নীল আলো ভালো নয়

নীল আলো ভালো নয়

বুঝলে? বলেই সামনে রাখা প্লেটের দিকে হাত বাড়াল বিনু। দুটো পেঁয়াজের পকোড়া টুক করে তুলে মুখের ভেতর ছুঁড়ে দিল।

ওর কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ আবার কোন দেশি কথা? নীল আলো ভালো নয় মানে?

সে-কথাই জিগ্যেস করলাম বিনুকে।

তাতে ও শব্দ করে হাসল। তারপর বড়া চিবোতে-চিবোতে জড়ানো গলায় বলল, এক এক রঙের আলোর এক-একরকম গুণ আছে কিংবা দোষও বলতে পারো। যেমন, নীল আলো। এই আলোটার ইয়ে…মানে, দোষ আছে।

 আমি মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সত্যি, বিনু পারেও বটে! এরকম একটা জমাটি আড্ডার মাঝে সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্যে ও দেখছি একটা নতুন ধাঁচের মতলব ফেঁদেছে।

বিনু বিনোদন অধিকারী আমার স্কুলের বন্ধু। স্কুলের পর কলেজ পেরিয়ে ও কলকাতা ছেড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ওর কাছেই শুনেছিলাম, ও নাকি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি নিয়েছে। ভারতের নানান বনাঞ্চলে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবার হাফলঙে ওর কাছে আমি বেড়াতেও গিয়েছিলাম।

শ্রীবিনোদন অধিকারীর গোটা ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যময়। ও যে কখন কোথায় ঘুরে বেড়ায়, চাকরি রেখেছে না ছেড়েছে, সত্যি-সত্যি বিয়ে করেছে না করেনি–এসব কিছুই আমি ভালো করে জানি না।

তার কারণ, ও যখন যা বলে সবটাই আমি-আমি করে বলে–যেন সবই ওর জীবনের ঘটনা। তারপর, বলা হয়ে গেলে, আবার বলে, এগুলো আমার লাইফের ঘটনা যদি নাও হয়, অন্য কারও তো হতে পারে! আর সত্যি-সত্যি যদি এগুলো নাও ঘটে থাকে তবু ঘটতে কতক্ষণ!

এই হচ্ছে বিনু। ও কখনও ওর বউ এর গল্প শোনায়, কখনও ওর খুন করার গল্প, কখনও আবার ওর জীবনের অলৌকিক ঘটনার কথা শোনায়। হয়তো আসলে সবগুলোই ওর বানানো ঘটনা। কিন্তু সেসব বোঝার উপায় নেই। গল্প শোনাতে-শোনাতে ও সবকিছু কেমন গুলিয়ে দেয়।

আর ও গল্পও বলে ভারী অদ্ভুত ধরনের। হয়তো বলল, শোন, তোদের আজ একটা বাঘের গল্প শোনাব কিন্তু সে-গল্পে কোনও বাঘ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বাঘের হিংস্রতা থাকবে, মানুষখেকো বাঘের চালাকি থাকবে, কিংবা নৃশংস ঘটনা থাকবে।

বিনুর কাছে এরকম সাপের গল্পও আমি শুনেছি। তাতে কিন্তু সাপ ছিল–আর সাপের মতো ছোবল মারার ঘটনা ছিল, বিষও ছিল।

আজ বিনু হঠাৎ বলেছে, তোমাদের আজ আলোর গল্প শোনাব।

ওর গল্প শোনার জন্যে আমি সবসময় মুখিয়ে থাকি। বেশিরভাগ সময় ও অন্ধকারের গল্পই শোনায়। তো আজ হঠাৎ আলো কেন?

বিনু সবসময় উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়। আমি ওর বহু পুরোনো বন্ধু হলেও ওর সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানি। ও ভারতের যে-প্রান্তেই থাকুক, মাঝে-মাঝে চিঠি দেয় আমাকে। কখনও কখনও ফোনও করে। তখন যেসব জায়গায় নাম চিঠিতে দেখি বা টেলিফোনে শুনি সেগুলো এতই বিচিত্র যে, এ নামে কোনও জায়গা থাকতে পারে কখনও ভাবিনি।

কদিন আগেই বিনু ফোন করেছিল। বলেছিল, শুক্রবার দিন কলকাতা পৌঁছব। পরদিনই ট্রেন ধরে আবার পালাব। রাতটা তোমাদের কাছে থাকব। কোনও অসুবিধে নেই তো?

অসুবিধে! আমার এই পায়ে সরষে এবং হাতে ডানা লাগানো বন্ধুটিকে তো কাছে পাওয়াই ভার! তার ওপর ওর গল্প কিংবা সত্যি ঘটনা শোনার এ-সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়!

ওকে বললাম, কেয়া বাপের বাড়ি গেছে। বাড়ি ফাঁকা। সুতরাং কোনও প্রবলেম নেই।

তবে একটা অসুবিধে ছিল। শুক্রবার সন্ধেটা আমার নিরুপমদের বাড়ি যাওয়ার কথা। সেদিন ওদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। সেখানে আরও দুজন বন্ধু আসবে। আচ্ছা এবং খাওয়াদাওয়া হবে। সন্ধে থেকেই। সুতরাং ফিরতে তো বেশ রাত হয়ে যাবে!

সেটা শুনে বিনুই সমাধান জোগাল। বলল, দ্যাখো, ভাই। পাক্কা একটি বছর পর কলকাতায় ফিরছি। সুতরাং তোমাকে ছাড়ার কোনও ব্যাপার নেই। আমি তোমার গেস্ট হয়ে ওই নিরুপমবাবুদের বাড়ি যাব–তুমি একটু ম্যানেজ করে নিয়ো।

বিনু এইরকমই–স্ট্রেটকাট। সামাজিকতার সংকোচের ধার ধারে না। ফলে আমার সঙ্গে অতিথি হয়ে ও সরাসরি হাজির হয়ে গেছে নিরুপমদের বাড়িতে।

কদিন ধরেই নিম্নচাপের বৃষ্টি চলছিল। ভিজে শাড়ি মেলে দিলে যেমন টপটপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ে অনেকটা সেইরকম। আকাশ আর বৃষ্টির হালচাল দেখে মনে হচ্ছিল না দিন সাতেকের আগে থামার কোনও সিন আছে। আজ সকাল থেকে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আর এখন, নিরুপমদের বাড়িতে বসে, দিব্যি ঝমঝম শুনতে পাচ্ছি।

নিরুপমের বাড়িতে আমাদের আরও দুজন বন্ধু রণজিৎ আর প্রেমতোষ এসেছে সঙ্গে ওদের বউ রুনি আর মানিনী। বিনুর সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দিয়েছি। ও খুব সহজেই আমাদের মধ্যে মিশে গেল। খাওয়াদাওয়া আর জমাটি আড্ডার দিব্যি সময় কাটতে লাগল।

নিরুপমদের বাড়িটা মাপে বড় কিন্তু বয়েসের ভারে কাবু হয়ে পড়েছে। বাড়ির ভেতরে ছড়ানো উঠোন, আর তার সঙ্গে একচিলতে বাগানও রয়েছে। এতবড় বাড়িটায় নিরুপম ওর বউ সরস্বতীকে নিয়ে একা থাকে। আমি হলে বেশ গা-ছমছম করত।

বিনু সে কথা সরস্বতীকে বলল, ম্যাডাম, নিরুপমবাবু অফিসে বেরিয়ে গেলে আপনার একা একা থাকতে ভয় করে না?

সরস্বতী চোখ কপালে তুলে জবাব দিল, একা কোথায় থাকি? সঙ্গে তিন ডজন গোলাপায়রা আছে না!

একথায় আমরা দলবেঁধে হেসে উঠলাম। সত্যি, নিরুপমদের বাড়িতে কিছু গোলাপায়রা আছে বটে!

এরপর সরস্বতী আমাদের বোঝাতে লাগল, নির্জন বাড়িতে থাকার কী কী সুবিধে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, লাগাতার হানিমুন এনজয় করা যায়। এবং নির্জনতার সুযোগে নিরুপম ওর সঙ্গে কী কী ধরনের কেলেঙ্কারি করে বেড়ায় সেসব রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগল।

নিরুপম একবার মিনমিন করে বলল, মাইরি, আমার বউটার সব ভালো–শুধু একটু নির্লজ্জ টাইপের।

সঙ্গে-সঙ্গে সরস্বতী স্বামীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, আর নিজে কী!

ওদের সবে তিনবছর বিয়ে হয়েছে। সেই তুলনায় আমি, রণজিৎ আর প্রেমতোষ বেশ পুরোনো।

রণজিৎ হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি খুব লাকি, নিরুপম, যে একটা নির্লজ্জ বউ পেয়েছ। আমারটা ভাই বড় বেশি লজ্জাবতী।

ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে বর-বউদের হুলুস্থুল লেগে গেল। হইহুল্লোড়ের মধ্যে আড্ডা সরগরম হয়ে উঠল।

সরস্বতী আড্ডার ফাঁকে-ফাঁকে আমাদের সেবা করতে লাগল। ওর সঙ্গে হাত লাগাল রুনি আর মানিনী। কেয়া থাকলে আর-একটু সুবিধে হত।

সরস্বতী স্কুলের মেয়ের মতো টগবগ করে রান্নাঘর আর বসবার ঘরের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছিল আর একইসঙ্গে নানান কথার খই ফোঁটাচ্ছিল।

প্রেমতোষ বেশ মোটাসোটা গম্ভীর মানুষ। ও হাত মুঠো করে সিগারেট পাকড়ে ধরে তাতে কড়া টান দিচ্ছিল। হঠাৎ ও বলে উঠল, নাও নিরুভাই, আর দেরি কোরো না–দোকান খোলো। একটু পেট্রল না নিলে গাড়ি তো ভাই আর চলছে না!

মানিনী বেশ খাটো চেহারার। ফরসা সুন্দর গোলগাল মুখ। চোখে চশমা। স্বামীর কথায় চোখ ঘুরিয়ে বলল, ওর এই এক বদ নেশা। মদ না পেলে চলে না।

সেইজন্যেই তো আমার ডাকনাম মদ-অন, মানে মদন। আর যারা মদ দেখলেই না, না বলে তাদের ডাকনাম মদ-না। বলে প্রেমতোষ গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

হেসে উঠলাম আমরাও।

নিরুপম আর সরস্বতী মিলে টেবিলে পেঁয়াজের পকোড়া, বোতল, গ্লাস, ঠান্ডা জল–সব সাজিয়ে দিতে লাগল।

প্রেমতোষ তখন ধোঁয়া ছাড়ছে আর গুনগুন করে গাইছে, ইয়ে লাল রঙ্গ কব মুঝে ছোড়েগা–।

হঠাৎই ডানা ঝটপটিয়ে একটা গোলাপায়রা ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে।

রুনি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আমি আর রণজিৎ চেয়ার ছেড়ে চট করে উঠে পড়লাম। নিরুপম বোতল আর গ্লাসগুলো সামলাতে লাগল।

পায়রাটা ঘরের মধ্যে ডানা ঝাঁপটে এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছিল। ওটার ভেজা ডানা থেকে জল ছিটকে পড়ছিল চারিদিকে।

আমরা তাড়াহুড়ো করে ঘরের এক কোণে সরে গেলাম। শুধু বিনু আর নিরুপম জায়গা ছেড়ে উঠল না। রুনি আর মানিনী দূর থেকেই হুস-হুঁস শব্দ করে পায়রাটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল।

কয়েক পাক এলোমেলো ওড়ার পর পায়রাটা রান্নাঘরের কাছে ফ্রিজের ওপরে গিয়ে বসে পড়ল। তখন ভালো করে খেয়াল করলাম, ওটার সারা গা বৃষ্টিতে ভেজা। পালক থেকে জল ঝরছে। বেশ হাঁপাচ্ছে।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সরস্বতী বেরিয়ে এসেছিল রান্নাঘর থেকে। ও খপ করে পায়রাটাকে ধরে ফেলল। ওটার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, বোধহয় বেড়ালে তাড়া করেছে। যাই, ওকে উঠোনের খোপে রেখে আসি।

প্রেমতোষ বলল, ভাগ্যিস শালা টেবিলটার ওপরে এসে পড়েনি! সব ভেঙেচুরে কেলো হয়ে যেত!

মানিনী বলল, হুঃ! যে আছে যার চিন্তায়। ফ্যানে ঠোক্কর খেলে পায়রাটা মরেই যেত।

রণজিৎ ফিরে এসে সোফায় বসতে-বসতে বলল, আসলে টিউব লাইটের আলোর বেচারার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।

ঠিক তখনই বিনু মন্তব্য করল, এক-একরকম আলোর এক একরকম এফেক্ট আছে।

ব্যস, আমি গল্পের গন্ধ পেয়ে গেলাম। সঙ্গে-সঙ্গে চেপে ধরলাম বিনুকে–উসকেও দিলাম।

ততক্ষণে আমাদের পানাহার শুরু হয়ে গেছে। মেয়েরা পেঁয়াজের পকোড়া আর চা। আর আমরা চা-এর বদলে প্রেমতোষের ভাষায় পেট্রল।

প্রেমতোষের একটা অভ্যেস হল, মদ খাওয়া শুরু করলেই ও সবাইকে ব্রাদার বলে ডাকে। সুতরাং আমার ওসকানির পর ও বিনুকে একরকম বায়না করেই চেপে ধরল : আর-একটু খুলে বলুন, ব্রাদার, কেসটা কী। বেশ ধীরে-ধীরে রসিয়ে রসিয়ে খুলুন, ব্রাদার–তা হলে হেভি জমবে।

বিনু গ্লাসে চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকাল। চাপা দুষ্টুমির হাসি হেসে যেন নীরব অনুমতি চাইল। তারপর ওর নিজস্ব ঢঙে বলতে শুরু করল।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল। উত্তরের একটা আধখোলা জানলার বাইরে একটুকরো কালো আকাশ। সেখানে সাদা আলোর রেখা ঝিকিয়ে উঠল। তারপরই বাজ পড়ল বিকট শব্দে। স্পষ্ট দেখলাম, রুনি চমকে উঠল। মানিনী হাত রাখল প্রেমতোষের উরুতে।

মানে, আমি বলতে চাইছি…নানা রঙের আলোর নানান রকম এফেক্ট। তবে তার মধ্যে নীল আলোটা সবচেয়ে বাজে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। বিনু হাতে হাত ঘষল। একটা পেঁয়াজের পকোড়া মুখে দিল। কিছুক্ষণ চোয়াল নাড়ার পর বলল, অনেকদিন আগের কথা। বাবা মারা যাওয়ার পর তখন বছর ছয়েক কেটে গেছে। আমি তখন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেব। বাড়িতে ছোট্ট একটা ঘরে বসে হেভি পড়াশোনা করছি। পাশের ঘরে আমার রুগ্‌ণ মা শুয়ে আছে। মা বহুদিনের গ্যাসট্রিকের রুগি। আমার লেখাপড়া নিয়ে সবসময় ভীষণ চিন্তা করে, আর দিন-রাত বলে পড়, ভালো করে পড়। রেজাল্ট ভালো করতে হবে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এসব কথা মা এত বেশি বলত যে, আমার ভীষণ বিরক্ত লাগত। অনেক সময় মাকে রুক্ষভাবে জবাবও দিতাম। বলতাম, কী হচ্ছে! এসব কথা দিন-রাত ঘ্যানঘ্যান করলে আর পড়া যায়!

সে যা হোক–সেদিন রাতে রাত তখন বারোটা তো হবেইমা পাশের ঘরে শুয়ে-শুয়ে প্র্যাকটিক্যালি প্রলাপ বকছিল। ঘুম আসছে না বলে আপনমনেই বকবক করছিল আর মাঝে-মাঝে আমাকে ভালো করে পড়ার কথা বলছিল। এতে আমার পড়ার ভীষণ ডিসটার্ব হচ্ছিল। কয়েকবার চেঁচিয়ে বললাম, কী হচ্ছে, চুপ করো না! কিন্তু তাতে কাজ হল না। তাই একসময় আর থাকতে না পেরে উঠে গেলাম মায়ের ঘরের দরজায়।

নাটকের আচমকা সিন চেঞ্জ হলে যেমনটা হয়, আমার মনে হল, সেরকমই কিছু একটা হল। একটা ছায়া যেন সড়াৎ করে সরে গেল, আর নীল রঙের একটা আলো মায়ের ঘরটা ভরিয়ে দিল। অথচ চারদিকে তাকিয়েও আমি আলোটা কোথাও খুঁজে পেলাম না। স্টেজের আলো যেমন আড়ালে লুকিয়ে থাকে বোধহয় সেরকমই কিছু একটা হবে।

বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি, বিছানায় মা নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি একেবারে পাথর হয়ে গেলাম। মায়ের শরীরটা ভীষণ ছোট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, আড়াই ফুট কি তিন ফুট মাপের একটা পুতুল।

আমি মা! মা! করে কয়েকবার ডাকলাম। সুইমিং পুলের জলে ঢিল পড়লে পাশের দেওয়ালে জলের ছায়া যেমন কাপে, নীল আলোটা সেরকমই কঁপতে লাগল। আর আমি হঠাৎই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তবে কেন, তা জানি না।

বিনু একটু থামল। সকলের চোখের দিকে তাকাল। তারপর গ্লাস তুলে হুইস্কিতে আলতো করে চুমুক দিল।

রুনি জিগ্যেস করল, তারপর কী হল?

লক্ষ করলাম, ওর মুখ বেশ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখে যেন অল্পস্বল্প আতঙ্কের ছায়া।

বিনু একটু বিষণ্ণ হাসল : তারপর? তারপর নীল আলোটা হঠাৎ সরে গেল। সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে গেল–শুধু আমার মা ছাড়া। বারবার ডেকেও আমার প্রলাপ-বকা মায়ের কোনও সাড়া পেলাম না। তখন কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম, মা চলে গেছে।

বিনু থামল। কিছুক্ষণ আমরা সবাই চুপচাপ। শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ঘরের আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।

হঠাৎই স্তব্ধতা ভাঙল প্রেমতোষ। বলল, ধুস! ওসব আপনার মনের ভুল–মানে দেখার ভুল। মাঝে-মাঝে অনেকেরই ওরকম হয়, ব্রাদার। ইংরেজিতে এটাকে বলে হ্যাঁলু কী যেন হাঁ– হ্যালুসিনেশান–। তবে সুপারন্যাচারাল বলে সত্যি-সত্যি একটা মাল আছে।

বিনু ঠোঁটে হাসল : হ্যালুসিনেশান? কে জানে! হতেও পারে। তবে আমি যা দেখেছি সেটাই বললাম।

রুনি কেমন যেন চাপা গলায় বিনুকে জিগ্যেস করল, তখনও আপনার মা কি মাপে ওরকম ছোটই ছিল?

না। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল বিনু, সাইজটা তখন আবার নরমাল হয়ে গিয়েছিল।

লক্ষ করলাম, রণজিৎ কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে। স্থির চোখে ও তাকিয়ে আছে বিনুর মুখের দিকে।

সরস্বতী হঠাৎই সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, যতই বলুন বিনুদা, এ থেকে আপনি কখনওই কনফার্ড হতে পারেন না যে, নীল আলো মানেই একটা ইয়ে মানে, অ্যাবনরমাল ব্যাপার।

বিনু আবার হাসল ও অ্যাবনরমাল নয়, বরং প্যারানরমাল বলুন। তা ছাড়া ম্যাডাম, ওই একবার তো নয়…আমার কাকার বেলায়…।

কী হয়েছিল তোমার কাকার বেলায়? আমি জিগ্যেস করলাম।

সঙ্গে-সঙ্গে বিনু আবার বলতে শুরু করল।

কাকার ঘটনাটা ঘটেছিল মা মারা যাওয়ার বছর ছয়েক পর। আমি তখন কিছুদিনের জন্যে সেসে ঢুকেছিলাম। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে কাপড় কাঁচার গুঁড়ো সাবান বিক্রি করতাম আর কমবয়েসি একদল ছেলেমেয়েকে এইরকম পুশ সেলের কায়দাকানুন শেখাতাম। আমি রোজ সকাল-সকাল বেরোতাম।

তো একদিন সকাল সাড়ে আটটায় বেরিয়ে সাউথ ক্যালকাটা চষতে শুরু করেছি। এইভাবে কাজ করতে করতে দুপুর হলে আমি রাস্তার কোনও পাইস হোটেল-ফোটেলে ভাত খেয়ে নিতাম। এটাই ছিল বলতে গেলে রোজকার রুটিন। তো সেদিনও তাই হওয়ার কথা কিন্তু হল না।

কাজ করতে করতে এ-পাড়া-ও-পাড়া ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎই একসময় খেয়াল করলাম, আমি শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।

আপনাদের বলেছি কি না জানি না আমাদের আদিবাড়ি পাইকপাড়ায় টালা পার্কের পেছনটায় একটা গলির ভেতরে। তো শ্যামবাজারের মোড়ে এসে ভাবলাম, এখানে যখন এসেই পড়েছি, তা হলে আমাদের কোম্পানির যে ছোট্ট অফিসটা বৃন্দাবন পাল লেনে আছে, সেখানে একবার দেখা করেই যাই। তারপর আমার সিঁথির মোড়ের দিকে রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু খিদেয় পেট এমন চেঁ-চেঁ করে উঠল যে, অফিসে কথা শেষ করার পর হঠাৎ মানে, একেবারে আচমকা– মনে হল, বাড়ির কাছাকাছি যখন চলে এসেছি তখন বাড়িতে গিয়ে কাকিমার হাতের রান্না খেলে কেমন হয়!

আমি যে সেলসের কাজে ঘুরতে-ঘুরতে শ্যামবাজারের দিকে এসে পড়ব এটা আমার আগে জানা ছিল না। তখন যে আমার খিদে পাবে সেটাও জানতাম না। কোম্পানির সেক্স অফিসটায় যেমন আচমকা গিয়ে হাজির হয়েছি ঠিক তেমনই আচমকা আমি বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।

বাড়ির গলিতে ঢুকতেই দেখি আমার কাকা খালি গায়ে দোতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কাকা আমার বাবার একমাত্র ভাই। বয়েস ছাপ্পান্ন-কি-সাতান্ন হলেও স্বাস্থ্য ভালোই। একটু আধটু ব্লাড সুগারের প্রবলেম ছাড়া আর কোনও প্রবলেম ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও।

হঠাৎই চুপ করল বিনু। গভীর মনোযোগে হুইস্কির গ্লাস তুলে নিয়ে তাতে দুবার চুমুক দিল।

মানিনী সামনের প্লেট থেকে তিনটে পকোড়া মুঠো করে তুলে নিল। তার একটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে জিগ্যেস করল, কী হল তারপর?

রুনি সিরিয়াস গলায় বলে উঠল, কাকাও কি আপনার মায়ের মতো চলে গেলেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিনু! বলল, হ্যাঁ–তবে একটু অন্যরকমভাবে। ব্যাপারটা বলছি।

আমি বাড়ির দিকে এগোচ্ছি, কাকা হঠাৎই দোতলা থেকে আমাকে দেখতে পেলেন। দেখেই হাসলেন সামান্য। আর তখনই সার্চলাইটের মতো একটা তীব্র নীল আলো কাকার গায়ে ঠিকরে এসে পড়ল। দিনেদুপুরে কাকা শ্রীকৃষ্ণের মতো নীলে নীল হয়ে গেলেন। কিন্তু সে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। তারপরই আলোটা ফস করে মিলিয়ে গেল।

আমি বাড়িতে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে সবে খেতে বসব, ঠিক তখনই ধড়াম শব্দটা শুনতে পেলাম। সে এমন বিকট শব্দ যেন ভূমিকম্পে কোনও টাওয়ার ভেঙে পড়েছে।

একছুটে বাইরে বেরিয়ে দেখি, আমাদের ঝুলবারান্দাটা গলিতে ভেঙে পড়েছে। আর সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কাকার রক্তাক্ত দেহটা লুটোপুটি খাচ্ছে সারা গা সিমেন্ট-বালি আর ধুলোয় মাখামাখি। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কাকা আর নেই।

থামল বিনু। হাতের গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলে রেখে সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর ও এটাকে আপনারা কী বলবেন?

সরস্বতী সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল, কেন, কাকতালীয়। এ ছাড়া আর কী!

নিরুপম তেমন তুখোড় নাবিক নয়। তাই জলপথ ছেড়ে স্থলপথে এল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, বিনুবাবু–ওই নীল আলোটা আপনার দেখার ভুল। আর অ্যাক্সিডেন্টটা সিপ্ল কোইনসিডেন্স। এরকম কেসের কথা অনেক শুনেছি।

বিনু হাসল। বলল, আপনি আপনার মত জাহির করতেই পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। সেদিন দুপুরে আমার শ্যামবাজারে আসা, পেট-চোঁ-ঠোকরা খিদে পাওয়া, বাড়িতে আচমকা ভাত খেতে যাওয়া, কাকার সঙ্গে শেষ দেখা–এবং তারপরই ওই অ্যাক্সিডেন্ট। এতগুলো কাকতালীয় এমনি-এমনি হতে পারে না, নিরুপমবাবু। আসলে কাকা আমাকে টানছিলেন। একবার শেষ দেখা দেখতে চাইছিলেন। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক আদর-যত্নে আমাকে মানুষ করেছিলেন। আমার জন্যে কাকার ভীষণ টান ছিল…।

রুনি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রণজিৎ তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে এল বউয়ের কাছে। ওর গায়ে-মাথায় বারবার হাত বোলাতে লাগল আর জড়ানো গলায় বলতে লাগল, কী হয়েছে? কঁদছ কেন? কী হয়েছে, বলো না।

আমরাও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। নিরুপম সিগারেটে টান দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল, মনে হয় ভয় পেয়েছে। তারপর রুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ভয়ের কী আছে! আমরা তো আছি!

রুনি চোখ-টোখ মুছে নিজেকে সামলে নিল। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে বলল, সরি, আপসেট হয়ে পড়েছিলাম।

মানিনী জিগ্যেস করল, কেন বলো তো?

একটু ইতস্তত করে রুনি বলল, আমার মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মা গ্রুপ থিয়েটারে অ্যাক্টিং করত। একবার…একবার…জলে ডুবে যাওয়ার একটা সিন দেখানোর সময় মায়ের গায়ে নীল আলো ফেলা হল। সেই নাটকের শো করার সময় মায়ের স্ট্রোক হয়েছিল। তখন…সেই…সেই ডুবে যাওয়ার সিনটা হচ্ছিল। মা স্ট্রোক হয়ে মারা গেল…। আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল রুনি।

রণজিৎ ব্যস্তভাবে বলল, কীসব আলতুফালতু বকচ্ছ! ওটা সিম্পলি একটা অ্যাক্সিডেন্ট নাথিং এস।

প্রেমতোষ ভারী গলায় মন্তব্য ছুঁড়ে দিল, নীল আলোর একটা দ্রব্যগুণ থাকলেও থাকতে পারে, ব্রাদার। ওই আলোটা দেখলেই আমার গা-টা কেমন কিরকির করে ওঠে।

সরস্বতী বলে উঠল, থামুন তো! যত্তসব গাঁজাখুরি ব্যাপার! ধরেই নিন না যে, বিনুদা গপ্পো শোনাচ্ছেন! কী বিনুদা, ঠিক বলিনি?

শেষ প্রশ্নটা বিনুকে লক্ষ করে।

উত্তরে বিনু অদ্ভুত হেসে বলল, যদি গপ্পো হয়, ম্যাডাম, তা হলে আমার গপ্পো এখনও শেষ হয়নি।

আমার হঠাৎই মনে হল, এই বর্ষা-ঝমঝম রাতে বিনু আমাদের স্রেফ ভয় দেখানোর জন্যে এসব গল্প বানিয়ে বানিয়ে শোনাচ্ছে না তো! কিন্তু ওর গল্পের ওই এক মুশকিল সত্যি, না মিথ্যে, কিছুতেই বোঝা যায় না।

রণজিৎ মজা করার ঢঙে বলল, বিনুবাবু, আর কী গল্প বাকি আছে তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। আমার খিদেটা বেশ চাগিয়ে উঠেছে। আর রান্নাঘর থেকে যা মাংসের গন্ধ আসছে–আর বেশিক্ষণ তর সইছে না।

বিনু গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আর খুব বেশি বলার নেই। শুধু ছোট্ট দুটো ঘটনা বলব।

একদিন বিকেলে শোভাবাজার এলাকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, একটা বাড়ির রোয়াকের দিকে নজর গেল। বাড়িটায় বড় মাপের সদর দরজার দুপাশে পুরোনো দিনের উঁচু লাল রোয়াক। একটা বছর আষ্টেকের ফ্রক-পরা বাচ্চা মেয়ে রোয়াকের একপাশ থেকে লাফিয়ে আর একপাশে যাচ্ছে। আবার লাফিয়ে ফিরে আসছে।

হঠাৎই মেয়েটার হলদে ফ্রকের ওপরে নীল আলো ঢেউ খেলে গেল। হলদে ফ্রকটা ঘোর সবুজ রঙের হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে হল, এক্ষুনি মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়বে। আর হলও ঠিক তাই। একপাশ থেকে লাফিয়ে আর-এক পাশে যেতে গিয়ে মেয়েটা মাপে ভুল করল এবং ওর থুতনিটা রোয়াকের কোনায় আছড়ে পড়ল। সে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড! তবে আমার মা কিংবা কাকার মতো মেয়েটার মারাত্মক কিছু হয়নি।

আর শেষ ঘটনাটা গত সপ্তাহের। আমি দানাপুরে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার চেনা একজন ভদ্রলোক এক নামকরা ডাক্তারের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুকে খুব ডাকাডাকি করছেন। আমি জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার? উনি বললেন যে, ওঁর স্ত্রী হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

চকিতে কোথা থেকে ছিটকে এল নীল বিদ্যুৎ। গাঢ় নীল রং ভদ্রলোকের শরীর একেবারে ভাসিয়ে দিল। আমার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল, ডাক্তার ডেকে আর কোনও লাভ নেই। কিন্তু অনেক কষ্টে সেটা থামালাম। ওঁকে শুধু বললাম, আপনি শিগগিরই একবার বাড়ি যান–আপনার স্ত্রীর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করুন, কথা বলুন।

ভদ্রলোক বাড়ি ফেরার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিনু। সঙ্গে-সঙ্গে কাছেই কোথাও কড়কড় করে বাজ পড়ল। আমরা অনেকেই চমকে উঠলাম।

বিনু নিচু গলায় বলল, ভদ্রলোক, পরে আমাকে কোনও প্রশ্ন করেননি। বরং হাত দুটো ধরে ভেজা চোখে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বারবার বলেছেন, আপনার জন্যেই ওকে শেষ দেখা দেখতে পেলাম, মুখে জল দিতে পারলাম।

বিশ্বাস করুন, এসবের আমি কোনও ব্যাখ্যা পাইনি। তবে ঘটনাগুলো সব সত্যি–গপ্পো নয়।

বিনুর গল্প শেষ হল। আমরা সব চুপচাপ। যেন শ্মশানে মড়া পোড়াতে এসেছি। বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমেছে। তবে রিমঝিম শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আর মাঝে-মাঝে মেঘের ডাক।

রুনি থমথমে মুখে বিনুর কথা শুনছিল। বিনু থামতেই লক্ষ করলাম, রুনির চোখে জল। ও মুখে আঁচল চাপা দিল। তা সত্ত্বেও একটু-আধটু কান্নার গোঙানি শোনা যাচ্ছিল।

রণজিৎ বউকে প্রায় ধমকে উঠল : কী হচ্ছে কী, রুনি! তোমাকে বলছি না, এসব গাঁজাখুরি গপ্পো। তোমাদের ভয় পাওয়ানোর জন্যে বিনুবাবু এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছেন–।

নিরুপম হাতের সিগারেটটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাপোর্ট করছি, রণজিন্দা। অল বোগাস!

প্রেমতোষ মানিনীর কাঁধে হাত রেখে জড়ানো গলায় বলল, শুনলে তো, মানিনী ব্রাদার। তোমাকে কতবার বলেছি, সুপারন্যাচারালে অবিশ্বাস কোরো না।

রুনি তখনও কান্না চাপতে চেষ্টা করছিল।

ওকে ধমক দিতে দিতে রণজিৎ আচমকাই খেপে গেল। বিনুর দিকে ফিরে টেবিলে দড়াম করে এক কিল বসিয়ে দিয়ে ও পাগলের মতো চিৎকার করে বলে উঠল, কাম অন, শ্রীবিনোদন অধিকারী। এবারে সত্যি কথাটা ফস করুন। বলুন, সব আপনার বানানো গাঁজাখুরি ঢপের কীর্তন, বলুনকাম অন!

বুঝতে পারছিলাম, রণজিতের নেশা চড়ে গেছে।

নিরুপম ওকে সামলাতে চেষ্টা করছিল। আমার ভয় হচ্ছিল, আমাদের নেশার টেবিলটাই না উলটে যায়।

হঠাৎই আমাদের অবাক করে দিয়ে বিনু উঠে দাঁড়াল, বলল, ঠিক আছে। আপনারা যখন অবিশ্বাস করছেন তখন দেখাচ্ছি। দেখে বলুন, কীসের কীর্তন। তবে আমাকে যেন দোষ দেবেন না।

বিনুর চোয়াল শক্ত, চোখ ঠান্ডা। অপলকে রণজিৎকে দেখছে।

রণজিৎ হিংস্র চোখে বিনুর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসল। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, শালা, চিট কোথাকার!

রণজিতের হাসিতে নিরুপম আর সরস্বতীও যোগ দিল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগছিল না।

বিনু ভারী গলায় বলল, আমাকে কিন্তু কেউ দোষ দেবেন না যেন।

তারপর চটপটে পায়ে এগিয়ে গেল আলোর সুইচের দিকে। এবং আলো নিভিয়ে দিল।

অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরে। বৃষ্টির শব্দটা যেন আচমকাই জোরালো শোনাল কানে। আমরা টুকরো-টুকরো কথা বলছিলাম। কে যেন বলল–বোধহয় মানিনী–এ কী! আলো নেভালেন কেন?

বিনু সে-প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, সাবধান!

 সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের নীল রঙের নাইটল্যাম্পটা জ্বেলে দিল বিনু।

অন্ধকার ঘরে নীল আলোর তরঙ্গ পলকে মায়া ছড়িয়ে দিল। আর আমরা সবাই হুড়োহুড়ি করে আড়াল খুঁজতে লাগলাম–নীল আলো যেন কিছুতেই আমাদের গায়ে না পড়ে।

আবছা আলোর সবাইকে ছায়া-ছায়া দেখাচ্ছিল। দেখলাম, কেউ হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের নীচে ঢুকতে চাইছে। কেউ ছুটল ফ্রিজের আড়ালে। কেউ চলে গেল আলনার পাশে। কেউ বা শাড়ির আঁচল মাথায়-মুখে জড়িয়ে নিয়ে নীল আলোর হাত থেকে বাঁচতে চাইল।

ঘরে কোনও শব্দ নেই। শুধু বৃষ্টির ছমছম নুপুর। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানের সামান্য কিচকিচ ম্যারাকাস। আর আমরা সাতজন যে-যার জায়গায় দমবন্ধ করে লুকিয়ে আছি। থরথর করে কঁপছি।

ঠিক তখনই ডানা ঝাঁপটে একটা ভেজা পায়রা ঢুকে পড়ল ঘরে। ওটার ডানার ঝাঁপটের সঙ্গে-সঙ্গে শান্তির জলের মতো জল ছিটকে পড়ছিল আমাদের গায়ে। নীল আলোর অন্ধকার পাখিটা দু-পাক ওড়ার পরই ফ্যানের ব্লেডে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পড়েই নিথর হয়ে গেল।

মেয়েদের মধ্যে কে যেন ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

একইসঙ্গে নীল আলোটা নিভে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *