঘরের দরজা খুলে কুতুজভ দ্বারপথে দেখা দিল। মাথায় ব্যান্ডেজ-করা সেনাপতিটি কোনো বিপদের হাত থেকে পালাবার ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে তাড়াতাড়ি সরু পা ফেলে কুতুজভের দিকে এগিয় গেল।

লোকটি ভাঙা গলায় নিজের নামটা বলল।

খোলা দ্বার-পথে দাঁড়িয়ে কুতুজভের মুখটা কয়েক মুহূর্ত সম্পূর্ণ নির্বিকার হয়ে রইল। পরক্ষণে মুখের উপর ঢেউয়ের মতো কয়েকটা ভাঁজ পড়ল, কপালটা আবার মসৃণ হল। সশ্রদ্ধভাবে মাথাটা নুইয়ে সে চোখ বুজল, নীরবে ম্যাককে তার আগেই ঘরে ঢুকবার পথ করে দিল, তারপর নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিল।

অস্ট্রিয় পরাজিত হয়েছে এবং গোটা বাহিনী উলমে আত্মসমর্পণ করেছে এই মর্মে যে সংবাদ রটেছিল সেটা ঠিকই। আধ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাডজুটান্টদের এই নির্দেশ দিয়ে চারদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল যে, যে-সব রুশ সৈন্য এতদিন অকর্মণ্য হয়ে বসেছিল এবার তাদেরও শত্রুর সম্মুখীন হতে হবে।

প্রিন্স আন্দ্রু সেই সব বিরল অফিসারদের একজন যাদের প্রধান আগ্রহ যুদ্ধের অগ্রগতিকে নিয়ে। ম্যাককে দেখে এবং তার দুর্গতির বিবরণ শুনে সে বুঝতে পারল যে অভিযানের অর্ধেকই হাতছাড়া হয়ে গেছে; রুশ বাহিনীর সামনে যে সব অসুবিধা সমুপস্থিত তাও বুঝতে পারল; আর ভবিষ্যতে তাদের কপালে কি আছে এবং সে অবস্থায় তার কি ভূমিকা হবে তাও সে কল্পনা করে নিল। উদ্ধত অস্ট্রিয়ার এই পরাভবের চিন্তায় এবং একসপ্তাহকালের মধ্যেই সে হয়তো ফরাসিদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার প্রথম যুদ্ধটা দেখতে পাবে এবং তাতে অংশও নিতে পারবে এই ভাবনায় সে নিজের অজান্তেই একটা সানন্দ উত্তেজনা অনুভব করল। তার আশংকা হল, বোনাপার্তের প্রতিভা হয়তো রুশ বাহিনীর সব সাহসকেই হার মানাবে; আবার সেই সঙ্গে তার নায়কের পরাজয়কে সে মনে মনে মেনে নিতে পারল না।

এই সব চিন্তায় উত্তেজিত ও বিরক্ত হয়ে প্রিন্স আন্দ্রু তার ঘরে চলে গেল বাবাকে চিঠি লিখতে। প্রতিদিন সে বাবাকে চিঠি লেখে। বারান্দায় নেসভিৎস্কির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুজন এক ঘরেই থাকে। ভাড় ঝেরকভও সেখানে ছিল।

প্রিন্স আন্দ্রুর কালো মুখ ও চকচকে চোখ দেখে নেসভিৎস্কি শুধাল, তোমার মন খারাপ কেন?

খুশি হবার তো কারণ নেই, বলকনস্কি জবাব দিল।

নেসভিৎস্কি ও ঝেরকভের সঙ্গে প্রিন্স আর দেখা হতে না হতেই বারান্দার অপর দিক থেকে তাদের দিকে এগিয়ে এল অস্ট্রিয়া সেনাপতি স্ট্রচ এবং আগের দিন সন্ধ্যায় আগত হফক্রিগসরাথের সদস্যটি। স্ট্রচ কুতুজভের অধীনস্থ কর্মচারী, রুশ বাহিনীর খাদ্য ব্যবস্থার ভারপ্রাপ্ত। তিনজন অফিসারের পাশ দিয়ে চলে যাবার মতো যথেষ্ট জায়গা সেনাপতি দুজনের ছিল, কিন্তু নেসভিস্কিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঝেরকভ রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল, ওঁরা আসছেন! ওঁরা আসছেন!…সরে দাঁড়াও, পথ ছেড়ে দাও, দয়া করে পথ ছেড়ে দাও!

সেনাপতি দুজন পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল; এতটা মনোযোগ তাদের ভালো লাগে নি। এদিকে ভাঁড় ঝেরকভের মুখে হঠাৎ একটা দুষ্টুমির হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল, কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না।

এক পা এগিয়ে অস্ট্রিয় সেনাপতিকে লক্ষ্য করে বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সি, আপনাকে অভিনন্দন জানাই।

মাথাটা নিচু করে নাচের তালিম-নেওয়া ছোট শিশুর মতো সে প্রথমে এক পা ও পরে আর এক পা ঘষ্টে দাঁড়াল।

হফক্রিগসরাথের সদস্যটি কড়া চোখে তার দিকে তাকাল; কিন্তু তার দুষ্টু হাসির গুরুত্ব লক্ষ্য করে মুহূর্তের জন্য ফিরে তাকাল। চোখ দুটো পাকিয়ে বুঝিয়ে দিল যে সে শুনছে।

আপনাকে অভিনন্দন জানাই। সেনাপতি ম্যাক এসে গেছেন, ভালোই আছেন, তবে এখানটায় একটু ছড়ে গেছে, মাথাটা দেখিয়ে সে খুশির হাসি হাসল।

সেনাপতি ভুরু কুঁচকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

কয়েক পা গিয়ে রেগে বলে উঠল, হা ঈশ্বর, কী সরলতা!

নেসভিৎস্কি হেসে প্রিন্স আল্লুকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু বলকনস্কি মুখটাকে আরো কালো করে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে ঠেলে দিয়ে ঝেরকভের দিকে মুখ ফেরাল। ম্যাকের আগমন, তার পরাজয়ের খবর, আর রুশ বাহিনীর ভবিষ্যৎ চিন্তায় তার মনে যে বিরক্তির ভাব জমে উঠেছিল, ঝেরকভের বেতালা ঠাট্টায় সেটাই ক্রোধে ফেটে পড়ল।

নিচের চোয়ালটা ঈষৎ কাঁপিয়ে সে কঠোর স্বরে বলে উঠল, তুমি যদি নিজেকে একটা ভাঁড় বানাতে চাও তো আমি সেটা আটকাতে পারি না; কিন্তু আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমার সামনে যদি ভঁড়ামি করার দুঃসাহস দেখাও তো আমি তোমাকে দ্ৰব্যবহার শিখিয়ে দেব।

বলকনস্কির এতখানি রাগ দেখে নেসভিৎস্কি ও ঝেরকভ এতই অবাক হয়ে গেল যে তারা হাঁ করে তার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল।

ব্যাপারটা কি? আমি তো ওদের অভিনন্দন জানাচ্ছিলাম মাত্র, ঝেরকভ বলল।

আমি তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছি না, দয়া করে চুপ কর! বলকনস্কি চিৎকার করে বলল; তারপর

নেসভিৎস্কির হাত ধরে চলে গেল। ঝেরকভ কি বলবে বুঝতেই পারল না।

তাকে সান্ত্বনা দিতে নেসভিৎস্কি বলল, আরে, কি হল রে বাপু?

কি হল? প্রিন্স আন্দ্রু দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে বলতে লাগল : তুমি কি বুঝতে পারছ না যে, হয় আমরা আমাদের জার ও আমাদের দেশের সেবায় নিযুক্ত অফিসাররা, যেটা আমাদের সকলের লক্ষ্য তার সাফল্যে আমরা আনন্দ করব, দুর্ভাগ্যে দুঃখ পাব, আর না হয়তো আমরা সামান্য খানসামা মাত্র, মনিবের সুখ-দুঃখে যাদের কিছুই যায় আসে না। চল্লিশ হাজার সৈন্য খুন হয়ে গেল, আমাদের মিত্র-শক্তি ধ্বংস হয়ে গেল, আর তাই নিয়ে তোমরা ঠাট্টা করছ! যেন নিজের বক্তব্যকে জোরদার করার জন্যই সে কথাগুলি ফরাসিতে বলল। ওই যে অকর্মার ধাড়িটার সঙ্গে তুমি বন্ধুত্ব পাতিয়েছ এ-কাজ তাকে সাজে, কিন্তু তোমাকে সাজে না, সাজে না। এভাবে মজা করা শুধু অকর্মাদেরই সাজে।

কর্নেলটি কোনো জবাব দেয় কি না শুনবার জন্য সে একমুহূর্ত দাঁড়াল, কিন্তু সে মুখটা ঘুরিয়ে বারান্দার পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

*

অধ্যায়-৪

পাভলোগ্রাদ হুজারদের মোতায়েন করা হয়েছে ব্রাউমাউ থেকে দুমাইল দূরে। যে অশ্বারোহী সেনাদলে নিকলাস রস্তভ শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দিয়েছে তাদের বাসা পড়েছে একটি জার্মান গ্রাম সালজেনেকে। গ্রামের সবচাইতে ভালো বাসাটা দেওয়া হয়েছে অশ্বরোহী সেনাদলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন দেনিসভকে। গোটা অশ্বারোহী বাহিনীতে সে ভাস্কা দেনিসভ নামেই পরিচিত। পোল্যান্ডে এসে সেনাদলে যোগ দেবার পর থেকেই ক্যাডেট রস্তভ অধিনায়কের সঙ্গেই থাকে।

১১ অক্টোবর তারিখে ম্যাকের পরাজয়ের খবর নিয়ে হেড-কোয়ার্টারে সকলেই যখন চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তখনো এই অশ্বরোহী সেনাদলের অফিসারদের শিবির-জীবন যথারীতিই চলেছে। দেনিসভ সারা রাত তাস খেলায় হেরেছে; সে এখনো ঘরে ফেরে নি। খাদ্য-সগ্রহ অভিযান সেরে রস্তভ সবে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এসেছে। ক্যাডেট-ইউনিফর্ম পরিহিত রস্তভ ঘোড়াটাকে একেবারে ফটকে এনে হাজির করল, যৌবনসুলভ সহজ ভঙ্গিতে পাটাকে জিনের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল, যেন ঘোড়া ছেড়ে নামতে ইচ্ছা করছে না এমনিভাবে পা-দানের উপর একমুহূর্ত দাঁড়াল, আর তারপরেই লাফ দিয়ে নেমে আর্দালিকে ডাকল।

যে হুজারটি এক দৌড়ে ঘোড়র কাছে এসে হাজির হল তাকে দেখে রস্তভ বলল, আহা বন্দারেংকো, বন্ধু! ওকে একটু হাঁটাচলা করাও ভাই। সৎস্বভাবের যুবকরা মন ভালো থাকলে সকলের সঙ্গেই যেমন ভাই বেরাদারের মতো কথা বলে সেই রকম ভাবেই সে কথাগুলি বলল।

ইউক্রেনীয় হুজারটি খুশিতে মাথা নেড়ে বলল, করছি ইয়োর এক্সেলেন্সি।

মনে থাকে যেন, একটি হুজারও ঘোড়র কাছে ছুটে এসেছে, কিন্তু বন্দরেংকো ততক্ষণে ঘোড়ার মাথা থেকে রাশটা খুলে ফেলেছে। বোঝা গেল যে এই ক্যাডেটটি বেশ দরাজ হাতেই বকশিস দিয়ে থাকে, তার কাজ করে দিলে লাভ আছে। রস্তভ ঘোড়াটার গলায় ও পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় মারতে মারতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।

একটু হেসে মনে মনে ভাবল, চমৎকার! একদিন এটা কী ঘোড়াই না হবে! তলোয়ারটাকে উপরের দিকে তুলে সে এক দৌড়ে ফটকের সিঁড়ির কাছে গেল। তার বাড়িওলা ওয়েস্টকোট ও দুলো টুপি পরে একটা উকনঠেঙা হাতে নিয়ে গোয়াল থেকে গোবর পরিষ্কার করছিল। বাইরে তাকিয়ে রস্তভকে দেখেই তার মুখটা ঝলমলিয়ে উঠল। Schou gut Morgen! Schou gut Morgen! (সুপ্রভাত! সুপ্রভাত!) বড়ই খুশি হয়ে চোখ মিটমিট করে হাসতে হাসতে সে যুবকটিকে অভ্যর্থনা জানাল।

সেই একই ভাইয়ের মতো হাসি হেসে রস্তভ বলল, এর মধ্যেই কাজে লেগে গেছ! তারপর জার্মান বাড়িওলাটি প্রায়ই যে কথাগুলি বলে থাকে তারই পুনরাবৃত্তি করে বলে উঠল, অস্ট্রিয়ার জয় হোক! রাশিয়ার জয় হোক! সম্রাট আলেকজান্ডারের জয় হোক!

জার্মানটি হাসতে হাসতে গোয়াল থেকে বেরিয়ে এল। মাথার টুপি খুলে মাথার উপর নাড়তে নাড়তে চেঁচিয়ে বলল : Und die ganze Welt hoch! (সারা বিশ্বের জয় হোক!)।

জার্মানটির মতো রস্তভও টুপিটাকে মাথার উপর ঘুরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, Und vivat die ganze Welt! (সারা বিশ্ব জিন্দাবাদ!) জার্মানটি গোয়াল পরিষ্কার করছে, রস্তভ সবে ফিরেছে খড়-সংগ্রহের কাজ সেরে, দুজনের কারোরই আনন্দ করার কোনো হেতু নেই, তবু তারা ভাইয়ের মতো ভালোবাসায় খুশিমনে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল, পরস্পরের প্রতি অনুরাগের চিহ্নস্বরূপ মাথা নাড়তে লাগল, তারপর হেসে বিদায় নিল, জার্মানটি ফিরে গেল গোয়ালে, আর রস্তভ ফিরে গেল সেই ঘরটিতে যেখানে দেনিসভের সঙ্গে সে থাকে।

দেনিসভের আর্দালি লাভ্রুশকাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার মনিবের খবর কী?

লোকটিকে সকলেই পাজি বলেই জানে। সে উত্তর দিল, সন্ধ্যা থেকে তো দেখা নেই। নির্ঘাত খেলায় হারছেন। এতদিনে আমি বুঝে ফেলেছি, খেলায় জিতলে তাড়াতাড়ি ফিরে সে কথা সাতখানা করে বলেন, আর সকাল পর্যন্ত বাইরে কাটালেই বুঝতে পারি, খেলায় হেরেছেন, আর ফিরে এসে তম্বি শুরু করবেন। কফি খাবেন কি?

হ্যাঁ, আনো।

দশ মিনিট পরে লাভ্রুশকা কফি নিয়ে এল। বলল, তিনি আসছেন! এবার ঝামেলা শুরু হবে! জানালা দিয়ে তাকিয়ে রস্তভ দেখল, দেনিসভ ফিরছে। ছোটখাট চেহারা, লাল মুখ, কালো চকচকে চোখ, এলোমেলো কালো গোঁফ ও চুল। গায়ের আলখাল্লার বোতাম খোলা, চওড়া ব্রিচেস ভঁজে ভাঁজে ঝুলে পড়েছে, মাথার পিছনে একটা দুমড়ানো শাকো। বিষণ্ণ মুখে মাথা নিচু করে ফটক পর্যন্ত এল।

রেগে চেঁচিয়ে বলল, লাভ্রুশকার জবাব শোনা গেল।

ঘরে ঢুকে দেনিসভ বলল, আচ্ছা, তুমি এসে গেছ দেখছি!

রস্তভ বলল, অনেকক্ষণ এসেছি। খড় আনতে গিয়েছিলাম, ফ্রলিন মাথিল্ডার সঙ্গে দেখা হল।

বটে! আর আমি এদিকে হেরে ভূত, বাওয়া! কাল তো বোকা গাধার মতো হেরেছি! কপাল খারাপ! কপাল খারাপ! তুমিও চলে এলে আর অমনি শুরু হল, চলতেই থাকল। এই, কোথায় রে! চা!

মুখ ফাঁক করে হেসে ছোট ছোট শক্ত দাঁত বের করে সে তার ঘন কালো জটাধা চুলে আঙুল চালাতে লাগল।–

কপালে ও সারা মুখে দুই হাত ঘষতে ঘষতে বলল, কেন যে মরতে ওই ধেড়ে ইঁদুরটার কাছে গিয়েছিলাম? (একজন অফিসারের ডাক নাম ধেড়ে ইঁদুর)। ভেবে দেখ, সে লোকটা আমাকে একটা কানা কড়িও জিততে দেয়নি।

পাইপটা ধরিয়ে এনে দিলে সেটাকে মুঠোর মধ্যে ধরে মেঝের উপর আছড়াতে শুরু করল। আগুনের ফুলকি যত উড়তে থাকে, সেও তত চেঁচাতে থাকে।

জ্বলন্ত তামাকগুলোকে চারদিকে ছড়িয়ে দিল, পাইপটাকে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ খুশি হয়ে উঠে কালো চকচকে চোখ মেলে রশুভের দিকে তাকাল।

অন্তত কিছু মেয়েমানুষও যদি এখানে থাকত, কিন্তু শুধু মদ গেলা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তাড়াতাড়ি লড়াইতে চলে যেতে পারলেও হত। হেই, কে ওখানে? ভারী বুটের শব্দ ও পাদানির ইং-ঠাং আওয়াজ এবং একটি সশ্রদ্ধ কাশির শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে সে বলল।

সেনাদলের কোয়ার্টার মাস্টার! লাভ্রুশকা হেঁকে বলল। দেনিসভের মুখটা আরো কুঁচকে উঠল।

হতভাগা! বিড় বিড় করে কথাটা বলে কিছু স্বর্ণমুদ্রাসহ থলিটা ছুঁড়ে দিল। রস্তভ, ভাই, এর মধ্যে কত আছে দেখে নিয়ে থলিটাকে বালিশের নিচে ঢুকিয়ে দাও তো। কথা শেষ করে সে কোয়ার্টার মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেল।

রস্তভ থলি ঝেড়ে নতুন ও পুরনো মুদ্রাগুলোকে আলাদা করে সাজিয়ে গুণতে শুরু করল।

ওহো! তেলিয়ানিন! কেমন আছ? কাল রাতে ওরা আমার পালক ছাড়িয়ে দিয়েছে, পাশের ঘর থেকে দেনিসভের গলা শোনা গেল।

কোথায়? সেই ধেড়ে ইঁদুর বাইকতের কাছে… আমি জানতাম, একটি বাঁশির মতো সুরে জবাব শোনা গেল, আর পরক্ষণেই ওই একই সেনাদলের একজন খুদে অফিসার লেফটেন্যান্ট তেলিয়ানিন ঘরে ঢুকল।

থলিটাকে বালিশের নিচে গুঁজে দিয়ে রস্তভ তার বাড়ানো ঠাণ্ডা হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিল। যে কারণেই হোক, এই অভিযানের ঠিক আগেই তেলিয়ানিনকে রক্ষীবাহিনী থেকে বদলি করা হয়েছে। রেজিমেন্টে তার ব্যবহার বেশ ভালোই, তবু কেউ তাকে পছন্দ করে না; বিশেষত রস্তভ তাকে খুবই অপছন্দ করে এবং লোকটির প্রতি তার এই অকারণ বিরূপতাকে জয় করতে বা ঢেকে রাখতেও পারে না।

এই যে তরুণ হুজার, আমার রুকটি কেমন চলছে? সে জিজ্ঞাসা করল। (তেলিয়ানিন রুক নামক একটা ঘোড়া রশুভের কাছে বিক্রি করেছিল।)

ফেলটেন্যান্টটি যার সঙ্গে কথা বলে কখনো সোজা তার মুখের দিকে তাকায় না; তার চোখ দুটো অনবরত এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে।

আজ সকালেই তোমাকে ঘোড়ায় চাপতে দেখেছি, সে আরো বলল।

ঘোড়াটার জন্য রস্তভ সাতশো রুবল দিয়েছিল, কিন্তু সেটার উচিত দাম তার অর্ধেকও হওয়া উচিত নয়। তবু সে জবাবে বলল, ওঃ, ঘোড়াটা ভালোই আছে; বেশ ভালো ঘোড়া। তবে বাঁদিকে সামনের পাটা একটু খুঁড়িয়ে চলতে শুরু করেছে।

ক্ষুরটা ফেটে গেছে! ও কিছু না। কি করতে হবে আমি বলে দেব। কি ধরনের কাটা ব্যবহার করতে হবে তাও দেখিয়ে দেব।

দয়া করে দিও, রস্তভ বলল।

নিশ্চয় দেব, নিশ্চয় দেব। এটা তো গোপন ব্যাপার কিছু নয়। অবশ্য ঘোড়াটার জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতেই হবে।

তাহলে তো ঘোড়াটাকে নিয়ে আসতে হয়, তেলিয়ানিনকে এড়াবার জন্য রস্তভ বেরিয়ে গেল।

বারান্দার দেনিসভ চৌকাঠের উপর বসে ছিল, আর সামনে দাঁড়িয়ে কোয়ার্টার মাস্টার কি যেন বুঝিয়ে বলছিল। রশুভকে দেখে দেনিসভ মুখটা বিকৃত করে ঘাড়ের উপর দিয়ে বুড়ো আঙুলটাকে বেঁকিয়ে যে ঘরে তেলিয়ানিন রয়েছে সেটা দেখিয়ে দিল। তার চোখে-মুখে বিরক্তি ও অস্বস্তি ফুটে উঠল।

কোয়ার্টার মাস্টারের সামনেই বলে উঠল, উঃ! ঐ লোকটাকে আমি দেখতে পারি না।

রস্তভ কাঁধটা ঝাঁকুনি দিল; যেন বলতে চাইল; আমিও দেখতে পারি না, কিন্তু কি করা যাবে? ঘোড়া আনবার হুকুম করে সে আবার তেলিয়ানিনের কাছে ফিরে গেল।

তেলিয়ানিন সেই একইভাবে নেতিয়ে বসে হোট শাদা হাত দুটো ঘষছে।

ঘরে ঢুকতেই রভের মনে হল, সত্যি, কিছু লোক আছে যারা বড়ই বিরক্তিকর।

উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্তত তাকাতে তাকাতে তেলিয়ানিন বলল, ঘোড়াটাকে আনতে বলেছ তো?

বলেছি।

চল আমরাই যাই। আমি শুধু কালকের নির্দেশনামার কথা দেনসিভের কাছ থেকে জানতে এসেছিলাম। তুমি কি হুকুমটা পেয়েছ দেনিসভ?

এখনো পাইনি। কিন্তু তুমি কোথায় চললে?

এই যুবকটিকে ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো শিখিয়ে দিতে, তেলিয়ানিন জবাব দিল।

ফটক পেরিয়ে তারা আস্তাবলে ঢুকল। ক্ষুরে কেমন করে কাটা মারতে হয় সেটা বুঝিয়ে দিয়ে লেফটেন্যান্ট তার নিজের বাসায় চলে গেল।

রস্তভ ফিরে গিয়ে টেবিলের উপর এক বোতল ভদকা ও কিছুটা কাবাব দেখতে পেল। দেনিসভ সেখানে । বসে এক তা কাগজে কলম দিয়ে খসখস করে কি যেন লিখে চলেছে। গম্ভীরভাবে রস্তভের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল :

তাকে চিঠি লিখছি।

কলমটা হাতে নিয়ে কনুইতে ভর দিয়ে চিঠির বক্তব্যটা মুখেই রস্তভকে বলতে লাগল।

দেখ বন্ধু, যখন ভালোবাসা না থাকে তখনই আমরা ঘুমোই। আমরা তো মাটির সন্তান…কিন্তু লোকে তো প্রেমে পড়ে, ঈশ্বর হয়, সৃষ্টির প্রথম দিনের মতো পবিত্র হয়…আবার কে এল? তাকে নরকে পাঠিয়ে দাও, আমি এখন ব্যস্ত আছি! মোটেই ঘাবড়ে না গিয়ে লাভ্রুশকা তার কাছে এসে হাজির হতেই দেনিসভ চিৎকার করে বলে উঠল।

আবার কে! আপনিই তো ওকে আসতে বলেছিলেন। কোয়ার্টার মাস্টার এসেছে টাকার জন্য।

দেনিসভ ভুরু কুঁচকে চেঁচিয়ে কি একটা জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল।

নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, হতভাগা কাজ! থলিতে কত আছে? রস্তভের দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

সাতটা নতুন আর তিনটে পুরনো বড় মুদ্রা।

ওঃ, হতভাগা! আরে, তুমি এখানে কাকতাড় য়ার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোয়ার্টার মাস্টারকে ডাক, সে লাভ্রুশকাকে হেঁকে বলল।

দেখ দেনিসভ, আমি তোমাকে কিছুটা ধার দিচ্ছি : তুমি জান আমার কিছু আছে, মুখ লাল করে রস্তভ বলল।

আপনজনের কাছ থেকে ধার করা আমি পছন্দ করি না, মোটেই পছন্দ করি না, দেনিসভ গজরাতে গজরাতে বলল।

কিন্তু তুমি যদি বন্ধু মনে করে আমার কাছ থেকে টাকা না নাও তাহলে আমি অসন্তুষ্ট হব। সত্যি, আমার টাকা আছে, রস্তভ আবার বলল।

না। আমি বলছি, না।

বালিশের তলা থেকে থলিটা বের করতে দেনিসভ বিছানার কাছে গেল।

কোথায় রেখেছ রস্তভ?

নিচের বালিশের তলায়।

দেনিসভ দুটো বালিশই মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। থলিটা নেই।

এ তো অলৌকিক ব্যাপার।

দাঁড়াও, তুমি ফেলে দাও নি তো? একটা একটা করে বালিশ দুটো তুলে ঝাড়তে ঝাড়তে রস্তভ বলল।

লেপটা তুলে ঝাড়ল। সেখানেও থলি নেই।

তাই তো ভাই, তাহলে কি আমারই ভুল? না, তুমি যে মূল্যবান সম্পত্তির মতো ওটাকে মাথার নিচেই  রাখ সে-কথা যে আমি ভেবেছিলাম তাও আমার বেশ মনে পড়ছে, রস্তভ বলল। ঠিক এখানেই রেখেছিলাম। কোথায় গেল? সে লাভ্রুশকাকে জিজ্ঞাসা করল।

আমি তো ঘরেই ছিলাম না। আপনি যেখানে রেখেছিলেন সেখানেই তো থাকবে।

কিন্তু সেখানে নেই!…

তুমি তো সব সময়ই ওই রকম; জিনিসপত্র যেখানে-সেখানে ফেলে রাখ, আর তার পরে ভুলে যাও। নিজের পকেট খুঁজে দেখ।

রস্তভ বলল, না, ওটাকে অতটা মূল্যবান আমি ভাবি নি, কিন্তু আমার বেশ মনে আছে, এখানেই রেখেছিলাম।

লাভ্রুশকা গোটা বিছানাটা উল্টে পাল্টে দেখল, বিছানার নিচে, টেবিলের নিচে খুঁজল, কোনো জায়গা দেখতে বাকি রাখল না; তারপর ঘরের মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দেনিসভ চুপচাপ লাভ্রুশকার চালচলন দেখল; তারপর সে যখন অবাক হয়ে দুই হাত উপরে তুলে জানাল যে কোথাও সেটা পাওয়া গেল না, তখন রস্তভের দিকে তাকাল।

রস্তভ, তুমি ইস্কুলের ছেলেদের মতো চালাকি করছ না তো…

দেনিসভের দৃষ্টি যে তার উপর নিবদ্ধ সেটা বুঝতে পেরে রস্তভ চোখ তুলে তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিল। যে রক্তটা এতক্ষণ গলার নিচে কোথাও জমেছিল সেটা এবার তার মুখে ও চোখে উঠে এল। সে যেন শ্বাস নিতেও পারছে না।

লাভ্রুশকা বলল, লেফটেন্যান্ট ও আপনি ছাড়া আর কেউ ঘরে ঢোকে নি। ওটা এখানেই কোথাও থাকবেই।

তবে রে ব্যাটা শয়তানের পুতুল! একটু নড়ে-চড়ে খুঁজে দেখ, দেনিসভ হঠাৎ অগ্নিমূর্তি হয়ে চিৎকার করতে করতে আর্দালির দিকে ছুটে গেল। থলি পাওয়া গেলে আমি তোকে চাবুক মারব, চাবুক মারব।

দেনিসভের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রস্তভ কোটের বোম এঁটে, কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে টুপিটা মাথায় দিল।

আর্দালিকে ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দেয়ালের উপর ঠুকে দেনিসভ চেঁচাতে লাগল, থলিটা আমার চাই, এই তোকে বলে রাখছি।

দরজার কাছে গিয়ে চোখ না তুলেই রস্তভ বলল, ওকে ছেড়ে দাও দেনিসভ; আমি জানি থলি কে নিয়েছে।

দেনিসভ থামল; এক মুহূর্ত কি ভাবল; তারপর রস্তভের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার হাতটা চেপে ধরল।

বাজে কথা! সে চেঁচিয়ে উঠল; তার কপালের ও গলার শিরাগুলো দড়ির মতো ফুলে উঠল। আমি বলছি, তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ। এ আমি হতে দেব না। থলি এখানেই আছে! আমি এই শয়তানটাকে জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নেব, তাহলেই সেটা পাওয়া যাবে।

আমি জানি ওটা কে নিয়েছে, কাঁপা গলায় আর একবার কথাটা বলে রস্তভ দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

তাকে বাধা দিতে দরজার দিকে ছুটে গিয়ে দেনিসভ চিৎকার করে বলল, আমি বলছি, অমন কাজও করো না।

কিন্তু রস্তভ তার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এমন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সোজা তার মুখের দিকে তাকাল যেন দেনিসভ তার সবচাইতে বড় শত্রু।

কাঁপা গলায় বলল, তুমি যা বলছ তার অর্থ বোঝ? আমি ছাড়া এ ঘরে আর কেউ ছিল না। কাজেই আমি যা ভাবছি তা যদি না হয়তো…

কথা শেষ না করেই সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আঃ, শয়তান তোমাদের সকলের মাথায়ই ভর করুক, সর্বশেষ এই কথাগুলিই রস্তভ শুনতে পেল।

রস্তভ গেল তেলিয়ানিনের বাসায়।

তেলিয়ানিনের আর্দালি বলল, মনিব তো বাড়ি নেই, হেড-কোয়ার্টারে গেছেন। তারপর ক্যাডেটের বিক্ষুব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে?

না, কিছু না।

অল্পের জন্য তাকে ধরতে পারলেন না, আর্দালি বলল।

সালজেনেক থেকে হেড-কোয়ার্টারের দূরত্ব দুমাইল। বাড়ি ফিরে না গিয়ে রস্তভ একটা ঘোড়া নিয়ে সেখানেই ছুটল। গ্রামের একটা সরাইখানায় অফিসারদের খুব যাতায়াত ছিল। সেখানে পৌঁছে রস্তভ দেখল, ফটকে তেলিয়ানিনের ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে।

সরাইখানার দুই নম্বর ঘরে লেফটেন্যান্ট বসে আছে এক ডিম কাবাব ও এক বোতল মদ নিয়ে।

হেসে ভুরু তুলে সে বলল, আরে, তুমিও এসে পড়েছ দেখছি!

হ্যাঁ, অনেক কষ্টে কথাটা উচ্চারণ করে সে কাছেই একটা টেবিলে বসল।

দুই জনই চুপচাপ। ঘরে আরো দুই জন জার্মান ও একজন রুম অফিসার ছিল। কারো মুখে কথা নেই। শুধু ছুরির টুং-টাং আর লেফটেন্যান্টের চিবনোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।

খাওয়া শেষ করে তেলিয়ানিন পকেট থেকে একটা ডবল থলি বের করল; থলির রিংটা একপাশে টেনে একটা বড় স্বর্ণমুদ্রা বের করে ভুরু তুলে সেটা পরিচারককে দিল।

বলল, একটু তাড়াতাড়ি করো।

মুদ্রাটা নতুন। রস্তভ আসন ছেড়ে তেলিয়ানিনের কাছে গেল।

প্রায় শুনতে পাওয়া যায় না এমনি নিচু গলায় বলল, তোমার থলিটা একটু দেখি তো।

তেলিয়ানিন থলিটা তার হাতে দিল।

হ্যাঁ, থলিটা বেশ ভালো। সত্যি সত্যি, বলেই হঠাৎ তার মুখটা কালো হয়ে গেল। আবার বলল, চেয়েই দেখ না মশাই।

রস্তভ থলিটা হাতে নিল, থলিটা ও ভিতরকার মুদ্রাগুলি খুঁটিয়ে দেখল। তারপর তেলিয়ানিনের দিকে তাকাল। তেলিয়ানিন অভ্যাসমতোই চারদিকে তাকাচ্ছিল; হঠাৎ সে খুব খুশি হয়ে উঠল।

বলল, ভিয়েনায় যেতে পারলেই এটাকে হাল্কা করে ফেলব; এই হতভাগা ছোট শহরে তো খরচ করবার জায়গাই নেই। ঠিক আছে, ওটা আমাকে দিয়ে দাও। আমি চলে যাব।

রস্তভ কথা বলল না।

তেলিয়ানিন বলতে লাগল, আর তুমি? তুমিও লাঞ্চ খাবে না কি? এখানে এরা কিন্তু খাওয়ায় ভালো। এবার তাহলে ওটা আমাকে দিয়ে দাও।

থলিটা নেবার জন্য সে হাত বাড়াল। রস্তভও দিয়ে দিল। থলিটা নিয়ে তেলিয়ানিন আলগাভাবে সেটাকে রাইডিং-ব্রিচেসের পকেটে রেখে এমনভাবে ভুরু দুটো তুলে মুখটাকে ঈষৎ ফাঁক করল যেন বলতে চাইল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার থলি আমি পকেটে পুরলাম; এটা তো একটা সরল ব্যাপার, এ নিয়ে অন্য কারো মাথা ঘামাবার কিছু নেই।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল, আচ্ছা, চলি। ভুরু দুটি তুলে সে রশুভের দিকে তাকাল।

তেলিয়ানিনের চোখ থেকে একটা বিদ্যুতের ঝিলিক যেন রশুভের চোখে গিয়ে লাগল, আবার ফিরে এল; মুহূর্তের মধ্যে এমনি বারবার গেল আর ফিরে এল।

এখানে এস, বলে রস্তভ তেলিয়ানিনের হাত ধরে তাকে প্রায় টানতে টানতেই জানালার কাছে নিয়ে গেল। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ও টাকা দেনিসভের; তুমি নিয়ে নিয়েছ…

কি? কি? এত সাহস তোমার? কি? তেলিয়ানিন বলল।

কিন্তু কথাগুলি শোনাল বড় করুণ, হতাশ কান্নার মতো, ক্ষমা প্রার্থনার মতো। কথাগুলি শুনেই সন্দেহের একটা প্রকাণ্ড বোঝ রস্তভের মন থেকে নেমে গেল। সে খুশি হল, আবার সেই সঙ্গে সম্মুখে দাঁড়ানো দুঃখী লোকটির জন্য করুণাও হল। কিন্তু যে কাজ সে শুরু করেছে সেটা তো শেষ করতেই হবে।

টুপিটা হাতে নিয়ে একটা ছোট খালি ঘরের দিকে যেতে যেতে তেলিয়ানিন আমতা-আমতা করে বলল, এখানকার লোকগুলো কি মনে করল তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। একটা কিছু তো বোঝাতে হবে…

আমি জানি; প্রমাণ করেও দেব,রস্তভ বলল।

আমি…

তেলিয়ানিনের ভয়ার্ত মুখের প্রতিটি পেশী কাঁপছে; চোখ দুটো এখনো এদিক-ওদিকে ঘুরলেও সে দৃষ্টি অবনত, রশুভের মুখের দিকে সে তাকাতে পারছে না; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছে।

কাউন্ট! একটি যুবকের ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না…এই নাও সেই হতভাগা টাকা, নাও… থলিটাকে টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিল, আমার বুড়ো বাবা আছে, মা আছে!…।

তেলিয়ানিনের চোখের দিকে না তাকিয়ে রস্তভ টাকাটা নিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার কাছে থেমে আবার ফিরে এল। চোখের জল ফেলে বলল, হা ঈশ্বর, এ কাজ তুমি করলে কেমন করে?

তার কাছে গিয়ে তেলিয়ানিন ডাকল, কাউন্ট,…

পিছনে সরে গিয়ে রস্তভ বলল, আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার যদি দরকার থাকে, টাকাটা নিয়ে যাও; থলিটা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে রস্তভ ছুটে সরাইখানা থেকে বেরিয়ে গেল।

*

অধ্যায়-৫

সেদিন সন্ধ্যায় স্কোয়াড্রন-অফিসারদের মধ্যে একটা উত্তেজিত আলোচনা চলছিল দেনিসভের বাসায়। আমি তোমাকে বলছি রস্তভ, কর্নেলের কাছে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে, স্টাফ-ক্যাপ্টেন কারনে কথাটা বলল। লোকটি লম্বা, মাথায় ধূসর চুল, প্রকাণ্ড গোঁফ, আর মুখভর্তি বলী-রেখা। রস্তভ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে।

স্টাফ-ক্যাপ্টেন কারস্তেনের দুইবার পদাবনতি ঘটেছে, আবার দুইবারই কমিশনে পুনর্বহাল হয়েছে।

রস্তভ চেঁচিয়ে বলে উঠল, কেউ আমাকে মিথ্যুক বলবে তা আমি হতে দেব না। সে বলেছে আমি মিথ্যা বলেছি, আর আমি বলেছি সে মিথ্যা বলেছে। বাস, ঐ পর্যন্ত। সে আমাকে রোজ ডিউটি করাতে পারে, আমাকে গ্রেপ্তার করাতে পারে, কিন্তু কেউ আমাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াতে পারবে না। কারণ এই রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে সে যদি মনে করে যে আমার কাছে কৈফিয়ৎ দেওয়া তার মর্যাদার পক্ষে হানিকর, তাহলে…

স্টাফ-ক্যাপ্টেন তার লম্বা গোঁফে ধীরে ধীরে চাড়া দিয়ে গম্ভীর গলায় কথার মাঝখানেই বলে উঠল, এক মিনিট থাম; আমার কথাটা শোন। অন্য অফিসারদের সামনে তুমি বলেছ যে একজন অফিসার চুরি করেছে…

কথাটা যে অন্য অফিসারদের সামনে শুরু হয়েছিল সে জন্য তো আমি দোষী নই। হয়তো তাদের সামনে কথাটা বলা আমার উচিত হয় নি, কিন্তু আমি তো কূটনীতিবিদ নই। তাই তো অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দিয়েছি, কারণ আমি ভেবেছিলাম এখানে কোনো রকম চাতুরির দরকার হবে না। সে বলেছে যে আমি মিথ্যাবাদী-কাজেই তাকে আমার কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে… ।

ঠিক আছে। কেউ তোমাকে ভীরু ভাবছে না, কিন্তু আসল কথাটা তা নয়। একজন ক্যাডেটের পক্ষে একজন রেজিমেন্ট-কমান্ডারের কাছে কৈফিয়ৎ চাওয়াটাই অবাস্তব কি না সেটা তুমি বরং দেনিসভকেই জিজ্ঞাসা কর।

দেনিসভ চুপচাপ বসে গোঁফ কামড়াতে কামড়াতে আলোচনা শুনছিল; তাতে যোগ দেবার ইচ্ছা তার ছিল না। আপত্তিসূচক ঘাড় নেড়েই সে স্টাফ-ক্যাপ্টেনের প্রশ্নের জবাব দিল।

স্টাফ-ক্যাপ্টেন বলতে লাগল, অন্য অফিসারদের সামনে এই বাজে কথাগুলি তুমি কর্নেলকে বলেছ, আর বোগদানিচ (কর্নেলের নাম) তোমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

সে আমাকে চুপ করিয়ে দেয় নি, বলেছে আমি মিথ্যা বলেছি।

বেশ তো তাই হল; তুমিও তাকে অনেক বাজে কথা বলেছ, তাই তোমাকে ক্ষমা চাইতেই হবে।

কিছুতেই না, রস্তভ চেঁচিয়ে বলল।

স্টাফ-ক্যাপ্টেন এবার গম্ভীর হয়ে কড়া গলায় বলল, তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করি নি। ক্ষমা চেয়ে নেবার ইচ্ছা তোমার নেই, কিন্তু বাপু, শুধু তার কাছে নয়, গোটা রেজিমেন্টের কাছে আমাদের সকলের কাছে–তুমিই তো দোষী। ব্যাপারটা তো এই : তোমার উচিত ছিল সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে পরামর্শ নেওয়া; কিন্তু তা না করে তুমি গিয়ে সকলের সামনে হৈ-চৈ শুরু করে দিলে। এ অবস্থায় কর্নেল কি করবে? অফিসারের বিচার করে গোটা রেজিমেন্টকে অপমান করবে? একটা পাজি লোকের জন্য গোটা রেজিমেন্টের অসম্মান করবে? তুমি কি সেইভাবে ব্যাপারটাকে দেখেছ? আমরা সে ভাবে দেখছি না। আর বোগদানিচও কাঠ-বোকা : সে তোমাকে বলে বসল তুমি মিথ্যা কথা বলছ। ব্যাপারটা সুখের নয়, কিন্তু কি কথা করা যাবে বাপু? তুমি নিজেই গাড়ায় পা দিয়েছ। আর এখন, আমরা চাইছি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে, অথচ অহংকারের বশে তুমি ক্ষমা চাইতে নারাজ হয়ে সমস্ত ব্যাপারটাকে জনসাধারণের সামনে হাজির করতে চাইছ। তোমার মনে আঘাত লেগেছে তা বুঝি, কিন্তু একজন প্রবীণ সম্মানিত অফিসারের কাছে ক্ষমা চাইতে দোষ কি? আর যাই হোক, বোগদানিচ একজন সম্মানিত, সাহসী, প্রবীণ কর্নেল তো বটে! তার ব্যবহারে তুমি অসন্তুষ্ট হয়েছ, কিন্তু গোটা রেজিমেন্টের অসম্মানের কথাটা একবারও ভাবলে না! স্টাফ-ক্যাপ্টেনের গলা কাঁপতে লাগল। আরে বাপু, তুমি সবে রেজিমেন্ট এসেছ; আজ এখানে আছ, কালই হয়তো অন্য কোথাও অ্যাডজুটান্ট হয়ে চলে যাবে। সেখানে কেউ যখন বলবে, পাভলোগ্রাদ অফিসারদের মধ্যে যত সব চোরের আড্ডা তখন তুমি তো খুশিতে আঙুল মটকাবে। কিন্তু আমরা তো তা পারব না! ঠিক বলি নি দেনিসভ? ব্যাপারটা এক নয়!

দেনিসভ চুপ করে রইল, কোনোরকম নড়াচড়াই করল না, তবে মাঝে মাঝে চকচকে কালো চোখ মেলে রস্তভের দিকে তাকাতে লাগল।

স্টাফ-ক্যাপ্টেন বলতে লাগল, নিজের অহংকারই তোমার কাছে বড় হল, তাই তুমি ক্ষমা চাইতে নারাজ; কিন্তু আমরা প্রবীণরা এই রেজিমেন্টে থেকেই বড় হয়েছি, আর ঈশ্বর করলে এই রেজিমেন্টেই মারাও যাব, তাই তো রেজিমেন্টের সম্মানকে আমরা মূল্য দিই, আর বোগদানিচ তা জানে। সত্যি বলছি, আমরা বুড়োরা রেজিমেন্টকে যথেষ্ট মূল্য দিই! তাই এ সব ঠিক হচ্ছে না, ঠিক হচ্ছে না! তুমি কষ্ট পাও বা না পাও, আমি সব সময় সত্যকেই আশ্রয় করি। এ ঠিক হচ্ছে না!

স্টাফ-ক্যাপ্টেন উঠে রভের কাছ থেকে চলে গেল।

লাফিয়ে উঠে দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল, ঠিক কথা! তারপর রস্তভ, তারপর!

রস্তভের মুখ একবার লাল হচ্ছে, একবার কালো হচ্ছে। সে একবার এ অফিসারের দিকে, একবার ও অফিসারের দিকে তাকাতে লাগল।

না, ভদ্রমহোদয়গণ, না…আপনারা ভাববেন না…আমি সব বুঝি। আমার সম্পর্কে আপনাদের এ ধারণা ভুল…আমি…আঃ, ঠিক আছে, আমি কাজেই তা দেখাব; আর আমার কাছে পতাকার সম্মান…আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, এ কথাই সত্যি যে আমারই দোষ, সকলের কাছে আমিই দোষী। তারপর, আপনারা আর কি চান?…

এই তো, এই তো সব ঠিক হয়ে গেল কাউন্ট! ঘুরে দাঁড়িয়ে মস্ত বড় হাত দিয়ে রস্তভের কাঁধটা চাপড়ে দিয়ে স্টাফ-ক্যাপ্টেন বলে উঠল।

দেনিসভও চেঁচিয়ে বলল, আমি বলছি, এ অতি সজ্জন লোক।

স্টাফ-ক্যাপ্টেন বলল, এই তো ভালো হল কাউন্ট। যাও ইয়োর এক্সেলেন্সি, ক্ষমা চেয়ে নাও। হ্যাঁ, যাও!

মিনতির সুরে রস্তভ বলল, ভদ্রমহোদয়গণ, সব কিছু করতে আমি প্রস্তুত। কারো কাছে আমি একটি কথাও বলব না, কিন্তু ক্ষমা চাইতে পারব না; ঈশ্বরের দোহাই, আমি তা পারি না; আপনাদের যা ইচ্ছা করতে পারেন! কেমন করে আমি ছোট ছেলের মতো গিয়ে ক্ষমা চাইব?

দেনিসভ হাসতে লাগল। এতে তোমার পক্ষে আরো খারাপ হবে। বোগদানিচ প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ; এই একগুয়েমির ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে কারস্তেন বলল।

না, বিশ্বাস করুন এটা একগুয়েমি নয়! আমার মনের ভাব আমি বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আমি পারি না…

স্টাফ-ক্যাপ্টেন বলল, ঠিক আছে; তোমার যেমন অভিরুচি। তারপর দেনিসভকে বলল, আর সে পাজিটার কি হয়েছে?

দেনিসভ আমতা-আমতা করে বলল, সে অসুস্থতার রিপোের্ট করেছে; কালকের তালিকা থেকে তার নামটা কেটে দিতে হবে।

স্টাফ-ক্যাপ্টেন বলল, অসুস্থতা ছাড়া অন্য কোনোভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

রক্ত-তৃষাতুর স্বরে দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল, অসুখ হোক আর নাই হোক, সে যেন আমার সামনে না আসে। আমি তাকে খুন করে ফেলব!

ঠিক সেই সময় ঝেরকভ ঘরে ঢুকল।

নবাগতের দিকে ফিরে অফিসাররা চিৎকার করে বলল, তুমি আবার এখানে কেন?

মশাইরা, আমাদের যুদ্ধে যেতে হবে! তার পুরো বাহিনী নিয়ে ম্যাক আত্মসমর্পণ করেছে।

এ কথা সত্যি নয়!

আমি নিজে তাকে দেখেছি!

কি? আসল ম্যাককে দেখেছ? সশরীরে?

যুদ্ধ! যুদ্ধ! এমন খবর আনার জন্য ওকে একটা বোতল এনে দাও! কিন্তু তুমি এখানে এলে কেমন করে?

সেই শয়তান ম্যাকের জন্যই আমাকে রেজিমেন্টে ফেরৎ পাঠানো হয়েছে। একজন অস্ট্রিয় সেনাপতি আমার নামে নালিশ করেছে। ম্যাক এখানে এলে আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম।…ব্যাপার কি রস্তভ? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র গরম জলে স্নান করে এলে।

আরে বাবা, গত দুদিন যাবৎ আমরা বড়ই গোলমালে কাটাচ্ছি।

ঘরে ঢুকল রেজিমেন্ট-অ্যাডজুটান্ট; ঝেরকভের দেওয়া সংবাদ সেও সমর্থন করল। হুকুম হয়েছে, পরদিনই তাদের যাত্রা শুরু হবে।

আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি মশাইরা!

ভালোই তো, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! বড় বেশি দিন এখানে বসে আছি।

*

অধ্যায়

পথে ইন নদী (ব্রাউনাউতে) ও ব্রাউন নদীর (লিঞ্জে) সেতুগুলি ধ্বংস করে দিয়ে কুতুজভ ভিয়েনার দিকে পশ্চাপসরণ করল। ২৩ অক্টোবর রুশ বাহিনী এনস নদী পার হচ্ছে। দুপুর বেলা রাশিয়ার মালবাহী ট্রেন, কামান-বন্দুক ও সেনাদলগুলি সেতুর দুই দিক বরাবর সার বেঁধে এনস শহরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে।

হেমন্তকালের বষর্ণসিক্ত গরম দিন। পাহাড়ের উপর সজ্জিত রুশ কামানগুলি সেতুটাকে পাহারা দিচ্ছে। সেই পাহাড়ের সামনেকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর কখনো তির্যক বৃষ্টিধারার স্বচ্ছ আবরণে ঢেকে যাচ্ছে, আবার পরমুহূর্তেই তার উপর রোদ ছড়িয়ে পড়ছে বহুদূরবর্তী জিনিসগুলিও নতুন বার্নিশ-করা দ্রব্যের মতো পরিষ্কার ঝকঝক করতে দেখা যাচ্ছে। আরো নিচে ছোট শহরটির লাল ছাদওয়ালা শাদা বাড়ি-ঘর, গির্জা ও সেতুটা দেখা যাচ্ছে; সেতুর দুই পাশে রুশ সৈন্যরা সার বেঁধে চলেছে। দানিয়ুব নদীর বাঁকে অনেক জাহাজ, একটি দ্বীপ এবং এনস ও দানিয়ুব নদীর সঙ্গম থেকে প্রবাহিত জলধারায় বেষ্টিত পার্ক সমেত একটি দুর্গও চোখে পড়ছে। আরো দেখা যাচ্ছে সবুজ তরুশীর্ষ ও নীলাভ গিরিবর্টের রহস্যময় পশ্চাৎপটে পাইন-অরণ্যে ঢাকা দানিয়ুব নদীর বামপার্শ্বস্থ পর্বতমালা। জনহীন পাইন-অরণ্যের ওপারে একটা মঠের চূড়াগুলি চোখে পড়ছে; আর এনস নদীর ওপারে বহু দূর থেকে ভেসে আসছে শত্রুপক্ষের অশ্বক্ষুরধ্বনি।

পাহাড়ের একেবারে প্রান্তে কামানশ্রেণীর মাঝখানে পশ্চাত্বতী রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত সেনাপতি একজন স্টাফ-অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ফিল্ড-গ্লাসের সাহায্যে গ্রামাঞ্চলটাকে খুঁটিয়ে দেখছে। প্রধান সেনাপতি এই রক্ষীবাহিনীতেই নেসভিৎস্কিকে পাঠিয়েছে। একটু পিছনে সেও বসে আছে একটা কামানবাহী গাড়ির পিছন দিকে। তার সঙ্গী জনৈক কসাক একটি ঝোলা ও ফ্লাস্ক তার হাতে তুলে দিয়েছে, আর নেসভিৎস্কি কয়েকজন অফিসারকে পিঠে ও আসল ডোপেল-কুমেল খাওয়াচ্ছে।

অফিসাররা মনের সুখে তাকে ঘিরে আছে; কেউ হাঁটু ভেঙে বসেছে, কেউ বা তুর্কি কায়দায় ভিজে ঘাসের উপরেই বসে পড়েছে।

নেসভিৎস্কি বলছে, সত্যি, অস্ট্রিয়ার যে রাজা এই দুৰ্গটা বানিয়েছিল সে লোকটি বোকা ছিল না। চমৎকার জায়গাটা! আরে মশাইরা, আপনারা খাচ্ছেন না কেন?

এ রকম একজন মর্যাদাসম্পন্ন স্টাফ-অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে পারায় খুশি হয়ে একজন অফিসার বলে উঠল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ প্রিন্স। জায়গাটা ভারী মনোরম! পার্কটার পাশ দিয়ে আসতে আসতে আমরা দুটো হরিণ দেখতে পেয়েছি…আর বাড়িটা কী চমৎকার!

আর একজন অফিসারের আরো একটা পিঠে খাবার যথেষ্ট ইচ্ছা থাকলেও লজ্জায় সে কথা বলতে না পেরে আপাতত গ্রামাঞ্চলের সৌন্দর্য দেখার ভান করে বলল, দেখুন, দেখুন প্রিন্স, আমাদের পদাতিক সৈন্যরা এর মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। ঐ দেখুন, গ্রামের পিছনকার ঐ মাঠটায় তাদের তিনজন কি যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা দুর্গে ঢুকবে।

তা তো ঢুকবেই, নেসভিৎস্কি বলল। তারপর সুন্দর মুখের ভিজে ঠোঁট দিয়ে একটা পিঠে চাটতে চাটতে সে আরো বলল, কিন্তু আমার ইচ্ছা করছে, লুকিয়ে ওই হোথায় চলে যেতে।

হেসে উঠে সে একটা চূড়াওয়ালা সন্ন্যাসিনীদের মঠ দেখাল; তার চোখ দুটো কুঁচকে চকচক করতে লাগল।

তাহলে ভারী মজা হত মশাইরা!

অফিসাররা হেসে উঠল।

সন্ন্যাসিনীদের একটু নাচানো যেত আর কি। শুনেছি ওদের মধ্যে কয়েকটি ইতালিয় মেয়েও আছে। সত্যি বলছি, এর জন্য জীবনের পাঁচটা বছর দিয়ে দিতে আমি রাজি আছি।

একজন সাহসী অফিসার হেসে বলল, ওদেরও তো খুব একঘেয়ে লাগছে।

ইতিমধ্যে সামনে দাঁড়ানো স্টাফ-অফিসারটি সেনাপতিকে কি যেন দেখাতেই সে ফিল্ড-গ্লাসটা চোখে লাগাল।

সেনাপতি ফিল্ড-গ্লাসটা নামিয়ে কাঁদ ঝাঁকুনি দিয়ে রেগে বলে উঠল, হ্যাঁ, ঠিক তাই, ঠিক তাই। ঠিক চৌমাথার কাছে ওদের উপর গুলি ছোঁড়া হবে। ওরা ওখানে অকারণে সময় নষ্ট করছে কেন?

অপর দিকে এখন খালি চোখেই শত্রুপক্ষকে দেখা যাচ্ছে তাদের কামানশ্রেণীর উপর থেকে একটা দুধ শাদা মেঘ উঠে এল। পরক্ষণেই অনেক দূর থেকে একটা গোলার আওয়াজ ভেসে এল, আর আমাদের সৈন্যরা চৌমাথার দিকে ছুটতে লাগল।

নেসভিৎস্কি হাসতে হাসতে সেনাপতির দিকে এগিয়ে গেল।

বলল, ইয়োর এক্সেলেন্সি কি একটা জলযোগ করতে ইচ্ছা করেন?

তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেনাপতি বলল, যত সব বাজে ব্যাপার; আমাদের সৈন্যরা অকারণে সময় নষ্ট করছে।

আমি কি ঘোড়া ছুটিয়ে যাব ইয়োর এক্সেলেন্সি? নেসভিৎস্কি শুধাল।

দয়া করে তাই যাও, সেনাপতি জবাব দিল; তারপর ইতিমধ্যেই যে হুকুম বিস্তারিতভাবে জারি করা হয়েছে সেটারই পুনরাবৃত্তি করল : আর হুজারদের বলে দাও তারা যেন সকলের শেষে নদী পার হয় এবং আমার হুকুম মতো সেতুটা উড়িয়ে দেয়; আর সেতুর উপরে যে সব দাহ্য পদার্থ আছে সেগুলি অবশ্যই আর একবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

খুব ভালো কথা, নেসভিৎস্কি জবাব দিল।

সে ঘোড়াসমেত কসাককে ডাকল, ঝোলা ও ফ্লাস্কটা নামিয়ে নিতে বলল এবং একলাফে ভারী শরীরটা নিয়ে জিনের উপর চেপে বসল।

অফিসাররা সহাস্য বদনে তাকে দেখছিল। সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে সত্যি দেখা করব, এই কথা তাদের বলে সে পাহাড়ের ঘোরানো পথে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

গোলন্দাজ-অফিসারের দিকে ফিরে সেনাপতি বলল, এবার দেখা যাক ক্যাপ্টেন, জল কতদূর গড়ায়। চেষ্টা তো করুন! সময় কাটাতে একটু মজা তো করা যাবে?

অফিসার হুকুম দিল, যার যার কামানের কাছে চলে যাও।

মুহূর্তের মধ্যে সৈন্যরা ক্যাম্প-ফায়ার ছেড়ে খুশিমনে ছুটে গিয়ে কামানে বারুদ ঠাসতে লেগে গেল।

এক নম্বর। হুকুম এল।

এক নম্বর লাফ দিয়ে একপাশে সরে গেল। কান-ফাটানো ধাতব শব্দে কামানটা গর্জে উঠল, আর একটা গোলা সশব্দে আমাদের নিচেকার সৈন্যদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে গিয়ে শত্রুর অনেক আগেই মাটিতে ছিটকে পড়ল; কোথায় পড়ল সেটা বোঝা গেল শুধু কিছুটা ধোয়া উড়তে দেখে।

সে শব্দ শুনে অফিসার ও সৈন্যদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে নিচে আমাদের সৈন্যদের চলাচল এবং অনেক দূরের আগুয়ান শত্রুপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল। ঠিক সেই সময় সূর্যটা মেঘের আড়াল থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এল। একটিমাত্র গোলার স্পষ্ট আওয়াজ আর উজ্জ্বল রোদের প্রসন্নতা মিলেমিশে একটি আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করল।

*

অধ্যায়-৭

ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের দুটি গোলা সেতু পার হয়ে ছুটে এসে সশব্দে ফেটে পড়েছে। প্রিন্স নেসভিৎস্কি সেতুর মাঝামাঝি ঘোড়া থেকে নেমে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দুটি ঘোড়ার রাশ ধরে যে কসাকটি তার কয়েক পা পিছনে দাঁড়িয়েছিল, তার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে সে হাসতে লাগল। প্রিন্স নেসভিৎস্কি যতবার এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছে ততবারই সৈনিকরা ও তাদের গাড়িগুলো তাকে ঠেলে রেলিংয়ের গায়ে চেপে ধরছে; ফলে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসা ছাড়া আর কিছুই করবার ছিল না।

পদাতিক সৈন্যরা কসাকটির গাড়ির চাকা ও তার ঘোড়া দুটির উপর একেবারে চেপে এসে পড়েছে; ওদিক থেকে মালগাড়িসহ একটি রক্ষী-সৈনিক তাদের ঠেলে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করছে দেখে কসাকটি বলে উঠল, তুমি কেমন লোক হে বাপু! এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পার না! তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না যে সেনাপতি এগিয়ে যেতে চাইছেন?

রক্ষী-সৈনিকটি কিন্তু সেনাপতি কথাটা গ্রাহ্যই করল না; যে সব সৈন্য তার পথ আটকে দিয়েছিল তাদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলল, হাই বাপুরা! বাঁদিকে চেপে চল! একটু থাম। কিন্তু সৈন্যরা এমনভাবে কাঁধে-কাঁধে এক হয়ে জমে গেছে যে তাদের বেয়নেটগুলো একটা সঙ্গে আরেকটা আটকে গেছে; কাজেই তারা একটিমাত্র ঘন পদার্থের মতো সেতুর উপর দিয়ে এগোতে লাগল। রেলিংয়ের উপর দিয়ে নিচে তাকিয়ে প্রিন্স নেসভিৎস্কি দেখল, এনস নদীর ঘোট ছোট ঢেউগুলি কুলকুল শব্দে সেতুর স্তম্ভগুলির চারপাশে পাক খেতে খেতে একে অন্যকে ধাওয়া করে ছুটে চলেছে। সেতুর উপরে তাকিয়েও দেখতে পেল সৈন্যদের এক জীবন্ত স্রোত-কাঁধের পট্টি, শাকো পিঠের বোঁচকা, বেয়নেট, লম্বা বন্দুক এবং শাকোর নিচে চওড়া চোয়াল, বসে যাওয়া গাল, ক্লান্ত অবসন্ন ভাব; সেতুর কর্দমাক্ত পিচ্ছিল কাঠের উপর দিয়ে পাগুলো এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে সেই একঘেয়ে সৈন্যপ্রবাহের ফাঁকে ফাঁকে এনস নদীর ঢেউগুলির বুকে ছুটে-জলা শাদা শাদা ফেনার মতো এক একজন অফিসার আলখাল্লায় শরীর ঢেকে সৈন্যদের চাইতে ভিন্ন ধরনের মুখ দেখিয়ে পথ করে : এগিয়ে যাচ্ছে; কখনো বা নদীর বুকে পা-খাওয়া একটুকরো কাঠের মতো কোনো হুজার, বা আর্দালি, বা নাগরিক পায়ে হেঁটে সেই পদাতিক সৈন্যদের স্রোতে ভেসে চলেছে; আবার কখনো বা নদীর বুকে ভেসে-চলা প্রকাণ্ড কাঠের গুঁড়ির মতো অফিসারদের অথবা সৈন্যদের মালপত্রে আকণ্ঠ বোঝাই হয়ে চামড়ায় ঢাকা একটা মালগাড়ির সেতুর উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে।

কসাকটি হতাশ হয়ে বলল, যেন একটা বাঁধ ভেঙেছে। এমন আর কত আসবে হে তোমরা?

ছেঁড়া কোট পরা একটি রসিক সৈনিক চোখ টিপে জবাব দিল, একজন কম দশ লাখ হে! বলতে বলতে চলে গেল; তার পিছন পিছন এল একটি বুড়ো।

বিষণ্ণ মুখে সে তার পাশের সৈন্যকে বলল, ওরা (মানে শত্রুপক্ষ) যদি এখন সেতুর উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে তাহলে তোমার গা চুলকানোও ভুলিয়ে দেবে।

সে চলে গেল; গাড়ির উপর বসে আর একজন এল।

কি মুস্কিল, আমার পায়ে পডিটা কোথায় গেল? বলতে বলতে একটি আর্দালি গাড়ির পিছনে ছুটতে লাগল।

সে গাড়ি নিয়ে চলে গেলে এল একদল ফুর্তিবাজ সৈন্য; তারা এতক্ষণ মদ খাচ্ছিল।

গ্রেটকোটটাকে ভালো করে খুঁজে নিয়ে একটি সৈন্য জোরে জোরে হাত নেড়ে খুশির সুরে বলল, তারপর, বুঝলে বুড়ো, বন্দুকের কুঁদো দিয়ে ওরা ঝাড়ল একখানা তার দাঁতের উপর…।

আর একজন হো-হো করে হেসে বলল, হ্যাঁ, শুয়োরের মাংসটা ভালোই ছিল…তারাও চলে গেল। কিন্তু নেসভিৎস্কি বুঝতেই পারল না, কার দাঁত গেল, আর তার সঙ্গে শুয়োরের মাংসরই বা সম্পর্ক কি।

বাঃ! কী রকম জোর চালাচ্ছে! একটা গোলা ছুঁড়েই ভাবে সব মরে যাবে, জনৈক সার্জেন্ট রেগে গিয়ে ঘৃণার সুরে বলল।

মস্তবড় হা-ওয়ালা একটি তরুণ সৈনিক অনবরত হাসতে হাসতে বলল, আরে বাবা, ওটা যখন আমার পাশ দিয়ে উড়ে গেল, মানে আমি গোলাটার কথাই বলছি, তখন আমার মনে হল যে আমি ভয়েই মরে যাব। সত্যি বলছি, কী ভীষণ ভয়ই না পেয়েছিলাম! সে এমনভাবে কথাগুলি বলল যেন ভয় পাওয়াটাও একটা বাহাদুরির ব্যাপার।

সেও চলে গেল। তারপর এল এমন একটা গাড়ি যেটা অন্য গাড়িগুলো থেকে আলাদা। জনৈক জার্মান একটা জার্মান গাড়িকে এক জোড়া ঘোড়ায় টেনে নিয়ে চলেছে; তাতে যতরাজ্যের গৃহস্থালীর জিনিসপত্র বোঝাই। পালকের বিচানার উপরে বসে আছে স্তন্যপায়ী শিশু কোলে একটি স্ত্রীলোক, একটি বুড়ি ও একটি স্বাস্থ্যবতী লাল-গাল জার্মান মেয়ে। বোঝাই যায়, এই পলাতকরা বিশেষ অনুমতি নিয়েই চলেছে। সৈন্যদের সবগুলি চোখ তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে; গাড়িটা পায়ে হাঁটার তালে তালেই এগিয়ে চলেছে; দুটি অল্পবয়স্কাকে ঘিরেই সৈন্যদের মুখে নানারকম মন্তব্যের খই ফুটতে লাগল। সকলের মুখে একই ধরনের হাসি; তাদের অশোভন চিন্তারই প্রকাশ।

দেখ, দেখ, জার্মান চাটনিও কেমন পথ চলছে হে!

জার্মানটিকে লক্ষ্য করে একজন বলল, কুমারীটিকে আমার কাছে বেচে দাও হে। লোকটি রাগ করল, আবার ভয় পেল; চোখ নিচু করে সে সাধ্যমতো পা চালাতে লাগল।

দেখ, মেয়েটা কেমন সেজেছে! আহারে, শয়তান!

এই ফেদতভ, তোমাকে ওদের সঙ্গেই চালান করা দরকার।

আরে স্যাঙাৎ, এমন আমি কত দেখেছি!

তোমরা কোথায় চলেছ? একজন পদাতিক অফিসার জিজ্ঞাসা করল। সেও এতক্ষণ আপেল খেতে খেতে মুচকি হেসে সুন্দরী মেয়েটিকেই দেখছিল।

মেয়েটিকে একটা আপেল দিয়ে বলল, ইচ্ছা করলে এটা নাও।

মেয়েটি হেসে আপেলটা নিল। সেতুর উপরকার অন্য সকলের মতোই নেসভিৎস্কিও এতক্ষণ এই স্ত্রীলোকদের উপর থেকে একবারও চোখ ফেরায় নি। তারা চলে গেলে সেই একই সৈন্যের স্রোত বয়ে চলল, তাদের মুখে সেই একই ধরনের কথাবার্তা। শেষপর্যন্ত সকলেই থেমে গেল। যেমন প্রায়ই হয়, সেতুর শেষ প্রান্তে কোনো মালগাড়ির ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে, আর সকলকেই থেমে যেতে হয়।

সৈন্যরা বলে উঠল, এরা সব থামল কেন? এরকম তো হুকুম ছিল না! তুমি কোন দিকে এগোচ্ছ? তোমার মাথায় শয়তান চাপুক! একটু অপেক্ষা করতে পার না? ওরা যদি সেতুটা উড়িয়ে দেয় তো বুঝবে মজা। দেখ, দেখ, একজন অফিসারও জ্যাম-জমাট হয়ে গেছে। নানা জনে নানা কথা বলতে লাগল; সকলেই চাপ দিয়ে এগোতে চেষ্টা করছে সেতু থেকে বের হবার মুখটার দিকে।

সেতুর নিচে এনস নদীর দিকে তাকিয়ে নেসভিৎস্কি হঠাৎ একটা নতুন ধরনের শব্দ শুনতে পেল; একটা কি যেন দ্রুত এগিয়ে আসছে…বেশ বড়সড় একটা কিছু জল ছিটিয়ে এগিয়ে আসছে।

সেদিকে তাকিয়ে একটি সৈনিক বলল, দেখ, ওটা কোথায় যাচ্ছে!

আর একজন অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমাদের আরো তাড়াতাড়ি চলতে উৎসাহ দিচ্ছে।

ভিড় আবার এগিয়ে চলল। নেসভিৎস্কি বুঝতে পারল, ওটা একটা কামানের গোলা। সে হাঁক দিল, হেই কাক, আমার ঘোড়া!…এই, এবার তোমরা সব পথ ছাড়! পথ ছাড়!

অনেক কষ্টে ঘোড়র কাছে পৌঁছে অনবরত চিৎকার করতে করতে সে এগিয়ে চলল। সৈনিকরা জড়সড় হয়ে নিজেরা চেপে তাকে পথ করে দিল; কিন্তু পরক্ষণেই তারা আবার তার পা দুটোকে পর্যন্ত চেপে ধরল; যারা তার কাছে ছিল তাদেরও দোষ দেওয়া চলে না, কারণ পিছন থেকে তাদের উপরেও প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।

নেসভিৎস্কি! নেসভিৎস্কি! এই হাঁদারাম! পিছন থেকে একটা কর্কশ গলা ভেসে এল।

নেসভিৎস্কি চারদিকে তাকাল; চলন্ত পদাতিক বাহিনীর ওপারে প্রায় পনেরো পা দূরে বাস্কা দেনিসভকে দেখতে পেল। এলোমেলো লাল চেহারা; টুপিটা কালো, মাথার পিছন দিকে পরা, আলখাল্লাটা কাঁধের উপরে ঝুলছে।

এই শয়তানগুলোকে, এই পিশাচগুলোকে বল, আমার পথ ছেড়ে দিক! রাগে গরগর করে দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল; তার কয়লা-কালো চোখের রক্ত-লাল শাদা অংশটা ঝিকমিক করে ঘুরছে; মুখের মতোই লাল  খোলা হাতে সে কোষবদ্ধ তলোয়ারটাকে অনবরত ঘোরাচ্ছে।

নেসভিৎস্কি খুশি হয়ে জবাব দিল, আরে, ভাস্কা! হল কী তোমার?

আরে, সৈন্যদল এগোতে পারছে না, ভাস্কার দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল; শাদা দাঁতগুলি হিংস্রভাবে বেরিয়ে পড়েছে; কালো আরবি ঘোড়াটার গায়ে বারবার পায়ের কাঁটা দিয়ে ঠুকছে; আর ঘোড়াটাও নাক ডাকিয়ে শাদা ফেনা ছুটিয়ে এমনভাবে ক্ষুর দিয়ে সেতুর কাঠের উপর পা ঠুকছে যেন অশ্বারোহী আপত্তি না জানালে সে রেলিংয়ের উপর দিয়ে ঝাঁপ দিতেও রাজি। এবার সত্যি সত্যি খাপ থেকে তলোয়ার খুলে ঘোরাতে ঘোরাতে সে চেঁচিয়ে উঠল, এসব কি? যত সব ভেড়ার দল। একেবারে ভেড়া! ভাগ হিয়াসে!…আমাদের যেতে দে!…এই গাড়িওলা শয়তান, গাড়ি থামা! নইলে দেব তলোয়ারের এক কোপ!

ভয়ার্ত মুখে একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জনতা পথ করে দিল। দেনিসভ নেসভিৎস্কির কাছে এল।

ঘোড়া নিয়ে কাছে এলে নেসভিৎস্কি বলল, কি ব্যাপার, এখনো মাল পেটে পড়ে নি?

ভাস্কা জবাব দিল, এক পাত্রও মুখে দেবার সময় পাই নি। সারাদিন রেজিমেন্টকে নিয়ে টানা-হাচড়া করছে। ওরা যদি যুদ্ধই চায় তো যুদ্ধ হোক। কিন্তু এসব কি হচ্ছে তা শয়তানই জানে।

দেনিসভের নতুন আলখাল্লা আর নিজের কাপড় দেখে নেসভিৎস্কি বলল, তোমাকে যে একেবারে ফুলবাবুটি দেখাচ্ছে!

দেনিসভ হাসল। তলোয়ারের হাতলের নিচ থেকে একটা রুমাল বের করে নেসভিৎস্কির নাকে কাছে ধরল। রুমালটা গন্ধে ভুরভুর করছে।

বুঝতেই তো পারছ, যুদ্ধে চলেছি। দাড়ি কামিয়েছি, দাঁত বুরুশ করেছি, গায়ে গন্ধ ঢেলেছি।

একে নেসভিৎস্কির দশাসই চেহারা ও তার পিছনে কাক অনুচর, তার উপর দেনিসভের তলোয়ার ঘোরানো ও অবিশ্রাম চিৎকার–এসব দেখেশুনে ভিড়ের লোকজনরা এতই হকচকিয়ে গেল যে তারা দুজন ভিড়ের ভিতর দিয়ে পথ করে সেতুর একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেল এবং পদাতিক বাহিনীকে থামিয়ে দিল। সেতুর পাশেই কর্নেলকে দেখতে পেয়ে নেসভিৎস্কি হুকুম-নামটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে গেল।

পথ পরিষ্কার করে নিয়ে দেনিসভ সেতুর শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল। ঘোড়ার রাশটা হাতে ধরে সে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, তার অধীনস্ত সেনাদলটি ক্রমেই এগিয়েই আসছে। সেতুর কাঠের উপর অনেকগুলি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল; সামনে অফিসাররা ও তাদের পিছনে চারজন করে সৈন্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সেনাদল তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল।

যে পদাতিক বাহিনীকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তারা সেতুর কাছে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিদ্বেষ, বিরক্তি ও ঠাট্টার মনোভাব নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে-চলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হুজারদের দিকে তাকিয়ে রইল; বিভিন্ন বিভাগের সৈন্যরা সাধারণত এই রকম মনোভাব নিয়েই পরস্পরকে দেখে থাকে।

একজন বলল, সব ফুলবাবুর দল! যেন মেলা দেখতে চলেছে!

কোন কাজে লাগবে ওরা? সবই তো কেবল দর্শনধারী। আর একজন বলল।

ঘোড়ার ক্ষুর থেকে কয়েকটি পদাতিকের গায়ে কাদা ছিটকে দিয়ে একজন হুজার ঠাট্টা করে বলল, এই পদাতিক, ধুলো উড়িয়ে না!

হাতের আস্তিন দিয়ে মুখের কাদা মুছতে মুছতে একজন পদাতিক সৈন্য বলল, কাঁধে বোঁচকা চাপিয়ে তোমাকে দুদিনের মার্চে পাঠাতে বড়ই ইচ্ছা করে। বাহারে পোশাকের তাহলে বারোটা বেজে যেত। মৌজ করে এমনভাবে বসে আছ যে পক্ষী কি মানুষ তা বোঝা বার।

পিঠের বোঝার চাপে নুয়ে-পড়া একটি ছোটখাট সৈন্যকে লক্ষ্য করে কর্পোরাল বলল, আরে জিকিন, ওদের তো উচিত ছিল তোমাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে নেওয়া।

একজন হুজার চেঁচিয়ে বলল, দুই পায়ের ফাঁকে একটা লাফি ভরে নাও, তাহলেই তো ঘোড়া পেয়ে যাবে!

*

অধ্যায়-৮

পদাতিক বাহিনীর শেষ সৈনিকটি পর্যন্ত গায়ে গায়ে লেগে যেন একটা ফানেলের ভিতর দিয়ে ঢুকছে এমনি ঘন হয়ে সেতুটা পার হয়ে গেল। অবশেষে মালগাড়িগুলোও পার হয়ে গেল, হৈ-চৈ কমে এল, শেষ সেনাদলটিও সেতুর উপর উঠে এল। শুধু দেনিসভের শেষ হুজার দলটি শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করবার জন্য সেতুর এপারে থেকে গেল। অপর তীরের পাহাড়ের উপর থেকে শত্রুপক্ষকে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু সেতুর উপর থেকে এখনো তাদের দেখা যাচ্ছে না; কারণ যে উপত্যাকাটার ভিতর দিয়ে নদীটা বয়ে চলেছে, মাত্র আধ মাইল দূর থেকেই তার বুকে অনেকগুলি ঢিবি গড়ে উঠে দিগন্ত-রেখাটা গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের নিচে যে পতিত জমিটা রয়েছে তাতে আমাদেরই কয়েক দল কসাক, স্কাউট চলাফেরা করছে। হঠাৎ উঁচু জমির মাথায় কামান-বন্দুক ও নীল ইউনিফর্ম পরা সৈন্যদের দেখা গেল। একদল কসাক স্কাউট জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে নিচে নেমে গেল। দেনিসভের সেনাদলের সব অফিসার ও সৈন্যরা অন্য বিষয়ে কথা বলতে ও অন্য দিকে তাকাতে চেষ্টা করলেও তারা শুধু পাহাড়ের উপরকার কথাই চিন্তা করতে লাগল, এবং দিগন্তরেখা বরাবর যে দৃশ্য ফুটে উঠছে সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল, কারণ তারা জানে যে ওরা শত্রুসৈন্য। দুপুরের পর থেকে আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেছে; উজ্জ্বল সূর্য ক্রমেই দানিয়ুব নদী ও চতুর্দিকের কালো পাহাড়ের বুকে নেমে যাচ্ছে। একদিকে সেনাদল, অন্যদিকে শত্রুপক্ষ-এই দুইয়ের মাঝখানটা প্রায় ফাঁকা। দুইয়ের মাঝখানে মাত্র সাত গজের মতো ফাঁকা জায়গার ব্যবধান। শত্রুপক্ষ গোলাবষর্ণ থামিয়ে দিয়েছে; তাই দুই বিরোধী সৈন্যদলের মধ্যবর্তী কঠোর, ভয়াল, অগম্য ও স্পর্শাতীত রেখাঁটি যেন আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

জীবন ও মৃত্যু মধ্যবর্তী সীমান্তস্বরূপ এই রেখাঁটি অতিক্রম করে এক পা বাড়ালেই অনিশ্চয়তা, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর রাজত্ব। কি আছে ওখানে? কে আছে ওখানে?-সূর্যের আলোয় আলোকিত ঐ প্রান্তর, ঐ গাছ ও ঐ ছাদের ওপারে? কেউ তা জানে না, কিন্তু সকলেই জানতে চায়। মনে ভয়, তবু ঐ সীমারেখা তুমি পার হতেই চাও; কারণ মৃত্যুর ওপারে কি আছে তা যেমন একদিন তোমাকে অনিবার্যভাবে জানতেই হবে, ঠিক তেমনি তুমি এটাও জান যে আগে হোক পরে হোক ঐ সীমারেখা তোমাকে পার হতেই হবে, তার ওপারে কি আছে তাও জানতেই হবে। তবু তুমি শক্তিমান, স্বাস্থ্যবান, ফুর্তিবাজ, উত্তেজনাপ্রবণ, আর তোমার চারপাশেও রয়েছে তেমনি সব মানুষের দল। সুতরাং শত্রুপক্ষকে দেখতে পেলেই মনে ভাবনা জাগে, অনুভূতি জাগে, আর সেই অনুভূতি সেই মুহূর্তের সবকিছুকেই একটা নতুন আকর্ষণ ও তীব্রতায় ভরে দেয়।

শত্রুপক্ষ যে উঁচু জায়গাটায় রয়েছে সেখান থেকে কামানের ধোঁয়া উঠল, আর একটা গোলা শো করে হুজার বাহিনীর মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। যে অফিসাররা এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। তারা ঘোড়া ছুটিয়ে যার যার জায়গায় চলে গেল। হুজাররা সতর্কতার সঙ্গে ঘোড়াগুলিকে যথাস্থানে সাজাতে লাগল। গোটা স্কোয়াড্রন যেন থমথম করছে। সকলেই তাকিয়ে আছে সামনের শত্রুপক্ষের দিকে আর স্কোয়াড্রন-কমান্ডোর দিকে; কখনো হুকুম আসবে তারই প্রতীক্ষায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোলাও পাশ দিয়ে উড়ে গেল। লক্ষ্য অবশ্যই হুজাররা, কিন্তু গোলাগুলি দ্রুত সশব্দ গতিতে অশ্বারোহী সৈনিকদের মাথার উপর দিয়ে দূরে কোথাও গিয়ে পড়ল। হুজাররা পিছন ফিরে তাকাল না, কিন্তু যেমন প্রতিটি গোলার শব্দের সঙ্গে, তেমনি প্রতিটি হুকুমের সঙ্গে, গোটা স্কোয়াড্রনের প্রতিটি মানুষ রুদ্ধশ্বাসে একবার পাদানিতে দাঁড়িয়েই আবার বসে পড়ল। পরস্পরের মুখের ভাব লক্ষ্য করবার কৌতূহলে প্রতিটি সৈনিক ঘাড় বেঁকিয়ে একে অন্যকে দেখতে লাগল। দেনিসভ থেকে শুরু করে বিউগলবাদক পর্যন্ত প্রতিটি মুখের উপরই একই দ্বন্দ্ব, বিরক্তি ও উত্তেজনার প্রকাশ। কোয়ার্টার মাস্টার ভুরু কুঁচকে এমনভাবে সৈনিকদের দিকে তাকাতে লাগল যেন তাদের শাস্তির ভয় দেখাচ্ছে। যতবার গোলা ছুটছে ক্যাডেট ততবারই মাথাটা নিচু করছে। বাঁদিকে রয়েছে রস্তভ তার খোঁড়া অথচ সুন্দর ঘোড়া রুকের পিঠে চড়ে; তার মুখে এমন খুশি-খুশি ভাব যেন কোনো স্কুলের ছাত্রকে পরীক্ষার জন্য অনেক লোকের সামনে ডাকা হয়েছে, আর সে নিশ্চিত জানে যে পরীক্ষায় সে ভালো ফল করবেই। পরিষ্কার, উজ্জ্বল চোখ তুলে সে সকলের দিকে তাকাচ্ছে; যেন বলছে, তোমরা দেখ কেমন শান্তভাবে আমি আগুনের নিচে বসে আছি। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও তার মুখেও একটা নতুন ও কঠোর কিছুর আভাস ফুটে উঠেছে।

ওখানে কে মাথা নোয়াচ্ছ হেঃ ক্যাডেট মিয়োনভ! ওটা ঠিক নয়! আমার দিকে তাকাও, দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল। এক জায়গায় চুপ করে থাকতে না পেরে সে স্কোয়াড্রনের সামনে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ভাস্কা দেনিসভের কালো, লোমশ, থ্যাবড়া নাক, বেঁটে শক্ত শরীর, পেশীবহুল লোমশ হাতের মোটা মোটা আঙুলে খোলা তলোয়ার শক্ত করে ধরা। তাকে ঠিক সেইরকম স্বাভাবিকই দেখাচ্ছে যেরকমটি দেখায় সন্ধ্যার দিকে দুটো বোতল সাবাড় করবার পরে; তবে একটু বেশি লাল দেখাচ্ছে এই যা তফাৎ। জলপানরত পাখিদের মতো ঝাঁকড়া-চুল মাথাটাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে, ভালো ঘোড়া বেদুইনের পেটে নির্মমভাবে পায়ের কাঁটা ইকে, এবং পিছনে ঝুঁকে ঘোড়ার পিঠে বসে সে স্কোয়াড্রনের অন্য পাশে জোর কদমে ছুটে গিয়ে কর্কশ গলায় সৈন্যদের পিস্তলের দিকে চোখ রাখবার হুকুম দিল। তারপর ছুটে গেল কারস্তেনের কাছে। চওড়া-পিঠ ঘোটকিটার পিঠে চেপে স্টাফ-ক্যাপ্টেন তার দিকে এগিয়ে গেল। তার লম্বা মুখখানা যথারীতি বেশ গম্ভীর, শুধু চোখ দুটো একটু বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

দেনিসভকে বলল, আরে, এ সব কি হচ্ছে? যুদ্ধ তো শেষপর্যন্ত হবেই না। দেখবে–আমরাই সরে যাব।

দেনিসভ বলল, ওদের মাথায় যে কি আছে তা শুধু শয়তানই জানে! রশুভের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে রস্তভ, শেষপর্যন্ত পেয়েছ তাহলে।

তাকে হাসতে দেখে রস্তভও খুশি হল। ঠিক সেই সময় কমান্ডার সেতুর উপর এসে দাঁড়াল। দেনিসভ তার দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

ইয়োর এক্সেলেন্সি, আসুন আমরাই আক্রমণ করি! আমিই ওদের তাড়াব।

যেন একটা বিরক্তিকর মাছি তাড়াচ্ছে এমনিভাবে নাকটাকে উঁচু করে কর্নেল বিক্তিকর গলায় বলল, আক্রমণই বটে! তোমরা এখানে থেমে আছ কেন? দেখতে পাচ্ছ না, গোলযোগকারীরা পিছনে সরে যাচ্ছে? তোমার স্কোয়াড্রনকে পিছিয়ে নিয়ে যাও।

স্কোয়াড্রন সেতু পার হয়ে কামানোর পাল্লার বাইরে চলে গেল। একটি সৈনিকও মারা যায় নি। সামনের সারির স্কোয়াড্রনটাও তাদের অনুসরণ করল। শেষ কসাকটিও নদী পেরিয়ে চলে গেল।

দুটি পাভলোগ্রাদ স্কোয়াড্রন সেতু পার হয়ে একে একে পাহাড়ে উঠে গেল। তাদের কর্নেল বোগদানিচ শুবার্ট দেনিসভের স্কোয়াড্রনের কাছে পৌঁছে পায়ে-হাঁটার গতিতে ঘোড়া চালাতে লাগল। রস্তভও কাছাকাছিই চলেছে; কিন্তু তেলিয়ানিনকে নিয়ে দুজনের মধ্যে সাক্ষাতের পরে এই তাদের প্রথম দেখা হলেও বোগদানিচ রশুভের দিকে ফিরেও তাকাল না। রস্তভও কর্নেলের চওড়া পিট, হাল্কা চুলে ঢাকা ঘাড় ও লাল গলার দিকেই তাকিয়ে রইল। রশুভের মনে হল, বোগদানিচ তাকে না দেখার ভান করেছে মাত্র ক্যাডেটের সাহস পরীক্ষা করাই তার আসল লক্ষ্য; তাই সেও নিজেকে সংযত করে খুশি মনে চারদিকে তাকাতে লাগল; পরক্ষণেই তার আবার মনে হল, নিজের সাহস দেখাবার জন্যই বোগদানিচ তার এত কাছাকাছি ঘোড়া চালাচ্ছে। তারপরেই আবার ভাবল, তাকে অর্থাৎ রশুভকে শাস্তি দেবার জন্যই এই শত্ৰুটি প্রচণ্ড আক্রমণের জন্য একটি স্কোয়াড্রনকে পাঠাবে। তারপরেই কল্পনা করল, আক্রমণের পরে সে যকন আহত অবস্থায় পড়ে থাকবে তখন বোগদানিচ তার কাছে এগিয়ে এসে উদারতার সঙ্গে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলবে।

ঝেরকভের উঁচু-কাঁধ মূর্তিটা ঘোড়ায় চেপে কর্নেলের সামনে হাজির হল। হেড-কোয়ার্টার থেকে কিছু না করেই বেশ মোটা বকশিস কামানো যায় তখন যুদ্ধক্ষেত্রে চাকরের খাটুনি খাটবার মতো বোকা সে নয়; তাই সে প্রিন্স ব্যাগ্রাশনের অধীনে একটা আর্দালি-অফিসারের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। পশ্চাদ্বর্তী রক্ষীদলের কমান্ডারের একটা হুকুম বয়েই সে এখন তার প্রাক্তন প্রধানের কাছে এসেছে।

বিষণ্ণ গাম্ভীর্যের ভাব দেখিয়ে চারদিককার সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে রস্তভের শত্রুকে লক্ষ্য করে সে বলল, কর্নেল, এখানে থেকে সেতুটাকে গোলা ছুঁড়ে উড়িয়ে দেবার হুকুম হয়েছে।

হুকুমটা কার উপর? কর্নেল জিজ্ঞাসা করল।

ঝেরকভ গম্ভীর গলায় বলল, কার উপর সেটা আমি নিজেও জানি না; প্রিন্স আমাকে বললেন; তুমি গিয়ে কর্নেলকে বল, হুজাররা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে যায় এবং সেতুটাকে উড়িয়ে দেয়।

ঝেরকভের ঠিক পরেই সেই দলের একজন অফিসারও সেই একই হুকুম নিয়ে হুজার কর্নেলের কাছে ছুটে এল। তার পরেই একটা কসাক ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হল নেসভিৎস্কি।

আসতে আসতেই সে চিৎকার করে বলল, এটা কি হল কর্নেল? আমি আপনাকে বললাম সেতুটা উড়িয়ে দিতে, আর এদিকে কে একজন গিয়ে সব ভণ্ডুল করে দিয়েছে; সেখানে তারা একেবারে ল্যাজে-গোবরে করে বসেছে; কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল ইচ্ছা করেই রেজিমেন্টকে থামিয়ে নেসভিস্কির দিকে মুখ ফেরাল।

বলল, আপনি আমাকে দাহ্য পদার্থের কথা বলেছেন, কিন্তু সেতু উড়িয়ে দেবার কথা তো বলেন নি।

আরো কাছে এসে টুপিটা খুলে হাত দিয়ে ঘামে ভেজা চুলটাকে পাট করতে করতে নেসভিৎস্কি বলল, কিন্তু প্রিয় মহাশয়, দাহ্য পদার্থগুলি যখন যথাস্থানে রাখা হল তখন কি আমি আপনাকে সেতু লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়তে বলি নি?

মি. স্টাফ-অফিসার, আমি আপনার প্রিয় মহাশয় নই, আর আপনি আমাকে সেতুটা জ্বালিয়ে দিতে বলেন নি! আমার কাজ আমি বুঝি, আর কঠোরভাবে হুকুম তামিল করাই আমার রীতি। আপনি বলেছিলেন সেতুটা জ্বালিয়ে দিতে হবে, কিন্তু কে জ্বালাবে সেটা আমি বুঝতে পারি নি।

নেসভিৎস্কি হাত নেড়ে বলল, আঃ, সবসময় এই হয়ে থাকে! ঝেরকভের দিকে ঘুরে বলল, তুমি এখানে এলে কেমন করে?

ঐ একই কাজে। কিন্তু তুমি যে ঘামে একেবারে ভিজে গেছ।

অসন্তুষ্ট গলায় কর্নেল বলতে লাগল, মি. স্টাফ-অফিসার, আপনি বলছিলেন…

অফিসারটি বাধা দিয়ে বলল, কর্নেল, জলদি করুন, নইলে শত্রুপক্ষ কামান সাজিয়ে ছররা চালাতে শুরু করবে।

নীরবে অফিসারের দিকে, স্টাফ-অফিসারের দিকে ও ঝেরকভের দিকে তাকিয়ে কর্নেল ভুরু কুঁচকাল।

গম্ভীর গলায় বলল, আমি সেতুটাকে জ্বালিয়ে দেব। যেন সে বলতে চাইল, যত অপ্রীতিকর অবস্থাই সহ্য করতে হোক না কেন তবু সে সঠিক কর্তব্যই পালন করবে।

যেন ঘোড়াটারই যত দোষ এমনিভাবে পেশীবহুল পা দিয়ে সেটাকে ঠোক্কর মেরে কর্নেল এগিয়ে গিয়ে হুকুম দিল, যে দুই নম্বর স্কোয়াড্রনে রস্তভ দেনিসভের অধীনে কর্মরত ছিল সেটাকে সেতুর কাছে ফিরে যেতে হবে।

রস্তভ নিজের মনে বলল, দেখ, আমি যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হল। তার হৃৎপিণ্ডটা সংকুচিত হয়ে সব রক্ত মুখে উঠে গেল। আমি ভীরু কি না সেটা সে ভালো করে দেখুক! সে ভাবল।

স্কোয়াড্রনের সকলের উজ্জ্বল মুখের উপরেই আবার নেমে এল যুদ্ধকালীন গাম্ভীর্য। রস্তভ বেশ ভালো করে তার শক্র কর্নেলকে দেখতে লাগল; কর্নেল কিন্তু একবারও রশুভের দিকে তাকাল না; তার মুখ গম্ভীর, কঠোর। তারপরই শোনা গেল হুকুম।

তার চারপাশে কয়েকজন বলে উঠল, সোজা তাকাও! সোজা তাকাও! কী করতে হবে বুঝতে না পেরে হাতে তলোয়ার নিয়ে পাদানিতে শব্দ করে হুজাররা তাড়াতাড়ি ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। সৈন্যরা ক্রুশ-চিহ্ন আঁকতে লাগল। রস্তভ এখন আর কর্নেলকে দেখছে না; সময় নেই। পাছে সে হুজারদের পিছনে পড়ে যায় এই ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডটা যেন থমকে থেমে গেছে। আর্দালির হাতে ঘোড়াকে তুলে দেবার সময় তার নিজের হাতই কাঁপতে লাগল; মনে হল, সব রক্ত বুঝি তার হৃৎপিণ্ডে এসে জমে যাবে।

দেনিসভ ঘোড়ার পিঠে পিছনে হেলে কি যেন বলতে বলতে চলে গেল। হুজারদের ছাড়া আর কাউকে রস্তভ দেখতে পাচ্ছে না; হুজাররা তার চারপাশে ছুটছে, তাদের পাদানির কাঁটায় শব্দ হচ্ছে, তাদের তলোয়ার বাজছে ঝন ঝন করে।

চোর! পিছন থেকে কে একজন চিৎকার করে উঠল।

স্ট্রেচার ডাকার মানে কি তা চিন্তা না করে রস্তভ ছুটেই চলল; সে চাইছে সকলের আগে যেতে; কিন্তু ঠিক সেতুর মুখে মাটির দিকে চোখ না থাকায় খানিকটা পিচ্ছিল কাদায় তা পা হড়কে গেল; সে হাতের উপর পড়ে গেল। অন্যরা তাকে পেরিয়ে চলে গেল।

ক্যাপ্টেন, দুদিক দিয়ে, কর্নেলের গলা কানে এল। ঘোড়া ছুটিয়ে সেতুর কাছে পৌঁছে সে সহাস্য মুখে থেমে পড়েছে।

কাদা-মাখা হাত দুটো ব্রিটেসে মুছে রস্তভ তার শত্রুর দিকে তাকাল; যতটা এগিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো এই কথা ভেবে আবার দৌড়তে শুরু করবে এমন সময় বোগদানিচ রশুভের দিকে না তাকিয়ে বা তাকে

চিনেই চেঁচিয়ে বলল, সেতুর মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে কে? ডাইনে যাও। ক্যাডেট, ফিরে এস! রেগে চিৎকার করে কথাগুলি বলে সে দেনিসভের দিকে মুখটা ফেরাল। দেনিসভও সাহস দেখাবার জন্য সেতুর কাঠোর উপর ঘোড়া তুলে দিয়েছে।

সে বলল, কেন বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছ ক্যাপ্টেনঃ ঘোড়া থেকে নেমে পড়।

ঘোড়ার পিঠে নড়েচড়ে বসে ভাঙ্কা দেনিসভ বলল, আঃ! প্রতিটি বুলেটের বিনিময়ে আছে একখানি প্রেমপত্র।

ইতিমধ্যে নেসভিৎস্কি, ঝেরকভ ও অফিসারটি গোলাগুলির পাল্লার বাইরে একত্রে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়েছি। একবার দেখল, হলুদ শাকো মাথায়, কর্ড-বসানো গাঢ় সবুজ কুর্তা ও নীল রাইডিং-ব্রিচেস পরা ছোট একদল সৈন্য সেতুর কাছে ভিড় করে আছে; আবার দেখল, দূরে বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছে অনেক নীল ইউনিফর্ম অশ্বারোহীর দল; সহজেই চেনা যায় একটা গোলন্দাজ বাহিনী।

ওরা কি সেতুটাকে জ্বালিয়ে দেবে না? কে ওখানে আগে পৌঁছবে? তারাই আগে গিয়ে সেতুটাকে উড়িয়ে দেবে, নাকি ফরাসিরাই ছররা গোলার পাল্লার মধ্যে পেয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে? সেতুর উপরকার উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে সেনাদলের প্রতিটি মানুষই ভগ্নহৃদয়ে এই একই প্রশ্ন নিজেকে করছে, আর সন্ধ্যার উজ্জ্বল আলোয় দেখছে-একদিকে সেতু ও হুজারদের, এবং অন্যদিকে বেয়নেট ও কামান নিয়ে অগ্রসরমান নীল কুর্তার দলকে।

আঃ! হুজাররাই মার খাবে! তারা এখন ছররার পাল্লার মধ্যে এসে গেছে, নেসভিৎস্কি বলল।

এত লোক সঙ্গে নেওয়া তার উচিত হয় নি, অফিসারটি বলল।

নেসভিৎস্কি জবাব দিল, সেটা সত্যি; দুটি চালাক-চতুর ছেলেই এ কাজ ভালোভাবে করতে পারত।

হুজারদের দিকে চোখ রেখে ঝেরকভ বলল, আহা, ইয়োর এক্সেলেন্সি, আপনার কি দৃষ্টি! দুই জনকে পাঠাবেন? আর তাহলে কে আমাদের ভাদিমির মেডেল ও ফিতে দিত? আর এখন, ওরা যদি কচুকাটাও হয়ে যায়, তবু হয়তো স্কোয়াড্রনটির নাম খেতাবের জন্য সুপারিশ করা হবে, আর উনি একটা ফিতে পাবেন। কি করে কাজ বাগাতে হয় সেটা আমাদের বোগদানিচ জানে।

অফিসারটি বলল, ওই দেখুন! ঐ একটা ছররা গোলা!

ফরাসিদের কামানের সামনের অংশগুলি খুলে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। সেটা দেখিয়ে অফিসারটি কথাটা বলল।

ফরাসি পক্ষের কামানবাহী সেনাদলের মধ্যে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেল; তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কুণ্ডলিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল; আর প্রথম গোলা ফাটার শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই চতুর্থ কুণ্ডলিও দেখা গেল। তারপরই পর পর দুটো, ও তৃতীয় শব্দটি শোনা গেল।

ওঃ! ওঃ। যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এমনিভাবে অফিসারটির হাত চেপে ধরে নেসভিৎস্কি আর্তনাদ করে উঠল। দেখুন, একটা সৈন্য পড়ে গেল! পড়ে গেল, পড়ে গেল!

আমার মনে হচ্ছে দুজন।

আমি জার হলে কখনো যুদ্ধে যেতাম না, মুখ ফিরিয়ে নেসভিৎস্কি বলল।

ফরাসি কামানগুলিতে তাড়াতাড়ি নতুন করে গোলা ভরা হল। নীল ইউনিফর্মধারী পদাতিক সৈনিকরা এক দৌড়ে সেতুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নিয়মিত বিরতির ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়া উঠতে লাগল, আর ছররা এসে সেতুর উপর ফাটতে লাগল। কিন্তু এবার ধোয়ার ঘন মেঘ উঠতে থাকায় সেখানে কি ঘটছে তা নেসভিৎস্কি দেখতে পেল না। হুজাররা সেতুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, আর ফরাসি কামান থেকে তাদের লক্ষ্য করেই গোলা ছুড়ছে; তাদের উদ্দেশ্য হুজারদের বাধা দেওয়া হয়; যেহেতু কামান সাজানো হয়েছে এবং কোনো একটা লক্ষ্যবস্তুও পাওয়া গেছে তাই গোলা ছোঁড়া হচ্ছে।

হুজাররা যার যার ঘোড়র কাছে ফিরে আসবার আগেই ফরাসিরা তিন দফা ছররা ছুঁড়বার মতো সময় পেল। দুটোর নিশানা ঠিক হয় নি, গোলাগুলো অনেক উঁচ দিয়ে চলে গেল, কিন্তু তৃতীয় রাউন্ডটি পড়ল একদল হুজারের মাঝখানে এবং তাদের তিনজনকে ফেলে দিল।

বোগদানিচের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের চিন্তায়ই মগ্ন হয়ে ছিল রস্তভ। কি করবে বুঝতে না পেরে সে সেতুর উপরেই দাঁড়িয়ে ছিল। কচুকাটা করবার মতো কেউ সেখানে ছিল না, আর সেতুতে আগুন লাগাবার কাজেও সে সাহায্য করতে পারছিল না, কারণ অন্য সৈন্যদের মতো সে আগুন জ্বালাবার খড় সঙ্গে নিয়ে আসে নি। দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছিল এমন সময় সেতুর উপর নাট খুলবার মতো একটা শব্দ হল আর তার একবারে কাছের হুজারটি আর্তনাদ করে রেলিংয়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ল। অন্য সকলের সঙ্গে রস্তভও দৌড়ে তার। কাছে গেল। একজন চেঁচিয়ে বলল, স্ট্রেচার! চারজন এস হুজারটিকে ধরে উঁচু করে তুলল।

উঃ! খৃস্টের দোহাই, আমাকে একা থাকতে দাও! আহত লোকটি চিৎকার করে বলল। তবু তাকে তুলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দেওয়া হল।

নিকলাস রস্তভ সেখান থেকে সরে গেল। যেন কোনো কিছু খুঁজছে এমনিভাবে সে বহুদূরে, দানিয়ুবের জলরাশির দিকে, আকাশের দিকে, সূর্যের দিকে তাকাল। আকাশটা কী সুন্দর দেখাচ্ছে কত নীল, কত শান্ত, কত গভীর! অস্তগামী সূর্যটা কী উজ্জ্বল ও গৌরবময়! অনেক দূরের দানিয়ুবের জল কী সুন্দর ঝিলমিল করছে। তার চেয়েও বেশি সুন্দর নদীর ওপারের বহুদূরের নীল পর্বতমালা, মঠটা, রহস্যময় গিরিখাদগুলি, আর কুয়াশা ঢাকা পাইনের সারি।…কী শান্তি, কী সুখ। রস্তভ মনে মনে বলল, ওখানে যেতে পারলে আর কিছুই আমি চাই না, কিন্তু এখানে…আর্তনাদ, যন্ত্রণা, আতংক, আর এই অনিশ্চয়তা ও ছুটাছুটি… ঐ–আবার তারা চেঁচাচ্ছে, আবার সকলে ছুটে পালাচ্ছে, আর আমিও তাদের সঙ্গে ছুটব, আর এখানে আমার মাথার উপরে ও চারদিকে আছে মৃত্যু…আর একটিমাত্র মুহূর্ত পার হতেই এই সূর্য, এই জল, এই গিরিখাদ–কিছুই আর আমি দেখতে পাব না।…

ঠিক সেই মুহূর্তে সূর্য মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। রস্তভ দেখল, তার সামনে আরো স্ট্রেচার এসে হাজির হয়েছে। আর মৃত্যু ও স্ট্রেচারের আতংক এবং সূর্য ও জীবনের প্রতি ভালোবাসা–সবকিছু মিলে তার মনে একটা দুঃসহ উত্তেজনার অনুভূতি দেখা দিল।

রস্তভ অস্ফুট কণ্ঠে বলতে লাগল হে ঈশ্বর! স্বর্গ হতে তুমি আমাকে রক্ষা কর, ক্ষমা কর, আশ্রয় দাও!

যে লোকগুলো ঘোড়াগুলো ধরে রেখেছিল হুজাররা তাদের কাছে ছুটে গেল; তাদের কণ্ঠস্বর আরো উচ্চে উঠল; স্ট্রেচারগুলো দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

ভাস্কা দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল, তাহলে বন্ধুরা, বারুদের স্বাদ পেয়েছ তো?

রস্তভ ভাবল, এখন সব শেষ; কিন্তু আমি একটা ভীরু-হা, ভীরু। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আর্দালির কাছ থেকে আর ঘোড়া রুককে নিয়ে তাতে চড়তে গেল।

ওটা কি ছররা গোলা ছিল? দেনিসভ শুধাল।

হ্যাঁ, তাতে কোনো ভুল নেই! দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল। তুমি তো একেবারে গবেটের মতো কাজ করলে! আক্রমণ তো মজার ব্যাপার! কুকুরগুলোকে তাড়া করা! কিন্তু এটা কি বাজে ব্যাপার হল! তোমাকে নিশানা করে তারা গোলা ছুঁড়ল।

ততক্ষণে কর্নেল, নেসভিৎস্কি, ঝেরকভ ও অফিসার সকলেই রস্তভের কাছে গিয়ে জুটেছে। দেনিসভও ঘোড়ায় চেপে সেখানে গিয়ে হাজির হল।

রস্তভ ভাবল, যাকগে, মনে হচ্ছে কেউ খেয়াল করে নি। কথাটা সত্যি। গোলাগুলির সামনে একজন ক্যাডেটের প্রথম অভিজ্ঞতা কি রকম হয় সেটা সকলেই জানে বলে কেউ রস্তভকে লক্ষ্য করে নি।

ঝেরকভ বলল, তোমাকে একটা খবর বলছি। আমি যদি; সাবলেফটেন্যান্ট পদে প্রমোশন না পাই তো কি বলেছি।

কর্নেল সগৌরবে খুশি মনে বলল, প্রিন্সকে বল, সেতুতে আমিই আগুন ধরিয়েছি।

আর তিনি যদি লোকসানের কথা জিজ্ঞাসা করেন?

কর্নেল গম্ভীর গলায় বলল, যৎসামান্য : দুইজন হুজার আহত হয়েছে, আর একজন পপাত ধরণীতলে। একটা খুশির হাসি চাপতে না পেরে পপাত ধরণীতলে কথাটাকে একটু বিশেষ জোর দিয়ে উচ্চারণ করল।

*

অধ্যায়-৯

বোনাপার্টের নেতৃত্বে এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে গঠিত ফরাসি বাহিনীর তাড়া খেয়ে, অমিত্রসুলভ মনোভাবসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে বাস করে, মিত্রশক্তির উপর আস্থা হারিয়ে, রসদ-সরবরাহের স্বল্পতার অসুবিধা ভোগ করে, এবং অদৃষ্টপূর্ব সামরিক পরিবেশে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়ে, কুতুজভের নেতৃত্বে পরিচালিত পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত রুশ বাহিনীর দানিয়ুব নদীর তীর বরাবর দ্রুত গতিতে পশ্চাদপসরণ করে চলেছে; শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলেই থামছে, এবং যতদূর সম্ভব অল্প ক্ষতি স্বীকার করে পশ্চাদপসরণের পক্ষে প্রয়োজনীয় যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হচ্ছে। ল্যাম্ব্যাক, আমসটেট্রেন ও মেলকে যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু রুশ সৈন্যগণ যত সাহস ও সহিষ্ণুতার সঙ্গেই যুদ্ধ করুক না কেন, তার ফল দ্রুত পশ্চাদপসরণ ছাড়া আর কিছুই হয় নি। উলমের যুদ্ধে বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে অস্ট্রিয় বাহিনী ব্রাউনাউতে এসে কুতুজভের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। এখন তারা আবার আলাদা হয়ে গেছে। কুতুজভের হাতে আছে শুধু তার নিজস্ব দুর্বল ও রণক্লান্ত সৈন্যদল। আধুনিক সমর-বিজ্ঞানের রীতি অনুসারে আক্রমণের যে পরিকল্পনা সযত্নে তৈরি করে অস্ট্রিয় হক্ৰিগসরাথ ভিয়েনাতে কুতুজভের হাতে তুলে দিয়েছিল তার পরিবর্তে এখন কুতুজভের পক্ষে প্রায় দুর্লভ একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ম্যাক যে ভাবে উলমে তার সৈন্য নষ্ট করেছে সেটা না করে রাশিয়া থেকে যে নতুন সৈন্যদল আসছে তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়া।

২৮ অক্টোবর তারিখে কুতুজভ সসৈন্যে দানিয়ুব পার হয়ে বাঁ তীরে গিয়ে পৌঁছল এবং এই প্রথম এমনভাবে ঘাঁটি করতে পারল যাতে মূল ফরাসি বাহিনী ও তার মধ্যে নদীটাই ব্যবধান দৃষ্টি করল। ৩০ তারিখে সে বামতীরবর্তী মৰ্তিয়েরের বাহিনীকে আক্রমণ করে তছনছ করে দিল। এই যুদ্ধে এই প্রথম শত্রুপক্ষের কিছু স্মারক তারা ছিনিয়ে নিতে পারল : নিশান, কামান ও শত্রুপক্ষের দুজন সেনাপতি। পক্ষকাল ধরে পশ্চাদপসরণের পরে এই প্রথম রুশ বাহিনী এক জায়গায় ঘাঁটি করে যুদ্ধে শুধু যে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে তাই নয়, ফরাসি বাহিনীকে হটিয়ে দিতে পেরেছে। সৈন্যরা যদিও যথেষ্ট সজ্জিত ছিল না, ছিল ক্লান্ত ও অবসন্ন এবং হত, আহত, রুগ্ন ও পরিত্যক্তের সংখ্যাই ছিল এক-তৃতীয়াংশ; যদিও রুগ্ন ও আহত সৈনিকদের অনেককেই দানিয়ুবের অপর তীরে ফেলে আসা হয়েছে শুধু একখানি চিঠি লিখে যাতে কুতুজত তাদের তুলে দিয়েছে শত্রুপক্ষের মানবতাবোধের হাতে; এবং যদিও ক্রেমসের সব বড় হাসপাতাল ও বাড়িগুলোকে সামরিক হাসপাতালে পরিণত করেও সব রুগ্ন ও আহত সৈন্যদের স্থান-সংকুলান করা যাচ্ছে না, তবু ক্রেমসের দৃঢ়তায় এবং মৰ্তিয়েরের বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে সৈন্যদের মনোবল যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। গোটা বাহিনীর মধ্যে এবং হেডকোয়ার্টারে এমন সব ভুল গুজব মহা আনন্দে ছড়িয়ে পড়েছে যে রাশিয়া থেকে নতুন নতুন সৈন্যদল আসছে, অস্ট্রিয় বাহিনী অনেক জায়গায় বিজয়ী হয়েছে, এবং ভীত বোনাপার্ত পিছু হটতে শুরু করেছে।

যুদ্ধের সময় প্রিন্স আন্দ্রু অস্ট্রিয়ার সেনাপতি শমিডের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল। সেনাপতি শমিড যুদ্ধে মারা গেছে। প্রিন্স আর ঘোড়াটা চোট পেয়েছে, আর তার নিজের হাতটাও বুলেটে কিছুটা ছড়ে গেছে। প্রধান সেনাপতির বিশেষ অনুগ্রহের প্রতীক হিসেবে যুদ্ধে জয়লাভের সংবাদ দিতে তাকেই পাঠানো হয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজদরবারে। ফরাসিদের আক্রমণের ভয়ে রাজ-দরবার এখন ভিয়েনা থেকে ব্রুনে স্থানান্তরিত হয়েছে। দেখতে রোগা-পটকা হলেও প্রিন্স আল্লু অনেক পেশীবহুল শক্তিমানের চাইতে অনেক বেশি শারীরিক ধকল সহ্য করতে পারে। যুদ্ধের রাতেই দখতুরভের (একজন রুশ সেনাপতি) কাছ থেকে চিঠিপত্র নিয়ে সে যখন কেমসে কুতুজভের কাছে পৌঁছেছিল তখনই একটা বিশেষ চিঠি নিয়ে তাকে পাঠানো হল ব্রুনে। এই পাঠানোর অর্থ শুধু একটা পুরস্কার প্রাপ্তিই নয়, পদোন্নতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও বটে।

অন্ধকার রাত; কিন্তু আকাশে অনেক তারা। আগের দিন-যুদ্ধের দিন খুব বরফ পড়েছে। সেই বরফের মধ্যে রাস্তাটাকে কালো দেখাচ্ছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধের কথাগুলি তার মনে পড়ছে, জয়ের সংবাদ পৌঁছে দিলে সেখানে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে খুশি মনে এটা কল্পনা করছে, প্রধান সেনাপতি ও অফিসার-বন্ধুরা তাকে যে ভাবে বিদায়-সম্বর্ধনা জানিয়েছে সে-কথা তার মনে পড়ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রিন্স আন্দ্রু একটা ডাক গাড়িতে চেপে চলেছে। তার মনের ভাবখানা এমন যেন শেষপর্যন্ত একটা বহু-বাঞ্ছিত সুখের দরজায় সে পৌঁছতে যাচ্ছে। চোখ বুজলেই তার কানে যেন বাজছে চাকার ঘর্ঘর শব্দ আর জয়ের অনুভূতি। তারপরেই সে কল্পনায় দেখতে পেল, রুশরা ছুটে পালাচ্ছে, আর সে নিজে মারা গেছে; কিন্তু পরমুহূর্তেই একটা নবীন আনন্দের অনুভূতির মধ্যে জেগে উঠে সে বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা সে রকম মোটেই নয়; বরং ফরাসিরাই দৌড়ে পালিয়েছে। জয়ের বিস্তারিত বিবরণগুলি নতুন করে মনে পড়ল; মনে পড়ল যুদ্ধ চলাকালীন তার শান্ত সাহসের কথা; আর নিশ্চিন্তমনে সে ঝিমুতে শুরু করল…তারকাখচিত কালো রাতের শেষে দেখা দিল উজ্জ্বল আনন্দময় সকাল। রোদ লেগে বরফ গলতে শুরু করেছে, ঘোড়াগুলি দ্রুত ছুটছে, রাস্তার দুই পাশে নানারকম জঙ্গল, ক্ষেত ও গ্রাম ছড়িয়ে আছে।

একটা ডাক-ঘাঁটিতে একদল আহত রুশ সৈন্যের সঙ্গে তার দেখা হল। ভারপ্রাপ্ত রুশ অফিসারটি সামনের গাড়িতে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে চিৎকার করে একটা সৈন্যকে কাঁচা খিস্তি করতে শুরু করেছে। প্রতিটি লম্বা জার্মান গাড়িতে ছয় বা তার বেশি বিবর্ণ, নোংরা, ব্যান্ডেজ-বাঁধা মানুষ পাথুরে রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে চলেছে। কেউ কেউ কথাবার্তা বলছে (রুশ শব্দ তার কানে এল), কেউ বা রুটি খাচ্ছে; যারা গুরুতর আহত তারা নিঃশব্দে ডাক-গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রিন্স আন্দ্রু কোচয়ানকে গাড়ি থামাতে বলল; একটি সৈনিককে জিজ্ঞাসা করল, তারা কোন যুদ্ধে আহত হয়েছে? সৈন্যটি জবাব দিল, গত পরশু, দানিয়ুবের তীরে। থলে বের করে প্রিন্স আন্দ্রু সৈনিকটিকে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা দিল।

অফিসারটি এগিয়ে এলে তাকে বলল, সকলের জন্যই দিলাম।

শিগগির ভালো হয়ে ওঠ হে ছেলেরা! এখনো অনেক কিছু করবার আছে, সৈন্যদের দিকে ফিরে সে বলল।

খবর কি স্যার? কথা বলার আগ্রহে অফিসারটি শুধাল।

খবর ভালো!…চল হে! চেঁচিয়ে কোয়ানকে বলল। গাড়ি ছুটে চলল।

প্রিন্স আন্দ্রুর গাড়ি যখন ব্রুনের বাঁধানো পথের উপর দিয়ে সশব্দে ছুটতে লাগল তখন অন্ধকার হয়ে। এসেছে; চারদিকে উঁচু-উঁচু বাড়ি, দোকানের ঘর-বাড়ির, ও রাস্তার আলো; ভালো ভালো গাড়ি চলাচল করছে; এককথায় একটা কর্মচঞ্চল বড় শহরের যে পরিবেশ শিবির-জীবন কাটাবার পরে একজন সৈনিকের কাছে খুবই মনোরম লাগে সে সবই উপস্থিত। দ্রুত পথ পরিক্রমা এবং বিদ্রি রাত কাটানো সত্ত্বেও প্রাসাদ অভিমুখে যেতে যেতে প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল সে যেন আগের দিনের চাইতে আরো বেশি কর্মঠ ও তৎপর হয়ে উঠেছে। শুধু চোখ দুটি জরাগ্রস্তের মতো জ্বালা করছে, আর টুকরো টুকরো চিন্তাগুলি একের পর এক অসাধারণ স্পষ্টতায় ও দ্রুতগতিতে মনের মধ্যে আসা-যাওয়া করছে। যুদ্ধের বিবরণগুলি আর একবার অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে তার মনের সামনে ভাসতে লাগল; যেন কল্পনায় দেখতে পেল যে সে নিজেই অত্যন্ত স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত আকারে সম্রাট ফ্রান্সিসের কাছে সে বিবরণ নিবেদন করছে। তাকে কী কী প্রশ্ন করা হবে, আর সে তার কী উত্তর দেবে, সেসবও সে কল্পনা করতে লাগল। সে আশা করল যে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে সম্রাটের সমানে উপস্থিত করা হবে। অবশ্য প্রাসাদের প্রধান ফটকে একজন সরকারি কর্মচারী তাকে দেখেই ছুটে এল, এবং সে একজন বিশেষ সংবাদবাহক জানতে পেরে তাকে আর একটা ফটক দেখিয়ে দিল।

বারান্দা দিয়ে এগিয়ে ডান দিকে Euer Hochgeboren! সেখানেই কর্তব্যরত অ্যাডজুটান্টকে দেখতে পাবেন। তিনিই আপনাকে যুদ্ধমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাবেন।

কর্তব্যরত অ্যাডজুটান্ট প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখেই তাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে যুদ্ধমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে গেল। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে বিশেষ সম্ভ্রমের সঙ্গে অভিবাদন জানিয়ে সে প্রিন্স আন্দুকে নিয়ে একটা বারান্দা দিয়ে যুদ্ধমন্ত্রীর ঘরের দিকে নিয়ে চলল। অ্যাডজুটান্টটি এত বেশি শিষ্টাচার দেখাতে লাগল যেন সে চাইছে যে রুশ সংবাদদাতাটি যেন তার সঙ্গে কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের চেষ্টা করতে না পারে।

মন্ত্রীর ঘরের দিকে যেতে যেতেই প্রিন্স আর মনের প্রফুল্লতা যেন অনেকটা কমে গেল। সে মনে মনে আহত বোধ করল, আর সঙ্গে সঙ্গেই আহত মনোভাবটি একটি অকারণ ঘৃণায় পরিণত হল। অ্যাডজুটান্ট ও মন্ত্রীকে ঘৃণা করবার অধিকার যে তার আছে, তার উর্বর মস্তিষ্ক সেটা তাকেই বুঝিয়ে দিল। সে ভাবল, এরা হয়তো ভাবে যে গোলা-বারুদের গন্ধ থেকে দূরে থেকে সহজেই যুদ্ধ জয় করা যায়। তার চোখ দুটি ঘৃণায় সংকুচিত হয়ে উঠল; সদর্পে পা ফেলে সে যুদ্ধমন্ত্রীর ঘরে ঢুকল। কিন্তু সে যখন দেখল, একটা মস্ত বড় টেবিলে বসে মন্ত্রীমশাই কাগজপত্র পড়ছে, আর পেন্সিল দিয়ে কি সব লিখছে, অথচ প্রথম দুতিন মিনিট তার উপস্থিতিটা লক্ষ্যই করল না, তখন তার ঘৃণার ভাবটা আরো বেড়ে গেল। মন্ত্রীর কপালের দুই পাশে কিছুটা পাকা চুল; বাকি মাথাটায় টাক। টাক মাথার দুই পাশে দুটো মোমবাতি। দরজা খোলার ও পায়ের শব্দে চোখ না তুলেই সে শেষপর্যন্ত পড়েই চলল।

এটা নিয়ে দিয়ে দাও, কাগজপত্রগুলি অ্যাডজুটান্টের হাতে দিয়ে মন্ত্রী বলল; তখনো সে বিশেষ সংবাদদাতার উপস্থিতি খেয়াল করল না।

প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল, হয় নিজের অন্যান্য কাজকর্মের তুলনায় কুতুজভের সেনাবাহিনীর কাজকর্মের প্রতি যুদ্ধমন্ত্রীর আগ্রহই কম, অথবা রুশ সংবাদদাতাটির কাছে সেই ভাবটিই সে দেখাতে চায়। কিন্তু সেটা তো আমার প্রতি পুরোপুরি ঔদাসিন্যের সামিল, সে ভাবল। মন্ত্রীমশাই বাকি কাগজপত্র একত্র করল, ভালোভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখল, তারপর মাথা তুলল। তার মাথাটি বুদ্ধিমত্তা ও বিশিষ্টতার পরিচয় বহন করে; কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকানো মাত্রই তার মুখের স্থির, বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটি সম্পূর্ণ বদলে গেল; যেন এটাই তার পক্ষে সহজ ও স্বাভাবিক। তার মুখে ফুটে উঠল এমন একটা কৃত্রিম বোকা বোকা হাসি (কৃত্রিমতাকে ঢাকবার চেষ্টা পর্যন্ত নেই) যা শুধু সেই মানুষের মুখেই দেখা যায় যে একের পর এক অনেক আবেদনকারীর সঙ্গে দেখা করতে অভ্যস্ত।

মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, সেনাপতি ফিল্ড-মার্শাল কুতুজভের কাছ থেকে এসেছেন? আশা করি সংবাদ শুভ? মৰ্তিয়েরের সঙ্গে একটা যুদ্ধ তো হয়েছে? জয় হয়েছে তো? তার সময় তো হয়েছে!

তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটা হাত নিয়ে মন্ত্রী পড়তে লাগল। তার মুখে শোক-চিহ্ন ফুটে উঠল।

হা আমার ঈশ্বর! আমার ঈশ্বর! শমিড! জার্মান ভাষায় সে হাহাকার করে উঠল। কী বিপদ!

কী বিপদ। চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে কি যেন ভাবতে ভাবতে সে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল।

কী বিপদ! আপনারা বলছেন যে চূড়ান্ত জয় হয়েছে। কিন্তু মৰ্তিয়েরকে বন্দি করা হয় নি। সে আবার একটু ভাবল। আপনি শুব সংবাদ নিয়ে আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি, যদিও শমিডের মৃত্যুতে সে জয়লাভের জন্য বড় বেশি দাম দিতে হয়েছে। হিজ ম্যাজেস্টি অবশ্যই আপনার সঙ্গে দেখা করবেন, কিন্তু আজ নয়। আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনার বিশ্রামের দরকার। আগামীকাল প্যারেডের পরে দরবারে হাজির থাকবেন। অবশ্য, আমি আপনাকে জানাব।

কথা বলার সময় যে নির্বোধ হাসিটি তার মুখ থেকে চলে গিয়েছিল সেটা আবার ফিরে এল।

মাথাটা নিচু করে সে বলল, Au revoir! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। হিজ ম্যাজেস্টি সম্ভবত আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন।

প্রাসাদ থেকে চলে আসার পথে প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল, এই জয়লাভ যে আগ্রহ ও সুখ তাকে এনে দিয়েছিল, সব এখন গচ্ছিত রইল যুদ্ধমন্ত্রী ও তার বিনীত অ্যাডজুটান্টের উদাসীন হাতে। তার গোটা চিন্তার ধারাই মুহূর্তে বদলে গেল; মনে হল, যুদ্ধটা যেন বহুদূর অতীতের একটি ঘটনার স্মৃতিমাত্র।

*

অধ্যায়-১০

ব্রুনে প্রিন্স আর থাকবার ব্যবস্থা হল কূটনৈতিক দপ্তরে চাকরিরত তার পরিচিত একজন রুশ ভদ্রলোকের সঙ্গে না, বিলিবিন।

বাইরে এসে প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে দেখা করে বিলিবিন বলল, আরে, প্রিন্স! আমার কাছে তোমার চাইতে স্বাগত অতিথি কেউ নয়। ফ্রাঞ্জ, প্রিন্সের প্রিয় সামান আমার শোবার ঘরে নিয়ে যাও। যে চাকরটি বলকনস্কিকে সঙ্গে করে এনেছে তাকেই সে কথাটা বলল। তাহলে তুমি যে জয়ের অগ্রদূত হে? চমৎকার! আর দেখতেই তো পাচ্ছ, আমি এখানে অসুখ বাধিয়ে বসে আছি।

হাত-মুখ ধুয়ে সাজপোশাক পরে প্রিন্স আন্দ্রু কূটনীতিকের বিলাসবহুল খাবার ঘরে গিয়ে তার জন্য তৈরি খানা খেতে বসল। বিলিবিন আরাম করে আগুনের পাশে পা ছড়িয়ে বসল।

যুদ্ধের অভিযানের যোগদানের পর থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আরাম এবং জীবনের সব রকম সুখ সম্ভোগ থেকে প্রিন্স আন্দ্রু সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল। তার উপর দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি। তাই শিশুকাল থেকে যে বিলাসবহুল পরিবেশে বাস করতে সে অভ্যস্ত সেই পরিবেশে এসে এখন সে খুবই আরাম বোধ করল। তাছাড়া, অস্ট্রিয়দের অভ্যর্থনার পরে যদিও এখন রুশ ভাষায় কথা বলছে না (তারা কথা বলছে ফরাসিতে), তবু একজন রুশ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে পেরে তার বেশ ভালো লাগছে; কারণ তার ধারণা সেই সময়ে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে রুশদের মধ্যে যে তীব্র বিরূপ মনোভাব ছিল সেটা এই রুশ লোকটির মধ্যেও অবশ্যই থাকবে।

বিলিবিনের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর; সে অবিবাহিত এবং প্রিন্স আন্দ্রুর একই সমাজের মানুষ। পিটার্সবুর্গে থাকতে পূর্বেই তাদের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে প্রিন্স আন্দ্রু যখন কুতুজভের সঙ্গে ভিয়েনায় ছিল তখন সে পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। প্রিন্স আন্দ্রু যেমন প্রথম যৌবনেই সামরিক বিভাগে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবার স্বাক্ষর রেখেছিল, তেমনি বিলিবিনও রেখেছিল কূটনৈতিক কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর। এখনো সে বয়সে যুবক, কিন্তু এখন সে তার যুবক কূটনীতিক নয়; কারণ খোল বছর বয়সে কূটনৈতিক চাকরিতে ঢুকে সে প্যারি ও কোপেনহেগেনে ছিল, এবং এখন ভিয়েনায় বেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমাদের ভিয়েনাস্থ রাষ্ট্রদূত উভয়েই তাকে চেনে এবং প্রশংসা করে। যে সব কূটনীতিকদের প্রশংসা করা হয় যেহেতু তারা কতকগুলি নেতিবাচক গুণের অধিকারী, কতকগুলি বিশেষ বিশেষ কাজ তারা করে না এবং ফরাসিতে কথা বলে, বিলিবিন তাদের একজন নয়। সে তাদেরই একজন যারা নিজেদের কাজ পছন্দ করে, সে কাজ করতে জানে এবং আলস্যপ্রিয়তা সত্ত্বেও কখনো কখনো লেখার টেবিলে বসে সারাটা রাত কাটিয়ে দিতে পারে। কাজ যেমনই হোক, সে কাজ সে সুষ্ঠুভাবেই শেষ করে থাকে। কিসের জন্য? নয়, কেমন করে? এই প্রশ্নটাই তার কাছে আসল। কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়বস্তু কি তা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না; যে কোনো বিষয় নিয়ে সুকৌশলে, তীক্ষ্ণতার সঙ্গে ও সুচারুরূপে ইস্তাহার, স্মারকলিপি অথবা প্রতিবেদন তৈরি করাতেই তার আনন্দ। শুধু লেখার জন্যই যে বিলিবিনকে মর্যাদা দেওয়া হয় তাই নয়, উঁচু মহলের লোকদের সঙ্গে ব্যবহার ও আলোচনার কুশলতার জন্যও তাকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

বিলিবিন যেমন কাজ ভালোবাসে, তেমনি আলাপ-আলোচনাও ভালোবাসে, শুধু সে কাজটি সুষ্ঠু ও বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া চাই। সমাজে সে সর্বদাই অপেক্ষা করে থাকে একটা উল্লেখযোগ্য কিছু বলবার সুযোগের জন্য; আর একমাত্র সেটা সম্ভব হলে তবেই সে কোনো আলোচনায় যোগ দেয়। তার কথাবার্তার মধ্যে সব সময়ই সকলের পক্ষে বোধগম্য কিছু বুদ্ধিদীপ্ত মৌলিক পরিচ্ছন্ন বাক্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবেই। যেন ইচ্ছা করেই এ সব বাক-ভঙ্গিতে সে মনের গভীর ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে রাখে; যাতে সমাজের অতি সাধারণ মানুষরাও সেগুলিকে এক বৈঠকখানা থেকে আর এক বৈঠকখানায় বয়ে নিয়ে যেতে পারে। বস্তুত, বিলিবিনের এইসব রসিক ভাষণ ভিয়েনার বৈঠকখানার ঘরে ঘরে ফেরি করা হয়, এবং নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রায়ই যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে থাকে।

তার শুকনো, বিবর্ণ মুখটা সব সময়ই গভীর ভাজে ঢেকে থাকে; অথচ সে মুখ সর্বদাই দেখায় ধোয়া মোছা, পরিষ্কার, ঠিক যেন রুশ-স্নানের পরে আঙুলের ডগার মতো। মুখের ভাঁজগুলি এমনভাবে নড়েচড়ে যে তাতেই তার মনের ভাবগুলি প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই হয়তো তার কপালে অনেকগুলো ভাজ পড়ল আর ভুরু দুটো ঠেলে উঠল; আবার হয়তো ভুরু দুটো নেমে এল নিচে আর গালে পড়ল অনেকগুলো গভীর ভাঁজ। ছোট দৃঢ়বদ্ধ চোখ দুটো সর্বদাই মিটমিট করে, সোজা সামনে তাকায়।

আচ্ছা, এবার তাহলে তোমাদের যুদ্ধ জয়ের কথা বল, সে বলল।

একবারও নিজের নাম উল্লেক না করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলকনস্কি যুদ্ধমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা ও তার অভ্যর্থনার একটা বিবরণ দিল।

উপসংহারে বলল, স্কিটল খেলায় লোকে যেভাবে একটা কুকুরকে গ্রহণ করে সেইভাবেই তিনি আমাকে ও আমার সংবাদটিকে গ্রহণ করেছেন।

বিলিবিন হাসল; তার মুখের ভাঁজগুলি মিলিয়ে গেল।

একটু দূর থেকে নখগুলোর দিকে তাকিয়ে এবং বাঁ চোখের উপরকার চামড়াটা কুঁচকে সে বলল, কিন্তু প্রিয় বন্ধু, গোঁড়া রুশ বাহিনীর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও এ কথা বলতে আমি বাধ্য যে তোমাদের এই জয় আসলে জয়যুক্ত নয়।

সে ফরাসিতেই কথা বলে চলল; শুধু যে কথাগুলির উপর সে একটু ব্যঙ্গাত্মক জোর দিতে চায় (এক্ষেত্রে গোঁড়া রুশ বাহিনী) সেগুলিকে রুশ ভাষায় উচ্চারণ করল।

ভেবে দেখ। আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়লে ভাগ্যহীন মর্তিয়ের ও তার এক ডিভিশন সৈন্যের উপর, আর তা সত্ত্বেও মৰ্তিয়ের তোমাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে গেল! তাহলে জয়টা হল কোথায়?

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, কিন্তু গুরুতরভাবে ভাবলে আমরা এটা তো গর্ব না করেই বলতে পারি যে উলমের চাইতে ভালো কাজ আমরা করেছি…

একজন, অন্তত একজন মার্শালকে তোমরা বন্দি করনি কেন?

কারণ সবকিছুই আশানুরূপভাবে, অথবা কুচকাওয়াজের মতো সহজ, সরলভাবে ঘটে না। তোমাকে তো বলেছি, আমরা আশা করেছিলাম সকাল সাতটার মধ্যেই তাদের পিছন দিকটায় হাজির হতে পারব, কিন্তু বিকেল পাঁচটার মধ্যেও সেখানে পৌঁছতে পারি নি।

বিলিবিন মৃদু হেসে মন্তব্য করল, সকাল সাতটায় কেন পৌঁছলে না? সকাল সাতটায়ই তো তোমাদের পৌঁছনো উচিত ছিল।

সেই একই সুরে প্রিন্স আন্দ্রু পাল্টা আঘাত করল, তোমরাই বা কূটনৈতিক পদ্ধতিতে বোনাপার্তকে বোঝাতে পার নি কেন যে তার পক্ষে জেনোয়া ছেড়ে যাওয়াই ভালো ছিল?

বিলিবিন বাধা দিয়ে বলল, আমি জানি, তুমি ভাবছ যে আগুনের পাশে সোফায় বসে মার্শালকে ধরা খুবই সোজা! সে কথা ঠিক, কিন্তু তবু তোমরা তাকে বন্দি করলে না কেন? কাজেই শুধু যুদ্ধমন্ত্রী নন, মহামহিম সম্রাট ও রাজা ফ্রান্সিস তোমাদের জয়লাভে যথেষ্ট পুলকিত না হন তো আমি অন্তত অবাক হব না।

এমন কি আমি যে রুশ দূতাবাসের একজন নগণ্য সচিব, আমার মনেও বাসনা জাগে না যে আনন্দের প্রকাশ হিসেবে আমার ফ্রাঞ্জকে একটা রৌপ্যমুদ্রা দেই, অথবা তাকে একদিন ছুটি দেই।…

সে সরাসরি প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল; হঠাৎ তার কপালের ভাঁজগুলি মিলিয়ে গেল।

বলকনস্কি বলল, প্রিয় বন্ধু, এবার কিন্তু আমার পালা; তোমাকেও জিজ্ঞাসা করব কেন? স্বীকার করছি আমি ঠিক বুঝি না : হয়তো এখানে এমন কিছু কূটনৈতিক সূক্ষ্ম প্রশ্ন আছে যা আমার ক্ষীণ বুদ্ধির অতীত, কিন্তু আমি সেটা বুঝতে পারি না। ম্যাক একটা গোটা বাহিনী নষ্ট করেছেন, আর্চডিউক ফার্ডিনান্ড ও আর্চডিউক কার্লের মধ্যে জীবনের কোনো লক্ষণই নেই, তারা ভুলের পর ভুল করছেন। কুতুজভই শেষপর্যন্ত একটা সত্যিকারের জয়লাভ করেছেন, ফরাসিদের অপরাজেয়তার যাদুকে ধ্বংস করেছেন, অথচ যুদ্ধমন্ত্রী তার বিবরণটুকু শুনতেও আগ্রহী নন।

ঠিক তাই প্রিয় বন্ধু! বুঝতেই পারছ, জারের পক্ষে, রাশিয়ার পক্ষে, গোঁড়া গ্রিক ধর্মের পক্ষে এটা একটা জয়-গৌরব! এ পর্যন্ত খুব ভালো, কিন্তু এ সব জয়ে আমাদের, আমি বলতে চাই অস্ট্রিয় রাজদরবারের, কি যায় আসে? আর্চডিউক কার্ল বা ফার্ডিনান্ডের (তুমি তো জান সব আর্চডিউকই সমান) জয়ের একটা ভালো খবর আমাদের এনে দাও, এমন কি সে জয় যদি বোনাপার্তের একটা ফায়ার-ব্রিগেডের বিরুদ্ধেও হয় সেও ভালো, তাহলেই সেটা হবে বাহিনী, আর আমরাও কামান থেকে গোলা ছুঁড়ব! কিন্তু এ সব তো করা হয় আমাদের বিরক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই। আর্চডিউক কার্ল কিছুই করেন না, আর্চডিউক ফার্ডিনান্ড যে কাজ করেছেন তাতে তার নিজেরই লজ্জা। তোমরা ভিয়েনা ছেড়ে গেলে, তার রক্ষা-ব্যবস্থা তুলে নিলে–যেন বলতে চাইলে : ঈশ্বর আমাদের সহায়, কিন্তু ঈশ্বর তোমাদের ও তোমাদের রাজধানীকে রক্ষা করুন! শমিডই একমাত্র সেনাপতি যাকে আমরা ভালোবাসতাম; তাকে তোমরা বুলেটের মুখে ঠেলে দিলে, আর তারপর এলে জয়লাভ উপলক্ষে আমাদের অভিনন্দন জানাতে! স্বীকার কর যে তোমাদের এই খবরের চাইতে বিরক্তিকর আর কিছু ভাবাই যায় না। মনে হয়, যেন ইচ্ছা করেই এটা করা হয়েছে। তাছাড়া, ধর তোমরা একটা সত্যিকারের জয়লাভই করেছ, এমন কি আর্চডিউক কালও যদি জয়লাভ করে থাকে, সাধারণ ঘটনা প্রবাহের উপর তার কি প্রভাব হবে? ফরাসি বাহিনী যখন ভিয়েনা দখল করে নিয়েছে তখন এ সব কিছুই তো বড় বেশি বিলম্বে ঘটেছে!

কি? দখল করেছে? ভিয়েনা দখল করেছে?

শুধু দখল করে নি, বোনাপার্ত শমব্রুনে (অস্ট্রিয়ার সম্রাটের ভিয়েনাস্থ গ্রীষ্মবাস) এসেছে, আর কাউন্ট, আমাদের প্রিয় কাউন্ট ভূবনা তার কাছে যাচ্ছেন হুকুম শুনতে।

পথের ক্লান্তি, তার অভ্যর্থনা, এবং বিশেষ করে আহারাদির পরে বলকনস্কির মনে হল, এসব কথার পুরো অর্থ তার মাথায় ঢুকছে না।

বিলিবিন বলতে লাগল, কাউন্ট লিচটেনফেলস আজ সকালেই এখানে এসেছিলেন; তিনি আমাকে একটা চিঠি দেখালেন, তাতে ভিয়েনাতে ফরাসিদের কুচকাওয়াজের পূর্ণ বিবরণ লেখা আছে।…বুঝতেই পারছ, তোমাদের জয়লাভে এখানে আনন্দ-উৎসব করার কোনো কারণ নেই, আর তোমাকেও ত্রাণকর্তা বলে অভ্যর্থনা জানানো চলে না।

প্রিন্স আন্দ্রু এতক্ষণে একটু একটু বুঝতে পারছে যে, অস্ট্রিয়ার রাজধানীর পতনের মতো এতবড় ঘটনার পরে ক্রেমসের যুদ্ধের সংবাদের গুরুত্ব সত্যিই খুব সামান্য। সে বলল, সত্যি বলছি, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না, মোটেই না।…কিন্তু ভিয়েনা দখল হল কেমন করে? সেই সেতু, তার বিখ্যাত সেতু-মুখ ও প্রিন্স অয়ের্সপার্গের কি হল তাহলে? আমরা শুনেছিলাম, প্রিন্স অয়ের্সপার্গ ভিয়েনা রক্ষা করছিলেন?

প্রিন্স অয়ের্সপার্গ তো এদিকে, নদীর আমাদের দিকে রয়েছেন; তিনি তো আমাদের রক্ষা করছেন–যদিও সে কাজটা তিনি খুব খারাপভাবেই করছেন, তবু তিনিই আমাদের রক্ষা করছেন। কিন্তু ভিয়েনা তো নদীর ওপারে। না, সেতুটা এখনো বেদখল হয় নি, আর আশা করছি হবেও না, কারণ ওখানে মাইন পাতা আছে। আর ওটাকে উড়িয়ে দেবার হুকুম হয়েছে। নইলে অনেক আগেই আমাদের চলে যেতে হতো বোহেমিয়ার পাহাড়ে, আর সসৈন্যে তোমাদের সময় কাটাতে হতো দুই অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে।

কিন্তু তবু তার অর্থ এই নয় যে অভিযান শেষ হয়ে গেছে, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

দেখ, আমি তো মনে করি শেষ হয়েই গেছে। এখানকার বড় বড় মাথারাও তাই মনে করেন, যদিও সেকথা বলতে সাহস করেন না। যুদ্ধের গোড়াতে আমি যা বলেছিলাম তাই হবে; যুদ্ধের মীমাংসা দুরেনস্তিনে তোমাদের কাটাকাটিতেও হবে না, বা গোলাবারুদেও হবে না; যারা যুদ্ধ বাধিয়েছে তারাই এর মীমাংসা করবে। কথা বলতে বলতে বিলিবিনের কপালের ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেল। একটু থেমে সে আবার বলল, একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, সম্রাট আলেকজান্দার ও প্রাশিয়ার রাজার মধ্যে বার্লিনে যে মুলাকাত হবে তার ফলটা কি দাঁড়াবে? প্রাশিয়া যদি মিত্রপক্ষে যোগ দেয় তাহলে অস্ট্রিয়াও যোগ দিতে বাধ্য হবে, এবং যুদ্ধ বাধবে। তা না হলে নতুন ক্যাম্পো ফর্মিও-প্রাথমিক সূত্রগুলি কোথায় রচিত হবে সেটা ঠিক করাই হবে আসল প্রশ্ন।

প্রিন্স আন্দ্রু সহসা মুষ্টিবদ্ধ হাতে টেবিলের উপর আঘাত করে চেঁচিয়ে উঠল, কী অসাধারণ প্রতিভা! আর লোকটির কী ভাগ্য!

একটা মজার কথা কিছু বলতে যাচ্ছে এমনি ভাব দেখিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বিলিবিন জিজ্ঞাসা করল, বোনাপার্ত? বোনাপার্ত? নামের ইউ অক্ষরটার উপর জোর দিয়ে সে নামটা দুইবার উচ্চারণ করল। আমি অবশ্য মনে করি, শত্রুনে সেই যখন অস্ট্রিয়ার জন্য নিয়ম-কানুন বাতলে দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমরা তার নামের ইউটা বাদ দিয়েই দেব। আমি তো একটা নতুন শব্দ প্রবর্তন করে তাকে বনাপার্ত বলেই ডাকব (ইউটা বাদ দিয়ে)।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, ঠাট্টা রাখ; তুমি কি সত্যি মনে কর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে?

আমি তো তাই মনে করি। অস্ট্রিয়াকে বোকা বানানো হয়েছে, আর সে তাতে অভ্যস্ত নয়। সে প্রতিশোধ নেবেই। প্রথমত তাকে বোকা বানানো হয়েছে কারণ তার প্রদেশগুলি তচনছ করা হয়েছে–তারা বলছে যে পবিত্র রুশ বাহিনী ভয়ংকরভাবে লুটতরাজ করেছে-তার সেনাদলকে ধ্বংস করা হয়েছে, তার রাজধানী, বেদখল হয়েছে, আর এ সবই হয়েছে হিজ সার্ডিনিয় ম্যাজেস্টির দুটি সুন্দর চোখের জন্য। আর তাই–কথাটা শুধু আমাদের মধ্যেই বলছি–আমি মনে মনে অনুভব করছি যে আমাদেরও ঠকানোর আয়োজন চলছে। আমার মন বলছে, ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনা, সন্ধির পরিকল্পনা ও আলাদাভাবে একটা গোপন চুক্তির চেষ্টা হচ্ছে।

প্রিন্স আন্দ্রু চেঁচিয়ে বলল, অসম্ভব! এত নিচ তারা হতে পারে না!

যদি বেঁচে থাকি তো সবই দেখতে পা, বিলিবিন জবাব দিল। তার মুখ আবার শান্ত হয়ে গেল, বোঝা গেল, আলোচনা শেষ হল।

প্রিন্স আন্দ্রু তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে একটা পরিষ্কার শার্ট পরে গরম, সুগন্ধি বালিশে মাথা রেখে পালকের বিছানায় শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে তার মনে হল, যে যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে সে এসেছে সেটা অনেক অনেক দূরের একটা ব্যাপার। প্রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা, অস্ট্রিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, বোনাপার্তের নতুন জয়লাভ, আগামীকালের রাজ-দরবার ও কুচকাওয়াজ ও সম্রাট ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ–এইসব চিন্তার মধ্যেই সে ডুবে গেল।

সে চোখ বুজল। সঙ্গে সঙ্গে কামান-বন্দুকের গর্জন ও চাকার ঘর্ঘর শব্দ তার কানে বাজতে লাগল; একদল বন্দুকধারী সৈন্য সরু রেখায় পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে। ফরাসিরা গোলাগুলি চালাচ্ছে; আর চারদিকে বুলেটের শিসের ভিতর দিয়ে শমিড-এর পাশে পাশে ঘোড়ায় চড়ে যেতে যেতে তার হৃৎপিণ্ডটা দপ দপ করছে। বেঁচে থাকার আনন্দ যেন দশগুণ হয়ে তার মনকে ভরে দিল। শৈশবের পরে এরকম অভিজ্ঞতা তার আর কখনো হয় নি।

সে জেগে উঠল…

হ্যাঁ, এসবই ঘটেছে! শিশুর মতো খুশির হাসি হেসে সে নিজেকেই বলল; তারপর যৌবনসুলভ গভীর তন্দ্রায় ঢলে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *