০১. শৈশব

০১. শৈশব *

[*এই রচনা এবং এর পরবর্তী রচনার ভিত্তি হল ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জুরিখে আন্তর্জাতিক মোটর নিউরন সমিতি (Motor Neurone Disease Society) তে প্রদত্ত বক্তৃতা। এছাড়া ১৯৯১ সালের লেখা প্রবন্ধে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বক্তৃতার তথ্যগুলো যুক্ত হয়েছে।]

আমার জন্ম ১০৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। তারিখটা গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক তিনশ’ বছর পরবর্তী। তবে আমার অনুমান, সেদিন আরও প্রায় দুই লক্ষ শিশু জন্মেছিল। আমি জানি না তাদের ভিতরে আর কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানে আকৃষ্ট হয়েছিল কিনা। আমার বাবা-মা যদিও লন্ডনে থাকতেন, তবুও আমার জন্ম হয়েছিল অক্সফোর্ডে। তার কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্মানোর পক্ষে অক্সফোর্ড জায়গাটা ভাল ছিল। জার্মানদের সঙ্গে একটা চুক্তি ছিল : তারা অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজে বোমা বর্ষণ করবে না, তার বদলে ব্রিটিশরাও হাইডেলবার্গ (Heidelberg) এবং গটিংগেন (Gottingen) এ বোমা বর্ষণ করবে না। খুব দুঃখের কথা, অনেকটা সুসভ্য এই ব্যবস্থা অন্যান্য শহরগুলোতে বিস্তৃত করা যায়নি।

আমার বাবা ছিলেন ইয়র্কশায়ারের (Yorkshire) লোক। তাঁর পিতামহ অর্থাৎ আমার প্রপিতামহ ছিলেন একজন সম্পন্ন কৃষিজীবী। তিনি অনেকগুলো ক্ষেত খামার কিনেছিলেন। এই শতাব্দীর প্রথম দিকে ফসলের বাজারে যে সঙ্কট উপস্থিত হয় তার ফলে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান। এজন্য আমার বাবার বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়ে। তবুও তারা বাবাকে শিক্ষার জন্য অক্সফোর্ডে পাঠান। বাবা সেখানে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ নেন। তারপর তিনি ট্রপিক্যাল ডিজিজে (Tropical disease গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ব্যাধি) গবেষণা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি পূর্ব আফ্রিকায় যান। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থলপথে আফ্রিকা পেরিয়ে একটা জাহাজ ধরে ইংল্যান্ডে পৌঁছান। সেখানে তিনি স্বেচ্ছায় সামরিক কর্মে যোগ দিতে চান। কিন্তু তাঁকে বলা হল তাঁর চিকিৎসাবিদ্যায় গবেষণা আরও বেশি মূল্যবান।

আমার মা ছিলেন একজন পারিবারিক চিকিৎসকের সাতটি সন্তানের ভিতরে দ্বিতীয়। তাঁর জন্ম হয়েছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো (Glasgow) শহরে। তার যখন বার বছর বয়স তখন তাঁদের পরিবার দক্ষিণে ডেভন (Devon) এ চলে আসেন। আমার বাবার পরিবারের মতো তাদের পরিবার ব্যবস্থা করেন। তারপর তিনি অনেকরকম কাজ করেছেন। তার ভিতরে একটি ছিল ট্যাক্স ইন্সপেক্টরের (Tax Inspector) চাকরি। কাজটা তার অপছন্দ ছিল। সে চাকরি ছেড়ে উনি সেক্রেটারির কাজ নেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে এইভাবে তার সঙ্গে আমার বাবার দেখা হয়।

আমরা থাকতাম উত্তর লন্ডনের হাইগেট (Highgate) এ। আমার বোন মেরীর জন্ম হয় আমার জন্মের আঠার মাস পর। আমি শুনছি, আমার বোনের জন্ম আমার পছন্দ হয়নি। আমাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিল খুব অল্প, সেজন্য সমস্ত শৈশব জুড়ে আমাদের দুজনের ভিতর দ্বন্দ্ব ছিল। বড় হওয়ার পর কিন্তু এই দ্বন্দ্ব চলে যায়। তার কারণ আমরা ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছি। বোন ডাক্তার হল, ফলে আমার বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার ছোট বোন ফিলিপা (Philippa)-র যখন জন্ম হয়, তখন আমার বয়স প্রায় পাঁচ। ব্যাপারটা কি ঘটছে সেটা তখন বুঝতে পারতাম। আমার মনে পড়ে আমি তার আগমনের প্রতীক্ষা করেছি। ভেবেছি, আমরা তিনজন একসঙ্গে খেলতে পারব। সে ছিল খুব ভাবপ্রবণ আর অনুভূতিপ্রবণ, আমি সবসময়ই তার বিচারবুদ্ধি এবং মতামতের মূল্য দিয়েছি। আমার ভাই এডওয়ার্ডের জন্ম হয়েছে অনেক পরে। সুতরাং আমার শৈশবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খুবই কম। পরিবারের অন্য তিন শিশুর সঙ্গে তার বেশ পার্থক্য ছিল। বৈদ্ধিক (intellectual) এবং শিক্ষাজগতের সঙ্গে (academic) তার সম্পর্ক একেবারেই ছিল না। হয়ত এটা আমাদের পক্ষে ভালই হয়েছে। শিশু হিসেবে ওকে সামলানো ছিল বেশ কঠিন। কিন্তু ওকে ভাল না বেসে পারা যেত না।

প্রথম যে স্মৃতি আমার মনে আছে সেটা হল হাইগেটের বায়রন হাউসে (Byron House) নার্সারিতে দাঁড়িয়ে কেঁদে বুক ফাটিয়ে দেওয়া। আমার চারদিকে বাচ্চারা খেলা করছিল। আমার মনে হয়েছিল খেলনাগুলো বেশ সুন্দর। আমারও খেলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমার বয়স মোটে আড়াই বছর। আর এই প্রথম আমাকে অচেনা লোকদের ভিতরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার মনে হয় বাবা-মা আমার ব্যাপার দেখে একটু আশ্চর্যই হয়েছিলেন। আমি ছিলাম তাদের প্রথম সন্তান। তারা শিশুদের বিকাশ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলেন, সেসব বইয়ে লেখা ছিল দুই বছর বয়স থেকেই শিশুদের সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। কিন্তু সেই ভয়াবহ সকালের পর থেকে ওঁরা আমার স্কুল ছাড়িয়ে দিলেন। আবার আমাকে বায়রন হাউসে পাঠিয়েছিলেন দেড় বছর পর।

সেই সময় অর্থাৎ যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের ঠিক পরপর হাইগেট অঞ্চলে বিজ্ঞানজগৎ এবং শিক্ষাজগতের অনেকেই থাকতেন। অন্য কোন দেশ হলে তাদের বুদ্ধিজীবী বলা হত। কিন্তু ইংরেজরা নিজেদের ভিতরে বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব কখনও স্বীকার করেনি। এখানকার সমস্ত বাবা-মা-ই তাঁদের ছেলে-মেয়েদের বায়রন হাউসে পাঠাতেন। সেই সময়কার মান অনুসারে স্কুলটা ছিল খুবই প্রগতিশীল। আমার মনে পড়ে বাবা-মার কাছে আমি নালিশ করতাম স্কুলে আমাকে কিছু শেখায় না। তখনকার প্রচলিত পদ্ধতি ছিল জোর করে ছাত্রদের শেখানো। এ পদ্ধতিতে তারা বিশ্বাস করতেন না। তার বদলে আশা করা হত, ছাত্ররা বুঝতে পারবে না যে তারা শিখছে কিন্তু তারা পড়তে শিখে যাবে অজান্তে। শেষ পর্যন্ত আমি পড়া শিখেছিলাম কিন্তু আট বছর বয়সে। বয়সটা একটু বেশিই হয়েছিল। আমার বোন ফিলিপপা-কে শেখানো হয়েছিল প্রচলিত পদ্ধতিতে। সে চার বছর বয়সেই পড়তে পারত। নিঃসন্দেহে তার বুদ্ধি ছিল আমার চাইতে বেশি।

উঁচু, সরু একটা ভিক্টোরীয় যুগের বাড়িতে আমরা থাকতাম। বাবা যুদ্ধের সময় বাড়িটা খুব সস্তায় কিনেছিলেন। তখন সবাই ভেবেছে লন্ডনকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে। এমনকি একটা V-2 রকেট আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি ছাড়িয়ে গিয়ে পড়েছিল। আমি তখন আমার মা বোনের সঙ্গে বাইরে ছিলাম কিন্তু বাবা বাড়িতে ছিলেন। কপালগুণে তাঁর কোন চোট লাগেনি, বাড়িটারও বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু রাস্তায় একটু দূরে কয়েক বছর ধরে বোমা পড়া জায়গাটা ছিল। সেখানে আমি আর আমার বন্ধু হাওয়ার্ড খেলা করতাম। সে থাকত রাস্তার অন্যদিকে তিনখানা বাড়ি পরে । হাওয়ার্ড যেন আমার কাছে রহস্য উন্মোচন করেছিল। আমার চেনা অন্যান্য ছেলে মেয়েদের বাবা-মায়ের মতো হাওয়ার্ডের বাবা-মা বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। ও বায়রন হাউস স্কুলে যেত না, যেত সরকারি স্কুলে (Council School)। সে ফুটবল আর বক্সিং খেলা জানত। আমার বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের ঐ ধরনের খেলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।

জীবনের প্রথমদিকের আর একটা স্মৃতি আমার প্রথম খেলনা রেলগাড়ির সেট পাওয়ার। যুদ্ধের সময় খেলনা তৈরি হত না–অন্তত দেশের জন্য তো নয়ই। কিন্তু খেলনা রেলগাড়ি আমার আকর্ষণ ছিল বিরাট। বাবা আমাকে একটা কাঠের রেলগাড়ি বানিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমি তাতে খুশি হইনি। আমি এমন গাড়ি চেয়েছিলাম যেটা চলে। তাই তো বাবা একটা পুরানো স্প্রিংয়ের রেলগাড়ি (clock work train) কিনে লোহা দিয়ে ঝালাই করে আমাকে বড়দিনে দিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স প্রায় তিন। সে রেলগাড়িটাও ভাল হয়নি। যুদ্ধের পরপরই বাবা আমেরিকা গিয়েছিলেন, কুইন মেরী’ জাহাজে ফেরার সময় মায়ের জন্য কিছু নাইলন কিনে এনেছিলেন। তখন ব্রিটেনে নাইলন পাওয়া যেত না। বোনের জন্য কিনে এনেছিলেন একটা পুতুল। সেটাকে শুইয়ে দিলে চোখ বন্ধ করত। আর আমার জন্য তিনি এনেছিলেন একটা আমেরিকান রেলগাড়ি। সেটাতে গরু ধরবার ফাঁদ ছিল, এমনকি বাংলা চারের আকারে রেললাইনও ছিল। বাক্সটা খুলে আমার যে উত্তেজনা হয়েছিল সেটা এখনও মনে পড়ে।

স্প্রিয়ের রেলগাড়িগুলো ভালই ছিল কিন্তু আসলে আমি চেয়েছিলাম ইলেকট্রিক ট্রেন। হাইগেটের কাছে ক্রাউচ এন্ড (Crouch End) এ একটা রেলওয়ে ক্লাবের প্রতিরূপে ইলেকট্রিক ট্রেনের নক্সা দেখতে দেখতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম। শেষ পর্যন্ত যখন বাবা-মা দুজনেই কোথায় যেন গিয়েছিলেন তখন আমি পোস্ট অফিসের ব্যাঙ্কে সামান্য যে কটা টাকা ছিল তাই তুলে নিয়ে একটা ইলেকট্রিক ট্রেনের সেট কিনে ফেললাম। টাকাগুলো আমি উপহার পেয়েছিলাম ক্রিনিং (christening) এর মতো কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দিনে। কিন্তু তাতেও হতাশ হলাম, গাড়িটা ভাল হয়নি। আজকাল আমরা ক্রেতাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। আমার উচিত ছিল দোকানদার কিংবা যারা বানিয়েছে তাদের কাছে গিয়ে ঐ সেটটা ফেরৎ দিয়ে তার বদলে নতুন সেট দাবি করা। কিন্তু তখনকার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কিছু কেনা, মানে একটা সুবিধা পাওয়া। সেটার যদি দোষ থাকে তাহলে আপনার কপালটা খারাপ। সুতরাং ইঞ্জিনের ইলেকট্রিক মোটরটা মেরামত করার জন্য আমি টাকা দিলাম কিন্তু সেটা কখনওই ভাল কাজ করেনি। পরে বয়স যখন তের থেকে উনিশের মধ্যে তখন আমি এরোপ্লেন আর জাহাজের প্রতিরূপ (model) বানিয়েছি। হাতের কাজে আমি কোনদিনই ভাল ছিলাম না তবে কাজটা আমি করেছিরাম আমার স্কুলের বন্ধু জন ম্যাক্লেনাহান John Macclenahan) এর সঙ্গে। ও কাজটা অনেক ভাল করত। বাড়িতে তার বাবার একটা কারখানা ছিল। আমি সবসময়ই চাইতাম এমন একটা প্রতিরূপ (model) গড়তে যেটা কাজ করে এবং আমি সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটা দেখতে কিরকম তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না। আমার মনে হয় এই উদ্দেশ্যে আমি আর আমার স্কুলের আর এক বন্ধু রজার ফার্নেহাউ (Roger Ferneyhough) দুজনে মিলে অনেকগুলো জটিল খেলা আবিষ্কার করেছিলাম। একটা খেলা ছিল কারখানার উৎপাদন নিয়ে। সেটাতে ফ্যাক্টরি ছিল। সেই রাস্তার রেললাইনে মাল যাতায়াত করত, এমনকি একটা শেয়ার মার্কেটও ছিল। যুদ্ধের খেলা ছিল। সে খেলার বোর্ডটাতে চার হাজার চৌকোণা খুপরি (square) ছিল। একটা সামন্ত্ৰতান্ত্রিক খেলা ছিল–সে খেলায় প্রত্যেক খেলোয়াড়ের একটা বংশ থাকত আর থাকত সম্পূর্ণ একটা বংশপঞ্জি। আমার মনে হয় এই সমস্ত খেলা এবং রেলগাড়ি, জাহাজ আর এরোপ্লেনের খেলার উৎস ছিল একটাই। সে উৎস ছিল এগুলোর কর্মপদ্ধতি জানা আর সেগুলোকে কি করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা জানা। পি. এইচ. ডি. (P.H.D. শুরু করার পর এই প্রয়োজন মিটিয়েছে আমার মহাবিশ্ব তত্ত্বসম্পকীয় গবেষণা । মহাবিশ্বের কর্মপদ্ধতি যদি আপনার জানা থাকে তাহলে এক অর্থে সেটাকে আপনি নিয়ন্ত্রণও করতে পারেন।

১৯৫০ সালে আমার বাবার কর্মস্থল হাইগেটের কাছে হ্যাঁম্পস্টেড (Hampstead) থেকে লন্ডনের উত্তর পার্শ্বে মিল হিলে (Mill Hill) নবনির্মিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চ এ (National Institute for Medical Research চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান) স্থানান্তরিত হয়। তাঁর মনে হয়েছিল হাইগেট থেকে বাইরে যাতায়াত করার চাইতে লন্ডনের বাইরে থেকে শহরে যাতায়াত বুদ্ধিমানের কাজ। সেজন্য আমার বাবা-মা সেন্ট অ্যালবান্সের ক্যাথেড্রল টাউনে (Cathedral City of St. Albans) একটা বাড়ি কেনেন। জায়গাটা ছিল লন্ডনের কুড়ি মাইল উত্তরে আর মিল হিল থেকে দশ মাইল উত্তরে। সেটা ছিল বেশ বড় ভিক্টোরীয় স্টাইলের জমকালো আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাড়ি। বাড়িটা কেনার সময় বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। বাসযোগ্য করতে হলে বাড়িটাতে অনেক কাজ করাবার ছিল। তারপর আমার বাবা আর টাকা খরচ করতে রাজি হলেন না। এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন ইয়র্কশায়ারের অন্যান্য লোকেরই মতো। তার বদলে তিনি বাড়িটাকে চালু রাখতে চেষ্টা করলেন আর রঙ করতেন। কিন্তু বাড়িটা ছিল বেশ বড় আর বাবাও এসমস্ত কাজে খুব ওস্তাদ ছিলেন না। তবে পাকাঁপোক্ত গঠন ছিল বাড়িটার সুতরাং এ অযত্নে তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। ১৯৮৫ সালে বাবা খুব অসুস্থ হন (তার মৃত্যু হয় ১৯৮৬ সালে)। বাবা-মা ১৯৮৫ সালেই বাড়িটা বিক্রি করেছেন। বাড়িটা আমি কিছুদিন আগে দেখেছি। মনে হয়নি বাড়িটাতে আর বেশি কিছু কাজ করা হয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হল বাড়িটা একরকমই আছে।

গৃহকর্মী রাখে এরকম একটা পরিবারের জন্য বাড়িটার পরিকল্পনা করা হয়েছিল । ভাড়ারঘরে একটা নির্দেশক ফলক ছিল– সেটা নির্দেশ করত কোন ঘর থেকে ঘণ্টা বাজানো হচ্ছে। আমাদের কোন গৃহকর্মী অবশ্য ছিল না কিন্তু আমার প্রথম শোবার ঘরটা ইংরাজি L গঠনের একটা ছোট ঘর। ঐ ঘরটা আমি চেয়েছিলাম আমার মাসতুতো বোন সারা (Sarah)-র কথায়। সে আমার চাইতে একটু বড়। সারা সম্পর্কে আমার খুব উচ্চ ধারণা ছিল। সে বলেছিল আমরা ঐ ঘরে খুব মজা করতে পারব। ও ঘরটার একটা আকর্ষণ ছিল, ঐ ঘরের জানালা থেকে মাইকেলের ঘরের ছাদে উঠে জমিতে নেমে যাওয়া যেত।

সারা ছিল আমার মায়ের সবচেয়ে বড় বোন জ্যানেট Janet) এর মেয়ে। তিনি ডাক্তারি পড়েছিলেন আর তাঁর বিয়ে হয়েছিল একজন সাইকোঅ্যানালিস্টের সঙ্গে। তাঁরা পাঁচ মাইল উত্তরে হার্পেন্ডেন (Harpenden) গ্রামে একইরকম একটা বাড়িতে থাকতেন। আমাদের সেন্ট অ্যালবান্স (St. Albans) এ বাস করতে যাওয়ার সেটা ছিল একটা কারণ। সারার কাছে থাকা আমার কাছে ছিল একটা বিরাট লাভের ব্যাপার। আমি প্রায়ই বাসে করে হার্পেন্ডেন যেতাম। সেন্ট অ্যালবান্স ছিল প্রাচীন রোমান শহর ভেরুলামিয়ামের (Verulamiam) পর। ভেরুলামিয়াম ছিল লন্ডনের পরেই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রোমান জনপদ। মধ্যযুগে ব্রিটেনের সবচাইতে বিত্তশালী মঠ ছিল ওখানে। এটা তৈরি হয়েছিল সেন্ট অ্যালবান্সের মন্দিরের চারপাশে। তিনি ছিলেন প্রথম রোমান শতায়ু যাকে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মঠের অবশিষ্ট ছিল শুধুমাত্র একটা বিরাট এবং কুশ্রী গির্জা আর প্রাচীন মাঠের প্রবেশদ্বারের দালানটি। মসেটা তখন ছিল সেন্ট অ্যালবান্স স্কুলের অংশ। পরে আমি সেই স্কুলেই পড়েছিলাম।

হাইগেট কিংবা হার্পেন্ডেনের তুলনায় সেন্ট অ্যালবান্স ছিল একটু গোঁড়া আর ভারিক্কি জায়গা। আমার বাবা-মায়ের সেখানে কোন বন্ধু হয়নি। অংশত সেটা ছিল তাদের নিজেদের দোষ। কারণ তাদের স্বভাব ছিল একটু একা থাকা, বিশেষ করে এরকম স্বভাব ছিল আমার বাবার। কিন্তু ওখানকার জনসাধারণের শ্রেণীগত পার্থক্যেরও এটা প্রকাশ ছিল। আমার সেন্ট অ্যালবান্সের স্কুলের বন্ধুদের কারোরই বাবা-মাকে বুদ্ধিজীবী বলা যেত না।

হাইগেটে আমাদের পরিবারটা মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু মনে হয় সেন্ট অ্যালবান্সে আমাদের নিশ্চয়ই একটু ছিটগ্রস্ত (eccentric) বলে ভাবা হত। আমার বাবার আচার-ব্যবহারে লোকের এরকম মনে হত। টাকা বাঁচানো সম্ভব হলে তিনি নিজের চেহারা কেমন হল তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। অল্পবয়সে তাঁদের পরিবার ছিল খুবই গরিব। তার মনে সে দারিদ্র্য একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল। নিজের আরামের জন্য পয়সা খরচ করা তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। এমনকি শেষ বয়সে যখন পয়সা খরচ করবার মতো অবস্থা হয়েছিল তখনও না। তিনি ঠাণ্ডায় খুবই কষ্ট পেতেন। কিন্তু বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং লাগাতে রাজি হননি। তার বদলে তিনি নিজের স্বাভাবিক পোশাকের উপর কয়েকটা সোয়েটার আর ড্রেসিংগাউন পরে বসে থাকতেন। কিন্তু পরের জন্য তিনি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন।

১৯৫০ সালে তিনি ভাবলেন নতুন গাড়ি কেনার মতো পয়সা তার নেই, সুতরাং তিনি যুদ্ধের আগেকার পুরানো একটা লন্ডন ট্যাক্সি কিনলেন। আমি আর বাবা দুজনে মিলে একটা নিসেন হাট তৈরি করেছিলাম। সেটা ছিল গাড়ির গ্যারেজ। আমাদের পড়শীরা খুব রেগে গিয়েছিলেন কিন্তু আমাদের কাজ বন্ধ করতে পারেননি। সব ছেলেদের মতোই আমি সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করতাম। আমার বাবা-মায়ের কাজকর্মে একটু লজ্জাও পেতাম, কিন্তু ওঁরা তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।

আমরা সেন্ট অ্যালবান্সে যখন প্রথম গেলাম তখন আমাকে মেয়েদের হাইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। স্কুলের নামটা ওরকম হলেও দশ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা ঐ স্কুলে . পড়তে পারত। সেই স্কুলে এক টার্ম (বছরের একটা অংশ) পড়বার পরে কিন্তু আমার বাবা আফ্রিকায় গেলেন। আফ্রিকায় তিনি প্রতিবছরই যেতেন, তবে সে বছর তিনি একটু বেশিদিনের জন্য গিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রায় চার মাসের জন্য। বাবাকে ছেড়ে অতদিন থাকা আমার মায়ের পছন্দ হয়নি। সুতরাং তিনি আমাকে ও আমার দুই বোনকে নিয়ে তার স্কুলের বন্ধু বেরিল (Beryl) এর কাছে চলে গেলেন। বেরিলের বিয়ে হয়েছিল রবার্ট গ্রেভ (Robert Graves) এর সঙ্গে। তিনি থাকতেন স্পেনের মেজরকা (Mejorca) দ্বীপের দেয়া (Deya) গ্রামে। ব্যাপারটা ঘটেছিল যুদ্ধের মাত্র পাঁচ বছর পর। হিটলার মুসোলিনীর বন্ধু স্পেনের ডিক্টেটর তখনও ক্ষমতায় আসীন। (আসলে তিনি তারপরেও কুড়ি বছর ক্ষমতায় আসীন ছিলেন)। যুদ্ধের আগে আমার মা ইয়াং ক্যুনিস্ট লীগের সদস্যা ছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি তিনটি তরুণ শিশুকে নিয়ে মেজরকা গেলেন। আমরা দেয়া-তে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। সেখানে আমাদের দিনও কেটেছে আনন্দে। আমার এবং রবার্টের ছেলে উইলিয়ামের একই মাস্টার ছিলেন। এই মাস্টারমশাই ছিলেন রবার্টেরই একজন চেলা (Protege)। আমাদের পড়ানোর চাইতে তাঁর বেশি আকর্ষণ ছিল এডিনবরা উৎসবের জন্য একটা নাটক লেখা। সুতরাং তিনি আমাদের প্রতিদিন। বাইবেলের এক অধ্যায় করে পড়ে সে সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখতে বললেন। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ইংরেজি ভাষার সৌন্দর্য শেখানো। ওখান থেকে চলে আসার আগে আমরা বাইবেলের জেনেসিস (Genesis) এবং এক্সেস (Exodus) অধ্যায়ের একটা অংশ শেষ করি। প্রধান যে কয়টা জিনিস আমি শিখেছিলাম তার ভিতর ছিল ‘And’ দিয়ে কোন বাক্য শুরু না করা। আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম বাইবেলের প্রায় প্রতিটি বাক্যই ‘And’ দিয়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাকে বলা হল রাজা জেমস্ (King James) এর পরে ইংরেজি ভাষার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি বললাম, তাহলে আমাদের বাইবেল পড়ালেন কেন? কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সেই সময় রবার্ট গ্রেভস এর বাইবেলের ভিতরকার অতীন্দ্রিয়বাদ ও প্রতীকীবাদ (mysticism & Symbolism) এ ছিল খুব উৎসাহ।

হয়। তারপর আমি তথাকথিত ইলেভেন প্লাস পরীক্ষা দিলাম। এটা ছিল একটা বুদ্ধির পরীক্ষা। যারা সরকারি শিক্ষা চাইত তাদের এ পরীক্ষা দিতে হত। এ পরীক্ষা এখন উঠে গেছে। তার প্রধান কারণ অনেক মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা এ পরীক্ষায় ফেল করত এবং তাদের এমন স্কুলে পাঠানো হত যেখানে খুব তাত্ত্বিক শিক্ষা হত না (non-academic school)। আমি স্কুলে ক্লাসের পড়ায় যত নম্বর পেতাম তার চাইতে অনেক বেশি নম্বর পেতাম পরীক্ষায়। সুতরাং আমি ইলেভেন প্লাসের পরীক্ষায় পাস করে সেন্ট অ্যালবান্স স্কুলে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেলাম।

আমার যখন ১৩ বছর বয়স তখন আমার বাবা চাইলেন আমি ওয়েস্ট মিনস্টার (West Minster) স্কুলে ভর্তি হই। সেটা ছিল একটা প্রধান পাবলিক স্কুল অর্থাৎ আসলে প্রাইভেট স্কুল। তখনকার দিনে শ্রেণীর ভিত্তিতে শিক্ষার একটা কঠিন বিভাজন ছিল। আমার বাবার ধারণা ছিল তাঁর যোগাযোগ কম এবং গুরুত্বও কম। সেজন্য তাঁর চাইতে অনেক কম দক্ষ লোকেরা তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান অনেক উঁচুতে। আমার বাবা-মায়ের অবস্থা ভাল ছিল না। সেজন্য আমার প্রয়োজন ছিল স্কলারশিপ পাওয়া। স্কলারশিপ পরীক্ষার সময় কিন্তু আমি অসুস্থ ছিলাম। সেজন্য পরীক্ষাটা আমার দেওয়া হয়নি। তার বদলে আমি সেন্ট অ্যালবাঙ্গ স্কুলেই রয়ে গেলাম। সেখানে আমি যা শিক্ষা পেয়েছিলাম সে শিক্ষা ওয়েস্ট মিনস্টার স্কুলে আমি যে শিক্ষা পেতাম তার মতো নিশ্চয়ই, হয়ত বা তার চাইতেও ভাল। আমার কখনও মনে হয়নি উঁচুতলার সমাজের আদব-কায়দা জানা না থাকায় আমার বিশেষ কোন বাধা হয়েছে।

তখনকার দিনে ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খুবই শ্রেণীভিত্তিক। শুধু স্কুলগুলোকেই উচ্চশিক্ষার (academic) জন্য এবং উচ্চশিক্ষার জন্য নয় (non-academic) এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল তাই নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য যে স্কুলগুলো, সেগুলোকেও ভাগ করা হয়েছিল A, B এবং C এই তিনটি স্রোতে (stream)। যারা A স্ট্রীমে ছিল তাদের পক্ষে ব্যাপারটা ভালই হত। কিন্তু যারা B স্ট্রীমে থাকত তাদের পক্ষে ব্যাপারটা অত ভাল হত না। আর যারা C স্ট্রীমে থাকত তাদের পক্ষে ব্যাপারটা খারাপই হত। ফলে তারা নিরুৎসাহ হত। এগারো প্লাসের পরীক্ষার ভিত্তিতে আমাকে A স্ট্রীমে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম বছরের পর যাদের স্থান কুড়ি জনের নিচে হত তাদের B স্ট্রীমে নামিয়ে দেওয়া হত। এটা ছিল তাদের আত্মসম্মানের পক্ষে একটা বিরাট আঘাত। ফলে অনেকেই সে আঘাত সামলে উঠতে পারত না। সেন্ট অ্যালবান্সে প্রথম দুই টার্মে আমি চব্বিশ আর তেইশতম স্থান পেয়েছিলাম। কিন্তু তৃতীয় টার্মে আমার স্থান হয়েছিল অষ্টাদশ। সুতরাং আমি কোনোরকমে কান ঘেঁসে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

আমি কখনোই ক্লাসে মাঝামাঝির উপরে উঠতে পারিনি (ক্লাসটা ছিল খুবই মেধাবী আর সম্ভাবনাময়)। আমার ক্লাসের কাজকর্ম ছিল খুবই অপরিচ্ছন্ন আর আমার হাতের লেখা ছিল মাস্টারমশাইদের হতাশার কারণ। কিন্তু আমার ক্লাসের বন্ধুরা আমার নাম দিয়েছিল আইনস্টাইন। সেজন্য মনে হয় আমার ভিতরে তারা ভাল কোন লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল। আমার যখন বার বছর বয়স তখন আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আর এক বন্ধুর এক ব্যাগ মিষ্টি বাজি হয়েছিল। বাজির বিষয় ছিল আমি জীবনে কখনোই কিছু করতে পারব না। জানি না এই বাজির হিসাব কখনো মেটানো হয়েছিল কি-না। আর মেটানো হয়ে থাকলেও কে জিতেছিল সেটা জানা নেই।

আমার ছয়-সাত জন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাদের অধিকাংশের সঙ্গে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। আমরা খুব দীর্ঘ আলোচনায় মগ্ন থাকতাম। আর সব বিষয়েই আমাদের তর্ক হত। যেমন বেতার-নিয়ন্ত্রিত মডেল (প্রতিরূপ) থেকে ধর্ম পর্যন্ত আবার প্যারাসাইকোলজি (Parapsychology)* [* সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া বহির্ভুত ব্যাপার বা অবস্থাদি (যেমন, ইন্দ্রিয়াতীত প্রক্রিয়ায় মন জানাজানি, পূর্বাহ্নে লব্ধ জ্ঞান, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতিরেকে প্রত্যক্ষকরণ) সংক্রান্ত বিদ্যা ও বিজ্ঞান] থেকে পদার্থবিদ্যা পর্যন্ত। যেসব বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম তার ভিতরে একটা ছিল মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য এবং মহাবিশ্ব চালু করার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল কিনা। আমি শুনেছিলাম সুদূর নীহারিকা থেকে আলো বর্ণালির লালের দিকে বিচ্যুত হয় এবং এজন্য মনে করা হয় মহাবিশ্ব বিস্তারমান (নিলের দিকে বিচ্যুত হলে তার অর্থ হত মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হচ্ছে)। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম লালের দিকের এই বিচ্যুতির অন্য কোন কারণ রয়েছে। হয়ত আলোক ক্লান্ত হয়ে পড়ত এবং আমাদের কাছে আসার পথে লাল হয়ে যেত। মূলগতভাবে অপরিবর্তনশীল এবং চিরস্থায়ী মহাবিশ্বকে মনে হত স্বাভাবিক। পি. এইচ. ডি-র জন্য দুবছর গবেষণার পর আমি বুঝতে পারলাম আমার ভুল হয়েছিল।

স্কুলের শেষ দুবছরে আমি চেয়েছিলাম গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হতে। মি, তাহতা (Mr. Tahta) বলে একজন গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন গণিতে অনুপ্রাণিত। স্কুলে একটা নতুন গণিতের ঘর তৈরি করা হয়েছিল। গণিতের লোকেরা সেখানে নিজেদের ক্লাসঘর বানিয়ে নিলেন। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন এর ঘোর বিরোধী। তার ধারণা ছিল মাস্টারি ছাড়া গণিতবিদদের অন্য কোন চাকরি ভবিষ্যতে থাকবে না। আসলে আমি ডাক্তার হলেই তিনি খুশি হতেন। কিন্তু জীববিদ্যায় আমার কোন আকর্ষণ ছিল না। আমার মনে হত জীববিদ্যা অতিরিক্ত বিবরণসর্বস্ব এবং যথেষ্ট মূলগত নয়। তাছাড়া স্কুলে জীববিদ্যার স্থানও ছিল নিচে। সবচাইতে মেধাবী ছেলেরা গণিত এবং পদার্থবিদ্যা পড়ত। তার চাইতে যারা কম মেধাবী তারা পড়ত জীববিদ্যা। বাবা জানতেন আমি জীববিদ্যা পড়ব না। কিন্তু তিনি আমাকে জোর করে রসায়ন পড়িয়েছিলেন আর সামান্য কিছু গণিতও করিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এর ফলে বিজ্ঞানের যে কোন শাখা নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত থাকবে। আমি এখন গণিতের অধ্যাপক। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে সেন্ট অ্যালবান্স স্কুল ছাড়ার পর থেকে গণিতশাস্ত্রে কোন প্রথাগত শিক্ষা আমার হয়নি। আমার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাকে গণিত শিখে নিতে হয়েছে অর্থাৎ আমি যতটা গণিত জানি ততটা শিখতে হয়েছে কেব্রিজে। আমাকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েটদের দেখাশোনা করতে হত এবং তাদের শিক্ষাক্রমে তাদের চাইতে এক সপ্তাহ এগিয়ে থাকতে হত।

বাবা ট্রপিক্যাল ডিজিজ নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি মিল হিল-এ আমাকে তার । সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেতেন। ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগত, বিশেষ করে ভাল লাগত অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখা। তিনি আমাকে কীটপতঙ্গের (insects) ঘরেও নিয়ে যেতেন। সে ঘরে তিনি ট্রপিক্যাল ডিজিজ সংক্রমিত মশা রাখতেন। আমার দুশ্চিন্তা হত। কারণ মনে হত কিছু মশা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি খুবই পরিশ্রমী ছিলেন এবং গবেষণাকর্মে ছিলেন উৎসর্গীকৃতপ্রাণ। তাঁর একটু বিদ্বেষ এবং অবজ্ঞার ভাব ছিল। কারণ, তার ধারণা ছিল যারা অতটা ভাল নয় অথচ যাদের বংশপরিচয় উত্তম এবং যোগাযোগ ও সম্পর্কও ভাল, তারা তার চাইতে এগিয়ে গেছে। তিনি এসব লোক সম্পর্কে আমাকে সাবধান করে দিতেন। কিন্তু আমার মনে হয় ডাক্তারির সঙ্গে পদার্থবিদ্যার একটু পার্থক্য রয়েছে। তুমি কোন স্কুলে পড়েছ কিংবা কার সঙ্গে তুমি সম্পর্কিত তাতে কিছু এসে যায় না। তুমি কি করছ এটাই আসল।

আমার সবসময়ই জিনিসগুলো কি করে চলে সেটা জানার খুব আগ্রহ ছিল। আমি সেগুলো কি করে কাজ করে দেখার জন্য জিনিসগুলো খুলে ফেলতাম। কিন্তু সেগুলো আবার জুড়ে দেয়ার ব্যাপারে অত ভাল ছিলাম না। আমার ব্যবহারিক ক্ষমতা কখনোই তাত্ত্বিক অনুসন্ধিৎসার সমকক্ষ ছিল না। আমার বাবা আমার বিজ্ঞানে আকর্ষণকে সবসময়ই উৎসাহ দিতেন। এমনকি তিনি আমাকে গণিতও পড়িয়েছেন। তবে আমার বিদ্যা যতদিন না তার বিদ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে ততদিন পর্যন্ত। আমার এই পঞ্চাৎপট আর বাবার কর্মক্ষেত্র এরকম থাকার ফলে আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করব। অল্প বয়সে আমি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ভিতরে কোন পার্থক্য করিনি। কিন্তু তের-চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমি জানতাম, আমি পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করতে চাই। কারণ, পদার্থবিদ্যাই ছিল মূলগত বিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা স্কুলের সবচাইতে একঘেয়ে বিষয় ছিল। তার কারণ, এটা ছিল এত সহজ ও স্বতঃপ্রতিয়মান কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার পদার্থবিদ্যাই পছন্দ ছিল। রসায়নশাস্ত্রে মজা ছিল অনেক বেশি। কারণ, বিস্ফোরণের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা হামেশাই ঘটত। কিন্তু পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের আশা দিত, আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং কেন আমরা এখানে এসেছি সেটা বুঝবার। আমি মহাবিশ্বের গভীরতা মাপতে চেয়েছিলাম। হয়ত আমি খানিকটা সফলও হয়েছি। কিন্তু এখনো আমার জিজ্ঞাসা প্রচুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *