1 of 2

নষ্ট চাঁদ, কষ্ট চাঁদ

নষ্ট চাঁদ, কষ্ট চাঁদ

গল্পের নামটা ভালো হল না—তাই না রে? আসলে কবিতা-কবিতা করতে চেয়েছিলাম—কেমন যেন গদ্যের আঁশটে গন্ধ ঢুকে পড়ল। যাকগে। আসলে এটা তো আর গল্প নয়—তোকে লেখা শেষ চিঠি। কিন্তু তুই কি আর চিঠিটা পড়বি—মানে, পড়তে পারবি?

মনে পড়ে, সেটা ছিল শ্রাবণ মাস। তোর ভালোবাসার দোকানে আমি কী করে যেন ঢুকে পড়েছিলাম। হ্যাঁ—দোকানই তো! যেখানে সবসময় তোর ভালোবাসা চাওয়ার এত ভিড়। সুজাতা, বন্যা, তিতি, অনিতা—আরও কারা-কারা যে তোর সঙ্গে ঘুরতে চাইত, থাকতে চাইত কে জানে!

না, আমি চাইনি। কারণটা তো তুই জানিস। আমার গায়ের রং কালো, রূপও কালো। কখনও কেউ ঘুরে তাকাবে না—এমন মেয়ে আমি। তুই যেমন এটা জানিস আমিও তো জানি। জানব না আর! রোজ হতচ্ছাড়া আয়নাটা যে আমাকে জানিয়ে দেয়!

যখন ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম, যখন বড় হব—আরও বড় হব—তখন এই আজেবাজে চেহারাটা একটু-একটু বদলে গিয়ে কমবাজে হয়ে যাবে। সেই ‘আগলি ডাকলিং’-এর মতো। তখন কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই তাকাবে। আমার বাপি, মামণি আর কাকিমা-জেঠিমারা আমার বিয়ে হবে-কি-হবে না সেই নিয়ে কী চিন্তাই না করত! অবশ্য আমার সামনে কিছু বলত না। কিন্তু আড়াল থেকে আমি শুনতাম। আর আমার কান্না পেত। ওঃ, একটা মেয়ের জীবনে পুরুষ এত জরুরি! কেন, কেন?

পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না—ভালোই ছিলাম। নইলে তোর সঙ্গে সায়েন্স কলেজে দেখা হল কী করে! তুই লেখাপড়ায় আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো। আর দেখতে? তুই যে কেন সিনেমায় কিংবা টিভি সিরিয়ালে গেলি না কে জানে! সুজাতা, বন্যারা তোকে বারবার সে-কথা বলত। অবশ্য তুই আমাকে পরে বলেছিলি ওগুলো তোকে খুশি করার জন্যে।

বাইরে আমাকে দেখতে যা-ই হোক আসলে ভেতরে-ভেতরে আমি তো একটা মেয়ে। তখন রোজ ভাবতাম, ‘বিউটি ইজ ওনলি স্কিন ডিপ।’ চামড়া ডিঙোলেই সৌন্দর্য শেষ। তা হলে কেন? কেন এরকম হবে? তোরা—মানে, পুরুষরা—শুধু বাইরেটাই দেখবি? ভেতরের সুন্দরকে দেখবি না! তুই তো তখন জানতি না ভেতরে-ভেতরে আমি কী আশ্চর্য রূপসী।

আমি মনে-মনে ভাবতাম, বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়ায় ভোরের আলো এসে পড়লে যেমন অপরূপ দেখায়, আমি সেইরকম। শীতের পর বসন্ত এলে মরাগাছের ডালে যখন ঝকঝকে সবুজ নতুন পাতা ফোটে—ওদের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমি ওদের মতন। কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ যেমন ডালে-ডালে ফুলের আগুন জ্বালিয়ে রূপসজ্জায় সবাইকে মাতিয়ে দেয়, আমি সেইরকম।

তো এইসব ভাবতাম আর বিছানায় অসহায়ভাবে শুয়ে শব্দ না করে কাঁদতাম। নইলে পাশের ঘরে শুয়ে থাকা বাপি আর মামণি শুনতে পাবে যে!

আমার কল্পনা আমার ছিল। আমার স্বপ্ন আমার। হঠাৎ কী যে হয়ে গেল! একটা কাগজের গোল বল সব তালগোল পাকিয়ে দিল।

মনে আছে নিশ্চয়ই তোর, সেদিন আমরা সবাই মিলে টিএসপি-র ক্লাস করছিলাম। উনি জের্যান্টোলজির মেন্টাল এজিং নিয়ে কীসব বকবক করছিলেন। আমি মন দিয়ে শুনতে পারছিলাম না। কারণ, গতকাল ক্যান্টিনে বন্যা একটা কমেন্ট করেছিল। হয়তো ঠাট্টা করেই—কিন্তু সেটা আমাকে খুব বিঁধেছিল।

আমি তখন গৌরদার ক্যান্টিনে সেকেন্ড দরজা দিয়ে ঢুকছি। তোরা লম্বা বেঞ্চটায় বসে কী দিয়ে যেন হাসাহাসি ঢলাঢলি করছিলি। আমাকে দেখেই বন্যা হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল, অ্যাই, আলো জ্বলে দে—মিস ডার্কনেস এসে গেছে!

তখন ঘোর দুপুর। আলো জ্বালার কোনও প্রশ্নই নেই। সুতরাং, বুঝতেই পারছিস—আমি এসেছি বলে কেন আলো জ্বালতে হবে।

তাই ক্লাসে বেশ অন্যমনস্ক ছিলাম। তাকিয়েছিলাম টিএসপি-র দিকে, কিন্তু শুনছিলাম না কিছুই। হঠাৎই কী একটা যেন গায়ে এসে লাগল। মাথা ঘুরিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা কাগজের বল। ক্লাসে যেমন ছোড়াছুড়ি হয় আর কী! কিন্তু আমার গায়ে কেউ কখনও ছোড়েনি।

‘অপরাধী’র খোঁজে তাকাতেই তোকে দেখলাম। তুই একটু-একটু হাসছিলি। আমি ভাবলাম, ব্যাপারটা তোর কাজ। কিন্তু তুই হঠাৎ আমার গায়ে কেন কাগজের বল ছুড়বি এর উত্তরটা কোনও যুক্তিতেই মাথায় আসছিল না। কিন্তু তুই হাসছিলি। আর আমি তোর দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় বললি, পরে কথা হবে।

চাপতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও বুকের ভেতরে পাগল-করা একটা ঢেউ উঠল। আমাকে ভিজিয়ে দিল, ভাসিয়ে দিল। মনে হল, একটা অলৌকিক স্বপ্ন যেন কোন ম্যাজিকে জ্যান্ত হয়ে হঠাৎ করে ক্লাসরুমে নেমে এসেছে।

পরে তোর সঙ্গে কথা হল। প্রথমে ক্যান্টিনে—তারপর রাস্তায়। ক্যান্টিনে আরও অনেকে ছিল…কিন্তু রাস্তায় আর-কেউ ছিল না। শুধু তুই, আর আমি। আমাদের পাড়ার কোন একটা দোকানের ঠিকানা খোঁজ করার ছুতোয় তুই আমার হেলপ চেয়েছিলি। এই ছুতোটা হয়তো শুধু আমার জন্যে নয়—বন্যা, তিতি, সুজাতাদের জন্যেও। বেশ মনে আছে, ওরা বেশ অবাক চোখে তোর দিকে তাকিয়েছিল।

রাস্তায় আমাকে একা পেয়ে তুই যে কত কথা বলেছিলি! খইয়ের বস্তার মুখ আচমকা ছিঁড়ে হাট হয়ে গেলে যেভাবে খই ছড়িয়ে পড়ে ঠিক সেভাবে তোর কথাগুলো শব্দের বন্যা হয়ে আমাকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।

মনে আছে, অনেক কথার মাঝে তুই আমাকে ফস করে বলেছিলি, তুই সবসময় পাঁচিল দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখিস কেন? কারও সঙ্গে কথা বলিস না—সরে-সরে থাকিস…।

কী মারাত্মক কথা! তুই কী করে এটা বুঝলি কে জানে! সত্যিই তো, আমি সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখি। ছেলেদের সঙ্গে মিশি না। অথচ মিশতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওরা যদি আমার এই হতচ্ছাড়া চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গ করে! ঠাট্টার খোঁচা কখনও দিয়ে ফ্যালে আমায়! অথচ দ্যাখ, বাইরের চেহারার ওপর কারও কি কোনও হাত থাকে? ওটা তো ‘আকাশ’ থেকে আসে। তাই আমি যে কত যত্ন নিয়ে আমার ভেতরটা সাজিয়েছি—রোজ সাজাই—তার খবর কে রাখে!

তুই আবার বললি, অনেক চেষ্টা করে তারপর তোর ভেতরটা আমি দেখতে পেয়েছি। তোর ভেতরে-ভেতরে এত!

কী সর্বনেশে কথা! আমি আর কোনও কথা বলতে পারিনি।

প্রথমদিনের পর তোর আর আমার দেখা হওয়াটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল। এতে আশপাশে যে ‘ফিসফাস’ হচ্ছে সেটা টের পাইনি এমন বোকা আমি নই। একদিন বন্যা যে চাপা গলায় অনিতাকে বলেছিল, শালা ব্যাপক কম্বিনেশান!—সেটাও আমার কানে এসেছিল। কিন্তু আমি তখন অন্ধ। ‘নিঃশব্দ চরণে’ যে এসেছে তাকে আমি পাগলের মতো আঁকড়ে ধরেছিলাম। মনে-মনে বলেছিলাম, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না।

কবিতা লেখার অসুখ ছিল আমার। কিন্তু লুকিয়ে-লুকিয়ে। ভাবতাম কালো কুৎসিত মেয়ের আবার কবিতা! একটা কাল্পনিক লজ্জা, একটা কাল্পনিক অপমানের ভয়, একটা কাল্পনিক সংকোচ আমাকে সেই বালিকা বয়েস থেকেই শামুকের মতো গুটিয়ে দিয়েছিল। একদিন, দু-দিন, তিনদিনে তুই সেই খোলসটাকে চুরমার করে দিলি। লুকোনো কবিতা সামনে এসে গেল। তোর সামনে।

অবিশ্বাস্য হলেও তোর সঙ্গে আমার কী করে যেন কী হয়ে গেল। অনেকটা কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের মতন।

শ্রাবণ গড়িয়ে ভাদ্র এল। আমি তোর নেশায় পাগল। আমার ছন্নছাড়া ছিন্নছেঁড়া জীবনটা তখন যেন একটু-একটু করে মানে খুঁজে পাচ্ছে। তুই আসা-যাওয়া করছিস আমাদের বাড়িতে। বাড়ির আবহাওয়াটা বদলাচ্ছে। মামণি আর বাপির চোখেমুখে চাপা স্বস্তির ভাব টের পাচ্ছি। হাহুতাশ আঁধারের মধ্যে ওরা যেন একটু আলো দেখতে পেয়েছে।

তোর নিশ্চয়ই সেদিনটার কথা মনে আছে? মানে, সেই রাতটার কথা। বাড়িতে সেদিন কেউ ছিল না। আমাদের ফাটল-ধরা ছাদে দুজনে বসেছিলাম। তুই হঠাৎ বললি, চাঁদের আলোয় তোকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।

কী করে আমাকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিল জানি না। চাঁদের আলো কি অন্তর পর্যন্ত যায়? তাতে কি ভেতরের সৌন্দর্যটা ধরা পড়ে? তবে সেদিনটা বোধহয় নষ্টচন্দ্রের রাত ছিল। ভাদ্রমাসের শুক্লচতুর্থীর রাত। শুনেছি এই চাঁদ দেখলে কলঙ্ক হয়। হলও। যে-কলঙ্কের আকাঙ্ক্ষায় আমার শরীর আর মন বহুবছর ধরে অপেক্ষা করেছে তুই আমার সেই আশ মেটালি।

প্রথমে হাতে হাত। তারপর ঠোঁটে ঠোঁট। আর সবশেষে শরীরে শরীরে। সে রাতে আমি পূর্ণ হলাম। তৃপ্তি আর বিস্ময়ে সারাটা রাত ঘুমোতে পারিনি। পরদিন সায়েন্স কলেজে, সুযোগ পেতেই, তোর হাতে একটা আবছা নীল কাগজ ধরিয়ে দিলাম। তাতে একটা কবিতা লেখা ছিল। শুধু তোর জন্যে। তোকে লেখা আমার প্রথম ‘চিঠি’। তার চারটে লাইন এই মুহূর্তেও আমার মনে পড়ছে:

ওষ্ঠাধরে কোমল নিপীড়ন,

সয়েছিলাম মধুর যন্ত্রণাতে—

স্পর্শকাতর আমার স্পষ্ট হাত,

রেখেছিলাম তোমার নষ্ট হাতে।

তুই আমাকে বলেছিলি, তোর নৌকোয় কোনও মাঝি ছিল না। অথচ ভাসতে-ভাসতে সেই দিশাহীন নৌকোটা কী করে যেন হঠাৎ তীর খুঁজে পেল। সত্যিই জীবন বড় আশ্চর্য!

তোর কথাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। এ যেন আমারই মনের কথা—তোর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বাস কর, আমি তখন মনে-মনে তোর সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলাম।

কিন্তু একদিন…।

জানি, এইখান থেকে চিঠিটা লিখতে আমার বেশ কষ্ট হবে। কিন্তু লিখতে তো আমাকে হবেই।

সেদিন জেসিএম-এর পিরিয়ডটা অফ ছিল। তো আমি লাইব্রেরিতে একটা বই চেঞ্জ করতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে ক্লাসে ঢুকতে যাব—হঠাৎ শুনি তোর গলায় আমার নাম। ক্লাসের বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। তুই কী বলছিস আমার নামে? কাকেই-বা বলছিস? আমাদের দুজনের যা একান্ত গোপন কথা, যা শুধু আমরা দুজনই জানি—সেসব বলবি না তো?

শুনলাম তুই আমার নাম করে বলছিস, জানিস, ওকে সেদিন নামিয়ে দিয়েছি।

কে একজন জিগ্যেস করল, বস, নামিয়ে দিয়েছ মানে?

সালা ন্যাকা! কিছু বোঝে না!—তুই বললি, নামিয়ে দিয়েছি মানে ওর কেস কমপ্লিট। ছাদে চাঁদের আলোয় বোল্ড করে দিয়েছি।

তা হলে তো তুমি বস ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ প্রাইজ পাবে। ওরকম বিশখোবড়া থোবড়া তুমি ট্যাকল করলে কী করে?

তোর হাসির শব্দ পেলাম। তারপর তুই বললি, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে নিয়েছিলাম।

আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল। ক্লাসরুমের কাছ থেকে ছুটে চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু দোতলার সিঁড়ির কাছে এসে মাথাটা সাংঘাতিক টলে উঠল। কোনওরকমে রেলিং ধরে সামলে নিলাম। বসে পড়লাম সিঁড়ির ধাপে।

ও মিথ্যে কথা বলছে! আমার মুখে ও মোটেই রুমাল চাপা দেয়নি। বরং আকাঙ্ক্ষার চরম মুহূর্তে ও আমার দিকেই তাকিয়েছিল। কিন্তু কে এখন বিশ্বাস করবে এ-কথা! কেউ না!

আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সেই মুহূর্তেই মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু…কিন্তু তখন যদি আমি সুইসাইড করতাম তা হলে তোর মিথ্যেটাই যে চিরস্থায়ী হয়ে যেত! সে আমি হতে দিই কেমন করে!

সেদিনটা কাটল কোনওরকমে। তার পরের দিন। তারও পরের দিন। তুই আমাকে এড়িয়ে-এড়িয়ে চলতে লাগলি। কিছুটা আমিও। পরপর কয়েকটা দিন চোখ-কান খোলা রেখে আরও কিছু খবর পেলাম। জানলাম যে, চারপাশে আড়াল তোলা কুৎসিত এই মেয়েটাকে বোল্ড আউট করবি বলে তুই জয়জিতের সঙ্গে বিরিয়ানি বাজি রেখেছিলি। না, এই খবরটা নতুন করে কোনও ব্যথা দেয়নি আমাকে। এমনকী খবরটা সত্যি না মিথ্যে সেটা জানার জন্যেও কোনও আগ্রহ জাগেনি। শুধু ওই রুমালের মিথ্যেটা বুকের ভেতরে নিষ্ঠুর অপমানের ছুরি চালিয়েছিল।

তুই ভালো করেই জানতিস, নিজের ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স আড়াল করার জন্যে আমি সুপিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সের পাঁচিল তুলে দিয়েছিলাম আমার চারপাশে। আকাঙ্ক্ষায় কাতর এই অরূপ মেয়েটাকে সবাই ভাবত পুরুষবিদ্বেষী, অহঙ্কারী। আজ আর ভালো করে ঠাহর করতে পারি না, আমি তোর প্রেম স্টোর্সে ঢুকে পড়েছিলাম, নাকি তুই আমার পাঁচিলটাকে তোড়ফোড় করে আমার অন্তরে অনুপ্রবেশ করেছিলি। স্রেফ একপ্লেট বিরিয়ানি খাওয়ার জন্যে।

এই মুহূর্তে সব আমার গুলিয়ে গেছে। শুধু ওই নৃশংস মিথ্যেটুকু সত্যি হয়ে আমার কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে হা-হা করে হাসছে। ক’দিন ধরেই শুনছি এই হাসিটা। আর হৃৎপিণ্ডের গা থেকে নখ দিয়ে খুঁটে ক্রমাগত নুনছাল তুলছে কেউ। জ্বালা—অসহ্য জ্বালা!

তাই আর সইতে না পেরে টেলিফোনে কান্নাকাটি করে তোকে একবারের জন্যে ডেকেছিলাম। বলেছিলাম, শেষবারের জন্যে। আর কোনওদিনও তোকে আসতে বলব না। এই একটিবার অন্তত আয়। ফর ওল্ড টাইমস সেক।

তুই এলি। সঙ্গে তোর রূপ, অহংকার আর মেয়েভোলানো আত্মবিশ্বাস।

সবকিছুই ছিল ঠিক সেদিনের মতো।

আকাশে নির্লজ্জ শুক্লচতুর্থীর চাঁদ। চারপাশে বৃষ্টিভেজা বাতাস। আর নির্জন ছাদের রহস্যময় অন্ধকার।

তুই সেদিনের মতো আবার বললি, চাঁদের আলোয় তোকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।

আমি বললাম, জানি।

তারপর তুই আমায় জাপটে ধরলি। এবার কপালে বিরিয়ানি জুটুক-না-জুটুক, পড়ে পাওয়া চোদ্দোআনা হাতছাড়া করার কোনও মানে হয় না। তাই আবার তুই আমার ‘কেস কমপ্লিট’ করলি। ছাদে চাঁদের আলোয় আমাকে দ্বিতীয়বার বোল্ড আউট করলি তুই।

তারপর?

তারপর আমার পালা।

মাংসাকাটার ছুরিটা কোথায় লুকোনো ছিল তুই দেখতে পাসনি। কী করেই বা দেখবি! ওটার রং তো আমার গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। তা ছাড়া ওই রহস্যময় অন্ধকার।

তোর গলার নলি ফাঁক হয়ে গেল। রক্তে ভেসে গেল আমার শরীর। তুই ছাদের ফাটল-ধরা রুক্ষ মেঝেতে ছটফট করতে লাগেলি। শেষবারের মতো চিৎকার করতে চেয়েছিলি বোধহয়—কিন্তু চিৎকারের কঙ্কালটা ঘড়ঘড় শব্দে গলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল।

আমি এবারে চাদরের নীচে লুকোনো ছোট্ট টেপরেকর্ডারটা চালিয়ে দিলাম।

শোনা গেল তোর গাঢ় গলা: চাঁদের আলোয় তোকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।

তোর বলা কথাগুলো মণিমুক্তো হয়ে ধরা রইল চিরকালের জন্যে। এই সত্যিটা এবার চিরস্থায়ী হল।

কিন্তু এখনও যে আমার আর-একটা কাজ বাকি!

তাই তোর স্থির-হয়ে-আসা শরীরের পোশাক হাতড়ে তোর রুমালটা বের করলাম। তুই তখন হাঁ করে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে। চাঁদও ভ্যাবাচ্যাকা মুখে তোকে দেখছে।

তোর মুখটা রুমালে ঢেকে দিলাম আমি। সুন্দর যেমন কুৎসিতকে ঘৃণা করে, কুৎসিতও তেমন ঘৃণা করতে পারে সুন্দরকে। এই যেমনি আমি এখন তোকে।

এইবার…এইবার আমার দ্বিতীয় সত্যিটা চিরস্থায়ী হল। কেউ আর একে পালটাতে পারবে না। তুইও না। তোর খোঁজে সবাই যখন আসবে, তখন দেখবে—আমার নয়, তোর মুখই রুমালে ঢাকা। আর তোর শরীরের পাশে রাখা টেপরেকর্ডারে শুনবে তোর শেষকথা। তোর শেষ সত্যি কথাটা।

এখন নীচের ঘরে এসে এই চিঠি লিখছি। খারাপ লাগছে চিঠিটা তুই পড়তে পারবি না বলে। কিন্তু এখন তোর আর কিছু করার নেই!

এবার আমি ছাদে যাব আবার। অন্ধকারে তোর পাশে শুয়ে পড়ব। তারপর রক্তাক্ত ছুরিটা আরও একটা গলার নলি ফাঁক করবে। বেশ হবে, তাই না? আমি আর তুই পাশাপাশি শুয়ে থাকব। আর আমি অপলকে নষ্ট চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকব…তাকিয়ে থাকব…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *