গুপ্তধন (উপন্যাস)

গুপ্তধন (উপন্যাস)

এক

রাত সাড়ে তিনটে। রাস্তার একপাশে একখানা মোটরগাড়ি। সামনের আসনে মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে আছে একটা লোক। কনস্টেবল লুইস শিলি নিজের ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নজর রাখছিল গাড়িখানার উপরে। এইভাবে কেটে গেল ঘণ্টা খানেক। তারপর শিলি এগিয়ে এসে গাড়ির ভিতরে ফেলল নিজের টর্চের আলো। ড্রাইভারের আসনে বসে বসেই ঘুমোচ্ছে একটি ছোকরা। দুই চোখ মোদা, মাথাটি এলিয়ে পড়েছে কাঁধের উপরে। শিলির প্রথম ধাক্কায় ছোকরা নড়েচড়ে উঠল বটে কিন্তু তার ঘুম ভাঙল না। দ্বিতীয় ধাক্কা দিয়ে শিলি হাঁকলে, এই! কে তুমি? উঠে পড়ো।

ধড়মড় করে ছোকরা জেগে উঠল। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক। তারপর ভালো করে চেয়ে দেখে একটা অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে বললে, তবু ভালো, পুলিশ! আমি ভেবেছিলুম ডাকাত যা ভয় পেয়েছিলুম।

শিলি শুধাল, কে তুমি বাপু? এখানে কি করছিলে?

–ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

নাম কী?

–ডেভিড টিঙ্গো।

বয়স?

সতেরো।

বাড়ি কোথায়?

 ক্যামডেনে।

 –এত রাত্রে বাড়িতে না গিয়ে রাস্তায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিলে কেন?

–সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছিলুম। হঠাৎ চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে এল।

ছোকরা জবাবগুলো দিচ্ছিল বেশ সপ্রতিভ মুখেই। তার ভাবভঙ্গিও সন্দেহজনক নয়। কিন্তু শিলি ভাবলে তবু বলা তো যায় না, দিনকাল যা খারাপ! চারিদিকেই চুরির পর চুরি হচ্ছে; ছোকরাকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক।

–টিঙ্গো, তোমার গাড়ির লাইসেন্স দেখি।

–একটা চামড়ার ব্যাগে পুরে লাইসেন্সখানা পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। আজ দুদিন হল ব্যাগটা হারিয়ে গিয়েছে।

বটে, বটে। তাহলে আমার সঙ্গে একবার থানায় চলো তো বাপু।

টিঙ্গো কোনওরকম ইতস্তত না করেই শিলির অনুসরণ করলে।

থানায় এসে টিঙ্গো বললে, মা-বাবা আমার জন্যে ভাবছেন। একবার বাড়িতে ফোন করতে পারি?

–নিশ্চয়ই। ওই ঘরে ফোন আছে।

টিঙ্গো চলে গেল। শিলি থানার ফাইল ঘেঁটে দেখতে লাগল, ডেভিড টিঙ্গো নামে কোনও ছোকরা আসামির নাম খুঁজে পাওয়া যায় কিনা! খোঁজাখুঁজি ব্যর্থ হল, টিঙ্গোর নাম নেই।

টিঙ্গো বলেছে তার বাসা ক্যামডেনে। শিলি অন্য একটা ফোনের সাহায্যে সেই এলাকার থানার কর্মচারীকে ডাকলে। ডিকেটটিভ মর্গ্যান শিলির কাহিনি শুনে ক্যামডেন থানার ফাইল খুঁজে বললেন, ডেভিড টিঙ্গো নামে কোনও ছোকরা কোনও দিন এ এলাকায় ধরা পড়েনি। তখন শিলির বিশ্বাস হল যে টিঙ্গো তাহলে দুষ্ট ছোকরা নয়।

সে টিঙ্গোর কাছে গিয়ে বললে, তোমার গাড়ি আপাতত থানাতেই থাক। প্রায় তোর হয়েছে। তুমি বাসে চড়ে বাড়ি যেতে পারবে?

অনায়াসেই।

 –বেশ। বাড়িতে গিয়ে তোমার বাবাকে একবার এখানে ডেকে আনো।

টিঙ্গো চমকে উঠল। প্রস্তাবটা তার পছন্দ হল না। বললে, বাবাকে কেন? মাকে ডেকে আনলে চলবে না?

বাবার নাম শুনেই তুমি চমকে উঠলে কেন?

 টিঙ্গো বললে, এত ভোরে বাবাকে ডাকাডাকি করলে তিনি চটে যেতে পারেন।

–বেশ, তাহলে যে কেউ এলে চলবে। তোমার বাবা কি মা এসে যদি লাইসেন্সের কথা স্বীকার করেন, তবে গাড়ি ছেড়ে দিতে আমি কোনও আপত্তি করব না।

টিঙ্গোর প্রস্থান। শিলি বসে বসে ভাবতে লাগল, সাবধানের মার নেই বলেই এত হ্যাঁঙ্গামা করলুম। ছোকরা অপরাধী নয়। দেখা যাক ওর মা এসে কী বলে।

আধ ঘণ্টা পরে বেজে উঠল টেলিফোনের ঘণ্টা। শিলি রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললে, হ্যালো!

আমি ক্যামডেন থানার ডিটেকটিভ মর্গ্যান। একটু আগেই তুমি না বলেছিলে, ডেভিড টিঙ্গো নামে কে এক ছোকরা তার চামড়ার ব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে?

–হ্যাঁ, তাই।

–উত্তম। সেই ব্যাগটা আমরা পেয়েছি। ছোকরা এখন কোথায়?

বাড়ি থেকে মাকে ডেকে আনতে গিয়েছে।

–সে ফিরে এলে থানায় বসিয়ে রেখো। আমরা এখনি যাচ্ছি। মর্গানের কণ্ঠস্বর উত্তেজিত।

শিলি অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, এ আবার কী ব্যাপার? টিঙ্গোর ব্যাগ ক্যামডেন থানায় হাজির হল কেমন করে? আর ওটা যে টিঙ্গোর ব্যাগ, তাই বা মর্গ্যান জানতে পারল কেমন করে?

এমন সময় টিঙ্গোর পুনরাবির্ভাব–সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের ভিতর এসে দাঁড়ালেন মর্গ্যান ও কেনলি দুই ডিটেকটিভ।

শিলি জিজ্ঞাসা করলে, টিঙ্গো, তোমার মা কই?

–এত সকালে মাকে টানাটানি করতে ভালো লাগল না। তাকে আর আনাবারও দরকার নেই।

–কেন?

আমি ভুল করেছিলাম। ব্যাগে নয়, লাইসেন্সখানা ছিল আমার বাড়ির ভিতরেই। এই নিন।

লাইসেন্সের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শিলি বললে, দেখছি সব ঠিকঠাক আছে। ভালো কথা টিঙ্গো, ক্যামডেন থানা থেকে এই দুজন ডিটেকটিভ এসেছেন তোমার সন্ধানে।

.

দুই

ক্যামডেনেই তার বাসা, সেখানকার দু-দুজন ডিটেকটিভ তাকে খুঁজতে এসেছে শুনে টিঙ্গোর মুখ শুকিয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলে, কেন? ব্যাপার কী?

মর্গ্যান বললেন, ব্যাপার কিছুই নয় বাপু। তবে তোমার কাছ থেকে হয়তো আমরা কিছু সাহায্য পেতে পারি। দ্যাখো তো এই চামড়ার ব্যাগটা তোমার কি না? তিনি টেবিলের ওপরে একটি ছোট ব্যাগ স্থাপন করলেন।

ব্যাগটা নকল চামড়ার তৈরি। তার ওপরে মুদ্রিত আছে এক অশ্বারোহী কাউ-বয় এর ছবি। বালকরাই এরকম ব্যাগ ব্যবহার করতে ভালোবাসে।

টিঙ্গো এক গাল হেসে বললে, বাঃ, এ তো আমারই ব্যাগ। আপনারা এটা কোথায় পেয়েছেন?

তীক্ষ্ণ চোখে তার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে মর্গ্যান বললেন, টিঙ্গো, তুমি ওই চেয়ারে বোসো।

টিঙ্গো বসল। চেয়ার টেনে তাকে ঘিরে বসলেন গোয়েন্দারাও।

মর্গ্যান বললেন, শোনো টিঙ্গো। আজই রাশি রাশি চোরাই মাল আমাদের হস্তগত হয়েছে। কেমন করে তা বলতে চাই না, কারণ সে হচ্ছে অনেক কথা। এইটুকু খালি জেনে রাখো, সেইসব চোরাই মালের ভিতরে ছিল তোমার এই ব্যাগটাও। ফাউন্টেন পেন, বন্দুক, রিভলভার, জড়োয়া গহনা প্রভৃতি আরও অনেক কিছু দামি-দামি জিনিসের সঙ্গে এই তুচ্ছ ব্যাগটি ছিল কেন, আমরা তা বুঝতে পারছি না। এখন তুমি বলতে পারো ব্যাগটা কোথায়, কেমন করে হারিয়ে ফেলেছিলে, তাহলে চোরের সন্ধান পেতে দেরি হবে না।

ডেভিড টিঙ্গোর মুখ দেখে মনে হল যেন দস্তুরমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। তারপর সে মাথা নেড়ে বলল, ব্যাগটা আমার কাছ থেকে চুরি যায়নি, ওটা আমি নিজেই কোথাও হারিয়ে ফেলেছিলুম। তবু চোরাই মালের সঙ্গে পাওয়া গেল আমার ব্যাগ, ভারি আজব ব্যাপার তো!

মর্গ্যান বললেন, ব্যাগটা হয়তো তোমার কাছ থেকেই চুরি গিয়েছে!

–অথচ আমি টের পাইনি।

–আশ্চর্য কি, হয়তো চোর তোমার পকেট মেরে সরে পড়েছিল।

টিঙ্গো আবার মাথা নেড়ে জানালো, না।

 মর্গ্যান শুধোলেন, তোমার ব্যাগটা কবে হারিয়ে গিয়েছে?

–দিন তিনেক আগে।

–তোমার ঠিক মনে আছে।

–অন্তত গেল দুদিন থেকে ব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছি না।

 মর্গ্যান পকেট থেকে একখানা ট্রলি-হস্তান্তরপত্র বার করে বললেন, এখানা কি তোমার?

নিশ্চয়। যদিও ও কাগজখানা এখনও আমি ব্যবহার করিনি।

 মর্গ্যান বললেন, কাগজখানা তোমার ওই ব্যাগের ভিতরেই ছিল।

আচম্বিতে টিঙ্গোর মুখ হয়ে গেল রক্তশূন্য। সে বলে উঠল, না, না, ও কাগজখানা আমার নয়। আমি কি বলতে কি বলে ফেলেছি। আপনারা আমার মাথা গুলিয়ে দিয়েছেন।

–হ্যাঁ তাই দিয়েছি বটে!

–ও কাগজ আমার হতে পারে না। আমি বলছি ও কাগজ আমার নয়।

মর্গ্যান গাত্রোত্থান করে বললেন, টিঙ্গো, তোমাকে এখন আমাদের সঙ্গেই যেতে হবে। দেখছি, আমরা কোনও সাধারণ চুরির মামলা হাতে পাইনি, এর ভিতরে আছে গভীর রহস্য।

মর্গানের কথাই পরে সত্য হয়ে দাঁড়ায়। ডেভিড টিঙ্গো বালক মাত্র, কৈশোর অতিক্রম করে সবে যৌবনে পা দিয়েছে বটে, কিন্তু এখনও তাহার মুখের ওপরে আছে বালকতার সুস্পষ্ট ছাপ। অথচ তারই চারিদিক ঘিরে রচিত হয়েছিল যে জটিল ও অদ্ভুত রহস্যের জাল, তা যেমন অসাধারণ তেমনি অভাবিত ও অতুলনীয়। আপাতত আমরাও টিঙ্গোকে পুলিশের জিম্মায় রেখে গোয়েন্দাদের সঙ্গে রহস্য জালের খেই খোঁজবার চেষ্টা করব।

.

চুরির হিড়িক শুরু হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট তারিখে। চোরেরা হানা দেয় কলিংস রোডের মিঃ উটো টপারকারের বাড়িতে। তারা একটা জানলা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। চুরির আগে ভারী ভারী আসবাবগুলো টেনে এনে এমনভাবে সদর দরজার ওপরে চাপিয়ে রেখেছিল যে, বাড়ির মালিক ভিতরে আসবার জন্যে ঠেলাঠেলি করলেই তারা সরে পড়বার সুযোগ পাবে। চুরির পর তারা বেরিয়ে গিয়েছিল খিড়কির দরজা দিয়ে।

তারপর থেকে শুরু হল চুরির পর চুরি ক্যামডেন, কলিংসউড, গ্লসেস্টার, পেনসকেন ওকলিন, অডুবন ও হ্যাডন হাইটস প্রভৃতি সাউথ ডারসির শহরে-শহরে। সর্বত্র তাদের একই পদ্ধতি। তারা জানলা ভেঙে ভিতরে ঢোকে, সদর দরজার ওপরে আসবাবগুলো চাপিয়ে রাখে এবং খিড়কির দরজা দিয়ে পলায়ন করে।

প্রত্যেকবারেই তাদের আবির্ভাব হয় রাত আটটার কাছাকাছি কোনও একটা সময়ে। সেইজন্যে তাদের নাম রাখা হল রাত আটটার চোরের দল। তারা যে সন্ধানী চোর সে। বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কারণ প্রত্যেকবারেই চুরি সময়ে বাড়ির লোক থেকেছে অনুপস্থিত।

অনেকদিন পর্যন্ত জনপ্রাণী চোরেদের মুখদর্শন করবার সুযোগ পায়নি। একবার মাত্র। জনৈক ব্যক্তি একটি ঘটনা-ক্ষেত্রে দুইজন লোককে চলে যেতে দেখেছিল, কিন্তু সেও তাদের পিছন দিক ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি।

অবশেষে মিঃ জ্যাফার্টির বাড়িতে তাদের একজনের খানিকটা বর্ণনা পাওয়া গেল।

ডিটেকটিভ মর্গ্যান ও কনলির কাছে জ্যাফার্টি বললেন : বাড়ির অন্যান্য লোকেরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, আমি সব আলো নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। রাত যখন আটটা পনেরো, তখন একতলায় কি একটা শব্দ হয়, আমারও ঘুম ভেঙে যায়। আমি বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে গিয়ে সিঁড়ির আলো জ্বেলে দিয়ে দেখি,নীচে একটা লোক দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে আছে আমার পানে। সে আমাকে শাসিয়ে বললে, খবরদার টুঁ শব্দটি কোরো না। পরমুহূর্তে সে সাঁৎ করে নিজের পকেটে হাত চালিয়ে দিল–আমি ভাবলুম, এই রে, এইবারে বার করে বুঝি রিভলবার! তারপর সে রিভলভার বার করলে না বটে, কিন্তু পকেট থেকে নিজের হাত বার করে আমার দিকে একটা অঙ্গুলি নির্দেশ করে তালুতে জিভ লাগিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করলে। তার পরেই খিলখিল করে হেসে উঠে এক ছুটে বাড়ির বাইরে পালিয়ে গেল। আমি নীচে নেমে গিয়ে দেখি আমার আসবাবগুলো স্থানচ্যুত হয়েছে বটে, কিন্তু চোর সেগুলো সদর দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাবার সময় পায়নি। একটা জানলাও ভাঙা।

গোয়েন্দারা চোরের চেহারার বর্ণনা জানতে চাইলেন।

জ্যাফার্টি বললেন, তার বয়স উনিশ-বিশের মধ্যেই। মাথার উচ্চতা হবে আন্দাজ সাড়ে পাঁচ ফুট, দেহের ওজন দুই মণের বেশি হবে না। তার মাথায় লম্বা লম্বা চুল, সরু নাক। দুই গালের হাড় উঁচু। তার চোখ দুটো ছোট ছোট।

সব থানাতেই জেল খাটা বিখ্যাত বা অবিখ্যাত আসামিদের অসংখ্য ফটো সংগ্রহ করে রাখা হয়।

গোয়েন্দারা বললেন, লোকটার ছবি দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?

–পারব।

জ্যাফার্টিকে ছবির বইগুলোর সামনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেওয়া হল–গাদাগাদা বই। কয়েক ঘণ্টা পরে ছবি দেখা শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার বাড়িতে যে অনাহূত অতিথি এসেছিল এর মধ্যে তার ছবি নেই।

.

তিন

গেল পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনার পরের দিনের কথা। গ্লসেস্টারের একখানা বাড়িতে গিয়ে হানা দিলে রাত আটটার চোরের দল। তার পরের দিনই কলিংসউডে হল আবার তাদের আবির্ভাব। এ পর্যন্ত তারা যে সব নগদ টাকা জড়োয়া গহনা রেডিয়ো ও ঘড়ি প্রভৃতি সরিয়ে ফেলতে পেরেছে তার মোট দাম হবে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার চেয়েও বেশি।

পুলিশের অবস্থা অত্যন্ত অসহায়। তারা উদভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করছে, প্রাণপণ চেষ্টার ও তদন্তের কিছুই বাকি রাখছে না, তবু নিয়মিতভাবেই চুরি হচ্ছে আজ এখানে, কাল ওখানে– যেখানে-সেখানে। পুলিশ অতঃপর কি করবে যেন তা জানতে পেরেই চোরের দল পুলিশের আগে-আগেই গিয়ে আবির্ভূত হয় যে-কোনও ঘটনাক্ষেত্রে।

পুলিশের খাতায় ছাড়া পাওয়া যত দাগী চোরের নাম আছে, তাদের ভিতর থেকে প্রত্যেক সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আবার ধরে এনে খোঁজখবর নেওয়া হলফল কিন্তু অষ্টরম্ভা। রাতে পথে পথে চৌকিদারের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হল। যেসব দোকানে লোক জিনিসপত্তর বাঁধা রাখে বা বিক্রি করে, সেখানে খানাতল্লাশ করেও একটিমাত্র চোরাই মাল পাওয়া গেল না।

কনলি একদিন মর্গ্যানকে ডেকে বললেন, চোরেরা যদি না চুরির পদ্ধতি বদলায় আর রাত আটটার চুরি করার অভ্যাস না ছাড়ে, তবে একদিন না একদিন আমাদের হাতের মুঠোর ভিতরে তাদের আসতে হবেই।

তারপর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের দোসরা জানুয়ারি তারিখে সাতষট্টি বৎসরের বৃদ্ধ জর্জ ব্রাউন রাজপথ দিয়ে যেতে যেতে আক্রান্ত হলেন দুইজন গুন্ডার দ্বারা।

একটা গুন্ডা রিভলভার দেখিয়ে টাকা দাবি করে। ব্রাউন প্রতিবাদ করাতে সে রিভলভারের বাড়ি মেরে তার মাথা ও মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দেয় এবং তিনি মাটির ওপরে পড়ে যান প্রায় অচৈতন্যের মতো।

পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে ব্রাউনের কাছ থেকে আততায়ীর যে বর্ণনা সংগ্রহ করলে, তার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল গত পরিচ্ছদে জ্যাফার্টির দ্বারা বর্ণিত চোরের চেহারা।

অধিকতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঘটনাটা ঘটেছিল প্রায় রাত আটটার সময়েই।

মর্গ্যান বললেন, একই লোকের কীর্তি বলে সন্দেহ হচ্ছে।

কনলি মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু আচমকা এই নতুন পদ্ধতিটা আমার ভালো লাগছে না। কোথায় বাড়িতে বাড়িতে চুরি, আর কোথায় রাজপথে রাহাজানি। চোরেরা সাধারণত নিজেদের এক এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করে, সহসা তারা নিজেদের পদ্ধতি বদলায় না। তবু বর্তমান ক্ষেত্রে সময় আর চেহারার যে মিল দেখেছি, তাও উপেক্ষা করা চলে না।

চুরির পর চুরি চলতে লাগল, একটানা চলতে লাগল চুরির পর চুরি। চোরেদের হাত যেন দম-দেওয়া ঘড়ির কাঁটা, নির্দিষ্ট সময়ে করে নির্দিষ্ট কর্তব্যপালন।

হ্যাডন হাইটের একখানা বাড়ি থেকে রাত আটটার চোরেরা নিয়ে গেল সাত লক্ষ টাকার জড়োয়া গহনা।

মর্গ্যান ও কনলি থানায় বসে চোরেদের নব নব কীর্তি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, হঠাৎ এল টেলিফোনের আহ্বান।

স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর। সে মার্কেট স্ট্রিটের এক রেস্তোরাঁর পরিবেশিকা। উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, শিগগির আসুন, শিগগির। এখানে একটা লোক এসেছে।

–কে লোক? কি বলছ তুমি?

–এখানে একটা লোক কোথায় রাহাজানি করে এসেছে বন্ধুদের কাছে সেই গল্প করছে। শীগগির আসুন, নইলে সে চলে যাবে।

তখন দুই গোয়েন্দা মোটর ছুটিয়ে দিলেন সেই রেস্তোরাঁর দিকে।

পরিবেশিকা রেস্তোরাঁর দরজাতেই দাঁড়িয়ে পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করছিল। এক ব্যক্তিকে সে দেখিয়ে দিলে অঙ্গুলি নির্দেশে। সে তখন বাইরে বেরিয়ে পথের ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে।

তার পথ রোধ করলে গোয়েন্দারা।

সচমকে সে বললে, কি চান আপনারা?

আমরা পুলিশ!

সে ভয়ে-ভয়ে বললে, তাই নাকি?

মর্গ্যান বললেন তুমি কোথায় গিয়ে রাহাজানি করেছ, এতক্ষণ সেই গল্প বলছিলে? আমরাও গল্পটা শুনতে চাই।

–রাহাজানি?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাহাজানি। এতক্ষণ তাই নিয়ে যে খুব মুখশাবাশি করছিলে।

–মুখশাবাশি? হা মশাই, ঠিক তাই। বন্ধুবান্ধবের কাছে অনেকেই মুখের কথায় রাজা উজির মারতে চায়, তা কি আপনারা জানেন না? আমি যা বলছিলুম সব বাজে বানানো কথা।

–তোমার নাম?

–অ্যান্ডি ক্লিং।

–আমাদের সঙ্গে থানায় চল।

ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বৃদ্ধ জর্জ ব্রাউনকে থানায় ডেকে আনা হল।

ক্লিংকে আরও কয়েকজন লোকের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসা করলেন, মি. ব্রাউন, দোসরা জানুয়ারিতে যে লোকটা আপনাকে রিভলভার দিয়ে মেরে আহত করেছিল, সে কি এই দলের মধ্যে আছে?

ব্রাউন মিনিট কয়েক ভালো করে লক্ষ করে দেখিয়ে দিলেন অ্যান্ডি ক্লিংকে।

ক্লিং যেন একেবারেই স্তম্ভিত! তারপর সে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, না, না, এ সত্য নয়। উনি ভুল করেছেন।

ব্রাউন বললেন, অসম্ভব। আমি যদি আরও দশ লক্ষ বৎসর বাঁচি তাহলেও তোমার মুখ জীবনে ভুলতে পারব না।

কনলির জামার হাত চেপে ধরে ক্লিং বললে, আমার কথায় বিশ্বাস করুন। এ ভদ্রলোক কি বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

কনলি বললেন, উনি তোমাকে শনাক্ত করেছেন। তবু তুমি দোষ স্বীকার করছ না কেন? ক্লিং বললে, যে দোষ করিনি তাই আমাকে স্বীকার করতে হবে?

–সেদিন তোমার সঙ্গে আর একজন লোক ছিল। কে সে?

–কেউ নয়। আমিই যখন ঘটনাস্থলে হাজির ছিলুম না, তখন আমার সঙ্গে থাকবে কে?

–এই যে রাত আটটায় চুরি, এর সম্বন্ধে তুমি কি জানো?

–আপনি কি বলতে চান? আমার বিরুদ্ধে আরও সব চুরির মামলা আছে নাকি?

গোয়েন্দারা এমনি সব প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলেন, কিন্তু ক্লিংয়ের কাছ থেকে কোনও স্বীকার-উক্তিই আদায় করতে পারলেন না। তার এক কথা–সে ব্রাউনকে আক্রমণ করেনি, রাত আটটার চুরি সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ জানে না।

গোয়েন্দারা বুঝলেন, ব্রাউনের মামলায় ক্লিংকে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে বটে, কিন্তু রাত আটটার চুরির মামলায় তার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণিত হয়নি। তাই জ্যাফার্টিকে ডেকে আনা হল, সর্বপ্রথমে যাঁর সঙ্গে রাত আটটার চোরদের একজনের মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছিল।

তিনিও কয়েকজন লোকের ভিতর থেকে ক্লিংকে বেছে নিয়ে বললেন, এই লোকটিকে সেই চোরটার মতন দেখতে বটে, কিন্তু এ ভিন্ন লোকও হতে পারে!

তাহলে আপনি ঠিক শনাক্ত করতে পারছেন না?

–প্রায় তাই-ই বটে। চোরের চেহারার সঙ্গে এর অনেক মিল আছে, এর বেশি আর কিছু আমি বলতে পারব না।

ক্লিংকে রাহাজানির মামলায় বিনা জামিনে ধরে রাখা হল।

মর্গ্যান বললেন, ক্লিং বন্দি, এখন দেখা যাক এর পরেও রাত আটটার চুরি বন্ধ হয়। কিনা! তা যদি হয়, তবে বুঝতে হবে ক্লিং সত্য সত্যই ওই চুরিগুলির সঙ্গে জড়িত আছে।

.

চার

এপারে ক্যামডেন, ওপার ফিলাডেলফিয়া এবং দুই শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় ডেলিওয়ার নদী। নদী পার হয়ে অপরাধীরা দুই শহরে গিয়েই উৎপাত করে এবং নদী পার হয়ে গোয়েন্দাদেরও দুই শহরে গিয়েই কাজ করতে হয়।

কিন্তু ফিলাডেলফিয়ায় এ পর্যন্ত রাত আটটার চোরদের কোনও উপদ্রব হয়নি। তার বদলে ঘটতে লাগল অন্যরকম ঘটনা।

আদালতে যেদিন অ্যান্ডি ক্লিংয়ের মামলা, ঠিক সেই তারিখেই ফিলাডেলফিয়ার ডাক্তার গ্রুয়েস যখন নিজের ডিসপেনসারিতে বসে আছেন, তখন দুজন লোক এসে তার কাছে সর্দি কাশির ওষুধ চাইল।

ডাক্তার গ্রুয়েস তাদের সঙ্গে কথা কইছেন, হঠাৎ একটা লোক রিভলভার বার করে বললে, তোমার কাছে টাকাকড়ি কি আছে দাও।

ডাক্তার বিনা বাক্যব্যয়ে নিজের ব্যাগটা (তার ভিতরে দুইশো টাকা ছিল) বার করে দিলেন। তবু অকারণেই তারা তাকে রিভলভারের দ্বারা নির্দয়ভাবে প্রহার না করে অদৃশ্য হল না।

পুলিশ ভাবলে, স্থানীয় অপরাধীর কীর্তি।

আরও দুই হপ্তা পরে ঠিক ওই ভাবেই নিজের ডিসপেনসারিতে বসেই আক্রান্ত ও প্রহৃত হলেন ডাক্তার আর্ভিং রোসেনবার্গ। চোরেরা তাঁর কাছ থেকে হস্তগত করলে এক হাজার সাতশো পঞ্চাশ টাকা।

গোয়েন্দারা বললেন, একই দলের কীর্তি।

দুই হপ্তা পরে স্থানান্তরে আবার সেই কাণ্ড। এবারে স্টার্লি বক্ নামে আর এক ডাক্তারের পালা।

প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আবির্ভূত হয়েছিল দুজন করে তোক এবং প্রত্যেক ডাক্তারের কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছিল তাদের চেহারার বর্ণনা। কিন্তু পুলিশ তবু কোনও অপরাধীরই নাগাল পেল না।

এদিকে অ্যান্ডি ক্লিং যখন বাস করছে ক্যামডেনের জেলখানায়, তখনও বন্ধ হল না রাত আটটার চুরিগুলি।

সত্যি কথা বলতে কি আদালতে যেদিন উঠল অ্যান্ডি ক্লিংয়ের মামলা, ঠিক সেদিনই রাত আটটার সময়ে চোরের দল হানা দিলে কলিংসউডের একখানা বাড়িতে এবং যাবার সময়ে পিছনে রেখে গেল নিজেদের বিখ্যাত ট্রেডমার্ক ও সেই ভাঙা জানালা, সেই খোলা খিড়কির দরজা।

কনলি বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

মর্গ্যান বললেন, ক্লিংয়ের রাহাজানির সঙ্গে এই রাত আটটার চুরির কোনও সম্পর্ক নেই।

কনলি বললেন, ক্লিং ধরা পড়ার পরও তার জুড়িদার রাত আটটার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, এও হতে পারে তো?

মর্গ্যান বললেন, তাতে আর আমাদের কি সুরাহা হবে? ক্লিং তো তার জুড়িদারের নাম আমাদের কাছে ফাঁস করে দেবে না?

এদিকে চুরির পর চুরি, ওদিকে ডাক্তারের পর ডাক্তারের ওপরে আক্রমণ, দুই কাজই চলতে লাগল একসঙ্গে। এই দুই ব্যাপারের মধ্যে যে কোনও যোগাযোগ আছে, এমন সন্দেহ পুলিশের মনে ঠাঁই পেল না। কাগজওয়ালারা খাপ্পা হয়ে উঠল। কিন্তু পুলিশ নাচার।

ডাক্তার হোরোসিয়ো ক্যাম্পবেল ডিসপেনসারিতে উপবিষ্ট। বাহির থেকে দরজায় করাঘাত হল। তিনি উঠে দরজা খুলে দিয়ে দেখলেন, তিনজন লোক বাইরের বেঞ্চির ওপর পাশাপাশি বসে আছে।

একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললে, বড়ই ঠান্ডা লেগেছে ডাক্তারবাবু। ওষুধ-টষুধ দিতে পারেন?

ডাক্তার ক্যাম্পবেলের বুকটা ধড়াস করে উঠল। ডাক্তারদের ওপর আক্রমণের কাহিনি তার জানতে বাকি নেই। আততায়ীদের চেহারার বর্ণনাও তিনি খবরের কাগজে পাঠ করেছেন। তিন জনের মধ্যে দুইজনের চেহারা সেই বর্ণনার সঙ্গে অবিকল মিলে যায়।

কোনওরকমে বুকের কাঁপুনি থামিয়ে শান্ত ভাবেই তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

ঘরের ভিতরে ফিরে এসেই তিনি ধারণ করলেন টেলিফোন যন্ত্র। তার পরেই থানার লোক পেলে তার বিপদের খবর।

তারপর কাটল এক মিনিট…দুমিনিট..তিন মিনিট। প্রত্যেকটা মিনিট কি সুদীর্ঘ। প্রত্যেক মিনিটেই ডাক্তারের ভয় হয়, এই বুঝি ডাকাতের দল হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে রিভলভার হাতে করে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে! চার মিনিট..পাঁচ মিনিট।

অবশেষে ঘরের বাইরে শোনা গেল কাদের কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। ডাক্তার বাইরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন পুলিশ কর্মচারী।

পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানা গেল তিনজন সন্দেহজনক আগন্তুকের মধ্যে দুইজন হচ্ছে সহোদর নাম ওয়াল্টার ও ডানিয়েন গ্লেনন। তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে তাদের শ্যালকম ওয়াল্টার স্যামসন।

গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এখানে কি করতে এসেছ?

স্যামসনের ঠান্ডা লেগেছে। আমরা ওষুধ নিতে এসেছি।

 গোয়েন্দারা বললেন, স্যামসনের ঠান্ডা লাগার কোনও লক্ষণই তো দেখতে পাচ্ছি না।

স্যামসন বললে, ঠান্ডা লেগেছে আমার বুকের ভেতরে। আপনারা তা যদি দেখতে না পান সে জন্যে আমি দায়ী নই।

–বেশ, থানায় চল।

যে তিনজন ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে দুজনের পাত্তা পাওয়া গেল। ডাক্তার বক্‌ কিছুক্ষণ লোক তিনজনের দিকে তাকিয়ে ওয়াল্টার গ্লেননকে সনাক্ত করলেন। এবং ওয়াল্টার স্যামসন সম্বন্ধে বললেন, ওকেও দ্বিতীয় ব্যক্তির মতো দেখতে বটে, কিন্তু আমি হলফ করে কিছু বলতে পারব না।

ডাক্তার রোসেনবার্গও ওয়াল্টার গ্লেননকে সনাক্ত করলেন; এবং ডানিয়েল গ্লেনন সম্বন্ধে বললেন, ওর সঙ্গে দ্বিতীয় ব্যক্তির মিল আছে বলে মনে হচ্ছে!

তিনজন আসামিই প্রবল প্রতিবাদ করে জানালে তারা সম্পূর্ণরূপেই নিরপরাধ এবং দুইজন ডাক্তারকে তারা জীবনে কখনও চোখেও দেখিনি।

তাদের ওপরে বিনা জামিনে হাজতবাসের হুকুম হল।

.

পাঁচ

ফিলাডেলফিয়ার ওয়াল্টার গ্লেনন ক্রমাগত প্রতিবাদ করছে–আমি নিরপরাধ। ডাক্তারদের আমি আক্রমণ করিনি।

ক্যামডেনের অ্যান্ডি ক্লিংয়ের মুখেও ওই একই কথা? আমি নিরপরাধ। মি. ব্রাউনের ওপরে আমি হানা দিইনি।

অথচ আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের দুজনকেই নিশ্চিতরূপে সনাক্ত করতে পেরেছেন।

 এদিকে রাত আটটার চোরের দল নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে পরিপূর্ণ উৎসাহে।

অবশেষে ক্যামডেনের মিসেস ক্যাথারাইন অ্যান্টনের কাছ থেকে টেলিফোনে থানায় খবর এল, তার প্রতিবেশীর এক শিশুপুত্র একটি বাক্স কুড়িয়ে পেয়েছে, তার মধ্যে আছে বন্দুক, জড়োয়া গয়না, ঘড়ি ও আরও হরেক রকম দামি জিনিস।

কনলি তখনই যথাস্থানে গিয়ে হাজির হতে দেরি করলেন না। শিশুর নাম ফ্রেডি টম, বয়স সাত বৎসর। সে একটা নয় পেয়েছে তিন-তিনটে বাক্স।

একটা বাক্স খুলে দেখা গেল, তার ভিতরে রয়েছে অনেক ঘড়ি, ফাউন্টেন পেন, রূপোের বাসন, আংটি, হীরকখচিত সোনার গহনা, একটা রিভলভার ও কতকগুলো কার্তুজ–

কনলির বুকের ভিতর উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল রক্তস্রোত! বিপুল আগ্রহে ও অন্য দুটোও তিনি খুলে ফেললেন তাড়াতাড়ি। সে দুটো বাক্সও ওই দামি জিনিসে ঠাসা।

এ যে রাজার ঐশ্বর্য।

দু-একখানা গয়না পরীক্ষা করেই বোঝা গেল, সেগুলো হয়েছিল রাত আটটার চোরের দলের করতলগত।

এ যে স্বপ্নতীত সৌভাগ্য!

শিশুর দিকে ফিরে কনলি শুধোলেন, খোকাবাবু, এগুলো তুমি কোথায় পেয়েছ?

নদীর ধারে। খুব ভোরবেলায় খেলা করতে গিয়েছিলুম। সেইখানে ছুটোছুটি খেলা করতে করতে আমি আর একটু হলেই বাক্সগুলোর উপরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলুম আর কি।

–তুমি বাক্সগুলো খুলে দেখেছিলে?

–তা আবার দেখিনি? আমি ভেবেছিলুম এগুলো হচ্ছে বোম্বেটেদের গুপ্তধন।

 –তার পরই তুমি সোজা বাড়িতে ফিরে এলে বুঝি?

–উঁহুঁ। আমার যেসব বন্ধু বাক্সগুলোকে বাড়িতে তুলে আনবার জন্যে সাহায্য করেছিল, বাক্সের কিছু কিছু জিনিস নিয়ে আগে তাদের কিছু উপহার দিয়েছিলুম।

কী কী জিনিস বাছা?

–অত কি ছাই মনে আছে। যে যা চাইলে, তাই।

ফ্রেডি টমের মায়ের দিকে ফিরে কনলি বললেন, আপনি পেয়েছেন এক আশ্চর্য সৎপুত্র। বেশিরভাগ ছেলেই এরকম কিছু পেলে আর কারুর কাছে সেকথা প্রকাশ করত না।

থানায় যখন বাক্স তিনটে নিয়ে আসা হল সবাই তখন চরম বিস্ময়ে একেবারে হতবাক।

মর্গ্যান বললেন, এত ঐশ্বর্য নদীর ধারে পরিত্যক্ত হল কেন? যে এমন কাণ্ড করেছে তাকে আমরা খুঁজে বার করব যে-কোনও উপায়ে।

কনলি বললেন, আমিও ও-কথা ভেবে দেখেছি। আমার কি সন্দেহ হয় জানো? ক্লিং ধরা পড়াতে তার জুড়িদার ভয় পেয়ে এই কার্য করেছে।

জিনিসগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা যাক নতুন কোনও সূত্র পাওয়া যায় কি না।

রাত আটটার চোরের দল যেখান থেকে যেসব জিনিস চুরি করেছিল, পুলিশের কাছেই ছিল তার সুদীর্ঘ তালিকা।

পরীক্ষা কার্য যখন চলছে, সেই সময় মর্গ্যান বাক্স হাতড়ে বার করলেন একটা নকল চামড়ার ব্যাগ। একখানা ট্রলি হস্তান্তরপত্র ছাড়া তার ভিতরে আর কিছুই ছিল না।

মর্গ্যান বললেন, এই ব্যাগের ওপরে সম্ভবত কারুর নামের দুটো আদ্য অক্ষর লেখা আছে–ডি.টি। এরকম ব্যাগ তো ছোরারাই ব্যবহার করে। এর মানে কি?

–হ্যাঁ, এ ছোকরাদের উপযোগী বটে।

–এমন এক ছোকরা, যার নামের দুটো আদ্য অক্ষর হচ্ছে ডি. টি। যদিও তা হয়তো সম্ভবপর নয়, তবু একটা কথা আমার মনে হচ্ছে।

কী কথা?

–একটু আগেই গ্লসেস্টারের থানা থেকে ফোন এসেছিল, ডেভিড টিঙ্গো নামে এক ছোকরার খবরাখবর নেবার জন্যে। সে-ও না কি তার একটা চামড়ার ব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে। ডি. টি.-তো ডেভিড টিঙ্গোরও নামের আদ্য অক্ষর হতে পারে।

কনলি তৎক্ষণাৎ জাগ্রত হয়ে বললেন, চলো সেখানেই যাই।

.

তার আধ ঘণ্টা পরেই গ্লসেস্টারের থানায় গিয়ে মর্গ্যান ও কলির সঙ্গে ডেভিড টিঙ্গোর যেসব কথাবার্তা হল, আমরা তা বর্ণনা করেছি এই আখ্যায়িকার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই।

তবু এখানে একটু খেই ধরিয়ে দেওয়া দরকার।

 টিঙ্গো স্বীকার করলে ব্যাগটা তারই। তিনদিন আগে হারিয়ে গিয়েছিল।

গোয়েন্দারা তাকে সেই ব্যাগের ভিতরে ট্রলি হস্তান্তরপত্রখানাও দেখালেন। প্রথমটা সেখানাও সে নিজের বলে মেনে নিলে। কিন্তু পরমুহূর্তেই রক্তহীন হয়ে গেল তার মুখ। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না–ওখানা আমার নয়। আমি কি বলতে কি বলে ফেলেছি। আপনারা আমার মাথা গুলিয়ে দিয়েছেন।

হস্তান্তরপত্রের ওপরে ছিল গতকল্যকার তারিখ। অথচ টিঙ্গো বলে তার ব্যাগ খোয়া গেছে তিনদিন আগে। তার মানে, গতকল্যও এই ব্যাগটি ছিল তার কাছেই।

কেন সে এই মিথ্যে কথাটা বললে? পুলিশের সন্দেহ হল তখন।

ডেভিড টিঙ্গোকে নিয়ে গোয়েন্দারা গেলেন তার বাড়িতে। তার বাবা তখন কর্মস্থলে। গিয়েছেন। বাড়িতে ছিলেন কেবল তার মা।

তাদের বাসা খানাতল্লাশ করে সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না, কেবল একটা রিভলভার ছাড়া। সেটা বেলজিয়ামে প্রস্তুত এবং লুকানো ছিল ডেভিড টিঙ্গোর শোবার ঘরের বিছানার তলায়।

তাকে জিজ্ঞাসা করা হল রিভলভারটা কোথা থেকে সে পেয়েছে? সে বেশ সপ্রতিভভাবেই বললে, রাস্তায় একখানা আরোহীহীন মোটরগাড়ি দাঁড় করানো ছিল, ওটা পড়েছিল তারই পিছনের আসনে। ছেলেবেলা থেকেই আমার মনে একটা রিভলবার পাবার প্রবল ইচ্ছা ছিল। তাই লোভ সামলাতে পারলুম না। রিভলভারটা চুপিচুপি তুলে নিয়ে সরে পড়লুম। তার আগে জীবনে আর কোনওদিন আমি চুরি করিনি।

তার কাছ থেকে কোনও তথ্য উদ্ধার করা গেল না।

.

রাত আটটার চোরের দল এ পর্যন্ত যাদের বাড়ির ওপরে হানা দিয়েছিল তাঁদের প্রত্যেককেই থানায় আহ্বান করা হল, তিনটে বাক্সে পাওয়া চোরাই মালগুলো সনাক্ত করবার জন্যে।

সেই বেলজিয়ামে প্রস্তুত রিভলভারটা দেখেই জনৈক মহিলা বললেন, ওটা আমাদের সম্পত্তি। চোরেরা আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রিভলভারের ক্লিপটা তাড়াতাড়িতে বা ভুল করে নিয়ে যেতে পারেনি, এখনও আমাদের বাড়িতেই পড়ে আছে।

তৎক্ষণাৎ ক্লিপটা আনিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল, রিভলভারের সঙ্গে তা খাপ খেয়ে যায় যথাযথ ভাবেই।

কনলি বললেন, টিঙ্গো, রিভলভারটা তাহলে তুমি কোনও মোটরগাড়ি থেকে চুরি করোনি। তুমি যে রাত আটটার চোরেদেরই একজন, এইবার তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল। তুমি কি এখনও মিথ্যা কথা বলতে চাও?

না, ডেভিড টিঙ্গো আর মিথ্যা কথা বলতে চায় না। কিন্তু সে যে সব আজব কথা বললে, তা শ্রবণ করে গোয়েন্দাদের চিত্ত একেবারে চমৎকৃত হয়ে গেল।

রাত আটটার চুরিতে তার জুড়িদার ছিল না অ্যান্ডি ক্লিং।

টিঙ্গোর একমাত্র জুড়িদার হচ্ছে তার পিতা স্বয়ং।

সে বললে, বাবা রোজ রাত্রে চুরি করবার জন্যে আমাকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, আমাকে তার সঙ্গী হতে হত ইচ্ছার বিরুদ্ধেই । তাই রাত্রে প্রায়ই আমি পালিয়ে বেড়াতুম। যেদিন আপনার প্রথম আমাকে থানায় নিয়ে আসেন, সেদিনও আমি বাবার ভয়ে রাত্রে রাস্তায় মোটরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলুম।

সেই রাত্রেই ডেভিড টিঙ্গোর বাবা ধরা পড়ল। তার নাম বেঞ্জামিন টিঙ্গো। ধরা পড়েই সে অপরাধ স্বীকার করতে একটুও ইতস্তত করলে না। সে এক অদ্ভুত চরিত্রের লোক– সত্যিকারের ডা. জেকিল ও মিঃ হাইড। দিনের বেলায় ভালো চাকরি করে, মাহিনা পায় হপ্তায় পাঁচশো টাকা। সকলেই তাকে অত্যন্ত সাধু, ভদ্র-নম্র প্রকৃতির মানুষ বলে জানে। সে যারপরনাই ধর্মভীরু, নিজের বাড়িতে প্রত্যেক ঘরে রাখে একখানা করে বাইবেল।

সে নিজের বাড়ির গুপ্তস্থান থেকে আরও চল্লিশ হাজার টাকার চোরাই মাল বার করে দিয়ে বললে, পুলিশ চারদিকে ধরপাকড় করছে বলে ভয় পেয়ে আমি তিন বাক্স চোরাই মাল নদীর ধারে ফেলে দিয়েছিলুম। সেই সঙ্গে ভ্রমক্রমে গিয়েছিল আমার ছেলের চামড়ার ব্যাগটাও।

কিন্তু এখনও গোয়েন্দাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে নতুন নতুন বিস্ময়।

বেঞ্জামিন টিঙ্গো নিজেই বলল, ফিলাডেলফিয়ার ডাক্তারদের উপর হানা দিয়েছিলুম আমরাই।

ডেভিড টিঙ্গো বললে, অ্যান্ডি ক্লিংকে বিনা দোষে ধরা হয়েছে। বুড়ো জর্জ ব্রাউনকে রিভলভার দ্বারা আঘাত করেছিলাম আমিই।

তাদের কথা যে মিথ্যা নয়, সে প্রমাণ পেতে বিলম্ব হল না। নির্দোষ ব্যক্তিরা মুক্তিলাভ করল। আসামিরা গেল কারাগারে।

আর সেই ছোট্ট জর্জ ফ্রেডি টম–যে আবিষ্কার করেছিল চোরাই মালের বাক্স তিনটে– সে উপহার লাভ করল একখানি বাইসাইকেল।

–এখানে যে ডিটেকটিভ কাহিনিটি দেওয়া হল, এটি গল্প নয়, একেবারে সত্য ঘটনা। ঘটনাক্ষেত্র হচ্ছে আমেরিকা। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *