ধর্মগুরু ৪

৩০.

হাতদুটো পেছনে যিপ-টাই দিয়ে আটকে, ঘাড়ে অস্ত্রের খোঁচা মারতে মারতে রানাকে নিয়ে যাওয়া হলো টেম্পলে।

প্যারিসের অডিটোরিয়ামের চেয়ে বহু গুণ সুন্দর এই টেম্পলের ভেতরটা। দরজা পেরিয়ে কাঁচ ও স্টিলের স্টেয়ারকেসের মাধ্যমে কূপের মত গভীর এক জায়গায় জড় হয়েছে নাদির মাকালানির অনুসারীরা।

রানার মনে হলো ওটা ষাঁড়ের লড়াইয়ের এরিনা। গুঞ্জন তুলছে অন্তত তিন শ তরুণ-তরুণী। তাদেরকে দুভাগে ভাগ করেছে একটা পথ। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ব্লেযার পরা একদল গার্ড। দূরে সরু সিঁড়ি উঠেছে চওড়া ক্যাটওয়াকে। সামনে বেড়ে আছে উঁচু এক কালো মার্বেলের স্টেজ। চার কোণে চকচক করছে ক্রোম পালিশ করা চারটে ইজিপশিয়ান দেবতার মূর্তি। ফ্রস্টেড গ্লাসের প্যানেলে তৈরি চারপাশের দেয়াল। তাতে লেসার দিয়ে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক্স।

জায়গাটা রক স্টেডিয়ামের মত, তবে কেন যেন অশুভ মনে হলো রানার। কয়েকজন গার্ড রানাকে ঠেলে নামিয়ে দিল গভীর কূপের মেঝেতে। অস্ত্রের নলের গুঁতো খেয়ে এগোল রানা। সামনের রেলিংহীন সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠল স্টেজে। সামনে বন্দি দেখে হৈ-হৈ করে উঠেছে তরুণ তরুণীরা। জোর দাবি জানানো হলো, যেন প্রাণ নেয়া হয় অবিশ্বাসী যুবকের। স্টেজে ক্রোম ও কাঁচের তৈরি বলির বেদি। রানা টের পেল, হঠাৎ করেই শুকিয়ে গেছে ওর বুকের ভেতরটা।

ওকে একপাশে সরিয়ে নিল গার্ডরা। সুযোগ এলে কোন্ পথে পালাবে, সেজন্যে চারপাশ দেখছে অসহায় রানা। বেরোবার উপায় হতে পারে ওই কূপে নেমে যাওয়া, অথবা স্টেজের পেছনের জোড়া কবাটের দরজা ব্যবহার করা। দুই কবাটের পাশে দুটো করে বড় মূর্তি। দেখলে প্রথমে মনে হয় ওসাইরিসের, কিন্তু মূর্তির ঘাড়ে মানুষের বদলে ঘোড়া ও শেয়ালের মিশ্রণে অদ্ভুত কোন জন্তুর মাথা। ভয়ঙ্কর চেহারা।

ওই মূর্তি দেবতা সেট-এর।

মাত্র চারদিনে টেম্পলের সবই বদলে নিয়েছে নাদির মাকালানি। কেন দূরের দরজা দিয়ে ভক্তদের এখানে আনা হয়েছে, তা বুঝে গেল রানা। উত্তরদিকের জোড়া কবুটের দরজা শুধু রাজপুরুষের জন্যে। এটাই ছিল প্রাচীন মিশরের নিয়ম। নিজ মন্দিরে একই আইন জারি করেছিল কাদির ওসাইরিস। যেহেতু নিজেকে রাজপুরুষ বলে মনে করে, তাই এই নিয়ম বদল করেনি নাদির।

পেরোতে লাগল সময়। অধৈর্য হয়ে উঠছে ভক্ত অনুসারীরা। তারপর কমল সব বাতির প্রভা।

খুলে গেল দরজার দুকবাট। পিরামিডের আলাদা তিনটে পথে হাজির হলো নাদির মাকালানি, আবু ও ভার্নে। তাদেরকে দেখে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করল গার্ডরা।

কিন্তু সেট! সেট! সেট! বলে চিৎকার করতে করতে হাতদুটো মাথার ওপরে তুলল ভক্তরা। বাতাসে ঘুষি চুড়ছে অনেকে। সেট! সেট! সেট!

স্পটলাইট পড়ল নাদিরের ওপর। থমকে দাঁড়িয়ে গেছে সে। তিন সেকেণ্ড পর উঠল স্টেজে। কিছুক্ষণ আগে রানার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে তার, তখন পরনে ছিল দামি কিন্তু সাধারণ সুট- কিন্তু এখন পরনে ইজিপশিয়ান রাজকীয় পোশাক- সবুজ-কালো আলখেল্লা। মাথায় বিশাল এক মুকুট। এ জিনিসই ব্যবহার করত ফেরাউনরা। নাদিরের পেছনে আঘোছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে আবু আর ভার্নে।

নাদিরকে দেখে পাগল হয়ে উঠেছে তরুণ-তরুণীরা। আকাশে ছুঁড়ছে হাত, পা ঠুকছে মেঝেতে। মৃদু কাঁপছে স্টেজ। সেট! সেট! সেট!

বড়ভাইয়ের মতই পীর-দরবেশের ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলল নাদির। কয়েক সেকেণ্ডে কমল সব আওয়াজ। সেটের ভক্তরা! লাউড স্পিকারে গমগম করে উঠল নাদিরের কণ্ঠ। এমন কী তার মুকুটেও আছে মাইক্রোফোন। স্বাগতম! শেষ হয়েছে ওসাইরিসকে তোষণ। সত্যিই এসেছে নতুন শুভ দিন। এখন পৃথিবীতে নেই ওসাইরিস। ফিরেছি আমি, সত্যিকারের নেতা! আবারও ফিরে এসেছি! আমি পরাক্রমশালী সেট! এবার দেখিয়ে দেব দুনিয়াকে, আসলে কত ক্ষমতাশালী হয় সত্যিকারের দেবতা!

এ কথা শুনে খুশিতে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠল তরুণ তরুণীরা। এমন কী খেপে উঠল গার্ডরা। কী কারণে ওকে স্টেজে আনা হয়েছে, সেটা ভুলে যেতে চাইছে রানা। এই সুযোগে হাতের বাঁধন পরীক্ষা করল। বুঝল, দশ মিনিটেও খুলতে পারবে না ওই জিনিস। এইমাত্র ওর পিঠে জোর এক খোঁচা দিয়েছে এক গার্ড। হুঁশ টনটনে তার।

আবারও সবাইকে নীরব হতে ইশারা দিল নাদির মাকালানি। উঠানে তার সঙ্গে যে বিজ্ঞানী ছিল, সে উঠে এল মঞ্চে। হাতে কনটেইনমেন্ট ফ্লাস্ক। কুর্নিশ করল নাদিরকে, তারপর জিনিসটা তুলে দিল মনিবের হাতে। পিছিয়ে চলে গেল আঁধারে।

এই জিনিস, নিচু গলায় বলল নাদির, আমাদেরকে দেবে প্রচণ্ড ক্ষমতা। এটাই ছড়িয়ে দেবে সেট-এর মন্দিরের বাণী। এই কন্টেইনারের ভেতর… মাথার ওপর ফ্লাস্ক তুলল সে। আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু! যারা আমার বিরুদ্ধে যাবে, এ মৃত্যু তাদের! অবিশ্বাসীরা বাঁচবে না প্রাণে! যারা প্রতাপশালী সেটের সামনে মাথা নিচু করবে না, মৃত্যু তাদের!

আবারও পাগল হয়ে উঠল তরুণ-তরুণীরা।

রানা টের পেল, আগের চেয়ে কমেছে উৎসাহ। অন্তত চারভাগের একভাগ ভক্ত চাইছে না দুনিয়া জুড়ে গণহত্যা চালানো হোক।

ফ্লাস্ক নিচে নামিয়ে নিল নাদির। এই কন্টেইনার প্রথম লটের। তোমরা যখন এখান থেকে বিদায় নেবে, সঙ্গে থাকবে একটা করে এই জিনিস। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেবে এটা। আর আমাদের শত্ররা যখন টের পাবে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে তাদের। পরে বুঝবে, তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সাক্ষাৎ মৃত্যু। বাঁচার একমাত্র উপায় সেটের কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়া! একমাত্র সেট পারে সবাইকে বাঁচাতে! তবে তোমরা, সেটের অনুরক্তরা, কিছুই হবে না তোমাদের! সেটের পাউরুটি রক্ষা করবে বিশ্বাসীদের! গলা চড়ে গেল নাদিরের। এখন চিৎকার করছে, যাদেরকে উপযুক্ত বলে মনে করব, শুধু তারাই পাবে ওই পাউরুটি অন্যরা মরবে ক্ষুধার্ত কুকুরের মত! সত্যিই দুনিয়া জুড়ে শুরু হচ্ছে সেটের রাজত্ব!

কূপ থেকে এল প্রশংসাসূচক চিৎকার। কিন্তু আরও কমে গেছে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ। জায়গায় জায়গায় নীরব হয়েছে অনেকে। বিজ্ঞানী এগিয়ে আসতেই তার হাতে ফ্লাস্ক দিল নাদির। আবারও ফিরল অনুসারীদের দিকে। লোকটার মুখে উত্তেজনা ও রাগের ছাপ দেখল রানা।

জানি, তোমাদের কেউ কেউ ভাবছ, উচিত হবে না ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া, ভেলভেটের মত মসৃণ কণ্ঠে বলল নাদির। বড়ভাইয়ের মত মানুষের মন জয়ের শিক্ষা তার নেই। কিন্তু দ্রুত শিখছে সে। কারও আপত্তি থাকলে এখনই তা জানিয়ে দেয়া উচিত। স্টেজে ওঠার সরু সিঁড়ি দেখাল নাদির। এসো, এগিয়ে এসো এক পা। দূর করে দেব তোমাদের সব ভয়।

মিষ্টি হাসছে সে, কিন্তু চোখ কুমিরের চোখের মত শীতল, অভিব্যক্তিহীন।

কয়েকজন নড়ে উঠেছে দেখে চিৎকার করে উঠল রানা, ওকে বিশ্বাস কোরো না! নির্ঘাত খুন হবে! ওর ঘাড়ের ওপর নামল পিস্তলের নল। প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও। নিচের ভিড়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। নাদির মাকালানিকে সন্দেহের চোখে দেখছে কেউ কেউ। কারও কারও চোখে রাগ ও অভিযোগ।

রানার কথা শোনার পরেও জটলা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তেরোজন তরুণ-তরুণী। তাদেরকে মাঝের পথে সরিয়ে আনল গার্ডরা।

আর কেউ নেই? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল নাদির। ঠোঁটে হাসি। চেপে রেখেছে আবেগ ও অনুভূতি। অনুসারীদের ওপর ঘুরছে তার চোখ। কারও আপত্তি দেখলেই আলাদা করে নেবে তাকে। কিন্তু সবার মুখ নির্লিপ্ত। কয়েক সেকেণ্ড পর গর্জে উঠল নাদির, ওই তেরোজনকে নিয়ে এসো আমার কাছে!

এই নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছিল সবুজ ব্লেযার পরা গার্ডরা। ঘিরে ফেলল তেরোজন অবিশ্বাসীকে। পরক্ষণে শুরু হলো বেধড়ক লাথি, ঘুষি ও কিল। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে মেঝেতে শুইয়ে ফেলা হলো রক্তাক্ত তরুণ-তরুণীদেরকে।

থেমে গেল সব আওয়াজ।

থমথম করছে চারপাশ।

একেকবারে তিনজন করে আহত তরুণ-তরুণীকে টেনে তোলা হলো মঞ্চে।

মার খাওয়া মানুষগুলোর উদ্দেশে বু! বু! আওয়াজে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছে একদল নিষ্ঠুর তরুণ। আহত তরুণ তরুণীর মুখ থেকে গোঙানি শুনে হাসছে কেউ কেউ।

তাদেরকে জানোয়ার বলে মনে হলো রানার।

বেদিতে প্রথমে তোলা তিন তরুণকে। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে তাদেরকে দেখল নাদির মাকালানি। ঘুরে তাকাল ভক্তদের দিকে। আমাকে নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছ স্বীকার করেছ আমি তোমাদের দেবতা! এখন কারও উচিত নয় সন্দেহ করা! ভয় পাওয়ার অধিকারও নেই! আমিই দেব চিরকালীন জীবন! বদলে চাই চিরকালীন আনুগত্য! আমি তোমাদের দেবতা! আমি সেট!

সেট! সেট! সেট! প্রতিধ্বনি তুলল ভক্তরা।

বেদির পেছনে গেল নাদির। বেছে নিল বাঁকা ফলার বিশাল এক ছোরা। কাছের গার্ডদের উদ্দেশে মাথা দোলাল। তিন বন্দিকে বেদির ওপর আনল তারা। পুরু কাঁচের ব্লকে রাখা হলো তিন তরুণের বুক। ভীষণ ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে কমবয়সী ছেলেগুলো। কিন্তু কূপ থেকে এল অন্তত এক শ তরুণের দাবি খুন করা হোক, খুন!

স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঝিকঝিক করছে, ছোরা। ওটা ওপরে তুলল নাদির। শুরু হলো গুনগুন করে অশুভ প্রার্থনা। কিন্তু মাইক্রোফোন ছড়িয়ে দিল তা মস্তবড় কক্ষে।

হে প্রভু, রা, স্বর্গের মালিক, সম্মান নিন! আমি আপনার বীরযোদ্ধা, হে, প্রভু! আপনিই তো পৃথিবীর বুকে আমাকে করেছেন দেবতা! যাতে শাসন করি নগণ্য মানুষকে! আপনার আলো পড়েছে বিজয়ী মা নাটের ওপর, নইলে উনি তুলে রাখতে পারতেন না মস্তবড় আকাশ! জন্ম দিতে পারতেন না আমাদেরকে মহান পিতা জেব! তার দেহ আজও রয়ে গেছে। পৃথিবীর মাটির নিচে। আর আমি আপনার পুত্র, আপনার ভৃত্য… আপনার যোদ্ধা!

ছোরা আরও ওপরে তুলল নাদির। রক্তের মাধ্যমেই জানিয়ে দিচ্ছি: আপনার পথ থেকে বিচ্যুত হইনি! রক্তের অধিকারে হয়েছি পৃথিবীর মালিক! এ জীবন এবং পরজগৎ হবে আমার অধীন! যারা বিশ্বাস করবে না আপনাকে, তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর শাস্তি! আমি সেট, মরুভূমি ও অন্ধকারের মালিক, আবার আমিই মৃত্যুদেবতা! আমি সেট!

গুঞ্জন তুলে প্রার্থনা করছে ভক্তরা। কেউ কেউ আকাশে মুঠি পাকিয়ে চিৎকার করছে। তাদের মাঝে গিবন মুরকে দেখল রানা। ভীষণ ভয় নিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে নায়ক। বুঝে গেছে, এবার গণহত্যা হবে এখানে। না পারবে লড়তে, না পালাতে। আসলে কিছুই করার নেই তার।

আমি সেট! আবারও চিৎকার করে উঠল নাদির। নিজ হাতে খতম করেছি কাপুরুষ ওসাইরিসকে! বুঝে নিয়েছি নিজের অধিকার! কারণ আমি সেট! সেট! সেট!

সাঁই করে ছোরা নামাল সে।

এক তরুণের বুক থেকে ছিটকে উঠল রক্ত। ছোরা বের করেই আবারও বুকে গাঁথল নাদির। আবারও।

শক্ত হাতে তরুণের হাত-পা আটকে রেখেছে দুই গার্ড।

মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে তরুণ। মিনিট খানেক পর একদম স্থির হয়ে গেল সে।

তিক্ত চোখে নাদিরকে দেখছে রানা।

কিন্তু কাজ শেষ হয়নি নাদির মাকালানির। পোশাকে লাগা রক্ত টপটপ করে পড়ছে মেঝেতে। প্রায় ছুটে গিয়ে পরের বন্দির সামনে পৌঁছুল সে। চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আমিই এনে দিই ভয়ঙ্কর মৃত্যু! চিৎকার করে উঠল নাদির। ঝুঁকে পড়ে জবাই করল তরুণকে। রক্তের ফোয়ারা ছিটকে লাগল তার বুকে। ছুটে যেতে চাইছে অন্য তরুণ-তরুণীরা। প্রাণের ভয়ে জুড়েছে আর্তচিৎকার। কিন্তু কঠিন হাতে ধরা হয়েছে তাদেরকে।

একের পর এক তরুণ-তরুণীর গলা জবাই করছে নাদির! কখনও কখনও বুকে গাঁথছে তীক্ষ্ণধার ফলা। বিশ্বাসঘাতকের এ-ই হয়! কারণ আমি সেট! কারও সাধ্য নেই আমার কাজে প্রশ্ন তোলে! যারা অনুসরণ করবে আমাকে, কখনও মৃত্যু হবে না তাদের! চিরকাল বাঁচবে তারা! কারণ, আমিই সেট! অন্যরা মরবে! কারণ, আমি সেট!

.

গিবন মুরের ফোনের মাধ্যমে সব শুনছে লাবনীরা। দুহাতে মুখ চেপে ধরেছে বেলা। বড় বড় হয়ে উঠেছে দুই চোখ।

হায়, আল্লা! করুণ সব আর্তনাদ শুনে প্রায় কেঁদে ফেলেছে লাবনী। ওই লোক মানুষ খুন করছে! ঝট করে হামদির দিকে ফিরল ও। এক্ষুণি সৈনিক পাঠান!

শীতের ভেতরেও দরদর করে ঘামছেন হামদি। নিজেও কাঁপছেন ভয়ে। আমার… আমার যে সেই অথোরিটি নেই! ফোন করতে হবে মন্ত্রী সাহেবের কাছে!

সেই সময় নেই! যা করার এখনই… নাদির আবারও কথা বলে উঠতেই থেমে গেল লাবনী।

.

গিবন মুর, ডাকল নাদির মাকালানি। মন্দিরে জোরালো প্রতিধ্বনি তুলল তার কণ্ঠ। এগিয়ে আসুন, গিবন মুর! মিস্টার মুর?

জিভ শুকিয়ে গেছে বলে ব্যাঙের ডাকের মত শোনাল মুরের কণ্ঠ: আ… আমি… এখানে!

ভেরি গুড, টিটকারির সুরে বলল নাদির। আমার ভুল না হলে তোমরা সবাই চেনো মিস্টার মুরকে। কিন্তু… ভয়ঙ্কর চেহারায় হাসল সে। সে ছিল আমার বড়ভাই ওসাইরিসের ভক্ত। কাজেই দেখে নিতে হবে, সে এখন তার নতুন দেবতা খুঁজে পেয়েছে কি না।

আঁ… আমি… হ্যাঁ, তা তো ঠিকই! আমি আপনার ভক্ত, ও, সেট! বেসুরো কণ্ঠে বলল গিবন মুর, এতই বিশ্বাস করি, মরে যেতেও আপত্তি নেই!

আরও প্রমাণ চাই, বলল নাদির। উঠে আসুন মঞ্চে।

দ্বিধায় পড়ে গেছে মুর, কিন্তু পেছন থেকে তাকে ঠেলে দিল দুই পাষণ্ড তরুণ। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল নায়ক। মঞ্চে উঠে তাকাল চারপাশে। একটু দূরে মাসুদ রানা। প্রকাণ্ড মূর্তি। ছাত। সবই দেখতে রাজি মুর, কিন্তু সাহস নেই নাদিরের শীতল চোখে তাকাবে। চোখ সরিয়ে রেখেছে রক্তাক্ত লাশ ও বলির জায়গাটা থেকে।

এবার মস্তবড় সম্মান দেব আপনাকে। এগিয়ে আসুন, মিস্টার মুর, নায়কের দিকে কয়েক পা এগোল নাদির। হাতের ছোরা থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত। ওটা দেখে শিউরে উঠল মুর। আপনি দেখেছেন, যারা বেঈমান, কী হয়েছে তাদের। আমার নির্দেশের এদিক ওদিক হলে কী হয়, আপনি এখন জানেন। এবার… রানার দিকে ফিরল সে। ঠোঁটে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর হাসি। আপনি দেখবেন, সেটের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে তার পরিণতি কী হয়।

মরতে হবে সবাইকেই, নির্বিকার সুরে বলল রানা।

কথাটা পাত্তা দিল না নাদির। বাঁকা হাসল। আঙুল তুলে দেখাল রানাকে। এই লোক দাঁড়িয়েছে আমার বিরুদ্ধে! অবিশ্বাস করেছে যে চিরকালীন জীবন দিতে পারি না আমি!

এ কথা শুনে হৈ-হৈ করে উঠল একদল তরুণ।

আর তোমরা জানো, এই অপরাধের শাস্তি মাত্র একটি ভয়ঙ্কর মৃত্যু! ঝট করে গিবন মুরের দিকে ঘুরল নাদির। বেচারার নাকের কাছে তুলল ছোরা। এবার, মিস্টার মুর, আপনি প্রমাণ করবেন যে আপনি বিশ্বাসী! সেটের মন্দিরের পূজারী হলে এক্ষুণি খুন করবেন ওই লোককে!

হাঁ করেও কিছু বলতে পারল না মুর। কয়েক সেকেণ্ড পর ভয় পেয়ে বলল, ইয়ে… হা… কিন্তু… সত্যিই অনেক সম্মান দিয়েছেন, প্রভু।

এই সম্মান আপনাকে নিতেই হবে, শীতল কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি। আপনি তো জানেন, যারা সেটের বিরুদ্ধে যায়, তাদের জীবনে কীভাবে আসে মৃত্যু।

অভিনেতার হাতে ছোরার বাঁট গুঁজে দিল নাদির। পিছিয়ে গেল দুফুট। যেসব গার্ড ধরে রেখেছে রানাকে, ইশারা করল তাদেরকে। বেদিতে চিত করে শুইয়ে দাও মাসুদ রানাকে!

.

৩১.

 আপনারা কিছুই করবেন না? কড়া সুরে জানতে চাইল লাবনী।

কর্তৃপক্ষের আগের নির্দেশ এবং তা না মানার মাঝে ঝুলছেন হামদি। নিজেদের জিপগাড়ির পাশ থেকে ডাক দিল। রানা এজেন্সির শাখা প্রধান শাহেদ কামাল, লাবনী আপা, আসুন! আমরা বোধহয় অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছি!

তাদের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে ছয় মিশরীয় সৈনিক। কী করবেন এখনও স্থির করতে পারছেন না হামদি।

রাগ-ভয় নিয়ে সামনের জিপগাড়ির কাছে পৌঁছুল লাবনী। প্রথমবারের মত খেয়াল করল, রানা এজেন্সির অন্য তিনজন এখন গাড়ির ভেতরে। শাহেদ কামাল ড্রাইভিং সিটে উঠতেই পাশের সিটে উঠল লাবনী।

দৌড়ে এল বেলা। ও-ও যাবে।

সরে সিটে বেলাকে জায়গা করে দিল লাবনী।

সামনের জিপগাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই জানতে চাইল মিশরীয় সৈনিকদের দলনেতা, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

যেখানে কাপুরুষ নেই, জবাব দিল লাবনী, সেখানে!

চাকা পিছলে রওনা হলো জিপগাড়ি।

পেছন থেকে লাবনীর হাতে দেয়া হলো একটা শটগান। রাখুন। কাজে লাগতে পারে।

ওটা রায়ট গান আরওয়েন ৩৭। পেটমোটা ম্যাগাযিনের সঙ্গে আছে পাঁচটা টিয়ার গ্যাস কান্ট্রিজ।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে লেকের পাশের রাস্তায় ছুটল শোগান। হেডসেটে মন্দিরের কথাবার্তা শুনছে ওরা। চালু আছে নায়কের মোবাইল ফোন।

এখনও মেরে ফেলা হয়নি মাসুদ রানাকে।

এইমাত্র নরকের কীট বলা হলো নাদির মাকালানিকে।

 কণ্ঠ গম্ভীর রানার।

চিৎকার করে উঠল নাদির, ও, রা, শ্রদ্ধা নিন! নতুন বলি হিসেবে দিতে চাই নরাধম এই মাসুদ রানাকে!

মেঝেতে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরেছে শাহেদ কামাল।

তুমুল বেগে ছুটছে জিপগাড়ি।

.

একবার নাদির আবার রানাকে দেখছে গিবন মুর। হত্যা প্রার্থনায় ব্যস্ত নাদির। জোর গুঞ্জন তুলে অন্ধকারের দেবতার মন্ত্র পড়ছে তার ভক্তরা। ক্রমেই বাড়ছে গলার আওয়াজ।

তেরো বিদ্রোহী তরুণ-তরুণী হত্যার পর কূপে ফিরে গেছে বেশিরভাগ গার্ড। তবে মঞ্চে রয়ে গেছে চারজন। তারা চিত করে শুইয়ে রেখেছে রানাকে বলিপীঠে।

নাদির, কোনওকালেও দেবতা ছিলে না, মানুষও নও, স্রেফ গুখোর কুকুর তুমি, গম্ভীর কণ্ঠে জানাল রানা।

এ কথা শুনে থরথর করে কাঁপল নাদিরের গালের ক্ষতটা। ঘুরেও তাকাল না সে। তবে এক গার্ড এসে বুট নামাল বন্দির পেটের ওপর। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল রানা।

হে, রা, লাল রক্তের রঙে প্রমাণ দেব আমার মূল্য, আর…

.

শাখা রাস্তার মুখে পৌঁছে গেছে মিতসুবিশি জিপগাড়ি। ঝড়ের বেগে কাত হয়ে বাঁক নিল ওটা। নানানদিকে ছিটকে গেল একরাশ নুড়িপাথর। বেঞ্চ সিটে পিছলে গেল বেলা। কাঁপা গলায় বলল, অ্যাক্সিডেন্ট হবে তো!

সরি! বলল শাহেদ কামাল। শক্ত হয়ে বসুন।

দেখা গেল লেক তীরে গেটহাউস। সামনে ওপরে উঠতে শুরু করেছে ড্র-ব্রিজের দুই প্রান্ত। রানা এজেন্সির ছেলেদের জিপগাড়ি দেখে সতর্ক হয়ে উঠেছে নাদির মাকালানির লোক।

ভয় ভরা কণ্ঠে বলল বেলা, চাইলেও সেতু পেরোতে পারব না!

পারতেই হবে! জোর দিয়ে বলল লাবনী।

খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে শাহেদ কামাল। মেঝের সঙ্গে চেপে রেখেছে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল। ঝড়ের বেগে ছুটছে গাড়ি। খুলে গেল ড্র-ব্রিজের দুই জোড়া।

একফুট… দুফুট করে উঠছে সেতুর দুই খোলা দিক।

ইঞ্জিনের গর্জনের ওপর দিয়ে ওরা শুনল নাদিরের প্রার্থনা। ভয়ে ভুরু কুঁচকে গেছে বেলার। মেরে ফেলবে!

…আমি সেট! মরুভূমি ও আঁধারের দেবতা! মৃত্যুদেবতা আমি! হে, রা…

.

রানার বুকের দিকে ছোরার ডগা তাক করেছে গিবন মুর। থরথর করে কাঁপছে হাত। হঠাৎ করেই পিছিয়ে যেতে চাইল সে। কিন্তু তার পিঠে অস্ত্রের নল ঠেকিয়ে দিল এক গার্ড। থমকে দাঁড়িয়ে গেল মুর।

বিদ্বেষের চোখে তাকে দেখল নাদির। আমি হত্যা করেছি কাপুরুষ ওসাইরিসকে, এবং যা আমার, তাই অর্জন করে নিয়েছি! কারণ আমি সেট! মৃত্যুদেবতা! এবার…

.

গাড়ি চুরমার হলে খুন হব! হায়-হায় করে উঠল বেলা।

বুকে সাহস রাখো! বলল লাবনী।

স্টিয়ারিং হুইল শক্ত করে ধরেছে কামাল। চোখ ড্র ব্রিজের ওপর। এরই ভেতর পঁচিশ ডিগ্রি উঠে গেছে সেতুর সামনের অংশ। আরও দ্রুত উঠছে ওটা।

গতি কমাল না শাহেদ কামাল।

প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে সেতুর এদিকের অংশে উঠল তীরগতি জিপগাড়ি। সাঁই-সাঁই করে উঠে যাচ্ছে ওপরে। সেতুর দুই অংশের মাঝে তৈরি হয়েছে অনেকটা ব্যবধান। নিচে লেকের কালো পানি। উড়ে গিয়ে সেতুর সামনের অংশে নামল জিপগাড়ি। ঝনঝন করে ভাঙল দুটো সাইড উইণ্ডো। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল বেলা।

ফটাস্ করে সামনের কম্পার্টমেন্ট থেকে বিস্ফোরিত হলো এয়ার ব্যাগ। বেলা ও শাহেদকে চেপে ধরল ওদুটো। সেতু পেরিয়ে শক্ত জমিতে নেমেই ব্রেক কষল শাহেদ। তখনই চুরমার হলো উইণ্ডশিল্ড। দূরের পিরামিডের দুকোণ থেকে এসেছে একরাশ গুলি।

জিপগাড়ি থামতেই নেমে গেল শাহেদ। পেছনের সিট থেকে হুড়মুড় করে নামল অন্য তিন রানা এজেন্সির এজেন্ট।

দুদিক থেকে দৌড়ে আসছে কজন গার্ড। সরাসরি সামনে পিরামিডের দিক থেকেও আসছে অন্তত চারজন সশস্ত্র গার্ড।

আপনারা আমাদের সঙ্গে আসুন, লাবনী আপা, বেলা, নির্দেশ দিল শাহেদ। প্রায় একইসময়ে গার্ডদের উদ্দেশে গুলি পাঠাল চার এজেন্ট।

ডানদিকের দুই গার্ড গুলি খেয়ে ধুপ্‌ করে পড়ল মাটিতে। এমপি-সেভেনের গুলিতে ফুটো হয়েছে বুক। একটা বাসের পেছনে আড়াল নিল বামদিকের দুই গার্ড। দুটো গাড়ির পেছনে সরল শাহেদ ও ওর সঙ্গীরা। ছড়িয়ে পড়ছে। পিরামিডের দিক থেকে এল একপশলা গুলি।

কিন্তু হঠাৎ করে জিপগাড়ি আবারও রওনা হতেই হতবাক হলো শাহেদের দলের সবাই।

এখন ড্রাইভিং সিটে লাবনী!

গাড়ির নাক তাক করেছে কাঁচের পিরামিডের মূল দরজার দিকে!

ওর কানে গমগম করছে নাদিরের কণ্ঠ: আমি সেট! সেট! সেট! সেট! আমি মৃত্যুদেবতা!

তুই একটা হারামজাদা, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল বেলা।

পেছনে রানা এজেন্সির ছেলেদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করছে নাদিরের কয়েকজন গার্ড।

মাত্র বিশ সেকেণ্ডে অন্তত পঞ্চাশ মাইল গতি তুলল জিপগাড়ি। পিরামিডের দুই কোণ থেকে এল গুলি।

প্রাণের ভয়ে মাথা নিচু করে নিল বেলা। কিন্তু ঠিক দিকেই স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখেছে লাবনী। মাথার ওপর দিয়ে গেল কটা গুলি। পরের মুহূর্তে জোরালো বু! শব্দ তুলে পিরামিডের কাঁচের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা!

একটু আগে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে বাইরে গোলাগুলির আওয়াজ। বোধহয় দুর্গে হামলা করেছে রানা এজেন্সির ছেলেরা ও এএসপিএস সৈনিকরা। তবে তাতে বিপদ কমেনি রানার। গিবন মুরের চোখে চেয়ে আছে। বুঝে গেছে, নিজে খুন হলেও ওর বুকে ছোরা বসাবে না ওই যুবক। তার অর্থ: নাদিরের হাতে একে একে খুন হবে ওরা দুজন!

কাঁচের ব্লকের ওপর চিত করে ফেলে রেখেছে রানাকে। হাতদুটো পিঠের কাছে আটকানো। কোনও কিছু ঠেকাবার অবস্থায় নেই ও।

বুম!

বিকট আওয়াজে ওদিকে তাকাল মঞ্চের সবাই।

বিস্ফোরিত হয়েছে পিরামিডের জোড়া কবাটের দরজা, ঝোড়ো গতিতে ভেতরে ঢুকেছে একটা জিপগাড়ি। সোজা আসছে বেদির দিকে!

ঝাঁপিয়ে পড়ে নাদিরকে জিপের গতিপথ থেকে সরিয়ে নিল ভার্নে। অন্যদিকে শরীর গড়িয়ে দিয়েছে আবু। রানাকে ছেড়ে জানের ভয়ে নানানদিকে ছুট দিল গার্ডরা।

বেদির পাশে ক্ৰিচক্রিচ আওয়াজে ব্রেক কষে থামতে গেল জিপগাড়ি, কিন্তু তত দিল বড় এক মূর্তির হাঁটুতে। ক্রোমের প্লেট ভাঙতেই লেংচে উঠে কূপে পড়তে গেল মূর্তি। পরক্ষণে উল্টোদিকে ঘুরেই পড়ল প্রচণ্ড ওজন নিয়ে মার্বেলের মেঝেতে। ওখানেই ছিল বিজ্ঞানী। চ্যাপ্টা হয়ে গেল। লাশের হাত থেকে ছুটে গেল ক্যানিস্টার। গড়িয়ে চলেছে আরেক দিকে।

দ্বিতীয় গড়ান দিয়ে বেদি চুরমার করল ওই মূর্তি। এক সেকেণ্ড আগে ওখান থেকে সরে গেছে রানা। ওর দেহের ধাক্কা লেগে একপাশে পড়েছে গিবন মুর। আরও দুবার গড়িয়ে মঞ্চ থেকে পড়তে গেল মূর্তি। ততক্ষণে পিষে দিয়েছে এক গার্ডকে। ওটার ভীষণ ওজনে ধসে গেল সরু সিঁড়ি। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল কজন নাদির-ভক্ত। করুণ আর্তনাদ ছেড়ে পালাতে চাইল তারা, কিন্তু তাদের ওপর চেপে বসল দেবতার ভারী মূর্তি। শোনা গেল রক্ত-মাংস ঘেঁচে যাওয়ার ফচাৎ-ফচাৎ কয়েকটা বিশ্রী আওয়াজ।

উঠে বসল রানা। ভেবেছিল তুবড়ে যাওয়া জিপগাড়িতে দেখবে রানা এজেন্সির ছেলে ও এএসপিএস সৈনিকদের কিন্তু ওখানে ড্রাইভিং সিটে লাবনী! ওর পাশেই বেলা। যুদ্ধের কোনও কৌশলই জানা নেই ওদের। স্রেফ বেপরোয়া সাহস নিয়ে ঢুকে পড়েছে শত্রুঘাঁটির ভেতর!

আসুন, মাসুদ ভাই! চিৎকার করল বেলা।

দেরি করছ কেন? তাড়া দিল লাবনী। পরক্ষণে চমকে গেল। রানা, সাবধান!

রানার মাথার দিকে পিস্তলের নল তাক করেছে আবু।

কোথাও যেতে পারবে না রানা। কিন্তু তখনই শোগান থেকে এল ভোতা থ্যাম্প! আওয়াজ। মঞ্চের ওপর দিয়ে এল কী যেন। তুমুল গতি ওটার। সোজা লাগল আবুর পাঁজরে। কড়াৎ করে দেবে গেল বুকের হাড় হৃৎপিণ্ডের ভেতর। ছিটকে পেছনের গভীর কূপে গিয়ে পড়ল লোকটা।

আবুর বুকে লেগে মেঝেতে পড়ে গড়াতে শুরু করেছে জিনিসটা। মুখ থেকে ভক-ভক করে বেরোচ্ছে সাদা ধোঁয়া।

কিন্তু সাধারণ ধোঁয়া নয় ওটা। চোখ-নাক জ্বলে উঠতেই রানা বুঝল, ওটা শাহেদের আনা টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টার। জিপগাড়ির দিকে তাকাল। ভাঙা জানালা দিয়ে আরওয়েন বের করেছে বেলা।

শ্বাস আটকে রাখো! সতর্ক করল রানা। মুর, আমার হাতের বাঁধন খুলুন!

এবার গিবনের মনে পড়ল, হাতে ছোরা। সামনে বেড়ে রানার হাতের যিপ-টাই কাটতে লাগল সে। করাতের মত ছোরা চালাতেই কটাস করে কেটে গেল প্ল্যাস্টিকের দড়ি। প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। মঞ্চ ভরে যাচ্ছে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায়। আবছা দেখা যাচ্ছে চারপাশ। তবে রানা দেখল, মঞ্চে একটা মূর্তির পাশেই আছে নাদির আর ভার্নে।

কূপের দিকে তাকাল রানা। সিঁড়ি ধসে গেছে বলে স্টেজে উঠতে পারবে না ভক্ত বা গার্ডরা। কিন্তু অন্য কোনও পথে আসতে পারে শত্রুপক্ষ।

রানার ধারণাই ঠিক, মন্দিরের ওদিকের সিঁড়ির দিকে চলেছে কেউ কেউ। তারা উঠে এলে কোণঠাসা হবে ওরা। খেপা নাদির-ভক্তরা খালি হাতে ছিঁড়ে ফেলবে ওদেরকে!

জিপগাড়ির পাশে চলে গেল রানা। দাও তো ওটা! বেলার হাত থেকে আরওয়েন ৩৭ নিল ও, অন্য চারটে ক্যানিস্টার ফেলল কূপের ওদিকের সিঁড়ির ওপর।

টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝ নাকে-মুখে ঢুকতেই পিছিয়ে গেল অতি উৎসাহী তরুণ ও গার্ডরা। খক-খক করে কাশছে। দুহাতে চেপে ধরেছে নাক-মুখ। মেঝেতে বসে পড়ল অনেকে।

গাড়িতে ওঠো! রানাকে তাড়া দিল লাবনী।

না, তোমরা বেরিয়ে যাও! পাল্টা বলল রানা, এই গ্যাস বেশিক্ষণ কাজ করবে না! অন্য কোনওভাবে আটকে রাখতে হবে এদেরকে!

কিন্তু তা কীভাবে করবে?।

জিপ কাজে আসতে পারে, বলল রানা।

কিন্তু বেরোতে হলে এটা লাগবে! আপত্তি তুলল লাবনী।

ড্র-ব্রিজ ওপরে তুলে ফেলেছে? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ। আঙিনায় লড়ছে তোমার দলের সবাই। দলে নাদিরের গার্ডরা বেশি।

তার মানে, এএসপিএসের সৈনিকরা আসেনি? তিক্ত অনুভূতি হলো রানার।

না। তাদের অনুমতি নেই।

তা হলে আর ড্র-ব্রিজ নামানোর সময় পাব না, বলল রানা। সেক্ষেত্রে নেমে পড়ো জিপ থেকে। তুমিও, বেলা!

দুই দরজা খুলে নামল লাবনী ও বেলা। প্যাসেঞ্জার সিটে উঠল রানা। বিড়বিড় করে বলল, হয়তো কাজে আসবে। জিপের গিয়ার ফেলল ও, তারপর খালি রায়ট গান আটকে দিল অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেলের ওপরে।

গর্জন ছেড়ে ভাঙা সিঁড়ির দিকে ছুটল জিপগাড়ি। ডাইভ দিয়ে ওটা থেকে মেঝেতে পড়ল রানা। গড়িয়ে চলেছে, ভীষণ ব্যথা পেল বেদির ভাঙা অংশে লেগে। মসৃণ মার্বেলে পিছলে গিয়ে পড়ছিল কূপে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে ওর ডান বাহু ধরে ফেলল নায়ক মুর। রানার পা দুটো ঝুলছে কূপে।

মিতসুবিশি জিপগাড়ি হুড়মুড় করে কূপে নামতেই ভীষণ ভয়ে নানানদিকে পালাতে চাইল নাদিরের ভক্ত ও গার্ডরা। কিন্তু মাঝের পথে রয়ে গেছে বেশ কজন গার্ড। তাদের ওপরে চেপে বসল জিপগাড়ি। মট-মট আওয়াজ হলো মানুষের হাড়গোড় ভাঙার। সোজা চলেছে জিপ। হারিয়ে গেল ঘন সাদা ধোয়ায়।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে এল বিকট এক আওয়াজ। জিপগাড়ির গুঁতো খেয়ে ভেঙে পড়েছে কাঁচ ও স্টিলের স্টেয়ারকেস। সাতটা ধাপ ভেঙে নাক ওপরে তুলে থামল যন্ত্রদানব। যেন সৈকতে উঠে পড়েছে বাচ্চা তিমি। কিন্তু ওটার প্রচণ্ড ওজনে ধসে পড়ল গোটা সিঁড়ি।

আছড়ে পাছড়ে আবারও মঞ্চে উঠে এল রানা। কূপের দুই সিঁড়ি ভেঙে পড়েছে বলে গভীর কূপে আটকা পড়েছে। সবুজ ব্লেয়ার পরা গার্ড ও নাদিরের অনুসারীরা। সত্যিকারের অ্যাকশন কেমন লাগছে?

ঢোক গিলল মুর। আমার… ইয়ে… মনে হয় হলিউডের ভার্শনটাই ভাল।

আশা করি সেটাই পাবেন পরে, আসুন। রানা রওনা হতেই ওর পাশে চলল নায়ক। প্রথম ক্যানিস্টার থেকে এখনও বেরোচ্ছে সাদা গ্যাস। বাধ্য হয়ে রানাদের দিকে পিছিয়ে এসেছে লাবনী। চারপাশে চোখ বোলাল রানা। বেলা কোথায়?

চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরছে লাবনীর। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, এদিকেই তো ছিল কোথায়!

বেলা! আমার কথা শুনছ? গলা চড়াল রানা। সাদা মেঘ থেকে এল মেয়েলি কাশির আওয়াজ। এই মেঘের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। শ্বাস আটকে রাখো। ঢেকে রাখবে চোখ নাক। আমার হাত ধরো। হাত সামনে বাড়িয়ে দিল রানা।

গ্যাসের প্রভাবে ভুগছে নায়ক মুরও.। নাক-মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আপনার কিছু হচ্ছে না, মিস্টার রানা? এক পাশ থেকে এসে রানার হাত ধরল মুর, অন্যপাশে চলে এল লাবনী।

এর চেয়েও খারাপ জিনিস দেয়া হয় ট্রেনিঙের সময়, বলল রানা। সব অভ্যেস হয়ে যায়। ঠিক আছে, এবার চলুন, যাওয়া যাক! মাথা দোলাল লাবনী ও মুর।

সাদা মেঘে ঢুকে পড়ল ওরা।

একহাতে লাবনী, অন্যহাতে মুরের হাত ধরে রেখেছে রানা। টের পেল, অনেক দিন হলো নতুন করে ট্রেনিং নেয় না। জ্বলতে শুরু করেছে নাক-মুখ। থামল না ও, আধমিনিট পর বেরিয়ে এল হালকা মেঘ থেকে। ধারে-কাছে দেখতে পায়নি ওরা বেলাকে।

ভাঙা দরজা দিয়ে এল ঝিরঝিরে হাওয়া। এবড়োখেবড়ো হলো সাদা মেঘের কিনারা। মেয়েলি কাশির আওয়াজ পেল রানা। একটু দূরে আবছাভাবে দেখল বেলাকে। বেলা! এদিকে এসো! লাবনী ও মুরের হাত ছেড়ে তরুণীর দিকে পা বাড়াল রানা। একরাশ টিয়ার গ্যাস লাগতেই জ্বলতে লাগল ওর চোখ। তখনই কুয়াশার ভেতর দেখল আরও দুজনকে।

বেলা! সতর্ক করতে চাইল রানা।

 কিন্তু দেরি হয়ে গেছে!

ওই দুই ছায়ামূর্তির একজন নাদির মাকালানি। পেছন থেকে বামহাতে বেলাকে জাপ্টে ধরল সে। ডানহাতের পিস্তল ঠেকাল মেয়েটার মাথার পাশে। বেলাকে জিম্মি করেছে সে। টের পেয়ে গেছে, প্রতিপক্ষের কাছে অস্ত্র নেই!

পিরামিডের বাইরে দুদলে চলছে তুমুল গোলাগুলি! বাঙালি ছেলেরা অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসছে বলেই বাধ্য হয়ে পিছাতে হচ্ছে নাদিরের গার্ডদের।

টান দিয়ে গিবন মুরকে একটা মূর্তির আড়ালে সরিয়ে নিল লাবনী। ওই একই সময়ে আবারও গ্যাসের মেঘে ঝাঁপ দিল রানা। ওটা ছাড়া কোনও কাভার নেই ওর। ঘুরপাক খাওয়া গ্যাসে সুড়ঙ্গ তৈরি করল একটা বুলেট। রানার মাথার ওপর দিয়ে হারিয়ে গেল ঘন কুয়াশায়।

রানাকে হারিয়ে ফেলে পর পর আরও দুবার গুলি করল নাদির। এবার লাগাতে চেয়েছে লাবনী ও মুরের গায়ে। ঠকাস্ ঠকা আওয়াজে দেবতার মূর্তির গায়ে লাগল দুই বুলেট। আবারও বেলার মাথায় নল ঠেকিয়ে নিল সে।

ব্যথা পেয়ে উফ! বলে উঠল বেলা। গরম নলের স্পর্শে পুড়ছে মাথার পাশের চামড়া। হ্যাচকা টান দিয়ে ওকে পিছিয়ে নেয়া হলো।

ভার্নে! চিৎকার করল নাদির, ওই ক্যানিস্টার নাও!

ঝুঁকি নিয়ে মূর্তির আড়াল থেকে উঁকি দিল লাবনী। মঞ্চের আরেক পাশে দেখল স্টিলের কন্টেইনার। সামনে বেড়ে ওটা তুলে নিল ভার্নে। নাদিরের নির্দেশের জন্যে ঘুরে তাকাল।

একহাতে বেলাকে জাপ্টে ধরে পিছিয়ে যেতে শুরু করে নির্দেশ দিল নাদির, সোজা হেলিকপ্টারে!

সাদা মেঘ থেকে বেরিয়ে নাদিরের কাছের এক মূর্তির আড়াল নিল রানা। আবারও ওর দিকে গুলি পাঠাল নাদির। ঠুং! আওয়াজে পিছলে গেল বুলেট। ধমকে উঠল ধর্মগুরু, খবরদার! পিছু নিলে খুন হবে এই মেয়ে! পৌঁছে গেল একপাশের এক দরজার কাছে। কবাট খুলে দিল ভার্নে। পিছিয়ে দরজার ওদিকে চলে গেল তারা।

চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরছে রানার। বার কয়েক কেশে উঠল।

একটু দূরের মূর্তির কাছ থেকে জানতে চাইল লাবনী, কী হয়েছে, রানা?

শেষ গ্যাস ড্রিলের পর পাল্টে নিয়েছে বিজ্ঞানীরা তাদের ফর্মুলা!

রানার পাশে পৌঁছে গেল লাবনী ও মুর।

এবার কী করব? বলল লাবনী, বেলাকে তো ধরে নিয়ে গেল!

মুরকে নিয়ে নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে পড়ো, বলল রানা, পরে সুযোগ পেলে নামিয়ে দেবে ড্র-ব্রিজ। সেক্ষেত্রে হয়তো দুর্গের আঙিনায় ঢুকবে ডক্টর হামদির সৈনিক।

তুমি কী করবে? জানতে চাইল লাবনী।

ছুটিয়ে আনব বেলাকে, বলল রানা। মৃদু হাওয়ায় ভর করে সরে গেছে একদিকের সাদা মেঘ। ওখানে চোখ পড়তেই আবর্জনার ভেতর একটা জিনিস চোখে পড়েছে ওর। আগ্নেয়াস্ত্র। হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল কোনও গার্ড। এগিয়ে গিয়ে অস্ত্রটা তুলল রানা। লাবনীকে অবাক করে দিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিল ওটা। সবুজ কিছু দেখলেই গুলি করবে।

তুমি সঙ্গে পিস্তল নেবে না? জিজ্ঞেস করল লাবনী। হয়তো এখনও বাইরের দরজায় গার্ড আছে।

আমিও আপাতত কিছু দূর তোমাদের সঙ্গেই যাব, বলল রানা।

গিবন মুরকে পাহারা দিতে হবে না, বলল লাবনী। দেখো বেলাকে ছুটিয়ে আনতে পারো কি না। আমি আছি মুরের পাশে।

ওকে অপদার্থ ধরে নেয়া হয়েছে বুঝে আহত বোধ করছে। নায়ক। লাবনী, আমাকে আগলে রাখতে হবে না।

কখনও সত্যিকারের পিস্তল ব্যবহার করেছেন? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ।

মানুষের দিকে গুলি করেছেন?

না। ভুরু কুঁচকে গেল নায়কের। তা হলে কি মিস আলম কারও দিকে গুলি করেছেন?

বাধ্য হয়ে, বলল লাবনী। কখনও কখনও।

আপাতত লুকিয়ে পড়ন, মুর। নাদির যে দরজা দিয়ে গেছে, সেদিকে ছুট লাগাল রানা। পরে নামাতে চেষ্টা করবেন ড্র-ব্রিজ! দরজা পেরোবার সময় ঘুরে তাকাল। ও, আরেকটা কথা, ওই গর্তে পড়া থেকে বাঁচিয়েছেন বলে ধন্যবাদ! এবার হাওয়া হয়ে যান!

তা বলতে! বলল লাবনী। ঘুরে দেখল নায়ককে। ঠিক আছে, আসুন আমার সঙ্গে। সামনের দরজার দিকে ছুট দিল ওরা।

সত্যিই কাউকে গুলি করেছেন? জানতে চাইল মুর।

হ্যাঁ। একবার তলোয়ার উঁচু করা এক লোকের দিকে গুলি করেছিলাম।

ও। ছোট এক লবিতে বেরিয়ে এল ওরা। মেঝেতে পিরামিডের চওড়া দরজার অজস্র ভাঙা কাঁচ। এদিক দিয়েই পিরামিডে ঢুকেছিল মিতসুবিশি জিপ। বাইরে ওরা দেখল, একপাশের বাগানে ছুটে ঢুকল সবুজ ব্লেযার পরা দুই লোক। গোলাগুলিতে আহত।

দূরে ড্র-ব্রিজ। ওপরে তুলে রাখা হয়েছে দুই প্রান্ত।

কাউকে কখনও বলেছেন আপনার জীবনের কাহিনী? জানতে চাইল মুর। দারুণ সিনেমা হবে কিন্তু!

কিন্তু রানা বা আমার ভূমিকায় অভিনয় করবে কারা? বাইরে চোখ বোলাল লাবনী। চলুন, বেরিয়ে যাই। আপনাকে কোথাও রেখে রানার পিছু নেব।

.

৩২.

 প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে রানা। এ পথেই ঢুকেছিল পিরামিডে। একপাশের দরজা দিয়ে বেরোলেই সামনে করিডর। জায়গাটা পিরামিডের পুবে।

নাদির, ভার্নে বা বেলার দেখা নেই। এদিকটা একেবারেই ফাঁকা। ধর্মগুরুর চেলারা সবাই নেমেছিল কূপে। এখনও আটকা পড়ে আছে ওখানেই।

লবি পেরিয়ে বাইরের দরজার কাছে থামল রানা। কয়েক সেকেণ্ড বাইরের দৃশ্য দেখে নিয়ে খুলল দরজার স্লাইডিং কবাট। বাইরে কমে গেছে গুলির আওয়াজ। সব ছাপিয়ে গর্জন ছাড়ছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন। যে-কোনও সময়ে আকাশে উঠবে যান্ত্রিক ঘাসফড়িং। এবং দুর্গ ত্যাগের পর নাদিরের মনে হবে, বেলা আসলে ভারী একটা আবর্জনা!

দরজার একপাশ থেকে দূরের উঠানে হেলিপ্যাড দেখল রানা। ওখানে বসে আছে ছয় প্যাসেঞ্জারবাহী চকচকে এক ইউরোকপ্টার ইসি হান্ড্রেড-থার্টি। পাইলটের পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে ভার্নে। পেছনের সিটে নাদির ও বেলা। কী যেন চকচক করছে ভার্নের হাতে। ওটা আগ্নেয়াস্ত্র। নিজের দিকের দরজা খুলে রেখেছে সে। কেউ ধারেকাছে গেলেই গুলি করবে।

ঝুঁকি কমাতে হলে যেতে হবে পাইলটের দিকেই। যদি প্রাণপণ ছুটে যেতে পারে, হয়তো হেলিকপ্টার আকাশে ওঠার আগেই ওটায় উঠতে পারবে রানা। অবশ্য, গণ্ডারের মত ভার্নের হাতের টিপ নিখুঁত হলে খুন হবে আগেই!

বড় করে দম নিল রানা, তারপর ক্ষিপ্র চিতার বেগে ছুটল হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে!

.

বামদিকের বাগান থেকে এখন আর গুলি আসছে না।

একটু আগে পিরামিডে দৌড়ে গিয়ে ঢুকল রানা এজেন্সির চার সশস্ত্র এজেন্ট। অনায়াসেই কূপে বন্দি গার্ড ও নাদিরের ভক্তদের আটক করবে তারা।

একটু আগেও ওখানে ছিল মানুষের হৈ-চৈ। এখন থেমে গেছে সব। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। রানার দলের ছেলেরা।

অবশ্য তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই লাবনীর। সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়েই মুরকে নিয়ে ছুট লাগাল গেটহাউসের উদ্দেশে। মাত্র দুমিনিটে পৌঁছুল ওখানে।

এদিকটা দুর্গের বাড়তি অংশ। বুথের মত। জানালা কাঁচের। ছোট সিকিউরিটি স্টেশন।

ওটার ভেতরেই থাকার কথা ড্র-ব্রিজের যন্ত্রপাতি।

গিবন মুরের আগেই ঝটকা দিয়ে গেটহাউসের দরজা খুলল লাবনী। তখনই শুনল পিরামিডের কাছে গুলির আওয়াজ। ঘুরে তাকাল ও। নিশ্চয়ই রানা….

গেটহাউসের ভেতর থেকে এল ধড়মড় আওয়াজ। আবারও ওদিকে ফিরল লাবনী। চেয়ার ছেড়ে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করছে এক গার্ড। ভয় পেয়ে ঝট করে পিছিয়ে যেতে চাইল লাবনী। কিন্তু ওর পিছু নিয়ে গেটহাউসে ঢুকতে যাচ্ছিল নায়ক। সরাসরি ধাক্কা লাগল দুজনের। কাত হয়ে নিজেকে সামলে নিল মুর। কিন্তু তাল হারিয়ে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল লাবনী। হাত থেকে মেঝেতে পড়ে ঠনাৎ শব্দে আওতার বাইরে চলে গেল পিস্তল।

এদিকে ওর দিকে তেড়ে এল গার্ড।

বিপদ বুঝে উঠে দাঁড়াতে চাইল লাবনী, কিন্তু ততক্ষণে চড়াও হয়েছে লোকটা। সরাসরি মাযল তাক করল ওর মাথা লক্ষ্য করে। কিন্তু ভীষণ ঝটকা খেল তার হাত। ছিটকে গেল পিস্তল। দুর্দান্ত এক হাই কিক ঝেড়েছে মুর।

হুড়মুড় করে লাবনীর ওপর পড়ল গার্ড। সামলে নেয়ার আগেই তার তলা থেকে হাঁচড়েপাঁচড়ে বেরিয়ে এল লাবনী। পরক্ষণে ওর কনুই নামল গার্ডের বুকের ওপর। উল্টো হাতের চড় খেয়ে গাল লাল হয়ে গেল লোকটার। দিশেহারা।

এবার দেখুন কীভাবে ভাল কিক দিতে হয়! লাবনীকে বলল মুর। পা টেনে লাথি মারতে গেল গার্ডের মাথার পাশে। এটা নামকরা এক সিনেমায় দেখিয়েছি!

কিন্তু ঝট করে মাথা সরিয়ে নিয়েছে গার্ড।

কী হলো, লাগাতে তো পারলেন না! উঠে দাঁড়াতে শুরু করে বলল লাবনী। এটা কিন্তু সিনেমা নয়!

লাথিটা লাগল না বলে দোষ হয়ে গেল? এবার দেখুন! ডান পা আবারও পিছিয়ে রেডি হতে গেল মুর, কিন্তু ঝটকা দিয়ে উঠে পড়ল গার্ড। রাগে লাল চেহারা। পাকিয়ে ফেলেছে হাতের দুই মুঠো। কিন্তু সেট-এ কাউকে লাথি মারলে সবসময়ই তো পড়ে যায়!

আরে, গাধা, ওরা তো স্টান্টমেন! পয়সা পায়! লাফিয়ে সরে গেল লাবনী। এদিকে সামনে বেড়ে: ল্যাং মেরে নায়ককে ধরাশায়ী করল গার্ড। এক সেকেণ্ড পর ঝুপ করে পাশে বসেই দুই হাতে টিপে ধরল মুরের গলা!

নির্বিরোধ গরুর মত অসহায় চোখে গার্ডের দিকে চেয়ে রইল নায়ক। ভয়ে গলা চিরে বেরোল গ্যাঁ-গ্যাঁ আওয়াজ।

উঠানে কড়াৎ আওয়াজে গর্জে উঠল অস্ত্র। চুরমার হলো রানার পেছনে পিরামিডের কাঁচের প্যানেল। হেলিকপ্টারের দিকে ঝড়ের বেগে ছুটছে রানা। ককপিট থেকে ওর দিকে পিস্তল তাক করছে ভার্নে। কিন্তু গুলি করতে হলে নামতে হবে হেলিকপ্টার থেকে। অথবা, গুলিতে চুরমার করতে হবে সামনের উইণ্ডশিল্ড। কোনওটাতেই মন সায় দিচ্ছে না তার। এদিকে ওপরে উঠতে যাচ্ছে হেলিকপ্টার।

বড়জোর আর দশ সেকেণ্ড…।

এরই ভেতর গুলি করতে হবে বেপরোয়া লোকটাকে।

 বাইরে ঝুঁকে এসে গুলি পাঠাল ভার্নে। কিন্তু এক সেকেণ্ড আগে ডাইভ দিয়েছে রানা। ওর পায়ের কাছের ফ্ল্যাগস্টোন খুবলে নিল বুলেট। দুই গড়ান দিয়ে উঠেই আবার দৌড়াতে লাগল ও। কোনাকুনি চলেছে পাইলটের দিকে।

প্যাড ছেড়ে ভেসে উঠল হেলিকপ্টার।

দৌড়ের গতি আরও বাড়ল রানা। তুমুল বাতাসে যেন ছিটকে পড়বে একপাশে। বুজে এসেছে চোখ।

পূর্ণ গতি তুলেছে হেলিকপ্টারের রোটর ব্লেড। মাত্র দুই সেকেণ্ডে জমিন থেকে সাঁই করে ভেসে উঠল ছয় ফুট ওপরে।

ওটা নাগালের বাইরে যাওয়ার আগেই লাফ দিল ছুটন্ত রানা। একহাত রয়ে গেল স্কিড থেকে এক ইঞ্চি নিচে। কিন্তু অন্যহাতে ধরে ফেলল স্কিড। একইসময়ে ঘুরল হেলিকপ্টার। সামান্য কাত হলো রানার ওজনে। ভেতরের সবাই জেনে গেল, হেলিকপ্টারে চড়েছে অন্য কেউ।

ঝাঁকুনি মেরে ওকে ঝেড়ে ফেলো! নির্দেশ দিল নাদির।

এদিকে দুহাতে স্কিড ধরেছে রানা। কিন্তু হঠাৎ করেই কাত হলো হেলিকপ্টার। ফেলে দিতে চাইছে বাড়তি ওজন! গিবন মুরের মাথা ধরে ঠাস্ করে মেঝেতে ঠুকে দিল গার্ড। আরেক হাতে খামচে ধরেছে বেচারার গলা। পিংপং বলের মত প্রায় বেরিয়ে এল নায়কের দুই চোখ।

ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল গার্ড, আরে, শালার পো, তোর সব কটা সিনেমা গুয়ের মত পচা!

আপত্তি তুলতে গিয়েও থেমে গেল মুর। গলা দিয়ে বেরোল গোঙানি। তারই ফাঁকে ঘুষি মারতে চাইল গার্ডের মাথার পাশে। হালকা ঘুষিতে দমল না লোকটা। বুড়ো আঙুল দিয়ে আরও জোরে টিপে ধরল মুরের ক্যারোটিড আর্টারি।

এই যে, ভাই? গার্ডকে বাংলায় ডাকল কে যেন!

মুখ তুলে তাকাল গার্ড। সরাসরি তার মুখে লাগল লাবনীর সবুট লাথি। নাক-ঠোঁট ফেটে যেতেই ভীষণ ব্যথায় নায়কের ওপর থেকে গড়িয়ে সরে গেল লোকটা। গুহ করে মুখ থেকে ফেলল ভাঙা দুটো দাঁত। তাতে লড়াই করার সাধ বা সাধ্য কমেনি তার। চোখ পড়েছে মেঝেতে লাবনীর পিস্তলটার ওপর। ধড়মড় করে উঠে হামাগুড়ি মেরে চলল ওটার দিকে।

তার নিজের পিস্তল পড়েছে আরও দূরে। পেছন থেকে ডাইভ দিল লাবনী, ধুপ করে পড়ল গার্ডের পিস্তলের সামনে। ব্যথায় মনে হলো মরে গেছে। তবুও তুলে নিল পিস্তল, নল ঘুরিয়েই দেখল, ওরই পিস্তল তাক করছে লোকটা!

ট্রিগার টিপে দিল লাবনী। সবুজ ব্লেযারের পেটে তৈরি হলো গোল গর্ত। ওখান থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোল রক্ত। করুণ আর্তনাদ ছাড়ল নোকটা। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুলে গেছে পাল্টা গুলি করতে। হাত থেকে পড়ে গেল পিস্তল।

যিযাস! আঁৎকে উঠল মুর। আপনি মানুষকে গুলি করেছেন!

তো কী করব? এবার ওর পিস্তলটা নিন! ধমক দিল লাবনী। সামনে বেড়ে গার্ডের হাতের পাশ থেকে পিস্তল তুলে নিল মুর। উঠে বুথের আরও ভেতরে গেল লাবনী। সিসিটিভি স্ক্রিনে দেখাচ্ছে মেইন গেট, ড্র-ব্রিজ ও লেকের তীরের রাস্তা। গেটহাউসের কাছে থেমেছে এএসপিএস জিপগাড়ি। সুযোগ পেলে দুর্গে ঢুকবে।

ড্র-ব্রিজের কন্ট্রোল খুঁজছে লাবনী। একদিকের দেয়ালে প্যানেল দেখে সামনে বেড়ে নামিয়ে দিল বড় এক লিভার। টিপে দিল সবুজ এক বাটন। চাপা শব্দের পর তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলল মোটর। ওই দুই আওয়াজ চাপা পড়ল ঠং-ঠাং শব্দের শেকলের নিচে। নামছে ড্র-ব্রিজের দুই প্রান্ত।

বুথ থেকে ছুটে বেরিয়ে এল লাবনী। চোখে পড়ল, কাঁচের বিশাল পিরামিডের পেছনের আকাশে বেকায়দাভাবে ভাসছে এক হেলিকপ্টার!

স্কিড থেকে ঝুলছে কেউ!

 মাসুদ রানা!

.

সাইক্লিক কন্ট্রোল স্টিক একদিক থেকে আরেকদিকে নাড়ছে পাইলট। হোঁচট খাচ্ছে হেলিকপ্টার। চলে গেল দুর্গের উঁচু এক টাওয়ারের পাশে। যখন তখন বাড়ি খেয়ে বিধ্বস্ত হবে যান্ত্রিক ফড়িং। স্টিক নেড়ে সরে গেল পাইলট। বারবার ঝাঁকি খেয়ে চমকে উঠছে যাত্রীরা। পাইলটের জানালার নিচে ফিউযেলাজে ঘুষি মারছে কে যেন। হেলিকপ্টার পড়ে যাবে ভেবে ভীষণ ভয়ে চিৎকার করে উঠল বেলা।

হারামজাদা খসে পড়েছে? জানতে চাইল নাদির।

ভালভাবে স্কিড দেখতে সামনে ঝুঁকল পাইলট। তখনই খুলে গেল তার পাশের দরজা।

কেবিনে ঢুকল প্রচণ্ড হাওয়া ও বিকট আওয়াজ। সঙ্গে এল রানা। হেলিকপ্টার কাত হতেই উঠেছে স্কিডে। স্টিলের দণ্ডে পা বাধিয়ে হ্যাণ্ডেল ধরে মুচড়ে খুলে ফেলেছে দরজা। বিস্মিত পাইলট কিছু করার আগেই মুখে লাগল প্রচণ্ড এক ঘুষি। সামলে ওঠার আগেই বামহাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরল রানা। চোকহোল্ডে তাকে রেখে গর্জে উঠল, নিচে নামাও হেলিকপ্টার!

গুলি করো ওকে! ঘেউ করে উঠল নাদির।

অস্ত্র তাক করল ভার্নে, কিন্তু আবারও পাইলটের ঘাড়ে ঘুষি মারল রানা। আরেক হাতে তাকে সরিয়ে আনল নিজের সামনে। লাইন অভ ফায়ারে এখন পাইলট। গালি বকল ডাচ লোকটা। গুলি করতে চাইল লোকটাকে এড়িয়ে।

সাইক্লিক স্টিক ধরে হ্যাচকা টান দিল রানা।

নিচে নাক তাক করল ইউরোকপ্টার। হোঁচট খেয়ে পেছনে পড়ল সবাই। কর্কশ শব্দে বাজতে লাগল অ্যালার্ম। দ্রুত পিছিয়ে নামছে হেলিকপ্টার। প্রায় খাড়া হলো রোটর ব্লেড। যথেষ্ট বাতাস কাটছে না বলে ওজন রাখা অসম্ভব।

চোখের কোণে পিরামিড দেখল রানা। ছেড়ে দিল স্টিক। ওটাকে সামনে ঠেলল পাইলট। পায়ে চেপে ধরেছে রাডার প্যাডেল। পিরামিডে আছড়ে পড়ার আগেই বাঁচতে হবে। মনপ্রাণ ঢেলে ওপরে ওঠায় মন দিল পাইলট। সামনে হোঁচট খেল ইসি হাড়ে-থার্টি। ঘুরছে চরকির মত। সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স রানাকে ঠেলে দিল বাইরে। আরেকটু হলে পড়ত বহু নিচে। ভাল কিছু না পেয়ে ধরেছে পাইলটের হার্নেস। কিন্তু রিলিয বাটনে চেপে বসল ওর বুড়ো আঙুল।

কটাস শব্দে বেল্ট খুলতেই ভীষণ ভয়ে বোবার মত আর্তনাদ ছাড়ল পাইলট। শুধু কন্ট্রোল স্টিক ধরে আছে বলে পড়ছে না সিট থেকে। ঘুরে আরেকদিকে গেল পিরামিড, আরেকটু হলে হেলিকপ্টারের লেজ লাগত কালো কাঁচের ঢালু দেয়ালে।

হেলিকপ্টার নামাও! ধমক দিল রানা।

ওপরে তোল! বিকট ধমক মারল নাদির। খুলে ফেলল নিজের সিটবেল্ট। পাইলটের ওপর থেকে রানাকে সরাতে ঝুঁকে এল সামনে।

নাদিরের মুখে বাম কনুই নামাল বেলা। তীব্র ব্যথা পেয়ে ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল লোকটা। মাথা থেকে পড়ে গেল মুকুট।

বেলার দিকে অস্ত্রের নল ঘোরাল ভার্নে। তবে গুলির আগেই আবারও কপ্টারের কন্ট্রোল ধরে ঝাঁকি দিল রানা।

.

আতঙ্ক নিয়ে হেলিকপ্টার দেখছে লাবনী।

মাতালের মত নানাদিকে দুলছে যান্ত্রিক ফড়িং। চলে গেল পিরামিডের পেছনে। এবার বোধহয় গতি ও উচ্চতা হারিয়ে আছড়ে পড়বে!

লাবনী ভাবল: হায়, আল্লা, এখন? খুন হয়ে যাচ্ছে রানা!

উঠে দাঁড়িয়ে গলা ডলছে গিবন মুর। যাক, বাবা, কপাল ভাল যে আমি ওটার ভেতর নেই! রানা কোথায় গেছেন?

রেগে গিয়ে নায়ককে দেখল লাবনী। তা-ও বলে দিতে হবে, হাঁদা!

ওদেরকে পাশ কাটিয়ে থামল শোগান জিপগাড়ি। লাফিয়ে ওটা থেকে নামল সাতজন লোক। তাদের ভেতর আছেন ডক্টর হামদি। চারপাশে ছড়িয়ে গেল তাঁর সৈনিকরা। এলোমেলো চুলে লাবনীকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন মিশরীয় ডক্টর: ডক্টর আলম! কী হয়েছে? …যোডিয়াকই বা কোথায়?

দুর্গের দিকে আঙুল তাক করল লাবনী। পিরামিড বা দুর্গে! কিন্তু পিরামিডে আটকা পড়েছে নাদিরের ভক্তরা। ওখানেই আছে রানার দলের সবাই। ওদেরকে সাহায্য করুন। পরে দেখবেন যোডিয়াক! কর্তৃপক্ষ আসার আগেই নাদিরের লোক পালিয়ে গেলে সর্বনাশ হবে। এরা সঙ্গে নেবে বীজগুটি। সেক্ষেত্রে দুনিয়ার বুকে নামবে কেয়ামত!

 চিন্তায় পড়ে মাথা দোলালেন ডক্টর হামদি। দুই দলে ভাগ করে দিচ্ছি সৈনিকদেরকে। একদল যাবে যোডিয়াক পাহারা দিতে, অন্যদল যাবে… বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে দৃশ্যপটে হেলিকপ্টার আসতেই চমকে গেলেন তিনি। আল্লা মাবুদ! কী শুরু হলো!

নাদির ওই হেলিকপ্টারে! বলল লাবনী, সঙ্গে রানা আর বেলা! আবারও পিরামিডের ওদিকে গেল কপ্টার। অনেকটা নেমেছে বলে দেখা গেল না। কয়েক সেকেণ্ড পিরামিড দেখল লাবনী, তারপর সামনে বেড়ে চেপে বসল শোগানের ড্রাইভিং সিটে।

চমকে গেছেন ডক্টর হামদি। আরে, আরে, ডক্টর আলম! থামুন! কোথায় চললেন?

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই নুড়িপাথরে পিছলে কপ্টারের দিকে ছুটল জিপগাড়ি।

দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে মেয়েটা।

কোথায় চললেন…

.

উঠানের মাত্র বিশ ফুট ওপরে নেমে এসেছে হেলিকপ্টার। ঘুরছে চরকির মত। সামনের সিট ও কালেকটিভ কন্ট্রোল লিভারের মাঝে আটকা পড়েছে আঙুল, তাই ইঞ্জিনের ক্ষমতা বাড়াবে সে-উপায় নেই পাইলটের।

একহাতে তার ঘাড় জাপ্টে ধরেছে রানা। আরেক হাতে এদিক-ওদিক নেড়ে দিচ্ছে কন্ট্রোল। বনবন করে হেলিকপ্টার ঘুরছে বলে বমি আসছে ভার্নের। বেলাকে গুলি করা কঠিন তার জন্যে।

একই অবস্থা নাদিরের। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, সে বাস্তবে দেবতা হলে পোয়াতি মহিলার মত এত বমি আসত না। সুযোগ বুঝে তার গালে ঘুষি মারতে গেল বেলা। কিন্তু খপ করে হাতটা ধরে ফেলল নাদির। এত জোরে মুচড়ে দিল, কটাস করে খুলে গেল বেলার কাঁধের হাড়ের জয়েন্ট। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। ওকে ধাক্কা দিয়ে দরজার ওপর ফেলল নাদির।

ব্যথায় ফোঁপাতে শুরু করেছে মেয়েটা।

ক্লিক আওয়াজে খুলে গেল আরেকটা সিটবেল্টের বাটন। সামনে ঝুঁকল ভার্নে। পাইলটকে এড়িয়ে রানার দিকে তাক করতে গেল পিস্তল।

মুক্ত হাতে অস্ত্রটার নল আরেক দিকে সরিয়ে দিল রানা।

 শুরু হলো দুজনের শক্তির প্রতিযোগিতা।

ভার্নে চাইছে রানার দিকে নল তাক করতে। কিন্তু ওটাকে সরাতে চাইছে রানা। শক্তি কারও কম নয়। আরও শক্তি প্রয়োগ করতে স্কিড থেকে পা তুলে কেবিনে ঢুকতে গেল রানা।

থরথর করে কাঁপছে পিস্তল। নল তাক হলো পাইলটের দিকে। এখন গুলি করলে নিজ মৃত্যুর পরোয়ানা সই করবে ভার্নে। শরীরের সমস্ত জোরে সামনে বাড়তে চাইছে রানা।

রাগ-ঘৃণা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে নাদিরের চোখ। প্রায় লাফিয়ে সামনে বাড়ল সে। প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল রানার চোয়ালে।

হাত থেকে অস্ত্র ছুটে যেতেই চিত হয়ে পড়ল রানা। ওর সঙ্গে পড়ছে পাইলট। ঠাস্ করে স্কিডে পড়ল রানার পিঠ। ভীষণ ব্যথায় আটকে গেল শ্বাস। সিটবেল্টের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এক পা। দড়ির মত স্ট্র্যাপে আটকা পড়ে ঝুলছে পা বাঁধা মোরগের মত। মাথা নিচু, পা ওপরে। মাত্র দশ ফুট নিচে মাটি, ঘুরতে ঘুরতে নামছে কপ্টার। বিধ্বস্ত হবে যে কোনও সময়ে। স্রেফ পিষে যাবে রানা ওটার ওজনে।

.

শোগান জিপগাড়ি নিয়ে পিরামিডের কোনা ঘুরেই সামনে কপ্টার দেখল লাবনী। ঘুরতে ঘুরতে নেমে এসে সোজা এল ওটা ওর গাড়ির দিকেই!

ওরে, বাবারে! আঁৎকে উঠল লাবনী। ব্রেকে চাপ তৈরি করে পরক্ষণে লাফিয়ে পড়ল খোলা দরজা দিয়ে।

শিমুল বীজগুটির মত ভাসতে ভাসতে জিপের দিকে এল ইসি হান্ড্রেড-থার্টি।

.

নিজেকে সামলে সিটে উঠে বসল পাইলট- এত নিচে নেমে এসেছে দেখে হাঁ হয়ে গেল মুখ। সামনেই জিপগাড়ি। এক পায়ে অন্য রাডার প্যাডেল চেপে ধরল সে। থামাবে ঘুরন্ত হেলিকপ্টার। ইঞ্জিনের শক্তি বাড়াতে মুচড়ে ধরল থ্রটল।

হাতের আঙুলে জমির স্পর্শ পেল রানা।

 আবারও স্থির হলো হেলিকপ্টার।

রানা দেখল, শোগান জিপগাড়ির পাশেই পড়ে আছে লাবনী। পরক্ষণে জিপগাড়ির ওপর দিয়ে গেল ও নিজে।

উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল লাবনী, রানা!

 উঠানের একটু ওপরে ভাসছে হেলিকপ্টার।

 জিপগাড়ির উইঞ্চ! প্রাণপণে চেঁচাল রানা, ওটা দাও!

কী বললে? কপ্টারের ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজে ভালভাবে শুনতে পায়নি লাবনী।

দুহাতে জিপগাড়ির সামনের দিক দেখাল রানা। উইঞ্চ! বেল! উইঞ্চ! ওটা দাও!

জিপের সামনে বাম্পারে আছে উইঞ্চ সিস্টেম। এক শ পঞ্চাশ ফুট স্টিলের কেবল, শেষমাথায় হুক। উইঞ্চের দিকে দৌড়ে গেল লাবনী। ওর দিকেই পিছিয়ে আসছে কপ্টার। রিলিয লিভার টেনে দেয়ায় খুলে গেল স্কুল, বেশ কয়েক ফুট কেবল ছুটিয়ে নিয়েই হুক হাতে রানার দিকে ছুটল লাবনী।

.

অ্যাই, শালার পাইলট, উঠতে শুরু কর! ধমক দিল নাদির।

ইঞ্জিনকে শক্তি দিল পাইলট। উঠছে হেলিকপ্টার। ওটার নিচে ঝুলতে ঝুলতে চলেছে রানা। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হলো লাবনীর। কেউ জানে না, যথেষ্ট কেবল ছুটিয়ে নিয়েছে কি না। এখন নতুন কিছু করার উপায়ও নেই। রানাকে বাঁচাতে হলে এই একটাই সুযোগ পাবে লাবনী।

হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রানা।

সারাশরীরের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে হুক ছুঁড়ল লাবনী।

হুকের পেছনে ছুটল কেবল। ওপরের জোরালো বাতাসের চাপে আবার নামছে। হাত বাড়িয়ে রেখেছে রানা। এক সেকেণ্ড পর দুই আঙুলে ধরতে পারল হুক। দুহাতে ওটা টেনে নিল। পেছনে পড়ে গেছে জিপগাড়ি। ফুরিয়ে এসেছে লাবনীর ছুটিয়ে নেয়া কেবল। টানটান হওয়ার পর তুমুল বেগে বনবন করে ঘুরতে লাগল স্কুল। খুলে আসছে কেবল।

মুখ তুলে তাকাল লাবনী।

দ্রুত আকাশে উঠছে হেলিকপ্টার।

.

সিটবেল্টে পা জড়িয়ে ঝুলছে রানা। চাইল কোমর তুলে আনতে। কিন্তু ওর মনে হলো, উঠে আসতে পারবে না স্কিড পর্যন্ত। ব্যথায় টনটন করছে শরীর। তার ওপর টান পড়ল হাতের কেবলে।

এদিকে সাইক্লিক ছেড়ে পাশের দরজা বন্ধ করতে চাইল পাইলট। কিন্তু বাধা দিল কী যেন। আবার স্টিকে হাত রেখে তাকাল সিটের পাশের টানটান হার্নেসের দিকে। ওই লোক এখনও আছে!

ভার্নে! গর্জে উঠল নাদির, বাইরে গিয়ে গুলি করো ওকে!

বাইরে বেরোতে হবে? সন্দেহ নিয়ে বলল ভার্নে।

স্কিড থেকে ঝুলছে ব্যাটা! গুলি করো! গনগনে রাগ নিয়ে মেঝের দিকে আঙুল তাক করল নাদির।

খুব দ্বিধায় পড়ল ডাচ। কিন্তু দুসেকেণ্ড পর ভাবল, নির্দেশ পালন করাই ভাল। একহাতে সিটবেল্টের স্ট্র্যাপ

আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে খুলল দরজার ল্যাচ।

একবার উইঞ্চ আবার কপ্টার দেখছে লাবনী। প্রায় ফুরিয়ে এসেছে স্পুলের কেবল।

ঠেলা দিয়ে দরজা খুলে ফিউযেলাযের নিচে দেখল ভার্নে। এয়ারক্রাফটের আরেকদিকে ঝুলছে মাসুদ রানা।

আরও ঝুঁকে পিস্তলের নল রানার দিকে তাক করল ভার্নে।

রানাও বুঝেছে, কী হচ্ছে। প্রাণপণে উঠে আসতে চাইল স্কিডের দিকে।

পিস্তলের নল সরাসরি ওর বুকে তাক করেছে ভার্নে।

ওই একইসময়ে রানার হাতের হুক আটকে গেল স্কিডে। পরের সেকেণ্ডে ফুরিয়ে গেল শুলে ঘুরন্ত কেবল।

মিতসুবিশি ভীষণ ঝাঁকি খেতেই ভয় পেয়ে সরে গেছে লাবনী। বহু ওপরের আকাশে ঝটকা খেয়েছে কপ্টার। সামনের সিটে হুমড়ি খেল নাদির। ক্যানোপির ওপর ঠাস করে নামল পাইলটের মাথা। সিটবেল্ট আছে বলে ছিটকে পড়া থেকে বেঁচে গেছে আহত বেলা। কিন্তু কেবিনের বাইরে রানা ও ভার্নের পরিণতি হলো অন্যরকম।

কসেকেণ্ড আগে স্কিডে উঠতে চাইছিল রানা, এখন হঠাৎ এক ঠেলা খেয়ে উঠে গেল পাইপের মত স্কিডের পাশে। দুই কনুই ভাজ করে ধরে ফেলল ওটা।

কিন্তু রানার মত এত সৌভাগ্যবান নয় ভার্নে। পিস্তল ধরা হাত লাগল খোলা দরজার ফ্রেমে। বাড়ি খেয়ে কেবিনে পড়ল অস্ত্রটা। ওপরে উঠে গেছে ভার্নে…

সোজা ওপরের রোটর ব্লেডে ঢুকল তার মাথা।

উইণ্ডশিল্ড জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল লাল-ধূসর ঘন কুয়াশা। দুচোখের ওপরে কপাল বা মাথা বলতে কিছুই থাকল না লোকটার। সাই করে নেমে গেল দেড় শ ফুট নিচের মাটির দিকে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর আছড়ে পড়ে থেঁতলে গেল লাশ।

ভীষণ ব্যথা পেয়ে ঝিমঝিম করছে পাইলটের মাথা। বুক পড়ে আছে ইন্সট্রুমেন্ট কন্সেলের ওপর। ঠেলা খেয়ে এগিয়ে গেছে সাইক্লিক স্টিক। কোনাকুনিভাবে ওড়া ঘুড়ির মত কাত হয়ে হেলিকপ্টার চলেছে পিরামিডের দিকে। নিচ থেকে ওটাকে আটকে রেখেছে কেবল।

হঠাৎ ভয় পেয়ে পালাতে চাইল লাবনী। পেছন পেছন তেড়ে আসছে ভারী জিপগাড়ি!

কপ্টারের শক্তি নেই যে তুলবে আড়াই টনের গাড়ি, কিন্তু টেনে নিয়ে চলেছে পেছনে।

মুক্ত পায়ে স্কিড মুড়িয়ে নিল রানা। তাকাল নিচে। পিরামিডের চূড়ার একটু ওপরে আছে হেলিকপ্টার।

সিটবেল্ট থেকে পা ছুটিয়ে নিল রানা, উঠে এল স্কিডে। জানালা দিয়ে দেখল, অসুস্থ চেহারা করে এইমাত্র সোজা হয়ে বসল পাইলট। পেছনের সিটে বেলা। ব্যথায় কুঁচকে আছে। মুখ। একহাতে ধরে রেখেছে কাঁধের ভাঙা জয়েন্ট।

মেয়েটার পাশেই উবু হয়ে কী যেন খুঁজছে নাদির। বোধহয় ফুটওয়েল থেকে বের করছে কিছু। রানার মনে হলো, জিনিসটা ভাইরাসের ক্যানিস্টার। তবে দুসেকেণ্ড পর দেখল, স্টিলের ফ্লাস্ক আছে তার সিটের পাশে।

পরক্ষণে সিধে হয়ে বসল নাদির। এখন হাতে ভার্নের ওই পিস্তল! সোজা তাক করল রানার দিকে!

একইসময়ে নাদিরের বাহুতে ধাক্কা দিল বেলা। পরক্ষণে চাপ পড়ল ট্রিগারে। সাইড উইণ্ডো ভরে গেল থোক-থোক মগজ ও রক্তে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক-রেঞ্জে বুলেট উড়িয়ে দিয়েছে। পাইলটের অর্ধেক খুলি। ভীষণ ঝটকা খেল লোকটা। লাশের এক পা চেপে বসল রাডার প্যাডেলে। ঘুরে ঘুরে টার্কি-ডান্স শুরু করেছে হেলিকপ্টার।

খুলে গেল পাইলটের দরজা। প্রায় হুমড়ি খেয়ে লাশের ওপর দিয়ে উঠে এল রানা। কেবিনের উল্টোদিকে পড়েছে নাদির। হাতে এখনও পিস্তল। অন্যহাতে কিছু ধরে সামলাতে চাইছে নিজেকে।

উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল ককপিট। হেলিকপ্টার আছে পিরামিডের শীর্ষের আলোর ওপরে। চোখ কুঁচকে চারপাশ দেখল রানা। বুঝে গেল কী করা উচিত।

আবার ওরা সরে গেল তীব্র আলো থেকে।

রানার মুখের দিকে পিস্তল তাক করল নাদির।

নিচে পিরামিডের কাঁচের দেয়ালে নাক খুঁজল মিতসুবিশি জিপ। ভারী স্টিলের ফ্রেমে বেধে গেল কেবল। ওই সংঘর্ষে সামনের সিটে হুমড়ি খেল রানা। দরজায় আছড়ে পড়েছে নাদির। কটাৎ আওয়াজে খুলে গেল ল্যাচ। কাত হয়ে সরছে হেলিকপ্টার। ভীষণ ভয়ে ডোর ফ্রেম আঁকড়ে ধরল নাদির। ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়তেই বুম! করে উঠল পিস্তল। বুলেট লাগল পেছনের বালকহেডে। শক্তভাবে ফ্রেম ধরতে গিয়ে হাত থেকে পিস্তল ছেড়ে দিল সে। ওটা নেমে গেল পিরামিডের ঢালু দেয়াল বেয়ে নিচে।

কর্কশ আওয়াজে কন্সেলে বাজতে শুরু হয়েছে বাযার। দপদপ করে জ্বলছে লাল সতর্কতাসূচক বাতি।

ওদিকে চেয়ে রানা দেখল, খুব দ্রুত কমছে একটা গেজ। অয়েল প্রেশার। বুলেট ক্ষতি করেছে ইঞ্জিনের।

আবারও ঝাঁকি খেল ইসি হান্ড্রেড-থার্টি। জোর টান দিচ্ছে কেবলে। পেছনের সিটে গড়িয়ে এদিক-ওদিক যাচ্ছে স্টিলের ক্যানিস্টার। একইসময়ে ওটার দিকে তাকাল রানা ও নাদির। আবার দেখল পরস্পরকে।

রানা চায় বীজগুটি ধ্বংস হোক।

নাদির চাইছে ওটা রক্ষা করতে।

সামনের সিট টপকে পেছনে হাজির হলো রানা। একই মুহূর্তে আবারও কপ্টারের কেবিনে ফিরল নাদির। দুজনের মধ্যে নাদিরই আগে পেল ক্যানিস্টার। হ্যাণ্ডেল ধরেই ওটা দিয়ে প্রচণ্ড এক বাড়ি দিল রানার মাথার চাঁদিতে।

আবারও অস্বাভাবিক সাদা আলোয় ভরে গেল কেবিন। পিরামিডের শীর্ষের আলোর ওপরে ফিরে এসেছে কপ্টার। পনেরো তলা নিচের জিপগাড়ি-ননাঙরে আটকা পড়েছে যান্ত্রিক ফড়িং।

সিলিণ্ডারের মত ফ্লাস্ক বুকের কাছে ধরেছে নাদির। বুকে। লাথি মেরে সরাতে চাইল রানাকে।

ঝটকা দিয়ে আগেই সরে গেছে রানা।

ষাঁড়ের মত চিৎকার ছাড়ল নাদির, তুই কিছুই না! পারবি না আমার সঙ্গে! আমি সেট! আমি মৃত্যুদেবতা!

আগেই রানা দেখেছে, ডোর ফ্রেম ধরে রেখেছে লোকটা। সাদা হয়েছে মুঠোর হাড়। আপোষের সুরে বলল ও, যদি দেবতাই হবে, দেখি তো তুমি উড়তে পারো কি না! ওর মুঠো নামল নাদিরের মুঠোর ওপর। নিজেই নিদারুণ ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল রানা। ফেটে গেছে- ত্বক। কিন্তু ওর যন্ত্রণা কিছুই নয়। শক্ত স্টিলের ওপর রাখা হাতে পড়েছে ভয়ঙ্কর কিল। মড়াৎ করে ভেঙে গেছে মধ্যমার হাড়। প্রচণ্ড ব্যথায় করুণ আর্তনাদ ছাড়ল নাদির। তখনই তার ক্ষতচিহ্ন ভরা মুখে নামল রানার রক্তাক্ত মুঠোর ঘুষি।

কাত হয়ে আবারও নিচের আলোয় ফিরল হেলিকপ্টার।

ভারসাম্য রাখতে না পেরে টুপ করে খসে পড়ল নাদির। এখনও বুকে ধরে রেখেছে সাধের ক্যানিস্টার। তীব্র আলোর মাঝে সাই করে নেমে গেল পনেরো ফুট। কড়াৎ এক আওয়াজ তুলে পিঠে গেঁথে গেল পিরামিডের চোখা শীর্ষ।

নিচে তাকাল রানা। কয়েক ভাগে আলো আসছে এখন।

নাদিরের ফুটো পেট আকাশের দিকে। মৃত্যু হয়নি তার। গলগল করে বেরোচ্ছে রক্ত। একহাতে ওপরে তুলল ক্যানিস্টার। খুলবে ওটার মুখ। বাতাসে ছড়িয়ে দেবে ভয়ানক ভাইরাস।

তার দিকে চেয়ে নেই রানা। কঙ্গেলে জ্বলছে অন্তত চারটে ওয়ার্নিং বাতি। সতর্ক কবছে অ্যালার্ম। ওদিকে মন দিল ও। খুব দ্রুত কমছে অয়েল প্রেশার গেজ। যে-কোনও সময়ে বন্ধ হবে ইঞ্জিন।

কন্সোলে কয়েকটা বাটন টিপে দিয়ে বেলার পাশে পৌঁছুল রানা। কাঁধের ব্যথায় নাক কুঁচকে রেখেছে মেয়েটা। বেলা, ঠিক আছ তো?

হারামজাদা আমার কাঁধের হাড় ভেঙে দিয়েছে, দাঁতে দাঁত চেপে নালিশ করল বেলা। আপনি নামাতে পারবেন এই হেলিকপ্টার?

না, অন্য কিছু করব, বলল রানা।

তা হলে খুন হব? আপনি এত কিছু পারেন, আর একটা হেলিকপ্টার চালাতে পারেন না!

এটা পড়বে পিরামিডের ওপর, বলল রানা। তা হলে থাকবে না ওই ল্যাব।

কিন্তু আমাদের কী হবে?

আমরা লাফ দেব।

পনেরো তলা থেকে?

ক্ষতি কী!

হতবাক হয়ে গেল বেলা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, কিন্তু আমরা তো প্রায় চাঁদের কাছে!

স্থির হয়ে ভাসছে হেলিকপ্টার, কিন্তু কর্কশ শব্দে কী যেন ভাঙছে ইঞ্জিনের ভেতর।

বলমাত্র লাফ দেবে! বলে উঠল রানা, তা হলে এবার লাফ দাও! জলদি!

গতি কমে গেছে রোটরের। শক্তি দেবে না ইঞ্জিন। ভারী পাথরের মত শুরু হবে হেলিকপ্টারের পতন!

বেলাকে একহাতে জড়িয়ে ধরেই কেবিন থেকে নেমে পড়েছে রানা। ওর ভাব দেখে বেলার মনে হলো, পিছলে নেমে পড়ছে কোনও সুইমিং পুলে!

দশ ফুট সাঁই করে নামল ওরা, তারপর পা নিচে রেখে সড়াৎ করে পিছলে গেল পিরামিডের ঢালু গায়ে। কড়-মড় আওয়াজে ফাটল ধরল শক্ত কাঁচে, তবে ভাঙল না। সর-সর করে নেমে চলেছে ওরা।

তখনও দুর্বল হাতে ক্যানিস্টারের ক্যাপ খুলতে চাইছে। নাদির। তীব্র ব্যথাভরা ঘোলা চোখে দেখল, আকাশ থেকে নেমে আসছে ভারী হেলিকপ্টার!

প্রাণের ভয়ে করুণ এক আর্তনাদ ছাড়ল নকল দেবতা।

ওপর থেকে হেলিকপ্টার পড়েই চুরমার করল পিরামিডের শীর্ষ। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঁচ ও ধাতব টুকরো। ল্যাবের মেঝেতে পড়েই বিস্ফোরিত হলো হেলিকপ্টার। নানাদিকে গেল শক ওয়েভ। পৌঁছুল ওই ধাক্কা লুকিয়ে রাখা সি-ফোর পর্যন্ত।

বিস্ফোরিত হলো শক্তিশালী বোমা। চুরমার হলো গ্যাস ট্যাঙ্ক। লেলিহান আগুন গিলে নিল গোটা ল্যাব। পুরো পিরামিডের তিনভাগের একভাগ মুহূর্তে হয়ে উঠল কাঁচের আগ্নেয়গিরির মত। ঝরঝর করে নামতে লাগল সব।

এরই ভেতর পিরামিড বেয়ে অনেক নেমে এসেছে রানা ও বেলা। বিস্ফোরণের আগুন দেখে সরে যাচ্ছে লাবনী, নিচে দেখল রানা। পিরামিডে নাক খুঁজেছে জিপগাড়ি।

কাঁচে পা বাধিয়ে গতিপথ বদলে নাও! চিৎকার করে বেলাকে বলল রানা। জুতোর সোল ব্যবহার করে বাধা তৈরি করছে ওরা। চেষ্টা করো বাঁক নিতে! নিচে জিপগাড়ি!

পা ঠেকিয়ে বামদিকে গেল রানা। বেলা চলল ডানদিকে। ওদের দিকে সাঁই করে উঠে এল শোগান জিপগাড়ি। পরক্ষণে পিরামিড থেকে পিছলে মাটিতে হড়কে চলল ওরা। পাগল হয়ে গেল পায়ের ব্যথায়। শুরু হলো গড়িয়ে যাওয়া।

বেলার আর্তচিৎকার শুনল রানা। আকাশ থেকে ধুপ-ধাপ শব্দে পড়ছে ভাঙা কাঁচ ও জঞ্জাল।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর স্থির হলো রানা। টের পেল, প্রায় কোনও আওয়াজই নেই। শুধু শোঁ-শোঁ শব্দে ভাঙা পিরামিডের ওপরে জ্বলছে লকলকে কমলা আগুন। তার মানে, পুড়ে ছাই হয়েছে নারকীয় ওই বীজগুটি।

রক্তাক্ত শরীরে মাথা তুলে এদিক-ওদিক দেখল রানা। ওর মনে হলো খুন হয়ে গেছে যন্ত্রণায়। নিজ নাম শুনে ঘাড় ফেরাল।

রানা! ছুটে আসছে লাবনী। কাছে এসে ওকে আস্ত দেখে কেঁদে ফেলল। তুমি একটা পাগল! একদম!

বেলার ক্ষতি হয়নি তো? জানতে চাইল রানা।

একটু দূর থেকে এল বেলার কণ্ঠ: আমি ঠিকই আছি। কিন্তু জীবনেও আর আপনার ধারেকাছে আসছি না! আমি তো আর বদ্ধ পাগল নই!

ব্যথা সহ্য করে মৃদু হাসল রানা। উঠে বসেই দেখল, যোডিয়াক নিয়ে পিরামিড থেকে বেরিয়ে আসছেন হামদি ও তাঁর এএসপিএস সৈনিকরা। পেছনেই গিবন মুর।

এবার? রানার দিকে তাকাল লাবনী। বাড়ি ফিরবে?

কয়েক দিন পর, আগে কিছু কাজ আছে, বলল রানা।

.

পাঁচ দিন পর।

নিউ ইয়র্ক।

সোনালি রোদেলা সকাল। আটটা।

কলিং বেল বাজতেই গিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা খুলল লাবনী। চমকে গেল রানাকে দেখে। শুনেছিল দেশে ফিরবে বিসিআই এজেন্ট।

লাবনী কবাট থেকে সরে যেতেই ভেতরে ঢুকল রানা। নরম সুরে বলল, হবে নাকি এক মগ কফি, ম্যাডাম?

হ্যাঁ, হবে, দরজা বন্ধ করে কিচেন লক্ষ্য করে চলল লাবনী। পাঁচ মিনিট পর ড্রইংরুমে এসে দেখল চুপ করে বসে আছে রানা। নিচু টেবিলের ওপর একটা সাদা খাম। লাবনী কফির মগ দেয়ায় অন্য হাতে খাম বাড়িয়ে দিল মাসুদ রানা।

এটা কীসের? খাম নিয়ে জানতে চাইল লাবনী। কিছু বলতে হলো না রানাকে, নিজেই ও দেখল ইউএন সিল।

খামের একদিক ছিঁড়ে ভেতর থেকে কাগজ বের করে চোখ বোলাল লেখার ওপর। হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ। তাকাল রানার দিকে। আবারও?

হ্যাঁ, আবারও, বলল রানা। তবে যারা তোমার পেছনে লেগেছিল, কান ধরে বের করে দেয়া হয়েছে তাদের আইএইচএ থেকে। দেখতেই পাচ্ছ, কর্তৃপক্ষ অনুতপ্ত। তা ছাড়া… একটু থামল রানা। হাসল। বেতনও মেলা।

সত্যি কি যাওয়া উচিত? তোমার কী মনে হয়, রানা?

সম্মান দিয়ে ডাকছে, ভেবে দেখতে পারো। এক চুমুকে মগের অর্ধেক খালি করে উঠে দাঁড়াল রানা। এবার দেশে ফিরব। একটু পর ফ্লাইট। চলি?

মাথা কাত করল লাবনী। অবাক চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা। ভাল করেই বুঝেছে, রানা হস্তক্ষেপ না করলে আইএইচএর চিফের চাকরিটা ফেরত পাওয়া সহজ হত না।

কিছু বলার আগেই ওর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেল রানা। পেছন থেকে চেয়ে রইল লাবনী। নতুন করে আবারও উপলব্ধি করল: রানার মত এমন বন্ধু আগে কখনও ছিল না ওর, এখনও নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *