৭ম সর্গ

সপ্তম সর্গ

দেবদূত রাফায়েলের কথা শেষ হলে তার কণ্ঠস্বর আদমের কানে এমনভাবে অনুরণিত হতে লাগল যে তার মনে হলো তার কথা যেন শেষ হয়নি তখনো। মনে হলো এখনো সে সব কথা শুনতে পাচ্ছে।

তখন সে সদ্যনিদ্রোখিত ব্যক্তির মত বলতে লাগল, হে ঐশ্বরিক দৈব ঐতিহাসিক, কি বলে ধন্যবাদ দেব তোমায়? তোমার এ কর্মের জন্য কি প্রতিদান দেব তোমায়? তুমি আমার জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত করার জন্য অনেক কিছু বলেছ। যে জ্ঞান শত অনুসন্ধান ও চেষ্টার দ্বারা অধিগত করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে, তুমি তোমার দৈব মর্যাদার আসন হতে পরম বন্ধুর মত নেমে এসে সে জ্ঞান আমায় দান করেছ। সে জ্ঞানের কথা আমি বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে সব শুনেছি এবং উপযুক্ত গৌরবদানের দ্বারা আমাদের পরম স্রষ্টাকেই অনিন্দিত করছি।

তথাপি কিছু সংশয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং একমাত্র তুমিই তার সমাধান করতে পার।

যখন আমি স্বর্গ ও মতসমন্বিত এই জগৎকে প্রত্যক্ষ করি এবং তার বিশালতাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করি তখন এই পৃথিবীকে অনন্ত প্রসারিত আকাশের তুলনায় একটি শস্যকণা বা অণু বলে মনে হয়। আকাশের অসংখ্য নক্ষত্ররাজি যে দূরত্বের ব্যবধানে আপন আপন কক্ষপথে ঘুরতে থাকে তা সত্যিই রহস্যময় এবং দুর্বোধ্য।

আমি শুধু একটা জিনিস যুক্তি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেও বুঝতে পারি না। সেটা হলো এই যে, প্রকৃতি বিজ্ঞ এবং উদার হলেও তার সৃষ্টির মধ্যে এমন সমানুপাতবিহীন তারতম্য কেন? যে প্রকৃতি উদার হাতে এত সব বিরাটাকায় গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছে সেই প্রকৃতি তাদের তুলনায় এই পৃথিবীকে এত ছোট করে কেন সৃষ্টি করল?

আমাদের আদিপিতা এইসব কথা দেবদূত রাফায়েলকে বলল। তার মুখমণ্ডলের উপর এক অতৃপ্ত জ্ঞানানুসন্ধিৎসা ফুটে উঠল। ঈভ তা দেখে তার আসন থেকে উঠে এসে তাদের সামনে বসল। সে একবার ফল-ফুল কোথায় কি আছে তা দেখার ও গাছপালার সেবা করার জন্য তার কব্যকর্ম পালনের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তার স্বামী ও দেবদূত অতিথির মধ্যে যে সব আলোচনা হচ্ছিল তা শোনার জন্য সে উঠে দাঁড়িয়েও গেল না।

সুন্দরী ঈভকে তাদের কাছে বসতে দেখে তারা প্রীত হলো। উচ্চ বিষয়ে এইসব আলোচনা সে যে বুঝতে পারছিল না তা নয়। এসব শোনার সে অযোগ্য ছিল কোনক্রমে। বরং এসব শুনে সে আনন্দই পাচ্ছিল।

তার স্বামীর সঙ্গেও নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয় তারা যখন একা থাকে। আদম কথা বলে, সে শুনে যায়। শুনতে ভালবাসে। কত জটিল বিষয়ের সমাধান করে দেয় সে। এখন তাদের অতিথি দেবদূতের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তার স্বামীর যে সব কথাবার্তা হচ্ছিল তার মধ্যে তার স্বামীর কথাই দেবদূত্রে কথার থেকে বেশি ভাল লাগছিল তার। তার স্বামীর শুধু কথা নয়, তার জ্ঞান, তার জানার আকাঙ্ক্ষা ও বৃদ্ধির প্রশংসা না করে পারে না সে। স্বামীর প্রতি তার ভালবাসার মধ্যে মিশ্রিত ছিল শ্রদ্ধা। এমন দাম্পত্য প্রেম সত্যিই বিরল। স্বামীর প্রতি তার প্রেম যেমন ছিল অতুলনীয় তেমনি তার দেহসৌন্দর্য ও রূপলাবণ্য ছিল অনুপম। তাকে এবার দেখলেই আরও দেখার বাসনা শর হয়ে বিদ্ধ করতে থাকে।

আদমের সংশয় নিরশনের জন্য রাফায়েল এবার বলতে লাগল, এ বিষয়ে কোন কিছু প্রশ্ন করা বা গবেষণা করা আমি দোষাবহ বলি না। কারণ স্বর্গলোক হচ্ছে ঈশ্বরের এমন একটি গ্রন্থ যাতে তাঁর আশ্চর্যজনক সৃষ্টিসমূহের কথা জানতে পারা যায়। ঋতু পরিবর্তন, প্রহর, দিন, মাস, বৎসর, প্রকৃতির আবর্তনের কথা জানা যায়। জানা যায় পৃথিবী ঘোরে না গ্রহনক্ষত্রাদি সৌরজগৎ ঘোরে। বাকি বিষয় পরম স্রষ্টা মানুষ বা দেবদূতদের কাছে অপরিজ্ঞাত রেখেছেন। সে রহস্য তারা উদঘাটন করতে পারবে না বা তার কোন চেষ্টাও করবে না, তারা শুধু ঐশ্বরিক সৃষ্টিকার্যের প্রশংসা করে যাবে।

তবু যদি তারা এ বিষয়ে অনুমানের দ্বারা কিছু জানতে চায় এবং তর্কবিতর্ক করে তাতে শুধু বিবাদই বেড়ে যাবে এবং অজ্ঞতাজনিত তাদের নির্বোধসুলভ মন্তব্য ঈশ্বরের মধ্যে হাসির উদ্রেক করবে অর্থাৎ তারা তাঁর কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে উঠবে। তারা যদি জানতে যায় স্বর্গলোকের গঠনপ্রণালী কি, কিভাবে এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গঠিত হয়েছে বা চালিত হচ্ছে, তারা যদি আকাশের অগণিত নক্ষত্ররাজিকে গণনা করতে যায় তাহলে ভুল করবে।

আমি ইতিমধ্যেই তোমার কথা ও প্রশ্ন থেকে জানতে পেরেছি তুমি ভাবছ সৌরজগতের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যস্থিত যে সব গ্রহনক্ষত্রগুলি আকার অনেক বড় এবং সতত আলোকোজ্জ্বল তারা অপেক্ষাকৃত ছোট ও অনুজ্জ্বল গ্রহগুলিকে আলোকদান করে কেন? তারা বড় হয়েও সব সময় সচল ও সক্রিয় এবং তারা স্বতন্ত্র ও অতন্ত্রভাবে তাদের আপন আপন কক্ষপথে আকাশ পরিক্রমা করে অথচ পৃথিবী অন্য জায়গায় স্থির হয়ে থাকে কেন? অথচ পৃথিবীই তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকার পায়।

কিন্তু আর একটা জিনিস ভেবে দেখ, কোন বস্তু আকারে বড় এবং উজ্জ্বল হলেই যে তা গুণগতভাবে উত্তম হবে এমন কোন কথা নেই। যদিও পৃথিবী সূর্য বা অন্য সব গ্রহনক্ষত্রের তুলনায় আকারে ছোট এবং তার কোন নিজস্ব উজ্জ্বলতা নেই, তথাপি তার মধ্যে এমন অনেক মূল্যবান ও ব্যবহারযোগ্য বস্তু আছে যা জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে নেই। সূর্য ও গ্রহনক্ষত্রগুলি আকারে ও আয়তনে বিরাটাকায় হলেও তারা একেবারে বন্ধ্যা। কোন প্রাণীর পক্ষেই তা বসবাসযোগ্য বা ব্যবহারযোগ্য নয়। তাদের যে সব নিজস্ব গুণ আছে তার ফল তারা নিজেরাই পায় না, অথচ সেই গুণের দ্বারা পৃথিবী হয় ফলবতী। তাদের আলো পৃথিবীতেই পড়ে এবং পৃথিবী তাতে আলোকিত হয়। অথচ পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের কাছ থেকে ঐ সব জ্যোতিষ্কগুলি কত দূরে।

স্বর্গলোকের সুবিশাল পরিমণ্ডল, তার আয়তন ও পরিধি পরম স্রষ্টার মহত্ত্বকেই সূচিত করে। তিনিই তাকে এত বড় ও বিস্তৃত করে গঠন তার সীমারেখা। বিশালায়তন স্বর্গলোকের সুবিস্তৃত পরিসরের একট মাত্র অংশে ঈশ্বর বাস করেন, বাকি স্থানে কারা বাস করে তা তিনিই জানেন। চোখে কিছুই দেখা যায় না পৃথিবী থেকে। অথচ স্বর্গে ও সৌরলোকে যারা থাকে তারা প্রচণ্ড গতিশক্তিসম্পন্ন। একটি জড়দেহের মধ্যে এমন গতিশক্তির সঞ্চার ঈশ্বরেরই সর্বশক্তিমত্তার পরিচয় দান করে। কিন্তু পৃথিবী থেকে সে গতি বোঝা যায় না।

এই আমাকেই ধরো না কেন। আমাকে তুমি ধীরগতি ভেবো না। আমি সুদূর স্বর্গলোক থেকে প্রভাতকালে রওনা হয়েছিলাম এবং বেলা দ্বিপ্রহরের আগেই এখানে এসে উপনীত হয়েছি। অথচ স্বর্গ ও মর্তের মধ্যে দূরত্ব অবর্ণনীয়, অপরিমেয়। এ বিষয়ে তোমার সংশয় দূর করার জন্যই একথা বললাম।

ঈশ্বর স্বর্গলোক থেকে যে সব কার্য পরিচালনা করে থাকেন তা মানবজগতের জ্ঞানের গোচরীভূত না করার জন্য স্বর্গকে পৃথিবী থেকে এত দূরে রেখেছেন। মানুষ যদি পৃথিবী থেকে স্বর্গের সব কিছু দেখতে পেত তাহলে ঐশ্বরিক কার্যাবলী সম্বন্ধে তারা অনেক কিছু ভুল অনুমান করত, অথচ তার থেকে কোন লাভই হত না তাদের।

সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগতের গ্রহনক্ষত্রেরা যেন মহাশূন্যে ঘুরছে অবিরাম। মনে হয় যেন তারা ঈশ্বরের চারদিকে কখনো উপরে উঠে, কখনো নীচে নেমে, কখনো একটু এগিয়ে, কখনো কিছুটা পিছিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচতে থাকে। তাদের গতি সব সময় একভাবে থাকে না।

পৃথিবীরূপ এই গ্রহটিকে তোমার স্থিতিশীল মনে হয় বটে, কিন্তু তারও মধ্যে তিনটি গতি আছে। আরও কয়েকটি গ্রহের এই গতি আছে। কিরণদানের ব্যাপারে সূর্যের শ্রমকে বাঁচাবার জন্য পৃথিবী পূর্বদিকে প্রতিদিন এগিয়ে যায় ঘুরতে ঘুরতে। পৃথিবীর যে দিকটি সূর্যের দিক থেকে সূর্যালোক গ্রহণ করে সেই দিকেই দিন হয় এবং তার অনালোকিত অপর দিকটিতে রাত্রি হয়। পৃথিবী আবার সূর্যের কাছ থেকে আলো নিয়ে চাঁদে স্বচ্ছ বাতাসের মধ্য দিয়ে সেই আলো পাঠিয়ে চন্দ্রলোকের দিনকে আলোকিত করে। চন্দ্র আবার তার প্রতিদানস্বরূপ রাত্রিবেলায় সূর্যের কাছ থেকে আলো নিয়ে পৃথিবীর রাত্রিকে পর্যায়ক্রমে আলোকিত করে। চন্দ্রলোকেও নিশ্চয় ফুল, ফল, মাঠ, ঘাট ও মানুষ আছে। চাঁদের মধ্যে যে সব কালো কালো দাগ দেখা যায় সেগুলি হয়ত মেঘ। সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে চাঁদের ভূখণ্ডকে উর্বর করে তুলে গাছে গাছে ফল ফলায়। সেই ফল নিশ্চয় তার অধিবাসী জীবরা খায়। প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহেই নিশ্চয় জীবন্ত প্রাণী ও নরনারী আছে। আলোর মধ্যেও নারী-পুরুষ আছে। সূর্যের আলোকে আমরা বলি পুরুষ-আলো, চাঁদের আলোকে আমরা বলি মেয়ে-আলো। প্রকৃতি পুরুষ সব জগৎ শাসন করে। প্রকৃতির রাজ্যে কোন স্থানই শূন্য বা পরিত্যক্ত থাকতে পারে না।

কিন্তু কেন এ জিনিস হলো, কেন হলো না, তা জানতে চেও না। আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে সূর্য কেন এত প্রভাবশালী, সেই সূর্য পৃথিবীতে উদিত হয় কি না, সূর্য পূর্বদিক হতে তার উজ্জ্বল পথে পৃথিবীকে আলোকদান করার জন্য এগিয়ে আসে না কি, পৃথিবী পশ্চিম দিক হতে সূর্যের আলো গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে যায়–এই সব গোপন বিষয় জানার জন্য কোন অনুরোধ করো না। এসব ব্যাপার ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দাও। তাঁকে ভয় করো, তাঁর সেবা করে যাও। অন্যান্য প্রাণীরা এসব বিষয় কিছুই জানতে চায় না। তাই তারা নীরব আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে তাঁকে প্রীত করে সবচেয়ে বেশি। ঈশ্বর নিজে থেকে তোমাকে যা কিছু দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাক। তাতেই আনন্দলাভ করে। এই মনোরম স্বর্গোদ্যান, তোমার জীবনসঙ্গিনী ঈত–এ সবই ঈশ্বরের দান। স্বর্গে কি হচ্ছে, ঈশ্বর কি করছেন না করছেন–এসব ঊর্ধ্বলোকের ব্যাপার তোমার জ্ঞানগম্য নয়। তোমার জ্ঞানকে সীমিত করে রাখ। যে সব বিষয় তোমার জীবন ও অস্তিত্বের সঙ্গে সংজড়িত তুমি শুধু সেই সব কথাই ভাব। অন্যান্য জগতের কথা স্বপ্নেও ভাবতে যেও না। অন্যান্য গ্রহগুলিতে কারা কিভাবে এবং কি অবস্থায় বাস করে তা মর্ত্যমানবের জানার বিষয় নয়, তা একান্তভাবে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ব্যাপার।

আদম তখন সংশয়মুক্ত হয়ে উত্তর করল, হে প্রশান্ত দেবদূত, বিশুদ্ধ স্বর্গীয় জ্ঞানের প্রতীক, তুমি আমার জ্ঞানগত কৌতূহলটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত করেছ। আমার চিন্তাকে সমস্ত জটিলতা থেকে মুক্ত করেছ তুমি। যে সব জটিল চিন্তা ও জ্ঞানান্বেষণ বাঁচার আনন্দকে বিঘ্নিত করে সেই সব অহেতুক চিন্তা হতে মুক্ত হয়ে কিভাবে সহজ সরল জীবনযাপন করা যায় তুমি তা শিখিয়েছ আমাকে। এই সব উদ্বেগাকীর্ণ চিন্তাভাবনা থেকে ঈশ্বর দুরে থাকতে বলেছেন আমাদের। আমরা যেন অস্থির উদ্ধত চিন্তাকল্পনা ও ব্যর্থ অনুমানের দ্বারা নিজেদের অকারণে বিব্রত করে

তুলি। কিন্তু মনের ধর্মই হচ্ছে অবাধ উদ্ধত কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করা এবং তার এই। বিচরণ বা অশান্ত গতিচঞ্চলতার বিরাম নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে মন কারো দ্বারা সতর্কিত হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার অভিজ্ঞতার দ্বারা জানতে পারছে দূরাম্বিত, দূরধিগম্য রহস্যজটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলিকে জানতে চাওয়া এক অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা, তার বাস্তব ব্যবহারিক দৈনন্দিন জীবনের সীমার মধ্যে যা কিছু আছে শুধু সেই সব কিছুই তার একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় এবং তার বাইরে সব কিছুই ধোঁয়া, এক শূন্যতামাত্র ততক্ষণ মন আমাদের শান্ত হয় না।

সূতরাং জ্ঞানের দিক থেকে বেশি উপরে উড়তে না গিয়ে নীচের দিকে নামাই ভাল। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে যে সব বিষয়গুলি অপরিহার্য যা আমাদের হাতের কাছে থেকে ঘটনাক্রমে প্রশ্ন জাগায় আমাদের মনে, সেই সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করা বা কথা বলাই উচিত আমাদের পক্ষে।

কিছুক্ষণ আগে আমার স্মৃতি ক্রিয়াশীল হবার আগে যা যা ঘটেছে তা বর্ণনা করেছ তুমি এবং আমি তা শুনেছি। এবার আমার কাহিনী শোন। এখনো দিন শেষ হয়নি। সে কাহিনী তুমি শোননি। দিন গত হলে দেখবে কেমন কৌশলে আমি তোমায় আটকে রেখে আমার কাহিনী শোনাচ্ছি। এই উদ্যানের সুমিষ্ট ফলের থেকে তোমার মুখের উত্তর-প্রত্যুত্তরগুলি অনেক বেশি মধুর বলেই তোমার কথা শুনতে চাই। শ্রমজনিত ক্লান্তির পর এখানকার তালগাছের সুস্বাদু ফলগুলি ভক্ষণ করলে শীঘ্রই আমাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা একই সঙ্গে পরিতৃপ্তি হয়। কিন্তু তোমার মুখের মিষ্টি কথা শত শুনেও আশ মেটে না। যত শুনি ততই শুনতে মন হয়।

রাফায়েল তখন তার উত্তরে বলল, হে মানবজাতির আদিপিতা, তোমার ওষ্ঠাধরনিঃসৃত বচনগুলিও কম সুধাময় নয়। তোমার জিহ্বাও জড়তামুক্ত। কারণ তুমি ঈশ্বরেরই এক সুন্দর প্রতিমূর্তি বলে ঈশ্বর তোমার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গটিকে তার দ্বারা প্রদত্ত অনেক গুণেই ভূষিত করেছেন। সবাক বা নির্বাক যে অবস্থাতেই তুমি থাক না কেন তোমাকে সব অবস্থাতেই সুন্দর দেখায়। তোমার প্রতিটি বচন ও গতিভঙ্গি সুন্দর।

স্বর্গে আমরা আমাদের অনুগত সেবকদের কথা যেমন বলি, তেমনি তোমার কথাও কম আলোচনা করি না, মানবজাতির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রশ্নও করি। কারণ ঈশ্বর তোমাদের কম সম্মানে ভূষিত করেননি। আমাদের মতো তোমাদেরও সমানভাবে ভালবাসেন। সুতরাং কি বলবে বল।

সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না। ঈশ্বরের আদেশে আমি একদল দেবসেনা নিয়ে নরকদ্বারে এক অভিযানে গিয়েছিলাম। ঈশ্বর যেদিন এই পৃথিবী সৃষ্টি করেন সেদিন। তিনি হয়ত আভাস পেয়েছিলেন নরক থেকে শয়তানপ্রেরিত কোন শত্রু বা গুপ্তচর এসে ভঁর নবনির্মিত সৃষ্টিকার্যের মধ্যে কোন ধ্বংসের বীজ বপন করতে পারে। তাই তিনি আমাকে পাঠান।

তারা অবশ্য সে চেষ্টা করেনি। আমরা গিয়ে দেখলাম নরকের ভয়ঙ্কর দ্বারগুলি দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ আছে। আমরা নরকদ্বারের এপার হতে শুনতে পেলাম নরকের অভ্যন্তরে যন্ত্রণায় কাতর আর্তনাদ করছে অসংখ্য ব্যক্তি। কোন নৃত্যগীতের শব্দ নয়, শুধু সেই আর্তনাদের ধ্বনিইশুনতে পেলাম আমরা। আমরা সানন্দে ফিরে এলাম স্বর্গলোকে।

যাই হোক, এবার তোমার কাহিনী বর্ণনা করো। আমার কথা শুনে তুমি যেমন আনন্দ পাও, তেমনি তোমার কথা শুনেও আনন্দ পাই আমি।

রাফায়েলের এই কথা শুনে আমাদের আদিপিতা বলল, মানবজীবনের উৎপত্তির কথা বলা মানুষের পক্ষে সত্যিই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেউ কখনো তার নিজের জীবনের উৎপত্তির কথা জানতে পারে না। তোমার সাহচর্যকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই আমি এ কাহিনী বলতে যাচ্ছি।

একদিন গভীর ঘুম থেকে সূর্যালোকের তপ্ত স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠে দেখলাম পত্রপুষ্পের এক পেলব শয্যায় শুয়ে আছি, রৌদ্রতাপে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে আমার কলেবর। সহসা আমার চোখের দৃষ্টি আকাশের পানে নিবদ্ধ হতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।

তারপর আকাশ থেকে আমার দৃষ্টি নামিয়ে আমার চারদিকে তাকিয়ে পাহাড়, উপত্যকা, ছায়াচ্ছন্ন বনভূমি সূর্যালোকিত প্রান্তর ও কলমন্দ্রমুখরা ঝর্ণার তরলিত প্রবাহ দেখতে পেলাম। তার সঙ্গে অনেক জীবজন্তুকেও ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। দেখলাম অনেক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে অথবা গাছের শাখায় বসে গান করছে। দেখলাম সমগ্র প্রকৃতি হাস্যোজ্জ্বলা, শব্দগন্ধবর্ণময় এক আনন্দের উচ্ছ্বাসে মত্তপ্রাণা।

তা দেখে এক সুবাসিত আনন্দের প্লাবনে প্লাবিত হয়ে উঠল আমার অন্তর। তখন এক অদম্য উজ্জ্বল প্রাণশক্তিতে সজীব আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম আমি। কিন্তু আমি কে, কোথা হতে কি কারণে এসেছি এখানে তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি কিছুক্ষণ হেঁটে ও ছুটে বেড়ালাম। তারপর কথা বলার চেষ্টা করলাম এবং কথা বলতে পারলাম।

আমি তখন বলতে লাগলাম, হে সূর্য, হে আলোকোজ্জ্বল ও আনন্দময় পৃথিবী, হে পর্বত ও উপত্যকারাজি, নদী বন ও প্রান্তরসমূহ, হে সকল প্রাণিগণ, তোমরা বল, এখানে আমি কেমন করে এলাম তা তোমরা দেখেছ কি? কিভাবে আমার উৎপত্তি হলো বল। আমি নিজের দ্বারা নিজে সৃষ্ট হইনি। নিশ্চয় সততা, উদারতা ও সৃষ্টিশক্তিতে মহান কোন স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন আমাকে। যাঁর অনুগ্রহে আমি আমার এই জীবন ও গতিশক্তি লাভ করেছি, যাঁর কৃপায় আমি এত সুখী, তাঁকে কেমন করে জানব? কেমন করে ভক্তিশ্রদ্ধা করব?

এই কথা বলতে বলতে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি তা আমি বুঝতে পারলাম না। পথে যেতে যেতে আমি প্রাণভরে বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নিলাম। তখন আমি এই আলোর সুষমা দেখলাম। কিন্তু কেউ আমার কথার উত্তর দিল না।

ছায়াচ্ছন্ন এক কুসুমিত নদীতটে আমি বসলাম। ক্রমে শান্ত মধুর এক নিদ্রা এক মেদুর চাপ সৃষ্টি করে আচ্ছন্ন করে ফেলল আমার তন্দ্রাভিভূত চেতনাকে। তখন আমার মনে হলো আমি যেন আমার জন্মের পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়েছি। অবলুপ্ত হয়ে গেছে আমার সচেতন সত্তাটি।

সহসা স্বপ্নের মধ্যে আমার নিজেরই এক ছায়ামূর্তি দেখে মনে হলো আমি তখনো বেঁচে আছি, চেতনা আছে আমার দেহের মধ্যে।

এমন সময় এক দৈবাকৃতি পুরুষ এসে আমায় বলল, হে আদি মানবপিতা আদম, ওঠ, তুমি হবে অসংখ্য মানবসন্তানের পিতা। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে এই স্বর্গোদ্যানের মধ্যে তোমার পথপ্রদর্শকরূপে আমি তোমার বাসস্থান নির্দিষ্ট করে দিতে এসেছি।

এই বলে সেই পুরুষ তার হাত দিয়ে আগাভাবে ধরে তুলে নিয়ে মাটিতে পা না দিয়ে শুধু বাতাসে ভর করে কত পাহাড়, উপত্যকা, নদীপ্রান্তরের উপর দিয়ে আমাকে পর্বতশিখরস্থ এক সমতল ভূমির উপর নিয়ে গেল। সেই মালভূমিটি ছিল সুন্দর সুন্দর গাছে ঘেরা। সেই উদ্যানের মধ্যে মাঝে মাঝে পথ আর কুঞ্জবন ছিল। আগে যে জায়গায় প্রথম পৃথিবীকে দেখি তখন তাকে এত সুন্দর ও মনোরম মনে হয়নি।

সেই মনোরম উদ্যানের মধ্যে আমার ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার চারদিকে প্রতিটি গাছে ফল ঝুলছে। তা দেখে সেই সব ফল খাবার লোভ হলো আমার। আমার ক্ষুধা জাগল। দেখলাম স্বপ্নে যা দেখেছিলাম তা সব সত্য।

সেখানে আবার ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এমন সময় আমার পথপ্রদর্শক দৈবমূর্তিতে আমার সামনে উপস্থিত হলো। তাকে দেখে আমি আনন্দিত হলেও ভয়ে ভয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তার চরণতলে পতিত হলাম।

সেই মূর্তিটি বলল, তুমি যাঁকে খুঁজছ আমি হচ্ছি সেই। এই উদ্যানের যিনি স্রষ্টা তিনি ঊর্ধ্বে, নিমে বা তোমার চারপাশে সর্বত্রই বিরাজমান। এই স্বর্গোদ্যান ঈশ্বরনির্মিত। এই উদ্যান আমি তোমাকে দান করলাম। এখানে তুমি ভূমি কর্ষণ করে গাছপালা উৎপন্ন করে ও সব রক্ষণাবেক্ষণ করে ফল ভক্ষণ করবে। এই উদ্যানে যত গাছ আছে, সেই সব গাছের ফল তুমি ইচ্ছামত ভক্ষণ করবে। ফলের কোন অভাব তোমার কোনদিন হবে না।

কিন্তু এই উদ্যানের মধ্যে জীবনবৃক্ষের পাশে যে জ্ঞানবৃক্ষ আছে তার ফলের। মধ্যে আছে ভাল-মন্দ ও ন্যায় জ্ঞান। সেই ফল তুমি ভক্ষণ করবে না। এই ফল তোমার ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। আমার এই সতর্কবাণী স্মরণ রাখবে। এ ফল কোনদিন আস্বাদন করবে না, খাবে না, কারণ তার আস্বাদ যাই হোক, সেই ফলভক্ষণের পরিণাম বড় ভীষণ হবে। সুতরাং এই পরিণামের কথা স্মরণ করে সে ফলভক্ষণের কৌতূহল ত্যাগ করবে।

জেনে রাখবে, যেদিন এই জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করবে সেই দিনই আমার ও ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘিত হবে। সেই দিন তোমার অনিবার্যভাবে মৃত্যু ঘটবে। তুমি হয়ে উঠবে মরণশীল। সেইদিন তুমি এই স্বর্গোদ্যান হতে বিতাড়িত হয়ে এক চিরমূখের জগতে নির্বাসিত হবে।

তার এই কঠিন নিষেধাজ্ঞাটি এখনো আমার কানে অনুরণিত হচ্ছে, যদিও এর কারণ আমি বুঝতে পারছি না।

এরপর সেই মূর্তি আবার বলতে লাগল, শুধু এই উদ্যান নয়, এই উদ্যানসীমানার বাইরে যে জগৎ আছে সে জগৎ তোমাকে ও তোমার থেকে যে মানবজাতির উদ্ভব হবে তাদের দান করে গেলাম আমি। সে জগতের নদ-নদী, সমুদ্র, আকাশ, পাহাড়, পর্বত, পশুপাখি–সব কিছুর উপর প্রভুত্ব করবে তোমরা। সব কিছু ভোগ করে যাবে। সেই জগতের যেখানে খুশি তোমরা বাস করবে। সেখানকার পশুপাখিরা তোমাদের প্রভুত্ব মেনে নেবে। তোমরা তাদের নামকরণ করবে। জলাশয়ের মাছদের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য হবে। জলের মাছ মাটিতে আসতে পারবে না। তারা জলেই বিচরণ করবে।

তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক জোড়া জোড়া পশুপাখি আমি দেখতে পেলাম। আমি তাদের নাম দিলাম। তাদের প্রকৃতি আমি বুঝে নিলাম।

আমি তখন সেই দৈবমূর্তিকে বললাম, তোমরা যারা মানবজাতির ঊর্ধ্বে, এই পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে যাদের বাস, যারা মানবজাতির উন্নতি ও কল্যাণের জন্য এই জগৎ সৃষ্টি করে আমাদের সুখের জন্য দান করেছ তাদের কি নামে অভিহিত করব? কিন্তু আমার তো কোন অংশীদার দেখছি না। নিঃসঙ্গ জনের সুখ কোথায়? একা কেউ কি সুখভোগ করে যেতে পারে? সঙ্গী ছাড়া সুখভোগে তৃপ্তি কোথায়?

তখন আমার কথায় সেই মূর্তি বলল, নির্জনতা তুমি কাকে বলছ? কত প্রাণী ও জীবজন্তুদ্বারা এই পৃথিবী পরিপূর্ণ। জগতের সর্বত্র বায়ু প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এখানকার সব প্রাণীই তোমার বশীভূত। তোমার ডাকে তারা যে কোন সময়ে এসে খেলা করবে তোমার সামনে। তাদের ভাষা তুমি বুঝতে পার না। তোমার এই বিশাল রাজ্যে তুমি তাদের নিয়েই আনন্দ করবে। তাদের নিয়েই থাকবে।

কথাগুলি আদেশের সুরে বলল সে। আমি তখন তার অনুমতি নিয়ে বলতে লাগলাম, হে ঐশ্বরিক শক্তি, আমার কথায় রাগ করো না। তোমরা আমাকে তোমাদের প্রতিরূপ করে সৃষ্টি করেছ, কিন্তু এই পশুরা অন্য আকৃতির এবং আমার থেকে নিম্নমানের। সমজাতীয় প্রাণীতে প্রাণীতেই বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু আমি ও এই পশুরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতীয় প্রাণী। তাদের সঙ্গ বা সাহচর্য আমাকে কি কোন আনন্দ দিতে পারে? বন্ধুত্ব মানেই পারস্পরিক দান-প্রতিদান। এই দান-প্রতিদান সমানুপাতিক হওয়া চাই। কিন্তু সেখানে ছোট-বড় ভিন্ন দুই জাতীয় প্রাণীর মধ্যে বন্ধুত্ব হলেও দুজনের দান-প্রতিদানের ব্যাপারটা সমান হয় না। একজনের ভালবাসার পরিমাণ বেশি হলে অন্যজন তার প্রতিদান দিতে পারে না। সে ভালবাসার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। ফলে সে বন্ধুত্ব অসহনীয় হয়ে ওঠে উভয়ের পক্ষে।

আমি চাই এমন বন্ধু যে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আমার আনন্দের অংশগ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু যারা অসভ্য পশু তারা কখনো মানুষের সহচর বা বন্ধু হতে পারে না, যেমন সিংহ সিংহীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এই জন্য তাদের জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছ। একই জাতীয় প্রাণীর মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ হলে বন্ধুত্ব ভাল হয়। তাই সেখানে পাখি পশুর সঙ্গে, মাছ পাখির সঙ্গে, বনজ বানরের সঙ্গে মিশতে বা বন্ধুত্ব করতে পারে না। মানুষও পশুর সঙ্গে কোনক্রমেই মিশতে পারে না।

তখন সেই ঐশ্বরিক মূর্তি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়েই উত্তর করলেন, আদম? আমি দেখছি তুমি তোমার সঙ্গী নির্বাচন করে এক সুন্দর ও সূক্ষ্ম আনন্দ লাভ করতে চাও। অর্থাৎ নির্জনে একা থেকে কোন আনন্দই আস্বাদন করতে পারবে না, এটাই হলো তোমার অভিমত।

কিন্তু আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ তো। আমার অবস্থা দেখে আমাকে সুখী বলে মনে হয় কি না। আমাকে কি প্রভূত সুখে সুখী বলে মনে হয় না তোমার? অনন্তকাল ধরে আমি নিঃসঙ্গ অবস্থায় একা একা বাস করে আসছি। কারণ আমার সমান বা উপযুক্ত যোগ্য সাথী কেউ নেই। সুতরাং আমার সমান বা অনুরূপ কোন সাথী যদি না পাই তাহলে আমারই সৃষ্ট হীনতর প্রাণীদের সঙ্গে ছাড়া আর কার সঙ্গে কথাবার্তা বলব? যারা আমার থেকে ছোট, আমার আসন থেকে নেমে তাদের কাছে গিয়েই আলাপ-আলোচনা করতে হয় আমাকে। অন্যান্য প্রাণী ও পশুরা যেমন তোমার থেকে হীন তেমনি তারাও আমার থেকে হীন।

এই বলে তিনি থামলেন। আমি তখন বিনয়াবনত হয়ে তাঁকে বললাম, তোমার ঐশ্বরিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির গুরুত্ব, মহিমা বা গভীরতা অনুধাবন করা কোন মানবমনের চিন্তার পক্ষে সম্ভব নয়।

হে পরম স্রষ্টা, তুমি স্বয়ংসিদ্ধ, আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। তোমার মধ্যে কোন অপূর্ণতা নেই। কিন্তু এ পূর্ণতা মানুষের নেই। মানবজীবনের মধ্যে আছে অনেক অপূর্ণতা আর তাই তারা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার দ্বারা আপন আপন অপূর্ণতার দুঃখে সান্ত্বনা পেতে চায়। কিন্তু যেহেতু তুমি এক অদ্বিতীয়, সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, কারো সঙ্গে আলোচনা করার কোন প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি অনন্ত, পূর্ণ, পরম স্রষ্টা।

কিন্তু মানুষ সংখ্যায় যত বেশিই হোক, সকলের মধ্যেই আছে কিছু না কিছু অপূর্ণতা। অপূর্ণ মানুষ তারই অনুরূপ অপূর্ণ মানুষের জন্ম দেবে। তাই তাদের পারস্পরিক ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও ঐক্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যেহেতু তুমি আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ সেইহেতু তুমি নির্জনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় থাকলেও আপন আত্মিক পূর্ণতায় সমৃদ্ধ হয়ে পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাক। সামাজিক মেলামেশার কোন প্রয়োজন হয় না। কারো কোন সাহচর্য বা সঙ্গ ছাড়াই তুমি আনন্দ পেতে পার।

তুমি যেমন তোমার সৃষ্ট হীন প্রাণীদের তোমার স্তরে উন্নীত করে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পার না তেমনি আমিও এই সব পশুদের সঙ্গে কথা বলে তাদের হীন স্তর ০ আনতে পারি না। তাদের জীবনযাত্রার মধ্যেও কোন আনন্দ পেতে পারি না।

তার অনুমতি নিয়ে আমি সাহস করে এই কথা বললে তিনি বললেন, আমি তোমাকে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়েছি আদম। আমি দেখছি তুমি শুধু পশুদের প্রকৃতিই বোঝ না। নিজের প্রকৃতির বা স্বরূপের কথাও অনেক জান। তুমি ঠিকই বলেছ, তোমার মধ্যে যে আত্মা আছে তা আমার মতই স্বাধীন। পশুদের মধ্যে সে আত্মা নেই। তাই তাদের সাহচর্য তুমি যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছ। সে সাহচর্য কখনো তোমার মনোমত বা পছন্দমত হতে পারে না।

আমি তা জানতাম। আমি জানতাম মানুষ একা থাকতে চাইবে না। সেটা শুভ হবে না মানুষের পক্ষে। তা জেনেও আমি পরীক্ষা করে দেখলাম তুমি কি ধরনের সাথী চাও। দেখলাম তোমার বিচারবুদ্ধি কেমন।

এরপর দেখবে আমি যাকে এখানে আনব সে হবে তোমারই অনুরূপ, তোমার পছন্দমত। সে হবে তোমারই আর এক আত্মা, তোমার অন্তরের কামনার যথাযথ প্রতিমূর্তি।

এই কথা বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর! আমি আর তাঁর কথা শুনতে পেলাম না। তাঁর দিব্য দ্যুতির দ্বারা আমার সকল ইন্দ্রিয়চেতনাকে অভিভূত করে দিয়ে তিনি তার স্বর্গলোকের আপন ভূমিতে প্রস্থান করলেন।

আমার সেই অভিভূত অবসন্ন ইন্দ্রিয়চেতনার উপর নিদ্রার আবেশ নেমে এল। মুদ্রিত হয়ে গেল আমার চক্ষুদুটি। প্রকৃতি যেন আমার সাহায্যে সে নিদ্রাকে পাঠিয়ে দিল। কিন্তু আমার চর্মচক্ষু দুটি মুদ্রিত হলেও আমার অন্তঃক্ষুটি খোলা রয়ে গেল। আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম।

আমি সেই নিদ্রিত অবস্থাতেই স্বপ্নের মধ্যে আগের ঐশ্বরিক মূর্তিটির থেকে আরও উজ্জ্বল এক মূর্তি দেখতে পেলাম। সে মৃর্তি আমার পাশে বসে আমার দেহের বাম দিকটিকে একেবারে খুলে ফেলল। আমার বাঁ দিক থেকে একটি পাঁজর তুলে নিল। তার মধ্যে তখনো ছিল ক্রিয়াশীল হৃৎপিণ্ডের তাপ। উষ্ণ রক্তস্রোত বেরিয়ে আসছিল সেই ক্ষতস্থান থেকে। কিন্তু নূতন মাংসপিণ্ড দ্বারা তখনি পূর্ণ হয়ে গেল সেই ক্ষতস্থান।

সেই মূর্তিটি এবার আমার পাঁজরটি খুলে নিয়ে তা দিয়ে কি গড়তে লাগল দুহাত দিয়ে। এইভাবে তার হাতে মানুষের মতই এক প্রাণী গড়ে উঠল। কিন্তু পুরুষ নয় আমার মত, নারী। সে নারীমূর্তি দেখতে এত সুন্দর যে পৃথিবীতে প্রকৃতি জগতের মধ্যে যত সুন্দর বস্তু দেখেছি সেই সৌন্দর্যের থেকেও সুন্দর। অথবা সেই সব সৌন্দর্যের সমন্বিত রূপই মূর্ত হয়ে উঠেছে তার মধ্যে। তার দৃষ্টি ও ভাবভঙ্গি আমার মধ্যে প্রেম ও আনন্দ সঞ্চারিত করল। এ আনন্দ আগে আমি অনুভব করিনি কখনো।

সহসা আমার কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। আমি তাকে আর দেখতে পেলাম না। আমি তাকে দেখতে পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম সব কিছু।

আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাকে দেখার জন্য জেগে উঠলাম আমি। শুনলাম, বাইরের জগতে তার দেখা পাই তো ভাল, তা নাহলে সারাজীবন ধরে তার অভাব আমাকে দুঃখ দেবে। তার অভাব আর কিছুতে পূরণ হবে না আমার জীবনে। উল্টে আমার জীবনের সকল আনন্দই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সহসা তাকে কিছুদুরে দেখতে পেলাম আমি। স্বপ্নে তাকে যেমন দেখেছিলাম তার অদৃশ্য স্রষ্টার সঙ্গে আমার দিকে আসতে লাগল সে। তার সেই স্রষ্টাকে চোখে দেখা যাচ্ছিল না। শুধু তার কণ্ঠস্বর শুনে পথ চলছিল সে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল এক গম্ভীর আত্মমর্যাদার ভাব, দৃষ্টিতে ছিল এক স্বর্গীয় প্রেমের দ্যুতি। বিবাহের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম সবই মেনে চলল সে।

আমি তা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললাম, হে আমার পরম স্রষ্টা, উদার করুণাময়। তুমি তোমার কথা রেখেছ। আমার সব অভাব পূরণ করে দিয়েছ। তুমি আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছ। কিন্তু তোমার এই দান অন্য সব দানের থেকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ। এখন আমি আমারই অস্থিমজ্জামাংস ও আত্মারই একটি অংশকে দেখেছি আমারই সামনে। তার নাম হলো নারী, পুরুষেরই অর্ধাঙ্গিনীরূপে সৃষ্ট। একই রক্তমাংস থাকবে তাদের দেহে–একই প্রাণ, একই আত্মা।

সেই নারী আমার কথা শুনল। ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি সেই নারী ছিল নির্দোষিতা, সরলতা ও লজ্জার মূর্ত প্রতীক। তার বিচিত্র গুণাবলী, বিবেক ও যোগ্যতা সকলেরই ভালবাসার যোগ্য। কিন্তু তার এই সব গুণ ও অন্তরবৃত্তি বাইরে তেমন প্রকাশ হচ্ছিল না। তার এই সব অন্তর্নিহিত ও আভাসে অস্পষ্টভাবে প্রকাশিত গুণগুলির জন্যই সে আরও বেশি কাম্য হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। প্রকৃতি যেন তাকে এইভাবে সরল নিষ্পাপ করে গড়ে তুলেছিল।

সে আমাকে দেখে ও আমার কথা শুনে পিছন ফিরে চলে যেতে লাগল। কিন্তু তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম আমি। তাকে থামিয়ে আমি তাকে বোঝাতে লাগলাম। এক সুগম্ভীর আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে সে আমার যুক্তি মেনে নিল। পরে লজ্জারুণ ঊষার মত দেখাচ্ছিল তাকে। আমি তার হাত ধরে তাকে বিবাহের জন্য বাসরকুঞ্জে নিয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে আকাশ ও সমস্ত গ্রহনক্ষত্রগুলি উজ্জ্বল অনুকূল প্রভাব বিস্তার করতে লাগল। সমগ্র পৃথিবী যেন নানা সুলক্ষণ প্রকাশের দ্বারা আমাদের এই বিবাহ সমর্থন করল। প্রতিটি আনন্দোচ্ছল পাহাড়-পর্বত, প্রতিটি পাখি, চঞ্চল বাতাস যেন আমাদের বিবাহ সম্পর্কে সবুজ বনভূমির কানে কানে ফিস ফিস করে কি সব বলতে লাগল। পবর্তশীর্ষে উদিত সন্ধ্যাতারার আলো বাসরপ্রদীপের কাজ করতে লাগল আমাদের কুঞ্জে।

এইভাবে আমি আমার অতীত অবস্থার কথা আমার যতদূর মনে আছে তা তোমাকে বললাম। আমি বর্তমানে যে পার্থিব সুখ ভোগ করি সে কথা তো আমার অন্তর থেকে প্রকাশের আলোয় টেনে আনলাম। আমি স্বীকার করছি, সকল বস্তুতেই আমি আনন্দ পাই। কিন্তু সে আনন্দ পাই বা না পাই আমার মনের ক্রিয়ার কোন পরিবর্তন হয় না। অথবা কোন বস্তু দেখে আমার কামনার বেগ বেড়ে যায় না। কারণ ফুল ও ফলের রূপ, রস ও গন্ধ, পাখিদের গান, বর্ণ গন্ধ ও গানের সমন্বিত সৌন্দর্যসম্ভারে ভূষিত বনপ্রকৃতির মধ্যে আমাদের ইতস্তত বিচরণ–এই সব কিছুই অন্যরূপে দেখি আমি।

প্রকৃতি জগতের সকল সৌন্দর্যের আবেদনের মাঝে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির আলোড়ন জাগে। সে অনুভূতির মধ্যে এমনই এক অটল অবিচলিত মহত্ত্বের ভাব আছে যার কাছে প্রকৃতির রূপ, রস, শব্দ, গন্ধজনিত সকল সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। তখন আমার মনে হয় প্রকৃতির যা কিছু সৌন্দর্য তা শুধু তার বহিরঙ্গেই সীমাবদ্ধ। তার অন্তরঙ্গে নেই কোন সে সৌন্দর্যের মহিমা।

পরিশেষে আমি বুঝতে পারি আমাদের মধ্যে যে সব অন্তরবৃত্তিগুলি আছে তা প্রকৃতির থেকে অনেক বড়; তাদের তুলনায় প্রকৃতি ছোট। আবার তার বহিরঙ্গে যে সৌন্দর্য প্রকটিত সে সৌন্দর্য তাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই পরম স্রষ্টার সৌন্দর্যের অনুরূপ নয় অথবা তার সৃষ্ট যে মানবের উপর এই প্রকৃতি জগতের ও অন্যান্য প্রাণীর উপর প্রভুত্ব করার ভার ন্যস্ত হয়েছে তার চরিত্রের মতও সমুন্নত মহিমায় সমৃদ্ধ নয়।

তবু যখন আমি এই প্রকৃতির সুন্দর রূপকে প্রত্যক্ষ করি, তাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অখণ্ড সত্তা বলে মনে হয়। মনে হয় তার নিয়ম, তার ইচ্ছা সবচেয়ে বিজ্ঞ, সবচেয়ে গুণবান ও উত্তম। প্রকৃতির সামনে মানুষের সকল প্রজ্ঞা ব্যর্থ হয়, অপ্রতিভ বা হীনপ্রভ হয় মানুষের সকল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। প্রকৃতির কাছে মানুষের সকল প্রভুত্ব ও যুক্তিবোধ হয়ে যায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত। মনে হয় যে প্রকৃতি পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগেই সৃষ্ট হয়, সে প্রকৃতি মানবমনের সকল মহত্ত্ব ও সমুন্নতিকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে তার রূপের মধ্যে। দেবদূত প্রহরীর মত কেমন যেন এক ভীতির ভাব জাগাল আমাদের মনে।

দেবদূত রাফায়েল তখন ভ্রুকুটি করে বলল, প্রকৃতিকে দোষী করো না। সে তার আপন কাজ করে চলেছে, তুমি তোমার কাজ করে যাবে। অজ্ঞতার পরিচয় দিও । তুমি যদি প্রকৃতিকে ভুল না বোঝ তাহলে সে তোমাকে কখনই ত্যাগ করবে । তাকে তোমার প্রয়োজন আছে। তার কাছে তোমাকে যেতেই হবে। কোন বস্তুর অপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষ করলে তার উপর খুব একটা বেশি গুরুত্ব আরোপ করো না। প্রকৃতির যে বহিরঙ্গ তোমাকে আনন্দ দেয়, যার তুমি প্রশংসা করো, নিঃসন্দেহে তা সুন্দর, তা নিশ্চয়ই তোমার কামনা, সম্মান ও ভালবাসার যোগ্য। তা কখনই তোমার প্রভুত্বের অধীন নয়। তার সঙ্গে নিজেকে ঠিকমত ওজন করে বিচার করে তবে তা মূল্যায়ন করো। তা না হলে তোমার বিচারের কোন অর্থ হয় না। সে বিচারে শুধু এক ভ্রান্ত আত্মপ্রসাদ ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না। তোমার জ্ঞানবুদ্ধি ও কলাকৌশলদ্বারা প্রকৃতিকে যতই জানবে সে ততই মাথা নত করবে তোমার কাছে। তোমার বাস্তব জীবনে সে তোমাকে অনেক ভোগ্যবস্তু দান করবে। তখন মনে হবে তোমারই আনন্দের জন্য সজ্জিত হয়ে আছে বিচিত্র সম্ভারে।

প্রকৃতিকে যতই ভীতিপ্রদ মনে হবে ততই তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভালবাসবে। যে নারী তোমার জীবনের সাথী, তাকেও তুমি দান করবে শ্রদ্ধাবিমিশ্রিত ভালবাসা। মনে রাখবে শুধু স্পর্শেন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি বা আনন্দ ভালবাসা নয়। সে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি পশুদের জন্য, মানুষের জন্য নয়। তার মধ্যে যে সব গুণ আকর্ষণীয়, মানবিক ও যুক্তপূর্ণ তাই ভালবাসবে। কোন কামনার আবেদনকে প্রশ্রয় না দিয়ে শুধু ভালবেসে যাবে। কামনার আবেগের মধ্যে কখনো প্রকৃত ভালবাসা থাকে না। প্রকৃত প্রেমচিন্তাকে পরিমার্জিত করে হৃদয়কে করে প্রসারিত, যুক্তি ও নীতির মধ্যে তার উচ্চ আসনটি পাতা। ন্যায়পরায়ণ প্রেমের সোপান থেকেই মানুষ ঐশ্বরিক প্রেমের ঊর্ধ্বতন স্তরে উন্নীত হতে পারে। শুধু দেহগত আনন্দের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থেকো না, এইজন্যই পশুদের মধ্যে তোমার সাথী পাওয়া যায়নি।

এই কথায় আদম কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল, তার বহিরঙ্গটি সুন্দর এবং সে সৃষ্টির দিক থেকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে পৃথক, শুধু এই জন্যই তার মধ্যে আমি আনন্দ পাই না। তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কর্মের মধ্যে যে সুষমা ছন্দায়িত হয়ে ওঠে, তার প্রতিটি কথার মধ্যে যে প্রেম যে সৌন্দর্য তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে তাতেই আমি আনন্দ পাই। তার সুমধুর নমনীয়তা, শান্ত নিরুচ্চার এক আত্মসমর্পণের ভাব আমাদের দুটি মনকে মিলিত করে দেয়, এক ও অভিন্ন করে তোলে দুটি আত্মাকে। ঐক্য বা মিলন কথাটি শুনতে যত না ভাল, কোন বিবাহিত দম্পতির মধ্যে তা দেখতে আরও অনেক ভাল।

তুমি অন্য কিছু মনে করো না। অন্তরে আমি যা ভাবি বা অনুভব করি তাই অকপটে বললাম আমি। তুমি বলছ ভালবাসায় কোন দোষ নেই। ভালবাসাই মানুষকে স্বর্গের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। প্রেম একই সঙ্গে মানুষের পরম পথ এবং পথ প্রদর্শক। এখন যদি অন্যায় না হয় তাহলে আমার একটি কথার উত্তর দাও।

স্বর্গে যারা বাস করে অর্থাৎ ঈশ্বর ওদেবদূতেরা কি ভালবাসে? তাদের ভালবাসা কি শুধু দৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, না কি স্পর্শের মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হয়?

দেবদূত রাফায়েল তখন গোলাপের মত লাল স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত এক হাসি হেসে বলল, শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে জেনে রাখবে আমরা সুখী। কিন্তু ভালবাসা ছাড়া কারো সুখ হতে পারে না। তোমরা তোমাদের দেহের মধ্যে যে সুখ ও আনন্দ উপভোগ করো, আমরা বিদেহী হয়েও সেই সুখ ও আনন্দ উপভোগ করি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা অবয়বসংস্থান কোনভাবে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। বাতাসের থেকে হালকা বিদেহী দেবদূতেরা যখন পরস্পরকে আলিঙ্গন করে তখন দুজনে একেবারে মিশে যায়। সেই আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে একটি পবিত্র আত্মা আর একটি পবিত্র আত্মার মধ্যে লীন হয়ে যায় তারা। মানুষের মত দেহের সঙ্গে দেহ ও মনের সঙ্গে মনের মিশবার কোন প্রয়োজন হয় না। রক্তমাংসের দেহগত কোন বাধা বিঘ্ন ঘটাতে পারে না তাদের সে মিলনে।

কিন্তু আর আমি থাকতে পারছি না এখানে। সূর্য এখন সবুজ পৃথিবীর সীমা ত্যাগ করে অস্তাচলে গমন করছে। এটা আমার প্রস্থানের সংকেত। আমি যাচ্ছি, তুমি তোমার মনকে শক্ত করো। সুখে বসবাস করো। ভালবেসে যাও। তবে তোমার পরম স্রষ্টা ঈশ্বরকে ভুলে যেও না। তাঁর প্রতি তোমার প্রেম এবং আনুগত্য যেন অব্যাহত থাকে চিরকাল। তাঁর মহান আদেশ মেনে চলবে সব সময়। স্বাধিকারপ্রমত্তের মত স্বাধীন ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে যেন কামনার স্রোতে তোমার বিচারবুদ্ধিকে ভেসে যেতে দিও না। মনে রাখবে তোমার ভবিষ্যৎ সন্তানসন্ততিদের সমস্ত সুখদুঃখ তোমার উপরেই নির্ভর করছে। তুমি ঠিক থাকলে আমি তাতে আনন্দিত হব। ন্যায়নীতিকে ভিত্তি করে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, না তোমার পতন ঘটবে সেটা তোমার বিচারবৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। আপনাতে আপনি পূর্ণ হও। কোন বাইরের সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। সমস্ত প্রলোভনকে জয় করবে সংযত চিত্তে। কোন কিছুই যেন বিধির বিধান লঙ্ঘনে বাধ্য করতে না পারে।

এই বলে উঠে পড়ল রাফায়েল। আমও তার সঙ্গে কিছুটা এগিয়ে গেল। তার আশীর্বাদ লাভ করল। বলল, আমার পরম শ্রদ্ধেয় পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হে বিদেশী দেবদূত, হে স্বর্গীয় অতিথি, তুমি স্বস্থানে প্রস্থান করো। তোমার এই সদয় আচরণের কথা আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখব। মানবজাতির প্রতি সদয় হয়ে যেন মাঝে মাঝে স্বর্গ থেকে নেমে এস এমনি করে।

এইভাবে তাদের ছাড়াছাড়ি হলো। রাফায়েল চলে গেল স্বর্গলোকে আর আদম ফিরে এল কুঞ্জবনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *