০৯. মহাবিশ্বের উৎপত্তি

০৯. মহাবিশ্বের উৎপত্তি*

[*১৯৮৭ সালে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হওয়ার ত্রিশতমবার্ষিকীতে কেমব্রিজে অনুষ্ঠিত ‘মহাকর্ষের তিন শতাব্দী’ সভায় দেওয়া বক্তৃতা।]

মহাবিশ্বের উৎপত্তির সমস্যা অনেকটা সেই প্রাচীন প্রশ্নের মতো : প্রথম কি হয়েছিল? ডিম না বাচ্চা? অন্য কথায় কোন্ কর্মক (agency) মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিল এবং সেই কর্মক কে । সৃষ্টি করেছিল? কিংবা হয়ত মহাবিশ্ব কিংবা যে কর্মক মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিল তার অস্তিত্ব চিরদিনই ছিল –তাদের সৃষ্টি করার দরকার হয়নি। আধুনিক কাল পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকদের প্রবণতা ছিল এ ধরনের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার। তারা ভাবতেন এগুলো বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়। এ প্রশ্নগুলো অধিবিদ্যা (metaphysics) কিংবা ধর্মের অধিকারে। গত কয়েক বছরে কিন্তু এ মতের উদ্ভব হয়েছে যে বিজ্ঞানের বিধিগুলো হয়ত মহাবিশ্বের আরম্ভতেও সত্য। সেক্ষেত্রে মহাবিশ্ব হয়ত নিজেই নিজেকে ধারণ করেছিল (self-contained) এবং বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো সম্পূর্ণভাবে তার নিয়ামক।

মহাবিশ্বের কোন আরম্ভ ছিল কি না এবং থাকলে সে আরম্ভটা কিভাবে হয়েছে এ বিতর্ক চলেছে লিখিত ইতিহাসের শুরু থেকে। মূলত চিন্তাধারা ছিল দুটি। বহু প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইহুদি, ক্রীশ্চান আর ইসলামিক ধর্মের মতে মহাবিশ্ব সষ্টি হয়েছিল বেশ নিকট অতীতে। সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশপ উসার (Biship Ussher) হিসাব করে বলেছিলেন মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। ওল্ড টেস্টামেন্টের লোকদের বয়স যোগ করে তিনি এই হিসাব পেয়েছিলেন। মহাবিশ্বের জন্ম অদূর অতীতে– একটি তথ্য ও কল্পন সমর্থন করে। সেটা হল মানবজাতি যে সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিবিদ্যায় অগ্রসরমান, স্পষ্ট প্রতীয়মান এই তথ্য–তার স্বীকৃতি। আমরা স্মরণ করি কোন কাজ কে প্রথমে করেছে কিংবা কোন্ প্রযুক্তি কে বিকশিত করেছে। যুক্তিটা হল : সেজন্য আমাদের অস্তিত্ব বেশি দিনের নয়, তা না হলে আমাদের যা অগ্রগতি হয়েছে তার চাইতেও বেশি অগ্রগতি হত। আসলে বাইবেলের সৃষ্টির তারিখ এবং শেষ তুষার যুগ শেষ হওয়ার তারিখের ভিতরে খুব বেশি দূরত্ব নেই। মনে হয় সেই সময়ই আধুনিক মানবজাতি দেখা গেছে।

অন্যদিকে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতো কিছু লোক মহাবিশ্বের যে একটা আরম্ভ ছিল এ চিন্তন পছন্দ করেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল এর নিহিতার্থ হবে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ। মহাকালের অস্তিত্ব চিরকাল রয়েছে এবং থাকবে এই বিশ্বাসই তাদের পছন্দ ছিল। যা সৃষ্টি করা হয়েছে তার চাইতে যা চিরন্তন সেটা অনেক বেশি নিখুঁত। উপরে উল্লিখিত মানব প্রগতির যুক্তির একটা প্রত্যুত্তর তাদের ছিল : মাঝে মাঝে বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা মনুষ্যজাতিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে।

দুটি চিন্তাধারাতেই বিশ্বাস ছিল মহাবিশ্ব মূলত কালের সঙ্গে অপরিবর্তনশীল। হয় মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় এইরূপই ছিল কিংবা আজ যেমন আছে চিরকালই সেরকম ছিল। এটা ছিল একটা স্বাভাবিক বিশ্বাস, তার কারণ মানবজীবন, এমন কি লিখিত ইতিহাসের সম্পূর্ণটাই এত সংক্ষিপ্ত যে, মানুষের জীবনকালে মহাবিশ্বের কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। একটা সুস্থিত অপরিবর্তনশীল মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এর অস্তিত্ব চিরন্তন, না অতীতে কোন সীমিত কালে এর সৃষ্টি হয়েছিল সে প্রশ্ন অধিবিদ্যা কিংবা ধর্মের ব্যাপার। যে কোন তত্ত্বই ঐরকম মহাবিশ্বের কারণ দেখাতে পারে। প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) একটি উল্লেখযোগ্য এবং অত্যন্ত দুর্বোধ্য বই লিখেছিলেন, ‘The Critique of Pure Reason’। সে বইয়ে তার সিদ্ধান্ত ছিল, মহাবিশ্বের কেন একটা আরম্ভ ছিল এবং কেন আরম্ভ ছিল না –এই দুটি মতেরই সপক্ষে এবং বিপক্ষে সমান অকাট্য যুক্তি আছে। শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, তার সিদ্ধান্তের ভিত্তি ছিল শুধুমাত্র যুক্তি। অন্য কথায় বলা যায় তারা মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের উপর কোন গুরুত্ব দেননি। আসলে একটি অপরিবর্তনশীল মহাবিশ্বে পর্যবেক্ষণ করার আছেটা কি?

ঊনবিংশ শতাব্দীতে কিন্তু পৃথিবী এবং বাকি মহাবিশ্ব যে কালের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে এ বিষয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ জমতে লাগল। ভূতত্ত্ববিদরা বুঝতে পারলেন প্রস্তর এবং সেগুলোর ভিতরকার জীবাশ্ম সৃষ্টি হতে বহু কোটি কিংবা অবুদ বছর লেগেছে। এই কাল, সৃষ্টকদিগের (creations) গণনা করা পৃথিবীর বয়সের চাইতে অনেক বেশি। আরও সাক্ষ্য পাওয়া গেল তথাকথিত তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় বিধি থেকে। এই বিধিটি গঠন করেছিলেন জার্মান পদার্থবিদ লুডভিক বোজম্যান (Ludwing Boltzmann)। এ বিধি বলে : মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলার মোট পরিমাণ কালের সঙ্গে সবসময়ই বর্ধমান [এটাকে একটি রাশি দিয়ে মাপা হয় তাকে বলা হয় এনট্রপি’ (entropy)]। মানবিক অগ্রগতির যুক্তির মতো এই যুক্তিও বলে মহাবিশ্বের শুধুমাত্র সসীম কালে অস্তিত্ব থাকারই সম্ভাবনা, তাছাড়া মহাবিশ্ব এতদিনে অপজাত হয়ে (degenerated) সম্পূর্ণ বিশৃঙখল অবস্থায় পৌঁছাত এবং সবটাই একই তাপাঙ্গে পৌঁছাত ।

সুস্থিত মহাবিশ্বের কল্পন সম্পর্কে আরেকটি অসুবিধা : নিউটনের (Newton) মহাকর্ষ বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটি তারকাই অন্য প্রতিটি তারকাকে স্বাভিমুখে আকর্ষণ করছে। তাই যদি হয় তাহলে তারা পরস্পর থেকে স্থির দূরত্বে থেকে কি করে গতিহীন হতে পারে? তাদের কি একসঙ্গে পতন হবে না?

নিউটন এ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। রিচার্ড বেন্টলি (Richard Bentley) নামে তখনকার একজন অগ্রগণ্য দার্শনিককে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে এ বিষয়ে তিনি একমত : সীমিত সংখ্যক তারকাসমূহ গতিহীন হয়ে থাকতে পারে না, তারা কোন কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়বে। তবে তার যুক্তি ছিল অসীম সংখ্যক তারকাসমূহ একসঙ্গে পতিত হবে না। তার কারণ, পতিত হওয়ার মতো কোন কেন্দ্রবিন্দু তাদের থাকবে না। অসীম তন্ত্র (infinite system) নিয়ে কেউ আলোচনা করতে গেলে তিনি কিরকম চোরাবালিতে আটকে যেতে পারেন এই যুক্তি তারই একটি উদাহরণ। মহাবিশ্বের অসীম সংখ্যক অন্য তারকাগুলো থেকে আগত প্রতিটি তারকার উপর বল বিভিন্ন পদ্ধতিতে যোগ করে তারকাগুলো পরস্পর থেকে স্থির দূরত্বে থাকতে পারে কিনা –এ প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর পাওয়া সম্ভব। এখন আমরা জানি সঠিক পদ্ধতিটি হল তারকাগুলোর সীমিত অঞ্চল নিয়ে বিচার করা এবং তারপর তার সঙ্গে আরও তারকা যোগ করা। সেই তারকাগুলো অঞ্চলের বাইরে মোটামুটি সমভাবে বন্টিত। তারকাগুলোর একটি সীমিত সংগ্রহ একত্রে পতিত হবে এবং নিউটনীয় বিধি অনুসারে অঞ্চলের বাইরে অধিকতর সংখ্যক তারকা যোগ করলে চুপসে যাওয়া বন্ধ হবে না। সুতরাং অসীম সংখ্যক তারকা সংগ্রহ গতিহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। এককালে যদি তারা পরস্পর সাপেক্ষ চলমান না হয় তাহলে তাদের পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে তারা পরস্পরের উপরে পতিত হতে শুরু করবে। বিকল্পে তারা পরস্পর থেকে দূরে অপসরণ করতে পারে, সেক্ষেত্রে মহাকর্ষ তাদের অপসরণের বেগ শ্লথতর করবে।

সুস্থির এবং অপরিবর্তনীয় মহাবিশ্বের কল্পন সম্পর্কে এই অসুবিধাগুলো থাকলেও সপ্তদশ, অষ্টাদশ, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এ প্রস্তাব কেউ করেননি যে কালের সঙ্গে মহাবিশ্বেরও বিবর্তন হতে পারে। নিউটন এবং আইনস্টাইন দুজনেই। মহাবিশ্ব হয় প্রসারিত হচ্ছে না হয় সঙ্কুচিত হচ্ছে এই ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগ হারিয়েছেন। নিউটনকে এজন্য দোষ দেওয়া যায় না কারণ নিউটন জীবিত ছিলেন প্রসারমাণ মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণভিত্তিক আবিষ্কারের আড়াইশ’ বছর আগে। কিন্তু ব্যাপারটা আইনস্টাইনের বোঝা উচিত ছিল। ১৯১৫ সালে তিনি যে ব্যাপক অপেক্ষবাদ গঠন করেছিলেন তার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল–মহাবিশ্ব প্রসারমাণ। কিন্তু সুস্থির মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাঁর এতই বিশ্বাস ছিল যে তিনি নিউটনের তত্ত্ব এবং মহাকর্ষকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তার তত্ত্বে একটি উপাদান যোগ করেন।

১৯২৯ সালে এডুইন হাবল (Edwin Hubble) এর মহাবিশ্বের প্রসারণ আবিষ্কারের ফলে এর উৎপত্তি সম্পর্কীয় আলোচনায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়। আপনি যদি নীহারিকাগুলো সম্পর্কে আধুনিক মত মেনে নেন এবং সেগুলোকে কালে পশ্চাৎগামী করে চালিয়ে দেন তাহলে মনে হয় দশ থেকে কুড়ি হাজার মিলিয়ন বছর আগে কোন এক মুহূর্তে সবগুলো নীহারিকাই (galaxy) একটা মহাবিশ্বের শুরু হওয়ার কথা সেটা বলতে পারে না। সেজন্য দরবার করতে হবে ঈশ্বরের কাছে।

অনন্যতা সম্পর্কে মতামতের আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা বেশ আকর্ষণীয়। আমি যখন গ্র্যাজুয়েট ছাত ছিলাম তখন প্রায় কেউই এগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করত না। এখন অনন্যতা উপপাদ্যগুলোর ফলে প্রায় সবাই বিশ্বাস করে, মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল অনন্যতা দিয়ে এবং সেসময় পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো ভেঙে পড়েছিল। তবে আমার এখন মনে হয় যদিও অনন্যতা একটি রয়েছে তবুও পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো স্থির করতে পারে কি করে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল।

কণিকাগুলোর নির্ভুলভাবে সংজ্ঞিত অবস্থান এবং গতিবেগ থাকে না –কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি বলে তারা একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে প্রলিপ্ত থাকে (smeared out)। কণাবাদী বলবিদ্যা অবস্থান এবং বেগ যুগপৎ মাপন অনুমোদন করে না। ব্যাপক অপেক্ষবাদ এই তথ্যগুলোকে ধর্তব্য বলে গ্রহণ করে না। সেজন্য যাকে চিরায়ত তত্ত্ব বলা হয় ব্যাপক অপেক্ষবাদ সেইরকমই একটা তত্ত্ব। এর ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোন অসুবিধা হয় না, তার কারণ স্থান-কালের বক্তৃতার ব্যাসার্ধ কণিকার অবস্থানের অনিশ্চয়তার তুলনায় খুবই বৃহৎ। তবে অনন্যতা উপপাদ্যগুলোর নির্দেশ : মহাবিশ্বের বর্তমান সম্প্রসারণ দশার প্রারম্ভে বক্রতার ব্যাসার্ধ থাকবে ক্ষুদ্র এবং স্থান-কাল অত্যন্ত বেশি বিকৃত হবে। এই অবস্থায় অনিশ্চয়তার নীতি হবে অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং অনন্যতার ভবিষ্যদ্বাণী করে ব্যাপক অপেক্ষবাদ নিজেই নিজের পতন ঘটিয়েছে। মহাবিশ্বের প্রারম্ভ নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন কণাবাদী বলবিদ্যা এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদকে সংযুক্ত করে এরকম একটা তত্ত্ব।

সেই তত্ত্বটা কণাবাদী মহাকর্ষ quantum gravity)। সঠিক কণাবাদী মহাকর্ষ তত্ত্ব নির্ভুল কি রূপ নেবে আমরা এখনো জানি না। আপাতত যে তত্ত্ব সবচাইতে ভাল প্রার্থী তার নাম অতিতন্তু তত্ত্ব (theory of superstring)। কিন্তু এখনও এমন কয়েকটা সমস্যা আছে যার সমাধান হয়নি। তার ভিতর একটা হল আইনস্টাইনের কল্পন : মহাকর্ষের ক্রিয়ার প্রতিরূপ হতে পারে, এমন একটা স্থান-কাল যেটা তার ভিতরকার পদার্থ এবং শক্তির দ্বারা বক্র কিংবা বিকৃত হয়েছে অথবা জড়িয়ে গেছে। এই বক্রস্থানে বস্তুপিণ্ডগুলো ঋজুরেখার নিকটতম পথে যেতে চেষ্টা করে। তবে স্থানটা বঙ্কিম হওয়ার দরুন মনে হয় মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যেন তাদের বঙ্কিম করে দিয়েছে।

পরম তত্ত্বের (ultimate theory) আর একটি উপাদান অর্থাৎ রিচার্ড ফাইনম্যানের প্রস্তাব আমরা আশা করতে পারি। সে প্রস্তাবে বলা রয়েছে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে আমরা বহু ইতিহাসের যোগফল’ (sum over histories) রূপে গঠন করতে পারি। এর সরলতম রূপে কল্পনটি হল : স্থানকালে প্রতিটি কণিকারই সম্ভাব্য সবরকম পথ কিংবা ইতিহাস রয়েছে। প্রতিটি পথ কিংবা ইতিহাসেরই একটা সম্ভাব্যতা আছে। সেটা নির্ভর করে তার আকারের (shape) উপর। এই কল্পনকে কার্যকর করতে হলে, যে বাস্তব কালে আমরা বেঁচে আছি বলে অনুভব করি সে কালে বিচার না করে আমাদের কাল্পনিক কালে যে ইতিহাস ঘটে সেগুলো বিচার করতে হবে। কাল্পনিক কালকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অংশের মতো শোনাতে পারে কিন্তু এটি একটি সুসংজ্ঞিত গাণিতিক ধারণা (a well-defined mathematical concept)। এক অর্থে একে কালের একটি অভিমুখরূপে ভাবা যেতে পারে। সে অভিমুখ বাস্তব কালের সমকোণে। বিশেষ কয়েকটি ধর্ম সমন্বিত কণিকার ইতিহাসগুলোর সম্ভাব্যতা যোগ করা হয়। ধর্মটি হতে পারে বিশেষ কয়েকটি কালে বিশেষ কয়েকটি বিন্দুর ভিতর দিয়ে গমন করা। তারপর আমরা যে স্থান-কালে বাস করি যোগফলটিকে সেই স্থান-কালে বহির্বেশন (extrapolate) করতে হয়। কণাবাদী বলবিদ্যায় সবচাইতে পরিচিত অভিগমন (approach) এটা নয় তবে এ পদ্ধতিতে অন্য পদ্ধতির মতো একই ফল পাওয়া যায় ।

কণাবাদী মহাকর্ষের ক্ষেত্রে ফাইনম্যানের ইতিহাসগুলোর যোগফলের কল্পনের সঙ্গে জড়িত থাকবে মহাবিশ্বের অর্থাৎ বিভিন্ন বক্র স্থান-কালের সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর যোগফল। এগুলো হবে মহাবিশ্ব এবং তার অন্তর্গত সমস্ত জিনিসের প্রতিনিধি। ইতিহাসের এই যোগফলের ভিতরে কোন শ্রেণীর সম্ভাব্য বক্রস্থানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেটা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করতে হবে। এই শ্রেণীর স্থান নির্বাচনই নির্ধারণ করবে মহাবিশ্ব কোন অবস্থায় আছে, যে শ্রেণীর বক্র স্থান মহাবিশ্বের অবস্থা সংজ্ঞিত করে। অনন্যতা সমন্বিত স্থান যদি তার অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে ঐ ধরনের স্থানের সম্ভাবনা তত্ত্ব দিয়ে নির্ধারিত হবে না। তার বদলে কোন যাদৃচ্ছিক উপায়ে সম্ভাব্যতাগুলোকে আরোপ করতে হবে। এর অর্থ বিজ্ঞান স্থান-কালের এই ধরনের একক ইতিহাসগুলোর সম্ভাবনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। অর্থাৎ মহাবিশ্বের কি আচরণ হবে সে সম্পর্কে বিজ্ঞান ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। তবে এ সম্ভাবনা থাকতে পারে যে, মহাবিশ্ব এমন একটা অবস্থায় রয়েছে যে অবস্থা একটা যোগফল দিয়ে সংজ্ঞিত, যার অন্তর্ভুক্ত শুধুমাত্র অনেক (nonsingular) বঙ্কিম স্থানগুলো। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিধিগুলোই মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণ করবে। কি করে মহাবিশ্বের প্রারম্ভ সেটি নির্ধারণ করার জন্য মহাবিশ্ব বহির্ভূত কোন কর্মকের (agency) দ্বারস্থ হতে হবে না। একদিক দিয়ে মহাবিশ্বের অবস্থা শুধুমাত্র অনেক ইতিহাসগুলোর যোগফল দিয়ে নির্ধারিত হয় –এই প্রস্তাব মাতালের ল্যাম্প পোস্টের (আলোক স্তম্ভ) নিচে চাবি খোঁজার মতো। যেখানে সে চাবিটা হারিয়েছে ওটা সে জায়গা না হতে পারে কিন্তু ওটাই একমাত্র জায়গা যেখানে তার চাবিটা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। একইভাবে বলা যায় মহাবিশ্ব অনেক ইতিহাসগুলোর যোগফল দিয়ে সংজ্ঞিত হতে পারে এরকম অবস্থায় না থাকতে পারে কিন্তু এটাই একমাত্র অবস্থা যেখানে বিজ্ঞান ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে মহাবিশ্বের কি অবস্থায় থাকা উচিত।

১৯৮৩ সালে আমি এবং জিম হার্টল Jim Hartle) প্রস্তাব করেছিলাম মহাবিশ্বের অবস্থা একটি বিশেষ শ্রেণীর ইতিহাসগুলোর যোগফল দিয়ে প্রকাশ পাওয়া উচিত। এই শ্রেণীতে থাকবে বঙ্কিম স্থান কিন্তু তাতে কোন অনন্যতা থাকবে না। এদের আকার সীমিত থাকবে কিন্তু এদের কোন সীমানা কিংবা কিনারা থাকবে না। এগুলো হবে ভূপৃষ্ঠের মতো সসীম কিন্তু তাদের আরও দুটি মাত্রা থাকবে। ভূপৃষ্ঠের এলাকা সসীম কিন্তু এর কোন অনন্যতা, সীমানা কিংবা কিনারা নেই। এটি আমি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে বিচার করে দেখেছি। আমি পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছি কিন্তু কখনো পড়ে যাইনি।

আমি আর জিম হার্ট যে প্রস্তাব করেছিলাম তাকে এই বাগ্বিধিতে প্রকাশ করা যায়: মহাবিশ্বের সীমান্তের অবস্থা এমন যে তার কোন সীমানা নেই। মহাবিশ্ব যদি শুধুমাত্র এই সীমানাবিহীন অবস্থায় থাকে তাহলেই বিজ্ঞানের বিধিগুলো স্বকীয়ভাবে প্রত্যেকটি সম্ভাব্য ইতিহাসের সম্ভাবনা নির্ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ শুধুমাত্র এরকম ক্ষেত্রেই জানিত বিধিগুলো নির্ধারণ করবে মহাবিশ্বের আচরণ কি রকম হওয়া উচিত। মহাবিশ্ব যদি অন্য কোন অবস্থায় থাকে তাহলে ইতিহাসগুলোর যোগফলের যে শ্ৰেণীতে বঙ্কিম স্থানগুলো পড়বে তার অন্তর্ভুক্ত হবে। অনন্যতা সমন্বিত নির্ধারণ করতে হলে বিজ্ঞানের জানিত বিধিতে বাদ দিয়ে অন্য কোন নীতিকে আহ্বান জানাতে হবে। এই নীতি (Principle) হবে আমাদের মহাবিশ্ব বহির্ভুত একটা কিছু। আমাদের মহাবিশ্বের ভিতর থেকে আমরা সে সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত করতে পারি না। অন্য দিকে মহাবিশ্ব যদি সীমানাহিবীন অবস্থায় থাকে তাহলে মহাবিশ্বের আচরণ আমরা সম্পূর্ণ নির্ধারণ করতে পারি –অবশ্য অনিশ্চয়তা নীতি নির্ধারিত সীমানা পর্যন্ত।

মহাবিশ্ব যদি সীমানাবিহীন অবস্থায় থাকত তাহলে বিজ্ঞানের পক্ষে খুবই ভাল হত। সন্দেহ নেই, কিন্তু মহাবিশ্ব ঐ অবস্থায় আছে কিনা, কি করে আমরা বলব? এর উত্তর হল: সীমানাহীনতার প্রস্তাব মহাবিশ্বের, আচরণ কি রকম হবে সে সম্পর্কে কতকগুলো নির্দিষ্ট নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করে। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর সঙ্গে যদি পর্যবেক্ষণফলের অনৈক্য হয় তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি মহাবিশ্ব সীমানাহীন অবস্থায় নেই। সুতরাং দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) সংজ্ঞিত অর্থে সীমানাহীনতার প্রস্তাব একটি উত্তম বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। পর্যবেক্ষণের সাহায্যে এ তত্ত্বকে অপ্রাণ করা যায় কিংবা মিথ্যা প্রমাণ করা যায়।

পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যদি ভবিষ্যদ্বাণীর মতানৈক্য হয় তাহলে আমরা জানব সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর শ্রেণীর ভিতরে অনন্যতা অবশ্যই আছে। তবে ঐটুকুই আমরা জানতে পারব। আমরা একক ইতিহাসগুলোর সম্ভাব্যতা গণনা করতে পারব না সুতরাং মহাবিশ্বের আচরণ কি রকম হবে সে সম্পর্কেও আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব না। ভাবা যেতে পারে এই ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতার অভাব যদি শুধুমাত্র বৃহৎ বিস্ফোরণের সময় হয় তাহলে খুব বেশি কিছু আসবে যাবে না। কারণ ঘটনাটা তো এক হাজার কিংবা দুই হাজার কোটি বছর আগেকার ব্যাপার। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা যদি বৃহৎ বিস্ফোরণের অত্যন্ত শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ে তাহলে যখনই একটি তারকা চুপসে যায় তখনও এটা ভেঙে পড়তে পারে। শুধু আমাদের ছায়াপথেই এ ঘটনা ঘটতে পারে সপ্তাহে কয়েকবার।

অবশ্য, বলা যেতে পারে একটা দূরস্থিত তারকায় যদি ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। ভেঙ্গে পড়ে তাহলে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে –যা সত্যই নিষিদ্ধ নয় তা ঘটতে পারে এবং ঘটবে। উদাহরণ : অনন্যতা সম্পর্কিত স্থান যদি সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে অনন্যতা যে কোন জায়গাতেই ঘটতে বেপারে –শুধুমাত্র বৃহৎ বিস্ফোরণে এবং চুপসে যাওয়া তারকাতেই নয়। এর অর্থ হবে : আমরা কোন ভবিষ্যদ্বাণীই করতে পারতাম না। বিপরীতে conversely) আমরা ঘটনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি এই তথ্যই অনন্যতাগুলোর বিপক্ষে এবং সীমানাহীনতার প্রস্তাবের সপক্ষে পরীক্ষাভিত্তিক সাক্ষ্য।

তাহলে সীমানাহীনতার প্রস্তাব মহাবিশ্ব সম্পর্কে কি ভবিষ্যদ্বাণী করে–এ বিষয়ে প্রথম বক্তব্য : যেহেতু মহাবিশ্বের সমস্ত ইতিহাসগুলোই বিস্তারের দিক দিয়ে সসীম (finite in extent), সেজন্য কালের মাপনের জন্য যে রাশিই ব্যবহার করা হোক না কেন সে রাশির একটি বৃহত্তম, একটি ন্যূনতম মূল্যাঙ্ক থাকবে। সুতরাং মহাবিশ্বের একটি প্রারম্ভ থাকবে এবং একটি অন্ত থাকবে। বাস্তব কালে প্রারম্ভ হবে বৃহৎ বিস্ফোরণ অনন্যতা। তবে কাল্পনিক কালের প্রারম্ভ একটি অনন্যতা হবে না, তার বদলে এটা হবে অনেকটা পৃথিবীর উত্তর মেরুর মতো। যদি অক্ষাংশের ডিগ্রীকে (degree of latitude) কালের পৃষ্ঠে (surface of time) কালের সমরাশি (analogue) রূপে গ্রহণ করা হয় তাহলে বলা যেতে পারে ভূপৃষ্ঠ শুরু হয় উত্তর মেরুতে। তবুও উত্তর মেরু পৃথিবীর একটি নিখুঁত সাধারণ বিন্দু। উত্তর মেরুর বিশেষত্ব কিছু নেই। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যে বিধি সত্য উত্তর মেরুতেও সে বিধিগুলো সত্য। একইভাবে বলা যায়, যে ঘটনাকে কাল্পনিক কালে মহাবিশ্বের আরম্ভ’ বলে নির্বাচন করে চিহ্নিত করতে পারি সেটা হবে স্থান-কালের একটা সাধারণ বিন্দু– যে কোন অন্য বিন্দুর মতোই। অন্যান্য স্থান-কালের (elswhere) মতোই প্রারম্ভে বিজ্ঞানের বিধি সত্য হবে।

ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে উপমা থেকে আশা করা যায় মহাবিশ্বের অন্ত প্রারম্ভের মতোই হবে, ঠিক যেমন উত্তর মেরু অনেকটা দক্ষিণ মেরুর মতো। তবে উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু মহাবিশ্বের ইতিহাসে প্রারম্ভ এবং অন্তের অনুরূপ। শুধু কাল্পনিক কালে, যে বাস্তব কাল আমরা অনুভব করি সেই বাস্তব কালে নয়। আমরা যদি ইতিহাসের যোগফলটি কাল্পনিক কাল থেকে বাস্তব কালে বহির্বেশন করি (extrapolation) তাহলে দেখা যাবে বাস্তব কালে মহাবিশ্বের প্রারম্ভ তার অন্ত থেকে খুবই পৃথক হতে পারে।

জোনাথন হ্যাঁলিওয়েল (Jonathan Halliwell) এবং আমি সীমানাবিহীন অবস্থার নিহিতার্থ কি হবে সে সম্পর্কে একটা আসন্ন গণনা (approximate calculation) করেছিলাম। আমরা মহাবিশ্বকে বিচার করেছিলাম একটি নিখুঁত মসৃণ এবং সমরূপ পশ্চাৎপটরূপে। তার ভিতরে ঘনত্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচরণ (perturbations) ছিল। বাস্তব কালে মনে হয় মহাবিশ্ব তার সম্প্রসারণ শুরু করবে অতি ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধ থেকে। প্রথমে সম্প্রসারণ হবে যাকে বলা হয় অতিস্ফীতি, সেরকম : মহাবিশ্ব এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের আকারে দ্বিগুণ হবে, ঠিক যেমন অনেক দেশে মূল্যমান প্রতিবছরে দ্বিগুণ হয়। অর্থনৈতিক মুদ্রাস্ফীতির বিশ্বরেকড বোধহয় ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির। সে দেশে একটা পাউরুটির দাম কয়েক মার্ক থেকে বেড়ে কয়েক মাসে কয়েক মিলিয়ন মার্কে পৌঁছায়, কিন্তু মনে হয় আদিম মহাবিশ্বে যে অতিস্ফীতি হয়েছিল (inflation) তার তুলনায় এই মুদ্রাস্ফীতি কিছুই নয় : এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের ভিতরে আকার বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল এক মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন, মিলিয়ন গুণ। অবশ্য সেটা হয়েছিল বর্তমান সরকারের আগে।

অতিস্ফীতি ব্যাপারটা ভালই হয়েছিল কারণ এর ফলে এমন একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল যেটা বৃহৎ মানে ছিল মসৃণ এবং সমরূপ, আবার চুপসে যাওয়া এড়ানোর জন্য সম্প্রসারণ হচ্ছিল ঠিক ক্রান্তিক হারে। এই অতিস্ফীতি অন্যদিক দিয়েও ভাল জিনিসই ছিল। তার কারণ এর ফলে উৎপন্ন হয়েছিল মহাবিশ্বের সমস্ত আধেয় (content– অন্তর্বন্তু)। এ সৃষ্টি হয়েছিল আক্ষরিক অর্থে শূন্যতা থেকে। মহাবিশ্ব যখন উত্তর মেরুর মতো একক বিন্দু ছিল তখন এর কোন অন্তর্বস্তু ছিল না, কিন্তু এখন মহাবিশ্বের যে অংশ আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাতে রয়েছে অন্তত ১০৮০ কণিকা। এই সমস্ত কণিকা এল কোথা থেকে? উত্তরটা হল : অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যা শক্তি থেকে বস্তু সৃষ্টি অনুমোদন করে। বস্তুটি সৃষ্টি হয় কণিকা, বিপরীত কণিকা জোড়রূপে। তাহলে এই পদার্থ সৃষ্টির জন্য শক্তি কোথা থেকে এল? উত্তরটা হল শক্তিটা ধার করা হয়েছিল মহাকর্ষীয় বলের কাছ থেকে। অপরা (negative) মহাকর্ষীয় শক্তির কাছে মহাবিশ্বের একটা বিরাট ঋণ রয়েছে। তার সঙ্গে পদার্থের পরা শক্তির কাছে মহাবিশ্বের একটা বিরাট ঋণ রয়েছে –তার সঙ্গে পদার্থের পরাশক্তির ভারসাম্য নিখুঁত (exactly balances)। অতিস্ফীতির যুগে আরও পদার্থ সৃষ্টি করার অর্থ যোগান দেওয়ার জন্য মহাবিশ্ব মহাকর্ষীয় শক্তির কাছ থেকে বিরাট ঋণ গ্রহণ করেছিল। এর ফলে হয়েছিল কী এর অর্থনীতির জয় : একটা বীর্যবান এবং সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব আর সেটা ছিল নানা পদার্থে পরিপূর্ণ। মহাবিশ্বের অন্তিম কালের আগে পর্যন্ত এই মহাকর্ষীয় ঋণ শোধ করতে হবে।

আদিম মহাবিশ্ব সম্পূর্ণরূপে সমসত্ব এবং সমরূপ হওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ তাহলে কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি ভেঙে যেত। তার বদলে সমরূপ ঘনত্ব থেকে নিশ্চয়ই কিছু বিচ্যুতি হয়েছে। সীমানাহীনতার প্রস্তাবের নিহিতার্থ হল ঘনত্বের এই পার্থক্য শুরু হবে একদম নিচুতলা থেকে অর্থাৎ তারা হবে যত ক্ষুদ্র সম্ভব। অবশ্য অনিশ্চয়তার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। অতিস্ফীতিরূপ সম্প্রসারণের সময় কিন্তু পার্থক্যের বিবর্ধন (amplification) হবে। অতিস্ফীতিরূপ সম্প্রসারণের যুগ শেষ হওয়ার পর এমন একটা মহাবিশ্ব রইল যেটা কোন কোন জায়গায় অন্য জায়গার তুলনায় দ্রুততর সম্প্রসারিত হচ্ছিল। যেসব অঞ্চলে সম্প্রসারণ শ্লথতর ছিল সেই সমস্ত অঞ্চলে পদার্থের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ সম্প্রসারণকে আরও শ্লথ করে দেবে। শেষে ওই অঞ্চলে সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং অঞ্চলটা নীহারিকা এবং তারকা গঠন করার জন্য সঙ্কুচিত হতে থাকবে। সুতরাং আমরা আমাদের চারপাশে যে সমস্ত গঠন দেখতে পাই সেগুলোর কারণ হতে পারে সীমানাহীনতার প্রস্তাব। তবে এই প্রস্তাব মহাবিশ্ব সম্পর্কে শুধুমাত্র একটা ভবিষ্যদ্বাণীই করে না, তার বদলে এর ভবিষ্যদ্বাণীতে থাকে সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর সম্পূর্ণ একটা গোষ্ঠী। এর প্রত্যেকটিরই নিজস্ব সম্ভাব্যতা আছে। ইতিহাসের একটি সম্ভাবনা হতে পারে : গত নির্বাচনে লেবার পার্টি জিতেছিল। অবশ্য তার সম্ভাব্যতা খুবই কম।

সীমানাহীনতার প্রস্তাবে মহাবিশ্বের ব্যাপারে ঈশ্বরের ভূমিকা বিষয়ে গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এখন সাধারণত মেনে নেওয়া হয় সুসংজ্ঞিত বিধি অনুসারে মহাবিশ্ব বিবর্তিত হয়। এই বিধিগুলো ঈশ্বরের আদেশে হয়েছে –এটা হতে পারে। কিন্তু তিনি এখন আর আইনভঙ্গ করার জন্য মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন না। তবে আধুনিক কাল পর্যন্ত এই বিধিগুলো মহাবিশ্বের আরম্ভের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ঘুড়ির মতো মহাবিশ্বকে গুটিয়ে নিয়ে তাঁর যেমন খুশি সেইভাবে মহাবিশ্বকে আবার শুরু করা ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন। সুতরাং মহাবিশ্বে বর্তমান অবস্থা হবে ঈশ্বরের প্রাথমিক অবস্থা নির্বাচনের ফল।

যদি সীমানাহীনতার প্রস্তাব নির্ভুল হয় তাহলে কিন্তু পরিস্থিতিটা খুবই পৃথক হবে। সেক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো মহাবিশ্বের আরম্ভেও প্রযোজ্য হবে। সুতরাং ঈশ্বরের প্রাথমিক অবস্থা নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকবে। অবশ্য মহাবিশ্ব যে বিধিগুলো মেনে চলে সে বিধিগুলো নির্বাচন করার স্বাধীনতা তাঁর থাকত। তবে নির্বাচনের খুব বেশি কিছু হয়ত থাকত না, হয়ত খুব অল্পসংখ্যক বিধি থাকত। সে বিধিগুলো নিজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমাদের মতো জটিল জীব সৃষ্টির পথিকৃৎ। সেই জীবেরা প্রশ্ন করতে পারে : ঈশ্বরের চরিত্র (nature) কিরকম।

যদি অদ্বিতীয় এক কেতা বিধিই থাকে, সেটা শুধুমাত্র এক কেতা সমীকরণ। সেই সমীকরণগুলোতে প্রাণসঞ্চার করে কে? কে তা থেকে একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে, যে মহাবিশ্ব তারা পরিচালনা করতে পারে? পরম ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব কি এমনই শক্তিশালী যে সে নিজেই নিজের অস্তিত্ব সৃষ্টি করে? যদিও বিজ্ঞান হয়ত মহাবিশ্ব কি করে সৃষ্টি হয়েছে সে সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না : মহাবিশ্ব অস্তিমান হওয়ার ঝামেলা কেন নিয়েছে? আমিও তার উত্তর জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *