1 of 2

না ভেবে খুন কোরো না…

না ভেবে খুন কোরো না…

অনাদি সামন্ত আগে কখনও খুন করেনি। কিন্তু প্রত্যেক জিনিসেরই ‘শুভ উদ্বোধন’ বলে একটা কথা আছে, সুতরাং অনাদি সামন্তর জীবনেও সেই ‘শুভ উদ্বোধন’ এল। শুভ ১লা বৈশাখের পুণ্য লগ্নে সে তার জটিলা এবং কুটিলা স্ত্রী নিরুপমা সামন্তকে খুন করল।

খুনটা সে করেছিল নেহাতই গলা টিপে। নিরুপমার দেহটা যখন অসাড় হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ল তখন রাত ন’টা।

অনাদির বাড়ি বউবাজার অঞ্চলে। ফ্ল্যাট ভাড়া করে স্বামী-স্ত্রীতে মিলে থাকত। খুন করার আগে অতশত সে ভাবেনি। তাকে যদি কেউ প্রশ্ন করত, বউয়ের এই পঁয়ষট্টি কেজি লাশ তুমি গায়েব করবে কী করে, সে সোজা উত্তর দিত, অতশত এখনও ভেবে দেখেনি। সুতরাং, নিরুপমা মৃতসমা হওয়ার পরই সে একটু চিন্তায় পড়ল। লাশটা নিয়ে কী করা যায়?

প্রথমে ভাবল ঘরের ভেতরেই ওটা জ্বালিয়ে দেবে কি না। পরে চিন্তা করে দেখল, তাতে পাড়াপড়শি ও বাড়িওয়ালার দুর্গন্ধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয় কোনও পন্থা ভেবে বের করার আগে সে রহস্য-রোমাঞ্চ বইয়ে পড়া লাশ গায়েবের উপায়গুলো স্মৃতির পাতা হাতড়ে খতিয়ে দেখতে শুরু করল।

নিরুপমাকে টুকরো-টুকরো করে আচার দিয়ে খেয়ে ফেলবে? নাকি খণ্ড-খণ্ড করে মৃতদেহের অংশগুলো কাগজে মুড়ে কলকাতার জনবহুল রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেবে? আবার ট্রাঙ্কে ভরে ট্রেনে তুলে দেওয়ার কায়দাটাও হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তার চিন্তাধারা অব্যাহত গতিতে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলল।

নিরুপমা যখন শক্ত-পোক্ত (রাইগ্যর মর্টিস) হল তখন অনাদির সামন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছল। এতক্ষণ সে ঘরের আলো জ্বেলে নিরুপমার মাথার কাছে বাবু হয়ে বসেছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল কাটারি আনতে। কাটারি নিয়ে এসে তার চেষ্টাচরিত্র শুরু হল।

প্রথম কোপটা পড়ল নিরুপমার গলায়। যে-নিরুপমা বেঁচে থাকলে তীব্র প্রতিবাদে ছটফট করে উঠত, ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠত, সে এখন চুপটি করে রইল। অনাদির অস্বামীসুলভ আক্রমণ নিরুপমার শরীরে অব্যাহত রইল সারাটি রাত। মাঝখানে শুধু একবার হাত-পা ধুয়ে সে খেতে গেল। সামান্য একটু আঁশটে গন্ধ ছাড়া খাওয়াদাওয়া করতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি।

সুপ্রভাত হল। ক্লান্ত-শ্রান্ত অনাদি ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা নিরুপমার কাছেই শুয়ে। কাটারিটাও অনাদি সামন্তর অদূরে ঘুমিয়ে আছে। কাকের ডাক ও নিরুপমার গন্ধে অনাদির ঘুম ভাঙল। সঙ্গে-সঙ্গেই তার প্যাকিং-পর্ব শুরু হল। বারোটা প্যাকেটে শুছিয়ে ফেলা হল পঁয়ষট্টি কেজির নিরুপমাকে।

অনাদি সামন্ত সেকেন্ডারি বোর্ডের অফিসে কাজ করে। সুতরাং পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলটার রাতের নির্জন চরিত্র তার ভালোই জানা। গোটা দিনটা সে অফিস কামাই করে বাড়িতে বসে রইল। নিরুপমা পর্যায়ক্রমে কাঠিন্য, নম্রতা ও গন্ধ বদল করে চলল। অবশেষে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ নিরুপমার মাথার প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে অনাদি সামন্ত রাস্তায় পা দিল। রওনা হল পার্ক স্ট্রিটের দিকে।

রাস্তায় বেরোনোর আগে নিরুপমার সুগন্ধির শিশি নিজের গায়ে উজার করে দিল অনাদি। হাড়কাটার মোড় থেকে বেলফুলের মালা কিনে হাতে জড়াল। এইভাবে বেলফুল ও সুগন্ধির পরিচিত রাবার স্ট্যাম্প মেরে নিজেকে খারাপ পাড়ার খদ্দের সাজিয়ে ফেলল।

ট্যাক্সি পাওয়া এখন আর সৌভাগ্য নয়। কিন্তু তবুও পাওয়া গেল না। সুতরাং, নিরুপমার মাথা সঙ্গে নিয়ে ট্রামে চড়ে বসল অনাদি। এই প্রথম নিরুপমা আংশকিভাবে ট্রামে চড়ল।

ওয়েলিংটনে নেমে ট্রাম বদল করল। ট্রাম এখন খালি। নিরুপমাকে ট্রামে ফেলে রেখে নেমে পড়লে কেমন হয়? যথা ভাবনা তথা কাজ। ম্যাজেস্টিক সিনেমা হলের সামনে ট্রাম থেকে নেমে পড়ল অনাদি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ফার্স্ট ক্লাসের গদিমোড়া সিটে মাথা রেখে শুতে নিরুপমার কোনও অসুবিধে হবে না।

কিন্তু তাকে অবাক করে চলন্ত ট্রামটা কয়েক পা এগিয়ে আবার থামল। কন্ডাক্টর গলা বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকল অনাদিকে। কষ্টকৃত অন্যমনস্কভাব দেখিয়েও কোনও লাভ হল না। আশেপাশে বিশেষ কোনও লোকজন নেই যে, অনাদি না বোঝার ভান করে ন্যাকামো করবে। সুতরাং ফিরতে হল। কন্ডাক্টরের হাত থেকে নিরুপমাকে ফেরত নিতে হল।

আবার হাঁটতে শুরু করল অনাদি। আস্তে-আস্তে বলল, ‘নিরু, এখনও আমায় ছাড়বি না?’

নিরুপমা জবাব দিল না।

পার্ক স্ট্রিটে পৌঁছে খুশি হল অনাদি সামন্ত। নির্জনতা, জনশূন্যতা ইত্যাদি একসঙ্গে পরিবেশে হাজির। ডানদিকে ঘুরে রাস্তা পার হয়ে অ্যালেন গার্ডেনে ঢুকল সে। একটা ঝোপের পাশে ঘাসের ওপরে বসল। এবং পরমুহূর্তেই নিরুপমাকে রেখে উঠে পড়ল।

ডাকটা এল পিছন থেকেই। কেউ তাকে ডাকছে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হল অনাদি। একটি লাল শাড়ি পরা চটকদার সাজগোজ করা দেহাতি মহিলা ঘাসের ওপরে ফেলে যাওয়া প্যাকেটে মোড়া নিরুপমার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এখন প্যাকেটটা তুলে না নিলে এই মেয়েটিই পরে অনাদি সামন্তের বিরুদ্ধে খুনের মামলায় সাক্ষি দেবে। অতএব ট্রামের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল।

এরপর ক্যামাক স্ট্রিট। একটা ডাস্টবিনের কাছে প্যাকেটটা প্রায় ফেলেই দিয়েছিল অনাদি, থমকাল জনৈক রিকশাওয়ালাকে দেখে।

এইভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই লাগল। কখনও নির্জনতা খোঁজা প্রেমিক-প্রেমিকা, কখনও মেয়েছেলের দালাল, কখনও-বা প্রহরারত পুলিশ। ভূমিকা তাদের একই। অনাদি সামন্তর কাছ থেকে নিরুপমা সামন্তর মাথাকে অবিচ্ছিন্ন রাখা।

রাত যখন সাড়ে বারোটা হল, তখনও নিরুপমাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে অনাদি। শ্রান্ত, ক্লান্ত, অবসন্ন। কাউকে খুন করে দেহের টুকরোগুলো সবার অলক্ষ্যে কলকাতা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়াটা মোটেই সহজ কাজ নয়। অন্তত গল্পের বইয়ের মতো।

অনাদি সামন্ত এবার অন্ধকার রাস্তার ধারে বসে পড়ল। প্যাকেটে ভরা নিরুপমাকে দু-হাতে ধরে মুখের খুব কাছে এনে ফিসফিস করে ওর সঙ্গে অনেক কথা বলল। তারপর হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে আবার শুরু করল পথ চলা।

একজন রোগা ছাপোষা লোককে একটা প্যাকেট নিয়ে রাত একটা নাগাদ থানায় ঢুকতে দেখে সদর দরজার সেপাই অবাক হল।

অনাদি সামন্ত সটান ঢুকে গেল অফিসারের ঘরে। তাঁর টেবিলে প্যাকেটটা নামিয়ে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ইন্সপেক্টর-সাহেব, একজন লোক বিরক্ত হয়ে তার বউকে হঠাৎই একদিন খুন করে ফ্যালে। গল্পের বইয়ে পড়া বিদ্যে থেকে সে ঠিক করে বউকে টুকরো-টুকরো করে লুকিয়ে কলকাতা শহরে ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে পারল না। দেখল, কলকাতায় কোনও নির্জন জায়গা নেই। এখানে সবজায়গাতেই সাক্ষী হাজির। আজ নয় কাল পুলিশের হাতে ধরা সে পড়বেই। সুতরাং রাস্তার ধারে বসে সে তার বউয়ের সঙ্গে ব্যাপারটা অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করল। তারপর সে চলে এল পার্ক স্ট্রিট থানায়। অফিসার-ইন-চার্জের সামনে সব ঘটনা খুলে বলে হালকা হল…।’

কথা বলতে-বলতে টেবিলে ঝুঁকে পড়ল অনাদি সামন্ত। অতি যত্নে প্যাকেটটা খুলতে লাগল। একটু পরে হতভম্ব অফিসারের সামনে কোমল স্ফীত নিরুপমা প্রকাশিত হল।

অনাদি সামন্ত নিরুপমার চুল সরিয়ে দিল কপাল থেকে। নিরুপমা সামনে তাকিয়ে। অনাদি একবার হাসল, তারপর বলল, ‘নিরু, এবার তুই খুশি তো?’

নিরুপমা কোনও জবাব দিল না। অনাদি অফিসারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘…সেই লোকটাকে ফাঁসি দিন, স্যার, সেই লোকটাকে ফাঁসি দিন…।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *