১২. সবাই কী পূর্ববিধারিত?

১২. সবাই কী পূর্ববিধারিত?*

[* ১৯৯০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিগমা ক্লাব সেমিনারে প্রদত্ত একটি বক্তৃতা।]

জুলিয়াস সীজার নাটকে কেসিয়াস ব্রুটাসকে বলছে, অনেক সময় মানুষ নিজের ভাগ্যবিধাতা হয়। কিন্তু সিত্যই কী আমরা নিজেদের ভাগ্যবিধাতা? আমরা যা করি সবই কী পূর্বনির্ধারিত? আগেই ভাগ্যে লেখা ছিল? পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের সপক্ষে যুক্তি ছিল– ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং কালের অতীত, সুতরাং কি হতে চলেছে ঈশ্বর সেটা জানেন। কিন্তু তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা আমাদের কী করে থাকতে পারে? নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আমরা কী করে দায়ী হতে পারি? একজনের কপালে যদি আগে থাকতেই ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা লেখা হয়ে থেকে থাকে তাহলে তার দোষ কোথায়? তাহলে সেজন্য কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হবে?

সাম্প্রতিককালে নিয়তিবাদের (determinism) ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞান। মনে হয় মহাবিশ্ব এবং তার ভিতরকার সবকিছু কালানুসারে কিভাবে বিকাশলাভ করবে সে সম্পর্কে সুসংজ্ঞিত বিধি আছে। যদিও আমরা এই সমস্ত বিধির একবারে নির্ভুল গঠন আবিষ্কার করতে পারিনি তবুও একেবারে চরম পরিস্থিতি ছাড়া প্রায় সবক্ষেত্রেই কি হবে সেটা নির্ধারণ করার মতো জ্ঞান আমাদের আছে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা অবশিষ্ট বিধিগুলো আবিষ্কার করতে পারব কিনা সে প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে মানুষের মনের উপর। আমার মনে হয় আগামী কুড়ি বছরে বিধিগুলো আবিষ্কার হওয়ার আধাআধি সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা যদি আবিষ্কার নাও করতে পারি তাহলেও আমাদের যুক্তিতে সত্যিকারের কোন পার্থক্য হবে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল : এমন এক কেতা বিধি থাকা উচিত যে বিধিগুলো শুরু থেকে মহাবিশ্বের বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করবে। এ বিধিগুলো ঈশ্বর সৃষ্টি করে থাকতে পারেন কিন্তু মনে হয় ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী আইনভঙ্গ করার জন্য মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন না।

মহাবিশ্বের প্রাথমিক নক্সা হয়ত ঈশ্বর বেছে নিয়েছিলেন কিংবা হয়ত সেটাও নির্ধারিত হয়েছিল বিজ্ঞানের বিধিগুলো দিয়ে। যাই হোক না কেন, মনে হয় তারপর থেকে মহাবিশ্বের সবই নির্ধারিত হবে বিজ্ঞানের বিধিসম্মত বিবর্তনের দ্বারা। সুতরাং আমরা কি করে নিজেদের ভাগ্যবিধাতা হব সেটা বোঝা কঠিন।

এমন কোন মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আছে যে তত্ত্ব মহাবিশ্বের সব কিছু নির্ধারণ করে–এ কল্পন কতগুলো সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রথমত ধরে নেওয়া যেতে পারে মহান ঐক্যবদ্ধ হতত্ত্ব গাণিতিক বাগ্বিধিতে সুষ্ঠু এবং সংক্ষিপ্ত (অনাবশ্যক বাহুল্যবর্জিত compact)। সর্ববিষয়সম্পর্কীয় তত্ত্বের একটি বিশেষত্ব এবং সারল্য থাকা উচিত, অথচ কয়েকটি সমীকরণ কি করে আমরা চারপাশে যে জটিলতা এবং খুঁটিনাটি বিশদ বিস্তার দেখতে পাই তার কারণ দেখাতে পারে? সত্যিই কি বিশ্বাস করা যেতে পারে যে মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব স্থির করে দিয়েছেন এ সপ্তাহের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গানের রেকর্ডের শিরোনামে থাকবে সিনিয়া ওকিনোর (Sinead O’Connor) কিংবা কসমোপলিটানের (Cosmopolitan) প্রচ্ছদপটে থাকবেন ম্যাডোনা?

মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব সমস্তই স্থির করে এ কল্পনের দ্বিতীয় সমস্যা : আমরা যা বলি সবই নির্ধারিত হয় তত্ত্বটি দিয়ে। কিন্তু বাক্যটি যে সঠিক হবে সেটা কেন নির্ধারিত হবে? ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি নয় কি? কারণ একটি সঠিক বক্তব্য থাকলে সঠিক বক্তব্য অনেক থাকে। প্রতিদিন ডাকে আমার কাছে কয়েকটি তত্ত্ব আসে। লোকে যে তত্ত্বগুলো আমার কাছে পাঠায় তাদের প্রত্যেকটি পৃথক এবং অধিকাংশেরই পারস্পরিক সামঞ্জস্য নেই। তবুও হয়ত মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব স্থির করেছে– লেখকরা মনে করবে তারাই সঠিক। সুতরাং আমি যা বলি তার কেন বৃহত্তর সত্যতা থাকবে? আমি কি মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের দ্বারা সমরূপে নির্ধারিত নই?

সবকিছু পূর্বনির্ধারিত এই কল্পনের আরেকটি সমস্যা : আমরা বোধ করি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে। আমরা যদি কিছু করব বলে ঠিক করি তাহলে সেটা করার স্বাধীনতা আমাদের আছে। কিন্তু সবই যদি বিজ্ঞানের বিধি দিয়ে নির্ধারিত হয় তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা নিশ্চয়ই একটা মায়া এবং আমাদের যদি স্বাধীন ইচ্ছা না থাকে তাহলে আমাদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের দায়িত্বের ভিত্তি কি? কোন উন্মাদ যদি কোন অপরাধ করে তাহলে আমরা তাকে শাস্তি দিই না। তার কারণ আমরা সিদ্ধান্ত করেছি, তারা এ কাজ না করে পারে না। কিন্তু মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব যদি আমাদের সকলের নিয়ামক হয় তাহলে আমরা কেউই সে কাজ না করে পারি না। সুতরাং কৃতকর্মের জন্য কোন লোককে কেন দায়ী করা হবে।

নিয়তিবাদ কিংবা নির্ধারণীয়তাবাদে এ সমস্যাগুলো নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনা ছিল কিন্তু খানিকটা পণ্ডিতি ব্যাপার। কারণ তখন আমার বিজ্ঞানের বিধি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থেকে অনেক দূরে এবং আমরা জানতাম না মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা কি করে নির্ধারিত হয়েছিল। সমস্যাগুলো এখন অনেক বেশি জরুরি কারণ সম্ভাবনা আছে একটা সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব। আমরা মোটে কুড়ি বছরে আবিষ্কার করতে পারি। আমরা বুঝতে পারছি প্রাথমিক অবস্থা হয়ত বিজ্ঞানের বিধিগুলো দিয়ে নির্ধারিত হয়েছিল। এর পর আমি আলোচনা করেছি, এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। আমার বিরাট কোন মৌলিকতা বা গভীরতার দাবি নেই কিন্তু এই মুহূর্তে আমি এর চাইতে বেশি কিছু করতে পারি না।

প্রথম সমস্যা দিয়ে শুরু করি : তুলনামূলকভাবে একটা সরল এবং সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব কি করে একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারে? সেই মহাবিশ্ব–আমরা যাকে পর্যবেক্ষণ করি, সেরকম জটিল এবং যার রয়েছে নানা তুচ্ছ খুঁটিনাটি। এর চাবিকাঠি রয়েছে কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতিতে। এ নীতির বক্তব্য–একটি কণিকার অবস্থান এবং দ্রুতি দুটোই খুব নির্ভুলভাবে মাপা সম্ভব নয়। অবস্থান যত নির্ভুলভাবে মাপবেন দ্রুতির মাপন হবে তত কম নির্ভুল এবং এর বিপরীতটাও সত্য (vice versa)। বর্তমানকালে যখন জিনিসগুলো খুব দূরে দূরে অবস্থিত এবং অবস্থানে সামান্য অনিশ্চয়তা খুব বেশি পার্থক্য সৃষ্টি করে না, তখন এই অনিশ্চয়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু অতি আদিম মহাবিশ্বে সব জিনিসই খুব কাছাকাছি ছিল সুতরাং অনিশ্চয়তা ছিল প্রচুর এবং মহাবিশ্বের বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য অবস্থা ছিল। এই বিভিন্ন সম্ভাব্য আদিম অবস্থাগুলো বিবর্তনের পথে মহাবিশ্বের বিভিন্ন ইতিহাসে একটা গোষ্ঠীর সৃষ্টি করত। বৃহত্মানের বিচারে এই ইতিহাসগুলোর অবয়ব সমরূপ। তারা যে মহাবিশ্বের অনুরূপ হত সে মহাবিশ্ব ছিল সুষম (uniform), মসৃণ এবং প্রসারমাণ। অবশ্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে তাদের পার্থক্য থাকত। যেমন, তারকাগুলোর বণ্টনে এবং তারও পার্থক্য থাকত তাদের পত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদপটে কি আছে তাই নিয়ে (অবশ্য ঐ ইতিহাসগুলোতে যদি পত্রিকা থাকত)। সুতরাং আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বের জটিলতা এবং তাদের খুঁটিনাটির উদ্ভব হয়েছিল আদিম যুগের অনিশ্চয়তার নীতি থেকে। এ থেকে মহাবিশ্বের ইতিহাসের একটি পুরো গোষ্ঠী পাওয়া যায়। এমন একটা ইতিহাস থাকবে যেখানে নাৎসীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতেছিল। যদিও তার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমরা এমন একটি ইতিহাসে বাস করি, যে ইতিহাসে মিত্রপক্ষ যুদ্ধ জয় করেছিল এবং কসমোপলিটানের প্রচ্ছদপটে ম্যাডোনা ছিলেন।

এখন আমি দ্বিতীয় সমস্যা বিচার করব : যদি আমরা যা করি সেটা কোন মহান একটা ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব দ্বারা নির্ধারিত হয়, তাহলে সে তত্ত্ব কেন নির্ধারণ করবে যে আমরা। মহাবিশ্ব সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেব? আমরা যা বলছি তার সত্যতা কেন থাকবে? এ প্রশ্নে আমার উত্তরের ভিত্তি ডারউইনের স্বাভবিক নির্বাচনের কল্পন থেকে। আমি ধরে নিচ্ছি কতগুলো পরমাণুর আপতনিক (chance) সমন্বয়ের ফলে পৃথিবীতে জীবনের একটি আদিম রূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়েছিল। জীবনের এই আদিম রূপ বোধহয় ছিল একটি বৃহৎ অণু। কিন্তু সম্ভবত সেটি ডি. এন. এ. ছিল না। কারণ, পূর্ণ একটি ডি. এন. এ. অণু অসম্বন্ধ (random) সমন্বয় দ্বারা সৃষ্টি হওয়ার আপতনিক chance) সম্ভাবনা কম।

আদিম জীবন নিজের বংশ রক্ষা করত। কণাবাদী অনিশ্চয়তার নীতি এবং পরমাণুগুলোর অসম্বন্ধ তাপীয় গতির অর্থ হবে বংশ রক্ষার ব্যাপারে কিছুসংখ্যক ভুল হয়েছিল। এই ভুলগুলোর অধিকাংশই জীবটির জীবন রক্ষার পক্ষে কিংবা বংশ রক্ষার পক্ষে মারাত্মক হয়েছিল। এই ভুলগুলো তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে বাহিত হত না। তারা লুপ্ত হত। কয়েকটি গুণ উপকারে লাগত, তবে সেগুলোও শুদ্ধ আপতনিক। যে সমস্ত জীবের এই ভুলগুলো ছিল তাদের বেঁচে থাকবার এবং বংশ রক্ষা করার সম্ভাবনা ছিল বেশি। ফলে তাদের প্রবণতা হত মূল অনুন্নত জীবগুলোর স্থান অধিকার করা।

আদিম স্তরে ডি. এন. এ-র জোড়া প্যাচানো তারের মতো গঠন (double helix structure) হয়ত ঐ রকমই একটি উন্নতি ছিল। এটি বোধহয় এমন একটি অগ্রগতি ছিল যে জীবের আগেকার রূপ যাই থাক না কেন, এই উন্নীত জীবগুলো সম্পূর্ণভাবে তার স্থান দখল করে নিল। বিবর্তনের অগ্রগতি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকাশের পথও প্রদর্শন করেছে। যে জীবগুলো তাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোর সগ্রহ করা উপাত্তগুলোর নিহিতার্থ সঠিকভাবে বুঝতে পারত এবং সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করত, তাদের বেঁচে থাকার এবং বংশ রক্ষা করার সম্ভাবনা ছিল বেশি। মানব জাতি এই ক্ষমতাকে অন্য স্তরে নিয়ে এসেছে। উচ্চশ্রেণীর বাঁদরদের সঙ্গে দেহ এবং ডি. এন. এ. তে আমাদের সাদৃশ্য খুবই বেশি। কিন্তু আমাদের ডি. এন. এ.-তে সামান্য পরিবর্তন আমাদের ভাষা বিকাশের ক্ষমতা দান করেছে। এর অর্থ আমাদের এক প্রজন্মের সমাচার এবং সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, অন্য প্রজন্মকে কথ্য ভাষায় এবং পরবর্তীকালে লিখিত ভাষায় হস্তান্তর করতে পারি। পূর্বকালে অভিজ্ঞতার ফল হস্তান্তর করা যেত শুধুমাত্র বংশবৃদ্ধির সময় অসম্বন্ধ ভ্রমের মাধ্যমে ডি. এন. এ.-র সঙ্কেত লিপিভুক্ত হয়ে। এ পদ্ধতির গতি ছিল ধীর। এর ফল হয়েছে বিবর্তনের নাটকীয় গতিবৃদ্ধি। মানবজাতি (human race) পর্যন্ত বিবর্তন হতে সময় লেগেছে তিনশ’ কোটি বছর। কিন্তু গত দশ হাজার বছরে আমাদের লিখিত ভাষা বিকাশলাভ করেছে। এর ফলে আমরা গুহাবাসী অবস্থা থেকে মহাবিশ্বের পরম তত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করার সামর্থ্য ভাল করার মতো অবস্থায় এসে পৌঁছেছি।

গত দশ হাজার বছরে কোন গুরুত্বপূর্ণ জীববিজ্ঞানভিত্তিক বিবর্তন হয়নি। সুতরাং আমাদের বুদ্ধি, আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়েয় সংগ্রহ করা সংবাদ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সামর্থ্য সবেরই শুরু আমাদের গুহাবাসী জীবন থেকে কিংবা তারও আগে থেকে। এগুলো নির্বাচন করার ভিত্তি ছিল কতগুলো জন্তুকে খাদ্যের জন্য হত্যা করার সামর্থ্যের ভিত্তিতে কিংবা তাদের দ্বারা নিহত হওয়া এড়ানোর সামর্থ্যের ভিত্তিতে। এই উদ্দেশ্যে যে মানসিক গুণগুলো নির্বাচন করা হয়েছিল, বর্তমান যুগের অত্যন্ত পৃথক পরিস্থিতিতে যে সেই গুণগুলো আমাদের এত বেশি কাজে লাগছে, সেটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একটা মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার কিংবা নিয়তিবাদ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর করায় জীবন রক্ষার দিক দিয়ে কোন বিশেষ সুবিধা হয় না। তবুও অন্য উদ্দেশ্য আমরা যে বুদ্ধি বিকশিত করেছি, সে বুদ্ধি এই সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর খোঁজার সামর্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিতি দান করে।

এখন আমি তৃতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব : স্বাধীন ইচ্ছার প্রশ্ন এবং নিজের কৃতকর্ম সম্পর্কে দায়িত্বের প্রশ্ন। ব্যক্তিনিষ্ঠভাবে আমরা চিন্তা করি আমরা কে এবং আমরা কি করছি, এগুলো বেছে নেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে। কিন্তু এটি একটি বিভ্রান্তিও (illusion) হতে পারে। অনেকে ভাবেন তারা যীশু খ্রিস্ট কিংবা নেপোলিয়ান। কিন্তু তারা সবাই সঠিক হতে পারেন না। আমার প্রয়োজন একটি বস্তুনিষ্ঠ পরীক্ষা, যেটা আমরা বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে পারি এবং সে পরীক্ষার দ্বারা বুঝতে পারি একটি জীবের স্বাধীন ইচ্ছা আছে কি নেই। উদাহরণ : ধরে নেওয়া যাক, অন্য একটি তারকা থেকে ছোট সবুজ ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আমরা কি করে বুঝব তার স্বাধীন ইচ্ছা আছে না আমাদের মতো আচরণের কর্মসূচি তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে একটি যন্ত্রমানব আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে?

মনে হয়, স্বাধীন ইচ্ছার চরম বস্তুনিষ্ঠ পরীক্ষা হবে : এই জীবটির আচরণ সম্পর্কে কি ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব? যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে স্পষ্টতই তার স্বাধীন ইচ্ছা নেই। তার আচরণ পূর্বনির্ধারিত। অন্যদিকে, যদি আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব না হয়, তবে কার্যকর সংজ্ঞা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে জীবটির স্বাধীন ইচ্ছা আছে।

স্বাধীন ইচ্ছার এই সংজ্ঞায় একটি আপত্তি হতে পারে : আমরা একটি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার করলে মানুষ কি করবে এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব। তবে মানুষের মস্তিষ্কও অনিশ্চয়তার অধীন। যেমন, কণাবাদী বলবিদ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি অসম্বন্ধতার উপাদান মানুষের আচরণে রয়েছে। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে জড়িত শক্তি অল্প, সেজন্য কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তা একটি ক্ষুদ্র অভিক্রিয়া মাত্র। মানবিক আচরণ সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করার অসামর্থ্যের সত্যিকারের কারণ এ কাজটা খুব শক্ত। আমরা বর্তমানে মস্তিষ্কের ক্রিয়া শাসনকারী মূলগত ভৌতবিধিগুলো জানি। তুলনায় তারা সরল কিন্তু কয়েকটি কণিকা বেশি জড়িত থাকলে সমীকরণ সমাধান খুবই শক্ত। এমনকি সরলতর নিউটনীয় তত্ত্বের নির্ভুলভাবে সমীকরণ সমাধান করা যায় শুধুমাত্র দুটি কণিকার ক্ষেত্রে। তিনটি কিংবা ততোধকি কণিকা থাকলে আসন্নতার (approximation) দ্বারস্থ হতে হয়। কণিকার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাঠিন্যও বাড়ে। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০২৬ কিংবা ১০০ মিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ান কণা আছে। মস্তিষ্কের প্রাথমিক অবস্থা এবং যে স্নায়ুবিক উপাত্তগুলো datas) তাতে প্রবেশ করছে সেটা থাকলে বোঝা যাবে এ সংখ্যা এত বেশি যে আমরা কোনদিনও মস্তিষ্ক কি রকম আচরণ করবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব না। আসলে আমরা অবশ্য মস্তিষ্কের প্রাথমিক অবস্থা মাপতে পারি না। তার কারণ সেটা করতে গেলে মস্তিষ্কটিকে ছিন্নবিছিন্ন করতে হবে। সেটা যদি আমরা করতে প্রস্তুতও হই, তাহলেও আমাদের এত কণিকার হিসাব রাখতে হবে যা সম্ভব নয়। তাছাড়া, সম্ভবত প্রাথমিক অবস্থা সাপেক্ষ মস্তিষ্ক খুবই স্পর্শকাতর। প্রাথমিক অবস্থার সামান্য পরিবর্তন পরবর্তী আচরণে বিরাট পার্থক্য নিয়ে আসতে পারে। সুতরাং যদিও আমরা মস্তিষ্ক শাসনকারী মূলগত সমীকরণগুলো জানি, তবুও আমরা মানবিক আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে একেবারেই অপারগ।

যখনই আমরা স্থলসত্ত্বক (macroscopic) তত্ত্বগুলো নিয়ে বিচার করি তখনই বিজ্ঞানে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তার কারণ, মূলগত সমীকরণগুলো সমাধান করার মতো কোনরকম সম্ভাবনা থাকার পক্ষে কণিকাগুলোর সংখ্যা সবসময়ই অত্যাধিক। তার বদলে আমরা কার্যকর তত্ত্বগুলো ব্যবহার করি। এই তত্ত্বগুলো হল আসন্নতা। এ ক্ষেত্রে বিরাট সংখ্যক কণিকাস্থলে কয়েকটি মাত্র রাশি প্রতিস্থাপিত হয়। প্রবাহী বিজ্ঞানে (fluid mechanies) জলের মতো একটি তরলপদার্থে লক্ষ কোটি অণু থাকে সেগুলো আবার গঠিত হয় ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে। তবুও তাকে অবিচ্ছিন্ন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা একটি উত্তম আসন্নতা। তার বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র গতিবেগ, ঘনত্ব এবং তাপমাত্রা। প্রবাহী বিজ্ঞানের কার্যকর তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো একেবারে নির্ভুল নয়। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো শুনলেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু জাহাজ কিংবা তৈলবাহী পাইপ লাইনের পরিকল্পনা করার পক্ষে সেগুলোই যথেষ্ট।

আমার অভিভাবন (suggestion) : স্বাধীন ইচ্ছা এবং আমাদের কৃতকর্মের জন্য নৈতিক দায়িত্বের কল্পন আসলে যে অর্থে প্রবাহী বিজ্ঞানের তত্ত্ব কার্যকর সেই অর্থে কার্যকর। হতে পারে আমরা যা করি তার সবটাই কোন এক মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের দ্বারা নির্ধারিত। সেই তত্ত্ব যদি স্থির করে থাকে আমরা ফাঁসিতে মরব, ডুকে মারব না– তাহলে ঝড়ের ভিতরে একটি ছোট নৌকা নিয়ে সমুদ্রে ভাসতে হলে ফাঁসিকাঠই যে আপনার নিয়তি সে সম্পর্কে ভয়ঙ্করভাবে নিশ্চিত হতে হবে। আমি দেখেছি, যারা দাবি করেন–সমস্তই পূর্বপরিকল্পিত এবং এ সম্পর্কে আমরা কিছুই করতে পারি না, তারাও রাস্তা পারে হওয়ার আগে ভাল করে দেখে নেন। হতে পারে, যারা দেখে নেন না, তাঁরা কাহিনীটা বলার জন্য বেঁচে থাকেন না।

সবই পূর্বপরিকল্পিত এই কল্পনের উপর ভিত্তি করে কেউ নিজের আচরণের ভিত গড়তে পারেন না। কারণ, কি নির্ধারিত আছে সেটা তিনি জানেন না। তার বদলে একটি কার্যকর তত্ত্ব গ্রহণ করা উচিত। ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা আছে এবং সে নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়ী। মানবিক আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য এই তত্ত্ব খুব ভাল নয়। কিন্তু তবুও আমরা এ তত্ত্ব গ্রহণ করি। তার কারণ মূলগত বিধি থেকে উদ্ভুত সমীকরণগুলো সমাধান করার কোন সম্ভাবনা নেই। আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা বিশ্বাসের একটি ডারউইনীয় যুক্তিও আছে। যে সমাজে ব্যক্তি তার কৃতকর্মের দায়িত্ব বোধ করে সে সমাজের মানুষের যুক্তভাবে কাজ করার এবং নিজের মূল্যবোধ বিস্তার করার জন্য বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। অবশ্য পিঁপড়েরা একযোগে কাজ করে এবং ভালই কাজ করে। কিন্তু ঐ রকম সমাজ নিশ্চল (static), এ রকম সমাজ পরিবেশের বিরুদ্ধতায় (challenges) সাড়া দিতে পারে না কিংবা নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে না। নিজেদের পারস্পরিক উদ্দেশ্যের অংশীদার স্বাধীন মানুষের সমবায় কিন্তু নিজেদের সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের অংশীদার স্বাধীন মানুষের সমবায় কিন্তু নিজেদের সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সহযোগিতা করতে পারে আবার নতুন আবিষ্কার করার মতো নমনীয় (flexible) হতে পারে। সেজন্য ঐ রকম একটি সমাজের সমৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা এবং নিজেদের মূল্যবোধ বিস্তার করার সম্ভাবনা বেশি।

স্বাধীন ইচ্ছার কল্পন বিজ্ঞানের মূলগত বিধির চাইতে পৃথক ভুক্তির (arena) অধিকারে। কেউ যদি বিজ্ঞানের বিধির ভিত্তিতে অবরোহী পদ্ধতিতে মানবিক আচরণ স্থির করেন তাহলে তিনি আত্মনির্দেশক তন্ত্রের (self referencing system) একটি যৌক্তিক স্ববিরোধিতায় (paradox) জড়িয়ে পড়বেন। যদি মূলগত বিধি থেকে ব্যক্তি কি করছে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত তাহলে এই ভবিষ্যদ্বাণীই ঘটনার পরিবর্তন করতে পারত। কালে ভ্রমণ সম্ভব হলে যে সমস্যা হত এ সমস্যা অনেকটা সেইরকম। কালে ভ্রমণ কখনও সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। ভবিষ্যতে কি হবে তা যদি আপনি জানতে পারতেন তাহলে আপনি ভবিষ্যতের ঘটনার পরিবর্তনও করতে পারতেন। আপনি যদি জানতেন গ্র্যান্ড ন্যাশনাল রেসে কোন ঘোড়াটা জিতবে তাহলে আপনি তার উপরে বাজি রেখে বিরাট লাভ করতে পারতেন। কিন্তু সেই ক্রিয়া বাজির বৈষম্যের পরিবর্তন করবে change the odds)। ব্যাক টু দি ফিউচার’ বইটি দেখলে বুঝতে পারা যাবে কি রকম সমস্যা হতে পারে।

নিজের কর্ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার এই স্ববিরোধিতার সঙ্গে এর আগে আমি যে সমস্যা উল্লেক করেছি সেটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত : পরম তত্ত্ব কি স্থির করবে আমরা পরম তত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসব? আমার যুক্তি ছিল প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) সম্পর্কে ডারউইনের কল্পন আমাদের সঠিক সমাধান এনে দেবে। হতে পারে নির্ভুল উত্তরের বিবরণ দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি এটা নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের অন্ততপক্ষে আমাদের এমন পথে নিয়ে যাওয়া উচিত, যে পথে আমরা এমন এক কেতা ভৌত বিধি পাব যে বিধি মোটামুটি ভাল কাজ করবে। তবে ঐ ভৌত বিধিগুলো আমরা অবরোহী পদ্ধতিতে (deduce) মানবিক আচরণ নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করতে পারি না। তার দুটি কারণ। প্রথমত: আমরা সমীকরণগুলো সমাধান করতে পারি না। দ্বিতীয়ত: আমরা যদি পারতামও তাহলেও ভবিষ্যদ্বাণী করার পর তন্ত্রটি গোলমাল হয়ে যেত। মনে হয় প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা বিষয়ে কার্যকর তত্ত্ব গ্রহণের পথ দেখাবে। কেউ যদি মেনেও নেন যে ব্যক্তির কর্মগুলো স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়া, তাহলে তিনি আর যুক্তি দেখাতে পারবেন না যে, কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলো বহিরাগত বল দ্বারা নির্ধারিত। প্রায় স্বাধীন ইচ্ছা’ কল্পনের কোন অর্থ হয় না। একজন ব্যক্তির কি নির্বাচন করার সম্ভাবনা সেটা কেউ কেউ অনুমান করতে পারেন, এই তথ্যের সঙ্গে কারও কারও এই নির্বাচন স্বাধীন নয়–এই মত গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা আছে। আমার অনুমান ‘আপনাদের অনেকে আজ বিকেলে কিছু খাবেন কিন্তু না খেয়ে শুতে যাওয়া স্বাধীনতা আপনাদের সবারই আছে’। এই রকম গোলমালের একটি উদাহরণ দায়িত্বের হ্রাসপ্রাপ্তি মতবাদ: একটি ব্যক্তিকে তার কৃতকর্মের জন্য চাপ দেওয়া উচিত নয়, তার কারণ সে পীড়নের (stress) মুখে ছিল। হতে পারে কারও কারও হয়ত পীড়নের মুখে থাকলে সমাজবিরোধী কাজ করার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তার শাস্তি কমিয়ে দিয়ে তার অপরাধমূলক কর্ম করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

বিজ্ঞানের মূলগত বিধিগুলো সম্পর্কে গবেষণা এবং মানবিক আচরণ সম্পর্কে গবেষণা ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে রেখে দেওয়া উচিত। অবরোহী পদ্ধতিতে মানবিক আচরণ নির্ধারণের জন্য মূলগত বিধিগুলো ব্যবহার করা যায় না। এর কারণগুলো আমি আগেই ব্যাখ্যা করেছি। তবে আশা করা যেতে পারে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের যে বুদ্ধি এবং যৌক্তিক চিন্তার ক্ষমতা আমরা বিকশিত করেছি, সেগুলোকে আমরা ব্যবহার করার আশা করতে পারি। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রাকৃতিক নির্বাচন আগ্রাসনের মতো অন্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্যও বিকশিত করেছে। গুহাবাসের যুগে কিংবা তারও আগে আগ্রাসন জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারত। ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের এ প্রবৃত্তিকে পছন্দ হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যা আমাদের হাতে এমন ধ্বংস ক্ষমতা দিয়েছে যে, আগ্রাসন এখন একটা বিপজ্জনক গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ গুণ এখন মনুষ্যজাতির অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলেছে। মুশকিল হল আগ্রাসনী সহজাত প্রবৃত্তি (instinct) আমাদের ডি.এন.এ.-র সঙ্কেতলিপিতে রয়েছে (encoded মনে হয়। ডি.এন.এ.-র পরিবর্তন হয় জীববিদ্যাভিত্তিক বিবর্তনে। সে বিবর্তনকালের মান বহু নিযুক্ত (million ১০,০০,০০০) বছর। কিন্তু আমাদের ধ্বংস ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তথ্যের বিবর্তনের fevolution of information) কালের মানে, সে মান এখন মাত্র কুড়ি কি ত্রিশ বছর। আমরা যদি আমাদের আগ্রাসন বৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজেদের বুদ্ধিকে না প্রয়োগ করতে পারি তাহলে মানবজাতি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তবুও যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। আমরা যদি আরও একশ’ বছর কিংবা তার কাছাকাছি বেঁচে থাকতে পারি তাহলে আমরা অন্য গ্রহে কিংবা অন্য তারকাতেও বিস্তার লাভ করব। তার ফলে পারমাণবিক যুদ্ধের মতো চরম বিপদে সমগ্র মানবজাতির ধ্বংস হওয়ার মতো বিপদ অনেকটা হ্রাস পাবে।

পুনবৃত্তি : যদি বিশ্বাস করা যায় যে, মহাবিশ্বের সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত, তাহলে যে সমস্যাগুলোর উদয় হয় তার কিছু কিছু আমি আলোচনা করেছি। এই নিয়তিবাদের কারণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কিংবা বৈজ্ঞানিক বিধি যাই হোক না কেন, তাতে কিছু পার্থক্য হবে না। সত্যিই সব সময় বলা যেতে পারে বিজ্ঞানের বিধিগুলো ঈশ্বরের ইচ্ছায় প্রকাশ।

আমি তিনটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছি : প্রথম, মহাবিশ্বের জটিলতা এবং সমস্ত খুঁটিনাটি কি করে সরল এক কেতা সমীকরণ দিয়ে নির্ধারিত হবে? বিকল্পে সত্যিই কি কেউ বিশ্বাস করতে পারে যে ঈশ্বরই সমস্ত খুঁটিনাটি জিনিস পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন, যেমন কসমোপলিটানের প্রচ্ছদপটে কে থাকবেন? উত্তরটা মনে হয় কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি। তার অর্থ মহাবিশ্বের শুধুমাত্র একটা ইতিহাস নেই, আছে সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর সম্পূর্ণ একটি গোষ্ঠী। খুব বৃহৎ মানে এই ইতিহাসগুলো সদৃশ হতে পারে কিন্তু সাধারণ দৈনন্দিন মানে তারা পৃথক হবে। আমরা বাস করছি একটি বিশেষ ইতিহাসে। সে ইতহাসের একটি বিশেষ ধর্ম এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। কিন্তু অন্য ইতিহাসেও অত্যন্ত সদৃশ বুদ্ধিমান জীব আছে। যুদ্ধে কে জিতেছিল এবং জনপ্রিয় গায়কদের ভিতর শ্রেষ্ঠ কে সে ইতিহাস নিয়ে তাদের মতভেদ থাকতে পারে। সুতরাং আমাদের খুঁটিনাটিতে পার্থক্যের কারণ কণাবাদী বলবিদ্যার মূলগত বিধিগুলোর অন্তর্ভুক্তি। এই বলবিদ্যায় রয়েছে অনিশ্চয়তা কিংবা অসম্বন্ধতা।

পরের প্রশ্ন ছিল : সমস্তই যদি কোন মূলগত তত্ত্ব দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে তত্ত্বটি সম্পর্কে আমরা যা বলি সেটাও ওই তত্ত্ব দ্বারাই নির্ধারিত এবং কেন সেগুলো সোজাসুজি ভুল কিংবা অবান্তর না হয়ে সঠিক হবে–এ প্রশ্নে আমার উত্তর ছিল, ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের দ্বারস্থ হওয়া। যারা বিশ্বে তাদের সর্বদিক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন শুধুমাত্র তাদেরই বেঁচে থাকা এবং বংশ রক্ষা করার সম্ভাবনা।

তৃতীয় প্রশ্ন ছিল : সম্ভবতই যদি পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা এবং নিজের কৃতকর্ম সম্পর্কে দায়িত্বের কি হবে? একটি জীবের স্বাধীন ইচ্ছা আছে কি না তার একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ পরীক্ষা তার আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় কি না। মানুষের ক্ষেত্রে আমরা মানুষ কি করবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য মূলগত বিধিগুলো ব্যবহার করতে পারি না, তার দুটো কারণ : প্রথম, যে বিরাটসংখ্যক কণিকা জড়িত সেগুলো সম্পর্কে সমীকরণগুলো আমরা সমাধান করতে পারি না। দ্বিতীয়, যদি আমরা সমীকরণগুলো সমাধান করতে পারতাম তাহলেও ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রক্রিয়াই তন্ত্রটিতে গোলযোগ বাধিয়ে দিত এবং পৃথক ফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। সুতরাং, যেহেতু আমরা মানুষের আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না সেজন্য আমরা এই কার্যকর তত্ত্বটি গ্রহণ করতে পারি : মানুষ স্বাধীন নিযুক্তক (agent) তবে তারা কর্তব্য নির্বাচন করতে পারে। মনে হয় স্বাধীন ইচ্ছার এবং নিজের কৃতকর্মের দায়িত্ববোধে বেঁচে থাকার দিক দিয়ে একটি নির্দিষ্ট নিশ্চিত সুবিধা আছে। এর অর্থ এই বিশ্বাসকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা শক্তিশালী হতে হবে। ভাষা দ্বারা পরিবাহিত দায়িত্ববোধ ডি. এন. এ. পরিবাহিত আগ্রাসনের সহজ প্রবৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিনা সেটা জানা নেই। যদি না পারে তাহলে মানবজাতি প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটা কানাগলিতে শেষ হয়ে যাবে। দায়িতুবোধ এবং আগ্রাসনের ভিতর এর চাইতে ভাল একটা ভারসাম্য আনতে পারবে হয়ত নীহারিকার অন্য কোন বুদ্ধিমান জীবের জাতি। তা যদি হয়, তাহলে আশা করা যায়, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত কিংবা আমরা তাদের বেতার সঙ্কেত ধরতে পারতাম। হয়ত তারা আমাদের অস্তিত্বের কথা জানে কিন্তু আমাদের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। আমাদের যা অতীত ইতিহাস–কাজটা বুদ্ধিমানের মতো বলেই মনে হয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, এই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল একটা প্রশ্ন : সবকিছুই কী পূর্বনির্ধারিত? আমার উত্তর ‘হ্যাঁ’। কিন্তু উত্তরটা ‘না’ হতে পারে কারণ কী পূর্বনির্ধারিত সেটা আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *