রক্তপাঞ্জা

রক্তপাঞ্জা

অদ্ভুত একটা ফোন পেলেন ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবে প্রাতরাশ শেষ করেছেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝন শব্দে–

–হ্যালো? কে?

আমি লালবাজার থেকে কথা বলছি, ডেপুটি কমিশনার ডি. ডি. নর্থ সেকশন।

–ও, আপনি স্যার! হঠাৎ এত ভোরে কী আবার হল?

–বাগবাজারে মল্লিক স্ট্রিটের তেরো নম্বর বাড়িতে নাকি এক ভদ্রলোককে ছোরা মেরে খুন করা হয়েছে আর বিষয়টির তদন্ত ভার আমরা দিতে চাই আপনার উপর। আশা করি কৃতকার্য হবেন এক্ষেত্রে। উইস ইউ গুড লাক–

সুন্দরবাবু হেসে বললেন–ধন্যবাদ স্যার।

তাড়াতাড়ি পোশাক পরে তিনি যখন তদন্তে বেরিয়ে গেলেন তখন সাড়ে আটটা।

পরদিন বেলা নটা।

বিখ্যাত ডিটেকটিভ জয়ন্ত তার প্রাত্যহিক খবরের কাগজ পড়া শেষ করে মুখ তুলল। একটু আগে চা এবং খাবার খেয়ে শরীরটাও বেশ একটু চাঙ্গা। এখন হাতে কোনও কাজ নেই, চুপচাপ বসে থাকতে তার কোনওদিনই ভালো লাগে না।

ঘরে সশব্দে প্রবেশ করলেন ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু। ঘরে পা দিয়েই হন্তদন্ত হয়ে বলতে শুরু করলেন–আরে জয়ন্ত, তুমি এখনও চুপচাপ বসে!

জয়ন্ত হেসে বলল–তাছাড়া আর উপায় কী বলুন? কাজ নেই, আপনারাও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। আমি আর কী করব বলুন। চুপ করে বসে থাকতে কি আর ভালো লাগে! কিছু কাজকর্ম না থাকলে বনের মোষ তাড়িয়ে তো আর বেড়াতে পারি না!

সুন্দরবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন কী বলছ কাজ নেই! জানো পরশু রাতে বাগবাজারের তেরো নম্বর মল্লিক স্ট্রিটে একজন লোক রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছেন। পেছন থেকে ছোরা মেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন কোনও চিহ্নই পাওয়া যায়নি যাতে কাউকে সন্দেহ করা যায় অথবা কোনও সূত্র মিলতে পারে।

জয়ন্ত হেসে বলল–তার মানে সংক্ষেপে এই বোঝায় যে, আপনারা একেবারে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন।

সুন্দরবাবু বললেন–তা ছাড়া উপায়ই বা কী এ ক্ষেত্রে? অথচ ডেপুটি কমিশনার আমার উপরই ভরসা করে এ-কেসটির ভার অর্পণ করেছেন। কিন্তু আমি তো প্রায় বোকা বনে গেছি!

জয়ন্ত হেসে বললে–ও, বোকা বনে গেছেন বলেই শেষ পর্যন্ত ভাঙা কুলো অর্থাৎ আমার কাছে ছুটে এসেছেন?

সুন্দরবাবু ঠাট্টাটা গায়ে মেখে বললেন–বেশ, তাই না হয় স্বীকার করছি। একথা বলতে আমার লজ্জা নাই যে, এসব ক্ষেত্রে তোমার মাথা আমাদের চেয়ে অনেকটা পরিষ্কার।

জয়ন্ত বললে– বেশ, আমার উপরেই যখন ভার দিচ্ছেন তখন কয়েকটা প্রশ্ন করছি, উত্তর দিন দেখি।

সুন্দরবাবু বললেন–বেশ, বলো।

জয়ন্ত প্রশ্ন করলে–প্রথম কথা, পেছন থেকে যখন ছোরা মারা হয়েছে বলছেন, তখন এটা নিশ্চয়ই খুনের কেস? কিন্তু এ ছাড়া আর কি কোনও সুত্রই আশেপাশে দেখেননি?

সুন্দরবাবু বললেন, একটা কথা ভুলে গিয়েছিলাম। একটা চিহ্ন পাওয়া গেছে। সেটা আর কিছুই নয়, দালানের গায়ে একটা রক্তাক্ত পাঞ্জার ছাপ। পুরোনো পাপীদের হাতের যে ছাপ লালবাজারে আছে তার সাথে মিলিয়ে দেখা গেছে যে এ কোনও পুরোনো পাপীই নয়। এটাই এই খুনির প্রথম খুন, এবং দালানের গায়ে হাতের ছাপ দিয়েই সে তার বিজয়-বার্তা ঘোষণা করে গেছে।

জয়ন্ত একটু চিন্তা করে বললে–আমার মনে হয় কেউ হয়তো লোকটির ওপরে পুরোনো কোনও প্রতিহিংসা পোষণ করত! তাই এভাবে হত্যা করে দালানের গায়ে রক্তাক্ত হাতের ছাপ রেখে সে যে সেটাই চরিতার্থ করল তা প্রমাণ করতে চায়।

তারপর একটু থেমে বলল–কোনও হাতের ছাপ পেয়েছেন দালানের গায়ে?

সুন্দরবাবু বললেন–বাঁ-হাতের।

জয়ন্ত প্রশ্ন করল–আচ্ছা, পেছন থেকে ছোরা মারা হয়েছে কোনদিকে? নিহত লোকটির পিঠের বাঁ-পাশে না ডান পাশে?

সুন্দরবাবু একটু চিন্তা করে বললেন–ছোরা মারা হয়েছে লোকটির বাঁ-পাঁজরে।

জয়ন্ত বলল, লোকটি বাঁ-হাতের সাহায্যেই ছোরা মেরেছে দেখছি, সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, খুনি বাঁ-হাত ব্যবহার করে বেশি। অর্থাৎ খুনি লেফট হ্যানডেড…

তারপর একটু থেমে প্রশ্ন করল–আচ্ছা, ছোরার আঘাত ছাড়া আর কোনও আঘাত দেখতে পেয়েছেন কি?

সুন্দরবাবু বললেন–না, একটি ছোরার আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে।

জয়ন্ত প্রশ্ন করল–আচ্ছা, নিহত লোকটির শরীর কি বেশ হৃষ্টপুষ্ট?

সুন্দরবাবু বললেন হ্যাঁ নিহত লোকটির দেহে যে যথেষ্ট শক্তি ছিল তা তাকে দেখলেই বুঝতে পারা যায়।

জয়ন্ত বললে–বেশ, তাহলে এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, এমন একজন শক্তিশালী লোককে যে একটি মাত্র ছোরার আঘাতেই খুন করতে পারে তার নিজের দেহেও শক্তি কম নেই। অর্থাৎ সংক্ষেপে খুনি যথেষ্ট শক্তিশালী। কী বলেন?

সুন্দরবাবু বললেন হ্যাঁ, তা বটে!

জয়ন্ত প্রশ্ন করল–আচ্ছা, মেঝে থেকে রক্তমাখা হাতের ছাপ কতটা ওপরে তা কি বলতে পারেন?

সুন্দরবাবু বললেন না, তা মেপে দেখিনি। কিন্তু ছাপের উচ্চতার কী প্রয়োজন?

 জয়ন্ত বলল–দেখুন, কোনও লোক খুন করে ছাপ মেরে যখন পলায়ন করে তখন ঠিক হাতের সামনেই তাড়াতাড়ি ছাপ মারে। ইচ্ছা করে অনেক উঁচুতে কিংবা অনেক নীচুতে মারবার মতো অবকাশ তার থাকে না।

সুন্দরবাবু বললেন, হ্যাঁ, তা বটে।

জয়ন্ত বলল–তার থেকে অনুমান করা যায় খুনির দেহের দৈর্ঘ্য। অবশ্য পাঞ্জার ছাপটা যে কয় ইঞ্চি লম্বা তাও জানা প্রয়োজন।

সুন্দরবাবু বললেন–আচ্ছা, ফোনে তোমায় আমি জানাব।

সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে জয়ন্ত সুন্দরবাবুর কাছ থেকে ফোনে জানতে পারল যে, মেঝে থেকে ছয় ফিট কয়েক ইঞ্চি ওপরে খুনির হাতের ছাপ পাওয়া গেছে এবং ছাপটির দৈর্ঘ্য প্রায় আট ইঞ্চি।

জয়ন্ত হাসতে-হাসতে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলল, দেখছি খুনির দৈর্ঘ্য প্রায় ছফুটের কাছাকাছি হবে।

আপনমনেই সে গভীর চিন্তার মাঝে তলিয়ে যায়।

.

তিনদিন পর।

খুব ভোরে জয়ন্তের ঘুম ভাঙল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। তাড়াতাড়ি ধড়মড় করে উঠে গিয়ে সে দরজা খুলে দিল। দেখা গেল ইনস্পেকটর সুন্দরবাবুকে।

আশ্চর্য হয়ে সে প্রশ্ন করল–এত ভোরে যে আপনার আগমন সুন্দরবাবু! রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে মনে হচ্ছে।

সুন্দরবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–আর বলো কেন ভায়া? এক মুহূর্তও কি আর শান্তিতে থাকবার যো আছে। কাল বরানগরে আলমবাজারের কাছে আর একজন লোককে ছোরা মেরে। খুন করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রেও দালানের গায়ে পাওয়া গেছে রক্তমাখা হাতের ছাপ।

জয়ন্ত প্রশ্ন করল–এবারে মেঝে থেকে কত ফুট ওপরে ছাপ পেয়েছেন, এবং ছাপটি কত ইঞ্চি লম্বা?

সুন্দরবাবু বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, সেইজন্যেই তো আমি এসেছি ভায়া। এবারে সমস্ত মাপ-জোপ করে তৈরি হয়েই এসেছি। এবারেও ঠিক বাঁ-হাতে ছোরা মেরে খুন এবং এবারেও মেঝে থেকে প্রায় ছফিট ওপরে আট ইঞ্চি লম্বা অবিকল পূর্বের মতো হাতের ছাপ। তাই তো ভায়া তোমায় আমার এত সুনজরে পড়ে গেছে। এখন উপায় একটা করো দেখি।

জয়ন্ত হেসে বলল–না, আর চুপ করে বসে থাকলে আরও দু-একজনের ওপরে লোকটি প্রতিহিংসা নিতে পারে! সুতরাং কালই সন্ধ্যায় আমি খুনিকে গ্রেপ্তার করব সুন্দরবাবু। কিন্তু আপনার সাহায্যের যে আমার একান্ত প্রয়োজন।

সুন্দরবাবু বললেন কি সাহায্য?

জয়ন্ত বলল–আচ্ছা, নিহত প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তির মধ্যে কোনও আত্মীয়তা কিংবা অন্য কোনও সম্পর্ক ছিল কি?

সুন্দরবাবু বললেন–মোটেই নয়। বিষয়-সম্পত্তির লোভে যে খুনি এ কাজ করেনি, তা নিশ্চিন্ত। কারণ দুজনের মধ্যে কোনও সম্পর্কই ছিল না। সুতরাং দুজনকেই হত্যা করবে এমন আত্মীয় আসবে কোথা হতে! তা ছাড়া ওঁরা দুজনেই যদিও নেহাত গরিব নন তবুও এমন প্রচুর অর্থ ওদের ছিল না যার জন্যে কোনও আত্মীয়ের এত বড় লোভ হতে পারে!

জয়ন্ত বলল–বেশ, প্রথম ব্যক্তির কোনও নিকট আত্মীয় আছেন কি?

সুন্দরবাবু বললেন–হ্যাঁ, তার ভাইপো মণিবাবু আছেন।

জয়ন্ত বলল–ওতেই চলবে। এখন একটা কাজ করুন দেখি। প্রথম যে ব্যক্তি খুন হয়েছে তার অতি পরিচিত, অল্প পরিচিত, এমনকী সামান্যতম পরিচিত এ-রকম যতগুলি লোক আছে তাদের সকলের নাম জেনে নিয়ে একটা তালিকা প্রস্তুত করুন। আর দ্বিতীয় যে ব্যক্তিকে খুন করা হয়েছে তারও ঠিক এমনি একটা তালিকা প্রস্তুত করুন। তারপর দেখুন, এই দুই নিহত ব্যক্তিকেই চেনে, অর্থাৎ দুজনেরই পরিচিত এরূপ কজন ব্যক্তি আছে এবং তাদের মধ্যে কে কে লম্বা ও শক্তিশালী–তাদের নামের লিস্টটা আমায় দিন।

সুন্দরবাবু বললে–খাসা বুদ্ধি বটে তোমায় জয়ন্ত। তুমি কি ঘটনাস্থলে না গিয়ে শুধু ঘরে বসেই সব কাজ সারতে চাও?

জয়ন্ত হেসে বলল হ্যাঁ। ঘরে বসেই আমি খুনিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব সুন্দরবাবু। যা আপনারা খুনের ব্যাপারে তদন্ত করেও পারেননি।

.

সন্ধ্যাবেলা জয়ন্তের ঘরে আবার সুন্দরবাবুকে দেখা গেল। হাতে তাঁর বিরাট দুটি নামের তালিকা। জয়ন্তকে দেখে হেসে বললেন–দেখো জয়ন্ত, প্রথম এবং দ্বিতীয় নিহত ব্যক্তির আত্মীয়, পরিচিত এমনকী একবারও যে তাঁদের সাথে আলাপ করেছে তাদের আমি একটি তালিকা প্রস্তুত করেছি। কিন্তু দুজনকেই চেনে এমন লোক মাত্র এই পাঁচজন। তার মধ্যে আবার ছফুট লম্বা শক্তিশালী ব্যক্তি এই তিনজন। এদের নাম আমি লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছি।

জয়ন্ত প্রশ্ন করল–অপর দুজন?

সুন্দরবাবু হেসে বললেন–ওরা নেহাত বেঁটে আর রোগা। সুতরাং ওদের দ্বারা যে। এ হত্যা সম্ভব হয়নি তা নিশ্চিত সত্য।

জয়ন্ত বলল–ঠিক। এখন এই তিনজনের নাম ও পরিচয় আমি জানতে চাই।

সুন্দরবাবু বললেন–মোটামুটি যা জানা আছে দেখ। প্রথমজন, একজন রেসের বুকি। নাম তার অমর সিং। দ্বিতীয়জন, চক্রধরপুরের জমিদার রামতারণ বোস আর তৃতীয় ব্যক্তি একজন শাস্ত্রপণ্ডিত জ্যোতিষী, যিনি ওদের দুজনকেই শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। তাঁর নাম রামদেও শর্মা! লোকটির আসল বাড়ি বিহার, তবে বাংলায় বেশ কথা বলতে পারে।

জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ওঁরা দুজনেই কি ছিলেন শক্তিমন্ত্রের উপাসক?

সুন্দরবাবু শুধু বললেন হুঁ।

জয়ন্ত বলল–এবার তাহলে খুনিকে ধরবার ব্যবস্থা করি, কী বলেন?

 সুন্দরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন কিন্তু তুমি কী করে জানবে যে আসল খুনি কে?

জয়ন্ত হেসে বলল–দেখুন, আসল খুনি ধরা পড়ে দোষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হবে…

.

জয়ন্তের বাড়িতে বসেছে একটা চায়ের বৈঠক। উপস্থিত আছেন জয়ন্ত, মানিক, সুন্দরবাবু, দুজন ছদ্মবেশী পুলিশ-ইনস্পেকটর আর ওরা তিনজন–অমর সিং, চক্রধরপুরের জমিদার রামতারণ বোস এবং জ্যোতিষী রামদেও শর্মা।

চায়ের বৈঠকে সাধারণ নানা আলোচনা চলছিল। হঠাৎ সুন্দরবাবু বলে উঠলেন– অমরবাবু, জয়ন্তবাবু পাশের ঘরে আপনার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চান। আপনার অসুবিধা হবে না তো?

অমরবাবু হেসে বললেন–না না, অসুবিধা আর কী?

জয়ন্ত অমরবাবুর সাথে পাশের আধো-অন্ধকার ঘরটিতে প্রবেশ করল।

অমরবাবু ঘরের মধ্যে পা দিয়েই চমকে উঠলেন। আধো-অন্ধকার ঘরের এক কোণে ঠিক যেন নিহত ব্যক্তি দুজন দাঁড়িয়ে আছে বাঁ-পাঁজরে ছোরা বেঁধানো, রক্তে দেহ ভেসে যাচ্ছে, মুখে আতঙ্কের চিহ্ন…

জয়ন্তের দিকে চেয়ে অমরবাবু প্রশ্ন করলেন–এটা কী জয়ন্তবাবু?

জয়ন্ত হেসে বলল, ও কিছু না, শুধু আমার একটা খেয়াল মাত্র।

তার মানে?

–মনে করছি এবার থেকে নিহত ব্যক্তিদের একটা করে মোমের পুতুল তৈরি করে আমার এই ঘরটায় সাজাব একে-একে।

অমরবাবু হেসে বললেন, আচ্ছা অদ্ভুত খেয়াল তো মশাই আপনার!

জয়ন্ত হেসে বলল–হ্যাঁ। ডিটেকটিভদের মাঝে-মাঝে এরকম অদ্ভুত খেয়াল হয়ে থাকে বটে। তবে এরও নিশ্চয় কোনও অর্থ আছে!

দু-একটা কথাবার্তার পর জয়ন্ত তাকে বিদায় দিয়ে ডেকে পাঠালে জ্যোতিষী রামদেও শর্মাকে। রামদেও নিশ্চিন্ত মনে ঘরে প্রবেশ করছিল। হঠাৎ একসময় নিজের অজ্ঞাতেই তার চোখ দুটো গিয়ে ঠিকরে পড়লে ঘরে এককোণে রক্ষিত মূর্তিদুটির ওপরে। তার যেন মনে হল নিহত ব্যক্তি দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। কে যেন মুহূর্তে শুষে নিল তার মুখের সব রক্তটুকু। একটা অস্ফুট শব্দ করেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।

সবাই ছুটে এল। চারিদিকে বেধে গেল হইহুল্লোড়।

সুন্দরবাবুও ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার দিকে চেয়ে জয়ন্ত বললে–এই নিন সুন্দরবাবু আপনার খুনি। একে এক্ষুনি গ্রেপ্তার করুন।

.

জ্ঞান ফিরে পাবার পর জয়ন্ত তার দিকে চেয়ে হেসে প্রশ্ন করল–আপনার অপরাধ আমরা জানতে পেরেছি, সুতরাং এবারে দোষ স্বীকার করুন, তাহলে শাস্তির পরিমাণ কম হতে পারে।

জ্যোতিষী রামদেও শর্মা দোষ স্বীকার করল।

 জয়ন্তের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সংক্ষেপে জানালেন তার হত্যার কারণ।

.

রামদেও শর্মা যে কাহিনি বলল তা অতি রহস্যজনক। রামদেও আসলে খুব বড় জ্যোতিষী ছিল না। জ্যোতিষী সেজে কেবল লোকের মনের খবর বের করে নিত। তারপর অন্য একজন লোকের নাম দিয়ে চিঠি লিখে জানাত তাকে প্রচুর টাকা না দিলে সে সব রহস্য ফাঁস করে দেবে। আসলে সে ছিল একজন ব্ল্যাকমেলার। পুলিশ কিন্তু তার ওপরে কোনওদিন সন্দেহই করেনি।

নিহত ব্যক্তি দুজন এবং আরও চার-পাঁচজন লোককে সে ব্ল্যাকমেল করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই পরে টাকা দিতে অস্বীকার করে। নিহত ব্যক্তি দুজনও তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও ওরা দুজনেই তাকে ভক্তি করত এবং তার কাছেই শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল, কিন্তু পরে তারা বেঁকে বসে, যখন তার আসল রূপ ওদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে।

ওদের মতো আরও অনেকে রামদেও শর্মার কবল থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে এবং চক্রধরপুরের জমিদার রামরতন বোসও তাদের মধ্যে অন্যতম।

কোনও উপায় না পেয়ে রামদেও শর্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তার মক্কেলদের ভয় দেখাবার জন্যেই পরপর দুটি খুন করে এবং ঘরে রক্ত-পাঞ্জার ছাপ এঁকে রেখে যায়।

পরিশেষে রামদেও শর্মা স্বীকার করল যে, সত্যি জয়ন্তবাবুর মতো সুযোগ্য গোয়েন্দা এ ব্যাপারে হাত না দিলে কেউ তাকে সন্দেহও করতে পারত না।

ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু সবার শেষে বললেন সত্যি জয়ন্ত, অদ্ভুত তোমার ক্ষমতা। ঘরে বসেই তুমি খুনিকে আবিষ্কার করলে! জয়ন্ত হেসে বললে–সে তো আপনাদেরই সাহায্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *