৬ষ্ঠ সর্গ

ষষ্ঠ সর্গ

হে ইউরানিয়া, আমি অলিম্পাস পর্বতের ঊর্ধ্বলোকে বিরাজিত যে স্বর্গলোকে কাব্য ও সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীদের অনুগৃহীত অশ্ব পেগাসের পাখায় ভর করে উড়ে যেতে চাই সেই স্বর্গলোক হতে তোমার অলৌকিক কণ্ঠনিঃসৃত সুরধারা সহ নেমে এস। তুমি স্বর্গজাত, শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী নয়জন দেবীর সঙ্গে সুপ্রাচীন অলিম্পাস পর্বতের উপর বাস করো।

তুমি সেই পর্বতে ঝর্ণার ধারে তোমর কোন জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর সঙ্গে কথা বল। তুমি একবার তোমার বোনের সঙ্গে পরম পিতাকে অলৌকিক সঙ্গীত শুনিয়ে তাঁকে প্রীত করেছিলে।

আমি ভেবেছিলাম আমার মত একজন মর্ত্যলোকের অতিথিকে আকাশমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে পথ দেখিয়ে স্বর্গলোকে নিয়ে যাবে এবং আবার নিরাপদে আমাকে আমার এই মর্ত্যলোকের আবাসভূমিতে পৌঁছিয়ে দিয়ে যাবে। তা না হলে শিমেরাকে হত্যা করে বেলারোফোন যেমন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে স্বর্গে যেতে গিয়ে দেবরাজ জিয়াসের কোপে লাইসিয়ায় এ্যানিয়ার সমতলভূমিতে পতিত হয়েছিল, আমারও হয়ত তেমনি অবস্থা হবে। সুতরাং স্বর্গলোকে একাকী যাওয়া বা সেখানে ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে বিপজ্জনক।

আমার সব গান গাওয়া এখনো হয়নি। অর্ধেক বাকি আছে।

আমি একজন মরণশীল মানুষ, এই মর্ত্যভূমির সীমার ঊর্ধ্বে উঠতে পারি না। আমি এই মর্ত্যভূমির উপর নিরাপদে দাঁড়িয়ে আপন মনে আপন কণ্ঠে গান করি কিন্তু সে গানের সুর ঠিক হয় না। দুঃখকষ্ট দুঃসময়ের অন্ধকারে নিষ্ফল হয়ে বিপদের আশঙ্কার দ্বারা পরিবৃত হয়ে আমি একাকী গান করি। কিন্তু তুমি যখন রাত্রিতে আমার ঘুমের মধ্যে আবির্ভূত হও, তখন আর আমি একা থাকি না।

হে ইউরানিয়া, তুমি আমার গানকে শ্রুতিমধুর করে তোল। কিন্তু সুরার দেবতা আনন্দোন্মত্ত বেকারসের বেসুরো বর্বর সঙ্গীতের মত সে সঙ্গতি যেন না হয়। বেকাস একবার রোডোপে একজন থ্রেসীয় চারণকবিকে রেগে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেন। সেখানে প্রতিটি অরণ্য ও পাহাড় উল্লসিত হয়ে সেই কবির গান শুনত। কিন্তু মত্ত বেকাসের অত্যাচারে সেই কবির কণ্ঠ ও বীণার সুর পৈশাচিক তর্জন-গর্জনের মধ্যে ডুবে যায়। তখন মিউজ বা সঙ্গীত ও কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী তাঁর পুত্রকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। হে ইউরানিয়া, আমি তোমাকে অনুনয়-বিনয় করছি, আমার কথা শোন। কারণ তুমি স্বর্গের দেবী।

হে দেবী বল, অন্যতম প্রধান দেবদূত রাফায়েল শয়তানদের সেই ভয়ঙ্কর পতনের দৃষ্টান্ত দ্বারা আদমকে সতর্ক করে দিলে কি হলো। যাতে আদম ও মানবজাতির স্বর্গীয় বিধান লঙ্ঘনের জন্য শয়তানদের মত পতন না হয় তাকে বারবার সাবধান করে দিল, তারা যেন সেই জ্ঞানবৃক্ষকে স্পর্শ না করে। তারা ক্ষুধাতৃপ্তির জন্য যে কোন বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে পারে, কিন্তু তারা যেন জ্ঞানবৃক্ষের ফল আস্বাদন করতে না যায়। তারা যদি ঈশ্বরের অমোঘ নিষেধাজ্ঞা ঘুণাক্ষরেও অমান্য করে তাহলে তাদেরও পতন অনিবার্য। এই বলে তাদের সাবধান করে দিল রাফায়েল।

রাফায়েলের কথাগুলি এবং অতীতের কাহিনী শ্রদ্ধা ও মনোযোগসহকারে শুনল আদম ও তার স্ত্রী ঈভ। শুনতে শুনতে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল তারা। কথাগুলি অদ্ভুত মনে হলো তাদের। যে স্বর্গলোকে স্বয়ং ঈশ্বর বাস করেন এবং সতত পরম শান্তি ও স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করে সেই স্বর্গে ঘৃণা, যুদ্ধবিগ্রহ বা কোন শৃংখলার স্থান থাকতে পারে–একথা অকল্পনীয় তাদের কাছে। তবে যাই হোক, অশুভ শক্তিগুলি শীঘ্রই নিঃশেষে বিতাড়িত হয়েছে স্বর্গ থেকে। অশুভ শক্তি কখনো পরম শুভ ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে থাকতে পারে না মিলেমিশে।

অবশেষে আমাদের মনে যে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল সে তা ব্যক্ত করল। তবু তার মন ছিল নিষ্পাপ। তাদের জানতে ইচ্ছা হলো কিভাবে এই জগৎ এবং স্বর্গলোকের উৎপত্তি হয়। কখন, কার দ্বারা এবং কি কারণে সৃষ্ট হয় এই স্বর্গ-মর্ত্য? এই ইডেনের ভিতরে বা বাইরে কিভাবে সব জিনিস সৃষ্ট হয়? ইডেনের ভিতরে যে সব ঝর্ণা আছে তার কলতান শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেন পিপাসা বেড়ে যায়?

স্বর্গীয় অতিথি রাফায়েলের কাছ থেকে আরও কিছু জানার জন্য আদম বলে যেতে লাগল, এই জগতের বাইরের অনেক বিষয়ের রহস্য উদঘাটন করে তুমি ঈশ্বরের নির্দেশে আমাদের অনেক বিষয়ে যথাসময়ে পূর্ব হতে সতর্ক করে দিয়েছ যা মানুষ কখনো তার সীমিত জ্ঞানের দ্বারা জানতে পারে না এবং তা জেনে আমরা ভুল করে বসলে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হতাম আমরা। এজন্য পরম মঙ্গলময়ের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ এবং তাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর উপদেশাবলী মেনে চলব এবং তার ইচ্ছা পূরণ করে চলব।

যেহেতু তুমি পার্থিব জ্ঞানের অতীত পরম জ্ঞানের বিষয় আমাদের শিক্ষার জন্য অনেক বলেছ সেইহেতু আমি আরও কিছু জানতে চাই এবং তা আমাদের জানা উচিত বলে মনে করি। তুমি না বললে এসব আরও কোনদিন জানা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।

এখন দয়া করে বল, আমাদের ঊর্ধ্বে দূরে যে স্বর্গলোক দেখতে পাচ্ছি, যার চারপাশে অসংখ্য জ্যোতিষ্কমণ্ডলী মহাশূন্যে শৃংখলাবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যার ভতরে ও বাইরে সর্বত্র বায়ু প্রবাহিত হয়ে চলেছে, পরমস্রষ্টা কি কারণে তাঁর পবিত্র বিশ্রাম ব্যাহত করে তা সৃষ্টি করেন? অনন্ত বিশৃংখলা আর শূন্যতার মাঝে কিভাবে শুরু হয় তার সৃষ্টিকার্য এবং কত শীঘ্রই বা তা শেষ হয়? ঈশ্বরের এইসব অনন্ত সৃষ্টিকার্যের রহস্যময় বিষয়গুলি আমাদের জানালে আমরা তার মহিমা কীর্তন করতে পারি। তাতে তাঁর গৌরব আরো বাড়বে ছাড়া কমবে না। এখনো দিনের আলো শেষ হয়নি, শেষ হয়নি সূর্যের আকাশ পরিক্রমা। সূর্য যেন তোমার মুখ থেকে তার বংশধারার উৎপত্তির কথা শুনতে চায়, শুনতে চায় কি করে এই বিশ্বপ্রকৃতি শূন্যতার অনন্ত গর্ভ হতে সৃষ্ট হয়। এরপর সন্ধ্যাতারা আর চন্দ্রও হয়ত তোমার কথা শুনতে আসবে। তারপর বিশুদ্ধতা ও নিদ্রাসহ রাত্রি এসেও তোমার কথা শুনতে চাইবে। অবশেষে রাত্রি প্রভাত হলে তুমি চলে যাবে।

আদমের কথা শেষ হলে দেবদূতপ্রধান রাফায়েল শান্তকণ্ঠে বলতে লাগল, তুমি সাবধানে অনুরোধ করলেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অনন্ত সৃষ্টিকার্যের সব কথা ভাষায় ব্যক্ত করা কোন দেবদূতের পক্ষে সম্ভব নয়, কোন মানুষের পক্ষে তা বোঝাও সম্ভব নয়। তথাপি স্রষ্টার গৌরববৃদ্ধি করার মানসে এবং তোমাকে সুখী করার জন্য তোমাকে আমি তা শোনাব। কারণ একটি বিশেষ সীমার মধ্যে থেকে তোমার জ্ঞানপিপাসাকে নিবৃত্ত করার জন্য ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন। তাঁর বাইরে আর কিছু জানতে চেও না এবং নিজের কোন চেষ্টার দ্বারাও তা জানতে যেও না। অদৃশ্য সর্বজ্ঞ ঈশ্বর তার আপন আত্মার গুহান্ধকারেই তা নিহিত রেখেছেন। স্বর্গ বা মর্ত্যের কারোরই সে বিষয় জ্ঞাতব্য নয়। সেই পরম গুহ্য বিষয় ছাড়া আর সব কিছুই জানতে পার। জ্ঞান হচ্ছে একরকম খাদ্যের মত। খাদ্যের মত জ্ঞানও হবে পরিমিত। অপরিমিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে খাদ্য গ্রহণ করলে যেমন দেহের ক্ষতি হয় তেমনি অনিয়মিত জ্ঞানও নির্বুদ্ধিতায় পরিণত হয়।

জেনে রাখ, স্বর্গের ভূতপূর্ব দেবদূতদের প্রধান লুসিফারের পতন ঘটলে এবং সে তার অনুগত বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ে জ্বলন্ত নরককুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হলে ঈশ্বরপুত্র সদলবলে ঈশ্বরের সিংহাসনের কাছে বিজয়গৌরবে ফিরে এলেন।

ঈশ্বর তখন তাঁর পুত্রকে বললেন, অবশেষে আমার প্রতিহিংসাপরায়ণ শক্তির পতন ঘটল। ব্যর্থ হলো তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ। সে ভেবেছিল স্বর্গের সব দেবদূতই তার মত বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। ভেবেছিল স্বর্গের সব দেবদূতদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলে তাদের সাহায্যে আমাদের সিংহাসনচ্যুত করে সমগ্র স্বর্গসাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে উঠবে। তাই সে প্রতারণা ও ছলনামূলক কথায় অনেক দেবদূতকে বশীভূত করে বিদ্রোহী করে তোলে। তাদেরও তাই পন ঘটে। তাদের আর কোন দিন স্থান হবে না এই স্বর্গলোকে। তবে বেশির ভাগ দেবদূতই আজও আমার অনুগত আছে। স্বর্গের জনসংখ্যা খুব একটা কম না হলেও এই স্বর্গলোকের মধ্যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল আছে যেখানে কোন লোকবসতি নেই। তাছাড়া এখানে মন্দিরে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম ও পূজা-অর্চনার জন্য অনেক লোক দরকার। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমার এই স্বর্গলোকের অনেক অধিবাসীদের তার দলভুক্ত করে নিয়ে গিয়ে যে ক্ষতি সে আমার করেছে সে ক্ষতি পূরণ করতে হবে আমাকে।

আমার যতই ক্ষতি হোক, আমি একমুহূর্তে আর এক জগৎ সৃষ্টি করব। একজন মানুষ থেকে অসংখ্য মানুষ জন্মলাভ করে সে জগতে বাস করবে। সে জগৎ হবে এই স্বর্গলোক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই মানবজাতিকে তাদের গুণাবলীর উন্নতিসাধনের দ্বারা ধীরে ধীরে উন্নীত করার জন্য কিছুকাল তাদের সেই জগতে অর্থাৎ মর্ত্যলোকে রাখব। সেখানে তাদের আনুগত্য ও ঈশ্বরভক্তির পরীক্ষা করব। পরে তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবং দেবোপম গুণগরিমায় সমুন্নত হলে আমি তাদের সেই মর্ত্যকে একদিন স্বর্গলোকে পরিণত করব এবং এই স্বর্গ ও মতের সব ব্যবধান লুপ্ত করে দিয়ে দুটি জগৎকে এক করে তুলব। দুটিকে যুক্ত করে এক রাজ্যে পরিণত করব এবং সেই সম্মিলিত স্বর্গরাজ্যে দেবতা ও মানুষ সব এক হয়ে সকলে মিলেমিশে এক অনন্ত মিলনানন্দ উপভোগ করবে।

এখন আমি তোমার মাধ্যমে এ কাজ করতে চাই। তুমিই এ কাজ সম্পন্ন করবে। সুতরাং হে আমার পুত্র, তুমি যাও। এই স্বর্গলোকের নিম্নদেশে যে শূন্যতার গহ্বর অতলান্তিক গভীরে নেমে গেছে, তুমি সে শূন্যতাকে শুধু মর্ত্যলোকে পরিণত হবার জন্য আদেশ করবে। সঙ্গে সঙ্গে তা মর্ত্যজগৎ হয়ে উঠবে। মনে রাখবে, সেই শূন্যতার মাঝেও আমি আছি। আমার সীমাহীন অন্তহীন সত্তা কোন এক বিশেষ স্থানে আবদ্ধ থাকে না। আমি জলে স্থলে অন্তরীক্ষের শূন্যতায় এক সর্বব্যাপী মহাসত্তায় বিরাজিত থাকি।

সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সে আদেশ কার্যকরী করার জন্য সময়ের থেকে দ্রুতগতিতে চলে গেলেন ঈশ্বরপুত্র। ঈশ্বরের এই ইচ্ছা ঘোষিত হতেই এক বিপুল আনন্দের সাড়া পড়ে গেল স্বর্গলোকে। ঈশ্বরের জয়গান গাইতে লাগল দেবদূতেরা। ভবিষ্যৎ মানবজাতির শান্তিপূর্ণ আবাসভূমির প্রতি অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা জানাতে লাগল তারা। তারা বলল, ঈশ্বরের প্রতিশোধাত্মক রোষ পবিত্র স্বর্গভূমি হতে ঈশ্বরদ্রোহীদের ও সকল অশুভ শক্তিকে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতাড়িত করে তাদের জায়গায় এক নূতন প্রজাতিকে সৃষ্টি করতে চলেছেন।

এইভাবে পরম মঙ্গলময় ও পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের গৌরবগান করতে লাগল সাধু দেবদূতেরা। তারা বুঝতে পারল এইভাবে তাদের পরম-পিতার মঙ্গলময় শুভপ্রসারী হস্ত লোকে লোকান্তরে যুগ যুগান্তরে চিরকাল ধরে প্রসারিত হবে।

এদিকে ঈশ্বরপুত্রের সেই বিরাট সৃষ্টি-অভিযান শুরু হয়ে গেল। সর্বশক্তিমানের শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে তার জ্যোতিতে মস্তক ও মুখমণ্ডলকে দ্যোতিত করে তিনি যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হলে অসংখ্য রথ এসে উপনীত হলো তাঁর সামনে। অসংখ্য দেবদুত তাঁর সহকারী হিসাবে তার সঙ্গে যাবার জন্য এগিয়ে এল।

স্বর্গের অনন্ত ঐশ্বর্যসম্ভার ও অজস্র দেবদূতে পরিপূর্ণ রথগুলি যেতে লাগল । স্বর্গসীমান্তের দিকে। সবার আগে ছিল ঈশ্বরপুত্রের রথ। ঘর্ঘর শব্দে রথগুলি নিকটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গদ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল আপনা থেকে।

এক নূতন জগৎসৃষ্টির মানসে অগ্রসরমান ঈশ্বরপুত্র ও দেবদূতেরা স্বর্গলোকের সেই শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে থামলেন।

ঈশ্বরপুত্র সেখান থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করে অবলোকন করলেন। তিনি দেখলেন, স্বর্গলোকের প্রান্তসীমা যেখানে শেষ হয়েছে সেই উপকূলভাগের পর থেকেই শুরু হয়েছে এক অপরিমেয় শূন্যতার অন্ধকার গহুর। সে শূন্যতার যেন শেষ নাই, সমুদ্রের মতোই অন্তহীন, অতলান্তিক ও সর্বগ্রাসী সেই শূন্য গহ্বরের অতল থেকে সমুদ্র তরঙ্গের মতই বেগবান বাতাসের বিশাল ঢেউগুলি সমুন্নত স্বর্গলোককে আঘাত হানার জন্য ছুটে আসতে লাগল প্রবলতম উচ্ছ্বাসে।

ঈশ্বরপুত্র সেইদিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, স্তব্ধ হও হেবিক্ষুব্ধ বায়ুপ্রবাহ ও তরঙ্গমালা, হে গভীর গহুর, শান্ত হও। তোমাদের সর্বগ্রাসী ক্ষোভের অবসান ঘটুক।

এই বলে কিন্তু ক্ষান্ত হয়ে রইলেন না ঈশ্বরপুত্র। তিনি দেবদূতদের পাখায় ভর করে তার পরম পিতার গৌরবে গৌরবমণ্ডিত হয়ে সেই শূন্যগহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দিলেন। এক সীমাহীন শূন্যতার মধ্য থেকে কোন্ অলৌকিক শক্তিবলে এক নূতন জগতের সৃষ্টি করেন ঈশ্বরপুত্র তা দেখার জন্য দেবদূতেরাও তাঁর সঙ্গে তাদের পাখা মেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই গহ্বরে।

সেই নতুন জগতের পরিধি ও সীমা নির্ধারণের জন্য হাতে একটি সোনার দিকনির্ণয়যন্ত্র নিলেন ঈশ্বরপুত্র। একটি পাকে শূন্যে এক জায়গায় স্থাপন করে সেটিকে কেন্দ্র করে আর একটি পাকে প্রসারিত করে ও চক্রাকারে ঘুরিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, হে নবজাত জগৎ, তুমি এই পর্যন্ত প্রসারিত হবে, এই হবে তোমার পরিধি বা প্রান্তসীমা।

এইভাবে শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় এই পৃথিবীর। সৃষ্টির আগে সেই সর্বব্যাপী শূন্যতা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। তারপর প্রথমে শান্ত জলরাশির সৃষ্টি হলো। ঈশ্বরের আত্মা তখন সেই শান্ত জলরাশির উপর পাখা বিস্তার করে তাঁর প্রাণশক্তির সঞ্চার করলেন। সেই তরল পদার্থকে উত্তপ্ত করলেন। তারপর তার উপর বাতাস ও মাটি সৃষ্টি করে তাদের এক ভারসাম্যের মধ্যে স্থাপন করলেন। এইভাবে পৃথিবীর উৎপত্তি হলো।

তারপর ঈশ্বর বললেন, আলো হোক। সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকার গহ্বরের গম্ভীর হতে আলোক উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিক হতে সেই শূন্যপথে আকাশ পরিক্রমা করতে লাগল। কিন্তু পৃথিবীতে তখন সূর্য ছিল না। ঈশ্বর তখন পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণ–এইদুটি গোলার্ধে বিভক্ত করে আলো ও অন্ধকারকেও ভাগ করে দিলেন। আলোকে দিন আর অন্ধকারকে রাত্রি নাম দিলেন।

স্বর্গের দেবদূতরা যখন প্রথম অন্ধকারের ভিতর হতে স্বচ্ছ আলোকরশ্মিকে বেরিয়ে আসতে দেখল, তখন তারা আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ল। তারা তখন আনন্দোৎসবের সঙ্গে পৃথিবীর জন্মোৎসব পালন করতে লাগল। তাদের উল্লসিত আনন্দধ্বনিতে পরিপূরিত হয়ে উঠল পৃথিবীর আকাশ-বাতাস। সোনার বীণা বাজিয়ে পরম স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকার্যের গৌরবগান করতে লাগল তারা।

এরপর ঈশ্বর বললেন, আকাশ হোক জলের উপরে। এইভাবে ঈশ্বর স্বচ্ছ বায়ুমণ্ডলে পূর্ণ আকাশ উৎপন্ন করে গোলাকার পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে দিলেন। এই আকাশ উপরের জল থেকে নিচেকার জলরাশিকে বিভক্ত করে দিল। পৃথিবীর নিম্নভাগের অনন্ত জলরাশি মহাসমুদ্ররূপে বিস্তৃত হয়ে রইল। ঈশ্বর আকাশকে স্বর্গ নামে অভিহিত করলেন। পৃথিবী সৃষ্টির দ্বিতীয় দিনে সকাল সন্ধ্যায় দেবদূতেরা সমবেত কণ্ঠে ঈশ্বরের স্তোত্ৰগান করতে লাগল।

পৃথিবী সৃষ্টি হলো বটে, কিন্তু তার জলময় গর্ভে তখন জ্বণের মত যে মাটি ছিল তা বাইরে প্রকাশ পেল না। পৃথিবীর সমগ্র উপরিপৃষ্ঠ জুড়ে অনন্ত মহাসমুদ্র প্রবাহিত হতে লাগল। কিন্তু জল একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তার থেকে তপ্ত বাষ্প উখিত হচ্ছিল। এক আদ্রতা আচ্ছন্ন করেছিল পৃথিবীকে।

ঈশ্বর তখন বললেন, হে আকাশ ও নিকটস্থ জলরাশি, তোমরা একত্রিত হও এক জায়গায়, শুষ্ক ভূমিকে উত্থিত হতে দাও।

সঙ্গে সঙ্গে বহু বিরাট পর্বত বেরিয়ে এল সেই জলরাশির মধ্য হতে। তাদের মাথায় ও পৃষ্ঠদেশে ছিল মেঘের আস্তরণ। সেইসব পর্বতের চূড়াগুলি আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে। তাদের মাথাগুলি যেমন আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাদের নিম্নদেশও সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত ছিল বিস্তৃত। সেই খাড়াই পর্বতগুলির গাত্রদেশগুলিকে বিধৌত করে তরঙ্গায়িত জলরাশি প্রবাহিত হয়ে যেতে লাগল।

তারপর ঈশ্বর শুষ্ক তটভূমিসমম্বিত অনেক নদী সৃষ্টি করলেন পৃথিবীতে। তিনি বললেন, পৃথিবীর শুষ্ক ভূমিগুলি সবুজ তৃণগুল্মদ্বারা আচ্ছাদিত হোক। অনেক ফলবান বৃক্ষরাজি উৎপন্ন হোক এবং এক একটি বৃক্ষ তাদের শ্রেণী ও গুণানুসারে এক এক রকমের বিশেষ ফল দান করুক।

ঈশ্বর আদেশদানের সঙ্গে সঙ্গে শুষ্ক মরুভূমির মত পৃথিবীর ভূখণ্ডগুলি তৃণগুল্ম ও অরণ্যরাজির দ্বারা সমাচ্ছাদিত হয়ে মনোরম সবুজের শোভায় শোভিত হয়ে উঠল। বৃক্ষলতাগুলি বিভিন্ন বর্ণগন্ধময় পুষ্পে মণ্ডিত হয়ে উঠল।

প্রথমে ঝোপেঝাড়ে বিভিন্ন লতাগুল্ম ও পরে একে একে অসংখ্য বৃক্ষ তাদের সবুজ পত্ৰশোভিত শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ফলবতী হয়ে উঠল। কত নদী ও ঝর্ণার জলধারাবিধৌত উপত্যকাগুলি তৃণগুল্ম ও পুষ্পিত ফুলের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে মনোরম আকার ধারণ করল। শুষ্ক প্রস্তরময় পর্বতশীর্ষগুলিও অরণ্যের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে উঠল। ক্রমে সমগ্র মর্ত্যভূমি অসংখ্য পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, প্রান্তর, নদী, পুষ্প ও অরণ্য সমন্বিত হয়ে এমন মনোহর শোভায় শোমান হয়ে উঠল যে তা দেবভোগ্য হয়ে উঠল। দেবতারাও সেখানে প্রমোদভ্রমণে বিশেষ প্রীত হতে পারেন। ক্রমে শিশির, কুয়াশা, মেঘ ও বৃষ্টির দ্বারা জলসিঞ্চিত ও সিক্ত করে পৃথিবীর তৃণলতাগুল্ম ও গাছগুলিকে সবুজ ও সজীব করে তুললেন ঈশ্বর। তিনি দেখলেন এই সব কিছুই মঙ্গলময়। এই হলো বিশ্বসৃষ্টির তৃতীয় দিন।

তারপর সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বললেন, ঊর্ধ্বলোকে অনন্তবিস্তৃত আকাশের উপর আলোক সৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর দিবারাত্রিকে সুস্পষ্টরূপে বিভক্ত করুক এবং তার ফলে একে একে ঋতুর আবক্স ও মাস বৎসরের পরিক্রমা শুরু হোক।

পৃথিবীকে ঠিকমত আলোকিত করার জন্য ও আলোকমালার গতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আকাশের ঊর্ধ্বে অবস্থিত স্বর্গলোকে এক কার্যালয় স্থাপিত হলো। দিনে ও রাত্রিতে পৃথিবীকে পর্যায়ক্রমে আলোকিত করার জন্য সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রমণ্ডলের সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। সূর্য পৃথিবীর দিনকে আলোকিত করতে লাগল এবং চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি রাত্রিকে আলোকিত করে অন্ধকার হতে আলোকে পৃথক করে তুলল।

এই ব্যাপারে ঈশ্বর প্রথমে আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলের মধ্যে প্রথমে সূর্য ও এক ক্ষীণালোকসম্পন্ন নক্ষত্রমণ্ডলের সৃষ্টি করলেন। সূর্য যেমন দূরের আকাশ থেকে দিনের বেলায় পৃথিবীর একটি গোলার্ধকে আলোকদান করতে লাগল আর সূর্য থেকে আলোকসম্ভার বার করে চন্দ্র দূর থেকে পৃথিবীর অন্য একটি গোলার্ধকে অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল আলোকদান করতে লাগল। এই চন্দ্র হাজার হাজার নক্ষত্ৰদ্বারা পরিবৃত। রাত্রিশেষে আকাশে সূর্য উদিত হবার আগেই ঊষাকালে সূর্যের অগ্রবর্তী আলোকরশ্মির দ্বারা আকাশের পূর্ব দিগন্ত আলোকিত হয়। তারপর সূর্য ধীরে ধীরে উদিত হয় এবং দিবাভাগ শুরু হয়। এই হলো চতুর্থ দিন।

অতঃপর ঈশ্বর বললেন, পৃথিবীর জলরাশিতে সরীসৃপ জাতীয় প্রচুরসংখ্যক জীব সৃষ্টি হোক। এই বলে তিনি জলের মধ্যে তিমি মাছ ও নানা প্রকার জলজ জীবজন্তুর সৃষ্টি করলেন।

তারপর সৃষ্টি করলেন নানা রকমের পাখি যারা পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল নীল আকাশে। নানা রকম মাছ তাদের পাখনা আর উজ্জ্বল চকচকে আঁশ নিয়ে জলের তলায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। তারা কখনো একা একা আবার কখনো বা তাদের সাথীসহ জলজ আগাছা-সমূহ ভক্ষণ করতে লাগল। খেলা করে বেড়াতে বেড়াতে মাঝে মাঝে তারা জলের উপরিপৃষ্ঠে তাদের মুক্তোর মত চকচকে গাগুলোকে তুলে ধরতে লাগল সূর্যের আলোয়।

তারপর সমুদ্রের মধ্যে সবচেয়ে বৃহদাকার লেভিয়াথান বা বিরাটাকায় এক জলজন্তুর উৎপত্তি হলো। তারা কখনো ঘুমোতো, কখনো বা সাঁতার কাটতো জলে। সাঁতার কাটার সময় তাদের এক একটি সচল দ্বীপের মত দেখাত। আকারে তারা এমনই বড় ছিল।

তারপর ঈগল পাখিরা পাহাড়ের চূড়ায় ও দেবদারু গাছের উপর বসে থাকতে লাগল আবার কখনো উড়ে বেড়াতে লাগল। সারস পাখিরা বছরে একবার এক একটি জায়গায় অনুকূল বাতাসে ভর করে উড়ে আসত। এ ছাড়া আরও কত সব ছোট ছোট পাখি তাদের গানের মিষ্টি স্বরে বনভূমিগুলিকে মুখরিত করে তুলত। মধুকষ্ঠি নাইটিঙ্গেলরা গান গাইত রাত্রিতে।

শুভ্রপক্ষ শুভ্রবক্ষ জলচর হাঁসেরা নদী ও হ্রদে সাঁতার কেটে বেড়াতে লাগল সারিবদ্ধভাবে।

এইভাবে জল, মাছ ও জলজন্তুর দ্বারা এবং পৃথিবীর আকাশ বাতাস ও পাখিদের দ্বারা পূর্ণ হওয়ায় সৃষ্টির পঞ্চম দিন গত হলো।

ষষ্ঠ দিনে ঈশ্বর বললেন, এবার পৃথিবীতে বিভিন্ন শ্রেণীর পশু সৃষ্টি হোক। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী সে আদেশ পালন করল। পৃথিবীর স্থলভাগে অসংখ্য ও বিভিন্ন জাতীয় জন্তু-জানোয়ার জন্মগ্রহণ করল। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তারা পূর্ণ আকৃতি লাভ করল। ব্যাঘ্র, সিংহ প্রভৃতি বন্য হিংস্র জন্তুর সঙ্গে সঙ্গে মেষ, মৃগ, গরু প্রভৃতি শান্ত পশুর সৃষ্টি হলো। স্থলচর সর্প ও মৌমাছির সৃষ্টি হলো।

কিন্তু বন্যজন্তুদের প্রকৃতি যাই হোক, তোমাদের পক্ষে কিন্তু তারা কেউ ক্ষতিকর হবে না। বরং তোমার ডাকে সবাই শান্তভাবে আসবে তোমার কাছে।

এইভাবে স্বর্গ ও মর্ত্য আপন আপন গৌরব ও গরিমায় মণ্ডিত হয়ে আপন আপন কক্ষপথ পরিক্রমা করতে লাগল। পৃথিবীর মাটি, জল ও আকাশ বিভিন্ন জাতীয় প্রাণীর দ্বারা পূর্ণ হয়ে গৌরববোধ করতে লাগল।

সৃষ্টির ষষ্ঠ দিন তখনো অতিবাহিত হয়নি। ঈশ্বর তখন সহসা উপলব্ধি করলেন, তিনি এতকিছু সৃষ্টি করা সত্ত্বেও সৃষ্টিকার্য সম্পূর্ণ হয়নি তাঁর। তাঁকে এখনো এমন এক প্রাণী সৃষ্টি করতে হবে যারা অন্যান্য বন্যজন্তুদের মত বন্য বা বর্বর নয়, যাদের যুক্তিবোধ আছে এবং যারা বিভিন্ন সদ্গুণাবলীতে ভূষিত। এই প্রাণী অন্যান্য প্রাণীদের শাসন করবে এবং যার মহত্ত্ব স্বর্গবাসীদের সমতুল।

তাই পরম পিতা তাঁর পুত্রকে বললেন, এবার আমরা আমাদেরই প্রতিরূপ মানুষ সৃষ্টি করি। তারা হবে দেহের দিক থেকে আমাদেরই প্রতিমূর্তি। তারা পৃথিবীতে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সকল জীবের উপর প্রভুত্ব করবে।

এই বলে তিনি হে আদম, তোমাকে সৃষ্টি করলেন। তুমিই হচ্ছ আদি মানব। তোমার নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রাণবায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। তোমাকে তিনি তাঁরই প্রতিরূপ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তুমি এক জীবন্ত আত্মা। তোমাকে পুরুষজাতি এবং তোমার সাথীকে নারীজাতিরূপে সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের থেকে সৃষ্টি হবে মানবজাতির।

সৃষ্টির পরেই তোমাদের তিনি বলেছেন, হে মানব, সংখ্যাবৃদ্ধি করো। সমগ্র পৃথিবীকে মানবজাতির দ্বারা পরিপূর্ণ করে পৃথিবীর জলে স্থলে বিচরণকারী সকল জীবের উপর প্রভুত্ব করো। ঈশ্বর তাঁরই বৃক্ষশোভিত এই মনোরম উদ্যান মধ্যস্থিত কুঞ্জবনে নিয়ে এসেছেন তোমাকে। এখানকার সুন্দর সুন্দর ফলগুলি তোমারই ভক্ষণের জন্য দান করেছেন তিনি। কিন্তু একমাত্র জ্ঞানবৃক্ষের ফল তুমি ভক্ষণ করতে পাবে না। যেদিন তুমি তা ভক্ষণ করবে সেইদিনই তোমার মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যুই তার শাস্তি। সুতরাং তোমার ক্ষুধা আর কৌতূহলকে নিয়ন্ত্রিত করবে। তা না হলে নিয়মভঙ্গের জন্য পাপ আর সেই পাপের ফলে মৃত্যু অনিবার্য।

এইখানেই সমাপ্ত হলো ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য। তিনি যা যা সৃষ্টি করেছেন তা সব নিরীক্ষণ করলেন। এইভাবে ষষ্ঠ দিন সমাপ্ত হলো।

এইসব সৃষ্টিকার্যে ঈশ্বর কোন ক্লান্তিবোধ না করলেও কাজ শেষ করে স্বর্গলোকের ঊর্ধ্বতন লোকে তার আবাসভূমিতে উঠে গেলেন তিনি। সেখান থেকে তিনি তার সৃষ্ট নূতন জগৎকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। এই নূতন জগতের দ্বারা আরও প্রসারিত হলো তাঁর সাম্রাজ্য। তাঁর সিংহাসন থেকে সে জগৎ দেখতে কত সুন্দর, কত ভাল। তিনি ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি।

এরপর ঈশ্বর তার সিংহাসনে উপবেশন করলে দশ হাজার বীণা তাঁর বন্দনাগানে ধ্বনিত হতে লাগল আর সেই মধুর ধ্বনি পৃথিবীর শান্ত আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। মহাশূন্যে ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্রগুলি সহসা স্তব্ধ হয়ে সেই বন্দনাগীতির সুর শুনতে লাগল। হে স্বর্গলোক, তোমার শাশ্বত দ্বারপথগুলি উন্মুক্ত করে দাও। সেই দ্বারপথে যেন ছয় দিন ধরে যে সব সৃষ্টি করেছেন এবং যে নূতন জগৎ সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর তা সব প্রবেশাধিকার পায়। সেই নূতন জগতে যে সুখী মানবজাতি বাস করবে সেখানে পরম স্রষ্টা ঈশ্বর মাঝে মাঝে ভ্রমণ করতে যাবেন। সেই জগতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য প্রায়ই দেবদূতদের পাঠাবেন।

এইভাবে দেবদূতেরা স্বর্গলোকের ঈশ্বরের বন্দনাগান গাইল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আকাশে দৃষ্ট ছায়াপথের মত নক্ষত্রখচিত একটি প্রশস্ত পথ ঈশ্বরের পবিত্র আবাসভূমি পর্যন্ত উন্মুক্ত হলো। সে পথের প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত সুবর্ণময়। এদিকে মর্ত্যলোকে সূর্য অস্ত যাওয়ায় পূর্বদিক হতে সন্ধ্যা সমাগত হলো। আভাসিত হয়ে উঠল আসন্ন রাত্রি।

এদিকে স্বর্গের উধ্বলোকে সেই পবিত্র পর্বতশীর্ষে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বরের রাজসিংহাসনের পাশে এসে ঈশ্বরপুত্ৰ উপবেশন করলেন।

ক্রমাগত ছয়দিন ধরে সৃষ্টিকার্যে ব্যাপৃত থাকার পর বিশ্রাম গ্রহণ করতে লাগলেন ঈশ্বর। সকল কর্ম হতে বিরত হলেন। কিন্তু একেবারে নিঃশব্দে অতিবাহিত হলো না সে বিশ্রামকাল। অজস্র বীণাবাদন সহযোগে বন্দনাগান গীত হতে লাগল দেবদূতদের দ্বারা। এক সোনালী, তরল ও গন্ধবহ মেঘমালা বিস্তৃত হয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলল সেই পবিত্র পর্বতশীর্ষস্থ ঈশ্বরের আবাসভূমিটিকে।

দেবদূতেরা তাদের সেই স্তুতিগানে বলতে লাগল, হে জেহোভা, পরম ঈশ্বর, কি মহান তোমার সৃষ্টি, অনন্ত তোমার শক্তি। কোন চিন্তা সে শক্তির পরিমাপ করতে পারে না। কোন ভাষা তা প্রকাশ বা বর্ণনা করতে পারে না। দেবদূতেরা তাদের পূজার্চনার মাধ্যমে তাদের অন্তরের যে ভক্তি-শ্রদ্ধা দান করে তোমায়, তার থেকে অনেক বেশি তারা প্রতিগ্রহণ করে তোমার কাছ থেকে। সেদিন তোমার অজস্র বজ্রের শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তুমি যে পরিমাণ ধ্বংসকার্য সাধন করেছ তার থেকে অনেক বেশি তোমার সৃষ্টিকার্যের পরিমাণ।

হে স্বর্গাধিপতি, কে তোমার শক্তিকে খর্ব করতে পারে? কে তোমার সীমাহীন সাম্রাজ্যকে অধিকার করতে পারে? কত অনায়াসে তুমি বিদ্রোহী দেবদূতদের সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দাও। যারা তোমার মহান শক্তিকে খর্ব করতে চায় তারা তাদের অজানিতে তোমার শক্তির মহিমাকে বাইরে প্রকাশিত ও প্রকটিত করে তোলে। যে বিদ্রোহীরা ভেবেছিল তোমার সঙ্গে শক্তিপরীক্ষায় জয়ী হয়ে তোমার বহুসংখ্যক ভক্তকে তোমার প্রতি বিমুখ করে তুলে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে, তারা ব্যর্থ ও বিতাড়িত হয়ে তোমার শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করল অবিসম্বাদিতভাবে। গূঢ় গোপন সকল অশুভ শক্তিকেই দেখতে পাও তুমি। শুভ ও মঙ্গলজনক সৃষ্টির দ্বারা সেই সব অশুভ শক্তিকে ব্যর্থ ও বিদূরিত করো তুমি।

তুমি তোমার এই গৌরবোজ্জ্বল সিংহাসন হতে পৃথিবী নামে তোমার সৃষ্ট যে নূতন জগৎকে প্রত্যক্ষ করছ তা হচ্ছে মানবজাতির মনোরম স্থায়ী বাসস্থান। সেখানে মানবজাতি সুখে বসবাস করে তোমার উপাসনা করবে এবং তার পুরস্কারস্বরূপ সমুদ্র ও আকাশসমন্বিত পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করবে তারা। একজন আদিপিতা ও আদিমাতা থেকে অসংখ্য মানব সৃষ্ট হয়ে তোমার উপাসনা করবে, তোমাকে ভক্তি করবে।

এইভাবে স্তুতিগান করল তারা এবং সে গানের সুরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো স্বর্গের সাম্রাজ্য। এইভাবে সম্পন্ন হলো তাদের ধর্মোৎসব।

হে আদম, তোমার অনুরোধ আমি রক্ষা করলাম। তুমি জানতে চেয়েছিলে কিভাবে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়, তোমার স্মৃতিশক্তি জাগ্রত হবার আগে কি কি ঘটেছিল, যাতে তুমি তোমার উত্তরসুরীদের সে সব কথা জানাতে পার। কিন্তু যা মানুষের জ্ঞাতব্য নয়, যা তাদের জ্ঞানের সীমার অতীত তা যেন জানতে চেও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *