ফিরে আসা

ফিরে আসা

ওকে নিয়ে হইচই কম হল না। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, এই প্রথম একটা মানুষ চুক্তিমাফিক দাম দিয়ে ফিরে এল ভিনগ্রহের কলোনি থেকে।

আঠারো বছর ধরে মানুষটা দেশছাড়া। রুক্ষ বেজান নভোনি-নাইন গ্রহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ক্রীতদাসের মতো খেটেছে, আর তিল তিল করে সঞ্চয় করেছে ঘরে ফেরার গাড়িভাড়া। হবেই তো–মহাকাশ-পাড়ির খরচ তো আর কম নয়!

তা ছাড়া রসালো গুজবও রটেছিল একটা। সবাই বলাবলি করছিল, একটা মেয়ে নাকি জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। যদি তাই হয়, তাহলে এ তো শতাব্দীর সেরা প্রেমকাহিনি। মানুষটাকে নিয়ে মহাকাশযান কলকাতার স্পেসপোর্টে এসে নামার আগেই চন্দন দাশগুপ্ত বিখ্যাত হয়ে গেছে। কী করে যেন খবরটা রটে গেছে আগেভাগেই। শুধু খবর নয়, তার সঙ্গে গুজব, কিংবদন্তি, রূপকথার আরব্যরজনী।

ছায়াপথের একপ্রান্ত থেকে দুস্তর মহাকাশ পাড়ি দিয়ে ভেসে আসছিল নক্ষত্রযান রাকেশ। নক্ষত্রযানে এই প্রথম ছিল এক পৃথিবীযাত্রী–চন্দন। সুতরাং স্পেসপোর্টে যে সাংবাদিকদের আগাম ভিড় হবে সে আর আশ্চর্য কী!

আকাশমুখী তাকিয়ে নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নক্ষত্রযানের ল্যান্ডিং এলিভেটর যখন সেই মানুষটিকে নিয়ে জমির দিকে নেমে আসতে লাগল তখনই শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন।

চন্দন দাশগুপ্তের চেহারা রূপকথার নায়কের মতোই বটে। লম্বা, ছিপছিপে, শক্তিমান। শান্ত মুখ, ঠোঁট পাতলা বিবর্ণ, এই মাঝ-চল্লিশ বয়েসেই মাথার নব্বইভাগ চুল সাদা। তবে চোয়ালের রেখা শক্ত, চোখের নজর স্বপ্নমাখা এবং গভীর। কিংবদন্তির সঙ্গে সবকিছুই যেন মিলে যাচ্ছে? চেহারা, মুখ, চোখ। হ্যাঁ, এই মানুষটাই পারে ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে অভিমানে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে, তারপর নিছক সেই অপূর্ণ ভালোবাসায় শক্তিতে পরিশ্রম করে যেতে পারে আঠারো বছর!

ক্যামেরা চলছে। চলছে টিভি আর ভিডিয়ো ক্যামেরা। এপাশে-ওপাশে ফ্ল্যাশগানের ঝিলিক। প্রায় পাঁচশো সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফারের জিভ শুকিয়ে এল, গলায় রবারের বল। একটু পরেই জানা যাবে শতাব্দীর সেরা খবর, রোমাঞ্চকর সত্যকাহিনি।

চন্দন ঠান্ডাভাবে হাসল, খবরের কাগজের লোকজনদের দিকে হাত নাড়ল। ওর চোখের পাতা পড়ল না। হাত দিয়ে ফ্ল্যাশগানের চড়া ঝিলিক আড়াল করল না। মুখও ফেরাল না ক্যামেরার দিক থেকে। অদ্ভুত এক শান্তভাব ওর চোখেমুখে, অস্বাভাবিক এক নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে যেন সেখানে। সবাই ভেবেছিল, আঠারো বছর পর জন্মভূমিতে পা রেখে মানুষটা বাচ্চা ছেলের মতো অঝোরে কাঁদবে। হাঁটুগেড়ে বসে চুমু খাবে মাটিতে। কিন্তু ও কিছুই করল না। শুধু ঠোঁটে হাসল আর হাত নাড়ল।

গ্লোবাল নিউজ কাগজের রিপোর্টার সামনে এগিয়ে এল। ইন্টারভিউ নেওয়ার লটারিতে সে-ই জিতেছে। সুতরাং প্রথম ইন্টারভিউর সুযোগ তার।

পৃথিবীতে স্বাগত জানাই, মিস্টার দাশগুপ্ত। ফিরে এসে কেমন লাগছে?

খুব ভালো লাগছে। মাপা ভারী গলায় উত্তর দিল চন্দন। ওর সবকিছুর মধ্যেই যেন নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে।

খবরের কাগজের এত লোক দেখে আপনি নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যাননি?

একসঙ্গে এত লোক আমি আঠারো বছর ধরে দেখিনি। তবে তার জন্যে ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে!

মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। চুক্তিপত্র সই করে বহু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু ফিরে কেউই আসেনি–মানে, আপনি ছাড়া।

তাই? জানতাম না তো! হাসিটা সামান্য চওড়া করে সহজ গলায় জবাব দিল চন্দন।

আপনি না জানলে কী হবে, দুনিয়ার আর সবাই জানে। আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ আপনার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনার এই চলে যাওয়া-আর দেড়যুগ পরে ফিরে আসা–এর নেপথ্য কাহিনি জানার জন্যে ছটফট করছে সবাই। প্রথমত, আপনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কেন, মিস্টার দাশগুপ্ত? আবার নভোনি-নাইন থেকে ফিরেই বা এলেন কেন?

বিষণ্ণভাবে হাসল চন্দন। বলল, একটা মেয়ের জন্যে। সুন্দরী এক তরুণীর জন্যে। সে এখন খুব বিখ্যাত। ও আমাকে ভালোবাসত। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু যখন ও আমাকে মানে, যেদিন থেকে ও আমাকে ফিরিয়ে দিল, সেদিনই আমি ঠিক করি, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। এতদিন পর আমার মনে হয়েছে, ওর ভালোবাসা আবার ফিরে পাব আমি–তাই ফিরে এসেছি। একটু থেমে কপালে হাত বুলিয়ে নিল চন্দন, বলল, আমি খুব টায়ার্ড। যদি আমাকে এখন ছেড়ে দেন…পরে কথা বলব।

মিস্টার দাশগুপ্ত, প্লিজ, যদি ব্যাপারটা আর একটু খুলে বলেন–

লম্বা জার্নি করে এসেছি–একটু বিশ্রাম না নিতে পারলে মরে যাব। কাল বিকেলের প্রেস কনফারেন্সে আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব দেব।

একথা বলেই ও ভিড় ঠেলে একটা গাড়িতে গিয়ে উঠল। স্পেশাল সিকিওরিটি গার্ডের দল ওকে নিরাপদে একটা ম্যাগনেটিক মোবাইলে তুলে দিল। স্পেসপোর্ট ছেড়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল ম্যাগ-মোবাইল।

.

নিউজ মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রায় প্রত্যেকেই এই সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউ দেখেছে অথবা তার খবর শুনেছে। এর ফল হয়েছে মারাত্মক। চন্দন দাশগুপ্তের ফিরে আসার খবর ছবি-টবিসমেত ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। আগে চন্দনকে ঘিরে জনতার কৌতূহল ছিল, এখন সেটা দাঁড়িয়ে গেল প্রায় মনের অসুখে। ভালোবাসায় ব্যথা পেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া, তারপর দ্বিতীয় সুযোগের জন্য আঠারো বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা–এ যেন সেই আদ্যিকালের রূপকথার গল্প হাই-টেক চব্বিশ শতকের মাঝামাঝি আবার জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছে।

তা ছাড়া, ভিনগ্রহের কলোনিতে নাম লিখিয়ে, পরে চুক্তিমাফিক দাম মিটিয়ে কলোনি ছেড়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা তো নেহাত সহজ কাজ নয়! সোলার ফেডারেশন নামের আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা প্রায় একশো বছর আগে একটি প্রকল্প চালু করে ৪ ডিসট্যান্ট প্ল্যানেট কোলোনাইজেশন। ভিনগ্রহে কলোনি স্থাপন করে মানবসভ্যতা ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য। ভিনগ্রহে গিয়ে বসতি স্থাপন করে সেখানকার পাকাপাকি বাসিন্দা হতে চায় এমন মানুষদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা। শর্ত ছিল, বিনা খরচে সেইসব মানুষকে পৌঁছে দেওয়া হবে অন্য নক্ষত্ৰজগতের কোনও গ্রহে। তাদের যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে, জমি দেওয়া হবে। বিনিময়ে তাদের শপথ করতে হবে যে, তারা সেখানেই বসবাস করবে চিরকালের জন্য বিয়ে করবে, মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবে মানবসভ্যতার স্বার্থে। গত একশো বছরে এই প্রকল্প মানবসভ্যতাকে ছড়িয়ে দিয়েছে ছায়াপথের নানা গ্রহে। মহাকাশে প্রায় পাঁচশো আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধ জুড়ে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে এরকমই নানা কলোনি। তবে সেইসব মানুষের কেউ ফিরে আসেনি–একমাত্র চন্দন ছাড়া।

না, কলোনি ছেড়ে কোনও মানুষের ফিরে আসাটা যে তত্ত্বগতভাবে অসম্ভব তা নয়। তবে খুব কম লোকই ফিরে আসতে চায়। আর যেকজনের মনে সে-ইচ্ছে জাগে, শর্তের কথা শুনলেই তারা পিছিয়ে যায়। শুধু চন্দন দাশগুপ্ত পিছিয়ে যায়নি।

ফিরে আসতে গেলে প্রথমেই সরকারি ঋণ মেটাতে হবে। সেই ঋণের একটা মোটামুটি হিসেব এইরকম : যাতায়াতের খরচ আট লক্ষ টাকা, জমির জন্য দু-লাখ টাকা, আর যন্ত্রপাতির জন্যও তাই–মোট বারো লক্ষ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে দশ পার্সেন্ট হারে সুদ।

পৃথিবীতে যে দিব্যি সুখে-শান্তিতে আছে, যার পয়সাকড়ি সম্পত্তি আছে, সে কখনও কলোনিতে যাওয়ার জন্য নাম লেখাবে না। আর নিঃস্ব যে-মানুষটি ভিনগ্রহের কলোনিতে গিয়ে বাস করবে সে কী করে এত টাকা জোগাড় করবে! সেই কারণেই বন্ডের টাকা মিটিয়ে কলোনির কোনও মানুষ ফিরে আসতে পারেনি পৃথিবীতে।

চন্দনই প্রথম পারল। নভোটনি-নাইন-এ গিয়ে ঘড়ির কাঁটা ধরে ও পরিশ্রম করেছে, ঘাম ঝরিয়েছে। প্রতিবেশীদের চেয়ে অনেক বেশি ফসল ফলিয়েছে, যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে তারপর বাড়তি জিনিস বিক্রি করেছে তাদের কাছে। সঞ্চয়ের টাকা কেন্দ্র করে পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। টেলি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে শেয়ার বাজারে লাগিয়েছে সেই টাকা। জুয়া খেলেছে ও। প্রাণপণ শ্রম দিয়ে কান্না-ঘাম-রক্ত দিয়ে জুয়া খেলেছে চন্দন। ওকে যে ফিরতেই হবে। ভালোবাসার মানুষের কাছে ওকে ফিরতেই হবে। তা সে যতদিন পরই হোক।

এইভাবে কেটে গেছে আঠারো বছর। বারো লক্ষ টাকা চুক্তিপণ দিয়ে চন্দন ফিরে এসেছে।

এখন সারা দুনিয়ার মানুষ জানতে চায়, ও কেন ফিরে এল, কার জন্য ফিরে এল।

ফিরে আসার পরদিনই হোটেলের ঘরে প্রেস কনফারেন্স ডাকল ও। সোলার ফেডারেশন ওর জন্য হোটেলের সেরা সুইট ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ ছাড়া ওর নিরাপত্তার জন্য রয়েছে স্পেশাল সিকিওরিটি গার্ডের দল। কর্তৃপক্ষ বাছাই করে কুড়িটি প্রথম সারির সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিকে চন্দনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে।

চন্দন দাশগুপ্ত রিপোর্টারদের সামনে এল। পরনে জিক্স-এর জামা, জিল্স-এর প্যান্ট। পায়ে ছাইরঙের স্পোর্টস শু। আচরণের প্রতিটি কণায় আভিজাত্যের ছাপ। মুখে স্থির প্রতিজ্ঞা। বলিষ্ঠ হাতের শিরা-উপশিরা চেয়ে আছে। মাথার চুলে সাদাকালো ছবি। এখনকার আধুনিক প্রসাধন-পদ্ধতির যুগে কারও বয়েস বাড়ে না। কিন্তু চন্দনের যে প্রসাধন দরকার নেই। ওর চলাফেরার ভঙ্গিতে সেই ঔদ্ধত্য নজরে পড়ছে। আর চোখ দুটো যেন লাইটহাউসের তীব্র আলো, ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের চারদিকে, প্রত্যেককে একবার করে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে।

ওর দিকে তাকিয়ে সকলেই অস্বস্তিতে পড়ল। মানুষের চোখে এমন দৃষ্টি ওরা আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু কলোনি থেকে ফিরে আসা কোনও মানুষকেও তো ওরা আগে দেখেনি।

যান্ত্রিক হাসি হাসল চন্দন। বলল, গুড আফটারনুন। বলুন, আপনারা কী জানতে চান–

খুবই সাধারণ প্রশ্ন দিয়ে রিপোর্টারদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল।

নভোনি-নাইন কীরকম গ্রহ, মিস্টার দাশগুপ্ত?

ঠান্ডা। টেমপারেচার কখনও পনেরো ডিগ্রির ওপরে ওঠে না। আর মাটি ভীষণ রুক্ষ। চাষবাস খুব মেহনতের ব্যাপার। স্রেফ বেঁচে থাকতে গেলেই ওখানে দিনরাত খাটতে হয়।

সইসাবুদ করে যখন ওখানে রওনা হন তখন এসব জানতেন?

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল চন্দন : হ্যাঁ, জানতাম। আমি সবচেয়ে খারাপ গ্রহের খারাপ কলোনিতে যেতে চেয়েছিলাম।

সেখানে কত লোক আছে?

প্রায় বিশ হাজার। বুঝতেই পারছেন, সহজে কেউ নভোনি-নাইন-এ যেতে চায় না।

মিস্টার দাশগুপ্ত, কলোনিতে যাওয়ার চুক্তির মধ্যে একটা শর্ত আছে যে, ওখানে গিয়ে বিয়ে করতে হবে। আপনি কি বিয়ে করেছেন?

বিষণ্ণভাবে হাসল চন্দন : ওখানে পৌঁছোনোর এক সপ্তাহ পরেই বিয়ে করেছিলাম আমি। সেই ২৩১৯ সালেই। কিন্তু সে-বছরের শীতেই আমার স্ত্রী মারা যায়। কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি আমাদের। পরে আর বিয়েও করিনি।

কবে আপনি ঠিক করলেন যে চুক্তিপণ দিয়ে পৃথিবীতে আবার ফিরে আসবেন? নভোটুনি-নাইন-এ যাওয়ার প্রায় আড়াই বছর পরে।

তার মানে প্রায় পনেরো-সাড়ে পনেরো বছর ধরে আপনি পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য পরিশ্রম করেছেন!

ব্যাপারটা আমারও বিশ্বাস হতে চায় না কিন্তু সত্যি।

ট্রান্সওয়ার্ল্ড নিউজ-এর এক তরুণ রিপোর্টার শেষ পর্যন্ত লাখ টাকার প্রশ্নের দিকে ঝুঁপ দিল ও কিন্তু আপনি কলোনি ছেড়ে ফিরে আসার ডিসিশন নিলেন কেন? স্পেসপোর্টে আপনি বলছিলেন, সুন্দরী এক তরুণীর জন্যে আপনি ফিরে এসেছেন ।

চন্দন হাসল, তবে সে-হাসিতে খুশি নেই। বলল। হ্যাঁ, তাই। আসলে যখন আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই তখন আমার বয়েস কম ছিল মাত্র পঁচিশ। তখন একটি মেয়েকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু সে অন্য আর একজনকে বিয়ে করে। তখন ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে রোমান্টিক জেদের বশে আমি নভোটনি-নাইন-এ যাবার জন্যে সই করে দিই। আড়াই বছর পর পৃথিবী থেকে পাওয়া টেলি-নিউজে জানতে পারি ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে–অর্থাৎ ২৩২২ সালে। তখনই ঠিক করি, পৃথিবীতে আমি ফিরে আসব, ওকে বিয়ে করব–যে করে থোক, ওকে রাজি করাবই।

আর একজন সাংবাদিক বলল, তার মানে পুরোনো প্রেম জোড়া দেবার জন্যে আপনি পনেরো বছর ধরে লড়াই করে গেছেন। এর মধ্যে এই ভদ্রমহিলা যে আবার বিয়ে করেননি সেটা কী করে জানলেন?

সবাইকে চমকে দিয়ে চন্দন নির্লিপ্ত গলায় বলল, না, বিয়ে ও করেছে—

 বিয়ে করেছে! তাহলে–।

২৩২৪ সালে ওর দ্বিতীয় বিয়ের খবর আমি পাই। সেটা ডিভোর্স হয়ে যায় ২৩২৫-এ। তারপর ২৩২৭-এ আবার বিয়ে, ২৩২৯-এ ডিভোর্স। সে-বছরই আবার বিয়ে, আর ২৩৩৪-এ ডিভোর্স। ২৩৩৫-এ শেষ বিয়ে, আর চার মাস আগে সেটা ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপর ওর আর কোনও বিয়ের খবর পাইনি।

রিপোর্টাররা মনে মনে হিসেব কষছিল, কোন বিখ্যাত মহিলা পাঁচবার বিয়ে করে পাঁচবারই ডিভোর্স করেছেন স্বামীকে। কিন্তু হিসেবটা খুব সহজ নয়। বিয়ে আর ডিভোর্সটা এখন আর কোনও ঘটনার মধ্যে পড়ে না। নেহাতই সাদামাঠা। তা সত্ত্বেও

এই বিয়ের খবর পাওয়ার পর আপনার মনের অবস্থা কী হত? হাল ছেড়ে দিতেন?

চন্দন মাথা নাড়ল? না, আমি টাকা জমিয়েই যাচ্ছিলাম–থামিনি। কারণ আমার কেন যেন মনে হত, ওর কোনও বিয়েই টিকবে না। ওকে তো আমি চিনি। এতগুলো বছর ধরে ও শুধু আমার শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। হবেও না। কারণ একটা মানুষের সঙ্গে আর একটা মানুষের কখনও হুবহু মিল থাকে না। ওর পাঁচ-পাঁচটা বিয়ে আমি সহ্য করেছি। ছনম্বর বিয়েটা আর সহ্য করতে হবে না, ওটা আমার ভালো লাগবে। কারণ ছনম্বর বিয়েটা হবে আমার সঙ্গে।

এই মহিলা কে? মানে, ওঁর নামটা আমাদের বলবেন, মিস্টার দাশগুপ্ত?

ঠান্ডা হাসি হাসল চন্দন। বলল, এখনও নাম বলার সময় আসেনি। আপনাদের আর কোনও প্রশ্ন আছে?

.

চন্দনের প্রেস কনফারেন্স যখন শেষ হল তখন সন্ধে গাড়িয়ে গেছে। সাংবাদিকদের কাছে কিছুই লুকোয়নি ও : কত কষ্ট করে টাকা জমিয়েছে; কলোনির জীবন কেমন ছিল; কত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়েছে সেখানে। যার জন্য ও এত কাণ্ড করেছে শুধু তার নামটা এখনও বলেনি।

ওরা সবাই চলে যাবার পর হোটেলের বিলাসবহুল সুইটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার কলকাতা দেখছিল চন্দন। এখানে-ওখানে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের আলো জোনাকির মতো জ্বলছে। আকাশপথে জেট প্লেন উড়ে যাচ্ছে ঘন ঘন। তাদের তীব্র আলো থেকে থেকেই অন্ধকার চিরে দিচ্ছে খুশিমতো। কোথা থেকে ভেসে আসছে যন্ত্রের শব্দ। নভোটনি-নাইন-এর কথা মনে পড়ছিল বারবার। গ্রহটা রুক্ষ ছিল, ঠান্ডা ছিল, কিন্তু যান্ত্রিক ছিল না। প্রকৃতির উষ্ণতা ছিল সেখানে।

চন্দনের যে না ফিরে কোনও উপায় ছিল না। একটা অদৃশ্য টান ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। অনেকটা মহাকর্ষের টানের মতো–যেটানের রহস্য এখনও সকলের অজানা।

ঘরে ঢুকে এল চন্দন। একটা সুইচ টিপে জানলার কাচ অস্বচ্ছ করে দিল। আপনমনেই হাসল ও। এখন নভোটনি-নাইন-এ শীতকাল। এখন সরীসৃপদের মতো শীতঘুমে লুকিয়ে পড়ার সময় সেখানে। পাহাড়ের মতো উঁচু নীলচে-সাদা বরফের তাল তুষারঝড়ে চলে বেড়ায় সেই গ্রহের মাটিতে। এখানকার ষোলো মাসে ওখানকার একবছর। তার মধ্যে আটমাসই শীত। তখন মাটিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেঁধিয়ে যেতে হয় ইঁদুরের মতো–একটু উষ্ণতার জন্যে। আর বাকি আটমাসের মধ্যে মোটামুটি চারমাস বাসযোগ্য আবহাওয়া থাকে। কিন্তু এত প্রতিকূল অবস্থাতেও মানুষ লড়াই করতে পারে। চন্দন পেরেছে।

সেখানে ওর বন্ধুবান্ধবও ছিল। না, পৃথিবী থেকে যাওয়া অন্যান্য কলোনিবাসী নয়। তারা পরিশ্রমী ভালোমানুষ। চন্দন ভাবছিল, কাঁপাসিয়াদের কথা–নভোটনি-নাইন-এর যারা বরাবরের বাসিন্দা।

পৃথিবী থেকে যে-সব সার্ভে প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছিল তাতে নভোটনি-নাইন-এর কাঁপাসিয়াদের কথা জানা যায়নি। অবশ্য ওদের সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র শপাঁচেক-এ এসে ঠেকেছিল। চন্দনের কাঁপাসিয়া বন্ধু ডোনোই সেরকমই বলেছিল ওকে। তাছাড়া চন্দনও কখনও একসঙ্গে একডজনের বেশি কাঁপাসিয়া দেখেনি। ওদের সবাকেই একই রকম দেখতে। উচ্চতায় ফুট তিনেক, রোগা ভঙ্গুর চেহারা, ছোট্ট মুখে বড় বড় দুটো বিষণ্ণ চোখ। ভীষণ ঠান্ডাতেও ওরা বিনা পোশাকে ঘুরে বেড়ায়। মাটির নিচে ছোট ছোট গুহায় ওরা বাস করে। এইরকমই একজন কাঁপাসিয়া ডোনোই চন্দনের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।

ডোনোই-এর কথা মনে পড়তেই চন্দন ঠোঁটে হাসল। তুষারঝড়ের মধ্যে একদিন ডোনোইকে খুঁজে পেয়েছিল ও। দেখে মনে হয়েছিল, বেঁচে নেই। কিন্তু ডোনোই বেঁচে উঠেছিল, সেরে উঠেছিল। সেবারে শীতকালটা ও চন্দনের কেবিনেই কাটিয়েছিল। খুব সামান্য কথা বলেছিল চন্দনের সঙ্গে। বরং বেশিরভাগ সময় ও চুপচাপ শুধু চন্দনের কথাই শুনত।

চন্দন ওকে সব কথাই বলেছিল। বলে মন হালকা করেছিল। বলেছিল নিজের বোকামির কথা, ওর অন্ধ বিশ্বাসের কথা যে মাধুরী এখনও ওকে ভালেবাসে, আর বলেছিল পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার পাগলকরা বাসনার কথা। মাধুরীকে যে কিছুতেই ও ভুলতে পারছে না।

সব শোনার পর, বোঝার পর, ডোনোই বলেছে, পৃথিবীতে তুমি ফিরে যাবে। দেখবে, মাধুরী তোমার কাছেই ফিরে আসবে আবার।

তখন মাধুরীর দ্বিতীয় বিয়ে চলছে। যেদিন টেলি-নিউজে মাধুরীর দ্বিতীয় বিয়ের খবর চন্দন জেনেছিল সেদিন ও একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস ডোনোই ছিল কাছে! ওই ছোটখাটো কৃশকায় ভিনগ্রহীর মনে এত জোর কে জানত! ডোনোই ওকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, আশ্বাস দিয়েছিল, ভরসা দিয়েছিল। তারপর থেকে চন্দনের প্রতিজ্ঞা একচুলও টলেনি। মাধুরী একটার পর একটা বিয়ে করেছে, বিয়ে তেতো হয়েছে, নষ্ট হয়েছে, শেষমেশ ভেঙে ছত্রখান হয়েছে কিন্তু চন্দন পরিশ্রম করে গেছে অবিচলভাবে। ওর মনে শুধু এই বিশ্বাস ছিল, ও পৃথিবীতে ফিরে এলে মাধুরীকে পাবে।

ডোনোই শান্ত ধীর স্বরে চন্দনকে বলেছিল, বন্ধু, তেমন করে যদি চাওয়া যায়, তাহলে ঠিক পাওয়া যায়। এই বিশ্বাস কখনও নষ্ট হতে দিও না। দ্যাখো, আমি তো বরফে চাপা পড়ে মরেই যাচ্ছিলাম। আমি মনপ্রাণ দিয়ে চেয়েছিলাম তুমি এসে আমাকে খুঁজে বের করো। ব্যস, তুমি এলে, আমাকে বাঁচালে।

চন্দন তখন প্রতিবাদ করে বলেছে, কিন্তু ডোনোই, আমি তো তোমার মতো কাপাসিয়া নই! আমার মনে এত জোর নেই। আমি ইচ্ছে করলেই অন্যের ইচ্ছে বদলে দিতে পারি না।

ভুল, বন্ধু। যে প্রাণী চিন্তা করতে পারে, তারই ইচ্ছাশক্তি আছে। দেখি, তোমার হাতটা দাও, তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি–

পনেরো বছর আগের কথা মনে পড়ল চন্দনের। ও তৃপ্তির হাসি হাসল। সারাজীবনে কোনও বন্ধু ডোনোই-এর মতো করে কখনও ওর হাত ধরেনি। ওর মনে পড়ল ডোনোই-এর সরু নরম হাতটার কথা। হাড় প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ হাতটা ধরামাত্রই একটা অলৌকিক ঝাঁকুনি টের পেয়েছিল ও। এক অদ্ভুত শক্তি চিনচিন করে প্রবাহিত হয়ে এসেছিল চন্দনের শরীরে। তার পর বহু দিন ধরে ও টের পেয়েছিল সেই আশ্চর্য অনুভূতি। কিন্তু স্পর্শের সেই ক্ষণ থেকেই চন্দন বুঝতে পেরেছিল, ও জিতবেই। মাধুরী আর কারও নয়। আর কারও হতে পারে না।

*

পরদিন সকালে চন্দনের সঙ্গে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন।

সেদিন বিকেলে আর একটা প্রেস কনফারেন্স হওয়ার কথা ছিল। সেইজন্য চন্দন বলে রেখেছিল আলাদাভাবে আর কোনও ইন্টারভিউ দেবে না। কিন্তু যিনি দেখা করতে এসেছেন তিনি নাছোড়বান্দা। সুতরাং শেষ পর্যন্ত হোটেলের রিসেপশান থেকে চন্দনকে ফোন করে জানাল যে, জনৈক রাকেশ চিরিমার ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

নামটা যেন চেনা চেনা ঠেকল। চন্দন ফোনে বলল, ওপরে পাঠিয়ে দিন–

কয়েক মিনিট পরই রাকেশ চিরিমার চন্দনের ঘরের বেল বাজালেন। তারপর দরজা খোলাই আছে জেনে ঢুকে পড়লেন ঘরে।

মাথায় চন্দনের তুলনায় খাটো, মোটাসোটা, ফরসা রং, দাড়ি-গোঁফ নিখুঁত করে কামানো। ডান হাতের মাঝের আঙুলে একটা সুন্দর আংটি। তার পাথরটা ভিনগ্রহের বলেই মনে হল।

রাকেশ হাত বাড়িয়ে দিলেন। চন্দন হাত মেলাল। জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার, বলুন–।

রাকেশ তার হাতে ধরা একটা নিউজফ্যাক্স দেখালেন। তার প্রথম পাতায় ছবি দিয়ে বড় করে চন্দনের ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে। সেটা আঙুল ঠুকে দেখিয়ে বললেন, মিস্টার দাশগুপ্ত, এটা পড়েই আমি বুঝতে পেরেছি মেয়েটা কে। আমি আপনাকে ইয়ে মানে সাবধান করতে এসেছি– বন্ধু হিসেবে। ওর সঙ্গে আপনি জড়াবেন না।

চন্দনের চোখে হিরের কুচি ঝিলিক দিল। জিগ্যেস করল, কেন জানতে পারি?

রাকেশ জড়ানো গলায় বললেন, মেয়েটা মেয়ে নয়, ডাইনির বাচ্চা। ও শুধু ছেলে ধরে আর ছিবড়ে করে ছেড়ে দেয়। আমি তো জানি। আপনি শুধু ওকে ভালোবেসেছিলেন। আর আমি….আমি ওকে বিয়ে করেছিলাম।

হ্যাঁ, আঠারো বছর আগে আপনিই ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।

না, মোটেই তা নয়– রাকেশ প্রতিবাদ জানালেন ৪ ও আমাকে বিয়ে করেছিল ওর কেরিয়ারের পক্ষে সুবিধে হবে ভেবে। তা যে হয়নি তা নয়। আপনি নভোটুনি-নাইন-এ রওনা হওয়ার দিন ওকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠিটা দেখে আমি প্রথম জানতে পারি আপনার কথা। তার আগে কিছুই জানতাম না, বিশ্বাস করুন! ও সে-চিঠি আমাকে যখন দেখায় তখন আপনার নামে বহু কথা বলেছিল। সে-সব কথা আমি উচ্চারণ করতে পারব না, মিস্টার দাশগুপ্ত। শুধু ওর তখনকার হাসিটা মনে পড়লেই আমার অস্বস্তি হয়। আর বলতে গেলে সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদের বিয়েটাতে চিড় ধরতে শুরু করে। পুরোপুরি ফাটল ধরতে অবশ্য বছর আড়াই লেগেছিল। ওকে আমি কারও কাছ থেকে ছিনিয়ে নিইনি, মিস্টার দাশগুপ্ত। ও-ই একরকম আমার গলায় ঝুলে পড়েছিল। বিশ্বাস করুন ।

বিশ্বাস করলাম।

রাকেশ চিরিমার রুমাল বুলিয়ে নিলেন কপালে। একটু দম নিয়ে বললেন, ওর অন্য বিয়ের গল্পও সেই একই। ওর কেরিয়ারের দিকে বরাবরই আমার নজর রয়েছে। ও বাঁচে স্রেফ নিজের জন্যে-মাধুরী মিত্রের জন্যে। আমাকে ও ডিভোর্স করেছিল মোহন রসতোগিকে বিয়ে করার জন্যে। রসতোগি বেচারার বয়েস হয়েছিল। তার ওপরে হার্টের ট্রাবল ছিল। বুকে বসানো ছিল পেসমেকার। ফিলিম স্টারকে বিয়ে করার আনন্দে ওর বোধহয় মাথার ঠিক ছিল না। একদিন সকালে চা খেতে খেতে মাধুরী হঠাৎই ওকে বলে, আমি চললাম। তোমার মতো বুড়োকে বিয়ে করে কোনও মজা নেই। ব্যস… দুপাশে হাত ছড়িয়ে করুণ হাসলেন চিরিমার। বললেন, রসতোগি সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করেছিল। কিন্তু মাধুরীর তাতে কোনও প্রবলেম হয়নি। রসতোগির পর একে একে এসেছে সমীরণ দাশুগুপ্ত, অনুপম মহান্তি, রঞ্জিত কাপুর। মাধুরী মইয়ের ধাপে ধাপে পা রেখে পৌঁছে গেছে খ্যাতির চূড়ায়। সেই সঙ্গে পয়সাও কামিয়ে নিয়েছে দুহাতে। শুধু ওর চলার পথে পড়ে ছিল পাঁচটা স্বামীর ছিবড়ে। তেতো হাসি হাসলেন রাকেশ। নিজের বুকে আঙুল ঠুকে বললেন, তার মধ্যে একটা ছিবড়ে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে এখন কথা বলছে।

চন্দন কাধ আঁকিয়ে বলল, মাধুরীর পুরোনো ব্যাপার নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।

আপনি কি সত্যি সত্যি ভাবছেন মাধুরী আপনাকে বিয়ে করবে?

হ্যাঁ, বিয়ের কথায় ও একেবারে লাফিয়ে উঠবে। বিশেষ করে আমাকে এখন বিয়ে করলে ও জোর পাবলিসিটি পাবে। কাগজে বড় বড় হেডলাইন ছাপা হবে : পাঁচবার ঘর-ভাঙা রমণী এবারে তার প্রথম প্রেমিকের ঘরণী হতে চলেছে।

রাকেশ চিরিমার শুকনো ঠোঁটের ওপরে জিভ বুলিয়ে নিলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চন্দনের উত্তরে তিনি খুশি হতে পারেননি। তবে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন : হ্যাঁ, পাবলিসিটির এমন সুযোগ মাধুরী হাতছাড়া করবে না। কিন্তু কদ্দিন টিকবে আপনাদের বিয়ে? ছমাস, একবছর পাবলিসিটির ঢেউ থিতিয়ে গেলেই বিয়েতে ইতি পড়বে। তারপর আপনি আবার পথে বসবেন। আপনার মতো ভিখিরি স্বামী মাধুরীর কোনও কাজে লাগবে না।

না, ও আমাকে ছাড়বে না।

চন্দনের গলায় আস্থা ছিল। রাকেশ কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ রইলেন। তারপর বললেন, আপনি তাহলে খাল কেটে কুমির ডাকবেন বলেই ঠিক করেছেন? কী ব্যাপার বলুন তো, দাশগুপ্ত? আপনি কি ওকে বিয়ে করবেন বলে মা কালীর কাছে দিব্যি কেটেছেন?

চন্দন শান্ত গলায় বলল, ওসব ভগবানের চেয়ে আমি নিজেকে বেশি বিশ্বাস করি। কিন্তু আপনি কি এসব কথা বলার জন্যেই দেখা করতে এসেছেন?

রাকেশ চিরিমার একবার মাথা নাড়লেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, না, আসলে আমি একটা অফার নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। আপনি তো এখন পৃথিবী বিখ্যাত। আপনার পাবলিসিটি আমার কোম্পানির কাজে আসবে। আমার কোম্পানির একজন ডাইরেক্টর দরকার, মাসে দু-কোটি করে আপাতত দেব। এখন তো মশাই দুনিয়ার সব মেয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে। একবার কসমেটিক সার্জারি করালেই আপনার বয়স আবার সুড়সুড় করে পঁচিশে নেমে যাবে। তখন কাণ্ডটা দেখবেন! শুধু মাধুরীকে নিয়ে এই পাগলামি ছাড়ুন। এখানে একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে-থা দিয়ে দেব। তখন দেখবেন, ওই নাইন না টেন গ্রহের সব ব্যাপার-স্যাপার দিব্যি ভুলে যাবেন।

না, আমার কোনও ইচ্ছে নেই।

মিস্টার দাশগুপ্ত, ভাববেন না আপনাকে আমি দয়া দেখাচ্ছি। আপনাকে পেলে সত্যিই আমার কোম্পানির সুবিধে হবে। তাছাড়া, এটাও সত্যি যে, মাধুরীর মতো মেয়ের খপ্পর থেকে আপনাকে বাঁচানো দরকার। আঠারো বছর আগে আমি অজান্তে আপনার ওপরে অবিচার করেছিলাম। তারও তো প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার। সেইজন্যেই এই অফারটা–

সরি, মিস্টার চিরিমার। এখন আমার মাথায় মাধুরী ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা নেই। আপনি অন্য লোক খুঁজুন। আপনার অ্যাডভাইসের জন্যে ধন্যবাদ।

রাকেশ চিরিমারের মুখ লাল হল। উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, ঠিক আছে। তাহলে মাধুরীর কাছেই যান–একবার বাতি দেখতে পেলে শ্যামাপোকা কারও কথা মানে না। আমার ওপেন অফার রইল। প্লিজ হ্যাভ মাই ডিপেস্ট সিমপ্যাথি।

সেদিন বিকেলের প্রেস কনফারেন্সে মেয়েটির নাম বলল চন্দন। মাধুরী মিত্র। খবরটা পেয়ে নিউজ নেটওয়ার্ক টগবগ করে ফুটতে লাগল। একঘণ্টার মধ্যেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ল সারা দুনিয়ায়।

পঁচিশ বছর ধরে ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্রের গ্ল্যামার কুইন মাধুরী মিত্রের জন্য চন্দন দাশগুপ্ত নভোটনি-নাইন-এর কলোনি থেকে ফিরে এসেছেন। চন্দন দাশগুপ্ত বলেন, আঠারো বছর আগে মাধুরীদেবী নেহাতই ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ২৩১৯ সালে চন্দন দাশগুপ্তকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি বম্বের প্রখ্যাত শিল্পপতি রাকেশ চিরিমারকে বিয়ে করেন। কিন্তু এইভাবে মাধুরীদেবী পাঁচবার বিয়ে করেও সংসারী হতে পারেননি।

এ-বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে চন্দন দাশগুপ্ত বলেন, আমি ওকে আঠারো বছর আগে যেমন ভালোবাসতাম, এখনও তাই বাসি। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।

এই প্রসঙ্গে বম্বেতে মাধুরীদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

তিনদিন মাধুরী চুপচাপ রইল। কারও সঙ্গে দেখা করল না। নিউজ মিডিয়াকে কোনও স্টেটমেন্ট দিল না। চন্দন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল। আঠারো বছরের অপেক্ষা মানুষকে ধৈর্য ধরতে শেখায়। তাছাড়া নভোনি-নাইন-এ ও আর ডোনোই যখন বসন্তকালের বনানীর পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন ডোনোই বলেছিল, বন্ধু, যে তাড়াহুড়ো করে সে ইচ্ছের লড়াইয়ে বোকার মতো সব সুযোগসুবিধে জলাঞ্জলি দেয়।

একটি ভিনগ্রহী প্রজাতির শেষ যুগের প্রাণী ডোনোই। সেই প্রজাতির প্রায় সারা জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা ছিল ডোনোই-এর মধ্যে। খুদে ভিনগ্রহীর উপদেশ মনে রেখে হোটেলের সুইট ছেড়ে বেরোল না চন্দন। ডোনোই কখনও চন্দনের ইচ্ছের ভালো-মন্দ নিয়ে মন্তব্য করেনি। শুধু দরকারি পরামর্শ দিয়েছে, উপদেশ দিয়েছে। আর শিখিয়েছে ইচ্ছেশক্তির ব্যবহার, কুশলতা।

চন্দনের সম্পর্কে আর কোনও নতুন তথ্য নিউজ মিডিয়া পেল না। চন্দনও ওদের আর কোনও নতুন খবর দিতে চায়নি। ফলে, স্বাভাবিক কারণেই, ওদের আগ্রহ গেল কমে। তৃতীয় দিন থেকেই প্রেস কনফারেন্সের আর কোনও দরকার হল না। চন্দন দাশগুপ্ত ফিরে এসেছে, বলেছে। মাধুরী মিত্রের প্রতি ওর আঠারো বছরের পুরোনো ভালোবাসার কথা। তারপর থেকেই ও বসে রয়েছে চুপচাপ শুধু অপেক্ষা করেছে।

শান্ত হয়ে বসে থাকতে চন্দনের কষ্ট হচ্ছিল। পৃথিবীতে এখন হেমন্তের শুরু। আর নভোনি নাইন-এ হিমশীতল শীতের হাহাকার। এখানে পাঁচশো কোটি মানুষের কর্মব্যস্ততা, হইচই। অথচ চন্দন একা। আঠারো বছর নিরিবিলি শান্ত জীবন কাটিয়ে ও যেন অন্যরকম হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, মাধুরীকে ফোন করলে কেমন হয়! ভিজিফোনের ডিজিটাল প্যানেলে আঙুল ছোঁয়ালেই বম্বে আর কলকাতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। কিন্তু নিজেকে সংযত করেছে। চন্দন। আজ হোক, কাল হোক মাধুরী ওকে ফোন করবেই।

চতুর্থ দিনে ফোনটা এল।

মাধুরী ভিজি সারকিট অফ করে রেখেছিল, তাই শুধু ওর গলা শোনা গেছে–ছবি দেখা যায়নি। সুতরাং চন্দনও ওর ভিজি সারকিট অন করেনি।

অপারেটর লাইন দেওয়ামাত্রই শোনা গেল মাধুরীর গলা। কোনওরকম ভূমিকা না করেই ও বলল, এত বছর পর কেন ফিরে এলে, চন্দন?

তোমার জন্যে। তোমাকে এখনও আমি ভালোবাসি—

এখনও?

হ্যাঁ, এখনও। বিশ্বাস করো।

মাধুরী ওর নেশা ধরানো বিখ্যাত হাসি হাসল। এখন এ-হাসি শুধু চন্দনের জন্য। তারপর ঠাট্টার সুরে বলল, তোমার আই. কিউ. দেখছি আগের চেয়েও অনেক কমে গেছে, চন্দন

আই. কিউ. হয়তো কমেছে–ভালোবাসা কমেনি। চন্দন শান্ত গলায় বলতে চাইল। কিন্তু ওর বুকের ভেতরটা কীরকম যেন করছিল।

এই পাগলামির কথা প্রেসকে বলে তুমি আমাকে দারুণ পাবলিসিটি দিয়েছ। তার জন্যে ধন্যবাদ। জানোই তো, আমার এই বয়েসে এ-লাইনে পাবলিসিটি কুড়িয়ে বাড়িয়েই বাঁচতে হয়।

প্রেসকে আমি মিথ্যে কিছু বলিনি।

কী ইয়ারকি মারছ, চন্দন! তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে করতে চাও নাকি? এত বছর পরে এসবের কোনও মানে হয় না। প্রথম প্রেমের অসুখ কখনও এতদিন থাকে না।

আমার অসুখ সারেনি, মাধুরী।

বাজে কথা ছাড়ো, চন্দন। তুমি সত্যি সত্যি কী চাও বলো তো! মাধুরীর গলা তীক্ষ্ণ হয়েছে, বেড়ে যাওয়া বয়েস হঠাৎই উঁকি মেরেছে সেখানে।

চন্দন শান্ত গলায় বলল, প্রথমত আমি তোমাকে চাই। দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই। তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই। শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।

চন্দন, কী হচ্ছে! কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল মাধুরী। তারপর গলা শক্ত করে বলল, তুমি কেমন করে ভাবলে তোমাকে আমি বিয়ে করব? এখন তোমার পুঁজিতে সস্তা পাবলিসিটি ছাড়া আর কী আছে! আঠারো বছর আগে তোমার অন্তত যৌবন ছিল। এখন তাও নেই।

মাধুরী, তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে—

আমার ইচ্ছে করছে না।

প্লিজ, মাধুরী, একবার–একটিবার দেখা করো আমার সঙ্গে। আমি তোমার কাছে যাব–

ও-প্রান্ত চুপচাপ।

মাধুরী, তোমাকে আমি আঠারো বছর ধরে ভালোবেসেছি। আর তুমি-তুমি আমাকে আঠারো মিনিট সময় দিতে পারবে না!

কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর মাধুরী বলল, ঠিক আছে। এসো দেখা করতে। তবে বিয়ে আমি তোমাকে করব না।

.

মাঝরাতের কাছাকাছি কলকাতা ছেড়ে বম্বে রওনা হল চন্দন। সোলার ফেডারেশন ওর জন্য গোপনে একটা জেট প্লেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সকলের নজর এড়িয়ে সেই প্লেনে চড়ে বসেছে চন্দন। রিপোর্টাররা একবার এই খবর জানতে পারলেই সর্বনাশ! চন্দন প্লেনের জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছিল। ওর মনে পড়ছিল আঠারো বছর আগের দিনগুলোর কথা। সেই মিষ্টি ক্ষণগুলোর কথা। মাধুরীর সঙ্গে ওর দূরত্ব সময়ের হিসেবে আর মাত্র পনেরো মিনিট।

প্লেনটা একটু সেকেলে মডেলেরসলিড ফুয়েল পাওয়ার্ড জেট। তবুও ষোলো মিনিটের মাথায় ওকে পৌঁছে দিল বম্বে এয়ারপোর্টে। মাধুরী গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। রুপোলি রঙের টারবাইন পাওয়ার্ড লিমুজিন। সেই গাড়ি চন্দনকে নিয়ে বাতাসের বেগে উড়িয়ে নিয়ে গেল মাধুরীর বিলাস বাংলোয়।

কী নেই সেখানে।

কৃত্রিম হ্রদ। তার শান্ত জলে ছোট ছোট খেলনা-নৌকো ভাসছে। তাদের ঘিরে রঙিন আলোকমালা। হ্রদ থেকে সবুজ তৃণভূমি মসৃণভাবে ঢাল তৈরি করে উঠে গেছে ওপরে। সেখানে রূপসির কপালে মনোরম টিপের মতো সুন্দরী এক বাংলো। ধবধবে সাদা তার রং।

অপরূপ পথ বেয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল বাংলোর সামনে। চন্দন নেমে পড়ল। এবং ঢুকে পড়ল আঠারো বছর আগের এক স্বপ্নের মধ্যে।

বড় বড় ঘর আর ফিনফিনে পরদা পেরিয়ে ও দেখতে পেল মাধুরীকে। একটা সোফায় স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে বসে আছে। স্বপ্নের মতো। ভীষণ দামি এক পোশাক ওর শরীর ঢেকে রেখেছে। আর পোশাকের ভেতরের মেয়েটা–সেই আগের মতোই। চোখে কটাক্ষ, ভুরু সজীব, পুরু প্রাণবন্ত ঠোঁট। সব মিলিয়ে ওর বয়েস যেন বাড়েনি।

চন্দন খানিকটা দূর থেকেই দেখছিল মাধুরীকে।

মাধুরী!

কী দেখছ?

চন্দন হাত তুলে ক্ষণিক চুপ করতে বলল ওকে। তারপর অস্ফুটে উচ্চারণ করল, আমি স্বপ্ন দেখছি, মাধুরী। প্লিজ, আমাকে জাগিয়ে দিয়ো না–

তুমি বুড়িয়ে গেছ, চন্দন।

তেতাল্লিশে কেউ বুড়িয়ে যায় না। তবে তুমি ঠিক সেই আগের মতোই রয়ে গেছ।

তার জন্যে আমার ডাক্তারদের ধন্যবাদ দিও। কে বলবে আমার বয়েস চল্লিশ! তুমিও কসমেটিক সার্জারি করিয়ে নাও। খরচ যা লাগে আমি দেব। তখন আবার তুমি পঁচিশ বছরে ফিরে যাবে।

চন্দন আরও কাছে এগিয়ে এল। মাথা নাড়ল। বলল, গত আঠারোটা বছর আমি কিছুতেই আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাই না। সেই দিনগুলো আমি যে সবসময় তোমাকে নিয়েই ভেবেছি। তাই মনে রাখতে চাই।

মাধুরী কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, সত্যি করে বলো তো, তোমার মতলবটা কী!

তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।

ও খিলখিল করে হাসল। অসংখ্য হিরের কুচি যেন কেউ ঢেলে দিচ্ছে কোনও কাচের নলের ভেতরে। একসময় থামল মাধুরী, চোখের কোণ দিয়ে তাকাল ও আঠারো বছর আগে এই জেদের হয়তো মানে ছিল, আজ আর নেই। তাছাড়া লোকে বলবে, তুমি টাকার জন্যে আমাকে বিয়ে করছ। জানো তো, আমি এখন বেশ বড়লোক।

যে যা বলে বলুক। আমি তোমার টাকা চাই না। শুধু তোমাকে চাই।

মাধুরী উঠে পড়ল সোফা ছেড়ে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা গলায় বলল, চন্দন, চন্দন, আমাকে এই যে ফিরে পেতে চাইছ, এ তোমার নিছকই একটা জেদ। আঠারো বছর আগে তুমি যাকে ভালোবাসতে আমি মোটেই সেই মিষ্টি মেয়ে আর নই। আমি এই আঠারো বছরে আরও লোভী হয়েছি, আরও বুড়ি হয়েছি। আমাকে তুমি সইতে পারবে না, চন্দন।

মাধুরীর শরীর থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ টের পাচ্ছিল চন্দন। ওদের দুজনের মধ্যে আর মাত্র হাত কয়েক দূরত্ব। চন্দনের বুকের মধ্যে সেই পুরোনো কষ্টটা জেগে উঠছিল। চোখের নজর ঠিকঠাক কাজ করছিল না। ওর জীবনের শান্ত হ্রদে আঠারো বছর আগে একটা ঢিল পড়েছিল। মাধুরী এসেছিল। এতে ঢিলের কোনও কষ্ট হয় না। সে অতি দ্রুত ডুবে যায় হ্রদের জলের গভীরে। কিন্তু হ্রদে জেগে ওঠা তরঙ্গমালার যে কী কষ্ট! ওরা বারবার ছুটে যায় পাড়ের দিকে। মাথা কুটে ফিরে আসে। আবার যায়। আবার ফিরে আসে। শুধু যাওয়া-আসা চলতে থাকে।

আঠারো বছর ধরে হ্রদের পাড়ে মাথা কুটে মরেছে চন্দন। কিন্তু এখন অন্তত শেষ হোক ওর তরঙ্গের যন্ত্রণার জীবন!

মাধুরী, তোমাকে আমি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল তক, আপাদমস্তক, এখনও ভালোবাসি

তেতো হাসল মাধুরী। বলল, জানো, আমার এই শরীরটা কতবার ব্যবহার হয়েছে? বারোয়ারি পান্থনিবাসের মতো কত পথিক

চন্দনের মধ্যে কী হয়ে গেল। এক পলকে হাত কয়েকের দূরত্ব কমিয়ে ফেলে ও মাধুরীর ঠোঁটে হাত রাখল। থামিয়ে দিল ওর কথা। বলল, তোমার শরীরটাই ব্যবহার হয়েছে–মন ব্যবহার হয়নি, মাধুরী।

ঘুমিয়ে-চলা মানুষের মতো ডান হাতটা শূন্যে তুলল মাধুরী। আর চন্দন উষ্ণ হাতে সেই হাত আঁকড়ে ধরল!

মাধুরী অস্ফুট স্বরে বলল, আমার মাথা আর কাজ করছে না…

চন্দনের মনে পড়ল ডোনোই-এর কথা? তেমন করে যদি চাওয়া যায়, তাহলে ঠিক পাওয়া যায়। এই বিশ্বাস কখনও নষ্ট হতে দিয়ো না।

ডোনোই চন্দনের হাতে হাত রেখেছিল। অদৃশ্য ইচ্ছাশক্তি প্রবাহিত হয়েছিল হাত থেকে হাতে। এখন চন্দন ধরে রেখেছে মাধুরীর নরম ফরসা হাত। ও প্রাণপণে চাইছে, আর কখনও যেন এই দুটো হাতের মধ্যে কোনও দূরত্ব তৈরি না হয়।

ডোনোই বলেছিল? যে-প্রাণী চিন্তা করতে পারে, তারই ইচ্ছাশক্তি আছে।

চন্দন তীব্র আকুলভাবে মনে মনে একটাই কথা উচ্চারণ করছিল ও তোমাকে চাই।

ওর হাতের মুঠোয় মাধুরীর হাত কেঁপে উঠল। আর একই সঙ্গে মাধুরী হঠাৎ আঠারো বছরের পুরোনো স্বরে বলে উঠল, চন্দন, চলো, আমরা নভোনি-নাইন-এ চলে যাই। এখানে আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না

চন্দন মাধুরীকে কাছে টানল। কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই গভীর চুমু খেল ওর ঠোঁটে। তারপর অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল, আমি জানতাম, মাধুরী, আমি জানতাম

ও ভাবছিল, কাল নিউজ মিডিয়ার লোকজন নতুন এই খবরটা শুনে কী সাংঘাতিকভাবেই না চমকে উঠবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *