• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০২. ক্লাশে মন বসছিলো না সালমার

লাইব্রেরি » জহির রায়হান » আরেক ফাল্গুন (উপন্যাস) (১৯৬৯) » ০২. ক্লাশে মন বসছিলো না সালমার

ক্লাশে মন বসছিলো না সালমার।

প্রফেসর নার্ভাস সিসটেমের উপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আর সে ভাবছিলো তার কারারুদ্ধ স্বামীর কথা।

মাঝে মাঝে এমনি হয় তার। মনটা খারাপ থাকলে অথবা কোনো আন্দোলনের সামনে এসে দাঁড়ালে, কোন মিছিল দেখলে, কেন সভা-সমিতিতে গেলে, স্বামীর কথা মনে পড়ে। বড় বেশি মনে পড়ে তখন। কে জানে এখন কেমন আছে রওশন।

মাসখানেক আগে শেষ চিঠি পেয়েছিলো তার। তারপর আর কোন চিঠি আসেনি।

আগে নিজ হাতে লিখতে। কি সুন্দর হাতের লেখা ছিলো তার। আজকাল অন্যের হাতে লেখায়।

হাতের কথা মনে হতে মুখখানা ব্যথায় লাল হয়ে এলো তার। দুখানা হাতই হারিয়েছে রওশন।

একখানাও যদি থাকতো।

প্রথমে কিছুই জানতো না সালমা। শুনেছিলো রাজশাহী জেলে গুলি চলেছে। শুনে আর্তচিৎকারে কিংবা গভীর কান্নায় ফেটে পড়ে নি সে। বোব দৃষ্টি মেলে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। মুহূর্তের জন্য চারপাশের এই সচল পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল ভুলে গিয়ে, জানালার দুটো শিক দুহাতে ধরে নির্বাক দাঁড়িয়েছিলো সে। বুকের ঠিক মাঝখানটায় আশ্চর্য এক শূন্যতা।

হয়তো মারা গেছে রওশন।

পরে শুনলো মরে নি। ভালো আছে সে। সুস্থ আছে।

এই ঘটনার মাস দুয়েক পরে রাজশাহী জেলে রওশনের সঙ্গে দেখা করতে যায় সালমা। জেল অফিসের সেই ঘরে সেদিন সহসা যেন মাথায় রাজ পড়েছিলো সালমার। যে বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করতো সে দুটো হাত হারিয়েছে রওশন। শার্টের হাতজোড়া শুধু ঝুলে আছে কাঁধের দুপাশে।

সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো মনের ভাবটা আঁচ করতে পেরেছিলো রওশন। তাই ক্ষণিকের জন্যে সেও কেমন উন্মনা হয়ে পড়েছিলো। সেই প্রথম অতি কষ্টে, বাঁধ ভেঙ্গে আসা কান্নাকে সংযত করলে সালমা। আস্তে করে শুধালো, কেমন আছো?

শূন্য হাতজোড়া সামান্য নড়ে উঠলো। ঠোঁট কাঁপলো। রওশন মৃদু গলায় জবাব দিলে, ভালো।

নিজেকে বড় বিপন্ন মনে হলো সালমার, মনে হলো শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকের নিচে একটা চিনচিনে ব্যথা। সালমা সহসা প্রশ্ন করে বসলো, খাও দাও কেমন করে? বলে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলে সে। মুখের রঙ হলদে থেকে নীলে বদল হলো।

চোখজোড়, অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে রওশন ইতস্তত করে জবাব দিলো, বন্ধুরা খাইয়ে দেয়। বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এসেছিলো তাঁর। আর সালমার চোখে টলটল করে উঠেছিলো দু’ফোটা পানি।

ভাত না হয় বন্ধুরা খাইয়ে দেয়। কিন্তু কেমন করে বিড়ির ছাই ফেলে সে? কেমন করে বইয়ের পাতা উল্টোয়? কেমন করে জামাকাপড় পরে? ভাবতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠেছিলো তার। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ তুলে শুধালো, দুহাতেই কি গুলি লেগেছিলো? হ্যাঁ। রওশন জবাব দিলো, আর কয়েক ইঞ্চি এদিক ওদিক হলেই এ জন্যে আর দেখা পেতে না। সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো রওশন। অপরিসর সেই ঘরের চার দেয়ালে প্রতিহত হয়ে সে হাসি তীরের ফলার মত এসে বিঁধলো সালমার কানে।

সালমা শিউরে উঠলো। লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি?

শূন্য হাতজোড়া তখনন কাঁপছে হাসির ধমকে।

রওশনের সঙ্গে সালমার প্রথম আলাপ হয়েছিলো এক শাওন ঘন রাতে, ঢাকাতে ওদের টিকাটুলীর বাসায়।

তখন সালমা স্কুলে পড়তো। বয়সে আরো অনেক ছোট ছিলো। তখন আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের অনেকটা থিতিয়ে এসেছে। গ্রেফতার করে কয়েকশো লোককে আটক করা হয়েছে জেলখানায়। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে।

রওশনের নামেও পরোয়ানা বেরিয়েছিলো। আর তাই, আজ এখানে, কাল সেখানে গা ঢাকা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সে।

একদিন শাওন রাতে রিমঝিম বৃষ্টি ঝরছিলো। দাদার সঙ্গে রওশন এলে ওদের বাসায়।

বৃষ্টিতে গায়ের কাপড় ভিজে গিয়েছিলো।

গামছায় গা মুছে নিয়ে দাদা ডাকলেন, সালমা শুনে যা।

এই আসি, বলে দাদার ঘরে এসে রওশনকে দেখে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলো সালমা।

লম্বা গড়ন। উজ্জ্বল রঙ। তীক্ষ্ণ চেহারা। দাদা পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার বন্ধু রওশন। আর এ আমার বোন সালমা। ক্লাশ নাইনে পড়ে। সালমা হাত তুলে আদাব জানালো তাকে।

রওশন মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, কোন স্কুলে পড়ছে? কামরুন্নেছায়।

দাদা বললেন, মাসখানেক ও এখানে থাকবে সালমা। ওর দেখাশোনার ভার কিন্তু তোমার ওপর।

মাসখানেকের জন্যে ওর ভার নিয়েছিলো সালমা।

জীবনের জন্যে নিতে হবে কে জানতো?

ক্লাশ শেষে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পুরনো দিনের স্মৃতিটা যেন স্বপ্নের মত মনে হলো ওর।

 

শহরের এ অংশটা পুরানো আর ভাঙ্গাচোরা। বাড়িগুলো সব একটার সঙ্গে আরেকটা একেবারে ঠাসা। দরজাগুলো সব এত ছোট যে, ভেতরে যেতে হলে উপুর হয়ে ঢুকতে হয়। রাস্তাগুলো খুব সরু সরু। অনেক জায়গায় এত সরু যে পাশাপাশি একটার বেশি দুটো রিকশা যেতে পারে না। এমনি একটা সরু রাস্তার ওপরে মতি ভাইয়ের ছোট রেস্তোরাঁ।

সকাল থেকে মনটা আজ কেমন উন্মুখ হয়ে পড়ে আছে তার। কাউন্টারে বসে এতক্ষণ ফজলুর সঙ্গে তর্ক করছিলো সে।

ফজলু বলছিলো, আমি নিজ কানে শুনে এলাম, করাচীতে কোন এক মন্ত্রী মারা গেছে, তার জন্য খালি পায়ে হেঁটে শোক করছে ওরা।

আর তুমি বলছে মিথ্যে কথা?

তুমি একটা আন্ত উলুক। মতি ভাই গাল দিয়ে উঠলো। মন্ত্রীর জন্যে শোক করতে ওদের বয়ে গেছে। আসলে অন্য কোন কারণ আছে।

আমার তো মনে কেমন ধাঁ ধাঁ লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। আর জানো? কাল রাতে আমি একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি। মনে আছে, সেবারে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই সেবার। মনে পড়ছে না তোমার। উহ্ সে এক জামানা গেছে ভাই। আমার তো মনে হয়েছিলো দুনিয়াটা বুঝি ফানাহ্‌ হয়ে যাবে। চারদিকে শুধু হরতাল আর হরতাল। ইউনিভারসিটির ছাত্ররা। মেডিকেল কলেজ। সেক্রেটারিয়েট। হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি। ব্রিক ওয়ার্ক। রেলওয়ে। সব হিসেব দিয়ে কি আর শেষ করা যায়? তাই মিছিলের তো অন্ত ছিলো না। এ গলি দিয়ে একটা বেরুচ্ছে, ও গলি দিয়ে আরেকটা। সবার হাতে বড় বড় সব প্রাকার্ড। তাতে লাল কালিতে লেখা খুনীরা সব গদি ছাড়। সে এক জমানা গেছে ভাই। একটানা কথা বলতে গিয়ে ঘামিয়ে উঠলো মতি ভাই। কোলের উপর থেকে গামছাখানা তুলে নিয়ে গায়ের ঘাম মুছলো সে। তারপর সামনে ঝুঁকে পড়ে বললো, জানো? এই যে বসে আমি, এখান থেকে বিশ হাত দূরে, ওই-ওইযে ল্যাম্পশোস্টটা দেখতে পাচ্ছে, ওটার নিচে গুলি খেয়ে মারা গেলো আমাদের আমেনার বার বছরের বাচ্চা ছেলেটা।

ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো সে। হঠাৎ কোত্থেকে একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামলো ওখানটায়। পুলিশ দেখে, কি যে বলবো, ভাই, এতটুকুন বাচ্চার যে কি সাহস। চিৎকার করে বললো, জুলুমবাজ ধ্বংস হোক।

মতি ভাই যখন কথা বলছিলো ঠিক তখন চা খাবে বলে রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকলো মুনিম আর রাহাত। মতি ভাই তাকিয়ে দেখলে ওদের পা জোড়া নগ্ন। দেখে খুশীতে নড়েচড়ে। বসলো সে। এবার ওদের জিজ্ঞেস করে আসল খবর জেনে নিতে পারবে। সকালে অবশ্য একটা ছেলেকে মতি ভাই পাঠিয়েছিলো মোড়ে যে মেয়েদের স্কুল আছে সেখান থেকে খবর আনতে। কিন্তু, মেয়েরা নাকি গালাগালি করে তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে। বলেছে, অমন হেঁড়া কাপড় পরে থাকলে কি হবে টিকটিকিদের আমরা ভালো করে চিনি। খবরদার এখানে যদি আবার আসো, তাহলে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবো।

এটা ওদের বাড়াবাড়ি।

একজনকে না জেনেশুনে টিকটিকি বলা উচিত হয় নি ওদের। নিজের মনে ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো মতি ভাই। কিন্তু দেশের যা অবস্থা হয়েছে ওদেরও বা কি দোষ। কে গোয়েন্দা আর কে ভদ্রলোক সেটা বুঝাই বড় মুশকিল হয়ে পড়েছে। অদূরে বসা রাহাত আর মুনিমের দিকে বার কয়েক ফিরে তাকালো মতি ভাই। চা খাচ্ছে আর চাপা গলায় কি যেন আলাপ করছে। মতি ভাইয়ের ভীষণ ইচ্ছে হলো ওরা কি বলছে শুনতে। কিন্তু, সাহস হলো না তার। কে জানে, যদি ছেলে দুটো আবার তাকে গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করে বসে। কিম্বা এমন তো হতে পারে যে ছেলে দুটোই গোয়েন্দার লোক। আজকাল তো এসব হরদম হচ্ছে।

একটু পরে চা কাউন্টারে পয়সা দিতে এলো মুনিম।

মতি ভাই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনারা সবাই আজ খালি পায়ে হাঁটছেন কেন?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুনিম আর রাহাত পরস্পরের দিকে তাকালো। তারপর সামনে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে মতি ভাইকে কি যেন বললো মুনিম। শুনে মুখটা আনন্দে চিকচিক করে উঠলো তার। তাহলে সে যা আঁচ করেছিলো তাই।

পয়সা দিয়ে ওরা চলে যাচ্ছিলো। মতি ভাই পেছন থেকে ডাকলো ওদের। ডেকে পয়সাগুলো ফিরিয়ে দিলো হাতে।

মুনিম অবাক হলো। কি ব্যাপার, এগুলো অচল নাকি?

না। অচল হতে যাবে কেন? মতি ভাই লজ্জিত হলো, চায়ের পয়সা দিতে হবে না, যান।

সেকি কথা, জোর করে পয়সাগুলো হাতে গুঁজে দিতে চাইলো মুনিম। মতি ভাই তবু নিলো না।

রাস্তায় নেবে রাহাতকে বিদায় দিলো মুনিম। বললো, তোমার আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। তুমি যাও। লিফলেটগুলো প্রস থেকে নিয়ে আমি একটু পরেই আসছি। তুমি আসাদকে গিয়ে বলো, নীরার সঙ্গে দেখা করে ও যেন দেয়াল পত্রিকাগুলো নিয়ে আলাপ করে।

রাহাত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো, তারপর ধীরে ধীরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলো মুনিম। এটা একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে ওর। এ নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। ও হাসে। কিছু বলে না। রুমালটা আবার যথাস্থানে রেখে দিল মুনিম। এখান থেকে সোজা প্রেসে যাবে কিনা ভাবলো। ভাবতে গেলে কপালে ভাঁজ পড়ে ওর। মুখখানা সূচালো হয়ে আসে। চোখজোড়া নেমে আসে মাটিতে।

মুনিম ভাবছিলো। এমনি সময়ে একটা বাচ্চা ছেলে রাস্তার ওপাশ থেকে ছুটে এসে হাত চেপে ধরলে ওর। মুনিম ভাই, আপনাকে আপা ডাকছে।

আরে, মিন্টু যে! তুমি এখানে?

আপনাকে আপা ডাকছে।

ও। হঠাৎ মুনিমের খেয়াল হলো, তাইতো, ডলিদের বাসার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। এতক্ষণ কোন খেয়াল ছিলো না। নিজের এই অন্যমনস্কতার জন্যে রীতিমত অবাক হলো মুনিম। একটু ইতস্তত করে বললো, এখন আমি খুব ব্যস্ত, বুঝলে মিন্টু, তোমার আপাকে গিয়ে বলো, পরে আসবো। না।

তাহলে আপা আমায় বকবে। ওইতো উনি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চলুন না। মিন্টু একেবারে নাছোড়বান্দা।

ওকে অনেক করে বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হলো মুনিম।

চোখজোড়া বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বল করছিলো ডলির।

মুখটা লাল হয়ে উঠেছিলো রাগে। দোরগোড়ায় পৌঁছতে বললো, না এলেই তো পারতে।

আসতে তো চাইনি। জোর করে নিয়ে এলো।

তাইতো বলছি, এলে কেন, চলে যাও না।

আহ্ বাঁচালে তুমি। বলে চলে যেতে উদ্যত হলো মুনিম।

পেছন থেকে চাপা গলায় ডলি চিৎকার করে উঠলো। যাচ্ছ কোথায়?

কেন, তুমি যে যেতে বললে।

না। ভেতরে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।

ডলির পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলো মুনিম।

বাসাটা বেশ বড় ডলিদের। সামনে যত্ন করে লাগানো, বাগান। পেছনে একটা ছোট টেনিস কোর্ট, সামনের গোল বারান্দাটা পেটেলে সাজানো বৈঠকখানা। পাশের ঘরটা খালি। তারপর চাকরদের থাকবার কামরা। নিচে ওরা কেউ থাকে না। থাকে দোতালায়।

মুনিমকে ওর ঘরে বসিয়ে, আলনা থেকে তোয়ালেটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো ডলি। বললো, তুমি বসো, আমি এক্ষুণি আসছি।

আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারবো না। পরক্ষণে জবাব দিলো মুনিম।

ডলি তখন চলে গেছে।

এ ঘর মুনিমের অনেক পরিচিত। বহুবার এখানে এসেছে সে। বসেছে। ঘন্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছে ডলির সঙ্গে।

একটা খাট। খাটের পাশে ডলির পড়বার ডেস্ক। একখানা চেয়ার! ডান কোণে একটা তাকের ওপর যত্ন করে সাজানো কয়েকটা বই। গল্প। উপন্যাস। এর মধ্যে একখানা বইয়ের ওপর চোখ পড়তে এক টুকরো মিগ্ধ হাসির আভা ঢেউ খেলে গেলো ওর ঠোঁটের কোণে। ও বইটা ডলিকে উপহার দিয়েছিলো মুনিম।

ডলিকে প্রথম দেখেছিলো মুনিম দীর্ঘ ছবছর আগে। দেশ বিভাগের পরে তখন সবে নতুন ঢাকায় এসেছে সে। বাবা-মা তখনো কোলকাতায়। ঢাকায় এসে জাহানারাদের বাসায় উঠেছিলো মুনিম। সম্পর্কে জাহানারা ফুফাত বোন। স্বামী-স্ত্রীতে ওরা মিটফোর্ডের ওখানে থাকত। পাশাপাশি দুটো কামরা। একটা পাকঘর আর সরু একফালি বারান্দা। সপ্তাহ খানেক থাকবে বলে এসেছিলো মুনিম। কিন্তু জাহানারা ছাড়লো না, বললো, কোনোদিন আসবে তা ভাবি নি। এসেছে যখন দিন পনেরো না থেকে যেতে পারবে না। পাগল হয়েছে। সাতদিনের বেশি থাকলে মা-বাবা ভীষণ রাগ করবেন। মুনিম জবাব দিয়েছিলো। সামনের বার এলে পনেরো দিন কেন, মাস খানেক থাকবো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিন পনেরো থাকতে হয়েছিলো তাকে। কোলকাতায় ফিরে যাবার আগের দিন ডলিকে প্রথম দেখলো সে। হাল্কা দেহ, ক্ষীণ কটি, কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙ। প্রথম দৃষ্টিতেই ভালো লেগে গিয়েছিলো মুনিমের। ডলিরা তখন ও পাড়াতেই থাকতো।

জাহানারার সঙ্গে আলাপ ছিলো বলে বাসায় মাঝে মাঝে আসতো ডলি। তীক্ষ্ণ নাক। পাতলা চিবুক। সরু ঠোটের নিচে একসার ইদুরের দাঁত। ভেতরের ঘরে বসে জাহানারার সঙ্গে গল্প করছিলো সে। পর্দার এপাশ থেকে ওকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো মুনিম। আর, পরদিন ওকে কোলকাতায় চলে যেতে হবে ভেবে মনটা কেন যেন সেদিন বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।

বছর খানেক পরে ওরা যখন কোলকাতা ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকাতে চলে এলো, ডলিরা তখন চাটগাঁ-এ। খোঁজটা জাহানারার কাছ থেকে পেয়েছিলো মুনিম। জাহানারা প্রশ্ন করলো, হঠাৎ ডলির খোঁজ করছে, ব্যাপার কি? যতদূর জানি, ওর সাথে তো তোমার কোন পরিচয় ছিলো না। মুনিম ঢোক গিলে বললো, না এমনি। সেবার তোমাদের এখানে দেখেছিলাম কিনা, তাই।

জাহানারা মুখ টিপে হাসলো। তাই বলে।

তারপর থেকে ডলির কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলো মুনিম। মাঝে মাঝে যে মনে হতো না। তা নয়। তবে সে মনে হওয়ার মধ্যে প্রাণের তেমন সাড়া ছিলো না।

তখন প্রথম বর্ষের পাঠ চুকিয়ে দ্বিতীয় বৰ্ষ অনার্সে পড়ছে মুনিম। এমনি সময়, একদিন বিকেলে জাহানারাদের ওখানে বেড়াতে গিয়ে ডলিকে আবিষ্কার করলো সে।

টেবিলে বসে চা খাচ্ছিলো ওরা।

ওকে দেখে জাহানারা মৃদু হাসলো, মুনিম যে এসো। তারপর ডলির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম ডলি। ডলি আরক্ত হয়ে তাকালো ওর দিকে।

তারপর আদাব জানিয়ে বললো, জাহানারার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি।

তাই নাকি? খুব সহজভাবে ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ শুরু হলো মুনিমের। একগাল হেসে বললো, আমিও আপনার কথা অনেকগুনেছি ওর কাছ থেকে। কি শুনেছেন? চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে তুলে এনে আবার নামিয়ে রাখলে ডলি।

মুনিম বললো, আপনি যা শুনেছেন তাই।

উত্তরটা শুনে নিরাশ হয়েছিলো ডলি । কিন্তু নির্বাক হয় নি। মাঝে মাঝে দেখা হলে এটা সেটা নিয়ে আলাপ করতে ওর সঙ্গে। কখনো শহরের সেরা ছায়াছবি নিয়ে আলোচনা চলতো। কখনো শেকস্পীয়রের নাটক কিংবা শেলীর কবিতা। প্রথম প্রথম এ আলোচনা ক্ষণায়ু হতো, পরে দীর্ঘায়ু হতে শুরু করলো।

 

একদিন দুপুরে ওকে একা পেয়ে জাহানারা অকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসলো, আচ্ছা মুনিম, ডলিকে তোমার কেমন লাগে?

সহসা কোন উত্তর দিতে পারলো না মুনিম। ইতস্তত করে বললো, মন্দ না, বেশ ভালই তো। শেষের কথাটার ওপর বিশেষ জোর দিল সে । জাহানারা মুখ টিপে হাসলো, হুঁ, এই ব্যাপার।

কেন, কি হয়েছে? পরক্ষণে প্রশ্ন করলো মুনিম।

না এমনি। তা তুমি অমন লাল হচ্ছে কেন। এতে আবার লজ্জার কি হলো। এবার শব্দ করে হেসে দিলো জাহানারা। আমি সব জানি তো, ডলি আমাকে সব বলেছে।

হাতমুখ ধুয়ে এ ঘরে ফিরে এসে ডলি দেখলো তাকের উপরে রাখা বইগুলো ঘাটছে মুনিম।

কি খুঁজছে? ডলি শুধালো ।

কিছু না। একটা বই হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুনিম। বাড়ির চাকরটা দরজা দিয়ে একবার উঁকি দিয়ে চলে গেলো। তোয়ালে দিয়ে মুখখানা মুছে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে সঁড়ালো ডলি। অপূর্ব গ্রীবাভঙ্গি করে বললো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো।

বইটা তাকের ওপর রেখে দিয়ে মুনিম আস্তে করে বললো, না, এবার চলি। না। মুহূর্তে খোলা দরজাটার সামনে পথ আগলে দাঁড়ালো ডলি।

পাগলামো করো না। আমার এখন অনেক কাজ?

কি কাজ?

জান তো সব। তবু আবার জিজ্ঞেস করো কেন?

না এমনি। কাপড়ের আঁচলটা আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে মৃদু গলায় জবাব দিলো ডলি।

তার মুখখানা ম্লান আর বিবর্ণ। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার বললে সে, আজ আমার জন্মদিন।

জন্মদিন! তাইতো, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।

কোনদিন হয়তো আমাকেই ভুলে যাবে। অদ্ভুত গলায় জবাব দিল ডলি।

মুনিম ইতস্তত করে বললো, কি যা-তা বলছে ডলি।

ডলি মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুনিমের দিকে তাকিয়ে রইলো ক্ষণকাল।

ওর মুখে কি যেন খুঁজলো তারপর বললো, তুমি দিনে দিনে কেমন যেন বদলে যাচ্ছো।

বদলে যাচ্ছি! পরিবর্তনটা কোথায় দেখলে তুমি?

তোমার ব্যবহারে।

যেমন–।

নিজে বুঝতে পারে না? ওটা কি উদাহরণ দিয়ে বলে বুঝিয়ে দিতে হবে? অত্যন্ত পরিষ্কার গলায় টেনে টেনে কথাগুলো বললে ডলি।

মুনিম নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো।মনে মনে একটা উত্তর খুঁজছিলো সে।

কি বলবে ভেবে না পেয়ে বললো, চলি।

এবার আর বাধা দিলো না ডলি। বিষণ্ণ মুখখানা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে গেলো সে। আজ বিকেলে আসছে তো?

হ্যাঁ। আসবে।

ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটু পরে রাস্তায় বেরিয়ে এলো মুনিম। দুপুরের দিকে রোদ খুব কড়া হয়ে উঠলো। বাতাস না থাকায় রোদের মাত্রা আরো তীব্রভাবে অনুভূত হলো। মনে হলো পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বটা যেন অর্ধেক কমে গেছে।

ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে তার শোবার ঘর বানায় বজলে হোসেন গরমে অস্থির হয়ে পড়েছিলো। একটা কবিতা কি একটা গল্প যে লিখবে তাও মন বসছে না। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস ছিলো তিনটে। দুটো অনার্স, এটা সাবসিডিয়ারি। ওর বড়ো দুঃখ হলো যে আজ তিনটে পার্সেন্টেজ নষ্ট হলো। শুধু আজ নয়, আসছে দুটো দিনেও ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবে না সে। কি করে যাবে? জুতো পায়ে দিয়ে গেলে যে ছেলেরা তাড়া করবে ওকে। অথচ জুতো ছাড়া খালি পায়ে হাঁটার কথা ভাবতেও পারে না বজলে হোসেন। সত্যি খালি পায়ে ইউনিভারসিটিতে যাওয়া কি সম্ভব?

পাগল। যতসব পাগলামো! হঠাৎ উদ্যোক্তাদের গালাগাল দিতে ইচ্ছে করলো ওর। খেয়ে-দেয়ে কোন কাজ নেই। কি যে করে সরকার। এসব ছেলেদের ধরে ধরে আচ্ছা করে ঠেঙ্গায় না কেন? গরমে গা জ্বালা করছিলো বজলে হোসেনের। বন্ধু মাহমুদকে আসতে দেখে মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বললো, মাহমুদ যে, এসো। কি খবর?

উত্তরে কাঁধটা বেশ কায়দা করে ঝাঁকলো মাহমুদ। তারপর সিগারেটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। ভাবলাম, তোমাকে এক নজর দেখে যাই। কি ব্যাপার, আজ বেরোও নি?

বজলে মাথা নাড়লে, না।

সিগারেটে একটা টান দিয়ে মাহমুদ কি যেন ভাবতে লাগলো। গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করে সে। এককালে কবিতা লেখার বাতিক ছিলো খুব।

সেই সূত্রে বজলের সঙ্গে আলাপ। এখন আর লেখে না। একা থাকে শহরে। মা আর ছোট এক বোন আছে, তারা দেশের বাড়িতে।

একটুকাল পরে বজলে প্রশ্ন করলো, এদিকে কোথায় আসছিলে? মাহমুদ জবাব দিলো, একটা প্রেসে। প্রেসে?

হ্যাঁ।

প্রেসে কি কাজ তোমার? বজলে অবাক হলো। তারপর সোৎসাহে বললো, কবিতার বই ছাপাতে দিয়েছ বুঝি? চমৎকার! কনগ্রেচুলেশন মাহমুদ। আমি বলি নি, তুমি ওই চাকরিটার মাথা খেয়ে আবার কবিতা লিখতে শুরু করে দাও। অন গড বলছি তুমি খুব সাইন করবে।

ওর কথা শুনে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো মাহমুদ। বললো, তোমাদের ছাত্ররা নাকি এখানে একটা প্রেসে লিফলেট ছাপতে দিয়েছে।

খবর পেয়ে খোঁজ নিতে এসেছিলাম।

নুইসেন্স। ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো বজলে। তোমাদের সবাইকে ওই একই ভূতে পেয়েছে। খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে অন্য মনস্কভাবে বললো, কিছু পেলে?

না, মাহমুদ একটা লম্বা হাই তুললো। ভার্সিটির খবর কি?

বজলে সংক্ষেপে বললো। জানি না। আমি যাই নি। তারপর কি মনে হতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলে সে। টেবিলের ওপর থেকে একটা খাতা টেনে নিয়ে আবার বললো, কাল রাতে হঠাৎ একটা দীর্ঘ কবিতার জন্ম দিয়েছি। দেখ তো কেমন হয়েছে। বলে কবিতাটা টেনে টেনে আবৃত্তি করে তাকে শোনাতে লাগলো বজলে হোসেন।

Category: আরেক ফাল্গুন (উপন্যাস) (১৯৬৯)
পূর্ববর্তী:
« ০১. রাত দুপুরে সবাই যখন ঘুমে অচেতন
পরবর্তী:
০৩. কলতাবাজারে ওদের ছোট বাসা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑