৩. আগের বাসায় ফেরত

১১.

ক্লেমেনরা তাদের আগের বাসায় ফেরত এসেছে কিনা তা বুঝতে পারছি না এ মুহূর্তে। কিন্তু সেটা আরেকটু পরেই বোঝা যাবে।

পাশের বাগান থেকে একটা ভারি পাথর হাতে তুলে নিলাম। ভালোই ওজন হবে পাথরটার, মনে হচ্ছে কাজে দেবে। আমার প্ল্যান হল ভারি পাথরটা দিয়ে আঘাত করে কাঁচের দরজাটার বাইরে যে তালাটা লাগানো আছে সেটা ভেঙে ফেলা। বারি দেয়ার জন্যে পাথরটা মাথার উপর তুললাম।

মিয়াও।

নিচের দিকে তাকালাম। আমার এই অভিযানে ল্যাসিকে সাথে করে নিয়ে এসেছি এই আশায়, ও হয়ত গন্ধ শুঁকে এমন কিছু খুঁজে পাবে যা পুলিশি তল্লাশির সময় ধরা পড়েনি।

“আমি জানি, এই প্ল্যানটা ফালতু, কিন্তু এর থেকে ভালো কিছু আছে তোর কাছে?”

মিয়াও।

“সত্যি?”

মিয়াও।

“তা, আগে বলিসনি কেন?”

ব্যাটা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো থেকে আমাকে বাগানের একদম পেছন দিকে একটা ফুলের টবের সামনে নিয়ে গেল। মাটিগুলো কেমন যেন আলগা হয়ে আছে। আমি মাটির ভেতরে হাত ঢোকাতেই জিনিসটা আমার ঠেকল। একটা চাবি!

“সাব্বাশ, ওয়াটসন!”

মিয়াও।

“না, তুই না, আমি শার্লোক!”

দশ সেকেন্ডের ভেতরে আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম।

এখন বাজে তিনটা দশ।

টিভি রিমোটটা এখনো আগের জায়গাতেই আছে। এর মানে ক্লেমেনরা এখনো সপরিবারে ফ্লোরিডাতে ছুটি কাটাতেই ব্যস্ত। পুলিশের লোকজনও মনে হয় তল্লাশির পর সব কিছু আবার আগের জায়গায় ঠিকমতো রেখে দিয়েছে।

ফ্রিজ থেকে দুটো পনিরের টুকরো বের করে মুখে পুরে দিলাম। কয়েকটা পশু-খাবারের ব্যাগও রাখা আছে। ওখান থেকে দুটো বের করে ল্যাসিকে দিলাম। ব্যাটা একেবারে গিলে ফেলল খাবারগুলো।

“কিরে, তুই তো ঠিকমতো চাবালিও না।”

মিয়াও।

“না, এখন আরো দিলে তোর ক্ষিধে নষ্ট হয়ে যাবে।”

মিয়াও।

“আচ্ছা, তুই কোন কিছু খুঁজে পেলে তোকে আরো দুটো দেব, যাহ!”

মিয়াও।

“সাতটা?! না তিনটা।”

মিয়াও।

“চারটা, এর থেকে একটাও বেশি না।”

মিয়াও।

“আচ্ছা যা, পাঁচটা।”

ব্যাটা লাফ দিয়ে টেবিলটা থেকে নেমে অন্য ঘরগুলোর দিকে হাটা দিল।

প্রেসিডেন্ট যদিও ঐ রাতের ঘটনাগুলোর ব্যাখা দিয়েছে, কিন্তু আমি এখনো এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না, সে খুনটার সাথে জড়িত নয়। তবে সে আমাকে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করে দিয়েছে এটা স্বীকার করতেই হবে। না-হলে আমাকে এ মুহূর্তে এখানে পাওয়া যেত না।

যদি প্রেসিডেন্ট আসলেও খুনটা না করে থাকে, তাহলে তো অন্য কেউ একজন নিশ্চয়ই জানতো তিনি ঐ রাতে এই বাসায় আসবেন। আমি আশায় আছি, সেই ব্যক্তি হয়ত ভুল করে কোন সূত্র পেছনে ফেলে রেখে গেছে, যেটা আমার চোখে পড়বে।

লিভিং রুমের দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো দেখতে দেখতেই পাঁচ মিনিট চলে গেল। ক্লেমেনদের বয়স ষাট-পয়ষট্টি হবে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে তাদের। আর চারজন নাতি নাতনির ছবিও দেখা যাচ্ছে। এখানে আর কিছু না পেয়ে মাস্টার বেডরুমটাতে চলে এলাম। এখানেও সব আগের মতোই আছে। জেসিকা যে এখানে গত তিনমাস ধরে থাকতো তার কোন চিহ্নই নেই।

ক্লোজেটের কাপড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে সেগুলোও ক্লেমেনদের। আচ্ছা, ওরা মেয়েটাকে বাসা ভাড়া দেয়ার সময় কি এমন দেখেছিল যে নির্দ্বিধায় ভাড়া দিয়ে দিল, তা-ও তাদের সব জিনিসপত্র ভেতরে থাকা অবস্থাতেই। অবশ্য রে এটা বলেছিল, ভাড়াটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই পাচ্ছিল তারা। তবুও, মেয়েটা নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্টের উপর যে জাদু চালিয়েছিল তার কিছুটা ঝলক এই বুড়ো বুড়িকেও দেখিয়েছিল।

ক্লোজেটের নিচের তিনটা ড্রয়ার জেসিকার। তার কাপড়চোপড়গুলো উল্টেপাল্টে দেখলাম। একটা ড্রয়ারে তার শার্ট আর জিন্সের প্যান্টগুলো ভাজ করে রাখা। আমি জিন্সের পকেটগুলোতে হাত ঢুকিয়ে দেখতে লাগলাম। পাঁচ নম্বর প্যান্টটার পকেটে একটা কাগজের টুকরা খুঁজে পেলাম। একটা রশিদ, ভাজ করা।

রশিদের উপরে লেখা ‘বেস্ট পন শপ। এটা একটা পুরনো জিনিসপত্র বেচাকেনার দোকানের। জেসিকা তাদের কাছে ১২০০ ডলারে কিছু বিক্রি করেছিল।

মিয়াও।

“দেরি করে ফেলেছিস তুই, আমি পেয়েছি এটা আগে।”

মিয়াও।

“আচ্ছা, আচ্ছা।”

ওকে আরো দুইটা স্লাইস দিলাম।

মিয়াও।

“হুম, ওয়েলকাম।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাসায় ফিরে গেলাম আমরা।

*

“এটা এখানেই, বামদিকে কোথাও।”

“ঐ নিয়ন সাইনটার নিচের দোকানটাই না?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

‘বেস্ট পন শপ দোকানটা ওয়াশিংটন ডিসির সবচেয়ে ঘিঞ্জি এলাকাগুলোর একটায়। আমার বাসা থেকে এখানে আসতে প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিটের মত লেগেছে। আমি গাড়িতেই খেয়ে নিয়েছি। পেছনের সিটে ল্যাসি আর মারডক বসা। বাবা যখন মাঝ রাতের দিকে আমার বাসায় ঢোকেন তখন নাকি ল্যাসি জেগেই ছিল। মারডক আর ল্যাসির প্রথম মোলাকাতটা অবশ্য সুবিধার ছিল না, কারণ মারডক আগে কখনও বিড়াল দেখেনি। তাই ঢুকেই ল্যাসিকে তাড়া করতে শুরু করে ও। ওদের দুজনের হুটোপুটিতে নিচের তলা থেকে লোক উঠে এসেছিল। বাবা তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার নিচে পাঠিয়ে দেন। ঐ সময় হঠাৎ করেই নাকি মারডক চুপ করে যায়। বাবা ঢুকে দৃশ্যটা দেখে অবাক না-হয়ে পারেন না। দেখেন, ল্যাসি তার খাবারের প্যাকেটগুলোর একটা মারডকের সামনে ফেলে দিয়েছে আর গর্দভটা সেটা থেকে খাচ্ছে। এরপরেই দু-জনে বন্ধু হয়ে যায়।

দুইঘন্টা পরে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি, তখন লিভিং রুমে গিয়ে দেখি দু-জনই ঘুম। মারডকের বড় একটা থাবা ল্যাসির উপর রাখা।

“ভুলে যাস না, তুই আমার সাথে থাকিস,” পেছনে ঘুরে বললাম। ল্যাসি এখন মারডকের পেটের উপর আরামসে হেলান দিয়ে বসে আছে।

মিয়াও।

“না, একসাথে দু-জন বেস্টফ্রেন্ড থাকা চলবে না তোর।”

“তুমি ঠিক আছে?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে দোকানটার দিকে ইঙ্গিত করলাম।

“তুমি কি নিশ্চিত, ওটা এখন খোলা?”

“রশিদে লেখা আছে, দোকানটা চব্বিশ ঘন্টাই ভোলা থাকে।”

দোকানের বাইরে কয়েকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের দেখে বেশি সুবিধার মনে হল না।

“আমি সাথে আসব তোমার?” ওদের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলেন বাবা।

“না, আপনি গাড়িতেই থাকেন।”

আামি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। এমন ভাব দেখালাম যেন আমার পকেটে কোন কিছু নেই। লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে দোকানের দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

কাউন্টারের পেছনে লম্বাচুলো এক লোক দাঁড়িয়ে। চুলগুলো আবার উঁচু করে ঝুঁটি করে রাখা হয়েছে। জায়গাটার সাথে তাকে একেবারে মানিয়ে গেছে।

“কি করতে পারি আপনার জন্যে?” আমাকে সামনে আগাতে দেখে জিজ্ঞেস করল সে।

আমি পকেট থেকে রশিদটা বের করে তার হাতে দিলাম, “আমার গার্লফ্রেন্ড এই জিনিসটা এখানে বিক্রি করে দিয়েছিল। আমি সেটা আবার কিনতে চাচ্ছি এখন।”

আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রশিদটার দিকে মনোযোগ দিল সে। কাগজটার এক কোণায় একটা কোড লেখা।

আমার কোন ধারণাই নেই জিনিসটা কি। যেকোন কিছু হতে পারে। আমি শুধু আশায় আছি যে জিনিসটা কোন না কোনভাবে খুনির সাথে জড়িত। যে জেসিকাকে শুধু খুনই করেনি, বিশ লাখ ডলারও চুরি করে নিয়ে গেছে।

“আমাকে একটু দেখতে দিন,” এই বলে সে কাউন্টারের নিচের তাকে দেখতে লাগলো।

“আপনার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, জিনিসটা এখনও এখানেই আছে, এই বলে সে একটা ঘড়ি বের করে কাউন্টারের উপর রাখল।

ঘড়িটা রূপালি, সাথে চামড়ার বেল্ট। দেখেই বোঝা যায় জিনিসটা দামি।

“সুন্দর ঘড়ি,” লোকটা বলল। আমি মাথা নাড়লাম। “এটাই চাইছিলেন আপনি?”

“হ্যাঁ, এটাই। যে মেয়ে এটা বিক্রি করেছিল তার কিছু কথা মনে আছে আপনার?”

“আমি তখন এখানে ছিলাম না। জন ডিউটিতে ছিল সে-সময়। আর সে-ই আমাকে বলেছিল, এক সুন্দরি এসে নাকি এই ঘড়িটার জন্যে দশ হাজার ডলার দাম হাঁকে। কি মনে হয় আপনার, সেই মেয়েটার কথাই তো বলছিলেন আগে?”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কিন্তু মনে মনে জেসিকার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। সে দশ হাজার ডলার দাম চেয়ে শেষে ১২০০ ডলারেই বিক্রি করে দেয় ঘড়িটা। টাকাগুলো নিশ্চয়ই খুব দরকার ছিল তার।

“আমাকে কত দিতে হবে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“আপনি কত দিতে চান?”

“তিন হাজার।”

সে একটা হাসি দিয়ে বলল যে ঘড়িটার দাম নাকি এর প্রায় তিনগুণ।

“সাড়ে তিন হাজার।”

আবার হাসি দিল সে।

“চার।”

এবার হাসিটা একটু কম।

“সাড়ে চার।”

মুখ দেখে মনে হল, প্রায় রাজি হয়ে যাবে।

“পাঁচ।”

“আচ্ছা।”

আমি নোটগুলো তাকে দিয়ে দিলাম। সে ঘড়িটা প্যাকেটে ভরে আমার দিকে এগিয়ে দিল। ঠিক এই সময় আমার মনে হল ঘড়িটা হয়ত ক্লেমেন বুড়োটারও হতে হবে। পকেটে ঘড়িটা রেখে দোকান থকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়লাম।

“পেয়েছ জিনিসটা?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ,” বলে ল্যাসির দিকে তাকালাম। “তোকে নিয়ে গেলে পারতাম। আরো ভালো দামাদামি করতে পারতি তুই। ঐ ব্যাটা আমাকে ছিলে দিয়েছে।”

মিয়াও।

“না, তুই গেলে পঞ্চাশ ডলারে এটা উদ্ধার করে আনতে পারতি না।”

বাবা দেখতে চাইলো ঘড়িটা কিন্তু বাইরের লোকগুলো এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

“তাড়াতাড়ি চলেন এখন এখান থেকে। পরে দেখাচ্ছি।” ঘড়িতে বাজে তিনটা তেপ্পান্ন।

পাঁচ মিনিট পরে অন্য এক এলাকায় রাস্তার পাশে বাবা গাড়িটা থামালে তাকে দেখালাম ঘড়িটা।

“বাহ, সুন্দর ঘড়ি,” তিনি বললেন। কিন্তু তখন আমি ব্যস্ত ঘড়িটার পেছন দিকে খোদাই করা লেখাগুলো পড়তে।

“আদরের রিস্কিকে, তোমার স্বপ্নগুলো যেন সত্যি হয়। বাবা ও মা,” জোরে জোরে পড়লাম আমি।

শুনে বাবার ভুগুলো কপালে উঠে গেল। “কি?”

“আমার মনে হয় আমি জানি ঘড়িটা কার।”

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

তিনি বললেন, রিকি আসলে লোকটার ডাক নাম। আসল নামটাও বললেন, “রিকি সুলিভান।”

প্রেসিডেন্টের ছেলে!

*

১২.

কয়েক বছর আগে একবার যখন আমি গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বাবা চেষ্টা করেছিলেন আমাকে ঐ অবস্থাতেই আমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেয়ার। কিন্তু খুব সহজ ছিল না কাজটা। উপরে উঠতে উঠতে দু-বার আমাকে সুদ্ধই পড়ে গিয়েছিলেন। আর আমার নিচেরতলার প্রতিবেশি পুলিশে ফোন দিয়েছিল এই ভেবে, তিনি আমার মৃতদেহ লুকিয়ে রাখছেন ওখানে! এরপর থেকে আমি কখনও গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়লে বাবা আমাকে ওখানেই রেখে দেন। আর গাড়ির সিটটা নিচু করে দিয়ে আমার গায়ে একটা কম্বল দিয়ে দেন যাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি। আমার মনে হয় প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় এসে একবার করে দেখেও যান।

তিনটার একটু পর ঘুম থেকে উঠে আমার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি বাবা, ল্যাসি আর মারডক তিনজনই আমার বিছানায় শুয়ে আছে জড়াজড়ি করে। ল্যাসি আর মারডক আমাকে দেখেই উঠে এলো।

“কিরে, কাল ঠিকমতো মজা করেছিস তো দুজন মিলে?” দুজনকেই আদর করে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে দু-জনেই চেটে দিল আমাকে একবার করে।

“মজা করবে না আবার? দুজনের ভাব দেখলে মনে হয় যেন ছোটকালে হারিয়ে যাওয়া দুই ভাই,” বাবা ওদের হয়ে জবাব দিলেন।

“আপনি কি থাকবেন আজকে?” জিজ্ঞেস করলাম বাবাকে।

“নাহ, চলে যাব। কাল কিছু জরুরি কাজ পড়ে গেছে।”

“বুধবার আসবেন তো আবার?”

“অবশ্যই। ঘড়িটা নিয়ে কি করবে কি ঠিক করেছ?”

“এখনো জানি না। একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখি। প্রেসিডেন্টের ছেলে যদি কোনভাবে এর সাথে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই এর শেষ দেখে ছাড়ব আমি।”

কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগেই বাবা আমাকে রিকি সুলিভান সম্পর্কে যা যা জানেন সব খুলে বলেন। প্রেসিডেন্টের এই একমাত্র ছেলের স্বভাব চরিত্র হলিউডের কোন নায়কের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কনর সুলিভান। যখন গভর্নর ছিল তখনও বেশ কয়েকবার উশৃঙ্খল জীবন-যাপনের খবরে এসেছিল রিকি। যদিও কখনও গ্রেফতার হয়নি সে। দুইটা জিনিস খুব পছন্দ তার-দামি গাড়ি আর সুন্দরি নারী। আর তার বাবা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই দুটো জিনিসের প্রতি তার আকর্ষন আরো বেড়েছে বলতে হবে। সঙ্গত কারণেই তাকে তুলনা করা হয় ইংল্যান্ডের প্রিন্স হ্যারির সাথে। আর দু-জন আসলেও বন্ধু ছিল। তবে গত এক বছর ধরে বড় ধরণের কোন খবরে আসেনি সে। জর্জটাউন ল কলেজে তার দ্বিতীয় বছর নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা এখন তার।

“আরেকটা জিনিস কালকে বলতে ভুলে গেছি তোমাকে, প্রেসিডেন্টের ছেলে সম্পর্কে। তার একটু জুয়ার নেশা আছে,” বাবা বললেন।

আমি মাথা নাড়লাম।

“দুই বছর আগে খবরে আসে জুয়ায় প্রায় আশি হাজার ডলার হেরে গলা পর্যন্ত ধার-দেনায় ডুবে আছে সে। আর তুমি বলছিলে, মেয়েটার বাসা থেকে নাকি বিশ লাখ ডলারও হারিয়ে গেছে।”

ব্যাপারটা আমার মাথায়ও ঘুরছিল, “আমার মনে হয় আপনি যেটা বলতে চাচ্ছেন তাতে যুক্তি আছে।”

“যাই হোক, আমার এখন যাওয়া উচিত,” এই বলে উঠে দরজার দিকে এগোতে শুরু করলেন তিনি। মারডকও পিছু নিল তার, যদিও ব্যাটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আছে।

“ল্যাসি তোর বন্ধুকে বিদায় জানা এখন,” এই বলে কোলে তুলে নিলাম ওকে।

মিয়াও।

“না, ও থাকবে না।”

মিয়াও।

“কারন তোদের একা ছেড়ে দিলে বাসাটার অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দিবি লাফালাফি করে।”

মিয়াও।

“আর ও দু-দিন পরেই আবার আসবে। তখন যত খুশি মজা করিস।”

মিয়াও।

“পিজা? আচ্ছা, সেটা দেখা যাবে!”

বাবা মারডকের কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। একটু পর নিচ থেকেও মারডকের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আজকে ওকে গাড়িতে তুলতে বেশ কষ্ট হবে বাবার।

*

আমি আর ল্যাসি খেতে বসব ঠিক এই সময়ে কে যেন আমার দরজায় নক করল।

এখন বাজে তিনটা এগার।

দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। ভেবেছিলাম বাবাই হয়ত ফেরত এসেছেন কিছু নিতে।

দরজাটা খুলে দিলাম।

“আপনার সমস্যাটা কি, মি বিনস?!”

“আপনাকেও শুভেচ্ছা ডিটেক্টিভ রে!”

ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রেগে আছে। কালো রঙের একটা টিশার্ট আর একটা জিন্সে অসাধারণ লাগছে তাকে। রেগে যাওয়াতে আরো বেশিই যেন সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।

“এফবিআইর কাছে যাওয়ার কি দরকার ছিল আপনার?” ঐ একই স্বরে জিজ্ঞেস করল সে।

“এফবিআই?”

সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন কিছু চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে গেছি আমি।

“আমি জানি না আপনি কি বলছেন?”

“সত্যিই জানেন না?” ভুজোড়া কপালে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“না।”

“কাল সকালে,” বলে একটু থামলো রে, “কাল সকালে ওরা প্রেসিডেন্টকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করবে।”

*

“কি?!”

“ক্যালি ফ্রেইগের আসল নাম ক্যালি ফ্রেইগ না।”

আমি এমন ভাব ধরলাম যেন খুব অবাক হয়ে গেছি কথাটা শুনে। চোখ বড় বড় করে মুখ হা-করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

“অজ্ঞাত পরিচয়ের কে যেন এফবিআইকে ফোন করে বলেছে : নাম বদলে ফেলার আগে ক্যালির আসল নাম ছিল জেসিকা রেনয়। আর সে নাকি প্রেসিডেন্টের গভর্নর নির্বাচনের সময় ভার্জিনিয়ায় তার সাথে কাজ করত। এটাও বলেছেন, প্রেসিডেন্টকে ঐ রাতে জেসিকার বাসা থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছে সে।”

আমার দিকে এমনভাবে তাকালো রে যেন সব দোষ আমার।

“সেটা আর যে-ই হোক না কেন, আমি না,” নিশ্চিত করলাম তাকে। “কিন্তু এফবিআই যা বলেছে আমার কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে আরো তথ্য আছে ওদের কাছে।”

“আসলেও আছে,” বলে জোরে একবার শ্বাস নিল রে।

“কনর সুলিভান যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়, রুটিন কিছু চেক আপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাকে। এরমধ্যে একটা হল তার ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা। পুলিশের ডাটাবেজে এটা নেই অবশ্য। কিন্তু এফবিআই’র কাছে ঠিকই আছে। তারা জেসিকার বিছানায় পাওয়া কিছু চুলের সাথে মিলিয়ে দেখে সেটা। একশ ভাগ মিল পাওয়া গেছে রেজাল্টে।”

এবার আমাকে আর বিস্ময় গোপন করতে হল না।

“একটা সৌজন্য ফোন অবশ্য দিয়েছিল তারা আমাদের ক্যাপ্টেনের কাছে। কারণ খুনের তদন্তের দায় তো আসলে আমাদের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টেরই।”

“আপনাদের ক্যাপ্টেন কি বললেন জবাবে?”

“কি আর বলবে সে? ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গ্রেফতারের সুযোগটা হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে তার। আমাকে আর ক্যালকে ডেকে যখন সব খুলে বললেন তিনি, অবস্থা বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছিল না।”

“ক্যালের চেহারাটা নিশ্চয়ই দেখার মত হয়েছিল?” ও ব্যাটা তো শুরু থেকে আমাকে দোষি মনে করে আসছিল।

“সে এখনো ভাবছে এসব গাঁজাখুরি গপ্পো ছাড়া আর কিছু না। এটা প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ডেমোক্রেটদের একটা চাল মাত্র।”

“গাধা!”

দু-জনেই চুপ করে গেলাম কিছু সময়ের জন্যে। তার মাথায়ও নিশ্চয়ই একই জিনিস ঘুরছে আমার মতো। প্রেসিডেন্টের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটা নাইন ইলেভেনের পরে এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় খবর হতে যাচ্ছে। মিডিয়া লুফে নিবে এটা।

“তার সাথে আমার কথা হয়েছে,” বললাম।

“কার সাথে?”

“প্রেসিডেন্টের।”

“তাই, না? কনর সুলিভানের সাথে কথা হয়েছে আপনার! এটাও বিশ্বাস করতে বলেন আমাকে!”

“আসলেও হয়েছে। দুই রাত আগে।”

“খুলে বলুন তো সব, কিছু বাদ দিবেন না।”

সব কিছুই শুরু থেকে আবার বললাম তাকে। একদম শুরু থেকে। “তো, ল্যাসি আসলে আমার নিজের বিড়াল না। মানে এখন আমার, কিন্তু আগে ওর মালিক ছিল জেসিকা রেনয়,” এটুকু বলে থামলাম।

এরপরের দশ মিনিটে গত কয়েক রাতের ঘটনা খুলে বললাম তাকে।

“তো জেসিকা আসলে প্রেসিডেন্টকে ব্ল্যাকমেইল করছিল?”

“তাই তো বললেন তিনি।”

“আর ঐ ভিডিও টেপটা কোথাও ফাঁস হয়ে যায়নি?”

“আমার তো মনে হয়, যদি ওরকম রগরগে একটা ভিডিও ফাঁস হয়ে যেত তাহলে মঙ্গল গ্রহের লোকজনও জানতো ওটার কথা।”

“তো প্রেসিডেন্ট ঘটনার রাতে জেসিকার বাসায় যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এরপর তিনি ব্ল্যাকমেইলের টাকাগুলো জেসিকাকে দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। আর পরে অন্য কেউ এসে মেয়েটাকে মেরে টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়?” রে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।

এই অন্য কেউটা প্রেসিডেন্টের ছেলেও হতে পারে। মনে মনে বললাম। মেয়েটার সাথে যে প্রেসিডেন্টের ছেলের যোগাযোগ ছিল এর প্রমাণ তো পেয়েছি আমি। কিন্তু মুখে এসব কিছু বললাম না।

“হয়ত এসবই গাঁজাখুরি কাহিনী, প্রেসিডেন্টই আসল খুনি,” বললাম তাকে।

“আপনার কি আসলেও মনে হয়, প্রেসিডেন্টই খুনটা করেছে? সত্যি কথাটা বলুন।”

প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা হওয়ার রাতটার কথা আবার চিন্তা করলাম। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল সত্যি কথাই বলছিলেন।

“নাহ, সে সত্যি কথাই বলছিল।”

জবাবে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে।

আমার কি হল জানি না। হঠাৎ করে রে’র হাতটা ধরে ফেললাম। সে আমার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো। ঐ বাদামি চোখজোড়া কি চিন্তা করছে আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই।

“এক কাপ কফি খেয়ে যান?”

“এই রাত সাড়ে তিনটায়?” হেসে ফেলল সে। “এখন আমার ঘুমানো উচিৎ, কালকের দিনটায় যা হবে না!”

ল্যাসি লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে এসে রের পায়ে মুখ ঘষতে লাগলো। রে ঝুঁকে ল্যাসিকে আদর করে দরজার দিকে হাটা দিল।

“আপনি কি নির্বাচনে ওনাকেই ভোট দিয়েছিলেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

জবাব না দিয়ে আমার দিকে দুষ্টু একটা হাসি দিল শুধু সে।

“কফিটা পাওনা রইল।”

*

১৩.

চোখ খোলার দশ সেকেন্ডের মধ্যে ল্যাপটপ চালু করে ইন্টারনেটে বসে গেলাম।

‘প্রেসিডেন্ট গ্রেফতার!’

‘খুনের দায়ে প্রেসিডেন্ট গ্রেফতার!’

‘প্রেসিডেন্ট সুলিভান একজন খুনি?!

‘মার্ডারগেট।‘

এ তো শুধু কয়েকটা শিরোনামের নমুনা। পুরো ইন্টারনেট ছেয়ে গেছে প্রেসিডেন্টের গ্রেফতারের খবরে।

একটা ভিডিওতে ক্লিক করে দেখলাম প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার করে গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। অন্তত পনেরজন এফবিআই এজেন্ট তাকে ঘিরে রেখেছে। আরেক জায়গায় দেখলাম এফবিআই প্রধান সংবাদ সম্মেলন করে প্রেসিডেন্টের গ্রেফতার হওয়ার কথাটা জানাচ্ছে। তাকে দেখে স্বভাবতই খুব খুশি মনে হল, কারণ বর্তমান সরকারের ঘোরবিরোধি সে। বার বার এটাও বলছে, “কেউই আইনের উর্ধে নয়! স্বয়ং প্রেসিডেন্টও।”

টিভির টকশোগুলোও জমে উঠেছে এই খবর নিয়ে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর এটাই সবচেয়ে বড় ধরণের কেলেঙ্কারি মিডিয়ার মতে। আর সচরাচর তো কোনও প্রেসিডেন্ট খুনের দায়ে গ্রেফতারও হন না। সিনেট হাউজ জরুরি বৈঠক ডেকেছে। হোয়াইট হাউস থেকেও জরুরি বিবৃতি এসেছে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের জন্যে যে, “একজন সাধারণ নাগরিক জেসিকা রেনয়ের খুনের অভিযোগের প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” মোদ্দা কথা, প্রেসিডেন্ট এখনও পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি, কিন্তু পায়ের নিচের মাটিটা বেশ নড়বড়ে এখন তার।

“তোর কি মনে হয় রে? প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে ওরা?”

জবাবে ল্যাসি মাথাটা এক দিকে কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। দেখে মনে হল যেন ভেবে দেখছে ব্যাপারটা মনে মনে।

মিয়াও।

“কি?! ওকে শূলে চড়ানো উচিৎ?”

মিয়াও।

“হাতদুটো কেটে ফেলবে?”

মিয়াও।

“বুঝতে পারছি, আজ থেকে তোর গেম অব থ্রোন্স দেখা বন্ধ।”

ফ্রিজ থেকে কিছু খাবার বের করে নিয়ে এসে আবার ল্যাপটপের সামনে বসে গেলাম। রিকি সুলিভান’ লিখে গুগলে সার্চ দিলাম।

বাবা আমাকে রিকি সুলিভান সম্পর্কে যা যা জানিয়েছিলেন তার বেশি খুব কমই আছে ইন্টারনেটে। রিকি সুলিভান সম্পর্কে সর্বশেষ আপডেটটা দেখলাম বার ঘন্টা আগের। ছুটি কাটাতে ব্যস্ত সে এখন।

আপডেটটা পুরোপুরি পড়ে বাবাকে ফোন দিলাম, “গাড়ি নিয়ে এখানে এসে পড়েন এখনই। লাস ভেগাস যাচ্ছি আমরা।”

*

গাড়িতে করে আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে লাস ভেগাস যেতে প্রায় চৌত্রিশ ঘন্টার মত সময় লাগার কথা।

আমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি আমরা কলোরাডো পার হচ্ছি।

“ঘুম ভাঙলো তাহলে,” বাবা রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন।

হালকা মাথা নেড়ে জবাব দিয়ে পেছনে তাকালাম।

“কিরে, কি খবর তোদের?”

ল্যাসি আবারো মারডকের পেটের উপর বসে আছে। ব্যাটা লাফ দিয়ে একবার আমার কোলে এসে আমার মুখটা সুন্দরমত চেটে দিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল। মারডকও মনে হল বেশ খুশি ব্যাপারটা নিয়ে।

“একঘন্টার জন্যে গাড়ি চালাবে নাকি?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

“অবশ্যই।”

একটু পরেই আমরা জায়গা অদলবদল করে নিলাম। তিন মাইল যেতে না যেতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

গাড়ি চালানো অবস্থাতেই ফোনটা বের করে ইন্টারনেট চালু করলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম। কনর সুলিভানের একটা ভিডিও, তার হোয়াইট হাউজের অফিসে। সংবাদ সম্মেলনে জাতির উদ্দেশে কথা বলছেন তিনি।

“প্রিয় দেশবাসি, এই মুহূর্তে আমি আপনাদের সামনে এসেছি একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, বরং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে,” এই বলে কিছুক্ষণ থামলেন তিনি। “আমাকে একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িত করার প্রচেষ্টা চলছে। আমার বিরুদ্ধে ভুল অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এই দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে, আমি এ-ও জানি, শেষ পর্যন্ত আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব। বরং এই বিষয়ে আমি গর্বিত যে আমাকে তদন্তের খাতিরে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেকবার প্রমাণিত হল, এ দেশে কেউই আইনের উর্ধে নয়। আশা করি আপনারা খুব তাড়াতাড়ি সত্যটা জানতে পারবেন। ঈশ্বর আমাদের জাতির মঙ্গল করুন।”

খারাপ বলেনি কিন্তু। খুব বেশিক্ষন মনে হয় না হাজতে থাকবে সে। একদিন পুরো হওয়ার আগেই জামিন হয়ে যাবে তার।

আমার দেখার বিষয় এটা ছিল না। আমি খেয়াল করছিলাম সংবাদ সম্মেলনের সময় তার পেছনে কে কে আছেন। তার স্ত্রীকে দেখতে পেলাম। কিন্তু ছেলেকে কোথাও দেখলাম না। যাক, এটাই দরকার আমার।

ফোনটা রেখে দিয়ে পুরোপুরি রাস্তায় মনোনিবেশ করলাম এরপর। পাহাড় আগেও দেখেছি আমি কিন্তু এরকম চাঁদের আলোতে বরফাচ্ছন্ন পাহাড়ের চূড়া দেখিনি কখনও। স্বর্গীয় দৃশ্য।

তিনটা আটান্নর সময় গাড়িটা রাস্তার পাশে রেখে বাবাকে ডেকে তুললাম। বাবা ড্রাইভিং সিটে বসলেন আর আমি আগের জায়গায় ফিরে গেলাম।

পরের বার একেবারে লাস ভেগাসের ঝলমলে আলোয় ঘুম ভাঙবে আমার।

*

১৪.

লাস ভেগাসে ১২২টা ক্যাসিনো, ৮৭৪টা নাইটক্লাব, দু-হাজারের ওপরে রেস্টুরেন্ট আর প্রায় পঞ্চাশটার ওপরে স্ট্রিপ ক্লাব আছে। কোনকিছুই রাত চারটার আগে বন্ধ হয় না। আর রিকি সুলিভান এ মুহূর্তে এর যেকোন একটাতে থাকতে পারে। তা-ও যদি এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের হাত থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে না গিয়ে থাকে সে।

প্রায় ছয়ঘন্টা আর তিনশো ডলার খরচ করার পর বাবা অবশেষে রিকি আর তার কিছু বন্ধুকে একটা নাইটক্লাবে খুঁজে পান।

তিনটা ছয়ে বাবা ঐ নাইটক্লাবের সামনে গাড়িটা পার্ক করে রাখার সাথে সাথে লাফিয়ে নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। প্রায় বিশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলাম আমি।

ঢুকেই চোখটা ধাধিয়ে গেল লাল নীল আলোয়। জোরে জোরে ডিস্কো গান বাজছে স্পিকারে। ঘামের গুমোেট একটা গন্ধ। নানা বয়সি ছেলে মেয়েতে ভর্তি জায়গাটা। আমি ভিড় ঠেলে কোনমতে সামনে এগুতে লাগলাম। পুরো শরীরে ঠিক ছয় ইঞ্চি কাপড় পরা এক মেয়ে এগিয়ে এসে আমার কানে কানে কিছু কথা বলল। যত তাড়াতাড়ি পারলাম সরে যেতে চাইলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু আমার হাতটা ধরে ড্যান্সফ্লোরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল সে। ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম হাতটা।

একবার ভালোমত তাকালাম তার দিকে। একেবারে খারাপ না দেখতে, ফিগারও সেই রকম। কিন্তু পরমুহূর্তেই ডিটেক্টিভ রে’র কথা মনে হতে ঝেড়ে ফেললাম মাথা থেকে মেয়েটাকে। রে’র সাথে কারোরই তুলনা চলে না।

অবশেষে যখন বারের কাছে পৌঁছুলাম তখন বাজে তিনটা চৌত্রিশ।

“রিকি সুলিভান কোথায়?” চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম বারের পেছনে যে লোকটা বসে আছে তাকে।

সে পাত্তাই দিল না আমাকে। এই একই প্রশ্ন হয়ত আরো অনেকেই করেছে আজকে তাকে। একশো ডলারের নোট বের করে বারের উপর রাখলাম। নোটটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে মাথা দিয়ে ডানদিকে একবার ইঙ্গিত করল শুধু। এরপর অন্য এক কাস্টমারের কাছে চলে গেল সে।

ভিড় ঠেলে ভিআইপি টেবিলে পৌঁছুতে আরো চার মিনিট চলে গেল আমার। ঐ দিকে একটা মোটা দড়ি দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। দুজন গাট্টাগোট্টা বডিগার্ড পাহারা দিচ্ছে সামনে। সুন্দর করে সাজানো দশটা টেবিলে বসে থাকা লোকজনের মধ্যে অনেক সেলেব্রিটিকেও দেখতে পেলাম। তিনজন ফুটবল তারকা, দু-জন গায়ক, একজন নামকরা কমেডিয়ান, একজন সুপারমডেল আর প্রেসিডেন্টের ছেলেও আছে তাদের মধ্যে।

তারই বয়সি আরো দুজন ছেলের সাথে বসে আছে সে, আর তাদের ঘিরে রেখেছে আটজন সুন্দরি মেয়ে। একটা দামি সোফায় তারা সবাই। তাদের সামনে অন্তত কয়েক হাজার ডলারের মদের বোতল আর অন্য জিনিসপত্র রাখা। কালো স্যুট আর সানগ্লাস পরা অবস্থায় তিনজনকে দেখতে পেলাম রিকির পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। সিক্রেট সার্ভিসের লোক হবে।

তাদেরকে দেখে খুবই সাবধান বলে মনে হল। গত আটচল্লিশ ঘন্টায় বোধহয় অনেক লোককে আটকাতে হয়েছে তাদের।

আমি আরো সামনে এগোতেই ক্লাবের বডিগার্ড দু-জন আমাকে আটকে দিল। একজন আমার হাত দেখতে চাইলো। ভিআইপি জোনে ঢোকার জন্য বিশেষ অনুমতি হিসেবে কব্জিতে সবুজ রঙের একটা ব্যান্ড লাগাতে হয় ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিনে।

এই মুহূর্তে আমার হাতেও আছে একটা।

এটা ড্যান্সফ্লোর থেকে দুইশ ডলার দিয়ে এক মেয়ের কাছ থেকে কিনেছি। সুন্দরমত আমার হাতে লেগে যায় ব্যান্ডটা।

দড়িটা সরিয়ে আমাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হল।

আরো চারটা টেবিল পার হয়ে রিকি যে-ই টেবিলটা আছে তার কাছে গেলাম। সাথে সাথে সিক্রেট সার্ভিসের দু-জন এসে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো।

“কি খবর?” জিজ্ঞেস করলাম আমি, যেন কতদিনের চেনা আমার।

কিছুই বলল না ওরা।

“আমি শুধু রিকির সাথে দুই মিনিট কথা বলতে চাই।”

একে অন্যের দিকে একবার তাকালো দুজন।

“ভাগো এখান থেকে।”

“রিকি,” এই বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। ফিরেও তাকালো না ছেলেটা।

সিক্রেট সার্ভিসের একজন আমাকে ধাক্কাতে শুরু করল।

আমি পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে ছুঁড়ে মারলাম। রিকির পাশে যে মেয়েটা বসে আছে একদম তার কোলে গিয়ে পড়ল ওটা।

ঘড়িটা হাতে নিতে নিতে আমার দিকে একবার তাকালো রিকি।

“আসতে দাও ওকে,” সিক্রেট সার্ভিসের লোকটাকে বলল সে। এই মুহূর্তে ব্যাটা আমার হাতটা পেছনের দিকে মুড়িয়ে পিঠের সাথে ঠেস দিয়ে রেখেছে শক্ত করে।

“বললাম, ছেলেটাকে আসতে দাও এখানে!,” এবার আগের চেয়ে আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো রিকি।

আমি সিক্রেট সার্ভিসের লোকটার কাছ থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রিকির টেবিলের দিকে এগোতে লাগলাম। এরইমধ্যে তার টেবিলের অন্য সবাইকে চলে যেতে বলেছে সে। শুধু আমি রিকি আর ঘড়িটা এখন টেবিলে।

ওর থেকে দুই ফুট দূরে বসে পড়লাম। সামনে রাখা ভদকার বোতল থেকে একটু ভদকা একটা গ্লাসে ঢেলে নিয়ে চুমুক দিলাম।

“তুমি এটা কোথায় পেয়েছ?”

মুখ তুলে রিকির দিকে তাকালাম। রিকি সুলিভানের চোখটা অবিকল তার মায়ের মত। আর বাকি সব দিক থেকেই বাবার সাথে মিল। যদিও গত কয়েক বছরে কয়েক কেজি ওজন কমেছে ওর তবুও মোটার দিকেই দৈহিক গড়ন।

“এটা আমি পেয়েছি একটা দোকান থেকে, যেখানে জেসিকা এটা বিক্রি করে দিয়েছিল,” বললাম তাকে।

জবাবে নাক দিয়ে একটা আওয়াজ করল শুধু সে।

“কখন নিয়েছিল জেসিকা এটা?”

জবাব দেয়ার আগে আরেকবার গ্লাসে ভদকা ঢেলে নিয়ে লম্বা একটা চুমুক দিল সে, “প্রায় দু-মাস আগে।”

“তুমি জানতে সে এটা নিয়ে গেছে?”

“জানতাম। কিন্তু তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি। ভেবেছিলাম, মেয়েটার কিছু টাকার দরকার ছিল খুব। আর সে শুধু এই একটা জিনিসই নেয়নি।”

“ওর সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছিল?”

“ক্যাম্পাসে একটা কফিশপে। বলেছিল, আমার সাথে কোন একটা ক্লাসে যেন আছে সে। দেখেই বুঝেছিলাম মিথ্যা কথা বলছে, কিন্তু পাত্তা দেইনি, কাঁধটা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল রিকি। “আমার দেখা সব চেয়ে সুন্দর ফিগারের মেয়ে ছিল সে, আর চেহারাটাও দারুণ।”

এরপর রিকি আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কে। কিন্তু এড়িয়ে গেলাম প্রশ্নটা।

“তুমিই কি খুন করেছ মেয়েটাকে?”

চোখটা বড় বড় হয়ে গেল রিকির। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। পানি গড়াতে লাগলো দুই গাল বেয়ে।

“না!” নাক টানতে টানতে বলল সে। “জেসিকাই একমাত্র মেয়ে যাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম আমি।”

“মেয়েটার সাথে যে তোমার বাবার যোগাযোগ ছিল এটা জানতে?”

“না, অতীত নিয়ে কোন কথাই বলত না মেয়েটা,” মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল। “আমার সাথে বিছানায় সময় কাটাতেই পছন্দ করত সে। অন্তত প্রথম দিকে এরকমই ছিল ব্যাপারটা। আমিও ভেবেছিলাম প্রেসিডেন্টের ছেলের সাথে ওঠা বসা আছে তার এটুকুতেই খুশি সে। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল আসলেও আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে,” এই বলে বোকার মত একটা হাসি দিল সে, যেন সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারেনি অমন একটা মেয়ে ভালোবাসবে তাকে।

“কখনও ওর বাসায় গিয়েছিলে?”

“না, আমি জানতামও না সে কোথায় থাকে। “ডেভ আর জেরি,” এই বলে সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট দু-জনের দিকে ইঙ্গিত করল সে। “ওরাই আমাদের দেখা সাক্ষাতের সব ব্যবস্থা করে দিত।”

“তোমাদের সম্পর্কটা ছিল কতদিনের?”

“তিন মাস হবে।”

“তুমি ওকে কি নামে চিনতে? ক্যালি না জেসিকা?”

“প্রথম প্রথম তো ক্যালিই বলতাম। কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরে একদিন সে আমাকে বলে তাকে জেসি বলে ডাকতে।”

জেসি?

“আর সে তোমাকে তার অতীত জীবনের কথা কিছুই বলেনি? এই যেমন সে তোমার বাবার নির্বাচনের ক্যাম্পেইনের সময় একজন ভলান্টিয়ার ছিল?”

“না, একবারও না।”

“তাহলে কি নিয়ে কথা হত তোমাদের মাঝে?”

“তেমন কিছু না। এই সিনেমা, গান, বই, এসব নিয়েই। সে কোন ক্লাব পছন্দ করত, কোন দলকে সাপোর্ট করত এইসব টুকিটাকি বিষয়। আর সে তাস খেলতে পছন্দ করত অনেক। ঘন্টার পর ঘন্টা তাস খেলতাম আমরা।”

“সে কি তোমার বাবার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল?”

“প্রথম প্রথম কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। বাবা হিসেবে সে কেমন? আমাকে কেমন সময় দিত? কিন্তু রাজনীতি খুব অপছন্দ ছিল তার। তাই আর বেশি আলোচনা হয়নি।”

“সে যে খুন হয়েছে এটা জানলে কিভাবে তুমি?”

“জেরি এসে আমার আগের ফোনটা নিয়ে যায়। বলে, ক্যালি নাকি খুন হয়েছে তার নিজের বাসাতেই। কিছুক্ষণ পরে একটা নতুন ফোন নিয়ে ফিরে আসে সে।”

এতক্ষনে জেসিকার কললিস্টের ফোন নম্বরটা বন্ধ থাকার রহস্য বুঝতে পারলাম। ওটা প্রেসিডেন্টের ফোন নম্বর ছিল না, ছিল রিকির।

“তোমার কি মনে হয়? জেসির টাকার এত দরকার ছিল কেন যে সে তোমার ঘড়িটা পর্যন্ত বেচে দেয়?” জিজ্ঞেস করলাম।

“জানি না। সে কোন চাকরি করত না। কিন্তু মাস শেষে ভাড়ার টাকা যেন কিভাবে পেয়ে যেত। আমিও জিজ্ঞেস করিনি কখনও কোন কিছু এ ব্যাপারে। জানি, জিজ্ঞেস করাটা উচিত ছিল।”

“তুমি পছন্দ করতে ওকে অনেক, তাই না?”

কিছুই বলল না রিকি। চোখ দেখেই যা দেখার বুঝে নিলাম। আসলেও ভালোবাসতো ও মেয়েটাকে।

“তোমার কি মনে হয়? তোমার বাবাই খুন করেছে ওকে?”

এবারও কোন উত্তর পেলাম না। তা-ও যা যা জানার দরকার তার প্রায় সবই জেনে নিয়েছি। আর আজকের মত আমার সময়ও শেষ প্রায়। আস্তে করে একবার রিকির হাতে চাপ দিয়ে উঠে পড়লাম।

*

এরপরের বার যখন ঘুম ভাঙল তখন চোখ খুলে দেখি গাড়িটা আমার বিল্ডিংয়ের পার্কিংলটে রাখা। গাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা বাসার দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু আসার পথে দেখি অপরিচিত একটা গাড়ি আমার বাসার উল্টাদিকে পার্ক করে রাখা। এটাও মনে হল কেউ বোধহয় নজর রাখছে আমার উপর।

বাবা আর মারডক বের হয়ে গেলে আমি আর ল্যাসি ল্যাপটপের সামনে বসে পড়লাম।

ইমেইল অ্যাকাউন্টে লগ ইন করে দেখি, যে কোম্পানিকে জেসিকা রেনয়ের অতীত সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য টাকা দিয়েছিলাম তারা একটা ইমেইল পাঠিয়েছে। ইমেইল খুলে দেখি খুব কম তথ্যই খুঁজে পেয়েছে ওরা। একটা ক্রেডিট কার্ডের সিরিয়াল, একটা ফোন নম্বর আর ওরিগনের একটা ঠিকানা। কিন্তু সব কিছুই ভুয়া। যেমনটা ছিল ক্যালি ফ্রেইগের ক্ষেত্রে। অবাক হলাম না।

তাহলে এজন্যেই টাকাটা প্রয়োজন ছিল জেসিকার-আগের পরিচয় মুছে ফেলার জন্যে। আগেও করেছে সে এই কাজ। দু-বার।

আমি এই পর্যন্ত জেসিকা নামের চারজনকে দেখেছি আমার জীবনে। কিন্তু এদের মধ্যে কেউই নিজের ডাকনাম জেসি বলে পরিচিতি দেয়নি। জেস বলেছিল একজন। কিন্তু জেসিকার ডাক নাম হিসেবে কেন জানি জেসি মানায় না।

ভার্জিনিয়ার হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যে ওয়েবসাইটে সেখানে গিয়ে জেসি’ লিখে সার্চ দিলাম। কোন ফলাফল আসলো না।

ভুলও হতে পারে আমার।

রিকি মেয়েটা সম্পর্কে কি বলেছিল মনে করার চেষ্টা করলাম। মেয়েটা ফুটবল পছন্দ করত। আর তার পছন্দের দল ছিল টাইগার্স।

মেরিল্যান্ড টাইগার্স!

এবার মেরিল্যান্ডের হারানো বিজ্ঞপ্তির ওয়েবসাইটে ঢুকে সার্চ দিলাম। দুইটা ফলাফল ভেসে উঠলো সামনে।

এর মধ্যে একটা বার বছরের এক ছেলের।

আরেকটা ষোল বছরের একটা মেয়ের। নাম জেসি ক্যালোম্যাটিক্স। ছবিটা বেশ পুরনো। কিন্তু চিনতে অসুবিধে হল না।

এটাই জেসিকা রেনয়। আমাদের ক্যালি ফ্রেইগ।

আরো দুবার গুগল করার পর সব কিছু বুঝতে পারলাম। রিকি যা বলেছিল মনে পড়ে গেল আবার সে জানতে চাইতো প্রেসিডেন্ট বাবা হিসেবে কেমন ছিল।

আমাকে সেদিন গাড়িতে কনর সুলিভান মিথ্যা কথা বলেছিল।

মেয়েটা তাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা ঐ ভিডিওর জন্যে নয় মোটেও। আর তারা একসাথে কোন রাতও কাটায়নি।

বরং জেসিকা তাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল কারণ কনর সুলিভান হচ্ছে তার আসল বাবা।

*

১৫.

আরো তিনদিন (আসলে তিনঘন্টা) লাগলো আমার সবকিছু গুছিয়ে আনতে। তিনঘন্টার প্ল্যানিং আর কিছু ফোনকল।

পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম।

গাড়িটা এখনও আছে বাইরে। নজর রাখছে।

এখন বাজে তিনটা তিন। ঠিক তিনটা চারের সময় সাইরেন শুনতে পেলাম বাইরে।

“এসে গেছে ওরা,”ল্যাসির দিকে তাকিয়ে বললাম।

মিয়াও।

“না, তোকে নেয়া যাবে না এবার। যা করার আমাকে একাই করতে হবে।”

মিয়াও।

“হ্যাঁ। জানি, ব্যাপারটা বিপজ্জনক হবে আমার জন্যে।”

মিয়াও।

“না, তোর ভালো নাম ডেঞ্জার না।”

মিয়াও।

“কারণ আমি তোর ভালো নাম ডেঞ্জার রাখিনি তো বাবা!”

মিয়াও।

“পিস্তল! নাহ, এটাও না।”

মিয়াও।

“না, পিস্তল শুনতে যতটাই ভালো হোক না কেন। আচ্ছা, রজার কেমন হয়?”

মিয়াও।

“কি? আরে, ল্যাসি টিম্বারলেক বিনস শুনতেও ভালো লাগে না অতটা।”

মিয়াও।

“মারডক কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

মিয়াও।

“আচ্ছা, যাহ! ডেঞ্জারই তোর ভালো নাম এখন থেকে।”

মিয়াও।

অ্যাম্বুলেন্সটা আমার বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।

“থাক, তাহলে ল্যাসি ডেঞ্জার বিনস। আমাকে কাজে যেতে হবে এখন। সাবধানে থাকবি, কোনকিছু নষ্ট করবি না আর বাইরেও যাবি না।”

তিন মিনিট পরেই অ্যাম্বুলেন্সটা রাস্তা ধরে তীরবেগে ছুটতে লাগলো।

“হাই,” সারা বলে উঠলো প্যাসেঞ্জার সিট থেকে।

“আবারো ধন্যবাদ তোমাদের,” বললাম আমি।

জবাবে সারার বয়ফ্রেন্ড ক্লে আর তার বন্ধু জেক্যারা একটু আগে আমাকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছিল, দু-জনেই মাথা নাড়ল। “আজকে রোগিও ছিল না খুব একটা।”

“কেউ কি পিছু নিয়েছে আমাদের?”

“হ্যাঁ, আমাদের থেকে অন্তত আরো দুইটা সিগনাল পেছনে ওরা,” সারা বলল।

এক মিনিট পরে সামার পার্কের সামনে অ্যাম্বুলেন্সটা একটু থেমে গেল। আমি দেরি না করে নেমে এক দৌড় দিলাম।

*

জানালায় একবার নক করতেই সে লাফিয়ে উঠলো।

“আপনি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন!” গাড়ি থেকে বের হতে হতে বলল রে।

“আপনি কতক্ষন ধরে বসে আছেন এখানে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“সেই তিনটা থেকে, যেমনটা আপনি বলেছিলেন,” এই বলে একটু থামলো,, “দয়া করে একটু খুলে বলবেন আমাকে ব্যাপারটা?”

আমি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এখন না, পরে। আগে সে আসুক।”

“কে?”

কিছু বললাম না।

দশ সেকেন্ড পরে রাস্তার মাথায় একটা গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ পরে সেটা আমাদের কাছে এসে থেমে গেল।

দরজা খুলে গেলে ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো, “উঠে পড়ুন।”

রে’র ভ্রূদুটো কপালে উঠে গেল। “ওটা কি প্রেসিডেন্টের গাড়ি নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এরপর দু-জনেই গাড়িটার পেছনের সিটে উঠে বসে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

গতবার কনর সুলিভান যে পোশাক পরে ছিল আজকেও সেই একই পোশাক তার পরনে। জিন্সের প্যান্ট আর একটা জার্সি।

“ইনি হচ্ছেন ডিটেক্টিভ রে,” পরিচয় করিয়ে দিলাম।

“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো, মি. প্রেসিডেন্ট, রে হাতটা বাড়িয়ে দিল।

“আমারও,” বলে তার হাতটাও বাড়িয়ে দিয়ে করমর্দন করলো কনর সুলিভান।

“এবার খুলে বলুন সব আমাকে,” আমার দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলো সে।

আমি আগে কিছুই জানাইনি তাকে। খালি তার প্রাইভেট নম্বরে ফোন করে একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম আজকে তিনটা পনেরর সময় সামার পার্কে আমার সাথে দেখা করার জন্যে। এই নম্বরটা গত বারই আমাকে দিয়েছিলেন তিনি।

তার হাতে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে বললাম, “আপনার ড্রাইভারকে বলুন এই ঠিকানায় যেতে।”

সে একবার কাগজের লেখাটা পড়ল, কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝ গেল না কী ভাবছে। একটা বোতামে চাপ দিতেই ড্রাইভার আর আমাদের মাঝে যে পাটিশনটা ছিল সেটা নেমে গেল। কাগজটা সেদিক দিয়ে বাড়িয়ে দিলো সে।

“কি খবর, রেড?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

জবাবে মাথাটা আস্তে করে একবার শুধু ঝাঁকালো সে।

পার্টিশনটা আবার উঠে গেল আর গাড়ি চলতে শুরু করল।

রে আর প্রেসিডেন্ট-দু-জনের দৃষ্টিই আমার দিকে। নাহ, এবার কিছু বলতেই হবে, নইলে আর ধৈর্য থাকবে না ওদের।

“আপনি মিথ্যা কথা বলেছেন আমাকে,” প্রেসিডেন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি আক্রমন করলাম।

বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হল না তার।

“কোন ভিডিও নেই, সব আপনার বানানো কথা।”

এবারও কোন প্রতিক্রিয়া নেই তার মধ্যে।

“জেসিকা কখনই রাতের বেলা আপনার সাথে শুতে আপনার রুমে যায়নি।”

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম সে হয়ত এখনই ফুঁসে উঠবে, আমাকে গাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলবে। কিন্তু অমন কিছুই করলো না।

“সে ছিল আপনার নিজের মেয়ে।”

রে আমার পায়ে আস্তে করে একটা চিমটি কাটলো। তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম যে ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে যাচ্ছে সে।

“হ্যাঁ, জেসিকা আমার মেয়ে,” অবশেষে মুখ খুললো প্রেসিডেন্ট।

“কি?” রে’কে দেখে মনে হল যেন ভুত দেখেছে সে। “জেসিকা আপনার নিজের মেয়ে?” চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল এবার।

“আমি এখনই সব খুলে বলছি,” বললাম তাকে।

“আপনি কিভাবে জানলেন একথা?” সুলিভান জিজ্ঞেস করল আমাকে।

“আপনার ছেলের মাধ্যমে।”

একবার জোরে নিঃশ্বাস ফেলল সে।

“আপনার ছেলেকে জেসিকা বলেছিল তাকে জেসি নামে ডাকলেই সে খুশি হবে।”

জেসি? আমি তো জানতাম ওর নাম ছিল জেসিকা,” রে সবকিছু মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলো নিজে নিজে।

“মেয়েটা দু-বার নিজের পরিচয় পালটে ফেলেছিল,” রে’কে বললাম আমি। “তার আসল নাম ছিল জেসি।”

এরপর আমি ঐ দোকানটা থেকে শুরু করে সব কিছু খুলে বললাম। কিভাবে ঘড়িটা পেলাম, রিকি সুলিভানের সাথে লাস ভেগাসে কি কি কথাবার্তা হয়েছে, কিভাবে মেরিল্যান্ডের ওয়েবসাইট থেকে জেসি নামের দু জন হারিয়ে যাওয়া মানুষের ছবি খুঁজে পাই। এরপর কিভাবে সবকিছু মিলালাম আমি তা-ও বললাম।

“আপনার ছেলের ধারণা আপনি জেসিকে খুন করেছেন, প্রেসিডেন্টের দিকে ঘুরে বললাম কথাটা।

“আসল সত্যটা থেকে এটা জানা অনেক ভালো ওর জন্যে, তাই না,” এই বলে সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। “সে যে তার সৎ বোনের সাথে তিনমাস ধরে বিছানায় যাচ্ছিল এটা না জানাই ভালো তার জন্য।”

“দু-জনেই থামুন,” রে বলল অধৈর্যভাবে। “আমি এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।”

“আপনিই খুলে বলুন না কেন সবকিছু। একদম শুরু থেকে, আর আশা করি এবার মিথ্যা কিছু বলবেন না,” প্রেসিডেন্টকে বললাম আমি।

“ঠিক আছে, বলছি। কিন্তু তার আগে আমাকে এটা বলুন, আমরা এখন গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছি?”

“ঠিকানাটা দেখে চিনতে পারেননি?”

“এটুকু বুঝতে পেরেছি, ঠিকানাটা মেরিল্যান্ডের। কেন, আমার কি চেনার কথা নাকি ঠিকানাটা?” গলা শুনে আসলেও অবাক মনে হল তাকে।

“হ্যাঁ, ওখানে যে থাকে তার সাথে আপনার বিয়ে হয়েছিল।”

*

এরপরে আমরা যে কাহিনি শুনলাম তা থেকে জানতে পারলাম কনর সুলিভান কিভাবে প্রেসিডেন্ট হলেন। কাহিনিটা শুনে মনে হবে একজন সাধারণ লোকের কাহিনি। যে কিনা এক সময় ভুল করে বিয়ে করেছিল এক ভুল মহিলাকে।

কিম্বারলি এ. বেলসের জন্ম নেভাডায়। সে ওহাইওর এক ছোট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করত। ডেটন ইউনিভার্সিটি। সেখানেই ভার্সিটির বাস্কেটবল টিমের এক খেলোয়াড়ের সাথে প্রেম হয় তার। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর সেই ছেলের সাথেই ভার্জিনিয়ায় চলে যায়। একটা সন্তান হয় তাদের। আর এর কিছুদিন পরেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে সে।

আর কিম্বারলি এস. বেলসের বেড়ে ওঠা ভার্জিনিয়াতে। সেখানে পল ক্যালোম্যাটিক্সের সাথে পরিচয় হয় তার বাইশ বছর বয়সে। একটা মেয়েও হয় তাদের। এরপর তারা মেরিল্যান্ডে চলে যায়। সেখানে ষোল বছর সুখে সংসার করে। কিন্তু পরে ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের।

দুটো বিয়েই হয়েছিল একই জায়গায়। উত্তর ভার্জিনিয়ার একটা ছোট গির্জায়। কনর সুলিভানের সাথে কিম্বারলি এ. বেলসের বিয়ে হয়েছিল শনিবারে। আর পল ক্যালোম্যাটিক্সের সাথে কিম্বারলি এস, বেলসের বিয়েটা হয়েছিল রবিবারে।

কিন্তু একটা ছোট সমস্যা হয়েছিল তখন। কেউ বলতে পারবে না, আসল ভুলটা কার ছিল। বিয়ে নিবন্ধনের কাগজপত্রে ছিল ভুলটা। সেখানে ভুল করে কনর সুলিভানের স্ত্রীর জায়গায় নাম এসেছিল কিম্বারলি এস, বেলসের আর পল ক্যালোম্যাটিক্সের ক্ষেত্রে নাম এসেছিল কিম্বারলি এ. বেলসের। একটা ‘এ’ আর ‘এস’-এর মধ্যে ভুল হয়েছিল শুধু।

আপনাদের হয়ত মনে হতে পারে, একটা ছোট অক্ষরের ভুলে তেমন কী আসে যায়। আসলেও শুরুতে সেরকম কোন সমস্যা হয়নি। শুধুমাত্র ট্যাক্সের কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে ভুলটা বের হয়। প্রথমে কনর সুলিভান বুঝতে পারছিল না, তাদের পরিবারকে এত টাকা দিতে হচ্ছিল কেন ট্যাক্স হিসেবে। প্রায় দু-সপ্তাহ পরে সে বুঝতে পারে তার স্কুল টিচার স্ত্রীর নামে যে ট্যাক্সের রশিদ আসছে সেটা আসলে এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের ট্যাক্সের রশিদ। আর সেই মহিলার কামাই তার স্ত্রীর তুলনায় প্রায় তিনগুণ।

সে বুঝতে পারে, ভুলটা আসলে বিয়ের নিবন্ধনের সময় হয়েছে।

“আমি সেই মহিলার সাথে দেখা করতে চাই, যার সাথে নিজের অজান্তেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল,” হেসে কথাটা বলল প্রেসিডেন্ট। শুধু তাই না, ঐ লোকটার সাথেও দেখা করতে চাই আমি।”

আমি একবার রে’র দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, তার মাথায় কি চলছে এ মুহূর্তে।

“ট্যাক্স অফিস থেকে যে ঠিকানাটা পেয়েছিলাম সেটা আমার বাসা থেকে মাত্র আধঘন্টার দুরত্বে ছিল। আর একদিন কি এক কাজে যেন ওদিকে গিয়েছিলাম আমি। হঠাই সিদ্ধান্ত নেই ঐ বাসাটায় যাব আমি। কোনকিছু না ভেবেই দরজায় নক করি। আর দরজা খোলামাত্র বুঝে যাই ফেঁসে গেছি আমি,” মাথা নাড়তে নাড়তে স্মৃতিচারণ করতে লাগলো প্রেসিডেন্ট।

আমি অবশ্য মহিলার ছবি দেখেছি ইন্টারনেটে। যখন সুলিভান গভর্নরের পদে দাঁড়ান প্রথমবারের জন্যে তখন একজন সাংবাদিক খুঁজে বের করেছিল এই ঘটনা। সে ঐ মহিলাকে খুঁজে বের করে তার কিছু ছবিও তুলে নেয়। মাঝারি গড়নের মহিলা, বাদামি চোখ, সুন্দরি।

“আপনাদের সম্পর্ক কি সেই দিনই শুরু হয়?”

“না। সেদিন আমরা শুধু কিছুক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করেছিলাম আর একে অন্যকে এটা বলেছিলাম, একদিন আমরা দুই পরিবার একই সাথে বসে কোথাও ডিনার করব।”।

“কিন্তু সেটা আর পরে হয়ে ওঠেনি কখনও, তাই না?” রে জিজ্ঞেস করল।

“না। আসলে তার সাথে আমার আর দেখাই হয়নি পরের তিন বছর। তারপর আমি একদিন মেরিল্যান্ডে কি এক মিটিঙের জন্যে যাই, সেখানেই তার সাথে আবার দেখা হয় আমার। সে নাকি তার স্বামীর সাথে ওখানেই বাসা নিয়েছে কয়েকদিন ধরে। তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম স্বামীর সাথে ঠিক বনিবনা হচ্ছিল না তার। কারণ সে সারাদিন তার কাজ নিয়েই পড়ে থাকতো। এরপর থেকে আমরা প্রতি মাসে দুবার করে দেখা করা শুরু করলাম।”

“তাহলে আপনাদের সম্পর্কটা শুরু হল কখন?”

“সেই বছরেরই ডিসেম্বরে। কিম, আমার স্ত্রী, এক সপ্তাহের জন্য শহরের বাইরে গিয়েছিল। আরেক কিম আবার তখনই আমাকে কল দিয়েছিল যে, সে ভার্জিনিয়াতে তার পরিবারের লোকজনের সাথে দেখে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। আমি তাকে বাসায় আসতে বলি আর আমাদের মধ্যে…” বলে চুপ করে গেল সে। “বুঝতেই পারছেন কি হয়েছিল।”

“কতদিন টিকেছিল আপনাদের সম্পর্কটা?”

“এই ছ’মাসের মত হবে। আমার স্ত্রী যখন আমাকে বলল সে প্রেগন্যান্ট তখনই আমি সব কিছু বন্ধ করে দেই।”

“এটা নিয়ে সে কিছু বলেনি?”

“না। এরপরে তার সাথে আমার আর কথাই হয় নি কখনও।”

“তাহলে এসবের মধ্যে জেসি কিভাবে আসলো?”

“আসলে জেসি যখন আমার সাথে দেখা করে ততদিনে সে তার নাম বদলে ফেলেছিল। সে যদি এসে বলত তার আসল নাম জেসি ক্যালোম্যাটিক্স তাহলে মনে হয় না তাকে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজে নিতাম আমি। তো, সে আমার অফিসে চাকরি নেয় জেসিকা রেনয় নামে। তিন মাস খুব ভালোমত কাজও করে। এরপর এক রাতে এসে হঠাৎ করে আমাকে তার আসল পরিচয় খুলে বলে। বলে যে, এক রাতে মদ্যপ অবস্থায় তার মা আমার সম্পর্কে সব কিছু বলে দিয়েছে তাকে। তার মা নাকি বলেছিল, আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল। আর সেটা শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এরপর আমাকে ছোট একটা প্যাকেট আর একটা কাগজ দেখায় সে। প্যাকেটে ছিল আমার কিছু চুল, সেটা নাকি একরাতে আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন কেটে নেয় সে। কাগজটা ছিল আসলে একটা ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট। সে বলে আমি নাকি তার আসল বাবা। এরপরই সে দশ লক্ষ টাকা ডলার দাবি করে।”

“সে চাইলো আর আপনি দিয়ে দিলেন?”

“হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। টাকাটা নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল সে পরদিনই। এরপরে আমার সাথে আর যোগাযোগ করেনি। তিনমাস আগ পর্যন্ত।”

“তিনমাস আগে কি বলল সে?”

“একটা ইমেইল পাঠিয়েছিল। আমি সেই আগের ইমেইল এড্রেসটাই ব্যবহার করি এখনও। ইমেইলে দেখি, একটা ছবি পাঠিয়েছে জেসিকা। আমার ছেলের সাথে তার নিজের ছবি।”

“এটাতে নিশ্চয়ই আপনার টনক নড়ে উঠেছিল?”

“অবশ্যই।”

“আর এবার সে আপনার কাছে বিশ লাখ ডলার চায়? আপনার ছেলের সাথে সম্পর্কটা বন্ধ করার জন্যে?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি সেই রাতে টাকাটা তার বাসায় পৌঁছে দিতেই গিয়েছিলেন তার দেয়া ঐ ঠিকানাতে?”

“হ্যাঁ, কিন্তু সে টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।”

“কি?”

“সে বলে, তার টাকা লাগবে না। সে নাকি আমার ছেলেকে আসলেও ভালোবেসে ফেলেছে, কোনভাবেই তাকে ছাড়তে পারবে না।”

“আর তখনই আপনি তাকে খুন করেন?”

“না!”

আমার নিজেরও অবশ্য মনে হচ্ছিল না, খুনটা সে করেছে, তবুও আমি তার প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাচ্ছিলাম।

“তাহলে সে চিৎকার করে উঠেছিল কেন?”

“আমি তাকে জোরে একটা থাপ্পড় দেই। বলি যে, সে যা করছে তা কেবল একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব। এটা বলেও হুমকি দেই, সে যদি আমার ছেলের সাথে মেলামেশা বন্ধ না করে তাহলে তাকে একেবারে উধাও করে দেব আমি। এই বলে টাকাটা সেখানে রেখে বের হয়ে যাই আমি। আর তখনই জানালায় আপনার সাথে চোখাচোখি হয় আমার,” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেল প্রেসিডেন্ট।

এই সময়ে গাড়িটাও আস্তে করে থেমে যায়। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি আমরা একটা ছোট বাসার সামনে।

ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে তিনটা চৌত্রিশ।

আমার হাতে আছে ছাব্বিশ মিনিট। আর এই ছাব্বিশ মিনিটের মধ্যেই একটা খুনের স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *