নরপশু ১

মাসুদ রানা ৪৫৪ – টপ টেরর – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

০১.

গ্রিসের সবুজ অরণ্যে ভরা পাহাড়ি দ্বীপ কোর্ফিউ।

জুন মাসের উত্তপ্ত এক রাত।

মাত্র তিন দিন আগে এই দ্বীপে ওই যুবতীকে খুঁজে পেয়েছে তারা। তারপর থেকে চোখ রেখেছে ওর ওপর। আর আজ বুঝেছে, কীভাবে কিডন্যাপটা করবে। অসংখ্য জলপাই গাছের ছায়ায় পাহাড়ের ওপরে নির্জন, বড় এক ভিলা ভাড়া করেছে মেয়েটা। টিলার পায়ে লুটিয়ে পড়ছে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, ঝলমলে নীল সাগরের ঢেউ।

ভিলায় একাই থাকে মেয়েটা। কেউ ভাবতে পারে, ওকে কিডন্যাপ করা সহজ। বাস্তবে তা নয়। ওই বাড়ি সরগরম করে রেখেছে নিমন্ত্রিত অতিথিরা। পার্টিতে দিনরাত চলছে গান-বাজনা, মদ্যপান ও জুয়া। এ কারণেই দূর থেকে চোখ রাখলেও ধারেকাছে ভিড়তে পারেনি কিডন্যাপিং টিম।

অবশ্য, আজকের প্ল্যান একদম নিখুঁত। ভিলায় ঢুকবে। মেয়েটাকে আটক করবে। বেরিয়ে আসবে।

টেরও পাবে না কেউ, উধাও হয়েছে মেয়েটা।

কিডন্যাপিং টিমে তারা সবমিলে আছে চারজন। তিনজন পুরুষ, চতুর্থজন ছাব্বিশ বছর বয়সী এক সুন্দরী। তারা জানে, এই দ্বীপে আজই শেষ দিন ওই মেয়ের। আগামীকাল ভোরেই কোর্ফিউ এয়ারপোর্টে বিমানে উঠবে, চলে যাবে নাগালের বাইরে।

সুতরাং, কাজ সারতে হলে আজই, নইলে আর কখনও নয়। সবদিক ভেবে দেখেছে তারা।

আজ রাতে হারিয়ে গেলে কোথাও কোনও চিহ্ন থাকবে না মেয়েটার।

সকালে কেউ খুঁজবে না ওকে।

সবাই জানে, ও ফিরে যাচ্ছে নিজের দেশে।

 দিন ফুরোতেই আকাশে জ্বলে উঠেছে হাজারো নক্ষত্র। সন্ধ্যা থেকে ভিলায় শুরু হয়েছে ফেয়ারওয়েল পার্টি।

স্থানীয় এক রেন্টাল কোম্পানি থেকে সেলুন গাড়িটা ভাড়া করেছে কিডন্যাপিং টিম। ওটা রেখেছে ভিলা থেকে এক শ গজ দুরে রাস্তার ধারে একঝাড় জলপাই গাছের ছায়ায়।

এখন চুপচাপ বসে ভিলার ওপর নজর রাখছে তারা।

জ্বলছে ভিলার সব বাতি। জোরেশোরে বাজছে মিউযিক। দূর থেকেও আসছে হাসির আওয়াজ। পাথরের সাদা বাড়িটা চমৎকার। তিনদিকে ব্যালকনি। ওখানে নাচছে কপোত কপোতীরা। রেলিঙে ভর দিয়ে ড্রিঙ্ক করছে কেউ কেউ। কারও কারও চোখ শ্বাসরুদ্ধকর সাগর বা পাহাড়ি দৃশ্যে।

চাঁদের রুপালি আলোয় টলমল করছে নিচের সাগর। তীর থেকে আসছে উষ্ণ, মৃদু বাতাস, তাতে শত শত ফুলের মিষ্টি সুবাস। কখনও কখনও বাড়ির সামনে থামছে একটা দুটো গাড়ি। ওগুলো থেকে নামছে অতিথিরা।

রাত এগারোটার পর কাজে নামল কিডন্যাপিং টিম।

গাড়ির সামনের সিটে ঠায় বসে থাকল দুজন। হয়তো অপেক্ষা করতে হবে বহুক্ষণ, তবে এ ধরনের কাজে অভ্যস্ত তারা। পেছন সিটের দুজন একবার মাথা দোলাল পরস্পরের উদ্দেশে। চকচকে কালো চুলের খোঁপায় হাত বোলাল সুন্দরী, তারপর ওটা খুলে বেঁধে নিল ইলাস্টিক ব্যাণ্ড। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল মেকআপ। দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভিলার উদ্দেশে চলল তারা। লোকটার হাতে এক বোতল দামি, স্থানীয় ওয়াইন। ছায়া থেকে বেরিয়ে ওপরের ভিলার মেইন গেট পেরোল তারা। টেরেসে উঠে সদর দরজা দিয়ে ঢুকল বাড়ির ভেতর। পেছন থেকে চেয়ে রইল গাড়ির ভেতরের দুজন।

ভিলার উজ্জ্বল আলো ও ফুর্তির পরিবেশে নিজেদেরকে চট করে মানিয়ে নিল দুই কিডন্যাপার। কথা হলো না পরস্পরের মাঝে। সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ট্রেনিং আছে তাদের। ভিড়ের মাঝ দিয়ে চলেছে দুজন। এমনিতেই প্রচুর মদ্যপান করেছে বলে তাদের দিকে খেয়াল নেই বেশিরভাগ অতিথির। খালি হয়েছে অন্তত পঞ্চাশটা হরেক রকম মদের বোতল। সিগারেটের ধোঁয়ায় আবছামত লাগছে ঘর। শুধু কি সিগারেট, হ্যাঁশিশ বা মারিইয়ুয়ানার গন্ধও মিশে আছে তার সঙ্গে।

একে একে সবগুলো ঘর ঘুরে দেখছে দুই কিডন্যাপার। প্রতিটি আসবাবপত্র অভিজাত ও দামি। কিছুক্ষণ পর পেয়ে গেল টার্গেটকে। কাছ থেকে মেয়েটার ওপর সতর্ক চোখ রাখল তারা।

কিছুই জানল না যুবতী। কেড়ে নিয়েছে সবার মনোযোগ। খুব খুশি মধ্যমণি হতে পেরে। কিডন্যাপাররা জানে, দুহাতে খরচ করছে সে। আরও প্রচুর টাকা পাবে এমন নিশ্চয়তা না পেলে এভাবে অকাতরে টাকা নষ্ট করে না কেউ। আজকের পার্টিতে অভাব নেই শ্যাম্পেনের। মেইন রুমের কোণে সেলফ-সার্ভিস বার থেকে যে-যার মত নিচ্ছে পছন্দের ড্রিঙ্ক। চলছে হরিলুঠ। গলা পর্যন্ত গিলছে বিশেষ করে যুবকরা।

বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে যেভাবে ছুঁচোর ওপর নজর রাখে, ঠিক সেই দৃষ্টিতে যুবতীকে দেখছে দুই কিডন্যাপার। ভাল করেই জানে, অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে এর ভাগ্যে।

টার্গেটের বয়স পঁচিশ। সুন্দরী। মোনালিসার ছবির মতই আকর্ষণীয়। গত কিছুদিনে একটু দীর্ঘ হয়েছে সোনালি চুল। রোদে পুড়ে বাদামি হয়েছে ত্বক। সেজন্যেই উজ্জ্বল নীল মনে হচ্ছে হরিণী দুই চোখ। পরনে সাদা সুতির ট্রাউযার ও হলদে সিল্কের টপ। প্রশংসা ও লোভের দৃষ্টিতে ওর দুর্দান্ত শরীরটা দেখছে যুবকরা, মেয়েরা জ্বলে যাচ্ছে হিংসায়।

যুবতীর নাম ক্যাথি হার্বার্ট।

ওর বিষয়ে সবই জানে কিডন্যাপাররা। সম্মানজনক পেশা বেছে নিয়েছে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। বই লিখেছে। স্কলার। ইতিহাসবেত্তা। বাইবেল বিষয়ক প্রত্নতত্ত্ববিদ। হাজার হাজার পাঠক ও দর্শক বিশ্বাস করে ওকে। এখনও বিয়ে করেনি। ভিড় করে আগ্রহ নিয়ে ওকে ঘিরে রাখে একদল যুবক। তাতে খুব খুশি হয় ক্যাথি। পার্টিতে আসা সুদর্শন যুবকদের নাচের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিচ্ছে না সে। জাতে ক্যাথি ইংলিশ। এসেছে অক্সফোর্ড শহর থেকে। ওর বাবা-মার নামও ভাল করেই জানে কিডন্যাপাররা। তদন্ত করে যুবতীর বিষয়ে প্রায় সব তথ্যই জোগাড় করেছে। এজন্যে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত টাকা।

কিডন্যাপারদের পরিকল্পনা খুব সহজ।

একটু পর ভিড় থেকে সরে যাবে মহিলা কিডন্যাপার। তখন টার্গেটের কাছে যাবে তার পুরুষ সঙ্গী। ড্রিঙ্ক সাধবে। প্রশংসা করবে ক্যাথির রূপের। পুরুষ কিডন্যাপারের বয়স তিরিশ। মিষ্টি কণ্ঠ। সুদর্শন। তার কাজ হবে যুবতীর মদের গ্লাসে সঠিক পরিমাণের মাদক মিশিয়ে দেয়া।

খুব ধীরে কাজ করবে এমন কেমিকেল ব্যবহার করছে তারা। কাজেই যুবতীকে দেখলে যে-কেউ ভাববে, অতিরিক্ত মদ্যপান করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনিতেই একটু পর পর ড্রিঙ্ক নিচ্ছে সে। মাদকের কারণে অতিরিক্ত ঘুম পেলে, তখন গিয়ে শুয়ে পড়বে বেডরুমে। শারীরিক কোনও ক্ষতি হবে। হোস্ট ঘুমিয়ে পড়েছে দেখলে ভেঙে যাবে পার্টি। যে-যার মত চলে যাবে ভিলা ছেড়ে। তখন ভাড়া করা সেলুন গাড়ি বাড়ির সামনে আনবে কিডন্যাপাররা। ওদের জন্যে মোটরবোটও অপেক্ষা করছে জায়গামত।

ধরে নেয়া হয়েছে, খুব কঠিন হবে না ক্যাথি হার্বার্টের কাছাকাছি যাওয়া। ধারণা ভুল নয় তাদের। নিজের নাম জানাল যুবক বাড হিগিন্স বলে। মিষ্টভাষী লোক। প্রশংসা দিয়ে তুষ্ট করতে জানে মেয়েদেরকে। মুগ্ধ হয়ে গেছে এমন ভান করল সে। কিছুক্ষণ পর বলল, ক্যাথির জন্যে এক গ্লাস মাটিন এনে দেবে কি না।

মদ খেতে কোনওকালেই আপত্তি ছিল না যুবতীর।

বার-এ চলে গেল সুদর্শন কিডন্যাপার। ড্রিঙ্ক মিক্স করে ওটার সঙ্গে মিশিয়ে দিল ভায়ালের মাদক! সত্যিকারের পেশাদার লোক। হাসিমুখে ফিরে এসে ড্রিঙ্ক দিল ক্যাথির হাতে।

চিয়ার্স, খিলখিল করে হাসল ক্যাথি। দুষ্টুমির ভঙ্গিতে ওপরে তুলল গ্লাস, যেন টোস্ট করবে। ওর কবজির সোনার ব্রেসলেট ঝিলিক দিল কনুইয়ের কাছে নেমে এসে।

আর তখনই মাঠে মারা গেল কিডন্যাপারদের প্ল্যান।

কিডন্যাপাররা খেয়াল করেনি, একটু আগেও ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ছিল এক লোক। হঠাৎ করেই হনহন করে হেঁটে এসে ক্যাথির সামনে হাজির হলো সে। চট করে ধরল যুবতীর কনুই। একটু নাচবে আমার সঙ্গে?

ওই লোককে আগেও ভিলায় কয়েকবার দেখেছে। কিডন্যাপাররা। বয়স হবে পঁয়তাল্লিশের মত। হালকা-পাতলা শরীর। পরনে দামি পোশাক। কানের পাশে পাকতে শুরু করেছে চুল। ক্যাথি হার্বার্টের অন্য বয়ফ্রেণ্ডদের তুলনায় অনেক বেশি বয়স্ক। এই লোক যে বাগড়া দেবে, কে জানত!

লোকটার কথায় মাথা দোলাল ক্যাথি। গ্লাস রেখে দিল টেবিলের কোণে। মধ্যবয়স্ক লোকটা মাতাল নয়, অথচ অদ্ভুত কাণ্ড করল সে। তার হাঁটুর গুতো লাগল টেবিলে। গাধা না হলে এমনটা করবে না কেউ। কিডন্যাপারদের মনে হলো, ইচ্ছে করেই ওটা করেছে লোকটা। ধাক্কা খেয়ে টেবিল থেকে মেঝেতে পড়ল মাদক মেশানো ড্রিঙ্ক।

কিডন্যাপারদের কাছে ছিল মাদকের ওই একটাই মাত্র ভায়াল। অসহায়, বিরক্ত চোখে মধ্যবয়স্ককে দেখল পুরুষ কিডন্যাপার।

ক্যাথিকে নিয়ে টেরেস-এ বেরিয়ে গেল লোকটা।

তারাভরা আকাশের নিচে ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছে বেশ কয়েকটা জুটি। ধীর তালে বাজছে জ্যায।

দুই ট্রেইণ্ড কিডন্যাপার ঝটপট ঠিক করল, এরপর কী করবে। কথা হলো দুজনের চোখে চোখে। কেউ জানল না কিছু। নতুন প্ল্যান গুছিয়ে নিয়েছে তারা। ভিড় থেকে বেরিয়ে ঘরের পেছনে হারিয়ে গেল দুজন। আপাতত বাড়ির ভেতর রয়ে যাবে তারা। অতিথিরা বিদায় নিলে একা থাকবে ক্যাথি হার্বার্ট। তখন কাজে নামবে দুজন। তখনও কঠিন হবে না কিডন্যাপিঙের কাজটা। কোনও তাড়াহুড়ো না করে অনেকের মতই টেরেসে বেরিয়ে এল তারা। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চুমুক দিল যে যার ড্রিঙ্কে।

টার্গেট আর মধ্যবয়স্কের মধ্যে আড়াআড়ি একটা সম্পর্ক খেয়াল করছে তারা। কিছুক্ষণ নাচল ক্যাথি আর ওই লোক। কানের কাছে ফিসফিস করে যুবতীকে কী যেন বোঝাতে চাইছে সে। কোনও কারণে খুব উদ্বিগ্ন দেখাল তাকে। তবে আড়াল করতে চাইছে সেটা।

দুই কিডন্যাপার ছাড়া কারও খেয়াল নেই ওদিকে।

মধ্যবয়স্ক যা-ই বলে থাকুক, পাত্তা দিল না ক্যাথি। ভাব দেখে মনে হলো তর্কাতর্কি হবে দুজনের মধ্যে। তারপর পিছিয়ে গেল লোকটা। হাত বোলাল যুবতীর বাহুতে, সান্ত্বনা দিচ্ছে কী বিষয়ে যেন। কয়েক সেকেণ্ড পর ক্যাথির গালে চুমু দিয়ে পার্টি ছেড়ে বিদায় নিল। কিডন্যাপাররা দেখল, নিজের মার্সিডিযে চেপে চলে গেল লোকটা।

ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা একত্রিশ মিনিট।

পৌনে বারোটা বাজতেই হাতঘড়ি দেখল ক্যাথি। অপ্রত্যাশিতভাবে হাতের ইশারা করল অতিথিদের উদ্দেশে। এবার বিদায় হও আমার ভিলা ছেড়ে! নিজে গিয়ে বন্ধ করে দিল ডেকসেট। মিউযিক হঠাৎ করে থেমে যেতেই চারপাশে নামল নৈঃশব্দ্য। অতিথিদেরকে জানাল: অসংখ্য ধন্যবাদ যে আপনারা এসেছেন এই পার্টিতে। দারুণ কাটল আজকের সন্ধ্যাটা। পরে আবার দেখা হবে। এখন পার্টি ভেঙে দিতে হচ্ছে, ভোরে বিমান ধরতে যেতে হবে আমার এয়ারপোর্টে।

প্রায় সবাই অবাক হলেও মন খারাপ করল না কেউ। আরও অনেক পার্টি আছে। গ্রীষ্মকালে এই দ্বীপে প্রায় প্রতি রাতেই চলে এরকম পার্টি।

বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে পড়ার উপায় নেই, বাধ্য হয়ে অতিথিদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল দুই কিডন্যাপার। ভালভাবেই গোপন করেছে হতাশা! জানে, এটা সামান্য সময়ের ব্যর্থতা। হাল ছাড়ার কোনও কারণ তৈরি হয়নি এখনও। রাস্তায় বেরিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে পৌঁছে গেল জলপাই গাছের ঝাড়ের নিচে। উঠে পড়ল নিজেদের গাড়ির পেছনের সিটে।

এবার? জানতে চাইল ড্রাইভার।

 আবার অপেক্ষা, পেছনের সিট থেকে জবাব দিল সুন্দরী।

ভুরু কুঁচকে ফেলল পরিপাটি চুলের লোকটা। ইশশ, এত্ত সময় নষ্ট হলো! পিস্তলটা দাও, ধরে আনি হারামজাদী কুত্তীকে! তুড়ি বাজাল সে।

কাঁধ ঝাঁকাল ড্রাইভার। জ্যাকেটের তলা থেকে নাইন এমএম পিস্তল নিয়ে বাড়িয়ে দিল পরিপাটি চুলের দিকে।

অস্ত্রটা খপ করে ধরল পরিপাটি। গাড়ি থেকে নেমে  পড়বে, এমনসময় নরম সুরে বলল সুন্দরী, ভুলে গেছ, কারও মনোযোগ আকর্ষণ করা চলবে না? যা করার করতে হবে আড়ালে থেকে।

মরুক শালার অর্ডার। আমি এখনই গিয়ে…

আমরা অপেক্ষা করব, আবারও বলল সুন্দরী। শীতল চোখে তাকাল পরিপাটি চুলের দিকে।

ওই দৃষ্টি দেখে থমকে গেল লোকটা।

ঠিক তখনই শোনা গেল মোটর সাইকেল স্টার্টের গর্জন।

বাজে রাত ঠিক বারোটা।

.

সুযুকি বার্গম্যান স্কুটারে চেপে তুমুল বেগে প্রায় উড়ে চলেছে ক্যাথি হার্বার্ট। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে শীতল, ঝোড়ো হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর চুল।

একটু পর দেখল, পেছনে আসছে একটা গাড়ি। ওটার হেডলাইটের কারণে আলোকিত হয়ে উঠেছে সামনের পথ। বারকয়েক নিভে আবারও জ্বলে উঠল হেডলাইট। থামতে সিগনাল দেয়া হচ্ছে ক্যাথিকে।

লোকটা কে, ভাবল ও। পার্টি থেকে বিদায় নেয়া কেউ? অবাক কাণ্ড! ভিলার দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসার সময় ধারেকাছে কোনও গাড়ি দেখেনি ও।

থ্রটল আরেকটু মুচড়ে ধরল ক্যাথি। দুপাশে সাঁই-সাঁই করে পিছনে পড়ছে গাছের সারি। মাঝের দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে ও। প্রচণ্ড বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওর দীর্ঘ চুল ও পোশাক। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, বেশ পেছনে পড়েছে গাড়িটা।

আনমনে হাসল ক্যাথি। কালকে ফিরছে অক্সফোর্ডে, তার আগে শেষবারের মত মায়াবী এই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ছুটে যেতে দারুণ লাগছে। ওর সব ব্যাগেজ নিজের বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে বুদ্ধির কাজ করেছে প্যাসিফিকো। লটবহর নিয়ে স্কুটারে করে যাওয়া কঠিন কাজ।

চার শ সিসির স্কুটার ছুটতে পারে প্রচণ্ড বেগে, ভয়ই লাগে ওর। তবে উত্তেজনা ও ঝুঁকির আকর্ষণ কখনও এড়াতে পারে না ও। থ্রটল আরও খুলে দিল ক্যাথি। ঠোঁটে ফুটে উঠল ফুর্তির হাসি।

তখনই আবার আয়নায় দেখল ওই হেডলাইট। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে স্কুটারের পেছনে হাজির হয়েছে গাড়িটা। এবার চলে এসেছে খুব কাছে। উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল ক্যাথির। একটু কমিয়ে নিল গতি। সরে গেল কিনারে, চাইছে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাক গাড়িটা।

কিন্তু তা করল না ড্রাইভার। আসছে ঠিক পেছনে। গতি কমছেও না, বাড়ছেও না। অস্বস্তি বোধ করছে ক্যাথি। ড্রাইভারের উদ্দেশে হাতের ইশারা করল। ওভারটেক করে নিজের পথে চলে যাক লোকটা। কিন্তু একই দূরত্বে রয়ে গেল ড্রাইভার। সুযুকির মৃদু খির-খির শব্দের ওপর দিয়ে শক্তিশালী গাড়িটার ইঞ্জিনের গর্জন শুনছে ক্যাথি।

আস্ত কোনও গাধা চাইছে রেস করবে। মেজাজ গরম হয়ে উঠল ক্যাথির। দাঁড়া, হারামজাদা, দেখিয়ে দিচ্ছি রেস কাকে বলে!

থ্রটল মুচড়ে ধরে কাত হয়ে সামনের বাঁক পেরিয়ে গেল ও। দুদিকে দুলতে দুলতে তুলল ঝড়ের গতি। পিছু নিল ওই গাড়ি। থ্রটল আরও খুলে মাঝের ব্যবধান বাড়িয়ে নিল ক্যাথি। অবশ্য, তাতে লাভ হলো না। আবারও পেছনে হাজির হলো গাড়িটা। ক্যাথির ভয় হলো, পেছনের লোকটা বোধহয় ওকে পিষে মারতে চায়!

ধক-ধক করছে ওর হৃৎপিণ্ড। গভীর রাতে পাহাড়ি নির্জন পথে রেস করা এখন আর মজার বলে মনে হচ্ছে না। রকেটের বেগে পিছিয়ে যাচ্ছে দুপাশে গাছের সারি।

একটু দূরে দেখল ডানে সরু পথ। ওটা গেছে পরিত্যক্ত এক ফার্মহাউসের দিকে। আগেও দুএকবার ওদিকটা পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখেছে। পথ শেষ হয়েছে লোহার বিশাল গেটের সামনে। কড়ায় ঝুলছে তামার তালা। কিন্তু গেটের কলামের পাশেই ধসে গেছে দেয়াল। ওখানে যে ফোকর তৈরি হয়েছে, ওটা দিয়ে স্কুটার নিয়ে ঢুকতে পারবে যে-কেউ।

কাত হয়ে ফার্মহাউসের পথে নেমে গেল সুযুকি স্কুটার। আরেকটু হলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। নরম মাটিতে পিছলে গেছে চাকা। পড়তে পড়তেও সামলে নিল ক্যাথি। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, আবারও কাছে চলে এসেছে। গাড়ির হেডলাইট।

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল ওর। কী চায় লোকটা?

সামনে থেকে তীরের বেগে এগিয়ে আসছে চওড়া গেট। আর বড়জোর ত্রিশ গজ। বিশ…

কড়া ব্রেক করল ক্যাথি। টলমল করে উঠল স্কুটার। পরক্ষণে ঢুকে পড়ল ভাঙা দেয়ালের অংশ দিয়ে। স্কুটারের প্লাস্টিকের বাড়তি অংশ লাগল দুদিকের দেয়ালে। গেটের সামনে ব্রেক করে থামল পেছনের ওই গাড়ি। আবারও ওটার আলো দেখল ক্যাথি রিয়ার ভিউ মিররে। পরক্ষণে পেছনে হারিয়ে গেল ওই আলো।

প্রতিযোগিতায় জিতে খুশির হাসি হাসল ক্যাথি। এক সেকেণ্ড পর আয়নায় চোখ রেখে দেখল, গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে কয়েকজন। তাদের হাতে শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট। দৌড়ে আসছে তারা। দুএকজনের হাতে পিস্তল!

পেছনে বুম! করে উঠল একটা আগ্নেয়াস্ত্র।

ক্যাথি টের পেল, ভীষণভাবে থরথর করে কেঁপে উঠেছে। স্কুটার। গুলি লেগে বিস্ফোরিত হয়েছে পেছনের চাকা।

ছুটন্ত স্কুটার চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। হঠাৎ করেই ক্যাথি টের পেল পিছলে পড়ছে। দ্রুতবেগে উঠে এল মাটি! মাথায় ঠাস করে কী যেন লাগতেই জ্ঞান হারাল ও।

.

০২.

 এস্টেটের সোনাপানি করা চওড়া মেইন গেট এখন খোলা।

ঠাণ্ডা আমেজ। চারপাশে ফুলের সুবাস।

গাড়ি আর্চওয়ে পেরোতেই হরিৎ এক সুড়ঙ্গে ঢুকল রানা। কারও ব্যক্তিগত এই পথে বাঁক নিতেই পেছনে পড়ল গাছের সারি। দূরে রাজা জর্জের আমলের কাউন্টি হাউস। সামনে মখমলের মত বিছিয়ে আছে নিয়মিত ছাঁটা মসৃণ, সবুজ ঘাস ও নানান ধাঁচের স্কাল্পচার করা লন। অডি গাড়ির চাকার নিচে কুড়মুড় শব্দ তুলছে নুড়িপাথর। পার্কিং লটে বেন্টলি, রোলস রয়েস ও জাগুয়ারের মত দামি গাড়িগুলোর পাশে গিয়ে থামল রানা।

কয়েক মুহূর্ত বসে থাকল, তারপর টাই ঠিক করে নিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। ওর পরনের কোট অত্যন্ত দামি। কিনেছে আজকের বিশেষ এই অনুষ্ঠানের জন্যেই। বাকি জীবনেও হয়তো আর ব্যবহার করবে না। মৃদু বাতাসে ভেসে আসছে ব্যাণ্ডের বাজনা। ওই আওয়াজ অনুসরণ করে লন পেরিয়ে বাড়ির পেছনে চলে এল রানা। প্রথমবারের মত বুঝল, বিশাল এলাকা নিয়ে এই এস্টেট।

লনের একপাশে ডোরাকাটা মস্তবড় এক তাঁবু। ওখানে ভিড় করেছে অতিথিরা। চলছে গল্প। হাসিখুশি সবাই। দীর্ঘ কয়েকটি টেবিলে রাখা হরেক রকম খাবার ও দামি ড্রিঙ্ক। ট্রে হাতে নানাদিকে ছুটছে ওয়েটাররা। মহিলাদের পরনে গ্রীষ্মকালীন পোশাক, মাথায় ফুল গোঁজা হ্যাট।

অনেক টাকা খরচ করা হচ্ছে এই ওয়েডিং রিসেপশনে, ভাবল রানা। বোধহয় গত কয়েক মাসে বড় দাও মেরেছে জঁ্যা মউরোস। সাত মাসের বেশি দেখা নেই। তারপর হঠাৎ করেই আজ লণ্ডনে রানা এজেন্সিতে এল ওই বিয়ের কার্ড।

সবসময় বন্ধুদেরকে বিস্মিত করতে ভালবাসে মউরোস। ফোন করলে সারপ্রাইয থাকে না, তাই চুপচাপ থেকেছে। শুধু কার্ডের সঙ্গের চিঠিতে লেখা ছিল: প্রেমিকার চাপে হঠাৎ করেই বিয়ে করছি। বন্ধুদের কাউকে পেলাম না পাশে। ইউরোপেই নেই কেউ। তবে, রানা, জেনে গেছি, তুমি কিন্তু ইংল্যাণ্ডেই আছ। যদি আমার বিয়েতে না আসো… বউয়ের কাছে জ্জায় কান কাটা পড়বে আমার। প্লিয, রানা, এই বিপদ থেকে আমাকে বাঁচাও, ভাইটি আমার!

বেশ কয়েকটি জুটির সঙ্গে লনে নাচছে মউরোস আর ওর বউ। ওদিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। জাতিতে ফ্রেঞ্চ ওর বন্ধু, আদব-কায়দাও অন্যরকম। কাজ নিয়েছিল মস্ত বড়লোকের মেয়ের বডিগার্ডের। কিন্তু ওকে বিয়ে করতে পাগল হয়ে উঠল মেয়েটা। নিজেও পটে গেল মউরোস। আজ সেই মেয়েকে বিয়ে করেছে।

দূরে সরে মিউযিক শুনছে রানা, দেখছে অতিথিদেরকে। কিছুক্ষণ পর থামল বাজনা। লনের আরেকদিকে রানাকে দেখে হাত নাড়ল মউরোস। চুমু দিল স্ত্রীর গালে। কী যেন বলল। হেসে ফেলল মেয়েটি, বান্ধবীদের সঙ্গে চলল তাঁবুর দিকে।

নতুন বাজনা বাজাতে লাগল ব্যাণ্ড পার্টি।

রানার দিকে পা বাড়াল মউরোস। খুশিতে ঝলমল করছে দুই চোখ। প্রথম সুযোগেই রানার হাতটা ভরে ফেলল মুঠোর ভেতর। দোস্ত, মনটা ছোট হয়ে গিয়েছিল, সত্যিই বুঝি এই অনুষ্ঠানে এল না কোনও বন্ধু!

এমনটা ভাবলে কেন? মাথা নাড়ল রানা। জরুরি সব কাজ ফেলে আসতে চেয়েছে অনেকেই। কিন্তু শুনলাম তুমি নিজেই নাকি বাধা দিয়েছ– কাজ আগে, পরে বিনোদন।

মাথা দোলাল মউরোস। কথা ঠিক। হাতের ইশারায় দেখাল দিগন্ত পর্যন্ত জমি ও সবুজ অরণ্য। এবার আমাকেও খুঁজে নিতে হবে ভাল কোনও কাজ। আমার বউয়ের বাবার সম্পত্তি এসব। তাদের একমাত্র মেয়ে জোয়ি। ও আর আমি চেয়েছিলাম কোর্ট ম্যারেজ করে নেব। কিন্তু ওর বাবা-মায়ের জেদাজেদিতেই এই অনুষ্ঠান। টাকার অভাব নেই তাদের। পাশ দিয়ে এক ওয়েটার যাচ্ছে দেখে তার কাছ থেকে শ্যাম্পেনের একটা বোতল আর দুটো গ্লাস নিল মউরোস। বন্ধুকে ইশারা করে পা বাড়াল একটু দূরের এক টেবিল লক্ষ্য করে। একটা ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।

টেবিলে পাশাপাশি চেয়ারে বসল ওরা। রানা বলল, বলে ফেলো: জটিল কোনও সমস্যা?

ধরেসুস্থে বলছি, শ্যাম্পেনের বোতলের মুখ খুলে গ্লাসে সোন! ল তরল ঢালল মউরোস। গ্লাসে যোগ করল বরফের টুকরে।

রানার চোখ পড়েছে একটু দূরের এক তরুণের ওপর। তোমার খালাত ভাই না?

ওকে মনে আছে? অবাক হলো মউরোস। শেষ দেখেছ অন্তত পাঁচ বছর আগে! বদলে গেছে দেখতে। চিনলে কী করে ওকে?

কখনও কাউকে দেখলে তার চেহারা মনে থাকে আমার। কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা, কাজের কথায় এসো, কী ধরনের সমস্যা তোমার?

আস্তে করে মাথা দোলাল মউরোস। বড় করে দম নিয়ে বলল, পরস্পরকে ভালবাসি জোয়ি আর আমি। এদিকটাতে কোনও ঝামেলা নেই। চুপ মেরে গেল ও।

তা হলে সমস্যা পর্যাপ্ত টাকার? 

দূরে বাজছে ব্যাণ্ডের বাজনা।

বুঝতেই পারছ, হবু শ্বশুরের চাকরি করতে চাইনি। এদিকে বেশ কয়েক মাস ধরে ভাল কোনও কাজও পাচ্ছি না। ঝুঁকি আছে এমন কোনও চাকরিও নিতে দেবে না জোয়ি।

অযৌক্তিক নয় ওর কথা, বলল রানা।

অর্থনৈতিক মন্দার সময় এখন। মাথা নাড়ল মউরোস। এদিকে সংসার করতে হলে চাই ছোটখাটো একটা বাড়ি। তাই চুক্তি করেছি ব্যাঙ্কের সঙ্গে। বিয়েতে যে ক্যাশ উপহার পেয়েছি, তা দিয়ে চালাতে পারব পাঁচ মাসের মর্টগেজের পেমেন্ট। এরপর কী করব জানি না। কাজই যখন নেই, তো পাব কোথায় ভাল চাকরি! ভবিষ্যতে কী করব ভাবতে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার দশা হয়েছে আমার।

জোয়ি কোনও চাকরি করে? জানতে চাইল রানা।

 দাতব্য এক সংস্থায়। বেতন খুব কম।

ফ্রেঞ্চ আর্মিতে কিন্তু দক্ষ লোকদের জন্যে প্রচুর ডেস্ক জব আছে, বলল রানা। অ্যাপ্লাই করে দেখেছ?

মাথা নাড়ল মউরোস। আমার বউয়ের পরিবারের প্রবল আপত্তি আছে আর্মির ব্যাপারে। যুদ্ধের গন্ধ পান তাঁরা। চাপ দিতে শুরু করেছেন আমার শ্বশুর। তাঁর চেয়েও বেশি জোর দিচ্ছেন শাশুড়ি। তাদের ব্যবসায় যেন মন দিই। ভাবতে পারো, জ্যাঁ মউরোস বিক্রি করছে মোবাইল ফোনের রিং টোন? আমি তো খুন হয়ে যাব!

আমার তো কাজটা ভাল লেই মনে হচ্ছে, হাসল রানা। গোলাগুলি নেই, শুধু শুনবে মিষ্টি সব আওয়াজ।

আমার বন্ধু হয়ে এমন পাষাণের মত কথা বলতে পারলে, রানা? দুঃখে গলা ভেঙে গেল মউরোসের। মাথা নাড়ল। আমি আত্মহত্যা করব। তার আগে তিক্ততা তৈরি হবে জোয়ির সঙ্গে আমার। তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো শ্যাম্পেনের বোতল খালি করে ফেলল মউরোস।

তোমার বিয়েতে কোনও উপহার দিইনি, বলল রানা। কাজে এলে হাজার কয়েক পাউণ্ড নিতে পারো আমার কাছ থেকে।

আগে ধার নিতাম, শোধও করে দিতাম; কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কোনও কাজ নিতে পারব না বলে ধারও নেব না। শোধ করার সাধ্য নেই।

তা হলে কী করতে চাও?

রানা এজেন্সি তো মাঝে মাঝে কিডন্যাপিং কেস পায়, তাই না? আলাপের মাধ্যমে জিম্মি ছুটিয়ে নেয়ার মত তেমন কোনও সহজ কেস পেলে…।

তেমন কোনও কেস পেলে জানাব। তবে তাতেও বিপদ হতে পারে। রাজি না-ও হতে পারে তোমার স্ত্রী।

ওকে বলব, চাকরি নিয়েছি সিকিউরিটি কন্সালটেন্টের।

গ্লাস খালি করে ফেলেছে রানা।

বিয়ের পর নিজ দায়িত্ব বুঝে চলতে হয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলল মউরোস। টাকা ধার নিয়ে পরে শোধ করতে পারব না, তেমন মানুষ নই। এখন মাথার ওপর ভেঙে পড়ছে আকাশ। দূরে তাকাল মউরোস। সহজ কাজ হলে জানিয়ো। প্রচুর টাকা লাগবে এমন নয়। আগে পেট তো চালাতে হবে।

ওদের টেবিলের দিকে হনহন করে হেঁটে আসছে জোয়ি থম্পসন। মেহেদি রঙা চুল, বেশ দীর্ঘাঙ্গিনী। নাকে নাকফুল। একটু উঁচু চোয়াল। তাতে খারাপ লাগে না দেখতে। পরনে দামি পোশাক। চোখের কঠোর দৃষ্টিতে সন্দেহ। রানার সামনে এস দাঁড়াল মেয়েটা।

জোয়ির সঙ্গে রানাকে পরিচয় করিয়ে দিল মউরোস।

আপনার কথা অনেক শুনেছি, রানাকে আপাদমস্তক দেখল জোয়ি। দুর্ধর্ষ, বেপরোয়া, কঠোরে-কোমলে মেশানো মানুষ। জান দিতে পারেন বন্ধুদের জন্যে। মউরোসের সঙ্গে  আপনার সব অভিযানের গল্প জানি। মনে মনে প্রশংসা না করে পারিনি।

চুপ করে মেয়েটির দিকে চেয়ে আছে রানা।

এবার নিশ্চয়ই আমার স্বামীকে প্রস্তাব দেবেন আপনার কোনও অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দেয়ার জন্যে? কড়া সুরে জানতে চাইল জোয়ি।

জোয়ি, ভুলে গেছ রানাকে দাওয়াত দিয়েছি আমি? রাগে-লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মউরোসের গাল।

স্বামীকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি রানার চোখে তাকাল জোয়ি। আমি চাই না মউরোসকে বিপজ্জনক কোনও কিছুর ভেতর জড়ান আপনি।

দুশ্চিন্তা করবেন না, নরম সুরে বলল রানা।

ঘোঁৎ করে নাক দিয়ে তাচ্ছিল্যের আওয়াজ করল জোয়ি। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। এবার, প্লিয, ফেরত পেতে পারি আমার স্বামীকে? …আপনার সঙ্গেও পরিচিত হতে চাইছে। একজন।

জোয়ির আঙুল অনুসরণ করল রানা। তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী এক যুবতী। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। সরাসরি চেয়ে আছে রানার দিকে।

ওর নাম জেনি হাওয়ার্ড, বলল জোয়ি, ওর বাবা-মা প্রায় কিনে ফেলেছে শ্ৰপশায়ার। অসম্ভব ধনী। এমন কী আমার বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি। ভারবিয়ারে সময় কাটায়। শীতে, ড্রাইভ করে ল্যাম্বোরগিনি। আমার কাছে জানতে চেয়েছে, মউরোসের পাশে কালো চুলের লম্বা ওই বাদামি যুবক কে।

এমন একজন, যাকে কখনও পাবে না ওই মেয়ে, বলল মউরোস।

কঠোর চোখে স্বামীকে দেখে নিয়ে বলল জোয়ি, যান না, গিয়ে বলুন ওর সঙ্গে নাচতে চান?

জোয়ি… শুরু করেছিল মউরোস…

আমি তো নাচই জানি না! বন্ধুর দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। ঠিক আছে, তোমাদের দারুণ পার্টিতে এসে খুব ভাল লাগল। পরে দেখা হবে। চেয়ার ছেড়ে রওনা হয়ে গেল ও।

পেছন থেকে বলল অসহায় মউরোস, পরে ফোনে কথা হবে, রানা!

জবাবে মাথা দোলাল রানা। তবু পেরোবার সময় চট করে দেখল হাতঘড়ি। ওর দিকে আসছে জেনি হাওয়ার্ড। ঝলমল করছে সিল্কের নীল ব্লাউয, মানিয়ে গেছে আকাশী দুই চোখের মণির সঙ্গে। হাই, মিষ্টি কণ্ঠে বলল মেয়েটি। আমি জেনি হাওয়ার্ড। আপনি কি সত্যিই মিস্টার মউরোসের বন্ধু?

ডাহা মিথ্যা বলেছে কেউ, জানিয়ে দিল রানা। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। পরে হয়তো কখনও দেখা হবে।

থমকে গিয়ে বিস্মিত চোখে দেখল সুন্দরী, ওকে পাত্তা না দিয়ে কার-পার্কিং লটের দিকে চলেছে বাঙালি যুবক।

.

০৩.

বিকেল পেরিয়ে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা।

অক্সফোর্ড শহরের সামারটাউন।

সদর দরজা বন্ধ করে হলওয়ের কাছে থামলেন প্রফেসর জন হার্বার্ট। ফুলদানীর পাশের ওক কাঠের স্ট্যাণ্ডে ঝুলিয়ে দিলেন গাড়ির চাবি। কয়েক পা হেঁটে কাঠের ডেস্কে রাখলেন হাতের ব্রিফকেস। 

থমথম করছে বাড়িটা। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। আজ ফেরার কথা ক্যাথির। তাঁর মেয়ে বাড়িতে থাকলে লিভিংরুমের হাই-ফাই সেট-এ ফুল ভলিউমে বাজে হার্ড রক মিউযিক।

খোলামেলা মস্ত কিচেন। প্যাশিয়োর দিকে একটা জানালা খোলা। ওই পথে আসছে বাগানের ফুলের মিষ্টি সুবাস। প্রফেসরের মনে পড়ল, গতরাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ফ্রিযে রেখেছেন আধখালি ওয়াইনের বোতল। ফ্রি খুলতেই দেখলেন, তার দিকে চেয়ে হাসছে সদ্য তৈরি চকোলেট মুস। ওটা খুব প্রিয় ক্যাথির। ও বাড়ি ফিরলে সবসময় ওই পুডিং তৈরি করে ওর মা।

বোতল থেকে গ্লাসে ঠাণ্ডা ওয়াইন ঢেলে নিলেন প্রফেসর, চেহারায় বিরক্তি। গ্লাসে মৃদু চুমুক দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে পা রাখলেন বাগানে। ফুলের বেডের কাছেই হাঁটু গেড়ে বসে আছেন তাঁর স্ত্রী। পাশেই রঙচঙে তাজা ফুলে ভরা ট্রে।

মুখ তুলে স্বামীকে দেখে হাসলেন মহিলা। আজ বেশ তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?

ও কোথায়?

এখনও আসেনি।

আওয়াজ নেই দেখেই বুঝেছি। এতক্ষণে তো ওর চলে আসার কথা।

নরম মাটিতে কর্ণিক গাঁথলেন রিয়ানা হার্বার্ট। উঠে দাঁড়িয়ে হাত থেকে ঝাড়লেন ধুলোবালি। চোখ স্থির হলো স্বামীর হাতের ওয়াইনের গ্লাসের ওপর। দেখে তো দারুণ মনে হচ্ছে। স্ত্রীর হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিলেন প্রফেসর। ওয়াইনে চুমুক দিয়ে জিভ চাটলেন রিয়ানা, তারপর নরম সুরে বললেন, চিন্তা কোরো না। জানোই তো ও কেমন। হয়তো কোনও বন্ধুর কাছে লণ্ডনে রয়ে গেছে।

ওর উচিত ছিল সরাসরি চলে আসা। এত বেশি বন্ধু ভাল কথা নয়। আজকাল আমাদের সঙ্গে আর দেখাই হয় না। ওর।

এখন তো আর ছোটটি নেই। পুরো পঁচিশ বছর।

 সেক্ষেত্রে ওর উচিত বড়দের মত আচরণ করা।

পরে নিশ্চয়ই ফোন দেবে। তারপর কালকে হাজির হবে হঠাৎ করে।

তুমি ওকে বেশি বাড়তে দিয়েছ, বিরক্তি নিয়ে বললেন প্রফেসর হার্বার্ট। ওর প্রিয় পুডিংও দেখলাম ফ্রিযে।

রিয়ানা হাসলেন। আমার চেয়ে কম আদর করো না তুমি ওকে।

বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে প্রফেসর বললেন, উচিত ছিল ফোনে জানিয়ে দেয়া, ও কোথায় আছে। তা হলে অন্তত দুশ্চিন্তা করতাম না।

.

০৪.

গ্রিস, প্যাক্সোস দ্বীপ।

হাঁফিয়ে উঠে জেগে গেল ক্যাথি হার্বার্ট। চোখের পাতা মেলতেই দেখল, মুখে পড়ছে কড়া রোদ। বারকয়েক চোখ পিটপিট করল। ঠিকভাবে দেখতে চাইছে, কিন্তু সব ঝাপসা। প্রথমেই মনে হলো: আমি আছি কোথায়?

মিনিটখানেক পর কমল মগজের ঘোলাটে ভাব।

হ্যাঁ, ও আছে একটা বেডরুমে।

কিন্তু কার বেডরুম?

ওর নিজের? 

কিছুই তো মনে পড়ছে না!

বুকে অদ্ভুত এক অনুভূতি টের পেল ক্যাথি।

নারকেলের ছোবার মত কর্কশ এক ম্যাট্রেসে শুয়ে আছে। ও। গায়ে কুঁচকে যাওয়া পুরনো চাদর। ধড়মড় করে উঠে বসল ক্যাথি। শরীরের একপাশে টনটনে ব্যথা। কুঁচকে গেল ওর গাল। চেপে ধরল পাঁজর। মনে হলো ফেটে গেছে। দুএকটা হাড়। দাউদাউ আগুনে যেন পুড়ছে মগজ। সিযন করা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে জিভ। হাতের দিকে তাকাল ক্যাথি। ফুলে আছে। ছড়ে-কেটে গেছে। বেশ ব্যথা। নিশ্চয়ই পড়ে গিয়েছিল ওপর থেকে। তখন আত্মরক্ষা করতে গিয়েই হাতের এই বেহাল অবস্থা।

হঠাৎ মনে পড়ল, আলো দেখেছিল। খুব উজ্জ্বল আলো। বিকট আওয়াজ হয়েছিল। কোথায় যেন ভিড় করেছিল অনেক মানুষ। অদ্ভুত এসব স্মৃতি খুবই ঘোলাটে। জড়িয়ে যাচ্ছে একটার সঙ্গে আরেকটা, যেন ছায়া। অস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে একটা-দুটো কথা। পড়ে যাচ্ছিল ও। তখনই ঠুকে গেল মাথাটা। হাত দিয়ে স্পর্শ করল করোটির পেশি। ফুলে গেছে। চোট লেগেছে জোর।

আসলে কী হয়েছিল?

 মন থেকে মেঘের জটলা দূর করতে চাইল ক্যাথি।

বারকয়েক চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়ল। না, সত্যিই, কোনও স্মৃতি নেই ওর!

এবার ভয় পেল ক্যাথি। কিছুই মনে পড়ছে না। জানা নেই ও কে, কী করছে এখানে! কী এক সর্বনাশ হয়েছে ওর! হয়তো বহু ওপর থেকে পড়েছিল। তাতে ক্ষতি হয়েছে মগজের। মনে মনে প্রার্থনা করল, বড় কোনও সমস্যা যেন না হয়। যেন ঠিক হয়ে যায় ওর ব্রেন।

শুধু বুঝতে পারছে, পড়েছে মস্তবড় বিপদে!

ভয়ানক হিংস্র জানোয়ার ধারেকাছে এলে, ফাঁদে পড়া নিরীহ জন্তুরও বোধহয় এমনই লাগে।

সহজাত অনুভূতি সতর্ক করছে ওকে।

দেরি কোরো না! পালাও! পরের কথা ভাবতে হবে না! আগে প্রাণে বাঁচতে চেষ্টা করো!

ঘরে ও ছাড়া আর কেউ নেই। মৃদুমন্দ হাওয়ায় উড়ছে। জানালার পর্দা। বাইরের ব্যালকনিতে বসে আছে এক লোক।

গলা আরও শুকিয়ে গেল ক্যাথির।

রোদে ডেক-চেয়ারে বসে থাকা লোকটার হাতে পিস্তল! ওটা দেখতে অনেকটা বাক্সের মত। নল তাক করে রেখেছে ওর দিকেই!

প্রথমে ক্যাথি ভেবেছিল, এদিকেই চেয়ে আছে লোকটা। কিন্তু খুব ধীরে ধীরে নড়ছে তার বুক। জেগে থাকলে ঠিকই দেখত, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছে ও। সাগর থেকে আসা হালকা বাতাসে উড়ছে লোকটার পরিপাটি চুল। পায়ের কাছে ওউযযার খালি বোতল।

দাঁতে দাঁত চেপে শরীরের ব্যথা সয়ে বিছানা থেকে নামল ক্যাথি। এক পা রাখল টাইল করা মেঝেতে। ঠাণ্ডা।

নড়ল না লোকটা।

উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা থেকে সরে গেল ক্যাথি। বনবন করে ঘুরছে মাথা। বিমানের ডানার মত দুদিকে হাত বাড়িয়ে ঠিক করে নিতে চাইল ভারসাম্য। দেখল, ওর পরনে ময়লা সাদা প্যান্ট, হলদে টপ। ঘামে চটচট করছে গা। এই পোশাকেই আছে ও এখনও। ছিঁড়ে গেছে প্যান্টের ডান হাঁটু। শরীর ভরা ধুলোবালি। ব্যথা ডানদিকেই বেশি। বুঝে গেল, পতনের সময় পড়েছে ওদিকে কাত হয়ে।

বিছানার পাশে হিলওয়ালা স্যাণ্ডেল। ওটা মানিয়ে গেছে ওর হলদে টপ-এর সঙ্গে। স্যাণ্ডেল কি ওর? জানা নেই। স্ট্র্যাপ ধরে স্যাণ্ডেল নিয়ে দরজার দিকে চলল ও। প্রার্থনা করছে, চেয়ারে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা যেন চট করে জেগে না  ওঠে।

আস্তে করে দরজার হ্যাণ্ডেলে মোচড় দিল ক্যাথি। ভাবছে, ওটা লক থাকবে। কিন্তু মৃদু ক্লিক আওয়াজে খুলল দরজা। বুকের ভেতর মস্ত এক লাফ দিল ওর হৃৎপিণ্ড। শব্দ না করেই বেরিয়ে এল সামনের করিডোরে। একটু এগোলেই নিচে যাওয়ার সিঁড়ি। পা টিপে-টিপে করিডোর পেরিয়ে ধাতব রেলিঙের পাশ থেকে উঁকি দিল নিচে। কারা যেন আলাপ করছে বাড়ির ভেতর কোথাও। শুনল এক মহিলা কণ্ঠ। হেসে উঠল এক লোক।

হাতুড়ির মত পাঁজরে ধুপ-ধাপ বাড়ি মারছে ক্যাথির হৃৎপিণ্ড। সিরামিক টাইলের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে লাগল। ব্যথায় কুঁচকে ফেলেছে মুখ। ভীষণ ভয়ের কারণে ওকে খুব সতর্ক করে তুলেছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। জানা নেই, আছে কোথায়। পরিষ্কার বুঝল, প্রথম সুযোগেই এখান থেকে বেরোতে হবে ওকে।

শব্দ না করেই নিচতলায় নামল ক্যাথি। ওপরের বেডরুম থেকে দৌড়ে এল না কেউ। কোনও বিপদও হলো না।

সিঁড়ি শেষ হতেই সামনে পড়ল আরেকটা দরজা। ওটা খোলা। বাইরে থেকে আসছে ঝলমলে সোনালি রোদ। এক হাতে স্যাণ্ডেল, অন্য হাতে পাঁজর চেপে ধরে ছোট্ট টেরেসে বেরিয়ে এল ক্যাথি। চাতালে ছোট সব টবে রাখা ফুলের গাছ। ওগুলো পাশ কাটিয়ে তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে সাদা পাথরের সৈকতে নেমে পড়ল ও। আগুনের মত গরম নুড়িপাথর বেশ ধারালো, খচখচ করে বিধছে পায়ে। স্যাণ্ডেল পরে নিল ক্যাথি। ওগুলো অচেনা কারও হলেও মানিয়ে গেছে। একদম মাপে মাপে।

সৈকত ধরে এগোল ক্যাথি। মাঝে মাঝে ঘুরে দেখছে সাদা বাড়িটা। জানালায় শাটার, ছাত লাল টাইলের। দোতলার ব্যালকনিতে লোকটাকে দেখল ক্যাথি। ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে ডেক-চেয়ারে। বাড়ির পেছনে উঁচু ক্লিফে চড়েছে জঙ্গুলে জমি। ওদিক দিয়ে উঠতে পারবে না ক্যাথি। হতাশ হয়ে চারপাশ দেখল।

সৈকত ফাঁকা। তবে একটু দূরে প্রায় ধসে পড়া কাঠের এক জেটি। একপাশে নোঙর করেছে এক মোটর বোট। মৃদু ঢেউয়ের দোলায় দুলছে এদিক ওদিক।

জেটির দিকে পা বাড়াল ক্যাথি। আগের চেয়ে জোরে হাঁটছে। স্যাণ্ডেলের তিন ইঞ্চি হিলের জন্যে হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল। বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছে ওই সাদা বাড়ি।

না, ওদিকে কেউ নেই।

হয়তো নিরাপদেই বেরোতে পারবে এই বিপদ থেকে।

জেটিতে পৌঁছে গেল ক্যাথি। কাঠের পাটাতন শক্তপোক্ত বলেই মনে হলো। ফস্কা পাথর আর বালির চেয়ে ওটার ওপর দিয়ে যাওয়া সহজ হবে। হাঁটার গতি বাড়াল ক্যাথি। ভুলে গেছে টনটনে ব্যথার কথা।

কিন্তু তিন সেকেণ্ড পর পেছনে শুনল কর্কশ এক চিৎকার।

ওটা এসেছে বাড়ি থেকেই।

পুরুষকণ্ঠ। রেগে গিয়ে ফাটিয়ে ফেলছে গলা।

ভয়ে বুক ধক-ধক করছে ক্যাথির। ঝট করে ঘুরে তাকাল। ওর হৃৎপিণ্ড যেন এক লাফে বেরিয়ে আসবে পাঁজর ভেদ করে। দোতলার ব্যালকনির পরিপাটি চুলের ওই লোক টেরেসের তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ছুটে আসছে জেটির দিকে, হাতে পিস্তল! চিৎকার করে জঘন্য সব গালি দিচ্ছে সে।

দুসেকেণ্ড পর বাড়ি থেকে বেরোল আরও তিনজন। এক সুন্দরী যুবতী ও দুই পুরুষ। ক্যাথির দিকে আঙুল তুলল মেয়েটা, পরক্ষণে জেটি লক্ষ্য করে দৌড় দিল তিনজন। চিৎকার করে কী যেন বলছে নিজেদের ভেতর।

জেটির মাঝে পৌঁছে গেছে ক্যাথি। যেতে পারবে বোট  পর্যন্ত। কিন্তু আউটবোর্ড মোটর চালু করতে পারবে কি না, তা জানে না।

গুলি করবে না তো এরা?

 কী চায় এরা ওর কাছে?

দুর্বলতা ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে ক্যাথির পা। টলমল করতে করতে চলল বোটের দিকে। তখনই হোঁচট খেল এবড়োখেবড়ো কাঠের পাটাতনে। তক্তার মাঝের এক ফাটলে পা পড়তেই মুচড়ে গেছে গোড়ালি। পা টেনে নিতে চাইল ক্যাথি। বেকায়দাভাবে আটকা পড়েছে স্যান্ডেলসহ গোড়ালি। উঠে বসে খুলতে চাইল স্ট্রাপওয়ালা স্যাণ্ডেল।

জেটির পাটাতনে ধুপ-ধাপ আওয়াজে ছুটে আসছে কেউ। তিন সেকেণ্ড পর ক্যাথির ঘাড়ে ঠেকিয়ে দেয়া হলো পিস্তলের মাযল। কানের কাছে ফোঁস-ফোঁস শাস ফেলছে সে। মুখ তুলে তাকাল ক্যাথি। দাঁত খিঁচিয়ে ওকে দেখছে রাগে অন্ধ পরিপাটি চুলের লোকটা!

পৌঁছে গেল অন্যরাও।

কী হয়েছে? জানতে চাইল একজন।

কুত্তীটা কখন যেন জেগে গিয়েছিল, কাঁধের ওপর দিয়ে বলল পরিপাটি চুল।

তুমি কী করছিলে? কঠোর সুরে জানতে চাইল সুন্দরী যুবতী। নিজে ঘুমাচ্ছিলে?

পরিপাটি চুল জবাব না দিয়ে ঘাড় ধরে টেনে তুলল ক্যাথিকে। ঘাড়ে-পিঠে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে চলল বাড়ির দিকে।

দৌড়ে পালাতে চাইল ক্যাথি। কিন্তু খপ করে ধরা হলো ওর দুহাত। লাথি ছুঁড়তে চাইল ও, প্রাণপণে জুড়ল আর্তচিৎকার।

ওকে কিছুই বলল না কিডন্যাপাররা। নিয়ে চলেছে টেনে হিঁচড়ে। আবারও তুলল দোতলার ঘরে। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলল। কিডন্যাপাররা এবার ডাক্ট টেপ ব্যবহার করল ওর দুই গোড়ালি ও হাঁটুতে। উপায় থাকল না হাঁটার।

কাজটা শেষ হলে বেল্টের পেছনে পিস্তল জল পরিপাটি চুল। খপ করে ধরল ক্যাথির ডান কবজি। এত জোরে চাপ দিল, ওর মনে হলো গুঁড়ো হচ্ছে হাতের হাড়। হ্যাচকা টানে ওর বাহু ওপরে তুলল লোকটা। ধাতব ঠং-ঠনাৎ আওয়াজ হলো। হ্যাণ্ডকাফের মাধ্যমে বিছানার ফ্রেমের সঙ্গে আটকা পড়ল ক্যাথির ডান কবজি। একইভাবে আটকে দেয়া হলো বাম কবজি।

প্রাণপণে লড়তে চাইল ক্যাথি। তাতে কোনও কাজ হলো না। আমার কাছে কী চান আপনারা? ছেড়ে দিন আমাকে! কী চান আপনারা আমার কাছে?

মুখে ডাক্ট টেপ লাগিয়ে দিতেই থামল ক্যাথির চেঁচামেচি। এখন শুধু দুচোখ থেকে দরদর করে নামছে অশ্রু।

পরিপাটি চুলের লোকটা বেল্টের পেছন থেকে পিস্তল নিয়ে আবারও নল ঠেকাল ওর মাথার পাশে। শীতল লোহার স্পর্শে ভীষণ ভয়ে সরতে চাইল ক্যার্থি। কিন্তু সে উপায় নেই। চোখ বুজে ফেলল ও।

হাসল লোকটা, সরিয়ে ফেলল পিস্তল। পিছিয়ে দাঁড়িয়ে ক্যাথিকে দেখল কিডন্যাপাররা। ভাল করেই জানে, ওই মেয়ের শক্তি নেই যে লড়বে। দম নিচ্ছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

যে-কোনও সময়ে আতঙ্কে জ্ঞান হারাবে ক্যাথি।

কোমরে দুহাত রেখে ঘাড় কাত করে ওকে দেখছে সুন্দরী যুবতী, ঠোঁটে মৃদু হাসি। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আপাতত একাই থাকুক। আমাকে ফোন করতে হবে। কাজটা শেষ হলে ওর পেট থেকে বের করব সব।

আপনারা কী চান আমার কাছে? চিৎকার করে জানতে চাইল ক্যাথি, কিন্তু মুখের টেপের কারণে কিছুই বলতে পারল না।

একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল কিডন্যাপাররা। 

সবার পরে গেল পরিপাটি চুলের লোকটা। তার আগে ঝুঁকে এসে ক্যাথিকে বলল, তোমাকে দুরমুশ করার সময় দারুণ মজা পাব আমি। সত্যি!

.

০৫.

অক্সফোর্ড শহর।

ভোরে ঘুম ভাঙতেই মুখ-হাত ধুয়ে টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ব্যায়াম করেছে রানা। স্নান সেরে জিন্স প্যান্ট ও সুতির সাদা শার্ট পরে নেমে এল হোটেলের রেস্টুরেন্টে। ধীরেসুস্থে সারল ইংলিশ নাস্তা। বিল মিটিয়ে আধঘণ্টা হেঁটে পৌঁছে গেল শহরের প্রাণকেন্দ্রে।

গতকাল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওর কজন সহপাঠীর দেয়া ডিনারে যোগ দিতে এই শহরে এসেছিল রানা। হাতে জরুরি কাজ নেই বলে ঠিক করেছে, স্মৃতি-বিজড়িত এই শহরে কাটিয়ে যাবে আরও দুএকটা দিন। ওর বন্ধুরা চাপ দিচ্ছিল, যেন তাদের বাড়িতে ওঠে। কিন্তু হোটেলে স্বস্তি বোধ করবে বলে নরম কথায় তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে রানা।

আপাতত চলেছে বড়লিয়ানের উদ্দেশে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে বড় ও পুরনো লাইব্রেরি ওটাই।

সাতসকালেই মাথার ওপর আগুন ঢালছে সূর্য। হাঁটতে হাঁটতে গরম লেগে উঠতে জ্যাকেট খুলে ফেলল রানা। ওটা ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি। আবারও যেন ফিরেছে ছাত্রজীবনে। লেখাপড়া ছাড়া আর কোনও দায় দায়িত্ব নেই, জীবনে নেই কোনও জটিলতা। সত্যিকারের মুক্ত-বিহঙ্গ।

আনমনে মৃদু হাসল রানা। ওকে অবাক চোখে দেখল এক পথচারী। হয়তো ভাবছে এই যুবক বদ্ধ-পাগল। হাসিটা আরও চওড়া হলো রানার। আপাতত ভুলে গেছে সব অপ্রাপ্তি ও কষ্ট। গুনগুন করে গেয়ে উঠল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে গিয়েই ব্রেক কষল। না, সুর জ্ঞান ঠিকই আছে, কিন্তু রাম ছাগলের ডাকের মতই লাগছে গলাটা নিজের কানে।

যা, ব্যাটা, তোর ফাঁসি! আর যা-ই হোক, তোকে দিয়ে গান-টান হবে না, মনে মনে রায় দিল রানা। পৌঁছে গেছে বডলিয়ান লাইব্রেরির আর্চওয়ের নিচে। ভাবল, মেইন রিডিং রুমগুলোয় আজও কি আছে পুরনো চামড়া আর বার্নিশ করা কাঠের গন্ধ?

লাইব্রেরিতে ঢুকে সোজা ডেস্কের সামনে থামল রানা। পকেট থেকে বের করে লাইব্রেরিয়ানের উদ্দেশে বাড়িয়ে দিল ওর পুরনো কার্ড। মনে পড়েছে, হাতির মত ইয়া মোটা জেন প্যাটারসনকে। লাইব্রেরিয়ান ওই মহিলা ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মহা এক আতঙ্ক। লালচে দুই চোখে সবাইকে চাইত ভস্ম করতে।

না, যুদ্ধের মাটিল্ডা ট্যাঙ্কের মত বিধ্বংসী জেন এখন আর নেই। সে-জায়গায় মিষ্টি এক মেয়ে। বয়স বড়জোর চব্বিশ। বেণী করেছে বালিরঙা চুল। এক গোছা পড়েছে চোখের ওপর। কার্ড নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত রানাকে দেখল মেয়েটা, তারপর মন দিল কার্ডে। বুঝলাম পুরনো ছাত্র, কিন্তু এই কার্ডে তো কাজ হবে না। লাগবে নতুন কার্ড।

ও। তা হলে নতুন কার্ড পাওয়া যায় কি না দেখি গিয়ে।

হাসল মেয়েটা। লাগবে না। চিনি আপনাকে। আমার তিন ক্লাস ওপরে পড়তেন। …কোন্ বই লাগবে, তা তো লেখেননি ফর্মে!

বই পড়তে আসিনি, ঘুরে দেখতে এসেছি, বলল রানা।

 তো যান, ঘুরে দেখুন, স্মিত হাসল লাইব্রেরিয়ান।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে সরে এল রানা। এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে দেখছে। রিডিংরুমে গভীর মনোযোগে বই ঘাটছে গম্ভীর কজন ছাত্র-ছাত্রী। কিছুক্ষণ পর আবার সামনের ঘরে ফিরল রানা। খেয়াল করেছে, প্রথম থেকেই ওকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে তরুণী লাইব্রেরিয়ান। চোখে চোখ পড়তেই লাল হচ্ছে দুগাল। তারপরই তাকাচ্ছে অন্যদিকে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেল নাকি রে, বাবা?

মেয়েটাকে মধুর এক নায়কোচিত হাসি দিয়ে লাইব্রেরি ছেড়ে বেরিয়ে গেল রানা।

নেই কাজ তো খই ভাজ– অবস্থা ওর।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে শত শত মানুষের ব্যস্ততা। নীরব বডলিয়ানের গভীর পেট থেকে বেরিয়ে এখন কাঠফাটা গরমে মনটা আনচান করে উঠল রানার। ঢুকে পড়ল সামনের প্রথম পাব-এ।

নাহ্, গোটা দুয়েক বিয়ার না খেলেই নয়!

.

০৬.

 গ্রিস, প্যাক্সোস দ্বীপ।

লাইন কি যথেষ্ট সিকিয়োর? আপনার সঙ্গে জরুরি আলাপ করতে চাই।

লাইন সিকিয়োর। তবে আগেই রিপোর্ট দাওনি কেন, পার্কার?

একটা সমস্যা হয়েছে।

চুপ করে আছে ওদিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, মেয়েটার বিষয়ে সমস্যা?

জী।

খুন করে ফেলোনি তো? আমি কিন্তু তোমাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলাম, যাতে জীবিত থাকে সে।

বেঁচেই আছে।

তা হলে আবার কী?

বেঁচে আছে, কিন্তু আমাদের কোনও কাজে আসছে না।

তার মানে সব গোলমাল করে ফেলেছ?

ওকে হাতে পেয়েছি আমরা, ঠিক আছে? কঠিন হয়েছে ওকে ধরা। ছিল একটা ছুটন্ত মোটরসাইকেলে। ভিলা থেকে তিন মাইল ধাওয়া করে টিলাগুলোর ওখানে ওকে ধরি। আঁকা কা পাহাড়ি পথ। দুপাশে জঙ্গল। থামাতে চেয়েছি আমরা। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে রাস্তা থেকে নেমে চলে গেল একটা ফার্মের গেটের ওদিকে। গাড়িতে বেণ্ডার আর ক্লেটনকে রেখে বয়েটারকে নিয়ে পায়ে হেঁটে পিছু নিই আমি।

তার মানে পালিয়ে গেছে?

না। পেয়েছি ওকে। মোটরসাইকেল থেকে পড়ার পর আর কোথাও যেতে পারেনি।

কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে ওর?

দৈহিকভাবে তেমন কিছু না, সামান্যই। কোথাও কোথাও ফুলে গেছে বা ছড়ে গেছে। কিন্তু চোট লেগেছে মাথায়। সমস্যা এখানেই। অজ্ঞান ছিল তিরিশ ঘণ্টা। চেতনা ফিরেছে, কিন্তু ভুগছে ট্রমাটিক অ্যামনেযিয়ায়। জবাব দিতে পারছে না আমাদের কোনও প্রশ্নের। জানেও না, ও আসলে  কে।

ঠিক মেয়ে, না ভুল করে অন্য কাউকে ধরেছ?

ভুল করিনি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।

কতটা খারাপ ওর অবস্থা?

সত্যি বলতে, তা আমরা জানি না। হয়তো চট করে উঠে আসবে অ্যামনেযিয়া থেকে।

নিজেদের জন্যে প্রার্থনা করো, যেন তা-ই হয়। বুঝতে পারছ, বিষয়টা কতটা সিরিয়াস?

সব আমাদের নিয়ন্ত্রণের ভেতরেই আছে।

আমার তো তেমন মনে হচ্ছে না, পার্কার। কয়েক দিনের ভেতর ওই মেয়ের স্মৃতি না ফিরলে, নিয়ে আসবে এখানে। ভাল ফ্যাসিলিটি আছে, এমন কোথাও নেব।

আরেকটা ছোট সমস্যা আছে।

 তার মানে, সমস্যা আরও আছে?

ভিলা থেকে উধাও হয়েছে মেয়েটার সব মালপত্র। ওই বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি আমরা। লাগেজ-টাগেজ কিছুই নেই। কথা ছিল ভোরে এয়ারপোর্টে যাবে। বুঝতেই পারছেন, আবারও নতুন করে প্ল্যান করতে হবে। আমরা দেখাতে পারব না যে দুর্ঘটনায় মরেছে।

কথা ঠিক, পার্কার।

আরেকটা কথা। পার্টিতে ছিল ওর এক বয়ফ্রেণ্ড। তখন তাকে সন্দেহ করিনি। ঝামেলা করেছে পরে। মেয়েটাকে দেয়া বয়েটারের ড্রিঙ্ক ফেলে দিয়েলি টেবিল থেকে। কাজটা করেছিল ইচ্ছে করে।

তার মানে, কিছু জানে ওই লোক। কে সে? যতটা জানি, স্থানীয়। ওই মেয়ের গাদা-গাদা বয়ফ্রেণ্ডদের একজন। বোধহয় বিবাহিত। প্রায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল পার্টিতে। ভিলার গ্যারাজে সবসময় রাখে ওর মার্সিডিয, যাতে কেউ না দেখে। আমাদের ধারণা, মেয়েটার মালপত্র আগেই সরিয়ে ফেলেছে ওই লোক। আমরা এটাও জানি, তার সঙ্গে বিছানায় যেতেই রওনা হয়েছিল ওই মেয়ে।

তা হলে সবই জানে লোকটা।

তাই তো মনে হয়। কিন্তু ওই মেয়ের স্মৃতি হারিয়ে গেছে বলে কিছুই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

লোকটা সম্পর্কে আর কিছু জানতে পেরেছ?

 তথ্য জোগাড় করার চেষ্টা করছি।

যা করার ঝটপট করবে। ঘড়ির কাঁটা মেপে কাজ করতে হবে। এদিকে যে-কোনও সময়ে ওই মেয়েকে খুঁজতে শুরু করকে ওর আত্মীয়স্বজনরা।

ওর প্রেমিককে খুঁজে নেব আমরা।

 নইলে পড়বে মস্ত বিপদে। কৈফিয়ত, অজুহাত বা ব্যর্থতা কোনওটাই সহ্য করা হবে না। ওই লোককে পাওয়ার পর গুম করবে তাকে। এখনও সুযোগ আছে এই বিচ্ছিরি পরিস্থিতি সামলে নেয়ার। মনে রেখো, কোনও গোলমাল হলে কেউ তোমরা প্রাণে বাঁচবে না। আমার কথা বোঝা গেছে?

.

০৭.

গত কয়েক দিন লণ্ডন শাখার রানা এজেন্সির জরুরি সব কাজ সারতে গিয়ে যথেষ্ট দৈহিক পরিশ্রম হয়নি রানার। আজ বিকেলের আগেই হোটেল থেকে বেরিয়ে এল জগিং প্যান্ট ও টি-শার্ট পরে। কর্নর্মার্কেটের ক্রেতাদের এড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলো পুরনো ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের কাছে। মনে পড়ছে অতীত স্মৃতি। এখানেই অধ্যাপনা করেন প্রফেসর জন হার্বার্ট। চাচার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। চাচা ক্যান্সারে মারা গেলে বেশ কবার এসেছিলেন ফুফুর বাড়িতে। সেই ছোটবেলায় দেখেছে, চেহারাটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। ওকে খুব উৎসাহ দিতেন অঙ্কের বিষয়ে। তাঁর নিজের ইচ্ছে ছিল গণিতের ছাত্র হওয়ার। বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আর হয়ে ওঠেনি। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে লেখাপড়া করে ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের লেকচারার হোক। তাই হন তিনি। বাইবেল সম্পর্কে মজার সব গল্প বলতেন রানাকে। পরেও কবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সবসময় মিষ্টি করে হাসতেন, জিজ্ঞেস করতেন লেখাপড়া ঠিকভাবে হচ্ছে কি না।

ক্রাইস্টচার্চের মেইন গেট পেরিয়ে চারকোনা বিশাল জমির দিকে তাকাল রানা। হেঁটে পৌঁছে গেল রাজকীয়, পুরনো বালিপাথরের দালানগুলোর কাছে। সূর্যের সোনালি আলোয় অদ্ভুত লাগছে সব। সমান করে ছাটা সবুজ ঘাসের প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডের ঠিক মাঝে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের ফোয়ারা। কিছুই বদলে যায়নি। যেন এখুনি ডানা মেলে উড়াল দেবে রোমান বার্তাবাহক দেবতা মার্কারি। ওই মূর্তি পাশ কাটিয়ে থমকে গেল রানা। একটু সামনেই প্রবেশপথের আর্চওয়ে, ওদিকে ইংল্যাণ্ডের সবচেয়ে ছোট ক্যাথেড্রাল। ব্যবহার করা হয় কলেজের চ্যাপেল হিসেবেও। সন্ধ্যা হলেই ওখানে শুরু হবে সমবেত প্রার্থনা।

ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের পেছনে বিস্তৃত তৃণভূমি।

 চ্যাপেলকে ডানে রেখে বামে চলল রানা।

চারপাশ নির্জন।

নদীতীরে গিয়ে আধঘণ্টা জগিং করে টের পেল, অনেকটা কেটেছে কাফ মাসলের আড়ষ্টতা। যে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আছে, একটু আনফিট হলেই খুন হয়ে যাবে। ঠিক করল, আগামীকাল ভোর থেকে বরাবরের মতই প্রতিদিন দৌড়াবে দশ মাইল করে।

বিশ্রাম না নিয়েই হালকা চালে দৌড়ে কলেজের বিশাল চৌকো জমির দিকে ফিরতে লাগল রানা। গুনগুন করে গাইছে বিখ্যাত এক গায়কের বিরহের গান। নিজের গানে এতই মুগ্ধ, খেয়াল করেনি এগিয়ে আসছেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক। রানা চ্যাপেল পেরোবে, এমনসময় ওর সামনে থমকে গেলেন মানুষটা। এক্সকিউয মি!

বলুন? গান গিলে ফেলল রানা।

 আপনি কি মাসুদ রানা?

জী। প্রথমবারের মত ভদ্রলোককে খেয়াল করে দেখল রানা।

আমি…

আপনি প্রফেসর জন হার্বার্ট, বলল রানা। বেশ কয়েক বছর পর দেখা হলো আপনার সঙ্গে।

আপনি… তুমি তা হলে সত্যিই রানা? বিস্মিত কণ্ঠে বললেন প্রফেসর।

তাই তো মনে হচ্ছে, আঙ্কেল জনি। আছেন কেমন?

মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক। চোখে কীসের যেন ঘন ছায়া।

ওটা কি বিষাদের? ভাবল রানা।

তোমার বন্ধু রিচার্ডের কাছে শুনেছি, এ শহরে এসেছ, বললেন প্রফেসর হার্বার্ট।

জী। বন্ধুদের একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলাম।

আজই একটু আগে ফোন করেছিলাম রানা এজেন্সিতে, ওরা তোমার ফোন নম্বর দিল না।

দেয়ার নিয়ম নেই। তবে আপনি নিজের নাম ও ঠিকানা দিয়ে থাকলে একটু পরেই মেসেজ পেয়ে যাব।

মাথা দোলালেন প্রফেসর। রানা, একান্ত ব্যক্তিগত একটা বিষয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। অস্বস্তি বোধ করছেন, ইতস্তত করে দ্বিধা কাটিয়ে বললেন,  আগামীকাল কি লাঞ্চের সময়ে ফ্রি আছ?

জী, আছি।

তুমি কি একবার আসবে আমাদের বাড়িতে? একসঙ্গে লাঞ্চ করতাম?

যা বলার তখনই বলবেন প্রফেসর, বুঝল রানা। আপনি নিশ্চয়ই এখনও সামারটাউনের ওই বাড়িতেই আছেন?

মাথা দোলালেন প্রফেসর হার্বার্ট।

 চলে আসব।

দুপুর একটায় অপেক্ষা করব তোমার জন্যে। ক্লান্ত হাসলেন প্রফেসর। রানা মাথা দোলালে চললেন ক্যান্টারবেরি কোয়াডে নিজ অফিসের দিকে।

পেছন থেকে দেখল রানা, বড় দুর্বল ভঙ্গিতে হাঁটছেন ভদ্রলোক। অথচ, বয়স তার মাত্র তেষট্টি। ছিলেন সবসময় হাসিখুশি ছটফটে মানুষ। চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। রসিয়ে বলতেন দারুণ মজার সব কৌতুক। আজকের এই প্রফেসরের সঙ্গে অতীতের ওই মানুষটাকে মেলাতে পারল না রানা।

একদম বুড়িয়ে যাওয়া পরাজিত এক মানুষ তিনি।

প্রফেসরের ভয়ানক কোনও রোগ হয়নি তো?

তা হলে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ দিলেন কেন?

না, অন্য কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন আঙ্কেল জনি।

ওর যাওয়াই উচিত।

.

০৮.

 গ্রিস, প্যাক্সোস দ্বীপ।

সুযোগ পেলেই বাক ক্ল্যাস্প নাইফ আরও ধারালো করে পরিপাটি চুলের লোকটা। ব্যালকনিতে বসে আছে কড়া রোদে। একটু পর পর ওউযযা ঢালছে গলায়। মাঝে মাঝে দেখছে ক্যাথিকে, আর ভাবছে: কুত্তী মেয়েলোকটাকে কুচি কুচি করে কাটতে পারলে মন্দ হতো না। মেয়েটাকে দেখলেই প্রতিবার ঘৃণায় কুঁচকে ফেলছে ভুরু। ধার দেয়ার তেলমাখা পাথরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘষছে ছুরির চকচকে রুপালি ফলা। এতই ধারালো করেছে, রাতে ফলার ওপর একটা ব্যাঙ্ক নোট রেখে গেলে, পরদিন সকালে এসে দেখবে দুটুকরো হয়েছে ওটা।

প্যান্টের পকেট থেকে ছুরি নিয়ে ক্ষুরধার ফলা খুলল পরিপাটি চুল। ধীর পায়ে এসে থামল ক্যাথির বিছানার পাশে। বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখল মেয়েটা। ভয় পেয়েছে ভীষণ। চাইল গলা ফাটিয়ে আর্তচিৎকার করতে, কিন্তু মুখের টেপের জন্যে বেরোল অদ্ভুত আওয়াজ। হ্যাণ্ডকাফ পরা ওর প্রসারিত দুহাত পড়ে আছে বিছানায়। ম্যাট্রেসের কর্কশ কাপড় ভয়ে খামচে ধরল ক্যাথি।

বিছানার পাশে বসল পরিপাটি চুল। ঝুঁকে দেখাল ধারালো ছোরা। ওটা নিল ক্যাথির চোখের সামনে। দরদর করে ঘামছে মেয়েটা। দারুণ জিনিস, তাই না? সাবধানে ফলার ওপর বুড়ো আঙুল বোলাল। তাতে কেটে গেল ত্বকের পাতলা অংশ। তুমি জানোও না কতটা ধারালো। তবে সবই টের পাবে কিছুক্ষণ পর।

ছোরার ফলার উল্টো দিকের পুরু অংশ ক্যাথির গালে ছোঁয়াল সে। আঁৎকে উঠে শ্বাস ফেলল মেয়েটা। ঢোক গিলছে বারবার।

এবার তোমার মুখ খুলব, তবে চিৎকার কোরো না ভুলেও। সব খুলে বলবে। কিছুই চেপে যাবে না। নইলে এক খোঁচায় তুলে আনব তোমার একটা চোখ। তাতে দারুণ মজাও পাব।

ঘরের আরেক পাশ থেকে ক্যাথিকে দেখছে কৃষ্ণকেশী যুবতী। বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখেছে দুহাত। গম্ভীর। পরিপাটিকে বাধা দিতে গিয়েও চুপ করে থাকল।

ক্যাথির মুখ থেকে ফড়াৎ করে টেপ খুলল লোকটা। আতঙ্কে হাঁফাচ্ছে মেয়েটা। ঢোক গিলছে বারবার। শীতল ফলা আলতো করে ওর কপালে বুলিয়ে নেয়ায় গুঙিয়ে উঠল। ফলা এসে থামল চোখের কোণে।

আমার কিছুই মনে নেই, বিড়বিড় করল ক্যাথি। কিছুই জানি না।

সবই জানো। মিথ্যা বলবে না।

বিশ্বাস করুন… মিথ্যা বলছি না।

জানো, ছোরার ছোট্ট এক খোঁচায় টুপ করে উঠে আসবে তোমার ওই নীল চোখ, বলল পরিপাটি চুল। কখনও দেখেছ কীভাবে ফেটে যায় অক্ষিগোলক? দেখতে দারুণ মজার। যেন খোসা ছাড়ানো সিদ্ধ ডিম। হিমশীতল হাসল লোকটা। আস্তে করে ছোরা বোলাল ক্যাথির গালে। সরিয়ে নিল ছোরা।

ভয়ঙ্কর ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল ক্যাথি। ফুঁপিয়ে উঠল, আমি জানি না আপনারা কী বলছেন। কিছুই জানা নেই আমার।

সিম্পসন… বলল বয়েটার। তোমার মনে আছে মিস্টার সিম্পসনকে… তাই না? মনে নেই কী সর্বনাশ করেছ তার?

ঘনঘন মাথা নাড়ল ক্যাথি। প্রায় কেঁদে ফেলল।

ওটা কই? জানতে চাইল লোকটা।

আমি জানি না ওটা কী জিনিস।

 রেখেছ কোথায়? কড়া ধমক দিল পরিপাটি চুল।

কিছুই জানি না! ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি। আপনারা কী চান, তা-ই জানি না আমি! কিছুই জানি না! বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ওর চোখ। জুলফি বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া অশ্রুর সঙ্গে আটকে গেছে কয়েকটা চুল। বিশ্বাস করুন, কিছুই জানি না। আপনারা ভুল মানুষকে ধরেছেন! মনের দুঃখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল ক্যাথি। করুণা প্রার্থনা করল, ছেড়ে দিন আমাকে মাফ করে দিন! যেতে দিন! আমি কাউকে কিছুই বলব না, যিশুর কিরে!

সামনে বেড়ে লোকটার কাঁধে হাত রাখল কালো চুলের যুবতীটি। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

আড়ষ্ট হয়ে গেল লোকটা। কঠোর চোখে দেখছে ক্যাথি হার্বার্টকে। কয়েক সেকেণ্ড পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে পিছু নিল মেয়েটার। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল দুজন। পেছনে ভিড়িয়ে দিল দরজা। এখন কথা শুনতে পাবে না ক্যাথি। হুমকি দিয়ে কাজ হচ্ছে না।

ওই মেয়ে সব গোপন করছে, পার্কার, উত্তেজিত কণ্ঠে ফিসফিস করল লোকটা।

আমার তা মনে হচ্ছে না। ভুল ভাবছ।

কুত্তীটার সঙ্গে মাত্র আধঘণ্টা কাটাতে দাও, ওর পেট থেকে বের করে আনব সব।

কী করে? চোখ উপড়ে নিয়ে?

আধঘণ্টাই যথেষ্ট হবে। 

ওর ওপর কম মানসিক চাপ দিইনি আমরা। তোমার কেন মনে হচ্ছে ওর মুখ খোলাতে পারবে?

ঠিকই মুখ খুলবে। একটা ঘণ্টা সময় দিয়ে দেখো।

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়ল যুবতী। ওকে আর এখানে রাখব না। দরকারি সুযোগ সুবিধা এখানে নেই। ওকে পাঠিয়ে দেব।

তার আগে মাত্র দশটা মিনিট দাও, বাপ-বাপ করে মুখ খুলবে।

না।

পাঁচ মিনিট? বিশ্বাস করো, ভড়-ভড় করে সব বলবে।

 নির্যাতন করে খুব আনন্দ পাও, বয়েটার।

আমি শুধু নিজের কাজ করছি।

যদি মেরে ফেলো ওকে? তা হলে সবাই খুন হব।

খুন করব না। জানি কী করতে হবে।

তাই নাকি? নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল ক্রিস্টিনা পার্কার। মন দিয়ে শোনো, সরিয়ে ফেলবে তোমার ওই ছোরা। আবার যদি ওটা দেখি, তোমার মগজে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

তিরিক্ষি মেজাজ সামলে যুবতীর দিকে তাকাল খুনি বয়েটার। মুখে কোনও কথা নেই।

ওকে পাঠিয়ে দেব, বলল ক্রিস্টিনা পার্কার। কথা বের করার অন্য উপায় আছে ওদের।

.

০৯.

অক্সফোর্ড শহর।

হলিওয়েল মিউযিক রুমের খটখটে সিটে বসে একজন দুজন করে শ্রোতা ঢুকতে দেখছে রানা। এই হলরুমে সামান্য আওয়াজও ছড়িয়ে পড়ে দূরে, তাই ফিসফিস করে আলাপ করছে কেউ কেউ। পেছনের সারিতে আছে রানা। ভাল করেই জানে, শ্রোতার ভিড় হবে না এই কনসার্ট শুনতে।

ছাত্রজীবনে একবার ওকে এখানে ধরে এনেছিল এক আঁতেল বন্ধু। চরম অস্বস্তি বোধ করেছিল রানা। আজ কাজ নেই বলে এদিক-ওদিক ঘুরতে গিয়ে ঢুকে পড়েছে হলিওয়েল মিউযিক রুমে। ভাবছে, দেখাই যাক সহ্য হয় কি না তারের বার্টোকের চৌপদী। বেশিরভাগ মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে ওই আওয়াজে। মন বলতে শুরু করে, নিশ্চয়ই এই বাজে শব্দ আসছে স্রেফ নরক থেকে!

বডলিয়ান লাইব্রেরি থেকে সামান্য দূরেই এই কনসার্ট রুম। সাদা রঙ করা ঘর, শেষ প্রান্তে নিচু এক মঞ্চ। সব মিলিয়ে আঁটে বড়জোর এক শজন শ্রোতা। ভেতরে উজ্জ্বল, কড়া আলো। সিট তো নয় কাঠের তক্তা। নিতম্ব ও পিঠের বিশ্রামের উপায় নেই। কর্তৃপক্ষ গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দেন: এটা গোটা ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো কনসার্ট হল। একসময়ে এখানেই তাঁর কমপোযিশন বিলিয়ে দিতেন কমপোটির মাসিয়া হ্যাণ্ডেল।

একটু পর মঞ্চে উঠবে বাদক দল। তাদের নেতা সংক্ষেপে কমপোযিটর হ্যাণ্ডেল সম্পর্কে বক্তৃতা দেবে। নাম জানিয়ে দেবে দলের সবার। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মিউযিক বিভাগ থেকে অন্তত মাস্টার্স পাশ করেছে এরা প্রত্যেকে। মশা মারতে মারতে যেমন মানব-হত্যাকারী হয়ে ওঠে ভয়ানক খুনি, এদেরও ওই একই অবস্থা। একটু পর যে-যার বিশ্রী, বিকট আওয়াজ দিয়ে জান কবজ করতে চাইবে। ওই যান্ত্রিক তুমুল ঝড়ে টিকতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছে রানা।

মানসিক অত্যাচার সহ্য করার জন্যে তৈরি হচ্ছে, এমনসময় হঠাৎ করে দেখল ওই মেয়েটাকে।

ওকেও চিনে ফেলেছে মেয়েটা। ঠোঁটে ফুটল মৃদু হাসি।

বডলিয়ানের লাইব্রেরিয়ান। কাঁধে লুটিয়ে আছে বালিরঙা চুল। পরনে হালকা জ্যাকেট। তাতে আড়াল হয়নি যৌবন। দারুণ আকর্ষণীয় ফিগার মেয়েটার।

মেয়েটা এগিয়ে আসতেই কোল থেকে প্রোগ্রাম লিস্ট নামাল রানা।

একা? নরম সুরে জানতে চাইল মেয়েটা। বিরক্ত হবেন আমি বসলে?

পাশের সিটের পিঠে জ্যাকেট রেখেছে রানা, ওটা খপ করে ধরে সরিয়ে নিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না-না, বিরক্তি কীসের!

বসল মেয়েটা। ঠোঁটে হাসি। ওর হাতে ছোট একটা ব্যাগ, নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ভাবতেও পারিনি আপনাকে এখানে দেখব। নামটা বোধহয় আগে বলিনি? আমি লিলি।

জেনে খুশি হলাম। আমি রানা।

জ্যাকেট খুলে ফেলল লিলি।

রানা দেখল, প্রথম যখন ওদের দেখা হয়, সেই একই সাদা ব্লাউয মেয়েটার পরনে। কাজের চাপ বেশি?

মাথা নাড়ল লিলি। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মঞ্চে অবতরণ করেছে মিউযিশিয়ানরা, হাতে তাদের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র।

হাততালি দিল কয়েকজন শ্রোতা।

দুচার কথা বলল লিডার, তারপর যে-যার সিটে বসল দুই বেহালা বাদক, একটু দূরে ভায়োলা বাদক। দুদলের মাঝে বসেছে চেলিস্ট। পরস্পরের উদ্দেশে মাথা দোলাল তারা। তারপরই আর রক্ষা থাকল না রানার, কানের কাছে করুণ শব্দে আর্তনাদ ছাড়ল অন্তত দুতিনটে ক্ষুধার্ত হায়েনা।

ওই আওয়াজ যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি অস্বস্তিকর। কেন যেন মনে হয় বেঁচে থেকে আর লাভ কী! আত্মহত্যার ইচ্ছে হলেও টিকে থাকল রানা, কারণ নাকে এসেছে লিলির মিষ্টি পারফিউম। ওর হাঁটুর সঙ্গে ঘষা লাগছে মেয়েটার হাঁটু। প্রায় খালি হল-এ এত সিট পড়ে থাকতে মেয়েটা ওর পাশে এসে বসল কেন, ভাবছে রানা। প্রাণপণে ভুলে যেতে চাইল, ওর অসহায় কানের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন করছে নিষ্ঠুর একদল বাদক।

কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে। রানার মনে হলো কেয়ামত তক ওকে নরকে রাখার পর থেমে গেল সব শাব্দিক জট। ততক্ষণে সূর্যাস্ত হয়েছে। হলিওয়েলের সরু গলিতে বেরিয়ে এল রানা ও লিলি।

দারুণ লাগল, প্রশংসার সুরে বলল মেয়েটা।

হ্যাঁ, অন্তরটা একেবারে থরথর করে কাঁপিয়ে দেয়, সায় দিল গম্ভীর রানা।

একটু বেশি আওয়াজ, তাই না?

জেট বিমানের চালু ইঞ্জিনের মত তো আর নয়।

মনে এনে দেয় প্রশান্তি।

হাঁটতে হাঁটতে উদাস হয়ে গেল রানা।  

ড্রিঙ্ক নেবেন? জানতে চাইল লিলি।

ক্ষতি কী?

কাছেই টার্ফ পাব, মনে পড়ল রানার। ওরা রাস্তা পেরোতেই সামনে শুনল হালকা মিউযিক ও হাসির আওয়াজ।

পাবের ভেতরে ছাত একটু বেশি নিচু; দাঁত বের করে রেখেছে বিম, একদিকে গুহার মত জায়গায় কাঠের বার। দেখলেই বোঝা যায়, ওটার বয়স অন্তত দুআড়াই শ বছর।

ভেতরে গিজগিজ করছে কাস্টোমার। বেশ কয়েকটা টেবিল দখল করেছে একদল ইতালিয়ান পর্যটক। অতিরিক্ত আওয়াজ করছে তারা। লিলির জন্যে এক গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন আর নিজের জন্যে দু পেগ স্কচ হুইস্কি নিয়ে বেরিয়ে এল রানা। ওরা বসল নিরালা, নীরব বিয়ার গার্ডেনের এক কোণে। চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে পাথরের দেয়াল। তার ওপর উঠেছে কয়েক রকমের লতা ফুলগাছ। বাতাস ভারী হয়ে আছে মধুমালতির সুবাসে।

সিগারেটের প্যাকেট বের করে জানতে চাইল রানা, একটা ধরালে আপত্তি আছে?

আমিও নেব একটা, বলল লিলি।

প্যাকেট বাড়িয়ে ওকে একটা শলা দিল রানা। লাইটার জ্বেলে আগুন সরবরাহ করল। নিজেও ধরাল একটা। যে যার গ্লাস তুলে দুজন মৃদু টোকা দিয়ে নিল ওরা। এখানে কী করছে, ভাবতে গিয়ে কেমন যেন অবাক লাগছে রানার। তবে সহজভাবেই ওকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে মেয়েটা।

দারুণ কনসার্ট ছিল, বলল লিলি। শ্রোতা কম, এটা লজ্জাজনক।

বার্টোক শুনতে হলে রুচি তৈরি হতে হবে।

আধুনিক কনসার্ট চললে ফেটে পড়ত হলিওয়েল মিউযিক রুম। মৃদু হাসল লিলি। বলবেন, আপনি আছেন কী পেশায়?

টুকটাক সব কাজ। তেমন কিছু নয়।

 তা-ই না হয় শুনি আপনার আপত্তি না থাকলে।

ছোটখাটো একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাই, ওই কাজেই ব্যস্ত।

মনে হলো রানার কথায় সন্তুষ্ট হলো লিলি। এবার আমাকে নতুন করে ভাবতে হবে কী ধরনের ক্যারিয়ার বেছে নেব।

লাইব্রেরিয়ানের কাজ ভাল লাগে না?

লাগে। তবে আরও অনেক ভাল লাগে ছবি আঁকতে। আমি আসলে পেইন্টার হতে চাই। বড়লিয়ানের চাকরিটা সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টার। ওই বেতনে চলা কঠিন। চাইছি ফুল টাইম পেইন্টিং করতে। তাতে কোনওমতে খরচ উঠলে আর চিন্তা নেই।

আর্টিস্টদের জীবন খুব কষ্টের, বলল রানা, প্রাণপণ খেটেও অনেকে রয়ে যায় অসফল। আপনি কী ধরনের আর্ট করেন?

মৃদু হাসল লিলি। আপনার ভাল লাগবে না।

দেখিই না।

ব্যাগ থেকে একটা বিষনেস কার্ড নিল লিলি। ওটার এক দিকে লেখা: লিলি রিভার্স, ফাইন আর্ট পেইণ্টার। নিচে ফোন নম্বর আর ওয়েব সাইট অ্যাড্রেস। উল্টো দিকে অদ্ভুত এক ডিযাইন। ঝকঝকে, জ্যামিতিক। ওই ডিযাইন দেখে রানার মনে পড়ল ক্যাণ্ডিনস্কির কথা। এটা আপনার?

মাথা দোলাল লিলি।

সুন্দর। খুঁত নেই। আশা করি সফল হবেন। কার্ড বাড়িয়ে দিল রানা।

রেখে দিন, মৃদু হেসে বলল লিলি।

কার্ডটা পকেটে রাখল রানা। কিছুক্ষণের জন্যে ওদের মাঝে নামল নীরবতা। গ্লাসের সোনালি তরল ঘোরাচ্ছে রানা। অস্বস্তি বোধ করে হাতঘড়ি দেখল। ড্রিঙ্কটা শেষ করে বলল, এবার বিদায় নিতে হয়।

আপত্তি না থাকলে বলবেন, আপনি কোথায় থাকেন? জানতে চাইল লিলি।

উঠেছি উডস্টক রোডে মধ্যবিত্তদের জন্যে উপযুক্ত এমন এক গেস্ট হাউসে। …আপনি?

ছোট্ট ফ্ল্যাট জেরিকোতে।

সঙ্গে গাড়ি নেই, চলুন পায়ে হেঁটে কিছুদূর এগিয়ে দিই, বলল রানা।

গাড়ি থাকলে আমিও লিফট দিতাম। একই পথে সেন্ট গিলস্ পর্যন্ত যেতে পারি আমরা। যাবেন আমার সঙ্গে?

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

 মিষ্টি হাসল লিলি।

বিয়ার গার্ডেন থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি চলল ওরা।

সরু গলি ধরে হেঁটে চলেছে, তেমন কোনও কথা হচ্ছে না ওদের ভেতর। পুরনো সব কলেজ দালানে বাড়ি খেয়ে ফিরছে পদশব্দ। পৌঁছে গেল শহরের কেন্দ্রে। নিউ থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এল একদল দর্শক। ব্যস্ত হয়ে উঠল কাবাবের ভ্যানগুলো। রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে ভাজা মাংসের সুগন্ধ। সেন্ট জনের কলেজ পেরিয়ে চওড়া সেন্ট গিলস। এদিকের রাস্তা নির্জন। ল্যাম্প পোস্টের ঘোলাটে সোনালি আলোয় বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল লিলি। একপাশের গলি দেখাল। এবার আমাকে যেতে হবে ওই পথে। আশা করি আবারও দেখা হবে লাইব্রেরিতে?

হয়তো।

ঘুরে পা বাড়াবে রানা, এমনসময় ডাকল লিলি, রানা?

হ্যাঁ, কী?

 দ্বিধা নিয়ে বলল মেয়েটা, ভাবছিলাম… আগামীকাল রাতে আমার সঙ্গে সিনেমা দেখবেন?

চুপ করে থাকল রানা।

পেইন্টার গোয়েয়ার ওপরে সিনেমা, নার্ভাস সুরে বলল লিলি। বড় আর্টিস্ট ছিলেন।

তার ব্যাপারে জানি। কথাটা বলেই খারাপ লেগে উঠল রানার। এমন রুক্ষভাবে না বললেও পারত।

ভাল সিনেমা কি না, জানি না। ভাবলাম, আপনার হয়তো ভাল… মিইয়ে গেল লিলির কণ্ঠ। অস্বস্তি বোধ করে সামান্য সরল। চেয়ে আছে নিজের পায়ের পাতার দিকে।

নিজেও রানা পড়েছে অস্বস্তির ভেতর। নরম সুরে বলল, সরি, লিলি। আমি বোধহয় আপনার সঙ্গে যেতে পারব না। হয়তো আগামীকালই ফিরব লণ্ডনে।

ও। লজ্জায় লাল হলো মেয়েটা। নিচু করে নিয়েছে মাথা। ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। পরে হয়তো কখনও আবার ও দেখা হবে। ঘুরে হেঁটে চলল গলির ভেতর।

দাড়িয়ে থাকল রানা।

ঘুরে তাকাল না লিলি।

 নিজের পথে পা বাড়াল রানা। তবে এক শ গজ যেতেই গতি কমল ওর। তারপর ল্যাম্প পোস্টের সোনালি আলোর নিচে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মাথা নাড়ল বার কয়েক। লাথি দিতে ইচ্ছে হলো নিজের পাছায়। কানে শুনল নিজের কড়া কণ্ঠ। লিলির প্রস্তাবটা এভাবে ফিরিয়ে দেয়া অনুচিত হয়েছে। করে বসেছে বাজে কাজ। মেয়েটা এমন নয়, যে-কারও সঙ্গে ডেট-এর জন্যে প্রস্তাব দেবে। অনেক ভেবে, বহু দ্বিধা কাটিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর বোকার মত ওই হাত সরিয়ে দিয়েছে ও। করে বসেছে চরম অপমান। এখন ফিরে গিয়ে কৈফিয়ত দিলে হয়তো কমবে ওর দোষ।

ঘুরেই হন হন করে রওনা হলো রানা। ঢুকে পড়ল সরু ওই গলিতে। ল্যাম্প পোস্টের হলদে আলোয় প্রায় কিছুই দেখছে না। দুপাশে উঁচু দালানের দেয়াল। কেউ নেই, ফাঁকা পড়ে আছে গলি।

অবশ্য তিরিশ গজ দূরে রানা দেখল লিলি আর তিন তরুণকে। ওই তিনজন কোণঠাসা করেছে মেয়েটাকে।

সামনের জন গলা ধরে দেয়ালে ঠেলে রেখেছে লিলিকে। দুপাশে তার দুই অপকর্মের সঙ্গী। পালাবার পথ রাখেনি। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে মেয়েটা। ওর ব্যাগ এখন একদিকের তরুণের হাতে। শক্ত করে স্ট্র্যাপ ধরে রেখেছে লিলি, দেবে না সর্বস্ব। গায়ের জোরে পারবে না বুঝে শেষে ছেড়েই দিল ব্যাগ, ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গায়ের জোরে জিতে গিয়ে খলখল করে হাসল তিন তরুণ।

অন্ধকার ও ছায়ায় মিশে এগোল সতর্ক রানা। লিলিকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত ওরা। প্রশিক্ষিত সৈনিক হলেও জানত না কখন ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে রানা। তিন তরুণের দুজন শ্বেতাঙ্গ, তৃতীয়জন কুচকুচে কালো। তার হাতেই লিলির ব্যাগ। গলা ধরে লিলিকে ঠেসে ধরেছে যে, ন্যাড়া মাথা তার। নাকে রিং। আত্মবিশ্বাসী। তাকেই নেতা বলে মনে হলো রানার। দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গ তরুণ বেঁটে এবং মোটা। পেট ভরা চর্বি। কমবয়সী তিন ছিনতাইকারী। বয়স হবে সতেরো থেকে বিশ। পরনে একই কোম্পানির পোশাক।

বয়স কম হলেও বিপজ্জনক। সোনালি আলোয় ঝিলিক দিল কী যেন। জ্যাকেটের পকেট থেকে ছুরি বের করেছে দলনেতা। কিচেন নাইফ। হ্যাণ্ডেল কালো প্লাস্টিকের। ফলা দৈর্ঘ্যে আট ইঞ্চি। একদিক করাতের মত খাজ কাটা। শিকারের মুখের সামনে ছুরি নাচাল তরুণ। ভয় পেয়ে আঁৎকে উঠল লিলি। ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে ওকে ধমক দিল দলনেতা তরুণ। চিৎকার করে তোক জড় করতে চাইলে খুন করে ফেলবে।

ছুরি দেখে কঠোর হলো রানার মুখটা। নিঃশব্দে এগোল আবার। এখনও ওকে দেখতে পায়নি তিন ছিনতাইকারী।

ব্যাগ হাতড়ে দেখছে কালো তরুণ। পার্স চাই তার।

মোটা তরুণ ধরে রেখেছে লিলির বাহু। আরেক হাতে কবজি থেকে খুলতে চাইছে হাতঘড়ি। ভীষণ ভয়ে কাঁপছে লিলি। চোখে মৃত্যু-আতঙ্ক।

ভূতের মত ছায়া থেকে বেরিয়ে এল রানা।

 রানা! ওকে দেখতে পেয়েছে লিলি।

চমকে গেছে তিন ছিনতাইকারী। চোখ বিস্ফারিত হলো তাদের।

কী করবে তা ঝড়ের বেগে ভেবে নিয়েছে রানা। মাত্র তিন সেকেণ্ডে হাড়গোড় ভেঙে রাস্তায় পড়ে থাকবে তিন তরুণ। সাধারণ মানুষ মনে করে আতঙ্কের জিনিস ছিনতাইকারীর ছোরা, কিন্তু দলনেতা জানেও না, কীভাবে ব্যবহার করতে হয় ফলা। চাইলে এই ছোকরার কাছ থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে দুই সেকেণ্ডে তার মগজে গেঁথে দিতে পারবে রানা।

বিপজ্জনক তরুণ এরা। তবে কাঁচা।

পার্স খোলো, কুচকুচে কালো ছেলেটাকে বলল রানা।

একবার পার্স, তারপর আবার বাদামি যুবককে দেখল তরুণ। যুবকের চোখে ভয়ঙ্কর কঠোরতা।

নিজে চোখ পিটপিট করতে লাগল সে।

রানার চোখ দলনেতার ওপর। নিষ্কম্প, নরম কণ্ঠে আবারও বলল, খোলো ওটা।

চোখে-মুখে দ্বিধা ছুরিওয়ালার। কুঁচকে ফেলেছে ভুরু।

সে কী ভাবছে, তা বুঝল রানা।

তারা দলে তিনজন। কিন্তু তার পরও কী যেন ঠিক নেই। ছোকরার মনে হচ্ছে, এই লোক একাই দশজনের সমান। আত্মবিশ্বাস কমছে তার।

তরুণের চোখে হুমকির জায়গায় দেখা দিয়েছে ভয়। চেষ্টা করছে সেটা লুকাতে। ছুরির হ্যাণ্ডেল ধরা তালু ঘামছে। কাঁপছে ফলা। লিলির গলা থেকে হাত সরাল সে।

সুযোগ পেয়ে কয়েক পা সরে গেল মেয়েটা।

রানার কথা শুনেছে কালো তরুণ। চামড়ার ছোট্ট পার্স লিলির, বেশ ব্যবহৃত। চেইন টেনে খুলল ছেলেটা। ভেতর থেকে বেরোল একটা বিশ পাউণ্ডের নোট।

যথেষ্ট নয়, মাথা নাড়ল রানা। একেকজন পাবে সাত পাউণ্ডেরও কম। ডেবিট কার্ড ফুরিয়ে গেছে। একই কথা ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারেও। তো এই ভদ্রমহিলার কাছে বেশি টাকা নেই। বাড়ি ফিরবে তোমরা একেকজন পৌনে সাত পাউণ্ড হাতে। মাটি হবে পুরো রাত। বন্ধুদের গর্ব করে বলতে পারবে না, অসহায় এক মেয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছ সব।

মর শালা! নিজেকে সামলে নিয়ে গালি দিল দলনেতা। কণ্ঠ কেঁপে গেছে তার।

গালি পাত্তা দিল না রানা। ঠিক আছে, এসো একটা চুক্তি করি। প্যান্টের পেছন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল ও। ওটা খুলে দেখাল। ভেতরে সব পঞ্চাশ পাউণ্ডের নোট। অন্তত এক শটা। মানিব্যাগ নাচাল রানা। সবই পাবে। সেজন্যে কিছু না, শুধু খুন করতে হবে আমাকে। …কিন্তু যদি ব্যর্থ হও, পড়ে থাকবে এই গলিতে হাত-পা ভাঙা অবস্থায়। জীবনে আর উঠে বসতে পারবে না। মৃদু হাসল রানা। চকচক করছে দুচোখের কুচকুচে কালো মণি। মজার খেলা, তাই না?

কথাটা ভাল ঠেকল না বলে এক পা পিছাল দলনেতা। তার দিকে চেয়ে ঢোক গিলল অন্য দুজন।

অলসভঙ্গিতে মানিব্যাগ পকেটে রাখল রানা। আরও কথা আছে। পরে যদি শুনি লিলি রিভার্সকে আবারও বিরক্ত করেছ, খুঁজে নেব তোমাদেরকে।

 পাবেন কই? শুকনো গলায় বলল দলনেতা।

পাব, নরম সুরে বলল রানা। তখন শুধু হাত-পা ভাঙব। স্রেফ খুন হয়ে যাবে।

দ্বিধা যাচ্ছে না শক্তপোক্ত শরীরের তরুণের।

ছুরিটা ফেলল, বলল রানা। ব্যাগ আর পার্স ফেরত দাও ভদ্রমহিলাকে।

পরস্পরের দিকে তাকাল তিন ছিনতাইকারী।

মাত্র তিন গুনব, এক পা সামনে বাড়ল রানা। এরপরের সব দায়-দায়িত্ব তোমাদের।

লোকটা অস্বাভাবিক। কাঁপে না গলা। যা বলছে, করে দেখাবে বলেই মনে হচ্ছে। সামান্য ইতস্তত করে হাত থেকে ছুরি ফেলল দলনেতা। ব্যাগ ও পার্স লিলির হাতে ধরিয়ে দিল কালো ছেলেটা। পিছিয়ে গেল মোটকু। চেয়ে আছে রানার চোখে।

অ্যাই, চল! বলে হঠাৎ করেই দৌড় দিল দলনেতা। সে লেজ তুলে ভাগছে দেখে পেছনে ছুটল অন্য দুজন।

থরথর করে কাঁপছে লিলি, মুখ ফ্যাকাসে। সামনে বেড়ে চলে এল রানার পাশে। ওর কাঁধে হাত রাখল রানা। লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিল ছুরিটা।

সত্যিই হাত-পা ভাঙতে? জানতে চাইল লিলি। চমকে গেল রানার চোখের কালো মণিতে চোখ রেখে। তুমি আসলে কে, রানা?

চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই, বলল রানা।

.

১০.

 শহরতলীতে ফুল ও ফলের গাছে শোভিত ভিক্টোরিয়ান বড়সড় এক সেমি-ডিটাচড় বাড়িতে থাকেন হার্বার্ট পরিবার। দুপুর সাড়ে বারোটায় মিসেস হার্বার্টের জন্যে এক বোতল দামি ওয়াইন ও কিছু ফুল নিয়ে উপস্থিত হলো রানা।

বহুদিন পর দেখল রিয়ানা হার্বার্টকে। তাঁর চোখে-মুখে বয়সের ছাপ নেই। তবে কালো চুলের মাঝে এখন ধূসর সব রেখা। আগের মতই হালকা-পাতলা। কিন্তু রানার মনে হলো, বেশ রুগ্ন হয়ে গেছেন রোগেশোকে। চিরকাল ছিলেন চুপচাপ মানুষ। ভালবাসেন স্বামীর আড়ালে থাকতে। আজ যেন আরও বেশি নীরব। রানার জানার কথা নয়, পুরো সাত দিন ধরে নিখোঁজ তাদের একমাত্র সন্তান ক্যাথি।

বাড়ির পেছনে প্যাশিয়োতে সার্ভ করা হলো লাঞ্চ। রানা দেখল, আগের মতই আছে ওঁদের শখের বাগান। অবশ্য আরও ঝলমল করছে প্রফেসরের গোলাপ ঝাড়ের রঙিন ফুল। বাগানের শেষে পাথরের দেয়াল ছেয়ে ফেলেছে আইভি লতা।

লাঞ্চ শেষে ওয়াইনে চুমুক দিয়ে টুকটাক আলাপ করছে ওরা, এমনসময় ছুটে এল সাদা একটা ছোট টেরিয়ার কুকুর। সন্দেহ নিয়ে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে আর শুঁকছে ঘাস।

অনেকদিন আগে যখন এসেছি, ঠিক এমনই একটা কুকুর ছিল আপনাদের, বলল রানা। ওটারই উত্তর পুরুষ?

ওর নাম ছিল মারিয়া, বললেন রিয়ানা। এটা ওর নাতি উইস্কি।

নাম শুনে তদন্ত বাদ দিয়ে ছুটে এল কুকুরটা। রানার সামনে বসে পড়ে বাড়িয়ে দিল ডান থাবা। হ্যাণ্ডশেক করবে।

এটা শিখিয়েছে ক্যাথি, বললেন প্রফেসর। ওর জন্যে মরে যেতেও রাজি উইস্কি। ক্যাথি আপাতত বাড়িতে নেই বলে ওর দেখভাল করছি আমরা। বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে কাটায় আমাদের মেয়ে।

উইস্কির সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করে জানতে চাইল রানা, কেমন আছে ক্যাথি?

মেয়েটার কথা শুনে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো দম্পতির। অস্বস্তি নিয়ে চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন প্রফেসর হার্বার্ট। চেয়ে আছেন নিজের হাতের দিকে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছেন রিয়ানা। চোখে চোখে কথা হলো স্বামীর সঙ্গে। যেন চাইছেন কিছু বলুন প্রফেসর।

খারাপ কিছু হয়েছে? জানতে চাইল রানা।

স্ত্রীর বাহুতে হাত রাখলেন প্রফেসর। চোখ তুলে চাইলেন না রানার চোখে। মনে হলো, বুকটা ভেঙে গেছে তাঁর।

মনে হচ্ছে, এটা সাধারণ আমন্ত্রণ নয়, কিছু বলতে আজ আমাকে ডেকেছেন, স্যর, বলল রানা।

টুইডের জ্যাকেটের পকেট থেকে পুরনো ব্রায়ার পাইপ বের করলেন প্রফেসর। প্লাস্টিকের পাউচ থেকে বাউলে তামাক ভরলেন।

উনি কী বলবেন সেজন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে রানা।

ভুরু কুঁচকে পাইপে আগুন দিলেন জন হার্বার্ট। সুগন্ধী তামাক গিলে একটু পর আকাশের দিকে ছাড়লেন ধোঁয়া। বহু দিন পর তোমাকে দেখে খুশি আমরা। তোমার জন্যে সবসময় খোলা এ বাড়ির দরজা। সাধারণ পরিস্থিতিতেও লাঞ্চের দাওয়াত দিতাম।

কী ধরনের সমস্যা?

চুপ করে আছেন প্রফেসর। 

উঠে চলে গেলেন রিয়ানা। একটু পর ফিরলেন আরেক বোতল ওয়াইন হাতে। তিনটে গ্লাস ভরে দিলেন। বসে পড়লেন আগের চেয়ারে।

চোখাচোখি হলো স্বামী-স্ত্রীর।

তোমার চাচা আর আমি ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বললেন জন হার্বার্ট। নিয়মিত যোগাযোগ না হলেও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতই জানি তোমাকে।

সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ, বলল রানা।

তাই ভাবছি, বিশ্বাস করতে পারব তোমাকে, বললেন হার্বার্ট। খুলে বলতে পারব সব।

মৃদু মাথা নেড়ে চুপ করে থাকল রানা। অপেক্ষা করছে।

তোমার কাছে সাহায্য চাই আমরা, দ্বিধা নিয়ে বললেন প্রফেসর। তুমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি যোগ দিয়েছিলে আর্মিতে। খুবই ভাল করছিলে ওখানে। পরে চাকরি ছেড়ে খুলেছ ডিটেকটিভ এজেন্সি। নাম হয়েছে এ ক্ষেত্রেও। কখনও কখনও হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করেছ, যাদের ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। বিশেষ করে কিডন্যাপড় বাচ্চাদের উদ্ধারের কাজে ভাল করেছে তোমার এজেন্সি। চুপ হয়ে গেলেন হার্বার্ট।

ক্যাথির কিছু হয়েছে, নরম সুরে বলল রানা।

চেয়ার ছেড়ে বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন রিয়ানা। দুমিনিট পর ফিরলেন। এখন হাতে রুপালি দুটো ফোটোফ্রেম। চেয়ারে বসে একটা বাড়িয়ে দিলেন রানার দিকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হার্বার্ট। তোমার মনে আছে ক্যাথিকে, রানা? তোমার সঙ্গে ওর শেষ দেখা হয়েছিল অন্তত বিশ বছর আগে।

আবছাভাবে রানার মনে পড়ল মিষ্টি এক মেয়েকে। ওর পেছনে ছুটে বেড়াত সাদা এক কুকুর। ফোটোতে মন দিল রানা। খুশিতে উচ্ছল বাচ্চা এক মেয়ে। সামনের ওপরের পাটিতে দুটো দাঁত নেই।

পাঁচ বছর বয়স ছিল ওর, বলল রানা।

সাড়ে পাঁচ, বললেন প্রফেসর।

এখন পঁচিশ, জানালেন রিয়ানা। বাড়িয়ে দিলেন দ্বিতীয় ফ্রেম।

ওটা নিয়ে ফোটো দেখল রানা। যৌবনে এসে দেখতে দুর্দান্ত সুন্দরী হয়েছে ক্যাথি। নীল চোখ। খাড়া নাক। সুন্দর ঠোঁট। কোমর পর্যন্ত সোনালি চুল। জাপটে ধরে রেখেছে ছোট্ট একটা কুকুর ছানা।

আগামী মার্চে ওর ছাব্বিশ হবে, বললেন রিয়ানা।

ছবি টেবিলে নামিয়ে রাখল রানা। ক্যাথির কী হয়েছে?

ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বললেন প্রফেসর, সাত দিন আগে ফেরার কথা। কিন্তু ফেরেনি।

কী ধরনের সমস্যা? জিজ্ঞেস করল রানা।

অস্বস্তি নিয়ে পাইপ নাড়ছেন জন হার্বার্ট। কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন, তারপর দ্বিধা কাটিয়ে বললেন, আমরা খুব ভালবাসি ক্যাথিকে।

স্বাভাবিক, ভদ্রলোক আসলে কী বলতে চান, তা বুঝতে পারছে না রানা।

চুপ করে আছেন প্রফেসর। একটু পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলেন, আমাদের ব্যক্তিগত কিছু কথা বলব তোমাকে। আশা করি, এ বিষয়ে আর কারও সঙ্গে আলাপ করবে না। এমন বিষয়, যেটা আমাদের সম্মান-অসম্মানের সঙ্গে জড়িত।

আমার মুখ বন্ধ থাকবে, আঙ্কেল,বলল রানা।

দুর্বল হাসলেন হার্বার্ট। রিয়ানা আর আমার বিয়ের পর বহু দিন পেরোলেও বাচ্চা হয়নি। দোষ আমাদের ছিল না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। তারপর পুরো পাঁচ বছর পর প্রেগনেন্ট হলো রিয়ানা। এরপর পৃথিবীতে এল আমাদের পুত্র সন্তান। 

অপেক্ষা করছে রানা। ওর জানা আছে, হার্বার্ট দম্পতির কোনও ছেলে নেই।

ওর নাম দিলাম আমরা হেনরি। একটা বছরও বাঁচল না ও। আমরা তলিয়ে গেলাম চরম হতাশা ও দুঃখের সাগরে।

বুঝতে পেরেছি, কেমন কষ্ট লেগেছিল আপনাদের, বলল রানা।

অনেক বছর আগের কথা, তবুও ভাবলে এখনও বুক ভেঙে যায় আমাদের, বললেন প্রফেসর। ও চলে গেলে আবারও বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু হচ্ছিল না। আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে দত্তক নেব ভাবছি, এমনসময় কনসিভ করল রিয়ানা। ওটা ছিল আমাদের জন্যে অলৌকিক ঘটনা। নয় মাস পর এল নিখুঁত একটা মেয়ে।

ওকে মনে আছে, বলল রানা, হাসিখুশি, বুদ্ধিমতী।

তাই আসলে, বললেন প্রফেসর। তবে তখন মনে হয়েছিল, আবার যদি স্রষ্টা কেড়ে নেন ওকে আমাদের কাছ থেকে? জানি, এমনটা ভাবা অযৌক্তিক। বড় কোনও রোগ ছুঁতে পারল না ওকে। আমাদের অতি আদরে বড় হতে লাগল। আর এটাই দোষ করলাম আমরা। লাই দিয়ে খেয়ে ফেললাম ওর মাথাটা। মানুষ করতে পারলাম না।

এখন কী করছে, ক্যাথি? জানতে চাইল রানা।

অল্প বয়সে লেখাপড়া শেষ করে নামকরা অ্যাকাডেমিক। মগজ ভাল। বেশি খাটতে হয়নি ওকে। মাস্টার্স পাশ করল আর্কিওলজির ওপর। ম্যাগডালেন থেকে। ফার্স্ট ক্লাস। ওর প্রিয় সাবজেক্ট বিবলিকাল আর্কিওলজি। নতুন সায়েন্স। ওটায় প্রথমসারির পথিকৃৎ ও। গতবছর তিউনিসিয়ায়, যে টিম ওস্ট্রাকা আবিষ্কার করেছে, তাদের নেতৃত্বে ছিল ক্যাথি।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ওস্ট্রাকোন শব্দটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। অর্থাৎ খোসা। বহুবচনে ওস্ট্রাকা নামটি এসেছে আর্কিওলজিস্টদের কাছ থেকেই। হাজার হাজার বছর আগে ওই মাটিতে লেখা হতো দরকারি সব তথ্য। বাদ পড়ত না চুক্তি, হিসেব, বিক্রির খতিয়ান, বই এবং ধর্মীয় বিষয়বস্তু।

খবরটা জানি, বলল রানা। তবে জানতাম না আমার চেনা কেউ ওটা আবিষ্কার করেছে।

খুব খুশি হয়েছিল ক্যাথি, বললেন প্রফেসর। উনিশ শ দশ সালে ইরায়েলে যেসব ওস্ট্রাকা পাওয়া গিয়েছিল, তারপর এত বছর পর এত পরিমাণে লিখিত তথ্য পেল কেউ। সব ছিল প্রাচীন এক মন্দিরে। হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল।

পত্রিকার পাতায় পড়েছি, বলল রানা।

অন্যদের চেয়ে অনেক আলাদা ও। লিখে ফেলেছে গ্রিক সেজ প্যাপিয়াসের ওপরে বই। কয়েকবার ওকে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছে আর্কিওলজি টিভি চ্যানেল থেকে।

কৃতী-সন্তানের জন্যে গর্বিত হওয়ার কথা আপনাদের, বলল রানা।

মৃদু হাসলেন প্রফেসর জন হার্বার্ট। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর আবার মেঘ জমল চোখে-মুখে। বুকের কাছে ঝুঁকে গেল, থুতনি। নিভে গেছে পাইপ। ওটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। পেশাদার অ্যাকাডেমিক হিসেবে তুলনা নেই ওর। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে ও খুব অস্বাভাবিক। আমাদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভাল নয়। হতাশা বোঝাতে হাতদুটো তুলে আবার নামিয়ে নিলেন। আমি আর কী বলব? বয়স পনেরো হওয়ার পর থেকেই পুরো বখে গেল ও। কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। বেশ কয়েকবার ছিঁচকে চুরি করে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। দোকান থেকে মালপত্র চুরি, মানুষের পকেট মারা… এসব। ওর ঘরে পেতাম চোরাই মালপত্র। এসব ছিল ওর জন্যে মজার ব্যাপার। আমরা ভাবতাম, বয়স হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। মাতলামি, বাজে মানুষের সঙ্গে মেশা… নোংরা পার্টি নিয়ে ব্যস্ত থাকা, সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা… মারামারি… চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর। একটু পর আবার শুরু করলেন, কথায় কথায় তর্ক করে। আগ্রাসী মানসিকতা। যেটা চায়, যেভাবে হোক আদায় করে ছাড়ে। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে চুন থেকে পান খসলেও এত খারাপ সব কথা বলে, শুনলে লাল হয়ে যায় কান। লালচে হয়ে গেছে প্রফেসরের চোখ। রানার চোখে তাকালেন। জানি, এমন হয়েছে আমাদের দোষেই। দ্বিতীয়বার সন্তানের মুখ দেখতে পেয়ে এতই খুশি হয়েছিলাম, আহ্লাদ দিয়ে নষ্ট করেছি ওর মাথা।

প্রফেসর থেমে যেতে ওয়াইনে মৃদু চুমুক দিল রানা, তারপর বলল, বলেছেন ক্যাথি বাড়িতে নেই। তা হলে কি ধরে নেব ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?

আজ নিয়ে সাত দিন, আস্তে করে মাথা দোলালেন প্রফেসর।

আপনারা ভাবছেন, কোনও ঝামেলায় পড়েছে ও?

কী ভাবব, সেটাই জানি না।

ওর সম্পর্কে যা শুনলাম, তাতে এক সপ্তাহ কিন্তু অনেক দিন নয়। আপনিই বলেছেন, বুনো জীবন কাটাচ্ছে ও। হয়তো চলে আসবে যে-কোনও দিন।

যদি তা বিশ্বাস করতে পারতাম, ভাল হতো… মাথা নাড়লেন প্রফেসর। স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মুখ নিচু করে বসে আছেন রিয়ানা।

আপনারা কি চান আমি ওকে খুঁজে বের করি? জানতে চাইল রানা।

খুব ভাল হতো।

ইচ্ছে করে দূরে সরে থাকা এবং ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথাও বন্দি বা কিডন্যাপ হওয়া কিন্তু এক কথা নয়, বলল রানা।

মিথ্যা বলব না, আগেও নানান লোকের সঙ্গে উধাও হয়েছে, কাঁপা গলায় বললেন প্রফেসর।

মাথা নিচু করে বসে আছেন রিয়ানা। বললেন, কিন্তু এবার ব্যাপারটা তেমন নয়। খুব খারাপ অনুভূতি হচ্ছে আমাদের।

কী কারণে আপনাদের এমন মনে হচ্ছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। টাকা। টাকার জন্যে। কোথা থেকে পেল ক্যাথি অত টাকা?

একটু খুলে বলুন।

সরি, অতীতের বেশ কিছু কথা খুলে বলিনি। আগস্ট মাসে তুরস্কে এক এক্সকেভেশনের প্রোজেক্টে কাজ করছিল ক্যাথি। সেসময় হঠাৎ করেই আমরা জানলাম, ওই কাজ বাদ দিয়ে চলে গেছে কোর্ফিউ দ্বীপে। ওখানে এক বন্ধু আছে আমার। কয়েক দিন তার ওখানে ছিল ক্যাথি। চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে লাগলেন, তখনই হঠাৎ কোথা থেকে যেন পেয়ে গেল অনেক টাকা। ডক্টরাল ছাত্রী। অত টাকা ওর কাছে থাকার কথা নয়। অথচ, আমার বন্ধুর কথা অনুযায়ী, ওই সময়ে দুহাতে টাকা ওড়াতে লাগল ও। হাজার হাজার ডলার। আমার বন্ধুর মনে হয়েছে, এতই বেশি টাকা, চাইলেও খরচ করে ফুরাতে পারবে না ক্যাথি। দিতে লাগল একের পর এক পার্টি। প্রতি দিন নতুন সব লোক নিয়ে মাতাল হয়ে ফিরতে লাগল বাড়ি।

বুঝতে পারছি, আপনারা আছেন ভীষণ মানসিক কষ্টে।

মাথা নাড়লেন প্রফেসর। সেটা বড় কথা নয়। মন্দ দিক হচ্ছে, আমার বন্ধুর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। মেজাজ দেখিয়ে চলে গেছে ওর বাড়ি ছেড়ে। দ্বীপের সবচেয়ে দামি হোটেলে উঠেছে ক্যাথি। তারপর ওখানেও ঝামেলা করেছে বলে ওকে বের করে দিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। তখন ভাড়া করেছে উপকূলে বিলাসবহুল এক ভিলা। দামি জায়গা। বন্ধুর কাছে শুনেছি, অসভ্য একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশে ওই ভিলায় দিনরাত পার্টি করছিল ও। 

বলে যান।

তারপর হঠাৎ করেই উধাও হলো। আট দিন আগের কথা। ল্যাণ্ড ফোনের রেকর্ডারে পেলাম ওর মাতাল কণ্ঠের বার্তা। আগামীকাল দুপুরে বাড়ি ফিরবে ক্যাথি। ব্যস, তারপর থেকে আর কোনও খোঁজ নেই। এখনও অপেক্ষা করছি ওর জন্যে। কেউ জানে না কোথায় গেছে। আমাদের চেনা প্রতিটি ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে খোঁজ নিয়েছি। এখন আর ওই ভিলায় নেই ক্যাথি। কোনও হোটেলেও নেই। কোর্ফিউ এয়ারপোর্টের কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, সেই ভোরে বিমানে ওঠেনি ক্যাথি। স্রেফ যেন মিলিয়ে গেছে বাতাসে। কাতর চোখে রানাকে দেখলেন প্রফেসর হার্বার্ট। এসব থেকে কী বুঝছ?

কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল রানা, প্রথম থেকে ধরা যাক। আপনি অবাক হয়েছেন, কোথা থেকে এল এত টাকা। এটা বড় বিষয় না-ও হতে পারে। আপনি বলেছেন, ক্যাথির অভাব নেই বয়ফ্রেণ্ডের। হতে পারে, কোনও বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশছে। এখনও কোর্ফিউ দ্বীপ ত্যাগ করেনি। রূপসী মেয়ে। ওকে কাছে পাওয়ার জন্যে আগ্রহী হবে অসংখ্য ধনী মানুষ। সেজন্যে হাজার হাজার ডলার খরচ করতেও দ্বিধা করবে না। হয়তো কোর্ফিউ দ্বীপ থেকে দূরে দুর্দান্ত কোনও ইয়টে আমোদ-ফুর্তি করছে ও।

হতে পারে, বললেন প্রফেসর হার্বার্ট।

তার ওপর রয়েছে ক্রেডিট কার্ড। কয়েক শ ডলার খরচ করলেই দশ গুণ টাকা ধার দিতে চায় ক্রেডিট কার্ড কর্তৃপক্ষ। এই কারণে সহজেই নগদ টাকা পেয়ে থাকতে পারে।

অসম্ভব নয়, সায় দিলেন প্রফেসর।

তা হলে ঠিক কী কারণে আপনারা ভাবছেন, মস্ত কোনও বিপদে পড়েছে ক্যাথি?

বুঝিয়ে বলা কঠিন, বললেন হার্বার্ট, কিন্তু কেমন যেন লাগছে আমাদের। এ অনুভূতি শুধু সন্তানকে আগলে রাখার জন্যে, তা নয়। মন যেন বলছে, কোনও বিপদে পড়েছে। ক্যাথি। চেয়ারে ঝুঁকে রানার চোখে চোখ রাখলেন তিনি। আমাদের খুব উপকার হবে, তুমি একবার কোটি থেকে ঘুরে এলে। ক্যাথি ঠিক আছে কি না দেখবে। …আমাদের সর্বনাশ হবে ও ড্রাগ বা পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িয়ে গেলে… চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর।

ওসবে জড়াবে ভাবছেন কেন? বলতে গিয়েও চুপ করে থাকল রানা।

আমাদের সামনে আর কোনও উপায় নেই, রানা। এমন নয় যে আশা করব, তোমার কথায় বাড়ি ফিরবে ক্যাথি। কিন্তু হয়তো ফোন করবে আমাদেরকে। ওকে বোঝাতে পারবে তুমি, যত ঝগড়া বা তিক্ততাই হোক, সেজন্যে আমরা সত্যি দুঃখিত। অন্তর থেকে ভালবাসি ওকে।

অসহায় এক বাবার কাতর অনুরোধ কীভাবে ফেরাবে, তা নিয়ে ভাবছে রানা। তখনই দেখল, রিয়ানার চোখ থেকে টুপ করে পড়ল এক ফোঁটা অশ্রু।

আমরা ভেবেছি, ওকে খুঁজে বের করতে নিজেরা ওখানে যাব, বললেন হার্বার্ট, কিন্তু ওকে পেলেও, আমাদের কথা শুনবে না ও। নিজ ইচ্ছে মত চলে। দেখা হলেই শুরু করবে। ঝগড়া- আমরা নাক গলাচ্ছি ওর ব্যক্তিগত বিষয়ে। অভিযোগের পর অভিযোগ করবে- ওকে বাঁচতে দিচ্ছি না। তারপর চলে যাবে আরও বহু দূরে কোথাও। আমরা চিনি ওকে, আমাদেরকে কষ্ট দিতে ভাল লাগে ওর। তিক্ত হয়ে গেল তার চেহারা। এমন কাউকে চাই, যে কি না পরিবারের বন্ধু, ঠাণ্ডা মাথায় বোঝাতে পারবে ওকে। তেমন কাউকে পাচ্ছি না তোমাকে ছাড়া। …রানা, টাকা খরচ করতে দ্বিধা করব না। করুণ চোখে রানাকে দেখলেন তিনি। জমানো বেশ কিছু টাকা আছে আমাদের। খরচ করতে পারব দশ  হাজার পাউণ্ড। তাতেই হওয়ার কথা। বাড়তি কিছু টাকাও থাকবে তোমার হাতে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তোমার ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দিতে পারি ওই দশ হাজার পাউণ্ড। আসলে, আমার আর সাধ্য নেই, নইলে আরও বেশিই দিতাম।

রিয়ানার নীরব অশ্রু দেখার পর থেকেই মউরোসের কথা ভাবছে রানা। এবার সেটাই বলল, আমি হয়তো যেতে পারব না। তবে ব্যবস্থা করে দেব। আপনারা এমন কাউকে চান, যে কিনা বিশ্বস্ত। তেমনই একজনের কথা মনে পড়েছে আমার…

.

আধঘণ্টা পর হার্বার্ট ভিলা থেকে বেরোল রানা। সোজা ফিরল ওর হোটেলে। ঘরে পৌঁছে কল দিল মউরোসের নম্বরে। দ্বিতীয়বার রিং টোন বাজতেই ফোন ধরল ওর বন্ধু।

কাজ ঠিক করেছি তোমার জন্যে, বলল রানা। ওটা নিতে পারো।

খুশি হয়ে উঠল মউরোস। কী করতে হবে?

মন দিয়ে শোনো… প্রফেসরের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, সব গুছিয়ে বলতে লাগল রানা।

ওর কথা শেষ হলে মউরোস বলল, অন্তত এক বছরের মর্টগেজ শোধ দিতে পারব। তবে আগেই জানি, কী বলবে জোয়ি।

তোমার কাজ ক্যাথিকে খুঁজে বের করা। ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নয়। ওর বাবার কাছ থেকে যা শুনলাম, খুব কঠিন হবে না ওকে খুঁজে নেয়া। পার্টির বাজনা আর খালি বোতলের পথ পৌঁছে দেবে তোমাকে ঠিক জায়গায়। ওর বাবা-মা জানতে চান, তাঁদের মেয়ে সুস্থ কি না। তুমি বুঝিয়ে বলবে: ওর উচিত বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করা।

সহজ কাজ।

জোয়িকে বলতে পারো, তোমার কাজ এক বাবা-মার একটা মেসেজ তাদের মেয়ের কাছে পৌঁছে দেয়া। কাজটা কঠিন হওয়ার কথা নয়।

হ্যাঁ, গ্রিসের দ্বীপ তো আর আফগানিস্তান নয়। হাসল মউরোস। কাজ শেষ করতে বড়জোর চার-পাঁচ দিন, তাতে পাব দশ হাজার পাউণ্ড। যথেষ্ট বেশি। ভেরি গুড।

ঠিক আছে, তা হলে প্রফেসর হার্বার্টকে ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি, কাজটা নিচ্ছ তুমি।

স্বস্তির হাসি হাসল মউরোস। হ্যাঁ, জানাতে পারো, দোস্ত! আর… থ্যাঙ্ক ইউ।

মার খাবি, ব্যাটা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *