০১.২ সকলে চুপচাপ

অধ্যায়-১১

সকলে চুপচাপ। অমায়িক হাসির সঙ্গে কাউন্টেস অতিথিদের দিকে তাকাতে লাগল; অবশ্য এ সত্য লুকাল না যে এখন তারা সবাই বিদায় নিলে সে মোটেই দুঃখিত হবে না। অতিথির মেয়েটি এর মধ্যেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে পোশাকটা পরিপাটি করে নিচ্ছিল; এমন সময় হঠাৎ পাশের ঘর থেকে অনেক ছেলেমেয়ের দৌড়ে দরজার কাছে যাবার এবং একটা চেয়ার উল্টে যাবার শব্দ শোনা গেল। তেরো বছরের একটি মেয়ে মসলিনের খাটো ফ্রকের ভাঁজে একটা কিছু লুকিয়ে নিয়ে ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্পষ্ট বোঝা গেল, ছুটতে ছুটতে এতদূর চলে আসার ইচ্ছা তার ছিল না। তার পিছন পিছন দরজায় এসে হাজির হল লাল রঙের কোট-কলারওয়ালা একটি ছাত্র, রক্ষীবাহিনীর একজন অফিসার, পনেরো বছরের একটি মেয়ে এবং খাটো জ্যাকেটপরা গোলাপি মুখের একটি মোটাসোটা ছেলে।

কাউন্ট লাফিয়ে উঠে এ-পাশে হেলে দুই হাত বাড়িয়ে দৌড়ে আসা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল।

আঃ, এই যে ধরে ফেলেছি! হাসতে হাসতে কাউন্ট বলল। আমার মামণি, আজ যার নামকরণ দিবস। আদরের মাটি আমার!

কঠোর হবার ভান করে কাউন্টেস বলল, সোনামণি, সবকিছুরই সময়-অসময় আছে। স্বামীর দিকে ফিরে বলল, তুমিই ওকে নষ্ট করেছ ইলিয়া।

অতিথিটি বলল, কেমন আছ সোনা? তোমার নামকরণ দিবস বার বার ফিরে আসুক এই কামনা করি। মায়ের দিকে ফিরে বলল, কী মনোরম মেয়েটি!

কালো চোখ ও চওড়া মুখের মেয়েটি ঠিক সুন্দরী না হলেও প্রাণশক্তিতে ভরপুর; দৌড়ে আসার জন্য তার খোলা কাঁধ দুটো উঠছে-নামছে, বডিসটা কাঁপছে। পিছনে ঠেলে-দেওয়া কালো কোঁকড়ানো চুল, সরু খোলা হাত, লেস-লাগানো সরু পাজামা পরা ছোট দুখানি পা, নিচু চটিতে ঢাকা পায়ের পাতা–সব মিলিয়ে মেয়েটি এখন সেই মনোহর বয়সে এসে পৌঁছেছে যখন মেয়েটি ঠিক শিশুও নেই, আবার শিশুটি এখনো নারী হয়েও ওঠে নি। মায়ের বকুনিকে গ্রাহ্য না করে মেয়েটি বাবার কাছ থেকে পালিয়ে লজ্জারক্ত মুখখানি মায়ের ওড়নার লেসের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে ভাঙাভাঙা কথায় একটা পুতুলের কথা বুঝিয়ে বলে ফ্রকের ভাঁজের ভিতর থেকে সেটাতে বের করে দেখাল।

দেখতে পাচ্ছ?… আমার পুতুল…মিমি…দেখ…। নাতাশা শুধু এইটুকুই বলতে পারল (তার কাছে সব ব্যাপারটাই মজার খেলা)। মায়ের গায়ে ঠেস দিয়ে সে এমন প্রচণ্ডভাবে হো-হো করে হেসে উঠল যে গম্ভীর অতিথিটি পর্যন্ত সে হাসিতে যোগ না দিয়ে পারল না।

কঠোর হবার ভান করে মেয়েকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মা বলল, এবার এখান থেকে পালাও, আর তোমার দস্যিপনাও সঙ্গে নিয়ে যাও। অতিথির দিকে ফিরে বলল, এটি আমার ছোট মেয়ে।

নাতাশা একমুহূর্তের জন্য মায়ের ওড়না থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে আবার মুখটা লুকিয়ে ফেলল।

বাধ্য হয়ে এই পারিবারিক দৃশ্যের দর্শক হয়ে অতিথিটি ভাবল, তারও এতে অংশ নেওয়া দরকার।

সে নাতাশাকে বলল, বল তো সোনা, মিমি তোমার কে হয়? আমার তো মনে হয় মেয়ে, কি বল?

এ সব ছেলেমানুষি ব্যাপারে অতিথির নাম গলানো নাতাশার পছন্দ হল না; কোনো কথা না বলে সে গম্ভীরভাবে তার দিকে তাকাল।

ইতিমধ্যে ছোটদের দল : আন্না মিখায়লভনার ছেলে অফিসার বরিস; কাউন্টের বড় ছেলে উপ-স্নাতক নিকোলাস; কাউন্টের পনেরো বছর বয়সের ভাইঝি সোনিয়া, আর কাউন্টের ছোট ছেলে পেতয়া (পিটারের ডাকনাম)-সকলেই বসবার ঘরে জমিয়ে বসেছে এবং তাদের চোখে-মুখে যে উত্তেজনা ও উল্লাস ঝলমল করছে তাকে শোভন ব্যবহারের সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখতে চেষ্টা করছে। স্পষ্টতই পিছনের যে ঘর থেকে তারা ছুটে বেরিয়ে এসেছে সেখানে যে সব আলোচনা চলছিল সেগুলি এই বসবার ঘরের সামাজিক কুৎসা, আবহাওয়া ও কাউন্টেস এপ্রাক্সিনাকে নিয়ে আলোচনার চাইতে অনেক বেশি মজার। অনেক কষ্টে হাসি চেপে তারা মাঝে মাঝেই একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিল।

ছাত্র ও অফিসার–দুটি যুবকই ছেলেবেলা থেকে বন্ধু; দুজনের এক বয়স, দেখতে এক রকম না হলেও দুজনই সমান সুন্দর। বরিস লম্বা, ফর্সা, তার মুখমণ্ডল শান্ত, সুদর্শন। নিকোলাস ছোটখাট, মাথায় কোঁকড়া চুল, সরল মুখ। উপরের ঠোঁটে ইতিমধ্যেই কালো লোম দেখা দিয়েছে; সারা মুখে আবেগ ও উৎসাহ সুস্পষ্ট। বসবার ঘরে ঢুকে নিকোলাস লজ্জা পেল। কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। অপর দিকে বরিস সঙ্গে সঙ্গেই পায়ের নিচে মাটি পেয়ে গেল; শান্তভাবে হাসির মেজাজে সে বলতে লাগল-পুতুল মিমি যখন তরুণী ছিল, যখন তার নাকটা ভাঙে নি, তখন থেকে সে তাকে চেনে; এই পাঁচ বছরে চোখের সামনে সে কেমন বুড়ি হয়ে গেছে, খুলির মাঝবরাবর তার মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কথাগুলি বলে সে নাতাশার দিকে তাকাল। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাতাশা তাকাল তার ভাইয়ের দিকে; নিকোলাস তখন চোখ কুঁচকে চাপা হাসির দমকে কাঁপছে। তা দেখে রাগ সামলাতে না পেরে নাতাশা লাফ দিয়ে উঠে তার দুখানি ছোট পায়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। বরিস হাসল না।

ঈষৎ হেসে সে মাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কোথায় যাবে বলছিলে না মামণি? তোমাদের কি গাড়িটা চাই?

মাও হেসে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও তো গাড়িটা জুড়তে বল।

বরিস নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নাতাশার খোঁজে। মোটাসোটা ছেলেটি রেগে তাদের পিছন পিছন ছুটে গেল, তাদের কর্মসূচীতে ব্যাঘাত ঘটায় সে যেন বিরক্তি হয়েছে।

*

অধ্যায়-১২

তরুণী অতিথিটি এবং কাউন্টেসের বড় মেয়েকে (বোনের থেকে মাত্র চার বছরের বড় হলেও সে এরই মধ্যে বয়স্কদের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছে) না ধরলে এখন বসবার ঘরে অল্পবয়সীদের মধ্যে নিকোলাস আর ভাইঝি সোনিয়া। মেয়েটি একহারা, ছোটখাট, সুন্দরী; দীর্ঘ আঁখিপক্ষে ঢাকা দুই চোখে শান্ত চাউনি, ঘন কালো চুলের বিনুনি মাথাটাকে দুবার প্যাঁচ দিয়ে রেখেছে, গায়ের রঙে বাদামি আভা, বিশেষ করে সুডৌল ও পেশীবহুল বাহু ও গলার রঙে বাদামি আভা, বিশেষ করে সুডৌল ও পেশীবহুল বাহু ও গলার রঙে বাদামির আভাস। সুললিত চলন, নরম হাত-পায়ের নমনীয়তা, আচরণে একটা বিশেষ লাজম্রতা ও সংযম-সব মিলে আজ সে একটি সুন্দর, সদ্য বেড়ে-ওঠা বিড়ালছানা হলেও অচিরেই একটি সুন্দরী মার্জানী হয়ে উঠবার সম্ভাবনা তার মধ্যে আছে। তার হাসি দেখেই বোঝা যায় যে নিজেকে সে সাধারণ আলোচনার যোগ্য শ্রোতা বলেই মনে করে; নিজের অজান্তেই দীর্ঘ, ঘন আঁখিপক্ষের নিচ দিয়ে সে সেনাবিভাগে যোগদানকারী জ্ঞাতি-ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিল; স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, সুযোগে পেলেই তারা দুজনও নাতাশা ও বরিসের মতো বসবার ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে খেলা শুরু করে দেবে।

অতিথিটিকে সম্বোধন করে এবং নিকোলাসকে দেখিয়ে কাউন্ট বলল, কি জানেন, তার বন্ধু বরিস অফিসার হয়েছে, কাজেই বন্ধুত্বের খাতিরে সেও বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে, এই বুড়ো বাপকে ছেড়ে সামরিক চাকরিতে ঢুকতে যাচ্ছে। অথচ প্রাচীন সংগ্রহশালা বিভাগে তার জন্য চাকরি এবং সবকিছুই অপেক্ষা করছিল। এই তো খাঁটি বন্ধুত্ব, তাই না? জিজ্ঞাসার সুরে কাউন্ট কথাগুলি বলল।

কিন্তু লোকে তো বলছে যুদ্ধ ঘোেষণা করা হয়ে গেছে, অতিথি জবাব দিল।

কাউন্ট বলল, তারা তো অনেকদিন ধরেই একথা বলছে, বারবার একথা তারা বলবে, আর তাতেই শেষ হয়ে যাবে। কি জানেন, এই হল বন্ধুত্ব। সে অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছে।

কি বলবে বুঝতে না পেরে অতিথি মাথা নাড়ল।

নিকোলাস রেগে বলল, বন্ধুত্বের জন্য মোটেই নয়, আমি নিজেই বুঝতে পারি যে সেনাবাহিনীই আমার কর্মক্ষেত্র।

সে তার সম্পর্কিত বোন ও তরুণী অতিথিটির দিকে তাকাল; দুজনই স্মিত হাসিতে তাকে সমর্থন জানাল।

পাভলোগ্রাদ হুজার বাহিনীর কর্নেল শুবার্ট আজ আমাদের এখানেই নৈশভোজন সারবেন। তিনি ছুটিতে এখানে এসেছেন; নিকোলাসকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। কোনো উপায় নেই! কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে কাউন্ট বলল; কথাটা তার পক্ষে কষ্টকর হলেও সে সহজভাবেই বলল।

ছেলে বলল, আমি তো আগেই তোমাকে বলেছি বাপি, তুমি যদি আমাকে যেতে দিতে না চাও তো আমি থেকে যাব। কিন্তু আমি জানি, সেনাবাহিনী ছাড়া আর কোথাও আমাকে দিয়ে কিছু হবে না; আমি কূটনীতিকও হতে পারব না, সরকারি করণিকও নয়।-মনের কথা লুকিয়ে রাখতে আমি জানি না। কথা বলতে বলতেই সে একটি সুন্দর যুবকের প্রেমিকাসুলভ দৃষ্টিতে সোনিয়া ও তরুণী অতিথিটির দিকে তাকাতে লাগল।

ছোই বিড়াল ছানাটিও নিকোলাসকে বারবার দেখছে; তাকে দেখে মনে হচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে সে আবার লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে তার বিড়ালী স্বভাবকে প্রকাশ করবে।

বুড়ো কাউন্ট বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে! ও তো সব সময়ই রেগে আছে! ওই বোনাপার্তই ওদের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছে; সে যে একজন পতাকাবাহী সৈনিক থেকে সম্রাট হয়েছে, এ কথাই ওরা সকলে ভাবে। বেশ তো, বেশ তো, ঈশ্বর যেন তাই করেন। অতিথির মুখের ব্যঙ্গের হাসি তার নজরে পড়ল না।

বড়রা বোনাপার্তকে নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। জুলি কারাগিনা যুবক রস্তভের দিকে মুখ ফেরাল।

বড়ই দুঃখের কথা বৃহস্পতিবার দিন তুমি আখায়ভদের বাড়ি যাওনি। তুমি না থাকায় আমার এত খারাপ লাগছিল, মৃদু হেসে জুলি বলল।

যুবকটি খুশি হয়ে প্রেমিকসুলভ হাসি হেসে জুলির আরো কাছ বসে তার সঙ্গে গোপন কথায় মেতে উঠল, সে একবারও খেয়াল করল না যে তার এই হাসি সোনিয়ার বুকে ছুরি বসিয়েছে, সে বেচারি লজ্জায় লাল হয়ে অস্বাভাবিকভাবে হাসছে। আলোচনার ফাঁকে সে একবার সোনিয়ার দিকে তাকাল। সোনিয়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে একবার তাকাল; তারপর চোখের পানি চাপতে না পেরে এবং ঠোঁটের নকল হাসি রাখতে না পারে উঠে ঘর থেকে চলে গেল। নিকোলাসের সব হৈ-চৈ থেমে গেল। সে আলোচনার মধ্যে একটু ফাঁক খুঁজতে লাগল এবং সুযোগ পাওয়ামাত্রই বিষণ্ণ মুখে সোনিয়ার খোঁজে বেরিয়ে গেল।

এইসব তরুণ-তরুণীরা কত সহজে মন দেয়া-নেয়া করে! Cousinage-dangereux voisnage (সম্পর্কিত ভাইবোনের পাশাপাশি বাস বড়ই বিপজ্জনক।)।

তরুণ-তরুণীরা এই ঘরটাতে যে উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছিল সেটা মিলিয়ে যেতে কাউন্টেস বলল, ঠিক; কত দুঃখ, কত উদ্বেগ পার হয়ে তবে না আজ তাদের নিয়ে এত সুখ। অথচ আজও আনন্দের চাইতে উদ্বেগই বেশি। উদ্বেগের আর শেষ নেই। বিশেষ করে ঠিক এই বয়সে; ছেলে-মেয়ে উভয়ের পক্ষেই বয়সটা বড় বিপজ্জনক।

সবই নির্ভর করে শিক্ষাদীক্ষার উপরে, অতিথিটা মন্তব্য করল।

কাউন্টেস বলতে লাগল, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আজ পর্যন্ত আমি চেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই ব্যবহার করেছি আর তারাও আমার উপর পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে। এ ভুল তো সব বাবামাই করে যে ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে কিছুই লুকোয় না। আমি জানি, আমার মেয়ের যদি কোনো গোপন কথা থাকে তো আমাকেই তা প্রথমে বলবে, আর আবেগের বশে নিকোলাস যদি কোনো ক্ষতি করে বসে (একটি ছেলের পক্ষে সেটা ঘটতেই পারে) তাহলেও সে কখনো ঐ পিটার্সবুর্গের যুবকদের মতো হবে না।

ঠিক, তারা সব চমৎকার ছেলে, চমৎকার, কাউন্টও সুরে সুর মেলাল; যখনই কোনো বিভ্রান্তিকর সমস্যা দেখা দেয় তখনই সবকিছুকে চমৎকার ভেবে নিয়ে সমস্যার সমাধান করাই তার স্বভাব। ভাব তো, ও হতে চায় হুজার। কি আর করা যাবে?

অতিথিটি বলল, আপনার মেয়েটি কিন্তু খুবই মনোরমা; একটি ছোট আগ্নেয়গিরি!

কাউন্ট বলল, হ্যাঁ, একেবারে সত্যিকারের আগ্নেয়গিরি। ঠিক আমার মতোই হয়েছে। আর কী কণ্ঠস্বর; মেয়ে হলেও সত্যি কথাই বলব-ও বড় গায়িকা হবে, দ্বিতীয় সালামনি! ওকে গান শেখাবার জন্য একজন ইতালিয় শিক্ষক রেখে দিয়েছি।

ওর কি সে বয়স হয়েছে? আমি তো শুনেছি, এত অল্প বয়সে রেওয়াজ করলে গলা খারাপ হয়ে যায়।

আহা, না, না, ততটা অল্প বয়স নয়! কাউন্ট বলল। আগে আমাদের মায়েদের তো বারো-তেরো বছরেই বিয়ে হয়ে যেত।

আর ও তো এর মধ্যেই বরিসের প্রেমে পড়ে গেছে। ভাবুন তো! বরিসের মায়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসির সঙ্গে কাউন্টেস বলল। তারপর মনের কথাটা খুলেই বলে ফেলল : এখন যদি আমরা খুব কড়া হই, ওদের বাধা দেই…তাহলে ওরা লুকিয়ে কি কাণ্ড করে বসবে তা কে জানে (কাউন্টেসের বক্তব্য যে ওরা চুমো খাবে), কিন্তু ব্যাপার যা চলেছে তাতে মেয়ের সব কথাই আমি জানতে পারি। সন্ধ্যাবেলা ও নিজে থেকেই আমার কাছে ছুটে আসবে আর সব কথা খুলে বলবে। হয়তো আমি ওকে আস্কারা দিচ্ছি, কিন্তু আমার কাছে তো এটাই সেরা পথ বলে মনে হয়। ওর দিদির বেলায় আমি আরো কড়া ছিলাম।

সুন্দরী বড় মেয়ে কাউন্টেস ভেরা হেসে বলল, হ্যাঁ, আমাকে অন্যভাবে মানুষ করা হয়েছিল।

হাসিতে সাধারণত সৌন্দর্য বাড়ে, কিন্তু ভেরার বেলায় তা হল না; বরং একটা অস্বাভাবিক, অপ্রীতিকর ভাব ফুটে উঠল তার মুখে। ভেরা সুদর্শনা, মোটেই বোকা নয়, বেশ বুদ্ধি আছে, ভালো লেখাপড়া শিখেছে, গলাটা মিষ্টি; সে যা বলেছে তাও সত্যি ও সঙ্গত; অথচ কী আশ্চর্য, উপস্থিত সকলেই–অতিথি ও কাউন্টেস পর্যন্ত এমনভাবে ভেরার দিকে তাকাল যে তার কথায় তারা অবাক হয়েছে, বিচলিত বোধ করেছে।

অতিথিটি বলল, প্রথম মেয়েদের বেলায় সকলেই একটু বেশি সতর্ক হয়ে থাকে; তাদের কিছুটা অসাধারণ করে গড়ে তুলতে চায়।

কাউন্ট বলল, সে কথা অস্বীকার করে লাভ কি গো? আমাদের কাউন্টেসও তত ভেরার বেলায় একটু বেশি মাত্রায়ই সতর্ক হয়েছিল। আরে, তাতে কি হয়েছে? সে তো চমৎকার উৎরে গেছে। সে ভেরার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।

অতিথিরা উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিল; কথা দিয়ে গেল আহারের সময় আসবে।

কী ভদ্রতা! আমি তো ভেবেছিলাম ওরা কোনো দিনই উঠবে না এখান থেকে, অতিথিরা চলে গেলে কাউন্টেস বলল।

বলায় সকলেই অবাক হয়েছে, বিচলিতঅতিথি ও কাউন্টেস

*

অধ্যায়-১৩

বসার ঘর থেকে বেরিয়ে নাতাশা সবজিঘর পর্যন্ত গিয়েই থেমে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে বসার ঘরে কথাবার্তা শুনতে শুনতে সে বরিসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ক্রমেই সে অধৈর্য হয়ে উঠল, পা ঠুকতে লাগল, বরিস না এলে বুঝি কেঁদেই ফেলবে; এমন সময় তার সতর্ক পায়ের শব্দ কানে এল; না দ্রুত, না ধীরে সে আসছে। নাতাশা তাড়াতাড়ি ফুলের টবগুলোর ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।

বরিস ঘরের মাঝখানে এসে থামল, চারদিকে তাকাল, পোশাক থেকে একটু ধুলো ঝাড়ল, তারপর আয়নার কাছে গিয়ে নিজের সুন্দর মুখখানি দেখতে লাগল। সে কী করে দেখার জন্য নাতাশা লুকিয়ে থেকেই সবকিছু দেখতে লাগল। বরিস কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়াল, একটু হাসল, তারপর অপর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। নাতাশা তাকে ডাকতে গিয়েও মনের ইচ্ছাটা পাল্টে ফেলল। ভাবল, ওই আমাকে খুঁজে বের করুক। বরিস বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই সোনিয়া এসে হাজির হল। তার মুখ লাল, চোখে পানি, মুখে রাগ-রাগ অস্পষ্ট কথা। প্রথমেই তার কাছে ছুটে যাবার যে ইচ্ছাটা নাতাশার মনে এসেছিল সেটাকে চেপে রেখে সে লুকিয়েই রইল, বাইরে কি ঘটছে তাই দেখতে লাগল। একটা অদ্ভুত নতুন অভিজ্ঞতা তার হচ্ছে। আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে সোনিয়া বসবার ঘরের দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। দরজা খুলে নিকোলাস ঘরে ঢুকল।

সোনিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে বলল, সোনিয়া, তোমার কি হয়েছে? তুমি কেমন করে পারলে?

কিছু হয় নি, কিছু হয় নি; আমাকে একলা থাকতে দাও! সোনিয়া ফুঁপিয়ে উঠল।

আঃ, আমি জানি কি হয়েছে।

বেশ তো, জান তো ভালোই, তার কাছেই ফিরে যাও।

সো-নি-য়া! এদিকে তাকাও! বাজে কথা কল্পনা করে কেন তুমি এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, আর নিজেও কষ্ট পাচ্ছ? তার হাত ধরে নিকোলাস বলল।

সোনিয়া হাতটা সরাল না; তার কান্নাও থেমে গেল। নাতাশা একেবারে চুপ। বুঝি তার নিঃশ্বাসও পড়ছে না। জ্বলজ্বলে চোখ মেলে লুকিয়ে থেকেই সবকিছু দেখতে লাগল। ভাবতে লাগল, এখন কি ঘটবে?

নিকোলাস বলল, সোনিয়া! এ জগতে অন্য লোককে নিয়ে আমার কি দরকার? তুমিই আমার সব। তোমাকে আমি তা প্রমাণ করে দেব!

তোমার মুখে এসব কথা আমি শুনতে চাই না।

বেশ, তাহলে বলব না; শুধু তুমি আমাকে ক্ষমা কর সোনিয়া। কাছে গিয়ে নিকোলাস সোনিয়াকে চুমো খেল।

আহা, কী সুন্দর, নাতাশা ভাবল। সোনিয়া ও নিকোলাস সবজি-ঘর থেকে চলে গেলে নাতাশাও সেখান থেকে বেরিয়ে বরিসকে ডেকে আনল।

অর্থপূর্ণ চতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বরিস, এখানে এস। তোমাকে কিছু বলতে চাই। এখানে, এখানে! বরিসকে নিয়ে সে সবজি-ঘরে সেই টবগুলোর মধ্যে গেল যেখানে সে লুকিয়েছিল।

বরিস হাসতে হাসতে তাকে অনুসরণ করল।

সেই কিছুটা কি? বরিস প্রশ্ন করল।

নাতাশা বিচলিত বোধ করল, চারদিকে তাকাল, তারপর একটা টবের উপর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া পুতুলটাকে দেখে সেটাকে তুলে নিল।

পুতুলটাকে চুমো খাও, সে বলল।

বরিস একদৃষ্টিতে তার উন্মুখ মুখখানির দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলল না।

নাতাশা বলল, চাই কি? আচ্ছা, তাহলে এখান এস। গাছপালাগুলোর আরো ভিতরে ঢুকে সে পুতুলটাকে ফেলে দিল। ফিসফিসিয়ে বলল, আরো কাছে, আরো কাছে।

সে তরুণ অফিসারটার হাত চেপে ধরল; তার সলজ্জ মুখে ফুটে উঠল একটি গম্ভীর ভয়ের ভাব।

আর আমাকে আমাকে চুমো খাবে কি ভুরুর নিচ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে উত্তেজনায় প্রায় কেঁদে ফেলে অস্পষ্ট গলায় নাতাশা ফিসফিস করে বলল।

বরিস লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

নাতাশার উপর ঝুঁকে পড়ে আরো লাল হয়ে সে বলল, আচ্ছা মজার লোক তো তুমি! কিন্তু সে অপেক্ষা করে রইল, কিছুই করল না।

হঠাৎ নাতাশা লাফ দিয়ে একটা টবের উপর উঠে বরিসের চাইতে উঁচু হয়ে দুটি খোলা হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল এবং মাথার চুলগুলোকে পিছনে ঠেলে দিয়ে গভীর আশ্লেষে তার ঠোঁটের উপর চুমো খেল।

তারপর টবগুলোর অপর পাশে নেমে নাতাশা ঘাড় কাৎ করে দাঁড়াল।

বরিস বলল, নাতাশা, তুমি তো জান আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু…

তুমি আমাকে ভালোবাস? নাতাশা বলল।

হ্যাঁ, ভালোবাসি, কিন্তু দয়া করে এ রকম কাজের মধ্যে আমাদের টেনে নিও না।…আরো চার বছরের মধ্যেই…তখন আমি তোমার পাণি প্রার্থনা করব।

নাতাশা ভাবতে লাগল।

তেরো, চোদ্দ, পনেরো, মোল, সুন্দর ছোট আঙুলে সে গুনতে লাগল। ঠিক আছে। তাহলে কথা পাকা হল?

আনন্দ ও তৃপ্তির হাসিতে তার উনখ মুখখানি ঝলমল করে উঠল।

পাকা হল! বরিস জবাব দিল।

চিরদিনের মতো? মেয়েটি বলল। মৃত্যু পর্যন্ত।

বরিসের হাতটা ধরে খুশিভরা মুখে নাতাশা তাকে নিয়ে পাশের ছোট ঘরটাতে গেল।

*

অধ্যায়-১৪

অতিথিদের আপ্যায়ন করে কাউন্টেস এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে দরোয়ানকে হুকুম দিল যেন আর কাউকে ঢুকেত না দেয়; তবে দরোয়ানকে আরো বলা হল, অভিনন্দন জানাতে যারাই আসবে তাদের যেন খাবার নিমন্ত্রণ অবশ্যই জানানো হয়। ছোটবেলাকার বন্ধু প্রিন্সেস মিখায়লভনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা বলার ইচ্ছা হল কাউন্টেসের; বন্ধুটি পিটার্সবুর্গ থেকে আসার পরে তার সঙ্গে ভালো করে দেখাই হয় নি। আন্না মিখায়লভনা তার চেয়ারটা কাউন্টেসের চেয়ারের কাছে টেনে নিল।

আন্না মিখায়লভনা বলল, তোমার সঙ্গে আমি প্রাণ খুলেই কথা বলব। পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে কজনাই বা আর আছি! সেই জন্যই তো তোমার বন্ধুত্ব আমার কাছে এত মূল্যবান।

ভেরার দিকে তাকিয়ে সে থামল। কাউন্টেস বন্ধুর হাতে চাপ দিল।

বড় মেয়ে ভেরা তার খুব প্রিয় নয়; তাকে বলল, ভেরা, তোমার বুদ্ধি-বিবেচনা এত কম কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ না যে তুমি এখানে থাক এটা আমরা চাইছি না? অন্য মেয়েদের কাছে যাও, না হয়…

ভেরা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, কিন্তু মোটেই আহত হয়েছে বলে মনে হল না।

নিজের ঘরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি যদি আগেই আমাকে বলতে মামণি, আমি চলে যেতাম।

ছোট ঘরটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে দেখল দুই যুগল বসে আছে, এক এক জানালায় এক এক যুগল। সে থেমে ঘৃণার হাসি হাসল। সোনিয়া বসেছে নিকোলাসের পাশে; নিকোলাস নিজের লেখা প্রথম কবিতাটি সোনিয়াকে দেবার জন্য সেটা নকল করছে। বরিস ও নাতাশা বসেছিল আর একটা জানালায়; ভেরা ঢুকতেই। তারা কথা বন্ধ করল। অপরাধসূচক অথচ খুশি মুখে সোনিয়া ও নাতাশা ভেরার দিকে তাকাল।

দুটি ছোট মেয়ে প্রেমে পড়েছে–এ দৃশ্য তো সুখকর; কিন্তু তাদের দেখে ভেরার মনে কোনো রকম সুখের ভাব জাগল না।

সে বলল, কতবার তোমাকে বলি নি যে আমার কোনো জিনিস নেবে না? তোমার তো নিজের একটা ঘর আছে। নিকোলাসের কাছ থেকে সে দোয়াতটা নিয়ে নিল।

কলমটা ডুবিয়ে নিকোলাস বলল, এক মিনিট, এক মিনিট।

ভেরা বলল, তুমি সব সময়েই অসময়ে কাজ কর। বসবার ঘরে এমন ভাবে ছুটে এসেছিলে যে তোমার জন্য সকলেই লজ্জা পেয়েছিল।

সে যা বলল সে কথা ঠিকই, হয়তো সেই জন্যই কেউ কোনো জবাব দিল না, চারজনই এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল। দোয়াতটা হাতে নিয়ে ভেরা ঘরের মধ্যেই রয়ে গেল।

তোমাদের এই বয়সে নাতাশা ও বরিসের মধ্যে, অথবা তোমাদের দুজনের মধ্যে কী এমন গোপন কথা থাকতে পারে? যত সব বাজে ব্যাপার!

দেখ ভেরা, তাতে তোমার কি? আত্মপক্ষ সমর্থনে নাতাশা শান্ত গলায় বলল।

মনে হচ্ছে, আজ সে সকলের প্রতিই দয়ালু ও স্নেহশীল।

কী বোকামি, ভেরা বলল, তোমার জন্য আমি লজ্জিত। গোপন কথাই বটে!

একটু গরম হয়ে নাতাশা বলল, সকলেরই নিজস্ব কিছু গোপন কথা থাকে। তোমার ও বের্গের ব্যাপারে তো আমরা নাক গলাই না।

ভেরা বলল, না গলানোই উচিত, কারণ আমার আচরণে কখনো অন্যায় কিছু থাকে না। কিন্তু বরিসের সঙ্গে তোমার আচরণের কথা আমি এখনই মামণিকে বলে দেব।

বরিস বলল, নাতালিয়া ইলয়িনিচনা আমার প্রতি খুব ভালো ব্যবহারই তো করে। আমার কোনো অভিযোগ নেই।

থাম বরিস! তুমি এমনই এক কূটনীতিক যে আমরা বিরক্ত হয়ে উঠেছি, ঈষৎ কাঁপা ক্ষুব্ধ গলায় নাতাশা কথা বলল। (কূটনীতিক কথাটা এখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুবই চলতি; একটা বিশেষ অর্থেই সে কথাটা ব্যবহার করল।) আমাকে ও বিরক্ত করে কেন? তারপর ভেরার দিকে ফিরে বলল, এ সব তুমি কোননাদিন বুঝবে না! কারণ তুমি কোনোদিন কাউকে ভালোবাসনি। তোমার হৃদয় বলে কিছু নেই। তুমি একটি মাদাম দ্য জেনলিস, তার বেশি কিছু নয় (এই ডাক নামটা ভেরাকে দিয়েছে নিকোলাস; এটাতে যথেষ্ট হুল আছে বলে মনে করা হয়), আর মানুষের প্রতি বিরূপ ব্যবহার করাতেই তোমার সবচাইতে বেশি আনন্দ! যাও, বের্গের সঙ্গে যত পার প্রেম-প্রেম খেলা করগে।

আর যাই করি আমি কখনো অতিথিদের সামনে একটা ছেলের পিছনে ছুটব না…

নিকোলাস বলল, দেখ, তুমি যা চেয়েছিলে তা করেছ, প্রত্যেককে কতকগুলি অপ্রীতিকর কথা বলেছ, তাদের বিপর্যস্ত করেছ। চল, আমরা নার্সারিতে যাই।

একদল সন্ত্রস্ত পাখির মতো চারজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ভেরা বলল, অপ্রীতিকর কথা আমাকেই বলা হয়েছে, আমি কাউকে বলি নি।

দরজার পথে অনেকগুলো হাস্যমুখর গলার শব্দ ভেসে এল, মাদাম দ্য জেনলিস! মাদাম দ্য জেনলিস!

প্রত্যেককে বিরক্ত করে তুললেও সুন্দরী ভেরা কিন্তু হাসতে লাগল; এসব কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে আয়নার কাছে গিয়ে সে চুল ও গলবন্ধ ঠিক করতে লাগল। নিজের সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে সে যেন আরো নির্বিকার ও শান্ত হয়ে উঠল।

.

বসবার ঘরে তখনো আলোচনা চলছে।

কাউন্টেস বলছে, দেখ ভাই, আমার জীবনটাও কিছু শুধুই গোলাপে ছাওয়া নয়। যে ভাবে আমরা জীবন চালাচ্ছি তাতে আমাদের সামর্থে যে বেশিদিন কুলোবে না তা কি আমি জানি না? কেবল ক্লাব আর ক্লাব, আর আলস্যে গা ঢেলে দেওয়া। গ্রামে গিয়েও কি বিশ্রাম আছে? থিয়েটার, শিকার, আর কি যে নয় তা ঈশ্বরই জানেন! কিন্তু আমার কথা থাক; তুমি কেমন চালাচ্ছ তাই বল। তোমাকে দেখে আমি তো অবাক হয়ে যাই। আনেৎ,–এই বয়সেও কেমন করে তুমি গাড়ি হাঁকিয়ে একা মস্কো যাচ্ছ, পিটার্সবুর্গ যাচ্ছ, মন্ত্রী ও বড় বড় সব লোকদের সঙ্গে দেখা করছ, তাদের দিয়ে কার্যোদ্ধার করছ! খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। কেমন করে সব ব্যবস্থা করে ফেলবে? আমি সম্ভবত এ কাজ করতে পারতাম না।

আন্না মিখায়লভনা জবাব দিল, হায় প্রিয় সখী, ঈশ্বর করুন একটি ছেলেকে নিয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় বিধবা হওয়া যে কি জিনিস তা যেন তোমাকে কখনো জানতে না হয়। সে অবস্থায় পড়লে মানুষকে অনেক কিছু শিখতে হয়। সেই মামলাটা আমাকে অনেক শিখিয়েছে। যখন কোনো বড় মানুষের সঙ্গে দেখা করতে হয় তখনই একটা চিঠি লিখি : প্রিন্সেস অমুকের ইচ্ছা অমুকের সঙ্গে একবার দেখা করবে, তারপর একটা গাড়ি নিয়ে দুবার, তিনবার, চারবার–যতক্ষণ কার্যসিদ্ধি না হয় ততক্ষণ নিজেই তার কাছে যাই।

কাউন্টেস জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, বরির ব্যাপারে তুমি কার কাছে আবেদন জানিয়েছিলে? দেখ তো, তোমার ছেলে এর মধ্যেই রক্ষীবাহিনীর অফিসার হয়ে গেল, আর আমার নিকোলাস যাচ্ছে সমরশিক্ষার্থী ক্যাডেট হয়ে। তার হয়ে কথা বলবার কেউ নেই। তুমি কাকে ধরেছিলে?

প্রিন্স ভাসিলিকে। তিনি খুব দয়া দেখিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং সম্রাটের কাছে ব্যাপারটা তুললেন। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তাকে যে সব অসম্মান সইতে হয়েছিল তা ভুলে গিয়ে প্রিন্সেস আন্না মিখায়লভনা বেশ উৎসাহের সঙ্গে কথাগুলি বলল।

প্রিন্স ভাসিলি কি খুব বুড়ো হয়েছেন? কাউন্টেস জানতে চাইল। রুমিয়ান্তসভদের থিয়েটারে একসঙ্গে অভিনয় করার পরে আর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি। মনে হয় তিনি আমাকে ভুলেই গেছেন। সে সময় কিন্তু আমার দিকে তাঁর নজর ছিল, কাউন্টেস হেসে বলল।

আন্না মিখায়লভনা জবাব দিল, তিনি ঠিক আগের মতোই আছেন, অমায়িকতায় একেবারে উপচে পড়েন। পদমর্যাদা তাঁর মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেয় নি। আমাকে বললেন, প্রিয় প্রিন্সেস, আপনার জন্য মাত্র এইটুকু করতে পারছি বলে আমি দুঃখিত। আপনার কথা আমি সব সময় মনে রাখব। সত্যি, তিনি চমৎকার লোক, আর খুব দয়ালু আত্মীয়। কিন্তু আমার ছেলেকে আমি কত ভালোবাসি তা তো তুমি জান নাতালি : তার সুখের জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি! আর আমার সংসারের অবস্থা এখন এত খারাপ যে আমার অবস্থা অতি ভয়ংকর। আন্না মিখায়লভনা গলা নামিয়ে বলতে লাগল, হতভাগা মামলাটার জন্য আমি সর্বস্ব খুইয়েছি, অথচ মামলা ঝুলেই আছে। তুমি কি বিশ্বাস করবে যে আমার হাতে একটি পেনিও নেই; কি করে যে বরির পোশাক কিনব জানি না। রুমাল বের করে কাঁদতে শুরু করল। পাঁচশ রুবল আমার দরকার আর আছে মাত্র পঁচিশ রুবলের একখানা নোট। এই তো আমার অবস্থা…এখন আমার একমাত্র ভরসা কাউন্ট সিরিল ভাদিমিরভিচ বেজুকভ। তিনি যদি তার ধর্মছেলেকে সাহায্য না করেন-তুমি তো জান তিনি বরির ধর্মবাপ-এবং তার খরচপত্রের জন্য কিছু না দেন, তাহলে আমার সব পরিশ্রমই বৃথা হয়ে যাবে।…তার পোশাকের ব্যবস্থাই আমি করতে পারব না।

কাউন্টেসের দুই চোখ জলে ভরে গেল। সে নীরবে ভাবতে লাগল।

প্রিন্সেস বলল, আমি প্রায়ই ভাবি, যদিও হয়তো এ কথা ভাবা পাপ, এই তো কাউন্ট সিরিল ভ্রাদিমিরভিচ একেবারে একা থাকেন…তিনি এত ধনী…প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী…অথচ তার এ জীবনের কী দাম? এ তো তাঁর কাছে একটা বোঝা, আর বরি সবে তার জীবন শুরু করতে চলেছে…  

নিশ্চয়ই তিনি বরিসের জন্য কিছু রেখে যাবেন, কাউন্টেস বলল।

একমাত্র ঈশ্বরই জানেন ভাই। এই ধনী বুড়োরা বড়ই স্বার্থপর হয়। তবু বরিসকে নিয়ে এখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব, আর সোজাসুজি কথাটা তাকে বলব। লোকে আমাকে যা বলে বলুক, আমার ছেলের ভাগ্য যখন বিপন্ন তখন আমার কাছে সবই সমান। প্রিন্সেস উঠে পড়ল। এখন দুটো বাজে। তুমি খাবার খাও চারটেয়। তোমার সময় হয়ে গেছে।

পিটার্সবুর্গের বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মহিলারা সময়ের সদ্ব্যবহার করতে জানে; তাদের মতোই আন্না মিখায়লভনা একজনকে পাঠিয়ে দিল ছেলেকে ডেকে আনতে এবং তাকে নিয়ে সামনের ঘরে গেল।

কাউন্টেস তাদের বিদায় দিতে দরজা পর্যন্ত গেল। ছেলে যাতে শুনতে না পায় এমনভাবে ফিসফিস করে আন্না মিখায়লভনা বলল, বিদায় ভাই, আমার সৌভাগ্য কামনা করো।

খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের ঘরে এসে কাউন্ট বলল, আপনি কি কাউন্ট সিরিল ম্লাদিমিরভিচের কাছে যাচ্ছেন? তাঁর শরীর ভালো থাকলে পিয়েরকে বলবেন, সে যেন আমাদের সঙ্গে খাবার খায়। আপনি তো জানেন, সে এ বাড়িতে এসে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেচেছে। তাকে অবশ্য আমন্ত্রণ জানাবেন। আমরা দেখতে চাই তারাস কেমন করে আজ সুনাম রাখে। সে বলে, আমাদের মতো ডিনার কাউন্ট অর্লভ কখনো দিতে পারে নি।

*

অধ্যায়-১৫

প্রিন্সেস আন্না মিখায়লভনা ও তার ছেলেকে নিয়ে কাউন্টেস রস্তভার গাড়ি খড়-বিছানো রাস্তা ধরে চলতে– চলতে কাউন্ট সিরিল স্লাদিমিরভিচ বেজুকভের বাড়ির প্রকাণ্ড উঠোনে ঢুকলে প্রিন্সেস তার পুরোনো দিলে জামার ভিতর থেকে হাতটা বের করে আদর করে ছেলের কাদের উপর রেখে বলল, বাবা বরিস, তাকে ভক্তি করো। কাউন্ট সিরিল ভাদিমিরভিচ তোমার ধর্মবাপ; তার উপরেই তোমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কথাটা মনে রেখে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো; আর ভালো ব্যবহার করতে তো তুমি ভালোই জান।

ছেলে নির্বিকার গলায় বলল, তার ফলে অপমান ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে এমন ভরসা থাকলেও না হয় কথা ছিল…। কিন্তু আমি তোমাকে কথা দিয়েছি, তাই তোমার জন্যই সে কথা আমি রাখব।

একটা গাড়ি ফটকে দাঁড়িয়ে আছে দেখেও হলের দরোয়ান মা ও ছেলেকে ভালো করে লক্ষ্য করে, বিশেষ করে মহিলাটির পুরোনো ঢিলে জামাটার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইল তারা কাউন্ট অথবা প্রিন্সেস কার সঙ্গে দেখা করতে চায় এবং যখন শুনল যে তারা কাউন্টের সঙ্গে দেখা করতে চায় তখন বলে দিল যে হিস এক্সেলেন্সির শরীর আজ আরো খারাপ এবং তিনি কারো সঙ্গে দেখা করবেন না।

আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো, ছেলে ফরাসিতে বলল।

ছেলেকে শান্ত করার জন্য তার কাঁধের উপর হাতটা রেখে মা অনুনয় করে ডাকল, বাবা আমার!

বরিস আর কোনো কথা বলল না, কিন্তু জোব্বাটা না খুলেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মার দিকে তাকাল।

আন্না মিখায়লভনা নরম গলায় দরোয়ানকে বলল, দেখ ভাই, আমি জানি যে কাউন্ট সিরিল ভাদিমিরভিচ খুব অসুস্থ…সেজন্যই আমি এসেছি…আমি তাঁর আত্মীয়া। তাকে আমি বিরক্ত করব না ভাই…আমি শুধু প্রিন্স ভাসিলি সের্গেভিচের সঙ্গে দেখা করতে চাই : তিনি তো এখানেই আছেন, তাই না? তুমি আমার কথা বল।

দরোয়ান ঘন্টাটা টেনে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল; সেটা দোতলায় বেজে উঠল।

সরু ব্রিচেস, জুতো ও চাতক-পাখি-মার্কা কোট-পরা পরিচারক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে মাঝপথে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাতেই দরোয়ান হাক দিল, প্রিন্সেস বেস্কায়া প্রিন্স ভাসিলি সের্গেভিচের সঙ্গে দেখা করতে চান।

দেয়ালের মস্ত বড় ভেনিসিয় আয়নায় নিজের রং-করা পশমী পোশাকের ভাজ ঠিক করে নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া জুতো পায়ে মা কার্পেটে-মোড়া সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠতে লাগল।

ছেলের কাঁধে হাত রেখে তার মনে জোর আনবার চেষ্টায় মা আবার বলল, তুমি আমাকে কথা দিয়েছ বাবা!

চোখ নিচু করে ছেলে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে চলল।

একটা বড় হল-ঘরে তারা ঢুকল; সেই হলের একটা দরজা দিয়ে প্রিন্স ভাসিলির ঘরে যেতে হয়।

হলের মাঝখানে পৌঁছে মা ও ছেলে একজন বয়স্ক পরিচারককে সবে জিজ্ঞাসা করতে যাবে তারা কোন পথে এগোবে এমন সময় একটা দরজার ব্রোঞ্জের হাতল ঘুরিয়ে বেরিয়ে এল প্রিন্স ভাসিলি-তার বুকের উপর একটি তারা বসানো ভেলভেটের কোট; বাড়িতে এই পোশাক পরাই তার রীতি; প্রিন্স ভাসিলির সঙ্গে একজন সুদর্শন লোক, তার মাথাভর্তি চুল। পিটার্সবুর্গের বিখ্যাত ডাক্তার লোরেন।

প্রিন্স বলল, তাহলে এটাই নিশ্চিত?

প্রিন্স, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়, কিন্তু… ডাক্তার ফরাসি উচ্চারণে লাতিন ভাষায় জবাব দিল।

খুব ভালো, খুব ভালো…।

আন্না মিখায়লভনা ও তার ছেলেকে দেখে প্রিন্স ভাসিলি মাথা নুইয়ে ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে নীরবে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলে লক্ষ্য করল, হঠাৎ তার মার মুখের উপর গভীর দুঃখের একটা ছায়া নেমে এল। সে ঈষৎ হাসল।

প্রিন্স যে অসন্তোষের চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা যেন দেখতেই পায় নি এমন ভাব দেখিয়ে প্রিন্সেস বলল, আহা প্রিন্স, কি দুঃখের মধ্যে আবার আমাদের দেখা হল। আমার প্রিয় রোগী কেমন আছেন?

প্রিন্স ভাসিলি বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মহিলা ও বরিসকে দেখতে লাগল। বরিস বিনীতভাবে অভিবাদন করল। প্রত্যাভিবাদন না জানিয়েই প্রিন্স ভাসিলি আন্না মিখায়লভনার দিকে ঘুরে মাথা ও ঠোঁটের ভঙ্গিতেই জানিয়ে দিল যে রোগীর আশা খুব কম।

আন্না মিখায়লভনা বলে উঠল, এও কি সম্ভব? আহা, কী দুঃখের কথা! ভাবতেও ভয় হয়…এই আমার ছেলে। ও নিজেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছে।

বরিস আর একবার সবিনয়ে অভিবাদন করল।

বিশ্বাস করুন প্রিন্স, আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন একটি মায়ের হৃদয় তা কোনোদিন ভুলবে না।

লেসের চুনট ঠিক করতে করতে প্রিন্স ভাসিলি বলল, প্রিয় আন্না মিখায়লভনা, আপনার একটা কাজ করে দিতে পেরে আমি খুশি হয়েছি। তারপর শক্ত গলায় বরিসকে বলল, ভালোভাবে কাজ করতে চেষ্টা করবে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবে।…আমি খুশি হয়েছি…তুমি কি ছুটিতে এসেছ? তার গলায়, নির্বিকার ঔদাসিন্য।

আমি এখন নতুন রেজিমেন্টে যোগ দেবার নির্দেশের অপেক্ষায় আমি ইয়োর এক্সেলেন্সি, বরিস জবাব দিল; তার কথায় বিরক্তিও প্রকাশ পেল না, আবার আলোচনা শুরু করবার আগ্রহও দেখা গেল না; কিন্তু এত শান্ত ও সশ্রদ্ধভাবে সে কথা বলল যে প্রিন্স তাকে বেশ ভালো করে দেখতে লাগল।

তুমি কি মায়ের কাছেই থাক?

পুনরায় ইয়োর এক্সেলেন্সি কথাটা যোগ করে বরিস জবাব দিল, আমি কাউন্টেস রস্তভের বাড়িতে আছি।

মানে, ইলিয়া রস্তভের বাড়িতে, যিনি নাতালি শিনশিনাকে বিয়ে করেছেন?

একই একঘেয়ে গলায় প্রিন্স ভাসিলি বলল, আমি জানি, আমি জানি। নাতালি যে কী করে সেই আস্ত ভালুকটাকে বিয়ে করতে মনস্থ করল তা তো আমি বুঝতে পারলাম না! শুনেছি সে একটা অদ্ভুত বোকা লোক, আবার জুয়াড়িও বটে।

কিন্তু বড় দয়ালু মানুষ প্রিন্স, বিষণ্ণ হাসি হেসে আন্না মিখায়লভনা বলল, যেন সেও জানে যে এ নিন্দা কাউন্ট রস্তভের প্রাপ্য, তবু কেউ যেন বেচারি বুড়ো লোকটার প্রতি অতিরিক্ত কঠোর না হয়। একটু থেমে মুখে আবার দুঃখের ভাব এনে সে বলল, ডাক্তাররা কি বলছে?

তারা বিশেষ কোনো আশাই দিচ্ছে না, প্রিন্স জবাব দিল।

তাইতো আমার ও বরিসের প্রতি যে দয়া তিনি করেছেন সেজন্য চাচাকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম। বরিস তো তাঁরই ধর্মছেলে।

প্রিন্স ভাসিলি চিন্তিতভাবে ভুরু কুঁচকালো। আন্না মিখায়লভনা বুঝতে পারল তাকে কাউন্ট বেজুখভের সম্পত্তির একজন দাবিদার ভেবে প্রিন্স ভয় পেয়ে গেছে; তাই তাকে সান্তনা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠল, চাচার প্রতি ভক্তি ও অনুরাগবশতই আমি এসেছি; তাঁর চরিত্র তো আমার জানা : মহৎ, ন্যায়নিষ্ঠ…কিন্তু আপনি তো জানেন একমাত্র প্রিন্সেসরা ছাড়া তাঁর কাছে আর কেউ থাকে না…তারা তো এখনো ছোট… মাথাটা নিচু করে সে অনুচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগল, তিনি কি শেষ কাজগুলো করেছেন প্রিন্স? সেই শেষ মুহূর্তগুলি কত না অমূল্য! তাতে খারাপ কিছু হবে না, তাই তিনি যখন এতই অসুস্থ তখন তাকে প্রস্তুত করে রাখা তো একান্তই দরকার। দেখুন প্রিন্স, এই কথাগুলি কীভাবে বলতে হয় তা আমরা মেয়েরাই জানি। আমার পক্ষে যত কষ্টকরই হোক তবু তাঁর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। কষ্ট সইতে আমি অভ্যস্ত।

স্পষ্টতই প্রিন্স তাকে বুঝতে পেরেছে; আর আন্না পাভলভনার বাড়ির মতোই এখানেও বুঝতে পেরেছে যে আন্না মিখায়লভনাকে এড়িয়ে যাওয়া শক্ত।

সে বলল, তাঁর সঙ্গে দেখা করাটা কি তার পক্ষে খুব বেশি কষ্টকর হবে না? বরং সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। ডাক্তাররা একটা সংকটের আশংকা করছে।

কিন্তু প্রিন্স, এ রকম অবস্থায় তো অপেক্ষা করা চলে না। ভেবে দেখুন, তার আত্মার কল্যাণ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। আহা, সেটা বড়ই দুঃখের কথা : একজন খৃস্টানের অবশ্য করণীয়…।

ভিতরকার একটা ঘরের দরজা খুলে কাউন্টের ভাইঝি ঘরে ঢুকল; তার মুখটা কঠিন দেখাচ্ছে। তার খাটো পায়ের তুলনায় শরীরটা অস্বাভাবিক রকমের লম্বা। প্রিন্স ভাসিলি তার দিকে ফিরল।

এই যে, তিনি কেমন আছেন?

একই রকম; কিন্তু এইসব গোলমালের মধ্যে কি করে আশা করেন… আন্না মিখায়লভনার দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস বলল।

কাউন্টের ভাইঝির দিকে একটু এগিয়ে খুশির হাসি হেসে আন্না মিখায়লভনা বলল, আহা! আমি তো তোমাকে ঠিক চিনি না। আমি এসে পড়েছি, আমার চাচার সেবার ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত। তোমরা যে কী অবস্থার ভিতর দিয়ে চলেছ সেটা আমি বুঝি।

প্রিন্সেস কোনো জবাব দিল না, একটু হাসল না পর্যন্ত; তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে চলে গেল। আন্না মিখায়লভনা হাতের দস্তানা খুলল, বিজিত মর্যাদাকে দখল নেবার জন্য একটা হাতল-চেয়ারে বসে প্রিন্স ভাসিলিকে পাশের আসনে বসেত বলল।

হেসে ছেলেকে বলল, বরিস, আমার চাচা কাউন্টকে দেখতে আমি ভিতরে যাচ্ছি; ইতিমধ্যে তুমি গিয়ে পিয়েরের সঙ্গে দেখা কর; তাকে রস্তভদের আমন্ত্রণটা জানাতে ভুলো না যেন। তারা তাকে ডিনারে ডেকেছেন। প্রিন্সের দিকে ঘুরে বলল, মনে হচ্ছে, পিয়ের আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে না, কি বলেন?

প্রিন্সের মনের অবস্থা ভালো নয়; সে বলল, ঠিক উল্টো; আপনি যদি সে যুবকটির সঙ্গে থেকে আমাকে রেহাই দেন তাহলেই আমি খুশি হব।…সে এখানে এসেছে, কিন্তু কাউন্ট তাকে একটিবারও ডেকে পাঠান নি।

সে দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিল। একটি পরিচারক এসে বরিসকে নিয়ে সিঁড়ির এক ধাপ নেমে আর এক ধাপ উঠে পিয়েরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

*

অধ্যায়-১৬

পিয়ের শেষপর্যন্ত পিটার্সবুর্গে নিজের জন্য একটা জীবিকা বেছে নিতে পারে নি। হৈ-হট্টগোল করার অপরাধে তাকে সেখান থেকে মস্কোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাউন্ট রস্তভের বাড়িতে তার সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে সেটা ঠিকই। একজন পুলিশকে ভালুকের সঙ্গে বাঁধার ব্যাপারে তারও হাত ছিল। কয়েকদিন হল সে মস্কোতে এসেছে এবং যথারীতি তার বাবার বাড়িতেই আছে। যদিও যে আশংকা করেছিল যে তার সেই পলায়নের কাহিনী ইতিমধ্যেই মস্কোতে জানাজানি হয়ে গেছে এবং তার বাবার বাড়ির যে মহিলারা কোনোদিনই তার প্রতি সদয় ছিল না তারা সে গল্প বলে কাউন্টকে তার প্রতি বিরূপ করেই রেখেছে, তবু এখানে পৌঁছে প্রথম দিনেই সে বাড়ির বাবার অংশে চলে গেল। প্রিন্সেসরা বসবার ঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটায়। সেই ঘরে ঢুকে সে তাদের সঙ্গে দেখা করল। তাদের মধ্যে দুজন সেলাই নিয়ে বসেছিল, আর তৃতীয় জন গলা ছেড়ে বই পড়ছিল। যে পড়ছিল সেই সকলের বড়-তার সঙ্গেই আন্না মিখায়লভনার দেখা হয়েছিল। ছোট দুজন সেলাই করছিল : দুজনই গোলাপি, সুন্দরী; তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য, একজনের ঠোঁটে একটা তিল থাকায় তাকে আরো সুন্দরী দেখায়। তারা পিয়েরের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে একটি মরা মানুষ বা কুষ্ঠরোগী। বড় প্রিন্সেস পড়া থামিয়ে ভয়ার্ত চোখে নিঃশব্দে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল; মেজ প্রিন্সেসেরও সেই একই ভাব; কিন্তু ঠোঁটে তিলওয়ালা ছোটটির মেজাজ খুব হাসিখুশি; এই মজার দৃশ্য দেখে হেসে ফেলেই হাসিটা লুকোবার জন্য সে ফ্রেমের উপরে ঝুঁকে বসল। হাসি চাপতে না পেরে যেন একটা প্যাটার্ন তুলবার চেষ্টা করছে এমনিভাবে সেলাইতে নজর দিল।

কেমন আছ বোন? পিয়ের বলল। আমাকে চিনতে পারছ না?

খুব ভালো করেই চিনতে পারছি।

একটু বিব্রত বোধ করলেও না দমে গিয়ে পিয়ের জিজ্ঞাসা করল, কাউন্ট কেমন আছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি কি?

একটু বিব্রত বোধ করলেও না দমে গিয়ে পিয়ের জিজ্ঞাসা করল, কাউন্ট কেমন আছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি কি?

দেহে ও মনে কাউন্ট খুবই কষ্ট পাচ্ছেন, আর তার মানসিক কষ্টবৃদ্ধিতে তুমি তো সাধ্যমতোই চেষ্টা করেছ।

কাউন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারি কি? পিয়ের আবার জিজ্ঞাসা করল।

হুম… তাকে যদি মেরে ফেলতে চাও, একেবারেই মেরে ফেলতে চাও তো দেখা করতে পার… ওলগা, যা তো, দেখে আয় জেটার গোমাংস-চা তৈরি হয়েছে কি না-সময় তো প্রায় হয়ে গেছে। কথাগুলি বলে বড় বোন পিয়েরকে বোঝাতে চাইল যে তারা খুব ব্যস্ত; তারা ব্যস্ত পিয়েরের বারাকে আরাম দিতে, আর পিয়ের ব্যস্ত তাকে শুধু কষ্ট দিতে।

ওলগা চলে গেল। পিয়ের বোনদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল; তারপর মাথা নুইয়ে বলল, আমি তাহলে আমার ঘরে যাচ্ছি। কখন তার সঙ্গে দেখা করতে পারব আমাকে জানিও।

সে ঘর থেকে চলে গেল, তিলসুন্দরী বোনের খিলখিল হাসি তাকে পিছন থেকে তাড়া করল।

পরদিন প্রিন্স ভাসিলি এসে কাউন্টের বাড়িতেই উঠল। পিয়েরকে ডেকে বলল : দেখ, পিটার্সবুর্গে যেভাবে চলাফেরা করেছ এখানেও যদি তাই কর, তো তোমার কপালে দুঃখ আছে, শুধু এইটুকুই তোমাকে বলতে চাই। কাউন্ট খুব, খুব অসুস্থ, তুমি তার সঙ্গে মোটেই দেখা করবে না।

তারপর থেকে পিয়েরকে কেউ বিরক্ত করে নি; সারাক্ষণ সে উপরের ঘরেই কাটায়। বরিস যখন পিয়েছের ঘরের দরজায় পৌঁছল সে তখন ঘরময় পায়চারি করছে; মাঝে মাঝে এক কোণে থেমে দেয়ালের দিকে এমন অঙ্গভঙ্গি করছে যেন কোনো অদৃশ্য শক্রর বুকে একখানা তলোয়ার ঢুকিয়ে দিচ্ছে, চশমার উপর দিয়ে তাকাচ্ছে হিংস্রভাবে, তারপর আবার পায়চারি করছে, বিড়বিড় করে কথা বলছে, ঘাড় ঝাঁকুনি দিচ্ছে, আর অঙ্গভঙ্গি করছে।

অদৃশ্য কারো দিকে আঙুল বাড়িয়ে হাঁক দিল, ইংল্যান্ড শেষ হয়ে গেল। মি. পিট জাতির প্রতি, মানুষের অধিকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তার শাস্তি… কিন্তু পিটের শাস্তির কথা উল্লেখ করবার আগেই–সেই মুহূর্তে পিয়ের কল্পনা করছিল যে সে নিজেই স্বয়ং নেপোলিয়ন, এইমাত্র বিপজ্জনক ডোভার প্রণালী পার হয়ে লন্ডন দখল করে নিয়েছে–পিয়ের দেখল একটি সুগঠিত-দেহ সুদর্শন তরুণ অফিসার তার ঘরে ঢুকল। পিয়ের থামল। সে যখন মস্কো ছেড়ে এসেছে বরিস তখন চোদ্দ বছরের ছেলে; তার কথা পিয়ের সম্পূর্ণ ভুলে গেছে; কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ আবেগ ও আন্তরিকতার সঙ্গে সে বরিসের হাতটা ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে উঠল।

স্মিত হলে বরিস শান্তভাবে বলল, আমাকে আপনার মনে আছে? আমি মার সঙ্গে এসেছি কাউন্টকে দেখতে, কিন্তু মনে হয় তিনি সুস্থ নন।

হ্যাঁ, মনে হয় তিনি অসুস্থ। সর্বদাই লোজন তাঁকে বিরক্ত করছে, যুবকটিকে স্মরণ করবার চেষ্টা করতে করতে পিয়ের বলল।

বরিস বুঝতে পারল, পিয়ের তাকে চিনতে পারে নি, কিন্তু নিজের পরিচয় দেবার দরকারও বোধ করল না। এতটুকু বিব্রত বোধ না করে সে সোজা পিয়েরের মুখের দিকে তাকাল।

পিয়ের একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বরিস বলল, আজ তাদের সঙ্গে ডিনারে যোগ দিতে কাউন্ট রস্তভ আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

ওঃ, কাউন্ট রস্তভ! পিয়ের আনন্দে চেঁচিয়ে বলল। তাহলে তুমি তাঁর ছেলে ইলিয়া? কী আশ্চর্য, প্রথম তোমাকে আমি চিনতেই পারি নি। তোমার কি মনে আছে মাদাম জাকোতের সঙ্গে আমরা স্প্যারো পাহাড়ে গিয়েছিলাম?…এমন দিনকাল পড়েছে…

ঈষৎ ব্যঙ্গাত্মক অথচ বলিষ্ঠ হাসি হেসে বরিস ইচ্ছা করেই বলল, আপনি ভুল করেছেন। আমি বরিস, প্রিন্সেস আন্না মিখায়লভনা বেস্কায়ার ছেলে। বাবা রুস্তভই ইলিয়া, তার ছেলের নাম নিকোলাস। কোনো মাদাম জাকোৎকে আমি চিনি না।

যেন মশা বা মৌমাছিতে কামড়াচ্ছে এমনিভাবে পিয়ের মাথা হাত নাড়তে লাগল।

 আরে, এসব আমি কি ভাবছি? সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছি। মস্কোতে এতসব আত্মীয়স্বজন বাস করে। তাহলে তুমি বরিস? অবিশ্য। আচ্ছা, এবার বুঝতে পারছি আমরা কোথায় আছি। বোলন অভিযান সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? কি জান, নেপোলিয়ন যদি চ্যানেল পার হয় তাহলে ইংরেজদের বড়ই দুর্দিন। আমি তো মনে করি অভিযানটা খুবই সহজসাধ্য। শুধু যদি ভিলেনুভ সবকিছু তালগোল পাকিয়ে না ফেলে!

বরিস বোলন অভিযানের কিছুই জানে না; সে খবরের কাগজ পড়ে না; আর ভিলেনুভের নামও সে এই প্রথম শুনল।

শান্ত বিদ্রুপাত্মক গলায় সে বলল, এখানে মস্কোতে আমরা রাজনীতির চাইতে ভোজসভা আর কুৎসা রটনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকি। এ সব কথা আমি কিছু জানি না, আর ভেবেও দেখিনি। মস্কো প্রধান্ত গালগল্প, নিয়েই ব্যস্ত। এই মুহূর্তে তারা আপনার ও আপনার বাবার কথাই বলাবলি করছে।

পিয়ের ভালোমানুষি হাসি হাসল; যেন সঙ্গীটির জন্য তার ভয় হয়েছে পাছে সে এমন কিছু বলে বসে যার জন্য পরে তাকে অনুতাপ করতে হবে। কিন্তু পিয়েরের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বরিস স্পষ্ট উচ্চারণে, পরিষ্কার ভাষায়, কঠিন কণ্ঠে কথা বলতে লাগল।

গাল-গল্প করা ছাড়া মস্কোর আর কোনো কাজ নেই। প্রত্যেকেরই ভাবনা, কাউন্ট তার বিষয়-সম্পত্তি কাকে দিয়ে যাবেন, যদিও তিনি হয়তো আমাদের সকলের চাইতে বেশিদিন বেঁচে যেতেও পারেন; আমার তো আন্তরিক আশা, তাই তিনি বাঁচবেন।…

পিয়ের বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, এ সবই ভয়ংকর, খুব ভয়ংকর।

পিয়েরের তখনো ভয় যে এই তরুণ অফিসার হয়তো এমনকিছু বলে ফেলবে যাতে যে নিজেই গোলমালে পড়ে যাবে।

বরিস ঈষৎ লজ্জা পেলেও গলার স্বর বা মনের ভাবের কোনো পরিবর্তন না করেই বলল, আর এটাও আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে এই ধনী লোকটির কাছ থেকে সকলেই কিছু হাতাবার চেষ্টা করছে।

তাই তো মনে হয়, পিয়ের ভাবল।

কিন্তু পাছে আপনি ভুল বোঝেন তাই আমি বলতে চাই, আপনি যদি আমাকে বা আমার মাকে সেই দলের লোক বলে মনে করে থাকেন তাহলে আপনি খুবই ভুল করেছেন। আমরা খুব গরিব, কিন্তু অন্তত আমার দিক থেকে বলতে পারি যে যেহেতু আপনার বাবা ধনী লোক শুধু সেই কারণেই নিজেকে তার আত্মীয় বলে আমি মনে করি না, এবং আমি বা আমার মা কোনোদিনই তার কাছে কিছু চাইব না, বা নেব না।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত পিয়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারল না; কিন্তু যখন বুঝল তখন সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে কনুইর নিচ দিয়ে বরিসকে জড়িয়ে ধরে বরিসের চাইতেও বেশি লজ্জা পেয়ে লজ্জা ও বিরক্তির একটা মিশ্র অনুভূতির সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

আরে, এ তো খুব আশ্চর্য! তুমি কি মনে কর যে আমি… কে ভাবতে পারত?… আমি ভালোভাবেই জানি…

কিন্তু বরিস আবার তাকে বাধা দিল।

সব কথা বলতে পারায় আমি খুশি হয়েছি। আপনার হয়তো ভালো লাগেনি? আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু আশা করি আমি আপনাকে আঘাত দেইনি। খোলাখুলি কথা বলাই আমার রীতি।. আচ্ছা, কী জবাব আমি নিয়ে যাব? রস্তভদের বাড়িতে খেতে যাচ্ছেন তো?

একটা কর্তব্যের হাত থেকে রেহাই পেয়ে এবং একটা বিসদৃশ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে অন্য একজনকে তার মধ্যে আটকে দিয়ে বরিস আবারও বেশ খুশি হয়ে উঠল। একটু শান্ত হয়ে পিয়ের বলল, না, কিন্তু আমি বলছি, তুমি একটি আশ্চর্য ছেলে! এইমাত্র তুমি যা বললে সেটা ভালো কথা, খুব ভালো কথা। অবশ্য, আমাকে তুমি জান না। দীর্ঘদিন আমাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ নেই… ছেলেবেলার পরে আমাদে আর দেখা হয়নি। তুমি হয়তো ভাবতে পার যে আমি…আমি বুঝতে পেরেছি, ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। আমি নিজে এটা পারতাম না, সে সাহস থাকা উচিতও নয়, কিন্তু এটা চমৎকার। তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুব খুশি হয়েছি। একটু থেমে আবার বলল, তুমি যে আমাকে সন্দেহ করেছ এটা অদ্ভুত! সে হাসতে শুরু করল। আরে, তাতে কী হয়েছে। আশা করি আমাদের পরিচয় আরো ঘনিষ্ঠ হবে। সে বরিসের হাতে চাপ দিল। তুমি কি জান, আমি একবারও কাউন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। তিনিও আমাকে ডেকে পাঠাননি।… মানুষ হিসেবে তার জন্য আমার দুঃখ হয়, কিন্তু আমি কী করতে পারি?

বরিস হেসে জিজ্ঞেস করল, তাহলে আপনি মনে করেন যে নেপোলিয়ন তার বাহিনী নিয়ে ওপারে যেতে পারবে?

পিয়ের বুঝল যে বরিস প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাইছে; তার নিজেরও তাই ইচ্ছা, সুতরাং সে বোলন অভিযানের সুবিধা অসুবিধাগুলি বুঝিয়ে বলতে লাগল।

পরিচারক এসে বরিসকে ডাকল–প্রিন্সেস এবার যাবে। বরিসের সঙ্গে আরো বেশি করে পরিচিত হবার জন্য পিয়ের কথা দিল, ডিনারে যাবে; সাদরে তার হাতে চাপ দিয়ে চশমার উপর দিয়ে সস্নেহে বরিসের চোখের দিকে তাকাল। সে চলে গেলে অনেকক্ষণ ধরে সে ঘরের এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াতে লাগল, এখন আর কাল্পনিক তলোয়ার দিয়ে কোনো কাল্পনিক শত্রুকে বিঁধছে না; বরং একটি বুদ্ধিমান দৃঢ়চেতা যুবকের কথা স্মরণ করে হাসছে। * প্রথম যৌবনে যেমনটি ঘটে থাকে, বিশেষ করে তার বেলায় যে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে, এই যুবকটির

প্রতি পিয়ের একটা অদ্ভুত মমতা বোধ করতে লাগল, সে স্থির করল, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে।

প্রিন্স ভাসিলি প্রিন্সেসকে বিদায় জানাতে তার সঙ্গে এল। মহিলাটির চোখে রুমাল, মুখ অশ্রুসিক্ত।

সে তখন কেবলি বলছে, ভয়ংকর, ভয়ংকর! কিন্তু আমার যাই ঘটুক, আমার কর্তব্য আমি করব। এখানে এসে রাত থাকব। এ ভাবে ফেলে রাখা চলবে না। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। ভাইঝিরা যে এসব কাজ ফেলে রেখেছে কেন আমি তো ভেবে পাই না। তাকে প্রস্তুত করে তুলবার একটু উপায় বের করতে ঈশ্বরই আমাকে সাহায্য করবেন! বিদায় প্রিন্স! ঈশ্বর আপনার সহায় হোন।…

বিদায়, বলে প্রিন্স ভাসিলি চলে গেল।

গাড়িতে উঠে মা ছেলেকে বলল, তিনি এক ভয়াবহ অবস্থায় আছেন। কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারেন না।

আমি বুঝতে পারছি না মামণি–পিয়েরের প্রতি তার মনোভাব কী? ছেলে বলল।

সেটা উইল থেকে জানা যাবে বাবা। আমাদের ভাগ্যও তো তার উপরেই নির্ভর করছে।

কিন্তু তুমি কেন আশা করছ যে তিনি আমাদের কিছু দিয়ে যাবেন?

ওঃ বাবা, তিনি এত ধনী, আর আমরা এত গরিব!

যাই বলো, সেটা যথেষ্ট কারণ নয় মামণি।…

হা ঈশ্বর! তিন কত অসুস্থ! মা উচ্চৈঃস্বরে বলল।

*

অধ্যায়-১৭

আন্না মিখায়লভনা ছেলেকে নিয়ে কাউন্ট সিরিল ম্লাদিমিরভিচ বেজুখভের সঙ্গে দেখা করে চলে যাবার পরে কাউন্টেস রস্তভা অনেকক্ষণ পর্যন্ত চোখে রুমাল দিয়ে একা একা বসে রইল। শেষপর্যন্ত ঘন্টাটা বাজাল।

কয়েক মিনিট পরে দাসী এলে তাকে রেগে বলল, তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার কী বাপু? আমার কাজ করার ইচ্ছা নেই নাকি? তাহলে অন্য জায়গা খুঁজে দিই।

বন্ধুর দুঃখ ও অসম্মানজনক দারিদ্র্যের কথা শুনে কাউন্টেস খুব বিচলিত হয়ে পড়েছে; তার মেজাজও বিগড়ে গেছে, এরকম অবস্থা হলেই সে দাসীকে বাপু বলে ডাকে, আর অতিমাত্রায় বিনীতভাবে তার সঙ্গে কথা বলে।

আমি খুব দুঃখিত ম্যাম, দাসী উত্তর দিল।

আউন্টকে আমার কাছে ডেকে দাও।

যথারীতি অপরাধীর মতো তাকাতে তাকাতে কাউন্ট হেলেদুলে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এল।

কী খবর ছোট কাউন্টেস? কী খেলাই খেলোম গো! তারাসের জন্য হাজার রুবল দেয়া কিছু খারাপ নয়। সে তার উপযুক্ত!

হাঁটুর উপর কনুই রেখে স্ত্রীর পাশে বসে সে পাকা চুলে হাত বুলোতে লাগল।

কী আদেশ কাউন্টেস?

দেখ বাপু… ওটার এ অবস্থা কেন? কাউন্টের ওয়েস্টকোটটা দেখিয়ে সে বলল। তারপর হেসে যোগ করল, ওটাও সম্ভবত খেলা। দেখ কাউন্ট, আমার কিছু টাকার দরকার।

তার মুখটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল।

 ও, ছোট কাউন্টেস!…কাউন্ট পকেট-বইটা খুঁজতে লাগল।

আমার অনেক টাকা চাই কাউন্ট! পাঁচশ রুবল। ক্যান্ত্রিকের রুমালটা বের করে স্বামীর ওয়েস্টকোটটা মুছে দিতে লাগল।

হ্যাঁ, এখনি, এখনি দিচ্ছি। হেই, কে আছে? যে সব লোক জানে যে ডাকামাত্রই তোকজন এসে হাজির হবে তাদের মধ্যে সুরেই কাউন্ট হাঁক দিল। দিমিত্রিকে পাঠিয়ে দাও।

দিমিত্রি ভালো পরিবারের ছেলে; কাউন্টের বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। আর এখনো তার বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনা করে। আস্তে পা ফেলে সে ঘরে ঢুকল।

শ্রদ্ধাশীল যুবকটি ঘুরে ঢুকলে কাউন্ট বলল, আমি এই চাই হে বাপু। আমাকে এনে দাও… একমুহূর্ত ভাবল। হ্যাঁ সাত শো রুবল এনে দাও, হা! কিন্তু দেখো, গতবারের মতো ছেঁড়া ময়লা নোটগুলো এনো না, পরিষ্কার নোট এনে কাউন্টেসকে দাও।

গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাউন্টেস বলল, হা দিমিত্রি, পরিষ্কার নোট দিও।

নোটগুলো কখন চাই ইয়োর এক্সেলেন্সিং দিমিত্রি শুধাল। আপনাকে জানানো প্রয়োজন… কিন্তু আপনি অস্থির হবেন না, কাউন্টকে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে সে কথাটা যোগ করল, কারণ সে জানে যে ওটা আসন্ন রাগের লক্ষণ। আমি ভুলে গিয়েছিলাম… আপনি কি চান ওটা এখনি এনে দেই?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই! নিয়ে এসো। কাউন্টেসকে দাও। যুবকটি চলে গেলে কাউন্ট হেসে বলল, দিমিত্রি একটি রত্নভাণ্ডার। তার কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। সেটাকেই তো আমি ঘৃণা করি। সবকিছুই সম্ভব।

আঃ, টাকা কাউন্ট, টাকা! এ যে জগতে কত দুঃখের কারণই হয়। কিন্তু এ টাকাটার আমার বড় দরকার, কাউন্টেস বলল।

আমার ছোট্ট কাউন্টেস, তুমি তো একটি কুখ্যাত উড়নচণ্ডী, বলে কাউন্ট স্ত্রীর হাতে চুমো খেয়ে পড়ার ঘরেই ফিরে গেল।

আন্না মিখায়লভনা যখন কাউন্ট বেজুখভের বাড়ি থেকে ফিরে এল তখন, সব পরিষ্কার নোটে পুরো টাকাটাই কাউন্টেসের ছোট টেবিলের উপর একখানা রুমালে ঢাকা ছিল। আন্না মিখায়লভনা লক্ষ্য করল, কাউন্টেস কিছুটা উত্তেজিত।

তারপর বন্ধু? কাউন্টেস জিজ্ঞেস করল।

আঃ, কী ভয়ঙ্কর অবস্থায় যে তিনি আছেন! তিনি এত অসুস্থ যে তাঁকে চেনাই যায় না! মাত্র কয়েক মুহূর্ত সেখানে ছিলাম, কিন্তু কোনো কথাই বলতে পারিনি।…

আনেৎ, ঈশ্বরের দোহাই, তুমি আপত্তি করো না, কাউন্টেস বলল, তার শুকনো মর্যাদাসম্পন্ন, বার্ধক্যজীর্ণ মুখে লজ্জার আভাটুকু বড়ই বিচিত্র দেখাল, রুমালের নিচ থেকে সে টাকাটা তুলে নিল।

আন্না মিকায়লভনা তৎক্ষণাৎ তার ইচ্ছাটা বুঝে নিয়ে উপযুক্ত মুহূর্তে কাউন্টেসকে আলিঙ্গন করার জন্য নিচু হল।

এটা আমি বরিসকে দিলাম, তার পোশাকের জন্য।

আন্না মিখায়লভনা ততক্ষণে তাকে আলিঙ্কন করে কাঁদতে শুরু করেছে। কাউন্টেসও কাঁদল। তারা কাঁদল কারণ তারা বন্ধু, কারণ তারা দয়ালু হৃদয়, কারণ ছোটবেলার বন্ধু হয়েও টাকার মতো একটা তুচ্ছ জিনিসের কথা তাদের ভাবতে হয়েছে, আর কারণ তাদের যৌবন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এই অশ্রুজল তাদের দুজনের কাছেই বড় সুখকর।

*

অধ্যায়-১৮

মেয়েদের নিয়ে এবং বহুসংখ্যক অতিথিকে নিয়ে কাউন্টেস রস্তভা বসার ঘরে হাজির। আমন্ত্রিত ভদ্রলোকদের কাউন্ট নিজেই তার পড়ার ঘরে নিয়ে গেছে এবং নিজস্ব তুর্কি পাইপের সংগ্রহগুলি তাদের দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝেই সে খোঁজ করছে : সে কি এখনো আসেনি? সকলেই মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা আখসিমভার জন্য অপেক্ষা করছে। সমাজে সে ভয়ংকরী ড্রাগন নামে পরিচিত; মহিলাটির খ্যাতি অর্থ বা পদমর্যাদার জন্য নয়, সাধারণ বুদ্ধি ও স্পষ্ট কথার জন্য। রাজপরিবার থেকে শুরু করে মস্তো ও পিটার্সবুর্গ শহরের সর্বত্র মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার খ্যাতি, উভয় শহরই তাকে দেখে বিস্মিত হয়, তার কঠোরতায় গোপনে হাসে, তাকে নিয়ে গল্প বানায়, আবার সেই সঙ্গে সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করে, আবার ভয়ও করে।

কাউন্টের ঘরটা তামাকের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। একটি ইস্তাহারে যুদ্ধের কথা ঘোষণা করা হয়েছে; তাই সকলে যুদ্ধের কথা ও সৈন্যসংগ্রহের ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছে। ইস্তাহারটি কেউ এখনো চোখে দেখেনি, তবে সকলেই জানে যে সেটি প্রকাশিত হয়েছে। দুজন অতিথি ধূমপান করতে করতে গল্প করছে, আর তাদের মাঝখানে বসে আছে কাউন্ট। সে নিজে ধূমপান করছে না, কথাও বলছে না, কিন্তু একবার এদিকে, একবার ওদিকে মাথা হেলিয়ে পরম সুখে ধূমপানীদের দেখছে, তাদের কথাবার্তা শুনছে, আর একজনকে আর একজনের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে।

তাদের মধ্যে একজন সিভিলিয়ান, ফ্যাকাশে রং, পরিষ্কার কামানো, পাতলা বলীরেখাভরা মুখ, এর মধ্যেই বুড়ো হয়ে গেছে, যদিও পোশাক পরেছে একজন কেতাদুরুস্ত যুবকের মতো। বেশ আরাম করে সোফার উপর পা তুলে বসেছে। স্ফটিকের পাইপটা মুখের মধ্যে অনেকখানি ঢুকিয়ে কাশতে কাশতে ধূমপান করছে আর চোখ দযটো কুঁচকে যাচ্ছে। এই প্রবীণ অবিবাহিত পুরুষটির নাম শিনশিন, কাউন্টেসের সম্পর্কে বাই, মস্কোর সমাজে কড়া জিহ্বার মানুষ বলে পরিচিত। মনে হয় সঙ্গীকে সে কিছুটা কৃপার চোখে দেখে থাকে। অপরজন রক্ষীবাহিনীর গোলাপী অফিসার, ধোপদুরুস্ত, ঝকঝকে পোশাক, বোতাম-আঁটা, মুখের মাঝখানে পাইপটা ধরে লাল ঠোঁট দিয়ে ধীরে ধীরে ধোয়া টানে আর ধোয়া ছাড়ে রিং বানিয়ে। এই হল লেফটেন্যান্ট বের্গ, সেমেনভ রেজিমেন্টের অফিসার, এর সঙ্গেই বরিসের সেনাদলে যোগ দিতে যাবার কথা, আর একেই দিদি ভেরার ভাবী বলে উল্লেখ করে নাতাশা তাকে ঠুকেছিল। দুজনের মাঝখানে বসে কাউন্ট মন দিয়ে তাদের কথা শুনছিল। তার প্রিয় তাসের খেলা বোস্টন যখন চলে না, তখন তার মনের মতো কাজ হল শ্রোতা সাজা, বিশেষ করে যখন সে দুজন বাক্যবাগীশকে পরস্পরের দিকে লেলিয়ে দিতে পারে।

শিনশিনের কথা বলার বৈশিষ্ট্যই হল অতি সাধারণ রুশ বাকধারার সঙ্গে বাছা বাছা ফরাসি বাক্য জুড়ে দেয়া। ব্যঙ্গের হাসি হাসতে হাসতে সেই ভাষাতেই শিনশিন বলল তাহলে মাননীয় বুড়ো আলফোন্স কালোভিচ, তুমি সরকারের ঘাড় ভেঙেও মুনাফা লুটতে চাও, আবার সঙ্গীর কাছ থেকেও কিছু হাতাতে চাও?

না হে পিতর নিকলায়েভিচ; আমি শুধু দেখতে চাই যে দাতিক বাহিনীর তুলনায় অশ্বরোহী বাহিনীতে সুযোগ অনেক কম। এই আমার অবস্থাটাই ভেবে দেখ না পিতর নিকলায়েভিচ…।

বের্গ সর্বদাই কথা বলে ধীরে, সবিনয়ে ও ঠিক ঠিক মেপে। তার কথাবার্তা সব সময়ই নিজেকে নিয়ে; এমন আলোচনা যখন চলে যার সঙ্গে তার নিজের কোনো সম্পর্ক নেই তখন সে শান্তভাবে চুপ করে থাকে। কিন্তু সেই তার সম্পর্কে কোনো কথা ওঠে অমনি সে খোস মেজাজে কথা বলতে শুরু করে।

আমার কথাই ভাব পিতর নিকলায়েভিচ। যদি অশ্বরোহী বাহিনীতে থাকতাম তাহলে লেফটেন্যান্ট পদে থেকেও প্রতি চার মাসে আমি দুশো রুবলের বেশি পেতাম না, কিন্তু এখন আমি পাচ্ছি দুশো তিরিশ, শিনশিন ও কাউন্টের দিকে তাকিয়ে খুশির হাসি হেসে সে বলল।

সে আরো বলতে লাগল, তাছাড়া, রক্ষীবাহিনীতে বদলি নিয়ে আমি আরো ভালো পদে যেতে পারব, আর পদাতিক রক্ষীবাহিনীতে চাকরি খালিও হয় অনেক বেশি ঘন ঘন। তাহলেই ভাব, দুশো তিরিশ রুবলে কী না করা যেতে পারে। এমন কি আমি কিছুটা বাঁচাতে পারি এবং বাবাকেও কিছু পাঠাতে পারি, এই বলে সে একটা ধোয়ার রিং ছাড়ল।

পাইপটাকে মুখের আর এক কোণে ঠেলে দিয়ে কাউন্টকে চোখ টিপে শিনশিন বলল, হিসাব মিলে গেল… প্রবাদ আছে, জার্মানরা পাথরের গা থেকেও চামড়া তুলে নিতে জানে।

কাউন্ট হো হো করে হেসে উঠল। শিনশিনকে কথা বলতে দেখে অন্য অতিথিরাও এগিয়ে এল। বের্গ বলতে লাগল কেমন করে রক্ষীবাহিনীতে বদলি হয়ে সে ইতিমধ্যেই শিক্ষার্থী শিবিরের পুরনো বন্ধুদের চাইতে একধাপ এগিয়ে গেছে, কেমন করে যুদ্ধের সময় কোম্পানি কম্যান্ডার মারা গেলে প্রবণীতার বিচারে সে পদটা সে সহজেই পেয়ে যেতে পারে, রেজিমেন্টের সকলের সঙ্গেই তার দহরম মহরম চলে, আর তার বাবাও তাকে নিয়ে খুব খুশি।

সোফা থেকে পা তুলে বের্গের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে শিনশিন বলল, দেখ হে বাপু, পায়েই হাঁটো আর ঘোড়ায়ই চড়ো, তুমি যেখানে যাবে সেখানেই মাত করবে, এ আমি জোর গলায় বলে দিলাম।

বের্গ খুশিতে হাসতে লাগল। অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে কাউন্ট বসবার ঘরে গেল।

.

তখন বড় ভোজের আগেকার জাকুঙ্কার (ছোট হাজরি) সময়, সমবেত অতিথিরা এসময় কোনো বড় রকমের আলোচনায় জড়িয়ে না পড়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় ও অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলে, যেন দেখাতে চায় যে খাবার জন্য তারা মোটেই লালায়িত হয়ে ওঠেনি। গৃহকর্তা ও গৃহকত্রী তখন দরজার দিকে তাকায় আর মাঝে মাঝেই নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে, তা দেখেই অতিথিরা অনুমান করে নেয় তারা কার বা কিসের জন্য অপেক্ষা করছে-হয় কোনো বড় আত্মীয়ের জন্য, আর না হয়তো এমন কোনো খাদ্যসামগ্রীর জন্য যা এখনো বেঁধে নামানো হয়নি।

পিয়ের ঠিক খাবার সময়টাতেই এসেছে এবং বসার ঘরের মাঝখানে প্রথম যে চেয়ারটা পেয়েছে তাতেই এমন অদ্ভুতভাবে বসেছে যাতে অন্য সকলের পথ আটকে গেছে। কাউন্টেস তাকে কথা বলাতে চেষ্টা করল, কিন্তু যেন কারো খোঁজ করছে এমনবাবে সে চারদিকে তাকাতে লাগল এবং কাউন্টেসের সব প্রশ্নেরই এককথায় জবাব দিল। অতিথিরা অনেকেই ভালুকঘটিত ব্যাপারটা জানত বলে কৌতূহলের সঙ্গে তাকে দেখল আর ভাবল যে এরকম একটি বোকা বোকা বিনীত মানুষ পুলিশের সঙ্গে এমন খেলা খেলল কী করে।

কাউন্টেস জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এইমাত্র এলে?

হুঁ মাদাম, চারদিক তাকিয়ে সে জবাব দিল ।

আমার স্বামীর সঙ্গে এখনো দেখা করনি?

না মাদাম। সে শুধু একটু হাসল।

শুনলাম তুমি সম্প্রতি প্যারিতে ছিলে? আমার তো মনে হয় জায়গাটা খুব মজার।

খুব মজার।

কাউন্টেস আন্না মিখায়লভনার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। প্রিন্সেস বুঝতে পারল, কাউন্টেস চাইছে যে সে যুবকটির আপ্যায়নের ভার নিক; তাই পিয়েরের পাশে গিয়ে বসে প্রিন্সেস তাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কাউন্টেসের বেলায় যেমন এখনো তেমনি সে এককথায় জবাব সারল। অন্য অতিথিরা সকলেই নানা আলোচনায় ব্যস্ত।

রাজুমভক্তি-পরিবার…খুব মনোহারী …আপনার খুব দয়া… কাউন্টেস এপ্রক্সিনা…চারদিকে এইসব কথা শোনা যাচ্ছে। কাউন্টেস উঠে নাচঘরে গেল।

সেখান থেকেই ডাকল, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা?

স্বয়ং কর্কশ গলায় জবাব এলো; ঘরে ঢুকল মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা।

অবিবাহিতরা সকলে, এমনকি খুব বৃদ্ধা ছাড়া বিবাহিতা মহিলারাও উঠে দাঁড়াল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা দরজায় এসে থেমে গেল। লম্বা, মজবুত গড়ন, কোঁকড়া পাকা চুলভরা মাথাটা পঞ্চাশ বছর বয়সেও বেশ খাড়া। অতিথিদের খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আস্তিনটাকে ঠিকভাবে গোটাতে লাগল। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা সবসময় রুশ ভাষাতেই কথা বলে।

যার নামকরণ দিবস আজ আমরা পালন করছি তার ও তার ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও সুখ কামনা করছি, তার গম্ভীর জোরালো গলার শব্দে অন্যসব শব্দ চাপা পড়ে গেল। কাউন্ট এসে তার হাতে চুমো খেলে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এই যে পুরনো পাপী, মস্কোতে নিশ্চয় আপনার একঘেয়ে লাগছে; কী বলেন? কুকুর নিয়ে শিকারে যাবার জায়গাও নেই তো? তা আর কী করা যাবে বৃদ্ধ? দেখুন না, এইসব কাচ্চাবাচ্চারা কেমন বড় হয়ে উঠেছে, সে মেয়েদের দেখিয়ে বলল। এবার ওদের জন্য স্বামীর খোঁজ করতেই হবে, তা সে আপনার ভালো লাগুক আর নাই লাগুক।

তারপর বলল, আচ্ছা, আমার কসাক কেমন আছে? (মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা নাতাশাকে কসাক বলে ডাকে) নাতাশা নির্ভয়ে এসে তার হাতে চুমো খেলে তার বাহুতে চাপড় মারতে মারতে বলল, আমি জানি ও খুব দুষ্টু মেয়ে, কিন্তু আমি ওকে পছন্দ করি।

মস্ত বড় থলি তেকে ন্যাসপাতির মতো আকারের এক জোড়া চুনির ইয়ারিং বের করে গোলাপী নাতাশাকে দিল। সেও খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে সঙ্গে সঙ্গে পিয়েরকে ডাকল।

নরম উঁচু গলায় বলল, হেই, হেই বন্ধু! এখানে একটু এসো। এসো না বন্ধু… বলতে বলতে সে হাতের আস্তিন গুটিয়ে ফেলল। শিশুর মতো তার দিকে তাকিয়ে পিয়ের এগিয়ে গেল।

আরো কাছে এসো বন্ধু! তিনি যখন পক্ষে ছিলেন তখন একমাত্র আমিই তাকে সত্য কথাটা বলেছি, আর তোমার বেলায় এটা তো আমার অবশ্য কর্তব্য।

সে থামল। সকলে চুপচাপ; তারপর কী ঘটে তা দেখতে সকলেই উৎসুক, কারণ এটা তো সূচনামাত্র।

চমৎকার ছেলে! আমি বলছি! সুন্দর ছেলে! বাবা মৃত্যুশয্যায় আর উনি ভালুকের সঙ্গে পুলিশকে জুড়ে দিয়ে মজা করেন! কী লজ্জা, কী লজ্জা! এর চাইতে তোমার যুদ্ধে যাওয়া ভালো ছিল।

মুখ ঘুরিয়ে সে কাউন্টের হাত ধরল; কাউন্ট তখন হাসি চাপতে পারছে না।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, আমাদের খাবার টেবিলে যাবার সময় কি হয়নি?

প্রথম গেল কাউন্ট মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকে নিয়ে; তারপর গেল কাউন্টের জনৈক হুজার-কর্নেলের কাঁধে হাত রেখে; কর্নেলটির এখন গুরুত্ব অনেক, কারণ তার সঙ্গেই নিকলাস রেজিমেন্টে যাবে; তারপর গেল আন্না মিখায়লভনা শিনশিনের সঙ্গে। বের্গ ধরল ভেরার হাত। হাস্যময়ী জুলি কারাগিন গেল নিকলাসের সঙ্গে। তারপর জোড়ায় জোড়ায় অন্য সকলে এগিয়ে গেল; সারা খাবার ঘরটা ভরে গেল, সকলের শেষে একে একে গেল ছেলেমেয়েরা, গৃহশিক্ষকরা ও গভর্নের্সরা। পরিচারকরা ঘোরাঘুরি শুরু করল, চেয়ারের শব্দ উঠল, গ্যালারিতে ব্যান্ড বাজল, অতিথিরা যার যার আসনে বসল। তারপর কাউন্টের পারিবারিক ব্যান্ডের পরিবর্তে শুরু হল কাটা চামচের খুটখাট, অতিথিদের কলগুঞ্জন আর পরিচারকদের মৃদু পদশব্দ। টেবিলের একপ্রান্তে বসল কাউন্টেস, তার ডান দিকে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বয়ে আন্না মিখায়লভনা, তারপরে অন্য মহিলারা। অন্য প্রান্তে বসল কাউন্ট, বাঁদিকে হুজার-কর্নেল এবং ডানদিকে শিনশিন ও অন্য পুরুষ অতিতিরা। লম্বা টেবিলের মাঝামাঝি একদিকে বসল যুবক-যুবতীরা : বের্গের পাশে ভেরা, বরিসের পাশে পিয়ের; অন্যদিকে ছোটরা, শিক্ষকরা, গর্ভনেসরা; স্ফটিকের ডিকেন্টার ও ফলের পাত্রের আড়াল থেকে স্ত্রীর দিকে ও তার হাল্কা নীল রঙের ফিতেবাধা উঁচু টুপির দিকে চোখ রেখে কাউন্ট দ্রুতবেগে প্রতিবেশীদের গ্লাসগুলি ভরে দিতে লাগল; অবশ্য নিজের গ্লাসটিকেও উপেক্ষা করল না। ওদিকে কাউন্টেসও গৃহকত্রীর কর্তব্য পালনের ফাঁকে ফাঁকে আনারসের আড়াল থেকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে; স্বামীর পাকা চুলের তুলনায় তার মুখ ও টাক মাথার রক্তিমাভা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মহিলাদের দিকটাতে সারাক্ষণ কথার রক্তিমাভা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মহিলাদের দিকটাতে সারাক্ষণ কথার খৈ ফুটছে, আর পুরুষদের গলা ক্রমেই উঁচুতে আরো উঁচুতে উঠছে–বিশেষ করে হুজার-কর্নেলের গলা; সে যত লাল হচ্ছে ততই বেশি খাচ্ছে আর বেশি টানছে; ফলে কাউন্ট তাকে অন্য সকলের সামনে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরছে। স্মিতহাস্যে বের্গ ভেরাকে বলছে, ভালোবাসা মর্তের নয়, স্বর্গের অনুভূতি। বরিস নতুন বন্ধু পিয়েরকে অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, আর মাঝে মাঝে উল্টো দিকে উপবিষ্ট নাতাশার সঙ্গে দৃষ্টি-বিনিময় করছে। পিয়ের কথা বলছে কম, নতুন মুখগুলিকে ভালো করে পরখ করছে, আর এন্তার খেয়ে চলেছে। দুরকম ঝোলের মধ্যে সুগন্ধি প্যাটিসসহ কাছিমের ঝোলটাই তার বেশি পছন্দ; অবশ্য কোনো খাদ্যদ্রব্য বা কোনোরকম মদই সে বাদ দিল; সব চালিয়ে গেল। তেরো বছরের মেয়েরা ভালোবাসার মানুষকে, যাকে জীবনের প্রথম চুম্বনটি দিয়েছে, যে চোখে দেখে ঠিক সেই ভাবে নাতাশা বরিসের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে সেই দৃষ্টি পিয়েরের উপরেও পড়ছে; ছটফটে ছোট মেয়েটির চাউনি দেখে তার হাসি পেল, কেন তা সে জানে না।

নিকলাস বসেছে জুলি কারাগিনের পাশে, সোনিয়ার কিছুটা দূরে। সোনিয়ার মুখে হাসি থাকলেও স্পষ্টই বোঝা যায় যে সে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরছে; এই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, এই লাল হচ্ছে; নিকলাস ও জুলি কী কথা বলছে তা শোনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। গভর্নেস অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকাচ্ছে, যেন ছেলেমেয়েদের প্রতি কোনোরকম তাচ্ছিল্য দেখলেই প্রতিবাদ করবে। জার্মান গৃহশিক্ষকটি সবরকম খাবার ও মদের নাম মনে রাখতে চেষ্টা করছে যাতে জার্মানিতে তার লোকজনের কাছে এই নৈশভোজের একটা পূর্ণ বিবরণ পাঠাতে পারে। তাই খানসামা যখন একটা বোতলকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে তার পাশ দিয়ে চলে গেল তখন তার খুব রাগ হল। সে চোখ কুঁচকাল; যেন বোঝাতে চাইল যে, কোনো মদের প্রতিই তার লোভ নেই; কিন্তু তৃষ্ণা মেটাবার জন্য বা লোভের জন্য যে সে মদ চাইছে না, চাইছে শুধু জ্ঞানলাভের জন্য–এটা কেউ বুঝল না দেখে সে খুব মর্মাহত হল।

*

অধ্যায়-১৯

পুরুষদের টেবিলের আলোচনা ক্রমেই জোরদার হয়ে চলেছে। কর্নেল বলল, যুদ্ধের ঘোষণা ইতিমধ্যেই পিটার্সবুর্গে বেরিয়ে গেছে, তার একটা কপি সে নিজে দেখেছে, কারণ সেইদিনই সংবাদবাহক সেটা এনে প্রধান সেনাপতিকে দিয়েছে।

শিনশিন বলল, কিন্তু আমরা বোনাপার্তের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি কিসের জন্য? অস্ট্রিয়ার বকবকানি সে থামিয়েছে; আমার তো ভয় হয় এরপরই আমাদের পালা আসবে।

কর্নেল লোকটি শক্ত-সমর্থ, লম্বা রক্তবহুল জার্মান; চাকরির প্রতি অনুরক্ত, রুশ দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত। সে শিনশিনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করল।

জার্মান উচ্চারণে সে বলে উঠল, দেখুন মশাই, তার কারণটা সম্রাট ভালোই জানেন। ইস্তাহারে তিনি পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন যে, রাশিয়ায় সামনে, সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও মর্যাদা এবং মিত্রশক্তির পবিত্রতার সামনে যে বিপদ আসন্ন হয়ে উঠেছে তাকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না।

তারপর যে অভ্রান্ত সরকারি স্মৃতিশক্তি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তার উপর নির্ভর করে সে ইস্তাহারের মুখবন্ধ হতে আবৃত্তি করতে শুরু করল :

…সুদৃঢ় ভিত্তির উপর ইওরোপের শান্তিকে প্রতিষ্ঠিত করবার যে বাসনা ম্রাটের একমাত্র নিঃশর্ত লক্ষ্য তারই নির্দেশে তিনি স্থির করেছেন যে সৈন্যবাহিনীর একটি অংশকে বিদেশে পাঠাবেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণের অনুকূল একটি নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন।

মর্যাদাসহকারে এক পাত্র মদ খেয়ে কাউন্টের সমর্থনের আশায় তার দিকে তাকিয়ে সে তার বক্তব্য শেষ করল, জানেন মশাই, এই কারণেই….

শিনশিন ভুরু কুঁচকে হেসে বলল, জেরোম, জেরোম, বৃথাই ঘোরা, বাড়িতে বসে চরকা ঘোরা–এই প্রবাদটি জানেন কি? ঐ বাক্যটিই আমাদের পক্ষে মোক্ষম খাঁটি। সুভরভের কথাই ধরুন–তার কি কাজ সে তো ভালোই জানত, কিন্তু তারা তো তাকে মেরে একেবারে তক্তা বানিয়ে দিল। আমি শুধু সেই কথাটাই আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি। লোকটি অনবরত একবার ফরাসি ও একবার রুশ ভাষার খিচুড়ি বানিয়ে কথাগুলি বলল।

টেবিলের উপর একথা থাপ্পড় বসিয়ে কর্নেল বলল, আমাদের বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও আমরা যুদ্ধ করব; সম্রাটের জন্য আমরা জীবন দেব, তবেই মঙ্গল হবে; আর এ নিয়ে যথাসম্ভব কম আলোচনা করব। আমরা প্রবীণ হুজাররা এই দৃষ্টিতেই ব্যাপারটাকে দেখছি, আর এটাই শেষ কথা। তারপর নিকলাসের দিকে ফিরে সে বলল, আর তুমি তো একজন যুবক, একজন তরুণ হুজার, এ বিষয়ে তোমার কি মত?

নিকলাস জবাব দিল, আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা রুশ দেশের মানুষরা হয় মরব, নয় জয় করব।

জুলি বলল, চমৎকার বলেছ তুমি!

নিকলাসের কথাগুলি শুনে সোনিয়ার সারা শরীর কাঁপতে লাগল; তার কান থেকে গলা ও কাঁধ পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল।

পিয়ের কর্নেলের কথাগুলি মন দিয়ে শুনল; সমর্থন-সূচক ঘাড় নেড়ে বলল, সুন্দর।

আর একবার টেবিলে থাপ্পর মেরে কর্নেল বণে উঠল, এই যুবক একজন সত্যিকারের হুজার!

হঠাৎ টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার গম্ভীর গলা শোনা গেল : ওদিকে আপনারা কি নিয়ে এত সোরগোল তুলেছেন? এমনভাবে টেবিল চাপড়াচ্ছে কেন? এতটা উত্তেজিতই বা হচ্ছেন কেন? আপনারা কি মনে করছেন যে ফরাসিরা এখানে পৌঁছে গেছে?

হুজার হেসে জবাব দিল, আমি সত্য কথাই বলছি।

কাউন্ট গলা চড়িয়ে বলল, যুদ্ধের কথা হচ্ছে। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা, আপনি কি জানেন যে আমার ছেলে যুদ্ধে যাচ্ছে? আমার ছেলে যাচ্ছে।

আমার চার ছেলে সেনাদলে আছে, কিন্তু আমি তো চেঁচাচ্ছি না। সবই ঈশ্বরের হাতে। আপনি বিছানায় শুয়েই মারা যেতে পারেন, আবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও ঈশ্বর আপনাকে ফিরিয়ে আনতে পারেন, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা গম্ভীর গলায় কথাগুলি বলল; টেবিলের সকলেই তার দিকে হেলে পড়ল।

ঠিক কথা!

আলোচনা আবার জমে উঠল; মহিলারা এক প্রান্তে, পুরুষরা অন্য প্রান্তে।

নাতাশার ছোট ভাইটি বলল, তুমি চেয়ো না; আমি জানি, তুমি চাইবে না!

আমি চাইব, নাতাশা জবাব দিল।

বিবেচনাহীন ও সানন্দ দৃঢ়তায় তার মুখ হঠাৎ লাল হয়ে উঠল। অর্ধেক দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় পিয়েরকে তার কথা মন দিয়ে শুনবার নির্দেশ জানিয়ে সে মার দিকে ফিরে সরবে ডাকল : মামণি!

চমকে কাউন্টেস বলল, কি? কিন্তু পরক্ষণেই মেয়ের চোখেমুখে দুষ্টুমির ঝিলিক দেখে সে সজোরে আঙুল নেড়ে ও মাথা নেড়ে তাকে ভয় দেখাল।

আলোচনা থেমে গেল ।

মামণি! আমরা কি কি মেঠাই পাব? নাতাশার গলায় আরো বেশি দৃঢ়তা ও স্থির সিদ্ধান্তের ভাব ফুটে উঠল ।

কাউন্টেস চোখ রাঙাতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা মোটা আঙুল নাড়িয়ে ভয় দেখিয়ে ডাকল, কসাক!

এই দুষ্টুমিকে তারা কীভাবে নেবে ঠিক বুঝতে না পেরে অধিকাংশ অতিথি বড়দের দিকে তাকাল।

তোমার সাবধান হওয়া উচিত! কাউন্টেস বলল ।

মামণি! আমরা কী মেঠাই পাব? নাতাশা আবার চেঁচিয়ে দুষ্টুমিভরা হাসির সঙ্গে বলল; সে জানে তার। এই দুষ্টুমিকে সকলে ভালোভাবেই নেবে।

সোনিয়া ও মোটাসোটা ছোট্ট পেতয়া হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল।

নাতাশা ফিসফিস করে ছোট ভাই ও পিয়েরকে বলল, দেখলে তো! আমি ঠিক চেয়েছি।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, আইস-পুডিং আছে, কিন্তু তুমি একটুও পাবে না।

নাতাশা বুঝল ভয় পাবার কিছু নেই; কাজেই মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকেও সে ভয় পেল না।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা! কেমন আইস-পুডিং? আইসক্রিম আমি পছন্দ করি না।

ক্যারট-আইস।

না, কী রকম তাই বল? কী রকম? আমি জানতে চাই! নাতাশা প্রায় চিৎকার শুরু করল।

মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ও কাউন্টেস হো-হো করে হেসে উঠল; অতিথিরা সকলেই সে হাসিতে যোগ দিল। তারা হাসল মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার কথা শুনে নয়, যে ছোট মেয়েটি মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার সঙ্গে এ ধরনের ব্যবহার করতে পারল তার অবিশ্বাস্য সাহস ও বুদ্ধি দেখে।

– নাতাশাকে যখন বলা হলো যে পাইনঅ্যাপল-আইস আছে তখন সে থামল। আইসক্রিমের আগে সকলকে শ্যাম্পেন পরিবেশন করা হলো। আবার ব্যান্ড বেজে উঠল, কাউন্ট ও কাউন্টেস চুমো খেল, অতিথিরা তাদের আসন ছেড়ে কাউন্টেসকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে গেল, এবং টেবিলের দুই পাশ থেকে কাউন্টের সঙ্গে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ও পরস্পরের সঙ্গে গ্লাসঠোকাঠুকি করতে লাগল। আবার শুরু হলো পরিচারকদের ছুটাছুটি, চেয়ারের খসখস শব্দ, আর ঠিক যেভাবে পর পর সকলে খাবার ঘরে ঢুকেছিল ঠিক সেইভাবে মুখগুলিকে আরো লাল করে নিয়ে বসবার ঘরে ও কাউন্টের পড়ার ঘরে ফিরে গেল ।

*

অধ্যায়-২০

তাসের টেবিল পাতা হলো, বোস্টন খেলার জন্য তাস সাজানো হলো, কাউন্টের অতিথিরা সব বসে গেল, কতক দুটো বসবার ঘরে, কতক ভিতরের ঘরে, কতক বা লাইব্রেরিতে।

কাউন্ট নিজের তাসগুলো পাখার মতো করে হাতে ধরে আহারান্তিক ঘুমকে অনেক কষ্টে দুচোখ থেকে তাড়িয়ে অনবরত হাসছে। কাউন্টেসের তাড়নায় ছোটরা বাদ্যযন্ত্রের কাছে ভিড় করে দাঁড়াল। সকলের অনুরোধে জুলি প্রথম বাজাল। কিছুক্ষণ বীণা বাজার পরে সকলে মিলে নাতাশা ও নিকলাসকে অনুরোধ করল গান গাইতে; গানের ব্যাপারে দুজনেরই সুনাম আছে।

আমরা কি গাইব? নাতাশা বলল।

ঝর্নাটা গাও, নিকলাস প্রস্তাব করল।

বেশ, তাহলে তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও। বরিস, এখানে এস, নাতাশা বলল। কিন্তু সোনিয়া কোথায়?

চারদিকে তাকিয়ে বন্ধুকে দেখতে না পেয়ে নাতাশা তাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।

সোনিয়ার ঘরে গিয়ে তাকে পেল না; নার্সারিতে গেল, সেখানেও নেই। নাতাশা ভাবল, সে নিশ্চয় দালানের সিন্দুকের উপর আছে; সেটাই রস্ত পরিবারের ছোট মেয়েদের গোঁসা-ঘর। সত্যি সত্যি সেখানেই সোনিয়াকে পাওয়া গেল। সিন্দুকের উপর নার্সের নোংরা পালকের বিছানায় সে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, আঙুল দিয়ে মুখ ঢেকে এমনভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদছে যে তার কাঁধ অবধি কাঁপছে। তা দেখে নাতাশার ঝলমলে মুখটা হঠাৎ বদলে গেল : চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল, গলা দিয়ে কেমন একটা কাঁপুনি নামতে লাগল, আর মুখের কোণ দুটো ঝুলে পড়ল।

সোনিয়া! কী হলো?…ব্যাপার কী?…ও…ও…ও…! নাতাশার বড় মুখখানি হা হয়ে গেল, তাকে বেশ কুৎসিত দেখাতে লাগল, একটা ছোট মেয়ের মতো সেও কাঁদতে লাগল; অথচ সোনিয়ার কান্না ছাড়া তার কাঁদবার আর কোনো কারণই নেই। কথা বলার জন্য সোনিয়া মাথা তুলতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, মুখটা আরো বেশি করে বিছানায় গুঁজে দিল। নীল ডোরা-টানা পালকের বিছানায় বসে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে নাতাশা কাঁদতে লাগল। অনেক চেষ্টা করে সোনিয়া উঠে বসল; চোখের পানি মুছে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল, এক সপ্তাহের মধ্যে নিকলাস চলে যাচ্ছে, তার…কাগজপত্র… এসে গেছে…সেই আমাকে বলেছে…কিন্তু তাহলেও আমার কাঁদা উচিত নয়, এই বলে হাতের কাগজটা তুলে দেখাল-তাতে নিকলাসের লেখা একটা কবিতা, তাহলেও আমার কাঁদা উচিত নয়, কিন্তু তুমি বুঝবে না…কেউ বুঝবে না…তার হৃদয় কত বড়!

আবার সে কাঁদতে শুরু করল। কারণ নিকলাসের হৃদয় কত মহৎ।

গায়ে একটু জোর পেয়ে সে আরো বলতে লাগল, তোমার কপাল কত ভালো…আমি ঈর্ষা করছি না…আমি তোমাকে ভালোবাসি, বরিসকেও, সেও কত ভালো…তোমাদের পথে কোনো বাধাই নেই…কিন্তু নিকলাস আমার সম্পর্কে ভাই…তাই এ অবস্থায়…স্বয়ং মেট্রোপলিটন (রাশিয়ার গির্জার ব্যবস্থায় সম্পর্কিত ভাই-বোনের বিয়ের জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়)…আবার তাহলেও হবে না। তাছাড়া, ভেরা যদি মামণিক (সোনিয়া কাউন্টেসকে মা বলেই মনে করে এবং মা বলেই ডাকে) বলে দেয় যে আমি নিকলাসের জীবনটাকেই নষ্ট করে দিচ্ছি, আমি হৃদয়হীন, অকৃতজ্ঞ, অথচ আসলে…ঈশ্বর সাক্ষী, সে একটা ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল, আমি তাকে কত ভালোবাসি, তোমাদের সব্বাইকে ভালোবাসি, শুধু ভেরা…কিন্তু কিসের জন্য? আমি তার কি করেছি? তোমার কাছে আমি এতদূর কৃতজ্ঞ যে আমি স্বেচ্ছায় সবকিছু ত্যাগ করতে পারি, শুধু আমার তো কিছুই নেই…

সোনিয়া আর বলতে পারল না, বিছানায় শুয়ে আবার দুই হাতে মুখ ঢাকল। নাতাশা সান্ত্বনা দিতে লাগল, কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা গেল, বন্ধুর বিপদের গুরুত্ব সে ভালোই বুঝতে পেরেছে।

যেন এতক্ষণে বন্ধুর দুঃখের আসল কারণটা বুঝতে পেরেছে এমনিভাবে সে হঠাৎ বলে উঠল, সোনিয়া, আমি নিশ্চিত জানি ডিনারের পরে ভেরা নিশ্চয় তোমাকে কিছু বলেছে। তাই নয় কি?

হ্যাঁ, এই কবিতাগুলো নিকলাস নিজে লিখেছে, অন্য কতকগুলি আমি নকল করেছি; এগুলিকে আমার টেবিলে দেখতে পেয়ে ভেরা বলছে সব মামণিকে দেখাবে, আমি নাকি অকৃতজ্ঞ, আর মামণি কখনো আমার সঙ্গে তার বিয়ে হতে দেবে না, সে নাকি জুলিকে বিয়ে করবে। সে তো সারাটা দিন জুলির সঙ্গেই ছিল …নাতাশা, আমি এমন কি করেছি যার জন্য আমার কপালে এমনটা ঘটল?… ।

আবার সে আগের চাইতেও বেশি করে ফোঁপাতে লাগল। নাতাশা তাকে তুলল, জড়িয়ে ধরল, এবং চোখের পানি ফেলেও হাসতে হাসতে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

সোনিয়া, ভেরার কথায় বিশ্বাস করো না ভাই! তার কথায় বিশ্বাস করো না! তোমার কি মনে নেই, রাতের খাবারের পরে ছোট ঘরে বসে নিকলাস ও আমরা কত কথা বলেছি? আরে, কি যে হবে তা তো আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম? সেটা যে কি আমার মনে নেই, কিন্তু তোমারও কি মনে নেই, কি চমৎকার ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম? ঐ তো শিনশিন খুড়োর ভাই তার নিকট সম্পর্কের এক বোনকে বিয়ে করেছে না? আর আমরা তো দূর সম্পর্কের! আর বরিসও বলেছে যে এটা খুবই সম্ভব। কি জান, তাকে আমি সব কথা বলেছি। আর সে যেমন চালাক-চতুর, তেমনি ভালো! তুমি কেঁদ না সোনিয়া, লক্ষ্মী সোনিয়া! তাকে চুমো খেয়ে নাতাশা হাসতে লাগল। ভেরার মনে ঈর্ষা ঢুকেছে; তার কথা ভেবো না! সব ঠিক হয়ে যাবে; সে মামণিকে কিছু বলবে না। নিকলাস নিজেই তাকে বলবে; জুলিকে নিয়ে সে মোটেই মাথা ঘামায় না।

নাতাশা তার চুলে চুমো খেল।

সোনিয়া উঠে বসল। বিড়ালছানাটি ঝলমলিয়ে উঠল, চোখ চকচক করতে লাগল, মনে হলো, এখনই লেজ তুলে নরম থাকা মেলে লাফিয়ে সুতোর বলটা নিয়ে খেলা শুরু করবে, ঠিক যেমনটি বিড়াল বাচ্চা করে।

তাড়াতাড়ি ফ্রক ও চুল ঝেড়ে সোনিয়া বলল, তোমার তাই মনে হয়? সত্যি?

ঠিক বলছ? সত্যি, ঠিক!

নাতাশা জবাব দিল।

দুজনই হেসে উঠল।

ঠিক আছে, চল, গান করি গে, সেই ঝর্নার গান।

চলে এস।

হঠাৎ থেমে নাতাশা বলল, তুমি কি জান, আমার উল্টো দিকে যে মোটাসোটা পিয়ের বসেছিল সে কি রকম মজার লোক! আমার খুব খুশি লাগছে!

সে এক চুটে দালান পার হয়ে চলে গেল।

কবিতাগুলিকে বুকের মধ্যে খুঁজে নিয়ে সোনিয়া নাতাশার পিছনে ছুট দিল; আর মুখ লাল, পা দু-খানি খুশিতে হাল্কা। অতিথিদের অনুরোধে তারা সকলে মিলে ঝর্নার গানটা গাইল। সকলেই শুনে খুশি হলো। তার পর নিকলাস একটা সদ্য-শেখা গান গাইল।

রাতের বেলা যবে জ্যোৎস্না হাসে
তখন যদি তুমি ভাবতে পার–
একজন আছে শুধু তোমার পাশে,
আহা কি মিষ্টি সেই স্বপ্ন আরো।
বীণার তারে লেগে তারই ছোঁয়া
মিষ্টি রাগিণী যায় সাগর ছুঁয়ে,
তোমারই লাগি যায় সাগর ছুঁয়ে,
তোমারই লাগি তার এ-গান গাওয়া,
মধুর আবেশে যায় তোমারে ছুঁয়ে।

অমলিন স্বপ্নের দু-একটি দিন,
কিন্তু হায়! ততদিন রব না আমি!

গানের শেষ স্তবকটি শেষ হবার আগেই ছেলেমেয়েরা বড় হলটায় নাচের জন্য তৈরি হাতে লাগল; গ্যালারি থেকে ভেসে এল পায়ের শব্দ আর বাজনাদারদের কাশির শব্দ।

শিনশিন বসবার ঘরেই পিয়েরকে আটকে রাখল। সম্প্রতি সে বিদেশে থেকে ঘুরে এসেছে; তাই সে ভদ্রলোক তার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা জুড়ে দিল; আরো কয়েকজন তাতে যোগ দিল; কিন্তু পিয়ের বিরক্তি বোধ করতে লাগল। বাজনা শুরু হতেই নাতাশা সোজা তার কাছে এসে মুখ লাল করে হেসে বলল:

মামণি আমাকে বলে দিল, আপনাকে নাচে যোগ দিতে ওখানে নিয়ে যেতে হবে।

পিয়ের জবাব দিল, আমি তো নাচের তাল স্রেফ গুলিয়ে ফেলব; তবে তুমি যদি আমার গুরু হও…। ছোট মেয়েটির দিকে সে হাতখানা বাড়িয়ে দিল।

ওদিকে নাচের জুড়িরা তৈরি হচ্ছে; বাজনাদাররা সুর বাঁধছে; এদিকে পিয়ের তার সঙ্গিনীকে নিয়ে বসে পড়ল। নাতাশা খুব সুখী; এমন একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে সে নাচবে যে বিদেশে ঘুরে এসেছে। একটা ভালো জায়গায় বসে সে বয়স্কা মহিলার মতোই তার সঙ্গে কথা বলছে। অন্য কোনো মহিলার দেওয়া একটা পাখা তার হাতে। সমাজে চলতে অভ্যস্ত মহিলাদের মতো ভঙ্গি করে (ঈশ্বর জানেন কবে কোথায় সে এ সব শিখেছে) পাখার হাওয়া খেতে খেতে হাসি মুখে সে তার সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

নাচ-ঘর পার হতে গিয়ে নাতাশাকে দেখিয়ে বলে উঠল, আরে দেখ, দেখ। ওর দিকে তাকাও!

নাতাশাও হাসল; তার মুখ লাল।

আচ্ছা মামণি! তুমি ও কথা বলছ কেন? এতে অবাক হবার কি আছে?

নাচের তখন তৃতীয় পর্যায় চলছে। বিশিষ্ট প্রবীণ অতিথিদের নিয়ে কাউন্ট ও মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা এতক্ষণ ছোট ঘরটাতে তাস খেলছিল। অনেকক্ষণ একটানা বসে থাকবার পরে এবার তারা আড়মোড়া ভেঙে টাকার থলি ও পকেট-বই ঠিক মতো তুলে নিয়ে নাচ-ঘরে ঢুকল। খুশিভরা মুখে প্রথম ঢুকল মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ও কাউন্ট। কাউন্ট ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে হাতটা নুইয়ে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর এগিয়ে চলল; মার্জিত পৌরুষের স্মিত হাসিতে তার মুখটা উজ্জ্বল। নাচ শেষ হতেই বাজনাদারদের লক্ষ্য করে হাততালি দিয়ে সে গ্যালারির দিকে তাকাল; তারপর প্রথম বেহালাদারকে বলল :

সাইমেন! তুমি ডানিয়েল কুপার বাজাতে জান?

এটা কাউন্টের প্রিয় নাচ; যৌবনে এ-নাচ সে অনেক নেচেছে।

বাপিকে দেখ! সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাতাশা চেঁচিয়ে উঠল। তার হাসি সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ।

সত্যি সত্যি উপস্থিত সকলেই হাসি মুখে এই আনন্দময় বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে দেখতে লাগল। দীর্ঘদেহ, শক্তসমর্থ সঙ্গিনী মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকে পাশে নিয়ে ভদ্রলোক তাকে জড়িয়ে ধরল, সময় কাটাতে লাগল, ঘাড় সোজা করল, পা বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ঠুকতে লাগল, হাসির ঝোঁকে চওড়া মুখটাকে আরো চওড়া করে আসন্ন ঘটনার জন্য দর্শকদের প্রস্তুত করে নিল। তারপর ডানিয়েল কুপারের উত্তেজনাপূর্ণ মধুর বাজনা (অনেকটা পল্লী-নৃত্যের মতো) শুরু হতেই হঠাৎ নাচ-ঘরের সবগুলি দরজা বাড়ির দাসদাসীতে একেবারে ভরে গেল-একদিকে পুরুষরা, অন্যদিকে মেয়েরা; তাদের চোখ-মুখ চকচক করছে; মালিকের ফুর্তি দেখতে তারাও হাজির হয়েছে।

একটা দরজায় দাঁড়িয়ে নার্সটি সোচ্চারে বলে উঠল, মালিককে দেখ! ঠিক যেন ঈগল পাখিটি!

কাউন্ট এক সময় ভালো নাচত, নাচতে জানে। তার সঙ্গিনী ভালো নাচতে পারেও না, পারতে চায়ও না। তার প্রকাণ্ড দেহটা সোজা হলো, শক্তিশালী হাত দুটো ঝুলে পড়ল, শুধু তার শক্ত সুন্দর মুখকানিই যা নাচে অংশ নিল। কাউন্ট তার মোটা শরীরের সবটা দিয়ে যে ভাব প্রকাশ করছে, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা শুধু তার উদ্ভাসিত মুখ ও কম্পিত নাক দিয়েই সেই ভাব প্রকাশ করছে। কাউন্ট যেমন তার শরীরটাকে পাক খাইয়ে লঘু পদক্ষেপে নাচতে নাচতে দেহভঙ্গির অপ্রত্যাশিত ক্ষিপ্রতা ও নমনীয়তার দ্বারা দর্শকদের মোহিত করছে, তেমনি মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাও শরীরের ঈষৎ ঝাঁকুনিতে, ঘুরবার বা পা ফেলবার সময় কাঁধের ও বাহুর সামান্য মোচড়েই দর্শকদের উপর প্রচুর প্রভাব বিস্তার করত পারল; তার দেহের আকার ও বয়সের কঠোরতার কথা ভেবে সকলেই তার প্রশংসা করল। নাচ ক্রমেই জমে উঠল। অন্য সকলে নিজেদের নাচের কথা ভুলে কাউন্ট ও মারিয়া দিমিত্রিয়েভনাকেই দেখতে লাগল। তবু নাতাশা প্রত্যেকের পোশাক বা আস্তিন টেনে ধরে বলছে, বাপিকে দেখ! নাচের বিরতি হতেই কাউন্ট বাজনাদারদের আরো জোরে বাজাতে বলে। বাজনা দ্রুতর, আরো দ্রুততর হয় : কাউন্ট আরো, আরো, আরো হাল্কাভাবে ঘুরতে থাকে, মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার চারদিকে উড়তে থাকে, কখনো আঙুলের উপর, কখনো গোড়ালির উপর ভর দিয়ে শেষ পর্যন্ত সঙ্গিনীকে একটা পাক দিয়ে তাকে তার আসনে পৌঁছে দিয়ে কাউন্ট তার শেষ খেলা দেখাল : হাল্কা পাটা পিছনে দিয়ে, ঘাম-ঝরা মাথাটাকে নিচু করে, হেসে, দু-হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল; নাতাশাসহ সমস্ত দর্শকের প্রশস্তি ও উচ্চহাসিতে ঘর ভরে গেল। দুই নাচের সঙ্গী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল; ঘন গন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল; কেম্বিকের রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে লাগল।

কাউন্ট বলল, আমাদের কালে এই রকমই আমরা নাচতাম প্রিয় বন্ধবী।

আস্তিন গুটিয়ে জোর নিঃশ্বাস ফেলে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা বলল, একেই তো বলে ডানিয়েল কুপার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *