ভেনাস ছোরার রহস্য

ভেনাস ছোরার রহস্য

বৈঠকখানা। দুজনে চা পান করছিলেন। কমিশনার ডিটেকটিভ ইনস্পেকটর সুন্দরবাবুর সঙ্গে গোয়েন্দা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ধরণীধর রায়চৌধুরী। ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছে বসন্তকালের বৈকালী রোদ।

হঠাৎ দ্বারপথে দুই মূর্তিকে দেখে সুন্দরবাবু উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, হু, জয়ন্ত আর মানিক যে! বঁধুয়া অসময়ে কেন হে প্রকাশ?

মানিক বললে, অসময় মানে? চায়ের সময়ই তো ঠিক সময়। পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম। আচম্বিতে দ্বারপথ দিয়ে আপনার তৈলমার্জিত সমুজ্জ্বল টাক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আর অমনি আমাদের পদচালনা হল অবরুদ্ধ। তারপর

পাছে সে ফস করে কোনও বেতালা কথা বলে ফেলে সেই ভয়ে সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, থাক, আর ব্যাখ্যান করতে বলতে হবে না! এগিয়ে এস, বসে পড়ো। (ভৃত্যের উদ্দেশে সচিৎকারে)–ওরে, আর দু-পেয়ালা চা! (গলা নামিয়ে) জয়ন্ত, সুবিখ্যাত অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ধরণীধর রায়চৌধুরীর সঙ্গে বোধহয় তোমাদের আলাপ-পরিচয় নেই? ইনিই তিনি। ধরণীবাবু, এরা হচ্ছে জয়ন্ত আর মানিক। আমার মুখে এদের নাম শুনেছেন বোধহয়।

ধরণী আগে দুই বন্ধুর আপাদমস্তকের ওপরে চোরধরা দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। তারপর ভারিক্কি চালে বললেন, শুনেছি গোয়েন্দাগিরি নাকি এদের খেয়াল বা শখ!

জয়ন্ত জোড়হাতে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, বিলাসও বলতে পারেন। আপনার মতো নামজাদা পেশাদারের কাছে আমরা হচ্ছি–পর্বতের তুলনায় নুড়ির মতো তুচ্ছাদপি তুচ্ছ!

ধরণী কিঞ্চিৎ খুশি হয়ে বললেন, দেখছি আপনি কথার ম্যাজিকেও কম নন। বসুন। চা খান। কিন্তু গোড়াতেই বলে রাখা উচিত, আজ আমি এখানে সুন্দরবাবুর সঙ্গে একান্তে কিছু পরামর্শ করতে এসেছি।

–একান্তে? অর্থাৎ গোপনে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মানিক বললে, তা হলে সুন্দরবাবু, আজ এখানে আমরা চা না খেলেও পৃথিবী উলটে যাবে না। তোমার কী মত জয়ন্ত?

–হ্যাঁ, আমাদের গাত্রোত্থান করাই উচিত।

সুন্দরবাবু ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, আরে, আরে, তাও কি হয়? চা খেতে আর তোমাদের কতক্ষণ লাগবে? সেটুকু সময়ের মধ্যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!

মানিক মাথা নেড়ে বললে, না মশাই, ঘড়ি ধরে চা খাওয়া আমাদের ধাতস্থ হয় না। চা খাওয়ার মানে কি এক নিঃশ্বাসে চা গলাধঃকরণ করা? ধীরে-সুস্থে কিছু গালগল্প হবে না, দুটো ফস্টিনস্টি করবার ফুরসত পাওয়া যাবে না, তর্কাতর্কির চোটে চায়ের পেয়ালায় তুমুল তরঙ্গ উঠবে না, তবে আর হল কী দাদা! না জেনে কোথায় এসে পড়েছি রে বাবা!

কাঁচুমাচু মুখে উঠে দাঁড়িয়ে সুন্দরবাবু বললেন, না ভাই, তোমরা চা না খেয়ে চলে গেলে আমার দুঃখের সীমা থাকবে না। বোসো। ওই দেখো চা এসে পড়েছে।

ধরণীধর বিরক্তমুখে নির্বাক। সুন্দরবাবুর নির্বন্ধ এড়াতে না পেরে অগত্যা জয়ন্ত ও মানিক হাত বাড়িয়ে চায়ের পাত্র গ্রহণ করলে।

সুন্দরবাবু বললেন, জয়ন্ত, ব্যাপার কী জানো ভায়া? একটা অদ্ভুত মামলা হাতে নিয়ে আমরা মস্ত সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।

অদ্ভুত মামলা?

রীতিমতো। আসামিকে আবিষ্কার করেছি, অকাট্য সব প্রমাণ পেয়েছি, কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছি না।

জয়ন্ত বললে, মামলাটার কিছু আঁচ পেলে আপনাদের সঙ্গে আমরাও না হয় খানিকটা মাথা ঘামাবার চেষ্টা করতুম।

দস্তুরমতো অসন্তুষ্ট কণ্ঠে ধরণী বলে উঠলেন, কে মশাইদের মাথা ঘামাতে বলছে? পেশাদার পুলিশ শখের গোয়েন্দার সাহায্য অনাবশ্যক মনে করে। আমরা যেখানে হাবুডুবু খাই আপনারা সেখানে তলিয়ে যাবেন।

জয়ন্ত বললে, অবশ্য, অবশ্য।

মানিক মাথা নেড়ে বললে, উঁহু!

ধরণী কুপিত কণ্ঠে বললেন, উঁহু মানে?

–জয়ন্ত সাঁতার জানে, তলিয়ে না যেতেও পারে।

কবজি ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে ধরণী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তা হলে আপনারা সমস্যাসাগরে সাঁতার কাটুন আপাতত, আমার আর সময় নেই–অফিসে জরুরি কাজ আছে। সুন্দরবাবু, আধঘণ্টা পরেই যেন আপনার দেখা পাই।

–যে আজ্ঞে।

 জয়ন্ত বললে, ভদ্রলোক রাগে ফুলতে-ফুলতে চলে গেলেন।

হো-হো করে হেসে উঠে সুন্দরবাবু বললেন, হুম। ধরণীবাবু শখের গোয়েন্দার নাম শুনলেই খেপে যান। তাঁর মতে, পয়লা নম্বরের ধাপ্পাবাজরাই শখের গোয়েন্দা বলে আত্মপরিচয় দেয়।

জয়ন্ত গম্ভীরভাবে বললে, এখন আপনার অদ্ভুত মামলার কথা বলুন।

সুন্দরবাবু বললেন, ফলাও করে বলবার সময় নেই, ছুটি পেয়েছি আধঘণ্টা মাত্র। সংক্ষেপে বলব।সদানন্দবাবু মস্ত ধনী–মোটা ব্যাঙ্কের খাতা আর স্থাবর সম্পত্তির মালিক। তার স্ত্রী স্বর্গে, পুত্রসন্তান নেই, মা তার একমাত্র কন্যা। সে একাধারে রূপবতী আর গুণবতী– সসম্মানে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

হাতে অঢেল টাকা থাকলে অনেকের অনেক রকম শখ বা নেশা বা খেয়াল হয়। সদানন্দবাবুর শখ ছিল দেশভ্রমণ। তিনি ভারতের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ কোথাও টহল দিতে বাকি রাখেননি। তারপর যান ইউরোপে। তারপর আমেরিকায়। সেখানে গিয়ে তিনি এক নতুন বন্ধু লাভ করেন–যামিনীকান্ত। তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে সে-ও দেশে ফিরে আসে আর প্রতিদিনই দুজনে মিলে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা বা তাস-দাবা-পাশা খেলা চলে। ধনী না হলেও বাপের দৌলতে তাকেও চাকরি করে খেতে হয় না।

সদানন্দবাবুর বয়স ষাট আর যামিনীর পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু তাঁদের ঘনিষ্ঠতা বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। দুই বৎসরের মধ্যে তাঁদের বন্ধুত্বের ভিত এমন পাকা হয়ে উঠেছিল যে, যামিনীকে না পেলে সদানন্দবাবুর অবসর-মুহূর্তগুলো অচল হয়ে পড়ত চাকা-ভাঙা গাড়ির মতোই।

সদানন্দবাবুর প্রকৃতির ওপরে পাশ্চাত্য প্রভাব পড়েছিল যথেষ্ট পরিমাণেই। নিজের একমাত্র সন্তান মাকেও তিনি মানুষ করে তুলেছিলেন সেইভাবেই। সে এমএ পাস দেবার পরেই তাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে তিনি এক বৎসর কাল কাটিয়ে আসেন। তিনি জানতেন, তার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হবে মন্দা, সুতরাং দুনিয়াদারির সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ না হলে তার চলবে না।

সুপটু শিল্পীর হাতে গড়া আলমারিতে সাজিয়ে রাখা মোমের পুতুলের মতো সুন্দরী নয় মন্দ্রা–তার আশ্চর্য সৌন্দর্য যেন গতিচঞ্চল দেহের ভিতর থেকে উপচে পড়তে চায় প্রাণের প্রাচুর্যে আর জীবনের উচ্ছ্বাসে। তাকে দেখলেই মুগ্ধ হতে হয়। যামিনীও মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। খালি মুগ্ধ নয়, তাকে পাবার জন্যে সে হয়ে উঠল লুব্ধ। বরাবর এড়িয়ে এসেছে যে উদ্বাহবন্ধন, চল্লিশের কোঠা পেরিয়ে সে এখন ধরা দিতে চায় সেই কঠিন বাঁধনেই।

যামিনীর বয়স পঁয়তাল্লিশ বটে, কিন্তু অন্তরে-বাহিরে সে বয়োধর্মকে নিকটবর্তী হতে দেয়নি। তার হাবভাব, চালচলন ও কথাবার্তা সব তরুণের মতো, এমনকী চেহারা দেখলেও তার বয়স পঁয়ত্রিশ বৎসরের বেশি বলে সন্দেহ হয় না। তার এই তারুণ্যই আকৃষ্ট করেছিল সদানন্দবাবুকে এবং সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত মাকেও। অন্তত মা যে যামিনীকে পছন্দ করত এটুকু জানা গিয়েছে এবং তারই ফলে আশান্বিত ও উৎসাহিত হয়ে যামিনী সদানন্দবাবুর কাছে। তার জামাতা হবার বাসনা প্রকাশ করে।

আগেই বলেছি, সদানন্দবাবুর মন ছিল অতি আধুনিক। স্ত্রী-স্বাধীনতায় তাঁর ছিল প্রবল প্রত্যয়। নিজে কোনও মত জাহির করার আগে তিনি কন্যার মত জানতে চাইলেন। অতি আধুনিক কেতাদুরস্ত মা কিন্তু নিতান্ত সেকেলে বঙ্গবালার মতোই বললে, তোমার মতই আমার মত।

এ-বিবাহে সদানন্দবাবুর মত হল না প্রধানত দুটি কারণে : প্রথমত, পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান একুশ বৎসর। দ্বিতীয়ত, ইয়ার বন্ধুর সঙ্গে তিনি জামাতার সম্পর্ক স্থাপন করতে একান্ত নারাজ।

এই মতের অমিলে কিন্তু মনের অমিল হল না, বজায় রইল বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই। ব্যাপারটা যামিনী গ্রহণ করলে পয়লা নম্বরের দার্শনিকের মতো খুব সহজভাবেই। সদানন্দবাবু বাজারে মন্দ্রার যোগ্য পাত্র অন্বেষণ করতে লাগলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পাত্র আবিষ্কার করবার আগেই ইহলোক থেকে তাঁকে বিদায়গ্রহণ করতে হয়েছে।

গেল হপ্তার আঠারো তারিখে সদানন্দবাবুর মৃত্যু হয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, তিনি মারা পড়েছেন আততায়ীর অস্ত্রাঘাতে।

অস্ত্র একখানা ছোরা। অদ্ভুত ছোরা। ধরণীবাবুর মুখে শুনলুম, এরকম ছোরা এখনও বাজারে আসেনি। ছোরার একদিকে খুব ধারালো ফলা আর একদিকে গ্রিসের সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের নগ্ন মূর্তি। এই মূর্তিটাই হচ্ছে ছোরার হাতল। তা জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট-এর ছোরা নামে বিখ্যাত। আমেরিকায় বাজারেও তার চাহিদা যথেষ্ট। শিকারিরাই এই ছোরা ব্যবহার করে। সদানন্দবাবুর বুকের ওপরে ছোরাখানা বিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।

হত্যাকাল হচ্ছে রাত্রি সাড়ে নয়টা। ঘটনাস্থল হচ্ছে সদানন্দবাবুর শয়নগৃহ। কেবল খুন নয়, সদানন্দবাবুর আলমারির ভিতর থেকে নগদ পাঁচ হাজার টাকার নোটের তাড়া আর পনেরো হাজার টাকার জড়োয়া গয়নাও অদৃশ্য হয়েছে।

বাবার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে মন্দ্রা তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এসে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোতে স্পষ্ট দেখতে পায়, সদানন্দবাবুর শয়নগৃহ থেকে বেরিয়ে যামিনী দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। মা বারবার যামিনীবাবু বলে ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়া পায়নি।

একতলায় নিজের ঘর থেকে সদানন্দবাবুর ম্যানেজার হরিবাবুও স্বচক্ষে যামিনীকে বেগে রাস্তার দিকে ছুটে যেতে দেখেছেন।

মন্দ্রার মুখ থেকে আরও জানা গেছে, ব্ল্যাক ফরেস্ট-এর ওই ছোরাখানার অধিকারী হচ্ছে যামিনীই। আমেরিকায় মার সামনেই সে ছোরাখানা কিনেছিল।

সব শুনে আমাদের দৃঢ় ধারণা হল, খুনি যামিনী ছাড়া আর কেউ নয়। পাছে চম্পট দেয়, সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি তাকে গ্রেপ্তার করে ফেললুম। কিন্তু তার পরেই আমাদের চিত্ত বিভ্রম হবার উপক্রম। হুম, এ কী উদ্ভট মামলা!

হা হা করে হেসে উঠে যামিনী ধরণীকে বললে, খুলে দিন মশাই, খুলে দিন আমার নরম হাতে এই শক্ত লোহার বেড়ি সহ্য হবে না। আপনারাও হবেন অপদস্থ আর বিপদগ্রস্ত।

ধরণী চোখ রাঙিয়ে বললেন, চোপরাও ছুঁচো, শুয়োর! খুন করে আবার লম্বা-লম্বা বুলি কপচানো হচ্ছে? ঘুসি মেরে মুখ ভেঙে দেব জানিস?

–আমি খুন করেছি! প্রমাণ?

–মন্দ্রাদেবী আর তার ম্যানেজারবাবু স্বচক্ষে তোকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন।

–ওরা ভুল দেখেছে।

–এই ভেনাস-ছোরাখানা কার?

–আমার বলেই তো মনে হচ্ছে। আমেরিকায় কিনেছিলুম। কিন্তু ওখানা আজ ছ-মাস আগে আমার ঘর থেকে চুরি গিয়েছে। খবর নিয়ে দেখবেন যথাসময়ে থানায় ডায়েরি লেখানো হয়েছে।

বটে? কিন্তু জানিস কি এই ছোরার হাতলের ওপরে আছে খুনির আঙুলের স্পষ্ট ছাপ? ঘটনাস্থলেও পাওয়া গিয়েছে তার রক্তাক্ত হাতের ছাপ? এক জায়গায় নয়, তিন জায়গায়।

হাতের ছাপের নিকুচি করেছে! ফালতু হাতের ছাপ নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই!

–এই হাতের আর আঙুলের ছাপই প্রমাণ করবে খুন করেছিস তুই। পৃথিবীতে দুজন মানুষের হাতের ছাপ একরকম হয় না।

–বহুৎ আচ্ছা, দেখা যাবে। আপাতত আমার অ্যালিবাই নিয়ে মাথা ঘামান দেখি।

কী অ্যালিবাই?

–খুন হয়েছে আঠারো তারিখে। কিন্তু সতেরো থেকে উনিশ তারিখ পর্যন্ত তিনদিন আমি কলকাতাতেই হাজির ছিলুম না।

–কোথায় ছিলি?

 –বর্ধমানে। আমার বিশেষ বন্ধু বিজয়গোপালের বাড়িতে।

–কে বিজয়গোপাল?

–তাকে আপনি খুব চেনেন,–সে হচ্ছে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির একমাত্র ভগ্নিপতি।

ধরণীবাবুর চোখ উঠল চমকে। একটু থতমত খেয়ে তিনি শুধোলেন, বিজয়বাবুর সঙ্গে তোর কী সম্পর্ক?

বললুম তো, বিজয় আমার বিশেষ বন্ধু। তার একমাত্র পুত্রের বিবাহে সে আমাকে সাহায্য করতে ডেকেছিল। গোটা তিনদিন আমাকে কলকাতায় ফিরতে দেয়নি। বিজয়ের কাছে খবর নিলেই জানতে পারবেন। আপনাদের ডেপুটি কমিশনার সাহেবের কাছেও খবর পেতে পারেন কারণ তিনিও ওই তিনদিন ছুটি নিয়ে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত ছিলেন।

ধরণীবাবু আর আমি দুজনেই রীতিমতো মুষড়ে পড়লুম, যদিও মুখে কিছু ভাঙলুম না।

পরে খবরাখবর নিয়ে জানা গেল, যামিনীর কথা মিথ্যা নয়–এ যে ইংরেজিতে যাকে বলে একেবারে লোহা-বাঁধানো অ্যালিবাই, এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করবার উপায় নেই।

ঘটনাস্থলে পাওয়া আঙুল ও হাতের ছাপের সঙ্গেও যামিনীর আঙুল ও হাতের ছাপ একটুও মিলল না।

আমরা যামিনীর চোখা চোখা টিটকারি শুনতে-শুনতে প্রায় অপোবদনে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।

জয়ন্ত, মানিক, তোমরা এমন সৃষ্টিছাড়া মামলার কথা কখনও শুনেছ?

জয়ন্ত জবাব দিলে না, দুই চক্ষু মুদে কী ভাবতে লাগল!

মানিক বললে, হুঁ, প্রথম দৃষ্টিতে সবদিক দিয়েই সন্দেহ ধাবমান হয় বটে যামিনীরই দিকে। প্রায় প্রতিদিন যারা তাকে দেখে এমন দুইজন স্বচক্ষে দেখলে পলায়মান যামিনীকে, তার কেনা ভেনাস-ছোরা পাওয়া গেল হত ব্যক্তির বক্ষে বিদ্ধ অবস্থায়; তার ওপরে জামাতারূপে তাকে গ্রহণ করতে নারাজ হওয়ার দরুণ সদানন্দবাবু নিশ্চয়ই তার বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আচ্ছা সুন্দরবাবু, আপনি কি ঠিক জানেন, মন্দ্রা মনে-মনে যামিনীকে পছন্দ করত?

–লোকের মুখে তাই তো শুনেছি।

–তাহলে তো সহজেই যামিনীর বিশ্বাস হতে পারে, সদানন্দবাবুকে মাঝখান থেকে সরিয়ে দিলেই মা আর তার বিপুল সম্পত্তি নিশ্চয়ই সে অধিকার করতে পারবে।

–এ সব আমরাও ভেবে দেখেছি। কিন্তু খালি ভেবে-চিন্তে কী হবে ভায়া? পুলিশের চাই প্রমাণের মতো প্রমাণ।

আর একটা কথা। আপনাদের জামাই-আদর থেকে ছাড়ান পাবার পর যামিনী কি আবার মন্দ্রার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেনি?

করেনি আবার, খুব চেষ্টা করেছে। তাকে যে ভুল দেখা আর বোঝা হয়েছে, সেটা সবিস্তারে জানিয়ে যামিনী প্রথমে মাকে একখানা পত্র লেখে। কিন্তু মন্দার তরফ থেকে কোনও জবাব না পেয়ে সে সশরীরে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। মন্দা দেখা না করে লোকমুখে বলে পাঠায় নিজের চোখকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি না। পিতৃহন্তার সঙ্গে আমি দেখা করব না। যামিনীকে তাই হাল ছাড়তে হয়েছে।

আচম্বিতে জয়ন্ত চোখ চেয়ে বললে, ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র! এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির ষড়যন্ত্র আছে।

সুন্দরবাবু কৌতূহলী কণ্ঠে বললেন, কেমন করে বুঝলে?

 জয়ন্ত বললে, আমার বোঝাবুঝির মূল্য কতটুকু?

ধরণীবাবু বলবেন, কড়াক্রান্তিও নয়!

সুন্দরবাবু হেসে বললেন, কিন্তু আমি তো ধরণীবাবু নই।

জয়ন্ত বললে, তাহলে আপনাকে আমি গোটাকয়েক প্রশ্ন করতে পারি?

–তুমি অগুন্তি প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে ফেললেও আমি একটুও বিরক্ত হব না।

–আমার সর্বপ্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, যামিনীর দেশ কোথায়?

মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জে। কিন্তু আজ বিশ বৎসর আগে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে যামিনী দেশের সঙ্গে যা কিছু সম্পর্ক তুলে দিয়ে চলে আসে, তারপর নানাস্থানী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। জিয়াগঞ্জের কোনও লোকই তার কথা বিশেষ কিছুই জানে না। ভাসা-ভাসা কেবল শোনা যায়, কামিনীকান্ত নামে যামিনীর আর এক ছোটভাই ছিল, সে নাকি ক্রিমিন্যাল। ওয়ারেন্টে ধরা পড়বার ভয়ে আজ পনেরো বৎসর ধরে কোথায় কোন দেশে নিরুদ্দেশ হয়ে আছে, যামিনীও তার খোঁজখবর পায় না। সে বলে, তার ভাই নিশ্চয়ই বেঁচে নেই।

আমার পরের প্রশ্ন হচ্ছে : সদানন্দবাবুর সঙ্গে আমেরিকা থেকে ফিরে এসে যামিনী কোথায় বাসা বেঁধেছিল?

–আপার সারকুলার রোডের একখানা ছোট বাড়িতে। তার এক পুরোনো বন্ধু শ্যামাকান্তের সঙ্গে সেই বাড়িতেই বাস করত যামিনী।

বন্ধুটিকে দেখেছেন?

–দৈবগতিকে দেখেছি। মাস-পাঁচেক আগে ও পাড়ার একটা বড় চুরির মামলায় পুলিশের পক্ষে সে সাক্ষ্য দিতে আসে। মুখময় দাড়ি গোঁফের ঝোপ-ঝাঁপ, মাথায় কাঁধ পর্যন্ত ঝুলে পড়া এলোমেলো চুলের জঙ্গল, চোখে মোটা কাচের কালো চশমাদস্তুরমতো বন্য চেহারা। পরনে গেরুয়া কাপড়-জামা, বিবাহ করেনি। সংসারের ধরাবাঁধার ধার ধারে না–ধর্মালোচনায় আর তীর্থভ্রমণেই তার দিন কাটে হুম, দুনিয়ায় কতরকম জীবই যে আছে, আমরা যেদিন বোকা বনবার জন্যে যামিনীকে গ্রেপ্তার করতে যাই, সেদিনও সে বাড়িতে ছিল না, শুনলুম তীর্থভ্রমণে গিয়েছে।

হঠাৎ গাত্রোত্থান করে জয়ন্ত বললে, ভো সুন্দরবাবু! আমাদের পানে তাকিয়ে এইবার বলুন–জাগো এবং ভাগো!

সুন্দরবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, হুম, তোমার কথার অর্থ?

–আরে মশাই, আপনি ছুটি পেয়েছিলেন মাত্র আধঘণ্টাকাল। এতক্ষণে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। চলো মানিক, আমরা পালাইনইলে সুন্দরবাবুর কর্তব্যপালনে ত্রুটি হবে। আবার যথাসময়ে দেখা করব, নমস্কার!

সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

.

এক হপ্তা পরে। টেবিলের দুই প্রান্তে বিমর্ষের মতো উপবিষ্ট ধরণীধর ও সুন্দরবাবু। মাঝে-মাঝে চায়ের পেয়ালায় এক-একটা চুমুক দিচ্ছিলেন বটে, কিন্তু কেউ যেন চায়ের স্বাদ পাচ্ছিলেন না।

এমন সময়ে দ্বারপথে আবার জয়ন্ত ও মানিকের আবির্ভাব।

ধরণী চোখ তুলে একবার তাদের দেখলেন, তারপরেই বিরক্তভাবে মুখ ফিরিয়ে টেবিলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

সুন্দরবাবু অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন, সেদিন তোমরা অমন অসভ্যের মতো চলে গিয়েছিলে বলে আমি দুঃখিত হয়েছি?

মানিক বললে, দুঃখিত? কেন দুঃখিত হয়েছেন? আমরা কি মামলাটার আনুপূর্বিক বিবরণ অতিশয় মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিনি?

হুম, শুনেছ বটে। কিন্তু পরমুহূর্তেই হাঁ কি না কিছুই না বলে বেগে স্থানত্যাগ করোনি!

ধরণীর মুখের পানে একবার সকৌতুকে অপাঙ্গে তাকিয়ে নিয়ে মানিক বললে, তা ছাড়া আর কী করবার উপায় ছিল সুন্দরবাবু? শ্রদ্ধেয় ধরণীবাবু কি আমাদের স্পষ্টাস্পষ্ট বলে দেননি যে, পেশাদার পুলিশ শখের গোয়েন্দার সাহায্য অনাবশ্যক মনে করে?

ধরণী বললেন, হ্যাঁ, তখনও বলে দিয়েছি, আবার এখনও তাই বলছি–আমার এক কথা!

–নিশ্চয়-নিশ্চয়,ভদ্রলোকের এক কথা। তা আমরা তো মশায়ের কাছে গায়ে পড়ে সাহায্য করবার জন্যে আসিনি, আমরা এসেছি আমাদের প্রিয়বন্ধু সুন্দরবাবুকে একটা খবর দিতে।

সুন্দরবাবু শুধালেন, কী খবর?

 এইবার জয়ন্ত বললে, আমরা গতকল্য জিয়াগঞ্জ থেকে ফিরেছি।

সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললে, তোমরাও জিয়াগঞ্জে গিয়েছিলে? কেন হে? সেখানে তো যামিনীকে কেউ চোখেও দেখেনি।

জয়ন্ত বললে, আরও ভালো করে খুঁজলে আপনারাও দুই-তিনজন এমন বৃদ্ধ ব্যক্তির সন্ধান পেতেন, যারা যামিনী আর কামিনীকে জন্মাতে দেখেছে?

ধরণী তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন,–আরও ভালো করে খোঁজবার কোনওই দরকার ছিল না–আমাদের যেটুকু জানবার তা জেনেছি! যত সব বাজে কথা। পঁয়তাল্লিশ বৎসর আগে যারা জিয়াগঞ্জে যামিনীকে জন্মাতে দেখেছে সেই সব বুড়োর বকুনি শুনে কলকাতায় বসে কোনও খুনের মামলায় ফয়সালা করা যায় না।

–বলতে বাধ্য হলুম আপনার ধারণা ভুল। বুড়োদের মুখে কী খবর পেয়েছি জানেন? যামিনী আর কামিনী যমজ ভাই। তাদের চেহারার মিল এতটা বেশি যে, দুজনকে একই পোশাক পরালে কে যামিনী আর কে কামিনী কেউ ধরতে পারত না। সুন্দরবাবু, এ তথ্যটুকু আপনার কোনও কাজে লাগবে কি?

সুন্দরবাবু প্রথমটা গম্ভীর বদনে চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর সহসা লম্ফত্যাগ করে দাঁড়িয়ে উঠে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, মূল্যবান তথ্য, মূল্যবান তথ্য! খুন করলে কামিনী, লোহার বালা পরল যামিনী! বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি!

না সুন্দবাবু, এখনও বোধহয় ব্যাপারটা আপনি তলিয়ে বুঝতে পারেননি। যা কিছু ঘটেছে, তাবৎ ব্যাপারের মূলে আছে একমাত্র যামিনীরই মস্তিষ্ক। কামিনী করেছে তারই আদেশ পালন। যামিনী জানত, স্বাভাবিকভাবে পুলিশের সন্দেহ তারই ওপরে পড়বে। তাই পুলিশকে সে রীতিমতো নাকাল করতে চেয়েছিল। উপরন্তু প্রায় তারই মতো দেখতে কামিনীকে তার দরকার হয়েছিল, সদানন্দবাবুর বাড়িতে অবাধে প্রবেশ করবার সুবিধা হবে বলে।

কিন্তু কোথায় সেই কামিনী?

–তা আমি জানি না। তবে এক্ষেত্রেও একটা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি। ধর্মপরায়ণ, তীর্থপর্যটক শ্যামাকান্তকে আবিষ্কার করুন। তার মাথাটা দীর্ঘ কেশপাশ থেকে মুক্ত করুন, তার চোখের ওপর থেকে চশমার কালো কাচের আবরণ সরিয়ে ফেলুন, তার মুখ থেকে লম্বা দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দিন, তার গা থেকে গেরুয়া কাপড়-জামা কেড়ে নিন, হয়তো স্বচক্ষে দেখতে পাবেন যামিনীকান্তের যমজ ভাই কামিনীকান্তকে। হয়তো এ হচ্ছে আমার ভ্রান্ত ধারণা, কিন্তু এখানে আমি সঠিক কিছু বলতে পারব না।

সুন্দরবাবু হতাশভাবে বললেন, কিন্তু শ্যামাকান্তও যে খাঁচার বাইরে কোথায় উড্ডীয়মান হয়েছে, কে তার সন্ধান দেবে?

ধরণী গোঁ-ভরে নীরবে সব কথা শুনছিলেন, এতক্ষণ পরে মুখ খুলে বললেন, সুন্দরবাবু, ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমাদের যে-সব সুযোগ-সুবিধা আছে, শখের গোয়েন্দাদের তা নেই। আমি ডাকঘরের সঙ্গে এমন ব্যবস্থা করতে পারি যে, যামিনীর বাড়ির সমস্ত চিঠিপত্র যেন বিলি করবার আগে আমাদের কাছে পাঠানো হয়। জয়ন্তবাবুর সন্দেহ যদি সত্য হয় তবে আজ বা কাল না হোক, দুই কি চার কি ছয় মাসের মধ্যে কোনও না কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।

সুন্দরবাবু বললেন, তোমাদের কী মত জয়ন্ত?

 আমাদের আর কোনও মতামত নেই। এখন তবে আসি। চল মানিক।

.

তিনমাস পরের ঘটনা।

জয়ন্তদের প্রভাতী চায়ের আসর। সুন্দরবাবুর প্রবেশ–পিছনে-পিছনে ধরণীবাবু।

কেউ কিছু বলবার আগেই সুন্দরবাবু বললেন, জয়ন্ত আজ তোমাদের চায়ের আসরে ধরণীবাবু অনাহুত অতিথি হতে চান।

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে বললে, এ আমার পরম সৌভাগ্য–পরম সৌভাগ্য। আসুন, বসুন,–ওরে মধু, জলদি চা নিয়ে আয় রে, টোস্ট আর এগপোচ আনতেও ভুলিসনে যেন।

ধরণীবাবু বললেন, আজ চা পান হচ্ছে গৌণ ব্যাপার, আমার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাদের অনেক কটু কথা শুনিয়েছি বলে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

–আমাকে আর লজ্জা দেবেন না মশাই, কিন্তু এতদিন পরে হঠাৎ আপনার ক্ষমা প্রার্থনার কথা মনে হল কেন? সঠিক আপনার অনুমান! যামিনী শ্যামাকান্ত ওরফে কামিনীকে চিঠি লিখেছিল বোম্বাই শহরে। সে গ্রেপ্তার হয়েছে। ছোরার আঙুলের ছাপ মিলে গেছে অবিকল। যামিনীর সঙ্গে তার চেহারার আশ্চর্য মিলছদ্মবেশের ভিতর থেকে লোকের চোখে যা ধরা পড়ত না। যামিনীও এখন হাজতে। আপনি গোয়েন্দা বটে, কিন্তু অসাধারণ আর অতুলনীয়। ধন্য, ধন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *