০১. মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিত্র

কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Brief History of Time)
মূল : স্টিফেন ডব্রু হকিং
অনুবাদক মো: রিয়াজ উদ্দিন খান

.

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

১৯৮২ সালে হার্ভার্ডে লোয়েব (Loeb) বক্ততাবলি দানের পর থেকেই আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম স্থান এবং কাল বিষয়ে সাধারণের জন্য একটি বই লেখার চেষ্টা করব। মহাবিশ্বের প্রথম অবস্থা এবং কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে ইতঃপূর্বে অনেকগুলো বই লেখা হয়েছিল। স্টিফেন উইনবার্গের অত্যন্ত ভাল বই প্রথম তিন মিনিট’ (The First Three Minutes) থেকে শুরু করে অত্যন্ত খারাপ বই পর্যন্ত (তবে অত্যন্ত খারাপ বইয়ের নামটা আমি করব না)। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে সমস্ত প্রশ্ন আমার সৃষ্টিতত্ত্ব (cosmology) এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব (কণাবাদী তত্ত্ব) নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ, কোনও বইয়েই সে প্রশ্নগুলো নিয়ে সঠিক আলোচনা হয়নি। প্রশ্নগুলো হল : মহাবিশ্ব কোত্থেকে এসেছে? কিভাবে এর শুরু? কেনই বা এর শুরু হল? মহাবিশ্ব কি শেষ হয়ে যাবে? যদি হয় তবে কিভাবে হবে? এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আমাদের সবারই ঔৎসুক্য রয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এমন জটিল (technical) হয়ে উঠেছে যে শুধুমাত্র তার বিবরণের জন্য ব্যবহৃত গণিত আয়ত্ত করতে পেরেছেন খুব স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞ। তবুও মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও নিয়তি (fate) সম্পর্কিত মূলগত ধারণাগুলো গণিত ছাড়াই বলা যায়। এবং এমনভাবে বলা যায় যে যাদের বিশেষ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা নেই, তাঁরাও সেটা বুঝতে পারবেন। এ বইয়ে আমি সেই চেষ্টাই করছি। সফল হয়েছি কি না সে বিচার করবেন পাঠকরা।

আমাকে একজন বলেছিলেন : এক একটি সমীকরণ ব্যবহার করার অর্থ হবে পাঠকের সংখ্যা অর্ধেক করে কমে যাওয়া। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম, কোনও সমীকরণই (equation) ব্যবহার করব না। শেষ পর্যন্ত আমি একটি সমীকরণ ব্যবহার করেছি–আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc^2 আমার আশা, এর ফলে আমার ভাবী পাঠকদের অর্ধেক ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবেন না।

এ. এল. এস (ALS) অথবা মোটর নিউরন (Motor Neuron) ব্যাধির মত একটি দুর্ভাগ্য ছাড়া অন্য প্রায় সব ব্যাপারেই আমি ভাগ্যবান। আমার স্ত্রী জেন এবং আমার ছেলেমেয়ে রবার্ট, লুসি আর টিমির কাছে আমি যে সাহায্য পেয়েছি, তার ফলে আমার পক্ষে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব হয়েছে এবং সম্ভব হয়েছে কর্মজীবনে সাফল্য লাভ করা। তাছাড়া আছে আর একটি সৌভাগ্য– আমি বেছে নিয়েছিলাম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা তার সবটাই মনের ভিতরে কাজ। সুতরাং আমার অসুস্থতা একটা কঠিন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার বৈজ্ঞানিক সহকর্মীদের প্রত্যেকেই যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।

আমার কর্মজীবনের প্রথম ক্লাসিক্যাল পর্যায়ে আমার প্রধান সহচর এবং সহকর্মী ছিলেন রজার পেন্‌রোজ (Roger Penrose), রবার্ট গেরক (Robert Geroch), ব্রান্ডন কার্টার (Brandon Carter) এবং জর্জ এলিস্ (George Ellis)। এঁরা আমাকে যা সাহায্য করেছেন এবং আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে যে কাজ করেছি, তার জন্য আমি এদের কাছে কৃতজ্ঞ।

এই অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসার রয়েছে বৃহৎ মানে স্থান-কালের গঠন’ (The Large Scale Structure of Spacetime) পুস্তকে। সে পুস্তকটি আমি আর এলিস্ লিখেছিলাম ১৯৭৩ সালে। আমার পাঠকদের প্রতি আমার উপদেশ আরো সংবাদ সংগ্রহের আশায় ও বইটা না পড়া। বইটা অত্যন্ত জটিল, বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে পূর্ণ এবং বেশ অপাঠ্য। আমার আশা, কি করে সহজে বোধগম্য হওয়ার মত লিখতে হয়, ঐ বইটা লেখার পর এতদিনে আমি সেটা শিখেছি।

১৯৭৪ সাল থেকে আমার কর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ “কোয়ান্টাম (কণাবাদী)” পর্যায়ে আমার প্রধান সহযোগী ছিলেন গ্যারী গিবস (Gary Gibbons), ড পেজু (Don Page) এবং জিম্ হার্টল Jim Hartle)। তাঁদের কাছে এবং আমার গবেষণাকারী ছাত্রদের কাছে আমার অনেক ঋণ। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় অর্থেই তারা আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করা আমাকে বিরাটভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমার আশা, আমি সেজন্যই কোনও কানা গলিতে ঢুকে পড়িনি।

এই বইটির ব্যাপারে আমার ছাত্র ব্রায়ান হুইটের (Brian Whitt) কাছ থেকে আমি প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। বইটির প্রথম খসড়া করার পর ১৯৮৫ সালে আমার নিউমোনিয়া হয়। আমার ট্রাকিওস্টমি (Tracheostomy শ্বাসনালীর একটি অপারেশন) করতে হয়। ফলে আমার কথা বলার ক্ষমতা লোপ পায় এবং অন্যের সঙ্গে বাক্যালাপও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমি ভেবেছিলাম বইটি আমি শেষ করতে পারব না। কিন্তু ব্রায়ান শুধুমাত্র পুনর্বিচারের জন্য আবার পাঠ করতেই সাহায্য করেনি, উপরন্তু সে আমাকে লিভিং সেন্টার (Living Center) নামক যোগাযোগ পদ্ধতি (communication programme) ব্যবহার করায়। এটা আবার আমাকে দান করেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের ওয়ার্ডস প্লাস ইনকরপোরেটেড-এর (Words Plus Inc) ওয়াল্ট ওলটোজ (Walt Woltosz)। এর সাহায্যে আমি বই এবং গবেষণাপত্র লিখতে পারি। তাছাড়া স্পীচ প্লাস (Speech Plus) আমাকে যে স্পীচ সিনসেথাইজার (Speech Synthesizer) দান করেছেন তার সাহায্যে আমি লোকজনের সঙ্গে কথাও বলতে পারি। এঁরাও ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের। ডেভিড মেসন (David Mason) আমার হুইল চেয়ারে একটা সিনথেসাইজার এবং ছোট একটা ব্যক্তিগত কম্পিউটার লাগিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে– আসলে আমার কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে যা পারতাম এখন তার চাইতে ভাল বাক্যালাপ করতে পারি।

যারা প্রথম খড়সাটি দেখেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই বইটির উন্নতির জন্য উপদেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে উপদেশ দিয়েছেন ব্যান্টাম বুকস (Bantam Books)। আমার এ বইটির সম্পাদক পিটার গাঁজার্ডি (Peter Guzzardi)। যে সব বিষয়ে ভাল করে ব্যাখ্যা করা হয়নি বলে তিনি ভেবেছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে তিনি পাতার পর পাতা মন্তব্য আর প্রশ্ন পাঠিয়েছেন। যে সব জিনিস পাল্টাতে হবে, তার ঐ বিরাট তালিকা পেয়ে আমি রীতিমত বিরক্ত হয়েছিলাম সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি ঠিকই করেছিলেন। আমার নাকটা মাটিতে ঘষে দেয়ার ফলে বইটা অনেক ভাল হয়েছে

এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমার সহকারী কলিন উইলিয়ামস্ (Colin Williams), ডেভিড় টমাস্ (David Thomas) এবং রেমন্ড লাফ্লাম (Raymond Laflamme), আমার সেক্রেটারী জুডি ফেলা Judy Fella), wa 1612€ (Ann Ralph), corso forteta (Cheryl Billington) 478 J TV (Sue Masey) এবং আমার নার্সদের দলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার গবেষণা এবং চিকিৎসা বাবদ গনভিল (Gonville) এবং কাইয়াস কলেজ (Caius College), দি সায়েন্স এ্যান্ড এজিনীয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল (The Science and Engineering Research Council) এবং র‍্যাফল স্মিথ ফাউন্ডেশান (Ralph Smith Fundations) এরা যদি আমায় অর্থ দান না করতেন, তাহলে এ সমস্ত কাজ সম্ভব হত না। আমি সবার কাছেই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

স্টিফেন হকিং
২০ অক্টোবর, ১৯৮৭

.

ভূমিকা

বিশ্ব সম্পর্কে প্রায় কিছুমাত্রই না বুঝে আমরা দৈনন্দিন জীবন যাপন করি। যে যন্ত্র থেকে সূর্যালোক উৎপন্ন হচ্ছে এবং জীবন সম্ভব হচ্ছে, যে মহাকর্ষ আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে আটকে রাখে তা না হলে পৃথিবী আমাদের লাটুর মত ঘুরিয়ে মহাবিশ্বের স্থানে (space) নিক্ষেপ করত] কিম্বা যে পরমাণু দিয়ে আমরা তৈরি এবং যার স্থিরত্বের উপরে আমরা মূলগতভাবে নির্ভরশীল, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই ভাবি না। প্রকৃতিকে আমরা যেমন দেখি, প্রকৃতি কেন তেমন হল, মহাবিশ্ব কোত্থেকে এল, কিম্বা মহাবিশ্ব কি সব সময় এখানে ছিল, কালস্রোত কি কখনো পশ্চাদ্‌গামী হবে এবং কার্যকারণের পূর্বগামী হবে কিম্বা মানুষের পক্ষে যা জানা সম্ভব তার কি একটা চরম সীমা আছে? শিশুরা ছাড়া কেউই এ সমস্ত চিন্তায় বিশেষ কালক্ষেপ করেন না। (শিশুদের জ্ঞান এত অল্প যে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো না করে পারে না। আবার এমন কিছু শিশুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, যারা প্রশ্ন করেছে কৃষ্ণগহ্বর দেখতে কেমন, পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ কি? আমরা কেন অতীতই মনে রাখি ভবিষ্যৎ কেন মনে রাখি না? আগে বিশৃঙ্খলা (chaos) ছিল, এখন মনে হয় শৃঙ্খলা রয়েছে, এ রকম কেন হল? একটা মহাবিশ্বের অস্তিত্ব কেন রয়েছে?

আমাদের সমাজে এখনো রীতি হল– বাবা মা কিম্বা শিক্ষকরা এ প্রশ্নের উত্তরে একটু ঘাড় বেঁকান। কিম্বা অস্পষ্ট ধর্মীয় ধারণার সাহায্য নেন। এ সমস্ত প্রশ্নে কেউ কেউ অস্বস্তি বোধ করেন। তার কারণ মানুষের বোধশক্তির সীমারেখা এসব প্রশ্নগুলো বেশ স্পষ্টভবে ধরিয়ে দেয়।

কিন্তু দর্শন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির অনেকটাই হয়েছে এই সমস্ত প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত হয়ে। বয়স্কদের ভিতরে যারা এই সমস্ত প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক তাদের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক সময় তারা কিছু আশ্চর্যজনক উত্তর পান। পরমাণু এবং তারকা থেকে সমান দূরত্বে আমাদের অবস্থান। অতি ক্ষুদ্র এবং অতি বৃহৎকে নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানের সীমারেখা আমরা বাড়িয়ে চলেছি।

১৯৭৪ সালের বসন্ত কালে, ভাইকিং মহাকাশযান মঙ্গলগ্রহে অবতরণের প্রায় দু’বছর আগে আমি ইংল্যান্ডে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির উদ্যোগে আহুত একটি সভায় উপস্থিত ছিলাম। সভার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী বহির্ভূত জীব অনুসন্ধান কিভাবে করা যায় সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা। কফি খাওয়ার ফাঁকে আমি দেখলাম, পাশের হলে আরো অনেক বড় একটা সভা হচ্ছে। কৌতূহলের বশে আমি সেখানে ঢুকলাম। অচিরে বুঝতে পারলাম আমি একটা প্রাচীন রীতি দেখছি। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিদগ্ধ জনসংগঠনগুলোর একটি হল রয়্যাল সোসাইটি (Royal Society)। সেখানে হচ্ছে নতুন ফেলোর অভিষেক। সামনের সারিতে হুইল চেয়ারে বসে একজন তরুণ খুব ধীরে একটি খাতায় নাম সই করছিলেন। সেই খাতার প্রথম দিকটায় ছিল আইজাক নিউটনের স্বাক্ষর। স্বাক্ষর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিরাটভাবে অভিনন্দিত করা হল। এমন কি তখনও স্টিফেন

হকিং (Stephen Hawking) ছিলেন একজন প্রবাদ পুরুষ। হকিং এখন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শাস্ত্রের লুকেসিয়ান অধ্যাপক (Lucasian Professor)। এক সময় নিউটন ছিলেন এই পদের অধিকারী এবং পরে এ পদে ছিলেন পি, এ, এম. ডিরাক (P. A. M. Dirac)। এঁরা দুজনে ছিলেন অতিবৃহৎ এবং অতিক্ষুদ্র নিয়ে বিখ্যাত গবেষক। হকিং তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি। এঁর এই প্রথম বই থেকে সাধারণ পাঠক অনেক কিছুই পাবেন। এ বইয়ের বিরাট ব্যাপকত্ব যেমন আকর্ষণীয়, তেমন আকর্ষণীয় লেখকের মানসিক ক্রিয়া সম্পর্কীয় আভাস। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, মহাবিশ্বতত্ত্ব (Cosmology) এবং সাহসের সীমান্ত এ বইয়ে সহজভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

এ বইটা ঈশ্বর সম্পর্কেও বটে। হয়ত ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সম্পর্কে। এর পাতায় পাতায় ইশ্বর রয়েছেন। আইনস্টাইনের বিখ্যাত প্রশ্ন ছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার সময় ঈশ্বরের কি অন্যরকম কিছু করার সম্ভাবনা ছিল? হকিং এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। হকিং স্পষ্টই বলছেন তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে চেষ্টা করছেন। তার প্রচেষ্টায় তিনি এ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, সে সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত। এ মহাবিশ্বের স্থানে কোন কিনারা (edge) নেই, কালে কোন শুরু কিম্বা শেষ নেই এবং স্রষ্টার করার মত কিছু নেই।

কার্ল সাগান
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়
ইথাকা, নিউইয়র্ক।

.

০১. মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিত্র (Our Picture of the Universe)

একজন সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক (অনেকে বলেন, বাট্রান্ড রাসেল) একবার জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী কি করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, আবার সূর্য কি করে আমাদের নীহারিকা galaxy) অর্থাৎ বিরাট এক তারকা সংগ্রহের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে ঘোরে। বক্তৃতার শেষে ঘরের পিছন থেকে ছোটখাটো এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এতক্ষণ আপনি আমাদের যা বলেছেন, সব বাজে কথা। পৃথিবীটা আসলে চ্যাপ্টা, আর রয়েছে বিরাট এক কচ্ছপের পিঠের উপর।” বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “কচ্ছপটা কার উপর দাঁড়িয়ে আছে?” বৃদ্ধা বললেন, “ছোকরা, তুমি বেশ চালাক খুব চালাক। তবে তলায় পরপর সবই কচ্ছপ রয়েছে।”

মহাবিশ্ব অসংখ্য কচ্ছপের স্তম্ভ- এ চিত্র অধিকাংশের কাছেই হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু আমরা বেশি জানি এ কথা ভাবব কেন? মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কি জানি এবং কিভাবে জানি? মহাবিশ্ব এসেছে কোত্থেকে এবং যাচ্ছেই বা কোথায়? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল? যদি থেকে থাকে তাহলে তার আগে কি হয়েছিল? কালের চরিত্র কি? কাল কি কখনো শেষ হবে? পদার্থবিদ্যার ইদানীং কালের আবিষ্কারের সাহায্যে (সে আবিষ্কারগুলো অংশত হয়েছে কিছু অকল্পনীয় প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে) এই সমস্ত বহুদিনের বহু প্রাচীন প্রশ্নগুলোর কিছু কিছু উত্তরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কোন দিন হয়ত এই উত্তরগুলোকে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার মত স্বতঃপ্রতীয়মান মনে হবে। কিম্বা হয়ত মনে হবে কচ্ছপের স্তম্ভের মত হাস্যকর। এ সম্পর্কে শুধুমাত্র কালই (সে যাই হোক) বলতে পারবে।

প্রাচীনকালে ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তার অন দি হেভেন্স (On The Heavens–মহাকাশ সম্পর্কে) বইতে পৃথিবী যে একটি বৃত্তাকার গোলক এবং একটা চ্যাপ্টা থালা নয়, এ সম্পর্কে দুটি ভাল যুক্তি দেখাতে পেরেছিলেন। প্রথমত, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চন্দ্রগ্রহণের কারণ সূর্য এবং চন্দ্রের মাঝখানে পৃথিবীর আসা। চন্দ্রের উপর পৃথিবীর ছায়া সব সময়েই গোলাকৃতি। পৃথিবী গোলাকৃতি বলেই এটা সম্ভব। পৃথিবী যদি চ্যাপ্টা থালার মত হত তা হলে সূর্য যখন থালার কেন্দ্রের ঠিক নিচে অবস্থান করছে তখনই গ্রহণ না হলে ছায়াটি হত লম্বাটে এবং উপবৃত্তাকার (ellipti cal)। দ্বিতীয়ত, গ্রীকরা তাদের ভ্রমণের ফলে জানতেন দক্ষিণ দিক থেকে দেখলে উত্তর দিক থেকে দেখার তুলনায় দ্রুবতারাকে (North Star) আকাশের অনেক নিচুতে দেখা যায়। (যেহেতু ধ্রুবতারা উত্তর মেরুর উপরে অবস্থিত, সেজন্য উত্তর মেরুর একজন পর্যবেক্ষকের মনে হয় তারাটি ঠিক তার মাথার উপরে। কিন্তু বিষুররেখা থেকে দেখলে মনে হয় তারাটির অবস্থান দিবালে)। মিশর এবং গ্রীস থেকে ধ্রুবতারার আপাতদৃষ্ট অবস্থানের পার্থক্য পর্যালোচনা করে অ্যারিস্টটল পৃথিবীর পরিধির একটা অনুমান করেছিলেন : চার লক্ষ স্ট্যাডিয়া (stadia)। স্ট্যাডিয়ামের (Stadium) দৈর্ঘ্য ঠিক কতটা সেটা জানা যায় না। তবে প্রায় ২০০ গজ হয়ত ছিল। তা হলে ইদানীং কালের স্বীকৃত মাপের তুলনায় অ্যারিস্টটলের অনুমান প্রায় দ্বিগুণ। বৃত্তাকার এ তথ্যের সপক্ষে গ্রীকদের আরো একটি যুক্তি ছিল। তা না হলে দিকচক্রবাল থেকে জাহাজ আসার সময় প্রথম কোন পাল দেখা যাবে এবং তারপরে কেন দেখা যাবে জাহাজের কাঠামোটা?

অ্যারিস্টটল ভাবতেন পৃথিবীটা স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও তারকারা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার কক্ষে চলমান। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন তার কারণ অতীন্দ্রিয়বাদী (mystical) যুক্তিতে তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং বৃত্তাকার গতি সবচাইতে নিখুঁত। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টোলেমী (Ptolemy) এই ধারণা বিস্তার করে ব্রহ্মাণ্ডের একটি সম্পূর্ণ প্রতিরূপ (Cosmological model) তৈরি করেছিলেন। পৃথিবী ছিল কেন্দ্রে এবং তাকে ঘিরে ছিল আটটি গোলক। এই গোলকগুলো বহন করত চন্দ্র, সূর্য, তারকা এবং সেই যুগে জানিত পাঁচটি গ্রহ বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি (চিত্র ১.১)। গ্রহগুলো নিজেরা তাদের নিজ নিজ গোলকের সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্রতর বৃত্তে ভ্রমণ করে। এই বিবরণ ব্যাখ্যা করত তাদের আকাশে পর্যবেক্ষণ করা পথের জটিলতা। সবচাইতে বাইরের গোলকে থাকে তথাকথিত স্থির তারকাগুলো, এই তারকাগুলো পরস্পর সাপেক্ষ সব সময়ই একই অবস্থানে থাকে কিন্তু তারা একত্রে আকাশের এপার থেকে ওপারে ঘোরে। শেষ গোলকের বাইরে কি থাকত সেটা কখনোই স্পষ্ট ছিল না। তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই মানুষের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের অংশ ছিল না।

টোলেমীর (Ptolemy) প্রতিরূপ থেকে মহাকাশের বস্তুপিণ্ডগুলোর আকাশে অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব ছিল। সেজন্য টোলেমীকে একটা অনুমান করতে হয়েছিল : চন্দ্র এমন একটি পথ পরিভ্রমণ করে, যে পথে অনেক সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদের নৈকট্য দ্বিগুণ হয়। এর অর্থ চন্দ্রের আকার অনেক সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ দেখানো উচিত। এই ত্রুটি টোলেমী বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবুও এই প্রতিরূপটি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য সবাই মেনে নেন নি। খ্রিস্টীয় চার্চ এই প্রতিরূপ গ্রহণ করেছিল। তার কারণ তাদের ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে এই প্রতিরূপের মিল ছিল। এই প্রতিরূপের সুবিধা হল, স্থির তারকাগুলোর গোলকের বাইরে স্বর্গ এবং নরকের জন্য অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায়।

নিকোলাস কোপারনিকাস (Nicholas Copernicus) নামক একজন পোলিশ পুরোহিত ১৫১৪ সালে একটি সরলতর প্রতিরূপ উপস্থাপন করেন (প্রথমে হয়ত নিজেদের চার্চ ধর্মবিরোধী বলবে এই ভয়ে কোপারনিকাস নিজের প্রতিরূপটি নিজের নাম না দিয়ে প্রচার করেন)। তার ধারণা ছিল সূর্য কেন্দ্রে স্থিরভাবে অবস্থান করে এবং পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহ বৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই চিন্তাধারাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে প্রায় এক শতাব্দী লাগে। তারপর জার্মান জোহান কেপলার এবং ইতালীয়ান গ্যালিলিও গ্যালিলি এই দুজন জ্যোতির্বিদ প্রকাশ্যভাবে কোপারনিকাসের তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করতে শুরু করেন। অথচ, এই তত্ত্ব যে রকম কক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছিল তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা কক্ষের সম্পূর্ণ মিল ছিল না। অ্যারিস্টটলীয় টোলেমীয় তত্ত্বের উপর মরণ আঘাত আসে ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর গ্যালিলিও সদ্য আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে রাত্রির আকাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। বৃহস্পতি গ্রহকে দেখার সময় তিনি কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগ্রহ অর্থাৎ চন্দ্র দেখতে পান। সেগুলো বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। এর নিহিত অর্থ হল, অ্যারিস্টটল এবং টোলেমী যা ভাবতেন সেই মতানুসারে যদিও সবারই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা উচিত, তবুও সব জিনিসই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না (অবশ্য তখনও বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল : পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থিরভাবে অবস্থান করছে এবং বৃহস্পতির চন্দ্রগুলো অত্যন্ত জটিল পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। পথটা এমন যে, মনে হয় তারা বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু কোপারনিকাসের তত্ত্ব ছিল অনেক সরল)। একই সময় জোহান কেপলার কোপারনিকাসের তত্ত্বের পরিবর্তন করেন। তাঁর মতে গ্রহগুলো বৃত্তাকারে চলমান নয়, চলমান উপবৃত্তাকারে (ellipse : উপবৃত্ত লম্বাটে একটা বৃত্ত)। শেষ পর্যন্ত পূর্বাভাস এবং পর্যবেক্ষণে মিল হল।

কেপলারের কাছে কিছু উপবৃত্তাকার কক্ষ ছিল একটি অস্থায়ী প্রকল্প মাত্র বরং এ প্রকল্প ছিল প্রতিকূল। কারণ উপবৃত্ত স্পষ্টতই বৃত্তের চাইতে কম নিখুঁত। কেপলার আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করেন : পর্যবেক্ষণের সঙ্গে উপবৃত্ত ভাল মেলে। তার ধারণা ছিল গ্রহগুলোকে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে বাধ্য করে চৌম্বক বল। এই ধারণার সঙ্গে এই আকস্মিক আবিষ্কারকে তিনি মেলাতে পারছিলেন না। এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনেক পরে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে। স্যার আইজাক নিউটন তার ফিলোজফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া sytecipt (Philosophiae Naturalis Principia Matchematica) 910 প্রকাশ করার পর। এটা বোধ হয়, ভৌত বিজ্ঞান বিষয়ে প্রকাশিত বইগুলোর ভিতরে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এ বইটাতে নিউটন শুধুমাত্র স্থান-কালে বস্তুপিণ্ডগুলো কি করে চলাচল করে সে সম্পর্কে তত্ত্বকথাই দেন নি, তিনি এই গতিগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য যে জটিল গণিত প্রয়োজন সেটাও সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়া নিউটন একটি প্রকল্পিত সর্বব্যাপী মহাকর্ষীয় বিধি উপস্থাপন করেন। এই বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুপিণ্ডই পরস্পরের প্রতি একটি বল দ্বারা আকৃষ্ট হয়, বস্তুপিণ্ডগুলো পরস্পরের যত নিকটতর হবে, এই বল ততই শক্তিশালী হবে। তাছাড়া সে বলের শক্তি বৃদ্ধি হবে বস্তুপিরে ভর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। এই বলই বস্তুপিণ্ডগুলোর মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণ। (প্রচলিত কাহিনী হল: নিউটনের মাথায় একটা আপেল পড়াতে নিউটন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এ কাহিনী প্রায় নিশ্চিতভাবে অপ্রমাণিত। নিউটন নিজে যা বলেছেন, তা হল, তিনি চিন্তা করার মেজাজে’ বসেছিলেন, তখন একটা আপেল পড়তে দেখে তাঁর মাথায় মহাকর্ষ সম্পর্কে ধারণা এসেছে)। নিউটন আরো দেখিয়েছিলেন, তার বিধি অনুসারে মহাকর্ষ চন্দ্রকে উপবৃত্তাকার কক্ষে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করায় এবং সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার পথে ভ্রমণের কারণও এই মহাকর্ষ।

কোপারনিকাসের প্রতিরূপ টোলেমীর মহাকাশের নানা গোলক celestical spheres) সম্পর্কে ধারণা দূরীভূত করে এবং তার সঙ্গে দূরীভূত হয় মহাকাশের একটি স্বাভাবিক সীমানা রয়েছে সেই ধারণা। পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তনে দরুন স্থির তারকাগুলোর আকাশে আড়াআড়ি ঘূর্ণন (accross the sky) ছাড়া ‘সেগুলোর’ অবস্থানের কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এইজন্য স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা হয়েছিল যে ওগুলো আমাদের সূর্যের মতই বস্তু, তবে তাদের অবস্থান আরো দূরে।

নিউটন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর মহাকর্ষীয় তত্ত্ব অনুসারে তারকাগুলোর পরস্পরকে আকর্ষণ করা উচিত। সুতরাং মনে হয়েছিল তারা মূলত গতিহীন থাকতে পারে না। কোন একটি বিন্দুতে কি তাদের একসঙ্গে পতন হবে না? সে যুগের আর একজন চিন্তানায়ক রিচার্ড বেন্টলীকে (Richard Bentley ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দে একটি পত্রে নিউটন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, এ রকম হতে পারত শুধুমাত্র যদি তারকাগুলোর সংখ্যা সীমিত হত এবং তারা যদি স্থানের একটি সীমতি অঞ্চলে বিতরণ (distributed) থাকত। কিন্তু তার যুক্তি ছিল : অন্য দিক থেকে বলা যায় যদি তারকার সংখ্যা অসীম হয়, তারা যদি সীমাহীন স্থানে কমবেশি সমরূপে বিতরণ (distributed) থাকে, তা হলে এ রকম হবে না। কারণ, পতিত হওয়ার মত কোন কেন্দ্রবিন্দু থাকবে না।

অসীমত্ব নিয়ে বলতে গেলে কি রকম ভুল হতে পারে এই যুক্তি তার একটা দৃষ্টান্ত। একটি অসীম মহাবিশ্বে প্রতিটি বিন্দুকেই একটি কেন্দ্র বলা যেতে পারে। তার কারণ প্রতিটি বিন্দুরই সর্বদিকে অসীম সংখ্যক তারকা থাকবে। অনেক পরে বোঝা গিয়েছিল নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গি হবে শুধু সীমিত পরিস্থিতির বিচার করা। সেই পরিস্থিতিতে তারকাগুলোর পরস্পরের উপর পতিত হবে। তারপর প্রশ্ন করা উচিত এই অঞ্চলের বাইরে যদি মোটামুটি সমরূপে বিতরণ আরো অনেক তারকাকে যোগ করা যায়, তা হলে কি পরিবর্তন হতে পারে। নিউটনের বিধি অনুসারে বাড়তি তারকাগুলো মূল তারকাগুলো ব্যাপারে গড়ে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবে না। সুতরাং তারকাগুলো একই দ্রুতিতে পতিত হবে। আমরা যত খুশি তারকা যোগ করতে পারি। তবুও তারা সর্বদা নিজেদের উপর (but they will always collapse is on themselves) পতিত হয়ে চুপসে যাবে। এখন আমরা জানি মহাবিশ্বের এমন একটি স্থির প্রতিরূপ অসম্ভব যে প্রতিরূপে মহাকর্ষ সব সময়ই আকর্ষণ করে।

বিংশ শতাব্দীর আগেকার চিন্তা জগতের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় ব্যাপার হল কেউই মহাবিশ্ব বিস্তৃত হচ্ছে কিম্বা সঙ্কুচিত হচ্ছে এ রকম প্রস্তাব উত্থাপন করেন নি। সাধারণত মেনে নেয়া হয়েছিল, হয় মহাবিশ্ব চিরকালই অপরিবর্তিত অবস্থায় বর্তমান ছিল, নয়ত কোন এক সীমিত কালে আমরা মহাবিশ্বকে যে রূপে দেখছি, মোটামুটি সেরূপেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। অংশত এর কারণ, লোকে চিরন্তন সত্য বিশ্বাস করতে চাইত, তাছাড়া নিজেরা বৃদ্ধ হয়ে মরে গেলেও মহাবিশ্ব চিরন্তন ও অপরিবর্তনশীল– এই চিন্তায় তারা সান্ত্বনা পেতেন।

এমন কি যারা বুঝতে পেরেছিলেন যে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব থেকে বোঝা যায় মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না, তারাও মহাবিশ্ব প্রসারমান এ রকম প্রস্তাবনা করেন নি। বরং তারা মহাকর্ষীয় তত্ত্বের পরিবর্তন করতে পেয়েছিলেন। তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন, অত্যন্ত বেশি দূরত্বে মহাকর্ষ বিকর্ষণ করে। এর ফলে গ্রহগতি সম্পর্কে তাঁদের পূর্বাভাসে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নি। বরং অসীমভাবে বিতরণ তারকাগুলোর ভারসাম্যের অবস্থা অনুমোদন করেছেন। তার কারণ, নিকটবর্তী। তারকাগুলো আকর্ষণবল এবং দূরের তারকাগুলোর বিকর্ষণবল ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু এখন আমরা বিশ্বাস করি এ রকম ভারসাম্য হবে অস্থির। কোন একটি অঞ্চলে তারকাগুলো যদি পরস্পরের সামান্য নিকটবর্তী হয় তা হলে তাদের অন্তর্বর্তী আকর্ষণী বলগুলো শক্তিশালী হবে এবং বিকর্ষণী বলের উপর প্রভুত্ব করবে। সুতরাং তারকাগুলো পরস্পরের প্রতি পড়তেই থাকবে। আবার অন্যদিকে তারকাগুলো যদি সামান্য দূরে হয় তা হলে বিকর্ষণবল প্রভুত্ব করবে এবং তারা পরস্পর থেকে দূরে হতেই থাকবে।

অসীম স্থির মহাবিশ্ব সম্পর্কে আর একটি আপত্তি সাধারণত আরোপ করা হয় জার্মান দার্শনিক হাইনরিখ ওবারসের (Heinrich Olbers) উপরে। তিনি এই তত্ত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন ১৮২৩ সালে। আসলে নিউটনের সমসাময়িক অনেকেই এই সমস্যা উত্থাপন করেছিলেন। এমন কি ওলবারসের প্রবন্ধটি এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তিপূর্ণ প্রথম প্রবন্ধ নয় কিন্তু এটাই প্রথমে বহুলোকের নজরে এসেছিল। মুশকিল হল, একটি অসীম স্থির মহাবিশ্বে দৃষ্টির প্রতিটি রেখাই একটি তারকার পৃষ্ঠে গিয়ে শেষ হবে। সুতরাং আশা করা যাবে রাত্রিতেও সমস্ত আকাশ সূর্যের মত উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এর বিরুদ্ধে ওলবারসের যুক্তি ছিল দূরের তারকা থেকে নির্গত আলোক অন্তর্বর্তী পদার্থের শোষণের ফলে ক্ষীণতর হবে। কিন্তু এরকম যদি ঘটে তা হলে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী পদার্থও এমন উত্তপ্ত হবে যে সেগুলো তারকার মত তাপোদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে রাতের আকাশের সম্পূর্ণটাই সূর্যপৃষ্ঠের মত উজ্জ্বল হবে। এই সিদ্ধান্ত এড়াবার একমাত্র উপায় এই অনুমান করা যে তারকাগুলো চিরকালই ভাস্বর নয়, তার ভাস্বরতা অতীতের কোন সীমিত কালে শুরু হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশোষণকারী পদার্থ হয়ত এখনো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি, কিম্বা হয়ত সুদূরের তারকাগুলো থেকে আলোক এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় নি। এর ফলে আর একটি প্রশ্ন আমাদের কাছে উপস্থিত হয়, সেটা হল তারকাগুলো প্রথম জ্বলল কি করে?

অবশ্য এর অনেক আগেই মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কয়েকটি আদিম সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ইহুদি, ক্রীশ্চান ও মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে মহাবিশ্বের শুরু একটি সীমিত অতীত কালে এবং সে কাল খুব সুদূর অতীত নয়। এই রকম একটা শুরুর সপক্ষে ছিল এই বোধ যে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য একটি “প্রথম কারণ (first cause)” প্রয়োজন। (মহাবিশ্বের ভিতরে আপনি সব সময়ই একটি ঘটনার ব্যাখ্যা হিসেবে অন্য একটি পূর্বতন ঘটনাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু মহাবিশ্বের নিজের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার একমাত্র উপায় হল তারও একটা শুরু আছে এই অনুমান)। সেন্ট অগাস্টিন তাঁর বই ‘দি সিটি অব গড’ (The City of God–ঈশ্বরের নগর) এ আর একটি যুক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখালেন, সভ্যতার প্রগতি হচ্ছে এবং কোন কাজ কে করেছিলেন এবং কোন প্রযুক্তি কার দ্বারা বিকাশ লাভ করেছিল সেটা আমাদের । মনে থাকে। সুতরাং মানুষ এবং হয়ত মহাবিশ্বেরও অস্তিত্ব খুব বেশি দিনের নয়। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কীয় পুস্তক (Book of Genesis) অনুসারে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine) এ তথ্য মেনে নিয়েছেন। (আকর্ষণীয় ব্যাপার হল এই তারিখ এবং দশ হাজার বছর আগেকার শেষ তুষার যুগের সমাপ্তি খুব বেশি দূরবর্তী নয়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, সভ্যতার সত্যিকারের শুরু সে সময় থেকেই।)

অন্যদিকে অ্যারিস্টটল এবং গ্রীক দার্শনিকদের অধিকাংশই সৃষ্টি সম্পকীয় ধারণা পছন্দ করতেন না। কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাগবত হস্তক্ষেপ বড় বেশি রয়েছে। সেইজন্য তারা বিশ্বাস করতেন, মানবজাতি এবং তার চারপাশের বিশ্ব চিরকাল ছিল এবং থাকবে। প্রাচীনরা প্রগতি সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত যুক্তিগুলো আগেই বিচার করেছেন। তাদের উত্তর ছিল মাঝে মাঝেই বন্যা কি ঐ রকম কোন বিপর্যয় ঘটেছে এবং মানবজাতিকে বারবার পিছনে ঠেলে সভ্যতার একেবারে শুরুতে নিয়ে গিয়েছে।

কালে মহাবিশ্বের কোনও শুরু ছিল কিনা এবং মহাবিশ্ব স্থানে সীমিত কিনা এ বিষয়ে পরবর্তীকালে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ১৭৮১ সালে প্রকাশিত তার মহান (এবং অতি দুর্বোধ্য) গ্রন্থ ‘ক্রিটিক অব্‌ পিওর রিজ’-এ (Critique of Pure Reason বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। প্রশ্নগুলোকে তিনি বিশুদ্ধ যুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ (অর্থাৎ বিরোধাভাস) বলেছেন। তার কারণ মহাবিশ্বের একটা আরম্ভ রয়েছে এ তত্ত্ব বিশ্বাস করার সপক্ষে যেমন দৃঢ় যুক্তি রয়েছে তেমন দৃঢ় যুক্তি রয়েছে মহাবিশ্ব চিরকালই ছিল এই তত্ত্বের সপক্ষে। তত্ত্বের সপক্ষে তার যুক্তি ছিল মহাবিশ্বের যদি কোন আরম্ভ না থেকে থাকে, তাহলে যে কোন ঘটনার পূর্বেই একটা অসীম কাল থাকা উচিত। তাঁর মতে এটা অসম্ভব। বিরোধী যুক্তির সপক্ষে যুক্তি; মহাবিশ্বের যদি শুরু থেকে থাকে, তাহলে তার পূর্বে একটা অসীম কাল ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে একটি বিশেষ সময়ে মহাবিশ্বের আরম্ভ কেন হবে? তত্ত্বের সপক্ষে এবং তার বিরোধী তত্ত্বের সপক্ষে যুক্তিগুলো আসলে একই। দুটোরই ভিত্তি তার অব্যক্ত অনুমান : মহাবিশ্ব চিরকাল থাকুক কিম্বা না থাকুক কাল চিরন্তনভাবে অতীতে রয়েছে। এরপর আমরা দেখব, মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কাল সম্পর্কীয় কল্পনা অর্থহীন। এটা প্রথম দেখিয়েছিলেন সেন্ট অগাস্টিন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কি করছিলেন, অগাস্টিন তখন উত্তর দেন নি। এই ধরনের প্রশ্ন যারা করেন তিনি তাদের জন্য তৈরি করছিলেন নরক। তার বদলে তার উত্তর ছিল মহাবিশ্বের কাল ঈশ্বরসৃষ্ট। মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কালের অস্তিত্ব ছিল না।

যখন অধিকাংশ লোকেরই বিশ্বাস ছিল মহাবিশ্ব মূলত স্থির এবং অপরিবর্তনশীল তখন মহাবিশ্বের আরম্ভ ছিল কি ছিল না– এ প্রশ্ন আসলে ছিল অধিবিদ্যা (meta physics) এবং ধর্মতত্ত্বের (theology)। যা পর্যবেক্ষণ করা হয় তার দুরকম ব্যাখ্যাই অতি সুষ্ঠুভাবে দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকালই ছিল এই তত্ত্বের ভিত্তিতে; কিম্বা একটি সীমিতকালে মহাবিশ্বকে এমনভাবে চালু করা হয়েছে যার ফলে মনে হয় মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকালই ছিল– এই তত্ত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডুইন হাবল (Edwin Hubble) একটি যুগনির্দেশক (land mark) পর্যবেক্ষণ করেন। সেটা হল, যে দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করবেন, সে দিকেই দেখা যাবে সুদূরের নীহারিকাগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য ভাষায় বলা চলে মহাবিশ্ব প্রসারমান। এর অর্থ হল, অতীতযুগে বস্তুপিণ্ডগুলো পরস্পরের নিকটবর্তী ছিল। আসলে মনে হয়েছিল দশ কিম্বা কুড়ি হাজার মিলিয়ান (১০,০০,০০০) বছর আগে সবগুলো নীহারিকা একই জায়গায় ছিল সুতরাং সে সময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অসীম। এই আবিষ্কার শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের আরম্ভের প্রশ্নকে বিজ্ঞানের এলাকায় নিয়ে আসে।

হাবলের পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হয় একটা কাল ছিল যার নাম দেয়া হয়েছে বৃহৎ বিস্ফোরণ (big bang)। তখন ছিল অসীম ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব (infinitesimally) এবং তার ঘনত্বও ছিল অসীম। এই রকম অবস্থায় বিজ্ঞানের সব বিধিই ভেঙে পড়ে। সুতরাং ভেঙে পড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। এর পূর্বকালে যদি কোন ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে বর্তমান কালে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সে ঘটনাগুলোকে তারা প্রভাবিত করতে পারে না। তাদের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করা যেতে পারে, কারণ পর্যবেক্ষণের উপর তার কোন প্রভাব থাকবে না। বলা যেতে পারে বৃহৎ বিস্ফোরণের সময় (big bang কালের শুরু। অর্থাৎ পূর্বতন কালের কোন সংজ্ঞা দেয়া যাবে না। বেশ দৃঢ়ভাবে এ কথা বলা উচিত যে, কালের আরম্ভ সম্পর্কে আগে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে এর অনেক পার্থক্য। পরিবর্তনহীন মহাবিশ্বে আরম্ভ এমন একটা জিনিস যা মহাবিশ্ব বহির্ভূত কোন সত্তা আরোপ করেছে। এই আরম্ভের কোন ভৌত প্রয়োজনীয়তা নেই। কল্পনা করা যেতে পারে আক্ষরিক অর্থে অতীতের যে কোন কালে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে, মহাবিশ্ব যদি বিস্তারমান হয় তা হলে আরম্ভ কেন থাকবে তার একটা ভৌত কারণ থাকতে পারে। তবুও কল্পনা করা যেতে পারে বৃহৎ বিস্ফোরণের মুহূর্তে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। কিম্বা সৃষ্টি করেছেন বৃহৎ বিস্ফোরণের পরে। কিন্তু এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন মনে হয় একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ হয়েছিল। তবে বৃহৎ বিস্ফোরণের আগে সৃষ্টি হয়েছিল এ রকম অনুমান করা হবে অর্থহীন। প্রসারমান মহাবিশ্ব স্রষ্টাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু সম্ভবত কবে তিনি কাজটি করেছেন তার উপর একটা সময়সীমা আরোপ করে।

মহাবিশ্বের চরিত্র সম্পর্কে বলতে হলে এবং মহাবিশ্বের শুরু কিম্বা শেষ আছে কিনা এই সমস্ত প্রশ্ন আলোচনা করতে হলে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাকে বলে সে সম্পর্কে আপনার একটা স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সাধারণ সরল মানুষ যা মনে করেন সেটা হল– তত্ত্ব মহাবিশ্বের একটা প্রতিরূপ (model), কিম্বা প্রতিরূপ মহাবিশ্বের একটা সীমিত অংকের এবং আমরা যা পর্যবেক্ষণ করছি, তার সঙ্গে প্রতিরূপের পরিমাণগুলোকে সম্পর্কযুক্ত করে এ রকম কতকগুলো নিয়ম। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিচ্ছি। এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের মনে। তার অন্য কোন বাস্তবতা নেই (এর অর্থ যাই হোক না কেন)। একটা তত্ত্বকে ভাল তত্ত্ব বলা যেতে পারে যদি সে তত্ত্ব দুটি প্রয়োজন সিদ্ধ করে : যে প্রতিরূপে কয়েকটি মাত্র দৃচ্ছিক (arbitrary) উপাদান রয়েছে তার ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট শ্রেণীকে নির্ভুলভাবে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট শ্রেণীকে নির্ভুলভাবে অবশ্যই করতে হবে। উদাহরণ অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব : সব জিনিসই ক্ষিতি (earth), মরুৎ (air), অগ্নি (fire) এবং অপ water) এই কটি উপাদান দিয়ে গঠিত। এ তত্ত্বের সারল্য অনুমোদনের উপযুক্ত ছিল। কিন্তু এ তত্ত্ব কোন নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি। অন্যদিকে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ভিত্তি ছিল সরলতর। এ তত্ত্ব অনুসারে বস্তুপিণ্ডগুলো পরস্পরকে একটি বল দ্বারা আকর্ষণ করে। সে বল তাদের ভর (mass) নামক একটি পরিমাণের আনুপাতিক (proportional) এবং তাদের পারস্পরিক দূরত্বের বর্গের ব্যস্ত আনুপাতিক (inversely proportional)। কিন্তু তবুও এ তত্ত্ব চন্দ্র, সূর্য এবং গ্রহগুলোর গতি সম্পর্কে অতি উচ্চমানের নির্ভুলতা সম্পন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করে।

যে কোন ভৌততত্ত্ব সব সময়ই সাময়িক (provisional)। এর অর্থ হল, এটা একটি প্রকল্প মাত্র। আপনি কখনোই একে প্রমাণ করতে পারেন না। একটি তত্ত্বকে পরীক্ষার ফল যতবারই সত্য প্রমাণিত করুক না কেন পরের পরীক্ষার ফল যে তত্ত্বকে সত্য প্রমাণিত করবে; তত্ত্বের বিরুদ্ধে যাবে না– এ সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন না। অন্য দিকে, তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর বিরোধী একটি মাত্র পর্যবেক্ষণও তত্ত্বকে অপ্রমাণ করতে পারে বিজ্ঞানের দর্শনের দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) জোরের সঙ্গেই বলেছেন, একটি ভাল তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হল যে, সে তত্ত্ব এমন কতকগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করবে যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো নীতিগতভাবে অপ্রমাণ কিম্বা মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব হবে। যতবারই নতুন পরীক্ষায় দেখা যায় পর্যবেক্ষণমূলক ফলের সঙ্গে তত্ত্বের মতৈক্য রয়েছে, তত্ত্ব ততবারই বেঁচে থাকে এবং তত্ত্বে আমাদের বিশ্বাসও বাড়ে। কিন্তু যদি কখনো কোন নতুন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- এ মতৈক্য নেই, তা হলে তত্ত্বটিকে হয় পরিত্যাগ করতে হবে নয়ত তার পরিবর্তন করতে হবে। অন্ততপক্ষে এই রকমই হবে বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু যিনি পর্যবেক্ষণ করছেন তার যোগ্যতা সম্পর্কে আপনি সব সময়ই প্রশ্ন করতে পারেন।

কার্যক্ষেত্রে যা ঘটে তা হল : যে নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন করা হয় সেটা আসলে পুরাতন তত্ত্বেরই বিস্তৃতি। উদাহরণ : বুধগ্রহ নিয়ে অত্যন্ত নির্ভুল পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেল নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে বুধগ্রহের গণিত সামান্য পার্থক্য রয়েছে। আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ গতি সম্পর্কে নিউটনের তত্ত্বের চাইতে সামান্য পৃথক একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। আইনস্টাইন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণলব্ধ ফল মিলে গেল। কিন্তু নিউটনের তত্ত্বের সঙ্গে মিলল না। এটাই ছিল নতুন তত্ত্ব মেনে নেয়ার একটা প্রামাণ্য কারণ। আমরা কিন্তু ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে নিউটনের তত্ত্ব এখনো প্রয়োগ করি। তার কারণ, সাধারণত আমরা যে সব ক্ষেত্রে কাজ করি সে সমস্ত ক্ষেত্রে নিউটনীয় তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী এবং ব্যাপক অপেক্ষাবাদের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিতরে পার্থক্য সামান্যই (নিউটনের তত্ত্বের আর একটি বিরাট সুবিধা হল, আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার চাইতে নিউটনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করা অনেক সহজ)।

বিজ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হল এমন একটি তত্ত্ব দান করা যে তত্ত্ব সম্পূর্ণ মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ বৈজ্ঞানিকরা যে পথ গ্রহণ করেন সেটা হল সমস্যাকে দুটো ভাগে ভাগ করা। প্রথমত, কালের সঙ্গে মহাবিশ্বের কি রকম পরিবর্তন হয় সে সম্পর্কে একাধিক বিধি (law) রয়েছে (আমরা যদি জানি একটি বিশেষ কালে মহাবিশ্ব কি রকম দেখায়, তা হলে পরবর্তী যে কোন কালে মহাবিশ্ব কি রকম দেখাবে সেটাও ঐ ভৌত বিধিগুলো আমাদের বলে দেবে)। দ্বিতীয়ত, রয়েছে মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক অবস্থার প্রশ্ন। অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞানের শুধু প্রথম অংশটা নিয়েই চিন্তা করা উচিত। তাঁদের ধারণা, প্রারম্ভিক অবস্থায় প্রশ্নটা অধিবিদ্যা (metaphysics) কিম্বা ধর্মের (religion) বিষয়। তাঁরা বলবেন ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। (omnipotent)। তিনি ইচ্ছে করলে যেভাবে খুশি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারতেন। তা হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তিনি মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণ সাদৃচ্ছিক (arbitrary) পদ্ধতিতেও বিকশিত করতে পারতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্বকে তিনি বেশ নিয়মবদ্ধ রূপে কতকগুলো বিশেষ বিধি (law) অনুসারে বিকশিত করেছিলেন। সুতরাং মনে হয় প্রারম্ভিক অবস্থার নিয়ামক বিধির অস্তিত্ব অনুমান করাও একই রকম যুক্তিসঙ্গত।

দেখা যায় একবারে মহাবিশ্বের বিবরণ দেয়ার মত একটা তত্ত্ব উদ্ভাবন করা খুব শক্ত। তার বদলে বলে আমরা সমস্যাটাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে নিই এবং কতকগুলো আংশিক তত্ত্ব আবিষ্কার করি। এই আংশিক তত্ত্বগুলোর প্রতিটি, সীমিত শ্ৰেণীর কয়েকটি পর্যবেক্ষণ ফলের বিবরণ দান করে এবং সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। এ তত্ত্ব অন্য পরিমাণগুলোর (quantities) ক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে কিম্বা কয়েকটি সরল সংখ্যাগুচ্ছকে সেগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে স্থাপন করে। হতে পারে এ পথ সম্পূর্ণ ভুল। মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিসই যদি প্রতিটি জিনিসের উপরে মূলগতভাবে নির্ভরশীল হয়, তা হলে সমস্যার অংশগুলো সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে অনুসন্ধান করলে সম্পূর্ণ সমাধানের নিকটবর্তী হওয়া হয়ত অসম্ভব হতে পারে। তবুও অতীতে আমাদের যে প্রগতি হয়েছে, নিশ্চিতভাবে সেটা এই পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল নিউটনের মহাকর্ষীয় বিধি। এ তত্ত্ব আমাদের বলে, দুটি বস্তুপিণ্ডের অন্তর্বর্তী মহাকর্ষীয় বল প্রতিটি বস্তুপিণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত একটি সংখ্যার উপর নির্ভরশীল। সেটা হল তার ভর। কিন্তু বস্তুপিণ্ডের কি উপাদান দিয়ে গঠিত তার সঙ্গে এ বল সম্পর্কহীন। সুতরাং তাদের কক্ষ গণনার জন্য সূর্য এবং গ্রহগুলোর গঠন এবং উপাদান সম্পর্কে কোন তত্ত্বের প্রয়োজন হয় না।

আজকাল বৈজ্ঞানিকরা দুটি মূলগত আংশিক তত্ত্বের বাগ্বিধিতে মহাবিশ্বের বিবরণ দান করেন ব্যাপক অপেক্ষবাদ এবং কোয়ান্টাম মেকানিকস্ (কণাবাদী বলবিদ্যা)। এ দুটি তত্ত্ব এ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বিরাট বৌদ্ধিক কৃতিত্ব। ব্যাপক অপেক্ষবাদ মহাকর্ষীয় বল এবং মহাবিশ্বের বৃহৎ মানের (large scale) গঠন সম্পর্কে বিবরণ দান করে, অর্থাৎ, যে গঠনের মাপ মাত্র কয়েক মাইল থেকে শুরু করে মিলিয়ন মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ান (১ এর পিঠে চব্বিশটা শূন্য) মাইল পর্যন্ত। শেষেরটা হল পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মাপ। অন্যদিকে কণাবাদী বলবিদ্যার কাজকর্ম অতি ক্ষুদ্র মানের পরিঘটনা (extremely small scale) নিয়ে। যথা, এক ইঞ্চির এক মিলিয়ান ভাগের এক মিলিয়ান ভাগ। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা জানি এই দুটি তত্ত্বের পারস্পরিক অসঙ্গতি রয়েছে। দুটো তত্ত্বই নির্ভুল হতে পারে না। আধুনিক পদার্থবিদ্যার একটি প্রধান প্রচেষ্টা এবং এ বইয়ের একটি প্রধান বক্তব্য এমন একটি তত্ত্ব অনুসন্ধান করা যার ভিতরে দুটো তত্ত্বই থাকবে– মহাকর্ষ সম্বন্ধীয় কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এ রকম তত্ত্ব এখনো আমাদের নেই। হয়ত এরকম তত্ত্বে পৌঁছাতে আমাদের বহু দেরি। কিন্তু এই তত্ত্বের কি কি গুণ থাকা আবশ্যিক হবে তার অনেকটাই আমরা এখন জানি। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখব মহাকর্ষ সম্পর্কীয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের কি কি ভবিষ্যদ্বাণী করা আবশ্যিক হবে তার অনেকটাই আমাদের জানা।

আপনি যদি বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্ব যাদৃচ্ছিক নয় এবং সুনিশ্চিত কতকগুলো বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাহলে শেষ পর্যন্ত আংশিক তত্ত্বগুলোকে একত্রিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব গড়তে হবে এবং সে তত্ত্ব মহাবিশ্বের সবটারই বিবরণ দান করবে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্বের অনুসন্ধানের ব্যাপারে একটা মূলগত স্ববিরোধিতা (paradox) রয়েছে। উপরে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে যে সমস্ত ভাবধারার খসড়া দেয়া হয়েছে, তাতে অনুমান করে নেয়া হয়েছে আমরা যুক্তিবাদী জীব। আমাদের ইচ্ছামত পর্যবেক্ষণের স্বাধীনতা রয়েছে এবং যা পর্যবেক্ষণ করছি তা থেকে যৌক্তিক অবরোহী সিদ্ধান্ত (log ical deduction) নেয়ারও স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। এরকম একটা পরিকল্পনায় আমাদের মহাবিশ্ব পরিচালনা সম্পর্কীয় বিধিগুলো ক্রমশ নিকটতর হওয়ার দিকে অবিচ্ছিন্ন অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে, এ রকম অনুমান যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সত্যই যদি একটা ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব থাকে তা হলে সে তত্ত্ব আমাদের কার্যক্রমও নির্ধারণ করবে। সুতরাং, সে তত্ত্ব নিজেই আমাদের সেই তত্ত্ব অনুসন্ধানের ফলাফল নির্ধারণ করবে। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই নেব, এ তত্ত্ব কেন সেটা নির্ধারণ করবে? একইভাবে সে তত্ত্ব কি সাক্ষ্য থেকে আমাদের ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে একই রকম ভাবে সাহায্য করতে পারে না? কিম্বা কোন সিদ্ধান্তেই না পৌঁছাতে?

এই সমস্যার আমি একটাই সমাধান করতে পারি। সে সমাধানের ভিত্তি ডারউইনের স্বাভাবিক নির্বাচন সম্পর্কীয় নীতি (principle of natural selection)। চিন্তনটা হল : স্বতত বংশরক্ষণকারী যে কোন জীবগোষ্ঠীর ভিতর বিভিন্ন ব্যক্তির জেনেটিক পদার্থ (Genetic material) এবং লালন পালনে নানা পার্থক্য হবে। এই পার্থক্যের অর্থ হবে কিছু ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের চতুম্পার্শ্বের জগৎ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং সেই অনুসারে কাজ করতে পারবে অনেক ভাল ভাবে। এই সমস্ত ব্যক্তির বেচে থাকা এবং বংশবৃদ্ধি করার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং তাদের আচরণ এবং চিন্তার ধরন আধিপত্য করবে। আমরা যাকে বুদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলি সেগুলো বেঁচে থাকার পক্ষে একটা সুবিধা বহন করছে এ তথ্য অতীত সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে সত্য। ব্যাপারটা এখনও একই রকম রয়েছে কিনা সেটা স্পষ্ট নয় আমাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো হয়ত আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে পারে। তারা যদি ধ্বংস নাও করে তবুও একটি ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব আমাদের বাঁচার সম্ভাবনার ব্যাপারে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি না করতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্ব যদি নিয়মানুসারে বিবর্তিত হয়ে থাকে তা হলে আমরা আশা করতে পারি স্বাভাবিক নির্বাচনের ফলে আমরা যে যৌক্তিক ক্ষমতা লাভ করেছি, সে ক্ষমতার অস্তিত্ব এবং কর্মক্ষমতা আমাদের ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্বের অনুসন্ধানের সময়ও থাকবে এবং আমাদের ভুল সিদ্ধান্তের পথে নিয়ে যাবে না।

আমদের যে আংশিক তত্ত্বগুলো রয়েছে, সেগুলো অতি চরম ক্ষেত্রগুলো ছাড়া অন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করার পক্ষে যথেষ্ট। সেইজন্য ব্যবহারিক কারণে মহাবিশ্ব সম্পর্কে চরম তত্ত্বের অনুসন্ধানের যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল (যদিও এ কথা স্মরণ করা উচিত যে অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যার বিরুদ্ধে একই রকম যুক্তি প্রয়োগ করা যেত। কিন্তু এই তত্ত্বগুলোই আমাদের পারমাণবিক শক্তি এবং মাইক্রো ইলেকট্রনিক বিপ্লব দিয়েছে)। সুতরাং একটা ঐক্যবদ্ধ সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার আমাদের প্রজাতিকে বাঁচাতে সাহায্য নাও করতে পারে। এমন কি, এ তত্ত্ব আমাদের জীবন যাত্রার ধরনের উপরেও কোন প্রভাব বিস্তার না করতে পারে। কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ বিভিন্ন ঘটনাকে অসংযুক্ত এবং ব্যাখ্যার অতীত ভেবে সন্তুষ্ট হয় নি। মানুষ আকাক্ষা করেছে পৃথিবীর অন্তর্নিহিত নিয়ম বুঝতে। এখনো আমরা জানতে চাই কেন আমরা এখানে এসেছি এবং কোত্থেকে এখানে এসেছি? জ্ঞানের জন্য মানুষের গভীরতম আকাক্ষা অবিচ্ছিন্ন অনুসন্ধানের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যথেষ্ট। এবং আমাদের সর্বনিম্ন আকাক্ষা অবিচ্ছিন্ন অনুসন্ধানের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যথেষ্ট। এবং আমাদের সর্বনিম্ন আকাক্ষা হল, যে মহাবিশ্বে আমরা বাস করি তার সম্পূর্ণ বিবরণ।

1 Comment
Collapse Comments

The Qur’an says that “the heavens and the earth were joined together as one unit, before We clove them asunder” (21:30).
“The heavens, We have built them with power. And verily, We are expanding it” (51:47).

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *