নরপশু ৫

৪১.

সোনালি রোদের ঝকঝকে সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলল রানা। নাকে এল রোস্ট করা মাংসের সুবাস। নতুন করে জ্বেলে নেয়া আগুনের পাশে বসে আছে রেবেকা ট্রিপলার। দুটো কাঠি দিয়ে ধরেছে মোটাসোটা এক ছেলা খরগোশ। চিড়বিড় আওয়াজে ফুটছে ওটার চর্বি।

গন্ধ তো দারুণ! বলল রানা।

কথা শুনে ঘুরে তাকাল মেয়েটা। ওর হাসিটা খুব মিষ্টি। এলোমেলো চুলে অপ্সরার মত দেখাল ওকে। তোমার খিদে লেগেছে। ভাল খবর।

গুহার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল রানা। খেয়াল করল কীভাবে ধোঁয়া কমিয়ে রেখেছে রেবেকা। আগুনে টুপটাপ পড়ছে চর্বি। সিস্-সিস্ আওয়াজে রোস্ট হচ্ছে বেচারা মোটাতাজা খরগোশ। রানার চোখ এড়াল না রেবেকার দেহের সুন্দর বাঁকগুলো। আগে খেয়াল করেনি, মেয়েটা এত আকর্ষণীয়। ছিপছিপে শরীর, প্রতিটি নড়াচড়া সাবলীল।

রেবেকার জিন্স প্যান্টের পকেট থেকে বেরিয়ে আছে। বেরেটার বাট।

রানার ভাবনা যেন ধরতে পেরেছে। চাইলে ফেরত নিতে পারো। মন চায়নি যে ঘুম ভাঙিয়ে নিই। খুব খিদে লেগেছে ক্যাথির। একই কথা তোমার ব্যাপারেও। ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। তোমাকে।

খুব সাবধানে উঠে বসল রানা। মনে হলো করাত দিয়ে কেটে কাঁধ থেকে হাতটা নামাচ্ছে কেউ। বোতল থেকে কোডিন ট্যাবলেট নিয়ে দুটো বড়ি মুখে ফেলল ও। তোমার কাছে পিস্তল দেখে অস্বস্তি বোধ করছি না। রেখে দাও।

আবারও হাসল রেবেকা। তো বিশ্বাস করছ আমাকে?

বিশ্বাস না করে উপায় আছে আমার?

তা ঠিক, সত্যিই উপায় নেই। তবে মানুষটা বোধহয় আমি অতটা খারাপ নই। আগুন থেকে খরগোশ সরিয়ে সমতল এক পাথরে রাখল রেবেকা। ছুরির করাতের মত অংশ দিয়ে কাটতে লাগল। চার টুকরো হওয়ার পর ছোরার ডগা ব্যবহার করে এক টুকরো বাড়িয়ে দিল ক্যাথির দিকে।

বিরক্ত হয়ে নাক কুঁচকে ফেলল ক্যাথি। ওই গু-মুত আমি খাই না।

ভুরু কুঁচকে ফেলল রেবেকা। শক্তি হবে। খেয়ে নাও। সারাদিন হাঁটতে হবে আমাদের।

আমি ভেজিটারিয়ান।

গুড, বলল বিরক্ত রানা। তা হলে বেশি পাব রেবেকা আর আমি। ক্যাথি যদি ভেবে থাকে ওকে কোলে করে নিয়ে যাব, তো মস্ত ভুল ভাবছে।

রেবেকার দিকে আঙুল তাক করল ক্যাফি। ওই মেয়ের সঙ্গে কোথাও যাব না। ওর জন্যেই খুন হয়েছে ডক্টর মান।

চাইনি খুন হন, বলল রেবেকা, কিন্তু ঠেকাতেও পারিনি ওই হত্যাকাণ্ড।

নাক দিয়ে ফোৎ আওয়াজ তুলে নিজের কোণে গুটিসুটি মেরে বসল ক্যাথি। রানা ও রেবেকাকে মাংস খেতে দেখে মুখ কালো করে ফেলেছে সে।

ওর কথা বাদ দাও, রেবেকাকে বলল রানা। খিদে নেই বোধহয়। …বাহ্, রান্না তো চমৎকার!

আগে কখনও নাইন এমএম দিয়ে খরগোশ শিকার করিনি, বলল রেবেকা। ভাবছিলাম, এক গুলিতে চারপাশে ছিটকে পড়বে সব। পকেট থেকে রুমাল নিয়ে মুখ মুছল। উঠে গেল গুহামুখে। প্যান্টের পকেট থেকে নিল মোবাইল ফোন।

ওটা রেখে দাও, বলল রানা। এদিকে সিগনাল থাকলে সহজেই আমাদেরকে ট্র্যাক করবে।

ও, তাই তো! ঠিক! তবে প্রথম সুযোগে ল্যাণ্ড ফোন পেলেই কল দেব।

হ্যাঁ, তাই তো করবে, তিক্ত স্বরে বলল ক্যাথি। ফোন দিয়ে ডেকে এনে ধরিয়ে দিতে হবে না আমাদেরকে!

তা না করলেও তোমাকে পাঠাব নিরাপদ কোথাও, বলল রেবেকা। তারপর আমরা দুজন মিলে খুঁজে বের করব আসলে কেন কী হচ্ছে।

মাথা নাড়ল রানা। উপায় নেই। ক্যাথির দায় আমার। সিআইএর অন্য কাউকে ওর ধারে-কাছে যেতে দেব না। ওর বাবা-মাকে কথা দিয়েছি, পৌঁছে দেব বাড়িতে।

কিন্তু ওর কাছে তো কোনও দরকারি কাগজই নেই। বেরোবে কী করে ইউএস ছেড়ে?  

পৌঁছে দেব কাছের ব্রিটিশ কনসুলেট-এ। এসে নিয়ে যাবেন ওর বাবা-মা।

আর তারপর?

তারপর? যারা শুরু করেছে এসব, তাদের খুঁজব।

একা? ভাবছ ওটাই সমাধান? আরও খুন করবে?

খুন করতে চাই না, বলল রানা, কিন্তু যারা আমার প্রিয় কাউকে খুন করেছে, আমি নিজে বেঁচে থাকলে ওরা বাঁচবে না।

লড়বে কতজনের সঙ্গে?

সেটা জানি না।

মাথা নাড়ল রেবেকা। এরই ভেতর দুই পুলিশ খুনের জন্যে তোমাকে খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। দোষীদের কাছে পৌঁছুবার আগে নিজেই খুন হবে। আমার কথা শোনো। আমি বড় অফিসারদের সঙ্গে কথা বলব। আমার কথা বিশ্বাস করবে তারা। ভুলো না, আমি তোমার একমাত্র অ্যালিবাই।

আমার মতই মস্ত, বিপদে আছ তুমি, বলল রানা।

উর্ধ্বতন অফিসারদের বোঝাব, তোমাকে খুন করতে চাইছিল বলে বাধ্য হয়ে এজেন্টদেরকে খুন করেছ তুমি।

মাথা নাড়ল রানা। কীভাবে প্রমাণ করবে, অপরাধী বলে নিজ দলের কোনও এজেন্টকে খুন করেছ?

চুপ করে থাকল রেবেকা।

ক্যাথির দিকে ঘুরে তাকাল রানা। রাগী চেহারায় চুপচাপ মহাশূন্য দেখছে মেয়েটা। অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে তোমাকে, ক্যাথিকে বলল রানা।

আমাকে? কেন?

কারণ, সব জানতে হবে আমার। কোথায় রেখেছ ওস্ট্রাকা?

নাক ফুলিয়ে বলল ক্যাথি, কী সব আবোলতাবোল কথা!

 ডাক্তার মাল্ডুন বলেছিল, স্মৃতি ফিরছে তোমার, বলল রেবেকা। এখনও কিছু মনে পড়ছে না?

চেহারা বিকৃত করে দুহাতে মাথা চেপে ধরল ক্যাথি। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।

কী করে জানলে তোমার কোনও বাড়ি আছে? ওর কাছে জানতে চাইল রানা, তোমার না কিছুই মনে নেই?

মুখ তুলে কড়া চোখে ওকে দেখল মেয়েটা। ফালতু কথা বাদ দিয়ে আমাকে একা থাকতে দাও।

তোমার জানা নেই, তোমাকে খুঁজতে গিয়ে কীসের মাঝ দিয়ে গেছি, বলল রানা, জানো না, তোমার বদমায়েসির জন্যে খুন হয়েছে কতজন নিরীহ মানুষ!

অত কঠোর হয়ো না, বলল রেবেকা, ওরও সময় ভাল কাটেনি।

চুপ করে থাকল রানা। কিছুক্ষণ পর বলল, ঠিক আছে, তোমাকে চাপ দিতে চাই না, ক্যাথি।

গতকাল আরেকটু হলে ভেঙে দিতে আমার চোয়াল, অভিযোগের সুরে বলল ক্যাথি।

সেজন্যে দুঃখিত, মেয়েটার বাহুতে হাত রাখল রানা। কাঁধের ব্যথায় ওর মনে হলো, খুন হয়ে গেছে।

সরে বসল ক্যাথি।

এবার রওনা হওয়া উচিত, বলল রেবেকা। সামনে পড়ে আছে আস্ত দিন।

আগুন নিভিয়ে দিল ও।

সবুজ পাতা দিয়ে খরগোশের অবশিষ্টাংশ মুড়িয়ে নিজের ব্যাগে রাখল রানা।

মালপত্র গুছিয়ে নিল ওরা, তারপর বেরোল গুহা ছেড়ে।

জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কিছুটা নামতেই শীতল পানির এক ঝর্না দেখাল রেবেকা। মুখ-হাত ধুয়ে নিল ওরা।

অনেক উঁচু উত্তরদিকের পাহাড়। পায়ের কাছে জন্মেছে মাইলের পর মাইল ফার ও স্পস গাছ। ওই জঙ্গল এড়াতে ঘুর পথে চলল ওরা।

এমন হতেই পারে: সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাঁটলাম, কিন্তু দেখলাম না বসতি, মন্তব্য করল রেবেকা। আমেরিকার অন্যতম বড় স্টেট, জনসংখ্যা কম। আমাদের বোধহয় অনুচিত হয়েছে রাস্তা থেকে সরে যাওয়া।

মাত্র কয়েক মাইল যাওয়ার পর মনে মনে বলল রানা, ঠিকই বলেছিল রেবেকা। বারকয়েক মাছির মত পোকার গুঞ্জন ছাড়া পরের কয়েক ঘণ্টায় মাত্র একটা বড় এলক দেখেছে ওরা। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ওটা, ওদেরকে দেখে ভূতের মত হাওয়া হলো মুহূর্তে।

থেমে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও রওনা হলো ওরা। বনবন করে ঘুরছে রানার মাথা। কাঁধে অসহ্য ব্যথা। আরও কয়েক শ গজ হাঁটার পর বাধ্য হয়ে আবারও বসল ও।

তোমার অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না, বলল রেবেকা। এক কাজ করি, এখানে বসে বিশ্রাম নাও। আমি একা এগিয়ে যাই। দেখে আসি সামনের এলাকা। হয়তো পাব কোনও রাস্তা বা খামারবাড়ি। দুতিন ঘণ্টার ভেতর ফিরব।

আপত্তি করার পর্যায়ে নেই রানা। মৃদু মাথা দোলাল। ঠিক আছে। সতর্ক থেকো।

হাসল রেবেকা। ভেবো না, নিজের দেখভাল ভালই পারি। পিস্তল পরীক্ষা করে দেখল, তারপর কয়েক ঢোক পানি খেয়ে রওনা হলো নীরবে।

প্রথমবারের মত রানা টের পেল, মেয়েটা চলে যাচ্ছে বলে কেমন যেন খারাপ লাগছে ওর।

ওই মেয়ে অ্যামেটকে নিয়ে ফিরবে, রেবেকাকে হেঁটে যেতে দেখছে ক্যাথি। ভুল করলে, মাসুদ রানা।

কথাটা পাত্তা দিল না রানা। ওর ফিরতে সময় লাগবে। এসো, বিশ্রাম নেয়ার মত জায়গা খুঁজে বের করি।

আশপাশে কিছুক্ষণ খোঁজার পর ভেঙে পড়া এক স্ট্রস গাছ পেল ওরা। কাত হয়ে আছে ওটার কাণ্ড। মোটা একটা ডাল ধরে বলল রানা, টেনে নামাতে সাহায্য করো।

তাতে কী হবে?

আশ্ৰয় তৈরি হবে। খোলা জায়গায় বসতে পারবে না। আকাশ থেকে পরিষ্কার দেখা যাবে আমাদেরকে।

ভুরু কুঁচকে ফেলল ক্যাথি। ওরা আমাদেরকে খুঁজছে, তাই না?

মাথা দোলাল রানা।

আরেকটা ডাল ধরল ক্যাথি। দুজন মিলে টান দেয়ায় কড়-কড় শব্দে ভেঙে পড়ল গাছটা। মাটির ওপরে বড় এক ঝোঁপের মত ছাউনি তৈরি হলো। ভেতরে ঢুকলে আকাশ থেকে দেখবে না কেউ। পাতার বাড়ির মধ্যে ঢুকে ব্যাগে হেলান দিয়ে বসল রানা।

ওর পাশে ব্ল্যাঙ্কেট পেতে শুল ক্যাথি। মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খুব ক্লান্ত। খুন হয়ে যাচ্ছি পায়ের ব্যথায়। আর মাটিতে কিলবিল করছে হাজার হাজার পোকা। জেসাস, কী যে খুশি হতাম গরম পানিতে গোসল করতে পারলে!

চুপ করে থাকল রানা। কিছুক্ষণ বকবক করার পর ক্যাথি বুঝল, ওর কথা শুনতে বয়ে গেছে লোকটার। ফেস-ফেস করে শ্বাস ফেলে কী যেন ভাবতে লাগল সে। সময় পার হচ্ছে নীরবে। কোডিন ব্যথা কমিয়ে দিলেও দপদপ করছে রানার কাঁধের ক্ষত। ঝিমাচ্ছে ও, কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ছে। জেগে উঠে দেখছে হাতঘড়ি। আধ ঘণ্টার বেশি চলে গেছে রেবেকা।

আমার খুব খিদে লেগেছে, নালিশের সুরে বলল ক্যাথি।

ব্যাগ খুলে পাতা দিয়ে মোড়ানো খরগোশের মাংস বের করল রানা। পাতা খুলে এগিয়ে দিল ক্যাথির দিকে। খেয়ে নাও। তোমার খিদে লাগবে ভেবেই এত কষ্ট করে শিকার করেছিল রেবেকা।

যা-তা খাব না।

তোমার খিদে লাগেনি, তাই না?

মারা যাচ্ছি খিদেয়।

দেখে তা-ই মনে হচ্ছে, বলল রানা।

বিরক্তির চোখে খরগোশের মাংস দেখল ক্যাথি। চোখ তুলে তাকাল রানার চোখে। আবার দেখল মাংস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিল ছোট এক টুকরো মাংস। মুখে ফেলল। পরের টুকরোটা হলো আরও বড়। দুই টুকরো খাবার পর গোগ্রাসে মাংস খেতে লাগল সে। কিন্তু একটু পর যখন বুঝল ওকে খেতে দেখছে রানা, ভয়ানক তিক্ত চেহারা করল। ভাব দেখে মনে হলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিস্বাদ জিনিসটা খাচ্ছে। একবার ভঙ্গি নিল, যে-কোনও সময়ে বমি করে দেবে। আনমনে হাসল রানা। পুরো রোস্ট শেষ করে আঙুল চাটতে লাগল ক্যাথি। ওর দিকে মদের ফ্লাস্ক বাড়িয়ে দিল রানা। নরম স্বরে বলল, বুঝলাম, কত কষ্ট করে খেতে হলো। এটা গিলে ওটাকে পাঠিয়ে দাও পাকস্থলীতে।

ফ্লাস্কের ক্যাপ খুলে এঁকে দেখল ক্যাথি। খুশিতে চকচক করছে চোখ। এক চুমুকে সাবড়ে দিল অর্ধেক আগুনে তরল। ফেরত দিল ফ্লাস্ক। দুঢোক নিল রানা। আবার ফেরত দিল ক্যাথির হাতে। ফ্লাস্ক প্রায় খালি করে ফেলল মেয়েটা।

সিগারেট বের করে ধরাতে গিয়েও ওর দিকে বাড়িয়ে দিল রানা।

মাথা নাড়ল মেয়েটা। ধূমপান ধীরে ধীরে খুন করে।

গুড। ধীরে ধীরেই তো মরতে চাই, হঠাৎ আচমকা খুন হতে আপত্তি আছে আমার।

বিষণ্ণ হাসল ক্যাথি। দুসপ্তাহের বেশি হার্ড ড্রিঙ্ক পাইনি। ভীষণ মাথা ঘুরবে।

 শেষ করে ফেলো, বলে সিগারেট ধরাল রানা।

স্কচ শেষ করে ক্যাপ আটকে ওর হাতে ফ্লাস্ক ধরিয়ে দিল। ক্যাথি। শুয়ে পড়ল ব্ল্যাঙ্কেটে। চেয়ে আছে পাতার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশের দিকে। ভাল লাগছে মুক্ত পরিবেশে। এত দিন মনে হয়েছে, কূপে আটকে রেখেছিল ওরা।

পৌঁছে দেব তোমাকে বাড়িতে, বলল রানা।

আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছ। তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি।

সব সমস্যা দূর হওয়ার পর ধন্যবাদ দিয়ে, আবার চোখ বুজল রানা। বারবার গরম লাগছে, আবার শীত। আসছে কাঁপিয়ে দেয়া জ্বর। কাঁধ থেকে বের করতে হবে বুলেট।

বুঝলাম না, কী করে আমার বাবা-মার সঙ্গে পরিচয় হলো তোমার, বলল ক্যাথি।

তোমার বাবা আমার চাচার বন্ধু ছিলেন।

 ও। দেখতে তো তুমি দারুণ, তোমার কোনও গার্লফ্রেণ্ড নেই?

মাথা নাড়ল রানা।

তুমি সমকামী নও তো?

 মনে তো হয় না।

ভাল-ভাল। রানার আরও কাছে ঘেঁষল ক্যাথি। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল চুল। বলল তো, কতটা সময় লাগবে রেবেকার ফিরতে?

রেবেকা? কয়েক ঘণ্টা।

ভাল লাগছে তোমার সঙ্গে কথা বলে, বলল ক্যাথি।

আমারও।

আমাদের উচিত আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেদের ভালভাবে চেনা।

মাথার ওপর সূর্য। পাতার ফাঁক দিয়ে আসছে সোনালি রোদ। একটু সরে সোনালি আলোয় উরু পাতল ক্যাথি। গরম হয়ে উঠছি। খুলে ফেলল ভারী জাম্পার। ঊর্ধ্বাঙ্গে এখন মশারির মত পাতলা টপ। রানার দিকে ঝুঁকল ক্যাথির লোভনীয় সফেদ দুই স্তন। মিটমিট করে হাসছে মেয়েটা।

খুলে গেছে ওটা, আঙুল তুলে পাতার ভেতর সোনার ব্রেসলেট দেখাল রানা।

শিট! সবসময় খুলে যায়।

আরও সতর্ক হওয়া উচিত, বলল রানা। দেখে মনে হচ্ছে ওটা দামি।

পেয়েছি আমার বড় মার কাছ থেকে।

চিন্তিত চেহারায় মাথা দোলাল রানা। চুপ করে ভাবছে কী যেন। একটু পর হঠাৎ বলল, সব দোষ ছিল উইস্কির।

হ্যাঁ, ওই জিনিস পেটে গেলেই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠি, বলল ক্যাথি। খিলখিল করে হাসল। আরও পেলে মন্দ হতো না।

মাথা নাড়ল রানা। মদের কথা বলিনি। বলেছি উইস্কির কথা। গাড়ি চাপা পড়েছে। মারা গেছে।

বিস্ফারিত হলো ক্যাথির দুই চোখ। আড়ষ্ট হয়ে গেছে। মেয়েটা। কখন? কীভাবে?

যখন কোর্ফিউতে পার্টিতে ব্যস্ত ছিলে, তখন।

বাবার হারামজাদা বন্ধু আমাকে কিছুই বলেনি, রেগে গিয়ে বলল ক্যাথি। এক সেকেণ্ড পর একহাতে চেপে ধরল মুখ। বুঝে গেছে, কী করে বসেছে।

না, ওরা কিছু বলেনি, কারণ আসলে ওটা ঘটেনি, বলল রানা। মিথ্যা বলেছি। ওই কুকুর ঠিকই আছে। তবে প্রমাণ হলো ফিরেছে তোমার স্মৃতি।

লালচে হয়ে গেল ক্যাথির মুখ। জানি না কেন কুকুরটার কথা মনে পড়ল। আর কিছুই তো মনে নেই।

শক্ত হাতে মেয়েটার কবজি ধরল রানা। ভুলে গেছে কাঁধের ব্যথা। গ্রিসে তোমার বাবার বন্ধু যে হারামজাদা তা জেনেছি। মাংস তুমি খাও না। ব্রেসলেট তোমার বড় মা-র। …ক্যাথি, বুঝে গেছি, ভান করছ, আসলে জানো সবকিছুই।

ঝটকা দিয়ে কবজি ছুটিয়ে নিতে চাইল ক্যাথি। আমাকে ছেড়ে দাও!

আরও শক্ত হাতে কবজি ধরল রানা। আপাতত নয়। জীবনে প্রথমবারের মত সত্যি বলতে হবে তোমাকে।

.

৪২.

 খুব ভোরে ঝটকা দিয়ে হাত ছুটিয়ে নিল ক্যাথি। প্রায় ক্রল করে বেরোতে চাইল ঝোঁপের তলা থেকে। পিছু নিয়েছে রানা, খপ করে ধরল মেয়েটার গোড়ালি। কিন্তু পেছনে লাথি ছুঁড়ল ক্যাথি। ওর পা সরাসরি লাগল রানার আহত কাঁধে। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে ধুলোর ভেতর পড়ল রানা। গাছের ছাউনি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইল ক্যাথি। পেছন থেকে ডাকল রানা, কোথায় যাচ্ছ? হারিয়ে গেলে মরবে!

গাছের মাঝ দিয়ে দৌড়ে চলেছে ক্যাথি। দুহাতে সরিয়ে দিচ্ছে ডালপালা। কিন্তু পাঁচ সেকেণ্ড পর আর্তচিৎকার করে উঠল। ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসেছে কেউ।

রেবেকা ট্রিপলার। দীর্ঘ পথ হেঁটে লাল ওর গাল। চুলে শুকনো পাতার টুকরো। ঝর্না পেরোবার সময় ভিজে গেছে। জিন্সের প্যান্ট। ক্যাথি! কোথায় যাচ্ছ?

আহত কাঁধ চেপে ধরে ওদের কাছে পৌঁছুল রানা। কালো আগুনের ফুলকির মত জ্বলছে ওর চোখের মণি। মিথ্যা বলে লাভ হবে না, ক্যাথি। সব খুলে বলল।

বিস্মিত হয়েছে রেবেকা। তোমাদের কী হয়েছে? … নিয়ে এসেছি ভাল খবর। সামনের টিলা পেরোলেই একটা খামারবাড়ি। মাত্র দুই মাইল দূরে।

স্মৃতি আগেই ফিরেছে ক্যাথির, বলল রানা। গতকাল থেকে ভান করছে।

এ কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল ক্যাথি। হাঁটু গেড়ে বসল ধুলোর ভেতর।

কড়া চোখে ওকে দেখল রেবেকা। কথা ঠিক, ক্যাথি?

মিথ্যার ঝুলি বন্ধ করো, ধমকের সুরে বলল রানা। কোথায় ওসব ওস্ট্রাকা? কী হচ্ছে এসব? ওস্ট্রাকা দিয়ে কী করবে থর্ন আর ক্যাল অ্যামেট?

জানি না, ফুঁপিয়ে উঠল ক্যাথি।

সত্য না বলা পর্যন্ত কোথাও যাচ্ছ না, বলল রানা।

সত্যিই বলছি! চিৎকার করল ক্যাথি। আমার জানা নেই ওসব কেন চায় ওরা। আমি শুধু ওটার কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছি স্টিভ বার্কলেকে!

ওগুলো কোথায়? রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। রানার। জবাব দাও! ঝামেলা থেকে বেরোতে ওগুলো লাগবে। ধরিয়ে দিতে হবে লোকগুলোকে।

ঝড়ের বেগে কবার মাথা নাড়ল ক্যাথি। ধুলো ভরা মুখে চোখের পানি কাদা তৈরি করছে। আবারও ফুঁপিয়ে উঠল, বলতে পারব না কোথায় আছে।

কেন পারবে না? কড়া কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।

কারণ… কারণ… না… বলতে পারব না! অঝোরে কাঁদছে ক্যাথি। কাঁপা আঙুলে খামচে ধরল দুই গাল।

পাশে গিয়ে ক্যাথির বাহুতে হাত রাখল রেবেকা। ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই। সব খুলে বলো। ওস্ট্রাকার ব্যাপারে শোনার পর ওই খামারবাড়িতে যাব আমরা। বড় অফিসাররা এলে আমাদের ওপর হামলা করতে পারবে না কেউ।

চোখ মুছে ভয় নিয়ে রানার দিকে তাকাল ক্যাথি। ফুঁপিয়ে উঠছে। বুকের কাছে ঝুঁকে গেল মাথা।

কী? জানতে চাইল রানা, দেরি করছ কেন?

বলতে পারব না… কারণ… আসলে ওসব তো নেই। কাঁধ আরও ঝুঁকে গেল ক্যাথির। আর কিছু বলার নেই। সত্যি! মিথ্যা বলছি না! এবার খুশি হয়েছ তোমরা?

দুসেকেণ্ডের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেল রানা, তারপর ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী বললে?।

পা ফাঁক করে বসল ক্যাথি। ফিসফিস করল, সব ছিল মিথ্যা। সবই মিথ্যা। কোনও প্রমাণ আমার হাতে ছিল না। সব বানিয়ে বলেছি।

কথাগুলো শুনেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না রানার। জানতে চাইল, কিন্তু পিছলা সিম্পসনের মাধ্যমে বার্কলের কাছে পটারির টুকরো পাঠাও। ওটা সত্যিকারের জিনিস। কার্বন ডেট করিয়ে দেখেছে বার্কলে।

কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ল ক্যাথি। কার্বন ডেট দেখেছে ঠিক। সত্যিই ওই টুকরো সেই সময়ের। ব্যস, আর কিছুই না। ওই জন্যেই তো ওটা ব্যবহার করেছি ব্ল্যাকমেইলে। যে কোনও স্কলার বুঝবে, গায়ের সব লেখা অর্থহীন। আমার কাছে ছিল মাত্র দুএকটা টুকরো। আসল জিনিসটা হয়তো ছিল হিব্রু রেসিপি বা হিসাবের বইয়ের অংশ।

চুপচাপ ওর দিকে চেয়ে রইল রানা। প্রচণ্ড রাগ চেপে বসছে মাথায়। উধাও হয়েছে কাঁধের ব্যথা। নিচু স্বরে বলল, সব মিথ্যা?

স্টিভ বার্কলে ফাঁদে পা দেবে কি না, তা-ও জানতাম না, হড়বড় করে বলল ক্যাথি। তুরস্কে খননের সময় হঠাৎ একরাতে বুদ্ধিটা এল। মনে হলো মিথ্যা বলে লোকটার কাছ থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নিতে পারব। ওই লোক সর্বনাশ করেছে আমার। নইলে মিস ট্রুলির কাছ থেকে পেতাম বাকি জীবন চলার মত টাকা। কিন্তু পচা একটা বই লিখে আমাকে বিপদে ফেলল লোকটা। মিথ্যা বলার জায়গা পায় না! সেন্ট জন গেছেন তার সঙ্গে গল্প মারতে! আমি কি গাধা? লজ্জায় লালচে হলো ক্যাথির গাল। টাকা পাওয়ার কথা ছিল আমার, অথচ সব পেয়ে যাচ্ছে বার্কলে।

যা বললে, সব সত্যি? বলল রানা, সেন্ট জন আর বুক অভ রেভেলেশন সম্বন্ধে কোনও প্রমাণ নেই তোমার কাছে?

মিথ্যা বলছি না, মুখ গোঁজ করে বলল ক্যাথি।

রাগে কাঁপছে রানা। মনে পড়ছে মউরোসের হাসিমুখ। অন্তরের চোখে দেখল, বিস্ফোরণে উড়ে গেল ওর বন্ধু। জানা নেই, কিছু যায় আসে না, তবে তোমার জন্যে সর্বনাশ হয়েছে অনেক মানুষের। বোমার আঘাতে মরেছে। বাদই দিই তোমার বাবা-মার কথা। নরকে বাস করছেন তাঁরা। …খুন। হয়েছে থ্যানাটস, এটা জেনেই তোমার কী? দ্বিগুণ হয়ে ফিরল ব্যথা। রানার মনে হলো, জ্বলন্ত লোহার শিক ঢুকছে কাঁধের মাংসে।

ভয়ের চোখে ওকে দেখল ক্যাথি। বুজে ফেলল চোখ। মুখে রা নেই।

কোর্ফিউতে বোমা ফেটে মরেছে অনেকে, জানতেও চাও না, বলল রানা। কিন্তু তাদের মৃত্যুর দায় তোমার ওপর বর্তায়। যে ডাক্তার ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে মরল, তার কথাও ভুলে যেয়ো। তোমার সঙ্গে মিশেছে বলে বাজে এক মোটেলে এখন পড়ে আছে উকিল সিম্পসন। চুরমার করে দেয়া হয়েছে ওর দুই পায়ের হাড়। এসব হয়েছে, কারণ অন্যায় সুবিধা আদায় করতে গিয়ে তুমি বলেছ জঘন্য মিথ্যা। ব্যথায় হাঁফিয়ে উঠল রানা। সবসময় মেয়েদেরকে ছেলেদের সমান সম্মান দিয়েছি। কিন্তু তুমি যদি ছেলে হতে, ক্যাথি, স্রেফ পিটিয়ে খুন করতাম তোমাকে! জানোও না কী সর্বনাশ করেছ কতজনের! শুধু জানো নিজ স্বার্থ সিদ্ধির কূট কৌশল!

নীরবতা নামল।

চুপ করে আছে ক্যাথি। ফুঁপিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় নড়ছে গাছের পাতা। অনেক ওপরের আকাশ থেকে এল শকুনের কর্কশ ডাক।

আরও কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল রেবেকা, তা হলে এবার কী করা উচিত আমাদের?

জবাব দিল না কেউ।

গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে রানার। মনে হলো ক্লান্তিতে পড়ে যাবে মাটিতে। আবার ভিজে গেছে বামহাত। আঙুল থেকে টপটপ করে জঙ্গলের মাটিতে পড়ছে রক্ত। খেয়াল করেছে রেবেকা। চোখে ফুটে উঠল দুশ্চিন্তা।

দূর থেকে এল চাপা ধুপ-ধুপ শব্দ। মুখ তুলে তাকাল রানা। বহু দূরাকাশে দেখা দিয়েছে একটা বিন্দু। ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে ওটা।

হেলিকপ্টার, বলল রেবেকা। বোধহয় ওদের।

চলো, লুকাতে হবে, বলল রানা। হাত ধরে হ্যাচকা টানে ক্যাথিকে ঘুরিয়ে নিল ও। টলতে টলতে ঢুকল কাছের ঝোপে। ওর পিছু নিয়েছে রেবেকা। বসে পড়ল ওরা ঝোঁপের ভেতর। খুব কাছে বসেছে বলে রেবেকার চুলের সুবাস পেল রানা। ছুঁয়ে গেল দুজনের হাত। টনটনে ব্যথা সহ্য করছে, তবুও মেয়েটা ওর পাশে আছে বলে ভাল লাগল রানার।

আকাশ-বাতাস ভরে উঠল হেলিকপ্টারের আওয়াজে। মাথার ওপর দিয়ে দূরে চলে গেল ওটা।

বড় করে শ্বাস ফেলল রেবেকা। রানা, তোমার কি মনে হয় ওই জিপ পেয়ে গেছে ওরা?  

মাথার ওপর বাতাস ভরে আছে বলে

মাথা নাড়ল রানা। জানি না। সার্চ করবে পুরো এলাকা। আমি হলে তাই করতাম।

অ্যামেট ডেকে নেবে অন্তত পঞ্চাশজন এজেন্ট, বলল রেবেকা।

মিলিয়ে গেল হেলিকপ্টারের সব আওয়াজ।

উঠে দাঁড়াল রানা। এবার রওনা হওয়া উচিত।

.

৪৩.

 ভীষণ ক্লান্তিকর দুই মাইল কখনও ফুরাবে না, মারা পড়বে ও, টলমল করে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে রানা। প্রতি পদক্ষেপে শেষ হয়ে আসছে শক্তি।

পথ দেখাচ্ছে রেবেকা। রানার ব্যাগ ওর হাতে। বারবার থামছে, সাহায্য করছে কঠিন জমিতে রানাকে এগোতে। নীরবে তিরিশ গজ পেছনে আসছে ক্যাথি। চেহারা ফ্যাকাসে। সাহস নেই রানার চোখে চোখ রাখবে। পাহাড়ি শেষ ঢালে জন্মেছে অসংখ্য পাইন গাছ। তার মাঝ দিয়ে নেমে চলেছে ওরা। সামনেই নদী।

নদীটা পেরোতে হবে, বলল রেবেকা। খুব খরস্রোতা, কিন্তু অগভীর। রানার হাত ধরে পানিতে নেমে পড়ল ও।

কিছুটা যাওয়ার পর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রানা। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি থরথর করে কাঁপিয়ে দিল ওর সর্বাঙ্গ। দুই হাতে রানাকে টেনে তুলল রেবেকা। নরম সুরে বলল, আর মাত্র কয়েক ফুট।

মুখ তুলে ওর নিশ্চয়তার মিষ্টি হাসি দেখল রানা। ভীষণ ঘুরছে মাথা। দাঁতে দাঁত চেপে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে। নদী পেরিয়ে শুয়ে পড়ল পাথুরে তীরে। কয়েক মিনিট পর এদিকের তীরে উঠল ক্যাথি। মানসিক জোর খাটিয়ে আবারও উঠে দাঁড়াল, রানা। হেঁটে চলল। নদী-তীর থেকে খাড়া হয়ে উঠেছে জমি। কিছুক্ষণ পর উঁচু এক জায়গায় পৌঁছুল ওরা। ব্যাগ থেকে বিনোকিউলার নিয়ে নিচের উপত্যকা দেখল রেবেকা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, ওই যে খামারবাড়ি!

ব্যথা ও ক্লান্তি সত্ত্বেও চমৎকার এক দৃশ্য দেখছে রানা। মাইলের পর মাইল জুড়ে ভোলা প্ৰেয়ারি। শেষ দুপুরের সূর্যের সোনালি আলোয় বহু দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ঝিকঝিক করছে সফেদ বরফ। রানার হাতে বিনোকিউলার দিল রেবেকা। ওটা চোখে তুলে একমাইল দূরে দুলন্ত ঘাসের ওদিকে খামারবাড়িটা দেখল রানা। পাহাড়ি এলাকায় ছোট্ট ফার্ম। কয়েকটা বার্ন, ওখানে সাদা রঙ করা বেড়ার ওপাশে কিছু ঘোড়া।

কাউকে দেখছি না, বলল রানা। চিমনিতে ধোয়াও নেই।

চলো, গিয়ে দেখি, বলল রেবেকা।

ধীর পায়ে খামারবাড়ি পর্যন্ত যেতে রানার লাগল পৌনে একঘণ্টা। গেট পেরিয়ে ধুলোময় পথ মাড়িয়ে আউটবিল্ডিঙের কাছে পৌঁছুল ওরা। একটা খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে বসল রানা। বাড়ির দিকে চলেছে রেবেকা। বোর্ড দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে বাড়ির একটা জানালা। নিচে ইট দিয়ে মেরামত করা বারান্দার মেঝে ঘুণে খাওয়া।

দরজায় থাবা চালাল রেবেকা। হ্যালো? কেউ আছেন?

জবাব দিল না কেউ। বারান্দা থেকে নেমে জানালা দিয়ে উঁকি দিল ও। ঘুরে তাকাল রানার দিকে। কাঁধ ঝাঁকাল। মনে তো হয় না কেউ আছে!  

মাথার ওপর আগুন ঢালছে সূর্য। কপালে হাত রেখে চারপাশ দেখছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল দেহটা।

এক শ গজ দূরে ঘাসের ভেতর ঘোড়ার খোয়াড়ের কাছে পড়ে আছে বৃদ্ধ। রানা টলতে টলতে ওদিকে রওনা হতেই ওর সঙ্গী হলো রেবেকা। একটু পর শিথিল দেহটার পাশে বসল ওরা। বৃদ্ধের পরনে পুরনো জিন্সের প্যান্ট। শার্টটা লাল চেক দেয়া। পালস্ দেখল রেবেকা। বেঁচে আছে।

কাছের খোঁয়াড় থেকে বালতিভরা পানি আনল রানা। বরফ ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিল মানুষটার মুখে। গুঙিয়ে উঠল বৃদ্ধ। চোখ পিটপিট করে উঠে বসতে চাইল। মাথার চুল ও দাড়ি পেকে শন। রোদে পোড়া পাকা চামড়ার মতই তামাটে তৃক। ব্যথায় কুঁচকে ফেলল গাল। চেপে ধরল একটা গোড়ালি। ওটা ফোলা, দেখল রানা।

আছাড় মেরে নিচে ফেলেছে, আঙুল তাক করে তরুণ এক ঘোড়া দেখাল বৃদ্ধ। একটু দূরে নিশ্চিন্তে ঘাস চিবুচ্ছে। ওটা। এখনও লম্বা দড়িতে বাঁধা।

কড়া রোদে জ্বলছে চারপাশ।

ভাববেন না, এবার রোদ থেকে আপনাকে সরিয়ে নেব, বৃদ্ধকে বলল রেবেকা।

দশ মিনিট পর রেবেকা ও রানার সাহায্য নিয়ে লচকে যাওয়া বারান্দায় উঠল বৃদ্ধ। বাড়ির ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা পরিবেশ। প্রায় অন্ধকার এক প্যাসেজ পেরোলে সিটিং রুম। দেয়াল থেকে খসে আসছে ওঅলপেপার। একপাশে নিচু কাউচ, পঞ্চাশ দশকের। ওটার ওপর বৃদ্ধকে শুইয়ে দিল রানা ও রেবেকা। কপাল থেকে ঘাম মুছল রানা। গুটিয়ে তুলতে লাগল বৃদ্ধের প্যান্টের পায়া।

বাজেভাবে মচকে গেছে, তবে ফাটল ধরেনি, ঝুঁকে দেখল রেবেকা।

কপাল ভাল যে তোমরা এসেছিলে, বলল বৃদ্ধ, এদিকে প্রায় কেউই আসে না। চামড়া কুঁচকে যাওয়া চোখে দেখল রানার রক্তাক্ত শার্ট। নামটা আমার বার্টন ক্যাসল।

আমি মাসুদ রানা। ও রেবেকা ট্রিপলার।

বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে ক্যাথি। দূর থেকে দেখছে রানা, রেবেকা ও বৃদ্ধকে।

ওই মেয়ের নাম কী? জানতে চাইল ক্যাসল। ওর কি নাম বলতে কিছু নেই?

আছে, বলল রানা। ওর নাম: সত্যিকারের মহাবিপদ। সাবধানে বুড়োর বুট খুলল ও। উঠানে দেখলাম অনেক কমফ্রি। জানেন, ওগুলো দিয়ে কীভাবে মলম তৈরি করতে হয়? ব্যথা কমবে, ফোলাও।

লাগবে না, বলল বৃদ্ধ। কিচেনের তাক ভরা সব জার রেখেছে গোল্ডেন সান। সব রেড ইণ্ডিয়ান মলম। কাজও করে জাদুর মত।

গোল্ডেন সান কে?

খামারে আমাকে সাহায্য করে। দুদিন আগে বদমাস এক ষাঁড়ের পেছনে গেছে। তারপর আর ফেরার নাম নেই।

দেখি দরকারি জার পাই কি না, কিচেনের দিকে চলল রেবেকা। পিছু নিল ক্যাথি।

সতর্ক চোখে রানাকে দেখল বৃদ্ধ। তুমি কিন্তু, বাছা, রাস্তা থেকে বহু দূরে সরে গেছ। বুঝতে পারছি, ঘুরতে বেরোওনি।

ঠিকই ধরেছেন, বলল রানা।

আর আমার ভুল না হলে তোমাকে খুঁজতেই এসেছিল ওই হেলিকপ্টার। সরকারী লোকজন পছন্দ করি না আমি।

ওরা ছিল সিআইএর, বলল রানা, খুঁজছে আমাদের তিনজনকে।

তোমাদেরকে খারাপ মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, বলল বার্টন ক্যাসল। আমার ক্ষতি করলে বা লুঠপাট করলে আগেই করতে। জানি না কীসে জড়িয়ে গেছ, আর জানতেও চাই না। যত কম জানব, ততই কম বলতে পারব। কে কেমন, সেটা দেখেই তাকে বিচার করি। মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। ওই হেলিকপ্টারে নরকের কীটের মত লোকটা অনেক নেমে এসেছিল। পরিষ্কার দেখেছে পড়ে আছি ঘাসের ভেতর। তাকে মজা পেয়ে হাসতে দেখেছি। সাহায্য না করে চলে গেছে। আজ একটু আগে তোমরা না এলে, আগামীকাল সকালেও বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে পারতাম না। বুঝতেই পারছ, কোনও দলে যোগ দিতে হলে, ওই কুকুরের পক্ষে যাব না আমি।

বড় এক সবুজ মলমের জার হাতে ঘরে ঢুকল রেবেকা। ওটা খুলে পরখ করল রানা। হ্যাঁ, কমফ্রি। এবার ব্যথা আর ফোলা কমবে। মলম নিয়ে বৃদ্ধের আহত গোড়ালিতে মাখল ও। কাজটা শেষ করে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে নাড়ল পা-টা। রেবেকার আনা টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দিল গোড়ালি। ঠিক আছে, আপাতত কয়েক দিন বিশ্রাম নিতে হবে।

তোমাকেও তো, বাছা, সুস্থ লাগছে না, বলল বৃদ্ধ। আগেও গুলির ক্ষত দেখেছি।

চরকির মত বনবন ঘুরছে রানার মাথা। জোর করে হাসল। না, ঠিক আছি।

চিন্তিত চোখে ওকে দেখছে রেবেকা। চলে এল ওর পাশে। ঠিক তখনই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল রানা।

.

৪৪.

 একটু পর পর সচেতন হয়ে আবারও জ্ঞান হারাচ্ছে রানা। এটা ঘটছে বারবার। একবার ফিরছে আলোময় জগতে, আবারও তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। অস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে, চিরকাল ধরেই চলছে এমন। একবার শুনছে কণ্ঠস্বর, দেখছে নড়াচড়া, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে সব।

আবছা মনে আছে, উঠে এসেছে সিঁড়ি বেয়ে। ওর কাঁধ ছিল রেবেকার ঘাড়ে। ঢুকল একটা ঘরে। শুইয়ে দিল রেবেকা ওকে বিছানায়। টানটান ছিল সুতি চাদর। ভিজে গেল তাজা রক্তে। ওর ওপর ঝুঁকে এল রেবেকা। গভীর কালো চোখে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ। আবারও চেতনা হারাল ও।

তবে এবার জ্ঞান ফিরে দেখছে, ও আছে অচেনা এক ঘরে। কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আসছে ভোরের লালচে আলো।

কিছুক্ষণ পর বালিশ থেকে মাথা তুলতে চাইল রানা।

 কাজটা কঠিন।

কাঁধে নতুন ব্যাণ্ডেজ। ব্যথা আছে, কিন্তু তীব্র নয়।

বড় কোনও ঘরে আছে। নিচতলার মত নয়। সব পরিষ্কার। তকতকে। ব্যবহার করা হয় না এই ঘর। শুয়ে আছে তামার ফ্রেমের ডাবল খাটে। কারুকাজ করা বেড কাভার। ঘরের কোণে বেসিন। খাটের পাশে কাঠের রকিং চেয়ার। ওটার ওপর রাখা ওর কাপড়চোপড়। নতুন নীল ডেনিম শার্ট ও পরিষ্কার জিন্স প্যান্ট।

রানার পাশে অগোছালো হয়ে ঘুমিয়ে আছে রেবেকা। বেড কাভারে ছড়িয়ে আছে একরাশ কালো চুল। একটা হাত রানার ঊরুর ওপর। আনমনে ভাবল রানা, না জানি কত ঘন্টা সেবা করে তারপর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা!

নড়ে উঠল, রেবেকা। চোখ মেলে সরাসরি তাকাল রানার চোখে। ঝট করে জেগে এভাবে সতর্ক হয় শুধু বুনো প্রাণী ও ট্রেইল্ড পারসোনেল। হাই তুলে ধীরেসুস্থে জেগে ওঠা আর সতর্ক হওয়ার মাঝের সময়টা রেবেকার নেই। এখন নেই ওর সেই উলের জাম্পার। পরনে ফার্মের লাল চেক দেয়া শার্ট। ওটা অনেক বড় ওর তুলনায়। গিঁঠ মেরে নিয়েছে কোমরে।

জীবিত জগতে স্বাগতম, মিষ্টি হাসল রেবেকা।

কাজটা তুমি করেছ? জানতে চাইল রানা।

মাথা দোলাল মেয়েটা। গভীরে যেতে হয়েছে, তবে বেরিয়ে এসেছে। হাড়ে লাগেনি বুলেট। একটু চ্যাপ্টা হয়েছে, তবে ফেটে ছড়িয়ে যায়নি। বেডসাইড টেবিল থেকে ছোট একটা টিনের কাপ নিয়ে নাড়ল রেবেকা।

কাপ নিয়ে ভেতরে উঁকি দিল রানা। একটু চেপ্টে যাওয়া ছোট্ট বুলেট রীতিমত নিরীহ দেখাল। দুবার প্রাণ বাঁচালে, বলল রানা।

ওর হাত থেকে কাপ নিয়ে টেবিলে রাখল রেবেকা। ঠাণ্ডা হাতে স্পর্শ করল রানার কপাল। এখনও বেশ জ্বর। শুয়ে থাকো।

বালিশে মাথা এলিয়ে দিল রানা। সরে যেতে হবে এখান থেকে।

আপাতত কদিন সেটা সম্ভব নয়। বার্টন ক্যাসল বলেছেন, আমরা যত দিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পারি।

কেমন আছেন উনি?

ঘুমুচ্ছেন। ঠিক হয়ে যাবেন। হাসল রেবেকা। ওঁর ধারণা, আমরা বিবাহিত।

ক্যাথি কোথায়?

নিচের একটা ঘরে। খুব ক্লান্ত। ওর ওপর চাপ তৈরি করা ঠিক হবে না তোমার।

সম্ভব হলে ওকে খুন করতাম।

 খুব লজ্জিত মনে হলো। লজ্জায় মুখ ঢাকা উচিত ওর।

রানার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রেবেকা। চোখের কাছ থেকে সরিয়ে দিল চুল। বাইরে বাড়ছে রোদ। দূরে চিহি-চিহি শব্দে ডাকল কয়েকটা ঘোড়া। পাল্টা চিৎকার ছাড়ল একটা কুকুর। গিয়ে জন্তুগুলোকে খাবার দেব, বলল রেবেকা। আপাতত উঠতে পারবেন না ক্যাসল।

একটু অপেক্ষা করো।

মৃদু হাসল রেবেকা। ঠিক আছে।

চুপ করে বসে থাকল ওরা। কিছুক্ষণ পর বল। রেবেকা, তুমি অনেক স্বপ্ন দেখো। গতরাতে জ্বরের ভেতর প্রলাপ বকছিলে।

তাই?

মাথা দোলাল মেয়েটা। ঘুমের ভেতরেও। তোমার জীবনে এসেছে কিছু মেয়ে। কেউ কেউ মারা গেছে। তাদের একজনের নাম ছিল লুবনা, আরেকজন রেবেকা সাউল। কেউ কেউ হারিয়ে গেছে ভুল বুঝে। …বলবে, আসলে কেমন তোমার জীবনটা?

চুপ করে থাকল রানা।

একটু পর নরম সুরে বলল রেবেকা, গতকাল পোশাক খুলে তোমাকে শুইয়ে দিয়েছি বিছানায়। বের করেছি কাঁধ থেকে বুলেট। রক্তে ভিজে গিয়েছিল হাত। ক্ষতটা সেলাই শেষে ব্যাণ্ডেজ করেছি। স্নান করিয়ে পাশে বসে শরীর থেকে মুছে দিয়েছি ঘাম। জেগে ছিলাম প্রায় সারারাত। শুনেছি তোমার মনের গভীর দুঃখের সব কথা। কিন্তু তখন ছিলে প্রায় অচেতন। এখন তা নও। যদি বলতে চাও কিছু, মন দিয়ে শুনব।

অনেক কথা যে, বলল রানা। বলতে গেলে দিনের পর দিন লাগবে।

আমরা তো এখান থেকে সরে যেতে পারব না। বলতে শুরু করতে পারো।

আমার জীবনে ঘটেছে অনেক খারাপ ঘটনা।

সবার জীবনেই দুঃখজনক সব ঘটনা থাকে।

তা ঠিক।

জ্যাঁ মউরোস মারা গেছে, সেটা তোমার দোষে নয়, বলল রেবেকা, নিজেকে দোষ দিয়ে চলেছ, এটা অযৌক্তিক। জানতে না কী ঘটবে। তুমি শুধু চেয়েছিলে তোমার বন্ধুকে সাহায্য করতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

কী? রানার চোখে তাকাল রেবেকা। নিজের ওপর দোষ টেনে এনো না। দায় তোমার ছিল না।

বিড়বিড় করল রানা, ঘোড়াগুলোকে খেতে দেবে না? …বাইরে কিন্তু বেশিক্ষণ থেকো না। আবার ফিরতে পারে হেলিকপ্টার।

মৃদু হাসল রেবেকা। এত সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে আমি নই।

ওকে দেখল রানা। হয়তো ঠিকই বলেছ। দোষটা আমার ছিল না। আবার চুপ করে গেল ও।

কিন্তু আরও কিছু কথা আছে তোমার, বলে ফেলো।

চোখ বুজল রানা।

 বললে একটু হালকা হবে বুক।

কিছুক্ষণ পর ফিসফিস করল রানা, কিছু করতে হবে মউরোসের স্ত্রী আর ওর অনাগত বাচ্চার জন্যে। …আর প্রতিশোধ নিতে হবে। ওদের জন্যে না হলেও, আমার নিজের জন্যে। মউরোসের খুনিদের কেউ যেন না থাকে পৃথিবীর বুকে!

.

৪৫.

 তিল তিল করে পেরোচ্ছে সকাল। রানা টের পাচ্ছে, বেশ দ্রুতই ফিরছে ওর শক্তি। তাতেও হয়ে উঠছে অধৈর্য। নিজেকে সামলে গত কদিনের প্রতিটি ঘটনা মনের ভেতর নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।

বারবার মনে পড়ছে থর্নের কথা।

লোকটা কে?

এজেণ্ট নয়।

 পুলিশও না।

ক্যাল অ্যামেটের মত যোদ্ধা নয়।

 তবে নেতা সে।

সংগঠক।

মগজ খাটিয়ে চলে লোকটা।

হাতে আছে যা খুশি করার মত ক্ষমতা।

 হয়তো কোনও রাজনৈতিক নেতা।

 কিন্তু নামকরা কেউ নয়।

রেবেকা তার নাম কখনও শোনেনি।

এমন কেউ, যে কি না থাকে আড়ালে ছায়ার ভেতর।

স্টিভ বার্কলের বিষয়ে আগ্রহ আছে তার। ভাবছে, ক্যাথির ওস্ট্রাক প্রকাশিত হলে ক্ষতি হবে তার।

ধর্ম আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বার্কলে। চাইছে গভর্নর হতে। এখনও হয়নি বড় নেতা। কিন্তু তার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী কেউ টের পেয়েছে, বার্কলের ব্ল্যাকমেইলারের কারণে ক্ষতি হবে তার। ওই লোক নির্দেশ দিয়েছে বলে নোংরা সব অপরাধে নেমে পড়েছে থর্ন। প্রয়োজনে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করছে না।

কিন্তু রানার অন্তর বলছে, এসবের মধ্যে অন্যকিছু আছে। শুধু ক্ষমতার জোরে সিআইএর এজেন্টদের কাজে লাগাতে পারত না ওই লোক বা থর্ন। আরও বড় কিছু ঘটছে।

ভাবতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে শুয়ে থাকল রানা। কিন্তু অনেকক্ষণ পর আর সহ্য হলো না, বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল। টলমল করছে ওর পা। ঘুরছে মাথা। তবে আগের চেয়ে জোর ফিরেছে শরীরে। পরনে একটা হাফপ্যান্ট। ওটা একবার দেখে নিয়ে বুকের দিকে তাকাল রানা। শক্ত করে বুক ও কাঁধে ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছে রেবেকা।

জানালার সামনে গিয়ে থামল রানা। খামারের অন্য দালান ও খোয়াড় দেখছে। প্ৰেয়ারির বহু দূরে আকাশছোঁয়া নীল পাহাড়। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার খামারের ভেতরে চোখ বোলাল রানা। একটা বানের পাশে জং-ধরা প্রাচীন এক ফোর্ড পিকআপ ট্রাক। কিছুক্ষণ ওটা দেখার পর আনমনে মাথা দোলাল ও।

বেসিনের সামনে গিয়ে পানি ছিটিয়ে ভালভাবে ধুলো মুখ হাত। ফিরে এল বিছানার পাশে, চেয়ার থেকে নিল জিন্সের প্যান্ট। ওটা নতুন। বত্রিশ ইঞ্চি কোমরের লোক ক্যাসল, তার হতে পারে না। রানার দেরি হলো না প্যান্ট পরে নিতে। যেন ওর জন্যেই তৈরি। বোধহয় গোল্ডেন সানের। তার কথা বলেছিলেন ক্যাসল। ডেনিম শার্ট পরে নিল রানা।

নিচতলা থেকে আসছে কফির সুবাস।

 নিচে নড়াচড়া করছে কেউ।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিল রানা, তারপর চওড়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। কয়েক সেকেণ্ড পর ঢুকল বড়সড় কিচেনে। প্রকাণ্ড এক সিলিণ্ডারের গ্যাস ব্যবহার করে চুলায় কী যেন রাঁধছে রেবেকা। তুবড়ে যাওয়া এক প্যানে চিড়বিড় আওয়াজ তুলছে ভেড়ার মাংস।

রানা ঘরে ঢুকতেই অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল রেবেকা। আরে, উঠে পড়েছ? আমি খাবার নিয়ে ওপরে যাচ্ছিলাম।

বলল তো, ইউএসএর কোন্ রাজনৈতিক নেতা বাইবেল ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে? জানতে চাইল রানা।

কিছুক্ষণ চুপ করে ওকে দেখল রেবেকা, তারপর বলল, প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিল, স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন ইরাকে হামলা করতে।

ওই অপদার্থের কথা বাদ। ঈশ্বরের লেজ ধরে প্রেসিডেন্ট হতে চাইছে কে?

রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে চাইছে হাজার হাজার খ্রিস্টান নেতা, বলল রেবেকা, কেউ কেউ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তবে আপা ত মনে পড়ছে না কারও নাম। কেন, হঠাৎ করে এই চিন্তা লি কেন তোমার মনে?

না, বোধহয় ভুলই ভাবছি।

তোমার তো শুয়ে থাকার কথা। বিশ্রাম নেয়া উচিত।

অনেকটা শক্তি ফিরেছে।

দেখে অবশ্য তা-ই মনে হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে দুর্বল হবে। ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।

এখন যোব না। বাইরে দেখেছি একটা পিকআপ ট্রাক। পুরনো। কিন্তু চালু হলে ওটা নিয়ে আমরা বেরিয়ে যেতে পারব। ওটার যা দাম, তার দ্বিগুণ দেব মিস্টার ক্যাসলকে। পরে ভাল একটা কিনে নেবেন।

শুনে ভালই লাগে, কিন্তু ওটা নিয়ে কোথাও যেতে পারব না, বলল রেবেকা। চালু করতে গিয়ে টের পেয়েছি, ব্যাটারি ঠিক থাকলেও ওটার স্টার্টার মোটর নেই।  

এসপিয়োনাজ এজেন্ট, ডাক্তার, গাড়ির মিস্ত্রী আর রূপবতী, গুণী মেয়ে একইসঙ্গে এত কিছু! হাসল রানা।

কফিটাও খুব খারাপ বানাই না। খাবে এক কাপ?

ছাড়ে কে! রেবেকার কাছ থেকে কফির মগ নিয়ে সাবধানে চুমুক দিল রানা। চমৎকার স্বাদ।

খালি পেটে কফি খেয়ো না, তোমার জন্যে ফ্রেঞ্চ টোস্ট করেছি। আরও পাবে ভেড়ার ভাজা মাংস আর সেদ্ধ মটরশুটি। রানার বিস্মিত দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসল রেবেকা। আগে কখনও ভদ্রমহিলা দেখোনি? ওই যে, যাদেরকে তোমরা বলো মা, বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী বা মহিলা আত্মীয়স্বজন? ওই যে, যাদেরকে ছোট না করলে মোটেও ভাল লাগে না বেশিরভাগ পুরুষের?

চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে পড়ল হতবাক রানা। দুমিনিট পর ওর সামনে নাজেল হলো স্তূপ করা দারুণ গন্ধের সুস্বাদু খাবার। খেতে গিয়ে মনে পড়ল ক্যাথির কথা। কণ্ঠ থেকে তিক্ততা সরাতে পারল না। কোথায় আমাদের মহারানি?

ঠিক করেছে ঘর থেকে বেরোবে না।

 মিস্টার ক্যাসল?

তোমার মতই গোঁয়ার, বলল রেবেকা। লেংচে লেংচে গিয়ে জন্তুগুলোকে খাবার দিচ্ছেন। বুড়ো কঠিন চিড়িয়া। আমাকে বলেছেন, আগে একসময়ে মেরিন ছিলেন।

ভিয়েতনাম?

কোরিয়া, খসখসে কণ্ঠে বলল কেউ। ঘুরে তাকাল ওরা। দরজা খুলে এইমাত্র খোঁড়াতে খোঁড়াতে কিচেনে ঢুকেছেন ক্যাসল। টেবিলের পাশে লাঠি রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। তাঁর সামনে খাবারের প্লেট রাখল রেবেকা। বিড়বিড় করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন বৃদ্ধ, তারপর খেতে লাগলেন গোগ্রাসে। চুপচাপ খাচ্ছে ওরা তিনজন। একটু পর বার্নের কাছে পুরনো পিকআপ ট্রাকের কথা তুলল রানা।

চালু হলে তোমাকে দিয়ে দেব, বললেন ক্যাসল। বুঝলে, একটা পুরনো ছাউনির নিচে তারপুলিন দিয়ে ঢাকা আরেকটা ট্রাক পাবে। ইঞ্জিন নষ্ট। তবে কাজ করবে বোধহয় ওটার স্টার্টার মোটর। চেষ্টা করে দেখতে পারো।

চেষ্টা অবশ্যই করব, বলল রানা।

রেবেকার দিকে তাকালেন ক্যাসল। অ্যাই, মেয়ে, তুমি কি বুলেট বের করেছ এই ছোকরার কাঁধ থেকে?

মৃদু মাথা দোলাল রেবেকা। পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়েছি।

মাথা দোলালেন ক্যাসল। গুড। তা হলে ওদিকের ওই তাক থেকে সবুজ বোতলটা নাও।

ওটা দিয়ে কী হবে? জানতে চাইল রানা।

জাদুর মত কাজ করবে, বললেন ক্যাসল। ইণ্ডিয়ান মলম। দেখবে দুদিনে সেরে যাবে ঘা।

রানার দিকে তাকাল রেবেকা। মাথা দোলাল রানা।

গিয়ে ওপরের তাক থেকে সবুজ বোতল এনে ছিপি খুলল। রেবেকা। কুঁচকে গেল নাক বিটকেলে গন্ধে।

গন্ধটা গুয়ের মত হলেও ফুলের নির্যাস দিয়ে তৈরি, ভরসা দিলেন ক্যাসল।

রানার কাঁধের ব্যাণ্ডেজ খুলল রেবেকা। আঙুলে মলম নিয়ে মাখিয়ে দিল ক্ষতের ওপর। আবার করে দিল ব্যাণ্ডেজ।

ঠিক দুদিনে দেখবে ঠিক হয়ে গেছ, বললেন ক্যাসল।

বেচারা নাকটাকে দূরে রেখে এলে বুঝি ভাল ছিল, বিড়বিড় করল রানা।

পাশের কাবার্ড থেকে একটা বোতল নিলেন ক্যাসল। বোতলের ভেতরে স্বচ্ছ তরল। খাওয়ার পর একটু ড্রিঙ্ক না নিলে চলে না। নেবে নাকি দুএক পেগ? রানা বা রেবেকা হাঁ বা না বলার আগেই তিনটে মগে পানির মত জিনিসটা ঢাললেন তিনি। মগ বাড়িয়ে দিলেন ওদের সামনে। খুবই ভাল জিনিস। আমি নিজেই ডিসটিল করেছি।

মগ তুলে চুমুক দিল রানা। বুঝে গেল, স্কচ উইস্কির অন্তত দ্বিগুণ তাকদ ওটার। পটিনের কথা মনে করিয়ে দিল। আইরিস মুনশাইন।

এক লোককে চিনতাম, ঊনসত্তর সালে ডজ জিপ চালাত ওই জিনিস দিয়ে, বিড়বিড় করলেন ক্যাসল।

বৃদ্ধকে দেখছে রানা। কঠোর লোক উনি, কিন্তু অন্তরটা পরিষ্কার। আমাদেরকে থাকতে দিয়েছেন বলে আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ, বলল ও। ছেড়ে দিয়েছেন নিজের বেডরুম। সেজন্যে লজ্জিত বোধ করছি। আমাকে বার্নে থাকতে দিলেও হতো।

থুতনির শনের মত পাকা দাড়ি খামচে ধরে চুলকে নিলেন ক্যাসল। দুঃখিত হেসে বললেন, ওই ঘর শেরির। এখন আর ওখানে থাকি না। ও বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো যে তোমরা ওখানে থাকছ।

রেবেকা আর রানা পরস্পরের দিকে তাকাল। চুপ করে থাকল। কয়েক সেকেণ্ড পর কড়াৎ আওয়াজে খুলে গেল দরজা। ওদিকে চেয়ে ওরা দেখল, চেহারায় অনিশ্চয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথি।

চেয়ার টেনে বোস, লেডি, বললেন ক্যাসল।

উঠে চুলোর কাছ থেকে এনে টেবিলে চতুর্থ প্লেট রাখল রেবেকা। ওটাও গরম খাবারে ভরা। এসো, খেয়ে নাও।

এগিয়ে এসে বিমর্ষ চেহারায় চেয়ারে বসল ক্যাথি। খেতে লাগল চুপচাপ। ওকে পাত্তা দিল না রানা। খাবার শেষ করে মহা উৎসাহে জিভ দিয়ে প্লেট চাটতে লাগলেন ক্যাসল। কাজটা শেষ করে বললেন, আহা, কত দিন মেয়েদের হাতের রান্না খাইনি! চেয়ারে হেলান দিয়ে এক চুমুকে শেষ করলেন জ্যোৎস্না তরল। এবার পকেট থেকে বেরোল চেপ্টে যাওয়া এক প্যাকেট লাকি স্ট্রাইক সিগারেট। রানাকে একটা শলা দিয়ে আগুন জ্বেলে দিয়ে নিজেও একটা ধরালেন।

ঘরের কোণে দেয়ালে ঝুলছে প্লাস্টিকের কমদামি ফোন। ওটার ওপর চোখ পড়েছে ক্যাথির। চোরের মত চেহারা করে রানাকে বলল, বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে পারি?

মানা করতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু বলে উঠলেন ক্যাসল, ওটা কাজ করে না, মিস। গত দুবছর ধরে ধুলো জমিয়ে রাখছে। আর বিল দিই না। শেরি মাঝে মাঝে ওর বোনের সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু ওই জিনিসটা আমার কখনও ভাল লাগেনি। সরাসরি চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভালবাসি আমি। কাঁধের ওপর দিয়ে বুড়ো আঙুল পেছনে নিলেন। সবচেয়ে কাছে মেলভিলের খামারে ফোন। টিলা পেরোলে নয় মাইল দূরে।

রেবেকার দিকে তাকাল ক্যাথি। তোমার সেল ফোন?

এদিকে রিসেপশন নেই, বললেন ক্যাসল, মেলভিলের খামারেও নেই।

ও, তা হলে যাব মিস্টার মেলভিলের খামারে, বলল ক্যাথি। আমাকে একটা ঘোড়া ধার দেবেন?

কোথাও যাওয়া উচিত হবে না তোমার, সতর্ক করার সুরে বলল রানা।

তখনই উঠানে ঘোড়র ক্ষুরের আওয়াজ পেল ওরা। ধুলো ভরা জানালার কাঁচ দিয়ে দেখল চকচকে কালো এক ঘোড়ায় চেপে হাজির হয়েছে ব্রোঞ্জরঙা এক যুবক। ডেনিম জ্যাকেট থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল সে। জন্তুটার দড়িটা বেঁধে দিল খুঁটিতে।

ও-ই গোল্ডেন সান, বললেন ক্যাসল। বোধহয় পেয়ে গেছে ষাঁড়টাকে। যুবকের সঙ্গে কথা বলতে চেয়ার ছেড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেলেন বাইরে।

জানালা দিয়ে আগ্রহ নিয়ে যুবককে দেখছে ক্যাথি। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রানা বুঝে গেল, কী ভাবছে মেয়েটা। রেড ইণ্ডিয়ান যুবক সুদর্শন, পোক্ত শরীর, বয়স বড়জোর তেইশ। তার কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আছে ক্যাথির।

মনে রেখো কী বলেছি, বলল রানা, বাড়ি ছেড়ে বেরোবে না। সিআইএর লোক খুঁজছে তোমাকে।

জবাব দিল না ক্যাথি।

রেবেকার দিকে তাকাল রানা। চলো, গিয়ে দেখি চালু করতে পারি কি না পিকআপ ট্রাক।

.

৪৬.

 নাটবল্টুর ঘাট একবার ঘষা খেয়ে গোল হলে আর খুলতে পারবে না, রানাকে সতর্ক করল রেবেকা।

বিশাল বার্নের দেয়ালের ফাটল গলে ধুলো ভরা মেঝে, বেড়ার খুঁটি, যন্ত্রপাতি, ড্রাম ভরা তেল, সারের বস্তা ইত্যাদি অসংখ্য মালপত্রের ওপর পড়েছে সূর্যের সোনালি রোদ। ওপরতলায় খড় রাখার জায়গায় কক্‌-করো-কক্ করছে মোরগ-মুরগি।

বার্নের একেবারে পেছনে আরও অনেক বেশি পুরনো এক পিকআপ ট্রাকের চেসিসের নিচে শুয়ে আছে রানা। মুখে পড়ছে লালচে জং। নাটবল্ট না খুললে সরাতে পারবে না স্টার্টার মোটর।

চেইন রেঞ্চ নাও, কাজে আসবে, রানার দিকে যন্ত্রটা বাড়িয়ে দিল রেবেকা।

স্প্যানার রেখে রেঞ্চ নিল রানা। মুখ তুলে তাকাল রেবেকার দিকে। হঠাৎ করেই ওর মনে হলো, এত সুন্দরী মেয়ে বহু দিন দেখেনি। আগেও এমন হয়েছে ওর। রেবেকার কাঁধে ঝুলছে কালো বেণী। দুএক গোছা চুল আলগা হয়ে আরও আকর্ষণীয় করেছে ওকে। গরম বার্নে শার্টের হাতা তুলে দিয়েছে কাঁধ পর্যন্ত। পেলব বাহুতে সামান্য তেল। চেক শার্টের তিনটে বোতাম খোলা। চোখের ওপর থেকে সরাল এক গোছা চুল।

মেকানিক হয়েছ সিআইএতে চাকরি নিয়ে?

হাসল রেবেকা। না। আমার চার ভাই। পাগল গাড়ির ব্যাপারে। ওদের পেছন পেছন ঘুরেই শিখেছি সব।

চেইন রেঞ্চ ঠিক ঘাটে বসিয়ে মোচড় দিল রানা। কড়াৎ আওয়াজ তুলল নাটবল্ট। ঘুরে গেছে সামান্য। আসল কাজ শেষ। দুই মিনিটে স্টার্টার মোটর খুলে নিল রানা। বেরিয়ে এল পিকআপের তলা থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে কুঁচকে ফেলল ভুরু।

পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল রেবেকা। তাড়াহুড়ো না করলেও পারতে। কাজটা আমি করতে পারতাম।

রেবেকার স্পর্শ মসৃণ ও উষ্ণ। এরই ভেতরে অনেক কাজ করে ফেলেছ, বলল রানা।

ওর হাতে স্টার্টার মোটরের দিকে তাকাল রেবেকা। জিনিসটা জং-ধরা, ভারী। লেজে ঝুলছে তার। মনে করো কাজ হবে?

এখনও জানি না।

রানার কাছ থেকে স্টার্টার মোটর নল রেবেকা। কয়েক সেকেণ্ড ওর আঙুল স্পর্শ করে থাকল রানার আঙুল। ওটা প্রায় আদরের মত। মুখ তুলে দেখল রানাকে। আমার ভাল লেগেছে।

ভুরু নাচাল রানা। কী বিষয়ে ভাল লাগল?  

এত কিছু হলো, এত বিপদ, তবুও আমি খুশি দেখা হয়েছে তোমার সঙ্গে। তবে একইসঙ্গে খারাপও লাগছে। চলে যাবে, আটকাতে পারব না। মাত্র শুরু করেছি চিনতে।

চুপ করে আছে রানা।

পেরিয়ে গেল কয়েকটা মুহূর্ত।

পরস্পরের চোখে চেয়ে রইল ওরা। স্টার্টার মোটরটা নামিয়ে রাখল রেবেকা।

মৃদু কেঁপে সামান্য খুলল রেবেকার দুঠোঁট। বিড়বিড় করল, তুমি অনেক একা, তাই না? শক্ত করে ধরল রানার বাহু। জানি, কাউকে কষ্ট দেবে না বলে দূরে থাকো। ওই একই অনুভূতি ছিল আমারও। ঠকাব না কাউকে। চিরকালের জন্যে বাঁধনে বাঁধতে চাইব না কাউকে।

আরেকটু ফাঁক হলো রেবেকার ঠোঁট। আমন্ত্রণের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানার চোখে। দুসেকেণ্ড পর লোভনীয়, উষ্ণ, ভেজা অধরে নামল রানার চির ক্ষুধার্ত ঠোঁট।

হারিয়ে গেল ওরা দুজন।

একটু পর রেবেকাকে দুহাতে তুলে নিল রানা। চলে গেল একটু দূরে খড়ের গাদার কাছে। আস্তে করে শুইয়ে দিল ওকে। নিজেও বসল পাশে। রানার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে রেবেকা।

কিছু বলার আগেই ওরা শুনল রোটরের ধুপ-ধুপ আওয়াজ। বাড়ির বাইরে গুলি। ওই আওয়াজ ছাপিয়ে এল ক্যাথির বেসুরো আর্তনাদ।

.

বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ক্যাথি। বিরক্ত ও কামনার্ত। কতকাল পুরুষ সঙ্গ থেকে বঞ্চিত!

একটু পর জানালা দিয়ে দেখল একশ গজ দূরে খোঁয়াড়ে গোল্ডেন সান। ট্রেনিং দিচ্ছে তরুণ এক ঘোড়াকে। ওই ঘোড়াই ফেলে দিয়েছিল ক্যাসলকে।

দূর নীলাকাশে তাকাল ক্যাথি। একফোঁটা মেঘ নেই। ঝিরঝিরে হাওয়ায় দুলছে প্ৰেয়ারির সবুজ ঘাস। হঠাৎ করেই ওর মনে হলো, মরে যাবে বেরোতে না পারলে। কথা বলতে হবে গোল্ডেন সানের সঙ্গে। কী দারুণ আকর্ষণীয় ওই যুবক! যেন সিংহের মত শক্ত সব পেশি!

ওকে জড়িয়ে ধরলে কেমন লাগবে লোকটার?

আর তারপর, দুজন মিলে…

না, আর তর সইছে না ওর।

 কেমন কেমন লাগছে শরীরটা।

পাগলাটে সব চিন্তায় হাঁফিয়ে উঠল ক্যাথি।

 কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর ওর মনে পড়ল রানার কথা।

ওকে বলেছে বাড়ির ভেতরে থাকতে।

মরুক হারামজাদা!  

লোকটা গাধা মনে করে ওকে?

 হেলিকপ্টার আসার অনেক আগেই আওয়াজ পাবে ও।

অযথা নষ্ট করছে ভরা যৌবন!

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা খোয়াড়ের দিকে চলল ক্যাথি। ভাল লাগছে রোদে তপ্ত খোলা হাওয়ায় হাঁটতে। দূর থেকে ওকে দেখেছে যুবক। জানেও না, ওকে দিয়ে খায়েস মিটিয়ে নেব, ভাবল ক্যাথি। ক্ষতি নেই, বরং দুজনেরই লাভ। চওড়া হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ইণ্ডিয়ান যুবকের কাছে। পৌঁছে গেল ক্যাথি। হাই! আমি ক্যাথি। তুমি নিশ্চয়ই গোল্ডেন সান?

ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামল যুবক। হাত বাড়িয়ে দিল হ্যাণ্ডশেকের জন্যে। খুশি হলাম পরিচিত হয়ে, ক্যাথি।

প্রশংসা খুব পছন্দ করে ক্যাথি। প্রয়োজনে পাম্প দিতেও কম জানে না। মাত্র পাঁচ মিনিটে পটিয়ে ফেলল লাজুক রেড ইণ্ডিয়ান যুবককে।

গোল্ডেন সান ভাবছে: চাইলে কোথায় পাব সোনালি চুলের এমন সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী? আজ যা আছে কপালে!

ছোট এক দালানের আড়ালে গেল ওরা।

ব্যস্ত হয়ে উঠল দুজন।

গোল্ডেন সানের শার্টের প্রায় সব বোতাম একটানে ছিঁড়ে ফেলল ক্যাথি। যুবককে কাছে পেতে হয়ে উঠেছে উন্মাদিনী।

হাঁ করে রূপসী ক্যাথিকে দেখতে দেখতে প্যান্টের বোতাম খুলছে গোল্ডেন সান। কিন্তু ওপর দিয়ে গেল কালো এক বড় ছায়া!

ওদের মনে হলো সূর্যের পেট চিরে এসেছে ওই কপ্টার। নাক নিচু, লেজ আকাশে। মাটি থেকে ঝাড় মেরে ধুলোবালি তুলছে ঝোড়ো হাওয়া। পরক্ষণে স্কিডে পা রাখল রাইফেল হাতে এক লোক। কেবিন থেকে এল একরাশ গুলি।

আগেই লাফিয়ে উঠে প্যান্ট টেনে নিয়ে দৌড় শুরু করেছে ক্যাথি। সিনেমার রেপের উত্তেজনাময় দৃশ্যের মতই পেছনে ছুটছে খলনায়ক গোল্ডেন সান। আকাশ থেকে এসে গুলি ছুঁড়ছে দেখে ভয়ে আত্মা উড়ে গেছে ওর!

ক্যাথি আর গোল্ডেন সানের পায়ের কাছে নাক গুজল এক পশলা গুলি। কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল ক্যাথি। ভীষণ ভয়ে বিকৃত হয়েছে সুন্দর মুখ।

কপ্টার থেকে ফোকলা হাসছে ক্যাল অ্যামেট, হাতে এম সিক্সটিন রাইফেল। আবারও গুলি ছুঁড়ল সে। আছে মহানন্দে, হাতে লাফিয়ে উঠছে অস্ত্র। কিন্তু হোঁচট খেয়ে ক্যাথিকে মাটিতে পড়তে দেখে কষ্টে বুক আঁকড়ে এল তার।

যাহ্, শেষ হয়ে গেল সব মজা?

না, ইণ্ডিয়ানটা টেনে তুলেছে বেশ্যা হারামি বেটিকে!

এদিকে একদৌড়ে বার্ন ছেড়ে বেরিয়েই একটু দূরে ক্যাথির সাদা, থলথলে নিতম্বের দুলুনি চোখে পড়ল রানার। কাঁধে প্যান্ট তুলে প্রাণপণে পালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। পাশে গোল্ডেন সান। দৌড়ে কেউ কম যায় না!

এবার হেলিকপ্টার দেখল রানা। স্কিডে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পাইলটকে কী যেন বলছে ক্যাল অ্যামেট। কাত হলো কপ্টার। কিন্তু ততক্ষণে ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে ক্যাথি ও গোল্ডেন সান। পেছনে ধুপ করে বন্ধ করে দিল দরজা। তাতে রেগে গিয়ে বারান্দার ওপর ঝাল ঝাড়ল অ্যামেট। কাঠের তক্তা খুবলে তুলল একরাশ গুলি। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাঁচের জানালা।

বাড়ির ভেতর ক্যাথিকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে ওর ওপর চড়াও হয়েছে ইণ্ডিয়ান যুবক, উদ্দেশ্য মেয়েটাকে আড়াল করা। গুলির প্রচণ্ড আঘাতে নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে। ভাঙা কাঁচ। ছিঁড়ে কুচি-কুচি হলো পর্দা। খটাখট দেয়ালে লাগছে বুলেট। গোল্ডেন সানের কানের কাছে পোয়াতি শেয়ালের মত বিচ্ছিরি চিৎকার জুড়েছে ক্যাথি। ওর লালচে গালে কষে চড় দেবে কি না, ভাবল যুবক। আনমনে মাথা নাড়ল, অত সহজ নয় সুন্দরীদেরকে চড়িয়ে দেয়া!

ওদিকে রানার পিছু নিয়ে বার্ন থেকে বেরিয়ে এসেছে রেবেকা। ওদের চোখের সামনে বাড়ির উঠানের বিশ ফুট ওপরে ভাসছে হেলিকপ্টার। প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে বেরেটা পিস্তল বের করেই কপ্টারের দিকে তাক করল রানা। ওই একই সময়ে ওদের দিকে ঘুরল যান্ত্রিক ফড়িং। নিচু হয়ে ছুটে এল বার্নের দিকে। প্রায় মাটি ছুঁই-ছুঁই করছে স্কিড।

রাইফেল হাতে লোকটাকে চিনে ফেলল রানা। দেরি হলো না গুলি পাঠাতে। কানের পাশ দিয়ে বুলেট যেতেই এক লাফে ভেতরে ঢুকল ক্যাল অ্যামেট। পরের কয়েকটা বুলেট গাঁথল পাতলা ধাতুর ফিউজেলাজে। হঠাৎ করেই বাঁক নিয়ে সরে গেল হেলিকপ্টার। ওটার নিচে লাগল রানার কয়েকটা বুলেট। কিন্তু নাইন এমএম অ্যামিউনিশন ঢুকল না কেবিনে। তবে প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে পাইলট।

বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল রানা ও রেবেকা। বারান্দায় উঠেই দরজা খুলে ঢুকল ভেতরে। একটু দূরে মেঝেতে গোল্ডেন সানকে দেখল রানা। ঢেকে রেখেছে যুবক উলঙ্গ ক্যাথিকে।

আহত তোমরা কেউ? জানতে চাইল রানা।

বারকয়েক মাথা নাড়ল ইণ্ডিয়ান যুবক। এখনও হতভম্ব। উঠে দাঁড়িয়ে টেনে তুলল ক্যাথিকে। এক ছুটে পাশের ঘরে পালিয়ে গেল উলঙ্গ মেয়েটা। একইসময়ে ঘরে ঢুকলেন ক্যাসল। উত্তেজনায় বিস্ফারিত তাঁর চোখ। হাতে পুরনো, রঙচটা এক ইথাকা শটগান।

ঘরে থিতিয়ে আসছে ধুলো। হেলিকপ্টার চলে যাওয়ার পর এখন থমথম করছে চারপাশ। শটগান হাতে কাকে যেন জোর গলায় অভিশাপ দিতে লাগলেন ক্যাসল।

আবারও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। ওর পিছু নিল রেবেকা। দুশ্চিন্তা নিয়ে দূর দিগন্তে চেয়ে আছে রানা। নিচু গলায় বলল, রাইফেল হাতে ওই লোকটা ক্যাল অ্যামেট। দেরি হবে না ফিরতে। তখন সঙ্গে থাকবে অনেক লোক।

বলতে পারো আর্মি নিয়ে ফিরবে, বলল রেবেকা। বড় জোর কয়েক ঘণ্টা পাব। ওরা আসার আগেই সরে যেতে হবে অনেক দূরে।

স্টার্টার মোটর চালু হলে কাজে আসবে পিকআপটা, বলল রানা। সরে যেতে পারবে।

অবাক চোখে ওকে দেখল রেবেকা। তুমি নিজে কোথায় যাবে?

জবাব না দিয়ে আবারও বাড়ির ভেতর ঢুকল রানা। বৃদ্ধের উদ্দেশে বলল, মিস্টার ক্যাসল, আপনার কাছে রাইফেল আছে?

কয়েক সেকেণ্ড ওকে দেখলেন ক্যাসল, তারপর আগুনের ফুলকির মত চকচক করে উঠল দুই চোখ। রানার মনে হলো নতুন করে জীবন পেয়েছেন বৃদ্ধ। মাথা দোলালেন তিনি, তারপর পিছু নিতে বললেন হাতের ইশারায়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে প্যাসেজ পেরোল ওরা। সামনে পড়ল একটা দরজা। ওদিকেই কাঠের সিঁড়ি। নেমে এল ওরা বেসমেন্টে। ক্যাসল সুইচ টিপে বাতি জ্বালতেই দেখা গেল, একদিকের দেয়ালের তাকে রাখা এক রাইফেল। খুব সরু ওয়ালনাটের স্টক। ছোটখাটো হলেও দেখতে দারুণ অস্ত্রটা। খপ করে রাইফেল তুলে নিলেন ক্যাসল। একটা কথাও না বলে ধরিয়ে দিলেন। রানার হাতে।

রাইফেলটা দেখল রানা।

পয়েন্ট টু-টু ক্যালিবারের আণ্ডারলিভার মার্লিন। চমৎকার জিনিস। তবে ওটা দিয়ে শিকার করতে পারবে বড়জোর খরগোশ বা স্কুইরেল।

রানার হতাশ চেহারা দেখে মুচকি হাসলেন ক্যাসল। বুঝতে পারছি, বাছা, কী ভাবছ। ভারী জিনিস চাই তোমার।

চুপ করে আছে রানা।

তা হলে অন্য কিছু দেখাই, চলো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেসমেন্টের আরেক দিকে গিয়ে থামলেন ক্যাসল। জায়গাটা আবছা আঁধার। মেঝেতে পড়ে আছে ঘন ধুলো ও মাকড়সার জালে ভরা প্যাকিং বাক্স ও ভাঙা আসবাবপত্র। সেসব সরাতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। পাশে হাত লাগাল রানা। একটা বাক্স সরিয়ে ভারী এক ট্রাঙ্ক টেনে আনলেন ক্যাসল। কোরিয়া থেকে ফেরার পর আর কখনও খুলিনি। মনে হয়নি আবারও ওটাকে দেখব। কিন্তু ভাগ্য মানুষকে কোথায় নেবে, জানার উপায় নেই। কে জানে, একদিন এমন পরিস্থিতি হবে বলেই হয়তো হাজার হাজার মাইল দূর থেকে সঙ্গে এনেছিলাম। কেসের ওপর ফুঁ দিয়ে ধুলো সরালেন তিনি।

ট্রাঙ্ক খুলতেই দেখা গেল ভারী একটা ম্যাট। ওটা তুলে মেঝেতে ফেললেন ক্যাসল। ট্রাঙ্কের ভেতরে বড় একটা বস্তা। ওটার গায়ে মেখে আছে গ্রিস। রানার নাকে লাগল পুরনো গান অয়েলের গন্ধ।

টান দিয়ে বস্তা সরিয়ে বললেন ক্যাসল, ব্যস, আর কিছু নেই। এখন হয়তো ওটা তুলতেও পারব না। তবে যৌবনে কাজে এসেছিল।

রানাকে দেখতে দেয়ার জন্যে সরে দাঁড়ালেন তিনি।

চোখ বিস্ফারিত হলো রানার। অবিশ্বাস্য! ভাবতে পারিনি আপনার কাছে বার থাকবে।

ব্রাউনিং অটোমেটিক রাইফেল।

আগে মাত্র একবার ওই অস্ত্র ব্যবহার করেছে রানা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই জিনিস ব্যবহার করেছিল আমেরিকা। ডিকমিশন করা হয় ষাটের দশকে। এই লাইট মেশিন গান আজকাল দেখা যায় মিলিটারি মিউযিয়ামে। কিন্তু এটা একদম ঝকঝকে নতুন। ধূসর গান মেটাল। তেল দেয়া কাঠ ও স্টিলের ব্যাটল সাইট রানাকে মনে করিয়ে দিল, অপটিক রেড ডট, লেসার, রাবার আর পলিমারের যুগেও উপযুক্ত লোকের হাতে জাদু দেখাতে পারবে এই জিনিস।

ঝুঁকে কেস থেকে বার তুলে নিল রানা। বেশ ভারী ওটা। তেলমাখা। রাখা হয়েছে অত্যন্ত যত্নে। বোর পরিষ্কার। চকচক করছে অ্যাকশন। এমন কী ক্যানভাসের স্লিং-ও নতুন। দীর্ঘ, বাঁকা ম্যাগাযিন। কেসে সাজানো আরও পাঁচটা ম্যাগাযিন।

হাসলেন ক্যাসল। স্পেশাল হাই-ক্যাপাসিটি অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট ভার্শান। এই সুন্দরীকে দিয়ে আকাশ থেকে বিমান ফেলতাম আমরা। বেসমেন্টের আরও গভীরে গেলেন তিনি। সরিয়ে দিলেন আরও কয়েকটা বাক্স। ঘোঁৎ করে উঠে টেনে বের করলেন ভারী এক ধাতব কেস।

ওটা অ্যামিউনিশনের। জলপাই রঙা। কিনারায় ধরেছে জং। হলদে অক্ষর অস্পষ্ট।

স্টিলের ক্যাচ খুললেন ক্যাসল। টান দিতেই কাঁচ আওয়াজে খুলল ডালা। হলদে বাতির আলোয় প্রতিফলন। তৈরি করল পুরনো তামার বুলেটের খোসা। থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে .৩০৮ মিলিটারি ইশ্য কান্ট্রিজ। সংখ্যায় অন্তত এক হাজার। কোনও ক্ষতি হয়নি ওগুলোর। হালকা করে গ্রিস দেয়া। চিকচিক করছে অর্ধশতক পেরোলেও।

রানাকে বললেন ক্যাসল, বাছা, যুদ্ধ, আরম্ভ করতে এর বেশি কিছু লাগে না।

লড়বও এখানেই, বলল রানা। ম্যাগাযিনগুলোয় দ্রুত হাতে বুলেট ভরতে লাগল ও।

রানার কাজ দেখতে দেখতে আনমনে মাথা দোলালেন ক্যাসল। তোমাকে যোদ্ধা বলেই মনে হয়। ভুল বললাম?

বাংলাদেশ আর্মিতে ছিলাম। মেজর।

ইউনিট?

স্পেশাল কমাণ্ডো ইউনিট।

একা লড়বে কেন, আমিও পাশে থাকব।

মাথা নাড়ল রানা। এটা আপনার লড়াই নয়, স্যর। খুশি হব আপনি দূরে থেকে দেখলে।

থুক করে মেঝেতে থুতু ফেললেন ক্যাসল। তা পরে দেখব, বাছা। আমার বাড়িতে গুলি করেছে ওরা। তার ওপর আমার শুকনো পাছাটা বাইরে থেকে তুলে এনে কাউচে রেখেছ। কৃতজ্ঞতাবোধ বলে একটা কথা আছে না আমার?

এরা খুব বাজে লোক।

আমি নিজেও দেবতা নই, বাছা। বুড়ো হয়েছি, কিন্তু দরকার হলে কীভাবে পোদে লাথ মারতে হয় সেটা ভাল করেই জানি।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। আমার আরও কিছু জিনিস লাগবে, মিস্টার ক্যাসল।

.

৪৭.

 বার্ন থেকে বেরোল রানা। এইমাত্র দুই পুরনো পিকআপের মধ্যে নতুনটায় উঠে বসেছে রেবেকা। কালিঝুলি ভরা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে নিল হাত। গালে সামান্য তেল। উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল, হাসল রানাকে দেখে।

কাজ শেষ? ইঞ্জিন চালু হবে? জানতে চাইল রানা।

দেখব এখন। মোমেন্ট অভ ট্রুথ।

চাবি মুচড়ে দিতেই একরাশ নীল ধোয়া ছেড়ে গর্জে উঠল ইঞ্জিন। রেবেকার সুন্দর মুখে ফুটল বিজয়িনীর হাসি। ক্যাব থেকে নেমে এল। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল রানাকে। এবার চলো, ক্যাথিকে নিয়ে চলে যাই।

চুপ করে আছে রানা।

কী হয়েছে, রানা?

আমি থেকে যাচ্ছি, রেবেকা, বলল রানা।

আতঙ্ক নিয়ে ওকে দেখল মেয়েটা। কেন? এটা কী বলছ! রয়ে গেলে তো ওরা খুন করবে তোমাকে!

তুমি রওনা হও। নয় মাইল পশ্চিমে মেলভিলের খামার। ওখানে গিয়ে ঊধ্বর্তন অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তাঁরা সরিয়ে নেবেন ক্যাথি আর তোমাকে।

রানাকে দেখছে রেবেকা। ঘন ঘন মাথা নাড়ল। গেলে সবাই যাব। দেরি কোরো না, রানা। হাতে বেশিক্ষণ পাব না।

ওর কাঁধে হাত রাখল রানা। খোলা জায়গায় কোনও সুযোগই পাব না। হেলিকপ্টারে করে পৌঁছে যাবে। তা ছাড়া, গোল্ডেন সান, আর মিস্টার ক্যাসলকে রেখে গেলে, ক্যাল অ্যামেট এসে খুন করবে ওদের দুজনকে। চাই না সারাজীবন বিবেক আমাকে তাড়িয়ে বেড়াক। বদমাস লোকগুলোকে ঠেকাতে হলে এখানে আমাকে দরকার। ক্যাথিকে নিয়ে রওনা হও। এখানে থেকে মোকাবিলা করব অ্যামেটের দলকে।

তুমি রয়ে গেলে আমিও থাকব।

মাথা নাড়ল রানা, গম্ভীর। একটুও ভেবো না। ঠিক করেছি, আপাতত মরব না।

ঠাট্টা করছ? তুমি জানো, কী করবে ওরা!

জানি, চেষ্টা করবে, বলল রানা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেবেকা। বুঝে গেছে, ওর কথা শুনবে না মানুষটা। রানার বাহুতে হাত রাখল। চোখের কোলে নামল দুফোঁটা অশ্রু।

হাসছে রানা। মুছে দিল রেবেকার চোখ।

ফুঁপিয়ে উঠল রেবেকা। তুমি একদম পাগল! ভাবিনি প্রেমে পড়ব, কিন্তু শেষে তা-ই হলো। কোনও দাবি নেই, কিন্তু মনে রেখো, অপেক্ষা করব আমি তোমার জন্যে।

হঠাৎ বিমর্ষ বোধ করল রানা। মনে পড়েছে রেবেকা সাউলের মিষ্টি হাসিমুখ। অন্তর থেকে ওকে কাছে চেয়েছিল মেয়েটা। ও নিজেও কি চায়নি নিশ্চিন্ত জীবন? শেষে হয়নি কিছুই! চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে যে রেবেকা, ঠিক ওর মতই এখন সামনে দাঁড়িয়ে আরেক রেবেকা। সে-ও কি একই ভুল করছে না? নিষ্ঠুর প্রকৃতি বারবার মেতে উঠছে রানার মনটাকে নিয়ে খেলতে!

রেবেকার হাত ধরে পিকআপ ট্রাকের দিকে পা বাড়াল রানা। নরম সুরে বলল, এবার ক্যাথিকে নিয়ে চলে যাও। আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। পরে দেখা হবে।

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেবেকা।  

ওকে নিয়ে পিকআপ ট্রাকে উঠল রানা, ইঞ্জিন চালু করে বার্নের বাঁক ঘুরে গিয়ে থামল বাড়ির সামনে। দেখে নিল যথেষ্ট তেল আছে কি না। পরখ করল ফ্যান বেল্ট। এবার রেবেকাকে রেখে বাড়িতে ঢুকল রানা। ক্যাথির ঘরে গিয়ে জানাল, রেবেকার সঙ্গে দূরের খামারে যেতে হবে তাকে।

খুশিই মনে হলো মেয়েটাকে। রানার পিছু নিয়ে বেরিয়ে এসে উঠল পিকআপে।

রেবেকা চলে যাবে বলে খারাপ লাগছে রানার। মনকে সান্তনা দিল, ওরা যাবে নিরাপদ জায়গায়। রওনা হওয়ার আগে ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ল রেবেকা। পাল্টা টা-টা দিল রানা। অসমতল রাস্তা ধরে গেটের দিকে চলল পিকআপ। পেছন থেকে চেয়ে রইল রানা। কিন্তু আরও পাঁচ গজ যাওয়ার পর ব্রেক কষে থামল গাড়িটা। লাফ দিয়ে নামল রেবেকা, দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল রানাকে।

দুসেকেণ্ড পর পরস্পরকে চুমু দিল ওরা।

একমিনিট পর চোখ তুলে রানার চোখে তাকাল রেবেকা। সতর্ক থেকো, মাসুদ রানা, এটা আমার দাবি!

আবার দেখা হবে, নিচু গলায় বলল রানা।

তখন তোমার কাছে কিছু চাইব, লালচে হয়ে গেল রেবেকার গাল। আবার গিয়ে উঠল পিকআপ ট্রাকে। গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু। দাৰিয়ে দিল, অ্যাক্সেলারেটর। নুড়িপাথরে পিছলে রওনা হলো গাড়িটা। গেট পেরিয়ে দূরে হারিয়ে গেল টিলার বাঁকে।

রেবেকা ও ক্যাথি চলে গেছে। এবার জরুরি কিছু কাজ সারতে হবে রানাকে। পরের একটা ঘণ্টা ব্যস্ত কাটল ওর। ভালভাবে ঘুরে দেখল খামারবাড়ির আশপাশ। বুঝে নিল কেমন হবে শত্রুদের ওপর ও পাল্টা আক্রমণ।

একদল লোকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একা! শত্রুর সঙ্গে থাকবে ভারী অস্ত্র। প্রত্যেকে পেশাদার। সরাসরি হামলা করবে, চট করে শেষ করতে চাইবে রানাকে। তবুও টিকে থাকা সম্ভব বলেই মনে হলো ওর। পাবে বাড়তি কিছু সুবিধা, যেগুলো শত্রুরা পাবে না।

খামারবাড়ির বার্নে পেল রানা প্রয়োজনীয় প্রায় সবই। জড় করল বার্নের একপাশে। ওর রসদের কোন-কোনওটা ভারী, তাই স্যাক কার্টে তুলে সরিয়ে নিচ্ছে নানান দিকে। সাহায্য করার শারীরিক শক্তি নেই মিস্টার ক্যাসলের, দেখছেন রানার যুদ্ধ-প্রস্তুতি; তবে রানার সঙ্গে প্রাণপণ খাটছে গোল্ডেন সান।

স্যাক কার্টে করে মালপত্র তুলছে রানা, এমনসময় মুখ তুলে ওকে দেখল গোল্ডেন সান। জানতে চাইল, সংখ্যায় ওরা অনেক, তাই না?

হ্যাঁ। প্রথম সুযোগেই শেষ করতে চাইবে আমাদেরকে, বলল রানা। লড়ব। তবে চাই মিস্টার ক্যাসল বা তুমি সরে থাকবে।

আমি ব্ল্যাকফুট ইণ্ডিয়ান, কখনও লড়াই থেকে পিছিয়ে যাই না, নরম গলায় বলল গোল্ডেন সান। গর্ব প্রকাশ পেল কণ্ঠে, আমাদের বাপ-দাদার জমি কেড়ে নিয়েছে এরা। বাধ্য করেছে রিযার্ভেশনে বাস করতে। কেড়ে নিয়েছে আমাদের আজন্ম অধিকার। আস্তে করে মাথা নাড়ল সে। আমি ওদের মত লোকদের বিরুদ্ধে লড়তে চাই। তাতে মরতেও আপত্তি নেই। …তা ছাড়া, দেখতে চাই সত্যিকারের বীরপুরুষ কীভাবে লড়ে।

যুদ্ধ ঠিকই দেখবে, গোল্ডেন সান, বলল গম্ভীর রানা। চলে সারাজীবন মনে রাখবে কী হয়েছে এখানে।

দরকারি সবকিছু স্যাক কার্ট থেকে নামিয়ে ফেলেছে বানা। এবার সিকি মাইল দূরের খোয়াড়ে ঘোড়াগুলোকে নিয়ে রাখল ওরা। আগুনের গোলার মত রোদ ঢালছে সূর্য। দরদর করে ঘামছে রানা। টিসটিস করছে কাঁধের ব্যথা। একবার দেখে নিল হাতঘড়ি।

বিকেল চারটে।

বোধহয় সময় হয়েছে হামলার।

মুখ তুলে নীল আকাশে চোখ বোলাল রানা। ওই যে দূরে পর্বতে বরফে ছাওয়া চূড়া। ওদিক দিয়েই আসবে ওদের আক্রমণ।

রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করছে ওকে।

ওরা আসছে!

সাবধান, রানা!

.

৪৮.

মেঘমুক্ত নীলাকাশের পটভূমিতে তিনটে কালো বিন্দু, উড়ে আসুছে v আকৃতি নিয়ে। ক্রমেই বাড়ছে রোটরের ধুপ-ধুপ শব্দ। গোল্ডেন সানকে বলল রানা, লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেসমেন্টে থাকবেন মিস্টার ক্যাসল। তুমিও তাঁর পাশে থেকো।

কমুহূর্ত দ্বিধা করে দৌড়ে গিয়ে বাড়িতে ঢুকল যুবক। রানা চলে এল পাথরের তৈরি দোতলা স্টোররুমে। এখানেই একটা জানালার পাশে ট্রাইপডে ফিট করেছে রানা বার রাইফেল। প্রথমতলায় ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়ে ওপরে উঠে এল রানা। শুয়ে পড়ল অস্ত্রটার পেছনে। পাশেই পেটমোটা ব্যাগে লাইট মেশিন গান ও বেরেটা পিস্তলের কিছু গুলি ভরা স্পেয়ার ম্যাগাযিন।

কিছুক্ষণ পর খামারবাড়ির আকাশে ভাসতে লাগল তিন হেলিকপ্টার। রোটর ও ইঞ্জিনের প্রচণ্ড আওয়াজে কাঁপছে চারপাশ। তুমুল হাওয়ার তোড়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে ঘাস। দূরের খোয়াড়ে ভীষণ ভয়ে ছোটাছুটি করছে একপাল ঘোড়া।

স্টোররুমে রাইফেলের সাইটে চোখ রাখল রানা। নামতে গিয়েও ফর্মেশন ভাঙল না তিন কপ্টার। সামনে একটা, পেছনে দুটো। প্রথম কপ্টারের দুই দরজা থেকে নিচে পড়ল দুই দড়ি। নামতে লাগল কালো ইউনিফর্ম পরা ছয়জন এজেন্ট। রানার মনে হলো, কালো সিল্ক বেয়ে নামছে ছয় মাকড়সা, পরনে আর্মার, গগলস, হেলমেট, পিঠে ঝোলানো অটোমেটিক রাইফেল।

যে কারও বুকে কাঁপ-ধরিয়ে-দেয়া দৃশ্য।

সময় হয়েছে, বুঝে গেল রানা। এদেরকে হিংস্র পশু ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না। এসেছে নিরস্ত্র, অসহায় কজন মানুষকে হাসতে হাসতে নিশ্চিন্তে খুন করতে। কাজেই দয়ামায়া করবে না ও। চমকে দেবে শত্রুকে। চরম ক্ষতি করবে প্রথম সুযোগে।

ছয় ট্রুপার মাটিতে নামার আগেই বার রাইফেলের সেফটি ক্যাচ সরাল রানা, পরক্ষণে শুরু করল গুলি। তাক করেছে। ওপরের হেলিকপ্টারের ফিউয়েল ট্যাঙ্ক লক্ষ্য করে। পিস্তলের হালকা গুলি নয় যে ফিউজেলাজে ঢুকবে না, এগুলো মেশিন গানের বুলেট। প্রতি মিনিটে নয় শ রাউণ্ড হাই-ভেলোসিটি .৩০৮ গুলি মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ঝাঁঝরা করল কপ্টার। বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হলো ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। পরের সেকেণ্ডে মস্তবড় এক কমলা আগুনের গোলা গপ করে গিলে ফেলল কপ্টারটাকে। হাজার টুকরো হয়ে আগুনে বৃষ্টির ফোঁটার মত আকাশ থেকে ঝরঝর করে ঝরল সব। অগ্নিশিখার বিশাল ফুটবলের ভেতর আটকা পড়েছে ছয় ট্রপার। বাঁচার কোনও সুযোগই পেল না ওরা।

নির্লিপ্তভাবে খুন করছে রানা। বুকে দয়ামায়া নেই, কারণ ওটা দেখাবে না শত্রুরাও। আগুনে গুলি ছুঁড়ছে রানা। থরথর করে কাঁপছে বার লাইট মেশিন গান। ওটা থেকে বেরিয়ে ঘরের আরেক প্রান্তে গিয়ে পড়ছে খরচ করা গুলির খোসা। বাতাসে কর্ডাইটের কড়া কটু গন্ধ। জ্বলন্ত মানুষ দেখল রানা। হাত-পা ছুঁড়ছে, তারা। বুকে গুলি খেয়ে ধুপ-ধাপ পড়ল আগুনের ভেতর।

দ্বিতীয় এক বিস্ফোরণে চুরমার হলো হেলিকপ্টারের সুপারস্ট্রাকচার। আকাশে উঠল ঘন কালো ধোঁয়া ও কমলা রঙের মস্ত ছাতা। খামারবাড়ির নানান দিকে ছিটকে গেছে ভাঙা টুকরো।

একটা হেলিকপ্টার শেষ।

অন্যদুটো পিছিয়ে গেল। প্রাণ বাঁচাতে ওপরে উঠছে পাইলটরা। বাক নিয়ে বার্নের দিকে গেল দুই কপ্টার, পরক্ষণে ঘুরেই ছুটে এল ঝড়ের বেগে। দরজার পাশ থেকে নামছে ট্যাকটিকাল গিয়ার পরা কালো পোশাকের লোক। সবার হাতে উঠে এসেছে রাইফেল।

সামনের হেলিকপ্টারের ওপর লক্ষ্যস্থির করল রানা। বার রাইফেলের তপ্ত ব্রিচ থেকে ছিটকে বেরোল অসংখ্য খোসা। বুলেট ঝাঁঝরা করছে ফিউজেলাজ। গুলি লেগেছে কারও গায়ে। উইণ্ডশিল্ডে ছলাৎ করে লাগল একরাশ রক্ত। ভারী গুলিবর্ষণে ভেঙে পড়ল প্লাস্টিক মেশানো কাঁচ।

হঠাৎ বাঁক নিয়ে নিচে নাক তাক করল হেলিকপ্টার। কাত হয়ে জোরালো হুয়াম্প-হুঁয়াম্প আওয়াজ তুলল রোটর। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে যান্ত্রিক ফড়িং। কয়েক সেকেণ্ড রানার মনে হলো, সোজা বাড়ির উঠানে গাঁথবে ওটা। কিন্তু গরু রাখার কাঠের পুরনো ছাউনিতে লাগল এয়ারক্রাফটের রোটর। বিকট আওয়াজে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হতেই চারদিকে ছিটকাল কাঠের তক্তা ও জং ধরা লোহার কাঠামোর অসংখ্য টুকরো।

নানান জিনিস উঠে আসছে দেখে ওপরে কপ্টার তুলছে তৃতীয় পাইলট। রানার মাথার ওপরে প্রচণ্ড ধুপ-ধুপ আওয়াজ। ওদিকে মন দিল না ও। তিন সেকেণ্ড পর গরু রাখার ছাউনির দরজা দিয়ে বেরোল, কালো পোশাকের কয়েকজন। হাতে অস্ত্র। কপ্টার বিধ্বস্ত হলেও বেঁচে গেছে। প্রাণে। শত্রুকে খুঁজছে, চোখ বোলাচ্ছে চারপাশে।

বাম থেকে ডানে বার রাইফেলের নল ঘোরাল রানা। লোকগুলোর বুক-পেট থেকে ছিটিয়ে গেল রক্ত। অতি সহজেই শত্রু খতম করছে রানা। কিন্তু পরক্ষণে কাজটা হয়ে উঠল কঠিন।

আধুনিক মিলিটারি অস্ত্রের মাযল ফ্ল্যাশ লুকাতে সাপ্রেসর থাকে, ওই জিনিস নেই বার রাইফেলে। স্টোররুম থেকে হলদে-সাদা আগুনের হলকা দেখেছে তৃতীয় হেলিকপ্টারের পাইলট। তার তরফ থেকে এল পাল্টা হামলা।

টিনের ছাত ভেদ করে ও রানার ঘরের জানালা-পথে ঢুকল অজস্র বুলেট। ঝরঝর করে ওর গা-মাথায় নামল ভাঙা কার্ডবোর্ড। ধুপ-ধুপ আওয়াজে দূরে গিয়ে থামল কপ্টার। এবার এল অন্তত তিনটে অ্যাসল্ট রাইফেলের গুলির বৃষ্টি।

ভারী ব্রাউনিং সহ-গড়িয়ে সরে গেল রানা। সঙ্গে টেনে নিয়েছে ম্যাগাযিনের ব্যাগ। আবার মাথার ওপরে হাজির হলো হেলিকপ্টার। বার রাইফেলের নল তুলে ছাত লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা। তাতে ঝরঝর করে মুখে পড়ল একরাশ ধুলো।

ছাতের ওপর থেকে সরে গেল হেলিকপ্টার। চরকির মত ঘুরে গেল বাড়ির দিকে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ তুলে হুড়মুড় করে নিচতলায় নামল রানা। দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে এল কড়া রোদের ভেতর।

জঞ্জাল ভরা গলির একপাশে গরুর ছাউনি, অন্যদিকে স্টোররুম। মাঝে রানা। ওর বামে তিরিশ গজ দূরে নষ্ট এক ট্র্যাক্টর। পনেরো গজ আগে দালানের পাশে বড় দুটো স্তূপ। ঢেকে রাখা হয়েছে তারপুলিন দিয়ে। চারপাশে জড় করা হয়েছে খামারের ভাঙা মালপত্র।

ডানে বাড়ির উঠানের আকাশে ভাসছে তৃতীয় কপ্টার। ওটা থেকে দড়ি বেয়ে সরসর করে নামল ছয়জন ট্রুপার। একপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে ওদিকে তাকাল রানা। এখনও ওকে দেখেনি তারা। ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। সিগনাল দিচ্ছে পরস্পরকে।

কিন্তু রানাকে দেখেছে পাইলট। নিচু করে নিল কপ্টারের নাক। পরক্ষণে দুই দালানের মাঝ দিয়ে এল ঝড়ের বেগে। মাটি ছুঁই-ছুঁই করছে স্কিড।

ঘুরেই নষ্ট ট্র্যাক্টরের দিকে দৌড় দিল রানা। পেছনে গর্জে উঠল অ্যাসল্ট রাইফেল। তারপুলিন দিয়ে ঢাকা দুই স্কুপের মাঝ দিয়ে ছুটছে রানা। আরও বাড়াল ছোটার গতি। পেছনের মাটিতে বিধছে গুলি। তিন সেকেণ্ড পর ঝাঁপ দিল ট্র্যাক্টরের ওদিকে। উঠেই ওপরে তুলল বার রাইফেল। প্রচুর ধুলো উড়িয়ে সরাসরি ওর দিকে আসছে হেলিকপ্টার। এই মুহূর্তে আছে দুই তূপের ঠিক মাঝে।

কপ্টারটাকে ওখানেই চেয়েছে রানা। একমুহূর্ত দেরি না করে গুলি ছুঁড়ল ও। কপ্টার নয়, ওর লক্ষ্য বামদিকের স্তূপ। তিন সেকেণ্ড পর গুলি গেল ডানের স্তূপে। পুরো ম্যাগাযিন খালি হলো ওটার ওপর। পরক্ষণে রাইফেল ফেলে ট্রাক্টরের পেছনে শুয়ে পড়ল রানা। এক মুহূর্ত পর চারপাশে ছিটিয়ে গেল চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল সাদা আলো।

আজ দুপুরে বার্নে প্রোপেন গ্যাসের সিলিণ্ডার পেয়েছে রানা। কিচেনে লাগবে বলে রাখা ছিল ওখানে। পাশেই বস্তা ভরা চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের গজাল। গোল্ডেন সানের সাহায্য নিয়ে ডাক্ট টেপ দিয়ে সব আটকে নিয়েছে সিলিণ্ডারে। নোংরা তারপুলিনের নিচে ছিল ওর তৈরি প্রকাণ্ড গজালকাটার বোমা।

অবশ্য, সমস্যা হচ্ছে: এত কাছ থেকে ওটা ফাটাতে হবে, ভাবতেও পারেনি রানা।

দুই দালানের মাঝের অংশ সংকীর্ণ। ওই কারণেই বহু গুণ বাড়ল বোমার ধ্বংস-ক্ষমতা। বুম! শব্দে ফাটল কপ্টারের নাকের ওপর।

ভারী দেয়ালে যেন প্রচণ্ড বেগে বাড়ি খেল হেলিকপ্টার। বাচ্চারা রাগ করে খেলনা ভেঙেচুরে মাটিতে ফেললে যেমন হয়, সেই অবস্থা হলো ওটার। ভেতরের দিকে বিস্ফোরিত হলো জানালা। হাজারো টুকরো হয়ে নানাদিকে ছিটকে গেল ঘুরন্ত রোটর। রানার তৈরি পেট্রল বোমার আগুনটাকে পেল ভাঙা সিলিণ্ডারের প্রোপেন গ্যাস। বিস্ফোরিত হলো দেয়ালের পাশে লুকিয়ে রাখা সব জেরি ক্যান। গ্যাসের কারণে দাউ দাউ আগুনে দপ করে জ্বলে উঠল বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার। ভেতরে যারা ছিল, পুড়তে লাগল তারা। চিৎকার করছে প্রাণের ভয়ে। জ্বলন্ত শরীরে দৌড়ে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে। কিন্তু রক্ষা নেই লেলিহান শিখা থেকে।

মুখ গুঁজে পড়ে আছে রানা। কয়েক ফুট ওপর দিয়ে গেল আগুনের প্রচণ্ড হলকা। চড়চড় শব্দে পুড়ছে, ঘাড়ের খাটো চুল। মনে হলো, এবার পুড়েই মরবে। অবশ্য, পরের সেকেণ্ডে জোরালো হুশ শব্দে দপ করে নিভল অগ্নিশ্রোত। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল রানা।

পুড়ে ছাই হয়েছে চারপাশের প্রায় সবই। দুই দালানে জ্বলছে গনগনে আগুন। মাটিতে কয়েকজন লোকের মৃতদেহ। বাতাসে পোড়া মাংসের দুর্গন্ধ। জ্বলছে হেলিকপ্টারের কঙ্কাল।

ট্রাক্টরের কাছ থেকে সরল রানা। কয়েক গজ দূরে ধুলোয় পড়ে আছে বার রাইফেল। ওটা তুলে নিল রানা। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, উড়ন্ত শাপনেলের আঘাতে চুরমার হয়েছে রিসিভার। রাইফেলটা হাত থেকে ফেলে ব্যাগ হাতড়াল রানা। হালকা মেশিন গানের ম্যাগাযিন আর কাজে  আসবে না, ফেলে দিল। পিস্তল নিয়ে চারপাশে তাকাল সতর্ক চোখে।

তখনই বুঝল, তৃতীয় হেলিকপ্টার থেকে নেমেছে কজন ট্রপার। সংখ্যায় ছয়জন। জ্বলন্ত হেলিকপ্টারের সুপারস্ট্রাকচার আর বিধ্বস্ত দালানের মাঝে আছে তারা। উঁচু করে ধরেছে অটোমেটিক অ্যাসল্ট রাইফেল। চোখের সানগ্লাসে প্রতিফলিত হচ্ছে কমলা আগুন।

শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল রানার।

পড়েছে মস্ত বিপদে।

সামনে ট্রুপাররা ছাড়াও পেছন থেকে আসছে আরেক দল। তাদের নেতার মুখে ফোকলা, চওড়া হাসি।

ক্যাল অ্যামেট!

পেছনের গাছের জটলার ওদিকে হাজির হয়েছে চতুর্থ কপ্টার। রানাকে ব্যস্ত রাখতে ব্যবহার করেছে প্রথম তিন হেলিকপ্টারকে।

অ্যামেটের সঙ্গে হাঁটছে আরও পাঁচ ট্রুপার। সবার পরনে ট্যাকটিকাল গিয়ার, হাতে এম-সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল।

শত্রুরা দলে কমপক্ষে বারোজন, সঙ্গে হাই-ভেলোসিটি রাইফেলের তিন শ পঞ্চাশটা বুলেট।

কিছুই করার নেই রানার। আটকা পড়েছে দুদলের মাঝে। পিছিয়ে কাভার নেবে, সে উপায়ও নেই।

এবার পেয়েছি! চিৎকার করল ক্যাল অ্যামেট, তুই একা, বায়েন—!

.

৪৯.

 পরের গুলির আওয়াজে পেশি শক্ত করল রানা। মৃত্যুর জন্যে তৈরি। এবার ওকে শেষ করবে বুলেট। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর, হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে শূন্যে উঠল এক টুপার। মনে হলো উড়ে গেছে দ্রুতগামী ট্রেনের ধাক্কায়। কয়েক ফুট উড়ে ধুলোয় পড়ল লোকটা। পাশেই রাইফেল। একই সময়ে খামারবাড়ি থেকে এল কারও চিৎকার, রানা একা নয়!

হৈ-চৈ করে উঠল ট্রুপাররা। এল হামলা। টাশ করে উঠল ছোট ক্যালিবারের রাইফেল। মাথা চেপে ধুপ করে মাটিতে পড়ল আরেক ট্র্যপার। প্রাণের ভয়ে চারপাশে কাভার নিতে ছুটল লোকগুলো। যে-যার মত লুকিয়ে পড়ছে খামারের যন্ত্রপাতি, জং ধরা ড্রাম ও নষ্ট ট্র্যাক্টরের চাকার পেছনে।

গুলি যারা করছে, বারবার সরছে কাভার নিয়ে। তারা এমন কেউ, যারা ভাল করেই চেনে খামারের কোথায় কী আছে।

বুম! করে উঠল বন্দুক।

করুণ এক চিৎকার ছেড়ে উরু চেপে ধরল এক টুপার। গলগল করে বেরোচ্ছে রক্ত।

টাশ করে উঠল ছোট ক্যালিবারের রাইফেল। ক্যাল অ্যামেটের পাশের লোকটা টু শব্দ না করেই পড়ে গেল।

গুলি করছে দুজন।

অস্ত্রও দুটো।

একটা পয়েন্ট টু-টু মার্লিন, অন্যটা প্রাচীন ইথাকা শটগান।

ডাইভ দিয়ে আবারও ট্রাক্টরের আড়ালে গেল রানা। ওর বামে জ্বলন্ত কপ্টারের ওদিকে লুকিয়ে পড়েছে চার ট্রুপার। আটকা পড়েছে কোথা থেকে গুলি এসেছে বোঝার আগেই। জ্বালানি কাঠের স্তূপের ওদিকে লুকিয়ে পড়েছে অ্যামেট ও তার দলের লোকরা। নানাদিকে গুলি পাঠাচ্ছে তারা, আতঙ্কিত। বেরেটা তুলে একজনের কপাল ফুটো করল রানা। জবাবে ওর দিকে গুলি পাঠাল কজন। ট্র্যাক্টরের ফেণ্ডারে লেগে ছিটকে গেল বুলেট। আবারও গুলি পাঠাল রানা।, খুন হলো আরেক ট্র্যপার।

তখনই চমকে গেল রানা। গলির শেষে জ্বলন্ত গরুর ছাউনি আর স্টোররুম থেকে দশ গজ দূরে বেরিয়ে এসেছে। গোল্ডেন সান। হাতে পয়েন্ট টু-টু মার্লিন। ওর কাছ থেকে মাত্র দশ গজ দূরে অ্যামেট এবং তার দলের লোক। থুতনি উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ইণ্ডিয়ান যুবক। চোখে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। তার পেছনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরোলেন মিস্টার ক্যাসল। হাতে বন্দুক। চেহারা ভীষণ গম্ভীর। চিৎকার করে বললেন, আমার জমিতে পা রাখার কোনও অধিকার নেই তোদের, হারামজাদারা!

ঝট করে গোল্ডেন সান ও মিস্টার ক্যাসলের দিকে রাইফেল ঘোরাল অ্যামেট। গলির আরেক প্রান্ত থেকে পর পর চারবার গুলি করল রানা। প্রাণের ভয়ে জ্বালানি কাঠের স্কুপের ওদিকে ঝাঁপ দিল অ্যামেট।

এবার চারপাশে তৈরি হলো নরকের পরিবেশ।

 চারদিকে ছুটছে বুলেট।

 ব্যথায় মুখ কুঁচকে মাটিতে পড়ল গোল্ডেন সান।

নিজের অবস্থান থেকে একবিন্দু নড়লেন না ক্যাসল। পুরনো ইথাকা বন্দুক বারবার পাম্প করে পাঠালেন এলজি বুলেট। রানার হাতে লাফিয়ে উঠে টাশ! টাশ! আওয়াজ তুলছে বেরেটা পিস্তল। কসেকেণ্ড পর খালি হলো ওর অস্ত্র।

যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল লড়াই, তেমনি আচমকা থামল সব। খামারে নামল থমথমে নীরবতা। গলির মধ্যে মাটিতে ছিটিয়ে আছে ক্ষত-বিক্ষত সব রক্তাক্ত লাশ।

এই হামলায় শেষপর্যন্ত মারা গেছে বিশজনেরও বেশি ট্রুপার। বেঁচে আছে শুধু একজন ক্যাল অ্যামেট! কাভার থেকে সরে খালি রাইফেল ফেলে পালিয়ে গেছে। জ্বলন্ত কপ্টারের আগুন পেরোবার সময় দুহাতে ঢেকে রেখেছিল মুখ। গেছে ছোট-বড় সব দালানের গোলকধাঁধায়।

শটগান ফেলে গোল্ডেন সানের পাশে বসলেন মিস্টার ক্যাসল। পা চেপে ধরে গোঙাচ্ছে ইণ্ডিয়ান যুবক। আঙুলের ফাঁক দিয়ে নামছে রক্ত।

মুখ তুলে রানাকে দেখে খামার মালিক বললেন, মনে হয়েছিল সাহায্য দরকার তোমার, বাছা।

মাথা দোলাল রানা। আমি কৃতজ্ঞ। কখনও দরকার হলে একবার শুধু ডাকবেন। পৃথিবীর যেখানেই থাকি, আমি হাজির হয়ে যাব।

ব্যথা সহ্য করেও হাসল গোল্ডেন সান। আমরা ভালই দেখিয়ে দিয়েছি, তাই না, মিস্টার রানা?

ওর ক্ষতটা দেখল রানা। মাংস চিরে গেছে বুলেট। এবার সরে যেতে হবে এখান থেকে। এদের দলের আরও লোক আসবে এবার।

তুমি কোথাও চললে, বাছা? জানতে চাইলেন ক্যাসল।

বদমাস ক্যাল অ্যামেট, উঠে দাঁড়াল রানা। চুকিয়ে দেব ওর ঋণ। খালি ম্যাগাযিন ফেলে নতুন আরেকটা ভরল পিস্তলে।

গরুর ছাউনি পুড়ছে লকলকে আগুনে।

ওদিকে যাওয়া অসম্ভব। প্রায় বিধ্বস্ত স্টোররুমে ঢুকল রানা, আগুনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেরোল ওপাশের উঠানে। পলকের জন্যে দেখল, এইমাত্র বড় বার্নে ঢুকেছে অ্যামেট। ট্যাকটিকাল গিয়ারের জন্যে মন্থর লোকটা। দ্রুত পায়ে উঠান পেরিয়ে বার্নে ঢুকল রানা। বেশ কিছু দালানে আগুন ধরলেও, এটা অক্ষত।

বার্নের ভেতরে প্রায় অন্ধকার। পরিবেশ শীতল। সতর্ক চোখে চারপাশ দেখছে রানা। তখনই গাঢ় এক ছায়া থেকে বেরোল ক্যাল অ্যামেট, হাতে পিচফর্ক। রানার বুক লক্ষ্য করে গায়ের জোরে ছুঁড়ল ওটা।

ঝট করে সরে গেল রানা। পেছনে কাঠের গুঁড়ির দেয়ালে বিঁধল ত্রিশূলের মত জিনিসটা।  টলমল করে নিজেকে সামলে নিল অ্যামেট, চোখে তীব্র ঘৃণা। প্যান্টের পকেটের ভেলক্রো স্ট্র্যাপ খুলে ছো দিয়ে নিল ট্যাকটিকাল কমব্যাট নাইফ। কুঁজো হয়েছে আক্রমণোদ্যত হিংস্র জানোয়ারের মত।

এভাবে আসা উচিত হয়নি তোমার, নরম সুরে বলল রানা, মস্তবড় ভুল করেছ।

কর্কশ গর্জন ছেড়ে ষাঁড়ের মত তেড়ে এল সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট, ছোরা চালাল রানার গলা লক্ষ্য করে। তবে বিদ্যুদ্বেগে এক পা সরে খপ্‌ করে কবজিটা ধরেই গায়ের জোরে মোচড় দিল রানা। অ্যামেটের হাত থেকে খসে পড়ল ছোরা।

কবজির ব্যথায় গুঙিয়ে উঠেছে লোকটা। শরীর মুচড়ে পিছিয়ে গেল ছায়ার ভেতর। বুঝে গেছে, বিসিআই এজেন্টের সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে না। ঘুরেই দৌড় দিল খড় রাখার দোতলা চাতালের দিকে। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল ভীত চোখে। অস্ত্র হিসেবে কিছু পাওয়া যায় কি না, সেজন্যে পাগলের মত দুপাশ খুঁজছে তার চোখ। বেড়া দেয়ার খুঁটি ভরা এক ভারী ড্রামে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়তে গিয়েও সামলে নিল। বড় ওই ড্রামের ভেতর অনেকগুলো খুঁটি।একটানে তুলে নিল একটা খুঁটি। ওটা পাইন কাঠের তৈরি। পাঁচ ফুট লম্বা। একদিক পেরেকের মত চোখা। বর্শার মত করে ওটা ছুঁড়তে চাইল অ্যামেট। তবে অনেক বেশি ভারী। একটু গিয়েই পড়ল মেঝেতে। এদিকে ওটার ওজন সামলাতে না পেরে বড় এক বৃত্তাকার করাতের হাউসিঙে পিছলে পড়ল লোকটা।

ধীর পায়ে হাঁটছে রানা। দুজনই জানে, কোথাও পালাতে পারবে না অ্যামেট।

এবার? শান্ত কণ্ঠে বলল রানা। সঙ্গে তো অস্ত্র নেই। কাজেই খেলা খতম। তোমার উচিত ছিল না হামলা করা।

আক্রান্ত ছুঁচোর মত কিচকিচ করে দুর্বল স্বরে কী যেন বলল অ্যামেট। সরু মই বেয়ে উঠতে লাগল খড় রাখার দোতলা চাতালে।

লোকটার পিছু নিয়ে তিরিশ ফুট ওপরের মেঝেতে উঠে এল রানা। সোনালি রোদ ছোট এক জানালায়। ধুলোভরা মাকড়সার জাল চারপাশে। সরাসরি ক্যাল অ্যামেটের মাথা লক্ষ্য করে পিস্তল তুলল রানা।

খড়ের গাদায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অ্যামেট। গলা ভেঙে গেল তার, প্রিয, দয়া করো, মেরে ফেলো না!

পিস্তল নামিয়ে বেল্টে ঔজল রানা। সহজ সুরে বলল, না, তোমাকে খুন করব না। ব্যাগ নামিয়ে খুঁজছে কী যেন।

ওর হাতে ছোট বোতল ও সিরিঞ্জ দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল অ্যামেট। হাত থেকে ব্যাগ ফেলে সিআইএ স্পেশাল এজেন্টের দিকে পা বাড়াল রানা। বোতল থেকে সিরিঞ্জে টেনে নিল স্বচ্ছ তরল। ঠিক জায়গায় নিল প্লাঞ্জার। এবার রক্তে বুদ্বুদ তৈরি করবে না বাতাস। ভীষণ আতঙ্কে হড়বড় করে কী যেন বলতে চাইল অ্যামেট। খপ করে ঘাড় চেপে ধরে মেঝেতে ফেলল রানা। ঘাড়ে গেঁথে দিল নিডল। চাপ তৈরি করল প্লাঞ্জারে।

ফুঁপিয়ে উঠল অ্যামেট। হাঁ হয়ে গেছে ভয়ে। দেখা গেল তার মুখের চৌকো কালো ফাঁক।–কী করলে, রানা…

পিছিয়ে এসে ছায়ায় খালি সিরিঞ্জ ফেলল রানা। চোখের সামনে দেখল, পাল্টে যাচ্ছে সিআইএ এজেন্টের চেহারা। মেঝেতে মাথা ঠুকতে শুরু করেছে সে। ছিঁড়তে লাগল মাথার চুল। মুখে আঙুল ভরে চাইছে বমি করতে। শরীর থেকে বের করবে ওই ড্রাগ। দরদর করে নেমেছে দুচোখ থেকে অশ্রু।

কেমন লাগছে, অ্যামেট? বলল রানা। জানোই তো, মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বদ্ধউন্মাদ হয়ে যাবে। ওই ভিডিয়োর লোকটার মত।

খুন করো… আমাকে খুন করো! আবারও ফুঁপিয়ে উঠল অ্যামেট। মুখে লেগে আছে খড়। উঠে দাঁড়াল। দয়া করে আমাকে খুন করো, মিস্টার রানা!

সরি, নিষ্ঠুর শোনাল বিসিআই এজেন্টের কণ্ঠ। এবার সব খুলে বলল। বসল একটু দূরের খড়ের গাদায়। বুঝতে পারছে, লোকটার শিরার মাঝ দিয়ে বইছে ওই ড্রাগ। মাত্র একমিনিট পর অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেল অ্যামেট। আস্তে করে বসল খড়ের গাদায়।

ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর লোক থেকে হঠাৎ করেই হয়েছে নির্বিকার এক মানুষ। আরও দুমিনিট পর শুরু হলো প্রতিক্রিয়া। চোখ-মুখ নিস্পৃহ। অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া মানুষের মত ঝুলে গেল গালের পেশি। বোধহয় জানেও না কী হচ্ছে। উল্টে গেল চোখের মণি। বিড়বিড় করে বলতে লাগল পেটের সব কথা।

ও নিজে এখন কী করবে, ভালভাবেই জানে রানা। সরকারী এজেন্ট এবং পুলিশ অফিসার খুনের দায়ে ওকে খুঁজছে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ। কাজেই চাই এমন প্রমাণ, যেটা নিরপরাধ হিসেবে মুক্ত করতে পারে ওকে। রানা আশা করছে, নানান তথ্য পাবে ক্যাল অ্যামেটের কাছ থেকে।

ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে অন করে ভিডিয়ো ক্যামেরা অ্যাকটিভেট করল রানা। ক্যামেরা স্ক্রিনে আনল অ্যামেটকে। জোর গলায় বলল, জানাও, তুমি আসলে কে।

বারকয়েক চোখের পাতা নাড়ল অ্যামেট। তারপর দ্বিধা না করেই বলল, আমি ক্যাল অ্যামেট। কাজ করি সিআইএ তে।

মাথা দোলাল রানা। কাজ করছে ড্রাগ। এবার সামান্য মানসিক চাপ তৈরি করল ও, জানাও, কোর্ফিউ দ্বীপে প্রাক্তন দুই সরকারী অফিসার বয়েটার ও ক্রিস্টিনা কী করছিল। তাদের সঙ্গে ছিল সক্রিয় সিআইএর বেশ কজন এজেন্ট।

প্রতিবাদ করতে গিয়েও নানান দিকে চোখ ঘুরিয়ে আবার থেমে গেল অ্যামেট। বারবার পাকিয়ে ফেলল দুই মুঠো। যেন লড়াই চলছে মনের দুটো শক্তির মাঝে। কিন্তু জয়ী হলো ড্রাগ, কেমিকেল সিগনাল পাঠাল মগজে ক্যাথি হার্বার্ট, নিচু গলায় বলল অ্যামেট, ক্যাথি হার্বার্টকে কিডন্যাপ করেছিল ইউএস এজেন্টরা। মন্টানার প্রত্যন্ত এক আনঅথোরাইড ফ্যাসিলিটিতে নিয়ে আসা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে।

তোমার দায়িত্ব কী ছিল, এজেন্ট অ্যামেট?

মেয়েটার কাছ থেকে জরুরি তথ্য সংগ্রহ করা। দরকার হলে নির্যাতন করতে বলে দেয়া হয়। মাথা নাড়ল অ্যামেট। কোনও বাধা এলে খুন করতে হবে শত্রুদেরকে। সেজন্যেই খুন করেছি ডাক্তার মাল্ডুন আর দুই পুলিশ অফিসারকে। দরদর করে ঘামছে লোকটা। কপালে ফুটে উঠেছে নীল রগ। অন্তরের দুই ধরনের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছে সে।

কাছ থেকে ক্যামেরা ধরল রানা। ক্যাথি হার্বার্টের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এত জরুরি কেন?

কারণ এসবে জড়িত জেরুযালেম।

 খুলে বলো।

চোখ উল্টে গেল অ্যামেটের। মুচড়ে ফেলল ঠোঁট। দেখা দিল চৌকো গর্ত। তাকে দেখাল যোম্বির মত।

শিরশির করছে রানার শিরদাঁড়া। কী বলছে লোকটা?

ঠেকাতে পারবে না, চাপা স্বরে বলল অ্যামেট। শুরু হয়েছে, আর কিছু করতে পারবে না কেউ। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আরম্ভ হবে সব।

কী শুরু হবে?

ওই মেয়ে কিছুই জানে না। আসল কথা হলো যুদ্ধ।

কীসের যুদ্ধ?

চোখ আবারও উল্টে গেল অ্যামেটের। তারপর সরাসরি তাকাল রানার চোখে। অদ্ভুতভাবে হাসল। কেন? বাইবেলের সেই চরম শেষ যুদ্ধ?

রানার মনে হলো কষে ওর গালে চড় দিয়েছে কেউ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, বলতে থাকো।

টপটপ করে নাক বেয়ে ঘাম পড়ছে অ্যামেটের। আগে কখনও কাউকে এভাবে ঘামতে দেখেনি রানা। ফুঁপিয়ে উঠে দম নিল লোকটা। ছিঁড়তে চাইল গায়ের পোশাক। যেন আগুন ধরেছে তার গায়ে। নানান দিকে ঘোরাচ্ছে চোখ। কর্কশ স্বরে বলল, সময় ঘনিয়ে এল। মহাপ্রলয়। ওটা শুরু করবে ওরা। পটভূমি তৈরি। সব শুরু হবে জেরুযালেমে।

কী করবে ওরা?

মস্তবড় কিছু, বলল অ্যামেট, তুমি বা কেউ কিছু করতে পারবে না। পারবে না ঠেকাতে।

হতভম্ব হয়ে গেছে রানা। এক সেকেণ্ড পর বলল, এসব করছে বা করাচ্ছে থর্ন? কে সে?

জমাট হাসি ফুটল অ্যামেটের মুখে। থরথর করে কাঁপছে লোকটা। বিড়বিড় করে কী যেন বলল।

পরিষ্কার করে বলল, বলল রানা।

সরাসরি ওর চোখে তাকাল অ্যামেট। রক্তের মত লাল হয়েছে দুচোখ। ফিসফিস করল, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

হ্যাঁ, কথা ঠিক। প্রশ্নের জবাব দাও।

ড্রাগের কারণে বাকি জীবন পাগলাগারদে থাকবে, সেই ভয়ে অস্থির হয়ে উঠছে অ্যামেট। কী যেন ভাবল। স্থির করল কিছু। তার চোখে বিপদের সঙ্কেত দেখল রানা। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেল ওর।

হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াল লোকটা, বাধা দেয়ার আগেই দৌড়ে পাশ কাটিয়ে গেল রানাকে। দুই সেকেণ্ডে দশ ফুট পেরিয়ে গেল অ্যামেট, পরক্ষণে ঝাঁপ দিল তিরিশ ফুট উঁচু দোতলা থেকে। কোনও রেলিং নেই যে বাধা দেবে। শূন্যে পাক খেল শরীরটা, পরের সেকেণ্ডে শুরু হলো পতন। লোকটার চোখের সাদা অংশ দেখল রানা।

কিন্তু নিচের মেঝেতে পড়ল না অ্যামেট।

কিছুক্ষণ আগে যে ড্রাম থেকে খুঁটি নিয়ে রানাকে গাঁথতে চেয়েছে ক্যাল অ্যামেট, সেসব খুঁটিই গেঁথে গেল তার পিঠে। দেহের ওজনে ঝাঁঝরা হলো বুকের পিঞ্জর। অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাত হয়ে ঝুলে থাকল লোকটা। সরাসরি চেয়ে আছে ওপরে রানার চোখে। এক সেকেণ্ড পর তার মাথা ঠাস্ করে পড়ল পুরনো বৃত্তাকার করাতের ফলার ওপর। জং ধরা করাতের ফলা থেকে টপটপ করে নিচে পড়ল রক্ত ও গলে যাওয়া মগজ।

মোবাইল ফোন অফ করে পকেটে রাখল রানা। ব্যাগ তুলে নেমে এল নিচে। ঘুরপাক খাচ্ছে মনে ক্যাল অ্যামেটের বলা কথাগুলো।

ক্যাথিকে কিডন্যাপ করেছে প্রলয় ডেকে আনার জন্যে?

ব্যাপারটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না ওর।

হয়তো ড্রাগের ঘোরে যা খুশি বলেছে লোকটা।

কিন্তু…নাহ্!

 লোকটার চোখে অন্য কিছু দেখেছে রানা।

সত্যি বলছিল সে!  

সিআইএ এজেন্টের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবল, এসব থেকে কী বুঝব?

কসেকেণ্ড পর সতর্ক হয়ে উঠল রানা।

বাইরে আওয়াজ!

দৌড়ে বার্ন থেকে রোদে বেরিয়ে এল ও। গলির ভেতর এখনও দাউদাউ জ্বলছে আগুন। তাপ লাগছে মুখে। তাপ প্রবাহের মাঝ দিয়ে দেখল, খামারবাড়ির উঠানে একসঙ্গে নামছে চারটা হেলিকপ্টার। রঙ গাঢ় সবুজ। গায়ে সাদা লেখা: এফবিআই।

প্রথমটা বড় টুইন প্রপ বোয়িং। পিছলে খুলে গেল হ্যাচ। নেমে পড়ল এক লোক। পরনে ট্যাকটিকাল পোশাক নেই। ধূসর কোট। রোটরের দমকা হাওয়ায় উড়ছে এলোমেলো ধূসর চুল। মাথা নিচু করে ঘাস মাড়িয়ে দূরে সরল সে।

ওই লোকের পেছনেই আছে রেবেকা। চারপাশের জ্বলন্ত দালান ও কপ্টারের ধ্বংসস্তূপ দেখে বিস্ফারিত হয়েছে ওর চোখ। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল রানাকে। লক্ষ ওয়াটের দারুণ উজ্জ্বল এক হাসি ফুটল রেবেকার মুখে।

ধ্বংসস্তূপের মাঝ দিয়ে হেঁটে ওর দিকে চলল রানা। বেল্ট থেকে নিয়ে ধুলোয় ফেলে দিল বেরেটা পিস্তল।

অন্য তিন হেলিকপ্টার নেমে পড়তেই ওগুলো থেকে বেরোল অন্তত বিশজন এজেন্ট। ধূসর কোট পরা লোকটা হেঁটে আসছে রানার দিকে। কোটের পকেট থেকে ব্যাজ নিয়ে ওপরে তুলে ধরল। ছুটে এসে তাকে প্রায় ঘিরে ধরল সশস্ত্র এজেন্টরা। সবার অস্ত্র তাক করা রানার বুকে।

গম্ভীর চেহারায় মাথার ওপরে হাত তুলল রানা।

আমি সিআইএর স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন, বলল ধূসর কোট, গ্রেফতার করা হচ্ছে আপনাকে, মিস্টার রানা।

.

৫০.

 রানাকে ঘিরে ধরে বোয়িং কোম্পানির বড় হেলিকপ্টারে তুলল কজন সিআইএ এজেন্ট। জানালা দিয়ে রানা দেখল, কালো সানগ্লাস পরা ধূসর কোটের লোকটার ইশারায় আরেকটা কপ্টারে উঠল রেবেকা ও ক্যাথি। ওই যান্ত্রিক ফড়িঙে নিজেও উঠল লোকটা।

আকাশে দীর্ঘক্ষণ উড়ে চলল চার হেলিকপ্টার। সন্ধ্যার দিকে নামল ব্যক্তিগত কারও রানওয়েতে। অপেক্ষা করছিল কালো এসইউভি গাড়ি নিয়ে সশস্ত্র লোক। রানাকে তুলে দেয়া হলো চকচকে নতুন এক জেট বিমানে। গার্ডরা চোখ রাখল ওর ওপর। দূরের সিটে রেবেকা ও ক্যাথি।

টেকঅফের আধঘণ্টা পর বিমান নামল এক মিলিটারি এয়ারফিল্ডে। অপেক্ষা করছিল আরও কয়েকটা কালো গাড়ি। একটায় তোলা হলো রানাকে। দুপাশে থাকল একজন করে এজেন্ট। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। তুমুল বেগে রওনা হলো গাড়ি। সামনে ও পেছনে কয়েকটা কালো এসইউভি। একটা কথাও বলল না কেউ।

কোথায় নেয়া হচ্ছে, বুঝে গেছে রানা।

গন্তব্য ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে সিআইএ হেডকোয়ার্টার। কিছুক্ষণ পর দূরে রানা দেখল বিশাল দালান। 

উঁচু স্টিলের গেটের সামনে গাড়ির বহর ঠেকাল সশস্ত্র সিকিউরিটি পারসোনেলরা। গেটে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ঈগল ও নক্ষত্রের সিল। হ্যামারস্টাইন তার কার্ড দেখাবার পর ছেড়ে দেয়া হলো পথ।

পেরোতে হলো কয়েকটা গেট, তারপর পৌঁছে গেল ওরা হাজারো জানালা বসানো মস্তবড় এক দালানের কাছে। সন্ধ্যার আঁধারে উজ্জ্বল আলোয় ওটা যেন ঝিকঝিক করা প্রকাণ্ড কোনও জাহাজ। ফ্লাডলাইটের আলোয় মৃদু হাওয়ায় উড়ছে আমেরিকার পতাকা। এখানে সবই মাপা। কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। প্রকাশ পাচ্ছে জাতীয় দম্ভ।

কয়েক সেকেণ্ড পর থামল গাড়ি, রানাকে নিয়ে যাওয়া হলো ভবনের ভেতর। চারপাশে বহু মানুষের ব্যস্ততা। পেরোতে হলো কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী। চওড়া সব করিডোরে নানাদিকে চলেছে অসংখ্য কর্মী। রানাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত হাঁটছে স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। পেছনেই কালো কোট পরা ফেউয়ের মত কজন এজেন্ট। কাঁধের ওপর দিয়ে পনেরো গজ পেছনে রেবেকাকে দেখল রানা। মেয়েটাকে পাহারা দিয়ে আনছে আরেকদল এজেন্ট। রানার দিকে চেয়ে হাসল রেবেকা, তবে সেই হাসি নার্ভাস মানুষের। কোথাও দেখা গেল না ক্যাথিকে।

হ্যামারস্টাইনের পিছু নিয়ে মস্তবড় এক অপারেশন রুমে ঢুকল রানা। সারি সারি ডেস্কে কমপিউটার টার্মিনাল নিয়ে বসে আছে সিআইএ টেকনিশিয়ানরা। জায়গাটাকে স্টক এক্সচেঞ্জের মত লাগল ওর। শত শত স্ক্রিনে নানান দেশের তথ্য। দেয়ালে রঙিন পলিটিকাল ম্যাপ। বারবার বদলে যাচ্ছে দৃশ্য। সবার চোখ কমপিউটার স্ক্রিনে। গম্ভীর চেহারা। হয়তো ভাবছে পলক ফেললেই সর্বনাশ হয়ে যাবে আমেরিকার।

বিশাল অপারেশন রুম পেরিয়ে কাঁচের কয়েকটা স্লাইডিং ডোর পেরোল রানা। সামনেই ভার্টিকাল পর্দা দিয়ে ঘেরা ঘর। ওদেরকে দেখে ডেস্কের পেছন থেকে উঠে দাঁড়াল এক সিকিউরিটি গার্ড।

তার হাতে একটা কার্ড দিল হ্যামারস্টাইন। হুইশ আওয়াজে খুলে গেল পরের ঘরের দরজা। এজেন্টের পিছু নিয়ে লম্বাটে এক কনফারেন্স রুমে ঢুকল রানা।

মাঝে চকচকে কালো টেবিল। চারপাশে চামড়ামোড়া আরামদায়ক চেয়ার। তিনদিকের দেয়ালে কাঠের প্যানেল, চতুর্থ দিকে মস্ত মিরর উইণ্ডো। পাশে উড়ছে দুটো পতাকা। প্রথমটা ইউএসএর নক্ষত্র খচিত, দ্বিতীয়টা এমব্রয়ডারি করা সিআইএর সাদা-সোনালি পতাকা। বেশ নিচু ঘরের ছাত। ছাতে বেশ কয়েকটা স্পটলাইট।

রেবেকাকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিল নীরব এজেন্টরা। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। রানার দিকে তাকাল রেবেকা। চোখ বলছে অনেক কথা, কিন্তু আপাতত মুখ খোলার উপায় নেই। দুসেকেণ্ড ওর চোখে চেয়ে অভয় দিল রানার চোখ।

কনফারেন্স টেবিলের একমাথায় আছেন চওড়া কাঁধের এক কৃষ্ণ বর্ণের ভদ্রলোক। বয়স ষাটের কাছাকাছি। পরনে ধূসর কোট, গলায় নেভি টাই। বিচারকের মতই অত্যন্ত গম্ভীর তিনি। টেবিল ঘুরে গিয়ে তাঁর ডানদিকের চেয়ারে বসল হ্যামারস্টাইন। ঠিক করে নিল টাই। অপেক্ষা করছে কথা শুরু করবেন বস।

রানা বুঝল, সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে।

আমার নাম জেরাল্ড ডালটন, বললেন ভদ্রলোক। কণ্ঠ গম্ভীর, তবে মোলায়েম। চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ। সিআইএর এই নতুন চিফ সম্বন্ধে কোনও বদনাম শোনেনি রানা।

অলসভঙ্গিতে হাত তুলে বামদিকের চেয়ার দেখালেন জেরাল্ড ডালটন। প্লিয, বসুন।

বসল রানা। তিন ফুট দূরের চেয়ারে রেবেকা। নার্ভাস হয়ে খুকখুক করে কাশল।

বন্দিকে ধরে এনে প্রথমেই ঘাবড়ে দেয়ার জন্যে এই ঘর রেখেছে সিআইএ, ভাবল রানা। সহজ সুরে জানতে চাইল ও, ক্যাথি কোথায়?

ভাল আছে, শান্ত স্বরে বললেন ডালটন, এজেন্ট হ্যামারস্টাইনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার নিরাপত্তার।

সিআইএর হেফাজতে রাখা হয়েছে ওকে?

নিরাপদে আছে, বললেন ডালটন, এর বেশি আপাতত আপনার জানার দরকার নেই। ঠোঁট মুচড়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন তিনি। কমুহূর্ত পর একটু ঝুঁকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন সরাসরি রানার চোখে। মস্ত বিপদে পড়েছি আমরা, মিস্টার রানা। তাঁর চোখ পড়ল রেবেকার ওপর। এজেন্ট ট্রিপলার, তুমি বোধহয় বুঝতে পেরেছ, কত বড় ঝামেলায় আছ? মিটিং শুরুর আগে জরুরি কিছু বলার আছে তোমার?

রেবেকাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মনে হলো রানার। আগেই সব জানানো হয়েছে জেরাল্ড ডালটনকে। এখন ঘরের মিরর উইণ্ডোর ওদিক থেকে দেখছে একদল লোক। শুনবে সব। রেকর্ড করবে কথা। ভিডিয়ো করা হবে প্রতিটি দৃশ্য।

আসার পথে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছি, তার বাইরে আর কিছু বলার নেই আমার, স্যর, শান্ত গলায় বলল রেবেকা।

রেকর্ড করার জন্যে সব শুনব আবার প্রথম থেকে, বললেন ডালটন।

শীতল হাসল স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন।

মেপে মেপে কথা বলতে শুরু করল সতর্ক রেবেকা। আমি ছিলাম ক্যাল অ্যামেটের দলে। আমাকে ধারণা দেয়া হয়: অনুমোদিত মিশনে কাজ করছি। কিন্তু পরে দেখলাম কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা, আর তাই মনে জেগে উঠল সন্দেহ। আমি সাক্ষ্য দেব, নিজ হাতে জর্জিয়ার দুই পুলিশ অফিসারকে খুন করেছে ক্যাল অ্যামেট। এ ছাড়া, চিনুকের কাছে একটা ফ্যাসিলিটিতে তার হাতে খুন হয়েছেন ডক্টর মান। প্রতিটি ঘটনা ঘটেছে আমার চোখের সামনে। নিজ চোখে দেখেছি, মণ্ট্যানার ফ্যাসিলিটিতে অ্যামেট এবং তার দলের লোকরা আটকে রেখেছিল ক্যাথি হার্বার্টকে। আমরা বাধা না দিলে নির্যাতন করে মেয়েটাকে খুন করত তারা।

টেবিলের ওদিক থেকে আক্রমণাত্মক সুরে বলল হ্যামারস্টাইন, অথচ সব জেনেও ঊর্ধ্বতন অফিসারকে জানাওনি।

স্যর, এজেন্ট অ্যামেট ছিল আমার ইমিডিয়েট সুপিরিয়র। নিজ নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয়েছে আমাকে। রিপোর্টে লিখেছি, সে সময়ে কিছুই করার উপায় ছিল না বলে আমি লজ্জিত।

চুপ করে আছেন জেরাল্ড ডালটন। কয়েক মুহূর্ত পর গম্ভীর চেহারায় মাথা দোলালেন। পরে এই বিষয়ে আলাপ করব আমরা। রানার দিকে তাকালেন। এবার আসা যাক আপনার বিষয়ে, মিস্টার রানা। আমরা ভাল করেই জানি আপনি কে। কাজেই নতুন করে পুরনো কথা তুলব না।

ভদ্রলোকের স্থির দৃষ্টির বদলে তাঁকে একইরকম ঠাণ্ডা দৃষ্টি ফেরত দিল রানা। আমি কিছুই গোপন করছি না।

মিস হার্বার্টের বাবা-মার কথায় মেয়েটাকে খুঁজে দেয়ার কাজ নেন আপনি।

মাথা নাড়ল রানা। কাজটা নেয় আমার এক বন্ধু। আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম না।

ঘটনা যা-ই হোক, পড়তে লাগল লাশের পর লাশ। প্রথমে গ্রিসে, তারপর জর্জিয়ায়। এরপর মন্টানায়। আমাদের তদন্ত দল এখনও ওই হোটেল থেকে এজেন্টদের লাশ বের করছে। কেউ সক্রিয় সরকারী এজেন্ট, আবার কেউ প্রাক্তন। যে খামারে আপনাকে পাওয়া গেছে, ওই জায়গা ছিল রণক্ষেত্রের মত। আপনি যেখানেই গেছেন, ধ্বংস হয়েছে ওই এলাকা। বিসিআই এজেন্ট হিসেবে আপনি এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?

আমাকে খুন করতে এসে কেউ মারা পড়লে সেটাকে আমি খুন বলে মনে করি না, বলল রানা।

ডালটনের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। ও। বুঝলাম। তবুও ক্যাথি হার্বার্ট কিডন্যাপ হওয়ার পর আপনি জড়িয়ে যাওয়ায় কী হলো, তা একটু খুলে বলুন।

ক্যাথি হার্বার্টের জড়িয়ে যাওয়া কাকতালীয় ঘটনা, বলল রানা। আসলে আরও অনেক বড় কিছু ঘটছে।

যেমন?

যেমন, যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া হবে পৃথিবী জুড়ে, বলল রানা।

পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ডালটন। আপনি জানিয়েছেন, গোপনে কোনও মিশনে জড়িয়ে গিয়েছিল এজেন্ট ক্যাল অ্যামেট। তার সঙ্গে ছিল সিআইএর একদল এজেন্ট।

আপনার নাকের ডগায় বসে যা খুশি করেছে, বলল রানা, নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করতে ব্যবহার করছিল আপনাদের ফ্যাসিলিটি ও টাকা।

কী তাদের উদ্দেশ্য?

সেটা জানতে সময় লেগেছে আমার, বলল রানা, আমার কাছ থেকে সবই জেনে নিয়েছে আপনার এজেন্টরা। তাদের কাছ থেকেই শুনতে পাবেন।

তবুও আপনিই বলুন।

সব শুরু হয়েছে বুক অভ রেভেলেশনের কল্যাণে, বলল রানা।

বাঁকা হাসল হ্যামারস্টাইন। আপনি পাগল হয়ে যাননি তো? আমরা অভিশাপ আর জন্তুর গল্প শুনতে বসিনি।

আপনার অধীনস্থ অফিসারকে বলুন সব খুলে বলতে, বিরক্ত হয়ে বলল রানা।

আপনি চুপ করুন, হ্যামারস্টাইন, রানার ওপর থেকে চোখ সরালেননা ডালটন। মিস্টার রানা, প্রথম থেকে বলুন। সব পরিষ্কারভাবে বুঝতে চাই।

ক্যাল অ্যামেট যে খ্রিস্টান সংস্থার হয়ে কাজ করত, সেটার সদস্যরা চাইছে মহাপ্রলয় হোক পৃথিবীর বুকে। এবং যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার জন্যে জেরুযালেমে সন্ত্রাসী হামলা করবে তারা।

হো-হো করে হেসে ফেলল সিআইএ স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন।

বিরক্ত চোখে তাকে দেখলেন ডালটন। চেহারা গম্ভীর।

আমার কথা অবিশ্বাস করতে পারেন, তবে আপনাদের নিজেদের লোকের মুখে শুনলে বিশ্বাস আসবে, বলল রানা। ওই ফার্মে আমার ফোনটা নিয়েছেন এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। ওটা ফেরত দিন।

কাকে কল দেবেন? হাসল হ্যামারস্টাইন। উকিল?

দেখবেন ক্যাল অ্যামেটের ভিডিয়ো।

 ওঁকে ফোনটা দিন, বললেন ডালটন।

আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুলল এজেন্ট, তারপর ব্রিফকেস খুলে বের করল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগ। ওটা থেকে নিল ফোন। বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। ওটা নিয়ে অন করল রানা। মেনু থেকে অ্যামেটের ভিডিয়ো বের করল। সিআইএ চিফ ডালটন ও এজেন্ট হ্যামারস্টাইনের দিকে রাখল ফোনের স্ক্রিন, তারপর চালু করল ভিডিয়ো।

ছোট স্ক্রিনে মনোযাগ দিলেন ডালটন ও হ্যামারস্টাইন।

খড়ের গাদায় বসে কথা বলছে ক্যাল অ্যামেট।

একটু পর টাই ঠিক করে নড়েচড়ে বসল হ্যামারস্টাইন। আরও গম্ভীর হয়ে গেছেন ডালটন। কয়েক সেকেণ্ড পর স্ক্রিন থেকে সরল অ্যামেট। শোনা গেল কেমন খচখচ আওয়াজ। ওপর থেকে পড়ে খুঁটিতে গেঁথে গেছে লোকটা। ভিডিয়ো প্রোগ্রাম বন্ধ করল রানা।

আশা করি আপনার জানা আছে, বেআইনীভাবে ওই স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে? সতর্ক কণ্ঠে বললেন ডালটন। এই ভিডিয়ো কোনও ধরনের প্রমাণ নয়।

ওই লোকও আইনী কোনও কাজে ছিল না, বলল রানা। ক্যাল অ্যামেট যে টুথ সিরাম ক্যাথি হার্বার্টকে দিতে চেয়েছিল, ওই একই জিনিস ব্যবহার করেছি তার ওপর। ওই জিনিস কিন্তু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে পাবেন না।

কড়া চোখে ওকে দেখলেন ডালটন। বলতে থাকুন।

সংক্ষেপে সবই খুলে বলল রানা। বাদ পড়ল না কিছুই। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখল, ভুরু কুঁচকে গেছে সিআইএ চিফের।

সন্দেহের চোখে রানাকে দেখল হ্যামারস্টাইন।

যে থর্নের কথা বললেন, ওই নোক তো নির্দেশ দিত অ্যামেটকে, কিন্তু একবারও তার কথা নেই ভিডিয়োয় অ্যামেটের স্বীকারোক্তির ভেতর।

মিথ্যা বলছে না রানা, নার্ভাস সুরে বলল রেবেকা।

নিজে তুমি ওই লোককে কখনও দেখেছ? কড়া সুরে রেবেকার কাছে জানতে চাইল হ্যামারস্টাইন।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকল রেবেকা, তারপর মাথা নাড়ল। না, স্যর।

হাসল স্পেশাল এজেন্ট। আঙুল তাক করল রানার দিকে। তার মানে, মাসুদ রানা একমাত্র মানুষ, যে কিনা বলছে থর্ন নামের এক লোক এসবের পেছনে আছে। প্রমাণ হিসেবে ধরার মত কিছুই নেই।

শুধু থর্ন? বললেন ডালটন। নামের শুরু কী?

থর্ন নামটা নকলও হতে পারে, বলল রানা।

তার মানে আপনি মোটেও জানেন না সে কে, বলল হ্যামারস্টাইন।

চেহারার বর্ণনা দিতে পারব, বলল রানা, বয়স চল্লিশ। আমেরিকান। শ্বেতাঙ্গ। লালচে চুল। হালকা-পাতলা শরীর। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। পেশাদার। যদিও জানি না পেশা কী। লোভী চোখ। টাকা-পয়সার অভাব নেই। হাতে সোনার দামি হাতঘড়ি, তাতে ডায়মণ্ড বসানো।

এমন লাখে লাখে লোক আছে আমেরিকায়, মাথা নাড়ল হ্যামারস্টাইন।

থর্নের ব্যাপারে আরও তথ্য চাই, কড়া সুরে বললেন ডালটন। ওই লোক থেকে থাকলে, সে আছে আমাদের ডেটা বেস-এ। রানার দিকে তাকালেন। বলুন তো, মিস্টার রানা, খ্রিস্টান একটা দল হঠাৎ কেন চাইছে যুদ্ধ বাধাতে? আপনার কোনও কারণ জানা আছে?

আমার ধারণা, তারা চাইছে বাস্তব হয়ে উঠুক বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী। হয়তো বিরক্ত ঈশ্বরের ওপর, তাই নিজেরাই নেমে পড়েছে যুদ্ধ বাধাতে। অথবা, এটা কোনও কৌশল, যেন সাধারণ মানুষ মনে করে সত্য হচ্ছে বাইবেলের বাণী। কোটি কোটি আমেরিকান সেক্ষেত্রে ধরে নেবে ফুরিয়ে এসেছে। সময়। সামনেই মহাপ্রলয়। ঘটনা যাই হোক, আমার মনে হয়েছে, এসব করা হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্যে।

জড়িত কারা? শান্ত কণ্ঠে বললেন ডালটন। কোন স্তরের লোক তারা?

তা আমার জানা নেই, বলল রানা। তবে ধরে নিতে পারেন, চাল দেয়া হচ্ছে ওপর পর্যায় থেকে। দেশে দেশে বাধিয়ে দেয়া হবে যুদ্ধ। ভীষণ আতঙ্কে পড়বে সাধারণ মানুষ। আমেরিকার অন্তত পাঁচ কোটি ভোটারের কাছ থেকে ভোট চাইবে কেউ।

এটা উন্মাদের মত কথা হলো, আপত্তির সুরে বলল হ্যামারস্টাইন। আপনি স্রেফ আন্দাজ করছেন। শক্ত কোনও প্রমাণ বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নেই।  

তাকে পাত্তা না দিয়ে রানাকে দেখছেন ডালটন। চেহারা বলে দিচ্ছে, তিনি অত্যন্ত চিন্তিত। এসব থেকে আপনি কী ভাবছেন, মিস্টার রানা?

হাজার বছর ধরেই স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ জেরুযালেম, বলল রানা। একই শহরে পাশাপাশি আছে ইহুদি ও মুসলিমদের পবিত্র স্থাপনা। রাগ ও হতাশার এলাকা। বলতে পারেন ধর্মীয় গান-পাউডারের বস্তা। সর্বনাশ করতে পারে আগুনের মাত্র একটা ফুলকি। গ্রাউণ্ড যিরো। যারা মনে করে সময় হয়েছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার, তাদের চোখ পড়ে আছে জেরুযালেমের ওপর। সংখ্যায় এরা কোটি কোটি। বিশ্লেষণ করছে প্রতিটি ঘটনা। ওই এলাকার জন্যে পাল্টে যাচ্ছে রাজনৈতিক পরিবেশ। এটুকু বলে চুপ হয়ে গেল রানা।

মাথা দোলালেন ডালটন। ঠিক আছে, আমি শুনছি। আপনি বলে যান।

ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, হামলা হবে ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় ইসরায়েলের ইহুদি জাতির ওপর, বলল রানা। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটাতে চাইলে কী করা উচিত?

চুপ করে কী যেন ভাবছেন ডালটন। একটু পর বললেন, কাজে লাগাতে হবে জেরুযালেমের ধর্মীয় উত্তেজনাকে। উস্কে দিতে হবে মুসলিম নেতাদেরকে, যাতে তারা হামলা করে ইহুদিদের ওপর। তাতে ছড়িয়ে পড়বে আরব ভূখণ্ডে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ।

মাথা দোলাল রানা। সেক্ষেত্রে আগে হামলা করতে হবে মুসলিম নেতাদের ওপর। তাতে মুসলিম দেশগুলো চাইবে শত্রু রাষ্ট্রের ওপর হামলা করতে।

তার মানে, ধরে নিতে পারি, আগে আক্রমণ করা হবে মুসলিম নেতাদের ওপর। আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন সিআইএ চিফ।

এমন কিছু করতে হবে, যেন খেপে ওঠে মুসলিম জগৎ, বলল রানা। তা হবে এমন কিছু, যেমন আগে কখনও করা হয়নি। চরম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে মুসলিমরা।

যেমন? ভুরু উঁচু করে রানার দিকে তাকালেন ডালটন।

আন্দাজ করতে গেলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি, বলল রানা। তবে সন্ত্রাসী কোনও হামলার কথাই ভাবছি। খুন হবেন রাজনৈতিক কোনও ইসলামী নেতা। অপমানিত হবে গোটা মুসলিম বিশ্ব।

যে-কোনও কিছু হতে পারে, বললেন ডালটন। কারা প্রতিপক্ষ, কী করবে, এসব একদম অজানা। কোথা থেকে শুরু করা উচিত, সেটাও আমাদের জানা নেই।

আপনাদের শুধু জানা আছে দুটো তথ্য, বলল রানা। জেরুযালেমে খারাপ কিছু হবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। আর সব দোষ চাপিয়ে দেয়া হবে ইযরায়েলিদের ঘাড়ে।

তিক্ত চেহারায় টেবিলে চাপড় মারল হ্যামারস্টাইন। পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে।

তার দিকে তাকালেন না সিআইএ চিফ ডালটন। হাতের ইশারা করলেন মিরর উইণ্ডোর দিকে।

রানা বুঝল, ওর ধারণাই ঠিক, ভিডিয়ো করা হচ্ছিল সব। মানা করে দেয়া হলো এখন।

স্টপ ট্রান্সক্রিপশন। রানা ও রেবেকার দিকে ফিরলেন ডালটন। কুঁচকে গেছে ভুরু। এখন যা বলব, সেটা কখনও প্রকাশ করবেন না। তিন মাস আগে হারিয়ে গেছে ইযরায়েলি মোসাদ এজেন্ট জাত খুনি সলোমন রুশদি। তারপর থেকে সিআইএ তার কোনও খোঁজ বের করতে পারেনি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম খুন হয়ে গেছে। কিন্তু ওই খুনের জন্যে দায় নেয়নি কেউ। এরপর মাত্র একবারের জন্যে তাকে দেখা গেছে কোর্ফিউ দ্বীপে। আজ মিস্টার রানা যা বললেন, তাতে এখন মনে হচ্ছে, বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে রুশদিকে কিনে নিয়েছে কেউ। বোমা ফাটিয়ে হাওয়া হয়েছে আগেও। প্রমাণ করা যায়নি যে সে দোষী।

খুনির অস্ত্র পেলে হয়তো হাতের ছাপ থেকে বুঝব, খুন করেছে সলোমন রুশদিই, বলল রেবেকা।

সঙ্গে পাবেন তার ক্রেডিট কার্ড ভরা মানি ব্যাগ, বলল রানা। যেমন ৯/১১-এ পাওয়া গিয়েছিল সন্ত্রাসীদের আধ পোড়া আইডি।

চোখ সরু করে ফেললেন ডালটন। চুপ করে আছেন।

নোংরা লড়াইয়ে বড়ে ছাড়া খেলা যায় না, যোগ করল রানা। সলোমন বড়ে। তার মাথার ওপরে আছে আপনাদের দেশের হাতি-ঘোড়া-নৌকা-মন্ত্রী; একদল ক্ষমতাশালী লোক।

কড়া চোখে ওকে দেখে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিল হ্যামারস্টাইন। স্যর, আশা করি এই লোকের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না? আন্দাজে যেদিক খুশি বন্দুক মারছে।

ঠাণ্ডা চোখে তাকে দেখে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ডালটন, অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনছি মিস্টার রানার কথা। …হ্যামারস্টাইন, আপনার যৌক্তিক কোনও কথা না থাকলে, দয়া করে চুপ করে থাকুন।  

মুখ লালচে করে নীরব হয়ে গেল হ্যামারস্টাইন।

টেবিলের দিকে একটু ঝুঁকে এলেন ডালটন। মিস্টার রানা, আপনি আছেন মস্ত বিপদে। খুনের দায়ে হয়তো জেল হবে পঞ্চাশ বছর। কারও সাধ্য নেই আপনাকে বের করে আনবে।

তা হলে ভরে দিন জেলেই, নির্বিকার সুরে বলর রানা।

হাসলেন ডালটন। আমরা তা চাইছি না।

স্যর, আমি কিন্তু ওসব খুনের সাক্ষী, প্রতিবাদের সুরে বলল রেবেকা। খুন করেছে ক্যাল অ্যামেট, রানা নন।

কড়া চোখে ওকে দেখলেন ডালটন। মুখটা বন্ধ রাখো, রেবেকা। নিজেও আছ বিপদে। তোমার রিপোর্টে উল্লেখ আছে, খুন করেছ সিআইএর এক এজেন্টকে। রানার দিকে তাকালেন তিনি। মিস্টার রানা, আপনি হয় আমাদের পক্ষে কাজ করবেন, অথবা দুই পুলিশ অফিসার আর এজেন্টদের খুনের দায়ে ফেঁসে যাবেন। অন্তত বিশ বছরের জেল হবে রেবেকা ট্রিপলারেরও।

আপনার মনে হয়েছে আমি উপযুক্ত লোক, আপনাদের হয়ে কাজ করব- এটা ভাবার কারণটা কী? জানতে চাইল রানা।

নইলে বাকি জীবনেও আর বেরোতে পারবেন না জেল থেকে। …স্নাইপার কাউন্টার স্নাইপারের লড়াই হলে, আপনার চেয়ে দক্ষ আর কাউকে পাব না। সেজন্যেই আপনাকে চাই। শার্টের পকেট থেকে ম্যাচের বাক্স বের করলেন ডালটন। বাড়িয়ে দিলেন। ভেতরে পাবেন খরচ করা একটা কাঠি। ওটা দেখলে মনে পড়বে জর্জিয়ার এক রাইলে শুটিঙের কথা।

চুপ করে আছে রানা।

কয়েক মুহূর্ত পর বললেন ডালটন, আমার সুপিরিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলব। তবে মনে হচ্ছে, সব শোনার পর উনি বলবেন, আপনি নিজে যেন যান ইযরায়েলে।

আমি তো আপনার সুপিরিয়র অফিসার, অর্থাৎ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের চাকরি করি না, বলল রানা।

তা ঠিক, মাথা দোলালেন ডালটন, বিমানে করে আসার সময় রিপোর্ট দিয়েছেন হ্যামারস্টাইন। বিস্তারিতভাবে সব শোনার সময় যখন জানলাম, আপনি জড়িয়ে গেছেন এসবে, তখনই বুঝেছি সাহায্য চাইলে এ কথাই বলবেন।

তো?

কাজেই ফোন দিয়েছি বিসিআই চিফের কাছে। খুলে বলেছি কী ধরনের সমস্যা।  

কী বললেন তিনি?

জানালেন, আপনি চাইলে সিআইএর এই মিশনে যোগ দিতে পারেন, তার কোনও আপত্তি নেই।

ফোন দিতে পারি তার কাছে? জানতে চাইল রানা।

পারেন। রানার মোবাইল ফোন দেখালেন ডালটন।

বিসিআই চিফের ব্যক্তিগত ফোনে কল দিল রানা। তিন সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে রিসিভ করলেন মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। হ্যালো, রানা।

স্যর, আমি…

তুমি আছ সিআইএ হেডকোয়ার্টারে, মুখের কথা কেড়ে নিলেন রাহাত খান, চাপা কণ্ঠে উদ্বেগ। কথা হয়েছে চিফ ডালটনের সঙ্গে।

উনি চাইছেন আমি যেন ইসরায়েলে যাই।

যাবে কি না, তা তোমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে, রানা। এ বিষয়ে আমার কোনও নির্দেশ বা বাধা নেই। তবে, ঘুরে আসাই বোধহয় ভাল। যদি ঠেকিয়ে দেয়া যায় ম্যাস মার্ডার, তা ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলিম সবার জন্যেই মঙ্গলকর। আমরা কেউ চাই না ধর্মের নামে যুদ্ধ বাধিয়ে খুন করা হোক নিরীহ মানুষ।

চুপ করে আছে রানা।

আর কিছু বলবে? জানতে চাইলেন রাহাত খান।

না, স্যর, বলল রানা, তা হলে পরে রিপোর্ট দেব আপনাকে।

গুড। লাইন কেটে দিলেন বিসিআই চিফ।

চুপ করে আছেন সিআইএ চিফ জেরাল্ড ডালটন। বাংলায় বলা একটা কথাও বুঝতে পারেননি। তবে রানার চেহারা দেখে আঁচ করেছেন কিছু। জেরুযালেমে আপনাকে দরকারি প্রতিটি বিষয়ে সাহায্য করবেন হ্যামারস্টাইন, বললেন তিনি। ওই শহরের সিআইএ এজেন্টদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে।

আমার কিছু শর্ত আছে, বলল রানা।

মাথা দোলালেন ডালটন। শুনতে আপত্তি নেই। বলুন।

পৌঁছে দিতে হবে ক্যাথি হার্বার্টকে ওর বাবা-মার কাছে।

অসম্ভব, মাঝ থেকে বাগড়া দিল স্পেশাল এজেন্ট হ্যামারস্টাইন। সে আমাদের সাক্ষী।

অন্যায়কারী সিআইএ এজেন্টদের অসহায় শিকার ক্যাথি, বলল রানা। জোর করে ওর কাছ থেকে সংগ্রহ করতে চেয়েছে তথ্য। কাজেই চাইব সেরা পুলিশ প্রহরা দিয়ে ওকে পাঠানো হবে ব্রিটেনে। ওখানেও নজর রাখতে হবে ওর ওপর। নইলে যে-কোনও সময়ে খুন হবে।

কী যেন ভাবছেন ডালটন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ঠিক আছে। আমি রাজি। কিন্তু পরে প্রয়োজন পড়লে সাক্ষ্য দেবে সে-কথা দিতে হবে তাকে।

আরও কিছু কথা আছে, বলল রানা। ভবিষ্যতে অতীত তুলে অভিযোগ আনা যাবে না রেবেকার বিরুদ্ধে।

মাথা দোলালেন সিআইএ চিফ। আর কিছু?

গ্রিসে কোর্ফিউ দ্বীপে রেখে এসেছি পুলিশ ক্যাপ্টেন আবদাল্লা অ্যানেস্তাসিয়োকে। চাই না ইউরোপে ফিরলে আমার পেছনে লেলিয়ে দিক ইন্টারপোল অফিসকে।

মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন ডালটন। বলে দেয়া হবে, জীবনেও আপনার নাম শোনেনি সে। আর কিছু?

না, আর কিছু না।

তো চুক্তি হয়ে গেল, বললেন সিআইএ চিফ, প্রস্তুতি নেয়া শেষ হলেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব জেরুযালেমে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *