1 of 2

টাইম-কিলার (নভেলেট)

টাইম-কিলার (নভেলেট)

লেখার শুরুতেই শ্রীহার্বাট জর্জ ওয়েলস-কে আমার প্রণাম জানাই। যাকে আপনারা সবাই এইচ. জি. ওয়েলস নামে বেশি চেনেন। ডি. এসসি., ডি. লিট. ইত্যাদি ডিগ্রিওয়ালা মস্ত পণ্ডিত ছিলেন তিনি। কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখে প্রচুর নাম-টাম করেছিলেন। আজও ওঁর লেখার জবাব নেই।

কিন্তু আমি ওঁকে ‘গুরু’ বলে মানি ওঁর ‘দ্য টাইম মেশিন’ গল্পটার জন্যে। কারণ, ওই গল্পের আইডিয়া থেকেই এনার্জি পেয়ে আমি শুধু একটা টাইম মেশিন তৈরি করার জন্যে তেরোবছর ধরে লড়ে গেছি।

শেষ পর্যন্ত সেটা তৈরি করতে পেরেছি। তবে ওয়েলস-এর মেশিনের চেয়ে আমার মেশিনটা একটু অন্যরকম। আর যে-কাজে আমার মেশিনটাকে লাগাতে চলেছি সেটাও ওয়েলস-এর ‘টাইম ট্রাভেলার’-এর চেয়ে অন্যরকম।

মানে, আমার টাইম মেশিনটা কাজে লাগিয়ে আমি একটা খুন করতে চলেছি। নিখুঁত খুন। পারফেক্ট মার্ডার। তবে সে-কথায় পরে আসছি।

এই দুনিয়ায় টাকার দরকার কার নেই! আমারও আছে। আর সেই দরকারটা চাগিয়ে উঠেছে গত পনেরোবছর ধরে হাজারোরকমের যন্ত্রপাতি তৈরি করার নেশায় পাগলের মতো খরচ করার জন্যে। তাই আমার টাইম মেশিন তৈরির পেছনে একনম্বর মোটিভেশান ছিল টাকা। দু-নম্বরে যশ, খ্যাতি এটসেটরা। তারপর…।

মোটের ওপর আর যা-ই থাক, মার্ডারটা আমার প্ল্যানে ছিল না। সেটা আচমকা মাথায় ঢুকে পড়েছিল। তা ছাড়া যখন আপনি জানেন যে, খুন করলেও পুলিশ আপনার চুলের ডগাও স্পর্শ করতে পারবে না—আপনি সৎ-সাচ্চা নাগরিকের মতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, তখন তো সাহস বাড়বেই!

মেশিনটা আবিষ্কার করার পর ওটা নিয়ে ছোটখাটো কয়েকটা টেস্ট করলাম। যখন দেখলাম, ব্যাপারটা মোটামুটি ঠিকঠাক আছে, তখন আনন্দে এক অদ্ভুত চিৎকার করে লাফিয়ে উঠেছিলাম। তাতে গ্যারাজের নীচু সিলিং-এ মাথা ঠুকে গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই প্রথম আনন্দের ঝলকটা ছিল নিখাদ আবিষ্কারের উল্লাস—জেনুইন বিজ্ঞানীদের যেমনটা হয়ে থাকে। তখন কিন্তু টাকা, বড়লোক—এসব ব্যাপার মাথায় ছিল না।

প্রায় দু-দিন এই ‘মহান’ আবিষ্কারের ব্যাপারটা চেপে রাখলাম। বন্ধুবান্ধব, রিলেটিভ কাউকে বললাম না। এমনকী জিনিয়ার কাছেও ভাঙলাম না। কিন্তু দু-দিন পেরোনোর পর এই খুশির খবরটা চেপে রাখতে গিয়ে আমার দম প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

শেষ পর্যন্ত, তিনদিনের দিন, সাড়ে আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে চা খেতে-খেতে জিনিয়াকে বললাম, ‘একটা দারুণ খবর দেব—।’

ও টিভিতে কী একটা নাচের প্রোগ্রাম দেখছিল। তেরছাচোখে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ‘কী খবর? এইমাত্র নিউজপেপারে পড়লে?’

‘না, না, আমার একটা নতুন ইনভেনশান। একটা ইউনিক মেশিন। টাইম মেশিন। সারা পৃথিবী একেবারে চমকে যাবে। আমাদের…।’

‘চা-টা একবার সিপ করে দ্যাখো তো, চিনি ঠিক আছে কি না।’ খবর পড়ার ঢঙে নিষ্প্রাণ গলায় জিনিয়া বলল।

না, ওর কোনও দোষ নেই। আমাদের বিয়ের পর দশবছর ধরে আমার নানান আবিষ্কারের এক্সক্লুসিভ খবর শুনে-শুনে ও ক্লান্ত।

প্রথম-প্রথম ও এইসব খবর শুনে খুশি হত। তারপর একসময় লক্ষ করলাম, ও বিরক্ত হয়। ওর রিঅ্যাকশানগুলো কেমন তিরিক্ষে, ব্যঙ্গের খোঁচায় খচিত। আর ইদানিং ওর প্রতিক্রিয়া নির্লিপ্ত, তিব্বতী ইয়াকের মতো।

আমি ওকে বললাম যে, চায়ে চিনি ঠিক আছে এবং আমি একটা অভিনব আবিষ্কার করেছি।

ও আবেগহীন গলায় বলল যে, আবিষ্কারটা অবশ্যই অভিনব, সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো, এবং নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সম্ভাবনায় প্রেগন্যান্ট। এটার জন্যে ও আমাকে হার্দিক অভিনন্দন জানাচ্ছে।

কথাগুলো বলেই ও চায়ের কাপ হাতে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। একটা সোফায় গা এলিয়ে টিভির নাচে এবং চায়ে মনোযোগ দিল।

আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকালাম। তারপর সামনের খোলা বারান্দায় চোখ রাখলাম। সকালের রোদ, বাইরের গাছপালার সবুজ, নীলচে আকাশ— সব সত্যি। আমার টাইমে মেশিনও। কিন্তু জিনিয়া শেষের সত্যিটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারছে না। সব তাবড়-তাবড় বিজ্ঞানীর কপালেই এইরকম হেনস্থা জুটেছে।

এমনিতে জিনিয়া খুব ভালো মেয়ে। দেখতে ভালো। ফিগার চমৎকার। সর্বাঙ্গে প্রচুর হাতছানি। তা ছাড়া গুণও আছে। একসময় নাচের চর্চা করত। এখন প্রায়ই ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নৃত্যনাট্যের রিহার্সাল করায়। রবীন্দ্র-জয়ন্তী আর নজরুল-জয়ন্তীতে সেগুলো প্রদর্শিত হয়। প্রশংসাও পায় প্রচুর। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এসব ব্যাপারে ও সত্যিই মাহির।

শুধু ইনভেন্টর স্বামীর ব্যাপারে ও একটু বেশি টায়ার্ড।

নিজের পাগলামোয় টায়ার্ড আমিও ছিলাম। কারণ, গত পনেরোবছরে বেশ কয়েকটা ছোটখাটো আবিষ্কার করতে পারলেও আমার অসমাপ্ত কিংবা ব্যর্থ আবিষ্কারের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু তিনদিন আগে টাইম মেশিনটা আবিষ্কারের পর আমি আবার টগবগিয়ে উঠেছি। এটাই পৃথিবীর প্রথম সফল বাস্তবের টাইম মেশিন। এটা কল্পবিজ্ঞান নয়—বিজ্ঞান। এর আবিষ্কারের নাম দেবদত্ত রায়চৌধুরী। আমি।

এবারে মেশিনটার কথা একটু বলা যাক।

ব্যাপারটা ব্যাপক কমপ্লিকেটেড হলেও আমি সিম্পল টার্মস-এ বোঝানোর চেষ্টা করছি।

মেশিনটার মাপ একটা ছোট টিভির মতো। তার সঙ্গে লাগানো একটা একফুট বাই একফুট মেটাল প্ল্যাটফর্ম। টাইম ট্রাভেল করতে হলে এই প্ল্যাটফর্মের ওপরে দাঁড়াতে হয়, বা কোনও জিনিস রাখতে হয়। তারপর ডায়াল সেট করে, কিবোর্ডে একগাদা বোতাম ঠুকে, নব ঘুরিয়ে, ‘এন্টার’ বাটন টিপে মেশিনটাকে অ্যাক্টিভেট করতে হয়।

মেটাল প্ল্যাটফর্মটা ভাঁজ করা যায়। ওটা সমেত মেশিনটার ওজন সাড়ে চার কেজি। সুন্দর নীল রঙের একটা চৌকোনা ক্যাবিনেটের মধ্যে ঢোকানো। বাইরে থেকে শুধু কয়েকটা ডায়াল, এলসিডি প্যানেল, একটা কিবোর্ড, আর চারটে নব ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একটা রিচার্জেবল ব্যাটারি মেশিনটার শক্তি জোগায়। মোবাইল ফোনের মতো। চারঘণ্টা চার্জ দিয়ে নিলে মেশিনটা প্রায় ঘণ্টাদুয়েক অ্যাক্টিভ থাকে।

টাইম স্কেলে আমার মেশিনটা সরাসরি পেছনদিকে যেতে পারে না। মানে, অতীতে যাওয়ার ব্যাপারে ওটার কিছু রেসট্রিকশান আছে। যেমন, ধরা যাক, আমি পাস্ট-এ যেতে চাই। যদি আমি পাঁচবছর আগের একটা সময়ে কোনও পারটিকুলার লোকেশানে হাজির হতে চাই, তা হলে সেই সময়ে আমি সেখানে ঠিক যে-অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় তৈরি হয়ে মেশিনটা অপারেট করলে তবেই মেশিনটা আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে। মানে, আমার সবকিছুই সেই পাঁচবছর আগেকার মতো হুবহু এক হতে হবে—এমনকী পোশাক-আশাকও। যাকে বলে জেরক্স কপি। তা না হলে মেশিনটা এলসিডি প্যানেলে ‘মিসম্যাচ ফেলিয়োর’ এরার মেসেজ দেখিয়ে দেবে।

সোজা কথায়, একমাত্র বয়েসটাকে মেশিনটা মিসম্যাচ এরার বলে ধরে না। বাকিগুলোকে ধরে।

এই সমস্যাটির কারণ হল স্পেস-টাইম। অর্থাৎ, অতীতকে কখনও কেউ পালটাতে পারে না। একই বস্তু একই সময়ে দু-জায়গায় থাকতে পারে না।

‘আ সিঙ্গল অবজেক্ট ক্যান নট ফিজিক্যালি একজিস্ট অ্যাট টু ডিফারেন্ট প্লেসেস অ্যাট দ্য সেম টাইম। দ্য অবজেক্ট, ইফ সাবজেক্টেড টু টাইম ট্রাভেল ইন দ্য পাস্ট, উইল অলওয়েজ রিপ্লে ইটস রোল—অফ কোর্স ইগনোরিং দ্য এজিং ফ্যাক্টর—ফ্ললেসলি। আদারওয়াইজ ইট উইল অলওয়েজ কাম আপ উইথ দ্য এরার মেসেজ ”মিসম্যাচ ফেলিয়োর”।’

মেশিনটা তৈরি এবং আবিষ্কারের ধাপগুলো নিয়ে আমি যেবিশাল থিসিস তৈরি করেছি, তারই একটা অংশ আপনাদের মুখস্থ শোনালাম। আমি এর নাম দিয়েছি টাইম মেশিনের ‘একজিস্টেন্স প্যারাডক্স’।

মেশিনটা নিয়ে আমার কয়েকটা ‘স্পেশাল’ কাজ সারা হয়ে গেলেই আমি এই আবিষ্কারটার কথা রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সারা পৃথিবীকে জানাব। তখন আমার থিসিসটাও পাবলিশ করে সারা পৃথিবীর সায়েন্টিস্টদের চমকে দেব। এবং ভারতমাতার মুখ উজ্জ্বল করব।

‘অতীত’ নিয়ে মেশিনটার এই প্রবলেম থাকলেও ‘ভবিষ্যৎ’ বেশ উজ্জ্বল। যদি মেশিনটার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি নিজে ভবিষ্যতে চলে যাই তা হলে ‘বর্তমান’ থেকে আমি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাব এবং আমার ডায়াল সেট করা জায়গায় আমার ‘আবির্ভাব’ ঘটবে। সেখানে যতক্ষণ খুশি আমি থাকতে পারি—কিন্তু সেই সময়টুকু মেশিনটার কাছে আমাকে দেখা যাবে না। আবার যখন আমি ফিরে আসব তখন আমাকে মেশিনটার প্ল্যাটফর্মের ওপরে হঠাৎ করে ‘আর্বিভূত’ হতে দেখা যাবে।

সোজা কথায়, সময়ের একমুখী গতিকে কিছুতেই থামানো যাবে না, বদলানো যাবে না।

এই ‘একজিস্টেন্স প্যারাডক্স’ নিয়ে আগের বিজ্ঞানীরা ভাবেননি।

ভাগ্যিস ভাবেননি! ভাবলে আমার কপালে এই কৃতিত্ব আর জুটত না।

জিনিয়ার কাছ থেকে বরফের মতো ‘উষ্ণ’ অভ্যর্থনা পেয়ে আমি কিন্তু মোটেই দমে গেলাম না। বরং একটা জেদ চেপে গেল মনে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চলে গেলাম একতলার গ্যারাজে—মানে, আমার ল্যাবরেটরিতে। আমার ‘মহান’ আবিষ্কারের দিকে তাকিয়ে আমার আবেগ এবং ইগো একেবারে উথলে উঠল।

ওই তো নীল রঙের বাক্সটা! আমার বিলাভেড ইনভেনশান! ওর কেরামতি দেখিয়ে আমি কি জিনিয়াকে চমকে দিতে পারি না? ওর তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষার মুখের মতো জবাব দিতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি।

একটা আওয়ারা বেড়াল প্রায় বছরতিনেক ধরে আমাদের বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে। জিনিয়া সবসময় ওকে খেতে-টেতে দেয়, লালনপালন করে। আমিও ওকে মাঝে-মাঝে আদর-টাদর করি। তার কারণ, আমার ডিফারেন্ট এক্সপেরিমেন্টের ও-ই হচ্ছে একমাত্র অ্যাভেইলেবল ‘গিনিপিগ’। তাই ওকে আমি ‘গিনিপিগ’ বলেই ডাকি। জিনিয়ার মতে ব্যাপারটা ‘বৈজ্ঞানিক আহ্লাদ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। জিনিয়া ওকে আদুরে নাম দিয়েছে ‘মিন্টি’।

এদিক-ওদিক সামান্য খোঁজাখুঁজি করতেই গিনিপিগকে পেয়ে গেলাম। পাঁউরুটির টুকরো দেখিয়ে ‘আ-আ-তু-তু’ করে ওকে গ্যারাজে নিয়ে এলাম। তারপর টাইম মেশিনের প্ল্যাটফর্মটা ভাঁজ খুলে পেতে দিলাম। গিনিপিগকে তার ওপরে দাঁড় করিয়ে মেশিনের সুইচ অন করে দিলাম। গিনিপিগ ‘মিঁউ-মিঁউ’ করতে লাগল।

আমি ডায়াল সেট করলাম, কিবোর্ডে ঠকাঠক বোতাম ঠুকলাম, নব ঘোরালাম, এবং ঠকাস করে ‘এন্টার’ বাটন টিপে দিলাম।

চোখের পলকে—বিশ্বাস করুন—চোখের পলকে গিনিপিগ উধাও হয়ে গেল। ওর ‘মিঁউ-মিঁউ’-র সুইচ কেউ যেন আচমকা অফ করে দিল।

সঙ্গে-সঙ্গে দোতলা থেকে জিনিয়ার চিৎকার শুনতে পেলাম। গিনিপিগকে হঠাৎ শূন্য থেকে হাজির হতে দেখে ও ভয়ে চিৎকার করে উঠেছে।

আমি দুদ্দাড় করে দোতলায় ছুটলাম।

ড্রইং-ডাইনিং-এ ঢুকে দেখি জিনিয়ার টিভি দেখা মাথায় উঠেছে। ও সোফা ছেড়ে উঠে ঝুঁকে পড়েছে আহ্লাদী গিনিপগের ওপরে। অবাক হয়ে কাতর গলায় বলছে, ‘ও মা, মিন্টিসোনা! তুই এখানে কী করে এলি?’

আমি বেশ গর্বের সঙ্গে বললাম, ‘আমি পাঠিয়েছি—।’

‘কী? এইটুকু বেড়ালকে তুমি একতলা থেকে দোতলায় ছুড়ে দিলে!’

আমি তাড়াতাড়ি হাত-পা নেড়ে ওকে আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলাম, ‘না, না—ছুড়িনি, ছুড়িনি। আমার টাইম মেশিন ওকে এখানে পাঠিয়েছে। এক্ষুনি ও আবার চলেও যাবে—নীচের গ্যারাজে…।’

‘তুমি ওকে…তুমি ওকে…।’ জিনিয়া রেগে-টেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল।

কিন্তু তার আগেই গিনিপিগ ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমি ওকে দু-মিনিটের জন্যে ফিউচারে পাঠিয়েছিলাম।

জিনিয়াকে হতবাক অবস্থায় ফেলে রেখে আমি আবার একতলায় ছুট লাগালাম। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছিল। জিনিয়াকে সকাল-সকাল আচ্ছা টাইট দেওয়া গেছে। আমার এই জয়টাকে স্ত্রীর উপেক্ষায় জর্জরিত বিজ্ঞানীদের উৎসর্গ করলাম।

চাঁদনি চকে আমার ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টস-এর একটা দোকান আছে। দোকানের নাম ‘সুপার ইলেকট্রনিক্স’। দোকানটা মাপে ছোট হলেও বেশ চালু দোকান। আমি আর দুজন ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট মিলে দোকান সামলাতে বেশ হিমসিম খাই। দোকানের রোজকার সেল সাত থেকে দশ হাজার টাকা।

অ্যাসিস্ট্যান্টদের মধ্যে একজনের নাম তারক, অন্যজনের নাম সতু। তারক রোগা-পাতলা। একটা চোখ সামান্য লক্ষ্মীট্যারা। সবসময় পানমশলা চিবোচ্ছে, চোয়াল নড়ছে, আর ঘনঘন পিক ফেলছে।

সতুর চেহারা বেশ ভারী। চালচলন গুরুগম্ভীর। খদ্দেরদের সঙ্গে খেঁকিয়ে কথা বলাটা বেশি পছন্দ করে। ওকে সবসময় ‘আঃ, সতু…কেয়ারফুল।’ বলে ডাক দিতে হয়। এ ছাড়া ওর এফ. এম. চ্যানেল শোনার প্রবল বাতিক। ওর জন্যেই আমাকে দোকানে সবসময় রেডিয়ো চালিয়ে রাখতে হয়।

ওদের দোষ যতই থাকুক, একটা গুণ বেশ তারিফ করার মতো। ওরা দুজনেই খুব অনেস্ট। দরকার হলে চেয়ে নেবে, কিন্তু লুকিয়ে ক্যাশবাক্সে হাত ঢোকাবে না।

পরের টেস্টটার জন্যে আমি ‘সুপার ইলেকট্রনিক্স’-কে বেছে নিলাম।

কিন্তু তার আগে থিয়োরিটা শেষবারের মতো খতিয়ে দেখার জন্যে আমি একজন সরল পণ্ডিত মানুষের খোঁজ করে চললাম। কারণ, একটা আউটডোর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করার আগে ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু এক্সপার্ট কমেন্টস দরকার। আর সেই এক্সপার্টকে হতে হবে সরল—যাতে আমার কথায় তিনি সন্দেহ না করে বসেন। এবং পণ্ডিত—যাতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মতামতে কোনও ভেজাল না থাকে।

অনেক খোঁজখবর করে আমার পাড়ার বন্ধু সুবীরের এক জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হল। ভদ্রলোকের নাম মণিমোহন সরখেল। ফিজিক্সের রিটায়ার্ড প্রফেসর। প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিলেন। পরে সেখানেই অধ্যাপক। তারপর আমেরিকায় চলে যান। বহুবছর ক্যালটেক-এ ছিলেন, আর তিনবছর স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে। মানে, সিভি যাকে বলে ব্যাপক ঘ্যাম।

একদিন বিকেলে সুবীর আমাকে প্রফেসর সরখেলের কাছে নিয়ে গেল। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘জেঠু আমার ছোটবেলাকার বন্ধু, দেবু—দেবদত্ত রায়চৌধুরী। ও খুব নামকরা ইয়ে…’ মাঝপথে আটকে গিয়ে সুবীর আমার দিকে তাকাল: ‘কী বলে যেন তুই নিজের পরিচয় দিস?’

আমি লজ্জা পেয়ে গিয়ে চোখ নামিয়ে বললাম, ‘ওই ইনভেন্টর…মানে, বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় মজা করে বলি আর কী!’

প্রফেসর সরখেল ভুরু কুঁচকে কপালে ভাঁজ ফেলে গোরিলার ঢঙে আমার দিকে তাকালেন, ‘ইনভেন্টর? অ। তা কী নিয়ে পড়াশোনা করেছ?’

ব্যস, শুরু হল তাঁর হামানছেঁচা জেরা। একেবারে সি. বি. আই.-এর বাবা। আমি কোত্থেকে পাশ করেছি। কতদূর লেখাপড়া করেছি। কী নিয়ে গবেষণা করেছি। কোন-কোন জার্নালে রিসার্চ পেপার পাবলিশ করেছি। ফরেনে গেছি কিনা। এবং, সবশেষে, এ পর্যন্ত আমি কী-কী ইনভেন্ট করেছি।

ওঁর প্রশ্নের ধাক্কায় আমি ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। নির্বিঘ্নে আমার সব প্রশ্নের উত্তর এই মানুষটার কাছ থেকে বের করতে পারব তো? নাকি এই বৃদ্ধই আমার পেট থেকে সব মতলব টেনে বের করে চারদিকে ছড়িয়ে ছত্রখান করে দেবেন?

আমি বৃদ্ধ বাঘা বিজ্ঞানীটিকে হাঁ করে দেখছিলাম।

ফরসা মোটাসোটা গাবলু চেহারা। মাথায় টাক, তাকে ঘিরে বাউন্ডারি ওয়ালের ঢঙে ধবধবে সাদা চুল। গালে খোঁচা-খোঁচা সাদা দাড়ি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। চশমার কাচের ওপরে সাদা ভুরুর ঝালর উঁকি মারছে। দু-দিকের গাল বার্ধক্যের ভারে ঝুলে পড়েছে। গায়ে সাদা ফতুয়া, পায়ে পাজামা।

প্রফেসর সরখেল একটা মোটা বাঁধানো বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে হাতে ধরে ছিলেন। আমাকে জেরা করার কাজ শেষ হতে বইটা শব্দ করে সামনের টেবিলে রাখলেন। একটা ‘হুম’ শব্দ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে সরাসরি আমার দিকে তাকালেন: ‘বলো, কী বলবে?’

আমি কয়েকবার ঢোক গিলে বললাম, ‘লাস্ট দু-চারবছর ধরে আমি একটা টাইম মেশিন ইনভেন্ট করার কথা ভাবছি। আমার কনসেপ্টগুলো…।’

ধীরে-ধীরে আমার আইডিয়ার নিরীহ অংশগুলো ওঁকে বললাম।

সুবীর একফাঁকে অন্দরে চলে গিয়েছিল। বোধহয় চা-বিস্কুটের বন্দোবস্ত করতে। কারণ, ও ফিরে আসার একটু পরেই এটি অল্পবয়েসি মেয়ে আমাদের তিনজনের জন্যে চা ইত্যাদি টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেল।

আমার সব কথা মন দিয়ে শোনার পর প্রফেসর সরখেল কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। তারপর চোখ খুলে চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসালেন। চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তোমার ব্যাপারটা আসলে টেলিট্রান্সপোর্টেশান অফ ম্যাটার। মানে, আই মিন, কোনও একটা জিনিসকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় পাঠানো। মানে, ম্যাটারকে যেভাবেই হোক এনার্জিতে কনভার্ট করতে হবে। তারপর সেই এনার্জিকে লাইটের ভেলোসিটিতে আর-এক জায়গায় পাঠাতে হবে। সেখানে পৌঁছনোর পর সেই এনার্জিকে, আই মিন, রিকনভার্ট করতে হবে ম্যাটারে। আর পুরো ট্রান্সপোর্টেশানটাই তোমার হবে গিয়ে হাইপারস্পেস দিয়ে…।’

সুবীর অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘জিনিসটা ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসবে?’

মণিমোহন গম্ভীরভাবে ভাইপোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আসবে। তোমার তাতে আপত্তি থাকতেই পারে। তুমি তো আর্টস-এর ছাত্র ছিলে—।’

সুবীর আর্টস-এর ছাত্র ছিল ঠিকই তবে এখন ‘সিটিজেন ফিনান্স’ নামে একটা ঘ্যাম কোম্পানির একজিকিউটিভ ডায়রেক্টর। কিন্তু হলে কী হবে, বিজ্ঞানী জেঠুর কাছে ওর ওজন তিলতুল্য। তাই ও কাঁচুমাচু হয়ে মুখে কুলুপ আঁটার শপথ নিল বলে মনে হল।

প্রফেসর সরখেল আমার দিকে তাকিয়ে বলে চললেন, ‘মানে, আইনস্টাইনের ইকুয়েশান। ম্যাটার টু এনার্জি, এনার্জি টু ম্যাটার। রিভারসিবল প্রসেস। সবটাই হবে ফোর্থ ডায়মেনশান—আই মিন, ওই যে বললাম—হাইপারস্পেস দিয়ে…। শুধু কনভারশনটা হবে একটা লোকেশানের। আর রিকনভারশন হবে অন্য আর-একটা লোকেশানে। তবে লোকেশানের ডেটাগুলো ঠিকঠাক হওয়া দরকার…।’

‘যদি ম্যাটার পাঠানোর সময় মেশিনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়? তার জন্যে কোনও প্রোটেকশান সাজেস্ট করতে পারেন?’ আমি এবারে আমার সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। ‘সুপার ইলেকট্রনিক্স’-নিয়ে পরীক্ষায় নামার আগে নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখা দরকার।

‘দ্যাখো, যদি এরকম কোনও মেশিন কখনও তৈরি করা যায় তা হলে তাতে টেলি- ট্রান্সপোর্টেশান-এর ব্যাপারটা ঘটবে আলোর গতিতে। বলতে গলে একপলকে। ধরো, লাইটের ভেলোসিটি সেকেন্ডে প্রায় তিনলক্ষ কিলোমিটার। আর আমাদের পৃথিবী পরিধি হল চল্লিশহাজার কিলোমিটার। মানে, একসেকেন্ডে আলো পৃথিবীকে সাড়ে সাতবার পাক মেরে আসবে। সুতরাং, তুমি সেফলি বলতে পারো, ট্রান্সপোর্টেশান-এর ওই পারটিকুলার মোমেন্টে তোমার মেশিনটা খারাপ হওয়ার চান্স প্র্যাকটিক্যালি জিরো। নাঃ, থিয়োরিটিক্যালি আমি তো কোনও প্রবেলম দেখছি না।’ মাথা নেড়ে শ্রাগ করলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী।

‘ধরুন, কোনও অবজেক্টকে অন্য জায়গায় পাঠালাম। তারপর যদি মেশিন ব্রেকডাউন হয়?’

‘এর আনসার খুব সিম্পল—’ দু-হাত ঘুরিয়ে নাড়ু পাওয়ার ভঙ্গি করলেন মণিমোহন: ‘জিনিসটা ওখানেই থেকে যাবে—মেশিন ঠিক না হওয়া পর্যন্ত। মেশিন ঠিক হলেই সেটা ফেরত আনা যাবে। আই মিন, থিয়োরিটিক্যালি এটাই লজিক্যাল…।’

মেশিন যদি আর কোনওদিন ঠিক না হয়? কেউ যদি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ওটাকে চিরকালের জন্যে বিকল করে দেয়? কিংবা ওটার সুইচ অফ করে শাট ডাউন করে দেয়?

সে-কথা আর সুবীরের জেঠুকে জিগ্যেস করলাম না। তবে একটা ছোট্ট ভয় আমার মনে দানা বাঁধল।

মণিমোহন জিগ্যেস করলেন, ‘যন্ত্রটা নিয়ে তুমি কদ্দূর এগিয়েছ?’

‘এগোইনি। থিয়োরিটিক্যাল কনসেপ্টগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি।’

‘বেশ, বেশ। তোমার ব্যাপারটায় আমার ইন্টারেস্ট রইল।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে একটা শব্দ করে উঠে দাঁড়ালেন: ‘কিছু মাইন্ড কোরো না। একটু প্রেশার আসছে—টয়লেটে যেতে হবে।’

আমি আর দেরি করলাম না। সুবীরকে ‘মেনি-মেনি থ্যাংকস’ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

বাড়িতে এসে মেশিন নিয়ে প্রবল প্র্যাকটিস শুরু করলেন। জিনিয়া যখন বাড়িতে থাকে না তখন সদর দরজা বন্ধ করে নিজে মেশিনের পাটাতনে দাঁড়িয়ে মেশিন চালু করে নিজেকে যেখানে-সেখানে পাঠাতে লাগলাম। কখনও দোতলায় হুস করে হাজির হলাম, কখনও ছাদে গেলাম, কখনও মাস্টার বেডরুমে গেলাম—রান্নাঘর, বাথরুম কিছুই বাদ রাখলাম না।

প্রতিক্ষেত্রেই আমি একমিনিট বা দু-মিনিট টাইম সেট করে ‘রওনা’ হয়েছিলাম। ফলে একবার ছাড়া প্রত্যেকবার গ্যারাজের ভেতরেই ফিরে এলাম। শুধু লোকেশান সেট করার সময় জিয়োগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশান আর ফিগারেটিভ ডেটায় কিছু অ্যাপ্রক্সিমেশান থাকায় একেবারে সঠিক জায়গায় হাজির হচ্ছিলাম না। একটু-আধটু এদিক-সেদিক হয়ে যাচ্ছিল। আর ফিউচারে অন্য লোকেশানে পৌঁছে যদি আমি সেখানে হাঁটাহাঁটি করে পজিশান শিফট করি তা হলে টাইম মেশিনের প্ল্যাটফর্মে ফিরে না এসে দু-দশহাত দূরে অন্য জায়গায় ফিরে আসছিলাম। একবার তো গ্যারাজের বাইরে করিডরে এসে ল্যান্ড করলাম!

তখনই ঠিক করলাম, ফিউচারে অন্য লোকেশানে পৌঁছে আমি পজিশান সম্পর্কে সবসময় অ্যালার্ট থাকব।

সাতদিনের অক্লান্ত চেষ্টায় টাইম মেশিনের টার্গেট ডেস্টিনেশানের পজিশান বা কো-অর্ডিনেট এরারকে মিনিমাইজ করে ফেললাম। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এইবার ‘সুপার ইলেকট্রনিক্স’-এর পরীক্ষায় নামা যায়।

পরীক্ষাটা খুবই সামান্য, তবে আমার দ্রুত বড়লোক হওয়ার প্রজেক্টের এটাই প্রথম মেজর স্টেপ।

এক শনিবার ‘জরুরি কাজ আছে’ বলে সতু আর তারককে দোকানে রেখে আমি বেরিয়ে গেলাম। ওদের বললাম, বিক্রিবাটার টাকা ঠিকমতো গুনে-গেঁথে ওরা যেন ক্যাশবাক্সেই রেখে দেয়। তারপর দোকান বন্ধ করে চাবির গোছা যেন আমার বাড়িতে ‘বউদি’-র কাছে পৌঁছে দেয়। আমি পরে যা ব্যবস্থা করার করব।

ব্যাপারটা মালিকের নির্দোষ নির্দেশ বলে মনে হলেও আসলে তা নয়। ওদের চাকরিজীবনে ওরা কখনও এরকম নির্দেশ আগে পায়নি। আমি জানতাম, ওরা আমার কথামতো কাজ করবে। তাই গভীর রাতে নিশ্চিন্তে আমার টাইম মেশিনে চড়ে বসলাম। তারপর ডায়াল, কিবোর্ড, নব—হুউস।

প্রথম চেষ্টায় আমি হাজির হলাম আমার দোকানের বাইরের রাস্তায়। আমি টাইম সেট করেছিলাম একমিনিট। যদি দোকানের ভেতরে ঠিকমতো হাজির হতে পারতাম তা হলে ক্যাশবাক্স খুলে ক্যাশ নিয়ে আমার গ্যারাজে ফিরে আসার পক্ষে সময়টা যথেষ্ট। কিন্তু নির্জন রাস্তায় হঠাৎ গজিয়ে উঠে একমিনিট ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পক্ষে সময়টা যথেষ্টর চেয়েও একশোগুণ বেশি। তা ছাড়া এতে বিপদও অনেক।

তো সেই বিপদে পড়লাম।

আমাকে ম্যাডান স্ট্রিটের মাঝখানে হঠাৎই শূন্য থেকে গজিয়ে উঠতে দেখে ফুটপাতে আধশোয়া অবস্থায় পড়ে থাকা একটা মাতাল আনন্দে চেঁচিয়ে লাফিয়ে উঠল। আমি কিছু করে ওঠার আগেই ছুটে এসে আমার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। হাঁউমাঁউ করে বলতে লাগল, ‘এতদিনে দর্শন দিলে, ভোলেবাবা! কিছু মালকড়ি দাও, প্রভু। তোমার নির্দেশমতো রোজ মাল-টাল খাই। ওই মাল টানার জন্যেই কিছু মালপানি দাও, বস। জয় ভোলেনাথ!’

আমার পজিশান চেঞ্জ করলে যদি টাইম মেশিনে আবার ফিরে যেতে না পারি! শুধু এই ভয়ে আমি মাতালটার কাছ থেকে ছুটে পালাতে পারছিলাম না।

শুনশান রাস্তায় সে এক কেলেঙ্কারি! ফুটপাতে এখানে-ওখানে আর যারা সব শুয়ে আছে তারা না জেগে ওঠে!

এদিক-ওদিক তাকালাম।

দূরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে গেল। রাস্তার লাইটগুলো নীরব সাক্ষী হয়ে জেগে বসে আছে। মাঝে-মাঝে কুকুরের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। রাত দুটোয় রাস্তাঘাটের অবস্থা যেমন হয়।

মাতালটা কেঁদে-কঁকিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই একমিনিট পূর্ণ হল। ওর ঝাপসা চোখের সামনে আমি ভ্যানিশ হয়ে গেলাম।

দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় আমি সাকসেসফুল হলাম। ‘এন্টার’ বোতাম টেপার পরই দেখলাম, আমি আমার দোকানের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েই আছি।

অন্ধকার যে থাকবেই সেটা আগে থেকেই আমার মাথায় ছিল। তাই চট করে পকেট থেকে ছোট একটা টর্চলাইট বের করে নিলাম। ক্যাশবাক্সের চাবি সঙ্গে ছিল। বাক্স খুলে ক্যাশের টাকা গুছিয়ে নিতে পনেরো সেকেন্ডের বেশি লাগল না। তারপর একমিনিট পুরো হতেই…হুউস। দোকান থেকে আমি ভ্যানিশ হয়ে গেলাম। পলকে চলে এলাম আমার ল্যাবরেটরিতে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি টাকার গোছা ঠিকমতোই রয়েছে।

এই পরীক্ষাটা সাকসেসফুল হতেই আমার কনফিডেন্স লেভেল বেড়ে গেল। এবং আমি বড়লোক হওয়ার কাজে নামলাম।

প্রথমেই বলে রাখি, ব্যাংক-ট্যাংক-কে আমি আমার টার্গেট লিস্টের মধ্যে রাখিনি। কারণ, ব্যাংকে সব কিছু ভল্ট বা সিন্দুকে নিরাপদে রাখা থাকে। ওগুলোর তালা ভাঙা আমার এলেমের বাইরে। আবার ব্যাংকিং আওয়ার্স-এ যখন নোটের বান্ডিল ছড়ানো-ছেটানো থাকে তখন গাদাগুচ্ছের লোকজনও তার সামনে দারোয়ান হয়ে হাজির থাকে।

সুতরাং, আমার টার্গেট হল ছোটখাটো দোকান। যাদের ক্যাশবাক্স খোলা থাকে এবং হাঁটকালে অল্পবিস্তর টাকা পাওয়া যায়।

আমি জানতাম যে, আমার সামনে অঢেল সময়—কোনও তাড়াহুড়ো নেই। সপ্তাহে দুটো কি তিনটে অপারেশান করলেই চলবে। তা ছাড়া ক্যাশ সরে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে দোকানদাররা যাতে থানা-পুলিশ বা হইচই না করে সেজন্যে আমি খুব সূক্ষ্মভাবে কাজ করে চললাম। অর্থাৎ, এক-একটা দোকান থেকে মাত্র দুশো-পাঁচশো কি হাজার টাকা সরাতে লাগলাম। এতে বেশিরভাগ মালিকই ভাববে, ব্যাপারটা তাদের গোনার ভুল।

নির্বিঘ্নে কাজ চালাতে লাগলাম। মাসে আট-দশহাজার টাকা বাড়তি ইনকাম হতে লাগল। আমি জানি, অতি লোভ না করে ধৈর্য ধরে কাজ করে গেলে আরও সুযোগ আসবে—আয়ও অনেক বাড়বে।

সুতরাং, ধৈর্য—শুধু ধৈর্য।

এইসব অপারেশান করার আগে আমাকে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করতে হত। দোকানের লোকেশান, ক্যাশ কোথায় রাখে, ক’টায় দোকান খোলে, ক’টায় বন্ধ হয়, দোকানের ভেতরে কেউ রাতে শুয়ে থাকে কিনা, সম্ভব হলে মালিক কোথায় থাকে—এসব তথ্য জোগাড় করে আমাকে রীতিমতো স্টাডি করতে হত।

এইভাবে কাজ করতে-করতে আমার সামনে একটা বড় সুযোগ এসে গেল। একটা প্রিমিয়াম কাপড়ের দোকান থেকে সাড়ে এগারো লাখ টাকা সরানোর সুযোগ পেলাম। চোখের সামনে অতগুলো টাকা দেখে আমার নিয়ত খারাপ হয়ে গেল। সূক্ষ্ম ব্যাপার-ট্যাপার সব ভুলে গিয়ে পুরো টাকাটাই লোপাট করে দিলাম। মনে-মনে ঠিক করলাম, যদি এই মিস্টিরিয়াস চুরি নিয়ে খুব হইচই হয় তা হলে আমি থামব। এক-দু-বছর চুপচাপ থাকব। তারপর সব থিতিয়ে গেলে আবার আমি বড়লোক হওয়ার প্রজেক্টে হাত দেব।

তাই করলাম। এবং একটা ছোট্ট গন্ডগোল হওয়ায় আমাকে থামতেই হল।

টাকাটা পরিমাণে বেশি ছিল বলে আমার গায়ের জামা খুলে নোটগুলো পুঁটলি বাঁধতে হয়েছিল। তখনই কীভাবে যেন আমার পকেটের রুমালটা স্পটে পড়ে যায়। আর জামার একটা বোতাম খসে পড়ে। সেগুলো নিয়ে প্রচুর ঝামেলা হল। পুলিশ-কুকুর লাগানো হয়। খবরের কাগজে লেখালেখি হয়। আমি ভয়ে জামাটা পুড়িয়ে ফেলি।

কিন্তু একটা ঘটনা থেকে আর-একটা ঘটনা যে কীভাবে গড়ায় সেটা কেউ জানে না।

একদিন রাতে যখন শার্টটা পোড়াচ্ছি তখন জিনিয়া সেই পোড়া গন্ধ পেল। ও ছুটে এল ড্রইং-ডাইনিং-এর টয়লেটের কাছে।

‘এই মাঝরাতে কী করছ?’ ভুরু কুঁচকে ও জানতে চাইল।

‘এই…ইয়ে…শার্টটা পোড়াচ্ছি…।’ আমতা-আমতা করে বললাম।

‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু পোড়াচ্ছ কেন?’

‘আমার…আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট-এ লাগবে।’ চট করে যা মাথায় এল বলে দিলাম।

‘এক্সপেরিমেন্ট? নাকি লিপস্টিকের দাগ লেগেছিল?’

‘লিপস্টিক? লিপস্টিক কোথা থেকে আসবে?’ দু-চোখ কপালে তুললাম আমি।

জিনিয়া ওর গালের পাশ থেকে চুল সরিয়ে বেশ খোঁচা দেওয়া গলায় বলল, ‘কোথা থেকে আবার আসবে? যেখান থেকে আসে—কোনও দুশ্চরিত্র ছেনাল মেয়ের ঠোঁট থেকে…।’

এ-মন্তব্য আমি কল্পনাও করিনি। এতটাই অবাক হয়ে গেলাম যে, আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না।

জিনিয়া আমাকে এখনও সন্দেহ করে? আশ্চর্য! দ্রৌপদীর ব্যাপারটা তা হলে ও ভোলেনি!

বিয়ের বছর-পাঁচেক পর একবার একটা গায়েপড়া মেয়ের সঙ্গে আমার সামান্য ইয়ে হয়েছিল। ওর নাম ছিল দ্রৌপদী। ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট কিনতে প্রায়ই আমার দোকানে আসত। তারপর কথাবার্তায় বুঝতে পারে যে, এ-বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা আছে। তখন দোকানে ওর আসা-যাওয়া বাড়ে। দরকার পড়লেই আমাকে মোবাইলে ফোন করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ও দরকার ছাড়াই ফোন করা শুরু করে।

এরপর একদিন দ্রৌপদীকে একটা সার্কিটের অপারেশান দেখানোর জন্যে আমি বাড়িতে নিয়ে আসি। জিনিয়ার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। জিনিয়া ওকে বন্ধুর মতো মেনে নেয়।

দিন যায়। দ্রৌপদীর সঙ্গে বন্ধুত্বটা আমার বাড়তে থাকে। না, ওটা কখনও প্রেম-টেম-এর দিকে টার্ন নেয়নি। কিন্তু জিনিয়ার কয়েকটা খোঁচা দেওয়া কথায় একদিন বুঝলাম ব্যাপারটা ওর ভালো লাগছে না। ও একটা ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স-এ ভুগছে। তার ওপর বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি বলে কমপ্লেক্সটা হাইপারবোলিক এক্সপ্যানশান হয়ে বীভৎস চেহারা নিয়েছে।

আমি ব্যাপারটা বুঝতাম। তাই কখনও পালটা আঘাত না দিয়ে ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি।

একদিন জিনিয়া আমাকে আর দ্রৌপদীকে সাউথ সিটি মল থেকে বেরোতে দ্যাখে। ব্যাপারটা একেবারেই নির্দোষ ছিল। দ্রৌপদী একটা হ্যান্ডব্যাগ কেনার জন্যে ওখানে যাচ্ছিল। আর আমার দুটো জিনস কেনার ছিল। তাই চাঁদনি থেকে দুজনে সাউথ সিটি মল-এ গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু এই কাকতালীয় ব্যাপারটা বাড়িতে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। সে-বিস্ফোরণ নাইন/ইলেভেন-এর বিস্ফোরণের চেয়েও মারাত্মক।

আমাকে ক’দিন তুলোধোনা করার পর দ্রৌপদীকেও টেলিফোনে জঘন্য অপমান করেছিল জিনিয়া। সেসময়ে ওকে দেখে আমার মনে হয়নি ওর মধ্যে কোনও শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা রুচি-সভ্যতার ছাপ আছে।

তখন আমার মনে একটা বাজে ইচ্ছা চেপেছিল। কিন্তু নানান অসুবিধের কথা ভেবে ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দিই। কারণ, তখনও তো আমার টাইম মেশিন তৈরি হয়নি।

এরপর থেকে আমি বরাবর জিনিয়ার অকারণ সন্দেহের আওতায় থেকে গেছি। প্রায় বছরখানেক জিনিয়া নর্মাল ছিল। নাচের রিহার্সাল, নাচের প্রোগ্রাম—এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাতে আমি ভেবেছিলাম, সন্দেহবাতিকটা অবশেষে গেছে। কিন্তু এখন বুঝলাম, ব্যাপারটা সহজে যাওয়ার নয়।

আমি কাতরভাবে বললাম, ‘জিনিয়া, প্লিজ, তুমি ভুল ভাবছ। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি…।’

‘তুমি যদি ক্লিন হও তা হলে আমাকেই শার্টটা পোড়ানোর দায়িত্ব দিতে পারতে। একা-একা মাঝরাত্তিরে চুপিচুপি…ছিঃ!’

জিনিয়া প্রবল চিৎকার করে কথা বলছিল। এখুনি আশেপাশের বাড়ির লোক না জেগে ওঠে!

‘জিনি, প্লিজ—আস্তে…আস্তে। পাড়ার লোকজন এবার জেগে উঠবে। প্লিজ।’ ওর কাছে এগিয়ে গেলাম আমি: ‘শোনো। তোমাকে সবটা খুলে বলছি। আমার এই নতুন এক্সপেরিমেন্টটা হল, কোনও জিনিসকে পুড়িয়ে ছাই করে সেই ছাই থেকে জিনিসটাকে আবার তৈরি করা। রিকনস্ট্রাকশন। বুঝলে? তারই ফার্স্ট স্টেপ হিসেবে এই শার্ট…মানে…।’

সে-রাতে ওকে ঠান্ডা করতে আমার প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, যেহেতু ও আমার বিজ্ঞান-টিজ্ঞান করার ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করে না তাই ওকে লুকিয়ে মাঝরাতে শার্টটা পোড়াচ্ছিলাম।

অনেক ইনিয়েবিনিয়ে ঘ্যানঘেনিয়ে ওকে শান্ত করলাম। একেবারে শেষে কান্নাভাঙা গলায় বলেছি, ‘আমার জীবনে শুধু বিজ্ঞান আর তুমি—এ ছাড়া আর কী আছে বলো? রোজ-রোজ দোকানে যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না…।’

যাই হোক, অনেক কষ্টে জিনিয়ার রোষ থেকে বাঁচলাম। কিন্তু পুরোনো বাজে ইচ্ছেটা আবার মাথা চাড়া দিল। এখন তো আর কোনও প্রবলেম নেই! আমার হাতে টাইম মেশিন আছে।

কিন্তু মনকে বোঝালাম। তোমার হাতে ক্ষমতা থাকলে তাকে সামলে রেখে ব্যবহার করতে হয়। সামান্য টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে—তার চেয়ে বেশি আর এগিয়ো না। নিজের ওপরে কাবু রাখো। ক্ষমতার অপব্যবহার কোরো না। লাগাম—লাগাম! লাগামের কথা কখনও ভুলবে না।

অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে এসব কথা ভেবেছিলাম। মনে-মনে অনেক ভালো-ভালো শপথ নিয়েছিলাম।

কিন্তু সেগুলো যে সাতদিন পরেই চটকে চচ্চড়ি হয়ে যাবে সেটা তখন বুঝতে পারিনি।

কী করেই-বা বুঝব? তখন তো সোনির সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি!

আলাপটা করিয়ে দিয়েছিল সুবীর। ফলে এক অর্থে বলা যেতে পারে আমার অপকর্মের জন্যে সুবীরই দায়ী। ওই যে বলেছি, একটা ঘটনা থেকে আর-একটা ঘটনা যে কীভাবে গড়ায় সেটা কেউ জানে না। ফলে আমার মেন্টাল কন্ডিশান, সুবীরের সঙ্গে দেখা হওয়া, ওর অফিসের পার্টিতে আমার যাওয়া সোনির সঙ্গে পরিচয়, তারপর…।

নাঃ, ব্যাপারটা শুরু থেকেই বলি।

একদিন রাতে খুব ‘মুড অফ’ অবস্থায় সুবীরের সঙ্গে আড্ডা মারছিলাম।

হঠাৎই ও বলল, ‘তোর কী হয়েছে বল তো?’

‘কিছু হয়নি। নিজেকে জাস্ট ফালতু লাগছে…।’

সুবীর সিগারেট খাচ্ছিল। সেটাতে লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘বস, বলো তো, কেসটা কী?’

আমি মুখ খুলতে না চাইলেও সুবীর ভীষণ চাপাচাপি করতে লাগল।

ওর সঙ্গে বেশিক্ষণ পেরে উঠলাম না। শেষ পর্যন্ত জিনিয়ার কথা একটু-আধটু রেখে-ঢেকে ওকে বললাম।

‘জানিস, জিনিয়া সবসময় আমাকে সন্দেহ করে। সায়েন্টিস্ট হিসেবে আমাকে কোনও পাত্তাই দেয় না।’

সুবীর গম্ভীরভাবে সিগারেট টান দিয়ে বলল, ‘দেবু, আমি সায়েন্সের কিছু বুঝি না, কিন্তু তোর কেরিয়ার তো আমি জানি! তা ছাড়া সেদিন তোর আর জেঠুর কথাবার্তা শুনেছি। আমার জেঠু ভীষণ স্নব টাইপের—বিজ্ঞান নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। হাইফাই সায়েন্টিস্ট হলে যা হয় আর কী! কিন্তু তোর সঙ্গে জেঠু যেভাবে কথা বলেছে তাতে আমি এটুকু বুঝেছি যে, তোর মধ্যে সামথিং হ্যাজ। আমি বিশ্বাস করি, তুই একদিন দুনিয়াকে চমকে দিবি…।’

সুবীরের কথাগুলো আমার কানে সান্ত্বনার মতো শোনাচ্ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে এও বুঝতে পারছিলাম, ওর কথাগুলো খুব জেনুইন। ও আমার খুব কাছের বন্ধু।

হঠাৎ আমাকে ছোট্ট একটা ধাক্কা মারল সুবীর। রকের খিস্তি দিয়ে বলল, ‘ওসব ফালতু চিন্তা ছাড় তো! নে একটা সিগারেট ধরা—’ ও জোর করে একটা সিগারেট গুঁজে দিল আমার হাতে।

আমি এমনিতে স্মোক করি না। হয়তো ছ’মাসে ন’মাসে মুড খারাপ হলে একটা সিগারেট টান দিই। যেমন এখন।

সুবীর আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘কাল দোকান থেকে তাড়াতাড়ি ব্যাক কর। কাল আমাদের অফিসে একটা গ্র্যান্ড পার্টি আছে—কোম্পানির দুর্ধর্ষ বিজনেসের জন্যে। তুই আমার সঙ্গে যাবি—আমার গেস্ট হয়ে।’

আমার কিছু ভালো লাগছিল না। টাইম মেশিন নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার আপাতত শেষ। তার ওপর জিনিয়ার ম্যানিয়া—সঙ্গে ফাউ হিসেবে উপেক্ষা তো আছেই। অঅর সবশেষ আমার নতুন আবিষ্কারটার কথা সবাইকে জানাতে না পারার অসহ্য যন্ত্রণা।

আমার প্রতিবাদ করতে ভালো লাগছিল না বলেই সুবীরের কথায় রাজি হলাম।

পরদিন ওর সঙ্গে পার্টিতে গেলাম। এবং মরলাম।

সেখানে রঙিন বেলুন, হুইস্কি, মিউজিক, নাচ— কী নেই! প্রথম কুড়িমিনিট কোম্পানির সাফল্য নিয়ে প্যানপ্যানানির পর পার্টির হুল্লোড় শুরু হল। এইসব পার্টিতে যে নিয়মকানুনের খুব একটা বালাই থাকে না, সেটা বুঝতে পারলাম।

আমি বোকার মতো ড্রিংক-এর গ্লাস হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, চারপাশে উদ্দাম নাচ চলছে। মনে হল, দুর, এখানে আমি কেন যে এলাম! মাথা উঁচু করে ভিড়ের মধ্যে সুবীরকে খুঁজতে লাগলাম।

হঠাৎই এক ধাক্কায় আমার হাতের গ্লাসটা ছিটকে পড়ল।

চমকে তাকিয়ে দেখি একটি ছিপছিপে লম্বা মেয়ে কোমরে মোচড় দিয়ে পেছনদিকে ঘুরে আমার চোখে তাকিয়ে আছে।

আমার মনে এই দৃশ্যটা এখনও ফ্রিজ হয়ে আছে।

‘স—রি,’ লম্বা করে টেনে মেয়েটি বলল।

মোমবাতির আলোয় যে-স্নিগ্ধ সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি মানানসই এ-মেয়েটি সেরকম সুন্দর। ওর মোলায়েম মুখ, সরু চোখ, ধনুকের মতো ভুরু, ছোট অথচ পুরু ঠোঁট, কপালের ওপরে নেমে আসা চুলের ঝালর—সব মিলিয়ে এক প্রশান্ত সৌন্দর্য। যেন সন্ধে নেমে আসা ছায়া-মাখা আলোয় দেখা দিঘির জল। যার কাছে সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্ছ্বলতা হেরে যায়।

একজন বেয়ারা আমার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে কাচের টুকরোগুলো একটা ট্রে-তে তুলে নিচ্ছিল। আশপাশের দু-একজন ছোট-ছোট কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল। ইতিমধ্যে সুবীর কোথা থেকে যেন ছুটে এসে আমার কাছে হাজির হয়ে গেছে।

ব্যাপারগুলো আমার চোখে পড়ছিল কিন্তু মাথার ভেতরে ঢুকছিল না। কারণ, মাথার ভেতরটা চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকা মুখটাকে ঘিরেই ব্যস্ত ছিল।

সাদা টপ। সাদা প্যান্ট। কোমরে মেটালের বেল্ট। গলায় টকটকে লাল ঝকঝকে পাথরের মালা। কানে ছোট-ছোট লাল পাথর।

স্টানিং বিউটি ওকে বলা যায় কি না জানি না, কিন্তু আমি স্টানড হয়ে গেলাম।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আমার মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়াল। আবার টেনে-টেনে বলল, ‘বাবা বললাম তো—স—রি…।’

এবারে সুবীর পরিস্থিতির দায়িত্ব নিল। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। আমি তখন জামা-প্যান্টে চলকে পড়া তরল রুমাল দিয়ে মুছে নেওয়ার চেষ্টা করছি।

ওর নাম সোনি। সুবীরের কোম্পানির ভিপি-র মেয়ে। ফিন্যান্স নিয়ে এম. বি. এ. করলেও সায়েন্সে প্রচুর ইন্টারেস্ট।

আমার কাঁধে হাত রেখে সুবীর বলল, ‘সোনি, আই প্রেজেন্ট টু ইউ মাই হার্ট-টু-হার্ট ফ্রেন্ড—দ্য গ্রেট ইনভেন্টর—দেবদত্ত রায়চৌধুরী।’

‘হোয়াট আ ইউনিক নেম। কমপোজড অফ ফোর সারনেমস! এরকম আমি কখনও শুনিনি—চার-চারটে পদবি দিয়ে তৈরি একটা নাম: দেব, দত্ত, রায়, চৌধুরী। তার ওপর আবার ইনভেন্টর! গ্রেট। বলুন, কী-কী ইনভেন্ট করেছেন আপনি?’

আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। কোনও জবাব দিতে পারলাম না।

মিউজিক বাজছিল। কিন্তু সোনি অনেকক্ষণ নাচ বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর কী যে হল! হঠাৎই খেয়াল করলাম, আমরা দুজনে হলঘরের এককোণে একটা লম্বা সোফায় বসে আড্ডা মারছি। আমার নাকে ওর পারফিউমের গন্ধ আসছে।

‘বলুন, আপনি কী-কী ইনভেন্ট করেছেন?’ পুরোনো প্রশ্নটা আবার করল সোনি, ‘সুবীরদা বলল, আপনি নাকি একজন গ্রেট ইনভেন্টর।’

আমি এখন অনেকটা নরমাল হয়েছি। তাই হেসে বললাম, ‘আমার লেটেস্ট ইনভেনশানটা দারুণ।’

‘কী?’ ওর চোখে আগ্রহ।

‘আপনি। অবশ্য ব্যাকরণ মানতে গেলে ”ডিসকাভারি” বলা উচিত।’

এ-কথায় সোনি হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর হাসি থামলে বলল, ‘ব্যাকরণ আপনি মানেন নাকি?’

‘আগে মানতাম—এখন আর মানি না।’

‘আমিও তাই—।’

‘জানেন, ভীষণ মনখারাপ লাগছিল বলে সুবীর আমাকে জোর করে এই পার্টিতে নিয়ে এসেছে। এখন দেখছি এসে ভালোই হয়েছে—মনখারাপটা আর নেই।’

‘দ্যাটস গুড। এবারে আপনার সত্যিকারের ইনভেনশানের কথা বলুন। ইনভেনশান ব্যাপারটাই খুব ইন্টারেস্টিং।’

আমি ওর আগ্রহ দেখে খুশি হলাম। ওকে আমার কয়েকটা ইমপরট্যান্ট আবিষ্কারের কথা বললাম। যেমন, রুমাল কেচে শুকিয়ে ভাঁজ করার যন্ত্র, ট্রান্সপারেন্ট শিট দিয়ে তৈরি ফ্রিজ, আলট্রাসনিক শোনার স্পেশাল অডিয়ো কনভার্টার, খুব সংক্ষেপে কোনও ছোট মাপের জিনিসের সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি বের করার মেশিন—এইরকম অনেক কিছু। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই টাইম মেশিনের কথা বললাম না।

‘আচ্ছা, সোনি, আপনি কি জানেন সারা জীবনে টমাস আলভা এডিসন মোট ক’টা আবিষ্কার করেছিলেন?’

‘না—ক’টা?’

উনি তেরোশো পেটেন্ট নিয়েছিলেন। এডিসন মেনলো পার্কে থাকতেন। সবাই ওঁকে বলত ”উইজার্ড অফ মেনলো পার্ক”…।’

‘আপনি ক’টা পেটেন্ট নিয়েছেন?’

‘ধুস—’তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মাথা ঝাঁকালাম আমি।

‘বলুন না—প্লিজ!’

‘একুশটা।’ কথাটা বলে মনে হল এ-প্রশ্ন জিনিয়া কখনও আমাকে করেনি। ওর ধারণা, বিজ্ঞান করাটা আমার ভান। আবিষ্কারের কথা বলাটা আমার হিডন ডিজায়ার সংক্রান্ত একটা ম্যানিয়া।

সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন সোনির সঙ্গে গল্পে আমি একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমাদের দুজনের চিন্তাভাবনা একই ফ্রিকোয়েন্সিতে বাঁধা।

সোনির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে সুবীরকে বারবার কৃতজ্ঞতা জানালাম। এবং একটা বিচিত্র ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরে এলাম।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। অন্ধকার রাত, বাঁকা চাঁদ, এবং তারা আমাকে স্বাগত জানাল। একইসঙ্গে বাতাসের ঝাপটা আমাকে ছুঁয়ে গেল।

সোনিকে ফোন করলাম।

ওর সঙ্গে আলাপ গভীর হওয়ার সেটাই শুরু।

মিথ্যে কথা বলব না, সোনির প্রতি আমার একটা টান তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। না, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। সোনি যে রূপসি সেটা এই টানের মেজর কারণ নয়। আসল কারণটা হল, আমার কাজকে ও ভীষণ রেসপেক্ট দিচ্ছিল। একজন ইনভেন্টর হিসেবে এরকম আন্তরিক অ্যাপ্রিসিয়েশান আর রেসপেক্ট আমি কখনও পাইনি। আমার নানান আবিষ্কার নিয়ে ওর কত যে কৌতূহল আর প্রশ্ন!

সোনি আমাকে ফোন করত। আমিও করতাম। প্রথম-প্রথম সময়ে—তারপর অসময়ে। প্রায় মাসখানেক ধরে এরকম চলল। ও আমার ল্যাব দেখার জন্যে প্রায় রোজই বলত, কিন্তু আমি নতুন সমস্যা তৈরির ভয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতাম। ফোনেই টেকনোলজি আর ইনভেনশান নিয়ে প্রচুর কথা বললাম।

এই অতিরিক্ত ফোনের ব্যাপারটা জিনিয়ার নজর এড়ায়নি। কিন্তু ওর সরু চোখে সন্দেহের কাজল যে ধীরে-ধীরে আঁকা হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল।

আমি মোবাইল হাতে কখনও ছাদে গেলে একটু পরে জিনিয়াও টবের গাছগুলো দেখাশোনার ছুতোয় সেখানে চলে আসে। কিংবা আমার ল্যাবে—যেখানে ও বলতে গেলে কখনও পদার্পণ করে না—সেখানেও কোনও-না-কোনও অজুহাতে চলে আসে। কখনও ওর কোলে আদরের মিন্টি, আবার কখনও-বা একা।

ব্যাপারটা প্রায় গোয়েন্দাগিরির লেভেলে গিয়ে দাঁড়াল। যেন কোনও ডিটেকটিভ মরিয়া হয়ে একটা কংক্রিট এভিডেন্সের খোঁজ করে চলেছে। সেটা হাতে পেলেই…!

বেশ বুঝতে পারছিলাম, জিনিয়ার মধ্যে দ্রৌপদী সিনড্রোম আবার মাথাচাড়া দিয়েছে।

জানি, কমবেশি সন্দেহবাতিকে ভোগা স্ত্রী-ধর্ম, কিন্তু জিনিয়ার বাতিকটা এবার বোধহয় অসুখের দিকে টার্ন নিচ্ছিল। আর তাতে আমার পড়াশোনা, নতুন-নতুন চিন্তা, আর যন্ত্রপাতি নিয়ে রোজকার কাজকর্ম ভীষণ ডিসটার্বড হতে লাগল।

সবমিলিয়ে সে এক অসহ্য পরিস্থিতি। আমার গবেষণা আর ইনভেনশান প্রায় লাটে ওঠার জোগাড়।

এরকম একটা অবস্থায় একদিন হঠাৎ মনে হল, সোনিকে বাড়িতে ডেকে জিনিয়ার সঙ্গে আলাপ-টালাপ করিয়ে দিলে কেমন হয়! এতে জিনিয়া হয়তো খানিকটা নরমাল হতে পারবে। আর সোনিও আমার ল্যাব দেখার সুযোগ পাবে। ল্যাব দেখে যে ও কী খুশি হবে সেটা কল্পনা করে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল।

আর দেরি করলাম না। সোনিকে একদিন বাড়িতে আসতে বললাম।

সোনির ব্যাপারে জিনিয়াকে আগেই সব বলে রেখেছিলাম। মিথ্যে করে বলেছিলাম, ও আমার বন্ধু সুবীরের কাজিন। এবং সুবীরকেও সোনির সঙ্গে আসার জন্যে বারবার করে বলেছিলাম।

‘তুই যদি আমার সুইসাইড ঠেকাতে চাস তা হলে সোনির সঙ্গে অবশ্যই আসবি। প্লিজ! আর মনে রাখবি সোনি তোর কাজিন—।’

উত্তরে সুবীর একটা নোংরা ঠাট্টা করে কথা দিয়েছিল, আসবে।

ওরা হল। জিনিয়ার সঙ্গে ওদের আলাপ-পরিচয় হল। জিনিয়া বেশ হাসিমুখে ওদের আপ্যায়ন করল।

খানিকক্ষণ আড্ডার পর ওদের ল্যাব দেখাতে নিয়ে গেলাম। জিনিয়া আসতে চাইছিল না, কিন্তু আমি জোরাজুরি করে ওকেও ডেকে নিলাম। গিনিপিগও ওর পেছন-পেছন গ্যারাজে চলে এল। ‘গিনিপিগ’ নামে বেড়ালটার পরিচয় করিয়ে দিতেই সোনি আর সুবীরের কী হাসি!

সুবীর বলল, ‘ইনভেনশানের ইতিহাসে গিনিপিগ অমর হয়ে গেল।’

সোনি বলল, ‘ ”গিনিপিগ”—কী কিউট নেম!’

জিনিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ওর কথা ছাড়ুন তো! এই মেনিটার আমি নাম দিয়েছি ”মিন্টি”।’ তারপর বেড়ালটাকে ‘মিন্টি! মিন্টি!’ বলে আদুরে গলায় ডেকে কোলে নেওয়ার জন্যে হাত বাড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে হতভাগা বেড়ালটা মেঝে থেকে একলাফে জিনিয়ার কোলে চড়ে বসল। ‘মিঁউ-মিঁউ’ করতে লাগল।

নেহাত আমার এক্সপেরিমেন্টে প্রায়ই মালটাকে কাজে লাগে তাই। নইলে এটাকে আমি লাথি মেরে বাড়িছাড়া করতাম। যখন তখন বাড়ির যেখানে সেখানে নোংরা করে!

গ্যারাজের এককোণে রয়েছে একসেট টেবিল-চেয়ার আর একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার। এ ছাড়া বাকি স্পেসটা একেবারে ছন্নছাড়া। ছুরি, হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভার, সলডারিং আয়রন আর হাজাররকম যন্ত্রপাতি এখানে সেখানে ছড়ানো। সোনি আমার যন্ত্রগুলো দেখে ‘গৌরী বালিকা’ হয়ে গেল। ওর সেকী আনন্দ, সেকী খুশি!

ও প্রশ্নে-প্রশ্নে আমাকে পাগল করে তুলল। জিনিয়া সামনে থাকায় আমি মনের উচ্ছ্বল আবেগ চেপে বিজ্ঞানীর গাম্ভীর্য বজায় রেখে ছোট-ছোট জবাব দিতে লাগলাম। কোথা দিয়ে সময় গড়িয়ে গেল টেরই পেলাম না।

সুবীর আর সোনি যখন চলে গেল তখন রাত দশটা। সন্ধেটা কী দারুণ কাটল ভেবে আমি তৃপ্তির নেশায় ডুবে গেলাম। অনেক রাতে সোনিকে ফোন করলাম।

আমার ফোন চলতে লাগল। সোনির আসা-যাওয়াও। আমার আবিষ্কার নিয়ে ওর এনথুর দেখলাম শেষ নেই। ওর কাছে আমার গ্যাজেটগুলোর মেকানিজম এক্সপ্লেইন করতে-করতে আমি ক্লান্ত হতাম না। কোথা থেকে যেন অফুরান এনার্জি আমার শরীর আর মনে ঢুকে পড়ত।

সোনি আমার ল্যাবের সব যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে-দেখতে প্রায়ই বলত, ‘ইনভেন্টর, ইউ আর আ জিনিয়াস!’

ওর ‘ইনভেন্টর’ সম্বোধনে আমি খুশি হতাম। জিনিয়াস বলাতেও। কিন্তু ‘জিনিয়াস’-এর মধ্যে ‘জিনিয়া’ অংশটুকু আমার মনে কাঁটার মতো খচখচ করত।

সোনি আর সুবীরকে আমার সব মেশিন দেখালেও টাইম মেশিনটা দেখাইনি। আর বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন সাকার হয়ে গেলে তারপর হয়তো দেখাব। আর মেশিনটা দেখিয়ে জিনিয়াকে বহু আগেই বলে দিয়েছি, এই উদ্ভট বেআক্কেলে যন্ত্রটা চিরকালের জন্যে অকেজো হয়ে গেছে।

সোনির সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ধরনটা জিনিয়া ঠিক বুঝতে পারেনি। আমার বিজ্ঞান নিয়ে ওর অ্যাপ্যাথি যেমন অবিচল, তেমনই সোনির ব্যাপারটা ও সবসময় দ্রৌপদী সিনড্রোমের আলোকে বিশ্লেষণ করতে লাগল। ওর নৃত্যকলা আর নৃত্যনাট্য চর্চার ফাঁকে-ফাঁকে আমাকে ও হুল ফুটিয়েই চলল।

এক-একসময় ব্যাপারটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠত। তখন সেই পুরোনো বাজে চিন্তাটা মাথায় ধাক্কা মারত।

একদিন ঝোঁকের মাথায় ঠিক করেই ফেললাম, একটা খুন করব। এটা হবে আমার মার্ডার সিরিজের প্রথম এক্সপেরিমেন্ট।

আমি বেচারা সতুকে বেছে নিলাম। না, খুন করার জন্যে নয়। মানে, ওর বাড়িতে টার্গেট করলাম।

এর প্রথম কারণ, ওর সোদপুরের বাড়িতে আমি দু-চারবার গেছি।। ওর বোনের বিয়েতেও গিয়েছিলাম। সুতরাং বাড়িটার জিয়োগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশান আমার জানা।

আর দ্বিতীয় কারণ, ও একটা টিয়াপাখি পোষে। ওই পাখিটাই হবে আমার প্রথম টার্গেট। ভিকটিম নাম্বার ওয়ান। কিন্তু পাখিটাকে খুন করতে পারব তো? উঁহু, কিন্তু-কিন্তু করলে চলবে না। আমাকে পারতেই হবে।

আমার ইদানিংকার অ্যাক্টিভিটি সতু আর তারকের চোখে খুব একটা যে ভালো ঠেকছিল না সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম। দোকানে ঠিকমতো যাই না। মালপত্র পারচেজের ব্যাপারে গাফিলতি। এমনকী পাওনা টাকা তাগাদার ব্যাপারেও আগের মতো উৎসাহ দেখাই না।

কিন্তু আমি ওদের অবাক চোখকে আমল দিইনি।

আমি সতুর সঙ্গে দু-দিন ধরে গল্প জুড়ে দিলাম। দোকানে বসে তেলেভাজা-মুড়ি বা অন্য কিছু আনিয়ে আমি, সতু আর তারক সান্ধ্য টিফিন সারি আর গল্প করি। কখনও-কখনও মাটন রোল-টোলও আনাই।

গল্প করে-করে সতুর বাড়ির টোপোলজিটা ভালো করে ঝালিয়ে নিলাম। জেনে নিলাম, টিয়াপাখিটা কখন একা থাকে, রাতে খাঁচাটা কোথায় রাখা হয়, বেড়ালের ভয় আছে কি না, সদর দরজা রাতে কীভাবে বন্ধ করা থাকে, ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকে কি না ইত্যাদি।

এইরকম খোঁজখবর করে টিয়াপাখির ইনফরমেশান ফাইল কমপ্লিট হওয়ার পর কাজে নামলাম।

একটা ছোট তোয়ালে আর টর্চলাইট সঙ্গে নিয়ে আমি একদিন রাতে দশমিনিটের জন্যে ভবিষ্যতে উধাও হলাম। সোজা গিয়ে হাজির হলাম সতুর বাড়ির উঠোনে।

খাঁচাটা উঁচুতে একটা হুকে ঝুলছিল। তার ওপরে একটা পুরোনো শাড়ি ঢাকা দেওয়া। আমি শাড়িটা সাবধানে সরালাম। তারপর বাঁ-হাতে টর্চ জ্বেলে তোয়ালেসমেত ডানহাতটা খাঁচার ভেতরে ঢোকালাম।

হঠাৎ আলোয় টিয়াপাখিটার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। আমি ওটাকে তোয়ালেসমেত সাপটে বাইরে বের করলাম।

পাখিটা একবার চাপা চিৎকার করে উঠল।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কেউ যদি জেগে ওঠে!

একটা টিয়াপাখি খুন করতে এসে যে এত ভয় করতে পারে সেটা আগে বুঝিনি। আমার হাত কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতরে ধড়াস-ধড়াস শব্দ, কান ভোঁ-ভোঁ করছে। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। যা করার জলদি করতে হবে। দশমিনিট শেষ হতে এখনও অনেক দেরি।

আমি আর দাঁড়ালাম না। সদর দরজার খিল-ছিটকিনি খুলে চট করে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। তোয়ালের ওপর দিয়েই পাখিটার গলা টিপে ধরলাম। কয়েক সেকেন্ডেই ওটার ছটফটানি শেষ। তোয়ালেসমেত পাখিটা রাস্তায় ফেলে দিলাম।

আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। আমার মধ্যে এতটা হিংস্রতা লুকিয়ে ছিল আগে বুঝিনি। নিরীহ অবোলা জীবটাকে কী সহজেই না আমি নিকেশ করে দিলাম!

পথের একটা নেড়ি কুকুর আমাকে দেখতে পেয়ে ঘেউঘেউ করে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে আমার দশমিনিটের কোটাও শেষ হল। হুউস।

গ্যারাজের বদলে আমি বাড়ির ছাদে এসে ল্যান্ড করলাম।

সর্বনাশ করেছে! ছাদের দরজা তো বাড়ির ভেতর থেকে বন্ধ করা থাকে! তা ছাড়া বাড়তি সুরক্ষার জন্যে যে-কোলাপসিবল গেট আছে সেটাতেও তালা।

অগত্যা ছাদেই শুয়ে পড়লাম। সকালে জিনিয়ার সঙ্গে একপ্রস্থ লড়াইয়ের জন্যে মনে-মনে তৈরি হলাম।

কিন্তু আশ্চর্য! লড়াইটাকে এমনভাবে এড়িয়ে যেতে পারলাম যে, আমার বিশ্বাস হতে চাইছে না।

সকালে ধাক্কাধাক্কি করে বাড়ি মাথায় করতেই জিনিয়া ঘুম-চোখে এসে দরজা খুলল। ওকে বললাম যে, রাতে টাইম মেশিন দিয়ে উলটোপালটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েই আমার এই দুর্দশা। মেশিনটা সবসময় গন্ডগোল করছে।

ও ঠান্ডা গলায় বলল, ‘মেশিনের আর দোষ কী! যেমন ইনভেন্টর, তেমনই ইনভেনশান।’

আমার সামনে অনেক বড় প্ল্যান। তাই খোঁচটা হজম করে গজগজ করে আপনমনেই মন্তব্য করলাম, ‘যদি আর একমাসের মধ্যে একে ঠিকঠাক করে তৈরি করতে না পারি তা হলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মডেলটাকে ডেসট্রয় করে ফেলব।’

‘বাঁচা যাবে।’ বলে জিনিয়া সিঁড়ি নামতে শুরু করল।

আমি তখন প্রথম খুনের সাফল্যে ভেতরে-ভেতরে টগবগ করে ফুটছি।

সতু পরদিন আমাকে টিয়াপাখি হত্যার করুণ কাহিনি শোনাল। বলল, বাড়ির কোনও জিনিস চুরি যায়নি—শুধু পাখিটাকে গলা টিপে মেরে বাইরের রাস্তায় কে যেন ফেলে দিয়ে গেছে। পাখিটার পাশে একটা বাদামি রঙের নতুন তোয়ালে পাওয়া গেছে।

‘খুনি’ কী করে বাড়িতে ঢুকল সেটা কারও মাথায় ঢুকছে না। আর কেনই-বা বেচারি পাখিটাকে গলা টিপে মারল সেটাও এক রহস্য।

আমি সতুর কাহিনি শুনছিলাম আর মনে-মনে ফুলছিলাম। ইগো বুস্ট বোধহয় একেই বলে! ক্ষমতায় নিজেকে ভগবানের কাছাকাছি মনে হচ্ছিল। আমার প্রথম মার্ডার সাকসেসফুল।

ঠিক করলাম, সিরিজের দ্বিতীয় খুনটা দিন-সাতেক পরে করব। তবে এবারে আর পাখি-টাখি নয়— বরং চারপেয়ে কিছু। আসলে একটু-একটু করে এগোনো দরকার। তারপর…।

সোনি আমাকে এক রবিবার সন্ধেবেলা ফোন করল।

‘হাই, ইনভেন্টর! কেমন আছেন?’

‘ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

‘ফাইন। এখন কী করছেন?’

আমি বেডরুমে বিছানায় বসে খবরের কাগজের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির পাতাটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়ছিলাম। আমার আবিষ্কারগুলোর কথা যেদিন সবাইকে অফিশিয়ালি জানাব সেদিন এই পৃষ্ঠাতেই আমার ফটোগ্রাফ থাকবে, নিউজ থাকবে। টিভির নানান চ্যানেলে আমার ইন্টারভিউর লাইভ টেলিকাস্ট হবে।

আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সোনি প্রশ্নটা আবার করতেই ঘোর কাটল। বললাম যে, আমি খবরের কাগজ পড়ছি।

‘বলুন না, নতুন কী ইনভেন্ট করছেন—মানে, কী নিয়ে এখন রিসার্চ করছেন।’

‘একটা ইনসেক্ট রোবট তৈরি করার চেষ্টা করছি—যেটা সাইজে সাবান-টাবানের মতো হবে, আর টুকিটাকি জিনিস কুড়িয়ে নিয়ে আসতে পারবে। যেমন, বোতলের ছিপি, খুচরো পয়সা, পেনের ক্যাপ বা কাগজের টুকরো—মেঝেতে পড়ে এসব জিনিস উড়ে গেলে বা ছিটকে গেলে মেশিনটা সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। মানে, মেঝেতে জিনিসটা প্রথম যেখানে পড়ছে সেই ইমপ্যাক্ট পয়েন্টে জিনিসটাকে পৌঁছে দেবে।’

‘ওঃ, গ্রেট! খুশিতে ফেটে পড়ল সোনি: ‘এই রোবটটা দারুণ কাজের জিনিস হবে।’

‘আপনি এখন কী করছেন?’

‘কী আর করব, ফিস্ক্যাল পলিসি নিয়ে স্টাডি করছি। এত বোরিং টপিক—ভাবা যায় না।’

‘বোর হয়ে গেলে অন্য কোনও বই পড়ুন—ল্যাপটপ খুলুন, নয়তো টিভি দেখুন—।’

‘দুর! ওসব ভাল্লাগে না। আপনাকে আমার হিংসে হয়।’

‘কেন?’

‘আপনার কাজটা কী ইন্টারেস্টিং। আমাকে আপনার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিন না।’

সোনি হালকাভাবে কথাটা বললেও আমার বুকের ভেতরে মেঘ ডেকে উঠল। জিনিয়া।

তখনই মনে পড়ে গেল, পাশের ঘরে—মানে ড্রইং-ডাইনিং-এ—জিনিয়ার রিহার্সাল চলছে। চারটে ছেলেমেয়ে এসেছে। সামনের মাসে কী একটা যেন জয়ন্তী টাইপের আছে। তার জন্যে প্রবল প্র্যাকটিস চলছে।

‘এসব কথা মুখেও আনবেন না, সোনি। আপনি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হলে আমার বাড়িতে আগুন জ্বলে যাবে। আপনাকে তো আগেই বলেছি—জিনিয়া-ম্যানিয়া…।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সোনি। তারপর বেশ সিরিয়াস গলায় বলে উঠল, ‘আগুনে একটা হাত-টাত দিতে শিখুন। আপনি তো আর ছোট নেই।’

তারপরই ‘রাখছি’ বলে ফোন কেটে দিল।

এটা কী কথা বলল সোনি?

‘আগুনে একটু হাত-টাত দিতে শিখুন। আপনি তো আর ছোট নেই।’

আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। এভাবে কখনও আমি ভাবিনি। সোনি আমার খুব ভালো বন্ধু। আমার আবিষ্কারের জেনুইন অ্যাডমায়ারার। ওর সঙ্গে কথা বলে আমি কাজে নতুন উৎসাহ পাই। ও যেভাবে বলে ‘দেখবেন, আপনি একদিন ওয়ার্ল্ড ফেমাস হয়ে যাবেন—’ সেটা সত্যি-সত্যি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। তার সঙ্গে সোনি অবশ্য এও বলে, ‘সেদিন আমাকে ভুলে যাবেন না তো?’

তাই তো ওকে টাইম মেশিনটার কথা এখনও বলিনি! শুনলে ওর একেবারে তাক লেগে যাবে। দুনিয়ার লোককে বলে বেড়াবে।

হঠাৎ জিনিয়া এসে ঘরে ঢুকল। বোধহয় কংক্রিট এভিডেন্সের খোঁজে।

‘কী ব্যাপার? আমার পায়ের আওয়াজ পেয়েই ফোন কেটে দিলে?’

আমি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। মাথাটা কেমন ফাঁকা লাগছিল। জিনিয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। কোনও উত্তর দিতে পারলাম না।

‘চমৎকার অভিনয় করতে পারো তো!’ জিনিয়া নাচের বিভঙ্গে একটা হাতের ভর কোমরের নীচে রাখল: ‘আমি ও-ঘরে রিহার্সাল করছি আর তুমিও বেডরুমে বসে রিহার্সাল চালিয়ে যাচ্ছ…?’

আমি জিনিয়ার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়েই রইলাম। পাশের ঘর থেকে টেপরেকর্ডারের মিউজিক ভেসে আসছিল। আর সেই তালে-তালে আমি তিননম্বর মার্ডারটার কথা ভেবে চললাম। কবে, কখন, কী কায়দায় ফাইনাল মার্ডারটা এক্সিকিউট করব সেসবের মেজর পয়েন্টস হাতড়ে চললাম।

সোনি ঠিকই বলেছে। এবারে আগুনে সত্যি-সত্যি হাত দেব। আমি আর ছোট নেই।

‘…আর রিহার্সাল দিয়ে কী হবে? বহুদিন তো রিহার্সাল হল—এবার আসল কাজে নেমে পড়ো। তুমি তো জানো না…।’

জিনিয়া কথা বলেই যাচ্ছিল—তবে গলার স্বর তোলেনি। চাপা, হিসহিসে। কারণ, পাশের ঘরে ওর নৃত্য-ছাত্ররা রয়েছে।

আমি উদাসীন সাধুর চোখে ওকে দেখতে লাগলাম। আশ্চর্য! কী সহজেই না ও নিজের শেষ সুনিশ্চিত করছে!

যখন ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তখন আমার মনে আর কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই।

নেক্সট স্টেপ, মার্ডার নাম্বার টু। সেকেন্ড রিহার্সাল। তারপর ফাইনাল স্টেপ, মার্ডার থ্রি। পারফেক্ট মার্ডার। ব্যস। নৃত্যনাট্যের যবনিকা।

দ্বিতীয় মার্ডারের ভিকটিম হিসেবে আমি একটা লোমওয়ালা পোষা কুকুরকে বেছে নিলাম। প্রথমে পাখি। তারপর কুকুর। তারপর…।

আমাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা তিনতলা বড় বাড়ি আছে। বাড়ির নীচে একটা বড় মাপের ওষুধের দোকান। দোকানটার নাম ‘মেডিকো’। বাড়ি এবং দোকানের মালিক একই লোক। ভদ্রলোকের চেহারা বেশ ফুলবাবুর মতো। মাথায় বাবরি চুল, চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা, শৌখিন গোঁফ, কানে আতর মাখানো তুলো গোঁজা, পরনে সবসময় ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি।

এই বাবুটির একটি শখের কুকুর আছে। গায়ে বড়-বড় সাদা লোম, ঝিরকুটে চেহারা। সবসময়েই এদিক ওদিক চঞ্চলভাবে ঘুরঘুর করছে আর গন্ধ শুঁকছে।

আমি বাড়িটার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলাম। শুনলাম, রাতে কুকুরটা ছাড়া থাকে। ডবল তালা দেওয়া কোলাপসিবল গেটের ওপিঠের চৌকো চাতালে ওটা সারারাত পায়চারি করে।

প্ল্যান ছকে নিতে কোনও অসুবিধে হল না।

বড়বাজারে গিয়ে একটা ছ’ইঞ্চি ফলার ছুরি কিনলাম। তারপর দোকান থেকে শিককাবাব কিনে তাতে র‌্যাটকিলার আর ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে বেশ ভালো করে মাখিয়ে দিলাম। এবং রাত ঠিক একটার সময়ে টাইম মেশিনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রওনা হলাম।

আমি ভবিষ্যতে পাড়ি দিলাম মাত্র কুড়ি সেকেন্ডের জন্যে। আর সেফটি ফ্যাক্টর বাড়ানোর জন্যে হালকা ছদ্মবেশ নিলাম। একটা পাওয়ার ছাড়া রেডিমেড চশমা কিনে এনেছিলাম। সেটা চোখে দিলাম। আর মাথায় পাগড়ির ধাঁচে একটা লাল গামছা জড়িয়ে নিলাম।

ছোট মাপের কুকুরগুলো লোক দেখলেই কেঁউকেঁউ করে চেঁচায়। তাই কুড়ি সেকেন্ডের বেশি সময় আমি কুকুরটার সামনে থাকতে চাইনি।

আমি অন্ধকারে চাতালে আচমকা হাজির হতেই কুকুরটা হকচকিয়ে গেল। তারপরই একটা ছোট্ট চিৎকার করল। সঙ্গে-সঙ্গে শিককাবাবের টুকরোগুলো সাদা প্রাণীটার সামনে ছড়িয়ে দিলাম। ওটা গন্ধ শুঁকতে মুখ নীচু করল। একটুকরো মাংস কপ করে মুখে তুলে চিমোতে শুরু করল।

আর দেরি করলাম না। আমার মধ্যে একটা কসাই জেগে উঠল। চোখের পলকে কুকুরটার গলায় ছুরি ঢুকিয়ে দিলাম। বাঁ-হাতে ওটার নরম শরীর চেপে ধরলাম মেঝেতে। ছুরিটা টেনে বের করে বসিয়ে দিলাম আবার। আর-একবার।

ছোট্ট একটা আর্তনাদ। রক্ত। সব শেষ।

বাড়ির মধ্যে কোথায় যেন একটা আলো জ্বলে উঠল।

ততক্ষণে আমার কুড়ি সেকেন্ডও শেষ। হুউস।

গ্যারাজে ফিরে দেখলাম আমার মাথায় গামছাটা নেই। কখন যেন খসে পড়ে গেছে। আর আমার জামা-প্যান্টে বেশ খানিকটা রক্তের ছিটে।

আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম, হাঁপাচ্ছিলাম।

চশমাটা চোখ থেকে খুলে ফেললাম। একতলার গেস্ট রুমে ঢুকে রক্তের ছিটে লাগা জামা-প্যান্ট ছেড়ে ফেললাম। তারপর বাথরুমে স্নান করতে ঢুকলাম। কালো চশমা আর জামা-প্যান্ট দুটোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে হবে। আগের বারের শার্ট পোড়ানোর মতো বোকামি আর আমি করছি না।

ফেলে আসা গামছাটা নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম।

দ্বিতীয় ‘খুন’টার পর বেশ টের পেলাম আমার ইগো আর কনফিডেন্স, দুটোই অনেক বেড়ে গেছে। আমি যেন এক নতুন ‘আমি’। কী সহজেই না আমি টিয়াপাখিটাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছি! তুলতুলে কুকুরটার গলায় নৃশংসভাবে ছুরি বসানোর সময়েও আমি কী অদ্ভুতভাবে মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম। তা হলে কি আমার ভেতরে একটা ঠান্ডা খুনি ঘুম থেকে ধীরে-ধীরে জেগে উঠছে?

নতুন করে আবার মনে হল, আমি ভগবানের কাছাকাছি। এবং সেই হাই লেভেল থেকে আমি রোজ জিনিয়াকে লক্ষ করে চললাম। ওর হাঁটা-চলা, কথা বলা, নাচের রিহার্সাল, বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেরিয়ে আসার ভঙ্গি—সবই এক অদ্ভুত তৃষ্ণা নিয়ে দেখতে লাগলাম। যেন এই শেষবারের মতো দেখছি।

সত্যিই তো তাই! ক’দিন পরই তো এগুলো আর দেখতে পাব না!

সোনিকে নিয়েও আমি নতুনভাবে ভাবতে শুরু করলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে টাইম মেশিনটার কথা বলি। এও ইচ্ছে হচ্ছিল, মাঝরাতে মেশিনে চড়ে ওর বেডরুমে হাজির হয়ে ওকে চমকে দিই। তারপর…।

নাঃ, ওসব বাজে চিন্তা থাক—কাজের চিন্তা করি। মার্ডার নাম্বার থ্রি। দ্য পারফেক্ট মার্ডার।

তিনদিন চিন্তার পর দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললাম। সুবীরকে বললাম, আমি একটা পার্টি থ্রো করতে চাই। কিন্তু আমি যে পার্টি দিচ্ছি সেটা জিনিয়ার কাছে সিক্রেট রাখতে হবে—কারণ, ও এসব পছন্দ করে না।

পার্টি দেওয়ার কারণ একটা দেখাতে হয়। তাই সুবীরকে বললাম যে, লাস্ট দু-মাসে আমার ব্যবসায় যাচ্ছেতাইরকমের ‘মেগা’ প্রফিট হয়েছে। আর সোনির সঙ্গে পার্টিতে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়াটা একটা দারুণ ব্যাপার।

উত্তরে সুবীর আমাকে চোখ মারল, ভেংচে বলল, ‘হুঁ—দারুণ ব্যাপার!’

আমি ওর ঠাট্টাটা গায়ে মাখলাম না।

আমারই প্ল্যানমতো সুবীর আমাদের পাড়া থেকে বহুদূরে—সন্তোষপুরে—ওর এক বড়লোক কোলিগের ফ্ল্যাট সাজেস্ট করল। বলল, ‘শেয়ারে রিসক নিয়ে শালা প্রচুর টাকা করেছে। প্রায় তিনহাজার স্কোয়ার ফুটের নতুন এই ফ্ল্যাটটা রিসেন্টলি কিনেছে। তুই ওখানে ফুটবল খেলতে পারবি…।’

সুবীরের সেই কোলিগের নাম তনুময়—ডাকনাম টনি। তো আমি, সুবীর আর টনি মিলে পার্টির সব ব্যবস্থা করতে লাগলাম। জনাপঁচিশ লোককে নেমন্তন্ন করলাম। তার মধ্যে সোনি অবশ্যই ছিল। ওর বাবা-মা-কেও আসতে বললাম। সুবীর আর টনিও ওদের ক্লোজ সার্কেলের ইমপরট্যান্ট বন্ধুদের নেমন্তন্ন করল।

পার্টির চার-পাঁচদিন আগে থেকেই আমি জিনিয়ার সঙ্গে প্রেমিকের মতো ব্যবহার শুরু করলাম। যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমাদের সম্পর্কটা আর ঠিকঠাক নেই। কোথাও একটা চোরা ফাটল ধরেছে।

জিনিয়া মাঝে-মাঝে ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখত। কয়েকবার বলেও ফেলেছে, ‘তোমার কী হয়েছে বলো তো? সকাল-বিকেল এত মিষ্টি কথা! নিশ্চয় এর পেছনে কোনও মতলব রয়েছে।’

আমি হেসে বলেছি, ‘মতলব আছে। তোমাকে বদলে দেওয়ার মতলব। পুরোনো দিনগুলো আবার ফিরে পেতে চাই আমি।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে ও: ‘সে কি কখনও হয়! দিন বদলায়, মানুষ বদলায়। সেটাই নিয়ম।’

ওরে বাবা! এ যে একেবারে ফিলজফারের ডায়ালগ! যাকগে, হাতে তো আর মাত্র ক’টা দিন!

মার্ডার নাম্বার থ্রি-র পারফেকশানের কথা ভেবে আমি আরও একটা কাজ করেছিলাম। হুবহু একইরকম দেখতে দুটো জামা আর দুটো প্যান্ট কিনেছিলাম। দু-সেটই আমার জন্যে— তবে একটা সেটের সাইজ একটু ছোট, আর-একটা একটু বড়।

ঘটনার দিন জিনিয়াকে বললাম যে, আমার একটা পার্টিতে নেমন্তন্ন আছে—অনেক দূরে, এক্সট্রিম সাউথে। সুবীরের এক বন্ধুর বাড়িতে। ফিরতে রাত হবে।

জিনিয়ার চোখে সন্দেহের ছায়া ফুটে উঠবে জানতাম। তাই উঠল।

আমি হেসে বললাম, ‘যখন খুশি আমাকে ফোন কোরো। যতবার খুশি। আমিও তোমাকে ফোন করব।’

জিনিয়া অবাক হল। খুশিও হল।

ও তো আর জানে না, এই ফোন করার ব্যাপারটাও আমার অ্যালিবাই এস্টাবলিশ করার একটা প্ল্যান!

জিনিয়াকে খুন করার জন্যে আমি এমন একটা দিন বেছে নিয়েছিলাম যেদিন ওর কোনও নাচের রিহার্সাল থাকে না। কারণটা খুবই সহজ। আমি খুনের কোনও সাক্ষী চাই না। খুনের যদি কোনও আই উইটনেস থাকে তা হলে টাইম মেশিনের বাবাও আমাকে বাঁচাতে পারবে না।

আসল দিনটা দেখতে-দেখতে এসে গেল।

সকালবেলা আমি জিনিয়ার চোখ এড়িয়ে একটা হাতুড়ি আমাদের মাস্টার বেডরুমে তোশকের নীচে লুকিয়ে রাখলাম।

বিকেল হতে-না-হতেই টাইম মেশিনটাকে বাক্সে ঢুকিয়ে ভালো করে প্যাক করলাম। তারপর নতুন কেনা ডবল জামা-প্যান্ট পরে প্যাক করা মেশিনটা নিয়ে ট্যাক্সি করে রওনা দিলাম।

টনির বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে ফোনে সুবীরকে ধরলাম। শুনলাম, ও আর টনি খানাপিনার আয়োজন অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে।

টনির ফ্ল্যাট তিনতলায়। মেশিনটা সঙ্গে করে লিফটে তিনতলায় উঠলাম। তারপর ফ্ল্যাটের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আমার সামনেই টনি আর সুবীর।

প্যাক করা বাক্সটা দেখে ওরা খুব অবাক হল। একগাল হেসে বললাম যে, এর ভেতরে একটা হাই পাওয়ার জেনারেটার আছে। আমার লেটেস্ট ইনভেনশান। আজকের পার্টিতে এই যন্ত্রটার আবিষ্কার আমি অ্যানাউন্স করব।

টনির অনুমতি নিয়ে যন্ত্রটা আমি টয়লেটের কাছাকাছি একটা কোণে রাখলাম। বললাম, যন্ত্রটা এখানে থাক। ওটাকে মাঝে-মাঝে জল ঢালার দরকার হয়—ব্যাটারির মতো। সেরকম কেস হলে ওটা নিয়ে টয়লেটে ঢুকে পড়তে আমার সুবিধে হবে।

ওঃ, কত মিথ্যেই না বলতে হচ্ছে! একটা পারফেক্ট মার্ডারের ঝক্কি কি কম! লাস্ট দশদিন ধরে শুধু মনে-মনে হাজার একটা প্ল্যান ভেঁজে চলেছি। চলেছি আর চলেছি। অবশেষে…।

সুবীর হঠাৎ বলল, ‘অ্যাই, তোর সেই টাইম মেশিনের খবর কী? কদ্দূর এগোলি?’

পলকে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সামনে আয়না থাকলে নিশ্চয়ই দেখতে পেতাম মুখের সব রক্ত উধাও হয়ে গেছে।

কয়েক সেকেন্ড মরিয়া চেষ্টার পর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল।

‘ওটা থিয়োরিতেই বস আটকে গেছি। মালটা এখনও তৈরি করতে পারিনি। তোর জেঠুর কাছে আমাকে আবার যেতে হবে।’

আমি ঘামতে শুরু করেছিলাম। একে খাপছাড়া বর্ষার গুমোট, তার ওপর ডবল জামা ডবল প্যান্ট। আমার হাঁটতে-চলতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছে।

দমবন্ধ করে আমি সময় কাটাতে লাগলাম। কখন সাতটা-আটটা বাজবে তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। অন্যান্য গেস্ট তখন এসে পড়বে। বোতলের ছিপি খোলা হবে। পার্টির হইহই তখন তুঙ্গে উঠবে। আমার দিকে ততটা কেউ আর খেয়াল করবে না। সেই সুযোগে আমি…।

সময় গড়িয়ে সন্ধে হল। সন্ধে আরও গভীর হল। অতিথির ভিড়ে টনির ফ্ল্যাট একেবারে হাটবাজার হয়ে উঠল। সোনিও ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে পড়েছে। সুবীর আমাকে ওদের কাছে নিয়ে গেল, পরিচয় করিয়ে দিল ‘গ্রেট ইনভেন্টর’ বলে। আর সোনি আমার নামে ওর বাবা-মায়ের কাছে এত প্রশংসা করতে লাগল যে, আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।

সোনিকে দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, যে-পথে আমি পা বাড়িয়েছি সেই পথটাই একমাত্র সঠিক পথ।

এর মধ্যে জিনিয়া আমাকে তিনবার ফোন করেছে। দু-পাঁচমিনিট করে কথা বলেছে। আমিও ওকে পালটা দুবার রিং করেছি। সুবীরের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি। পার্টির নেশা ধরানো মিউজিক নিশ্চয় জিনিয়ার কানে গেছে। ও বুঝেছে, আমি ওকে পার্টির ব্যাপারটা মোটেই ব্লাফ দিইনি।

রাত ন’টার সময় জিনিয়াকে ওর মোবাইলে আবার ফোন করলাম।

‘কী করছ?’

‘হঠাৎ জানতে চাইছ?’

‘এমনি জানতে ইচ্ছে হল।’

‘শুয়ে আছি। ম্যাগাজিন পড়ছি।’

আমি জানি, জিনিয়া অনেক সময় বিছানায় শুয়ে-শুয়ে নানান পত্রপত্রিকা পড়ে। তারপর সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা একসঙ্গে খেতে বসি।

আমি বললাম, ‘তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তুমি কোথায় সল্টলেকে নিজের বাড়িতে শুয়ে-শুয়ে আয়েস করছ, আর আমি সন্তোষপুরে তনুময় বোসের ফ্ল্যাটে পার্টি করছি। বিলিভ মি, ভীষণ বোর লাগছে। এক্ষুনি তোমার কাছে চলে যেতে পারলে হত।’

হাসল জিনিয়া: ‘চলে এসো। অভিনয় যখন করছ ভালো করেই করো।’

‘অভিনয়?’ ঠাট্টা করে বললাম, ‘এক্ষুনি তোমার কাছে যাচ্ছি। দেখাচ্ছি মজা।’

আমার ডায়লগগুলো আপনারা দয়া করে খেয়াল করবেন।

জিনিয়া খুন হলে পুলিশ অফিসাররা ওর মোবাইল ফোন নিয়ে পড়বে। ওর কল লিস্ট দেখবে। এমনকী কথাবার্তার রেকর্ডও শুনবে। তখন ওরা যাতে নিশ্চিত প্রমাণ পায় যে, খুন হওয়ার পাঁচ-সাত মিনিট আগেও আমার আর জিনিয়ার মধ্যে অন্তত বিশ কিলোমিটার ফারাক ছিল, সেইজন্যেই আমার ওই কথাগুলো বলা। আর এ তো জানা কথা, ওয়াইফ মার্ডার হলে সমস্ত সন্দেহের তির আগে ছোটে বেচারা হাজব্যান্ডের দিকে।

আর দেরি করলাম না। ফ্ল্যাটের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সবাই নাচে, গানে আর গ্লাসে মত্ত। আমার দিকে কারও নজর নেই। তাই টুক করে টাইম মেশিন হাতে টয়লেটে ঢুকে পড়লাম। দরজা বন্ধ করে দিলাম ভেতর থেকে।

কোথায় যেন প্লাগ পয়েন্টটা? ওই তো!

মেশিনটাকে তাড়াতাড়ি সেখানে নিয়ে গেলাম। সুইচ অন করলাম। প্ল্যাটফর্মটা পেতে তার ওপরে উঠে দাঁড়ালাম।

আমার বুকের ভেতরে ডুগডুগি বাজছিল। দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল।

মেশিনের ডায়াল সেট করলাম, কিবোর্ডে বোতাম ঠুকতে লাগলাম।

এত ঘামছি কেন কে জানে! আমার মার্ডার স্কিমে তো কোনও ফাঁকফোকর নেই! পারফেক্ট মার্ডার। পারফেক্ট।

এবার নব ঘোরালাম। ‘এন্টার’ বোতাম টিপলাম।

আমাকে দেখে জিনিয়া চমকে উঠল।

‘হাই, জিনি!’

‘তু-তুমি!’ ম্যাগাজিনটা ওর হাত থেকে খসে পড়ে গেল। ও ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল।

‘হ্যাঁ, আমি।’ হেসে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম: ‘বললাম যে, এক্ষুনি তোমার কাছে যাচ্ছি। দেখাচ্ছি মজা।’

‘তুমি পার্টিতে যাওনি? সন্তোষপুরে?’

উত্তরে ঝুঁকে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কপালে একটা চুমু খেলাম। বললাম, ‘আমার টাইম মেশিনের ব্যাপারটা গল্প নয়—সত্যি, জিনি। এই দ্যাখো—’ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুপাশে দু-হাত ছড়িয়ে দিলাম: ‘আমি—রিয়েল আমি। রক্ত-মাংসের দেবদত্ত রায়চৌধুরী—।’

বিছানার সেই জায়গাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তোশকের নীচে হাত ঢুকিয়ে হাতুড়িটা বের করলাম।

বেশ ভারী হাতুড়ি। মুন্ডুটা প্রায় পাঁচশো গ্রাম হবে। কারও মুন্ডু গুঁড়ো করার পক্ষে বেশ নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার।

জিনিয়া হাঁ করেছিল। বোধহয় চিৎকার করবে বলে। কিন্তু সেটা করে ওঠার আগেই আমি শূন্যে হাত ঘুরিয়ে সাংঘাতিক মোমেন্টামে হাতুড়িটা ওর মাথায় নামিয়ে আনলাম।

কিন্তু রিফ্লেক্স যাবে কোথায়!

শেষ মুহূর্তে জিনিয়া মাথাটা ইঞ্চিচারেক সরাতে পেরেছিল। তাই আমি ব্রহ্মতালু তাক করলেও হাতুড়িটা শেষ পর্যন্ত ওর মাথার বাঁ-দিক ছুঁয়ে কান ঘেঁষে কাঁধে গিয়ে পড়ল।

ও বাঁ-দিকে কাত হয়ে গেল। ‘দেবু, কী করছ, কী করছ!’ বলে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। তারপরই আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরের দরজা লক্ষ্য করে ছুট লাগাল।

এটা আমার ছকের মধ্যে ছিল না। ও যে দৌড়ে পালাতে পারবে সেটা ভাবিনি।

আমি একমুহূর্তে হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই ওকে পাগলের মতো তাড়া করলাম। ডবল জামা-প্যান্টের জন্যে ছুটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড গোঁ আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমার ভেতরের ঠান্ডা খুনিটা আবার জেগে উঠেছে।

দরজার বাইরে বেরিয়ে ও ড্রইং-ডাইনিং-এর দিকে দৌড়তে শুরু করেছিল। তার সঙ্গে-সঙ্গে একটা চিৎকারও শুরু করেছিল।

কিন্তু আমি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় হাত বাড়িয়ে ওর ঘাড়ের গোড়ায় হাতুড়ি বসিয়ে দিলাম। ছুটন্ত জিনিয়া এবং চিৎকার—দুটোকেই মাঝপথে থামিয়ে দিলাম।

‘আঁক’ শব্দ করে জিনিয়া মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে।

জিনিয়া উপুড় হয়ে পড়েছিল। ওকে আর চিত হওয়ার সুযোগ দিলাম না। চট করে ওর পাশে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লাম। হাতুড়ি দিয়ে এলোপাথাড়ি কাজ করে চললাম। ওর নাচ, সন্দেহ, দ্রৌপদী সিনড্রোম, ফিগার—সব একসঙ্গে থেঁতো হয়ে যাচ্ছিল।

আমার ভেতরে বোধহয় একটা জন্তু ঢুকে পড়েছিল। কারণ, বেশ টের পাচ্ছিলাম, অন্ধ আক্রোশ, রাগ, ঘৃণা, হিংসা—সব আমার মাথার ভেতরে টগবগ করে ফুটছিল। আমি ফোঁস-ফোঁস করে হাঁপাচ্ছিলাম। জিনিয়াকে কখনও মনে হচ্ছিল টিয়াপাখি, কখনও-বা তুলতুলে কুকুর।

কিন্তু একই সঙ্গে আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবছিলাম। বাড়ির সদর দরজা বন্ধ। বাড়িতে আর কেউ নেই। বারান্দার দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ—খিল ছিটকিনি আঁটা। সুতরাং জিনিয়ার মার্ডার মিস্ট্রির সমাধান করতে পুলিশ হিমসিম খেয়ে যাবে। ইমপসিবল ক্রাইম। লকড রুম মিস্ট্রি। খুনি বাড়িতে ঢুকল কী করে, আর বেরোলই বা কী করে? ঢোকার সময় জিনিয়া যদিও বা দরজা খুলে দিয়ে থাকে, খুন করে চলে যাওয়ার পর জিনিয়ার পক্ষে তো আর দরজা বন্ধ করে খিল-ছিটকিনি এঁটে দেওয়া সম্ভব নয়!

মনে-মনে হাসি পেয়ে গেল আমার। পুলিশ আমাকে সন্দেহ করে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ করবে, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। আমি হাতুড়িটা হাতে নিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে রুমাল বের করে ওটার হাতলটা ঘষে-ঘষে মুছে দিলাম। তারপর ওটাকে একপাশে ফেলে দিলাম।

জিনিয়ার বডিটা মেঝেতে উপুড় হয়ে লেপটে রয়েছে। ওর মাথা থেকে রক্ত চুঁইয়ে-চুঁইয়ে মেঝেতে গড়িয়ে যাচ্ছে। দু-তিনটে মাছি কোথা থেকে যেন এসে ওড়াউড়ি শুরু করেছে। ডিসগাস্টিং মেস।

রক্ত ছিটকে আমার জামা-প্যান্টেও লেগেছে। কিন্তু তার জন্যে চিন্তার কোনও কারণ নেই। ওই যে বলেছি, ডবল জামা-প্যান্ট।

টনির ফ্ল্যাটের টয়লেটে ফিরে ওপরের রক্ত মাখা জামা আর প্যান্ট খুলে ফেলব। ওগুলো টাইম মেশিনের বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে রাখব। তারপর মেশিনের সঙ্গে প্যাক করে নিয়ে সোজা বাড়ি।

এবারে আর জামা-প্যান্ট পোড়ানোর গন্ধ পেয়ে কেউ আমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।

জিনিয়ার ডেডবডির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল, ওর নাচের প্রোগ্রামগুলোর এখন তা হলে কী হবে?

আর ঠিক তখনই ‘মিঁয়াও-মিঁয়াও’ ডাক শুনতে পেলাম।

আচমকা ডাকে চমকে তাকিয়ে দেখি গিনিপিগ। কোথায় ছিল কে জানে! আদরের মালকিনের খোঁজে বেরিয়ে এসেছে। তারপর জিনিয়ার রক্ত মাখা ডেডবডির কাছে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে গন্ধ শুঁকছে আর মিঁয়াও-মিঁয়াও’ করে ডাকছে।

হঠাৎই বেড়ালটা মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের ওপরে মাথা নামাল। জিভ বের করে চাটতে শুরু করল।

আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল। ওটাকে ‘হুস-হুস’ করে তাড়াতে চেষ্টা করলাম।

বেড়ালটা সবুজ চোখে সরাসরি তাকাল আমার দিকে। এবং কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ ‘হোঁয়াও’ করে বিকট ডেকে উঠে আমার বুক লক্ষ্য করে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তারপরই হুউস।

টনির হলঘরে আমি সার্কাসের জোকারের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি। রক্ত মাখা জামাকাপড়ে একটা বেড়ালের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি। আমাকে ঘিরে ঝকঝকে পোশাক পরা গেস্টের দল। পাগল করা ছন্দে ঝিনচ্যাক মিউজিক বাজছে। সেই তালে তাল মিলিয়ে সবাই এলোমেলো পা ফেলে নাচছে।

আমাকে দেখামাত্রই পলকে মিউজিক থেমে গেল। নাচ থামিয়ে সবাই যেন ফ্রিজ শট হয়ে গেল। আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সবাই। তাদের অবাক গোল-গোল চোখে নীরব প্রশ্ন।

আমার মাথা কাজ করছিল না। শুধু বুঝতে পারছিলাম আমার বাড়ির মাস্টার বেডরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম বলে ফিউচারে পৌঁছে আমার পজিশান বদল গিয়েছিল। সেইজন্যে টাইম মেশিন আমাকে ঠিকঠাক টয়লেটের ভেতরে ফেরত নিয়ে আসার বদলে এই হলঘরে এনে হাজির করেছে।

এ ছাড়া সঙ্গে রয়েছে এই হতচ্ছাড়া পাগল বেড়ালটা। আঁচড়ে কামড়ে আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আর আমার জামা-প্যান্টের এখানে ওখানে লেগে রয়েছে রক্ত—জিনিয়ার রক্ত।

ওদের সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করে আর কোনও লাভ নেই। টয়লেটের দরজা ভাঙলেই টাইম মেশিনটা ওরা দেখতে পাবে। তারপর…।

সোনি হাঁ করে আমাকে দেখছিল। হঠাৎই ও তীক্ষ্ন গলায় চিৎকার করে উঠল। তার সঙ্গে আরও দু-একজন মহিলা গলা মেলাল।

অপমানে, ক্ষোভে, লজ্জায় আমার চোখে জল এসে গেল। এরই নাম পারফেক্ট মার্ডার! ছিঃ!

তাই আপনাদের হাতজোড় করে একটা রিকোয়েস্ট করছি। টাইম মেশিন হাতে থাকলেও কখনও খুন করবেন না। প্লিজ!

গল্প

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *