৩. বাইক আরোহী

অধ্যায় ২১

বাইক আরোহী ওর নাকের ডগা দিয়েই যায়। চাইলে হাত খানিকটা বাড়িয়ে ওর টয়োটা করোলা ছোঁয়া যেত। কিন্তু গু-গন্ধী জটাধারী ওরফে সুপার এজেন্ট বুলশিট ওরফে ইভান সারভব হাত বাড়িয়ে নিজের হাত হারানোর ঝুঁকিতে যায় না।

সে এখন ভ্রাম্যমাণ সিগারেট বিক্রেতা। খদ্দের এসে পান চায়। সে এক খিলি পান প্রস্তুত করে দেয়। আরেকজন এসে বেনসন লাইট চায়। সে বেনসন লাইট দেয়।

এখন আর তার গায়ে শুয়ের গন্ধ নেই। খদ্দেররা আর তাকে দেখে ছ্যা ছ্যা করে না। নাক চেপে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় না। তার পরনে দুমড়ানো মোচড়ানো সাদা শার্ট আর সুতির লুঙ্গি। জটাধারী হওয়ার সময় মুখে কালো রং ঘষে দিয়েছিল ও, এবার চেহারায় কালোর পরিমাণ তুলনামূলক কম। এখন সে শ্যামলা, অনুজ্জ্বল শ্যামলা।

দালানটা দুইতলা। এখানেই ঢুকেছিল বাইক চালক। অবশ্য পথে নিজের বাহন পরিবর্তন করে সে টয়োটা করোলা চালক হয়ে গেছে। ডক্টরের প্যাকেট ডেলিভারি দিলো খুব সম্ভবত। সাথে নিশ্চয়ই কর্তার পিঠ চাপড়ানিও পেয়েছে। অবশ্য চালকের মুখ দেখে সেটা মনে হয় নাই। গম্ভীর মুখ, চিন্তাক্লিষ্ট। প্রশংসা কিংবা পিঠ চাপড়ানি পেয়ে মুখে যে একশো ওয়াটের বাতি জ্বলে ওঠে, ওটা আর দেখা যায় নি। বাতি মনে হয় ফিউজড।

দালানের বাইরে উঁচু গেট, সীমানা প্রাচীরও যথেষ্ট উঁচু। উপরে কাঁটাতার। নির্দিষ্ট বিরতিতে একটা করে সিসিটিভি ক্যামেরা। কান এড়ায় না কুকুরের ঘরঘর গর্জন। আওয়াজ চিনতে একটুও ভুল হয় না সারভবের।

জার্মান শেফার্ড।

সিকিউরিটি খুব টাইট। কিন্তু প্রশ্ন হলো এতো টাইট কেন? কে থাকে এর ভেতরে?

চায়না থেকে যে রহস্যময় সম্পদ সাথে করে নিয়ে এসেছেন ডক্টর তার পেছনে অনেকেই ঘুরছে। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ইউরোপের অনেক দেশ। প্রতিদ্বন্ধীর সংখ্যা কম না। ব্যাপারটা বুলশিট জানে।

কিন্তু বাইক চালক কার আজ্ঞাবহ? কার হয়ে কাজ করছে ও?

সময় গড়ায়। রাত হয়। ঘুরে ঘুরে সিগারেট বিলি করে বেড়ায় বুলশিট, ছড়িয়ে দেয় ক্যান্সারের ব্যামো। আর দুর্গ প্রদক্ষিণ করে ছিদ্র খুঁজে।

পেছনে একটা টং দোকান আছে। দোকানের ওপর উঠে কী একটা চেষ্টা করা যায়?

না, দেয়ালের সাথে দূরত্ব অনেক। সম্ভব নয়। সম্ভব হতো যদি সে ফ্যান্টাস্টিক ফোরের মিঃ ফ্যান্টাস্টিক হতো যে কিনা ইচ্ছামতো নিজের শরীরের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু সে মিঃ ফ্যান্টাস্টিক

কিন্তু চাইলে সে মিশন ইম্পসিবলের ইথান হান্ট হয়ে যেতে পারে! উঁচু দালান বেয়ে উঠা তো হান্টের কাছে দুধভাত।

মলোটভকে মেসেজ পাঠায় ও। দড়ি দরকার। ক্লাইম্বিং রোপ। সিসিটিভি ক্যামেরাকে অকেজো করার জন্য দরকার ইনফ্রারেড লেজার। অন্ধকারে দেখার জন্য দরকার বিশেষ ধরণের গগলস। একজন সহকারীও দরকার। লেজার মেরে ক্যামেরা অকেজো করে দেয়ার জন্য। আর সেইসাথে কাটার লাগবে। কাঁটাতারের বেষ্টনী কাঁটার জন্য।

চাহিদামত সবকিছু পাঠিয়ে দেয় মলোটভ। খানিকটা দূরে গিয়ে ওগুলো সংগ্রহ করে নেয় বুলশিট।

একটা চটের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর দড়ি, গগলস ও কাটার আছে। একজন সহকারীও এসেছে দেখা গেল। সহকারী পরিচিত না, হয়তোবা মলোটভ রিক্রুট করেছে। নাম জানা নেই সারভবের। সারভব ধরে নেয়, সহকারী = এক্স…

এক্স বেশ নিয়েছে চা বিক্রেতার। লেজার আছে ওর জিম্মায়।

সিদ্ধান্ত হয় ৩:৩০ এর দিকে অপারেশনে যাওয়ার। পেছন দিয়েই ঢুকবে। ওদিকে ক্যামেরা কম। দেয়ালের মাঝামাঝিতে একটা ক্যামেরা, আর দুই কোণায় দুইটা। কোণার দুইটার কাভারেজ এদিকে হওয়ার কথা না। তাই মাঝখানেরটা অকেজো করলেই কেল্লা ফতে।

রাত বাড়ে। হাজার বছরের পুরনো রাত।

রাস্তায় গাড়ি কমে গেছে। দোকান-পাটের শাটারও একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গলির শেষ মাথায় একটা ফার্মেসির শাটার অবশ্য খোলা। এটা চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে।

রাস্তার অন্য পাশে গিয়ে আশ্রয় নেয় বুলশিট। সে এখন ভাসমান মানুষের বেশ নিয়েছে। ফুটপাথে চাদর বিছিয়েছে, মাথার নিচে দিয়েছে চটের ব্যাগ। চোখ দুটো হালকা খোলা রেখে সে সময় গুনে-১, ২, ৩, ৪, ৫…

ঠিক রাত ৩ঃ২০-এ উঠে দাঁড়ায় সারভব। স্যামসাং মোবাইলে শব্দহীন অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল ও, উরুতে কম্পন দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। দুই তলা দালানের পেছনে ততক্ষণে হাজির সহকারী। ও এতক্ষণ একটি মিষ্টির দোকানের সিঁড়িতে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল।

ওর হাতের তালু চকিতে দেখে নেয় বুলশিট। তালুতে লেজার লুকিয়ে রেখেছে এক্স।

এক্স এগোয়। মুখে কাপড় পেঁচিয়ে ও দাঁড়ায় ক্যামেরার নিচে। হাতের ইনফ্রারেড রশ্মি ফেলে ও ক্যামেরার ওপর। ওপাশের দর্শনার্থীদের আর কিছু দেখতে পারার কথা না।

মৃদু মাথা ঝাঁকায় ও বুলশিটের দিকে তাকিয়ে।

এটারই অপেক্ষায় ছিল বুলশিট। ও প্রস্তুত হয়েই আছে। গগলস, কাটার, দড়ি ও শোল্ডার হোলস্টারে রিভলবার নিয়ে। টং দোকানের আড়াল ছেড়ে ও এগোয় দেয়ালের দিকে। দড়ি ছুঁড়ে মারে দেয়ালের অপর পাশে। হুক আটকায়।

ভালো করে টেনে দেখে সারভব। না, হড়কাবে না।

দেয়াল ধরে তর তর করে উপরে উঠে যায় ও। কাটার বের করে তার কাটে। ফাঁক প্রস্তুত হতেই টুপ করে নিচে নেমে যায়।

আর বিদঘুঁটে শব্দে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। সাথে ঝকঝকে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে চারপাশ।

শিট!

অ্যালার্ম সিস্টেম ইনস্টল করা থাকতে পারে এটা মাথাতেই ঢুকেনি ওর।

আড়াল নিতে হবে। কুইক!

ওই যে ঝোঁপ। ওটার পেছনে…

কুকুরের ঘরঘর শোনা যায়। জার্মান শেফার্ড! আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে বেশ কয়েকটা।

ঝোঁপের আড়ালে পৌঁছানোর আগেই কুকুরগুলোকে দেখা যায়। বিশাল দেহী কুকুর, ফুট দুয়েক উচ্চতার। লম্বা জিহ্বা ঝুলছে। সংখ্যায় ৬-৭ টা হবে। তাদের গলার চেইন ধরে আছে ষন্ডা চেহারার ক’জন লোক।

পেছন পেছন এ কে আসছে?

বেঁটেখাটো, টাইট শরীরের এক লোক। গায়ে এক রত্তি পোশাক নেই। তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করে বুলশিট, কিন্তু সেটা কী তা আর ধরতে পারে না।

তখন মাথায় দশ নাম্বার মহাবিপদসংকেত বাজছে, মুখের দিকে তাকানোর সময় কোথায়?

লোকটার খনখনে গলার আওয়াজ দূর থেকেই শুনতে পারে ও।

“সিগারেটওয়ালা…”

বুঝতে সমস্যা হয় না সারভবের। লোকগুলো অনেক আগেই খেয়াল করেছে ওকে। এখন কী করণীয়? লেজ গুটিয়ে পলায়ন না বীর বিক্রমে আক্রমণ?

বীর বিক্রমে আক্রমণই বেছে নেয় সুপার এজেন্ট। আর প্রথমেই যে অস্ত্রের কথা খেয়াল আসে তা সবসময় ওর সাথে থাকে। ও যেখানেই যায়, অস্ত্রটাও ওর সাথে যায়।

সারভব আদর করে নাম দিয়েছে-ব্রহ্মাস্ত্র!

ওর দুই হাতের কব্জিতে কৃত্রিম চামড়ার সাথে লাগানো দুটা মাইক্রোচিপ আছে। দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রকায় বোমা। কিন্তু কাজে বড় বোমার চেয়ে কোন অংশে কম না। অ্যাক্টিভেট করে ছুঁড়ে দিলেই হলো। মাটিতে পড়েই ফাটবে।

লোকগুলোকে কাছে আসতে দেয় ও। কাছ থেকে কুকুরগুলোকে আরো ভয়ংকর দেখায়, জিহ্বাগুলো দেখায় আরো লম্বা।

চিপ আনলক করে অ্যাক্টিভেট করে বুলশিট।

আর তখনই হাতের চেইন ছেড়ে দেয় ষন্ডা লোকগুলো। তেড়ে আসে জার্মান শেফার্ড।

আর দেরি নয়। ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়ে মারে ও।

দুম করে একটা বিকট শব্দ হয়। ছিটকে পড়ে শেফার্ডগুলোর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ, ষন্ডা ক’জনের অবস্থাও তথৈবচ। বাকি ক’জন দূরে ছিল বিধায় বোমের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে যায়। তবে পুরোপুরি বাঁচে না। কেউ ঝলসায়, কেউ বিস্ফোরণের প্রচন্ডতায় আছড়ে পড়ে যায়।

পুরোপুরি বেঁচে যায় নগ্ন লোকটা। এঁকেবেঁকে দৌড়ানো শুরু করে সে। চালাক আছে, গুলি লাগাতে দিতে চায় না। এ জন্যই এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে। ফোনে কী জানি নির্দেশ দেয়। ভাষা শুনে বুঝতে পারে বুলশিট।

চাইনিজ।

গুলি চালাতে যাবে, কিন্তু আহত এক শেফার্ড এসে হামলা চালায়। বিশাল থাবা নিয়ে হামলে পড়ে ওর শরীরে। টাল সামলাতে পারে না ও, শেফার্ড নিয়ে পড়ে যায়। লোকটার দিকে নজর দিতে গিয়ে আর লক্ষ্য করে নি, ওর অন্যমনস্কতার সুযোগে শেফার্ডটাও আক্রমণ চালিয়ে বসেছে।

ধারালো দাঁত বসে যায় সারভবের গলা বরাবর। গলার নরম মাংসে। দাঁত ঢুকছে, ঢুকছে…।

রিভলবার গর্জায়। একবার, দু’বার।

প্রথম বারেই ওর খুলি উড়ে গিয়েছিল, দ্বিতীয়টা স্রেফ মনের রাগ মেটানোর জন্য করা।

তিন আহত ষন্ডাও সাহস পেয়ে উঠে আসে। এবার সারভব আরো ক্ষিপ্র, আরো নিপুণ।

দুম, দুম, দুম। গুনে গুনে তিনটা গুলি। তিনটাই ষন্ডাগুলোর তরমুজ সদৃশ মাথাগুলোকে ফাটা তরমুজ বানিয়ে দেয়।

কুঁই কুঁই করছিল এক শেফার্ড। দুম। কুঁই কুঁই শেষ।

এক ষন্ডার সাথে শটগান ছিল। ওটা নিয়ে নেয় বুলশিট। কাজে আসবে। এবার ন্যাংটাটাকে খুঁজে বের করা যাক।

পা বাড়াতে যাবে গুলির আঘাতে ছিটকে পড়ে সারভব। ঘাড়ে লাগাতে চেয়েছিল সম্ভবত। সামান্য মিস হয়েছে। লেগেছে ডান কাঁধে। গুলিটা স্রেফ লাগেইনি, যাওয়ার সময় কাঁধের প্রায় আধ পাউন্ড মাংস নিয়ে চলে গেছে।

তীব্র ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখে সুপার এজেন্ট।

দুপ দুপ দুপ!

আরো কয়েকটা গুলি আশেপাশের মাটি বিদ্ধ করে। ব্যথা নিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করে ও। ক্রল করে এগোয়।

দুম!

আবারো ছিটকে পড়ে সারভব। এবার গুলি লেগেছে ওর বাম উরুতে। উরুর এক পোয়া মাংস উধাও হয় গুলির সাথে।

দুম দুম। এর পরেরটা চুল ঘেঁষে যায়। অন্যটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গাছে বিধে।

পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়ায় সুপার এজেন্ট। পেছন থেকে যে গুলি করছে তার পজিশনটা মনে মনে আন্দাজ করে নিতে পেরেছে ও। ও যে ফকফকা আলোয় উদ্ভাসিত, রীতিমত শুটিং ডাক, তাও বুঝতে পারছে।

ঘুরে গুলি করে ও। দুম দুম দুম।

তিনটা গুলি ধসিয়ে দেয় তিনটা হাইপাওয়ারড বাতি। অন্ধকারে নিভে যায় চারপাশ। সৌভাগ্যক্রমে গলায় ঝুলানো গগলস হাতছাড়া হয়নি, এখনো গলাতেই আছে। ওটা চোখে আঁটে বুলশিট।

সবকিছু দিনের আলোর মত পরিস্কার। কিন্তু সমস্যা হলো শটগানটা হারিয়ে ফেলেছে ও। হাত থেকে ছিটকে কোথায় গিয়ে পড়েছে তা আর খেয়াল নেই।

এলোপাথাড়ি কিছু গুলি ছোঁড়া হয় ওপর থেকে। আশেপাশে এসে বিধে। সাথে সাথে মাটিতে বসে পড়ে ও।

ওপরের লোকটা বড় বিরক্ত করছে। একটা বিহিত করা দরকার। দূরে একটা ইটের ঢেলা ছুঁড়ে মারে ও।

ধুপ করে একটা আওয়াজ হয়।

এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে যায় ওপাশ। আওয়াজ লক্ষ্য করে ছাদ থেকে লোকটা গুলি চালিয়েছে।

কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, পিস্তলের মাজল দেখা গেছে! গুড়।

লোকটা দোতলা দালানের ছাদে। ওখান থেকে গুলি করছে। এদিকে সারভবের রিভলবার চেম্বারে আর মাত্র একটা গুলি আছে।

ভালো শুটার হলে একটাই যথেষ্ট।

আরেকটা ইটের ঢেলা হাতে নিয়ে আরো দূরে ছুঁড়ে মারে ও। ছাদের আড়াল থেকে একটা কালো মূর্তির মাথা উঁকি দেয়।

দুম!

গুলিটা বুলশিট করে। ধপ করে একটা শব্দ হয়। শব্দটা ছাদ থেকে ভারি দেহ পতনের।

বিংগো!

ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে সামনে এগোয় বুলশিট। পড়ে থাকা শটগান কুড়িয়ে নেয়।

দালানের পাশ ঘেঁষে ছোট্ট একটা গলি। ন্যাংটা লোকটা এদিক দিয়েই গেছে।

গলি শেষ হয় লনে এসে। ছোট করে ছাঁটা ঘাস। টবে ফুল। কৃত্রিম ঝোঁপ। ঘাসের দঙ্গল মাড়িয়ে শুরু হয়েছে বারান্দা। এদিকটা আবার আলোয় আলোকিত।

ব্যথা। কাঁধে ও উরুতে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সারভব।

লনের একপ্রান্তে চারপেয়ে কিছুর নড়াচড়া দেখা যায়। হঠাৎ আলোয় চোখ সয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। জন্তুটা বিশাল। অনেকটা সেন্ট বার্নাড কুকুরের মত বিশালদেহী। কেউ একজন গলায় চেইন দিয়ে আটকে রেখেছে ওকে।

বাতাসে গন্ধ শুঁকে জন্তুটা। তারপর সোজা ওর দিকে তাকায়।

লোকটা কিছু একটা বলে জন্তুটির চেইন ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেতেই ছুটতে শুরু করে ও। বিশালদেহী জন্তুর ভারে মাটি কাঁপছে কিনা বুঝতে পারে না বুলশিট।

ঘুরে দৌড় দিবে নাকি? যেদিক দিয়ে এসেছিল ওদিক দিয়েই না হয় পালানো গেল।

সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বুলশিট।

বুক ভরে শ্বাস নেয় ও, নিজেকে শান্ত করে। শটগান কাঁধে ঠেকায়। তারপর লক্ষ্যস্থির করে ট্রিগার টিপে।

দুম!

গুলিটা জন্তুর বিশাল লোমের দঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে যায়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো গুলি খেয়েও দমে না জন্তুটি। ছুটতে থাকে, ছুটতেই থাকে…

আবারো গুলি করে বুলশিট।

এবার যেন হার্ড ব্রেক কষে কেউ। মুখ থুবড়ে পড়ে বিশালাকায় জন্তুটা।

চিৎকারের আওয়াজ হয় কোথাও। উপরে তাকায় সারভব। দেখে ন্যাংটা লোকটা ক্ষ্যাপা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, হাতে উদ্যত পিস্তল।

শুরু হয় এলোপাথাড়ি গুলি।

দুম দুম দুম দুম দুম দুম।

ড্রাইভ দিয়ে আড়াল খুঁজে রাশিয়ান এজেন্ট। আনাড়ি হাতের গুলি লক্ষ্যভেদ করে না, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বেশ দূর দিয়ে চলে যায়।

ঝোঁপের আড়াল পায় ও। উঁকি দিয়ে প্রতিপক্ষের অবস্থান দেখতে যাবে, তার আগেই শীতল এক স্পর্শ অনুভব করে মাথার পেছন দিকে।

“নড়বি তো মরবি।” হিসহিসিয়ে উঠে পেছনের কণ্ঠ।

বুলশিট নড়ে না, এত কাছ থেকে টার্গেট মিস করার কথা না। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ও।

“আই গট হিম, বস!” চিৎকার করে বসকে জানায় লোকটা। হাত বাড়িয়ে শটগানটাও নিয়ে নেয়।

এলোপাথাড়ি গুলি থেমে যায়। দুদ্দাড় পায়ের আওয়াজ। শব্দ শুনে মনে হয় একসাথে অনেক মানুষ সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে।

ঝোঁপের আড়াল থেকে ওকে সামনে নিয়ে আসে লোকটা। সিঁড়ির পায়ের আওয়াজ নিম্নগামী। একে একে অনেক মানুষ হাজির হয় নিচতলার বারান্দায়। প্রায় বিশ জন হবে। ছেলে-বুড়ো, যুবক-যুবতী। কারো গায়েই কোন কাপড় নেই।

ন্যাংটার মিছিল।

ন্যাংটা বুড়োটা মিছিলের মাথায়। বুড়োটা অস্থির। হাত নাচাচ্ছে, পা নাচাচ্ছে। চিৎকার করছে। চোখদুটো রাগে-ক্ষোভে বিস্ফোরিত। হাতের পিস্তলও ওর সাথে নাচে দিগ্বিদিক। চাইনিজ ভাষায় বুলশিটের দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে কী জানি বলে ও। তারপর সেন্ট বার্নাডের মতো দেখতে কুকুরের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে ফের। কুকুর হারানোর শোকে মুহ্যমান বুড়ো।

কিন্তু এসবের কিছুই খেয়াল নেই বুলশিটের। সে অবাক হয়ে জনা বিশেক লোকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা অদ্ভুত মিল চোখে পড়ে ওর।

হ্যাঁ, চোখেই পড়ে।

এই লোকগুলোর কোন চোখের পাতা নেই। সাথে সাথে বুলশিট বুঝতে পারে এরা কারা। এরা কুখ্যাত চাইনিজ কাল্ট, কাল্ট অভ হিডেন আই। গুপ্তচোখ কাল্ট।

ওরা ধারণা করে আমাদের সবারই তৃতীয় একটা চোখ আছে। যে তৃতীয় চোখ থাকে গুপ্ত বা হিডেন। সবাই ওই চোখের ব্যবহার জানে না। বেশিরভাগ মানুষ এর অস্তিত্ব সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল না। তবে যারা যারা এই চোখের ব্যাপারে জানে, এর ব্যবহার জানে তারা আলোকিত ও জ্ঞানী মানুষ। জীবনের জটিল রহস্য তাদের চোখে ধরা পড়ে।

এই কাল্ট গুরু মানে বোধিধার্মাকে। বোধিধার্মা একবার ধ্যান করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তখন রেগে গিয়ে চোখের পাতা কেটে ফেলেন তিনি। কাল্ট অভ হিডেন আই’য়ের প্রধান এজেন্ডা এই চোখের পাতা খুঁজে বের করা। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস বোধিধার্মার কেটে ফেলা চোখের পাতা জোগাড় করে ফেললে জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হবে। জীবনের জটিল সব রহস্য উন্মোচিত হবে তখন।

গুপ্তচোখ কাল্ট অনেক পুরনো। মধ্যযুগে এর প্রধান ছিলেন ওয়াং ওয়েই। মানুষজন ওকে উন্মাদ ওয়েই বলে ডাকতো। ও মনে করতো তৃতীয় চোখ মানে আক্ষরিক অর্থেই তিনটা চোখ। তার গ্যাংয়ের কাজ ছিল চোখ জোগাড় করা। মানুষজনের চোখ উপড়ে তা কাল্ট প্রধান ওয়াং ওয়েই’র নিকট হাজির করা হতো। ওয়াং ওয়েই কচকচ করে কাঁচা চোখ গিলে ফেলতো। ওয়াং ওয়েই’র ধারণা ছিল এভাবে কাঁচা চোখ গিলে খেলে আরেকটা চোখের জন্ম হবে।

সভয়ে ন্যাংটা লোকটার দিকে তাকায় বুলশিট। ওয়াং ওয়েই’এর মতো উন্মাদ নয় তো লোকটা? ওয়াং যেভাবে চোখ উপড়াতো, ও কী সেভাবে কোনকিছু উপড়াবে?

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ন্যাংটা লোকটা সারভবের চোখের দিকে তাকিয়ে কী জানি ইঙ্গিত দেয়!

ভয়ে ভেতরটা একদম শুকিয়ে যায় তার। ঝেড়ে দৌড় দেবে, সে পথও বন্ধ। পেছনে রিভলবারের নল ঠেকানো। ভুলক্রমেও যদি ট্রিগারে চাপ পড়ে, তাহলে সাড়ে সর্বনাশ। এমনিতেই দুটা গুলি খাওয়া হয়ে গেছে, তৃতীয় গুলি জায়গামত লাগলে গেম ওভার।

ভয়ের কারণে একটা লাভ হয়েছে অবশ্য। ক্ষতস্থান জ্বলছিল রীতিমত, এখন আর অত লাগছে না।

ন্যাংটাদের গ্যাং থেকে শক্ত-সমর্থ দু’জন ভলান্টিয়ার হিসেবে এগিয়ে আসে। দুজন দুদিক থেকে ঝাঁপটে ধরে তাকে। আরেকজন ভেতরের রুমে গিয়ে ঢুকে। বেরিয়ে আসে খানিক পরই। তার হাতে তখন একটা কাঁচি শোভা পাচ্ছে।

তবে কী ওদের মতো ওর চোখের পাতাও…

তারস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে বুলশিট। মোক্ষম এক লাথি কষায় বামের জনের অন্ডকোষ বরাবর। ডান দিকের জনকেও লাথি দিতে যাবে তার আগেই কানফাটানো গুলির আওয়াজ। গালে গরম হ্যাঁকা অনুভব করে ও। বুলশিটের মনে হয় গুলিটা যেন ওর গাল ঘেঁষে গেল। আড়চোখে দেখে তার গালে ব্যারেল ঠেকিয়ে গুলি করেছে পেছনের জন।

“ইজি নাও,” চুকচুক করে সান্তনা দেয় টাইট শরীরের বুড়ো লোকটা। তারপর ইংরেজিতেই বলে, “নিষিদ্ধ ফল খেতে গেলে একটু-আধটু দুর্ভোগ তো পোহাতেই হবে। কষ্ট করলেই না কেষ্ট মেলে।”

নিষিদ্ধ ফল!

ফরবিডেন ফুটের ভিন্ন এক অর্থ আছে কাল্টের লোকগুলোর আছে। আব্রাহামিক ধর্মে নিষিদ্ধ ফলের গাছকে যেমন জ্ঞানবৃক্ষ বলা হয়, ওরাও তেমনি মনে করে বোধিধার্মার কেটে ফেলা চোখের পাতাও জ্ঞানবৃক্ষ। এটা জ্ঞানবৃক্ষ এই কারণে যে কেটে ফেলা ওই চোখের পাতা থেকে গাছের জন্ম হয়।

চা গাছ!

কাঁচি বাগিয়ে ধরে এগিয়ে আসে লোকটা। ল্যাং মেরে বুলশিটকে ততক্ষণে ফেলে দেয়া হয়েছে সবুজ ঘাসের লনে। দু’জন দুদিকে চেপে বসেছে, আরো দু’জন এগিয়ে এসে ওর দুই পায়ে চেপে বসে। পাশে রিভলবার হাতে দাঁড়ানো একজন। তেড়িবেড়ি দেখলেই গুলি চলবে।

কাঁচি হাতে লোকটা ওর মাথার পাশে এসে বসে। ছটফট করে উঠে বুলশিট। তবে কী ওর কপালে লেজকাটা শেয়ালের পরিণতি অপেক্ষা করছিল?

ও না বুলশিট, এজেন্টদের এজেন্ট?

রিভলবারধারী উবু হয়ে বসে ওর ডান চোখটা মেলে ধরে। চোখের পাতাটা আলগা করে। কাঁচি বাগিয়ে ধরে কাঁচিধারী।

কাঁচি এগিয়ে আসে…

শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চেঁচিয়ে উঠে বুলশিট, নিজেকে মুক্ত করার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে।

কিন্তু চারজন চারদিক থেকে আরো জোরে চেপে ধরে।

ঘ্যাঁচাং করে কেটে যায় ডান চোখের পাতা।

রক্তে চোখে অন্ধকার দেখে বুলশিট। তারপর সবকিছু অটোতে চলে যায়। ওর হাত-পায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যেন অন্য কেউ।

কামড়ে ধরে ও কাঁচিধারীর ডান হাত। তারপর কচ্ছপের মতো ধরেই রাখে। মুখে রক্তের নোনা স্বাদ অনুভব করে সারভব। মুহূর্তে রক্তে ভরে যায় ওর পুরো মুখ।

কাঁচিধারীকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যায় বুলশিটের বামের জন। নিমেষে মুক্ত বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে ও ডানের জনের উন্মুক্ত অন্ডকোষ।

মট করে একটা আওয়াজ হয়।

অন্ডকোষ কী তবে ভেঙে গেল?

কাঁচিটা ওর কাঁধে বসিয়ে দিয়েছে একজন। অন্ডকোষ ছেড়ে সে আক্রমণকারীর চোখদুটোতে ওর দুই আঙুল সেঁদিয়ে দেয়। চোখ গেলে বেরিয়ে আসে আঙুলদ্বয়। পা চেপে ধরে থাকা দুইজন সামনে এগিয়ে এসেছে। সামনে এগিয়ে এসেছে ন্যাংটা গ্যাংয়ের আরো কিছু সদস্য।

রিভলবারধারী দুই চোখ হারিয়েছে, ওর রিভলবারের দখল নিতে এগিয়ে যায় একজন।

বুলশিট চোখে ঝাপসা দেখছে, আন্দাজের ওপর লড়াই করে যাচ্ছে ও। কতক্ষণ পারবে জানে না, তবে বেশিক্ষন টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।

দুই পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও। দুটা কারাতে কোপ, দুটা লাথি।

চারদিকে ছিটকে পড়ে ওর আক্রমণকারীরা।

গুলির গর্জন। ন্যাংটা বুড়ো গুলি চালিয়েছে। সাথে সাথে সহস্র ভোল্টের ধাক্কা খেয়ে উল্টে গিয়ে পড়ে বুলশিট। পেটে গুলি লেগেছে। লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে লনের সবুজ ঘাস, আনমনে ও যেন এঁকে যাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা।

ওর ঝাপসা ভাব আরো বেড়েছে। সেইসাথে পেয়েছে মারাত্মক পানির তৃষ্ণা। হাতের কাছে পেলে এক চুমুকে এক পুকুর সমান পানি সে খেয়ে ফেলতো। এতটাই পিপাসার্ত বুলশিট!

পানি খেতে হলে আগে তো উদ্ধার হওয়া লাগবে। কিন্তু লড়ার মতো ওর কাছে তো কিছুই নেই। তখন হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ে যায় এক বিশেষ অস্ত্রের কথা।

ব্রহ্মাস্ত্র!

একটার ব্যবহার হয়েছে, আরেকটা এখনো আছে। কৃত্রিম ত্বক খসিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র বের করে বুলশিট। শুয়ে থেকেই আনলক করে ও, তারপর পাশ ফিরে শরীরের সর্বশক্তি জড়ো করে ছুঁড়ে মারে বারান্দার দিকে।

বিকট শব্দে তালা লাগার জোগাড় হয়।

শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে বুলশিট। দেখে টলোমলো পায়ে হতভম্বের মতো এখনো দাঁড়িয়ে আছে ক’জন। ন্যাংটা বুড়ো কাতরাচ্ছে, ওর রিভলধার ধরা হাত উড়ে গেছে। কাতরাচ্ছে আরো বেশ কয়েকজন। কাঁদছে, ফোঁপাচ্ছে, আহাজারি করছে…।

এই-ই সময়। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করে বুলশিট। ওর বাম উরুতে গুলি, ডান কাঁধে গুলি, বাম কাঁধে কাঁচি ঢুকানো। এগুলো নিয়েই দৌড়ায় সারভব।

ঠা ঠা গুলির আওয়াজ হয়। টনক নড়েছে কারো, গুলি করছে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গুলিগুলো। সাথে সাথে আরো গুলির আওয়াজ আসে। সামনেই গেট। পেছনে বুড়োর চিৎকার ভেসে আসে। বুলশিটের খুব ইচ্ছা হয় ঘুরে দাঁড়িয়ে বুড়োর উদ্দেশ্যে বলতে, ইজি নাও।

কিন্তু আর গতি থামায় না ও।

গেটে ছিটকিনি লাগানো। পেছনে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। ছিটকিনি খুলতেই গেটের সামনে একটা স্টার্ট নেওয়া টয়োটা গাড়ি দেখতে পায় বুলশিট। সহকারী এক্সের বুদ্ধি আছে। পালানোর সাজ-সরঞ্জাম রেডি করেই রেখেছে।

গাড়িতে চেপে বসতেই এক্সিলেটরে পা দাবিয়ে বসে এক্স। মত্ত ঘোড়ার মতো আগে বাড়ে গাড়ি। সিটেই গা এলিয়ে দেয় বুলশিট।

পেছনে গেট ধরে গজরায় গুপ্তচোখ কাল্টের এক উলঙ্গ সদস্য।

*

অধ্যায় ২২

চোখ মেলতেই সবকিছু উল্টা মনে হয় রাইলি’র।

মাথা ব্যথায় টনটন করছে। ডানপাশটা ভেজা লাগলো।

রক্ত নাকি? না প্রস্রাব?

কটু গন্ধ ধক করে নাকে এসে ধাক্কা মারে রাইলি’র।

পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারে ও। মাথায় রক্ত থাকার কথা, প্রস্রাব না। অবশ্য অত নিশ্চিতও হতে পারে না রাইলি। মাথা ফেটে রক্তের বদলে প্রস্রাব বের হতেও পারে। এতে আশ্চর্যের কী আছে?

শেকসপিয়ার তো বলেছেনই, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেড অ্যান্ড শালডারস দ্যান আর ড্রিমট অভ ইন ইওর ফিলোসফি। হেড অ্যান্ড শোলডারস বালের শ্যাম্পু। মোটেও ভালো না। খুশকি একটুও দূর হয় না। এর চেয়ে ডাভ ভালো। ডাবের পানি খুব মজা। রাইলির তেষ্টা পায়। প্রচন্ড তেষ্টা। একটা ডাব পেলে হতো। ঢক ঢক করে খাওয়া যেত, কিংবা স্ট্র দিয়ে চু চু করে। নিদেনপক্ষে মাথার প্রস্রাব চেটে খেয়ে ফেললেও তো হয়…

মাথা ঘুরছে রাইলি’র। তেষ্টা বাড়ছে। সহজ ভাবে চিন্তা করতে পারছে ও। একটা চিন্তার সাথে আরেকটা চিন্তা জড়িয়ে গিট্ট লেগে যাচ্ছে। গির সাথে আরো গিটু লাগছে।

মাথার টনটনানি আরো বাড়ে।

ক্ষতস্থান দেখতে গিয়ে রাইলি আবিষ্কার করে তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। তার পা’দুটো একটি আংটার সাথে ঝুলানো। মাথার নিচেই মেঝে। মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।

রক্ত না প্রস্রাব?

তরল পানীয়টা লাল লাল, কাজে রক্তই হওয়ার কথা। কিন্তু গন্ধটা কটু, ঝাঁঝালো, প্রস্রাবীয়। মোটেও রক্তের মতো না।

সে হালকা দুলছে।

মাথা ঝিমঝিম করে রাইলি’র। নেশাগ্রস্তের মতো মনে হয় নিজেকে। চিন্তায় চিন্তায় গিট্ট লাগে। গিটুর সাথে আরো গিটু যুক্ত হয়।

চিড়িক দিয়ে মাথার মাঝখান দিয়ে ব্যথা উঠে। চোখের বাতি যেন দপ করে নিভে যায়। আঁধারে ঢেকে যায় সব।

এখন কী রাত না দিন?

বুঝতে পারে না রাইলি। মুখটা তিতা তিতা লাগে তার। মনে হয় করলার জুস মুখে দিয়েছে। প্রীতি সাক্সেনা করলার জুস খেত খুব। করলার জুস নাকি খুব উপকারী। ওজন কমায়। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাঁপানিতে কাজে দেয়। আরো কতকিছু করে। সবকিছু মনেও নাই রাইলি’র। প্রীতির চাপাচাপিতে প্রতিদিন সকালে উঠে করলার জ্যুস খেত ও। প্রীতি তখন চামচে করে গু নিয়ে আসলেও খেতে আপত্তি করতে না রাইলি, করলার জুস তো ছার। প্রিয়ার এক চাচা নাকি নিজের প্রস্রাব নিজেই খেত। ও নাক সিঁটকালে প্রিয়া সাফাই গাইতো, কোন এক ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারের রেফারেন্স টানতো। ওই প্রাইম মিনিস্টারও নাকি নিজের প্রস্রাব খেত। কী জানি নাম প্রাইম মিনিস্টারের? ম দিয়ে শুরু। মহাত্মা গান্ধী, মেরিলিন মনরো, ম্যালকম এক্স, মার্লোন ব্রাভো….

মাথার ঝিমঝিমানি বাড়ে রাইলি’র। গিটু লাগে চিন্তায়। গিটুর সাথে যুক্ত হয় আরো গিটু। চিন্তার নদীতে ডুব দেয় ও, হারিয়ে যায় অতল জলরাশিতে। জলে ডুবে জলের তেষ্টা পায় রাইলি’র।

একটু জল দিবেন গো!

কিন্তু জল তো হিন্দুরা বলে। ও তো হিন্দু না, খ্রিস্টান। খ্রিস্টানরা জল কে কী বলে?

প্রিয়া জল বলতো। প্রিয়া কলকাতার মেয়ে। কোথায় জানি বাড়ি ছিল ওর? পার্ক সার্কাস পার্ক স্ট্রীট? মনে পড়ে না রাইলি’র। তবে ওর সাথে থেকে থেকে বাংলাটা ভালোই রপ্ত করে নিয়েছিল ও।

প্রিয়া, এক গ্লাস জল এনে দেবে? না হলে আমি মাথা থেকে চেটেপুটে প্রস্রাব খাব! মাইরি বলছি!

প্রিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশে অনেক গান আছে। আসিফ আকবর নামের এক শিল্পীর গান শুনেছিল রাইলি, খুব নাকি ব্লকবাস্টার হিট গান। কলকাতায় গিয়ে একবার শুনেছিল। হাওড়া ব্রিজে যখন ট্যাক্সি নিয়ে উঠেছিল তখন। ওপার বাংলার গান নামের এক অনুষ্ঠানে। লিরিকস টা এখনো খেয়াল আছে তার। তেষ্টা ভুলে দরাজ গলায় গান ধরে রাইলি :

বুকের জমানো ব্যথা, কান্নার নোনা জলে
ঢেউ ভাঙে চোখের নদীতে
অন্যের হাত ধরে চলে গেছো দূরে
পারি না তোমায় ভুলে যেতে
ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়?

রুমের দরজা খুলে যায়। গটগট করে কেউ একজন ঢুকে ভেতরে। তার পিছু পিছু আরো দুজন। সামনের জন লম্বা, মেদহীন, ফ্যাকাশে গায়ের রং। চুল, ভুরু বরফের মতো সাদা। নাম ফিওদর স্মোলভ। ভদ্রলোক কেজিবির বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ, যদিওবা কাগজে কলমে এখন আর কেউ কেজিবি বলে ডাকে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর নাম পাল্টে গেছে। নতুন নাম এফআইএস-ফরেন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস।

এই মুহূর্তে এফআইএস চিফের বরফের মতো সাদা ভুরু দুটো কুঁচকে আছে বিরক্তিতে ও রাগে।

“আমি ওকে টুথ সেরাম দিতে বলেছিলাম, চিফ,” মিনমিনিয়ে পাশ থেকে বলে উঠে ওর সেকেন্ড ইন কমান্ড আলেক্সেই মিরানচুক। ও বলতে এখানে ডাক্তার নিকোলাই রাসকাজোভ’কে বুঝানো হয়েছে। রাসকাজোভ বেশ ভালো ডাক্তার, তবে একটু খ্যাপাটে কিসিমের।

“ও কী দিছে?” ছোট্ট কথায় জানতে চান চিফ।

“সেরামের সাথে এলএসডি মিশায়া দিছে। বলছিলো এতে নাকি দ্রুত কাজ দিবে,” আরো মিনমিনিয়ে জানান দেয় লালচুলো মিরানচুক।

“পিদোরাস, মুদাক…” রাশিয়ার রাশি রাশি স্ল্যাং উপুড় করে ঢেলে দেন চিফ। মিনিট দুয়েক ধরে ননস্টপ গালি চলতে থাকে। গালিবৃষ্টি শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ মেরে থাকেন স্মোলভ। তারপর স্থির কণ্ঠে জানতে চান-”প্রিয়া, প্রীতি ছাড়া আর কিছু কী বলেছে রাইলি?”

প্রিয়া আগরওয়াল ও প্রীতি সাক্সেনা যে এককালে রাইলি’র গার্লফ্রেন্ড ছিল তা ইতিমধ্যেই চিফের গোচরে আনা হয়েছে। এফআইএস-এ আমেরিকান এজেন্টদের ওপর সমৃদ্ধ ডোশিয়ার থাকে। সেখানে এজেন্টদের অতীত ইতিহাস, বাপ-দাদার পরিচয়, বংশলতিকা, প্রেমিক-প্রেমিকার নাম, কাকে কখন কীভাবে লাগিয়েছে সবকিছু পুংঙ্খানুপুঙ্খভাবে উল্লেখ করা থাকে। দুধ চা-১০

এবার কথা বলে উঠে এতক্ষণ ধরে চুপ মেরে থাকা ভ্যালেরি কারপিন। এই সেফ হাউজের সুপারভাইজার ও। ম্যাথু রাইলিকে দেখভালের দায়িত্বও তার। “না চিফ। বলে নাই।”

মেজাজ খিঁচড়ে যায় ফিওদর স্মেলভের। আরো খানিকক্ষণ শাপ শাপান্ত করেন তিনি। ২৪ ঘন্টা হয়ে গেল আমেরিকান এজেন্ট ম্যাথু রাইলি ওদের কবজায়, কিন্তু ওরা কিছুই করতে পারেনি। এতক্ষণ ধরে ভ্যারেন্ডা ভেজে চলেছে। এদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ওর ওপর একটুও আস্থা নেই ক্রেমলিনের। ইভান সারভবের বাংলাদেশে পা রাখার খবর কানে এসেছে তার। ইভান এফআইএসের টপ এজেন্ট। খুব গুরুত্বপূর্ণ কেস না হলে ইভানকে পাঠাতো না ক্রেমলিন। সহজেই অনুমেয় ক্রেমলিন কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে এই কেসটাকে। ইভান যে বাংলাদেশে আসছে এটা জানতেনই না চিফ। ওকে জানানোর প্রয়োজনই বোধ করে নাই ক্রেমলিন। ইভান অবশ্য ওর আসল নামে পরিচিত না। ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিতে ইভান পরিচিত বুলশিট নামে।

রাইলি’র হেঁড়ে গলায় চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় তার। “এই বিরক্তিকর গানটা কার বলো তো?” সাদা ভুরুদ্বয় আরো কুঁচকে উঠে চিফের।

গানের মধ্যে কোন কোড-ফোড কিছু লুকিয়ে নেই তো?

অন্য দুজন কান খাড়া করে গান শোনে খানিকক্ষণ। রাইলি তৃতীয়বারের মতো আসিফ আকবরের গানটা ধরেছে।

“বলতে পারছি না চিফ। বাংলাদেশি পপ জাতীয় কিছু হবে।” মিরানচুক জানায়। “বাংলাদেশি কোন মিউজিক এক্সপার্টকে নিয়ে আসবো?”

জবাবে কিছু বলেন না এফআইএস’এর বাংলাদেশ প্রধান। ঘোত করে একটা শব্দ করে দরজার দিকে হাঁটা ধরেন তিনি। মিরানচুকও বসকে অনুসরণ করে। যাওয়ার আগে কারপিনের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে একটা ইঙ্গিত দেয়।

যা বোঝার বুঝে নেয় কারপিন। শেষবারের মতো রাইলি’র দিকে তাকিয়ে সেও হাটা ধরে। রাইলি ততক্ষণে পঞ্চমবারের মতো গান ধরেছে :

ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়?

*

অধ্যায় ২৩

কর্নওয়েল সারারাত ঘুমাননি। ঘরময় পায়চারি করে বেড়িয়েছেন। মানিপেনি দু’একবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রতিবারই তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছেন তিনি। কথা বলার মুডে নেই এখন তিনি। এখন চিন্তার সময়, বুঝবার সময়।

গতকাল ওদের সাথে একটা সার্ভেইল্যান্স টিম ছিল। ব্র্যাক বিল্ডিংয়ের ১৭ তলার ছাদে। ওদের কাছে হাই রেজুলেশন ক্যামেরা ছিল। ওরা ভিডিও করেছে, ছবি তুলেছে। সে সব ছবি ও ফুটেজ সারারাত ধরে পরীক্ষা করেন তিনি।

তারপর সকাল দশটায় জরুরি মিটিং ডাকেন।

“গতকালকের ঘটনা একটু ব্যবচ্ছেদ করা জরুরি। কালকে অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তাহলে একে একে শুরু করা যাক।” পয়েন্টার নিয়ে বোর্ডের দিকে এগোন কনওয়েল। তারপর বরাবরের মত খুক খুক কাশিতে আক্রান্ত হন।

খুক খুক খুক। খুক খুক খুক।

টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খান তিনি। টিস্যু বের করে মুখ মোছেন এবং ব্যবহৃত টিস্যুটি ছুঁড়ে ফেলেন কোণায় রাখা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের দিকে।

বাস্কেটের এক প্রান্তে লেগে টিস্যুটি পাশে পড়ে থাকে।

কর্নওয়েলের ‘হাউ ডিড আই মিস দ্যাট’, মিলিয়ে যায় মানিপেনি’র ‘ইট ওয়াজ প্রিটি ক্লোজ, স্যার’-এ। মানিপেনি উঠে টিস্যটি বাস্কেটস্থ করে। তার আঁটসাঁট স্কার্টের পেছনে টানটান নিতম্ব পরিস্কার দেখা যায়। একেবারে প্যান্টির ভাঁজ পর্যন্ত।

চোখ ফিরিয়ে নেয় জোনাথন কিং। ডিপার্টমেন্টে মানিপেনি’র ডাকনাম চাইনিজ রোবট। মানিপেনি অবশ্য পুরো চাইনিজ না। বাপের দিক থেকে চাইনিজ, মা আমেরিকান। কিন্তু খাসলতে পুরো রোবট। মানবীয় অনুভূতি বলতে কিছুই নেই। কয়েকবার ওকে ফুসলানোর চেষ্টা করেছে কিং, ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তারপর একসাথে ছবি দেখা। ছবি দেখার ফাঁকে ফাঁকে চুমু-চাটি, হাতাহাতি, তারপর ফাইনাল অ্যাক্ট। এই-ই ছিল কিংয়ের প্ল্যান।

চাইনিজ মাল লাগানোর অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। সবকিছুর অভিজ্ঞতার দরকার আছে। কিন্তু ওর সমস্ত চেষ্টাকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে এসেছে মানিপেনি। ননা মুভি ডেট, নো ডিনার। সিআইএ’র আরো অনেকেই এই চাইনিজ মালটাকে চাখতে চেয়েছে কিন্তু কারো অভিজ্ঞতাই খুব একটা সুখকর না। সবার প্রতিই ওর মনোভাব যান্ত্রিক, শুধু বস ছাড়া। বসকেই ও একটু তোয়াজ করে চলে, আর কাউকে না। ওর নাম তাই রোবট হতে বেশি সময় লাগেনি। বসের খাতির-যত্ন একটু বেশি বেশি করে বলে কেউ কেউ বসের চামচা বলেও ডাকে ওকে।

চেয়ারে ফিরে আসে মানিপেনি। স্কার্ট ঠিক করে। কর্নওয়েল পয়েন্টার দিয়ে বোর্ড দেখান। তার মখমলীয় ভাষণ শুরু হয় :

“ঘটনাগুলো হলো–১. ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু

২. তার হাতের প্যাকেট ছিনতাই এবং

৩. রাইলি’র কিডন্যাপ।

মূল ঘটনা এইগুলোই। আমরা ছাড়াও আরো কয়েক টিমের উপস্থিতি ছিল গতকাল। রাশিয়া? চীন? বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা? ইট ব্যুড বি এনি অভ দেম। ইট কুড বি অল অভ দেম। অন্য কেউও হতে পারে। সবার উদ্দেশ্য কী এক? আমরা সবাই কী একই জিনিস চাই? টম?”

টম ক্ল্যান্সি বাংলাদেশের সিআইএ হেড। প্রায় সাত ফুট উচ্চতার বিশালদেহী এক মানুষ। কপালের বাম দিকে একটা স্পষ্ট কাটার দাগ। শার্ট খুললে পিঠে দুটা গুলির দাগও মিলবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্মৃতি। যুদ্ধের মাঠ থেকে এখন তিনি ইন্টেলিজেন্সের মাঠে। এখানেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

“আপাতদৃষ্টিতে তো একই মনে হচ্ছে। কিন্তু…”

“কিন্তু?”।

“ডক্টরের বিখ্যাত আর্টিকেলটি অভ শ্যানংয়ের রেফারেন্স টানি। ডক্টর বলছেন অমরত্বের কথা, আবার ডক্টর ধ্বংসের কথাও লিখেছেন। রেফারেন্স দিয়েছেন ব্রহ্মাস্ত্রের। কাজেই আমাদের চাওয়ার মাঝে ভিন্নতা থাকতেই পারে। আপনি হয়তোবা অমরত্ব চান, কেউ ব্ৰহ্মাস্ত্র বানিয়ে দুনিয়া কজায় নিতে চায়।”

“রাইট।”

“গতকাল আরো একজন ছিল, আপনার চোখে পড়ে নাই হয়তোবা।” কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠে জোনাথন কিং।

“কে?”

“চাকমার সাথে লাইভ ভিডিও ফিডে আমরাও ছিলাম। ওখানেই ছিল লোকটা। ক্যান উই হ্যাভ দ্যাট প্লিজ?” প্রশ্নটা মানিপেনির উদ্দেশ্যে করা।

মানিপেনি একবার কর্নওয়েলের দিকে তাকায়। কর্নওয়েল মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের সম্মতি জানান।

কর্নওয়েলের সবুজ সংকেত পেয়ে মানিপেনি আর বসে থাকে না, উঠে নিজের ল্যাপটপ সংযুক্ত করে দেয় প্রজেক্টরের সাথে। খানিকপর পর্দায় ভেসে উঠে গতকালকের ভিডিও। হসপিটাল থেকেই ডক্টরকে ফলো করে আসছিল চাকমা। ডক্টর গাড়ি নিয়ে ঢুকে যায় মহাখালী কাঁচা বাজারে। চাকমা বুদ্ধি করে গাড়ি পার্ক করে ফেলে আগের ব্লকেই। রাস্তাভর্তি গাড়ি গিজগিজ করছে। একটা ফটোকপির দোকানে খুব দামি একটা গাড়ি পার্ক করে রাখা দেখা গেল। ব্র্যান্ড নিউ মাজদা।

“হিয়ার হি ইজ। লুক এট দ্য উইন্ডো।”

জানালার কাঁচের ফাঁকে দুটি চোখ দেখা যায়।

“পজ অ্যান্ড জুম।”

জুম করা হয়। দুটা চোখ দুই ধরণের। একটা সবুজ, একটা নীল। ইংরেজিতে দুই রঙা চোখের মণিকে বলা হয় হেঁটেরোক্রমিয়া।

“আই নো দিস গাই,” কর্নওয়েলের মখমলীয় গলা শোনা যায়। “মুন ফার্মাসিউটিক্যালসের ছোটা মালিক আলফনসো কুয়ারোন।”

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে সবাই। নতুন তথ্য হজম করে নিতে কষ্ট হয়। “ফার্মাসিউটিক্যালসের ইন্টারেস্ট হওয়াটা বিচিত্র কিছু না। ইমাজিন, এমন একটা ওষুধ আবিষ্কার করা হলো যা যে কোন রোগ সারাতে সক্ষম। যে কোন। এমনকি বয়স্ক জনিত কারণে যে সব মানুষের মৃত্যু ঘটে তাও সারিয়ে ফেলতে সক্ষম হলো ওই ওষুধ। কী রকম রেসপন্স পাবে বুঝতে পারছো?” চোখদুটো মার্বেলের মতো গোল গোল হয়ে যায় কনওয়েলের। চিকচিক করছে এখন তা।

ওষুধ খেয়ে কনওয়েল অমর হয়ে যাবেন। রোগ-জরা-মৃত্যু আর তাকে স্পর্শ করবে না। তিনি অনন্তকাল টিস্যু বাস্কেটের বাইরে ফেলবেন, আর অনন্তকাল মানিপেনি টিস্যুটি বাস্কেটস্থ করে কনওয়েলকে সান্ত্বনাবাক্য শোনাবে-’ইট ওয়াজ প্রিটি ক্লোজ, স্যার।

দৃশ্যটা কল্পনা করেই হাঁপিয়ে উঠে জোনাথন কিং।

সবাই তখনো অমরত্বের বুদবুদে ভাসছে। কথা বলে উঠেন ডেভিড কর্নওয়েল।

“মাঠে খেলোয়াড়ের কিন্তু সংখ্যা কম না। রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ইউরোপিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। হোয়াই ডিডন্ট উই অ্যান্টিসিপেট দ্যাট? আমরা তো ব্রিফ করেছিলাম। দিজ ইজ নট গোয়িং টু বি ইজি। ম্যাকলিন?”

অ্যালিস্টার ম্যাকলিন সার্ভেইল্যান্স টিমের হেড। ১৭ তলার ছাদে ওর নেতৃত্বেই একটা টিম সবকিছু তত্ত্বাবধান করছিল। ওর নাকের ডগায় চাকমা গুলি খেল। ডক্টরের মহামূল্যবান জিনিস হাওয়া হলো। রাইলি ধরা খেল। এ সব কিছুই ঘটেছে ওর নাকের ডগায়। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করেনি ম্যাকলিন আর তার টিম। আর “যৌনকেশ” ছেঁড়া ছাড়া। যৌনকেশ ছেঁড়া শব্দবন্ধনীটি কর্নওয়েলের মুখনিঃসৃত। মেজাজ খারাপ হলে তার মখমলি গলা থেকে যেসব গালিগালাজ বের হয় সেগুলোও মখমলের মত মসৃণ। গালি বলে মনেই হয় না, মনে হয় কেউ প্রশংসা করছে।

ম্যাকলিন পানি খেতে গিয়ে বিষম খেল। গতকাল থেকে সবকিছু তিতা তিতা লাগছে তার। পানিও। তার ব্যর্থতা থেকে ফোকাসটা সরাতে হবে। ডিস্ট্রাক্ট করতে হবে। যেভাবেই হোক।

“রাইলি’র ফিড হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল ওর জিপিএস লোকেটর। ওকে এখন আর লোকেট করা যাচ্ছে না। এমনকি ওর স্কিনের নিচে যে ডিভাইসটা লুকানো, ওটাও ডিঅ্যাক্টিভ্যাটেড। ওর অ্যাটাকার এসব কিছু ভালোভাবেই জানে। কোথায় কী লুকানো, না লুকানো। কিন্তু প্রশ্ন হলো কিভাবে জানলো? ইজ ইট অ্যান ইনসাইড জব?”

নিস্তব্ধতা নেমে আসে পুরো কনফারেন্স রুমে। প্রশ্নটা গত কয়েক মাস ধরেই সিআইএ’র চাঁইদের মাথাব্যথার কারণ। তাদের ধারণা সিআইএ’তে ছুঁচ ঢুকেছে। কয়েকদিন আগেও ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল মিটিংয়ে ব্যাপারটা নিয়ে বেশ হইচই হলো। সিআইএ’র ভেতরে ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চলছে। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক একটা রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে সকল ডেস্ক প্রধানের কাছে।

প্রাথমিক রিপোর্টটা খুঁটিয়ে পড়েছেন ডেভিড কর্নওয়েল। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না, ডিপার্টমেন্ট হেডের কড়া নির্দেশ। কারণ কমিটির ভাষ্যমতে কনওয়েলের টিমেই আছে ওই ছুঁচ। সিআইএ সাউথইস্ট এশিয়া ডেস্কের চিফ অভ অপারেশন্স তাই আছেন মারাত্মক চাপে।

“ইজ ইট?” প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়েই দেন কনওয়েল। তার মখমলীয় গলা বিন্দুমাত্র কাঁপে না। গলা শান্ত, স্থির, অবিচলিত। সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নেন তিনি।

“আচ্ছা আকবরের খবর কী?” প্রসঙ্গটা ইচ্ছে করেই পাল্টান কর্নওয়েল।

“ডক্টরের বাসার চাকরটা? ও তো হাপিশ!” ম্যাকলিন জানায়।

“রিয়েলি?” কনওয়েল ভ্রু কুঁচকান। এই কুঁচকানো দ্রু’র মানে হচ্ছে তিনি কথাটাকে চ্যালেঞ্জ করছেন। সংকেত পেয়ে ভিডিও আবার চালু করে মানিপেনি। ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে একটা বিশেষ জায়গায় এসে থামায়।

ভিডিওতে আকবরকে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা যায়। ওর সঙ্গিসাথিদের একজনের গলায় ক্যামেরা ঝুলছে। আকবরের মুখ বিকৃত। ব্যথা পেয়েছে নাকি ছেলেটা?

“হিয়ার হি ইজ, মিঃ ম্যাকলিন! কালকে আপনার সার্ভেইল্যান্স টিম কী শীতন্দ্রিায় চলে গিয়েছিল?” ভর্ৎসনা ঝরে তার কণ্ঠে।

ম্যাকলিনের তিতা ভাব আরো বাড়ে। তার মনে হতে থাকে মুখে এক ডিব্বা লবণ নিয়ে বসে আছে ও। কর্নওয়েলকে পাল্টা জবাব দেয়ার মতো কোন জবাব আসে না মুখে।

গলা খাঁকারি শোনা যায়। কিং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছে। সবার নজর ওর ওপর গিয়ে পড়ে।

“আমি মনে হয় আকবরের খবর জানি।”

দরজা খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে সেফ হাউজের একজন সহকারী, তার পেছনে উঁকি দিচ্ছে আকবর। তার মুখটা ব্যথায় বিকৃত রুপ ধারণ করেছে।

*

অধ্যায় ২৪

চট্টগ্রাম তোলপাড় লালন বৈরাগীর অন্তধানে। রফিকুল ইসলাম এই লাইনের লোক না, তাই ধরতে পারেননি। কিন্তু বাংলাদেশের আর্টিস্ট সমাজে লালন বৈরাগীর আলাদা একটা কদর আছে দেখা গেল। অথবা কদর নেই। মৃত শিল্পীকে নিয়ে অহেতুক আহাজারি করা আমাদের স্বভাব। যদিও লালন বৈরাগী মারা গেছেন কিনা এরকম কোন কনফার্ম খবর পাওয়া যায়নি। তবে তার চাকরের নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে সবাই খারাপটাই ভেবে নিয়েছে।

দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় নাতিদীর্ঘ একটা আর্টিকেল লিখেছেন বিখ্যাত আর্টিস্ট মোস্তফা মনজুর, বিষয় লালন বৈরাগীর শিল্পভাবনা। আর্টিকেল পড়ে শিল্পী লালন বৈরাগীকে নিয়ে মোটামুটি একটা হধারণা করতে পারলেন রফিকুল ইসলাম। অল্প বয়সেই ছবি আঁকার নেশা পেয়ে বসেছিল বৈরাগীর। একক প্রদর্শনী করেছেন দু’বার। আর্ট সমাজে একটা পরিচিতি আছে, তবে সেরকম নাম-যশ কিংবা খ্যাতি কিছুই পাননি।

আর্টিকেলে বিষাদের একটা প্রচ্ছন্ন সুর খেয়াল করলেন গোয়েন্দাপ্রবর, যেনবা লালন বৈরাগী আর বেঁচে নাই।

হোটেল রুমের জানালার দিকে তাকান তিনি। ওপাশে রৌদ্র ঝলমল একটা দিন। বাইরে ব্যস্ত রাজপথ।

তার মাথায় কিছু প্রশ্ন গিজগিজ করছে, রীতিমত মাথা কুটে মরছে মাথার বাইরে আসার জন্য। তার মাঝে সবচেয়ে বেয়াড়া প্রশ্নটা আজকের পত্রিকা পড়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে–

লালন বৈরাগী বেঁচে আছেন তো?

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা মোটেও আশাবাদী করে তুলতে পারে না তাকে। লালন বৈরাগীর বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যে বা যারা তার কাজের ছেলেকে এভাবে মেরেছে, তাকে অপহরণ (ধারণা) করে নিয়ে গেছে, তারা কী তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে?

মনে হয় না।

তবে বেয়াড়াতম প্রশ্নটা এখনো করেননি তিনি।

কাজের ছেলেটিকে লালন বৈরাগী যদি নিজেই খুন করে থাকেন তাহলে? খুন করে দেয়ালে আবোল তাবোল কিছু লিখে রাখলেন? এমনিতেই পুরো বাড়িটা ফাঁকা, খুন করার জন্য আদর্শ জায়গা, কেউ বুঝতেও পারবে না। তারপর সুযোগ বুঝে গা ঢাকা দিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার মোটিভ কী?

বেরসিকের মতো মোবাইল বেজে উঠে। জহির। গতকাল ওর বাসাতেই রাতের খাবার খেয়েছেন তিনি। আয়োজন ভালোই ছিল। মাংসের পদই ছিল কয়েক প্রকার। গরু, খাসী, মুরগী তো ছিলই। সাথে ছিল কোয়েল পাখির মাংস। তারপর মাছের মুড়িঘন্ট, কয়েক পদের সবজি, ফুট সালাদ। ডেজার্টে নারিকেলের নাড়, দই, মিষ্টি।

খাওয়া দাওয়া শেষে মনে হচ্ছিল আর নড়তে পারবেন না। ভাবি খুব জোরাজুরি করছিলেন ওদের ওখানেই উঠে যেতে। জহিরও। পিচ্চি দুটোর সাথেও খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। আইরিন, ফারিন। পরীর মতো ফুটফুটে দুই বাচ্চা। ফারিন তো কোল থেকে নামতেই চাচ্ছিলো না।

কিন্তু একলা থেকে থেকে অভ্যাস খারাপ করে ফেলা রফিকুল ইসলাম মানুষের সাহচর্যে রীতিমত হাঁসফাঁস বোধ করেন। আর তাছাড়া মেহমানদারির যন্ত্রণা পেতে মোটেও ইচ্ছা করছিল না তার। এর চেয়ে নিঃসঙ্গ হোটেল রুম ভালো। তাই অজুহাত খাড়া করেন-হোটেলটা একদম সেন্টারে, কাজ করতে সুবিধা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পিচ্চি দুটোকে ছেড়ে যেতে কষ্টই হয় রফিকুল ইসলামের।

ফোনে প্রথমেই হালকা কুশলাদি বিনিময় হয়, এরপর অভিযোগ-থেকে গেলে পারতি, কাজের কী আর এমন ক্ষতি হতো, তুই আসলে শালা একটা অসামাজিক। তারপর আসল কথা পাড়ে জহির।

“তোর জন্য একটা গরম খবর আছে,” গলায় রহস্য ঢেলে বলে ও।

“কী খবর?”

“আমরা তো এতদিন ধরে জানি, এ্যাফিতির আর্টিস্ট লালন বৈরাগী। তাই না?”

“হ্যাঁ…কেন?” রফিকুল ইসলাম ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।

“আজ আমার এক ছাত্র এসেছিল দেখা করতে। তার কাছ থেকে একটা ইনফর্মেশন পাওয়া গেল। একদম নতুন ইনফর্মেশন।”

“কী ইনফর্মেশন?”

“লালন বৈরাগীদের নাকি একটা গ্রুপ ছিল। আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন গ্রুপ নামে। ঐ গ্রুপের মেম্বার আট-দশ জন। আমার ছাত্রের ভাষ্যমতে গ্রাফিতি ওই গ্রুপের কেউ একজন এঁকেছে, নট লালন বৈরাগী।”

“কী?”

“হ্যাঁ, ঠিকই শুনছিস। লালন বৈরাগী দুধ চা’র আর্টিস্ট না।”

*

অধ্যায় ২৫

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

বিরক্তিতে কানে হাত চাপা দেন মুন ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক আলফনসো কুয়ারোন। এ কী মুসিবতে পড়া গেল! ধরে নিয়ে আসার পর থেকে এই একটা কথাই ঘুরে ফিরে বলে যাচ্ছে লোকটা। চেষ্টা-ত্রুটি কম করছে না তারা। গরম পানি থিওরি অ্যাপ্লাই করেছে, গনগনে গরম পানিতে মাথা চুবিয়ে রাখা। ঠান্ডা পানি থিওরি অ্যাপ্লাই করেছে, বরফশীতল পানিতে মাথা চবিয়ে রাখা। বেছে বেছে স্পর্শকাতর অঙ্গে ইলেকট্রিক শক দিয়েছে। রুমের তাপমাত্রা একদম কমিয়ে দিয়ে দেখেছে, বাড়িয়ে দিয়ে দেখেছে। কিন্তু কসাই কাসেমের মুখ দিয়ে এই কথার বাইরে নতুন কিছু বের করতে ব্যর্থ তারা।

“ড, মেহবুব আরেফিন চৌধুরীকে চিনতি?”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“ডক্টরকে মারার জন্য কে টাকা দিয়েছে তোকে?”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“ডক্টরের সাথে একটা প্যাকেট ছিল। ওইটা কোথায় রাখছিস তুই?”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

মেজাজ হারায় রাফসার রশিদ। আরেকটু হলেই স্টিলের চেয়ার কাসেমের মাথায় ভাঙ্গতো ও। হাত ধরে ওকে থামান কুয়ারোন।

মাথায় চেয়ার ভেঙে কোন ফায়দা হবে না। ফায়দা হলে মাথায় হাজারটা চেয়ার ভাঙা যেত। উনি নিজেই ভাঙ্গতেন।

লোকটার কী কোন সমস্যা আছে? একই কথা বারবার বলছে কেন?

রাফসার রশিদকে প্রশ্নগুলো করেন কুয়ারোন।

ত্যাগ করে রাফসার রশিদ। পরে যোগ করে, “এতে আর আশ্চর্যের কী? সমস্যা তো আছেই। নাহলে এভাবে কেউ কোপ দিয়ে ব্রেইন বের করে ফেলে!”

চোখ সরু করে ওর দিকে তাকান কুয়ারোন। “ওর মতো তো তুমিও কোপ দিয়ে ব্রেন বের করে ফেলার কথা বলতেছো?”

“ওইটা তো ওর অবস্থা বোঝানোর জন্য বললাম। আপনি যে রকম কোপ দিয়ে ব্রেন বের করার কথা বললেন, ঠিক সেরকম।”

“এটা ওর মানসিক সমস্যা মনে হচ্ছে। না হলে কেউ বারবার কোপ দিয়ে ব্রেন বের করে ফেলার কথা বলতো না।”

মাথা দুলিয়ে সায় দেয় রাফসার রশিদ। “আমারও ওটাই মনে হচ্ছে, বস। এটা ওর কোন সিরিয়াস মেন্টাল প্রবলেম। নইলে কেউ কী ভাঙা টেপ রেকর্ডারের মতন কোপ দিয়া ব্রেইন বাইর কইরা দিছি, কোপ দিয়া ব্রেইন বাইর কইরা দিছি জপতে থাকতো?”

“বস, ইচ্ছা হইতেছে হারামজাদার মাথায় কোপ বসায়া দিয়া ব্রেইন বাইর কইরা ফেলি।” ইলেকট্রিক শক দেয়ার যন্ত্রপাতি সরিয়ে বলে

একজন।

“আমার তো ইচ্ছা হইতেছে, নিজের মাথায়ই কোপ বসায়া ব্রেইন বাইর কইরা ফেলি।” আরেকজন বলে। “মাথায় খুব যন্ত্রণা হইতেছে।”

কুয়ারোনের মাথায়ও প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কসাই কাসেমকে পাকড়াও করার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হতে চললো। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ওরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। মাঝখান দিয়ে সবার মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে কোপ দিয়ে ব্রেন বের করে ফেলার ইচ্ছা।

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

উফ, অসহ্য!

কুয়ারোন ইশারা দেন। সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে। “এই হারামজাদা খুব সেয়ানা মাল। দেখেছো আমাদের মাথায় কী রকম গিটু লাগিয়ে দিয়েছে?”

গম্ভীর মুখে সায় দেয় রাফসার রশিদ। “হ্যাঁ। জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলা দরকার। ও-ই পারবে কসাই কাসেমকে সিস্টেম করতে।”

কুয়ারোন স্রেফ দুই শব্দে সিজের সম্মতি জানান। “ফেচ হিম।”

*

কসাই কাসেমকে ধরিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু মোহরানা পেয়েছিল জাহাঙ্গীর। ওটা উড়াতেই ব্যস্ত ছিল সে তখন। কয়েক টাইপের মদ নিয়ে আসা হয়েছে। রাম, টাকিলা, হুইস্কি। চিপস আছে। বিস্কুট আছে।

গিয়াসকে ডাকে ও। গিয়াস নিয়ে আসে গাঁজার স্টিক। সাথে নিয়ে আসে ওর দুই বশংবদকে-অরুণ আর বরুন। যমজ দুই ভাই।

চারজন মিলে তাস পেটায়। অরুণ-বরুন ওস্তাদ খেলোয়াড়। বাজির পর বাজি জিতে চলে। ওরা অত ওস্তাদ না। কিন্তু তবু খেলে যায়। অন্ন ধ্বংস করে, পানীয় ধ্বংস করে। গিয়াস গাঁজা খুঁকে। রামের সাথে কোক মিশিয়ে দেয়। লেবু-লেটুস পাতা সহ আরো কী কী জানি মেশায়, নামও জানে না জাহাঙ্গীর। টাকিলার সাথে হুইস্কি মিলিয়ে ককটেল বানায়।

আর ওরা খায়।

দুবাইয়ের হোটেলে বারটেন্ডার ছিল গিয়াস। প্রায় বছর পাঁচেক কৃতিত্বের সাথে বারটেন্ডারগিরি করে কাটিয়েছে। অন্য ব্যাপারে ওর ঘিলু না থাকলেও, অ্যালকোহলের ব্যাপারে ওর অগাধ জ্ঞান। মাঝে মাঝে সেই

জ্ঞানের আলোকচ্ছটায় ঝলসে যায় ওরা। হুঁশ হারায়।

এখন যেমন হারিয়েছে।

নাহলে কলিংবেলের আওয়াজটা কারো না কারো কানে যেত। তারপর একসময় মড়াৎ করে একটা শব্দ হয়। কাঠের দরজা দু’ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরের দুই রুমের ফ্ল্যাট।

“মনে হচ্ছে কেউ দরজা ভাঙ্গতেছে,” গিয়াস মাথা চুলকে বলে।

“এই এলাকায় ডাকাতরা খুব ডিস্টার্ব করে।” জাহাঙ্গীর জানায়। “পাশের বাসায় ডাকাত পড়ছে মনে হয়।”

অরুণ-বরুন একসাথে চিৎকার শুরু করে। “ওই ডাকাত, ডাকাত। ধর, ধ, ধর্।”

কিন্তু ডাকাতেরা ওদেরকে বেশি সময় দেয় না। দুজন দুটা কারাতের কোপ দেয় অরুণ-বরুনকে। গিয়াসের অন্ডকোষ বরাবর লাথি কষায়। তারপর দুজন মিলে দুদিক থেকে ঝাঁপটে ধরে জাহাঙ্গীরকে।

জাহাঙ্গীর এলোপাথাড়ি লাথি কষে। একজনের নাকে গিয়ে লাগে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। নাকমুখ রক্তে একাকার হয়ে যায়।

রাফসার রশিদ পিস্তল তাক করে জাহাঙ্গীরের মাথা বরাবর-”এই রকম কোপ দিবো আর ব্রেইন বাহির হয়ে যাবে।” জাহাঙ্গীরের একবারও মনে হয় না রাফসার রশিদ পিস্তল দিয়ে কীভাবে কোপ দিবে। উপস্থিত কারোরই মনে হয় না। যেনবা পিস্তল দিয়ে কোপ দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ঘটনা, প্রায়ই ঘটে থাকে।

কোপের ভয়েই হোক বা অন্য কিছুর ভয়েই হোক জাহাঙ্গীর আর লাথি কষায় না। তাকে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তোলা হয়।

আরো কিছুক্ষণ পর জাহাঙ্গীর নিজেকে আবিষ্কার করে আলফনসো কুয়ারোনের ডেরায়, কসাই কাসেমের মুখোমুখি। জাহাঙ্গীরকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হবে, কীভাবে কাসেমের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিতে হবে।

কিন্তু আজ জাহাঙ্গীর একটু বেসামাল। তার সবকিছু বেড়াছেঁড়া লেগে যায়। কাসেম তখনো বিড়বিড় করেই যাচ্ছে

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

জাহাঙ্গীর উৎকর্ণ হয়ে শোনে। তারপর শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া জিনিসপত্র বেমালুম ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বসে-”কীভাবে কুপ দিলা, ও কাসেম বাই?”

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!” আবারো কাসেমের বিড়বিড়ানি।

জাহাঙ্গীর যেন কিছুটা খেপেই যায়। “কিরাম কুপ দিলা, দেখাও না।”

অস্ফুট গলায় কী জানি বলে কাসেম। আলফনসো কুয়ারোন, রাফসার রশিদ দুজনেই লাফ মেরে উঠে। টোটকা ওষুধে কাজে দিয়েছে। ওরা ইশারা দিয়ে উৎসাহ জোগায় জাহাঙ্গীরকে। কুয়ারোন ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, রাফসার রশিদ দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখিয়ে দেয়।

জাহাঙ্গীর ঝুঁকে পড়ে কাসেমের মুখের কাছে কান নিয়ে যায়। কাসেম তখনো অস্ফুট কণ্ঠে কী জানি বলে যাচ্ছিল।

জাহাঙ্গীর খানিকক্ষণ শোনে, তারপর যেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলে, “কী, দা নিয়ে আসবো? তুমি দেখাবা?”

এবার জাহাঙ্গীর ওদের দিকে তাকায়। “যান, দা নিয়া আসেন। কাসেম বাই বিসমিল্লাহ বলে কুপ দিবে।”

মুখ চাওয়া চাওয়ি করে কুয়ারোন ও রাফসার রশিদ। কুয়ারোন সায় জানায়। কিন্তু রাফসার রশিদ দোনামোনায় ভুগে। পাগল-ছাগলের হাতে দা ধরিয়ে দেয়া কী ঠিক?

কিন্তু বসের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কুয়ালরানের মতে যে কোন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো যথেষ্ট মানুষ আছে। পাগল-ছাগলকে থামিয়ে দেয়ার হজন্য একটা গুলিই যথেষ্ট।

একটা ধারালো দা এনে ধরিয়ে দেয়া হয় কসাই কাসেমের হাতে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কুয়ারোনের চেলাচামুন্ডারা। হাতে অস্ত্র প্রস্তুত, যে কোন ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সতর্ক।

কিন্তু কাসেম অস্ত্র-টস্ত্র কিছুই দেখে না, সে দেখে না এক দঙ্গল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখে সারি সারি মাংসের দলা, আংটায় ঝুলছে। নানা সাইজের, নানা বর্ণের। মাংসের মনমাতানো সৌরভে ম ম করছে চারপাশ। জিভে জল চলে আসে তার।

জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে কুয়ারোন আবারো ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, রাফসার রশিদ দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখিয়ে দেয়।

জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করে, “কিরাম কুপ দিলা, অ কাসেম বাই?”

আর পারে না কাসেম। মাথায় কিছু একটা সাৎ করে ছিঁড়ে যায় তার।

 জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে ও স্রেফ বলে-”এইরাম কুপ দিলাম।”

তারপর আর মুখ চলে না, চলে হাত। ডানে, বামে। বামে, ডানে। সামনে, পেছনে। পেছনে, সামনে।

চপ চপ চপ চপ চপ চপ।

আগ্নেয়াস্ত্রও চলে। ওইটা চলে না অবশ্য, গর্জায়। গুলি উড়িয়ে নেয় কাসেমের ডান কানের লতি, বাম উরুর মাংস, চুল সহ মাথার তালুর ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু কাসেম ভ্রূক্ষেপও করে না।

তার দা দুনির্বার। অদম্য। অপ্রতিরোধ্য।

ডান থেকে বামে। বাম থেকে ডানে।

 শুধু চপ চপ চপ চপ চপ চপ।

আবার চপ চপ চপ চপ চপ চপ।

ও যখন থামে কুয়াররানের ডেরা তখন রক্তসমুদ্র। রক্তবন্যা বইছে ফ্লোরে, দেয়ালে, চেয়ারে, টেবিলে। কাটা হাত, পা ও মাথার সাথে মিশে গেছে রক্ত, ভুড়ি ও পুঁজ।

তান্ডবলীলার দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকায় একবার ও। ওর ডান কাঁধে গুলি লেগেছে, বাম পাঁজরের হাড় ভেঙে গুলি ভেতরে ঢুকে গেছে। কিন্তু হকাসেম ভাবলেশহীন, যেনবা প্রতিদিন দু’চারটা গুলি খাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা।

কুয়ারোন আর রশিদ দুজনেই পালিয়েছে। জাহাঙ্গীর পালাতে পারে নাই। ভয়ে সে প্রস্রাব করে দিয়েছে। এখন নিজের প্রস্রাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ও।

বাকিরা মৃত অথবা কোনমতে জীবিত। কঁকাচ্ছে, গোঙ্গাচ্ছে, নিজের রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কাসেম দা উঁচিয়ে মরণচিৎকার দেয়। তারপর মুখ দিয়ে আঁ আঁ করতে করতে দরজা অভিমুখে দৌড় শুরু করে। দরজা ফাঁকা, কেউ নেই। কোন বাঁধা আসে না।

কসাই কাসেম রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। সে দেখে রাস্তায় সারি সারি আংটা লটকানো। আংটায় ঝুলছে মাংস।

ক্রুর হাসি ফুটে ওর মুখে।

*

অধ্যায় ২৬

“আমার এক ফ্রেন্ড আছে। সোহান। আঁকাআঁকির খুব শখ। ও ওই গ্রুপে আছে। গ্রুপের নাম ডার্ক। বেশ পার্ট আছে গ্রুপের। আলাদা লোগো, আলাদা ব্যাজ। গত নিউ ইয়ারে ওরা একটা ম্যাগাজিন বের করেছিল, লালন স্যার ছিলেন এডিটর…” মাহদী গরগর করে বলে যাচ্ছিল। মাহদীই হলো জহিরের ওই ছাত্র।

ওরা বসেছেন শহরের এক ক্যাফেতে। রফিকুল ইসলাম ও মাহদী দু’জনের হাতেই ধূমায়িত চায়ের কাপ, জহির একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে।

“তোমার ওই ফ্রেন্ড সোহান কিভাবে জানলো যে দুধ চা’র আর্টিস্ট লালন বৈরাগী না, অন্য কেউ?” কথার মাঝখানেই সুড়ুৎ করে একটা প্রশ্ন করে বসেন রফিকুল ইসলাম।

“সোহানই গতকাল বলছিল। ডার্কের ভেতর নাকি আরেকটা গ্রুপ আছে, পিচ ডার্ক। পিচ ডার্ক হলো ডার্কের কয়েকজন মাথাদের নিয়ে একটা হাই-প্রোফাইল গ্রুপ। ওইটার মেম্বার মাত্র তিনজন। ওই তিনজনের একজন হলো দুধ চা’র আর্টিস্ট। ও আরেকটা কথা বললো। ও নাকি কার কাছে শুনেছে যে ঢাকা থেকে একজন গোয়েন্দা এসেছেন লালন বৈরাগীর ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করতে। আমাকে বললো আপনাকে এই ডার্ক-পিচ ডার্কের তথ্য দিতে।”

“তাই?” কী জানি ভাবেন সিনিয়র গোয়েন্দা। লালন বৈরাগীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে ইতিমধ্যে রেজিস্টার অফিসে ঢু মেরেছেন রফিকুল ইসলাম, ভার্সিটিতে হালকা-পাতলা ঘুরেছেন। তার নামটা তাই চাউর হয়ে যাবার কথা। “আচ্ছা, নাম কী দুধ চা’র আর্টিস্টের?”

“স্পেসিফিক করে বলে নাই। তবে পিচ ডার্কের মেম্বারদের তিনজন হলো লালন বৈরাগী নিজে, জুলফিকার জন আর জে. কে। সোহানের ভাষ্য অনুযায়ী এই তিনজনের কেউই গ্রাফিতিটা আঁকছে। তবে লালন বৈরাগী ্না। তাহলে তো বাকি থাকলো মাত্র দুইজন…”

“জুলফিকার জন আর জে. কে। কিন্তু ও কেন বলতেছে লালন বৈরাগী এটা আঁকে নাই? বৈরাগী কী কনফেস করছে কারো কাছে?”

“আই ডোন্ট নো…সোহান আর কিছু খুলে বলে নাই। সে শুধু এটাই বললো যে এটা নাকি ওদের গ্রুপে ওপেন সিক্রেট।” মাহদী শেষে আবার যোগ করে, “ইউ ক্যান টক টু হিম ইফ ইউ ওয়ান্ট।” শেষে মুচকি হেসে বলে, “যদি সে কথা বলার পর্যায়ে থাকে তাহলে, “

“মানে? কথা বলার পর্যায়ে থাকে মানে?” রফিকুল ইসলাম অবাক হন।

“দুধ চা চাইছিলাম, রং চা না,” এক ক্রেতা উম্মা প্রকাশ করে। ক্যাফের পিচ্চি রং চা’টা আরেকজনের হাতে ধরিয়ে দেয়।

মাহদীর মুখে তখন আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি। “আপনে নিজেই দেখবেন। ওর গড়াগড়ির জায়গা মিউনিসিপাল্টি মার্কেটের পেছনের গলি…”

*

মিউনিসিপ্যালিটি মার্কেটের পেছনের গলি ডাস্টবিনে টইটুম্বুর। ময়লা ফেলার নির্ধারিত জায়গা আরো খানিকটা দূরে, চুগতাই খালের কোল ঘেঁষে। একটু ভুল বলা হলো, ময়লা ফেলার কোন নির্ধারিত জায়গা আসলে নেই। চুগতাই খাল এখন মৃতপ্রায়। নগরীর পরিবেশবিদরা প্রায়ই মরা খাল পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নানা আন্দোলন করেন, মিছিল-মিটিং করেন, হাতে হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়ান, পোস্টার-লিফলেট সঁটেন। এখনো চুগতাই খালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ‘খাল বাঁচলে, চট্টগ্রাম বাঁচবে নামাঙ্কিত একটা পোস্টার সাঁটানো দেখা যায়। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। খালের বেঁচে উঠার কোন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং মৃতপ্রায় চুগতাই খালকে হনগরবাসীরা বেছে নিয়েছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার উপযুক্ত জায়গা হিসেবে। নিয়ম করে ওখানেই সবাই ময়লা ফেলে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে মারাত্মক অলসতায় আক্রান্ত। তারা নিজের ঘর-দুয়ার পরিস্কার থাকলেই খুশি থাকেন, নগরী গু-মুতে ডুবে যাক তাতে কোন মাথাব্যথা নেই। ঘর থেকে বের হয়ে কয়েক ব্লক হেঁটে ময়লা ফেলতে তাদের অনেক কষ্ট। এইসব অলসদের জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা এই মিউনিসিপ্যালিটি মার্কেট।

মার্কেট অনেক পুরনো, পাকিস্তান আমলের। পুরনো ধাঁচের দালান। স্বাধীনতার পর আর সংস্কার কাজ হয়নি। জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে। মার্কেট না বলে এখন একে মার্কেটের ধ্বংসাবশেষ বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। কথাবার্তা চলছে খুব শীঘ্রই এখানে আলিশান মার্কেট উঠবে। তবে তার এখনো ঢের দেরি। মালিকপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি শেষ হয়নি, মূলামূলি চলছে। যে জন্য এখনো ভগ্নস্তূপ দালানই টিকে আছে। কয়েকটা দোকান নামকাওয়াস্তে আছে, তবে বেশিরভাগই ব্যবসা বন্ধ করে অন্য ধান্দায় ব্যস্ত। আর পেছন দিকটা পরিণত হয়েছে ডাস্টবিনে। ময়লা ফেলার নতুন ঠিকানা। আশেপাশের ব্লকের বাসিন্দারা বাসা থেকে ময়লার ব্যাগ নিয়ে বের হয়, দু’কদম হাঁটে, তারপর মার্কেটের পেছনে এসে দূর থেকে বর্শা নিক্ষেপের মত ময়লার ব্যাগ নিক্ষেপ করে।

রফিকুল ইসলামরা মিউনিসিপ্যালিটি মার্কেটের পেছনে গিয়ে দেখেন কয়েকটা কুকুর গড়াগড়ি খাচ্ছে, কোন মানুষের নামগন্ধও নেই। দুটা কাক বৃত্তাকারে ঘুরছে, আর পাঁচটা বসে আছে বটগাছের ডালে।

রফিকুল ইসলাম সামনে এগোন, তার সাথে মাহদী। জহিরও আসে পিছু পিছু। রুমাল দিয়ে নাক চাপা দেয়া জহিরের। ডাস্টবিনের গা ঘেঁষে একটা অটো মেকানিকের দোকান। কাউন্টারে অল্পবয়সী এক ছোকরা বসে আছে। মোবাইল টিপছে। রফিকুল ইসলাম মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন-”সোহান কী এই গলিতেই বসে আড্ডা মারে?

“কোন সোহান? সুগার সোহান?” ছোকরার মুখে ফিচেল হাসি।

“সুগার সোহানা!” কপালে কুঁটি জাগে রফিকুল ইসলামের। পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে জানায় মাহদী-”সোহানের নিক নেম। সুগার সোহান।”

রফিকুল ইসলাম শুনেন, মাথা নাড়েন। তারপর কাউন্টারের ছোকরাকে জিজ্ঞেস করেন-”কোথায় পাওয়া যাবে এই সুগার সোহানকে?”

“কই আর? চুগতাই খালে।”

*

চুগতাই খালের সবুজ পানিতে তখন কোমর ডুবিয়ে বসে আছে সোহান। তার হাতে একটা বোতল। সোহান খালের পানি বোতলে ভর্তি করছে আবার ফেলছে। ভর্তি করছে আবার ফেলছে। যেনবা একটা লুপের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে ও। বোতলের পানি ফুরিয়ে গেলে আবার মিষ্টি হেসে আপনমনেই বিড়বিড় করছে-খাল বাঁচলে, চট্টগ্রাম বাঁচবে!

বন্ধুর উদ্দেশ্যে হাঁক দেয় মাহদী। “সোহান, কী করতেছিস ওখানে? উঠে আয়।”

রাগি চোখে ওর দিকে তাকায় সোহান। তারপর খাস চাটগা ভাষায় যা বলে তার তর্জমা অনেকটা এরুপ দাঁড়ায়। “দেখস না, পানির কী অবস্থা! একদম সবুজ হয়া গেছে। খাওয়া যায় না, গোসল করা যায় না। মাছও সব কয়টা পলিউটেড। এর লাইগ্যা ফিল্টার করতাছি। খাল বাঁচলে, চট্টগ্রাম বাঁচবে।”

সে খালের পানি আবার বোতলে ভরে, তারপর খানিকটা ঝাঁকাঝাঁকি করে খালেই ফেলে দেয়। ফিল্টারড!

মাহদী আরো বেশ কয়েকবার অনুনয়-বিনয় করে।

উঠে আয়, উঠে আয় বাপ!

কিন্তু সোহান নাছোড়বান্দা। সে আজ খালের সব পানি ফিল্টার করে ছাড়বে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে বোতল নিয়ে চুগতাই খালে এসে হাজির হয়েছে। উদ্দেশ্য-পানি ফিল্টার। সে বরং বন্ধু মাহদীর উদ্দেশ্যে উদাত্ত আহবান জানায়-”তোরাও বোতল লইয়া আয়। সবাই মিলা করলে তাড়াতাড়ি হবে।”

খালের আশেপাশে ততক্ষণে ছোটখাট ভিড় লেগে গেছে। বিনা পয়সায় তামাশা দেখতে সবারই পছন্দ।

সোহানের ওদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বোতলে পানি ভরে ঝাঁকাঝাঁকি করে খালেই ফেলে দিতে থাকে।

অগত্যা সোহানকে টেনে-হিঁচড়ে খাল থেকে ভোলা হয়। খানিকক্ষণ হাত-পা ছুঁড়ে ও, আবোলতাবোল বকে, গালিগালাজও করে। তাকে ফিল্টার করতে না দিয়ে চট্টগ্রামের পরিবেশের ক্ষতি করছে তারা খাল বাঁচলে, চট্টগ্রাম বাঁচবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দেয় না। চ্যাংদোলা করে পাড়ে এনে ফেলা হয় সোহানকে।

তার পুরো চেহারায় নীলচে ভাব। একটু একটু করে কাঁপছে ও। দাঁত ঠকঠক করছে। এরই মাঝে সোহান জানায়, সূর্য উঠারও অনেক আগে ও এখানে হাজির হয়েছে। কারণ গতকাল রাতে ওর স্বপ্নে এসে হাজির হয়েছিলেন পানির দেবতা পসাইডন। পসাইডন রেগে কাঁই হয়ে ছিলেন। চোখ মুখ টকটকে লাল। রাগে রীতিমত কাঁপছিলেন।

সোহান ভয়ে ভয়ে শুধায়, “আপনি রেগে আছেন কেন, জনাব? গরীবের কী কোন ভুল হয়েছে?”

“পানিতে হেগে মুতে রাখিস, ময়লা-আবর্জনা ফেলিস, গন্ধে টিকা যায় না। চট্টগ্রামে এসেছিলাম বেড়াতে, চুগতাই খালে আস্তানা গেড়েছিলাম। কিন্তু চামড়ায় তো ময়লার আস্তর জমে গেছে রে, হারামজাদা। এক মণ ময়লার আস্তর। লাক্স সাবানে এই ময়লা সাফ হবে না, এর জন্য মাউন্ট অলিম্পাসের বিশেষ সাবান লাগবে। আবার বলছিস, গরীবের কী কোন ভুল হয়েছে?”

সোহান ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটে। দেবতা পসাইডনের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, চুগতাই খালের সমস্ত পানি ফিল্টার করে পরিশুদ্ধ করে ফেলবে।

সবাই মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে ওর কথা শুনে। রফিকুল ইসলাম আর সোহানকে শুধরে দেন না যে পসাইডন পানির দেবতা না, সমুদ্রের দেবতা। আশেপাশে ভিড় দেখে ওকে কোন কিছু জিজ্ঞাসাও করেন না। একটু নিরিবিলি দরকার।

সামনের গলিতেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চুগতাই রেস্টুরেন্ট। ওখানে বসা যায়। তার আগে এক সেট শুকনো কাপড় চোপড় নিয়ে আসা হয়। রেস্টুরেন্টের বাথরুমে ঠেলে ঢুকানো হয় সোহানকে। ভেজা কাপড়চোপড় পাল্টে ফেলে ও। এক সাইজ বড় হয়েছে কাপড়। টি-শার্ট কোমর ছাড়িয়ে জঙ্গায় গিয়ে ঠেকেছে।

“বস্তা বস্তা লাগতেছে। এরকম জানলে তো প্যান্ট আননের দরকার ছিল না!” বের হয়ে বলে ও।

চা’র অর্ডার দেয়া হয়। সোহানের ঠকঠকানি কমেছে। ওর মধ্যে এখন কেমন জানি একটা নিস্তেজ ভাব। ঝিম মেরে আছে। মাহদী ইশারায় জানায় হেরোইনের প্রভাব কমছে বোধহয়।

গরম চা এসে হাজির হয়। চায়ে চুমুক দেয় সোহান, চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খায়।

রফিকুল ইসলাম আনমনেই মাহদীকে প্রশ্ন করেন-”আচ্ছা তোমাদের ভার্সিটিতে যে গ্রাফিতি আছে, ‘দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব’, ওটা তো লালন বৈরাগীর আঁকা, তাই না?” সোহানের অলক্ষ্যে চোখ টিপে দেন তিনি মাহদীর উদ্দেশ্যে।

প্রশ্নে কাজ হয়। মাহদী উত্তর দেয় না, উত্তর দেয় সোহান। “জি না, ওই রকম একটা রেভুলুশনারি কাজ লালন বৈরাগীর কম্মো না। বৈরাগীর বলার মত কাজ একটাই, চা সিরিজ। কিন্তু লোকটা অন্যের আইডিয়া খুব কপি মারে। এই তো এক মাস আগেও জে, কে একটা সেমিনারে বলতেছিল এক চাইনিজ দেবতা শ্যানংয়ের কথা। দেখলাম বৈরাগী শুরু কইরা দিছে নতুন পেইন্টিং, বিষয়বস্তু শ্যানং। দ্য টি অভ শ্যানং। নতুন কিছু উনারে দিয়া হয় না।”

“তাহলে কে আঁকছে?”

“আপনারে বলবো কেন? আপনার জেনে কী লাভ? আর্টের কী বুঝেন আপনি?” হোরেইঞ্চি সোহান হঠাৎ করেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা চালায় মাহদী।

রফিকুল ইসলাম আর কথা বাড়ান না। চাটা এক চুমুক দিয়েই সরিয়ে রেখেছেন। মুখে দেয়া যাচ্ছে না। খালের সবুজ পানি দিয়ে কী চা বানিয়েছে এরা?

সোহানের অবশ্য চা খুব ভালো লেগেছে। এক কাপ চা শেষ করে আরেক কাপের অর্ডার দিয়েছে ও। সাথে বিস্কুট ও বনরুটি। এক প্যাকেট সল্টেড বিস্কুট শেষ করে সে হাত বাড়ায় গোল গোল বনরুটির দিকে।

সোহান জানায় গতকাল রাত থেকে সে না-খাওয়া। এখন এতই খিদে লেগেছে যে এক চুমুকে চুগতাই খাল সাবাড় করে দিতে পারবে।

নিজেদের কৃত্রিম আলাপচারিতা চালিয়ে যান রফিকুল ইসলাম ও মাহদী। “জে.কে-এর তো এলেম নাই দুধ চা’র মতো কিছু একটা আঁকার আর জুলফিকার…

কথা শেষ করতে পারেন না রফিকুল ইসলাম। হুংকার দিয়ে উঠে সোহান। “এলেম নাই? জে.কে-এর এলেম নাই! ফাজলামি চুদান আপনে?”

“এলেম আছে তাহলে?” অবিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন গোয়েন্দাপ্রবর।

“অফকোর্স শি হ্যাঁজ। শি ইজ দ্য আর্টিস্ট বাংলাদেশ ডিজার্ভ, লালন বৈরাগী কিংবা জুলফিকার জন কারোরই ওর মতো ভার্সাটাইলিটি নাই।”

“সো ইটজ এ শি? আমি তো শুনলাম একজন পুরুষ শিল্পী দুধ চা এ্যাফিতি এঁকেছেন।” মুখে মুচকি হাসি। টোপ গিলেছে সোহান।

“ভুল শুনছেন আপনে।” এক কামড়ে বনরুটির অবশিষ্টাংশ পেটে চালান করে দেয় ও। “জাকিয়া খানের ধন নাই, পুরা শরীরে ধনের ট্যাটু থাকার পরও। তয় আঁকার হাত আছে, এলেমও আছে। লালন বৈরাগী জুলফিকার জনদের থাকার মধ্যে শুধু ওই ধন-ই আছে, আর কিছু নাই।”

বিশ্রি শব্দে ঢেঁকুর তুলে ও। ওয়েটারকে দাবড়ানি দিয়ে আরেকটা বনরুটি চায়। আগের বনরুটি নাকি পেটের কোন চিপায় গিয়ে ঢুকেছে, তা সে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারে নাই। আরেকটা দরকার। তাহলে বোধহয় ঠাহর করতে পারবে।

“হাঁসের মাংস খাইছেন, মুরুব্বি? খুব টেস্টি। জে. কে’র বাড়িতে বহু হাস আছে। খালি প্যাক প্যাক করে সাঁতার কাটে আর খায়। প্যাক প্যাক করে সাঁতার কাটে আর খায়।”

খানিকক্ষণ মুখ দিয়ে প্যাক প্যাক করে শব্দ করতে থাকে সোহান। তারপ হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রস্রাবের বেগ পাইছে। মুতে আসি।”

গটগট করে রেস্টুরেন্টের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় ও। তারপর রাস্তাভর্তি মানুষের সামনে জিপার খুলে মুত্রত্যাগ করা শুরু করে। ওরা উঠে আসতে আসতে তার মুত্রত্যাগ শেষ।

মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠে সোহানের। হাত বাড়িয়ে অবলম্বন খুঁজে।

কিছু খুঁজে না পেয়ে নিজের প্রস্রাবের মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে ও।

*

অধ্যায় ২৭

“টমি, কাম হিয়ার।”

“টমি, কাম হিয়ার।”

“টমি, কাম হিয়ার।”

এক কথা শুনতে শুনতে মাথায় যন্ত্রণা ধরে গেছে সবার। কয়েক ঘন্টা যাবত এক নাগাড়ে বকে যাচ্ছে আকবর। বুড়ো আঙুলে নতুন করে ব্যথা পেয়েছিল ও মাজেদা খালার ডেরায়। এখানে এসে তাই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।

ও মা গো, ও বাবা গো।

এখানকার রেসিডেন্ট ডাক্তার এসে ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যায়, ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয় নতুন করে, ব্যথানাশক ওষুথ দেয়। ঘন্টাখানেক চুপ থাকে আকবর, তারপর আবার শুরু হয়।

ড্যান্ডির বুদ্ধি তখন জোনাথন কিংই দেয়। আকবরের আদি-অন্ত জানে কিং। ডক্টরের কাজের লোক আকবর, এক ছাদের নিচে থাকে। ডক্টরের অনেক গোমরই ওর জানার কথা। তাই টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে আকবরকে হাত করতে চাচ্ছিল কিং। কিন্তু আকবরকে হাত করা যাচ্ছিল না, বারবার পিছলে যাচ্ছিল ও। সাংবাদিক মাহফুজ আহমেদ তখন চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দেখিয়ে দেয়, আকবরকে বশ করতে পারে স্রেফ ড্যান্ডিই। আর কিছু না।

একটু ভুল বলা হলো। শুধু ড্যান্ডি না, মাজেদা খালাও বশ করতে পারে আকবরকে। তাই মাজেদা খালাকে দিয়ে কিংই ফোন করায় আকবরকে। তারপর মওকা বুঝে পাকড়াও করে নিয়ে আসে।

কিন্তু আসার পর থেকে সেই যে গোঙ্গানি শুরু হয়েছে, আর থামছে না। ডাক্তার চাচ্ছিল ঘুম পাড়িয়ে দিতে। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। আকবরের ওপর দিয়ে শারীরিক ধকলই যায়নি শুধু, মানসিক ধকলও গেছে। চোখের সামনে সে তার মনিবকে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছে। ওর একটু সময় দরকার, এখনই তাড়াহুড়া করলে চলবে না। এক নাগাড়ে সাত-আট ঘন্টা ঘুমালে অনেক ফ্রেশ লাগতো নিজেকে। কিন্তু কর্নওয়েল বাঁধ সাধেন। উনার ঝটপট খবর দরকার। আকবর এতক্ষণ ঘুমালে চলবে কীভাবে?

আইডিয়াটা তখন কিংই দেয়। কমলাপুর রেলস্টেশনে ছেলেপিলেরা এই ড্যান্ডি খেয়ে ব্যথা-বেদনা ভুলে থাকে।

তো, ড্যান্ডি দিলে কেমন হয়?

ড্যান্ডিতে আধাঘন্টা টান দিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা যাবত বকে যাচ্ছে আকবর।

“টমি, কাম হিয়ার।”

“টমি, কাম হিয়ার।”

“টমি, কাম হিয়ার।”

টমি কে, সে কেনইবা আসবে-এসব বিষয়ে প্রথম প্রথম খানিকটা আগ্রহ জন্মালেও এখন আর কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। টমি যেই হোক, চুলোয় যাক ও।

“হু ইজ দিস টমি, কিং?” বিরক্তির চরমে উঠে প্রশ্ন করেন কর্নওয়েল।

কিং বলবে না বলবে না করেও শেষমেষ বলেই ফেলে। “টমি হলো ডক্টরের কুকুরের নাম।”

“নিয়ে আসো ওই কুত্তাটাকে। তাতে যদি ওর বকবকানি থামে।” কিংকে ছুটতে হয় ডক্টরের বাসা অভিমুখে, সাথে বাংলাদেশি এজেন্ট অভিজিৎ। রাস্তাঘাটে ভাষাগত কোন সমস্যায় পড়লে অভিজিৎ ট্যাকল দেবে। তাছাড়া স্থানীয় কেউ যেরকম এ দেশের ভাও বুঝে বিদেশিরা তো চট করে বুঝবেও না। তাই অভিজিতের শরণাপন্ন হওয়া।

কিন্তু ডক্টরের বাসায় ঢুকতে চাইলেই কী ঢোকা সম্ভব? ডক্টরের বাসা সিলগালা, বাইরে পুলিশ প্রহরা।

কিংকে তখন ভিন্নপন্থা অবলম্বন করতে হয়। মুখ কাঁদো কাঁদো করে সে গেটের বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের কাছে এগিয়ে যায়। “মাই নেম ইজ মাইক পেন্স। আই এ্যাম এ ফটোগ্রাফার। আই লস্ট মাই ডগ টমি। হ্যাভ ইউ সিন হিম?”

অভিজিৎ তৎক্ষণাৎ তর্জমা করে দেয়। “আমার নাম মাইক পেন্স। আমি একজন ফটোগ্রাফার। আমি আমার কুত্তা টমিকে হারিয়ে ফেলেছি। তোমরা কী তাকে দেখেছো?”

দু’জন পুলিশই দু’দিকে মাথা নাড়ে। না, তারা দেখেনি।

কিংয়ের বেশভূষা ট্যুরিস্টদের মত। পরনে ঢোলা টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট। মাথায় সাদা হ্যাট। গলায় ঝুলছে ক্যামেরা। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যের ছবি তুলে নাম-যশ কামানো কোন ফটোগ্রাফারের মতই লাগছে কিংকে।

না-বোধক জবাব শুনে কান্নাভেজা গলায় নিজের ফরিয়াদ জানায় কিং। “টমি এদিকেই ছুটে এসেছিল। আমি কী গেটের ভেতরটা একটু দেখতে পারি, প্লিজ?”

সাদা চামড়াদের প্রতি বাংলাদেশিরা যে ভয়াবহ রকমের দুর্বল, তা ভালোই জানা জোনাথন কিংয়ের। পুলিশ দু’জন তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার অনুরোধ মেনে নেয়। গেটের ভিতর ঢুকে কিং খানিকক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচি করে-”টমি, সুইটহার্ট। টমি, কাম হিয়ার সুইটহার্ট।”

অভিজিৎও খুঁজে। কিন্তু টমির নাম-নিশানাও নেই কোথাও। পুলিশগুলো উপরের ফ্ল্যাটও খুঁজে দেখে।

না, কোন কুকুর নেই।

বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে ফটোগ্রাফার মাইক পেন্স ওরফে জোনাথন কিংয়ের মুখে। পুলিশদের একজন তখন একটা বুদ্ধি বাতলায়। ভার্সিটি ছাড়িয়ে একটা দুইতলা দালান আছে। ওই বাসার মালিক এক দঙ্গল কুকুর পালে। গন্ধ শুঁকে কে আপনার কুকুর কী ওদিকে দৌড় দিলো?

দিতেও পারে। বিষণ্ণ মুখে সায় জানায় কিং।

বেস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে ছেলেপিলেদের জটলা। আড্ডা দিচ্ছে, চা খাচ্ছে, সিগারেট ফুকছে। এর একটু সামনে একটা তিনতলা দালান পড়ে। চমৎকার ইটের কারুকাজ করা বিল্ডিং। বাইরের উঁচু গেটটা বন্ধ।

টোকা দেয় অভিজিৎ। দরজা খুললে একটু আগের দৃশ্যটা আবার অভিনীত হয়। আমেরিকান ফটোগ্রাফারের বিষাদময় কাহিনী শুনে দারোয়ান বেশ আবেগআপ্লুত। ও জানায় ওর মনিব কুকুর-অন্তপ্রাণ। কুকুর ছাড়া কিছু বুঝে না। ওর পিচ্চি ছেলেটাও বাপের মতো হয়েছে। মানুষের চেয়ে কুকুরের সাথে সময় কাটায় বেশি। বাইরের দেশে বেড়াতে গেলে মনিব সাথে করে কুকুর নিয়ে আসেন। গেলবার কানাডা গিয়েছিলেন, সাথে করে চারটা সেম টু সেম কুত্তা নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে একটা কুকুর প্রফেসর সাবকে গিফট দিয়েছেন কর্তা।

টনক নড়ে কিংয়ের। “প্রফেসর?”

“এটু সামনেই তেনার বাড়ি। ওই যে মাথায় কোপ খাইছেন।” চুকচুক করে সমবেদনা জানায় দারোয়ান। “বড় ভালা মানুষ আছিল।”

“প্রফেসরসাহেবের কুকুরটা এখন কোথায়? ওই বাড়িতে তো এখন কেউ নেই।”

“টমি তো এইখানে চইল্লা আসছে। দেখবেন?” হেসে জানায় দারোয়ান।

“প্লিজ। আমার কুকুরটার নামও টমি। ওকে দেখে যদি দুধের সাধ ঘোলে মিটে।”

দারোয়ান ওদেরকে ভেতরে নিয়ে যায়। কিং জানে ডক্টরের বাসায় কী জাতের কুকুর ছিল। একটা ফ্যাকাশে হলুদ ল্যাব্রাডর। দারোয়ান তখন বকবক করে যাচ্ছে ওদের কাছে কতোটা কুকুর আছে, সেগুলো কী কী জাতের কুকুর ইত্যাদি ইত্যাদি।

তিনতলা দালানের পাশে একটা লম্বা শেড, উপরে ঢালাই দেয়া। শেডের বাইরে থেকেই কুকুরের কলরোল শোনা যায়।

আশেপাশে তাকায় কিং। কেউ নেই।

ঘাড়ের পেছনে একটা মোক্ষম কারাতে কোপ। কাটা কলাগাছের মত পড়ে যায় দারোয়ান। ধরাধরি করে তাকে একটু সাইডে নিয়ে যায় কিং ও অভিজিৎ। তারপর শেডের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।

ভেতরে নানা জাতের কুকুর আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টমি।” বলে ডাক পাড়ে কিং।

কুকুরগুলোর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তারা আগের মতই ঘুরে বেড়াতে থাকে।

“টমি, কাম হিয়ার।” এবার ডাক পাড়ে অভিজিৎ।

ঘেউ ঘেউ করে চারটা ফ্যাকাশে ল্যাব্রাডর ছুটে আসে। দাঁত-মুখ খিচাননা, জিহ্বা বের করা। ওদের দেখে যোগ দেয় বাদবাকি কুত্তাগুলোও। জার্মান শেফার্ড, রটওয়েলার, ব্লাডহাউন্ড। দাঁতমুখ খিচে সবগুলো তেড়ে আসে। ওদের ভাবভঙ্গি মোটেও সুবিধার ঠেকে না অভিজিতের কাছে।

“কিং, রান।” কথা কয়টা বলে আর দাঁড়ায় না ও, খিঁচে দৌড় দেয়।

কিংও দৌড়ায়। ল্যাব্রাডর না হয় পরে নেয়া যাবে, এখন পৈতৃক প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ওটা বাঁচানো ফরজ।

সে-ও দৌড়ায়। গেটের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে জার্মান শেফার্ডটা ধরে ফেলে আমেরিকান এজেন্টটিকে। পাছা ধরে ঝুলে পড়ে তাঁদড় শেফার্ড। টাল সামলাতে পারে না কিং, হোঁচট খেয়ে পড়েই যায়। ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায় ক্যামেরা। একে একে এগিয়ে আসে ল্যাব্রাডর, রটওয়েলার, ব্লাডহাউন্ড।

শেফার্ড কামড়ে কিংয়ের হাফপ্যান্ট ছিঁড়ে ফেলেছে, নিচের আন্ডারওয়্যার ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে রটওয়েলারটা। বাম বগলের নিচে রিভলবার। কিং ডান হাত ওইদিকেই নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ব্লাডহাউন্ডটা মরণকামড় দেয় ডান কনুইয়ে।

আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে আমেরিকান স্পাই।

কিংয়ের চিৎকার শুনে পেছনে তাকায় অভিজিৎ। সে ততক্ষণে গাড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। কিংকে ঘিরে রেখেছে সাত থেকে আটটি কুকুর। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এটা বুঝতে পারে অভিজিৎ। যেভাবেই হোক, কিংকে বাঁচাতে হবে।

মানুষজন জড়ো হতে শুরু করবে। ইতিমধ্যে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে, উৎসাহী লোকজনের উঁকিঝুঁকি। সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। সময় একদমই নেই।

অভিজিৎ গুলি করে। পরপর তিনটা। একটা জার্মান শেফার্ডের খুলিকে মুহূর্তে বানিয়ে দেয় ফাটা তরমুজ। দ্বিতীয়টা হাউন্ডের ডান দিকে পাজর চিরে বেরিয়ে যায় উল্টা পাশ দিয়ে। ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। তৃতীয়টা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। রটওয়েলারের লোম ছুঁয়ে আঘাত হানে থামে।

আকস্মিক আঘাতে কুকুরগুলো থমকে যায়। সিঁড়ির ধাপ থেকে বিস্ময়ধ্বনি ভেসে আসে, উঁকিঝুঁকি মারতে দেখা যায় কয়েকটি মাথাকে। হয়তোবা গুলির শব্দ তাদেরকে শঙ্কিত করে তুলেছে, ক্রসফায়ারে পড়তে চায় না।

বাকি কুকুরগুলোর থমকানো ভাব দেখে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় কিং। ঘুরে দৌড়ানো শুরু করে। য পলায়তি স জীবতি! যে পালায় সে বেঁচে যায়। আর কিংয়ের বেঁচে থাকাটা জরুরি।

ওর মুখ ক্ষত-বিক্ষত, ডান হাতের অনেকটাই খুবলে নিয়েছে বজ্জাত ব্লাডহাউন্ড। হাফপ্যান্ট নাই, টি-শার্ট ছিঁড়ে ত্যানা। পরিধেয় বস্ত্র বলতে স্রেফ জকি আন্ডারওয়্যার। ওটা নিয়েই দৌড়ায় ও।

হইহই করে পিছু নেয় বাকি কুকুরগুলো। দৌড়াতে দৌড়াতেই ঘুরে গুলি করে কিং।

লক্ষভ্রষ্ট।

গুলি ল্যাব্রাডরের লেজ মিস করে গেটে গিয়ে বিঁধে।

“শিট।”

আবার গর্জায় ওর রিভলবার। এবারেরটা দ্রুত ধাবমান রটওয়েলারের ডান পাটা ছিটকে নেয়। কংক্রিটের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে রটওয়েলার। মট করে একটা শব্দ হয়। ঘাড় ভেঙে গেছে বেচারার।

গাড়ির পেছনের দরজা খোলা। আর কয়েক কদম বাকি।

প্রাণপণে দৌড়ায় কিং। লাফ দিতে যাবে এমন সময় ওর জকি আন্ডারওয়্যার ধরে ঝুলে পড়ে এক ব্লাডহাউন্ড। কিং আতঙ্কের সাথে অনুভব করে ওর ডান নিতম্বের নরম মাংসে কুকুরের ধারালো দাঁত ঢুকে পড়ছে।

মরণ চিৎকার দিয়ে উঠে কিং। একটা হাত এসে ওকে ঝাঁপটে ধরে, গুলির প্রচন্ড আওয়াজ। তারপর সবকিছুই ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট। সেই ধোঁয়াশায় একটা ছবি প্রকট হয় শুধু। সেই ছবিটা ব্লাডহাউন্ডের। মুখে জকি আন্ডারওয়্যার নিয়ে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাম কান দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তড়পাচ্ছে কুকুরটা। রক্ত কংক্রিটের রাস্তায় পড়ে পড়ে অদ্ভুত নকশার সৃষ্টি করে। ওর মুখের আন্ডারওয়্যারটা তবুও ফসকায় না, মুখে লেগেই থাকে। যেন কেউ আইকা গাম মুখে লাগিয়ে দিয়েছে।

ব্লাডহাউন্ডের মুখে যদি ওর জকি আন্ডারওয়্যার থাকে তাহলে ও কী পরে আছে?

পাছার নিচে নরম গদি অনুভব করে কিং। তুমুল ঢিলবৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাড়ির ওপর টুপটুপ করে পড়তে থাকে ওগুলো। পাশ থেকে অভিজিৎ চিৎকার করে-”জোরে চালাও গাড়ি।”

গাড়িও গোত্তা খেয়ে সামনে বাড়ে। নগ্ন জোনাথন কিংকে এক হাতে বেষ্টন করে রাখে অভিজিৎ। গাড়ির দুলুনিতে দোল দোল করে দোলে কিংয়ের পুরুষাঙ্গ। ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। যেন পুরুষাঙ্গটিকে যাই বলা হচ্ছে, দু’পাশে মাথা নেড়ে না বলে দিচ্ছে।

*

অধ্যায় ২৮

আধা পাকা দালান। নিচে ইট-পাথরের গাঁথুনি, উপরে টিন। বাড়ির গা ঘেঁষে একটি পেয়ারা গাছ বেড়ে উঠেছে। ডালে থোকা থোকা পেয়ারা। একটা কাঠবিড়ালী দেখা যায়। ডালের আড়াল থেকে তাকাচ্ছে, আবার সুড়ৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায় কোথাও।

গেট লক করা। গরাদের ফাঁক দিয়ে ভেতরটা ভালোই দেখা যায়। কয়েক বার ধাক্কা দেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।

তবে কী ভুল ঠিকানায় এলো ওরা?

জাকিয়া খান লেকচারার হিসেবে সদ্য জয়েন করেছে, আর্ট ডিপার্টমেন্টে। তার নাম-ধাম-ঠিকানা সব ভার্সিটির রেজিস্টার অফিস থেকে নেয়া, তারপর অকুস্থলে আসা। এ তল্লাটে এসে খোঁজখবর কিন্তু কম করা হয়নি। সমস্যা হলো, জাকিয়া খান নামে কাউকে চিনে না এ এলাকার কেউ। অনন্যোপায় রফিকুল ইসলাম এলাকাবাসীদের হিন্টস দেন তখন।

ঐ যে আর্টিস্ট! আঁকাআঁকি করে।

এবার চিনতে পারে মানুষ। আর্টিস্ট তো এলাকায় মাত্র একজনই। ঐ যে আউলা-মাথা চাকমা মুখো মেয়ে। এলাকায় জে কে ওরফে জাকিয়া খানের নাম চাকমা। ওই নামেই সবাই ওকে চেনে।

ওদের দিক-নির্দেশনা ও রেজিস্টার অফিসের ঠিকানা মিলিয়ে এই আধা-পাকা দালানে আগমন। কিন্তু মানুষের কোন চিহ্নও তো পাওয়া যাচ্ছে না।

“বেয়ে বেয়ে উঠবি?” জহির পরামর্শ দেয়।

গেট মাঝারি উচ্চতার। চাইলে বেয়ে বেয়ে টপকানো যাবে। সীমানা প্রাচীরও অত উঁচু না।

রফিকুল ইসলাম সাত-পাঁচ ভেবে বেয়ে উঠারই সিদ্ধান্ত নেন। জুতা খুলে গেটে উঠে পড়েন তিনি। তারপর বেয়ে বেয়ে গেটের চূড়ায় হাজির হন। খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে লম্বা একটা লাফ দেন তিনি। এক লাফে অন্য পাশে।

সদর দরজা তালা চাবি মারা না, ছিটকিনি আঁটকানো। ছিটকিনি খুলে দেন রফিকুল ইসলাম। জহিরও ঢুকে পড়ে। মাহদী নাই। ওকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বেহুশ সোহানের সাথে। চাইলে পুলিশে খবর দিয়ে ফোর্স নিয়ে আসতে পারতেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু ফোর্স আনা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অযথা সময় নষ্ট করতে চাননি তিনি। তবে পুলিশকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। যে কোন সময় ফোর্স লাগতে পারে, তাই প্রস্তুতি নিয়ে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ।

উঠানে বাগান মত করা আছে। সূর্যমুখী, ডালিয়ার ফাঁকে টমেটোর গাছ। নজরে পড়ে। লাল লাল টমেটো ধরে আছে গাছে। হঠাৎ পরিবেশ-পরিস্থিতি বেমালুম ভুলে ঢালিউডের উদ্ভট এক গান মনে পড়ে তার। গানের একটা লাইন এরকম :

যৌবন আমার লাল টমেটো

এই দরজাও বন্ধ। কলিংবেল আছে। চাপ দেন রফিকুল ইসলাম। ভেতর থেকে ক্ষীণ একটা সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসে।

পাশ থেকে বেরসিকের মতো জহির বলে উঠে, “খিদে পাইছে দোস্ত।”

রফিকুল ইসলাম মুখে একটা সান্ত্বনার হাসি ঝুলান। এর অর্থ অনেক কিছু হতে পারে। জহির ধরে নেয় ওর পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক যে অর্থ, সেটা।

কাজটা শেষ হোক, ভাল কোন জায়গায় খেতে যাবো। আমার ট্রিট।

ভেতরটা সুনসান, নীরব। পেয়ারা গাছে মৃদু আলোড়ন। কাঠবিড়ালীটা ডাল বদল করেছে।

কাঠের জানালা বন্ধ। ফাঁকে চোখ লাগিয়ে ভেতরে দৃষ্টি দেন রফিকুল ইসলাম। ভেতরটা অন্ধকার। চোখ সয়ে আসলে সোফাসেট, সেন্টার টেবিল আর ফুলদানি নজরে আসে তার।

পেছন দিকটা দেখা যাক। হেঁটে পেছনে এসে হাজির হন তিনি। পেছনে একটা ছোট্ট পুকুর। সুন্দর বাঁধানো ঘাট। টি-শার্ট পরা এক তরুণীকে দেখা যায় তাদের দিকে পেছন ফিরে ছবি আঁকছে। মেয়েটার কোন দিকে কোন হুঁশ নেই, রং-তুলিতে নিমগ্ন।

তারা যথেষ্ট আওয়াজ করেই মেয়েটার পেছনে এসে দাঁড়ান। গলা খাকারি দেন।

নাহ্, তাতেও কাজ হয় না।

শেষমেষ রফিকুল ইসলাম মুখ খোলেন। “এক্সকিউজ মি…”

“ইউ আর এক্সকিউজড।” মেয়েটা ঘাড় ফেরায়।

ফর্সা, পেন্সিলের মত চিকন ঠোঁট, মুখের মাঝখানে থ্যাবড়া এক নাক। চোখ দুটো কুতকুতে। গালে কয়েকটা রংয়ের মিশেল দেখা যায়। আঁকতে আঁকতে অন্যমনস্ক হয়ে গালেই মুছে ফেলেছে রং। ওর গাল দুটো ক্যানভাসে ঘষলে যে আর্টের সৃষ্টি হবে তাকে বিমূর্ত পেইন্টিং বলে সহজেই চালিয়ে দেয়া যাবে। অন্তত রফিকুল ইসলামের সেটাই মনে হয়।

ইজেলে একটা পেইন্টিং রাখা। সাদা ক্যানভাসে একটা বিশাল বৃক্ষের ছবি। প্রচুর ডাল, পাতা। থোকা থোকা টসটসে ফল। অজগরের পিঠের মতো মোটা শেকড়।

রফিকুল ইসলামকে একমনে পেইন্টিংয়ের দিকে তাকাতে দেখে মেয়েটাই আগ বাড়িয়ে বলে, “এটা হলো ট্রি অভ নলেজ। অ্যাডাম অ্যান্ড ঈভ এই গাছ থেকেই নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন।”

“কী ফল?” রফিকুল ইসলাম ঠিক এ ধরণের কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

“নিষিদ্ধ ফল, ফরবিডেন ফুট। ইসলাম ধর্মে যাকে বলা হয়েছে গন্ধম ফল।”

রফিকুল ইসলাম পেইন্টিং থেকে চোখ ফেরান। “আপনিই জে. কে ওরফে জাকিয়া খান?”

“হু। আমিই জে. কে ওরফে জাকিয়া খান।”

“দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব এ্যাফিতি আপনিই এঁকেছেন?”

খানিকক্ষণ নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। “কে আপনি?”

রফিকুল ইসলাম পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে দেখান। মেয়েটা আইডি কার্ডে একবার চোখ বুলিয়ে আবার গোয়েন্দাপ্রবরের দিকে দৃষ্টি দেয়। “হ্যাঁ, আমিই এঁকেছি। অথবা, বলতে পারেন আমাকে দিয়ে আঁকিয়ে নেয়া হয়েছে।”

“আঁকিয়ে নেয়া হয়েছে? একটু ক্লিয়ার করে বলবেন, প্লিজ।”

মেয়েটার মুখে কিঞ্চিৎ হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলায়। “মিউজ মানে জানেন তো?”

এতটুকু বিদ্যা রফিকুল ইসলামের পেটে আছে। “মিউজ হলো গ্রিক দেবী। শিল্প কিংবা সাহিত্য সৃষ্টিতে যে অনুপ্রেরণা যোগায়। মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন মিউজ আপনাকে দিয়ে এটা করিয়ে নিয়েছে।”

“হু।“

“আপনি কী জানেন যে ঠিক সেম প্যাটার্নে ঢাকায় গত দেড়-দু’মাসের ব্যবধানে চার-চারটা খুন হয়েছে। ওয়ালে আপনারটার মতই এ্যাফিতি আঁকা, আপনারটার মতই ওখানে লেখা ‘দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব’। খুনগুলোও কী মিউজের অনুপ্রেরণায় করা, মিস জাকিয়া খান?”

মেয়েটার চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়। “আমি কোন খুন করিনি। কোন খুনি যদি আমার আর্ট দ্বারা ইন্সপায়ার্ড হয়, তাহলে তো আমার কিছু করার নেই।”

“আর লালন বৈরাগীর অন্তর্ধান এবং তার কাজের লোক হান্নান মিয়া হত্যা? ওগুলোর ব্যাপারে কী বলবেন?”

এবার মেয়েটা বিরক্ত হয়। “ওগুলোর ব্যাপারে আমাকে কেন কিছু বলতে হবে?”

এবার আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েন রফিকুল ইসলাম। “লালন বৈরাগীর সাথে আপনার একটা রেষারেষি আছে এটা কিন্তু সবাই জানে। আপনাদের আর্ট গ্রুপ ডার্কের প্রতিটা মেম্বারও কিন্তু এই রেষারেষির ব্যাপারটা বলেছে। আপনার সৃষ্টি ‘দুধ চা’-র ক্রেডিটও বলতে গেলে এই লোকই নিয়ে নিয়েছে। সবাই ‘দুধ চা’র স্রষ্টা হিসেবে লালন বৈরাগী ওরফে দুলাল হাসানের নামই জানে। এই জিনিসগুলো আপনাকে হার্ট করেছে নিশ্চয়ই। সব ক্রিয়েটিভ লোকই রিকগনিশন চায়, কিন্তু আপনার রিকগনিশন অন্য একজন হাইজ্যাক করে ফেলেছে…”।

“লালন বৈরাগী কখনোই বলেননি উনি ‘দুধ চা’র স্রষ্টা…”

“কখনো অস্বীকারও তো করেননি। উনি কী জানি বলতেন, জহির…” সাহায্যের জন্য জহিরের দিকে তাকান রফিকুল ইসলাম। জহির তখন একমনে পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। পুকুরে কয়েকটা হাঁস সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ সোহানের কথা খেয়াল হয় তার। দুধ চা-১২

প্যাক প্যাক করে সাঁতার কাটে আর খায়…

জবাবটা জাকিয়া খানই দেয়। “যে আঁকার সে-ই এঁকেছে।”

“হ্যাঁ, হেঁয়ালিময় জবাব। যখন উনি ইজিলি আপনার নাম বলতে পারতেন।”

“উনি কেন আমার নাম বলেন নাই সেটা তো উনিই ভালো বলতে পারবেন, রফিকসাহেব।”

“আপনিও কিন্তু কখনো গিয়ে দাবি করেন নাই। কেন?”

জবাবটা যেন মুখেই ছিল মেয়েটার, ঠাস ঠাস করে দিয়ে দেয়। “আই ডোন্ট ওয়ান্ট আননেসেসারি অ্যাটেনশন।” কথাটা বলেই তাদের দিকে পিঠ ফেরায় মেয়েটা। “এখন যদি আমাকে আপনারা এক্সকিউজ করেন।”

মেয়েটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন রফিকুল ইসলাম। টি শার্টের নিচে হালের ফ্যাশন ঢোলা পায়জামা পরে আছে মেয়েটা। বাহারি একটা নাম আছে পায়জামার। এই মুহূর্তে মনে করতে পারেন না তিনি।

“ঠিক আছে। এখন এক্সকিউজ করছি। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না প্লিজ। আর লালন বৈরাগীর ব্যাপারে কিছু জানলে ডোন্ট হেজিটেট টু কল আস। নেন, আমার কার্ডটা রাখেন।

ডান হাতে ব্রাশ ধরা, পেছনে তাই বাম হাত বাড়িয়ে দেয় জাকিয়া খান। বাড়িয়ে ধরা হাতে টুপ করে কার্ড ফেলে দেন রফিকুল ইসলাম।

 “আর আরেকটা কথা। আপনার ঘরটা আমাদের একটু চেক করতে হবে। রুটিন চেক।”

এবার ঘাড় ফেরায় দুধ চা শিল্পী, চোখে ভ্রুকুটি। “ঘর চেক করার জন্য ওয়ারেন্ট আছে?”

“আপনি চাইলে আমি ওয়ারেন্ট নিয়ে আসতে পারি। অথবা, আপনি আমাদের সাথে কো-অপারেট করতে পারেন। আমরা চেক করে সন্দেহজনক কিছু না পেলে চলে যাবো। চয়েজ ইজ ইওরস।”

মেয়েটা চোখ কুঁচকে ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর ঠোঁট উল্টায়। “বি মাই গেস্ট।” হাত দিয়ে পেছনের খোলা দরজা দেখায় ও। “আচ্ছা গেট তো বন্ধ ছিল, ভেতরে ঢুকলেন কীভাবে?”

”বেয়ে উঠলাম। আপনি তো গেট খুলছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে…”

জবাব শুনে মেয়েটা আবারো ঘাড় ফেরায়। মেসেজ পরিস্কার। নিষ্ক্রান্ত হও।

ওরা জাকিয়া খানের সামনে থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে তার বাড়িতে গিয়ে সেঁধোয়। পুরনো আমলের বাড়ি। পেছনের চৌকাঠ পেরিয়ে একটা বারান্দা। বারান্দায় প্রচুর টব। বারান্দার সাথে লাগোয়া দরজা। মূল বাড়িতে ঢোকার। ঢুকতেই বেডরুম। জাকিয়া খানের, খুব সম্ভবত। ছোট্ট একটা বিছানা। চারদিকে শুধু বোর্ড। বোর্ডে ঝুলছে সাদা ক্যানভাস, অর্ধ-সমাপ্ত পেইন্টিং, রং-তুলি। টি-টেবিলে চার কাপ, বই, অ্যাশট্রে। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের বাট। অন্তত দশ থেকে বারোটা তো হবেই। আলনায় এলেমেলো কাপড় ঝুলছে। হাওয়াই শার্ট, টি-শার্ট, আন্ডারগার্মেন্টস।

টি-টেবিলের ড্রয়ার ঘাঁটেন রফিকুল ইসলাম। ড্রয়ারে মোবাইল রাখা। জহিরকে দরজার দিকে নজর রাখতে বলে মোবাইলের পেছনের খাপ খুলে দেখেন তিনি। পকেট থেকে ক্ষুদ্রকায় একটা বস্তু বের করে মোবাইলে সংযুক্ত করেন। তারপর আবার জায়গামত রেখে দেন।

মেরুন রংয়ের একটা পার্স রাখা পাশে। ভেতরে খুচরো টাকা-পয়সা। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড। নিজের মোবাইল বের করে ছবি তুলে রাখেন তিনি। টেবিলের ওপর রাখা বইটায় একবার নজর বুলান। ফরবিডেন ফুট, ভিনসেঞ্জো মন্টেলা। প্রচ্ছদে একটা গাছের ছবি। গাছ থেকে ঝুলে থাকা ফল পেড়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছেন এক যুবতী, তার পাশে এক যুবক। ডাল পেঁচিয়ে ঝুলছে এক সাপ। ফণা তোলা, যে কোন সময় ছোবল মারবে এরকম।

বই রেখে পাশের রুমে পা বাড়ান তিনি। ডাইনিং রুম। খাওয়ার টেবিল, ফ্রিজ, ওভেন। ফ্রিজটা খুলে দেখেন রফিকুল ইসলাম। প্রায় শূন্য। কয়েকটা পানির বোতল আছে। একটা বিয়ারের ক্যান। আর কিছু টমেটো। কোণার দিকের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে যাওয়া যায়। আরেকটা দরজা দিয়ে যাওয়া যায় ড্রয়িং রুমে। রান্নাঘরের প্রতিটা ড্রয়ার খুলে দেখেন তিনি। বিভিন্ন সাইজের ডিব্বা রাখা, কিংবা কাঁচের জার। চাল, ডাল, চিনি, বিস্কুট, দুধ, চা-পাতা।

ড্রয়িংরুমটা জানালা দিয়ে একটু আগে দেখে নিয়েছেন তিনি। নতুন কিছু নেই। শুধু দেয়ালের কিছু পেইন্টিং নজর কাড়ে তাদের। একটাতে ভাঙাচোরা একটা মাথার ছবি, মগজ গলে পচছে। আরেকটায় আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ের মুখ। মেয়ের মুখটা হাসিখুশি, আয়নার মুখটা বিষণ্ণ।

ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রফিকুল ইসলাম ঘুরে ঘুরে বাড়ির ছবি তুলেন, পুকুরের ছবি তুলেন। জাকিয়া খান তখনো রং-তুলিতে মগ্ন, পুকুরে হাঁসের অলস সন্তরণ। একটা হাঁস খুঁটে খুঁটে কী জানি খায়। তার ভিভভা মোবাইলের ৩২ জিবি মেমরিতে জায়গা করে নেয় এইসব।

“আমরা গেলাম। সহযোগিতার জন্য মেনি থ্যাংকস।”

মেয়েটা বাম হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দেয়।

যেতে গিয়েও থেমে যান সিনিয়র গোয়েন্দা। “লাস্ট প্রশ্ন। আচ্ছা, এই যে দুধ চা এ্যাফিতি আঁকলেন, এর মানে কী? এর মাধ্যমে আসলে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?”

পিঠ ঘুরিয়ে আছে বলে জাকিয়া খানের অভিব্যক্তি ওদের নজরে আসে না। তবে সেজন্য হাপিত্যেশও করা লাগে না। জাকিয়া খান ঘাড় ঘুরায়, তার মুখ হাসি হাসি। “অনেক আগে হুমায়ুন আহমেদ একটা কথা বলেছিলেন। তেতুল বনে জোছনা নামের একটা বইয়ের ফ্ল্যাপে। তিনি সেখানে বলেছেন যে কেউ যদি তাকে প্রশ্ন করে তেতুল বনে জোছনা কথাটার মানে কী, তবে তিনি বিপদে পড়ে যাবেন। কারণ এর কোন বিশেষ অর্থ তার কাছে নাই। এই কথাটা স্বীকার করে নেয়ার পর শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ পাল্টা কিছু প্রশ্ন পাঠকদের উদ্দেশ্যে রেখেছেন। চাঁদের আলোর অর্থ কী? বর্ষার মেঘমালার অর্থ কী? যে অনন্ত নক্ষত্র বিথী আমাদের আগলে রেখেছে সেগুলোরই বা অর্থ কী? আমরা কী এক অর্থহীন জগতে বসে অর্থের অনুসন্ধান করছি না? কেন করছি?

কেন করছি, রফিকসাহেব? হোয়াই?” মেয়েটা ঐ নাচায়।

এ ধরণের দার্শনিক জবাব মোটেও আশা করেননি রফিকুল ইসলাম। নাচানো জ্বর সামনে তাই আর দাঁড়ান না, ঘুরে গেটের দিকে এগোতে শুরু করেন দুজন। শেষ বিকেলের ঝাঁজহীন রোদ ওদের সঙ্গি। কাঠবিড়ালীটাকে আর কোথাও দেখা যায় না। থাকলে ছবি তোলা যেত।

“তুই ওকে অ্যারেস্ট করলি না কেন?” জহির জিজ্ঞেস করে।

“আমি ওকে ২৪ ঘন্টা সার্ভেইল্যান্সে রাখবো। যেটা অ্যারেস্ট করার চেয়েও বেটার।”

মোবাইল বের করে থানার নাম্বার চাপেন রফিকুল ইসলাম। “হ্যালো…”

*

অধ্যায় ২৯

কসাই কাসেমের দা’র চপচপানিতে হাত, পা ও মাথা হারায় জনা ত্রিশেক মানুষ। সংখ্যাটা নিয়ে দ্বন্ধ আছে এখনো। সরকারী ভাষ্যে সংখ্যাটা মাত্র ১২, বাকিদের সামান্য চোট লেগেছে। হাত-পা ছড়ে গেছে কিংবা দৌড়াতে গিয়ে উষ্টা খেয়েছে টাইপ। কিন্তু বেসরকারি ভাষ্যে সংখ্যাটা ২৯, দেশের প্রথমসারির দৈনিক পদ্মা নিউজ অনলাইনে দাবি করেছে একটা বেশি। তাদের মতে কনফার্ম ত্রিশজন কাসেমের দা’র কোপে মারাত্মক আহত হয়েছে। সংখ্যাটা আরো বেশিও হতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই কম না। জনগণের আতঙ্ক কমানোর জন্য নাকি সরকার সংখ্যাটা কম দেখাচ্ছে।

কাসেমের রণরঙ্গিনী রুপের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছিল সবাই। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে পরিণত হয়েছিল প্রাণ সংহারী হিন্দু দেবী মা কালীতে। কোপ দিচ্ছিল কাসেম, আর ব্রেন বের হয়ে যাচ্ছিল সবার!

কাসেম রাস্তায় মানুষ দেখছিল না, সে দেখছিল সারি সারি মাংসের দলা আংটায় ঝুলছে। তার কাজ আংটায় ঝুলানো মাংস একে একে সাইজ করা। ছোট ছোট পিস বানানো। বড় পিসে বরকত নাই। ছোট একটা মাংসের পিস দিয়ে এক প্লেট ভাত খাওয়া যায়।

কথাটা কাসেমের গুরু জুম্মানের।

গুরুর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কাসেম। সে মাংসের বড় বড় দলাগুলোকে ছোট ছোট পিসে পরিণত করে। এক আংটা শেষ করে পরবর্তী আংটায় মনোযোগ দেয়। এক মাংস শেষে আরেক মাংসে।

এভাবে আংটা শেষ করতে করতে এক পর্যায়ে কাসেম নিজেকে আবিষ্কার করে শ্রীঘরে। জানা যায় ওকে ধরতে একটা স্পেশাল টিম গিয়েছিল। ঘুঘুর করিৎকর্মা অফিসার আলমগীর অভিযানে নেতৃত্ব দেয়, সাথে ছিল আরো পাঁচজন। মোটমাট ৬ সদস্যের এক টিম। কিন্তু স্পেশাল টিম স্পেশাল কিছু করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত গুলি করে কসাই কাসেমের অমূল্য সম্পদ ডান হাতের কব্জি উড়িয়ে দেয়া হয়।

কব্জি ছাড়া দা গ্রিপ করা সম্ভব না। কসাই কাসেমও দা গ্রিপ করতে পারেনি। সে চেষ্টা করেছিল বাম হাত দিয়ে দা ঘুরানোর। কিন্তু বাম হাতে জোর নাই কাসেমের। বাম হাতটা অকাজের, খালি শৌচকার্যেই যা কাজে লাগে। না হলে নিজের বাম হাতটা কবেই এক কোপে আলাদা করে দিত কাসেম।

ধরা পড়ার পর এমনটাই বলছিল ও, বারবার।

এইরাম কুপ দিতাম, আর বাম হাতটা আলগা হইয়া যাইতো!

এইরাম কুপ দিতাম, আর বাম হাতটা আলগা হইয়া যাইতো!

এইরাম কুপ দিতাম, আর বাম হাতটা আলগা হইয়া যাইতো!

ইতিমধ্যে অফিসের ডাক্তার দেখে গেছে একবার। ডান হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধেছে। ডাক্তারের মতে নতুন এক ধরণের ড্রাগ দেয়া হয়েছে কাসেমকে, যার জন্য এমনটা করছে ও। ড্রাগসটাকে ভালোবেসে সবাই আই-বম্ব বলে ডাকে। ইনডিউসড বম্ব, সংক্ষেপে আই-বম্ব। মনের কামনা-বাসনা, স্বপ্ন কিংবা ফ্যান্টাসি যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, এ ড্রাগ নিলে ওগুলো সব জাগ্রত হয়ে উঠে। এরকম ম্যাসিভ স্কেলে খুনোখুনি/কোপাকুপি করার ইচ্ছাটা আগে থেকেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল কাসেমের, ড্রাগসটা স্রেফ উসকে দিয়েছে। আর কিছু না।

ডাক্তার অবশ্য সাত তাড়াতাড়ি সতর্ক করে দেন। এত দ্রুত রায় জানিয়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। টেস্ট-ফেস্ট করলে কনফার্ম বলা যাবে।

কসাই কাসেমকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন লতিফুর রহমান। এমনিতেই গু-বৃষ্টিতে ভিজে প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে গেছে। বাসায় ফিরে দুটা লাক্স সাবান ঘষেছেন, পরিধেয় বস্ত্রগুলো ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছেন কিন্তু তবু কেন জানি গন্ধটা রয়েই গেছে মনে হচ্ছে। তবে কী শ্যাম্পু দেয়া হয়নি? রাস্তায় নেমে পুনরায় বাসায় ফিরেন লতিফুর রহমান। এবার শ্যাম্পুর বোতল উপুড় করে দেন মাথায়। ডলে ডলে গু-গন্ধ বের করেন। অফিসে যাওয়ার আগে পারফিউমের শিশিটাও বলতে গেলে দেহের কোনা-কুপচিতে ঢেলে দেন।

বৌ তো বলেই বসলো-”এই গন্ধ তো গুয়ের চেয়েও মারাত্মক!”

কিন্তু তবু লাভ আর হলো কই? ডিপার্টমেন্টে ফিরে সমানে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হজম করতে হচ্ছে। কৃত্রিম গন্ধ শুঁকে নাক সিঁটকাচ্ছে সবাই। এক সিনিয়র অফিসার টিপ্পনি কাটে–

ওকে ভালো করে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে আসো তো!

এই দুর্যোগের মাঝে কসাই কাসেম একটা পজিটিভ খবর। আলমগীরের মতো মাকাল এক অফিসার ওর সন্ধান কীভাবে পেল সেটা এক রহস্য। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে উনি খবর পেয়েছেন, কাসেম যখন তান্ডবলীলা চালাচ্ছে তখন কেউ একজন ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট দেয়। লাইভ হত্যাকান্ডের ভিডিও। সেই ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। আলমগীরের ক্রেডিট বলতে সে ঐ ভিডিওটা দেখেছে এবং কাসেমকে শনাক্ত করতে পেরেছে। তারপর একটু উদ্যোগ নিয়ে স্পেশাল একটা টিম গঠন। অতঃপর কাসেমকে পাকড়াও। গুলিটা আলমগীর করেনি অবশ্য, নতুন এক অফিসার করেছে। আলী হায়দার নাম। যদিও আলমগীর বুক ফুলাচ্ছে খুব, ও না থাকলে ঘুঘুর কী হতো’-এই টাইপ কথাবার্তা প্রচুর বলছে। আলী হায়দারকেও বিন্দুমাত্র ক্রেডিট দিচ্ছে না। কিন্তু ওর কথা কেউ গোনায় ধরে না। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে।

তবে কসাই কাসেম গ্রেফতার-সব বিচারেই একটা স্বস্তির খবর। টিভি স্কুলে লেখাটা দেখেও শান্তি আসছে। ড, মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর খুনি কসাই কাসেম গ্রেফতার।

এখন হারামজাদারা ফ্ল্যাশ কর আমাদের। কর, ফ্ল্যাশ।

কিন্তু সমস্যা হলো কসাই হারামজাদা আবোল-তাবোল বকছে। ডিপার্টমেন্ট হেড তানজীম ওয়ালিদ ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডেকেছেন। ওরা এই মুহূর্তে কাসেমের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। বাইরে লতিফুর রহমান অপেক্ষা রত। পুরো ইউনিট কাজ থামিয়ে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে অবজার্ভেশন রুমে।

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছে কাসেম। বমি করে করে এখন ওর পেট পুরো খালি। পানি-বমি হচ্ছে এখন। ওর বমি থামানোর জন্য আইভিতে করে বমির ওষুধ দেয়া হয়। ব্লাড প্রেশারও বেড়ে গেছে খুব। নর্মাল করার জন্য ডোপামিন দেন ডাক্তাররা। আস্তে আস্তে কাসেমের ছটফটানি কমতে থাকে। তারপর অবজার্ভেশন রুমের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে ও।

ডাক্তাররা একে একে বেরিয়ে আসেন। একজন ডাক্তারের দিকে এগিয়ে যান লতিফুর রহমান। মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি আর সম্ভান্ত চেহারা দেখে তাকে বিশেষ কেউ হিসেবেই ধরে নিয়েছেন তিনি। ডাক্তার বলেন–

“ড্রাগটা একদমই নতুন। এক ধরণের চাইনিজ ড্রাগ। আই-বম্ব এর নাম। এর ইফেক্ট ২৪-৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। ওর হাতের তালুতে ড্রাগটা কেউ ইনজেক্ট করে দিয়েছে। সেখান থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে গেছে। সমস্যা হলো, এর এন্টিডোট এখনো আসেনি। তবে পেশেন্ট আপাতত স্টেবল। ওষুধ যা দেয়ার দেয়া হয়ে গেছে। পেশেন্ট এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গলে আমার মনে হয় ওকে সুস্থ অবস্থাতেই পাবো। সো, টিল দেন, হ্যাভ পেশেন্স।”

খবরটা শোনা মাত্র ডিপার্টমেন্ট হেড তানজীম ওয়ালিদের মেজাজ সপ্তমে চড়ে। পেশেন্স জিনিসটা তার একদমই নেই। তিনি ত্বরিৎ গতিতে কোন সমাধান চাচ্ছিলেন। পুলিশ ড্রামায় যেরকম দেখায়। অপরাধীকে পাকড়াও করা হলো, তারপর সে গরগর করে সব বলে দিচ্ছে। তিনি এরকম কিছুই কসাই কাসেমের কাছ থেকে আশা করছিলেন। কিন্তু না, বিধি বাম।

গতকাল থেকেই অবশ্য তার মেজাজ সপ্তমে। কাসেমকে ধরতে যেয়ে শু-বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে পুরো দল। ডিপার্টমেন্টে মুখ দেখানোর জো থাকলো না আর। গতকাল রেগে কাঁই হয়ে ছিলেন তিনি, ঝড়-ঝাঁপটা সব আলমগীরের ওপর দিয়ে গেছে।

যাওয়ারই কথা। অনেক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল অভিযান ঘিরে। ডিপার্টমেন্ট জুড়ে গুঞ্জন, ফিসফাস-ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী চায়না থেকে মহামূল্যবান এক জিনিস নিয়ে এসেছেন। সাত রাজার ধন এর কাছে কিছুই না, তেজপাতা। আমেরিকা, রাশিয়া-সবাই এর পিছু নিয়েছে। কিন্তু কারোরই সঠিক ধারণা নেই জিনিসটা আসলে কী। তানজীম ওয়ালিদ ধারণা করেন জিনিসটা অ্যাটম বোমা জাতীয় কিছু। হিন্দু পুরাণে যে ব্রক্ষ্মাস্ত্রের কথা আছে, ওটা হয়তোবা তারই নবতর সংস্করণ। যে এর নাগাল পাবে সে-ই হবে অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী।

তার কথা শুনে ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল মিটিংয়ে খুব হাসাহাসি হয়। কেউ কেউ তর্জনী দিয়ে কপালের একপাশ ইঙ্গিত করে।

মানে তানজীম ওয়ালিদের মাথাটা গেছে। জলদি ওরে কেউ পাবনা পাঠাও।

ওদের থোতা মুখ ভোঁতা হয়ে যেত যদি অভিযানটা সফল হতো। অভিযানের নামও দিয়েছিলেন দুর্দান্ত-অপারেশন ব্রহ্মাস্ত্র। যদি ডক্টরের হাতের প্যাকেট কোনভাবে হস্তগত হতো। আহা! তিনি তখন ধেই ধেই করে নাচতেন। তার মুখে তখন হাসি থাকতো, আর ওদের মুখে আলকাতরা।

কিন্তু না।

আলমগীরের গাধামির কারণে পুরো অভিযান জলে গেল। রেগেমেগে আলমগীরকে তাই কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়।

‘আপনাকে কেন চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে না, কারণ দর্শান।‘

বাংলায় মাস্টার্স করা আলমগীর কবির লম্বা এক জবাব দেয়, আঠারটা পয়েন্ট সহ। এর মধ্যে নিজের সুউচ্চ সিজিপিএ, ভার্সিটি বিতর্কে ঈর্ষনীয় সাফল্য ও ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় হওয়ার ঘটনা হাইলাইট করে দেয় ও। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে অন্য জায়গায়। ঝামেলা বাঁধে নামের বানানে। আলমগীরের মতে ডিপার্টমেন্ট হেডের নামের বানান ভুল। নামটা তানজিম হবে, তানজীম না। ই-কার, ঈ-কার না।

তানজীম ওয়ালিদের খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো মূর্তিমান গাধাটাকে কানে ধরে ১০০ বার উঠবস করান, কাদাপানির মধ্যে ঘন্টাখানেক ক্রল করান কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও অফিসে অনেককিছু করা সম্ভব না। যেটা করা সম্ভব সেটাই করেন তিনি। আলমগীর কবিরকে বাধ্যতামূলক পনেরো দিনের ছুটিতে পাঠিয়ে দেন।

আলমগীর নাকি গাঁটকি-বোঁচকা বেঁধেই ফেলেছিল ফেনী যাবে বলে। এর মধ্যে ফেসবুকে ভিডিও-দর্শন, অতঃপর রাজার বেশে অফিস প্রত্যাবর্তন। তানজীম ওয়ালিদ চাইলে তাকে ও তার টিমকে শাস্তি দিতে পারতেন। কেন সে তার ঊর্ধ্বতন বসের নির্দেশ অমান্য করে পনেরো দিনের বাধ্যতামূলক ছুটিতে না গিয়ে এসব করে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু না।

কসাই কাসেমকে পাকড়াও করে নিয়ে আসার পর এ ধরণের কিছু করা মোটেও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। ব্যক্তিগত রাগ কিংবা ক্ষোভ আপাতত আলমারিতে ভোলা থাক। দরকার হলে আলমারি থেকে নামানো যাবে।

গতকাল স্পটে প্রচুর বিদেশি লোকের আনাগোনা দেখা গেছে। চাকমা চাকমা চেহারার একজন গুলি খেয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে ও আমেরিকা/রাশিয়ার গুপ্তচর। কে জানে, চীনেরও হতে পারে। আরেকজন মোটরবাইক এক্সিডেন্ট করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে মোটরবাইক আরোহীকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। মোরটবাইক আরোহী ও কিডন্যাপার কারোরই চেহারা দেশিয় না, বিদেশি।

দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে খুব একটা কষ্ট হয় না তানজীম ওয়ালিদের।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে সুখবর মেলে। ঘুম ভেঙেছে কসাই কাসেমের। ঝিম মেরে আছে ও, কথা বলছে না। শুধু খেতে চাইলো। ডিম ভাজি দিয়ে ভাত, সাথে আলু ভর্তা। খাবার শেষে এক কাপ কড়া চা।

চাহিদামাফিক সবকিছু নিয়ে আসা হয়। হাতা গুটিয়ে খাবার খায় কাসেম। ডান হাতের কব্জি ডুবানোর খুব শখ ছিল ওর, কিন্তু ডান কব্জিই তো নেই। তাই বাম হাতের কব্জি দিয়েই কাজ সারে কাসেম। এক্সট্রা ভাত নেয়, এক্সট্রা ডিম নেয়, এক্সট্রা আলু ভর্তা নেয়। লেবু আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। ওর জন্য লেবু নিয়ে আসা হয়।

খাওয়া শেষে আয়েস করে দুধ চায়ে চুমুক দেয় ও।

তানজীম ওয়ালিদ, লতিফুর রহমানরা অপেক্ষা করেন। একজন ডাক্তারও আছে সাথে।

“তোমার শরীর এখন কেমন কাসেম?”

“ভালা!”

“খিদে আছে? আর কিছু খাবা?”

“এক খিলি পান হইলে ভালা হইতো।”

তানজীম ওয়ালিদ ইঙ্গিত দেন। একজন ছুটে বেরিয়ে যায়। খানিকক্ষণ পর পান নিয়ে ঢুকে ও। কাসেমের হাতে ধরিয়ে দেয়।

পান মুখে পুরে কাসেম। চিবায় খানিকক্ষণ। এক গাল থেকে আরেক গালে নেয়।

“গতকালকে কী ঘটেছিল কাসেম? কিছু মনে আছে তোমার?” ডিপার্টমেন্ট হেড তানজীম ওয়ালিদ জিজ্ঞেস করেন। ইউনিট হেড লতিফুর

রহমান প্রচন্ড মনোযোগ নিয়ে তাদের আলাপচারিতা দেখছেন।

কাসেম জবাব দেয় না। পান চিবাতে থাকে।

তানজীম ওয়ালিদ প্রশ্নটা পুনরায় করেন। এবার জবাব মিলে।

“সাঁই সাঁই কইরা ঘইট্ট্যা গেল সব। অনেক কিছুই বুঝবার পারি নাই। খালি মনে আছে, কুপ দিছি আর ব্রেইন বাইর অই গেছে।”

“কার মাথায় কোপ দিছো?”

“ক্যান, ডাকতর সাবের মাথায়।” প্রশ্ন শুনে অবাকই হয় কাসেম।

“ডক্টরের মাথায় কোপ দিতে গেলে কেন? কার কথায় কোপ দিতে গেছো?”

“ক্যান, ডাকতর সাব নিজেই তো কইলো।” কাসেম আবারো অবাক।

“মানে?” অবাক হবার পালা এবার তানজীম ওয়ালিদের, লতিফুর রহমানেরও চোয়াল স্কুলে যায়।

“পরশুর আগের দিন একজন আমার লগে দেখা করতে আসে, হে নিজের পরিচয় দেয় ডাকতর হিসেবে। ডাকতর বেটা পঞ্চাশ হাজার টাকা অফার দেয় আমারে। কয় খোলা বাজারে হলের সামনে ওর মাথায় কুপ দেওন লাগবো। আমি মনে করছি ওর মাথা খারাপ, হের লাইগ্যা যা যা কইরা তাড়ায়া দিছি। গত পরশু আরেকজন আসে। ও-ও সেইম কথা কয়। ডাকতররে খোলা বাজারে কুপ দেওন লাগবো। ওর অফার ডাবল। এক লাখ। আমি হেরে জিগাই, ওই মাথা খারাপ ডাকতর আপনেরে পাঠাইছে নাকি? হে কয়, ডাকতর পাঠাইবো ক্যান? আপনের কী মাথা খারাপ? কন, রাজি আছেন কিনা? মনে মনে কইলাম, এটু বাজায়া দেখি। চাইলাম, দুই লাখ। এর এক পয়সাও কম না। অর্ধেক কাজের আগে, বাকি অর্ধেক পরে। ভাইরে ভাই, লুকটা রাজি হয়া গেল! কইলো পরদিন সক্কাল সক্কাল রেডি থাইকেন, কুপটা অইদিনও দেওন লাগবো। ডাকতর আপনের এইখানে আইবো। আপনি দা লইয়া রেডি থাইকেন। তারপর পকেট থিকা এক লাখ টাকার বান্ডিল বাইর কইরা নগদ ধরায়া দিলো আমার হাতে। আমি তো পুরাই বিসমিত।”

তার কথা শুনে রুমের সবাইও মোটামুটি বিস্মিত। খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকে সবাই। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে তানজীম ওয়ালিদ প্রশ্ন করেন-”ওই লোকটার নাম কী? পরিচয় দিয়েছিল তোমারে?”

“খালি কইলো ওর নাম গিল্টি, গিল্টি মিয়া। আমার হাতে একটা মোবাইল ধরায়া দিলো। কইলো কাম শেষ হওনের পর ট্যাঙ্গোতে যোগাযোগ করতে। ও আইসা বাকি টাকা দিয়া যাইবো, আর আমারে লুকায়া রাখবো কয়দিন। কিন্তু খানকির পোলাটা আর ফোন ধরে নাই, আমার এক লাখ টাকাটাও মাইর গেল পুরা।”

*

অধ্যায় ৩০

রাতে খাবার শেষে আধশোয়া হয়ে বসেন রফিকুল ইসলাম। হোটেলের রুম বয়কে এক কাপ চা আনার জন্য বলেছেন তা প্রায় মিনিট পনেরো হতে চললো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওর কোন হদিস নাই।

তবে কী দুধ চা খেয়ে কেউ ওকে গুলি করে দিলো?

আপনমনেই হাসেন রফিকুল ইসলাম। পরক্ষণেই কপালে ভ্রুকুটি জন্মায় তার। কেসটা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু জবাব মিলছে না।

এই কেসের সাথে জাকিয়া খানের কোন সম্পর্ক কী আছে? থাকলে সেটা কী?

জাকিয়া খানই কী দুধ চা খুনি? নাকি জাকিয়া খানের উদ্ভট ওই দেয়ালচিত্র দেখে কোন মনোবিকারগ্রস্ত খুনির মানুষ মারার খায়েশ জেগেছে?

সবাই জানে দুধ চা দেয়ালচিত্রের স্রষ্টা লালন বৈরাগী। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। লালন বৈরাগী না, বরং জাকিয়া খান হলেন ওই এ্যাফিতি-শিল্পী। ক্রিয়েটিভ লোকেরা এগুলোর ব্যাপারে প্রচন্ড খুঁতখুঁতে হয়। নিজের কাজের স্বীকৃতি চায়, অন্য কেউ মেরে দিলে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে বসে।

ও আমার প্লট চুরি করেছে, ও আমার আইডিয়া নকল করেছে, ও আমার সুর মেরে দিয়েছে।

মামলা অনেক সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু জাকিয়া খানকে দেখা গেল একদম বিকারহীন। যেন কিছুই যায় আসে না। এক ধরণের সন্তসুলভ উদাসীনতা। তার ক্রেডিট আরেকজন নিচ্ছে, কিন্তু এ ব্যাপারে তার কোন প্রতিক্রিয়াই নাই।

আই ডোন্ট ওয়ান্ট আননেসেসারি অ্যাটেনশন।

কিন্তু রফিকুল ইসলাম এতদিন উল্টাটাই জানতেন। যে ক্রিয়েটিভ লোকেরা প্রচন্ড রকম অ্যাটেনশন সিকার হন। তাহলে, জাকিয়া খানের কেসটা কী? তিনি কী মাদার তেরেসার আর্টিস্ট ভার্সন?

জহির চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। খানিক আগে পেটপূজা সেরে এসেছেন তারা। চট্টগ্রামের বিখ্যাত মেজবানি বিরিয়ানি পাওয়া যায় এরকম একটা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের নামটা আবার হিন্দি ফিল্ম থেকে নেয়া, থ্রি ইডিয়টস। তিন বন্ধু মিলে এ রেস্টুরেন্ট বানিয়েছেন, তাই এ অদ্ভুত নামকরণ। নামটা কপি হলেও খাবার-দাবারের মান খুব ভালো। রীতিমত গলা অবধি গিলে এসেছেন তারা। শুধু চা-টাই ছিল হতচ্ছাড়া টাইপের বিস্বাদ। এই হোটেলের চা ভালো। তাই রুমে ফিরেই চা আনতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখনো রুম বয়ের কোন হদিস নেই।

লো-ভলিউমে হোটেল রুমের টিভিটা ছাড়া। সংবাদ চলছে। লো ভলিউমের কারণে সংবাদ পাঠিকা কী বলছে বুঝতে পারেন না রফিকুল ইসলাম। তবে সংবাদের হেডিং চোখ এড়ায় না তার। মোহাম্মদপুরে গোলাগুলি, তিনটি কুকুর খুন।

অবাক হন তিনি। গোলাগুলিতে সচরাচর মানুষ মারা যায়, কিন্তু কুকুর মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল।

ঢাকা সরগরম। গতকাল সর্বসমক্ষে খুন হলেন প্রফেসর মেহবুব আরেফিন চৌধুরী। বিগ ম্যাক। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার দরুন স্যারকে চিনতেন রফিকুল ইসলাম। বিগ ম্যাক তার ডিরেক্ট টিচার ছিলেন না যদিও। তার সাবজেক্ট ছিল পরিসংখ্যান, স্যার পড়াতেন ফিলোসফি। গতকাল আর কাজের চাপে খবর দেখা হয়নি, আজ সকালেই রিপোর্টটা নজরে পড়লো রফিকুল ইসলামের। শহর থেকে চিটাগাং ইউনিভার্সিটি প্রায় ঘন্টাখানেক দূর। বাসে প্রচুর সময় মিলে। জহিরের ফোন পেয়ে আজ ভার্সিটি যাওয়ার পথে স্মার্টফোনে খবরের কাগজ পড়ে নেন তিনি।

খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রফেসরসাহেব কয়েক মাস আগে থানায় জিডি করে রেখেছিলেন। তার ধারণা, কিছু লোক তাকে ক্রমাগত ফলো করে যাচ্ছে। জিডি করার পরও পুলিশ তেমন কোন স্টেপ নেয়নি। অনুমিতভাবেই রিপোর্টার এখানে এসে পুলিশের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়লেন।

এ সংক্রান্ত আরো কয়েকটা রিপোর্ট দেখে নেন রফিকুল ইসলাম। দৈনিক তাজা খবর নামক একটা পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় মাহফুজ আহমেদ একটা আর্টিকেল লিখেছেন, অনন্ত জীবনের রহস্য। তার ধারণা, বিগ ম্যাক মাস দুয়েকের জন্য চায়না ট্রিপে গিয়েছিলেন। ওখান থেকে তিনি অনন্ত জীবনের চাবিকাঠি নিয়ে আসেন। তার মতে, অনন্ত জীবনের চাবিকাঠি হলো একটা রহস্যময় ফল। ওটা খেলে মানুষ অমরত্বের স্বাদ পাবে। শেষের দিকে এসে অবশ্য ভদ্রলোক খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। সস্তা হিউমার শুরু করেছিলেন। তার মতে আমরা অমর হয়ে গেলে অনেক সুবিধা হবে। তখন আর আমাদের ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করা লাগবে না–ম্যান ইজ মর্টাল। তখন আমরা বলবো ম্যান ইজ ইমমর্টাল!

রহস্যময় ফল থেকে হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল হয় রফিকুল ইসলামের। দ্রুত নিজের স্মার্টফোনে গিয়ে ওয়াই-ফাই অন করেন তিনি। হোটেলটাতে ওয়াই-ফাই ফ্রি, পাসওয়ার্ড প্রতিটি রুমের দেয়ালে সাঁটানো।

গুগলে গিয়ে সার্চ করেন রফিকুল ইসলাম। অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু তিনটা। ফরবিডেন ফুট, এর বাংলা নিষিদ্ধ ফল, সবশেষে গন্ধম।

সার্চ রেজাল্টে অপরিচিত কিছু আসে না। গন্ধম ফল নিয়ে তো সবাই কমবেশি জানে। রফিকুল ইসলামও জানেন। তবে কিছু নতুন তথ্য নজরে আসে তার। হাদীস কিংবা কুরআনে গন্ধম শব্দটা কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। ওখানে “শাজারাত” লেখা। শাজারাত অর্থ বৃক্ষ। আবার খ্রিস্টান ধর্মে, ফরবিডেন ফুট বা নিষিদ্ধ ফল বলতে আপেলকেই বুঝানো হয়। বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে কিংবা শিল্পীর তুলিতে আমরা এমনটিই দেখি। নিষিদ্ধ ফল মানেই হলো আপেল। ডেভিলের প্ররোচনায় যা অ্যাডাম ও ঈভ খেয়ে ঈশ্বরের বিরাগভাজন হন। বাইবেলে কিন্তু আপেল কথাটা লেখা নাই। ল্যাটিন ভাষায় যখন বাইবেল অনূদিত হয় সমস্যার শুরু আসলে তখন থেকে। ল্যাটিনে “ম্যালাম” এর অর্থ একই সাথে খারাপ ও আপেল গাছ।

কিন্তু হঠাৎ জাকিয়া খান কেন ফরবিডেন ফুট নিয়ে এত আগ্রহী হলেন?

কী জানি নাম ছিল লেখকটার? ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ? লুই ভিনসেন্ট?

হ্যাঁ, মনে পড়ছে! ভিনসেঞ্জো মন্টেলা।

একটু গুঁতোগুতি করে একটা ই-বুক ভার্সন পাওয়া গেল বইয়ের। ফরবিডেন ফুট বাই ভিনসেঞ্জো মন্টেলা। পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে অবশ্য দমে যেতে হয় রফিকুল ইসলামকে।

৫১৯!

বই না ডিকশনারি?

মোবাইল বেজে উঠে।

“হ্যালো, স্যার। থানা থেকে নাহিদ বলছিলাম। জানি না আপনার কাছে খবরটার গুরুত্ব কতটুকু। তবুও বলি। খানিকক্ষণ আগে জাকিয়া খান একটা কল করেছেন। অন্যপাশে পুরুষের গলা। আমরা নাম্বারটা ট্র্যাক করে দেখলাম। ফোনের মালিক এই মুহূর্তে ঢাকায় আছেন। একদম সঠিক লোকেশন একটু পরেই জানতে পারবো। মোবাইল কোম্পানি একটু সময় চাইলো।”

“তাই? দুজনের মধ্যে কী কথা হলো?” আধশোয়া অবস্থা থেকে ততক্ষণে উত্তেজনায় উঠে বসেছেন রফিকুল ইসলাম।

“ইজুয়াল কথাবার্তা। কুশল বিনিময়। আপনারা যে আজ গিয়ে দেখা করে এসেছেন এটা জানালেন জাকিয়া খান। তখন ওপাশের লোকটা জানালো সাবধানে থাকতে। দিনকাল ভালো না।”

“এইটুকুই?”

“ওহ, আরেকটা জিনিস। উনাদের এলাকায় খুব গোলাগুলি হইছে। জানালো। বললো কয়েকটা কুকুর নাকি গুলি খেয়ে মারা গেছে।”

“কী?”

হালকা গলায় হেসে উঠে নাহিদ। “জি, আমাদেরও উইয়ার্ড লেগেছে স্যার…এক মিনিট স্যার, একটু হোল্ড করবেন। মোবাইল কোম্পানি থেকে কল এসেছে। ওরা মনে হয় লোকেট করতে পেরেছে।”

খানিকক্ষণ ওপাশে গুঞ্জন শোনা যায়। ফোনে আবারো নাহিদের গলা ভেসে আসে-”জায়গাটা লোকেট করা গেছে স্যার। মোহাম্মদপুর।”

রফিকুল ইসলাম টিভিতে চোখ ফেরান। স্ক্রলে খবর দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, ওই যে।

মোহাম্মদপুরে গোলাগুলি, তিনটি কুকুর খুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *