১১শ সর্গ

একাদশ সর্গ

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাইকেল বলল, তুমি তোমার চোখের সামনে একটি পুরনো জগৎকে শেষ হয়ে যেতে ও একটি নূতন জগৎকে শুরু হতে দেখবে। যেন এক নূতন প্রজন্ম থেকে শুরু হবে মানবজাতির অগ্রগতি। তবু আরো অনেক কিছু দেখতে হবে তোমায়। কিন্তু তোমার দর্শনেন্দ্রিয় স্তিমিত হয়ে এসেছে। তোমার ক্লান্ত ইন্দ্রিয়শক্তিকে সতেজ করার জন্য ঐশ্বরিক সাহায্য দরকার। এরপর কি হবে তা আমি বলব। এখন তা মন দিয়ে শুনবে।

অবশিষ্ট মানবজাতি নবজীবন লাভ করল মং প্লাবনের পর। কিন্তু মানুষের সংখ্যা তখন নিতান্তই কম। ঐশ্বরিক বিচারের স্মৃতি তখন ভালভাবেই জেগে ছিল তাদের মনে। তারা দৈব ভয়ে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ঠিক সৎ পথেই চলবে। এইভাবে তারা জীবন যাপন করে বংশবৃদ্ধি করে যাবে। তারা মাঠে শ্রমসহকারে চাষের কাজ করে প্রচুর ফসল ফলাবে। অনেক শস্য, মদ ও তেল উৎপন্ন করবে। মাঝে মাঝে ধর্মীয় উৎসবের অনুষ্ঠান করে তাদের পশুর পাল থেকে বলদ, মেষশাবক অথবা ছাগলছানা দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে মদের অঞ্জলি দেবে। তারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিবার ও জাতিসহ দীর্ঘকাল সুখে শান্তিতে নিষ্কলুষ ও নির্দোষ জীবন যাপন করবে। পরে তাদের মধ্যে একজন অহঙ্কারী উচ্চাভিলাষী মানুষের আবির্ভাব হবে। সে এই সৌভ্রাতৃত্বমূলক সমাজে সাম্যবস্থায় তৃপ্ত হবে না। সে প্রাকৃতিক নিয়ম লঙঘন করে পৃথিবীর বুক থেকে সব ঐক্য বিনষ্ট করে তার সমাজের ভাইদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজ্য স্থাপন করবে আপন শক্তিবলে।

ঈশ্বরের বিধানকে অগ্রাহ্য করে সে এক শক্তিশালী শিকারীরূপে যুদ্ধবিগ্রহের কুটিল ফাঁদ পেতে মানুষ ও পশুশিকারে মত্ত হয়ে উঠবে। যারা তার দ্বারা স্থাপিত সাম্রাজ্যের কাছে বশ্যতা বা অধীনতা স্বীকার করবে না, তাদের উপর সে নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন ও অত্যাচার চালাবে। সর্বশক্তিমান জগদীশ্বরের কাছে সে দ্বিতীয় সার্বভৌম শক্তিরূপে নিজের প্রতিষ্ঠা দাবি করবে।

এইভাবে সে ঈশ্বরদ্রোহিতার দ্বারা নাম-যশ অর্জন করবে। অথচ যারা তার এই প্রভুত্বকে স্বীকার করতে চাইবে না তাদের সে বিদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনবে।

যারা তার উচ্চাভিলাষ ও অত্যাচারের শরীক হবে তাদের নিয়ে এক সেনাদল গঠন করে ইডেন উদ্যান থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে এক সমতল প্রান্তর পাবে, যে প্রান্তরের শেষে একটি বিশাল খাদ আছে। সেই খাদই হলো নরকের মুখ।

সেই প্রান্তরের উপর ইট ও পাথর দিয়ে বহু সৌধসমম্বিত এক নগর প্রতিষ্ঠা করবে। যার চূড়া উচ্চতায় স্বর্গলোকের কাছাকাছি উঠে যাবে। তারা প্রভুত যশ অর্জন করবে। কিন্তু রাজ্যজয়ের মোহে সে যশ শুভ কি অশুভ সেকথা বিচার করতে ভুলে যাবে তারা।

কিন্তু ঈশ্বর মাঝে মাঝে অদৃশ্য অবস্থায় নেমে আসেন মানুষের জগতে। তাদের আবাসভূমিতে ঘুরে বেড়িয়ে তাদের কর্মকর্ম দেখেন খুঁটিয়ে। সেইসব অহঙ্কারী উচ্চাভিলাষী লোকদের দ্বারা নবনির্মিত নগরটি দেখে তিনি সেই নগরে একদিন নেমে আসবেন। দেখবেন তাদের সেই নগরের স্পর্ধিত চূড়া স্বর্গলোককে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তখন তিনি সেই নগর নির্মাতাদের মুখে বিভিন্ন জাতীয় ভাষা দান করবেন যার ফলে তারা কেউ কারো কথা বুঝতে পারবে না। এর ফলে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করে নিজেদের গড়া নগর নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলবে।

তাদের গোলমাল, চিৎকার ও তর্জনগর্জন স্বর্গলোকের সবাই শুনতে পাবে এবং তারা সবাই হাসাহাসি করবে।

আদম এতে অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, হে দুষ্ট মানবসন্তান, ঈশ্বর তো আমাদের জগতের পশুপাখি, জল, স্থল, আকাশ সব কিছুর উপর প্রভুত্ব দান করেছেন, একমাত্র মানুষ ছাড়া। মানুষ মানুষের উপর প্রভুত্ব করবে না। একমাত্র ঈশ্বরই সকল মানুষের প্রভু। কিন্তু তুমি ঈশ্বরের কাছে থেকে সে প্রভুত্ব জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছ। সমগ্র মানবজাতির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজ্যস্থাপন করেছ। তুমি শুধু মানুষের সব অধিকারকে গ্রাস করনি, স্বর্গ অবরোধ করে সেখানেও তোমার অন্যায় অবৈধ প্রভুত্ব বিস্তার করতে চেয়েছ। কিভাবে তুমি ও তোমার হঠকারী সেনাদলকে বাঁচিয়ে রাখবে ঈশ্বর ও প্রকৃতির রোষ থেকে? হে হতভাগ্য মানবসন্তান, স্বর্গ থেকে প্রতিকূল বাতাস ঈশ্বরের রোষ হিসাবে নেমে এসে তোমাদের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে দেবে। তোমাদের প্রাণবায়ু স্তব্ধ করে দেবে।

মাইকেল তখন বলল, তুমি সঙ্গতভাবেই ঐ মানবসন্তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছ। কারণ সে মানুষের যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে শান্তিপ্রিয় মানবজাতির উপর অশান্তি নিয়ে এসেছে। প্রকৃত স্বাধীনতা সব সময় যুক্তির সঙ্গে সহাবস্থান করে।

কিন্তু সেই যুক্তিকে জোর করে আচ্ছন্ন করে দিলে বা তাকে না মানলে অসঙ্গত উদ্ধত কামনার বেগ শাসনযন্ত্রকে যুক্তিবিবর্জিত করে স্বাধীন মানুষকে দাসে পরিণত করে তোলে। যে শক্তির সে যোগ্য নয় সেই শক্তি দিয়ে তার স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবোধকে দমিয়ে রাখে। ফলে ঈশ্বরের বিচারে সেই উদ্ধত স্বৈরাচারী মদন রাজা তার থেকে আরও শক্তিশালী রাজাদের কাছে পরাজিত হয়ে তাদের অধীন হয়ে পড়ে। বাইরের স্বাধীনতা হারিয়ে তারা তাদের দাস হয়ে পড়ে। অত্যাচারী অত্যাচারের শিকারে পরিণত। এইভাবে অনেক জাতি অন্য জাতির স্বাধীনতা গ্রাস করে নিজেরাই আবার অপর জারি পরাধীন হয়ে ওঠে। ঈশ্বর এইসব দেখে শুনে এইসব পাপাত্মাদের ভাগ করে তাদের কুপথে চলতে ছেড়ে দেন। নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করে যায় নিজেরা।

এরপর যারা বেঁচে থাকবে তাদের মধ্যে একজন ধার্মিক লোক থেকে এক নূতন জাতির উদ্ভব হবে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে। প্রথমে সেই জাতি পৌত্তলিক ছিল। নির্বোধের মতো পুতুল পূজা করত। মহাপ্লাবন হতে উদ্ধারপ্রাপ্ত ও ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য প্রধান পিতা নোয়া তখন জীবিত থাকলেও সেই জীবম্ভ ঈশ্বরস্বরূপ তাঁকে ছেড়ে তারা যত কাঠ-পাথরকে দেবতা বলে পূজা করত।

অবশেষে ঈশ্বর একদিন স্বপ্নে আদেশ দেন, পৈতৃক বাড়ি ও সেই সকল দেবতাদের মৃতিগুলিকে ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, তার থেকে এক শক্তিশালী জাতির উদ্ভব হবে এবং সেই জাতি ঈশ্বরের আশীর্বাদলাভে ধন্য হবে। কোথায় তিনি থাকেন তা পরে বলে দেবেন।

ঈশ্বরের সেই প্রত্যাদেশ যথাযথভাবে পালন করলেন তিনি। তিনি জানেন না কোন দেশে কোথায় যাবেন তিনি। তিনি তাঁর গভীর অবিচল বিশ্বাসের জন্য যথাসময়ে ঈশ্বরই তাকে তা বলে দেবেন। তিনি যেখানে তাকে নিয়ে যাবেন।

মাইকেল আরও বলল, তুমি জান না, কিন্তু আমি জানি, তিনি কোন বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে দক্ষিণ বেবিলনের অন্তর্গত তাঁর জন্মভূমি, গৃহদেবতা ও বন্ধুবান্ধবদের পরিত্যাগ করে অজানার পথে যাত্রা করেন। তাঁর সঙ্গে বহু পশুর পাল আর বহুসংখ্যক ভৃত্য ও অনুচরবর্গও যায়। তিনি একেবারে নিঃস্ব ছিলেন না তখন। তাঁর কাছে যে ধনসম্পদ ছিল তার ভার ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

এইভাবে তিনি আঁর দলবল নিয়ে ক্যান্নানে এসে উপস্থিত হন। জেরুজালেমের উত্তরে মধ্য প্যালেস্টাইনের সমভূমিতে অবস্থিত সেকেম বা মোবে নগরে তাঁর তাঁবুর ছাউনি আমি দেখতে পাচ্ছি।

ঈশ্বরের নির্দেশে সেখানে গিয়ে তিনি সেই সমগ্র ভূখণ্ড ভঁর ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য দান হিসাবে লাভ করেন। উত্তরে সিরিয়া থেকে দক্ষিণের মরুভূমি পর্যন্ত, পূর্বে হার্মন ও কার্মেন পাহাড় থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড। জর্ডন নদী তার পূর্বদিকের শেষ সীমান্ত। সেই প্রবীণ পিতার বংশ থেকে সমগ্র পৃথিবী ধন্য হবে।

তাঁর বংশধরের অর্থ হলো মানবজাতির মহান পরিত্রাতা যিনি সাপের মাথায় আঘাত হানবেন। তোমার সামনে তিনি পরিষ্কাররূপে আবির্ভূত হবেন।

ঈশ্বরের অনুগ্রহীত এই প্রবীণ পিতা পরে পরম ঈশ্বরবিশ্বাসী আব্রাহাম নামে অভিহিত হলেন। তাঁর একটিমাত্র পুত্র আর একটিমাত্র পৌত্র হবে। ধর্মবিশ্বাস, জ্ঞান ও খ্যাতিতে তারা হবে তাঁরই মতো।

পরে তাঁর পৌত্র তাঁর বারোজন পুত্র নিয়ে ক্যান্নান থেকে নীলনদের দ্বারা বিভক্ত মিশর দেশে চলে যান। তার কনিষ্ঠ পুত্র মিশরেই থাকত এবং কান্নানে তখন দুর্ভিক্ষ চলতে থাকার জন্য সেই কনিষ্ঠ পুত্র তাকে মিশরে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এই পুত্রটি এমনই কতকগুলি গৌরবজনক কাজ করে মিশর দেশে যার জন্য সে দেশের রাজা ফ্যারাওর পরেই তার স্থান ছিল।

পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং তার উপজাতি বাড়তে বাড়তে এক জাতিতে পরিণত হয়।

ঐ দেখ মিশরের নীলনদ মোহ্নর কাছে সাতটি মুখ নিয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে।

এদিকে ক্রমে সেই বিদেশাগত জাতির শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ফ্যারাও তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে অত্যাচার চালাতে থাকে তাদের উপর। তাদের পুত্রসন্তান হলেই শিশু অবস্থাতেই তাদের মেরে ফেলত।

পরে সেই জাতির মধ্যে দুজন ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ আসেন। তাঁরা হলেন মোজেস আর এ্যারন। এঁরা রাজার কাছে অঁদের জাতির দাসত্ব থেকে মুক্তির দাবি জানান, মিশর থেকে তাঁরা স্বদেশে ফিরে যেতে চান। কিন্তু তার আগে যে অত্যাচারী নিষ্ঠুর রাজা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না বা তাঁর বিধান মানত না তাকে ককগুলি কুলক্ষণ বা বিভিন্ন দুর্ঘটনার দ্বারা এ বিষয়ে অনুমতি দান করতে বাধ্য করতে হবে।

ঈশ্বরের বিধানে দেশের সব নদীর জল রক্তে পরিণত হয়ে উঠবে। ব্যাঙ, উকুন ও মাছি ঝাঁকে ঝাঁকে রাজপ্রাসাদ পরিপূর্ণ করে তুলবে। রাজার পশুদের মৃত্যু ঘটবে অকারণে। রাজার সারা দেহ ক্ষত ও ফোঁড়ায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। আরঝড়ের সঙ্গে বজ্রাঘাতে বজ্রাগ্নিতে দেশের বহু লোকের জীবননাশ হবে। বহু গাছপালা পুড়ে যাবে। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল নেমে এসে মাঠের সব সবুজ ফসল খেয়ে ফেলবে। তিন দিন ধরে এক নিবিড় অন্ধকার আচ্ছন্ন করে থাকবে সমস্ত দেশকে। একদিন গভীর রাত্রিতে দেশের সব নবজাত শিশুর মৃত্যু হবে।

অবশেষে রাজা তাদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের দেশ ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়। কিন্তু তার কঠিন অন্তর বিগলিত হলেও তা আবার বরফের মতো কঠিন হয়ে ওঠে। তাই তার আদেশে তার সৈন্যরা প্রত্যাবর্তনরত সেই বিদেশীদের অনুসরণ করতে থাকে তাদের ধ্বংস করার জন্য।

সামনে বিশাল সমুদ্র, পিছনে শত্রুসৈন্য। মোজেস তখন সমুদ্রের কূলে এসে তার হাতের অলৌকিক দণ্ডটি তিনবার ঠুকতেই তাদের জন্য সমুদ্রের উপর পথ তৈরি হয়ে গেল। সে পথের দুধারে দুটি স্ফটিকস্বচ্ছ পাথরের প্রাচীর উঠে যায়। মোজেসের জাতির লোকেরা নিরাপদে সমুদ্র পার হয়ে ওপারের কূলে গিয়ে ওঠে।

এদিকে রাজার সৈন্যরা তাদের সমুদ্রের উপর হেঁটে যেতে দেখে সমুদ্রের জলে নামতেই তারা ডুবে যায়। ওপারে গিয়ে মোজেস তার দণ্ডটি আবার ফুঁকতেই সে পথ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ফ্যারাও-এর সৈন্যরা সব ডুবে যায়। যুদ্ধোন্মাদ সৈন্যদের যুদ্ধের সাধ মিটে যায়। তাছাড়া যাতে রাজসৈন্যরা পলায়মান মোজেসদের দেখতে না পায় তার জন্য ঈশ্বরপ্রেরিত এক দেবদূত দিনের বেলায় মেঘ এবং রাত্রিবেলায় ঘন অন্ধকার নিয়ে তাদের ঘিরে রেখে অপরিদৃশ্য করে তোলেন তাদের সৈন্যদের চোখ থেকে।

সমুদ্রের উপকূল থেকে মোজেসরা এবার দুর্গম মরুপথের উপর দিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে। ক্রমে তারা ক্যান্নানে গিয়ে উপনীত হয়। কিন্তু ক্যান্নানবাসীরা মোজেসদের দেখে ভীত হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মোজেসদের লোকেরা যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ থাকায় তারা যুদ্ধ না করে আবার দাসত্বের ঝুঁকি নিয়ে মিশরেই ফিরে আসে।

সেখানে এসে তারা ঘুরতে ঘুরতে এক নির্জন বিশাল মরুপ্রান্তরের উপর এক রাজ্য স্থাপন করে। বারোটি উপজাতি থেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে এক সিনেট বা পরিষদের মাধ্যমে শাসনকার্য চালাতে থাকে তারা। ঈশ্বর সিনাই পর্বতের শিখরদেশে নেমে এসে বজ্রবিদ্যুৎ ও জয়ঢাকের শব্দের মাধ্যমে আইনের বিধানগুলিকে তাদের জানিয়ে দেন।

অসামরিক ন্যায়বিচার ও শাসনপদ্ধতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বলিদানের রীতি এবং মানবজাতির মুক্তির জন্য সাপের মাথায় আঘাত করতে তিনি তাদের শিখিয়ে দেন।

কিন্তু ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর মরণশীল মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর ও দুঃসহ। তাই তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালে তিনি তার যা কিছু বলার তা যেন এবার থেকে তাদের নেতা মোজেসের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দেন। ঈশ্বর তাদের এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। তিনি তাদের জানিয়ে দেন, প্রাক্তন গুরু বা মাধ্যম ছাড়া ঈশ্বরের কাছে কেউ যেতে পারে না, তার কণ্ঠ শুনতে পায় না।

এইভাবে ঈশ্বরের নির্দেশে মোজেসের মাধ্যমে আইন ও আনুষ্ঠানিক রীতিনীতির প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁর ইচ্ছা ও বিধানের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ আনুগত্য দেখে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন তাদের প্রতি। তিনি তাদের এক নূতন দেশে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেন।

তাঁর নির্দেশমতো দেবদারু কাঠের তৈরি স্বর্ণখচিত এক গাড়ি নির্মিত হয়। সেই পবিত্র গাড়ির মধ্যে দুটি দেবদূত এসে অধিষ্ঠিত হয়। তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে তারা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত দেশে এসে উপস্থিত হয়।

এরপর বলা হবে বহু যুদ্ধ, বহু বাজার ধ্বংস আর রাজ্যজয়ের কথা। বলা হবে কিভাবে একদিন মানুষের আদেশে সূর্য মধ্য আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন, কিভাবে রাত্রির গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। মানুষ আদেশ করে, হে সূর্য, হে চন্দ্র, যতদিন না ইসরায়েল জয় করতে পারি ততদিন রুদ্ধ হয়ে থাকবে তোমাদের গতি। এই ঈশ্বরপ্রেরিত মানুষ আইজ্যাকপুত্র তৃতীয় আব্রাহাম নামে অভিহিত হবে এবং তার থেকে নূতন বংশের উদ্ভব হবে, যে বংশ অবশেষে ক্যান্নান জয় করবে।

এইখানে আদম বলে উঠল, হে ঈশ্বরপ্রেরিত দেবদূত, আমার অন্ধকারের আলো, তুমি আব্রাহাম ও তার বংশ প্রভৃতি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা ও কাহিনী বলেছ। এই সব কথা শুনে চোখ আমার খুলে গেছে। আগে আমার ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ ভাবনায় আমার যে অন্তর বিব্রত ও জর্জরিত হয়ে উঠেছিল, এখন সে অন্তর সমস্ত দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন আমি সেই দিন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেদিন পৃথিবীর সব জাতি ঈশ্বরের আশীর্বাদে ধন্য হয়ে উঠবে। আমি একদিন নিষিদ্ধ জ্ঞান লাভ করতে গিয়ে ঈশ্বরের যে অনুগ্রহ হারাই সে অনুগ্রহ তারা লাভ করবে ভবিষ্যতে।

কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না যে মানবজাতির মধ্যে ঈশ্বর বাস করতে চান পৃথিবীতে, সেই মানবজাতির মধ্যে এত সব আইনকানুন কেন? এত সব পাপের সঙ্গে সেই সব আইনকানুনকে লড়াই করতে হয় কেন? কি করে ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে বাস করতে পারেন?

মাইকেল তখন তাকে বলল, ভেবো না সেই সব মানুষের মধ্যে কোন পাপ থাকবে না। তাই তাদের সহজাত পাপপ্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য আইনের বিধান দেওয়া হয়। আইনের বিধান পাপের সঙ্গে লড়াই করে পাপকে সংযত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন তারা দেখবে আইন পাপকে প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু সে পাপকে বিদূরিত করতে পারে না, যখন বুঝবে পাপপ্রবৃত্তির প্রতীকস্বরূপ বলদ, ছাগ প্রভৃতি পশুগুলি পাপ-দূরীকরণের এক দুর্বল উপায়মাত্র, তখন তারা ভাববে মানুষের পাপমুক্তির জন্য আরও মূল্যবান রক্তদান দরকার যাতে করে অন্যায়ের উপর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হতে পারে, যাতে তার বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত হতে পারে এবং ঈশ্বরের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বস্ত হতে পারে যা কোন আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের দ্বারা সম্ভব নয়। তারা বুঝতে পারবে জীবনে ন্যায়নীতি মেনে না চললে ভালভাবে তারা বাঁচতে পারবে না।

আইন এ বিষয়ে অসম্পূর্ণ হলেও এই আইন তাদের মনকে উন্নততর বিধানের দিকে নিয়ে যাবে। দেহগত কামনা-বাসনার উপর আত্মার প্রাধান্যকে তারা স্বীকার করে নেবে। তখন তাদের উপর আইনের কঠোর বিধান জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে না। তারা স্বেচ্ছায় পরম পিতা ঈশ্বরের মহিমা লাভ করতে চাইবে। আইনের বিধানকে ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত ও একাত্ম করে দেখবে।

তাই মোজেস ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র হলেও শুধু আইনের প্রশাসক ও মন্ত্রণাদাতারূপে। তাদের ক্যান্নানে নিয়ে যেতে পারবে না। খৃস্টের অনুরূপ যীশুই তাদের শত্রু সর্পকুলকে বশীভূত করে তাদের ঊষর প্রান্তর থেকে চিরশান্তির স্বর্গে নিয়ে যাবে। অনেক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে ক্যান্নানে উপনীত হবে।

দীর্ঘকাল তারা সেখানে সুখে-সমৃদ্ধিতে বাস করবে। তারপর সেই জাতির মধ্যে পাপ বৃদ্ধি পেতে পেতে তাদের জাতীয় শান্তিকে বিঘ্নিত করতে থাকলে তখন ঈশ্বর তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবেন। একমাত্র অনুতাপের দ্বারা মানুষ তার পাপ থেকে মুক্ত হতে পারে।

ঈশ্বর প্রথমে তাদের বিচারক ও রাজাদের দ্বারা তাদের পাপ থেকে সংযত করার চেষ্টা করবেন। তাদের দ্বিতীয় রাজা বড় ধার্মিক ব্যক্তি হবেন। তার ধর্মাচরণে সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর তাকে প্রতিশ্রুতি দেবেন, তার রাজসিংহাসন আদায় হবে। এই রাজার নাম হবে ডেভিড। এই ডেভিডের বংশে এক পুত্রসন্তান হবে যার উপর সমগ্র জাতি আস্থা স্থাপন করতে পারবে। আব্রাহামকে সে কথা বলা হয়েছিল আগেই। তিনি হবেন রাজার রাজা এবং তাঁর রাজ্যশাসনের কোনদিন শেষ হবে না।

কিন্তু তার আগে ডেভিডের পর আরো কয়েকজন রাজা রাজত্ব করবে। ডেভিডের পুত্র সলোমন সম্পদ ও জ্ঞানে যশস্বী হয়ে উঠবে। একটি মন্দিরের মধ্যে সে ঈশ্বরের বেদী প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তার প্রজারা হবে পৌত্তলিক এবং ঈশ্বরের বিধান না মেনে নানারূপ পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে ঈশ্বরকে রুষ্ট করে তুলবে। তাদের নগরের নাম হচ্ছে বেবিলন। ঈশ্বর তাদের পরিত্যাগ করবেন। তাদের রাজধানী, মন্দির, নগর ও সব পবিত্র বস্তু বিদেশী রাজারা দখল করে নেবে।

সেই উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত গর্বোদ্ধত নগরীতে তারা সত্তর বছর ধরে বিদেশী শাসকদের অধীনে বন্দী অবস্থায় ছিল। তারপর ঈশ্বর ডেভিডকে অতীতে একদিন করুণা প্রদর্শনের যে প্রতিশ্রুতি দান করেছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে তাদের বেবিলন থেকে জেরুজালেমে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করলেন। ঈশ্বরের নির্দেশে তাদের প্রভুরাও বেবিলন থেকে তাদের চলে যাবার অনুমতি দিল।

প্রথমে তারা ঈশ্বরের একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে দীনহীনভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে লাগল। ক্রমে তারা সম্পদ ও সমৃদ্ধিলাভ করল। তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল। তারা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হলো। প্রথমে পুরোহিত বা যাজকদের। মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ দেখা দিল।

তাদের কাজ হলো মন্দিরে ঈশ্বরের বেদীমূলে উপাসনাকার্য পরিচালনা করা এবং দেশে শান্তি স্থাপন ও রক্ষা করে চলা। তারা পরস্পরে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে মন্দিরকে কলুষিত করে তার পবিত্রতা নষ্ট করল। পরে ডেভিডের পুত্রদের আগ্রাহ্য করে রাজদণ্ড কেড়ে নিয়ে রাজক্ষমতা দখল করে নিল।

ক্রমে একদিন এক বিদেশীর হাতে সে শাসনক্ষমতা হারাল। এই বিদেশী হলো রোমকদের দ্বারা নিযুক্ত জেরুজালেমের শাসনকর্তা রাজা হেরদের পিতা এ্যান্টিকোটার। ফলে তাদের প্রকৃত রাজা মেসিয়ার রাজাধিকার বিবর্জিত অবস্থায় জন্ম হলো।

তথাপি তাঁর জন্মকালে এক অদৃশ্য তারকা তাঁর আবির্ভাব ঘোষণা করে এবং প্রাচ্যের জ্ঞানী সাধুদের তার জন্মস্থান বেথলেহেমে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে যাতে তারা গন্ধদ্রব্য ও স্বর্ণোপচার দিয়ে সেই নবজাত ঈশ্বরপুত্রের পূজা করতে পারে। একজন দেবদূত তার সেই জন্মস্থানটি রাখালদের দেখিয়ে দেয় এবং সারারাত্রি পাহারা দিতে বলে তাদের। তা শুনে তাড়াতাড়ি করে সেখানে গিয়ে একজন দেবদূতদের দ্বারা গীত প্রার্থনাসঙ্গীত শুনতে পায়।

সেই নবজাতকের মাতা হলো এক কুমারী, কিন্তু তার পিতা হলেন সর্বশক্তিমান পরম পিতা ঈশ্বর। জন্মসূত্রে তিনি পিতার স্বর্গসিংহাসনের অধিকার লাভ করবেন। এবং তাঁর পিতা তাঁর রাজত্বকে সারা পৃথিবীব্যাপী প্রসারিত করে তাকে দান করবেন ঐশ্বরিক গৌরব।

এই বলে থামল মাইকেল। কারণ সে দেখল তার কথা শুনে আনন্দের আবেগে অবর্ষণ করছে আদম। কোন কথা বলতে পারছে না।

অবশেষে আদম কোনরকমে বলল, হে আনন্দ সংবাদের ভবিষ্যৎস্বরূপ চূড়ান্ত আশার পূরণক, যে কথা আমি কতবার বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি সে কথা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি এখন। বুঝতে পারছি কিভাবে আমাদের মহান প্রত্যাশার এক নারীর গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে সার্থকজ্ঞানে। হে কুমারীমাতা, অভিনন্দন জানাই তোমায়। তুমি ঈশ্বরের প্রেমে সমৃদ্ধ। তবু তুমি আমারই বংশে জন্মলাভ করবে। তুমি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পুত্রকে গর্ভে ধারণ করবে। এইভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে মানবজাতির যুদ্ধ হবে। দেবতার সঙ্গে মিলিত হবে মানুষ। এখন বুঝেছি সর্পকুলের মাথায় আঘাত হানার প্রয়োজন আছে। মারাত্মক যন্ত্রণাভোগ করতে হবে তাদের। এখন বল, কোথায় কিভাবে মানুষের সঙ্গে সর্পকুলের বিবাদ বাধে। কিভাবে কখন মানুষ সর্পকুলের মাথায় আঘাত হানে এবং সর্পরাই বা কি করে তাদের পায়ের গোড়ালিতে দংশন করে।

মাইকেল তখন বলল, মনে ভেবো না মানবজাতির সঙ্গে সর্পকুলের দ্বন্দ্ব এক সাধারণ লড়াই এবং তাদের মাথা ও পায়ের ক্ষত এক সাধারণ আঘাতজনিত ক্ষত। আরও বৃহত্তর শক্তির দ্বারা পর্যদস্ত হবে তোমার শত্রু।

তাদের মাথায় আঘাতের অর্থ হলো যে সর্পরূপী শয়তান তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে তোমাদের পতন ঘটায় সেই শয়তান স্বর্গ হতে তোমাদের পায়ের তলায় নরকে পতিত হবে। সেই শয়তান নীচে থেকে তোমাদের পায়ে ক্ষত সৃষ্টি করলেও অর্থাৎ তারা তোমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও কোন মারাত্মক আঘাত হানতে পারবে না। কারণ তোমাদের পরিজ্ঞাতা তোমাদের সব ক্ষত নিরাময় করে দেবেন। কিন্তু তিনি শয়তানকে একেবারে ধ্বংস করলেন না। তিনি শুধু তোমাদের ও সন্তানদের : মধ্য দিয়ে তাদের সব কাজকে ব্যর্থ করে দেবেন। তবে তার জন্য একদিন যা তোমরা করতে পারনি তাই তোমাদের করতে হবে। অর্থাৎ ঈশ্বরের বিধান লঙ্ঘন করার জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে তার যে শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দান করেছিলেন তোমাদের সে বিধান অবনত মস্তকে মেনে নিতে হবে তোমাদের। তাঁর আদেশ পালন করে যেতে হবে অকুণ্ঠভাবে। তোমরা তা করলে তোমাদের শত্রুরাও সমুচিত শাস্তি পাবে।

শুধু আক্ষরিক অর্থে আনুগত্য নয়, একমাত্র ঈশ্বরপ্রেমের দ্বারাই ঈশ্বরের বিধানকে সঠিকভাবে মেনে চলা যায়। এই প্রেমের বশবর্তী হয়েই ঈশ্বরপুত্র মানুষের মতো রক্তমাংসের দেহ ধারণ করে অবতীর্ণ হবেন পৃথিবীতে। জীবনে অনেক লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন সহ্য করে এক অভিশপ্ত মৃত্যুবরণ করবেন তিনি। যারা তাঁর এই পরিত্রাণে, বিশ্বাস করবে তাদের তিনি নবজীবন দান করে থাকেন।

কিন্তু তার স্বর্গগত লোকেরা পরম পিতা ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্য ও অটল বিশ্বাসকে ভুল বুঝবে। তিনি যে মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য এসেছেন সেকথা বুঝতে পারবে না তারা। তাঁকে তারা ঘৃণা করবে। তাকে বিধর্মী বলে গণ্য করে তার বিচার করবে। বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবে। তাকে ক্রুসে বিদ্ধ করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। যিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য নবজীবনের বাণী নিয়ে এসেছিলেন পৃথিবীতে, তাকে এইভাবে বধ করা হবে।

কিন্তু আসলে তিনি সেই মানবজাতির পাপ, অবৈধ আইন ও শত্রুদেরই বিদ্ধ করলেন। কিন্তু যারা তাকে বিশ্বাস করে তাদের কোন আঘাত করলেন না। কিন্তু তাঁর তখন মৃত্যু হলেও আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলেন তিনি। মৃত্যু তাকে বেশিদিন আবদ্ধ করে রাখতে পারল না সমাধিগহ্বরে।

তার মৃত্যুর তিন দিন পরে প্রভাতের আলো ফুটে উঠতেই তিনি উঠে পড়লেন তার সমাধিগহুর হতে। মানবজাতির পক্ষ থেকে মৃত্যুর সব দেনা তিনি শোধ করে দেবেন এইভাবে। তোমার মৃত্যুদণ্ড তিনি ভোগ করে মুক্ত করবেন তোমাকে সে দণ্ড হতে। তার এই ঐশ্বরিক কর্ম শয়তানের মাথায় আঘাত করে তার সব শক্তি চর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন। শয়তানের দৃষ্টি বহ্নিস্বরূপ পাপ আর মৃত্যুকে এইভাবে পরাস্ত করবেন তিনি।

শয়তানের মাথার গভীরে মৃত্যুর ক্ষত অনুপ্রবিষ্ট হবে, তারা মানুষের পায়ে ক্ষত সৃষ্টি করে বিশেষ কিছু করতে পারবে না। তাতে তার মৃত্যু হলেও সে মৃত্যু হবে সাময়িক এবং তারপর তারা অনন্ত জীবন লাভ করবে।

পুনর্জীবন লাভের পর কিন্তু সেই ঈশ্বরপুত্র বেশিক্ষণ থাকবেন না এই পৃথিবীতে। যে সব ভক্ত শিষ্যরা তাকে বিশ্বাসের সঙ্গে অনুসরণ করবে তাদের কাছে মাঝে মাঝে আবির্ভূত হবেন না। তারা সকল পাপ ও মৃত্যুর অভিশাপ হতে যে মুক্তি লাভ করেছে সে মুক্তির বাণী জগতের মানুষদের মধ্যে প্রচার করার ভার দেবেন তিনি তাদের উপর। তারা নবজাত মানুষদের সব পাপের কলুষ ধুয়ে এক পবিত্র জীবন দান করবে। সেই পবিত্র জীবনে কোথাও মৃত্যু থাকবে না, কারণ তাদের পরিত্রাতা তাদের এই নবজীবনের জন্যই মৃত্যুবরণ করে তাদের চিরমুক্তি দান করে গেছেন ঈশ্বরপুত্র।

সেদিন হতে শুধু আব্রাহামের সন্তানদের মধ্যেই নয়, সমগ্র জগতে আব্রাহামের ধর্ম প্রচারিত হবে। এইভাবে আব্রাহামের বংশ থেকে সমগ্র মানবজাতি উদ্ধারলাভ করবে।

এরপর তার ও তোমার শত্রুদের নির্জিত করে বিজয়গৌরবে আকাশপথে স্বর্গে চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে সর্পরূপী শয়তানকে শৃঙ্খল আবদ্ধ করে তার সারা রাজ্যে টেনে টেনে বেড়াবেন এবং পরে নির্জীব অবস্থায় ফেলে দেবেন। তারপর ঈশ্বরের স্বর্গসিংহাসনের পাশে ঈশ্বরের দক্ষিণ পার্শ্বে উপবেশন করে পূর্ণ গৌরব ও জ্যোতিতে বিরাজমান হবেন।

পরে পৃথিবীর ধ্বংস ও শেষ বিচারের দিন তিনি পূর্ণ গৌরবে নেমে এসে মৃত আত্মাদের বিচার করে পাপীদের শাস্তি আর পুণ্যাত্মাদের পুরস্কৃত করে তার স্বর্গরাজ্যে স্থান দেবেন। এই পাপ-পুণ্যের বিচারের ফলে পৃথিবী তখন ইডেন থেকে আরও সুন্দরতর হয়ে উঠবে।

এই বলে মাইকেল থামল এবং আদম আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, হে অনন্ত মঙ্গলের বার্তাবহ, এখন বুঝলাম সমস্ত মৃত্যু অর্থাৎ অমঙ্গল থেকে একদিন এক অফুরন্ত মঙ্গলের উদ্ভব হবে। সমস্ত অশুভ শক্তি শুভ হয়ে উঠবে। সৃষ্টির আদিতে যখন অন্ধকার থেকে আলোর সৃষ্টি হয়, সেই আশ্চর্য ঘটনার থেকে এ ঘটনা আরও আশ্চর্যজনক।

এখন আমি সংশয়াম্বিত অবস্থায় ভাবছি, আমার কৃত পাপকর্মের জন্য আমি অনুশোচনা করব, না কি সে পাপ থেকে অনেক মঙ্গলজনক ঘটনার উদ্ভব হবে বলে আনন্দ করব। পরম গৌরব ও মঙ্গলময় ঈশ্বর মানুষের অনেক মঙ্গল সাধন করবেন। সমস্ত রোষাবেগের উপর প্রাধান্য লাভ করবে তার মহিমা।

এখন বল, আমাদের পরম পরিত্রাতা স্বর্গারোহণ করলে তার অল্পসংখ্যক বিশ্বস্ত অনুগামীরা অবিশ্বাসী নাস্তিকদের মধ্যে কি করবে? তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে? সত্যের শত্ৰু সেই সব ঈশ্বরদ্রোহীদের কবল থেকে কে তাদের রক্ষা করবে? সেই সব অবিশ্বাসীরা ঈশ্বরপুত্রের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিল, তার অনুগামীদের সঙ্গে কি তার থেকে খারাপ ব্যবহার করবে না?

তখন দেবদূত প্রধান মাইকেল বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবে। স্বর্গ থেকে ঈশ্বর একজন উদ্ধারকর্তাকে পাঠাবেন। পরমপিতার এক উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি বহন করে আনবেন তিনি। তিনি তাদের মধ্যে তাদের অন্তরাত্মারূপে বাস করবেন। ঈশ্বরপ্রেমের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরবিশ্বাস কিভাবে কাজ করে তার বিধানগুলি তিনি মুদ্রিত করে দেবেন তাদের অন্তরে। তিনি তাদের ন্যায় ও সত্যের পথ দেখাবেন। তিনি তাদের এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তি দান করবেন যে শক্তি দিয়ে তারা শয়তানদের সব আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে, তার সব অগ্নিগর্ভ শরগুলিকে ব্যর্থ করে দিতে পারবে। মানুষ তখন নির্ভীক চিত্তে তাদের আত্মশক্তির দ্বারা সব নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এমনভাবে রুখে দাঁড়াবে যে তা দেখে সেই সব গর্বোদ্ধত অত্যাচারীরাও আশ্চর্য হয়ে যাবে।

ঈশ্বর প্রথমে কয়েকজন সাধুপুরুষকে মানবজাতির মধ্যে তার বাণী প্রচারের জন্য পাঠাবেন। তারপর যারা তাঁর ধর্মে দীক্ষিত হবে তাদের এমন এক আশ্চর্যজনক শক্তি দান করবেন যার দ্বারা তারা সকল জাতির মানুষের সঙ্গে সকল ভাষায় কথা বলে ধর্মবোধে অনুপ্রাণিত করতে পারবে সকলকে। অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারবে।

এইভাবে তারা প্রতিটি জাতির মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষের হৃদয় জয় করতে পারবে যারা স্বর্গ থেকে আগত ঈশ্বরের বাণী আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে।

অবশেষে সেই ধর্মপ্রচারকেরা তাদের কাজ শেষ করে তাদের নীতি উপদেশ সমম্বিত ধর্মবাণীগুলিকে লিপিবদ্ধ করে মহাপ্রয়াণ করবেন। তারা আগে থেকে সাবধান করে দিয়ে যাবেন, তাদের মৃত্যুর পর যত সব নরখাদক ভয়ঙ্কর নেকড়ের দল ধর্মপ্রচারকের আসনে এসে বসবে যারা ঈশ্বরের পবিত্র বাণী ও নীতি উপদেশগুলিকে নিজেদের অসংযত উচ্চাভিলাষ ও স্বাহপূরণের উপায় হিসাবে ব্যবহার করবে। সত্যের সঙ্গে কুসংস্কার ও প্রথাগত ক্রিয়াকাণ্ডগুলিকে মিলিয়ে ধর্মের মূল সত্যকে কলুষিত করে তুলবে তারা। সে সত্য শুধু বিশুদ্ধ অবস্থায় গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকবে। অন্তর দিয়ে সে সত্য কেউ বুঝতে চেষ্টা করবে না।

তারপর সেই সব স্বার্থান্ধ ধর্মপ্রচারকেরা আধ্যাত্মিকতার ভান করে রাজক্ষমতা লাভ করবে। তখন তারা নিজেদেরই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ধর্মবিশ্বাসীদের প্রভাবিত করে তাদের বড় বড় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবে। ফলে সেই সব বিধান তাদের অন্তরাত্মা গ্রহণ করতে পারবে না।

এইভাবে মানবাত্মার উপর জোর করে ঈশ্বরের বাণী চাপিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের মহিমাকে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর বন্ধনে আবদ্ধ করবে তারা। ফলে অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস ও প্রেমভক্তির ভিত্তিভূমির উপর ঈশ্বরের যে মন্দির স্থাপিত হয় সে মন্দিরের মহিমাকে ধূলায় লুটিয়ে দেবে তারা। যে মানুষের পৃথিবীতে ঈশ্বরের এক একটি জীবন্ত মন্দির তাদের স্বাধীনতা হরণ করে তাদের মধ্যে প্রভূত ধর্মবিশ্বাস জাগাতে পারবে সে মন্দির ধ্বংস করে দেবে তারা। সেই সঙ্গে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলবে। যার নিজের মধ্যে কোন ধর্মবিশ্বাস নেই তার মুখে ধর্মের কথা কেন শুনবে লোকে? কি করে তাকে অভ্রান্ত বলে মনে করতে পারবে?

অবশ্য অনেকেই তা মেনে চলবে। ফলে যারা ধর্মোপাসনার মধ্যে ধর্মের সত্য ও মর্মার্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে তাদের উপর জোর অত্যাচার শুরু হবে। কারণ বেশির ভাগ মানুষ তখন বাইরের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের দ্বারাই তাদের ধর্মবোধকে তৃপ্ত করবে। সেই সব নীরস কর্মের মধ্যেই ধর্মের সত্যকে সীমাবদ্ধ দেখে তৃপ্ত হবে। নিন্দার ভয়ে সত্য মুখ লুকোবে, প্রকৃত ধর্মবিশ্বাস কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এইভাবে জগৎ চলবে মন্দ ও অশুভ শক্তির হাতে পড়ে, যা কিছু শুভ ও সত্য তা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করবে। অবশেষে দুষ্ট ও দুবৃত্তদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আবার তিনি ফিরে আসবেন নারীর গর্ভজাত সন্তানরূপে। একথা আগেই দুর্বোধ্যভাবে বলা হয়েছিল।’

তোমার পরিত্রাতা এবং প্রভু সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছ। অবশেষে তিনি স্বর্গ থেকে মেঘের আবরণে নিজেকে আবৃত করে পৃথিবীতে এসে পরম পিতার গৌরব ও মহিমা প্রকাশ করবেন। শয়তান ও তার বিকৃত জগৎকে ধ্বংস করে দেবেন। মানুষের চিত্তকে শোধন করে অক্ষয় শান্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তির উপর এক নূতন স্বর্গ ও পৃথিবী গড়ে তুলবেন। সে পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে অবিচ্ছিন্নভাবে পরিপূর্ণ আনন্দ ও এক পরম স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করতে থাকবে।

মাইকেলের কথা এইখানে শেষ হলে আদম বলল, হেসত্যদ্রষ্টা, তোমার ভবিষ্যৎবাণী কত শীঘ্র দ্রুতগতি কালের মতো ধাবমান হয়ে সমগ্র জগৎ পরিক্রমা করে এল। তার বাইরেই বিরাট শূন্যতার এক খাদ। যার অনন্ত অতল গভীরতা চোখে দেখা যায় না।

আমি অনেক উপদেশ অনেক শিক্ষা লাভ করেছি। আমি এবার শান্ত মনে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাব এখান থেকে। আমি প্রচুর জ্ঞান লাভ করে তৃপ্ত হয়েছি। তার বাইরে কিছু জানতে চাওয়া নির্বুদ্ধিতামাত্র। এখন আমি বুঝতে পেরেছি এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও আশঙ্কার সঙ্গে তাঁর সমস্ত বিধান মেনে চলাই সবচেয়ে ভাল। তার উপরেই জগৎ ও জীবনের সব কিছু নির্ভর করে।

তিনি পরম করুণাময়। তাঁর করুণায় সমস্ত অশুভ শক্তিকে জয় করে মঙ্গল লাভ করা যায়। যারা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ও দুর্বল তারাও তার করুণা ও অনুগ্রহের ফলে পার্থিব শক্তিতে বলবানদের বশীভূত করতে পারে। সত্যের খাতিরে দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে জয়ের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারা যায়। ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে মৃত্যুও নবজীবনের দ্বার খুলে দেয়। যাঁকে আমি আমার পরম পরিত্রাতা মনে করি তাঁর দৃষ্টান্ত থেকেই এ শিক্ষা লাভ করেছি।

তখন মাইকেল শেষবারের মতো বলল, এই কথা জেনে তুমি সমস্ত ধর্মের সারমর্ম জেনে ফেলেছ। এক বৃহত্তর জীবনের আশায় অনুপ্রাণিত হবে তুমি। সব নক্ষত্রদের নাম, স্বর্গে ঈশ্বরের সব কর্মপদ্ধতি, ঐশ্বরিক শক্তির সব রহস্য, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে প্রকৃতির সব কাজকর্ম, জগতের সব রাজ্য ও সাম্রাজ্যের শাসনপদ্ধতি ও ধনসম্পদের রহস্য সব জানতে পারবে তুমি।

এইভাবে সব জ্ঞাতব্য বিষয় জানতে পেরে তোমার জ্ঞান বেড়ে যাবে। তার ফলে তোমার ধর্মবিশ্বাস, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, প্রেম, ভালবাসা প্রভৃতি গুণগুলিও বেড়ে যাবে। তখন তুমি এই স্বর্গোদ্যান ছেড়ে আর দুঃখবোধ করবে না। তোমার মনই এক মনোরম স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠবে। তুমি আগের থেকে আরও অনেক সুখী হবে। সকল গুণের শ্রেষ্ঠ প্রেম তোমাদের বদান্যতা ও সাবলীলতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবে। এখন এই কল্পনার শিখরদেশ এই মর্ত্য থেকে নেমে চল। এখন আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। ঐ দেখ, নিকটবর্তী এক পাহাড়ে অবস্থিত শিবির থেকে দেবদূত প্রহরীরা একটি জ্বলন্ত তরবারি ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার সংকেত দান করছে। আর আমরা এখানে একমুহূর্তও থাকতে পারি না।

যাও, ঈভকে গিয়ে জাগাও। এক মধুর স্বপ্ন দিয়ে শান্ত করে রেখেছি তাকে। সে স্বপ্নে অনেক সুলক্ষণ দেখতে পাবে। এক অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণে দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠবে তার অন্তরাত্মা। তুমি সময় বুঝে যা যা আমার কাছে শুনেছ তা সব বলবে তাকে, বিশেষ করে তার ধর্মবিশ্বাস দৃঢ় করার জন্য যা তার জানা দরকার। বলবে মানবজাতির পরম মুক্তিদাতা তারই গর্ভজাত এক সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করবে।

বলবে, তুমি দীর্ঘকাল বাঁচবে। দুঃখের দিন সব পার হয়ে গেছে। ধর্ম অবলম্বন করে উপাসনার দ্বারা সুখে জীবন অতিবাহিত করবে তুমি।

মাইকেলের কথা শেষ হতেই পাহাড় থেকে অবতরণ করতে লাগল তারা।

পাহাড়ের পাদদেশে নেমে এসেই আদম সেই কুঞ্জবনে ছুটে গেল যেখানে ঈভ ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল, ঈভ আগেই জেগে উঠেছে ঘুম থেকে।

ঈভ তখন উৎফুল্লভাবে আদমকে বলল, কোথায় গিয়েছিলে, কোথা হতে ফিরে এলে তুমি তা আমি জানি। কারণ ঈশ্বর নিদ্রা ও স্বপ্নের সময়ে মানুষের আত্মার মধ্যেই বিরাজ করেন। গভীর বিষাদ ও দুঃখের ভারে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু তিনি আমার সেই ঘুমের মধ্যেই কয়েকটি সুলক্ষণের দ্বারা আমাদের ভবিষ্যৎ সুদিনের কথা বলে দিয়েছেন।

এখন চল কোথায় যাবে। তোমার সঙ্গে যেকোন স্থানে যাওয়া আর এখানে থাকা সমান কথা। তোমাকে ছেড়ে এখানে থাকা মানে আমার আত্মাহীন ইচ্ছাহীন দেহের অবস্থানমাত্র। তুমি আমারই অপরাধের জন্য নির্বাসিত হয়েছ এখান থেকে। এখন তুমি আমার সব, স্বর্গ-মর্ত্যের সব স্থান তোমার মধ্যেই আছে।

এখন একটা সান্ত্বনা নিয়ে শান্ত মনে যাচ্ছি এখান থেকে। আমি সব কিছু হারালেও আমি শত অযোগ্য হলেও ঈশ্বরের একটি মহতী অনুগ্রহতে ধন্য হয়েছি, আমারই গর্ভজাত সন্তান অধঃপতিত মানবজাতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে তার হারানো গৌরবের মধ্যে।

আমাদের আদিমাতা এই কথা বললে আদম তা শুনে সন্তুষ্ট হলো। কিন্তু কোন কথা বলল না। কারণ প্রধান দেবদূত মাইকেল প্রহরীদের সঙ্গে নিকটেই অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। তারা সবাই পাহাড় থেকে নামছিল। তাদের সামনে সেই জ্বলন্ত তরবারিটি জ্বলন্ত উল্কার মতো তাদের আগে আগে যাচ্ছিল।

মাইকেল এবার আদম ও ঈভকে দুহাতে ধরে স্বর্গলোকের পূর্বদ্বারে নিয়ে গেল। তারপর সেই খাড়াই পাহাড়ের প্রান্তভাগ থেকে নীচের এক সমতলভূমিতে তাদের নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আদম ও ঈভ একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে তাদের এতদিনের বাসভূমি সেই স্বর্গোদ্যানের পূর্বদিকটি দেখল। এখন সেই দ্বারপথটিকে ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দেবদূত প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে।

স্বতঃস্ফূর্ত কয়েক বিন্দু অশ্রু ঝড়ে পড়ল তাদের চোখ থেকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে ফেলল তারা। তারা দেখল তাদের সামনে প্রসারিত হয়ে আছে অনন্ত পৃথিবী। কোন্ স্থানটিকে তাদের আবাসভূমি হিসাবে বেছে নেবে, কিভাবে ঐশ্বরিক বিধান তাদের পথ প্রদর্শন করবে তা ভাবতে লাগল তারা। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে ধীর গতিতে এগিয়ে চলতে লাগল জনমানবহীন পৃথিবীর পথে।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *