1 of 2

(খুনি) তুমি রবে নীরবে (নভেলেট)

(খুনি) তুমি রবে নীরবে (নভেলেট)

নীতু মেহতা

নীতু মেহতার মৃতদেহটা যখন রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয় তখন সুদেশ সেখানে ছিল না। কিন্তু রতনলাল ছিল। সে কথা ওদের বলতে গিয়ে ঝিকিয়ে উঠেছিল রতনলালের কালো চোখ, ঝলসে উঠছিল হিংস্র দাঁতের সারি। রাহুল দস্তিদার চাপা স্বরে শাসিয়ে উঠল, রতন, রতন, আস্তে। লোকে শুনতে পাবে।

রাহুল দস্তিদার রাহুলদা–ওদের নেতা। সবাই ওর কথা শোনে। রতনলালও শুনল।

ওরা বসেছিল একটা রেস্তোরাঁয়। ওরা যখন আলোচনার জন্য জমায়েত হয়, তখন লোকজনের ভিড়ের মাঝেই আশ্রয় খুঁজে নেয়। লুকিয়ে কোনও গোপন জায়গায় সাক্ষাৎকারের চেয়ে চোখের সামনে থাকাটাই ভালো। তাতে গোয়েন্দা-পুলিশের নেকনজরটা কম পড়ে। কিন্তু সময়ে-সময়ে যে পোড়ো আস্তানায় দেখা করতে হয় না তা নয়।

রতনলালের স্বর আলতো হল। হল আরও হিংস্র। ও বলল, নীতুর কোনও আঙুলে নখ ছিল না। আঙুলগুলো ভেঙেচুরে চৌচির। আর–আর মাথায় একটা মস্ত গজাল ছুঁড়ে ছিল।

সুদেশ হুদা কেঁপে উঠল। এ সবই ওরা জানে, আগেই কানে এসেছে। কিন্তু তবুও ওদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ত্রাসের উলঙ্গ ছায়া। নীতু মেহতা ওদেরই একজন ছিল। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে, একইসঙ্গে সেই বীভৎস মৃতদেহ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে দলের বাকি সবাইকে।

সামনে পড়ে আছে চায়ের কাপ, ওমলেট। খাওয়ার ইচ্ছে মিলিয়ে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠছে। চারপাশের গুঞ্জন ওদের কানে আসে না। ওরা শুধু শুনতে পায় নিজেদের হৃৎপিণ্ডের শব্দ–টিক টিক-টিক। জীবনের ঘড়ি চলছে। এখনও।

সুদেশ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আড়চোখে তাকায় কাছে বসা পুতুল বক্সীর দিকে। ওর মুখের রং মিলিয়ে গেছে। সুদেশ অবাক হয়। মেয়েটা কেন তাদের দলে এল? আরও অবাক হয় এই ভেবে, রাহুল দস্তিদারের দলে এসে কীভাবে ও পুতুলের প্রেমে পড়ল!

রাহুল তখন নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। অর্থাৎ, ও এখন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। স্টিল ফ্রেমের চশমার আড়ালে ওর চোখে এক কুৎসিত দ্যুতি।

রাহুলের চেহারা রোগার দিকে। শরীরে এমন কিছু শক্তিও নেই। কিন্তু সে ইউনিভার্সিটির এক তুখোড় ছাত্র এবং সুদেশের ধারণা, যে-গঠনমূলক বিপ্লব বিস্ফোরণের পথে এগিয়ে চলেছে, তার পিছনে অনেকটাই কাজ করেছে রাহুল দস্তিদারের মাথা।

এ ভালো কথা নয়, বিড়বিড় করে বলল রাহুল, এ মোটেই ভালো কথা নয়। নীতু…।

মানে নীতু ওদের কাছে গান গেয়েছে?–প্রশ্ন করল ফিদা জয়সওয়াল, পুলিশ তাহলে আমাদের খবর জানতে পেরে গেছে?

নীতু গান গাওয়ার ছেলে নয়, কঠিন স্বরে ফিদার সন্দেহের উত্তর দিল রতনলাল, ওদের হাজার টরচারেও ও মুখ খুলবে না–আমি জানি।

মানুষের টলারেট করার একটা লিমিট আছে। ফিদা মন্তব্য করল।

না, নীতু কথা কইবার ছেলে নয়। রতনলাল আবার বলল, এ আমি জান বাজি রেখে বলতে পারি।

শুকনো স্বরে মুখ খুলল রাহুল দস্তিদার, সে-বাজি শুরু হয়ে গেছে, রতন। নীতু গেছে। এবার আমাদের পালা। বাজিতে তোমার জিত হোক তা-ই সবাই চায়।

ফিদা জয়সওয়ালের চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। যেন গোয়েন্দা-পুলিশ এখনই ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।

কী করে জানব নীতু সবাইকে ফাসায়নি?–ফিদার কণ্ঠস্বর উষ্ণ, আমাদের এখন লুকিয়ে থাকাটাই ঠিক হবে।

তার মানে, নীতুর সঙ্গে যে আমাদের কানেকশান ছিল সেটা গোয়েন্দা-পুলিশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া।–চাপা অথচ শান্ত গলায় এ-মন্তব্য পুতুল বক্সীর। ওর মুখের রং ফিরে এসেছে। সুদেশ সেটা লক্ষ করল। তেজি জেনানা! ওর সহ্য শক্তি সম্পর্কে সুদেশের অনুমানে ভুল হয়েছিল!

রাহুল প্রশংসার চোখে পুতুলের দিকে তাকাল।

পুতুল ঠিক বলেছে, ফিদা। আমাদের এখন ভয় পেলে চলবে না। এখন মাথা ঠিক রাখতে হবে।–সে তাকাল সুদেশ হুদার দিকে। পুরু লেন্সের পিছনে রাহুল দস্তিদারের চোখ জ্বলছে? তুমি কী বলো, সুদেশ? একেবারে চুপচাপ যে?

সুদেশ কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, পুলিশকে এখনই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।

ফিদা জয়সওয়াল তীব্র ব্যঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, নীতু যেমন ভেবেছিল!

সাপের চোখে ফিদার দিকে তাকাল সুদেশ। ওরা পরস্পরকে মোটেই পছন্দ করে না।

সুদেশ বলল, নীতু এখন সব আলোচনার বাইরে। সব সাহায্যের বাইরে। তবে আমার ধারণা, নীতু আমাদের কথা পুলিশকে বলেনি।

রাহুল তীক্ষ্ণ কৌতূহলে সুদেশকে খুঁটিয়ে দেখছিল–নীচের ঠোঁটে দাঁতের কামড়। তারপর বলল, তোমার এ ধারণার কারণ, সুদেশ?

এ তো একদম ক্লিয়ার। নীতু যদি সব ফাঁস করে দিত, তাহলে ওর ডেডবডি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে পুলিশ আমাদের অ্যালার্ট করে দিত না। ওরা প্রথমে আমাদের অ্যারেস্ট করত।

রাহুল দস্তিদার আঙুলে টুসকির শব্দ করল? সারা সন্ধের এই একটা দামি কথা। নীতু আমাদের নাম বলেছে কি বলেনি তার উত্তর হল, আমরা এখনও জেলের বাইরে। নীতু আমাদের নাম বলে থাকলে এতক্ষণে নীতু মেহতার দাওয়াই আমাদের ওপর চালু হয়ে যেত। নীতুকে যে হেভি অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে, সেটা আমাদের জানিয়ে পুলিশ বোকামি করত না। রাহুলের চোখ পিছলে গেল কাছাকাছি বসা এক যুবকের ওপর। সে খেতে-খেতে হঠাৎই চোখ তুলে তাকিয়েছিল ওদের দিকে।–ঢের হয়েছে। এবার উঠে পড়া যাক। নইলে সবাই আমাদের নজর করতে শুরু করবে। আবার আমাদের দেখা হবে। তবে, কোথায়, কখন, পরে জানিয়ে দেওয়া হবে…।

সুদেশ হুদা

রাহুল আর সুদেশ পুতুলকে বাসে তুলে দিল। ফিদা আর রতনলাল নিজের নিজের ডেরায় চলে গেল। পুতুলের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল সুদেশের। কিন্তু নীতুর ভয়াবহ পরিণতি যেন ওদের মাঝে পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই শুধু নীরবে হাতে চাপ দিয়ে পুতুলকে বিদায় দিয়েছে।

বাস ছেড়ে দেওয়ার পর নিজেকে ভীষণ একা মনে হল সুদেশের। মন হয়ে উঠল বিষণ্ণ। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর মনে পড়ল, দলের কথা, বর্তমান পরিস্থিতির কথা, নিজেদের লক্ষ্যের কথা।

রাহুল দস্তিদার সুদেশের কাঁধে হাত রাখল : চলো, সুদেশ। চায়ে একটু গলা ভেজানো যাক। কথা আছে।

সামান্য হাঁটা-পথ পেরিয়ে একটা নির্জন চায়ের দোকান ওদের চোখে পড়ল। ভেতরে ঢুকে দু-কাপ চা নিয়ে বসল দুজনে। রাহুল চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল।

চায়ে চুমুক দিয়ে বেশি গরম বলে মনে হল সুদেশের। অথচ গরম চা ওর প্রিয়। তবে আজ কেন…!

রাহুল সুদেশের দিকে তাকিয়ে। চশমার পিছনে ওর চোখ অগ্নিময়। সুদেশ, আমাদের ভেতর একজন ইনফরমার আছে।

সরাসরি এই মন্তব্যে সুদেশ প্রচণ্ড চমকে উঠল, কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। রাহুলের সেটা নজরে পড়ল। সে হাসল হালকাভাবে।

তুমিও যে এ-কথা ভাবোনি, সে-কথা আমাকে বলো না, সুদেশ। এ ছাড়া নীতুর অ্যারেস্ট হওয়া বা মৃত্যুর কোনও সঠিক ব্যাখ্যা নেই–থাকতে পারে না।

কিন্তু কিন্তু, এ যে অসম্ভব!

 উজ্জ্বল ময়াল-চোখ সামান্য তীক্ষ্ণ হল চশমার আড়ালে।–কেন? অসম্ভব কেন?

যদি ইনফরমার কেউ থেকেই থাকে, তা হলে সে শুধু নীতুর খবরই পুলিশকে জানাল কেন? সবাইকে কেন ধরিয়ে দিল না?

মাথা নাড়ল রাহুল, ঠোঁটের ওপর তীব্র হল ওর দাঁতের কামড়। ঠিকই বলেছ, সুদেশ। হয়তো সে নীতুর খবর পুলিশকে জানাতে বাধ্য হয়েছিল। হয়তো নীতু সেই ইনফরমারকে চিনে ফেলেছিল, তাই সে নিজেকে বাঁচাতে নীতুকে ধরিয়ে দেয়।

তা হলে নীতুকে ওরকম বীভৎসভাবে টরচার করা হল কেন?

রাহুল কাঁধ ঝাঁকাল, ওর ঠোঁট শক্ত হল।–এদেশের পুলিশরা স্যাডিস্ট। একটা কসাইয়ের কর্মচারীরা এর চেয়ে বেশি কী হবে?

রাহুল দেশনেতাকে কখনও নাম ধরে সম্বোধন করে না। বলে কসাই, অথবা বিশ্বাসঘাতক। দেশের রক্তচোষা।

সেই ইনফরমার আমাদের সম্পর্কে আর নতুন কী জানতে চায়? সুদেশ প্রশ্ন করল। আমরা কী, কে, তা তো সে ভালোভাবেই জানে!

সে জানতে চায় আমাদের বিস্ফোরণের দিনটা–কোন দিন আমরা আক্রমণ করব এই দুর্নীতিভরা শাসন ব্যবস্থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আমাদের আসল নেতাদের নাম-ঠিকানা। তাঁদের পরিচয় আমিও ঠিকঠাক জানি না। তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একজন মিলম্যানের মাধ্যমে।

সুদেশ সতর্কভাবে লক্ষ করছে রাহুল দস্তিদারকে।

আর কাউকে তোমার এ-সন্দেহের কথা বলেছ? বলেছ ইনফরমারের কথা?

 ক্ষুরধার হাসি ফুটে উঠল রাহুলের ঠোঁটে, এবং মিলিয়ে গেল।

তোমাকেই প্রথম বললাম, সুদেশ।

 কেন? আমাকে কেন?

আবার সেই হাসিঃ দলের মধ্যে তুমি একটু অন্যরকম, সুদেশ। তুমি আমাদের দেশের লোক নও। এখানে পড়তে এসেছ সুদূর মিক্স ইস্ট থেকে। আমাদের দলে তোমার যোগ দেওয়ার কারণ স্পষ্ট এবং জোরালো। আমাদের বিরুদ্ধে ইনফরমারগিরির জন্যে তুমি এত কষ্ট করে আমাদের দলে আসবে এ সম্ভবনা কম। তোমার প্রাণ দেশপ্রেমীর প্রাণ।

ধন্যবাদ রাহুলদা। সুদেশ হাসল।আমি তাহলে সন্দেহের বাইরে আছি?

আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই, সুদেশ।

বিশেষ কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?

 তোমার হয়?

সুদেশ চোখ ছোট করে রাহুলের দিকে তাকাল ও আমাকে দিয়ে কী বলাতে চাও, রাহুলদা?

আবার হাসি।–যে-কোনও একজনের নাম করো। মনে রাখবে, আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই। সুতরাং, একজনের নাম করো। যে-কোনও একজনের।

এর কোনও মানে হয়?সুদেশ হুদা বলল, তুমি তো জানো, ফিদাকে আমি পছন্দ করি না। ওর নাম বললাম, কারণ, ওকে আমার ভালো লাগে না। ও ইনফরমার কি না জানি না– তবে হতেও পারে।

ফিদা।–আস্তে-আস্তে উচ্চারণ করল রাহুল দস্তিদার। ঠোঁট কামড়ে ধরল দাঁতে। হতে পারে। ইনফরমার আছে কি না আছে জানার আগে থেকেই ফিদাকে আমার সন্দেহ হত। বড় বেশি নার্ভাস– ওকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায় না। দেখেছ, নীতুর খবর শুনে কীরকম লুকিয়ে পড়ার কথা বলছিল? অন্য কারও নাম বলো।

সুদেশ ইতস্তত করতে লাগল।–রতনলাল? আমার মনে হয় ইনফরমারগিরির বুদ্ধি ওর নেই।

হয়তো সেটা ওর অভিনয় হতে পারে। কারণ, কখনও কখনও ওকে বেশ বুদ্ধি খেলাতে দেখেছি। চালাকিটা চমৎকার। ওপর-ওপর এক বোকাসোকা গোবেচারা ছাত্র। নেহাতই আমার শেখানোর ঠেলায় আর পরীক্ষার হলে টোকাটুকির জোরে পাস করে। কেই-বা ওকে সন্দেহ করবে? অন্য কারও নাম কোরো, সুদেশ।

আর কে আছে?

 হালকা হাসির লক্ষ্য এবার সুদেশ। সবে তো শুরু করেছ, সুদেশ।

আমি..আমি। বলল সুদেশ, কিন্তু তুমিই তো বলেছ, আমি সন্দেহের বাইরে।

 ভুল করছ, সুদেশ। আমি বলেছি, আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই।

সুদেশ রাহুল দস্তিদারের দিকে তাকিয়ে হাসল ও রাহুলদা, আমি কি নিজের সাফাই নিজেই গাইব? তিন মাস আগে আমি মিডল ইস্ট থেকে এসেছি। আমার পাসপোর্ট, কাগজপত্র, সব হোস্টেলের ঘরে আছে। পুলিশ কি আমার মতো একজন বিদেশিকে তোমাদের দলে ইনফরমার হিসেবে ঢোকানোর ঝুঁকি নেবে?

তাই বুঝি?–চশমার কাচের আড়ালে রাহুল দস্তিদারের চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠল। সুদেশ হুদার সেটা নজর এড়াল না। সুদেশ, তুমি আইন-পালানো দাগি হতে পারো। এখানকার গোয়েন্দা পুলিশ এইরকম দাগিদেরই ইনফরমার হিসেবে পছন্দ করে।

আমি? দাগি?সুদেশের বিস্ময়ে ওরা দুজনেই হেসে উঠল।

রাহুল হাত বাড়িয়ে মৃদু চাপড় মারল সুদেশের হাতে।

আমার কথাগুলো মনে রেখো, সুদেশ। আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই। এমনকী আমিও।

চেয়ারে হেলান দিয়ে রাহুলের চোখে চোখ রাখল সুদেশ।

 তুমি?

মাথা নাড়ল রাহুল।–কেন নয়? সেটাই তো হবে সত্যিকারের চালাকি। যে-লোকটা সব সন্দেহের বাইরে–আমি–সে-ই হল গিয়ে আসল লোক। অ্যাটাকের দিনটার কথা আমিই প্রথম জানব। আমাদের দলের হাই লেভেল লিডারদের আমিই খানিকটা হয়তো চিনি।

রাহুলদা।–সুদেশ বলল।–এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। আমি জানি, এই বিপ্লবের জন্য তোমার দরদ কতখানি। তুমি কখনও বিট্রে করতে পারবে না। যদি আমাদের মধ্যে ইনফরমার কেউ থেকেই থাকে, তবে সে হয় রতনলাল, নয় ফিদা।

আমার কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ, সুদেশ। আমি বলছি, আমাদের কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। এখনও একজন বাকি আছে যার নাম আমরা এখনও তুলিনি।

সুদেশ হুদার দু-চোখে আতঙ্ক।

অসম্ভব, রাহুলদা! পুতুল হতে পারে না।

সেও তো আমাদের একজন।–মাথা নেড়ে বলল রাহুল।

তুমি ঠাট্টা করছ।

 রাহুল দস্তিদারের ঠোঁটের রেখা হিংস্র হল। বলল, নীতু মেহতার সঙ্গে কেউ ঠাট্টা করেনি।

সুদেশ হিংস্র স্বরে জবাব দিল, পুতুলকে নিয়েও ঠাট্টা চলে না।

তুমি ওকে ভালোবাসো, তাই না সুদেশ?–শান্ত গলায় বলল রাহুল, বড়ই দুঃখের কথা যে, ভালোবাসা অন্ধ হয়।

সুদেশ চোখ নামিয়ে তাকাল চায়ের কাপের দিকে। চা এখন ঠান্ডা। সুতরাং, সুদেশের জিভে বিস্বাদ ঠেকবে। ওর চোখের সামনে পুতুলের মুখ। মনে-মনে ওর ঠোঁটের স্পর্শ, শরীরের উষ্ণতা, আর একইসঙ্গে ওকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে…সব মিলিয়ে এক বিষণ্ণতা ঘিরে ফ্যালে সুদেশ হুদাকে। এই রাজনীতির মধ্যে পুতুলের আসার কী দরকারটা ছিল?

সুদেশের রাগ হল। হিংসা, প্রতিহিংসা, রাজনীতি, বিপ্লব–এসব পুরুষদের কাজ। পুতুল তো ওর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে পারত, পারত না?

হঠাৎই সুদেশের মনে পড়ল, পুতুল যদি রাহুলদার দলে না থাকত তা হলে সুদেশ এখানে এসে কোনওদিনই ওর দেখা পেত না। গড়ে উঠত না ওদের এই অদ্ভুত ভালোবাসা।

হ্যাঁ, ভালোবাসি। রাহুলের দিকে চোখ রেখে সুদেশ বলল, ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, রাহুলদা। সেইজন্যেই বলছি, ওকে সন্দেহ কোরো না। অন্য কাউকে সন্দেহ করো, আমাকে করো, কিন্তু ওকে না। আমাদের বন্ধুত্বকে বন্ধুত্বের মধ্যেই ধরে রাখো, রাহুলদা।

রাহুল দস্তিদারের চোখে বিষণ্ণ দৃষ্টি।

তোমার জন্যে দুঃখ হয়, সুদেশ। তোমরা ইরানিরা বড় অদ্ভুত। আমরা অন্যরকম–অন্তত আমি। কোনও মেয়ে আমার নজর কাড়ে না। এই বিপ্লবই আমার মা, বোন, বউ-সব। বলতে পারো এই বিপ্লবের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে। সেই কারণেই পুতুল বক্সীকেও আমি সন্দেহের চোখে দেখি। সে পুরুষ কি মেয়ে তা দেখি না। আমি দেখি, সে আমাদেরই একজন, অতএব সন্দেহের বাইরে নয়।

আর কোনও কথা আমি শুনতে চাই না।–উঠে দাঁড়াল সুদেশ।

রাহুল দস্তিদার চারপাশে তাকাল। দোকানে ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন খদ্দের ঢুকেছে।

হ্যাঁ, সেই ভালো। আমাদের কথাবার্তা ক্রমশই উঁচু পরদায় উঠছে।

চশমার কাচ ভেদ করে সুদেশের দিকে তাকাল সে। আবার আমাদের দেখা হবে… শিগগিরই…দলের ডেরায়।

কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল সুদেশ হুদা।

.

সুদেশ হুদা বাড়ি ফিরতেই খবর পেল, একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা ইরানের লোক।

আপনার দেশ থেকে এসেছেন। প্রতিবেশী মহিলা বললেন সুদেশকে। তাঁর চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ৷ যাতে ভুলে না যাই সেজন্যে তাদের নাম-ধাম লিখে রেখেছি–এই যে।

এক টুকরো কাগজ সুদেশের হাতে তুলে দিলেন তিনি। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি। কসমোপলিটান হোটেল। রুম নাম্বার চারশো পাঁচ।

কাগজটা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে ফেলল সুদেশ।

 কী হল, ঠিকানাটা আপনার লাগবে না?–মহিলাটি প্রশ্ন করলেন।

 না। মনে থাকবে।

ওঁদের তাহলে আপনার ভালোমতো মনে আছে? ওঁরা বলছিলেন, আপনাদের ফ্যামিলির সঙ্গে নাকি ওঁদের জানাশোনা আছে। এ দেশে বেড়াতে এসে তাই ভাবছিলেন আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন। সত্যি, দুর-দেশে চেনা লোক পাওয়া মানে…।

হাতে স্বর্গ পাওয়া।–সুদেশের গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।

আপনি ঠিক দেখা করবেন কিন্তু। ওঁরা অনেক করে বলে গেছেন।

কাল দেখা করব। এখন পড়াশোনা আছে। খবরটা দেওয়ার জন্যে থ্যাঙ্কস।

 আলোচনায় দাঁড়ি টেনে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল সুদেশ।

ফিদা জয়সওয়াল

সেই রাত্রেই ফিদাকে অনুসরণ করল সুদেশ।

ফিদা ওকে দেখতে পায়নি। রাস্তায় অনেক লোকের ভিড়। সুতরাং, নিজেকে গোপন রেখে অনুসরণে কোনও অসুবিধেই হয়নি।

ফিদার চালচলন এখন খেয়ালি, উদ্দেশ্যহীন। একটা দোকান থেকে একটা কোকাকোলা কিনে গলায় ঢালতে শুরু করল সে। তারপর একটা ম্যাগাজিন-স্টলে দাঁড়িয়ে দু-একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে দেখল। একটা সিনেমা হলের সামনে কিছুটা সময় কাটিয়ে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ল ফিদা।

ফিদার সামনে চায়ের কাপ। চোখ চায়ের কাপে। মন অন্য কোথাও। ওর কপালে গভীর চিন্তার রেখা। সে-চিন্তার কি নীতু মেহতা আর নাম-না-জানা ইনফরমার জায়গা করে নিয়েছে? ভাবল সুদেশ। একটা থামের আড়ালে একটা টেবিলে বসেছে সুদেশ। গোপনে লক্ষ রাখছে ফিদা জয়সওয়ালের ওপর।

চায়ের কাপে টোকা মারছিল সুদেশ। তখনই সে দেখতে পেল জগদীশ আম্বাস্তাকে।

নেশা করা চোখ নিয়ে কালো জলহস্তীমার্কা জগদীশ আম্বাস্তা রেস্তোরাঁয় ঢুকেছেন। তার বেজির মতো চঞ্চল চোখ পিছলে যাচ্ছে প্রতিটি লোকের মুখে। পুলিশ বিভাগের চরম কুখ্যাত অফিসার জগদীশ আম্বাস্তা। রাহুল দস্তিদারের দলে ঢোকার কয়েকদিন পরেই জগদীশকে চিনিয়ে দিয়েছিল রাহুলদা। গোয়েন্দা-পুলিশের দলে সবচেয়ে নৃশংস স্যাডিস্ট এই জগদীশ। বিপ্লব সফল হলে তাঁর জন্য বিশেষ পুরস্কার তাকে তুলে রেখেছে রাহুলদা। নীতু মেহতার করুণ ধ্বংসের মুলে জগদীশ আছেন বলেই সকলের ধারণা।

জগদীশ সাদা পোশাকে আছেন। গিয়ে বসলেন ফিদার মুখোমুখি। ফিদার শরীর হাই ভোল্টেজ শকে শিউরে উঠল–সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য। কিন্তু সুদেশের সেটা নজর এড়াল না।

ফিদা চিনতে পেরেছে জগদীশকে।

জগদীশ পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করলেন। সকলের চোখের সামনেই ভেতরের তরলটুকু গলায় ঢাললেন। জগদীশকে সকলেই চেনে। কয়েক জোড়া ভয়ার্ত চোখ ছিটকে এল কুচকুচে কালো লোকটার দিকে। ফিদা চটপট ওর চা শেষ করল। তখনই জগদীশ কী যেন বললেন ওকে। তারপর বোতলটা পকেটে রেখে একটা চুরুট বের করলেন। ফিদা একটা দেশলাই এগিয়ে দিল তার দিকে। গোটাকয়েক কাঠি নষ্ট করে চুরুট ধরালেন জগদীশ। তিনি ফিদাকে আরও কী যেন বললেন। কাধ কঁকিয়ে ফিদা তাকাল দরজার দিকে। জানোয়ারের মতো হাসলেন জগদীশ, খামচে ধরলেন ফিদার কাঁধ। ফিদা কাষ্ঠ হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল। হেসে কী যেন বললেন জগদীশ। ফিদা বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে।

সুদেশও উঠে দাঁড়িয়ে অনুসরণ করল ফিদাকে।

ফিদা চটপট পা চালাল রাতের পথ ধরে।

নিজের আস্তানার কাছে পৌঁছে ওর চলার শব্দ আয়েশি হল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল ফিদা। সুদেশ অপেক্ষা করতে লাগল রাস্তায়। রাস্তার অল্প আলোয় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সুদেশের তেমন কষ্ট হল না। তারপর আলো জ্বলে উঠল ফিদার ঘরে।

তোমার নজরদারির প্রশংসা করতে হয়, সুদেশ।

বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো ঘুরে দাঁড়াল সুদেশ। ওর গলা চিরে বেরিয়ে এল এক চাপা চিৎকার– ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়ানো আগন্তুকের ওপর যখন চিতাসুলভ ক্ষিপ্রতায় ও ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তখনই ও চিনতে পারল মানুষটাকে।

রাহুল দস্তিদার।

অল্প আলোয় ওর চশমার কাচ চকচক করছে।

রাহুলদা! তুমি এখানে কী করছ? ফিশফিশ করে বলল সুদেশ।

তোমাকেও তো একই প্রশ্ন করতে পারি।

 আমি ফিদাকে ফলো করছিলাম।

 আর আমি তোমাকে।

অবাক-দৃষ্টিতে রাহুল দস্তিদারের দিকে চেয়ে রইল সুদেশ। রাহুল নিঃশব্দে হাসল।

সন্ধেবেলা তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম, রাহুল বলল, কিন্তু তুমি বাড়িতে ছিলে না। পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি বোধহয় কসমোপলিটান হোটেলে গেছ তোমার দেশের কোন লোকের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর পথে তোমার দেখা পেয়ে ফলো করতে শুরু করলাম। পরে বুঝলাম, তুমি ফিদাকে ফলো করছ। সুতরাং, কোনও জানান না দিয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়।

তুমি সবই দেখেছ তাহলে? সুদেশ জানতে চাইল, ফিদা আর জগদীশকে দেখেছ?

হ্যাঁ, দেখেছি।

তাহলে তো সবই বুঝতে পারছ।

কী বুঝতে পেরেছি?

 যে ফিদাই সেই ইনফরমার!

ফিদার ঘরের জানলার আলোর দিকে রাহুল দস্তিদারের চোখ স্থির। ঠোঁটের ওপর দাঁতের সেই পুরোনো খেলা।

আজ রাতে যা দেখেছ তার জোরেই বলছ যে, ফিদা ইনফরমার?

জগদীশ আম্বাস্তা ওর সঙ্গে কথা বলেছে। সে ফিদাকে চেনে, কিন্তু ওকে অ্যারেস্ট করছে না। কেন?

আমার তো মনে হয়েছে, জগদীশ আম্বাস্তা ফিদার কাছে দেশলাই চাইছিল।

সেই দেশলাইয়ের সঙ্গে কি কোনও সাংকেতিক খবর হাতবদল হতে পারে না? চুরুট ধরাতে জগদীশের অনেক বেশি সময় লেগেছে। কোনও খবর হাতবদল করতে তার বেশি সময় লাগে না।

ফিদার ঘরের আলো নিভে গেল।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে পকেটে হাত ঢোকাল রাহুল দস্তিদার।

তোমার কয়েকটা কথা ভাববার মতো সুদেশ। কিন্তু তা বলে ফিদা যে নির্দোষও হতে পারে সে কথা ভুলে যেয়ো না। সেই ইনফরমার অন্য কেউও হতে পারে।

রতনলাল?–অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল সুদেশ। তারপর আরও অস্পষ্ট স্বরে যোগ করল, পুতুল?

রাহুল পকেট থেকে হাত বের করে হাওয়ায় দোলাল।

সেইজন্যেই আজ তোমার কাছে গিয়েছিলাম। ক্ষমা চাইতে। এই নয় যে, পুতুলকে আমি সন্দেহ থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়েছি। সেটা সম্ভব নয়। কারণ, অনেকগুলো লাইফের ব্যাপার। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব রাখতে চাই, সুদেশ। আজ সন্ধেয় তুমি রাগ করে চলে গিয়েছিলে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়। আমাদের এখন একজোট হয়ে থাকতে হবে। জগদীশ আম্বাস্তা আর গোয়েন্দা পুলিশকে দূরে রাখতে গেলে এটাই একমাত্র পথ। শুনেছি, জগদীশ টরচার করতে এক্সপার্ট। আমি চাই না, সে তার টরচারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের ওপর চালাক।

চারপাশে তাকাল রাহুল। অন্ধকার নির্জন রাস্তা। ঘুমিয়ে পড়া বাড়ি-ঘর। ফিদার অন্ধকার জানলা।

রাত হয়েছে। আজ কারফিউ হতে পারে শুনেছি। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার কোনও মানে হয় না। চললাম, সুদেশ। মনে রাগ রেখো না।

না। রাখব না।

সুদেশের দৃষ্টির সামনে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হল রাহুল দস্তিদার। ফিদার জানলার দিকে আর একবার তাকিয়ে রওনা হল সুদেশ। আজকের পরিশ্রমের ফল কী হবে সে জানে না।

তোমার জন্যে, পুতুল।–আপনমনে ভাবল সুদেশ।–যা করছি সব তোমার জন্যে। তোমাকে বাঁচানোর জন্যে।

জগদীশ আম্বাস্তা

পরের দিনটা সুদেশের পড়াশোনা, লাইব্রেরি নিয়েই কেটে গেল। বাড়ি ফিরতে সিঁড়িতে দেখা হল প্রতিবেশী সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তার চোখে-মুখে একটা বিস্রস্ত ছাপ।

মিস্টার হুদা! তাঁর গলার স্বরে ছেলে-কে তিরস্কারের ইঙ্গিত।–ওঁরা আবার এসেছিলেন– মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি। আপনি কাল ওঁদের সঙ্গে দেখা করেননি বলে খুব দুঃখ করছিলেন।

সময় পাইনি।বলল সুদেশ, দেখা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, যেতেই পারিনি।

ওঁরা কালকের প্লেনে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। কী লজ্জার কথা বলুন তো! একবার দেখা করতে পারলেন না? ওঁরা এত আশা করে এসেছেন।

আজ রাতে দেখা করব। কোনও ভুল হবে না। আচ্ছা–ধন্যবাদ।

তাঁকে পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সুদেশ।

 ঘরে ঢুকে বইপত্র নিয়ে আবার পড়াশোনায় বসল। কিন্তু মনে চিন্তার ঘূর্ণিঝড়, কালো ঘূর্ণিঝড়।

অন্ধকার ঘন হতেই পড়াশোনায় মনোযোগ ফিকে হয়ে এল সুদেশের।

ফিদা। ফিদা জয়সওয়াল।

*

সুতরাং, সংবিৎ যখন ফিরল, তখন গতকালের মতোই ফিদাকে অনুসরণ করে চলেছে সুদেশ।

একই রাস্তা ধরে পথ চলার অভ্যেস ফিদার। ওকে খুঁজে নিতে বেশি অসুবিধে হয়নি সুদেশের। এবং আজকের অনুসরণ গত সন্ধের অ্যাকশান রিপ্লে বলা যায়। অবশেষে সেই একই রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল ফিদা। সুদেশও ঢুকল।

জগদীশ আম্বাস্তা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টলোমলো পায়ে এগিয়ে গেলেন ফিদার কাছে। একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন। ফিদা এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছিল–সেটা এসে পৌঁছলে জগদীশ ওকে কী যেন বললেন। সুদেশ শত চেষ্টা করেও কথাগুলো শুনতে পেল না।

হঠাৎই এক হিংস্র গর্জন করে লাফিয়ে উঠলেন জগদীশ। বাঁ-হাতের মুঠোয় খামচে ধরলেন ফিদার চুল। পিছন দিকে লাথি মেরে ফেলে দিলেন নিজের চেয়ার। এবং ডানহাতে গরম চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন ফিদার মুখে।

একটা জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এল ফিদার গলা চিরে। রেস্তোরাঁর সব লোক ত্রাসে বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে। জগদীশের লাথি-ঘুসি এখন অবাধে ছিটকে পড়ছে ফিদার শরীরে।

শালা, বিপ্লব। গর্জে উঠলেন জগদীশ আম্বাস্তা। নীতুকে দেখে শিক্ষা হয়নি? চল সালা! তোকে বিপ্লব দেখাচ্ছি।

তার পরেই শুরু হল জগদীশের অশ্রাব্য খিস্তি।

অন্যান্য খদ্দেরের মতো সুদেশও উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর হাত চলে গেছে পকেটে। রিভলভারের খোঁজে। পিছন থেকে কে যেন ওর হাত চেপে ধরল।

এক ঝটকায় ফিরে তাকাল সুদেশ।

 রাহুলদা। রাহুল দস্তিদার।

কেটে পড়ো এখান থেকে।–চাপা গলায় বলল রাহুল। তারপর কোলাহল আর ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল।

সুদেশ জানে, আগামীকালই হয়তো বড় রাস্তায় পড়ে থাকবে ফিদা জয়সওয়ালের বডি।

প্রথম নীতু মেহতা। দ্বিতীয় ফিদা। তিন নম্বর কে?

 আশপাশে তাকিয়ে রাহুলকে একবার খুঁজল সুদেশ। পেল না।

পুতুল এখন কোথায়? ভাবতে-ভাবতে বাড়ির দিকে পা চালাল ও।

পুতুল বক্সী

মাথা নীচু করে গভীর চিন্তা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছিল সুদেশ, হঠাৎই আলোর ঝলক চোখে পড়তেই মুখ তুলল। একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে ওর মুখোমুখি। তীব্র হেডলাইটের আলো ঝাপটা মারছে সুদেশের চোখ-মুখে। কুঁকড়ে গেল সে। তৈরি হল বিদ্যুৎবেগে দৌড়োনোর জন্য। তখনই ভেসে এল পুতুলের মিষ্টি গলা।

সুদেশদা!

গাড়িটা দেখে সুদেশ অবাক হল। ও দেখল, ভেতরে ড্রাইভার ছাড়া পুতুল একা।

 গাড়িটা পেলে কোত্থেকে?

সে জেনে কী হবে? সময়ে-সময়ে দরকার হলে পাওয়া যায়। রাহুলই জোগাড় করে দিয়েছে। এখন এসো।

পিছনের সিটে পুতুলের পাশে গিয়ে বসল সুদেশ। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল ড্রাইভার যুবকটিকে দেখিয়ে।

দলের ছেলে।–ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল পুতুল।

গাড়ি চলতে শুরু করল। জনবহুল চঞ্চল এলাকা এড়িয়ে শান্ত নির্জন পথ ধরে এগিয়ে চলল ওরা। সুদেশের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু কোথায় শুরু করবে ও বুঝতে পারছে না। অবশেষে ফিদার কথাই ও বলল।

পুতুল, ফিদা ধরা পড়েছে।

জানি। জগদীশ আম্বাস্তা ধরেছে।–পুতুল বক্সীর চোখ সামনের অন্ধকার পথে স্থির।

কে বলল? রাহুলদা?

হ্যাঁ। আমাদের খতমের লিস্টে এর পরের নাম জগদীশ আম্বাস্তার। শান্ত স্বরে পুতুল বলল, রাহুলদা তোমাকে সকালে খুব খুঁজেছে, সুদেশদা।

আমি লাইব্রেরিতে ছিলাম।

আমরাও তাই ভেবেছি–যখন অন্য কোথাও তোমাকে পাইনি। বাড়িতে তো একটা খবর রেখে যেতে পারো।

কী করে জানব রাহুলদা ডাকবে। আমাকে বলেছিল, এখন কয়েকদিন আমরা একজোট হব না।

তোমার পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা রাহুলকে বলেছে তুমি নাকি আজকাল বাড়িতে প্রায় থাকোই না। শুধু স্নান করতে আর খেতে যাও।

এ কটাদিন খুব পড়াশোনায় চাপ যাচ্ছে। আমাদের মিটিং-এর জন্য পড়াশোনায় খুব পিছিয়ে পড়েছি। পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে আমার স্কলারশিপ নষ্ট হয়ে যাবে।–চোখ ফিরিয়ে পাশে বসা পুতুলের দিকে তাকাল সুদেশ।ভয় নেই, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।

অল্প হাসল পুতুল।–জানি। তা ছাড়া পালিয়ে যাবেই বা কোথায়! আমাদের যতজনকে তুমি চেনো, তার চেয়েও অনেক বেশি লোক এ-শহরে ছড়িয়ে আছে, সুদেশদা।

রাহুলদা কি পুতুলকে ইনফরমারের কথা বলেছে? ভাবল সুদেশ। সে সন্দেহ করেছিল ফিদাকে। ফিদা জয়শওয়ালকে। কিন্তু তার পরিণতি কী অদ্ভুত! জগদীশের নৃশংস হাতে ধরা পড়ল ফিদা।

ফিদাকে যখন ধরা হয়, তখন আমি জগদীশকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। আনমনাভাবে বলল সুদেশ, রাহুলদা বারণ করল। জানো পুতুল, আমি ফিদাকে পছন্দ করতাম না।

পছন্দ-অপছন্দ যার-যার নিজের কাছে। ফিদার কপাল খারাপ ছিল। তুমি কিছু একটা করতে গেলে ভালোর চেয়ে খারাপ হত।

পুতুল কি জানে, রাহুলদা পুতুলকে সন্দেহ করতে চেয়েছিল? সুদেশ পুতুলের পক্ষ নিয়ে বাধা দিয়েছে? হয়তো বলেনি। বললে পুতুল এত শান্ত, নিশ্চিন্ত, থাকতে পারত না। এই অনুভবের সঙ্গে-সঙ্গে এক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা ঘিরে ফেলল সুদেশকে।

ও বাইরে তাকাল। শহর ছেড়ে ওদের গাড়ি শহরতলির খোলা পথ ধরেছে। দু-পাশে অন্ধকার প্রান্তর। আলো নজরে পড়ে না। শুধু নিজেদের গাড়ির হেডলাইট ছাড়া।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? সুদেশ জানতে চাইল।

 বেশি দূরে নয়।

ঠিক কতটা দূরে? সুদেশের স্বরে কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা অধৈর্যের সুর।

পৌঁছোলেই জানতে পারবে।

মিটিং আছে?

হ্যাঁ।

আগে কখনও শহরের বাইরে আমাদের মিটিং হয়নি।

মিটিংয়ের জায়গা তো আমি পছন্দ করি না, সুদেশদা। রাহুলদা করে। মুখ ফিরিয়ে সুদেশের দিকে তাকিয়ে হাসল পুতুল। সে-হাসিতে কিছুটা বিষণ্ণতা খুঁজে পেল সুদেশ।–আমাক তুমি বিশ্বাস করো না?

করি, পুতুল। সুদেশ হুদার কণ্ঠস্বর একাগ্র, একান্ত।

 এই তো, এসে গেছি।বলার সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ির গতি কমে এল।

রাস্তা নির্জন নির্জনতর। অন্ধকার। শুধু ওপরের আকাশে দিশেহারা নক্ষত্ররা চোখ পিটপিট করছে। এখানে, এই অদ্ভুত জায়গায় থামছে কেন গাড়ি? কই, অন্য কাউকে, রাহুলদাকে, তো চোখে পড়ছে না? সুদেশ অবাক হতে-না-হতেই গাড়ি একেবারে থেমে গেল।

এবার আমি চলে যাব।–বলল পুতুল।

 চলে যাবে? সুদেশের স্বর বিপন্ন।

হ্যাঁ, রাহুলদার তা-ই নির্দেশ।

আকাশের ছেঁড়া মেঘের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে সুদেশ। চারপাশ একেবারে চুপচাপ, শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের চাপা গর্জন এক বিদ্রোহ।

কী ব্যাপার বলো তো, পুতুল?

জানি না।–ওর গলায় অস্বস্তির সুর। রাহুলদা আমাকে সব খুলে বলেনি। শুধু বলেছে আমি যেন এখানে না থাকি, আবার শহরেও ফিরে না যাই। গাড়ি নিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে অন্য একটা জায়গায়। সে-জায়গার নাম আমি আর রাহুলদা ছাড়া কেউ জানে না, জানবে না। তোমাকে জানানো ঠিক নয়, তবুও বলছি…অ্যাকশন সম্ভবত আজ রাতেই শুরু হবে। ফিদা ধরা পড়ার পর রাহুলদা আর দেরি করতে চাইছে না।

আজ রাতে?সুদেশের স্বর যেন পাহাড়ি প্রতিধ্বনি। তাহলে আমাকে এখানে আনা হয়েছে কী করতে?

অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার জন্য। আক্রমণের সময় তোমাকে একটা গ্রুপ লিড করতে হবে। তোমার সঙ্গে রিভলভার আছে তো?

আছে।

ভালো। ওরা যখন আসবে, তোমাকে সিগন্যাল দেবে–আলো জ্বালিয়ে-নিভিয়ে।

আর সঙ্গে-সঙ্গেই দু-হাতে সুদেশকে জড়িয়ে ধরল পুতুল। ওর ঠোঁট থমকে গেল সুদেশের ঠোঁটে। উষ্ণতা। আচ্ছন্নতা। অবাধ্য হৃৎপিণ্ডের শব্দ। সুদেশের ঘ্রাণে ফোঁটা পদ্মের গন্ধ। এই মুহূর্ত চিরন্তন হয়ে থাক।–ও ভাবল।

তোমার গায়ে আঁচ লাগতে দেব না,–পুতুল বক্সীর নরম শরীরে সুদেশের কথা জড়িয়ে যায়।–ভয় কোরো না। তোমার কোনও ক্ষতি আমি হতে দেব না। বিশ্বাস করো।

পুতুল ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ও ফিশফিশ করে বলল, যাও–বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করো। ওরা এখুনি এসে পড়বে। আমি চললাম। গুড বাই, সুদেশ।

সুদেশ হুদা যেন শোলার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে গাড়ির অপস্রিয়মান লাল আলোর দিকে। দূরে, অন্ধকারে, কোথাও পাচা ডেকে ওঠে কর্কশ স্বরে। শরীরে শিহরন জাগে সুদেশের। এই মুহূর্তে পুতুল ওর সর্বাঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু ও একা। সঙ্গী শুধু নৈঃশব্দ্য, আকাশের নক্ষত্র, আর অন্ধকার নির্জন প্রান্তর।

ইনফরমার

সত্যিকারের সময়ের অঙ্কে খুব বেশিক্ষণ ও অপেক্ষা করেনি, কিন্তু সুদেশের মনে হল এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। খোলা রাস্তায় ও পায়চারি করতে লাগল। কখনও রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল ঘাসে ছাওয়া অন্ধকার প্রান্তর, কখনও দেখল রাতের আকাশ। ওর মনে লক্ষ কথার ভিড়, লক্ষ ঘটনার ইশারা। পরিস্থিতি ওর বিচার-বুদ্ধির বাইরে চলে যাচ্ছে কেন?

প্রথমটা মনে হয়েছিল জোনাকির ছলনা। তারপর বোঝা গেল দূরাগত কোনও আলো দুটো চিতাবাঘের চোখ–দপদপ করে জ্বলছে-নিভছে। এগিয়ে আসছে সুদেশ হুদার দিকে।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ও লক্ষ করে যায়। অবশেষে আলোয় উচ্ছ্বাসী ঢেউ ছন্নছাড়াভাবে স্নান করিয়ে দেয় ওকে।

যাক, তুমি তাহলে সময় মতোই এসেছ, সুদেশ।

কণ্ঠস্বর আলোয় দিক থেকে আসেনি। এসেছে তার অনেকটা বাঁ-পাশ থেকে। তাই চমকে ঘুরে দাঁড়াল সুদেশ।

রাহুলদা! সুদেশ চিৎকার করে ওঠে, তুমি?

আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, সুদেশ। এ-জায়গাটা তোমার মনে নেই? মনে থাকা উচিত। শত হোক, এখানেই তো তোমাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।

অনুমানে কণ্ঠস্বরের দিকে এগিয়ে যায় সুদেশ হুদা। কিন্তু আলোয় বন্যা তার শরীরে অঙ্গাঙ্গী। পিছন থেকে কার গলা শোনা যায়,–আর-এক পা-ও এগোবে না। আমার হাতে পিস্তল আছে।

রতনলালের গলা সন্দেহ নেই।

 ত্রাসে বরফ সুদেশ।

 এ সব, কী রাহুলদা?–সে চিৎকার করে ওঠে, এ কী ধরনের ইয়ার্কি?

ইয়ার্কি নয়, ঠাট্টাও নয়, সুদেশ রাহুল দস্তিদারের কণ্ঠে হিংসা, উলঙ্গ হিংসা। মনে পড়ে? তিন মাস আগে এয়ারপোর্ট থেকে একজন ছাত্র ট্যাক্সি করে শহরে যাচ্ছিল। তার নাম সুদেশ হুদা। সুদূর ইরান থেকে এ-দেশে সে পড়াশোনা করতে এসেছিল। পথে জগদীশ আম্বাস্তার সিক্রেট-পুলিশ তাকে আটকায়। গাড়ি থেকে নামিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়। তারপর তারা সুদেশ হুদাকে খুন করে। পুঁতে ফ্যালে এই ঘাসজমিতে। কিন্তু অন্য এক সুদেশ হুদা ঠিকই শহরে এসে পৌঁছোয়। ইউনিভার্সিটিতে ভরতিও হয়। যদিও সে তুমি–নকল সুদেশ। জগদীশ আম্বাস্তার ডিপার্টমেন্টের লোক, গোয়েন্দা পুলিশের লোক। বুদ্ধির তোমার তুলনা নেই, সুদেশ। ওরা তোমাকে ভালোই ট্রেনিং দিয়েছিল…তারপর পাঠিয়েছিল আমার দলে। আমার কথা বুঝতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?

সুদেশের হৃৎপিণ্ড বুকের ভেতর দামামা। মস্তিষ্ক তীব্র চিৎকারে উন্মত্ত–পালাও, পালাও! কিন্তু সুদেশের পা অনড়, নিশ্চল। শ্যামাপোকার মতো আলোর বৃত্ত ওকে সম্মোহিত করে রাখে।

তুমি প্রোটেস্ট করবে না? সাফাইও গাইবে না? রাহুলদার গলায় ঠাট্টার সুর,সব্বাইকে ঠকালেও আমি ঠকিনি, সুদেশ। বিপ্লব আমার মা, বোন, বউ আমার রক্তে শুধু বিপ্লব আছে– আর কিছু নেই। ছাত্র সুদেশ হুদার মারা যাওয়ার খবরটা খবরের কাগজে বেরোয়নি–বের করা হয়নি। সুতরাং, তোমার কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। প্রথমটা হয়ওনি। নীতু মেহতা গেল। আমাকে ঠকানোর জন্যে তোমার পরিকল্পনায় সাহায্য করল জগদীশ আম্বাস্তা। ফিদার সঙ্গে মাখো মাখো ভাব দেখাল। তুমি আমাকে বোঝাবে, ফিদাই ইনফরমার। তোমার নির্দেশে ফিদা ধরা পড়ল। ছাড়াও পাবে। তখন তুমি আমাকে বোঝাবে, ফিদা জগদীশের লোক। তাই সে ফিদাকে ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। কই, নীতুকে তো দেয়নি! আমিও তাই বুঝতাম। কিন্তু তোমার সর্বনাশ ডেকে আনল মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি।

এখন সুদেশ বুঝতে পারল অসহায়তা কাকে বলে। এই হতাশ অনুভূতিহীন মুহূর্তে বুঝতে পারল নীতুর শেষ অবস্থার কথা, জগদীশের হাতে ফিদার করুণ অবস্থার কথাও।

প্রথমে বুঝিনি তুমি তাদের এড়িয়ে চলছ কেন। নিজের দেশের লোক, প্রতিবেশী, পরিবারের বন্ধু–অথচ তাদের সঙ্গে দেখা করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে তোমার নেই? এ তো ভালো কথা নয়! সুতরাং হোটেল কমোপলিটান-এ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজির সঙ্গে আমি দেখা করলাম। ওদের ঠিকানা তোমার প্রতিবেশী মহিলাই দিয়েছিলেন। যে সুদেশ হুদাকে তারা চিনতেন, সে বেঁটে এবং মোটা ছিল। তার গায়ের রংও পরিষ্কার। তুমি কে, সুদেশবাবু? নিজের লোকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো নোংরা মানসিকতা তোমার মনে কীভাবে জন্ম নিল? টাকার লোভে? পেটের দায়ে? তা হলে দ্যাখো, বড়লোক হয়ে ভরতি পেটে মরতে কেমন লাগে। রতনলাল!

আলো নিভে যায় মুহূর্তে। নিভেই থাকে। সময় দোদুল শূন্য। ক্রমশ গাঢ় হয় নৈঃশব্দ্যের পরদা। সুদেশ জানে, সামনে-পিছনে রাস্তা বন্ধ। এবং অন্ধকারে ওরা এগিয়ে আসছে, ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে ওকে শাস্তি দিতে। ওর শরীরে আলোড়ন তুলতে।

ওর সঙ্গে এখন রিভলভার নেই। সুতরাং ওরা নির্ভয়ে আসতে পারবে। ওর রিভলভার সরিয়ে নেওয়ার জন্যেই পুতুল ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। তখনই তুলে নিয়েছে সুদেশের আগ্নেয়াস্ত্র। এখন মনে পড়ছে, ওকে ছেড়ে দিয়ে পুতুলের কী কান্না! পুতুলের বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণার চেয়ে কী আর বেশি যন্ত্রণা ওরা দেবে? সুদেশ কাঁদবে না, ওর চোখে জল নেই। চোখের জল ফেলার অধিকারও ওর নেই। কারণ, সেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? নীতুর সঙ্গে, ফিদার সঙ্গে নীতুর আগে আরও অনেকের সঙ্গে, দেশের অন্যান্য জায়গায়। সুতরাং, চোখের জল ফেলার কোনও কারণ নেই। বরং কারণ আছে নীরব থাকার এবং প্রতীক্ষার। ও অপেক্ষা করছে করবে। হে ভগবান! নিঃশব্দ চিৎকারে ভাবল সুদেশ, ওরা এত দেরি করছে কেন…?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *