০৫. মৌলকণা এবং প্রাকৃতিক বল

০৫. মৌলকণা এবং প্রাকৃতিক বল (Elementary Particles and the Forces of Nature)

অ্যারিস্টটলের বিশ্বাস ছিল ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পদার্থ চারটি মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত। ক্ষিতি (earth), মরুৎ (air), অগ্নি (fire) এবং অপ (water)। এই উপাদানগুলোর উপরে দুটি বল ক্রিয়াশীল : মহাকর্ষ–ক্ষিতি এবং অপের ডুবে যাবার প্রবণতা এবং লঘুত্ব মরুৎ এবং অগ্নির উপরে ওঠার প্রবণতা। মহাবিশ্বের উপাদানগুলোকে পদার্থ এবং বলে বিভাজন আজও ব্যবহার করা হয়।

অ্যারিস্টটলের বিশ্বাস ছিল পদার্থ অবিচ্ছিন্ন, অর্থাৎ পদার্থের একটা টুকরোকে ক্ষুদ্র তর এবং ক্ষুদ্রতম অংশে ভাগ করা সম্ভব। এই ভাগ করার কোনও সীমা নেই। এমন কোনও পদার্থ কণিকা পাওয়া সম্ভব নয় যাকে ভাগ করা যায় না। ডেমোক্রিটাসের মত দু-একজন গ্রীক কিন্তু বিশ্বাস করতেন, পদার্থ জন্মগত ভাবেই দানাদার (grainy) এবং সমস্ত পদার্থই বহু সংখ্যক নানা ধরনের পরমাণু দিয়ে গঠিত [গ্রীক ভাষায় পরমাণু (atom) শব্দের অর্থ “অবিভাজ্য”] এই দ্বন্দ্ব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছিল। তবে কোন পক্ষেই কোন বাস্তব সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ রাসায়নিক এবং পদার্থবিদ জন ডালটন John Dalton) দেখালেন, রাসায়নিক যৌগগুলো (chemical compound) সব সময়েই একটি বিশেষ অনুপাতে মিশ্রণের ফলে হয়। এ তথ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় পরমাণুগুলোর বিশেষ বিশেষ এককে গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়া। এগুলোর নাম তিনি দিয়েছিলেন অণু। কিন্তু, এই শতাব্দীর প্রথম দিকটা পর্যন্ত চিন্তাধারার এই দুটি দলের যুক্তি তর্কের পরমাণুবাদীদের সপক্ষে চরম মীমাংসা হয়নি। একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌত সাক্ষ্য উপস্থিত করেছিলেন আইনস্টাইন। বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ সম্পর্কীয় বিখ্যাত গবেষণাপত্র প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ আগে ১৯০৫ সালে তিনি দেখিয়েছিলেন ব্রাউনীয় গতিকে একটি তরল পদার্থের অণুগুলোর সঙ্গে ধূলিকণার সংঘর্ষ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি তরল পদার্থে ভাসমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূলিকণার এলোমেলো এবং অনিয়মিত গতিকে বলা হয় ব্রাউনীয় গতি।

এই পরমাণুগুলো আসলে অভিভাজ্য নয়– এর ভিতরেই এই সন্দেহ হওয়া শুরু হয়েছিল। কয়েক বছর আগে কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের জে. জে. টমসন (J. J. Thomson) নামে একজন ফেলো ইলেকট্রন নামক একটি ক্ষুদ্র পদার্থকণার অস্তিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। এই কণার ভর লঘুতম পরমাণুর ভরের এক সহস্রাংশের চাইতেও কম। তিনি আধুনিক টি. ভি.র পিকচার টিউবের মত একটা যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। উত্তাপে রক্তবর্ণ একটি ধাতব ফিলামেন্ট থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। যেহেতু ইলেকট্রনগুলোর আধান অপরা (negative) সেজন্য একটা ফসফরাস মাখানো পর্দার অভিমুখে তাদের ত্বরণ সৃষ্টি করার জন্য একটা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ব্যবহার করা যেত। ইলেকট্রনগুলো পর্দায় আঘাত করলে আলোর ঝলক সৃষ্টি হত। অনতিবিলম্বেই বোঝা গিয়েছিল ইলেকট্রনুগুলো নিশ্চয়ই নির্গত হয় পরমাণুগুলোর ভিতর থেকে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পদার্থবিদ আনেস্ট রাদারফোর্ড (Ernest Rutherford) ১৯১১ সালে দেখাতে সমর্থ হন– পরমাণুগুলোরও একটি আভ্যন্তরীণ গঠন আছে। তাদের গঠনে রয়েছে পরা (positive) আধান সম্পন্ন একটি কেন্দ্ৰক (nucleus)। তার চতুষ্পর্শ্বে আবর্তিত হচ্ছে কতকগুলো ইলেকট্রন। তেজস্ক্রিয় পরমাণুগুলো থেকে বিকিরিত পরা আধান সম্পন্ন ৫ (আলফা) কণিকাগুলোর পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তাদের গতিপথে যে বিচ্যুতি হয় সেটা বিচার করেই তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন।

প্রথমে মনে হয়েছিল পরমাণুর কেন্দ্রক একাধিক ইলেকট্রন এবং বিভিন্ন সংখ্যক পরা আধান যুক্ত কণিকার দ্বারা গঠিত। এগুলোর নাম দেয়া হয়েছিল প্রোটন। আসলে গ্রীক শব্দ প্রোটসের অর্থ প্রথম। কারণ তখন বিশ্বাস ছিল এগুলোই বস্তু গঠনের মূলগত একক। কিন্তু ১৯৩২ সালে কেম্ব্রিজে রাদারফোর্ডের সহকর্মী জেমস্ চ্যাডউইক James Chadwick) আবিষ্কার করলেন কেন্দ্রকে আর একটি কণাও থাকে তার নাম নিউট্রন। এর ভর প্রোটনের মতই কিন্তু এর কোন বৈদ্যুতিক আধান নেই। এই আবিষ্কারের জন্য চ্যাডউইক নোবেল পুরস্কার পান এবং কেম্ব্রিজের গনভিল ও কাইয়াস কলেজের মাস্টার নির্বাচিত হন (আমি এখন এই কলেজের ফেলো)। পরে তিনি মাস্টার পদ ত্যাগ করেন। এর কারণ, ফেলোদের সঙ্গে তার মতানৈক্য ঘটে। যুদ্ধের পর একদল তরুণ ফেলো ফিরে এসে অনেক প্রাচীন ফেলোর বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তাদের কলেজ থেকে বহিষ্কৃত করেন। এই পুরানো ফেলোরা বহুদিন কলেজের অনেক পদ অধিকার করে ছিলেন। এই ঘটনা নিয়ে কলেজে তিক্ত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল আমার আসার আগে। আমি এ কলেজে যোগদান করি এ বিবাদের একেবারে শেষ দিকে ১৯৬৫ সালে। তখন এই ধরনের মতানৈক্যের জন্য আর একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার নেভিল মট (Sir Nevill Mott) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

বছর কুড়ি আগে পর্যন্ত মনে হয়েছিল প্রোটন এবং নিউট্রনই “মৌল কণা” (ele mentary particle)। কিন্তু কতকগুলো পরীক্ষায় প্রোটনের সঙ্গে প্রোটেনের সংঘর্ষ ঘটানো হয়। কিম্বা সংঘর্ষ ঘটানো হয় দ্রুতগামী ইলেকট্রনের সঙ্গে। প্রোটনের এই পরীক্ষাগুলো থেকে নির্দেশ পাওয়া যায় আসলে এগুলোও ক্ষদ্রতর কণা দ্বারা গঠিত। ক্যালটেক পদার্থবিদ মারে গেলম্যান (Muray Gell-Mann) এই কণাগুলোর নাম দেন কার্ক quark) এই গবেষণার জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে নোবেল প্রাইজ পান। এ নামের উৎপত্তি হয় জেমস জয়েসের একটা হেঁয়ালী কবিতা “Three quarks for Muster Mark!” থেকে। কার্ক শব্দের উচ্চারণ হওয়া উচিত quart এর মত, তবে শেষে t এর বদলে k হবে কিন্তু সাধারণত উচ্চারণ করা হয় লার্কের মত।

কার্ক অনেক রকমের আছে। মনে হয় কার্ক রয়েছে অন্তত ছটি সুগন্ধের (flavour)। এগুলোর নাম নিচু (down), অজানা (strange), মোহিত charmed), সবার নিচে (bottom) এবং সবার উপরে (top)। প্রতিটি শুগন্ধেরই আবার তিনটি রঙ (colour) : লাল, সবুজ, নীল (জোরালো ভাবে বলা উচিত, এই শব্দগুলো শুধুমাত্র নাম। কার্কের আকার দৃশ্যমান আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চাইতে অনেক বেশি কল্পনাশক্তির অধিকারী। তারা শুধুমাত্র গ্রীক শব্দে আবদ্ধ থাকেন না!) প্রতিটি প্রোটন কিম্বা নিউট্রন তিনটি কার্ক দিয়ে গঠিত। প্রতিটির এক একটি রঙ। একটা প্রোটনের রয়েছে দুটি উঁচু কার্ক (up quark) এবং একটা নিচু কার্ক (down)। নিউট্রনে রয়েছে দুটি নিচু (down) কার্ক আর একটি উঁচু কার্ক। অন্য কার্ক দিয়েও আমরা কণিকা বানাতে পারি । অজানা (strange), মোহিত (charmed), সবার নিচে (bottom) এবং সবার উপরে (top)। কিন্তু এ সবগুলোরই ভর অনেক বেশি এবং দ্রুত অবক্ষয় হয়ে তারা প্রোটনে এবং নিউট্রনে পরিণত হয়।

এখন আমরা জানি পরমাণু কিম্বা তাদের ভিতরকার প্রোটন নিউট্রন কোনটাই অবিভাজ্য নয়। সুতরাং প্রশ্ন হল, সত্যিকারের মৌল কণা অর্থাৎ যা দিয়ে সমস্ত জিনিস তৈরি হয়েছে সেগুলো কি? আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য একটি পরমাণুর আকারের চাইতে অনেক বড়। সুতরাং সাধারণভাবে পরমাণু দেখার কোন আশাই নেই। অতএব আমাদের প্রয়োজন তার চাইতেও অনেক ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য সম্পন্ন কিছু। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মতে সমস্ত কণাই আসলে তরঙ্গ এবং শক্তি যত বেশি অনুরূপ তরঙ্গ তত ছোট। সুতরাং আমাদের প্রশ্নের সব চাইতে ভাল উত্তর হল, কতটা কণিকাশক্তি (particle energy) আমাদের হাতে আছে। তার কারণ তার উপরে নির্ভর করবে কতটা ক্ষুদ্রমানের দৈর্ঘ্য আমরা দেখতে পাব। এই কণিকা শক্তি মাপনের সাধারণ এককের নাম ইলেকট্রন ভোল্ট (টমসনের ইলেকট্রন নিয়ে পরীক্ষাতে আমরা দেখেছি তিনি ইলেকট্রনের ত্বরণের জন্য বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ব্যবহার করেছিলেন। এক ভোল্টের একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র থেকে একটা ইলেকট্রন যে শক্তি সংগ্রহ করে তাকে বলে এক ইলেকট্রন ভোল্ট)। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে কণিকাশক্তির ব্যবহার জানা ছিল সেটা হল, আগুন জ্বালার সময় কিম্বা ঐ রকম কোন রাসায়নিক ক্রিয়ার সময় উদ্ভূত কয়েকটি ইলেকট্রন ভোল্ট মাত্র। তখন মনে করা হত, পরমাণুই ক্ষুদ্রতম একক। রাদারফোর্ডের পরীক্ষাতে ৫ (আলফা) কণিকাগুলোর শক্তি ছিল বহু মিলিয়ান ইলেকট্রন ভোল্ট। আরো আধুনিক কালে আমরা শিখেছি কি করে বিদ্যুৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে কণিকাগুলোকে প্রথমে কয়েক মিলিয়ান ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি দান করা যায় এবং তারপর দান করা যায় হাজার হাজার মিলিয়ান ভোল্ট শক্তি। এভাবেই আমরা জানতে পেরেছি কুড়ি বছর আগে যেগুলোকে মৌলকণা ভাবা হত, সেগুলোও ক্ষুদ্রতর কণা দ্বারা গঠিত। আমরা যদি উচ্চতর শক্তিতে পৌঁছাই, তাহলে কি দেখা যাবে এই কণাগুলো আরো ক্ষুদ্র কণিকা দ্বারা গঠিত? এটা নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু আমাদের সত্যসত্যই এমন কিছু তাত্ত্বিক যুক্তি রয়েছে, যার দরুন আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে প্রকৃতির গঠনের অন্তিম মৌলকণা সম্পর্কে আমরা জেনেছি কিম্বা জানার অত্যন্ত কাছাকাছি এসে পড়েছি।

আগের অধ্যায়ে আমরা যে তরঙ্গ কণিকা দ্বৈততা সম্পর্কে আলোচনা করেছি, তার সাহায্যে আলোক এবং মহাকর্ষ সমেত মহাবিশ্বের সব কিছুই কণিকার বাগ্বিধিতে প্রকাশ করা যায়। এই কণিকাগুলোর একটি ধর্মের নাম চক্ৰণ (spin)। চক্রণ সম্পর্কে ভাবার একটি পদ্ধতি হল এগুলোকে এক একটি অক্ষে (axis) ঘূর্ণায়মান লাটিম ভাবা। এতে কিন্তু ভুল হতে পারে, কারণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আমাদের বলে কণিকাগুলোর কোন সুসংজ্ঞিত (well-defined) অক্ষ নেই। একটি কণিকার চক্ৰণ বলতে বাস্তবে যা বোঝায় সেটা হল বিভিন্ন অভিমুখ থেকে সেটা কি রকম দেখায়। একটি কণিকার চক্ৰণ (spin) যদি শূন্য হয় তাহলে সেটা একটা বিন্দুর মত : যে কোন দিক থেকে সেটা একই রকম দেখাবে (চিত্র : ৫.১-i)। কণিকার চক্ৰণ ১ হলে সেটা একটা তীরের মত, এক এক দিক থেকে সেটা দেখতে এক এক রকম (চিত্র : ৫.১-ii)। শুধুমাত্র যদি পূর্ণভাবে আবর্তিত (৩৬০ ডিগ্রী) হয়, তা হলেই কণাটিকে এক রকম দেখাবে। দুই চক্ৰণ বিশিষ্ট কণিকা একটি দুমুখী তীরের মত (চিত্র : ৫.১-iii), অর্ধবৃত্ত পথে আবর্তিত হলে (১৮০ ডিগ্রী) সেটাকে এক রকম দেখাবে। একইভাবে উচ্চতর চক্ৰণবিশিষ্ট কণিকাগুলোকে একই রকম দেখাবে, যদি সেগুলোকে পূর্ণ আবর্তনের ক্ষুদ্রতর ভগ্নাংশ পরিমাণ ঘোরানো যায়। এই পর্যন্ত ব্যাপারটা সহজবোধ্য (fairly straight forward) কিন্তু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এমন অনেক মৌলকণা আছে, যেগুলোকে ঠিক একটি আবর্তনে এক রকম (look the same) দেখায় না। সেগুলোকে এক রকম দেখায় দুটি আবর্তনে। বলা হয় এই মৌল কণাগুলোর চক্র অর্ধেক (১/২)।

মহাবিশ্বের সমস্ত জানিত কণিকাগুলোকে দুই গোষ্ঠীতে ভাগ করা যায় : যে সমস্ত কণিকার চক্ৰণ (spin) অর্ধেক, পৃথিবীর সমস্ত পদার্থই সেই কণিকাগুলো দিয়ে গঠিত এবং সে সমস্ত কণিকার চক্রণ (spin) ০, ১ এবং ২, আমরা দেখতে পাব সেগুলো দিয়েই পদার্থকণিকার অন্তর্বর্তী বল তৈরি হয়। পদার্থ কণাগুলো পাউলির অপবর্জন নীতি (Pauli’s exclusion principle) নামক নীতি মেনে চলে। এ নীতি ১৯৫২ সালে অষ্ট্ৰীয় পদার্থবিদ উলফগ্যাঙ পাউলি (Wolfgang Pauli) আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯৪৫ সালে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মূল আদর্শ (archetypal)। তাঁর সম্পর্কে কথিত আছে, এমন কি একই শহরে তার উপস্থিতিও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোকে গোলমাল করিয়ে দিত। পাউলির অপবর্জন নীতির বক্তব্য : দুটি সমরূপ (similar) কণা একই অবস্থায় থাকতে পারে না। অর্থাৎ অনিশ্চয়তাবাদ অনুমোদিত সীমার ভিতরে দুটি কণারই একই অবস্থান এবং একই গতিবেগ থাকতে পারে না। অপবর্জন নীতি বিনিশ্চায়ক crucial)। কারণ : চক্রণ ০, ১ এবং ২ বিশিষ্ট কণাগুলো দ্বারা সৃষ্ট বলের প্রভাবে পদার্থগুলো কেন চুপসে অত্যন্ত সন্নিকট হগে তাদের গতিবেগে পার্থক্য থাকবেই। এর অর্থ হবে কণাগুলো একই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকবে না। পৃথিবী যদি অপবর্জন নীতি ছাড়া সৃষ্ট হত, তা হলে কার্কগুলো বিচ্ছিন্ন সুসংজ্ঞিত প্রোটন এবং নিউট্রন গঠন করত না। আবার এগুলোও ইলেকট্রন সহযোগে বিচ্ছিন্ন সুসংজ্ঞিত পরমাণু গঠন করতে পারত না। তারা সবাই চুপসে মোটামুটি এক রকম ঘন একটি “সুপ” (soup) তৈরি করত।

ইলেকট্রন এবং অর্ধেক চক্রণ বিশিষ্ট কণিকাগুলো সম্পর্কে ১৯২৮ সালের আগে সঠিক উপলব্ধি হয়নি। সে বছরে পল ডিরাক (Paul Dirac) একটি তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তিনি পরে কেম্ব্রিজে গণিতশাস্ত্রের লুকেসিয়ান (Lucasian) অধ্যাপক নির্বাচিত হন (এক সময় নিউটন এই অধ্যাপক পদে ছিলেন এবং এই পদে এখন আমি রয়েছি)। ডিরাক এর তত্ত্বই এই ধরনের প্রথম তত্ত্ব যার সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং বিশিষ্ট অপেক্ষবাদের সঙ্গতি এই ধরনের প্রথম তত্ত্ব যার সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং বিশিষ্ট অপেক্ষবাদের সঙ্গতি রয়েছে। ইলেকট্রনের কেন অর্ধেক চক্রণ রয়েছে এবং সম্পূর্ণ একটি আবর্তনে তাকে কেন একই রকম দেখায় না, অথচ দুটি আবর্তনে দেখায় এই প্রশ্নগুলো ডিরাকের তত্ত্ব গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছে। এই তত্ত্ব আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী করে : ইলেকট্রনের নিশ্চয়ই একটি জুড়ি থাকবে। অর্থাৎ থাকবে একটি বিপরীত ইলেকট্রন (anti-electron) কিম্বা পজিট্রন। ১৯৩২ সালে পজিট্রন আবিষ্কৃত হয়। ফলে ডিরাকের তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এই আবিষ্কার ১৯৩৩ সালে ডিরাকের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পথিকৃৎ। আমরা এখন জানি প্রতিটি কণিকারই একটি বিপরীত কণিকা (antiparticle) আছে। তার সঙ্গে কণিকাটি বিনাশপ্রাপ্ত (annhilated) হতে পারে (বলবাহী কণাগুলোর ক্ষেত্রে বিপরীত কণিকা এবং কণিকাটি অভিন্ন)। বিপরীত কণিকার দ্বারা গঠিত বিপরীত পৃথিবী এবং বিপরীত মানুষও থাকতে পারে। কিন্তু আপনার বিপরীত সত্তার সঙ্গে দেখা হলে তার সঙ্গে করমর্দন করবেন না। তা করলে আপনারা দুজনেই একটা বিরাট আলোর ঝলকে মিলিয়ে যাবেন। বিপরীত কণিকার তুলনায় সাধারণ কণিকাগুলোর সংখ্যা এত বেশি মনে হয় কেন? এ প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়ের শেষে আমি সে প্রশ্নে ফিরে আসব।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় অনুমান করা হয় পদার্থ কণিকাগুলোর অন্তর্বর্তী বল কিম্বা পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াগুলো পূর্ণসংখ্যায় চক্রণ (spin) বিশিষ্ট কণা দ্বারা বাহিত হয়। যেমন– ০, ১ এবং ২। আসলে যা ঘটে তা হল : ইলেকট্রন কিম্বা কার্কের মত একটা পদার্থ কণিকা একটি বলবাহী কণিকা নিক্ষেপ করে। এই নিক্ষেপে (emission) যে প্রত্যাগতি (recoil) হয়, তার ফলে পদার্থ কণাটির গতিবেগের পরিবর্তন হয়। বলবাহী কণিকাটির সঙ্গে তখন অন্য একটি পদার্থ কণিকার সংঘর্ষ হয়। ফলে বলবাহী কণিকাটি বিশোষিত হয় (absorbed)। এই সংঘর্ষের ফলে দ্বিতীয় কণিকাটির গতিবেগের পরিবর্তন হয়, ঠিক যেন দুটি পদার্থ কণিকার ভিতরে একটি অন্তর্বর্তী বল ছিল।

বলবাহী কণিকাগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম হল, তারা অপবর্জন নীতি মানে না (exclusion principle)। এর অর্থ হল কতকগুলো কণিকার বিনিময় হবে তার সংখ্যার কোন সীমা নেই। সুতরাং তা থেকে একটি শক্তিশালী বল উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু বলবাহী কণিকাগুলোর ভর বেশি হলে, সেগুলো তৈরি করা (produce) এবং বেশি দূরত্বে বিনিময় করা (exchange) খুব কঠিন হবে। সুতরাং তারা যে বল বহন করবে তার পাল্লা (range) হবে কম। অন্যদিকে যদি বলবাহী কণিকাগুলোর নিজস্ব কোন ভর না থাকে তাহলে বলগুলোর পাল্লা (range) হবে বেশি। বলা হয় কণিকাগুলোর অন্তর্বর্তী যে বলবাহী কণিকাগুলোর বিনিময় হয় সেগুলো কল্পিত (virtual) কণিকা। কারণ কণিকা অভিজ্ঞাপক যন্ত্রে তাদের “বাস্তব (real)” কণিকার মত প্রত্যক্ষভাবে সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব আমরা জানতে পারি। তার কারণ, তাদের একটা মাপনযোগ্য অভিক্রিয়া রয়েছে। তারা পদার্থ কণিকাগুলোর অন্তর্বর্তী বল সৃষ্টি করে। কোন কোন অবস্থায় ০, ১ কিম্বা ২ চক্ৰণ (spin) বিশিষ্ট কণাগুলো বাস্তব কণিকারূপে বিদ্যমান থাকে। তখন তাদের প্রত্যক্ষভাবে সনাক্ত করা সম্ভব নয়। চিরায়ত পদার্থবিদ্যায় যাকে তরঙ্গ বলে ঐ কণিকাগুলোকে তখন আমাদের সেই রকমই মনে হবে। যেমন, আলোক তরঙ্গ কিম্বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। পদার্থ কণিকাগুলো কল্পিত (virtual) বলবাহী কণিকা বিনিময় দ্বারা যখন পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় সেই সময় ওগুলো (অর্থাৎ ০, ১ কিম্বা ২ চক্ৰণ সম্পন্ন বাস্তব কণিকা অনুবাদক) নির্গত হতে পারে। (উদাহরণ : দুটি ইলেকট্রনের মধ্যবর্তী বৈদ্যুতিক বিকর্ষণ বলের কারণ দুটি কল্পিত ফোটন বিনিময়। এই ফোটনগুলোকে কখনোই প্রত্যক্ষভাবে সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু একটি ইলেকট্রন যদি আর একটিকে অতিক্রম করে তাহলে বাস্তব ফোটনও নিক্ষিপ্ত হতে পারে, সেগুলোকেই আমরা আলোক তরঙ্গ বলে সনাক্ত করতে পারি)।

বাহিত বলের শক্তি এবং যে সমস্ত কণিকার সঙ্গে তাদের প্রতিক্রিয়া হয় সেই অনুসারে বলবাহী কণিকাগুলোকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। একটু জোরের সঙ্গেই বলা উচিত : এই চারটি শ্রেণীতে বিভাগ মনুষ্যকৃত। আংশিক তত্ত্ব গঠন করতে গেলে এই রকম বিভাজনে সুবিধা হয় কিন্তু গভীরতম কিছুর অনুরূপ এই বিভাজন নাও হতে পারে। অধিকাংশ পদার্থবিদেরই আশা তারা শেষ পর্যন্ত এমন একটা ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার করবেন, যার সাহায্যে বলের বিভিন্ন দিক রূপে চারটি বলকে ব্যাখ্যা করা যাবে। আসলে অনেকেই বলবেন আজকের পদার্থবিদ্যার প্রধান লক্ষ্য এটাই। ইদানীং চারটি বলের ভিতরে তিনটি বলকে ঐক্যবদ্ধ করার সফল প্রচেষ্টা হয়েছে। এ অধ্যায়ে আমি সে প্রচেষ্টাগুলোর বিবরণ দেব। অবশিষ্ট শ্রেণীকে অর্থাৎ মহাকর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্ন আমি পরবর্তী কালের জন্য রেখে দেব।

প্রথম শ্রেণী হল মহাকর্ষীয় বল। এই বল মহাবিশ্বব্যাপী অর্থাৎ প্রতিটি কণিকাই তার নিজস্ব ভর কিম্বা শক্তি অনুসারে মহাকর্ষীয় বল বোধ করে। চারটি বলের ভিতরে মাহকর্ষীয় বল দুর্বলতম এবং এ বিষয়ে অন্য বলগুলোর সঙ্গে তার পার্থক্য অনেকটা (by a long way)। এই বল এত দুর্বল যে দুটি বিশেষ ধর্ম না থাকলে এ বল আমাদের নজরেই আসত না। সে দুটি হল : বহু দূরত্বের এ বল ক্রিয়া করতে পারে এবং এ বল সব সময়েই আকর্ষণ করে। এর অর্থ : একটি বৃহৎ বস্তুপিণ্ডের অন্তর্বর্তী একক কণিকাগুলোর অত্যন্ত দুর্বল মহাকর্ষীয় বল সংযুক্ত হয়ে একটি লক্ষণীয় বল উৎপাদন করতে পারে। উদাহরণ : পৃথিবী এবং সূর্য। অন্য তিনটি বলগুলোর হয় পাল্লা (range) ছোট কিম্বা কখনো তারা আকর্ষণকারী, কখনো তারা বিকর্ষণকারী। সুতরাং তাদের পরস্পরকে বাতিল করার প্রবণতা রয়েছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গিতে, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে দুটি পদার্থ কণার অন্তর্বর্তী বল বহন করে গ্র্যাভিটন (graviton) নামক দুটি চক্রণ (spin) বিশিষ্ট একটি কণিকা, এই কণিকার নিজস্ব কোন ভর নেই, সেজন্য সে যে বল বহন করে তার পাল্লা দীর্ঘ। বলা হয় : সূর্য এবং পৃথিবীর অন্তর্বর্তী মহাকর্ষীয় বল পারস্পরিক গ্যাভিটন (gravition) বিনিময় থেকে উদ্ভূত। এই কণিকাগুলো যদিও কল্পিত (virtual) তবুও তারা নিশ্চিতভাবে একটি মাপনযোগ্য ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা পৃথিবীতে সূর্য প্রদক্ষিণ করায়। চিরায়ত পদার্থবিদরা যাকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বলতেন, সেগুলো আসলে বাস্তব গ্র্যাভিটন (graviton)। মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলো খুব দুর্বল। সেগুলো সনাক্ত করা এত কঠিন যে কখনোই সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা যায় নি।

পরের শ্রেণীর নাম বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। এই বলের ইলেকট্রন এবং কার্কের (quark) মত বৈদ্যুতিক আধান বিশিষ্ট কণিকার সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া হয় কিন্তু গ্র্যাভিটনের (gravition) মত আধান বিহীন কণিকার সঙ্গে কোন পারস্পরিক ক্রিয়া হয় না। দুটি ইলেকট্রনের অন্তর্বর্তী বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল মহাকর্ষীয় বলের চাইতে মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান (একের পিঠে বিয়াল্লিশটা শূন্য) গুণ শক্তিশালী। বৈদ্যুতিক আধান কিন্তু দু রকমের পরা (positive) এবং অপরা (nega tive)। দুটি পরা আধানের অন্তর্বর্তী বল বিকর্ষণকারী তেমনি দুটি অপরা (negative) আধানের অন্তর্বর্তী বল বিকর্ষণকারী। কিন্তু একটি পরা এবং একটি অপরা আধানের অন্তর্বর্তী বল আকর্ষণকারী। সূর্য কিম্বা পৃথিবীর মত একটি বৃহৎ বস্তুপিণ্ডে প্রায় সম সংখ্যক পরা এবং অপরা আধান রয়েছে। সুতরাং একক বস্তুপিণ্ডগুলোর অন্তর্বর্তী আকর্ষণকারী এবং বিকর্ষণকারী বলগুলো পরস্পরকে প্রায় বাতিল করে দেয় ফলে অবশিষ্ট (net) বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল থাকে সামান্যই। কিন্তু অণু পরমাণুর মত ক্ষুদ্র মাত্রার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের প্রাধান্য থাকে। অপরা আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রন এবং পরা আধান বিশিষ্ট কেন্দ্রকের (nucleus) অন্তর্বর্তী আকর্ষণই ইলেকট্রনকে পরমাণুর কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করায়। ব্যাপারটা পৃথিবীকে যে রকম মহাকর্ষীয় বল সূর্যকে প্রদক্ষিণ করায় সেই রকম। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় আকর্ষণকে মনে করা হয় ফোটন নামক ভরহীন কল্পিত (virtual) এক চক্রণ (spin) বিশিষ্ট বহু সংখ্যক কণিকার বিনিময়ের ফলশ্রুতি। যে সমস্ত ফোটন বিনিময় হয় সেগুলো কিন্তু কল্পিত কণিকা।(১) কিন্তু যখন একটি ইলেকট্রন একটি অনুমোদিত কক্ষ থেকে কেন্দ্রকের নিকটতর অন্য একটি কক্ষে গমন করে তখন শক্তি মুক্ত হয় এবং একটি বাস্তব ফোটন নির্গত হয়। যদি তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য সঠিক থাকে তা হলে সেটা মানুষের চোখে ধরা পড়ে। এছাড়া দেখা যায় ফটোগ্রাফের ফিমের মত কোন ফোটন অভিজ্ঞাপক যন্ত্রের সাহায্যে। সেই রকম একটি বাস্তব ফোটনের সঙ্গে একটি পরমাণুর সংঘর্ষ হলে একটি ইলেকট্রনকে কেন্দ্রকের (nucleus) নিকটতর কক্ষ থেকে একটি দূরতর কক্ষে সরিয়ে দিতে পারে। ফলে ফোটনের শক্তি ব্যবহৃত হয় সুতরাং সে বিশোষিত হয়। তৃতীয় শ্রেণীর নাম দুর্বল কেন্দ্রীয় বল (weak nuclear force)। তেজস্ক্রিয়তার কারণ এই ভর। অর্ধেক চক্রণ বিশিষ্ট সময় পদার্থ কণিকার উপরই এই বল ক্রিয়া করে কিন্তু ফোটন কিম্বা গ্র্যাভিটনের মত ০, ১ কিম্বা ২ চক্রণ বিশিষ্ট কোন কণিকার উপরে ক্রিয়া করে না। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্বল কেন্দ্রীয় বলকে ভাল করে বোঝা যায়নি। সেই সময় লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের আবদুস সালাম এবং হার্ভার্ডের স্টিভেন উইনবার্গ কয়েকটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। সেই তত্ত্বগুলো এই পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াকে (interaction) বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ (unified) করে। প্রায় একশ বছর আগে ম্যাক্সওয়েল (Maxwell) বৈদ্যুতিক এবং চুম্বকীয় বলকে এইভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সালাম এবং উইনবার্গের বক্তব্য ছিল ফোটন ছাড়া আরো তিনটি এক চক্ৰণ (spin) বিশিষ্ট কণিকার অস্তিত্ব আছে। একত্রে এগুলোর নাম? (অধিক ভরযুক্ত) ভেক্টর বোসন (massive vector bosons)।(২) এগুলো দুর্বল বলটিকে বহন করে। এগুলোর নাম W+ (উচ্চারণ– ডবলু প্লাস), W- (উচ্চারণ– ডবলু মইনাস) এবং Z* (উচ্চারণ– জেড নট) এবং প্রত্যেকটির ভর প্রায় ১০০ GeV (GeV এর অর্থ giga-electron-volt কিম্বা এক হাজার মিলিয়ান ইলেকট্রন ভোল্ট)। ইউনবার্গ-সালামের তত্ত্ব একটি ধর্ম প্রদর্শন করে তার নাম স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভঙ্গ হওয়া (spontaneous symmetry break ing)। এর অর্থ : স্বল্প শক্তিতে (at low energy) যে সমস্ত কণিকাগুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হয় সেগুলো আসলে একই জাতীয় কণিকা, তবে বিভিন্ন অবস্থায়। উচ্চ শক্তিতে (at high energy) এই সমস্ত কণিকার আচরণ সমরূপ। ক্রিয়াটা অনেকটা রুলেট (roulette)(৩) চক্রে অবস্থিত রুলেট বলের আচরণের মত। উচ্চশক্তিতে (যখন চক্রটি খুব তাড়াতাড়ি ঘুরছে) বলটির আচরণ মূলত একই রকম। এটা ঘোরে আর ঘোরে। কিন্তু ঘূর্ণন ধীরতর হলে বলের শক্তি কমে যায়। শেষ পর্যন্ত বলটা চাকার ৩৭টি গর্তের ভিতরকার যে কোন একটা গর্তে পড়ে। অন্য কথায় কম শক্তির ক্ষেত্রে বলটি ৩৭টি অবস্থায় থাকতে পারে। কোন কারণে যদি আমরা স্বল্প শক্তি সম্পন্ন অবস্থায় বলটিকে পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম তা হলে আমরা ভাবতাম ৩৭টি বিভিন্ন ধরনের বল রয়েছে।

উইনবার্গ-সালাম তত্ত্ব অনুসারে ১০০ Gey এর চাইতে অনেক বেশি উচ্চ শক্তিতে তিনটি নতুন কণিকা এবং ফোটন সবগুলোরই আচরণ হবে এক রকম। কিন্তু অধিকাংশ স্বাভাবিক অবস্থায় যে স্বল্পতর কণিকাশক্তির সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে কণিকাগুলোর ভিতরকার প্রতিসাম্য (symmetry) ভেঙে যাবে। w+, W® এবং z° অনেক বেশি ভর যুক্ত হবে। ফলে তারা যে বল বহন করে তার পাল্লাও (range) অনেক কমে যাবে। সালাম এবং উইনবার্গ যখন এই তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন, তখন এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেছিলেন খুব কম লোকই। তাছাড়া কণিকা ত্বরণ যন্ত্রগুলোর (particle accelerators) ১০০ Gev শক্তিতে পৌঁছানোর মত ক্ষমতা ছিল না। w+, w® এবং z° এই সমস্ত বাস্তব কণিকা উৎপন্ন হওয়ার জন্য ঐ পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন। কিন্তু পরবর্তী প্রায় দশ বছরে স্বল্প শক্তির ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষামূলক তথ্যের সঙ্গে এত ভালভাবে মিলে যায় যে ১৯৭৯ সালে সালাম এবং ইউনবার্গকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়। তাঁদের সঙ্গে নোবেল প্রাইজ পান হার্ভার্ডের শেলডন গ্ল্যাশো (Sheldon Glashow)। তিনিও দুর্বল কেন্দ্রীয় বল এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের একই ধরনের ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব উপস্থিত করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে CERN (European Centre for Nuclear Research) a capucava foallo uso (massive) pealints আবিষ্কৃত হয়। তাই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয় ভবিষ্যদ্বাণীর অনুরূপ তাদের নির্ভুল ভর এবং অন্যান্য ধর্ম। নোবের কমিটি একটি ভুল করে অপ্রস্তুত হওয়ার দায় থেকে বেঁচে যায়। কয়েক শ’ পদার্থবিদের একটি দল এই আবিষ্কার করেন। তাদের নেতা ছিলেন কার্লো রুবিয়া (Carlo Rubbia)। তিনি ১৯৮৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান। এই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পান CERN এর ইঞ্জিনিয়ার সাইমন ভ্যান দার মীর (Simon Van Der Meer)। তিনি পুরস্কার পান বিপরীত পদার্থ (anti matter) সঞ্চয়ের যে ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন সেইজন্য (আজকালকার দিনে আগে থাকতেই শ্রেষ্ঠ কর্মী বলে পরিচিতি না থাকলে পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যায় (experimental physics) কৃতিত্ব লাভ করা খুবই কঠিন)।

শক্তিশালী কেন্দ্ৰকীয় বলকে (strong nuclear force) বলা হয় চতুর্থ শ্রেণীর বল। এই বল প্রোটন এবং নিউট্রনের কার্কগুলোকে একত্রে ধরে রাখে। তাছাড়া একত্রে ধরে রাখে পরমাণুর কেন্দ্রকের প্রোটন এবং নিউট্রনগুলোকে। বিশ্বাস করা হয় গ্লুয়ন (gluon) নামক এক চক্রণ বিশিষ্ট আর একটি কণিকা এই বল বহন করে। এই কণিকার পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া হয় শুধুমাত্র নিজের সঙ্গে এবং কার্কের সঙ্গে। শক্তিশালী নিউক্লীয় বলের (strong nuclear force) একটি অদ্ভুত ধর্ম আছে, তার নাম অবরোধ (confinement)। এ বল সবসময়ই কণিকাগুলোকে বন্ধন করে এমনভাবে সংযুক্ত করে যায় কোন রঙ নেই। স্বনির্ভর একক কোন কার্ক পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তাহলেই এর কোন না কোন রঙ থাকবে (লাল, সবুজ কিম্বা নীল)। তার বদলে একটা লাল কার্ককে একটি গ্লুয়ন (gluon) “মালিকার (string)” সাহায্যে একটি সবুজ এবং একটি নীল কার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে (লাল + সবুজ + নীল = সাদা)। এইরকম একটি ত্রয়ীর (triplet) দ্বারা একটি প্রোটন কিম্বা নিউট্রন গঠিত হয়। আর একটি সম্ভাবনা কার্ক এবং বিপরীত কার্কের (anti-quark) জোড় লাল + লাল বিপরীত (anti red) কিম্বা সবুজ + সবুজ বিপরীত কিম্বা নীল + নীল বিরোধী = সাদা]। এই রকম সমন্বয়ে মেসন (meson) নামক কণিকা গঠিত হয়। এই কণিকাগুলো অস্থির। কারণ কার্ক এবং বিপরীত কার্ক পরস্পরকে বিনাশ করে এবং উৎপন্ন করে ইলেকট্রন এবং অন্যান্য কণিকা। এইরকম কারণে অবরোধের (confinement) ফলে স্বকীয়ভাবে একক একটি গ্রুয়ন (gluon) পেতে বাধা সৃষ্টি হয়। কারণ, গ্লয়নেরও নিজস্ব রঙ আছে। তার বদলে একাধিক গুয়নের সমষ্টি পেতে হবে। সেগুলোর রঙের যোগফল হবে সাদা। গ্লয়নের এ রকম সংগ্রহে একটা অস্থির কণিকা গঠিত হয়, তার নাম বল (glueball)।

অবরোধী ধর্ম গ্ৰয়ন কিম্বা কার্ক পর্যবেক্ষণের প্রতিবন্ধক। এই তথ্যের ফলে কার্ক এবং গ্লুয়নকে কণিকারূপে বিচার সম্পর্কিত সমগ্র ধারণাকেই অধিবিদ্যাশ্রয়ী (meta physical) মনে হতে পারে। শক্তিশালী নিউক্লীয় বলের (strong nuclear force) কিন্তু অনন্তস্পর্শী স্বাধীনতা (asymptotic freedom) নামক আর একটি ধর্ম আছে। এই ধর্মের অস্তিত্বের ফলে কার্ক এবং গ্লুয়ন সম্পর্কিত ধারণা আরও সুসংজ্ঞিত হয়েছে। স্বাভাবিক শক্তিস্তরে (atnormal energies) শক্তিশালী নিউক্লীয় ভর সত্যই শক্তিশালী। এই বল কার্কগুলোকে দৃঢ়ভাবে বন্ধন করে রাখে। কিন্তু বৃহৎ কণিকাত্বরণ যন্ত্রের large particle accelerator) সাহায্যে পরীক্ষার ফল থেকে নির্দেশ পাওয়া যায় : উচ্চশক্তির স্তরে শক্তিশালী বল খুবই কম শক্তিশালী হয়ে পড়ে এবং কার্ক ও গ্নয়নের আচরণ হয় প্রায় স্বাধীন কণিকার মত। (চিত্র : ৫.২) তে একটি উচ্চশক্তি সম্পন্ন প্রোটন এবং অ্যান্টিপ্রোটনের সংঘর্ষের আলোকচিত্র দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি প্রায় স্বাধীন কার্ক সৃষ্টি হয়েছিল এবং চিত্ৰদুষ্ট একাধিক উৎসরণ পথ (jets of track) দেখা গিয়েছিল।

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লীয় বলের ঐক্য সাধনের সাফল্যের ফলে এ দুটি বলের সঙ্গে শক্তিশালী নিউক্লীয় বলের সমন্বয় করে একটি মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব গঠন করার একাধিক প্রচেষ্টা হয়েছে (GUT-Grand Unified Theory)। এই নামকরণ কিন্তু একটি অতিশয়োক্তি। এই সমস্ত প্রচেষ্টার ফলে যে তত্ত্বগুলো সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো এমন কিছু মহান নয়। এমন কি তারা সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধও নয়, কারণ, মহাকর্ষ এ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সেগুলো সম্পূর্ণ তত্ত্বও নয়। কারণ, সেগুলোতে এমন কতগুলো স্থিতিমাপ (parameter) রয়েছে, তত্ত্ব থেকে যার মূল্য (value) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না– বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার মত করে মূল্যগুলো (value) বেছে নিতে হয়। তবুও এগুলোকে সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব সৃষ্টির পথে একটি পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। GUT (মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব) এর মূলগত ধারণা : আগে উল্লেখ করা হয়েছিল শক্তিশালী নিউক্লীয় বল উচ্চশক্তির ক্ষেত্রে কম শক্তিশালী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আবার যে সমস্ত বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ভর এবং দুর্বল বলের অনন্তস্পর্শী (asymptotically) স্বাধীনতা নেই, সেগুলো উচ্চ শক্তিতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কোন কোন অতি উচ্চশক্তির নাম দেয়া হয়েছে ঐক্য সৃষ্টিকারী মহান শক্তি (grand unification energy)। এই শক্তিতে ৩টি বলের একই রকম শক্তি থাকে। সে অবস্থায় এগুলো একই শক্তির বিভিন্ন দিক হতে পারে (fifferent aspect)। GUT এর আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী : এই শক্তিতে কার্ক এবং ইলেকট্রনের মত বিভিন্ন অর্ধ চক্রণ বিশিষ্ট (spin 1/2 matter particle) পদার্থকণাগুলো মূলত একই হবে। এইভাবে তারা আর এক ধরনের ঐক্য লাভ করেছে।

মহান ঐক্য সৃষ্টিকারী শক্তির (grand unification energy) পরিমাণগত মূল্য সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে যতদূর সম্ভব এর পরিমাণগত মূল্য অন্ততপক্ষে হতে হবে এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ান GeV। আধুনিক কণিকাতৃরণ যন্ত্রগুলো (par ticle accelerators) প্রায় একশ’ GeV শক্তি সম্পন্ন কণিকাগুলোর ভিতরে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে। কয়েক হাজার GeV শক্তিসম্পন্ন কণিকার সংঘর্ষ ঘটাতে পারে এ রকম যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মহান ঐক্য সৃষ্টিকারী শক্তিতে কণিকাগুলোর ত্বরণ ঘটানোর মত শক্তিশালী যন্ত্রের আয়তন হবে সৌরজগতের (solar system) মত বিরাট। আধুনিক অর্থনৈতিক অবস্থায় এই পরিমাণ অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। সুতরাং মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব গবেষণাগারে প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষা করা অসম্ভব। কিন্তু বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় এবং দুর্বল ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের ক্ষেত্রের মত এই তত্ত্বের স্বল্পশক্তি ফলশ্রুতিও রয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব।

এগুলোর ভিতরে সব চাইতে আকর্ষণীয় হল প্রোটন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। সাধারণ পদার্থের ভরের অনেকটাই প্রোটন দিয়ে তৈরি। এ ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে প্রোটনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবক্ষয় হয়ে এ্যান্টিইলেকট্রনের মত অপেক্ষাকৃত হাল্কা কণিকায় পরিণত হতে পারে। এ রকম ব্যাপার সম্ভব হওয়ার কারণ মহান ঐক্যসৃষ্টিকারী শক্তিতে কার্ক এবং এ্যান্টিইলেকট্রনে কোন মূলগত পার্থক্য নেই। সাধারণত একটি প্রোটনের ভিতরে যে তিনটি কার্ক থাকে তাদের এ্যান্টিইলেকট্রনে পরিণত হওয়ার মত শক্তি থাকে না। কিন্তু কখনো কখনো তারা হয়ত পরিবর্তিত হওয়ার মত প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। এর যুক্তি : অনিশ্চয়তাবাদ অনুসারে প্রোটনের ভিতরকার কার্কের শক্তি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায় না। এ রকম শক্তি সংগ্রহ করলে প্রোটনের ভিতরকার কার্কের শক্তি নির্ভুল নির্ণয় করা যায় না। এ রকম শক্তি সংগ্রহ করলে প্রোটনের অবক্ষয় হতে পারে। কার্কের এ রকম যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি সংগ্রহ করার সম্ভাব্যতা এমন যে এ পরিবর্তন দেখতে হলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হতে পারে অন্ততপক্ষে এক মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান (অর্থাৎ একের পিঠে ত্রিশটি শূন্য) বছর। এই সময়ের পরিমাণ বৃহৎ বিস্ফোরণের সময় থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত সময়ের পরিমাণের চাইতে অনেক বেশি। সে সময়ের পরিমাণ মাত্র দশ হাজার মিলিয়ন বছর কিম্বা তার কাছাকাছি (একের পিঠে দশটি শূন্য)। সুতরাং অনেকে ভাবতে পারেন প্রোটনের স্বত্বঃস্ফূর্ত অবক্ষয় পরীক্ষামূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু অতি বৃহৎ সংখ্যায় প্রোটন আছে এই রকম বিরাট পরিমাণ পদার্থ পর্যবেক্ষণ করলে এই অবক্ষয় দেখার সম্ভাবনা থাকতে পারে (উদাহরণ : কেউ যদি একের পিঠে একত্রিশটি শূন্য পরিমাণ সংখ্যায় প্রোটনকে একবছরব্যাপী পর্যবেক্ষণ করে তা হলে সরলতম GUT অনুসারে তার একাধিক প্রোটনের অবক্ষয় দেখার সম্ভাবনা থাকতে পারে)।

এরকম কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু কোন পরীক্ষাতেই প্রোটন কিম্বা নিউট্রনের অবক্ষয় সম্পর্কে নিশ্চিত সাক্ষ্য পাওয়া যায় নি। একটি পরীক্ষা করা হয়েছিল ওহিওর মর্টন লবণ খনিতে (Morton Salt Mine) [কারণ ছিল, মহাজাগতিক (cos mic) রশ্মির ক্রিয়ার ফলে যে সমস্ত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া। কারণ, এই ক্রিয়া এবং প্রোটনের স্বতঃস্ফূর্ত অবক্ষয় নিয়ে একটা বিভ্রান্তি হতে পারে। এই পরীক্ষাতে ৮০০০ টন জল ব্যবহার করা হয়েছিল। এই পরীক্ষার সময় প্রোটনের কোন স্বতঃস্ফূর্ত অবক্ষয় দেখা যায়নি। সেজন্য হিসেব করে বলা যেতে পারে প্রোটনের জীবনকাল দশ মিলিয়ন মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান (একের পিঠে একত্রিশটা শূন্য) বছরেরও বেশি। সরলতম মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে প্রোটনের জীবনকালের চাইতে এই সময়কাল বেশি। কিন্তু আরো বিস্তৃত অনেক তত্ত্ব আছে। সে তত্ত্বগুলো অনুসারে ভবিষ্যদ্বাণী করা জীবনকাল আরো অনেক বেশি। এ তত্ত্বগুলো পরীক্ষা করতে গেলে আরো অনেক বেশি পরিমাণ পদার্থ নিয়ে সূক্ষ্মতর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রয়োজন হবে।

স্বতঃস্ফূর্ত প্রোটন অবক্ষয় পর্যবেক্ষণ করা খুব শক্ত। কিন্তু আমাদের অস্তিত্বটাই হয়ত এর বিপরীত পদ্ধতির ফলশ্রুতি। অর্থাৎ প্রোটন উৎপাদনের ফলশ্রুতি। কিম্বা আরো সরলভাবে বলা যায়, যে প্রাথমিক অবস্থায় বিপরীত কার্কের চাইতে কার্ক বেশি ছিল না সেই অবস্থায় উৎপাদনের ফলশ্রুতি। মহাবিশ্বের শুরু সম্পর্কে এটাই সব চাইতে স্বাভাবিক কল্পনা। পৃথিবীর পদার্থের বেশিরভাগই তৈরি পোটন এবং নিউট্রন দিয়ে। সেগুলো আবার তৈরি কার্ক দিয়ে। বৃহৎ কণিকা ত্বরণযন্ত্রে পদার্থবিদদের সৃষ্টি করা সামান্য কয়েকটি ছাড়া বিপরীত কার্ক (anti-quark) দিয়ে তৈরি বিপরীত প্রোটন (anti-proton) এবং বিপরীত নিউট্রনের (anti-neutron) কোন অস্তিত্ব নেই। মহাজাগতিক রশ্মিগুলোর সাক্ষ্য অনুসারে আমাদের নীহারিকার সমস্ত পদার্থ সাপেক্ষ এ তথ্য সত্য : উচ্চশক্তিতে সংঘটিত সংঘর্ষের ফলে যে সামান্য সংখ্যক কণিকা (parti cle) বিপরীত কণিকা জোড় (anti-particle pairs) সৃষ্টি হয় সেগুলো বাদ দিলে কোন বিপরীত প্রোটন কিম্বা বিপরীত-নিউট্রনের অস্তিত্ব নেই। আমাদের নীহারিকাতে যদি বিপরীত পদার্থ দিয়ে গঠিত বৃহৎ অঞ্চল থাকত তা হলে পদার্থ এবং বিপরীত পদার্থ অঞ্চলের সীমান্ত থেকে বৃহৎ পরিমাণ বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করার আশা আমরা করতে পারতাম। সেখানে বহু কণিকার সঙ্গে বিপরীত কণিকার সংঘর্ষ হত ফলে তারা পরস্পরকে বিনাশ করত এবং উচ্চশক্তি সম্পন্ন বিকিরণ নির্গত হত।

অন্যান্য নীহারিকাতে পদার্থ প্রোটন এবং নিউট্রন অথবা বিপরীত প্রোটন এবং বিপরীত নিউট্রন দ্বারা গঠিত কি না, এ সম্পর্কে আমাদের কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য নেই। তবে হয় এ রকম না হয় ও রকম হওয়া আবশ্যিক : একই নীহারিকাতে দুইয়ের মিশ্রণ থাকতে পারে না। কারণ, সেরকম হলে আমরা বিনাশের ফলে উদ্ভূত প্রচুর বিকিরণ দেখতে পেতাম। সেজন্য আমরা বিশ্বাস করি সমস্ত নীহারিকাই কার্ক দিয়ে গঠিত, বিপরীত কার্ক দিয়ে নয়। মনে হয় কতকগুলো নীহারিকা পদার্থ দিয়ে গঠিত এবং কতকগুলো নীহারিকা বিপরীত পদার্থ দিয়ে গঠিত এ রকম সম্ভাবনা নেই।

বিপরীত কার্কের তুলনায় কার্কের সংখ্যা অত বেশি কেন? দুইয়েরই সংখ্যায় এক হওয়ার কারণ কি? দুইয়ের সংখ্যা সমান না হওয়া আমাদের সৌভাগ্য। তার কারণ, সে রকম হলে সমস্ত কার্ক এবং বিপরীত কার্ক মহাবিশ্বের আদিমকালে পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলত। মহাবিশ্ব বিকিরণে ভর্তি থাকত, কিন্তু বিশেষ কোন পদার্থ থাকত না। মনুষ্যজীবন বিকাশ লাভ করার মত কোন নীহারিকা, কোন তারকা, কোন গ্রহ থাকত না। শুরুতে যদি দুইয়ের সংখ্যা সমান থেকেও থাকে, তা হলেও এখন কার্কের সংখ্যা এত বেশি কেন সৌভাগ্যক্রমে সে সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বগুলো একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে। আমরা দেখেছি উচ্চশক্তিতে কার্কের বিপরীত ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হওয়ার অনুমোদন GUT এর আছে। এর বিপরীত পদ্ধতি অর্থাৎ বিপরীত কার্কের ইলেকট্রনে রূপান্তর এবং ইলেকট্রন আর বিপরীত ইলেকট্রনের বিপরীত কার্ক এবং কার্কে রূপান্তর তারা অনুমোদন করে। মহাবিশ্বের অতি আদিম যুগে একটা সময় ছিল যখন মহাবিশ্ব এত উত্তপ্ত হওয়ার ফলে কণিকা শক্তি এত উচ্চমানের হত যে এই সমস্ত রূপান্তর সম্ভবপর ছিল কিন্তু তার ফলে কার্কের সংখ্যা বিপরীত কার্কের চেয়ে বেশি হবে কেন? তার কারণ পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো কণিকা এবং বিপরীত কণিকার ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়।

১৯৫৬ সাল অবধি বিশ্বাস ছিল পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো তিনটি পৃথক প্রতিসাম্যের (symmetry) প্রত্যেকটিকে মেনে চলে। এদের নাম C, P এবং T। C প্রতিসাম্যের অর্থ : বিধিগুলো কণিকা এবং বিপরীত কণিকার ক্ষেত্রে অভিন্ন। প্রতিসাম্য P এর অর্থ : বিধিগুলো যে কোন পরিস্থিতি এবং তার দর্পণ প্রতিবিম্বের (mirror igame) ক্ষেত্রে অভিন্ন হবে (দক্ষিণ দিকে ঘূর্ণায়মান একটি কণিকার দর্পণ প্রতিবিম্ব হবে বাম দিকে ঘূর্ণায়মান প্রতিবিম্ব) প্রতিসাম্য T এর অর্থ : আপনি যদি সমস্ত কণিকা এবং প্রতিকণিকার গতি বিপরীতমুখী করে দেন, তা হলে তন্ত্রটি (system) অতীত কালে যা ছিল সে অবস্থায় ফিরে যাবে। অর্থাৎ বিধিগুলো কালের সম্মুখ অভিমুখে এবং পশ্চাৎ অভিমুখে একই হবে।

১৯৫৬ সালে সুং-দাও লী (Tsung-Dao Lee) এবং চেন নিং ইয়াং (Chen Ning Yang)(৪) নামে দুজন আমেরিকান পদার্থবিদ প্রস্তাবনা করেন যে, আসলে দুর্বল বল (weak force) প্রতিসাম্য P মানে না। অর্থাৎ দুর্বল বল (weak force) তার দর্পণ প্রতিবিম্বের যেভাবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল মহাবিশ্বকে তার তুলনায় অন্যভাবে বিকশিত করাবে। সে বছরই চেন-শিউং উ (Chien-Shiung Wu) নামী আর একজন সহকর্মী তাদের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রমাণ করেন। সেই মহিলার পদ্ধতি ছিল : একটি চৌম্বক ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর কেন্দ্রগুলোকে এক সারে (lining up) সাজিয়ে দেয়া যায় ফলে তারা সবগুলোকেই অভিমুখে ঘূর্ণায়মান থাকে। তিনি দেখিয়েছিলেন এক অভিমুখের তুলনায় অন্য অভিমুখে বেশি সংখ্যক ইলেকট্রন নির্গত হয়। পরের বছর লী (Lee) এবং ইয়াং তাদের চিন্তাধারার জন্য নোবেল পুরস্কার পান। এও দেখা গিয়েছিল যে দুর্বল বল (weak force) প্রতিসাম্য C মেনে চলে না। অর্থাৎ এর ফরে বিপরীত কণিকা দিয়ে গঠিত মহাবিশ্বের আচরণ আমাদের মহাবিশ্বের চাইতে পৃথক হবে। তবুও মনে হয়েছিল দুর্বল বল CP এর যুক্ত প্রতিসাম্য মেনে চলে। অর্থাৎ এর উপরে যদি প্রতিটি কণিকাকে তার বিপরীতে কণিকার সঙ্গে বদলে নেয়া যায়, তা হলে মহাবিশ্ব তার দর্পণ প্রতিবিম্বের মত একইভাবে বিকাশ লাভ করবে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে জে. ডব্লিউ. ক্রোনিন J. W. Cronin) এবং ভ্যাল ফিচ্ (Val Fitch) নামক আরো দুজন আমেরিকান আবিষ্কার করেন কয়েকটি কণিকা তাদের অবক্ষয়ের সময় CP প্রতিসাম্য মেনে চলে না। এগুলোর নাম কে-মেস (K-Meson)। পরিণামে ১৯৮০ সালে ক্রোনিন এবং ফিচ্ তাদের গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন (আমরা হয়ত যা ভেবেছি, মহাবিশ্বের গঠন যে অতটা সরল নয় সেটা প্রমাণ করার জন্য অনেক পুরস্কার দেয়া হয়েছে।)

একটা গাণিতিক উপপাদ্য অনুসারে যে তত্ত্ব কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং অপেক্ষবাদ মেনে চলে, সে তত্ত্বকে সব সময়ই CPT এর সংযুক্ত প্রতিসাম্য মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ কণিকাগুলোর স্থলে যদি বিপরীত কণিকা (Anti-particle) প্রতিস্থাপন করা যায় এবং তার দর্পণ প্রতিবিম্ব নেয়া হয় আর কালের অভিমুখ বিপরীতগামী করা হয়, তা হলেও মহাবিশ্বের আচরণ একই রকম থাকবে। কিন্তু ক্রোনিন এবং ফিচ্ দেখালেন : যদি কণিকার স্থানে পিরীত কণিকা (anti-particle) স্থাপন করা যায় এবং সেটা যদি দর্পণ প্রতিবিম্বের রূপ গ্রহণ করে কিন্তু সময়ের অভিমুখ যদি বিপরীত না হয় তা হলে মহাবিশ্বের আচরণ অভিন্ন হবে না। সুতরাং সময়ের অভিমুখ বিপরীত হলে পদার্থবিদ্যার বিধির (law) পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তারা প্রতিসাম্য T মেনে চলে না।

আদিম মহাবিশ্ব অবশ্যই প্রতিসাম্য-T মানে না : সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়। সময়ের অভিমুখ পশ্চাদবর্তী হলে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হবে। এবং যেহেতু প্রতিসাম্য T মেনে চলে না এ রকম একাধিক বল রয়েছে, সেজন্য মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গেই এই বলগুলো (force) সে সংখ্যায় ইলেকট্রনগুলো বিপরীত কার্কে রূপান্তরিত হয় তার তুলনায় অনেক বেশি বিপরীত ইলেকট্রনকে কার্কে রূপান্তরিত করবে। তারপর মহাবিশ্ব যখন সম্প্রসারিত হয়ে শীতল হবে তখন বিপরীত কার্কগুলো কার্কের সঙ্গে বিনষ্ট হবে কিন্তু যেহেতু বিপরীত কার্কগুলোর তুলনায় কার্কের সংখ্যা সামান্য বেশি, সেজন্য সামান্য বেশি পরিমাণ কার্ক অবশিষ্ট থাকবে। আজকের দিনে যে পদার্থ আমরা দেখতে পাই এবং যা দিয়ে আমরা নিজেরাও তৈরি হয়েছি সে পদার্থ এই কার্ক দিয়েই তৈরি। সুতরাং আমাদের অস্তিত্বটাকেই মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বগুলোর (grand unified theory) সপক্ষে প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু এ প্রমাণ গুণগত (qualitive) মাত্র। অনিশ্চিতিগুলো এমনই যে বিনাশের পর অবশিষ্ট কার্কের সংখ্যা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়, এমন কি কার্ক অবশিষ্ট থাকবে না বিপরীত কার্ক অবশিষ্ট থাকবে সেটা বলা সম্ভব নয় (যদি বিপরীত কার্ক বেশি থাকত, তাহলে কিন্তু আমরা সোজাসুজি বিপরীত কার্কের নাম দিতাম কার্ক এবং কার্কের নাম দিতাম বিপরীত কার্ক)।

মহাকর্ষীয় ভর মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। এতে খুব বেশি কিছু এসে যায় না। কারণ, মহাকর্ষীয় ভর এত দুর্বল যে মৌলিক কণিকাগুলো কিম্বা পরমাণু নিয়ে বিচার করার সময় আমরা সাধারণভাবে মহাকর্ষীয় বলকে অগাহ্য করতে পারি। কিন্তু যেহেতু এই বলের পাল্লা (range) দীর্ঘ এবং সবসময়ই আকর্ষণী, সেজন্য এই বলের ক্রিয়াগুলো পরস্পরের সঙ্গে যোগযুক্ত হয় (add up)। ফলে পদার্থ কণিকাগুলোর সংখ্যা যথেষ্ট বৃহৎ হলে মহাকর্ষীয় বলগুলো অন্যান্য সমস্ত বলের উপরে প্রাধান্য লাভ করতে পারে। সেজন্য মহাকর্ষ বিশ্বের বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে। এমন কি যে সমস্ত বস্তুপিণ্ডের আকার তারকার মত সেগুলোর ক্ষেত্রেও মহাকর্ষীয় বল অন্যান্য সমস্ত বলের উপরে প্রাধান্য লাভ করতে পারে। ফলে তারকাটি চুপসে যেতে পারে (collapse)। ১৯৭০ এর দশকে আমার গবেষণার বিষয় ছিল তারকা চুপসে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর এবং সেগুলোর সর্ব পার্শ্বের তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রসমূহ। এই গবেষণা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তত্ত্ব এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদ কিভাবে পরস্পরকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে প্রথম ইঙ্গিতের পথিকৃৎ। এটা ছিল আগামী দিনের কোয়ান্টাম তত্ত্বীয় মহাকর্ষের রূপের একটি ছায়া (glimpse)।

———
১. তাহলে এগুলো মানুষের চোখে দৃশ্যমান আলোকরূপে ধরা পড়ে।

২. বোসন নামটি হয়েছে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম থেকে–অনুবাদক।

৩. রুলেট : এক ধরনের জুয়া খেলা। একটা টেবিলের মাঝখানে একটা চক্র থাকে সেটা ঘোরানো যায়। তার উপরে একটা বল চাপিয়ে দেয়া হয়। বলটা শেষ পর্যন্ত টেবিলের একটা ধাপে গিয়ে পড়ে। খাপগুলোতে একটা করে সংখ্যা লেখা থাকে। –অনুবাদক।

৪. সঠিক চীনা উচ্চারণ অনুবাদকের জানা নেই –অনুবাদক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *