পাখির রাজা

পাখির রাজা

লাল, নীল, হলদে, সবুজ, গোলাপি। নানারকম রঙের খেলা। রামধনুর সাত রঙের ছোট বড় টুকরোগুলো লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে খাঁচাগুলোর ভেতরে। সেই খাঁচা বাঁকে বেঁধে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে বুধন পাখিওলা। মুখে তার দেহাতি স্বরে সুরেলা ডাক, টিয়া, ময়না, বুলবুলি, বদ্রী, মুনিয়া পাখি চাই বাবু, পাখি রং-বেরঙের পাখি–

সকালের রোদ্দুর সবে দেখা দিয়েছে। শীতের কুয়াশা ভয়েভয়ে সরে পড়েছে চোখের আড়ালে। মফস্সল শহরে নতুন একটা দিনের শুরু হয়েছে। আর সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে বুধন পাখিওলার নতুন একটা দিন। কাঁচাপাকা এবড়োখেবড়ো নানান সড়ক ধরে শুরু হয়েছে তার পথ চলা।

অন্যদিন বাঁক কাঁধে নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বুধন যখন পথে নামে, তখন মনে থাকে অনেক চিন্তা। কটা পাখি বিক্রি হবে আজ। কটাকাতেই বা বিক্রি হবে। তারপর সেই টাকা কীভাবে খরচ করবে সে। দেশে মানি-অর্ডার করে তা কতটুকু বুধন পাঠাবে।

কিন্তু আজ তার মনে এসব চিন্তা নেই। বরং সে ভীষণ খুশি। কারণ গত পরশু ঠিক সন্ধের মুখে একটা দারুণ জিনিস পেয়ে গেছেন বুধন। কোনওদিন সে স্বপ্নেও ভাবেনি, এরকমভাবে তার কপাল খুলে যাবে।

এই শহরে সাত-সাতটা লম্বা বছর কেটে গেছে বুধনের। সেই কোন যুগে দেশ ছেড়ে এখানে পাড়ি জমিয়েছিল সে। প্রথমে মোট বওয়া শুরু করেছিল হাট-বাজারের এলাকায়। পরে তার পাখির নেশা লাগে। ঝোপে-জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে একটা-দুটো করে পাখি ধরতে শুরু করে সে। তারপর দেখতে দেখতে একদিন তার নাম হয়ে গেল বুধন পাখিওলা। সেই যে খাঁচাসমেত বাঁক একবার কাঁধে তুলে নিয়েছে, আর নামানোর ফুরসত পায়নি।

পাখিদের সঙ্গে থাকতে-থাকতে তাদের হাবভাব, চালচলন, কথাবার্তা, সবই যেন বুঝতে পারে বুধন। কখন ওদের খিদে পায়, কখন তেষ্টা পায়, কখন ঘুম পায়, সবকিছু বুধন পাখিওলার নখদর্পণে। সে থাকে আধা-শহরের এক প্রান্তে, দেহাতি মানুষদের বস্তিতে।

প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক থাকে এই বস্তিতে। যেন একটা একান্নবর্তী পরিবার। প্রত্যেকেই ওরা দেশছাড়া। এখানে খাটে, খায়, দেশে টাকা পাঠায়, আর মাঝে-মাঝে অক্ষর-পরিচয় আছে এমন কোন মুরুব্বিকে ধরে চিঠি লিখিয়ে নেয়। দেশ থেকে কোনও চিঠি এলে সেই এক ব্যাপার। মুরুব্বি এসে পড়ে দেয়। শেষ যে-চিঠিটা বুধন দেশ থেকে পেয়েছে, সেটা এসেছে তিনদিন আগে। আর বেশ খারাপ খবরই বয়ে নিয়ে এসেছে সেই চিঠি। তার একমাত্র ছেলে মুন্নার খুব অসুখ।

মুন্নার কথা খুব আবছাভাবে মনে পড়ে বুধন পাখিওলার।

সাত বছর আগে যখন সে মুলুক ছেড়ে আসে, তখন মুন্নার বয়েস মাত্র দেড় বছর। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সে তিন মাস পরপর টাকা পাঠায় বউয়ের কাছে, আর মুন্নার খবর নেয় চিঠিতে। উত্তরও আসে ঠিকমতো। বছরে-বছরে একটু-একটু করে বড় হচ্ছে মুন্না। বুধন কল্পনাতে দ্যাখে, ছোট্ট মুন্না হাঁটতে শিখেছে, দৌড়োতে শিখেছে। সে ছুটে-খেলে বেড়াচ্ছে ভুট্টা-জওয়ার-এর খেতে।

এই বছরেরই গোড়ার দিকে ইস্কুলে ভরতি হয়েছে মুন্না। খবরটা পেয়ে বুধনের খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু তিনদিন আগে পাওয়া চিঠিটায় খারাপ খবরটুকু পেয়ে সে ভীষণ মুষড়ে পড়েছে।

প্রথমটা সে বিশ্বাসই করতে চায়নি। মুরুব্বিকে বলেছে বারবার চিঠিটা পড়তে। কিন্তু তাতে খবরটা পালটায়নি। মুন্নার চিকিৎসার জন্য এখুনি বেশ কিছু টাকা পাঠানো দরকার।

এতগুলো বছর দেশছাড়া হয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে বুধনের। মাঝে-মাঝেই ইচ্ছে হয়েছে। দেশে পাড়ি জমাতে। কিন্তু অনেকগুলো টাকা গাড়িভাড়ার কথা ভেবে সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুন্নার ভালোর জন্যেই তো সে বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে জান দিয়ে খেটে চলেছে!

বুধন একবার ভাবল, দেশোয়ালি ভাইদের কাছে হাত পাতে। কিন্তু তাদের অবস্থাও তো বুধনের চেয়ে কিছু ভালো নয়। তারা বড় জোর দু-পাঁচ টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তাতে তো মুন্নার চিকিৎসার কোনও সুরাহা হবে না। সুতরাং আনমনাভাবে একটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে বুধন। সেদিন সে আর পাখি নিয়ে টহলে বেরোয়নি। তখন কি জানত সে, পরদিনই নেহাত কপালজোরে তার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

রোজকার মতো সেদিনও খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে বুধনের। ঘুম না ভেঙে উপায় নেই। কারণ, ভোরের আলো ফুটে ওঠামাত্রই কাপড়ে ঢাকা খাঁচার পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দে কলরোল জুড়ে দেয়। যেন বলতে চায়, ওঠো, বুধনভাই, আমাদের খেতে দাও। জল দাও। তারপর কাঁধে করে বেড়াতে নিয়ে চলো।

সুতরাং বুধন উঠে পড়ে। একটা ছোট্ট ঘরে তারা দুজন শোয়। সে এবং তার এক সঙ্গী শিবুয়া। শিবুয়া ফুচকা বিক্রি করে। ফলে তার ভোরে ওঠার দরকার হয় না। সে বেরোয় বিকেলে। সারাদিন ঘরে থেকে সেই দুজনের খানা পাকায়। বদলে বুধনের কাছ থেকে টুকিটাকি জিনিস উপহার পায়–তেল, সাবান ইত্যাদি।

ঘুম থেকে উঠে গায়ের ছেঁড়া কম্বলটা চাদরের মতো শরীরে জড়িয়ে নেয় বুধন। তারপর চটের বিছানাটা গোল করে গুটিয়ে তুলে রাখে ঘরের কোণে। শিবুয়া গুটিসুটি মেরে এখনও ঘুমে অচেতন। নিমের দাঁতন আর অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে আসে বুধন। এখানে ওখানে উনুনে আঁচ ধরানো হয়েছে। ঘন ধোঁয়া এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে আকাশে। কাছেই মিউনিসিপ্যালিটির কলে জল পড়ছে। সেখানে বস্তির অন্যান্য বাসিন্দার ভিড়। তারা হাত-মুখ ধুয়ে নিচ্ছে। কেউ বা স্নান সারতে এসেছে। কারও মুখে শোনা যায় ভোজপুরী গানের কলি। দাঁতন করতে করতে সেদিকে এগোয় বুধন।

হাত-মুখ ধুয়ে এসে বুধন পাখির খাঁচার ঢাকনা খুলল। পাখিরা ছটফট করতে লাগল চঞ্চল হয়ে। ওরা জানে, এখন খেতে দেওয়া হবে।

ছোলা, কাঙনিদানা, ছাতুর ডেলা, গুঁড়ো আটা, যার যা বরাদ্দ সবাইকে সেইমতো খেতে দিল বুধন। বাখারি দিয়ে খাঁচার তারে আটকানো ভাড়ে জলও ঢেলে দিল প্রয়োজন মতো। তারপর গতকালের একজোড়া বাসি রুটি দিয়ে নিজেও খাওয়া সেরে নিল। আর একজোড়া রুটি কোমরে গুঁজে নিল বেলায় খাবে বলে।

গায়ের কম্বল নামিয়ে রেখে দড়িতে ঝোলানো কালো রঙের ময়লা সোয়েটারটা টেনে নিল সে। গেঞ্জির ওপরে পরে নিল। তারপর একটা পাতলা লিনেনের চাদর তার ওপরে জড়িয়ে নিয়ে ঘরের কোণে দাঁড় করানো তামাটে রঙের বাঁকটা তুলে নিল। সেটাকে মাটিতে বার-দুয়েক ঠুকে এগিয়ে গেল খাঁচাগুলোর কাছে। পাখিরা তখন খাওয়াদাওয়া সেরে ভোরের গান ধরেছে। যেন সমস্বরে বলছে, বেড়াতে চলো, বুধনভাই, বেড়াতে চলো।

বাইরে এসে হিমে ভেজা পথ-চলতে শুরু করল বুধন। ভোরের কুয়াশার জন্য সূর্যের আলো এখনও তেমন তেজি হয়নি। দূর থেকে ভেসে এল কু-ঝিকঝিক ট্রেনের শব্দ। সঙ্গে তিরবেগে ছুটে চলা লোহার চাকার ঘটাং-ঘটাং আওয়াজ। সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতেই বুধন পাখিওলা সুর তুলে প্রথম হাঁক দিল, পাখি চাই বাবু, পাখি রংবেরঙের পাখি।

পাড়া-বেপাড়া ঘুরে এগিয়ে চলে বুধন। আজ একটা সবুজ টিয়া আর একজোড়া মুনিয়া বিক্রি করতে পেরেছে। এখানে বেশি দামের পাখি খুব একটা বিক্রি হতে চায় না। সেগুলো বিক্রি করার জন্য রয়েছে সাহেবপাড়া। ইস্টিশানের কাছে নতুন-নতুন সব বাড়ি উঠছে, কোয়ার্টার তৈরি হচ্ছে। সেখানে এসে বাসা বেঁধেছে বড়-বড় অফিসারের দল। তাদের কয়েকজনের তো আবার মোটরগাড়ি আছে। ময়না কিংবা বদ্রী বেশিরভাগ বিক্রি হয় ওই সাহেবপাড়াতেই। তবে সেখানে ছুটির দিন দেখে যেতে হয়। তখন বাবুরা সব বাড়িতে থাকেন। আজ ছুটির দিন নয়, তাই সাহেবপাড়ার দিকে আর যায়নি বুধন।

সূর্যের তাপ ক্রমে বাড়ছে। শীত কেটে গিয়ে এক অদ্ভুত আমেজ তৈরি হচ্ছে। বাঁক কাঁধে নিয়ে পায়ে-পায়ে প্রাইমারি স্কুলের কাছে পৌঁছে গেল বুধন। এখনও এগারোটা বাজেনি। ফলে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বাইরের মাঠে-সড়কে জটলা করছে, ছুটোছুটি করছে। এই সময়টাতে রোজ এখানে চলে আসে বুধন। একটা শিমুল গাছের নীচে বাঁক নামিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে বসে। শুকনো রুটি দুটো কোমরের গেঁজে থেকে বের করে ধীরে-ধীরে খেতে থাকে। প্রাণচঞ্চল প্রজাপতির মতো রংবেরঙের শীতের পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের দু-চোখ ভরে দ্যাখে। তার মনে পড়ে যায় মুন্নার কথা। আনমনা হয়ে ওদের কলরোল শোনে বুধন। সেই সঙ্গে খাঁচার পাখিদের কলরোলও তার কানে আসে। কয়েক টুকরো রুটি ছিঁড়ে সঙ্গে খাঁচার মধ্যে গুঁজে দেয়। পাখিরা ব্যস্তভাবে ঠোকরায় সেগুলো।

কাছাকাছি টিউবওয়েল থেকে জল খেয়ে ফিরে আসে বুধন। দেখে ইতিমধ্যেই বাচ্চারা তার খাঁচা ঘিরে ভিড় করে ফেলেছে। রোজই ওরা স্কুলের ঘণ্টা বাজার আগে এইভাবে পাখির খাঁচাগুলো ছেকে ধরে। পাখিদের সঙ্গে কথা বলে, খেলা করে, কেউ বা খোঁচায়। বুধন গিয়ে বসে খাঁচার পাশটিতে।

ও পাখিওলা, পাখিওলা, এই পাখিটার নাম কী?

ছেলেটির মুখের দিকে তাকায় বুধন। মাজা রং, গোলগাল চেহারা, মুখটা ভারি মিষ্টি। বয়েস কতই বা হবে! আট কি নয়। গায়ে লাল কালো উলের সোয়েটার। মাথার চুল কপালে নেমে এসেছে।

মুন্নার কথা আবার মনে পড়ে বুধনের। এখন দেখতে কীরকম হয়েছে ও? এইরকম কি?

বুধন ছেলেটিকে জিগ্যেস করে, কোন পাখিটা, খোকাবাবু?

এই যে, এইটা। ঘাড় গুঁজে বসে আছে। একদম খাচ্ছে না। আঙুল দিয়ে একটা ফুলটুসি পাখিকে দেখায় ছেলেটি। বুধন সেটার নাম দিয়েছে বড়াসাব। কারণ, পাখিটা সারাদিন আপনমনে বসে থাকে। শুধু খাওয়ার সময় নড়াচড়া করে জায়গা ছেড়ে।

এটা খুব রাশভারী পাখি, খোকাবাবু। কারও সঙ্গে কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। ওর নাম বড়াসাব।

বুধনের কথায় খিলখিল করে হেসে ওঠে ছেলেমেয়ের দল। ঈশ্বর যেন জলতরঙ্গ বাজাচ্ছেন। বুধন মুগ্ধ হয়ে শোনে। একটি মেয়ে বলে ওঠে, তোমার সব পাখির নাম আছে?

হ্যাঁ, দিদিমণি, ঠিক তোমাদের মতো। এটার নাম ঘুরঘুটিয়া, এটার নাম খিলাড়ি, এই পাখিটার নাম শরবতী– একে-একে পাখিগুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখায় বুধন। তার কথায় হইহই করে হাসির রোল পড়ে যায়। ওরা নামগুলো আওড়ে ডাকাডাকি করতে থাকে পাখিগুলোকে। বুধন লাল সোয়েটার পরা ছেলেটিকে দেখতে থাকে। খুশিতে মুখ-চোখ যেন টগবগ করছে।

এমন সময় স্কুল বসার ঘণ্টা বাজল। ছেলেমেয়েরা সঙ্গে-সঙ্গে ছুটল স্কুলের দিকে। যেন বসন্তের অস্থির বাতাস। ওরা চলে গেলে বুধন পাখিওলা একা পড়ে রইল। তার পাখি তখন অল্প-স্বল্প ডাকছে।

ফাঁকা জায়গাটার চারপাশে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিল বুধন। বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বাঁক কাঁধে তুলে আবার সে রওনা হল। মুন্নার অসুখ সারবে কী করে সে-কথাই শুধু ভাবতে লাগল।

বিকেল-বিকেল সময়েই ঘটনাটা ঘটল।

কোনও চিঠিপত্র এসেছে কি না সে-খোঁজ নিতে পোস্ট অফিসের দিকে গিয়েছিল বুধন।, নতুন কোনও চিঠি আসেনি। তাই স্টেশনের লাগোয়া সরু পথ ধরে তখনই সে ফিরে আসছিল।

কাঁচা সড়ক। দু-পাশে আকন্দ, ধুতরো আর ভেরেণ্ডা গাছের ঝোঁপ।

হঠাৎই আনমনা বুধনের কানে এল একটা মিষ্টি টুই-টুই শব্দ।

পাখির ডাক! ভীষণ সুরেলা এবং মিষ্টি।

কী পাখি এটা! থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বুধন। অতি সাবধানে চারপাশে তাকাল। পাখি ধরা তার অনেকদিনের অভ্যেসলাঠির মাথায় শিরীষের আঠা মাখিয়ে বা অন্যভাবে ফাঁদ পেতে। কিন্তু এখন, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায়, সে কি পারবে এই লুকোনো পাখিটাকে বন্দি করতে?

তীক্ষ্ণ নজর চালিয়ে পাখিটাকে একসময় আবিষ্কার করল বুধন পাখিওলা।

টুকটুকে গোলাপি তার গায়ের রং। ডানায় ফিকে রঙের দাগ। মাপে চড়ুই পাখির চেয়ে একটু বড়। ছোট্ট কোনাচে ঠোঁট। জলপাই সবুজ ও বাদামি রঙে মেশানো লেজটা দু-ভাগে ভাগ সরেলা শিস সেবটা খুলে ফেলতে সময় নিয়ে নিন করা। ছটফটে পাখিটা একটা বুনো ফুলে মুখ ডুবিয়ে মধু খাচ্ছে। আর থেকে-থেকেই টুই-টুই করে সুরেলা শিস দেওয়ার ভঙ্গিতে ডাকছে। যেন প্রশ্ন করার সুরে বলছে, তুই? তুই?

গায়ের চাদরটা খুলে ফেলল বুধন। তারপর আড়ালে-আড়ালে পা টিপে টিপে বিভোর পাখিটার খুব কাছে পৌঁছে গেল। এক মুহূর্ত সময় নিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিল। তারপর চাদর বাগিয়ে ধরেই ঝপাৎ। চাদরের ফঁদে ধরা পড়ল নাম-না-জানা অচিন পাখি। বুধনের বুকটা আনন্দে নেচে উঠল। না জানি কত দামে বিক্রি হবে এই পাখি। সে মনে-মনে বলে উঠেছে, রাজা পাখি, তুই আমার মুন্নাকে বাঁচাবি।

চাদরে বন্দি পাখিটাকে বুকে করে ঘরে নিয়ে এসেছে বুধন। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে।

এ-সবই গত পরশুর ঘটনা।

তারপর নতুন পাখিটাকে আলাদা একটা খাঁচায় রেখেছে সে। খেতেও দিয়েছে। অন্য পাখিগুলো নতুন পাখিটাকে ঘিরে জটলা করে শুরু করে দিয়েছে কিচিরমিচির। কিন্তু নতুন পাখিটা একেবারে চুপচাপ। মাঝে-মাঝে শুধু ডানা ঝাঁপটে উড়ে বেড়াচ্ছে খাঁচার ভেতরে। এরকম প্রথম-প্রথম হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। বুধন তা ভালো করেই জানে।

কিন্তু সেদিন রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সেই ঘটনায় রীতিমতো অবাক হয়ে গেল সে। কারণ সাত বছরের পাখি-বেচার জীবনে এরকমটা কখনও বুধন দেখেনি।

রাত তখন কত হবে? বারোটা, একটা, না দুটো, তা বুধন বলতে পারবে না। তবে এটুকু জানে, পাখিদের খেতে দিয়ে, খাঁচা ঢাকা দিয়ে, লণ্ঠন নিভিয়ে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল অদ্ভুত সুরেলা শিসের শব্দে। রাজা পাখি রাত্তিরে শিস দিয়ে ডাকছে। কান খাড়া করে শুয়ে রইল বুধন। অদ্ভুত মিষ্টি ডাক।

তার একটু পরেই ঘটে গেল আরও অবাক করা ঘটনা। অন্য পাখিগুলোও একে-একে ডাকতে শুরু করল। রাজা পাখির ডাকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওরা ডাকছে। এদের মুখে এত মিষ্টি ডাক বুধন কখনও শোনেনি। সে যেন স্বপ্নের মধ্যে চলে গেছে স্বর্গের কোনও বাগিচায়। সেখানে লাল নীল-হলদে-সবুজ পাখিরা সব ডাকছে। এক অপূর্ব খুশিতে বুধনের মনটা ভরে উঠল। ওদের ডাক শুনতে-শুনতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালেও তার ঘুম ভেঙেছে সেই রাজা পাখির ডাকে।

ওদের খাবার দিতে গিয়ে কেমন একটা খুশি-খুশি ভাব লক্ষ করল বুধন। এই একটা নাম না-জানা পাখি যেন সবাইকে খুশিতে মাতিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বুধনের খুশির আকাশে মুন্নার অসুখের খবরটা যেন দুঃখের কালো মেঘের মতো জমাট বেঁধে রয়েছে।

রোজকার মতো ওদের খাঁচা বাঁকে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল বুধন। ভগবান যেন তার বেশ কয়েকটা পাখি আজ বিক্রি করিয়ে দেন। কিন্তু রাজা পাখিকে যদি কেউ কিনতে চায়? কত দাম চাইবে বুধন? দশ-কুড়ি, না পঞ্চাশ টাকা?

বেলায় যখন স্কুলের সামনে সে হাজির হল তখন সত্যিই সাড়া পড়ে গেল রাজা পাখিকে ঘিরে।

ছেলেমেয়েরা মুখ দিয়ে নানান শব্দ করছে, আর পাখিগুলোও যেন সাড়া দিচ্ছে সেই তালে। টুই-টুই ডাকে মধু ছড়িয়ে রাজা পাখি নাচছে তারের দোলনায়।

এই নতুন পাখিটার নাম কী গো পাখিওলা? গোলগাল মিষ্টি ছেলেটি খাঁচার ওপর ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইল।

আসল নাম তো জানি না, খোকাবাবু। তবে আমি ওর নাম দিয়েছি রাজা পাখি।

ব্যস, নাম শুনেই ওদের মধ্যে হুল্লোড় পড়ে গেল।

কী মজা, পাখির রাজা! কী মজা, পাখির রাজা! ওরা সমস্বরে ছড়া কেটে বলতে লাগল। কেউ-কেউ আবার হাততালিও দিচ্ছে।

বাচ্ছা ছেলেটি বুধনকে লক্ষ করে বলল, তোমার রাজা পাখি কী সুন্দর!

এ খুব মাহাঙ্গী পাখি, খুকি। অনেক দাম এর।

একসময় স্কুলের ঘণ্টা পড়ে। ছেলেমেয়েদের ভিড় কঁকা হয়ে যায়। বুধন আবার পথ চলতে শুরু করে।

আজও যখন পাখি নিয়ে ইস্কুলে সে পৌঁছোল তখন গতকালের মতোই হল্লোড় পড়ে গেল রাজা পাখিকে নিয়ে। কত আবদার, কত প্রশ্ন, কত খেলা! বুধনের খুব ভালো লাগে ওদের এই চপলতা। যেন এক ঝাঁক রং-বেরঙের পাখি।

আবার রাতে ঘরে ফিরেও সেই একই ব্যাপার। মাঝরাতে রাজা পাখির সুরেলা শিস, আর তাকে অনুসরণ করে অন্য পাখিগুলোর মিষ্টি গান। আবার ভোরবেলা শুরু হয় ওদের সূর্যস্তবের মন্ত্র। বুধন যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে ওদের আশ্চর্য ভাষা।

এইভাবে দিন কাটছিল বুধন পাখিওলার। কিন্তু একদিন বিক্রি হয়ে গেল রাজা পাখি।

দিনটা ছিল রবিবার। ছুটির দিন। তাই পাখি নিয়ে সাহেবপাড়ায় টহল দিতে বেরিয়েছিল বুধন। তখন সবে সকালের শুরু।

 কোয়ার্টারগুলোর পাশ দিয়ে হাঁক পেড়ে সে এগিয়ে চলেছে, পাখি চাই, বাবু, পাখি–লাল নীল হরেক রঙের পাখি।

হঠাৎই একটা বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে একটা ছোট মেয়ে ডাকল তাকে, এই পাখিওলা, ওপরে এসো।

সবুজ রঙের ছিটকাপড়ের ফ্রক পরা বছর দশেকের একটি মেয়ে। লাল ফিতে বাঁধা ছোট্ট বিনুনি দুটো কানের পাশ দিয়ে ঝুলে রয়েছে নীচের দিকে। মেয়েটি রেলিং-এ ঝুঁকে পড়ে বুধনকে ডাকছে।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলার উঠে গেল বুধন। ওদের দরজার সামনে খাঁচাগুলো নামিয়ে বসল মেঝেতে। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। দরজায় ডোরাকাটা স্লিপিং স্যুট পরা এক ভদ্রলোক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কাঁচাপাকা চুল, ফরসা চেহারা। তাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে বারান্দায় দেখা ছোট্ট মেয়েটি। সে হাত-পা নেড়ে বুধনকে সব পাখির দাম জিগ্যেস করতে লাগল।

মেয়েটির কথার উত্তর দিলেও বুধনের চোখ কিন্তু ভদ্রলোকের দিকে। কারণ তিনি তখন একদৃষ্টে রাজা পাখিকে দেখছেন।

হঠাৎই তিনি বুধনকে জিগ্যেস করলেন, এ-পাখি তুমি কোথায় পেলে?

 থতোমতো খেয়ে গেলেও বুধন বলল, ইস্টিশানের কাছে ঝোঁপ থেকে ধরেছি বাবু।

ভদ্রলোক মেয়েটিকে লক্ষ করে বললেন, টুনি, এই পাখিটা নাও। এ-পাখি চট করে পাওয়া যায় না। এগুলো কাশ্মীর আর পশ্চিম হিমালয়ে পাওয়া যায়। শীতকালে যাযাবর পাখি হয়ে নীচে নেমে আসে। খুব মিষ্টি গান গায় এরা।

ভদ্রলোকের কথার প্রমাণ দিতেই যেন রাজা পাখি মিহি সুরেলা কণ্ঠে বারকয়েক ডেকে উঠল।

বুধনের বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে চলেছে। ইশ, যদি সত্যি পাখিটা ওরা কিনে নেয়, তা হলে বড় ভালো হয়। কিন্তু কত দাম চাইবে বুধন?

পাখিটার নাম কী, বাবা? মেয়েটি জানতে চাইল কৌতূহলী গলায়।

লালটুটি। কেউ কেউ শুধু টুটিও বলে। তারপর বুধনকে লক্ষ করে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, কত দাম পাখিটার?

তিরিশ টাকা বলবে? নাকি চল্লিশ? মুন্নার অসুখের কথাটা মনে পড়তেই বুধনের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, পঞ্চাশ টাকা।

দামটা কি বেশি বলা হয়ে গেল?

কিন্তু বুধনকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে, তবে খাঁচাসমেত দিতে হবে। টুনি, যাও, মায়ের কাছ থেকে পঞ্চাশটা টাকা চেয়ে নিয়ে এসো।

মেয়েটি চলে গেল। তবে একটু পরেই ফিরে এল। হাতে চকচকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট। সেটা দেখে খুশিতে বুধনের বুকের ভেতরটা যেন নাচছে।

রাজা পাখিকে খাঁচাসমেত ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিল বুধন। তারপর পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিয়ে কোমরে গুঁজল। সেলাম জানিয়ে অন্য খাঁচাগুলো বাঁকে ঝুলিয়ে সে নামতে লাগল নীচে। তার পা দুটো যেন তাড়াতাড়ি চলার জন্য ছটফট করছে। কতক্ষণে টাকাটা সে মানি-অর্ডার করবে দেশে। তা ছাড়া দেরি করলে যদি সাহেব-বাবুর মত পালটে যায়? যদি পাখি ফেরত দিয়ে ফেরত চান টাকাটা? সুতরাং, রাস্তায় এসে বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটা দিল বুধন। আজ আর টহল দেওয়ার দরকার নেই। রাজা পাখি বেচে সে রাজা-টাকা পেয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করার জন্য হয়তো খেয়াল করল না, খাঁচার অন্য পাখিগুলো হঠাৎই যেন একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে।

সেদিন রাতে ঘুম ভেঙে অন্ধকারে চোখ মেলে উত্তর্ণ হয়ে রয়েছে সে। আশ্চর্য! চারদিকে নিঝুম। থমথমে। একটা পাখিও ডাকছে না। কোথায় গেল ওদের কিচিরমিচির কলতান! অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে এক সময় সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন ভোর হল রোজকার মতো। সূর্যও উঠল। কিন্তু রোজকার মতো পাখিরা আর ডাকল না। ফলে বেশ বেলাতেই বুধনের ঘুম ভাঙল। পাখিদের সে খেতে দিল, কিন্তু ওদের কাছ থেকে বিশেষ সাড়া পাওয়া গেল না। খাবার নিয়ে রোজকার মতো আর কাড়াকাড়ি করল না ওরা।

বুধন ঠিক করল, পাখি নিয়ে ফেরি করার টহল সেরে দুপুরে টাকাটা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পোস্ট-অফিসে যাবে। শিবুয়াকে সেইরকম বলে বেরিয়ে পড়ল সে।

এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেলাবেলি আবার সেই প্রাইমারি স্কুলের সামনে। রোজকার মতো হইচই করে ছুটে এল কচি ছেলেমেয়ের দল। কিন্তু খাঁচাগুলোর কাছে এসেই ওরা থমকে দাঁড়াল। যেন একটা ধাক্কা খেয়েছে।

রাজা পাখি কোথায় গেল?

 ছোট্ট ছেলেটির প্রশ্ন যেন বুধনের দিকে আঙুল তুলে অভিযোগ করল।

ওদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, রাজা পাখি নেই, রাজা পাখি নেই। তারপর ওরা একই প্রশ্নে বুধনকে ছেকে ধরল, রাজা পাখি কোথায় গেল?

কেন যেন নিজেকে অপরাধীর মতো মনে হতে লাগল বুধনের। সে ছোট্ট করে জবাব দিল, রাজা পাখি বিক্রি হয়ে গেছে গো। পঞ্চাশ টাকায়।

পঞ্চাশ টাকায় কথাটা যতটা গর্বের সঙ্গে বলা উচিত ছিল ততটা গর্বের সঙ্গে বলতে পারল না বুধন। সে দেখল, লাল কালো সোয়েটার পরা গোলগাল মিষ্টি ছেলেটি মনমরা হয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। সে হঠাৎ বুধনকে লক্ষ করে অভিমানী গলায় বলে ওঠে, তুমি বাজে পাখিওলা। রাজা পাখি বিক্রি করে দেয়!

অন্য সবাই যেন মনের কথাটি খুঁজে পেয়ে সুর মেলায়, বাজে পাখিওলা! তোমার সব পাখি বাজে!

তারপর স্কুলের ঘণ্টা না-পড়তেই ওরা সবাই ছুটে চলে যায় বুধনকে ফেলে। রংবেরঙের অন্য পাখিগুলো ওদের যেন ধরে রাখতে পারে না।

ধীরে-ধীরে উঠে পড়ে বুধন। খাঁচাসমেত বাঁক কাঁধে তুলে নেয়। শরীরে এক অদ্ভুত ক্লান্তি। পাখিগুলোও সব চুপচাপ। দু-একবার শিস দিয়ে সে ওদের খুশি করার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনও লাভ হল না। কেউ যেন বাণ মেরে ওদের বোবা করে দিয়েছে।

ক্লান্ত পায়ে বুধন ফিরে চলে ঘরের পথে। তার মনে তখনও অভিমানী ছেলেটির মুখ ভাসছে আর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার অভিযোগ, তুমি বাজে পাখিওলা! রাজা পাখি বিক্রি করে দেয়।

নানান দোটানায় বুধন পাখিওলার দুপুরটা কেটে গেল। পঞ্চাশ টাকার নোটটা এখনও তার কোমরে খচখচ করছে। মুন্নার অসুখ কি এখন বেড়েছে না কমেছে?

ডাগদারসাব পারবে তো এ-অসুখ সারিয়ে তুলতে? এত চিন্তা সত্ত্বেও টাকাটা সে মানি-অর্ডার করতে পারেনি। কোথায় যেন একটা বাধা পেয়েছে।

এইরকম ভাবনায়-ভাবনায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়। সন্ধে গড়িয়ে রাত। পাখিগুলোকে খেতে দিয়েছে বুধন, কিন্তু ওরা খায়নি। সেই সকালের খাবারই জমিয়ে রেখেছে। খাঁচার ওপরে কাপড় ঢাকা দিয়ে লণ্ঠন নিভিয়ে দিল বুধন। শুয়ে পড়ল। কিন্তু সহজে তার ঘুম এল না।

সারাটা রাত ছটফট করে জেগে কাটাল বুধন। তারপর ভোরের আলো ফাঁক-ফোকর দিয়ে নজরে পড়তেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। সোয়েটার পরে চাদর মুড়ি দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে এল রাস্তায়। তারপর হনহন করে হাঁটা দিল সাহেবপাড়ার দিকে। একবার শুধু কোমরের গেজেটা অনুভব করে দেখল।

সেই বাড়ির দোতলায় উঠে যখন সে কড়া নাড়ল তখন লাল থালার মতো সূর্য উঁকি দিয়েছে। দিগন্তে। ঘুমচোখে দরজা খুল তাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন কাঁচাপাকা চুলওলা সেই ফরসা ভদ্রলোক। এখন তার চোখে চশমা নেই। তার ঠিক পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছেন ফরসা মোটাসোটা এক মহিলা। সম্ভবত ভদ্রলোকের স্ত্রী। বাচ্চা মেয়েটি নিশ্চয়ই এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।

কী ব্যাপার, কী চাই?

রুক্ষ প্রশ্নটা শুনেই বুধন বুঝল, ভদ্রলোক তাকে চিনতে পারেননি। সে তাড়াতাড়ি বলল, আমি সেই পাখিওলা, বাবু।

ভদ্রলোক এবার চিনতে পারলেন বুধনকে। বললেন, তা এই সাত-সক্কালে কী চাই তোমার?

কোমর হাতড়ে লুঙির ভাঁজ খুলে পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করল বুধন। ভদ্রলোকের দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে কঁপা গলায় বলে উঠল, আমার রাজা পাখিকে ফিরিয়ে দিন আমার রাজা পাখিকে ফিরিয়ে দিন, বাবু।

টাকাটা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন বুধনের দিকে। যেন এই আকুলভাবে চেয়ে থাকা দেহাতি পাখিওলাটাকে বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর পিছন ফিরে স্ত্রীকে বললেন, পাখিটা এনে দাও।

একটু পরেই খাঁচাসমেত রাজা পাখিকে হাতে পেল বুধন। তাকে দেখে রাজা পাখি শিস দিচ্ছে, টুই-টুই।

ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রীকে অনর্থক বারবার সেলাম করল বুধন। তারা তখনও অবুঝ চোখে বুধনের দিকে তাকিয়ে।

খুশিতে ডগমগ পায়ে সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নেমে এল বুধন পাখিওলা। রাজা পাখি এখনও সুরেলা গান গেয়ে চলেছে। সকালের সোনালি রোদে কেটে যাচ্ছে ভোরের কুয়াশা। বুধন যেন স্পষ্ট দেখতে পেল, তার সাধের মুন্না সোনালি ধানখেতে ছুটোছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে। ওর অসুখ আর নেই। একেবারে সেরে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *