০৪. বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি

০৪. বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি*

[*১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রিন্স অফ আসটুরিয়াস হারমনি এবং কনকর্ড প্রাইজ (Price of Asturias Harmony & Concord Prize) pour app wreczucht (Oviedo)-60 প্রদত্ত বক্তৃতা। বক্তৃতাটির কালোপয়োগী সংস্কার করা হয়েছে।]

আমাদের ভাল লাগুক কি না লাগুক, যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি গত একশ’ বছরে তার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে এবং আগামী একশবছরে তার আরও বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা। অনেকে এ পরিবর্তন বন্ধ করে অতীতে ফিরে যেতে চান। তাঁদের দৃষ্টিতে অতীত যুগ ছিল শুদ্ধতর আর সরলতর। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই অতীতকালে এমন কিছু চমকপ্রদ ছিল না। সুবিধাভোগী একটা সংখ্যালঘু অংশের কাছে ব্যাপারটা অত মন্দ ছিল না। তবু তারা আধুনিক চিকিৎসা পেতেন না, মেয়েদের সন্তান জন্ম ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার। অথচ জনগণের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশের কাছে জীবনটা ছিল নোংরা, পশুসুলভ আর স্বল্পস্থায়ী।

তবে, কেউ চাইলেও কালকে অতীত যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। জ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যা খুশিমতো ভুলে যাওয়া যায় না। কেউ ভবিষ্যতের দিকে বৃহত্তর অগ্রগতি বন্ধ করতে পারে না। যদি গবেষণার জন্য দেয় সমস্ত সরকারি অর্থদান বন্ধ করে দেওয়া হয় (আধুনিক সরকার এ কর্ম করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে) তাহলেও প্রতিযোগিতার শক্তিই প্রযুক্তিবিদ্যাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাছাড়া অনুসন্ধিৎসু মনকে কেউ মূলগত বৈজ্ঞানিক চিন্তা থেকে বিরত করতে পারে না। সে চিন্তার জন্য তাদের অর্থপ্রাপ্তি হোক বা না হোক তাতে কিছু এসে যায় না। বিজ্ঞানের আরও অগ্রগতি বন্ধ করার একমাত্র উপায় বিশ্বজোড়া এমন একটি একনায়কতন্ত্রী সরকার গঠন, যে সরকার যে কোন নতুন চিন্তা দমন করবে। তবে মানবিক উদ্যম এবং উদ্ভাবনী শক্তি এমনই যে এতেও কোন সাফল্য হবে না। এর ফলে শুধুমাত্র পরিবর্তনের হার একটু কমতে পারে।

আমরা যদি মেনে নিই যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা আমাদের পৃথিবীর পরিবর্তন আমরা বন্ধ করতে পারি না, তাহলে অন্ততপক্ষে আমরা চেষ্টা করতে পারি পরিবর্তনের অভিমুখ সঠিক করতে। এর অর্থ হল একটা গণতান্ত্রিক সমাজে জনসাধারণের বিজ্ঞান সম্পর্কে একটা মূলগত বোধ থাকা উচিত। তার ফলে তারা সঠিক সংবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, বিশেষজ্ঞের হাতে সবটা ছেড়ে দেবে না। বর্তমানে জনসাধারণের বিজ্ঞান সম্পর্কে দুটো বিপরীতধর্মী ধারণা রয়েছে। একদিকে তাঁরা চান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি জীবনধারণের মানের যে উন্নয়ন করে চলেছে। সে উন্নয়নের হার অক্ষুণ্ণ থাকুক। আবার অন্যদিকে তারা বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করেন না, তার কারণ বিজ্ঞান তারা বোঝেন না। উন্মাদ বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরিতে একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করার চেষ্টা করছে–এই রকম সব কার্টুনে সে অবিশ্বাস স্পষ্ট। গ্রীনপার্টিগুলোর সমর্থনের পিছনে এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু জনসাধারণের টেলিভিশনে কসমস কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকথার (science fiction) দর্শকদের বিরাট সংখ্যা দেখে।

এই আকর্ষণকে কি করে কাজে লাগানো যায়? কি করে তাদের ভিতরে সত্য সংবাদের ভিত্তিতে অম্ল বৃষ্টি (acid rain), গ্রীনহাউস অভিক্রিয়া (green house effect), পারমাণবিক অস্ত্র (nuclear weapons), বংশগতি সম্পৰ্কীয় প্রযুক্তিবিদ্যা (genetic engineering) ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক পশ্চাৎপট সৃষ্টি করা যায়? স্পষ্টতই এর ভিত্তি হতে হবে স্কুলের শিক্ষা। কিন্তু স্কুলে বিজ্ঞানকে অনেক সময় নীরস আকর্ষণহীনরূপে উপস্থিত করা হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় পাস করার জন্য মুখস্থ করে কিন্তু বিশ্বে তাদের চতুষ্পর্শে সে বিদ্যার প্রাসঙ্গিকতা তারা বুঝতে পারে না। তাছাড়া বিজ্ঞান অনেক সময়ই সমীকরণের সাহায্যে শেখানো হয়। যদিও সমীকরণগুলো গাণিতিক চিন্তন বোঝানোর সবচাইতে নির্ভুল এবং সংক্ষিপ্ত উপায়, তবুও অধিকাংশ লোকই সমীকরণ দেখলে ভয় পায়। কিছুদিন আগে আমি সাধারণ মানুষের জন্য একটা বৈজ্ঞানিক বই লিখেছি। তখন আমাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল : বইটিতে সমীকরণ থাকলে প্রতিটি সমকিরণের জন্য বিক্রি অর্ধেক করে কমে যাবে। বইটাতে আমি একটাই সমীকরণ দিয়েছি–আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=Mc2 হয়ত এই সমীকরণটা না থাকলে বই বিক্রি দ্বিগুণ হত।

বৈজ্ঞানিকরা আর ইঞ্জিনিয়াররা চেষ্টা করেন তাদের চিন্তাধারা সমীকরণের অবয়বে প্রকাশ করতে। তার কারণ তাদের পরিমাণগত মূল্যগুলো নির্ভুলভাবে জানা। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাগুলো সম্পর্কে গুণগত ধারণাগুলোই যথেষ্ট। এই ধারণাগুলো ভাষা এবং ছবির সাহায্যেই প্রকাশ করা যায়–সমীকরণ ব্যবহার প্রয়োজন হয় না।

স্কুলে যে বিজ্ঞান শেখানো হয় সেটা শুধু মূলগত কাঠামো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির হার এখন এত দ্রুত যে, সবার ক্ষেত্রেই স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়বার পর থেকে বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিকাশ হয়ে চলেছে। স্কুলে থাকতে আমি কখনোই আণবিক জীববিদ্যা (molecular biology) কিংবা ট্রানজিস্টার (transistors) সম্পর্কে কিছু শিখিনি। কিন্তু বংশগতির ইঞ্জিনিরিং (genetic engineering) এবং কম্পিউটার–এই দুটির বিকাশে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রা পরিবর্তন করার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। সাধারণের জন্য লেখা বই এবং পত্র-পত্রিকায় লেখা বিজ্ঞান সম্পর্কীয় প্রবন্ধ বিজ্ঞানের নতুন বিকাশ প্রচার করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য লেখা সবচাইতে জনপ্রিয় বইয়ের পাঠক ও জনসাধারণের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। শুধুমাত্র টেলিভিশনই জনসাধারণের কাছে পৌঁছায়। টেলিভিশনে অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক ভাল প্রোগ্রাম (programme কার্যক্রম) থাকে কিন্তু অন্য অনেক প্রোগ্রামে বৈজ্ঞানিক বিস্ময়কে যাদুর খেলার মতো দেখানো হয়। অথচ সেগুলো ব্যাখ্যা করা হয় না কিংবা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার কাঠামোর সঙ্গে তাদের কি রকম মিল সেটা দেখানো হয় না। যারা টেলিভিশনের জন্য বিজ্ঞানের প্রোগ্রাম তৈরি করেন তাদের বোঝা উচিত জনসাধারণকে শুধুমাত্র আনন্দ দেওয়াই তাদের কর্তব্য নয়, জনতাকে শিক্ষাদানও তাদের কর্তব্যের অঙ্গ।

নিকট ভবিষ্যতে বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট কোন কোন বিষয়ে জনসাধারণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? সবচাইতে জরুরি বিষয় হল পারমাণবিক অস্ত্র। খাদ্য সরবরাহ কিংবা গ্রীনহাউস অভিক্রিয়া ইত্যাদি সমস্যা ধীরগতি কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র কয়েকদিনের ভিতরেই পৃথিবী থেকে সমস্ত মনুষ্য জীবন ধ্বংস করতে পারে। ঠাণ্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার ফলে পূর্ব-পশ্চিমের ভিতরকার উত্তেজনা অনেকটাই কমেছে। এর অর্থ হল পারমাণবিক অস্ত্রের ভীতি গণচেতনার পিছনের সারিতে স্থান নিয়েছে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার মতো অস্ত্র রয়েছে ততদিন পর্যন্ত বিপদও রয়েছে। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্রগুলোকে উত্তর গোলার্ধের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নগরের দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু করতে প্রয়োজন শুধু কম্পিউটারের একটা ভুল কিংবা অস্ত্রগুলো চালনা করার দায়িত্ব যাদের রয়েছে তাদের কয়েকজনের বিদ্রোহ। আর দুশ্চিন্তার বিষয় হল তুলনামূলকভাবে স্বল্প সামরিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোও পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করছে। বৃহৎ শক্তিরা মোটামুটি যুক্তিপূর্ণ আচরণ করে এসেছে কিন্তু লিবিয়া কিংবা ইরাক, পাকিস্তান এমন কি আজারবাইজানের মতো রাষ্ট্র সম্পর্কে সে রকম বিশ্বাস থাকা সম্ভব নয়। কয়েকটা পারমাণবিক অস্ত্র অদূর ভবিষ্যতে তাদের দখলে আসতে পারে। বিপদটা সেখানে নয়। কারণ তাদের অস্ত্রগুলো হয়ত বেশ পুরানো ধরনের। হয়ত তারা কয়েক মিলিয়ন নরহত্যাও করতে পারবে। আসলে বিপদটা হল দুটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রশক্তির ভিতর যুদ্ধ বৃহৎ শক্তিদের যুদ্ধে নামাতে পারে–সে শক্তিদের অস্ত্রসম্ভার বিরাট।

জনসাধারণের এটা বুঝতে পারা এবং অস্ত্রখাতে ব্যয় হ্রাস করার জন্য সরকারের উপর চাপ দেওয়ার গুরুত্ব প্রচুর। পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ দূর করা হয়ত কার্যক্ষেত্রে সম্ভব নয়, কিন্তু অস্ত্রের সংখ্যা হ্রাস করে আমরা বিপদটা কমাতে পারি। আমরা পারমাণবিক যুদ্ধ যদি এড়াতে পারি তবুও এমন অনেক বিপদ আছে যা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে পারে। একটা বদ রসিকতা আছে : অন্য গ্রহের কোন সভ্যতা যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তার কারণ আমাদের স্তরে পৌঁছে তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠ। কিন্তু জনসাধারণের সদিচ্ছার উপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। হয়ত এই বদ রসিকতা আমরা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *