নরপশু ২

১১.

 রানা যখন কথা বলছে মউরোসের সঙ্গে, ওই একইসময়ে অক্সফোর্ড শহর থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে, গ্রিক দ্বীপ প্যাক্সোসের এক নির্জন সৈকতে জেটির দিকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্যাথি হার্বার্টকে।

চার দিন আগে জেটিতে রাখা বোট নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তারপর আর রোদের মুখ দেখেনি। বিছানায় আটকে রেখেছিল এরা। চিৎকার করলে তখন শুধু টয়লেটে যাওয়ার অনুমতি মিলত। পুরো চার দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এরা ওকে।

পুরো সময়টা মগজ খাটাতে চেষ্টা করেছে ক্যাথি।

অথচ, জানতে পারেনি, ও আসলে কে।

কী নাম ওর? 

মগজ যেন মস্তবড় কালো দেয়াল। তবে কখনও কখনও মনে পড়েছে স্বপ্নের মত আধখাপচা এক-আধটা দৃশ্য।

চেহারা।

 কণ্ঠস্বর।

অচেনা জায়গা।

সবই যেন চলে আসে খুব কাছে, তারপর চট করে আবারও হারিয়ে যায় কুয়াশার ভেতর।

আঙুলে আছে ছোট্ট এক পুরনো ক্ষত। ওটার দিকে চেয়ে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভেবেছে, ওটা বোধহয় ছোটবেলার কাটাচিহ্ন।

কিন্তু ব্যথাটা পেয়েছিল কীভাবে?

কোনও স্মৃতি নেই ওর।

হাজারটা প্রশ্ন জাগছে মনে।

কোথা থেকে এসেছে ও?

কারা ওর পরিবার বা বন্ধু?

 কেমন ছিল ওর জীবন?

এর চেয়েও ভীতিকর হচ্ছে একটি প্রশ্ন: এরা ওকে মেরে ফেলবে না তো?

প্রথমে ভীষণ ভয় ছিল মনে। তারপর তা হয়ে উঠল চাপা আতঙ্ক। চুপচাপ খেয়াল করেছে কিডন্যাপারদেরকে, শুনেছে কথা। দুই লোক কখনও কথা বলে না। বেশিরভাগ সময় দেখাও দেয় না। কিন্তু ওই ছাব্বিশ বা সাতাশ বছরের মেয়েটা আর পরিপাটি চুলের লোকটা আসে নিয়মিত। ওই মেয়েটার চোখ খুব কঠোর, তবে কখনও একটু গলে মন। নরম সুরে কথাও বলে।

আর ওই লোকটা… ভয়ঙ্কর নীচ এক সাইকোপ্যাথ। অন্তর থেকে তাকে ঘৃণা করে ক্যাথি। চার দিন পড়ে থাকার সময় বারবার মনে হয়েছে কোনও উপায়ে নিজেকে মুক্ত করবে ও, কেড়ে নেবে ওই লোকের কাছ থেকে পিস্তল বা ছোরা, পালিয়ে যাওয়ার আগে খুন করবে শয়তানটাকে।

কিন্তু এরা জরুরি তথ্য জোগাড় করতে যতই চেষ্টা করুক, কোনও কাজ হচ্ছে না হুমকি বা ধমকিতে।

গত কদিনে ধীরে ধীরে তাদেরকে হতাশ হতে দেখেছে ও।

এই দীর্ঘ সময়ে হঠাৎ করে একটা চিন্তা এসেছে ক্যাথির।

 সত্যিই যদি ফিরে আসে ওর স্মৃতি… তখন কী হবে?

 দরকারি সব জেনে যাওয়ার পর কী করবে এরা?

ক্যাথি জানে, সুযোগ পেলে কী করবে পরিপাটি চুলের ইবলিসটা। তাকে ঠেকিয়ে রেখেছে শুধু ওই মেয়েটা।

হয়তো ওর এই অ্যামনেযিয়াই রক্ষা করছে ওকে!

আজ কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে এরা।

কিন্তু কোথায়?

 হাল ছেড়ে দিয়েছে?

এটা ভাবতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠছে ক্যাথি।

ছেড়ে দিচ্ছে?

পৌঁছে দেবে বাড়িতে?

অথবা, ধরে নিয়েছে কোনও কাজেই আসবে না ও।

 উচিত খেলা খতম করে দেয়া।

মেরে ফেলবে ওকে?

চিন্তাটা আসতেই থরথর করে কাঁপতে লাগল ওর দুই হাত। ক্যাথির মেরুদণ্ডে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে খোঁচা দিচ্ছে পরিপাটি চুল। সামনে বাড়ো!

আগের চেয়ে জোরে হাঁটতে চাইল ক্যাথি। কিন্তু খালি পায়ে বালিতে গতি তুলতে পারছে না। হাঁটুদুটো যেন নরম রবারের, যে-কোনও সময়ে ভাঁজ হয়ে যাবে।

হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু রুক্ষ একটা হাত ধরে ফেলল ওর বাহু। হ্যাচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল। পিঠে গুঁতো দিল পিস্তলের নল। 

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল ক্যাথি।

রাগে লাল হয়ে ওকে দেখছে পরিপাটি চুলের লোকটা। ধৈর্যের মূর্তি হয়ে পেছনে আসছে মেয়েটা। হাতঘড়ি দেখে নিয়ে আকাশে চোখ বোলাল সে। দুপাশে দুই লোক। নীরব, নিস্পৃহ চেহারা। একজনের ঊরুর পাশে আলগাভাবে ঝুলছে পিস্তল।

ঝড়ের কবলে পড়া বাঁশের পাতার মত কাঁপছে ক্যাথি। বুঝে গেছে, এরা এবার খুন করবে ওকে!

হ্যাঁ, আজ রক্ষা নেই ওর!

ভাল করেই জানি, কী ভাবছ, নিচু গলায় পেছন থেকে বলল কেউ। দৌড়ে পালাতে চাও। খিকখিক করে হাসল লোকটা। তা হলে দৌড় দাও! আমি চাই যেন তাই করো। তা হলে সহজেই খুন করতে পারব।

মুখটা বন্ধ রাখো! ধমক দিল কালো চুলের মেয়েটা।

সাগরের তীরে পৌঁছে গেছে ওরা। কাঠের জেটিতে ঠেলে ভোলা হলো ক্যাথিকে। লবণাক্ত তক্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে শিউরে উঠল ও।

পিছু নিয়েছে, অন্যরা।

এরা ডুবিয়ে মারবে ওকে?

তখনই শুনল আওয়াজ। দূর থেকে আসছে বিমান। কপালে হাত রেখে আকাশে চোখ তুলল ক্যাথি।

সাদা বিন্দুর মত একটা বিমান।

পিঠে ঠেলা খেয়ে জেটি ধরে এগোল ও।

সাদা বিন্দু বড় হয়ে উঠল। একটু পর দেখা গেল আকার-আকৃতি। ওটা ছোট একটা সি-প্লেন।

জেটির শেষপ্রান্তে পৌঁছে থামল সবাই।

দুই ইঞ্জিনের খ্যাট-খ্যাট আওয়াজ তুলে নামছে সি-প্লেন। কিছুক্ষণ পর স্পর্শ করল ঢেউয়ের মাথা। লাফিয়ে উঠল বারকয়েক, তারপর নেমে পড়ল প্রচুর পানি ছিটিয়ে। বাঁক ঘুরে চলে এল জেটির দিকে, পেছনে সাদা ফেনা।

একটু পর জেটির পাশে ভিড়ল সি-প্লেন। নামছে-উঠছে। সাগরের ঢেউয়ের তালে। গতি কমল প্রপেলারের। ইঞ্জিনের বিকট শব্দে দুহাতে দুকান চেপে ধরেছে ক্যাথি। পিঠে খোঁচা দিচ্ছে পিস্তলের নল।

সরু ফিউজেলাজের হ্যাচ খুলতেই দেখা দিল এক লোক। শীতল চোখে ক্যাথিকে দেখে নিয়ে মাথা দোলাল অন্যদের উদ্দেশে। সে এবং আরেক লোক মিলে বিমান বেঁধে ফেলল জেটির পিলারে। গ্যাংওয়ে বাড়িয়ে দেয়া হলো জেটির ওপর।

পেছন থেকে ঠেলে সরু ওই সেতুর ওপর তোলা হলো ক্যাথিকে। টলমল করতে করতে বিমানে উঠল ও। ভেতর দিকটা ঘুপচি। বিশ্রী গরম। তৃতীয় একলোক ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলল পেছনের সিটে।

আমাকে কোথায় নিচ্ছেন? আতঙ্ক নিয়ে জানতে চাইল ক্যাথি।

হ্যাচের ওদিক থেকে উঁকি দিল পরিপাটি চুল।

মুহূর্তের জন্যে ক্যাথির মনে হলো, ওই শয়তানটাও উঠবে বিমানে। তবে তার কাঁধে হাত রাখল কালো চুলের মেয়েটা। মাথা নাড়ল। তর্ক জুড়তে চাইল ইবলিসটা, তারপর ধমক খেয়ে পিছিয়ে গেল। তার জায়গায় বিমানে উঠল চুপচাপ দুজন। বসে পড়ল ক্যাথির পাশের দুটো সিটে। পাত্তাই দিল না ওকে। ধুপ আওয়াজে বন্ধ হলো হ্যাচ। দুই ইঞ্জিনের গতি বাড়তেই থরথর করে কাঁপতে লাগল হালকা বিমান। একটু পর আবারও উঠবে আকাশে।

.সি-প্লেনটাকে ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ছুটতে দেখল বয়েটার ও ক্রিস্টিনা পার্কার। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে নীল আকাশে ভেসে উঠল যান্ত্রিক প্রকাণ্ড মশা। বহু দূরে গিয়ে হয়ে উঠল সাদা বিন্দু। তারপর সেটাও থাকল না।  

ঘাড় থেকে নামল আপদ, বলল ক্রিস্টিনা।

রাগী চোখে তাকে দেখল বয়েটার। ইচ্ছে ছিল বিমানে উঠবে। অন্যদেরকে বুঝিয়ে বদমাস মেয়েটার মুখ থেকে বের করবে সব কথা। দিনের পর দিন পাথুরে এই সাগরতীরে সময় নষ্ট করেও কিছুই পেল না। নিজেকে বঞ্চিত লাগছে তার। বিড়বিড় করে বলল, এবার তা হলে বিদায় নেব এই নরক থেকে?

না, বলল ক্রিস্টিনা। শেষ হয়নি আমাদের কাজ।

.

১২.

 রানা এজেন্সি। লণ্ডন।

আজই সন্ধ্যায় অক্সফোর্ড শহর থেকে ফিরেছে রানা। একটু দূরের বাঙালি এক রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার সেরে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছে, এমনসময় বেজে উঠল মোবাইল ফোন। টেবিল থেকে ওটা নিয়ে স্ক্রিন দেখল রানা। ফোন ট্র্যা মউরোসের।

কল রিসিভ করল ও, হ্যাঁ, মউরোন্স।

এদিকে গণ্ডগোল বেধেছে, তোমার সাহায্য লাগবে, রানা, চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল ফ্রেঞ্চ মার্সেনারি।

তুমি এখন কোথায়? জানতে চাইল ক্লান্ত রানা।

এখনও কোর্ফিউতে, বলল মউরোস। যা বলেছিলে, তার চেয়ে এখানকার পরিস্থিতি অনেক জটিল।

কী ধরনের সমস্যা?

কী যেন বলল মউরোস, শুনতে পেল নারানা। একটু জোরে বলো, শুনতে পাচ্ছি না।

যত দ্রুত সম্ভব চলে এসো।

ফোনে বলা যাবে না? জানতে চাইল রানা।

 সামনাসামনি বলব। বাজে ধরনের ঝামেলা।

কাজটা তো সহজ হওয়ার কথা ছিল, মউরোস।

তাই বলেছিলে। কিন্তু ঘাপলা আছে বড় ধরনের।

রানা চুপ করে আছে।

রানা, আমি সিরিয়াস, বলল মউরোস। আসতে দেরি কোরো না।

কতটা সিরিয়াস?

ভয়ঙ্কর সিরিয়াস।

তুমি ভাবছ সামলাতে পারবে না? ব্যা

কআপ চাই, নইলে যখন তখন বিপদে পড়ব।

চট করে হাতঘড়ি দেখল রানা।

হিথ্রো এয়ারপোর্টে গিয়ে উঠতে হবে এথেন্সের বিমানে। তারপর ওখান থেকে পৌঁছাতে হবে কোর্ফিউ দ্বীপে।

ঠিক আছে, আগামীকাল দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব। …কোথায় দেখা হবে?

.

পরদিন সকাল।

সারি সারি টিলা, সবুজ অরণ্য, উপত্যকার হাজারো বুনো ফুল, দূরে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, পাইনে ঘেরা প্রায় ঘুমন্ত গ্রাম ও বিশাল নীল সাগর- স্বর্গ বললেও ভুল হবে না কোর্ফিউ দ্বীপকে। কাকাইরা এয়ারপোর্টের চারপাশ ঘুরে নামল বিমান।

আগেও এ দ্বীপে এসেছে রানা। ছোট্ট এয়ারপোের্ট ত্যাগের আগে লকার ভাড়া করে ওখানে রাখল পাসপোর্ট ও রিটার্ন টিকেট। লকারের চাবি গেল জিন্সের প্যান্টের পকেটে। ওর সঙ্গে থাকল শুধু মোবাইল ফোন, ওয়ালেট ও কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়ার মত হালকা একটা ক্যানভাস ট্র্যাভেল ব্যাগ। 

বেরিয়ে এল এয়ারপোর্ট ছেড়ে। অসুবিধা হলো না ট্যাক্সি পেতে। বকবক করছে গ্রিক ড্রাইভার। তাকে পাত্তা দিল না রানা। ম্যাপ খুলে দেখে নিল কোথায় যেতে হবে।

মাত্র দুমাইল দূরে শহর।

সরু সব পথ পেরিয়ে কিছুক্ষণ পর নির্দিষ্ট রাস্তায় পৌঁছুল রানা। রাস্তার দুপাশে সারি সারি বাড়ি। রাস্তায় শুরু হয়েছে সকালের ভিড়। খুলেছে শপিং আর্কেড, ট্যাভাস, হট ফুড বার ও ক্যাফে।

নানা জাতের মানুষে গিজগিজ করছে বাজার, তাদের মাঝ দিয়ে পথ করে এগোল ট্যাক্সি। নাকে এল লবণ মাখা চিংড়ি ও স্কুইডের আঁশটে গন্ধ। সূর্যের আলোয় চকচক করছে দোকানে সাজানো তাজা জলপাই।

খুব ব্যস্ত স্যান রোক্কো স্কয়্যার। ক্যাফেগুলোর বাইরে টেবিলে খদ্দেরদের জন্যে দেয়া হচ্ছে নাস্তা ও কফি। প্রাচীন সরু, আঁকাবাঁকা পথে গর্জন ছেড়ে অতিরিক্ত জোরে ছুটছে। গাড়িঘোড়া।

কাছাকাছি পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল রানা গাড়ি থেকে। কঠোর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, করিকর্মা মউরোসের কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছে রানা। ওর বন্ধু পরিস্থিতি সামলাতে পারবে না, এটা সত্যি ওর জন্যে বিস্ময়কর। প্রেম ও বিয়ে ধার কমিয়ে দিল মউরোসের? আগেও কারও কারও জীবনে এমন দেখেছে রানা।

সকাল নয়টার আগেই মউরোসের গেস্টহাউসের সামনে পৌঁছুল ও। পুরনো শহরের ব্যস্ত রাস্তার একপাশে ফ্যাকাসে পাথরের বাড়ি। সামনে ক্যাফে টেরেস। ফুটপাথের ধারে টেবিলের ওপরে ছায়া দিচ্ছে মস্তবড় সব রঙিন ছাতা। এখানে ওখানে পাথরের বড় টবে ডযনখানেক সবুজ গাছ।

একটু দূরের এক টেবিলে বসে আছে মউরোস। একহাতে নিউয পেপার। পাশে কফির পট ও মগ রানাকে রাস্তা পেরোতে দেখে চেহারায় ফুটল স্বস্তি। কিন্তু হাসি নেই মুখে।

ভিড় ঠেলে বন্ধুর টেবিলের সামনে পৌঁছে গেল রানা। নাস্তা নিয়ে ব্যস্ত একদল টুরিস্ট। তাদের মাঝে যেমন আছে হানিমুনে আসা দম্পতি, তেমনি আছে বয়স্ক দম্পতিরা। প্রায় সবার সঙ্গে ক্যামেরা ও গাইডবুক। কর্মস্থলে যাওয়ার পথে মুখে কিছু দিয়ে নিচ্ছে অনেকে। টেরেসের প্রান্তে বসে আছে সুতি জ্যাকেট পরা ছোটখাটো এক লোক, নাক খুঁজে রেখেছে। ল্যাপটপ কমপিউটারে।

মউরোসের টেবিলে উইকার চেয়ারে জ্যাকেট ঝুলিয়ে দিল রানা। মেঝেতে নামিয়ে রাখল ক্যানভাস ব্যাগ। বসে পড়ল পাশের চেয়ারে।

কফি দেব? জানতে চাইল মউরোস।

দাও।

রানার জন্যে পট থেকে কফি ঢালল মউরোস। চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। কফি মগ সামনে ঠেলে দেখাল পাশের খবরের কাগজ। তুমি না এলে বিপদে পড়তাম। আমার ধারণা, খুব খারাপ কিছু হয়েছে ক্যাথি হার্বার্টের।

প্রথম থেকে বলো, কফির মগে চুমুক দিল রানা।

পাঠালে বার্তাবাহক হিসেবে, কিন্তু কাজটা হয়ে উঠল গোয়েন্দাগিরির, বলল মউরোস। বলেছিলে সেই ভিলাতে থাকবে না ওই মেয়ে। তবুও সার্চ করেছি। ওর বিষয়ে কোনও ক্লু ছিল না। ভিলার মালিক জানে না কোথায় গেছে। বিমানে ওঠেনি। হার্বার্ট পরিবারের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত। বুঝে গেলাম, কেন ওই পরিবারের সঙ্গে মিশ খায়নি মেয়েটা। ওর বাবা যা বলেছেন, ওই একই কথা বললেন ভদ্রলোক। ঝগড়া করে চলে গেছে ক্যাথি। উঠেছিল হোটেলে। ওখান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ওকে। তখন ভাড়া করল ভিলা। নতুন কোনও তথ্য নেই। বাধ্য হয়ে খোঁজখবর শুরু করলাম দ্বীপ জুড়ে। বাদ পড়ল না কোনও বার বা ক্যাফে। প্রতিটি জায়গায় দেখালাম ওর ছবি। জানালাম, আমি তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওকে খুঁজছি, কারণ আইনী কিছু জটিলতার কারণে ওকে লাগবে।পুলিশ, ফেরির লোকজন, এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ, ট্যাক্সি ড্রাইভার, হোটেল, হাসপাতাল… বাদ দিলাম না কিছু। নিজের ভিজিটিং কার্ড দিলাম সবার হাতে। কোনও তথ্য পেলে যেন আমাকে জানানো হয়। খরচ করেছি অন্তত ষাট বা সত্তরটা কার্ড। এখন পর্যন্ত নেই কোনও খবর। দ্বীপে নেই ওই মেয়ে।

তোমার ধারণা, খারাপ কিছু হয়েছে ওর? বলল রানা। কাগজের জটিলতা এড়িয়েও দ্বীপ ছাড়তে পারে। হয়তো চলে গেছে কারও ইয়টে করে। আমরা আলাপ করছি, অথচ হয়তো মাত্র একমাইল দূরের সাগরে ইয়টের আমচেয়ারে বসে শ্যাম্পেনে চুমুক দিচ্ছে।

চুপ করে শুনছিল মউরোস, রানা থেমে যেতেই মাথা নাড়ল। মনে হয় না। ঘটনা আরও জটিল।

এই বিষয়ে নতুন কোনও তথ্য পেয়েছ?

হুঁ। ফোন এল এক লোকের কাছ থেকে। জানাল, নাম অ্যাবেলিনো থ্যানাটস। পরিচিত এক লোকের কাছ থেকে শুনেছে, খুঁজছি ক্যাথি হার্বার্টকে। মেয়েটার জন্যে চিন্তিত মনে হলো তাকে। বলল, ভাল করেই চিনত। ওর সম্পর্কে জরুরি কিছু তথ্যও জানে। কিন্তু ফোনে বলবে না, ভাল হয় গোপনে কোথাও দেখা করলে।

অর্থাৎ, বিবাহিত লোক, বলল রানা। স্থানীয় সম্মানিত কেউ। স্ত্রী যখন বাইরে কোথাও, সেই সুযোগে মেলামেশা করেছে ক্যাথির সঙ্গে।

আমারও তা-ই ধারণা। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। ব্যবসায়ী। স্থানীয় গলফ ক্লাবের বড়সড় কর্মকর্তা। সমাজের মাথা। কোর্ফিউ টাউনে চমৎকার বিলাসবহুল বাড়ি। দূরে পাহাড়ের ওপরে জঙ্গলের মাঝে দারুণ সুন্দর বাংলো। সুযোগ সুবিধা সবই আছে। সঙ্গে সুন্দরী মেয়ে থাকলে আর কী চাই! গত কয়েক দিন ছুটি কাটিয়ে টাউনের বাড়িতে ফিরেছে তার ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী। তাই ওখানে দেখা করতে রাজি হয়নি সে। দেখা করতে বলেছিল পাহাড়ি বাংলোয়। গেলাম। খুব নার্ভাস মনে হলো তাকে। বলল এমন সব কথা, যেগুলো শুনব ভাবতেও পারিনি।

থেমে গিয়ে টেরেস দেখল মউরোস। ছোট্ট এক গ্রিক ছেলে। সাত বছর হবে বয়স। কালো চুল, কালো চোখ, রোদে পোড়া চামড়া। পরনে ডোরাকাটা টি-শার্ট ও লাল হাফ প্যান্ট। টেরেসের টেবিলের মাঝ দিয়ে দক্ষ খেলোয়াড়দের মত দাপাচ্ছে বাস্কেট বল। এদিক-ওদিক বাউলি কাটার ভঙ্গি করছে। সিমেন্টে পড়ে ধ্যাপ-ধ্যাপ আওয়াজ তুলছে বল। টেবিলের কোনা ঘুরে চলে গেছে রাস্তার কাছে। একটু দূরের টেবিল থেকে ছেলেটাকে উৎসাহ দেয়ার জন্যে হাসছেন কয়েকজন মহিলা।

নতুন করে কফি নেবে বলে চুপ হয়ে গেছে মউরোস। এই সুযোগে চেয়ারে ঘুরে ছেলেটাকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখল রানা। বারবার ড্রপ দিয়ে বলটা নিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে পিচ্চি। কিন্তু কেউ চেয়ে আছে দেখে মনোযোগ সরে যেতেই ওর হাত থেকে ফস্কে গেল বল। কমপিউটার নিয়ে ছোটখাটো লোকটা যেখানে বসেছে, সেই টেবিলের পায়ায় লেগে গিয়ে পড়ল রাস্তায়। নিচু গলায় গালি দিল লোকটা। গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজে ভাষাটা চিনল না রানা। বাঁদরের মত দেখতে লোকটা, ত্রিকোণ চেহারা। চোখে আগুন নিয়ে চেয়ে আছে ছোট্ট ছেলেটার দিকে। রাস্তা থেকে বল কুড়িয়ে নিয়ে সরে গেল পিচ্চি।

দুর্ঘটনা এড়াতে হলে উচিত মাঠে গিয়ে খেলা, মন্তব্য করল মউরাস। 

বন্ধুর দিকে ফিরল রানা। কী বলেছে থ্যানাটস।

বেশ কিছু দিন ধরেই গোপনে প্রেম করছিল ওরা, বলল মউরোস। একরাতে মিলিত হলো ওরা। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই একসাথে রাত কাটাত দুজন। এমন নাগর আরও কজন ছিল ক্যাথির। কিন্তু থ্যানাটসকে বিছানাসঙ্গী হিসেবে বেশি পছন্দ করত মেয়েটা। কিছু গোপন না করেই সব খুলে বলেছে লোকটা। আগেও অনেক মেয়ের সঙ্গে বিছানায় গেছে। তারও মনে হয়েছিল বিছানায় ক্যাথির তুলনা নেই। ওকে কাছে পাওয়ার জন্যে নানান দামি জিনিস দিচ্ছিল। তারপর হঠাৎ করেই থ্যাটসের টাকা আর প্রয়োজন পড়ল না ক্যাথির। কোত্থেকে যেন পেল অঢেল টাকা।

জানতে পেরেছ, কোথা থেকে পেয়েছে?

মাথা দোলাল মউরোস। স্টেট থেকে। আন্তর্জাতিক মানি অর্ডারের মাধ্যমে এসেছে বিশ হাজার ডলার। থ্যানাটসকে বলেনি কে পাঠিয়েছে। তবে এটা বলেছে, কিছু দিনের ভেতর আসবে আরও অনেক টাকা।

আরও?

হ্যাঁ। লাখ লাখ ডলার। বাকি জীবনে আর কোনও কাজ করতে হবে না। থ্যানাটসকে জানিয়েছিল, ও ভাবছে দ্বীপে বড় একটা বাড়ি কিনে এখানেই রয়ে যাবে। সামান্য বিরতি নিয়ে বলল মউরোস, তবে আরও বিস্ময়কর ঘটনা কী, জানো?

না জানালে জানব কী করে, হাই চাপল রানা।

কোথা থেকে এত টাকা এসেছে না বললেও, এটা বলেছে, ওই টাকা আসবে একটা ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে।

কী ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী?

আর কিছুই জানে না থ্যানাটস। ওই ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে টাকা। আর কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি। যে-কেউ বলবে, কপালের জোরে লটারি পেয়েছে ওই মেয়ে।

শেষ কবে ক্যাথির সঙ্গে দেখা হয় থ্যাটসের? জানতে চাইল রানা।

যে রাতে পার্টি দিল ক্যাথি, শেষবার দেখা হয়েছে। সেখানেই। পরদিন ভোরে এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা ছিল মেয়েটার। তবে যায়নি। থ্যানাটস চায়নি পার্টিতে কেউ চিনে ফেলুক তাকে। গিয়েছিল মনের টানে দেখা করতে। প্রায় লুকিয়ে ছিল পার্টিতে। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ওখানেই ছিল। ক্যাথির সঙ্গে কথা হয়েছিল, রাতে দুজন মিলে মৌজ করবে পাহাড়ি বাংলোয়। পার্টি শেষ করে স্কুটারে চেপে ওখানে যাবে মেয়েটা। আবারও কফি ঢেলে নিল মউরোস।

কিন্তু ক্যাথি ওই বাংলোয় যায়নি, বলল রানা।

মাথা দোলাল মউরোস। তারপর থেকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। পার্টি শেষ হওয়ার পর গভীর রাতে থ্যানাটসের বাংলোতে যাওয়ার পথে হারিয়ে গেছে।

স্কুটারে করে যাওয়ার কথা ছিল ক্যাথির?

হুঁ। ভাড়া নেয়া হয়েছিল রেন্ট-এ-কার এজেন্সি থেকে। দামি সুপার স্কুটার। ওটাও উধাও হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা? হয়তো পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছে মাতাল হয়ে। এখন পড়ে আছে কোনও খাদে।

অসম্ভব নয়, বলল মউবোস, কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। থ্যানাটস বলেছে, অদ্ভুত এক ঘটনা দেখেছিল পার্টিতে। ওখানে ছিল কমবয়সী অনেক যুবক। সবার চোখ ছিল ক্যাথির দিকে। সেজন্যে প্রেমিকার ওপরে চোখ রেখেছিল থ্যানাটস। খুব হিংসা লাগছিল। তখনই দেখল এক যুবককে। বয়স ত্রিশ মত। চমৎকার সোনালি চুল। সুদর্শন। সঙ্গে এক যুবতী। কিন্তু তাকে পাত্তা না দিয়ে ক্যাথির সঙ্গে ভিড়ে যায়। যুবক। নাম বলেছিল বাড। থ্যানাটসের ধারণা, সে আমেরিকান। 

আর তার সঙ্গের মেয়েটা?

থ্যানাটস বলেছে, মেয়েটা দেখতে ছিল অনেকটা গ্রিক দেবীর মতই রূপসী। গ্রিকও হতে পারে। একবারও কথা বলতে শোনেনি। সবার কাছ থেকে দূরে ছিল। বাডকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল থ্যানাটস। যুবককে বেশ পাত্তা দিচ্ছিল ক্যাথি। একটু পর থ্যানাটস দেখল, বারের পেছনে গেল যুবক। কী যেন মিশিয়ে দিল ড্রিঙ্কে। তারপর ওটা এনে দিল ক্যাথির হাতে। সত্যিই কিছু মিশিয়ে দিয়েছে কি না, তা পুরো নিশ্চিত নয় থ্যানাটস। যুবকের পিঠ ছিল তার দিকে।

ভাবছে রানা, ওটা হয়তো যৌন উত্তেজনা তৈরির কোনও ওষুধ। যাতে যুবকের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে ক্যাথি। আবার এ-ও হতে পারে, বেশ কয়েকজন মিলে চেয়েছিল ক্যাথিকে দল বেঁধে রেপ করতে। অবশ্য, এরচেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে। হয়তো কিডন্যাপ হয়েছে মেয়েটা। বন্ধুর দিকে তাকাল রানা। খারাপ কিছু হয়েছে, ধরে নেয়া যায়।

থ্যানাটস শিয়োর নয় গ্লাসে কিছু মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, বলল মউরোস, কিন্তু গ্লাসটা টেবিলে রেখেছিল ক্যাথি। সেই সুযোগে হাঁটু দিয়ে টেবিলের পায়ায় গুঁতো মেরে গ্লাসটা ফেলে দেয় থ্যানাটস। যে-কেউ নাকি ভাবত, বেসামাল মাতালের কাজ। এরপর ক্যাথিকে নিয়ে ব্যালকনিতে আসে থ্যানাটস। বাডের ব্যাপারে সতর্ক করে বলে, ওই যুবক থেকে সাবধান। যাতে পার্টি ভেঙে দিয়ে চলে যায় ওর বাংলোয়। তাতে তর্ক শুরু করল ক্যাথি। থ্যানাটস ভয় পেল, যে-কোনও সময়ে চেঁচামেচি করবে ও। তাতে সমস্যায় পড়বে সে। বাডের দেয়া কোনও ড্রিঙ্ক যেন ক্যাথি স্পর্শ না করে, সেটা জানিয়ে পার্টি ত্যাগ করে থ্যানাটস। সোজা ফেরে পাহাড়ি বাংলোয়।

পরে ওখানে যাবে ক্যাথি, তা না-ও হতে পারে, বলল রানা। হয়তো স্রেফ নাচিয়ে মজা পেয়েছে।

আমার তা মনে হয় না, বলল মউরোস। যাবে না মনে করলে, থ্যাটসের মাধ্যমে আগেই নিজের মালপত্র ওই বাংলোয় পাঠিয়ে দিত না। নিজের মার্সিডিয গাড়িতে করে সব নিয়ে গিয়েছিল ব্যানাটস। কাপড়চোপড় আর টুকটাক সব। এ ছাড়া, ছিল ছোট একটা ট্র্যাভেল পাউচ। ওটাতে ছিল পাসপোর্ট, বিমানের টিকেট আর টাকা। থ্যানাটসকে ফাঁকি দেয়ার ইচ্ছে ক্যাথি হার্বার্টের ছিল না।

হয়তো হাল ছাড়েনি বাড নামের ওই যুবক, বলল গম্ভীর রানা। তারপর কী হয়েছে?

সেরাতে যখন ক্যাথি বাংলোয় গেল না, ল্যাণ্ড ফোনে ভিলায় কল দিল থ্যানাটস। ওদিকে থেকে ফোন ধরল না কেউ। বাধ্য হয়ে ভিলায় গেল সে। সব দরজা-জানালা বন্ধ। করে গিয়েছিল ক্যাথি। কোথাও ছিল না স্কুটার। মেয়েটা উধাও হয়েছে ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ল থ্যানাটস।

পুলিশকে জানাতে পারল না যে হারিয়ে গেছে মেয়েটা, বলল রানা। নইলে প্রকাশ পেত দুজনের সম্পর্ক। তা ছাড়া, থ্যানাটস ভেবেছে, কে জানে, হয়তো দুচার দিন পর আপনিই ফিরবে ক্যাথি।

মাথা দোলাল মউরোস। ফাঁদে পড়েছিল ব্যানাটস। কিন্তু যখন শুনল ক্যাথির অভিভাবকরা খুঁজতে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তখন খুশি মনেই মেয়েটার সব জিনিসপত্র আমাকে দিয়ে দিয়েছে।

ওগুলো এখন কোথায়?

পেছনের দোতলার একটা জানালা দেখাল মউরোস। আমার ঘরে। তবে ওর পাউচ আমার কাছে। পাশের মেঝে থেকে প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ তুলে টেবিলে রাখল ও।

ওটা থেকে ট্র্যাভেল পাউচ নিয়ে হাতড়ে দেখল রানা। ভেতরে তেমন কিছুই নেই। শুধু পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন আর একটা কাপড়ের পার্স। ওটার ভেতরে একগাদা ইউরো। সব মিলে ছয় হাজারেরও বেশি।

রাকস্যাকে কাপড়ের নিচে আরও আছে, বলল মউরোস, বিশ হাজার ডলারের বড় এক অংশ খরচ করেছে।

তোমার কথাই ঠিক, রাত কাটাতে চেয়েছিল থ্যাটসের সঙ্গে, বলল রানা, এত টাকা কেউ ফেলে যাবে না। ব্যাগ থেকে বের করল ট্র্যাভেল এজেন্টের চকচকে এক পেপার ওয়ালেট। ওটা থেকে নিল এথেন্স থেকে হিথ্রো বিমানবন্দরে যাওয়ার বিমান টিকেট। যেদিন হারিয়ে গেল ক্যাথি, সেদিনের তারিখ। ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা বই নিল রানা। ওটা চামড়া দিয়ে মোড়া। অ্যাড্রেস বুক। পাতার কিনারা ঝকঝকে। নতুন কেনা হয়েছিল। বাড নামের কাউকে পাওয়া যায় কি না ভেবে অ্যাড্রেস বুকে চোখ বোলাতে লাগল রানা।

যা ভেবেছে, তেমন কিছুই পেল না। বাড নামের কেউ নেই অ্যাড্রেস বুকে। লেখাগুলোর ওপর আবারও চোখ বোলাল রানা। মাত্র কয়েকটা এন্ট্রি। প্রায় সবই ০১৮৬৫ সংখ্যার। অক্সফোর্ডের কোড। এসব সংখ্যার একটা ক্যাথির বাবা-মার। অবশ্য, এ ছাড়াও আছে বিদেশের কয়েকটা নম্বর। তাদের একজন মেরিয়ান ট্রুলি। আরেকজনের নাম বার্কলে। কোনও কোম্পানির নামও হতে পারে। কোনও ঠিকানা নেই, শুধু ফোন নম্বর। মেরিয়ান ট্রুলি আর বার্কলের ফোন নম্বর থেকে রানা বুঝল, এরা দুজন বাস করে মার্কিন মুলুকে।

বার্কলে কে? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল মউরোস। জানি না।

অ্যাড্রেস বুকের আরও কয়েকটা পাতা উল্টে দেখল রানা। টুপ করে ওটা থেকে পড়ল একটা ব্যবসায়িক কার্ড। তুলে নিল রানা। কার্ডে লেখা: হার্ভে সিম্পসন, অ্যাটর্নি। ঠিকানা বলছে, সে বাস করে আমেরিকার জর্জিয়া রাজ্যের স্যাভানা শহরে। কার্ডটা প্যান্টের পকেটে রাখল রানা। টাকা আর পোশাক ছাড়া আর কিছু পেয়েছ রাকস্যাকে?

না, আর কিছু না, বলল মউরোস।

তা হলে সূত্র বলতে এ-ই। টাকা পাঠানো হয়েছে আমেরিকা থেকে, ভাবছে রানা। গ্রিসের ওই পার্টিতে ছিল আমেরিকান ওই নোক বাড। ইউএস-এর বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ক্যাথির। এ বিষয়ে কিছু বলেছে থ্যানাটস?

টাকা ওখান থেকে এসেছে, এ ছাড়া আর কিছুই বলেনি, বলল মউরোস।

সেক্ষেত্রে থ্যানাটসের সঙ্গে কথা বলতে হবে আমাকে, বলল রানা। সময় দিতে পারবে সে?

না, পারবে না, রানা।

বুঝতে পারছি, সামাজিক জটিলতার কথা ভেবে আড়ালে থাকতে চাইছে। তবে মাত্র দুচারটা প্রশ্ন করব তাকে।

কথা বলতে পারবে না বলেছি অন্য কারণে, বলল মউরোস।

কী সমস্যা তার?

 ভেবেছ এমনি এমনি ডেকেছি? ভাঁজ করা খবরের কাগজ খুলে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল মউরোস। প্রথম পাতায় চোখ বোলাও। গতকালকের পেপার। গ্রিক ভাষা না জানলেও সবই বুঝবে!

দৈনিক পত্রিকায় ছেপেছে সাদা-কালো ছবি। পুলিশের কয়েকটা গাড়ি রাখা। কয়েকজন অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। জঙ্গল দিয়ে ঘেরা ছোট এক ভিলার বাইরে। পাশের ছবিতে এক লোকের মুখ। বয়স পঁয়তাল্লিশ মত। পৌরুষদীপ্ত। গোঁফ আছে। জুলফির চুল ধূসর। নিচে লেখা: খুন হয়েছেন শিল্পপতি ও সমাজসেবী অ্যাবেলিনো থ্যানাটস।

আগেই বলেছি, ব্যাপারটা সিরিয়াস, বলল মউরোস। ওই লোক খুন হয়েছে জেনেই ফোন করি। ছবি দিয়েছে ওই ভিলারই। ওখানে পাওয়া গেছে লোকটাকে। দ্বীপে ছড়িয়ে গেছে খবরটা।

কে পেয়েছে ব্যানাটসকে?

পুলিশে খবর দিয়েছে কেউ। লাশ পড়ে ছিল দুদিন ধরেই। অতিরিক্ত পরিমাণের হেরোইন ছিল মৃতদেহে। বাড়িতে কয়েক জায়গায় ছিল কয়েক প্যাকেট হেরোইন। যে কেউ ভাববে, বেশি হেরোইন সেবন করে মরেছে সে, অথবা আত্মহত্যা। কারও কারও ধারণা, খুন হয়েছে সে। আসলে কী ঘটেছে, বলতে পারছে না কেউ। গত কয়েক বছরের ভেতর দ্বীপের সবচেয়ে বড় স্ক্যাণ্ডাল হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা। আগে কখনও এমন কিছু হয়নি এখানে।

চুপ করে আছে রানা। কী ভাববে, জানে না। সবসময় হাতে হাত রেখে চলে ড্রাগস, নগদ টাকা ও মৃত্যু। কিন্তু ক্যাথি আর থ্যানাটস ড্রাগসের ব্যবসার সঙ্গে জড়ালে, মউরোসকে কেন ওসব জানাল লোকটা? সেক্ষেত্রে মুখ বুজে থাকার কথা। কেন নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে?

উঁহু, এসবের ভেতর আছে অন্য কোনও জটিল ব্যাপার।

টাকার সঙ্গে কীসের সম্পর্ক ওই ভবিষ্যদ্বাণীর?

জানা যায়নি ওটা কী বিষয়ে। আরও আছে, বলল মউরোস, কারা যেন ফলো করছে আমাকে।

কখন থেকে?

দ্বীপে এসে ক্যাথি হার্বার্টকে খুঁজতে শুরু করার পর থেকেই।

কোনও ভুল হচ্ছে না তো তোমার?

মাথা নাড়ল মউরোস। না। ওরা কাজে ভাল। তবে এত ভাল নয় যে চোখ এড়িয়ে যাবে। দলে একাধিক লোক।

কজন?

তিন কি চারজন। তাদের একজন মহিলা।

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। আপাতত আশপাশে আছে কেউ?

না। হয়তো–এসেছে নতুন কেউ, যাকে চিনি না। …এবার কী করতে চাও, রানা? আমরা কি পুলিশের হাতে ব্যাপারটা তুলে দেব? তারা চেষ্টা করে দেখুক কী করা যায়।

বাধ্য না হলে পুলিশের কাছে যাব না, বলল রানা।

কিন্তু এগোবার কোনও পথ নেই, বলল মউরোস, বার্তাবাহক হিসেবে এসেছি, ওই কথাই বলেছি জোয়িকে। …আমার কাজ শেষ, তা হলে কি বাড়ি ফিরব?

আবারও টেবিলগুলোর মাঝে বাস্কেট বল হাতে এসে খেলছে পিচ্চি ছেলেটা। একটু আগে কমপিউটার নিয়ে ছোটখাটো লোকটা বসেছিল যে টেবিলে, সেটা এখন খালি। দক্ষতার সঙ্গে ডজ দিয়ে ওই টেবিল পাশ কাটিয়ে গেল পিচ্চি। কিন্তু হঠাৎ করে হোঁচট খেতেই হাত থেকে ছুটে গেল বল। ওটার পেছনে দৌড় দিল পিচ্চি। নেমে পড়েছে। পেভমেন্ট ছেড়ে। রাস্তায় গিয়ে পড়েছে বল।

চোখের কোণে রানা দেখল, একটা ভ্যান। সবুজ। তোবড়ানো। কোনও ডেলিভারি ভেহিকেল। দ্রুতগতি। বলের পেছনে ছুটছে ছেলেটা। সোজা পড়বে গিয়ে ভ্যানের নিচে!

কী যেন বলল মউরোস, ওদিকে খেয়াল নেই রানার। ঘুরে দেখল, তীর বেগে আসছে ভ্যান। পাশের প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলছে ড্রাইভার। রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়েছে চোখ। জানে না, সামনেই বাচ্চা এক ছেলে।

গড়াতে গড়াতে থেমেছে বল। তুলতে ঝুঁকল ছেলেটা। তখনই দেখল ভ্যান। বিস্ফারিত হলো ওর চোখ। পাথরের মূর্তি হলো ভয়ে। ধেয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু!

কমছে না ভ্যানের গতি।

ব্রেক করেও এখন আর থামাতে পারবে না ড্রাইভার।

মগজ অত্যন্ত দ্রুত চললে, সবসময় মনে হয় সব ঘটছে স্লো মোশনে রানার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল, দুলাফে নামল রাস্তায়। ছেলেটা আছে আঠারো ফুট দূরে। ক্ষিপ্র চিতার বেগে ছুটল রানা। কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছুল বাচ্চাটার পাশে। কোমর জড়িয়ে ধরে তুলেই টের পেল, চাপ লাগতেই বেরিয়ে গেছে বেচারার ফুসফুস থেকে সব বাতাস।

ভ্যান পৌঁছে গেছে নাকের ডগায়। ডাইভ দিয়ে গাড়িটার ওপাশে পড়ল রানা। রাস্তায় গড়াচ্ছে, বুকের ভেতর আড়াল করেছে ছেলেটাকে।

ভীষণ ভয়ে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।

ভ্যানের ড্রাইভার কড়া ব্রেক করতেই চারপাশে ছড়িয়ে গেল তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ। আটকে গেছে চার চাকা। পোড়া রাবার রাস্তায় তৈরি করল কালো সাপের মত আঁকাবাঁকা দাগ। বাঁক নিয়ে বেকায়দাভাবে থামল ভ্যান। ক্যাফের টেরেস আর রানা ও ছেলেটার মাঝে সাসপেনশনের ওপর ভর করে এদিক-ওদিক দুলছে ওটা।

রানার মনে হলো, নতুন করে চালু হলো সময় ও জীবন। চিৎকার করছে ক্যাফের খদ্দেররা। চোখ এদিকে। বুঝে গেছে, বেপরোয়া ওই বাদামি চামড়ার যুবক প্রাণের ঝুঁকি নিল বলেই বেঁচে গেছে ছোট ছেলেটা।

বাজে ভাবে কাঁধ ছিলে গেছে, ভীষণ জ্বলছে রানার। উঠে বসে ভ্যানের নাকের ওপর দিয়ে দেখল, ক্যাফে টেরেসে দাঁড়িয়ে আছে মউরোস। বিস্মিত চোখে দেখছে ওকে। এক হাতে শক্ত করে ধরেছে চেয়ারের পিঠ।

তখনই রানার চোখের সামনে বিস্ফোরিত হলো গোটা পৃথিবী!

.

১৩.

 একমুহূর্ত আগে  জমজমাট ছিল ক্যাফে টেরেস। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবীসহ নাস্তা সারছিল অনেকে। পরমুহূর্তে বিস্ফোরণের কমলা আগুন গপ করে গিলে ফেলল সব। পেভমেন্ট পেরিয়ে শকওয়েভ পৌঁছুল রাস্তায়। ভেঙেচুরে আকাশে উঠল জ্বলন্ত টেবিল-চেয়ার ও ঘেঁড়া মস্ত ছাতা। বৃষ্টির মত ওপর থেকে নামল আগুনধরা জঞ্জাল। চুরমার হয়েছে আশপাশের বাড়িগুলোর কাঁচের জানালা। শকওয়েভ কষে চড় লাগাল ভারী ভ্যানটাকে। আকাশে উঠে কাত হয়ে ধুম্ করে পড়ল ওটা, বাইরের দিকে বিস্ফোরিত হয়েছে জানালা।

বেকায়দাভাবে উঠে দাঁড়াচ্ছিল রানা, বুকে চেপে রেখেছে বাচ্চাটাকে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড এক ধাক্কা লাগতেই ছিটকে গেল পেছনে। রাস্তায় পড়েই গড়ান দিয়ে বুকে লুকিয়ে ফেলল ছেলেটাকে। আকাশ থেকে ঝরঝর ঝরছে ভাঙা আবর্জনার টুকরো।

হঠাৎ নামল ভুতুড়ে থমথমে নীরবতা। তারপর শুরু হলো হৈ-চৈ ও আর্তচিৎকার।

কানের পাশে প্রকাণ্ড ঘণ্টি বাজিয়ে দিলে যেমন লাগে, তেমনই ঝনঝন করছে রানার দুকান। বনবন করে ঘুরছে মাথা। সচেতন প্রথম চিন্তা এল: নিরাপদ কোথাও সরাতে হবে বাচ্চাটাকে। ভাঙা কাঁচের মধ্যে ধীরে ধীরে হাঁটুর ওপর ভর করে উঠে বসল রানা। ছেলেটার বিস্ফারিত চোখে চোখ পড়ল ওর। ভীষণ ভয় পেয়েছে বেচারা। আহত কি না পরখ করে দেখল রানা। কপালের জোরে কিছুই হয়নি পিচ্চির। অবশ্য, এমনই শক পেয়েছে, বন্ধ হয়েছে জবান।

এবার মউরোসের কথা মনে পড়ল রানার। টলমল করে উঠে দাঁড়াল। ঘাড়ে ও কাঁধে ভীষণ ব্যথা। রক্তে ভিজে গেছে ছেঁড়া শার্ট। ঘাড়ে বুলিয়ে চোখের সামনে হাত আনল রানা। চটচট করছে লাল আঙুল। জ্বলন্ত ভ্যানটাকে ঘুরে টেরেসের ধ্বংসাবশেষ দেখল।

নৃশংসভাবে খুন হয়েছে অনেকে। রক্তে ভেজা ক্ষত বিক্ষত লাশ। এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অনেকে চিৎকার করছে আতঙ্কে। গুঙিয়ে সাহায্য চাইছে আহতরা। মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ছে বাকিরা। উঠে দাঁড়াল, মারাত্মকভাবে আহত নয় এমন কজন। ঘঘারের ভেতর টলতে টলতে সরে যাচ্ছে হত্যাযজ্ঞের এলাকা থেকে। বাতাসে কালো ধোঁয়া ও কটু গন্ধ। ছোট সব আগুন জ্বলছে রাস্তায়।

মউরোস! গলা ফাটিয়ে ডাকল রানা। দুই সেকেণ্ড পর পেল বন্ধুকে।

এখনও সেই চেয়ারের পিঠে রয়ে গেছে মউরোসের হাত। শুধু কবজি পর্যন্ত। পেভমেন্টে পড়ে আছে ওর ছিন্নভিন্ন লাশ। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চোখ বুজল রানা।

আহতদের আর্তচিৎকার, করুণ গোঙানি ও দৌড়ে আসা সাহায্যকারীদের হৈ-চৈ ছাপিয়ে কসেকেণ্ড পর এল অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ির সাইরেনের তীক্ষ্ণ নিনাদ। একটু পর ব্যস্ত হয়ে আহতদের সেবা দিতে লাগল প্যারামেডিকরা। উপস্থিত হয়েছে যেন যুদ্ধক্ষেত্রে। রাস্তা ভরে গেল ইমার্জেন্সি ভেহিকেল ও ইকুইপমেন্টে। ক্যাফে এলাকা ঘিরে ফেলেছে পুলিশ অফিসাররা। চিৎকার করে কথা বলছে রেডিয়োতে। সরিয়ে দিচ্ছে আশপাশের রাস্তা থেকে আসা কৌতূহলী মানুষের ভিড়। প্রিয় কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কেউ। রাগ ও আতঙ্কের ছাপ সবার চোখে-মুখে, নিমর্ম হিংস্রতার মাত্রা বুঝে হতবাক।

চাদর দিয়ে লাশ ঢাকছে করোনারের দলের লোক। পরে ব্যাগ এলে ভরবে মৃতদেহ। যে-যার কাজ করছে মেডিকেল টিম। অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়ার আগে আহতদেরকে দেয়া হচ্ছে প্রাথমিক চিকিৎসা। চাকার কর্কশ আওয়াজ তুলে বিদায় নিচ্ছে ইমার্জেন্সি ভেহিকেল। সে-জায়গায় আসছে নতুন অ্যাম্বুলেন্স।

রাস্তার ওপার থেকে দেখছে রানা। পাশেই দুই হাঁটুর মধ্যে বাস্কেট বল রেখে ফুটপাথে চুপ করে বসে আছে ছেলেটা। অবাক চোখে দেখছে সব। জিজ্ঞাসার চোখে রানার দিকে তাকাল। কেটে গেছে ডান ভুরু। ওখানে সামান্য রক্ত। বাচ্চাটার কাধ আলতো করে চাপড়ে দিল রানা।

ভিড়ের ভেতর কী যেন দেখল ছেলেটা। রানা বাধা দেয়ার আগেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠে ছুটে চলে গেল।

একটু পর প্যারামেডিক দলের দুজন দেখল রানাকে। দৌড়ে এল তারা। রানার মনে পড়ল, রক্তে ভিজে গেছে ওর শার্টের একপাশ। তবে কোনও ব্যথা নেই। শুধু মনে হচ্ছে, অবশ হয়ে গেছে দেহের ওদিকটা। ঠিকভাবে শুনছে না কানে। রানা আপত্তি তুলতে চাইলেও ওর কাঁধে ভারী ব্ল্যাঙ্কেট চাপিয়ে দিল দুই প্যারামেডিক। শুরু হলো আহত জায়গার চিকিৎসা। লোকদুজনের কথা থেকে রানা বুঝল, ওর ঘাড়ের ক্ষতটা বেশ, গুরুতর। এবার আপত্তি তুলল না, ধরে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে ওকে নিয়ে চলল প্যারামেডিকরা।

শেষবারের মত টেরেসের দিকে তাকাল রানা। রক্তাক্ত চাদরে রেখেছে মউরোসের অবশিষ্টাংশ। এখন আর চেয়ারের পিঠে নেই ছেঁড়া কবজি। রানাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিল প্যারামেডিকরা। শুইয়ে দেয়া হলো সরু এক বাঙ্কে। ধুপ করে  বন্ধ হলো দরজা। গর্জন ছাড়ল গাড়ির ইঞ্জিন। বাজতে শুরু করেছে সাইরেন।

রানা বুঝল, রওনা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স। চারপাশে তাকাল। চলন্ত গাড়ির ভেতর দুলছে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট আর টিউব। ওর ওপরে একটা স্ট্যাণ্ডে নড়ছে ড্রিপ।

গাড়িতে একা নয় রানা। ওর শরীর হাতড়ে দেখছে কারা যেন। নাকের কাছে এসেও সরে গেল দুটো মুখ। ঝনঝন করছে কান। শুনছে নানান কণ্ঠ। বহু দূরে আবছা একটা মুখ। কোথায় যেন ভেসে চলেছে ও। কোনও ওজন নেই। গিয়ে পড়ছে কালো এক গহ্বরে। গভীর কোনও কূপে তলিয়ে যেতে যেতে আগুন ও বিস্ফোরণের দুঃস্বপ্ন দেখছে রানা। ওর দিকে চেয়ে হাসছে জ্যা মউরোস। তারপর ওই জায়গা দখল করল ছোট্ট ছেলেটা। একবার ওকে দেখে নিয়ে দৌড়ে হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। তখনই ঝুপ করে নামল রানার চোখের সামনে কালো একটা ভারী পর্দা।

.

১৪.

 হঠাৎ ঘুম ভাঙল রানার। কিছুক্ষণ লাগল নিজেকে ফিরে পেতে। চোখদুটো সামান্য একটু মেলে দেখল, ও ঘরে একা। আসবাবপত্র সব সাদা। এটা বোধহয় কোনও ক্লিনিক হবে। নাকে চাপড় দিল ডিসইনফেক্ট্যান্ট ও হাসপাতালের খাবারের কুবাস। খোলা দরজার ওদিকে করিডোর ধরে ট্রলি ঠেলে নিয়ে গেল নীল ওভারঅল পরা এক আর্দালি।

শক্ত বিছানায় কাত হলো রানা। ঘাড় ও কাঁধের তীব্র ব্যথায় কুঁচকে ফেলল ভুরু। হাত তুলে দেংলি ঘাড়ে বড় একটা সাদা ড্রেসিং। এবার সবই মনে পড়ল ওর। বিস্ফোরণ হয়েছিল ক্যাফে টেরেসে। কাঁচের টুকরো গেঁথেছিল ঘাড়ে। ওকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল প্যারামেডিকরা।

চট করে মনে পড়ল, খুন হয়ে গেছে মউরোস।

একটু দূরের বেডসাইড টেবিলে রানার হাতঘড়ি। ওটা তুলে নিতে গিয়ে টান পড়ল ঘাড়ের সেলাইয়ে। ঘড়ির তারিখ আর সময়টা দেখল। বিস্ফোরণের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় বাইশ ঘণ্টা। অজ্ঞান হয়ে পার করেছে একদিন একরাত।

ধীরে ধীরে বেড থেকে নামল রানা। পরে নিল হাতঘড়ি। এই ঘরের একপাশে অ্যাটাচড় বাথরুম। টলমল পায়ে ওখানে। গিয়ে ঢুকল ও। আয়নায় দেখল ঘাড় ও কাঁধের ড্রেসিং। গজ কাপড়ের প্রান্ত তুলে পরখ করল ক্ষত।

এর চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর জখম আগেও হয়েছে ওর। সামান্য কটা কাঁচের টুকরো আটকে রাখতে পারবে না ওকে। মাথা গলিয়ে খুলে ফেলল হাসপাতালের গাউন। দেরি না করে ধুয়ে নিল হাত-মুখ। ঘরে ফিরল নিজের পোশাক পরতে। বেডের পাশের চেয়ারে ভাজ করে রাখা আছে ওর প্যান্ট। ঘেঁড়া, রক্তাক্ত শার্ট উধাও। মেঝেতে ওর জুতো।

রানা প্যান্ট পরে নিয়েছে, এমনসময় ঘরে ঢুকল এক নার্স। ঝড়ের বেগে গ্রিক ভাষায় প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে। রানাকে হাঁটাচলা করতে দেখে।

ওই ভাষা ভালই বোঝে রানা, কিন্তু আস্তে করে মাথা নেড়ে ইংরেজিতে বলল, সরি, ঠিক বুঝতে পারছি না।

বেড দেখাল সুন্দরী নার্স। হাতের ইশারা করছে ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়তে।

এবার আগের চেয়ে জোরে মাথা নাড়ল রানা। জরুরি কাজ আছে। আমাকে একটা শার্ট দিতে পারেন?

হাসপাতাল ছাড়তে পারবেন না, রানার ঘাড়ের ড্রেসিং  দেখাল নার্স। আপনি আহত।

ঠিক আছি, বলল রানা। জরুরি কাজে যেতে হবে।

ডাক্তার ডাকছি, ঘুরেই ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নার্স। পেছনে দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা।

ডাক্তারের অপেক্ষা করতে হবে, বেডের কিনারায় বসল রানা। পেরিয়ে গেল কয়েক মিনিট, তারপর জোর নক হলো দরজায়। রানা ভেবেছিল ভুরু কুঁচকে ঘরে ঢুকবে ডাক্তার। শুরু হবে তর্ক। কিন্তু ডাক্তার নয়, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ভালুকের মত প্রকাণ্ড এক লোক। চৌকাঠে মাথা ঠুকে যাবে বলে ঘরে ঢুকতে নিচু হতে হয়েছে তাকে। চকচকে চোখে দেখল রানাকে। এসে থামল ওর সামনে। বিশাল চওড়া হাসি তার ঠোঁটে। খপ করে শক্ত হাতে ধরল রানার হাত। তার পিছু নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকেছে শীর্ণ এক মহিলা।

অপ্রতিরোধ্য উৎসাহ নিয়ে রানার হাত ঝাঁকাচ্ছে দৈত্য।

রানার মনে হলো, রক্ষা নেই এর খপ্পর থেকে। হাতটা হ্যাচকা টানে খুলে নেবে ব্যাটা!

আপনি একজন হিরো! গ্রিক সুরে ইংরেজি বলল দানব।

এই লোককে কী বলা যেতে পারে, ভাবছে বিস্মিত রানা, এমনসময় দেখল দরজায় সেই ছোট্ট ছেলেটা। ডান ভুরুর ওপর প্লাস্টার। গালে দুটো সেলাই। এবার রানা বুঝল, বাস্কেট বলের মালিক ওই ছেলেটারই বাবা-মা এরা।

আপনি সত্যিকারের হিরো, আবারও বলল দৈত্য। ছাড়ল না রানার হাত। আপনি রক্ষা করেছেন আমাদের ছেলেকে।

তেমন কিছুই করিনি, বলল রানা। ও-ও তো আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ও যদি রাস্তায় না নামত, বোমার আঘাতে খুন হতাম আমি।

কিন্তু আপনি ঠিক সময়ে হাজির না হলে ভ্যানের নিচে পড়ত সালোমাও। ছেলের করুণ পরিণতি ভেবে এক চোখ থেকে গালে নামল দানবের অশ্রু। নাক টেনে নিল সে। আমার নাম প্যাসিফিকো কোলিয়াস। ইনি আমার স্ত্রী অ্যাবে। বোমাটা যেখানে ফেটেছে, তার পেছনেই আমাদের গেস্টহাউস। রানার ঘাড় ও কাঁধের ওপর চোখ পড়ল তার। আপনি আহত হয়েছেন।

তেমন কিছু না, বলল রানা। কয়েক টুকরো কাঁচ। একটা শার্ট পেলেই একটু পর বিদায় নেব।

দৈত্যের হাসি দারুণ মিষ্টি। খুলতে শুরু করেছে শার্টের বোতাম। নিচে কোলিয়াস হোটেলের টি-শার্ট। আমার শার্টটা নিন। না-না, কোনও দ্বিধা করবেন না। খুব সম্মানিত বোধ করব ওটা আপনি নিলে।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে শার্ট নিল রানা। সুতির হালকা নীল শার্ট, চমৎকার করে ইস্ত্রি করা। ভাবছে, আরেকটু লম্বা হলে ওটা ওর পাঞ্জাবি হতে পারত। শার্ট পরতে গিয়ে সেলাইয়ে টান পড়তেই গাল কুঁচকে গেল ওর।

বকবক করছে দৈত্য। বোমা ফাটার সময়ে কিচেনে ছিল তার স্ত্রী এবং সে। ধরে নিয়েছিল চিরকালের জন্যে হারিয়ে ফেলেছে সালোমাওকে। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসে দেখে, টেরেসে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ ও আহতরা। ক্ষত-বিক্ষত বাড়ির সামনের দিক। ভেবেছে, তাদের প্রশান্তিময় দ্বীপে হানা দিয়েছে ড্রাগ লর্ডদের খুনেরা। তলানিতে ঠেকেছে নিরীহ মানুষের নিরাপত্তা। সর্বনাশ হবে ওদের ব্যবসার। কিন্তু এখন তারা জানে, সবই সামলে নিতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, ক্ষতি হয়নি সালোমাওর। আর সেজন্যে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে তারা রানার কাছে। যা আছে, সবই দিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না ওকে। কখনও ভুলবে না…

এই পর্যায়ে দানবকে বাধা দিল রানা, আমি যা করেছি, সেই একই কাজ করত অন্য যে-কেউ।

কই, অন্য আর কেউ তো করেনি? আপনি কোন্  হোটেলে উঠেছেন, স্যর? জানতে চাইল প্যাসিফিকো।

উঠতে পারিনি, বলল রানা। মাত্র পৌঁছেছিলাম। দ্বীপে থাকার ইচ্ছে ছিল না।

কিন্তু আহত হয়েছেন, এখন আপনার কিছু দিনের জন্যে থেকে যাওয়াই ভাল। আমরা খুব খুশি হব আপনি আমাদের ওখানে উঠলে।

কী করব এখনও ভেবে দেখিনি।

প্লিয, যদি দ্বীপে থাকেন, দয়া করে কোনও হোটেলে উঠবেন না, বলল প্যাসিফিকো। পকেট থেকে বের করল সুতলি বাঁধা চাবি। সৈকতে আমাদের ছোট একটা বাড়ি আছে। শহরের ঠিক বাইরে। খুব আরামদায়ক নয়, তবে কোর্ফিউ ত্যাগের আগে আপনি ওখানে থাকলে আমরা খুব খুশি হব।

বলেছেন বলে ধন্যবাদ, তরে লাগবে না, বলল রানা।

রানার কবজি খপ করে ধরল দৈত্য, তালুতে গুঁজে দিল বাড়ির চাবি। ওটার সঙ্গে আছে প্লাস্টিকের ছোট ট্যাগ। ওখানে লেখা ঠিকানা। দয়া করে আমাদেরকে কষ্ট দেবেন না। যত দিন কোর্ফিউ দ্বীপে আছেন, ওই বাড়ি আপনার।

রানার আরও একগাদা প্রশংসা করে, আবারও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিল প্যাসিফিকো, তার স্ত্রী অ্যাবে ও পিচ্চি ছেলেটা। গ্রিক পরিবার চলে যাওয়ার পর জিন্সের প্যান্টে মস্তবড় শার্ট খুঁজতে লাগল রানা। তখনই আবারও খুলে গেল দরজা।

ঘুরে তাকাল রানা। ভেবেছিল এসেছে ডাক্তার। কিন্তু এবারের মানুষটি ওর চেনা।

জোয়ি থম্পসন। মুখ ফ্যাকাসে। কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে চেহারা। গালে অশ্রুর দাগ। মেয়েটার পিছু নিয়ে ঘরে ঢুকল বয়স্ক এক লোক ও এক মহিলা। গম্ভীর চেহারায় রানাকে দেখল তারা। ওয়েডিং পার্টিতে তাদেরকে দেখেছে রানা। জোয়ি থম্পসনের বাবা-মা।

আমি দেখতে এসেছি তোমার চেহারাটা, বলল জোয়ি।

জবাব দিল না রানা। জানা নেই কী বলা উচিত।

আমার স্বামীকে যে খুন করেছে, তাকে দেখতে এসেছি, বলল জোয়ি। বলতে এসেছি, ঠিক কেমন লাগছে আমার। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট। চোখের অশ্রু মুছল ও।

হঠাৎ হাঁটুর কাছে জোর পাচ্ছে না, টের পেল রানা। মনে। হলো, বলা উচিত, আমি খুন করিনি মউরোসকে। যদি জানতাম, বিপদের ঝুঁকি আছে, মরে গেলেও বন্ধুকে এসবে জড়াতাম না। কিন্তু এসব বলা এখন অর্থহীন। এ ধরনের কৈফিয়ত দেয়ার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভাল।

রাগে-কষ্টে মুখ বিকৃত হলো জোয়ির। ওয়েডিং পার্টিতে তোমাকে দেখেই বুঝেছি, সর্বনাশ ডেকে আনছ আমাদের জীবনে। খুবই দুঃসাহসী, বেপরোয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক তুমি, মাসুদ রানা, লোভ দেখিয়ে ঠেলে দিয়েছ আমার স্বামীকে মৃত্যুর মুখে।

জোয়ি, ভাবতেও পারিনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে, নিচু গলায় বলল রানা।

নিজেও জানে না, তুমি আসলে কতটা ভয়ঙ্কর, নিষ্ঠুর খুনি! ঘৃণা ফুটল জোয়ির কণ্ঠে, শেষ করে দিয়েছ আমার সংসার, আমার জীবন। আমার বাচ্চার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ ওর বাবাকে।

হতবাক হয়ে ওকে দেখল রানা।

দুদিন আগে জেনেছি আমি মা হতে চলেছি, ফুঁপিয়ে উঠল জোয়ি। ভেবেছিলাম মউরোস বাড়ি ফিরলে জানাব। কিন্তু আর কখনও ফিরবে না ও। আমার বাচ্চা কখনও চিনবে ওর বাবাকে। সেজন্যে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, মাসুদ রানা!

প্রচণ্ড দুঃখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জোয়ি। দুলছে, যে-কোনও সময়ে পড়ে যাবে জ্ঞান হারিয়ে। ওকে ধরে ফেললেন ওর বাবা। কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জোয়ি। ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ভরা চোখে দেখল রানাকে। তুমি খুনি, মাসুদ রানা! চিৎকার করে উঠে চড় দিতে গেল রানার গালে।

এক পা সরে গেছে রানা। তবুও লাগল চড়টা ওর গালে। নিজ পায়ের দিকে চেয়ে রইল ও। বুক ভেঙে গেছে ওর নিজেরও। চোখ তুলে তাকাতে পারল না মানুষগুলোর চোখে। চিৎকার শুনে বাইরে থেকে ঘরে ঢুকেছে দুজন নার্স। এগোতে গিয়েও থমকে গেল তারা।

প্রায় দুভাঁজ হয়ে কাঁদছে জোয়ি। থরথর করে কাঁপছে দুকাধ। পাশ থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলেন ওর মা। চলো, যাই, জোয়ি। দরজার দিকে পা বাড়াল দুজন।

বিষাক্ত দৃষ্টিতে রানাকে দেখলেন জোয়ির বাবা। নার্সদের ঠেলে সরিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

দরজার কাছ থেকে রানাকে দেখলেন মিসেস থম্পসন। ঈশ্বরের বিচার বলে কিছু থাকলে, নিজের বিবেকের দংশনে নরকে যাবে তুমি, মাসুদ রানা!

.

১৫.

 প্যাক্সোস দ্বীপ, গ্রিস।

সৈকতের কাছে সাদা রঙের বড় এক ভবনের দোতলার অ্যাপার্টমেন্টে বসে আছে সোনালি চুলের বয়েটার ব্ল্যাকউড। তার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিস্টিনা পার্কার। ল্যাপটপ কমপিউটারের স্ক্রিনে গভীর মনোযোগ তাদের।

 ঝকঝকে ডিজিটাল ইমেজ। গতকাল কোর্ফিউ দ্বীপের এক অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে তুলেছে ওই ভিডিয়ো। ক্যামেরা যুম করা হয়েছে দুজন লোকের ওপর। তারা বসে আছে টেরেসের বাইরের প্রান্তে।

আপাতত ওই দুজনকে এক নম্বর লোক এবং দুই নম্বর লোক হিসেবে ধরে নিয়েছে ক্রিস্টিনা ও বয়েটার। কোর্ফিউ দ্বীপে পৌঁছেই ক্যাথির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিল প্রথম লোকটা। গতকাল হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিতভাবে হাজির হলো দ্বিতীয়জন। এদের সম্পর্কে কিছুই জানা নেই ক্রিস্টিনা ও বয়েটারের। এ কারণে অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেছে তারা।

আরও খারাপ কথা, বোমা ফাটলেও বেঁচে গেছে দুই নম্বর। এ কারণেই এই এলাকায় বাধ্য হয়ে রয়ে যেতে হয়েছে তাদেরকে।

কমপিউটার স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, আলাপ করছে দুই লোক। তারপর হঠাৎ ওখানে হাজির হলো বল হাতে ছোট এক ছেলে। কিছুক্ষণ পর ঝট করে চেয়ার ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল দুই নম্বর লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড পর লেলিহান আগুন গ্রাস করল ক্যাফের টেরেস।

পয করো, বলল ক্রিস্টিনা।

কি বোর্ডের বাটন টিপল বয়েটার। স্থির করা পর্দায় দেখা গেল আগুনের কমলা গোলা। নানাদিকে ছিটকে যেতে গিয়েও থমকে গেছে চুরমার হওয়া জঞ্জাল। মানুষের মুখে আতঙ্ক।

বামে সরো, বলল ক্রিস্টিনা।

আরেকটা কি টিপে ইমেজ সরাল বয়েটার। রাস্তায় দেখা দিয়েছে সবুজ ডেলিভারি ভ্যান। বাঁক নিয়ে থেমে গেছে। ওদিকে উপুড় হয়ে পড়ে আছে ক্যাফে টেরেস থেকে নামা ওই লোক, বুকের ভেতর বাচ্চা ছেলেটা।

চিন্তিত চেহারায় লোকটাকে দেখছে ক্রিস্টিনা। কিছুক্ষণ পর বলল, এ বিষয়ে কিছু জানা আছে তার? দেখেছে কিছু?

মনে হয় না জানে, বলল বয়েটার, দৌড় দিয়েছিল ছেলেটাকে বাঁচাতে। কয়েক সেকেণ্ড এদিক-ওদিক হলেই পড়ত বোমার আওতার ভেতর।

কিন্তু যদি দেখে থাকে সলোমনকে? যদি মনে থাকে ওর চেহারা? এই লোক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী।

কিছুই জানে না। বেঁচে গেছে কপালের জোরে। এসব জানার কোনও উপায় ছিল না তার।

ভুরু কুঁচকে ফেলল ক্রিস্টিনা। হয়তো। পিছিয়ে যাও। ঠিক আছে। থামো। আবারও প্লে করো।

অন্তত এক শবার দেখেছি আমরা, বিরক্তি নিয়ে বলল বয়েটার।

জানতে চাই কে ওই লোক। খারাপ অনুভূতি হচ্ছে আমার।

আবারও ভিডিয়ো দেখতে লাগল তারা। খারাপ রেকর্ডিঙের কারণে আসছে নানান শব্দ। টেবিলে বসে আলাপ করছে অনেকে। হেঁটে যাচ্ছে পথচারীরা। গাড়ির চাপা গর্জন।

এত আওয়াজে ওদের কথা শুনতে পাব না, বিড়বিড় করল ক্রিস্টিনা।

আমরা তো আর সিনেমা তৈরি করতে বসিনি, বলল বয়েটার। ভিডিয়ো ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েছিলাম বলে আওয়াজ পাচ্ছি। নইলে শুনতেই পারতাম না এতকিছু।

চুপ করো তো! চলতে দাও ভিডিয়ো।

নীরব হয়ে গেল বয়েটার। এই অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ক্রিস্টিনার ওপর। তার কথা মত না চললে বিপদ হবে। প্রয়োজনে খুন করতেও দ্বিধা করে না ওই মেয়ে।

প্য, বলল যুবতী। শুনলে? আবারও মেয়েটার নাম বলল। আরেকটু পিছিয়ে যাও।

কয়েক ফ্রেম পেছনে গেল বয়েটার। বোঝার উপায় নেই যে ওই মেয়ের কথাই বলেছে।

আমি শিয়োর। বাড়াও ভলিউম। কমাতে পারবে বাজে আওয়াজ?

সাধ্যমত করেছি, আর সম্ভব নয়, তিক্ত চেহারায় বলল বয়েটার। গতরাত থেকে খেটে মরছে। ক্রিস্টিনা চাইছে লোকদুজনের আলাপ শুনবে। আরও পরিষ্কার শুনতে হলে কয়েক ঘণ্টা বাড়তি সময় দিতে হবে আমাকে।

ওই হারামজাদা ছোঁড়ার বলের আওয়াজ দূর করলেই হবে, বলল যুবতী। মাইকের কাছে এলেই থ্যাপ-থ্যাপ শব্দ তুলছে বাস্কেট বল। তখন শোনা যাচ্ছে না লোকদুজনের আলাপ। এ কারণে মাথায় আগুন জ্বলে উঠছে ক্রিস্টিনার।

নতুন করে ভিডিয়ো চালু করল বয়েটার। আরও সতর্ক হয়ে কান পাতল তারা।

ওই যে হার্বার্টের নাম নিল, বলল ক্রিস্টিনা। ঠিকই শোনা গেছে।

হ্যাঁ। হার্বার্ট।

সর্বনাশ! ঠিক আছে, চলতে দাও। আরও কয়েক সেকেণ্ড চলল ভিডিয়ো। চোখ বুজে শব্দের ওপরে মনোযোগ দিয়েছে ক্রিস্টিনা। একটু পর আবার মেলল চোখ। দঢ়বদ্ধ হলো চোয়াল। স্টপ। সিম্পসন। এক নম্বর লোকটা বলেছে: সিম্পসন।

বিরক্ত হলো বয়েটার। আগে শুনতে পায়নি। ঠিক। সিম্পসনের ব্যাপারে কী বলছিল লোকটা?

আবারও প্রথম থেকে শুনব। গতি কমিয়ে দেবে।

চাপা হিসহিস শব্দের রেকর্ডিং শুনতে লাগল তারা। আমার মনে হচ্ছে বলেছে, কোথায় আছে সিম্পসন? বলল ক্রিস্টিনা। আমি বোধহয় ভুল করছি না।

কিন্তু এরা সিম্পসন সম্পর্কে জানল কী করে?

তার মানে, ক্যাথি হার্বার্টের সঙ্গে কথা বলেছিল এরা।  ধরে নিতে পারি, প্রায় সবই জানা আছে এদের।

অথবা, ওই অ্যাড্রেস বুক দেখেছে।

ঘটনা যা-ই হোক, চাই না আরও কিছু জানুক দুই নম্বর লোকটা।

ভিডিয়ো দেখতে লাগল তারা দুজন। দুই নম্বর লোকটার দিকে খবরের কাগজ বাড়িয়ে দিল এক নম্বর লোকটা।

ওই একই দিনের দৈনিক পত্রিকা ডেস্ক থেকে তুলে নিল ক্রিস্টিনা। প্রথম পাতায় চোখ রেখেছে দুই নম্বর লোকটা। নিশ্চয়ই দেখছে থ্যানাটসের মৃত্যু-সংবাদ।

আবারও ভিডিয়ো ফ্রেমে ঢুকে পড়ল বাচ্চা ছেলেটা। ওর বলটা গিয়ে পড়ল রাস্তায়। আবারও দুই নম্বর লোকটার দিকে মন দিল তারা। ওই লোক লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে ছুট দিল বাচ্চাটাকে বাঁচাতে। কসেকেণ্ড পর টেরেসে ফাটল শক্তিশালী বোমা।

এবার বন্ধ করতে পারো, বলল ক্রিস্টিনা। যা বোঝার বোঝা শেষ।

বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে হিরো হওয়ার শখ হয়েছিল শালার, বিড়বিড় করল বয়েটার।

ঘরে পায়চারি করতে লাগল ক্রিস্টিনা। দুইয়ে দুই মেলালে যা হয়। সবই জেনে গিয়েছিল এরা। ক্যাথি হার্বার্ট। টাকা। সিম্পসন। থ্যানাটস। এক নম্বর লোকটা ভাল করেই জানত, পিছু নিয়েছি আমরা।

সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে ক্রিস্টির দিকে ফিরল বয়েটার। ওই লোক জানবে কী করে? স্ক্রিন কালো হয়ে যাওয়ার এক সেকেণ্ড পর শাট ডাউন হলো ল্যাপটপ।

মাথা নাড়ল ক্রিস্টিনা। ক্যাথির পরিবারের সাধারণ কোনও বন্ধু ছিল না সে। আচরণ পেশাদার। নইলে কখনও বুঝত না তার পিছু নিয়েছি।

তা হলে কারা এরা? কাজ করছে কাদের হয়ে?

জানি না।

তোমার কী মনে হয়, ওটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ক্যাথি?

ঊর্ধ্বতনদের কাছে রিপোর্ট দিতে হবে, বলল ক্রিস্টিনা, তাদেরও ভাল লাগবে না এসব। দুই নম্বর লোকটা যে এখনও বেঁচে আছে, সেটা সুবিধার ঠেকছে না আমার। গোপনে আলাপ করতে পাশের ঘরে ঢুকল ক্রিস্টিনা। ডায়াল করল নির্দিষ্ট নম্বরে। লং-ডিস্ট্যান্স কল। ফোন রিসিভ করল আগের সেই পুরুষকণ্ঠ।

আমরা বোধহয় আরেকটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি, বলল ক্রিস্টিনা। সংক্ষেপে জানাল এদিকের পরিস্থিতি।

কতটা জানে সে? জিজ্ঞেস করল পুরুষকণ্ঠ।

যথেষ্টরও বেশি। জানে, টাকা আর সিম্পসনের ব্যাপারে। জেনে গেছে আমাদের কথাও। হয়তো জেনেছে আরও অনেক কিছুই।

দীর্ঘ নীরবতা বিরাজ করল। আরও কিছুক্ষণ পর লোকটা বলল, গোটা ব্যাপারটা বাজে দিকে মোড় নিচ্ছে।

সব সামলে নেব, বলল ক্রিস্টিনা।

সে চেষ্টা করাই তোমাদের নিজেদের জন্যে মঙ্গলকর। ওই লোকের পেট থেকে বের করবে সব। এবার যেন কোনও ভুল না হয়। কাজ সারবে গোপনে। চাই না আবার সলোমনের সাহায্য নিতে। অতিরিক্ত খরচ তার পেছনে।

কথা ফুরিয়ে যেতে ফোন রেখে পাশের ঘরে ফিরল ক্রিস্টিনা। চাপা স্বরে বলল, ঠিক আছে, চলো। ওপারে পাঠাতে হবে দুই নম্বরকে। তার আগে সব বের করতে হবে ওর পেট থেকে।

.

১৬.

 ডাক্তার আপত্তি তুললেও মাথা-ঘোরা আর অবশ অনুভূতি নিয়েই হাসপাতাল ছাড়ল রানা। কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতেই আরেক গালে চড় দিল সকালের তপ্ত রোদ। পেভমেন্টে দাঁড়িয়ে ভাবল, এবার কী করব? জানা নেই কী করা উচিত।

পায়ের আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল রানা।

দুই লোক। একজনের হাতে ক্যামেরা। অন্যজনের হাতে নোটবুক। রিপোর্টার। অপেক্ষা করছিল ওর জন্যেই।

নোটবুক হাতে লোকটা বলল, আপনিই তো ওই বাচ্চা ছেলের প্রাণ রক্ষা করেছেন? আমরা কি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

পরে, জানাল গম্ভীর রানা।

পরে? ঠিক আছে, এই যে আমার কার্ড। রানার হাতে ভিযিটিং কার্ড ধরিয়ে দিল রিপোর্টার।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। কথা বলার মানসিকতা নেই। ক্যামেরা তুলে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলল ফোটোগ্রাফার। তাকে বাধা দিল না রানা।

দুই সাংবাদিক চলে যাচ্ছে, এমনসময় কড়া ব্রেক কষে কর্কশ আওয়াজ তুলে পেভমেন্টের কাছে থামল কোটি পুলিশের একটা জিপ। খুলে গেল দুই দরজা। বেরিয়ে এল দুই লোক। তাদের একজনের পরনে ইউনিফর্ম। অন্যজনের গায়ে সিভিলিয়ান পোশাক। শেষের লোকটা বেঁটে এবং মোটা। মাথা ভরা টাক। চোয়ালে ছটা দাড়ি।

রানার সামনে থামল, লোকদুজন। সাধারণ পোশাকের লোকটা ইংরেজিতে বলল, মিস্টার রানা? জ্যাকেটের পকেট থেকে নিয়ে দেখাল আইডি কার্ড। আমি কোর্ফিউ দ্বীপের পুলিশ ক্যাপ্টেন আবদাল্লা অ্যানেস্তাসিয়ো। জরুরি কিছু তথ্য চাই, তাই দয়া করে আসুন আমার সঙ্গে।

চুপ করে থাকল রানা। দুই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে উঠল ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়িতে। ওর পর পর সিটে উঠল ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো। ড্রাইভারকে জানাল, ফিরবে অফিসে। ঝড়ের গতি তুলে রওনা হলো জিপ। রানার দিকে ফিরল ক্যাপ্টেন। সুস্থ হওয়ার আগেই হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। ভেবেছিলাম, আপনাকে পাব বেড-এ।

সুস্থ হয়ে গেছি, বলল রানা।

 শেষবার আপনাকে দেখেছি রক্তাক্ত অবস্থায় স্ট্রেচারে।

সামান্য কেটে গেছে কাঁচের টুকরোয়। অনেকের মত গুরুতর আহত নই।

গম্ভীর চেহারায় মাথা দোলাল পুলিশ ক্যাপ্টেন।

দশ মিনিট পেরোবার আগেই সিকিউরিটি পয়েন্ট পেরিয়ে বিশাল পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পেছনে থামল জিপ। গাড়ি থেকে নেমে রানাকে অনুসরণ করতে ইশারা করল ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো।

গোটা হেডকোয়ার্টার এয়ার কণ্ডিশণ্ড। লোকটার পিছু নিয়ে গোছানো এক অফিস-ঘরে ঢুকল রানা।

বসুন, টেবিলের সামনে চেয়ার দেখাল অ্যানেস্তাসিয়ো।

কী ধরনের তথ্য চাইছেন, ক্যাপ্টেন? জিজ্ঞেস করল রানা।

মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন, ডেস্কের কোণে বসল ক্যাপ্টেন। দোলাতে লাগল ডান পা। মৃদু হাসল। লোকে বলছে, আপনি নাকি সত্যিকারের হিরো।

বাড়িয়ে বলছে, বলল রানা।

বোমা ফাটার আগের মুহূর্তে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন পিচ্চি সালোমাও কোলিয়াসকে। তার আগে কথা বলছিলেন ওই ক্যাফের এক খদ্দেরের সঙ্গে।

মাথা দোলাল রানা।

ওখানে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে আপনার?

না, বলল রানা।

মাথা দোলাল ক্যাপ্টেন। ডেস্ক থেকে নিল নীল এক নোটবুক। বোমায় খুন হয়ে যাওয়া জা মউরোস সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি তো আপনার বন্ধু ছিলেন?

মাথা দোলাল রানা।

কী কারণে কোর্ফিউ দ্বীপে এসেছিলেন তিনি?

এ ধরনের পুলিশ অফিসারদের চেনে রানা। এরা পূর্ণ আত্মনিয়োগকৃত। মিষ্টি করে হাসবে, কথা বলবে নরম সুরে। বের করবে পেট থেকে সব। সুতরাং অনুচিত হবে ভুল কথা বলা। মউরোসের জন্যেই আসি এই দ্বীপে। চেয়েছিল আমার পরামর্শ। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই ফাটল বোমাটা।

মাথা দোলাল ক্যাপ্টেন। নোট নিল প্যাডে। জানেন না, কী কারণে ই-মেইল বা ফোনে সরাসরি আলাপ করেননি তিনি।

কারণটা জানা নেই, বলল রানা।

হুম। নড়েচড়ে বসল ক্যাপ্টেন। অর্থাৎ, শুধু আলাপ করতে এত দূরে আসেন। অথচ, জানেনই না কী বিষয়ে কথা বলবেন তিনি?

জী।

এটা খুব অস্বাভাবিক।

বেড়াতে পছন্দ করি, বলল রানা।

কী ধরনের পেশায় আছেন আপনি, মিস্টার রানা?

একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাই।

নতুন নোট নিল ক্যাপ্টেন। আচ্ছা। মুখ তুলে রানাকে দেখল। আপনার কোনও কাজেই কি এসেছিলেন জ্যা মউরোস? তিনি কিন্তু দ্বীপে এসেই নানান প্রশ্ন তুলেছিলেন এক ইংরেজ মহিলা সম্পর্কে।

এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই, বলল রানা।

ভুরু উঁচু করল ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো। চকচক করছে চোখ। ওই দৃষ্টি যেন বলছে: এইবার তরে পাইছি! গতকাল রাতে মিস্টার মউরোসের স্ত্রী কিন্তু অন্য কথা বলে গেছেন। তার স্বামী নাকি কাজ করছিলেন আপনার হয়ে। খুঁজে বের করতে এসেছিলেন এই দ্বীপে ওই মেয়েকে।

চোখ বুজে মাথার তালু টিপল রানা। না বুঝেই ফাঁদে পা দিয়েছে। মনে মনে কষে এক লাথি দিল নিজের নিতম্বে।

মর্গে আছে ছয়টা লাশ, বলল ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো, গুরুতর আহত আরও এগারোজন। তাদের একজন কখনও চোখে দেখবে না। আরেকজন চিরকালের জন্যে পঙ্গু। আমার শহরে বোমা ফাটিয়েছে কেউ। কাজেই, কেন তা করা হয়েছে, এবং কে করেছে, সেটা জানার অধিকার আমার আছে।

চুপ করে থাকল রানা।

হাসল ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো। ওই হাসি বরফের মত শীতল। আছেন শকের ভেতর। ভাল করতেন হাসপাতাল না ছাড়লে। বোধহয় মাথা পরিষ্কার হতে আরও দুএক দিন লাগবে। আশা করি, চিন্তা গুছিয়ে নেয়ার পর খুলে বলবেন সব। তখন ওসব প্রশ্নের জবাব আবারও জানতে চাইব। বলে রাখি, আপাতত নিষেধাজ্ঞা জারি করছিঃ ভুলেও কোর্ফিউ দ্বীপ ত্যাগ করবেন না। জমা দিন পাসপোর্ট। আপনাকে আর প্রয়োজন না পড়লে ফেরত পাবেন।

ওটা আমার কাছে নেই, বলল রানা।  

কোথায় আছে?

জ্যাকেটের পকেটে ছিল, তখন ফাটল বোমা। পুড়ে গেছে বিমানের টিকেটও। চেয়ারের পিঠে ছিল ওই জ্যাকেট। ছাই হয়ে গেছে সব।

দীর্ঘক্ষণ কড়া চোখে ওকে দেখল ক্যাপ্টেন, তারপর বলল, আপনার প্যান্টের পকেটে ওয়ালেট দেখেছি। ওটা দিন।

তার হাতে ওয়ালেট দিল রানা।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভেতরের সব দেখছে ক্যাপ্টেন। বিশেষ মন দিল ড্রাইভিং লাইসেন্সের ওপর। ঘেঁটে দেখল ইউরো নোট। মন্তব্য করল, প্রচুর টাকা সঙ্গে রাখেন।

পারতপক্ষে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করি না, বলল রানা। দেখতেই পাচ্ছেন, ওয়ালেটে আমার পাসপোর্ট নেই।

আপনি খুব অস্বাভাবিক মানুষ। হাজার মাইল পথ পাড়ি দেন, কারণ ফোনে আলাপ করতে পছন্দ করেন না। ব্যবহার করেন না ক্রেডিট কার্ড, তাই সঙ্গে থাকে নগদ হাজার হাজার ইউরো। আরোগ্যের আগেই চেক আউট করেন হাসপাতাল থেকে। আর পুলিশ অফিসার হিসেবে আমার কাজ এসব অস্বাভাবিকতা খেয়াল করা। নিজেকে জিজ্ঞেস করছিঃ এমন কী কাজ আছে আপনার, যে কারণে এত তাড়া?

ভাবছেন ওই বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক আছে?

তা বলছি না। তবে সব কথা বলছেন না আপনি। মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়ো। তাই বলছি, এরপর থেকে কথা বলবেন ভেবেচিন্তে। আবার কথা হবে পরে। আপাতত বিদায় নিতে পারেন।

চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে চলে গেছে রানা, এমনসময় পেছন থেকে ডাকল ক্যাপ্টেন। তার হাতে কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ। এর ভেতরে আপনার কিছু জিনিসপত্র আছে। আগুনে পোড়েনি এসব।

ব্যাগটা নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল রানা। কেমন অবশ লাগছে দেহ-মন। মনোযোগ নেই চারপাশে। এগিয়ে চলেছে এক পা এক পা করে। বুকে উঠেহে ঝড়। ক্যাপ্টেন অ্যানেস্তাসিয়োর কথা ভাবছে না। বারবার মগজে খোঁচা দিচ্ছে জোয়ির কথা: আমার বাচ্চা কখনও চিনবে না ওর বাবাকে। সেজন্যে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, মাসুদ রানা। নিজেও জানো না, তুমি আসলে ভয়ঙ্কর, নিষ্ঠুর খুনি! শেষ করে দিয়েছ আমার সংসার, আমার জীবন। আমার বাচ্চার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ ওর বাবাকে!

কথাগুলো ধারালো ছোরার মত চিরছে হৃদয়। মৃদু টলতে টলতে হাঁটছে রানা। নিজেও জানে না, কখন বেরিয়ে এসেছে শহর ছেড়ে। পৌঁছে গেছে সাগরের উঁচু তীরে। নিচে সাগরে ভাসছে কিছু নৌকা। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে রইল রানা, তারপর ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে নামল রূপালি বালির নরম সৈকতে। চারপাশ নির্জন। কেউ নেই। কিছু দূর হাঁটার পর বাঁক ঘুরে ওপরে উঠলে পাথুরে জমি। সামনে সুদূর দিগন্ত পর্যন্ত পাইনের ঘন সবুজ জঙ্গল।

একটা পাথরে ধপ করে বসল রানা। দুপায়ের মাঝে থাকল কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ। বুজে ফেলল চোখ। ওর মনে হলো, ফুরিয়ে গেছে শরীরের সব শক্তি। রক্ষা পেল না– বারবার মনের আয়নায় ভেসে উঠছে মউরোসের হাসিমুখ। চিৎকার করে বলছে জোয়ি: তুমি নিষ্ঠুর খুনি!

ঠিকই বলেছে মেয়েটা। মউরোস মারা গেছে ওরই ভুলে। ও-ই বন্ধুকে ঠেলে দিয়েছিল মরণফাঁদে। বলেছিল, কাজটা খুব সহজ। কিন্তু এই দুনিয়ায় মূল্যবান কিছু চাইলে দিতে হয় প্রচুর সময় ও পরিশ্রম। রানা, তুই কেন ভাবলি যে সহজেই পাবে মউরোস অত টাকা? তোর তো জানার কথা ছিল!

খুন হয়ে গেছে মউরোস!  

বাচ্চাটা কখনও দেখবে না ওর বাবাকে!

প্রবল জ্বরের ঘোরে দরদর করে ঘামছে রানা। হাত ভরল প্লাস্টিকের ব্যাগে। হাতে ঠেকল নষ্ট মোবাইল ফোন। ওটা বের না করে তুলে নিল মদের ধাতব ফ্লাস্ক। ওটা ওর জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল মউরোস। ফ্লাস্কের মুখ খুলে ঢকঢক করে গিলল উষ্ণ উইস্কি। জিভ ও গলা পুড়িয়ে বুক চিরে নামল তরল-গরল। একটুক্ষণের জন্যে মগজ ভোতা করে দিলেও চিরকালের জন্যে বিবেকের দংশন থেকে রক্ষা করবে না ওটা।

চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। হিসহিস শব্দে এসে জুতোর ডগা ভিজিয়ে দিল ঢেউ। আবার ফিরল সাগরে। চোখ মেলে দূরাকাশে তাকাল রানা। নীরব চিৎকার করছে ওর। হৃদয়: আছ কেউ?

রানা জানে, জবাব দেবে না কেউ।

প্রচণ্ড ক্রোধ ও তীব্র হতাশায় থরথর করে কেঁপে উঠল রানা। বড় এক ঢোকে আধখালি করল ফ্লাস্ক। উঠে চলে গেল। কিছুটা দূরে। ওদিকের এক টিলার কোলে কটা ছোট বাড়ি। ওখান থেকে সিঁড়ি নেমেছে সৈকতে।

ঝিরঝিরে হাওয়ায় ভেসে এল মানুষের কণ্ঠস্বর। এদিকে আসছে কয়েকজন। কিন্তু তাদের সঙ্গে দেখা হোক, চাইছে না রানা। ওর এখন চাই নিঃসঙ্গ নীরবতা।

ঘুরে আবারও ছোট পাথরের কাছে ফিরল রানা। সাগরের তীরে হিসহিস শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ঢেউ।

তিক্ত হাসল রানা। এমনি করেই একদিন ফুরিয়ে যাবে ও নিজেও। একাকী পথচলা শেষে বিদায় নেবে পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু তার আগে আছে জরুরি একটা কাজ। যারা এতিম করেছে অসহায়, অনাগত, অবোধ শিশুকে, কোথাও পালিয়ে বাঁচবে না ওইসব নরপশু। দরকার হলে দুনিয়ার প্রতিটি কোণে হানা দেবে রানা। মউরোসের অকাল মৃত্যুর জন্যে কঠিন মূল্য দিতে হবে তাদেরকে।

.

১৭.

 কাঠের তক্তায় পেরেক মেরে আটকে দেয়া হয়েছে জানালা, অবশ্য তক্তার মাঝের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাতের নিকষ অন্ধকার। অনেকক্ষণ হলো ওদিকে চেয়ে আছে হতাশ ক্যাথি। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একটু পর বিছানায় শুয়ে চোখ রাখল সিলিং-এ।

গত পাঁচ দিন আগে ওই দ্বীপ থেকে বিমানে করে সরিয়ে নিয়েছে ওকে। জানার উপায় নেই, আছে কোথায়।

এ এলাকায় পড়েছে বেশ শীত। ঠাণ্ডায় যেন কষ্ট না পায়, তাই কিডন্যাপাররা দিয়েছে ভারী সোয়েটার, উলের প্যান্ট ও ভারী মোজা।

বেশিরভাগ সময় কাটছে অতীত ঘাটতে গিয়ে। মনে পড়ছে টুকরো সব স্মৃতি। তাতে যেমন বাড়ছে সচেতনতা, তেমনি ফিরছে অস্পষ্ট স্বপ্নের মত সব ভাবনা। একেকটা যেন ছোট ছোট দ্বীপের বিচ্ছিন্ন অংশ। তবে আশা করছে, একদিন সবমিলে তৈরি হবে স্বাভাবিক কোনও চিত্র। মাঝে মাঝেই অন্তরে হানা দিচ্ছে দুজন মানুষ। একজন বয়স্ক লোক, অন্যজন বয়স্কা মহিলা। এঁরাই বোধহয় ওর বাবা-মা। গভীর ধূসর কুয়াশা হাতড়ে সাদা এক কুকুরের দেখা পেয়েছে ক্যাথি। ওই কুকুরটা ওর নিজের। কী যেন ওটার নাম?

হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি যেন সোনালি রোদ, চাইলেও ধরা যায় না মুঠোর ভেতর। আবছা সব চিন্তা এলে সেসব নিয়ে ভাবতে চাইছে ক্যাথি, কিন্তু একপলকে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সব। আবার নিজে থেকেই ধরা দিচ্ছে বহু কিছু। যেমন ওই ভিলা, মনে পড়ছে পরিষ্কার। যদিও ভুলে গেছে ওই দ্বীপের নাম। এটাও মনে নেই, কী করছিল সে ওই দ্বীপে।

হঠাৎ একটা স্মৃতি মনে পড়ল: মোটরসাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ওর চুলের মাঝ দিয়ে সাঁই-সাঁই করে বইছিল দমকা হাওয়া। আয়নায় দেখেছে উজ্জ্বল আলো। মনে ছিল ভয়।

ভাবনাগুলো জড় করতে চাইছে ক্যাথি। অস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে, সে-সময়ে মোটরসাইকেল থেকে পতন হয়েছিল ওর। খুব লেগেছে মাথায়। এখনও ফুলে আছে জায়গাটা। তবে এখন আর ব্যথা নেই বললেই চলে।

এরপর কী হয়েছিল, ভাবতে চাইছে ক্যাথি। সহজেই চট করে মনে পড়ল, সাদা বাড়িতে আটকে রেখেছিল ওকে চারজন কিডন্যাপার। ওখান থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছে। ধরা পড়ে গিয়েছিল।

সোনালি চুলের ওই পিশাচের মত লোকটার কথা ভেবে শিউরে উঠল ক্যাথি। জানা নেই, কোথায় আছে ওই পশুটা। আবারও ফিরবে ভাবলেই আতঙ্ক লাগছে ওর।

মনে পড়ল, কীভাবে আনা হয়েছে ওকে এখানে।

দ্বীপ পেরিয়ে বহু দূরে গেছে সি-প্লেন। অনেকক্ষণ পর নামল নীল সাগরে। দূরে উপকূল। বারবার ক্যাথি জিজ্ঞেস করেছে, কোথায় নিয়ে চলেছে তারা। জবাব দেয়নি কেউ। সি-প্লেনে এসে ভিড়ল হলদে এক স্পিডবোট। ওটাতে করে তীরে নিল দুই লোক। পাথুরে সৈকতে ওকে হেঁচড়ে নিয়ে থামল সরু এক রাস্তার পাশে। অপেক্ষা করছিল ভ্যান। পেছনের সিটে তুলল তারা। চিৎকার করতে চেয়েছে ক্যাথি, কিন্তু চেপে ধরা হলো হাত-পা-মুখ।

ওর মনে হলো, ধর্ষণ করবে বুঝি এরা। পরে খুন করবে। কিন্তু তেমন কিছু করেনি লোকদুজন। তারপর এল তৃতীয় এক লোক। তার কাছে ছিল কালো চামড়ার কেস। ওটা থেকে নিল সিরিঞ্জ। উবু হয়ে ওটা গেঁথে দিল ওর বাহুতে। ভীষণ ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল ও।

পরে ঘুম ভাঙল ঠাণ্ডা এই ঘরের শক্ত বাঙ্কে। কোনও জানালা নেই। রঙচটা কংক্রিটের চার দেয়াল। ছাতে শেডহীন উজ্জল বাল। চারদিন ধরে বন্দি এখানে। হ্যাঁ, পুরো চারদিন! প্রায় পাগল হয়ে গেছে ভয় আর বুক ভেঙে দেয়া হতাশায়।

চার দিন ধরে ক্যাথির ঘরে আসছে কয়েকজন লোক। তাদের একজন দিচ্ছে খাবার ও পানি। পানি খেলেও বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকছে ওর খাবার। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বের করা হচ্ছে ঘর থেকে। জানালাহীন এক করিডোর পার করে নিয়ে যাচ্ছে এক ঘুপচি টয়লেটে। কখনও কথা বলে না লোকটা। গম্ভীর।

এ ছাড়া, আছে কালো সুট পরা এক লোক। প্রতিদিন দেখা দিচ্ছে তিনবার করে। সে ঘরে এলে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে ক্যাথি। রুক্ষ হলদেটে ত্বকের ওই লোক লম্বা, চিকন, বয়স প্রায় পঞ্চাশ। ব্যাকব্রাশ করা চুল। দাঁত হাঙরের দাঁতের মত ধারালো। যেন ক্ষুধার্ত নেকড়েমানব। এতই শীতল হাসি, হাত-পা কাপে ক্যাথির।

মাত্র একটা বিষয়ে কথা বলে লোকটা: ওটা কোথায়?

বরাবরের মত একই জবাব দিচ্ছে ক্যাথি। জানি না। আমি জানি না। জানি না। আমি জানি না।

ক্যাথির বক্তব্য শুনে বিরক্ত হয়ে গেছে লোকটা। ওর নিজেরও খারাপ লাগছে একই কথা বলতে। লোকটার চোখে জ্বলে ওঠে শীতল ক্রোধ। ওর মনে হচ্ছে, যে-কোনও দিন প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়বে লোকটা, পিটিয়ে মেরে ফেলবে ওকে। নিজেকে শেষে সামলে নিচ্ছে ম্যানিয়াকটা। ভেঙচি  কেটে হাসছে। আবারও জিজ্ঞেস করছে একই কথা।

ওটা কোথায়?

কোথায় রেখেছ?

 কিন্তু অজানা তথ্য পাবে কোথায়?

তবুও বারবার বলছে ওই লোক: বলো, কোথায় রেখেছ, তা হলেই ছেড়ে দেব। পৌঁছে দেব বাড়িতে। আর কোনও বিপদ হবে না তোমার।

অনেক ভেবেও কিছুই মনে পড়ছে না ক্যাথির। জানাতে পারছে না, জিনিসটা কী এবং কোথায় রেখেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরার পর ভেঙে পড়ছে। কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। নিস্পৃহ চেহারায় ওকে দেখছে লোকটা। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে। আটকে দিচ্ছে দরজার তালা।

তৃতীয়জন এক ডাক্তার। সাদা কোট। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। মোটাসোটা। মাথায় টাক। কুচকুচে কালো দাড়ি। নরম আচরণ করছে প্রথম থেকেই। তবে হাসিতে অনিশ্চয়তা। প্রতিদিন পরখ করে দেখছে দেহের তাপমাত্রা। বাদ পড়ছে না ব্লাড প্রেশার। কান পেতে শুনছে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। পরীক্ষা করছে মাথার ফোলা জায়গাটা। খুব সহানুভূতিপূর্ণ। হয়তো সত্যিই চাইছে, ফিরে আসুক ওর স্মৃতি। অনেক প্রশ্ন আছে এই ডাক্তারের মনে। কথা বলছে খুব নরম সুরে। তার প্রশ্নের কিছু জবাব দিতে পেরেছে ক্যাথি। আবার অনেক কথা জানা নেই। যা বলেছে, প্রতিটি কথা প্যাডে লিখে নিয়েছে ডাক্তার।

তোমার নাম কী?

 ক্যাথি হার্বার্ট।

বয়স কত তোমার?

 পঁচিশ।

বলো তো, এটা কী মাস চলছে?

 জানি না।

কী কারণে তুমি এখানে?

 জানি না।

কী হয়েছে তোমার?

আমি জানি না।

জোর খাটিয়ে ওর পেট থেকে কথা বের করতে চাইছে না ডাক্তার। নেকড়েমানবের জিজ্ঞেস করা কোনও প্রশ্ন নিয়ে কখনও কথা বলছে না সে। ক্যাথির ধারণা: মনের কথা বলতে পারবে ডাক্তারের কাছে। বলেছে, আমার খুব ভয় লাগে। এরা কোথায় এনেছে? আমাকে নিয়ে কী করবে এরা?

এসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না ডাক্তার। শুধু মৃদু হেসে বলছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা কোরো না। আবার ফেরত পাবে তোমার সব স্মৃতি।

কিন্তু দেখেছে ক্যাথি, ডাক্তারের হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে অসহায়ত্ব আর অনিশ্চয়তা। সে আসলে জানে না, তার নিজের কথা ঠিক কি না।

দুদিন আগে ডাক্তারের দ্বিতীয় ভিযিটের সময় ক্যাথি টের পেল, মন কষাকষি চলছে ডাক্তার আর নেকড়েমানবের ভেতর। ঘরের বাইরে ফিসফাস শুনেছে ক্যাথি। বাইরের করিডোরে চলছিল চাপা গলায় তর্ক। এতই অস্পষ্ট আওয়াজ, কান পেতেও কাজ হয়নি।

তারপর গতকাল আবারও এল ডাক্তার। তার সঙ্গে এক যুবতী। আগের ওই যুবতী নয়। এর চুল প্রায় লালচে, কালো নয়। মিষ্টি হাসছিল, কিন্তু দেয়ালে হেলান দিতেই জ্যাকেটের ফাঁকে হোলস্টার আর অস্ত্রের বাঁট দেখেছে ও।

গতকাল বিছানার কোণে বসে নরম সুরে বলল ডাক্তার, তোমার জন্যে সু-সংবাদ এনেছি, ক্যাথি।

আমাকে ছেড়ে দেবে? বাড়ি ফিরতে পারব? আমার বাড়ি কোথায়?

বিষণ্ণ হেসে ওর বাহুতে মৃদু চাপড় দিল ডাক্তার। আপাতত বাড়ি ফিরতে পারবে না, ক্যাথি। কিন্তু এর চেয়ে অনেক ভাল ঘরে নেব। ওটা আরামদায়ক। তোমার ভাল লাগবে।

আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই! চিৎকার করল ক্যাথি। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে দেখে ঘর ছেড়ে বিদায় নিল ডাক্তার ও ওই যুবতী। আবারও তারা ফিরবে, সেজন্যে সারাদিন অপেক্ষা করল ক্যাথি, কিন্তু এল না কেউ। শেষে ঘুমিয়ে পড়ল কাঁদতে কাঁদতে। ভাবছিল, ওর মনটাকে নিয়ে নিষ্ঠুর রসিকতা করছে ডাক্তার।

পরদিন সকালে এল ডাক্তার আর ওই মেয়ে। তাদের সঙ্গে আরও দুজন। এদেরকে আগে কখনও দেখেনি ক্যাথি। হয়তো বডিগার্ড। নেকড়েমানব আসেনি, সেজন্যে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছে ও।

ঘর থেকে ওকে বের করে করিডোর ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ডাক্তার। ক্যাথির পেছনে রূপসী ওই মেয়েটা। ওদের তিনজনকে অনুসরণ করেছে ওই দুই লোক। টয়লেটে যাওয়ার বামের বাঁক পেছনে পড়ার পর, ডানে নোংরা এক করিডোর ধরে হেঁটেছে ওরা। করিডোরের শেষমাথায় দরজা। ওটা পেরোবার পর সামনে পড়ল রঙচটা এলিভেটরের খোলা দরজা। মেয়েটা বাটন টিপে ওকে সবচেয়ে ওপরের তলায় নিয়ে এল।

দরজা খুলতে ক্যাথি দেখল, এবারের করিডোরের দেয়ালে সাদা রঙ। বড় স্কাইলাইট দিয়ে আসছে উজ্জ্বল সোনালি রোদ। বাঁক ঘুরে আরেকটা করিডোরের শেষমাথায় পৌঁছে খোলা হলো একটা দরজা।

বাঁদরের খাঁচার মত নিচের ছোট্ট ওই ঘরের অন্তত দ্বিগুণ বড় এই ঘর। পাশেই পরিষ্কার টয়লেট। বিছানায় পুরু তোষকের ওপরে সাদা, নিপাট চাদর। খাটের একপাশে ওর জন্যে নতুন পোশাক। ঘূরের কোণে টেবিলে কিছু ম্যাগাযিন ও ছোট এক পার্সোনাল ডিভিডি প্লেয়ার। আছে একগাদা সিনেমার ডিস্ক। ক্যাথির মনে হলো, আগেই দেখেছে এসব সিনেমা, তবে মনে পড়ল না কোথায় দেখেছিল। অদ্ভুত অনুভূতি হলো মনে।

এবার একটু বিশ্রাম নাও, বলল ডাক্তার, আগামীকাল থেকে শুরু হবে নতুন থেরাপি সেশন। ওটার কারণে ফেরত পাবে স্মৃতি। একবার চোখ টিপে চলে গেল সে। পেছনে আর সবাই। লক করে দেয়া হলো দরজা।

তাই, আজ ভোরে অধৈর্য হয়ে ডাক্তারের জন্যে অপেক্ষ করছে ক্যাথি। ভাবছে, এসব কী হচ্ছে ওর জীবনে? ডাক্তারকে দেখে মনে হয় দয়ালু। ইচ্ছে করছে তাকে বিশ্বাস করতে। কিন্তু ওর মগজে সতর্ক করছে আরেকটা কণ্ঠ: ডাক্তৃার কিন্তু দায়িত্বে নেই, তার ক্ষমতা সামান্যই।

কয়েক রাত হলো ঘুমাতে পারছে না ক্যাথি। শুধু ধড়ফড় করছে বুক। এ মুহূর্তে অস্থির লাগছে বলে বিছানায় উঠে বসন হাত চালাল মাথার চুলে। টিপে ধরল কপাল। ওর মগজে আছে জরুরি কোনও তথ্য। যেটার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে লোকগুলো।

সত্যি যদি মনে পড়ে সব?

 তারপর কী হবে?

.

১৮.

 কোর্ফিউয়ের রুপালি সৈকত ছেড়ে কাকাইরার দিকে হাঁটছে রানা। গার্বেজ ক্যান পেয়ে ওখানে ফেলল হাতের প্লাস্টিকের ব্যাগ ও ভেতরের সব পোড়া জিনিসপত্র। শহরে ঢুকে কিনল নতুন কয়েকটা শার্ট, দুটো জিন্স প্যান্ট ও মিলিটারি শোল্ডার ব্যাগ। জিনিসপত্র ভেতরে রেখে ওটা কাঁধে ঝুলিয়ে মিশে গেল ভিড়ের মাঝে। বোমা বিস্ফোরণের পর অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে দ্বীপে। সবার মনে রাগ, আতঙ্ক, উত্তেজনা ও তিক্ততা। আগের তুলনায় ফাঁকা সব রাস্তা। প্রতিটি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এখনও ছাপা হচ্ছে। রক্তাক্ত মৃতদেহের ছবি এবং বিস্তারিত লেখা।

শপিং মলের এক দোকান থেকে প্রি-পেইড মোবাইল ফোন কিনল রানা। স্যান রোক্কো স্কয়্যারের নিচু এক দেয়ালে বসে কল দিল প্রফেসর জন হার্বার্টকে। তাঁদের জানার কথা নয় বোমা বিস্ফোরণে খুন হয়েছে মউরোস। এখন এসব বললে ঘাবড়ে যাবেন তারা। সেটা চাইছে না ও।

অবশ্য, মিসেস হার্বার্ট কল রিসিভ করতেই বুঝে গেল, সব জেনে গেছেন তাঁরা। ফুঁপিয়ে কাঁদছেন মহিলা। খসখস শব্দ পেল রানা। ধরিয়ে দিয়েছেন ফোনের রিসিভার স্বামীর হাতে।

হ্যালো? ক্লান্ত স্বরে বললেন প্রফেসর। রানা? তুমি এখন কোথায়? দুদিন ধরে খুঁজছি। তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বলেছে, তুমি নাকি চলে গেছ কোর্ফিউ দ্বীপে?

জী, কোর্ফিউতেই আছি, বলল রানা। আমার ভুল না হলে সবই জেনেছেন।

প্রায় ভেঙে গেল প্রফেসরের চণ্ঠ, ক্যাথি কি আহত? এসবের সঙ্গে ওর সম্পর্ক আছে?

কোর্ফিউ দ্বীপে নেই ক্যাথি, বলল রানা।

ফোঁস করে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন হার্বার্ট। থ্যাঙ্ক গড! শুনেছি তোমার বন্ধুর ব্যাপারে। ভয়ঙ্কর। খুব খারাপ লাগছে ওর জন্যে। …এখন কী ভাবছ?

 জানি না, কী ভাবা উচিত।  

চুপ করে আছেন প্রফেসর। কিছুক্ষণ পর বললেন, একটা কথা বলব। শুনতে খারাপ লাগতে পারে। তবুও জিজ্ঞেস না করে পারছি নাঃ তোমার বন্ধু কি কথা বলতে পেরেছিল ওর সঙ্গে?

না, দেখা হয়নি। এখনও জানা যায়নি কোথায় আছে ক্যাথি।

তুমি কি খুঁজে বের করবে ওকে?

আমেরিকায় কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ওর? জানতে চাইল রানা। কখনও বলেছে কিছু?

বিস্ময় মেশানো কণ্ঠে বললেন হার্বার্ট, হ্যাঁ। ওখানে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে খুব চমৎকার সম্পর্ক ছিল ওর।

এক উকিল? নাম হার্ভে সিম্পসন?

না। ওই নাম কখনও শুনিনি। ক্যাথির বান্ধবী বয়স্কা এক মহিলা। দুবছর আগে গ্রীষ্মে এখানে এসে শিক্ষকতা করেন। তার নাম মিস মেরিয়ান ট্ৰলি। সেসময়ে কবার তাকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছি আমরা। নিজেও ক্যাথি তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গেছে আমেরিকায়।

তাঁর বাড়ি জর্জিয়াতে?

হ্যাঁ। জর্জিয়ার স্যাভানায়। কেন, রানা, কী হয়েছে? আরও দ্বিধান্বিত হয়ে উঠছেন প্রফেসর। ভয়ঙ্কর কোনও ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের মেয়ের?

স্টিভ বার্কলে নামের কাউকে চেনেন?

না।

অথবা বাড নামের কেউ?

 না।

শেষ প্রশ্ন, বলল রানা। কখনও কি কোনও ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে কিছু বলেছিল ক্যাথি?

চুপ করে কী যেন ভাবছেন প্রফেসর। একটু পর বললেন, কী বললে?  

এমন কোনও ভবিষ্যদ্বাণী, যেটার জন্যে বিশাল বড়লোক হবে ক্যাথি?

না, এসব কিছুই জানি না। রেগে যাচ্ছেন হার্বার্ট। আমরা জানতে চেয়েছি, কী হয়েছে আমাদের মেয়ের। ফোন দেব এথেন্সে ব্রিটিশ কলেটে। পুলিশকেও জানাব। হয়তো কিডন্যাপ হয়েছে ক্যাথি। অথচ, পাগলের মত তুমি বলছ কোথাকার কোন ভবিষ্যদ্বাণীর কথা।

মনে হতে পারে উন্মাদের মত কথা বলছি, কিন্তু যথেষ্ট কারণ আছে বলেই জিজ্ঞেস করেছি, বলল রানা। সত্যিই যদি কিডন্যাপ হয়ে থাকে ক্যাথি, আপনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আরও বড় বিপদে পড়বে ও।

তা হলে এখন কী করব? প্রফেসরের কণ্ঠ থেকে রাগ মিলিয়ে গিয়ে সেখানে এখন ভয় ও হতাশা।

চুপচাপ অপেক্ষা করুন। খুঁজতে শুরু করব চারপাশে। আসলে কী ঘটছে সেটা বুঝলে আমার কাছ থেকে জানতে পারবেন।

যদি মুক্তিপণ চায়? আমাদের টাকা নেই যে খরচ করব। টাকা দিতে পারব না বুঝলে হয়তো খুন করবে ওকে।

রানার ধারণা, ক্যাথির জন্যে মুক্তিপণ চাইবে না কেউ। সেজন্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন এগোতে হবে এক পা এক পা করে। দয়া করে ধৈর্য ধরুন। আপনারা কিন্তু বলেছেন, দ্বিধা না করেই বিশ্বাস রাখতে পারেন আমার ওপর।

দুর্বল স্বরে বললেন প্রফেসর, হ্যাঁ। সত্যিই তোমাকে বিশ্বাস করি আমরা।

ধরে নিন, সাধ্যমত করব। কল কেটে দিল রানা। বুক চিরে এল দীর্ঘশ্বাস। ভাল লাগছে না কিছুই। শুকিয়ে গেছে। মুখের ভেতরটা। খুঁজে নিয়ে ঢুকল কাছের বার-এ। নিল নির্জলা উইস্কি। বারের পরিবেশটা হতাশায় ভরা। বোমা বিষয়ক খবর প্রচার করছে টিভিতে। মন দিয়ে দেখছে খদ্দেররা। আধঘণ্টা ওখানে থাকল রানা, তারপর বেরিয়ে এল। ঘুরে বেড়াল স্কয়্যারে। টুরিস্টদের জন্যে কাবাবের দোকান থেকে এক-শিক কাবাব কিনে খেল। সরে গেল স্কয়্যারের পশ্চিমে। উঠল ছাউনি দেয়া ফুটপাথে। হাঁটতে হাঁটতে দেখছে পাশের দোকানের কাঁচের জানালা দিয়ে ভেতরের শো-কেস। কিছুক্ষণ পর থামল আরেকটা বার-এর সামনে। বসল বাইরের টেরেসে। নিল ঠাণ্ডা কয়েকটা বিয়ার, সঙ্গে এক বাউল জলপাই।

ওখান থেকে সরে কয়েক ঘণ্টা ঘুরে বেড়াল ভবঘুরের মত। বারবার মনে আসছে মউরোস আর ক্যাথির কথা। শেষ বিকেলে দিগন্তে সূর্য ঢলে পড়লে ব্যস্ত এক ট্যাক্সি র্যাংক থেকে নিল ক্যাব। ঠিকানা জানাতেই সৈকতের সড়ক ধরে ছুটল ড্রাইভার।

পনেরো মিনিট পর ট্যাক্সি ছেড়ে সামান্য হাঁটতেই পৌঁছে গেল প্যাসিফিকো কোলিয়াসের বিচ হাউসে।

জায়গাটা কোর্ফিউ টাউন থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে। চমৎকার করে গুছিয়ে রাখা ছোটখাটো বাড়ি। দেয়াল সাদা রঙ করা। মেঝে টাইলের, শীতল। কোলিয়াস দম্পতির অনুরোধ, যেন এই বাড়িতে ওঠে ও। ডাইনিং রুমের টেবিলে স্ফটিকের কারুকাজ করা ফুলদানীতে এক গুচ্ছ তাজা গোলাপ। ফ্রিযে আধ ডযন বরফের মত ঠাণ্ডা স্থানীয় হোয়াইট ওয়াইন ও মরিচ দিয়ে রান্না করা মাংস, সজি ও পাহাড়ের মত উঁচু করে রাখা বাউলে সবুজ জলপাই ও নানান ফল।

বরফ-ঠাণ্ডা এক ওয়াইনের বোতলের কর্ক খুলে সৈকতে বেরিয়ে এল রানা। বাতাসে ভেসে এল দূর থেকে বাজনা। ওদিকে তিন শ গজ দূরে সাদা বালির মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ট্যাভার্না। ছাত ক্যানভাসের। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রানা, তারপর রওনা হলো ট্যাভার্নার দিকে।

ওখানে পৌঁছুবার আগেই শেষ হলো হাতের ওয়াইনের বোতল। ছাউনির ভেতরে ঢুকে বারটেণ্ডারকে ওটা দেখাল রানা। আরেক বোতল দিন।

মাথা দুলিয়ে কাউন্টারের পেছনের তাক থেকে ওয়াইনের বোতল নিল লোকটা। কাউন্টারের সামনের স্টুলে বসল রানা। বোতলটা রেখে অন্যদিকে গেল বারটেণ্ডার। ছিপি খুলে এক ঢোক ওয়াইন গিলে সাগরের দিকে তাকাল রানা। দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে সোনালি বলের মত সূর্য। পানির বুকে ছড়িয়ে পড়েছে লালচে ঝিলিক।

আশপাশের টেবিল ঘিরে ড্রিঙ্ক করছে মাত্র কয়েকজন। নিচু গলায় চলছে আলাপ। হাসছে কেউ কেউ। গতকাল সকালের ভয়াবহ বিস্ফোরণের আতঙ্ক ভুলতে চাইছে সবাই, তবুও দুএকজনের চেহারায় দুশ্চিন্তা। গিটার ও বাউযুকি ব্যবহার করে স্থানীয় নাচের দ্রুত সুর তুলেছে চারজনের ব্যাণ্ড। ড্যান্স ফ্লোরে নাচছে মাত্র চার দম্পতি।

একটু দূরের টেবিলে বসেছে সুন্দরী দুই মেয়ে। তাদের একজন বারবার দেখছে রানাকে। ফিসফিস করে কী যেন বলছে বান্ধবীর কানে। একইসময়ে রানার দিকে চেয়ে হাসল তারা।

ওদের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে সূর্যাস্ত দেখল বিষণ্ণ রানা।

কয়েক মিনিট পর ট্যাভার্নায় ঢুকল এক যুবতী। বার কাউন্টারে রানা ছাড়া আর কেউ নেই দেখে এসে বসল ওর পাশে। বামদিকের স্টলে রাখল হাতব্যাগ। খুবই সুন্দরী মেয়েটা। বয়স পঁচিশ বা বড়জোর ছাব্বিশ। পরনে লো কাট ঘিয়ে রঙের পোশাক। তার সেরা সম্পদ বোধহয় মেঘের মত কালো, কোঁকড়ানো কোমর ছাওয়া চুল। বারটেণ্ডারের উদ্দেশে ইংরেজিতে অর্ডার দিল সে। কথায় কড়া স্প্যানিশ টান। অর্ডার পেয়ে এক বোতল মিনারেল ওঅটার দিল বারটেণ্ডার। এক চুমুক পানি খেয়ে ভাবনায় তলিয়ে গেল মেয়েটা। কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখল রানা, তারপর আবারও তাকাল সূর্যাস্তের মন-খারাপ-করে-দেয়া দৃশ্যে। ফুরিয়ে গেল জীবন থেকে আরও একটা দিন।

কাছেই বেজে উঠল কারও মোবাইল ফোন। ব্যাগ থেকে যন্ত্রটা বের করে স্প্যানিশ ভাষায় জবাব দিল মেয়েটা। ওই ভাষা অজানা নয় রানার। আযমেরি নামের কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে এই মেয়েটা। না, ভাল নেই সে। যখন তখন বোমা ফাটছে, তাই আর থাকবে না এ দেশে। আগামীকাল প্রথম ফ্লাইটে ফিরবে মাদ্রিদে।

ফোন কল কেটে দিল মেয়েটা। দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গিতে তাকাল রানার দিকে।

দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই,সান্ত্বনার সুরে বলল রানা।

মিষ্টি হাসল কেশবতী। আপনি কি ইংরেজ? আপনার উচ্চারণ তো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির।

ইংরেজ নই, তবে ওখানেই লেখাপড়া করেছি।

টুরিস্ট?

ঠিক তা বলা যায় না।

দারুণ মধুর হাসল মেয়েটা।

আপনি এসেছেন স্পেন থেকে? জানতে চাইল রানা।

মাথা দোলাল কেশবতী। সবার সামনে জোরে কথা বলাকে কখনও ভাল বলে মনে হয়নি আমার। সরি, তা-ই করে বসেছি। ফোন করেছিল আমার বোন। খারাপ কিছু হয়ে গেল কি না, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল।

স্বর্গের মত কোর্ফিউ দ্বীপে এসেও ভাল লাগছে না আপনার? একটু অবাক হয়েছে রানা।

জবাব না দিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেলল সুন্দরী। আমি স্পেন থেকে এসেছি বুঝলেন কী করে? আপনি স্প্যানিশ জানেন?  

এক-আধটু জানি, হাসল রানা। আমার সঙ্গে চলবে দুটো ড্রিঙ্ক?  মিষ্টি হাসল যুবতী। এরই ভেতর ড্রিঙ্ক নিয়েছি। আজ আর নয়। থ্যাঙ্ক ইউ।

পানির বোতল দেখাল রানা। ওটা তো সোমরস নয়। আমার খাতিরে না হয় নিন একটু ওয়াইন?

মৃদু মাথা দোলাল স্প্যানিশ সুন্দরী। বারটেণ্ডারকে রানা বলতেই সে বার-কাউন্টারে রাখল আরেকটা ওয়াইনের গ্লাস। রানার পাশের স্টুল থেকে হাতব্যাগ তুলে ওখানে বসল রূপবতী। পায়ের কাছে মেঝেতে রাখল হাতব্যাগ। হাত বাড়িয়ে দিল হ্যাণ্ডশেকের জন্যে। আমার নাম এমিলিয়া।

সুন্দরীর হাতটা নরম ও পেলব। করমর্দন করে বলল রানা, আমার নাম মাসুদ রানা। দূরের কোণের টেবিল দেখাল। ওখান থেকে ভাল দেখা যায় সাগর। আপনার আপত্তি না থাকলে, চলুন, ওই টেবিলে গিয়ে বসি?

মৃদু মাথা দোলাল মেয়েটি।

ভুলে যাবেন না আপনার ব্যাগ, ওটা তুলে সুন্দরীর হাতে ধরিয়ে দিল রানা।

গ্লাস ও ওয়াইনের বোতল নিয়ে কোণের টেবিলের দিকে চলল ওরা। যাওয়ার পথে একটা চেয়ারে হোঁচট খেল রানা। হাতের গ্লাস থেকে ছলকে পড়ল ওয়াইন। মাথা নাড়ল মৃদু। সরি! অনেক বেশি গিলে ফেলেছি।

টেবিলে মুখোমুখি বসল, ওরা, ধীরে ধীরে জমে উঠছে গল্প। কিছুক্ষণ পর আকাশে উঠল অজস্র তারা ও মস্ত এক চাঁদ সম্ভবত সুপার মুন। রুপালি আলোয় ঝলমল করতে লাগল সাগর।

আপনি সত্যিই কোর্ফিউ ছেড়ে যেতে চান? বলল রানা, এই দ্বীপ কিন্তু সত্যিই স্বর্গ।

বোমা ফাটছে, তাই ভয় পেয়েছি, স্বীকার করল এমিলিয়া, কী ভয়ঙ্কর! খুন হয়ে গেল নিরীহ এতগুলো মানুষ!

মাথা দোলাল রানা। চুপ করে আছে।

অন্যান্য সমস্যাও আছে, বলল এমিলিয়া।

যেমন? আগ্রহ প্রকাশ করল রানা।

সত্যিই কি জানতে চান? তা হলে শুনুন, আমার প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে জুটে গেছে আমারই প্রেমিক। আমার বোন। তাই ভেবেছিল, আমি এখানে এলে শক্ত করতে পারব মন। কিন্তু খুনোখুনি দেখে এখন আর জায়গাটা নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না। দুর্বল হাসল সুন্দরী। রানার চোখে চোখ রেখেও নামিয়ে নিল দৃষ্টি।

ভাবতে পারছি না, আপনার মত রূপসীকে ফেলে অন্য কারও পেছনে যেতে পারে কেউ, মেয়েটার বাহুতে দুআঙুলে মৃদু তবলা বাজাল রানা।

ফ্যাকাসে হয়ে গেল স্প্যানিশ সুন্দরী। আপনি নিজেও তো খুব হ্যাণ্ডসাম। আপনিই বা কী করছেন এখানে? ছুটি না ব্যবসা?

ছুটিই বলতে পারেন, গলা পর্যন্ত মদ গিলছি। বোতলের তলানির তরল নিজের গ্লাসে ঢেলে নিল রানা। ধীর গতির ঐতিহ্যবাহী চমৎকার এক গ্রিক গানের সুর বাজাচ্ছে ব্যাণ্ড। গলা মিলিয়েছে তরুণী এক ভোকালিস্ট।

জীবিকার জন্যে কী ধরনের কাজ করেন, রানা? জানতে চাইল এমিলিয়া।

বলার মত তেমন কোনও কাজই করি না।

 আপনার ঘাড়ে কী হয়েছে?

আপনি কিন্তু অনেক প্রশ্ন তোলেন।

হাসল এমিলিয়া। জানতে চাইছি, কারণ আপনাকে ভাল লেগেছে।

মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল রানা। আপত্তি না  থাকলে নাচবেন আমার সঙ্গে?

আপত্তি নেই, রানা। লাজুক হাসল সুন্দরী।

ছোট্ট ড্যান্স ফ্লোরে চলে এল ওরা। একবার কোণের টেবিলের পাশে রাখা হাতব্যাগটা দেখল এমিলিয়া! চুরি হবে না তো?

না, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, ভরসা দিল রানা।

ধীর লয়ে বাজছে মিউযিক। রানা ও এমিলিয়া যেন হারিয়ে গেল নিজেদের গোপন এক জগতে। এক হয়ে মিশে যেতে চাইছে বঞ্চিত দুটো উষ্ণ দেহ। চকচক করছে এমিলিয়ার দুই চোখ। দৃষ্টিতে অমোঘ এক বুনো আহ্বান। কিছুক্ষণ নাচার পর মেয়েটাকে দুহাতে কাছে টানল রানা।

স্প্যানিশ সুন্দরীর পুরুষ্ট ভেজা ঠোঁটে নামল বাঙালি যুবকের নিষ্ঠুর ঠোঁট। একবার শিউরে উঠে আত্মসমর্পণ করল এমিলিয়া। সাড়া দিল ওর জিভ।

দীর্ঘ চুম্বনের পর নিচু স্বরে বলল রানা, সৈকতে একটা বাড়িতে উঠেছি, কাছেই। ওখানে একাকী সময় কাটাতে পারব।

মুখ তুলে রানাকে দেখল এমিলিয়া। আগের চেয়ে দ্রুত হয়েছে ওর শ্বাস-প্রশ্বাস। চোখ নামিয়ে নিল। আস্তে করে মৃদু মাথা দোলাল। তা হলে চলো।

বিল মিটিয়ে এমিলিয়াকে নিয়ে ট্যাভার্না থেকে বেরিয়ে এল রানা। চাঁদের আলোয় হাসছে রুপালি বালি। ফিসফিস করছে সাগরের ঢেউ। পেছনে পড়ল প্রেমের মায়াবী সুর।

উঁচু হিলের স্যাণ্ডেল খুলে খালি পায়ে রানার পাশে চলেছে এমিলিয়া। ঝিক করে উঠল পায়ের সুন্দর নখের লাল নেইল পলিশ। হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে সুন্দরী মেয়েটার ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরল রানা। ছেড়েও দিল। বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। এমিলিয়া। হাঁটার গতি বাড়ল ওর। তাল রাখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলে পড়েই যেত রানা। থমকে গিয়ে খিলখিল করে হাসল স্প্যানিশ রূপসী। কাছে এসে শক্ত করে ধরল রানার হাত। পড়ে যেয়ো না যেন। মাতাল হয়ে গেলে?

হাসল রানা। একটু বেসুরো সুরে বলল, একদম ঠিক। সারাদিন ধরেই মদ গিলছি।

পাশাপাশি হাঁটছে ওরা।

একটু পর পৌঁছুল কোলিয়াসদের বাড়িতে। দরজার তালা খুলতে গিয়ে রানার হাত থেকে বালিতে পড়ল চাবি। অন্ধের মত এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল রানা। বিড়বিড় করে গালি দিল কাকে যেন। আরও কয়েক সেকেণ্ড পর চাবি পেয়ে বলল, পেয়েছি শালাকে!

হেসে হ্যাণ্ডেলে মোচড় দিল এমিলিয়া। এমনিতেই তো খোলা! ঠেলা দিতেই হাট হয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল স্প্যানিশ সুন্দরী। পিছু নিল রানা। এক হাতে আবারও জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। বামহাতে বাটন টিপে জ্বেলে নিল বাতি। থমকে গেছে রানা। এমিলিয়া এক পা এগোতেই তার ঘাড়ে নামল ওর কারাতে কোপ। টুঁ শব্দ না করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা।

অচেতন করতে চেয়েছে রানা, খুন করতে নয়। চট করে বসে পড়ল মেয়েটার পাশে। হ্যাণ্ডব্যাগটা নিয়ে ভেতরে হাত ভরতেই স্পর্শ পেল শীতল ইস্পাতের। পিস্তলটা বের করে নিল রানা। ট্যাভার্নায় ব্যাগের ওজন আর ভেতরের জিনিসের আকৃতি দেখে আগেই ভেবেছে, এমনই কিছু থাকবে মেয়েটার কাছে। বেরেটা নাইন্টিটু এফ সেমি-অটোমেটিক। ভাল অস্ত্র। নাইন এমএম কক ও লক করা। সেফটি অফ করল রানা। সরে গেল কয়েক ফুট দূরে।

ওই একইসময়ে ঝটকা দিয়ে খুলল কিচেনের দরজা। এমনই হবে, ভেবেছে রানা। ওর মুঠির ভেতর পর পর দুবার লাফিয়ে উঠল বেরেটা।

সরাসরি গুলির গতিপথে এসেছে লোকটা। দুই গুলি বুকে  নিয়ে ছিটকে পেছনের মেঝেতে গিয়ে পড়ল সে। হাত থেকে খসে মেঝেতে পিছলে গেল পিস্তলটা। চুপচাপ শুয়ে থাকল আততায়ী। থুতনি বুকের কাছে। রক্তে ভেসে গেছে দুই ঠোঁট।

গুলির বিকট আওয়াজে ঝনঝন করছে রানার কান। দেরি না করে সামনের দরজায় গিয়ে দেখে নিল চারপাশ। সৈকত এখনও নির্জন। বাড়ির দেয়াল কমিয়ে দিয়েছে গুলির শব্দ, নইলে টের পেত তিন শ গজ দূরের ট্যাভার্নার লোকজন।

জ্ঞান ফিরছে সুন্দরী মেয়েটার। একহাতে ঘাড় চেপে ধরে গুঙিয়ে উঠল। তাকে টপকে অনাহুত আগন্তুকের পিস্তল তুলে নিল রানা। একই মডেলের, নাইন এমএম বেরেটা। তবে এটার ব্যারেলে পরানো আছে সাইলেন্সার। বামহাতে স্লাইড পিছিয়ে নিল রানা। ব্রিচে চকচকে তামার কান্ট্রিজ। মৃত আগন্তুককে দেখল রানা। খুব স্টাইল করে কাটা সোনালি চুল। সুদর্শন। রানার মনে পড়ল, থ্যানাটস বলেছিল, ক্যাথির বিদায়-পার্টিতে গিয়েছিল এক যুবক এবং তার সঙ্গিনী। ওই মেয়েটা দেখতে ছিল গ্রিক দেবীর মতই রূপসী।

সাপ্রেসার খুলে অস্ত্রটা বেল্টে জল রানা। অন্য পিস্তলটা তাক করল মেয়েটার মাথা লক্ষ্য করে। কাছাকাছি রেঞ্জে ওটা ভয়ঙ্কর। উঠে বসো, নির্দেশ দিল রানা।

কেশে উঠে হাঁটু ও কনুইয়ে ভর করে উঠে বসল মেয়েটা। কপাল থেকে সরিয়ে দিল কালো চুল। এখন কালো চোখে তীব্র রাগ ও ঘৃণা।

আগেই শহরে দেখেছি, বলল রানা, প্রথম দেখি স্যান রোক্কো স্কয়্যারে। পরে দোকানের কাঁচে। পিছু নিতেই জেনেছি, তুমি আমার লেজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেছনে নিয়ে ঘুরেছি। যদিও ইচ্ছে করলে হাওয়া হয়ে যেতে পারতাম।

মার খাওয়া বাঘিনীর মত গুটিসুটি মেরে বসল মেয়েটা। উত্তেজিত। একহাত সামনের মেঝেতে। চেপে বসেছে ঠোঁটে ঠোঁট। কঠোর চোখে দেখছে বাঙালি গুপ্তচরকে। কপাল থেকে আবারও সরিয়ে দিল-এক গোছা চুল। রানা দেখল, মেয়েটার কপালের এক পাশে দপদপ করে কাঁপছে রগ।

পিছু নাওনি, আসলে আমিই ডেকে এনেছি, বলল রানা, ব্যস্ত ট্যাক্সি র‍্যাংক থেকে ক্যাব নিয়েছি, যাতে অনুসরণ করতে পারো। পরের ট্যাক্সিতে লাফিয়ে উঠেছ। কোথাও না গিয়ে সরাসরি এলাম, যাতে পথ না হারাও। মাতালের অভিনয় করেছি, যাতে নিশ্চিন্ত থাক। নইলে সহজে পা রাখতে না ফাঁদে।

ফাঁকা চোখে রানাকে দেখছে কৃষ্ণকেশী।

দুজনের মাঝের দূরত্ব মাপছে, বুঝল রানা। ঝুঁকি কতটা, সেটা নিয়ে ভাবছে। ভালই ট্রেনিং পেয়েছে। কাজে যথেষ্ট ভাল তুমি, বলল রানা, বোন আর প্রেমিকের গল্প ফাঁদলে, কিন্তু উচিত ছিল আরও সতর্ক হওয়া। এবার মুখটা খোলো, এমিলিয়া। যদিও মনে করি না ওটা তোমার আসল নাম। আমাকে বাধ্য কোরো না গুলি করতে।

চুপ করে থাকল মেয়েটা।

ক্যাথি হার্বার্ট এখন কোথায়?

জবাব দিল না সুন্দরী।

কে বোমা ফাটাল ওই ক্যাফেতে? জানতে চাইল রানা। ওটা কি ফাটানো হয়েছিল মউরোসকে মেরে ফেলতে?

আমার কিছুই জানা নেই। তুমি এসব কী বলছ!

মেঝেতে গুলি করল রানা। চিৎকার করে হাত সরিয়ে নিল মেয়েটা। ওর আঙুলের এক ইঞ্চি দূরে লেগেছে বুলেট।

তোমার রিফ্লেক্স ভাল, বলল রানা। গুলি করেছি দুই আঙুলের মাঝে। তবে পরেরবার উড়িয়ে দেব একটা আঙুল। মুখ খোলো। ক্যাথি হার্বার্ট। ওই মেয়ে এখন কোথায়?

চলে গেছে, প্রায় ফিসফিস করে বলল সুন্দরী।

এই তো মুখে বোল ফুটেছে। গুড। কোথায় গেছে ওই মেয়ে?

দ্বিধায় পড়ল যুবতী।

কোন্ আঙুল হারাতে চাও? জানতে চাইল রানা। যেটা কম ব্যবহার করো? হাত তোল, নইলে অন্য কোথাও গুলি লাগবে।

ওই মেয়ে এখন আর গ্রিসে নেই।

 তা হলে কোথায় গেছে?

তুমি তো এমনিতেই আমাকে খুন করবে, রাগী চোখে রানাকে দেখল যুবতী। তা হলে তোমাকে কিছু বলব কেন?

আমি তোমাদের মত নই, বলল গম্ভীর রানা। ভাল করেই জানি, আজ রাতে কী করতে যাচ্ছিলে তোমরা। তোমাদের দরকার কিছু তথ্য। জেনে নিয়ে খুন করতে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথার খুনি নই আমি। যদি বলো ক্যাথি হার্বার্ট কোথায়, এবং কী হচ্ছে, মরবে না। এমন কোথাও সরিয়ে দেব, যেখানে তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না কেউ। একবার ক্যাথিকে পেলে, তখন হয়তো ছেড়ে দেব তোমাকে। কী করবে স্থির করো। একটা কথা মাথায় গেঁথে নাও, মুখ না খুললে একটু পর সত্যিই মরবে। দ্বিধা করব না শেষ করে দিতে। …তোমার আঙুল নিয়ে খেলতে ভাল লাগছে না। মেয়েটার কপালে পিস্তল তাক করল রানা।

কে আসলে তুমি? কাঁপা গলায় জানতে চাইল যুবতী। এখন আর স্প্যানিশ টান নেই। সেখানে আমেরিকান সুর।

কেউ নই। শেষ সুযোগ দিচ্ছি। ক্যাথি হার্বার্ট কোথায়?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আমেরিকান যুবতী। পাঁচ দিন আগে, ওকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইউএসএ-তে।

গুড। মার্কিন মুলুকের কোথায় নিয়েছে? কারা কিডন্যাপ করেছে ওকে?

আমি সবকিছু জানি না, বলল মেয়েটা, আমাকে যা করতে বলা হয়েছে, শুধু সেটাই করেছি।

নির্দেশ দেয় কারা? তাদের নাম জানাও।

একটা নামও জানি না।

 তোমার নিজের নাম কী?

ক্রিস্টিনা পার্কার।

মনোযোগ দিয়ে তার চোখ দেখল রানা। মিথ্যা বলছে না মেয়েটা। মৃত সোনালি চুলের লোকটাকে দেখাল। ওর নাম কী?

বয়েটার ব্ল্যাকউড।

কী কারণে এসেছিলে, ক্রিস্টিনা? বোমা সেট করে কে?

হঠাৎ ঘর ভরে গেল বিকট আওয়াজে। কানের পাশ দিয়ে সই করে গেছে বুলেট, টের পেল রানা। ঝনঝন করে ভাঙল দেয়ালের একটা বাতি। ঘুরে বসেই পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। মুঠোয় লাফিয়ে উঠেছে বেরেটা। কনুইয়ে ভর করে আধ শোয়া হয়ে গুলি করেছে বয়েটার ব্ল্যাকউড। হাতে ছোট্ট রিভলভার। আবারও গুলি করল সে। দ্বিতীয় গুলি গেল রানার শার্টের কাফের মাঝ দিয়ে।

একইসময়ে পাল্টা জবাব দিয়েছে রানা। লোকটার চোখ গলিয়ে দিয়ে মগজে ঢুকেছে গুলি। ঠাস্ করে মেঝেতে পড়ল মৃত লোকটার মাথা। পেছনের দেয়ালে ছিটকে লাগল রক্ত।

আবারও নীরবতা।

 উঠে দাঁড়াল রানা, গুলি লাগেনি ওর।

এবার সত্যিই খতম হয়েছে ওই লোক।

লাথি মেরে নাকবোঁচা ম্যাগনাম .৩৫৭ রিভলভার দূরে পাঠাল রানা। পেছনে শুনল সামান্য ফুঁপিয়ে ওঠার আওয়াজ। ঝট করে ঘুরল রানা, মেঝেতে বসে আছে ক্রিস্টিনা পার্কার। অবাক চোখে দেখছে, ঘি রঙা ড্রেসের গর্ত থেকে ছড়িয়ে পড়ছে লাল রঙ। বয়েটারের লক্ষ্যহীন বুলেট ফুটো করে দিয়েছে তার পাকস্থলি। তারপর গিয়ে ঢুকেছে কোনও ভাইটাল অর্গানে।  

পোশাক ছিঁড়তে চাইছে মেয়েটা। তীব্র ব্যথায় মস্ত হাঁ মেলল। বুজল মুখ। চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। মুহূর্তে চলে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

.

১৯.

 জীবিত মানুষকে খুন করা সহজ, কিন্তু সেই লাশ গায়েব করা বড়ই কঠিন। কপাল ভাল রানার, টাইলে জমে থাকা রক্তের পুকুর পেরিয়ে কিচেনে পেয়েছে হেভি-ডিউটি কিছু প্লাস্টিক গার্বেজ ব্যাগ। অমন দুটো এনে বিছিয়ে দিল দরজার কাছের প্যাসেজে।

ফিরে এসে দুই কবজি ধরে টেনে নিয়ে চলল ক্রিস্টিনা পার্কারকে। পেণ্ডুলামের মত দুলছে মেয়েটার মাথা। ঘোলা চোখদুটো খোলা। রক্ত মাখা দীর্ঘ চুল বিশ্রী দাগ তৈরি করছে। টাইলে। লাশটা রাখল রানা একটা গার্বেজ ব্যাগের ওপর। ফিরে গিয়ে থামল বয়েটারের লাশের পাশে। উবু হয়ে ধরল দুই গোড়ালি। এই লাশ ভারী। বেশি রক্তাক্ত। নাইন এমএম বুলেটের আঘাতে চুরমার হয়েছে ডান অক্ষিকোটর ও চোয়াল। ক্রিস্টিনার লাশের পাশের ব্যাগে ভারী লাশ রাখল রানা।

সতর্কতার সঙ্গে সার্চ করল দুই লাশ। কোনও কাগজপত্র বা ব্যক্তিগত কিছুই পেল না। বয়েটারের পেছনের পকেটে মোবাইল ফোন। ক্রিস্টিনার হাতব্যাগ থেকেও পেল একই জিনিস। মেয়েটার ফোনের শেষ কল দেখে ডায়াল করল রানা। ওর অন্যহাতে থরথর করে কাঁপল বয়েটারের ফোন।

ওই দুটো ফোনের কল রেকর্ড ঘাটল রানা। শুধু নিজেদের ভেতর কল করেছে এরা।

লাশদুটো প্যাসেজে রেখে বাড়ি পরিষ্কারের অভিযানে নামল রানা। দেয়ালের ল্যাম্প ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁচের টুকরো। সব ঝাড় মেরে জড় করে, ডাস্টপ্যানে কাঁচ তুলে ফেলল বিনের ভেতর। কিচেনের এক কাবার্ডে পেল মপ, বালতি ও ব্লিচ। ঠাণ্ডা পানিতে বালতি ভরে নিয়ে এল বাইরের ঘরে। আঁশটে গন্ধে ভরে আছে ঘর। রক্ত মুছে ফেলার কাজটা শেষ হলে কিচেন থেকে নিল ধারালো ছুরি। ওটা দিয়ে কাঠের চৌকাঠের গভীর থেকে খুঁচিয়ে বের করল চ্যাপ্টা নাইন এমএম বুলেট। প্যান্টের পকেটে রাখল ওটা। দরজার চৌকাঠের বারোটা বেজে গেছে দেখে কুঁচকে ফেলল ভুরু।

 বাড়ি পরিষ্কারের কাজ করতে করতে গভীরভাবে ভাবছে রানা। আগেও দেখেছে ক্রিস্টিনা বা বয়েটারের চেয়েও দক্ষ সার্ভেল্যান্স টিম। কাজে খারাপ ছিল না এরা। দুই বেরেটা একই মডেলের। যত্ন করে রাদা মেরে তুলেছে সিরিয়াল নম্বর। বোঝা যায়, এরা পেশাদার। ওর ভুল না হলে, অ্যাবেলিনো থ্যানাটসকে শেষ করতে পাঠানো হয়েছিল এই দুজনকেই। সত্যিই ওই ব্যবসায়ী ড্রাগের সঙ্গে জড়িত হলে, কখনোই চাইত না খোঁজা হোক ক্যাথিকে; ভুলেও যোগাযোগ করত না মউরোসের সঙ্গে। লোকটাকে খুন করে তার বাড়িতে ড্রাগ রেখেছে এরা। পুলিশ নতুন করে আর কিছুই ভাববে না। ক্যাফেতে বোমা ফাটিয়ে খুন করেছে মউরোসকে, কারণ থ্যাটসের সঙ্গে আলাপ করেছিল ও। এদের পরের পদক্ষেপ সহজ। মউরোসের সঙ্গে রানাকে দেখা গেছে, তাই খুন করতে এসেছে ওকে।

মিলে যাচ্ছে চিত্রের এসব টুকরো। কিন্তু কী কারণে ক্যাথি হার্বার্ট এসবে জড়িয়ে গেল, তা বের করা যাচ্ছে না।  চাওয়া হয়নি মুক্তিপণ। কোনও কারণ নেই কিডন্যাপ করবে তাকে। ক্যাথির বাবা-মার এত টাকা নেই যে তাঁদের মেয়েকে জিম্মি করে কোটি ডলার চাইবে কেউ। প্রফেসর জন হার্বার্ট রাজনৈতিক নেতা হলে ধরে নেয়া যেত, জরুরি কোনও তথ্যের জন্যে কিডন্যাপ করা হয়েছে তাঁর মেয়েকে। কিন্তু ঘটনা তেমন নয়। নিরীহ এক থিয়োলজির প্রফেসর। কারও সাতে-পাঁচে নেই। তা হলে?

অস্বাভাবিক কোনও কারণে চরম ব্যবস্থা নিয়েছে কেউ। সেটা করতে হয়েছে ক্যাথির কারণেই। কিন্তু, কী করেছিল ওই মেয়ে? যেভাবেই হোক, ক্যাথির হাতে এসেছে হাজার হাজার ডলার। কোথা থেকে পেল অত টাকা? আশা করছিল, পাবে আরও। বোধহয় ব্ল্যাকমেইল করছিল কাউকে। যাকে ভাঙিয়ে খেতে শুরু করেছিল, তার আছে টাকা আর ক্ষমতা। বাধ্য হয়ে ধরে নিয়ে গেছে ক্যাথিকে। তার মানে, যে জিনিস বা তথ্য দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছিল মেয়েটা, ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আরেকটা প্রশ্ন জাগে মনে: কী কারণে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় নেয়া হলো ক্যাথিকে? সহজেই ওর মগজে গেঁথে দিতে পারত বুলেট। ভেবে-চিন্তে মাত্র একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুল রানা। ক্যাথির কাছে এমন কিছু আছে, যেটা খুব জরুরি ক্ষমতাশালী একদল লোকের কাছে। ওটা না পাওয়া পর্যন্ত বাধ্য হয়েই প্রাণে বাঁচিয়ে রাখছে মেয়েটাকে।

সেক্ষেত্রে আরও কথা আসে।

নরম মনের মানুষ ছিল না ক্রিস্টিনা বা বয়েটার। প্রয়োজনে খুন করতেও দ্বিধা করত না। ক্যাথিও এমন কোনও মেয়ে নয়, যে সৈনিকের ট্রেনিং পেয়েছে ইন্টারোগেশন এড়াবার। ওর পেট থেকে সব বের করবে ভাবলে, আততায়ীরা তা পারত মাত্র কয়েক মিনিটে। সাধারণ মানুষকে ছোরা বা পিস্তলের ভয় দেখানোই যথেষ্ট। প্রাণের ভয়ে সব বলে দিত গড়গড় করে।

সব জেনে নিয়ে সহজেই খুন করতে পারত এরা।

পুরো বারো দিন পেরিয়ে গেছে, পাওয়া যায়নি ক্যাথিকে।

কে জানে, সত্যিই হয়তো খুন হয়েছে মেয়েটা।

 রাত সাড়ে তিনটায় বন্ধ হলো সৈকতের ট্যাভার্না। শেষ খদ্দেরও রওনা হলো বাড়ির পথে। থেমে গেছে সব বাজনা, নিভিয়ে দেয়া হলো সব বাতি। চারপাশে থাকল শুধু স্তব্ধ চাঁদের আলো।

আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করল রানা। বালির সৈকত পড়ে থাকল নির্জন। জিন্স প্যান্টে দুই বেরেটা ও রিভলভার রেখে সদর দরজা খুলল রানা। বালির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে চলল বয়েটারের ভারী লাশ। গভীর দাগ তৈরি করছে ব্যাগ। হেঁচড়ে নিতে গিয়ে টান পড়ছে রানার ঘাড়ের সেলাইয়ে। ফুলে উঠছে বাহু ও কাঁধের পেশি। জমছে ল্যাকটিক অ্যাসিড। এক শ গজ গিয়ে পছন্দমত জায়গা পেল রানা। দুটো বালির ঢিবির মাঝে রাখল লাশ। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত। ধীর পায়ে রওনা হলো ফিরতি পথে।

বাড়িতে এসে ক্রিস্টিনার লাশ নিয়ে ফিরতে লাগল বালির টিবির দিকে। না-সূচকভাবে এদিক-ওদিক দুলছে লাশের মাথা। ঘোলা চোখ যেন দোষারোপ করছে রানাকে। রানা ভাবছে, ভাগ্যিস ওর গুলিতে খুন হয়নি মেয়েটা।

জ্যোৎস্নার রুপালি আলোয় দুই লাশ পাশাপাশি রাখল রানা। খুঁড়তে লাগল একদিকের বালির ঢিবি। কিছুক্ষণ পর তৈরি হলো অগভীর কবর। এক এক করে ওই গর্তে দুই লাশ ফেলল রানা। প্রথমে ক্রিস্টিনা। ওর ওপরে থ্যাশব্দে পড়ল বয়েটার। রাতের নৈঃশব্দ্যে রানার মনে হলো, প্রচণ্ড আকর্ষণে মিলিত হলো দুই লাশ।

সাদা বালিতে গর্তটা বুজে দিল রানা। বাকি যা করার, করবে সাগরসৈকতের হাজার হাজার কাঁকড়া।

একটু খুঁজতেই পেল মৃত গুগলি ও শামুকে ভরা বাতিল এক পুরনো, ছোট নৌকা। ওটা টেনে এনে কবরের ওপর রাখল রানা। সরে গিয়ে থামল সাগরের তীরে। কোমর থেকে নিয়ে সাগরে ছুঁড়ে ফেলল তিন আগ্নেয়াস্ত্র। বাড়ি ফেরার পথে পায়ের ছাপ রয়ে গেল, কিন্তু সেসব মিলিয়ে যাবে রাতের হাওয়ায়।

বাড়ি ভালভাবে পরিষ্কার করতে না করতেই রাত পেরিয়ে এসে হাজির হলো ধূসর ভোর। দীর্ঘ শাওয়ার নিল রানা। আগেই সৈকতে পুড়িয়ে দিয়েছে রক্তাক্ত শার্ট ও প্যান্ট। বালিতে ছড়িয়ে দিয়েছে ছাই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগে ডাইনিং টেবিলে রাখল পাঁচ শ ইউরোর একটা নোট। ওটার ওপর রাখল ওর চিঠি। ওখানে লেখা: নষ্ট হয়েছে দেয়ালের ল্যাম্প ও দরজার চৌকাঠ, সেজন্যে সে সত্যিই দুঃখিত। কোলিয়াসের দারুণ ওয়াইন খেয়ে এতই মাতাল ছিল, কী করছে, সেদিকে হুঁশ ছিল না ওর।

সাগরের সুনীল বুকে সোনালি সূর্য উঁকি দিতেই বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। হেঁটে চলল শহরের দিকে। একটু পর পেল ট্যাক্সি। ওটাতে চেপে চলল এয়ারপোর্টে। ক্রিস্টিনার দলের তরফ থেকে হামলা আসতে পারে, তাই সতর্ক। তবে অনুসরণ করল না কেউ।

এয়ারপোর্টের লকার থেকে পাসপোর্ট ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে রিটার্ন টিকেট ব্যবহার করে উঠল এথেন্সের বিমানে। মাঝ দুপুরে আধখালি বিযনেস ক্লাসে বসে সেভেন-ফোর সেভেন বিমানে করে চলল আটলান্টা লক্ষ্য করে।

ওর জানা নেই, কী আছে সামনে, কী পাবে আমেরিকায়। তবে, এটুকু জানে, মউরোসের এই অকাল মৃত্যুর জন্যে কোথাও না কোথাও চরম মূল্য দেবে কেউ না কেউ।

.

২০.

তাপমাত্রা কোর্ফিউ দ্বীপের চেয়ে বেশি না হলেও দ্বিগুণ সঁতসেঁতে আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট। আটলান্টার হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন এয়ারপোর্টে বিমান থেকে নামতেই শার্টের পিঠ ভিজে উঠল রানার। ঠিক করে নিল হাতঘড়িতে ইউএস টাইম। আলাদা যোনের কারণে গ্রিস থেকে রওনা হয়েও আমেরিকায় পৌঁছে প্রায় একই ক্ষণে রয়ে গেছে।

মাথার ওপরে আগুন ঢালছে সূর্য। এয়ারপোর্টে রুপালি বড় এক ক্রাইসলার গাড়ি ভাড়া নিয়ে স্যাভানার দিকে চলল রানা। নামিয়ে নিয়েছে জানালার কাঁচ, হু-হু হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে কালো চুল।

ফুরিয়ে আসছে সোনালি দুপুর, এমনসময় স্যাভানা শহরে ঢুকল রানা। চওড়া সব রাস্তার পাশে ছবির মত সুন্দর সব কলোনিয়াল বাড়ি, দেখলে মনে হয় গৃহযুদ্ধের আমলের। উকিল হার্ভে সিম্পসনের অফিসের দিকে যেতে যেতে অফিশিয়াল কার্ডের ফোন নম্বর অনুযায়ী কল দিল রানা। কিন্তু ধরল না কেউ। একটু পরেই পেল একটা মেসেজ। কিছু দিন আগে কেটে দেয়া হয়েছে ওই মোবাইলের সংযোগ। ল্যাণ্ড ফোনের নম্বর দেয়া হয়নি কার্ডে। ইয়েলো পেজ ঘাটল রানা। কোথাও নেই উকিল হার্ভে সিম্পসনের নাম। বাধ্য হয়ে কার্ডের ঠিকানা অনুযায়ী তার খোঁজ নেবে ঠিক করল রানা। মানচিত্র দেখে ঘুরিয়ে নিল ক্রাইসলার গাড়ি।

রানার ধারণা ছিল, সাদা, প্রকাণ্ড সব পিলার সামনে নিয়ে প্রকাণ্ড কোনও বাড়িতে হবে হার্ভে সিম্পসনের পশ ল ফার্ম। কিন্তু প্রাচীন গাছে ভরা সুন্দর, পুরনো বাড়ি ও রাস্তা পেছনে ফেলে শহরের শেষপ্রান্তে পেল পুরনো, প্রায় ধসে পড়া সিম্পসনের অফিস দালান।

এদিকটা হতদরিদ্রদের এলাকা। দালানের প্রথমতলায় নাপিতের দোকান। সামনে গাড়ি রাখার জায়গা। ফেটে গেছে মেঝে। জন্মেছে ঘাস ও ঝোপঝাড়। তৃতীয়বারের মত কার্ডের ঠিকানা দেখল রানা। না, ঠিক জায়গাতেই এসেছে।

প্রথমতলার দরজা পেরোতেই টিং-টুং! আওয়াজ তুলল বেল। ভেতরে আর্কটিকের ঠাণ্ডা। ফুল স্পিডে চলছে এয়ার কণ্ডিশনার। চারপাশ দেখে নিল রানা। আসবাবপত্র সব পঞ্চাশ দশকের। দুই নরসুন্দরও সত্তর বা আশি বছর পার করেছে। একজন ব্যস্ত হয়ে কাটছে এক ছোকরার চুল। অন্য কোনও খদ্দের নেই। দ্বিতীয় নাপিত চুপ করে বসে আছে স্টুলে, হাতে বিয়ার। বাজে ধরনের কুঁজো। দেখলেই মনে হয় মৃত্যুপথযাত্রী ইগুয়ানা। একটু দূরে টাইলের মেঝেতে ঝাড় দিয়ে কাটা চুল জড় করছে আঠারো বছরের এক শিক্ষানবীশ, পরনে অ্যাপ্রন।

রানাকে খদ্দের মনে করে বিয়ার হাতে ঘুরে তাকাল বয়স্ক নাপিত। আপনার জন্যে কী করতে পারি, মিস্টার? চুল কাটবেন, না শেভ?

কোনওটাই না, বলল রানা। বলতে পারেন কোথায় পাব হার্ভে সিম্পসনকে?

আপনি বলতে চাইছেন পিছলার কথা।

কার্ডে তো হার্ভে সিম্পসন দেখছি।

মাথা দোলাল বয়স্ক নাপিত। হ্যাঁ, সে-ই। পিছলা সিম্পসন।

ওই নাম পেল কীভাবে?

মুচকি হাসল নাপিত। সামনের ছয়টা দাঁত নেই। ওর একটা কর্ভেট গাড়ি আছে। ওটা যেভাবে চালায়, তাতে ওকে ওই নাম না দিয়ে উপায় ছিল না কারও। সবাই বলে, যে কোনও দিন অ্যাক্সিডেন্ট করে মরবে ব্যাটা।

কার্ডের অ্যাড্রেস অনুযায়ী এখানেই তার অফিস, বলল রানা।

হ্যাঁ। সরু, হিলহিলে আঙুল তাক করে দরজার কোনা দেখাল বয়স্ক নাপিত। ওদিকে সিঁড়ি। উঠে বামে। কিন্তু ওখানে দেখার মত কিছু নেই।

থ্যাঙ্কস, দরজার দিকে পা বাড়াল রানা।

কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙার দরকার নেই, মিস্টার। পাবেন না। ওকে ওই অফিসে। ফ্যাকাসে মাঢ়ী দেখিয়ে আবারও হাসল বুড়ো। নো, স্যর।

তা হলে কোথায় আছে সে? তার সঙ্গে জরুরি আলাপ আছে আমার।

রানার কথায় হেসে ফেলল দুই নাপিত ও ছোকরা। ভুরু কুচকে আয়নায় নিজেকে দেখছে খদ্দের। বিয়ার হাতে নাপিত বলল, পাবেন না তাকে। আমরাও চাই ও-ব্যাটার সঙ্গে কথা বলতে। এক মাসের ভাড়া বাকি ফেলে উধাও হয়েছে। দু সপ্তাহ হলো ডুব দিয়েছে নরকের নর্দমায়।

তার মানে, আপনারা জানেন না সিম্পসন কোথায়?

মিথ্যা বলব কেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। আমেরিকায় এসে প্রথমেই হোঁচট খেতে হচ্ছে ওকে। ঠিক আছে, থ্যাঙ্ক ইউ, বলে দরজা ঠেলে বেরোল রানা। আবারও বাজল টিং-টুং! ঘামছে গরমে। চলে গেল গাড়ির পাশে। পকেট থেকে চাবি নিয়ে খুলল ড্রাইভারের দিকের দরজা। উঠে পড়বে গাড়িতে, এমনসময় পেছনে শুনল পায়ের আওয়াজ।

ঘুরে দাঁড়াল রানা। সেলুনের সেই তরুণ। এখন অ্যাপ্রন নেই। ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া টি-শার্টে ছাপা: জিমি অ্যাণ্ড্রু।  মিস্টার, নিচু গলায় বলল সে। একমিনিট। কাঁধের ওপর দিয়ে দেখল দালান। ভয় পাচ্ছে, রানার সঙ্গে কথা বলছে, সেটা দেখে ফেলবে কেউ।

বোধহয় বেরিয়ে এসেছে পেছনের দরজা দিয়ে। উদ্বিগ্ন। আর ভীত দেখাচ্ছে তরুণকে। যা বলবে, সেটা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম।

পিছলা পড়েছে মস্তবড় বিপদে, মিস্টার।

কী ধরনের বিপদ?

তা জানি না। কিন্তু খারাপ কিছু। বাধ্য হয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। চুপ করে কী যেন ভাবল তরুণ, তারপর বলল, সবসময় আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত পিছলা। বিপদে পড়ে ধার চাইলে তাও দিত।

পিছলা বিপদে থাকলে, আমি হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারব, বলল রানা। তুমি কি জানো, কোথায় পাওয়া যাবে তাকে?

মাথা নাড়ল তরুণ। তবে একজনকে চিনি, সে হয়তো জানে কোথায় আছে পিছলা।

তা হলে তাকে জানাবে, পিছলাকে খুঁজছি আমি?

আবারও একবার নাপিতের দোকান দেখল তরুণ। মুখ ফিরিয়ে মাথা দোলাল।

ওকে বোলো, ক্যাথি হার্বার্টের এক বন্ধু এসেছে ইংল্যাণ্ড থেকে। কথা বলতে চায় পিছলার সঙ্গে। খুব জরুরি। বুঝতে পেরেছ?

ক্যাথি হার্বার্ট, বিড়বিড় করে নামটা মুখস্থ করে নিল তরুণ।

মেসেজ পেলে সবই বুঝবে পিছলা। এই নম্বরে ফোনে পাবে আমাকে। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে কাগজ ও কলম নিয়ে ফোন নম্বর লিখে তরুণের হাতে দিল রানা। ওয়ালেট বের করে ওর হাতে গুঁজে দিল বিশ ডলারের একটা নোট। মাথা দোলাল তরুণ। পেছনের পকেটে চলে গেল নোট। ফিরে গেল দালানের পেছনে।

একঘণ্টা পর। শহরে মাঝারি মানের কোনও হোটেল খুঁজছে রানা, এমনসময় বেজে উঠল ড্যাশবোর্ডে রাখা ফোন। কল রিসিভ করল ও।

আমি কার সঙ্গে কথা বলছি? ঝগড়াটে, নাকি সুরে জানতে চাইল এক লোক।

লোকটার মারকুটে কন্ঠ ভাল ঠেকল না রানার। দুই সেকেণ্ড পর জানাল, আমার নাম মাসুদ রানা। আপনি কে বলছেন?

আমি কে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে, তিক্ত স্বর। রানা টের পেল, ভয় পাচ্ছে ওই লোক। হাইন্সভিলের এক বার-এর ঠিকানা দিল। জায়গাটা স্যাভানা শহর থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। কীভাবে ওখানে পৌঁছুনো যাবে, সেজন্যে দুচারটে ল্যান্ডমার্কও উল্লেখ করল। ফোন কেটে দেয়ার আগে বলল, হাজির হবেন ঠিক সাড়ে সাতটায়।

অজানা জায়গায় ডেকে নেবে অচেনা কেউ, সেটা পছন্দ নয় রানার। তবে যে পেশায় আছে, প্রায়ই এই ঝুঁকি না নিয়ে উপায় থাকে না ওর।

ওই বার-এ পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে, তা বুঝতে হাতঘড়ি দেখল রানা। যথেষ্ট সময় আছে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে। দক্ষিণ-পশ্চিমে রওনা হলো ও। পেছনে পড়ছে সাদা সব পুরনো, বিশাল বাড়ি ও সুন্দর সব বাগান। রাস্তায় শীতল ছায়া দিচ্ছে প্রাচীন গাছ। একবার রাস্তার পাশে থেমে ছোট এক রেস্টুরেন্ট থেকে পর পর দুই কাপ কফি নিল রানা। ইতালির বাইরে আগে এত সুস্বাদু কফি পান করেনি। কিছুক্ষণ ওখানে বসে থাকল, তারপর বিল মিটিয়ে উঠল গাড়িতে। এবার গতি তুলল ষাট মাইলে।  

বার-এর পার্কিং লটে ক্রাইসলার গাড়ি রেখে নেমে পড়তেই হার্ড রক মিউযিকের হুঙ্কার শুনল রানা। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ঢুকতেই মনে হলো, কানদুটো বহু দূরে কোথাও রেখে এলে হয়তো রক্ষা পেত। প্রকাণ্ড ঘরে ভাপসা গরম। ধোয়া, বিয়ার আর গিজগিজে মানুষের ঘামের গন্ধে কুঁচকে গেল ওর নাক। চারপাশ দেখে নিল রানা। বার কাউন্টারে ঝুলছে বিদ্রোহীদের পতাকা। নিচের অংশে কোনাকুনিভাবে রাখা দুই তলোয়ার। হাইহিল জুতো পরে নানান টেবিল লক্ষ্য করে ছুটছে ওয়েট্রেসরা। পরনে জিন্স প্যান্ট ও খোলা গলার টি শার্ট। নিচু এক মঞ্চে রাখা ইলেকট্রিক গিটার, ব্যে গিটার ও ড্রাম। দুপাশে স্পিকারের পাহাড় আর অ্যামপ্লিফায়ার। ব্যাণ্ড দল এলেই শুরু হবে কানের ওপর আরও মারাত্মক অত্যাচার।

ভিড়ের মাঝ দিয়ে এগোল রানা।

ওকে ফোনে বলে দেয়া হয়েছে কোথায় যেতে হবে। একটা পিনবল মেশিন আর পে-ফোনের মাঝের দরজা দিয়ে গেলে সামনে পড়বে সিঁড়ি।

ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলে উঁচু ধাপগুলো টপকে দোতলার করিডোরে উঠে এল রানা। নিচ থেকে আসছে বিকট মিউযিক। এতই জোরে যে, কাঁপছে পায়ের নিচের মেঝে। নাচ শুরু হলে দ্বিগুণ জোরে বাজবে স্পিকার। সামনে দরজা দেখে টোকা দিল রানা।

ভেতর থেকে এল মহিলা কণ্ঠ, ভেতরে আসুন।

কবাট খুলে ঘরে পা রাখল রানা। এটা কোনও অফিস, তবে পরিত্যক্ত হয়েছে বহু দিন আগে। আসবাবপত্র বলতে একটা ডেস্ক ও কাঠের খটখটে চেয়ার। বইয়ের বদলে মাকড়সার ঝুল ভরা বুকশেল। এক কোণের টবে লম্বা একটা গাছ, কবে যে শুকিয়ে ওটার প্রাণ চলে গেছে স্বর্গে কেউ খেয়াল করেনি।

ঘরে ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাট এক মেয়ে। বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশ। দীর্ঘ কোঁকড়া চুল। ডাই মেখে সোনালি। পায়ে হাইহিলের বুট। পরনে টাইট জিন্স প্যান্ট ও সুয়েড শার্ট। কাঁধের স্ট্র্যাপে চামড়ার ভারী হাতব্যাগ।

ফোনে এক লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, মেয়েটাকে বলল রানা।

আপনি কথা বলেছেন পিছলার সঙ্গে, কড়া সুরে বলল মেয়েটা।

সে কোথায়? এক পা সামনে বাড়ল রানা।

এক পা-ও এগোবে না, মিস্টার, ধমক দিল মেয়েটা। যা জিজ্ঞেস করার, আমি করব। হাতব্যাগ থেকে বের করল বিশাল এক রিভলভার। শক্ত করে ধরেছে দুই হাতে। ওটার ওজন রাখতে গিয়ে ফুলে গেছে কবজির রগ।

ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি, বলল রানা। তো কী জানতে চাও তুমি?

কার হয়ে কাজ করো?

ভাবছ কেন, কারও হয়ে কাজ করি?

কারণ, স্টিভ বার্কলের লোক হলে প্রাণ নিয়ে বেরোতে দেব না, কঠোর সুরে বলল মেয়েটা। মনে হলো না মিথ্যা বলছে।

বার্কলেকে চিনি না, বলল রানা।

তাই? ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল মেয়েটা। কোত্থেকে এসেছ?

এদিকের লোক নই, বলল রানা, কথা বলতে চাই পিছলা সিম্পসনের সঙ্গে। ব্যাপারটা খুব জরুরি।

রিভলভার আরেকটু উঁচু করল মেয়েটা। খবরদার! নড়বে না!

রিভলভারটা ভাল করে দেখল রানা।  

ওটা বিশাল। সিঙ্গল অ্যাকশন। ভারী ক্যালিবারের। স্টেইনলেস স্টিলের। আলাস্কায় এই জিনিস দিয়েই গ্রিজলি ভালুক শিকার করে শিকারীরা। চেম্বারের মুখে উঁকি দিচ্ছে হলোপয়েণ্ট বুলেট। মাযলের ডায়ামিটার কমপক্ষে আধ ইঞ্চি। হালকা-পাতলা মহিলার হাতে মানাচ্ছে না ওটা। আধ হাত লম্বা ভারী নল উঁচু করে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা। সত্যিই যদি গুলি করে, ওটার রিকয়েলে পাটকাঠির মত ভাঙবে ওর কবজি।

রিভলভারটা তোমার না, তাই না? বলল রানা। নিশ্চয়ই পিছলার?

কার, তাতে কী যায় আসে? ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল মেয়েটা। গুলি করে ফুটো করে দিতে পারব তোমাকে। দরকার পড়লে তা-ই করব। কাজেই দূরে থাকো। যাতে দেখতে পাই, সেজন্যে সামনে রাখো হাত।

ওই জিনিস তোমাকে দেয়ার আগে পিছলার উচিত ছিল এর কায়দা-কৌশল শিখিয়ে দেয়া, কী করা যাবে, আর কী না। মৃদু হাসল রানা। ওটা কিন্তু কক্ করা নয়। গুলি করতে পারবে না।

চট করে রিভলভার দেখল মেয়েটা। অবিশ্বাসের চোখে তাকাল রানার দিকে।

ট্রিগারে টান দিয়ে দেখো, বলল রানা। কিছুই হবে না। ওই যে দেখতে পাচ্ছ, ওটা হ্যামার। বুড়ো আঙুল দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আগে ওপরে তুলতে হবে ওটাকে।

বুড়ো আঙুলে হ্যামার পেঁচিয়ে ধরল মেয়েটা।

 টেনে তোলো, দেখবে ক্লিক আওয়াজে লক হবে ওটা।

ধাতব ক্লাঙ্ক-ক্লাঙ্ক আওয়াজে ঘুরে লক হলো পাঁচ গুলির সিলিণ্ডার।

গুড, বলল রানা, এবার গুলি করতে পারবে। কিন্তু তার আগে দুএকটা কথা শোনো। আমি স্টিভ বার্কলের লোক নই। জানিও না ওই লোক কে। এবার, খুব সাবধানে জ্যাকেটের ভেতরে হাত ভরব। ভয় পেয়ো না। আমি নিরস্ত্র। বের করব আমার পাসপোর্ট। সবুজ বই বের করে ডেস্কে ফেলল রানা। আজই স্ট্যাম্প করেছে ইউএস ইমিগ্রেশন থেকে। ফাঁদে-পড়া এই বেচারার নাম মাসুদ রানা। পাসপোর্টেও দেখবে এই একই লোকের ছবি।

পাসপোর্ট তুলে পরখ করতে লাগল মেয়েটা। একদিকে সরে গেল রিভলভারের নল। হাসতে হাসতে অস্ত্রটা কেড়ে নিতে পারে রানা, কিন্তু মৃদু হেসে দাঁড়িয়ে থাকল।

কয়েক সেকেণ্ড পর মুখ তুলে ওকে দেখল মেয়েটা। বাড়িয়ে দিল পাসপোর্ট।

এবার বিশ্বাস করলে? জানতে চাইল রানা।

রিভলভার নামাল মেয়েটা। কোমল হয়ে এসেছে মুখ। চোখে স্বস্তি। ঠিক আছে, বিশ্বাস করছি, যাও।

তা হলে ওটা ডি-কক করো।

ও, হ্যাঁ। ইয়ে… তুমি করো।

ওর কাছ থেকে অস্ত্রটা নিয়ে বুড়ো আঙুলে হ্যামার পেঁচিয়ে ধরে, ট্রিগার চেপে ধীরে ধীরে নামিয়ে দিল রানা ঘোড়া।

তোমার নাম কিন্তু বলোনি, অস্ত্র ফেরত দিল রানা।

জলি।

পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, জলি।

জর্জিয়ায় কী কাজে এসেছ, মিস্টার রানা?

আমাকে রানা বলে ডাকতে পারো। ইউরোপ থেকে এসেছি ক্যাথি হার্বার্টের খোঁজে।

তোমাকে তো তেমন লোক বলে মনে হচ্ছে না, যে কিনা ওই বেশ্যার পেছনে ঘুরবে।

বিপদে পড়েছে।

নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে আওয়াজ তুলল জলি। ও নিজেই  তো ভয়ঙ্কর বাজে আপদ।

বিপদে আছে পিছলাও, বলল রানা, নইলে তোমার হাত-কামানের সামনে পড়তাম না।

সরি, সাবধান না হয়ে উপায় ছিল না।

পিছলা এখন কোথায়?

স্টিভ বার্কলের ভয়ে লুকিয়ে আছে।

ওর ওখানে নিয়ে যাবে আমাকে? মৃদু হাসল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *