০৫. সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

০৫. সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস*

[*এই রচনা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায়। কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ নিউ ইয়র্ক টাইমস এর সর্বাধিক বিক্রিত পুস্তকের তালিকায় ছিল তিপ্পান্ন সপ্তাহ। ব্রিটেনে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ এর লন্ডনের ‘দি সানডে টাইমস পত্রিকায় দেখা যায় বইটি সর্বাধিক বিক্রিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে ২০৫ সপ্তাহ ধরে। (১৮৪ সপ্তাহে এই তালিকায় সবচাইতে বেশিবার উল্লিখিত হওয়ার জন্য বইটি গিনেস বুক অফ রেকর্ডস এ নাথিভুক্ত হয়। বিভিন্ন ভাষায় বইটার অনুবাদ করা সংস্করণের সংখ্যা এখন তেত্রিশ।]

আমার লেখা বই ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ যে অভ্যর্থনা পেয়েছি তাতে আজও আমি বিস্মিত। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর সর্বাধিক বিক্রিত পুস্তকের তালিকায় বইটি ছিল সাঁইত্রিশ সপ্তাহ আর লন্ডনের সানডে টাইমস্ এর তালিকায় ছিল আঠাশ সপ্তাহ (বইটা ব্রিটেনে প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর)। এটা অনুদিত হচ্ছে। কুড়িটি ভাষায়। (আমেরিকান ভাষাকে যদি ইংরেজি থেকে পৃথক ভাবা যায় তাহলে একুশটি ভাষায়)। ১৯৮২ সালে প্রথম যখন আমি সাধারণ মানুষের জন্য মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটা বই লেখার কথা ভাবছিলাম। তখন যা আশা করেছিলাম এ প্রাপ্তি তার চাইতে অনেক বেশি। অংশত আমার উদ্দেশ্য ছিল মেয়ের স্কুলের মাইনে দেওয়ার জন্য টাকা সংগ্রহ করা (আসলে বইটা যখন সত্যিই ছাপা হয়ে বেরোল আমার মেয়ে তখন স্কুলের শেষ বছরে)। তবে মূল কারণ ছিল মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোধ কতদূর এগিয়েছে সে সম্পর্কে আমার নিজের বোধকে ব্যাখ্যা করার ইচ্ছা। অর্থাৎ আমরা কিভাবে মহাবিশ্ব এবং তার সর্বস্ব সম্পর্কে বিবরণ দেওয়ার মতো একটা সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কারের নিকটতর হতে পারি।

আমি চেয়েছিলাম, বই লেখার জন্য যদি সময় ব্যয় করতে হয়, আর পরিশ্রম করতে হয়, তাহলে যত বেশি সম্ভব পাঠক পেতে। এর আগে লেখা আমার বৈজ্ঞানিক বইগুলো প্রকাশ করেছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। কাজটা ওঁরা ভালই করেছিলেন। কিন্তু যেরকম সাধারণ মানুষের বাজারে আমি প্রবেশ করতে চেয়েছিলাম সে বাজারে ঢোকার মতো ব্যবস্থা তাদের ছিল বলে আমার মনে হয়নি। সুতরাং আমি যোগাযোগ করলাম একজন সাহিত্য প্রতিনিধির (Literary Agent) সঙ্গে। তার নাম আল জুকারম্যান (Al Zuckerman)। এক সহকর্মীর মাধ্যমে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সহকর্মীটি বলেছিলেন উনি ভদ্রলোক ব্রাদার ইন ল (শালা, ভগ্নীপতি, ভায়রা–এরকম সম্পর্ক)। আমি ওঁকে প্রথম অধ্যায়ের একটা খসড়া দিয়ে বলেছিলাম–আমি এমন বই করতে চাই যেটা বিমানবন্দরের বইয়ের স্টলে বিক্রি হবে। তিনি বললেন এর কোন সম্ভাবনা নেই। বইটা ছাত্র কিংবা পণ্ডিতমহলে ভালই বিক্রি হতে পারে কিন্তু ঐ রকম একটা বই জেফ্রি আর্চারের (Jeffrey Archer) কাছে যেতে পারবে না।

বইয়ের প্রথম খসড়া আমি জুকারম্যানকে দিয়েছিলাম ১৯৮৪ সালে। বইটা উনি কয়েকজন প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। পরে আমাকে সুপারিশ করলেন নর্টন (Norton) কোম্পানির মত গ্রহণ করতে। কোম্পানিটা একটা উঠতি ভাল আমেরিকান পুস্তক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তার বদলে আমি গ্রহণ করলাম ব্যান্টাম বুক্‌স (Bantam Books) এর প্রস্তাব। যদিও ব্যান্টাম বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশ করার বিশেষজ্ঞ হয়নি তবুও তাদের বই বহু বিমানবন্দরের বইয়ের দোকানে পাওয়া যেত। আমাদের বইটা তাদের গ্রহণ করার কারণ বোধহয় ছিল পিটার গুজার্ডি (Peter Guzzardi) নামে তাদের একজন সম্পাদকের আমার বইটার প্রতি আকর্ষণ। কাজটা তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মতো যারা অবৈজ্ঞানিক তারা যাতে পড়ে বুঝতে পারেন, সেই রকম করার জন্য তিনি আমাকে দিয়ে বইটি দ্বিতীয়বার লিখিয়েছিলেন। আমি যতবারই কোন অধ্যায় আবার নতুন করে লিখে ওঁর কাছে পাঠিয়েছি ততবারই তিনি ফেরত পাঠিয়েছেন এবং তার আপত্তির এক বিরাট তালিকাও পাঠিয়েছেন। আর পাঠিয়েছেন এমন কিছু প্রশ্ন যার উত্তর উনি আমার কাছ থেকে চাইতেন। এক এক সময় মনে হয়েছে এ পদ্ধতি আর কোনদিন শেষ হবে না। কিন্তু কাজটা তিনি ঠিকই করেছিলেন, এর ফলে বইটা অনেক ভাল হয়েছে।

ব্যান্টামের প্রস্তাব গ্রহণ করার সামান্য কয়েকদিন পর আমার নিউমোনিয়া হয়। আমার ট্রাকিওস্টমি (Tracheostomy) অপারেশন হয়, ফলে কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর্যন্ত আমার মনের ভাব প্রকাশ করার একমাত্র উপায় ছিল কেউ কার্ড অক্ষর দেখালে জ্বটা উঁচু করা। সুতরাং বইটা শুরু করা সম্ভব হত না, কিন্তু সম্ভব হয়েছিল যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম আমাকে করে দেওয়া হয়েছিল তার সাহায্যে। কাজ হত একটু ধীরে কিন্তু তখন আমি চিন্তাও করি ধীরে। সুতরাং ব্যবস্থাটা আমার কাজের উপযুক্তই ছিল। গুজার্ডির তাড়ায় ওই যন্ত্রের সাহায্যে আমার প্রথম খসড়াটা প্রায় সম্পূর্ণই নতুন করে লিখলাম। নতুন করে এই লেখার কাজে আমি ব্রায়ান হুইট (Brian Whitt) নামে আমার এক ছাত্রের সাহায্য পেয়েছিলাম।

জেকব ব্রোনোওয়াস্কির Jacob Bronowski) টি. ভি. সিরিজ –দি এ্যাসেন্ট অফ ম্যান (The Ascent of Man মানুষের উত্থান) খুবই ভাল লেগেছিল। (এরকম একটা লিঙ্গ প্রাধান্যমূলক নাম আজকাল আর কেউ বরদাস্ত করবে না।) এ থেকে মাত্র পনেরো হাজার বছর আগেরকার আদিম অবস্থা থেকে মানবজাতির আধুনিক অবস্থায় উত্তরণের কৃতিত্ব সম্পর্কে একটা ভাবানুভূতি লাভ করা যায়। মহাবিশ্বকে যে সমস্ত বিধি শাসন করে সেগুলোকে সম্পূর্ণ করে জানার পথে আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে ঐরকমই একটা ভাবানুভূতি আমি বহন করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। মহাবিশ্বের ক্রিয়াপ্রণালী সম্পর্কে প্রায় সবাই জানতে উৎসুক এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম কিন্তু বেশিরভাগ লোকই গাণিতিক সমীকরণ বুঝতে পারেন না–ব্যক্তিগতভাবে আমিও সমীকরণগুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করি না। অংশত এর কারণ আমার পক্ষে সমীকরণ লেখা শক্ত কিন্তু আসল কারণ হল সমীকরণ সম্পর্কে আমার স্বজ্ঞাবোধ (intuitive feeling) ছিল না। তার বদলে আমি চিন্তা করি চিত্রের বাগ্বিধিতে এবং এই পুস্তকে আমার উদ্দেশ্য ছিল এই সমস্ত মানসচিত্র কয়েকটি পরিচিত উপমা এবং চিত্রের সাহায্যে ভাষায় প্রকাশ করা। আমার আশা ছিল গত পঁচিশ বছরে পদার্থবিদ্যার যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে সে সম্পর্কে উত্তেজনা এবং কৃতিত্ববোধের অংশীদার সবাই হতে পারবে।

গণিতকে এড়িয়ে গেলেও, কিছু কিছু চিন্তাধারা অপরিচিত এবং ব্যাখ্যা করা কঠিন। এও একটা সমস্যা সৃষ্টি করল। এগুলো কি আমি ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার ঝুঁকি নেব, না কি অসুবিধাগুলো আগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাব? আমি যে চিত্র অঙ্কন করতে চাই তার জন্য অপরিচিত কল্পনা অপ্রয়োজনীয়। যেমন–বিভিন্ন গতিতে চলমান দুজন পর্যবেক্ষকের পক্ষে দুটি ঘটনার অন্তর্বর্তীকালের মাপন ভিন্ন হবে–এ তথ্য চিত্রটির জন্য অপরিহার্য নয়। সেজন্য আমি ভেবেছিলাম বেশি গভীরে না গিয়ে এগুলো শুধুমাত্র উল্লেখ করতে পারি। আমি যা বোঝাতে চাই তার জন্য কতগুলো শুধুমাত্র উল্লেখ করতে পারি। আমি যা বোঝাতে চাই তার জন্য কতগুলো কঠিন কল্পন ছিল মূলগত। বিশেষ করে এরকম দুটি কল্পনা ছিল যেগুলোকে আমি বইটিতে রাখা উচিত বলে ভেবেছিলাম। একটি ছিল তথাকথিত ইতিহাসগুলোর যোগফল। এ চিন্তনটি হল : মহাবিশ্বের শুধুমাত্র একটা ইতিহাসই নেই, বরং রয়েছে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সমস্ত ইতিহাসের সমাহার এবং এই সমস্ত ইতিহাসই সমভাবে বাস্তব (এর অর্থ যাই হোক না কেন)। ইতিহাসের যোগফল কথাটার গাণিতিক অর্থ করতে হলে আর একটা চিন্তন দরকার। সেটা হল কাল্পনিক কাল’। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এখন আমি বুঝতে পারছি, এই দুটি অত্যন্ত কঠিন কল্পনা ব্যাখ্যা করার জন্য আমার আরও বেশি পরিশ্রম করা উচিত ছিল। এ কথা বিশেষ করে প্রযোজ্য কাল্পনিক কাল সম্পর্কে। মনে হয় বইয়ের ভিতরের এই ব্যাপারটাই অধিকাংশ পাঠকের অসুবিধার কারণ হয়েছে। কাল্পনিক কাল নির্ভুলভাবে বুঝবার সত্যিই কোন প্রয়োজন কিন্তু নেই। এই কাল, আমরা যাকে বাস্তব কাল বলি তার চাইতে পৃথক–এটা জানাই যথেষ্ট।

বইটা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন একজন বৈজ্ঞানিক ‘নেচার’ পত্রিকায় সমালোচনার জন্য আগাম পাঠানো এই বই একখানা পান। বইটি পড়ে তিনি আঁৎকে উঠলেন। বইটি ছিল ভুলে ভরা–তাছাড়া আলোকচিত্র এবং অন্য ছবিগুলোর লেবেলেও (Label) গোলমাল ছিল। তিনি ব্যান্টামের সঙ্গে কথা বললেন। তাঁরাও একই রকম আঁৎকে উঠলেন। তাঁরা সেদিনই সমস্ত ছাপা বই ফিরিয়ে এনে নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা তিন সপ্তাহ অত্যন্ত পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ বইটা সংশোধন করলেন, তাছাড়া বারবার মিলিয়েও দেখলেন। বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ঠিক দিনেই। এর ভিতরে টাইম পত্রিকায় আমার সম্পর্কে একটা লেখা বের হল। তবুও বইটার চাহিদা দেখে সম্পাদকরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমেরিকাতে বইটির সপ্তদশ মুদ্রণ চলছে আর ব্রিটেনে চলছে দশম মুদ্রণ।*
[*১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকাতে বইটির চল্লিশতম বোর্ড বাধাই সংস্করণ চলছিল আর ঊনবিংশততম হাল্কা বাঁধাই সংস্করণ চলছিল এবং ব্রিটেনে চলছিল ঊনবিংশততম বোর্ড বাঁধাই সংস্করণ।]

এত লোক বইটি কিনলেন কেন? আমি যে বস্তুনিষ্ঠ সে সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া আমার পক্ষে শক্ত। সেজন্য আমার মনে হয়, অন্য লোকে যা বলেছিল সেই অনুসারে চলব। আমি দেখেছি অধিকাংশ সমালোচনাই আমার পক্ষে হলেও তারা বিশেষ কোন আলোকপাত করেনি। তারা সবাই একটা ফর্মুলা মেনে চলতে চেয়েছে : স্টিফেন হকিং এর লু গেরিগ এর (Lou Gehrig) ব্যাধি আছে (ব্রিটিশ সমালোচনাগুলোতে)। তিনি একটা হুইল চেয়ারে আটকে থাকেন, কথা বলতে পারেন না এবং এক্সসংখ্যক আঙুল নাড়াতে পারেন (এক্ষেত্রে মনে হয় X এর মান এক থেকে তিন এর ভেতরে ঘোরাফেরা করে। সংখ্যাটা নির্ভর করে, সমালোচক আমার সম্পর্কে কোন ভুল প্রবন্ধটা পড়েছেন তার উপরে)। তবুও তিনি বৃহত্তম প্রশ্নের উপরে এই বইটি লিখেছেন : কোত্থেকে আমরা এসেছি আর কোথায় আমরা চলেছি? কিং যে প্রস্তাব করেছেন সেটা হল মহাবিশ্ব কেউ সৃষ্টি করেনি এবং ধ্বংসও হয় না : এটা শুধুমাত্র রয়েছে। হকিং কাল্পনিক কালের কল্পন উপস্থিত করেছেন। সেটা বুঝতে আমাদের (সমালোচক) বেশ কষ্ট হয়। তবুও হকিং এর বক্তব্য যদি সঠিক হয় এবং আমরা যদি একটা সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব খুঁজে পাই তাহলে আমরা সত্যিই ঈশ্বরের মনটা জানতে পারব (প্রুফ দেখার সময় আমি বই এর শেষ বাক্যটি প্রায় কেটেই দিয়েছিলাম। সে বাক্যটি হল, আমি ঈশ্বরের মনটা জানতে পারব। এটা যদি করতাম তাহলে বিক্রিটা অর্ধেক হয়ে যেত)।

দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট (The Independent) নামে লন্ডনের একটা পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল সেটা (আমার মনে হয়েছিল) অনেক বেশি অনুভবগুণসম্পন্ন। এই প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বইও একটা ধর্মসম্প্রদায়ের পুস্তক হয়ে উঠতে পারে। আমার স্ত্রী আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু ‘জেন এবং মোটর সাইকেল রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়ার মতো একটা বই এর সঙ্গে আমার বই এর তুলনা হতে পারে এই ভেবে আমি খুব খুশি হয়ে উঠেছিলাম। জেনের মতো আমারও আশা, বিরাট বৌদ্ধিক এবং দার্শনিক প্রশ্নগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোন প্রয়োজন যে মানুষের নেই, সেই বোধ যেন তাদের হয়।

নিঃসন্দেহে অথর্ব হওয়া সত্ত্বেও আমি কিভাবে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হতে পেরেছি সেই মানসিক আকর্ষণোদ্দীপক কাহিনী সাহায্য করেছিল। কিন্তু যারা মানবিক আকর্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বইটি কিনেছিলেন তারা হয়ত হতাশ হয়েছেন। তার কারণ, আমার অবস্থা সম্পর্কে বইটিতে গোটা দুয়েক উল্লেখমাত্র আছে। বইটির উদ্দেশ্য ছিল মহাবিশ্বের ইতিহাস লেখা, আমার ইতিহাস নয়। তা সত্ত্বেও এই দোষারোপ এড়ানো যায় নি যে ব্যান্টাম নির্লজ্জভাবে আমার অসুস্থতাকে ব্যবহার করেছে এবং প্রচ্ছদপটে আমার ছবিটা ব্যবহার করতে দিয়ে আমিও তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছি। আসলে চুক্তি অনুসারে প্রচ্ছদের উপরে আমার কোন অধিকার ছিল না, তবে আমি ব্যান্টামকে বোঝাতে পেরেছিলাম আমেরিকান সংস্করণে বিশ্রী এবং আগেকার ফটো ব্যবহার না করে ব্রিটিশ সংস্করণের একটা ভাল ফটো ব্যবহার করা হোক। ব্যান্টাম আমেরিকান প্রচ্ছদ পরিবর্তন করবেন না। তার কারণ, আমেরিকান জনসাধারণ এখন বই এর প্রচ্ছদটাকে আমার সঙ্গে অভিন্ন মনে করে।

অনেকে এ কথাও বলেছেন যে, লোকে বইটি কেনেন তার কারণ তাঁরা বইটির সমালোচনা পড়েছেন কিংবা বইটির উল্লেখ সর্বাধিক বিক্রিত পুস্তকের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু বইটি তাঁরা পড়েননি। তাঁরা বইটি তাঁদের বুককেসে কিংবা কফির টেবিলে সাজিয়ে রাখেন। ফলে বইটি বুঝবার মতো পরিশ্রম না করে বইটির মালিকানার গৌরব অনুভব করেন। এরকম ঘটে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তবে বাইবেল কিংবা সেক্সপীয়রের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বই এর যেরকম অবস্থা হয় তার চাইতে মন্দ কিছু হয় বলে আমি জানি না। অন্যদিকে আবার আমি জানি অন্তত কিছু লোক বইটি পড়েছে। তার কারণ রোজই আমি গাদা গাদা চিঠি পাই, তাতে অনেকে প্রশ্ন করেন, আবার অনেকে বিস্তৃত মন্তব্য করেন। তাতে বোঝা যায় সবটা না বুঝলেও বইটি তাঁরা পড়েছেন। অপরিচিত অনেকে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেন বইটি তাঁদের কত ভাল লেগেছে। অবশ্য অন্য লেখকদের তুলনায় আমাকে অনেক সহজে চেনা যায় আর আমার বিশেষত্বত্ত বেশি। আমি বিখ্যাত হয়ত নই, কিন্তু জনসাধারণের কাছ থেকে আমি যত অভিনন্দন পাই (আমার নয় বছরের ছেলে তাতে খুব সঙ্কোচ বোধ করে) তা থেকে মনে হয় যারা বইটি কেনেন তাদের ভিতর অন্তত কিছু সংখ্যক লোক বইটি পড়েনও।

লোকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে এবং পরে আমি কি করব? আমি বুঝতে পারি কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের পরিমাণ কি পরিণতি লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটার নাম কি দেব? কালের দীর্ঘতর ইতিহাস? কালের সমাপ্তি পথ? কালের সন্তান? আমার এজেন্টরা বলছেন আমার জীবনীর উপরে একটা চলচ্চিত্র করার অনুমতি দিতে। কিন্তু আমি যদি অভিনেতাদের দিয়ে নিজের চরিত্র চিত্রণ করি তাহলে আমার কিংবা আমার পরিবারের কোন আত্মসম্মান অবশিষ্ট থাকে না। স্বল্পতর হলেও কাউকে যদি আমার জীবনী লিখতে দিই তাহলেও ব্যাপারটা এরকম হবে। অবশ্য, কেউ যদি স্বাধীনভাবে আমার জীবনী লেখেন তাহলে আমি বাধা দিতে পারি না। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি অপমানজনক কিছু না লিখছেন। কিন্তু আমি তাদের এই বলে বাধা দিই যে, আমি নিজের আত্মজীবনী লেখার কথা ভাবছি। হয়ত আমি লিখবও কিন্তু আমার কোন তাড়া নেই। বিজ্ঞান আমার অনেক কাজ, প্রথমে আমি সে কাজ করতে চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *