ধর্মগুরু ৩

২০.

 ভিআইপি বক্সে বসে কাঁচে নাক ঠেকিয়ে তুমুল রেস দেখছে কাদির ওসাইরিস। এইমাত্র হুঁই আওয়াজে দূরে গেল রেসের দুই প্রতিযোগীর গাড়ি। এখনও প্রথম জায়গা দখলে রেখেছে রনি রুবিল্যাক। হা! বাম তালুতে ঘুষি বসাল কাদির।

মাত্র গত বছর থেকে প্রাইমারি স্পন্সর হয়েছে। ওসাইরিয়ান টেম্পলের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। আজই হয়তো হবে চ্যাম্পিয়ন স্পন্সর। মোনাকোর রেসের পর দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়কে ওসাইরিয়ান টেম্পলের সুনাম। এরপর নামকরা সব রেসে দল নামাবে তারা।

কাদিরের পাশে বসে আছে নাদির মাকালানি, মোটেও মন দিচ্ছে না রেসে। মোবাইল ফোন বাজতেই কল রিসিভ করল সে। ওদিক থেকে চিৎকার করছে লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ শুনল নাদির, তারপর সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কাদির!

বিরক্ত কোরো না! হাতের ইশারায় মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করল কাদির ওসাইরিস।

কাদির! আবারও ডাকল নাদির, কণ্ঠে চাপা রাগ। মনোযোগ আকর্ষণ করতে বলল, আমুন রা ইয়ট!

ওটার আবার কী হলো?

বক্সের অন্যরা শুনবে, তাই ভাইকে দূরের কোণে নিয়ে গেল নাদির। মাসুদ রানা আর লাবনী আলম ছাড়া পেয়ে গেছে।

হতভম্ব চেহারা হলো কাদিরের। কী?

আমাদের কয়েকজনকে খুন করে জেট স্কি নিয়ে সরে গেছে।

এটা কখনকার কথা?

কয়েক সেকেণ্ড আগের কথা।

কী করবে ভাবতে শুরু করেছে কাদির ওসাইরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ওদেরকে ঠেকাতে হবে!

দেখছি কী করা যায়। ঘুরে দাঁড়াল নাদির। কানে ঠেকাল মোবাইল ফোন।

তার কাঁধে টোকা দিল কাদির। যা করার গোপনে। ধরে সরিয়ে নেবে। মোনাকোর কেউ যেন না জানে।

সেটা নির্ভর করে ওরা কী করবে। আমুন রা-র ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলল নাদির: ওদেরকে ধরতে লোক পাঠান। টেণ্ডার রওনা হোক, ওরা যাতে আসতে না পারে বন্দরের দিকে। দরকার হলে ইয়ট নিয়ে ধাওয়া করবেন। ঠেকাতে হবে যেভাবে হোক। যে-কোনও মূল্যে! ফোন রেখে বিরক্তির চোখে কাদিরকে দেখল নাদির, তারপর বেরিয়ে গেল ভিআইপি বক্স ছেড়ে।

.

আকাশ পরিষ্কার, তবে বইছে দমকা বাতাস। সাগরে উঠছে মস্তবড় সব ঢেউ। যে-কোনও সময়ে তলিয়ে যাবে হালকা ভেসেল, তাই সাগরে বেরোয়নি সাধারণ জেলেরা। অথচ প্রচণ্ড গতি তুলছে খইয়ের মত পলকা জেট স্কি। যেন রোলার কোস্টারের বগি। বিশাল এক ঢেউ থেকে আরেক ঢেউয়ে ঝাঁপ দেয়ার সময় আকাশে ঝুলছে ওটা।

হায়, আল্লা! খুন হব তো! রানার কানের কাছে চিৎকার করছে লাবনী। পানি চিরে যেতে পারবে না?

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে দেখল রানা। ধাওয়া করেছে বিশাল ইয়ট আমুন রা! এইমাত্র নামানো হলো স্পিডবোট!

কাদিরের নেভি আসছে! গতি কমালে ধরা পড়ব!

ওদেরকে ছিটকে শূন্যে পাঠাল বড় এক ঢেউ। উড়ন্ত অবস্থায় দিক ঠিক করে নিল রানা। ধড়াস্ করে নেমে এল পরের ঢেউয়ে চড়তে। সামনে আরেকটা ইয়টের স্টার্ন ঘুরে বন্দরের দিকে চলল ও।

একটু দূরে বিলাসবহুল সব ইয়টের ভিড়।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল লাবনী। জেট স্কি যত গতিই তুলুক, এরই ভেতর অনেক কাছে চলে এসেছে স্পিডবোট। রানার কানের কাছে বলল, ওদের স্পিড অনেক বেশি! ধরা পড়ব!

সেজন্যেই তো ওটার নাম স্পিডবোট! জ্ঞান দিল রানা, আরও খারাপ দিক, ওদের কাছে আছে সাবমেশিন গান!

তুমুল বেগে ছুটছে জেট স্কি। একের পর এক রঙিন ইয়ট পাশ কাটিয়ে চলেছে রানা। ওদের সাধ্য নেই যে চিনবে রঙ। সবই ঝাপসা। দূরে কী যেন দেখে সেদিকে চলল রানা।

কী করছ! নার্ভাস কণ্ঠে জানতে চাইল লাবনী। চট করে তাকাল, দূরে সাই করে সরল বন্দরের মুখ। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, বন্দর আগের জায়গায় আছে, ওরা চলেছে অন্যদিকে। ওদের দিকে ধেয়ে এল স্পিডবোট।

লাবনী, বললেই নিচু করবে মাথা!

সামনের ইয়টের নাকে প্রচণ্ড বেগে লাগবে জেট স্কি।

ভীষণ ভয় পেল লাবনী। তো লাগলে খুন হব!

ওটার কাছ দিয়ে যাব! ইয়টের বো লক্ষ্য করে ছুটছে হালকা জেট স্কি। তবে আরও কাছে থাকবে অন্য কিছু!

কী বলতে… বাপরে! চমকে গেছে লাবনী।

আরেক ইয়টের স্টার্ন ঘুরে বাঁক নিল লাল বিদ্যুাতি এক পাওয়ার বোট। যাবে সামনের ইয়টের বো-র নাকের কাছ দিয়ে। একপাশে রকেটের বেগে পিছিয়ে পড়ছে সারি সারি ইয়ট। বিকট আওয়াজে ছুটছে পাওয়ার বোট। গতি ঘণ্টায় আশি নট!

হাঁ হয়ে গেল লাবনী। ওরে, বাবা!

এদিকে কাদিরের স্পিডবোটের ড্রাইভার উঁচু করে ধরেছে সাবমেশিন গান।

মাথা নিচু! গলা ফাটাল রানা। হ্যাণ্ডেলবারের নিচে নামিয়ে নিয়েছে মাথা। একই কাজ করল লাবনী, মাথা গুজল রানার কোমরের কাছে।

তখনই সামনের ইয়টের বো পেরোল রানাদের জেট স্কি, আরেকটু হলে চেপে বসত পাওয়ার বোটের স্টার্নে। ওটার পেছনে আসছে এক ওয়াটার স্কিয়ার। তাকে টেনে আনা দড়ি আরেকটু হলে গর্দান নিত রানা ও লাবনীর।

বাঁক নিয়ে প্রচণ্ড বেগে এল কাদিরের স্পিডবোটের ড্রাইভার। ছিটানো পানির কণার জন্যে দেখেনি ওয়াটার স্কিয়ারের নাইলনের সরু দড়ি। দেরি হয়ে গেছে তার। প্রচণ্ড গতির কারণে থুতনির নিচে লাগল টানটান দড়ি। শরীরটা নিয়ে সাঁই করে চলে গেল স্পিডবোট, শূন্যে লাফিয়ে উঠল কাটা মাথা। এক সেকেণ্ড পর ওখানে পৌঁছে গেল স্কিয়ার।

জীবনে প্রথমবারের মত কারও ঘাড়ে দুটো মাথা দেখল রানা। পরক্ষণে সাগরে পড়ে টুপ করে ডুবে গেল বাড়তি মাথা। অনেকটা দূরে চলে গেছে স্পিডবোট। ওদিকে বাঁক নিয়ে থামতে শুরু করেছে পাওয়ার বোট।

জেট স্কির পেছনে আসছে আমুন রা ইয়ট। বন্দরের মুখ লক্ষ্য করে জেট স্কি ঘোরাল রানা। কিন্তু চমকে গেল, বন্দর থেকে বেরিয়ে ওদের দিকেই আসছে আমুন রা-র সবুজ সোনালি টেণ্ডার!

পেছনে আমুন রা, সামনে টেণ্ডার!

মাঝখানে আটকা পড়ছে ওরা!

এক সেকেণ্ড পর সিদ্ধান্ত নিল রানা, আবারও গিয়ে ঢুকবে মিলিয়নেয়ারদের ইয়টের জটলায়। শক্তিশালী সব বোটের গতি বেশি বলেও চট করে এদিক ওদিক সরতে পারবে জেট স্কি। নানান ইয়টের মাঝ দিয়ে এগোবে ওরা। তারপর প্রথম সুযোগেই দৌড় লাগাবে বন্দরে ঢুকতে।

কিন্তু কসেকেণ্ড পরেই দমে গেল রানা। কাজ হবে না ওর প্ল্যানে। বন্দরের মুখ পাহারা দিতে ওদিকে চলেছে আমুন। রা। নামাবে বাড়তি জেট স্কি ও স্পিডবোট। আসছে টেণ্ডার। সবাই মিলে ধাওয়া করবে, উপায় থাকবে না পালাবার।

আমুন রা থেকে আগেই নামিয়ে দেয়া হয়েছে স্পিডবোট। তুমুল বেগে আসছে ওদের জেট স্কি লক্ষ্য করে। বাড়ছে ভারী টেণ্ডারের গতি। নতুন সব ঢেউয়ে পড়ে তৈরি করছে ঘাপ-ঘাপ আওয়াজ।

 নতুন কোনও কৌশল চাই।

ভয়ে রানার কোমর জড়িয়ে ধরেছে লাবনী। সরাসরি টেণ্ডারের দিকে জেট স্কি ঘোরাল রানা। কী করো, রানা! ভয় পেয়ে বলল লাবনী, মুখোমুখি হলে খুন হব! সোজা চলেছে ওরা টেণ্ডারের দিকে। ওরা খুনি!

জানি! তা

 হলে অন্যদিকে চলো!

বিশ্বাস রাখো আমার ওপর! এঁকেবেঁকে যেতে যেতে সঠিক ঢেউয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে রানা।

টেণ্ডারের ডেকে উঠে দাঁড়াল এক লোক। একহাতে শক্ত করে ধরেছে উইণ্ডশিল্ড, অন্য হাতে তাক করছে আগ্নেয়াস্ত্র।

সামনেই রানা দেখল, বড় এক ঢেউয়ের গভীর খোড়ল, ওপাশেই আকাশে উঠছে ঢেউয়ের চূড়া। সরাসরি ওপাশে টেণ্ডার। শক্ত করে কোমর ধরো, লাবনী!

ঢেউয়ের গভীর খোঁড়লে নেমে গেল রানা, মুচড়ে রেখেছে থ্রটল। তীরের মত ছিটকে গিয়ে উঠবে চূড়ায়। ফলে শূন্যে ভেসে উঠবে জেট স্কি।

গুলি করবে কাদিরের লোক, এমনসময় সামনে থেকে উধাও হলো জেট স্কি। দেখা দিল কয়েক সেকেণ্ড পর। টেণ্ডারের বো-র ওপর নেমে এল ধুম করে!

দুহাতের সমস্ত জোর খাটিয়ে হ্যাণ্ডেলবার ধরেছে রানা। জেট স্কির সঙ্গে সঙ্গে কাত হলো লাবনীসহ। ডেকে পড়ে পিছলে চলেছে দ্রুতগামী জলযান। চুরমার করল টেণ্ডারের উইণ্ডশিল্ড, পরক্ষণে ভাঙল নৌযানের একপাশ। আগেই সিটে পিষে দিয়েছে টেণ্ডারের ড্রাইভারকে। অস্ত্র হাতে লোকটা যেন বেসবল, তাকে প্রচণ্ড এক বাড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে জল মোটরবাইক।

সরসর করে পিছলে টেণ্ডারের স্টার্ন পেরিয়ে সাগরে পড়ল জেট স্কি। রানাকে আঁকড়ে ধরেছে বলে পড়ে যায়নি লাবনী। ইমপেলার নতুন করে পানি পেতেই পুট-পুট আওয়াজ তুলল জেট স্কি। নতুন করে রওনা হলো রানা।

ফুল স্পিডে চলেছে টেণ্ডার। ডেক থেকে উঠে ড্রাইভারের লাশ সরাল অন্য লোকটা। ব্যস্ত হয়ে ঘুরিয়ে নিল বোট। কিন্তু চলে গেল সরাসরি স্পিডবোটের গতিপথে। আবারও স্টিয়ারিং ঘোরাতে লাগল সে।

কিন্তু গতি অনেক বেশি, টেণ্ডারের পেটে লাগল প্রচণ্ড গতি স্পিডবোট। বিস্ফোরিত হলো দুই নৌযান। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঠ ও ফাইবার গ্লাস। জ্বলন্ত সব টুকরো গিয়ে পড়ল আশপাশের সব ইয়টের ডেকে।

ঘুরে দেখল লাবনী। সাগরে ভাসছে ভাঙা দুই বোটের অসংখ্য জঞ্জাল। ওদিকে খেয়াল নেই রানার। চোখ সরাসরি সামনে। বন্দরের প্রায় মুখে পৌঁছে গেছে আমুন রা। শক্ত করে ধরো!

মস্তবড় ইয়টের ডেকে সবুজ ব্লেযার পরা লোক দেখল লাবনী। তাদের সবার হাতে অস্ত্র! ওরা গুলি করবে!

বাঁধের পাশ দিয়ে চলেছে রানা। আগেই ওদেরকে গুলি করো!

আমি লাগাতে পারব না।

লাগাতে হবে না! মাথার দিকে গুলি করো! তাতেই ভুলে যাবে আমাদের কথা!

অগ্রসরমান ইয়টের দিকে এমপি-সেভেন ঘোরাল লাবনী। চোখ-মুখ কুঁচকে নল তাক করে বলল, কেউ যদি মরেটরে যায়?

মরতে দাও!

ট্রিগারে চাপ দিল লাবনী। ওর হাতের ভেতর লাফিয়ে উঠল সাবমেশিন গান। প্রতিটি গুলি বেরোতেই চাপা খট-খট আওয়াজ তুলছে সাপ্রেসার। একহাতে অস্ত্র ধরেছে বলে প্রায় অসম্ভব তাক করা। কিন্তু অত বড় ইয়ট মিস করাও কঠিন কাজ। আমুন রা-র সুপারস্ট্রাকচারের সাদা গায়ে তৈরি হলো। ছোট সব গর্ত। ঝনঝন করে ভাঙল জানালার কাঁচ। ডেকে ডাইভ দিয়ে পড়ল সবুজ ব্লেযার পরা লোকগুলো।

থামো! থামো! হায়-হায় করে উঠল রানা। কয়েকটা গুলি রাখো! বিপদের খুব কাছে ওরা। বামে তীক্ষ্ণ বাঁক নিল জেট স্কি। কংক্রিটের বাঁধের মাত্র তিন ইঞ্চি দূর দিয়ে চলেছে। রানা।

এক সেকেণ্ড পর সামনে দেখল বিস্তৃত বন্দর।, তিন দিক থেকে ঘেরা ঝলমলে মোনাকোর ওপর আলো ঢালছে সূর্য। ইনার হার্বারের দিকে চলেছে রানা। বাইরের হার্বারের পাশে তৈরি করা হয়েছে উঁচু প্ল্যাটফর্ম। ওখানে ভিড়বে বাণিজ্য জাহাজ ও লাইনার। তীরে উঠতে হলে রানার চাই নিচু কোনও পিয়ার।

পেছনে চেয়ে চমকে গেল লাবনী। রানা! পালাও। ওদের পেছনেই তেড়ে আসছে আমুন রা। ছুরির মত জল কেটে আসছে উঁচু প্রাউ। অনেক কাছে! আরও জোরে যাও! হায়, আল্লা!

এটা জেট স্কি, জেট ফাইটার না, আর আমি বেচারাও ওলি-আল্লা নই! বলল রানা, ওরা মাথা বের করলে উড়িয়ে দিয়ো!

সিটে বেকায়দাভাবে বসল লাবনী। গায়ের কাছে উঠে এসেছে আমুন রা-র বো। পোর্টসাইডে দেখল এক লোককে। জেট স্কি দেখে ফেলেছে। কিন্তু গুলি করার আগেই লুকিয়ে পড়ল সে। ভয় দেখাতে কয়েকটা গুলি পাঠাল লাবনী।

ঢুকে পড়েছে ওরা ইনার হার্বারে।

উত্তর-পশ্চিম দিকে পছন্দমত জায়গা দেখেছে রানা। কিন্তু ওদিক থেকে আসছে আরেক বিপদ!

ওই বোট কাদির ওসাইরিসের নয়, পুলিশের!

 নয় মাস বয়সের শতখানেক বাচ্চার চেয়েও জোরে ওঁয়া ওঁয়া শুরু করেছে সাইরেন। বন্দরের বাইরের দিকে গোলমাল দেখে রওনা হয়েছে পুলিশ। একটা মেগাফোন মুখে ধরে চিৎকার করল এক অফিসার: খবরদার! জেট স্কি, ইয়ট এক্ষুণি থামবে!

প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী: পুলিশ ডিপার্টমেন্টে তোমার কোনও বন্ধু নেই? জেলে যেতে চাই না!

বন্ধু? মাথা নাড়ল রানা। ধরা পড়লে সোজা ভরে দেবে! বেরোতে পারব না দশ বছরেও! তার ওপর এ দেশে ঢুকেছি বেআইনীভাবে!

তা হলে খুন হয়ে গেলাম!

ইয়টের বো-তে এসে দাঁড়াল কয়েকজন। অস্ত্র তাক করছে ওদের দিকে….

আগে গুলি করল লাবনী। ঝটকা খেয়ে পিছিয়ে গেল এক লোক। কাঁধে লেগেছে বুলেট। টিপে দিয়েছে ট্রিগার। একরাশ গুলি লাগল সুপারস্ট্রাকচারের গায়ে। চুরমার হলো। ব্রিজের জানালা। হুইলের পেছনে সরাসরি কপালে গুলি খেল ক্যাপ্টেন। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের ওপর পড়ল লাশ। ঠেলা খেয়ে সামনে বেড়ে গেল থ্রটল। ঝটকা খেয়ে গতি বাড়াল মস্তবড় ইয়ট। বাইরের ডেকে ক্রুরা চেষ্টা করছে লাবনী ও রানাকে গুলি করতে। ব্রিজে আর কেউ নেই!

ধাওয়া করে ধরতে গিয়ে দিক পাল্টে নিয়েছে পুলিশের সারেঙ। তার বোটের পেছনের ক্ষুব্ধ পানি পেরোল রানার জেট স্কি। স্টার্নে ওরা দেখল এক অফিসারকে। রাইফেল তুলছে সে। লাবনী, মাথা নিচু করো, সাবধান করল রানা। ঘুরে দেখল লোকটাকে।

না, গুলি না করে অস্ত্র ফেলে বোট থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল অফিসার। দলের অন্যরাও বাদ পড়ল না, যে যেখানে ছিল, রেলিং টপকে ঝাঁপ দিল পানিতে। এক সেকেণ্ড পর পুলিশের অপেক্ষাকৃত ছোট বোটের বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসল আমুন রা। সহজেই মাঝ থেকে টুকরো করল পুলিশের বোট। বিস্ফোরিত হলো ওটার ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। আগুনের গোলার ভেতর দিয়ে চলল আমুন রা। যেন ধরেই ছাড়বে জেট স্কিকে। ওদিকে আগুনের মাঝে আটকা পড়ে আমুন রা-র ফোরডেক থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে সবাই।

এরা কি পাগল? অবাক হয়ে বলল লাবনী।

ব্যস্ত সব জেটির মাঝে ছোট এক পিয়ার দেখেছে রানা। জেট স্কির নাক তাক করল ওদিকে। এখন তেড়ে আসছে না আমুন রা। মনে হয় না কেউ রেস করছে!

কীসের রেস… আমি শুধু গুলি করেছি ওই লোকের কাঁধে!

তাতে আমার আপত্তি নেই!

প্রচণ্ড বেগে ওদের পাশ কাটিয়ে গেল আমুন রা। দেখা গেল ওপরের ডেক থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ল অবশিষ্ট কজন ক্রু। তুমুল বেগে চলেছে মেগা ইয়ট।

সরাসরি সামনে হার্বারের কোণে অত্যন্ত দামি কিছু ছোট ইয়ট। হঠাৎ রেস দেখা বাদ দিয়েছে ওগুলোর লোকজন। তেড়ে আসছে বিশাল এক ইয়ট! চিৎকার ছেড়ে যে যেদিকে পারে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা।

ভাগার জন্যে তৈরি হও! চাপা স্বরে বলল রানা। আধ মাইলের ভেতর থামবে না!

পানি ছেড়ে কর্কশ আওয়াজে কংক্রিটের পিয়ারে চাপল জেট স্কি, পিছলে গিয়ে লাগল সামনের ব্যারিয়ারে। রেসিং সার্কিটে ঢুকে পড়ল রানা জেট স্কি নিয়ে। সরসর করে স্থলে চলেছে জলযান। কারও সাধ্য নেই তাকে এদিক ওদিক নেবে।

ধুম! আওয়াজে করাগেটেড ব্যারিয়ারে লাগল জেট স্কি। কলের পুতুলের মত হ্যাণ্ডেলবারের ওপর দিয়ে উড়ে গেল

রানা ও লাবনী, গিয়ে পড়ল সামনের ট্র্যাকের পাশে।

অদ্ভুত অ্যাক্সিডেন্ট দেখেছে এক রেস মার্শাল, দৌড়ে এল রানা ও লাবনীর দিকে। কিন্তু দুসেকেণ্ড পর হাঁ হয়ে গেল আরও বিচিত্র দৃশ্য দেখে। ত্রিশ নট গতি তুলে কয়েক মিলিয়ন ডলারের ছোট সব ইয়ট চিড়ে-চ্যাপ্টা করল প্রকাণ্ড এক মেগা ইয়ট। কাত হলো নিজেই। উঠে এল তীরে। বো ঘষে ধূসর ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে চড়াও হলো ব্যারিয়ারের ওপর। উড়ে গেল লোহার ব্যারিয়ার। ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে ট্র্যাক ধরে চলল আমুন রা, যেন সাদা স্টিলের দেয়াল। কর্কশ আওয়াজে শেষে গিয়ে থামল এ্যাণ্ডস্ট্যাত্রে সামনে।

রেসে এখনও প্রথম জায়গা রনি রুবিল্যাকের। প্রচণ্ড বেগে ঘুরবে বন্দরের উত্তরদিকের ট্র্যাকে… কিন্তু হঠাৎ করেই দেখল কোত্থেকে এসে রাস্তা দখল করেছে আকাশছোঁয়া এক সাদা ব্যারিয়ার।

ওদিকে টনক নড়েছে মার্শালদের। উন্মাদের মত ওয়ার্নিং পতাকা দেখাতে লাগল তারা।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে!

ব্রেক প্যাডেলে প্রচণ্ড চাপ দিল রনি রুবিল্যাক। রানা ও লাবনীকে পাশ কাটাল তার গাড়ি। ঘুরতে লাগল চরকির মত। সোজা লেজ দিয়ে আছড়ে পড়ল আমুন রা-র খোলের ওপর। চুরমার হলো ওসাইরিয়ান টেম্পলের আরও সম্পদ। ছিটকে একপাশে গিয়ে পড়ল বিধ্বস্ত গাড়ি। কয়েক সেকেণ্ড পর খুলে গেল ওটার দরজা। টলতে টলতে বেরোল রনি রুবিল্যাক। খুলে ফেলল মাথা থেকে হেলমেট।

হাঁ করে তাকে দেখছে লাবনী।

ওর কনুই ধরে টান দিল রানা। চলো! মনে করো শুরু হয়েছে ম্যারাথন দৌড়! থামবে না এখন!

অ্যাঁ? ওহ্! আরও রেস মার্শাল আসার আগেই রানার পাশে দৌড়াতে লাগল লাবনী। ওই কাজ আপনাদের? সর্বনাশ! হা হয়ে গেছে বেলা আবাসি। টিভিতে দেখাচ্ছে হেলিকপ্টার থেকে তোলা ছবি। ট্রাকে কাত হয়ে পড়ে আছে আমুন রা ইয়ট। যা দেখছি, ধ্বংস হয়েছে সব মিলে এক শ মিলিয়ন ডলারের বোট!

কাদির ওসাইরিসকে বলতে চেয়েছি, রানার সঙ্গে লাগলে খরচ বাড়বে, কিন্তু পরে আর বলিনি, জানাল লাবনী।

হোটেলের লবিতে বসে আছে ওরা।

এমনভাবে তৈরি রেস সার্কিট, দর্শকের উপায় নেই ওদিকটা দেখবে। বেরিয়ে আসা কঠিন হয়নি রানা ও লাবনীর জন্যে। তবে সর্বক্ষণ ভয় ছিল, আটকে দেবে পুলিশ।

ওরা ফিরেছে ক্যাসিনো স্কয়ারে। চিনতে পারেনি কেউ।

সব ক্যামেরা তাক করা ছিল রেসের দিকে। বন্দরে কী হচ্ছে, জানত না কেউ। তারপর ট্রাকের সব আকর্ষণ হয়ে উঠল আমুন রা ইয়ট। অবশ্য, এবার একাধিক ইস্যুরেন্স কোম্পানি চাইবে কাদির ওসাইরিসের গর্দান!

আহা, আমাদের বেচারা রনি রুবিল্যাক, মাথা নাড়ল বেলা। সত্যিই চ্যাম্পিয়ন হতো!

ওর সঙ্গে কথা বলেছ? জানতে চাইল রানা।

ফিক করে হেসে ফেলল বেলা। শুধু কি কথাই বলেছি? রানা ও লাবনী চেয়ে আছে দেখে বলল, আপনারা নিশ্চয়ই চাননি ক্যাসিনো বন্ধ হলে সারারাত রাস্তায় বসে থাকি?

তো কী করলে? জানতে চাইল লাবনী।

সোজা গেলাম রনি রুবিল্যাকের সঙ্গে তার ঘরে। বলেছিল আমার সঙ্গে দুপেগ নেবে। কিন্তু পার্স থেকে নিয়ে দ্বিতীয় গ্লাসে ছেড়ে দিলাম কড়া ঘুমের দুটো বড়ি। বিপদে লাগবে ভেবে রেখেছি। শত্রুরা ধরে ফেললে নির্যাতনের আগেই বড়ি খেয়ে মরে যেতাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। তারপর খেল রুবিল্যাক ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ?

হ্যাঁ।

তারপর?

বোধহয় ভেবেছিল রাতে আমাকে কাছে পাবে। পেলও। ও মেঝেতে ঘুমাল, আর আমি ওর বিছানায়। ভোরে বেরিয়ে এসেছি হোটেল থেকে। আসলেই ভাল ড্রাইভার। নইলে আজ মাথা-ব্যথা নিয়েও এত ভাল রেযান্ট করতে পারত না!

এবার জরুরি বিষয়ে মন দেয়া যাক, পকেট থেকে যোডিয়াকের ছবি বের করল লাবনী। কুঁচকে গেছে ছবি। তবে পরিষ্কার বোঝা যায় রঙ ও সব প্রতীক। আমার ধারণা, জেনে গেছি কোথায় ওই পিরামিড। আছে অ্যাবাইদোসের কাছে। ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগল ও।

কিছুক্ষণ ছবিটা দেখল বেলা, তারপর বলল, যুক্তি আছে। ওই শহরের কাছেই থাকবে ওসাইরিসের সমাধি। যদিও খুঁজে বের করতে পারেনি কেউ। মিশরীয় আর্কিওলজিস্টরা বলেন, ওদিকেই আছে প্রথম রাজ বংশের ফেরাউনদের কবর, তাই ওখানেই ওসাইরিসের শহরের কাছে থাকবে ওসাইরিসের সমাধি। …আপনাদের মনে হচ্ছে ওই পিরামিড পশ্চিম দিকে?

মাথা দোলাল লাবনী।

হতে পারে। পশ্চিমের মরুভূমিতে থাকার কথা পাতাল জগতের পথ। ওদিকেই তলিয়ে যায় সূর্য।

ওসাইরিসের দ্বিতীয় চোখ সম্পর্কে কিছু জানো? জিজ্ঞেস করল লাবনী।

ভুরু কুঁচকে ভাবছে বেলা। দ্বিতীয় চোখ? না। তবে… হঠাৎ করে বিস্ফারিত হলো ওর দুচোখ। ওটা থাকতে পারে ওসেইরেন-এ!

ওটা কী? জানতে চাইল রানা।

ওসেইরেন… একটা দালান। ওটা নাকি ওসাইরিসের সমাধির নকল।

দ্বিতীয় সমাধি, বিড়বিড় করল লাবনী। দ্বিতীয় চোখ। ওটা হয়তো চেয়ে আছে রুপালি ক্যানিয়নের দিকে! রানার দিকে তাকাল। এবার বেরোতে হবে এ দেশ ছেড়ে। নিশ্চয়ই সেজন্যে কোনও ব্যবস্থা আছে তোমার?

মাথা দোলাল রানা। আছে, ভাঙাচোরা এক বোট। আমরা মেডিটারেনিয়ান পেরিয়ে গিয়ে উঠব মিশরের তীরে।

.

নিশ্চিত থাকুন, যারা ঘটিয়েছে এই ধ্বংসলীলা, তাদেরকে যে-কোনও মূল্যে ধরতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করব আমরা, সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলল কাদির ওসাইরিস। সত্যিকারের খেলোয়াড়ি মনের শত কোটি মানুষ, ওসাইরিয়ান টিম ও রনি রুবিল্যাকের জন্যে চিরকালের জন্যে বেদনাযুক্ত আজকের এই কলঙ্কিত দিন! আপনারা ভাবতেও পারবেন না আজ আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি।

শোনা যাচ্ছে, গুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে আপনার ইয়ট থেকে, বলল এক সাংবাদিক। খেলোয়াড়ি রিপোর্টের চেয়ে অনেক রসাল খবর পাবে ভাবছে।

রপ্ত করা সমস্ত অভিনয় ক্ষমতা ব্যবহার করে চেহারা নির্বিকার রেখেছে কাদির ওসাইরিস। এমন কিছু আমার কানে আসেনি। যা জেনেছি, সেটা শুনেছি মোনাকো পুলিশের কাছ থেকে। কথা শুনতে এসেছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে এবার জরুরি কাজে যেতে হবে আমাকে। আবারও ভিআইপি বক্সে ফিরল সে। বোমার মত সব প্রশ্ন ছুঁড়ছে সাংবাদিকরা। কাদিরের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

অপেক্ষা করছিল নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলার।

এবার? জানতে চাইল কাদির।

এ এলাকা থেকে সরে গেছে রানা-লাবনী, তিক্ত মুখে বলল নাদির, মোনাকো পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। পড়ার কথাও না। মাত্র দশ মিনিটে সীমান্ত পেরোতে পারবে যে কেউ।

আমুন রা-র যে অবস্থা, সর্বনাশ হয়েছে যোডিয়াকের?

না, ওটা এখনও অক্ষত। পুলিশ ওই এলাকা থেকে সরলে আরেকটা জাহাজে তুলে পাঠিয়ে দেব সুইটয়ারল্যাণ্ডে।

হায়, ওসাইরিস, বারকয়েক মাথা নেড়ে চেয়ারে বসে পড়ল কাদির। ওরা পালিয়ে গেল কীভাবে?

কারণ, প্রথম থেকেই ওই মেয়ের প্রতি তুমি দুর্বল, কড়া গলায় বলল নাদির। ছোটভাইয়ের রাগের মাত্রা বুঝতে পেরে চমকে গেছে কাদির। বারবার সাবধান করেছি। কিন্তু মেয়েলোকটাকে তোমার চাই-ই চাই! বিশ্বাসঘাতকতা করল, তোমাকে বললাম তাকে মেরে ফেলতে! কিন্তু আপত্তি আছে। তোমার। এবার মন ভরে দেখো কী হয়েছে!

ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে নাদিরের বুকে তর্জনী তাক করল কাদির ওসাইরিস। খবরদার! এই সুরে আমার সঙ্গে কথা বলবে না!

এসবই হয়েছে তোমার দোষে! গর্জে উঠল নাদির। ভয় পেয়ে দুপা পিছিয়ে গেল কাদির ওসাইরিস। আজ পর্যন্ত যা করেছি, তা টেস্পলের স্বার্থে অথচ বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত করে বেঁধে দিলে আমার দুহাত! আরে, ওসাইরিসের পিরামিডের সব নিজেদের কাছে রাখতে হলে রক্ত মাখতে হবে হাতে। রক্ত না ঝরলে কিছুই হয় না! জরুরি কাজে বাধা দিলে বলেই শত্রুর রক্তের বদলে রক্ত গেল আমাদের পক্ষের! গলা একটু নামল নাদিরের। এক পা বেড়ে ডানহাত রাখল বড়ভাইয়ের কাঁধে। কিছুই কি বুঝছ না, কাদির? যদি সব না পাই, কিছুই থাকবে না শেষে। কিন্তু সেটা হতে দেব না। যা করার করতে দাও আমাকে। ওরা পিরামিড পাওয়ার আগেই খুঁজে বের করব ডক্টর আলমকে বাঁচতে দেব না ওকে। তুমি নিজেও জানো, ঠিক কথাই বলছি।

তা ঠিক, মেনে নিল কাদির। আগেই শোনা উচিত ছিল তোমার কথা, নাদির।

চোখে-মুখে সন্তুষ্টি নিয়ে মাথা দোলাল নাদির। তা হলে আমরা একমত। ওদেরকে খুঁজে নিয়ে খুন করব। সরিয়ে নেব পিরামিডের ভেতরের সব।

ঠিক আছে, বলল কাদির।

ছোট্ট একটা সমস্যা আছে, টিটকারির সুরে বলল ভগলার, আমরা জানি না তারা কোথায় আছে। এটাও জানি না, কোথায় ওই পিরামিড।

সেসব জানতে এক্সপার্ট লাগবে, বলল নাদির। এমন কেউ, যে কি না ভাল করেই জানে মিশরীয় ইতিহাস।

লুকমান বাবাফেমি? জানতে চাইল কাদির।

মাথা নাড়ল নাদির। বাবাফেমি বড়জোর লাইব্রেরিয়ান। আমাদের চাই প্রথম শ্রেণীর আর্কিওলজিস্ট… একটা চিন্তা আসতেই বাঁকা হাসল সে। সেই লোক এমন কেউ, যার রাগ আছে ডক্টর লাবনী আলমের ওপর। মোবাইল ফোন নিয়ে কল দিল সুইটযারল্যাণ্ডে ওসাইরিয়ান টেম্পলে। মাকালানি বলছি, যোগাযোগ করো নিউ ইয়র্কে ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সিতে… তাদের জানাবে আমি কথা বলতে চাই ডক্টর ম্যান মেটয-এর সঙ্গে।

.

২১.

 বিসিআই এজেন্ট জাবেদ আলী জোগাড় করেছে লক্কড়-ঝক্কড়, পুরনো এক বোট। তবে ইঞ্জিন একদম নতুন। মানুষ পাচারে ওই বোট ব্যবহার করে গ্রিক ক্যাপ্টেন।

রাতের ঘুটঘুটে আঁধারে বোটে চেপে ভোরের আগেই সাইপ্রাসে পৌঁছে গেল রানা, লাবনী ও বেলা।

পরদিন সকালে পরিচিত এক সারেঙকে ঘুষ দিয়ে দুপুরে ফেরিতে উঠল রানারা। রাত আটটায় পোর্ট সাইদের বাইরে থামল ফেরি। নামিয়ে দেয়া হলো ওদেরকে।

আগেই ভাড়া করে রাখা জেলে-নৌকা তীরে পৌঁছে দিল ওদেরকে। লাবনী ও বেলাকে ছোট এক রেস্টুরেন্টে বসিয়ে উধাও হলো রানা। আধঘণ্টা পর ফিরল রেলগাড়ির টিকেট নিয়ে।

রেলস্টেশন থেকে মেইল ট্রেন ছাড়ল রাত দশটায়। কিন্তু ওটার গতিবেগ ঘণ্টায় পঁয়ত্রিশ মাইল। অবশ্য চারটের পর থেকে বাড়ল গতি।

এরই ভেতর কায়রোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেণ্ড অফিসার মিতালি গাঙ্গুলির সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে রানার। জানা গেছে, গত দুদিন সীমান্তের কাছে ও কিংস ভ্যালির আকাশে ছিল কয়েকটি ড্রোন। সেগুলোর মালিক কাদির ওসাইরিসের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। রানাকে পরামর্শ দিয়েছে মিতালি, উচিত হবে না কোনও গ্রামের মাঝ দিয়ে যাওয়া। হয়তো ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওদের ছবি। তথ্য দিলে পাবে মোটা অঙ্কের পুরস্কার।

এদিকে বিসিআই এজেন্ট জাবেদ আলীর সঙ্গে ফোন আলাপে রানা জেনেছে, মোনাকো থেকে কোথায় যেন ডুব দিয়েছে কাদির ওসাইরিস, নাদির মাকালানি এবং কিলিয়ান ভগলার।

আজ ভোরের পর দক্ষিণে সোহাগ শহরের কাছে আরও গতি কমাল ট্রেন। শামুকের মত চলছে বুঝে নেমে পড়ল রানারা।

মোনাকো ত্যাগের পর পেরিয়ে গেছে দুটো দিন।

প্রাচীন এক ল্যাণ্ড রোভার জিপগাড়ি পেয়ে সেটাই খুশি মনে ভাড়া করেছে রানা। তারপর থেকে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এগিয়ে চলেছে মরুময় প্রান্তরে।

কারও কারও ধারণা কায়রোর তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত, কিন্তু তাঁরা কাঁদতেন তিন শ মাইল দক্ষিণের অ্যাবাইদোসে এলে। পাশেই সাহারা মরুভূমি। ভোরের পর কিছুক্ষণ বাইরে রয়ে গেলে মনে হবে ফুটন্ত তেল ঢালা হচ্ছে গায়ে। এক শ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি তাপ। কখনও ঝিরঝিরে হাওয়া এলে মনে হচ্ছে ওটা আসছে স্রেফ স্বর্গ থেকে। উড়ন্ত বালি লেগে চটচট করছে ঘর্মাক্ত শরীর। ভোরের পর এরই মাঝে দুই বোতল পানি শেষ করেছে লাবনী।

কাঠফাটা রোদে বরাবরের মতই নির্লিপ্ত রানা। তবে গা থেকে খুলেছে জ্যাকেট। মাথায় পাতলা ক্যাপ। কিছুক্ষণ পর বলল, গরম আরও বাড়তে পারে।

এরচেয়ে বড় নরক কোত্থাও নেই, মন্তব্য করল বেলা, প্রাচীন দালান সবসময় এমন বাজে জায়গায় থাকে কেন?

একটু পর ছোট এক গ্রাম পেছনে ফেলে অ্যাবাইদোসে ঢুকল ওরা। বিস্তৃত জায়গায় পাথরের বড় মন্দির ও রাজকীয় দালানের ধ্বংসস্তূপ। কিছুক্ষণ পর থামল জিপ ওসেইরেন-এর সামনে। আগে থেকে না জানলে কেউ বুঝবে না এটা কোনও সমাধিস্থল।

টুরিস্ট বলতে দুচারজন। খাঁ-খাঁ করছে চারপাশ।

টুরিস্টদের জন্যে নোটিসে লেখা: দয়া করে কিছু ভাঙবেন না।

দূরে কয়েকজন পুলিশ। কারও প্রতি আগ্রহ নেই তাদের।

আমরা কী খুঁজব, বলো তো? বেলাকে বলল লাবনী। তুমি হচ্ছ আমাদের এক্সপার্ট!

নিজেকে এক্সপার্ট বলব না, খুশি হয়ে হাসল বেলা।

এবার কী?

পেছনের প্রায় আস্ত এক দালান দেখাল বেলা। ওটা টেম্পল অভ সেটি। বা স্যাথোেস। বাবার জন্যে তৈরি করেন র‍্যামেসেস দ্বিতীয়। খ্রিস্টপূর্ব তেরো শ সাল আগে তৈরি। অবিশ্বাস্য আর্কিটেকচার। মিশরের অন্য কোনও মন্দির এমন নয়। ঢোকার পর সামনে একের পর এক হল পাবেন না। এটা একেবারে অন্য কিছু।

কোন দিক দিয়ে? জানতে চাইল লাবনী।

ওসেইরেনের দিকে তাকাল বেলা। ধরুন, একই সময়ে তৈরি হয়েছে ওসেইরেন আর টেম্পল অভ সেটি। সব বইয়ে তা-ই লিখেছে। কিন্তু তা হয় কীভাবে? আপনি তো আর আপনার মন্দিরের অর্ধেক কাজ শেষ করে আধখাপচা রেখে আরেকটা তৈরি করবেন না! তা-ও আবার একই সময়ে একই জায়গায়! এমন তো আর নয় যে জায়গার অভাব ছিল। একটু দূরেই তৈরি করতে পারত টেম্পল অভ সেটি। দিগন্ত পর্যন্ত মরুভূমি দেখিয়ে দিল বেলা। জমির অভাব নেই।

তোমার থিয়োরি কী? জানতে চাইল রানা।

অনেকের মত আমারও মনে হয়, যিশুর জন্মের তেরো শ বছর আগে তৈরি হয়নি ওসেইরেন। আরও পুরনো। ডুবে গিয়েছিল বালির নিচে। পরে র‍্যামেসেস যখন দেখলেন ওটা, অর্ধেক মন্দির তৈরি করেই থেমে গেলেন। চাইলেন না ওসেইরেন ভেঙে ফেলতে। তখন ওসেইরেনের বাঁক ঘুরে তৈরি করা হলো টেম্পল অভ সেটি।

ওসেইরেনকে রেখে দিলেন কেন? জানতে চাইল রানা।

কারণ, ওটা দেখতে ওসাইরিসের সমাধির মত, জবাবটা দিল লাবনী, আসলটা হারিয়ে গিয়েছিল বহু কাল আগেই। র‍্যামেসেস বুঝেছিলেন, আসলটা না পেলেও এটার মূল্য কম নয়।

আমাদের ধারণা ঠিক হলে, ওটার ভেতর কোথাও আছে ওসাইরিসের চোখ, বলল বেলা।

ওই চোখ চেয়ে আছে পিরামিডের দিকে? চলো, ভেতরে যাওয়া যাক। পাথুরে শক্ত বালি মাড়িয়ে এগোল রানা।

একমিনিট পেরোবার আগেই ওসেইরেন-এ পা রাখ ওরা। খনন করে বের করা হয়েছে জায়গাটা। মনে হয় মং এক কূপ। বড় সিঁড়ির ধাপসদৃশ দেয়াল নেমেছে নিচে কারুকাজ করা সেটির মন্দিরের মত নয়- রুক্ষ, প্রকা একখণ্ড ফ্যাকাসে গ্ল্যানেট যেন। কামরাগুলো মোটামুটি নব্ব ফুট, মেঝেতে জমে আছে সবজেটে পানি।

পানির উচ্চতা বড়জোর এক ইঞ্চি, ভরসা দিল বেলা।

কপাল ভাল বর্ষার সময় আসিনি, মেঝেতে পা রাখল লাবনী।

উত্তর-পশ্চিমে অন্ধকারমত এক করিডোর দেখে ওদিবে চলল রানা। ওদিকটা দেখব।

উত্তর এন্ট্রান্স ওদিকে, বলল বেলা। আরেকবার দেখ গাইড-বুকের ডায়াগ্রাম।

করিডোরে ঢুকে ভুরু কুঁচকে দূরে তাকাল রানা। ধ নেমে আটকে গেছে ওদিকটা? কামরার শেষ প্রান্তে দেয়ালের কাছে থামল। ওই চোখ থাকবে পিরামিডের দিকে। ওট পশ্চিমে। সেক্ষেত্রে ওই চোখ আছে ভেতরের পুব দেয়ালে।

ঠিক! খুশি হয়ে উঠল লাবনী।

পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে ফ্ল্যাশলাইট বের করে নিন রানা। পানি ছলকে এগোল ওরা পুবের দেয়ালের দিকে।

খানিকটা হাঁটতেই পানি থেকে উঠে এল মেঝে।

সামনে শুকনো মেঝের ছোট এক ঘর। চোখ পিটপিৗ করে অন্ধকারে দৃষ্টি সইয়ে নিতে চাইল ওরা। একটু পর বুঝল, বাইরের কামরার মতই এদিকের দেয়ালও মসৃণ কোথাও কোনও কারুকাজ নেই।

কিছু দেখছেন? জানতে চাইল বেলা।

না, বিরক্ত হয়ে গেছে লাবনী।

দেয়ালে আলো ফেলে চারপাশ দেখছে রানা। একটু পর দেয়াল বাদ দিয়ে আলো তাক করল বিমের দিকে।

হ্যাঁ, পেয়ে গেছি! বলে উঠল বেলা। ওই যে!

আরও ভালভাবে দেখতে ঠিক দিকে আলো ফেলল রানা।

ওই তো, পাথরের চোখ! বলা লাবনী। ওসাইরিসের!

পাথরের বিমের গায়ে খোদাই করা, ফুলে আছে চোখ।

আমিই আবিষ্কার করেছি! খুশি হয়ে বলল বেলা।

কপালের জোরে, বলল লাবনী। ভাল আর্কিওলজিস্ট হতে চাইলে শিখতে হবে কীভাবে মেথোডিক্যালি কাজ করতে হয়। ভুলে যেয়ো না, নিয়ম মানেনি বলে হাস্যকর, ফালতু লোক হয়ে গেছে ম্যান মেটয। আশপাশের কিছুই যেন চোখ না এড়িয়ে যায়।

মাথায় রাখব, ওর হিরোইনের বকা শুনে ঢোক গিলল বেলা। খারাপ হয়ে গেছে মন।

সেটা টের পেয়ে বলল লাবনী, যা করা উচিত, করবে ধীরেসুস্থে, তা হলেই দেখবে কোনও ভুল হবে না।

কিন্তু মানুষ ভুল না করলে নতুন কিছু সহজে শেখে না, তাই না, বেলা? বলল রানা।

আপনিও ভুল করেন? অবাক হয়ে ওকে দেখল বেলা।

সবাই করে, জোর দিয়ে বলল রানা। শুধু লাবনী করে না!

চোখ পাকিয়ে ওকে দেখল লাবনী, ঠোঁটে মৃদু হাসি।

আবারও খুশি হয়ে উঠেছে বেলা। বলল, আপনাদের যা দারুণ মানাবে না বিয়ে হলে! সত্যিই…

এসব কথা এখন বাদ, লজ্জা পেয়ে বলল লাবনী। তারপর নিচুগলায় বলল, ঠিকই বলেছ, বেলা। হয়তো মানাত। কিন্তু তা হবে না। আমরা দুজনই অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিঃ অতি-ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের চেয়ে সহজ বন্ধুত্ব অনেক, অনেক শক্ত বাঁধন। আমরা আসলে বন্ধু চিরকাল। বন্ধুই থাকতে চাই। বেলার মাথায় হালকা টোকা দিল লাবনী, ঢুকল কিছু?

হাঁ করে চেয়ে রইল বেলা। এই দুটি মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ফুটে উঠল ওর দু-চোখে। ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল ও।

বিমে ফুলে থাকা চোখ ওসাইরিয়ান টেম্পলের লোগোর মতই। দেখা যাক কী আছে ওসাইরিসের চোখে, কম্পাস বের করল রানা। দু শ পঁচিশ ডিগ্রি। মানচিত্র নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে নিল। তা হলে, আমরা যাব ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে।

রুপালি গভীর খাদ, মন্তব্য করল লাবনী।

মানচিত্র আরও সতর্ক চোখে দেখল রানা। ওদিকে মরুভূমিতে কয়েকটা ক্যানিয়ন। যোডিয়াক কী দেখিয়েছে?

মাথা নাড়ল লাবনী। বোঝার উপায় নেই। শুধু জানা গেছে, ওসাইরিসের চোখ চেয়ে আছে রুপালি গভীর খাদের দিকে। পথ শেষে বোধহয় কাজে আসবে যোডিয়াকের অন্য হায়ারোগ্লিফিক্স।

আমাদের এখন চাই এমন এক ক্যানিয়ন, যেটার মুখ থাকবে মরুভূমির মেঝের চেয়ে নিচে, বলল রানা। একসময় ওখানে ছিল খাল বা নদী। ওপর থেকে নেমে এসেছে। নইলে তৈরি হতো না ওই ক্যানিয়ন। এই যে… মানচিত্রের নির্দিষ্ট জায়গায় তর্জনী রাখল রানা। ক্যানিয়ন গিয়ে উঠেছে চওড়া, খোলা মরুভূমিতে। ওদিকেই চেয়ে আছে ওসাইরিসের চোখ। মানচিত্রে টোকা দিল। তার মানে, পশ্চিমে সাত মাইল মত গেলে… এই যে এখানে পিরামিড।

ঝুঁকে দেখছে লাবনী ও বেলা।

কিন্তু মানচিত্রের বুকে কোনও পিরামিড নেই।

সমতল মরুভূমি।

ওটা হয়তো ঠিক ক্যানিয়ন নয়? আনমনে বলল লাবনী।

দেখা যাক, বলল রানা, এখান থেকে পনেরো মাইল গেলে এমন এক এলাকা পাব, যেখানে সহজেই ঢুকতে পারব মরুভূমিতে। সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়।

পরস্পরের দিকে তাকাল হতাশ বেলা ও লাবনী। জানে, ওদিকের বিরান এলাকায় কোনও পিরামিড নেই।

অত মন খারাপ কেন? নরম সুরে বলল রানা। প্রথমে ক্যানিয়ন খুঁজব। তারপর যাব ঠিক জায়গায়। দেখবে পেয়ে যাবে ওসাইরিসের পিরামিড।

থাকা তো উচিত, সবই তো মিলে যাচ্ছে, বিড়বিড় করল বেলা। আর ওটা পেলেই আমিও আপনাদের মতই হয়ে যাব বিখ্যাত!

তা হলে দেরি কীসের, চলল। মৃদু হাসল রানা।

উৎসাহের সঙ্গে বলল বেলা, চলুন, মাত্র পনেরো মাইল ঘুরতে হবে, তারপর এখান থেকে সাত মাইলের ভেতর পাব ওই পিরামিড!

ওসেইরেন থেকে বেরোবে বলে পা বাড়াল রানা।

 ওর পিছু নিল লাবনী ও বেলা।

.

খর রোদে শুষ্ক, বিরান মরুভূমি ধরে নাচতে নাচতে চলেছে তুবড়ে যাওয়া ল্যাণ্ড রোভার ডিফেণ্ডার। বহুকাল আগেই নষ্ট হয়েছে এয়ার-কণ্ডিশন। জানালা সব খোলা, তবু এমনই গরম, মনে হচ্ছে চুল্লির মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়েছে রানা, লাবনী ও বেলাকে। মাঝে মাঝে পানির বোতলে চুমুক দিচ্ছে ওরা। লাবনী ও বেলা ঠিক করেছে, পারতপক্ষে আঙুলও নাড়বে না।

সিটে দুজনের মাঝে বসেছে: বেলা, চোখ সরাসরি সামনে। একটু পর পর দেখছে ড্যাশবোর্ডে রাখা জিপিএস ইউনিটের ডায়াল। জায়গামত পৌঁছে গেছি না?

আরও এক মাইল বাকি, বলল রানা।

দাউদাউ আগুনের হল্কার মত লাফিয়ে উঠছে সামনের বাতাস। এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত কী যেন অবয়ব নিচ্ছে।

উঁচু শৈলশিরা। লক্ষ বছর ধরে তাকে ভেদ করে গেছে নীল নদ।

তেমনই এক খাদের দিকে চেয়ে আছে রানা। ওখানে কালচে ছায়া। মনে হচ্ছে ওটাই আমাদের ওই ক্যানিয়ন।

হতে পারে, সায় দিল লাবনী।

কিছুক্ষণ পর ক্যানিয়নের মুখে থামল ল্যাণ্ড রোভার। ক্যাপ পরে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা।

খাদে ঢুকে চমকে গিয়ে বলল বেলা, খেয়াল করুন।

সূর্যের হলদে আলোয় ক্যানিয়নের দেয়ালে চকচক করছে সাদা কী যেন!

রুপা! পাথরের গায়ে চিকচিক করছে। খুশি হয়ে উঠল লাবনী।

ভাল করে দেখবে বলে চোখ থেকে সানগ্লাস নামাল বেলা। মিশরে রুপা নেই বললেই চলে। তাই প্রাচীন যুগে ওটাকে সোনার চেয়েও বেশি দাম দেয়া হতো।

সরু ক্যানিয়নের মেঝে ধীরে ধীরে উঠেছে, ওদিকে চেয়ে আছে রানা। এদিক দিয়ে এগোতে পারবে জিপ নিয়ে।

যেতে পারবে? জিজ্ঞেস করল লাবনী।

আশা তো করি পারব, বলল রানা।

আবারও জিপের পাশে ফিরল ওরা।

ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে ক্যানিয়নের মাঝ দিয়ে সাবধানে এগোল রানা। দুপাশে দেয়াল, সরাসরি ওপর থেকে পড়ছে না রোদ। কিছুক্ষণ পর খাড়া হয়ে উঠল সরু পথ। একটু পর পর বাঁক। কখনও এতই সংকীর্ণ, আটকে যেতে চাইছে গাড়ির নাক। খুব সতর্ক হয়ে এগোচ্ছে ওরা।

এক জায়গায় ক্যানিয়নের দেয়ালে মস্তবড় এক গর্ত দেখল ওরা। ওখানে জিপ থামাল রানা। এই যে আমাদের রুপার খনি।

টিলার গা কেটে ভেতরে হারিয়ে গেছে সুড়ঙ্গ।

পুরো খনি খুঁজে হয়তো পাবে এক কাপ সমান রুপা, বলল লাবনী, যযাডিয়াকে লিখেছে, মার্কারির পথ ধরে এগোতে হবে। আমরা ভেবেছি বুধগ্রহ। তবে যাই লিখুক, এদিকে কিন্তু কোনও পিরামিড নেই।

আছে, দেখতে পাচ্ছেন না, জোর দিয়ে বলল বেলা।

 তুমি দেখিয়ে দিয়ো, জিপ নিয়ে আবারও এগোল রানা।

একটু পর আরও খাড়া হলো পথ। ওরা চলেছে গভীর এক নালার ভেতর দিয়ে। অনেক ওপরে এক চিলতে নীল আকাশ। কিছুক্ষণ খাড়াই পথে চলে ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এল জিপ। সামনে ধু-ধু মরুভূমি।

কম্পাস ও জিপিএস দেখল রানা। যোডিয়াক দেখিয়ে দিয়েছে ওদিকে যেতে হবে। বেলা, আমার রুকস্যাকে বিনকিউলার আছে। ওটা দেবে?

কয়েক সেকেণ্ড পর রানার হাতে বিনকিউলার দিল বেলা। আপনি কোনও পিরামিড দেখছেন?

না। শুধু বালির প্রান্তর। বিনকিউলার দিয়ে দূরে তাকাল রানা।

কত দূরে ওই পিরামিড? লাবনীর দিকে তাকাল বেলা।

 এক আতুর, সিক্স পয়েন্ট এইট-ফাইভ মাইল।

দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত দেখা শেষ রানার। নতুন কোঅর্ডিনেট দিল জিপিএস-এ। দূরে চোখা কিছুই নেই।

একটু দূরেই থাকার কথা পিরামিড। হতাশ হয়ে পড়েছে বেলা।

রানা গাড়ি নিয়ে রওনা হতেই একটু পর পর জিপিএস দেখতে লাগল লাবনী।

চার মাইল পেরোল ওরা।

 বাকি রইল তিন মাইল।

 তারপর দু মাইল।

শেষে এক মাইল।

আশপাশে দেখার মত আছে শুধু আকাশ আর হলদেটে বালির ঢিবি ও প্রান্তর।

মুখ গোমড়া করে বসে আছে বেলা।

আর মাত্র এক মাইল দূরে থাকবে পিরামিড।

কিন্তু দেখা গেল না কিছুই।

হতভম্ব দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে লাবনী।

 আর আধ মাইল দূরেই ওদের গন্তব্য।

আশপাশে বালির ঢিবির ঢেউ তোলা মরুভূমি ছাড়া কিছুই নেই।

বিপ আওয়াজ তুলল জিপিএস।

ল্যাণ্ড রোভার থামাল রানা। ব্যস, আমরা পৌঁছে গেছি।

দরজা খুলে নেমে পড়ল বেলা। কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেছে চেহারা।

চারপাশে ধু-ধু মরুভূমি ছাড়া কিছুই নেই!

আমরা সব সূত্র পেয়েছি! অনুসরণ করেছি রুপালি ক্যানিয়ন! তা হলে পিরামিড নেই কেন?

বেলার কাঁধে হাত রেখে নীরবে সান্ত্বনা দিল লাবনী।

ল্যাণ্ড রোভারের ছাতে উঠল রানা। ভরসা দেয়ার জন্যে বলল, হয়তো বালির নিচে চাপা পড়েছে পিরামিড?

বালির নিচে? মাথা নাড়ল লাবনী। সম্ভব না। ওটা হবে প্রকাণ্ড। এতই বড়, দশ মাইল দূর থেকেও দেখা যাবে।

এত হতাশ হয়ো না, বেলা, বলল রানা। আমরা তো এখনও চারপাশ ভালভাবে দেখিইনি।

আর দেখেই বা কী হবে? কেঁদে ফেলল বেলা। আপনাদের কষ্ট দিয়েছি! সবার সময় নষ্ট করেছি! মেরে ফেলতে চেয়েছে একদল লোক। অথচ, সব বৃথা! হায়, ঈশ্বর, আমি দুঃখিত!

কাঁদছ কেন, বেলা? মন খারাপ কোরো না। বেলাকে জড়িয়ে ধরল লাবনী।

ডক্টর ম্যান মেটয ঠিকই বলেছিলেন! আমি আস্ত একটা অপদার্থ! কোনও মূল্য নেই! সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে নষ্ট করেছি সবার সময়! দরদর করে বেলার গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু।

মন খারাপ করে না, বেলা, ওর বাহুতে হাত রাখল লাবনী। একদিন দেখবে মস্তবড় আর্কিওলজিস্ট হবে। আর তখন…

কখনোই কিছু হতে পারব না, মাথা নাড়ল বেলা। জীবনেও কোনও কাজ করিনি। বাবা-মার টাকা আছে বলে সবাই দাম দিত। ওই পয়সা আমার না। জীবনে একবার চাইলাম দুনিয়ার কাছে নিজেকে প্রমাণ করব, দেখিয়ে দেব আমিও কিছু করতে পারি! কিন্তু ব্যর্থ হলাম হাস্যকরভাবে!

জিপের ছাত থেকে বলল রানা, তুমি না থাকলে আমরা কিছুই জানতাম না। যোডিয়াক চুরি করে যা খুশি করত কাদির ওসাইরিস। অত ভেঙে পোড়ো না, পিরামিড না থাকার নিশ্চয়ই কোনও ব্যাখ্যা আছে। সেটা জানলেই পাব ওটা।

পাব না কিছুই, বিড়বিড় করল বেলা। দুঃখে থরথর করে কাঁপছে নিচের ঠোঁট।

জিপের ছাত থেকে নেমে পড়েছে রানা। চলো, চারপাশ ঘুরে দেখি। কিছু পেয়েও তো যেতে পারি?

ওকে চেনে লাবনী, তাই ওর মনে হলো কিছু ভাবছে রানা। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, কী যেন পেয়েছ, তাই না?

হুঁ। তবে ওটা পিরামিড নয়। উত্তর-পশ্চিম দিক দেখাল রানা। ওই যে ওদিকে।  

বালি ও পাথর ছাড়া চারপাশে কিছুই নেই, তবুও রানার দেখিয়ে দেয়া জায়গার দিকে তাকাল লাবনী। কী?

ওর চোখে বিনকিউলার দিল রানা। ওই যে পাথরগুলো। একটা এল শেপের।

হ্যাঁ। তো?

ওগুলো সাধারণ পাথর নয়।

বিনকিউলারের জন্যে অনেক কাছে চলে এল ওদিকের দৃশ্য। কাঠের কুটিরের ঢালু ছাতের মত উঁচু হয়ে আছে প্রকাণ্ড দুই পাথর, ঠেস দিয়েছে পরস্পরের ওপর। নিচে বালি ভেদ করে উঠে এসেছে ত্রিকোণ এক ছোট চূড়া।

সাধারণ পাথর নয়!

মসৃণ!

 পাথরের ব্লক!

যেসব ব্লক দিয়ে তৈরি ওসেইরেন, ঠিক তেমন!

কোনও দালান! প্রায় ফিসফিস করল লাবনী।

 অথবা তার ধ্বংসাবশেষ, বলল রানা।

লাবনী ও রানাকে অবাক চোখে দেখছে বেলা। বুঝতে চাইছে, ওরা নিষ্ঠুর কৌতুক করছে কি না। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ঠাট্টা করছে না কেউ। একমিনিট! আপনারা তা হলে কিছু পেয়েছেন? সেটা কী?

বেলার হাতে বিনকিউলার দিল লাবনী। ভাল করে দেখো পাথরগুলো।

চোখ মুছে বিনকিউলার নাকের ওপর তুলল বেলা। তিন সেকেণ্ড পর বলল, আমরা তা হলে বসে আছি কেন?! চলুন!

হ্যাঁ, চলো, হাসল রানা। সবাই গাড়িতে চেপে বসতেই রওনা হয়ে গেল ও।

পাঁচ মিনিট পর কুটিরের ঢালু ছাতের মত আকৃতির দুই পাথরের সামনে থামল ল্যাণ্ড রোভার।

নেমে পড়ল ওরা।

দালানটা বর্গাকৃতির। একেক দিক দৈর্ঘ্যে বারো ফুট।

এটা মার্কার, নিজের থিয়োরি জানাল লাবনী। নিশানা রাখতে তৈরি করেছিল।…কিন্তু এটা কীসের নিশানা?

বিশাল পাথরের ব্লক দেখছে বেলা। হয়তো এটা দেখে বুঝে নিত কোন দিকে যেতে হবে?

মাথা নাড়ল লাবনী। যোডিয়াক অনুযায়ী, রুপালি গভীর খাদ পেরোবার পর এক আতুর উত্তর-পশ্চিমে গেলে পাওয়া যাবে পিরামিড।

যদি নিচে থাকে ওটা? বলল রানা।

মাথা নাড়ল লাবনী। ছোট পিরামিড তৈরি করতেও যে পরিমাণের বালি সরাতে হবে, তা প্রায় অসম্ভব কাজ।

তো আমরা পিরামিড দেখছি না কেন? জানতে চাইল বেলা।

পকেট থেকে যোডিয়াকের ছবি নিল লাবনী। এটাতেই কোনও সূত্র আছে। রানা, দেখো তো উত্তরদিক কোটা?

কমপাস দেখল রানা।

কাঁটা দেখে দিক নির্দেশনা খুঁজছে লাবনী। মাথার ওপরে তুলল ছবি। উত্তর দিকে তাক করলাম।

ছবি নিচে নামাও, বলল রানা। এই দালান রাখা হয়েছে দিক নির্দেশনার জন্যে, ঠিক?

হ্যাঁ, তা ঠিক।

যোডিয়াকে উল্টো হয়ে আছে পিরামিড।

 হ্যাঁ, তো?

তার মানে, ওটা একটা উল্টো পিরামিড, বলল রানা। আর তুমি দাঁড়িয়ে আছ ওটার মাথার ওপর।

ষষ্ঠতম র‍্যামেসেসের সমাধিতে যেসব ছবি, সব আয়নার প্রতিবিম্বের মত করে আঁকা, বলল বেলা। যমপুরী দেখিয়ে দিয়েছে, যেন মাটির ওপরের দৃশ্য। আরেকটা কথা, স্ফিংসের ভেতরের যোডিয়াক যদি খাফ্রের আগের আমলের হয়, অন্যসব পিরামিডের চেয়ে বহু আগে তৈরি হয়েছে ওসাইরিসের পিরামিড। তখন হয়তো মাটির ওপর রাখত না ওই জিনিস?

অন্যান্য পিরামিডের উল্টো ওটা, মাটির নিচে তৈরি। শ্বাস আটকে ফেলল লাবনী। পরেরগুলো যারা তৈরি করেছে, তাদের হয়তো সাহসই ছিল না ওসাইরিসের নকল করার। অথবা, অত কষ্ট করতেই যায়নি?

গাঁয়ের যোগীর ভাত নেই, বিড়বিড় করল রানা। বসে পড়ল বালির ওপর। এক মুঠো বালি তুলে সরিয়ে রাখল। ওর তৈরি গর্ত দেখাল। এমনই গর্ত খুঁড়ে তৈরি করেছে। পরামিড। প্রতি স্তরের কাজ শেষ হলে পাথরের ব্লক গেঁথে উঠে এসেছে। ফলে গ্রেট পিরামিডের মত অত খাটুনি দিতে হয়নি। ওপরে তুলতে হয়নি পাথরের ব্লক, সাহায্য করেছে। মাধ্যাকর্ষণ।

তুমি তা হলে বলছ, আমরা আছি পিরামিডের ওপর? যেন মেনে নিতে পারছে না লাবনী।

আমার কথা ঠিক কি না, তা জানতে হলে গায়ে খাটতে হবে, ল্যাণ্ড রোভারের পাশে গেল রানা। ফিরল তিনটে কোদাল নিয়ে। ত্রিকোণ পাথরের পাশের বালি দেখাল। কাজে নেমে পড়ো।

কোথায় খুঁড়ব? জানতে চাইল বেলা।

এই ঘরের ঠিক মাঝখানে, একটা কোদাল বেলার হাতে ধরিয়ে নিল রানা। এটা ঠিকই মার্কার। আবার প্রবেশপথও।

চুপচাপ কাজে নামল ওরা। সূর্যের কড়া আলোয় একটু পর শুকিয়ে গেল সবার গলা। পানি খেয়ে নিল। গর্ত তৈরি করছে, আবার ঝরঝর করে গর্তে পড়ছে বালি। পঁচিশ মিনিট পর রানার কোদালের ফলায় লেগে ঠং আওয়াজ তুলল কী যেন।

নতুন উদ্যমে কাজ করছে রানা।

কিছুক্ষণ বালি সরাবার পর বেরোল চ্যাপ্টা একটা স্ল্যাব।

আমার মনে হয় দালানের মেঝে, বলল বেলা।

মাথা নাড়ল লাবনী। বোধহয় অন্যকিছু। এসো, ওটার ওপর থেকে বালি সরিয়ে ফেলি।

পাশেই সেই ত্রিকোণ পাথর। আরও পাঁচ মিনিট কাজ করার পর বালিমুক্ত হলো ছয় ফুট বাই তিন ফুট পাথরের স্ল্যাব। বালি মেখে ভূত হয়ে গেছে ওরা।

চার কোনা এন্ট্রান্সের ঢাকনি? বলল লাবনী।

স্ল্যাবের মাঝের জায়গা থেকে বালি সরিয়ে ফেলেছে বেলা। ফিক করে হেসে ফেলল। এটা দেখেছেন?

পাথরের ওপরে খোদাই করা একটা সিম্বল।

ওসাইরিসের ফোলা চোখ!

ড্যাব-ড্যাব করে রানাকে দেখছে লাবনী।

তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না এবার দুই টনি পাথরের চাপড়া সরাব? আপত্তির সুরে জানতে চাইল রানা।

ওর দিকে চেয়ে আছে বেলাও।

ও, দলে তা হলে তোমরাই ভারী? গর্ত ছেড়ে উঠে ল্যাণ্ড রোভারের কাছে গেল রানা। এবার ফিরল ক্রোবার হাতে। স্ল্যাবের কিনারা দেখল। একটা দিকে তো মেরে ঢোকাল ক্রোবার। হাতলে চাপ দিল দুই হাতে। তাতে সামান্য নড়ল স্ল্যাব। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রানা বলল, যত ভারী ভেবেছি, অতটা নয়! বড়জোর হার্নিয়া হবে! লাবনী, গাড়িতে ধাতব স্পাইক পাবে! নিয়ে এসো!

স্পাইক নিয়ে এল লাবনী। এক এক করে স্ল্যাবের নিচে স্পাইক ভরল রানা, তারপর চাড় দিল ক্রোবার দিয়ে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সামান্য সরল স্ল্যাব। কিনারা দিয়ে দেখা গেল নিচে কুচকুচে কালো আঁধার।

গিয়ে ল্যাণ্ড রোভার গাড়িটা খুব কাছে নিয়ে এল রানা। ওটার উইঞ্চ ব্যবহার করল স্ল্যাব ওপরে তুলতে। একপাশ থেকে ঠেলল স্ল্যাব। কয়েক সেকেণ্ড পর জোরালো খটাং আওয়াজে কাছের দেয়ালের গায়ে গিয়ে পড়ল পাথরের চাইয়ের একপাশ। ওটা যেখানে ছিল, সেই বালিজমির মাঝে এখন গোল এক গর্ত।

হাত থেকে বালি ঝরাতে শুরু করে বলল রানা, সহজ কাজ।

খুব বেশি সহজ, বলল বেলা, অন্যান্য পিরামিডের দরজা সবসময় লুকিয়ে রাখা হত।

একই কথা ভাবছে লাবনী। মাথা দুলিয়ে বলল, হয়তো ভেবেছে এখানে আসবে না কেউ, অথবা আসবে শুধু যাদের আসার কথা। তাই কোনও বাধা তৈরি করেনি।

ভাবছ, ভেতরে ফাঁদ পেতে রেখেছে? জানতে চাইল রানা।

মাথা দোলাল লাবনী। তা-ই তো মনে হয়।

 তাই সহজেই পেয়ে গেছি পিরামিড? বলল বেলা।

ভেতরে নামলে সবই বুঝব, বলল লাবনী।

তার আগে কাজ আছে, বলল রানা। অপেক্ষা করো। দূরে রেখে আসি গাড়ি।

মরুভূমির ভেতর কোথায় রাখবে? জানতে চাইল লাবনী।

আসার সময় একটা নালা দেখেছি, বলল রানা। গাড়ি রাখলে চট করে কেউ খুঁজে পাবে না।

খুঁজবে কেন কেউ? জানতে চাইল বেলা।

কারণ কাদির ওসাইরিস বলে একজন আছে, আমাদেরকে খুঁজছে, বলল রানা, গত কয়েক দিন ধরেই চোখ রাখছে কিংস্ ভ্যালিতে। এদিকে খুঁজবে না, এমন ভাবার কারণ নেই।

কথাটা শুনে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল বেলার। ওদিকে অবশ্য নালাটা দেখেছি।

গাড়ি রেখে আসছি। দালান থেকে বেরিয়ে গেল রানা। দরকারি ইকুইপমেন্ট নামিয়ে ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে রওনা হলো। সিকি মাইল গিয়ে গাড়ি নামিয়ে দিল অগভীর নালায়। পনেরো মিনিট পর ফিরল পাথরের দালানে।

ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে লাবনী ও বেলা। প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ভাগ করে নিল ওরা। দড়ি বাঁধল স্ল্যাবে, তারপর একে একে নেমে পড়ল আঁধার গর্তে।

ছয় হাজার বছর পর আবারও মানুষের পা পড়ছে ওসাইরিসের পিরামিডের ভেতর।

.

২২.

ম্যান হোল সদৃশ গর্ত দিয়ে নেমে এসেছে রানা, লাবনী ও বেলা। এন্ট্রান্স চেম্বারের ছাত আট ফুট উঁচু। ওপর থেকে ঝিরঝির করে পড়ছে মিহি বালি। পরিষ্কার ঘর, তবে বদ্ধ জায়গার বাতাস যেমন হয়, তেমনই গুমোেট। নির্মাতারা সমাধি বন্ধ করে চলে যাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর।

ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় চারপাশ দেখল বেলা।

এই পাতাল ঘর ওপরের বারো ফুট বর্গাকৃতির ঘরের চেয়ে অনেক বড়। কাছের দেয়ালের সামনে থামল ওরা।

হায়ারোগ্লিফিক্স! বিড়বিড় করল বেলা। অবাক কাণ্ড তো!

কীসের অবাক কাণ্ড? পাশ থেকে বলল লাবনী, পড়তে পারছ?

মোটামুটি। একটু অদ্ভুত। অনেক পুরো অক্ষর।

দেখতে দারুণ, সাদা দেয়ালে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল লাবনী। রঙিন হায়ারোগ্লিফ দেখলে মনে হয় আঁকা হয়েছে গতকাল। অক্ষরের মাঝে মাঝে ইজিপ্টের পুরাণের দেবতার ছবি।

রানাও দেখছে দেয়াল। অক্ষরের মাঝে জগৎ-স্রষ্টা সূর্য দেবতা রা ও উদোম দেহের আকাশ-দেবী নাট। কিন্তু পরিচিত এক দেবতা নেই। ওসাইরিস নেই, বলল রানা।

ওসাইরিস ছাড়া অসম্পূর্ণ প্রাচীন মিশরের ধর্ম।

হোরাস, বলল বেলা, সেট, আইসিস বা আনুবিসও নেই। শেষেরজন তো সমাধি-দেবতা। তাকে অন্তত দেখব ভেবেছিলাম।

এরা ওসাইরিসের সমসাময়িক, বা তার ছেলেমেয়ে, বলল লাবনী। হয়তো তখনও দেবতা হয়নি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই পিরামিড পুরনো রাজ বংশের চেয়েও আগের। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে ওসব দেবতাকে পূজা দেয়া হতো।

তা হলে আমরা ঠিকই ধরেছি! হাসল বেলা।

চেম্বারের আরেকদিকে একটা প্যাসেজের মুখে গিয়ে থেমেছে রানা। কারুকাজ করা দুই পিলারের ওদিকে দরজা। নেমে গেছে সিঁড়ির তিনটে ধাপ। তারপর বেশ খাড়া প্যাসেজ।

এখনই নেমো না, বলল লাবনী, আগে ভালভাবে দেখা হোক এ ঘর। জরুরি তথ্য পেতে পারি।

অক্ষর পড়ছে বেলা। প্রেতলোকে কী ধরনের বিচার বা পরীক্ষার ভেতর পড়তে হবে, সেসব লিখেছে।

জানার মত কিছু পাবে? জিজ্ঞেস করল রানা।

জানি না, বলল বেলা। এটা ইজিপশিয়ান বুক অভ দ্য ডেড-এর আগের ভার্শান।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়তে হয়, তাই না? শুকনো হাসল লাবনী। স্টিফেনকিংমুন!

খিলখিল করে হাসল বেলা। আবার মন দিল দেয়ালের অক্ষরে। এসব আসলে প্রার্থনা। একেকটা আরিত পেরোবার সময় লাগবে। আরিত মানে একেকটা স্তর। এখানে লিখেছে: যদি পাপ না করো, বিচার ছাড়া পৌঁছবে ওসাইরিসের কাছে। তবে এসব লেখা হয়েছে অন্যভাবে।

অন্যভাবে মানে কী? জানতে চাইল লাবনী।

মনে মনে কয়েকটা লাইন পড়ল বেলা। এই যে, এখানে লিখেছে: তুমি প্রবেশ করবে ওসাইরিসের বাড়ির প্রথমতলায়। এটা কম্পিত মহিলার আস্তানা। মৃতজগতের প্রহরী সে। আরও লিখেছে, এই মহিলা ধ্বংসের মালকিন। পুরনো বুক অভ দ্য ডেড-এ আরও লেখা: কেউ অন্যায় না করলে ধ্বংস না করে আরও নিচের প্রেতলোকে যেতে দেবে। এখানে লিখেছে: ওই মহিলা ধাতব।

আর কিছু জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল বেলা। প্রার্থনা না বলে এটাকে সতর্কবাণী বলতে পারেন। কোথাও লেখেনি কীভাবে পেরোতে হবে ওই আরিত।

রানার দিকে তাকাল লাবনী। ভয় লাগছে।

এগোলেই বুবি ট্র্যাপে? মাথা দোলাল রানা। কম্পিত মহিলার বিষয়ে আর কিছুই নেই, বেলা?

হায়ারোগ্লিফিক্স পড়ছে বেলা। কমিনিট পর বলল, এরপর পাবেন আগুনের হ্রদ। পাপীকে গিলে নেবে ওই আগুন। আরও কী যেন লিখেছে, বুঝছি না। এরপর ঝড় বৃষ্টির মহিলার স্তর। তাকে পার করলে প্রচণ্ড শক্তিশালী মহিলার স্তর। অন্যায়ভাবে ঢুকলে যে কাউকে পিষে ফেলবে। তারপর আছে প্রচণ্ড আওয়াজের দেবী…

প্রাচীন অক্ষর দেখছে বেলা। একটু পর বলল, বিকট আওয়াজের দেবী ছেড়ে দিলে গিয়ে পড়ব রক্ত-মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের পরীক্ষায়। ওটা পেরোলেও রক্ষা নেই, ওসাইরিসের কাছে যাওয়ার আগে সামনে পড়বে মাথা-কাটা যন্ত্র। এসবই লেখা আছে বুক অভ ডেড-এ। কিন্তু এখানে লিখেছে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে।

মিথ্যা লেখেনি, বলল লাবনী, প্রেয়ার অভ দ্য ডেড এসেছে এ বর্ণনা থেকেই। ওসাইরিসের সমাধি রক্ষায় যেসব বুবি ট্র্যাপ ব্যবহার করেছে, সে-কথাই উঠে এসেছে প্রাচীন ধর্মে।

রক্ত-মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের পরীক্ষায় পাশ করতে হলে শুধু প্রার্থনায় কাজ হবে না। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় নিচে যাওয়া প্যাসেজ দেখল রানা।

কাজে লাগবে এমন আর কিছুই লেখেনি? হতাশ হয়েছে লাবনী।

না, মাথা নাড়ল বেলা, একই কথা বারবার লেখা। ভয়ঙ্কর দেবতা ওসাইরিস! অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়েছে! যারা অপবিত্র করবে সমাধি, রক্ষা নেই তাদের। হাজারোভাবে বারবার খুন করবে! ইত্যাদি ইত্যাদি!

এখনই মরতে রাজি নই, বিড়বিড় করল লাবনী। গিয়ে থামল রানার পাশে। পিলারের কাছে একাধিক কারুকাজ করা মিশরীয় দেবতা। দেয়ালে লেখা: নিয়ম না মেনে আরিত পেরোতে গেলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। রানা, ঝুঁকি নেয়া উচিত?

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। কেউ আসেনি এত বছরে। তাতে হয়তো নষ্ট হয়নি ফাঁদ। আবার, হয়তো নষ্ট হয়েছে। ফাঁদ এখন কী অবস্থায় আছে, তা না জেনে বলা মুশকিল।

তুমি তো দেখছি পিচ্ছিল আমেরিকান কূটনীতিকদের মত দু-মুখে কথা বলছ, বিরক্ত হলো লাবনী। তাকাল বেলার দিকে। তোমার কী মনে হয়, বেলা?

কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে বলে খুব অবাক হলো বেলা। আমি? আমি কী বলব! আপনারা যা বলবেন, সেটাই মেনে নেব।

জীবনটা তো তোমার, বলল রানা।

চুপ করে কী যেন ভেবে নিয়ে বলল বেলা, বহু দূরে চলে এসেছি। আপনাদের কারণে এখনও আস্ত আছি। তাই মনে হচ্ছে, সঙ্গে গেলে কোনও ক্ষতি হবে না। চলুন, যাওয়া যাক!

সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল বেলা। কিন্তু কাঁধ ধরে ওকে থামাল রানা। তুমি আসবে আমাদের পর। পিছু নেবে, ঠিক আছে?

হুঁ।

উল্টো পিরামিডে দুবার নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে কারুকাজ করা দুটো পিলারের মাঝ দিয়ে গেছে ঢালু প্যাসেজ। সামনেই প্রথম আরিত বা স্তর।

প্রথম স্তর, নার্ভাস সুরে বলল বেলা।

আঁধারে ফ্ল্যাশলাইটের আলো পাঠাল রানা। কী যেন দেখে বলল, বিশাল। বোধহয় অনেক গভীর।

কৃপ? জানতে চাইল লাবনী।

হ্যাঁ, একটু সামনেই। গহ্বরের কিনারায় থামল রানা। কূপের ছাত তিরিশ ফুট ওপরে। নিচে আলো পাঠিয়ে বোঝ গেল না গভীরতা। কূপের ওদিকে গেছে অক্সিডাইড় তামার প্রকাণ্ড দুই পাইপ। ওপাশের দেয়ালে আঁকা দানবীয় এক মহিলা। কূপের ওপর পাথরের সরু এক কলাম বা সেতু।

অনিরাপদ, নিচু স্বরে বলল লাবনী। ওই সেতু চওড়ায় বড়জোর এক ফুট। বেকায়দাভাবে ঢালু।

সেতুর ওদিকে পুরু, কারুকাজ করা কোনও মেশিনের ওপর পড়ল রানার ফ্ল্যাশলাইটের আলো। দেখল, পাথরের বিশাল দাঁতওয়ালা দুটো চাকা। তাতে চিকচিক করছে ধাতব কী যেন।

পাথরের বড় সিলিণ্ডারের সঙ্গে চেইন লাগানো, রানা বলল, পুলিও আছে।

পৌঁছে গেছি কম্পিত মহিলার আস্তানায়, বলল লাবনী।

চেইনে ওজন চাপলেই ঘুরবে পাথরের চাকা, অমনি সেতুতে ওঠা যে কাউকে চ্যাপ্টা করবে দুই পাইপ, আন্দাজ করল রানা।

থরথর করে কাঁপবে সেতু? বিড়বিড় করল বেলা। কিন্তু মেশিনটা চালু হবে কী দিয়ে?

আমরাই চালু করব, তিক্ত হাসল লাবনী। সেতুর মধ্যে ট্রিগার করার মত কিছু আছে। ওজন চাপলেই কাপবে সব।

তা হলে আমরা পেরোব কী করে?

ব্যাগ থেকে দড়ি বের করেছে রানা। চেইন ওজন নিলে বেশিক্ষণ দুলবে না পাথরের সেতু। নিজেকে ঠিকভাবে বেঁধে নেব সেতুর সঙ্গে, এরপর সাবধানে পেরোব।

কথা শুনে আঁৎকে উঠেছে লাবনী। বলল কী! তোমাকে নিয়ে খসে পড়লে?

পড়বে বলে মনে হয় না, বলল রানা। এ ছাড়া উপায়ও নেই। নইলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এপারে।

রানার বাহু চেপে ধরেছে লাবনী। খুব ভাল করে সেতুতে দড়ি বাঁধবে, ঠিক আছে?

নির্ঘাত। কাজে নেমে পড়ল রানা। দুবার সেতুর সঙ্গে দড়ি পেঁচিয়ে গিঁঠ দিল। অন্যপ্রান্ত বাঁধল কোমরে। পাথরের কলামে আস্তে করে পা রেখে বিড়বিড় করল, রওনা হলাম।

তাতে কিছুই হলো না।

ঢালু হলেও নড়ছে না সেতু।

 হাঁটু গেড়ে বসল রানা, এগোল সাবধানে।

হতবাক হয়ে ওকে দেখছে লাবনী।

সেতুর মাঝে পৌঁছুল রানা, তারপর পেরিয়ে গেল চারভাগের তিনভাগ।

হঠাৎ নড়ে উঠল সেতু। ঠং-ঠং আওয়াজ তুলল চেইন।

দুহাতে সেতু জড়িয়ে ধরল রানা। অবশ্য, তিন সেকেণ্ড পর থামল চেইনের আওয়াজ। থমথম করছে চারপাশ।

কী হলো, রানা? ফ্যাকাসে মুখে জিজ্ঞেস করল লাবনী।

মুখ তুলে সামনে দেখল রানা। জানি না, তবে আর নড়ছে না! পেরিয়ে গেল শেষ কয়েক ফুট। দড়ি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকাল চারপাশে। একটু দূরে দেয়ালে বড় এক ফাটল। ওখান থেকে পড়ে দাঁতওয়ালা চাকার মাঝে আটকে গেছে একটা পাথরখণ্ড। এজন্যেই ঘুরতে পারেনি চাকা। চেইনও দোলাতে পারেনি সেতু।

পাথরের ওই টুকরো হঠাৎ করে খুলে আসবে না, সেটা নিশ্চিত করল রানা। এবার ভর দিলেও বিন্দুমাত্র নড়ল না সেতু। একজন একজন করে এসো। তাড়াহুড়ো করবে না।

প্রথমে সেতু পেরোল লাবনী, তারপর বেলা।

ভূমিকম্পে নষ্ট হয়েছে যন্ত্র? আনমনে বলল লাবনী। দেখছে পাশের ফাটল। বা হয়তো তৈরির সময়ে ত্রুটি ছিল।

ঢালু আরেকটা পথ দেখাল রানা। দুপাশে কারুকাজ করা পিলার। পরের আরিত কোটা যেন?

আগুনের লেক, বলল বেলা। বা বলতে পারেন, জীবন্ত খেয়ে ফেলা আগুন!

তার মানে আগুন থাকবে, বলল রানা। বদ্ধ জায়গায় ওই জিনিস ভয়ঙ্কর।

কপাল ভাল হলে পরের ফাঁদও নষ্ট থাকবে। পাথরের মেকানিযম দেখছে লাবনী।

ভাগ্যের ওপর এত ভরসা কোরো না। সামনের প্যাসেজ ধরে এগোতে লাগল রানা।

প্যাসেজ বেশ ঢালু। হাঁটা কঠিন।

দুবার নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিল প্যাসেজ।

 ঘুরে ঘুরে নিচে চলেছে, বুঝে গেল ওরা।

রানা ভাবছে, ওপরের তামার পাইপ নিচের চেম্বারে যুক্ত কি না। একটু যেতেই পড়ল কারুকাজ করা দুটো পিলার। ওগুলোই বুঝিয়ে দিল, সামনে আরেকটা স্তর বা ঘর।

নাক কুঁচকে গেছে রানার। গন্ধ পাচ্ছ? পিলার পেরিয়ে থামল ও। আলো ফেলল সামনের ঘরে।

কামরা ত্রিশ ফুট দৈর্ঘ্যের। ওপাশে বড় দরজা। তিরিশ ফুট উঁচু ছাত। ওখান থেকে ঢালু হয়ে পনেরো ফুট নেমেছে এক দেয়াল। ছাতে অসংখ্য বৃত্তাকার ফোকর। সেগুলোর ভেতর একটা বড়। চিমনির মত। ছোটসব গর্তের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকাল রানা। মন বলছে, সামনে মস্তবড় বিপদ!

ঘরে জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। ওদিকের দেয়ালে গ্ৰেহাউণ্ডের মত দেখতে এক দেবতার ছবি প্রবেশপথের কাছে তামার হেলমেটের মত বড় কয়েকট গ্লোব। সরাসরি সামনে ধুলোভরা মেঝেতে গর্ত। ওট চারকোনা, তিন ফুট চওড়া। কোনও ধরনের তরলে ভরা এমনই আরেক গর্ত দূরের দরজার সামনে। রানারা যে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়ে নিচু ঘরের ধুলোভর মেঝে। একটু ওপরে ছোট দুই চৌবাচ্চার কিনারা।

ওই ছবির মধ্যে কী যেন খুব অস্বাভাবিক, বলল লাবনী। কিন্তু আগুন কোথায়?

এ ঘরে বুবি ট্র্যাপ আছে, বুঝতে পারছে রানা। চারপাশ দেখছে সতর্ক চোখে।

হয়তো নিভে গেছে আগুন? দাঁত খিঁচিয়ে রাখা দেবতা দেখতে এক পা সামনে বাড়ল বেলা।

এগোবে না, মানা করল রানা। ঝুঁকে সামনের চৌবাচ্চায় তর্জনী চুবিয়ে নাকের কাছে ধরল। পানি। আলো ফেলে দেখল, চৌবাচ্চার তিনদিক দিয়ে ঘেরা দেয়াল। বড়জোর চার ফুট গভীর। এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে ঘরের শেষমাথার চৌবাচ্চার।

সুড়ঙ্গ? বলল লাবনী। অদ্ভুত। হেঁটে গেলেই তো হয়।

কাজটা সহজ নয়, বলল রানা, অন্য কোনও বিপদ হবে।

ওটা কী? ঘরে আলো ফেলল লাবনী।

ছাতের অসংখ্য গর্ত থেকে মেঝেতে নেমেছে টানটান সব কালো সলতে।

সলতে থেকেই বোধহয় আসবে মহাবিপদ, বলল রানা। আলো ফেলল ঘরের মেঝেতে। না সরিয়ে এগোতে পারব। না।

অভাব নেই সলতের, নানানদিকে আলো ফেলে দেখছে লাবনী। কী যেন মনে পড়তে চাইছে। বলো তো, এই ঘরে কী নেই?

কী? প্রতিধ্বনি তুলল বেলা। এক পা সামনে বাড়ল।

মেঝের স্ল্যাবের মাঝে কোনও ফাঁক নেই, বলল রানা। বড় পাথরের মেঝেতে ওই জিনিস থাকে। দূরের দেয়ালে আলো ফেলল। আগের ঘরে সবচেয়ে বড় ব্লক ছয় বাই দশ ফুটের ছিল। কিন্তু এই মেঝে কমপক্ষে ত্রিশ ফুট দৈর্ঘ্যের।

তা হলে কি ধরে নেব এ মেঝে তৈরি মাত্র একটা পাথর থেকে? জানতে চাইল বেলা। আরেক পা বেড়ে পা রাখল সামনের মেঝেতে। টুপ করে ডুবে গেল গোড়ালি। আরেহ! হুমড়ি খেয়ে পড়তে শুরু করে আঁৎকে উঠল বেলা।

এক সেকেণ্ড আগেও যা ভেবেছে, সেই মেঝে আসলে তেলতেলে কোনও পদার্থের চৌকো পুকুর।

রানা পেছন থেকে টেনে না নিলে তরলের গভীর চৌবাচ্চায় তলিয়ে যেত বেলা। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে বলল, এটা কী হলো? অবাক হয়ে গেছে।

তেল, বলল রানা, ওপরে ছড়িয়ে আছে বালি। মনে হচ্ছে মেঝে।

ছাতের গর্ত দেখছে লাবনী। সলতে ছিড়লেই দপ্ করে জ্বলে উঠবে ওপরের কিছু। পরক্ষণে শুরু হবে আগুন।

জুতোর সোল মেঝেতে ঘষল বেলা। এই ফাঁদ পেরোব কীভাবে?

ডুব সাঁতার কেটে, পানির ঘোট চৌবাচ্চা দেখাল রানা। ঘর ভরা আগুন থাকলেও পানির নিচে তা থাকবে না।

কাজটা এত সহজ? সন্দেহের চোখে নকল মেঝে দেখছে লাবনী।

তামার গ্লোবের ওপর ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল রানা। এসব পরেই আগুন থেকে বাঁচতে হবে।

জিনিসটা কী? জানতে চাইল বেলা।

একটা গ্লোব হাতে নিল রানা। ভেতরে ধরার হ্যাণ্ডেল। মাথায় গ্লোব পরল। শিরস্ত্রাণের মত কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। ভারী জিনিসটা। ডাইভিং হেলমেট। ভোতা শোনাল ওর কণ্ঠ।

রানার গ্লোবের চাঁদিতে টোকা দিল লাবনী। ভেতরে বেশিক্ষণ অক্সিজেন থাকবে না।

একবার সুড়ঙ্গে নামলে এটাই একমাত্র ভরসা, বলল রানা। চৌবাচ্চা ভরা পানি দেখল। মনে হয় না সুড়ঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ছাতের গর্তের। আগুন এড়িয়ে সুড়ঙ্গ পেরিয়ে উঠতে হবে দুই চৌবাচ্চার মাধ্যমে। ব্যস, জানে বেঁচে গেলে!

নিজেও গ্লোব পরখ করছে বেলা। যা পাতলা, আগুনের তাপে চট করে গরম হয়ে উঠবে।

তবুও ওটাই বাঁচার একমাত্র উপায়, বলল লাবনী, তুমি নিশ্চয়ই কই-ভাজা হতে চাও না?

না, জীবনেও না! বারকয়েক মাথা নাড়ল বেলা। আমি বিশ্বসুন্দরী হতে চাই।

সহজে সাঁতরে ওপারে যাবে, তা হবে না, বিশ্বসুন্দরী, বলল রানা। বড় বিপদ লুকিয়ে রেখেছে ওসাইরিসের লোক। প্রথমে যাব আমি।

না, আমি যাব, জোর দিয়ে বলল লাবনী।

ডাহা মিথ্যা বলল রানা, পানির নিচে বাধা থাকলে আমাকে সতর্ক করবে এমন কাউকে চাই।

কিন্তু…।

কোনও কিন্তু নেই, মানা করে দিল রানা। এক পা নামিয়ে দিল চৌবাচ্চার পানিতে।

ঢোক গিলল লাবনী। ভেবে দেখেছ, ওই পানি আছে হাজার হাজার বছর ধরে? ভাবলে কেমন শিউরে ওঠে না গা?

শিউরে উঠছি না, তবে পানি গিলতে রাজি নই, বলল রানা। একবার প্রাচীন হেলমেট ওপরে তুলে আবার বসিয়ে নিল মাথায়। দুহাতে ধরেছে ভেতরের হ্যাণ্ডেল। পরক্ষণে ডুব দিল। বেড়ে গেছে চৌবাচ্চার গভীরতা, তবে নাকের ফুটোর নিচেই থাকল পানি। অবাক হয়ে রানা বুঝল, ভেতরের বাতাসের কারণে ভেসে উঠতে চাইছে হেলমেট। সুড়ঙ্গের মাঝ দিয়ে এগোল ও। ছাতে ঘষা খেল হেলমেটের ওপরের দিক।

কী যেন লাগল বুকে, তারপর সরেও গেল।

সুড়ঙ্গের ভেতর ছিঁড়ে গেছে একটা সলতে।

চমকে গেছে লাবনী আর বেলা। ছাতের কাছ থেকে এসেছে ঘষ্টে যাওয়ার আওয়াজ।

কীসের শব্দ? লাবনীর দিকে তাকাল বেলা।

বড় লাইটার জ্বেলে নেয়ার মত আওয়াজ। এবার চিৎকার করে বলল লাবনী, রানা! জ্বলে উঠবে আগুন! আতঙ্ক নিয়ে ছাতের দিকে তাকাল। খর-খর আওয়াজ তুলছে। প্রাচীন পাথর ও ধাতু। যে-কোনও সময়ে ঝলসে উঠবে আগুনের ফুলকি…

ছোট গর্ত থেকে এল আগুনের লালচে ঝিলিক।

সরসর করে নেমে এল ধোয়া-তোলা সাপের মত সরু কিছু ফিতা। পড়ছে ঘরের নানানদিকে। মাত্র কয়েকটা ফিতায় জ্বলছে আগুন। কিন্তু নকল মেঝেতে পড়তেই পুরো ঘর জুড়ে দপ করে জ্বলে উঠল লেলিহান আগুন!

অগ্নি লেকের কথা লেখা ছিল হায়ারোগ্লিফে।

এখন সেই নরকেই আছে রানা।

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে ঘরের নিমজ্জিত মেঝে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করেছে রানা। শুনছিল নিজের শ্বাসের শব্দ। চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার। কিন্তু হঠাৎ করেই আলোকিত হলো সব। গোটা পুলে জ্বলে উঠেছে কমলা আগুন। প্রচণ্ড তাপে টগবগ করে ফুটছে তেল। বড় দ্রুত গরম হয়ে উঠছে তেলের নিচে পানি, সেইসঙ্গে হেলমেটের হাতল।

ভুলটা এখন বুঝতে পারছে রানা। চট করে এগোতে পারবে না পানির কারণে। উঠেও আসতে পারবে না। ওপরে দাউদাউ আগুন। পানির নিচে ভয়ঙ্কর এক স্লো-মোশন দুঃস্বপ্নে আটকা পড়েছে ও।

কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন নয় যে জেগে উঠলেই রক্ষা পাবে।

গ্লোবের ওপরে গনগনে আগুন দেখে গলা শুকিয়ে গেছে রানার। চৌবাচ্চায় নামার সময় ছলকে লেগেছে তেল, এখন মশালের মত জ্বলছে প্রাচীন হেলমেটের ওপরের অংশ।

রানা! ফিরে এসো! সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ো!

আগুনের কড়-কড় আওয়াজের ওপর দিয়ে আবছাভাবে লাবনীর কণ্ঠ শুনল রানা। বুঝে গেছে, আবার ফেরার মত বাতাস হেলমেটে নেই। এই কামরা বড়জোর তিরিশ ফুট দৈর্ঘ্যের। এগিয়ে চলল রানা। বেশিক্ষণ লাগবে না ওদিকের দরজার কাছে পৌঁছে যেতে।

হামাগুড়ি দিয়ে সামনে বাড়ছে রানা। নাকে পানি লাগছে বলে মাঝে মাঝে আটকে আসছে শ্বাস। হেলমেটের নিচের অংশ দিয়ে ফ্লোর দেখছে। হায়ারোগ্লিফিক্স। সেগুলোর ভেতর রয়েছে ওসাইরিসের ফোলা একটা চোখ।

ওর ধারণা, বিশেষ কারণেই মেঝেতে রাখা হয়েছে ওটা। হয়তো বোঝাতে চাইছে কিছু। কিন্তু অক্সিজেন কমে আসছে। বলে অন্যদিকে মনোযোগ দেয়ার সময় ওর হাতে নেই।

আগুনের তাপে ক্রমেই আরও উষ্ণ হচ্ছে হেলমেটের হাতল। একটু পর সরিয়ে নিতে হবে হাত। সেক্ষেত্রে ভেসে উঠবে গ্লোব। বাতাসের অভাবে ভেসে উঠলেই গনগনে আগুনে পুড়ে মরবে ও!

ঠং! করে কী যেন লাগল হেলমেটের সঙ্গে।

আরেকটু হলে হ্যাণ্ডেল থেকে হাত সরিয়ে নিত রানা, ভয় পেয়ে খামচে ধরল ওটা। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, সামনের পথ বন্ধ। মেঝে থেকে উঠেছে পাথরের চওড়া স্ল্যাব। যা ভেবেছে, তা-ই, আগুনের মাঝ দিয়ে সহজে যাবার পথ রাখেনি পিরামিডের নির্মাতারা!

পানির নিচে কাঁকড়ার মত বামে সরল রানা। হাঁটু বাড়িয়ে বুঝতে চাইল পাথরের দেয়াল কোথায় শেষ। ডানহাতে হ্যাণ্ডেল ধরে বামহাতে হাতড়াল পাথরের বুকে। বামে এগোল আরও একটু। এদিকে কোথাও বাধা নেই। কোথায় চলেছে বোঝারও উপায় নেই। স্বাভাবিক রাখতে চাইল শ্বাস। মনে পড়েছে, হেলমেটে আছে সীমিত অক্সিজেন।

ভীষণ রাগ হলো প্রাচীন মিশরীয়গুলোর ওপর। ইহ! গোলকধাঁধা তৈরি করেছে শালারা! শেষমাথা যদি বন্ধ থাকে?

নিশ্চয়ই কোথাও পথ আছে?

নির্মাতা যদি সত্যিই চাইত ওসাইরিসের সমাধিতে ঢুকতে দেবে না কাউকে, সেক্ষেত্রে বুজে দিত সব সুড়ঙ্গ। একদল পুরোহিত দেবতা করেছিল ওই রাজাকে। তাকে অনুসরণের জন্যে উদ্বুদ্ধ করত সবাইকে। এদিকে কোনও পথ থাকতেই হবে!

খুঁজে বের করতে হবে ওই পথ!

হাতে সময় নেই!

হেলমেটের ভেতর ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন।

মেঝের ওই হায়ারোগ্লিফিক্স…

দম আটকে পানির নিচে মুখ নিল রানা। ওপরের নারকীয় আগুনের লালচে আলোয় অদ্ভুত দেখাল মেঝে।

একটা হায়ারোগ্লিফিক্স চেনে রানা। সামনে বাড়তেই আবারও দেখল ওসাইরিসের কয়েকটা চোখ। কুচকুচে কালো মণি যেন সরাসরি দেখছে ওকে।

কিন্তু একটা অন্যরকম।

ওই মণি চেয়ে আছে বামে। পাশেই পাথরের ব্লক।

বামহাত বাড়িয়ে অন্ধের মত এগোল রানা। পুড়তে শুরু করেছে হাতল ধরা ডানহাতের আঙুল। সাবধানে আঙুল নাড়ল রানা। কিন্তু আগুনের তাপ থেকে রক্ষা নেই। একটু পর ছেড়ে দিতে হবে হেলমেট। আগুনে পুড়বে ওর মাথা।

মৃত্যু সেক্ষেত্রে নিশ্চিত!

বামহাতে মেঝে ঘষে এগোল রানা। হাত বাড়িয়ে দেয়ার দুসেকেণ্ড পর টের পেল, সামনেই একটা বাঁক!

বাঁকের কোনা চেপে ধরল বামহাতে। নিজেকে টেনে নিল ওদিকে। সামনের মেঝেতে ওসাইরিসের আরেকটা চোখ। এবার মণি চেয়ে আছে কামরার দূরে। ওটার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে এগোল রানা। কয়েক ফুট যাওয়ার পর পেল আরেকটা চোখ। এবার ওটা দেখাল ডানদিকে।

বেড়ে গেছে আগুনভরা কামরার তাপমাত্রা। ছাতের চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তেল-পোড়া ধোঁয়া। দুহাতে মুখ ঢেকে আগুনের দিকে চেয়ে আছে লাবনী, পাশেই বেলা। জ্বলন্ত তেলের পুলের মাঝে চোখে পড়ছে রানার হেলমেট। এদিক ওদিক যাচ্ছে উদ্ভ্রান্ত রানা। বাঁচার উপায় নেই। ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো লাবনীর। ওর চোখের সামনে পুড়ে মরবে ওর ভালবাসার মানুষটা, কিন্তু কিছুই করতে পারবে না!

ওদিকে ওসাইরিসের চোখ দেখে এগিয়ে চলেছে রানা। অক্সিজেন কমে গেছে বলে ঘুরছে মাথা। আটকে আসছে দম। ওপরের আগুনের তাপ অতিরিক্ত উষ্ণ করে তুলছে। পানি।

সামনে আরেকটা চোখ দেখে আবার এগোল রানা।

পুড়ে যাচ্ছে হাতল ধরা আঙুল!

 গন্তব্য আর কত দূরে?

প্রতিবার দম নিলে ভীষণ জ্বলছে বুক। যে-কোনও সময়ে জ্ঞান হারাবে রানা।

ওই যে আরেকটা চোখ!

ডানদিকে চেয়ে আছে!

গ্লোব ধরা হাত থরথর করে কাঁপছে ওর। হেলমেট থেকে বেরিয়ে গেল একটা বুদ্বুদ। সে জায়গা দখল করল পানি।

পরের চোখ সরাসরি চেয়ে আছে সামনে।

ওদিকে ছায়ামত কিছু।

আরেকটা সুড়ঙ্গ!

হেলমেট নিয়ে পানির নিচে ডুব দিল রানা। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল সুড়ঙ্গে। পাথরের ছাতে গুঁতো দিল তামার হেলমেট। আওয়াজ হলো ঘণ্টির মত।

মাত্র কয়েক পা যেতে হবে… নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে রানা। আর মাত্র…।

সুড়ঙ্গ ফুরাতেই উঠতে গেল রানা। পুড়ছে হাত, আঙুল থেকে খসে গেল হেলমেটের হাতল। ঠাস্ করে পানির ভেতর পড়ল তামার গ্লোব। গরম পানি লাগল মুখে। খক-খক করে কেশে উঠে রানা টের পেল, পাতলা রাবারের মত হয়ে গেছে পা। কাত হয়ে পড়ে গেল পানিভরা চৌবাচ্চার ভেতর। জ্ঞান হারাতে শুরু করে মনে মনে চিৎকার করল রানাঃ না, আমি হারব না!

কয়েক সেকেণ্ড পর ধড়মড় করে উঠে পানি থেকে তুলল মুখ। শক্ত হাতে ধরল চৌবাচ্চার ওপরের কিনারা। ভু করে ফুসফুস থেকে বেরোল কার্বন-ডাই-অক্সাইড। গরম বাতাসে ভরে নিল বুক।

মাসুদ ভাই উঠেছেন! চিৎকার করে উঠল বেলা।

ওহ্, ধন্যবাদ! বিড়বিড় করে কাকে যেন বলল লাবনী। গলার কাছে চেপে ধরে রেখেছে আটলান্টিসের লকেট। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, রানা! তুমি ঠিক আছ তো?

আগুনের কড়-কড় শব্দের ওপর দিয়ে বলল রানা, খুবই ভাল আছি। কিন্তু জীবনেও আর কোনও পিরামিডে ঢুকব না!

সুড়ঙ্গ থেকে বেরোবার পর কী হয়েছে? জানতে চাইল বেলা।

পানির তলা দিয়ে এলে মেঝেতে দেখবে ওসাইরিসের চোখ, বলল রানা, চোখে চোখে রাখবে ওসব চোখ। কোনও কোনওটা নির্দিষ্ট দিকে তাক করা। অনুসরণ করলে পৌঁছুবে এ পারে। এবার হেলমেট পরে নেমে পড়ো চৌবাচ্চায়। বেশি খরচ করবে না অক্সিজেন।

ভীষণ শুকনো মুখে চৌবাচ্চায় নামল লাবনী। তলিয়ে গেল পানির নিচে। ওপরে থাকল গ্লোবের একাংশ। বেঁটে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এগোল হামাগুড়ি দিয়ে। পিছু নিল বেলা।

ঘরের ওদিকে রানা জানে, লেক পেরোবার কাজটা সহজ নয়। শেষদিকে হেলমেটের হাতল এতই গরম হবে, মন বলবে শেষ পর্যন্ত পুড়েই মরছি।

অপেক্ষায় থাকল রানা।

অবশ্য ওর মত করে অসহায়ভাবে এগোতে হচ্ছে না লাবনী বা বেলাকে। মাত্র তিন মিনিটে পৌঁছে গেল দ্বিতীয় চৌবাচ্চার ভেতর। প্রথমে লাবনীকে টেনে তুলল রানা, তারপর এল বেলা। ভুস করে ভেসে উঠল ও।

নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে লাবনী। ওরে, বাবা! পুড়ে গেছে আঙুল!

আমার তো আঙুলই নেই! হাতে ফুঁ দিচ্ছে বেলা। উঠে এল চৌবাচ্চা থেকে।

ফুরিয়ে এসেছে জ্বলন্ত লেকের তেল। চারপাশে ধোঁয়া। কমে আসছে আগুনের তেজ।

কী হারামি দেখো, কীসব ফাঁদ পেতে রেখেছে! রেগে গিয়ে বলল লাবনী।

ওয়াটারপ্রুফ ফ্ল্যাশলাইট নতুন করে জেলে নিয়ে বলল রানা, আমি অন্য কথা ভাবছি।

সেটা কী? সমস্বরে জানতে চাইল লাবনী ও বেলা।

পেরোতে হবে আরও পাঁচটা আরিত!

বাপরে! খুশিতে ভুষি হয়ে গেলাম, বিড়বিড় করল লাবনী। কড়া চোখে দেখল বেলাকে। যেন সব দোষ ওর। পরের স্তর কোনটা?

ঝড়-বৃষ্টির মহিলার এলাকা, ঢাক গিলল বেলা।

বাহ্, খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, বাঁকা সুরে বলল লাবনী।

তা হলে চলে নাচতে নাচতেই, দলবল নিয়ে পরের ঢালু প্যাসেজ ধরে এগোেল রানা।

.

২৩.

 প্যাঁচ খেয়ে পিরামিডের আরও গভীরে গেছে সুড়ঙ্গ। দেয়ালে দেয়ালে কুৎসিত অলঙ্কারের মত দেবতাদের ভয়ঙ্কর সব চিত্র। অন্তর কাঁপিয়ে দেয়া লেখা দেয়ালে। মূল বক্তব্য: বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ করলে রক্ষা নেই কারও!

অলৌকিক বা আধিভৌতিক বিপদের ভয় রানার নেই, তবে ভাবছে ভয়ানক বিপজ্জনক সব বুবি ট্র্যাপের কথা। আজ তক যত প্রাচীন রহস্যময় দালানে ঢুকেছে, ওগুলোর ভেতর সম্পদ রক্ষা করতে ছিল বিস্মিত করার মত মারাত্মক সব ফাঁদ।

দেবতা-রাজা ওসাইরিসের পিরামিড প্রকাণ্ড এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভবন। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই সেই আমলের রাজ বংশ রক্ষা করতে চেয়েছে এটাকে। ফাঁদও সেজন্যেই।

ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় সামনে কারুকাজ করা পিলার দেখল রানা। ওদিকেই আরেকটা আরিত। কিন্তু কয়েক পা যাওয়ার পর বুঝল, সামনে কোনও ঘর নেই। বেশ খাড়াভাবে নেমেছে প্যাসেজ। এটাই একটা আরিত।

লাবনী, বেলা, আমরা যে আগুনের ঘর থেকে নেমে এসেছি, তার ঠিক নিচে এই প্যাসেজ, বলল রানা।

যেসব বাঁক ঘুরে এসেছে, সেগুলো মনে মনে খতিয়ে দেখল লাবনী। রানার কথাই ঠিক। প্যাসেজের ছাতের ওপরে আছে পানিভরা ওই ঘরের মেঝে। বিপদ হবে ভাবছ?

পরের ফাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ঝড়-বৃষ্টির, আর আমাদের মাথার ওপরেই টনকে টন পানি।

ঠিক! ছাতের দিকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো তাক করল লাবনী। প্যাসেজের দুপাশের দেয়ালে নানান ছবি, কিন্তু ছাতে তা নেই। মনে হলো নিরেট পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি ছাত। কোনও গর্ত দেখছি না।

সতর্ক চোখে চারপাশ দেখছে রানা। ছাত ঠিক আছে, কিন্তু সামনে পিলারের ওদিকে প্যাসেজের মেঝের দুপাশে গভীর নালা। চওড়া হবে চার ইঞ্চি। হয়তো ওখানে গেলেই শুরু হবে বিপদ।

আমার তো মনে হচ্ছে সাধারণ নালা, বলল বেলা।

ওপরের প্যাসেজে কিন্তু ছিল না, বলল লাবনী।

পিলারের ওদিকটা দেখছে রানা।

নতুন করে ভিজতে হবে? মাথা নাড়ল লাবনী। খুন হব ভারী জলপ্রপাত নেমে এলে?

আপনার কথা যেন কানে না যায় দেবতাদের! নার্ভাস হয়ে দুদিকের দেয়ালের দেবতাদেরকে দেখছে বেলা।

নিচে যেতে হলে এই প্যাসেজ ধরেই যেতে হবে, বলল রানা। আগে হোক বা পরে, ঘটবে খারাপ কিছু। কী করবে ঠিক করো তোমরা।

বহু কষ্টে এ পর্যন্ত এসেছি, এখন পিছিয়ে যাব না, মৃদু হেসে বলল লাবনী। তা ছাড়া, নষ্ট ছিল প্রথম ফাঁদ। পরেরটা পেরোতেও খুব কষ্ট হয়নি। এখনই বা হাল ছাড়ব কেন?

এখনও লাল হয়ে আছে আঙুল, বলল বেলা, তবে আছি লাবনী আপার সঙ্গে। মরলে তো একবারই মরব।

উচ্চ মম শির, বিড়বিড় করল রানা। বেলাকে বলল, ভাবছ মাথা নিচু করবে না কারও কাছে?

মনে আছে শেষ ফাঁদের নাম মাথা-কাটা যন্ত্র? ঢাক গিলল বেলা।

প্রয়োজনে মাথা নিচু করে নেবে, বলল গম্ভীর রানা। চলো, যাওয়া যাক। ঢালু প্যাসেজে আলো ফেলল ও। খুব ধীরে হাঁটবে, ঠিক আছে?

মাসুদ ভাই, আপনি এগিয়ে যান, আমরা আছি আপনার পেছনে, মিছিলের স্লোগানের মত করে বলল বেলা।

শামুকের গতি তুলে পিলার পেরোল রানা। বারবার দেখছে মেঝে ও ছাত। তবে পাঁচ ফুট যেতেই থেমে গেল। আলো ফেলেছে ছাতের একাংশে। ছাতের ব্লক ক্রমেই আরও বড় হচ্ছে।

ছাতের ব্লকের সরু সব ফাটল থেকে মাঝে মাঝে পড়ছে মিহি বালি!

চোখ বিস্ফারিত করল লাবনী। চুন-সুরকি খুলে আসছে!

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে বেলা। মাথার ওপর দানবীয় সব পাথরের ব্লক, ভাল লাগছে না আমার!

সাবধানে এগোও, পাকা চোরের মত এক পা এক পা করে চলেছে রানা। মাঝে মাঝে দেখছে এবড়োখেবড়ো ছাত। আবার দেখছে মেঝে। ভয়ে শুকিয়ে গেছে গলা। কয়েক পা গিয়ে বলল, মনে হচ্ছে, ঝড়-বৃষ্টির ভদ্রমহিলা যে-কোনও সময়ে হিসি করে দেবে!

সেক্ষেত্রে ভদ্রমহিলা বলা যায় না, বলল লাবনী, মানুষের মাথায় এসব কী?

ওপরেই… আরেক পা এগোল রানা। চমকে গেছে। ওর পায়ের নিচে একটু ডেবে গেছে একটা স্ল্যাব!

রানার মতই পাথরের মূর্তি হয়েছে লাবনী ও বেলা।

দুপাশের দেয়ালের ওদিক থেকে এল ঘড়ির মত মৃদু ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ। চাপ পড়ে গেছে ট্রিগারে…

ফাপা আওয়াজ হলো: ক্লং! কাঠের ওপর পড়েছে ভারী ধাতু। শোনা গেল জলোচ্ছাসের মত শোঁ-শোঁ আওয়াজ।

শত শত টন পানি নেমে আসছে নিচে!

জলদি! রানা আর কিছু বলার আগেই ছাতের ফাটল বেয়ে ঝরঝর করে নামল ভারী বর্ষণ। বাড়ছে পতনের গতি।

তিরিশ ফুট দৈর্ঘ্যের ছাতের ফাটলের পানি ছিটকে ফেলবে ঢালু প্যাসেজে?

অবাক কাণ্ড! বলল লাবনী। আমাদের ক্ষতি হবে না।

এই পানি আসল ফাঁদ নয়, পেছনের প্যাসেজের ছাত দেখছে রানা। ওটা বিপদ! ফাটল ধরেছে ছাতে। হুড়মুড় করে নামছে জলোস। হয়তো ওটার সঙ্গে নেমে আসবে পাথরের ভারী সব ব্লক! লেজ তুলে পালাও!

আপনার মত আমার লেজ নেই! ঝেড়ে দৌড় দিল বেলা। বিড়বিড় করে যিশুর কাছে প্রার্থনা করছে: বাঁচাও তো, বাপু, পুরো দশটা মোটা মোমবাতি দেব তোমার চার্চে! খেয়াল রেখো, আমি মরলে কিন্তু পাবে না কিছুই!

ছাতে সাধারণ চুন-সুরকির বদলে ব্যবহার করা হয়েছে মিহি বালি ও গুঁড়ো লাইমস্টোন। তাতে যত্ন করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে পাথরের ব্লক! ঠিকঠাক বসে ছিল এত হাজার বছর। কিন্তু ট্রিগারে চাপ পড়তেই নেমে আসতে শুরু করেছে বিপুল পানি। স্রোতে ভেসে যাচ্ছে লাইমস্টোন ও বালি। নড়ছে ভারী পাথরের ব্লক। ঠং-ঠাং শব্দে লাগছে পরস্পরের সঙ্গে। যে-কোনও সময়ে টুকরো টুকরো হয়ে নেমে আসবে ভাঙা ছাত।

কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ, ঢালু প্যাসেজে বিপুল পানি তৈরি করেছে জোরালো স্রোত। ছাতের মতই হিসাব কষে মেঝেতেও বসিয়ে দেয়া হয়েছিল স্ল্যাব। পানির স্রোত এখন খেয়ে ফেলছে ওগুলোর মাঝের প্লাস্টার!

নিচের গভীর গহ্বরে ধুপ-ধাপ শব্দে পড়ল প্যাসেজের শুরুর কিছু স্ল্যাব!

ওরে, বাবা, মরে গেলাম! চড়ুই পাখির মত লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে বেলা।

জানের ভয়ে তিন সেকেণ্ডে ওর পেছনে পৌঁছে গেল রানা ও লাবনী। পাশাপাশি ছুটছে রকেটের বেগে। পেছন থেকে আসছে স্রোত।

ভারী জলধারা খসিয়ে ফেলছে পেছনের মেঝে!

দৌড়াতে দৌড়াতে রানা টের পেল, দেয়ালের পাশে রয়ে যাচ্ছে পেছনের নালা। কিন্তু এতই সরু, ওটা ধরে দৌড়াতে পারবে না ওরা!

আমার সামনে দৌড়াও! গলা ফাটাল রানা। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারী ও। প্যাসেজের পাথরের স্ল্যাব নিয়ে ওর পতন হলে সঙ্গে যাবে লাবনী আর বেলাও।

আর পারব না! পিছিয়ে পড়ছে লাবনী। তোমরা যাও!

বহু নিচের গহ্বরে গুড়ম! আওয়াজে পড়ল প্যাসেজের কিছু স্ল্যাব! যে-কোনও সময়ে ছাত থেকে পড়বে প্রকাণ্ড সব পাথরের ব্লক! নিচের মেঝেতে বইছে বানের মত ছয় ফুটি উঁচু শ্রোত! খলখল আওয়াজে তেড়ে যাচ্ছে রানাদের দিকে!

ঘুরেই লাবনীকে কাঁধে তুলে আবারও সামনের প্যাসেজে ছুটল রানা। খসে পড়ল পেছনের মেঝের স্ল্যাব। প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে রানা। কিন্তু লাবনীকে সহ ওকে ভাসিয়ে নিল জোরালো পানির স্রোত। ছিটকে পড়ল সামনের মেঝেতে।

স্রোতের নিচে লাবনীকে নিয়ে গড়িয়ে চলেছে রানা। ওর তিন ইঞ্চি পেছনের পাথরের স্ল্যাব গিয়ে পড়ল গভীর গহ্বরে। লাবনীকে নিয়ে শেষ একটা গড়ান দিল রানা।

এবার পালা ওদের পতনের!

কিন্তু পেছনে গভীর গর্তে পড়ল প্যাসেজের মেঝের শেষ স্ল্যাব। বহু নিচ থেকে এল ভারী পাথর আছড়ে পড়ার জোর আওয়াজ। পরক্ষণে বিকট আরেক আওয়াজে ধসে গেল পুরো ছাত।

পাশেই কারুকাজ করা পিলার দেখল রানা।

ওরা বোধহয় আছে নতুন আরেক প্রস্থ প্যাসেজের মুখে!

কাছেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ, ঘুরে তাকাল রানা। চুনের মত ফর্সা হয়েছে বেলার মুখ। তবে অকৃত্রিম আনন্দের হাসি হেসে ফেলল রানা ও লাবনীকে দেখে। বন্যার পানিতে ভেজা মেঝে থেকে তুলে নিল ওর ফ্ল্যাশলাইট।

পেছনের প্যাসেজে তাকাল রানা। এখন আর ছাত নেই, মেঝেও নেই। ওটা এখন আর কোনও প্যাসেজই নয়!

উঠে বসল লাবনী, হাতে রয়ে গেছে জ্বলন্ত ফ্ল্যাশলাইট! কাঁধের ঝুলি থেকে আরেকটা নিয়ে এগিয়ে দিল রানার দিকে।

ফ্ল্যাশলাইটটা নিয়ে বাতি জ্বালল রানা।

ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে ওরা। চুপ করে বসে থাকল ভেজা পাথরের মেঝেতে। একটু দূরেই বড় এক পাথরের বোল্ডারে আঁকা ভয়ঙ্কর চেহারার শক্তিশালী এক ডাকাতনী। বড় বড় পা দিয়ে চ্যাপ্টা করছে পিঁপড়ে!

বুঝতে দেরি হলো না ওদের, এটা কোনও প্যাসেজ নয়। বড় কোনও ঘর। নতুন আরিত!

একটু দূরে ব্যারেলের মত মস্তবড় ধাতব দুই ফাটল ধরা রোলার। টুপ-টুপ করে ও-দুটো থেকে পড়ছে বানের পানির ফোঁটা। লেংচে লেংচে এখনও ঘুরছে রোলার।

ভূমিকম্পের জন্যে সম্ভবত নষ্ট হয়েছে ওসাইরিসের সমাধির কয়েকটা ফাঁদ। সময়ের আগেই ধসে গেছে প্যাসেজের মেঝে। যথেষ্ট স্রোত ওদেরকে আছড়ে ফেলতে পারেনি রোলারের ওপর, নইলে কিমা হয়ে যেত ওরা।

কেউ চোরের মত ঢুকলে পিষ্ট করবে শক্তিশালী মহিলা, বলল বেলা, কিন্তু আমরা ঢুকেছি আইনগতভাবেই। কিছুই করতে পারবে না পুরনো ওই দুই রোলার।

এত বড় পা-ওয়ালা কাউকে ভদ্রমহিলা বলতে পারব, বলল লাবনী।

ক্লান্তি ও ভারী ব্যাগের ওজনে পিঠ ভেঙে আসছে রানার। কাঁধে চোট পেয়েছে মেঝেতে গড়াবার সময়। শুকনো গলায় জানতে চাইল, তোমরা পরের আরিতের জন্যে রেডি তো?

বেলাকে দেখে নিয়ে বলল লাবনী, হ্যাঁ। কপাল ভাল। একইসময়ে পেরিয়ে গেছি দুটো ফাঁদ!

আরও তিনটে আছে, ঢোক গিলল বেলা।

পেছনে ফেলে এসেছি চারটে, সামনে কম, বলল রানা, তা হলে চলল, খুঁজতে যাই পরের আরিত।

উঠে রওনা হলো ওরা।

ঘর পেরোতেই সামনে পড়ল আবারও ঢালু প্যাসেজ।

হাঁটতে হাঁটতে বলল বেলা, নিচে কোথাও আছে বিকট শব্দের দেবী!

.

উল্টো পিরামিডের ওপরের ঘরে বাতাসে ওড়া বালি ছাড়া নড়ছে না কিছুই। মরুভূমির চারপাশ থমথমে নীরব। কিন্তু একটু পর উত্তর-পুর্ব থেকে এল হালকা একটা আওয়াজ।

বাড়তে লাগল ওই শব্দ।

দিগন্তে দেখা দিল ধূসর কিছু। তাপ বেশি বলে ঝলমল করছে দূরে মরীচিকা। পাক খেয়ে উড়ছে ধুলোর মেঘ। তবে বালিঝড় নয়। সে তুলনায় অনেক ছোট। সরাসরি আসছে পাথরের প্রাচীন কুটিরের দিকেই!

উড়ন্ত বালির মাঝে পাক খেয়ে উঠছে ধূসর-কালো কিছু। বাড়ছে ইঞ্জিনের চাপা আওয়াজ। সঁই-সাঁই করে ঘুরছে প্রচণ্ড বেগে প্রপেলার ব্লেড।

তবে ওটা কোনও এয়ারক্রাফ্ট নয়।

প্রকাণ্ড হোভারক্রাফট যুবর-ক্লাস অ্যাসল্ট ভেহিকেলের ব্রিজের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে নাদির মাকালানি। ওর বাহন সহজেই বহন করতে পারে ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য ভেহিকেল। চলতে পারে পৃথিবীর প্রায় সব কঠিন জমিতে। গ্রিক নেভি চারটে যুবর কিনলে তাদেরকে অনুকরণ করেছে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। ভূমধ্য এলাকার শত্রুদের ভয় দেখাতেই রাশানদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে প্রকাণ্ড দুই যুবর।

অফিশিয়াল সার্ভিসে যাওয়ার আগে এখনও ট্রায়ালে আছে ওগুলো। এখান থেকে ষাট মাইল দূরে নির্জন এলাকায় হচ্ছে ট্রায়াল। তবে, ব্রিজের দ্বিতীয় লোকটা এদিকের মরুভূমিতে নিয়ে এসেছে এই যুবরটাকে।

দারুণ জিনিস, জেনারেল খালিদ আসিরকে বলল নাদির মাকালানি। কাজ শেষ হলে হয়তো এই জিনিস ধার দেবে আমাদের কোনও মন্দিরের জন্যে! তবে জানি না, পার্ক করব কোথায়।

যেখানে খুশি রাখবে, দোস্ত! হাসল জেনারেল আসির। কেউ আপত্তি তুললেও চিন্তা নেই, এটার সঙ্গে আছে রকেট লঞ্চার আর গ্যাটলিং গান। নিচে ফোর ডেকের টারেট দেখাল সে। কারও দিকে ছয় ব্যারেলের কামান তাক করলে চট করে বুজে ফেলে মুখ।

মৃত্যুভয় সব সময়েই কাজে আসে, তাই না? পরস্পরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল নাদির মাকালানি ও জেনারেল খালিদ আসির। আর কয় মাইল, দোস্ত?

বড়জোর এক মাইল, স্যর, বলল পাইলট।

গুড। ব্রিজের পেছনের ওয়েপন্স রুমে ঢুকল নাদির। উঁচু গলায় বলল, সামনেই কোঅর্ডিনেট।

এই ঘরে আছে কয়েকজন যুবর ক্রু, কাদির ওসাইরিস, কিলিয়ান ভগলার, ডক্টর লুকমান বাবাফেমি এবং নাদিরের দলের নতুন এক সদস্য।

ডক্টর মেটয, আপনি শিয়োর তো ঠিক জায়গা খুঁজে পেয়েছেন? আর্কিওলজিস্টের কাছে জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস।

এর চেয়ে বেশি শিয়োর কখনও হইনি, তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে বলে বিরক্ত ম্যান মেটয। যোডিয়াকের উল্টো পিরামিড, নীল নদ, রুপার ক্যানিয়ন আর ওসেইরেনের অবস্থান, সবই বলে দিয়েছে। নিজের ল্যাপটপ দেখাল সে। ওটায় এক উইণ্ডোতে মরুভূমির স্যাটেলাইট ইমেজ, দূরত্বের লাইনের মার্কিং ও ডিরেকশন, অন্য উইণ্ডোতে আইএইচএর বিশাল ইজিপশিয়ান ডেটাবেস ও ওসেইরেনের ওসাইরিসের চোখের ইমেজ। হয় ওখানে থাকবে ওই পিরামিড, নয়তো কখনও কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে।

পাওয়া গেলেই আপনার ভাল, হুমকির সুরে বলল নাদির মাকালানি।

বিরক্তি আরও বাড়ল ম্যান মেটয-এর। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পয়সা নিলে নিজ কাজ ঠিকভাবেই করি। কাজেই দয়া করে হুমকি দিতে আসবেন না। কাদির ওসাইরিসের দিকে তাকাল সে। অবাক কাণ্ড, আজ থেকে মাত্র দুসপ্তাহ আগেও আমাকে কিনতে চাইলে, এককথায় উড়িয়ে দিতাম আপনার প্রস্তাব। …কিন্তু আজ? স্ফিংসের ওই দুর্ঘটনার পর আমিও চাই আমার প্রাপ্য বুঝে নিতে। চাপা রাগে বিকৃত হলো তার মুখ। দুনিয়ার সব দৈনিক পত্রিকায় ছাপার কথা ছিল আমার ছবি, কিন্তু তার বদলে ওখানে থাকল ডক্টর লাবনী আলম। আমাকে হাস্যকর বাঁদর বানিয়ে ছেড়েছে সে। এখন যথেষ্ট টাকা পেলে একটু কমবে আমার ক্ষতি।

ওয়েপন্স অফিসার ডাকতেই ঘরে ঢুকল খালিদ আসির। মনিটরে কী যেন দেখাল ওয়েপন্স অফিসার।

ভুরু উঁচু করল কাদির ওসাইরিস। ডক্টর মেট্য, আপনি লাবনী আলমের কথা তুললেন বলে একটু অবাকই লাগছে।

অবাক লাগছে কেন?

কারণ, আমার ভুল না হলে আবারও আপনাকে হারিয়ে দিয়েছে সে। আকাশের ড্রোন থেকে যুবরে আসছে ইমেজ। সিকি মাইল দূরে এক নালায় পড়ে আছে পুরনো এক তুবড়ে যাওয়া ল্যাণ্ড রোভার ডিফেণ্ডার।

ওদিকে হোভারক্রাফটের টার্গেটিং সিস্টেম দেখাচ্ছে পাথুরে দালানে কয়েকটা কোদাল। লোহার তৈরি যে-কোনও জিনিসের ওপর লক হয় ওয়েপেনারি কমপিউটারের কার্সার।

ও, আগেই পৌঁছে গেছে বেটি? মনিটরে চোখ রেখে রাগে লাল হলো ডক্টর মেটয।

তাকে দেখে বাকা হাসছে ভগলার।

প্রতিযোগী হলেও এখন কাজ করছে আমাদের জন্যেই, বলল কাদির, আশপাশে কেউ নেই। তার মানে, পিরামিডে ঢোকার পথ খুঁজে বের করেছে সে। কষ্ট করে একগাদা বুলডোর বা ডিগার আনতে হবে না!

ব্রিজে গিয়ে দাঁড়াল কাদির ওসাইরিস। পিছু নিয়ে ওই ঘরে ঢুকল নাদির মাকালানি ও ভগলার। সামনে বিছিয়ে আছে ফ্যাকাসে হলদে মরুভূমি। একটু দূরেই পাথরের কুটিরের মত দালান। পাঁচ শ টন হোভারক্রাফটের বেগ কমাল পাইলট। স্টার্নের ওপরে হ্রাস পেল ঘুরন্ত তিন বিশাল প্রপেলারের গতি।

আপনার লোক সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত? খালিদ আসিরের কাছে জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস। একবার সরকারের কানে এ বিষয়ে কিছু পৌঁছুলে…

খালিদের হয়ে তোমাকে কথা দিচ্ছি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল নাদির। আগেও আমার জীবন বাঁচিয়েছে ও।

আর আমার লোকের হয়ে শপথ করছি, বলল জেনারেল আসির। মাত্র কয়েকজনকে এনেছি। নিজে বেছে নিয়েছি তাদেরকে। বাঁকা হাসল সে। যথেষ্ট টাকা পাচ্ছে, কাজেই আপনার সবই গোপন রাখবে ওরা।

গুড। প্রাচীন কুটিরের দিকে ফিরল কাদির। শেষ কফুট এগিয়ে থামল যুবর। প্রকাণ্ড রাবারের কুশন চেপে বসল বালির ওপর। ভুস্ করে চারপাশে ছিটে গেল একরাশ বালি। বেশ, চলুন, ওসাইরিস আর ডক্টর লাবনী আলমকে খুঁজে বের করি।

.

২৪.

 বাপরে! গহ্বরে আলো তাক করে ওপরে ঘুটঘুটে কালো ছাড়া আর কিছুই দেখছে না লাবনী। এত উঁচু!

জানো, আছি কোথায়? দূরের দেয়ালে দুটো পাইপ দেখছে রানা। ওপরের সেতুর যন্ত্রপাতি কাজ করলে এতক্ষণে এই মেঝেতে থাকত আমাদের ফাটা লাশ। অন্তত দু শ ফুট ওপরে ওই সেতু।

মনের খাতায় পুরো পিরামিড এঁকে নেয়ার চেষ্টা করল লাবনী। সর্বনাশ! তা হলে তো এটা গ্রেট পিরামিডের সমান! বা আরও বড়!

ওই কারণেই পরে আর কোনও রাজা খুফুর পিরামিডের মত বড় কিছু তৈরি করতে চায়নি, চিন্তিত স্বরে বলল বেলা। কিন্তু ওই পিরামিড যদি ওসাইরিসেরটার সমানও হয়, অন্যরা হয়তো সাহসই পায়নি ওসাইরিসকে ছোট করার।

পাইপে মনোযোগ দিয়েছে রানা।

ওগুলো সংযুক্ত। একটা বেশ সরু। তবে গোড়ার কাছে মোটা, গিয়ে মিশেছে অনুভূমিক এক টে। ওপরে আঁকা মস্ত হাঁ করা এক মহিলার মুখ

চার্চের অর্গানের মত, বলল রানা, বাতাস কোনওভাবে ভেতরে পাঠালে শুরু হয় জোরালো আওয়াজ।

খুলে বলো কীভাবে কী হয়, বলল লাবনী।

অন্য টিউবে কিছু পড়লে তখন ওটা কাজ করে পিস্টনের মত। পাইপের কাছেই একটা প্যাসেজ। ধাতব গেট আছে। আপাতত বন্ধ। আমার ধারণা, ওই গেট খুললেই চালু হবে ফাঁদ। এই ঘর জুড়ে আরম্ভ হবে প্রচণ্ড আওয়াজ।

তো কী করা উচিত? চিন্তিত চেহারায় রানাকে দেখল লাবনী।

গেটের দিকে চলল রানা।

সাবধান, রানা! সতর্ক করল লাবনী।

গেট খুলছি না। তবে চাই ট্রিগার করতে যন্ত্রটা।

কিন্তু গেট না খুললে… শুরু করেছিল বেলা…

কিন্তু রানার পায়ের নিচে চাপ খেয়ে ডেবে গেল এক স্ল্যাব।

সর্বনাশ, ফ্যাকাসে চেহারায় রানাকে দেখল লাবনী।

জলদি অন্য প্যাসেজে ঢোকো! ফিরতি পথে পা বাড়াল রানা। ওর দেখাদেখি লাবনী ও বেলা।

কিন্তু প্রথম প্যাসেজের মুখে সড়াৎ করে নেমে এল দ্বিতীয় গেট। দেখতে জেলের শিকের তৈরি দরজার মত। ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেছে বেলা। শুরু হয়েছে গভীর ও বিষণ্ণ এক চাপা আওয়াজ। খুব দ্রুত বাড়তে লাগল ওটা।

একটু দূরে যেন চালু হয়েছে জেট ইঞ্জিন।

স্লট থেকে বেরোল দমকা হাওয়া। দীর্ঘ পাইপে বাড়ি খেয়ে বাড়ছে আওয়াজ। যেন থরথর করে কাঁপছে গোটা ঘর। মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠছে ধুলোবালি। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে রঙ ও প্লাস্টার।

মানসিক ও শারীরিক কষ্টে পড়েছে রানা, লাবনী ও বেলা। ফুঁপিয়ে উঠল লাবনী, হায়, আল্লা! আর সহ্য করতে পারছি না! কেমন যেন করছে ওর বুক। সেই সঙ্গে বমি-বমি ভাব। বুম! বুম! শব্দে কাঁপছে সারাশরীর। দুহাতে গেটের নিচের শিক ধরে প্রাণপণে ওপরে তুলতে চাইল। কিন্তু উঠল না ভারী গেট।

ওদিকের গেটের সামনে পৌঁছে গেছে রানা। ওর পক্ষেও সম্ভব হলো না শিকের দরজা তোলা। পাইপের দিকে ঘুরে তাকাল। চিৎকার করে বলল, স্লটে কিছু গুঁজে দিতে হবে!

বজ্রপাতের মত বিকট শব্দের মাঝে রানার কথা প্রায় শুনতেই পায়নি লাবনী। অবশ্য, বুঝেছে কী করতে হবে। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে মেঝেতে ফেলল ভেতরের সব। বেছে নিল নাইলনের দীর্ঘ দড়ি। ওটা দিয়ে তৈরি করছে বল। একই কাজ করল বেলা। ওদিকে পাইপের সামনে পৌঁছেছে রানা। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে কুঁচকে গেছে চেহারা। নিজের ব্যাগ থেকে জ্যাকেট নিয়ে বল তৈরি করে খুঁজে দিল সুটে। বাতাস বেরোবার পথ আটকে যাওয়ায় আরও তীক্ষ্ণ হয়ে সামান্য পাল্টে গেল আওয়াজের তীব্রতা।

থরথর করে কাঁপছে পাথুরে মেঝে। টলতে টলতে রানার কাছে পৌঁছুল লাবনী ও বেলা। ওদের বাড়িয়ে দেয়া নাইলনের বল নিয়ে স্লটে ঠাসল রানা।

হাত থেকে ফ্ল্যাশলাইট ফেলে দুহাতে কান চেপে ধরল লাবনী। অন্যরাও আছে মস্ত বিপদে। কান চেপে ধরলেও রক্ষা নেই। বুকে ঢুকে যেন সব ছিঁড়ে ফেলছে ভয়ঙ্কর আওয়াজ।

কাঁপছে পিরামিড। ওপরের বিশাল গহ্বর থেকে ঝরঝর করে ঝরছে চুন-সুরকি। নিচের মেঝেতে ঠুস্-ঠাস-ধুম শব্দে পড়ছে ছোট-বড় পাথর! প্যাসেজের দেয়ালে তৈরি হচ্ছে ফাটল। এই বিকট আওয়াজ না থামলে মস্তবড় ক্ষতি হবে ওসাইরিসের পিরামিডের।

দড়ির বল ও জ্যাকেটের গোলা স্লটে আরও ঠেসে দিল রানা, কানের ব্যথায় খিঁচিয়ে গেছে মুখ। ওপরের দিকে বন্ধ করা পাইপ অর্গ্যান। বাতাস শুধু বেরোচ্ছে স্লটের মাধ্যমে। এখন কোনওভাবে তীব্র বাতাস ঠেকাতে পারলে…

একটু একটু কমছে কম্পনের মারাত্মক রণন। রানা বুঝে গেছে, প্রাণে বাঁচতে হলে দড়ির বল ও জ্যাকেটের গোলা আরও ঠেসে রাখতে হবে। বাতাস ফুরালে থামবে বিপজ্জনক মেশিনের গর্জন।

তিরতির করে কাঁপছে পাইপ। ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করছে ভেতরের বাতাস। অর্গ্যানের মুখে জেহ্যামারের মত প্রচণ্ড বাড়ি দিল কমপ্রেসড় বাতাস। স্লট থেকে ছিটকে বেরোল গুঁজে রাখা কাপড় ও দড়ি। ওগুলোর ধাক্কা খেয়ে পেছনের মেঝেতে পড়ে চিতপাত হলো রানা। প্রকাণ্ড দানবের বিশ্রী কাশির মত বিকটভাবে খুক করে উঠল অর্গ্যান। এত ভয়ানক ভারী শব্দ আগে জীবনেও শোনেনি রানা। ওকে কোলে নিয়ে হরিকম্প করছে মেঝে। নতুন উদ্যমে চলল ভীষণ গম্ভীর হুঙ্কার। দেয়াল থেকে পড়ছে প্লাস্টার, ফেটে যাচ্ছে মেঝে।

লাবনী ও বেলাকে মেঝেতে কুঁকড়ে থাকতে দেখল রানা। নিজে ধড়মড় করে উঠে কুড়িয়ে নিল ফ্ল্যাশলাইট। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। পাইপের নিচের অংশে ফেলল আলো। সুট আটকে কাজ হয়নি, কিন্তু নিশ্চয়ই কোনও উপায় আছে এই ইস্রাফিলের শিঙা বন্ধ করার!

কানের কনকনে ব্যথা সহ্য করেও বিড়বিড় করল রানা, তুমি হয়েছ মিউযিক ইন্সট্রুমেন্টের কারিগর? পরক্ষণে ভাবতে লাগল, কীভাবে তৈরি করা যায় অর্গ্যান।

দুই পাইপের একটায় আছে পিস্টন। ওটা পড়তে শুরু করলে চাপ খেয়ে নিচে ছুটবে বাতাস। কিন্তু বেরোবার পথ সংকীর্ণ, তাই পিস্টনের পতনের গতি কমিয়ে দেবে বাতাস। ওদিকে অর্গ্যান পাইপের নিচে বালিঘড়ি আকৃতির চিমটা আরও কমিয়ে দেবে বাতাস বেরোবার পথ।

তৈরির নিয়মটা মনে পড়তেই রানা বুঝল, কী করতে হবে ওকে। হামাগুড়ি দিয়ে গেল ব্যাগের কাছে। বের করে নিল হাতুড়ি। আবার ফিরল তীব্র অথচ ভারী আওয়াজের অর্গ্যানের কাছে। জানে, চিৎকার করলেও নিজের কানেই পৌঁছাবে না তা।

একদিকের দেয়ালে চড়চড় করে ধরল ফাটল। ঝরঝর করে ঝরল চুন-সুরকি ও পাথরের চল্টা।

পরক্ষণে অর্গানের পাইপে হাতুড়ি নামাল রানা।

ধাতুর জিনিসটায় তৈরি হলো সামান্য ফাটল।

 স্লট থেকে এল করুণ এক তীক্ষ্ণ, প্রলম্বিত আর্তনাদ।

আবারও পাইপে হাতুড়ি নামাল রানা।

আবারও!

এবার বড় ফাটল ধরল পাইপে।

বড় ঢেকুর তোলার শব্দে ভু-ভু করে বেরোচ্ছে। বাতাস। দ্রুত কমতে লাগল গম্ভীর আওয়াজ।

ঝনঝন করছে মাথা, মেঝেতে বসে পড়ল রানা। এখনও চলছে জেট ইঞ্জিনের আওয়াজ। কিন্তু অন্যরকম আওয়াজও পেল।

খটাং-খটাং-খটাং!

বাড়ছে ওই শব্দ। আসছে ওর দিকেই!

ভয় পেয়ে একপাশে ডাইভ দিল রানা। পরক্ষণে যেখানে ছিল, সেজায়গার ওপর দিয়ে উড়ে গেল পাইপের ভাঙাচোরা, ধারালো অসংখ্য টুকরো। পাইপে আছে খুব ভারী, তীব্রগতি কিছু, ওটা ধুম করে মেঝেতে পড়ে তৈরি করল ছোটখাটো এক শুকনো পুকুর।

পিস্টন!

বাতাস বেরিয়ে যেতেই ওটাকে ঠেকাবার কিছুই ছিল না। তুমুল বেগে নেমে এসেছে মাধ্যাকর্ষণের টানে।

তবে ওই মহা পতনের পাঁচ সেকেণ্ড পর আপত্তিকর ছোট তিনটে পুট-পুট-ফ্যাড়াৎ শব্দে চিরকালের জন্যে চুপ মেরে গেল দেবতা-রাজা ওসাইরিসের প্রলয়ঙ্করী অর্গান!

মেঝেতে উঠে বসল রানা। ফুট পাঁচেক দূরে লাবনী ও বেলা। ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখে কেমন এক লজ্জা।

সবার আগে মুখ খুলল লাবনী, কানে কিছু শুনছ, রানা বা বেলা?

কান ঝনঝন করছে, কিন্তু শুনছি, বলল বেলা।

 উঠে বসেছে ওরা দুজন।

 রানা? আবারও বলল লাবনী।

 হু। ফ্ল্যাশলাইট কুড়িয়ে নিল রানা। তোমরা সুস্থ?

নীরবে মাথা দোলাল লাবনী ও বেলা।

উঠে ওদিকের গেটের সামনে গেল রানা। চেষ্টা করল শিকের গরাদে ওপরে তুলতে।

ভারী!

তবে এবার উঠছে।

গেট রেখে আবার ফিরল রানা।

নীরবে যে যার ব্যাগে ভরল দরকারি জিনিসপত্র। ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে ফিরল গেটের সামনে।

রানা গেট ওপরে তুলতে ওদিকে চলে গেল লাবনী ও বেলা। ওরা দুজন মিলে তুলে রাখল গেট। এ সুযোগে ওদের পাশে পৌঁছে গেল রানা। ওরা গেট ছেড়ে দিতেই জোরালো ঠং! শব্দে মেঝেতে পড়ল ওটা।

পেছনের ধ্বংসস্তূপ দেখল রানা। পাঁচটা গেছে, এখনও বাকি দুটো ফাঁদ।

পরের দুটোর নাম বেশি ভয়ঙ্কর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল বেলা। ওপরের দেয়ালে লেখা: বিকট আওয়াজের দেবী ছেড়ে দিলে গিয়ে পড়বে রক্ত-মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের পরীক্ষায়। ওটা পেরোলেও রক্ষা নেই, ওসাইরিসের কাছে যাওয়ার আগে সামনে পড়বে মাথা-কাটা যন্ত্র।

ওগুলোও পেরোব, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলল লাবনী। মনে মনে বলল, মরতেও ভয় পাই না। পাশে রানা আছে

ওই দুই যন্ত্র পেরোলেই পাব ওসাইরিসের দেখা, বলল বেলা।

রানার সঙ্গে পরের প্যাসেজে পা বাড়াল ওরা।

.

ওসাইরিসের পিরামিডে রানারা যে স্তরে আছে, তা থেকে কমপক্ষে দু শ ফুট ওপরে কম্পিত মহিলার কক্ষে নেমেছে কাদির ওসাইরিস। বিশাল অর্গানের পাইপের তৈরি ভয়ঙ্কর শব্দে বাতাসে ভাসছে মিহি ধুলো।

বুঝতে পারছি কোথা থেকে আসছে ওই আওয়াজ, মস্তবড় কূপে ফ্ল্যাশলাইটের আলো পাঠাল কাদির ওসাইরিস। তার পিছু নিয়ে গহ্বরের কিনারায় থামল দলের অন্যরা। কারও কারও পরনে মিলিটারির পোশাক, ওয়েবিঙে নানা ইকুইপমেন্ট ও অস্ত্র-গোলাবারুদ। কিন্তু সৈনিক নয় তারা। অবশ্য, কৌতূহল মেটাতে কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে এসেছে জেনারেল আসির। তার দলের লোক বাইরে অপেক্ষা করছে হোভারক্রাফটে। পিরামিডে যে দল নেমেছে, তারা ওসাইরিয়ান টেম্পলের সদস্য। নাদির মাকালানির ব্যক্তিগত সিকিউরিটি ফোর্স।

বহু নিচের আঁধার দেখল নাদির। কোনও ফাঁদ। ওটা ট্রিগার করেছে রানা, ডক্টর আলম বা ওই মেয়ে। অশুভ হাসল সে। আমার মন দুভাগে ভাগ করা, বুঝলে, বড়ভাই? দারুণ হতো না, ওরা ফাঁদে পড়ে মরল, আর নিরাপদে ওই জায়গা পেরিয়ে গেলাম আমরা? আবার মন চাইছে, বেঁচে থাকুক ওরা। যাতে নিজ হাতে ওদেরকে খুন করতে পারি।

বড় কথা, ওরা যেন এখান থেকে বেরোতে না পারে, বলল কাদির ওসাইরিস। ঘুরে দেখল ডক্টর ম্যান মেট্যকে। এই ঘর দেখে কী বুঝছেন?

এই ঘরের হায়ারোগ্লিফিক্স অনুযায়ী, প্রতিটি আরিতে আছে বুবি ট্র্যাপ। দাঁতওয়ালা বড় এক চাকা দেখাল মেট। আমার ভুল না হলে ওটাই বোধহয় কম্পিত মহিলা। ওরা পেরোবার সময় চালু হয়ে গিয়েছিল ওটা। তবে মরেনি ওরা।

তার মানে নিচেও পড়েনি? দুঃখের সুরে জানতে চাইল ডক্টর লুকমান বাবাফেমি।

আওয়াজ শুনছেন? ওটা প্রচণ্ড আওয়াজের দেবীর হুঙ্কার! তার মানে পঞ্চম স্তর। অন্তত ওই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তারা।

অর্থাৎ, ওই পর্যন্ত বিপদ হবে না আমাদের, বলল কাদির ওসাইরিস। পা রাখল সেতুর ওপর।

আপনি ঠিক জানেন, বিপদ হবে না তো? কাঁপা গলায় বলল বাবাফেমি।

আরেক পা এগোল কাদির। নড়ল না সেতু। নষ্ট করা হয়েছে ফাঁদ, বা বিকল ছিল।

সামনে বাড়ো, কাদির, বলল নাদির মাকালানি। তার ভাই সেতু পেরিয়ে যেতেই অন্যদেরকে পার হতে ইশারা করল। সামনে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা পড়লে ভয়ের কিছু নেই। দরকারি সব ইকুইপমেন্ট সঙ্গে নিয়েছি আমরা।

খড়খড় আওয়াজ তুলল দাঁতওয়ালা দুই চাকা। একটু সরে গেল পাথরের একটা টুকরো। খেয়াল করল না কেউ।

সামনে কারুকাজ করা পিলার দেখেই রানা বুঝল, ওরা পৌঁছে গেছে ষষ্ঠ আরিতে। লাবনী-বেলা, আমরা এখন আছি রক্ত মাংস ছিটকে দেয়া ভয়ঙ্কর যন্ত্রের সামনে। সতর্ক হয়ে পেছনে আসবে।

প্যাসেজে আলো ফেলল রানা ও লাবনী। এই প্যাসেজ সমতল। দুপাশের দেয়ালে ভয়ঙ্কর অশুভ চেহারার সর প্রাচীন দেবতা, যেন প্রতিযোগিতা করছে নিজেদের ভেতর কে বেশি ভয় দেখাতে পারে। বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, একবার ভুল হলে উপায় নেই বাঁচার। তবে নতুন অন্যকিছুও আছে। প্যাসেজে।

ওটাও খুব অশুভ।

দেয়ালের নানান উচ্চতায় অনুভূমিক সব সুট। ওপরের দিকে এবং নিচে জং-ধরা লালচে লোহার পাত।

কাছের স্লটে আলো ফেলল রানা। ভেতরে দীর্ঘ ধাতব কিছু। একমাথায় কবজা, আরেকদিক ক্ষুরের ফলার মত ধারালো। এসব গর্তে আছে নানান অস্ত্র। প্যাসেজ ধরে হাঁটলেই স্লট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গাঁথবে শরীরে।

জং-ধরা, বলল বেলা। হয়তো কাজ করবে না।

ঝুঁকি নিতে চাও? কড়া চোখে বেলাকে দেখল লাবনী। এসব সুট দৈর্ঘ্যে প্যাসেজের সমান। এদিক ওদিক সরে বাঁচার উপায় নেই। পার হব কীভাবে? রানার দিকে তাকাল

ব্যাকপ্যাক নামিয়ে ওটা থেকে এক খণ্ড কাঠের টুকরো নিল রানা। হাত বাড়িয়ে ওটা দিয়ে টোকা দিল মেঝেতে। রানা আহত হবে ভেবে ভয়ে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে লাবনী। এই বুঝি হাতে বিঁধল ধারালো কিছু!

কিন্তু কিছুই ঘটল না।

প্যাসেজের মুখে থেমে আবারও কাঠের টুকরো ঠুকল রানা। না, ট্রিগার আছে আরও দূরে। উঠে দাঁড়াল ও।

তার মানে মাঝে গেলেই, তখন… ঢোক গিলল বেলা।

প্যাসেজের শেষমাথা চল্লিশ ফুট দূরে। তাতেই শেষ। হয়নি প্যাসেজ। বাঁক ঘুরে চলে গেছে আরেক দিকে।

এসব অস্ত্র ট্রিগার না করে প্যাসেজ পেরোবার উপায় আছে? বলল লাবনী।

কাঠের টুকরো হাতে বলল রানা, দেখা যাক উপায় আছে কি না। প্যাসেজে কয়েক ফুট দূরের মেঝেতে কাঠের টুকরো ছুঁড়ল ও। আগের জায়গায় রয়ে গেল সব ফলা। আশা করি, অন্তত ওই পর্যন্ত আমরা নিরাপদ। কপা সামনে বাড়ল রানা।

আন্দাজে কিছু কোরো না, ভয়ে কাঁপছে আমার বুক, নালিশের সুরে বলল লাবনী।

এবার ব্যাকপ্যাক থেকে ভারী এক হাতুড়ি নিল রানা।

এবার কী? বলল লাবনী। একটু করে এগোবে আর কিছু না কিছু সামনে ফেলবে? কিন্তু বুঝবে কী করে, কোটা আসলে ট্রিগার? তারপর হঠাৎ করে… হাত দিয়ে গলা কেটে ফেলার ভঙ্গি করল ও।

তো তুমিই বলো কী করা উচিত? ভুরু নাচাল রানা। কথা বলে প্যাসেজ পেরোতে পারবে না।

আমরা হেঁটে যাব না, হঠাৎ করে বলল বেলা। মন দিয়ে দেখছে হায়ারোগ্লিফিক্স। দৌড়াতে হবে মুরগি-চোর শেয়ালের মত! লিখেছে, প্যাসেজ ধরে হেঁটে গেলে মরবে ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়ে। শেষ লাইনে লেখা: দৌড়াও ওসাইরিসের সঙ্গে দেখা করতে!।

সূত্র দিয়েছে? অবাক সুরে বলল লাবনী, আগের কোনও আরিতে তো এমন কিছু ছিল না!

মাত্র ক লাইন, মোটা কালিতে লেখা অক্ষর দেখাল বেলা। নামার সময় সব দেখতে দেখতে এসেছি। কিন্তু হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে দরকারি হায়ারোগ্লিফিক্স। সূত্র ছিল। এবারেরটা তো পরিষ্কার দেখছি চোখের সামনে।

তো প্রাণপণে দৌড়াতে হবে, আবারও প্যাসেজে আলো ফেলল রানা। ঝুঁকি আছে। অবশ্য, এ ছাড়া উপায়ও নেই। ওদিকে বাঁক নেয়ার পর কী আছে, তা জানো, বেলা?

সম্ভবত ওদিকে আছে মাথা-কাটা যন্ত্র, শিউরে উঠল বেলা। কচু করে কেটে নেবে আপনার কল্লাটা, তারপর…

আমার মাথা নিয়ে এত ভাবতে হবে না, বিরস সুরে বলল রানা। ব্যাকপ্যাকে রেখে দিল ভারী হাতুড়ি। তা হলে হরিণের মত দৌড়াব আমরা, ঠিক আছে?

হ্যাঁ, সায় দিল বেলা।

 হু, বলল বিমর্ষ লাবনী, আর মরে গেলে পরজগতে গিয়ে লাথি মেরে ফাটিয়ে দেব বেলার নরম পাছা।

অলিম্পিকের দৌড়বিদের ভঙ্গিতে তৈরি হয়ে গেল রানা। বেলা? লাবনী? রেডি?

মাথা দোলাল লাবনী ও বেলা।

 ঠিক আছে, ওয়ান, টু… থ্রি!

প্যাসেজে পাশাপাশি উড়ে চলল ওরা।

নড়ল না বা সামনে বাড়ল না একটা ফলাও।

প্যাসেজের দূরে গিয়ে পড়ল রানার হাতের ফ্ল্যাশলাইটের আলো। ওদের জুতোর নিচে মেঝে থেকে উঠছে ঠ-ঠপ ফাপা আওয়াজ।

দশ ফুট পেরিয়ে গেল ওরা।

বিশ।

প্রতিধ্বনি তুলছে পদধ্বনি।

 পেরোল ওরা ত্রিশ ফুট।

ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে বাঁক…

লাবনীর পায়ের নিচে কড়মড় করে উঠল ধুলোভরা একটা ব্লক। আত্মা কেঁপে গেল ওর। দৌড়ে চলেছে। দেয়ালের সুট থেকে এল না কোনও অস্ত্র।

তবে পেছনে হলো বিদঘুটে এক আওয়াজ।

কাঁচকোঁচ শব্দে ঘুরছে কোনও মেশিন।

খট-খট করে পড়ল ধাতুর ওপর ধাতু।

 চলছে বোধহয় কাউন্ট ডাউন!

আরও জোরে! বাঁকের খুব কাছে পৌঁছে গেছে রানা। প্রায় একইসময়ে বাঁক ঘুরল ওরা। থমকে গিয়ে ঘুরে পেছনে তাকাল রানা।

তীরধনুকের ছিলা টেনে ছেড়ে দেয়ার আওয়াজ হলো: সক্ল্যাং!

প্যাসেজের শুরুর স্লট থেকে ছিটকে বেরোল জং-ভরা ধারালো বর্শার সব ফলা। সামনে বেড়ে ঝুলে গেল কয়েকটা তলোয়ার। বর্শাগুলো ঠং-ঠং করে লাগল ওদিকের দেয়ালে।

হাজারো বছরে কমেছে দক্ষ কারিগরের তৈরি মরণ ফাঁদের কার্যকারিতা, ভাবছে রানা। তবুও প্যাসেজে কেউ থাকলে খুন হতো!

কিন্তু কে বলেছে নষ্ট হয়েছে ফাঁদের কার্যকারিতা?

লাবনী-বেলা! শুকনো গলায় তাড়া দিল রানা। নিজে ছুট দিয়েছে সামনের প্যাসেজ ধরে। পেছনে এল মেয়েদুটো। প্যাসেজের এদিকেও আছে ওই একই মারাত্মক সুট!

কানের কাছে ঠং-ঠং শুনল ওরা। ভেবেছিল বাঁক নিলেই আগের প্যাসেজ শেষ। তা নয়! খেয়াল করেনি সামনে নতুন আরিতের কারুকাজ করা পিলার নেই।

তীরের মত ছুটে প্যাসেজে আরেকবার বাঁক ঘুরেই রানা বুঝল, নতুন এ প্যাসেজেই আছে মাথা-কাটা যন্ত্র!

তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় পড়েছে ওরা!

প্যাসেজে আরিতের কারুকাজ করা পিলার। একটু দূরে দুদেয়ালে চকচকে কী যেন!

গলার উচ্চতায় মুখোমুখি দুটো সুট!

রানা বুঝে গেল, দেয়ালের ওই দুই অংশে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ওদের গর্দান নেয়ার!

পেছনের প্যাসেজের ধারালো বর্শা ও তলোয়ারের খপ্পর থেকে বাঁচতে প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে, পেরিয়ে গেছে নতুন আরিতের পিলার!

নিজেদেরকে রক্ষা করতে মহা দুষ্ট জিনের মত লাবনী ও বেলার কাঁধে চাপল রানা। মেঝে থেকে তুলে নিয়েছে পা। ভারী ওজন চেপে বসতেই হুমড়ি খেল বেলা। একইসময়ে লাবনীকে নিয়ে মেঝেতে পড়ল রানা। একটু দূরেই সপ্ত আরিত শেষ। ওদের ওপর দিয়ে সাঁই করে গেল ঘুরন্ত দুই ধারালো ধাতব ডিস্ক। বারবার খটাং-খটাং আওয়াজে লাগছে চারপাশের দেয়ালে। যে-কোনও সময়ে কেটে বসবে ওদের শরীরে।

মুখ গুঁজে পড়ে থাকল ওরা। আরও বেশ কবার ওদের ওপর দিয়ে গেল দুই ডিস্ক, তারপর সামনের দেয়ালে লেগে পড়ল প্যাসেজের পাশে। এখনও ঘুরছে বনবন করে।

শয়তান মিশরীয় পিশাচ! ভয়ে কেঁদে ফেলেছে লাবনী। খুনি… ইবলিশ… হারামজাদা…

গালির স্টক শেষ হওয়ার আগে নিজের কাছে কিছু রাখো, উপদেশ দিল রানা। মেঝে ছেড়ে উঠে গেল পেছনের এক স্লটের সামনে। ভেবেছিল সহজে পাবে না তলোয়ার, কিন্তু টান দেয়ায় বেরিয়ে এল স্লট থেকে। হাজার হাজার বছরের জং-ধরা কবজা খতম করে দিয়েছে মেকানিযম। বেরোবার সময় কোনও সমস্যা হবে না।

জিতে গেছি! দৌড়ে আসায় এখনও হাঁফাচ্ছে বেলা। এটাই শেষ বুবি ট্র্যাপ! রানার দিকে তাকাল অনিশ্চিত চোখে। ঠিক বলছি তো?

আমি কী জানি! হেসে বলল রানা, হায়ারোগ্লিফিক্স পড়েছ তুমি, আমি তো নই।

হায়ারোগ্লিফিক্স অনুযায়ী আর কোনও ফাঁদ নেই, বলল লাবনী। তবুও ভীষণ সতর্ক। দেখছে চারপাশ। উঠে দাঁড়াল।

তা হলে চলো, একটু দূরের বাঁক দেখাল রানা।

 নতুন করে এগিয়ে চলল ওরা।

মোড় ঘুরে পেল নিচে যাওয়ার ঢালু প্যাসেজ। অবশ্য, মাত্র দশফুট যেতেই পড়ল আবারও কারুকাজ করা পিলার।

আরিতের পিলার নয় ওগুলো।

অন্য কিছু।

সোনার তৈরি! জটিল কারুকাজ করা!

 ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঝিকঝিক করছে সোনা।

নিরেট সোনার পিলার, বলল লাবনী, আগে কখনও এ জিনিস দেখিনি!

হাঁ হয়ে গেছে বেলা। কসেকেণ্ড পর বলল, বলুন তো, কত টাকার গহনা বানানো যাবে?

চুপ! চোখ পাকিয়ে ধমক দিল লাবনী। গহনা? কীসের গহনা! এসব হচ্ছে দুনিয়ার সেরা দামি আর্টিফ্যাক্ট!

দুটো করে পিলারের মাঝে একটা করে মিশরীয় দেবতার মূর্তি। তা-ও সোনার তৈরি। ওপরের প্যাসেজে যেসর ভয়ঙ্কর চেহারার দেবতা দেখেছে ওরা, এরা তেমন নয়। একটু দূরেই উঁচু হেডড্রেস পরা দুই দীর্ঘদেহী মামি, কাপড়ে পেঁচিয়ে রাখা। দুহাতে কী যেন অস্ত্র, চিনল না ওরা। মুখে মুখোশ নেই, পুরনো তামার মতই সবজেটে ত্বক। দেহের এখানে ওখানে ঝুলছে সোনা ও রুপার পাতা।

এবং…

দুপাশের দুই মামির পেছনে অন্ধকার বড় এক চেম্বারে রাজসিংহাসনে বসে আছে সোনায় গড়া ওসাইরিস!

ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওরা দেখল, ঘরে ঝিকমিক করছে দেয়ালের তাকে তাকে থরে থরে উঁচু করে রাখা সাত রাজার ধন!

মস্তবড় ঘরের মাঝখানে রুপালি এক সারকোফাগাস!

হয়তো আছে আরও ফাঁদ, তাই সতর্কতার সঙ্গে এগোল ওরা। তবে নতুন কোনও বিপদ হলো না।

সত্যিই ওরা পৌঁছে গেছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

বুজে যাওয়া কণ্ঠে বলল লাবনী, পেয়ে গেছি, এটাই ওসাইরিসের সমাধি!

.

২৫.

 ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঝিকমিক করছে ওসাইরিসের সোনা-রুপার আর্টিফ্যাক্ট ও ধনদৌলত। সোনা ও রুপার মূর্তি যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সাধারণ কাঠের চেয়ার। একপাশে বেশকিছু বাণ্ডিল করা খাড়া বর্শার ডগায় ভাসছে প্রমাণ সাইযের এক নৌকা। সামনে বসে আছে। ওসাইরিস, মুখে সোনা-রুপায় গড়া মুখোশ। এর কাছে কিছুই নয় তুতেনখামেনের সমাধি। তাতে অবাক হওয়ার কোনও কারণও নেই। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে নতুন রাজ্যের অখ্যাত রাজা ছিল সে, সে-তুলনায় মিশরের প্রাচীন সভ্যতায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে বহুগুণ শক্তিশালী ও বিখ্যাত দেবতা-রাজা ছিল ওসাইরিস।

কফিন দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। সামনে গিয়ে থামল রানা, লাবনী ও বেলা। ঢাকনির ওপরে ওসাইরিসের রুপালি মুখ। সুর্মা চর্চিত শান্ত চোখ দেখছে ছাত।

এই কফিন যে তৈরি করেছে, তার কারুনৈপুণ্যের তুলনা নেই, নিচু গলায় বলল লাবনী, সবই নিখুঁত। চারপাশের আর্টিফ্যাক্ট দেখাল। ভাবিনি পুরনো সাম্রাজ্যের আগেও এত আধুনিক ছিল মিশরীয় শিল্প।

আটলান্টিসের সভ্যতার মত, বলল বেলা, আধুনিক, অথচ কেউ জানত ওটার কথা? তারপর ওই সভ্যতা আবিষ্কার করলেন আপনি!

রানা আর আমি মিলে আবঞ্চার করোছ, মৃত মনে পড়তে মৃদু হাসল লাবনী। আর এবারের এই আবিষ্কারের জন্যে আমাদের সঙ্গে সমান প্রশংসা পাবে তুমিও।

খুশিতে ঝলমল করে উঠল বেলার মুখ। সি গ্রেড পাওয়া ছাত্রী খুব খারাপ করেনি, তাই না?

কাছেই রঙিন কিছু রুক্ষ চেহারার কাঠের মূর্তি। তারা চাকর। মৃত্যুর পর রাজার যাবতীয় কাজ করে দেবে। চোখের জায়গায় লালচে পাথর।

সারকোফাগাসের একপ্রান্তে থামল রানা। ওসাইরিসকে তো পেলাম, এবার কী করতে চাও, লাবনী?

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগে ফোটো তুলতাম, তারপর ক্যাটালগ করতাম। এরপর আসত সব পরীক্ষা করার পালা। কাঁধ ঝাঁকাল লাবনী। কিন্তু বিপদের ভয় আছে। বলেই প্রথমে চাই এই সমাধি নিরাপদ রাখতে। প্রথম সুযোগে যোগাযোগ করব এসসিএ-তে ডক্টর হামদির সঙ্গে। তিনিই স্থির করুন কী করা যায়।

দেখেছি, পাথরের পিরামিডের এত গভীরে ফোনের সিগনাল নেই, জানাল রানা।

ওসাইরিসের পাউরুটির কী হবে? জানতে চাইল বেলা।

খাবারের অবশিষ্ট খুঁজছে রানার চোখ। কাঠের ছোট এক গোল টেবিলে ধুলোর মত কী যেন। হয়তো পাউরুটিই ছিল একসময়। মনে হয় না ওখান থেকে পাওয়া যাবে ইস্ট। কফিনের নিচে দশ ইঞ্চি গভীর এক তাক চোখে পড়ল ওর। ভেতরে ক্যানোপিক জার। মামিফিকেশনের সময় মৃতদেহের দরকারি অর্গান রাখত। কাদির ওসাইরিস ভেবেছে, ইস্টের স্পোর পাবে ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে।

লাবনীর পাশে আরেকটা জার দেখেছে বেলা। কফিনের মাথার দিকে পেল তৃতীয় জার। এখানেও একটা আছে। অন্যটা থাকবে পায়ের কাছের মেঝেতে। দেখে নিয়ে মাথা দোলাল রানা। বলে চলেছে বেলা: প্রতিটি জার কমপাসের পয়েন্ট অনুযায়ী রাখা। এদিকেরটা বাঁদরের মাথার মত। বেবুন। সে দেবতা হ্যাপি। অর্থাৎ, এটার ভেতরে আছে ওসাইরিসের ফুসফুস। জার তুলে নিতে গিয়ে বেলার মনে পড়ল, ভেতরে কী আছে। নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। উফ্, কী ভয়ঙ্কর!

এই জারে কী? জানতে চাইল লাবনী।

হ্যাপি থাকে উত্তরদিকে… কমপাস ডিরেকশন বুঝে নিল বেলা। তা হলে আপনার কাছেরটা শেয়ালের জার। ডুয়ামুটেফ দেবতা।

জারের ওপর আলো ফেলল লাবনী। ওটার মাথার ওপর লম্বা কানওয়ালা এক শেয়াল। হুম, ঠিক আছে।

ওটার ভেতরে আছে পেটের মালপত্র। উল্টোদিকে আছে এক বাজপাখি। কুয়েবেহূসেনুফ। অথবা কুয়েবেসুনেফ। স্বরবর্ণের অভাবে মিশরীয় ভাষার এই হাল। যাই হোক, ওটার ভেতর আছে ইনটেস্টাইন।

বাহু, বলল রানা। জার ভরা নাড়িভুড়ি।

ওসাইরিসের পায়ের দিকে দক্ষিণের জার মানুষ-দেবতা ইমসেটির। ওই জারের ভেতর আছে ওসাইরিসের যকৃৎ।

রানার দিকে তাকাল লাবনী। কাদির ওসাইরিস চাইছে এসব জার। এই অবস্থায় আমাদের কী করা উচিত?

পিরামিড থেকে বেরিয়েই ফোন দেব ডক্টর হামদির কাছে, বলল রানা।

উচিত হবে না, কক্ষের দরজা থেকে বলল কে যেন।

ঝট করে ঘুরে তাকাল রানা। চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠেছে বেলা। হাঁ হয়ে গেছে লাবনী।

ওসাইরিসের বড় এক মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছে কাদির ওসাইরিস। পাশেই নাদির মাকালানি। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। কাভার করছে রানাকে।

সামনে বাড়ল কাদির ওসাইরিস। কামরার ভেতরে ঢুকল বেশ কয়েকজন। তাদের ভেতর আছে কিলিয়ান ভগলার ও লুকমান বাবাফেমি। জ্বেলে নেয়া হলো শক্তিশালী বাতি। পরিষ্কার দেখা গেল চারপাশ।

যা ভেবেছি, তার চেয়েও দারুণ এই সমাধি, চারপাশ দেখতে দেখতে বলল কাদির ওসাইরিস, আর এসবই আমার। যেন নিজের ঘরেই ফিরেছি।

এসব কিছুই আপনার নয়, আপত্তির সুরে বলল লাবনী।

অস্ত্রের নল ঘুরিয়ে ওদেরকে কফিন থেকে সরে যেতে ইশারা করল নাদির মাকালানি। তোমাদের জন্যে দারুণ জিনিস রেখেছি। প্রত্যেককে দেব একটা করে। বুলেট।

তার দুই লোক সাবধানে সার্চ করল রানাকে। শোল্ডার হোলস্টার থেকে নিয়ে নিল ওয়ালথার পি.পি.কে।

রুপার কফিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কাদির ওসাইরিস। মামির পায়ের দিকের জার তুলল। এখানে আছে দেবতা রাজার দেহের সব অঙ্গ। বুঝলেন, ডক্টর আলম, ভুল বলি না আমি।

কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল লাবনী।

এইমাত্র কামরায় ঢুকেছে এক লোক।

ফুঁসে উঠল লাবনী, ম্যান মেটয! তা হলে এদের হয়ে কাজ করছ?

শীতল চোখে ওকে দেখল মেট। প্রথম থেকেই আমার পেছনে লেগেছ, লাবনী আলম। এটা বদঅভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে তোমার। কিছু আবিষ্কার করতে গেলেই দেখা যাচ্ছে, আগেই হাজির হচ্ছ। তবে এবার টিভি দর্শকদের সামনে জোকার বানাতে পারবে না আমাকে।

আহা, ম্যান মেটয, আজও তুমি শিশু, কবে হবে সত্যিকারের ম্যান? টিটকারির সুরে বলল লাবনী। তোমার সর্বনাশ করে দিচ্ছে সবাই। মনে কত শখ, কিছু আবিষ্কার করবে, কিন্তু সবাই দুষ্টুমি করে তা করতে দিচ্ছে না। তাই শেষে মিশলে গিয়ে নকল এক ধর্মের একদল বদমাশের ভিড়ে!

রাগে মুখ বিকৃত করল নাদির মাকালানি। অস্ত্রের নল তাক করল লাবনীর বুকে।

অস্ত্রের মুখে কিছুই করতে পারবে না, তবুও ধমকের সুরে বলল রানা, খবরদার, মাকালানি!

মাথা নাড়ল কাদির ওসাইরিস। খুন চলবে না, নাদির। অপবিত্র করা যাবে না এ সমাধি। হাতের জার নামিয়ে রেখে কফিন চক্কর দিল সে। চারটে জার। লিভার, ইনটেস্টাইন, লাংস আর স্টমাক। অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে শেয়ালের মাথাওয়ালা জার তুলল কাদির। ডক্টর আলম, মিস্টার রানা, এই জারে আছে চিরকালীন জীবনের চাবি। আছে ওসাইরিসের জন্যে তৈরি পাউরুটির ইস্ট-এর স্পোর। আমার লাগবে মাত্র সামান্য স্যাম্পল, আর ব্যস, ওই গোপন জ্ঞান হবে আমার। নতুন করে তৈরি করব ওই ইস্ট। কারও অধিকার থাকবে না ওটার ওপর। শুনলে অবাক লাগে, কিন্তু সত্যিই পাউরুটি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করব আমি গোটা দুনিয়া।

জারের ভেতরে স্পোর থাকলে, তবে, বলল রানা। কে জানে, ওসাইরিস হয়তো মরার দিন পাউরুটি খায়নি। বা বেশি ভেজে ফেলেছিল পাউরুটিওয়ালা। পুড়ে গেছে ইস্ট।

তা যদি না পাই, তাও কম পাচ্ছি না, ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল কাদির ওসাইরিস। আবার চোখ স্থির হলো রানার ওপর। তবে মনে করি না ইস্ট পাব না। সেজন্যে সঙ্গে এনেছি ডক্টর কার্ল ব্রনসনকে। দাড়িওয়ালা এক লোককে ইশারা করল। ওই লোককে চিনল লাবনী। সুইস ল্যাবোরেটরিতে ছিল। দুটো জার থেকে স্পোর পেতে পারি। দেখা যাক, আমি ঠিক, না ওরা। শেয়ালের মাথাওয়ালা জার ওপরে তুলল কাদির। এই জার ওয়েবেহসনুফের। এর ভেতরে কী আছে জানতে প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমার। ডক্টর ব্রনসন, পরীক্ষা করে দেখুন। আগে কোটা দেখবেন? ইনটেস্টাইন না স্টমাক?

ইনটেস্টাইনের ভেতরের জিনিস এসেছে ডাইজেস্টিভ প্রসেসের ভেতর দিয়ে, বলল দাড়িওয়ালা ডক্টর। স্পোর যদি থাকে, তো সেটা থাকার সম্ভাবনা বেশি স্টমাকে। কাজেই আগে দেখতে চাই ইনটেস্টাইন।

তা হলে তাই দেখুন।

বাজপাখির জার হাতে নিল ডক্টর কার্ল ব্রনসন।

একমিনিট! গলা চড়ে গেল লাবনীর, ওই জার খুব দামি আর্টিফ্যাক্ট। খুলতে গিয়ে নষ্ট হতে পারে। করুণ চোখে তাকাল ম্যান মেটয-এর দিকে। মেট, তুমি তো জানো আর্টিফ্যাক্টের মূল্য। ফ্যাকাসে হলো আর্কিওলজিস্ট। চোখে দ্বিধা। অবশ্য মুখ খুলল না। কত টাকা দিচ্ছে যে এতবড় ক্ষতি মেনে নিচ্ছ?

ডক্টর মেটয ভাল করেই জানে কত পাবে, আর সেটা কম না দেখেই রাজি হয়েছে, বলল কাদির ওসাইরিস। ছোট এক গোল পোর্টেবল টেবিল পেতে ওটার ওপর বাজপাখির জার রাখল ডক্টর ব্রনসন। ব্রিফকেস থেকে বেরোল দরকারি ইকুইপমেন্ট। লাবনী আলম, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত; বেঈমানি করেছ, নইলে আজ এ কক্ষে সম্মানের সঙ্গে আমার পাশে থাকতে। তার বদলে হয়েছ বন্দি। জানেও বাঁচবে না।

রানা, লাবনী ও বেলার দিকে সাবমেশিন গান তাক করে রেখেছে নাদির মাকালানি। পাশেই আরও দুই গার্ড। তাদের হাতেও এমপি-সেভেন। এতটা দূরে তারা, ঝাঁপিয়ে পড়ে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারবে না রানা।

সবাই অপেক্ষায় আছে, জার নিয়ে কাজ করবে ডক্টর ব্রনসন। হাতের পাশেই একসারিতে কিছু রঙহীন তরলের বোতল, টেস্ট টিউব, পোর্টেবল মাইক্রোস্কোপ। খোদাই করা জারের মাথা দেখছে লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড পর ধাতব চিমটে দিয়ে সরাতে চাইল সিলের কালো রজন। কাজটা শেষ হলে মুখ তুলে দেখল কাদির ওসাইরিসকে।

মাথা দোলাল ধর্মগুরু।

সাবধানে প্যাঁচ খুলছে ডক্টর ব্রনসন। মৃদু শব্দে ঘুরছে মাটির জারের ঢাকনি। সামান্য টিক্ আওয়াজ হলো। ভেঙে গেছে সিলের শেষাংশ। উঠে এল ঢাকনি।

নাক কুঁচকে গেল রানার। ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ানক, বিশ্রী দুর্গন্ধ।

উঁহহু, ওসাইরিস ব্যাটা পচা গরুর কাবাব খেয়েই মরেছে! নালিশের সুরে বলল বেলা।

ভাল করেই সিল করা ছিল, জানাল লাবনী, হাজার হাজার বছরেও নষ্ট হয়নি কিছুই।

পেলাইট তাক করে জারের ভেতরে দেখল ডক্টর ব্রনসন। চকচক করছে কিছু। তিনটে বোতল নিয়ে বারকয়েক ঝাঁকি দিয়ে সব ঢালল অপেক্ষাকৃত বড় আরেক বোতলে। এবার এক পিপেট দিয়ে নিল জারের কালচে পিচ্ছিল কী যেন। স্যাম্পল। ভরল টেস্ট টিউবে। এবার বড় বোতলের তরল ঢেলে দিল ওটার ভেতর।

টিউবের মুখ আটকে কাদির ওসাইরিসকে বলল ডক্টর, কয়েক মিনিট লাগবে। স্পোর থাকলে এই টেস্টে তা ধরা পড়বে।

তা হলে সময় নষ্ট করার দরকার নেই, এক গার্ডকে ইশারা করল কাদির ওসাইরিস। খোলো সারকোফাগাস।

আল্লার দোহাই লাগে! কাতর সুরে বলল লাবনী, আপনারা কী করতে চাইছেন? অটোপসি করবেন মামির?।

বুড়োভাম ওসাইরিসের কথা বাদ দিয়ে আমাদের কী হবে, সেটা ভাবুন, করুণ সুরে বলল বেলা। এরা মেরে ফেলবে!

অ্যাই, মেয়ে, একদম চুপ! ধমক দিল নাদির।

ক্যানোপিক জারের মতই পুরু রজন ও বিটুমেন দিয়ে। আটকে রাখা হয়েছে কফিনের ঢাকনি। কাদির ওসাইরিসের এক লোকের হাতে ছোট এক বৃত্তাকার করাত। সাবধানে ওটা দিয়ে সিল কাটতে লাগল সে। শাবল ব্যবহার করে কফিনের ঢাকনি খুলতে চাইছে আরেকজন।

কাজটা শেষ করতে কয়েক মিনিট লাগবে বুঝে নির্দেশ দিল কাদির ওসাইরিস, আগের দুজনের পাশে গেল আরও দুজন। কফিনের দুদিকে জ্যাক লাগাল তারা। ঢাকনি ও কফিনের মাঝের ফাঁকে ভরে দেয়া হলো ক্রোম-স্টিলের শাবল।

তাদের একজন বলল, আমরা রেডি, স্যর।

সন্তুষ্ট চোখে লাবনী ও রানাকে দেখল কাদির ওসাইরিস। মাথা দোলাল। এবার খোলো।

চারজন মিলে কাজ করছে। কয়েক সেকেণ্ড পর কড়-কড় আওয়াজ তুলল ধাতব শাবল। কটাস আওয়াজে খুলে গেল। সিল। একটা শাবল পিছলে যেতেই ঠুং করে আওয়াজ হলো। ট্যাপ পড়ে গেছে কফিনের ঢাকনির ওপর।

ক্ষতির পরিমাণ বুঝে প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী।

তাড়াতাড়ি! অধৈর্য হয়ে ধমক দিল নাদির মাকালানি।

দৈহিক জোর খাটাল লোকলো। তুলছে রুপার ভারী ঢাকনি। সারকোফাগাস থেকে এল কর্কশ আওয়াজ। খটাং শব্দে সরে গেল ঢাকনি। কফিনের ভেতরে দেখা গেল মামি।

কোনও মূর্তি নয়, সত্যিকারের ওসাইরিস। বা তার অবশিষ্ট। মামি করা দেহ। রঙচটা ব্যাণ্ডেজে মোড়া। হাতদুটো বুকের ওপর। মুখে মৃত্যুমুখোশ। ঢাকনির ওপরের ছবির মতই সোনা-রুপার তৈরি। তুতেনখামেন বা অন্য ফেরাউনদের রাজকীয় মুখোশের তুলনায় অনেক সাধারণ। হেডড্রেস নেই। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাজার মৃত্যুকালীন মুখ। প্রায় তরুণ মনে হলো ওসাইরিসকে দেখে।

সবার চোখ রাজার মুখের ওপর। সাবধানে সরে যেতে লাগল রানা। কিন্তু থমকে গেল নাদির মাকালানির ধমক খেয়ে। রানার মাথার দিকে অস্ত্র তাক করেছে সে।

কাজ বাদ দিয়ে চেয়ে আছে ডক্টর ব্রনসন। ঠিকভাবে এঁটে গেছে কফিনে মামি। আধ ইঞ্চি জায়গাও বাড়তি নেই। কঠিন রুপার ভারী ঢাকনি খাপে খাপ বসবে কফিনের ওপর।

ওসাইরিসের দিকে চেয়ে ফিসফিস করল কাদির, ওসাইরিস! দেবতা-রাজা! চিরকালীন জীবনের মালিক…

সত্যিই ভাবছ চিরকাল বাঁচবে? জানতে চাইল রানা।

মাত্র একমাস আগেও ভাবতাম ওসাইরিস বলে কেউ নেই, বলল কাদির ওসাইরিস, এখন জানি, পুরাণের কথা মিথ্যা নয়।

মিথ্যার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ, বলল রানা। ভাল করেই জানো, শেষপর্যন্ত মরতে হয় সবাইকে। মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছ একদল মানুষকে।

কে বলেছে ওদেরকে ভুল ধারণা দিয়েছি? বলল কাদির ওসাইরিস। আমার কথা ঠিক, তা তো প্রমাণ করছে ওই মামি। অতীতে ছিল ওসাইরিস। আমাকে দিয়ে নিয়তি আবিষ্কার করিয়ে নিয়েছে তাকে। ওই আত্মা এখন আমার ভেতরে। আমিই দেবতা-রাজা ওসাইরিস। কে বলবে আমার মৃত্যু হবে? চতুর শেয়ালের মত বিশ্রী হাসল সে। আসল কথা কোটি কোটি মানুষ চাইবে বাঁচতে। সেজন্যে টাকাও দেবে। বেশিদিন নেই, দুনিয়ার সবচেয়ে বড়লোক হব।

রানা খেয়াল করল, কথাগুলো শুনে কঠোর হয়েছে নাদির মাকালানির চোখ।

কাদির ওসাইরিস আরও কিছু বলার আগেই মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলল ডক্টর ব্রনসন। মিস্টার ওসাইরিস!

তার পাশে পৌঁছে গেল কাদির। টেস্টের রোল্ট কী?

মাইক্রোস্কোপ থেকে স্লাইড নিল ডক্টর ব্রনসন। কাঁপা গলায় বলল, টেস্টের রেয়াল্ট… পযিটিভ! ইস্টের স্ট্রেইনে স্পোর আছে!

হাসতে শুরু করেছে কাদির ওসাইরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ! ঠিক! আমার কথা ভুল হয়নি! খুশিতে মুঠো পাকিয়ে ফেলল সে। ঠিক ধরেছিলাম! মিথ্যা নয় ওসাইরিসের পাউরুটির কাহিনী! এবার হয়ে উঠব মস্তবড় বড়লোক, নাদির! এতই বড়লোক, ভাবতেও পারবে না কেউ! ছোটভাইয়ের দুকাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিল সে। দুনিয়া এখন আমার হাতের মুঠোয়!

বিরক্ত চেহারায় বলল নাদির মাকালানি, শুধু টাকার বেশি আর কিছুই চাও না তুমি? …আর ক্ষমতা?

শুধু টাকা নয়, আসবে প্রচণ্ড ক্ষমতা, হাসল কাদির ওসাইরিস। মজা পেয়ে গলা নিচু করল, আরও কিছু আসবে! লাখ লাখ মেয়ে চাইবে আমার সঙ্গ!

সত্যিই তোমার জন্যে করুণা হচ্ছে, শীতল কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি। তোমার কারণে ডুবেছে আমাদের বংশের নাম। বহু দিন ধরেই দেবতাদের অপমান করছ। কিন্তু এবার আর সুযোগ রাখব না। সাবমেশিন গান তুলল বড়ভাইয়ের বুকের দিকে।

কী হচ্ছে বুঝতে পারেনি কাদির ওসাইরিস। নিজের চোখও বিশ্বাস করেনি। কয়েক সেকেণ্ড পর মগজ কাজ করল তার। বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল, নাদির, কী ঠাট্টা শুরু করলে? ছোটভাইয়ের কঠোর চেহারা দেখছে। নাদির মাকালানির চোখে-মুখে রাগ ও ঘৃণা। পাগল হলে, নাদির? কী করছ?

তোমার নোংরা খেলা শেষ, বড়ভাই, মেঝেতে থুতু ফেলল নাদির। অনেক মজা লুঠে নিয়েছ। কিছু না করেও বহু কিছু পেয়েছ। কিন্তু ওসব প্রাপ্য ছিল না তোমার বুকে ধাক্কা দিয়ে কাদিরকে কফিনের ওপর ফেলল নাদির।

ভীষণ ভয় পেয়েছে কাদির ওসাইরিস। বুঝতে পেরেছে, তার ভাই সিরিয়াস। সাহায্য পাওয়ার জন্যে দলের সশস্ত্র লোকগুলোর দিকে তাকাল। অ্যাই, তোমরা ওর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নাও। তার দিকে কঠোর চেহারায় চেয়ে আছে লোকগুলো। আরেহ! আমাকে বাঁচাও!

ওরা তোমার অনুসারী নয়, সাপের মত হিসহিস করল নাদির। ঠোঁটে টিটকারির হাসি। ওরা আমার অনুসারী। এরপর থেকে তোমার অনুসারীরা পূজা করবে আমাকে। নইলে খুন হবে তারা।

পিছিয়ে গেছে নার্ভাস ম্যান মেটয। ইয়ে… এখানে… এসব কী হচ্ছে?

যা হচ্ছে, ডক্টর মেটয, সেটা সহজ ঘটনা, বলল নাদির। যা উচিত, তাই হচ্ছে। জন্মাধিকার অনুযায়ী ওসাইরিয়ান টেম্পলের প্রধানের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি আমি! কাদিরের পেছনে কফিনের ভেতর পড়ে থাকা মামিটাকে কঠোর চোখে দেখল সে। ওসাইরিস! গুহ্! দুই ভাইয়ের ভেতর সবসময় বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী ছিল সেট। কিন্তু ওসাইরিসের চাপে মাথা নিচু করে চলতে হতো তাকে! কথার সঙ্গে থুতু ছিটকে পড়ছে মুখ থেকে। সে যুগ শেষ! এবার আমার পালা! কর্কশ স্বরে চিৎকার করল নাদির, আমিই সেট! নতুন করে জন্ম নিয়েছি এই পৃথিবীতে!

ভয় ও বিস্ময় নিয়ে নাদিরের দিকে চেয়ে আছে কাদির। কৃ-কী… বলছ এসব, নাদির? কী হয়েছে তোমার? ঢোক গিলল সে। তুমি সেট নও… আমিও তো ওসাইরিস নই! আমরা দুই ভাই এক পাউরুটিওয়ালার ছেলে, নাদির! কেউ কখনও আবারও জন্মায় না… সত্যি সত্যি এসব হয় না! সব বানিয়ে বলেছি! মিথ্যা কথা! তুমি তো জানো, কেন এত মিথ্যা বলেছি!

হঠাৎ খুব শীতল স্বরে বলল নাদির, রাগিয়ে দিয়ে সত্যি জাগিয়ে তুলেছ দেবতাদেরকে! এখন প্রতিশোধ নেবে তারা! তোমার অনুসারীরা মনে করে তুমি সত্যিই ওসাইরিস, তাই তুমি ওসাইরিস। আর আমি ওসাইরিসের ভাই, তাই আমি সেট। অন্ধকার, বিশৃঙ্খলা ও মৃত্যুদেবতা! এবার সময় হয়েছে। আমার রাজত্ব করার!

তুমি… পাগল হয়ে গেছ, নাদির, ভয়ে কাঁপছে কাদির। ডা… ডাক্তার… মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে হবে তোমাকে!

আরও খেপল নাদির মাকালানি। ভাবছ পাগল হয়ে গেছি, না? না, আমি পাগল নই! জন্ম থেকে সবই পেয়েছ তুমি! আমি পাইনি কিছুই! তুমি ছিলে বাবা-মায়ের আদরের সন্তান মহানায়ক! আর আমি? অযোগ্য সন্তান! তুমি যখন নায়ক হয়ে দুনিয়া জয় করছ, সেসময়ে আমাকে যেতে হয়েছে সেনাবাহিনীতে। টাকা আর মেয়েলোকের অভাব ছিল না তোমার। আর মরতে মরতে বেঁচেছি আমি! একটানে শার্ট ছিঁড়ে ফেলল সে। পুড়ে গিয়েছিল পুরো বুক। দগদগ করছে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত। আসির আগুন থেকে টেনে বের না করলে, পুড়ে ছাই হতাম। হাসপাতালে একবারের জন্যেও দেখতে আসোনি! …হ্যাঁ, তুমি আসোনি!

বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের ঝগড়া, নিচু স্বরে রানাকে বলল লাবনী।

ফলাফল বোধহয় ভয়ঙ্কর, বলল রানা।

আমি… তখন… অন্য লোকেশনে ছিলাম, ভয় মেশানো স্বরে দুঃখপ্রকাশ করল কাদির। চাইলেও তোমাকে দেখতে যেতে পারতাম না।

পুরো দুমাসেও যেতে পারোনি, তাই না? ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হাসল নাদির। হ্যাঁ! জানি কী করছিলে। ঘুরে বেড়াচ্ছিলে দুনিয়া জুড়ে, সঙ্গে আট-দশজন দামি বেশ্যা!

এখনও হাল ছেড়ে দেয়নি কাদির। মাথা নাড়ল সে। ও, এবার বুঝতে পেরেছি। আমার টাকা আর নাম হয়েছে, সেজন্যে হিংসেয় বুক পুড়ে গেছে তোমার। এত ছোট মন নিয়ে পুরুষমানুষ হবে কী করে?

কথাটা শুনে রাগে থরথর করে কেঁপে উঠল নাদির। মুখে কিছু না বলে সাবমেশিন গানের নল দিয়ে প্রচণ্ড এক বাড়ি দিল বড়ভাইয়ের মুখে। গাল ফেটে ছিটকে গিয়ে রক্ত পড়ল কফিনের ডালার ওপর। কাদিরের গালের গভীর ক্ষত দেখে হা হয়ে গেছে বেলা। ভুরু কুঁচকে গেছে রানারও।

দুহাতে মুখ ধরে মেঝেতে বসে পড়ল কাদির ওসাইরিস। গলা নিয়ন্ত্রণে এনে ভগলারকে বলল নাদির, ভেতরের ওটাকে বের করো। আঙুল তাক করে দেখিয়ে দিল কফিনের মামি।

কফিনের ওপর ঝুঁকে গেল ভগলার ও দলের আরেকজন। লাবনী আপত্তি তোলার আগেই মামি তুলে অনানুষ্ঠানিকভাবে ফেলে দেয়া হলো কফিনের পাশে। মামির মুখ থেকে পড়ে গেছে মুখোশ। শুকনো লাশের পাতাহীন চোখের গর্ত চেয়ে আছে ছাতের দিকে।

বড়ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক করে ধমকের সুরে বলল নাদির। ঢুকে পড়ো সারকোফাগাসের ভেতর।

ভীষণ ব্যথায় প্রায় পাগল কাদির ওসাইরিস অবাক চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। ক্ব-কেন?

ঢোকো কফিনের ভেতর! এক্ষুণি!

হায়, আল্লা! কী হচ্ছে বুঝে চমকে গেছে লাবনী। কাদির, সত্যিকারের ওসাইরিস আর সেটের কাহিনী নকল করছে নাদির! মনে নেই, একটা ঘরে ডেকে নিয়ে এক কফিনের ভেতরে ওসাইরিসকে আটকে দিয়েছিল সেট?

লাবনীর দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর হাসল নাদির। খুশি হলাম যে সত্যিকারের কাহিনী অন্তত কেউ জানে!

আপনি কাদিরের পেনিস চোদ্দ টুকরো করে মাছকে খাইয়ে দেবেন? বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল বেলা।

এবার আর চোদ্দ টুকরো করতে হবে না। আইসিস নেই যে ওকে বাঁচিয়ে তুলবে। কাদিরের দিকে তাকাল নাদির। কফিনে নেমে পড়ো।

নিজেকে সামলে নিয়েছে কাদির। উঠে দাঁড়িয়ে কঠোর সুরে বলল, তোমার কথায় চলবে না ওসাইরিয়ান টেম্পলের সবাই। ওরা ওসাইরিসের ভক্ত। সেটের নয়।

ভুল জানো, বড়ভাই, বলল নাদির। গর্বের সঙ্গে দেখাল গার্ডদেরকে। জুয়া, মদ্যপান বা বেশ্যাদের নিয়ে যখন মৌজ করছ, সেসময়ে টেম্পলের সত্যিকারের ভক্তদেরকে খুঁজে বের করেছি আমি। টেরও পাওনি, সব ক্ষমতা চলে এসেছে আমার হাতে। সিনেমার নায়ক হতে হবে না আমাকে, মানসিক জোর ও ক্ষমতা দেখে দলে ভিড়বে সবাই। পূজা করবে আমাকে। নির্ধারিত মূল্য দেবে তারা। আর এরপরও কেউ আমাকে মানতে না চাইলে… মরতে হবে করুণভাবে।

কীসের মূল্য? জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস।

ডক্টর কার্ল ব্রনসন এবং তার বিজ্ঞানীরা তোমার নয়, কাজ করছে আমার হয়ে। ওসাইরিসের পাউরুটির ওই ইস্ট শুধু যে আয়ু বাড়িয়ে দেবে, তা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করবে। আমি স্থির করব কে বাঁচবে, আর কার বাঁচতে হবে না। আমার বিরুদ্ধে মাথা তুললে বাঁচবে না কেউ!

চিন্তিত চোখে রানাকে দেখল লাবনী। সুইটয়ারল্যাণ্ডের ল্যাবে ইস্টের জেনেটিক্যালি মডিফিকেশনের কথা বলছিল এরা।

কথা ঠিক, লাবনী, শয়তানির হাসি হাসছে নাদির, আমার অনুসারীরা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেবে বিশেষ স্পোর। মিশিয়ে দেয়া হবে ফসলে, পানিতে, এনিমেল ফিডে। যারা নিয়মিত খাবে না সেট-এর পাউরুটি, বা পূজা দেবে না সেট দেবতাকে নিজ দেহের কোষের বিষেই খুন হবে তারা।

বদ্ধউন্মাদ তুমি, উঠে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল কাদির। জানতে চাও, কেন বাবা আমাকে বেশি পছন্দ করতেন?

বাবার কথা শুনে আরও রেগে গেল নাদির মাকালানি। ঢোক ওই কফিনে, শুয়োরের বাচ্চা! এক্ষুণি! কাদিরের বুকে অস্ত্রের নলের জোর গুঁতো দিল সে। পরক্ষণে চেঁচাল, অ্যাই, তোমরা ওকে ভেতরে ভরো!

মার খাওয়া কাদিরকে ধরে ফেলল চারজন লোক, ভরতে চাইল কফিনের ভেতর। কিন্তু আসল ওসাইরিসের তুলনায় অন্তত ছয় ইঞ্চি বেশি দীর্ঘ কাদির। প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু তার বুকে প্রচণ্ড জোরে অস্ত্রের বাঁট নামাল নাদির। কফিনের ভেতর পড়ে ব্যথায় ছটফট করছে তার বড়ভাই। সুদর্শন চেহারা এখন ভয়ানক যন্ত্রণায় বিকৃত।

আমি সেট! চিৎকার করল নাদির, বুঝে নিচ্ছি নিজের রাজ্যের অধিকার!

হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে কাদির, ভীষণ আতঙ্ক ভরা চোখে দেখল, ওপর থেকে পড়ছে ভারী ধাতব ঢাকনি। ফাপা জোরালো ধুমপ আওয়াজে নামল ওটা। একইসময়ে কাদিরের বেরিয়ে থাকা হাতের কবজি ও পায়ের গোড়ালির হাড় ভাঙার মড়-মড়াৎ আওয়াজ হলো। ভয়ে চিৎকার করে উঠে অন্যদিকে তাকাল বেলা। রুপার কফিনের ডালার ফাঁক দিয়ে গলগল করে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত।

অস্ত্রের বাঁট দিয়ে বারবার ঢাকনির ওপর আঘাত হানছে। নাদির। চেঁচিয়ে চলেছে, আমি সেট! সেট! সেট! মৃত্যুদেবতা সেট!

না, তিক্ত স্বরে বলল রানা, কাদির ঠিকই বলেছে। তুমি বদ্ধউন্মাদ!

ঝট করে রানার দিকে ঘুরল নাদির। প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে। ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল। এবার গুলি করবে সে।

পেরিয়ে গেল পাঁচ সেকেণ্ড, কিন্তু গুলি করা হলো না।

রানা, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল লাবনী, অস্ত্র হাতে কেউ নিজেকে দেবতা দাবি করলে… সবসময় মেনে নিতে হয়!

কাঁপা-কাঁপা দম নিল নাদির। পিছিয়ে গেল। না, শান্ত করতে চাইছে নিজেকে। না, আমার ভাই ঠিকই বলেছে। এই সমাধি অপবিত্র করা ঠিক নয়! ওসাইরিস ফিরে এসেছে নিজের কফিনে। কিন্তু তোমরা? রাগী চোখে রানা, লাবনী ও বেলাকে দেখল সে। তোমাদের অধিকার নেই দেবতার এই সমাধিতে মরবে। কফিন ঘুরে আরেকদিকে গেল নাদির। দলের লোকদের উদ্দেশে বলল, ওদেরকে ওপরে নিয়ে গুলি করো। নিজ হাতে নিয়েছে শেয়ালের মাথা খোদাই করা জার। এটা রাখার কেস কোথায়?

অস্ত্রের মুখে রানা, লাবনী ও বেলাকে কামরার দরজার কাছে নিয়ে গেল ভগলার ও তার লোক। তাদের একজন ঘুরে দেখাল, তার পিঠেই ঝুলছে ইমপ্যাক্ট রেস্ট্যিান্ট কমপোযিট কেস। বুকের হার্নেস ক্লিপ খুলে কেস হাতে নিল সে। মেলল ডালা। ভেতরে নরম মেমোরি ফোম।

প্রোটেকটিভ লেয়ারে জার শুইয়ে দিল নাদির। সাবধানে বন্ধ করল ডালা। ক্লিক আওয়াজে ক্যাচ আটকে যেতেই বলল, জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবে, হাতেম। ..ব্রনসন, হাতেমের সঙ্গে থাকুন। চোখের আড়াল করবেন না জারের কেস। মাথা দোলাল বিজ্ঞানী। আবারও পিঠের হার্নেসে ব্যাকপ্যাকের মত করে কেস আটকে নিল হাতেম।

ঘুরে নাদির দেখল, এখনও রক্তাক্ত কফিনের দিকে চেয়ে আছে ডক্টর ম্যান মেটয ও লুকমান বাবাফেমি। নরম স্বরে বলল সে, আশা করি খারাপ কিছু হয়নি?

না-না, কী যে বলেন, কিছুই না, হড়বড় করে বলল বাবাফেমি, বরাবরের মতই আমার সম্পূর্ণ সমর্থন থাকবে আপনার প্রতি। এমন ব্যবস্থা করব, কখনও এই পিরামিডের কথা জানরে না এসসিএ। এই গোপন তথ্য আমাদের বুকেই লুকিয়ে থাকবে। পরক্ষণে ভয় পেয়ে শুধরে নিল, আপনার গোপন তথ্য, স্যর।

গুড। আর, ডক্টর মেটয?

আ… মি… ইয়ে… বিড়বিড় করল মেট্য, ঠিক আছে। আমি আপনার সঙ্গেই আছি।

শুনে সত্যিই খুশি হলাম, ম্যান মেটয-এর দিকে চেয়ে গলা শুকিয়ে দেয়া এক ভয়ানক হাসি দিল নাদির। তা হলে চলুন, ফেরা যাক হোভারক্রাফটে। এ জায়গা থাকুক মৃতদের জন্যে। দেরি না করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল ম্যান মেটয ও লুকমান বাবাফেমি। সারকোকাগাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাদির। ঘুরে রওনা হওয়ার আগে ফিসফিস করে বলল, গুড-বাই, বড়ভাই!

সবাই বেরিয়ে যাওয়ায় ওসাইরিসের সমাধিতে রইল শুধু নৈঃশব্দ্য।

.

২৬.

প্রচণ্ড শক্তিশালী মহিলা-র ঘরে দাঁড়িয়ে আছে মিশরীয় আর্মির জেনারেল খালিদ আসির। তার উদ্দেশে বলল লাবনী, ওই লোক উন্মাদ, নিশ্চয়ই ভাবছেন না সত্যিই নতুন করে জন্ম নিয়েছে সেট?

কী বিশ্বাস করি, তাতে কিছুই যায় আসে না, জবাবে বলল আসির, বড় কথা, কী বিশ্বাস করে সে। তা ছাড়া, প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছি বলে ও আমার কাছে কৃতজ্ঞ। ওর ধারণা, আমাকে দেয়া উচিত কোটি কোটি ডলার। কথা দিয়েছে, ওর পরিকল্পনা সফল হলে বড় পদে নিয়োগ দেবে। তা যদি না-ও হয়, টাকার অভাব হবে না আমার। কাজেই ভেবে দেখেছি, ও সেট হলেই বা কী ক্ষতি হচ্ছে আমার!

কিন্তু ওই লোক তো সাইকোপ্যাথ, বলল লাবনী। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে মরবে কোটি কোটি মানুষ!

চুপ করে শুনছে রানা। পেছনে অস্ত্র হাতে ট্রেইণ্ড কজন। উপায় নেই যে নিজেদেরকে মুক্ত করবে ও।

লাবনীর কথায় কাঁধ ঝাঁকাল জেনারেল। আজকাল তো অতিরিক্ত জনসংখ্যার কথা বলছে সবাই। ওই সংখ্যা কমলে ক্ষতি কী!

ঝড়-বৃষ্টির ঘরের নিচে নেই প্যাসেজ। পিঁপড়ে চ্যাপ্টা করে দেয়া মহিলার ঘরে লাগানো হয়েছে স্প্রিং লোডেড ক্লাইমিং ক্ল্যাম্প! প্যাসেজের মেঝে ও ছাত গায়েব হওয়ায়, নিচে ও ওপরে দীর্ঘ এক বিশাল শার্ট।

এবার কী করব? প্রায় ফিসফিস করল বেলা। ভীষণ ভয় লাগছে ওর। প্রায় উঠে এসেছি। একটু পর গুলি করে মেরে ফেলবে।

খুন হব না, বলল রানা, কোনও উপায়ে বেরিয়ে যাব। বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য লাগল না ওর নিজের কাছেই। অস্ত্র নেই। সংখ্যায় শত্রুরা অনেক।

রানার দিকেই চেয়ে আছে লাবনী। চোখে হেরে যাওয়া দৃষ্টি।

সবাই জড় হয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী মহিলার ঘরে। শুকিয়ে গেছে ফাটল ধরা রোলারদুটো। সবার আগে দড়ি বেয়ে সামনের প্যাসেজে গেল ট্রুপার হাতেম। তার কাছে রয়ে গেছে জারের কেস। হাতেমের পর দড়ি বেয়ে একে একে ঝুলতে ঝুলতে গহ্বর পেরোল অন্যরা।

ঢালু প্যাসেজ ধরে উঠল সবাই।

দড়িতে ঝুলে ঝড়-বৃষ্টির ঘর পেরোবার পর, ঢালু প্যাসেজ ধরে হেঁটে পৌঁছে গেল সেতুর কাছে।

কূপ পেরোলে আবারও প্যাসেজ, ওই খাড়াই পথে যাওয়ার পর সামনে পড়বে হায়ারোগ্লিফিক্স ভরা প্রথম ঘর।

জলদি! সবাইকে তাড়া দিল নাদির। অনিশ্চিত চোখে তাকে দেখল ডক্টর ব্রনসন। পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

লাবনী ও বেলার পিঠে দুবার অস্ত্রের নলের খোঁচা দিল ভগলার। দ্বিধা নিয়ে সরু সেতুতে পা রাখল দুই মেয়ে। অতিরিক্ত চাপ পড়তেই ঠং-ঠনাৎ শব্দ তুলল শেকল। লাবনী ও বেলার পেছনে সেতুতে চাপল নাদিরের কয়েকজন ট্রুপার।

সেতুর ওপর পা রাখতে গিয়েও চট করে শেকল দেখল রানা। চোখ গেল দাঁতওয়ালা চাকার নিচে। ওখানে আছে ওর গুঁজে রাখা পাথরখণ্ড।

লাবনী, মনে আছে এখানে এসে কী জেনেছি? বলল রানা, এবার কিন্তু সত্যিই খুব দুলবে সব।

চোখ বিস্ফারিত করে চেঁচিয়ে উঠল লাবনী, বেলা, জলদি সেতু জাপটে ধরো!

এক লাথিতে পাথরখণ্ড সরিয়ে দিল রানা।

ছাড়া পেতেই ভারী ওজনের জন্যে ঘুরল সিলিণ্ডারের মত পাথরের রোলার, পুলির মাধ্যমে টেনে নিচ্ছে চেইন। ঘুরছে দাঁতওয়ালা চাকা।

শুয়ে দুই হাতে সেতু জড়িয়ে ধরেছে লাবনী ও বেলা। খটাং-খট-খটাং-খট শব্দে সেতুর বাড়তি অংশকে ভীষণভাবে ঝাঁকি দিতে লাগল দাঁতওয়ালা চাকা। সেইসঙ্গে সি-সওর মত দুলছে গোটা সেতু। হাতেম ছিল সবার আগে, টলমল করতে শুরু করে হাত থেকে ফেলে দিল অস্ত্র। ডাইভ দিল ওপারের মেঝেতে পড়তে। কিন্তু ভুল হয়েছে হিসাব, পতন শুরু হতেই খামচে ধরল মেঝের কিনারা। ঝুলতে লাগল গহ্বরের পাশে।

কপাল এত ভাল নয় ডক্টর ব্রনসনের। প্রস্তুত ছিল না, সেতু থেকে পড়ে সাঁই করে নেমে গেল। চারপাশে থাকল তার প্রলম্বিত আর্তচিৎকার। বেলার পেছনে দুই ট্রুপার পড়ল গহ্বরে। সেতুর ওপর টিকে থাকতে চাইল তৃতীয়জন, কিন্তু দুসেকেণ্ড পর রওনা হলো আঁধার নরকের দিকে।

সেতুর ওপর দাঁড়ানো শেষ ট্রপার ডাইভ দিয়ে পড়ল পেছনের পাথুরে মেঝেতে। রানা ও ভগলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার। ওরা তিনজন পড়ল অন্যদের ওপর। ঢালু প্যাসেজে গড়িয়ে গেল ওরা। গায়ের ওপর থেকে লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল রানা। পরক্ষণে কষে একটা লাথি লাগিয়ে দিল ভগলারের পেটে। উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, লাবনী! সেতু পেরিয়ে যাও! ওপরে উঠে পালাও!

তিলতিল করে এগোচ্ছে লাবনী। ওকে অনুসরণ করছে বেলা। চিৎকার করে জানতে চাইল লাবনী, তোমার কী হবে? তুমিও এসো!

কিন্তু অনেক বেশি দুলছে সেতুর ওদিকটা। উঠতে পারবে না কেউ। তাই বলে বসে থাকল না রানা, ঘুরেই বুটের শক্ত ডগা দিয়ে জোর এক লাথি ঝেড়ে দিল নাদির মাকালানির বুকে। ওর চোখ খুঁজছে আগ্নেয়াস্ত্র। কূপের কিনারায় আছে একটা এমপি-সেভেন সাবমেশিন গান। ওটা পাওয়ার জন্যে সামনে ঝাঁপ দিল রানা।

বদ্ধ জায়গায় বিকট বুম! আওয়াজ তুলল ভগলারের রিভলভার। লক্ষ্যহীন বুলেট চেঁছে নিল রানার বাহুর সামান্য মাংস। মুখ কুঁচকে গেল রানার। অন্যহাতে চেপে ধরল ক্ষত। তীব্র ব্যথায় ভুলে গেছে অস্ত্রের কথা।

রানা, এসো! চিৎকার করে উঠল লাবনী।

ওই জারটা নিয়ে বেরিয়ে যাও! পাল্টা চেঁচাল রানা।

ঘুরেই লাবনী দেখল, কিনারায় বস্তার মত ঝুলছে হাতেম। কাঁধ ওপরে তুলেছে, কিন্তু পিঠে ভারী কেস, তাই আর পারছে না উঠতে।

শক্ত মেঝেতে পা রেখে হাতেমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল লাবনী, ওই কেস দাও, তা হলে টেনে তুলব! ঝুঁকে নিতে গেল জারের কেস। কিন্তু ওটা আছে ইকুইপমেন্ট ওয়েবিঙের ক্লিপে আটকানো।

লাবনী ভাবল, যে অবস্থায় ঝুলছে লোকটা, এখন বাধা দেবে না। কেস ধরে টান দিল ও… কিন্তু, খন্ করে ওর ডান গোড়ালি খামচে ধরল হাতেম।

ছাড়! ভীষণ ভয় পেল লাবনী।

মুখ তুলে বাঁকা হাসল হাতেম। কিনারায় কনুই বাধিয়ে ঝুলছে, অন্যহাতে হ্যাচকা টান দিল লাবনীর গোড়ালি ধরে।

পা পিছলে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল লাবনী। ওর কাফ মাসল শক্তভাবে ধরেছে হাতেম। এদিকে সেতু পেরিয়ে গেছে বেলা, মেঝেতে পা রেখেই লাথি মারল হাতেমের কনুইয়ে। ছেড়ে দে, শয়তান!

না, ওই কেসটা নাও! বলল লাবনী। হেঁচড়ে পিছিয়ে যেতে চাইছে। ওর চোখ পড়ল হাতেমের চোখে। চাপা গলায় বলল ও, বাধ্য কোরো না!

জবাবে আরও কঠোর হলো হাতেমের চোখ। উঠে আসছে। আরও জোরে চেপে ধরেছে কাফ মাসল। ব্যথায় অস্থির লাগল লাবনীর।

পারলে কিছু কর! দাঁতে দাঁত চেপে বলল হাতেম।

অন্য পায়ে তার মুখে সবুট লাথি মারল লাবনী। ঝটকা খেয়ে পিছিয়ে গেল হাতেমের মাথা। হাত পিছলে গেল কাফ মাসল থেকে। তবে আবারও চেপে ধরতে পারল গোড়ালি। তার ওজন বইতে গিয়ে কিনারার দিকে পিছলে যাচ্ছে লাবনী।

ওদিকে ওয়েবিং থেকে কেস ছুটিয়ে নিতে পারছে না বেলা। প্রাণপণে টান দিল স্ট্রাপ ধরে।

আবারও লাথি ছুঁড়ল লাবনী। সেতুর বুবি ট্র্যাপের জোরালো শব্দের ওপর দিয়েও এল ফটাস আওয়াজ। ফেটে গেছে হাতেমের নাক। চিৎকার করল লাবনী, ছেড়ে দে! ছাড়! ছেড়ে দে!

প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করেও ঝুলছে হাতেম। মুচড়ে দিতে চাইল লাবনীর গোড়ালি। কূপে পড়তে শুরু করে সঙ্গে নিচ্ছে শিকার।

আরেক লাথি খেয়ে হাত ছুটে গেল তার। ঝুলছে কিনারা থেকে। অন্যহাতে বুকের ওয়েবিঙের খাপ থেকে নিল ধারালো ছোরা। এবার ওটা গেঁথে দেবে লাবনীর পায়ে…

আবারও লাথি মারল লাবনী। তবে এবার মুখ লক্ষ্য করে নয়। সরাসরি লাগল হাতেমের কিনারা ধরা হাতে।

থুতনিতে লাথি ভীষণ ব্যথা দিয়েছে, কিন্তু সে-তুলনায় আঙুল ভাঙার যন্ত্রণা বহু গুণ বেশি! হাত থেকে মেঝেতে পড়ল ছোরা। করুণ আর্তনাদ ছাড়ল সে। ছুটে গেল কিনারা থেকে হাত। মাধ্যাকর্ষণের টানে গভীর কূপে পড়ল হাতেম। ওই একই সময়ে ওয়েবিঙের ক্লিপ খুলেছে বেলা। হার্নেস থেকে ছুটে সই করে রওনা হয়ে গেল লোকটা নিশ্চিত মৃত্যুর পথে।

বুঝে গেছে লাবনী, রানাকে জিম্মি করতে চাইবে নাদির মাকালানি। ওর কাছ থেকে আদায় করবে ক্যানোপিক জার। শেষে মরতে দেবে না ওদের কাউকেই। ওই একই পরিণতি হবে কূপে কেসটা ফেললে।

একমাত্র উপায় ক্যানোপিক জার নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে রানাকে বাঁচিয়ে রাখবে নাদির। প্রয়োজনে মিথ্যা আশ্বাস দেবে, জার পেলে ছেড়ে দেবে ওদেরকে। ঘটনা যাই হোক, আপাতত রানাকে ছেড়ে সরে যেতে হবে ওর।

ছোরা ও কেসসহ হার্নেস নিয়ে উঠে দাঁড়াল লাবনী। চলো, বেলা!

অবাক চোখে ওকে দেখল বেলা। কিন্তু, মাসুদ ভাই…

দৌড় দাও! ওপরের ঘরে যেতে ছুট দিল লাবনী, হাতে কেস। শত্রুপক্ষের হাতে বেরিয়ে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। একবার করুণ চোখে রানাকে দেখে নিয়ে লাবনীর পেছনে দৌড় দিল বেলা। ওর পাশের দেয়ালে পিছলে গেল বুলেট।

রাগে লালচে হয়েছে নাদির মাকালানি। খুন করো! খুন করো! চিৎকার করে উঠে এক লোকের হাত থেকে কেড়ে নিল সাবমেশিন গান। গুলি করে খালি করল ম্যাগাযিন। কিন্তু প্যাসেজ পেরিয়ে দূরে চলে গেছে লাবনী ও বেলা। প্রচণ্ড ক্রোধে আহত হিংস্র জানোয়ারের মত গর্জন ছাড়ল নাদির। এত জোরে অস্ত্রটা মেঝেতে আছড়ে ফেলল, ঠাস্ করে ফেটে গেল প্ল্যাস্টিকের হ্যাণ্ডগ্রিপ। হাত মুঠো করে বাঘের চোখে দেখল রানাকে।

রানার ধারণা হলো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বদমেজাজি লোকটা। গভীর কূপে ফেলবে ওকে। গুলি করো একে! চিৎকার করে উঠল নাদির। গুলি করো!

বোয়াল মাছের মত চওড়া ঠোঁটের বিস্তৃত হাসি দিল। কিলিয়ান ভগলার।

নাদির, একটু অপেক্ষা করো! বাদ সাধল জেনারেল আসির। কর্তৃত্বের সঙ্গে বলেছে। দ্বিধায় পড়ে গেল ভলার। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে আকস্মিক বাধা পড়তেই ঝট করে ঘুরে তাকাল নাদির। একে ব্যবহার করে ফিরে পাবে ওই জার। ওটা নষ্ট করবে না ওই মেয়ে। ওটার বদলে চাইবে মাসুদ রানাকে ফিরে পেতে।

বড় করে কয়েকবার দম নিল নাদির, এখনও থরথর করে কাঁপছে রাগে। একটু পর বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। বাধা দিলে বলে ধন্যবাদ, দোস্ত!

আমি সবসময় তোমার ভাল চেয়েছি, সেইসঙ্গে নিজের, মৃদু হাসল জেনারেল খালিদ আসির।

আমরা তা হলে একে খুন করব না? খুব হতাশ হয়েছে। ভগলার। ভুলতে পারেনি, তার মত ভয়ঙ্কর লোকের পাছায় লাথি দিয়েছিল ওই বাঙালি যুবক।

না, আপাতত নয়, বলল নাদির। তবে জার পাওয়ার পর…কঠোর চোখে রানাকে দেখল সে।

ওই জার আর পাবে না, আহত বাহু অন্যহাতে ধরেছে রানা। লাবনী বা বেলাকে ধরতে পারবে না। ফিরবে ওরা অ্যাবাইদোসে। মিশরের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে কী করছ তোমরা। তোমাদের খেলা খতম।

আমার তা মনে হয় না, বলল নাদির। বিস্মিত চোখে দেখল, বড় একটা ঝাঁকি দিয়ে থামল চেইন। সেতু স্থির হতেই কূপ পেরিয়ে গেল অবশিষ্ট কজন ট্রুপার। রানা, তুমি বোধহয় জানো না কীভাবে এখানে এলাম আমরা?

.

মাথার ওপরের ম্যান হোল থেকে নেমে এসেছে দড়ির মই। একটু আগে প্রথম ঘরে ঢুকেছে লাবনী ও বেলা। মই বেয়ে উঠে এসেছে মরুভূমির পাথুরে কুটিরে। কয়েক সেকেণ্ড চোখ রেখেছে হোভারক্রাফটের ওপর। ওটা প্রকাণ্ড মিলিটারি ক্রাফ্ট। নিচু করে রাখা হয়েছে ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্প। মস্ত হাঁ করে আছে যন্ত্রটা। তবে দেখা যায়নি কাউকে।

জিনিসটা কী? লাবনীর কাছে জানতে চেয়েছে বেলা।

ওটা আছে বলেই আমরা আছি বিপদে, বলেছে লাবনী। কিন্তু একবার জিপ নিয়ে ক্যানিয়নে ঢুকতে পারলে আর পিছু নিতে পারবে না।

তা হলে চলুন, দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।

 পরিত্যক্ত দালান থেকে বেরিয়ে সোজা সিকি মাইল দূরের ওই নালার দিকে দৌড় দিল লাবনী ও বেলা।

পেছন থেকে ধাওয়া করে এল না কেউ।

বালিতে দৌড়ে চলা কঠিন, তবে মাত্র পাঁচ মিনিটে তুবড়ে যাওয়া ল্যাণ্ড রোভারের পাশে পৌঁছে গেল ওরা।

স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসল লাবনী। মাঝের সিটে থাকল ক্যানোপিক জারের কেস। ছোরা রেখে দিল হার্নেসের খাপে।

ওপাশের দরজা খুলে সিটে উঠল বেলা। লাবনী ইঞ্জিন চালু করতেই আপত্তির সুরে বলল, মাসুদ ভাইয়ের কী হবে? তাকে তো মেরে ফেলবে ওরা! হয়তো মেরেই ফেলেছে!

পুবে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে রওনা হলো লাবনী। ওকে খুন করবে না। আমাদের কাছে ক্যানোপিক জার। এটা ফেরত চাইবে নাদির মাকালানি।

তারপর হতাশ হলেই মেরে ফেলবে মাসুদ ভাইকে। খুব খারাপ লাগছে। বড়ভাইয়ের মত আগলে রেখেছিলেন। সত্যিকারের বড়ভাই হলে, এমন করেই…

আরে, ভাবছ কেন যে মরবে ও, সান্ত্বনা দিল লাবনী। ওকে উদ্ধার করার একটা না একটা পথ বেরোবে।

চুপ হয়ে গেল বেলা। চোখ বোলাল কেসের ওপর। ক্ষতি হয়নি ওটার। সিটবেল্ট দিয়ে আটকে নিল। কাজটা শেষ করেই চমকে গেল। ওয়েবিঙে ঝুলছে ওই জিনিস। লাবনী আপু… প্রায় কেঁদে ফেলল ও। দুইটা গ্রেনেড! গায়ের কাছে!

থাকুক, ভুলেও ধরতে যেয়ো না, সতর্ক করল লাবনী।

কিন্তু গাড়ি চলছে বলে ঠুক-ঠাক টোকা লাগছে দুটোয়! সত্যিই এবার খুন হয়ে গেলাম!

পিন টেনে না খুললে মরবে না, শুকনো হাসল লাবনী। চোখ রেখেছে হলদে মরুভূমিতে।

ঝড়ের বেগে চলেছে ল্যাণ্ড রোভার ডিফেন্ডার।

পিরামিড ছেড়ে মরুভূমির মেঝেতে উঠে এসেছে নাদির মাকালানি। সঙ্গেই আছে জেনারেল আসির। তার উদ্দেশে এগিয়ে এল যুবরের পাইলট। আরবি ভাষায় জানাল, কী দেখেছে। আঙুল তুলল পুবদিকে।

টলমল করা প্রচণ্ড তাপের মাঝে দূরে ধুলো উড়তে দেখল রানা। জানতাম, ওদেরকে ধরতে পারবে না।

যে-কোনও জমিতে চল্লিশ নট বেগে চলে হোভার ক্রাফট, প্রকাণ্ড যুবর দেখিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল জেনারেল আসির, ওদের জিপ দৌড়ে হারবে।

মাথা নাড়ল রানা। হয়তো, তবে কীভাবে যাবে সরু ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে?

যুবরকে কিছু করতে হবে না, সঙ্গে আরও অন্য জিনিস আছে, জানাল ভগলার।

নাদির নির্দেশ দিতেই যুবরের দিকে ছুট দিল ট্রুপাররা। অন্যদের উদ্দেশে বলল সে, আগে ওদেরকে ধরে, তারপর খতম করব। একবার রানাকে দেখে নিয়ে যুবরের দিকে চলল সে। পেছনে অন্যরা। রানা, ভাল করেই দেখবে, কীভাবে কী করছি।

রিভলভারের নল দিয়ে রানার পিঠে খোঁচা দিচ্ছে ভগলার। তার দরকার ছিল না। নিজে থেকেই হাঁটছে রানা। যুবরের কাছে যাওয়ার আগেই ওটার পেট থেকে এল ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ। হোন্ড থেকে ছিটকে বেরোল দুটো ছোট ভেহিকেল। প্রায় উড়তে উড়তে নেমে এল র‍্যাম্প বেয়ে। মরুভূমিতে পড়ে ধুপ করে ছিটিয়ে দিল বালি। ঘুরেই রওনা হয়ে গেল পুবে। ধাওয়া করছে ল্যাণ্ড রোভারটাকে। গলা শুকিয়ে গেছে রানার। ওই দুই যন্ত্র লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল। মিলিটারাইড় ডিউন বাগি। হালকা ওজন, ফ্রেম, চারটে চাকা ও ইঞ্জিন। ড্রাইভারের মাথার ওপরে টারেটে মেশিন গান। দেখলে পছন্দ করবে না কেউ, আরামও নেই চেপে, কিন্তু মরুভূমিতে চলতে পারে সাইমুমের বেগে।

ডিফেণ্ডার জিপগাড়ির চেয়ে অনেক দ্রুত চলছে লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল।

শুরু হলো ধাওয়া, গম্ভীর কণ্ঠে বলল নাদির। টিটকারির চোখে দেখল রানাকে। অবশ্য, দুঃখের কথা, বেশিক্ষণের জন্যে নয় ওই ধাওয়া।

এরা ট্রেইণ্ড, অস্ত্রের মুখে বন্দি রানা। পিঠে রিভলভারের খোঁচা খেয়ে র‍্যাম্প বেয়ে যুবরের হোন্ডে উঠল ও। বিশাল এক বাক্সের মত জায়গা এই হোল্ড। রাখা যাবে তিন-তিনটে ব্যাটল ট্যাঙ্ক অথবা তিন শ সশস্ত্র সৈনিক। আপাতত হোল্ডে আছে হলদে রঙের নোংরা কয়েকটা এক্সকেভেটর ও আর্থমুভার। পাশেই তৃতীয় ডিউন বাগি। উঁচু প্ল্যাটফর্মে মরুভূমিতে অপারেশনের জন্যে ইকুইপমেন্ট। রানা বুঝল, ওসাইরিয়ান টেম্পলের কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল খুঁড়ে নিতে হবে পিরামিড।

কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে ফোন হেডসেট নিল জেনারেল খালিদ আসির। নির্দেশ দিল ব্রিজের অপারেটরকে। কসেকেণ্ড পর চালু হলো যুবরের মেইন ইঞ্জিন। বাড়ছে টারবাইনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। সেইসঙ্গে জোরালো ফিসফিস শব্দ। হোল্ডের পেছনে দীর্ঘ বাল্কহেডে কাজ করছে প্রকাণ্ড চারটে লিটু ফ্যান। স্কার্ট-এ হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকতেই মেঘের মত ভাসল একরাশ বালি। পুরু রাবারের বেল্টে ভর করে উঠে পড়ল বিশালাকার ভেহিকেল।

আসির বাটন টিপে দেয়ায় উঠে এল র‍্যাম্প। হাইড্রোলিক কাজ করতেই জোর আওয়াজে ধুম করে বন্ধ হলো স্টিলের কবাট। থেমে গেল বালিঝড়, কিন্তু কান প্রায় ফাটিয়ে দিল ফুল পাওয়ারের ইঞ্জিনের গর্জন।

হোল্ডের মাঝের মই বেয়ে উঠে গেল ভগলার। চেয়ে আছে ওপর থেকে। এবার উঠতে হবে রানাকে। সশস্ত্র গার্ডদের অস্ত্রের ইশারায় মই বেয়ে উঠল ও। বুকে ধাক্কা দিয়ে। একটা দেয়ালে ওকে ফেলল ভগলার। উঠল আরও কয়েকজন গার্ড। একজন হ্যাচকা টানে পেছনে নিয়ে ওপরে তুলল রানার হাতদুটো। বুলেটের ক্ষতে লাগতেই তীব্র ব্যথায় মৃদু আওয়াজ বেরোল রানার মুখ থেকে।

পিরামিডেই শেষ করতে পারলে ভাল হতো! আফসোস করল ভগলার। প্ল্যাস্টিকের যিপ-টাই দিয়ে আটকে দিল। রানার দুই কবজি। ঠেলে নিয়ে চলল সামনের ঘরের দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে হাত নাড়ল রানা। এত আঁটো হয়ে বসেছে যিপ-টাই, কেটে যাচ্ছে ত্বক-মাংস। বুঝে গেল, জরুরি ভিত্তিতে খুঁজতে হবে মুক্তির কোনও উপায়।

সর্বনাশ! ল্যাণ্ড রোভারের রিয়ার উইণ্ডো দিয়ে চেয়ে আছে বেলা। হামলা করতে আসছে ডিউন বাগি!

আয়নায় পেছনের মরুভূমিতে কালো দুটো জিনিস দেখল লাবনী। প্রচণ্ড গতি ওগুলোর। দ্রুত চলে আসছে কাছে। আবার সামনের মরুভূমিতে চোখ রাখল ও। কাজে আসবে। এমন কিছুই দেখল না। সমতল বালিজমি আর ঢেউ খেলানো ঢিবি। এখনও অনেক দূরে ওই ক্যানিয়ন।

কেসের ইকুইপমেন্ট ওয়েবিং দেখল লাবনী। অস্ত্র বলতে ওদের কাছে বড়জোর একটা ছোরা আর দুটো গ্রেনেড। ছোরা দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। কাছে পাবে না কাউকে। আগে নিজেই খুন হবে। অবশ্য, গ্রেনেড ছুঁড়তে পারে ডিউন। বাগির দিকে। কিন্তু ওয়েবিং হার্নেস দেখলে, গ্রেনেড ছোঁড়ার আগেই সরে যাবে ওগুলোর চালক।

একটা বুদ্ধি এল লাবনীর মনে। ওটা এতই সহজ, কেউ ভাববে না তাতে কাজ হবে। তবুও ওটাই বাঁচার একমাত্র উপায়।

আবারও মরুভূমির বুকে চোখ বোলাল লাবনী। এবার আরও সতর্ক। বড় একটা ঢিবি চাই ওর।

হঠাৎ আঁৎকে উঠল বেলা। নিচু করে নিয়েছে মাথা।

বিশ্রী খ্যাট-খ্যাট আওয়াজ। গাড়ির একপাশে বালি খুঁড়ে উষ্ণপ্রস্রবণ তৈরি করছে মেশিন গানের বুলেট। সিটে নিচু হয়ে বসল লাবনী। আরেক দিকে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি, কিন্তু যথেষ্ট দ্রুত কাজটা করতে পারেনি। চুর-চুর হয়ে ভেঙে পড়ল পেছনের জানালা, খটখট শব্দে বুলেট লাগল ডিফেণ্ডারের অ্যালিউমিনিয়ামের পাতলা দেহে।

মেশিন গানের গুলি পাঠাতে শুরু করেছে দ্বিতীয় গানারও। জিপগাড়ির পাশ দিয়ে গেল কমলা-একসারি তপ্ত ট্রেসার বুলেট। তাড়া খেয়ে আরেক দিকে ছুটল লাবনী। বুঝে গেছে, অধরা থাকতে পারবে না বেশিক্ষণ।

আরেক পশলা গুলি ছিঁড়েখুঁড়ে দিল জিপগাড়ির দেহ। ফাটল ধরল সামনের উইণ্ডশিল্ডে। লাবনীর পাশের জানালা ভেঙে ঢুকল একটা ট্রেসার বুলেট। দুই ইঞ্চি নিচে দিয়ে গেলে বিস্ফোরিত হতো ওর মাথা।

বনবন করে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে আরেক দিকে চলল লাবনী। বালির ভেতর এতই দ্রুত বাঁক নিয়েছে, আরেকটু হলে কাত হয়ে পড়ত গাড়ি। বুলেট লেগে বিস্ফোরিত হলো মাঝের সিটের পেছনে ফোলা ফোম। একটুর জন্যে রক্ষা পেল ক্যানোপিক জারের কেস।

ভীষণ ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করেছে বেলা।

গাড়ি সোজা করে নিল লাবনী। অনায়াসেই পিছু নিল এলএসভি। সামনে চেয়ে লাবনী দেখল, দীর্ঘ এক বালির ঢিবি।এঁকেবেঁকে গেছে ওটা। পাশেই বায়ুস্রোতে ক্ষয় হওয়া হাজার হাজার বছরের উঁচু শৈলশিরা। এমন জায়গাই খুঁজছিল ও। এবার…,

আয়না দেখল লাবনী। সরাসরি ওর দু শ ফুট পেছনে এক ডিউন বাগি। অনুসরণ করছে অন্ধের মত। স্টিয়ারিং হুইল ধরো! মৃদু কাঁপা গলায় বলল লাবনী।

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকাল বেলা। কী করতে হবে?

ড্রাইভ করবে! সরে আসতে ইশারা করল লাবনী।

আপনি কী করবেন? পাশে চলে এল বেলা।

অ্যাক্সেলারেটরে পা রেখে হেঁচড়ে বেলার ওপর দিয়ে এদিকে চলে এল লাবনী। আয়নায় দেখল গতি বাড়িয়ে তেড়ে আসছে কাছের এলএসভি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছুবে জিপগাড়ির ঠিক পেছনে। সঙ্গীদের গায়ে লাগবে ভেবে গুলি বন্ধ করেছে অন্য ডিউন বাগির গানার।

বেলা, অ্যাক্সেলারেটর চেপে রেখে সোজা যাও! লাবনীর দেহের বেশিরভাগ ওজন সহ্য করেও কথামত কাজ করছে বেলা। একটা বুদ্ধি এসেছে!

.

যুবরের ওয়েপন্স রুমে ওয়েপন্স অফিসারের কাঁধের ওপর দিয়ে মনিটরে জিপগাড়ির পলায়ন দৃশ্য দেখছে মাসুদ রানা।

প্রায় শেষ হয়ে এল ধাওয়া। যুবরের ফায়ার-কন্ট্রোল কমপিউটার দেখিয়ে দিচ্ছে শত্রুর রেঞ্জ, বেয়ারিং ও স্পিড। তিন গাড়ির পাশেই তিন কার্সার। যে-কোনওটা উড়িয়ে দিতে পারবে যুবরের কামানের গোলা। তবে সামনের এলএসভি প্রায় পৌঁছে গেছে ল্যাণ্ড রোভারের লেজের কাছে।

রানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নাদির মাকালানি। সামনের ডিউন বাগি থেকে গুলি চলতেই খুশি হয়ে কন্সেলের ওপর ধমাস করে একটা ঘুষি নামাল সে। ওয়েপন্স অফিসারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, গানারকে জানাও, জিপের ড্রাইভারের মাথার দিকে গুলি করতে! ভুলেও যেন জারের কেসের দিকে গুলি না করে!

সিটে নড়েচড়ে বসে আদেশ পাচার করল অফিসার।

নার্ভাস লুকমান বাবাফেমি জানতে চাইল, ওই বাক্স বুলেটপ্রুফ না?

হ্যাণ্ডগানের গুলিতে কিছু হবে বলে মনে হয় না, বলল জেনারেল আসির, তবে… মেশিন গানের… জানি না!

কেস আর জার ফেরত পেলে সব ঠিক আছে কি না, সেটা দেখে নেবেন, বাবাফেমি, বলল নাদির। কড়া চোখে দেখল ম্যান মেটযকে। ডক্টর মেটযের হাত বেশি কাঁপবে।

ম্যান মেটয-এর দিকে তাকাল রানা। কোনায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ফ্যাকাসে। অসুস্থ চেহারা। ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা, চেনা কাউকে গুলি করছে, ভাবতে ভাল লাগে না। ভাবছ, এসবে জড়িয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, তাই না? তো এসব ভাবার দরকারই বা কী? তুমি তো মোটা অঙ্কের টাকা পাবে!

মুখটা বন্ধ রাখো, মাসুদ রানা! কলোলের ওপর ঠেলে ওকে ফেলল কিলিয়ান ভগলার।

স্ক্রিনে দেখল রানা, বালির ঢিবিতে উঠছে ল্যাণ্ড রোভার ডিফেণ্ডার। একটু পেছনেই এলএসভি। মেশিন গানের নল তাক করছে গানার।

হাঁচড়েপাঁচড়ে ল্যাণ্ড রোভারের পেছনে চলে এসেছে লাবনী। এখন হাতে একটা গ্রেনেড। সোজা যাবে! বেলাকে জানাল। নিজে গেল পেছনের দরজার কাছে। বালির ঢিবির ওপরে উঠলেই চিৎকার করে জানাবে!

কী করবেন? পেছনে চেয়ে জানতে চাইল বেলা। খাড়া পথে জিপ উঠছে বলে কাছে চলে এসেছে ডিউন বাগি। দুই পা দিয়ে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল চেপে ধরল ও।

ঢিবিতে উঠলেই বলবে! পেছনের ভাঙা জানালা দিয়ে চেয়ে আছে লাবনী। গর্জন ছাড়তে ছাড়তে আসছে সামনের এলএসভি। বড়জোর দু শ ফুট দূরে। দেড় শ ফুট…

যাতে টলে না পড়ে, তাই পাশের দরজার হ্যাণ্ডেল ধরেছে লাবনী। অন্যহাতের বুড়ো আঙুল ঢুকেছে গ্রেনেডের রিঙের ভেতর। টান দিলেই খুলে আসবে পিন। আসছে, তারা! অনেক কাছে ডিউন বাগি। ড্রাইভার ও গানারের চেহারা পরিষ্কার দেখল লাবনী। তাদের ঠোঁটে ফুটে উঠেছে বিজয়ের হাসি। বেলা, কত দূরে চূড়া!

চিৎকার করে বলল বেলা, উঠে পড়ছি!

বুড়ো আঙুলের টানে গ্রেনেডের স্প্রিং লোডেড পিন খুলল লাবনী। আমড় হয়ে গেছে জিনিসটা।

শুকনো কাঠের মত খরখর করছে লাবনীর গলা। ভাবল, আশা করি এই গ্রেনেডে আছে পাঁচ সেকেণ্ডের ফিউয। নইলে গেছি!

বালিটিবির ওপরে উঠে প্রায় হুমড়ি খেল ল্যাণ্ড রোভার, তারপর চেপে বসল পাশের শৈলশিরায়। চূড়ার নিচে রয়ে গেছে এলএসভি।

ভাঙা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ল্যাণ্ড রোভারের ফেলে আসা, পথে গ্রেনেড ফেলল লাবনী। গড়ান দিয়ে সরে গেল কার্গো বেড পেরিয়ে সিটের ওদিকে। ততক্ষণে আবারও বালির ঢিবি বেয়ে নামতে শুরু করেছে ল্যাণ্ড রোভার। বাড়ছে গতি। লাবনীর জানা নেই পেছনের দরজা- ওকে নিরাপদ রাখবে কি না। ঝুঁকি না নিয়ে উপায়ও ছিল না।

ছিটকে চূড়ায় উঠে এল এলএসভি। গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন। সোজা চাকা তুলে দিল গ্রেনেডের ওপর। একইসময়ে ফাটল শক্তিশালী বোমা।

আকাশে ছিটকে উঠে বারকয়েক পাক খেয়ে পিছনে গিয়ে পড়ল এলএসভি। ঝাঁঝরা হয়ে গেছে প্রচণ্ড গতি এ্যাপনেলের আঘাতে। ধুপ করে উল্টো হয়ে পড়ল ওটা. তাঁবুর খুঁটির মত বালির ভেতর গেঁথে গেল গান টারেট। পাশেই ক্ষত-বিক্ষত দুই লাশ।

চোখ থেকে হাত সরিয়ে পেছনে দেখল লাবনী।

দাউদাউ আগুনে পুড়ছে এলএসভির ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু বালির ঢিবিতে উঠেছে দ্বিতীয় ডিউন বাগি। নতুন করে তেড়ে এল ওটা।

মন খারাপ হয়ে গেল লাবনীর।

দ্বিতীয়বার একই কৌশলে কাজ হবে না!

.

২৭

মনিটরে ধোঁয়ার কালো স্তম্ভ দেখে হতভম্ভ হয়েছে নাদির মাকালানি। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, কী হয়েছে? কী হলো ওটা?

লাবনী নষ্ট করে দিয়েছে তোমার একটা খেলনা, বলল রানা।

রাগে বিকৃত হলো মাকালানির চেহারা। ঘুরেই রানার পেটে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসল সে। চিৎকার করে উঠে ব্রিজে পাইলটকে বলল, পিছু নাও! ঘুরল ওয়েপন্স অফিসারের দিকে। ওদের বলো, যেন নল তাক করে ড্রাইভারের মাথার দিকে। জার যদি নষ্ট হয়, নিজ হাতে ওদেরকে খুন করব আমি!

অফিসার বড় করে দম নিয়ে ভাবল, কপাল ভাল জেনারেল আসিরের চাকরি করি, নাদির মাকালানির নয়। ডিউন বাগির ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতে লাগল সে।

হোঁচট খেল সবাই।

ল্যাণ্ড রোভারের পিছু নিয়েছে হোভারক্রাফট।

কর্কশ চিৎকার ছাড়ল নাদির, ফুল স্পিড! ফুল স্পিড! ধরো ওদেরকে!

আবারও সামনের সিটে ফিরেছে লাবনী। আপাতত সমান্তরাল ভাবে আসছে দ্বিতীয় এলএসভি। সরাসরি গুলি করতে পারবে গানার, কিন্তু কেন যেন তা করছে না। ওরা গুলি করছে না।

আপনি যেন তাতে খুশি নন? জানতে চাইল বেলা।

গুলি ঠিকই করবে, বলল লাবনী। বুঝে গেছে কারণটা। ওরা যখন বাগে পাবে, নির্ঘাত খুন হব। তার আগে ওই কেস চাই ওদের।

বাহ্, দারুণ খুশির কথা!

লাবনী দেখল, পেছনে আসছে প্রকাণ্ড হোভারক্রাফট। তবে ওটাকে আপাতত পাত্তা না দিলেও চলে। সামান্য দূরত্ব রেখে পাশাপাশি ছুটছে এলএসভি। বড় বিপদ ওটা। ওদের দিকেই ঘোরাচ্ছে মেশিন গানের নল।

টার্গেটিং মনিটরে পরিষ্কার দেখল রানা, প্রায় পাশে ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার ও এলএসভি। জয়স্টিক সামান্য নাড়ল ওয়েপন্স অপারেটর। লাবনী-বেলার গাড়ির ওপর গেল কার্সার। লাল হয়ে উঠেছে ওটা। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ল্যাণ্ড রোভারকে ট্র্যাক করছে আধুনিক রেইডার।

মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে উপস্থিত সবার দিকে তাকাল রানা। মনিটরের দৃশ্যে আঠার মত লেগে আছে নাদির মাকালানির প্রত্যাশাভরা চোখ। ভাব দেখে মনে হলো আমেরিকান ফুটবল দেখছে কিলিয়ান ভগলার। এইমাত্র প্রতিপক্ষকে পার করে টাচ লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার প্রিয় কোয়ার্টারব্যাক। খুব চিন্তিত চেহারা লুকমান বাবাফেমির। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে ম্যান মেটয। দেখবে না শেষদৃশ্য। পেশাদার অলস চোখে মনিটর দেখছে খালিদ আসির ও ওয়েপন্স অফিসার।

তার মানে, কেউ চেয়ে নেই রানার দিকে! হাতদুটো ওর পিঠের কাছে বাঁধা। কেউ ভাবছে না হুমকি হয়ে উঠবে ও। ওয়েপন্স রুমের অপরিসর জায়গায় বাধ্য হয়ে রিভলভারের নল নিচু করতে হয়েছে ভগলারকে। সবার চোখ মনিটরের দৃশ্যে।

আরেকবার ভগলারকে দেখল রানা, তৈরি হয়ে নিল।

বেলা যতই অন্তর থেকে কামনা করুক, অনেক জোরে ছুটবে ল্যাণ্ড রোভার, কিন্তু তা হওয়ার নয়। লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল অনেক বেশি দ্রুতগামী। আপাতত মাত্র এক শ ফুট দূরে। চলে আসছে আরও কাছে। সামনের গাড়ির ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে এম-সিক্সটি মেশিন গান তাক করছে গানার…

মরুভূমির হলদে পটভূমিতে এলএসভির গানারকে দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে। অস্ত্র তাক করছে সে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ জানিয়ে দিল, এবার যে-কোনও সময়ে গুলি করবে।

হঠাৎ করেই দুহাত মুঠি পাকিয়ে পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। ওর শক্ত মুঠো লাগল অপ্রস্তুত ভগলারের পেটে। কোৎ করে উঠল লোকটা। কাত হয়ে পড়ল এক টুপারের ওপর। এদিকে কেউ কিছু করার আগেই রানার হাঁটু লাগল ওয়েপন্স অফিসারের মাথার পাশে। সিট থেকে ছিটকে গেল সে। ঘুরেই দুহাতে জয়স্টিক ধরে একসারি বাটনের ওপর কপাল ঠুকল রানা।

এসব বাটন যুবরের একে-সিক্স হান্ড্রেড থার্টি গ্যাটলিং গানের। ল্যাণ্ড রোভারের ওপর থেকে টার্গেটিং কার্সার সরিয়ে নিয়ে এলএসভির ওপর স্থির করল রানা, পরক্ষণে টিপে দিল জয়স্টিকের বাটন। চওড়া মেইন ডেকে ঘুরে নতুন শিকারের ওপর স্থির হলো টারেট।

পরক্ষণে শুরু হলো তিরিশ এমএম মেশিন গানের বিশ্রী ভ্যার-ভ্যার-ভ্যার আওয়াজ। কানে তালা লেগে গেল সবার। মনে হলো খুব কাছে চালু হয়েছে চেইন সও। ছয় ব্যারেল থেকে প্রতি সেকেণ্ডে বেরোল আশিটি বিস্ফোরক শেল। ধাতব বজ্র-বৃষ্টির তোড়ে প্রায় উড়ে গেল এলএসভি। কিমা হয়েছে ড্রাইভার ও গানার। টার্গেট ধ্বংস হয়েছে না জানালে গুলি শেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে একে-সিক্স হান্ড্রেড থার্টি মেশিন গান।

এদিকে ঝট করে ঘুরেই এক টুপারের পাছায় কষে এক লাথি মেরেছে রানা। পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাশেরজনের ওপর। হুলুস্থুল লেগে গেছে ছোট্ট, ধাতব ঘরে। তবে সবার আগে সামলে নিল কিলিয়ান ভগলার, লাফিয়ে এসেই প্রচণ্ড এক ঘুষি বসাল রানার বুকে। পিছিয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে ছিটকে এক কন্সেলের ওপর পড়ল রানা। ঠাস করে ঠুকে গেল মাথা। চোখে দেখছে হাজার হাজার লাল-হলদে-নীল নক্ষত্র। ব্যথায় আটকে গেল দম।

থেমে গেল গ্যাটলিং গানের জোরালো গুঞ্জন। আবার সব নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওয়েপন্স অফিসার।

রানা সামলে নেয়ার আগেই ওর শার্টের কলার চেপে ধরল ভগলার। থুতনির নিচে ঠেসে ধরেছে রিভলভার। রানা কিছু বোঝার আগেই চোয়ালে লাগল নাদিরের জোরালো তিনটা ঘুষি। চতুর্থটা আরও প্রচণ্ড, মুঠো গেঁথে গেল ওর পেটে। ঝুঁকে গিয়ে ওর অবস্থা হলো আজন্ম কুঁজোর মত। হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ঘাড় ধরে দরজা পার করিয়ে দিল নাদির। বেতাল হয়ে বাইরের ডেকে ধুপ করে পড়ল রানা।

ঘর ছেড়ে পিছু নিয়ে তেড়ে এসেছে ক্রোধান্ধ নাদির। তার জোরালো কটা লাথি বুকে লাগতেই আবারও দম আটকে গেল ওর। সাধ্য থাকল না যে সরবে বা উঠবে। জানালার দিকে হাত তুলে চেঁচাল নাদির: ল্যাণ্ড রোভারের পিছু নাও!

বিস্মিত চোখে বিধ্বস্ত এলএসভি দেখছে বেলা। বলুন তো, এটা কী হলো?

ঘাড় ফিরিয়ে ছুটন্ত হোভারক্রাফট দেখল লাবনী। মনে জেগে উঠেছে সাহস। রানা! বেঁচে আছে এখনও।

এদিকে তাক করা হয়নি যুবরের মেশিন গান। ওরা বুঝে গেল, নাদির মাকালানি চায় না ধ্বংস হোক ক্যানোপিক জার। এখনও সুযোগ আছে রানা বা ওদের বাঁচার।

কিন্তু আগে চাই রানাকে ছুটিয়ে নেয়া, ভাবছে লাবনী। বেলাকে বলল, ঘুরে হোভারক্রাফটের দিকে চলো।

অবাক হয়ে ওকে দেখল বেলা। হা হয়ে গেছে মুখ। বলেন কী! দেখেননি কী করেছে ওই ন্যাংটো গাড়ির? খুন হব তো!

আমাদের দিকে গুলি করবে না, বলল লাবনী। মনে মনে ভাবছে, আমার কথা ঠিক হলেই হয়! ফিরে চলো!

বাঁক নিল ল্যাণ্ড রোভার। খুব অখুশি বেলা। আপনার মনে আছে, আপনাকে খুব বুদ্ধিমতী ভাবতাম? আশা করি আমার ধারণা ভুল নয়!

কীসের পর কী করবে ভাবছে লাবনী। একবার দেখল গ্রেনেড, তারপর খাপে রাখা ছোরা। এবার হার্নেস থেকে কেস ছুটিয়ে নিল ও।

এবার কী করবেন? জানতে চাইল বেলা।

কেস খুলে মেমোরি ফোমে শুয়ে থাকা জার দেখল লাবনী। ঢাকনি খোলা বলে একটু উঠে এসেছে জার। আবারও আগের মত হয়ে গেছে নিচের ফোম। ছোরা দিয়ে ফোমের কোনা থেকে কেটে নিল চার ইঞ্চি চতুর্ভুজ এক অংশ, তারপর বলল লাবনী, এবার দেখা যাক।

যুবরের বিস্মিত পাইলট জানাল, আবারও আমাদের দিকে ফিরছে।

বলো কী! ব্রিজের জানালা দিয়ে তাকাল নাদির। সত্যিই হোভারক্রাফটের দিকে সরাসরি ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার। হামলা করতে চায়? পাগল নাকি!

ওই জিপগাড়ি নিয়ে? হাসল জেনারেল আসির।

 হাতেমের কাছ থেকে গ্রেনেড পেয়েছে!

মাকালানির কথায় টিটকারির হাসি হাসল পাইলট। একটা গ্রেনেডে কিছুই হবে না। এই গাড়ি আর্মার্ড। বড়জোর ক্ষতি করবে রাবারের স্কার্টের। কিন্তু ওটা অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা। একটা সেকশন চুপসে গেলেও ক্ষতি হবে না।

তা হলে ফিরছে কেন?

দরজায় কবাটে হেলান দিয়ে বলল লুকমান বাবাফেমি, হয়তো হুশ ফিরেছে। ভাবছে, আত্মসমর্পণ করলে বাঁচবে।

বেধড়ক মার খেয়ে কুঁকড়ে আছে রানা। হাতদুটো মুক্ত থাকলে তবুও, লড়ত। দুপাশে দুই গার্ড। নাদির বলে দিয়েছে: তেড়িবেড়ি করলে লাথি মেরে হাগিয়ে দিতে হবে। কঠোর চোখে রানাকে দেখছে নাদির। একে যা বুঝেছি, মনে হয় না এর প্রেমিকা হার মানবে। বদমাশটাকে টেনে তোলো।

শার্টের কলার চেপে ধরে রানাকে দাঁড় করাল ভগলার। প্রচণ্ড এক ধাক্কা মেরে ফেলল পেছনের বালকহেডের ওপর।

অগ্রসরমান জিপ দেখল খালিদ আসির। ইঞ্জিনে গুলি করে থামিয়ে দিতে পারি।

মাথা নাড়ল নাদির। তাতে হয়তো নষ্ট হবে জার। খুশি মনে যখন আসছে, দেখাই যাক না কী করে। অশুভ চোখে রানাকে দেখল। তারপর কাজ ফুরালে খুন করব ওদের।

ল্যাণ্ড রোভার থেকে কালো-ধূসর পাথরের চাপড়ার মত দেখাল হোভারক্রাফট। সমতল ডেক থেকে সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের মত উঠেছে সুপারস্ট্রাকচার। ক্রমেই আরও বড় হয়ে উঠছে বিশাল যান।

হায়, ঈশ্বর! কী করতে চান? অস্ত্রের নল দেখে গলা শুকিয়ে গেছে বেলার।

লাবনীর পিঠে ব্যাকপ্যাকের মত করে ওয়েবিঙে ঝুলছে কেস। কুঁজো হয়ে বসেছে প্যাসেঞ্জার সিটে। সরে যেতে বললেই তা-ই করবে। রেডি হও…

ওই হোভারক্রাফট কিন্তু বিশাল! আপত্তির সুরে বলল বেলা। চ্যাপ্টা করে দেবে।

সেটা যেন না হয়, তা দেখার দায়িত্ব তোমার।

ও। উঁচু দালানের মত আসছে যুবর। যে-কোনও সময়ে চেপে বসবে ল্যাণ্ড রোভারের ওপর। প্রপেলারের গর্জনে থরথর করে কাঁপছে বাতাস।

ছোরা বের করেছে লাবনী। সরাসরি ওদের দিকে ছুটে আসছে হোভারক্রাফট। চারপাশে তুমুল বালিঝড়। রেডি… ওয়ান… টু… থ্রি… এবার!

স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে হোভারক্রাফটের পাশে চলে গেল বেলা। বামেই ওই ছুটন্ত দানব।

যে-কোনও সময়ে গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, সেজন্যে অপেক্ষা করছে লাবনী।

হোভারক্রাফটের একেবারে সামনে এসেও ঝড়ের বেগে সরে গেল ল্যাণ্ড রোভার। নাদিরের মনে হলো, জেনেবুঝে আত্মহত্যা করতে গিয়েও পরে ভয় পেয়েছে মেয়েদুটো। বালিঝড়ে হারিয়ে গেছে তারা। ঘোরো! ধাওয়া করো! চিৎকার করল নাদির।

স্টারবোর্ড উইঙে ব্রিজের হ্যাচ খুলল খালিদ আসির। ইশারা করল এক সৈনিককে। একই ইশারা পেল পোর্ট সাইডের সৈনিক। যাতে ঘুরে এসে হামলা না করে দুই মেয়ে, তা দেখবে তারা। দেখছি না, নাদির! গেছে বালির তুফানের ভেতর! জানাল আসির।

খুঁজে বের করো! পাল্টা চেঁচাল নাদির।

স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল পাইলট।

রাডার স্টার্নের তিন বিশাল প্রপেলার সরাতেই সাঁই করে ডানে গেল হোভারক্রাফট।

ভাঙা জানালা দিয়ে তুমুল বেগে ঢুকছে বালিকণা, পিনের মত বিঁধছে লাবনীর গোলাপী মোলায়েম তৃকে। তৈরি হয়ে বালিমেঘের ভেতর দূরে চেয়ে আছে ও।

ডানে কালো বড় কিছু। ওটা হোভারক্রাফট। ঘুরেই তেড়ে এল ল্যাণ্ড রোভারের দিকে। তুমিও চক্কর কাটো! নির্দেশ দিল লাবনী। চলে যাবে ওটার একেবারে পাশে!

বালিঝড়ে প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে বেলা। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে গাড়ি আবারও নিল যুবরের দিকে। দানবীয় হোভারক্রাফটের চেয়ে অনেক কম জায়গায় ঘুরতে পারছে। তীরের মত ছুটে গিয়ে পৌঁছে গেল ঘুরন্ত যানের পাশে।

প্রচণ্ড আওয়াজ তুলছে হোভারক্রাফটের মস্তবড় ফ্যান। তাড়া খেয়ে নানাদিকে ছুটছে বালিকণা। শোঁ-শোঁ আওয়াজ তালা লাগিয়ে দিচ্ছে লাবনী ও বেলার কানে। বাড়ছে খুন হওয়ার ঝুঁকি। কিন্তু যেতে হবে হোভারক্রাফটের আরও কাছে। একটু দূরেই ওটার স্কার্ট- রিইনফোর্সড় রাবারের কালো দেয়াল। গাড়ির দরজা খুলতেই তুমুল বাতাসের মুখে পড়ল লাবনী। প্রায় বেরিয়ে গেল ল্যাণ্ড রোভার ছেড়ে। হাতে উদ্যত ছোরা।

বাল্কহেডে চেপে ধরা হয়েছে রানার মুখ। পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে রিভলভারের নল ঠেসে ধরেছে ভগলার। যিপ-টাইখোলা সম্ভব হলেও কিছুই করতে পারবে না রানা। এত ব্যথা সহ্য করেও মৃদু হাসল নাদিরের হতাশাভরা কথা শুনে: গেল কই দুই শালী! দৌড়ে গিয়ে একবার ব্রিজের এ জানালা, আবার ও জানালায় উঁকি দিচ্ছে নতুন ধর্মগুরু।

বালিঝড়ের মধ্যে হোভারক্রাফটের পাশে ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার। প্রকাণ্ড উভচর যানের তলা থেকে ছিটকে আসছে প্রচণ্ড বেগের হাওয়া, সেইসঙ্গে বালি। পাঁচ ফুট দূরে কালো রাবারের স্কার্ট দেখল লাবনী।

ওটা চলে এল তিন ফুট দূরে।

তারপর দুই ফুট।

একরার সামনের দিক দেখে নিয়ে ডিফেণ্ডার থেকে লাফ দিল লাবনী, সরাসরি বাড়ি খেল স্কার্টের গায়ে। পুরু রাবারের গভীরে গেঁথে দিয়েছে ছোরা।

ওই গর্ত থেকে এল হাওয়া বেরোবার তীক্ষ্ণ হুইস। দুই হাতে ছোরার বাঁট ধরে ঝুলছে লাবনী। এরই ভেতর বাহুতে শুরু হয়েছে টনটনে ব্যথা। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পেছনে। ওর পরিকল্পনা শুনে আপত্তি তুললেও বাধা দেয়নি বেলা। আবার ঢুকে পড়েছে বালিঝড়ের মাঝে। প্রথম সুযোগে হোভারক্রাফট থেকে সরে যাবে দূরে।

লাবনীর পায়ের একটু নিচে সই-সাঁই করে পিছিয়ে যাচ্ছে হলদে মরুভূমি। ঘুরতে গিয়েও ঘণ্টায় অন্তত তিরিশ মাইল বেগে চলছে হোভারক্রাফট। এখন ছোরা খুলে এলে ছিটকে নিচে পড়বে লাবনী। রাবারের দেয়ালে পা বাধিয়ে উঠে যেতে চাইল। ওর ওজন রাখতে গিয়ে পায়ের নিচে কুঁকড়ে যাচ্ছে রাবার। মাথার মাত্র দুফুট ওপরেই খোল। হোভারক্রাফটের ইস্পাতের খোলের মাঝামাঝি জায়গায় রাবার থেকে ঝুলছে ও। তিন ডেক ওপরে ব্রিজ। ওর কাছ থেকে ছয় ফুট দূরে ধাতব রাং ল্যাডার উঠেছে:সংকীর্ণ এক ডেকে।

আরও শক্তভাবে বামহাতে ছোরার বাঁট ধরল লাবনী। ডানহাত তুলল ওপরে। ধরতে হবে খোলের নিচের অংশ। কিন্তু ছয় ইঞ্চি নিচে রয়ে গেল আঙুলের ডগা। দুহাতে ছোরার বাট শক্তভাবে ধরল লাবনী। রাবারের দেয়ালে পায়ের চাপ বাড়িয়ে পরক্ষণে উঠতে চাইল বাহুর জোরে। তাতে নড়ে গেল ছোরার ফলা। কাটা পড়ছে পুরু রাবারের স্কার্ট।

সর্বনাশ! বিড়বিড় করল লাবনী। ভয়ে ধড়ফড় করছে বুক। গর্ত থেকে বেরোচ্ছে আগের চেয়ে বেশি বাতাস। ওই গর্ত আরও বড় হলে খসে পড়বে ছোরা।

ফলাফল: ওর নিশ্চিত পতন!

সাহস করে আবারও খোলের দিকে হাত বাড়াল লাবনী, কিন্তু দুইঞ্চি দূরে রয়ে গেল মধ্যমার ডগা।

ওই যে! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পাইলট। আঙুল তাক করেছে বালিঝড়ের দিকে। ল্যাণ্ড রোভার! ক্রমেই দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে জিপগাড়ি!

এবার দেখতে পেয়েছে নাদির মাকালানি। বাঘের মত গর্জে উঠল, পিছু নাও!

গতিপথ পাল্টে ল্যাণ্ড রোভারের দিকে ছুটল যুবর। নড়েচড়ে বসেছে পাইলট। এবার বাগে পাবে শিকার।

হোভারক্রাফট বাঁক নিচ্ছে বলে তিরতির করে কাঁপছে ওটার স্কার্ট। আবারও ঝাঁকি খেল ছোরা। গর্তের নিচে তৈরি করছে। চেরা একটা ফাটল। লাবনী টের পেল, খুলে আসছে ছোরার ফলা।

বাঁটে দুহাতের চাপ তৈরি করে নিজেকে টেনে তুলতে চাইল লাবনী। পরক্ষণে ডানহাত ঝটকা দিয়ে বাড়িয়ে দিল ওপরে। ডেকের ধাতব স্পর্শ পেল ওর আঙুল। প্রাণপণে খামচে ধরল ইস্পাতের কিনারা। দেরি না করে ছেড়ে দিল ছোরার বাট। বামহাত বাড়িয়ে দিল ওপরে। জোর বাতাসের তোড়ে গর্ত থেকে মরুভূমিতে পড়ে গেল ছোরা। দুহাতে ডেকের কিনারা ধরে একটু দূরের মইয়ের দিকে দুলতে দুলতে চলল লাবনী। ভাবছে, কে বলেছে রানার সঙ্গে মিশে কিছুই শিখিনি!

কয়েক সেকেণ্ড পর ওর হাত পড়ল মইয়ের সবচেয়ে নিচের রাং-এর ওপর।

দপ-দপ্ করা লাল এক ওয়ার্নিং লাইট জ্বলছে। ওটা দেখে সতর্ক হলো কো-পাইলট। স্যর! লিক হয়েছে স্কার্টে!

কোথায়? জানতে চাইল পাইলট।

স্টারবোর্ড সাইড, স্যর। সেন্টার সেকশন।

উইং ব্রিজের জানালা দিয়ে নিচে তাকাল খালিদ আসির। ওই যে একপাশের ডেকের মই বেয়ে উঠছে সুন্দরী লাবনী আলম! ওই মেয়ে উঠে এসেছে! পিস্তল বের করল সে।

একদৌড়ে তার পাশে পৌঁছুল নাদির। গুলি কোরো না! অবাক চোখে তাকে দেখল আসির। ওর সঙ্গে ক্যানোপিক জারের কেস! ওই মেয়ে পড়লে ভাঙবে জার! তোমার ক্রুদের পাঠাও ওকে ধরে আনতে!

মইয়ের শেষ ধাপ পেরিয়ে নিচের ডেকের কোণে হারিয়ে গেল লাবনী। কাকে যেন অভিশাপ দিল খালিদ আসির, তারপর সরে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বলল, ইট্রডার! ইনট্রডার! ক্যাচ দ্য গার্ল, অ্যাণ্ড ব্রিং হার টু মি!

বিস্ময় নিয়ে রানার দিকে ঘুরে তাকাল নাদির মাকালানি। ওই মেয়ে সত্যিই ভাবছে, তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে?

পারলেও পারতে পারে, তোমার চেয়ে মাথায় বুদ্ধি ওর বেশি, জবাবে বলল রানা।

না, অত বুদ্ধি নেই, ঘোঁৎ করে উঠল ভগলার। ওর বুদ্ধি থাকলে জীবনেও আসত না! জানেও না, প্রাণ নিয়ে নামতে পারবে না এখান থেকে।

অন্তত তোমার চেয়ে বুদ্ধি বেশি, তা যে কেউ বুঝবে, জানাল রানা। তাতে অর্জন করল কিডনির ওপর ভগলারের মাঝারি এক ঘুষি।

ব্যথা পাত্তা দিল না রানা। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

 লাবনীর সঙ্গে অস্ত্র বলতে কিছুই নেই।

শত্রুরা সংখ্যায় অনেক।

এতবড় ঝুঁকি নিয়ে হয়তো মস্তবড় ভুলই করেছে লাবনী।

.

সাইড ডেকে থেমে কোথায় আছে বুঝতে চাইছে লাবনী। এই ক্রাফটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গেছে সরু ওয়াকওয়ে। মাঝে ভেতরে যাওয়ার মত কয়েকটা হ্যাচ। ডানদিকে কাছেরটা। আরেকটা মই উঠেছে যুবরের প্রকাণ্ড মেইন ডেকে। কিন্তু ওটা ফাঁকা ধাতব মাঠের মত। আকারে ফুটবল মাঠের অর্ধেক। রানার সঙ্গে মিশে অন্তত শিখেছে, ওখানে কোনও কাভার পাবে না। এখন উচিত কারও চোখে না পড়ে লুকিয়ে থাকা। কাজেই…।

স্টার্নে খুলে গেল একটা দরজা, ইঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে লাবনীকে ধরতে তেড়ে এল দুই লোক।

হয়েছে আমার লুকিয়ে পড়া, বিড়বিড় করে বলেই কাছের হ্যাচ খুলে ঢুকে পড়ল লাবনী। দড়াম করে বন্ধ করল হ্যাচ। আছে খুব সরু এক ভীষণ আওয়াজ ভরা হলওয়েতে। হ্যাচের ভেতরে লকিং মেকানিযম আছে, রঙ মাখা ধাতব দেহে স্টেনসিল করা সাইক্রিলিক ইন্সট্রাকশন। একবার আরবিতে, আরেকবার ইংরেজিতে: এনবিসি সিল বিলো।

লাবনী জানে, এ লেখার অর্থ: নিউক্লিয়ার, বায়োলজিকাল, কেমিকেল দূষণ থেকে বাঁচা যারে এসব সিল করা ধাতব কক্ষে। এক কথায় ম্যাস ডেস্ট্রাকশন ওয়েপন্স ব্যবহার হলেও কিছুই হবে না ভেতরে রয়ে যাওয়া মানুষের।

লিভার টেনে দিল লাবনী। ঘটাং আওয়াজে আটকে গেল ভারী বোল্ট। নিচেই লাল রঙের অপেক্ষাকৃত ছোট এক হ্যাণ্ডেল, টান দিতেই লক হলো ওটা।

বজ্রপাতের মত আওয়াজ ওকে জানিয়ে দিল, পেছনের বাল্কহেডেই রয়েছে হোভারক্রাফটের লিফট ফ্যান। প্যাসেজের শেষমাথায় পৌঁছে গেল ও। সামনের বাহেডে এক দরজার ওদিকে সারি সারি বাঙ্ক বেড়। ক্রু কোয়াটার। আর যাই হোক, ঘুমাবার জন্যে ভাল জায়গা নয়, ভাবল লাবনী। তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ভাল দিক হচ্ছে, ওদিকে আছে সাইড ডেকে যাওয়ার একটা হ্যাচ।

পেছনে দমাদম ঘুষি পড়ছে হ্যাচের ওপর। ওই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ক্রুরা। দরজা খুলতে চাইলেও কাজটা অসম্ভব। অবশ্য, চট করেই বুঝবে, হ্যাচ লক করা। তখনই ঢুকবে পরের হ্যাচ ধরে।

বাঙ্ক ভরা ঘর পেরিয়ে ওদিকের হ্যাচ বন্ধ করল লাবনী। এক সেকেণ্ড পর বাইরে থেকে ধুম-ধাম শুরু করল কে যেন!

পাশের হ্যাচের ওদিকেই ইঞ্জিন রুম। লক করা নয়। এবার যা করার দ্রুত করতে হবে। পিঠ থেকে ওয়েবিং খুলে একটা বেডের ওপর কেস রাখল লাবনী। খুলে ফেলল ডালা।

ইন্টারকমের মাধ্যমে রিপোর্ট শুনছে খালিদ আসির। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, নাদির, ওই মেয়ে স্টারবোর্ড কেবিনের ভেতরে। লক করে দিয়েছে হ্যাচ। ঢুকতে পারবে না কেউ। তবে ওই মেয়ে নিজেও কোনও দিকে যেতে পারবে না।

লুকমান বাবাফেমির দিকে তাকাল নাদির মাকালানি। বাবাফেমি, ওই কেস আমরা পেলেই ওটার ভেতরের জার পরীক্ষা করবেন।

তাতে একটু বাড়তি জায়গা লাগবে, ঘরে ঢুকল ভ্রষ্ট আর্কিওলজিস্ট।

দুই পাইলটের পেছনে রয়েছে ছোট ধাতব প্লটিং টেবিল, হাতের ঝাপটায় ওটার ওপর থেকে ম্যাপ ফেলল নাদির মাকালানি। ঘুরে তাকাল কিলিয়ান ভগলারের দিকে। যাও, ধরে আনো হারামজাদী বেটিকে! এমন কিছু করতে যেয়ো না, যে কারণে ক্ষতি হবে জারের। গুলি করা চলবে না।

এ কথা শুনে অখুশি হলো ভগলার, তবে মাথা দোলাল। বন্দি রানাকে পাহারা দেয়ার জন্যে হাতের ইশারা করল এক সৈনিককে। নিজে বেরিয়ে গেল ব্রিজ ছেড়ে।

পিএ সিস্টেমের হ্যাণ্ডসেট নিল নাদির, বাটন টিপে চিৎকার করে বলল, ডক্টর আলম!

পিঠে ক্যানোপিক জারের কেস ঝুলিয়ে নিয়েছে লাবনী, সাবধানে হ্যাচ খুলে উঁকি দিল হোন্ডে। সামনেই কাদামাটি মাখা দুটো ক্যাটারপিলার এক্সকেভেটরের মাঝে তৃতীয় ডিউন বাগি। ওটা সিভিলিয়ানদের জন্যে তৈরি, সঙ্গে অস্ত্র নেই।

ঘর ছেড়ে বেরোবে লাবনী, এমনসময় গমগমে কণ্ঠে লাউড স্পিকারে এল নাদিরের কণ্ঠ: ডক্টর আলম! ভাল করেই জানি, কথা শুনতে পাচ্ছেন। আত্মসমর্পণ করে আমাদের হাতে তুলে দিন ওই জার। তা যদি না করেন, খুন হবে মাসুদ রানা!

খচ-মচ আওয়াজ হলো। কয়েক সেকেণ্ড পর এল রানার কণ্ঠ: ভুলেও নাদিরের কথা শুনো না, লাবনী!

মৃদু হেসে ফেলল লাবনী।

বেঁচে আছে রানা!

 ওর এত বড় ঝুঁকি নেয়া বিফল হয়নি।

পাহারা দিয়ে রানাকে আটকে রেখে ওর মাধ্যমে এখন জার ফেরত চাইছে নাদির। ভালই!

অবশ্য নাদির মাকালানি কতটা রেগে যাবে, তার ওপর নির্ভর করছে রানা আর ওর জীবন রক্ষা পাবে কি না। জার পাওয়ার আগেই রানাকে মেরে ফেললে…

গলা ভীষণ শুকিয়ে গেল লাবনীর। ভালবেসেছে জীবনে মাত্র একবার। ওই লোক স্বপ্নের নায়ক মাসুদ রানা। তাকে হারালে বাঁচার আর কোনও উদ্দেশ্য থাকবে না ওর।

আমার কথা বাদ দাও, লাবনী, চুরমার করো নরকের জার। তারপর দেরি না করে নেমে পড়বে… মাঝপথে থেমে গেল রানার বক্তব্য। শোনা গেল ঘুপ! করে একটা আওয়াজ।

রাগে-দুঃখে কেঁপে উঠল লাবনীর বুক।

রানা অসহায়!

ওকে বন্দি করে পেটাচ্ছে অমানুষের দল!

ওই জার আনুন, ডক্টর আলম, নইলে খুন হবে রানা! ক্লিক আওয়াজে থেমে গেল পিএ সিস্টেম।

রানার ক্ষতি হবে ভাবতে গিয়ে হাত-পা কাঁপছে লাবনীর। পা রাখল হোল্ডে। কফুট এগিয়ে থামল। বুঝতে পারছে না এখন কী করবে। একইসময়ে একটা হ্যাচ খুলে ঢুকে পড়ল হোভারক্রাফটের কজন ক্রু। হাতে অস্ত্র। তাদের নেতা খপ করে ধরে পিঠের ওপরে নিল লাবনীর হাত।

গুহার মত হোন্ডের মই বেয়ে নামছে কেউ। ওই কাউবয় বুটের আওয়াজ চেনে লাবনী।

কিলিয়ান ভগলার!

মই বেয়ে নেমে এল সে, ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি। লাবনীকে বলল, আগেই ধরা পড়েছ। নইলে বুঝিয়ে দিতাম কত গমে কত রুটি! রিভলভার তাক করল সে লাবনীর বুকে। এবার চলো, উঠবে ওপরে।

সৈনিকরা প্রায় ঘিরে ফেলেছে লাবনীকে।

ওকে নিয়ে যাওয়া হলো মইয়ের সামনে।

তবে আগে উঠে গেল ভগলার, তারপর ওপর থেকে ইশারা করল উঠতে।

লাবনী পরের ডেকে উঠতেই একসারি রাং মই দেখাল ভলার। দোতলা পেরিয়ে মেইন ডেকে উঠল ওরা।

জানালাহীন এক প্যাসেজ পার করে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো ব্রিজে।

অপেক্ষায় ছিল নাদির মাকালানি। ঘরে আছে রানাও। ওকে পেছনের দেয়ালে পোর্ট উইং ব্রিজের হ্যাচের কাছে আটকে রেখেছে এক সৈনিক। হাল ছেড়ো না, বলল রানা। তবে তখনই দেখল লাবনীর সঙ্গে ক্যানোপিক জারের কেস। গম্ভীর হয়ে গেল রানা। হয়তো ভাল হতো ওই জার আগেই ভেঙে ফেললে।

চেয়েছি, তুমি যেন সুস্থ থা… চুপ হয়ে গেল লাবনী।

লোলুপ দৃষ্টিতে কেসটা দেখছে নাদির মাকালানি। ওটা সাবধানে নামিয়ে রাখুন, ডক্টর আলম। প্লটিং টেবিল দেখাল সে। খুব সাবধানে। ডক্টর বাবাফেমি!

বুক ফুলিয়ে সামনে বাড়ল লুকমান বাবাফেমি। বোকা লোক, নিজ গুরুত্ব নিজেই বাড়িয়ে নিয়েছে। দুই পাইলটের মাঝ দিয়ে সংকীর্ণ পথে এগোল সে।

এদিকে কাঁধের স্ট্র্যাপ থেকে কেস খুলেছে লাবনী।

ওটা হাতে পেয়ে টেবিলে রাখল বাবাফেমি। মাথা দোলাল। দেখে তো মনে হচ্ছে না ক্ষতি হয়েছে।

পিছিয়ে আনো ওই মেয়েকে, নির্দেশ দিল নাদির। স্টারবোর্ড বালকহেডের সামনে লাবনীকে নিল ভগলার।

লাবনী দেখল, ওয়েপন্স রুমে দাঁড়িয়ে আছে ম্যান মেটয। তাকে কড়া চোখে দেখল ও। লজ্জায় ফ্যাকাসে মুখ অন্যদিকে সরিয়ে নিল মিশরীয় আর্কিওলজিস্ট।

এবার খুলুন ওই কেস! নির্দেশ দিল নাদির।

 রানা, তৈরি থেকো! বলল লাবনী।

সতর্কতার সঙ্গে কেসের ল্যাচ খুলল লুকমান বাবাফেমি। তার দিকে ঝুঁকে এল অন্যরা। ব্রিজের আরেক প্রান্ত থেকে রানার দিকে তাকাল লাবনী। আশা করছে চোখে চোখ পড়বে দুজনের। সেক্ষেত্রে নীরবে ও বুঝিয়ে দেবে কী হয়েছে। কিন্তু তা হওয়ার নয়, মাঝে আছে এক সৈনিক।

কেসের ঢাকনি নাটকীয় ভঙ্গিতে খুলল বাবাফেমি। টুং আওয়াজে কেস থেকে ছিটকে এল বাঁকা, ধাতব এক টুকরো। টেবিলে পড়ে বার কয়েক ঘুরল ওটা।

ওটা কী, বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গেল সবাই।

হ্যাণ্ড গ্রেনেডের সুন!

এতক্ষণ ফোম ও কেসের ডালার মাঝের চাপে ঠিক জায়গায় বসে ছিল ওটা। বন্ধ করার আগে গ্রেনেড থেকে পিন সরিয়ে তারপর কেস আটকে নিয়েছে লাবনী।

কিন্তু এখন…

মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পর ফাটবে গ্রেনেড!

চার সেকেণ্ড!

ব্রিজের ভেতর হঠাৎ করেই যেন শুরু হলো হুলুস্থুল। কেসের সবচেয়ে কাছে ছিল নাদির মাকালানি। সে-ই আগে চরকির মত ঘুরে একদৌড়ে সামনের দরজা পেরিয়ে পালিয়ে গেল। ধাতব, ভারী টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ল এতবড় জেনারেল খালিদ আসির। দুহাতে চেপে ধরেছে দুকান। সিঁড়ির দিকে ছুট দিল এক সৈনিক। রানাকে পাহারা দেয়া ফেলে দূরের মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল দ্বিতীয় সৈনিক।

পেরোল তিন সেকেণ্ড…

ঘরের দুপ্রান্তে চোখে চোখে কথা হলো লাবনী ও রানার।

পরক্ষণে যে যার মত ঝেড়ে দৌড় দিল ওরা।

সামনেই উইং ব্রিজের দুই হ্যাচওয়ে।

গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে বাকি মাত্র দুই সেকেণ্ড!

এতক্ষণ ক্যানোপিক জার দেখবে বলে হাঁ করে চেয়ে ছিল লুকমান বাবাফেমি। এবার দেখল, ওই জিনিসের বদলে কেসের ভেতরে ভোতা সবুজ রঙের কী যেন! আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল তার। ও রে, মা! বলেই ঘুরে পালাতে গেল সে। কিন্তু লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে পথ আটকে ভাগছে দুই পাইলট!

বাকি রইল মাত্র এক সেকেণ্ড!

উইং ব্রিজের রেলিং টপকে যেতে গিয়ে রানা দেখল, নিচেই লিফট ফ্যানের বৃত্তাকার ভেন্ট। বনবন করে ঘুরছে ফ্যান। ওখানে পড়লে কি হবে! ওদিকে ঝাঁপ না দিয়ে এক লাফে পেছন ব্যারিয়ার সেকশনে ডাইভ দিল রানা। হাতদুটো প্ল্যাস্টিকের টাই দিয়ে বাঁধা। পতন এল হাড় গুঁড়ো হওয়ার মত ব্যথা নিয়ে।

ব্রিজের ওপাশের রেলিং টপকে ঝাঁপ দিয়েছে লাবনী।

তখনই বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড!

.

২৮.

 রিইনফোর্সড কেসে রাখা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতেই ছাত ও কোমর উচ্চতায় ছিটকাল ক্ষুরের মত ধারালো শাপনেল। মুহূর্তে খুন হলো দুই পাইলট। শূন্যে তিন ডিগবাজি দিয়ে পেছন জানালা ভেঙে নিচের মেইন ডেকে পড়ল লুকমান বাবাফেমির দুভঁজ হওয়া লাশ।

সিঁড়ির দিকে ছুটন্ত সৈনিক পৌঁছে গিয়েছিল দরজার কাছে, ওখানেই ঝাঁঝরা হয়েছে পিঠ ও ফুসফুস। লাশ পড়ে আছে রক্তের পুকুরের ভেতর। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সরাসরি হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে ঘরের অন্যরা। তবে আপাতত ওই বিকট আওয়াজের কারণে প্রায় কালা হয়েছে সবাই।

কবজা থেকে ছিটকে গেছে পোর্ট উইং হ্যাচ। কয়েক পল্টি খেয়ে গিয়ে পড়েছে নিচে মস্তবড় লিফট ফ্যানের ভেতর। তাতে হ্যাচ চিবিয়ে নিজেই চুরমার হয়েছে জেট ইঞ্জিনের পাখার মত ব্লেড। গড়াতে শুরু করেও থেমে মেঝেতে মুখ চেপে রেখেছে রানা। ওর ওপর দিয়ে সুপারস্ট্রাকচারে লাগল ভাঙাচোরা ধাতব সব টুকরো। ভীষণ এক ঘুরপাকে পড়ে খাড়া শাফটে ছিটকে ঢুকল,হ্যাচ। দুই সেকেণ্ড পর থরথর করে ডেক কাঁপিয়ে দিয়ে বিকট এক আওয়াজ হলো। আটকে গেছে ফ্যানের ড্রাইভশা। প্রতি মিনিটে জটিল মেশিনের চলার কথা চল্লিশ হাজার বার, কিন্তু থামতে হয়েছে মুহূর্তে। ফলে ছিঁড়েখুড়ে যাচ্ছে ওটা।

শুধু ফ্যানেরই ক্ষতি হয়নি, নষ্ট হয়েছে ড্রাইভশাফটের সঙ্গে সংযুক্ত পোর্ট সাইড ইঞ্জিন রুমের এক গ্যাস টারবাইন পাওয়ার প্লান্ট। এ কারণে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি খেয়েছে গোটা হোভারক্রাফট। উপড়ে গিয়ে নানাদিকে ছিটকে পড়েছে ইঞ্জিন রুমের যন্ত্রপাতি। টারবাইন বিস্ফোরিত হতেই হ্যাচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কমলা আগুনের গোলা।

ভেসে থাকার চার ভাগের এক ভাগ শক্তি হারিয়ে বসেছে যুবর। পোর্টসাইডে ঝুঁকে পড়েছে না। তাই বদলে গেছে গতিপথ। বেঁচে নেই পাইলট। গ্রেনেড বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কন্ট্রোল। বিশাল যন্ত্রটা চালাবার কেউ নেই।

ওপর থেকে আছড়ে পড়ে সারাশরীরে ব্যথা রানার। দুহাতে ভর করে উঠে বসল। এখন কারও বন্দি নয় ও। অবশ্য, এখনও পিঠের কাছে হাতে বাঁধা যিপ-টাই। বুঝতে পারছে, প্রথম কাজ হওয়া উচিত হাতদুটো খুলে নেয়া।

একটু দূরেই দেখল চোখা এক ধাতুর টুকরো। এক প্রান্তে আগুনে জ্বলছে ইনসুলেশন রাবার। সামনে বেড়ে বামহাতে ওটা তুলে নিল রানা। টের পেল, পুড়তে শুরু করেছে ত্বক। স্টিলের টুকরো এখনও আগুনের মত গরম। ভুরু কুঁচকে প্ল্যাস্টিকের টাই-এর ওপর জ্বলন্ত রাবার ঠেসে ধরল রানা।

ওয়েপন্স রুমে বস এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাদির মাকালানির ওপর থেকে সরে গেল কিলিয়ান ভগলার। ঘরের কোণে দুহাতে কান চেপে বসে আছে ম্যান মেটয। কন্সেলের ওপর মুখ থুবড়ে আছে ওয়েপন্স অফিসারের লাশ। উড়ন্ত সব জঞ্জাল ছিটে যাওয়ার সময় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে তার ঘাড়ে।

মেঝেতে খুঁজে নিজের রিভলভার পেয়ে একহাতে ওটা রেখে অন্য হাতে নাদির মাকালানিকে তুলল ভগলার। আপনি ঠিক আছেন তো?

বোধহয় ঠিকই আছি, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল নাদির। পরক্ষণে রাগে কুঁকড়ে গেল পোড়া মুখ। আমাকে খুন করতে চেয়েছিল ওই ডাইনী! যাও! শেষ করো ওই হারামজাদীকে!

জারের কী হবে? ওর কাছে রয়ে গেছে ওই…

 চিৎকার করে উঠল নাদির, আগে খুন করো শালীকে!

ভুরু কুঁচকে ব্রিজে গিয়ে ঢুকল ভগলার।

ঘরে এখনও ঘন ধোয়া। আগুনে জ্বলছে কটা কোেল। কাশতে শুরু করে টেবিলের তলা থেকে বেরোল জেনারেল খালিদ আসির। বাঁকা হয়ে গেলেও পুরু স্টিলের তৈরি টেবিল ঠেকিয়ে দিয়েছে বিস্ফোরণ। পোর্ট হ্যাচের কাছে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এক সৈনিক। এগিয়ে তার ক্ষত পরীক্ষা করল আসির। কিন্তু তাকে আঙুল তুলে ডেক দেখাল ভগলার। মাসুদ রানার পেছনে যান। আমি ধরে আনছি ওই মেয়েলোকটাকে।

কিন্তু এই আহত সৈনিকের…।

দরজার কাছ থেকে বলল নাদির, খালিদ, দ্বিগুণ টাকা পাবে। ওই দুই ইবলিশকে খুন করো!

দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়াল আসির। একবার বন্ধুকে দেখে নিয়ে পা বাড়াল হ্যাচের দিকে। স্টারবোর্ড উইং ব্রিজের দিকে ছুটে গেল ভগলার। রেলিঙে পৌঁছে দেখল নিচে।

ওপর থেকে লিফট ফ্যানের পাশে পড়েছে লাবনী। রিভলভার তুলে তাক করার আগেই ভগলারকে দেখল, তাই চাইল দৌড়ে পালিয়ে যেতে। পেছনে বৃত্তাকার দুফুট উঁচু এয়ার ইনটেকে লাগল ম্যাগনাম গুলি।

নিচের ধাতব ডেকে কাভার বলতে কিছুই নেই। অবশ্য, বো-র কাছে গ্যাটলিং গানের টারেট। কিন্তু ওই পর্যন্ত যাওয়ার আগেই পিঠে গুলি খেয়ে মরবে লাবনী।

এখন বাঁচার একমাত্র উপায়…

ডেকের রেলিঙের দিকে ঝাঁপ দিল লাবনী। একইসময়ে গুলি করল, ভগলার। কিন্তু রেলিঙের নিচে সেঁধিয়ে গেছে। লাবনী। ধাতব মেঝেতে লেগে রঙ চল্টে আরেক দিকে গেল বুলেট। শুকনো রঙ লেগেছে লাবনীর মুখে। আরেক গড়ান দিয়ে পড়ল একটু নিচের সরু ওয়াকওয়েতে। কানের কাছ দিয়ে গেল একটা বুলেট। শরীর সরিয়ে ওয়াকওয়ের আড়াল নিল লাবনী।

এখন আর ওকে দেখতে পাচ্ছে না ভগলার। যাশশালা! বলে নিচে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল সে।

ওদিকে পোর্ট উইঙে তাকাল খালিদ আসির। দানবের ফোকলা মুখের মত হাঁ হয়েছে লিফট ফ্যানের ভেণ্ট। কাছেই মাসুদ রানা। অস্ত্র বের করতে হোলস্টারে ছোবল দিল আসির।

ত্বক পুড়ে যাচ্ছে রানার। ধাতুর জ্বলন্ত টুকরো ঠেসে ধরেছে যিপ-টাইয়ের ওপর। টের পাচ্ছে, আগুনের তাপে গলছে প্ল্যাস্টিক। টান পড়তেই লম্বা হয়ে পরক্ষণে ছিঁড়ে গেল ওটা। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। একইসময়ে চোখের কোণে দেখল, ওপরের ব্যালকনিতে কে যেন! ওর দিকে তাক করছে আগ্নেয়াস্ত্র!

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ও ট্রেনিং একইসঙ্গে কাজ করল রানার মগজে। তপ্ত স্টিলের টুকরো ছুঁড়ে দিল ওপরে। পরক্ষণে চিতার বেগে দৌড় দিল স্টার্নের দিকে। বিস্মিত এক আর্তচিৎকার শুনে বুঝল, ভ্রষ্ট হয়নি লক্ষ্যভেদ!

খালিদ আসির সামলে নেয়ার আগেই সুপারস্ট্রাকচারের কোনা ঘুরে সরে যেতে পারলেই বাঁচবে ও!

কিন্তু বুম করে উঠল পিস্তল!

সামনের ডেকে লেগে পিছলে গেল বুলেট। ওদিকে যাওয়ার উপায় নেই, বুঝে গেল রানা। বাধ্য হয়ে পেছনের লিফট ফ্যানের পাশে ঝাঁপ দিল ও। উঠে বসেই হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল ইনটেকের ওদিকে। কিন্তু ওটা ওর জন্যে ভাল কাভার নয়। বড় বেশি নিচু।

অর্ধেক বেরিয়ে আছে রানার দেহ।

 অস্ত্র তাক করে ট্রিগার টিপে দিল আসির।

রানার দিকে ছুটল বুলেট, পরক্ষণে হ্যাচকা টান খেয়ে নেমে গেল নিচে। খপ করে ওটাকে গিলে ফেলল বিশাল ফ্যান। মাথা উঁচু করে রানা বুঝল, প্রচণ্ড বেগে বাতাস নিচ্ছে শাট। খালিদ আসির আর ওর মাঝে ওই ঘূর্ণিপাক রয়ে গেলে কোনওভাবেই ওকে গুলি করতে পারবে না লোকটা।

একই সময়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে জেনারেল আসির, লাফিয়ে নেমে এল নিচের ডেকে। ঘূর্ণিপাকের সুযোগ নিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের আড়ালে যাবে ভেবেছিল রানা, কিন্তু পিস্তল উঁচু করে মাঝের জায়গাটা কাভার করল লোকটা।

রানা বুঝল, মরণ ফাঁদে পড়েছে এবার।

ওয়াকওয়েতে পড়ে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠেছে লাবনী। তবুও ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। একটু দূরেই এক হ্যাচ। প্রথমে ওটা দিয়েই হোভারক্রাফটে ঢুকেছিল। আবারও হ্যাচ খুলে দিয়েছে কেউ। অলসভাবে ঝুলছে ভারী দরজা।

 চারপাশ দেখে নিয়ে লাবনী বুঝল, এ প্যাসেজে কেউ নেই। হ্যাচ গলে ঢুকে পড়ল ও। ক্রু কোয়ার্টার, এখনও ফাঁকা। যে বেডের নিচে ক্যানোপিক জার লুকিয়ে রেখেছিল, ওখানে চলে গেল লাবনী। রানা মুক্ত, কাজেই ওর হাতে এখন আছে জেতার জন্যে প্রয়োজনীয় বেশকিছু তাস। এবার যুবর থেকে নেমেই নষ্ট করবে ওই জার। নাদির মাকালানির উপায় থাকবে না জেনেটিক্যালি ইস্ট তৈরি করে দুনিয়ার মানুষের সর্বনাশ করার।

এখন প্রথম কাজ হচ্ছে রানাকে খুঁজে বের করা।

ক্যানিয়নের দিকে যেতে যেতে ঘুরে তাকাল বেলা। অবাক হয়ে দেখল, এখন আর ওর দিকে আসছে না কালান্তক হোভারক্রাফট! ওটা চলেছে তেরচাভাবে। মারাত্মক কোনও ক্ষতির কারণে ভকভক করে উঠছে ঘন কালো ধোঁয়া। স্টার্নে লকলক করছে লালচে আগুন।

নিশ্চয়ই ওটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন মাসুদ ভাই আর লাবনী আপু মিলে, ভাবল বেলা।

কিন্তু ছুটন্ত ওই দানব থেকে তারা নেমে গেছেন, এমন কোনও লক্ষণ নেই মরুভূমিতে। বেলা বুঝল, যে পথে ছুটছে হোভারক্রাফট, ক্যানিয়নের দিকে যাবে না ওটা। সোজা ছুটবে সমতল মরুভূমির বুক চিরে।

আর মরুভূমির ওই সমতল জমি ফুরিয়ে গেলে পড়বে উঁচু শৈলশিরা থেকে অনেক নিচে!

সেরেছে! বিড়বিড় করল বেলা।

ব্রিজে ঢুকে হতবাক হয়েছে ম্যান মেটয। আতঙ্ক নিয়ে দেখছে দুই পাইলটের রক্তাক্ত লাশ। কয়েক সেকেণ্ড পর ভাষা ফিরল তার: জিযাস! হঠাৎ কী হয়ে গেল?

বাদ দিন, বলল নাদির, এখন খুঁজে বের করতে হবে লাবনী আলমকে। সঙ্গে ওই জার। এরই ভেতর বুঝেছে, ল্যাণ্ড রোভার থেকে নামার আগে বা পরে গ্রেনেডের স্পন খোলেনি লাবনী, নইলে লাফিয়ে হোভারক্রাফটে ওঠার সময় বোমা ফাটার সম্ভাবনা ছিল। হোভারক্রাফটে ওঠার পর জার সরিয়ে গ্রেনেড রেখেছে। তার মানে… এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে ওই জার। আসুন আমার সঙ্গে।

ইয়ে… আমি…রক্তাক্ত লাশ থেকে চোখ সরাতে পারছে না মেটয। আমার কেমন যেন বমি আসছে।

ঠেলে বাহেডে তাকে ফেলল নাদির। পরক্ষণে কাঁধ খামচে ধরে সিঁড়ির দিকে রওনা হলো। ধমকের সুরে বলল, বাঁচতে চাইলে যা বলি, তাই করুন। নইলে খুন হবেন।

লিফট ফ্যানের আড়ালে রয়ে গেছে রানা। ডেকের এদিক ওদিক দেখল। না, উপায় নেই সরে যাওয়ার। সামনে একটা হ্যাচ। কিন্তু ওটা থেকে আসছে জ্বলন্ত ইঞ্জিন রুমের আগুনের হলকা। ওদিকের ওয়াকওয়ে ধরেও ভেসেলের অন্য কোনও দিকে যেতে পারবে না।

জগিঙের ভঙ্গিতে আসতে আসতে অটোমেটিক পিস্তল উঁচু করল জেনারেল খালিদ আসির। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর গুলি করে মারবে রানাকে।

কোনও উপায় নেই রানার সামনে। কিন্তু অপেক্ষা করে খুন হওয়ার চেয়ে অন্য কোনও পথ খোঁজা অনেক গুণে ভাল।

ঘুরেই স্টার্নের দিকে দৌড় দিল রানা। মাথার ওপরে জোরালো গুঞ্জন তুলে বনবন করে ঘুরছে তিনটে বিশাল প্রপেলার। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে বৃত্তাকার পাখা। ইঞ্জিনের পাইলনের পেছনে লুকালে হয়তো সুযোগ বুঝে ঢুকতে পারবে হোভারক্রাফটের সুপারস্ট্রাকচারের ভেতর। সেক্ষেত্রে হয়তো খুঁজেও পাবে লাবনীকে…

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে রানার!

লিফট ফ্যান ঘুরে হাজির হয়েছে খালিদ আসির। পিস্তল তাক করল রানার দিকে।

কিন্তু তখনই প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ এক সাইরেনের আওয়াজ এল সুপারস্ট্রাকচার থেকে। কারও মনে হয়েছে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ইঞ্জিন রুমের আগুন। ওই সাইরেন জানিয়ে দিচ্ছে, দেরি না করে নেমে পড়তে হবে হোভারক্রাফট থেকে। প্রচণ্ড আওয়াজে চোখ কুঁচকে ফেললেও গুলি করল আসির। রানার কানের এতই কাছ দিয়ে গেল বুলেট, ওটার তপ্ত হাওয়া লাগল ওর মাথার পাশে।

কটাস আওয়াজে লক হলো অস্ত্রের স্লাইড। গুলি নেই অটোমেটিক পিস্তলে। আরেকটা ম্যাগাযিন বের করতে গেল আসির, কিন্তু তার দিকে তেড়ে গেল রানা। এখন রিলোডের সময় নেই মিশরীয় নোকটার। অবশ্য, ঝটকা দিয়ে বের করল আরেকটা অস্ত্র।

আসিরের খুব কাছে পৌঁছেও কড়া ব্রেক কষল রানা। ওর বুকে ছোরা গাঁথতে চাইল লোকটা। কিন্তু পিছিয়ে গেছে। রানা। সামনে বেড়ে একপাশ থেকে ওর পেট লক্ষ্য করে ফলা চালাল আসির।

খপ করে তার কবজি ধরতে চাইল রানা। কিন্তু বাঁকা পথে ছোরা নামাল সে। চিরচির করে কাটল রানার শার্টের কবজি, ত্বক ও মাংস। ঝুঁকে এসেছে লোকটা। রানা তীব্র ব্যথায় হাত টেনে নিতে গিয়েও দুহাতে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল শত্রুর অ্যাডাম্স্ অ্যাপলে।

দম আটকে যেতেই পেছনে সরল আসির। কিন্তু কোমর উচ্চতায় কী যেন। লোকটা তাল সামলে নেয়ার আগেই সামনে বেড়ে তার বুকে প্রচণ্ড দুটো ঘুষি বসাল রানা।

প্রায় বসে পড়েছে আসির, কিন্তু প্রচণ্ডবেগী হাওয়ার ভয়ঙ্কর টানে সড়াৎ করে ঘুরন্ত প্রপেলারে ঢুকল তার মাথা ও গলা। বিস্মিত রানা দেখল, মুহূর্তে কুচি-কুচি হলো লোকটার আস্ত মাথা। ভুস করে শাফটের মাঝে হারিয়ে গেল লাল কুয়াশা। ধপ্ করে রানার পাশেই ডেকে পড়ল কবন্ধ লাশ।

দুসেকেণ্ড পর রানা বুঝল, আসিরের লাশের কোমরে হোলস্টার। ভেতরে পিস্তলও আছে। ছোরা বের করার আগে ঠিক জায়গায় খুঁজে রেখেছিল। পিস্তল বের করে নিয়ে বাড়তি একটা ম্যাগাযিন রিলোড করল ও, সতর্ক।

ডেকে বেরিয়ে এসেছে কজন ক্রু। কিন্তু জেনারেলের লাশ বা ওর দিকে মনোযোগ নেই তাদের। একমাত্র ইচ্ছে হোভারক্রাফট থেকে নামবে। স্কার্ট থেকে মরুভূমিতে পিছলে নেমে যেতে চাইল তাদের একজন। কিন্তু ফোলা রাবারের কারণে দুই ডিগবাজি দিয়ে পড়ল বালিঝড়ের ভেতর। মটকে গেছে ঘাড়। তার সঙ্গীরা বুঝল, এই ছুটন্ত, নষ্ট হোভারক্রাফট থেকে নামতে হলে খুঁজতে হবে অন্য উপায়। আবারও সুপারস্ট্রাকচারে ঢুকল তারা।

পিস্তল হাতে সামনে বাড়ল রানা। এবার নিজেও ঢুকবে ভেতরে। খুঁজে বের করতে হবে লাবনীকে।

হোভারক্রাফটের সঙ্গে তাল রেখে ছুটছে বেলা। প্রচণ্ড তাপ প্রবাহে দূরে দেখল এবড়োখেবড়ো, আঁকাবাঁকা শৈলশিরা।

মাত্র কমিনিট পর ওই শৈলশিরা টপকে বহু নিচে গিয়ে পড়বে যুবর হোভারক্রাফট।

ওটার ডেকে লোকজন দেখেছে বেলা। তবে তারা কেউ মাসুদ রানা বা লাবনী আলম নয়।

হোভারক্রাফটের আরও কাছে সরে এল বেলা। বিড়বিড় করল, আসুন! দেরি করবেন না! নইলে বাঁচবেন না!

ক্যানোপিক জার হাতে হোল্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লাবনী। চারপাশ দেখে গলা শুকিয়ে গেল ওর। আগুন জ্বলছে হোন্ডে। পোর্ট সাইডের পেছনের এক দরজা থেকে ক্রমেই কমলা শিখা ছড়িয়ে পড়ছে নানাদিকে। প্রশস্ত ডেকে তাপ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে কজন ক্রু। একজন অপারেট করল কন্ট্রোল প্যানেল। নামিয়ে দেয়া হলো ফ্রন্ট ও রিয়ার র‍্যাম্প। বালিভরা হু-হু হাওয়া ঢুকল হোল্ডে। তাতে বেরিয়ে গেল ধোয়া। কিন্তু বাড়ল আগুনের হলকা।

হোল্ডের পেছনে ছুটে গিয়ে হোভারক্রাফট থেকে লাফ দিতে চাইল এক লোক। সহজ হতো স্টার্ন থেকে লাফিয়ে নেমে গেলে, কিন্তু ওদিকে জ্বলছে দাউদাউ আগুন। হোল্ডের চেয়ে অনেক সংকীর্ণ দুই র‍্যাম্প, তার ওপর কাত হয়ে আছে। পোর্টসাইড। ওই ইস্পাতের দেহ চাটছে বাড়ন্ত আগুন। লোকটা মুখ ঢেকে রেখে দৌড়ে পৌঁছে গেল সোনালি রোদের চৌকো অংশে।

কিন্তু হিসাবে ভুল হয়ে গেছে তার। হ্যাচওয়ে থেকে এল গনগনে আগুনের হলকা। মুহূর্তে জ্বলে উঠল গায়ের পোশাক। জ্বলন্ত মশালের মত বালিঝড়ে হারিয়ে গেল সে।

সহজে নেমে পড়া অসম্ভব, বুঝল অন্যরা। সাহসী বা বোকা এক সৈনিক নেমে পড়ল র‍্যাম্পে। ভাবল, পৌঁছে যাবে স্কার্টে, তারপর সাবধানে নামবে মরুভূমিতে। দুসেকেণ্ড পর অন্যদের চেহারা দেখে লাবনী বুঝল, খুব বিমর্ষ হয়েছে তারা। প্রকাণ্ড হোভারক্রাফটের নিচে পিষে গেছে তাদের সঙ্গী। কিন্তু তা-ও ভাল আগুনে পুড়ে মরার চেয়ে। একে একে র‍্যাম্প থেকে লাফ দিল তারা।

শেষ লোকটা বিদায় নেয়ায় হোল্ডে ঢুকল লাবনী। গেল ডিউন বাগির পাশে। পরীক্ষা করে দেখল, ওটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে স্ট্র্যাপ দিয়ে। ওগুলো খুললে হয়তো আগুনে পুড়ে মরার আগেই রিয়ার র‍্যাম্প বেয়ে নেমে যেতে পারবে ও।

মইয়ের ধাপে পায়ের আওয়াজ শুনে আবারও হ্যাচের কাছে ফিরল লাবনী। ঢুকে পড়ল ডিউন বাগির পাশে এক আর্থমুভারের নিচে। তলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, মই বেয়ে হোল্ডে নেমেছে ম্যান মেটয ও নাদির মাকালানি।

আঙুল তুলে স্টার্ন দেখিয়ে মেটকে নির্দেশ দিল ধর্মগুরু, খুঁজে বের করুন ওই জার।

কথা শুনে চমকে গেছে ম্যান মেটয। ইতস্তত করে বলল, কিন্তু ওদিকে তো দাউদাউ আগুন!

তা হলে ওটার ভেতরে ঢুকতে যাবেন না! এবার নির্দেশ দিল মাকালানি, খুঁজে দেখুন বুলডোরের ভেতর। হয়তো এখানেই কোথাও লুকিয়েছে জার। নিচেও রাখতে পারে।

আপনি কী করবেন? জানতে চাইল মেট। ডিউন বাগির দিকে চলেছে নাদির।

ওটাতে চেপেই যেতে হবে। দেরি না করে খুঁজে বের করুন জার!

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল লাবনী। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, হোল্ডের অন্যদিকের আর্থমুভার দেখবে মেট। মাথার ওপরে যন্ত্রদানব, ওটার তলা থেকে বেরিয়ে এল লাবনী। একটু দূরেই আরেকটা খোলা হ্যাচ। একবার কারও চোখ এড়িয়ে ওই পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলেই…

হোল্ডের আগুন লেগে জ্বলে উঠছে ডেকে পড়া গ্রিয় ও তেল। ভুসভুস করে তৈরি হচ্ছে ধোয়া। প্রথম বুলডোর পরীক্ষা করা শেষ করে পেছনেরটা দেখতে লাগল মেট।

দরজা থেকে পনেরো ফুট দূরে লাবনী। ঘুরে দেখল, ডিউন বাগির পাশে মাকালানির পা। খুলে ফেলেছে শেষ স্ট্র্যাপ। অন্যদিকে চোখ। ম্যান মেটয এখন লাবনীকে দেখতে না পেলে; হয়তো পা টিপে টিপে দরজা পেরোতে পারবে ও।

ক্যাব পরীক্ষা করতে পাশের ধাপে পা রেখে ভেতরে উঁকি দিল মেট। তার পিঠ এখন লাবনীর দিকে।

এই হচ্ছে সঠিক সময়!

যন্ত্রদানবের তলা থেকে পিছলে বেরিয়ে এসেই উঠে বসল লাবনী। এবার দৌড় দেবে দরজার দিকে। কিন্তু ঠিক তখনই ঘুরে তাকাল ম্যান মেটয।

দেখে ফেলেছে সে!

পরস্পরের চোখে চোখ রাখল লাবনী ও মেট্য। পাথরের মূর্তি হয়েছে দুজন। এখন একবার মেট বলে দিলেই সব জেনে যাবে ধর্মগুরু!

কিন্তু একটা কথাও বলল না ম্যান মেট্য। চোখ পিটপিট করল, তারপর উদাস চোখে দ্বিতীয়বার তাকাল বুলডোয়ারের ক্যাবের ভেতর।

নীরবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দৌড়ের জন্যে তৈরি হলো লাবনী।

কী দেখলেন? চিৎকার করে জানতে চাইল নাদির। গাল কুঁচকে গেল লাবনী ও মেট-এর।

খুনে লোকটার চোখে পড়েছে বিজ্ঞানীর দ্বিধা।

ইয়ে… ঠিক বুঝতে পারছি না, বিড়বিড় করল মেট। এরই ভেতর গটগট করে লাবনীর দিকে আসছে মাকালানি।

ধরা যখন পড়বেই, তো ভয় কীসের, এই ভেবে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লাবনী। এক হাতে উঁচু করে ধরল জার। নড়বে না! খবরদার! নইলে চুরমার করে দেব জার!

থমকে গেল মাকালানি। উঁচু করল দুহাত। পাগলামি করবেন না, ডক্টর আলম। ওটা দিয়ে দিন।

জীবনেও না! পিছিয়ে যেতে লাগল লাবনী। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখল ছড়িয়ে পড়া আগুন। কেমন হয় আপনার জন্যে পাউরুটি তৈরি করে দিলে?

না! একপা সামনে বাড়ল নাদির। একবার ভাবছে, ছুটে এসে কেড়ে নেবে জার। আবার ভাবছে, ওটা নষ্ট হলে জীবনেও তৈরি হবে না জেনেটিক বিষ। ওটা আমাকে দিয়ে দিন… বদলে বাঁচতে দেব আপনাকে।

পিছিয়ে চলেছে লাবনী। এটা তোমার চাই, কারণ কোটি কোটি মানুষকে খুন করবে, তাই না? সেই সুযোগ তোমাকে দেব না, শয়তান! ধ্বংস করে দেব জার!

লাবনীকে একবার দেখল নাদির, তারপর তাকাল হোন্ডের অন্যদিকে। চোখ আবার ফিরল লাবনীর ওপর। হ্যাঁ, খেলা শেষ হয়ে এল। ঠিকই বলেছেন!

লাবনী! সতর্ক করতে চাইল ম্যান মেটয। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

খোলা হ্যাচ থেকে ডাইভ দিয়েছে কিলিয়ান ভগলার। তার দেহের ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ল লাবনী। হাত থেকে ছুটে গেছে জার। তবে মেঝেতে পড়ে ঠুং করে ভাঙল না জার। একহাতে ওটার পতন ঠেকিয়ে দিয়েছে ভগলার। কিন্তু ধরেও রাখতে পারল না একহাতে। গড়িয়ে আগুনের দিকে চলল জার। অবশ্য, কয়েক সেকেণ্ড পর বাড়ি খেল একটা কার্গো রিঙের গায়ে।

বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাদির। বুঝে গেছে, ওই জার এখন নিরাপদ। ওদিকে পা বাড়িয়ে ধমকের সুরে বলল, খুন কররা ওই শুয়োরনীটাকে!

খুশির সঙ্গে, বলল ভগলার। পনিটেইল ধরে হ্যাচকা টানে লাবনীর মাথা তুলল। সাপের চামড়ার জ্যাকেট থেকে বের করল প্রিয় রিভলভার…

কিন্তু থমকে যেতে হলো ওকে। এইমাত্র দড়াম করে খুলে গেছে আরেকটা দরজা। ওদিকে তাকাল সবাই।

বেরিয়ে এসেছে মাসুদ রানা। হাতে আসিরের পিস্তল। হোল্ডের সবচেয়ে বড় হুমকির দিকেই তাক করল অস্ত্র।

কিন্তু টান দিয়ে নিজের সামনে লাবনীকে আনল ভগলার। শক্ত হাতে ধরেছে ঘাড়। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল লাবনী। কাছের আর্থমুভারের আড়ালে সরল নাদির মাকালানি। ঘুপচি এক জায়গায় হোল্ডের আরেকদিকে একই কাজ করল ম্যান মেটয।

রানা! প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী। রক্তে মেখে আছে। রানার মুখ-হাত। একই অবস্থা শার্টের। হায়, আল্লা…

কিছুই হয়নি, বলল রানা। চোখ স্থির ভগলারের চোখে। পাফ অ্যাডার, তিন গোনার আগেই সরো লাবনীর কাছ থেকে! নইলে জানে বাঁচবে না!

লাবনীর মাথায় রিভলভারের নল ঠেকাল ভগলার। আমি গুনব দুই, এর ভেতর অস্ত্র না ফেললে খুন হবে তোমার ডার্লিং!

রানা, গুলি করো ওই জারে! বলল লাবনী। চোখের কোণে ক্যানোপিক জার দেখল রানা। জারই যদি না থাকে, হাতে ওদের কোনও তাসই থাকবে না!

জারে গুলি করলে সঙ্গে সঙ্গে খুন হবে ওই মেয়ে! আড়াল থেকে গলা ফাটাল নাদির। ইশারায় বডিগার্ডকে বলছে গুলি না করতে।

লাবনীর ঘাড় চেপে ধরল ভগলার। ইশারা করল হাঁটুতে ভর দিতে। লাবনী নির্দেশ পালন করতেই নিজে লুকিয়ে পড়ল পেছনে। অসহায় মেয়েটাকে সামনে রেখে হাঁটু ঘষে সরছে। রানার কাছ থেকে।

ভগলারের দিকে পিস্তল তাক করে নিজেও সরছে রানা। চালমাত অবস্থা। ভগলার ভাল করেই জানে, লাবনীকে খুন করার পরের সেকেণ্ডে লাশ হবে নিজে। কিন্তু লাবনীর গায়ে লাগবে না, এত নিশ্চিত হয়ে গুলি করতে পারবে না রানা।

অনুসরণ করছে ও। খোলা দরজার কাছে চলে গেল লাবনী ও ভগলার।

বস্! হাঁক ছাড়ল আমেরিকান খুনি, আর্থমুভারের ইগনিশনে চাবি আছে?

কী বলা হয়েছে বুঝে গেছে নাদির মাকালানি। দেরি না করে আর্থমুভারের ক্যাবে উঠল সে। নিচু করে রেখেছে মাথা, গুলি করতে পারবে না রানা। খুকখুক করে স্টার্টার মোটর কেশে উঠতেই জোরালো খ্যার-খ্যার শব্দে চালু হলো ইঞ্জিন।

ধমক দিতে গিয়েও চুপ থাকল রানা। ওর নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছুই। লাবনীর মাথার পেছনে রিভলভারের নল ঠেসে ধরেছে ভগলার। আরেক হাতে পকেট থেকে বের করল যিপ টাই। পাশের কার্গো রিঙে ঘুরিয়ে এনে লাবনীর কবজিতে পেঁচিয়ে মুচড়ে দিল। ব্যথা পেয়ে মুখ বিকৃত করেছে লাবনী। রিঙের সঙ্গে আটকা পড়েছে কবজি। ওর কানের কাছে মধুর স্বরে বলল ভগলার, এবার কোথাও যেতে পারবে না, সুন্দরী।

আর্থমুভারের কন্ট্রোল নেড়েচেড়ে বুঝে নিল নাদির। একটা লিভার দিয়ে উঁচু করল কোদালের মত সামনের স্কুপ। টুলবক্স থেকে বড় এক স্প্যানার নিয়ে আটকে দিল গ্যাস প্যাডেলে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। একস্ট পাইপ দিয়ে বেরোল তেলতেলে বাদামি ধোঁয়া। কিন্তু সামনে বাড়ল না আর্থমুভার। গিয়ার ফেলা হয়নি।

সামনের র‍্যাম্পের ওদিকে চোখ যেতেই, চমকে গেছে। নাদির। দূরে শৈলশিরার শেষ কিনারা। ওটা মাত্র এক মাইল দূরে!

আর বড়জোর দুমিনিট, তারপর ওখান থেকে বহু নিচে গিয়ে পড়বে হোভারক্রাফট।

ভগলার ও নাদিরকে দেখছে রানা। বুঝে গেছে, ভয়ঙ্কর কোনও পরিকল্পনা এঁটেছে এরা। এখন চাইলে ড্রাইভিং সিটে বসা নাদিরকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারবে ও। কিন্তু তাতে পিস্তলের নল ঘোরাতে হবে, সে-সুযোগে লাবনী বা ওকে খুন করবে ভগলার।

ওদিকে রিঙে লেগে ঠুকঠুক আওয়াজে নড়ছে জার। লাবনী থেকে একটু দূরেই ওটা।

রানাকে দেখছে নাদির। কী; রানা? আমাকে ঠেকাবে, না বাঁচাবে লাবনী আলমকে? যে-কোনও একটা করতে হবে।

ইঞ্জিন রিভার্স গিয়ারে নিল নাদির। আর্থমুভার হোঁচট খেয়ে পেছাতে শুরু করতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল সে।

মাত্র একফুট যেতেই ডেকে নিরাপদে রাখার চেইনে বাধা পেল আর্থমুভার। টানটান হয়ে উঠল চেইন। ওটা রয়েছে গাড়ির জায়গা স্থির করতে, কয়েক শ ঘোড়াশক্তির চলন্ত গাড়ি ঠেকাতে নয়। মেঝেতে বিশ্রী ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলল স্টিলের ট্র্যাক। চেইন ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে আর্থমুভার। কর্কশ কড়-কড় আওয়াজ তুলছে কার্গো রিং।

লাবনীর পেছনে রয়ে গেছে ভগলার। এক চোখ রেখেছে বারো ফুট দূরে সগর্জন আর্থমুভারের ওপর। রানার উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, যাও! ঠেকাও ওটা!

জারের দিকে তাকাল রানা। ভাবছে, লাথি মেরে আগুনে জার ফেলতে পারবে? আবার পরক্ষণে গিয়ে ঠেকাতে পারবে আর্থমুভার?

না, পারবে না।

যে-কোনও একটা করতে হবে। রানা জানে, এই অবস্থায় কী করবে ও।

ঝটাং করে ছিঁড়ে গেল চেইন।

সোজা লাবনীর দিকে পিছিয়ে আসতে লাগল আর্থমুভার!

অসহায় লাবনীকে রেখে এক লাফে আর্থমুভারের ওদিকে গিয়ে পড়ল ভগলার। পরপর দুবার গুলি করল রানা, কিন্তু লোহার মেশিনে লেগে ছিটকে গেল চ্যাপ্টা বুলেট।

ঝটকা দিয়ে সামনে বাড়ল রানা। আগে এত জোরে দৌড়ায়নি কখনও। রিং বা কবজি থেকে ছোটাতে হবে যিপ টাই, নইলে স্রেফ খুন হয়ে যাবে লাবনী!

ইঞ্জিনের ধক-ধক শব্দ তুলে পিছিয়ে আসছে আর্থমুভার। লাবনীর থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দূরে। চার…

লাবনীর পাশে পৌঁছে গেলেও রানা বুঝল, খুলতে পারবে না যিপ-টাই। পিস্তল তাক করেই ট্রিগার টিপে দিল ও। টাশ করে ছিঁড়ে গেল যিপ-টাই। রিঙে বুলেট লেগে ছিটকে এসে লাগল রানার হাতের পিস্তলের নলে। মাযলের আগুনে আরেকটু হলে পুড়ত লাবনীর বাহু। ওকে জাপ্টে ধরে ডাইভ দিয়ে আর্থমুভারের ওপারে গিয়ে পড়ল রানা। এক সেকেণ্ড পর ওই রিঙের ওপর দিয়ে গেল আর্থমুভার। তাতে শেষ হয়নি বিপদ। ক্যানোপিক জারের দিকে ছুটছে ভগলার। দুফুট পেছনেই উদ্যত পিস্তল হাতে নাদির। নিজের পিস্তলের খোঁজে পেছনে তাকাল রানা।

আর্থমুভারের নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়েছে ওটা!

ধক-ধক আওয়াজে পিছিয়ে চলেছে যন্ত্রদানব। লাবনীকে নিয়ে ওটার কাছ থেকে সরে গেল রানা। গুলি করল ভগলার, কিন্তু সেটা লাগল হলদে আর্থমুভারের গায়ে। রানা ও লাবনীকে শেষ করতে পিছু নিতে গিয়েও অন্য বুদ্ধি করল ভগলার। লাফিয়ে উঠল ক্যাবে। এবার ওদিকে নেমেই…

ক্যাবের ওদিক থেকে উঠে এল রানা। সিটের ওদিক থেকে ডাইভ দিল ভগলারের ওপর। ক্যাব থেকে হুড়মুড় করে ডেকে পড়ল ওরা দুজন। খটাং-খট আওয়াজে ডেকে পিছলে দূরে সরে গেল রিভলভার।

ততক্ষণে ক্যানোপিক জারের সামনে পৌঁছে গেছে নাদির, খপ করে ওটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। চেহারায় ফুটল তৃপ্তি। ক্ষতি হয়নি জারের সিলের। আরেক দৌড়ে ডিউন বাগির পাশে পৌঁছে গেল সে। এখনও লুকিয়ে আছে। ম্যান মেটয, উঁকি দিল। তার দিকে ভুরু কুঁচকে দেখল নাদির। ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল আর্কিওলজিস্ট।

ওদিকে ভগলারের চোয়ালে ঘুষি মেরেছে রানা। গাল কুঁচকে ফেলল নিজেই। ভীষণ ব্যথা লেগেছে গুলিতে আহত হাতে। ঘুষি খেয়ে আমেরিকান খুনি বুঝেছে, রানা এখন ওর চেয়ে দুর্বল। তার ওপর বাহুতে রক্ত। গুলিতে আহত বাহু খামচে ধরল ভগলার। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল রানার মুখ। পিছিয়ে যেতে চাইলেই প্রচণ্ড এক লাথি পড়ল ওর পেটে। মাথার পাশ দিয়ে ধক-ধক আওয়াজে চলেছে আর্থমুভার।

যন্ত্রদানবের ক্যাবে উঠেছে লাবনী। লাথি মেরে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল থেকে সরিয়ে দিল স্প্যানার। নিউট্রাল করল গিয়ার স্টিক। হোল্ডের পেছনের দিকে ছড়িয়ে যাওয়া আগুন থেকে এক ফুট আগে থামল আর্থমুভার। যন্ত্রের সামনের দিকে ভগলারকে দেখল লাবনী। এইমাত্র রানাকে ল্যাং মেরে ফেলে ওর বুকে কনুই নামিয়ে এনেছে সে। একটু দূরে ডিউন বাগিতে উঠছে নাদির মাকালানি। খোলা র‍্যাম্প দিয়ে দেখা গেল আতঙ্ককর দৃশ্য!

এগোচ্ছে যুবর, দ্রুত চলে আসছে শৈলশিরার কিনারা!

রানা হেঁচড়ে সরে গিয়েই ঘুষি মারল ভগলারের চোয়ালে। কিন্তু কাত হয়ে শরীর গড়িয়ে দিয়েই হাতের কাছে রিভলভার পেয়ে গেল লোকটা। তুলে নিল অস্ত্রটা, ঘুরেই তাক করল রানার দিকে। কিন্তু তখনই ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলে রওনা হলো ডিউন বাগি। একহাতে ক্যানোপিক জার বুকের কাছে রেখেছে নাদির মাকালানি।

মাকালানি! ঝোড়া হাওয়ার ওপর দিয়ে চিৎকার করল ভগলার। একমিনিট!

উঠে বসেছে রানা। ওর দিকে ঘুরেই রিভলভার তাক করল ভগলার।

একইসময়ে আর্থমুভারের গিয়ার ফেলে সামনে বেড়েছে লাবনী। যন্ত্রদানবের স্কুপ লাগল ভলারের হাতে। ছিটকে কোদালের গর্তে পড়ল রিভলভার। ওদিকে উঠে পড়েছে রানা, থুতনিতে ওর জোরালো এক আপারকাট খেয়ে বেসামাল হলো ভগলার। মুখ থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। স্কুপের কিনারার ধাতব দাঁত কামড়ে ধরল সাপের চামড়ার জ্যাকেট।

ঘাবড়ে যায়নি ভগলার। কোদালের গর্তে রিভলভার দেখেই ঝুঁকল তুলে নিতে। কিন্তু স্কুপ উঁচু করে নিয়েছে লাবনী। ধাতব দাঁতে ঝুলছে জ্যাকেট। ওটার কারণে আটকা পড়ল ভগলার। জ্যাকেট থেকে বের করে নিতে চাইল কাঁধ, কিন্তু হাতদুটো ছুটিয়ে নেয়া অসম্ভব। পেটে খেল রানার পর পর দুটো প্রচণ্ড ঘুষি। তখনই হোঁচট খেয়ে থামল আর্থমুভার। হোভারক্রাফটের বো-র দিকে চোখ গেল তার।

ডিউন বাগি নিয়ে র‍্যাম্প থেকে নামছে নাদির। শক্ত মরুভূমিতে পড়েই লাফিয়ে উঠল গাড়িটা। আগেই সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েছে ধর্মগুরু, একহাতে চালাচ্ছে হালকা ভেহিকেল। কসেকেণ্ডের জন্যে ওটার ওপর চেপে বসতে চাইল হোভারক্রাফট। আরেকটু হলে র‍্যাম্প কাজ করত বিশাল এক কোদালের মত, আবার তুলে নিত ডিউন বাগিটাকে; কিন্তু সামনে বেড়ে বাঁক নিয়ে সরে গেল নাদির মাকালানি। সাঁই করে তাকে পাশ কাটিয়ে সোজা শৈলশিরার দিকে ছুটল হোভারক্রাফট।

এইমাত্র ডিউন বাগিটাকে বাঁক নিয়ে সরে যেতে দেখল বেলা। এটাও বুঝে গেল, কে চালাচ্ছে ওই গাড়ি।

ছাড়া পেয়ে গেছে নাদির মাকালানি। আর আটকা পড়েছে। মাসুদ ভাই আর লাবনী আপু!

তারা মারা গেছে, মেনে নিতে পারছে না বেলা।

বিপদের সময় ওর পাশে ছিল মানুষদুটো।

এখন তাদের ফেলে চলে যাবে?

চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ করে অ্যাক্সেলারেটর টিপে ধরল বেলা।

এমনিতেই টেম্পারেচার গেজ আছে লাল সীমায়, তবুও ওভারহিটেড পুরনো ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে ছুটল হোভার ক্রাফটের দিকে।

.

আর্থমুভার থেকে নেমেই দৌড়ে গিয়ে রানাকে জড়িয়ে ধরল লাবনী। তুমি ঠিক আছ তো, রানা?

হ্যাঁ, তুমি? বলল রানা। বাহু বেয়ে পড়ছে রক্ত। ঘুরে স্টারবোর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকাল।

ওর দেখাদেখি ওদিকে তাকাল লাবনী। থামাতে হবে হোভারক্রাফট। একবার ইঞ্জিন বন্ধ করতে পারলে…

সময় নেই! বলল রানা। দেখিয়ে দিল সামনের র‍্যাম্প। একটু পর শৈলশিরা থেকে পড়ব! পেছনে চোখ বোলাল ও। ওদিকে জ্বলছে দাউদাউ আগুন। এদিকে সামনের র‍্যাম্প থেকে ঝাঁপ দিলে ওদেরকে পিষে দেবে হোভারক্রাফট।

কোথাও যাওয়ার উপায় নেই!

ধাতব ঘটাং আওয়াজে ঘুরে তাকাল ওরা।

হোঁচট খেয়ে র‍্যাম্পে উঠে এসেছে তুবড়ে যাওয়া এক ল্যাণ্ড রোভার!

সরাসরি ওদের দিকেই আসছে বেলা!

যুবর পিষে মেরে ফেলবে, সেই ভয় কাটিয়ে এসেছে প্রিয় মানুষগুলোকে বাঁচাতে!

কড়া ব্রেক কষে থামল বেলা। চোখে-মুখে ভীষণ ভয়। অবশ্য, গাড়ির পাশেই রানা ও লাবনীকে দেখে মিষ্টি হাসল। আসুন! মাসুদ ভাই! লাবনী আপু!

গুলির গর্তভরা জিপগাড়ির প্যাসেঞ্জার দরজা খুলে ফেলল রানা। লাবনী গলা ছাড়ল, মেট! জলদি!

তাড়া খাওয়া তেলাপোকার মত পিছলে বেরিয়ে ছুটে এল আর্কিওলজিস্ট। গাড়িতে উঠে পড়ল রানার ইশারায়। লাবনী উঠতে নিজেও উঠল রানা। ধক্ করে উঠল ওর বুক। খুব কাছে শৈলশিরার কিনারা। অনেক নিচে কঠিন জমিন!

রিয়ার র‍্যাম্প দিয়ে নামো, বেলা! দড়াম করে দরজা বন্ধ করল রানা।

কিন্তু ওদিকে তো আগুন!

আপত্তি তুলল মেটয।

আগুনই সই! বেলা, জলদি! তাড়া দিল রানা।

 ক্লাচ ছেড়ে গিয়ার ফেলেই অ্যাক্সেলারেটর দাবাল বেলা। দুসারি ভারী আর্থমুভারের মাঝ দিয়ে ছুট দিল ল্যাণ্ড রোভার। সরাসরি চলেছে লেলিহান আগুন লক্ষ্য করে। চেঁচিয়ে উঠল ম্যান মেটয: হায়, যিশু!

থেমো না, বেলা! সতর্ক করল রানা। আর্থমুভারের দাঁত থেকে ঝুলছে কিলিয়ান ভগলার। কাত হয়ে তুলে নিল রিভলভার। নাকের ডগার কাছেই ল্যাণ্ড রোভার। তাক করল চালকের দিকে, কিন্তু ভীষণ ভয়ে ভুলে গেল ট্রিগার টিপতে। আগে ভাল করে দেখেনি কতটা কাছে শৈলশিরার কিনারা!

এক সেকেণ্ড পর ভয় কাটিয়ে গুলি করল ভগলার। কিন্তু দেরি হয়েছে ওই এক সেকেণ্ডেরই। বুলেট বিঁধল বেলার মাথার ওপরে ল্যাণ্ড রোভারের ছাতে। সাঁই করে ভগলারকে পাশ কাটিয়ে গেল প্রাচীন গাড়ি।

ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল লাবনী। আমরা বাঁচব না!

দ্রুতগতি নয়, তবে টেকসই বলে নাম আছে ল্যাণ্ড রোভারের।

দেখো, নেমে পড়ব, বলল রানা। শেষ আর্থমুভার পাশ কাটিয়ে গেল ওরা। আগুন থেকে বাঁচতে কোনাকুনিভাবে র‍্যাম্পের দিকে চলল বেলা। সবাই মাথা নিচু করে নাও!

পরক্ষণে অগ্নিশিখায় ঢুকল ল্যাণ্ড রোভার। লকলক করে ওটাকে গিলে ফেলল লেলিহান হলকা। ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকল আগুনের কমলা সব ক্ষুধার্ত জিভ।

র‍্যাম্প থেকে নামল ল্যাণ্ড রোভার, ওই একইসময়ে শৈলশিরার কিনারায় পৌঁছে গেল হোভারক্রাফট।

নিচে পাথুরে জমিন হারাতেই স্কার্টের তলা থেকে নানা দিকে ছিটকে গেল টনকে টন বালি ও পাথর। নিরেট পাথরে ঘষা লাগতেই ভীষণ কেঁপে উঠল হোভারক্রাফট। বিশাল প্রপেলার কাজ করছে বলেই সি-সওর মত দুলল প্রকাণ্ড যান, তারপর ঝুপ করে নামাল নাক। ভেতরের আর সবকিছুর মতই ঝুলন্ত ভগলারকে নিয়ে সামনে পিছলে গেল ভারী আর্থমুভার। করুণ চিৎকার জুড়ল ভগলার। সামনের র‍্যাম্প পেরিয়ে সোজা নিচে চলল আর্থমুভার। দাঁত থেকে ঝুলছে বেসুরো কণ্ঠের ভগলার। ওই প্রাণপণ আর্তচিৎকার শোনার কেউ নেই!

সাঁই করে নেমে শৈলশিরার গোড়ায় আছড়ে পড়ল তিরিশ টনি আর্থমুভার। পরক্ষণে ওটার ওপর নামল পাঁচ শ টন ওজনের হোভারক্রাফটু। প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে চুরমার হলো ওটা। থরথর করে কাঁপতে লাগল জমিন। ছিটকে আকাশে উঠল ধুলোভরা আগুনের মস্ত এক মেঘ।

আরেকটু হলে আগুনের দীর্ঘ জিভ চেটে দিত ল্যাণ্ড রোভারটাকে। হোভারক্রাফটের অগ্রসরমান গতিকে টপকে যেতে পারেনি ছুটন্ত জিপগাড়ি। স্টার্ন থেকে নেমেই গেছে পিছলে। নতুন করে এগোবার আগেই শৈলশিরার কিনারা থেকে ধুম্ করে নিচে পড়েছে পেছনের দুই চাকা। বনবন করে ঘুরছে সামনের দুই চাকা, কিন্তু পেছনের দিক ভারী বলে সাধ্য নেই যে এগোবে। এবার গাড়ি নামবে মাধ্যাকর্ষণের টানে বহু নিচে।

ধুপ করে শৈলশিরায় পড়ে ভীষণ ঝাঁকি খেয়েছে রানা, বুঝেও গেছে কী বিপদে পড়ছে। সামনের ড্যাশবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও। কড়া গলায় বলল, সামনের দিকে ঝুঁকে এসো সবাই!

অন্যরা কিছু করার আগেই রানার একার ওজনেই নিচে জমিন খুঁজে পেল সামনের চাকা। ঝটকা দিয়ে এগোল পুরনো জিপগাড়ি। ধুমাস্ আওয়াজে চারপাশ কাঁপিয়ে উঠে এসেছে পেছনের চাকা। কিন্তু তিরিশ ফুট যেতে না যেতেই বুম্ করে ফাটল জ্বলন্ত দুই পেছনের চাকা। হোঁচট খেয়ে থামল ল্যাণ্ড রোভার।

চারপাশে শুধু ধুলোবালির মেঘ। কাশতে কাশতে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। থরথর করে কাঁপছে ম্যান মেটয। হাত ধরে ফেলল লাবনীর। অনেক… ধন্যবাদ! তোমরা অপেক্ষা না করলে…।

হাত ছুটিয়ে নিয়ে সন্দেহের সঙ্গে বলল লাবনী, তুমিও শেষদিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলে বলে মনে হয়েছে।

মাথা দোলাল মেট। তা হলে যা হয়েছে, সেসব মাফ করে দিয়েছ তো?

নিশ্চয়ই, তবে এটা তুমি আমার কাছ থেকে পাও! ম্যান মেটযের গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিল লাবনী। তুমি ঘোড়ার ডিমের আর্কিওলজিস্ট!

গাল চেপে ধরে বসে পড়ল লোকটা। এখন গর্ব বলতে কিছুই নেই মনে।

নাদির মাকালানির কী হবে? জানতে চাইল বেলা। দূর মরুভূমির দিকে চেয়ে আছে। ডিউন বাগি নিয়ে অনেক আগেই হাওয়া হয়েছে ওই লোক।

রানার দিকে তাকাল লাবনী। সর্বনাশ হয়েছে! বদমাশটা নিয়ে গেছে জার! আমরা তাকে ধরব কীভাবে?

এখন ধরার উপায় নেই, বলল রানা, দূরে কোথাও গিয়ে উঠবে হেলিকপ্টারে। ওর কাছে স্যাটেলাইট মোবাইল ফোন দেখেছি।

তা হলে আমরা হেরে গেলাম? বিমর্ষ চেহারা করল বেলা। এবার কোনও ভাইরাস ছড়িয়ে দেবে। সর্বনাশ হবে সবার। তাই না?

উঁহু, অন্য উপায় বেরোবে, হাল ছাড়ছি না, বলল রানা। ফোন দেব কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর যাব অ্যাবাইদোসে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সবার মুখ। ভাবছে, এই মরুভূমিতে মাইলের পর মাইল হাঁটবে কী করে? মৃদু হাসল রানা। কিছু ভেবো না, গল্প করতে করতে অ্যাবাইদোসে চলে যাব।

চাকা পাল্টে নিলে হয় না? জানতে চাইল লাবনী।

মাথা নাড়ল রানা। পাল্টাতে হলে দুটো চাকা লাগবে। পাব কোথায়?

ও, ভীষণ মুষড়ে পড়ল ম্যান মেটয।

হাঁটতে শুরু করো, গাধা! তাড়া দিল লাবনী, পথ বহু দূর!

 রানার পাশে চলল লাবনী ও বেলা। অনেকটা দূরে ক্যানিয়ন। কয়েক সেকেণ্ড পর পিছু নিল ম্যান মেট্য।

.

প্রথমে শোনা গেল ইঞ্জিনের গর্জন, তারপর লাল পশ্চিম দিগন্ত থেকে এল মিশরীয় মিলিটারি এমআই-এইট হেলিকপ্টার। দুমিনিট পর প্রচুর বালি উড়িয়ে নেমে পড়ল ওটা অ্যাবাইদোসে ওসেইরেনের সামনে।

অনেক টাকা খরচ করে আরেকটা জিপগাড়ি জোগাড় করেছে রানা। ওটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। তবে গরমের ভেতরেও জানালা সব বন্ধ করে পেছনের সিটে থম মেরে বসে আছে ম্যান মেটয।

হেলিকপ্টারের হ্যাচ খুলে যেতেই নেমে এল ছয়জন লোক। পাঁচজনই সৈনিক, তবে পরনের ইউনিফর্ম সাধারণ সৈনিকদের মত নয়। কালো ক্যামোফ্লেজুড় ওই প্যাটার্ন শুধু ব্যবহার করে স্পেশাল ফোর্স টিম।

ষষ্ঠ লোকটি অ্যান্টিকুইটির সুপ্রিম কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল, ডক্টর শরিফ হামদি। রানাদের সামনে এসে থামলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে দিলেন রানার দিকে। আশা করি ভাল আছেন, মিস্টার রানা।

কী করে ভাবলেন এই অবস্থায় ভাল থাকবে কেউ? মুখ ফস্কে বলে ফেলল বেলা।

ভদ্রলোকের সঙ্গে করমর্দন করল রানা। ডক্টর হামদি, গুড ইভিনিং। মরুভূমি দেখাল। আশা করি আপনাকে দেয়া জিপিএস কোঅর্ডিনেট অনুযায়ী আগেই ওদিকটা দেখেছেন?

জী। ভাবতেও পারিনি ওখানে ওরকম কিছু দেখব। মাথা নাড়লেন ডক্টর হামদি। শুধু এন্ট্রান্স চেম্বার দেখেছি। নিচে আরও কিছু আছে?

একেবারে নেমে গেলে পাবেন ওসাইরিসের সমাধি, গর্ব নিয়ে বলল বেলা।

ভাবা যায় না, বললেন হামদি। ওখানে রেখে এসেছি অ্যান্টিকুইটির স্পেশাল প্রোটেকশন স্কোয়াড। আগামী দুচার দিন পরেই ফুল এক্সপিডিশন শুরু করবে এসসিএ।

তবে ধারে-কাছে থাকবে না নাদির মাকালানি, বলল। লাবনী, যা চেয়েছে, পেয়ে গেছে সে।

মিস্টার রানা বলেছেন, বললেন হামদি। কিন্তু সত্যিই কি বায়োলজিকাল অস্ত্র তৈরি করবে ওই লোক?

সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, বলল রানা, সুইটহার ল্যাণ্ডের ওসাইরিয়ান টেম্পলে সে ধরনের রিসোর্স আছে তার।

নামও পাল্টে যাবে ওই টেম্পলের, বলল লাবনী। এখন থেকে হবে সেটিয়ান টেম্পল। দলে নাদির মাকালানি পাবে অনেক শয়তানকে। যা খুশি করতে পারবে।

ভুরু কুঁচকে গেল ডক্টর হামদির। হয়তো। কিন্তু ম্যাস ডেস্ট্রাকশন ওয়েপন্স আমার বিষয় নয়। তা ছাড়া, হাতে প্রমাণ না পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করতে পারব না।

আপনার পছন্দের বিষয়ে নজর দিতে পারেন, বলল রানা, স্ফিংস থেকে নেয়া যোডিয়াক এখন তার দুর্গে। ওটা সুইটযারল্যাণ্ডে মেমোরাবিলিয়া হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিল কাদির ওসাইরিস।

নাদির সত্যিই ওখানে যোডিয়াক রেখে থাকলে, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব, বললেন হামদি, সে একজন মিশরীয় নাগরিক। আর মিশরীয় সরকার পুরাকীর্তি, চোরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর।

সেক্ষেত্রে অন্য দেশে নিজেদের সৈনিক নেবেন আপনারা? জানতে চাইল রানা।

এটা বলতে পারব না যে আগে কখনও এএসপিএস অন্য দেশে মিশনে যায়নি, মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

এবং ওই মিশনে যদি প্রমাণ হয় বায়োলজিকাল অস্ত্র তৈরি করছে নাদির মাকালানি, সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবেন আপনারা, তাই তো? জানতে চাইল রানা।

সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেব। তবে আগে প্রমাণ লাগবে যে ওই দুর্গে যোডিয়াক আছে।

রানার দিকে চেয়ে আছে লাবনী। তা হলে যাবে ওসাইরিয়ান টেম্পলের হেডকোয়ার্টারে?

আমার কোনও আপত্তি নেই, বলল রানা, নাদির মাকালানির সঙ্গে ব্যক্তিগত বোঝাঁপড়াও আছে আমার।

কিন্তু ওটা তো সত্যিকারের দুর্গ, কী করবেন একা? চিন্তিত হয়ে পড়েছে বেলা। ওরা তো ঢুকতেই দেবে না আপনাকে!

দিতেও তো পারে। মৃদু হাসল রানা। অবশ্য, সেজন্যে সঙ্গে লাগবে নামকরা কাউকে!

.

২৯.

শুভ্র-তুষার ছাওয়া অ্যালপাইন পর্বতমালার ওদিকে সূর্য ডুবে যেতেই দুর্গের উঁচু দেয়াল থেকে মুছে যাচ্ছে নরম আলো। উঠানে কালো কাঁচের বিশাল পিরামিডের নিচে জ্বলে উঠেছে নীল এলইডি বাতি। পিরামিড-শীর্ষে অত্যুজ্জ্বল আলো গেছে সপ্তাকাশে ধ্রুবতারা লক্ষ্য করে। ওই নক্ষত্র মিশরীয় প্রাচীন এক দেবতা।

লেকের পারের সংক্ষিপ্ত শাখা পথে দুর্গের দিকে চলেছে একটি গাড়ি। একটু পর কালো রঙের মার্সিডিয এস-ক্লাস গাড়িটি থামল গেটহাউসে। টিন্টেড কাঁচও কালো। ড্রাইভারের জানালার কাঁচ বন্ধ হলেও নেমে গেল পেছন জানালার কাঁচ। গাড়ির মালিক একাই আছেন। ভরাট কণ্ঠে ইন্টারকমের উদ্দেশে বললেন: হাই! আমি গিবন মুর। ক্যামেরার দিকে দুর্দান্ত এক হাসি দিল নায়ক। ওসাইরিয়ান টেম্পল ঘুরিয়ে দেখাতে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন কাদির ওসাইরিস। তো চলেই এলাম!

হঠাৎ আপনার আগমনের কারণ, মিস্টার মুর? ভদ্রতার সুরে জানতে চাইল নাদির মাকালানি। রাগ লাগছে তার। ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে সুদর্শন লোকটাকে।

কাদির ওসাইরিসের লাউঞ্জে চামড়ার কাউচে আরাম করে রসেছে মুর। পরের মুভির প্রচারণায় এসেছি সুইটয়ারল্যাণ্ডে। ভাবলাম দেখা করে যাই! মিষ্টি হাসল। তাই চলেই এলাম। মিস্টার ওসাইরিস বলেছিলেন ঘুরিয়ে দেখাবেন আপনাদের টেম্পল। সেইসঙ্গে গল্প হবে পুরনো আমলের সিনেমা নিয়ে।

আমার ভাই… এখন দেশের বাইরে, বলল নাদির।

ছিহ! কপালটাই মন্দ। তা কবে ফিরবেন তিনি?

দুষ্ট হাসল নাদির মাকালানি। আপাতত আর ফিরছেন না এখানে। তবে তাতে আপনার সময় নষ্ট হয়েছে, তা ভাববেন না। আজ টেম্পলে বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। আপনি আমন্ত্রিত। সত্যি যদি প্রমাণ হয় আপনি এ ধর্মে বিশ্বাসী, পুরস্কারও দেয়া হবে আপনাকে।

বাহ্! গুড! নড়েচড়ে বসল মুর। ও, তা হলে আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না আপনার ভাই?

না, সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে আমার ওপর, আরও চওড়া হলো নাদির মাকালানির ঠোঁটে হাসি।

দরজায় টোকা দিল কে যেন।

ধূসর চুলের এক বিশালদেহী লোক ঢুকল ঘরে। মুখে হল অভ রেকর্ডসসের মারপিটের চিহ্ন। প্রায় পৌঁছে গেছে প্রথম বাস।

মাথা দোলাল নাদির। ঘুরে দেখল মুরকে। অনুষ্ঠানের জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে। একটু অপেক্ষা করুন। সঠিক সময়ে আপনাকে অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেবে কেউ।

খুশি মনে অপেক্ষা করব, বলল গিবন মুর। লোকদুজন চলে যেতেই পকেট থেকে নিল সেল ফোন। চালুই আছে ওটা। নিচু স্বরে বলল, অবস্থা বুঝলেন তো?

না বুঝে উপায় আছে? ওয়্যায়ারলেস হেডসেট-এ বলল লাবনী।

উপত্যকার আধমাইল দূরে দুটো মিতসুবিশি শোগান জিপগাড়ি রেখে দুর্গের দিকে চেয়ে আছে কজন মানুষ। গাড়ি দুটোর, ভেতর যথেষ্ট জায়গা, রাখা যাবে ছয় ফুট ডায়ামিটারের যোডিয়াক। আপাতত গাড়িদুটো কাজ করছে দুদল লোকের হেডকোয়ার্টার হিসেবে। প্রথম দল ইজিপশিয়ান সরকারের অ্যান্টিকুইটি স্পেশাল প্রোটেকশন স্কোয়াডের লোক। সংখ্যায় ছয়জন। দ্বিতীয় দলে মাত্র চারজন। তারা তরুণ। বাদামি ত্বক। হাতের কাছে অস্ত্র। রানা এজেন্সি থেকে এসেছে এই মিশনে।

কী ধরনের অনুষ্ঠান? জানতে চাইলেন ডক্টর হামদি। তিনি আছেন মিশরীয় দলের নেতৃত্বে।

কাঁধ ঝাঁকাল লাবনী। জানে না।

বেলাও মাথা নাড়ল।

ভুরু কুঁচকে নিজের দলের একজনের দিকে ফিরলেন ডক্টর হামদি। একটা বাসের কথা বলেছে। ওটা যাচ্ছে দুর্গের দিকে। মাথা দোলাল সৈনিক। তার সঙ্গে নেমে গেল রানা এজেন্সির জেনেভা শাখার চিফ শাহেদ কামাল। লাবনীর দিকে ফিরলেন হামদি। এএসপিএস শুধু সারপ্রাইস রেইড করে। শত্রু অনেক বেশি হলে…

লাবনী কিছু বলার আগেই জানতে চাইল গিবন মুর, আমাকে কী করতে বলেন? ওই যোডিয়াক থাকলে থাকবে ইজিপশিয়ান পুরনো আমলের মালপত্রে ভরা ঘরে। এখানে আসার সময় পেরিয়ে এসেছি ওই জায়গা।

মাথা নাড়লেন হামদি। চাক্ষুষ প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই করব না। তেমনই কথা হয়েছে সুইস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। এ দেশে যে-কোনও কাল্টকে গজিয়ে উঠতে দেয়া হয়। সত্যিই নাদির মাকালানির কাছে যোডিয়াক থাকলে কেবল তখনই হামলা করব আমরা।

তা হলে গিবন মুরের কাছে ক্যামেরা দেয়া উচিত ছিল, বলল বেলা।

প্রথমেই সন্দেহ পড়ত তার ওপর, বলল লাবনী। ওয়্যায়ারলেস হেডসেট-এ জানাল, মুর, আপাতত অপেক্ষা করুন।

ফোন চালু রাখুন, কোনও গোলমাল হলে আমাদের জানাবেন, ফিরে এসেছে কামাল। সেক্ষেত্রে আমরা আপনাকে বের করে আনব।

দুর্গ থেকে বের করে আনবেন? হাসল নায়ক, সিনেমায় ওই কাজ করেছি আগে। নায়িকাকে নিয়ে ভেগে গেছি।

হয়তো মাত্র একবার সুযোগ পাব, কাজেই তৈরি থাকুন, বলল শাহেদ কামাল।

ঠিক আছে, খসখস শব্দে পকেটে মোবাইল ফোন রাখল মুর।

এইমাত্র জিপে উঠেছে মিশরীয় সৈনিক। ডক্টর হামদির উদ্দেশে বলল, এইমাত্র পৌঁছুল বাস। নামাতে শুরু করেছে দুর্গের ড্র-ব্রিজ। লেকের পাশের রাস্তা ঘুরে এসেছি। আরও বাস আসছে।

বড় অনুষ্ঠান, বলল লাবনী। আমাদের কী করা উচিত?

ভুরু কুঁচকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন ডক্টর হামদি, যদি প্রমাণ হয় নাদির মাকালানির কাছেই আছে যোডিয়াক, সেক্ষেত্রে অ্যাটাকে যাব আমরা।

মাথা দোলাল লাবনী।

নিজের হেডসেটে বলল শাহেদ কামাল, মাসুদ ভাই?

.

পিরামিড থেকে একটু দূরে উঠানের দেয়ালের পাশে পার্ক করা হয়েছে কালো কাঁচের লোভনীয় বিলাসবহুল মার্সিডিয। একটু আগে নাদির মাকালানির লোক নিয়ে গেছে নায়ক গিবন মুরকে। তখন গাড়ি থেকে না নেমে সামনের সিটে চুপ করে বসে ছিল গাড়ির গম্ভীর ড্রাইভার। এ মুহূর্তে তার কানে ক্লিপ-অন ইউনিট। ওটাকে হেডসেট না বলে ব্লুটুথ ইয়ারপিস বলাই ভাল। একপাশে খুদে ভিডিয়ো ক্যামেরা।

শুনছি, বলল মাসুদ রানা। কী অবস্থা, কামাল?

নায়ক গিবন মুরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য রানাকে জানাল জেনেভা শাখা প্রধান শাহেদ কামাল। দুর্গের গেট দেখল রানা। নিচে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে ড্র-ব্রিজের দুই প্রান্ত। ভোতা ভুম্ আওয়াজ হলো। ঝনঝন করে উঠল পুরু শেকল। ধীর গতিতে তীর থেকে ড্র-ব্রিজে উঠল একটা বাস। ভেতরে অনেক মানুষ। পার্কিং লটের আরেকপ্রান্তে গিয়ে থামল বাসটা। ওদিকে চেয়ে আছে রানা।

ভিডিয়ো লিঙ্কের মাধ্যমে যাত্রীদেরকে বাস থেকে নামতে দেখে বলল লাবনী, বোধহয় অনেকে আসছে।

আরও বাস আসছে, বলল শাহেদ কামাল।

রানা, এত লোক, ভেতরে ঢুকতে পারবে? বলল লাবনী, বিপদ হবে না?

মনে হচ্ছে কাজটা কঠিন হবে না, বলল রানা। চওড়া দেয়ালের ব্যাটলমেন্টে দেখছে সশস্ত্র গার্ড। তবে তাদের সব মনোযোগ বাসের যাত্রীদের দিকে। পিছলে পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে সরল রানা। দরজা খুলে আস্তে করে বেরিয়ে এল। ইচ্ছে করেই বড় একটা এসইউভির পাশে পার্ক করেছে মার্সিডিয। নিজে আছে ছায়ার ভেতর। পাথরের মূর্তির মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর বুঝল, কেউ দেখেনি গাড়ি থেকে নামতে। সন্তুষ্ট হয়ে কয়েক পা সামনে বাড়ল রানা। এখন পরিষ্কার দেখছে পুরো উঠান।

সামনেই আকাশছোঁয়া, কাঁচের বিশাল পিরামিড। বামে বাস। এখন আশপাশে কেউ নেই। ডানদিকে দারুণ সুন্দর ছোট এক বাগান। ওটার ঝোপঝাড় ও গাছের আড়াল নিয়ে যেতে পারবে পিরামিডের কাছে। ঠিক আছে, মনে হয় কারও চোখে না পড়ে ঢুকতে পারব পিরামিডে। যোডিয়াক কত তলায়?

কাদির ওসাইরিসের কাছে শুনেছি, রাখবে দোতলায়, বলল লাবনী, তবে মাকালানি কী করবে…।

ঠিক আছে। দুই গাড়ির মাঝের সরু পথে সরে এল রানা। একবার দেখল ব্যাটলমেন্ট। তারপর উঠান। বরফের মূর্তি হয়ে গেল ও।

 এইমাত্র দুর্গের দরজা পেরিয়ে পিরামিডের দিকে চলেছে নাদির মাকালানি। তাকে পাহারা দিচ্ছে তিনজন লোক। তাদের দুজনকে চিনল রানা। আবু আর ভার্নে। কিলিয়ান ভগলারের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বোধহয় হয়ে উঠেছে প্রধান দুই বডিগার্ড। তৃতীয় লোকটাকে চিনল না রানা। তার হাতে সিলিণ্ডারের মত ধাতব কন্টেইনার।

রানা, কন্টেইনার হাতে ওই লোকটাকে দেখেছি ল্যাবে, বলল লাবনী। বিজ্ঞানী।

লোকটার হাতের সিলিণ্ডারে মন দিল রানা। স্টেইনলেস স্টিলে সিম্বল। চোখ সরু করে পড়তে চাইল। পিরামিডের কোনা ঘুরে চলে গেল তারা। তবে যা জানার জানা হয়ে গেছে রানার। তিনটে বাঁকা শিং এক বৃত্তের ভেতর। বায়োহ্যায়ার্ড। ওই সিলিণ্ডার কনটেইনমেন্ট ফ্লাস্ক।

তার মানেই, ভেতরের জিনিস বায়োলজিকাল এজেন্ট।

শিরশির করে উঠল রানার ঘাড়ের ছোটসব রোম।

সিলিণ্ডারের জিনিস এখনই বিপজ্জনক হবে, সে-সম্ভাবনা কম। নইলে হ্যাঁযমেট সুট পরে ঘুরত নাদির ও তার অনুগতরা। রানার মনে পড়ল, ওসাইরিসের পিরামিডে কী বলেছে লোকটা। তার কথামত না চললে লাশ হবে কোটি কোটি মানুষ! এখন ওই কন্টেইনারের জিনিস থেকে নিরাপদ ওই চার লোক। হয়তো নিয়েছে প্রতিষেধক।

রানা এসইউডির ছায়ায় ফিরতেই জিজ্ঞেস করল লাবনী, কী করছ, রানা?

উড়িয়ে দেব এদের ল্যাব। ওটা তো কাঁচের পিরামিডের ওপরের দিকে, তাই না?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমরা অন্য কাজে এসেছি, মিস্টার রানা, প্রায় হায়-হায় করে উঠলেন ডক্টর হামদি। আমাদের প্রথম কাজ যোডিয়াক উদ্ধার করা।

সেটা আপনাদের কাজ, বলল রানা, আমার আলাদা। কোনও নরপিশাচ খুনে ভাইরাস ছড়াবে জানার পরেও চুপ করে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। পিরামিডের দিকে তাকাল। একটু আগে কাঁচের দালানের সদর দরজা দিয়ে ঢুকেছে নাদির মাকালানি। এখন প্রবেশ করছে তার অনুসারীরা। কিন্তু এরা কেন ড্র-ব্রিজের কাছের সাইড ডোর ব্যবহার করছে না, বুঝল না রানা। ঠিক করে ফেলেছে, ওদের সঙ্গে মিশে ঢুকে পড়বে পিরামিডে। এ কথা বলতেই আপত্তি তুলল ডক্টর হামদি ও লাবনী। চুপ থাকল রানা এজেন্সির ছেলেরা।

তর্কে গেল না রানা, মন দিয়ে দেখছে উপস্থিত সবাইকে। নিউ ইয়র্ক ও প্যারিসের অনুষ্ঠানে ছিল নানা বয়সের অনুসারী, কিন্তু হেডকোয়ার্টারের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতরা বয়সে তরুণ। নানান দেশের নাগরিক। হয়তো পছন্দের অনুসারীদেরকে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে বলেছে মাকালানি।

ছায়ার আড়াল নিয়ে সাবধানে এগোল রানা। পৌঁছে গেল পিরামিডের কাছে এক গাড়ির পাশে। হেডসেটে নিচু স্বরে বলল, ঠিক আছে, অফ করছি মাইক। কপালের পাশে ক্যামেরা নিয়ে সবার সামনে হাজির হতে পারব না।

কিন্তু, রানা… বলতে শুরু করেছিল লাবনী, কিন্তু ইয়ারপিস খুলে ফেলেছে রানা। ওটা আটকে নিল জ্যাকেটের তলের অংশে।

অনুষ্ঠানে আপাতত এসেছে জনাপঞ্চাশেক তরুণ-তরুণী। আলাপ চলছে সবার ভেতর। প্রায় সবাই উত্তেজিত। দারুণ কিছু পাবে, এমন ভাব। উল্লসিত। যেন জয় করেছে গোটা দুনিয়া। তাদের পেছনে হাঁটছে সবুজ ব্লেযার পরা গার্ডরা।

একবার ব্যাটলমেন্টের দিকে তাকাল রানা। এমন ভঙ্গি নিয়েছে, এইমাত্র নেমেছে কোনও গাড়ি থেকে।

এদিকে চেয়ে নেই গার্ডরা। হনহন করে হেঁটে ভিড়ে মিশে গেল রানা। নিজেও উত্তেজিত। লড়তে বা দৌড়াতে হতে পারে, তাই তৈরি। বুঝতে পারছে, দুর্গের আঙিনায় আছে বলে কেউ জানতে চাইবে না কেন ও এখানে। তবুও সবুজ ব্লেযারের কারও সন্দেহ হলে, সেক্ষেত্রে চেষ্টা করবে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যেতে।

চিৎকার করে থামতে বলল না কেউ। একবার কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল এক তরুণ, তারপর আবার মনোযোগ দিল পাশের তরুণের কথায়। বড় করে শ্বাস ফেলল রানা। আর সবার সঙ্গে ঢুকে পড়ল পিরামিডের ভেতর।

নাদির ও তার দলের কাউকে লবিতে দেখল না।

গার্ড এদিকে বেশি।

আপনারা দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন, সবার কথার ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে বলল এক গার্ড। একটু পরেই খুলে দেয়া হবে মন্দির। ওই একই কথা বলা হলো ফ্রেঞ্চ ও আরবি ভাষায়। ভিড়ের বাইরের কিনারায় রয়ে গেল রানা। চট করে বেরোতে হলে কোন দিকে যাবে, দেখে নিয়েছে। একটু সামনেই কাঁচের এলিভেটর। সামান্য দূরে ফ্রস্টেড কাঁচের বিশাল দুই কবাটের গেট। বোধহয় ওদিক দিয়ে ঢুকতে হয় মন্দিরে। দূরপ্রান্তে দুপাশে ছোট দুটো দরজা। এলিভেটর ছাড়াও কোনও সিঁড়ি থাকবে, ভাবল রানা। ওটা খুঁজতে হবে।

কয়েক মিনিট পর এল আরও একদল তরুণ-তরুণী। তার পর পরই এল আরও অনেকে। লবিতে গিজগিজ করছে অন্তত দু শজন তরুণ-তরুণী। মানুষের চাপ কমাতে প্রথমে আসা দলের সবাইকে নেয়া হলো একপাশের এক দরজা দিয়ে। তাদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে নেই রানার। একটু দূরেই এক গার্ড। সে একবার সামান্য সময়ের জন্যে চোখ সরিয়ে নিলেই…

পেরিয়ে গেল দুমিনিট, তারপর ভোলা হলো মন্দিরের প্রশস্ত দরজা। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কারণে ওদিকে ঘুরে তাকাল সবাই। ওই সুযোগে ভিড় থেকে সরে পাশের ঘোট দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা। যা ভেবেছে, করিডরের শেষমাথায় স্টেয়ারওয়েল। প্রতিতলা অ্যাশার পেইন্টিঙের মত বিদঘুটে অ্যাংগেলে। নতুন করে হেডসেট পরে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা।

রানা! কী হচ্ছে ওদিকে? স্ক্রিনে সিঁড়ি দেখে জানতে চাইল লাবনী। এতক্ষণ রানার জিন্সের প্যান্ট ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি ওরা।

অনুসারীদের নিয়ে সম্মেলন করছে নাদির।

জানি। তিনটে বাসে করে গেছে। কিন্তু তুমি কী করছ? বা কী করবে এখন?

আগেই বলেছি, উড়িয়ে দেব ওদের ল্যাব।

কী দিয়ে? তোমার সঙ্গে তো বিস্ফোরক নেই। এমন কী পিস্তলও নেই!

দরকার হলে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

ওই বাঙালি যুবক কিছুই তোয়াক্কা করে না, এটা বুঝতে পেরে গাল কুঁচকে ফেললেন ডক্টর হামদি। তার পাশে এসে থামল এএসপিএস সৈনিকদের একজন। খুব চিন্তিত চেহারা তার। কিছু বলবে? জানতে চাইলেন হামদি।

ভ্যানের ইকুইপমেন্ট কেসের তূপের দিকে আঙুল তাক করল লোকটা। স্যর, গায়েব হয়েছে আমাদের দুই প্যাক সি-ফোর!

সি-ফোর? জানতে চাইল বেলা।

সৈনিকের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন হামদি।

সি-ফোর এক ধরনের এক্সপ্লোসিভ, জানাল লাবনী। ওই কেস থেকে সরে বসল বেলা।

সেট-আপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন ওগুলো নিয়েছি, হামদিকে জানাল রানা। এতই স্বাভাবিকভাবে বলেছে, যেন চেয়ে নিয়েছে একটা পেন্সিল ব্যাটারি।

মিস্টার রানা! পাগল হয়েছেন? প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন হামদি। ওখানে বিস্ফোরণ হলে, মিশরের সরকারের ঘাড়ে চাপবে সব দোষ!

তা হলে সঙ্গে সি-ফোর এনেছেন কেন? নিরীহ সুরে জানতে চাইল রানা।

চোর-চোর চেহারা করলেন ডক্টর হামদি। বিকল্প হিসেবে এনে থাকতে পারে সৈনিকরা।

আমিও ব্যবহার করব একই বিকল্প, মৃদু হেসে বলল রানা, আপনাদের কূটনীতির বারোটা বাজবে বায়োওয়েপন নাদির ছড়িয়ে দিলে। সে কারণেই সি-ফোর ধার নিয়েছি। দুটো চার্জেই কাজ হওয়ার কথা। ওপরে গিয়ে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেব। মুরকে নিয়ে বেরিয়ে আসব। উড়ে যাবে পিরামিডের ওপরের অংশ। আমরা সরে গেলে কেউ দোষ দেবে না আপনাদেরকে…

সবাই স্ক্রিনে দেখল, একটা ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে গেছে রানা। সামনেই অফিস লেভেল। এইমাত্র খুলে গেছে দরজা।

রানাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে এক গার্ড!

লোকটাকে দেখে মোটেও বিস্মিত নয় রানা।

সামলে নেয়ার আগেই গার্ডের কণ্ঠার ওপর ঘুষি বসাল বিসিআই এজেন্ট। এক পা পিছিয়ে গেল লোকটা, তখনই নাকে নামল মারাত্মক আরেক ঘুষি। ঠাস করে দরজার কবাটে বাড়ি খেল গার্ডের মাথার পেছনদিক। এতই জোরে লেগেছে, ধুপ করে মেঝেতে পড়ল সে। এক সেকেণ্ড পর রানার বাম পায়ের লাথি পড়ল তার মুখের ওপর। খটাং করে মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল বেশ কটা দাঁত। বোধহয় সেই ব্যথাতেই অজ্ঞান হলো গার্ড।

দুপা ধরে তাকে অফিসে টেনে নিল রানা।

অফিসে কেউ নেই। জ্বলছে অল্প ওয়াটের বাতি। কাঁচের দেয়ালের ওদিকে স্ক্রিন সেভারের আলো। আগেই আজকের মত কাজ শেষ করে বিদায় নিয়েছে ওসাইরিয়ান সাবসিডিয়ারি কোম্পানির লোক। অথবা, আছে টেম্পলের অনুষ্ঠানে। আপাতত কারও এদিকে আসার কথা নয়।

রানা! তুমি ঠিক আছ… বলতে শুরু করেছিল লাবনী…

কিন্তু সুযোগ না দিয়ে বলল রানা, আমি ভাল থাকব না তো কে থাকবে? দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে গার্ডকে দেখছে ও। ওই লোক উচ্চতায় ওর চেয়ে ইঞ্চি খানেক বেশি।

.

ছিহ, মাসুদ ভাই? আপত্তির সুরে বলল বেলা। জানতাম না আপনি এমন বাজে চোর! মানুষকে উলঙ্গ করে সব নিয়ে যান! অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলল ও।

কয়েক টানে অচেতন গার্ডের পোশাক খুলে ফেলেছে রানা। তারপর মনে পড়েছে লাবনী ও বেলার কথা। তখন আপত্তিকর দৃশ্য থেকে মেয়েদেরকে রক্ষা করতে সরিয়ে দিয়েছে ক্যামেরার চোখ। ওটা এখন দেখছে ছাত।

এবার কী করবে? জানতে চাইল লাবনী।

সেটাই ভাবছি। খস্-খস্ আওয়াজে পোক ছাড়ছে রানা। পুরো দেড় মিনিট পর আবার দৃশ্য দেখাল ক্যামেরা। এখন রানার পরনে গার্ডের পোশাক, হাতে পিস্তল।

ধরতে পারলে কিন্তু খুন করে ফেলবে, কেঁপে গেল লাবনীর কণ্ঠ।

আগে ধরুক তো!

 ঝুঁকি নিয়ো না, রানা!

তুমি তো জানো, কক্ষণো ঝুঁকি নিই না। ক্যামেরায় দেখা দিল রানার হাসিমুখ। ডক্টর হামদি, আপনার ছেলেদের বলুন রেডি হতে। ধরে নিন, ঝামেলা হবেই। শুধু টিয়ার গ্যাস বা মরিচের ঝাঁঝ দিয়ে কাজ হবে না।

বুঝেছি, বললেন অসন্তুষ্ট ডক্টর হামদি। এক সৈনিকের দিকে মাথার ইশারা করলেন। কেস থেকে বের করতে লাগল সৈনিকরা এফএন পি-নাইন্টি সাবমেশিন গান। লাবনী ও বেলার উদ্দেশে বললেন হামদি, এটাও বিকল্প। আশা করি ব্যবহার করতে হবে না।

নির্ভর করে নাদিরের ওপর, বলল রানা। নতুন পাওয়া সবুজ ব্লেযারের পকেটে রেখে দিল পিস্তল। পাশের পকেটে গেল সি-ফোর ও রেডিয়ো ডেটোনেটর। এবার রানা এজেন্সির ছেলেদের উদ্দেশে বাংলায় বলল, আমি রেডি। তোমরাও রেডি হও।

আগেই দলের সবাইকে নিয়ে পাশের গাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে শাহেদ কামাল। হাতের কাছেই এমপি-সেভেন সাবমেশিন গান। মনিটরে দেখছে রানাকে। জানিয়ে দিল, আপনি সিগনাল দিলেই মাঠে নামব আমরা, মাসুদ ভাই।

আবার স্টেয়ারওয়েলে ফিরেছে রানা। ওপর বা নিচ থেকে আসছে না কোনও আওয়াজ। জানার উপায় নেই ঠিক কতক্ষণ পর গার্ডকে খুঁজবে কেউ। জলদি কাজ সেরে বেরিয়ে যেতে হবে, তাই দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল পিরামিডের ওপরতলায়।

সামনের করিডরে এলিভেটরের জন্যে অপেক্ষা করছে এক লোক। স্টেয়ারওয়েল ডোর পেরিয়ে রানা আসতেই অলস চোখে ওকে দেখল সে। দ্বিতীয়বার তাকাল। রানার মনে হলো না সে খুব সতর্ক। তবে, ওকে দেখে যে কারণেই হোক, চিন্তায় পড়ে গেছে। মৃদু মাথা দোলাল রানা। ইয়ারপিস আড়াল করতে একদিকে সরিয়ে রেখেছে মুখ। এলিভেটর পৌঁছে যেতেই উঠে পড়ল লোকটা, ফিরেও পেছনে তাকাল না।

পরের ঘরে ঢুকে ইস্টের কড়া গন্ধ পেল রানা। একটু দূরেই কাঁচের দেয়াল। পিরামিডের চূড়া থেকে সামান্য নিচেই এই ল্যাব। চোখা ছাতের শীর্ষে আকাশের ধ্রুবতারার দিকে তাক করা হয়েছে শক্তিশালী এক স্পটলাইট।

ল্যাবে মানুষ বলতে মাত্র একজন। রানার দিকে পিঠ দিয়ে দেখছে ওয়ার্কবেঞ্চে রাখা স্টেইনলেস স্টিলের কনটেইনমেন্ট ফ্লাস্ক। ঘরে একইরকম অনেক সিলিণ্ডার। প্রতিটার গায়ে সিল করা বায়োহ্যায়ার্ড সিম্বল।

অন্তত পঞ্চাশটা ওই জিনিস, চাপা স্বরে বলল রানা।

হায়, আল্লা! বিড়বিড় করল লাবনী, অনুষ্ঠান নয়, মস্তবড় পরিকল্পনা করেছে নাদির মাকালানি। দুনিয়ার নানান দেশ থেকে নিজের অনুসারীদের ডেকে এনেছে। তারা আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বিষাক্ত বীজগুটি!

এত তাড়াতাড়ি এসব করা সম্ভব? বিস্ময় নিয়ে বললেন ডক্টর হামদি। মাত্র চারদিন হলো ওসাইরিসের পিরামিড থেকে ফিরেছে নাদির মাকালানি!

ল্যাবে চোখ বোলাল রানা। ইস্ট উৎপাদনের জন্যে ওদিকে বড় বড় ভ্যাট। আরেক পাশে ইস্ট শুকিয়ে বীজগুটি পাওয়ার জন্যে আভেন। একদিকে কাঁচের কেবিনেটে রাখা ক্যানোপিক জার। মুখ এখন ভোলা। ক্ষমতা আর টাকার জন্যে উন্মাদ হয়ে গেছে নাদির। আভেনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে কমপ্রেস গ্যাসের ট্যাঙ্ক। বিস্ফোরণের জন্যে ওই জায়গাটা ভাল।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আগে ঢুকতে হবে ওদিকের ঘরে।

ল্যাবের দরজায় কি-কার্ড লক। দুর্ঘটনা হলে আটকে রাখবে বায়োহ্যায়ার্ড ম্যাটার। পিস্তলের গুলিতে দাগও পড়বে না ওই কাঁচে।

মাসুদ ভাই, ঢুকবেন কী করে? বেলার কণ্ঠ শুনল রানা। ততক্ষণে দরজার কাছে পৌঁছে গেছে ও। একহাতে হ্যাণ্ডেল ধরে আরেক হাতে নক করল।

পুরু কাঁচের ওদিকে গেল না আওয়াজ।

আগের চেয়ে জোরে টোকা দিল রানা।

 এবার ওর দিকে মনোযোগ দিল বিজ্ঞানী।

দরজা খুলুন, নীরবে মুখ নাড়ল রানা। লোকটা যেন এগিয়ে আসে, সেজন্যে হাতের ইশারা করছে।

ভুরু কুঁচকে ফেলল বিজ্ঞানী। কী যেন বলল। কণ্ঠ প্রায় শোনাই গেল না মোটা কাঁচের কারণে। লিপ রিডিং জানে রানা, কিন্তু বুঝল না কোন ভাষায় কথা বলছে লোকটা। তাতে হাল ছেড়ে না দিয়ে হাসল রানা। বারকয়েক মাথা দোলাল।

আরও কুঁচকে গেল বিজ্ঞানীর ভুরু। ভীষণ বিস্মিত সে। লকের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল কি-কার্ড। পিছলে আরেক পাশে সরল দরজা। হ্যাঁ, কেমন আছ, দোস্ত! খাস বাংলায় বলল রানা।

এবার ইংরেজিতে বলল বিজ্ঞানী, কী বললে? কথায় জার্মান সুর।

বলেছি, তুমি শালা ভুল করে ফেলেছ, বলল রানা। লোকটাকে বিস্মিত হওয়ারও সুযোগ দিল না ও। দুহাতে মাথাটা ধরে নামিয়ে এনে ঠাস্ করে ঠুকে দিল দরজার হুড়কোর ওপর। নিশ্চিন্তে অচেতন হয়েছে বিষ-বিজ্ঞানী।

ওই লোককে ফেলে সরে যাবে? জানতে চাইল লাবনী। ল্যাব বেঞ্চের পেছনে অজ্ঞান বিজ্ঞানীকে গুঁজে দিল রানা। তুমি না উড়িয়ে দেবে ল্যাব?

কঠোর শোনাল রানার কণ্ঠ, বায়োওয়েপন তৈরি করছিল, কাজেই ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মানসিকতা নেই আমার। তবুও যাওয়ার আগে একতলা নিচে ফেলে যাব। খুশি হয়েছ?

খুশি হব তুমি আস্ত শরীরে বেরোলে, বলল লাবনী।

গ্যাস ট্যাঙ্কের দিকে মনোযোগ দিল রানা। ওগুলোর মাঝে সরু সব জায়গা। ডেটোনেশন সার্কিট চালু করে সিগারেটের প্যাকেট আকৃতির একটা সি-ফোর রেখে দিল সরু একটা জায়গায়। কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা নাড়ল।

কী হলো? জানতে চাইল লাবনী।

প্রথমেই যে-কারও চোখ পড়বে, বলল রানা। দেখছে ট্যাঙ্কের পাশে খোলা বিশাল স্টিলের আভেন। একটার পেছনে হাত দিয়ে পেল ফুটোওয়ালা গ্যাস পাইপ। ওদিকটা কাদাটে ও তেলতেলে। সি-ফোর রাখার জন্যে যথেষ্ট জায়গা আছে ওখানে। সার্কিট চালু করে দ্বিতীয় বোমাটা রাখল রানা। কাজ শেষ।

এবার তবে বেরিয়ে এসো? অনুরোধের সুরে বলল লাবনী।

আপত্তি নেই, বলল রানা। বেঞ্চের পাশে গিয়ে তুলল বিজ্ঞানীর দুহাত, তারপর টেনে নিয়ে চলল। এবার পিরামিড থেকে বেরিয়ে উড়িয়ে দেব ব্যাটাদের ল্যাব।

কিন্তু টেম্পলে যারা রয়ে যাবে? জানতে চাইল বেলা। খুন হয়ে যাবে না তারা?

কষ্ট পেতাম না এরা খুন হলে, বলল রানা, ভয় পেয়ে, কয়েক তলা নিচে আছে বলে ক্ষতি হবে না তাদের। হেঁচড়ে দরজার কাছে বিজ্ঞানীকে নিল। অবশ্য, এখান থেকে বেরিয়ে দেখবে, সাধের পিরামিডের বুক-মাথা নেই।

দেরি না করে বেরিয়ে এসো, বলল লাবনী। আসার সময় তোমার বন্ধু গিবন মুরকে আনতে ভুল কোরো না।

ওকে ভুলিনি। বিজ্ঞানীর কি-কার্ড ব্যবহার করে দরজা খুলল রানা। টেনে বের করল অচেতন লোকটাকে। তবে বড় বেশি ভারী। ফেলে গেলেই বাঁচত আমার কাঁধদুটো! সামনের দরজার কাছে পৌঁছে একহাতে কবাট খুলে লবিতে বেরোল। কিন্তু তখনই শুনল মিষ্টি একটা আওয়াজ।

এলিভেটর!

বিজ্ঞানীকে ফেলেই পিস্তল বের করতে গেল রানা, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ওর।

সিঁড়িঘর থেকে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দুই গার্ড। মাল তাক করেছে রানার বুকে। এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই বেরোল আরও দুজন সশস্ত্র লোক।

আবু তালাত আর লা ভার্নে!

চারজনের বিরুদ্ধে গোলাগুলি করতে গেলে খুন হবে, বড় করে একবার দম নিয়ে পিস্তল হাত থেকে ফেলে দিল রানা।

এবার এলিভেটর থেকে বেরোল নাদির মাকালানি। রাগে তিরতির করে কাঁপছে মুখের ক্ষতচিহ্ন। ভয়ঙ্কর হাসি ফুটল তার মুখে। মাসুদ রানা… একেবারে ঠিক সময়ে চলে এসেছ আমাদের অনুষ্ঠানে… গুড!

.

একটু আগে আবারও এই জিপগাড়িতে এসে বসেছে শাহেদ কামাল। কালো হয়ে গেছে মুখ। আতঙ্ক নিয়ে মনিটরের দিকে চেয়ে আছে লাবনী। ক্যামেরার ফিল্ড অভ ভিউ হাত দিয়ে বন্ধ করল নাদির মাকালানি। কেটে গেল লিঙ্ক।

শাহেদ ভাই, ওরা ধরে ফেলেছে রানাকে! প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী।

আপনারা আমাদের সঙ্গে আসবেন? ডক্টর হামদির দিকে তাকাল শাহেদ।

সম্ভব নয়, হতাশ সুরে বললেন ডক্টর, যোডিয়াক আছে না জানা পর্যন্ত ওখানে হামলার অনুমতি নেই এএসপিএস এর।

গিবন মুর বলেছেন ওটা ওখানেই আছে, জোর দিয়ে বলল বেলা। ওটাই তো যথেষ্ট প্রমাণ।

যথেষ্ট নয়, বললেন হামদি। মিস্টার রানা বলেছিলেন দেখবেন ওটা সত্যিই ওখানে আছে কি না। সেক্ষেত্রে হামলা করব আমরা।

জিপগাড়ি থেকে নেমে চিন্তিত চোখে লেকের দিকে চেয়ে আছে শাহেদ কামাল। আগেও বহুবার মস্তবড় সব বিপদ থেকে একা বেরিয়ে এসেছে মাসুদ রানা। সুযোগ্য বিসিআই এজেন্ট। শাহেদকে বলে গেছে, একেবারে বাধ্য না হলে সিগনাল দেবে না। সঙ্গে আছে গোপন মাইক্রোফোন। চাইলে ওদেরকে ডাকতে পারে।

শাহেদ কামালের পাশে থামল লাবনী। এখন কী করবেন ভাবছেন?

মাসুদ ভাই সিগনাল দেবেন, কথা সেরকমই হয়েছে, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল কামাল, তবে তিনি কিছুক্ষণের ভেতর বেরিয়ে না এলে আমরা ঢুকব ওখানে।

লাবনী চট করে হেডসেটের চ্যানেল পাল্টে নিল। মিস্টার মুর! শুনতে পাচ্ছেন? মিস্টার মুর!

কাপড়ের খসখস আওয়াজ হলো। হ্যাঁ, বলুন।

ওরা ধরে ফেলেছে রানাকে! বেরিয়ে আসুন ওখান থেকে! অন্য চিন্তা আসতেই বলল লাবনী, আপনার কাছে তো ফোন আছে! পারবেন যোডিয়াকের ছবি তুলতে? সেক্ষেত্রে হামলা করবে ইজিপশিয়ান ফোর্সও।

আতঙ্কে কাঁপল নায়কের কণ্ঠ, একমিনিট! মাই গড! মিস্টার রানাকে ধরে ফেলেছে? তা হলে তো আমিও গেছি!

আমার কথা শুনুন, মিস্টার মুর! গলা শান্ত রাখতে চাইল লাবনী। আপনি যান মিশরীয় আর্টিফ্যাক্টের ঘরে। যোডিয়াকের ছবি তুলে পাঠান। তা হলে আপনাকে আর রানাকে বের করে আনবে রানা এজেন্সির এজেন্ট ও মিশরীয় সৈনিকরা। ঘুরে মিশরীয় জিপগাড়ির দিকে তাকাল লাবনী। গলা উঁচু করে জানতে চাইল, ফোনের ছবি হলে চলবে?

শোগান থেকে নেমে এসেছেন ডক্টর হামদি। হেডসেটে শুনছিলেন কথা। মাথা দোলালেন।

হ্যাঁ। ছবি পেলেই হবে।

জুতোর আওয়াজ শুনল লাবনী। পরক্ষণে হুম্ শব্দ হলো। কাপড় লেগেছে মুরের মাউথ পিসে। চমকে গিয়ে প্যান্টের পকেটে ফোন রেখে দিয়েছে সে। কে যেন আসছে!

 খট করে খুলে গেল দরজা। বলে উঠল কেউঃ মিস্টার মুর?

ই-ইয়েস?

এখুনি অনুষ্ঠান শুরু হবে, আমাদের সঙ্গে আসুন।

আপনাদের তিনজনের সঙ্গে যেতে হবে? ঠিক আছে। ব্যক্তিগত এসকোর্ট? সম্মানিত বোধ করছি!

লাবনী ও শাহেদ বুঝল, কৌশলে নায়ক জানিয়ে দিল, তাকে নিয়ে যাচ্ছে তিন গার্ড। উপায় নেই যে যযাডিয়াকের ছবি তুলবে সে।

আপনাদের মাসুদ ভাই সিগনাল দেবেন, সেজন্যে অপেক্ষা করবেন? উচিত হবে সেটা? বলল লাবনী।

দ্বিধায় পড়ে দুর্গের দিকে তাকাল শাহেদ কামাল। আসতে পারল না কোনও সিদ্ধান্তে। ওর দিকে চেয়ে আছে জামিল হোসেন, টগর চৌধুরি ও নাফিস আহমেদ।

.

ল্যাব থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এল এক গার্ড, হাতে সি ফোর প্যাক। আমরা এটা পেয়েছি।

রানার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া রেডিয়ো ডেটোনেটর দেখল নাদির মাকালানি। এক্সপ্লোসিভ? বাজে জিনিস। তোমার মত লোকের কাছ থেকে এর চেয়ে ভাল কিছু আশা করিনি, মাসুদ রানা।

বলতে পারো হাল ছাড়ার লোক নই, দূরের দেয়াল দেখছে রানা। ভুলে যেতে চাইছে ওই ঘরে আভেন আছে। দ্বিতীয় বোমা খুঁজে বের করা কঠিন। তবে ডেটোনেটর মাত্র একটা, নাদির হয়তো ভাববে, বোমাও মাত্র একটা।

কিন্তু এরা বোমা খুঁজে না পেলেও বাড়তি সুবিধা পাবে না রানা। সি-ফোর ভাল বোমা। ভেতরের ব্লাস্টিং ক্যাপে প্রচণ্ড তাপ ও ঝাঁকি না লাগলে চট করে ফাটবে না। ল্যাব ধ্বংস করতে হলে চাই ওই ডেটোনেটর। কিন্তু আপাতত নাদিরের কাছ থেকে ওটা আদায় করতে পারবে না।

জানলে কী করে যে আমি এখানে? মিশরীয় ধর্মগুরুর মন ডেটোনেটরের দিক থেকে সরাতে চাইল রানা। নষ্ট না হলে প্রথম সুযোগেই জিনিসটা ব্যবহার করবে ও।

রানার সবুজ ব্লেযার দেখাল নাদির। গায়ে ঠিকভাবে লাগেনি। কাদির সবসময় পোশাক ঠিকঠাক রাখত। বলত, যাতে টেম্পলের সিকিউরিটি ফোর্সের ইউনিফর্ম সবসময় ফিটফাট থাকে। আরও সব সুবিধা আছে ভাল পোশাকের। তোমার গায়ে ব্লেযার দেখেই যে-কেউ বুঝবে, ওটা তোমার নয়।

মাথা দোলাল রানা। ঠিক কথাই বলেছ, দুমুখো।

চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ হলো নাদিরের। অবশ্য, সামলে নিল নিজেকে। আবুর দিকে তাকাল। তাতে রানার কাঁধের ওপর সজোরে পিস্তলের নল নামাল লোকটা। তীব্র ব্যথা পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রানা।

ওকে বলতাম তোমাকে খুন করতে, কিন্তু আরও ভাল বুদ্ধি এসেছে।

কথাটা শুনে ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল রানার।

তিনজন মিলে সার্চ করল ওকে।

জুতো খুলে নিয়ে ভালভাবে ঝাঁকিয়ে দেখল। টোকা দেয়া হলো সোলে। গোড়ালির দিকে ফাপা আওয়াজ পেয়ে রানার দিকে চেয়ে হাসল ভার্নে। ওখানে গুঁজে রাখা হয়েছে প্লগের মত কিছু একটা। ওটা খুলতেই পেল মাইক্রোফোন। নাদিরকে ওটা দেখাল গণ্ডার, তারপর নীরব নির্দেশ পেয়ে বুটের নিচে পিষে দিল মাইক্রোফোন। হাসছে। সিআইএতে ছিলাম। তোমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি, বুঝলে?

শাহেদ কামালের সঙ্গে যোগাযোগের আর উপায় নেই।

দুহাত ধরে রানাকে টেনে তোলা হলো। ল্যাব থেকে বেরোল আরেক গার্ড। আর কিছু পেলাম না, বস্।

সি-ফোরের ঢেলা দেখল নাদির। এই একটাই যথেষ্ট ছিল। আবারও ডেটোনেটরের দিকে তাকাল। ডিভাইস থেকে ব্যাটারি নিয়ে বুটের নিচে ফেলে চুরমার করে দিল ওটাকে।

মাস্টারের হোমওয়ার্ক না করা ছাত্রের মত মুখ কালো করেছে রানা। এখন বোমা ফাটাতে হলে তা করতে হবে নিজ হাতে। সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণে মরবৈ ও। কারণ, ওই প্যাকে কোনও টাইমার নেই।

রানার বিমর্ষ চেহারা দেখে বলল ধর্মগুরু, ব্যাকআপ প্ল্যান নেই, না? শীতল হাসল। আমার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বহু দূর থেকে এসেছ, রানা। তাই আপত্তি নেই তুমি অনুষ্ঠানে অংশ নিলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *