১ম সর্গ

প্যারাডাইস লস্ট – জন মিলটন
অনুবাদ : সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ

প্রথম সর্গ

হে কাব্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তুমি আমাকে প্রথমে বল আদি মানবের সেই ঐশ্বরিক আনুগত্যের অভাব বা ঈশ্বর-বিরোধিতার কথা, সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফলের কথা যা মর্ত্যলোকে নিয়ে আসে মৃত্যু আর যত সব দুঃখ এবং পরিশেষে স্বর্গচ্যুতি। পরে এক মহামানবের সহায়তায় সেই হারানো স্বর্গ আবার পুনরুদ্ধার করে মানুষ। তুমি বল সেই ওরেব বা সিনাই পর্বতের শিখরদেশের কথা যার উপর থেকে ঈশ্বর আদি মানবজাতির মেষচারণরত মোজেসকে দেখে প্রথম সৃষ্টির বীজটিকে অঙ্কুরিত করে তোলার রহস্যটি শিখিয়ে দেন। যার ফলে সৃষ্টিহীন শূন্যতার মধ্য থেকে স্বর্গ-মর্ত্যের প্রথম উদ্ভব হয়। একথা যদি তোমার ভাল লাগে তো বল সিডন পাহাড় আর জেরুজালেমের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মিলোয়া নদীর কথা।

তারপর আমি এক দুঃসাহসী সঙ্গীত রচনার জন্য তোমার সাহায্য প্রার্থনায় তোমাকে আবাহন করব যে সঙ্গীতের সুরলহরী আওনিয়ান পর্বতের শিখরদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। গদ্যে বা পদ্যে আজও পর্যন্ত যা রচিত হয়নি কখনো, সেই সঙ্গীতের মধ্যে আমি তা রচনা করব। হে দেবী, যেহেতু তুমি মন্দির বা ধর্মপ্রতিষ্ঠানের থেকে ভক্তজনের অন্তঃকরণের সততা ও শুচিতাকে বেশি মূল্যবান মনে করো, আমার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে এ বিষয়ে চালনা করো আমাকে উপযুক্ত নির্দেশদানের দ্বারা। কারণ কোন কিছুই অপরিজ্ঞাত নয় তোমার। কারণ তুমি আদিকাল হতে বিরাজিত আছ, সৃষ্টিহীন বিশাল শূন্যতার গভীরে কপোতসুলভ এক গম্ভীর প্রশান্তির সঙ্গে শক্তিশালী দুটি বিরাট ডানা বিস্তার করে বসেছিলে এবং ধীরে ধীরে সকল সৃষ্টিকে সম্ভত করে তোল তুমি। আমার মধ্যে যা অন্ধকার এবং অপরিজ্ঞাত রয়ে গেছে, তার উপর প্রজ্ঞার আলোকপাত করে তাকে আলোকিত করে তোল। আমার মধ্যে যা কিছু অশক্ত ও অবনমিত আছে তাকে এক দৃঢ় ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত করে তুলে ধরো যাতে আমি যত সব বিশৃঙ্খলাময় ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে ঈশ্বরের বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি এবং মানবজাতির কাছে পরিজ্ঞাত করে তুলতে পারি ঈশ্বরের রীতিনীতিগুলিকে।

স্বর্গলোকের কোন কিছুই লুক্কায়িত থাকতে পারে না তোমার দৃষ্টিপথ থেকে। এমন কি নরকের গভীর অন্ধকার গহ্বরের তলদেশ পর্যন্ত প্রতিভাত ও পরিদৃশ্য হয়ে ওঠে তোমার দৃষ্টির সম্মুখে। প্রথম বল, কোন্ কারণে আমাদের আদি পিতামহগণ ঈশ্বরের অনন্ত অনুগ্রহলাভে ধন্য হয়েও স্বর্গসুখ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ল? কেন তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম স্রষ্টা ও বিধাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল? কেন তারা তার আদেশ লঙঘন করে চরম অংযমের পরিচয় দিল? কে তাদের এই জঘন্য বিদ্রোহে প্রথম প্ররোচিত করল? শয়তানরূপী নারকীয় সর্পই কৌশলে মানবজাতির আদিমাতাকে প্রতারিত করে হিংসা আর প্রতিশোধ বাসনার উদ্রেক করে তার মনে। বল, কখন কোন সময়ে মানবজাতির আদিপিতা একদল বিদ্রোহী দেবদূতসহ তার মদমত্ততার জন্য বিচ্যুত হয় স্বর্গলোক থেকে।

এই সব বিদ্রোহী দেবদূতদের সহায়তায় আমাদের আদিপিতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষতা অর্জন করার এক উদ্ধত উচ্চাভিলাষে মত্ত হয়ে ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্য ও সিংহাসন অধিকার করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এক অন্যায় অধমোচিত যুদ্ধ ঘোষণা করে সে দর্পভরে। এর জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর স্বর্গলোক থেকে জ্বলন্ত অবস্থায় নরকের অতল গহ্বরের মধ্যে সরাসরি ফেলে দেন শয়তানদের। তারই জন্য এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের আদিপিতাকে। ঈশ্বর বিরোধিতার এক চরম শাস্তিস্বরূপ জ্বলন্ত নরককুণ্ডের মধ্যে পরাভূত ও শৃঙ্খলিত অবস্থায় আবদ্ধ থাকতে হয় তাকে। পূর্ণ নয় দিন যাবৎ তাকে দলের সকলের সঙ্গে সেই জ্বলন্ত নরককুণ্ডে মৃত্যুহীন এক যন্ত্রণায় জীবনযাপন করতে হয়।

কিন্তু তার এই সর্বনাশা নরকভোগ আরও বাড়িয়ে দেয় তার ক্রোধের মাত্রাকে। কারণ হারানো স্বর্গসুখ আর দীর্ঘায়িত জীবনযন্ত্রণার ভাবনা পীড়িত করতে থাকে তাকে। চারদিকে তার স্লান দু’চোখের বিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দীর্ঘায়িত দুঃখকষ্টের বিপুলতাকে প্রত্যক্ষ করে ভীত হয়ে ওঠে সে। তথাপি সেই ভীতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ওঠে তার সহজাত অহষ্কার আর বদ্ধমূল ঘৃণার অনমনীয়তা। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, সে দেখতে পায় শুধু এক বিরাট চুল্লীর মত জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দ্বারা আকীর্ণ এক অন্ধকার কারাগার। সেই অগ্নিশিখার মধ্যে কোন আলো নেই। সেই অগ্নিশিখার এক অন্ধ আভায় শুধু বেশি করে প্রকটিত হয়ে ওঠে ঘনীভূত অন্ধকারের ভয়াবহতা। সে আভায় সে দেখতে পেল শুধু অন্তহীন দুঃখকষ্টের ছায়াচ্ছন্ন বিস্তার। সেখানে নেই কোন শান্তি বা বিদ্রোহের ন্যুনতম অবকাশ, নেই কোন ক্ষীণতম আশার আনাগোনা। সেখানে আছে শুধু অন্তহীন যন্ত্রণার নিদারুণ প্রদাহ আর জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের নারকীয় দীপ্তির দুঃসহ দীর্ঘতা।

ঈশ্বরের বিধানে এই চির-অন্ধকার নরকপ্রদেশটি বিদ্রোহীদের কারাগাররূপে নির্দিষ্ট হয়েছে। সেই নরকপ্রদেশটি ছিল আয়তনে বিশাল। তা ঈশ্বর ও তাঁর স্বর্গরাজ্য থেকে যত দূরে, তার কেন্দ্র হতে পরিধিও ছিল তত দূরে। হায়, যে স্থান থেকে তারা বিচ্যুত হয়েছে, যে স্থানে আগে তারা বাস করত, সে স্থান হতে এ স্থান কত পৃথক, কত নিকৃষ্ট! ওখানে তার সঙ্গে তার পতনের সঙ্গীরা বিক্ষুব্ধ অগ্নিপ্রবাহে অভিভূত হয়ে বসে আছে তারই মত।

কিছুক্ষণের মধ্যে সেই নরকের অন্ধকারে জ্বলন্ত অগ্নিশিক্ষার আভায় একজনকে চিনতে পারল আদিপিতা। ক্ষমতা ও অপরাধে তার পরেই যার স্থান, দীর্ঘকাল আগে প্যালেস্টাইনে যার সঙ্গে পরিচয় হয় তার সেই বীলজীবাব নামে এক শয়তানকে দেখে চিনতে পারল সে। স্বর্গে যাকে শয়তান বলা হত সেই বীলজীবাব এবার নরকপ্রদেশের ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে উদ্ধতভাবে বলল, তুমি যদি সে-ই হও তাহলে কেমন করে তোমার পতন ঘটল? একদিন যে তুমি কত সুখে ছিলে, এক স্বর্গীয় জ্যোতিতে কত উজ্জ্বল ছিল তোমার দেহাবয়ব, এখন তুমি আর সেই ব্যক্তি নেই। কত পরিবর্তন হয়েছে তোমার! একদিন আমরা দুজনে মিলেমিশে একই আশায় সঞ্জীবিত ও একই আঘাতে অভিভূত ও একই ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমাদের গৌরবময় উদ্দেশ্যসাধনের পথে এগিয়ে চলি আমরা। আবার এখন একই দুঃখ আর সর্বনাশের কবলে পতিত হয়েছি আমরা। কত উঁচু থেকে কত নীচে পড়েছ তা একবার দেখ তো। বজ্রের যে এত শক্তি এর আগে তা জানতাম না আমরা।

কিন্তু এই সব দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা জাগেনি আমার মধ্যে। কোন পরিবর্তন হয়নি আমার মনের। এমন কি আমাদের শক্তিমান বিজয়ী প্রতিপক্ষ এর থেকে আরো যে বেশি শাস্তি দেবে আমাদের, তার জন্যও ভয় করি না আমি। যদিও আমার বহিরঙ্গের জ্যোতি আর জৌলুস আর নেই, তথাপি আমি দৃঢ়সংঙ্কল্প। আমার আহত অপমানবোধ ঘৃণা আর প্রতিশোধ বাসনার উদ্রেক করেছে আমার মনে। কারণ এর আগে আমি একবার বিদ্রোহী আত্মাদের সহায়তায় স্বর্গরাজ্যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। সে যুদ্ধ কাঁপয়ে তোলে তার সিংহাসনকে তবু সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারিনি আমরা। কিন্তু আমরা পরাভূত হলেও অপরাজেয় রয়ে গেছে আমাদের মনোবল। দুর্মর ঘৃণা, প্রতিশোধ বাসনা আর দুর্দমনীয় সাহসের দ্বারা কি জয়লাভ করতে পারব না আমরা? আমাদের এই অদম্য অনিবারণীয় শক্তি আর সাহসই এক পরম গৌরবের বস্তু। আমাদের প্রতিপক্ষ যতই প্রবল ও শক্তিশালী হোক না কেন, এ গৌরব ছিনিয়ে নিতে পারবে না আমাদের কাছ থেকে। শত্রুর সামনে নতজানু হয়ে তার করুণা ভিক্ষা করতে কখনই পারব না আমরা। তার থেকে যে শত্রু তার শক্তির দম্ভের দ্বারা তার সমগ্র সামাজ্যকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে, যে আমাদের শোচনীয় পতন ঘটিয়ে অমিত অপমান আর লজ্জার বস্তুতে পরিণত করেছে আমাদের, সে শত্রুর বিরোধিতা করব আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে। যদিও ভাগ্যের বলে বলীয়ান দেবতাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন ঘটেনি এখনো পর্যন্ত, তথাপি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা জেনেছি আমাদের শক্তিও কম নয়। আমাদের এই পরীক্ষিত শক্তির সত্যতা, দূরদর্শিতা, বলিষ্ঠ আশা আর অনমনীয় সংকল্পের দ্বারা অগ্রসর হয়ে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি যে শত্রু বর্তমানে বিজয়গর্বে মত্ত হয়ে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে স্বর্গরাজ্যে। ছলে-বলে সে যুদ্ধে জয়লাভও করতে পারি আমরা।

এইভাবে সেই অধঃপতিত দেবদূত গর্বে উন্মত্ত, যন্ত্রণায় কাতর এবং আশাহত বেদনায় অভিভূত হয়ে এই কথাগুলি বললে আমাদের দুঃসাহসী শয়তান উত্তর করল, হে রাজন, বহু প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির প্রধান, তুমি এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে শক্তিশালী দেবদূতদের নির্ভীকভাবে নেতৃত্ব দান করে সনাতন রাজশক্তিকে বিপন্ন করে তোল এবং তার প্রভুত্বকে এক চরম পরীক্ষার সামনে উপস্থাপিত করো। জানি না তাদের শক্তির জোরে, অথবা দৈব বা নিয়তির প্রভাবে পরাজয় ঘটল না তোমার শত্রুপক্ষের। যাই হোক, আমি আমাদের এই শোচনীয় পরাজয়, পতন আর সর্বনাশের ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিচার করে দেখেছি। আমাদের গৌরবসূর্য অস্তমিত হলেও এবং অন্তহীন দুঃখ আমাদের সকল সুখ ও অধিকারের মর্যাদাকে গ্রাস করে ফেললেও আমাদের অদম্য মনোবল এবং অপরাজেয় আত্মশক্তি ফিরে আসছে আবার। যে বিজয়ী আমাদের মত শক্তিকে পরাভূত ও ব্যর্থ করে দিয়ে এই বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণার রাজ্যে নিক্ষেপ করেছে আমাদের, সে বিজয়ীকে সর্বশক্তিমান না বলে উপায় নেই।

এখন আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি সেই সর্বশক্তিমান বিজয়ীর প্রতিহিংসাকে চরিতার্থ করার জন্য এই অতল নরকাগ্নির মধ্য থেকে তার দাসরূপে তার যত আদেশ অপ্রতিবাদে পালন করে যাব? কিন্তু আমাদের শক্তি যখুন এখনো অটুট ও অক্ষত রয়ে গেছে তখন কেন আমরা অনন্তকাল ধরে অনন্ত শান্তির বোঝা বহন করে। যাব? কি লাভ হবে তাতে আমাদের?

একথা শুনে সেই অধঃপতিত দেবদূতরূপী শয়তান বীলজীবাব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল, দুঃখকষ্ট যত বেশিই হোক, তাতে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়া আরও দুঃখজনক। আমাদের বিরুদ্ধ শক্তির মঙ্গল সাধন করা কখনই উচিই হবে না আমাদের। তার ইচ্ছার বিরোধিতা করে তার অমঙ্গল করে যাওয়াই হবে আমাদের পক্ষে আনন্দের ব্যাপার। আমাদের পরমশ সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি আমাদের চরম দুরবস্থা হতে নিজের কোন স্বার্থ পূরণ করতে চায় তাহলে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে সে উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেব এবং তার ক্ষতি করার চেষ্টা করব। আমাদের চেষ্টা যদি ফলবতী হয় এবং আমরা যদি ব্যর্থ না হই, তাহলে সে দুঃখ পাবে এবং সে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়বে। একবার দেখ, কিভাবে সেই বিজয়ী শত্রু প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তার সহকারীদের নিয়ে অগ্নিঝড়, বস্ত্র ও বিদ্যুৎসহ স্বর্গের প্রান্তদেশ পর্যন্ত আমাদের তাড়া করে আসে এবং স্বর্গলোকের সেই খাড়াই উচ্চতা হতে নীচে ফেলে দেয় আমাদের। এখন অবশ্য আর সেই বজ্রের কোন গর্জন এই নরকগহ্বরে ধ্বনিত হয় না।

আমাদের শত্রুদের ক্রোধের প্রচণ্ডতা প্রশমিত হোক না হোক, এই ঘটনাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। একবার চেয়ে দেখ, এক শূন্য ঊষর প্রান্তর বিস্তৃত হয়ে আছে। তোমার সামনে। আলোকহীন এই অন্ধকার প্রান্তরের এখানে-সেখানে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হতে বিচ্ছুরিত শিখাগুলি এক ম্লান ও ভয়ঙ্কর আভা বিকীর্ণ করছে। যদি সম্ভব হয় তো ঐ অগ্নিপ্রবাহের মধ্যেই বিশ্রাম করতে হবে আমাদের। ঐখানেই আমাদের ছত্রভঙ্গ হতোদ্যম সেনানীদের পুনরায় সমবেত ও সংগঠিত করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে কিভাবে শত্রুর উপর আমরা আঘাত হেনে আমাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারি, কিভাবে এই সর্বনাশা বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ পেতে পারি এবং আশা থেকে এক প্রাণশক্তি আহরণ করতে পারি। যদি তা না পারি তাহলে ভেবে দেখতে হবে, এই নৈরাশ্যজনক অবস্থা থেকে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে পারি।

এইভাবে শয়তান প্রবহমান বন্যাস্রোতের মধ্যে পা ডুবিয়ে মাথাটি কোনরকমে তুলে তার নিকটতম সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। বিরাটাকার জলজ জন্তু অথবা টিটানীয় দৈত্য-দানবদের মত জলের উপর মাথা তুলে ভাসছিল শয়তান বীলজীবাব। ঈশ্বরের বিধানে সে শৃঙ্খলিত অবস্থায় সেই জ্বলন্ত জলরাশির উপর এমনভাবে ভাসছিল যাতে করে তার কু-অভিসন্ধি পূরণ করার প্রচুর অবকাশ ছিল। যাতে করে সে তার অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে নতুন করে অভিশাপের বোঝা তুলে নিতে পারে তার মাথায়। সে তখন তার প্রচণ্ড ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনায় অন্ধ উন্মত্ত হয়ে পরের ক্ষতি ও ধ্বংস সাধনের চেষ্টা করে চলেছিল, তখন সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তার এই অশুভ চেষ্টার দ্বারা যে মানুষকে সে ছলনার দ্বারা অন্যায় পথে চালিত করে, সেই মানুষের সামনে অনন্ত মঙ্গল ও করুণার পথ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারেনি, সে চেষ্টার দ্বারা শুধু তার নিজের ক্ষতি করে চলেছে সে। তাই তার মাথায় পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে শুধু প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনা। শুধু তারই জীবনে নেমে আসছে এক জটিল বিশৃঙ্খলা আর কুটিল অশান্তি।

সেই জলরাশির মধ্যে সাঁতার কেটে পায়ের তলায় এক শক্ত মাটি পেল সে। সে তখন তার পাখাদুটি বিস্তার করে শুকনো জমির উপর তার বিশাল দেহটি নিয়ে অবতরণ করল। ধূসর ছায়ান্ধকারে ভরা সেই জমির উপর জ্বলছিল শুকনো আগুন। সেই জলাশয়ে জ্বলতে থাকা আগুনের মত সে আগুন তরল ছিল না। শত শত ধাতব দাহ্য বস্তুর দ্বারা পুষ্ট এটনার মত জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হতে যেমন ধূম ও অসংখ্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উদগীরিত হয়ে বাইরের বাতাসকে উত্তপ্ত করে তোলে, তেমনি সেই ধরনের ধূমায়িত অগ্নিতপ্ত বাতাসের দ্বারা পরিপূর্ণ সেই পতিত জমির উপর পদার্পণ করল সে।

বীলজীবাবের পরেই তার সঙ্গীও পদার্পণ করল সেখানে। দুজনেই নিজেদের শক্তিতে মুক্তি পেল সেই জ্বলন্ত জলরাশি থেকে।

তারপর বীলজীবাবের সঙ্গী সেই হৃতগৌরব বিদ্রোহী দেবদূত বলল, চির-আলোকিত অনন্ত সুষমা স্বর্গলোকের পরিবর্তে চির-অন্ধকার ও বিষাদাচ্ছন্ন এই স্থানই কি আবাসভূমি হবে আমাদের? তাই হোক, কারণ সর্বশক্তিমান যা ভাল বুঝবে তাই হবে, তার ইচ্ছাই পরিপূরিত হবে এবং তারই আদেশ পালিত হবে। শুধু শক্তির জোরে যে

সকলের উপর প্রভুত্ব করছে সেই সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল। বিদায়, হে চিরসুখবিরাজিত চির-হাস্যোজ্জ্বল মনোরম ক্ষেত্ররাজি। স্বাগত হে বিভীষিকাময় গভীরতম নরকপ্রদেশ, তোমার এই নূতন অধিকারীকে বরণ করে নাও, স্থান ও কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যার মন পরিবর্তিত হয় না। স্বস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত সেই মনই নরককে স্বর্গে এবং স্বর্গকে নরকে পরিণত করে তোলে। আমি যেখানেই থাকি না কেন, কি আসে যায় তাতে? বজ্রধারী আমার শত্রুর থেকে শক্তিতে যদি আমি কিছু কম হই তাতেই বা ক্ষতি কি? এখানে অন্তত আমরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারব। সর্বশক্তিমানের হিংসার জাল বিস্তৃত হবে না এতদূর পর্যন্ত। তার শাসন ও তাড়নের সীমা থেকে মুক্ত এ প্রদেশ। এখানে আমরা নিরাপদে রাজত্ব করতে পারি। আমার মতে রাজত্বই হবে সকল উচ্চাভিলাষের লক্ষ্যবস্তু এবং স্বর্গে দাসত্ব করার থেকে নরকে রাজত্ব করা অনেক ভাল। কিন্তু আমার সঙ্গীরা কি জন্য এখনো পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এই শক্ত জমির উপর না উঠে সর্ববিস্মরণী ঐ জ্বলন্ত জলাশয়ের মধ্যে দুঃখে কাতর হয়ে শুয়ে আছে? কেন তারা আমাদের ছিন্নভিন্ন শক্তিগুলিকে সমবেত ও সংগঠিত করে হারানো স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। না?

শয়তান এই সব বলার পর বীলজীবাব উত্তর করল, হে সুযোগ্য সেনানায়ক, একমাত্র সর্বশক্তিমান ছাড়া কেউ পরাভূত করতে পারত না তোমাকে। আজ যারা ঐ জ্বলন্ত জলরাশির মধ্যে দুর্দশার শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ে আছে, তারা যদি তোমার এই তেজোদ্দীপক কণ্ঠস্বর একবার শুনতে পায় তাহলে নূতন সাহস ও উদ্যমে উদ্দীপিত হয়ে উঠবে তারা। আমরাও ওই জ্বলন্ত জলরাশির মধ্যে ছিলাম স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হবার পর।

তার কথা শেষ হতেই আর একজন তার থেকে বড় শয়তান জল ভেঙে কূলের দিকে এগিয়ে চলছিল। তার বিশাল গোলাকার ঢালটি তার কাঁধের উপর পূর্ণ চাঁদের মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, যে চাঁদ তুষ্কার শিল্পীরা ফেলোলের গম্বুজ থেকে পর্যবেক্ষণ করে। তার বর্শাটিকে নরওয়ের পাহাড়ে জন্মানো সুউচ্চ পাইন গাছের মত দেখাচ্ছিল যে গাছ থেকে কোন বড় জাহাজের মাস্তুল হতে পারে। জল ভেঙে সমুদ্রপ্রমাণ সে জ্বলন্ত জলরাশির প্রান্তবর্তী কূলে উঠে দাঁড়াল সে, যে কুল ছিল ভলভার্নের পাহাড় নদী সমন্বিত উষর ও বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মত দেখতে।

জ্বলন্ত জলরাশির উপরে সেই কুলের উপর উঠে দাঁড়াতেই সে তার চিন্তামগ্ন সেই সব সঙ্গীদের ডাকল। তার সেই সব সঙ্গীদের অবস্থা হয়েছিল মিশরের রাজা ফ্যারাওর অত্যাচারে উৎপীড়িত ইহুদীদের মত। ফ্যারাওর সশস্ত্র সৈন্যরা যে মিশরীয় ইহুদীদের তাড়া করে লোহিত সাগরের উপকূলভাগ পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং নিরাপদ উপকূলভূমি হতে সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত ইহুদীদের ভাসমান মৃতদেহগুলিকে প্রত্যক্ষ করতে থাকে, সেই অসহায় ইহুদীদের মতই তার শয়তান সঙ্গীরাও সেই জলরাশির মধ্যে ডুবে ছিল শুধু তাদের মাথাটি বার করে।

সে তার সঙ্গীদের এত উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল যে সেই শব্দে সেই নরকপ্রদেশের গভীরতম কন্দর পর্যন্ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। তাদের অবস্থার এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনে বিস্ময়াভিভূত তার সঙ্গীরা চমকে উঠল সেই ডাকে।

সে তাদের বলল, হে আমার সহকর্মী যোদ্ধগণ, স্বর্গের যে সুষমা এতদিন ভোগ করে এসেছ তোমরা, আজ সে সুষমা হারিয়েছ। হে অমর আত্মাগণ, তোমরা কি এমনি করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বসে থাকবে বিকল প্রাণশক্তি নিয়ে? অথবা নিবিড় রণক্লান্তির পর স্বর্গলোকের মনোরম উপত্যকার মত এই স্থানটিকেই নিদ্রা যাবার জন্য বেছে নিয়েছ? অথবা তোমরা কি তোমাদের বিজয়ী শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে তাকে বরণ করে নেবার শপথ করেছ? সেই শত্রু তোমাদের মত অধঃপতিত ও জলমগ্ন বিদ্রোহী দেবদূতের দুরবস্থা আজও পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সুদূর স্বর্গলোক হতে। আজও সব শত্রুতা মুছে যায়নি তার মন থেকে। যে কোন মুহূর্তে বজ্রাঘাতে সে তোমাদের গেঁথে দিতে পারে নরকগহ্বরের গভীরতম তলদেশের সঙ্গে। সুতরাং আর ঘুমিয়ে থেক না। জাগো, ওঠ। আর তা যদি না করো তাহলে চিরদিন অধঃপতিত হয়ে থাক এইভাবে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ডাকে যেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরীরা সহসা ব্যস্ত হয়ে জেগে ওঠে, তেমনি প্রধান শয়তানের ডাক শুনে তার দলভুক্ত সকলেই পাখা বিস্তার করে এক লাফে জল থেকে উঠে পড়ল কূলে। এতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের দুরবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি ঠিকমত, তাদের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেনি। তথাপি তারা তাদের প্রধানের ডাক শুনে প্রস্তুত হয়ে উঠল তার আদেশ পালনের জন্য।

মিশরে থাকাকালে এক ঘোর বিপদের দিনে আসরামপুত্ৰ মোজস সমুদ্রকূলে বেড়াতে বেড়াতে পুবের বাতাসে ভাসমান মেঘমালার মত পঙ্গপালের দলকে আহ্বান করে এবং সেই পঙ্গপালের দল যেমন অধার্মিক ফ্যারাওর রাজ্যের উপর পাখা বিস্তার করে অকালে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয় সেই রাজ্যের আকাশ, তেমনি এই সব অশুভ শক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরদ্রোহী দেবদূতেরা পাখা বিস্তার করে অন্ধকার করে দিল সেই নরকপ্রদেশের আকাশকে।

তারপর তাদের নেতা বর্শা উত্তোলন করে তাদের পথনির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা জল থেকে বাইরে উঠে দাঁড়াল শক্ত মাটির উপরে। মধ্যযুগের প্রাক্কালে ইউরোপের উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করা বর্বর জাতিদের মতই তারা ছিল অগণ্য। সেই বর্বর জাতির আক্রমণকারীরা উত্তর দিক থেকে রাইন ও ড্যানিয়ুব নদী পার হয়ে বন্যাস্রোতের মত ছুটে এসে জিব্রাল্টার প্রণালী ও লিবিয়ার মরু অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তেমনি সেই বিদ্রোহী দেবদূতেরা তাদের সেনানায়কের নির্দেশে সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেইখানে এসে অবতরণ করল।

এই সব দেবদূতের দেহাকৃতি ছিল মানুষের থেকে সুন্দর, সুগঠিত ও রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্ন। একদিন তাদের প্রত্যেকেই ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্যে রাজকীয় সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বিদ্রোহ ও চক্রান্তের জন্য স্বর্গ থেকে মুছে যায় তাদের নাম। হারিয়ে ফেলে সব মর্যাদা ও মানসম্মান। আদি-মাতা ঈভের সন্তানদের মত তারা নূতন নামও পায়নি। স্বর্গচ্যুত হয়ে ঈশ্বরের শাস্তিস্বরূপ মানবজাতি যখন মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন এই অধঃপতিত ও নামহীন বিদ্রোহী দেবদুতেরা মিথ্যা ছলনার দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে মানবজাতিকে। পরম স্রষ্টা ঈশ্বরকে ত্যাগ করতে বাধ্য করে তারা। ঈশ্বরের বিধানে দেবদূত থেকে বর্বরে পরিণত হয় তারা। অর্থ ও ঐশ্বর্যের মোহে দেবতার পরিবর্তে সেই সব শয়তানদেরই বরণ করে নেয় মানুষ। নাস্তিক মানবজাতির মধ্যে এই সব শয়তানরা বিভিন্ন নামে পূজিত হতে থাকে।

হে কাব্যকলার অদিষ্ঠাত্রী দেবী, বল, কোন কোন নামে অভিহিত হয়ে থাকে তারা। তাদের মধ্যে প্রথম কে এবং কে শেষে তাদের সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই অগ্নিময় শূন্য বিশাল প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ায় তার কাছে।

তাদের মধ্যে যারা প্রধান তারা নরকগহুর হতে বেরিয়ে মানব শিকারের উদ্দেশ্যে মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারা ক্রমে ক্রমে মানবজাতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেবতার আসনে তাদের অধিষ্ঠিত করে তাদের পূজা করতে বলে মানবজাতিকে। প্রতিটি মন্দিরে তাদের বিগ্রহমূর্তি বেদীতে প্রতিষ্ঠা করে তাদের পূজা করা হতে থাকে। এইভাবে তাদের জঘন্য অভিসন্ধির অন্ধকার দিয়ে ম্লান করে দিতে চায় ঈশ্বরের আলোকে।

মলোক হলো এই ধরনের এক দেবতা যার বিগ্রহ নরবলির রক্তে রঞ্জিত ও অসংখ্য পিতা-মাতার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে থাকত সব সময়। কিন্তু অসংখ্য জয়ঢ়াক আর কসরের তুমুল শব্দে বলির শিশু ও তাদের পিতা-মাতাদের কান্না শুনতে পাওয়া যেত না। তারপর সেই নরবলির মাংস আগুনে ঝলসিয়ে ভোগ দেওয়া হত তার বিগ্রহকে।

আম্মোনাইট নামে আর এক দেবতাকে রাব্বা, আর্গর ও বেসালে পূজা করা হত। কিন্তু এই দেবতা এই পূজায় সন্তুষ্ট না হয়ে উদারহৃদয় সলোমনকে প্ররোচিত করে তাকে দিয়ে সেই ঘৃণ্য পাহাড়ের উপর ভগবানের মন্দিরের পাশে তার একটি মন্দির নির্মাণ করায়। এইভাবে জেরুজালেমের সন্নিকটস্থ সুন্দর হিল্লম উপত্যকাটি বলির রক্তে রঞ্জিত এক নরককুণ্ডে পরিণত হয়।

আর একজনের নাম হলো শেমস। অরোয়া থেকে নেবে ও হেনিবনের দক্ষিণের অরণ্যাঞ্চল পর্যন্ত মোয়াবের অত্যাচারী ভয়াবহ পুত্রেরা তার পূজা করত। এ ছাড়া সেদিন থেকে হয়রানাইম পর্যন্ত বিস্তৃত সিওমের রাজ্য ও তার ওপারে আঙুর গাছে আচ্ছাদিত সিবমার পুষ্পিত উপত্যকায় সে পূজিত হত।

আর একজনের নাম হলো পিওর। সে সিট্রিম্-এ ইহুদীরা যখন নীলনদের তীরে এক জায়গায় অভিযানে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল তখন তাদের তার জন্য অনেক পশুবলি দিতে প্ররোচিত করে। তার ফলে অনেক কষ্টভোগ করতে হয় তাদের। এরপর সে মাউন্ট অলিভ পর্যন্ত পশুবলি ও ধর্মবলির নিষ্ঠুর প্রথা প্রবর্তন করে। সেই সঙ্গে লোকের নরবলির প্রথাও চলতে থাকে। অবশেষে জোসিয়া একদিন মূর্তিপূজা ও নরবলি প্রথার উচ্ছেদ করে।

এরপর এল দু’জন নারী যারা মিশর ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী নদীবিধৌত অঞ্চলে র‍্যালিস ও এ্যাস্টারথ নামে দুই স্ত্রী-দেবতারূপে পূজিত হয়। দেবদূতদের বিদ্রোহী বিশুদ্ধ আত্মার মধ্যে অস্থিমজ্জা ও মাংসসমন্বিত কোন অবয়বসংস্থান না থাকায় তারা ইচ্ছামত স্ত্রী-পুরুষ যে কোন মূর্তি ধারণ করতে পারে। তারা যে কোন সময়ে সুন্দর বা কুৎসিত রূপ পরিগ্রহ করে মিত্ৰতা বা শত্রুতার দ্বারা তাদের যে কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। এই সব অপদেবতাদের প্রভাবেই ইহুদীরা তাদের প্রাচীন ধর্মসম্মত দেবতাদের ত্যাগ করে কতকগুলি পাশবিক অপদেবতার উপাসনা করতে থাকে। এই সব পাশবিক দেবদেবীর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তারা অন্যায় যুদ্ধে রত হয়ে ঘৃণ্য শত্রুদের সাময়িক শক্তির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়।

ফিনীশীয়রা এই অপদেবী এ্যাস্টারথকে স্বর্গের রানী এ্যাস্তাতে নামে অভিহিত করত। এই দেবীর মাথায় দুটি শিং-এর মত দুটি অর্ধচন্দ্র বিরাজ করত। সিডোনিয়ার কুমারী মেয়েরা চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে এই দেবীর বেদীর সামনে পূজা দিত এবং প্রার্থনার গান গাইত।

সিওনেও এই দেবী পূজিত হয় এবং একটি পাহাড়ের উপর তার এক মন্দির ছিল। কোন এক রাজা এই মন্দির নির্মাণ করে। এই রাজার অন্তঃকরণটি বেশ বড় এবং উদার হলেও এই সুন্দরী দেবীমূর্তির অশুভ প্রভাবে যত সব অপদেবতার পূজার্চনা করতে থাকে।

এর পর আসে থাম্মাজ। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালের কোন এক তিথিতে সিডোনিয়ার কুমারীরা যার আঘাতের জন্য শোকাহত হয়ে বিলাপ করতে থাকে সকরুণ সুরে। প্রতি বছর ভেনাসের প্রেমিক এ্যাডনিসের আঘাতে একবার করে আহত হয় থাম্মাজ আর তার রক্তে রঞ্জিত হয়ে এ্যাডনিস ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দেয় সমুদ্রের জলে। তার ব্যর্থ প্রেমের কাহিনীর দ্বারা সিয়নকন্যার হৃদয় সংক্রামিত হয়।

এরপর আর একজন এল। সে সত্যি সত্যিই বিলাপ করছিল তাঁর দুঃখে। একটি জাহাজের আঘাতে মন্দিরের মধ্যেই বিকৃত হয়ে যায় তার মৃর্তিটি। তার মাথা আর হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেহ থেকে। বেদীর উপর মূর্তিটি পড়ে যায়। ভক্তেরা লজ্জিত হয়। ভেগন নামে সে এক সমুদ্রদানব। তার উপর দিকটা মানুষের আকৃতি আর নিচের দিকটা মাছের মত। তথাপি প্যালেস্টাইনের দক্ষিণভাগে উপকূলবর্তী এ্যাজোটাস নামে এক শহরে এই দানবদেবতার এক সুউচ্চ মন্দির নির্মিত হয়। প্যালেস্টাইনের সমস্ত উপকূলভাগ, গথ ও এ্যাসকাসনে এই দেবতা ভয়ের সঙ্গে পূজিত হয়। একারন ও গাঁজার সীমান্ত অঞ্চলেও এই দেবতা পূজিত হয়।

এরপর আসে সিরিয়ার অন্যতম দেবতা রিম্মন। দামাস্কাসের একটি সুন্দর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয় তার বিগ্রহমূর্তি। আব্বানা ও ফারফর নামে দুটি নদীর তীরবর্তী উর্বর ভূখণ্ডে সে পৃজিত হয়। জামন নামে সিরিয়ার সেনাপতি জন নদীতে স্নান করে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্ত হয়ে ইহুদীদের দেবতার ভক্ত হয়ে ওঠে। আহাজ নামে জুড়ার এক রাজা সিরিয়ার সেনাপতিকে পরাজিত করে তার পুত্রদের পুড়িয়ে মারে। প্রথমে সিরিয়ার দেবতাদের অবমাননা করার পর শেষে সেই দেবতাদের ভক্ত হয়ে সিরিয়ার ধর্ম গ্রহণ করে।

এরপর আসে ওরিসিস, আইসিস ও ওরাস। তারা ভয়ঙ্কর দৈত্যের আকার ধরে এসে মিশরের ধর্ম ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা ও অপমান করতে থাকে। মিশরীয় ইহুদীরা গরুদের মৃতি মন্দিরে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে দেবতারূপে পূজা করত। এ্যারন একটি সোনার বাছুর মন্দিরে দেববিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করে। রাজা জেরিবোয়ামও দুটি সোনার বাছুরমূর্তি বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করে মন্দিরে। ওরিসিস, আইসিস ও ওরাস দৈত্যরূপে মিশরের গরুগুলোকে ভ্রাম্যমাণ ঘৃণ্য দেবতা ভেবে ধরতে যায়।

ইহুদীরা মিশরীয়দের গরু পূজা থেকেই গরুর মূর্তি মন্দিরে মন্দিরে পূজা করতে থাকে। চারণরত বলদকে তারা পরমস্রষ্টা বলে মনে করে। পরে ইহুদীদের ঈশ্বর জেহোভা মিশর থেকে চলে যাবার সময় বহু গরুকে বধ করে।

সবশেষে এল বিলায়েল। তার আত্মা সবচেয়ে বেশি হিংসাপরায়ণ। সে মন্দির ও বেদী পছন্দ করত না। তবু তার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরবেদীতে। সে সবচেয়ে হিংসাকে ভালবাসত। মন্দিরের পুরোহিতরাও নাস্তিক হয়ে যায় তার প্রভাবে।

বিলায়ালের মত এলির পুত্ররাও কামনা আর হিংসার তীব্রতার দ্বারা কলুষিত করে তোলে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে। বড় বড় শহরের পথে-ঘাটে তার প্রভুত্ব পরিলক্ষিত হয়। সেই সব শহরগুলিতে মারামারি হানাহানি হাঙ্গামার শব্দ যখন প্রাসাদশীর্ষগুলোতে ছড়িয়ে যায়, অন্ধকার নেমে আসে যখন রাজপথগুলোতে তখন বিলায়ালের পুত্ররা পানোন্মত্ত অবস্থায় দর্পভরে ঘুরে বেড়ায় সেই সব রাজপথে।

সোডম শহরের রাজপথেও এই ধরনের ঘটনা ঘটত। গিবীয়া শহরের রাজপথে কোন এক রাত্রিতে পাননান্মত্ত কয়েকজন ব্যক্তি এক নারীকে বলাৎকার করতে এলে পথের ধারে একটি বাড়ির দরজা খুলে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এই বিশৃঙ্খলাজনক ঘটনা প্রায়ই ঘটত তখন।

এরপর যারা এসেছিল তারা হলো গ্রীক দেবতাবৃন্দ যারা ছিল জোফেথপুত্র জানের সন্তান। গ্রীকপুরাণের মতে ইউরেনাস ও গী থেকেই সব দেবতা, দানব ও পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। ইউরেনাস-এর ভাই হলো স্যাটার্ন বা শনি এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম হলো টিটান। পরে তাদের থেকে শক্তিশালী রীয়ার পুত্র জোভ টিটান ও স্যাটার্নের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্যের অধিকার ছিনিয়ে নেয়। পরে প্রথমে ক্রীট ও আইডা এবং পরিশেষে তুষারাচ্ছন্ন অলিম্পাসের সর্বোচ্চ শিখরে রাজত্ব করতে থাকে। এটাই ছিল স্বর্গের রাজধানী। ডেলফির পাহাড়ে এ্যাপোলোর ভবিষ্যদ্বাণী আর উত্তর গ্রীসে অবস্থিত দোদনায় জিয়াসের ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যেত। সমগ্র দক্ষিণ গ্রীস, আদ্রিয়া হতে হেসপীরিয়া ও সুদূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জগুলিতে এই সব দেবতার প্রভাব প্রসারিত হয়। স্যাটার্ন আদ্রিয়াতিক সাগর অতিক্রম করে ইতালি গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে।

এরপর দেবদূতরূপী আরও অনেক আত্মা এল। তারা এল বিষণ্ণ মুখে ও অবনত মস্তকে। হতাশার ভারে তাদের অন্তর ভারী হয়ে থাকলেও তারা যখন দেখল তাদের প্রধানের মনে কোন হতাশা নেই, এক দুর্মর অবস্থায় উদ্দীপিত হয়ে আছে তার মনপ্রাণ, তখন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাদের মুখগুলো। ‘ তারা দেখল তাদের প্রধান পরাজিত হলেও তার মুখে রয়েছে এক অপরাজেয় প্রাণশক্তির রহস্যময় উজ্জ্বলতা। দর্পভরে তার সমস্ত উদ্ধত শক্তিকে সংহত করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষায় সে শক্তির দম্ভকে প্রকাশ করল সে। কিন্তু তাতে তার আসল শক্তির থেকে শক্তির দম্ভটাই প্রকাশিত হলো বেশি। তার এই দম্ভোক্তি তার অধীনস্থ অনুচরদের মন থেকে সব ভয় অপসারিত করে হারানো সাহস ফিরিয়ে আনল তাদের মনে।

এরপর প্রধান জোর গলায় ঘোষণা করল, যুদ্ধের জয়ঢাক আর ভেরী বাজার সঙ্গে সঙ্গে তার জয়পতাকা উত্তোলিত হবে ঊর্ধ্বে। আজাজেল নামে এক শয়তান হবে তার সেনাপতি এবং পতাকাবাহক।

এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পতাকা উত্তোলন করল আজাজেল। স্বর্ণ ও মণি-মুক্তাখচিত এবং বিভিন্ন অস্ত্র ও জয়চিহ্নমণ্ডিত সেই পতাকা ঊর্ধ্বলোকে বিস্তৃত হয়ে উল্কার মত জ্বলজ্বল করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে নানারকমের ধাতব বাদ্যযন্ত্রে সামরিক বাজনা বাজতে লাগল। শয়তান সেনারা ভয়ঙ্করভাবে এমন জয়ধ্বনি দিতে লাগল যার শব্দে আদিম অন্ধকারে আচ্ছন্ন নরকপ্রদেশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। মুহর্তমধ্যে বিচিত্র বর্ণের অজস্র পতাকা আন্দোলিত হতে লাগল আকাশে। অসংখ্য বর্শা, শিরস্ত্রাণ এবং ঢাল সঞ্চালিত হতে লাগল ইতস্তত।

এইভাবে রণসাজে সজ্জিত হয়ে উঠল শয়তানেরা। তাদের চোখমুখের উপর সেই সময় ছিল ক্রোধের পরিবর্তে এক বীরত্ববোধ এবং প্রাণপণ সংগ্রামের এক কঠিন সংকল্প। সমস্ত ভয়, সংশয় ও দুশ্চিন্তাকে মন থেকে নিঃশেষে অপসারিত করে ফেলার জন্য তারা যেন ছিল বদ্ধপরিকর।

একই সংকল্পে দৃঢ় ও একই উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই বিশাল শয়তানবাহিনী বর্শা, ঢাল প্রভৃতি উজ্জ্বল অস্ত্রসম্ভারে প্রাচীনকালের যোদ্ধাদের বেশে সজ্জিত হয়ে সেই অগ্নিদগ্ধ ভূমির উপর দাঁড়িয়ে তাদের প্রধানের কাছ থেকে নির্দেশ পাবার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে রইল।

তাদের প্রধান তখন তার অভিজ্ঞ ও সন্ধানী দৃষ্টি ইতস্তত পরিচালিত করে সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগল। দেখল সেই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সেনার মুখ এবং চেহারা দেবতাদের মত, তাদের সংখ্যা অগণ্য। তা দেখে এক অপরিসীম গর্বে ভরে উঠল তার বুক। এক সুদৃঢ় শক্তির উচ্ছ্বসিত গৌরব উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। পৃথিবীতে আসার পর থেকে কোন মানুষ সুসংগঠিত করে দেখেনি কখনো।

এইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার লেগ্রায় দৈত্যরা দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। থীবস ও ইলিয়ামে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় তাতে দেবতারা উভয় পক্ষে যোগদান করে সাহায্য করে দু পক্ষকে। উথার পুত্র রাজা আর্থারও ইংরেজ নাইটদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে ইতালির ক্যালাব্রিয়া ও এ্যাসপ্রামতে, দামাস্কা বা মরোক্কোতে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। খ্রিস্টানজীবি শার্লেমেনও সারাসীনদের সঙ্গে যুদ্ধে ফস্তারাব্বিয়াতে তার সেনাপতিগণসহ পরাজিত হয়।

এই সব মর্ত্যমানব বা যোদ্ধাদের সামরিক শক্তির থেকে সেই দেবদূতরূপী শয়তানদের শক্তি ছিল অনেক বেশি। অতুলনীয় সামরিক শক্তিসম্পন্ন সেই সব শয়তানরা রণসাজে সজ্জিত হয়ে তাদের প্রধানের কাছ থেকে চূড়ান্ত আদেশ পাবার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। আকারে ও দর্পিত অঙ্গভঙ্গিমায় তাদের প্রধান ছিল তাদের সবার থেকে শ্রেষ্ঠ। উদ্ধত প্রাসাদশীষের মত দাঁড়িয়ে ছিল সে তাদের মাঝে। অধঃপতিত দেবদূত হলেও তার অঙ্গজ্যোতি তার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারায়নি তখনো। তখনো ম্লান হয়নি তার গৌরব। কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে নবোদিত সূর্য অথবা গ্রহণকালে রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের মত শুধু স্তিমিত দেখাচ্ছিল তার তেজ। স্তিমিত হলেও তার তেজ অন্য সব অধঃপতিত দেবদূতদের তুলনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছিল সবার উপরে। যদিও তার মুখমণ্ডলে বজ্রাঘাতের এক ক্ষতচিহ্ন ছিল পরিস্ফুট এবং তার ম্লান মুখের উপরে বিরাজিত ছিল উদ্বেগের ছায়া, তথাপি এক দর্শনীয় সাহসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছিল তার জ্বযুগলের মধ্যে। প্রতিশোধ বাসনায় উদ্ধত হয়ে উঠেছিল এক অনমনীয় দম্ভ। তার দু’চোখের মধ্যে এক দৃঢ় সংকল্পের নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠলেও তার অধঃপতিত অনুচরবৃন্দের যন্ত্রণাভোগ দেখে অনুশোচনা ও সমবেদনা জাগছিল তাদের জন্য। একমাত্র শুধু তার অপরাধ ও বিদ্রোহের জন্য অসংখ্য আত্মা তাদের অনন্ত ঐশ্বর্যমণ্ডিত স্বর্গীয় আবাসভূমি থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে পতিত হয়েছে এই দুঃসহ নরকপ্রদেশে। আকাশ থেকে ঝরে পড়া জ্বলন্ত রৌদ্রতাপে পত্ৰচ্যুত হয়েও যেমন পর্বতোপরি পাইন গাছগুলি ও অরণ্যমধ্যস্থিত ওক গাছগুলি বিশুষ্ক শাখাপ্রশাখাসহ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি হৃতগৌরব হয়েও তার অনুচরেরা তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে দাঁড়িয়ে ছিল তার কাছে।

অবশেষে সে তাদের কিছু বলার চেষ্টা করল। তারা তা বুঝতে পেরে মাথা নত করে স্তব্ধ হয়ে রইল। তিনবার সে চেষ্টা করল। কিন্তু তিনবারই সে না চাইলেও অবধারিত অবাঞ্ছিত অশ্রুধারায় অবরুদ্ধ হয়ে উঠল তার কণ্ঠ। পরে এক গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তার কথা পথ খুঁজে বেরিয়ে এল তার কণ্ঠ থেকে।

সে তার অনুচরদের সম্বোধন করে বলল, হে অমর আত্মাগণ, একমাত্র সর্বশক্তিমান ছাড়া আর কারো সঙ্গে তোমাদের শক্তির তুলনা হয় না। যে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামস্বরূপ তোমরা এই ঘৃণ্য ও অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পতিত হয়েছ সে যুদ্ধ কিছুমাত্র অগৌরবের নয়। কে তার মনের সমস্ত শক্তি এবং বর্তমান ও অতীত সম্পর্কিত জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিল স্বর্গের সম্মিলিত দেবগণ আমাদের প্রতি-আক্রমণের দ্বারা বিব্রত ও বিপন্ন হবে? এই সব অধঃপতিত ও স্বর্গ হতে নির্বাসিত দেবদূতেরা তাদের আদি আবাসভূমি স্বর্গলোক নিজেদের শক্তিতে পুনরুদ্ধার করতে পারবে না, একথা এখন কেউ বিশ্বাস করবে? কে বলবে আমি সব বিপদ অতিক্রম করতে না পেরে সব আশা হারিয়ে ফেলেছি? সে আজ তার রাজশক্তি নিয়ে স্বর্গের সিংহাসনে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজত্ব করছে। তার শক্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতাই বিদ্রোহে প্রলুব্ধ করে আমাদের পতনকে ডেকে আনে।

এখন শুধু আমরা সেই শক্তির ও আমাদের নিজেদের শক্তির পরিমাণ কত তা জানি। এখন শুধু আমাদের প্রয়োজন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়া। এখন সামরিক শক্তি, ছলনা, প্রতারণা প্রভৃতি সব কিছু প্রয়োগ করে সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে পর্যদস্ত করতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, যারা গায়ের জোরে শত্রুদের জয় করে তারা শুধু অর্ধশক্তিকে জয় করে। সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারে না। স্বর্গ, মর্ত্য ও নরক ছাড়া মহাশূন্যমণ্ডলে আরও অনেক নূতন জগতের সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখানে ঈশ্বরের সন্তান মানবজাতির মত এক নূতন জাতির বংশধারার প্রবর্তন করার ইচ্ছা ছিল ঈশ্বরের। আমরা সেই ধরনের কোন জগতে বসতি স্থাপন করব। কারণ আমাদের মত স্বর্গীয় আত্মা বা দেবদূতেরা কখনো নরকগহ্বরের এই অন্ধকারে আবদ্ধ থাকতে পারে না চিরদিন। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন ভেবে দেখতে হবে, অশান্তি আর হতাশায় মন আমাদের আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও পরাভব বা বশ্যতা স্বীকারের কথা ভাবতেই পারি না আমরা। সুতরাং একমাত্র যুদ্ধ, ঘোষিত বা অঘোষিত যুদ্ধই সমাধান করতে পারে সকল সমস্যার।

এই কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বলিষ্ঠদেহী সেই সব শয়তানের কটিদেশে আবদ্ধ কোষগুলি থেকে মুক্ত হয়ে অসংখ্য শাণিত তরবারি ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হলো। সেই সব তরবারির উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে উঠল অন্ধকার নরকপ্রদেশ। তাদের বজ্রমুষ্ঠিগুলি ঢালের সঙ্গে ঘর্ষিত হওয়ায় স্বর্গলোকের বিরুদ্ধে এক প্রকাশ্য বিদ্রোহ বা যুদ্ধের সশব্দ প্রস্তুতি প্রকটিত হয়ে উঠল।

অদুরে একটি পাহাড় ছিল যার শিখরদেশ হতে ক্রমাগত অগ্নি আর ধুম উদগীরিত হচ্ছিল। সেই পর্বতশিখরটি ছিল উজ্জ্বল প্রস্তরের দ্বারা মণ্ডিত। এর থেকে বোঝা যাচ্ছিল সেই পর্বতের গর্ভের মধ্যে ছিল অনেক জ্বলন্ত ধাতু।

অভিযানকারী রাজার সৈন্যদল হতে একটি অগ্রবর্তীবাহিনী যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে আগে গিয়ে শিবির স্থাপন বা পরিখা খনন করে তেমনি বিদ্রোহী দেবদূতরূপী শয়তানদের মধ্যে থেকে একটি দল পাখা মেলে উড়ে গেল সেই পর্বতশিখরে। ম্যামন তাদের নেতৃত্ব দান করল। ম্যামনের দেহটা ছিল কুজ প্রকৃতির এবং তার চোখের দৃষ্টি সব সময় অবনত ছিল। যতদিন সে স্বর্গে ছিল তার অবনত দৃষ্টি নিয়ে সে শুধু রাজপথের ঐশ্বর্যগুলিই দেখতে পেত। কিন্তু স্বর্গলোকের ঊর্ধ্বতন স্তরের কোন পবিত্র বা স্বর্গীয় সুষমা ও সৌন্দর্য দেখতে পেত না সে।

এই ম্যামনের দ্বারা প্ররোচিত হয়েই মানবজাতির অপবিত্র হাতে ধনরত্নের আশায় পৃথিবীর গর্ভদেশ খনন করে বহু স্বর্ণখণ্ড নিয়ে আসে। এই উদ্দেশ্যেই তারা ঐ পর্বতের ধূমায়িত শিখরদেশ বিদীর্ণ করে পৃথিবীর গর্ভে চলে যায় এবং ঐ মুখ নিয়েই বেরিয়ে আসে। তবে নরকের মধ্যে যে ঐশ্বর্য আছে, মাটির গর্ভে যে সম্পদ আছে তার জন্য কেউ যেন মর্ত্যলোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে ওঠে। কারণ যারা মৰ্তমানবদের সম্পদ ও কৃতিত্বের জন্য বড়াই করে, যারা ব্যাবিলনের বিস্ময়কর স্বর্গোদ্যান ও মিশরের পিরামিডের জন্য গৌরববোধ করে তাদের জানা উচিত, মানুষ এক যুগে অসংখ্য হাতে অবিরাম শ্রমসহকারে যে সব গৌরবময় কীর্তি ও শিল্পকর্ম গড়ে তোলে, বিদেহী আত্মা বা দেবদূতেরা একদিনেই কত সহজেই তা নস্যাৎ করে দেয়। সামনের ঐ প্রান্তরের মধ্যেও অনেক ছিদ্রপথে পৃথিবীর গর্ভ থেকে অগ্নি উদগীরিত হচ্ছে।

অদুরে মাটির ভিতর থেকে যেখানে ঐকতানের মত এক সুরধারা বেরিয়ে আসে, সেইখানে অনেক মূর্তি ও কারুকার্যখচিত এক স্বর্ণমন্দির নির্মিত হয়েছে। সে মন্দিরের ছাদটিও স্বর্ণনির্মিত ছিল। মিশরের অন্তর্গত প্রাচীন কাইরো বা ব্যাবিলনের স্বর্ণযুগেও এই ধরনের অপূর্ব কোন দেবমন্দির নির্মিত হয়নি সেখানে। ও মন্দিরের সৌন্দর্যের কোন তুলনাই হয় না অতীতের কোন মন্দিরের সঙ্গে। এর সুউচ্চ স্তম্ভগুলি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্বর্ণনির্মিত ছাদের উপর নক্ষত্রের মত অসংখ্য বাতির আলো জ্বলে। মনে হয় আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে সে আলো। অসংখ্য মানুষ এ মন্দির দেখে এর স্থাপত্যকীর্তি ও স্থপতির প্রশংসা করে। এর স্থপতিই স্বর্গলোকের যত সব প্রাসাদ ও সৌধগুলিকে নির্মাণ করে তোলে নিজের হাতে। লোকে বলে তার নাম নাকি মুনসিবার। প্রাচীন গ্রীসেও তার নাম শোনা যেত এবং সর্বজনবন্দিত ছিল সে নাম।

তবু এই কীর্তিমান স্থপতিও স্বর্গচ্যুত হয়। ক্রুদ্ধ জোভ স্বর্গলোকের প্রান্তবর্তী এক দুর্গপ্রাসাদ হতে এই নরকে নিক্ষেপ করে তাকে। সেদিন গ্রীষ্মকালের কোন এক দিন। সকালে স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সূর্য অস্ত যাবার সময় ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত লেমনস দ্বীপে পতিত হয় সে।

কিন্তু যারা একথা বলে তারা ভুল বলে। কারণ সেই স্থপতি এই সব বিদ্রোহী দেবদূতদের সঙ্গেই চিৎ হয়ে পতিত হয় এই নরকপ্রদেশে। যে স্থপতি একদিন স্বর্গে অবস্থানকালে কত প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণ করত সেখানে, আজ সে সেই ধরনের প্রাসাদ ও সৌধমালা নরকে নির্মাণ করার জন্যই পতিত হয়েছে এখানে।

এদিকে দুতেরা রাজার আদেশে শয়তানদের রাজধানী প্যান্ডিমোনিয়ামে রাজপরিষদের ঘোষণা করে বেড়াতে লাগল। প্রতিটি সেনাবাহিনী হতে একজন করে সুযোগ্য প্রতিনিধিকে আহ্বান করল তারা। এইভাবে হাজার হাজার প্রতিনিধি যোগদান করল সে সভায়।

সে সভাস্থলের প্রকাণ্ড প্রবেশপথগুলি জনতার ভিড়ে ভরে গিয়েছিল। সুপ্রশস্ত হলঘরটিতে একেবারেই জায়গা ছিল না। সে ঘরের শুধু মেঝেতে নয়, মাথার উপর শূন্যেও অনেক দেবদূত পাখার উপর ভর করে ঝুলছিল।

বসন্তকালের মৌমাছিরা যেমন সকালবেলায় শিশিরসিক্ত ফুলের উপর ভিড় করে গুঞ্জন করতে থাকে, তেমনি সেই সভাগৃহে সমবেত প্রতিনিধিরা ভিড় করে কলগুঞ্জনে মুখরিত করে তুলেছিল সভাস্থলটিকে। তারা ছিল সংখ্যায় অগণ্য এবং এক স্বল্প পরিসরের মধ্যে অতিশয় ঘনসংবদ্ধ অবস্থায় ছিল।

সে এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য। আকৃতিতে আসলে যারা ছিল মর্তমানবদের থেকে : অনেক বড়, তারা পিরামিডের মত নিজেদের দেহগুলিকে মায়াবলে যথাসম্ভব ক্ষুদ্রাকৃতি করে সেই ছোট সভাগৃহটিতে অগণিত সংখ্যায় ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সব বিদেহী আত্মারা ইচ্ছামত ছোট-বড় করতে পারে নিজেদের দেহকে। তাদের মধ্যে ছিল প্রাচীন রোম ও গ্রীসের বহু অপদেবতা ও শয়তান। তারা স্বর্গআসনে ছিল সমাসীন। ক্ষণকাল নীরবতা পালনের পর সভার কার্যবিবরণী পাঠ করা হলে আলোচনা শুরু হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *