1 of 2

তিরিশ বছর পর চব্বিশজন

তিরিশ বছর পর চব্বিশজন

জানলার বাইরে ঝোড়ো বাতাস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল খেলছিল। শোঁ-শোঁ শব্দ আর জানলার পাল্লার খটখট। বাইরে পাঁচিলের ওপরে কালো আকাশ, আর দু-পাশে বনেদি বাড়ির টুকরো। সেইসঙ্গে কয়েকটা গাছের ডালপালা আর চঞ্চল সবুজ পাতার আন্দোলন।

আদিত্য চেয়ারে বসে আনমনা হয়ে বাইরের ঝড় দেখছিল, আর বুকের ভেতরে ঝড়টা অনুভব করছিল।

প্রায় তিরিশ বছর পর পুরোনো স্কুলের ক্লাস-ঘরে বসেছে আদিত্য। ওকে ঘিরে রয়েছে তেইশজন সহপাঠী। ১৯৬৭-তে এই ক্লাস-ঘরে ওরা শেষ বসেছিল। তারপর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাস-টাস করে যে-যার জীবনরেখা ধরে চলতে শুরু করেছে। সেই রেখাগুলোয় কখনও কাটাকুটি হয়নি। অর্থাৎ, ঠিক তেমনভা, পুরোনো পরিচয়ের সূত্র দানা বাঁধেনি।

এই ক্লাস-ঘরটাই বোধহয় ছিল ইলেভেন-বি, সায়েন্স সেকশন। না কি পাশের ঘরটা?

এখন এই ক্লাস-ঘরে তিনটে টেবিল গায়ে গায়ে লাগিয়ে একটা বড় টেবিলের চেহারা দেওয়া হয়েছে। আর সেই টেবিল ঘিরে অনেকগুলো কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ার। এছাড়া কয়েকটা খাটো বেঞ্চি রয়েছে পিছনের সারিতে। আর দেওয়াল ঘেঁষে দু-তিনটে ছোট টেবিল এলোমেলোভাবে রাখা।

তিরিশ বছর পর পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে বের করে স্কুলের ক্লাস-ঘরে এনে জড়ো করার পুরো কৃতিত্বই উৎপল, সুজিত আর কমলের। ওরা তিনজন কী করে যেন যোগাযোগ বজায় রেখেছিল নিজেদের মধ্যে। তারপর তিনজনের মাথায় ঝোঁক চেপে যায়–পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে বের করতেই হবে। তিনজনের নামের অক্ষর জুড়ে ওরা তৈরি করে উৎসুক। এবং তিন সদস্যের উৎসুক কাজে নেমে পড়ে।

আদিত্য আরও কী সব ভাবছিল, হঠাৎই সুজিতের চিৎকারে ওর খোয়ারি ভাঙল।

অ্যাই, আদিত্য–তুই প্রথম শুরু কর। উৎপল, টেপটা চালু করে দে—

টেপের সামনে বন্ধুদের প্রত্যেককে দু-চার কথা বলতে হবে। এটা সুজিতের আইডিয়া।

উৎপল এক্সটেনশন বোর্ডের সঙ্গে ওর ছোট টেপ রেকর্ডারটা জুড়ে দিয়ে সুইচ অন করে দিল। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে দু-হাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে বলল, অ্যাই–চুপচুপ! আদিত্য শুরু করছে।

কমল ফোড়ন কেটে বলল, আমাদের রমেনবাবু হলে বলত, অ্যাই–সুপ–সুপ, এত হট্টগোল কীসের!

রমেনবাবু অঙ্কের স্যার ছিলেন। অঙ্কে তুখোড় বললে কম বলা হয়। আদিত্যদের ব্যাচে দু চারজন ছাড়া সবাই অঙ্কে লেটার পেয়েছিল।

আদিত্য উঠে দাঁড়াতেই হইহই একটু কমল।

একটা অদ্ভুত ঢেউ আদিত্যর বুকের ভেতরে ছেলেখেলা করছিল। ঢেউটা বারবার আছড়ে পড়তে গিয়েও ফিরে যাচ্ছিল পিছন দিকে। আবার এগিয়ে আসছিল।

আজকের দিনটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না– আদিত্য বলতে শুরু করল, আজকের দিনটা স্বপ্ন, নাকি সত্যি? আজ ১লা মে, নাকি ৩১শে এপ্রিল? এরকম একটা দিন আমার জীবনে উপহার দেবার জন্য উৎপল, সুজিত আর কমলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজ এখানে এসে পুরোনো দিনের কথা…

আদিত্য কথা বলছিল, আর পুরোনো বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিরিশ বছর আগেকার পুরোনো মুখগুলো খুঁজছিল।

অশোকের মাথায় প্রায় শতকরা পঁচাত্তর ভাগই টাক। ফরসা মুখ বয়েসের ভারে ভারী হয়েছে। চোখে চশমা ওর বরাবরই। এখন বোধহয় পাওয়ার বেড়েছে,।

শশাঙ্ককে একেবারে চেনাই যাচ্ছে না। ছাত্রজীবনে একমাথা কোকড়া চুল ছিল ওর। এখন তার অবস্থা হেমন্তের অরণ্য। ফরসা চামড়া বৃদ্ধ হয়েছে। গাল বসে গেছে। শুধু হাসলে চেনা যায়। মুখটা পলকে তিরিশ বছর পিছিয়ে যায়। এখন শশাঙ্ক জাদুকর, অভিনেতা, আবৃত্তিকার। চাকরি করে পাবলিক সারভিস কমিশনে।

তিনজন পার্থকে নজরে পড়ল অদিত্যর। একজন ভট্টাচার্য, একজন ব্যানার্জি, আর একজন চক্রবর্তী। বয়েস তিনজনেরই মুখে থাবা বসিয়েছে। তবে সামান্য চেষ্টা করলেই পুরোনো মুখগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।

বরং আদিত্যকেই অনেকে চিনতে পারেনি।

কারণ ৬৭-র সেই রোগা কালো শান্তশিষ্ট ছেলেটা অনেক পালটে গেছে। বাইরেও, ভেতরেও।

উৎসুক জানিয়েছিল, ১ মে ঠিক সাড়ে তিনটেয় স্কুলের একতলার একটা ঘরে পুনর্মিলনের আসর বসবে। এব্যাপারে কথাবার্তা বলে হেডমাস্টারমশাইয়ের অনুমতির ব্যবস্থা করে রেখেছিল উৎপল। সবাইকে চিঠি দিয়ে সেইমতো খবরও দিয়েছিল। এ ছাড়া প্রত্যেককে অনুরোধ করেছিল এক পৃষ্ঠায় নিজের জীবন সম্পর্কে লিখে জানাতে। এবং স্কুলের রচনার মতো কয়েকটা পয়েন্ট-ও দিয়ে দিয়েছিল সেই একপৃষ্ঠার জীবনীর জন্য : এখন কী করছ?, ঠিকানা (সম্ভব হলে ফোনসহ), পরিবারের সকলের খবর, অবসর কীভাবে কাটাও?, ভবিষ্যতের ভাবনা, ইত্যাদি।

চিঠিতে উৎসুক আরও জানিয়েছিল, প্রত্যেকের এই একপৃষ্ঠার জীবনী ফটোকপি করে একসঙ্গে বাঁধিয়ে বইয়ের মতো করা হবে। ১ মে এই বই প্রত্যেকের হাতে এককপি করে তুলে দেওয়া হবে। ভাবতে দারুণ লাগছে না?

নিজের জীবনী লিখতে বসে আদিত্য বিষণ্ণ হেসেছিল। উৎসুক যা জানতে চেয়েছে সে সবই হল জীবনের মেকানিক্যাল ডেটা–যান্ত্রিক তথ্য। তা থেকে কি আসল জীবনের কোনও খোঁজ পাওয়া যাবে? বোঝা যাবে, আদিত্য ভালোবাসাহীন একটা মরুভূমির ওপর দিয়ে বহুদিন ধরে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে? সারাদিনের ক্লান্তিকর কাজের শেষে আদিত্য রোজ বাড়ি ফেরে, ঘরে ফেরে না। ওর নিঃসঙ্গতার সঙ্গী আকাশের চাঁদ, আর কয়েকটি তারা। আকাশে চাঁদ না থাকলে কত মানুষ যে অসহায় হয়ে যেত!

জীবনের যান্ত্রিক তথ্য যথাসময়ে উৎসুক-কে জানিয়ে দিয়েছিল আদিত্য। তারপর, আজ, তিনটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে এসে ঢুকে পড়েছে টাইম-মেশিনের দরজা দিয়ে পুরোনো সেই ক্লাস ঘরের মধ্যে।

ঘরে ঢোকামাত্র হইহই ও আদিত্য-এসেছে, দিতু এসেছে! আয়, আয়–

বেশ বড় ঘর। ঘরের মাঝখানে তিনটে টেবিল লম্বালম্বি জোড়া দেওয়া। সেই টেবিল-ত্রয়ী ঘিরে অনেকগুলো হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার।

ঘরের মেঝেতে রঙিন আলপনা, তবে ধুলোমলিন। এ ঘরটায় সরস্বতী পুজো হত–এখনও হয়।

ডানদিকের দেওয়াল সিমেন্টের ব্ল্যাকবোর্ড। এ ছাড়া কয়েকজন মনীষীর ফটো। বাঁ-দিকের দেওয়াল ঘেঁষে তিনটে কাঠের আলমারি–বেশ পুরোনো। আর মেঝেতে একপাশে গোটানো রয়েছে বিশাল এক নারকোল-দড়ির ম্যাট।

ঘরে দুটো বালব জ্বলছে। তা সত্ত্বেও ঘরটা যেন আধো-আঁধারি মনে হল আদিত্যর। তা ছাড়া মেঘের দৌলতে বিকেলের আকাশ এখনই ছাই-রঙা।

টাইম-মেশিনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তেই একটা পুরোনো বাতাস ঝাপটা মারল আদিত্যর নাকে। সেই সঙ্গে কেমন একটা পুরোনো গন্ধ।

পুরোনো ব্যাপারটা এই স্কুলের কাছে কিছু নতুন নয়। আদিত্যরা যখন এইচ. এস. পাশ করে বেরোয় এই স্কুলের বয়েস দেড়শো বছর। আর আজ এক কুড়ি কম দুশো।

হইচইয়ের মধ্যেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা মধ্যবয়েসি একজন বেঁটেখাটো মানুষ প্রশ্ন করল, বিল তো, আমি কে?

আদিত্য প্রশ্নকর্তার ভারি মুখটা কয়েক সেকেন্ড ধরে দেখল। গাল-গলা-চোখের নীচ তিরিশ বছরে অনেক ভরে উঠেছে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। আদিত্য শিক্ষানবিশ প্রতিমা শিল্পীর মতো ভারিক্কি মুখটার মাংস-চর্বি কমাতে লাগল। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগল তিরিশটা বছর। মাথার সাদা চুলগুলো কালো রঙ করতে লাগল।

তারপরঃ কমল!

কমল হেসে ফেলল, বলল, বাঃ, পরীক্ষায় পাশ! যা বোস। অ্যাই, ওকে কোল্ড ড্রিঙ্কস্ দে—

আদিত্য একটা চেয়ার নিয়ে বসল। পুরোনো বন্ধুদের একজন ঠান্ডা বোতল এগিয়ে দিল ওর সামনে। তাতে সামান্য চুমুক দিয়ে আদিত্য টাইম-মেশিনের অন্যান্য যাত্রীর মুখে চোখ বোলাতে লাগল। তুই কে? কী ছিল তোর নাম? কোন বেঞ্চে বসতিস তুই?

কাউকে কাউকে অস্পষ্ট ভাবে চিনতে পারছিল আদিত্য।

সুজিতের চেহারা সেই বালক বয়েসের মতোই আছে। শুধু ভারিক্কি হয়েছে আর কপালের দুপাশে বয়েসের রাজপথ চুলের অরণ্যে নগরায়ণ শুরু করেছে।

ক্লাস সেভেন থেকেই সুজিত ওদের ক্লাসে মনিটর ছিল। সাহেবদের মতো টকটকে ফরসা গায়ের রং, গম্ভীর গলা। ভাসা ভাসা মনে পড়ে, বড় ঘেরওয়ালা হাফপ্যান্ট পরে আসত স্কুলে। সেই সুজিত এখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।

পার্থ ব্যানার্জির নাম ধরে কে যেন ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল কার সঙ্গে। তখনই আদিত্য চিনতে পারল ওকে…নাকি পারল না? গায়ের রং অনেক ময়লা হয়ে গেছে। চোখে রিমলেস চশমা, গাল সামান্য ভাঙা। এই হল অতীতের প্রথম পার্থ-র বর্তমান চেহারা।

ঘরের অস্পষ্ট আলোয় পুরোনো সতীর্থদের চিনে নিচ্ছিল আদিত্য।

উৎপল, উদয়ন, রূপক, শুভেন্দু, নরোত্তম, কমলেশ, শান্তনু, আরও সবাই।

এমন সময় আর একজন এসে ঘরে ঢুকল।

আদিত্য তাকে চিনতে পারল সহজেই : চঞ্চল। ওর পাশেই বসত। পড়াশোনায় তেমন দক্ষ না হলেও ভীষণ ভালো ছেলে ছিল। চুয়াল্লিশ পেরোনো কালো ছেলেটার মুখে আজও সেই একইরকম অপ্রস্তুত মিষ্টি হাসি।

ঘরে যে এসে ঢুকছে তাকেই হইহই করে স্বাগত জানাচ্ছে শান্তনু, কমল, উৎপল, সুজিত। তারপরইঃ অ্যাই, আগে পরীক্ষা দে। এক এক করে সবার নাম বল। বল, এটা কে বসে আছে?

উত্তর ঠিক হলে পর একপ্রস্ত হইচই, আর না হলে পরে বকুনি। তবে পরীক্ষায় পাস বা ফেল যা-ই হোক না কেন, হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে সামনে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোল্ড ড্রিঙ্কস।

সুব্রতর কথা মনে পড়ছিল আদিত্যর। ওর সামনের বেঞ্চে বসত। লেখাপড়ায় দারুণ ছিল। দুরন্তপনাতেও। আদিত্যকে কখনও দিতু কখন তু-তু বলে খেপাত। আদিত্য অন্যমনস্ক হলেই মাথায় চঁটি মেরে অন্য দিকে তাকিয়ে ভিজে বেড়ালের মতো বসে থাকত। ছোট গোলগাল মুখ, মাথার চুলগুলো খাড়া-খাড়া।

সুব্রত খুব প্রাণবন্ত ছিল, ছটফটে ছিল। একটুখানি ডাকাবুকোও।

আদিত্যর মনে পড়ছিল, একবার ট্রামে ওর সঙ্গে কী নিয়ে যেন ঝগড়া হয়েছিল। আদিত্য সুব্রতকে এক ধাক্কা মেরেছিল। কিন্তু ওর সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে কেন! সুব্রত এক টানে ওর ব্যাগের ফিতে ছিঁড়ে ব্যাগটা ফেলে দিয়েছিল মেঝেতে।

কিন্তু শুধুই কি ঝগড়া! সুব্রত ওকে ভালোও বাসত। টিফিনে ছোলাভাজা, কুল বা হজমি কিনলে আদিত্যকে ভাগ দিত, আর বলত, জানিস দিতু, স্কুলের টিফিনে আমার পেট ভরে না।

এই ছোলাভাজাটা খেয়ে দ্যাখ। কী দারুণ, না? ফ্যানটাসটিক!

কথায় কথায় কী দারুণ, না? ফ্যানটাসটিক! বলাটা সুব্রতর যেন মুদ্রাদোষ ছিল।

এতদিন সুব্রতর স্মৃতিটা কীরকম ঝাপসা ছিল। সংসারের নানান সমস্যার মাঝে ওকে মনেই পড়ত না। অথচ আজ এই টাইম-মেশিনে ঢুকে সুব্রত স্মৃতির পিছনের সারি থেকে একেবারে সামনে চলে এসেছে।

সুব্রত আজ আসেনি। এলে ওকে সঙ্গে-সঙ্গেই চিনতে পারত আদিত্য। ওকে ভোলা যায় না। ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হত, কিন্তু সকলের সঙ্গে সহজভাবে মিশত, মজা করত। গরমের ছুটি পড়ার দিন স্যারদের আপ্যায়নের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সুব্রত যেমন উৎসাহী ছিল, তেমনটাই ছিল সরস্বতী পুজোর ব্যাপারে।

একবার স্কুল ছুটির সময়ে পেয়ারা কিনতে গিয়ে দুটো ছেলের সঙ্গে আদিত্যর প্রায় হাতাহাতি হয়। ছেলে দুটো ওকে একা পেলে মারবে বলে ভয় দেখায়। আদিত্য খুব ভয় পেয়ে গিয়ে সুব্রতকে ব্যাপারটা বলেছিল। শুনে বেপরোয়া সুব্রত গালাগাল দিয়ে বলেছিল, কোন শালা তোকে মারবে বলেছে! দেখি কার হিম্মত তোর গায়ে হাত দেয়–

সুব্রত সেদিন আদিত্যকে সঙ্গে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।

হঠাৎই আদিত্য চমকে উঠল।

ওই তো সুব্রত! ঘরের পিছনের দেওয়াল ঘেঁষে একটা টেবিলের ওপরে বসে আছে। বসার ভঙ্গিটা রকে আড্ডা মারার মতো, কিন্তু আবছায়া মুখে বিষণ্ণ ছাপ। আধো-আঁধারিতে চুপচাপ বসে আছে–যেন সম্প্রতি কোনও মানসিক আঘাত পেয়েছে।

ঘরের মধ্যে নানান কথার কলরোল। তাকে ছাপিয়ে মাঝে-মাঝেই শোনা যাচ্ছিল মেঘের ডাক।

টেপ রেকর্ডারের সামনে নিজেদের অনুভবের কথা এক এক করে বলছিল সকলে। পুরোনো দিনের কথা, স্যারদের কথা, স্কুল স্পোর্স-এর কথা, সরস্বতী পুজোর কথা।

উৎপল হঠাৎই হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল। তারপর একটা জীর্ণ মলিন বই তুলে দেখাল সকলকে।

এটা আমাদের ক্লাস এইটের বাংলা বই

আদিত্য হাতে নিয়ে দেখল বইটা। নাম সাহিত্য মুকুল। সেলাই ছিঁড়ে গেছে, পৃষ্ঠাগুলো ক্ষয় ধরা হলদে। অতীতের চিহ্ন অতি সহজেই চলে এসেছে বর্তমানে। তারপর ওদের সবাইকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে অতীতে।

বইটা হাতে নিয়ে অদ্ভুত লাগছিল আদিত্যর। অতীত, না বর্তমান কোনটা বেশি সত্যি? বর্তমানের জন্মের বীজ লুকিয়ে থাকে অতীতে। অতীত কায়া, বর্তমান তার ছায়া।

বইটা সবাই হাতে-হাতে দেখতে লাগল।

বাইরে মেঘের ডাক বাড়ছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগের বাতাস স্কুলের ভোলা উঠোনে পাক খেয়ে ঢুকে পড়ছিল ঘরের ভেতরে।

উৎপল আর একটা খাতা তুলে দেখাতে চাইল সবাইকে।

এই খাতায় আমাদের কয়েকজনের লেখা কবিতা আর গদ্য রয়েছে। ক্লাস সিক্সে এগুলো আমি লিখিয়ে নিয়েছিলাম। জিতেনবাবু মনে আছে, আমাদের বাংলা পড়াতেন? উনি একদিন বলেছিলেন, কে জানে, তোদের মধ্যে কেউ হয়তো একদিন নোবেল প্রাইজ পেয়ে যেতে পারে–

একথা শুনে অনেকে হেসে উঠল।

উৎপল একটু চুপ করে থেকে বলল, ক্লাস সিক্সে ব্যাপারটা আমি ঠাট্টা বলে ভাবিনি। তাই যারা নোবেল প্রাইজ-টাইজ পেতে পারে বলে আমার মনে হয়েছিল, তাদের দিয়ে এই খাতাটায় কিছু লিখিয়ে নিয়েছিলাম। তার মধ্যে শান্তনুর একটা লেখা ছিল আমার প্রিয় বই। ও আরণ্যক-এর কথা লিখেছিল। সেই লেখার প্রথম কয়েকটা লাইন আজকের দিনটার সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশে গেছে। আমি পড়ে শোনাচ্ছি–

শান্তনু নোবেল প্রাইজ পায়নি। জামশেদপুরে টিসকোয় ম্যানেজার। সেই ছোটবেলা থেকেই বাংলায় মাস্তান ছিল। নানা জায়গায় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেত।

উৎপল পড়তে শুরু করল, স্মৃতি সততই সুখের। স্মৃতি যেন অধরা মাধুরী। ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে বলেই স্মৃতি এত আকাঙ্ক্ষার। এমন কোনও জীবন নেই যে-জীবনে কোনও পিছুটান নেই। স্মৃতির পথ আমাদের পৌঁছে দেয় অতীতের নানা সুখের দিনে, ভালোবাসার দিনে।

পথের পাঁচালি র লেখকের স্মৃতিপথের পাঁচালি আরণ্যক।

উৎপল থামল।

আদিত্য মুগ্ধ হয়ে শুনল। ক্লাস সিক্সের এক বালক এইরকম লেখা লিখেছে! শান্তনুর দিকে দেখল আদিত্য। ওকে তখন বাহবা দিচ্ছে কয়েকজন সহপাঠী।

সুজিত আর কমল কখন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎই ওরা হইহই করে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরা একটি ছেলে। তার কাঁধের ঝুড়িতে ছোট ছোট মিষ্টির বাক্স।

সুজিত চেঁচিয়ে বলল, বন্ধুগণ, আমাদের ছেলেবেলায় সেই পুঁটিরামের প্যাকেট। মনে পড়ছে, পুঁটিরামের মিষ্টির দোকান?

মনে পড়ছে না আবার! সুতরাং ঘর জুড়ে তুমুল হাতহালি।

হাতে-হাতে সবার কাছে পৌঁছে গেল মিষ্টির বাক্স। খাওয়া শুরু হল। উৎপল সেই ফাঁকে টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেটটা উলটে দিল।

আদিত্য বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল। শশাঙ্ক মাঝে মাঝে দু-চার লাইন করে কবিতা আবৃত্তি করছিল। আবার কখনও ছোটখাটো ম্যাজিক দেখাচ্ছিল।

হঠাৎই কমল চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, চুপ কর সবাই। অরিন্দম এবার বলবে।

অরিন্দমের স্বাস্থ্যবান চেহারা, চাপদাড়ি, মুখে একটা ব্যবসায়ী ভাব। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আজকের দিনটার কোনও মানে হয় না। এই স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি তো কী হয়েছে? স্কুল শেষ হয়েছে, স্কুল-লাইফও শেষ হয়ে গেছে। যা শেষ হয়ে গেছে তা নিয়ে নাচানাচি করে লাভ কী? এখন লাইফে অনেক প্রবলেম। সব কিছু লাভ-ক্ষতি দিয়ে বিচার করতে হয়।

আচমকা কথা শেষ করে অরিন্দম বসে পড়ল।

আদিত্যর ওকে কসাই মনে হচ্ছিল। জীবনের সব অঙ্কই কি লাভ-ক্ষতির অঙ্ক? ওর দেবিকার কথা মনে পড়ল। বিয়ের পর থেকেই দেবিকার এক অভিযোগ ও আদিত্য মোটেই প্র্যাকটিক্যাল নয়। সেন্টিমেন্টাল ফুল। আবেগপ্রবণ গণ্ডমূর্খ। হয়তো কথাটা সত্যি। সেইজন্যই বোধহয় আদিত্য নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছে। আগে ও অনেক কথা বলত, যার মধ্যে বেশিরভাগটাই বাজে কথা। আকাশে প্রকাণ্ড চাঁদ উঠলে কি অপরূপ ঘন মেঘ করলে ও আর দেবিকাকে ডাকে না, দেবিকা তখন হয়তো কোনও কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

আদিত্যর ছেলে সুমিত ক্লাস এইটে পড়ে। কিন্তু এরই মধ্যে সে মায়ের জীবনতত্ত্বে দীক্ষা নিয়েছে। আদিত্য বুঝতে পারে।

সুমিত আদিত্যকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসার মধ্যেও ওর প্রয়োজনটা জানাতে কখনও ভুল হয় না। একটা বাচ্চা ছেলে তার প্রয়োজনের কথাটা কখনও ভুলবে না? কখনও বাজে খরচ করতে চাইবে না? অপচয়ের মধ্যেই যদি মানুষকে চেনা যায় তাহলে ছেলেকে আদিত্য আলাদা করে চিনবে কেমন করে!

শুভেন্দুর কথায় আদিত্য জেগে উঠল। ও তখন টেপ রেকর্ডারের সামনে কথা বলছে। বালক বয়েসের মতোই রোগা-সোগা চেহারা, চোখে রিমলেস শৌখিন চশমা, মাথায় কয়েক গাছা পাকা চুল। ক্লাসে শুভেন্দু বেশ মজা করে কথা বলত।

আমি একটা ছোটখাটো ব্যবসা করি। লাভ-ক্ষতির হিসেব আমাকেও করতে হয়। অরিন্দমের মতো। সোজা কথায়, রাত-দিন টুপি পরানোই আমার কাজ। কখনও ব্যাঙ্ককে টুপি পরাচ্ছি। কখনও সাপ্লায়ারকে টুপি পরাচ্ছি। আর কখনও কাস্টমারকে। সেইজন্যেই আজকের সন্ধেটা আমার দারুণ লাগছে। আমি মনে প্রাণে এই ভেবে খুশি যে, এখন আমাকে কাউকে টুপি পরাতে হবে না। সোজা কথা ভাই, রোজকার জীবনে টুপি পরাতে-পরাতে আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি।

শুভেন্দুর পর দীপক। ময়লা রং, সরু গোঁফ, চঞ্চল চোখ। একটা সদাগরি অফিসে সামান্য কেরানির চাকরি করে। ঘরে ঢোকার পর দীপক প্রথম প্রথম একটু আড়ষ্ট ছিল। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।

দীপক বলতে শুরু করল, এখানে আসার কথায় আমার একটু কিন্তু কিন্তু লাগছিল। তোরা সব বিরাট পোস্টে চাকরি করিস, কেউ বা বিশাল বিজনেসম্যান। আর আমি বারোশো টাকা মাইনের কেরানি। যে-কোনও দিন চলে যেতে পারে এমন একটা চাকরি। তাই এখানে আজ এসে মনে হচ্ছিল আমার অবস্থা অনেকটা হংস মধ্যে বকো যথা। কিন্তু টেরই পাইনি কখন যেন আমি বক থেকে হাঁস হয়ে গেছি। তোদের মাঝে একাকার হয়ে গেছি।

দীপকের পর কমলেশ। ও এখন সাহা ইন্সটিটিউটে বিশাল বিজ্ঞানী থিয়োরিটি ক্যাল ফিজিসিস্ট।

আমি নতুন কথা কী আর বলব! বরং স্কুলে আমার প্রথম দিনটার কথা বলি। আমি হুগলির এক গ্রামের স্কুল থেকে এসে এই স্কুলে ভরতি হয়েছিলাম। বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন, তাই আমাকেও স্কুল বদল করে এখানে এসে ক্লাস সেভেনে ভরতি হতে হয়েছিল। প্রথম দিন স্কুলে এসে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। প্রকাণ্ড বিল্ডিং, সারি সারি অসংখ্য ক্লাস-ঘর। তো আমি ভুল করে ক্লাস এইটের বি সেকশানে ঢুকে পড়েছিলাম। ভুল যে করেছি সেটা পরে বুঝেছিলাম। যাই হোক, ঘরে ঢুকে দ্বিতীয় না তৃতীয় বেঞ্চে বসেছি–দেখি, ক্লাসে যে-টিচার ছিলেন তিনি প্রথম বেঞ্চ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ছেলেকে একে-একে কাছে ডাকছেন। তারপর জম্পেশ করে তার কর্ণমর্দন করে ঘাড়ে একটি রদ্দা বসিয়ে দিচ্ছেন। তার এই অমানুষিক আক্রমণ থেকে কেউই বাদ যাচ্ছে না। ব্যাপারটা ক্রমশই আমার কাছে এগিয়ে আসছিল। ভয়ে আমার তখন হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এমন সময়ে একজন বেয়ারা একটা নোটিস নিয়ে ক্লাসে আসে। সেই সুযোগে আমি ক্লাস রুমের পেছনের দরজা দিয়ে চম্পট দিই। একটু থামল কমলেশ। তারপর বলল, আর-একটা ব্যাপার মনে পড়ছে। দোতলায় ক্লাস সেভেন এ-র ঘরে পাশের পার্ক থেকে একটা গাছের ডাল ঢুকে পড়েছিল একটা জানলা দিয়ে। টিফিনের সময় কেউ-কেউ ওই ডাল বেয়ে পালিয়ে গিয়ে মুনলাইট হলে সিনেমা দেখত। জানি না, ওই ডালটা এখনও আছে কি না।

কমলেশ বসে পড়তেই শান্তনু-উদয়ন-রূপক একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, গাছটা এখনও আছে। ইচ্ছে করলে ওটার মহানুভবতায় এখনও সিনেমা দেখা যায়।

সুজিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটা দুঃখের খবর দিই। কমলেশ যার কথা বলল, তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। বছর ছয়েক আগে সুকুমারবাবু সুইসাইড করেছেন।

সুকুমারবাবুর চাপড়, কানমলা আর রদ্দা বিখ্যাত ছিল। জর্দা-পান খেতেন। গলা ফাটিয়ে হাসতেন। দেখে মনে হত, কোনও দুঃখ-কষ্ট নেই। সেই মানুষটা আত্মহত্যা করতে গেল কেন? সুকুমারবাবুকে হিংসে হল অদিত্যর। ওর যদি ওরকম সাহস থাকত।

সুব্রত দূরে একটা চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছিল। ওর মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। গায়ের রং কেমন কালচে নীল দেখাচ্ছে।

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মেঘের ডাকও শোনা যাচ্ছে ঘন-ঘন। ভোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকে পড়ছে ঘরে। সুব্রতর মাথার কাছেই জানলাটা। ওর গায়ে জল লাগছে। কিন্তু ওর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ও চুপচাপ দোল খাচ্ছে।

এক-একজনের কথা শেষ হওয়ার পর তুমুল হাততালির মধ্যে সুব্রতর কথা শুনতে পাচ্ছিল আদিত্য। অন্তত ওর তাই মনে হচ্ছিল।

কী দারুণ, না? ফ্যানটাটিক!

উৎপল বলল, আমাদের প্রত্যেকের লেখাগুলো নিয়ে জেরক্স করে একটা বই তৈরি করে আমি নিয়ে এসেছি। সব বই এখনও তৈরি হয়নি। তা ছাড়া কভারটা এখনও কমপ্লিট হয়নি। নরোত্তম কভার আঁকছে।

নরোত্তমের হাতের লেখা ছিল অপূর্ব, আর ছবিও আঁকত খুব সুন্দর। যাক, এই তিরিশ বছরে ও তাহলে আঁকার অভ্যেসটা ছেড়ে দেয়নি। ভাবতে ভালো লাগল আদিত্যর। কারণ, এই তিরিশ বছরে ওকে অনেক কিছু ছাড়তে হয়েছে।

উৎপলের দেওয়া বইটা সবাই একে-একে নিয়ে দেখতে লাগল।

উৎপল বলল, এরপর আর একদিন আমরা মিট করব। সেদিন বইটা সবাইকে দিতে পারব।

আদিত্য প্রত্যেকের জীবনী উলটেপালটে পড়ছিল। পড়তে-পড়তে ওর মনে হল, দীপক খুব একটা মিথ্যে বলেনি। ওদের বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠিত, সফল। কিন্তু এটাই তো একমাত্র ছবি নয়। এটা প্রত্যেকের জীবনের মলাট। মলাটের ওপিঠেই রয়েছে আসল জীবন। সেটার খবর কে রাখে!

তৃতীয় পার্থ, পার্থসারথি চক্রবর্তী, তখন উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের কথা বলছিল। ওর চোখে চশমা। মাথার সব চুল প্রায় সাদা করে ফেলেছে। ও এখন সরকারি-আমলা, জিওলজিতে ডক্টরেট।

অরিন্দম বলছিল, এসব করে কী লাভ। প্রথমে বুঝতে পারিনি কী লাভ…কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। অসম্পূর্ণ কখনও পূর্ণের স্বরূপ বুঝতে পারে না। ময়ুর কখনও জানতে পারবে না আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার কী স্বাদ। তাই সে বলবে, উড়ে লাভ কী। যাই হোক, আমি বরাবরই ভাই কলকাতায় আছি। প্রত্যেক বছর সরস্বতী পুজোর দিন আমি স্কুলে আসি…।

বাইরে বৃষ্টির শব্দ রিমঝিম করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে শনশন হাওয়া। একটা অদ্ভুত আমেজ অদিত্যকে জড়িয়ে ধরছিল।

আমাদের সময়েও এই ঘরটাতেই সরস্বতী পুজো হত। তখন সরস্বতীর দুপাশে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা দুটি বালকের মূর্তি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকত। এখন আর সেই মূর্তি দুটো থাকে না। আমি প্রত্যেক বছর সরস্বতী পুজোর দিন এখানে এসেছি…কিন্তু কেন এসেছি জানি না। একটু হাসল পার্থ ও এসে কী লাভ হয়েছে তা-ও বুঝিয়ে বলব? ধরা যাক, একটা ঘরের একটা জানলা বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। হঠাৎই যদি সেই জানলাটা খুলে দেওয়া হয় তা হলে প্রথম যে-বাতাসটা ঘরে ঢোকে তার একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ আছে। তার মধ্যে এক অদ্ভুত প্রাণ থাকে। সেটা ঠিক ভাষায় বুঝিয়ে বলা যায় না। আজকের সন্ধেটা আমার কাছে ঠিক সেইরকম…।

সকলে হাততালি দিয়ে হইহই করে উঠল।

আদিত্য দেখল, ঘরের এক অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে সুব্রত ঠোঁট নাড়ল। বোধহয় ফ্যানটাটিক বলল। তারপর আলতো হাততালি দিল। অথচ ওর চোখমুখে কোনও খুশির ভাব নেই।

আদিত্য ইশারা করে ওকে কাছে ডাকল।

সুব্রত মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। ওর নীলচে মুখে কেমন অভিমানের ছাপ।

 দীপক চেঁচিয়ে পার্থসারথিকে মন্তব্য ছুঁড়ে দিল, তুই এত ভালো বাংলা শিখলি কোত্থেকে!

পার্থ দূরের একটা টেবিলে চড়ে বসেছিল। হেসে জবাব দিল, জানো না, আমার ফাদার বাংলার টিচার ছিল!

ঘরের মধ্যে এলোমেলো হইচই হচ্ছিল। একটা বাচ্চা ছেলে কোথা থেকে এসে কেটলি আর ভঁড় নিয়ে ঢুকে পড়ল। ঘরের মাঝবয়েসি বাচ্চাগুলোকে একে-একে চা দিতে লাগল।

না, উৎসুক আয়োজনে কোনও ত্রুটি রাখেনি।

এমন সময় কে যেন বলে উঠল, অ্যাই সুজিত, আমাদের মধ্যে আজ কারা কারা আসেনি, কে কোথায় আছে একটু পড়ে শোনা তো। জেরক্স করা বইটা যখন হাতে পাব তখন ধীরেসুস্থে পড়ে দেখব।

উৎপল চেঁচিয়ে সবাইকে থামাতে চেষ্টা করল।

সুজিত একগোছা কাগজ নিয়ে মনিটরের ভঙ্গিতে পড়তে লাগল ও এই লিস্টটা আমি পড়ে শোনাচ্ছি। পরে সবাইকে এটার একটা কপি দিয়ে দেব…।

সুজিতের লিস্ট পড়া শেষ হল। ক্লাস ইলেভেনে ওরা একচল্লিশ জন ছিল। আজ সতেরোজন আসতে পারেনি। কেউ কলকাতার বাইরে, কেউ বিদেশে, আর কেউ-বা খুব জরুরি কাজে আটকে গেছে।

আদিত্য চব্বিশজনকে গুনছিল, খুঁটিয়ে দেখছিল আবার।

ঠিক তখনই কে যেন বলল, সুব্রত চার বছর আগে মারা গেছে। সিমলিপালে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনদিনের জ্বরে মারা যায়। অসুখের কারণটা ডাক্তাররা ধরতে পারেননি।

আদিত্যর বুকের ভেতরটা ঠান্ডা পাথর হয়ে গেল। হাত-পাগুলো যেন জেলির তৈরি। ওর মাথা টলে গেল, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ও ঘরের কোণে সুব্রতকে দেখতে পাচ্ছিল। ওর শরীর বৃষ্টিতে ভেজা, নীলে নীল।

ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে সকলের বলা শেষ হল। তারপর শান্তনুর প্রস্তাবে সবাই মিলে গান ধরল : পুরানো সেই দিনের কথা…।

আদিত্য লক্ষ করল, সুব্রত ঠোঁট নাড়তে নাড়তে ওর কাছে এগিয়ে আসছে। ওর নীল গাল বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।

আদিত্যর খুব কাছে এসে দাঁড়াল সুব্রত।

গান শেষ হলে পর ঝুঁকে পড়ে আদিত্যর কানে কানে ফিশফিশ করে বলল, ফ্যানটাসটিক!

আদিত্যর কান্না পেয়ে গেল। এই টাইম-মেশিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে কিছুতেই ওর মন চাইছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *