২. জটাওয়ালা লোকটা

অধ্যায় ১১

জটাওয়ালা লোকটা নড়েচড়ে উঠে। তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকা মাছিগুলো ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। এই নোংরা, নির্জীব দেহে প্রাণ আছে এটা ওরা ভাবতেই পারেনি।

রাস্তায় অন্যদিকে তখন টানটান উত্তেজনার এক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। আমেরিকানদের জিপ টয়োটা প্রেমিওর পাছায় ধাক্কা মেরেছে।

আর পাছাও গেছে বেঁকে!

জটাওয়ালা লোকটা মাথা চুলকায়। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়। সে জানে আমেরিকানদের আরেকটা টিম এই মুহূর্তে ব্র্যাক বিল্ডিংয়ের ১৭ তলার ছাদে অবস্থান নিয়েছে। তাদের দলনেতা অ্যালিস্টার ম্যাকলিন। ম্যাকলিনরা চিলচোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। তাই অভিনয় ভালো হওয়া জরুরি।

জোরে জোরে কাশে ও। সশব্দে থুথু ফেলে। ভ্যাবলার মতো মাথা চুলকায়। হাইহিল পরে গটগট করে এগিয়ে আসা এক স্মার্ট তরুণীর দিকে হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চায়।

“কিছু দ্যান গো আম্মা।”

বাংলাটা গরগর করে বলতে পারে ও। মাতৃভাষা ছাড়াও পারে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, গ্রিক, হিন্দি ও আরবি। গত এক বছরের চেষ্টায় বাংলাটাও সে রপ্ত করে নিয়েছে। জুডো, কুংফু, কারাতের মারপ্যাঁচ জানে ও। যে কোন ধরণের ছদ্মবেশ নিতে পারে। বন্ধুর সাথে বাজি ধরে একবার কনকনে ঠান্ডায় ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়েছে। দুই হাতে লিখতে জানে। শত্রু শিবিরে গিয়ে একবার আঠারো জনকে মেরে নিজ দেশের বন্দী স্পাইকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।

শুধু এজেন্টই না ও, সুপার এজেন্ট।

প্যান্ট-শার্ট পরিহিত স্মার্ট তরুণী তো আর জটাধারীর আসল রুপ জানে না। তরুণী ওর বাহ্যিক রুপ দেখে সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠে। কালো রোদচশমার আড়ালে তরুণীর ভীত হরিণীর চোখদুটো দেখে মায়াই লাগে তার। কিন্তু চেহারায় তা ফুটে উঠে না। চেহারা এখনো রুক্ষ, কঠোর, নোংরা।

পার্স খুলে মেয়েটা দশ টাকার একটা নোট ওর হাতে ছুঁড়ে দিয়ে পালায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। হাইহিল ভেঙে গিয়ে উষ্টা খায় মেয়ে, চিৎপটাং হয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে।

হাসির হুল্লোড় উঠে। স্মার্ট তরুণীর পতনে সবাই মজা পেয়েছে খুব। মেয়েটার পার্স ছিটকে দূরে গিয়ে পড়েছে। ভেতরের কলকজা সব রাস্তায় ছড়ানো ছিটানো। লিপস্টিক, আইলাইনার, টাকা-পয়সা, চকলেট, চুইংগাম। তবে রোদচশমটা এখনো নাকের ডগায় বহাল তবিয়তে আছে। ওটা কী তবে আঠা দিয়ে কানের সাথে আটকানো?

জটাধারী পকেট হাতড়ে কয়েকটা ছেঁড়া-ফাটা দুই টাকার নোট ও এক টাকার কয়েন বের করে। গুনে দেখে ও। বারো টাকা আছে। দশ আর বারো মিলে হয় বাইশ টাকা। বাইশ টাকায় কী চাইনিজ ভাজি সহযোগে এক প্লেট ভাত হবে না?

ওদিকে নাটকে তখন নতুন মোড় নিয়েছে। এক মোটরসাইকেল ধারীর আগমন ঘটেছে। সে পতিত চাকমার পকেট হাতড়ে প্যাকেটটা নিয়ে নেয়।

আমেরিকানরা এখনো যৌনকেশ ছিঁড়ছে। সিআইএ সাউথইস্ট এশিয়া ডেস্কের চিফ অভ অপারেশন্স ডেভিড কর্নওয়েল নাকি বাল বলে গালি দেন না। ওটা তার মার্জিত রুচির সাথে ঠিক যায় না। তিনি তার মখমলীয় গলায় গালিটাকে পরিশুদ্ধ করে ডাকেন যৌনকেশ বলে।

তথ্যটা শিটের কাছ থেকে পাওয়া। শিট হলো ছুঁচ। সহজ ভাষায় ডাবল এজেন্ট। সে ছুঁচ হয়ে সিআইএ’তে ঢুকেছে, ফাল হয়ে বের হবে। শিটের পরিচয় শুধু জটাধারী নিজে ও তার বস জানেন। আর কেউ না।

শিটের আরেক পরিচয় সে বুলশিটের লাভার। শিট-বুলশিট।

ম্যাথু রাইলিকে দেখা যায় জিপ থেকে নেমে মোটরবাইক ধাওয়া করতে নেমে গেছে। রাইলিরও একটা ডাক নাম আছে। মিঃ গ্রাস। জনাব ঘাস!

মনে মনে হাসে জটাধারী। রাস্তার ধারে ছালা দিয়ে ঢাকা এক হোটেল আছে। ওখানে বসতে নেয় ও, কিন্তু ছ্যা ছ্যা করে আসে বেঞ্চে বসা খদ্দেররা। জটাধারীর গায়ে নাকি গুয়ের গন্ধ।

গুয়ের গন্ধ থাকাটা বিচিত্র কিছুই না। অভিনয় নিখুঁত দেখানোর জন্য জটাধারী নিজেই নিজের পোশাকে এক গাদা মল মেখে এসেছে, ড্রেনের নোংরা তুলে কাপড়ে ঘষেছে। গা থেকে গুয়ের গন্ধ আসবে না তো কী শ্যানেল পারফিউমের গন্ধ আসবে!

দোকানওয়ালা খদ্দের খসাতে চায় না। টাকা লক্ষী, ওটা পায়ে ঠেলতে নেই। তাই গু-গন্ধী জটাধারীকে ফুটপাথেই প্লেট দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। প্লেটভর্তি ছোলা-পেঁয়াজু। এক প্লেট বিশ টাকা, অতীব সুস্বাদু। সুপার এজেন্ট জনাব জটাধারী টানটান উত্তেজনাময় অপারেশনের মাঝখানে ছোলা-পেঁয়াজু খেতে বসে যায়।

কিন্তু বসতে না বসতেই মারাত্মক সংঘর্ষের আওয়াজ। অত দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না কী হয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই হয়তোবা কানে রাখা মাইক্রোচিপ সচল হয়ে উঠে। কথা বলে উঠে এজেন্ট মলোটভ, “বস, মিঃ গ্রাস ইজ ডাউন।”

“বাই হুম?” বিড়বিড়িয়ে বলে ও।

“বাই হিমসেল্ফ। ইট ওয়াজ অ্যান এক্সিডেন্ট।”

খানিকক্ষণ নীরবতা। হয়তোবা মলোটভের চোখ ড্রোন ক্যামেরার ওপর নিবদ্ধ।

“হারামজাদা কাক!” মলোটভের অস্কুট গালি কান এড়ায় না সুপার এজেন্টের।

“কী হইছে?”

“একটা কাক এসে বসছিল, টয়লেট করে দিছে…শিট!”

শিটটাকে আক্ষরিক অর্থেই ধরে নিয়েছিল জটাধারী। গু! এক্ষেত্রে কাকের গু। কিন্তু এজেন্ট মলোটভের পরের কথায় ভুল ভাঙে তার।

“বস, স্মোলভ! স্মেলভের লোক এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে রাইলিকে। একটা সাদা মাইক্রোবাস করে। ড্যাম!”

অস্ফুট কণ্ঠে নিজেও ড্যাম বলে উঠে গু-গন্ধী জটাধারী ওরফে সুপার এজেন্ট বুলশিট ওরফে ইভান সারভব।

*

অধ্যায় ১২

ফোনের শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে জাহাঙ্গীর।

ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় লেগে যায় তার। মাথা দপ দপ করছে। কপালের বাম পাশ মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাবে। তবে কী আসলেই ব্রেন খুলে পড়ে যাওয়ার দিন সমাগত? মিরপুর বাংলা কলেজের স্মৃতি উসকে উঠলো মনে। কলেজে তার কয়েক ব্যাচ সিনিয়র এক বড় ভাই ছিল। প্রায়ই কলেজে এসে আড্ডা দিতো, টং দোকানে বসে চা-সিগারেট ফুকতো। নাম বাকের। কোথায় কেউ নেই’র বাকের না। এই বাকেরের গালভর্তি দাঁড়ি নেই, আঙুলের ডগায় নেই চেইন। এই বাকেরকে সবাই বন্টু বাকের বলে ডাকে। কেন ডাকে তা কেউ জানে না। জানার কারো কোন গরজও নেই।

তো কথায় কথায় একবার বল্ট বাকের তাকে সুরা পানের লোভ দেখাচ্ছিল। এই জিনিস খেলে মনে হবে ব্রেন খুলে পড়ে যাবে!

জাহাঙ্গীরের একটুও লোভ হচ্ছিল না। আরে, যে জিনিস খেলে ব্রেন খুলে পড়ে যাওয়ার অনুভূতি জাগে তা আমি খেতে যাবো কোন দুঃখে? পরে একসময় খেয়ে দেখে কীসের ব্রেন খুলে পড়ে যাওয়া, এতো সাক্ষাৎ অমৃত। গরল না। ব্রেন খুলে টুপ করে পড়েও যায় না।

বাকের ভাইয়ের শেষটা বড় মর্মান্তিক হয়। গুলি মেরে তার মাথা ফাঁসিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ দলের এক গুন্ডা। তার ব্রেন আসলেই খুলে পড়ে যায়। ব্রেন খুলে পড়ে যাওয়ার ঐ ছবি ছেপে অধুনালুপ্ত ট্যাবলয়েড ক্রাইম বাংলাদেশ বেশ ভালো ব্যবসা করে নিয়েছিল। পাবলিক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বল্ট বাকেরের ব্রেন দেখার জন্য।

চিরিক করে ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠে। বাম দিক থেকে ডানে। চোখে সর্ষেফুল দেখে জাহাঙ্গীর, এক হাতে মাথা চেপে ধরে।

লালা পড়ে ভিজে গেছে বালিশের একাংশ, গালের সাথে লেপ্টে আছে ইস্কাপনের টেক্কা। গতকাল সারারাত সে আর গিয়াস মিলে কার্ড খেলেছে। আর গুছিয়ে রাখা হয়নি কার্ডগুলো। বিছানায়ই রয়ে গেছে। বালিশ ঘিরে তাই শুধু হরতন-ইস্কাপনদের আনাগোনা। দুধ চা-৬

শুধু কী কার্ড? টেক্কার নিচে চিপসের সবুজ প্যাকেট মুখ লুকিয়ে আছে, গুঁড়ো গুঁড়ো চিপস, টিপ বিস্কুটের ভাঙা টুকরো, বিস্কুট ঘিরে সারি সারি পিঁপড়ার মোচ্ছব, কাত হয়ে থাকা কাঁচের গ্লাস, গ্লাসের তলানিতে জমে থাকা সুরার অবশিষ্টাংশ। সুরা পড়ে চাদরের এক জায়গা কালচে হয়ে গেছে। একে এখন বিছানা না বলে ভাগাড় বলাই উত্তম। এর মাঝখানে কীভাবে ঘুমালো সে আল্লাহ মালুম!

বিছানার উল্টোপাশ থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসে। উঁকি দিয়ে দেখে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে গিয়াস, তার লম্বা ঢ্যাঙ্গা পাটা আয়েসে তুলে দিয়েছে জাহাঙ্গীরের পায়ের ওপর। উদাম গা, পরনে স্রেফ একটা জাঙ্গিয়া ছাড়া কিছু নেই।

দপ করে মাথায় আগুন ধরে যায় জাহাঙ্গীরের। শালারে কত করে বললাম-সোফায় ঘুমা, সোফায় ঘুমা। শালা ঠিকই বিছানায় এসে সেঁদিয়েছে!

আরাম চাস, না? নে, শালা আরাম নে।

পশ্চাৎদ্দেশে একটা মোক্ষম লাথি মেরে বসে সে। “অই হালা ওঠ!”

বেমক্কা লাথি খেয়ে টাল সামলাতে পারে না গিয়াস। পড়ে যায় বিছানার নিচে।

“আল্লাহরে…”

ফোনের ঘন্টি ততক্ষণে একদফা বেজে ক্লান্ত হয়ে স্তিমিত হয়ে গেছে। খেয়ালই ছিল না তার। দ্বিতীয় দফা রিং বেজে উঠতে টনক নড়ে জাহাঙ্গীরের। ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতে না বলতেই ওপাশ থেকে বাজখাই গলা ভেসে আসে।

“ফোনের রিং কানে যায় না, বাইঞ্চোত?”

জাহাঙ্গীর মনে মনে প্রমাদ গুনে। এই লোকটা আদর করে তাকে বাঞ্চোত বলে ডাকে। কিন্তু যখন সিরিয়াস লেভেলে চেতে যায় তখন একটা

অতিরিক্ত ই যুক্ত হয় গালির সাথে। বাঞ্চোত হয়ে যায় বাইঞ্চোত!

“কসাই কাসেম কই থাকে জানোস?”

“কসাই কাসেম?” রীতিমত আকাশ থেকে পড়ে জাহাঙ্গীর।

“হ্যাঁ, কসাই কাসেম!”

আলবত জানে! কেন জানবে না? কিছুকাল মহাখালী কাঁচা বাজারে মুরগি বেচতে জাহাঙ্গীর। তখন থেকেই কসাই কাসেমের সাথে চেনাজানা তার। বন্ধুত্বের খাতিরে ওর কত মুরগির চামড়া ছিলে মাংস কেটে দিয়েছে কাসেম! নাহলে কাসেম মুরগি ছুঁয়েও দেখতো না। গরু-ছাগল বানাতেই ব্যস্ত থাকতো।

“হ, জানি। ক্যান, কাসেম কী করছে বাই?” উচ্চারণে সমস্যার কারণে জাহাঙ্গীরের ভাই ডাকটা বাই হয়ে যায়। ফোনের ওপাশের লোকটা ব্যাপারটা জানে। ডাকটা মোটেও পছন্দ না তার, রীতিমত দাঁত কিড়মিড় করে সহ্য করা লাগে।

“কোন দুনিয়ায় তুই থাকস, হালা বাইঞ্চোত?”

আবারো প্রমাদ গুনতে হয় জাহাঙ্গীরকে। লোকটার রগচটা স্বভাব কিংবদন্তিতুল্য। একসময় ডিবি’তে চাকরি করতো। রেগে গিয়ে একবার এক পাতি নেতার মাতাল ছেলেকে আচ্ছামতো পিটিয়েছিলো। এর প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। নেতার চেলাচামুন্ডারা ওকে জানেই মেরে ফেলতো। তখন লোকটার বস ওদেরকে ঠান্ডা করেন, পাতি নেতাকে বুঝান। জানে মেরে ফেললে মিডিয়া খুব হাউকাউ করবে, পাবলিক সিমপ্যাথি নেতার বিপক্ষে যাবে। জিনিসটা দলের জন্য ভালো হবে না।

নেতা ঠান্ডা মাথায় সব বুঝেন, তারপর একটা সমঝোতায় আসেন। জানের বিনিময়ে তাই চাকরিটা নট হয়ে যায় লোকটার। তারপর থেকে প্রাইভেট এজেন্সি খুলে টুকটাক কাজ করে ও। নিজের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে এজেন্সির নাম রাখা-ডাবল আর প্রাইভেট এজেন্সি। ডাবল আর এর পূর্ণাঙ্গ রুপ হলো রাফসার রশিদ।

ডাবল আর কাজে খুবই দক্ষ, তবে মেজাজটা এখনো আগের মতই চড়া। রেগে গেলে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসে।

তবে আপাতত মেজাজকে ব্যাকসিটে পাঠিয়ে সংক্ষেপে ঘটনাগুলো খুলে বলে সে।

চুপ মেরে ডাবল আর এর কথা শুনে যায় জাহাঙ্গীর। তার ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। এও কী সম্ভব?

কাসেম কোপ মেরে মাথা দু’ফাঁক করে দিছে!

“কাসেম কই থাকে রে?”

খানিকক্ষণের জন্য মাথাটা আবারো শূন্য হয়ে যায় জাহাঙ্গীরের। প্রশ্নটা অনুধাবন করতে সময় লেগে যায় তার। রাফসার রশিদের আরেকটা ধাতানির প্রয়োজন পড়ে।

“অই বেটা বাইঞ্চোত!”

এবার নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পায় জাহাঙ্গীর। “কাম ঘটায়া কাসেম কী আর ওর বাড়িত যাইবো?”

“তাইলে কই যাইবো?”

“রিতার বাড়ি!”

*

অধ্যায় ১৩

কসাই কাসেমের মোটরসাইকেলে ডানা জুড়ে দিলে এতক্ষণে ও হয়তোবা সাত আসমান ভেদ করে স্বর্গেই পাড়ি জমাতো।

ঢাকার রাস্তায় রীতিমত আগুন ছুটাচ্ছে সে। আক্ষরিক অর্থেই তার কালো টায়ারের ঘর্ষণে পিচঢালা রাস্তায় স্ফুলিঙ্গ উড়তে দেখা যায়। ইতিমধ্যে ও দুইটা রেড লাইট অমান্য করেছে, ভিড়ের মাঝে সাইকেল তুলে দিয়েছে ফুটপাথে। ফুটপাথ লোকে লোকারণ্য, মোটরসাইকেল থেকে বাঁচতে মানুষজন পড়িমরি করে ছুটে। এক মধ্যবয়স্ক লোক পা ধরে কঁকাচ্ছে। কাসেমের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় মারাত্মক ব্যথা পেয়েছে লোকটা। আরেক ফলবিক্রেতার আপেল-কমলা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। বিক্রেতার হায় হায়, পথচারীদের আতঙ্কিত চিৎকার, গালাগালি কোন কিছুতেই যেন হুঁশ ফিরছে না কাসেমের।

সে এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বিশ বছরের সুদীর্ঘ কসাই জীবনে তার তীক্ষ্ণ চাপাতির ফলা কম মাংস ভেদ করেনি। গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি। মাংস বানানোতে তার জুড়ি নেই। কুরবানী ঈদে উটের মাংস বানানোর অভিজ্ঞতাও আছে তার। গুলশানের সিকদারসাহেব তো ওর উট বানানো দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সেবার। মুগ্ধ হওয়ারই কথা। বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যে আস্ত উট বানানো শেষ! এটা কী ছেলেখেলা নাকি!

মুগ্ধ সিকদারসাহেব ওর মোবাইল নাম্বার নিলেন, ওকে মোটা বকশিস দিলেন, বললেন এই ঈদেও ডাকবেন। যাওয়ার সময় ওর হাতে এক ব্যাগ উটের মাংস ধরিয়ে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু মাংস খেয়ে মোটেও আরাম পায়নি কাসেম। কেমন জানি রাবারের মত শক্ত। বৌ তো বলেই বসলো-”ইতা কুনু মাংসের জাত অইলো?”

আরে ফকিন্নী, বাপের জন্মে খাইসিলি উটের মাংস?

শুধু কী উট, বছর পাঁচেক আগে ওর চাপাতির নিচে হরিণ শাবকও নিজের দেহ পেতে দিয়েছিল। রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আহমেদ রশিদ চৌধুরী। বিশাল বড়লোক। রাজশাহীতে মাইলের পর মাইল ওর জমি আছে; আছে ধানক্ষেত, ভুটা ক্ষেত, সবজি ক্ষেত, আমবাগান, আনারস বাগান, সুপারি বাগান। জেলা শহরে স’মিল, লেদ কারখানা, দোকান, মার্কেট। কী নেই?

একটাই ছেলে ভদ্রলোকের। আদরাব রশিদ চৌধুরী। শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মেছে ছেলেটা, মাথা বেলুনের মতো গোল। কসাই কাসেমের মনে হয়, পিন দিয়ে খোঁচালে ঠাস করে বেলুনসদৃশ মাথাটা ফাটবে। পলকহীন চোখ দুটো দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে আদরাব। মুখটা সবসময় হাঁ করে রাখে, যেনবা ক্ষুধার্ত হাঙ্গর মাছ খুঁজে পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত শিকার। এই কপ করে গিললো বলে।

মুখ হাঁ করে ওর পাশেই এসে বসেছিল ছেলেটা ওইদিন। মুখের একপাশ দিয়ে লালা ঝরতে দেখে গা গুলিয়ে উঠেছিল কসাইশ্রেষ্ঠের। তখনো সে জানতো না এই ছেলেটার জন্যই এত এলাহি আয়োজন করা হয়েছে।

দেখে ‘নাক টিপলে দুধ বের হবে’ টাইপ বাচ্চা মনে হলেও পরে কাসেম জানতে পারে আদরাবের বয়স নাকি ৩৬! ওর বৌ আছে। দিন বিশেক আগে বহু চেষ্টায় ওর এক বাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চাটির আজ আকিকা। নাতির আকিকা উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়া থেকে অর্ডার দিয়ে একজোড়া পূর্ণবয়স্ক হরিণ কিনে নিয়ে এসেছেন আহমেদসাহেব। আত্মীয়স্বজনদের হরিণের মাংস খাওয়াবেন।

কাসেমের দূর সম্পর্কের এক মামা আহমেদ সাহেবের ম্যানেজার। উনিই ভাগ্নের জন্য সুপারিশ করেন-”ও খুব ভালো মাংস বানায়!”

শুনে আহমেদসাহেব চমকৃত হন। হরিণের মাংস বানানোর জন্য তাই ডেকে নিয়ে আসা হয় কসাই কাসেমকে। কাসেমও হাজির হয়ে যায় চাপাতি-ছুরি নিয়ে।

ছুরির ফলা যখন হরিণের মসৃণ চামড়া ভেদ করে মাংসে ঢুকে কাসেমের তখন যে অনুভূতি হয় তার সাথে তুল্য একটা অনুভূতি-ই। কাসেমের বস্তি ভাষায়-মাল ফেলার অনুভূতি। দ্রভাষায় অর্গাজম, রাগমোচন। ইন ফ্যাক্ট, মাংস বানানোর পর কেউ খোঁজখবর করলে কাসেমকে আহমেদসাহেবদের কর্নারের টয়লেটে খুঁজে পেত। হাত মারছে!

ধর্মে মানা, না হলে নধর শূয়োরও তার হাত থেকে মুক্তি পেত না। কিন্তু তাই বলে কী কসাই কাসেম কখনো ভেবেছিল তার তীক্ষ্ণধার চাপাতির ফলা মানুষের মাংস ভেদ করবে, যেভাবে ছুরি ভেদ করে মাখন?

কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! কসাই কাসেমের চাপাতি জায়গা করে নিলো চকচকে টাকওয়ালা লোকটার মস্তকে।

কিন্তু কী থেকে কী হয়ে যাওয়াটা কী কসাই কাসেমের নিয়তি না? পঁচিশ বছর আগে ওর সৎ বাপ যখন মা’কে বেল্ট-পেটা করছিল তখনও তো কী থেকে কী হয়ে গিয়েছিল তার। নিজের অজান্তেই হাতে উঠে এসেছিল ধারালো বটি। তারপর…

“ভাগ কাসেম ভাগ!”

মায়ের চিৎকার শুনে আর দাঁড়ায়নি কাসেম। দৌড়, দৌড়, দৌড়!

আজও যখন তার তীক্ষ্ণ চাপাতির ফলা টাকলুর মাথা এক কোপে ফাঁক করে ফেলে, মা আবারো হাজির। তার যাবতীয় আকাম-কুকামের সময় ভদ্রমহিলা আশেপাশেই থাকেন, শ্লেম্মাজড়িত কণ্ঠে সবসময় তাকে সতর্ক করে দেন–

ভাগ কাসেম ভাগ!

কাসেম তখন আর নিজেকে চিনতে পারে না। তার তখন হঠাৎ করেই দৌড়বিদ মিলখা সিংয়ের কথা মনে পড়ে যায়। এই তো সেদিনই ও আর রিতা মিলে ভাগ মিলখা ভাগ ছবিটা তৃতীয় বারের মত দেখলো। রিতার আবার হিন্দি ছবি দেখার খুব শখ। প্রতিদিনই একটা করে ছবি দেখা লাগে ওর। মাঝে মাঝে কাসেম সঙ্গ দেয়। শারীরিক আনন্দ উপভোগের ফাঁকে ফাঁকে ছবি দেখে। দাবাং, এক থা টাইগার, বাঘি, হিরোপান্তি। মাঝে মাঝে তামিল ছবি দেখে। উরাধুরা অ্যাকশন, উদ্ভট কাহিনী। তামিল নায়করা আবার বেশ বাস্থবান। ওদের গা ভর্তি লোম থাকে আর ঠোঁটের উপরে থাকে তাগড়া গোঁফ। নায়িকাগুলোও গোবদা মার্কা, হাত দেখলে হাতুড়ির কথা মনে হয়।

কোন হাতুড়ি টাইপ তামিল নায়ক অবশ্য রিতার পছন্দ না। রিতার পছন্দ নরম, পেলব টাইগার শ্রফ। বিছানার পাশে টাইগার শ্রফের একটা উদাম গায়ের পোস্টার টাঙ্গিয়ে রেখেছে সে। ছবি দেখতে দেখতে টকাস টকাস হিন্দি বলতে শিখে গেছে রিতা। স্ফুর্তিতে থাকলে কাসেমের সাথে হিন্দিতে বাতচিত চলে ওর। বড় ভালো লাগে কাসেমের।

বৌয়ের মত ম্যান্দামারা না রিতা। স্মার্ট আছে, ফিগারও যথেষ্ট মি। বৌ তো পুরা খোদার খাসী! বিছানায় বসলে একপাশ কাত হয়ে যায়। রিতা বসলে বিছানা কাত হয় না, তবে তার হৃদয় কাত হয়ে যায়। ভূমিকম্প শুরু হয়। দ্রিম দ্রিম করে বাজনা বাজে।

আজ ঘটনা ঘটানোর পর থেকে দ্রিম দ্রিম উচ্চলয়ে বাজছে। শুধু বুকই না, হাতদুটোও কাঁপছে। কাঁপাকাঁপির ঠ্যালায় মোটরসাইকেলের হ্যাঁন্ডেলে বারবার হাত ফসকাচ্ছে। দিকভ্রান্ত মোটরসাইকেল যেন অকূল পাথারে; কখনো ডানে, কখনো বামে। স্থির নেই এক মুহূর্তও। সামান্য একটু স্থিরতার খোঁজে বাচ্ছা অভিমুখে মোটরসাইকেল দাবড়াচ্ছে সে।

বাড্ডায় রিতা আছে। এই মুহূর্তে রিতার সঙ্গ কাসেমের খুব দরকার। একটু শারীরিক উষ্ণতা চাই তার। শরীরভর্তি উত্তেজনা কাসেমের। একটু রিলিজ দরকার।

রিতা হলো সেই রিলিজ।

এক কোপে মাথা দু’ফাঁক তো প্রতিদিন করে না সে। এক কোপে ছাগলের পা আলাদা করে দিতে পারে সে, ভেড়ারও। এক বার বাজি ধরে এক কোপে ভেড়ার মাথা পর্যন্ত আলাদা করে দিয়েছিল। কিন্তু জ্বলজ্যান্ত মানুষের মাথা ফাঁক করে দেয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা না। তারপর হড়বড়িয়ে ফাঁকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো সাদা সাদা মগজ, লাল লাল রক্ত! রক্ত-মগজে এক্কেরে মাখামাখি!

কুপ দিলাম আর ব্রেইন বাইর হইয়া গেল।

সাথে সাথে কাসেমের মাথার গিটুও যেন খুলে যায়। কাসেম ভেবে দেখেছে প্রতিবার খুনের পর এই রকম অনুভূতি হয় ওর। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী অনুভূতি। একটা অস্থির উত্তেজনার। অন্যটা উল্লাসের, স্বাধীনতার। মনে হয় কোথাও যেন গিটু লেগে ছিল দীর্ঘদিন, এখন খুলে গেছে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। আকাশে দুই হাত মেলে উড়তে ইচ্ছে করে। মনে হয় দীর্ঘদিন পর যেন সে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে।

এখন সে মুক্ত, স্বাধীন।

যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে। যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। সে এখন শুধু তার চাপাতি দিয়ে একটার পর একটা মাংস বানিয়ে যাবে। সারি সারি মাংসের দলা আংটায় ঝুলানো থাকবে। নানা রংয়ের, নানা সাইজের। কাঁচা মাংসের মনমাতানো সৌরভে ম ম করবে চারপাশ। সে শুধু একটা একটা করে নামাবে আর বানাবে। নামাবে আর বানাবে।

চপ চপ চপ! চপ চপ চপ!

দুনিয়ায় আর কোন শব্দ থাকবে না, চাপাতির চপ চপ ছাড়া।

একটু হালকা লাগে তার। স্পিড আরো বাড়ায়। রিতার পানে ছুটে চলে তার পঙ্খীরাজ ঘোড়া।

*

অধ্যায় ১৪

বটি সুমনকে ছোটবেলায় বাটি সুমন ডাকতো সবাই। কারণ আর কিছুই না, ওর চুলের ছাঁট। সুমন সবসময় বাটি ছাঁট দিতো, যার জন্য এই অদ্ভুত নামকরণ। অবশ্য ছাঁটটা ও নিজের ইচ্ছায় দিতো না, ঠেকায় পড়ে দিতো।

ছোটবেলায় সুমনের মা নিজেই ছেলের চুল কেটে দিতেন। আর চুল কেটে দেয়া বলতে ভদ্রমহিলা বুঝেন লম্বা একটা কাঁচি নিয়ে মাথার চারপাশ থেকে চুল কেটে কেটে ছোট করে ফেলা। চারপাশ থেকে কাটতে কাটতে শেষমেশ মাথার উপরিভাগে রয়ে যেত কিছু চুল যা উপর থেকে বাটির মত দেখায়।

আর এই বাটি দেখেই মা সন্তুষ্ট হয়ে যেতেন। তার মুখে হাসি ফুটে উঠতো। সুমনের গালে ধড়াস করে একটা থ্যাবড়া চুমু দিয়ে তিনি খাস বগুড়ার ভাষায় বলতেন, “হামার ছোলেক সিংক্যা নায়ক নায়ক লাগিচ্ছে!”

কিন্তু সুমন ভালোমতোই জানতো ওকে মোটেও নায়ক নায়ক লাগছে। । ওকে মূর্তিমান গাধার মতো লাগছে। সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে। ক্লাউন দেখলে যেরকম আমরা হেসে গড়াগড়ি খাই, সুমনকে দেখেও সবাই হেসে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করলো। সুমন পারলে গর্ত খুঁড়ে তার মাঝে ঢুকে পড়ে। তার খারাপ লাগতো, নিজেকে ছোট মনে হতো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ছোট্ট সুমন, যারা আজ তাকে দেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে একদিন তাদের ঠোঁট টেনে ছিঁড়ে ফেলবে ও। সেদিন ওরা কাঁদবে, আর ও হাসবে। হিসাব ওইদিন সমান সমান হবে।

ছোটবেলায় এরকম কতশত প্রতিজ্ঞা আমরা করি, বাস্তবে কতজন তা পালন করি? খুবই কম। সেই খুব কমদের মধ্যে আমাদের সুমনও আছে। কারণ সুমন কিন্তু তার প্রতিজ্ঞা পালন করেছিল। বছর বিশেক পরে সে ঠিকই খুঁজে বের করে তার পুরনো বন্ধুদের-যারা তাকে দেখে একসময় মুখ বেঁকিয়ে হাসতো। এই বের করা এত সহজ ছিল না। বিশ বছর দীর্ঘ সময়। এর মধ্যে ক’জন মারা গেছেন, ক’জন দেশান্তরী, ক’জনের কোন খোঁজ খবর নেই। একদম লাপাত্তা।

তবুও গরুখখাঁজা খুঁজে সুমন। তন্নতন্ন করে ফেলে পুরো বাংলাদেশ। একদম যাকে বলে, চিরুনি অভিযান। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে কয়েকজনকে হাজির করতে সমর্থ হয় সুমন। হিসাব চুকানোর দিন আসে।

বটি ধারালো করে সুমন। তারপর এক কোপে ঠোঁট কেটে নেয়। মাঝে মাঝে হিসাবে কমবেশ হয়ে যেত। ঠোঁটের সাথে নাকও চলে আসতো। সেইসব হতভাগাদের জন্য চুকচুক করে খানিকক্ষণ আফসোস করা ছাড়া আর কীইবা করতে পারে সুমন? তাই করতো সে।

এরপর থেকে বাটি সুমন পরিণত হয় বটি সুমনে। বটি আবার দীর্ঘদিন কাসেমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। কোরবানীর ঈদে দুজন জোড়ায় জোড়ায় মানুষের বাসায় গিয়ে মাংস বানিয়ে আসতো। কাসেমের হাতে থাকতো চাপাতি, সুমনের বটি।

দুজনই কাজে দক্ষ। মাংস বানাতে তাই সময় বেশি লাগতো না। মালিকপক্ষ বেজায় খুশি। হাত খুলে বকশিস দিতো।

সে সব পুরনো কথা। বটি সুমন এখন আর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংস বানিয়ে দিয়ে আসে না। ওইটা নিম্নস্তরের কাজ। কসাই থেকে তার পদোন্নতি হয়েছে। বটি সুমন এখন পুরোদস্তুর সন্ত্রাসী। তার এখন নিজস্ব একটা বাহিনী আছে, বটি বাহিনী। টিবি গেইট এলাকার সমস্ত অপরাধ তারই আঙ্গুলিহেলনে হয়। সে আঙুল হেলে, লাশ পড়ে। সে আঙুল হেলে না, লাশও পড়ে না। কয়েকবছর আগে ও কাসেমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল, এখন চাইলে ওরকম দুই-দশটা কাসেমকে পকেটে পুরে রাখতে পারে সে। ওর জন্য এটা কোন ব্যাপারই না।

কালকে অনেক রাত পর্যন্ত গঞ্জিকা সেবন করেছে সে। তারপর শেষ রাতে ঘরে ফিরে আশ্রয় নিয়েছে তায়্যিবার বুকে। কী হয়েছে পরিস্কার মনে নেই সুমনের, খালি তায়্যিবার পরিতৃপ্ত হাসির কথা খেয়াল আছে। বয়স বেশি না মেয়েটার। উনিশ হবে বড়জোর। কিন্তু মারাত্মক ভারি শরীর। আর ভারি শরীরের প্রতি সুমনের ভয়ানক দুর্বলতা। থলথলে মাংস দেখলেই রক্ত গরম হয়ে উঠে তার।

পর্দা ভেদ করে রোদ এসে তেরছাভাবে বিছানায় পড়েছে। খানিক আগে ঘুম ভেঙেছে সুমনের। পাশেই তায়্যিবার মাংসল শরীর, কিন্তু সুমন কোন ধরণের আকর্ষণ বোধ করে না। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এই মুহূর্তে পেটপূজা দরকার, ইন্দ্রিয়পূজা পরে করা যাবে।

এক রুমের ফ্ল্যাটে ঠেসে সবকিছু রাখা। টিভি, ফ্রিজ, গ্যাসের চুলা-সব এখানেই। চুলার ওপরে দড়ি টেনে কাপড় শুকায় তায়্যিবা। কোন খাবার টেবিল নেই। ভাত-তরকারি প্লেটে নিয়ে মাটিতে বসে খেতে হয়। কিংবা বিছানায়। সোফা-টোফা কিছু নেই। বাইরে থেকে কেউ আসে না। আসলেও মাটিতে আসন গেড়ে বসতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। একটাই চেয়ার। ওই চেয়ারের আবার একটা পায়া ভাঙা। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। চেয়ার খালি নেই, ওটার ওপর জায়গা করে নিয়েছে চাইনিজ সোগাও কোম্পানির একটা কমদামি ব্লেন্ডার। ফলের রস খাওয়ার দারুণ শখ তায়্যিবার। তাই একটা কিনে দিয়েছে সুমন।

ফ্রিজ খালি, ধূ ধূ মরুভূমি। বোতলে ঠান্ডা পানি রাখা। একটা গাজরের অবশিষ্টাংশ আছে, আর একটা চুপসে যাওয়া শসা। দুটা ডিম মিলে উপরের তাকে। এতক্ষণ চোখে পড়েনি সুমনের। ডিম দেখে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার।

বড় দেখে একটা গ্লাস নিয়ে আসে সে। দুটা ডিম ভেঙে উপুড় করে ঢেলে দেয় গ্লাসে। লবণ মেশায়, মরিচ গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়। ধনিয়া পাতা ছিল সামান্য, ওগুলোও মেশায়। চামচ দিয়ে নাড়ে খানিকক্ষণ। গ্লাসে রাখা তরল পদার্থ থলথল করে উঠে।

ঘ্রাণ নেয়ার জন্য মুখের কাছে একবার নিয়ে আসে সুমন।

আহা!

খিদেয় পেটটা মোচড় দিয়ে উঠে তার।

আর তখনই বেরসিকের মতো মোবাইলটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা নাম-ঘুঘু। মুখে আসা মাদারচোত গালিটা অবলীলায় গিলে ফেলে সুমন। সবুজ বাটনে চাপ দিয়ে হাসি হাসি মুখে বলে-”আরে বস! কী মনে কইর‍্যা?”

“জানালার কাছে একটু আয় তো সুমন।”

ঘরে একটাই জানালা। নিচের রাস্তার দিকে মুখ করা। ওটার দিকেই এগোয় সে। নিচের গলিতে দুইটা রিকশা দেখা যায়, একটা ভ্যানগাড়িতে করে তরকারি বিক্রি করছে একজন। কয়েকজন পথচারী নিশ্চিত মনে হেঁটে যাচ্ছে। আর কেউ নাই।

দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সুমন। তারপর বলে, “বস আমি তো ঢাকায় নাই। বগুড়া আইছিলাম একটু কামে। আম্মার শরীরটা বেশি ভালা না…”

কথা শেষও করতে পারে না সে। তার আগেই বিকট একটা শব্দ। সদর দরজা সশব্দে ভাঙে। হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে জনা চারেক লোক। সবার হাতেই রিভলবার। পেছন থেকে সানগ্লাস পরিহিত একজন সামনে এগিয়ে আসে।

“তোর আম্মার শরীর খুব বেশি খারাপ নাকি রে?”

প্রকান্ড একটা শব্দ হয়। লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে বিছানা থেকেই পড়ে গেছে তায়্যিবা। পা বোধহয় মচকে গেছে। কঁকায় খানিকক্ষণ। তারপর রিভলবারধারী একজনের ধমক খেয়ে চুপ মেরে যায়।

“মামুন ভাই…” অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসে সুমন। কী বলবে খুঁজে পায় না।

দুজন রিভলবার ধারী ইতিমধ্যে ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজছে। ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম দেখে, খাটের তলা দেখে। ড্রয়ার হাতড়ায়, ফ্রিজ খুলে।

“কসাই কাসেম কই, হারামজাদা?” মামুন জিজ্ঞেস করে।

“কাসেম ভাই! কাসেম ভাই আইবো কইখন ভাই?” চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠে তার।

এগিয়ে গিয়ে গালে একটা চড় কষিয়ে দেয় মামুন। “মিছা কথা বলবি তো খুপড়ি উড়ায়া দিমু হারামজাদা। বল, কাসেম কই?”

চড় খেয়ে পৃথিবীটা দুলে উঠে সুমনের। কাসেমকে দিয়ে মাঝে মাঝে টুকটাক কাজ করিয়ে নিতে সুমন। ব্যাপারটা কেউ জানে না, বটি বাহিনীর দু’একজন ছাড়া। মামুনও তথ্যটা জানে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ঘুঘু’র অফিসার মামুন-অর-রশিদ দীর্ঘদিন ধরেই বটি বাহিনীর পিছু নিয়েছে। মওকার অপেক্ষায় আছে। মওকা পেলেই কোপ দিবে। একদম গলা বরাবর।

কিন্তু সুমন ভেবে পায় না কাসেম ভাই আবার কী করলো?

আরো একটা রাম থাপ্পড় খেয়ে ধরায় ফিরে আসে সুমন। তায়্যিবা সুর তুলে কান্নার। রিভলধারী লোকটা আবারো একটা ধমক দেয়। তায়্যিবা চুপ মেরে যায়।

কিন্তু মুখ খুলে যায় সুমনের।

*

অধ্যায় ১৫

আজ সকাল থেকেই কুফা দিন যাচ্ছে মালেকা বানুর। সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই হাত ফসকে কাঁচের জগ পড়ে একশো টুকরা। অনেক শখ করে কিনেছিল সে জিনিসটা। আড়াইশো টাকা দাম। দোকানদার চাচ্ছিল সাড়ে তিনশো। মূলামূলি করে শেষ পর্যন্ত আড়াইশো টাকায় রফা হয়। জগের গায়ে সুন্দর নকশা কাটা ডিজাইন। গোলাপ ফুলের ডিজাইন। থোকা থোকা ফুল উঠেছে। হাতলের গ্রিপটা বেশ আরামদায়ক, ধরতে অনেক সুবিধা। অথচ সেই আরামদায়ক গ্রিপই কিনা ফসকে গেল। সুন্দর নকশা কাটা গোলাপ ফুলের ডিজাইন চোখের পলকে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। বুকটা হু হু করে উঠে মালেকা বানুর।

আহারে!

এর মধ্যে পাশের বাসার কুসুম ভাবি এসে বিচার দেয়। বিষ্ণু নাকি ওর ছেলেকে মেরেছে। গালে ঘুষি মেরেছে, আরেকটু হলে চোখে লাগতো। শুনে নিমেষেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠে মালেকা বানুর। বিল্ট দিনদিন তাঁদড় হচ্ছে। হবে না কেন, বাপ কী কম তাঁদড়? যেমন বাপ তেমন পোলা। ভাবিও ঘ্যানঘ্যানিয়ে অভিযোগ তুলে।

পোলাটা বেয়াদব হইছে খুব। যার তার গায়ে হাত তুলে। সেদিন আমারে দেইখ্যা ভেংচাইলো।

বিল্টুর খোঁজ মিলে না। কোথায় জানি পালিয়েছে। আসুক, আজকে ওর কপালে খারাবি আছে।

এর মাঝে সকাল থেকে সাপ্লাইয়ে পানি নাই, রান্নাও বসানো যাচ্ছে না। বিটা থাকলে পাড়ার টিউবওয়েল থেকে পানি আনা যেত। মালেকা বানুর বৃদ্ধা ফুফু শ্বাশুড়ি ঘ্যানঘ্যান করে-”বৌ, খাওন দ্যাও। ক্ষুধা লাগছে।”

তিরিক্ষি মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয় মালেকা বানুর। এত খিদে ক্যান বুড়ীর? খালি খাই খাই খাই। কিন্তু বুড়ীর ঘ্যানঘ্যানানি কমে না। আরো বাড়ে।

খাওন দ্যাও। খাওন দ্যাও। খাওন দ্যাও।

ঘরে পানি যা ছিল তা দিয়ে কোনমতে রান্না বসায় মালেকা বানু। নাস্তা বানিয়ে বুড়ীকে শান্ত করে। তারপর যায় টিউবওয়েলে পানি আনতে। কিন্তু টিউবওয়েলে তখন বিশাল লাইন। পুরো মহল্লার মানুষ এসে হাজির হয়েছে টিউবওয়েলের সামনে। একেকজনের হাতে চার-পাঁচটা করে কলসি ও বালতি। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। কাঁচরম্যাচর বাড়ে। এক পর্যায়ে আবদুল দোকানির বৌ তার লাল বালতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কানা বদরুলের বৌয়ের ওপর। কানা বদরুলের বৌ মৌসুমী নাকি ওকে খানকি বলেছে। গালি শুনে তো আর বসে থাকার পাত্র না আবদুল দোকানির বৌ সালমা। অ্যাকশনে নামে ও।

মৌসুমীর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকায় সালমা-”তুই খানকি। তোর বাপ খানকি। তোর মা খানকি। তোর চৌদ্দগুষ্ঠি খানকি।”

মানুষজন লাইন ছেড়ে তামাশা দেখতে বসে যায়। মারামারিতে লাভই হয় মালেকা বানুর। টুক করে লাইন ভেঙে পানি ভরে নিয়ে আসে।

মালেকা বানু উৎফুল্ল মনে বাড়ির পথ ধরে। সে তখনো জানে না মহাখালী কাঁচাবাজারে ওর স্বামীপ্রবর কারো মাথায় চাপাতির কোপ বসিয়ে দিয়েছে। অবশ্য সে কথা জানতে খুব বেশি দেরি হয় না তার।

বাড়ির সামনে আসতেই মালেকা বানু ওর বাবাকে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ওর বাবা ইব্রাহিম লস্কর, মেথর প্রধান। ভদ্র ভাষায় সরকারি পয়ঃনিষ্কাশন কর্মীদের নেতা। মানুষদের হাগা-মুতা পরিস্কার করা ওর কাজ। আপাতত সেমি রিটায়ারমেন্টে আছেন। ওর বড় ছেলে ইসমাইল এখন বাপের কাজ দেখাশোনা করে। বাবার পেছনে ছোট ছেলে ইয়াকুবকে দেখা যায়। ইয়াকুব অবশ্য এই লাইনে নাই। সে পড়াশোনা করছে। ইব্রাহিম লস্করের ইচ্ছা ছেলেকে ব্যারিস্টার বানাবেন। মেথরের ছেলে ব্যারিস্টার হবে, কালো গাউন পরে গটগট করে অফিসে যাবে। গর্বে তার বুক ফুলে যাবে।

ইয়াকুবের মুখেও শঙ্কার কালো ছায়া।

বাপের মুখে বিস্তারিত সব শুনে মাথায় বাজ পড়ে মালেকা বানুর। কাসেম ভর বাজারে কাউকে কোপ মেরেছে। সেটা এখন ফলাও করে টিভিতে দিচ্ছে। লোকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ খুব সম্ভবত। বাজার এখন গিজগিজ করছে পুলিশে।

বাড়ির সামনেই ধপ করে বসে পড়ে মালেকা বানু। তার মাথা ঘুরছে তখন। শ্যালক ইয়াকুব দুলাভাইকে ফোন ঘুরায়। ফোন বেজে যায়, কেউ ধরে না। এবার শ্বশুর ইব্রাহিম লস্কর নিজের জামাতাকে ফোন করেন। রিং হয়, কেউ ধরে না। বৌ মালেকা বানুও ফোন করেন। কিন্তু না। কাসেম হয়তোবা বধির হয়ে গেছে। ফোনের রিং আর শুনতে পাচ্ছে না।

টিভি দেখে আরো কয়েকজন এসে জড়ো হয় বাড়ির আশেপাশে। কেউ কেউ সহানুভূতি দেখায়। টিভিতে ভুল দেখাচ্ছে। কাসেম এরকম কিছু করতেই পারে না। এই কাসেম অন্য কাসেম।

ভেতর থেকে কাসেমের রোগাক্রান্ত ফুফু-ও এসে সুর তুলে। মা মারা যাওয়ার পর এই ফুফুই তো কোলেপিঠে করে মানুষ করলো কাসেমকে। খাওয়ালো, পরালো। কাসেমকে উনি চিনবেন না তো কে চিনবে? তিনি জোর গলায় দাবি করেন, কাসেম মোটেও এইরকম মানুষ না। এগুলো সব ষড়যন্ত্র। উত্তরপাড়ার আমিন জোয়ার্দারের বাপ এগুলো করতেছে। যদিওবা আমিন জোয়ার্দারের বাপ আজ আট বছর হলো পটল তুলেছে। ওপারে বসে কেউ যদি ষড়যন্ত্র করতে পারে তাহলে হিসাব ভিন্ন অবশ্য।

এক ফাঁকে বন্টু এসে হাজির হয়। কী ঘটেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। চুপচাপ এক কোণায় গিয়ে বসে পড়ে ও।

হঠাৎ একটা শোরগোল উঠে। সাংবাদিক এসেছে, সাথে ক্যামেরা ও ক্রু। নড়ে চড়ে বসে সবাই। কাসেমের বদৌলতে চেহারাটা টিভিতে দেখালে মন্দ হয় না। পাড়ার সবাই ততক্ষণে আছড়ে পড়েছে কসাই কাসেমের বাসায়।

সাংবাদিক এক তরুণী। বয়স ১৮-২৫ এর মধ্যে হবে। ফতুয়া-জিন্স পরে আছে, চেহারায় দৃঢ়তা। হেসে নিজের পরিচয় দেয়। আমব্রিন রহমান, এল টিভি। আমব্রিনের চোখেমুখে সমবেদনার ছাপ। তার প্রশ্নগুলোও বেশ নিরীহ গোছের। কেমন আছেন, কাসেম মানুষ হিসেবে কেমন, এখন কোথায় আছে কিংবা থাকতে পারে এই টাইপ। ইন্টারভিউ চলছিল ভাললাই। কিন্তু গোল বাঁধে আমব্রিন যখন কসাই কাসেমের মিস্ট্রেসের প্রসঙ্গ তুলে।

“শুনেছি কাসেমের অনেক মিস্ট্রেস আছে, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?” নিরীহ এক প্রশ্নের ভিড়ে সাক্ষাৎ কালো কেউটে ছুঁড়ে দেয় আমব্রিন।

“মিছটেছ মানে?”

“মিস্ট্রেস বলতে বুঝায়…” আমব্রিন মিস্ট্রেসের কেতাবি শব্দ হাতড়ায়, কিন্তু মুখ ফসকে অন্য কিছুই বের হয়-”বান্ধা মেয়েমানুষ…”

পাশ থেকে ক্যামেরাম্যান ফিসফিসিয়ে শালীন একটা শব্দ জোগায়। “রক্ষিতা।”

শব্দ খুঁজে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আমব্রিন। “হ্যাঁ। রক্ষিতা।”

নিমেষে শ্রাবণের কালো মেঘ এসে জড়ো হয় মালেকা বানুর মুখে। তার শ্যামলা মুখখানিতে কেউ যেন আলকাতরা গুলে দিয়েছে।

এবার মুখ খুলে যায় মালেকা বানুর। “রিতা তো একটা বেশ্যা। একটা মাগী। একটা ছিনাল… দুধ-পাছা দেখায়া জোয়ান পুরুষ বশ কইরা রাখে…”

এল টিভির লাইভ টেলিকাস্টের বারোটা বাজে। লাইভ ফিড বন্ধ করে দেয় তারা। কিন্তু মালেকা বানুকে বন্ধ করা যায় না। তার মুখ যেন নায়াগ্রা জলপ্রপাত। পানি পড়ছেই। অবস্থা বেগতিক দেখে মাইক্রোফোন গুটিয়ে সরে পড়ে আমব্রিন ও তার দলবল।

কিন্তু বানের পানির মতো আসতে থাকে সাংবাদিকদের দল। গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা পৌঁছে যায় মালেকা বানুদের দুয়ারে। কিউ টিভি, অবিরাম বাংলা, দৈনিক ভোরের পাখি। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়ে মালেকা বানু ও তার পরিবার। কিউ টিভি’র এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক বাড়ির পেছনের জানালা গলে ভেতরে ঢুকে পড়েন, সাথে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা।

“প্রিয় দর্শকবৃন্দ এই বাড়িতেই থাকেন ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর খুনি কাসেম মিয়া, যিনি লোকমুখে কসাই কাসেম নামে অত্যাধিক পরিচিত…”

সাংবাদিকের লাইভ টেলিকাস্ট ডেড হতে সময় নেয় না। লাঠিতে ভর দিয়ে কখন যেন কাসেমের বয়স্কা ফুফু এসে হাজির হয়েছে তা ওদের কারোরই খেয়াল নেই। অতঃপর লাঠির এলোপাতাড়ি বাড়িতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখানেই শেষ হয়। হুড়মুড় করে পালাতে গিয়ে সাধের হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরাটাও বিসর্জন দিয়ে আসে ভিডিও ।

অবস্থা খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না মালেকা বানুদের। তবে কী তাদের আত্মগোপনে যাওয়া উচিত? এদিকে মেজাজ সপ্তমে চড়েছে ইব্রাহিম লস্করের। মেয়েকে অপদস্থ হতে দেখতে কোন বাবার ভালো লাগে? লস্করেরও ভালো লাগছে না। তবে এত সহজে রণে ভঙ্গ দেয়ার পাত্র না সে। মেয়েকে তাই সাহস জোগায় মেথর প্রধান। “তুই টাইট হইয়া বইয়া থাক, মান্টু। দেখি কে তোর বালডা ছিঁড়ে?”

ফোন দিয়ে নিজের দলবল ডেকে আনে ইব্রাহিম লস্কর। ওরা প্রস্তুত হয়েই আসে। সবার হাতে বড় বড় পলিথিনের প্যাকেট। আর প্যাকেট ভর্তি গু।

“নাটকির পোলাগোরে গু দিয়া ভইরা দিবি। পারবি না?”

“পারমু, ওস্তাদ!” সমস্বরে জবাব দেয় সবাই।

গুয়ের কড়া গন্ধে ম ম করে উঠে চারপাশ। তামাশা দেখতে আসা প্রতিবেশীদের অনেকেই পালায়, কেউ কেউ নাক-মুখ খিচে বসে থাকে। নিজের মেয়েকেও নাক-মুখ কুঁচকাতে দেখে বেঁকিয়ে উঠে মেথর প্রধান, “ঢং করিস না। গু-মুত ছাইনাই তো বড় হইছস।”

নাক-মুখ ঠিক করে কাসেমকে আবার ফোন করে মালেকা বানু। এবার ফোন বন্ধ পায় সে।

দ্য নাম্বার ইউ ডায়ালড ইজ নট এভেইলেভল এট দ্য মোমেন্ট।

কপাল আবার কুঁচকায় মালেকা বানুর। তবে এবার গুয়ের গন্ধে না। ভয়ে, আশঙ্কায়।

*

গুলশান থানার সেকেন্ড ইন চার্জ আকরামুল হককে সকাল থেকেই অদ্ভুত এক ব্যারামে পেয়েছে। সকাল থেকে তিনি শুধু ঢোক গিলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে ছেদ পড়ছে ঢোক গেলায়, তারপর আবার ঢোক গেলা শুরু। ঢোক গেলা যেন থামছেই না। পানি খান তিনি, অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু লাভ হয় না।

এরকম এলাহি এক কান্ড ঘটে গেল। কসাই কাসেম দা দিয়ে মাথা দু’ফাঁক করে দিলো ডক্টরসাহেবের। তার মনে হয়েছিল ঘটনার ঘনঘটায় আপনাতেই ঢোক গেলা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু না।

এই মুহূর্তে ফোর্স নিয়ে ছুটছেন তিনি কসাই কাসেমের ডেরায়। খানিকক্ষণ আগে ওসির শক্ত ধাতানি খেতে হয়েছে। সাংবাদিকরা কসাই কাসেমের বাসা খুঁজে পেয়ে গেল, ইন্টারভিউও নিয়ে নিল ওর স্ত্রীর, আর এতক্ষণ ধরে তারা কী করছে? বাল ফেলছে?

রাস্তায় মানুষজন ভিড় করে টিভি দেখছে। ফতুয়া-জিন্স পরিহিত আমব্রিন রহমানকে দেখা যায়। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, মুখে মেকআপ। কসাই কাসেমের বৌয়ের ইন্টারভিউ বার বার দেখাচ্ছে। আজ এল টিভির টিআরপি সাঁই সাঁই করে বেড়ে যাবে।

ফোর্সের একজন ইউটিউবে ঢুকে পুরো ভিডিওটা দেখে। টিভিতে পুরো ভিডিও দেখায় নি, কেঁটে ছেটে দেখিয়েছে। সেন্সর করে দিয়েছে। কিন্তু ইউটিউবে আনসেন্সরড জিনিস আছে। কসাই কাসেমের বৌ মালেকা বানুর আলকাতরা গোলা মুখ ভেসে উঠে মোবাইল স্ক্রিনে–

“রিতা তো একটা বেশ্যা। একটা মাগী। একটা ছিনাল… দুধ-পাছা দেখায়া জোয়ান পুরুষ বশ কইরা রাখে…”

কসাই কাসেমের বাড়ির সামনের গলিতে ঢুকে পড়ে পুলিশের জিপ।

*

অধ্যায় ১৬

তখন কসাই কাসেমের বাড়ির পেছন দিকের গলিতে এসে হাজির হয়েছে। ঘুঘুর মাইক্রোবাস। বটি সুমন আঙুল দিয়ে দেখায়-”ঐ যে ঐটা হইলো গিয়া কাসেম ভাই’র বাড়ি।”

বটি সুমনকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। গাঁইগুই করছিল প্রথম প্রথম। তলপেটে একটা মোক্ষম ঘুষি খাওয়ার পর গাঁই-ছুঁই বন্ধ হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ ব্যথায় কুঁই কুঁই করেছে অবশ্য।

পেছন থেকে পাখির কিচকিচ শোনা যায়। খাঁচায় বন্দী ঘুঘু গরম গরম মলত্যাগ করে। বিষ্ঠার গন্ধে মাইক্রোবাসে টেকা দায়। এই কয়েক ঘন্টায় ইতিমধ্যে পেছনের সিটের দফারফা করা হয়ে গেছে। আর সহ্য হয় না লতিফুর রহমানের।

“হাগামুতা ছাড়া আর কী কিছু করতে পারে এই পাখি?” আগুনে দৃষ্টি হানেন তিনি আলমগীরের দিকে তাকিয়ে।

আলমগীর জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল, ধমক শুনে আরো গুটিয়ে পড়ে। ঘুঘুগুলোর দিকে কটমট করে তাকায় কিছুক্ষণ। কিন্তু ঘুঘুগুলো ড্যামকেয়ার। তার চোখের সামনেই দেখিয়ে দেখিয়ে মলত্যাগ করে।

“হারামজাদা!” রাগে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে আলমগীরের, কিন্তু বস সামনে। তাই কিছু করতে পারছে না।

“গাড়িটা তুমি নিজ হাতে পরিস্কার করবা, বুঝতে পারছো? নিজ হাতে। মনে থাকে যেন কথাটা।” চতুর্থবারের মতো রণহুংকার ছাড়েন লতিফুর রহমান।

আলমগীর হা-না কিছুই বলে না, মুখটা হাঁড়ির মতো করে রাখে।

মামুনের অ্যাটেনশন তখন অন্যদিকে। সাংবাদিকরা যে ছোঁক ছোঁক করতে করতে কসাই কাসেমের আস্তানায় এসে হাজির হয়েছে তা আর জানতে বাকি নেই তার। ইন্টারভিউটা ইতিমধ্যে কয়েকবার দেখা হয়ে গেছে।

“রিতা কে?” মামুন জিজ্ঞেস করে।

“রিতা কে আমি ক্যামনে কমু, মামুন ভাই? আমি কুনু রিতারে চিনি না।”

বেলুন ফাটার মতো একটা শব্দ হয়। শব্দটা চড়ের। দিনের দ্বিতীয় চড়টা খেয়ে ফেললো সুমন। প্রথমটা বাম গালে খেয়েছিলো, এবারেরটা ডানে। যাই হোক, সমান সমান হয়ে গেল।

ইন্টারভিউটা আবারো তাকে দেখায় মামুন। আবারো দেখে ও, এবং আবারো দুদিকে মাথা নাড়ে। “রিতা নামের কাউরে আমি চিনি না ভাই…”

“আচ্ছা রিতাকে চিনে কী না সেটা না হয় পরে দেখা যাবে। আপাতত ওর ঘরে ঢুকা যাক। যদিওবা কসাই কাসেমের এখানে থাকার সম্ভাবনা প্রায় জিরো। তবু কে জানে হয়তোবা কোন কু পেয়েও যেতে পারি।” লতিফুর রহমান বলেন।

মাইক্রোবাস ছেড়ে বাইরে বের হয় সবাই। সতেজ বাতাস পেয়ে মনটা একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে সবার, ভেতরটা হাবিয়া দোজখ হয়ে গিয়েছিল।

মামুন চার দলে ভাগ করে দেয় সবাইকে। তিনদল পেছন থেকে অ্যামবুশ করবে, একদল চলে যায় সামনে। আলমগীর ওর ঘুঘুর খাঁচা নিয়ে রয়ে যায় বটি সুমনকে পাহারার কাজে। ঘুঘুগুলো সমানে মলত্যাগ করে যাচ্ছে। সুমন চোখমুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে-”ওগো কী ডায়রিয়া?”

বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে রাখে আলমগীর, জবাব দেয় না।

“আমি এইভাবে শিস দিলে সবাই একসাথে অ্যাটাক করবা।” দুই আঙুল মুখে ঢুকিয়ে শিস দেয় মামুন। “কাসেম যাতে ফাঁক গলে না বেরোয়। সাবধান!”

ওদিকে গুলশান থানার সেকেন্ড ইন-চার্জ আকরামুল হকও দায়িত্ব বিলি-বন্টন করে দেন। মুখের বাঁশি দেখিয়ে সবাইকে বলেন-”ফুঁ দিলেই অ্যাকশনে যাবা। অকে?”

“অঙ্কে।” সমস্বরে জবাব দেয় সবাই।

কসাই কাসেমের শ্বশুরসাহেব ইব্রাহিম লস্করও তখন তার সাকরেদদের উদ্দীপ্ত করার জন্য বলছেন

“নাটকির পোলাগোরে গু দিয়া ভইরা দিবি। পারবি না?”

“পারমু, ওস্তাদ!”

মামুন ও আকরামুল হক শিস ও ফুঁ একসাথেই দেন। ব্যাপারটা মোটেও পূর্বপরিকল্পিত ছিল না, হয়ে গেছে। ঘুঘু বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী একসাথে অ্যাকশনে নামে। দুইদলের কেউই কারো উপস্থিতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল না। দুইদলের কেউই জানে না তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।

আকামটা ঘটায় আলমগীর। মাইক্রোবাস খানিকটা দূরেই পার্ক করা, আশেপাশে ওর সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ নেই। সবাই গলি ছেড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে, এখন যে যার পজিশন নিয়ে ব্যস্ত। মনে মনে আলমগীরের হাসি পায় এক কসাই কাসেমকে ধরার জন্য এত কিছু করা লাগছে ভেবে।

তখনই বিচ্ছিরিভাবে ওর প্রস্রাবের বেগ পায়। হয়তোবা নিজের অজান্তেই ও বহুমূত্র রোগে ভুগছে, হয়তোবা সিরিয়াস মুহূর্তে বেগ পাওয়ার বদঅভ্যাসে ও আক্রান্ত, হয়তোবা মূত্রত্যাগের অতি স্বাভাবিক নিয়মেই তার প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে।

হয়তোবা আরো অনেক কিছুই হতে পারে।

ত্যক্ত-বিরক্ত আলমগীর আর সুলুক সন্ধানে যায় না। সে বিরস বদনে প্রস্রাব করতে নেমে যায়। ও ভেবেছিল নিরীহ মুখ করে রাখা বটি সুমনের জন্য ড্রাইভারই যথেষ্ট। কিন্তু ও তো আর জানতো না ড্রাইভার মোহাম্মদ আলী নামে বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা হলেও কাজের বেলায় ঠনঠন। ও তো আর জানতো না দুই দুইটা চড় খেয়ে রাগে ফুঁসছে সুমন। ও তো এটাও জানতো ব্যাকআপ হিসেবে সুমন সবসময় ওর পায়ের কব্জিতে ধারালো ক্ষুর বেঁধে রাখে।

আলীকে নজর রাখতে বলে ড্রেনের পাশে মূত্রত্যাগে বসে পড়ে আলমগীর। সুমন বুঝতে পারে এই-ই সুযোগ। সে পা চুলকানোর ভান করে ক্ষুর বের করে নিয়ে আসে। আলী তখন আনমনে হিন্দি গানের সুর ভাঁজছে–তীর অ্যায়সা লাগা, দার্দ অ্যায়সা জাগা…।

বটি সুমন ক্ষুর চালায়। এতেই মোহাম্মদ আলীর গলায় সরলরেখা আঁকা হয়ে যায়, এক পোঁচে ফাঁক হয় গলা। সরলরেখা থেকে গলগলিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। আলীর হিন্দি গান আর শেষ হয় না, দার্দও আর খুব বেশি জাগে না তার। টুপ করে সিটেই বসে পড়ে ওর দাদহীন নিথর দেহ।

মাইক্রোবাসে তুলকালাম কান্ড যে ঘটে গেছে এটা আর জানে না আলমগীর, ও তখন আয়েস করে জলবিয়োগ করছে। বেগ পেয়েছিল খুব, আবেশে তাই চোখ বুজে গেছে তার। বুঝতেও পারে না সাক্ষাৎ মৃত্যু ওর দোরগোড়ায়।

কিন্তু ওর নসিব ভালো ছিল। শুধু ভালো না, সাংঘাতিক ভালো। নাহলে এরকম মোক্ষম সময়ে গালে মশা এসে বসে? ঢাউস এক মশা এসে বসেছিল আলমগীরের বাম গালে, প্রস্রাবরত অবস্থায় সে ডান হাতে চড় দেয় গালে। এতে ওর বসে থাকার অবস্থানে সামান্য হেরফের হয়ে যায়।

আর এতেই বেঁচে যায় ও।

শ্বাসনালী টার্গেট করে এগিয়ে আসা সুমনের ক্ষুর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ঘাড়ের এক পাশে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে ও, পায়ের নিয়ন্ত্রণও হারায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই মূত্র ত্যাগরত আলমগীর সদ্য নির্গত মূত্রধারার মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে। ড্রেনের ময়লায় পুর্নবার অবগাহন করে ওর পুরো অস্তিত্ব। তার নেতিয়ে থাকা লিঙ্গ থেকে তখনো টিপটিপ করে প্রস্রাব বের হচ্ছে।

সুমন বুঝতে পারে আলমগীর ফসকে গেছে। সে আর সময় নষ্ট করে না। এখন ভাগার সময়।

মাইক্রোবাস নিয়ে ভেগে যাওয়ার আগে আগে চিৎকার করে কাসেম ভাইকে সতর্ক করে দেয় সুমন। “কাসেম ভাই, ভাগেন। ওরা আইতাছে…”

সুমনের চিৎকার শেষ বিকালের নিস্তদ্ধতা খানখান করে দেয়।

আর তখনই মজাটা শুরু হয়।

সুমনের চিৎকার ইব্রাহিম লস্করের কান এড়ায় না। সে চকিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। দেখে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে কয়েকজন এগিয়ে আসছে; হাতে রিভলবার, রাইফেল। আর দেরি করে না মেথর প্রধান। গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দেয় ও। গু ভর্তি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওর সাকরেদরা ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র শুরু করে এলোপাথাড়ি গু বৃষ্টি।

বৃষ্টির মতো আকাশ থেকে পড়তে শুরু করে গুচ্ছ গুচ্ছ গু।

এ ধরণের অভ্যর্থনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না পুলিশ ও ঘুঘু বাহিনী। সেকেন্ড ইন চার্জ আকরামুল হকের মাথায় এক ব্যাগ গু পড়ে বিস্ফোরিত হলে আর দেরি করেন না তিনিও। ডিরেক্ট গুলি চালানোর আদেশ দেন।

গুলি চলে। ঠা ঠা ঠা ঠা।

দেয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে ঘুঘু বাহিনীর ইউনিট হেড লতিফুর রহমান নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তার দলকে। ধুপ ধাপ শব্দ হচ্ছিল।

“শব্দ কিসের?” লতিফুর রহমান জিজ্ঞেস করেন।

“স্যার কোন কুত্তায় জানি গু ফিকা মারতাছে!”

“কী সব আবোল তাবোল কথা বলতেছো? সামনে এগোয়।” বিরক্তিতে বেঁকিয়ে উঠেন লতিফুর রহমান।

“পারলে একবার দেয়াল ছাইড়া বাইর হন, মজা টের পাইবেন।”

দেয়ালের আড়াল ছেড়ে বের হন লতিফুর রহমান। আর তখনই পলিথিন ভর্তি গু ফটাস শব্দে ওর মুখে এসে বিস্ফোরিত হয়।

কিছুক্ষণ মূর্তিবৎ স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। তারপর ফেটে পড়েন রাগে।

পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুলি শুরু করেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও গুলি চালানো শুরু করে।

গুলি চলে। ঠা ঠা ঠা ঠা। চতুর্দিক থেকে বৃষ্টির মতো গু-গুলি চলতে থাকে। কোনটাই স্তিমিত হয় । পুলিশের গুলি খেয়ে ডান হাতের তালুর অর্ধেকটা উড়ে যায় ঘুঘু বাহিনীর অফিসার তমালের। কিন্তু ঘুঘু বাহিনী মনে করে এটা কাসেম বাহিনীর কাজ। কাসেম তার দলবল নিয়ে গাড়লের মতো ঘরের ভিতরেই অবস্থান নিয়েছে, এটাই মনে করতে থাকে তারা।

ঠিক তেমনি ঘুঘু বাহিনীর গুলিতে যখন মারাত্মক জখম হয় পুলিশের এক কনস্টেবল, পুলিশরা ভাবে এটা কাসেম বাহিনীর কাজ। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওরা রেডি হয়ে বসে আছে। কখনো গু ছুঁড়ছে, কখনো ছুঁড়ছে গুলি।

রেগেমেগে দু দলই গুলির বেগ দিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

কসাই কাসেমের বাড়িঘর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। একে একে নিজের সাকরেদ হারাতে থাকে মেথর প্রধান ইব্রাহিম লস্কর। তার বাম পাশে বসা ছিল লালু, আর ডান পাশে কালু। দুই ভাই। দুইজনই গুলিবিদ্ধ। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে মেয়ে মালেকা বানু। খাটের তলায় মেয়েটা আশ্রয় নিয়েছে। অবস্থা যে এত তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে তা তার ধারণারও বাইরে ছিল। যখন নাতি বন্টুর হাতে এসে গুলি লাগে তখন আর নিজেকে সামলাতে পারে না ও। সাকরেদদের থামতে বলে। থামতে বলে গুলি ছুঁড়তে থাকা দুই পক্ষকে।

“আপনারা থামেন, ভাইসব। থামেন, থামেন। আল্লার ওয়াস্তে গোলাগুলি থামান।”

নাতিকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে লস্কর। দুহাত তুলে বাইরে বেরিয়ে আসে ওর সাকরেদ কজন ও মেয়ে মালেকা বানু। বারান্দা গু’তে ভর্তি। গু মাড়িয়ে হাঁটে ওরা নির্বিকার। জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে, দরজার কজা উড়ে গেছে। খসে পড়েছে ওয়ালের প্লাস্টার। এক কোণায় কাতরাচ্ছে লস্করের আরো দুই সাকরেদ। একজনের তলপেটে গুলি লেগেছে, আরেকজনের কাঁধে।

সেকেন্ড ইন চার্জ আকরামুল হক আত্মসমর্পণরত লোকদের দেখে শান্ত হোন এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন বিরক্তিকর ঢোক গেলা বন্ধ হয়ে গেছে।

*

অধ্যায় ১৭

“এটাই কী ওই বাড়ি?” রফিকুল ইসলাম জিজ্ঞেস করেন। সামনে একটি ভঙ্গুর দুই তলা দালান। গেটে বাড়ির নামফলক টাঙ্গানো-হাসান ভিলা।

হাসান ভিলার অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। দেখলে মনে হয় জোরে হাঁচি দিলে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। উঁচু খিলান ওয়ালা সাবেকি ধাঁচের বাড়ি। পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভেঙে ঝুলছে জানালা। দাওয়ায় একটা বিড়াল গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ওদের আগমনে একবার উঁকি মেরে দেখে আবার ঝিমানো শুরু করে।

“রেজিস্টার অফিস অনুযায়ী তো এটাই ওর বাড়ি হওয়ার কথা।” চিরকুট বের করে আবার দেখে নেয় জহির। তাদের পেছনে আরেকজনকে দেখা যায়। গলির মুদি দোকানদারের কম বয়সী অ্যাসিস্ট্যান্ট বাগু। ওই ওদেরকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে। নাহলে আন্দরকিল্লার এই চিপা গলিতে বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না।

প্রশ্নটা বাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিল। বাগু তখন বিড়াল নিয়ে ব্যস্ত। ঝিমাতে থাকা বিড়াল বাগুর আগমন দেখে তড়াক করে লাফ দিয়ে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

হঠাৎ বাগুর খেয়াল হয় সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হুড়মুড় করে চাটগাইয়া ভাষায় যে উত্তর দেয় তার শানে নুযুল হলো-হ্যাঁ, এটাই ওই পাগলা স্যারের বাড়ি।

ততক্ষণে রফিকুল ইসলাম বাড়ির ভেতরে পা বাড়িয়েছেন। সামনেই ড্রয়িংরুম, ধূলোমলিন সোফাসেট। সেন্টার টেবিলে বিড়াল মলত্যাগ করে রেখেছে। বোঁটকা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে। বাধ্য হয়ে নাক চাপে সবাই। ড্রয়িংরুমের পাশেই ডাইনিং। খাবার টেবিল, শো-কেস।

এগোয় ওরা, বোঁটকা গন্ধও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।

“কোথাও উঁদুর মরে পড়ে আছে মনে হচ্ছে!” রুমাল দিয়ে নাক চেপে রেখেছে জহির।

ডাইনিংরুমের একপাশে কিচেন, অন্যপাশে একটা করিডর। করিডরের একপ্রান্তে বিশাল স্টুডিয়ো। দেয়ালে পেইন্টিং ঝুলছে, ইজেলে অর্ধ-সমাপ্ত একটা কাজ। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন রফিকুল ইসলাম।

ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা কুঁড়েঘর। চারদিক সবুজে ছাওয়া। উঠানে এক বয়স্ক বৃদ্ধ বসে আছে, থলথলে হুঁড়ি। বুক পর্যন্ত নেমে আসা দাঁড়ি, লম্বা চুল। পরনে জোব্বা। তার সামনে বিশাল এক হাঁড়ি রাখা। হাতল দিয়ে কী জানি ঘুটছে বুড়ো। তার মুখে সবুজ পাতা, দেখে মনে হচ্ছে বুড়ো পাতা চিবুচ্ছে। নিচে ইংরেজিতে নাম লিখে রাখা, দ্য টি অভ শ্যানং।

করিডরের অন্য প্রান্তে আরেকটা বড় রুম। টেবিল, বিছানা, আলনা। এ ছাড়া রুমে আর কোন আসবাব নাই। বিছানা খালি। কোন চাদর বিছানো নাই, স্রেফ ময়লা তোষক। আলনায়ও কোন কাপড় নাই।

ঘরের মাঝখানে একটা পেঁচানো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। কয়েক ধাপ উঠার পরই অন্য রকম একটা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা লাগে। রফিকুল ইসলাম ভ্রু কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকান।

“কীরে, কী হলো?” জহির পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে।

“গন্ধটা পাচ্ছিস?” রফিকুল ইসলামের কুঁচকানো আরো গাঢ় হয়।

নাক বাড়িয়ে গন্ধ শুঁকে দেখে জহির। “মরা ইঁদুরের গন্ধ?”

মাথা নাড়েন রফিকুল ইসলাম। “নাহ, এটা ইঁদুরের গন্ধ না।” তার হাতে ততক্ষণে রিভলবার বেরিয়ে এসেছে।

দুই তালায় শুধু শোবার ঘর। তিনটা বড় সাইজের ঘর, আরেকটা পিচ্চি। বড় একটাতে কাপড়-চোপড় ঝুলছে। খাটে চাদর বিছানো, এলেমেলো। শেলফে স্তূপাকৃত বই। টি-টেবিলে চার কাপ রাখা। কয়েকটা পিঁপড়াকে দেখা যায় একটি মৃত তেলাপোকা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাপের তলানিতে চা’র অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে। ওখানে ভাসছে আরেকটা তেলাপোকা। অ্যাশট্রেতে প্রচুর সিগারেটের বাঁট।

একটা বাঁট তুলে নেন রফিকুল ইসলাম। গোল্ড লিফ।

ছোট রুমটার দিকে এগিয়ে যেতেই গন্ধ তীব্রতর হয়। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে উঁকি দেন রফিকুল ইসলাম। বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে। কোন নড়চড়া নাই। নিষ্প্রাণ, নির্জীব। গায়ে একরত্তি কাপড় নেই লোকটার। চোখ দুটো বিস্ফোরিত, তাকিয়ে আছে সিলিং পানে। কপালের মাঝখানে কয়েন আকৃতির ছোট্ট একটা গর্ত। নিচের সাদা বালিশে রক্ত জমাট বেঁধে কালসিটে হয়ে আছে। বালিশ থেকে রক্তের স্রোতধারা বিছানায় পড়েছে, বিছানা থেকে মেঝেয়।

মেঝেতেও রক্ত জমাট বেঁধে আছে।

লাশজুড়ে পোকাদের মোচ্ছব শুরু হয়েছে। বিছানা, মেঝে পোকায় থকথক করছে রীতিমত।

এই দৃশ্য দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারে না জহির। ধপ করে পড়ে যায় নিচে। পেছনে চিৎকার করে পালায় বাগু।

দেয়ালের বাংলা লেখাটা চোখে পড়ে রফিকুল ইসলামের।

যা গুপ্ত, তা গুপ্তই থাক।

*

রেস্টুরেন্টে কিশোর কুমারের গান বাজছে।

একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে
ফিরবে না সে তো আর কারো আকাশে

রফিকুল ইসলামের মনে হয় টাইম মেশিনে চড়ে হঠাৎ তিনি সত্তর কিংবা আশির দশকে ফিরে গেছেন। সেজন্যই কিশোর কুমারের গান বাজছে। নাহলে রেস্টুরেন্টে তো হিন্দি গান বাজার কথা, কিশোর কুমারের না।

মাথায় পানি-টানি দিয়ে ততক্ষণে অনেকটাই স্বাভাবিক জহির। জানা গেছে লাশটা লালন বৈরাগীর কাজের লোক হান্নান মিয়ার। লালন বৈরাগীর আসল নামও জানা গেছে। দুলাল হাসান। মোটেও আর্টিস্ট সুলভ নাম নয়। বুঝতে কষ্ট হয় না দুলাল হাসান কেন লালন বৈরাগী নাম বেছে নিয়েছেন।

দুলাল হাসানের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, এটাও কেউ বলতে পারলো না। দুলাল হাসানের বাবা-মা গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন হলো। তার এক বোন আছে, বিদেশে থাকে। বিয়ে করে সেই যে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে, আর আসেনি। আর বৌ আরেকটা বিয়ে করেছে। এখন ঢাকায় থাকে।

এই তথ্যগুলো পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে পাওয়া গেছে। অন্য কোন নিকট আত্মীয়ের কথা কেউ বলতে পারলো না।

পুলিশের হাতে আপাতত হাসান ভিলার ভার সঁপে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। এখন একটু চা দরকার। পেটে গরম চা না পড়লে মাথা আর খুলবে না।

চা হাজির হয়। জহির ঝিম মেরে আছে। খানিক আগেও কিশোর কুমারের গানে হালকা তাল ঠুকছিল, এখন চায়ের কাপের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে।

“চা খা, ভালো লাগবে।” জহিরের আনমনা ভাব একটু দূর হয়। সে হাত বাড়িয়ে গরম চা’র কাপটা ছোঁয়। বিড়বিড় করে কী জানি বলে সে।

“কিছু বললি?”

এবার স্পষ্ট হয় জহিরের গলা। “ঢাকায় কেউ একজন গুলি করে মানুষ খুন করে যাচ্ছে। লাশের পাশে পাওয়া যাচ্ছে রহস্যময় একটা বাণী ও এ্যাফিতি, আপাতদৃষ্টিতে যার কোন আগামাথা নাই-দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব। এদিকে এই খুনগুলো শুরু হওয়ার অনেক আগে চিটাগাং ভার্সিটিতে সেইম থিমে কেউ একজন এ্যাফিতি এঁকে গেছে। সবাই ধারণা করে সেই আর্টিস্ট ভার্সিটিরই এক টিচার লালন বৈরাগী। এদিকে লালন বৈরাগী লাপাত্তা, তার চাকরের কপাল ফুটা করে দিছে কেউ একজন…ডিড আই মিস এনিথিং?”

দু’পাশে মাথা নাড়ান রফিকুল ইসলাম। জহির কিছু মিস করেনি। তিনি আরো একটা জিনিস যোগ করে দেন। দূরের টিভিতে চলা ব্রেকিং নিউজ দেখান।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী নৃশংসভাবে খুন। খুনি কসাই কাসেম পলাতক।

“এইগুলা হচ্ছে কী রফিক?”

আবারো দু’পাশে মাথা নাড়েন তিনি, সেইসাথে ছাড়েন দীর্ঘশ্বাস। “আই হ্যাভ নো ফাকিং আইডিয়া।”

*

অধ্যায় ১৮

মোহাম্মদপুর থানার ওসি (তদন্ত) খন্দকার দেলওয়ার হোসেন যখন ঘটনাস্থলে আসেন ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী মারা গেছেন, খবরটা চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক দঙ্গল লোক এসে বিগ ম্যাক ভিলায় হামলা চালায়। সবার মনে বদ্ধমূল ধারণা ডক্টর হয়তোবা তার বাড়িতে “মহামূল্যবান সম্পদ রেখে গেছেন। অমরত্বের বড়ি বা ট্যাবলেট কিংবা সঞ্জীবনী সুধা টাইপ কিছু।

তারা ফ্রিজ হাতড়ায়। ফ্রিজে রাখা তরল ঢকঢক করে গিলে। পানি শেষ করে, কোল্ড ড্রিংকস শেষ করে, ফলের জুসও শেষ করে। মহামূল্যবান সম্পদের খোঁজে মরিয়া হয়ে স্টাডিটাও তছনছ করে দেয়। শেলফের প্রতিটা বই মেঝেতে ফেলে রাখা, টেবিলে রাখা ফাইলপত্র ঘরময় ছড়ানো। আলমারি হাট করে খোলা, ভেতরের সব জিনিসপত্র বের করা। ওয়াড্রোব একদম খালি, কাপড়চোপড় সব মেঝেতে স্তূপ করে রাখা। সোফাসেটের কুশন ফালি ফালি করে কাটা, বেড কাভারের তুলা বের করে ফেলা হয়েছে।

অত্যুৎসাহী কয়েকজন তো কোদাল হাতে লনে নেমে পড়ে। ফুটখানেক গর্তও খুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। পরে পুলিশ এসে ওদের থামায়। নাহলে বাড়ির প্রতিটা ইট ওরা খুলে দেখতো।

খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ইচ্ছা হয় চাবকে সব কয়টার চামড়া তুলে ফেলতে। শালা, ইতরের দল। তিনি তার হাবিলদারদের নিয়ে যতটুকু পারেন গোছগাছ করার চেষ্টা করেন। লনের মাটি সমান করেন। কুশনগুলো ঠিকঠাক করেন, তুলাগুলো সরান। শেলফের বইগুলো সযত্নে তুলে রাখেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাগজ যতটুকু সম্ভব দেখে দেখে ফাইলস্থ করেন। আরেফিন চৌধুরীর লেকচার, নোটস, বইয়ের জন্য খসড়া। ব্যাংক স্টেটম্যান্টের কপি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন।

প্রেসক্রিপশন দেখতে গিয়েই ব্যাপারটা নজরে পড়ে তার। অনেক পুরনো একটা প্রেসক্রিপশন, রীতিমত হলদেটে হয়ে গেছে। সাথে একটা টেস্ট রিপোর্ট লাগানো। ইনফার্টালিটি টেস্ট। বন্ধ্যাত্ব পরীক্ষা। টেস্ট রেজাল্টঃ পজিটিভ। রোগীর জায়গায় নাম লেখাঃ শামসাদ চৌধুরী।

মানে শামসাদ চৌধুরী বন্ধ্যা ছিলেন। তার টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ আসছে। কিন্তু দেলোয়ার হোসেন ঠিক ধারণা করে উঠতে পারেন না শামসাদ চৌধুরী কে। ডক্টরের পরিবার সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ তিনি। কাজেই শামসাদ চৌধুরী প্রফেসরের বৌ ছিলেন না অন্য কেউ তা আর বুঝতে পারেন না তিনি।

প্রেসক্রিপশনসহ রিপোর্টটা জায়গামত রেখে দেন তিনি। তার কাজ ছিল বিগ ম্যাক ভিলায় শৃঙ্খলা আনা। তিনি শৃঙ্খলে ফিরিয়ে এনেছেন। কেস ডিসমিস।

*

হিরো হোন্ডা একটা গলিতে ঢুকে। ওখানে একটা সাদা কোলা রাখা। করোলা থেকে ড্রাইভার বেরিয়ে আসে। মোটর বাইক চালককে করোলা বুঝিয়ে দেয় ও, আর নিজে বুঝে নেয় হিরো হোন্ডা। তারপর বাইক একদিকে যায়, করোলা আরেকদিকে।

ঘন্টাখানেক ঢাকা শহরের জ্যাম মাড়িয়ে করোলা পৌঁছয় দোতলা একটা দালানের নিচে। লোকটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। ছাদে ডেক চেয়ার পাতা। একজন আধশোয়া হয়ে চেয়ারে বসা। তার পরনে সাদা সিল্কের গাউন, মাথায় হ্যাট। হ্যাট চোখ অবধি নামানো। টেবিলে আধ খাওয়া চুরুট, ছুঁচালো গ্লাসে অরেঞ্জ স্কোয়াশ। একটা পেপারব্যাক উল্টে রাখা। জন লে ক্যারের দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোন্ড। বাটিতে কাজু বাদাম। পিরিচে সাগর কলা, ডায়াবেটিক বিস্কুট। ডেক চেয়ারের পাশ ঘেঁষে নীল রংয়ের সুইমিং পুল। পানি দেখে মনে হয় যেন দু’হাত খুলে কেউ আহবান জানাচ্ছে-আসো, আসো! অবগাহন করো!

মোটরবাইক চালকের খুব ইচ্ছা হয়, একবার ডুব দিয়ে আসতে। অবগাহন করতে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করতেই হয়। যেখানে সেখানে ডুব দেয়ার ইচ্ছা মোটেই স্বাস্থ্যকর না।

“নিয়ে এসেছি স্যার,” লোকটা মৃদু গলায় নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। পকেট থেকে সুদৃশ্য প্যাকেজটাও বের করে দেখায়।

মটকা মেরে যেন তন্দ্রা ছুটে চেয়ারে বসে থাকা লোকটার। টান মেরে প্যাকেজটা নিয়ে নেয়। উপরের আবরণ খুলতেই বেরিয়ে পড়ে একটা লম্বাকৃতির শিশি।

“এটাই কী তবে শ্যান…” কথা আর শেষ করে না সে, বিস্ফোরিত চোখে শিশির দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু যেন ধন্দে পড়ে যায় সে। কিন্তু সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যেতে সময় লাগে না খুব একটা।

ছিপি খুলে ঢকঢক করে তরল পদার্থ এক চুমুকে গিলে ফেলে লোকটা। খেয়েই মুখ বিকৃত করে ফেলে।

“কী বিটকেল গন্ধ!”

শিশিতে সাদা লেবেল আঁটকানো। লেবেলে একটা নাম লেখা। ছোট ছোট অক্ষরের দরুন নামটা বুঝা দুষ্কর। ডেক চেয়ারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে খয়েরি রংয়ের শার্ট পরা এক যুবক। তাকে লেখাটা পড়তে সাহায্য করে যুবক :

“ইউরিন!”

পাথরের মত জমে যায় চেয়ারে বসে থাকা লোকটা। তড়াক করে লাফ দিয়ে ছুটে সে বাথরুম পানে। সুইমিং পুলের কিনারায় কয়েকটা বাথরুম আছে। তারই একটাতে সেঁধোয় লোকটা। আর বেরিয়ে আসে মিনিট বিশেক পর।

“এটা কী নিয়ে আসছো?” নিজের মাতৃভাষায় সবটুকু ক্ষোভ উগরে দেয় সে। বেঁটেখাটো, পেটানো শরীর লোকটার। বয়স অনেক হয়ে গেলেও চেহারা দেখে বুঝবার কোন উপায় নেই।

হিরো হোন্ডা চালিয়ে আসা লোকটা ভয়ানক বিস্মিত। বিস্মিত ডেক চেয়ারের পাশে দাঁড়ানো যুবকও। স্যার বাথরুমে সেঁদেনোর পর তারা দুজন মিলে শিশির আগপাশতলা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেছে। লেবেলও বারবার পড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বারবার পড়ার ফলে লেবেলের লেখাটার পরিবর্তন হয়নি, যা ছিল তাই আছে।

ইউরিন!

প্রস্রাব!

কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?

বয়স্ক লোকটা তখন পায়চারি করছে। হিসাব মেলাতে পারছে না।

হিসাব মিলছে না হিরো হোন্ডা চালকেরও। ডক্টরের বাসার কাজের ছেলে আকবর কনফার্ম খবর দিয়েছিল। সে বলেছিল, ডক্টরের কাছে একটা ছোট্ট বক্স আছে। হাতের তালুতে সহজে এঁটে যাবে এরকম সাইজ। প্যাকেটটার খুব যত্ন-আত্তি করে ডক্টর, বার বার বের করে দেখে। ঝেড়েপুঁছে রাখে। উৎসুক আকবর একবার বক্সটা খুলে দেখেছিল।

সে দেখে ওখানে দুইটা চোখের পাতা রাখা।

মানুষের চোখের পাতা!

আতঙ্কিত হয়ে বক্সটা আবার বন্ধ করে দেয় আকবর।

ও-ই আজ সকালে খবর দেয় বক্সটা নিয়ে বাইরে বেরিয়েছেন ডক্টর। ডক্টর হসপিটালে যান। ফেরার পথে কসাই কাসেমের দা’র কোপ খেয়ে পটল তুলেন। তাহলে বক্সটা গেল কই? আমেরিকান স্পাই ওই চাকমা লোকটার পকেটেই কী রয়ে গেল বক্সটা? সে কী তবে ভুল জিনিস নিয়ে এসেছে? নাকি ভুলটা চাকমা করেছে? ডক্টরের পকেট হাতড়ানোর সময় ভুলবশত ওই বক্সটাই রেখে এসেছে? কিন্তু এত কাঁচা কাজ কী করার কথা চাকমার?

নাকি হসপিটালেই কাউকে বক্সটা গছিয়ে দিয়েছেন ডক্টর? হোয়াট দ্য…

ততক্ষণে পুলের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে বয়স্ক লোকটা, ডেক চেয়ারে সিল্কের গাউন ফেলে রাখা। ছাদের মৃদু নীলাভ আলোয় তার নগ্ন দেহ পানির নিচে এলেমেলো এক বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। একবার ল্যাপ দিয়ে এসে খয়েরি শার্টের দিকে তাকায় সে :

“কল দেম। আমরা আজ ধ্যানে বসবো। জল-ধ্যান। ওয়াটার মেডিটেশন।”

যুবকটি চলে যায়। বাইক চালক দাঁড়িয়ে থাকে। বয়স্ক লোকটি একবার ডুব দিয়ে ভেসে উঠে।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।

খয়েরি শার্টের পিছু পিছু জনা বিশেক লোক এসে হাজির হয়েছে। যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। নানা রংয়ের, নানা বর্ণের। তাদের মাঝে আপাতদৃষ্টিতে কোন মিল নেই। তবে ভালোভাবে দেখলে একটা মিল চোখে পড়ে।

হ্যাঁ, চোখেই পড়ে।

মিলটা হলো ওদের কারোরই চোখের পাতা নেই। ওরা চাইলেও কেউ চোখ বুজতে পারে না।

সবার পরনেই গাউন। একে একে গাউন ছাড়ে সবাই। তারপর সিঁড়ি বেয়ে পুলে নামে। বয়স্ক লোকটার পাশে গিয়ে জমায়েত হয়।

বয়স্ক লোকটা পাতাহীন চোখে তার দিকে তাকায়। মনে মনে শিউরে উঠলেও অনুভূতি চেপে রাখে মোটর বাইক আরোহী। সে এই দৃষ্টির অর্থ জানে। এর মানে, হয় যোগ দাও, না হয় নিষ্ক্রান্ত হও।

বাইক চালক বেরিয়ে যায়। সে জানে পরদিন ভোরবেলায় একটা কল পাবে সে। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বলা হবে তখন তাকে।

সুইমিং পুলে কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে জনা বিশেক মানুষ। তারা তাকিয়ে আছে, আবার তাকিয়ে নেইও।

*

অধ্যায় ১৯

রিতার বাড়ি মধ্য বাড়ায়। চায়না মার্কেটের পেছনের গলি দিয়ে আনুমানিক ২০০ মিটার যাওয়ার পর ডানদিকে এক চিপা গলি পড়ে। দুইটা রিকশা পাশাপাশি চলতে পারে এইরকম বড়। ওই গলি দিয়ে খানিকক্ষণ হাঁটার পর বাম দিকে আরেকটা গলির দেখা মিলে। এটা আরো চিপা। কোনক্রমে একজন মানুষ আঁটে। ওই গলি দিয়ে গজ বিশেক হাঁটলে খানিকটা খোলা জায়গা। ওখানে পরপর কয়েকটা টিনশেডের বাড়ি। কোণার দিকের ঘরটাই রিতার।

বাড়িতে দুইটা মাত্র ঘর। বেডরুম আর কিচেন। আর বেডরুমের সাথে লাগোয়া ছোট্ট এক টাট্টিখানা। একদা একসময় টাট্টিখানা বাইরে ছিল। টিনশেডের সব বাসিন্দা মিলে ওই টাট্টিখানা ব্যবহার করতো। তখন টিনশেড আরো বেশি ছিল। ধীরে ধীরে টিনশেডের জায়গা দখল করে নিয়েছে উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর টাট্টিখানার জায়গা টাইলস বসানো টয়লেট।

তবে কয়েকটা টিনশেড এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। তার মধ্যে একটি রিতার। রিতার বাড়ি ঘিরে গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। ডাবল আর ও তার চেলাচামুন্ডারা পজিশন নিয়ে নেয়। জাহাঙ্গীর ইতিমধ্যে কসাই কাসেমের সাথে একবার কথা বলে নিয়েছে। কাসেম সচরাচর যে সিম ব্যবহার করে সেটা আজ বন্ধ। ওর আরো কয়েকটা ব্যাকআপ সিম আছে। ওগুলোর একটাতেই পেয়ে যায় জাহাঙ্গীর।

রিতার ওখানেই আছে ও। আজ রাতটা ওখানেই থাকার চিন্তা। কাল ভোরের দিকে ঢাকা ছাড়বে। কিন্তু কোথায় যাবে এটা এখনো ঠিক করেনি কাসেম। কয়েকবার “কুত্তার বাচ্চা গিল্টি মিয়া” বলে কাকে জানি গালি দিলো। জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করাতে বললো গিল্টি মিয়ার কাছে এক লাখ টাকা পায় ও। বলেছিল দিবে। কিন্তু এখন কোনভাবেই ওর নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।

জাহাঙ্গীর তখন টোপ ফেলে। সিলেটে ওর পরিচিত একজন থাকে। জাফলংয়ের পাথর ব্যবসায়ী। উনার মাধ্যমে ডাউঁকি বর্ডার ক্রস করা কোন ব্যাপারই না। আর বর্ডার ক্রস করে একবার ইন্ডিয়া গেলে আর পায় কে!

টোপ গিলতে সময় নেয় না কসাই কাসেম। তারপর ‘মেঘ না চাইতেই জল। রিতার বাসায় জাহাঙ্গীরকে আসার জন্য বলে দেয় কাসেম। তড়িঘড়ি করে প্ল্যান সাজিয়ে নেয় ডাবল আর।

জাহাঙ্গীর রিতার বাসায় যাবে। তারপর প্রাইভেটে কথা বলার ছুতোয় কাসেমকে বাসার বাইরে নিয়ে আসবে। ডাবল আররা বাইরে ওঁৎ পেতে থাকবে। কাসেম বাইরে আসার পরই ওকে কপ করে ধরে ফেলা হবে।

ডান হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে জাহাঙ্গীরকে ইঙ্গিত করলো রশিদ।

জাহাঙ্গীর জানে এর মানে কাঁচকলা না। এর মানে হলো, সব ঠিক আছে। এখন গিয়া দরজায় টোকা দাও।

জাহাঙ্গীর দরজায় টোকা দেয়। একটা পদশব্দ শোনা যায়। দরজার ওপাশে এসে কেউ একজন দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীর বুঝতে পারে দরজায় ফুটো আছে। সেই ফুটোয় চোখ রেখে কেউ একজন তাকে নিরীক্ষণ করছে। খানিক পর দরজা খুলে দেয় রিতা।

“ভাবি মালিকুম!” রিতাকে ভাবি বলেই ডাকে জাহাঙ্গীর।

ডাকটা ভারি অপছন্দ রিতার। রিতা চায় সবাই তাকে পু বলে ডাকুক। কাভি খুশি কাভি গামে কারিনা কাপুরকে সবাই পু বলে ডাকে। ফিল্মটা অত ভালো লাগেনি রিতার। কিন্তু কারিনাকে ওর খুব পছন্দ। শুধু কারিনার জন্যই ফিল্মটা বারো বারের মত দেখেছে ও। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো কেউ ওকে পু বলে ডাকে না। কাসেম তো কখনোই না। সে উল্টা রসিকতা করে-”পু মানে কী? পুটকি?”

কোন মানে হয়। যত্তসব আনকালচারড পুরুষ।

মুখ দিয়ে কৃত্রিম একটা হাসির ভঙ্গি করে সরে যায় রিতা।

“আয় জাঙ্গি, আয়।” ফিরে তাকাতেই জাহাঙ্গীর দেখে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে কাসেম, হাতে গ্লাস। গ্লাসের রঙ্গিন তরল দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। মদ।

সাদা একটা ট্যাবলেট বের করে রঙ্গিন তরলে গুলে ফেলে কাসেম। বার কয়েক ঝাঁকানি দেয়। তারপর এক ঢেকে পেটে চালান করে।

খোশমেজাজে আছে কাসেম। রঙ্গ রসিকতা করে কীভাবে কোপ মেরেছে তা বারবার হাত দিয়ে দেখায়।

“এইরাম কুপ দিলাম, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!”

জাহাঙ্গীর বুঝতে পারে কাসেমকে বাগে আনা খুব কঠিন কিছু হবে না। টুকটাক আলাপ হয়। রিতা গাজরের পায়েস খেতে দেয়। ঠান্ডা পায়েস। ফ্রিজে রাখা ছিল। দুই চামচ মুখে দিয়ে রেখে দেয় জাহাঙ্গীর। কাসেম একবার উঠে প্রস্রাব করতে যায়। তরল যা গিলেছিল সব উগরে দেয় কমোডে। বেডরুমে বসেই কাসেমের প্রস্রাবের শব্দ শুনতে পায় জাহাঙ্গীর।

ফুসসসসসসস্।

টয়লেট থেকে বেরিয়ে কাসেম আবারো ফর্মে ফিরে যায়, কোপ মারা দেখায়।

“এইরাম কুপ দিলাম, বুঝলি রে জাঙ্গি, আর ব্রেইন বাইর অইয়া গেল!” হেসে খুন হয় কাসেম।

জাহাঙ্গীর বুঝতে পারে এখনই সময়। প্রাইভেট কথা এখনই সেরে নিতে হবে।

প্রাইভেট কথার কথা বলতেই রাজি হয়ে যায় কাসেম। বাইরে বেরিয়ে আসে তারা।

বাইরে তখন আঁধার। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। টিনশেডের পেছনের দিকে ঝোঁপ আর গাছপালা। ওরা সেদিকেই এগোয়। জাহাঙ্গীর জানে ঝোঁপের আড়ালে ডাবল আরদের কেউ না কেউ থাকবেই।

থাকেও।

ওরা ঝোঁপের কাছাকাছি পৌঁছাতেই অন্ধকার থেকে চারটি ছায়া বেরিয়ে আসে। চারজন চারদিক থেকে ঘিরে ধরে কাসেমকে। কাসেম কিছু বুঝতেও পারে না। সে তখনো কান পেতে রাখে জাহাঙ্গীরের কথা শোনার জন্য।

কিন্তু জাহাঙ্গীরের কথা আর শোনা হয় না ওর। ঘাড়ের একটা বিশেষ জায়গায় কারাতে কোপ। সাথে সাথে হুঁশ হারায় ও। বেহুশ কাসেমকে মাটিতেও পড়তে দেয় না চারজন। পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে যায়।

ঝোঁপ ছাড়িয়ে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার একপাশ সদ্য কাটা হয়েছে। ওটা সরাতেই খানিকটা ঢালু জায়গা। তারপর পিচঢালা রাস্তা। রাস্তার ওপর একটা মাইক্রোবাসকে অপেক্ষমাণ দেখা যায়। পেছনের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে আরেকটা গাড়ি। গাড়িটাকে প্রথম প্রথম খেয়াল করে না জাহাঙ্গীর।

কাসেমকে মাইক্রোবাসে তোলা হয়। বাকিরাও একে একে উঠে পড়লে মাইক্রোবাস ছেড়ে দেয়।

এর খানিক পরই মৃদু গর্জন তুলে জেগে উঠে ঘুমন্ত অজগর। হেডলাইটের আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠে। বিস্মিত জাহাঙ্গীর দেখে পেছনের প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা হালকা নামানো।

ওই ফাঁকটুকুতে সানগ্লাস পরা একটা মুখ। সোজা তার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা।

*

অধ্যায় ২০

আকবর আছে মহামুসিবতে।

মুঘল সাম্রাজ্যের তিন নাম্বার শাসক জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের নামে ওর নিজের নাম হলেও সে সামান্য এক কাজের ছেলে। মাস পুরলে বেতন পায় মোটে পাঁচ হাজার টাকা। এর মধ্যে তিন হাজার টাকা সে পাঠিয়ে দেয় ওর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। সবসময় না, মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে এই জন্য বললাম যে, জুতার আঠা শুকায় আকবর এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে যায় যে দিন-দুনিয়ার কথা বেমালুম ভুলে বসে। রাত যায়, দিন যায় জুতার আঠা কে শুঁকে। জুতার আঠার চেয়ে মহার্ঘ্য বস্তু আর কিছু নাই ওর কাছে। পলিথিনের প্যাকেটে জুতার আঠা ঢুকিয়ে খোলা অংশ মুখে লাগিয়ে নিঃশ্বাস টানে এই মনোযোগী সেবক। নিঃশ্বাসের মাধ্যমে সেবন করে সলুশন। সলুশন সেবন করে জীবনের কঠিন হিসাবের সলিউশন বের করে আকবর।

গ্রামের বাড়িতে ওর মা, বোন আর এক ছোট ভাই থাকে। বাপ নাই। বাপ আরেকটা বিয়ে করে ঢাকাতেই আছে শুনেছে ওরা। মা-বোন দুজনেই বাসা বাড়িতে কাজ করে। ছোট ভাইটা বেশ ছোট, স্কুলে যায় সবে। আর আছে বৃদ্ধ দাদা-দাদী। আকবরের পরিবার-পরিজন বলতে এই-ই।

আকবর এমনিতে ছেলে ভালো। লোভটা শুধু একটু বেশি। ড্যান্ডির লোভ। ড্যান্ডিতে টান দিলেই যে স্বর্গসুখ! সাদাকালো জীবনে রং ফিরতে শুরু করে দ্রুত। ঝিম ধরা মাথায় অদ্ভুত দৃশ্যকল্প খেলা করে। ও দেখে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে ওর বাবা-মা প্রোদবিহারে বেরিয়েছেন। বাবার হাতে ঘোড়ার রাশ। মার কোলে ওরা দুই ভাই। বোনও বসে আছে একপাশে। বাজনা বাজছে কোথাও, সবার মুখ হাসি হাসি।

ছোটবেলা থেকে অভাবের মধ্যে বড় হয়েছে। আর অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে তার। বাপের সাথে যখন ঢাকায় আসে তখন ও খুব ছোট। কত হবে আর বয়স? ছয় কিংবা সাত। এক মেকানিকের দোকানে কাজ জুটে ওর। মেকানিক বজ্জাত ছিল, চুন থেকে পান খসলেই মার পড়তো। ঢিসুম ঢিসুম। তখন আকবর বাপের সাথে মগবাজার বস্তিতে থাকতো। বাপও ছিল খচ্চর। লাইন মারতো বস্তির উঠতি বয়সী মেয়ে জরিনার সাথে। নিজের রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে দিনভর ঘুরাতো। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে, মিটিমিটি হাসতো।

কয়েকবার দেখে ফেলেছিল আকবর। বাসায় ফিরে সে কী মার! এভাবে মার খেয়ে খেয়ে একদিন ত্যক্তবিরক্ত আকবর বাসা ছাড়ে। জায়গা করে নেয় কমলাপুর স্টেশনে। মানুষের ব্যাগ-লাগেজ বইতো। টুকটাক চুরি চামারি করতো। অন্যমনস্ক মহিলার হাত থেকে দামি মোবাইল ফোন নিয়ে দে ছুট। কিংবা ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত কারো ব্যাগ নিয়ে ভোঁ দৌড়।

একবার ধরা পড়ে শক্ত মার জুটে কপালে। কনুইয়ের হাড় ভেঙে যায়, হাঁটুতেও ব্যথা পেয়েছিল খুব। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছিল। তখনই মাজেদা খালার উদয়। ওর হাতে ড্যান্ডি ধরিয়ে দেন তিনি।

“নে পোলা। ড্যান্ডি খা। মাইয়াগো মতো ফাঁচ ফাঁচ করিস না। কেউ তোর কান্দন মুছায়া দিতে আইবো না।”

আকবর চেয়ে দেখে সাদা পলিথিন ব্যাগ হাতে ধুমসো এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ফুটবল আকৃতির মুখ। চুল ক্রপ করে কাটা। ঠোঁটের ওপর পাতলা ফিনফিনে গোঁফ। পরনে ঘিয়া রংয়ের ম্যাক্সি। বুকের ওপর থোক করে রাখা ওড়না তার তরমুজ আকৃতির স্তনদ্বয়কে ঠিক আড়াল করতে পারছে না। ওড়নার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে না ওগুলো, ওড়নাই বরং আড়ালে পড়ে গেছে।

হাত বাড়িয়ে পলিথিন নেয় আকবর। মাজেদা খালা দেখিয়ে দেয় ড্যান্ডি সেবন প্রক্রিয়া। সেবন শুরু করে আকবর। তারপর থেকে সেবনকার্য অব্যাহত আছে।

মাঝখানে ছেড় পড়েছিল। মেহবুব মামা ওকে রেলস্টেশন থেকে ঘরে এনে আশ্রয় দেন। ভালো খাবার-টাবার খেতে পায় আকবর, ভালো কাপড়চোপড় পরে। মাথার ওপর ভরসার ছাদ মিলে। মেহবুব মামা মানুষ খুব ভালো। ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। রাগ-গোস্বা একদমই নেই। তার সাথে পরিচয়ও একদম হঠাৎ করেই। অনেকটা ফিল্মি কায়দায়।

তখন কমলাপুর রেলস্টেশনকেই নিজের অস্থায়ী ঘর বানিয়ে ফেলেছে আকবর। ওখানেই থাকে। খায়, দায় আর ড্যান্ডি সেবন করে সারাদিন ঝিমায়। ড্যান্ডির পিনিকে যাবতীয় ব্যথা-বেদনা ভুলে যায় আকবর। মা’র কথা ভুলে যায় ও, ভুলে যায় রিকশাচালক বাবার কথা। পৃথিবী তখন শুধুই ড্যান্ডিময়। মাঝে মাঝে আকাশে উদয় হয় পঙ্খীরাজ ঘোড়া। ও ঘোড়ার নাম দিয়েছে টমি। ইংরেজি নাম না দিলে ঠিক ভাব আসে না। একবার ট্রেনের এসি কামরায় পিচ্চি এক ছেলেকে দেখেছিল আকবর। কোলে করে সাদা লোমওয়ালা এক কুকুর নিয়ে যাচ্ছে। কুকুরটাকে টমি বলে ডাকছিল পিচ্চি।

“টমি, কাম হিয়ার।” “টমি ইট দেট কুকি।”

সবকথা ভালোমতো বুঝতেও পারেনি আকবর। তবে ‘টমি কাম হিয়ার টা মাথায় রয়ে গেছে এখনো। ড্যান্ডি সেবন করে সে যখন পিনিকের চূড়ায় উঠে পড়ে তখন বেশ ভাব নিয়ে পোষা ঘোড়াটিকে ডাকে আকবর।

“টমি, কাম হিয়ার।”

লেজ দুলিয়ে সাদা পঙ্খীরাজ আসে। আবার লেজ দুলিয়ে চলেও যায়।

মাজেদা খালার হয়ে টুকটাক কাজ শুরু করে আকবর। মাজেদা খালা রেলওয়ে বস্তির মক্ষিরাণী। সবাই শ্রদ্ধাভরে তাকে খালা বলে ডাকে। ছেলেবুড়ো সবাই। এমনকি ওর তালপাতার সেপাই শুঁটকি স্বামীও ওকে খালা বলেই ডাকে। মাজেদা খালার ব্যবসা অনেক পুরনো। রীতিমত মানবজাতির অভ্যুদয়ের পর থেকেই এই ব্যবসার গোড়াপত্তন-আর সেটা হচ্ছে দেহ ব্যবসা। মাজেদা খালা বেশ্যার দালাল। বস্তির বেশিরভাগ মেয়ে ওর হয়ে ভাড়া খাটে। দেহ-ব্যবসার অর্থ ৮০-২০ প্রিন্সিপালে ভাগ হয়। ৮০ ভাগ মাজেদা খালার, ২০ ভাগ মেয়ের। আর মেয়ে এই লাইনে নতুন হলে প্রিন্সিপালটা আরেকটু কড়া। সেক্ষেত্রে ওটা পরিণত হয় ৯০-১০ প্রিন্সিপালে। ৯০ ভাগ মাজেদা খালার, ১০ ভাগ মেয়ের। মেয়ের থাকা খাওয়া সম্পূর্ণ ফ্রি। ঈদের সময় নতুন জামাকাপড়ের সাথে বোনাসও মিলে।

দেহব্যবসার হাত ধরেই ড্রাগসের ধান্দার গোড়াপত্তন। প্রথম প্রথম বস্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিল এ ব্যবসা। এখন পুরো কমলাপুর এলাকা মাজেদা খালার হাতের মুঠোয়। তিনি এ তল্লাটের মহান ড্রাগলেডি।

পুলিশ ওকে ঘাঁটায় না। বখরা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। তো এই মাজেদা খালার ব্যবসায় নেমে পড়ে আকবর। রাতারাতি সে পরিণত হয় খালার ড্রাগ ব্যবসার সাপ্লাই লাইনের এক যোদ্ধায়। হাতে হাতে গাঁজার স্টিক, ইয়াবা ট্যাবলেট, ফেনসিডিল ও হেরোইন ফেরি করে বেড়ায়। টাকা-পয়সা খারাপ পেত না ও। মাজেদা খালাকে বিক্রির টাকা বুঝিয়ে দেয়ার পর ওর টাকাও নগদ পরিশোধ করে দিতেন খালা। খালার কাছে বাকি বলে কিছু নাই। বাকির নাম ফাঁকি।

আর দিনে দিনে আয়-ব্যয়ের হিসাব বুঝিয়ে দেয়াটা আকবরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাজেদা খালা ঘরের বৈঠকখানাকে অফিস ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। সমস্ত হিসাব নিকাশ ওখানেই হতো। রাতে যখন আকবর হিসাব বুঝিয়ে দিতে যেত, তখন মাজেদা খালার কাপড়চোপড়ের ঠিক থাকতো না।

দেখা যেত পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছেন, ওড়নার ঠিকঠিকানা নেই। ম্যাক্সির বোতাম খোলা। ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে বিশাল স্তনের অংশবিশেষ। একবার তো সোফা থেকে উঠতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে তার কালো স্তনবৃন্ত বেরিয়ে পড়লো। আকবরেরও তখন প্রায় ভারসাম্য হারানোর অবস্থা।

খালার মুখ আবার সাংঘাতিক খারাপ। ছেলেটা যে তার নাদুসনুদুস পৃথুলা শরীরের প্রতি ভয়ানক দুর্বল, তা তিনি ভালো মতোই বুঝতে পারেন। এই আগ্রহ তার ভালো লাগে। তাই টিজ করতে ছাড়েন না তিনি।

“কীরে খাড়া হইয়া গেছেনি?” বেসামাল আকবরকে শুধান তিনি। রঙ্গ করে বুক দুলান।

আকবর জবাব দিতে পারে না। সে তখন আসলেই ভারসাম্যহীন, যাবতীয় হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে। খালা প্রায়ই ওকে ন্যায্য টাকার চেয়ে কম দেন, আকবর বুঝতেও পারে না। সে তখন দুই স্তনের খাঁজে হাবুডুবু খাচ্ছে। ঘরে ফিরে পলিথিনের ভেতর মুখ ঢুকালে তখন আর পঙ্খীরাজ ঘোড়া দেখতো না আকবর। দেখতো মাজেদা খালাকে। বিশাল বুক দুলিয়ে বিশ্রিভাবে হাসছেন। তার ম্যাক্সি ফেটে টাকা বের হচ্ছে। রাশি রাশি টাকা।

কিন্তু টুকটাক চুরি চামারির অভ্যাস তখনো যায়নি তার। এরকমই এক দিনে ওর পরিচয় মেহবুব মামার সাথে। মামা ঢাকায় ফিরছিলেন। রাত তখন দশটা হবে। শীতের মৌসুম। গলাবন্ধ সোয়েটারের ওপর কোট পরনে তার, মাথায় সাদা কানটুপি। হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ ছিল। বাদামী রংয়ের। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ উবু হয়ে বসে জুতার ফিতা ঠিক করতে লেগে যান তিনি। ব্যাগটা রেখে দেন পাশে।

আকবর দেখে এই-ই সুযোগ। লোকটা অন্যমনস্ক। ব্যাগটা আস্তে করে সরিয়ে দিলে বুঝতেও পারবে না। তারপর টুপ করে মিশে যাবে ভিড়ের মাঝে। তখন আর কে খুঁজে পাবে ওকে?

কিন্তু ওর হিসাবে ভুল ছিল। ব্যাগ বগলদাবা করে তার দৌড় শুরু করা উচিত ছিল জনস্রোতের দিকে মুখ করে। কিন্তু সে দৌড় শুরু করে উল্টাদিকে। ব্যাগসুদ্ধ গিয়ে সে ধাক্কা খায় এক তাগড়া জোয়ানের পেটে। জোয়ানও বুঝে গিয়েছে ঘটনা কী।

তারপর শুরু হয় উত্তমমধ্যম।

আকবর তখন দাঁতমুখ খিচে বসে আছে। সে বুঝে গেছে এবার আর নিস্তার নাই। হাড়ি কয়টা ভাঙে আল্লা মালুম।

কিন্তু হঠাৎই উত্তমমধ্যমের বেগ কমতে শুরু করে। তারপর একসময় থেমেই যায়। চোখ পিটপিট করে আকবর দেখে সাদা কান টুপিওয়ালা লোকটা মানুষজনদের থামতে বলছে। তারপর লোকটা ওকে হাত ধরে উঠায়। ঝেড়ে গায়ের ধূলাবালি সাফ করে।

স্টেশনের পাশে চার দোকান আছে। ওখানে নিয়ে চা-রুটি খাওয়ায়। আকবরের হঠাৎ খেয়াল হয় মারের চোটে ওর কড়ে আঙুলটা প্রায় থেঁতলে গেছে। লোকটাও লক্ষ্য করে। খাওয়া শেষে পাশের হসপিটালে যায় ওরা। ক্ষতস্থান পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয় ডাক্তার।

আকবরের বিশ্বাস হতে চায় না। এই লোকটা কী তবে বাংলা সিনেমার নায়ক জসিম? মহানুভবতায় পর্বত সমান?

“তোর চলে কেমনে?” লোকটার গলা ভেসে আসে।

আকবর সত্য কথাটাই বলে। পলিথিনে ঠোঁট ঢুকিয়ে পঙ্খীরাজ ঘোড়া দেখে। মাঝে মাঝে বিশালবক্ষা মাজেদা খালাও আসেন। এতেই চলে যায়। মাজেদা খালার কথা অবশ্য মুখ ফুটে বলে না আকবর।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে লোকটা যে প্রস্তাব দেয় তাতে আকবরের জীবনটাই পাল্টে যায়।

“আমার সাথে যাবি? ঘরের কাজ করবি টুকটাক।”

আকবরের হ্যাঁ বলতে বেশি সময় লাগে না। যদিও একটু দ্বিধা কাজ করছিল মনে।

লোকটার অন্য কোন মতলব নাই তো?

কমলাপুর এলাকায় বাচ্চাখোর বলে এক বুড়া আছে। ধনঞ্জয় নাম। ওরা ধনঞ্জয়কে শর্ট বানিয়ে ধন বলে ডাকে। ধন বুড়া। কিংবা বুড়া ধন।

ধনঞ্জয়ের নাকি ওদের বয়সী ছেলে খাওয়ার রেকর্ড আছে। রাজন বলছিল সেদিন। ওর এক পরিচিত ছেলে ছিল। স্টেশনে থাকতো এককালে। রিয়াজ নাম। ওকে ঘরের টুকটাক কাজ করার লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এই ধন বুড়া।

তারপর খেয়ে ছিবড়ে বানিয়ে দিয়েছে।

“আমার লগে লাগতে আইলে বিচি কাইট্যা দিমু স্টেরেট,” শিপু মতামত দেয়।

অন্যরাও মাথা নেড়ে সমর্থন জানায়। আকবর অদ্ভুত ওই লোকটার সাথে পথ চলতে চলতে আবারো কথাটায় সমর্থন জানায়।

স্ট্রেট বিচি কর্তন!

কিন্তু বিচি কর্তন করা লাগে না আকবরের। সাদা টুপি ওয়ালা বাচ্চাখোর না, নিপাট ভালো মানুষ। আকবর যে নেশাগ্রস্ত সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি তার। আকবরের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন তিনি। মাসখানেক ক্লিনিকে ছিল ও। ওখানে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়া হত। মাছ, মাংস, রুটি, ডিম, সবজি, মৌসুমী ফল। রুটিনমাফিক ওষুধ খাওয়া লাগতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা এক্সারসাইজ করা লাগতো।

ঘরে ফিরেও রুটিনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল আকবরের জীবন। সাদা টুপি ওয়ালাকে ততদিনে মামা ডাকা শুরু করেছে ও। মেহবুব মামা। মামা খুব বিদ্বান মানুষ এটা বুঝতে পারে আকবর। তার ঘরভর্তি খালি বই আর বই। পুরো ফ্ল্যাটে আটটা বিশাল শেলফ। প্রতিটি শেলফ বইয়ে ভরা। বগলে বই নিয়ে বাসা থেকে বের হন। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে ফিরেন ঢাউস আকারের বই নিয়ে। তারপর নাওয়া খাওয়া ভুলে বইয়ে ডুবে যান। তার পুরো জীবনটাই ছিল বইময়। আকবর বকলম বলে তাকে বিদ্যাশিক্ষা দিতেও লেগে যান তিনি।

অ তে অজগর আসছে তেড়ে, আ তে আমটি খাব পেড়ে।

ঘরদোরের কাজও শিখে গিয়েছিল আকবর। ঘরদোর ঝেড়েছে। পরিস্কার রাখতো, কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতো। ছাদে শাকসবজির বাগান ছিল। ওটার পরিচর্যা করতে ও হালকা রান্নাও শিখে নিয়েছিল রাঙ্গার মা’র কাছ থেকে। চা বানানো, ডিম ভাজি করা কিংবা ডাল রান্না। রাঙ্গার মা যখন গ্রামের বাড়ি যেত তখন সে আর মামা মিলে ছাদে বারবিকিউ পার্টি করতো। আগুনে ঝলসে মাংস খেত তারা। মামা গিটার বের করতেন। গলা ছেড়ে ইংরেজি গান ধরতেন যার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারতো না ও।

টমি তখন বেজায় খুশি থাকতো। তিড়িংবিড়িং করে লাফাতো। পঙ্খীরাজ ঘোড়া টমি না, মেহবুব মামার কুকুর টমি। পাড়ার মোস্তফা চাচা গিফট দিয়েছিলেন। আকবর ওর নাম দিয়েছিল টমি। মামা আর আপত্তি করেন নাই। টমি নামটাই টিকে যায়।

সুখেই দিন কাটছিল ওর। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা পেত যার বলতে গেলে কিছুই খরচ হতো না। মামাই ওকে বাড়িতে টাকা পাঠানোর পরামর্শ দেন। তখন ও নিয়মিত মা’কে টাকা পাঠাতো। একবার চাইনিজ একটা মোবাইল সেট কিনে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দিয়েছিল ও। মোবাইল পেয়ে মা সেকী খুশি!

তারপর বছরখানেক আগে মামা চায়না ট্রিপে যান। আর সবকিছু নিমেষে পাল্টে যায়। চিনে মাসদুয়েক ছিলেন মামা। তারপর বাংলাদেশে ফিরে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কী নিয়ে জানি ভাবতেন সারাদিন। চায়না থেকে বাক্সভর্তি করে অদ্ভুতদর্শন কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে ওগুলো খুলে দেখতেন।

সে সময়টায় একটা লোক উনার কাছে প্রায়ই আসতো। মোড়ের চা দোকানি। মান্নান মিয়া নাম। লোকটাকে কেন জানি মোটেও পছন্দ করতে পারে না আকবর। কেমন করে জানি চোরের মত তাকায়। কথা বলার সময় মুখে সবসময় একটা ষড়যন্ত্রী ভাব ঝুলিয়ে রাখে।

তবে ও শুনেছে লোকটা নাকি ভালো গল্প বলতে পারে। মুখে মুখে গল্প বানাতে রীতিমত সিদ্ধহস্ত। মামাই একদিন আফসোস করে বলছিলেন-”পেটে বিদ্যা থাকলে মান্নান মিয়া একদিন ভালো লেখক হতে পারতো।”

মামা ওই সময়টায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাসায় থাকতেনই না বলতে গেলে। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। বেশ স্বাস্থ্যবান চেহারা ছিল তার। কদিনের দৌড়াদৌড়িতে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। ওজন কমে যায়, চোখের নিচে পড়ে কালি। একদিন তো মাথা ঘুরেই পড়ে গেলেন। আকবর পাশে ছিল বলে রক্ষা। দৌড়ে গিয়ে ধরে ও। না হয় মাথায় সাংঘাতিক ব্যথা পেতেন।

ধরাধরি করে পাশের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ডাক্তার জানায় অত্যাধিক টেনশনই এই ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণ। টেনশন কমাতে হবে, স্ট্রেস কমাতে হবে। পরিমিত রেস্ট নিতে হবে। ঠিকমত খাবার খেতে হবে। তাহলেই শরীর সুস্থ থাকবে।

“মামা আপনের এতো কিয়ের টেংশন?” আকবর জিজ্ঞেস করে।

শুনে খুব এক চোট হাসেন মেহবুব মামা, জবাব দেন না।

“না, খালি হাসলে অইবো না। খুইল্ল্যা কন…কিয়ের লাইগ্যা এতো টেংশন করেন?” আকবর গোঁয়ারের মতো জিজ্ঞেস করে।

“শুনবি?” স্মিত হেসে পাল্টা প্রশ্ন করেন মামা।

“অবশ্যই শুনবো। কেন শুনবো না?”

মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে মোটে এক শব্দে কাজ সারেন তিনি। “চা।”

বেকুব বনে যায় আকবর। খানিকক্ষণ মুখে কথা জোগে না তার। তারপর প্রাণখুলে হাসে সে। “মামায় যে কী কয়!”

আকবর তো আর জানতো না যে চা নামক পানীয় দ্রব্যটি ঠিক হেসে উড়িয়ে দেবার মতো না। যে চা’র জন্য এককালে ব্রিটিশ আর চাইনিজদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল, সেটা আর যাই হোক হাস্যস্পদ না। আরো খানিকটা সম্মান তার প্রাপ্য। কিন্তু আকবরকে দোষ দিয়েও তো লাভ নেই।

সে প্রায় বকলম এক ছোকরা। মেহবুব মামা’র বদৌলতে সামান্য অক্ষরজ্ঞান শিখেছে। নাহলে তো তার দিনকাল কাটছিল পলিথিনে ঠোঁট ঢুকিয়ে ড্যান্ডি সেবনে আর মাজেদা খালার দেহের রহস্যময় ভাঁজে। চার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তাই আকবরের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকার কথা। আকবরের কাছে চা শ্রেফ পাঁচ টাকার একটি পানীয়, অতিরিক্ত চিনি আর কনডেন্সড মিল্কের সমাহারে বানানো। এর বেশি কিছু না। চা ভালো, কিন্তু চা তো আর ড্যান্ডি না। চা খেলে পঙ্খীরাজ ঘোড়া আসে না। চা খেলে মোহনীয় ভঙ্গিমায় হাজির হয় না মাজেদা খালাও। চা খেলে পিনিক জাগে না।

চা ফালতু। বাকোয়াজ।

চা’র জন্যই তার আজকের এই দুরবস্থা। মেহবুব মামা চায়না থেকে ফেরার পর বারবার বলতেন ওর পেছনে ফেউ লেগেছে। তাকে কেউ সবসময় ফলো করে। ওর ফোনে আড়ি পাতে।

শুনে হাসি আসতো আকবরের। মামার মাথায় কী ক্র্যাক দেখা দিল? কিন্তু কদিন পর ওর কাছেও যখন কিছু লোক ধরণা দেয়া শুরু করে তখন আকবর বুঝতে পারে মামার মাথা ঠিকই আছে। মাথা নষ্ট আসলে এই লোকগুলোর। ওরা চা নিয়ে এতো আগ্রহী কেন? মেহবুব মামা কী চা সওদাগর?

তার মন ভেজানোর জন্য ওই লোকগুলো তখন উপহারের ডালি মেলে ধরে। টাকা, দামি মোবাইল সেট, কাপড়-চোপড়, সেন্টের শিশি। বদলে কী চাই?

চাই তথ্য।

মেহবুব মামা চায়না থেকে কী নিয়ে এসেছেন? চা’র কোন জার? কোন ধরণের প্যাকেট? প্যাকেটের সাইজ কী রকম? উপরে কী কোন লেখা আছে? কিংবা ছবি?

লোভে পড়ে চা’র ডিব্বা ধরিয়ে দিয়েছিল একজনকে, দেখতে চাইনিজদের মতো ছিল লোকটা। বিনিময়ে ও পেয়েছিল পাঁচটা চকচকে হাজার টাকার নোট। আরেকজন বললো মামা সারাদিন কী করেন, না করেন সবকিছু রিপোর্ট করতে। শুধু তাই না, ওকে দিয়ে ডায়েরী চুরি করালো। মামা তো ডায়েরী খুঁজে না পেয়ে হয়রান। পুরো বাসায় চিরুনি অভিযান চললো। কিন্তু যা নেই তা কীভাবে খুঁজে পাবেন ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী?

কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ওই হারামজাদা সাংবাদিক মাহফুজ আহমেদ। সে লোভ দেখানোর জন্য এমন একটা জিনিস বেছে নিলো যা ফিরিয়ে দেয়া আকবরের জন্য প্রায় অসম্ভব।

ড্যান্ডি!

আকবরের অতীত ইতিহাস বের করা সাংবাদিকের জন্য খুব কঠিন কিছু ছিল না। কমলাপুর এলাকায় কয়েকবার ঢু মেরে, একে তাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আকবর কীসে বশ হয় তা বের করে ফেলে সাংবাদিক। তারপর ড্যান্ডি দেখিয়ে আকবর দ্য গ্রেটকে পোষ মানিয়ে ফেলে মাহফুজ আহমেদ।

সে-ও পুনরায় ড্যান্ডি আসক্ত হয়ে পড়ে। ড্যান্ডির পিনিকে আবারো পঙ্খীরাজ ঘোড়া দেখে। লেজ দুলিয়ে শূন্যে বিচরণরত। সওয়ার স্বয়ং মাজেদা খালা। খালার কাপড়চোপড়ের অবস্থা পুরো আস্তাগফিরুল্লাহ। উরু বের হয়ে আছে, বুকের অর্ধেক উন্মুক্ত। চোখ ফেরাতে গিয়েও ফেরাতে পারে না আকবর।

তার নেশার কাছে পুনরায় আত্মসমর্পণ কী ধরতে পেরেছিলেন মেহবুব মামা?

এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আকবরের। তবে খুব সম্ভবত পেরেছিলেন। এই জন্যই কী কথাবার্তা একদম কমিয়ে দিয়েছিলেন তিনি?

শেষদিকে এসে একদম চাপা স্বভাবের হয়ে গিয়েছিলেন মেহবুব মামা। দরকারী কথা ছাড়া আর একটা কথাও বলতেন না। কথা বললেও তা বেশিরভাগ সময়ে হা/নাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো। অথচ মেহবুব মামা কী প্রাণবন্ত মানুষই না ছিলেন! দিলদরিয়া, রসিক, আড্ডাবাজ। ঠা ঠা করে ঘর কাঁপিয়ে হাসতেন।

আর সেই তিনিই কিনা বাতাস ছাড়া চিপসের প্যাকেটের মতো চুপসে গেলেন!

বুড়ো আঙুলের ব্যথা কমে নাই। খানিক পরপর চিড়িক দিয়ে উঠছে। আর খানিক পরপর চোখে অন্ধকার দেখছে আকবর। ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ও। এখন কান্নাও শুকিয়ে গেছে। বজ্জাত সাংবাদিক ও তার গ্যাং আপাতত বিদায় নিয়েছে। সাথে ওর জন্য ছুঁড়ে দেয়া সতর্কবাণী-”বাসায় ফিরিস না। এখন এটা পুলিশ কেস।”

বাসায় ফেরার একদমই ইচ্ছা নাই আকবরের। সে এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে কাটায়। কিন্তু বুড়ো আঙুলের ব্যথা তাকে নড়তে দিচ্ছে না। ডিসপেনসারি’তে গিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে এসেছে ও। কিন্তু ব্যথা কী আর কমে তাতে?

এখন দরকার ড্যা…

তখনই উরুতে মৃদু কম্পন। মোবাইল বাজছে। ও যে নাম্বার ব্যবহার করে তা সকাল থেকেই বন্ধ। একদম স্যুইচড অভ। সিমটাও নষ্ট করে ফেলেছে ও। এটা গোপন নাম্বার। এই নাম্বার খুব বেশি মানুষের কাছে নাই। হাতেগোনা কয়েকজনের কাছে আছে এই নাম্বার। তাদের মধ্যে একজন…

“মালিকুম, খালা!” পরিচিত জন পেয়ে ফোঁপানিটা আবার শুরু হয় আকবরের।

ওপাশ থেকে মাজেদা খালার কৃত্রিম রুষ্ট গলা ভেসে আসে। “কীরে, নাটকির পোলা, আমারে তো ভুইল্লাই গেছস।”

*

খালার উদাম পিঠে তেল দিয়ে দিচ্ছে আকবর।

রাতের খাওয়া-দাওয়া ততক্ষণে শেষ। এতটাই খেয়েছে আকবর যে এখন আর নড়তে পারছে না। সারা দিন পেটে এক ফোঁটা দানাপানিও পড়ে নাই। তাই সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত ছিল ও। ঘরে খাবার বলতে ছিল ঝাল দেয়া মুরগির মাংস, পটল দিয়ে কই মাছ আর ঘন ডাল। মাংসের পুরো বাটিই আকবরের প্লেটে উপুড় করে দেন খালা।

“খা, পেট ভইরা খা!”

আকবর পেট ভরেই খায়। মাংস খায়, ডাল খায়, পটল দিয়ে কই মাছ খায়। খাওয়া শেষে খানিকক্ষণ চিৎ হয়ে শোয়। এখনো মাঝে মাঝে চিড়িক দিয়ে ব্যথা জাগছে বুড়ো আঙুলে। তবে ব্যথার ধার এখন খানিকটা ভোতা।

খালা এসে ডাক দেন ওকে। উনার পিঠে সাংঘাতিক ব্যথা। আকবর কী মালিশ করে দিতে পারবে?

আলবাত পারবে!

খালা পিঠ উদাম করে শুয়ে পড়েন। ঘরের বাতি নিভানো, বাইরের রুম থেকে ছিটকে এসেছে কিছু আলো।

শিয়রের পাশে গরম তেল রাখা। পর্যাপ্ত তেল নিয়ে নেয় আকবর। তারপর খালার মাখন-নরম পিঠে হাত ডুবিয়ে দেয়। কোমর থেকে ঘাড় পর্যন্ত উঠে, ঘাড় থেকে নিচে নেমে আসে।

উঠে, নামে। নামে, উঠে।

তরমুজ স্তন দুটো বিছানায় পিষ্ট হয়ে দু’পাশ দিয়ে উঁকি মারছে। তেল দিতে দিতে ওর লোভী হাত ওদিকেও যায়। তারপর বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো হাত সরিয়ে নেয় আবার।

যায়, ফিরে আসে। যায়, ফিরে আসে।

কোমরের কাছটায় হাত নিয়ে থতমত হয়ে যায় আকবর। তারপর থেকেই শ্রোণীদেশ শুরু। আরো কী নামবে ও?

বাঁধা বলতে কালো সায়া। উল্টাদিকে সায়ার গিঁট, আলতোভাবে আটকানো।

খালার গলা শোনা যায়-”এট্টু নামায়া দে।”

অত্যুৎসাহী আকবর এট্টু নামাতে গিয়ে একটু বেশিই নামিয়ে ফেলে।

“এট্টু নামাইতে কইছি হারামজাদা।”

ততক্ষণে নিতম্বের খাঁজ দেখা যাচ্ছে। গভীর খাঁজ।

হাত আবার তেলে ডুবিয়ে নেয় ও। নিজেকে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছে আকবরের। এ নেশা ড্যান্ডির নেশা না। এ আরো ভয়ানক নেশা।

মাংসের নেশা। নারী মাংস।

আচমকা গরম লাগতে শুরু করে আকবরের। গলার কাছটায় কী জানি আটকে আছে। ধুকপুক করছে বুকের ভিতরটা।

উত্তেজনার তুঙ্গে উঠা আকবর বুঝতেও পারেনি পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। একজন কেন পুরো আর্মি এসে দাঁড়ালেও ও বুঝতে পারতো না। ওর ধ্যান তখন শ্রোণীর খাঁজে, অন্ধকার ভাঁজে।

ঘাড়ের কাছটায় একটা ঝিলিক দেয়া ব্যথা। কেপে উঠে ওর শরীর। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে মাজেদা খালার তৈলাক্ত পিঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *