২য় সর্গ

দ্বিতীয় সর্গ

আলোচনার শুরুতেই তাদের প্রধান শয়তান স্বর্গের অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে এক বিতর্কের অবতারণা করল। উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ কেউ যুদ্ধের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করল। আবার কেউ কেউ যুদ্ধ হতে প্রতিনিবৃত্ত থাকার পরামর্শ দান করল। তখন তৃতীয় প্রস্তাব চাওয়া হতে তা উত্থাপিত হলো। শয়তান প্রধানই তার উল্লেখ করে বলল, স্বর্গে থাকাকালে । এর আগে তারা শুনেছিল ঈশ্বর আর এক জগৎ ও আর এক ধরনের মানবজাতি সৃষ্টি করবে। সে মানবজাতি হবে প্রায় দেবতাদেরই সমকক্ষ। এই ধরনের কোন জগৎ আছে কি না আমাদের তা খুঁজে বার করতে হবে। সম্ভব হলে সেখানে আমরা চলে যাব এবং সেই মানবজাতির সাহায্য নেব এই যুদ্ধে।

কিন্তু এই কঠিন অনুসন্ধানকার্যে যেতে কেউই উৎসাহ দেখাল না। তখন শয়তান নিজেই যেতে চাইলে সকলে হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল তাকে। শয়তান নরকদ্বারের। দিকে এগিয়ে গেলে তখনকার মত সভা ভঙ্গ হলো। এদিকে নরকদ্বারে গিয়ে শয়তান প্রধান দেখল দ্বার রুদ্ধ। কিভাবে সে দ্বার পার হয়ে নতুন জগতের সন্ধানে গেল তারই বর্ণনা আছে এই সর্গে।

রাজকীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে একটি সুউচ্চ সিংহাসনে সমুন্নত অবস্থায় বসেছিল শয়তানরাজ। স্বর্ণ ও মণি-মুক্তামণ্ডিত তার রাজসভার ঐশ্বর্য পারস্যের ওরহমাস, ভারতবর্ষ ও প্রাচ্যের রাজা-মহারাজের ঐশ্বর্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। সে তার বুদ্ধিবলে এই অশুভ খ্যাতিসম্পন্ন রাজসম্মানে অধিষ্ঠিত করে নিজেকে। হতাশার গভীর গহুর থেকে সমুচ্চ উচ্চাভিলাষের শিখরদেশে উন্নীত করে সে তার মনকে। স্বর্গের বিরুদ্ধে এক দুর্ধর্ষ সমরাভিযানের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। অনাগত সাফল্যের এক গর্বোদ্ধত কল্পনায় উদ্দীপিত হয়ে সে বলতে থাকে,

হে শক্তিমান রাজন্যবর্গ ও স্বর্গের অপদেবতাগণ, আমরা উৎপীড়িত ও অধঃপতিত হলেও যেহেতু আমাদের সুসংহত ও অবিনশ্বর শক্তিকে নরকপ্রদেশের কোন গভীরতাই আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না চিরতরে, সেইহেতু স্বর্গলোক অধিকারের আশা এখনো ত্যাগ করিনি আমি। এই পতনের শত অপমানকে অগ্রাহ্য করে আমাদের অমর গুণাবলী গৌরবময় ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে আরও এবং ভাগ্যের অন্য কোন বিপর্যয়কে ভয় করবে না। যদিও স্বর্গের দেবতাদের বিধানে ন্যায়সঙ্গতভাবে আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি তথাপি আমার বুদ্ধি ও সামরিক শক্তির জন্য তোমরা তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও পরামর্শের দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে অবিসম্বাদিত ও নিরাপদ এক রাজকীয় মর্যাদায় এই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছ আমাকে। কিন্তু আমি যখন স্বর্গলোকে আরও উন্নত ও সম্মানজনক অবস্থায় অধিষ্ঠিত হব তখন অনেকে আমায় হিংসা করতে পারে। কিন্তু যে সর্বশক্তিমান বস্ত্রধারী জুপিটারের সমকক্ষ এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে তাকে হিংসা করার মত ক্ষমতা কার আছে?

আর এখানেই বা কে আমায় ঈর্ষা করবে? কেই বা যুদ্ধ করবে আমার বিরুদ্ধে? যেখানে পরিণামে ভাল বা লাভজনক কিছু পাবার আশা বা সম্ভাবনা না থাকে সেখানে কখনো যুদ্ধ হতে পারে না। যে নরকপ্রদেশে সকলেই যন্ত্রণায় জর্জরিত, সকলেই যেখানে একই যন্ত্রণায় অংশগ্রহণ করে চলেছে, সেখানে কেউ কখনই বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে চাইবে না। তার ফলে স্বর্গের থেকে এখানে আমরা আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পে দৃঢ় হয়ে আমাদের পুরনো অধিকারের দাবি জানাব। নিশ্চয়ই আমরা আমাদের হারানো সুখসম্পদ পুনরায় লাভ করব। কিন্তু কিভাবে কোন উপায়ে তা সম্ভব হবে, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব প্রকাশ্যে অথবা কোন গোপন কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে যাব, সে বিষয়ে এখন আলোচনা করে দেখব। এ বিষয়ে এখন কোন পরামর্শ দেবার থাকলে সে তা বলতে পারে।

তার কথা শেষ হতেই মলোক নামে শয়তানদের আর এক দণ্ডধারী রাজা উঠে দাঁড়াল। শক্তি ও সমরকৌশলের দিক থেকে অন্যান্য শয়তানদের থেকে সে ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অবস্থার প্রতিকূলতা এবং হতাশা তাকে করে তুলেছিল আরও ভয়ঙ্কর এবং দুর্বার। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়ে ওঠার উচ্চভিলাষে সে হয়ে উঠেছিল নিভীক। স্বর্গ বা নরকের কোন শাস্তির ভয়াবহতাকেই গ্রাহ্য করত না সে।

মলোক এবার বলতে লাগল, আমি চাই প্রকাশ্য যুদ্ধ। আমরা যখন বসে বসে আলোচনা করছি, কৌশলের কথা চিন্তা করছি তখন আমাদের লক্ষ লক্ষ স্বর্গচ্যুত অনুগামীরা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে স্বর্গাভিযানের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশ পাবার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে আছে। নরকের এই লজ্জাজনক ঘৃণ্য গহ্বরকেই তারা তাদের বর্তমান আবাসভূমি হিসাবে মেনে নিয়েছে। এটা তাদের আবাসভূমি নয়, কারাগার। অথচ যারা আমাদের উপর অত্যাচার ও অবিচার করেছে তারা আমাদের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে রাজত্ব করছে স্বর্গে। না, কোন শক্তিই আমাদের আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না এখানে। এখনি প্রস্তুত হও সকলে। এক নরকাগ্নি ও ক্রোধের প্রচণ্ডতায় মণ্ডিত হয়ে স্বর্গলোকের আকাশচুম্বী সৌধমালাগুলিতে জোর করে প্রবেশ করব আমরা। আমাদের উপর যত অত্যাচার করা হয়েছে সেই সব অত্যাচারকে অস্ত্রে পরিণত করে তুলব আমরা। সেই অস্ত্র দিয়ে আঘাত করব সেই সর্বশক্তিমান অত্যাচারীকে। যুদ্ধের ধ্বনি শুনে সেই অত্যাচারী বেরিয়ে এসেই শুনতে পাবে নারকীয় বর্জ্যের শব্দ, বিদ্যুতের পরিবর্তে শুনতে ও দেখতে পাবে নরকাগ্নি আর বিদ্রোহী দেবদূতদের ক্রোধকুটিল রক্তচক্ষু। বুঝতে পারবে তারই আবিস্কৃত সালফারমিশ্রিত যে অগ্নিদ্বারা আমাদের দগ্ধ করে সেই সালফার আর অগ্নি তার সিংহাসনের মধ্যে মিশে আছে।

কিন্তু স্বর্গারোহণের পথটি বড় দূরতিক্রম্য, বড় কঠিন। সে পথ এত উঁচু এবং খাড়াই যে পাখা মেলে সেখানে উঠে যাওয়া সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।

এখন ভেবে দেখতে হবে স্বর্গ আর নরকের মধ্যবর্তী স্থানে যে বিস্মৃতির নদী আছে সেই নদী পার হয়ে স্বর্গে উঠে যেতে পারব কি না। ঊর্ধ্বগতিই আমাদের স্বভাবজাত ধর্ম। পতন বা নিম্নগতি আমাদের স্বভাবের বিপরীত। কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর শত্রুরা যখন আমাদের পিছন পিছন তাড়া করে নিয়ে আসছিল এই গভীর নরকগহ্বরে, যখন আমরা ছুটে পালিয়ে এসে রক্ষা পাই তখন আমাদের কি মনে হচ্ছিল? তাহলে আরোহণের কাজটা কি খুব সহজ হবে? এটা কি ভয়ের ব্যাপার নয়? যে আমাদের থেকে অধিকতর শক্তিশালী, আবার তাদের রোষ উৎপাদন করে নিজেদের ধ্বংস টেনে আনা কি উচিত হবে? আবার এই নরকে যদি নতুন করে আরও বেশি পরিমাণে শাস্তি ভোগ করতে হয় তাহলে অনেক বেশি পরিতাপের বিষয়।

তাছাড়া এই ঘৃণ্য নরকপ্রদেশে বাস করাটাই তো সবচেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়। এই যে আমরা অনিবার্য অগ্নির জ্বালায় ক্রমাগত দগ্ধ হয়ে আমাদের শত্রুর ক্রোধাবেগকে পরিতৃপ্ত করে চলেছি, এর থেকে দুঃখ বা পরিতাপের কি থাকতে পারে? এর থেকে বেশি শাস্তি মানেই তো একবারে ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। তা যদি হয় তাহলে আমাদের ভয় কিসের? তার রোষ উৎপাদনে আর ভয় পাই না আমরা। এই রোষ চরমে উঠলে হয় আমাদের ধ্বংস করে দেবে আর তা না হলে বিদ্রোহী আত্মা হিসাবে এই নরকেই রেখে দিতে পারে। কিন্তু এই আত্মা অমর ও অবিনশ্বর হলেও এখানে অন্তহীন যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে হবে আমাদের। তথাপি এই যন্ত্রণার মাঝেও আমাদের সর্বশক্তিমান শত্রুর স্বর্গলোক আক্রমণ করার মত উপযুক্ত শক্তি আছে আমাদের। তার সিংহাসন যত দুর্গম স্থানেই থাক না কেন, তাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলে সে সিংহাসন অধিকার করব আর তা না হলে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করব তাদের উপর।

এক কুটিল জাকুটির মধ্যে দিয়ে তার কথা শেষ করল মলোক। সে বলল, প্রতিশোধাত্মক এই যুদ্ধ যত ভয়ঙ্করই হোক, দেবতারা তার থেকে বেশি ভয়ঙ্কর।

এবার অন্য দিক থেকে বিলায়েল নামে একজন উঠে দাঁড়াল। তার সমগ্র দেহাবয়বের মধ্যে ছিল এক মর্যাদা আর মহিমার ভাব। মনে হচ্ছিল সে যেন এক কৃতী মহান পুরুষ। কিন্তু তার ভিতরটা ছিল মিথ্যা আর ফাঁপা। এক কপট মাধুর্যে ভরা তার কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটি কথা সুন্দর এক একটি যুক্তি দিয়ে অন্যায়কে ন্যায় এবং মন্দকে শুভ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করত। তার যুক্তির অস্ত্র দিয়ে সে প্রতিপক্ষের যে কোন পরিণত যুক্তি ও পরামর্শকে খণ্ডন করার চেষ্টা করত।

তার সব চিন্তা ছিল নিম্নমানের। পাপকর্মে তার ছিল অসাধারণ উৎসাহ ও তৎপরতা, কিন্তু কোন পুণ্যকর্মে বা মহকর্মে সে ছিল একেবারে অলস এবং মন্দগতি। কিন্তু তার কণ্ঠে এমনই মাধুর্য ছিল যে তার কথা সকলেই মন দিয়ে শুনত।

এবার সে বলতে শুরু করল, হে নেতৃগণ, আমিও সরাসরি যুদ্ধের পক্ষে। এক প্রবল ঘৃণার আবেগে আমার চিত্তও পরিপূর্ণ আপনাদের মত। কিন্তু অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করার জন্য যে যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছিল, সেই যুক্তি প্ররোচিত করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রতিনিবৃত্তও কম করেনি। যুদ্ধের সামগ্রিক সাফল্যের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিয়ে এক অশুভ সংশয়ের ছায়া বিস্তার করেছে আমার মনে। যারা শুধু এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ বাসনাকে লক্ষ্য করে সমস্ত সমরায়োজনকে সংহত করে এবং মন্ত্রণা ও জল্পনা-কল্পনার জাল বিস্তার করে, যারা শুধু এক হতাশার ভিত্তির উপর তাদের সমস্ত সাহসিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য।

কিন্তু কোন্ প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করতে চায়? স্বর্গের দুর্গকারগুলি অগণিত সশস্ত্র সৈনিকদের দ্বারা পরিপূর্ণ। দুর্ভেদ্য সেই দুর্গদ্বারে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য। স্বর্গলোকের সীমান্তবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলিতেও আছে অসংখ্য সৈন্যশিবির। এমন কি রাত্রির অন্ধকারেও অসংখ্য পক্ষবিশিষ্ট দেবসেনা দূর দূরান্ত পরিভ্রমণ করে প্রহরা দিয়ে চলেছে এবং তাদের প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে।

অথবা যদি আমরা বলপ্রয়োগের দ্বারা সেখানে প্রবেশ করি, যদি নরকপ্রদেশের সমস্ত অধিবাসী অভিযানে যোগদান করে এবং যদি আমরা আমাদের সম্মিলিত দেবদ্রোহিতার কৃষ্ণকুটিল ও নারকীয় অন্ধকারের দ্বারা স্বর্গলোকের পবিত্র জ্যোতিপুঞ্জকে ম্লান করে দিতে চাই, তাহলেও আমাদের প্রধানতম শত্রু ঈশ্বর অম্লান ও অক্ষত অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়ে থাকবে তার সিংহাসনে। আমাদের সকল অভিযান ও সমরোদ্যমকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে দিয়ে অপরাজেয় রয়ে যাবে সেই স্বর্গলোক।

এইভাবে যদি আমরা প্রতিহত হই সে যুদ্ধে, তাহলে ভূমিসাৎ হয়ে যাবে আমাদের সকল আশার উত্তঙ্গ সৌধ। আর তার ফলে সর্বশক্তিমান বিজেতা ঈশ্বরের ক্রোধাবেগ হবে বর্ধিত। সে তখন তার ক্রোধের সেই প্রচণ্ডতা আমাদের উপর প্রয়োগ করে সমূলে বিনাশ করবে আমাদের। আমাদের উপরে অকালে নেমে আসবে এক শোচনীয় পরিণতি।

তাহলে আসলে ক্ষতিটা কার হবে? মৃত্যুর অন্ধকার গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার থেকে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করে যাওয়া অনেক ভাল। আমাদের বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি আছে। আমাদের চিন্তাভাবনাকে অনন্ত প্রসারিত করে দিতে পারি।

কে জানে, এইখানে এইভাবে থাকাটাই হয়ত মঙ্গলজনক আমাদের পক্ষে। আমাদের ক্রুদ্ধ শত্রু ঈশ্বর আমাদের জন্য যে মঙ্গলের বিধান কোনদিনই করবে না, সে মঙ্গল আমাদের এখান থেকেই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের উদ্ধত কামনাকে পূরণ করার জন্য যুদ্ধ করি সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তাহলে অনন্তকাল ধরে শাস্তিভোগ করে যেতে হবে আমাদের।

যারা যুদ্ধ চায় আমাদের মধ্যে তারা বলতে পারে যুদ্ধ করে স্বর্গলোক অধিকার না করলে অনন্তকাল ধরে আমাদের এখানে দুঃখ ভোগ করে যেতে হবে। কিন্তু যেভাবে আমরা আছি এখন এখানে তাতে দুঃখ-কষ্ট কোথায় তা বুঝতে পারছি না। কিসের কষ্ট? এই যে আমরা বসে আছি, স্বাধীনভাবে আলোচনা করছি, সশস্ত্র অবস্থায় স্বাধীনভাবে বিচরণ করছি, এটাই যথেষ্ট নয় কি? কিন্তু আমরা যদি যুদ্ধ করতে গিয়ে দেবতাদের নিক্ষিপ্ত বজ্ৰদ্বারা তাড়িত হয়ে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়াই এবং অবশেষে এই নরকের মত অন্ধকার গর্ভে আশ্রয় গ্রহণ করি আঘাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য, অথবা যদি শৃঙ্খলিত অবস্থায় জ্বলন্ত হ্রদে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে হয় তাহলে সেটা কি আরো খারাপ হবে না?

আমাদের দগ্ধ করার জন্য যে অশুভ অগ্নি একদিন প্রজ্জ্বলিত হয় তার নিঃশ্বাসে, আজ আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করলে তার প্রচণ্ড ক্রোধাবেগে তপ্ত সেই নিঃশ্বাস থেকে আগের থেকে সাতগুণ বেশি জ্বলবে। আবার সে তার চরম প্রতিশোধ বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে প্রসারিত করে দেবে তার রক্তলোহিত দক্ষিণ হস্তটি।

অথবা ধরো, আজ আমরা যারা এক গৌরবময় যুদ্ধের পরিকল্পনা করছি, এবং যে যুদ্ধে প্ররোচিত করছি সকলকে সেই আমাদের মাথার উপর যদি নরকের আকাশখানা সহসা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠে ভেঙে পড়ে, যদি আমাদের আবার সেই জ্বলন্ত সমুদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে হয়, যদি দেবতাদের দ্বারা নিক্ষিপ্ত প্রস্তরের সঙ্গে গ্রথিত থাকতে হয় আমাদের, যদি আমাদের যুগ যুগ ধরে আশাহীন, ভরসাহীন, বিশ্রামহীন। ও শৃঙ্খলিত অবস্থায় দিন যাপন করতে হয়, তাহলে আমাদের জয়ের গৌরব যাবে কোথায়? সে অবস্থা হবে আরও খারাপ আমাদের পক্ষে।

আমার কণ্ঠ তাই গোপন অথবা প্রকাশ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হবে। যে শক্তি সর্বশক্তিমান, সর্বদপী, যে শক্তি এক স্থান থেকে সকল স্থানের সকল কিছু দেখতে পায়, সে শক্তিকে কেমন করে প্রতারিত করব আমরা? যে শক্তি স্বর্গ থেকে আমাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ থেকে আমাদের সকল চক্রান্তজাল লক্ষ্য করছে এবং উপহাস করছে, সে শক্তি শুধু আমাদের বাহিনীর প্রতিরোধই করবে না, আমাদের সমস্ত চক্রান্তকে আগে থেকেই ব্যর্থ করে দেবে। আমাদের উচ্চাভিলাষকে পদদলিত করে দিয়ে আমাদের আবার বিতাড়িত করবে স্বর্গলোক থেকে। তাহলে আবার আমাদের সারাজীবন কষ্ট করে যেতে হবে। সারাজীবন আমাদের পীড়ন সহ্য করে যেতে হবে। সুতরাং বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থাই ভাল সুতরাং আমার পরামর্শ হচ্ছে এই যে, যে অমোঘ সর্বশক্তিমান শক্তির বিধানে আমাদের এই পতন ঘটেছে, বিজেতার অভিলাষ জয়যুক্ত হয়েছে সেই শক্তিকেই মেনে নিতে হবে অপ্রতিবাদে। সেই শক্তির বিরোধিতা করে কোন লাভ হবে না। যেহেতু শক্তিতে আমরা বিজেতার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারিনি, সেইহেতু নির্বিবাদে আমাদের কষ্ট করে যেতেই হবে। তাছাড়া যে বিধানের বশে আমাদের পতন ঘটেছে সেই বিধানকে অন্যায়ই বা বলি কি করে?

আজ আমাদের এই সমস্যায় পড়তে হত না যদি আমরা এতবড় এক বিরাট শক্তির সঙ্গে বিরোধিতা করার ব্যাপারে আমাদের বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারতাম। একথা ভাবতে আমার হাসি পায় যে, আগে যারা এক সামরিক বীরত্ব প্রদর্শনে জন্য উদ্ধত ও অতিসাহসী হয়ে উঠেছে তারা যদি জানতে পারে তাদের সে বীরত্ব ব্যর্থ হলে বিজেতার নির্মম বিধানে আবার তাদের নির্বাসন, অপমান ও বন্দীত্বের বন্ধন-বেদনা ভোগ করে যেতে হবে, তাহলে তাদের সমস্ত ঔদ্ধত্য সঙ্কুচিত হয়ে উঠত মুহূর্তে।

এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থা যদি আমরা এখন সহ্য করে যেতে পারি তাহলে আমাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ক্রোধ হয়ত প্রশমিত হতে পারে, এমন কি সে ক্রোধ হয়ত দূরীভূত হয়ে যেতেও পারে। ক্রমে সে আমাদের কথা ভুলে যাবে একেবারে। আমরা যে শাস্তি এখন ভোগ করছি সেই শাস্তিতেই সন্তুষ্ট থাকবে সে। যদি তার ক্ৰোধতপ্ত নিঃশ্বাস ঐ জ্বলন্ত অগ্নির শিখাগুলিকে নতুন করে উদ্দীপিত না করে তাহলে ক্রমে নিস্তেজ ও স্তিমিত হয়ে আসবে সে অগ্নি, আমাদের সহিষ্ণুতার দ্বারা আবার সে অগ্নির ধূমরাশি ও ভয়ঙ্কর তাপকে জয় করব আমরা।

কালক্রমে আমরা হয়ত এই স্থানের ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারব নিজেদের। ক্রমে হয়ত যন্ত্রণাহীন ও সহনীয় হয়ে উঠবে এই দুঃসহ উত্তাপ। এই অন্ধকার হয়ে উঠবে আলো।

কিন্তু একবার ভেবে দেখ যদি আমরা আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে এই স্থানটুকুও হারাই, যদি চিরকাল আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়, তাহলে কোন প্রত্যাশায় অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করে যাব আমরা? তার থেকে বর্তমানের এই অবস্থা যত খারাপই হোক, তার তুলনায় অনেক সুখের, যদি আমরা নতুন করে কোন দুঃখকে ডেকে না আনি।

এইভাবে এক অপমানজনক শাস্তি, আলস্য আর অকর্মণ্যতাকে যুক্তির আবরণে আবৃত করে ব্যক্ত করে গেল বিলায়েল। তারপর ম্যামন বলতে উঠল।

সে বলল, আমরা কিজন্য যুদ্ধ চাইছি? হয় স্বর্গের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে অথবা আমাদের হারানো অধিকারকে পুনরায় লাভ করতে।

কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে আমরা স্বর্গের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার আশা করতে পারি না। সুতরাং এ আশা আমাদের বৃথা। স্বর্গের অধিপতিকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করতে না পারলে স্বর্গের মধ্যে কি করে স্থান পাব আমরা?

মনে করো, আমরা নরম হয়ে আত্মসমর্পণ করে আমাদের প্রতিপক্ষের করুণা ভিক্ষা করলাম। ধরে নাও, আমরা তার প্রভুত্ব মেনে নিয়ে আমাদের বশ্যতা স্বীকার করলাম নতুন করে। কিন্তু তার ফলে তার সামনে বিনয়াবনত হয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমাদের উপর যে সব কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হবে তা নির্বিবাদে মেনে চলবে হবে আমাদের। তার অবিসম্বাদিত আধিপত্য মেনে নিয়ে আবেগপূর্ণ ভাষায় স্তোত্ৰগান করে তুষ্ট করতে হবে তাকে। তিনি সর্বশক্তিমান সার্বভৌম প্রভু হিসাবে বসে থাকবেন তার সিংহাসনে আর তাঁকে ভগবান হিসাবে মেনে নিয়ে তার ঐশ্বরিক বেদীতে পুস্পাঞ্জলি দিতে হবে আমাদের অবনত মস্তকে। তাঁর সেবকরূপে।

স্বর্গলোকে এই হবে আমাদের একমাত্র আনন। অনন্তকাল ধরে এই হীন কর্ম করে যেতে হবে আমাদের। যাকে আমরা অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করি, আমাদের কাছে যে একেবারে অবাঞ্ছিত তাকেই পূজো করে যেতে হবে।

যে শক্তি, যে বল আমাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয় সে শক্তির মোহে আমরা যেন সবকিছু ভুলে মোহগ্রস্ত না হই, যে যুক্তি গ্রহণীয় নয় তা যেন আমরা গ্রহণ না করি। স্বর্গে গিয়ে পরের ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান হবার কামনা ত্যাগ করে আমরা নিজেরা নিজেদের মানের কথা চিন্তা করি, নিজেদের শক্তিতে বেঁচে থাকার জন্য সচেষ্ট হই।

এক বিশাল নরকপ্রদেশে আর যাই হোক, আমাদের অবস্থা যত খারাপ হোক না কেন, আমরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে চলেছি। এই স্বাধীনতা দুঃখকষ্টপূর্ণ দাসত্ব থেকে অনেক ভাল। আমাদের মহত্ত্ব সবচেয়ে প্রকটিত হয় তখনই যখন আমরা আমাদের শ্রমে ও সহিষ্ণুতার দ্বারা ছোট জিনিস থেকে বড় কিছু করতে পারি, অব্যবহার্য বস্তুকে ব্যবহার্য করে তুলতে পারি, দুরবস্থা হতে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারি এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাকে আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যে পরিণত করতে পারি। আমরা কি এই অন্ধকার নরকের গভীর গহুরকে ভয় করি?

কিন্তু তোমরা দেখেছ স্বর্গলোকের সর্বাধিপতি কতবার সঘন ধূমরাশির অন্ধকারের দ্বারা তার সিংহাসনকে পরিবৃত করে তার সকল গৌরব ও ঐশ্বর্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেই ধূমরাশি হতে গভীর গর্জনে ফেটে পড়ে কত বজ্র। সমগ্র স্বর্গলোক হয়ে ওঠে নরকের মত। সে যদি এইভাবে আমাদের নারকীয় অন্ধকারের নকল করে তার দ্বারা নিজেকে পরিবৃত করে রাখতে পারে তাহলে আমরা কি তার স্বর্গীয় আলোর নকল করে সেই আলোকে এই নরকে নিয়ে আসতে পারি না? দেবতাদের দ্বারা পরিত্যক্ত এই নরকপ্রদেশের গর্ভেও কি মণি, মুক্তো, সোনা প্রভৃতি উজ্জ্বল ধনরত্ন : নিহিত নেই? আমাদেরও কি এমন কোন কলাকৌশল নেই যার দ্বারা আমরা সেই সব বস্তু ও ধনৈশ্বর্যকে উদ্ধার করতে পারি? স্বর্গে এর থেকে বেশি কি ঐশ্বর্য আছে?

জ্বলন্ত অগ্নির নির্মম দহনজনিত যে জ্বালাময় পীড়ন আমরা এখন অহেরহ ভোগ করে চলেছি, কালক্রমে তা সহনীয় হয়ে আমাদের পরিবেশগত ভৌতিক উপাদানে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। কালক্রমে তাদের প্রকৃতি আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে আমাদের যন্ত্রণা ও সকল বেদনা বিদূরিত হতে পারে।

এখন আমাদের সামনে যে সমস্যা সমুপস্থিত এর জন্য চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান। চাই শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে কিভাবে আমরা আমাদের এই বর্তমানের বাস্তব অবস্থাকে মেনে নিয়ে এই অশুভ অসহনীয় অবস্থাকে উন্নতির সোপান হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। তার জন্য প্রথমেই যুদ্ধের সকল চিন্তাকে অপসারিত করে ফেলতে হবে মন থেকে। এই হলো আমার পরামর্শ তোমাদের প্রতি।

ম্যামনের কথা শেষ হতে না হতেই এক প্রবল কলগুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠল সমগ্র সভাস্থল। যে সামুদ্রিক ঝড় সারারাত ধরে সমুদ্রকে বিক্ষুব্ধ করে সমুদ্রনাবিকদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলে তাদের কোন পর্বতসংকুল উপসাগরে নোঙর করতে বাধ্য করে, সে ঝড়ের গর্জনে শূন্য পর্বতপ্রদেশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলে যে শব্দ উত্থিত হয়, সেই ধরনের শব্দে কম্পিত হয়ে উঠল শয়তানের নারকীয় সভাস্থল।

ম্যামনের কথা শেষ হতেই তার শান্তির পরামর্শ শুনে বিপুল হর্ষধ্বনি উঠল সভায়। শ্রোতারা সন্তুষ্ট হলো তার কথায়। কারণ যুদ্ধের বিভীষিকাকে, নরকযন্ত্রণাকে ভয় করছিল তারা। বজ্র আর মাইকেলের তরবারির ভয়ের দ্বারা তখনো পীড়িত হচ্ছিল তাদের মন। তার উপর এই নরকপ্রদেশে এমন এক সাম্রাজ্য স্থাপন করার আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল তাদের মন যে সাম্রাজ্য কালক্রমে তাদের দৃঢ় নীতি, শ্রম ও সাধনার দ্বারা স্বর্গরাজ্যের অনুরূপ মাহাত্ম্য ও মর্যাদা লাভ করবে।

এরপর সব কিছু দেখে শুনে বীলজীবাব উঠে দাঁড়াল। মর্যাদার দিক থেকে তাদের নেতা শয়তানের পরেই ছিল তার স্থান। তার চেহারাটা যেমন ছিল এক স্তম্ভের মতই বিশাল এবং গম্ভীর, তার মুখমণ্ডলের উপর তেমনি ছিল আলোচনার এক গভীর আগ্রহ এবং উদ্বেগ। এক শোচনীয় সর্বনাশের মধ্যেও তার মুখে ছিল এক রাজকীয় মর্যাদার ভাব। তার দৃঢ় ও উন্নত স্কন্ধদ্বয় বহু শক্তিশালী রাজ্যভার বহনের উপযুক্ত।

বীলজীবাবের রাত্রির মত গম্ভীর কণ্ঠস্বর উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সকলের মনোযোগ নিবদ্ধ হলো তার উপর। সে বলতে আরম্ভ করল,

সিংহাসন, সাম্রাজ্য, রাজকীয় শক্তি, স্বর্গের সন্তান, স্বর্গীয় গুণাবলী-আজ আমাদের এই সমস্ত উপাধি ত্যাগ করে নিজেদের কি নরকের রাজা হিসাবে অভিহিত করব আমরা? আমাদের এখানকার সকলে এখানে এক সাম্রাজ্য স্থাপনের পক্ষেই রায় দিয়েছে। কিন্তু যখন আমরা এই স্বপ্ন দেখছি তখন আমরা একথা ভেবে দেখছি না যে স্বর্গলোকের রাজা আমাদের এখানে কারারুদ্ধ করে রেখেছেন। এই নরকপ্রদেশ আমাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়, আসলে এটি হলো আমাদের কারাগার। মনে রাখবে, এই নরকপ্রদেশও তার শাসন ও প্রভুত্বাধীন এলাকার বাইরে নয়। স্বর্গলোক হতে যত দূরেই হোক, এখানে আমাদের তারই কঠোর শাসনাধীনে বন্দী হয়ে থাকতে হবে।

একথা নিশ্চিত যে, স্বর্গে ও নরকে সে-ই একমাত্র সার্বভৌম রাজারূপে রাজত্ব করে থাকে অনন্তকাল ধরে এবং আমরা যতই বিপন্ন বা বিদ্রোহ করি না কেন, সে তার দুলোক ও ভূলোকব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্যের কোন অংশ ছাড়তে চাইবে না। বরং সে তার সাম্রাজ্য এই নরকপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করে কঠোরভাবে শাসন করবে আমাদের।

তাহলে আমরা বসে বসে শান্তি আর যুদ্ধের কথা আলোচনা করছি কেন? আমরা যদি যুদ্ধ করার সংকল্প করি তাহলে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি নিতে হবে, আর যদি শান্তি বা সন্ধি স্থাপন করি তাহলে সে সন্ধির সুফল সম্বন্ধে কোন প্রতিশ্রুতি পাব না আমরা। আমাদের যদি দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেই হয় তাহলে কোন্ শান্তি পাব আমরা? শান্তির পরিবর্তে শুধু এক কঠোর স্বৈরাচারী শাসন আর শান্তি আরোপিত হবে আমাদের উপর বলপ্রয়োগের দ্বারা।

শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের বিজেতা শক্তিকেও কোন শাস্তি দিতে পারব না। তার পরিবর্তে সে শক্তি আমাদের কাছ থেকে পাবে শুধু এক অপরিসীম বিদ্বেষ, ঘৃণা, দুর্দমনীয় বিতৃষ্ণা আর প্রতিহিংসার তীব্রতা। যতই আমরা যত সব অত্যাচার, অবিচার এবং নির্যাতন সহ্য করে যাব ততই আমরা ধীরে ধীরে বিজেতা শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রতিশোধাত্মক ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাব। দেখব সে শক্তি আমাদের নির্যাতিত করে কত আনন্দ লাভ করে।

সে ক্ষেত্রে আমাদের সুযোগেরও হয়ত অভাব হবে না। হয়ত আমরা এক বিপজ্জনক অভিযানে তৎপর হয়ে স্বর্গলোক আক্রমণ করব। যে স্বর্গরাজ্যের সুউচ্চ প্রাসাদগুলি সুদুর নরকপ্রদেশ হতে কোন আক্রমণ, অবরোধ বা অভিযান আশঙ্কা করে না কখনো, সেই স্বর্গরাজ্য হয়ত আক্রান্ত হবে আমাদের দ্বারা।

এক্ষেত্রে দেখতে হবে আমরা এ বিষয়ে সহজতর উপায় খুঁজে পাই কিনা। স্বর্গ আর পাতালপ্রদেশের মাঝখানে আর এক তৃতীয় জগৎ আছে যেখানে মানবজাতি নামে এক নতুন জাতি বাস করে সুখে-শান্তিতে। এতদিনে হয়ত সে মানবজাতি সৃষ্ট হয়েছে। তারা দেখতে অনেকটা আমাদের মত। শুধু শক্তি-সামর্থ্য ও বীরত্বের দিক থেকে অনেক নিকৃষ্ট আমাদের থেকে। কিন্তু স্বর্গের অধিপতির বড় প্রিয় তারা এবং স্বর্গাধিপতি নিজে মানবজাতির প্রতি তার অনুগ্রহের কথা দেবতাদের কাছে ঘোষণা করে সদর্পে।

সেই মানবজাতির কথা আমাদের একবার ভাবা উচিত। তাদের দিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমাদের জানা উচিত সেই তৃতীয় জগতে কি ধরনের প্রাণী বাস করে, জানা দরকার কতখানি শক্তি ধারণ করে তারা। কি কি গুণাবলীর দ্বারা তারা ভূষিত এবং তাদের দুর্বলতাই বা কি। দেখতে হবে বলপ্রয়োেগ বা সূক্ষ্ম কৌশলের দ্বারা কিভাবে বশে আনতে পারা যাবে তাদের।

যদিও স্বর্গের দ্বার চিরতরে বন্ধ আমাদের কাছে এবং স্বর্গের সার্বভৌম অধিপতি। আপন শক্তিতে অধিষ্ঠিত আছেন নিরাপদে, তথাপি সেই বিরাট জগৎ হয়ত দুরধিগম্য নয় আমাদের কাছে। সে জগৎ স্বর্গরাজ্যের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এবং তা হতে তার অধিবাসীরা বঞ্চিত। সে জগৎ যদি আমরা অকস্মাৎ আক্রমণ করি তাহলে হয়ত আমাদের কিছু সুবিধা হতে পারে।

হয় আমরা সে জগৎকে নারকীয় অগ্নিকাণ্ডের দ্বারা বিধ্বস্ত করব সম্পূর্ণরূপে, আমরা যেমন বিতাড়িত হয়েছি স্বর্গরাজ্য হতে তেমনি মানবজাতিকেও বিতাড়িত করব তাদের জগৎ থেকে, অথবা যদি বিতাড়িত না করি তাহলে তাদের বশীভূত করে দলভুক্ত করব আমাদের যাতে ঈশ্বর নিজেই শত্রু হয়ে দাঁড়ায় তার সৃষ্ট প্রিয় মানবজাতির উপর এবং নিজের সৃষ্টিকে নিজেই নস্যাৎ করতে বাধ্য হয়।

সাধারণ প্রতিশোধগ্রহণ থেকে এ পথ অনেক ভাল। এতে আমাদের আনন্দ বর্ধিত হবে আর ঈশ্বরের আনন্দ ব্যাহত হবে। তার মানবসন্তানরা তাদের বাস্তু থেকে বিচ্যুত হয়ে আমাদের দলে যোগদান করতে বাধ্য হবে এবং তখন তারা সব সুখ হারিয়ে তাদের স্রষ্টাকে অভিশাপ দেবে। এখন আলোচনা করে দেখ, এই পথ অনুসরণের যোগ্য কিনা, অথবা এখানে অন্ধকারে বসে বসে স্বরাজ্য স্থাপনের ব্যর্থ পরিকল্পনা খাড়া করে চল।

এইভাবে বীলজীবাব তার শয়তানী পরামর্শ দান করল।

এই পরিকল্পনা শয়তানরাজ স্বয়ং খাড়া করে এক গভীর ঘৃণার বশবর্তী হয়ে মানবজাতিকে উচ্ছেদ করে মর্ত্য ও নরককে এক করে মিশিয়ে দিতে চায় এবং পরম স্রষ্টাকে অপমানিত করে তার গৌরবকে খর্ব করতে চায়।

কিন্তু তাদের এই ঘৃণা আর বিদ্বেষ সত্ত্বেও ঈশ্বরের গৌরব বেড়ে যেতে থাকে।

এদিকে বীলজীবাবের দুঃসাহসিক পরিকল্পনার কথা শুনে নরকের সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল। সে আনন্দের উজ্জ্বলতা এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গর মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাদের চোখে। তারা পূর্ণ সমর্থন জানাল এ পরিকল্পনাকে।

বীলজীবাব তখন আবার বলতে লাগল, তোমরা ঠিকই রায় দিয়ে এক দীর্ঘ বিতর্কের অবসান ঘটালে, এক বিরাট সমস্যার সমাধান করলে। একমাত্র এই পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণই আমাদের দুর্ভাগ্য সত্ত্বেও এই গভীর নরকগহ্বর হতে আমাদের উত্তোলিত করে আমাদের পুরাতন বাসস্থানের নিকটে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে হয়ত আমরা নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে উপযুক্ত সুযোগ বুঝে এক সামরিক অভিযানের দ্বারা স্বর্গলোকে পুনরায় প্রবেশ করব। আমরা স্বর্গের নিকটবর্তী এমন এক ভালো জায়গায় বসতি স্থাপন করব যে জায়গা স্বর্গের উজ্জ্বল আলোর দ্বারা আলোকিত, যে জায়গা নরকপ্রদেশের এই অন্ধকার হতে মুক্ত। সেখানকার শীতল বাতাস এই নরকাগ্নি দ্বারা দগ্ধ আমাদের দেহের ক্ষতগুলিকে শান্তির প্রলেপ দিয়ে সারিয়ে তুলবে।

কিন্তু সেই নতুন জগতের সন্ধানে কাকে আমরা পাঠাব? কাকে আমরা এ কাজের যোগ্য হিসাবে মনোনীত করব? কে আমাদের মধ্যে পায়ে হেঁটে পথ খুঁজে অথবা অক্লান্ত উদ্ধত পাখায় ভর করে আকাশপথে উড়ে যাবে সেই সুখের রাজ্যে? কার এমন শক্তি আছে যে শক্তির দ্বারা কৌশলে দেবদূতদের কঠোর প্রহরা এড়িয়ে গন্তব্যস্থলে উপনীত হতে পারবে? এজন্য তার চাই সার্বিক পর্যবেক্ষণশক্তি। আমাদের নির্বাচনও যেন ত্রুটিহীন হয়। কারণ যে ব্যক্তিকে আমরা পাঠাব তারই উপর নির্ভর করছে আমাদের পরিকল্পনার সকল গুরুত্ব এবং শেষ আশার সাফল্য।

এই কথা বলে বসে পড়ল বীলজীবাব। এরপর কে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থন করে অথবা প্রতিবাদ করে তা দেখার জন্য এক প্রত্যাশা ও উদ্বেগের আবেগ ফুটে উঠেছিল তার চোখে। তার প্রস্তাবিত তৃতীয় জগতের সন্ধানে, এক বিপজ্জনক যাত্রায় বার হতে কেউ এগিয়ে আসে কিনা তা দেখতে চাইছিল সে।

কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়াল না। সকলেই নীরব নির্বাক হয়ে বসে রইল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপদের কথা গভীরভাবে ভাবতে লাগল সবাই। প্রত্যেকেই বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যেকের চোখে তার আপন আপন আশঙ্কার প্রতিফলন দেখল।

যে সব বীরেরা কিছুক্ষণ আগে স্বর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছিল তাদের কেউ এগিয়ে এসে সাহসের সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর যাত্রা শুরু করতে চাইল না।

অবশেষে যার গৌরব ছিল সকলের ঊর্ধ্বে, এক রাজকীয় গর্বের বশবর্তী হয়ে যে নিজেকে সবচেয়ে যোগ্য বলে মনে করত সেই শয়তানরাজ অবিচলিতভাবে বলতে লাগল,

হে স্বর্গের সন্তানগণ, তোমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই যৌন হয়ে থাকলেও ভীত হয়ে পড়নি তোমরা। যে পথ এই নরকপ্রদেশ হতে আলোকের দিকে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে পথ দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য। সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখাসমন্বিত বিশাল অগ্নিকুণ্ড আমাদের কারাগারটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এখান থেকে বার হবার সব পথ রুদ্ধ। যদি কেউ জ্বলন্ত অগ্নিপূর্ণ এই কারাগার অতিক্রম করতে পারে তাহলেই সে জনপ্রাণীহীন ভীতিপ্রদ এক গভীর অন্ধকারের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে নিমজ্জিত হবে। সেই অন্ধকারের রাজ্য থেকে সে যদি কোনরকমে একবার কোন এক অজানা জগতে প্রবেশ করতে পারে তাহলে সে এমন কি বিপদের সম্মুখীন হবে যা সে অতিক্রম করতে পারবে না? কিন্তু এই রাজসিংহাসন, সার্বভৌম শক্তি, ঐশ্বর্য ও অস্ত্রসম্ভারের অধিকারী হয়েও আমি যদি এই বিপদ ও শ্রমসংকুল যাত্রাপথে অগ্রসর না হই তাহলে বৃথাই আমাদের এই ক্ষমতা ও মর্যাদালাভ। যে দুঃসাহসিক কর্মের মধ্যে বিপদ এবং সম্মান দুইই আছে সে কর্মসম্পাদনে যদি আমি সচেষ্ট না হই তাহলে কেন আমি এই রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছি? কেন আমি তাহলে এই সিংহাসন ত্যাগ করছি না?

আমাদের ঊর্ধ্বে যে স্বর্গের অধিপতি হয়ে বসে আছে তাকে তো আরও কত বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। হে স্বর্গত্রাস শক্তিশালী বীরগণ, তোমরা অধঃপতিত হলেও শক্তিহীন নও। আমি যখন দূরে গিয়ে সর্বগ্রাসী এক বিশালব্যাপ্ত অন্ধকারের মধ্যে আমাদের সকলের জন্য মুক্তির সন্ধানে ব্যাপৃত থাকব তখন প্রতিকারের আশা তোমাদের এই দুঃসহ আবাসভূমিটিকে সহনীয় ও তোমাদের নরকযন্ত্রণাকে কিছুটা প্রশমিত করে তুললেও আমাদের সদাজাগ্রত শত্রুর প্রতি তোমাদের কড়া দৃষ্টির প্রহরাকে যেন কিছুমাত্র শিথিল করো না। আমার এই যাত্রায় আর কাউকে সঙ্গী হতে হবে না।

এই কথা বলে শয়তানরাজ কারো কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়াল। পাছে তার কথা শুনে উপস্থিত বীরদের মধ্যে কেউ তার যাত্রাপথের সঙ্গী হবার জন্য এগিয়ে আসে তার জন্য আগে হতেই সে সে-পথ বন্ধ করে দিল। এক বিপুল পরিমাণ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে যে বিরাট খ্যাতি ও গৌরব সে অর্জন করতে চলেছে, সে খ্যাতি ও গৌরবের অংশীদার হবার জন্য কেউ যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে তার জন্য আগে হতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করল সে।

কিন্তু উপস্থিত বীরদের কেউ কোন কথা বলতে সাহস পেল না। দুর্গম যাত্রাপথের ভয়াবহতার থেকে শয়তানরাজের এই নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত কণ্ঠস্বর আরও ভয়াবহ মনে হলো তাদের কাছে। বীরেরা সকলেই নীরবে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দূরাগত বজ্রধ্বনির মত এক শব্দ উত্থিত হলো। তারা নত হয়ে ভয়ে ভয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করল তাদের রাজাকে। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক স্বর্গীয় দেবতার সম্মান তাকে দান করে তার গৌরবগান করল তারা। তাদের রাজা তাদের সকলের নিরাপত্তার জন্য নিজে কষ্ট স্বীকার করে যে বিপদসংকুল পথে যাত্রা করছে তার জন্য তার গুণগান করতেও ভুলল না। কারণ এই অভিশপ্ত অধঃপতিত আত্মারা সব গুণ হারায়নি। মর্ত্যের অনেক উচ্চাভিলাষী অহঙ্কারী ব্যক্তি অহঙ্কারে মত্ত হয়ে শুধু আপন কৃতিত্বের বড়াই করে চলে, অপরের গুণ বা যোগ্যতাকে স্বীকার করতে চায় না।

এইভাবে তাদের অতুলনীয় সর্বাধিনায়কের গুণগান ও আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে তাদের সকল সংশয়পূর্ণ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটল। পর্বতের শিখরদেশ হতে সমুথিত ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা যখন নীল আকাশকে আচ্ছন্ন করে তোলে ধীরে ধীরে, যখন দিন শেষের তুষার ও বৃষ্টিসিক্ত প্রান্তরের ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে হিমশীতল বাতাস গর্জন করে বেড়ায় তখন যদি সহসা শেষ সূর্যরশ্মি ঝরে পড়ে সে প্রান্তরকে আলোকিত করে তোলে, তাহলে যেমন নীরব হয়ে যাওয়া পাখিরা আবার গান শুরু করে, গৃহাভিমুখী পশুর পাল আনন্দে চিৎকার করতে থাকে এবং পশুপাখির মিলিত কণ্ঠস্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে পর্বত ও উপত্যকাদি মেনি এক উল্লসিত কলগুঞ্জনে ফেটে পড়ল সেই নরকনিবাসী শয়তানরা।

হায় মানুষ, তোমরা কত লজ্জার বস্তু! অভিশপ্ত শয়তানও শয়তানের সঙ্গে এক গভীর ঐক্যে আবদ্ধ হয়, কিন্তু মানুষ যুক্তিবাদী জীব হলেও ঐক্যবদ্ধ বা একমত হতে পারে না পরস্পরের সঙ্গে। যদিও তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং শান্তিলাভের আশ্বাস পেয়েছে ঈশ্বরের কাছ থেকে তথাপি তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, হিংসা, শত্রুতা ও যুদ্ধবিগ্রহ করে দিন কাটায়। কিন্তু তারা জানে না তাদের নরকের শত্রুরা তাদের অলক্ষ্যে অগোচরে তাদের ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছে দিনরাত। তা যদি তারা জানত তাহলে হয়ত তারা ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হত।

এইভাবে স্টাইজিয়াস্থিত নরকের সভার অবসান হলো। সমস্ত বীরেরা তাদের মুকুটমণি নরকের সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল সভাস্থল থেকে। এই স্বর্গদ্রোহী নরকসম্রাট ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যে ঈশ্বরেরই সমতুল। উজ্জ্বল অস্ত্রসম্ভার হাতে বীর সৈন্যরূপী অধঃপতিত দেবদূতেরা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর জয়ঢাক বাজিয়ে সভার ফল রাজকীয় ঘোষণা হিসাবে ঘোষণা করল। বাদ্যসহযোগে সেই ঘোষণার কর্ণবিদারক শব্দ বিশাল নরকগহ্বরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

এইভাবে মনের দিক থেকে কিছুটা শান্ত হয়ে ও এক অর্থহীন উদ্ধত আশায় উদ্দীপিত হয়ে তারা সকলে আপন পথে চলে গেল। আপন আপন ইচ্ছানুসারে এক একটি জায়গায় বসে যত সব দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের প্রধান ফিরে না আসা পর্যন্ত এক স্তব্ধ প্রতীক্ষায় প্রহর গণনা করতে থাকবে তারা।

কিন্তু নিজেদের শোচনীয় দুরবস্থার কথা ভেবে এক জায়গায় বিশ্রাম করতে পারল না তারা। দলবদ্ধভাবে ভয়ে কম্পমান কলেবরে, ক্রোধে বিঘূর্ণিত চোখ নিয়ে ম্লান মুখে বহু তুষারাচ্ছন্ন হিমশীতল পর্বত ও উত্তপ্ত উপত্যকা পার হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা।

তারা দেখল ঈশ্বরের দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়ে যে নরকপ্রদেশে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, সে নরকপ্রদেশ স্বর্গের তুলনায় বড় হীন এবং বসবাসের অযোগ্য।

সে জগৎ মৃত্যুর রাজ্য। সেখানে জীবন্ত মৃত্যু এক অপরিহার্য ভয়াবহতায় সতত বিরাজ করে সর্বত্র। সেখানে প্রকৃতিদৃষ্ট অনেক অতিকায় দানবাকৃতি ভয়ঙ্কর জীবজন্তু মৃত্যুর দূতরূপে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে।

এদিকে তখন ঈশ্বরদ্রোহী শয়তানরাজ পাখা মেলে ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে নরকপ্রদেশের সীমানা অতিক্রম করার জন্য নরকদ্বারের দিকে কখনো বাঁ দিকে কখনো ডান দিকে উড়ে চলেছে।

ঊর্ধ্বে উৎক্রমণ করতে করতে এক দুর্ভেদ্য ছাদের কাছে এসে পড়ল শয়তানরাজ। দেখল আর সে উপরে উঠতে পারবে না। সে ছাদ ভেদ করে তার বাইরে যেতে পারবে না। তাকে নরকপ্রদেশের সীমানা পার হতে হলে নরকদ্বারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

অবশেষে নরকদ্বারের কাছে এসে উপনীত হলো সে। দেখল তিনটি রুদ্ধ দরজা দ্বারা সে দ্বারদেশ-সুরক্ষিত। একটি দরজা পিতলের এবং একটি কঠিন পাথরের দ্বারা নির্মিত। চক্রাকার অগ্নিকুণ্ডের দ্বারা পরিবৃত সে দ্বারদেশ সে অগ্নিকুণ্ড জ্বলন্ত হলেও কিছুই দন্ধ হচ্ছে না তার দ্বারা।

সে আরও দেখল সেই দ্বারদেশের দুইদিকে দুজন ভয়ঙ্কর আকৃতির প্রহরী রয়েছে। একজন প্রহরীর কটিদেশ থেকে উপর পর্যন্ত সুন্দরী নারীমূর্তির আকৃতি, কিন্তু নিচের দিকটি সম্পূর্ণ বিষধর সাপের মত। যার দংশনমাত্রই মৃত্যু অনিবার্য। তার কটিদেশে ছিল এক নারকীয় কুকুরের মুখ। সে মুখ থেকে সব সময় ভয়ঙ্কর ঘেউ ঘেউ আওয়াজ বার হচ্ছিল।

অদ্ভুতদর্শন বিকটাকৃতি এই প্রহরীর থেকে সমুদ্ররাক্ষসী স্কাইল্লা কম ভয়ঙ্করী। নিয়ত শিশুর রক্তগন্ধবিশিষ্ট ল্যাপল্যান্ডের যে সব ডাইনিরা উজ্জ্বল চাঁদকে গ্রাস করে তারাও এর থেকে কম ঘৃণ্য ও কম জঘন্য।

অন্য প্রহরীটির মুখ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুই চেনা যাচ্ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল রাত্রির অন্ধকারের মত ঘনকৃষ্ণ এক করাল ছায়ামূর্তি। শয়তানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তি তার দিকে দর্পভরে বেগে ধাবিত হলো। তার পদভরে কম্পিত হয়ে উঠল সমগ্র নরকপ্রদেশ।

অপরাজেয় শয়তানরাজ সেই ছায়ামূর্তিকে দেখে ভয় পেল না বিন্দুমাত্র। সে ঘৃণাভরে ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে নির্ভীকভাবে বলতে লাগল, হে ঘৃণ্য আকৃতিবিশিষ্ট জীব, কে তুমি? কোথা হতে এসেছ? কেন তুমি এমন ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে এসে আমার গতিপথ রুদ্ধ করছ? আমি এই নরকদ্বার অতিক্রম করতে চাই। এ বিষয়ে আমি তোমার অনুমতির অপেক্ষা করি না। তুমি নরকজাত হয়ে স্বর্গের সন্তানের সঙ্গে বিবাদ করতে এস না।

তখন সেই ছায়ামূর্তি সরোষে বলল, তুমিই কি সেই বিশ্বাসঘাতক দেবদূত যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দর্পিত বিদ্রোহের দ্বারা প্রথম স্বর্গের শান্তি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে তৃতীয় জগৎবাসী স্বর্গের মানবসন্তানদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করো? আর এই অপরাধের জন্য তুমি ও তোমার দলের শয়তানরা ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে এই নরপ্রদেশে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় অশেষ দুঃখ ও যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছ। এক অভিশপ্ত ঘৃণ্য জীব হয়ে তুমি নিজেকে স্বর্গজাত সন্তান হিসাবে বড়াই করছ? যে আমি নরকপ্রদেশের বৈধ রাজা ও রক্ষক তাকে অমান্য ও ঘৃণা করে তুমি আবার নতুন করে তোমার প্রভু ও রাজাকে রুষ্ট করে তুলছ? যাও, যেমন শাস্তি ভোগ করছিলে তেমনি নীরবে শাস্তি ভোগ করগে। তা না হলে আমি বৃশ্চিক দংশনের মত জ্বালাময় চাবুক হাতে তুমি যেখানে যাবে আমি তোমাকে অনুসরণ করে যাব। হে ব্যর্থ পলাতক, অবিলম্বে চলে যাও এখান থেকে। তা যদি না যাও তাহলে তোমাকে ধরে এমনভাবে আঘাত করব যাতে অননুভূতপূর্ব যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে তোমায়।

এই কথা বলতে বলতে সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি তার আকারটাকে দশগুণ বর্ধিত করল। আগের থেকে আরও অনেক বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠল সে।

অন্যদিকে এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে এক জ্বলন্ত ধূমকেতুর মত নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ।

মেরুপ্রদেশের আকাশে জ্বলতে থাকা যে ধূমকেতুর মাথার ভয়ঙ্কর কেশরাশি থেকে মহামারী, মড়ক আর যুদ্ধের বিভীষিকা ঝরে পড়ে সেই ধূমকেতু অথবা আকাশে যুদ্ধরত দুটি বজ্রগর্ভ মেঘের মত তাদের দুজনকে দেখাচ্ছিল তখন। কুটিকুটিল রোষকশায়িত লোচনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা সামনাসামনি।– তাদের সেই ঐকুটিতে আরো বেড়ে গেল নরকের অন্ধকার। তাদের দুজনেরই মনে হলো তারা এমন ভয়ঙ্কর শত্রুর সম্মুখীন কখনো হয়নি জীবনে। তাদের দর্পিত পদভরে স্পর্ধিত আস্ফালনে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়ে উঠেছিল নরকের সেই দ্বারদেশ।

এমন সময় সেই অর্ধনারী ও অর্ধনাগিনী অদ্ভুতদর্শনা মূর্তিটি ছুটে এসে দাঁড়াল তাদের মাঝখানে। সে শয়তানকে সম্বোধন করে বলল, হে পিতা, কেন তুমি তোমার একমাত্র পুত্রকে আঘাত করার জন্য হস্ত উত্তোলন করেছ? হে পুত্র, কোন্ সে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তুমি তোমার পিতার উপর এমন মারাত্মক আঘাত হানতে চলেছ? কিন্তু জান কি কার জন্য একাজ করছ তুমি? তুমি তারই জন্য এই সব করছ যে স্বর্গলোকে বসে থেকে তোমাকে উপহাস করে চলে, যার বিধানে তুমি নরকের দ্বারী হয়ে আছ এবং যে তোমাকে নিয়ে তার খুশিমত যত সব হীন কাজ করিয়ে নেয়। যার রোষ একদিন তোমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে।

নরকের আবর্জনার মত ঝরে পড়া তার কথাগুলো সব বলা শেষ হলে শয়তানরাজ তাকে বলতে লাগল, তোমার চিৎকার এবং কথা এমনই অদ্ভুত যে আমি প্রতিনিবৃত্ত না হয়ে পারলাম না। তোমাকে দেখিয়ে দিতে পারলাম না আমি কি চাই।

কিন্তু আগে তোমার পরিচয় জানতে হবে। বল, কে তুমি এবং কেনই বা তুমি আমাকে তোমার পিতা আর ঐ প্রহরীকে আমার সন্তান বললে? তোমাকে আমি চিনি না। তোমার মত এমন ঘৃণ্য জীব কখনো দেখিনি আমি।

তখন সেই নারীনাগিনী দ্বারপালিকা বলল, তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ? তোমার চোখে কি আমি এতই ঘৃণ্য? অথচ একদিন স্বর্গের রাজসভায় এবং তোমার ও তোমাদের মত যে সব দেবদূত স্বর্গের রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের সকলের চোখে আমি ছিলাম সুন্দরী। তারপর অকস্মাৎ একদিন দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যে পতিত হয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাও তুমি। তোমার মাথা ঘুরতে থাকে। যখন অন্ধকারে জ্বলন্ত আগুনের মাঝে পড়ে যাও তখন বাঁ দিকে তোমারই মাথা থেকে স্বর্গীয় দ্যুতিসম্পন্ন এক দেবীমূর্তি বেরিয়ে আসে। আমি হলাম সেই দেবী।

তা দেখে স্বর্গের সব দেবদূতেরা বিস্মিত ও ভীত হয়ে পিছিয়ে যায়। আমাকে তখন পাপ নামে অভিহিত করতে থাকে। আমার মধ্যে তোমারই অবিকল প্রতিরূপ দেখে তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাও। গোপনে আমার সঙ্গে দেহসংসর্গ করতে থাক তুমি এবং তার ফলে গর্ভধারণ করি আমি।

তারপর বিদ্রোহীদের সঙ্গে ঈশ্বরের যুদ্ধ বাধে। আমাদের পরম শত্রু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করেন। বিদ্রোহী দেবদূতেরা সকলে বিতাড়িত হয় স্বর্গরাজ্য থেকে। স্বর্গলোক হতে তাদের সঙ্গে আমিও এই নরককুণ্ডের মধ্যে সরাসরি পতিত হই। সেই সময় নগরদ্বার রক্ষার জন্য একটা চাবি দেওয়া হয় আমার হাতে।

তালাবন্ধ এই দ্বার আমি খুলে না দিলে কেউ নরকপ্রদেশ হতে মুক্ত হতে পারবে না। আমি বিষাদগ্রস্ত ও চিন্তান্বিত অবস্থায় একাকী বসে থাকতাম এখানে। কিন্তু। এখন আর দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারিনি কারণ তোমার ঔরসজাত সন্তান বড় হয়ে ওঠে আমার গর্ভে। আমার পেটের ভিতর নড়াচড়া করতে থাকে ভয়ঙ্করভাবে।

অবশেষে তোমার যে সন্তানকে তুমি তোমার সামনে দেখেছ সে সন্তান একদিন আমার পেটের নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে আমাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে বেরিয়ে আসে আমার গর্ভ থেকে। এই জন্য আমার দেহটা বিকৃত হয়ে যায় সেই থেকে। জন্মমুহূর্ত হতেই সে আমার শত্রু হয়ে ওঠে। মাতৃদ্রোহী এই সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রসহকারে আমাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়।

আমি ‘মৃত্যু মৃত্যু’ বলে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যাই। আমার সেই চিৎকার ও আর্তনাদে সমগ্র নরকপ্রদেশ কম্পিত হয়ে ওঠে এবং আমার কথাটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আমি যতই প্রাণভয়ে পালাতে থাকি সে ততই আমায় অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু আমি দেখলাম তার মধ্যে ক্রোধের আগুনের পরিবর্তে ছিল জারজ কামনার আগুন।

বিদ্যুৎবেগে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এসে ধরে ফেলল সে আমায়। আমি গর্ভধারিণী জননী হওয়া সত্ত্বেও সে আমাকে জোর করে ধরে বলাৎকার করল আমার উপর। সেই পাশবিক বলাৎকারের ফলে আমি আবার গর্ভধারণ করি এবং তার এক ঘণ্টার মধ্যে এই বিকটাকার জীবগুলি আমার সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। আমার চারপাশে চিরক্রন্দনরত যে জীবগুলি দেখছ তারাই হলো সেই সন্তান।

তারা বাইরে বিচরণ করতে করতে প্রায়ই আমার গর্ভের মধ্যে প্রবেশ করে আঁচড় কাটতে থাকে। এইভাবে আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে আবার তারা বেরিয়ে আসে গর্ভ থেকে এবং এক একটি জ্বলন্ত বিভীষিকার মত আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ফলে আমি একমূহুর্তও কখনো বিশ্রাম বা শান্তি পাই না।

আমার বিপরীত দিকে আমার পুত্র করাল মৃত্যু বসে আছে। সে-ই অন্য সব সন্তানদের উত্তেজিত করে আমার বিরুদ্ধে। কোন খাদ্য না পেয়ে আমাকেই একদিন গ্রাস করবে। কিন্তু সে জানে নিয়তির বিধানে আমাকে গ্রাস করে সে আমার মৃত্যুর কারণ হলে তারও মৃত্যু ঘটবে সঙ্গে সঙ্গে। তারও জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে তখন।

কিন্তু হে আমার পিতা, আমি তোমাকে আগে হতে সাবধান করে দিচ্ছি, এর মারাত্মক শরটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করো। তোমার অস্ত্র যত তীক্ষ্ণ ও ভারী হোক না কেন তা তোমাকে অজেয় করে তুলবে ওর কাছে, এই মিথ্যা আশা পরিত্যাগ করো। কারণ একমাত্র স্বর্গের রাজা ছাড়া ওর শর কেউ প্রতিহত করতে পারবে না।

তার কথা শেষ হলে তার পিতা শয়তানরাজ উত্তর করল, হে আমার প্রিয় কন্যা, তুমি আমাকে তোমার পিতা বলে দাবি করছ! আমাদের ঐ পুত্র আমাকে আজ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে স্বর্গে অবস্থানকালে আমি একদিন তোমার সঙ্গে নর্মক্রীড়া করে কী পরিমাণ আনন্দ লাভ করেছিলাম। সেকথা আজ মনে করতেও কষ্ট হয়।

তারপর এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে আমাদের জীবনে। আমাদের পতিত হতে হয় এক গভীর দুঃখের যুগে। তবে জেনে রেখো, আমি তোমাদের শত্রুরূপে আসিনি এখানে। আমি এসেছি তোমাদের ও এই নরকপ্রদেশের স্বর্গচ্যুত সমস্ত দেবদূতদের মুক্ত করতে। আমি এসেছি তোমাদের সকলকে এই ভয়াবহ যন্ত্রণার কবল হতে মুক্ত করতে।

তাদের সকলের পক্ষ থেকে আমি একা সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এক বিশাল শূন্যতা অতিক্রম করে স্বর্গ ও এই পাতালপ্রদেশের মাঝখানে সৃষ্ট এক জগতের সন্ধানে চলেছি যেখানে মানবজাতি নামে এক জীব বাস করে, যেখানে আমরা নূতন বাসস্থান লাভ করতে পারব। আমাদের এক গোপন পরিকল্পনা অনুসারে সেই জগতের কথা জানবার জন্য আমি যাচ্ছি সেখানে। একবার জানা হয়ে গেলেই ফিরে আসব আমি। সেখানে আমি তোমাদের নিয়ে যাব। সেখানে তোমরা স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারবে এবং অদৃশ্য পাখা মেলে ইতস্তত উড়ে বেড়াতে পারবে সুগন্ধি বাতাসে। সেখানে অনেক শিকার করতে পারবে তোমরা।

শয়তানরাজ তার কথা বলা শেষ করলেই নরকদ্বারের এই প্রহরীরা সন্তুষ্ট হলো তার কথায়। মৃত্যু নামে তাদের সেই ভয়ঙ্কর সন্তানটা এক নূতন জগতে তার ক্ষুধা পরিতৃপ্ত হবে ভেবে এক ভয়াবহ হাসি হেসে সমর্থন জানাল খুশি হয়ে। তার মাও। খুশি হয়ে বলল :

স্বর্গের সর্বশক্তিমান রাজার আদেশে এই নরকের চাবি আমি রেখেছি, এই দ্বার আমি পাহারা দিচ্ছি। এই দ্বার খোলা নিষিদ্ধ। আমার পুত্র সাক্ষাৎ মৃত্যু তার অতুলনীয় শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে নির্ভীকভাবে যাতে এই দ্বারপথ দিয়ে কেউ ঢুকতে বা বেরোতে না পারে। যে যতবড় শক্তিধরই হোক না কেন ওর সঙ্গে পেরে উঠবে না। আমি স্বর্গে জাত ও স্বর্গের অধিবাসী হলেও সে আমাকে ঘৃণাভরে জোর করে এই নরকান্ধকারে এক চিরসখী যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে, যেখানে আমারই সন্তানরা আমার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে অহোরহ তার আদেশ কেন মানব আমি? তুমিই আমার পিতা, তুমিই আমাকে এ জীবন দান করেছ, আমি তোমারই আদেশ পালন করব। তুমি আমাকে এক আলোকিত সুখের জগতে নিয়ে যাবে যেখানে আমি তোমার কন্যা ও প্রিয়তমারূপে তোমারই পাশে থেকে সুখে বাস করতে পারব চিরকাল ধরে। সে জগতে তোমার সঙ্গে আমিও আধিপত্য বিস্তার করব।

এই বলে সে তার হাতের চাবি দিয়ে তালা খুলে নরকের দরজার বিশাল লৌহকপাটগুলো খুলে দিল। সেই কপাটগুলো খোলার সময় বজ্রগর্জনের শব্দ হলো এবং তাতে সমস্ত নরকপ্রদেশ কেঁপে উঠল।

সেই দরজা খুলে দিল সে। কিন্তু তা বন্ধ করবার শক্তি ছিল না তার। উন্মুক্ত রয়ে গেল সেই বিশাল দরজা যাতে রথ ও অশ্বসহ এক বিশাল বাহিনী যাতায়াত করতে পারে। ধূম আর অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছিল সেই দ্বারপথ দিয়ে।

তারা সেই উন্মুক্ত দ্বারপথ দিয়ে দেখল তাদের সামনে এক অন্ধকার মহাসমুদ্র অন্তহীন বিশালতায় প্রসারিত। সে মহাসমুদ্রের কোন দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কোন স্থান-কাল নেই। সেখানে বিরাজ করে শুধু অনন্ত রাত্রির গভীর অন্ধকার আর বিশৃঙ্খলা, বিক্ষোভ আর সীমাহীন অরাজকতা। সেখানে উত্তাপ, শীতলতা, আদ্রতা আর শুষ্কতা–এই চারটি দুর্ধর্ষ শক্তি প্রভুত্বলাভের জন্য এক অপরিসীম দ্বন্দ্বে চিরপ্রমত্ত। তাদের সঙ্গে আছে তাদের আপন বংশজাত অসংখ্য অণু পরিমাণ জ্বণ।

কখনো বাতাস, কখনো বিক্ষোভ, কখনো খেয়ালী নিয়তি বা দৈব আধিপত্য করে অন্যদের উপর। সে সমুদ্রের কোন কূল নেই। শেষ নেই, সীমা নেই, আলো নেই, অগ্নি নেই। সেই চির অন্ধকার সমুদ্রই প্রকৃতির গর্ভদেশ এবং সমাধিগহ্বর। সেই অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে পরস্পরবিরুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তিগুলি চিরকাল ধরে সংগ্রাম করে চলেছে পরস্পরের সঙ্গে।

নরকদ্বার হতে নির্গত হয়ে নরকপ্রান্তের সেই অন্ধকারাবৃত সমুদ্রকূলের উপর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সমুদ্র অতিক্রম করার কথা বিহ্বল হয়ে ভাবতে লাগল শয়তানরাজ। প্রবল ঝড় আয় সমুদ্রতরহের প্রমত্ত গর্জনের সঙ্গে আপীড়িত হচ্ছিল তার কর্ণকুহর।

অবশেষে নৌকার পালের মতো চওড়া পাখাগুলো মেলে মাটি থেকে ধূমরাশি ভেদ করে শয়তানরাজ লাফ দিল শূন্যে। সেই অন্ধকার শূন্যতার মধ্য দিয়ে আকাশপথে সমুদ্র, জলাশয়, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে লাগল সে। কিন্তু চারদিক থেকে আসা প্রকৃতিজগতের নানা বিক্ষোভ ও প্রচণ্ড শব্দে অভিভূত হয়ে পড়ল সে।

অবশেষে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে প্রকৃতিকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, হে প্রাকৃতিক শক্তিবৃন্দ, হে আদিম রাত্রি এবং বিশৃঙ্খলার অপদেবতাগণ, গুপ্তচর হয়ে তোমাদের গোপন কর্ম জানতে বা কোনরূপে বিব্রত করতে আসিনি আমি। আমি এই শূন্য। অন্তহীন অন্ধকারে আবৃত তোমাদের রাজ্যের মধ্যে এমন এক পথের সন্ধান করছি যে পথ আমাকে নিয়ে যাবে আলোকিত এক নতুন জগতে। তোমরা আমায় পথ দেখিয়ে দাও। আমায় সঠিক পথ বলে দাও।

তখন এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শয়তানকে বলল, হে বিদেশী আগন্তুক, আমি তোমাকে চিনি, আমি জানি তুমি কে। তুমি হচ্ছ অধঃপতিত দেবদূতদের শক্তিশালী নেতা। স্বর্গের রাজা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছ তুমি। আমাদের এই রাজ্যের নিম্নে তোমাদের বর্তমান বাসস্থান অন্ধকার নরকপ্রদেশ বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের রাজ্যের উর্বদেশে স্বর্গ ও পাতালের মাঝখানে সম্প্রতি এক নূতন জগতের সৃষ্টি হয়েছে। সে জগৎ একটি সোনার শিকল দিয়ে স্বর্গের সেই দিকের সঙ্গে বাঁধা আছে যে দিক থেকে তোমরা নিক্ষিপ্ত হয়েছ। সে জগৎ যদি তোমার গন্তব্যস্থল হয় তাহলে তা বেশিদূর নয় এখান থেকে। যাও, বেগে ধাবিত হও সেইদিকে।

এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আর সেখানে না থেমে আবার যাত্রা শুরু করল শয়তানরাজ। তার যাত্রাপথের আর বেশি বাকি নেই। অতি কষ্টে অকূল সমুদ্র পার হয়ে তার কুলের কাছে এসে পড়েছে একথা ভেবে খুশি হয়ে নূতন উদ্যমে পাখা মেলে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে লাগল সে। আরও বাড়িয়ে দিল তার উড়ে চলার গতিবেগ এক জ্বলন্ত আগুনের পিরামিড যেমন ঝড়-ঝঞ্জার মধ্য দিয়ে অনন্তবিস্তৃত আকাশে উড়ে চলে, জেসনের গ্রীকজাহাজ যেমন একদিন দ্রুতবেগে ছুটে চলে অথবা গ্রীকবীর ইউলিসিসের জাহাজ যেমন একদিন চ্যামিবডিসের ঘূর্ণনবর্ত এড়িয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায় তেমনি দ্রুতবেগে পাখা মেলে উড়ে চলতে লাগল শয়তানরাজ।

ঈশ্বরের বিধানে অন্ধকার শূন্যতার মধ্য দিয়ে পাপ ও মৃত্যু শয়তানের অনুসরণ করে চলতে থাকায় পথ অতিক্রম করতে দারুণ কষ্ট হচ্ছিল তার।

এমন সময় সহসা সোনায় শিকলবাঁধা সেই নূতন জগৎটা পরিদৃশ্য হয়ে উঠল শয়তানের চোখের সামনে। আকাশে সেটা নক্ষত্রের থেকে ছোট চন্দ্রের পাশে একটা গ্রহের মত দেখাচ্ছিল।

সেই জগতের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল শয়তানরাজ।

ঈশ্বর স্বর্গের সিংহাসনে সমাসীন অবস্থায় দেখলেন, শয়তান তাঁর নবনির্মিত পৃথিবীর দিকে উড়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁর ডান পাশে বসে থাকা তাঁর মানসপুত্রকে তা দেখিয়ে বললেন, শয়তান মানবজাতির মনকে কলুষিত করে তাদের বশীভূত করে তুলবে। তিনি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কথা উল্লেখ করে বললেন, তিনি মানুষ সৃষ্টি করে তাকে স্বাধীন বিচারবুদ্ধি দান করেছেন যাতে সে যে কোন বাইরের প্রলোভনকে জয় করতে পারে। তবে যদি কোন কারণে মানবজাতির পন ঘটে তাহলেও তারা তার অনুগ্রহলাভে বঞ্চিত হবে না। কারণ এক্ষেত্রে যদি মানবজাতির পতন ঘটে তাহলে বুঝতে হবে তারা ঈশ্বরের প্রতি কোন হিংসা পোষণ করে না এবং এই হিংসা থেকে তাদের পতন ঘটেনি, তাদের পতন ঘটেছে শয়তানের প্ররোচনাতে।

মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের অশেষ করুণা ও অনুগ্রহের জন্য তার মানবসন্তান তার পরমপিতা ঈশ্বরের গুণগান করতে লাগলেন। কিন্তু ঈশ্বর তাকে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, মানুষ ঈশ্বরের বিধান যদি যথাযথভাবে মেনে না চলে, তার ন্যায়পরায়ণতা ও বিচারবুদ্ধির পরিচয় দিতে না পারে তাহলে সে তাঁর কোন অনুগ্রহ লাভ করতে পারবে না। মানবজাতির সবচেয়ে বড় দোষ তারা ঈশ্বরের সমকক্ষতা অর্জনের উদ্ধত উচ্চাভিলাষের দ্বারা তারা রুষ্ট করে তুলেছে ঈশ্বরকে। এই অপরাধের জন্যই অপরিহার্য মৃত্যুর দ্বারা খণ্ডিত তাদের জীবন। যদি তাদের মধ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তি সমগ্র মানবজাতির এই পাপের সমুচিত শাস্তি মাথা পেতে নেবার জন্য এগিয়ে না আসে তাহলে এই মরণশীল জীবন থেকে মহাজীবন লাভ করতে কোনদিন পারবে তারা। ঈশ্বরের সেই পুত্র বলল, মানবজাতির মুক্তির জন্য সে শাস্তিভোগ করতে রাজী আছে। ঈশ্বর মেনে নিলেন তার প্রস্তাব। তাকে ঈশ্বরপুত্র হিসাবে অবতার দান করলেন এবং স্বর্গ ও মর্ত্যের সকলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মহান করে তুললেন। তিনি দেবদূতদের তার মহত্ত্বকে স্বীকার করে তাকে বরণ করে নিতে আদেশ দিলেন। দেবদূতেরা তখন তাদের বীণা বাজিয়ে ঈশ্বর ও তাঁর পুত্রের জয়গান করতে লাগল।

ইতিমধ্যে শয়তান পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এক ফাঁকা জায়গায় এসে অবতরণ করল। ঘুরতে ঘুরতে সে এক উপত্যকায় এসে পড়ল। তারপর সে স্বর্গের দ্বারদেশে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে সে আকাশের উপরে সৌরমণ্ডলের কক্ষপথে এসে পড়ল। সেখানে সে ইউরিয়েল নামে এক দেবদূত প্রহরীর দেখা পেল। তখন সে এক নিম্নস্তরের দেবদূতের বেশ ধারণ করল। তখন সে ঈশ্বরসৃষ্ট নূতন মানবজগতের সবকিছু দেখার জন্য এক প্রবল কৌতূহল অনুভব করল।

হে পবিত্র জ্যোতি, স্বর্গের প্রথমজাত সন্তান, আমি কি তোমার মহিমা অবিকৃতভাবে প্রকাশ করতে পারি? যে ঈশ্বর এক পরম জ্যোতিস্বরূপ, সেই জ্যোতির্ময় পরম পুরুষের সঙ্গে একই সঙ্গে আপনা থেকে সৃষ্ট হয়ে অনন্তলোকে বিরাজ করছ। অনন্তকাল ধরে আদিঅন্তহীন যে পবিত্র ধারায় তুমি প্রবাহিত হয়ে চলেছ তার উৎস কোথায় তা কে জানে?

যখন সৌরমণ্ডল ও আকাশের সৃষ্টি হয়নি তখনও তুমি ছিলে। যখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও আদেশে ধীরে ধীরে পৃথিবী জেগে ওঠে এবং জল সৃষ্ট হয় তারও আগে তুমি অনন্ত মহাশূন্যে নিরাকার অবস্থায় বিরাজ করতে। উদ্ধত পাখা মেলে আমি আবার তোমাকে দর্শন করতে এসেছি।

আমি স্টাইজিয়ার নারকীয় নদী পার হয়ে অনেক অন্ধকার আকাশপথ অতিক্রম করে অনন্ত রাত্রির প্রশস্তি গাইতে গাইতে কখনো নিচের দিকে নেমে, কখনো উপরের দিকে উঠে বহু ক্লেশ সহ্য করে এখানে এসেছি। তোমার সর্বব্যাপী পরম জ্যোতি পুনরায় দর্শন করতে চাই আমি। কিন্তু সে জ্যোতি হতে নিঃসৃত কোন আলোকরশ্মি পরিদৃশ্য হয়ে উঠছে না আমার সম্মুখে। এই নৈশনিবিড় অন্ধকারের যেন শেষ নেই। কোন প্রভাতের আলো দেখছি না কোন দিকে। তবে কি ঘন কুজ্বটিকাজাল ও মেঘমালার দ্বারা সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে তোমার জ্যোতির্মালা?

তবু আমি অদম্য ও অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছি। কোন ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে অথবা আলোকোজ্জ্বল কোন পর্বতশিখরে অথবা নির্মল জলের ঝর্ণাধারা তোমার পদধৌত করে কলস্বরে প্রবাহিত হয়ে চলে আমি সেখানে চলে যাই নিশীথ অন্ধকারে।

কিন্তু মাঝে মাঝে আমি আমারই মত দুজন কবির কথা ভুলে যাই। তারা হলেন প্রাচীন থ্রেসের কবি থেমিরিস আর এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত মেওনিয়ার কবি হোমার। এঁরা দুজনেই অন্ধ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন চারণ কবি এবং গায়ক। অন্ধকার বনভূমিতে নাইটিঙ্গেল পাখি যেমন গান করে, তেমনি তারা সুমধুর স্বরে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন স্থানে।

মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু আসে, তবু আলোকোজ্জ্বল কোন দিনের মুখ দেখতে পাই না আমি। বসন্তের পুষ্পদ্যান ও গ্রীষ্মের গোলাপ কখনো চোখে পড়ে না আমার। চারণরত কোন পশুর পাল অথবা কোন মানুষের স্বর্গীয় সুষমাসমৃদ্ধ মুখ দেখতে পাই না আমি।

তার পরিবর্তে নিয়তনিবিড় মেঘমালা আর অন্তবিহীন অন্ধকার পরিবৃত করে রেখেছে আমায় সব সময়ের জন্য। আনন্দময় মানবজগৎ হতে বিচ্ছিন্ন আমি সম্পূর্ণরূপে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এক সীমাহীন শূন্যতা আর অন্ধকার ছাড়া আর কোন জগৎ ও জীবনের কথা জানা নেই আমার। প্রকৃতি জগতের কোন সুন্দর বস্তু চোখে পড়ে না আমার। আমার অন্তরলোককে উদ্ভাসিত করো যাতে আমি অপরিদৃশ্যমান সকল বস্তু অবলোকন করতে পারি। আমার মন হতে সকল অন্ধকার বিদূরিত করে আমার অন্তরের চক্ষুকে উন্মীলিত করো।

ঠিক সেই সময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি তার স্বর্গের সিংহাসন হতে নিম্নে তার দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেন তাহলে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে একনিমেষে নিরীক্ষণ করতে পারতেন। তাঁর চারপাশে তখন স্বর্গলোকের জ্যোতিষ্মন পবিত্র বস্তুগুলি ঘনবদ্ধ নক্ষত্ররাজির মত বিরাজ করছিল। তার দিকে তার ডান পাশে তার একমাত্র পুত্র প্রদীপ্ত গৌরবে বসেছিল।

মর্ত্যলোকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তিনি দেখলেন মানবজাতির আদি পিতামাতা তখন একটি সুন্দর কাননে অনাবিল অখণ্ড আনন্দ আর অতুলনীয় প্রেমের ফল পেড়ে খাচ্ছিল পরম সুখে।

এরপর তিনি নরক আর মর্ত্য আর নরকপ্রদেশের মধ্যবর্তী অন্ধকার শূন্যতার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন শয়তান ক্লান্ত পাখা মেলে পৃথিবীর প্রান্তভূমিতে দেওয়াল বেয়ে উঠে পদস্থাপনের চেষ্টা করছে। স্বর্গের সিংহাসনে বসে থেকে শয়তানকে দেখার পর তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের সব কিছু দেখতে পেলেন।

এই দেখে তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, হে আমার একমাত্র পুত্র, দেখতে পাচ্ছ আমাদের ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কি করছে শয়তান? নরকের কারাগার তাকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি, কোন সীমার শাসন সে মানেনি, তূপাকৃত শৃঙ্খল তাকে দমন করতে পারেনি, সীমাহীন অন্ধকার ও শূন্যতা, মহাসমুদ্রের অনন্ত জলরাশি তার গতিরোধ করতে পারেনি। আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এক আত্মঘাতী সংকল্পে মত্ত হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু সে জানে না এর দ্বারা কিছুই করতে পারবে না সে। তার বিদ্রোহী উদ্ধত মস্তকের উপর দ্বিগুণ পরিমাণে চাপবে শুধু শাস্তির বেদনাভার। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে সমস্ত বিধিনিষেধের বেড়াজাল অতিক্রম করে এখন সে পাখা মেলে স্বর্গলোকের কাছাকাছি আলোর মধ্যে চলে এসেছে।

সে সরাসরি যেতে চায় মানবজাতির দ্বারা অধ্যুষিত নবনির্মিত পৃথিবীতে। বলপ্রয়োগ অথবা ছলনার দ্বারা সে জাতিকে ধ্বংস করতে চাইবে সে। মানু শয়তানের আপাতমধুর ও চাককিপূর্ণ যত সব মিথ্যাকথা শুনে ভুলে যাবে। ফলে তারা ঈশ্বরের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ও ঈশ্বরের আদেশ লঙঘন করবে। এইভাবে তারা এবং তাদের বংশধরেরা অধঃপতিত হবে।

কিন্তু সে অধঃপতন ঘটবে কার দোষে? তার নিজের দোষ ছাড়া এ দোষ কার? বড় অকৃতজ্ঞ এই মানবজাতি। তাদের যা যা প্রয়োজন তা তারা সব পেয়েছে আমার কাছ থেকে। আমি তাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ দান করেছি। এই বোধের দ্বারা তারা দাঁড়াতেও পারে আবার তাদের পতনও ঘটতে পারে। কারণ ন্যায়-অন্যায় বোধের সঙ্গে তাদের ইচ্ছামত চলার স্বাধীনতাও দান করেছি। স্বর্গের দেবদুতদেরও আমি এমনি করে স্বাধীনভাবেই সৃষ্টি করেছিলাম। তাদের মধ্যে অনেকে এই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে দাঁড়িয়েছিল, আবার অনেকে সে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অধঃপতিত

তারা স্বাধীন হলেও একনিষ্ঠ আনুগত্য, স্থায়ী বিশ্বাস ও অচলা প্রেমভক্তির কি প্রমাণ কি পরিচয় তারা দান করেছে? কি প্রশংসা তারা করেছে? তাদের আনুগত্য থেকে কতখানি আনন্দ আমি লাভ করেছি? তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য খুশিমত কাজ করে গেছে। তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং যুক্তিবোধের যথেচ্ছ অপব্যবহার করে সে দুটিকে ব্যর্থতায় পরিণত করে তুলেছে তারা। এ দুটিকে নিষ্ক্রিয় করে তুলে শুধু নিজেদের প্রয়োজনের সেবা করে গেছে। আমার সেবা করেনি তারা।

এইভাবে ইচ্ছামত চলার অধিকার আমিই দান করেছিলাম এবং এইভাবে তাদের সৃষ্টি করেছিলাম যারফলে তারা তাদের পতনের জন্য তাঁদের স্রষ্টার উপরে ন্যায়সঙ্গতভাবে কোন দোষারোপ করতে পারবে না। তাদের নিয়তিকেও কোন দোষ দিতে পারবে না। পূর্বনিদিষ্ট বিধির বিধান ও তাদের ভবিষ্যৎকাল অদের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বলেই তারা বিদ্রোহ করে আমার বিরুদ্ধে। আমি যদি একথা আগে হতে জানতে পারতাম তাহলে তাদের এই ভবিষ্যৎকাল কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারত না এই বিদ্রোহের উপর। তাদের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছানুসারেই আমার অমোঘ– বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে তারা। নিজেদের কর্মদোষে ও অপরাধের জন্য নিজেদের দাসত্ব ডেকে না আনা পর্যন্ত তারা স্বাধীনই থাকবে। আমার অমোঘ অপরিবর্তনীয় বিধান অনুসারেই তারা স্বাধীনতা পায়। কিন্তু তারা নিজেদের দোষে নিজেদের পতন ডেকে আনে। তারা শয়তানের দ্বারা প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত হয়ে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। তবু তারা আমার অনুগ্রহ এবং করুণা লাভ করবে। স্বর্গ আর মর্ত্যলোকের অধিবাসীরা আমার করুণা আর ন্যায়বিচার লাভ করে ধন্য হবে। আমার গৌরব উজ্জ্বলভাবে কিরণ দান করবে স্বর্গ ও মর্ত্যলোক ব্যাও করে।

এইভাবে ঈশ্বর তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। আনন্দরূপ অমৃতের এক অক্ষয় দিব্য সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল যেন সমগ্র স্বর্গলোক। এক নূতন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল দেবদূতেরা। তার পরমপিতার এক গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তিতে দীপ্তিমান হয়ে বসেছিল তার পুত্র। অনন্ত প্রেম আর করুণার এক স্বর্গীয় দ্যুতি উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছিল তার মুখমণ্ডলে।

ঈশ্বরের পুত্র এবার বলতে লাগলেন, হে পরমপিতা, তোমার শেষ বাক্যটির জন্য স্বর্গে-মর্ত্যে ঘোষিত হবে তোমার গৌরব। বিভিন্ন স্তোত্র ও পবিত্র প্রার্থনার সঙ্গীতে ধ্বনিত হবে তোমার জয়গান। কিন্তু তোমার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তোমার প্রিয় সৃষ্ট মানবজাতি কি তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য শয়তানের ছলনা ও প্রতারণার শিকার হয়ে অধঃপতিত হবে?

হে পরমপিতা, যে তুমি সমস্ত ন্যায়বিচারের অধিকর্তা এক মূর্ত প্রতীক সেই তোমার পুত্রের এমন অবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এত সহজে কি তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে এবং তোমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে তুলবে? সে কি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তোমার মহত্ত্বকে খর্ব করে তুলবে? সে কি সমগ্র মানবজাতিকে প্রলোভিত করে তাদের সকলকে তার সঙ্গে নরকে নিয়ে যাবে? অথবা তুমি কি তোমার নিজের গৌরবজনক সৃষ্টির নিজেই এইভাবে উচ্ছেসাধন করবে?

তাঁর পুত্রের এই কথার উত্তরে পরমপিতা ও স্রষ্টা বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, আমার আত্মার আনন্দ, আমার অন্তরের অন্তর, তোমার মধ্যেই আমার জ্ঞান ও শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। তুমি আমার মনের কথাই ব্যক্ত করেছ। আমার অমোঘ বিধান এবং উদ্দেশ্য হলো এই যে, মানবজাতি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হবে না। তাদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা নয়, আমার অনুগ্রহের দ্বারাই সমস্ত বিপদ হতে উদ্ধার লাভ করবে তারা। তাদের উচ্ছল কামনা-বাসনার তাড়নায় পাপের বশবর্তী হয়ে যে শক্তি হারাবে তারা সে শক্তি আমি পুনরায় দান করবে তাদের। আমার সাহায্য লাভ করে তাদের শত্রুর সব কাণ্ড ও শয়তানিকে ব্যর্থ করে আবার যথাস্থানে দাঁড়াতে পারবে তারা। আমার কাছ থেকে অনুই ও সাহায্য লাভ করে তারা বুতে পারবে তাদের অধঃপতিত অব। কত সোশী এবং জানতে পারবে একমাত্র আমার দ্বারাই উদ্ধার লাভ করেছে তারা।

মানবজাতির মধ্যে কিছু লোককে আমার বিশেষ অনুগ্রহলাভের যোগ্য হিসাবে নির্বাচিত করেছি। তাদের স্থান হবে অ্ন্য সকলের ঊর্ধ্বে। আমার নির্বাচিত এই সব অনুগৃহীত ব্যক্তিরা ছাড়া বাকি সকলে আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সতর্ক হয়ে তাদের পাপ সম্বন্ধে সচেতন হবে। তাদেরও আমি আমার অনুগ্রহ দান করব এবং তাদের মনের সব অন্ধকার ও অজ্ঞানতা দূর করব। ফলে তাদের প্রস্তরকঠিন অন্তর মেদুরতা প্রাপ্ত হয়ে আবার আমার অনুগত হয়ে উঠবে তারা। তারা তখন অনুতপ্ত হৃদয়ে আমার প্রার্থনা করে সমস্ত পাপ স্খালন করবে।

সদিচ্ছার সঙ্গে তারা পুনরুত্থানের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করলেও তাদের সব কথা শোনার জন্য আমার কর্ণকুহর সজাগ থাকবে সতত এবং তাদের সবকিছু দেখার জন্য আমার চোখও খোলা থাকবে। আর পরিচালক হিসাবে আমি বিবেককে স্থাপন করব তাদের অন্তরে। যদি তারা সেই বিবেকের বিবেকের নির্দেশ মেনে চলে তাহলে অন্ধকারের মধ্যে আলোর সন্ধান পাবে তারা এবং অবশেষে নিরাপদ হয়ে উঠবে তাদের জীবন। কিন্তু বিবেকবুদ্ধিকে অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখলে তারা বঞ্চিত হবে আমার অনুগ্রহলাভে। তারা মুক্তির আস্বাদ লাভ করতে পারবে না। তাদের কঠিন অন্তর কঠিনতর হবে এবং তাদের অন্ধ দৃষ্টি আরও অন্ধ হবে। ফলে পতনের গভীরতর স্তরে নেমে যাবে তারা এবং আমার করুণা হতে বঞ্চিত হবে।

কিন্তু সেটাই সব নয়। মানুষ যদি বিধির বিধানকে অমান্য করে স্বর্গের পরমেশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে পাশে নিমজ্জিত হয় তাহলে তাকে সব হারাতে হবে। তাতে সমগ্র মানবজাতির ধ্বংস অনিবার্য। তাদের সকলকেই মরতে হবে যদি তাদের মধ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাদের সকলের সম্মান ও মুক্তির জন্য মৃত্যুবরণ করে ঈশ্বরকে তুষ্ট না করে। হে দেবদূতগণ বল, এমন আত্যাগ ও ঈরশ্রেয় আমি কোথায় পাব? বল, কে তোমাদের মানবজাতিকে পাপ হতে উদ্ধার করার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে এ কাজে? মরণশীল মানুষের জন্য এভাবে আত্মোৎসর্গ করে স্বর্গবাসীদের মধ্যে কে এমন বিরল মহানবতার পরিচয় দেবে?

ঈশ্বরের এই প্রশ্নে সমস্ত দেবদূতগণ এক নির্বাক নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে রইল। মানবজাতির প্রতি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কেউ এগিয়ে এসে মৃত্যুবরণ করতে চাইল না। কেউ তাদের মুক্তির জন্য এই ভয়ঙ্কর আত্মোৎসর্গে সম্মত হলো না। ফলে। মুক্তিহীন মানবজাতির ধ্বংস, মৃত্যু ও নরকভোগ অনিবার্য হয়ে উঠল।

এমন সময় পরিপূর্ণ স্বর্গীয় প্রেমের মূর্ত প্রতীক ঈশ্বরপুত্র স্বয়ং বলতে লাগলেন : হে পরমপিতা, তোমার যা কিছু বলার তা শেষ হয়েছে। মানুষ তোমার অনুগ্রহ ও করুণালাভে ধন্য হবে ঠিক, কিন্তু কি উপায়ে এই করুণা তারা লাভ করবে তা জানে না। তোমার দ্রুতগতিসম্পন্ন পক্ষবিশিষ্ট যে সব দেবদূত সকল প্রাণীর কাছে অবাধে গিয়ে সাহায্য করে বেড়ায় তারা এখন নীরব। কিন্তু মানবজাতি যদি একবার ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তারা দেবদূতদের কাছ থেকে কিভাবে সাহায্য চাইবে? এই মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য জীবনদান করার কেউ নেই।

কিন্তু কেউ না এলেও আমি আছি। আমি সমগ্র মানবজাতির উদ্ধারের জন্য জীবনদান করতে প্রস্তুত আছি। আমাকে মানুষ মনে করে তোমার সমস্ত ক্রোধের আবেগ উজার করে ঢেলে দাও আমার উপর। আমি সেই মানবজাতির মুক্তির জন্য তোমার বক্ষস্থল ও আমার গৌরবের আসন ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করব। মৃত্যুর সমস্ত রোষ হাসিমুখে সহ্য করব আমি।

কিন্তু মৃত্যুবরণ করলেও মৃত্যর অন্ধকার কারাগারে তার কঠিন শক্তির অধীনে শর্ঘকাল আবদ্ধ থাকতে হবে না আমায়। কারণ তুমি আমায় অনন্ত জীবন দান করেছ। তোমার দ্বারাই বেঁচে আছি।

মানবজাতির ঋণ পরিশোধের জন্য আমি যদিও মৃত্যুবরণ করি তথাপি তুমি নিশ্চয় ঘৃণ্য কবরের মধ্যে মৃত্যুর শিকাররূপে বেশিদিন ফেলে রাখবে না আমাকে। আমার নিষ্কলুষ নিষ্কলঙ্ক আত্মাকে পাপে নিমজ্জিত হয়ে সেই অন্ধকার সমাধিগহ্বরের মধ্যে বেশি দিন বাস করতে হবে না নিশ্চয়।

আমি সে গহ্বর হতে অবশ্য বিজয়ী শত্রু মৃত্যুকে পরাভূত করে বেরিয়ে আসব শীঘ্র। তার সংশয়জনিত ক্ষতের দ্বারা নিজেই আহত হয়ে বীর্যহীন ও অগৌরবের গ্লানির দ্বারা জর্জরিত হয়ে পড়বে মৃত্যু। আমি মৃত্যুকে জয় করে বিজয়ী বীরের মত সমাধিগহ্বরের অন্ধকার হতে বেরিয়ে আসব প্রভূত আলো-বাতাসের রাজ্যে। আসার। সময়ে নরক বা মৃত্যুপুরীকেই বন্দী করে নিয়ে আসব।

হে পিতা, আমার সে কৃতিত্ব দেখে সন্তুষ্ট হবে তুমি। স্বর্গের সিংহাসন থেকে সে দৃশ্য অবলোকন করে আনন্দে হাসবে। তোমার সাহায্য ও অনুগ্রহে আমি সমাধিগহ্বর থেকে উত্থিত হয়ে আমার সমস্ত শত্রুদের ধ্বংস করব। মৃত্যুকে ধ্বংস করব সব শেষে। তার মৃতদেহ দিয়ে আমি চিরতরে বন্ধ করে দেব কবরের মুখ। তারপর মুক্ত মানবজাতিকে নিয়ে আমি আবার ফিরে আসব স্বর্গলোকে। হে পিতা, তখন তোমার মুখে কোন ক্ৰোধাবেগের মেঘ থাকবে না, সে মুখমণ্ডলে তখন বিরাজ করতে থাকবে শান্তি আর পুনর্মিলনের পরিপূর্ণ আনন্দ। তখন থেকে মানবজাতির উপর আর কোন ক্রোধের ধ্রুকুটি থাকবে না তোমার চোখে-মুখে।

ঈশ্বরপুত্রের কথা এইখানেই শেষ হলো। কিন্তু তাঁর নীরব মুখ হতে মরণশীল মানবজাতির প্রতি অমর নিরুচ্চার প্রেমের কত বাণী অশ্রুতভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল যেন। সেই প্রেমের সঙ্গে তার মুখে দ্যোতিত হয়ে উঠছিল তাঁর পরমপিতার প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের ভাব। আনুগত্যের আনন্দের দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠছিল তাঁর সমগ্র দেহাবয়ব। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল স্বর্গলোকের অধিবাসীবৃন্দ। ঈশ্বরপুত্রের এই মহানুভবতায় আশ্চর্য হয়ে গেল তারা সকলে।

সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর তখন বললেন, হে আমার পুত্র, আমার কোপানলে পতিত অধঃপতিত মানবজাতির মুক্তির জন্য তুমি আত্মোৎসর্গ করতে চেয়ে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে সকল বিবাদ-বিসম্বাদ দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলে। হে আমার আনন্দ আর আত্মপ্রসাদের মূর্ত প্রতীক, তুমি জান, আমার সকল সৃষ্টি কত প্রিয় আমার কাছে। মানুষ আমার শেষ সৃষ্টি হলেও সেও কম প্রিয় নয় আমার। সেই অধঃপতিত মানবজাতির উদ্ধারকল্পে আমি আমার বক্ষস্থল ও দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে কিছুকালের জন্য দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমায়। একমাত্র তুমিই পার তাদের চূড়ান্ত পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে। এই মুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের অন্ত:প্রকৃতি যেন তোমার অন্তঃকরণের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে উঠতে পারে। তোমার মধ্য দিয়ে তারা যেন লাভ করতে পারে এক আশ্চর্য নবজন্ম।

মানবজাতির আদিপিতা আদমের বংশধর তারা। কিন্তু আদমের পাপের জন্যই পতন ঘটে তাদের। কিন্তু তোমার দ্বারা উদ্ধার লাভ করে আবার তারা নবজন্ম গ্রহণ করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবে তারা গৌরবের আসনে। তুমি ছাড়া তাদের এ মুক্তি এ নবজন্ম সম্ভব নয়। আদমের দোষে দোষী হয়ে ওঠে তার সকল সন্তান। তোমার মহত্ত্বের গুণে তারা পাপমুক্ত হয়ে সমস্ত অন্যায় ঝেড়ে ফেলে এক নবজীবনের সন্ধান পাবে তোমার মধ্যে। তুমি মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের জন্যই মৃত্যুবরণ করবে এবং মৃত্যুর পর পুনরভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের সকলকে তুলে ধরবে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তুমি আনবে সমগ্র মানবজাতির মুক্তি। স্বর্গীয় প্রেমের সুষমা নারকীয় ঘৃণাকে ধ্বংস করে জয়ী হবে।

যদিও তুমি স্বর্গ থেকে অবতরণ করে মর্তে গিয়ে মানবসন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করবে, মানবপ্রকৃতি প্রাপ্ত হবে তথাপি তোমার দেবভাব ক্ষুণ্ণ হবে না কিছুমাত্র। কারণ তুমি ঈশ্বরপুত্র হিসাবে স্বর্গে মান-মর্যাদায় ঈশ্বরের সমতুল হয়ে ঐশ্বরিক সুযোগ-সুবিধা সবই ভোগ করেছ। কিন্তু সেই পরম স্বর্গীয় সুখ ত্যাগ করে একটা জগৎকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে জন্মগত অধিকারের থেকে তোমার নিজের গুণের জোরে আরো অনেক বেশি অধিকার লাভ করেছ। তোমার সততা, উদারতা ও মহত্ত্বের জন্য তুমি বেশি যোগ্যতা অর্জন করেছ। তোমার মধ্যে গৌরবের থেকে প্রেমের পরিমাণ বেশি।

মর্তে গিয়ে মানবসন্তানরূপে যে অপমান যে লাঞ্ছনা তুমি পাবে সেই অপমান যেন তোমার প্রকৃতিকে খর্ব বা কলুষিত করতে না পারে। কারণ তুমি মনে রাখবে তুমি আজ ঈশ্বরের সমান মর্যাদায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছ। ঈশ্বরের মতই পরম সুখ ও ঐশ্বর্য ভোগ করবে। তুমি সব কিছু ত্যাগ করে একটি জগৎকে চরম ধ্বংস হতে উদ্ধার করতে চলেছ। ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে তোমার সহজাত গুণের বাইরেও তোমার অনেক গুণ আছে। যেহেতু তোমার অন্তঃকরণ গৌরববোধ থেকে প্রেমবোধের দ্বারা বেশি পরিপূর্ণ, তোমার চরিত্রে মহত্ত্বের থেকে সততা ও উদারতার প্রাধান্যই বেশি। সুতরাং যদি তুমি যে কোন অপমান পাও তাহলে সে অপমান এই সিংহাসনের উপর অধিষ্ঠিত তোমার মানবত্বকে সমুন্নত ও মহিমান্বিত করে তুলবে।

এখানে তুমি ঈশ্বরের মানবতারূপে অধিষ্ঠিত থেকে দেবতা ও মানবদের উপর রাজত্ব করবে। তুমি হবে একাধারে ঈশ্বরপুত্র ও মানবপুত্র। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বররূপে অভিষিক্ত হবে তুমি। আমি তোমাকে সমস্ত ক্ষমতা দান করলাম। তুমি সেই ক্ষমতাবলে চিরকাল রাজত্ব করবে। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের যেখানে যত রাজা-রাজড়া আছে তাদের সমস্ত রাজক্ষমতা তোমার সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনস্থ হয়ে থাকবে। তোমার ক্ষমতার কাছে খর্ব হয়ে থাকবে। এটাই আমার বিধান। তুমি যখন মহিমায় গৌরবোজ্জ্বল মূর্তিতে আকাশে আবির্ভূত হবে তখন স্বর্গ, মর্ত ও পাতালের সকলেই নতজানু হয়ে তোমার অকুণ্ঠ বশ্যতা স্বীকার করবে। তোমার অধীনস্থ দেবদুতেরা তোমার কঠোর আইনকানুনগুলি সর্বত্র ঘোষণা করে বেড়াবে। সেই সব আইনকানুন যুগপৎ সমানভাবে বলবৎ হবে জীবিত ও মৃতদের জগতে।

মৃতদের শেষ বিচারের ক্ষণটি বজ্রগর্জনে নির্ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতীত সকল যুগের মৃতদের আত্মারা তাদের চিরনিদ্রা হতে উখিত হয়ে ছুটে আসবে তোমার কাছে। তুমি সাধু-সম্ভদের আত্মার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সকলের পাপপুণ্যের চূড়ান্ত বিচার সকলকে কর্মানুরূপ ফল দান করবে। কর্মের দ্বারা তাদের মধ্যে কে সাধু কে শয়তান তা নির্ণয় করবে। সৎ ও সাধুদের স্বর্গে এবং পাপীদের নরকে প্রেরণ করবে। পাপীদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে নরকদেশ। পাপীরা বিচারকালে ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে তোমার সামনে।

ইতিমধ্যে পাপপূর্ণ পৃথিবী অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তখন তার সেই ভস্মতূপ থেকে এক নূতন বিশুদ্ধ স্বর্গ ও বিশুদ্ধ মতের উদ্ভব হবে যেখানে নিয়ত বিরাজ করবে শুধু সত্য আর ন্যায়পরায়ণতা। সকল সৎ সাধু ব্যক্তিরা তাদের সুদীর্ঘকালীন দুঃখকষ্টের অবসানে দেখতে পাবে এক নূতন স্বর্ণযুগের আগমন। পুণ্যাত্মক কর্মের সুবর্ণ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে পৃথিবী। অনাবিল আনন্দ, মহতী প্রেম আর সুন্দর সত্যের জয় প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বত্র।

তখন আর তোমার রাজদণ্ডের প্রয়োজন হবে না। ঈশ্বরই হবে সর্বময় কর্তা। ঈশ্বরের ন্যায়রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে স্বর্গ ও মর্ত্যলোকে। কিন্তু হে দেবতাবৃন্দ, তোমরা আমার পুত্রকে বরণ করে নাও। আমার এই পুত্র ন্যায় ও সত্যের জয় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই মৃত্যুবরণ করবে। তোমরা আমার মতই তাকে সম্মান দান করো।

সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কণ্ঠ নীরব হতেই অসংখ্য দেবদূতেরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। এক বিপুল আনন্দোল্লাসে নিনাদিত সেই দিব্যমধুর কণ্ঠস্বরে আকাশমণ্ডলের প্রতিটি প্রত্যন্তভাগ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। তারা গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে মাথা নত করল ঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের কাছে।

স্বর্গলোকের কাননে অমর জীবনবৃক্ষে প্রস্ফুটিত দিব্য কুসুমমাল্যে সংজড়িত বীণাগুলি হাতে তুলে সেই নিয়ে বীণাবাদন সহযোগে মধুর সঙ্গীতের দ্বারা পরমপিতার জয়গান গাইতে লাগল তারা। তারা মধুর কণ্ঠে স্তব করতে লাগল, হে সর্বশক্তিমান, অনন্ত, অমর, সমগ্র ত্রিভুবনের অধিপতি, তুমিই সকল জীবের স্রষ্টা, সকল আলোর উৎস। চারিদিকের গৌরবময় উজ্জ্বলতার মাঝে তুমি নিজে অদৃশ্য অবস্থায় তোমার সিংহাসনে উপবিষ্ট থাক। সে সিংহাসন এমনই দুরধিগম্য যে কেউ তার নিকটস্থ হতে পারে না। যে দিব্য জ্যোতির দ্বারা তুমি সতত পরিবৃত সে জ্যোতি এমনই যে তার মাঝে পরিদৃশ্য হয় না তোমার মূর্তি। তোমার জ্যোতির তীব্রতা এমনই যে কারো চোখের দৃষ্টি তা সহ্য করতে পারে না। এমন কি সবচেয়ে উজ্জ্বল দেবদূত সেরাফিমও তোমার কাছে যেতে পারে না। তার ডানাদুটি দিয়ে চোখ চেপে রাখে। তুমি তোমার জ্যোতির তীব্রতাকে প্রশমিত না করলে কারো চোখে পরিদৃশ্য হবে না তোমার মূর্তিটি।

এরপর তারা ঈশ্বরপুত্রের স্তব করে বলতে লাগল, হে ঈশ্বরপুত্র, সমস্ত সৃষ্টির মাঝে ঈশ্বরের অবিকল সাদৃশ্যে উৎপন্ন ঈশ্বরের একমাত্র সন্তান তুমি। তোমার নির্দোষ, নির্মল মুখমণ্ডলে যে সর্বশক্তিমান পরমপিতাকে কেউ দেখতে পায় না চোখে সেই পরমপিতা এক মধুর উজ্জ্বলতায় অতিমূর্ত ও পরিদৃশ্য হয়ে আছেন। তার গৌরবের উজ্জ্বলতায় উজ্জ্বল তুমি। তাঁর অমিত শক্তি ও তেজ সঞ্চারিত তোমার মধ্যে। তিনি হচ্ছেন স্বর্গের স্বর্গ। তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চাভিলাষী, সর্বোচ্চ প্রভুত্বস্পৃহার মূর্ত প্রতীক।

একদিন তুমি তোমার পিতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তোমার দেবদূত সেনাদের নিয়ে পিতার শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে নির্গত হও। তোমার জ্বলন্ত রথচক্রনির্ঘোষে বিকম্পিত হয় সমগ্র স্বর্গলোক। কিন্তু স্বর্গচ্যুত মানবজাতির উপর তোমার কোন ক্রোধ বর্ষিত হয়নি। তাদের উপর কোন প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বা তাদের ধ্বংস না করে তাদের প্রতি করুণা ও মমতায় বিচলিত হয়ে যাও তুমি। তোমারই এই মমতা ও করুণা থেকেই তোমার পরমপিতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মানবজাতির সঙ্গে স্বর্গলোকের সব বিবাদ-বিসম্বাদের অবসান ঘটিয়ে ফেলেন।

হে ঈশ্বর, পরমপিতা! তোমার পরেই যাঁর স্থান, তোমার পরেই যিনি ঐশ্বরিক সম্মানের অধিকারী তোমার সেই পুত্র পরম স্বর্গীয় সুখে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু মানবজাতির অপরাধ স্খলনের জন্য নিজে মৃত্যুবরণ করেছেন।

হে ঈশ্বরপুত্র, মানবজাতির পরিত্রাতা, তোমার দৃষ্টান্তবিহীন অতুলনীয় ঐশ্বরিক প্রেম শুধু তোমার মাঝেই মূর্ত, এ প্রেম অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। তোমার, নামই হবে আমার সঙ্গীতের একমাত্র বিষয়বস্তু। আজ হতে পরম ঈশ্বরের জয়গানের সঙ্গে সঙ্গে তোমার জয়গান গাইতে কখনই ভুলে যাবে না আমার বীণা।

এইভাবে নক্ষত্রখচিত আকাশমণ্ডলের উর্ধ্বে স্বর্গলোকে দেবতারাঈশ্বর ও ঈশ্বরপুত্রের স্তোত্ৰগান গেয়ে সুখে কালাতিপাত করছিলেন।

এমন সময় চির-আলোকিত স্বর্গলোকের তলদেশে অনন্ত রাত্রির সীমাহীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক বিশাল জগতে অবতরণ করল শয়তান।নক্ষত্রহীন রাত্রির অন্তহীন অন্ধকারে আবৃত চির-উষ্ণ সে জগৎ সীমাহীন মহাদেশ বলে মনে হচ্ছিল। অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ুর দ্বারা সতত জর্জরিত সে মহাদেশ। সেই বিস্তৃত মহাদেশের একটিমাত্র অংশ স্বর্গের এক প্রাচীর বলে বিচ্ছুরিত স্বল্প আলোকরেখার দ্বারা আলোকিত। সে অংশে ঝড়ের প্রকোপ ছিল কিছু কম। সে অংশে শয়তান একাকী হাঁটতে লাগল।

হিমালয় পর্বতের পৃষ্ঠে অথবা গঙ্গা বা ঝিলামের নদীতটে চারণরত মেষ বা ছাগশিশুদের মাংস ভক্ষণ করার মত কোন মাংসলোভী কুনি যেমন সেই সব জায়গায় ইতস্তত পদচারণা করে তেমনি নিঃসঙ্গ শয়তান কোন জীবিত বা মৃত জীবনের আশায় সেখানে পদচারণা করতে লাগল। অন্য জাতীয় কোন না কোন জীবের দেখা পাবার আশা করছিল সে।

কিন্তু কোন জীবকেই দেখতে পেল না শয়তান। সেই উষর অন্ধকার প্রস্তরভূমি জুড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল শুধু বিদেশী কতকগুলি মানুষের ছায়ামূর্তি। মর্ত্যজীবন যাপনকালে যে সব মানুষ শুধু ইহলোকে বা পরলোকে সুখের আশায় ও অক্ষয় যশের লোভে সব কাজ করে, আত্মস্বার্থসর্বশ্ব সেই সব মানুষের আত্মা মৃত্যুর পর স্বর্গ ও মর্ত্যলোকের মধ্যবর্তী এই স্থানে এসে অনুশোচনার তীব্র জ্বালায় দগ্ধ হতে থাকে প্রকৃতির যে সব কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে যায় পৃথিবীতে অথবা ব্যর্থ হয় কোন কারণে, সেই ব্যর্থ অসমাপ্ত কাজের জন্য এই অঞ্চলে এসে ঘোরাফেরা করতে থাকে।

যে সব সাধুপুরুষদের আত্মা মৃত্যুর পরও স্বর্গগমন করতে পারেননি সেই সব সাধুদের দেবদূত ও মানুষের মাঝামাঝি এক একটি পোশাক পরে ছায়ামূর্তি ধারণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে।

প্রাচীনকালের ভাগ্যহত মানবসন্তানদের ও কুখ্যাত দানবদের আত্মারাও এখানে ঘুরে বেড়ায়। কত শত ব্যর্থ যুদ্ধবিগ্রহের পর মৃত্যুবরণ করে দানবদের আত্মারাও ছায়ামূর্তি ধরে আসে এখানে। বেবিলনের শূন্য উদ্যানের গর্বিত নির্মাতারাও মৃত্যুর পর এখানে আসে। আর আসে আত্মহত্যার দ্বারা যারা মৃত্যুবরণ করে সেই সব পাপী আত্মারা। গ্রীক দার্শনিক দেবোপম এম্পিডোকলস্ বৃহত্তর জীবনের অভিলাষে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি এটনাতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং ক্লিওমব্রোস প্লেটোর ফিড্রো পড়ে পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করার মানসে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। এইভাবে আত্মহত্যারূপ মহাপাপে নিমগ্ন হয়ে তাদের বিদেহী আত্মারা ছায়ামূর্তি ধরে স্বর্গলাভ হতে বঞ্চিত হয়ে এই ঊষর অন্ধকার দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এই দুটি আত্মার ছায়ামৃতি একা একা এল।

ভ্রূণ অবস্থায় যারা যারা গেছে তারে ও যত সব নির্বোধের আত্মারাও আসতে লাগল। তাদের পরনে ছিল সাদা, কালো ও ধূসর রঙের পোশাক। সে সব তীর্থযাত্রীরা গলগাথায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মৃতদেহটিকে খুঁজতে থাকে, অথচ যীশু স্বর্গে বাস করার জন্য যাদের দেখতে পায়নি সেই সব তীর্থযাত্রীরা এখানে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে।

নিশ্চিত স্বর্গলাভের আশায় এ্যাঞ্জেলো পলিজিয়ানো মৃত্যুশয্যায় ডোমিনিকান সম্প্রদায়ের পোশাক পরেন এবং গিদো বৃদ্ধ বয়সে স্বৰ্গকামনায় ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ভুক্ত হন। মৃত্যুর পর তাদের আত্মা পর পর সাতটি গ্রহ পার হয়ে স্বর্গদ্বারের নিকটস্থ হয়।

স্বর্গের দ্বারপাল পিটার রুদ্ধদ্বারের চাবি হাতে অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। কিন্তু এ্যাঞ্জেলো ও গিদোর আত্মার ছায়ামূর্তি স্বর্গে ওঠার শেষ সিঁড়িতে পৌঁছানোর জন্য পা তুলতেই এক প্রতিকূল ঝঞ্জাবায়ু প্রবলভাবে বইতে বইতে তাঁদের প্রায় বিশ মাইল দূরে ফেলে দেয়।

সেই প্রবল ঘূর্ণিবায়ু তাদের লিম্বো নামক এক নিম্নতর হীনতর নরকে ফেলে দেয়। সে নরকপ্রদেশকে মূর্খদের স্বর্গ বলা হয়।

এই অন্ধকার জগতের মধ্যে এই সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল শয়তান। অন্ধকারে এদিকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াল। চারিদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার আর অদৃশ্য ছায়ামূর্তির আনাগোনা।

অনেকক্ষণ এইভাবে কেটে যাবার পর স্বর্গ থেকে বিচ্ছুরিত এক আলোকরেখা শয়তানের প্রতিটি পদক্ষেপকে আলোকিত করে তুলল। সেই আলোর সাহায্যে ধীরে ধীরে সে স্বর্গপ্রাচীরের দিকে উঠে যেতে লাগল।

এইভাবে অনেকটা ওঠার পর শয়তানরাজ সেই প্রাচীরের উপর রাজপ্রাসাদের মত লোহার গেটওয়ালা এক প্রকাণ্ড বাড়ি দেখতে পেল। স্বর্ণ, হীরক ও নানা মণি-মুক্তাখচিত সেই প্রাসাদের মর্ত্যলোকের কোন তুলনাই হয় না। একমাত্র শুধু চিত্রে অঙ্কিত হতে পারে। সে প্রাসাদে ওঠার সিঁড়িগুলি সুন্দরভাবে সাজানো ছিল।

ইসেউ থেকে পাদান আরামে পালিয়ে যাবার সময় লজের প্রান্তরে মুক্ত আকাশের তলে রাত্রিতে নিদ্রাভিভূত অবস্থায় জ্যাকব স্বপ্নে যে সিঁড়ি দিয়ে দেবদূতদের ওঠানামা করতে দেখেছিল সেই প্রাসাদের সিঁড়িগুলি ছিল এমনি।

জ্যাকব সেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠেই বলেছিল, এই হলো স্বর্গারোহণের সিঁড়ি।

কিন্তু সে সিঁড়ি বড় রহস্যময়, ঐন্দ্রজালিকভাবে নির্মিত। সেই সিঁড়িগুলি সব সময় প্রাসাদের সঙ্গে সংজড়িত থাকে না। মাঝে মাঝে স্বর্গের উপর সেগুলিকে তুলে নেওয়া হয়। তার অর্থ হলো এই যে, বাইরের কোন অবাঞ্ছিত বা স্বর্গসুখে অনধিকারী কোন ব্যক্তির আত্মা যেন সে সিঁড়ি দিয়ে স্বর্গে আরোহণ করতে না পারে।

সেই সিঁড়ির তলদেশে গলিত ধাতুর এক বিশাল সমুদ্র প্রবহমান। মৃত্যুর পর মর্ত্য থেকে যে পুণ্যাত্মা দেবদূতদের দ্বারা বাহিত নৌকাযোগে সেই সমুদ্র পার হয়ে আসে অথবা আগ্নেয় অস্ত্রের দ্বারা বাহিত মায়াময় রথে করে এসে স্বর্গদ্বারে এসে উপস্থিত হয়, একমাত্র তারাই এই সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গারোহণের অধিকারী। তারা স্বর্গদ্বারে উপনীত হবার সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে তুলে নেওয়া সিঁড়িগুলি আবার সাজিয়ে রাখা হয়।

শয়তান যাতে সহজে স্বর্গে আরোহণ করতে না পারে, স্বর্গদ্বার হতে যাতে সে সহজে বহিষ্কৃত হয় তার জন্য মর্ত্যভূমি হতে সুদূর স্বর্গ পর্যন্ত এক বিশাল অন্ধকার গহুর সৃষ্ট হলো শয়তানরাজের সামনে।

সে তখন স্বর্গের নিম্নতম সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে এক অন্তহীন বিহ্বলতার সঙ্গে অকস্মাৎ সৃষ্ট সেই বিশাল অনতিক্রম্য গহ্বরের দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখল সেই গহ্বরের অন্ধকার শূন্যতার উপর দেবদূতেরা পাখা মেলে ইতস্তত উড়ে চলেছে।

কোন এক অন্ধকার বিশাল মরুভূমিতে বিচিত্র ও বিপজ্জনক রাত্রিযাপনের পর কোন নিঃসঙ্গ সৈনিক যেমন আলোকোজ্জ্বল প্রভাতকালে একটি পাহাড়ের উচ্চ চূড়া হতে অসংখ্য প্রাসাদ ও অট্টালিকামণ্ডিত কোন সুরম্য ও সুসজ্জিত বিদেশী নগরী দেখে এক বিস্ময়বিমিশ্রিত আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ে, শয়তানও তেমনি সেই অন্ধকার শূন্য গহ্বরের পরপারে দৃষ্টি প্রসারিত করে আশাসঞ্চারিণী কোন সুরম্য নগরী দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

সে যখন দেখল অন্ধকার শূন্য আকাশমণ্ডলের পরপারে নক্ষত্ররাজির মাঝে মাঝে আরো কত জগৎ রয়েছে। কিন্তু সে সব জগতে কারা বাস করে তা জানার কোন ইচ্ছা হলো না তার। ছোট ছোট দ্বীপের মত সেই সব জগৎগুলিতে রয়েছে বিস্তৃত প্রান্তর ও পুষ্পিত কত উপত্যকা। হেসপীরিয়ার উদ্যানের মত কত উদ্যানও আছে সেই সব জগতে।

অন্ধকার শূন্যমণ্ডলে ভাসমান সেই সব জগতের উর্ধ্বে বিরাজিত সূর্যকিরণের মত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত স্বর্গলোক বিমুগ্ধ করল তার দৃষ্টিকে। এই স্বর্গলোক তার উর্ধ্বায়িত দৃষ্টিপথে পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই সঙ্গে বিস্ময় ও ঈর্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার উচ্চাভিলাষী মন।

সুদূর ঊর্ধ্বলোকে অবস্থিত সেই উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলকে লক্ষ্য করে অন্ধকার শূন্যতার মাঝে ঝাঁপ দিল শয়তানরাজ। ঊর্ধ্ব আকাশপথে যতই উৎক্রমণ করতে লাগল ততই সে বুঝতে পারল ঐ আলোকমণ্ডলই হলো সৌরমণ্ডল। যে স্বর্গ সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আলোকিত করে, যা দিনরাত্রি, মাস ও বৎসররূপ কালকে নির্ণীত করে, যে সূর্য সারা বিশ্বভুবনের সকল জীবের প্রাণের উৎস, সেই সূর্যমণ্ডলকে লক্ষ্য করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল সে।

ক্রমে সে দেখল অনন্ত মহাশূন্যে অসংখ্য গ্রহনক্ষত্র এক একটি আলোকিত জগতের মধ্যে ভাসছে। তাদের মৃদুকম্পিত দেহগুলি দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তারা যেন ঝুলন্ত অবস্থায় নৃত্য করছে। কিন্তু সর্বত্র এমন এক সুন্দর শৃঙ্খলা বিরাজ করছে যাতে কারো সঙ্গে সংঘাত সংঘটিত হচ্ছে না।

শয়তানরাজ আরও দেখল, সূর্যের জ্বলন্ত কিরণগুলির মাঝে অনেক ভূখণ্ড রয়েছে।

সূর্যমণ্ডলমধ্যবর্তী সেই সব ভূখণ্ডের একটিতে অবতরণ করল শয়তান। সে ভূখণ্ডের সন্ধান আজও কোন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পায়নি। সে দেখল সেই ভূখণ্ডে সোনা, রুপো ও হীরকের মত অনেক ধাতুর স্তূপ উজ্জ্বল কিরণমালায় চকচক করছে। তেমন উজ্জ্বল ধাতু মর্ত্যলোকে বা পাতালপ্রদেশের কোথাও দেখা যায় না।

শয়তান আরও দেখল সেই বিশাল ভূখণ্ডের নিম্নদেশ শুধু উজ্জ্বল ধাতুতে পরিপূর্ণ হলেও কোথাও কোন উঁচু বস্তু বা পাহাড়-পর্বত, ঘর-বাড়ি, নদীর জলপথ, কিছুই নেই। চারিদিক উজ্জ্বল, কোথাও কোন ছায়া বা অন্ধকার নেই। যেদিকেই সে দৃষ্টি প্রসারিত করল, কোন বাধা পড়ল না তার দৃষ্টিপথে, চারিদিকেই মনে হতে লাগল উজ্জ্বল ধাতুর নদী বয়ে যাচ্ছে। এখানকার সব ধাতুই নির্বাচিত এবং খাঁটি।

কোনরূপ বিচলিত বা কিছুমাত্র অভিভূত না হয়ে অসমসাহসী শয়তান চারিদিক দেখতে দেখতে বহুদূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল। এইভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দূরে এক দেবদূতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। কি জন্য একদিন স্বগের মধ্যে এক দেবদূতকে দেখতে পেয়েছিল। সে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু পিছন ফিরে থাকলেও তার জ্যোতি কিছুমাত্র কমেনি। তার মাথায় ছিল সোনার টায়রা। তার মাথার চুলগুলো ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। তার দু’পাশের পাখাদুটি ঝুলছিল।

মনে হচ্ছিল কোন এক বড়রকমের কার্যভারে বিব্রত ছিল সেই দেবদূতটি। অথবা সে ছিল গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন।

সেই দেবদূতকে দেখে নতুন আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠল শয়তানরাজের অন্তর। সে ভাবল, কোন পথে উড্ডীন হয়ে সে মানবজাতির পরম সুখের আকাঙ্ক্ষিত স্থান তার গন্তব্যস্থল স্বর্গে উপনীত হতে পারবে তা ঐ দেবদূতই বলে দিতে পারবে।

কিন্তু ঐ দেবদূতকে কিছু বলার আগে সে তার রূপ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। কারণ এই শয়তানের বেশে তার কাছে গেলে তার বিপদ হতে পারে অথবা তার গন্তব্যস্থলে যেতে বিলম্ব হতে পারে।

এই ভেবে শয়তান এক দেবদূতের রূপ পরিগ্রহ করল। সে দেবদূত বয়সে যুবক না হলেও এক অনন্ত যৌবনের উজ্জ্বল দীপ্তি শোভা পাচ্ছিল তার মুখে। তার এই ছদ্মবেশ এমনই সার্থক হয়ে উঠেছিল যে তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এক স্বর্গীয় সুষমা ঝরে পড়েছিল। তার কুঞ্চিত কেশপাশ দু গালের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। বিচিত্র যাদুকাঠি।

দেবদূতের এই ছদ্মবেশ ধারণ করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগল শয়তানরাজ। কিন্তু সে দেবদূতের কাছে যাবার আগেই তার উপস্থিতির কথা জানতে পারল সেই দেবদূত। তার উজ্জ্বল মূর্তিটি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।

তখন সেই দেবদূতের মুখ দেখেই তাকে চিনতে পারল শয়তান। সে ছিল আর্কেঞ্জাল ইউরিয়েল। স্বর্গলোকে ঈশ্বরের সিংহাসনের কাছে যে সাতজন দেবদূত তাঁর আদেশ পালনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে ইউরিয়েল ছিল তাদেরই একজন। তারা সব সময় জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ত্রিভুবনের সর্বত্র ঈশ্বরের বার্তা বহন করে বেড়ায়।

ইউরিয়েলকে সম্বোধন করে শয়তান বলল, হে ইউরিয়েল, যে সাতজন দেবদূত এক গৌরবময় উজ্জ্বলতায় মণ্ডিত হয়ে ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে বিরাজিত থাকে তুমি তাদের মধ্যে প্রথম। তোমারই দৌত্যের দ্বারা ঈশ্বরের পুত্ররা তাদের পরমপিতার সকল অভিলাষ অবগত হন। স্বর্গলোকে ঊর্ধ্বতন প্রদেশ হতে ঈশ্বরের সকল বার্তা, সকল আদেশ তোমারই মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তুমি আজ এখানেও হয়ত ঈশ্বরেরই কোন পরম বিধান বহন করে এনেছ।

ঈশ্বরের যে সব বিস্ময়কর সৃষ্টি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সেই সব সৃষ্টি এবং বিশেষ করে তার সবচেয়ে অনুগৃহীত ও তার আনন্দের বস্তু মানবজাতি সম্পর্কে কিছু জানার কৌতূহলের তাড়নায় আমি একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছি। হে উজ্জ্বলতম দেবদূত, চারিদিকে যে সব উজ্জ্বল গ্রহ মহাশূন্যে ঘূর্ণমান তাদের কোটিতে মানবজাতি বাস করে অথবা তাদের কি কোন নির্দিষ্ট বাসভূমি নেই? সব গ্রহতেই বাস করে সাময়িকভাবে। বল, কোথায় কিভাবে তাদের দেখা পাব? তাদের কি গোপনে দূর থেকে দেখতে হবে, না কাছে গিয়ে প্রকাশ্যে দেখব? এক অবর্ণনীয় কামনায় অভিভূত হয়ে পড়েছি আমি তাদের দেখার জন্য।

যে ঈশ্বর মানবজাতিকে কত বড় জগৎ দান করেছেন অনুগ্রহবশত, যাদের উপর কত মহিমা ঢেলে দিয়েছেন, সেই মানবজাতিকে দর্শন করে পরমস্রষ্টার জয়গান করতে চাই। এই পরমস্রষ্টা ঈশ্বর ন্যায়সঙ্গতভাবেই তার বিদ্রোহী শত্রুদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে নরকের গভীরতম প্রদেশে নিক্ষেপ করেছেন এবং তাদের স্থান পূরণ করার জন্য এক নতুন সুখী জাতি সৃষ্টি করেছেন। এই জাতিই হলো মানবজাতি। যাতে তারা ঈশ্বরের আরও ভালভাবে সেবা করতে পারে তার জন্যই এই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। তিনি পরমপিতা।

এইভাবে দেবদূতের ছদ্মবেশে শয়তান তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধির জন্য এক বিরাট মিথ্যার অবতারণা করল। কিন্তু তার সেই ছলনা ও মিথ্যা ধরতে পারল না ইউরিয়েল।

বস্তুত একমাত্র সর্বদশী ঈশ্বর ছাড়া স্বর্গ বা মর্ত্যের কেউ কারো কোন ভণ্ডামি বা ছলনা ধরতে পারে না। যখন কেউ ছলনার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যার অবতারণা করে তখন সকলে স্বাভাবিক ক্ষমতার বশে সেই মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়। তখন আমাদের জ্ঞানের দ্বার থাকে রুদ্ধ, সকল সংশয় সেই জ্ঞানের রুদ্ধ দ্বারপথে ঘুমিয়ে থাকে, সরলতা কোন কাজ করে না। সূর্যের প্রতিনিধি এবং স্বর্গের সবচেয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন দেবদূত হয়েও ইউরিয়েল ভণ্ড প্রতারক শয়তানের এই ছলনা বুঝতে পারল না।

ইউরিয়েল শয়তানরাজকে বলল, হে সুন্দর সদাশয়, ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য নিজের চোখে দেখা ও তা দেখে সেই পরমস্রষ্টার গৌরবগান করার বাসনায় তুমি যে তোমার সুরম্য স্বর্গীয় প্রাসাদ ছেড়ে একাকী এই ভূখণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছ এটা এমন কিছু দোষাবহ ব্যাপার নয়। বরং অতীব প্রশংসার যোগ্য। কারণ অন্য যে কোন দেবদূত স্বর্গ থেকে এই সৃষ্টিকার্যের বিবরণ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে পারত।

ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য সত্যিই বিস্ময়কর এবং তা জানা সত্যিই আনন্দদায়ক যে অভিজ্ঞতার কথা আনন্দের সঙ্গে স্মৃতির স্বর্ণকোঠায় সংরক্ষিত রাখার যোগ্য। কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া আর কার মন সে সৃষ্টির সংখ্যা গণনায় সক্ষম এবং কার এমন অনন্ত জ্ঞান আছে যার দ্বারা সে সৃষ্টির গভীর কারণ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে?

আমি জানি, আমি নিজে দেখেছি সৃষ্টির আগে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এক অন্ধকার মহাশূন্যতা বিরাজ করত, চারিদিকে ছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা। সে সময় মাটি, জল, বাতাস, অগ্নি, আকাশ প্রভৃতি বিশ্বসৃষ্টির এই উপাদান বা ভূতগুলি নিরাকারভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিল। এমন সময় ঈশ্বরের একটিমাত্র কথায় সেই নিরাকার উপাদানগুলি এক একটি আকার লাভ করে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের রূপ পরিগ্রহ করে। ঈশ্বরের দ্বিতীয় আদেশে সমস্ত অন্ধকার বিচ্ছুরিত হয়ে যায় এবং উজ্জ্বল আলোকমালায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দশদিক। শৃঙ্খলা নেমে আসে সমস্ত বিশৃঙ্খলার মাঝে। তুমি এখন দেখছ, সেই সব গ্রহ-নক্ষত্রগুলি আপন আপন স্থানে আপন আপন কক্ষপথে কি সুন্দরভাবে ঘুরছে। নিম্নে যে জগৎ দেখছ, সে জগৎ স্বর্গলোক হতে প্রতিফলিত আলোকেই আলোকিত। ঐ পৃথিবীই হলো মানবজাতির বাসভূমি।

দুটি গোলার্ধে বিভক্ত এই জগতে সূর্যের আলো যখন একটি গোর্ধকে আলোকিত করে তখন অন্য গোলার্ধে রাত্রির অন্ধকার বিরাজ করে। তবে সূর্যের আলোয় আলোকিত চন্দ্রের আলো পৃথিবীর নৈশ অন্ধকারকে প্রতিমাসে একপক্ষকাল কিছুটা আলোকিত করে।

এরপর ঊর্ধ্বে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে ইউরিয়েল বলল, ঐ হলো স্বর্গলোক, আমাদের বাসভূমি। যে পথ দেখিয়ে দিলাম সে পথে যেতে ভুল করো না। আমি এবার চললাম।

শ্রদ্ধা জানাল। ইউরিয়েল চলে গেলে শয়তান শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে পৃথিবীর উপকূল অভিমুখে পাড়ি দিল তারপর আর্মেনিয়ার নাইকেত পর্বতে অবতরণ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *