1 of 2

অবচেতন

অবচেতন

ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার আলতো করে হাত রাখলেন তার পোষা অ্যালসেশিয়ানের লোমশ পিঠের ওপরে। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। বিস্তৃত কপালে উড়ে আসা কয়েকগুচ্ছ রুপোলি চুলকে স্বস্থানে ফেরত পাঠিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন।’

আমি পাঁচফুট চওড়া টেবিলের এ-প্রান্তে বসে বলে উঠলাম, ‘ডক্টর, স্বপ্ন হোক, দুঃস্বপ্ন হোক—এর মানে কী?’

আমার স্বরে উত্তেজনার আভাস পেয়ে কুকুরের পিঠ থেকে হাত তুললেন ডক্টর সমাদ্দার। সাইন পেনটা উচিয়ে ধরে সাদা প্যাডের ওপরে কিছু লেখার জন্যে তৈরি হয়ে বললেন, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মিস্টার রায়, আপনার গল্পটা আমি প্রথম থেকে আর-একবার শুনতে চাই। কাইন্ডলি একটু স্লোলি বলবেন। নিন, শুরু করুন—।’

আমি, সুদর্শন রায়, চেয়ারে গুছিয়ে বসলাম। ঘরে এয়ারকুলার থাকা সত্ত্বেও মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। ঘর এবং আসবাবপত্রের রং নিষ্কলঙ্ক, সাদা। ডক্টর সমাদ্দারের গায়েও সাদা স্ট্রেচলনের স্যুট। চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা। হাতের অনামিকায় হিরের আংটি।

একমাত্র ব্যতিক্রম ‘দুশমন’: ডক্টর সমাদ্দারের সাড়ে চারফুট লম্বা বিশাল অ্যালসেশিয়ান কুকুর। ওর রং কুচকুতে কালো। কাচের গুলির মতো চোখদুটো সবসময় ধকধক করে জ্বলছে।

ডক্টর সমাদ্দারের চেম্বারে আমি আগেও কয়েকবার এসেছি। কারণ, আমার মাঝে-মাঝে দেখা দুঃস্বপ্নগুলো। তাই দুশমন এবং তার প্রভু, দুজনের সঙ্গেই আমি যথেষ্ট পরিচিত।

আমার আগের দেখা দুঃস্বপ্নগুলো যেমনই অবাস্তব, তেমনই উদ্ভট। প্রথম দুঃস্বপ্নে দেখেছি, একটা এরোপ্লেন থেকে আমি একজন পাইলটকে ধাক্কা দিয়ে শূন্যে ফেলে দিচ্ছি। দ্বিতীয় স্বপ্নে দেখেছি জলের তলায় একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আমার মরণপণ যুদ্ধ চলছে। অবশেষে তাকে গলা টিপে খুন করে আমি জলের ওপরে ভেসে উঠছি (এবং একইসঙ্গে হাঁপাতে-হাঁপাতে বিছানায় উঠে বসেছি)।

দুঃস্বপ্ন হলেও সেগুলো কখনও স্থায়ী হয়নি। ক্ষণিকের দেখা, এবং ক্ষণিকেই তা মিলিয়ে গেছে। সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার বলেছিলেন, এ-দুঃস্বপ্ন দেখার কারণ মনের অবচেতনে অপরাধ করার সুপ্ত বাসনা—এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ চিন্তার কোনও কারণ নেই।

এসব ঘটনা প্রায় বছরখানেক আগের।

কিন্তু গত সাতদিন ধরে এক অদ্ভুত ধারাবাহিক স্বপ্ন আমি দেখে চলেছি। যা প্রথমে ছিল অর্থহীন, কিন্তু পরে…।

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলাম। রুমাল বের করে চোখ মুছলাম। ডক্টর সমাদ্দার নীরবে আমার কথা বলার অপেক্ষায় রইলেন। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করলাম, ‘ডক্টর, সবকিছুর শুরু লাস্ট মঙ্গলবার। আমি বিয়ে করিনি। শুতে-শুতে রোজই বেশ রাত হয়। সেদিনও রাত হয়েছিল। কিন্তু ঘুম আসতে আমার কখনও দেরি হয় না। সুতরাং মিনিটকয়েকের মধ্যেই গভীর ঘুমে ডুবে গেছি। সে-রাতেই অদ্ভুত স্বপ্নটা প্রথম দেখলাম।

‘দেখলাম, আমি একটা বিশাল বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে ব্যস্ত লোকজন সাদা পোশাকে চলাফেরা করছে। ফ্লুওরেসেন্ট আলো-ঝলমলে তেলচকচকে করিডর ধরে আমি ধীরে-ধীরে এগিয়ে চলেছি। কাজে ব্যস্ত লোকজন কেউ যেন আমাকে দেখেও দেখছে না। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি ঢুকে পড়লাম একটা ঘরে। সে-ঘরে সাজানো সারি-সারি স্প্রিং-এর খাট। তাতে শুয়ে আছে নানান বয়েসের নারী-পুরুষ। তাদের শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে।

‘প্রথম দিনের স্বপ্ন এখানেই শেষ!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, ‘কিন্তু দ্বিতীয় দিন এই স্বপ্ন আমি আবার দেখেছি! কিন্তু সেদিনের স্বপ্ন আমাকে আরও কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেল। দেখলাম, সেই বিশাল সাদা ঘরটার একপ্রান্তে একটা ছোট দরজা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো যান্ত্রিকভাবে সেই ছোট দরজাটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম।

‘দরজার চৌকাঠ পেরোতেই নজরে পড়ল একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা হয়তো রান্নাঘর, হয়তো বাথরুম, হয়তো ভাঁড়ার ঘর—ঠিকমতো কিছু বলতে পারব না। কারণ, ঘরের শুধুমাত্র ডানদিকের একটা অংশ আমার নজরে পড়েছে। সেটা একটা সাদা বেসিন। স্টিলের কল থেকে টইটম্বুর বেসিনে টপটপ করে জল পড়ছে। আর আমি যেন নেশার ঘোরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই জল পড়ার শব্দ শুনছি…।

‘তৃতীয় দিনের স্বপ্নে প্রথম থেকে শুরু করে সেই বেসিন পর্যন্ত আসার পর খেয়াল করলাম, ঘরে আমি একা নই। একজন লম্বা মানুষ, পরনে সাদা ধবধবে আলখাল্লা, বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার মুখে ব্যঙ্গের হাসি। বিশ্বাস করুন ডক্টর, সেই সাদা পোশাক পরা ভদ্রলোকের চেহারা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে! যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার কালো জোড়া ভুরু, টিকোলো নাক, কালো কুচকুচে শৌখিন গোঁফ, ছোট-ছোট চোখ, ফরসা গালের বাঁ-দিকে একটা আঁচিল তিরতির করে কাঁপছে।’

ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার এবার নড়েচড়ে বসলেন। বাঁ-হাতটা দুশমনের পিঠে রেখে বললেন, ‘এক্সকিউজ মি ফর দ্য ইন্টারাপশন, মিস্টার রায়। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। একটা জিনিস আপনার জানা প্রয়োজন। সাধারণত কোনও স্বপ্নে আমরা যখন আমাদের অচেনা কোনও মানুষকে দেখি, তখন চেতনা ফিরে সেই স্বপ্নে দেখা মানুষের চেহারার নিখুঁত বর্ণনা আমরা কখনও দিতে পারি না। ইটস আউট অ্যান্ড আউট ইমপসিবল সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই লম্বা লোকটিকে আপনি আগে কোথাও দেখেছেন। ইউ মাস্ট হ্যাভ সিন হিম সামহোয়্যার। আই অ্যাম শ্যুওর অফ ইট!’

আমার পাণ্ডুর মুখমণ্ডলে সম্ভবত একটা বিহ্বল ভাব ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘মিস্টার রায়। যেটা হওয়া উচিত সেটাই আপনাকে এক্সপ্লেইন করলাম। নাউ গেট অন উইথ ইয়োর স্টোরি—’ বলে চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে সাদা ফ্লানেলে লেন্সদুটো ঘষে নিলেন। তারপর চশমা চোখে দিলেন।

আমি ঘটনা-পরম্পরা একবার ভেবে নিয়ে বলে চললাম, ‘তৃতীয়দিনের স্বপ্ন সেখানেই শেষ। চারনম্বর দুঃস্বপ্ন দেখলাম আরও দু-দিন পরে, এবং আগের মতোই তিননম্বর স্বপ্নের অসমাপ্ত অংশ এবারেও শেষ হল চারনম্বরে গিয়ে।’

একটু ইতস্তত করে আবার বলতে শুরু করলাম, ‘ডক্টর, আমাকে দেখে সেই ভদ্রলোক হাসলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিস্টার রায়। আই অ্যাম ডক্টর শঙ্করদাস গিরি। আমি চুপ করে রইলাম। তারপর ডক্টর গিরি ঘুরে গেলেন বেসিনের দিকে। মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়ালেন কলের সামনে। বাঁ-পাশের ছোট্ট তাক থেকে একটা সাদা রঙের সাবান নিয়ে তিনি মুখে ঘষতে লাগলেন। আমি ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার মুখ ধোওয়া লক্ষ করে চললাম। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত উত্তেজনা টের পেলাম। আমার হাতদুটো যেন অধৈর্য আর চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। শেষে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম ডক্টর গিরির কাছে—খুব কাছে। তারপর বিদ্যুৎঝলকের মতো ক্ষিপ্রতায় বেসিনের ওপর ঝুঁকে থাকা তাঁর মাথাটা চেপে ধরলাম। ডক্টর গিরির শরীরটা ঝটকা দিয়ে ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। উনি প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও তারপরেই সর্বশক্তি দিয়ে আমার সঙ্গে যুঝতে শুরু করলেন। আমিও তাঁর মাথাটা বেসিন-ভরতি জলের দিকে ঠেলে নিয়ে চললাম। আমি পেছনে থাকায় ডক্টর গিরি বিশেষ সুবিধে করতে পারলেন না। একসময় হেরে গেলেন।

‘ডক্টর গিরির মাথাটা জলে ডুবিয়ে চেপে ধরতেই তাঁর শরীরটা প্রচণ্ড আক্ষেপে কেঁপে উঠতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলল শরীরের ঝটাপটি। একসময় সব থেমে গেল।

‘দুঃস্বপ্ন কেটে গিয়ে যখন জেগে উঠলাম, তখন আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। অসহায় চোখে তাকালাম অম্বিকা সমাদ্দারের দিকে। তিনি তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাঝে-মাঝে প্যাডের কাগজে কী যেন লিখছেন।

হঠাৎই মুখ তুলে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর?’

আমি মৃদুস্বরে জবাব দিলাম, ‘তারপর, গতকাল, অর্থাৎ, সোমবার, স্বপ্নটা আবার শুরু থেকে দেখতে শুরু করলাম। সেই করিডর, সেই ঘর, সেই ছোট দরজা—অবশেষে ডক্টর গিরির নিথর শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আমি।

‘আমি গিরির বডিটা একটা ঘোরের মধ্যে কাঁধে তুলে নিলাম। ওঁর মাথার ভিজে চুল থেকে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে।

‘আগে খেয়াল করিনি, এখন দেখলাম, ছোট ঘরটার ডানপাশে, বেসিন থেকে কিছুটা এগিয়ে, একটা খোলা দরজা। আমি একটুও ভয় না পেয়ে শঙ্করদাসকে কাঁধে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সামনের করিডরে একটা অল্প পাওয়ারের বালব জ্বলছিল। সেটা পেরোতেই চোখে পড়ল একটা ছোট দরজা। দরজা খুলে আমি বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে অন্ধকার খোলা মাঠ। দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। আমি একটুও না থেমে হেঁটে চললাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না।

‘একসময় দেখলাম, একটা হালকা জঙ্গলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কয়েকটা বড়-বড় গাছ। কী গাছ জানি না। শঙ্করদাসের দেহটা ঘাসছাওয়া মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। তারপর একটা কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। কোদালটা কোত্থেকে যে আমার হাতে এল বলতে পারি না।

‘মাটি খোঁড়া শেষ হল। সেই গর্তে ডক্টর গিরিকে আমি শুইয়ে দিলাম। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, তাঁর চোখদুটো কোটর ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে এসেছে। এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ওঁর ডানহাতের শক্ত মুঠোয় ধরা রয়েছে সেই সাদা সাবানটা।

‘কেমন একটা ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। তাড়াহুড়ো করে গর্তে মাটি ঢালতে লাগলাম। একসময় ভরাট হল গর্ত। কোদালটা হাতে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসছি, তখনই আমার নজরে পড়ল, ডক্টর গিরির ডানহাতটা কবরের বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। সে-হাতের শক্ত মুঠোয় তখনও ধরা রয়েছে সাদা সাবানটা। আমি ভয় পেয়ে খোলা মাঠ ধরে ছুটতে শুরু করলাম। কোদালটা কোথায় হারিয়ে গেল জানি না…।

‘একটু পরেই দেখি, আমি সেই বিশাল ঘরটায় দাঁড়িয়ে। যে-ঘরে সারি-সারিভাবে স্প্রিং-এর খাট সাজানো রয়েছে। ঘরে একটা নীল রঙের আলো জ্বলছে। সাদা চাদরে ঢাকা মানুষগুলোকে পেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম। দেখলাম, একেবারে শেষে একটা খাট খালি। কোনও লোক সেখানে শুয়ে নেই। আমি বাধ্য শিশুর মতো গিয়ে সেই ধবধবে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চাদরে ঢেকে ফেললাম আমার শরীর। ক্রমশ ঘুমে চোখ বুজে এল…।

‘স্বপ্নটা এখানেই শেষ, ডক্টর।’ আমার গলার স্বর যেন আশঙ্কায় কেঁপে উঠল: ‘কিন্তু আজ দুপুরে ঘুমের মধ্যে আবার এই একই স্বপ্ন। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিছানায় শোওয়া পর্যন্ত, আবার দেখলাম। আমার ভয় হচ্ছে, এবার থেকে হয়তো এই দুঃস্বপ্নটা রোজ রাতে আমাকে দেখা দেবে।’

ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার ডানহাত আর বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুল পরস্পরের মাথায় ছুঁইয়ে কয়েকমুহূর্ত নীরব রইলেন। আপনমনেই বারকয়েক মাথা নেড়ে বললেন, ‘আপনার অনুমান ভুল নয়। আমারও বিশ্বাস এ-দুঃস্বপ্ন রোজ রাতে আপনাকে দেখা দেবে। আপনার স্বপ্ন নিয়ে আমাকে দুটো দিন ভাবার সময় দিন। তারপরই আমি আপনাকে এর রিমেডি জানাব। আজ তা হলে—।’

আমি ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে গুনে-গুনে চৌষট্টি টাকা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। ডক্টর সমাদ্দার মাথা ঝুঁকিয়ে বিলটা লিখতে-লিখতে বললেন, ‘আপনি বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় আসুন। আর এর মধ্যে যদি ওই নাইটমেয়ার আবার দেখেন তা হলে আমাকে জানাবেন, কেমন?’

‘ইয়েস, ডক্টর।’ বিলটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে পকেটে ভরলাম। যথাক্রমে দুশমন এবং তার প্রভুর সঙ্গে নজর মিলিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। স্প্রিং-এর দরজা আপনাথেকেই বন্ধ হয়ে গেল।

সিঁড়ি নামতে-নামতে মনের আয়নায় ভেসে উঠল শঙ্করদাস গিরির মুখ। এবং পরক্ষণেই যেন দেখতে পেলাম কবরের বাইরে বেরিয়ে থাকা তাঁর সাবান-ধরা ডানহাতটা…।

বৃহস্পতির বিকেল ঠিক পাঁচটায় ডক্টর সমাদ্দারের চেম্বারে হাজির হলাম। আমাকে দেখে পরিচিতের হাসি হেসে তিনি বলতে বললেন। দুশমন যথারীতি তার প্রভুর পাশে বসে। ডক্টর সমাদ্দারকে জানালাম তাঁর অনুমানই ঠিক। এই দু-দিনে সেই স্বপ্ন আমি আরও দুবার দেখেছি।

উত্তরে মনের বক্তব্যকে যেন গুছিয়ে নিলেন ডক্টর সমাদ্দার। মাথার রুপোলি চুলে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মিস্টার রায়, এ দু-দিন আমি আপনার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। তাতে যে-সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, তার খানিকটা আমি আগেরদিনই আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি। অর্থাৎ, ডক্টর শঙ্করদাস গিরিকে আপনি সত্যি-সত্যি কোথাও-না-কোথাও দেখেছেন।’

আমি বিহ্বলভাবে মাথা নাড়লাম।

ডক্টর সমাদ্দার বলে চললেন, ‘তা ছাড়া আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। মিস্টার রায়, কখনও কি আপনি কোনও হসপিটাল, নার্সিং হোম বা মেন্টাল হোমে ছিলেন?’

আমি স্পষ্টস্বরে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ, ছিলাম। সামান্য মেন্টাল প্রবলেম হওয়ার জন্যে আমাকে মাসখানেক মাইথনের একটা মেন্টাল হোমে কাটাতে হয়।’

‘কবে?’

‘গতবছর শীতে।’

‘সেই মেন্টাল হোমের নাম আর অ্যাড্রেস আপনার মনে আছে?’

‘আছে।’ আমি নাম ও ঠিকানা বললাম।

প্যাডের কাগজে সেটা টুকে নিলেন ডক্টর সমাদ্দার। তারপর বললেন, ‘এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন: স্বপ্নে দেখা সেই বাড়ির সঙ্গে মাইথনের সেই হোমের কি কোনও মিল আছে? ভালো করে ভেবে জবাব দিন—।’

‘অত ভাবার দরকার নেই, ডক্টর—’ বিনা দ্বিধায় জবাব দিলাম, ‘অনেকটাই মিল আছে।’

‘তা হলে আমার অনুমানই ঠিক।’ ধীরে-ধীরে বললেন অম্বিকা সমাদ্দার, ‘কারণ, বাড়িটার এমন বর্ণনা আপনি দিয়েছেন, যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় কোনও হসপিটাল বা নার্সিং হোমের। সুতরাং, এখন আপনার উচিত মাইথনের সেই মেন্টাল হোমে যাওয়া, এবং স্বপ্নে দেখা ব্যাপারগুলো মিলিয়ে নেওয়া। যেমন ধরুন, সত্যিই শঙ্করদাস গিরি নামে কোনও ডক্টর সেখানে আছেন কিনা। অথবা সেই জঙ্গল, মাঠ—সত্যিই এসবের কোনও অস্তিত্ব সেখানে রয়েছে কিনা। তা হলেই আপনার কনশাস আর সাবকনশাস মাইন্ডের গরমিলগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে আপনার খোঁজখবরের রেজাল্ট আমাকে জানাতে ভুলবেন না, কেমন?’

আলোচনা-শেষের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু আমি বসেই রইলাম। ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বললেন না। অভিব্যক্তিতে একটি নীরব প্রশ্নচিহ্ন ফুটিয়ে অপেক্ষায় রইলেন।

‘ডক্টর, আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে।’ একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘মাইথনে আমার সঙ্গে আপনাকেও আসতে হবে। ওখানে একা যেতে হলে আমি খুব শেকি ফিল করব। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড—এ জন্যে আপনার ফিজ যা লাগে দেব। প্লিজ, ডক্টর, প্লিজ, আমার সঙ্গে আপনি চলুন। একটা দিনের তো ব্যাপার!’

ডক্টর সমাদ্দার কয়েকমিনিট চুপ করে রইলেন। কী যেন ভাবলেন মনে-মনে। অবশেষে মুখ খুললেন, ‘আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি, মিস্টার রয়, কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া একটু প্রবলেম। আমার চেম্বার রয়েছে, রয়েছে দুশমন, তা ছাড়া—।’

‘আপনি করবেন না, ডক্টর।’ অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘প্লিজ, একটা দিন আপনি আমার জন্যে সময় দিন। বললাম তো, আপনার প্রপার ফিজ আমি নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু আমার সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে। প্লিজ।’

‘কিন্তু দুশমন?’ দুশমনের পিঠে হাত রাখলেন ডক্টর সমাদ্দার, ‘আমাকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না। আমি ছাড়া কারও কথা ও শোনে না, কারও হাতে খাবার খায় না।’

মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, ‘ওকেও তা হলে সঙ্গে নিন। আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ডক্টর, প্লিজ, ওখানে আমাকে একা যেতে বলবেন না—।’

ডক্টর সমাদ্দার দুশমনের লোমশ কালো পিঠে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘আপনার কথাই থাক। দুশমনও আমাদের সঙ্গী হোক।’ তারপর দুশমনের পিঠে চাপড় মেরে: ‘গেট রেডি দুশমন, কাল আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।’

উত্তরে দুশমনের হিংস্র দাঁতের ফাঁক থেকে একটা চাপা গরগর শব্দ ভেসে এল।

‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ডক্টর।’ আবেগে ডক্টর সমাদ্দারের হাত চেপে ধরলাম। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভিজিট-এর চৌষট্টি টাকা তুলে দিলাম তাঁর শীর্ণ হাতে। বললাম, ‘তা হলে আগামীকাল দুপুরের ট্রেনে আমরা রওনা হচ্ছি।’

মৃদু হেসে ঘাড় হেলালেন অম্বিকা সমাদ্দার।

ওঁর চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি নামতে শুরু করলাম।

মাইথনের সেই মেন্টাল হোমের দরজায় যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

বর্ষার শেষ এবং শরতের শুরু। হয়তো সেই কারণেই বেলাশেষের আলোটুকু পশ্চিমপ্রান্তে অদৃশ্য হওয়ার আগে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধাগ্রস্ত আমিও। এই নির্জন পরিবেশে দাঁড়িয়ে সেই দুঃস্বপ্ন যেন ফিরে আসছে বারবার।

সদর দরজায় লাগনো নামের ফলকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম, ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দারের স্বরে চমক ভাঙল, ‘মিস্টার রায়, অকারণে সময় নষ্ট করে লাভ কী? চলুন, ভেতরে যাওয়া যাক।’

অতএব আমরা এবং দুশমন—তিনজনেই পা বাড়ালাম অন্দরমহলের দিকে।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় নির্জন ধু-ধু প্রান্তরে দাড়িয়ে থাকা বাড়িটায় আলো জ্বলছে। সারি-সারি জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলো যেন মাঝপথেই অন্ধকারের কাছে হার মেনে থমকে দাঁড়িয়েছে। চোখে এসে পড়ছে শুধুমাত্র তাদের মলিন আকৃতিটুকু।

কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠেই টানা করিডর। তার দু-পাশে কিছুদূর পরপর পরদাঢাকা দরজা। দরজার মাথায় সাইনবোর্ডের মতো বেরিয়ে থাকা কাঠের ফলকে অফিস, এনকোয়ারি, সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইত্যাদি স্পষ্ট ইংরেজি হরফে লেখা। করিডরে নজরে পড়ছে সাদা-পোশাকে ফিটফাট কর্মীদের আনাগোনা।

করিডর ধরে অফিসরুমে গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে অনুসরণ করলেন ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার। সঙ্গে দুশমন।

অফিস বলতে যা বোঝায়, ঘরটা ঠিক তাই। একেবারে নিখুঁত।

খুঁত শুধু টেবিলের ওপারে বসে থাকা ভদ্রলোকের ডানচোখে। চোখটা কালো প্যাচ দিয়ে ঢাকা। হয়তো কোনও দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে। যতদূর মনে পড়ল, গত শীতে এঁকে আমি দেখিনি।

আমাদের বসতে অনুরোধ করে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’

জবাব দিলেন ডক্টর সমাদ্দার। যদিও প্রশ্নটা করা হয়েছিল আমাকে লক্ষ্য করেই। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আমার নাম ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার, সাইকিয়াট্রিস্ট। মিস্টার সুদর্শন রায় আমার পেশেন্ট। গতবছর, শীতের সময়, ইনি আপনাদের কেয়ারে কিছুদিন ছিলেন। এখন এঁর ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে আপনাদের একটু কোঅপারেশান দরকার—যেমন, প্রথমে মিস্টার রায়কে নিয়ে এই গোটা বিল্ডিংটা আমি একবার ঘুরে দেখতে চাই। তারপর—।’

ডক্টর সমাদ্দারকে বাধা দিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘এক্সকিউজ মি, এখানে ডক্টর শঙ্করদাস গিরি নামে কেউ আছেন?’

‘শঙ্কর-দাস-গিরি?’ নামটা আপনমনেই বারকয়েক বিড়বিড় করলেন ভদ্রলোক। তারপর বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন।

পরক্ষণেই সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন বেয়ারা দরজায় এসে দাঁড়াল। তাকে লক্ষ্য করে একচক্ষু ভদ্রলোক আদেশ করলেন, ‘ভাটিয়াসাব কো সেলাম দো—।’

মিনিটকয়েক নীরবতার পর বেঁটেখাটো এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। বারদুয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একচক্ষু ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার, মিস্টার মহাজন?’

‘আসুন, মিস্টার ভাটিয়া।’ ইশারায় তাঁকে চেয়ারে বসতে বললেন মহাজন: ‘এঁরা জানতে চাইছেন শঙ্করদাস গিরির কথা। আমি তো এখানে নতুন, তাই ভাবলাম, খবরটা আপনিই ভালো দিতে পারবেন।’

ভাটিয়া চেয়ারে বসলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘দেখুন, ডক্টর শঙ্করদাস গিরির ব্যাপারটা একটু মিস্টিরিয়াস। মাসছয়েক আগে, গত শীতে, হঠাৎই একদিন তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। বহু চেষ্টা করেও তাঁর কোনও খবর আমরা পাইনি।’

আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা যেন আচমকা গা-ঝাড়া দিয়ে উন্মাদের মতো ছুটতে শুরু করল। শরীরে রক্তের চাপ হঠাৎ বেড়ে ওঠায় ভাটিয়ার আর কোনও কথা আমার কানে ঢুকল না। শুধু শঙ্করদাস গিরির নিখোঁজ হওয়ার খবরটা আমার মাথার ভেতরে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগল।

ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘বি স্টেডি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

নিজেকে সামলে নিয়ে দেখি ভাটিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। মহাজন আমাদের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে। ডক্টর সমাদ্দার তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। দুশমনও উঠে পড়ল।

ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় ডক্টর সমাদ্দার মহাজনকে জানালেন তাঁর খুব বেশি হলে আধঘণ্টা সময় লাগবে।

করিডর ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। এক-এক পা এগোচ্ছি আর আমার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। ডক্টর অম্বিকা সমাদ্দার কিন্তু নির্বিকার। দুশমনও নীরবে তার প্রভুকে অনুসরণ করে চলেছে।

মিনিটতিনেক হাঁটার পর চোখে পড়ল, আর-একটা করিডর আড়াআড়িভাবে প্রথম করিডরকে কেটে এগিয়ে গেছে। সেই চৌরাস্তায় পৌঁছে আমি একবার ডানদিকে এবং বাঁ-দিকে তাকালাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ডানদিকে এগোলাম। ডক্টর সমাদ্দারও আমাকে অনুসরণ করলেন।

কয়েক পা যেতেই বাঁ-দিকে একটা খোলা দরজা আমার নজরে পড়ল। দরজা পেরোতেই একটা বিশাল ঘর। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। আর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সাজানো রয়েছে সারি-সারি স্প্রিং-এর খাট। তাতে শুয়ে আছে বিভিন্ন বয়েসের পুরুষ। তাদের শরীর সাদা চাদরে খানিকটা করে ঢাকা। দেখে তাদের অসুস্থ বলেই মনে হচ্ছে।

বিশাল ঘরটার ডানকোণে একটা ছোট দরজা দেখে আমি একটুও অবাক হলাম না। কারণ, এখন বুঝতে পারছি, এরপর কোন-কোন দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ছোট দরজা লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। পেছনে অম্বিকা সমাদ্দার ও দুশমন।

ছোট দরজায় দাঁড়িয়ে আমার আর ডক্টর সমাদ্দারের চোখাচোখি হল। কারণ, দরজা পেরিয়েই একটা ছোট ঘর। সেই ঘরের ডানদিকে রয়েছে আর-একটা দরজা, আর দরজার পরে দেওয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে একটা ধবধবে সাদা বেসিন। সেটা জলে টইটম্বুর। কল থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল টপটপ করে বেসিনে পড়ছে। বেসিনের বাঁ-পাশে ছোট তাকে একটা সাবান রয়েছে: তার রং নীল—সাদা নয়।

এবার আমি সম্মোহিতের মতো ডানদিকের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকালাম না। কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলাম ডক্টর সমাদ্দারের ভারী বুটের শব্দ।

সামনের করিডরে একটা অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। সেটার শেষ প্রান্তে একটা খাটে দরজা। ধরজাটা ভেজানো ছিল, আমি সেটা খুলে বাইরের অন্ধকার খোলা মাঠে পা রাখলাম।

অন্ধকারের মধ্যেই দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে। আমি অক্লান্ত পায়ে হেঁটে চললাম। গন্তব্যস্থল কোথায় জানি না।

হঠাৎই পায়ের কাছে একটা আলোর বৃত্ত দেখে চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে দেখি ডক্টর সমাদ্দার পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বেলেছেন। এই ঘন অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলা দুশমনকে স্পষ্টভাবে নজরে পড়ছে না।

আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বলে উঠলেন অম্বিকা সমাদ্দার, ‘মিস্টার রায়, একমিনিট। আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আপনার স্বপ্নের সঙ্গে এইসব মিলে যাচ্ছে?’

আমি কোনও জবাব দিতে পারলাম না। শুধু মাথা ঝাঁকালাম।

ডক্টর সমাদ্দার থমকে দাঁড়ালেন। আমিও ঘুরে দাঁড়ালাম তাঁর মুখোমুখি।

‘আমার মনে হয়, আপনার অন্য স্বপ্নগুলের মতো এটাও আপনার কল্পনা। শুধু এই হোমের পটভূমি আপনার কল্পনাকে স্বপ্নে গড়ে তুলতে হেলপ করেছে, তার বেশি কিছু নয়। সুতরাং, আমার মনে হয়, আর সময় নষ্ট না করে আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো। বাড়ি ফিরে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করুন, ঘুরে বেড়ান, দেখবেন দু-দিনেই ওই নাইটমেয়ার কোথায় মিলিয়ে গেছে। সো, লেটস গো ব্যাক—।’

ডক্টর সমাদ্দার ঘুরে দাঁড়াতেই আমি চাপা গলায় বলে উঠলাম, ‘নো ডক্টর, নেভার। আমি এর শেষ দেখতে চাই।’

অন্ধকারে সমাদ্দারের অভিব্যক্তি আমার নজরে পড়ল না। শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘শেষ মানে? ও. কে.—অ্যাজ ইউ উইশ। কাম অন, দুশমন—।’

আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।

আচ্ছন্নের মতো চলতে-চলতে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, একটা হালকা জঙ্গলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ভিজে হাওয়ার ঝাপটা আমার চোখে-মুখে ঠান্ডা পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে চেয়ে দেখি কয়েকটা বড়-বড় গাছ: কী গাছ জানি না। তারই মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। পায়ের কাছে টর্চের আলোর বৃত্তে নজরে পড়ল ঘাসে ছাওয়া মাটি।

আমাকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অম্বিকা সমাদ্দার কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দুশমনের চাপা হিংস্র গর্জন তাঁকে থামিয়ে দিল। দুশমন আমাদের ছাড়িয়ে চট করে কিছুটা এগিয়ে গেল। ছটফটে পায়ে ফাঁকা জায়গাটাতে পায়চারি করতে লাগল।

আমার বুকের ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা যেন পাকে-পাকে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে।

দুশমনের গর্জন একটু জোরালো হল। অন্ধকারে ওর আবছায়া শরীরটা ঘাস-ছাওয়া জমিতে নড়াচড়া করছে।

কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম নড়াচড়া নয়, দুশমন প্রাণপণে মাটি আঁচড়াচ্ছে।

ডক্টর সমাদ্দারের টর্চ-ধরা হাত কেঁপে উঠল। তারপর গিয়ে স্থির হল দুশমনের কালো বিশাল শরীরের ওপরে। ওর তীক্ষ্ন থাবার আঁচড়ে ওপরের ঘাস ছিঁড়ে নীচের মাটি ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে।

মাত্র কয়েকমিনিট। তারপরই যে-দৃশ্য দুশমন দেখাল, তাতে আমি অবাক না হলেও ডক্টর সমাদ্দার চমকে উঠলেন। তাঁর মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। গর্জন করে উঠল দুশমন। আমি নিশ্চুপ, নিথর। ডক্টর সমাদ্দারের টর্চের আলো খাবলানো মাটির ওপরে থরথর করে কাঁপছে। তবুও দেখতে আমাদের কোনও অসুবিধে হল না। স্পষ্ট দেখলাম, সামান্য খোঁড়া মাটি থেকে বেরিয়ে রয়েছে পচে যাওয়া একটা হাত। সে-হাতের কোনও-কোনও জায়গায় সাদা হাড়ের আভাস নজরে পড়ছে। আর সেই বিধ্বস্ত হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটা ময়লা সাদা সাবান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *