উনিশ বিষ

উনিশ বিষ

ইমেইলটার হেডিং দেখেই ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল পীতাম্বরের। এরকম খেলা কখনও আবার হয় নাকি! কী অদ্ভুত নাম: আলট্রানিউ পয়জন গেম!

পীতাম্বরের ই-মেইল আইডি-তে প্রচুর আজব মেইল আসে। যেমন, নামিবিয়ার কোনও ব্যাঙ্কে বেওয়ারিশ দেড় মিলিয়ান ডলার পড়ে আছে। সেই ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পীতাম্বরকে মেইল করে জানাচ্ছেন, টাকাটা তিনি পীতাম্বরের নামে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেবেন। এর জন্য কাগজপত্র যা-যা দরকার সবই তিনি তৈরি করবেন। পীতাম্বরকে শুধু বাড়ির ঠিকানা আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস জানাতে হবে। তারপর, টাকাটা দেশের বাইরে নিশ্চিন্তে পাঠিয়ে দেওয়ার পর, তিনি ইন্ডিয়াতে এসে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকাটা ভাগাভাগি করে নেবেন।

আবার এমন মেইল-ও আসে যাতে এক সুন্দরী বিদেশিনীর ফটোগ্রাফ ও অন্যান্য তথ্য রয়েছে। তিনি ভারতীয় পাত্র খুঁজছেন। পাত্রের বয়েস তিরিশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে হলেও আপত্তি নেই। আর বিপত্নীক কিংবা ডিভোর্সি হলেও চলবে।

পীতাম্বরের চেহারা ছোটখাটো। মাথায় বড়সড় টাক। বয়েস বাহান্ন পেরিয়েছে। কিন্তু হলে হবে কী। মেয়েটির ছবি বেশ লোভ জাগায়। সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ে গেল স্ত্রী পদ্মাবতীর কথা। পদ্মাবতী…। পদ্মাবতীর ব্যাপারটা আগে ভাবতে হবে।

আজব বিয়ের প্রস্তাব ছাড়া সাংঘাতিক ডিসকাউন্টে নানান সফটওয়্যার কেনার প্রস্তাবও আসে ই-মেইল-এ। আবার পুরুষত্বকে তেজি করে তোলার বিচিত্র সব পদ্ধতির খোঁজখবরও পাঠায় নানান কোম্পানি।

সাধারণত এসব মেইল পীতাম্বর খোলেন না। তাই এগুলো ইনবক্স-এ না এসে বালক-এ জমা হয়। যদি বালক-এর কোনও মেইল-এর টাইটল পীতাম্বরের কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয় তবেই তিনি সেই মেইলটা খোলেন।

যেমন এই ‘আলট্রানিউ পয়জন গেম’।

আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনও মেইল-এ সাড়া দেননি পীতাম্বর। কিন্তু এই পয়জন গেম-এর মেইলটা দেখে মনে হল, এটা খুলে একটু নেড়েচেড়ে দেখলে হয়।

কিন্তু ঠিক তখনই পদ্মাবতীর ডাক এল।

এ-ডাক নিশির ডাক। অথবা তার চেয়েও বেশি।

সুতরাং সঙ্গে-সঙ্গে ইয়াহু থেকে ‘সাইন আউট’ করলেন পীতাম্বর। চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতেই চেঁচিয়ে বললেন, ‘যাই—।’

বয়েস পঞ্চাশ পেরোলেও পীতাম্বরের সব ইন্দ্রিয় এখনও দিব্যি টগবগে। ফলে যে- ক্ষিপ্রতায় তিনি পদ্মাবতীর ডাক লক্ষ্য করে শব্দভেদী বাণের মতো ছুটে গেলেন সেটা অবাক করার মতো।

পদ্মাবতী বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। ওর গায়ে গোলাপি নাইটি জাতীয় যে-বস্তুটি চাপানো রয়েছে সেটা বোধহয় কাচের তৈরি। অথবা, গোলাপি রং-টা পদ্মাবতীর গায়ের রং-ও হতে পারে।

বউকে অচেনা পুরুষের চোখ দিয়ে দেখতে চাইলেন পীতাম্বর। সত্যি, ওর সারা শরীরে শুধুই মারকাটারি বক্ররেখা। ওর দিকে তাকানোমাত্রই দুটো জিনিসের কথা মনে পড়ে: সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’ কবিতা, আর ‘আবার খাব’ সন্দেশের কথা।

কিন্তু পীতাম্বর তো আর ‘অচেনা’ পুরুষ নন! তিনবছর আগে তাই ছিলেন। সুতরাং এখন পদ্মাবতীর দিকে তাকালে ও-দুটো জিনিসের কথা ওঁর আর মনে পড়ে না। বরং মনে পড়ে কবিতায় পড়া ‘ডাকিনী যোগিনী এল কত নাগিনী…’ লাইনটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও পদ্মাবতীর নেশার টান এড়াতে পারেন না পীতাম্বর। কী করে যেন তিরিশের এই মেয়েটা বাহান্নর পীতাম্বরকে এখনও বশ করে রাখতে পারছে। শুধু মাঝে-মাঝে ভেতরে-ভেতরে উথলে ওঠা প্রচণ্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়তে চান পীতাম্বর—কিন্তু ওই পর্যন্তই। কোন এক ম্যাজিকে এই মায়াবী মেয়েটা ওঁকে সামলে নেয়—যেমন, এখন।

স্বামীকে কাছে ডেকে পদ্মাবতী যেভাবে হামলে পড়ে তাঁকে আদর করতে শুরু করল তাতে মেনকাও লজ্জা পাবে। পীতাম্বর অবাক হয়ে কাঠ-কাঠ অবস্থায় আদর খাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন কতক্ষণ ব্যালান্স রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন।

পদ্মাবতীর আদরের কোনও সীমানা নেই। তা ছাড়া কতরকম কলাকৌশল যে ও জানে! ওর পাল্লায় পড়লে চিতায় ওঠা পুরুষও জেগে উঠবে। পীতাম্বরের মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা ঠিক স্বামী-স্ত্রীর আদর নয়, পদ্মাবতী কোনও ব্লু-ফিল্ম-এর শুটিং-এ শট দিচ্ছে।

সে যা দেয় দিক—মনের অনিচ্ছাসত্ত্বেও পীতাম্বরের শরীর অনেকক্ষণ আগেই জেগে উঠেছিল। পদ্মাবতী তাকে মেঝেতে পেড়ে ফেলল। তারপর প্রবল ঝটাপটি করে ডাকিনী-যোগিনীর মতো পীতাম্বরকে কাবু করে বলতে গেলে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিল।

একটু পরে পদ্মাবতী উঠে দাঁড়ালেও পীতাম্বর তুলোঠাসা পুতুলের মতো এলোমেলো হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে পড়ে রইলেন। বড়-বড় শ্বাস নিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। তৃপ্তিতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল প্রায়। কিন্তু এখনই অফিসে বেরোতে হবে—কামাই করা যাবে না। তাই জোরে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে পদ্মাবতীর ঘোর কাটালেন পীতাম্বর। শরীরটা আধপাক গড়িয়ে খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে হাতে-পায়ে ভর দিয়ে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।

পদ্মাবতীর দিকে তাকালেন পীতাম্বর। সত্যি, এসব ব্যাপারে ওর ক্যালির কোনও জবাব নেই। তখন পীতাম্বরের ওকে দারুণ লাগে। কিন্তু বাকি সময়টা অসহ্য।

পীতাম্বর একটু সঞ্চয়ী মনের মানুষ। ফলে আয় করেন দু-হাতে, কিন্তু ব্যয় করেন কড়ে আঙুলে। আর পদ্মাবতী যেন সেই ‘সঞ্চয় প্রকল্প’-এর পদ্ম বনে মত্ত হাতি। দু-হাতে খরচ করাটাই ওর প্রথম কথা এবং শেষ কথা। ব্যাপারটা অপছন্দ হলেও পীতাম্বরের কিছু করার নেই। কারণ, পদ্মার নেশায় পড়ে ওকে বিয়ে করার সময় সব সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানা ওর নামে লিখে দিয়েছেন।

‘কী হল? কী ভাবছ?’

পীতাম্বর চমকে উঠে বললেন, ‘কই, কিছু না তো?’

পদ্মাবতী জলতরঙ্গের শব্দ করে হাসল। পীতাম্বরের সামনেই ড্রেস বদলাতে শুরু করল। নতুন পোশাক পরতে-পরতে বলল, ‘শোনো, দুপুর দুটো নাগাদ জিমি আসবে। তারপর আমরা একটু বেরোব…ফিরতে রাত হবে…। তুমি ডিনার করে শুয়ে পোড়ো…।’

পীতাম্বরের গা জ্বালা করে উঠল। এই জিমিটার জন্যই পদ্মাবতীকে আরও অসহ্য লাগে। ছেলেটার যেমন কুকুরের মতো নাম তেমনই কুকুরের মতো স্বভাব। সবসময় পদ্মাবতীকে ঘিরে ছোঁকছোঁক করছে। জিভ বের করে লালা ঝরাচ্ছে।

পীতাম্বর ভালো করেই জানেন, পদ্মাবতী ডিভোর্স চায় না—জিমিকে বিয়ে করতেও চায় না। কারণ, পীতাম্বরের টাকাপয়সা, এসি ফ্ল্যাটের আরাম, প্রিমিয়াম গাড়ির নরম গদি সবই পদ্মার দারুণ পছন্দ। তার পাশাপাশি ওর দরকার একটা পোষা তেজি যুবক—যে সবসময় মুখবুজে ওর ফরমাশ খাটবে আর ওর প্রবল আহ্লাদের চাপে কখনও কাহিল হয়ে পড়বে না। ফলে পদ্মাবতী যে উৎফুল্ল থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু পীতাম্বর? সবসময় অসহ্য এক টানাপোড়েনের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন—নাকি মরে রয়েছেন! চোখের সামনে রোজ জিমির হ্যাংলাপনা পীতাম্বরের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু পদ্মার মুখের ওপর কিছু বলতে পারেন না—শুধু ভেতরে-ভেতরে ছটফট করেন।

যদি পদ্মাবতীকে কোনওভাবে সরিয়ে দেওয়া যেত? তা হলে জিমির সমস্যাটাও আর থাকত না। পীতাম্বরের গলায় এঁটে বসা ফাঁসটা খুলে যেত তখন।

সেই দিনটার কথা ভেবে পীতাম্বরের মন ভালো হয়ে যায় পলকে। ইস, যদি…।

পদ্মাবতী চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার পরেও পীতাম্বর ঘোর লাগা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। আসলে তখন ভাবছিলেন, কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ‘আলট্রানিউ পয়জন গেম’ মেইলটার মধ্যে।

বিষ মেশানো খাবার একই টেবিলে বসে খাবে ছ’জন। কিন্তু মারা যাবে চারজন। দুজন দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকবে। এটা কীভাবে সম্ভব?

আপনি কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন?

বিষ মেশানো খাবার একইসঙ্গে বসে সমানভাবে ভাগ করে খাবে তিনজন। কিন্তু মারা যাবে দুজন। তৃতীয়জন বেঁচে থাকবে।

কেমন করে বলতে পারেন?

বিষ মেশানো খাবার খেল তিনজন। একজন মারা গেল। বেঁচে রইল দুজন।

বলুন, কোন ম্যাজিকে এটা সম্ভব?

ই-মেইলটায় এইরকম অদ্ভুত তীব্র সব প্রশ্ন। আর তার সঙ্গে কার্টুন ছবির ঢঙে আঁকা অ্যানিমেশান। খাবার টেবিলে বসে সবাই খাবার ভাগ করে নিচ্ছে। তাতে নীলরঙের বিষ মেশানো হচ্ছে। তারপর সবাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে। এবং কয়েকজন টেবিলেই ঢলে পড়ছে—বাকি কয়েকজন দিব্যি বেঁচে থাকছে।

সিনেমার মতো বারবার একই ঘটনা দেখাচ্ছে কার্টুন অ্যানিমেশান। তার নীচে বিজ্ঞাপনের কায়দায় নানান স্লোগান লেখা। আর সবশেষে একটা মোবাইল নম্বর। নম্বরটার পাশে লাল রঙের হরফে লেখা: রয়েছে ইফ ইউ ওয়ান্ট টু প্লে দ্য পয়জন গেম কনট্যাক্ট ইমিডিয়েটলি।

পীতাম্বর ই-মেইলটা বারবার পড়লেন। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন। কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে মোবাইলের বোতাম টিপে নম্বরটা স্টোর করে নিলেন।

পদ্মাবতী এখন বাড়িতে নেই। নিশ্চয়ই কুকুরটাকে বগলদাবা করে কোথাও ঘুরতে গেছে। অথবা দুজনে কোনও জলপান স্টোর্সে পাশাপাশি গ্লাস হাতে বসে চাপা গলায় বুড়বুড়ি কাটছে।

তবুও কী ভেবে কম্পিউটার-টেবিল ছেড়ে ঘরের বাইরে এলেন পীতাম্বর। ফ্ল্যাটের এ-ঘর ও-ঘর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, পদ্মাবতী সত্যিই ফ্ল্যাটে নেই।

তারপর ‘আলট্রানিউ পয়জন গেম’-এর ফোন নম্বরে ফোন করলেন।

‘গুড মর্নিং। আলট্রানিউ পয়জন গেম। মে আই হেলপ ইউ?’ মিষ্টি গলায় একটি মেয়ে কথা বলল।

পীতাম্বর মাথা চুলকোলেন দুবার। তারপর খসখসে গলায় বললেন, ‘আপনাদের এই নতুন পয়জন গেমটার ব্যাপারে একটু ডিটেইলসে জানতে চাই…।’

কথাবার্তা চালাতে কোনও অসুবিধে হল না। ওদের ঠিকানা লিখে নিলেন পীতাম্বর। বললেন, যে, আগামীকাল তিনি ওদের অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করবেন।

মেয়েটি একগাল হেসে বলল, ‘আই ওয়েলকাম ইউ টু আওয়ার গেমল্যান্ড, স্যার..।’

পীতাম্বরের বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ হচ্ছিল। বারবার ভাবছিলেন, ব্যাপারটা কি শুধু গেম, নাকি তার চেয়েও কিছু বেশি?

এই কথা ভাবতে-ভাবতেই পরদিন পয়জন গেমের ঠিকানায় পৌঁছে গেলেন পীতাম্বর। এবং ওদের দোকান—কিংবা অফিস—দেখে রীতিমতো হতাশ হলেন।

থুত্থুড়ে একটা তিনতলা বাড়ি কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাইরের পলেস্তারা-খসা নোনা-ধরা চেহারাটা এমন যেন আগমার্কা ভূতুড়ে বাড়ি। দেখে পীতাম্বরের মনে হল, জোরে ঝড়ঝাপটা এলেই কাঠামোটা হুড়মুড় করে খসে পড়বে।

বাড়ির একতলায় একটা ছোট দরজা। তার মাথাতেই একটা বড় সাইনবোর্ড। বোর্ডের লেখা যথেষ্ট রং-চটা হলেও পড়া যাচ্ছে: রানিবালা চিকিৎসালয়। তার নীচে লেখা: অব্যর্থ কবিরাজি ঔষধে বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া দোকানের ঠিকানাটা শেষ লাইনে লেখা। কাঁচা হাতে নতুন রং বুলিয়ে ঠিকানাটাকে স্পষ্ট করা হয়েছে।

ঢুকব-কি-ঢুকব-না করেও দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়লেন পীতাম্বর। বাড়িটার বাইরের চেহারা যেমন ভেতরটাও তাই। সামনে তেলচিটে ধরা কাঠের শো-কেস কাম কাউন্টার। তার কাচগুলো সব ময়লা হলদেটে। কোনও-কোনও ফাটা কাচ আঠা দিয়ে কাগজ জুড়ে মেরামত করা হয়েছে।

ঘরের পিছনের দেওয়ালে দুটো বড়-বড় কাঠের আলমারি। আলমারির পাল্লায় কাচ বসানো। তবে কয়েকটা খোপে কাচ নেই। আর কয়েকটা ফাটা কাচ কাগজ সেঁটে সামাল দেওয়া হয়েছে। কাচগুলো ময়লা হলেও তার ভেতর দিয়ে তাকে রাখা প্রচুর শিশি-বোতল বেশ নজরে পড়ছে। ডানদিকের আলমারির পাশ ঘেঁষে একটা সরু পথ। পথের মুখ কালো পরদায় ঢাকা।

পীতাম্বর ঘরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। ঘরের ফাঁকা দেওয়ালের বেশিরভাগ অংশই নানান ঠাকুর-দেবতার ক্যালেন্ডারে ঢাকা। সিলিং-এ ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে একটা বেঢপ মাপের পাখা ঘুরছে। তার হাওয়ায় ক্যালেন্ডারগুলো ছটফটে পাখির মতো উড়ছে।

ঘরে কাউকে দেখতে পেলেন না পীতাম্বর। ভুরু কুঁচকে গেল। তা হলে কি চলে যাবেন? কিন্তু ঠিকানাটা তো ঠিক-ঠিক মিলেছে!

শেষ পর্যন্ত কাউন্টারে ঠকঠক করে শব্দ করলেন, আর একইসঙ্গে ডেকে উঠলেন, ‘কেউ আছেন?’

সঙ্গে-সঙ্গে ‘আছি—আছি—’ বলতে-বলতে একগাল স্মিত হাসি নিয়ে একজন বেঁটেখাটো চেহারার বৃদ্ধ কালো পরদা সরিয়ে কাউন্টারের কাছে চলে এলেন। রং ফরসা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মাথার চুল সাদা ধপধপে হলেও গোঁফে সাদা-কালোর মিশেল রয়েছে।

বৃদ্ধের গায়ে একটা ময়লা ঘিয়ে রঙের ফুলহাতা শার্ট। পায়ে একইরকম ময়লা একটা খাকি প্যান্ট।

পীতাম্বর লক্ষ করলেন, বৃদ্ধ একটু খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।

‘বলুন—’ বলে ছোট্ট করে কাশলেন। ডানদিকের গালটা একবার চুলকে নিলেন।

‘আমার ই-মেইল-এ আপনাদের একটা গেম—মানে, আলট্রানিউ পয়জন গেম—তার একটা অ্যাড দেখেছি…।’ পীতাম্বর ইতস্তত করে একটু থামলেন।

বৃদ্ধের উজ্জ্বল চোখ সরাসরি ভেদ করল পীতাম্বরকে। একটু হেসে যেন অভয় দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—বলুন…।’

‘মানে, ওই পয়জন গেমটা সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিতে এসেছি। ওটার অ্যানিমেশান দেখে এত ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে…।’

‘তাই?’ পীতাম্বরকে জরিপ করলেন বৃদ্ধ। একটুকরো শব্দ করে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আসুন—ভেতরে আসুন—।’

কাউন্টারের একপাশের ডলা তুলে বৃদ্ধ পীতাম্বরকে ভেতরে আসতে ইশারা করলেন।

বৃদ্ধের পোশাক থেকে আতর টাইপের একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল। কাউন্টার ডিঙিয়ে ওপাশে ঢুকতেই গন্ধটা আরও উগ্র হল।

পীতাম্বরের কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছিল।

আধুনিক পদ্ধতিতে ই-মেইল-এ বিজ্ঞাপন। মোবাইল নম্বরে ফোন করে শোনা গেল আধুনিক তরুণীর মিষ্টি গলা। অথচ আসল জায়গায় এসে এ কী উলটো ছবি! যেমন সেকেলে জরাজীর্ণ দোকানঘর তেমনই নড়বড়ে দোকানদার! ব্যাপারটা পুরোপুরি ঠাট্টা নয়তো?

পরদা সরিয়ে ভেতরের ঘরটায় ঢুকলেন বৃদ্ধ। পিছন-পিছন পীতাম্বরও।

ঢুকতেই পীতাম্বরের নাকে বিচিত্র গন্ধের একটা ঝাপটা এসে ধাক্কা মারল। ওঁর মনে হল, একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে এসে পড়েছেন। কারণ, ঘরটা শিশি-বোতলে ছয়লাপ। তার কোনওটায় সাদা পাউডার, কোনওটায় রঙিন তরল, আবার কোনওটায় ছোট কিংবা বড় ট্যাবলেট। এ ছাড়া শুকনো গাছগাছড়া শেকড়বাকড়ও কিছু কম নেই।

ঘরের এককোণে একটা ছোট টেবিল। তার দু-দিকে মোট তিনটে চেয়ার। টেবিলে কিছু কাগজপত্র, খাতা, তিনটে বলপয়েন্ট পেন, আর একটা পুরোনো মডেলের টেলিফোন।

বৃদ্ধ একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। একটু হাঁপ ছেড়ে টেবিলের উলটোদিকের একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন।’

পীতাম্বর চারপাশে নজর বোলাতে-বোলাতে বসে পড়লেন।

‘এবারে বলুন স্যার, আপনার কী উপকার করতে পারি…।’

‘ওই যে বললাম…ওই পয়জন গেম-এর ব্যাপারটা…।’

পীতাম্বরকে খুঁটিয়ে দেখলেন বৃদ্ধ। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আসলে ওই গেমের একটা অ্যানিমেশান সিডি আমরা বিক্রি করি। দাম দুশো তিরিশ টাকা। কম্পিউটারে গেমটা লোড করে আপনি খেলতে পারেন। মানে, টাইম পাস করার জন্যে। ওতে অনেক অপশন আছে, অনেক পাজল আছে পয়েন্ট আছে—আপনি ভালোই এনজয় করতে পারবেন…।’

পীতাম্বরের মুখে বিরক্তি আর হতাশা ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে খুকখুক করে হাসলেন বৃদ্ধ। ভুরু উঁচিয়ে সরাসরি তাকালেন পীতাম্বরের চোখে। বললেন, ‘বুঝতে পারছি, আপনি খুশি হননি…।’

কেমিক্যালের শিশি-বোতলগুলোর দিকে ইশারা করে দেখালেন পীতাম্বর: ‘এগুলো তা হলে কী? ওই গেমের জন্যে? নাকি…।’

‘ঠিক ধরেছেন।’ ওপর-নীচে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ: ‘এগুলো আসল পয়জন গেমের জন্যে।’ হঠাৎই শিরদাঁড়া সোজা করে বসলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘বলুন, কে আপনাকে ট্রাবল দিচ্ছে? কাকে আপনি মাইনাস করতে চান?’

পীতাম্বর এ ধরনের সরাসরি প্রশ্নে একটু বিব্রত হলেন। চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন। এদিক-ওদিক তাকালেন।

বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘সিক্রেসি আমার গুডউইল। আমি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মেটাই—বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিই, ব্যস।’

কেমিক্যালের গন্ধে পীতাম্বরের দম আটকে যাচ্ছিল। মাথার ওপরে ছোট একটা পাখা ঘুরলেও পীতাম্বর বেশ ঘামছিলেন।

‘আমি…মানে…।’

‘আপনি কি আপনার ওয়াইফকে সরাতে চান?’

বৃদ্ধের প্রশ্নে যেন ইলেকট্রিক শখ খেলেন পীতাম্বর। ওঁর শরীর কেঁপে গেল। মনের কথা পড়তে পারে নাকি এই বুড়োটা!

দোকানদার সবজান্তা-হাসি হাসলেন: ‘অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই। আমার কাছে হাজব্যান্ড-ওয়াইফ-এর কেসই বেশি আসে। হয় হাজব্যান্ড ওয়াইফকে সরাতে চায়, নয় ওয়াইফ হাজব্যান্ডকে। আপনি…।’

বৃদ্ধকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে পীতাম্বর বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—ওয়াইফকে।’

জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে একটা দুঃখের শব্দ করলেন বৃদ্ধ। নরম গলায় বললেন, ‘একটা সময়ের পর সব বিয়ে কেমন তেতো হয়ে যায়। তখন মনটা মুক্তি চায়। কিন্তু ”মুক্তি, ওরে মুক্তি কোথায় পাবি…” ‘ হাসলেন বৃদ্ধ: ‘আর সেইজন্যেই আপনাদের মতো নিপীড়িত ক্লায়েন্টদের আমি সার্ভিস দিই…।’

‘এবারে আসল কথায় আসি—’ হাতে হাত ঘষে পীতাম্বরের দিকে ঝুঁকে এলেন বৃদ্ধ: ‘যে আলট্রানিউ পয়জনটার কথা আপনাকে এখন বলব সেটা আমার বাবার আবিষ্কার। আমার বাবা নেপালপদ সরকার এককালের বিখ্যাত কোবরেজ ছিলেন। খাবার তৈরি মোদক একবার খেলে মানুষ নেশার ফাঁদে পড়ে যেত। বাবা সবসময়েই হাজাররকম গাছগাছড়ার নির্যাস আর কেমিক্যাল নিয়ে হাজাররকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। তো ওইসব করতে-করতেই একদিন—আজ থেকে প্রায় বাহাত্তর বছর আগে—এক মারকাটারি বিষ আবিষ্কার করলেন। তার কেমিক্যাল ফরমুলা এখন আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।’

পীতাম্বর অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘মারকাটারি বিষ মানে?’

এ-প্রশ্নে বৃদ্ধ বেশ মজা করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘মারকাটারি মানে একেবারে স্পেশাল টাইপের অব্যর্থ বিষ। এই ধরুন খাবারের মধ্যে এই বিষ মাপা পরিমাণে মিশিয়ে আপনি আর আপনার ওয়াইফ একসঙ্গে খেয়ে নিলেন। আপনার ওয়াইফ যে মারা যাবেন তার একেবারে ফুল গ্যারান্টি। কিন্তু আপনি, বিষাক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও বেঁচে যাবেন। মানে, দু-চারদিন নার্সিংহোমে কাটাতে হলেও প্রাণে বেঁচে যাবেন। তখন পুলিশ আপনাকে মোটেই সন্দেহ করবে না—যেহেতু একই বিষ মেশানো খাবার আপনিও খেয়েছেন, অথচ লাকিলি আপনি বেঁচে গেছেন।

‘ব্যস, তখন মুক্তি—এবং মনের মতো করে নবজীবন শুরু। এককথায় আনন্দের আর সীমা নেই? কী বলেন?’

পীতাম্বর মন্ত্রমুগ্ধের মতো বৃদ্ধের কথা শুনছিলেন। এসব কি রূপকথা, নাকি বাস্তব? ওঁর বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছিল কেউ, আর অঝোরে লোভের লালা ঝরছিল।

কিন্তু ভদ্রলোকের কথাবার্তায় কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে না! বিষ মেশানো খাবার খেলেন দুজন—কিন্তু একজন বেঁচে যাবে কেমন করে? তার রহস্যটা বৃদ্ধ এখনও ফাঁস করেননি।

সে-কথা জিগ্যেস করতেই টেবিলে চাপড় মেরে হেসে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘ওটাই তো আসল মিস্ট্রি। ওটার জন্যেই তো আমার এত পসার।

‘এবার মনোযোগ দিয়ে কৌশলটা শুনুন…’ বৃদ্ধ বড় করে একটা হাই তুললেন। হাঁ করে মুখের সামনে দু-আঙুলে কয়েকবার তুড়ি বাজালেন। তারপর: ‘ওই বিষটার একটা অ্যান্টিডোট—মানে, প্রতিষেধক—বাবা তৈরি করতে পেরেছিলেন। আসলে সেটাও একরকমের হালকা বিষ।

‘বিষ মেশানো খাবার খাওয়ার আগে…ঠিক তিনঘণ্টা আগে…ওই অ্যান্টিডোটটা খেয়ে নিতে হবে। তা হলেই আপনি হয়ে গেলেন পুরোপুরি সুরক্ষিত। তখন মনের আনন্দে বিষ মেশানো খাবার খান—নো প্রবলেম। তবে হ্যাঁ…’ মাথা চুলকোলেন বৃদ্ধ। চোয়ালে হাত বোলালেন। বললেন, ‘তবে হ্যাঁ…একটু কষ্ট তো হবেই। আপনি বিষ মেশানো খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, নার্সিংহোমে যাবেন, জীবন নিয়ে একটু টানাটানি হবে—কিন্তু শেষ পর্যন্ত যমরাজ জিতবে না…আপনিই জিতবেন। আর…বুঝতেই পারছেন, আপনাকে সন্দেহ করার কোনও প্রশ্নই উঠবে না…।’

টেবিলে চাপড় মেরে বক্তৃতা শেষ করলেন বৃদ্ধ। মুখে তৃপ্তির হাসি। কারণ, ব্যাপারটা তিনি ক্লায়েন্টকে ঠিকমতো বোঝাতে পেরেছেন।

পীতাম্বরও মনে-মনে খুশি হয়েছিলেন। সত্যিই এই প্ল্যানটায় হিসেবের কোনও ফাঁক নেই। তবে একটা ছোট্ট প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে: বিষটায় কোনও গন্ধ নেই তো! খাবারে মেশানোর পর যদি উৎকট কোনও গন্ধ পাওয়া যায়…?

সেই প্রশ্ন করতেই বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘নো প্রবলেম। মাংসের ঝোল।’

‘মাংসের ঝোল মানে?’

‘আপনার ওয়াইফ মাংস খেতে পছন্দ করেন তো?’

‘পছন্দ মানে! ও পুরোপুরি মাংসাশী প্রাণী। কষা মাংস ওর হট ফেবারিট।’

‘চমৎকার। বেশ করে মশলাপাতি দিয়ে কষে মাংস রান্না করার বন্দোবস্ত করবেন। মানে, দুজনের জন্যে। তাতে আমি যে-শিশিটা দেব ওটার লিকুইডটা পুরোটা ঢেলে দেবেন। ব্যস—কাজ শেষ।’

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন পীতাম্বর। কোথাও কোনও রিস্ক ফ্যাক্টর আছে কিনা সেটাই খতিয়ে দেখছিলেন। পদ্মাবতীর মুখটা মনে পড়ল ওঁর। কল্পনায় দেখলেন, সেই সুন্দর মুখটা চোখের পলকে নীল হয়ে গেল।

মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তাই বৃদ্ধের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কত?’

‘বিশহাজার।’

‘বিশহাজার?’ আলট্রানিউ পয়জনের দাম শুনে আঁতকে উঠলেন পীতাম্বর।

‘হ্যাঁ, স্যার—বিশহাজার।’ হাসলেন বৃদ্ধ: ‘দামটা বেশি মনে হলে আপনি বরং ছুরি দিয়ে কাজ সেরে নিন—বিশটাকায় হয়ে যাবে। আর যদি ঘরোয়া কোনও ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করেন তা হলে পুরো বিনিপয়সায় হয়ে যাবে…।’ একটু কেশে নিয়ে আরও যোগ করলেন, ‘আপনার যা সমস্যা তাতে বিশহাজার তো জলের দর!’

পীতাম্বর টাকা খরচ করার চেয়ে জমাতেই বেশি ভালোবাসেন। পদ্মাবতীর উচ্ছৃংখল খরচের লাটসাহেবিয়ানা পীতাম্বরকে ভেতরে-ভেতরে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। তাই বৃদ্ধের মুখে বিষের দাম শুনে তিনি রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছেন। কিন্তু…।

এ ছাড়া উপায়ও তো নেই।

তবে একটাই সান্ত্বনা, এই বিশহাজার টাকা খরচ করার পর তিনি পদ্মাবতীর বেপরোয়া খরচের জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি পাবেন—চিরকালের জন্যে।

পীতাম্বর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, ‘ও. কে., এগ্রিড। বিশহাজার।’

‘আপনি বুদ্ধিমান। থ্যাংক ইউ—’ হেসে বললেন বৃদ্ধ, ‘এবারে আপনার কাজ হল পাঁচহাজার টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া। তারপর পরশুদিন সন্ধেবেলা এসে বাকি পনেরো দিয়ে…ইয়ে…মানে ওষুধের শিশিদুটো নিয়ে যাওয়া…।’

পরশু পনেরোহাজার টাকা দিয়ে দেওয়ার পর যদি বাই চান্স ওষুধে কাজ না হয়, তখন?

পীতাম্বর বেশ দোটানায় পড়ে গেলেন। কেস জন্ডিস হয়ে গেলে পীতাম্বর কার নামে অভিযোগ করবেন? আর কার কাছেই-বা করবেন? এই বুড়োটা যদি ডাহা ঠকায়, তখন? আচ্ছা, পরশুদিন পাঁচহাজার দিলে হয় না—তার পরে, কাজ ঠিকমতো চুকে গেলে বাকি দশ?

সে-কথাই বৃদ্ধকে বললেন পীতাম্বর।

বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘হতে পারে—তবে একটা কন্ডিশান আছে। পরশুদিন আপনাকে আইডেন্টিটি প্রূফ আর অ্যাড্রেস প্রূফ নিয়ে আসতে হবে—মানে, ভোটার কার্ড আর লেটেস্ট ইলেকট্রিক বিল কিংবা টেলিফোন বিল নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, আলট্রানিউ পয়জনের কাজ মিটে গেলে যদি আপনি আর টাকা না দেন? তখন আমি কার পেছনে টাকার জন্যে ঘুরব?…যদি রাজি থাকেন তা হলে পাঁচহাজার টাকা দিন—।’

অ্যাড্রেস প্রূফের কথা বলতেই পীতাম্বরের মুখে ফুটে ওঠা অস্বস্তির ভাব বৃদ্ধের নজর এড়ায়নি। তিনি গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘বেকার দুশ্চিন্তা করবেন না। আগেই তো বলেছি, সিক্রেসি আমাদের গুডউইল। ক্লায়েন্টদের ট্রাস্ট যদি একবার চলে যায় তা হলে আমার ব্যবসা দু-দিনেই লাটে উঠবে। সুতরাং—’ একবার কানের লতি চুলকে নিলেন: ‘সুতরাং পরশু সন্ধেবেলা সাতটা নাগাদ নিশ্চিন্তে চলে আসুন আইডেন্টিটি প্রূফ আর অ্যাড্রেস প্রূফ নিয়ে…সঙ্গে ক্যাশ পাঁচহাজার টাকা।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন: ‘এখন তা হলে পাঁচহাজার দিন…।’

পীতাম্বর নীরবে শর্ত পালন করলেন।

বৃদ্ধ একটা খাতা খুলে ছোট-ছোট হরফে কীসব লিখে নিলেন। তারপর খাতা থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘তা হলে এই কথা রইল। পরশু সন্ধে সাতটা।’

নীল লেবেল লাগানো ছোট্ট শিশিটার দিকে তাকালেন পীতাম্বর।

কবিরাজ নেপালপদ সরকারের আশ্চর্য আবিষ্কার। হালকা বিষ। অ্যান্টিডোট। প্রতিষেধক। আসল বিষের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র দাওয়াই।

এটা খাওয়ার পর তিনঘণ্টা কাটবে। রাত দশটা নাগাদ তিনি আর পদ্মা খেতে বসবেন। তেল ঝাল মশলা দিয়ে রান্না করা কষা মাংস আর পরোটা—সঙ্গে বাদশাহী স্যালাড। মাংসের মধ্যে মেশানো থাকবে লাল লেবেল লাগানো শিশির মারাত্মক বিষ। তার একফোঁটা গন্ধও টের পাবে না পদ্মাবতী। কারণ, রানিবালা চিকিৎসালয়ের বৃদ্ধ দোকানদার বলেছেন, বিষটা কষা মাংসে মিশিয়ে দিলে তার কোনও স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া বেশিরভাগ রাতেই পদ্মা অল্পবিস্তর নেশা করে ফেরে।

সুতরাং কষা মাংস এবং পরোটা ইত্যাদি খাওয়ার পরেই পদ্মার গল্প শেষ। নতুন গল্প শুরু।

এইসব কথা চিন্তা করতে-করতে নীল লেবেল লাগনো শিশিটার ছিপি খুললেন পীতাম্বর। মাথা পিছনে হেলিয়ে বড় মাপের হাঁ করে শিশির স্বচ্ছ তরলটুকু নিশ্চিন্তে গলায় ঢেলে দিলেন।

পীতাম্বরের গলা জ্বলতে শুরু করেছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে-করতে তিনি খাওয়ার টেবিলে রাখা জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ালেন। কিন্তু ঠিকমতো বোতলটা ধরতে পারলেন না। ওঁর হাতের ধাক্কায় বোতলটা টেবিলে কাত হয়ে পড়ে গেল। জলে ভেসে গেল টেবিল।

পীতাম্বরের হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ। দম নিতে অসহ্য কষ্ট হচ্ছিল।

ওঁর শরীরটা হঠাৎই টলে পড়ে গেল মেঝেতে। সেই অবস্থাতেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনটা বের করার চেষ্টা করলেন—পারলেন না।

ওঁর গল্প শেষ হয়ে গেল।

মারা যাওয়ার আগে পীতাম্বরের শেষ চিন্তা ছিল, দুটো শিশির লাল আর নীল রঙের লেবেল ভুল করে উলটে যায়নি তো!

পদ্মাবতী রাতে ফিরে পীতাম্বরের মৃতদেহটা দেখতে পেল। সঙ্গে-সঙ্গে ও মোবাইল ফোনের বোতাম টিপে একটা নম্বর ডায়াল করল।

‘হ্যালো, রানিবালা চিকিৎসালয়?’

‘হ্যাঁ—বলুন।’

‘আমি পীতাম্বর বিশ্বাসের ওয়াইফ বলছি। কাজটা হয়ে গেছে…।’

‘আপনি খুশি তো, ম্যাডাম?’

‘অফ কোর্স।’

‘ক্লায়েন্টদের স্যাটিসফ্যাকশনই আমাদের মটো। এবার তা হলে…ইয়ে…আমাদের সার্ভিস চার্জের বাকি বিশহাজার টাকাটা কাউকে দিয়ে কাইন্ডলি একটু পাঠিয়ে দেবেন। আপনাকে তো আগেই বলেছি, টোটাল তিরিশ হাজারের দশহাজার টাকা আপনার হাজব্যান্ড দিয়ে গিয়েছিলেন…।’

‘কোনও চিন্তা করবেন না—কালই টাকাটা পাঠিয়ে দেব।’

‘থ্যাংক ইউ, ম্যাডাম।’

ফোনে কথা শেষ করে বৃদ্ধ ভাবছিলেন। কী অদ্ভুত পেশায় তিনি জড়িয়ে আছেন! যারা খুন হতে চায় তারা নিজের ইচ্ছেয় তাঁর দোকানে আসে। খুন হওয়ার জন্য আগাম দেয়…অবশ্য কেউ-কেউ পুরো পেমেন্টও করে দেয়। তারপর নিজেই নিজেকে খুন করে। আর পুলিশের খাতায় সুইসাইডের সংখ্যা একটা বেড়ে যায়।

ইস, খুন হয়ে যাওয়া লোকগুলো যদি জানত আসল ক্লায়েন্টরা কখনও তাঁর দোকানে আসে না—তারা ফোনেই কাজ সারে—আর নিজের কবর খোঁড়ার জন্য শিকারকেই পাঠিয়ে দেয় তাঁর দোকানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *