০৮. আইনস্টাইনের স্বপ্ন

০৮. আইনস্টাইনের স্বপ্ন*

[*১৯৯১ সালের জুলাই মাসে টোকিওতে এন.টি.ডাটা কমুনিকেশন সিস্টেমের (NIT Data Communication System) প্যারাডিম সেশান-এ (Paradigm Session) এ প্রদত্ত বক্তৃতা।]

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দুটি নতুন তত্ত্ব স্থান-কাল এবং বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে দেয়। সত্তর বছরেরও বেশি হয়ে গেল আজও আমরা সেগুলোর নিহিতার্থ অনুধাবনের জন্য অনুশীলন করে চলেছি আর চেষ্টা করে চলেছি তাদের সমন্বয়। করে একটা ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে। সে তত্ত্ব এমন হবে যে মহাবিশ্বের সবকিছুরই বিবরণ দান করতে পারবে। তত্ত্ব দুটি হল ব্যাপক অপেক্ষবাদ আর কণাবাদী Topfenst i (general theory of relativity and quantum mechanics) ব্যাপক অপেক্ষবাদের বিচার্য বিষয় স্থান আর কাল, মহাবিশ্বের পদার্থ এবং শক্তিপ্রভাবে বৃহৎ মানে কি করে তারা বেঁকে যায় কিংবা প্যাঁচ খেয়ে যায়। অন্যদিকে কণাবাদী বলবিদ্যা বিচার করে অতি ক্ষুদ্র মান, যাকে অনিশ্চয়তার নীতি বলা হয় সেটা এর অন্তর্ভুক্ত। এই নীতি অনুসারে একটি কণিকার অবস্থান এবং গতিবেগ একই সময়ে এখনোই নির্ভুলভাবে মাপা যায় না। যত নির্ভুলভাবে একটিকে আপনি মাপবেন তত কম নির্ভুল হবে অন্যটির মাপন। একটা উপাদান সবসময়ই থাকে, সেটা হল অনিশ্চয়তা বা আপতন chance) এটা সবসময়ই ক্ষুদ্র মানে পদার্থের আচরণ মূলগতভাবে প্রভাবিত করে। আইনস্টাইন প্রায় একাই ব্যাপক অপেক্ষবাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং কণাবাদী বলবিদ্যার বিকাশে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেষোক্ত তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর মনের ভাব প্রকাশ পায় এই কথায়—’ঈশ্বর জুয়া খেলেন না’। কিন্তু সমস্ত সাক্ষ্য থেকে নির্দেশ পাওয়া যায়, ঈশ্বর সংশোধনের অতীত একজন জুয়াড়ি এবং তিনি জুয়ার দান ফেলে থাকেন। সুযোগ পেলেই তিনি জুয়া খেলেন।

এই রচনায় আমি চেষ্টা করব এই দুটি তত্ত্বের পিছনে যে মূলগত চিন্তাধারা আছে সেটা বলতে আর চেষ্টা করব বলতে আইনস্টাইন কেন কণাবাদী বলা বিদ্যার ব্যাপারে অসুখী ছিলেন। তাছাড়া আমি দুটি তত্ত্বের সমন্বয় করলে যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো ঘটে তার কয়েকটি বিবরণ দেব। এ থেকে নির্দেশ পাওয়া যায় কালের নিজেরও প্রায় দেড় হাজার কোটি বছর আগে একটা শুরু ছিল এবং ভবিষ্যতে কোন এক সময় এর শেষ হবে। তবুও অন্য এক ধরনের কালে মহাবিশ্বের কোন শুরু নেই। এর সৃষ্টিও হয়নি, ধ্বংসও হয়নি। এ শুধু অস্তিমান।

আমি শুরু করব অপেক্ষবাদ দিয়ে। জাতীয় বিধিগুলো শুধু একটি দেশেই প্রযোজ্য কিন্তু পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো ব্রিটেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাপান সর্বত্র অভিন্ন। এমনকি মঙ্গলগ্রহ কিংবা এ্যান্ড্রোমিডা (Andromeda) নীহারিকাতে এ বিধি এক। শুধু তাই নয়, আপনি যে গতিতেই চলমান হোন না কেন–বিধিগুলো একই থাকবে। একটা বুলেট ট্রেনে কিংবা একটা জেট বিমানে এক স্থানে দাঁড়িয়ে আছে এ রকম যে কোন ব্যক্তি সাপেক্ষ বিধিগুলো একই হবে। আসলে পৃথিবীতে যে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেও অবশ্যই সেকেন্ডে প্রায় 18.6 মাইল (৩০ কি. মি.) বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলমান। সূর্য সেকেন্ডে কয়েক শ’ কিলোমিটার বেগে ছায়াপথ প্রদক্ষিণ করে চলমান এবং এই রকম অনেক কিছুই। তবুও এই সমস্ত গতিই পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না। সমস্ত পর্যবেক্ষক সাপেক্ষই এগুলো অভিন্ন।

একটি তন্ত্রের দ্রুতির স্বাতন্ত্র প্রথমে আবিষ্কার করেন গ্যালিলিও। তিনি কামানের গোলা কিংবা গ্রহগুলোর মতো বস্তুপিণ্ডের গতির বিধি আবিষ্কার করেন। কিন্তু যখন এই দ্রুতির স্বাতন্ত্র আলোকের গতির বিধির ক্ষেত্রে প্রসারিত করার চেষ্টা করা হল, তখন একটা সমস্যা দেখা দিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবিষ্কার করা হয়েছিল, আলোক উৎস থেকে পর্যবেক্ষকের কাছে তৎক্ষণাৎ যায় না। বরং এটা যায় একটা বিশেষ গতিতে। সেকেন্ডে প্রায় এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল (সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার)। কিন্তু কি সাপেক্ষ এই দ্রুতি? মনে হয়েছিল সমগ্র স্থানে কোন একটি মাধ্যম থাকা উচিত যার ভিতর দিয়ে আলোক গমন করে। এই মাধ্যমের নাম ইথার। চিন্তনটি ছিল আলোকতরঙ্গ সেকেন্ডে 1 লক্ষ ৪6 হাজার মাইল দ্রুতিতে (speed) ইথারের ভিতর দিয়ে গমন করে। এর অর্থ হল, যে ইথার সাপেক্ষ স্থিরাবস্থায় রয়েছে, সে আলোকের দ্রুতি মাপবে সেকেন্ডে 1 লক্ষ ৪6 হাজার মাইল। কিন্তু যে পর্যবেক্ষক ইথারের ভিতর দিয়ে চলমান তার মাপনে আলোকের দ্রুতি উচ্চতর কি নিম্নতর মনে হবে, বিশেষ করে বিশ্বাস করা হত পৃথবী যখন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে কক্ষপথে ইথারের মধ্য দিয়ে চলমান তখন আলোকের দ্রুতির পরিবর্তন হওয়া উচিত। কিন্তু 1887 সালে মিচেলসন এবং মর্লি একটি সযত্ন পরীক্ষা করেন, তাতে দেখা গেল আলোলাকের গতি সবসময়ই অভিন্ন। পর্যবেক্ষক যে দ্রুতিতেই চলমান হোন না কেন, আলাকের গতি মাপলে তিনি সবসময়ই দেখবেন সেটা সেকেন্ডে 1 লক্ষ ৪6 হাজার মাইল।

এটা কি করে সত্য হতে পারে? বিভিন্ন দ্রুতিতে চলমান পর্যবেক্ষকরা কি করে আলোকের গতি মাপলে একই মাপনফল পাবেন? উত্তর : এরকম তারা পেতে পারেন না। অবশ্য যদি স্থান এবং কাল সম্পর্কে স্বাভাবিক চিন্তাধারা সত্য হয়। কিন্তু 1985 সালে একটি বিখ্যাত গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন দেখালেন যদি সার্বিক কালের (universal time) চিন্তাধারা পরিত্যাগ করা হয় তাহলে এ রকম সমস্ত পর্যবেক্ষকই আলোকের গতির মাপনফল অভিন্ন পাবেন। তার বদলে প্রত্যেকে তাঁদের ব্যক্তিগত কাল পেতে পারেন। সেটা মাপতে হবে যে ঘড়ি তারা নিজেরা বহন করছেন সেই ঘড়ি দিয়ে। এসব বিভিন্ন ঘড়ির মাপনে যে কাল দেখা যাবে সেটা প্রায় নির্ভুলভাবে অভিন্ন হবে। অবশ্য তারা যদি পরস্পরসাপেক্ষ ধীর গতিতে চলেন। কিন্তু তারা যদি উচ্চ গতিতে চলেন, তাহলে বিভিন্ন ঘড়ির মাপনে কালগুলো পাওয়া যাবে তাদের ভেতরে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকবে। এই অভিক্রিয়া বাস্তবে পর্যবেক্ষণ করা গেছে। সেটা করা হয়েছে পৃথিবী পৃষ্টে অবস্থিত একটি ঘড়ির সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক বিমানে অবস্থিত একটি ঘড়ির তুলনা করে। বিমানে অবস্থিত ঘড়িটি স্থিতাবস্থায় অবস্থিত ঘড়ির তুলনায় সামান্য ধীর গতিতে চলে। কিন্তু পর্যটনের স্বাভাবিক দ্রুতিতে ঘড়িগুলোর চলনের হারের পার্থক্য খুবই কম। আপনার আয়ু এক সেকেন্ড বাড়াতে হলে আপনাকে বিমানে পৃথিবীকে চল্লিশ কোটি বার প্রদক্ষিণ করতে হবে। কিন্তু বিমানে আপনাকে যে খাবার দেবে সেই খাবার খেয়ে আপনার আয়ু অনেক বেশি কমে যাবে।

নিজেদের ব্যক্তিগত কাল থাকলেও কি করে বিভিন্ন দ্রুতিতে চলমান লোকের কাছে আলোকের দ্রুতির মাপনফল একই হবে? একটি আলোকের স্পন্দনের দ্রুতি হবে দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী কালে সে যে দূরত্ব অতিক্রম করেছে তার সঙ্গে সেই দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী কালের ভাগফল (এই অর্থে একটি ঘটনা হল স্থানের একক একটি বিন্দুতে, কালের একটি বিশেষ বিন্দুতে যা ঘটে তাই)। বিভিন্ন দ্রুতিতে চলমান লোকদের দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী দূরত্ব সম্পর্কে মতৈক্য হবে না। উদাহরণ : আমি যদি বড় রাস্তা দিয়ে চলেছে এরকম একটা গাড়ি মাপি তাহলে আমি ভাবতে পারি গাড়িটা এক কিলোমিটার চলেছে। কিন্তু কেউ যদি সূর্য থেকে গাড়িটা দেখে তাহলে সে বলবে গাড়িটা প্রায় 1800 কিলোমিটার চলেছে। তার কারণ গাড়িটা যখন রাস্তা দিয়ে চলছিল পৃথিবীটাও তখন চলেছে। ভিন্ন দ্রুতিতে চলমান বিভিন্ন লোকের দূরত্বের মাপন বিভিন্ন হবে। তাদের যদি আলোকের দ্রুতি সম্পর্কে এক মত হতে হয় তাহলে ঘটনাগুলো অন্তর্বর্তী কালের মাপনেও তাদের পার্থক্য হবে।

1905 সালের একটি গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন অপেক্ষবাদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এখন আমরা এ তত্ত্বের নাম দিয়েছি বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ। এ তত্ত্ব বস্তুপিণ্ডগুলো স্থান-কালে কিভাবে চলমান তার বিবরণ দান করে। এ তত্ত্ব দেখায় কাল একটি স্বতন্ত্র অস্তিমান exists on its own) স্থান থেকে স্বতন্ত্র সার্বিক রাশি নয়। অতীত এবং বর্তমান শুধু অভিমুখ মাত্র–স্থান-কালের মতো একটা কিছুর ভিতরে উঁচু এবং নিচু (up and down), দক্ষিণ-বাম, সম্মুখ-কালের মতো অনেকটা। কালে আপনি শুধু ভবিষ্যৎ অভিমুখেই যেতে পারেন তবে তার সঙ্গে একটু কৌণিকভাবেও যেতে পারেন। সেজন্যই কাল বিভিন্ন হারে চলমান হতে পারে।

বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ স্থান এবং কালকে সংযুক্ত করেছে। কিন্তু স্থান-কাল ছিল ঘটনা ঘটবার একটি স্থির পশ্চাৎপট। আপনি স্থান-কালের ভিতর দিয়ে চলবার জন্য বিভিন্ন পথ বেছে নিতে পারেন। কিন্তু যাই করুন না কেন স্থান-কালের পশ্চাৎপটের কোন পরিবর্তন হবে না। তবে 1915 সালে আইনস্টাইন যখন ব্যাপক অপেক্ষবাদ গঠন করলেন তখন এ সবেরই পরিবর্তন হল। তার যে বিপ্লবী চিন্তাধারা ছিল সেটা হল মহাকর্ষ, শুধুমাত্র স্থান-কালের পশ্চাৎপটে সক্রিয় একটি বল নয়। তার বদলে মহাকর্ষ স্থান-কালের একটি বিকৃতি। তার কারণ এর ভিতরকার বল এবং শক্তি। কামানের গোলা কিংবা গ্রহগুলোর মতো বস্তুপিণ্ড স্থান কালের ভিতর দিয়ে ঋজুরেখায় চলমান হয় কিন্তু যেহেতু স্থান-কাল সমতল না হয়ে বঙ্কিম এবং পঁাচ খাওয়া, সেজন্য বস্তুপিণ্ডগুলোর চলার পথকে বঙ্কিম মনে হয়। পৃথিবী চেষ্টা করে স্থান-কালের ভিতর দিয়ে ঋজুপথে যেতে কিন্তু সূর্যের ভরের ফলে স্থান-কালের বক্রতা পৃথিবীকে সূর্য প্রদক্ষিণ করে চক্রাকারে ঘোরায়। একইভাবে আলোক চেষ্টা করে ঋজুপথে যেতে কিন্তু সূর্যের নিকটের স্থান-কালের বক্রতা সুদূর তারকাগুলো থেকে আগত আলোককে সূর্যের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁকিয়ে দেয়। সাধারণত প্রায় সূর্যের অভিমুখে অবস্থিত আকাশের তারাগুলোকে দেখা যায় না। তবে গ্রহণের সময় সূর্যের প্রায় অধিকাংশ আলোককেই চাঁদ আটকে দেয়, তখন ঐ সমস্ত তারকা থেকে আগত আলোক পর্যবেক্ষণ করা যায়। আইনস্টাইন ব্যাপক অপেক্ষবাদ সৃষ্টি করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। কিন্তু 1919 সালে যুদ্ধের পরপরই একটি ব্রিটিশ অভিযান গ্রহণটি পর্যবেক্ষণ করে এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদের সত্যতা প্রমাণিত হয় : স্থান-কাল সমতল নয়, ভিতরকার পদার্থ এবং শক্তির ফলে স্থান-কল বক্রতাপ্রাপ্ত হয়।

এটা ছিল আইনস্টাইনের বৃহত্তম বিজয়। তার আবিষ্কারের ফলে স্থান-কাল সম্পর্কে আমাদের কল্পন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেগুলো আর যার ভিতরে ঘটনা ঘটে তার অক্রিয় পশ্চাৎপট নয়। আমরা আর স্থান-কালকে মহাবিশ্বে কি হচ্ছে তা দিয়ে প্রভাবিত না হয়ে, অবিরত চলমান ভাবতে পারি না। তার বদলে এখন এরা হল নিজেরাই গতীয় রাশি dynamic quantities) তার ভিতরে যা ঘটে তা দিয়ে তারা নিজেরা প্রভাবিত হয় এবং ঘটনাগুলোকেও প্রভাবিত করে।

ভর এবং শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম হল তারা সবসময়ই পরা (positive)। এজন্য মহাকর্ষ সবসময়ই বস্তুপিণ্ডগুলোকে আকর্ষণ (পরস্পরের অভিমুখে) করে । উদাহরণ : বিশ্বের মহাকর্ষ পৃথিবীর দুই বিপরীত অভিমুখ পর্যন্ত আমাদের আকর্ষণ করে। সেজন্যই অস্ট্রেলিয়ার লোকেরা পৃথিবী থেকে পড়ে যায় না। একইরকমভাবে সূর্যের মহাকর্ষ গ্রহগুলোকে সূর্য প্রদক্ষিণ করা কক্ষপথে রক্ষা করে এবং পৃথিবীটার আন্তঃতরাকাস্থানের অন্ধকারে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া বন্ধ করে। ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুসারে ভর সবসময়ই পরা (positive) হওয়ার অর্থ স্থান-কাল ভূপৃষ্ঠের মতো নিজের উপরে বেঁকে থাকে। ভর অপরা (negative) হলে স্থান-কাল ঘোড়ার জিনের মতো অন্য দিকে বেঁকে থাকত। স্থান-কালের এই পরা বক্রতা মহাকর্ষ যে আকর্ষণীয় সেটাই প্রকাশ করে। আইনস্টাইনের কাছে এটা ছিল একটা বিরাট সমস্যা। তখনকার দিনে বহুল প্রচলিত বিশ্বাস ছিল মহাবিশ্বের অবস্থা স্থৈতিক (static)। তবুও, স্থান, বিশেষ করে কাল, যদি নিজের পশ্চাত্মখে বঙ্কিম থাকে তাহলে মহাবিশ্ব কি করে বর্তমানে যেরকম অবস্থায় একই অবস্থায় থাকতে পারে?

ব্যাপক অপেক্ষবাদ সম্পর্কে আইনস্টাইনের প্রথম সমীকরণগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল মহাবিশ্ব হয় প্রসারমাণ নয়ত সঙ্কোচনশীল। সুতরাং আইনস্টাইন তার সমীকরণগুলোতে আর একটি পদ (term) যোগ করলেন। এই পদটি মহাবিশ্বের ভর এবং শক্তির সঙ্গে স্থান-কালের বক্রতার সম্পর্ক নির্দেশ করে। এই তথাকথিত মহাবিশ্বতাত্ত্বিক পদের (cosmological term) একটি বিকর্ষণকারী মহাকর্ষীয় ক্রিয়া ছিল। এভাবে পদার্থের আকর্ষণের সঙ্গে মহাবিশ্ব তাত্ত্বিক পদের (term) একটা ভারসাম্য করা সম্ভব ছিল। অন্য কথায় মহাবিশ্বতান্ত্রিক পদের তৈরি স্থান-কালের অপরা বক্রতা (negative curva ture) মহাবিশ্বের ভর এবং শক্তি দিয়ে তৈরি পরা বক্রতাকে (positive curvature) নাকচ (cancel) করে দিতে পারে। এভাবে মহাবিশ্বের এমন একটা প্রতিরূপ পাওয়া যেতে পারে যেটা চিরকাল একই অবস্থায় থাকে। আইনস্টাইন যদি তার মহাবিশ্বতাত্ত্বিক পদ ছেড়ে দিয়ে তাঁর প্রথম সমীকরণগুলোতে লেগে থাকতেন তাহলে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন, মহাবিশ্ব হয় প্রসারিত হচ্ছে নয়ত সঙ্কুচিত হচ্ছে। ব্যাপারটা হল : ১৯২৯ সালের আগে কেউই ভাবতে পারেনি যে কালের সঙ্গে মহাবিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে। সেই সময় এডুইন হাবল (Edwin Hubble) আবিষ্কার করলেন : দূরের ছায়াপথগুলো আমাদের কছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব প্রসারমাণ। পরে আইনস্টাইন বলেছেন– মহাবিশ্ব তাত্ত্বিক পদ আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।

মহাবিশ্ব তাত্ত্বিক পদ থাকুক কিংবা না থাকুক পদার্থের স্থান-কালকে নিজের উপর বাঁকিয়ে দেওয়াটা একটা সমস্যা হয়ে রইল। অবশ্য সাধারণভাবে এটাকে সমস্যা বলে বোঝা যায়নি। এর অর্থ ছিল পদার্থ একটি অঞ্চলকে নিজের উপর এমনভাবে বাঁকিয়ে দিতে পারে যে পদার্থের কার্যকরভাবে নিজেকে বাকি মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব। যাকে কৃষ্ণগহ্বর বলা হয় সেটা হয়ে দাঁড়াবে তাই। বস্তুপিণ্ডগুলো তার ভিতরে পড়ে যেতে পারে কিন্তু তার ভিতর থেকে কিছুই বেরোতে পারে না। বেরোতে হলে তাদের গতি হতে হবে আলোকের দ্রুতির চাইতে বেশি। অপেক্ষবাদ এটা অনুমোদন করে না। এভাবে কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরকার পদার্থ একটা ফাঁদে আটকে যাবে এবং চুপসে গিয়ে অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বসম্পন্ন একটা অজানা অবস্থায় পৌঁছাবে।

এই চুপসে যাওয়ার নিহিতার্থ আইনস্টাইনকে গভীরভাবে বিচলিত করেছিল এবং এরকম যে হতে পারে তিনি সেটা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে রবার্ট ওপেনহাইমার দেখিয়েছিলেন সূর্যের দ্বিগুণ ভরসম্পন্ন একটি বৃদ্ধ তারকার কেন্দ্ৰকীয় জ্বালানি (nuclear fuel) ফুরিয়ে গেলে সেটা চুপসে যেতে বাধ্য। তারপর যুদ্ধ এসে বাধা দিল, ওপেনহাইমার পারমাণবিক বোমা তৈরিতে জড়িয়ে পড়লেন এবং মহাকর্ষের ফলে চুপসে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর আর কোন আগ্রহ রইল না। অন্য বৈজ্ঞানিকরা পদার্থবিদ্যার যে অংশ নিয়ে পৃথিবীতেই গবেষণা করা যায় তাই নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। মহাবিশ্বের সুদূর অঞ্চল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীতে তাদের বিশ্বাস ছিল না, তার কারণ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সেগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব বলে তাদের মনে হয়নি। তবে ১৯৬০ এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের গুণগত মান এবং পাল্লার (range) বিরাট উন্নতিতে মহাকর্ষের ফলে চুপসে যাওয়া (gravitational collapse) এবং আদিম মহাবিশ্ব সম্পর্কে আকর্ষণ নতুন করে সৃষ্টি হল। আমি এবং রজার পেনরোজ কয়েকটি উপপাদ্য প্রমাণ না করা পর্যন্ত আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ এই অবস্থাগুলো সম্পর্কে ঠিক কি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল সেটা ছিল অস্পষ্ট। এগুলো দেখিয়েছিল : স্থান-কাল নিজের উপরে বক্ৰ এজন্য অনন্যতা থাকবে অর্থাৎ থাকবে এমন জায়গা যেখানে স্থান-কালের শুরুও ছিল শেষও ছিল। পনের শত কোটি বছর আগে বৃহৎ বিস্ফোরণে ছিল এর আরম্ভ এবং যে তারকা চুপসে যাবে তার পক্ষে এবং চুপসে যাওয়া তারকার পিছনে ফেলে যাওয়া যে কোন জিনিস যা কৃষ্ণগহ্বরে পড়বে সেগুলোর পক্ষে এই চুপসে যাওয়াটা হবে অন্তিম।

আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনন্যতার বাস্তবতা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার ফলে পদার্থবিদ্যায় একটা সঙ্কট উপস্থিত হল। ব্যাপক অপেক্ষবাদের সমীকরণগুলোর স্থান-কালের বক্রতার সঙ্গে ভর এবং শক্তির একটা সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। তবে একে অনন্যতা বলে সংজ্ঞিত করা যায় না। তার অর্থ : একটি অনন্যতা থেকে কি বেরিয়ে । আসবে সে সম্পর্কে ব্যাপক অপেক্ষবাদ কোন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। ব্যাপক অপেক্ষবাদ, বিশেষ করে পারে না বৃহৎ বিস্ফোরণে মহাবিশ্ব কি করে শুরু হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে। সেজন্য অপেক্ষবাদ একটা সম্পূর্ণ তত্ত্ব নয়। মহাবিশ্ব কি করে শুরু হবে এবং পদার্থ যখন নিজের মহাকর্ষের চাপে চুপসে যায় তখন কি ঘটতে পারে–এগুলো নির্ধারণের জন্য অপেক্ষবাদের আরও একটি উপাদান যোগ করা প্রয়োজন।

মনে হয় প্রয়োজনীয় বাড়তি উপাদানটি হল কণাবাদী বলবিদ্যা। ১৯০৫ সালে অর্থাৎ যে বছর আইনস্টাইন বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ লেখেন, সেই বছর তিনি আলোকবিদ্যুৎ অভিক্রিয়া (photoelectric effect) নামক পরিঘটনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। দেখা গিয়েছিল কিছু কিছু ধাতুর উপর আলো পড়লে আধানযুক্ত কণিকা নির্গত হয়। হতবুদ্ধি হওয়ার মতো একটা ব্যাপার ছিল : আলোকের তীব্রতা কমলে নির্গত কণিকার সংখ্যা কমে কিন্তু যে দ্রুতিতে কণিকাগুলো নির্গত হয় সেটা অভিন্ন থাকে। আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন সবাই যা অনুমান করেছিল আলোক যদি সেরকম অবিচ্ছিন্নভাবে নির্গত না হয়ে একটা বিশেষ আকারের ক্ষুদ্র মোড়কে নির্গত হয়–এ তথ্য যদি মেনে নেওয়া যায়, তাহলে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আলোক শুধুমাত্র কোয়ান্টা নামে প্যাকেটে আসে–কয়েকবছর আগে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্ক (Max Planck) এই চিন্তাধারা উপস্থিত করেন। এটা অনেকটা এই কথা বলার মতো : বাজারে চিনি খুচরো কিনতে পাওয়া যায় না-পাওয়া যায় এক কিলোগ্রাম ব্যাগে। প্লাঙ্ক কোয়ান্টাম সম্পর্কিত চিন্তন ব্যবহার করেছিলেন–কেন একটি তপ্ত, লোহিতবর্ণ ধাতুখণ্ড অসীম পরিমাণ তাপ বিকিরণ করে না সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য। তার চিন্তনে কোয়ান্টা ছিল একটি তাত্ত্বিক কৌশল মাত্র–সেগুলো কোন ভৌত বাস্তবতার অনুরূপ নয়। আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রে দেখা গেল একক কোয়ান্টামগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। প্রতিটি নির্গত কণিকা এক কোয়ান্টাম আলোকের ঐ ধাতুকে আঘাত করার অনুরূপ। এই গবেষণাপত্রটি কণাবাদী বলবিদ্যায় (কোয়ান্টাম তত্ত্বে) একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে বহুল স্বীকৃতি লাভ করল। এই গবেষণার জন্য তিনি ১৯২২ সালে নোবের পুরস্কার পান। ব্যাপক অপেক্ষবাদের জন্য তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু স্থান এবং কাল বক্রতা প্রাপ্ত হয় এই চিন্তাধারা তখনও অত্যন্ত দূর কল্পনাভিত্তিক এবং বিতর্কমূলক বলে বিবেচনা করা হত। সেজন্য তার বদলে তাঁকে আলোকবিদ্যুৎ অভিক্রিয়ার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে এই গবেষণা যে তার নিজস্ব গুণে পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত ছিল না তা নয়।

এই আলোকবিদ্যুৎ অভিক্রিয়ার পূর্ণ নিহিতার্থ ১৯২৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণ বোঝা যায়নি। সেই বছর ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ (werner Heisenberg) দেখালেন এর ফলে একটি কণিকার অবস্থান নির্ভুলভাবে মাপা অসম্ভব। কণিকাটি কোথায় আছে দেখবার জন্য তার উপর আলো ফেলতে হয়। কিন্তু আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ আলোক ব্যবহার করা যায় না। অন্ততপক্ষে এক প্যাকেট–অর্থাৎ এক কোয়ান্টাম আলোক ফেলতেই হবে। আলোকের এই প্যাকেট কণিকাটিকে বিচলিত করবে এবং একে কোন দ্রুতিতে কোন এক অভিমুখে চালনা করবে। যত নির্ভুলভাবে আপনি কণিকাটির অবস্থান জানতে চাইবেন, তত বেশি শক্তিসম্পন্ন প্যাকেট আপনাকে ব্যবহার করতে হবে। ফলে কণিকাটি তত বেশি বিচলিত হবে। কণিকাটিকে আপনি যতই মাপতে চেষ্টা করবেন–তার অবস্থানের অনিশ্চয়তা এবং দ্রুতির অনিশ্চয়তার গুণফল সবসময়ই একটা সর্বনিম্ন পরিমাণের বেশি হবে।

হাইসেনবার্গের এই অনিশ্চয়তার নীতি দেখিয়েছে একটি তন্ত্রের অবস্থা নির্ভুলভাবে মাপা সম্ভব নয় সুতরাং ভবিষ্যতে সে কি করবে সে সম্পর্কে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। করা যেতে পারে শুধু বিভিন্ন পরিণতির সম্ভাব্যতার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। এই আপতনিক উপাদান element of chance) অর্থাৎ নিয়মহীনতাই আইনস্টাইনকে অতখানি বিচলিত করেছিল। ভৌত বিধিগুলো ভবিষ্যতে কি হবে সে সম্পর্কে যে নির্দিষ্ট, নিশ্চিত সুনিয়মিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারা যাবে না–এ কথা বিশ্বাস করতে আইনস্টাইন অস্বীকার করেন। কিন্তু যে ভাবেই এটা প্রকাশ করা হোক না কেন, সমস্ত সাক্ষ্যতেই দেখা যায় কোয়ান্টাম পরিঘটনা এবং অনিশ্চয়তার নীতি পরিহার করা যায় না এবং পদার্থবিদ্যার সমস্ত শাখাতেই এদের অস্তিত্ব রয়েছে।

যাকে চিরায়ত তত্ত্ব বলে আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ হল তাই–অর্থাৎ অনিশ্চয়তার নীতি এ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এমন একটা নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে হবে যে তত্ত্ব ব্যাপক অপেক্ষবাদে এবং অনিশ্চয়তার নীতি সংযুক্ত করে । অধিকাংশ পরিস্থিতিতেই এই নতুন তত্ত্ব এবং চিরায়ত ব্যাপক অপেক্ষবাদে পার্থক্য হবে খুবই কম, এর কারণ আগেই যা বলা হয়েছে তার অনুরূপ। অর্থাৎ কোয়ান্টাম অভিক্রিয়া যে অনিশ্চয়তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে সেটা খুবই ক্ষুদ্র মানে অথচ ব্যাপক অপেক্ষবাদের ক্রিয়াকর্ম অত্যন্ত বৃহৎ মানে স্থান-কালের গঠন নিয়ে। কিন্তু আমি আর রজার পেনরোজ যে অনন্যতা উপপাদ্য প্রমাণ করেছিলাম তাতে দেখা যায় অতি ক্ষুদ্র মানেও স্থান-কাল অত্যন্ত বঙ্কিম হবে। তখন অনিশ্চয়তার নীতির প্রভাব হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মনে হয় এগুলো কিছু উল্লেখযোগ্য পরিণতি নির্দেশ করে।

একটি তন্ত্রের একটা নির্দিষ্ট নিশ্চিত ইতিহাস আছে–সাধারণ বুদ্ধিজাত এই দৃষ্টিভঙ্গি আইনস্টাইন গ্রহণ করেছিলেন। কণাবাদী বলবিদ্যা এবং অনিশ্চয়তার নীতি নিয়ে তার সমস্যার আংশিক উৎস এটাই। একটি কণিকার অবস্থান হয় একটি জায়গায় নয়ত অন্য জায়গায়। সেটা কখনোই অর্ধেক এক জায়গায় এবং বাকি অর্ধেক অন্য জায়গায় হতে পারে না। ব্যাপারটা অনেকটা এই তথ্যের মতো : আপনি সামান্য মৃত কিংবা সামান্য গর্ভবতী হতে পারেন না। হয় আপনি হয়েছেন নয়ত আপনি হননি। কিন্তু একটি তন্ত্রের যদি একক একটি নির্দিষ্ট নিশ্চিত ইতিহাস থাকে তাহলে অনিশ্চয়তার নীতির ফলে নানারকম স্ববিরোধিতা (paradox) উপস্থিত হয়। যেমন, কণিকাগুলোর একই মুহূর্তে দুটি জায়গায় অবস্থান কিংবা মহাকাশচারীর চন্দ্রে অর্ধেক অবস্থান।

এই জাতীয় স্ববিরোধগুলো আইনস্টাইনকে খুবই কষ্ট দিয়েছে। এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি সুস্থ উপায় প্রস্তাব করেছিলেন আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান (Richard Feynman)। আলোকের কণাবাদী তত্ত্বের (quantum theory) উপর গবেষণার জন্য ১৯৪৮ সালে ফাইনম্যান সুপরিচিত হন। আরেকজন আমেরিকান জুলিয়ান সুইংগার Julian Schwinger) এবং জাপানি পদার্থবিদ শিনিচিররা টোমোনাগো (Shinchirio Tomonaga)-র সঙ্গে তিনি ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু তিনি ছিলেন পদার্থবিদদের পদার্থবিদ অর্থাৎ আইনস্টাইনের ঐতিহ্যবাহক। জাঁকজমক আর ভড়ং তিনি ঘৃণা করতেন। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স থেকে তিনি ইস্তফা দেন। তার কারণ তিনি দেখেছিলেন তারা অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন অন্য কোন বৈজ্ঞানিককে অ্যাকাডেমিতে নেওয়া হবে কিনা সেই আলোচনায়। ফাইনম্যানের মৃত্যু হয় ১৯৮৮ সালে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় বহু দানের জন্য তাঁকে স্মরণ করা হয়। এর ভিতরে ছিল তার নাম বহন করে এমন কতগুলো চিত্র (diagram)। পদার্থবিদ্যার কণা-বিজ্ঞান শাখার (particle physics) প্রায় প্রতিটি গণনার ভিত্তি এই চিত্রগুলো। কিন্তু তাঁর এর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি দান ছিল ইতিহাসের যোগফল সম্পৰ্কীয় কল্পন। চিন্তাধারাটি ছিল এরকম : চিরায়ত অ-কোয়ান্টাম তত্ত্বে যে রকম স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা হয়–একটি তন্ত্রের (system) স্থান-কালে সেরকম একটি মাত্র ইতিহাস ছিল না। বরং তার ছিল সম্ভাব্য সবরকম ইতিহাস। উদাহরণ : বিচার করুন A বিন্দুতে একটা বিশেষ কালে অবস্থিত একটি কণিকা সাধারণ অনুমান করা হয় কণিকাটি একটি ঋজুরেখায় A থেকে দূরে চলমান হবে। কিন্তু ইতিহাসের যোগফল অনুসারে কণিকাটি A থেকে শুরু হয় এরকম যে কোন পথে চলমান হতে পারে। ব্যাপারটা এক টুকরা ব্লটিং পেপারে এক ফোঁটা কালি ফেললে যা ঘটে অনেকটা সেরকম। কালির কণিকাগুলো সম্ভাব্য সবকটি পথে ব্লটিং পেপারের ভিতর দিয়ে চলমান হবে। এমনকি আপনি যদি ব্লটিং পেপারের একটা জায়গা কেটে দিয়ে দুটি বিন্দুর মধ্যবর্তী ঋজুরেখা বন্ধ করে দেন তাহলেও কালিটা কোণ দিয়ে ঘুরে যাবে।

প্রতিটি পথ কিংবা কণিকাটির প্রতিটি ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত থাকবে একটি সংখ্যা। সংখ্যাটি নির্ভর করবে পথের গঠন (shape) উপর। যে পথগুলো কণিকাটিকে A থেকে B তে নিয়ে যায় তার সবগুলোর সঙ্গে জড়িত সংখ্যাগুলোকে যোগ করে কণিকাটির A থেকে B তে গমনের সম্ভাব্যতা পাওয়া যায়। অধিকাংশ পথের ব্যাপারেই পথের সঙ্গে জড়িত সংখ্যাগুলো নিকটবর্তী পথগুলো থেকে আসা সংখ্যাগুলোকে প্রায় বাতিল করে দেবে। সুতরাং কণিকাটির A থেকে B তে যাওয়ার সম্ভাব্যতার ব্যাপারে তাদের দান থাকবে সামান্যই। কিন্তু ঋজুপথ থেকে আগত সংখ্যাগুলোর সাথে যোগ হবে প্রায় ঋজুপথ থেকে আগত সংখ্যাগুলোর। সুতরাং সম্ভাব্যতার প্রধান দান আসবে যে পথগুলো ঋজু কিংবা ঋজু সেগুলোর কাছ থেকে। সেজন্য একটি কণিকা যখন বুদ্বুদ কক্ষ (Bubble chamber) দিয়ে গমন করে তখন তার গমনপথকে প্রায় ঋজু মনে হয়। কিন্তু আপনি যদি কণিকাটির গমনপথে রেখা ছিদ্র (slit) সমন্বিত দেওয়ালের মতো একটা কিছু রেখে দেন তাহলে কণিকার গমনপথগুলো ওই রেখাছিদ্রের ওপারেও বিস্তার লাভ করতে পারে। কণিকাটিকে রেখাছিদ্র থেকে দূরে প্রত্যক্ষ রেখায় পাওয়ার খুব সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃষ্ণগহ্বরের কাছে বঙ্কিম স্থান-কালে একটি কণিকার উপর অনিশ্চয়তার নীতির কি ক্রিয়া হবে ১৯৭৩ সালে তিনি সেই বিষয়ে গবেষণা শুরু করি। যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল : আমি আবিষ্কার করলাম কৃষ্ণগহ্বর সম্পূর্ণ কৃষ্ণ হবে না। অনিশ্চয়তার নীতি কণিকা এবং বিকিরণের স্থিরহারে ক্ষরিত হওয়া (leak out) অনুমোদন করবে। এই গবেষণা ফল আমার কাছে এবং অন্যান্যদের কাছে সম্পূর্ণ আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল এবং সাধারণ অবিশ্বাসই এই গবেষণা ফলকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল। পশ্চাদৃষ্টিতে বোঝা যায় ব্যাপারটি স্বতঃপ্রতীয়মান হওয়া উচিত ছিল। কৃষ্ণগহ্বর স্থানের এমন একটি অঞ্চল যেখান থেকে আলোর দ্রুতির চাইতে স্বল্প দ্রুতিতে চললে নিষ্ক্রমণ অসম্ভব। কিন্তু ফাইনম্যানের ইতিহাসের যোগফল অনুসারে কণিকাগুলো স্থান-কালের ভিতর দিয়ে যে কোন পথ গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং একটি কণিকার আলোকের চাইতে দ্রুততর গমন সম্ভব। কিন্তু আলোকের দ্রুতির চাইতে বেশি দ্রুতিতে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার সম্ভাব্যতা অল্প। তবে কণিকাটি আলোকের চাইতে দ্রুতগতিতে কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিষ্ক্রমণের মতো দূরত্ব মাত্র অতিক্রম করতে পারে, তারপর এটা যেতে পারে আলোকের চাইতে স্বল্পতর গতিতে। এভাবে অনিশ্চয়তার নীতি কণিকাগুলোকে আগে যাকে বলা হত অন্তিম কারাগার (ultimate prison) তা থেকে পলায়ন অনুমোদন করে। সূর্যের মতো ভরসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর থেকে একটি কণিকার পলায়নের সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ সেক্ষেত্রে এ কণিকাটির আলোকের চাইতে দ্রুতগতিতে কয়েক কিলোমিটার যেতে হবে। কিন্তু আদিম কৃষ্ণগহ্বরগুলোর আকার একটি পরমাণুর কেন্দ্রকের চাইতেও ক্ষুদ্র হতে পারে অথচ ভর হতে পারে এক হাজার কোটি টন অর্থাৎ ফুজি পর্বতের ভরের মতো। তারা একটা বৃহৎ শক্তি (বিদ্যুৎ) উৎপাদন কেন্দ্রের মতো শক্তি বিকিরণ করতে পারে । অবশ্য যদি আমরা ঐরকম একটা ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে বার করে তার শক্তিকে কাজে লাগাতে পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মহাবিশ্বে আমাদের খুব কাছাকাছি ওরকম কৃষ্ণগহ্বর খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না।

কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিকিরণের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদের সঙ্গে কোয়ান্টাম নীতির সংযোগের অনতিতুচ্ছ ফল। এ থেকে দেখা গেছে মহাকর্ষের ফলে চুপসে যাওয়াকে যেরকম অন্তিম অবস্থা মনে হয়েছিল ব্যাপারটি সেরকম নয়। কৃষ্ণগহ্বরের কণিকাগুলো একটা অনন্যতায় এলে সেটাই তাদের ইতিহাসের অন্তিম হওয়া আবশ্যিক নয়। তার বদলে তারা কৃষ্ণগহ্বর থেকে পালিয়ে বাইরে এসে তাদের ইতিহাসকে চলমান রাখতে পারে। হয়ত কোয়ান্টাম নীতির অর্থ হতে পারে –কালে ইতিহাসের একটা প্রারম্ভ থাকা, বৃহৎ বিস্ফোরণে একটা সৃষ্টির মুহূর্ত থাকা — এ জাতীয় তথ্য এড়িয়ে যাওয়া।

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অনেক বেশি কঠিন, কারণ এর সঙ্গে জিড়ত শুধুমাত্র একটি বিশেষ স্থান-কালের পশ্চাৎপটে কণিকাটির গমনপথই নয়, এর সঙ্গে জড়িত আছে স্থান কালের নিজেদের গঠনের উপর কোয়ান্টাম নীতি প্রয়োগ করা যেটা প্রয়োজন সেটা শুধু কণিকাগুলোর ক্ষেত্রেই ইতিহাসের যোগফল বার করা নয়, স্থান-কালের সার্বিক গঠনেরও যোগফল বার করা। আমরা এখনো এই যোগ ঠিক কিভাবে করতে হবে জানি না, তবে সেই যোগের অবয়ব কি হবে তার খানিকটা আমরা জানি। তার একটা হল : ইতিহাস সম্পর্কে কাজ করতে হলে সাধারণ বাস্তব কালের মাধ্যমে করার চাইতে যাকে কাল্পনিক কাল বলে তার মাধ্যমে করা সহজ। কাল্পনিক কালের কল্পন কঠিন–সেটা বোঝা শক্ত। আমার বইয়ের পাঠকদের কাছে এটাই সবচাইতে বড় সমস্যাগুলোর সৃষ্টি করেছে। কাল্পনিক কাল ব্যবহার করার জন্য দার্শনিকরাও আমার হিংস্র সমালোচনা করেছেন। কাল্পনিক কালের সঙ্গে বাস্তব মহাবিশ্বের কি সম্পর্ক থাকতে পারে? আমার মনে হয় এই দার্শনিকরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। এক সময় পৃথিবী চ্যাপ্টা এবং সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করে এই মতই স্বতঃপ্রতীয়মান মনে হত কিন্তু কোপারনিকাস আর গ্যালিলিও-র পর থেকে পৃথিবী গোল এবং সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এই মতের সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছে। একইভাবে বহুদিন পর্যন্ত স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল কাল প্রতিটি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ সমহারে চালমান, কিন্তু আইনস্টাইনের পর থেকে আমাদের মেনে নিতে হয়েছে কাল বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সাপেক্ষ বিভিন্ন হারে চলমান। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান মনে হয়েছিল যে, মহাবিশ্বের একটা অদ্বিতীয় ইতিহাস আছে তবুও কণাবাদী বলবিদ্যা আবিষ্কারের পর থেকে আমাদের ভাবতে হয়েছে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সর্বপ্রকার ইতিহাসই থাকতে পারে। আমি প্রস্তাব করতে চাই কাল্পনিক কালও এমন একটা জিনিস যা আমাদের মেনে নিতে হবে। পৃথিবী গোলাকার এই বিশ্বাস করার মতোই কাল্পনিক কালে বিশ্বাস একটা বৌদ্ধিক লক্ষ্য। আমার মনে হয় পৃথিবী গোলাকার এ তথ্য এখন যে রকম স্বাভাবিক মনে হয় ভবিষ্যতে কাল্পনিক কালও মনে হবে তেমনি স্বাভাবিক, শিক্ষাজগতে চ্যাপ্টা-বিশ্বে বিশ্বাসী (flat earthers) আর বেশি অবশিষ্ট নেই।

সাধারণ বাস্তব কালকে ভাবা যেতে পারে –বাম থেকে দক্ষিণে গমনকারী একটি আনুভূমিক (horizontal) রেখা। পূর্ববর্তী কাল রয়েছে বাঁদিকে আর পরবর্তী কাল রয়েছে ডাইনে। কিন্তু কালের অন্য অভিমুখও আপনি ভাবতে পারেন– পৃষ্ঠার উপরে আর নিচে। ঐটাই তথাকথিত কাল্পনিক কালের অভিমুখ। এ অভিমুখ বাস্তব কালের সমকোণে।

কাল্পনিক কালের কল্পন উপস্থিত করার কারণ কি? সাধারণ বাস্তব কাল –যা বুঝতে পারি তাতেই আমরা বিশ্বাসী হয়ে যাব না কেন? এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। কারণটা হল স্থান এবং কালের নিজের উপর একটা স্থান-কাল বক্রতা সৃষ্টি করার প্রবণতা রয়েছে। বাস্তব কালের অভিমুখে সুনিশ্চিতভাবে এর ফল হয় একাধিক অনন্যতা –অর্থাৎ এমন কতগুলো জায়গায় যেখানে স্থান-কাল শেষ হয়ে যায়। অনন্যতাগুলোতে পদার্থবিদ্যার সমীকরণগুলো সংজ্ঞিত করা যায় না। সুতরাং কি হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। কিন্তু কাল্পনিক কালের অভিমুখ বাস্তব কালের সমকোণে। তার অর্থ : যে তিনটি অভিমুখ স্থানে চলাচলের অনুরূপ, এর আচরণ তার সমরূপ। মহাবিশ্বের পদার্থের জন্য স্থান-কালের অভিমুখ তার পশ্চাতে মিলিত হতে পারে (meeting up around the back)। তারা পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতো একটি বদ্ধ পৃষ্ঠ তৈরি করবে। তিনটি স্থানিক অভিমুখ এবং কাল্পনিক কাল এমন একটি স্থান-কাল তৈরি করবে যেটা নিজের উপরেই বদ্ধ তবে তার কোন কিনারা কিংবা সীমানা থাকবে না। শুরু কিংবা শেষ বলা যায় এরকম কোন বিন্দু তার থাকবে না। ভূপৃষ্ঠের যেমন কোন শুরু কিংবা শেষ নেই অন্তত তার চাইতে বেশি কিছু এর থাকবে না।

1983 সালে আমি আর জিম হার্টল Jim Hartle) প্রস্তাব করেছিলাম –মহাবিশ্বের ইতিহাসগুলোর যোগফলকে বাস্তব কালে ইতিহাসগুলোর যোগফলরূপে গ্রহণ করা উচিত হবে না। বরং গ্রহণ করা উচিত কাল্পনিক কালের ইতিহাসগুলো– তারা ভূপৃষ্ঠের মতো নিজের উপরে বদ্ধ। যেহেতু এই ইতিহাসগুলোর কোন অনন্যতা কিংবা কোন শুরু কিংবা কোন শেষ ছিল না, সেজন্য কি ঘটেছিল সেটা স্থির হবে শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো দিয়ে। এর অর্থ কাল্পনিক কালে কি ঘটেছিল সেটা গণনা করা যায় এবং আপনি যদি কাল্পনিক কালে মহাবিশ্বের ইতিহাস জানেন তাহলে বাস্তব কালে এর আচরণ আপনি গণনা করতে পারবেন। এভাবে আপনি একটি পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার আশা করতে পারেন। সে তত্ত্ব মহাবিশ্বের সবকিছু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে। আইনস্টাইন জীবনের শেষভাগ ব্যয় করেছেন এ রকম একটি তত্ত্ব অনুসন্ধান করে। এ রকম তত্ত্ব আইনস্টাইন খুঁজে পাননি –তার কারণ কণাবাদী বলবিদ্যায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ইতিহাসগুলোর যোগফলের মতো মহাবিশ্বের বহু বিকল্প ইতিহাসের সম্ভাবনা তিনি মানতে রাজি ছিলেন না। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে ইতিহাসের যোগফল কি করে সঠিকভাবে করতে হয় সেটা এখনো আমরা জানি না তবে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে কাল্পনিক কাল এবং স্থান-কালের নিজের উপর বদ্ধ থাকার কল্পন এর সঙ্গে জড়িত থাকবে। আমার মনে হয় আগামী প্রজন্মের কাছে বিশ্ব গোলাকৃতি এই কল্পনের মতোই উল্লিখিত কল্পনগুলো স্বাভাবিক মনে হবে। কাল্পনিক কাল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে আজকাল খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু কাল্পনিক কালের গুরুত্ব বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কিংবা গাণিতিক চাতুর্যের চাইতে বেশি। এ কল্পন এমন জিনিস যা আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি সেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *