ধর্মগুরু ২

১০.

 রূপসী প্যারিস। লুভর মিউযিয়াম।

অলস পায়ে মাঝের প্রাঙ্গণে কুওর (কোর্ট) নেপোলিয়ন পেরোল রানা, লাবনী ও বেলা।

কবছর পর আবার এলাম, বলল লাবনী, কীভাবে যে চড়ুই পাখির মত ফুড়ত করে বেরিয়ে যায় সময়!

পাশ কাটাল ওরা পরের কোর্টইয়াডের মাঝে সত্তর ফুটি কাঁচ ও অ্যালিউমিনিয়ামের পিরামিড। পৌঁছে গেল কারুকাজ করা নোংরা ইজিপ্ট উইঙে। তবে আজ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গার্ড। গত কয়েক মাসে পৃথিবীর নানান মিউযিয়াম থেকে নামকরা বেশকিছু শিল্পকর্ম লুঠ হওয়ায় সতর্ক হয়েছে। কর্তৃপক্ষ। চায় না একই ঘটনা ঘটুক লুভর মিউযিয়ামে।

ডেনডারা যোডিয়াক দেখতে হলে যেতে হবে ১২এ রুমে, টুরিস্ট গাইড ভাঁজ করে রাখল বেলা। বেশ খানিকটা দূরে। প্রথমে বাঁক নিতে হবে, ওই যে ওখানে, তারপর যেতে হবে বামে। এরপর সোজা সামনে গেলেই পৌঁছে যাব।

পুরো লুভর ঘুরব না, বলল রানা, শুধু দরকারি যোডিয়াক দেখেই বেরিয়ে যাব।

সমস্যা নেই, বলল বেলা। মোনা লিসার ছবি দেখতে দেখতে পচে গেছে চোখ। তবে অন্যসব…

হয়তো এরই মধ্যে ওসাইরিসের পিরামিডের কাছে পৌঁছে গেছে নাদির মাকালানি বা তার দলের লোক, বলল লাবনী, প্যারিসে এসে পরেও দেখতে পারবে লুভর। ওসাইরিসের পিরামিডের আর্টিফ্যাক্ট সরিয়ে ফেললে আর কখনও সেগুলোর খোঁজ পাব না। আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত সবার আগে ওখানে পৌঁছে যাওয়া।

পথে সাধারণ মিশরীয় প্যাপিরাস স্কুল থেকে শুরু করে প্রমাণ সাইজ মূর্তি ও কারুকাজ করা মন্দিরের কলাম দেখছে ওরা। তবে চুম্বকের মত টানছে ডেনডারা যোডিয়াক।

১২এ কক্ষ থেকে একটু দূরে ছোট অ্যান্টিরুম। ভেতরে একপাশে কাৰ্যাকের টেম্পল অভ আমুনের বালিপাথরের সব প্রাচীন কীর্তি। ঘরের আরেক পাশে…

ওটা মেঝেতে নেই, ঝুলছে সরাসরি ছাতে।

মুখ তুলে ওরা দেখল, নয় ফুট ওপরে পুরু কাঁচের ওদিকে ডেনডারা যোডিয়াক।

ফ্যাকাসে বাদামি পাথরের স্ল্যাব বললেও দোষ হবে না। উজ্জ্বল আলো পড়েছে ওটার ওপর। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি খাজ-ভাঁজ। হল অভ রেকর্ডসসের যোডিয়াকের চেয়ে বড়। পাথরের আকাশে নক্ষত্রের মেলা।

ওই যে লিয়ো আর স্করপিয়ো, হারকিউলিসের খুন করা সিংহের আকৃতির নক্ষত্ররাশি এবং বৃশ্চিক নক্ষত্ররাজি দেখছে বেলা। কিন্তু আরও অনেক আছে, সেগুলো চিনলাম না।

কই, দেখছি না ঋক্ষমণ্ডল, বলল লাবনী।

আঙুল তুলে যযাডিয়াকের মাঝের একটু দূরের এক চিহ্ন দেখাল বেলা। ওই যে ওটার চিহ্ন!

ভেড়ার বাচ্চার ঠ্যাং? ভুরু ওপরে তুলল লাবনী।

প্রাচীন মিশরীয়রা ভেবেছে দেখতে ওটা অমনই, জানাল বেলা।

একইরকম আছে নক্ষত্রমণ্ডলী, বলল লাবনী, লিবরা, টরাস, এরিয… তবে খোদাই একটু অন্যভাবে। পশ্চিমা যোডিয়াক তৈরি করা হয়েছে মিশরীয়দের যোডিয়াক দেখেই। পরে সামান্য বদলে নিয়েছে নাম। ছাতে আঙুল তাক করল। যেমন ওরিয়ন বা কালপুরুষ। মিশরীয়রা ভাবত পুরাণের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা সে।

মৃদু হাসল রানা। ওসাইরিস?

 দশে দশ দেয়া হলো তোমাকে, হাসল লাবনী।

রঙিন প্রিন্টআউট নেয়া হয়েছে যোডিয়াকের ভিডিয়ো থেকে, ওই কাগজটা খুলল বেলা। জামসি যতটা পেরেছে, বড় করেছে ছবি ও ছায়াছবি। দুধরনের ছবি দিয়েছে। একটা ভিডিয়ো ফ্রেম থেকে নেয়া সরাসরি ব্লোআপ, অন্যটায় ব্যবহার করেছে ফোটোশপ। শেষেরটা সরাসরি নিচে থেকে তোলা ছবির মত। ইমেজ নিম্ন শ্রেণীর ছিল বলে ভাল হয়নি ছবি। অবশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে স্ফিংসের যোডিয়াকের অংশ।

মাথার ওপরের যযাডিয়াকের সঙ্গে প্রিন্টআউট মেলাল বেলা। দুটো কাছাকাছি হলেও তফাৎ আছে, প্রিন্টআউটের লাল বৃত্ত কিন্তু ডেনডারা যোডিয়াকে নেই।

লাল বোধহয় মঙ্গল গ্রহকে বোঝাতে, বলল লাবনী। তবে আমার জানা নেই, গত কয়েক হাজার বছরে কতটা বদলে গেছে নক্ষত্ররাজি। কয়েক সপ্তাহ পর পর নানাদিকে সরছে পৃথিবী। একটা যোডিয়াক কখন তৈরি হয়েছে, সেটা জানতে হলে কমপিউটারে অঙ্ক কষে বের করতে হবে, কোথায় ছিল আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলের অবস্থান। মঙ্গল যদি থাকে অ্যাকুয়েরিয়াস-এ, শনি থাকবে ক্যাপরিকর্নে… ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রিন্টআউট ও ছাতের যোডিয়াক মিলিয়ে দেখছে রানা। সামান্য কুঁচকে গেছে ভুরু। সেটা খেয়াল করেছে লাবনী, রানা কী ভাবছে জিজ্ঞেস করবে, এমনসময় তুড়ি বাজাল বেলা। ও-ও! এখানে তো অন্যরকম! প্রিন্টআউটের একটা প্রতাঁকে আঙুল ঠুকল। ওখানে কালো পটভূমিতে হালকা ছাপের মিল্কি ওয়ে। আমার ভুল না হলে এটা আবারও সেই ওসাইরিস। অন্য নক্ষত্রটার মতই একই রঙ। সবুজ।

ওসাইরিস কি সবুজ ভূত? হাসল লাবনী।

মিশরীয়দের ধারণা ছিল, সবুজ মানে নতুন জীবন, বলল বেলা, কিন্তু ওই লোক… আবারও আঙুল রাখল প্রতাঁকে, এখানের বড় যোডিয়াকে নেই সে।

প্রিন্টআউট ও ছাতের যোডিয়াক দেখল লাবনী, তারপর বলল, তার পাশে ওটা কে? সবুজ ওসাইরিসের পাশেই হলদে-কমলা ছোট আরেক আকৃতি। আরেকটা গ্রহ?

মনে হয় না… লো রেসোলিউশন হলেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বৃত্তাকার মঙ্গল গ্রহ। কিন্তু হলদে-কমলা আকৃতি প্রায় ত্রিকোণ।

পিরামিডের মত।

না তো! হঠাৎ চমকে উঠল বেলা। কিন্তু… চুপ হয়ে গেল।

লা-জওয়াব কেন? একটু অপেক্ষার পর জানতে চাইল রানা।

ওটা… ওটা পিরামিড অভ ওসাইরিস!

তাই হবে, সায় দিল লাবনী। নিশ্চিত হতে মুখ তুলে দেখল ছাতের যোডিয়াক। বহু আগেই মুছে গেছে ডেনডারা প্রস্তর লিপির রঙ। তবে পরিষ্কার দেখা গেল খোদাই করা সব আকৃতি। ওসাইরিসের ফিগার বা ওপরের কোথাও নেই ত্রিকোণ পিরামিড। এখন স্ফিংস যোডিয়াকের নক্ষত্রমণ্ডলীর পযিশন বেরোলে, পেয়ে যাব পিরামিড অভ ওসাইরিসের লোকেশন!

কিন্তু আনমনে মাথা নাড়ছে রানা।

জানতে চাইল লাবনী, কী ভাবছ?

ওভাবে বের করা যাবে বলে মনে হয় না, বলল রানা। নক্ষত্র ন্যাভিগেট করে দেখা যেতে পারে, কিন্তু নক্ষত্রমণ্ডলীর মানচিত্র দেখে ঠিক জায়গায় পৌঁছুবে না। আগে তোমার চাই সেক্সট্যান্ট আর একটা বর্ষপঞ্জী। শুধু তাই নয়, জানতে হবে অতীতের সেই তারিখ, যখন তৈরি হয়েছে যোডিয়াক। নইলে বেরোবে না নক্ষত্রের পযিশন।

উত্তেজনা হারিয়ে গেল লাবনীর। ও?

আরও আছে। স্ফিংসের বুক থেকে যে যোডিয়াক ওরা নিয়ে গিয়ে ভাবছে, ওটা মানচিত্র, ওটা তা না-ও হতে পারে।

তাই? রানার কথা বুঝতে পারছে না লাবনী।

সম্ভাবনা খুব বেশি, ওটা নক্ষত্রমণ্ডলীর মানচিত্রই নয়। অন্য ধরনের ম্যাপ। সিলিঙের দিকে তাকাল রানা। ওই যোডিয়াকের মূল সমস্যা হচ্ছে, ওটা বহনযোগ্য নয়। কাজেই যখন যাবে ওসাইরিসের পিরামিড খুঁজতে, চাই ওই যোডিয়াকের একটা নকল। কাজেই তা তৈরি করবে কাগজে। আর তখনই হবে মস্তবড় ভুল। …লাবনী, তোমার কাছে কলম আর কাগজ আছে?

লাবনী কিছু বলার আগেই পার্স থেকে বলপয়েন্ট কলম ও ছোট প্যাড বের করে রানার হাতে দিল বেলা।

মৃদু মাথা নাড়ল রানা। নিজেই ম্যাপ তৈরির চেষ্টা করো, লাবনী। কাজটা যখন করবে, দেখব তোমার অনিন্দ্য সুন্দর মুখ।

কলম ও কাগজ নিয়ে অবাক চোখে রানাকে দেখল লাবনী। হঠাৎ রোমান্টিক হয়ে উঠলে যে?

এবার কাগজ তুলে আঁকতে শুরু করো সিলিঙের যোডিয়াক আর এই ঘর, মৃদু হেসে বলল রানা।

ঘাড় কাত করে যোডিয়াক দেখে নিয়ে ঘর দেখল লাবনী, তারপর নেমে পড়ল কাজে। কিছুক্ষণ পর বলল, হ্যাঁ, এবার কী?

ফাঁকা ঘরের শেষমাথায় গেল রানা। ধরে নিলাম এটা উত্তরদিকের দেয়াল। এবার মানচিত্রে লিখে নাও উত্তরদিক। কাগজ কিন্তু তুলে রাখবে আগের মত করেই।

ড্রয়িং করা কাগজে উত্তরদিকে এন লিখল লাবনী।

এখন ওটা যদি নর্থ হয়, অবশ্যই উল্টোদিকটা সাউথ, বলল রানা। সেটাও লিখে নাও। এবার… ডানহাত তাক করল একপাশের দেয়ালের দিকে। তার মানে এই দেয়াল পুব, আর ওদিকের দেয়াল পশ্চিম ঠিক?

হ্যাঁ, ঠিক। কাগজে পুব ও পশ্চিম লিখে নিল লাবনী। কোথাও কোনও ভুল নেই।

ওকে দেখল রানা, ঠোঁটে মৃদু হাসি। ঘড়ির কাঁটার মত ঘুরল প্রতিটি দেয়ালের দিকে। তা হলে পেলে নর্থ, ইস্ট, সাউথ ও ওয়েস্ট। সব ঠিক আছে তো তোমার ড্রইঙে?

হ্যাঁ। মটকে যাচ্ছে, এবার ঘাড় নিচু করতে পারি? নিশ্চয়ই, বলল রানা।

ঘাড় সোজা করে পাতায় নিজের অসাধারণ শিল্প দেখল লাবনী।

সমস্যা এখান থেকেই শুরু, বলল রানা, ম্যাপ ঘুরিয়ে ওটার উত্তরদিক তাক করো উত্তর দেয়ালের দিকে। কাজটা করল লাবনী। তা হলে এবার বুঝে নাও কোথায় ত্রুটি হয়েছে মানচিত্রে।

কাগজ দেখল লাবনী। ঠিকভাবেই লিখেছে প্রতিটি দিক। আরও কয়েক সেকেণ্ড দেখার পর কপালে চাপড় দিল। ও! উত্তর আছে উত্তর দিকে, দক্ষিণ আছে দক্ষিণ দিকে। কিন্তু কাগজে পুরো উল্টে গেছে পুর্ব ও পশ্চিম! বিদঘুটে সমস্যা তো!

ন্যাভিগেশন ট্রেইনিঙে শেখানো হয় এসব, বলল রানা। এতই সহজ সমস্যা, কেউ ধরিয়ে না দিলে বোঝার উপায় থাকে না।

লাবনীর কাগজের দিকে চেয়ে আছে বেলা। আমি ঠিক বুঝলাম না।

ওর হাতে কাগজ ও কলম ধরিয়ে দিল লাবনী। নিজেই বুঝে নাও।

কাগজ হাতে যোডিয়াকে চোখ রাখল বেলা।

কিন্তু ওসাইরিসের পিরামিড খুঁজতে এতে কী সুবিধা হবে? জানতে চাইল লাবনী।

সত্যি বলতে, সেটা এখনও জানি না, বলল রানা, তবে একটা কথা তো মানবে, স্ফিংসের যোডিয়াক সহজ মানচিত্র নয়? পিরামিড খুঁজতে শুরু করে নতুন করে ভাবতে হবে নাদির মাকালানিকে।

তাই তো মনে হচ্ছে।

নোটবুক নিচু করে দেয়াল দেখল বেলা। বুঝে গেছে। ও, তার মানে ওপরের যোডিয়াক আঁকতে গেলে পাল্টে যায় পুব ও পশ্চিম। পাগলের কাণ্ড!

কী যেন বলতে যাচ্ছিল লাবনী, এমনসময় ঘরের দরজায় এসে থামল সুট পরা এক অফিশিয়াল। ঝড়ের বেগে ফ্রেঞ্চ বলল সে।

ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা আছে রানার, তবে বক্তব্য শুনে বিরক্ত হয়েছে, তাই ইংরেজিতে বলল, সরি, ইংরেজি বলুন। আমার সঙ্গে দুই ভদ্রমহিলা আমেরিকান।

ও, আমেরিকান। ইংরেজি? বুঝলাম। পাত্তা না দিয়ে বলল লোকটা, আশা করি ভাল লেগেছে লুভর মিউযিয়াম? তবে দুঃখিত, বিশিষ্ট এক ভিআইপি অনুরোধ করেছেন, একা দেখবেন ডেনডারা যোডিয়াক। কাজেই এবার আপনাদেরকে বিদায় নিতে হবে এই ঘর ছেড়ে।

ভিআইপি? মৃদু হাসল রানা। তারা তো আর আমাদের মত সাধারণ মানুষের সঙ্গে একই ঘরে থাকবেন না! তো চলে যেতেই হয়!

ঠিক কথাই বলেছ, সায় দিল লাবনী। আমাদের নাক থেকে বের হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড শেষ করে দিতে পারে তাঁদের অমূল্য জীবন! রানার বাহুতে হাত রেখে দরজার দিকে রওনা হয়ে গেল ও।

বিরক্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে মিউযিয়াম অফিশিয়াল। পাশ কাটাবার সময় বলল বেলা, আমরা আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি বলে মাফ করে দেবেন, নইলে নরকেও ঠাই হবে না আমাদের।

ফ্রেঞ্চ লোকটার সরু দুই ঠোঁট চেপে বসল পরস্পরের ওপর। কয়েক সেকেণ্ড পর কাকে যেন ডাক দিল।

এদিকে মেইন হলে বেরিয়ে চমকে গেল রানা, লাবনী ও বেলা। পেছনে কয়েকজনকে নিয়ে ডেনডারা যোডিয়াকের ঘরের দিকে হেঁটে আসছে নাদির মাকালানি। পাশেই খুনে কিলিয়ান ভগলার!

খুব খুশি হলাম দেখা হয়ে, বলল রানা।

সাপের চামড়ার জ্যাকেটে হাত ভরে দিয়েছে বডিগার্ড। কিন্তু কড়া চোখে তাকে দেখল নাদির মাকালানি।

লুভর মিউযিয়ামে গোলাগুলি পছন্দ করবে না ফ্রেঞ্চ পুলিশ, সান্ত্বনা দিল রানা।

রানার দল এবং নাদির মাকালানির দলের মাঝে থমকে গেছে মিউযিয়াম অফিশিয়াল। আপনারা পরস্পরকে চেনেন?

কেউ কখনও পরিচয় করিয়ে দেয়নি, তবে পরস্পরকে চিনি, বলল রানা। ইনি সম্ভবত মিস্টার নাদির মাকালানি। সঙ্গে তাঁর প্রিয় বন্ধু কিলিয়ান ভগলার।

কারও সঙ্গে পরিচয়ের ইচ্ছে আমাদের নেই, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি, তবে ডক্টর লাবনী আলমকে ঠিকই চিনেছি। স্ফিংসের ঘরে ছিল। দুনিয়ার অনেকেই চেনে এখন। চোখ পিটপিট করে কয়েক সেকেণ্ড দেখার পর লাবনীকে চিনে ফেলল লুভর অফিশিয়াল। তার সঙ্গে ছিল বেলা আবাসি ও মাসুদ রানা। কী কারণে এসেছে, তা-ও বুঝতে পারছি।

আপনারা এখানে কেন? প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইল বেলা।

চোখ সরু করল মাকালানি। আপনারা এখানে কেন, ডক্টর আলম?

বোধহয় একই কাজে, বলল লাবনী, প্রাচীন নক্ষত্র নিয়ে সমান আগ্রহ আমাদেরও।

আচ্ছা! আরও কঠোর হলো লোকটার চোখ।

লাবনী ওর বাহু ধরে রওনা হতে চাইছে দেখে বলল রানা, আশা করি আবারও দেখা হবে।

এখনই বাইরে গিয়ে দেখা করি না কেন দুজন? খেপা গোখরো সাপের দৃষ্টিতে রানাকে দেখল কিলিয়ান ভগলার। বোধহয় ভুলতে পারেনি, নিতম্বে বেদম এক লাথি দিয়েছিল বাঙালি যুবক। আবারও চলে গেল তার হাত হোলস্টারের কাছে।

তার কাঁধ চাপড়ে দিল নাদির মাকালানি। অধৈর্য হয়ে, কিল। আবার হাতের কাছে পাবে ওকে। তখন আর এত ভদ্রতাও করতে হবে না।

অপেক্ষা আমিও করব, বলল রানা, ওরও হাত কোমরের কাছে। যদিও নেই ওয়ালথার পি.পি.কে.।

পাথরের মূর্তি হয়েছে মাকালানি ও ভগলার। তাদের চোখ দেখছে রানা। লাবনী ও বেলা ঘর থেকে বেরোতেই নিজেও বেরোল ঘর ছেড়ে। চাপা স্বরে বলল, চলো, সুযোগ বুঝে দলের লোককে লেলিয়ে দেয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।

লাবনী ও বেলাকে বিপদে ফেলতে রাজি নয় ও।

পাতাল-ঘর থেকে মিউযিয়ামের পুবে প্লেস দু লুভর-এ বেরোল ওরা।

একটু দূরে রেস্ট্রিকটেড যোনে টিন্টেড জানালার কালো এক বড় মার্সিডিয এসইউভি।

নাদির মাকালানির? জানতে চাইল লাবনী।

 তাই তো মনে হয়, বিড়বিড় করল বেলা।

আমরা গোপনে পিছু নিতে পারি, বলল রানা।

এইমাত্র না খুন হয়ে যাচ্ছিলাম? আপত্তি তুলল বেলা।

রানা কিন্তু ঠিকই বলেছে, বলল লাবনী। পিরামিড অভ ওসাইরিস বের করতে হলে চাই ওই যোডিয়াক, আর সেটা আছে নাদির মাকালানির কাছে।

লাবনী ও বেলার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একটা কোণ ঘুরে থমকে গেল রানা। দেয়ালের পাশ থেকে উঁকি দিল পেছনের পথে। পিছু নিয়ে আসছে না কেউ।

গাড়িটা তার না-ও হতে পারে, বলল বেলা।

সেক্ষেত্রে আর কিছু করার থাকবে না, বলল রানা।

তবে নাদির মাকালানি না ভিআইপি? বলল লাবনী। তারই তো দামি গাড়ি থাকার কথা। পার্কিংলটে ওরকম আর একটাও নেই।

কথাটা চুপচাপ মেনে নিল বেলা।

নাদির মাকালানি আসবে সেজন্যে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় থাকল ওরা।

দশ মিনিট পর লুভর থেকে বেরোল বিকৃত মুখের মিশরীয়। পেছনে খাস বডিগার্ড। দুজন উঠে পড়ল মার্সিডিয গাড়িতে। পেছনের গাড়িতে চাপল আরও তিনজন।

আপনাদের কি মনে হচ্ছে, ওই পিরামিড কোথায় আছে, তা জেনে গেছে এরা? জানতে চাইল বেলা।

সেটা জানতে হলেও পিছু নিতে হবে, বলল রানা।

 রওনা হয়ে গেছে এসইউভি এবং পেছনের গাড়ি।

হনহন করে হেঁটে মোড়ে পৌঁছে মাথার ওপর হাত তুলল রানা। ট্যাক্সি!

.

১১.

 ট্যাক্সিতে চেপে নাদির মাকালানির মার্সিডিয এসইউভির পিছু নিয়েছে রানা, লাবনী ও বেলা।

ইতালিয়ান ক্যাথোলিক ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রথমে সন্দেহ করেছিল, বেআইনী কিছুর সঙ্গে জড়িত ওরা। কিন্তু তখনই রানা খুব গম্ভীর মুখে জানাল, ওর একমাত্র প্রিয় শালার পলাতক ফ্রেঞ্চ বউয়ের আমেরিকান প্রেমিক সামনের গাড়িতে। ওদিকে বাড়িময় গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছে শালার তিন বছরের শিশু মেয়েটা। কাজেই ওর জানতেই হবে সামনের ওই লোক কোথায় লুকিয়ে রেখেছে শালার বদমাশ বউকে।

এটা শোনার পর মার্সি-মার্সি! বলে আঁৎকে উঠে গলায় ঝুলন্ত ক্রুশ ছুঁয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভার। এরপর সমস্যা হয়নি। লক্ষ্মী ছেলের মত ভদ্রস্থ দূরত্ব রেখে অনুসরণ করছে সে।

প্যারিসের আরেক প্রান্তে পৌঁছে মাঝারি এক রাস্তার ধারে থামল মার্সিডিয। সামনের বাড়ির বড় গেটের ওপরে ঝুলছে ওসাইরিয়ান টেম্পলের লোগো। নিউ ইয়র্কে যে টেম্পলটা দেখেছে রানা, সেটার মতই বিশাল দালান। বাইরের বাগানে গিজগিজ করছে নানান পোশাকের অসংখ্য পুরুষ ও নারী।

বাড়ির একটু দূরে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল রানা, লাবনী ও বেলা। ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতে রানা টিপস্ সহ টাকা দিতে যাওয়ায় মাথা নাড়ল লোকটা। না, কিছুই লাগবে না। শুধু আমার হয়ে ওই বাজে মহিলার গালে কষে একটা চড় দেবেন।

টাকা না নিলে ছোট হয়ে যাব, বলে জোর করেই প্রৌঢ় লোকটার বুক পকেটে পঞ্চাশ ডলারের নোট গুঁজে দিল রানা।

বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাথে পৌঁছে অবাক হলো বেলা। এত মানুষ এসেছে ওসাইরিসের সঙ্গে দেখা করতে? জানি সে মুভি স্টার, কিন্তু তাই বলে… বাপরে!

ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে কাল্ট গড়বে, হয়ে উঠবে পীরফকিরনি, আর তখন দেখবে কত পাগল তোমার পেছনে ছুটছে, বলল লাবনী।

কথাটা ভেবে দেখছে বেলা। কসেকেণ্ড পর বলল, খারাপ হবে না শার্ট ভোলা ফায়ার-ফাইটার যুবকরা পেছনে পেছনে ঘুরলে।

তোমার নাম হবে অগ্নিনারী, বলল রানা।

পার্কিংলটে মার্সিডিয রেখে বাড়ির চওড়া পথ ধরে হাঁটছে নাদির মাকালানি ও তার বডিগার্ড। আলাদা হয়ে গেছে অন্য তিনজন। বিকৃত মুখের নাদির বডিগার্ড সহ ঢুকে পড়ল মস্তবড় বাড়ির ভেতর। অন্য তিনজন গেল পেছন বাগানের দিকে। রানার সঙ্গে হেঁটে ভিড়ের কাছে গেল লাবনী ও বেলা।

এবার কী? জানতে চাইল লাবনী। আমরা অপেক্ষা করব? কে জানে, লোকটা আবার কখন বেরোবে!

ওদের সভায় যোগ দেব, বলল রানা।

আপত্তি নেই, বলল লাবনী, কৌতূহল হচ্ছে, আসলে কী করে এরা। হয়তো জানব, কীভাবে খুঁজে বের করবে ওসাইরিসের পিরামিড।

মনে রেখো, নাদির মাকালানি আমাদেরকে ভাল করেই চেনে, বলল রানা, আমাকে চিনবে কাদির ওসাইরিস। কাজেই সাবধান। পেছনের দিকের সিটে বসব। মুখ থাকবে নিচু করা।

ইয়ে… মিস্টার রানা, আমাদের চেহারা কিন্তু দেখেছে টিভিতে লাখ লাখ মানুষ, বলল বেলা। বলতে পারেন আমরা এখন ফেমাস লোকজন।

জানি, বলল রানা। ট্যাক্সি করে আসার সময় আগেই দেখেছে উল্টোদিকে আছে পোশাকের দোকান। আমরা ছদ্মবেশ নেব।

আবার বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হলো ওরা। কিছু দূর হেঁটে ঢুকল একটা কাপড়ের দোকানে। ওখান থেকে কিনল যার যার পছন্দের বিশেষ কয়েকটা পোশাক। পরে নিল ট্রায়াল রুমে গিয়ে। সময় নষ্ট না করে আবার ফিরল টেম্পলের ড্রাইভওয়েতে।

ভেতরের হলরুমে গিয়ে ঢুকছে কেউ কেউ। ওই ঘরে এরই মধ্যে জড় হয়েছে কাদির ওসাইরিসের অন্তত দেড় শ অনুগত ভক্ত।

হলরুমে পেছনের সারির সিটে বসল রানা, লাবনী ও বেলা। লাবনীর মাথায় জেইমে প্যারিস লেখা বেসবল ক্যাপ। রানার পরনে চামড়ার জ্যাকেট আর নেই। চোখে সানগ্লাস। গলায় খয়েরী মাফলার। লাবনী ও বেলা হেসে ফেলে বলেছে, ওকে দেখাচ্ছে পাকা চোরের মত। রানার চামড়ার জ্যাকেট এখন বেলার গায়ে। হাঁটু পর্যন্ত নেমেছে ঝুল। চোখে সবুজ সানগ্লাস।

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ওরা।

অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মানুষে ভরে গেল প্রকাণ্ড হলরুম। তারও একটু পর সামনের এক দরজা খুলে হেঁটে এসে উঁচু মঞ্চে উঠল কাদির ওসাইরিস।

হৈ-হৈ করে উঠল অন্তত তিন শ ভক্ত অনুসারী।

তাদের ধর্মগুরুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ওসাইরিয়ান টেম্পলের সিনিয়র সদস্যরা। তাদের ভেতর নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলারকে দেখল ওরা। মাফলার দিয়ে থুতনি ঢেকে সানগ্লাসের ওদিক থেকে তাদের দিকে চেয়ে রইল রানা।

দশ সেকেণ্ড পর মার্সি, মার্সি, বলে ওপরে হাত তুলল কাদির ওসাইরিস। বোজু এত বেউভেনি! এবার ইংরেজিতে জানাল, আমার ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ খুবই খারাপ! আমাকে মাফ করতে হবে! এই কথায় হলরুমে বয়ে গেল প্রশংসার ঝড়। তাই এখন থেকে অনুবাদের সাহায্য নিচ্ছি! মঞ্চের এক লোকের দিকে ইশারা করল সে। ওই লোক এসে থামল কাদির ওসাইরিসের পাশে। মনিবের আগের বক্তব্য জানাল ফ্রেঞ্চ ভাষায়। তাতে হো-হো করে হেসে ফেলল বেশিরভাগ শ্রোতা। ইংরেজি ভাল করেই জানে তারা।

কাদির ওসাইরিস হলরুমে প্রবেশের সময় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সবাই, এবার তাদের উদ্দেশে হাতের ইশারা করল ধর্মগুরু। বসুক সবাই সিটে। অন্যরা বসে পড়লেও দাঁড়িয়ে আছে ওসাইরিস ও তার দোভাষী। খুব খুশি হয়েছি যে আপনারা এসেছেন, বলল ধর্মগুরু। সূর্য-দেবতা রা সবসময় পবিত্র আলো দেবেন আপনাদের হৃদয়ে!

জবাবে বলে উঠল অনেকে: অতীত ওসাইরিসের পবিত্র আত্মা আরও শক্তিশালী করুন আপনাকে, প্রভু!

আজ সত্যিই ভাল লাগছে, আপনারা অনেকে এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে। প্রতি দিনই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে আমাদের পবিত্র মন্দির। এবং প্রতি দিনই ওসাইরিসের শুভ জ্ঞানের আলোয় আরও সুন্দর ও সঠিক হয়ে উঠছে এই পৃথিবী!

তার প্রশংসায় ফেটে পড়ল শতখানেক ভক্ত।

চলল ওসাইরিসের বক্তৃতা।

রানা নতুন করে বুঝল, সত্যিই চৌম্বক আকর্ষণ আছে কাদির ওসাইরিসের কণ্ঠে। সহজেই মুগ্ধ করে বেশিরভাগ মানুষকে। এমনি এমনি এত নাম হয়নি নায়ক হিসেবে। তার চেয়েও বড় কিছু করেছে সে। প্রতিষ্ঠা করেছে নিজের ধর্ম। হলিউডের নামকরা নায়করাও সুবিধা পাবে না তার মত। ধর্মের দোহাই দিয়ে অনায়াসেই ফাঁকি দিচ্ছে ইনকাম ট্যাক্স। পাগল নয় সে, প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলেছে ভেবেচিন্তে।

সব প্রশংসা আপনার, ও, দেবতা-রাজা ওসাইরিসের প্রভু, রা! হাত ওপরে তুলে গমগমে কণ্ঠে বলল কাদির ওসাইরিস।

তার কথার সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের মত গর্জে উঠল কয়েক শ মানুষের কণ্ঠ: ওসাইরিস! ওসাইরিস! অমর ওসাইরিস! বিশ্বের সমস্ত আত্মার মালিক! অমর আপনি! আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর ওপারের অ্যাবাইদোসে! আমাদের দয়া করুন, প্রাণের ও, ওসাইরিস!

সবাই বলছে কথাগুলো। কাছের কয়েকজন বিস্মিত হয়ে দেখছে রানা, লাবনী ও বেলা তাল মেলাচ্ছে না।

সমস্যাটা টের পেয়ে শুকনো গলায় অন্যদের সঙ্গে চেঁচাল লাবনী ও বেলা, ও, ওসাইরিস! ও, অমর, ওসাইরিস!

ওই, ব্যাটা বদমাশ, হাত নেড়ে বিড়বিড় করছে রানা।

গম্ভীর কণ্ঠে নাটকীয়ভাবে বলে চলেছে কাদির: আপনার জন্যেই প্রতিনিয়ত সঙ্গীত গাইছে আকাশের দেবতারা! মাথা নিচু করে নিচ্ছে পাতালের সব দেবতা! আপনিই তো সেই দেবতা, মালিক পবিত্র পাউরুটির যেটা দেয় চিরকালীন যৌবন! তাই তো পরের জীবনেও থাকি অমর! আপনিই তো সেই রক্ষাকারী, যিনি আড়াল করেন ভয়ঙ্কর শয়তান সেট-এর অশুভ ক্ষমতা থেকে! নইলে কি ধ্বংস হতাম না আমরা? হায়, দয়ালু ওসাইরিস! রক্ষা করুন আমাদেরকে!

ও, ওসাইরিস! বিকট চিৎকার ছাড়ল শত শত অনুগত ভক্ত।

সব মানুষ আর দেবতাদের রাজা, আমাদেরকে দেখিয়ে দিন চিরকালীন প্রাণের পথ! দেখান পাতালের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পথে আলো! পার করে দিন শেষ দিনের বিচারে! আমরা আপনারই অনুগত, ও, ওসাইরিস!

কাদির ওসাইরিসের কথার সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসা ও প্রশংসা নিয়ে দেবতার নামে গর্জে উঠছে ভক্তরা। মঞ্চে চোখ বুজে আছে ধর্মগুরু। ওই লোক এসব বিশ্বাস করে কি না, জানে না রানা, তবে ওর মনে হলো, লোকটা সত্যিই সফল মঞ্চ অভিনেতা। জীবনে যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। বিপুল অর্থ, প্রশংসা বা অনুগত ভক্ত- সব!

তবে একই কথা খাটে না তার ভাইয়ের বিষয়ে। তার চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ, শীতল চোখে চাপা ক্রোধ।

রানার মতই বেলাও খেয়াল করেছে। ওর সমস্যা কী?

সমস্যা অবশ্যই আছে, বলল লাবনী। বোধহয় ওই প্রার্থনা পছন্দ হচ্ছে না তার।

কারণটা বুঝতে পেরেছেন?

সহজ কথায় বললে, সত্যিকারের ইজিপশিয়ান প্রার্থনা নিজের জন্যে পাল্টে নিয়েছে কাদির ওসাইরিস। প্রাচীন পুরাণের গল্পও বলছে অন্যভাবে। সেট ভাল লোক ছিল না, তবে তাকে কোনওভাবেই তুলনা করা যাবে না শয়তানের সঙ্গে।

তা ঠিক, সায় দিল বেলা।

হাত নামিয়ে নিল কাদির ওসাইরিস। থেমে গেল সব চিৎকার ও গুঞ্জন।

ওসাইরিসের ভাই ছিল সেট? নিচু স্বরে জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ, বলল লাবনী। খুনও করেছিল ভাইকে। মনে ছিল ভীষণ হিংসা। চেয়েছিল দেশের রাজা হতে। ওসাইরিসের মত সে-ও সূর্য-দেবতা রা-র প্রিয় ভক্ত। ভাইয়ের মতই মিশরীয় মন্দিরে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। দেশের কোথাও কোথাও তাকে ওসাইরিসের চেয়েও বড় দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো।

লাবনীকে হাতের ইশারা করল পাশের বিরক্ত মধ্যবয়স্কা মহিলা, যেন চুপ করে ও। প্রার্থনা শুনতে অসুবিধে হচ্ছে তার।

এই মুহূর্তে যাজকের মত প্রার্থনার সুরে কথা বলছে না কাদির ওসাইরিস, হয়ে উঠেছে সত্যিকারের পণ্য-বিক্রেতা: বন্ধুরা, মহান ওসাইরিসের দেয়া পথে আপনারা পৌঁছে যাবেন চিরকালীন জীবনে। আর আজ এসেছি সে-কথা বলতেই। আমার সঙ্গে কথা বলেছেন ওসাইরিসের পবিত্র আত্মা। আমার মাধ্যমেই পাবেন তার শুভ জ্ঞান। ওই পবিত্র আত্মার কথা শুনবেন আমার মুখে। সেসব হবে আপনাদের জীবনের পাথেয়। হয়ে উঠবেন অমর। সমাপ্ত হয়েছে ওসাইরিসের পুরাণের দ্বাদশ খণ্ড, এবার ওটা নিয়ে যাবেন যে যার বাড়িতে। অন্তরে গেঁথে নেবেন তাঁর দেয়া শুভ বাণী।

এটা ধর্মোপদেশের অনুষ্ঠান, না পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপনী? নিচু স্বরে বলল লাবনী।

এদিকে ওসাইরিয়ান টেম্পলের তৈরি নানান পণ্যের বর্ণনা দিচ্ছে কাদির ওসাইরিস। তাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দর্শক শ্রোতা। অনেকের হাতে বেরিয়ে এসেছে ক্রেডিট কার্ড।

আজ পবিত্র মন্দির ছেড়ে বাড়ি ফেরার সময় ওসাইরিসের প্রতিটি বই এবং আরও বহু কিছু পাবেন সুলভ মূল্যে, মিষ্টি হাসল কাদির ওসাইরিস। জানি, এজন্যে অপেক্ষা করেছেন বহু দিন। আজ সুযোগ এসেছে ওসাইরিসের অসীম জ্ঞানের বিষয়ে আমার কাছে যে-কোনও কিছু প্রশ্ন করবার!

অনুগত ভক্তদের অনেকেই হাত তুলল মাথার ওপর।

হাসল কাদির ওসাইরিস। খুবই খুশি হতাম প্রত্যেককে সময় দিতে পারলে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজই জরুরি নানা বিষয় সমাধানের জন্যে আবারও ফিরতে হচ্ছে সুইটযারল্যাণ্ডে আমাদের ওসাইরিয়ান প্রধান মন্দিরে। সেসব শেষে যেতে হবে, মোনাকোয়। ওখানে গ্রাঁ প্রির মহা আসরে প্রচার হবে ওসাইরিসের অমিয় বাণী। দ্রুতগামী গাড়ির ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে আমাদের ওসাইরিয়ান টিম। আশা করি জিতে নেবে ওই পুরস্কার!

অনুসারীদের অনেকেই মোটর রেসিঙের ভক্ত, হৈ-হৈ করে উঠল তারা। রানা দেখল, খুব বিরক্ত চেহারা করেছে নাদির মাকালানি। চুপ করে আছে সে।

হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে নির্দেশ দিল কাদির ওসাইরিস। থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ! এবার পাঠাব ববি শাবানকে আপনাদের মাঝে প্রশ্ন সংগ্রহ করতে।

দোভাষীকে দেখাল সে।

মঞ্চ থেকে নেমে দুসারি সিটের মাঝের পথ ধরে হাঁটতে লাগল ববি শাবান। ভক্তের উঁচু হাত দেখলে সেখানে থামবে। প্রথমেই কৃষ্ণকেশী এক সুন্দরী ফ্রেঞ্চ তরুণীকে মাইক্রোফোন দিল সে। তাতে থতমত খেয়ে গেল মেয়েটা, তলে উঠে প্রশ্ন করল ফ্রেঞ্চ ভাষায়। ওই বক্তব্য ইংরেজিতে জানাল যাব শাবান: পাতাল-জগতের মাঝ দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলে খুব ভয় লাগে। কী হবে, যদি ওসাইরিসের কাছে যাওয়ার আগেই ধরা পড়ে যাই নরকের প্রহরীদের হাতে?

এতে ভরসা দেয়ার হাসি হাসল কাদির। পাতাল-জগতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যদি তুমি অনুসরণ করো ওসাইরিসের বাণী.। একমাত্র অশুভ মানুষ বিপদে পড়বে ওখানে। ভাল কেউ কখনও ধরা পড়বে না প্রহরীদের হাতে। চওড়া হলো তার হাসি। চকচক করছে চোখ। তুমি চাইলে সুইটযারল্যাণ্ডে আসতে পারো আমার কাছে এ বিষয়ে জ্ঞান নেয়ার জন্যে। সবই বুঝিয়ে দেব। দেখিয়ে দেব কীভাবে পৌঁছুতে হবে ওসাইরিসের কাছে। আরও অনেক কিছু জানবে।

অন্তর থেকে কাদির ওসাইরিসকে ধন্যবাদ জানান মেয়েটা।

মেয়েটাকে বোধহয় বিছানায় চায় ব্যাটা, বলল রানা।

হ্যাঁ, বিছানায় নিয়ে সব শিখিয়ে দেবে, বলল লাবনী।

শশশশ! সাপের মত আওয়াজ তুলল পাশের মধ্যবয়স্ক মহিলা।

আরেক ভক্তের সামনে থামল ববি শাবান।

এই মেয়েও সুন্দর এবং তরুণী, চুল সোনালি। ওর পরে মেয়েটিও স্বর্ণকেশী। তার পরেরজন বাদামি চুলের।

আহা, খুশিতে বাকুম-বাকুম করছে কাদির, বলল বেলা, টাকাও আসছে, আবার দেবতার মত পূজাও পাবে মেয়েদের কাছ থেকে আর কী চাই?

কী যেন বলবে রানা, কিন্তু মুখ খোলার আগেই হঠাৎ করেই কয়েক সারি আগে হাত তুললেন এক ভদ্রলোক একহাতে উঁচু করে ধরেছেন ঝিকমিকে ক্রুশ। ভাব দেখে মনে হলো তিনি কোনও চার্চের যাজক। আমার একটা প্রশ্ন আছে!

কাদির ওসাইরিস মিশরীয় পুরাণকে ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যে কাজে লাগাচ্ছে বলে খেপে গেছে পেশাদার আর্কিওলজিস্ট লাবনীও।

এদিকে যাজক বলে উঠলেন: এই কপট ধর্মের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস আপনার ভক্তরা?

এ লোকের কারণে তো খুন হব, বিড়বিড় করল বেলা।

ঘরের পেছনে এদিকের সারির কাছে পৌঁছে গেছে বৰি শাবান। যাজকের দিকে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিল।

মঞ্চ থেকে স্পট লাইট এসে পড়ল যাজকের ওপর আলোকিত হয়ে উঠেছে রানাদের আশপাশ।

অসংখ্য মানুষের গুঞ্জন ছাপিয়ে মাইক্রোফোনে বললেন যাজক, জানতে চাই, কী করে এ জগৎ আর পরের জগতে একইসঙ্গে যাব আমরা? সেক্ষেত্রে আগে তো আমাদেরকে মরতে হবে, তাই না? তা হলে তো আর আমরা অমর রইলাম না।

বিরক্তি এবং আপত্তির দৃষ্টিতে তাঁকে দেখল অনেকে।

মঞ্চের দিকে চেয়ে আছে রানা। ওর মনে হলো না এতটা দূর থেকে ওদেরকে চিনতে পারবে নাদির মাকালানি।

তবে যাজকের দিকে আসছে বেশ কয়েকজন গার্ড।

ক্ষমাশীল, দয়ালু দেবতার মতই কাদির ওসাইরিসের ঠোঁটে মৃদু হাসি। বহু আগেই ভেবে রেখেছে এসব। সহজভাবেই বলল, ওই দুই জীবন কিন্তু একই জীবন। শেষ হবে একটা, শুরু হবে আরেকটা। অবশ্য, আমাদেরকে অমর করবেন কি না, তা বিবেচনা করবেন তিনিই। অর্থাৎ, দেবতা ওসাইরিস চাইলে আমাদেরকে এ জীবন থেকে নেবেন পরের অমর জীবনে। তার মাঝে কোনও বিরতি থাকবে না। আবার পণ্য-বিক্রেতা হয়ে উঠল লোকটা, এসবই জানিয়ে দেয়া হয়েছে ওসাইরিস বিষয়ক প্ৰথমখণ্ড বইয়ে। আপনি এখনও পড়ে না থাকলে, পাবেন বাইরের স্টলে। মূল্য সামান্য।

যাজকের বোকামিতে টিটকারির হাসি হাসছে অনেকে। ক্ষমার মানসিকতা নেই কারও কারও। এ ধর্মের পথে পিছিয়ে পড়তে রাজি নয় কেউ।

মাইক্রোফোন নিয়ে আরেক দিকে রওনা হবে ববি শাবান, এমনসময় বলে উঠলেন যাজক, মিথোলজি নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে: আপনি কীভাবে বদলে নেবেন মিশরীয় পুরাণের ওসাইরিসের সেই গল্প? মারা যাওয়ার আগে তো ওসাইরিসকে অমর করা হয়নি। পরে সামান্য সময়ের জন্যে তাকে জীবিত করেন আইসিস। আর তার পর পরই তো ওসাইরিসের ভাই তাকে কেটে চোদ্দ টুকরো করে। একটা মাছকে দিয়ে খাইয়ে দেয় ওসাইরিসের পুরুষাঙ্গ।

হলরুমে শুরু হয়েছে আপত্তির গুঞ্জন।

হঠাৎ মঞ্চে বিস্ফারিত হলো নাদির মাকালানির দুই চোখ। চিনে ফেলেছে যাজকের পেছনের সারিতে বসা একজনকে।

এবার বিদায় নিতেই হচ্ছে, বিড়বিড় করল রানা।

ঠোঁটস্থ বক্তব্য দিতে গেল কাদির ওসাইরিস, কিন্তু পেছন থেকে কী যেন জানাল মাকালানি। ভুরু উঁচু করল মহানায়ক। শুনলাম, আমাদের মাঝে আছেন বিশিষ্ট আর্কিওলজিস্ট ডক্টর লাবনী আলম। নিশ্চয়ই গত কদিন আগে টিভিতে তার অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি দেখেছেন আপনারা।

হ্যালো… হাই! টিটকারির সুরে বলল লাবনী।

চলো, চাপা স্বরে বলল রানা। ওর হাতের টান খেয়ে মাঝের পথে চলে এসেছে লাবনী। পেছনেই বেলা।

কাদিরের পেছনে মঞ্চ থেকে নামছে খুনি কিলিয়ান ভগলার।

ঠিক আছে, কাদির, আপনি দেবতার পেনিস কাটা নিয়ে কিছু বলতে না-ও চাইতে পারেন, কিন্তু স্ফিংসের ঘর থেকে যে যোডিয়াক চুরি করেছে ওসাইরিস টেম্পল, সেটা নিয়ে কী বলবেন? গুঞ্জন ছাপিয়ে বলল লাবনী। আপনারা তো পিরামিড অভ ওসাইরিস খুঁজতে শুরু করেছেন, তাই না?

দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো! চাপা স্বরে বলল রানা।

জানি না কী বলছেন, ডক্টর আলম, মঞ্চ থেকে বলল কাদির ওসাইরিস। বিস্ময়ের ছাপ পড়েছে চেহারায়। ভাবতেও পারেনি লাবনী পিরামিডের কথা জানে।

ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সবুজ ব্লেযার পরা লোকগুলোকে ইশারা দিল নাদির মাকালানি। তারা রয়েছে ঘরের পেছন দিকে। গর্জে উঠল মিশরীয়, অবিশ্বাসীর দল হামলা করেছে এই মন্দিরে! আপনারা সহ্য করবেন এই অপমান?

বু! বু! শব্দে চিৎকার ছাড়ল ওসাইরিসের একদল ভক্ত। সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেছে অনেকে, চেহারায় ক্রোধ। দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে কাদির ওসাইরিসের মুখে। আপনারা দয়া করে রাগ প্রশমন করুন, শুরু করল সে, কিন্তু তাকে পাত্তা দিল না কেউ। নাদির মাকালানির হাতের ইশারায় ধাক্কাধাক্কি করতে করতে রানাদের করিডোরের দিকে এল অনেকে।

মাইক্রোফোন সিটে ফেলে প্যাসেজে বেরিয়ে গেলেন যাজক। রওনা হয়েছেন দরজার দিকে। বুঝে গেছেন, সামনে। সমূহ বিপদ। মারাও যেতে পারেন পিট্টি খেয়ে।

আমাদেরও বিদায় নেয়া উচিত, এক্সিটের দিকে চলল রানা। টের পেল, কাছেই কয়েকজন, পরনে সবুজ ব্লেয়ার।

এত বকবক না করলেও পারতেন, ফাদার! ভয় পেয়ে বলল বেলা।

ঠিক, ভুলই হয়ে গেছে! স্বীকার করলেন যাজক। জানতে চেয়েছিলেন, ফালতু ধর্মের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস কাদিরের ভক্তরা, এখন টের পেয়েছেন হাড়ে-হাড়ে। প্রথম সুযোগেই দরজা খুলে ভোঁ দৌড় দিলেন তিনি। ঠাস্ করে আবারও আটকে গেল দুই কবাট।

একবার মঞ্চের দিকে তাকাল রানা। নেমে এসে সংকীর্ণ পথে এগোচ্ছে কিলিয়ান ভগলার। হাতে রিভলভার। তবে তার সামনের পথ জুড়ে আছে একদল ভক্ত। রানা বুঝে গেল, লোকটা গুলি করার সুযোগ পাওয়ার আগেই বেরোতে হবে হলরুম ছেড়ে।

সবুজ ব্লেযার পরা এক লোক হাত বাড়িয়ে দিল রানার কাঁধ খামচে ধরতে।

বেরিয়ে যাও! লাবনী ও বেলাকে বলেই ঘুরে প্রচণ্ড এক ঘুষি হাঁকাল রানা লোকটার চোয়ালে।

পড়ন্ত যুবকের কাছ থেকে লাফিয়ে সরল লাবনী, পরক্ষণে দৌড় দিল দরজা লক্ষ্য করে। ঘাড় ধরতে গিয়েও খপ করে ওর ক্যাপ পেল ওসাইরিসের এক ভক্ত। ক্যাপের সঙ্গে আটকা পড়েছে লাবনীর একগোছা চুল। ব্যথা পেয়ে মারাত্মক এক চড় বসিয়ে দিল তরুণের গালে। পথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছোকরা। চরকির মত পাক খেয়েই লাথি মেরে দরজা খুলল লাবনী, ঢুকে পড়ল পরের ঘরে।

এখানে বেশ কয়েকটা টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বই, ডিভিডি, তুচ্ছ রঙিন খেলনা পিরামিড ও জড়িবুটি ইত্যাদি। ওকে ছিটকে বেরোতে দেখে চমকে গেছে স্টলের মালামাল বিক্রেতারা। গলা ছাড়ল লাবনী, রানা, বেলা! জলদি!

স্টল থেকে বেরিয়েই ওর কাঁধ ধরতে গেল কাদিরের এক অনুগত কর্মী, কিন্তু তখনই পাশ থেকে রানার প্রচণ্ড এক লাথি পড়ল পেটে। দুভঁজ হয়ে মেঝেতে পড়ল সে। ধড়ফড় করছে, জুতোর নিচে চাপা পড়া ইঁদুরের মত গলা থেকে বেরোচ্ছে কুঁই-কুঁই আওয়াজ।

কে যেন পেছন থেকে চেপে ধরল রানার শার্টের কলার। ঝট করে সরে লোকটার নাকে ঘুষি বসাল রানা। রক্তের স্রোতে ভেসে গেল সবুজ ব্লেয়ার। দরজার পাশে ওসাইরিসের মূর্তির ওপর পড়ল সে। কড়াৎ শব্দে ফেটে গেল প্লাস্টার ও ফাইবারের কীর্তি। এদিক ওদিক দুলছে। ওটার পায়ের কাছে পড়েছে সবুজ ব্লেয়ার পরা লোকটা।

গলা ফাটিয়ে সবাইকে শান্ত করতে চাইছে কাদির ওসাইরিস, কিন্তু শুনছে না কেউ। সাধের মূর্তির অপমানে, রাগে লাল হয়ে গেছে একদল ফ্রেঞ্চ যুবক। ছুটে আসছে রানা, লাবনী ও বেলার দিকে।

সামনে বেড়ে লাথি মেরে সুইং ডোের খুলল রানা, পরক্ষণে মূর্তির বাহু ধরে ঠেলে ফেলল কজন যুবকের ওপর। অনুগত ভক্তদের নিয়ে মেঝেতে পড়ে হাজার টুকরো হলো প্লাস্টার ও ফাইবারের মূর্তি।

সবার পা মাড়িয়ে ছুটে আসছে কিলিয়ান ভগলার।

এদিকে একটু দূরে রাস্তায় যাওয়ার দরজা খুলে ফেলেছে লাবনী। ওর পেছনে ছুটছে বেলা।

হলরুমের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করল রানা। টান দিয়ে কাত করে ফেলল একটা টেবিল। ঝরঝর করে মেঝেতে পড়ে ছড়িয়ে গেল একগাদা ডিভিডি। পরের টেবিলে উঁচু করে রাখা কার্ডবোর্ড ভরা বই। কিছু বইয়ের চ্যাপ্টা প্ল্যাস্টিকের টাই এখনও পুরো ভোলা হয়নি। দুটো টাই নির লাবনীর পেছনে ছুটল রানা।

পেছনে দড়াম করে জোর আওয়াজে খুলে গেল হলরুমের দরজা, বেরোল সবুজ ব্লেযার পরনে এক লোক। পেছনেই কিলিয়ান ভগলার। দুহাতে উদ্যত জোড়া রিভলভার।

রানার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে সামনের লোকটা টের পেল, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ডিভিডির প্ল্যাস্টিকের অসংখ্য কেস। সে থমকে যাওয়ায় তার পিঠে হুমড়ি খেয়ে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল ভগলার। একটা রিভলভার থেকে বেরোল গুলি। ভীষণ ভয় পেয়েছে স্টলগুলোর কর্মীরা, চিৎকার ছেড়ে দৌড় লাগাল তারা।

লাবনী ও বেলার পর কাঠের ডাবল ডোর পেরোল রানা। পেছনে বন্ধ করে দিল দুই কবাট। গোল দুই নব-এ পেঁচিয়ে দিল প্ল্যাস্টিকের টাই। গিঁঠ মেরেই রওনা হলো রাস্তা লক্ষ্য করে।

মেইন গেটে পৌঁছে হাঁফাতে হাফাতে বলল বেলা, বলুন ততা, ডক্টর আলম, এটা কীরকম কাজ করলেন ওই ফাদার?

কাদিরের লোক নিজ ধর্মের বাইরে কিছু শুনলেই খেপে যায়! বলল লাবনী, এটা ভাল মানুষের কাজ নয়। কীভাবে সরে পড়বে, তা বুঝতে রাস্তার দিকে তাকাল। দূরে সেই যাজক। দৌড়ের গতি দেখে মনে হলো পেরোবেন শত শত মাইল। এদিকে ট্যাক্সি তো দূরের কথা, কোনও গাড়িই নেই!

অবশ্য রানা বুঝেছে, কোন্ পথ বেছে নেয়া উচিত। দেরি না করে মেয়েদের উদ্দেশে ইশারা করল।

একটু দূরেই কাদির ওসাইরিসের লিমাযিন। গাড়ির পাশে সুপারস্টার নায়কের মতই পোয় মেরে দাঁড়িয়ে আছে শোফার, কিন্তু পরক্ষণে কিছু বোঝার আগেই নাকে-মুখে দুটো বেদম ঘুষি খেয়ে ড্রাইভওয়েতে শুয়ে পড়ল সে। দুহাতে চেপে ধরেছে মুখটা। স্পষ্ট বুঝে গেছে, এখন উঠে দাঁড়ানো মোটেও নিরাপদ নয়।

সহজ সুরে বলল রানা, কই, এসো! আমাদের জন্যেই তো গাড়ি এখানে রেখেছে দোস্ত কাদির!

আমরা তার গাড়ি চুরি করব? চমকে গেছে বেলা।

ওকে প্রায় ঠেলে পেছন সিটে তুলল লাবনী। নিজেও হুড়মুড় করে উঠল ভেতরে।

ক্যাবের চেয়ে ভাল! ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা আটকে নিল রানা। ইঞ্জিন চালু করে রওনা হয়ে গেল। পা দিয়ে চেপে ধরেছে অ্যাক্সেলারেটর। বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে বাঁক নিল লিমো, ছুটছে তুমুল বেগে।

রিয়ার ভিউ মিররে দেখল রানা, থরথর করে কাঁপছে বাইরের দুই কাঠের কবাট। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর ছিঁড়ে গেল প্ল্যাস্টিকের টাই। দড়াম করে দরজা খুলে দৌড়ে এসে রাস্তায় থামল ভগলার। রিভলভার নাচিয়ে কী যেন বলছে। অবশ্য, পুলিশের ভয় আছে। সাহস নেই যে গুলি করবে প্যারিস শহর।

পর পর দুবার বাঁক নিল রানা, তারপর স্কিড করে থামাল লিমো। পাশেই একটা পাতাল রেলের স্টেশন।

রানার ইশারায় গাড়ি থেকে নামল লাবনী ও বেলা। তবে স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে না নেমে আরেকদিক দেখাল রানা। ওরা ভাববে ট্রেনে চেপেছি। পুলিশে ফোন দেবে। তারা খুঁজবে সাবওয়ে সব স্টেশনে। কিন্তু আমরা থাকব তখন একটু দূরের কোনও স্টারবাক কফি শপে।

আপনি পুরনো পাপী, তাই না, মিস্টার রানা? প্রশংসার সুরে বলল বেলা।

তাই তো মনে হচ্ছে, হাসল রানা। সামান্য হেঁটে মেয়েদেরকে নিয়ে ঢুকে পড়ল এক ইন্টারনেট ক্যাফেতে। কফি হয়তো নেই, তবে ইন্টারনেট আছে।

দোকানে ওয়েব সার্ফারদের ভিড় নেই।

একটা কমপিউটারের সামনে বসল রানা, দখল করা হলো পাশের আরও দুটো কমপিউটারের সামনের দুই চেয়ার। পাশাপাশি বসে অপেক্ষায় রইল ওরা।

মাত্র পাঁচ মিনিট পর ওঁয়া-ওঁয়া শব্দে ওদের ক্যাফে পেরোল পুলিশের দুটো গাড়ি।

কাজ হয়েছে রানার কৌশলে। অন্যদিকে মন দিয়েছে ওসাইরিয়ান টেম্পল।

তবুও সামনের জানালার ওপর চোখ থাকল ওঁদের।

আরও দশ মিনিট অপেক্ষার পর বলল রানা, মনে হচ্ছে। এবার বেরোলে বিপদে পড়ব না।

এবার কী? কমপিউটার থেকে চোখ সরিয়ে ওকে দেখল লাবনী। কাদির ওসাইরিসের কাছে যোডিয়াক। সে এবার খুঁজে নেবে ওই পিরামিড। তোমরা খেয়াল করেছ, ওটার কথা বলতেই কেমন চমকে গিয়েছিল?

কপাল ভাল, জান হাতে নিয়ে বেরোতে পেরেছি, বলল বেলা। এখন উচিত যা জেনেছি মিশরীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া। ওই যোডিয়াক তাদের, তারাই খুঁজে বের করুক না!

প্রমাণ হিসেবে কিছুই দেখাতে পারব না, বলল লাবনী।

যোডিয়াক বোধহয় আছে সুইটয়ারল্যাণ্ডের ওই মন্দিরে, বলল বেলা।

টেম্পলের ছবি কমপিউটার স্ক্রিনে এনেছে রানা। মন্ত্রী কোন্তার বা ডিরেক্টর জেনারেল হামদিকে ওই মন্দিরের কথা বললেই তারা সুইটয়ারল্যাণ্ডের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যোডিয়াক আদায় করতে পারবেন, তা না-ও হতে পারে।

এদিকে ফুরিয়ে আসছে সময়, বলল লাবনী, দেরি হলে লুঠ হবে ওসাইরিসের পিরামিড।

তো আমরা কী করব? বলল বেলা, আমাদের তো কিছুই করার নেই!

মাথা দোলাল লাবনী। তা ঠিক, চাইলেই আমাদেরকে ওই মন্দিরে ঢুকতে দেবে না ওরা।

কয়েক সেকেণ্ড পর ঝট করে রানার দিকে তাকাল বেলা। আপনি না আর্মিতে ছিলেন? আপনিও কিছু করতে পারবেন না?

কিছুই করতে পারব না, তা ভাবছি না, বলল রানা।

ওদের মন অন্যদিকে সরালে হয়তো ঢুকতে পারবেন। ওই মন্দিরে? চোখ বড় বড় করে বলল বেলা, তারপর খুঁজে নেবেন কোথায় যোডিয়াক। এরপর নিনজা যোদ্ধাদের মত করে…

স্রেফ প্রলাপ বকছ, বেলা, বলল লাবনী, বাস্তব দুনিয়ায় সিনেমার দৃশ্যের মত সহজে কিছুই হয় না।

হতাশ হলো বেলা। পরক্ষণে বলল, তবে ওদের ভয়ঙ্কর দেবতা সেট তার ভাইয়ের সাধের টিউিশটা কেটে ফেলেছে যাজক জানালেন বলেই তো এত রেগে গেল ওরা! ফাদারের কারণে মাঝখান থেকে ধরা পড়লাম আমরা। নইলে…

মাথা নাড়ল লাবনী। ভুল ধারণা। ভাবছ সহজেই পেতাম যোডিয়াক? কীভাবে?

যা হওয়ার হয়েছে, বাদ দাও, আমি একটা কথা ভাবছি, বলল রানা।

সেটা কী? সমস্বরে জানতে চাইল লাবনী ও বেলা।

একেবারে ভুল বলেনি বেলা, বলল রানা। তবে আমার বদলে সুইটয়ারল্যাণ্ডের ওই টেম্পলে ঢুকতে পারো, লাবনী। জেনে নেবে কোথায় আছে যোডিয়াক বা কী আছে ওটার ভেতর।

বলো কী! আঁৎকে উঠল লাবনী। খুন হয়ে যাব তো!

উঁহু, হবে না, বলল রানা, কাছেই কোথাও থাকব। বিপদ হলে যোগাযোগ করবে। সেক্ষেত্রে ঢুকব আমিও।

ঝুঁকিটা কিন্তু ভয়ঙ্কর, মাথা নাড়ল বেলা।

আর কিছুই করার নেই? রানার দিকে তাকাল লাবনী।

সত্যিই ঝুঁকি আছে, বলল রানা, তবে আমি নিজে সব প্রস্তুতি নিয়ে ওই টেম্পলে ঢুকতে চাইলে, সময় লাগবে অন্তত কয়েকটা দিন।

অত সময় আমাদের হাতে নেই, মাথা দোলাল বেলা।

সত্যিই যাব? অনিশ্চিত সুরে বলল লাবনী। ঝুঁকিটা ভয়ঙ্কর নয়?

ঝুঁকি হ্রাস করা হবে, বলল রানা। অবশ্য তার আগে জেনে নেবে, কীভাবে জয় করবে নকল ওসাইরিসের মন।

কসেকেণ্ড ভেবে নিয়ে বলল লাবনী, তা হলে খুলে বলো কী ফন্দি এঁটেছ। আগ্রহ ও ভয়ের মাঝে দুলছে মন।

এখন ফিরব হোটেলে, বলল রানা, বিশ্রামের পর মনে গেঁথে নেবে কিছু তথ্য। কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে দেখা হলে কাজে আসবে ওসব। এদিকে বাঙালি ছোটভাই এক হ্যাঁকার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবে, আজ ওসাইরিয়ান টেম্পল থেকে বেরোবার পর ভেঙে গেছে আমাদের এনগেজমেন্ট।

আপনাদের তো এনগেজমেন্টই হয়নি! এসব মিথ্যা ছড়িয়ে কার কী লাভ? অবাক হয়ে রানাকে দেখল বেলা।

রানার দিকে চেয়ে আছে লাবনী। ভাবছে, বিয়ে হলে কিন্তু সত্যিই দারুণ হতো!

পরে বুঝবে, জানাল রানা।

.

১২.

 শুভ্র-সফেদ গিরিকন্যা রূপসী সুইটযারল্যাণ্ড।

হেঁটে সংক্ষিপ্ত পথ পেরিয়ে নীল লেকের তীরে থামল লাবনী। ভীষণ উত্তেজনায় পাক খাচ্ছে পেটের নাড়িভূঁড়ি।

তীরে গেটহাউস। ওটার ড্র-ব্রিজ পেরিয়ে উঠতে হবে দ্বীপে। ওখানেই ওসাইরিয়ান টেম্পল। যেমন ভেবেছিল লাবনী, মোটেও তেমন নয় ওটা।

লেকের মধ্যে পঞ্চাশ ফুট দূরে পাহাড়ি দ্বীপে মন্দির। ওটাকে দূর থেকে ঘিরে রেখেছে ধূসর চওড়া, উঁচু প্রাচীর। ব্যাটলমেন্টে পায়চারি করছে সশস্ত্র গার্ডের দল। একটু পর পর চৌকো টাওয়ার, ছাত উজ্জ্বল লাল স্লেটের। দেয়ালের ওদিকে দূরে গথিক আমলের গম্ভীর চেহারার দুর্গ।

আকাশে নাক তুলেছে ড্র-ব্রিজের দুপ্রান্ত। কেউ চাইলেও চোখ এড়িয়ে উঠতে পারবে না দ্বীপে।

নীল লেকের ওপারে অ্যালপাইন সব চূড়া। এতই সুন্দর, মন চায় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতে। তবে দ্বীপে বিদঘুটে একটা জিনিস দেখে বিরক্তি এল লাবনীর।

দুর্গের উঠানে আকাশ ভেদ করেছে বিশাল এক কালো কাঁচের পিরামিড।

ওয়েবসাইটে ওসাইরিয়ান টেম্পলের ছবিতে আগেই কাদির ওসাইরিসের পেছনে দেখেছে প্রকাণ্ড ওই স্তম্ভ।

কালো, ভারী কাঠের ড্র-ব্রিজের এদিকের অংশ যেন গেটহাউসের আর্চওয়ের সামনে খাড়া দেয়াল। পরিষ্কারভাবে দেখা গেল না দুর্গ।

গেটহাউসের পাথুরে ঘরে ঢুকে একপাশে ইন্টারকম দেখল লাবনী। দেয়াল থেকে ঝুলন্ত ক্যামেরা ওকে দেখছে। কাঁচের চোখে।

কত বড় বিপদে পড়বে ভাবতে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল লাবনী। দুই সেকেণ্ড পর টিপে দিল ইন্টারকমের বাটন।

প্যানেল স্পিকারে এল ভারী কণ্ঠ, হ্যাঁ, কাকে চাই?

নাম ডক্টর লাবনী আলম, ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলল লাবনী। ভাবছে, ভাল করেই দেখুক মুখ। কাদির ওসাইরিসের কাছে এসেছি। তাঁকে বলবেন, এসেছি তাঁর সঙ্গে একটা চুক্তি করতে।

.

দশ মিনিট পর লাবনীকে দেখে মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস। অস্বীকার করব না, আপনাকে দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। বিশেষ করে এখানে।

আমি নিজেও একটু বিস্মিত, বলল লাবনী। ওকে পথ দেখিয়ে আনা হয়েছে মস্ত এই ঘরে। এটা আসলে মিউযিয়াম, তবে প্রদর্শনীর জন্যে আছে মাত্র একটি বিষয়: দেবতা-রাজা ওসাইরিস।

এর সঙ্গে কথা বলার দরকার কী? প্রায় ধমকের সুরে জানতে চাইল নাদির মাকালানি। মেইন গেটে গিয়ে লাবনীকে দেখেছে সে। সঙ্গে ছিল সবুজ ব্লেযার পরা একদল সশস্ত্র লোক। লাবনীর মনে হয়েছে, এই দ্বীপে ওসাইরিসের চেয়ে ক্ষমতাশালী নাদির মাকালানি। অবশ্য কাদির ওসাইরিস নিষেধাজ্ঞা জারি না করলে ড্র-ব্রিজ থেকে নামার আগেই খুন হতো ও। ফাঁদ পেতেছে এই মেয়ে। ফনিকে বলে দেব, এমন জায়গায় লাশ ফেলবে, কেয়ামত পর্যন্ত খোঁজ পাবে না কেউ।

আমার ভাইকে মাফ করতে হবে, হাতের ইশারায় নাদিরকে বিদায় করতে চাইল কাদির ওসাইরিস। তাতে আরও রাগল লোকটা। আসলে লোকজন পছন্দ করে না নাদির।

আমারও তাই ধারণা, কাছের এক ডিসপ্লে কেস দেখতে দেখতে বলল লাবনী। কেসের ভেতরে দুটো কাঁচের মাঝে শুইয়ে রাখা হয়েছে প্রাচীন একটি স্কুল।

লাবনীর আগ্রহ টের পেয়েছে ধর্মগুরু। আপনি বোধহয় জানেন ওটা কী?

ভুল না হলে, হল অভ রেকর্ডস আবিষ্কারের জন্যে যে চতুর্থ স্ক্রলটা দরকার ছিল, ওটা সে জিনিসই।

ঠিক। মিশর সীমান্তে গাঁজা এলাকায় আর্কিওলজিকাল খননের জন্যে টাকা দিয়েছিল ওসাইরিয়ান টেম্পল। আর্কিওলজিস্টরা ছিল আমার ধর্মের অনুসারী। তবে তারা যে ওই জিনিস আবিষ্কার করবে, ভাবতেও পারিনি।

তার মানে, নিজেদের জন্যে রেখে দেন শেষ স্ক্রল।

মিশরীয় কর্তৃপক্ষ হল অভ রেকর্ডসসের সব পেলেও আপত্তি ছিল না। জাতীয় সম্পদ। তবে ওসাইরিয়ান টেম্পলের দরকার ছিল ভেতরের জরুরি এক জিনিস। প্যাপিরাস দেখাল কাদির ওসাইরিস। জানতাম, ওটা সরাতে হবে যে-কোনও মূল্যে। নানা আর্টিফ্যাক্ট দেখাল সে। প্রাচীন দেবতার খুদে সব মূর্তি থেকে শুরু করে পাথরের দেয়ালের অংশ, কলাম ও হায়ারোগ্লিফ। ওসাইরিসের আর্টিফ্যাক্ট বিষয়ে পৃথিবীর সেরা ব্যক্তিগত জাদুঘর এটা। বছরের পর বছর ধরে সংগ্রহ করেছি এসব। আশা করছি, কিছু দিনের ভেতর হয়ে উঠবে আরও সমৃদ্ধ।

পিরামিড অভ ওসাইরিস খুঁজে পেলেই, বলল লাবনী।

ঠিক, এবং আমার মনে হচ্ছে, ওই পিরামিড খুঁজে বের করতে সহায়তা দিতে চান আপনি।

একে বিশ্বাস করা একদম অনুচিত, কড়া কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি।

পরে এ নিয়ে ভাবব, নাদির। …এবার আমার সঙ্গে আসুন, ডক্টর আলম। লাবনীকে একটু দূরের এক দরজা দেখাল কাদির ওসাইরিস। প্রদর্শনীর মাঝ দিয়ে এগোল ওরা। একটা ফাঁকা জায়গায় চোখ পড়তেই লাবনী বুঝল, ওখানেই যোডিয়াক রাখতে চায় ধর্মগুরু। তবে আপাতত ওই জিনিসটা আছে অন্য কোথাও। এ বিষয়ে কিছু বলবে ভাবছে, এমন সময় পৌঁছে গেল পরের ঘরে।

মিশরীয় থিম মাথায় রেখে গুছিয়ে নেয়া হয়েছে এই ঘর। তবে লাউঞ্জ দেখলে যে-কেউ বাবে, এটা সাজানো হয়েছে কোনও প্লেবয়ের জন্যে। নানানদিকে সোনালি কারুকাজ। হালকা রঙের কাঠের আসবাবপত্র মুড়ে রেখেছে দামি কালো চামড়ায়। দয়া করে বসুন, লাবনীকে বলল কাদির ওসাইরিস।

ফোলা এক চামড়ার কাউচে বসল লাবনী। হাতের পাশেই সাদা ভেড়ার চামড়ার তৈরি কুশন। ও ভেবেছিল মুখোমুখি কাউচে বসবে ধর্মগুরু, কিন্তু তা না করে পাশেই বসল সে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকল নাদির মাকালানি। হ্যাঁ, বলুন কী দিতে বলব? মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস।

নো, থ্যাঙ্কস্, বলল লাবনী।

আমি নিজে কিছু নিলে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? কাঁচের দামি কফি টেবিলে রাখা স্টাইলিশ স্পিকারফোনের বাটন টিপল কাদির। নরম সুরে বলল, তানিনা? প্লিয, আমার জন্যে নরমাল কফি। নাদিরের দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ল নাদির। তা হলে এক কাপ, থ্যাঙ্ক ইউ। হেলান দিয়ে বসে বামহাত রাখল কাউচের পিঠে। আঙুলের ডগা প্রায় ছুঁই-ছুঁই করছে লাবনীর কাঁধ। বেশ, ডক্টর আলম… নাকি আপনাকে ডাকব লাবনী বলে?

কোনওটাতেই আপত্তি নেই, সামান্য দ্বিধা নিয়ে বলল লাবনী।

তো আমাকে দয়া করে ডাকবেন কাদির বলে। তাতে পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার পরিবেশ তৈরি হবে।

ঠিক আছে… কাদির, হাসল লাবনী।

মিষ্টি হেসে ওর হাসি ফিরিয়ে দিল কাদির। তো, লাবনী, আপনি বলেছেন আমার সঙ্গে চুক্তি করতে চান। ঠোঁটে এখনও ঝুলছে হাসি, তবে ওটা ব্যবসায়িক। আমি আপনার প্রস্তাবের জন্যে অপেক্ষা করছি।

আমিও অপেক্ষা করছি, শীতল কণ্ঠে বলল নাদির।

আসুন, যে যার তাস টেবিলে রাখি, বলল লাবনী, ভাল করেই জানেন স্ফিংস থেকে যোডিয়াক সরিয়ে নিয়েছেন আপনারা। তা আমিও জানি।

নাদির মাকালানির দিকে তাকাল কাদির ওসাইরিস।

আমরা বডি স্ক্যান করেছি, বড়ভাইকে বলল নাদির। গোবরে পোকা বা ওয়্যায়ার নেই। শুধু মোবাইল ফোন।

আমিও চাই না এসব প্রকাশিত হোক, বলল লাবনী, আসল কথায় আসি। ওই যোডিয়াক তো এখন আপনাদের হাতে, ঠিক?

তা ঠিক, বলল ধর্মগুরু।

তা হলে তো প্রমাণ হয়ে গেল সব! কাদির ওসাইরিসের দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলল লাবনী। পরক্ষণে আঙুল নামিয়ে হেসে ফেলল। যমের মত চেহারা করেছে বিকৃত মুখের নাদির। ঘাবড়ে গেছে আপনার ভাই!

মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস। সত্যিই চমকে দিয়েছেন ওকে। আপনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। …হ্যাঁ, আমাদের কাছেই আছে ওই যোডিয়াক।

ওটা দেখে খুঁজে বের করবেন কোথায় ওসাইরিসের পিরামিড, তাই না?

ভুল বলেননি।

ভুল খুব কমই বলি বা করি। আর তাই এসেছি পিরামিড অভ ওসাইরিস খুঁজতে। সাহায্য করতে পারব ওই কাজে। কিন্তু সেজন্যে আমাকে দিতে হবে যথেষ্ট…

ভুরু উঁচু করল কাদির ওসাইরিস। ভাবতেও পারিনি লাবনী আলমের মত সুখ্যাত আর্কিওলজিস্ট বিক্রি হবে টাকার কাছে।

দুনিয়ায় টাকা কতটা জরুরি, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।

আমি একে বিশ্বাস করি না, সরাসরি বলল নাদির।

আপনি জানেন, আসলে কেন এসেছি? কাটা-কাটা স্বরে বলল লাবনী। কারণ এইচআইএর শয়তানের দল শেষ করে দিয়েছে আমার ক্যারিয়ার। নতুন করে সব শুরু করা অসম্ভব।

মাসুদ রানা আপনার এ বিপদে সাহায্য করতে পারেনি? জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস। বাঙালি গুপ্তচর সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহ করেছে তার ভাই। তার প্রায় সবই জানে এখন কাদির।

চায়নি হয়তো, তিক্ত হাসল লাবনী, সেদিন ফ্রান্সে ওসাইরিয়ান টেম্পল থেকে বেরোবার পর চেয়েছি, আপনার সঙ্গে চুক্তি করব। কিন্তু বাধা দিল সে। তুমুল ঝগড়া হলো। কম মানুষই জানত, আঙটি বদল করেছি আমরা। সেদিনই ভেঙে গেল এনগেজমেন্ট। তারপর আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়ায় আমার ফাইল খুললে দেখবেন, মিথ্যা বলছি না।

তার মানে, আগেই চেয়েছেন এখানে আসতে?

অবশ্যই! কম সহ্য করিনি মাসুদ রানাকে। আইএইচএর চিফের চাকরিটা গেলে চেয়েছি তাকে আঁকড়ে বাঁচতে। কিন্তু ওই ভবঘুরের সংসার করতে পারবে না সুস্থ মনের কোনও মেয়ে! মরুক মাসুদ রানা! ধ্বংস হোক আইএইচএ! এতই তিক্ততা নিয়ে বলেছে লাবনী, এমন কী চমকে গেছে নাদির মাকালানি। সত্যি কথা বলব? চাই লাখ-কোটি মানুষ যেন বিদ্রূপ করে ওই কর্দমাক্ত সংগঠনের কর্মকর্তাদেরকে! এরই ভেতর হল অভ রেকর্ডস পাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব কেড়ে নিয়েছি ওদের কাছ থেকে! নিজ কাজ শেষ করতে চাই ওসাইরিসের পিরামিড খুঁজে বের করে। তবে সেজন্যে দিতে হবে যথেষ্ট টাকা। ওই পিরামিড পাওয়ার পর কে কী করছে, সেটা দেখার বিষয় আমার নয়।

টাকা সমস্যা নয়, নরম সুরে বলল কাদির ওসাইরিস। আলতো করে তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করল লাবনীর কাঁধ। সরে গেল না লাবনী। তবে মনে দুর্বলতা নেই তো আপনার মাসুদ রানার প্রতি? কণ্ঠ জানিয়ে দিয়েছে, তার ধারণা ঠিক কাজই করেছে লাবনী।

মিথ্যা বলতে গিয়ে হঠাৎ লাল হলো লাবনীর ফর্সা দুই গাল। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, ওর সঙ্গে চুকেবুকে গেছে সব। চাই না আর দেখা হোক। বহু কষ্ট সহ্য করেছি লোকটার জন্যে। আমাদের পথ এখন আলাদা। চুপ হয়ে গেল। ভাবছে, মিথ্যা ধরা পড়লে ভাইয়ের হাতে ওকে তুলে দেবে কাদির ওসাইরিস। সেক্ষেত্রে মরবে খুব করুণভাবে।

চওড়া হাসল কাদির ওসাইরিস। সেক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে চুক্তি করতে আপত্তি নেই, লাবনী। খুলে বলুন কী করতে পারেন আমাদের জন্যে।

স্বস্তির শ্বাস চাপল লাবনী। আমি বোধহয় বের করতে পারব কোথায় আছে ওই পিরামিড।

কী করে? কঠোর সুরে জানতে চাইল নাদির মাকালানি। আপনি তো ওই যোডিয়াক একবারও দেখেননি!

যা দেখেছি, তা কিন্তু কম নয়, বলল লাবনী, ধারণা করছি, আপনারা ভাবছেন ওই যোডিয়াক কোনও মানচিত্র।

টিটকারির হাসি হাসল নাদির। এটা বুঝতে শার্লক হোমস হতে হয় না।

তা ঠিক, তবে এটাও জানি, নক্ষত্রের মানচিত্র থেকে কিছুই বের করতে পারেননি আপনারা।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে নাদির। ওর কথাই ঠিক, বুঝল লাবনী।

মাথা দোলাল কাদির ওসাইরিস। কিন্তু আপনি কিছু বের করতে পেরেছেন, ঠিক?

ধারণা করছি। বিনে পয়সায় একটা তথ্য দেব, ওটা জানলে হয়তো বুঝবেন, আমাকে দরকার আছে। তবে এরপর থেকে প্রতিটি পদক্ষেপে পারিশ্রমিক দিতে হবে।

মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস। আপনি পুরো যোডিয়াক না দেখেই কিছু আবিষ্কার করেছেন বুঝে আগ্রহী হয়ে উঠেছি। খুলে বলুন।

সহজ এক তথ্য দেব। রানার কাছ থেকে শেখা মানচিত্র দেখার কৌশল কাজে লাগাল লাবনী। বুঝিয়ে দিল যোডিয়াক দেখতে হলে কীভাবে তা করতে হবে। পুব ও পশ্চিম কোন্ দিকে, তা তো এখন জানেন। আপনারা নিশ্চয়ই যোডিয়াক ছাতে তুলে তারপর দেখেননি ওটা?

সঠিক অনুমান করেছেন, বলল কাদির ওসাইরিস, তাকাল ভাইয়ের দিকে।

মাথা নাড়ল নাদির।

তুমি তো আর্মিতে ছিলে। ম্যাপ রিডিং ক্লাসে মনোযোগ দাওনি কেন?

আমাদের ম্যাপ ছাতে ঝুলত না, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি। কুঁচকে গেছে ঠোঁটের কোণ। দমিয়ে রাখছে রাগ। তা ছাড়া, আমাদের দুজনের ভেতর না তুমি জাহির করে খুব বুদ্ধিমান বলে, প্রিয় বড়ভাই?

তা ঠিক। দরজায় টোকা পড়তেই ওদিকে তাকাল কাদির ওসাইরিস। এসো, তানিনা!

উর্বশীর মত সুন্দরী এক যুবতী ঢুকল ঘরে। হাতের ট্রেতে কড়া গন্ধের ধূমায়িত কফির ছোট এক কাপ। সুন্দরী লাবনীকে গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখল রূপসী। তবে কাদিরকে কাপ দেয়ার সময় হাসল মোহনীয় হাসি।

তানিনার বাহুতে মৃদু টোকা দিয়ে কাপ নিল কাদির। বরাবরের মতই পারফেক্ট কফি, থ্যাঙ্ক ইউ, মাই ডিয়ার। হাসিমুখে ফিরতি পথ ধরল তানিনা। ওর দুলন্ত গুরু নিতম্ব মন দিয়ে দেখল বেলাজ কাদির। মেয়েটা বিদায় নেয়ায় হেলান দিয়ে বসে চুমুক দিল কফির কাপে। অবাক কাণ্ড! দুনিয়ার সেরা যে-কোনও কিছু পেতে পারি… কিন্তু একটা কারণে সবসময় পান করি ইজিপশিয়ান সাড়া কফি।

নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল নাদির। এত কিছু পেলে সারাজীবনে, আর নস্টালজিক হলে ওই কাদার জন্যে?

কী বলব? কিছু জিনিস আছে, যেগুলো আমরা জোর করে পছন্দ করি না, বরং ওসবই বেছে নেয় আমাদেরকে। তেমনই এক জিনিস আমার এই কফি। তৃপ্তির সঙ্গে কাপে চুমুক দিল কাদির ওসাইরিস।

ওসাইরিস দেবতার মুখে কেমন যেন লাগছে এসব কথা, মন্তব্য করল লাবনী।

ওসাইরিসের কাহিনীর বড় একটা দিক, নানানভাবে সেসব ব্যাখ্যা করা যায়। যেমনটা আপনি বলেছিলেন প্যারিসে।

প্রয়োজনে কাহিনী তৈরি করে নেন, তাই না?

হাসল কাদির ওসাইরিস। আপনি আমার ভাইয়ের মতই কট্টরপন্থী, লাবনী! তবে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।

এই মেয়ে আগে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, সেটা মাথায় রেখো! বলল নাদির মাকালানি, বলছে প্রেমিককে ফেলে এসেছে। কিন্তু আমরা কি সত্যিই জানি, এ আসলে আমাদের সাহায্য করবে, না ওকে? আমার তো মনে হচ্ছে ফাঁদ পেতে ক্ষতি করবে আমাদের।

মনে কুমতলব থাকলে বিপদে পড়ব জেনেও এখানে আসতাম? পাল্টা বলল লাবনী, জানিই তো এখানে থাকবেন আপনি আর আপনার সাপের চামড়ার জ্যাকেট পরা খুনি।

আমার ধারণা, নাদির বা ওর লোক মন্দির-রক্ষায় অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে, বলল কাদির। আশা করি এজন্যে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন আমাদেরকে। চাইনি কখনও কাউকে আহত করা হোক। শুধু চেয়েছি আইএইচএর আগেই হল অভ রেকর্ডস থেকে যোডিয়াক সরিয়ে নিতে। যাতে খুঁজে বের করতে পারি ওসাইরিসের পিরামিড।

কিন্তু ওই পিরামিড খুঁজছেন কেন? জানতে চাইল লাবনী, ওটা এত জরুরি কী কারণে?

কফি শেষ করে লাবনীর পেলব হাতের কবজি ধরে উঠে দাঁড়াল কাদির। চলুন, দেখবেন কেন এত ব্যস্ত হয়েছি।

ফণা তোলা সাপের মত হিসহিস করে উঠল নাদির কাদির!

কড়া চোখে ছোটভাইকে দেখল কাদির ওসাইরিস। তুমি আমার ছোটভাই হতে পারো, কিন্তু ভুলে যেয়ো না, ওসাইরিয়ান টেম্পলের প্রধান আমি, তুমি নও! রাগে থরথর করে কাঁপলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে নাদির মাকালানি তার দিক থেকে ফিরে লাবনীকে দেখল কাদির ওসাইরিস আবারও দুঃখপ্রকাশ করছি। আপনার কি ছোটভাই আছে। বা বোন?

না, নেই, মাথা নাড়ল লাবনী।

তা হলে বুঝবেন না পেটে কত হিংসে জমিয়ে রাখে ছোট ভাই-বোনরা। অবশ্য বড়দের কাজই তাদেরকে আগলে রাখা। যদিও মাঝে মাঝে কঠিন হয় রাগ সামলে নেয়া। শেষ কথাটা বলা হয়েছে নাদির মাকালানির উদ্দেশে। নীরব রাগে মুখ বিকৃত করল সে। চলুন, যাওয়া যাক, লাবনীর হাত ধরে দরজার দিকে চলল ওসাইরিস। সব দেখলে বুঝবেন, কেন খুঁজছি ওসাইরিসের পিরামিড।

.

১৩.

 কাদির ওসাইরিসের পাশে হাঁটছে লাবনী। ক্ষুধার্ত বাঘের মত পেছনে আসছে নাদির মাকালানি। উঠানে হেলিপ্যাডের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। প্রথমবারের মত লাবনী বুঝল, কত প্রকাণ্ড ওই কালো কাঁচের পিরামিড। দুর্গের সবচেয়ে বড়, আশি ফুটি টাওয়ারটাকেও ছাড়িয়ে গেছে ওটার শিখর।

সুইটযারল্যাণ্ডে পিরামিড? ওদিকে চেয়ে বলল লাবনী, ঠিক মানাচ্ছে না কিন্তু। লুভরের কাঁচের পিরামিডের চেয়ে বহু গুণ বড় ওটা। বামন করে দিয়েছে দুৰ্গটাকে।

আমার তো ধারণা প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেছে পিরামিড-মন্দির, বলল কাদির, সুইটহার ল্যাণ্ডের বিশাল সবকিছুর সঙ্গে মানানসই। অবশ্য স্বীকার করতে আপত্তি নেই, এ দেশে বাস করছি সহজ ট্যাক্স সিস্টেমের কারণে।

আরেকটু হলে লাবনী বলে ফেলত: এই কাল্টের কারণে আয়কর ফাঁকি দেয়া সম্ভব হচ্ছে, তাই না? তবে কথাটা গিলে নিয়ে বলল, ধর্মের বিষয়ে এই দেশে ট্যাক্স ধরা হয় না, তা-ই?

হ্যাঁ, তা-ই। তবে আগে প্রমাণ করতে হয়েছে, এটা সত্যিই ধর্ম। তাতে লেগেছে প্রচুর সময় ও প্রচেষ্টা। পনেরো বছর আগে চালু করেছি ওসাইরিয়ান টেম্পল, এরপর গত পাঁচ বছরে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে গেছে এ ধর্ম। তখন থেকে পেয়েছি নানা সুবিধা। বেশকিছু ব্যবসা আছে আমার, যেগুলো ইনকাম ট্যাক্সের আওতার বাইরে নয়। সেসবের সদর-দফতর অন্য দেশে বলে পুষতে হচ্ছে অতিবুদ্ধিমান, দামি একদল হিসাব-রক্ষককে।

আগেরবার পিরামিডের সামনের উঠানে কেউ ছিল না, কিন্তু এবার ওখানে পৌঁছে লাবনী দেখল, কালো শর্ট ও টি শার্ট পরে ক্যালিসথেনিস্ করছে ত্রিশজন যুবক। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ড্রিল ইন্সট্রাক্টরের মত করে নির্দেশ দিচ্ছে কিলিয়ান ভগলার। পরনে নেই সাপের চামড়ার জ্যাকেট। নাদির মাকালানি সংক্ষেপে কী যেন বলল খুনি লোকটাকে। তাতে কড়া চোখে লাবনীকে দেখল সে। নিচু স্বরে যুবকদের উদ্দেশে কী যেন বলছে নাদির মাকালানি।

আপনার দেখছি ব্যক্তিগত আর্মি আছে, কাদিরকে বলল লাবনী।

আইডিয়াটা নাদিরের, ভাই পেছনে চলে আসতেই বলল ধর্মগুরু। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে। মাঝে মাঝে ঝামেলা হয় টেম্পল নিয়ে, বুঝতেই পারছেন। হাসল কাদির।

পিরামিডের সামনে পৌঁছুতেই খুলে গেল কাঁচের স্লাইডিং জোড়া দরজা। ওদিকে রাজকীয় লবি। ওখানে যারা রয়েছে, কাদির ওসাইরিসকে সম্মান দেখিয়ে মাথা নিচু করল প্রত্যেকে। লাবনীকে নিয়ে কাঁচের পিরামিডের একপাশে এলিভেটরের দরজায় থামল কাদির। বাঁকা অ্যাংগেল ধরে নিচতলা থেকে চূড়ার কাছে উঠে গেছে শাফট।

একেই বলে জায়গা নষ্ট, ভাবল লাবনী।

ওরা এলিভেটরে চাপতে নিজেও উঠল নাদির মাকালানি। শীতল চোখে দেখছে লাবনীকে। সাঁই-সাই উঠছে কাঁচের দেয়ালওয়ালা এলিভেটর, পরিষ্কার দেখা গেল পিরামিডের ভেতরের সব। নিচতলায় বিশাল কক্ষ, বোধহয় ব্যবহার করা হয় মন্দির হিসেবে। প্যারিসের ওই টেম্পলের মত নয়, পিরামিডের মাঝে রয়েছে কাঁচের প্যানেলে লেসারে খোদাই করা আলংকারিক হায়ারোগ্লিফ, বিশাল উঁচু, সোনাপানি দেয়া ঝকমকে মিশরীয় সব দেবতার মূর্তি।

এটাই ওসাইরিয়ান টেম্পল হেডকোয়ার্টার, গর্ব ভরে বলল কাদির, আবার এটাই ওসাইরিয়ান ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের হেডকোয়ার্টার। এ ছাড়া, জেনেভায় আছে নানান অফিস, সবই নিয়ন্ত্রণ করা হয় এখান থেকেই।

ধর্ম পরিচালনা করেন, আবার বিজনেসও করেন একই দালান থেকে?

ও-দুটো আসলে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, হাসল কাদির। ক্রেতা বিশ্বস্ততা, বাজার শেয়ার, বিনিয়োগের প্রতিদান… সবই জরুরি। নিচে হারিয়ে গেল উঁচু, প্রকাণ্ড কক্ষ।

পরের দোতলা ও তৃতীয়তলা অফিস পেরিয়ে কসেকেণ্ড পর থামল এলিভেটর। দরজা খুলতেই ভাজা ইস্ট-এর কড়া সুবাস পেল লাবনী। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে বেকারিও খুলেছেন?

হেসে ফেলল কাদির ওসাইরিস। তা নয়। তবে আমার জীবনের বড় এক অংশ জুড়ে আছে পাউরুটি। আমার বাবা ছিলেন রুটিওয়ালা। রুটি তৈরি করতে করতেই বড় হয়েছি। উদাস হয়ে নেমে পড়ল এলিভেটর থেকে। বাবা ভেবেছিলেন তাঁর ব্যবসা ধরে রাখব।

হ্যাঁ, বলল নাদির, আরেকটু হলে সুইটয়ারল্যান্ত্রে দুর্গে বাস না করে এখনও তৈরি করতে মালকড়ি।

কিন্তু ভাগ্য অন্যভাবে লেখা হয়েছিল আমার জন্যে লাবনী, প্রিয, ওদিকে চলুন।

কাদির ওসাইরিসের পিছু নিয়ে একটা দরজা পেরোল লাবনী। আরও কড়া হয়ে উঠেছে ইস্ট-এর গন্ধ। ঘরের শেষ মাথায় রিইনফোর্সড় কাঁচের দেয়াল। ওদিকে কিচেন ও ল্যাবোরেটরির মাঝামাঝি এক ঘর। বিশফুট ওপরে পেরেকের ডগার মত চোখা কাঁচের পিরামিডের চূড়া। ওদিকের ঘরে সাদা ওভারঅল ও মুখোশ পরা কজন লোক। কেউ কেউ দেখছে কমপিউটারের স্ক্রিন বা মাইক্রোস্কোপের স্লাইড, অন্যরা ব্যস্ত আভেন ও চকচকে স্টিলের ভ্যাট নিয়ে। ঠিক বুঝলাম না, বলল লাবনী। ওই ঘর…।

এ কারণেই খুঁজছি ওসাইরিসের পিরামিড, বলল কাদির ওসাইরিস। বলুন তো, টেলোমার্স বলতে কী জানেন?

হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়ায় অবাক হয়েছে লাবনী। কাঁধ ঝকাল। প্রাণীর কোষ বিষয়ক কিছু… ঠিক জানি না। আমি আসলে আর্কিওলজিস্ট, বায়োলজিস্ট নই।

ছিহ্, লাবনী, ঠাট্টার সুরে বলল কাদির, নিজের জ্ঞানকে কখনও সীমিত রাখবেন না। আমাকে দেখে শিখুন। ছিলাম রুটিওয়ালা, হলাম অভিনেতা, তারপর ব্যবসায়ী, শেষে ধর্মগুরু… কিন্তু তাতেই কি থেমে গেছি? না, নিজের মত করে জেনে নিয়েছি, কীভাবে বাড়িয়ে নেয়া যায় আয়ু।

আয়ু বাড়িয়ে নেয়া যায়? বিস্ময় নিয়ে বলল লাবনী।

হ্যাঁ, অমর হওয়া ওসাইরিয়ান টেম্পলের মূল লক্ষ্য। যেন স্পর্শ করতে না পারে মৃত্যু। আমরা হতে চাই। ওসাইরিসের মতই। …যখন অভিনেতা হলাম, তখন থেকেই এটা হয়ে উঠল সার্বক্ষণিক চিন্তা। আমি তো নায়ক, হয়তো হলিউডের নামকরা দুনিয়া বিজয়ী নায়কদের মত নই, কিন্তু… ভদ্রতার হাসি হাসল কাদির। সবাই চিনত আমাকে মিশরে। সেই কম বয়সেও।

তাই ভাবলেন, যদি রয়ে যাওয়া যায় তরুণ…

ঠিক! আপনিও কি তা-ই চান না?

সত্যি বলতে, জানা নেই, বলল লাবনী, চিরকাল বেঁচে কী করব?

তা হলে খুব ভাগ্যবান আপনি, হাসল কাদির ওসাইরিস। উপভোগ করছেন প্রতিটা মুহূর্ত। আপত্তি নেই বুড়ো হয়ে মরে গেলে। কিন্তু ভেবে দেখুন, বিরুদ্ধে কাজ করছে আপনারই শরীর। বুড়িয়ে দিচ্ছে আপনাকে। খুব ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে, প্রতিটি কোষ। অথচ, পারছেন না কিছুই করতে। তবে… ওদিকের ঘরের ভ্যাট দেখাল ধর্মগুরু। সত্যিই যদি দেহ বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে ফিরে পান তারুণ্য… দারুণ হয় না?

এসব ভ্যাটে তেমন কিছু আছে? জানতে চাইল লাবনী। অমর হওয়ার ওষুধ তৈরি করেছেন আপনারা? কণ্ঠে ঠাট্টার সুর লুকাতে পারেনি।

আগেও শুনেছি এ সুরে কথা বলেছে অনেকে, বলল কাদির ওসাইরিস। নালিশ নেই কণ্ঠে, রয়েছে ব্যর্থতা। কিন্তু অমর হওয়ার জন্যেই কাজ করছি। জীবনকে ভালবাসি। চাই এমনভাবেই বাঁচতে কোটি কোটি বছর। প্রথমে শুরু করলাম, কীভাবে নানান খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ধরে রাখা যায় যৌবন, পরে সরে গেলাম ভিটামিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, হর্মোন,..

ওসাইরিয়ান টেম্পলের অনুসারীদের কাছে এসবই বিক্রি করেন?

হ্যাঁ, ওসাইরিয়ান টেম্পলের প্রতিটি শাখায় বিক্রি হয় এসব পণ্য। সেজন্যে পেরেন্ট কোম্পানির কাছ থেকে আইন অনুযায়ী লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। তবে… চকচক করছে কাদির ওসাইরিসের চোখ। ভাল দিক হচ্ছে, এসব সাবসিডিয়ারি কোম্পানির কাছে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে ওসাইরিয়ান টেম্পল। বুঝতেই পারছেন, ওসব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি মুনাফা কী করবে, তার বদলে আয়কর বিভাগকে দেখায় ক্ষতির খতিয়ান।

যেহেতু মুনাফা হচ্ছে না, আয়কর দেবে কী করে, মাথা দোলাল লাবনী।

ঠিকই ধরেছেন। যেহেতু মুনাফা করছে সত্যিকারের ভাল একটি ধর্মীয় সংগঠন ওসাইরিয়ান টেম্পল, তার তো আর দিতে হচ্ছে না আয়কর। ব্যাপারটা আরও জটিল, তাই আগেই বলেছি, পুষতে হচ্ছে একদল দামি হিসাবরক্ষক ও উকিলকে। আয়কর বিভাগের লোকদের চেয়ে এক পা এগিয়ে আছে তারা। তবে এসবই আইনানুগভাবেই করা হচ্ছে।

চাতুর্যের সঙ্গে করা হচ্ছে এসব, মাথা দোলাল লাবনী।

বুঝতে পেরেছেন বলে ধন্যবাদ, আয়কর ফাঁকি দিতে পেরে সত্যিই আনন্দের হাসি দিল কাদির ওসাইরিস। কিন্তু তাতেই খুশি হলাম না। ভবিষ্যতে আসতে পারে বিপদ। লাখ লাখ মানুষ বলতে পারে, কই, আয় তো বাড়ছে না! চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রতিটি ক্রোমোমের ভেতর রয়েছে একটি করে কোষ, যেটার ভেতর রয়েছে টেলোমার্স। ওটা একটা ছিপির মত। প্রতিবার কোষ নতুন করে তৈরির সময় একটু সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে টেলোমার্স। আর তার ভেতর রয়ে গেছে একটা ট্রিগার। তাই সমান থাকছে না কোষ। ক্যানসারের মতই দোষ আছে ওই টেলোমার্স-এ।

চুপ করে শুনছিল লাবনী, এবার বলল, প্রতিবার টেলোমার্সের কারণে নতুন কোষ ছোট হলে, একদিন এমন হবে যে নতুন করে তৈরিই হবে না কোষ।

হ্যাঁ। বয়স হলে তাই হয় কোষের। মারা পড়ে। কোনও উপায় নেই বাঁচিয়ে রাখার। যত ভাল স্বাস্থ্যের মানুষই হোক, দেহের নির্ধারিত সময়ে মরতেই হবে তাকে। কিন্তু… ওদিকের গবেষণাগারে তাকাল কাদির, উপায় আছে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে দেয়ার।

ইস্ট দিয়ে? সহজ সুরে বলল লাবনী।

হ্যাঁ, আমরা খুঁজছি বিশেষ একটি ইস্ট। হয়তো জানেন, আজ পর্যন্ত যত ইস্ট মানুষ পেয়েছে, তার এক শ ভাগের মাত্র এক ভাগ ক্লাসিফাই করা গেছে। খুবই ছোট মাইক্রো অর্গানিযম, তা আবার নানান ধরনের। কোনও কোনওটা লাগে বায়োফিউয়েল তৈরিতে। অন্যগুলো কাজে লাগে বিপজ্জনক কেমিকেল বা নানান ড্রাগস তৈরি করতে। মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস। আবার কিছু আছে, যেগুলো তৈরি করে পাউরুটি। আর অমনই এক ইস্ট খুঁজছি আমি।

কেমন চোখে যেন তাকে দেখল লাবনী।

ভাবছেন আমি পাগল? জানতে চাইল কাদির।

না… ঠিক তা নয়। আপনি তা হলে ওসাইরিসের পিরামিড খুঁজছেন পাউরুটি বানাবেন, তাই?

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন এবার। ভাবছেন আসলে আমি বদ্ধ পাগল। হাসল কাদির ওসাইরিস। উন্মাদ ভাববেন না। ওই পাউরুটি সাধারণ পাউরুটি নয়। গম্ভীর হয়ে গেল সে। বিশেষ পাউরুটি। ওটা খেতেন মিশরীয় দেবতা ও রাজারা। ওই পাউরুটি ছিল ওসাইরিসের বিশেষ প্রিয়।

হঠাৎ স্মৃতির সাহায্য পেল লাবনী, চট করে বলল, একমিনিট! বেলা একবার বলেছিল আইএইচএর স্ক্রলে ছিল জীবনের পাউরুটির কথা!

মাথা দোলাল কাদির ওসাইরিস। ওই স্ক্রলেই লেখা ছিল ওসাইরিসের পিরামিডের বিষয়ে। হ্যাঁ, ওখানে রয়েছে হাজারো কোটি ডলারের সোনাদানা, আরও আছে। ওসাইরিসের কফিন… কিন্তু ওসবের চেয়ে বহু গুণ বেশি দামি খুব সাধারণ একটা জিনিস… পাউরুটি। ইস্ট। ওটা করে দিতে পারে সাধারণ মানুষকে অমর।

আপনার ধারণা, ওই ইস্ট ওসাইরিসকে করেছিল অমর?

মাথা নাড়ল কাদির ওসাইরিস। অমর বলতে আপনি যা ভাবছেন, তেমন কিছু করেনি। প্রাচীন মিশরের মানুষ তখন বাঁচত বড়জোর চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ বছর। সেই আমলে কেউ সত্তর বছর বাঁচলে, সবাই ধরে নিত সে-মানুষ অসম্ভব সৌভাগ্যবান। আর সেই লোক যদি হয় রাজা, যে কেউ কেন ধরে নেবে না যে উনি অমর?

কিন্তু ওই সময়ে কীভাবে অত বছর বাঁচিয়ে রাখত সেই বিশেষ ইস্ট? জানতে চাইল লাবনী।

আপনাকে আগেই বলেছি, আছে হাজার হাজার ইস্ট। কমপিউটারে ব্যস্ত দাড়িওয়ালা এক বিজ্ঞানীকে দেখাল কাদির ওসাইরিস। বিশেষ সব জেনেটিক কোডের সঠিক সিকিউয়েন্স বের করছেন ডক্টর কার্ল ব্রনসন এবং তাঁর দলের সবাই। আর তা যদি করতে পারেন, আমি হয়তো হয়ে উঠব পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোক। কিন্তু এই গবেষণা সফল করতে হয়তো পেরিয়ে যাবে এক শ বছর। সেক্ষেত্রে অনেক আগেই মারা পড়ব। কিন্তু থাকবে আমার দেখিয়ে দেয়া সঠিক পথ। …যাই হোক, চাইছি ওসাইরিসের সেই পাউরুটির ওই স্ট্রেইন।

তার মানে, ওসাইরিসের জন্যে তৈরি পাউরুটির ইস্ট খুঁজছেন, যেটা বাড়িয়ে দেবে আয়ু?

সব ইস্ট ভাল নয়। এমন সব ইস্ট আছে, যেগুলো ক্ষতি করে মানবদেহের। বা ওগুলোর ভেতর থাকে ভাইরাস। কিন্তু ওসাইরিসের পাউরুটি ছিল অন্যকিছু। ওটার ক্যারিয়ারে থাকত বিশেষ এনযাইম। ফলে ওটা মেরামত করত টেলোমার্স।

চোখ বিস্ফারিত করল লাবনী। ওটা ছোট হতে দিত না পরবর্তী কোষগুলোকে। তাই বাড়ত না বয়স। সেক্ষেত্রে মৃত্যু হওয়ার কথা নয়।

বুঝতেই পারছেন, যারা নিয়মিত ওই ইস্ট খেত, মৃত্যুর ভয় থাকত না তাদের, বিজয়ীর হাসি হাসল কাদির ওসাইরিস। ওই পাউরুটির এনইম রয়ে যেত ওসাইরিসের দেহের কোষে। একই জায়গায় আটকে থাকত বয়স। মিশরীয়রা ভাবত সে অমর।

পাউরুটির কারণে বয়স না বাড়লে, ওই তথ্য লুকাবার কথা রাজাদের, বলল লাবনী। পরক্ষণে কুঁচকে গেল ওর ভুরু। কিন্তু বেকিঙের সময় মারা যাওয়ার কথা ওই ইস্টের!

আমার ভাই আর আমি বেকিং সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, বাঁকা হাসল নাদির মাকালানি।

মিশরের প্রাচীন কাদা-হঁটের চুল্লির তাপমাত্রা কেমন। হবে, বুঝে ওঠা কঠিন, বলল কাদির। কখনও কখনও জ্যান্ত থাকে ইস্ট। তা ছাড়া, রুটিওয়ালা যদি জানে, ওই ইস্ট বাড়াবে আয়ু, তো অবশ্যই চাইত ইস্ট যেন বেঁচে থাকে। দুষ্টু হাসল সে। না-ই হলো সেরা টেস্টি রুটি, চিরকাল বাঁচতে ওটুকু সহ্য করবে না কেন কেউ?

চিরকাল নয়, আপত্তি তুলল লাবনী, অসুখে মরত, বা চাপা পড়ত উটের পায়ের নিচে। খুব বিপজ্জনক জায়গা ছিল প্রাচীন মিশর।

কিন্তু বুদ্ধিমান রাজা নিজেকে সরিয়ে রাখত সব বিপদ থেকে, হাসল কাদির ওসাইরিস। আর ওসাইরিস ছিল সবচেয়ে জ্ঞানী রাজা। এমনি এমনি তো আর তাকে দেবতা বলে ধরে নেয়া হয়নি!

তো ওসাইরিসের সমাধি পেলে, নতুনভাবে চাষ করবেন বিশেষ ওই ইস্ট?

সেটাই আমার ইচ্ছে। ইস্টের আয়ু প্রায় কেয়ামত পর্যন্ত। ওই পিরামিডে পুরোহিতরা ওসাইরিসের পরজন্মের জন্যে পাউরুটি না দিলেও, ওখানে রয়ে গেছে রাজার ক্যানোপিক জার। সেখানে থাকবে তার শরীরের ভেতরের সব অঙ্গ। আমরা পেয়ে যাব স্যাম্পল। ল্যাবোরেটরি দেখল কাদির ওসাইরিস। সত্যিকারের ওই স্ট্রেইন হারিয়ে গেছে হাজার হাজার বছর আগে। কিন্তু নতুন করে আবারও ওটাকে জাগাতে পারব আমরা। সামান্য জেনেটিক মডিফিকেশন করলেই আমি হয়ে উঠব নতুন ওসাইরিস।

সন্দেহের চোখে তাকে দেখল লাবনী। জেনেটিক মডিফিকেশন?

কঠোর চেহারায় ওকে দেখল নাদির মাকালানি। আমার ধারণা, এরই ভেতর অনেক কথা বলেছ, বড়ভাই।

বিরক্তির চোখে তাকে দেখল কাদির ওসাইরিস। যুক্তি আছে ওর কথায়।ভদ্রতার হাসি হাসল। তা ছাড়া, এসবের সঙ্গে আমাদের গোপন চুক্তির কোনও সম্পর্ক নেই। দেখা যাক দুনিয়ার বুকে আমরা অমর হতে পারি কি না। ওটা হবে বিশাল এক অর্জন।

সত্যিই মস্ত বড়লোক আর ক্ষমতাশালী হবেন… বিরক্তি চেপে মিষ্টি হাসল লাবনী। ওসাইরিসের পিরামিড পেলে যা খুশি করতে পারবেন। …তা হলে আগের প্রসঙ্গে ফিরি, ওই পিরামিড পেলে আমাকে দিতে হবে দশ মিলিয়ন। তা মিশরীয় পাউণ্ড নয়। আমেরিকান ডলার।

রাগে নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল নাদির মাকালানি। মাথা দোলাল কাদির ওসাইরিস। আপনি ওই পিরামিড খুঁজে বের করতে সাহায্য করলে, সেই পরিমাণ ডলারই পাবেন।

খুশি হলাম, করমর্দনের জন্যে হাত বাড়াল লাবনী, তা হলে চুক্তি হয়ে গেল।

কাদির, পাগল হলে? আপত্তি তুলল নাদির। তোমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে এই মেয়ে! আমার কথা না শুনলে পরে পস্তাবে।

কঠোর চোখে ছোটভাইকে দেখল কাদির। আমি ঝুঁকি নিতে ভালবাসি, সত্যি লাবনী পিরামিড আবিষ্কার করলে দশ মিলিয়ন ডলারই দেব। …আসলে তোমার সমস্যা কী, সেটা জানে, নাদির? তুমি কখনও জুয়া খেলো না। কখনও ঝুঁকি না-ও না। কিন্তু আমি নিই। কখনও জিতি, কখনও হারি। কিন্তু যখন জিতি, পাই বহুগুণ বেশি। কাঁচের পিরামিডের চারপাশে চোখ বোলাল সে। নিজ চোখে দেখো কীভাবে অর্জন করেছি এসব! ঝুঁকি না নিলে কখনও বড় কিছু পাবে না।

মস্তবড় ঝুঁকি নিচ্ছ, বড়ভাই, ফণা তোলা সাপের মত হিসহিস করে বলল নাদির।

তবুও ঝুঁকি নেব। লাবনীকে দেখল কাদির ওসাইরিস। আপনি মিথ্যা বলছেন না, ধরে নিলাম। এখন থেকে পিরামিড খুঁজতে যা যা দরকার বলে মনে করবেন, আমাকে জানাবেন। লাবনীর বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে করমর্দন করল সে। তবে মিথ্যা বললে মারা পড়বেন ভয়ঙ্করভাবে। লাবনীর হাত ছেড়ে ইশারায় নাদিরকে দেখিয়ে দিল সে।

ওই পিরামিড ঠিকই খুঁজে বের করব, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল লাবনী।

কয়েক সেকেণ্ড ওকে দেখার পর হাসল কাদির ওসাইরিস। চুক্তি হয়ে গেল।

রাগ ও বিরক্তি নিয়ে দূরে তাকাল নাদির মাকালানি।

ঠিক আছে, আগে আমার লাগবে ওই যোডিয়াক, বলল লাবনী।

মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস। ওটা এখানে নেই।

শিরশির করে উঠল লাবনীর মেরুদণ্ড। তো কোথায়?

ব্যবসার কাজে যাব মোনাকোতে। তখন আমার ইয়টে জোড়া দেয়া হবে ওটা। গোপন তথ্য আবিষ্কারের সময় নিজে ওখানে থাকতে চেয়েছি। আপনিও যাবেন আমার সঙ্গে। লাবনীর অনিশ্চয়তা ভরা চোখ দেখে বলল সে, ওই ইয়ট অত্যন্ত বিলাসবহুল। ওখানে থাকতে আপনার কষ্ট হবে না।

আপনি ওখানে কারও সঙ্গে দেখা করবেন না তো? রাগী গলায়, লাবনীর কাছে জানতে চাইল নাদির। যেমন মাসুদ

হাতের ইশারায় কথাটা উড়িয়ে দিল লাবনী। আমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই ওই অপদার্থের। কাদির ওসাইরিসের দিকে তাকাল। ও, আপনার নিজস্ব ইয়ট আছে? ভেরি গুড!

.

ভাড়া করা গাড়ির পাশে পায়চারি করছে বেলা আবাসি, মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন চোখে দেখছে দ্বীপের মধ্যে দুর্গ ও কাঁচের পিরামিড। কোথাও নড়ছে না কিছু। দেখা নেই লাবনীর। আরও কিছুক্ষণ পর রানার সামনে থামল বেলা। চুপ করে বসে আছেন? এতক্ষণে হয়তো মেরে ফেলেছে ওঁকে!

ড্রাইভিং সিটে বসে আছে রানা। প্রয়োজন পড়লে যোগাযোগ করবে লাবনী।

যদি সেই সুযোগ না পায়? মেরেই ফেলে?

তেমন কোনও কারণ দেখছি না। পাশের সিট দেখাল রানা। বসে পড়ো।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে প্যাসেঞ্জার সিটে বসল বেলা। দড়াম করে বন্ধ করল দরজা।

মুখে কিছু না বললেও চিন্তিত রানা। প্যারিসে লাবনীকে সব বুঝিয়ে দেয়ার পর এটাও বলেছিল: তুমি ইচ্ছে করলে না-ও যেতে পারো। কাদির ওসাইরিসের দুর্গে পা রাখা মানেই ক্ষুধার্ত সিংহের গুহায় ঢোকা। তুমি না গেলে অন্য ব্যবস্থা করব। তবে তাতে লাগবে কয়েকটা দিন।

তখন জোর দিয়ে বলল লাবনী, ওসাইরিসের পিরামিড লুঠ হলে তা হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্কিওলজিকাল ট্র্যাজেডি। জান থাকতে সেটা হতে দেবে না। যদি সম্ভব হয়, ওই যোডিয়াক দেখে নিজেই খুঁজে বের করবে পিরামিড। সেজন্যে রানাকে পাশে চেয়েছে লাবনী।

আপনার কি কিছুই করার নেই, মিস্টার রানা? আবারও মুখ খুলল বেলা।

লাবনী চেয়েছে ওই যোডিয়াক দেখতে, বলল রানা, কিন্তু গিয়ে দেখতে চাই বললেই তো দেখতে দেবে না। তাই বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করে ওখানে গেছে। তুমি নিজেও সেটা জানো। আপাতত কিছু করার নেই, ধৈর্য ধরতে হবে।

কিন্তু পেরিয়ে গেছে পুরো দুই ঘন্টা! ঈশ্বর! হয়তো এতক্ষণে খুন হয়ে গেছেন লাবনী!

চুপ করে থাকল রানা।

 কিছু বলছেন না কেন?

কারণ ধৈর্য ধরতে শেখানো হয়েছে আমাকে।

কে শিখিয়েছে?

সেনাবাহিনী। বিপজ্জনক অপারেশনে ধৈর্য খুব জরুরি, তাতে লাগতেই পারে বিরক্তি। কিন্তু ওই ধৈর্য না ধরলে যে কোনও সময়ে খুন হবে যে-কেউ।

অস্থির লাগলে কী করতেন সেসময়ে?

অন্যদিকে মন সরিয়ে নিলে যে-কোনও সময়ে খুন হব, তাই ধৈর্যই ধরতাম। তুমি হয়তো অন্যকিছু ভাবছ, এমনসময় লাল আগুনের ফুলকি দেখলে, পরক্ষণে বুকে লাগল ভীষণ জোরে কী যেন! পরে আর কিছু জানলে না। কারণ মারা গেছ তুমি।

কথাগুলো ভাল লাগল না বেলার। মুখে শুধু বলল, ও।

তাই আপাতত চুপ করে বসে আছি। যদি বোধ করি বিপদে আছে লাবনী, লেক সাঁতরে গিয়ে উঠব ওই দুর্গে। চেষ্টা করব ওকে সরিয়ে নিতে। সবসময় তৈরি থাকা জরুরি।

বুঝলাম, ভাল সৈনিক হব না। ঘাড় কাত করে দুর্গ দেখল বেলা। তো এখন আমার সঙ্গে কথা বলছেন কেন?

মৃদু হাসল রানা। কারণ, আপাতত যুদ্ধের ময়দানে নেই।

কী যেন বলতে যাচ্ছিল বেলা, তখনই বেজে উঠল রানার মোবাইল ফোন। স্পিকার মোড চালু করল বিসিআই এজেন্ট। লাবনী?

প্রায় ফিসফিস করে বলল লাবনী, হা। আমার মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করেছে কাদির ওসাইরিস। তার ভাই একটু আগে জেনেভা এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে খোঁজ নিয়েছে। বিমানে একাই ছিলাম, এটা এখন প্রমাণিত। কমপিউটারেও দেখেছে উইকিপিডিয়ায় আমার সব তথ্য। খুঁত বের করতে পারেনি। সত্যিই ভেঙে গেছে এনগেজমেন্ট। পাকা কাজ করেছে তোমার লোক। তোমার উইকিপিডিয়া ফাইলেও তুলে দিয়েছে এসব। আমি নাকি ভয়ঙ্কর দুর্ব্যবহার করেছি তোমার সঙ্গে?

কী জানি! পরে সব কথাই মুছে ফেলা হবে।

বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। আছি বাথরুমে। বেশি দেরি করলে সন্দেহ করবে।

দেখতে পেয়েছেন যোডিয়াক? জানতে চাইল বেলা।

 না। ওটা এখানে নেই।

চট করে বেলাকে দেখল রানা। তা হলে কোথায়?

মোনাকোয় তার ইয়টে, বলল লাবনী, একটু পর রওনা হব হেলিকপ্টারে। ওটা নামিয়ে দেবে জেনেভা এয়ারপোর্টে। তারপর কাদির ওসাইরিসের ব্যক্তিগত জেট বিমানে করে যাব মোনাকোয়।

কিন্তু আপনি যদি ইয়টে থাকেন, মিস্টার রানা আপনাকে সরিয়ে আনবেন কী করে? চিন্তায় পড়ে গেছে বেলা।

তা জানি না। রানা ভেবেচিন্তে… সর্বনাশ! আর দেরি করতে পারছি না! পরে কথা হবে! কল কেটে দিল লাবনী।

মোনাকো তিন শ মাইল দূরে। বিমানে পৌঁছুতে লাগবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। কিন্তু এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কমপিউটারে থাকবে ওদের এন্ট্রি ডেটা। পরে ওই দেশে কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে গোলমালে জড়ালে শেষে পড়বে মস্তবড় বিপদে। কিন্তু ইতালি বা মোনাকোর স্থানীয় বিসিআই এজেন্টের সাহায্য নিয়ে কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে ঢুকতে পারবে ওই খুদে দেশে। সেক্ষেত্রে অ্যালপাইন পাহাড়ি এলাকা পেরিয়ে গাড়িতে যেতে হবে। তাতে লাগবে কমপক্ষে পাঁচঘণ্টা।

কসেকেণ্ড ভেবে বলল রানা, লাবনী পৌঁছে যাবে একঘণ্টারও আগে।

আমরা কী করব?

যাব মোনাকোর সীমান্তে, এরপর ঢুকব বেআইনীভাবে।

 দুর্গের উঠানে গর্জে উঠেছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন। নিজেও ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল রানা, নুড়িপাথর পেছনে ছিটকে রওনা হয়ে গেল ওরা।

.

১৪.

ইউরোপের বিশাল মানচিত্রে বড়জোর পিনের ডগার সমান একতিল জায়গা জুড়ে আছে মোনাকো। কিন্তু মাথাপিছু-আয় বিশ্বের অন্যসব এলাকার চেয়ে বেশি। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার কাছে ইতালিয়ান সীমান্তে প্রায়-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পরিবেশে বিলাসবহুল দেশ আর নেই কোথাও। প্রাচীন রাজবংশ এবং নামকরা সব ক্যাসিনোর জন্যে বিরাজ করছে অদ্ভুত মায়াময় সিনেমেটিক পরিবেশ। প্রায় আয়কর আইনহীন এ দেশ দুনিয়ার অতিবড় ধনীদের সত্যিকারের স্বর্গ।

এখানেই প্রতিবছর আয়োজন করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মোটর রেসিং। আঁকাবাঁকা রাস্তায় ঘণ্টায় এক শ আশি মাইল বেগে ছোটে মিলিয়ন ডলারের সব রেসের গাড়ি।

তীর থেকে একটু দূরে ব্রেকওয়াটারের কাছে নোঙর করেছে কাদির ওসাইরিসের বিশাল ইয়ট: আমুন রা। ওটার ফোরডেক থেকে দেখা যাবে রেস। শনিবার কোয়ালিফিকেশন সেশনে লড়ছে ড্রাইভাররা। আগামীকাল মূল প্রতিযোগিতা। সাগর থেকেও লাবনী শুনছে আল্টা-হাই-পারফর্মেন্স ইঞ্জিনের কর্কশ গর্জন। বাড়িঘরের মাঝ দিয়ে ছিটকে গিয়ে বন্দরের মুখ থেকে ঘুরছে রেসিং গাড়ি, আবারও শহরে ঢুকে খাড়া রাস্তা বেয়ে উঠছে ক্যাসিনো স্কয়ারের নাকের ডগায়।

কাদির ওসাইরিসকে বলল লাবনী, ওই শহরে বাস করলে কে টিভিতে দেখবে রেস?

ধর্মগুরু কিন্তু টিভিই দেখছে। বলল, মোনাকোর কেউ রেসিং গাড়ির গর্জন অপছন্দ করলে প্রতিবছর এক সপ্তাহের জন্যে এখান থেকে তাকে চলে যেতে হবে। চোখ সরাল না কোয়ালিফাইং সেশন থেকে। কিন্তু অন্য কেউ হয়তো… নাহ! আরবিতে গালি বকল সে।

রুবিল্যাকের ল্যাপ টাইমের চেয়েও ভাল করছে কেউ? তাচ্ছিল্যের সুরে জিজ্ঞেস করল নাদির মাকালানি। বসেছে একটু দূরের লাউঞ্জ চেয়ারে।

কড়া চোখে তাকে দেখল কাদির ওসাইরিস। এক সেকেণ্ডের দশভাগের একভাগ সময়ে জিতে গেছে! এভাবে হারলে সামনের অর্ধেক গ্রিডে সুযোগ পাব না আমরা।

তোমার উচিতই ছিল না গাড়ির রেসে নামা। একেই বলে সময় এবং টাকার বেহুদা অপচয়।

কিন্তু এরফলে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে ওসাইরিয়ান টেম্পলের নাম, বলল কাদির ওসাইরিস। আমার ধারণা, ওই সামান্য টাকার কথা না ভেবে এটাকে মস্ত বিনিয়োগ মনে করা উচিত। ভবিষ্যতে আর কখনও এ বিষয়ে একটা কথাও বলবে না, নাদির! ভুরু কুঁচকে বড়ভাইকে দেখে নিয়ে ইয়টের ভেতর ঢুকে পড়ল বিকৃত মুখের লোকটা।

সূর্যালোকে ভরা শহর থেকে চোখ সরিয়ে কাদিরকে দেখল লাবনী। ভেবেছিলাম, ধর্মের নামে গাড়ি স্পন্সর করতে দেবে না কর্তৃপক্ষ।

টেকনিকালি, ওসাইরিয়ান টেম্পল কিছুই স্পন্সর করছে না, টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ সরাল না কাদির। সব টাকা এসেছে ওসাইরিয়ান ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের তরফ থেকে। স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে নতুন কিছু সংখ্যা। হ্যাঁ, গুড! এবার থার্ড রো-তে পেয়ে যাব চান্স।

রেসিং টিম স্পন্সর করা, বিশাল এই ইয়ট… আসলে কোনও চার্চের মত নয় ওসাইরিয়ান টেম্পল, তাই না?

সানগ্লাসের ওপর দিয়ে লাবনীকে দেখল কাদির ওসাইরিস। কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনি এসব পছন্দ করছেন না, লাবনী।

কাঁধ ঝাঁকাল ও। এসব আমার বিষয় নয়। কথার প্রসঙ্গে বলেছি।

আমার হিসাবরক্ষকরা ব্যবস্থা করেছে, যাতে আমুন রা ইয়টের জন্যে আমাকে এক পয়সাও আয়কর দিতে না হয়। ওই যে, ক্ষতির মধ্যে রয়েছে মালিক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি? তাদের সঙ্গেই চুক্তি আমার। আরাম করে ভোগ করছি বলে আপত্তি তুলতে পারবে না কেউ। আপনিও তাই করুন। লাউঞ্জার চেয়ারের হাতলে বাটন টিপল সে। মাদিরা? প্লিয, দুটো মার্টিনি।

আমার লাগবে না, মানা করল লাবনী।

এটা আমার অনুরোধ, বলল কাদির। ঝলমলে এমন দিনে আপনার উচিত মজায় শরিক হওয়া।

তার বদলে যোডিয়াক দেখতে পেলেই বেশি খুশি হব।

আগে ওটা তৈরি হোক, বলল কাদির। হতাশা দেখেছে লাবনীর চোখে। আমার কারিগর এখন নিখুঁতভাবে জোড়া লাগাচ্ছে ওটাকে। তাতে লাগবে ঘন্টার পর ঘণ্টা। তাতে আমার আপত্তি নেই। চাই না হারিয়ে যাক কোনও সূত্র।

আমার মনে হয়, ওটা হল অভ রেকর্ডসসের ছাতে রেখে দেয়াই ভাল ছিল, না বলে পারল না লাবনী।

মাথা নাড়ল কাদির। আপনি সত্যিই পোড় খাওয়া আর্কিওলজিস্ট। নিয়মের একটু এদিক ওদিক হলেই রেগে যান।

চাইনি ওটা ওখান থেকে সরিয়ে নেয়া হোক। তার ওপর তখন আমাকে খুন করতে গেল আপনার ভাই আর কিলিয়ান ভগলার। খুশি হওয়ার মত ব্যাপার নয়। তিক্ত চোখে ওপরের ডেক দেখল লাবনী। রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকান খুনি। চোখে চোখ পড়ল দুজনের। যা হওয়ার হয়েছে, এবার দেখা যাক আমরা দুপক্ষ পরস্পরের কাছ থেকে লাভবান হই কি না।

নিশ্চিত থাকুন, লাভবান হবেন। ক্ষতির মুখে পড়ব না আমরা। হাসল কাদির ওসাইরিস। তার সামনে এসে থেমেছে জ্যামাইকান লাস্যময় এক তরুণী। পরনে রঙচঙে বিকিনি। হাতে ট্রে। মাদিরা… থ্যাঙ্ক ইউ।

মাদিরা দুজনের হাতে ধরিয়ে দিল মদিরা। গ্লাসের ভেতর টুং-টাং শব্দ তুলছে ত্রিকোণ বরফ। মাখনের মত নরম সুরে কাদির ওসাইরিসকে বলল মাদিরা, আরও কিছু লাগবে না তো? বোঝা গেল, ভেট হিসেবে কী অঙ্গ দিতে চাইছে।

চওড়া হাসি দিল কাদির ওসাইরিস। লাগলে বলব, মাই ডিয়ার… তবে এখন লাগবে না। ক্যাসিনোর পার্টির পর হয়তো? মাদিরার কালো নিতম্বে আলতো এক চাপড় বসাল সে। রওনা হয়ে গিয়ে খিলখিল করে হাসল তরুণী।

এই ইয়টে বেশ কজন প্রায় উলঙ্গ তরুণীকে দেখেছে লাবনী। তাতে আপত্তি ছিল না ওর। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সবুজ ব্লেযার পরনে ঘুরঘুর করছে বেশ কজন গার্ড। তাদের হাতে এমপি-সেভেন সাবমেশিন গান। নতুন করে লাবনীর মনে পড়ল, এখানে এসে বাথরুমে গিয়েও যোগাযোগ করতে পারেনি রানার সঙ্গে। এমনও হতে পারে, ইয়টে এমন কোনও যন্ত্র আছে, যেটার কারণে পাওয়া যায় না ফোনের রিসেপশন। লাবনী ঠিক করল, আবারও চেষ্টা করবে একটু পর। মুখে বলল, বলবেন, রুটিওয়ালা থেকে কীভাবে হয়ে উঠলেন ধর্মগুরু? বা কীভাবে হলেন সিনেমার নায়ক? জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

পছন্দের বিষয় পেয়ে ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি মিউট করল কাদির ওসাইরিস। নিজেকে নিয়ে বলতে ভালবাসে। সুইটয়ারল্যাণ্ডে আগেই বলেছি, আমি ভালবাসি জুয়া খেলতে ঠিক? আসলে নায়ক হয়ে উঠলাম, কারণ পছন্দ করি জুয়া খেলতে। আমার তখন মাত্র চোদ্দ বছর বয়স, এমন সময় আমাদের শহরে শুটিং করতে এল এক সিনেমা পার্টি। তাদের সঙ্গে নায়ককে দেখেই বুঝলাম, ওই লোককে খুব পাত্তা দিচ্ছে দলের সবাই। মনে হলো, যেভাবে হোক, আমাকেও সুযোগ পেতে হবে সিনেমায়। নায়ক হতে হবে। কিন্তু মাত্র তিন দিন পর শুটিং শেষ করে ফিরবে তারা। তাই প্রতিদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে যেতে লাগলাম তাদের শুটিঙে। কথা বললাম কারও কারও সঙ্গে। তাদের ভেতর ছিল সেই নায়কও। ইউসুফ শাকিল। ফুসলিয়ে নাদিরকেও আনতে চেয়েছি আমার সঙ্গে। কিন্তু… তখন ওর বয়স বারো… ভয় পেল ধরা পড়বে। আর তা হলেই বেধড়ক মারবে আমাদের বাবা।

খুব রাগী ছিলেন তিনি?

হাসল কাদির ওসাইরিস। হ্যাঁ। তাই ছিলেন। কিন্তু কিছুই পাত্তা না দিয়ে স্কুল ফাঁকি মেরে যেতে লাগলাম শুটিং দেখতে। কিন্তু তৃতীয় দিন, তাদের হোটেলের কাছে এক শুটিঙে দরকার পড়ল ব্যাকগ্রাউণ্ডের জন্যে কজন এক্সট্রা। ওদিকে সিনেমার এক তরুণ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমার। সে ডেকে নিল আমাকে।

তার মানে, এভাবেই শুরু হলো মস্তবড় এক নায়কের এগিয়ে চলার পথ, বলল লাবনী। প্রায় রানার কণ্ঠের মতই মিষ্টি ও ভারী কাদির ওসাইরিসের গলা, সত্যিকারের কাহিনীকার এই লোক। তারপর কী হলো?

স্কুল ফাঁকি দিয়ে ছোট এক জুয়া খেলেছি, কিন্তু সিনেমায় নেমে নিলাম মস্ত ঝুঁকি। দৃশ্যের মাঝে হঠাৎ করে বলে ফেললাম একটা ডায়ালগ।

ও, তাতে রেগে গেলেন ডিরেক্টর?

মাথা নাড়ল কাদির। এখন আর লাবনীকে দেখছে না, চোখ হারিয়ে গেছে দূরাকাশে। এখনও মনে আছে, গাড়ি থেকে ভারী একটা বাক্স নামালেন নায়ক ইউসুফ শাকিল। আমি বুঝলাম, এবার কাট বলে উঠবেন ডিরেক্টর, তাই দেরি না করে সামনে বেড়ে বললাম, স্যর, সাহায্য করতে পারি? দিতে হবে মাত্র দশটা পিয়াস্ত্রে। হাত বাড়িয়ে দিলাম অলিভার টুইস্টের মত করে।

তারপর কী হলো?

চমকে গিয়েছিলেন ডিরেক্টর। ভুলেই গিয়েছিলেন কাট বলতে। হাসল কাদির ওসাইরিস। এরপর হেসে ফেললেন নায়ক ইউসুফ শাকিল। রেগে না গিয়ে বললেন, তুমি যদি ভদ্রমহিলার সব মালপত্র হোটেলে তুলে দাও, আমি তোমাকে দেব বিশ পিয়াস্ত্রে! সবাই হাসল ওই দৃশ্য দেখে। ডিরেক্টর ঠিক করলেন সিনেমায় রাখবেন ওই সিন। পয়সাও দিলেন। ভাবতেও পারবেন না কত!

বিশ পিয়াস্ত্রে?

পয়সাটা দিয়েছিলেন ইউসুফ শাকিল। ওটাই ছিল আমার প্রথম ঝুঁকি নেয়া। প্রথমবারের মত আমাকে দেখা গেল সিনেমায়। হিংসায় পাগল হয়ে গেল নাদির। বাবা-মাকে বলে দিল কী করেছি। রাগে জ্বলে গেলেন আমার বাবা। কিন্তু কদিন পর চিঠি পেলেন ডিরেক্টরের কাছ থেকে। ওই দৃশ্যে আমাকে দেখার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন, ওই দৃশ্যের কারণে চমৎকার হয়ে উঠেছে নায়কের চরিত্র। তাই তিনি চান, আমি যেন দেখা করি তাঁর সঙ্গে কায়রোয়। ঠিক করলাম চলে যাব সেই সুদূর শহরে, অভিনয় করব সিনেমার দৃশ্যে।

অদ্ভুত ঘটনা, কাজে লেগেছিল আপনার জুয়াখেলা, প্রশংসার সুরে বলল লাবনী।

যা ভেবেছি, তার চেয়েও বেশিকিছু হবে, বুঝলাম। একটু কষ্ট হলেও রাজি করাতে পারলাম বাবাকে। পেয়ে গেলাম এগোবার টিকেট। প্রথম সন্তান হওয়ার সুবিধা বলতে পারেন। কায়রো শহরে গিয়ে কাজ করলাম স্টুডিয়োতে। এখন শুধু চাই ভাল একটা চুক্তি। আমার নাম ছিল কাদির মাকালানি, কিন্তু সমস্যা: ওই নামে আছে এক চরিত্রাভিনেতা। সবাই বলল, যেন নতুন নাম নিই। আমি বেছে নিলাম ওসাইরিস নামটি। মনে হয়েছিল ওটাই আনবে সৌভাগ্য।

তাই হলো শেষে, বলল লাবনী।

ঠিক। ষোলো বছর বয়সে হলাম নিয়মিত অভিনেতা। প্রথমে ছোট সব চরিত্রে অভিনয় করতাম। শিখতে লাগলাম কীভাবে ক্যামেরার সামনে ভাল অভিনয় করতে হয়। আর আঠারো বছর বয়সে পেলাম নায়ক হিসেবে প্রথম সিনেমা। মিশরের সিনেমা-বাজারের তুলনায় বেশ সফল হলো ওটা। স্টুডিয়ো চাইল আরও সিনেমায় যেন নায়ক হই। কিন্তু সেসময় জাতীয় সার্ভিস হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে এল ডাক। তিনবছর ট্রেইনিং নিতে হবে যুদ্ধের জন্যে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়ল সিনেমা জগতের সবাই। তা ছাড়া, সরকারে ছিল আমার বন্ধু-বান্ধব। তারা টানল দরকারি সব সুতো।

মার্টিনিতে চুমুক না দিয়ে টেবিলে গ্লাস রাখল লাবনী। মিলিটারি সার্ভিস থেকে ছেড়ে দেয়া হলো আপনাকে?

মাথা দোলাল কাদির। ওই কাজেই যোগ দিতাম, কিন্তু খুশি হয়েছি রেহাই পেয়ে। ফুর্তিতে ছিলাম। বয়স মাত্র আঠারো বছর। নাম করে ফেলেছি। হুড়মুড় করে আসছে টাকা। শত শত সুন্দরী চাইছে আমাকে এক রাতের জন্যে। চওড়া হাসল কাদির। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর ম্লান হলো ওই হাসি। কিন্তু এসবের কারণে আরও হিংসুটে হলো নাদির। আর তারপর ওর দুর্ঘটনা হওয়ার পর তো… চুপ হয়ে গেল সে।

কী হয়েছিল তার? মুখ পুড়ে গিয়েছিল জানি, কিন্তু…

আর্মিতে যাওয়ার পর ঘটে ওই দুর্ঘটনা, মন খারাপ করে বলল কাদির ওসাইরিস। আমার মত কপাল ভাল ছিল না ওর। সেজন্যে আগে থেকেই রেগে ছিল আমার ওপর। তার ওপর মাত্র কয়েক সপ্তাহ ট্রেইনিঙের পর এক ট্রাক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ল মুখের একপাশ। হাসপাতালে ছিল পুরো দুমাস। এরপর ছাড়া পেয়ে সোজা ফিরল তিন বছরের জন্যে ওর ওই ইউনিটে। বুঝি, কেন এমন তিক্ত হয়েছে ওর মন।

মাথা দোলাল লাবনী। অগ্নিকাণ্ডের জন্য দুনিয়ার মানুষকে শত্রু ভাববে নাদির, সেটা মেনে নেয়া কঠিন ওর জন্যে।

এরপর যখন আর্মি থেকে বেরিয়ে এল নাদির, বড়ভাই হিসেবে দায়িত্ব নিলাম, ওকে করলাম আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। তারপর যখন শুরু করলাম ওসাইরিয়ান টেম্পলের কাজ, ওকেই দিলাম গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব।

কীভাবে শুরু করলেন ওসাইরিয়ান টেম্পল? নতুন কোনও ধর্ম চালু করা তো সহজ কথা নয়!

মৃদু হাসল কাদির ওসাইরিস। কাজ করেছিলাম ওসাইরিস অ্যাণ্ড সেট নামের এক সিনেমায়। ছিলাম ওসাইরিস। আমার ভাগ্য ছিল নির্ধারিত। খুব নাম করেছিল ওই সিনেমা। এমন কী চলেছিল আমেরিকার বাজারেও। মিশরের সিনেমা সাধারণত এমন সুযোগ পায় না। ওটার কারণে হয়ে গেলাম মিশরের জাতীয় বীর। সবাই চিনত। শুনতে চাইত কী বলতে চাই। পূজা করা হতো আমাকে। যেন সিনেমার ওসাইরিস নই, সত্যিকারের দেবতা-রাজা ওসাইরিস! গ্লাসে বরফ নাড়ছে কাদির। আসলে হঠাৎ করে কেউ অনেক নাম করলে, তার প্রতি আকর্ষিত হয় বহু মানুষ।

তাই আসলে।

হাসল কাদির। নিজেকে দেখলেন টিভির স্ক্রিনে, তারপর দেখলেন নিজের মুখ পত্রিকার পাতায় কেমন শিহরন লাগবে বুকে? দুনিয়া দেখছে আপনাকে, শুনতে চাইছে আপনার মুখের কথা! তুলনা আছে এই আনন্দের? …আর এরপর যদি আপনার হয় পতন, পারবেন সহ্য করতে?

চুপ করে আছে লাবনী, আস্তে করে মাথা নাড়ল। মনে পড়ে গেছে নিজের কষ্টকর অতীত।

কাদির ওসাইরিস বলল, আর সবার মতই চাই আরও সুনাম। আকাশের নক্ষত্র নয়, হতে চাইলাম মানুষের হৃদয়ের মালিক। সবাই যেন অনুসরণ করে আমাকে।

যেন পূজা করে?

কেন নয়? মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে দুহাত তুলল কাদির। হা, চেয়েছি তা-ই। সেজন্যে আরম্ভ করলাম ওসাইরিয়ান টেম্পলের কার্যক্রম। ওই একইসময়ে চালু করলাম ওসাইরিয়ান টেম্পলের সাবসিডিয়ারি সব কোম্পানি।

আবারও জুয়া? বলল লাবনী।

এবার খেললাম জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া। ছিলাম সাধারণ মুসলিম। বুঝতে পারছেন এর অর্থ? ধর্মান্ধ সব জঙ্গির টার্গেট হলাম। হুমকির পর হুমকি এল: তোকে মেরে ফেলব, হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা! আর এসব সামলাতেই নাদিরকে দিলাম আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব। একইসঙ্গে রক্ষা করবে ওসাইরিয়ান টেম্পলকে। পরে দেখলাম, নিজ কাজে খুব দক্ষ ও।

অতি সক্ষম, বলল লাবনী। ওপরের ডেকে কিলিয়ান ভগলারের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছে কাদিরের ভাই।

আগে যা হয়েছে, সেজন্যে আমি দুঃখিত, বলল কাদির ওসাইরিস। টিভির স্ক্রিনে চোখ রেখে টিপে দিল আনমিউট বাটন। দ্বিতীয় হচ্ছে রুবিল্যাক! আছি প্রথম সারিতে! ঘুরেও দেখল না লাবনীর দিকে। আবারও বলছি, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

ঠিক আছে, বুঝেছি। এবার একটু ওয়াশরুমে যাব। চেয়ার ছেড়ে ইয়টের নিরাপদ কোনও টয়লেটের খোঁজে চলল লাবনী।

.

তুমি কোথায়, লাবনী? কল রিসিভ করেই জানতে চাইল রানা।

আমি মোনাকোয়, এল ফিসফিস কণ্ঠ, আছি কাদির ওসাইরিসের ব্যক্তিগত ইয়টে। তুমি কোথায়?

প্রতিঘণ্টায় গতি তুলতে পারি এক শ ত্রিশ কিলোমিটার, কিন্তু জ্যামের কারণে ইতালির অটোস্ট্রাডা ধরে আসছি ত্রিশ কিলোমিটার বেগে।

ইতালি? ওখানে কেন?

বিমানে না চাপলে সবচেয়ে দ্রুত মোনাকোয় আসতে পারব এই পথেই। কী করছ? দেখতে পেয়েছ যোডিয়াক?

না। এখনও ওটা রিঅ্যাসেম্বল করেনি কাদির ওসাইরিসের লোক। আজ রাতে কাজ শেষ হবে।

কী যেন ভেবে নিয়ে বলল রানা, ওই ইয়ট কি বন্দরে?

না। উপকূল থেকে বেশ একটু দূরে। কীভাবে নামব জানি না। নিজে পারব না, আমাকে সরিয়ে নিতে হবে তোমার।

বুঝলাম।

তবে আজ বিকেলে একটা ক্যাসিনোর পার্টিতে যাবে কাদির ওসাইরিস, তবে আমার মনে হয়েছে সে চাইছে আমিও যেন তার সঙ্গে যাই।

পার্টি? কোন্ ক্যাসিনো বলতে পারবে?

না, তবে ওখানে থাকবে ওসাইরিয়ান রেস টিম। মোনাকোয় এলে সহজেই জেনে নিতে পারবে। অথবা হয়তো কোনও বোট ভাড়া করে এলে আমুন রা ইয়টে? …সর্বনাশ! কে যেন আসছে! বাই, রানা!

কান থেকে মোবাইল ফোন সরাল রানা। কিছু বলার আগেই জিজ্ঞেস করল বেলা, উনি ঠিক আছেন তো?

আপাতত, হ্যাঁ। আছে কাদির ওসাইরিসের ইয়টে। তবে ওখানে বোধহয় যেতে পারব না। বছরের সেরা অনুষ্ঠানের আগের রাতে বোট ভাড়া দেবে না কেউ।

পার্টির কথা যেন শুনলাম?

মৃদু হাসল রানা। আমার ফুপুর মতই কান পেতে সব শোনার অভ্যেস তোমার! কী, যেতে চাও ওই পার্টিতে?

কী ধরনের পার্টি।

পার্টি দেয়া হচ্ছে ওসাইরিসের গ্রাঁ প্রি টিমের সম্মানে।

ঝলমল করে উঠল বেলার চোখ-মুখ। তা হলে তো ওখানে রেসিং ড্রাইভাররা থাকবে? আমাদের ওখানে যাওয়াই উচিত।

সামাজিক অনুষ্ঠান হবে না ওটা, বলল রানা।

দুঃখে শুকিয়ে গেল বেলার মুখ। তা ছাড়া, দামি পোশাকও নেই। হাতের ইশারায় রানার জিন্স, টি-শার্ট ও চামড়ার জ্যাকেট দেখাল। কুঁচকে আছে ওর নিজের শার্ট ও খাকি কমব্যাট ট্রাউযার। বাবা-মার কাছ থেকে যে টাকা পাই, তাতে মন্টে কার্লোর উপযুক্ত পোশাক কিনতে পারব না। না, ঢুকতে দেবে না ওই ক্যাসিনোর ভেতর।

অত ভেবো না, সান্ত্বনা দিল রানা। মানিব্যাগে চকচকে সোনালি ক্রেডিট কার্ড। চাইলে ব্যয় করতে পারবে বিশাল অঙ্কের টাকা।

আজ রাতে যে পোশাক কিনে দেবেন, আরেকটু বড় হলেই সেই টাকা শোধ করে দেব, খুশি হয়ে উঠল বেলা।

তুমি কি আর বড় হবে, বেলা? হেসে ওর মাথায় আলতো চাপড় দিল রানা। মনোযোগ দিল সামনের রাস্তায়।

.

১৫.

 দেখার মতই সোনালি ঝলমলে মোনাকোর সব রিসোর্ট, অথচ অবিশ্বাস্য উত্তেজনাহীন এ দেশের ক্যাসিনো! বড় বাজেটের রঙিন সিনেমায় বা টুরিস্ট অফিস যতই দেখাতে চেষ্টা করুক: দামি টুক্সেডো পরা যুবক, হীরার ঝলক, কার্ড উল্টেই মিলবে শত কোটি ডলার, বা হুইলের এক চক্করে আসবে সাত রাজার ধন- কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে ক্যাসিনোয় ঠায় অপেক্ষায় আছে সারি-সারি কমপিউটারাইড় চাট মেশিন। লাস ভেগাসের মতই খুব কম সময়ে বড় মাপের জুয়া খেলা হয় মোনাকোতে। বছরের পর বছর এসব ক্যাসিনোর বড় অঙ্কের টাকা আসছে শুধু অতিসাধারণ মধ্যবিত্ত টুরিস্টের পকেট কেটে। জুয়া খেলার সময় ক্যাসিনোর অতি দামি মদ গিলে, পেটে দুর্মূল্য রেস্টুরেন্টের খাবার পুরে একজন গো হেরে বিদায় নিলে, তার মতই বোকামি করতে আসছে অন্য কেউ!

অবশ্য এমন নয় সব ক্যাসিনো।

রিভিয়েরার রঙিন সুখ-স্বপ্ন ধরে রেখেছে বলে ধন্যবাদ পাবে দ্য-আযুর ক্যাসিনো। এখানেও আছে স্লট মেশিন, কিন্তু রাখা হয়েছে গরীবদের জন্যে দূরে। মস্তবড় ক্যাসিনোর বুকে চলছে স্বাভাবিক সব জুয়া।

কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে দ্য-আযুর ক্যাসিনোর মেইন লাউঞ্জে ঢুকে চারপাশ দেখল লাবনী। কখনোই জুয়াকে আকর্ষণীয় মনে হয়নি। তবে দালানের আর্কিটেকচার দেখে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না ও। পঞ্চাশ দশকে অতিধনী ব্যবসায়ী টেনে আনতে তৈরি হয়েছিল এ ক্যাসিনো। ছাতে ঝুলছে ক্রিস্টালের মস্তবড় সব ঝাড়বাতি, কুচকুচ করছে জুয়ার টেবিলের দামি কালো কাঠ।

দারুণ জায়গা তো! ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলল লাবনী।

আপনার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের কাছে ম্লান এসব, মিষ্টি কণ্ঠে বলল কাদির ওসাইরিস। মোনাকোর সেরা পার্লার থেকে সঙ্গিনীকে সাজিয়ে এনেছে সে। বারবার চোখ ফিরছে বেদানার দানার মত গোলাপি রঙের সুন্দরী যুবতীর অপরূপ মুখে।

লাবনী বুঝল, লাল হয়ে উঠছে ওর দুই গাল। নিজেকে মনে হচ্ছে খুবই সতর্ক। পরনে কয়েক হাজার ডলার দামের নীল সিল্ক ইভিনিং গাউন। ব্রিটেনের রানীর কেশবিন্যাসকেও হার মানাবে ওর চুলের খোঁপা। মনে মনে আফসোস করল, হায় রে, আজ যদি কাদির ওসাইরিসের বদলে পাশে থাকত মাসুদ রানা, তা হলে আর কিছুই চাইত না ও!

মিশরীয় ধর্মগুরুকে ঘিরে রেখেছে বডিগার্ডরা। তাদের সঙ্গে রয়েছে নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলার। খুনিটা আজ ভদ্রতা দেখাতে সাপের চামড়ার জ্যাকেটের গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে বেগুনি টাই। নইলে হয়তো তাকে ঢুকতেই দিত না ক্যাসিনোর বিকেলের অনুষ্ঠানে।

ধন্যবাদ, কাদির ওসাইরিসকে বলল লাবনী।

নিজে সাদা এক দামি টুক্সেডো পরেছে কাদির ওসাইরিস। হাঁটছে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। কারও বাপেরও সাধ্যি নেই তাকে ওয়েটার বলে ধরে নেবে। সাইড এক্সিট পেরিয়ে লাবনীকে নিয়ে মূল কামরার দিকে চলল সে। চিনতে পেরে হাতের ইশারায় তাকে এগিয়ে যেতে বলল ক্যাসিনোর এক স্টাফ।

একদিকের দরজা দিয়ে ক্যাসিনোর উঠানে দেখা গেল রেসিং সার্কিট। কোয়ালিফাইং শেষ হওয়ায় পাবলিকের জন্যে খুলে দিয়েছে ট্রাক। ক্যাসিনোয় ঢুকতে দেয়ার জন্যে সরানো হয়েছে একপাশের ক্র্যাশ ব্যারিয়ার। রানাকে দেখবে সে আশায় রাস্তায় চলে গেল লাবনীর চোখ। কিন্তু ওদিকে নেই মাসুদ রানা বা বেলা আবাসি।

বজ্রপাতের মত কড়াৎ করে উঠল কী যেন। ঘুরে তাকাল সবাই। এইমাত্র চালু হয়েছে সবুজ-সোনালি রঙের ওসাইরিয়ান টিমের একটি রেসিং গাড়ির ইঞ্জিন। ককপিটে বসে আছে সোনালি চুলের এক তরুণ। হাসছে কাদির ওসাইরিসের দিকে চেয়ে। চাপ দিল অ্যাক্সেলারেটরে।

গমগম করে উঠল কাদির ওসাইরিসের কণ্ঠ, লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন! আমার মনে হচ্ছে, রেসিং করতে অধৈর্য হয়ে উঠেছে আমাদের ড্রাইভারদের কেউ!

হাসছে পার্টির সবাই। ঝিলিক দিল সাদা আলো। তোলা হচ্ছে ছবি। গাড়ির পাশে থেমে ড্রাইভারের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল কাদির ওসাইরিস। দয়া করে সবাই মনোযোগ দিন! ইনি রনি রুবিল্যাক! আশা করি আগামীকাল আঁ প্রি-তে দুনিয়ার সেরা হবেন!

হৈ-হৈ করে উঠল সমর্থকরা। গর্জন কমল রেসিং গাড়ির ইঞ্জিনের। রেসিং টিমের সবচেয়ে বড় স্পন্সর হিসেবে বক্তৃতা আরম্ভ করল কাদির ওসাইরিস। ক্যাসিনো স্কয়ারের দিকে তাকাল লাবনী। ওদিকে কোথাও নেই রানা। আবারও কাদির ওসাইরিসের দিকে ফিরল লাবনী। তখনই সামনে হাজির হলো কিলিয়ান ভগলার। টিটকারির সুরে জানতে চাইল, কাউকে যেন খুঁজছ, ডার্লিং?

অন্তত আপনাকে নয়, রেগে গিয়ে বলল লাবনী।

সেটা খারাপ কথা! আমি কিন্তু চোখ রাখব তোমার ওপর। নাদির বলে দিয়েছেন, তুমি মিস্টার ওসাইরিসের বিশেষ অতিথি, তাই যেন তোমার নিরাপত্তার দিকে নজর রাখি। আমার ধারণা, সুযোগ পেলেই গোলমাল বাধাবে তুমি।

ভুল ভাবছেন, তিক্ত সুরে বলল লাবনী, কিছুই করিনি, আর করবও না। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।

নাদির মাকালানি এ কথা শুনলে হতাশ হবেন, বাঁকা হাসল ভগলার। ঘুরে চলে গেল মাকালানির পাশে। ওখান থেকে লাবনীকে সন্দেহের চোখে দেখছে দুজন।

নিজের বক্তৃতা শেষ হতেই অতিথিদের সঙ্গে দুচার কথা সারল কাদির ওসাইরিস। লাবনীর পাশে ফিরে বলল, এখানে বড় আওয়াজ। আরেকটা দরজা দেখাল। বলরুমে যাওয়াই ভাল। সঙ্গিনীর কনুই ধরে এসকর্ট করে এগোল।

বিস্মিত হয়েছে লাবনী। আপত্তি তুলল না।

পিছু পিছু এল নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলার। তাদের পেছনে বডিগার্ডরা।

কর্কশ গর্জন ছাড়ল রেসিং কারের ইঞ্জিন।

.

ব্যস্ত বিকেল। ক্যাসিনো স্কয়ার। নানা শব্দ ছাপিয়ে ক্যাসিনো দ্য-আযুর থেকে এল ভি-এইট ইঞ্জিনের বিকট হুঙ্কার।

লাবনী বোধহয় ওখানে, বলল রানা। যোগাযোগের চেষ্টা করেছে, কিন্তু অফ ছিল লাবনীর মোবাইল ফোন। হয়তো এখনও জোড়াই দেয়া হয়নি যোডিয়াক, তাই সুযোগও পায়নি ওটা দেখার। হয়তো ওকে অবিশ্বাস করছে কাদির ওসাইরিস। সেক্ষেত্রে সেই সন্দেহ দূর করার দায়িত্ব রানার। সেটাই করবে ভেবেছে।

ওর সঙ্গে হেঁটে রাস্তা পেরোল বেলা। আশা করি এখনও আস্ত আছেন লাবনী আপা।

লাবনীকে বিশ্বাস করে থাকলে এখানে এনেছে কাদির। তবে একবার যোডিয়াক দেখার পর কঠিন হবে ওকে সরিয়ে আনা।

কী ধরনের প্ল্যান করেছেন?

লাবনীকে খুঁজে বের করে নাটকীয় অভিনয় করব।

যদি ধরা পড়েন?

মৃদু হাসল রানা। আমি অপমানিত প্রেমিক, কাজেই খেপে আছি। পাগলে কী না করে!

কী করতে চান? মারাত্মক কিছু নয় তো?

না, তেমন কিছুই নয়।

আমার কী করা উচিত?

ইশারা দিলেই একপাশে ঝাঁপ দেবে। ক্যাসিনোর এন্ট্রান্সে পৌঁছে গেল রানা ও বেলা। ঠিক আছে, এবার দাও তোমার পাসপোর্ট।

মোনাকোর ক্যাসিনোতে ঢুকতে দেয়ার আগেই পাসপোর্ট দেখে কর্তৃপক্ষ। এ দেশের সরকার জুয়া থেকে বিশাল অঙ্কের আয় করলেও দেশের সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেয় না ওখানে। খেয়াল করা হয় কাস্টোমারের পোশাক। সেটা রুচিশীল না হলে সুযোগ পায় না কেউ ক্যাসিনোয় ঢুকতে। সেজন্যে এ মুহূর্তে রানা ও বেলার পরনে দামি পোশাক।

রানা পরেছে কালো টুক্স। ওদিকে বেলা পরেছে মেটালিক ফ্যাব্রিকের লো-কাট মিনিড্রেস। রানা ভেবেছিল অনাকর্ষণীয়। কিছু কিনবে মেয়েটা। কিন্তু এককথায় মানা করে দিল বেলা। হয়তো বাকি জীবনেও আর আসবে না এ দেশে, তা হলে কেন ইচ্ছেমত দামি পোশাক কিনবে না? বিশেষ করে টাকা যখন রানাই দেবে!

রানার হাতে পাসপোর্ট দিল বেলা। ধরুন। নিজের কাছে রাখতে পারবেন? আমার ছোট্ট পার্সে ওটা আঁটছেই না!

জ্যাকেটের পকেটে রাখব। পাসপোর্টের পাতায় চোখ যেতেই চট করে বেলার চোখে তাকাল রানা।

না-না, পড়বেন না! হায়-হায় করে উঠল বেলা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে!

বেলিড্যান্সার বেলা আবাসি? হেসে ফেলল রানা। তা হলে এটাই তোমার আসল নাম?

চুপ করুন! ধমকে উঠল বেলা। আমার দাদী জানতেন না, ওই জঘন্য নামের জন্যে বড় হয়ে কত কষ্ট সহ্য করতে হবে আমার! আপনি আমাকে বেলা বলেই ডাকবেন! আর, প্রিয, এই নাম উচ্চারণও করবেন না ডক্টর আলমের সামনে!

জীবনেও না, সিরিয়াস চেহারা করল রানা। আমি তো চিনিই না তোমাকে!

ডোরম্যানের হাতে ওদের পাসপোর্ট দিল ও। বুঝে গেছে, কোথায় পাবে ওসাইরিয়ান টিমের সবাইকে।

বেলাকে নিয়ে গেমিংরুমে ঢুকল রানা। উঁচু সব জানালার পর্দা ঠেকাচ্ছে না বাইরের রেসিং গাড়ির ইঞ্জিনের জোর গর্জন। জুয়াড়ীরা যাতে সব ভুলে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে জুয়ায়, তাই ভারী পর্দা দিয়ে গোপন করেছে সূর্যালোক বা নিকষ আঁধার।

উঠানের দরজা পাহারা দিচ্ছে আরও দুজন ডোরম্যান। রানা ওদিকের ঘরে যাবে শুনেই ভদ্রতার সঙ্গে মাথা নাড়ল তারা। আগে দেখাতে হবে আমন্ত্রণপত্র। দরজার পাশ দিয়ে ফেরার সময় ওদিকের ঘরে লাবনী বা কাদির ওসাইরিসকে দেখল না রানা। তবে চোখ পড়েছে অন্য এক দরজায়। ওটা পেরিয়ে ক্যাসিনোর আরেক দিকে চলেছে কেউ কেউ।

ওখানে সারি সারি স্লট মেশিনের কাছে একটা এক্সিট। সেখানেও পাহারা দিচ্ছে আরও দুই ডোরম্যান। রানা বুঝে গেল, ওই পথেও ঢোকা যায় কাঙ্ক্ষিত ঘরে। দরজার ওদিক থেকে আসছে বাজনার আওয়াজ।

গেমিং রুমের অন্যদিক লক্ষ্য করে যেতে যেতে বেলাকে বলল রানা, ওই দরজার ওদিকে পার্টি। চোখে পড়ল, কোণে আরও একটা দরজা। ওই পথে ঢুকল ক্যাসিনোর এক স্টাফ। দরজায় কি-প্যাড বা কার্ড-লক নেই, কড়ায় ঝুলছে ইয়েল লক। টাকা-পয়সার লেনদেন নেই ওখানে। খুব সহজ সারে বলল রানা, চললাম, দরকার হলে দরজা ভেঙে ঢুকব।

কিন্তু…।

অপেক্ষা করো, বলল রানা, ওদিকে থাকবে কাদির ওসাইরিসের সিকিউরিটির লোক। চাই না তোমাকে কিডন্যাপ করুক। বিপদ দেখলে সরে পড়বে। বেআইনীভাবে এ দেশে ঢুকেছি, কাজেই ধরা পড়লে সোজা ভরে দেবে জেলখানায়।

কিন্তু কাদির ওসাইরিসের লোক যদি আপনাকে আটক করে? চিন্তায় পড়ে গেছে বেলা।

সহজ হবে না। চোখ-কান খোলা রেখো।

রানা কাছের ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়াল বেলা। চোখ বোলাল কোনার দরজার ওপর।

সেদিকেই চলেছে রানা।

কসেকেণ্ড পর ওই দরজা খুলে ওদিকের করিডোরে ঢুকল ক্যাসিনোর মহিলা এক স্টাফ। নিঃশব্দে তার দশ ফুট পেছনে চলল রানা। এদিকটা ক্যাসিনোর কিচেন এরিয়া। আরেকটু দূরেই ফাংশান রুমে যাওয়ার আরেক সার্ভিস ডোর।

মহিলা স্টাফ কিচেনে ঢুকতেই ওই কবাট পেরিয়ে এগোল রানা। সামনের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিল। ওদিকের ঘরে অন্তত দেড় শজন অতিথি। জুয়ার কয়েকটি টেবিলে ভিড় করেছে অনেকে। কেউ ব্যস্ত আলাপে। বাজনদারদের একটু দূরের ফ্লোরে ওয়াল নাচছে কপোত-কপোতীরা।

কাছেই সাপের চামড়ার জ্যাকেট পরা ভগলারকে দেখে সতর্ক হলো রানা। ওই লোকের খুব কাছেই থাকবে নাদির মাকালানি। আশপাশেই আছে কাদির ওসাইরিস এবং লাবনী।

কয়েক সেকেণ্ড পর এক ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলে কাদির ওসাইরিসকে দেখল রানা। পাশেই রানির মত পোশাক পরে বসে আছে রূপসী লাবনী।

আস্তে করে দরজা খুলে নাচিয়েদের পাশ কাটিয়ে এখোল রানা। ধর্মগুরুর কয়েক ফুট দূরে বেশ কজনের সঙ্গে আলাপ করছে কিলিয়ান ভগলার ও নাদির মাকালানি।

কাদির ওসাইরিসের কাছেই শক্তপোক্ত কজন বডিগার্ড। এখনও রানাকে চিনতে পারেনি কেউ। নাদির মাকালানিকে এড়িয়ে ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলের কাছে পৌঁছে গেল ও।

আপাতত লাবনীর হাতের তিন তাসে আছে আঠারো পয়েন্ট। কাদির ওসাইরিসের হাতে উনিশ পয়েন্ট। ওদিকে ডিলারের খোলা তাস একটা রাজা।

খেলা বাদ দেয়া উচিত অন্য দুই খেলোয়াড়ের।

ঠোঁট কামড়ে বলল লাবনী, হুম, খুব কঠিন সিদ্ধান্তে যেতে হবে।

আপাতত ভাগ্য মন্দ তোমার, একটু আগে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে কাদির ওসাইরিস।

অথচ ভেবেছি আজ রাত সৌভাগ্যের। টেবিলে টোকা দিল লাবনী। কার্ড দিন।

ওর দিকে একটা তাস বাড়িয়ে দিল ডিলার।

কিন্তু ওটা মাত্র তিন।

 একুশ… বিড়বিড় করল লাবনী। এবার?

হাতে অকর্মা জোকার উঠতেই হতাশ হয়ে তাস ফেলে দিল ডিলার।

লাবনীর চিপসের স্তূপে যোগ হলো ছোটখাটো পাহাড়।

কাদির ওসাইরিস বলল, তুমি সত্যিই সৌভাগ্যবতী!

সবই অঙ্কের খেলা। কখন অফ হতে হবে, আর কখন রয়ে যেতে হবে, ছোটবেলা থেকে এসব শিখিয়েছেন মা।

দুষ্টু হাসছে কাদির। তার মানে, প্রতিটি কার্ড গুনে খেলছ? ক্যাসিনোর কর্তৃপক্ষ অখুশি হবে।

লাবনী জানাল না, মস্তবড় সব পাটিগণিতের উত্তরও চট করে বের করতে পারে ও।

দেখা যাক পরের দানে কী করো, ডিলারকে নতুন তাস দিতে ইশারা করল ধর্মগুরু।

হঠাৎ লাবনীর পেছন থেকে বলল গম্ভীর কণ্ঠ, আমিও খেলব। টেবিলে ছুঁড়ে দেয়া হলো কয়েকটা পঞ্চাশ ইউরোর নোট। সবাই তো খেলতে পারে, তাই না?

ঘুরে পেছনে রানাকে দেখে চমকে গেছে লাবনী। রানা! খুশি হলেও মনে পড়ল মুখ কালাকালি হয়ে গেছে ওদের। কেউ এখন ওর অন্তরের কথা বুঝলে বিপদ। কঠোর সুরে বলল লাবনী, কী চাই, বদমাস-শয়তান কোথাকার! রানা মুখ খোলার আগেই উঠে দাঁড়াল, প্যারিসে যে জঘন্য আচরণ করেছ, তারপর আশা করো তোমাকে মাফ করে দেব?

ভেবেছ এত সহজে ছেড়ে দেব? খলনায়কের মত হাসল রানা। কোনও চিটিংবাজি চলবে না। বিয়ে তো করবেই, মাফও চাইবে বেয়াদবির জন্যে!

মাথার ইশারায় বডিগার্ডদের কাজে নামতে আদেশ দিল কাদির। আবছাভাবে রানাকে চেনা-চেনা লাগছে তার। কে এই লোক, লাবনী?

আমার প্রাক্তন প্রেমিক, চাপা স্বরে বলল লাবনী। ভুল করেছি ওর সঙ্গে মিশে!

নামটা আমার মাসুদ রানা, কাদির ওসাইরিসকে বলল রানা। তোমাকে ভাল করেই চিনি, কপট ধর্মের ভণ্ড গুরু!

কাদিরের এবার মনে পড়ল। ও, তুমি ছিলে প্যারিসে ওসাইরিয়ান টেম্পলে।

এগিয়ে এসেছে নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলার।

কাদির! ভাইয়ের কানের কাছে বলল নাদির, আগেই বলেছি, এই মেয়েকে বিশ্বাস করা যায় না!

আমিও আপনার মতই চাই না ঝামেলা করুক মাসুদ রানা! রাগ নিয়ে বলল লাবনী।

কয়েক পা এগোল ভগলার। তা হলে ব্যবস্থা করছি। এখান থেকে বের করে দেব ওকে!

হাত তুলে মানা করল কাদির ওসাইরিস, ঠোঁটে হাসি। না, বসুন না উনি! আসুন, মিস্টার রানা, বসুন ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলে। চাই না কেউ খেলা থেকে বাদ পড়ক। লাবনীর ওদিকের চেয়ার দেখাল সে। ওখানে বসা লোকটা চট করে উঠে চলে গেল। প্লিয, মিস্টার রানা।

কাদির, প্রিয, ওকে বিদায় করো, আবদারের সুরে বলল লাবনী।

এত কষ্ট করে এসেছে, এখন ঘাড় ধরে বের করে দেয়া অন্যায়, বলল কাদির ওসাইরিস। গোঁয়ারের মত চেহারা করে চেয়ারে বসেছে রানা। ওকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ধর্মগুরু। তা ছাড়া, জানতে চাই, কীভাবে তোমার মত অপরূপা সুন্দরীর মন পেয়েছিল ও।

ওর দিকে হাত বাড়ালে ভেঙে দেব সে-হাত, কর্কশ গলায় হুমকি দিল রানা।

মাথা নাড়ল লাবনী। ভুল করছ, রানা। কখনও পাবে না আমাকে। তুমি দয়া করে বিদায় হলে খুশি হব।

তুমি উড়াল দিতে চাইলে হবে? আমি তো আর এনগেজমেন্ট ভাঙিনি! বাঁকা হাসল রানা। ডিলারের দিকে তাকাল। অ্যাই, চিপস্ দাও। দেখি কে কত বড় জুয়াড়ী!

 ওর সামনে দেয়া হলো চিপসের ছোটখাটো স্তূপ।

 প্রতি দানে বাজি পঞ্চাশ ইউরো, ডিলারের দিকে তাকাল কাদির ওসাইরিস।

মাথা দুলিয়ে তাস দিতে লাগল ডিলার।

জেমস্ বণ্ডের সিনেমার মত করে জুয়া খেলতে হবে, নাকি? টিটকারির হাসি হাসল রানা। দেখল নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলারকে। আমার ওপর চোখ রাখবে তোমার খুনির দল, নাকি, কাদির ওসাইরিস? ঠিক আছে, আপত্তি নেই!

আমার ভাই খুনি নয়, বলল কাদির। দেখছে হাতের তাস। একটা রাজা, একটা চার- সব মিলে চোদ্দ পয়েন্ট।

ডিলারের খোলা কার্ড একটা দশ।

 হিট মি। এবার একটা ছয় পেল কাদির। আছি।

লাবনীর কপালে জুটেছে একটা তিন ও পাঁচ। আরেকটা তাস দিন। এবার পেল আরেকটা পাঁচ। চতুর্থ তাস একটা সাত। আছি।

এবার রানার পালা। প্রথমেই পেয়েছে ফালতু গোলাম এবং একটি ছয়। হিট মি। পেল একটা ছয়। ধূর, শালা!

অন্য দুজন খেলোয়াড় হাত থেকে ফেলে দিল তাস। খেলবে না। এবার হোল কার্ড দেখাল ডিলার। একটা সাত। ব্ল্যাকজ্যাক খেলার নিয়ম অনুযায়ী সতেরোতে স্ট্যাণ্ড করতে হলো তাকে। এই দানে জিতল লাবনী ও কাদির ওসাইরিস।

মৃদু হাসল ধর্মগুরু। মনে হয় ব্ল্যাকজ্যাক আপনার খেলা নয়, মিস্টার রানা।

মাত্র গরম হয়ে উঠছি, তিক্ত হাসল রানা।

 শুরু হলো আরেক দান।

এবার তৃতীয় তাস টেনে মন দমে গেল রানার। শালার কপাল! ফেলে দিল তাস।

হাসল কাদির ওসাইরিস। কাজ হচ্ছে না জেমস বণ্ডের মত করে তাস খেলে?

বারবার তিন দান! মরুক সব শালা!

তুমি বিদায় নিলে পরিবেশ স্বাভাবিক হবে, তাই করো! অভিনয়ে খারাপ করছে না লাবনী।

খেলাই তো দেখোনি, মাত্র শুরু করেছি।

হেরে ভূত হও, কিন্তু কখনও পাবে না আমাকে।

পরের দুই তাসে রানা পেল একটা টেক্কা ও একটা রানি। তার মানেই ব্ল্যাকজ্যাক। মৃদু হাসল। আমার মনে হয় না কেউ একুশ পয়েন্ট নিয়ে হারবে।

ডিলারের কাছেও আছে একই রঙের ব্ল্যাকজ্যাক।

আরে! এসব কী? আপত্তির সুরে বলল রানা। ওর কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হলো বেশিরভাগ চিপস্। অ্যাই, ড্র হয়েছে!

আপনার উচিত ছিল ইসুরেন্স বেট ধরা, বলল কাদির ওসাইরিস। নিজে হেরেছে বলে আফসোস নেই। এবার পরের দানের জন্যে তৈরি থাকুন।

হুঁ।

আবার শুরু হলো নতুন দান।

এবারও হারল রানা। ওর সামনের টেবিলে এখন একটা চিপও নেই! অথচ, ফুলে গেছে কাদির ওসাইরিসের চিপসের স্তূপ। এবার কী করবেন, মিস্টার রানা?

গভীরভাবে চিন্তা করছি।

তখনই একটু দূরের স্টেজে বেজে উঠল নতুন এক সুর। আহা, ট্যাঙ্গো! চেয়ার ছেড়ে লাবনীর দিকে হাত বাড়াল কাদির ওসাইরিস। চলো, একটু নাচি?

গলা শুকিয়ে গেল লাবনীর। নিচু স্বরে বলল, ট্যাঙ্গো নাচতে জানি না। কোনও নাচই পারি না।

তাতে কিছুই যায় আসে না, জোর দিয়ে বলল কাদির। লিড নেব। উড়িয়ে নেব তোমাকে স্বপ্নের জগতে।

 আপত্তি তুলল না লাবনী। ওর হাত ধরে ড্যান্স ফ্লোরে পা রাখল কাদির ওসাইরিস।

এদিকে ভীষণ রেগে গিয়ে চেয়ার ছেড়েছে পাকা অভিনেতা রানা। কিন্তু ও পা বাড়াবার আগেই পথ আটকে দিল দুই বডিগার্ড। কর্কশ গলায় পেঁচিয়ে উঠল রানা, আরে! আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলতে চাই!

কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না! ড্যান্স ফ্লোর থেকে জানাল লাবনী। কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে নাচছে।

একটু দূর থেকে বলল নাদির মাকালানি, বড়ভাই, ওরা কিন্তু খেলছে তোমাকে নিয়ে!

কথাটা পাত্তা না দিয়ে মাথা নাড়ল কাদির। আমার তা মনে হয় না। নিখুঁতভাবে লাবনীকে ঘুরিয়ে নিল সে।

আর তখনই ধাক্কা দিয়ে সামনের দুই বডিগার্ডকে সরিয়ে দিল রানা। যেন পাগল হয়ে গেছে ব্যর্থ প্রেমিক! শুয়োরের বাচ্চা, সরে যা আমার প্রেমিকার কাছ থেকে!

চিৎকার শুনে চমকে গেছে সবাই। স্টেজে থমকে গেছে নাচিয়েরা।

হনহন করে কাদির ওসাইরিসের দিকে চলেছে রানা।

আপনার বোধহয় এখান থেকে চলে যাওয়াই ভাল, মিস্টার রানা! ধমকের সুরে বলল কাদির ওসাইরিস।

ক’পা যেতেই রানার সামনে আবারও দাঁড়িয়ে গেল দুই বডিগার্ড। চাপা স্বরে বলল নাদির মাকালানি, আমরা ওকে দূরে ছেড়ে আসছি, বড়ভাই! অ্যাই, ধরো ওকে, তুলে নিয়ে ফেলে দেবে রাস্তায়!

দুই বডিগার্ডের হাত কাঁধে পড়তেই গর্জে উঠল রানা, খবরদার! গা থেকে হাত সরাও!

দ্বিতীয় বডিগার্ড খামচে ধরল ওর কনুই। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবে রানা, এমনসময় রাগী গলায় বলল লাবনী, ওকে ফেলুন সাগরে! জঘন্য এক অপদার্থ! ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে লাবনীর। ভাবছে, আরও খারাপ কিছু করবে নাদির মাকালানি বা ভগলার। আফসোস হচ্ছে, বেশি অভিনয় করে ফেলেছে! দূর হও এখান থেকে, রানা!

লাবনীর মত একই কথা ভাবছে রানাঃ নিজেকে ছাড়িয়ে না নিলে পিটিয়ে ওর হাড়গোড় গুঁড়ো করবে এরা!

ওর কনুই খামচে ধরে একদিকের সার্ভিস ডোরের দিকে চলল দুই বডিগার্ড। পিছনে নাদির ও ভগলার, ঠোঁটে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হাসি। একবার ক্যাসিনো থেকে বের করতে পারলেই খতম কররে শত্রুকে। দলে তারা ভারী।

খুব সতর্ক হয়ে উঠল রানা। ফুলে আছে ভগলারের জ্যাকেটের বগলের কাছে। ওটা রিভলভার না হয়েই যায় না!

দরজা মাত্র বিশ ফুট দূরে!

…দশ!

ওই দরজা ভাল চোক পয়েন্ট। একসঙ্গে বেরোতে পারবে না দুপাশের দুই বডিগার্ড। অবশ্য, দক্ষ লোক হলে আগেই সতর্ক হবে…

পৌঁছুবার আগেই খুলে গেল কবাট। হাতের ট্রেতে দামি কয়েকটা ওয়াইনের বোতল নিয়ে ঢুকেছে এক ওয়েইটার। বিশালদেহী, ভারী…

রানাকে দুপাশ থেকে ধরে প্রায় তুলে নিয়ে চলেছে দুই বডিগার্ড। এই সুযোগে দুপা তুলে দানবের মত ওয়েইটারের পেটে কষে একটা লাথি লাগিয়ে দিল রানা।

পেছনে গিয়ে ছিটকে পড়ল হতভম্ব, হতভাগ্য দানব। ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে ভাঙল দামি সব ওয়াইনের বোতল। রানার কাজে এসেছে নিউটনের তৃতীয় সূত্র পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেল দুই বডিগার্ড। ডানেরজন কাত হয়ে পড়ল নাদিরের বুকে, বামেরজন ভারসাম্য নষ্ট করল ভগলারের। পরের সেকেণ্ডে মেঝেতে বেকায়দা একটা স্তূপ তৈরি করল ওরা পাঁচজন মিলে।

সবার ওপরে গদিনসীন রানা। হ্যাচকা টানে ছুটিয়ে নিল দুই হাত। ওর এক কনুই নামল পাশের বডিগার্ডের পেটে। থেমে না গিয়ে গড়াতে শুরু করে সরছে ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলের দিকে। সটকে পড়বে ওদিকের সার্ভিস ডোর খুলে।

লাফিয়ে মেঝে ছেড়ে উঠে দরজা পেরোতে চাইল রানা। কিন্তু ব্যাট উইঙের মত বন্ধ হলো দুই কবাট। ক্লিক আওয়াজে আটকে গেল তালা। সময় নেই যে চিতপাত ওয়েইটারের কাছ থেকে চাবি জোগাড় করবে।

দাঁড়া, শালা! খেপা বাঁদরের মত থুতু ছিটাল ভগলার। বডিগার্ডদের তলা থেকে অর্ধেক বেরিয়ে হাত ভরল জ্যাকেটে, এবার শোল্ডার হোলস্টার থেকে তুলে নেবে রিভলভার।

টেবিল থেকে কার্ড শাফলিং মেশিন নিয়েই ভগলারের মুখ লক্ষ্য করে বাটন টিপল রানা। রাগী মথের মত ফড়াৎ-ফড়াৎ আওয়াজে আমেরিকান খুনির চোখে-মুখে লাগছে নতুন সব তাস। চোখ রক্ষা করতে হাত নাকের কাছে নিল সে। প্রায়। বের করে আনা রিভলভার হাত ফস্কে পড়ল কার্পেটে। তার মাথা তাক করে কার্ড শাফলার চুড়ল রানা। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। খটাং শব্দে লাগল কপালে। এই সুযোগে ঘুরে মেইন লাউঞ্জের দিকে ছুটল রানা।

ভিড়ের মাঝ দিয়ে ছুটতে ছুটতে একবার তাকাল ড্যান্স ফ্লোরে। লাবনীর চোখে খুশির হাসি। ঠোঁট গোল করে বুঝিয়ে দিল, যাও, রানা! শাবাশ!

পরক্ষণে প্রায় উড়তে উড়তে দরজার কাছে পৌঁছুল রানা।

.

১৬.

 হৈ-চৈ, হুলুস্থুল শুনে মূল ক্যাসিনোতে সতর্ক হয়ে উঠেছে সিকিউরিটির লোক ও ডোরম্যানরা। রানা দরজা হাট করে পার্টিরুম থেকে ছিটকে বেরোতেই চমকে গেল এক ডোরম্যান। চোয়ালে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে মেঝেতে পড়ল সে। তবে তার সঙ্গী ধাক্কা দিয়ে ফেলতে চাইল রানাকে। কিন্তু হঠাৎ হুড়মুড় করে নিজেই পড়ল মেঝেতে। ফেটে চ্যাপটা হয়ে গেল তার নাক।

লাফিয়ে দুই ডোরম্যানকে পেরোল রানা। দৌড় দেবে লাউঞ্জ থেকে বেরোতে। তখনই টের পেল, পেছনের দরজায় ডোরম্যানের পায়ে পা বাধিয়ে তাকে ফেলে দিয়েছে বেলা। নীরবে মুখ নেড়ে ওকে ধন্যবাদ দিল রানা। ওর পিছু নেবে ভেবেছিল বেলা, কিন্তু ছুটতে শুরু করে মাথা নাড়ল রানা। হাতের ইশারায় দেখাল, ভিড়ে হারিয়ে যেতে। ওরা একসঙ্গে এসেছে, তা জানলে বিপদ হবে।

মস্তবড় ঘরের আরেক দিকে চলল বেলা।

জুয়াড়ীদেরকে বিস্মিত করে দৌড় দিয়েছে রানা। পেছনে চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে নাদির মাকালানি। রেলগাড়ির দ্রুতগামী ইঞ্জিনের গতি তুলে রানার পিছু নিল কাদির ওসাইরিসের দুই বডিগার্ড। উঠানের দুই ডোরম্যানও এল রানাকে ঠেকাতে! জুয়ার টেবিলগুলোর মাঝ দিয়ে তীরবেগে ছুটছে বাঙালি গুপ্তচর।

একটু দূরেই সামনে খোলা দরজা। কিন্তু ওই পথে হুড়মুড় করে ঢুকল ক্যাসিনোর সিকিউরিটির অন্তত চারজন লোক। খড়-মড় আওয়াজ তুলছে তাদের ওয়াকি-টকি। জুয়াখেলার প্রতিটি ঘরে আছে সিসিটিভি। কেউ ঠকবাজি করলে ধরা পড়বে। একই কারণে পার্টিরুমে গোলমাল হতেই বাজিয়ে দেয়া হয়েছে অ্যালার্ম।

ফাঁদে পড়ে রানা বুঝে গেল, যেভাবে হোক সরাতে হবে সবার মনোযোগ।

একটা রুলেত টেবিল লক্ষ্য করে চলেছে ক্যাসিনোর ইউনিফর্ম পরা এক মহিলা ক্লার্ক। হাতের ট্রেতে উঁচু করে রাখা সারি সারি চিপস্। একদৌড়ে মহিলার কাছে হাজির হলো রানা, পাশ কাটাবার আগে লাথি ঝেড়ে দিল ট্রের নিচে। ছিটকে শূন্যে রওনা হলো একরাশ রঙিন চিপস্। তিন সেকেণ্ড পর ঝরঝর করে নেমে এল বৃষ্টির মত।

তাতে স্রেফ পাগল হয়ে গেল সবাই।

জিনিসগুলোর ভেতর রয়েছে সামান্য ইউরো থেকে শুরু করে দশ হাজার ইউরোর চিপস্। পরেরগুলো পেতে মেঝেতে হামলে পড়ল সবাই। পাশের স্টুলের এক মহিলাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে এক লোক। জাহাজের ভেঁপুর মত বিকট আর্তনাদ ছাড়ল মহিলা। ধাক্কাধাক্কির ভেতর কাত হয়ে পড়ল একটা ড্রিঙ্ক কার্ট। ঝনঝনঝনঝন আওয়াজে মেঝেতে ভাঙল ক্রিস্টালের গ্লাস ও দামি মদের বোতল। একটা ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলের মহিলা ডিলার হাউমাউ করে উঠল তার টেবিল উল্টে পড়তেই। তার চিপস্ও ছড়িয়ে গেল মেঝেতে। চারপাশে শুরু হয়েছে হরিলুঠ। রানাকে ধাওয়া করা বাদ দিয়ে শত শত হাতের মাঝ দিয়ে পথ খুঁজছে কাদির ওসাইরিসের দুই বডিগার্ড।

প্রায় রায়ট শুরু হওয়ায় বাইরের দরজার কাছেই থেমে গেছে সিকিউরিটির লোক। রানা ও তাদের মাঝের মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে একদল সুশীল। তাদেরই কারও কারও হাত মাড়িয়ে দিয়ে বেরোবার পথ খুঁজছে রানা।

ধর, ওই যে শালা! গর্জন ছাড়ল ভগলার। বেরিয়ে এসেছে পার্টিরুম থেকে। পাশেই কাদির ওসাইরিসের আরেক বডিগার্ড। ভগলারের হাতে এখন রিভলভার। এতই রেগে গেছে, খেয়াল নেই যখন তখন তাকে গ্রেফতার করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক।

এর-ওর পাঞ্জা মাড়িয়ে এগোচ্ছে রানা। শক্ত কী যেন লাগল পায়ে। ওটা কার্ট থেকে পড়া আস্ত এক শ্যাম্পেনের বোতল। উবু হয়ে তুলে নিল রানা। অস্ত্র না থাকার চেয়ে বোতল ভাল। ব্যবহার করতে পারবে গদার মত। তখনই ওর সামনে খুলল অবারিত পথ। একটা রুলেত টেবিলের নিচে নিজেদের ভেতর চিপস নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে একদল লোক।

নিজেও রুলেত টেবিলের নিচে ঢুকল রানা। হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করে খুলে ফেলল শ্যাম্পেনের বোতলের ফয়েল ও তারের জাল। এবার সহজেই খুলতে পারবে কর্ক। পেছনে শুনল ফ্রেঞ্চ গালি। ওকে হারিয়ে ফেলেছে সিকিউরিটির লোক। টেবিলের আরেক প্রান্তে পৌঁছে ভোরের সূর্যের মত লাফিয়ে উদয় হলো রানা।

ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ল এক লোক। তাকে মাড়িয়ে আসছে কাদির ওসাইরিসের এক বডিগার্ড। পেছনেই কিলিয়ান ভগলার। রুলেত টেবিল ঘুরে তেড়ে এল রানার দিকে। ওই একইসময়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে শ্যাম্পেইনের কর্ক খুলল রানা।

পপ!

বোতল থেকে ম্যাগনাম বেগে গিয়ে বডিগার্ডের ডান চোখে লাগল কর্ক। কাতরে উঠল লোকটা। একহাতে চেপে ধরেছে আহত চোখ। মুখে পড়ল শ্যাম্পেনের মিষ্টি ও ঝাঁঝাল ফোয়ারা। তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইল ভগলার। তা না পেরে কাঁধের ওপর দিয়ে তাক করল রিভলভার…

ভুসভুস করে বেরোচ্ছে শ্যাম্পেন, কাঁধের সর জোর খাটিয়ে বোতল ছুঁড়ল রানা। ঠনাৎ করে রিভলভারের নলে লাগল বোতল। ভগলারের হাত থেকে রুলেত টেবিলে পড়ে গেল রিভলভার, বেইয থেকে পিছলে চলে গেল ঘুরন্ত হুইলে। কিনারা থেকে বেরিয়ে আছে কাঠের বাট।

অন্ধপ্রায় বডিগার্ডকে ঠেলে রানার ওপর ফেলতে চাইল ভগলার। সরাসরি বাড়ি খেল রানা ও বডিগার্ড। টলমল করছে রানা, ওদিকে টেবিলের আরেক দিকে ঝাঁপ দিয়েছে। ভগলার। তার চাই ওই রিভলভার। কিন্তু অস্ত্রটা ঘুরে অন্যদিকে চলে যেতেই বাম কনুইয়ে ভর করে ওটা ধরতে চাইল সে।

ধাক্কা মেরে বডিগার্ডকে সরিয়েই টেবিলে ঝাঁপ দিল রানা। ওর চোখা কনুই খচ্‌ করে নামল ভগলারের শিরদাঁড়ার ওপর। ওউপস্! মারাত্মক ব্যথায় কেঁদে উঠল আমেরিকান খুনি। হাত ফস্কে গেল রিভলভার। ঘুরে চলে গেল আরেক দিকে। দুই হাঁটু ধরে হিড়হিড় করে টেবিল থেকে ভগলারকে নামাল রানা। প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল ওর মাথায়। পরক্ষণে নিজে ডাইভ দিল রিভলভার পেতে।

বাতাসে খামচি মারল ওর আঙুল। ঘুরে অন্যদিকে গেছে রিভলভার। তখনই ওর মাথায় নামল কী যেন! ঘোলা হয়ে গেল দৃষ্টি। ঘুরছে রুলেত টেবিলের হুইল। রানার মাথায় আবারও ঘুষি বসাল ভগলার। ভেলভেট কাপড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল রানা। চোখ তুলে দেখার আগেই ওর কোমরে লাগল ভগলারের প্রচণ্ড এক লাথি। টেবিল থেকে ছিটকে একপাশে পড়ল রানা। হুইল থেকে ঝরঝর করে ঝরল বাজির চিপস।

বেইয-এ কাউবয় বুট বাধিয়ে টেবিল ধরে সামলে নিল ভগলার। থাবা মেরে আটকে ফেলল ঘুরন্ত হুইল।

অসহায় রানা দেখল, রিভলভারের বাঁট খপ করে চেপে ধরেছে ভগলার। এদিকে লাথি মেরে ওকে এত দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে, চাইলেও ঘুষি মারতে পারবে না ও। বাঁচতে হলে দরকার উপযুক্ত কোনও অস্ত্র!

ক্রুপিয়ের র‍্যাক…।

 লম্বা দণ্ড তুলেই সাঁই করে চালাল রানা।

মাঝখান থেকে মড়াৎ করে ভেঙে গেল পাতলা র‍্যাক।

কালো হাতলটা বড়জোর ছোট একটা কীলক। টিটকারির চোখে ওকে দেখল ভগলার। হালকা দণ্ডের আঘাতে কিছুই হয়নি তার। হাত নাচিয়ে রানার দিকে রিভলভার তাক করল সে…

তখনই চোখা র‍্যাকের শেষাংশ গেঁথে দিল রানা ভগলারের পেটে।

এবার আর ব্যথা না পেয়ে পারল না ভগলার। একেকটা চোখ হয়ে উঠল পিংপং বলের মত বড়! এদিকে সুযোগ পেয়ে সামনে বেড়ে ভগলারের আঁশ ভরা জ্যাকেটের কলার চেপে ধরেছে রানা, পরক্ষণে মাথা দিয়ে ভয়ঙ্কর এক গুঁতো মারল নোকটার কপালে! শত্রুর হাত থেকে কেড়ে নিল রিভলভার। লাফিয়ে উঠল টেবিলের ওপর। বুঝে নিতে চাইল ঘরের কোন দিক দিয়ে পালাবে।

ভূরি ভূরি চিপসের লোভে মস্তবড় ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে রায়ট। তবে পালাতে চাইছে শুঁটকি কেউ কেউ। ওদিকে হঠাৎ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাওয়ার আগেই ঘরের দূর থেকে ছুটে আসছে শক্তিশালী লোকগুলো।

রানার হাতে রিভলভার দেখে চিলের মত চিৎকার ছাড়ল আতঙ্কিত এক মহিলা। ঘুরে ওদিকে তাকাল রানা। ছুটে আসছে সিকিউরিটির কয়েকজন। যেভাবে হোক বেরিয়ে যেতে হবে ওকে। অথচ, প্রতিটি দরজায় পাহারা দিচ্ছে ক্যাসিনোর লোক।

বাদ থাকল শুধু জানালা।

টেবিল থেকে নেমে উঠানের দরজা লক্ষ্য করে ছুট দিল রানা। ওকে ঠেকাতে চাইল কাছের এক অ্যাটেণ্ড্যান্ট। কিন্তু তার দিকে রিভলভারের নল ঘুরতেই হারাল সব উৎসাহ। বুলেট বলতে রানার মাত্র ছয়টা, তা ছাড়া নিরীহ মানুষের ভিড়ে চালাবে না গুলি। একটা ক্র্যাপ টেবিল ঘুরে এগোবার সময় কারুকাজ করা ছাত দেখল রানা। একটু ওপরে ঝুলছে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি…

একসারি স্লট মেশিনের পেছন থেকে তেড়ে এল কাদির ওসাইরিসের আরেক বডিগার্ড। ওকে জাপ্টে ধরার আগেই মোড় নিল রানা, তবুও একহাতে ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরল ষাড়ের মত লোকটা। প্রায় পাশাপাশি ওরা, সে-সুযোগে শত্রুর মাথায় কনুইয়ের জোর গুলো বসাল রানা। তবে তাতে দমে না গিয়ে ধাক্কা মেরে সামনের স্লট মেশিনে ওকে ফেলতে চাইল বডিগার্ড।

হুমড়ি খেয়ে পড়বে বুঝে শত্রুর গলা পেঁচিয়ে ধরল রানা। সামনে বাগিয়ে রেখেছে শত্রুর মাথা। ভয় পেয়ে থামতে চাইল বডিগার্ড, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে অনেক!

মুখোমুখি সংঘর্ষে চুরমার হলো স্লট মেশিনের ভিডিয়ো স্ক্রিন। প্রায় কোমর পর্যন্ত গেঁথে গেল বডিগার্ড। কারেন্টের শকের ভয়ে থমকে গেছে রানা। সামনের গর্ত থেকে ঝিলিক দিচ্ছে লালচে ফুলকি। ঝরঝর করে ট্রেতে নামল টোকেন। খদ্দেরের বিজয়ে খুশির রিনরিনে আওয়াজ ছাড়ছে মেশিন।

অচেতন বডিগার্ডের প্রশংসা করল রানা, বাহ, এই তো জ্যাকপট পেয়েছ! সবচেয়ে কাছের জানালা ওর কাছ থেকে কমপক্ষে চল্লিশ ফুট দূরে। ওদিকে পঁয়ত্রিশ ফুট দূর থেকে তেড়ে আসছে সিকিউরিটির কয়েকজন।

অজ্ঞান বডিগার্ডের কোমরে পা রেখে স্লট মেশিনের ছাতে উঠল রানা। সারি সারি মেশিনের ছাতে উড়ে চলেছে ও।

একপাশ থেকে তেড়ে এসে গোড়ালি ধরতে চাইল দুএকজন গার্ড। কিন্তু তাদেরও দেরি হয়ে গেছে। শেষ মেশিনের ওপর থেকে ঝাঁপ দিল রানা। খপ করে ধরল ছাত থেকে ঝুলন্ত এক ঝাড়বাতি।

টুং-টাং মিষ্টি শব্দে পরস্পরের গায়ে লাগছে অসংখ্য ক্রিস্টালের টুকরো। টারজানের মত দুলতে দুলতে জানালায় পৌঁছে গেল রানা। ওকে মুড়িয়ে নিয়েছে ভারী পর্দা। ঝাড়বাতি ছেড়ে দিতেই জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে গেল। পর্দার কারণে ওর শরীরে বিঁধল না ভাঙা কাঁচ। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়নি বলে ধুপ করে পড়ল শক্ত সিমেন্টের চাতালে। চারপাশে ছড়িয়ে গেল ভাঙা কাঁচের অসংখ্য টুকরো। বার কয়েক গড়ান দিয়ে পর্দা সরিয়ে উঠে বসল ও। ব্যথা পেয়ে কুঁচকে ফেলেছে নাক-মুখ। একটু দূরে হতবাক হয়ে ওকে দেখছে পার্টিতে আসা কয়েকজন।

আরে, এই হতভাগার কথা বাদ দিন, উঠে দাঁড়াল রানা। যান, পার্টিতে যান! ওর চোখ পড়েছে উঠানের মাঝে সবুজ-সোনালি ওসাইরিয়ান টিমের রেসিং কার। এখনও ধিক-ধিক আওয়াজে চলছে ইঞ্জিন। আধবসা হয়ে এদিকে চেয়ে আছে ড্রাইভার।

ওই গাড়িটা দরকার, বুঝে গেল রানা। একদৌড়ে হাজির হলো ওসাইরিয়ান রেসিং গাড়ির সামনে। চিনেও ফেলল ড্রাইভারকে। বেশ নাম করেছে। রনি রুবিল্যাক। খুব দ্বিধার ভেতর পড়ে গেছে তরুণ।

দুঃখিত, দোস্ত, ঘাড় ধরে রুবিল্যাককে বের করে নিজে লাফিয়ে ককপিটে উঠল রানা। প্রায় শুয়ে পড়তে হয়েছে ওকে। আগেও ড্রাইভ করেছে এসব গাড়ি। তোমার রেস ভাল হোক, দোস্ত!

তাদের হিরোকে বের করে দিয়ে গাড়ি লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে বাদামি এক যুবক! চমক কাটল টিম টেকনিশিয়ানদের, হৈ-হৈ করতে করতে তেড়ে এল তারা। কিন্তু ততক্ষণে ক্লাচ চেপে গিয়ার ফেলে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরেছে রানা। ওর জানা ছিল, হেলমেট নেই বলে কানে বিকট আওয়াজ তুলবে ইঞ্জিন। তীরের গতি তুলে রওনা হয়ে গেছে সুপারকার।

কয়েকজন আসছিল রাস্তা ধরে, চোখের সামনে তুমুল বেগের গাড়ি দেখে দুপাশে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণরক্ষা করল তারা। হালকা ওজনের ব্যারিয়ার উড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল রানা।

বলরুম থেকে দৌড়ে এল কাদির ওসাইরিস, পেছনেই লাবনী। অবাক হয়ে দেখল, কর্ডন চুরমার করে ক্যাসিনো স্কয়ারের জমিতে চলে গেছে রানা। থামাও! ওকে থামাও! চিৎকার করল কাদির ওসাইরিস।

ক্যাসিনো থেকে ছিটকে এল নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলার। শেষেরজনের হাতে দ্বিতীয় রিভলভার। তাক করল রেসিং গাড়িটার দিকে। কিন্তু ধমকে উঠল কাদির ওসাইরিস, না-না! গুলি না! ট্রিগার থেকে আঙুল সরাল ভগলার। পিছু নাও! পিছু! নাদির, যাও!

রাগী চোখে লাবনীকে দেখে নিয়ে রানার গাড়ির পেছনে ছুটল নাদির। পেছনে ভগলার এবং এক বডিগার্ড। এদিকে উঠানে বেরিয়ে এসেছে সিকিউরিটির লোক। কিন্তু আপাতত তাদের কিছুই করার নেই। ক্যাসিনোর দরজায় থেমেছে বেলা। হাতের ইশারায় ওকে আবারও লুকিয়ে পড়তে বলল লাবনী।

ওর দিকে তাকাল কাদির ওসাইরিস। লাবনী, এইমাত্র তোমার প্রেমিক চুরি করেছে আমার মিলিয়ন ডলারের রেসের গাড়ি!

এসব কারণেই তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখিনি, রাগী গলায় বলল লাবনী, জঘন্য লোক! অন্যের সম্পত্তি নষ্ট করার ওস্তাদ!

বিরক্তি নিয়ে মাথা নাড়ল কাদির ওসাইরিস। কপাল ভাল, ওটা প্রদর্শনী গাড়ি। পেশাদার ড্রাইভার তো নয়, বেশি দূরে যেতে পারবে না।

.

বহুদিন পর আবারও রেসিং কার চালাচ্ছে রানা। মনে পড়ছে। গ্রা প্রি-র উত্তেজনাময় সেসব দিনের কথা। সত্যিই আবারও রেসিং ট্র্যাকে নেমেছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি অন্যরকম, সামনে থেকে এসে ঘাড়ে চাপতে চাইছে সিভিলিয়ান সব গাড়ি। রেসিং কার নিয়ে তুমুল বেগে চলেছে উল্টোপথে সার্কিট ধরে। উঁচু গাড়ির হেডলাইটের কড়া, সাদা আলো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ওর চোখ।

আরেকটু হলে মস্ত নাকওয়ালা এক বেন্টলি চ্যাপ্টা করে দিত ওকে। একেবারে শেষসময়ে বাঁক নিয়ে সরে গেল রানা। তাতে রাস্তার পাশের ক্র্যাশ ব্যারিয়ারে লাগল ফ্রন্ট উইং। ভাঙল পাতলা কার্বন ফাইবার। সোজা পথে যাওয়ার জন্যে বারবার সতর্ক করছে ব্যাটারি চালিত ওয়ার্নিং বাতি।

অ্যাভিনিউ ডিঅস্টেণ্ডের টু-ওয়ে রোডে পড়ল রানা। টিলা বেয়ে রকেটের বেগে নেমে যেতে লাগল বন্দরের দিকে। খুব ব্যস্ত রাস্তা। হঠাৎ করেই সামনে হাজির হলো এক রেঞ্জ রোভারের পেছনদিক। কষে ব্রেক করেছে ওই ড্রাইভার। রানাও চাপল ব্রেক প্যাডেল। আটকে গেল ওর গাড়ির চার চাকা। তবুও চলেছে পিছলে। রেসিং কারের সামনের ফেণ্ডার ধুম করে লাগল রেঞ্জ রোভারের পেছনের চাকায়। ছিঁড়ে দিল সামনের গাড়ির রাবারের টায়ার।

ভুম শব্দে ফাটল চাকা। রাস্তায় ঘষা খেল রেঞ্জ রোভারের অ্যালয় হুইলের রিম।

দুঃখিত! বিড়বিড় করল রানা। তবে কার্বন ফাইবারের ধারাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে রেসিং কারের চাকাও। থরথর করে কাঁপছে। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পরের গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে গেল রানা। প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে মার খাওয়া গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা।

তার চেয়েও খারাপ সংবাদ পেয়ে গেছে রানা।

ইঞ্জিনের বিকট শব্দ ছাপিয়ে এল পুলিশের সাইরেনের হাহাকার। রাস্তার আর সব গাড়ি বাদ দিয়ে ওকে খুঁজে নিতে সময় লাগবে না অফিসারদের!

ধরা পড়ার আগেই পৌঁছুতে হবে বন্দরে।

অপেক্ষাকৃত উঁচু সব গাড়ির কারণে সামনের রাস্তা প্রায় দেখছেই না রানা। বোঝার উপায় নেই কোন গাড়ি উঠছে টিলা বেয়ে। টিভিতে দেখেছে, একটু সামনে প্রথমবারের মত বাঁক।

চুলের কাঁটার মত তীক্ষ্ণ ওটা।

সর্বনাশ! বিড়বিড় করল রানা। প্রথম গিয়ারেও ষাট মাইল বেগে অন্যসব গাড়ির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে। ওর গাড়ি। সামনেই সেইন্ট ডেভোট কর্নার, অতিব্যস্ত রাস্তার অন্তচ্ছেদ।

তবে সামনে সোজা চলে যাওয়া পথ দেখল রানা। হুঁ–ই ই শব্দ তুলল রেসিং কারের ইঞ্জিন। ত্যাগ করছে হাই প্রেশারের নাইট্রোজেন। কিন্তু তখনই রিম থেকে খসে গেল সামনের ক্ষতিগ্রস্ত একটা চাকা।

চরকির মত ঘুরল রেসিং কার। পিছলে গিয়ে পেছনের দিক লাগল এক ফেরারি গাড়ির পেটে। আরেক পাক খেয়ে চৌরাস্তার মাঝে পৌঁছে গেল রানা। আবছা চোখে দেখল, ঝড়ের বেগে আসছে ওদিকের ক্র্যাশ ব্যারিয়ার।

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ও।

একইসময়ে পাশ থেকে ব্যারিয়ারের গায়ে চেপে বসল গাড়ি। মুহূর্তে চ্যাপ্টা হলো ইমপ্যাক্ট-অ্যাবর্নিং বডিওয়ার্ক। এখনও চরকির মত ঘুরছে গাড়ি। ছিটকে গেল রাস্তার মাঝে। বিধ্বস্ত রেসিং কারের সঙ্গে দুর্ঘটনা এড়াতে সরে যাচ্ছে অন্যান্য গাড়ি। তবে টিলা বেয়ে উঠে এসে কড়া ব্রেক কষল এক বড় ভ্যান। সোজা গেল রানার গাড়ির দিকে।

তবে পাঁচ সেকেণ্ড পর একইসময়ে থামল মুখোমুখি দুই গাড়ি। রেসিং কার নাক খুঁজেছে ভ্যানের সামনের বাম্পারের নিচে।

ককপিটের কোনা লেগে কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে রানা। অবশ্য, ঠিকই কাজ করেছে গাড়ির সেফটি ফিচার। এই দুর্ঘটনা থেকে হেঁটে সরে যেতে পারবে ও। অবশ্য, বনবন করে ঘুরছে মাথা। কয়েক সেকেণ্ড চারপাশ দেখল রানা, তারপর চোখে পড়ল দক্ষিণে স্টার্ট/ফিনিশ সাইনবোর্ড। ওদিকেই বন্দর।

সিয়েস, জেম্স্ বণ্ড! ফ্রেঞ্চ ভাষায় উঁচু গলায় বলে উঠল কে যেন।

মনে মনে বলল রানা, জেম্স্ বণ্ড নই, বাঙালি গুপ্তচর মাসুদ রানা। টের পেল, জমছে ভিড়। পরনে ওর টুক্সেডো, গাড়ি দুর্ঘটনা করেছে মোনাকোর মাঝে, এটা খুব অস্বাভাবিক কিছুই নয়।

ফেরারির ড্রাইভার বড় বড় চোখে দেখছে নিজের গাড়ির ক্ষত-বিক্ষত পেট। রেসিং কার থেকে নেমে পড়ল রানা, জগিং করে বন্দর লক্ষ্য করে রওনা হওয়ার আগে বলল, বিলটা পাঠিয়ে দেবেন ওসাইরিয়ান টিমের কাছে!

ব্যারিয়ার টপকে ভিড়ের মাঝে দেখতে না দেখতে উধাও হলো রানা। তখনই দুর্ঘটনার অকুস্থলে হাজির হলো পুলিশের প্রথম গাড়ি।

.

বদমাসটা গাড়ি চুরমার করে ফেলেছে? দুঃখে কালো হয়ে গেছে কাদির ওসাইরিসের মুখ। এইমাত্র ফোন করে এসব বলেছে তার ছোটভাই। ধরতে পেরেছ লোকটাকে? উত্তর নেতিবাচক। তা হলে অন্তত তাকে ধরেছে পুলিশ? আবারও না-সূচক জবাব পেল কাদির। বাহ! কীসব খুশির খবর!

স্বস্তি চাপতে গিয়ে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে লাবনীর। নাক বাঁকা করে বলল, ওই লোক পৃথিবীতে এসেছে সব ধ্বংস করতে! সম্পর্ক… জীবন… রেসিং কার…।

বুঝলাম, কীজন্যে ওর হাত থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছ, বিড়বিড় করল কাদির ওসাইরিস। আবার মনোযোগ দিল ফোনের দিকে। আমি আমুন রা ইয়টে ফিরছি। …হ্যাঁ, সঙ্গে ডক্টর লাবনী আলম। …না, নাদির, আবারও ওই একই কথা শুনতে চাই না। …দলের সবাইকে নিয়ে কাজে নেমে পড়ো। ওই মাসুদ রানাকে খুঁজছে পুলিশ। তাদের রেডিয়ো মনিটর করো। ওকে হাতে চাই। নাদির মাকালানির কথা শুনছে কাদির ওসাইরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, শুধু বাধ্য হলে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চাই না। অন্তত আজ রাতে নয়। মাসুদ রানাকে ধরে এনে তুলবে ইয়টে।

কাদির ফোন রাখতেই আপত্তির সুরে জিজ্ঞেস করল লাবনী, বদমাসটাকে খুন করবে না? কাঁপছে ওর বুক।

পার্টির ধ্বংসাবশেষ দেখল কাদির ওসাইরিস। এসব কেন ঘটল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জান যাবে আমার। তার ওপর এখন চাই না টিভিতে বলুক, মাসুদ রানা নামের এক ফালতু লোককে খুন করে গ্রেফতার হয়েছে নাদির মাকালানি!

মাসুদ রানাকে হাতে পেলে তখন কী করবে?

দাঁতে দাঁত পিষল কাদির ওসাইরিস। মেডিটারেনিয়ান যেমন বড়, তেমনি গভীর।

ও… তা হলে আর ওই লোককে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না আমাকে।

শীতল চোখে লাবনীকে দেখল কাদির। ঠিক আছে, ভেঙে গেছে পার্টি। জানি না দেখার জন্যে তৈরি হয়েছে কি না যোডিয়াক, তবে এখন আমরা ফিরব ইয়টে। একমিনিট অপেক্ষা করো। কয়েকজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।

একটু দূরে গিয়ে একদল লোকের সঙ্গে আরবিতে কথা শুরু করল কাদির। এই সুযোগে দরজার কাছে গেল লাবনী। দর্শকদের ভেতর বেলাকে দেখে হাতের ইশারায় ডেকে নিল।

মাসুদ রানা কোথায়? জানতে চাইল বেলা। উনি ঠিক আছেন তো?

একটা রেসিং গাড়ি নিয়ে সরে গেছে।

হাসল বেলা। সত্যিই ওই লোক দুর্দান্ত সুপুরুষ!

আমারও তাই ধারণা, উঠানে চোখ বোলাল লাবনী। এখনও আলাপে ব্যস্ত কাদির ওসাইরিস। বেলা, শুনলে অবাক লাগবে, কিন্তু সত্যি কথা হলো, এটা এখন তোমার জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। রানাকে খুঁজতে গেছে নাদির মাকালানি ও কিলিয়ান ভগলার। এদিকে যোডিয়াক দেখাতে আমাকে ইয়টে নেবে কাদির ওসাইরিস।

ঠিক আছে। কিন্তু ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে গেলে? তখন কী করব? হোটেল রুমও পাব না। আমার পাসপোর্ট সঙ্গে নিয়ে গেছেন মাসুদ রানা!

আপাতত আমার কিছু করার নেই, বেলা। পেছনে তাকাল লাবনী। ওকে খুঁজছে কাদির ওসাইরিস। একটা উপায় বের করে নেবে। এবার আমাকে যেতে হচ্ছে। রানা বা আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলে, একটু দূরের ওই হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করবে। আমরা তোমাকে খুঁজে নেব।

খুব অখুশি হলো বেলা। দুসেকেণ্ড পর মাথা দোলাল। গুড লাক, ডক্টর আলম। সাবধানে থাকবেন।

তুমিও সতর্ক থেকো। উঠানে ঢুকে ওসাইরিসের পাশে থামল লাবনী। আমরা কি এবার ফিরব?

গাড়ি আসছে, পৌঁছে দেবে বন্দরে। সঙ্গীদের উদ্দেশে নকল হাসি দিল কাদির ওসাইরিস। বন্দরে যেতে সময় লাগবে। সেইন্ট ডেভোটিতে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এ কথা শুনে শুকনো কাঠফাটা হাসি হাসল কেউ কেউ।

লাবনীর কনুই ধরে আবারও ক্যাসিনোয় ঢুকল কাদির ওসাইরিস। পিছিয়ে পথ করে দিল অ্যাটেণ্ড্যান্টরা। সেই সুযোগে উঠানে বেরিয়ে গেল বেলা। কেউ চেনার আগেই চলল হোটেলের দিকে। চাকার ধোঁয়া তুলে সেরা আকর্ষণ বিদায় নেয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে পার্টি।

অবশ্য নতুন এক আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছে বেলা। রেসিং ওভারঅল পরা সোনালি চুলের রনি রুবিল্যাক আছে রাস্তার পাশে। বয়স্ক দুই লোকের সঙ্গে উত্তেজিত সুরে কথা বলছে। বেলা বুঝল, এই তরুণ রেসের ড্রাইভার না হয়েই যায় না। সামনে গিয়ে হাজির হলো ও। বলবেন এখানে কী হয়েছে?

বিরক্ত চোখে ওকে দেখল রনি রুবিল্যাক। তবে পরক্ষণে টের পেল, দারুণ সুন্দরী এই তরুণী। সবচেয়ে বড় কথা, এই মেয়ে মধ্যবয়স্ক স্পন্সরের কেউ নয়। ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে না। দমে যাওয়া সুরে বলল রনি, ভয়ঙ্কর ঘটনা! ডাকাতি করে নিয়ে গেছে আমার গাড়ি। লোকটার হাতে ছিল কুচকুচে কালো রিভলভার! আমি ঠেকাতে চেয়েছি, কিন্তু তখনই সাহস হারিয়ে পালিয়ে গেছে। মিটমিট করে হাসছে। তার বয়স্ক দুই সঙ্গী। দলের তারকাকে অপমান করতে চায় না।

মাই গড! আপনি এত বড় ঝুঁকি নিলেন কী করে? ঠিক আছেন তো? ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বেলা।

সারাশরীর ছড়ে গেছে, কিন্তু ঠিকই আছি। কাল রেসেও নামব। এবার বোধহয় হোটেলে ফেরা উচিত। অবশ্য… চওড়া হাসি দিল রুবিল্যাক। তার আগে তোমার সঙ্গে দুটো ড্রিঙ্ক নিলে মন্দ হয় না। সঙ্গিনী হবে আমার?

খুশি হয়ে বলল বেলা, আমার কোনও আপত্তি নেই!

.

১৭.

 হাজারো রঙিন বাতির আলোয় ঝলসে উঠছে বন্দর, যেন ব্যস্ত শহরেরই অংশ। দালানগুলোর খুব কাছেই একের পর এক জেটি, পাশেই কালো জলে ভাসছে সারি সারি দামি ইয়ট।

চট করে কাদির ওসাইরিসের দিকে তাকাল উদ্বিগ্ন লাবনী।

এইমাত্র তীরে ভিড়েছে আমুন রা ইয়টের টেণ্ডার।

ও ভেবেছিল, কাছেই থাকবে রানা। পিছু নেবে। গিয়ে উঠবে ইয়টে। কিন্তু ভাসমান এসব প্রাসাদের আশপাশে কোথাও নেই মানুষটা।

ভয় লাগছে লাবনীর।

 রানাকে ধরে ফেলল পুলিশ?

নাকি আরও খারাপ কিছু হয়েছে?

রানাকে মেরে ফেলেছে নাদির মাকালানি?

আনমনে মাথা নাড়ল লাবনী। সহজে রানাকে ধরতে পারবে না এরা। তা ছাড়া, ওকে ধরে আনতে বলে দিয়েছে কাদির ওসাইরিস।

রানা এখন কোথায়?

দূর সাগরে তাকাল লাবনী। দেখা গেল, ওদিকে আধমাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে আমুন রা।

নিশ্চয়ই ওখান থেকে ওকে উদ্ধার করবে রানা?

ওর নিজের সাধ্য নেই সাগর পেরিয়ে তীরে এসে উঠবে।

কাদির ওসাইরিসের সঙ্গে টেণ্ডারে লাবনী উঠতেই ডিজেল ইঞ্জিনের চাপা গর্জন ছেড়ে রওনা হলো বোট। সন্ধ্যায় গরম ছিল বাতাস, কিন্তু এখন সাগরে বইছে শীতল হাওয়া। খোলা বাহু ডলল লাবনী।

এই যে, নিজের জ্যাকেট খুলে ওর কাঁধে চাপিয়ে দিল কাদির ওসাইরিস।

ধন্যবাদ, বিড়বিড় করল লাবনী। ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপছে। রানার কিছু হয়ে গেল কি না, সেজন্যে দুরুদুরু করছে বুকটা।

বিলাসবহুল সব ইয়ট পেরিয়ে পোর্ট হারকিউল বন্দরের ইনার হার্বার পেরোল টেণ্ডার। সামনে পড়ল কুচকুচে কালো মেডিটারেনিয়ান সাগর। বন্দর ও কংক্রিটের বাঁধ পেছনে ফেলে জোরালো স্রোতে পড়ল দুলন্ত বোট। গতিপথ অ্যাডজাস্ট করল পাইলট।

বিশাল ঢেউয়ের বিক্ষুব্ধ সাগর সাঁতরে তীরে উঠতে পারবে না, বুঝে গেছে লাবনী। খোলে লেগে ছিটকে উঠছে ঢেউ ও ফেনা। বোটে বাড়ি খেয়ে প্রতিবার ঠং-ঠুং শব্দ তুলছে নোঙরের শেকল।

তীরের দিকে তাকাল লাবনী। তিন দিক থেকে ঘিরে রাখা টিলার কোলে ঝলমল করছে মোনাকো। দেখার মত দৃশ্য। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণে কিছুই ভাল লাগছে না ওর।

তীর থেকে দূরে নোঙর করেছে কিছু জলযান। তবে অন্যসব মেগা ইয়টের চেয়েও বড় আমুন রাঁ। মস্তবড় ইয়টের স্টার্নে চওড়া মুরিং প্ল্যাটফর্মে ভিড়ল টেণ্ডার। পাশেই দুটো ছোট স্পিডবোট এবং বেশ কয়েকটা জেট স্কি।

ইয়টের এক ক্রু বোটের দড়ি বেঁধে নেয়ায় উঠে দাঁড়াল কাদির ওসাইরিস, লাবনীর হাত ধরে পা রাখল ইয়টের ডেকে। নরম সুরে বলল, পুরো সময় সুন্দর না কাটলেও খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গ।

আমারও খুব ভাল লেগেছে, বলল লাবনী। আর… সরি… তোমার এত ক্ষতি করে দিল মাসুদ রানা! তাকে বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু শুনবে না। ওর মত বাজে লোক জীবনে দেখিনি আমি!

ওর জন্যে তোমাকে দোষ দেবে না কেউ, নির্দ্বিধায় বলল কাদির ওসাইরিস। আর আর্থিক ক্ষতির কথা যে বলছ, ওটা কিছুই নয়। একবার ওসাইরিসের পিরামিড পেলে পুষিয়ে নেব তার হাজার কোটি গুণ!

সেক্ষেত্রে বোধহয় সময় নষ্ট না করে দেখা উচিত ওই যোডিয়াক? বলল লাবনী।

ইয়টের ওপরের ডেকে উঠল ওরা।

লাবনীকে নিয়ে ভেতরের এক দরজার সামনে থামল কাদির ওসাইরিস। এটা আমার কেবিন। ভেতরে অপেক্ষা করবে তুমি। দেখে আসছি যোডিয়াক তৈরি কি না।

লাবনী ঘরে ঢুকে বুঝল, ওর অ্যাপার্টমেন্টের চেয়েও বড় এ কেবিন। আরও প্রকাণ্ড লাগছে সংলগ্ন বাথরুম ও ওয়াক ইন ক্লযিটের জন্যে। বিশাল বেডের ওপরের ছাতে নিখুঁত আয়না। প্রতিটি দুর্মূল্য জিনিস জাহির করছে: এই ইয়টের মালিক সত্যিকারের প্লেবয়। সুইটয়ারল্যাণ্ডের দুর্গের কথা মনে পড়ল লাবনীর। এই কেবিনে অবশ্য মেঝেতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছাল নেই। দারুণ সুন্দর কেবিনটা! না বলে পারল না লাবনী।

ঘরের আরেকদিকের দরজার কাছে চলে গেছে কাদির, ঠোঁটে মৃদু হাসি। আরাম করে বসো। দুই মিনিটের ভেতর ফিরব।

বেডের এক কোণে বসল লাবনী।

দেড় মিনিট পর ফিরল কাদির ওসাইরিস। আরও চওড়া হয়েছে হাসি। খুলল ভাঁজ করা এক দরজার ছিটকিনি। ওদিকে দেখা গেল আরেকটা বড় ঘর। যোডিয়াক তৈরি।

উঠে ওই দরজার দিকে চলল লাবনী। পাশ কাটাল কাদির ওসাইরিসকে। প্রথমবারের মত দেখল সম্পূর্ণ যোডিয়াক।

কাজটা যেই করুক, ভালভাবেই জোড়া দিয়েছে। ছয় ফুটি বৃত্তাকার পাথরের যোডিয়াক এখন নিচু এক স্ট্যাণ্ডে। যোডিয়াকের ওপরে স্বচ্ছ বুলেটপ্রুফ লেক্সান। খুব কাছে না। যাওয়া পর্যন্ত হল অভ রেকর্ডস থেকে কেটে আনার চিহ্ন চোখে পড়ল না লাবনীর।

দেখার মতই সুন্দর যোডিয়াক। লুভরেরটার চেয়ে একটু ছোট। প্রাকৃতিক অত্যাচার ছিল না বলে স্ফিংসের ভেতর ক্ষতি হয়নি ওটার। কালচে পটভূমির মাঝে নানান রঙে ঝিকমিক করছে প্রতিটি নক্ষত্রমালা। ফ্যাকাসে নীল দিয়ে বোঝানো হয়েছে আকাশ। ওটা সম্ভবত মিল্কি ওয়ে, ভাবল লাবনী।

এ ছাড়া রয়েছে নানান চিহ্ন। যেমন একটা লাল বিন্দু। ওটা মঙ্গল। বেলার ফোটোতে দেখেছে লাবনী। আরও আছে। সৌরজগতের অন্য কয়েকটি গ্রহ। ওসাইরিসের ছোট প্রতাঁকের খুব কাছে হলদে এক ত্রিকোণ আকৃতির ওপর চোখ গেল ওর।

ওটা একটা পিরামিড। ওসাইরিসের।

ঝুঁকে দেখল লাবনী। পিরামিডের খুব কাছে অস্পষ্ট রঙে আঁকা খুদে অক্ষর: হায়ারোগ্লিফ।

ঘুরে উত্তেজিত চোখে কাদির ওসাইরিসকে দেখল লাবনী। এটা আগেই দেখেছ?

অবশ্যই, বড় এক টেবিলের সামনে থামল কাদির। ল্যাপটপের পাশ থেকে নিল প্রিন্টআউট। যোডিয়াক টুকরো অবস্থাতেই অনুবাদ করিয়ে নিয়েছি। এসব হায়ারোগ্লিফে আছে দিক নির্দেশনা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোথা থেকে শুরু করতে হবে, তা জানি না। আর সেজন্যেই তোমার সাহায্য এত দরকার।

অনুবাদ করা লেখা লাবনীর হাতে দিল সে।

পড়ল লাবনী, ওসাইরিসের দ্বিতীয় চোখ থেকে যেতে হবে রুপালি গভীর খাদে। বুধগ্রহ থেকে যেতে হবে এক আতুর, তাতেই পাওয়া যাবে অমর দেবতা-রাজার সমাধি। আতুর বোধহয় প্রাচীন মিশরীয় সংখ্যার একক। ঠিক?

এগারো হাজার পঁচিশ মিটার।

মনে মনে হিসাব কষল লাবনী। কসেকেণ্ড পর বলল, তার মানে ছয় পয়েন্ট আট-পাঁচ মাইল। কপালে ভুরু তুলল কাদির ওসাইরিস। অঙ্কে খারাপ নই। হাসল লাবনী। অর্থাৎ, রুপালি গভীর খাদ বা ক্যানিয়ন থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে বুধগ্রহের দিকে গেলেই ওই পিরামিড। কিন্তু জানতে হবে এই যোডিয়াকের গ্রহগুলোর ভেতর কোটা বুধগ্রহ।

ঠিক তা পাবে না, বলল কাদির, এই যোন্ডিয়াকে আছে মঙ্গল, শনি ও বৃহস্পতি। আঙুল তুলে ওগুলো দেখিয়ে দিল সে। ওগুলোর পযিশন হিসাব কষে বের করেছি বুধগ্রহের পযিশন। এই যে, ওটা এখানে। পিরামিডের কাছে নির্দিষ্ট এক জায়গা দেখাল ধর্মগুরু।

তো ক্যানিয়নের শেষে প্রায় সাত মাইল পুবে পিরামিড। কিন্তু… দেয়াল আয়না দেখাল লাবনী। আমরা যেহেতু দেখব মানচিত্র ওপর থেকে, কাজেই ওই জায়গা আছে সাত মাইল পশ্চিমে।

খুশি হয়ে মাথা দোলাল কাদির। ঠিক। তবে আগে খুঁজে বের করতে হবে রুপালি গভীর খাদ।

অর্থাৎ, আগে চাই ওসাইরিসের দ্বিতীয় চোখ। তা হলে জানতে হবে, প্রথম চোখ কোটা। …তোমার জানা আছে?

যোডিয়াকে সবমিলে আছে ওসাইরিসের দুটো প্রতীক, বলল কাদির ওসাইরিস। হয়তো দুটো মিলেই নির্দিষ্ট কোনও দিক দেখাচ্ছে?

মনোযোগ দিয়ে দুই প্রতীক দেখল লাবনী। মিশরের প্রাচীন সব নক্সার মত। একটা করে চোখ। বড়জোর বিন্দুর মত। দুই প্রতাঁকের মাঝে মনে মনে একটা রেখা তৈরি করল লাবনী। কিন্তু কোনওভাবেই পিরামিডের দিকে গেল না ওটা।

মনে হচ্ছে ওসাইরিসের চোখ বিশেষ সঙ্কেত, তাই না? জানতে চাইল লাবনী।

মাথা দোলাল কাদির ওসাইরিস। নিরাপত্তা চিহ্ন। মন্দিরে পাওয়া যায়। বা সমাধিতে। দেখিয়ে দেয় কীভাবে যেতে হবে প্রেতলোকে।

ওসব সহজেই মেলে। তার আরেক মানে, সহজ হবে না কাজ। যযাডিয়াকের দিকে তাকাল লাবনী, ভাবছে। রুপালি ক্যানিয়ন কোনও সূত্র হতে পারে? প্রাচীন মিশরীয়রা সোনার চেয়ে মূল্য দিত রুপাকে। সেক্ষেত্রে কি রাজ বংশের পত্তনের আগে মিশরে কোনও রুপার খনি ছিল?

জানি না। ইতিহাস তোমার জানার কথা, আমার নয়।

কথা ঠিক। আরও রিসার্চ করতে হবে। সেজন্যে চাই আর্কিওলজিকাল ডেটাবেস। জটিল এই রহস্য লাবনীর বুকে তৈরি করেছে পেশাদারী উত্তেজনা। প্রায় ভুলেই গেছে, যাকে ঠেকাতে চায়, তাকেই সাহায্য করার চেষ্টা করছে।

তুমি ঠিক আছ তো? জানতে চাইল কাদির ওসাইরিস।

আসলে… সারাদিন উত্তেজনার ভেতর থেকেছি, বলল লাবনী। বড় ক্লান্তি লাগছে।

হাসল ধর্মগুরু। সত্যিই দুঃখিত। আমার বোঝা উচিত ছিল। আজ রাতেই এই ধাঁধা সমাধান করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। তা ছাড়া, আগামীকাল রেস। আশা করি ট্রাকে তুমি আমার সঙ্গে যাবে।

ভাল লাগবে, মিথ্যা বলল লাবনী। মন খারাপ, বিকট আওয়াজের গাড়িগুলোকে সহ্য করতে হবে।

গুড। তো এসো, এক গ্লাস শ্যাম্পেইন খেয়ে যে যার মত বিদায় নিই।

ইয়ে… আমার গিয়ে শুয়ে পড়াই ভাল। একবার একা হলে রানার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবে লাবনী।

মাত্র এক গ্লাস, প্লিয, নরম স্বরে বলল কাদির। পাশের ঘরে এক বোতল ভিউভ ক্লিকো রেখেছি। মন খারাপ হবে ওটা একা খেতে হলে।

তোমার ওসব… পতিতা প্রায় বলে ফেলেছিল লাবনী, নিজেকে সামলে বলল, তরুণী বান্ধবীদের কী হলো?

আমার পূজারিণীরা? মাথা নাড়ল কাদির। ওরা সুন্দরী, তবে ওদের চেয়ে অনেক বেশি ভাল লাগে বুদ্ধিমতী কাউকে। সে হবে এমন কেউ, যার জীবনে আছে অনেক কাহিনী। যেমন তুমি। আজও জানতে পারিনি কীভাবে আবিষ্কার হলো আটলান্টিস। মিষ্টি করে হাসল কাদির। মাত্র এক গ্লাস, ঠিক আছে?

.

একঘণ্টা গল্পের পর তৃতীয় গ্লাস শ্যাম্পেইন গলায় ঢালল কাদির ওসাইরিস। সত্যি, তোমার জীবনও আমার মতই, একের পর এক অভিযান। কপাল ভাল, আমাদের পাশেই আছে ভাগ্যদেবী।

আমার ভাগ্য অতটা ভাল নয়, বলল লাবনী। বেডের কিনারায় বসে আছে।

পাশে আয়েস করে শুয়ে পড়ল কাদির ওসাইরিস। আর কখনও দুশ্চিন্তা করবে না। একবার ওসাইরিসের পিরামিড পেলেই জীবনে যা চাইবে, তার সবই পাবে।

সেই প্রথম গ্লাস শ্যাম্পেইনেই মৃদু চুমুক দিল লাবনী। তা হলে কাদিরের আয়ু বর্ধনকারী পাউরুটি পাব নিয়মিত?

যা চাইবে, তাই পাবে।

শুনে খুশি হলাম। ভুরু কুঁচকে গেল লাবনীর। ভাবছে সুইটযারল্যাত্রে ওই ল্যাবের কথা। ওই পাউরুটি খাওয়া কি নিরাপদ হবে? তুমি না বলেছ, ওটা জেনেটিক্যালি মডিফাই করবে?

হাসল কাদির ওসাইরিস। সম্পূর্ণ নিরাপদ হবে। আমি নিজেই খাব! তবে জেনেটিক্যালি বদলে দেব অন্যদের জন্যে। যা চাইব, তাই তৈরি করে দেবে বিজ্ঞানীরা।

কী বানাবে তারা? নাকি তুমি এসব আমাকে বলে দিলে ধমক খাবে তোমার ভাইয়ের কাছে?

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল কাদির ওসাইরিস। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নই, নাদির আছে টেম্পলের দায়িত্বে! তা কিন্তু সত্যি নয়। মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক ও। আসলে জেনেটিক্যালি পাল্টে নেব, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে কপিরাইট করাতে পারি নতুন ওই অর্গানিযমকে। পেটেন্টও নেব। ইস্ট গজিয়ে নেয়া সহজ। চাই না ওসাইরিসের পাউরুটি তৈরি করুক আর কেউ। আইনের কারণে ওসাইরিয়ান টেম্পলের কাছ থেকেই কিনতে হবে ওই জিনিস। চতুর হাসল কাদির। দেখতে তাকে লাগল ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত। তা ছাড়া, চাইব না ঠিকভাবে মানুষের কোষ মেরামত হোক। সবাই বছরে মাত্র একবার ওই পাউরুটি খাবে, তা হলে আমার চলবে না। প্রতি সপ্তাহ বা তিন দিনে আমার কাছ থেকে কিনতে হবে।

তার মানে বড়শিতে আটকে নেবে সবাইকে?

কাঁধ ঝাঁকাল কাদির। তাতে কম পাবে না মানুষ, সামান্য পয়সায় হয়ে উঠবে প্রায় অমর। ড্রাগ, সিগারেট বা মদের পেছনে খরচ করবে কেন? তার চেয়ে ওই টাকা দেবে ওসাইরিয়ান টেম্পলকে! দাঁতব্য নানান কাজে খরচ করব আমরা ওই টাকা।

ওসাইরিয়ান টেম্পলের কথা শুনে চলবে যেসব দেশ, তারাই পাবে ওই পাউরুটি, ভাবল লাবনী। ও, তা হলে তুমি চাও না সবাই অমর হোক?

সহজ কথা, বুঝতে পারোনি? হাসল কাদির। ওসাইরিস চেয়েছিল অমর হতে। তাকেই অনুসরণ করছি। আমার তো ধারণা, দুনিয়ার মানুষ প্রশংসা করবে আমাকে। আর যাই হোক, আমিই তো এনেছি প্রায় অমর হওয়ার ওষুধ। আধ শোয়া হয়ে গ্লাস শেষ করল সে। আরেক গ্লাস নাও?

নিজের গ্লাস দেখাল লাবনী। এখনও একটু আছে। আমার বোধহয় উচিত হবে না আর নেয়া।

নিলে কী হবে? কিছুই না! পিছলে বেড ছেড়ে নেমে পড়ল কাদির ওসাইরিস।

চিন্তায় পড়ে গেছে লাবনী। মাতাল হয়ে উঠছে লোকটা। এবার যে-কোনও সময়ে জাপ্টে ধরবে ওকে।

খুবই খুশি হব আমার সঙ্গে আরেক গ্লাস নিলে। মার্বেলের তৈরি বারের ওদিকে গেল কাদির। ফ্রি খুলে বের করল নতুন শ্যাম্পেইনের বোতল। ওটা রাখল বারের ওপর। এক্সকিউয মি, এক্ষুণি টয়লেট থেকে ফিরছি।

পাশের দুর্দান্ত সুন্দর টয়লেটে ঢুকল সে। বিশাল আয়নায় মুগ্ধ হয়ে দেখল নিজেকে। খুলে ফেলল পোশাক। পরনে শুধু সিল্কের জাঙ্গিয়া। গায়ে চাপিয়ে নিল সিল্কের গাউন। গলা ও বুকে স্প্রে করল দামি কোলন। ছোট কাজ সেরে বেরিয়ে এল টয়লেট ছেড়ে। হেসে ফেলল খুশিতে। প্রায় নিভিয়ে দেয়া হয়েছে ঘরের সব বাতি জ্বলছে ডিম লাইট। বেডের চাদরের নিচে পরিচিত, সুন্দরী যুবতীর লোভনীয় দেহ!

আহ্, একেই বলে স্বর্গসুখ!

একটু টলতে টলতে বেড়ে উঠল কাদির। ভাল লাগছে, আরাম করে শুয়েছ। নিজেও নিঃশব্দে সেঁধিয়ে গেল চাদরের নিচে। আবেগী এক চুমু দেবে বলে মুখ নিচু করতেই চমকে দেখল, ঐ-কুঁচকে কঠোর চোখে তাকে দেখছে মাসুদ রানা, মুখে নিষ্ঠুর হাসি!

হাই, এভারগ্রিন রোমিয়ো! হতভম্ব কাদিরের হাঁ করা মুখে ভগলারের রিভলভারের লম্বা নলটা জল রানা।

.

১৮.

আত্মা চমকে যাওয়ায় কালচে পাথর হয়ে গেছে কাদির। উঠে বসে রিভলভারের নলটা মুখ থেকে বের করে তার গলায় ঠেকাল রানা।

প্রথমে মোরগের মত কে করে উঠল কাদির, তারপর নিজেকে সামলে বলল, কু-কী করে?

আমিও খুব অবাক হয়েছি, যোডিয়াকের ঘর থেকে বেরিয়ে এল লাবনী। একটু আগে চোরের মত ঘরে ঢুকে ওদিকের ঘরে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে রানা।

বন্দির ওপর রিভলভার তাক করে গায়ের ওপর থেকে চাদর সরাল বাঙালি গুপ্তচর। ভিজে চুপচুপ করছে পোশাক। জানতাম ইয়টের টেণ্ডার আসবে বন্দরে। পিয়ারের তলায় অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর টেণ্ডারের নোঙরের শেকল ধরে ভেসে এসেছি এখানে।

কঠোর দৃষ্টিতে বিশ্বাসঘাতিনী লাবনীকে দেখছে কাদির। ও, তা হলে তোমরা একই দলের? নাদির ঠিকই বলেছিল!

তাই তো মনে হচ্ছে, বলল লাবনী, ভাবলে কীভাবে উন্মাদ এক ধর্মগুরুর দলে ভিড়ে খুন হব? রানার দিকে তাকাল। এবার কী করব আমরা?

ইশারায় কাদিরকে টয়লেট দেখাল রানা। প্রথম কাজ একে বেঁধে ফেলা। যেন টু-শব্দ করতে না পারে। পরের কাজ পিরামিড কোথায় জেনে সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া।

মাথা দোলাল লাবনী।

ঠিক আছে, লাভার বয়, এবার নেমে পড়ো, তাড়া দিল রানা। সোজা টয়লেটে। নিজে নেমে পড়েছে বেড ছেড়ে।

লাবনীর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না মিশরীয় নায়ক। মেঝেতে পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল, ভেবেছিলাম কারও ক্ষতি করব না, কিন্তু এখন ভাবছিঃ তার উল্টোও করতে পারি।

কথা কম, কাজ বেশি, রানার অস্ত্রের ইশারায় বাথরুমে গিয়ে ঢুকল কাদির। পিঠে ধাক্কা খেতেই তার কনুই লেগে ঝনঝন করে তাক থেকে মেঝেতে পড়ল একরাশ টয়লেট্রি। বসে মাথা নিচু রাখো। ইশারা পেয়ে লোকটা বসল নিচু কমোডের বাউলে। আরেক হাতে টান দিয়ে তার গাউনের বেল্ট খুলল রানা। লাবনী, ওর দুহাত নিয়ে পেছনের ওই নিচের পাইপে বাঁধো। একপাশ থেকে রিভলভার তাক করে রেখেছে ও। নিচে যাওয়ার ময়লার পাইপে ভালভাবে কাদিরের দুই হাত বাঁধল লাবনী। পা বাঁধার মত কিছু নিয়ে এসো।

কেবিনে গিয়ে ঢুকল লাবনী। ফিরে এল রঙিন সব টাই হাতে। রঙ কিন্তু তুমিই বেছে নেবে, কাদির।

আমার আপত্তি আছে। একটা টাই নিয়ে গোল পাকাল রানা। আপত্তি তুলতে হাঁ মেলতেই কাদিরের মুখে গুঁজে দিল ওটা। বড় মুখে লাগবে আরেকটা। কাদিরের মুখে ভরল দ্বিতীয় টাই। এবার তৃতীয় টাই দিয়ে তার দুই পায়ের গোড়ালি বাঁধল বেসিনের পাইপে। লম্পট ধর্মগুরুর মাথায় রিভলভারের নল ঠুকল রানা। এবার মন দিয়ে শোনো, কিং তুত! আওয়াজ করলে তুমি শেষ!

 মুখ ভরা টাই, রাগী গার্গলের আওয়াজ তুলল কাদির।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে কেবিনের দরজা লক করল রানা। ফিরে এল লাবনীর পাশে যোডিয়াকের সামনে। পিরামিডটা পেলে, লাবনী?

এখনও না।

কত সময় লাগতে পারে?

জানি না। তবে ওদিকের টেবিলে কাদিরের লোকদের সংগ্রহ করা ডেটা আছে।

টেবিলের সামনে গিয়ে থামল ওরা।

যোডিয়াক বিষয়ে প্রচুর ডেটা জোগাড় করেছে কাদিরের লোক। ওটা তৈরির সময়ে সব গ্রহের অবস্থানও বের করেছে। সেই হিসাব অনুযায়ী যোডিয়াক তৈরি হয়েছে অক্টোবরে, খ্রিস্টপূর্ব ৫,৫৭৬ সালে। এ তথ্য মিলল বেলার কথার সঙ্গে। খুফুর পিরামিডের অনেক আগেই ছিল স্ফিংস। এ ছাড়াও রানা ও লাবনী পেল নানান নক্ষত্রমণ্ডলীর নাম, রঙের কেমিকেল অ্যানালাইসিস, যোডিয়াকের নিখুঁত মিলিমিটার ডিমেনশন, পাথরের ধরন ইত্যাদি।

সব অর্থহীন, বিড়বিড় করল লাবনী। পাতার পর পাতা ঘটছে।

পাশের কেবিন থেকে ঘুরে এসে জানতে চাইল রানা, পেলে কিছু?

সবই আছে যোডিয়াকের ব্যাপারে, কিন্তু যা চাই, তা নেই। হায়ারোগ্লিফিক্স বলছে: কোথায় গিয়ে পেতে হবে ওসাইরিসের পিরামিড। কাদিরের লোক বুধগ্রহের পযিশন বের করেছে, ওটা সূত্র। কিন্তু অন্যান্য দরকারি তথ্য কোথায় পাব!

অন্যান্য সূত্র কী কী? জানতে চাইল রানা।

রুপালি এক গভীর খাদ, যেটা কোথায় আমরা জানি না। আছে ওসাইরিসের দ্বিতীয় চোখ। সেটাও জানি না কোথায় আছে। জানা নেই প্রথম চোখই বা কোথায় গেল বেয়াক্কেলে লোকটার! যোডিয়াক একচক্কর ঘুরল লাবনী। ভাবছে, পাবে নতুন প্রয়োজনীয় তথ্য। কয়েক মিনিট পর বলল, কোথাও কিছু ভুল করেছি?

যোডিয়াক মিশরীয়, বেলা হয়তো কিছু বুঝবে। টুক্সেডোর ভেতর হাত ভরল রানা। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ। হোটেলের লবিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছি।

ভাল হতো ওকে কোনও হোটেলে তুলে দিতে পারলে। যে সংক্ষিপ্ত পোশাক, শীতে মরেও যেতে পারে। প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে পাসপোর্ট ও মোবাইল ফোন রেখেছে রানা। ভেবেছিল সাগরের পানি ভেতরে ঢুকবে না। কিন্তু ফেটে গেছে ব্যাগ। ভিজে নেতিয়ে পড়েছে বেলা আর ওর পাসপোর্ট। বিসিআই থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট মোবাইল ফোনের কেসিং থেকে টপটপ করে পড়ছে পানি। লাবনী, তোমার মোবাইল ফোনটা আছে তো?

হ্যাঁ। কিন্তু আছে দুই ডেক নিচে আমার কেবিনে। তা ছাড়া, প্রয়োজন না পড়লে জাহাজে ঘুরে বেড়াব না। বিশেষ করে যখন ওটার মালিককে আটকে রেখেছি টয়লেটে।

হুঁ, ভাবছে রানা। কিছু হলেই কাদিরের লোক প্রথমে আসবে এই কেবিনে। তার মানে, আপাতত পাব না বেলার সাহায্য।

নানান কাগজ ঘেঁটে সূত্র বা দরকারি তথ্য খুঁজছে লাবনী। তাক থেকে নিল প্রাচীন মিশরের ওপরে লেখা রেফারেন্স বই। রুপালি ক্যানিয়ন বা ওসাইরিসের চোখের কথা কোথাও লেখা নেই।

বুঝলাম না, হতাশ হয়ে হাল ছাড়ল লাবনী। অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর আবার গেল যোডিয়াকের সামনে। এটা কোথায় যেতে বলেছে? নক্ষত্রের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে। নক্ষত্রমালা পেয়েছি। মিল্কি ওয়ে। গ্রহ। কিন্তু এসব মিলে কী বুঝব? ওই যে যযাডিয়াকে এঁকে রেখেছে পিরামিড। দেখিয়ে দিয়েছে কোন্ দিকে যেতে হবে। কিন্তু জানব কী করে কোথা থেকে রওনা হতে হবে?

একটা কথা বলব, ম্যাডাম? জানতে চাইল রানা।

কী?

তোমার ওই যোডিয়াকে ওটা কিন্তু মিল্কি ওয়ে নয়।

হালকা নীল ছাপ দেখল লাবনী। নয়?

না। ওটার শেপ অন্যরকম। দেখতে অন্যরকম হয় মিল্কি ওয়ে।

ওটা যদি মিল্কি ওয়ে না হয়, তা হলে কী? সেক্ষেত্রে নক্ষত্রের মানচিত্রে ওটা দেবে কেন?

মাথা নাড়ল রানা। ওটা আসলে নক্ষত্রের ম্যাপই নয়। আয়নার সামনে চলে গেছে। নক্ষত্র রাখলেও জিনিস অন্য। ওর মুখে ফুটে উঠেছে রহস্যময় হাসি। এবার দেখো কী হয়। তাক থেকে অ্যাটলাস নিল রানা। পাতা খুলে কী যেন খুঁজছে।

যোডিয়াকের প্রতিবিম্ব দেখছে লাবনী। কী দেখব?

এটা। অ্যাটলাস থেকে নির্দিষ্ট ম্যাপ বের করেছে রানা। কাগজে শুয়ে আছে মিশর। ওর আঙুল নামল একটা নদীর ওপর। উত্তর থেকে গেছে দক্ষিণে। কিছু বুঝতে পারছ?

ম্যাপের দিকে তাকাল লাবনী, তারপর দেখল আয়না। কসেকেণ্ড পর আবারও দেখল ম্যাপ। বুঝে গেছে। একই নদী! হায়, আল্লা, ওটা তো নীল নদ!

যোডিয়াক ছাতে থাকলে, দেখতে পাবে উল্টো নীল নদ। কাগজে এঁকে নিলে সাধারণ মানচিত্রে পাবে একই জিনিস।

প্রায় ছুটে গিয়ে যোডিয়াক দেখল লাবনী। নির্দিষ্ট আঁকাবাঁকা রেখায় চোখ। হ্যাঁ, উত্তরদিকে নীল নদের ব দ্বীপ। সেক্ষেত্রে উল্টোদিকে… রানা, অ্যাটলাসটা আনবে?

এগিয়ে লাবনীর জন্যে মানচিত্র খুলে ধরল রানা। তবে আঁকা রেখার সঙ্গে তফাৎ আছে প্রতিবিম্বের।

কয়েক সেকেণ্ড পর বলল লাবনী, একই ব-দ্বীপ নয়। পুরনো আমলের মানচিত্রে আরও নদী ছিল।

নীল নদের সেসময়ে আরও মুখ ছিল, পরে বুজে গেছে, বলল রানা। যোডিয়াকের নদের উজান দেখাল। ওই যে, ভ্যালি অভ কিংস্-এর কাছে বাঁক নিয়ে অন্যদিকে গেছে।

লেক্সান কাঁচে টোকা দিল লাবনী। এই ওসাইরিসের প্রতীক কিন্তু ডেনডারা যযাডিয়াকে ছিল না। এবার বুঝলাম, কোথায় ওসাইরিসের চোখ!

মনে মনে যোডিয়াকের সঙ্গে অ্যাটলাসের মানচিত্র মেলাল রানা। প্রতাঁকের মাথা তাক করা নদের উত্তরে। ওদিকে আছে আল বালায়ানা।

আরও কিছু আছে। একটু দূরের কফি টেবিল থেকে ছবির বই নিল লাবনী। ওটা ছিল প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। উল্টে সঠিক পাতা খুলল। অ্যাবাইদোস। ওসাইরিসের শহর!

ছবিতে বেশ কয়েকটা বিশাল ধ্বংসাবশেষ।

মিশরে যাওয়ার পর খুঁজে নেব রুপালি ক্যানিয়ন, বলল রানা।

মাথা দোলাল লাবনী। সাত মাইলের মধ্যে পড়বে ওই পিরামিড। ওসাইরিসের শহরেই আছে তার দ্বিতীয় চোখ। যোডিয়াকের প্রতীক দেখাত অ্যাবাইদোসকে। হয়তো মুছে গেছে হায়ারোগ্লিফ, বা ছিল বিশেষ কোনও বিন্দু, দেখাত রুপালি ক্যানিয়ন। নিশ্চয়ই অ্যাবাইদোসেই আছে ওসাইরিসের আসল প্রতীক বা চোখ দেখাবে গন্তব্য। অবশ্য, জানি না শহরের কোথায় আছে ওই চোখ। বেলা হয়তো জানে।

তো চলো, ইয়ট ছেড়ে শহরে ফিরি, বলল রানা, দেখছে যোডিয়াক।

 ঘন-ঘন মাথা নাড়ল লাবনী। ভাল করেই চেনে রানাকে। না! খবরদার, রানা!

কী? ভুরু নাচাল রানা।

ভুলেও ভাঙচুর চলবে না যোডিয়াক!

 এটা না পেলে ওসাইরিসের পিরামিড পাবে না কাদির।

সব তথ্য পেয়েও যখন খুঁজে পায়নি সূত্র। ভবিষ্যতেও পাবে না।

ভাবছ, পিরামিড পেলে মিশরের কর্তৃপক্ষকে বলবে, তখন তারা দেশে ফিরিয়ে নেবে যোডিয়াক? সেজন্যে আগে গ্রেফতার করতে হবে ওই ইমহোটেপকে। বাথরুম দেখাল রানা।

পিরামিড পেলে সহজেই যোডিয়াকসহ ধরিয়ে দেব। পনিটেইল দোলাল লাবনী। যাওয়ার আগে কেবিন থেকে নেব টুকটাক জিনিস। আরও দুইতলা নিচে কেবিন।

ঠিক আছে। কাদিরকে দেখতে টয়লেটে গেল রানা। আগের মতই থম মেরে বসে আছে ধর্মগুরু। আবার কেবিনে ঢুকল রানা। এবার চলো। হাতে উঠে এসেছে রিভলভার।

কিন্তু তখনই ঠক-ঠক শব্দে কেবিনের দরজায় টোকা দিল কেউ!

রানার পাশে পৌঁছে গেছে লাবনী। ফিসফিস করল, এবার? এবার কী করব?

সসসসস! বাথরুমে চাপা আওয়াজ তুলছে কাদির।

দুই লাফে টয়লেটে ঢুকে পাশ থেকে তার কোমরে কষে এক লাথি লাগাল রানা। একদম চুপ, ইমহোটেপ!

কাদির! বাইরে থেকে অধৈর্য স্বরে হাঁক ছাড়ল কেউ। নাদির মাকালানি! প্রেমিক-প্রবর, ভাল করেই জানি ভেতরে আছ। সঙ্গে আমেরিকান ওই সুন্দরী আর্কিওলজিস্ট! ঢুকতে দাও! খট-খট আওয়াজ তুলল তালা মারা দরজার হ্যাণ্ডেল।

ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে ওটার দিকে চেয়ে আছে লাবনী।

এক সেকেণ্ড পর বেডের পাশে পৌঁছুল রানা। গায়ের জোরে ডানহাতে চাপ দিল স্প্রিঙের জাজিমে। কাঁচ-কোচ আওয়াজ তুলছে স্প্রিং। লাবনীর দিকে তাকাল রানা।

বুঝেছে লাবনী, লাল হয়ে গেল দুই গাল। তবে দুসেকেণ্ড পর বেসুরো কণ্ঠে চেঁচাল: না, কাদির! মাই গড, খুলবে না দরজা…

ওদিকে থেমে গেছে হ্যাণ্ডেলের ঝাঁকুনি। নাক দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল নাদির মাকালানি। গট-মট আওয়াজ তুলে দূরে সরে গেল জুতোর আওয়াজ।

আরও পঁচিশ সেকেণ্ড স্প্রিং ঝাঁকিয়ে কেবিনের দরজার সামনে হাজির হলো রানা। তালা খুলে সামান্য ফাঁক করল কবাট। প্যাসেজে কেউ নেই। লাবনীর দিকে তাকাল। কোন দিকে যেতে হবে?

লজ্জায় রানার চোখে তাকাতে পারছে না লাবনী। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, সোজা সামনের কোণে। ওদিকে সিঁড়ি আছে।

এসো! রিভলভার হাতে প্যাসেজে বেরোল রানা। আশপাশে কেউ নেই। বামে ধোঁয়াটে কাঁচের দরজার ওদিকে ডেক। আবছাভাবে দেখা গেল মোনাকোর আলো। প্যাসেজ ধরে এগোতেই ডানে পড়ল বাঁক। সাবধানে ওপাশে উঁকি দিল রানা। কেউ নেই। ত্রিশ ফুট দূরে সিঁড়ি। লাবনী, পথ পরিষ্কার!

ওকে অনুসরণ করছে লাবনী। ইয়টের নৈঃশব্দ্যের ভেতর প্রতি পদক্ষেপে খসখস আওয়াজ তুলছে দীর্ঘ ড্রেসের শেষপ্রান্ত। ফিসফিস করল, এজন্যেই আঁটো পোশাক পরি।

সিঁড়ির কাছে থামল রানা। ওপরের ডেকে একাধিক লোক। কথার অস্পষ্ট আওয়াজ। তবে এদিকে আসছে না কেউ।

সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা। দুইডেক নিচে, ঠিক?

হুঁ।

দোতলায় নেমে প্যাসেজের কোনা ঘুরল ওরা। পাশের এক কেবিন থেকে এল পপ গানের জোরালো আওয়াজ। ওই ঘর পেরিয়ে পৌঁছে গেল লাবনীর কেবিনের সামনে। দরজায় তালা দিয়ে যায়নি লাবনী, ওরা ঢুকে পড়ল ভেতরে।

বাথরুমে ঢুকল লাবনী, মাত্র পাঁচ মিনিট পর বেরিয়ে এল স্বাভাবিক পোশাক পরে। গুছিয়ে নিয়েছে সঙ্গে আনা সামান্য কিছু জিনিস। মোবাইল ফোন হাতে বলল, বেলার সঙ্গে কথা বলবে?

না, আগে ইয়ট থেকে নামব, বলল রানা।

তীরে যাব কীভাবে?

বোট ধার করে, করিডোরে বেরোল রানা। এসো।

আবারও পপ গানের কেবিন পেরোল ওরা। এবার গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে মেইন ডেকে। প্রথম কাজ হবে বোট জোগাড় করা।

কিন্তু কাজটা অত সহজ নয়!

খুলে গেছে মিউযিক ভরা কেবিনের দরজা। দুই হাতে দুই খালি গ্লাস হাতে বেরিয়ে এসেছে সোনালি চুলের এক তরুণী। থমকে গেল নাকের কাছে রানার রিভলভারের নল দেখে। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর লাফিয়ে পেছাল। বিকট চিৎকার ছেড়েই আবারও ঢুকল কেবিনে। চমকে গিয়ে হাউমাউ করে উঠল তার সঙ্গী।

পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও লাবনী।

ভাগো! তাড়া দিল রানা।

ঘুরেই সিঁড়ির দিকে ছুটল ওরা। ওপরের ডেকে উঠতে না উঠতেই বেজে উঠল জোরালো অ্যালার্ম। আরও ওপরের ডেক থেকে এল চিৎকার। হঠাৎ অ্যালার্মের শব্দে অপ্রস্তুত হয়েছে কাদিরের লোক। কিন্তু পাঁচ সেকেন্দ্রে মধ্যে সামলে নেবে।

ধোঁয়াটে কাঁচের দরজার ওদিকে পেছনের ডেক। সংক্ষিপ্ত প্যাসেজে লাবনীকে নিয়ে ছুটছে রানা। পেছনে চিৎকার করে উঠল কে যেন!

সময় নেই থেমে দরজা খুলবে রানা, সরাসরি গুলি করল। ভেঙে ঝনঝন করে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের অসংখ্য টুকরো। ওগুলো মাড়িয়ে একদৌড়ে ডেকে বেরিয়ে এল রানা ও লাবনী।

ওরা ছাড়া ডেকে কেউ নেই। সামনে সিঁড়ি গেছে নিচের মুরিং প্ল্যাটফর্মে। রানার পাশে ছুটতে ছুটতে জিজ্ঞেস করল লাবনী, কোন্ বোট?

যেটাতে চাবি আছে! কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রানা। একটা দরজা খুলে ওপরের ডেকে বেরিয়ে এসেছে কেউ। তার দিকে গুলি পাঠাল রানা। লুকিয়ে থাকুক লোকটা। ওর ইশারায় সিঁড়ি বেয়ে নামল লাবনী। নিজে কাভার দিতে ওপরে রয়ে গেছে রানা।

ওদিকে ছোটসব জেট স্কি অপছন্দ করেছে বলে বোটের কাছে চলে গেছে লাবনী। অনেক বেশি গতি তুলবে ওগুলো। কিন্তু চাবি নেই ইগনিশনে। একই কথা বলা যায় না আমুন রা-র টেণ্ডারের ব্যাপারে। ওটার ইগনিশনে ঝুলছে চাবি।

লাফিয়ে টেণ্ডারে উঠল লাবনী। রানা, চলে এসো!

ঘুরে টেণ্ডার দেখল রানা।

 চালু হয়েছে বোটের ইঞ্জিন। কিন্তু দড়ি খোলেনি লাবনী!

গলা ছাড়ল রানা, আগে দড়ি তো খোলো! ওর গুলির আওয়াজে সতর্ক হয়েছে আমুন রা-র ক্রুরা। কারও ইচ্ছে নেই যে আগে গিয়ে বিপদে পড়বে।

অবশ্য, বেশিক্ষণ থাকবে না সহজ এই পরিস্থিতি। যে কোনও সময়ে হাজির হবে নাদির মাকালানি বা কিলিয়ান ভগলার। তাদের নির্দেশ পেলেই দৌড়ে এসে বোট ডক দখল করবে লোকগুলো। এদিকে রিভলভারে আছে মাত্র চারটে গুলি। এত কম বুলেট নিয়ে শত্রুর দলকে ঠেকাতে পারবে না রানা। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। এখনও দড়ির জট খুলতে পারেনি লাবনী।

ওপরের ডেকে বেরোল দুই লোক। কিন্তু রানার হাতে রিভলভার দেখে ডাইভ দিয়ে পড়ল আরেক দিকে। গুলি ঠিকই করেছে রানা, কিন্তু লাগাতে পারেনি কারও গায়ে।

গুলি আছে আর মাত্র তিনটে!

রানা! চিৎকার করল লাবনী। টেণ্ডার থেকে খুলেছে দড়ি। লাফিয়ে গিয়ে পড়ল স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে।

রওনা হও! নির্দেশ দিল রানা।

কিন্তু মাথা নাড়ল লাবনী। সরে যাবে না রানাকে ছেড়ে।

 আরে, আমি লাফিয়ে নামব! তুমি রওনা হও!

বিকট গর্জন ছাড়ল টেণ্ডারের ইঞ্জিন। ঘুরেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে গেল রানা, কিন্তু তখনই ভাঙা কাঁচের দরজা দিয়ে ছিটকে এল কিলিয়ান ভগলার। চোখের কোণে তাকে দেখে গুলি পাঠাল রানা। কিন্তু ডাইভ দিয়ে সরে গেছে লোকটা। তার মাথার ওপর দিয়ে গেছে বুলেট।

রানার রিভলভারে আছে মাত্র দুটো গুলি!

ওপরের ডেকের কিনারায় উঁকি দিল কালো ব্যারেলের এক এমপি-সেভেন। অন হলো লেসার সাইট। তাক করছে। লাল বিন্দু, কিন্তু রানার গুলি সরাসরি লাগল ওই অস্ত্রের স্টকে। হাত থেকে ছিটকে গেল লোকটার এমপি-সেভেন।

হায় রে, রিভলভার! বিড়বিড় করল রানা।

গুলি আছে আর মাত্র একটা!

ওয়ালথার পি.পি.কে. হলে চেম্বারে থাকত একটা বুলেট, ম্যাগাযিনে আটটা। সেক্ষেত্রে রয়ে যেত চারটে বুলেট!

এখন সর্বসাকুল্যে গুলি বলতে একখানা, অথচ সশস্ত্র শত্রু বেশ কজন!

না, এবার সময় হয়েছে লেজ গুটিয়ে পলায়নের!

ঝাঁপ দিয়ে নিচের ধাতব ডেকে পড়েই শরীর গড়িয়ে দিল রানা। ইয়ট থেকে সরে যেতে শুরু করেছে টেণ্ডার। তবে রানা আসবে সে আশায় পুরো থ্রটল খুলছে না লাবনী।

উঠে তীরের মত ছুটল রানা। দৌড়ে গিয়ে ডাইভ দিয়ে পড়বে টেণ্ডারে…

কিন্তু হঠাৎ করেই ভীষণ টলে উঠল রানা। প্রচণ্ড ব্যথায় মনে হলো বিস্ফোরিত হয়েছে ওর মাথা!

কাটা কলা গাছের মত ডেকে ধুপ করে পড়ল ও। এখনও কয়েক ইঞ্চি দূরে ডেকের কিনারা। ডানহাতে চেপে ধরল তীব্র ব্যথার জায়গাটা। চোখের সামনে হাত নিতেই দেখল, পাঞ্জা ভেসে যাচ্ছে তাজা রক্তে। রিভলভারের গুলি চিরে দিয়েছে ওর বাম কানের ওপরে করোটির হাড়।

ছুটবার সময় ডান পায়ের বদলে বাম পায়ে ভর দিলে এতক্ষণে খুন হতো। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখ কুঁচকে টেণ্ডারের দিকে তাকাল রানা।

ভীষণ ভয় নিয়ে ওকে দেখছে লাবনী।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রানা। লাবনী, যাও! পালাও!

কী করবে বুঝতে গিয়ে সময় নষ্ট করেছে, লাবনীর বুকে তাক করা হলো লেসারের লাল বিন্দু।

খুব সাবধানে থ্রটল থেকে হাত সরিয়ে নিল লাবনী।

কাউবয় বুটের ক্লিপ-ফ্লপ শব্দ শুনল রানা। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে ঘুরে তাকাল। মাত্র দুফুট দূরেই রিভলভার। হাত বাড়াল ওটার দিকে। কিন্তু আগেই তুলে নেয়া হলো অস্ত্রটা। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ভগলার, আমার ধারণা, এটা আমার।

নিতে পারো, জিনিস সুবিধার না, চাপা স্বরে বলল রানা। ভীষণ ব্যথায় পৌঁছে গেছে নরকে। মাত্র একটা গুলিই আছে!

ওই একটাই তোমাকে শেষ করতে যথেষ্ট। ট্রিগার টেনে নেয়ায় মৃদু খুট শব্দে ঘুরছে সিলিণ্ডার। খালি বুলেটের খোসা সরিয়ে ঠিক জায়গায় আসছে তাজা বুলেট, ওপরে উঠছে হ্যামার…

না, গাধা! চিৎকার করল কেউ। কাদির ওসাইরিস। তুমি পাগল নাকি! অন্য ইয়ট থেকে দেখছে সবাই!

কিলিয়ান ভগলারের চাপা কণ্ঠ শুনল রানা। তাতে কী? মরুক শালারা! অবশ্য দুসেকেণ্ড পর মৃদু আওয়াজে নামিয়ে নেয়া হলো হ্যামার। মোনাকোর উপকূলে একমাত্র দামি মেগা ইয়ট নয় আমুন রা। এরই ভেতর গোলাগুলির আওয়াজ পেয়েছে অন্যরা। সবার নজর এখন এই ইয়টে।

এদেরকে চোখের আড়ালে সরাও! নির্দেশ দিল কাদির।

বড়ভাইয়ের পাশে থামল নাদির। এদের খুন না করে উপায় নেই। আগেই উচিত ছিল আমার কথা শোনা।

হ্যাঁ, কথা ঠিক। খুনই করব এদের। তবে এখানে নয়। গোলাগুলির শব্দে মোনাকোর পুলিশ এলে ফেঁসে যাব জাহাজ ভরা লাশ…।

মুরিং প্ল্যাটফর্মে আনা হলো টেণ্ডার।

অস্ত্রের মুখে আবারও ডেকে এসে দাঁড়াল লাবনী। ওর দিকে তিক্ত, ঘৃণাভরা দৃষ্টি ফেলল কাদির ওসাইরিস। চাইনি মেরে ফেলতে, কিন্তু উপায় রাখলে না। আগামীকাল রেসের পর যখন মোনাকো ত্যাগ করবে ইয়ট… তখন লাশ হবে তোমরা।

.

১৯.

 এ-ই তোমার আতিথেয়তা? বিরক্তির সুরে বলল রানা।

কাদির ওসাইরিসের দিকে চেয়ে আছে লাবনী। মনে মনে বলল, ভাল দিক হচ্ছে, তোমাকে বসতে দেয়ার আগে অন্তত ফ্লাশ করেছে নিজের পয়মাল।

বুকের ঝাল মেটাতে রানা ও লাবনীকে এনে নিজের বাথরুমে গুঁজে দিয়েছে ধর্মগুরু। লাবনীর দুহাত বাঁধা হয়েছে ওয়াশ বেসিনের নিচের পাইপে। ওদিকে নিচু কমোডে বসে আছে রানা। ময়লার পাইপে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা দুই কবজি। তবে নেক টাইয়ের বদলে ওদের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে দড়ি। পা না বাঁধলেও ওদের ওপর চোখ রাখবে এক লোক। ঠিক হয়েছে, আজ সারারাত যোডিয়াক নিয়ে গবেষণা করবে কাদির ওসাইরিস এবং তার গবেষকদল,

সারারাত আরাম করে বসতে পারোনি, তাই না, রানা? জানতে চাইল কাদির। খুব দুঃখের কথা!

গতরাতে পুলিশের লোক সামলাতে গিয়ে নিঘুম কেটেছে নাদির মাকালানির, ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ ডলল। যোড়িয়াক থেকে কিছুই জানা যাচ্ছে না। সময় নষ্ট করছি আমরা।

ওখানেই আছে সূত্র, বলল কাদির। ওটা পেয়েছে এই মেয়ে। আমরাও পাব।

লাবনীর দিকে চেয়ে বাঁকা হাসল নাদির। লজ্জার কথা, এ যখন কিছু জানল, কান খাড়া রেখেও কিছুই শুনলে না তুমি। যাই হোক, এরা সত্যিই পিরামিডের ব্যাপারে কিছু জানলে, সেটা নির্যাতন করে জেনে নিতে পারব আমরা। ভাইয়ের দিকে চেয়ে টিটকারির হাসি হাসল সে।

কাদির ওসাইরিস বলল, নাদির! নিজেরাই আমরা জেনে নেব কোথায় আছে ওই পিরামিড। কাউকে বাড়তি কোনও ব্যথা দেব না।

ব্যথা সম্পর্কে কতটুকু জানো? বড়ভাইয়ের নাকের ডগায় প্রায় নিজের নাকের ডগা ঠেকিয়ে ফেলল নাদির। রাগে টিপটিপ করে লাফ দিচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত গালের পেশি।

দুজনের মাঝে নামল অস্বস্তিকর নীরবতা। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর সামান্য পিছিয়ে গেল কাদির ওসাইরিস। নিচু স্বরে বলল, আমরা ঠিকই বের করব ওই পিরামিড। এদের দুজনকে ফেলে দেব সাগরে। তবে তার আগে জরুরি কাজ আছে। প্রথম কাজ ওই রেসে জেতা।

তুমি যাও, অনেকটা অনুমতির সুরে বলল নাদির, আমি এখানেই থাকছি। নিষ্ঠুর হাসি ফুটল ঠোঁটে। পিরামিডের লোকেশন নিয়ে আন্তরিক আলাপ করব ডক্টর আলমের সঙ্গে।

মুখ শুকিয়ে গেল লাবনীর।

মাথা নাড়ল কাদির। সবাই আশা করবে আমার সঙ্গে ওখানে থাকবে তুমি।

তা হলে তাদেরকে বলবে, আমি অসুস্থ।

নাদির, ওসাইরিয়ান টেম্পলের স্বার্থে আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমাকে! কড়া চোখে: ছোটভাইকে দেখল কাদির। এবার পিছিয়ে গেল নাদির। অবশ্য, থরথর করে কাঁপছে ঘাড়ের ফোলা রগ। গার্ডের দিকে তাকাল কাদির। আমরা ফেরত আসা পর্যন্ত এদের ওপর চোখ রাখবে।

মাথা দুলিয়ে চেয়ারে বসল গার্ড। সরাসরি দেখছে বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে। কেবিন ছেড়ে চলে গেল কাদির ওসাইরিস ও নাদির মাকালানি।

রেস কখন শেষ? জানতে চাইল লাবনী।

 বিকেল চারটেয়, বলল রানা। এখন কটা বাজে?

কাত হয়ে হাতঘড়ি দেখল লাবনী। প্রায় দশটা।

অ্যাই! এমপি-সেভেন তুলে ধমক দিল গার্ড। নড়বে না! কথা বলবে না!

আরও একটু নিচু হয়ে বসে গার্ডের দিকে চেয়ে রইল লাবনী। কিন্তু কয়েক মিনিট পর অন্যদিকে মনোযোগ গেল লোকটার। বন্দিদের ওপর থেকে সরে গেছে অস্ত্রের নল। চোখ দিয়ে কেবিনের দামি সব জিনিস চাটছে লোকটা।

গার্ড দেখছে না বলে বাথরুমে চোখ বোলাল রানা। এক কোণে পড়ে আছে নখ-কাটা কাচি। পিঠে ঠেলা দেয়ায় কাদিরের কনুইয়ের পুঁতো খেয়ে টুকটাক জিনিস পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। ওকে আটক করার সময় এসবই দেখেছে। রানা। কিন্তু নাগালে পাবে না কিছুই। অবশ্য, লাবনীর হাত পাইপে বাঁধা থাকলেও পা দিয়ে স্পর্শ করতে পারবে কাঁচি। কিন্তু ও নড়লেই ওকে দেখবে গার্ড।

ছয় ঘণ্টা সময় পাবে ওরা। তার ভেতরে বের করতে হবে মুক্তির পথ।

অত্যন্ত অস্বস্তিকর প্রায় চারঘণ্টা পর এল সুযোগ।

ওদের গার্ডও রেসিং ফ্যান। একটু পর রেস শুরু হবে বলে চালু করেছে বিশাল বড় প্লামা টিভি। কিন্তু ওটা আছে বেকায়দা অ্যাংগেলে। টিভি স্ক্রিন ও দুই বন্দির ওপর একই সময়ে চোখ রাখতে চেয়ার একটু সরিয়ে নিল গার্ড।

গ্রিড শুরু হওয়ার আগে শোনা গেল দর্শকের চাপা গর্জন। সেই সুযোগে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রানা, তুমি ঠিক আছ?

হাঁটুর ব্যথায় পাগল হয়ে গেলাম!

আমার কপাল ভাল যে মাথার ব্যথা কমেছে। চট করে গার্ডকে দেখল রানা। বাথরুমে একপলক দেখে আবার টিভির স্ক্রিনে মন দিল লোকটা। লাবনী, তোমার পায়ের আওতার মধ্যে আছে কাঁচি। লোকটা অন্যদিকে চেয়ে আছে, এমন সময়ে আমার দিকে পাঠাতে পারবে?

পারব বোধহয়।

মাথা কাত করে কাঁচি দেখল রানা। যদি পায়ের কাছে পাই, কাজে আসবে।

প্রথমবারেই সফল হতে হবে, না? অস্বস্তি নিয়ে হাসল লাবনী।

ওর দিকে চেয়ে ভরসা দেয়ার হাসি হাসল রানা। কাজটা কোরো রেসিং শুরু হলে। মোনাকোর ট্র্যাকের প্রথম বাঁকে বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তখন হৈ-হৈ করে অনেকে।

আমার লাগবে বড়জোর তিন সেকেণ্ড। গার্ডকে দেখল লাবনী।

মাঝে মাঝে দেখছে লোকটা, তবে বেশিরভাগ সময় চোখ টিভির পর্দায়। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ধারাভাষ্য চলছে। মূল রেস শুরুর আগে বিকট আওয়াজে ফর্মেশন ল্যাপ দিচ্ছে গাড়িগুলো।

খুব ধীরে এক হাঁটুর ওপর শরীরের বেশিরভাগ ওজন চাপাল লাবনী। অন্য পা সরাল। ব্যথায় ছিঁড়ে যেতে চাইছে উরুর পেশি। ওর দিকে ঘুরে তাকাল গার্ড। বরফের মূর্তি হয়েছে লাবনী। মনে ভয়, লোকটা বুঝে গেছে কী করছিল ও। সন্দেহ দূর করতে ঘাড় ফোঁটাল। ভঙ্গি নিল, ঘাড়ের ব্যথায় অস্থির। ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল গার্ড। তারপর আবার মন দিল টিভিতে।

গাড়ি গ্রিডের যে যার জায়গায় থামতেই উত্তেজিত কণ্ঠে কথা শুরু করল ভাষ্যকার। পা সাধ্যমত সামনে বাড়িয়ে দিল লাবনী। ফিসফিস করল, রেডি?

পায়ের আঙুল সামান্য ওপরে তুলল রানা।

রেসের সবাই পৌঁছে গেছে পযিশনে। সামনে ঝুঁকে চোখ সরু করে টিভি দেখল গার্ড। গর্জে উঠছে সব গাড়ির ইঞ্জিন। আর তখনই জ্বলে উঠল স্টার্টিং বাতি। উন, দিউখ, ত্ৰয়েইস, কয়েত্রে, সাই… এবার উত্তেজনা বাড়াতে বিরতি দিল ভাষ্যকার, পরক্ষণে গলা ফাটাল: আলিয!

দশগুণ আওয়াজে গ্রিড ছেড়ে ছিটকে গেল গাড়িগুলো। রুবিল্যাক, রুবিল্যাক! চিৎকার জুড়ল ভাষ্যকার। আরেকটু হলে উত্তেজনায় চেয়ার থেকে পড়ে যেত গার্ড। আর সব গাড়ির আগে ছুটছে ওসাইরিয়ান টেম্পলের সেরা ড্রাইভার। ওহ! ওহ! চুরমার হয়ে গেল মুলারের গাড়ি!

প্রথম বাঁকে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে কেউ। চেয়ারে প্রায় লাফিয়ে উঠল গার্ড। ওই একই সময়ে হালকা লাথি মেরে ছোট্ট কচি রানার দিকে পাঠিয়ে দিল লাবনী।

টিভিতে যতই আকর্ষণীয় দৃশ্য থাকুক, পেরিফেরাল ভিশনের গুণে চোখের কোণে বাথরুমে নড়াচড়া দেখেছে গার্ড। ঝট করে ঘুরে অস্ত্র তাক করল সে। আগেই পা নামিয়ে কাঁচি আড়াল করেছে রানা। এমপি-সেভেন লাবনীর দিকে তাক করল গার্ড। প্রায় দৌড়ে এসে ঢুকল বাথরুমে। আমি না বলেছি না নড়তে!

ভীষণ খিঁচ ধরেছে! মুখ কুঁচকে ফেলেছে লাবনী। কথা মিথ্যা নয়। অসহ্য ব্যথা সহ্য করতে গিয়ে বেকায়দাভাবে নাড়ছে পা। খুব ব্যথা! দয়া করে গুলি করবেন না! …প্লিয!

অ্যাই মেয়ে, ঠিক হয়ে বোসো!

নির্দেশ পালন করল লাবনী।

অস্ত্রের নল ওর মাথায় ঠেকিয়ে ঝুঁকে হাতের দড়ির বাঁধন দেখল গার্ড। ঠিকই আছে। এবার পরখ করল রানারটা। সবই ঠিকঠাক। একদম নড়বে না! আবার কেবিনে ফিরল গার্ড। বারকয়েক সন্দেহ নিয়ে দেখল রানা ও লাবনীকে, তারপর আবার মন দিল রেসিঙে।

পেয়েছ? ফিসফস করল লাবনা।

ডান পায়ের পাতা তুলে কাঁচি দেখাল রানা। একটু পর ধীরে ধীরে নিজের দিকে সরাতে লাগল কাঁচি। প্রতিবারে বড়জোর এক ইঞ্চি করে। বারবার আগের জায়গায় রাখছে পা, তারপর সুযোগ বুঝে নামছে কাজে। মিনিট খানেক পর প্রায় নিয়ে এল হাঁটুর কাছে।

সবচেয়ে কঠিন কাজ, বিড়বিড় করল রানা। এক পাশে কাত করে সরিয়ে নিল পা। এবার… ঝাঁকি দিয়ে পেছনে নিল হাঁটু।

পলিশ করা মেঝেতে পিছলে গেল কাঁচি, সোজা গিয়ে লাগল পেছনের দেয়ালে। ধরা পড়ার আশঙ্কায় নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে রানা। তবে টিভি ভাষ্যকারের কণ্ঠ চাপা দিয়েছে কাঁচির তৈরি মৃদু টিঙ্ক আওয়াজ।

রানার টানটান করা হাত থেকে এক ইঞ্চির বিশ ভাগের এক ভাগ দূরে রয়ে গেছে কাঁচি!

মহা মুশকিল! পাইপের ফুলে থাকা একটি জয়েন্টে আটকে গেছে ওর হাতের দড়ি। পেছাতে পারছে না। ওদিকে শরীর উঁচু করে কবজির বাঁধন সুবিধামত করতে চাইলে নড়াচড়া দেখবে গার্ড।

অবশ্য, ওই ঝুঁকি না নিয়ে উপায়ও নেই। পিঠ একটু ওপরে তুলল রানা। তাতে কাজ হলো। বাড়তি ওজনের জন্যে সামান্য ছাড় দিচ্ছে দড়ি। জ্বলছে ছড়ে যাওয়া কবজি। কয়েক সেকেণ্ড পর আঙুল চলে গেল কাঁচির খুব কাছে…

অ্যাই! এক দৌড়ে বাথরুমে এসে ঢুকল গার্ড। ওই একইসময়ে কাঁচি পেল রানা। লুকিয়ে ফেলল তালুর ভেতর। ঠিকমত বসো!

পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে! নালিশ করল রানা। তাতে খেল কোমরে মাঝারি একটা লাথি। আমি প্রস্রাব করব!

বড় বড় দাঁত বের করে হাসল গার্ড। হারামজাদা, ঠিক জায়গাতেই আছিস! আবারও দড়ি পরখ করে দেখল। সন্তুষ্ট হয়ে গিয়ে বসল চেয়ারে।

তুমি ঠিক আছ, রানা? খুব দুঃখ পেয়ে জিজ্ঞেস করল লাবনী। ভাবতে পারছে না, লাথি খেতে হচ্ছে রানাকে।

কোমরে লাথি দিলেও কাঁচি এখন হাতে। সাবধানে দুই ফলা ফাঁক করে নিল রানা। এবার দড়ি কাটতে হবে। সময় লাগবে, লাবনী।

করাতের মত করে কাঁচি ব্যবহার করছে ও। ছোট ফলা। খিচ ধরছে আঙুলে। দড়ি কাটার কাজটা মন্থর গতির। অবশ্য কিছুক্ষণ পর ছিঁড়ে যেতে লাগল দড়ির আঁশ। পেরিয়ে গেল দশ মিনিট। তারপর বিশ। রেসে কুঁদ হয়ে আছে গার্ড। রনি রুবিল্যাক এখনও প্রথম। তবে ওর লেজের কাছে লেগে আছে আরেক রেসার। চারভাগের একভাগ সময় পেরিয়ে গেছে প্রতিযোগিতার। বেশিক্ষণ নেই ফিরবে কাদির ওসাইরিস আর নাদির মাকালানি।

আরও কিছুক্ষণ পর মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

ফিসফিস করল লাবনী, রানা? কাজ শেষ?

হু। একহাতে কাঁচি রেখে, অন্যহাতের আঙুলে দড়ি গুটিয়ে নিচ্ছে রানা। পেয়ে গেল ছেঁড়া অংশ। খুলে নিল এক কবজি। এবার সহজেই মুক্ত হলো অন্য হাত। সমস্যা হচ্ছে, আমরা টয়লেটে, আর ওই লোকের হাতে এমপি-সেভেন। চেষ্টা করো ডেকে আনতে। ভঙ্গি করো আবারও খিচ ধরেছে।

ব্যথায় জোরেশোরে গুঙিয়ে উঠল লাবনী। ছটফট করছে দুপা।

রেসের এমন উত্তেজনাময় মুহূর্তে বাধা পড়তে মহাবিরক্ত হলো গার্ড। তবে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে। মাগী, তোকে না বলেছি না নড়তে! বাথরুমে এসে ঢুকল লোকটা।

ব্যথা! দয়া করো! গাল কুঁচকে ফেলেছে রূপসী লাবনী।

আমার পা শেষ হয়ে গেল! ব্যথা! জীবনে আর কখনও হাঁটতে পারব না!

তোর হাঁটতে হবে কেন? বাঁকা হাসল গার্ড। তুই যাবি সাগরের নিচে! লাবনীর কবজির বাঁধন পরীক্ষা করল। এবার ঝুঁকে দেখতে গেল রানার হাতের বাঁধন।

কিন্তু কবজিতে কোনও দড়িই তো নেই!

অ্যাই…।

ঝট করে উঠে এল রানার হাত, পরক্ষণে লোকটার ডান চোখে গাঁথল কাঁচির ফলা।

ওটার ফলা মাত্র এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের, কিন্তু পুরো কাঁচি ঢুকে গেছে করোটির ভেতর। প্রচণ্ড ব্যথা ও শক পাথরের মূর্তি করল গার্ডকে ঝট করে কমোড থেকে উঠেই তার শার্ট খামচে ধরে নিচে টান দিল রানা। গার্ডের মাথা পড়ল ফ্ল্যাশ লিভারের ওপর। ঠাস্ করে ফাটল কপাল। টয়লেটের ভেতর গুঁজে গেল মাথাটা। মেঝেতে সাপের মত মোচড়াচ্ছে দুপা।

মেঝে থেকে এমপি-সেভেন সাবমেশিন গান তুলে নিল রানা, ঝুঁকে খুলে দিল লাবনীর কবজির বাঁধন।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল লাবনী। মরে গেছে?

কমোডের দিকে ঘুরে তাকাল রানা। নিথর হয়েছে গার্ড। নাক পানির নিচে। উঠছে না বুদ্বুদ।

মাথা দোলাল রানা। পরীক্ষা করে দেখল এমপি-সেভেন। ম্যাগাযিনে আছে পুরো বিশটা বুলেট।

এবার কী? জানতে চাইল লাবনী।

গতকাল যা চেয়েছি, তাই করব। গিয়ে উঠব তীরে। খুঁজে নেব বেলাকে। তারপর ভাগব এ দেশ ছেড়ে।

আর ওসাইরিসের পিরামিড?

খুঁজে নেব।

কেবিনে ঢুকে ডেস্কের ওপর থেকে নিজের জিনিসপত্র নিল লাবনী। চলে গেল যোডিয়াকের ঘরে। গতরাতে ওটা নিয়ে গবেষণা করেছে কাদির ওসাইরিস এবং তার দলের লোক। টেবিলে আরও কিছু কাগজ ও ছবি। পছন্দমত একটা ছবি নিয়ে পকেটে রেখে দিল লাবনী। রানাকে বলল, পরে এটা হয়তো লাগবে। যোডিয়াক আর দেখতে দেবে না কাদির।

কেবিনের দরজা থেকে বলল রানা, চলো। সাবধানে কবাট ফাঁক করে দেখল বাইরের করিডোর। পেছনে থাকবে।

করিডোরে বেরিয়ে এল ওরা। মাথার ক্ষতে অ্যাডহেসিভ ব্যাণ্ডেজ আটকে নিয়েছে রানা। কান ও মুখের পাশে লেগে আছে শুকনো, কালো রক্ত।

নতুন করে লাগিয়ে নেয়া হয়েছে সামনের দরজায় ধোয়াটে কাঁচ। আপাতত কবাট খোলা। নিচের ডেকে দেখা গেল সূর্যস্নান করছে বিকিনি পরা কাদির ওসাইরিসের কজন তরুণী প্রেমিকা। তাদের সঙ্গে গল্প করছে ইয়টের তিন ক্রু। মাঝে মাঝে দেখছে টিভির স্ক্রিনে রেস। প্রত্যেকে সশস্ত্র।

সোজা উঠবে ভাসমান কোনও বোটে, লাবনীকে বলল রানা। ইঞ্জিন চালু হলেই দেরি না করে রওনা হবে। ওরা চেষ্টা করবে খুন করতে। দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে বাঁচার সুযোগ পাব না। বুঝতে পেরেছ?

মাথা দোলাল লাবনী।

ঠিক আছে, ওয়ান… টু… থ্রি! মেডিটারেনিয়ানের তপ্ত সূর্যের আলোয় বেরিয়ে এল রানা ও লাবনী। একদৌড়ে রেলিং টপকে গেল ওরা। নয় ফুট নিচে ডেক। পায়ে ভীষণ ব্যথা পেল লাবনী, টলমল করতে করতেও সামলে নিল। ওদিকে ব্যাঙের মত পা ছড়িয়ে নেমেছে রানা। লাবনী উড়ে চলেছে পেছনের ডেক লক্ষ্য করে। তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়েছে এক মেয়ে। অবাক চোখে রানা ও ছুটন্ত লাবনীকে দেখল অন্যরা। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকগুলো। হড়বড় করছে অস্ত্র তুলে নেয়ার জন্যে।

ঘুরে এমপি-সেভেন তাক করল রানা। কর্কশ আওয়াজে গর্জে উঠল অস্ত্রটা। দুই ক্রুর বুক থেকে ছিটকে বেরোল রক্তের লাল ফোয়ারা।

পেছনে আওয়াজ। ঘুরেই নিচের ব্যালকনি লক্ষ্য করে আরেক পশলা বুলেট পাঠাল রানা। অস্ত্র ফেলে বুক খামচে ধরে রক্তভরা বাল্কহেডে আছড়ে পড়ল লোকটা। ওখান থেকে মেঝেতে।

বসে পড়েছিল লাবনী, জিজ্ঞেস করল রানা, ঠিক আছ? মাথা দোলাল লাবনী। তা হলে বোটে গিয়ে ওঠো!

লাবনী দৌড় দিতেই কাভার দিল রানা। চিলের মত চিৎকার জুড়েছে মেয়েরা। এখনও অবাক হয়ে মৃত সঙ্গীদের দেখছে তৃতীয় ক্রু। দুসেকেণ্ড পর তার চোখ স্থির হলো মেঝেতে পড়ে থাকা অস্ত্রের ওপর।

তোমরা সাঁতার জানো? জানতে চাইল রানা।

তিন মেয়ে এবং সেই লোক বারকয়েক মাথা দোলাল।

গুড! তিন সেকেণ্ড পেলে সাগরে লাফ দিতে! এমপি সেভেন তাক করেছে রানা।

যা বুঝবার বুঝেছে ওরা, একদৌড়ে রেলিং টপকে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।

লাবনীর পেছনে যাওয়ার আগে আবারও সুপারস্ট্রাকচারের দিকে অস্ত্র তাক করল রানা। দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। সবুজ জ্যাকেট পরা এক লোক। খামচে ধরল এমপি সেভেনের চার্জিং হ্যাণ্ডেল। কিন্তু তখনই রানার গুলি বুকে নিয়ে ছিটকে ঢুকে গেল পেছনের লাউঞ্জে।

অস্ত্রে মাত্র দুএকটা গুলি, বুঝে গেছে রানা। হাতের এমপি-সেভেন ফেলে মৃত এক গানম্যানের অস্ত্র তুলে নিল ও।

ওদিকে ভয় পেয়েছে লাবনী। ডেকে তুলে রাখা হয়েছে দুই বোট। পালাতে হলে ব্যবহার করতে হবে জেট স্কি। রানা! চালাতে পারো এই জিনিস?

ইয়টের সুপারস্ট্রাকচার থেকে বেরোতে চাইছে কজন ক্রু, তাদেরকে ভয় দেখাতে এক পশলা গুলি পাঠাল রানা। ইঞ্জিন চালু করো! একদৌড়ে পৌঁছে গেল লাবনীর পাশে। আমি ড্রাইভ করছি!

মানা করেছে কে! খুদে ক্রাফটের শক্তিশালী তলস্রোতের সম্পর্কে স্টিকার চোখে পড়েছে লাবনীর। শুকিয়ে গেছে মুখ। এখানে লেখা, লাইফ জ্যাকেট পরে চালাতে হবে!

ওটা ছাড়াই চলবে, জেট স্কির সিটে চেপে বসল রানা। উঠে পড়ো! অস্ত্রটা হাতে নাও! পড়ে যেয়ো না!

এমপি-সেভেনের বাঁট ধরে পেছনের সিটে চাপল লাবনী। আরেক হাতে জড়িয়ে ধরেছে রানার কোমর।

থ্রটল মুচড়ে ধরল রানা। ইয়ট পেছনে ফেলে তুমুল বেগে ছুটল জেট স্কি। পেছনে ছিটিয়ে দিল পিচকারির মত সাদা পানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *