ধর্মগুরু ১

মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

০১.

হাজার হাজার বছরের নিয়ত প্রাকৃতিক অত্যাচারে মলিন হয়েছে প্রকাণ্ড স্ফিংস। এই মুহূর্তে নির্বিকার, নিষ্পলক, মৃত চোখে দেখছে, তার মস্ত দুই থাবার সামনে পায়চারি করছে সুন্দরী তরুণী বেলা আবাসি।

বিখ্যাত পাথুরে প্রাচীন মনুমেন্টের দিকে ঘুরেও চাইছে না মেয়েটা। এখানে এসেছে দুসপ্তাহ, এরই ভেতর স্ফিংস বা পিরামিড হয়ে উঠেছে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য থেকে পাথরের সাধারণ দালান। অথচ ভেবেছিল, দারুণ লাগবে মিশরে কাজের সুযোগ পেলে। প্রথম সপ্তাহটা গেছে ডিজিটাল ছবি ও ভিডিয়ো ক্লিপ সংগ্রহে। কিন্তু তারপর থেকেই থাই পকেটে ঘুরছে ক্যামেরা। গত কয়েক দিন একটা ছবিও তোলেনি।

মিশরে এসে মাত্র কদিনে সব ম্যাড়মেড়ে হবে, ভাবতেও পারেনি বেলা। অথচ, ছোটবেলায় এ দেশের প্রাচীন রাজা রানি, অশুভ জাদুকর, ভয়ঙ্কর ডাইনী ও রূপকথার কত গল্প শুনেছে দাদা-দাদীর মুখে! ভাবত, তাদের বলা প্রতিটি গল্প জাদুময়। তাঁরা এই দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় গেছেন বলে ভীষণ আফসোস ছিল মনে। মায়ামির কি বিসক্যায়নি এলাকার ধনী পরিবার থেকে এসেছে বেলা, শিশুকাল থেকেই ভেবেছে, প্রথম সুযোগেই ঘুরে দেখবে মায়াবী এ অদ্ভুত দেশ।

কিন্তু বাস্তবতার রূঢ় কশাঘাতে হোঁচট খেয়ে ভেঙেছে ওর সব স্বপ্ন।

হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে স্ফিংসের ডান থাবার পাশের পোর্টেবল কেবিন দেখল বেলা।

এখনও ফিরল না আর্কিওলজিকাল টিমের নেতা ম্যান মেট্যু!

চট করে হাতঘড়ি দেখল বেলা: রাত আটটা পনেরো মিনিট।

একটু পর নিউ ইয়র্কে ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সি চিফের সঙ্গে ভিডিয়োকনফারেন্স করবে এক্সপিডিশন লিডার। এ কারণেই হাতে খুব কম সময় পাবে বেলা। তা ছাড়া, সাড়ে আটটায় প্রতি রাতের মত শুরু হবে সাউণ্ড অ্যাণ্ড লাইট শো। রঙিন লেসার আলো ফেলবে পিরামিড ও স্ফিংসের ওপর। সেইসঙ্গে বিকট শব্দে চলরে অতীতের বর্ণনা। এসব অত্যাচার শুরুর আগেই জুনিয়রদের ঘাড়ে সব চাপিয়ে সরে পড়বে টিম লিডার ম্যান মেটযয় ও সিনিয়র আর্কিওলজিস্টরা। স্থানীয় কর্মীদের নিয়ে এক্সকেভেশনের কাজ গুছিয়ে রাখতে হবে বেলাদের।

ম্যান মেটয যে দলের জুনিয়র সদস্য বলে ওকে মেনে নেবে, তা-ও মনে করে না বেলা।

ও যেন বিনা পয়সার শ্রমিক!

এ-ও ঠিক, আরও দুবছর লাগবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতে, এদিকে রেযান্টও খুব ভাল হচ্ছে না। কিন্তু কেউ বলুক বা না বলুক, অন্তরে ও সত্যিকারের আর্কিওলজিস্ট। যদিও এটা মানছে না কেউ। ভাল কোনও দায়িত্ব না দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে সিনিয়রদের কফি তৈরি আর নুড়িপাথর সরিয়ে নেয়ার কাজে।

কী অপমানজনক।

আবারও পায়চারি আরম্ভ করল বেলা আবাসি। স্ফিংসের মুখে পড়া কমলা স্পট লাইটের আভা পড়েছে ওর জলপাই ত্বকে। ওর বংশের নাম আবাসি হলেও দেখতে হয়েছে ও কিউবান মার মতই। না শ্বেতাঙ্গ, না বাদামি। থমকে গিয়ে পনিটেইল সিধে করল বেলা। আর তখনই শুনল স্ফিংসের থাবার ওদিক থেকে আবছা কথাবার্তা। দেরি না করে বিশাল সিংহ-থাবা ঘুরে ওদিকে চলে গেল বেলা।

ওই যে, খনন এলাকায় পৌঁছে গেছে আর্কিওলজিকাল দলনেতা ম্যান মেটয।

প্রথম দর্শনে বেলার মনে হয়েছিল, নিউ ইংল্যাণ্ডবাসী দারুণ আকর্ষণীয় সুপুরুষ ডক্টর ম্যান মেটয। বয়স পঁয়ত্রিশ, কপালে বাদামি কোঁকড়া চুল। চোখে-মুখে জ্ঞানের দ্যুতি। কিন্তু মুখ খুলতেই বুঝেছিল, অত্যন্ত অন্দ্র, উদ্ধত, অহংকারী, বেয়াড়া এক লোক সে।

এসব বিশেষণ প্রয়োগ করতে পারবে বেলা মেট-এর অন্য দুই সঙ্গীর বিষয়েও। প্রথমজন, টিভি প্রডিউসার লোগান ক্যাসপাস। ফ্রিযের মত চারকোনা এক লোক সে। সাপের মত নিষ্পলক চোখে ভীষণ লোলুপ দৃষ্টি। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই জিভ থেকে পড়তে শুরু করে লালা। বেলার প্রতি বিশেষ নজর তার। সুযোগ পেলেই হাজির হয় গায়ের কাছে। অসত্য বলবে না বেলা, বেশিরভাগ পুরুষ ওর প্রতি আগ্রহী হলে ও খুশিই হয়, কিন্তু তাই বলে চৌকো কোনও জোঁককে পছন্দ করতে হবে, এমন তো নয়!

ম্যান মেটযয-এর দ্বিতীয় সঙ্গী মিশরীয়। নাম ডক্টর লুকমান বাবাফেমি। দেশের আর্কিওলজিকাল কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণকারী সরকারী এজেন্সি সুপ্রিম কাউন্সিল অভ অ্যাণ্টিকুইটি সংস্থার সিনিয়র অফিসার সে। পেটমোটা, প্রায়-টাক পড়া এক লোক। ভীষণ খারাপ চোখের দৃষ্টি। চাটতে থাকে মেয়েদের দেহের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা। এই খননের দায়িত্ব আসলে তার ওপরেই, কিন্তু যা খুশি করতে দিচ্ছে ম্যান মেটযকে। বদলে টিভি ক্যামেরার সামনে বেশিক্ষণ তাকে থাকতে দিলেই হবে। বেলার ধারণা: হাজার-হাজার বছরের পৌরাণিক হল অভ রেকর্ডস উন্মোচিত হলে ঠিক সময়ে লেন্সের সামনে হাজির হবে সে, বলতে শুরু করবে, এই আবিষ্কারের সময় নিজে কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে মিশর দেশটাকে উদ্ধার করে দিয়েছে।

ওই ব্রডকাস্ট নিয়েই এখন আলাপ করছে ওরা তিনজন।

কোনও ভুল হবে না, এটা আপনি এক শ ভাগ নিশ্চিত? ঠিক সময়ে খুলতে পারবেন তো ওই দরজা? জানতে চাইল লোগান ক্যাসপাস। কণ্ঠে গভীর সন্দেহ।

আবারও বলছি, জানি কী করছি, নাকি সুরে বলল বিরক্ত ম্যান মেটয। ঠিক সময়ে খুলব ভল্টের পথ। আপনি ভাল করেই জানেন, এটা আমার প্রথম খনন কাজ নয়।

কিন্তু এটা লাইভ অনুষ্ঠান, বিশ্বের অন্তত পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ দেখবে। দুঘণ্টা ধরে পুরনো হঁট খসিয়ে আনতে গিয়ে নেটওঅর্কের স্পেশাল প্রাইম টাইম নষ্ট করলে, খেপে যাবে কর্তৃপক্ষ। অকল্পনীয় কিছু দেখতে চায় তারা। একই কথা খাটে অন্যদের ক্ষেত্রেও। মিশরীয় এসব আবর্জনা দেখতে ভালবাসে সবাই।

নিজ দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পক্ষ নিয়ে তর্ক করবে, না আমেরিকান টিভি প্রডিউসারের পায়ে লুটিয়ে পড়বে, ভাবছে লুকমান বাবাফেমি। নরম সুরে বলল, ডক্টর মেট্য, আপনি শিয়োর, সঠিক সময়ে স্কেজুয়াল মেনে কাজ শেষ হবে?

আজ থেকে আট দিন পর, দেখবেন আটলান্টিস আবিষ্কারের চেয়েও অবিশ্বাস্য ঘটনা মনে সন্দেহ রাখবেন না, দাঁতে দাঁত চাপল ম্যান মেটয। ঘুরে গেল পোর্টেবল কেবিনের দিকে। ওটার ছাতে বড় এক স্যাটেলাইট ডিশ। স্কেজুয়ালের কথাই যখন উঠল, এবার আমাকে যোগাযোগ করতে হবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।

লোকটার মেজাজ বোধহয় ভাল নেই, ভাবল বেলা। কিন্তু ধমক খাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে উপায়ও নেই ওর। ডক্টর মেটয, এক মিনিট কথা বলতে পারি? খুব জরুরি!

ওই কেবিনে ঢোকা পর্যন্ত কথা বলতে পারবে, বিরক্ত চোখে বেলাকে দেখল ম্যান মেটয। সময় কম!

বিষয়টি ব্যক্তিগত, স্যর, আর্কিওলজিস্টের পাশে যেতে যেতে জানাল বেলা, আপনি আর্কিওলজিকাল কোনও কাজ দিলে খুশি হতাম। এত দিনে নিশ্চয়ই প্রমাণ করেছি, কাজে আমি একদম খারাপ নই।

থমকে গিয়ে বেলাকে দেখল মেট। কাজ? ঠোঁট বেঁকে গেল তার। কাজ কথাটা বলেই বুঝিয়ে দিয়েছ, কী পাব তোমার কাছ থেকে! বেলা, আর্কিওলজি সাধারণ কাজ নয়, ওটা ঘোর। যে-কোনও আর্কিওলজিস্টের সার্বক্ষণিক নেশা। কাজ চাইলে যোগ দাও ম্যাকডোনাল্ড বা সেভেন-ইলেভেনের মত কোনও প্রতিষ্ঠানে। ওরা কর্মী খুঁজছে।

না, ইয়ে… আমি আসলে ঠিক… শুরু করেছিল বেলা, কিন্তু দাবড়ি খেয়ে থামতে হলো ওকে।

এজন্যেই তোমাকে নেয়া হয়নি মূল খননে, বলল মেট, কারণ: তুমি এখনও হতে পারোনি আর্কিওলজিস্ট। কী এমন করেছ যে জায়গা পাবে এই দলে? অন্যান্য জুনিয়র এরই মাঝে কাজ করেছে কয়েকটা খনন সাইটে। ভাল রেযান্ট করে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। …আর তুমি? রাগ নিয়ে বলল মেট্য, তোমার মা দাঁতব্য সংস্থার জন্যে টাকা তোলেন, তাই ইউএনএর কর্মকর্তা জন হার্ট জুটিয়ে দিয়েছে তোমাকে আমার গুরুত্বপূর্ণ এই খনন কাজে। তা করেছে, কারণ তার উপকার করেছিল তোমার মা। তোমার খুশি থাকা উচিত, সুযোগ পেয়েছ আমার দলে যোগ দেয়ার। …যাও, এবার গিয়ে সাইট পরিষ্কার করো। এমনিতেই প্রফেসর ট্রিপের সঙ্গে ভিডিয়োকনফারেন্সে দেরি করেছি। সোজা গিয়ে কেবিনে ঢুকল সে। পেছনে দড়াম করে বন্ধ করল দরজা।

হতবাক হয়ে দরজার দিকে চেয়ে রইল বেলা। কয়েক সেকেণ্ড পর ঘুরে দেখল, ওকেই দেখছে লুকমান বাবাফেমি ও লোগান ক্যাসপাস। অস্বস্তি বোধ করে সিল্কের বো টাই নাড়ল বাবাফেমি, তারপর চলে গেল প্রধান খনন এলাকার ছাউনির ভেতর। একা রয়ে গেল লোগান ক্যাসপাস। মধুর মত মিষ্টি কণ্ঠে বলল, অন্য কোনও ক্যারিয়ার খুঁজছ? কটা মডেলিং এজেন্সির মালিকের সঙ্গে চেনাশোনা আছে আমার।

মর, হারামজাদা! বিড়বিড় করল বেলা। ভুরু কুঁচকে লোভী শয়তানটাকে দেখে নিয়ে সরে এল স্ফিংসের এদিকে। দূরে চোখে পড়ল, খনন এলাকার র‍্যাম্প বেয়ে নেমে চলেছে কন্ট্রাক্টরদের দেয়া ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটির এক লোক। মন খারাপ, একা একা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে ঢুকল বেলা। সামনেই ভাঙা মূর্তি, এখানে-ওখানে ফাটল ধরা দেয়াল। পরিবেশটা ছায়াময়।

চৌকো এক সমতল পাথরখণ্ডে বসল বেলা। নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে বিক্ষিপ্ত মনটাকে। ওর কাছে স্বপ্নের জাদুর দেশ ছিল মিশর। অথচ, এখন দেখছে সব অন্যরকম। তার চেয়েও বড় কথা, ওকে পছন্দ করে না দলনেতা। সুযোগ পেয়েই করেছে চরম অপমান। সত্যিই খুব জঘন্য লোক!

পাল্টে গেল লাইটিং, আরও গভীর ছায়ায় হারাল স্ফিংসের মন্দির। এবার যে-কোনও সময়ে শুরু হবে সাউণ্ড অ্যাণ্ড লাইট শো। গত দুসপ্তাহ ধরে ধারাভাষ্য শুনছে বেলা। মুখস্থ হয়ে গেছে প্রতিটা শব্দ। মন ভাল থাকলে এখন ও থাকত দলের মালামাল গুছিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আজ রাতে আর ভাল লাগছে না কিছুই।

মরুক সব, বিড়বিড় করল বেলা। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল পাথরখণ্ডের ওপর। ঠেকা পড়লে নিজের যন্ত্রপাতি ঠিক জায়গায় রাখুক ম্যান মেটযয।

.

উত্তর-পশ্চিমে আরও প্রাচীন এক ধ্বংসাবশেষ ও স্ফিংসের মাঝের ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে চলেছে সাইট সিকিউরিটি চিফ মাধু কামিল। ওঅকওয়ের শেষপ্রান্তে গেট পাহারা দিচ্ছে। সশস্ত্র গার্ড। দুহাজার আট সালে সাধারণ মানুষের জন্যে গিজা মালভূমি উন্মোচিত করার আগে ছিঁচকে চোর যাতে দামি কিছু সরাতে না পারে, সেজন্যে পুরো বারো মাইল এলাকা ঘিরে নেয়া হয়েছে স্টিল ও তারকাটার বেড়া দিয়ে। আগে উটের পিঠে চেপে আসত দর্শনার্থী, তাতে ক্ষতি হতো নিদর্শনের।

আরও একটা কারণে অত্যন্ত সতর্ক মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। উনিশ শ সাতানব্বই সালে লুক্সর-এ নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল একদল টুরিস্ট। তেমন আবারও ঘটুক, তা চায় না মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। কাজেই শত শত সিকিউরিটি ক্যামেরা বসানো হয়েছে মালভূমিতে। চারপাশে ঘুরছে টুরিস্ট পুলিশ, প্রত্যেকের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র এবং মেটাল ডিটেক্টর।

মালভূমির বাইরে কাঁটাতারের বেড়া তো আছেই, ভেতরেও নির্দিষ্ট সব জায়গায় বেড়া। টেরোরিস্ট হামলার ভয়ে নয়, এসব রাখা হয়েছে মিশরের প্রাচীন সম্পদ সাধারণ টুরিস্টের হাত থেকে রক্ষার জন্যে। প্রতিদিন মাত্র কয়েকজন টুরিস্টকে ঢুকতে দেয়া হয় পিরামিডের অভ্যন্তরে। এদিকে প্রায় কেউই ঢুকতে পারে না স্ফিংস এলাকায়। চলছে নানা আর্কিওলজিকাল এক্সকেভেশন। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে পাহারা দেয়া হচ্ছে জায়গাটা। পুবে বালিপাথরের কূপে মিলেছে প্রাচীন মূর্তি, এদিকে মরুভূমির পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে মন্দির ঘিরেছে পাথুরে টিলা। উত্তরদিকে উঁচু, আধুনিক কংক্রিটের দেয়াল। ওপাশে সমতলে সড়ক। গেট দিয়ে ঢুকতে পারবে শুধু পাসধারী কেউ।

কিন্তু এর ব্যতিক্রম করা হবে আজ রাতে।

গেটের কাছে পৌঁছে গেল মাধু কামিল। তখনই শুরু হলো সন এট লুমিয়ের ডিসপ্লে। স্ফিংসের মন্দিরের ওদিকে সারি সারি চেয়ারে বসেছে কয়েক শ দর্শক। চালু হয়েছে আলো ও ধারাভাষ্যের অনুষ্ঠান।

এসব শেষ হলে টুরিস্ট ও আইএইচএ টিম বিদায় নিলে, এবং গভীর রাতে আজকের এই মিটিং শেষ হলে নিশ্চিন্ত থাকত মাধু কামিল। কিন্তু তা হওয়ার নয়। অধৈর্য হয়ে উঠেছে নাদির মাকালানি। চট করে রেগে ওঠে সে। কখন কী করে বসবে, তার ঠিক নেই।

সবার গাড়ি থাকে পার্কিংলটে, কিন্তু অগ্রসরমান উজ্জ্বল সাদা হেডলাইট কামিলকে জানিয়ে দিল: ওই কালো মার্সিডিয এসইউভিতে করেই আসছে বিশেষ লোকটি।

গেটের সামনে গাড়ি থামতেই ওটা থেকে নামল মইয়ের মত ঢ্যাঙা এক অচেনা শ্বেতাঙ্গ। মাথায় দীর্ঘ চুল। গায়ে সেঁটে আছে সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি জ্যাকেট। থুতনিতে খোঁচা খোঁচা ছাগলা দাড়ি। চেহারা রুক্ষ। গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে গিয়ে পেছনের দরজা খুলল সে।

সিট ছেড়ে নামল এক লোক, সে মাধু কামিলের মতই মিশরীয়।

গেট পেরিয়ে তার সামনে থামল কামিল। মিস্টার মাকালানি, আবারও আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় খুব ভাল লাগছে।

মিষ্টি কথার মুড নেই নাদির মাকালানির। কড়া সুরে বলল, খনন কাজ স্কেজুয়াল থেকে পিছিয়ে পড়েছে।

ডক্টর মেটয বলেছে…

 ওর খননের কথা বলছি না।

মাকালানি সরাসরি ঘুরে তাকাতেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ল কামিল। লোকটার ডান গালে পুরনো পোড়া ক্ষতচিহ্ন। কান থেকে নেমেছে ঠোঁটে। থরথর করে কাঁপছে ওটা। চকচক করছে আলো পড়ে। নিচে নেমে গেছে চোখের পাতা। ফলে দেখা যাচ্ছে লালচে টিশ্য। আগেরবার দেখা হলে সিকিউরিটি চিফ বুঝেছে, নিজের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে মানসিক চাপ তৈরি করে নাদির মাকালানি। বাম থেকে সে সুদর্শন। কিন্তু একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকালে চমকে ওঠে সবাই।

সামান্য পিছিয়ে পড়েছি, চট করে জবাব দিল মাধু কামিল, ধসে গিয়েছিল ছাতের অংশ। এরই ভেতর ওদিকটা ঠিক করে ফেলেছি।

কারও তোয়াক্কা না করে গেট পেরিয়ে নির্দেশের সুরে বলল মাকালানি, চলুন, দেখব।

নিশ্চয়ই, স্যর। আসুন আমার সঙ্গে। সন্দেহের চোখে অন্য লোকটাকে দেখল কামিল। শ্বেতাঙ্গ চলেছে ওঁদের সঙ্গে।

এ আমার বডিগার্ড, বলল মাকালানি, এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিস্টার ভগলার।

ভগলার? অনিশ্চিত সুরে প্রতিধ্বনিতুলল কামিল।

কিলিয়ান ভগলার, আমেরিকান টানে বলল বডিগার্ড। বলার সুরে অশুভ কী যেন। আমার নামটা নিয়ে আপনার কোনও আপত্তি আছে?

না, না-না, চট করে বলল মাধু কামিল। প্লিয, চলুন এ পথে। হাঁটতে শুরু করে ওয়াকওয়ে দেখাল সে।

.

পিরামিড ও স্ফিংস বিষয়ে বর্ণনাকারীর বোমার মত সব বক্তব্য শুনে, নিজে তা নকল করে উল্টোপাল্টা বলে অনেকটাই ভাল হয়ে গেল বেলার মন। আর তখনই দেখল সিকিউরিটি চিফকে। ও নিজে যে ছায়ার ভেতর রয়েছে, সেখান থেকে লোকটার ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখছে মন্দিরের উত্তর দেয়ালের ওদিকে।

মাধু কামিলের সঙ্গে আরও দুই লোক। তাদের একজনের পরনে সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি জ্যাকেট। কুৎসিত চেহারা তার। অন্যজনকে চিনে ফেলল বেলা। নাম বোধহয় নাদির মাকালানি। খননকাজ শুরু হলে দেখতে এসেছিল। ধর্ম বিষয়ক এক সংগঠনের কর্মকর্তা। ওই সংগঠন আইএইচএর সঙ্গে মিলে অর্থের জোগান দিচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই খননে।

নিশ্চয়ই ম্যান মেটয-এর সঙ্গে দেখা করবে, ভাবল বেলা।

লোক তিনজন চলে গেল অপেক্ষাকৃত ছোট মন্দিরের কোণে, ওখানেই থামল মাধু কামিল। চট করে ঘুরে দেখল স্ফিংসের এদিকটা। আচরণ চোরের মত। সাপের চামড়ার জ্যাকেট পরা নিষ্ঠুর চেহারার লোকটাও শীতল চোখে দেখছে চারপাশ। খেয়াল করেনি ছায়ায় রয়ে গেছে কেউ। দ্বিতীয়বার এদিকটা দেখল লোকটা। বুক শিরশির করে উঠল বেলার। এখানে থাকার পুরো অধিকার আছে ওর। কোনও অন্যায়ও করছে না। তবুও মনে কেমন অস্বস্তি।কসেকেণ্ড পর ওর অন্তর জানাল, খারাপ কিছু করিসনি, তাই বিপদ হবে না তোর।

তৃতীয়বারের মত এদিকটা দেখে নিয়ে রওনা হলো সর্প চর্ম। পিছু নিল অন্য দুজন।

বিস্মিত হয়েছে বেলা।

স্ফিংসের র‍্যাম্প বেয়ে না নেমে উল্টো গিয়ে উঠছে তারা সিংহের মূর্তির ওপরের কম্পাউণ্ডে। দূরে চলে গেল তারা।

অবাক কাণ্ড তো, ভাবল বেলা।

সুপ্রাচীন বড় মন্দিরের চেয়ে অন্তত একহাজার বছর কম ওপরের ছোট মন্দিরের বয়স। যিশুর জন্মের মাত্র চোদ্দ শ বছর আগে তৈরি। তাই পুরনো মন্দিরের চেয়ে ভাল অবস্থায় রয়ে গেছে।

কিন্তু তাতে কী?

ছোট মন্দিরের তো ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক কম।

ওটা দেখাবার কী আছে?

কেন এদেরকে নিজে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে মাধু কামিল?

তা-ও আবার রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে!

উঠে দাঁড়িয়ে দূরে লোক তিনজনের মাথা দেখল বেলা।

তারা একটু পর পাশ কাটিয়ে গেল মন্দিরের প্রবেশদ্বার।

এবার সত্যিই কৌতূহলী হয়ে উঠল বেলা।

ওপরের মালভূমিতে দেখার মত কিছুই তো নেই!

 কোথায় চলেছে এরা?

পুরনো মন্দির থেকে বেরিয়ে এল বেলা। ওপরে দেখল, ধ্বংসাবশেষের ওদিকে লোকগুলো।

সন্দেহ তৈরি হলো ওর মনে।

না, জানতে হবে এরা কী করছে!

নিজেকে সামলে নিত, কিন্তু তখনই স্ফিংসের কাছ থেকে এল চিৎকার। এইমাত্র একটা বাক্স হাত থেকে ফেলে দিয়েছে বলে মিশরীয় শ্রমিককে গালি দিয়ে উঠেছে ম্যান মেটয।

ব্যাটা নিজেকে ফেরাউন মনে করে, ভাবল বেলা। যা খুশি করুক, আপাতত তার ধারেকাছে যাবে না ও। তার চেয়ে ঘুরে দেখা যাক ওপরে কী করছে মাধু কামিল। র‍্যাম্প বেয়ে ওপরের মন্দিরের দিকে চলল বেলা।

ধ্বংসাবশেষে পড়ছে সবুজ লেসার আলো। প্রজেক্টর দিয়ে আলো ফেলে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে পিরামিডের গায়ের হায়ারোগ্লিফিক। এদিকে মিশরের ঐতিহাসিক অমর দেবতা রাজা ওসাইরিসের দীর্ঘ প্রশংসা করতে গিয়ে মুখে সাদা ফেনা তুলে ফেলছে বর্ণনাকারী।

ওপরে উঠে এসে মন্দিরের দেয়ালের ওদিকে উঁকি দিল বেলা। বিড়বিড় করল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবই শুনেছি! আর কত! কানটা তো পচিয়ে দিলি, বাবা!

মালভূমির উত্তরদিকে কমলা প্লাস্টিকের নেটিং দিয়ে ঘেরা সংস্কারাধীন উঁচু দেয়াল। ওখানে ছোট কটা কেবিন, পাশেই এক তাঁবু। একটু দূরেই হঁট, নুড়িপাথর ও ধুলোবালির স্তূপ। প্রতিদিন সূর্যের আলোয় ওই পথে স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে ঢোকে বেলা। কিন্তু আজ খেয়াল করল, সত্যিই আগে কখনও নজর দেয়নি এদিকটায়। এখানে যেন কোনও কাজই করে না কেউ!

ওখানে আপাতত আছে এক লোক। গেটের কাছে যেমন গার্ড আছে, তেমনি কম্পাউণ্ড পাহারা দিচ্ছে সশস্ত্র প্রহরী। স্ফিংসের এলাকার আশপাশে ভিড়তে পারবে না টুরিস্ট। কিন্তু বেলা বুঝল, অন্য গার্ডদের মত নয় বিশেষ ওই গার্ড। মাধু কামিল ও অন্য দুজনের জন্যে নির্মাণ এলাকা পাহারা দেয়ার দায়িত্ব তার।

পাল্টে গেল ঝলমলে রঙিন বাতি, কালো আকাশকে উদ্যত তলোয়ারের মত চিরে দিল অসংখ্য লেসার ও স্পট লাইট। আলোর ডিসপ্লে দেখছে প্রহরী। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর অতিথিরা পৌঁছুতেই ঘুরে তাকাল সে। সংক্ষিপ্ত কথা হলো দুপক্ষের, তারপর নেটিঙের মাঝ দিয়ে অতিথিদেরকে পথ দেখাল প্রহরী।

সবার আগে তাঁবুর কাছে পৌঁছুল মাধু কামিল, সরিয়ে দিল একদিকের ফ্ল্যাপ। ভেতরে জ্বলছে আলো। কুঁজো হয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকল সিকিউরিটি চিফের দুই অতিথি। একবার বাইরের দিক দেখে নিয়ে তাদের পিছু নিল কামিল।

ঝট করে পিছিয়ে মন্দিরের দেয়ালে মিশে গেল বেলা। ভাবছে, ওকে দেখে ফেলেনি তো লোকটা? এখন বুঝতে পারছে, নিয়েছে মস্ত ঝুঁকি!

কসেকেণ্ড পর দেয়ালের পাশ থেকে আবারও উঁকি দিল বেলা। নেটিঙের বাইরে পায়চারি করছে মহাবিরক্ত গার্ড। তাঁবুর ফ্ল্যাপের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল লোকজনের নড়াচড়া। তবে একটু পর থেমে গেল সব। নিভে গেছে বাতি।

চেয়ে রইল বেলা।

কিন্তু একদম নড়ছে না কিছু।

ভেতরে কী করছে লোকগুলো?

 তাঁবুর পেছনের দিকে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে নাকি?

তাঁবু যথেষ্ট ছোট, কেউ একটু নড়লে বোঝা যেত।

ওখানে বোধহয় কেউ নেই।

তা হলে কোথায় গেল তারা?

বিষয়টা কী?

 তাঁবুর শেষদিক মিশে আছে উঁচু দেয়ালের গায়ে।

অন্য একটা দিক খেয়াল করল বেলা। নীলচে মৃদু ধোয়া বেরোচ্ছে তাঁবুর দরজা দিয়ে। না, ধোয়া নয়, ওটা বাষ্পের মত। বেরোচ্ছে কোনও ইঞ্জিনের হোস পাইপ থেকে। কিন্তু আশপাশে কোথাও নেই কোনও জেনারেটর।

তা হলে ওই ফিউম আসছে কোত্থেকে?

যথেষ্ট আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে বেলা। দেয়ালের কোনা ঘুরে ধুলোবালির স্তূপের আড়াল নিয়ে পিঠ কুঁজো করে এগোল ও। তবে কিছু দূর যেতেই বুঝল, এত সতর্কতা বৃথা। নির্মাণ এলাকায় যেতে হলে পেরোতে হবে মাঝখানের চওড়া ফাঁকা এক জায়গা। গার্ড লোকটা অন্ধ না হলে ধরা পড়বে ও।

তবে… কসেকেণ্ডের জন্যে অন্যদিকে সে তাকালে…

বেলার মনে পড়ে গেছে, একটু পর সাউণ্ড অ্যাণ্ড লাইট শো-তে কী ঘটবে। বর্ণনাকারী বলতে শুরু করবে গ্রেট পিরামিডের নির্মাতা খুফুর কাহিনী। তখন কিছুক্ষণের জন্যে প্রায় সব কিছুর ওপর থেকে সরে গিয়ে বাতি পড়বে খুফুর কীর্তির ওপর।

চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় রইল বেলা…

তারপর দপ্ করে নিভে গেল সমস্ত আলো।

চোখ খুলেই ত্রস্ত হরিণীর মত তাঁবুর দিকে ছুটল বেলা। হাতে পাবে মাত্র কয়েকটা সেকেণ্ড। তারপর সূর্যের মত উজ্জ্বল আলো গিয়ে পড়বে গ্রেট পিরামিডের ওপর…

লাউড স্পিকারে বিকট জোরে বাজতে লাগল নাটকীয় বাজনা, পরক্ষণে উত্তর-পশ্চিমে গ্রেট পিরামিড যেন বিস্ফোরিত হলে অত্যুজ্জ্বল আলোর মধ্যে। নেটিঙের ফাঁকের পাশে ইটের সারির পেছনে ব্রেক কষে থেমে গেছে বেলা। চট করে দেখল চারপাশ। ওই যে, আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া প্রকাণ্ড পিরামিডের দিকে চেয়ে আছে গার্ড।

ভাল!

নীরবে কয়েকবার দম নিল বেলা। মিশরে আসার পর এই প্রথম উত্তেজনা বোধ করছে। দারুণ লাগছে ওর। হেসে ফেলল মৃদু। একবার দেখে নিল তাঁবু। বেশ একটু দূরেই ওটা। এখন পরিষ্কার শুনছে জেনারেটরের চাপা গর্জন। তবে ওই আওয়াজ আসছে দূর থেকে। কেমন প্রতিধ্বনির মত। আবার গার্ডের দিকে তাকাল। অন্যদিকে চোখ তার। সাবধানে ফ্ল্যাপ সরিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকল বেলা।

কিন্তু তাঁবুর ভেতরে কেউ নেই!

হলোটা কী? অবাক হয়ে বিড়বিড় করল বেলা।

তাঁবুর পেছনে সস্তা পার্টিবোর্ডে তৈরি এক কিউবি, চওড়ায় বড়জোর তিন ফুট। ওটার ভেতর আঁটবে না মাধু কামিল বা তার দুই অতিথি।

কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়, তাঁবুর আরেক দিকে দারুণ আকর্ষণীয় জিনিস দেখতে পেয়েছে বেলা।

ট্রেসল টেবিলের ওপর কনস্ট্রাকশনের নীল নক্সা। ওপরের দিক স্ফিংসের কম্পাউণ্ড। তবে বেলার আকর্ষণ অন্যখানে। ওটা টেবিলে নেই। ঝুলছে তাঁবুর দেয়ালে। রঙিন ফোটোগ্রাফ ওগুলো। পাশেই প্রাচীন প্যাপিরাসের স্ক্রলের কটা ব্লোআপ। এসব স্ক্রল পাবে ভেবেই মিশরের খনন কাজে যোগ দিয়েছিল ও।

অল্প কজন আর্কিওলজিস্ট ধারণা করতেন, লাইব্রেরি অভ আলেকন্দ্রিয়ায় ছিল এসব দলিল। তবে বিশেষজ্ঞদের বেশিরভাগই ভাবতেন, ওই প্যাপিরাস বাস্তবে নেই, সবই পৌরাণিক গালগল্প। এরপর এক আর্কিওলজিস্ট ব্যক্তিগত ফাণ্ড ব্যয় করে আর্কিওলজিকাল খনন কাজ করলে গিজায় মিলল প্যাপিরাস পাতার বেশকিছু। তাতে লেখা, কেমন ছিল হল অভ রেকর্ডস। কী ধরনের প্যাসেজ পেরিয়ে স্ফিংসের দুই থাবার মাঝ দিয়ে ঢুকতে হবে, তা-ও লেখা ছিল। ওসব পাতা যখন বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করা হলো, জানা গেল ওগুলোর বয়স কমপক্ষে চার হাজার বছর। এর ফলেই হঠাৎ করে হল অভ রেকর্ডস হয়ে উঠল আর্কিওলজির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। এর কদিন পর ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সিকে খননের অনুমতি দিল মিশরীয় সরকার। এখন সবাই জানতে চাইছে, কী লেখা হয়েছে স্কুলগুলোয়।

আইএইচএর হাতে আছে তিনটে স্ক্রল, ভাল করেই জানে বেলা।

কিন্তু ছিল আসলে চারটে স্ক্রল।

ঝুলন্ত স্কুলের সামনে গেল বেলা। নিঃশব্দে পড়তে লাগল হায়ারোগ্লিফিক্স। মিশরীয় ইতিহাস, মিথোলজি এবং এ দেশের প্রাচীন ভাষা ওকে শিখিয়েছেন ওর দাদা। এ কারণেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সহজেই বেলা বেছে নিয়েছে আর্কিওলজির মত কঠিন বিষয়। হল অভ রেকর্ডস বিষয়ে আইএইচএ যেসব তথ্য পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি কিছু দেখছে স্ক্রলে। বর্ণনা করা হয়েছে হল অভ রেকর্ডস জায়গাটা কোথায়। ওখানে রয়ে গেছে মানচিত্রের একটি কক্ষ। এ ছাড়া, একটি যোডিয়াক। ওটা জানিয়ে দেবে কোথায় পাওয়া যাবে…

পিরামিড অভ ওসাইরিস? অবিশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করল বেলা।

কিন্তু ওটা না ছিল দাদার পৌরাণিক গল্পগুলোর একটা?

নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু ছিল ওটা?

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পত্তন হয় প্রথম রাজবংশের। পরের ফেরাউনদের মত দর্শনীয় সমাধি তৈরি করেনি তারা। ওই আমলের চেয়েও পুরনো ওসাইরিসের

পৌরাণিক কাহিনী।

কিন্তু এই স্কুলের ব্লোআপ বলছে: সত্যিই কোথাও রয়ে গেছে দেবতা-রাজা ওসাইরিসের পিরামিড!

কোথাও বলা হয়নি এই বিষয়টি পুরাণের গল্প।

প্রাচীন অক্ষর অনুযায়ী, হল অভ রেকর্ডসসের মতই বাস্তব ওই পিরামিড।

সর্বনাশ! ফিসফিস করল বেলা।

 বুঝতে পারছে, এর অর্থ কী।

সত্যিই ওসাইরিসের পিরামিড থাকলে, ওটার ভেতরে আছে দেবতা-রাজার মমি। কল্পনাপ্রসূত দেবতা নয় সে, রক্ত মাংসের রাজা। হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে কোথাও। সত্যিই ওই সমাধি পেলে, তা হবে আজ তক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সেরাগুলোর একটা।

টেবিলে বিছিয়ে রাখা ব্লপ্রিন্টে চোখ বোলাল বেলা। পরিষ্কার দেখল, হল অভ রেকর্ডসসের পুব ও পশ্চিম এন্ট্রান্স। পুবের পথটা খনন করছে আইএইচএ। কিন্তু উত্তরদিক থেকে এসেছে দীর্ঘ আরেকটা সুড়ঙ্গ।

ওটা গেছে বর্তমানের আধুনিক রাস্তার তলা দিয়ে।

বেলা বুঝল, এ তাঁবুর নিচেই আছে সেই প্রাচীন সুড়ঙ্গ।

কাঠ জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি কিউবিকলের দিকে ঘুরল বেলা। কবজা লাগানো প্যানেল। ওখানে হ্যাণ্ডেল হিসেবে আছে গোল গর্ত। ওখানে হাত ভরে নিঃশব্দে প্যানেল ওপরে তুলল বেলা।

এবার বুঝল, কোথায় গেছে ওই তিন লোক।

প্যানেল সরতেই দেখতে পেয়েছে কূপের মত গভীর এক গর্ত। শাফটের মেঝে বিশ ফুট তলায়। একপাশে, মই। ওদিক থেকে আসছে আবছা হলদেটে আলো। মেঝেতে জেনারেটরের একস্ট ফিউমের হোস পাইপ।

দূরে মেশিনটার চাপা গর্জন পরিষ্কার শুনল বেলা।  

নিচে আলাপ করছে কয়েকজন লোক।

এগিয়ে আসছে এদিকেই।

নিভে গেল বেলার উৎসাহ-উত্তেজনা। সে-জায়গা দখল করল ভীষণ ভয়।

গোপনে খনন করছে কেউ। আইএইচএকে কাঁচকলা দেখিয়ে আগেই পৌঁছে যেতে চাইছে হল অভ রেকর্ডসসে। মূল উদ্দেশ্য বোধহয় সবার আগে ওসাইরিসের পিরামিডে পৌঁছুনো।

তার মানে, ধরা পড়লে হবে মস্ত বিপদ।

এখন কী করা উচিত?

কাউকে জানাতে হবে, কী অন্যায় চলছে এখানে!

কাকে বলবে, ম্যান মেটয, না লুকমান বাবাফেমিকে?

 সন্দেহ নেই মাধু কামিল এ ডাকাতির সঙ্গে জড়িত।

কিন্তু ওই লোকের ওপর দিয়ে ওর কথা বিশ্বাস করবে ম্যান মেটয বা লুকমান বাবাফেমি?

কাজেই ওর এখন দরকার নিরেট প্রমাণ…

 ঊরুর পকেটে ভারী কী যেন। হ্যাঁ, ক্যামেরা!

অত্যাধুনিক যন্ত্রটা বের করে সুইচ অন করল বেলা। এর আগে কখনও মনেই হয়নি, বেরিয়ে আসার জন্যে অতিরিক্ত সময় নিচ্ছে লেন্স। চট করে জ্বলেও উঠছে না স্ক্রিন!

দুসেকেণ্ড পর খড়মড় আওয়াজ এল শাফট থেকে। মই বেয়ে উঠে আসছে কেউ।

গলা শুকিয়ে গেছে বেলার। বুকে টের পেল শীতল ভয়ের ছোঁয়া। দেরি না করে চট করে প্যাপিরাসের চার পাতার ছবি তুলল ও, পরক্ষণে ছবি তুলতে চাইল ব্লুপ্রিন্টের।

ক্লিক আওয়াজ তুলল ওর ক্যামেরা।

শালার কী হচ্ছে! নিচ থেকে ঘেউ করে উঠল কেউ। উচ্চারণ আমেরিকান! সর্প-চর্ম জ্যাকেট! ওই লোকের চোখে পড়েছে ফ্ল্যাশের আলো!

আবারও চিৎকার করে উঠল কেউ। এবার বাইরের গার্ড। ছুটন্ত পায়ের ধুপ-ধাপ আওয়াজ পেল বেলা। ছুটে আসছে লোকটা তাবুর দিকে। খটখট আওয়াজ তুলল মইয়ের ধাপ। ঝড়ের বেগে উঠছে নিচের লোকগুলোও!

ঘুরেই দৌড় দিল বেলা। একইসময়ে ফ্ল্যাপ সরিয়ে হাজির হলো গার্ড। তার বগলের তলা দিয়ে ছিটকে বেরোল বেলা, তার আগে গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়েছে গার্ডের পাঁজরে। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল লোকটা।

সোজা মন্দির লক্ষ্য করে ছুটল বেলা। গার্ড উঠে দাঁড়াবার আগেই পেরিয়ে গেল নেটিং। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, বাঁচাও!

ভাবছে, আইএইচএ খনন এলাকায় কেউ থাকতে পারে।

কিন্তু লাইট শো-র বর্ণনাকারীর জোরালো কণ্ঠের নিচে চাপা পড়ল ওর চিৎকার।

পেছনে গর্জে উঠে নির্দেশ দিল নাদির মাকালানি।

জানের ভয় এনে দিল গতি, তাড়া খাওয়া হরিণীর চেয়েও জোরে ছুটল বেলা। ঘুরে পেরোল চারপাশের ধ্বংসাবশেষ। তীরের মত নেমে গেল নিচের স্ফিংসের মন্দিরের গোলক ধাঁধায়। এখানে-ওখানে এসে পড়ছে লাল ও সবুজ লেসারের আলো।

একটু দূরে ওয়াকওয়েতে কে যেন!

ডক্টর বাবাফেমি! গলা ছাড়ল বেলা। ডক্টর বাবাফেমি, বাঁচান!

থমকে গিয়ে অবাক চোখে ওকে দেখল আর্কিওলজিস্ট।

তখনই তার সামনে লাফিয়ে হাজির হলো বেলা।

কী হয়েছে, মিস… আরে, তুমি না বেলা আবাসি?

পেছনে! ওরা… হাঁপিয়ে গেছে বেলা। ওরা ডাকাতি করছে হল অভ রেকর্ডস!

কী বললে? তুমি কি পাগল হলে? 

ঘুরে তাকাল বেলা। ওপরের মন্দিরের কোনা ঘুরে দৌড়ে আসছে গার্ড। ডক্টর বাবাফেমিকে দেখে মাঝপথে ব্রেক কষে থামল সে।

মুখে ক্ষত ভরা ওই… নাদির মাকালানি… ওই লোক ডাকাতির পেছনে! তার কাছে চার নম্বর স্ক্রল! ছবি তুলেছি ওটার! বাটন টিপে স্ক্রিনে ইমেজ ফোঁটাতে চাইল বেলা। এই যে দেখুন!

বাবাফেমির চেহারা ভরা দ্বিধা কেটে সেখানে দেখা দিল আতঙ্ক। খপ করে বেলার কনুই ধরল সে। বুঝলাম! আমার সঙ্গে এসো!

বাহুর মাংসে আঙুল গেঁথে যেতেই সরতে চাইল বেলা। আরে, কী ব্যাপার? আপনি ব্যথা দিচ্ছেন কেন? আরও শক্ত হাতে ধরা হলো ওর বাহু।

কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না বাবাফেমি। ওদিকে দৌড়ে এসে ওপরের মন্দিরের কোণে থেমেছে সর্প-চর্ম। থেমে গিয়ে কর্কশ স্বরে জানাল, ওকে নিয়ে আসুন ওপরে!

কঠিন হাতে বাহু ধরেছে ডক্টর বাবাফেমি। বেলাকে টেনে নিয়ে চলল মন্দিরের দিকে।

এরই ভেতর সব বুঝে গেছে বেলা, খামচি মেরে তুলে নিতে চাইল লোকটার নাক-চোখ।

কিন্তু অন্য হাতে ওকে সরিয়ে রাখল বাবাফেমি।

সাহায্য করতে দৌড়ে আসতে লাগল গার্ড।

স্টিলের ভারী ক্যামেরা তুলেই বাবাফেমির মুখে মারল বেলা। একে বেদম ব্যথা, তার ওপর চোখের সামনে ফ্ল্যাশ দিশেহারা বোধ করছে লোকটা।

চারকোনা ক্যামেরার একদিকের কিনারা নামল তার খাড়া নাকের হাড়ের ওপর। পরের বাড়ি পড়ল কপালে।

ইবলিশ! নিজের নাক-কপাল চেপে ধরে ওয়াকওয়েতে বসে পড়ল বাবাফেমি। যন্ত্রণায় ভুলেছে ছাড়া পেয়ে গেছে বেলা।

দৌড়ে এসে স্ফিংসের দিকের ফাঁকটা আড়াল করল গার্ড। ওদিকে যেতে দেবে না বেলাকে। দূরের কম্পাউণ্ড থেকে ছুটে আসছে আরও দুজন গার্ড। ঘুরেই ওয়াকওয়ে ধরে উড়ে চলল বেলা। বুঝে গেছে, দুদিক থেকে আসছে গার্ডরা।

দিক পরিবর্তন করে একলাফে স্ফিংসের মন্দিরের উত্তর দেয়ালে উঠে পড়ল ও। ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে। পায়ের নিচে ফাটল ধরা প্রাচীন, এবড়োখেবড়ো পাথর।

ধর শালীকে! চিৎকার করল আমেরিকান বডিগার্ড।

দেয়ালে উঠে বেলার পিছু নিল প্রথম গার্ড। দিক পাল্টে নালার মত এক জায়গা লক্ষ্য করে ছুটল সামনের দুই গার্ড। ওই নালা আলাদা করেছে মন্দির ও ওপরের কম্পাউণ্ডকে। ওখানে যাওয়ার আগেই বেলাকে আটক করতে চাইছে তারা।

যে দেয়ালের ওপর দিয়ে ছুটছে, ওটার উচ্চতা বারো ফুটেরও বেশি, লাফিয়ে নামলে আহত হবে বেলা। হাত-পা ভাঙার ঝুঁকি না নিয়ে পা রাখল পাঁচ ফুট নিচের এক পিলারের ধ্বংসাবশেষে। ওখান থেকে লাফ দিল নিচের আঁধার লক্ষ্য করে। দুপায়ে ভর করে ধুপ করে নামল মেঝেতে। ওর মনে হলো, পাগল হয়ে গেছে উরু, হাঁটু ও গোড়ালির ব্যথায়। হুমড়ি খেয়ে পড়েই গেল। বুক পকেট থেকে ছিটকে গেল মোবাইল ফোন ও কয়েকটা কয়েন।

বেলাকে পাকড়াও করতে উঁচু দেয়াল থেকে লাফ দিয়েছে গার্ড। কিন্তু বদলে গেল লেসারের লাল আলো, পরক্ষণে হঠাৎ করেই হাওয়া হলো ওটা। নিচে এখন কোনও আলোনেই। ভাঙা পিলারের দিকে বাড়িয়ে দেয়া পা ফস্কে গেল গার্ডের। অন্য পায়ের হাঁটুর বাটি লাগল বেড়ে থাকা পাথরের কিনারায়। লোকটা পাক খেয়ে সোজা পড়ল পাথুরে মেঝেতে। আহত পা চেপে ধরে করুণ আর্তনাদ ছাড়ল সে।

নিজেও ভাল নেই বেলা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঠে দাঁড়াল। আগেই হাতে তুলে নিয়েছে ক্যামেরা। পড়ে গিয়েও নষ্ট হয়নি ওটা। রেখে দিল গভীর পকেটে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল চারপাশ। মন্দিরের ফটক থেকে বেশি দূরে নেই ও। গোড়ালির ব্যথা সহ্য করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলল ঘন ছায়া লক্ষ্য করে। একটু দূরেই পুবের দেয়াল।

প্রথম বাঁকে পৌঁছে ঘুরে পেছনে তাকাল। উত্তরদিকের দেয়ালে চড়েছে এক গার্ড। কিন্তু তার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে আহত সঙ্গী। দেখতে পায়নি বেলাকে।

দ্বিতীয় বাঁক নিয়ে থমকে গেল ওখানেই। সামনে লোহার শিকের উঁচু ফটক।

মরেছি! বিড়বিড় করল বেলা। আগে থেকেই জানত, টুরিস্টদের অত্যাচার ঠেকাতে দরজা আছে মন্দিরে, কিন্তু, ওটা যে এত উঁচু, ভাবতেও পারেনি। একটু দূরেই দেখল, সিটে বসে আছে একদল শ্রোতা। পেছনের পুরনো ধ্বংসাবশেষের দিকে নয়, সবার চোখ উজ্জ্বল আলোয় রাঙা স্ফিংসের ওপর। এখন সাউট্র্যাকের বোমার মত আওয়াজে গলা ফাটালেও বেলার চিৎকার শুনবে না কেউ।

অন্যান্য আওয়াজ শুনল বেলা।

 মন্দিরের ভেতর ওকে খুঁজছে শয়তান লোকগুলো!

ফাঁদের শেষমাথায় আটকা পড়েছে ও!

কাছে চলে আসছে গলার আওয়াজ!

গেট ও অন্য দেয়ালের চেয়ে নিচু ভেতর দিকের দেয়াল।

ঝলমলে আলোয় ফাটল ও গর্ত খুঁজে কয়েক সেকেণ্ডে হাঁচড়েপাঁচড়ে ওই দেয়ালে উঠে এল বেলা। চিয়ার লিডার হওয়ার জন্যে জিমে ঘণ্টার পর ঘন্টা ব্যায়াম করার সুফল পেয়েছে।

দেয়াল থেকে দেখল, মাত্র দশ ফুট দূরে সর্প-চর্ম জ্যাকেট পরা লোকটা। অন্যরা ছড়িয়ে পড়েছে মন্দিরের ভেতর। তাদের একজন প্যাসেজ ধরে দৌড়ে এসে থামল ফটকের সামনে।

নিজের করুণ হাল ভেবে মন খারাপ হলো বেলার। উপুড় হয়ে চুপ করে শুয়ে থাকল দেয়ালের ওপর। ভুলে গেছে শ্বাস ফেলতেও। প্যাসেজের কোনা ঘুরে দৌড়ে এসে থামল কজন গার্ড। শিকের ভেতর দিয়ে তাকাল ওদিকে। মন্দির থেকে পালিয়ে যাচ্ছে কেউ, এমন কাউকে দেখল না তারা। হা করে ডিসপ্লে দেখছে দর্শকরা।

মেয়েটাকে এদিকে দেখেছ? জানতে চাইল আমেরিকান বডিগার্ড। হাতে ছোট এক উজ্জ্বল আলোর লেড ফ্ল্যাশলাইট। আলো ফেলল ভাঙাচোরা সব পিলারের ওপর।

না-সূচক উত্তর দিল অন্যরা।

ব্যস্ত পায়ে এল নাদির মাকালানি ও বাবাফেমি।

ওই মেয়ে বেরোতে পারবে না, জানাল আর্কিওলজিস্ট। একহাতে চেপে রেখেছে রক্তঝরা নাক। এদিকের প্রতিটি প্রবেশপথ বন্ধ।

কে ওই মেয়ে? রাগী গলায় জানতে চাইল মাকালানি।

আইএইচএ টিমের, বলল বাবাফেমি, বেলা আবাসি। ছাত্রী।

ছাত্রী হোক বা কচুর ছাতা, ওই মেয়ে সর্বনাশ করতে পারে আমাদের প্ল্যানের, বলল মাকালানি, বেরোতে দেয়া যাবে না তাকে।

খুঁজে বের করতে হবে, বলল তার বডিগার্ড, জলদি!

পেলে কী করবেন, মিস্টার ভগলার? জানতে চাইল বাবাফেমি।

আপনার কী মনে হয়?

ধাতব কড়াৎ শব্দ শুনে হিম হয়ে গেল বেলার বুকের রক্ত। তোলা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের হ্যামার!

আপনারা ওই মেয়েটাকে… বাস্তবতা বুঝে চুপ হয়ে গেল বাবাফেমি।

আগামী বিশ বছর মিশরের জেলের রুটি খাওয়ার শখ আমার নেই, কাজেই মরতে হবে ওই মাগীকে!

ডক্টর বাবাফেমি, ওই মেয়ে পালিয়ে গেলে ম্যান মেটযকে ম্যানেজ করবেন আপনি আর মাধু কামিল, বলল নাদির মাকালানি। এদিকে মেয়েটার হোটেলে লোক পাঠাবে কিলিয়ান। বাদ পড়বে না এয়ারপোর্ট। ওকে সাহায্য করবে, এমন সবার ওপর চোখ রাখব। ওই মেয়ে কি আমেরিকান?

মাথা দোলাল লুকমান বাবাফেমি।

ঠিক আছে, আমাদের কন্ট্যাক্টদের জানানো হবে, তারা যেন খুঁজে বের করে কোথায় তার বাড়ি। পরিবারের ওপর চোখ রাখবে। ট্যাপ করতে হবে ফোন। যেভাবে হোক চিরকালের জন্যে বন্ধ করতে হবে তার কণ্ঠ।

ভরসা করতে পারেন আমার ওপর, বলল ভগলার।

কথাটা শুনে শিউরে উঠল বেলা। ভয়ের চোটে ঘুরতে শুরু করেছে মাথা। ওকে খুন করতে চায় এরা!

মন্দিরের দক্ষিণ থেকে চিৎকার করল এক গার্ড। অন্য সব প্যাসেজের শেষে লোহার শিকের দরজা সব বন্ধ। উঠানে আলো ফেলল কিলিয়ান ভগলার। ওদিকের ওই দেয়ালের কাছের পাথরগুলো খুঁজেছ? দেয়ালের ওপর ওঠেনি তো? গার্ডদের দিকে চলল সে। পাথরের ওপর ক্লিপ-ক্লপ আওয়াজ তুলছে তার কাউবয় বুট।

ওর সঙ্গে যাও, বলল নাদির মাকালানি।

কসেকেণ্ড বেলা ভাবল, বাবাফেমিকে বডিগার্ডের সঙ্গে যেতে বলেছে লোকটা। তারপর বুঝল, বলা হয়েছে গার্ডদের একজনকে।

ওই লোকই ওর পিছু নিয়ে এসেছিল এই প্যাসেজে। তার মানে, এ মুহূর্তে পুব দেয়াল আর ওর মাঝে অন্য কেউ নেই!

ভয়কে দূর করল অ্যাড্রেনালিন। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়াল ধরে ঝেড়ে দৌড় দিল বেলা। প্রয়োজনে লাফ দিয়ে উঠছে আরও ওপরের পাথরের ব্লকে।

আরেহ!

ছুটন্ত বেলাকে দেখে ফেলেছে ভগলার।

ভয়ে হাঁপাচ্ছে বেলা। বুক কাঁপছে, যে-কোনও সময়ে গুলি বিধবে পিঠে। কিন্তু গর্জে উঠল না পিস্তল বা রিভলভার। শেষ হয়েছে সাউণ্ড অ্যাণ্ড লাইট শো। এখন গুলি হলে শুনবে অন্তত এক শজন মানুষ। আরেকটা উঁচু ব্লক পেরিয়ে বেলা পৌঁছে গেল পুবের দেয়ালের শেষমাথায়। অন্তত বিশ ফুট নিচে পাথরের মেঝে।

ঘুরে তাকাল বেলা। যেখানে শুয়ে ছিল, অনায়াসে সেই দেয়ালে উঠে এসেছে গিরগিটির মত লোকটা। ছুটে আসছে এখন। ওদিকে প্যাসেজে ফিরেছে গার্ড। দেয়ালের ওপর ঘুরে কুঁজো হয়ে বসল বেলা। এক সেকেণ্ড ভাবল, তারপর পিছলে যেতে দিল শরীরটাকে। হাজার হাজার বছরের পাথর খামচে ধরতে চাইছে আঙুলগুলো দিয়ে। সরসর করে পিছলে নামছে। পায়ের বুড়ো আঙুল খুঁজছে গর্তের মত জায়গা। তেমন কিছুই নেই!

খামচে ধরা এবড়োখেবড়ো পাথর ছেড়ে দিল বেলা। এবারের পতন এল আরও ব্যথা নিয়ে। পিঠ দিয়ে মেঝেতে পড়ল বেলা। কিন্তু বুকে এতই ভয়, গড়ান দিয়ে উঠেই ছুট দিল ধুলোময় প্রান্তরে। ভিড় করে বিদায় নিচ্ছে দর্শকরা। একটু দূরেই বাইরের বেড়ার কাছে এক্সিট।

বেলার পেছনে লোহার শিকের দেয়াল বেয়ে উঠেছে এক গার্ড। ওদিকে দেয়ালের সবচেয়ে উঁচু অংশে পৌঁছেছে। ভগলার। বেলাকে খুঁজছে তার চোখ। কয়েক সেকেণ্ড পর পেয়ে গেল টার্গেট। কিন্তু তখনই কয়েকজনকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে গেল মেয়েটা। আপত্তি তুলল কজন।

কাউকে পাত্তা না দিয়ে কুঁজো হয়ে ভিড়ের মাঝ দিয়ে এগোল বেলা। একবার বেড়ার ওই এক্সিট দিয়ে বেরোলে পৌঁছুবে কায়রোর শহরতলীতে।

লোহার শিকের গেট টপকে নামল গার্ড। একইসময়ে তার পাশে নেমে এল ভগলার। ওপরের মন্দিরের ওয়াকওয়ে ধরে ছুটে আসছে আরও গার্ড।

ছুটবার গতি আরও বাড়ল বেলার। বেপরোয়া হয়ে ধাক্কা দিয়ে বিরক্ত করছে আশপাশের লোকদের। গেটে দাঁড়িয়ে আছে সাদা ইউনিফর্ম পরা দুজন টুরিস্ট পুলিশ। সতর্ক করা হয়নি তাদেরকে। সামনের কজনকে গুতো মেরে পুলিশদের খুব কাছে পৌঁছে গেল বেলা।

পেছনে দৌড়ে আসছে ভগলার ও সেই গার্ড। চিৎকার করে পুলিশদেরকে কী যেন বলছে সিকিউরিটির লোকটা।

ওদিকে মনোযোগ দিল পুলিশ দুজন। এত চিৎকার কীসের জানতে তাদের মতই ঘুরে তাকাল কয়েকজন টুরিস্ট।

মাঝে ফাঁক তৈরি হয়েছে দেখে ওই পথে ছুটল বেলা। পুলিশরা গেট বন্ধ করার আগেই বেরিয়ে এল শহরতলীতে।

কসেকেণ্ড পর সিকিউরিটি গার্ডের বক্তব্য শুনে ধাওয়া করতে চাইল দুই পুলিশ। ততক্ষণে অন্ধকার এক গলির মাঝে পৌঁছে গেছে বেলা। ছায়ার ভেতর দিয়ে চলেছে ব্যস্ত পায়ে। সামনে পড়ল সরু চৌরাস্তা। ডানে বাঁক নিল বেলা। ঢুকে পড়ছে গোলকধাঁধার আরও গভীরে। পেছনে বুটের ধুপ-ধাপ আওয়াজ।

বামে তারপর ডানে বাঁক নিল বেলা। মনে মনে বলল, সামনে কানাগলি না থাকলেই বাঁচি!

আরেকটু এগোতেই এক চৌরাস্তার আগে বামের দেয়ালে পেল সরু ফাটল। কেন যেন ওর মনে হলো, ওদিক দিয়ে ঢুকে পড়াই উচিত। পেট টেনে রেখে ফাটলের মাঝ দিয়ে চলে গেল ওদিকে। ও আছে একটা বাড়ির পেছনের জঙ্গুলে উঠানে। দোতলার জানালায় জ্বলছে মৃদু সবুজ বাতি। উঠান থেকে বেরোবার একমাত্র উপায় বাড়ির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বিস্ফারিত চোখে চুপ করে থাকল বেলা। খুব কাছে এসে ফাটল পেরিয়ে গেল বুটের আওয়াজ। থামল চৌরাস্তার মাঝে। ছুটে আসছে আরও পদশব্দ। ক্লিপ ক্লপ। কিলিয়ান ভগলার।

শ্বাস আটকে ফেলল বেলা।

একবার ওই সরু ফাটল দেখে ফেললে…

আবারও ছুটতে লাগল কয়েক জোড়া বুট। ছড়িয়ে পড়ছে সামনের নানান গলিতে। একটু পর অন্ধকার রাতে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল সব পদশব্দ।

মাটিতে ধুপ করে বসল বেলা। হাঁপাতে শুরু করেছে এতক্ষণে।

পুরো বিশ মিনিট উঠানে লুকিয়ে বসে রইল ও, তারপর ওর মনে হলো আশপাশে কেউ নেই। এবার ফাটল পেরিয়ে আবারও বেরিয়ে এল জনশূন্য, নীরব গলিতে। কোথায় আছে। বুঝে নিয়ে চলল গোলকধাঁধার আরও গভীরে।

পেরোল টানটান উত্তেজনাময় দশ মিনিট। পৌঁছে গেল ছোট এক চত্বরে। একটু দূরের এক ক্যাফে থেকে আসছে মৃদু বাজনা। কাছেই হলদে মারখাওয়া চেহারার এক পে-ফোন বুথ। ওটা দেখে বুকে স্বস্তির সুবাতাস টের পেল বেলা। সতর্ক চোখে দেখল চারপাশ। তারপর গিয়ে ঢুকে পড়ল ফোন। বুথে। পকেটের অবশিষ্ট কয়েন বের করে কল দিল।

ওদিক থেকে বলে উঠল পুরুষ কণ্ঠ: বেলা? তুমি? গনগনে রাগ ম্যান মেটযযের স্বরে।

জী, নিচু গলায় বলল বেলা, ওরা ঠিক করেছে ডাকাতি করবে হল অভ রেকর্ডস! ওখানে একটা সুড়ঙ্গ আছে! মাটি খুঁড়ে…।

বেলার কথা শুনছে না লোকটা। বেলা, এক্ষুণি ফিরে এসো! দেরি না করে নিজেকে তুলে দাও পুলিশের হাতে!

আমি… পুলিশ… এসব কী বলছেন? আমি তো কিছুই করিনি!

হামলা করেছ বলে তোমার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করছেন না মিস্টার বাবাফেমি। কিন্তু দেরি না করে পুলিশের হাতে ধরা দাও। তাদের হাতে তুলে দেবে চুরি করা আর্টিফ্যাক্ট!

কীসের আর্টিফ্যাক্ট? আপত্তির সুরে বলল দ্বিধান্বিত বেলা, আমি তো কিছুই নিইনি!

বেলা, ডক্টর বাবাফেমি আর মাধু কামিল- দুজনই দেখেছে স্ফিংসের একটা টুকরো কেটে নিয়েছ তুমি! বুঝতে পারছ এর পরিণাম কী হতে পারে? এর চেয়ে অনেক কম অপরাধে দশ বছরের জেল হয় লোকের! পালিয়ে গেছ বলে আরও গুরুতর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। পুলিশের হাতে ধরা না দিলে আরও বড় বিপদে পড়বে! আমি দেখব কর্তৃপক্ষ যেন কম শাস্তি দেয় তোতামাকে…

আগে আমার কথা শুনুন! রেগে গিয়ে বলল বেলা। হল অভ রেকর্ডস-এ ডাকাতির সঙ্গে জড়িত বাবাফেমি আর কামিল! নিজে ঘুরে আসুন না, ওখানে…।

বেলা! কড়া ধমক দিল আর্কিওলজিস্ট। এক্ষুণি ফিরে এসো! আত্মসমর্পণ করো! তা যদি না করো, কোনও সাহায্য করতে পারব না। তখন…

ঠাস্ করে রিসিভার রেখে দিল বেলা। শীতল এক ভয়ের স্রোত বইছে ওর মেরুদণ্ড বেয়ে।

এবার কী করবে ও?

ওর হোটেলে চোখ রাখবে নাদির মাকালানি।

 দরকারি কোনও জিনিসপত্র এখন পাবে না ও।

গায়ের কাপড়, প্রিয় ক্যামেরা, অল্প কিছু ইজিপশিয়ান পাউণ্ড, এক শ ইউএস ডলার ছাড়া আর কিছুই নেই ওর।

হোটেলে পাসপোর্ট ও ক্রেডিট কার্ড রাখা উচিত হবে না ভেবেছিল, তাই এখনও সঙ্গে রয়ে গেছে ওগুলো।

এবার কী করবে ভাবতে লাগল বেলা।

একবার যদি কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা দেয়, মুক্তি পাবে না আর। ডক্টর লুকমান বাবাফেমি আর তার দলের লোক সাক্ষ্য দেবে ওর বিরুদ্ধে। এদিকে নাদির মাকালানির লোক ধরতে পারলে,..

যত ভাবছে, বুক ধড়ফড় বাড়ছে বেলার।

ওই লোকগুলো খুন করতে চায় ওকে!

একবার কোনওভাবে মিশর থেকে বেরিয়ে গেলেও, তারা খুন করার জন্যে অপেক্ষা করবে আমেরিকায়। ওর বাবা-মার ওপরও চোখ রাখবে। কাজেই অনুচিত হবে এসবে তাদেরকে জড়ানো।

এদিকে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছে নাদির মাকালানি।

একবার হল অভ রেকর্ডসসে ঢুকলে সরিয়ে ফেলবে অমূল্য আর্টিফ্যাক্ট। আইএইচএর আর্কিওলজিস্টরা পরে কখনও জানবে না, হারিয়ে গেছে কী জিনিস। তা ছাড়া, কোটি কোটি মানুষ নিজ চোখে টিভির পর্দায় দেখবে, হাজার হাজার বছর পর প্রথম মানুষ হিসেবে হল অভ রেকর্ডসসে পা রেখেছে ডক্টর ম্যান মেটয।

এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাউকে সতর্ক করা উচিত।

 কিন্তু সে ম্যান মেটয নয়। কিছুই শুনবে না ওই লোক।

অন্য কাউকে চাই। এমন কেউ, যে কি না বিশ্বাস করবে ওর কথা। এমন একজন, যে দায়িত্বশীল। বোঝাতে পারবে অন্যদেরকে।

ফোন বুথ থেকে বেরিয়ে দূরে সরে এল বেলা। আনমনে নাড়ছে পনিটেইল। ওটার কারণেই মনে এল অন্য চিন্তা।

পাসপোর্ট ছাড়াও ওর প্যান্টের পকেটে আছে ভাঁজ করা একটা কাগজ। হাত ভরে ম্যাগাযিনের পাতাটা বের করল বেলা। ভাঁজ খুলতেই দেখল সুন্দরী এক যুবতীর হাসিমুখ। বেলার মতই পনিটেইল করা চুল।

ছবিটার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল তরুণী।

ডক্টর লাবনী আলম।

আটলান্টিস ছাড়াও বহু আর্কিওলজিকাল সাইট আবিষ্কার করেছেন। তাঁর মত হবার জন্যেই আর্কিওলজি পড়তে শুরু করেছিল বেলা।

অদ্ভুত দৃঢ়চিত্তের মানুষ ডক্টর আলম। বারবার অবিশ্বাস করা হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত দারুণ সব আর্কিওলজিকাল আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, তিনিই ছিলেন সঠিক।

আরেকবার ছবিটা দেখল বেলা আবাসি।

বহু দূরে ঢিল ছুঁড়তে হচ্ছে ওকে।

এখন আর আইএইচএর সঙ্গে নেই ডক্টর লাবনী আলম। অযোগ্য একদল আর্কিওলজিস্ট ষড়যন্ত্র করে ওই সংগঠন থেকে বিদায় করেছে তাকে। সুন্দরী মহিলা আর্কিওলজিস্টের মুখোমুখি হয়ে আলাপের ইচ্ছে ছিল বেলার, কিন্তু সে সুযোগ আর পায়নি।

তবে মিশরে কী ঘটছে, তা নিশ্চয়ই ক্ষমতাশালী কাউকে বোঝাতে পারবেন ডক্টর লাবনী আলম।

অবশ্য সেজন্যে আগে যোগাযোগ করতে হবে ডক্টর আলমের সঙ্গে। উনি এখন আছেন নিউ ইয়র্কে, আর ও নিজে আছে স্ফিংস থেকে মাত্র সিকি মাইল দূরে।

এক পা এক পা করে এগোতে হবে, মন শান্ত করতে চাইল বেলা। চলল কায়রো শহরের কেন্দ্র লক্ষ্য করে।

.

০২.

ইউনাইটেড নেশন্স-এর বিশাল, উঁচু দালানের দিকে চেয়ে আছে ডক্টর লাবনী আলম। মনে নানান অনুভূতি। মাত্র সাত মাস আগেও এখানে ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সির চিফ হিসেবে কর্মরত ছিল। কিন্তু হিংসুটে কজন শ্বেতাঙ্গ আর্কিওলজিস্ট নানান মিথ্যা অভিযোগ আনল। ফলে প্রায় তদন্ত ছাড়াই বিদায় করে দেয়া হলো ওকে ওই পদ থেকে। লাবনীর ওপর চরম অন্যায় হচ্ছে: প্রবল আপত্তি তুলেছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে কাজ হয়নি তাতে।

আজ আবারও আইএইচএ বা ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সির অফিসে পা রাখবে লাবনী আসলে বন্ধু মাসুদ রানার অনুরোধেই, নইলে কিছুতেই আসত না এখানে।

তিনদিন আগে নিউ ইয়র্কে এসেছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সুযোগ্য রত্ন, দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানা। খুব ব্যস্ত ছিল রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির কাজে। পুরো দুদিন ধরে এজেন্টদের জটিল সব কেসের জরুরি সূত্র খুঁজে দেয়া এবং দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের পর বিসিআই থেকে পেয়েছে মাত্র কয়েক দিনের ছুটি।

গতকাল সন্ধ্যায় লাবনীর অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হয়ে একেবারে চমকে দিয়েছে ওকে। প্রিয় বান্ধবীকে নিয়ে ডিনার সেরেছে সাগরতীরে প্রাচীন এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয়।

কয়েক মাস আগে ভারতে শিবের গুহা থেকে বেরিয়ে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল ওরা। কিন্তু দুজনই ছিল সচেতন, তাই শুরুতেই সামলে নিয়েছে নিজেদেরকে। চায়নি নষ্ট হোক ওদের মিষ্টি-মধুর বন্ধুত্ব। ঠিক করেছে, পারতপক্ষে নষ্ট করবে না এই হঠাৎ গড়ে ওঠা সুন্দর সম্পর্ক। দেখাই যাক না ভবিষ্যৎ কোথায় নিয়ে যায় ওদের দুজনকে!

ডিনারে কথাটা তুলেছিল লাবনীই।

আজ সকাল এগারোটায় অ্যাপার্টমেন্টে বসে আছে, এমনসময় ফোন করলেন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর অ্যালবার্ন ফিলবি। লাবনী রিসিভার তুলতেই তিনি বললেন, হ্যালো, মাই ডিয়ার লাবনী, কেমন আছ?

ব্যস্ততার কারণে গত দুমাস যোগাযোগ হয়নি দুজনের।

হাই, প্রফেসর ফিলবি! আমি ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন, স্যর? বলল লাবনী।

আমি? একদম মরেছি! মৃদু হাসলেন প্রফেসর। তোমাকে ফোন করেছি একটা জরুরি কাজে, একটু সময় দিতে পারবে?

আজকাল তো কোনও কাজই নেই আমার, বলল লাবনী। আপনার কোনও কাজে নিশ্চয়ই সময় দিতে পারব?

এরপর সরাসরি মূল কথায় এলেন প্রফেসর ফিলবি। জানালেন, কেন যেতে চেয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সির বর্তমান অস্থায়ী চিফ, প্রফেসর ক্যাথারিন ট্রিপের সঙ্গে কথা বলতে। এরপর বললেন, আমার মত আরও অনেকেই চাইছেন বন্ধ হোক কিংসের ওই প্রোগ্রাম। ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ আনতে চেয়েছিলাম প্রফেসর ট্রিপের কাছে। কিন্তু… চুপ হয়ে গেলেন ফিলবি।

কিন্তু? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল লাবনী। রেগে গেছে প্রফেসর ট্রিপের নাম শুনে। ওই মহিলাই আমেরিকার সরকারের উঁচু পর্যায়ের কজনকে লেলিয়ে দিয়েছিল ওর পেছনে। ওই একই মহিলা স্বামীর রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে চেপে বসেছে ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ এজেন্সির চিফের পদে।

শেষমেশ মিটিঙে রাজি হয়েছে ট্রিপ, আগামীকাল মিটিং।

তাই? খুব ভাল হলো!

মিষ্টি কিন্তু মিথ্যা এমন অনেক কথা বলতে হয়েছে, বুঝতেই পারছ। কিন্তু দুঃখের কথা, চাইলেও আগামীকাল তার সঙ্গে দেখা করতে পারব না।

কেন, প্রফেসর ফিলবি?

কারণ দোতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে ফেলেছি। ডান পা এখন মিশরের মামির মতই ব্যাণ্ডেজ করা।

হায়, আল্লা! শুনে খুব খারাপ লাগছে। নরম সুরে জানতে চাইল লাবনী, এখন কেমন বোধ করছেন, স্যর?

যখন যুবক ছিলাম, পোল ভল্ট আর হাই জাম্পে ইউনিভার্সিটির চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। কিন্তু বয়স হয়েছে তো, বুঝতেই পারছ, লেগে আছে নানান রোগ। এখন তিন ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে নামলে হাত-পা ভেঙে খুন হয়ে যাব।

তা হলে প্রফেসর ট্রিপের সঙ্গে আলাপ করবেন কী করে? আগের কথায় ফিরল লাবনী।

সেজন্যেই তো তোমাকে ফোন করেছি। তুমি যদি আমার জায়গায় যেতে…

স্যর, এটা সম্ভব নয়, অদ্ভুত প্রস্তাব পেয়ে চমকে গেছে লাবনী। ওঁর কারণেই অপমানিত হয়েছি। চাকরি গেছে আমার।

তা ঠিক। ইয়ে… সত্যিই বিচ্ছিরি হবে মহিলা আবারও তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে। এদিকে এটাও ঠিক, আর্কিওলজিকে হাস্যকর করে তুলছে সে। টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন আর ম্যান মেটযয়-এর বকরবকর। আমাদের মত আর্কিওলজিস্টদের আর কোনও সম্মান থাকছে না।

ম্যান মেটয আর বিজ্ঞাপন আমিও দেখেছি, বলল লাবনী, কদিন পর উন্মোচিত হবে হল অভ রেকর্ডস।

এসব নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন, কোনও সায়েন্স নয়, বললেন প্রফেসর ফিলবি। আর এরপর যদি সত্যি দেখা যায়, কিছুই পাওয়া গেল না, তখন আর্কিওলজি পেশাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে সবাই। আমার মত কজন চেয়েছেন, এ বিষয়টি তুলে ধরবেন প্রফেসর ট্রিপের সামনে। কিন্তু অন্যরা এখন ভিন দেশে নানান খননে ব্যস্ত। তাই বাধ্য হয়ে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।

কিন্তু, স্যর, প্রফেসর ট্রিপের মুখোমুখি হতে চাই না, চাই জীবনেও যেন আর দেখা না হয় তার সঙ্গে, বলল লাবনী।

বুঝতে পেরেছি, বললেন প্রফেসর। কয়েক সেকেণ্ড পর জানালেন, ভাবছিলাম, তুমি রাজি হবে না। তবুও চেষ্টা করে দেখলাম আর কী! উপযুক্ত কারও না কারও তো জানাতে হবে মহিলাকে, কী সর্বনাশ ডেকে আনছে সে!

মন থেকে তিক্ততা সরিয়ে বলল লাবনী, আমার উচিত হবে না কিছু বলা। ক্ষমতায় গিয়ে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছে প্রফেসর ট্রিপের দলের সবাই।

নিজেকে ছোট ভেবো না, লাবনী, বললেন ফিলবি, ভুলে যেয়ো না, আবিষ্কার করেছ আটলান্টিস এবং শিবের গুহা। অন্য কেউ কিন্তু পারেনি। অন্তর থেকে জানি, আবারও ভাল সময় আসবে তোমার।

চুপ করে রইল লাবনী।

যাক গে, হাল ছেড়ে দিলেন ফিলবি, উপায় থাকল না মহিলাকে কিছু বোঝাবার। প্রার্থনা করছি, মস্তবড় কোনও বিপর্যয় যেন না হয় আর্কিওলজিকাল সমাজের।

আমিও তাই আশা করি, স্যর, বলল লাবনী।

ভাল থেকো, লাবনী, সুস্থ হয়ে দেখা করব তোমার সঙ্গে।

ভাল থাকুন, স্যর, অন্তর থেকে বলল লাবনী। সুযোগ মত একবার গিয়ে দেখে আসব আপনাকে।

একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিলেন প্রফেসর।

ডিনারে বসে এসব বলার পর নিজ সিদ্ধান্ত রানাকে জানাল লাবনী: চরম দুর্বহারের মহারানি ট্রিপ এখন ওই সংস্থার চিফ, তাই আর কখনও পা রাখবে না আইএইচএতে।

সব মন দিয়ে শুনেছে রানা। তারপর নরম সুরে বলেছে, তোমার বোধহয় একবার ঘুরে আসাই ভাল ছিল। অন্তত জানবে প্রফেসর ফিলবির অভিযোগের বিরুদ্ধে কী বক্তব্য আছে ক্যাথারিন ট্রিপের।

.

রানাকে কথা দিয়েছে বলেই দুমুখ ক্যাথারিন ট্রিপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে লাবনী। ইউএন ভবনের দিকে চেয়ে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাঁপছে ওর বুক। জানা নেই, আবারও বিনা দোষে অপমানিত হবে কি না! মনে পড়ল, নিজেও রানা আছে ঝামেলায়, তবে ভয়ঙ্কর অপমানের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে না বাঙালি গুপ্তচরকে।

আটলান্টিস থেকে পাওয়া সৌভাগ্যের লকেটটা গলার কাছে একবার স্পর্শ করল লাবনী, তারপর ঢুকে পড়ল ভবনের ভেতর।

ওর মনে হলো আগের চেয়ে ধীরে চলছে এলিভেটর। জায়গাও হয়ে উঠেছে সংকীর্ণ। বাতাস নেই ভেতরে। বুঝতে পারছে, বদমেজাজি মহিলার সঙ্গে দেখা করতে হবে ভেবে গলা শুকিয়ে গেছে ওর।

এলিভেটরের দরজা হাঁ হতেই একটু দূরে গুনগুন শব্দে খুলল সিকিউরিটি ডোর। লাবনী দেখল, আগের মত নেই রিসেপশন, সেখানে কদর্য কিছু আসবাবপত্র। তবে আগের মতই ডেস্কের পেছনে পরিচিত সেই হাসিখুশি মেয়েটি।

ডক্টর আলম! লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল লিপি গোমেয। কেমন আছেন?

ভাল। তুমি কেমন আছ, লিপি? মেয়েটা এগিয়ে আসতেই ওকে জড়িয়ে ধরল লাবনী।

ভাল নেই, কয়েক সেকেণ্ড পর এক পা পিছিয়ে গেল লিপি। চট করে দেখল চিফের অফিসের দরজা। নিচু স্বরে বলল, সহ্য করছি অসহ্য দুর্ব্যবহার। বাঙালিদের পছন্দ করেন না মিসেস ট্রিপ। রাখতে চাইছেন নিজের পছন্দের লোক।

যা খুশি করার অভ্যেসটা ক্যাথারিন ট্রিপের বহু পুরনো, বলল লাবনী, তবে দাঁতে দাঁত টিপে টিকে থাকো। আজকাল আর আমেরিকায় সহজে ভাল চাকরি পাওয়া যায় না।

নিজে হুড়মুড় করে টাকা রোজগার করছেন ট্রিপ, প্রায় ফিসফিস করল লিপি।

মৃদু মাথা দোলাল লাবনী। অন্যান্য কারণের মধ্যে এটাও একটা, যেজন্যে এখানে এসেছি। প্রফেসর ফিলবি অনুরোধ করেছেন, যেন তার হয়ে মিটিং করি মিসেস ট্রিপের সঙ্গে। এদিকে তোমার মাসুদ ভাই প্রায় ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন, নইলে ভিড়তাম ওই সাপের ধারে-কাছে?

ডেস্কের পেছনে গিয়ে কমপিউটার স্ক্রিন দেখল লিপি। প্রফেসর ট্রিপ এখন আছেন ডক্টর মেটয-এর সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সে। সাধারণত পনেরো মিনিটের বেশি লাগে না। তারপর স্কেজুয়াল অনুযায়ী দেখা করবেন প্রফেসর ফিলবির সঙ্গে। উনি ভিডিয়োকনফারেন্স রুম থেকে বেরোলেই জানাব, প্রফেসর ফিলবির হয়ে দেখা করতে এসেছেন। আপনি।

আর আমাকে দেখলেই পেয়ে বসবে, বলল লাবনী। অভদ্র মহিলার কথা ভাবতে গিয়ে আবারও রেগে উঠছে। বুঝতে পারছে, এখানে এসে কোনও লাভই হয়নি। যা খুশি বলবে মহিলা। কোনওমতেই তাকে ঠেকাতে পারবে না ও। তবে ঠিক করল, শুনিয়ে ছাড়বে নিজের বক্তব্য। তাতে অন্তত ঠাণ্ডা হবে মাথা।

মিসেস ট্রিপ ঠিকই দেখা করবেন, মনিটরের পাশের ট্রে দেখল লিপি। ও, একটা কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! আপনার জন্যে একটা মেসেজ এসেছে।

আমার জন্যে? বিস্মিত হলো লাবনী।

 জী। এক ইন্টার্ন… এই যে, কয়েকটা কাগজ সরিয়ে ছোট এক চিরকুট নিয়ে লাবনীর হাতে দিল লিপি। মেয়েটার নাম বেলা আবাসি। গতকাল ফোন করেছিল। ফোন নম্বর চাইল। নিয়ম নেই, তাই দিইনি। তবে বলেছি, মেসেজটা পাঠিয়ে দেব। অফিস ছুটির পর ফোন করেছি, কিন্তু কমপিউটারাইড় মহিলা কণ্ঠ বলল, দুমাস আগে ডিসকানেক্ট করা হয়েছে ওই লাইন। মোবাইল ফোনও বন্ধ পেয়েছি।

হ্যাঁ, অন্য অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেছি, বলল লাবনী। আর ট্রিপের চেলা আর্কিওলজিস্টরা বিব্রত করছিল, তাই পাল্টে ফেলেছি মোবাইল ফোনের সিম কার্ড।

প্রাক্তন বসের দুর্গতির কথা শুনে আফসোস করে মাথা নাড়ল লিপি।

কাগজে চোখ না বুলিয়ে জানতে চাইল লাবনী, কী জন্যে যোগাযোগ করতে চায়?

বলেনি। অবাক কাণ্ড, ওই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে এই অফিসের কেউ কেউ। ডক্টর মেটয-এর খননের সঙ্গে জড়িত ছিল বেলা আবাসি। কেউ না বললেও আমার মনে হয়েছে, ইজিপশিয়ান পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে ওই মেয়ে। হাসিখুশি, সুন্দরী তরুণী। মনেই হয়নি, ও অন্যায় করার মত মানুষ। তবে এ-ও ঠিক, আপনি চলে যাওয়ার পর তোক নেয়ার পলিসি বদলে গেছে। আজকাল আর খোঁজ নেয়া হয় না মানুষটা ভাল কি না।

কাগজে লেখা ফোন নম্বরটা পড়ল লাবনী, তারপর রেখে দিল পার্সে। কী যেন বলবে, এমনসময় খুলে গেল করিডোরের দরজা। ঘুরে তাকাল লাবনী। রিসেপশনে এসে ঢুকলেন আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর ক্যাথারিন ট্রিপ। লাবনীকে দেখেই থমকে গেলেন। দুসেকেণ্ড পর এগিয়ে এলেন ঠোঁটে টিটকারির হাসি নিয়ে। আরে, ডক্টর লাবনী যে!

শুকনো গলায় বলল লাবনী, কেমন আছেন, মিসেস ট্রিপ?

কখনও ভাবিনি আবারও আসবে। কী চাই তোমার?

জরুরি আলাপ করতে এসেছি।

চশমার পুরু কাঁচের পেছনে সরু হলো ট্রিপের চোখ। আমি ব্যস্ত, লাবনী। মিটিং আছে প্রফেসর ফিলবির সঙ্গে। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে তাকে?

অবশ্যই! সত্যি বলতে, তিনিই পাঠিয়েছেন আমাকে, যেন তাঁর হয়ে এই মিটিঙে কথা বলি। আপাতত তিনি অসুস্থ।

ও। সহানুভূতির ছাপ নেই প্রফেসর ট্রিপের চোখে মুখে। আশা করি খুব সিরিয়াস কিছু নয়।

না, তা নয়। তবে কয়েক দিনের জন্যে হাঁটতে পারবেন। সেজন্যেই চেয়েছেন, যেন ওঁর হয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলি।

মহিলার অন্তর পড়তে পারল লাবনী।

এককথায় ওকে উড়িয়ে দিত ক্যাথারিন, কিন্তু প্রফেসর ফিলবি নামকরা আর্কিওলজিস্ট। অ্যাকাডেমিক সমাজে তিনি অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁর প্রতিনিধিকে ফিরিয়ে দিলে সেটা হবে প্রফেসরকে অপমান করা। তাতে প্রকাশ পাবে, ক্যাথারিন ভয় পাচ্ছে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে।

ঠিক আছে, এসো, বিরক্তি নিয়ে বলল ট্রিপ, কয়েক মিনিট খরচ করতে আপত্তি নেই। তবে তা করছি প্রফেসর ফিলবির সম্মানে। নিজের অফিসের দিকে চলল মহিলা।

একবার লিপিকে দেখে নিয়ে ট্রিপের পেছনে প্রশস্ত ঘরে ঢুকল লাবনী। আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

সাত মাস আগেও এটা ছিল ওর অফিস। কাঁচ দিয়ে ঢাকা চওড়া জানালার ওদিকে ম্যানহাটান।

প্রকাণ্ড ডেস্কের পেছনে বিশাল চেয়ারে বসল প্রফেসর ট্রিপ। অপেক্ষাকৃত কম আরামদায়ক সিট হাতের ইশারায় দেখাল। হ্যাঁ, কী? কী বলতে চেয়েছেন প্রফেসর ফিলবি?

ওই বিষয়ে, ডেস্কে পড়ে থাকা চকচকে ব্রোশার দেখাল লাবনী। প্রচ্ছদে সোনালি লেখা: দ্য লাইভ টেলিভিশন ইভেন্ট অভ দ্য ডিকেড! নিচে গিজার প্রকাণ্ড স্ফিংস। ব্রোশারটা তুলে নিল লাবনী। যতবার টিভি খুলছি, দেখছি ওই বিজ্ঞাপন। ভাবতেও পারিনি, প্রাইম টাইম টেলিভিশন বা বিদঘুটে কোনও কাল্টের সঙ্গে কাজ করবে আইএইচএ।

কারও সঙ্গেই কাজ করছে না আইএইচএ, লাবনী, রাগী কণ্ঠে বলল ক্যাথারিন। ওসাইরিয়ান টেম্পল কাল্টকে সঙ্গে রাখা হয়েছে, যাতে যথেষ্ট ফাণ্ড পাওয়া যায়। এদিকে টিভির বিজ্ঞাপন থেকে আসছে প্রচুর টাকা। পরে অন্যসব প্রজেক্টে তা ব্যয় করা হবে। তাতে দুনিয়া জুড়ে নাম হবে আইএইচএর। সবদিক থেকেই লাভবান হব আমরা। ভাল ব্যবসা বলতে পারো। ক্ষতির কোনও সম্ভাবনাই নেই।

তাই? মাথা নাড়ল লাবনী। জানা ছিল না আইএইচএ এখন ব্যবসায়িক সংস্থা। ব্রোশার খুলল ও। প্রথমেই দেখল পিরামিডের সামনে নায়কের মত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে ডক্টর ম্যান মেটয। মেটযের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন?

সেরা প্রার্থী ছিল সে।

কিন্তু সে তো নিজের ঢাক পেটাবার ওস্তাদ, সত্যিকারের আত্মশ্লাঘী। তার বদলে জন গ্যারিসন বা কার্ল গ্রেবার নয় কেন? অভিজ্ঞতার দিক থেকেও তারা ছিল, মেটযের চেয়ে অনেক দক্ষ।

তোমার যখন জানতেই হবে, তো শোনো, তালিকায় ওরাও ছিল, শীতল কণ্ঠে জানাল ক্যাথারিন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দ ম্যান মেটযয। সবার মধ্যে তার উপস্থাপন ছিল সেরা।

তার মানে, আপনার লালচে, ফোলা পাছায় ভালভাবে পুচপুচ করে চুমু দিয়েছে মেট, ভাবল লাবনী। মুখে বলল, ও, তবে পুরাতত্ত্বের রীতিনীতি বিসর্জন দিয়েছে ম্যান মেটযই।

তুমি কী বলতে চাও, লাবনী?

যা খুশি করছে সে। সঠিকভাবে খনন না করে ছুঁড়ে ফেলেছে এতদিনের বিজ্ঞানকে। ছুটছে টিভি প্রযোজকদের পেছনে।

অন্তত তোমার মুখে এসব মানায় না, ধমকের সুরে বলল ক্যাথারিন ট্রিপ, কী বোঝো আর্কিওলজিকাল সায়েন্স? নিজে কবে নিয়ম মেনে কাজ করেছ? আরে, এ কারণেই তো বিদায় করেছে তোমাকে এই সংস্থা থেকে! নাকি ভুলে গেছ, তুমি এখন আর আইএইচএতে নেই?

আমার বিষয়ে কথা হচ্ছিল না, রাগে গা জ্বলছে লাবনীর। আঙুল তাক করল ব্রোশারের দিকে। কথা হচ্ছিল, পয়সার লোভে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আইএইচএ। যে সংস্থার দায়িত্ব প্রাচীন নিদর্শন রক্ষা করা, সেটাই এখন ওগুলোকে ভাঙিয়ে খেতে শুরু করেছে!

ও, এবার বুঝলাম তোমার উদ্দেশ্য, সরু দুঠোঁট বাঁকা করে হাসল ক্যাথারিন। ফালতু যুক্তি দাঁড় করিয়ে চাপড়ে নেবে নিজের পিঠ? প্রমাণ করতে চাইবে তুমি ঠিক, অন্যরা প্রথম থেকেই ভুল করেছে? উঠে দাঁড়িয়ে লাবনীর দিকে ঝুঁকে এল সে। মগজ থেকে বদচিন্তা দূর করো, লাবনী! যতই ভাবো তোমাকে ছাড়া চলবে না আইএইচএ, বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। আসল কথা, তোমার আমলের চেয়ে ঢের ভালভাবে চলছে এখন এ সংস্থা। শুনে রাখো, তুমি বিদায় হওয়ার পর থেকে মারা যায়নি একজন আর্কিওলজিস্টও!

বড় করে দম নিল লাবনী। আপনার মনটা বড় ঘোট, ট্রিপ, মনে মনে বলল ও।

এমন কী ক্যাথারিন ট্রিপের চেহারাতেও প্রকাশ পেল, অত্যন্ত বাজে কথা বলে ফেলেছে সে। পেরিয়ে গেল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর শান্ত স্বরে বলল বদরাগী মহিলা, যা বলতে এসেছিলে, বলা হয়েছে তোমার। এবার ভাল হয় তুমি বিদায় নিলে। খুশি হব এরপর আর কখনও যদি না আসো।

প্রচণ্ড রাগ সামলাতে গিয়ে হাত মুঠো করে ফেলেছে। লাবনী, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মনে রাখবেন, ইজিপ্টে আপনি যা করছেন, সেটা আর্কিওলজিকাল পেশার জন্যে অপমানজনক। এটা আপনি নিজেও ভাল করেই জানেন।

আমরা দুজনই জানি, কে আসলে পচিয়ে ছেড়েছে এই পেশাটাকে, বলল ক্যাথারিন ট্রিপ।

ওই অফিস থেকে বেরিয়ে এল লাবনী। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ওর চোখ পড়ল রিসেপশনে লিপির ওপর। লাবনীর রাগী চোখ দেখেই যা বোঝার বুঝেছে মেয়েটা। মাথা নিচু করে নিল।

ইউএন ভবন থেকে বেরিয়ে একটু দূরে উত্তরদিকের পার্কে বসল লাবনী। ঠাণ্ডা করতে হবে মাথা। চুপ করে বসে থাকল চোখ বুজে।

দশ মিনিট পর চোখ মেলে পার্স থেকে নিল বেলা আবাসির দেয়া ফোন নম্বর। ভাবছে, কথা বলবে কি না। লিপি জানিয়েছে, ইজিপশিয়ান পুলিশী ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে মেয়েটা। কোনও গোলমালে পড়তে চায় না লাবনী। তবে কিছুক্ষণ পর ভাবল, দেখিই না কেন খুঁজছে মেয়েটা আমাকে!

আজ সকালে নিউ ইয়র্কে রানা এজেন্সির তিনতলায় ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ইন্টারকমের আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই ভয় পেল দুর্দান্ত সাহসী, দুর্ধর্ষ মাসুদ রানা। নিচের রিসেপশন থেকে জানানো হয়েছে, ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন রোমান্টিক সিনেমার বর্তমান সময়ের সুপারক্রে নায়করাজ গিবন মুর।

ওই যুবককে সিনেমা-জীবনের শুরুর দিকে সাহায্য করেছিল রানা। তাতে ওর ভক্ত হয়ে যায় সে। পরে নিউ ইয়র্কে ইউএন ভবনের ভল্ট থেকে স্টাডা কোডেক্স সরাবার পর, তার কাছ থেকে একবার সাহায্য নিয়েছে রানা। নইলে সফল হতো না প্ল্যান, কখনওই ভারতে গিয়ে লাবনীকে উদ্ধার করতে পারত না বিলিওনেয়ার মঙ্গেলকারদের হাত থেকে। কাজেই এককথায়, নায়কের অনুরোধ ফেলতে পারবে না ও। মুরকে ওর অফিসে বসাতে বলেছে রানা।

দশ মিনিট পর নেমে এসেছে নিচের অফিসে। আর অমনি ওকে চেপে ধরেছে নায়ক। একটাই কাতর অনুরোধ: মিস্টার রানা, প্লিয-প্রিয, আমাকে বাঁচান!

কী হয়েছে আপনার? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে রানা।

মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে মুর। আপনি তো জানেন, গোটা বিশেক রোমান্টিক সিনেমায় কাজ করেছি। নামও হয়েছে তাতে। কিন্তু এবার দারুণ সুযোগ এসেছে নিজের খোলনলচে পাল্টে ফেলার। যে ডিরেক্টর আমাকে অ্যাকশান সিনেমায় নিয়েছেন, তিনি আবার অস্কারপ্রাপ্ত। প্রথমেই বলে দিয়েছেন, দেখার মত হতে হবে আমার চলন-বলন। কিন্তু আপনি তো জানেন, বাস্তবের ধারে-কাছেও থাকি না আমরা সিনেমার নায়করা। এদিকে এবারের সিনেমায় অভিনয় করব উঁদে এক গোয়েন্দার ভূমিকায়। তাই ছুটে এসেছি আপনার কাছে। করুণ চোখে রানাকে দেখল মুর।

আমাকে কী করতে হবে? জানতে চাইল রানা।

আপনি চাইলে বাঁচাতে পারেন আমাকে। জুলজুল করে তাকিয়ে আছে মুর রানার মুখের দিকে।

বিপদটা কী, সেটাই বুঝছি না, বলল বাঙালি গুপ্তচর।

ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসল মুর। বুঝবেন কী করে, আমি কি বলেছি নাকি?

তা হলে বলে ফেলুন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

মাত্র একটা দিন সময় দেবেন।

তাতে কী লাভ হবে?

আপনি শুধু থাকবেন আমার পাশে।

পাগলাটে নায়ককে জিজ্ঞেস করল রানা, তাতেই কেটে যাবে বিপদ?

নিশ্চয়ই! নানান অনুষ্ঠানে যাব, সবার সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেব। একটু দূর থেকে খেয়াল করব আপনার হাঁটাচলা, কথা, হাসি বা চাহনি। সোজা কথায়, সব গেঁথে নেব মনে। পরে পুরো ফলো করব আপনাকে। এটাই আমার বাঁচার একমাত্র উপায়। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ডুবিয়ে দেবেন না?

ও, তার মানে আমাকে অনুকরণ করবেন?

হ্যাঁ, এই তো বুঝতে পেরেছেন! আপনার মত দুর্ধর্ষ মানুষ আর দেখিনি আমি। পুলিশ বা আর্মির কাউকে অনুকরণ করতে পারতাম, কিন্তু কাহিনীর নায়ক আবার প্রাইভেট ডিটেকটিভ। পিছু নিয়েছে দুর্দান্ত সুন্দরী এক খুনি মেয়ের। সবই মিলে যাচ্ছে আপনার জীবনের সঙ্গে। আমার ধারণা, আপনাকে নকল করলেই ব্যবসা-সফল হবে এই সিনেমা।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রানা। জরুরি কোনও কাজ নেই ওর হাতে।

সামান্য হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে আছে মুর। প্ল্যি, মিস্টার রানা, বাঁচান! আপনি রাজি হলে, চলুন, বেরিয়ে পড়ি!

ঠিক আছে, চলুন, চেয়ার ছাড়ল রানা। যাওয়ার পথে কোনও রেস্তোরাঁ থেকে নাস্তা করে নেব।

আরে, ভাই, দুনিয়ার সেরা নাস্তা খাওয়াব আমি আপনাকে। চেয়ার ছেড়ে খুশিতে একপাক নেচে নিল নায়ক। এমন অনুকরণ করব, লোকে সিনেমা দেখে বলবে, অভিনয়ই করিনি। সবই বাস্তব!

বাইরে এসে দেখল রানা, কমলা নতুন ল্যাম্বোরগিনি সুপারকার চেপে এসেছে নায়ক।

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে খাবার সেরে চলল ওরা প্রথমে ওসাইরিয়ান টেম্পলের উদ্দেশে।

.

বাইরে থেকে বাড়িটা দেখলে বোঝা যায় না ওটা কোনও মন্দির। অবশ্য গেটের ওপরের নিয়ন সাইনবোর্ডে লেখা:

ওসাইরিয়ান চার্চ।
ভেতরে ত্রিকোণ এক ছোট পিরামিড।

মস্তবড় হলঘরে জড় হয়েছে অন্তত দু শজন মানুষ। অনেকে হৈ-হৈ করে উঠল নায়ককে দেখে। সই দিতে হলো নোটবুকে।

নিউ ইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ কজন নাগরিকের সঙ্গে রানাকে পরিচয় করিয়ে দিল গিবন মুর। তাদের ভেতর আছেন মেয়র। আগে থেকেই রানাকে ভাল করে চেনেন, তাই অবাক হয়েছেন ওকে ওসাইরিয়ান ধর্মের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখে।

বাড়িতে ঢোকার সময় রানাকে বলেছে নায়ক, এই চার্চ খ্রিস্টানদের চার্চের চেয়ে ঢের ভাল। পৃথিবী জুড়ে নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এই ধর্ম।

অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও বেশ দেরি। অনেকে ঘিরে রেখেছে মুরকে। তবে তাদের প্রতি তেমন নজর নেই তার। খেয়াল করছে রানার আচরণ।

একটু পর হঠাৎ করেই তাকে ও রানাকে ফেলে ছিটকে দরজার দিকে ছুটল সবাই। গেটের সামনে থেমেছে কালো এক ক্যাডিলাক। পেছনের দরজা খুলে দিল বডিগার্ড। গাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানহাত তুলল দীর্ঘদেহী এক লোক। অদ্ভুত রূপবান সে। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ।

ওসাইরিস! সবার আগে চেঁচিয়ে উঠল কেউ।

পরক্ষণে চিৎকার ছাড়ল প্রায় সবাই: ওসাইরিস! মহান ওসাইরিস! আমাদের দেবতা-রাজা!

রানা দেখল, করুণভাবে হার মেনেছে মুর। বুঝে গেছে, মানুষের কাছে ওর মূল্য ধর্মগুরুর চেয়ে ঢের কম।

লোকটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে রানা।

অদ্ভুত শক্তিশালী কারিশমা তার। প্রবল আত্মবিশ্বাসী। যেন সিনেমার নায়ক!

কমুহূর্ত পর রানা টের পেল, বয়স তার পঞ্চাশ মত।

ওসাইরিয়ান মন্দিরে স্বাগতম! গমগমে কণ্ঠে বলল কাল্ট নেতা, আমি খুশি যে, আপনারা এসেছেন। আপনাদের হৃদয়ে আলো জ্বেলে দেবেন সূর্য-দেবতা রা।

জবাবে ভিড় থেকে কজন বলে উঠল, অতীত ওসাইরিসের আত্মা আরও শক্তিশালী করুন আপনাকে, প্রভু!

সবাই দুভাগ হয়ে যেতে মাঝ দিয়ে হেঁটে মঞ্চে গিয়ে উঠল বর্তমানের ওসাইরিস।

রানা লক্ষ্য করল, ওই লোকের বেশিরভাগ ভক্ত সুন্দরী মেয়েরা।

এবার ক্যাডিলাক থেকে বেরোল আরেক লোক। ভুরু কুঁচকে রেখেছিল, দর্শক দেখে মুখে টেনে আনল হাসি।

এ ওসাইরিসের আপন ভাই বা নিকট আত্মীয়, ভাবল রানা। তবে জেনেটিক লটারিতে এবং এই জীবনে জিতে গেছে এর বড় ভাই।

কঠোর চেহারা এর। অপেক্ষাকৃত সরু মুখের একপাশে মারাত্মক পোড়া এক ক্ষতচিহ্ন।

লোকটার সঙ্গে রয়েছে তেলতেলে চুলের এক লোক। পরনে সাপের চামড়ার জ্যাকেট। লাল ঘাড়। কঠোর চোখে দেখছে চারপাশ। আগে কখনও ছিল মিলিটারিতে।

সিনেমার নায়কের সঙ্গেই থাকল রানা।

ওসাইরিসের মঞ্চের কাছে চলে গেল ওরা দুজন।

মঞ্চের ওপর থেকে ঝুঁকে আন্তরিকভাবে মুরের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল ধর্মগুরু। ভিড় থেকে ঝলসে উঠল অনেক ফ্ল্যাশ। তার আগেই প্রায় পাশাপাশি হয়ে চওড়া হাসি দিয়েছে ওসাইরিস আর মুর।

হ্যাঁ, মিস্টার মুর! কেমন আছেন আপনি?

ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন, ওসাইরিস?

খুশি হব কাদির বলে ডাকলে। সিনেমায় দেখেছি বলে আপনাকে যেন চিনি বহুকাল থেকে। আমার সৌভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত দেখা হলো।

এ কথায় আনন্দিত হয়ে হাসল মুর। সত্যিই? দারুণ তো! এদিকে আমিও আপনার ভক্ত! সিনেমাও দেখেছি। ওসাইরিস অ্যাণ্ড সেট ছিল দেখার মত একটা সিনেমা। আপনাকে দেখতে লেগেছে দুর্দান্ত!

মৃদু হাত নেড়ে ভদ্রতা দেখাল ওসাইরিস। একবার চলে আসুন সুইটয়ারল্যাণ্ডে আমাদের ওসাইরিয়ান টেম্পলে। ঘুরিয়ে দেখাব সব। যখন খুশি আসতে পারেন। আমার দরজা সবসময় ভোলা থাকবে আপনার জন্যে। তবে আজকাল আর সিনেমায় কাজ করি না। আমার জন্যে পুরনো হয়ে গেছে ওই পেশা। এসেছে দেবতার তরফ থেকে অমোঘ এক আহ্বান। আমি খুশি, আপনি আমার ধর্মের বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন। এবার ঘুরে শ্রোতাদের উদ্দেশে বলল সে, আপনারা যারা চেয়েছেন অসাধারণ এই অভিযাত্রায় অংশ নিতে, তাদেরকে বলছিঃ এরই ভেতর পৃথিবীর নানান দেশে জড় হচ্ছেন দশ হাজার মানুষ। প্রতি দিনই বাড়ছে এই সত্য ধর্মের অনুসারী। সবাই বুঝতে পারছে, ওসাইরিসের ধর্ম মানলে কখনও মৃত্যু হবে না তাদের। চিরকাল বাঁচবে। হ্যাঁ, আমরা হব চিরকালের জন্যে অমর! হাত ওপরে তুলল কাদির ওসাইরিস।

খুশিতে হৈ-হৈ করে উঠল ভক্তরা।

অধৈর্য হয়ে কী যেন নির্দেশ দিল ওসাইরিসের ভাই। শক্তপোক্ত কজন প্রহরী হটিয়ে দিল কাছের মানুষগুলোকে। মঞ্চ থেকে নেমে একটা দরজার দিকে চলেছে ওসাইরিস।

পিছু নিতে গিয়েও রানাকে দেখল মুর। চলুন, গিয়ে দেখি কী ঘটে।

আমার আগ্রহ নেই, বলল রানা, বাইরেই থাকি।

চলুন না, অমরও তো হতে পারেন! আমি হয়তো হাজার হাজার সিনেমায় নায়ক হব।

ইচ্ছে হলে ঘুরে আসুন, বলল রানা।

কী করে? বলল মুর, আপনাকে অনুকরণ করবে কে?

তো অন্য কোথাও চলুন নকল করতে হলে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ভাল লাগছে না।

এদিকে খিদেও লেগেছে, স্বীকার করল মুর। ওটা এমনই জিনিস, ওসাইরিসের বাপও বাপ-বাপ করবে!

হলরুম থেকে বেরিয়ে পার্কিংলটে এসে ল্যাম্বোরগিনিতে চাপল ওরা।

 .

০৩.

হ্যালো? কল রিসিভ করেছে পুরুষ-কণ্ঠ।

হাই, বলল লাবনী। বাজে কোনও কথা শুনলেই চট করে টিপে দেবে এণ্ড কল বাটন। আমি কি বেলা আবাসির সঙ্গে কথা বলতে পারি?

দ্বিধা নিয়ে বলল পুরুষকণ্ঠ: আপনি কে?

নাম ডক্টর লাবনী আলম। আমার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গিয়েছিল বেলা, যাতে কল করি।

আবছা হলো ওদিকের সব শব্দ। হাত দিয়ে মাউথ পিস চেপে ধরেছে লোকটা। কার সঙ্গে যেন সংক্ষেপে আলাপ সারল সে, তারপর উত্তেজিত নারীকণ্ঠ শুনল লাবনী। কুঁচকে গেল ওর ভুরু।

ঠুক আওয়াজ এল।

কেড়ে নেয়া হয়েছে ফোনের রিসিভার। হ্যালো? হ্যালোয় আপনিই কি ডক্টর লাবনী আলম? দক্ষিণা টান কণ্ঠে, তাতে সামান্য হিসপ্যানিক সুর।

হ্যাঁ, আমিই, বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসল লাবনী। তুমিই বেলা আবাসি?

জী-জী, আমিই! অসংখ্য ধন্যবাদ, ডক্টর আলম, কষ্ট করে কল-ব্যাক করেছেন! খুব সম্মানিত বোধ করছি! সত্যিই! আমি আপনার অন্ধভক্ত!

অন্ধভক্ত শুনে অবাক হয়েছে লাবনী। ভাবছে, প্র্যাকটিকাল জোক করছে না তো মেয়েটা?

ইয়ে… থ্যাঙ্কস, আইএইচএতে মেসেজ রেখে গিয়েছিলে, কথা বলতে চাও আমার সঙ্গে।

জী-জী! আসলে হয়েছে কী, আপনি আমাকে পাগল ভাবতে পারেন, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আপনার সঙ্গে সামনা-সামনি আলাপ করা খুবই জরুরি। আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। আপনি তো এখনও নিউ ইয়র্কেই থাকেন, তাই না?

হ্যাঁ।

আমি আছি ইস্ট ভিলেজে, এক বন্ধুর বাড়িতে। আমি কি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি? লাবনী কিছু বলার আগেই আবার বলল মেয়েটা, মাত্র দশটা মিনিট দেবেন, তাতেই চিরকালের জন্যে কৃতজ্ঞ হব।

কী বিষয়ে কথা বলবে? জানতে চাইল লাবনী।

মিশরে ডক্টর মেটযের খননের ব্যাপারে। জায়গাটা স্ফিংসের খুব কাছে।

ডক্টর মেটযের নাম শুনে লাবনীর মনে পড়ল, কী হয়েছে হেরিটেজ অফিসে। আগে কখনও এত অপমানিত হয়নি ও। সত্যিকারের চরম অভদ্র মহিলা ক্যাথারিন ট্রিপ! ওই খননের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, মেয়েটাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল লাবনী। কিছু জানাতে চাইলে, তোমার উচিত আইএইচএর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা।

কিন্তু, ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। একবার দেখলেই বুঝবেন। প্লিয, ডক্টর আলম? মাত্র দশটা মিনিট। ঠিক আছে, পাঁচ মিনিটই না হলে দিন? খুব জরুরি!

মেয়েটার কণ্ঠে নিখাদ সনির্বন্ধ মিনতি বুঝল লাবনী। ঠিক আছে, কসেকেণ্ড পর বলল, চলে এসো বিকেলের পর সেভেন্থ স্ট্রিটের ফিফটিটু পার্ক আপ-এ। সেকেণ্ড অ্যাভিনিউতে পাবে একটা কফি শপ। সাতটার সময় পৌঁছুলে আলাপ হবে, তবে দেরি করলে আমাকে ওখানে পাবে না।

অসংখ্য ধন্যবাদ, স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেলা আবাসি। সময় দিলেন বলে অনেক ধন্যবাদ, ডক্টর আলম।

বাই, কল কেটে দিল লাবনী। ভাবছে, কীভাবে নরম কথায় বিদায় করবে মেয়েটাকে। ডক্টর মেটযের খননের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই।

.

নীলাকাশ কালচে করে নামছে সন্ধ্যা। সারাদিন নায়কের সঙ্গে ঘুরে বিরক্ত হয়ে উঠেছে রানা। অত্যন্ত নামকরা নাইট ক্লাব দ্য প্ল্যাটিনামের বাইরে দেখল জটলা। সুন্দরীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহে ভিড় করেছে নিঃসঙ্গ পুরুষরা।

দারুণ, তাই না? কমলা ল্যাম্বোরগিনি মার্সেইল্যাগো সামনে বাড়াল গিবন মুর। সাধারণত নিউ ইয়র্কে চলাচলের জন্যে লিমো সার্ভিস থেকে গাড়ি ও ড্রাইভার ভাড়া করে সে, কিন্তু বিশেষ সব অনুষ্ঠানে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেবার জন্যে ব্যবহার করে নতুন মডেলের এই সুপারকার। কী লোভনীয় পা সুন্দরীদের! এন্ট্রান্সের শর্ট মিনিস্কার্ট পরা মেয়েটিকে ভালভাবে দেখতে জানালার কাঁচ নামাল সে। শতখানেক মানুষ চিনে ফেলল হলিউডের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটিকে। শুরু হলো মেয়েদের ভেতর প্রায় রায়ট। মুখে দারুণ মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে হাত নাড়ল মুর। সামান্য চাপ দিল অ্যাক্সেলারেটরে। তাতে চাপা গর্জন ছাড়ল ছয় শ একত্রিশ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন।

ক্লাবের এন্ট্রান্সের একপাশে ভেলভেটের দড়ি, ওদিকে গাড়ি রাখবেন ভিআইপিরা। দড়ির পাশে গাড়ি থামতেই এগিয়ে এল ভ্যালে। রানা ও নায়ক নেমে পড়তেই চাবিটা নিল সে, বদলে ধরিয়ে দিল মুরের হাতে টোকেন। প্রতিটি পদক্ষেপে ক্যামেরার ফিল্মে বন্দি হলো নায়ক। চারপাশে ঝলসে উঠছে ফ্ল্যাশ। কেউ দেখতে গেল না, ভিআইপি লিস্টে গিবন মুরের নাম আছে কি না। পাশের সুদর্শন যুবকের দিকে ফিরেও দেখল না কেউ। ইনি আমার সেরা বন্ধু, মিস্টার রানা! গলা উঁচিয়ে বলল মুর।

কথাটা শুনতে পেয়েছে ক্লাবের পাহাড়ের মত বিশালদেহী দুই বাউন্সার। একজন আরেকজনকে বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে বডিগার্ড।

মাথা দোলাল সঙ্গী। হতে পারে। তবে পিচ্চি। বাঁদরের সাইয। দুই ঘুষিতে ভর্তা হয়ে যাবে।

সবই শুনেছে রানা, চুপচাপ হজম করল কথাটা।

গর্জন ছেড়ে পার্কিংলট লক্ষ্য করে ছুটল ল্যাম্বোরগিনি। রানা ও মুর ঢুকে পড়ল ক্লাবের অভ্যন্তরে।

তিনটে স্তরে ভাগ করা হয়েছে ক্লাব। নিচে কূপের মত মস্ত এক ড্যান্স ফ্লোর। একপাশে রঙিন আলোয় ঝলমলে বার। সমতলে ভিআইপি লাউঞ্জ। একপাশে কাঁচ ঢাকা ব্যালকনি। এসেছে নামকরা কোনও ব্যাণ্ড, বাজছে ফুর্তির মিউযিক। দোতলা যা খুশি করার জন্যে। কাউন্টার থেকে চাবি সংগ্রহ করে যার-যাকে-খুশি নিয়ে প্রশস্ত সব ঘরে ঢুকে পড়ছে ক্লাবের সদস্যরা।

হৈ-হল্লার এই পরিবেশটা বিরক্তিকর মনে হলো রানার।

চলুন পরিচয় করিয়ে দিই স্টেট গভর্নরের সঙ্গে, তারপর ফলো করব আপনাকে, বলল মুর।

তার সঙ্গে ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে পা বাড়াল রানা। মুরকে জানাল না, ওই স্টেট গভর্নর ভদ্রলোককে ভাল করেই চেনে ও।

.

গত সাত মাসে তেমন পাল্টে যায়নি ইস্ট ভিলেজ। হাত বদল হয়েছে কয়েকটি দোকান ও বাড়ি। নতুন করে মালিক সাজিয়ে নিয়েছে কফি শপ স্টার্টআপ। পেছনের দেয়ালে ঝুলছে স্থানীয় এক চিত্রকরের তৈলচিত্র। কফি সার্ভ করছে নতুন দুজন মেয়ে।

ছোট দোকান, এই মুহূর্তে মাত্র কজন কাস্টমার। ভেতরে পা রেখেই লাবনী বুঝল, ডানের টেবিলে আছে বেলা আবাসি।

লাবনীকে দেখেই উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। ডক্টর আলম! হাই!

তুমি নিশ্চয়ই বেলা? মেয়েটার টেবিলের সামনে থামল লাবনী। দেখতে যেমন হবে ভেবেছে, তেমন নয় বেলা। স্ফিংসে খনন কাজ করলেও এখনও গ্র্যাজুয়েশনই করেনি। সুন্দরী তরুণীর বয়স বড়জোর উনিশ। মাথায় কালো পনিটেইল। পরনে শর্ট ডেনিম ও টাইট ডিযাইনার টপ। লাবনীর মনে হলো, অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের জন্যে নয়, এই মেয়েকে টিমে রেখেছিল ম্যান মেটয কুমতলবে। পরক্ষণে ভাবল, এর সম্পর্কে কিছুই জানি না, কাজেই উচিত নয় কিছু ধরে নেয়া। হয়তো অনেক কাজের কাজী বেলা আবাসি।

জী, আমিই বেলা!

ওকে দেখে খুব খুশি হয়েছে মেয়েটা, ভাবল লাবনী। হয়তো সত্যিই ভক্ত!

আমার কপাল ভাল লিপি গোমেয আপনাকে আমার ফোন নম্বর দিয়েছেন, নইলে কখনও খোঁজ পেতাম না! আগে ফোন করেছিলাম আপনার বাড়িতে, কিন্তু ডিসকানেক্ট করে দেয়া হয়েছে লাইন। তখন গেছি ওই বাড়িতে। কিন্তু সুপারইন্টেন্টে বললেন, আপনি চলে গেছেন অন্য কোথাও।

কয়েক মাস আগে অন্য অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি, বলল লাবনী। ভাবছে, সত্যিই কি ফ্যান, না ফ্যানাটিক? দেখে তো পাগল মনে হচ্ছে না!

কফি নেব? জানতে চাইল বেলা।

না, লাগবে না, বলল লাবনী। বেলার টেবিলে বসে আছে এক তরুণ। গলায় কাঠের মালা। চুল পেরেকের মত খাড়া। যেন উঠে এসেছে জাপানি কার্টুন থেকে। তরুণের উদ্দেশে বলল লাবনী, হাই!

জবাবে ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ ছাড়ল তরুণ।

গোপনে আলাপ করতে চাই, জনি, বলল বেলা।

উঠে দাঁড়িয়ে বলল তরুণ, সামনের দরজার কাছে গিয়ে বসছি। তোমরা আলাপ করো।

কৌতূহলী চোখে বেলাকে দেখল লাবনী। গোপনীয় কিছু বলতে চাও?

জী।

সেটা কী?

বসুন, সবই জানাব, উল্টো দিকের চেয়ার দেখাল বেলা। লাবনী বসে পড়বার পর নিজেও বসল। চারপাশে চোখ রাখবে জনি। নিউ ইয়র্ক শহরে আর কাউকে চিনি না। আমি এসেছি মায়ামি থেকে। মিষ্টি হাসল মেয়েটা। কলেজে পড়তে গিয়ে জনির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। আমরা ঠিক করেছি, লেখাপড়া শেষ হলে হয়তো বিয়ে করব দুজন।

গুড, বলল লাবনী। এবার বলো, কী কারণে খুঁজছ আমাকে?

পিঠ সোজা করে বসল বেলা। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছেন, তাই নিজে চলে এসেছেন দেখা করতে ঠিক? এদিকে আমিও ভাবিনি, আপনার মত নামকরা এক আর্কিওলজিস্টকে চোখের সামনে দেখতে পাব! গত দুবছর ধরে চেয়েছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে! আপনি প্রথম থেকেই আমার হিরোইন!

তাই? খাঁটি প্রশংসা পেয়ে বুক ভরে গেল লাবনীর। তবে কিছু দিন হলো পেশাদার কোনও সাফল্য নেই ওর। সত্যি বলতে, কোনও কাজই নেই। জীবনটা মনে হচ্ছে অনর্থক।

বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে আর্কিওলজি সাবজেক্ট বেছে নিয়েছি শুধু আপনার কারণে! কী বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করব ভাবছি, তখনই এক ম্যাগাযিন পত্রিকার পাতায় পড়লাম একটা আর্টিকেল। মনে হলো, আরে, আর্কিওলজি তো দারুণ সাবজেক্ট! ব্যাগ থেকে কোঁচকানো কয়েকটা পাতা বের করল বেলা। টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিল একটা প্রচ্ছদ।

লাবনী চিনে ফেলল ওটা। দেড় বছর আগে প্রকাশ করা হয়েছিল আটলান্টিস বিষয়ে ওই আর্টিকেল। প্রচ্ছদে ওর নিজের ছবি। সে-সময়ে পনিটেইল করত। ওই স্টাইল অনুকরণ করেছে বেলা আবাসি।

ঠিকই ধরেছেন, ঘোড়ার লেজের মত নিজের চুল দেখাল বেলা। পুরো অনুকরণ করি আপনাকে। আমার মনে হয়েছে, নকল করলে আপনার মত নাম করতে পারব! …কিছু মনে করলেন না তো?

না। গত সাত মাস এত অপমানের পর আজ মনটা ভাল লাগছে লাবনীর। আজও কেউ আছে, যে ওর ভক্ত!

এককাপ কফি বেলার সামনে রেখে আবারও সদর দরজার পাশের টেবিলে গিয়ে বসল জনি।

আর্টিকেল পড়ে বুঝলাম, চেষ্টা করলে দারুণ সব জিনিস আবিষ্কার করা যায়। লাবনীর ছবির ওপর টোকা দিল বেঁলা। আপনিই আবিষ্কার করেছেন আটলান্টিস! আগে ভাবতাম, আর্কিলজিস্টরা সবাই বুড়ো লোক। তাই অন্তর বলল, হায়, ঈশ্বর, ইনি একজন মহিলা আর্কিওলজিস্ট! কপাল ভাল হলে আমিও তো ওঁর মত বড় কেউ হতে পারি!

আগে আর্কিওলজির ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলে না?

কাঁধ ঝাঁকাল বেলা। না তো! দাদা-দাদীর কাছ থেকে ইজিপ্টোলজি জেনেছি। তারা মিশরের মানুষ। দাদা পড়তে শিখিয়েছেন হায়ারোগ্লিফ। কিন্তু আপনার কথা জানার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি আমার উচিত আর্কিওলজি পড়া। কিন্তু প্রথম বছরটা খুব খারাপ রেযাল্ট করলাম। প্রতি রাতে আড্ডা মারতাম। চিয়ার লিডার হয়ে সময় নষ্ট করেছি। বুঝতেই পারছেন, হঠাৎ স্বাধীনতা পেলে যা হয় আর কী!

বুঝলাম, বলল লাবনী। ওর মনে পড়ল, নাক ডুবিয়ে রাখত প্রতি দিন আঠারো ঘণ্টা বইয়ের ভেতর।

তারপর বুঝলাম, বাবা-মাকে তো ডুবিয়ে দিতে পারি না! আমার পেছনে হাজার হাজার ডলার খরচা করছেন তাঁরা। যেহেতু যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছি, ঠিক করলাম ভালভাবে লেখাপড়া করব। তা কয়েক মাসআগের কথা। নতুন উদ্যমে শুরু করলাম লেখাপড়া। আগের চেয়ে ভাল হলো গ্রেড। আর তখনই শুনলাম, স্ফিংসের এলাকায় খনন কাজ করবে আইএইচএ। ভাবলাম, এটা আমার জন্যে বিরাট সুযোগ। অবশ্য, যদি ওই টিমে থাকার সুযোগ পাই। যাই হোক, শেষপর্যন্ত স্থান হয়ে গেল টিমে…।

অনেকের সঙ্গে কমপিটিশন করে সুযোগ পেয়েছ, তাই না?

তা নয়। আমার মা ফাণ্ড সংগ্রহ করেন আন্তর্জাতিক সব দাঁতব্য সংস্থার জন্যে। ইউএন-এ উঁচু পদে বন্ধু আছে তার। তাঁরা সাহায্য করেছেন। খুশির হাসি দিল বেলা আবাসি।

ও। একটু হতাশ হয়েছে লাবনী। নিজের পরিশ্রমের কারণে খনন কাজে সুযোগ পায়নি মেয়েটা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল লাবনী, ঠিক আছে, দেখা হলো, তাই খুব খুশি হয়েছি। আর আমার কারণে উৎসাহী হয়েছ জেনেও ভাল লাগল, বেলা। তবে এবার উঠে পড়তে হয়। জরুরি কাজ রেখে এসেছি।

ফ্যাকাসে হয়ে গেল বেলা আবাসির মুখ। বলেন কী! একমিনিট! প্লিয, একটু অপেক্ষা করুন! একটা জিনিস দেখাব আপনাকে। কাগজপত্র হাতড়ে নিয়ে ব্যাগে পুরল মেয়েটা। হাতে উঠে এল দামি ডিজিটাল ক্যামেরা। আপনি তো জানেন, কয়েকটা স্ক্রল আবিষ্কার হওয়ার পরেই আমরা জানতে পারি, কোথায় আছে হল অভ রেকর্ডস। ঠিক?

গিজায় যেগুলো পাওয়া গিয়েছিল? হ্যাঁ। ওগুলোর ব্যাপারে এখনও নতুন সব খবর সংগ্রহ করি।

লাবনীর কণ্ঠের প্রচ্ছন্ন টিটকারি টের পেল না বেলা। আপনি তো জানেন, ওসাইরিয়ান টেম্পল থেকে পাওয়া গেছে তিনটে স্ক্রল, কিন্তু আইএইচএকে সব স্ক্রল দেয়নি তারা।

ক্যামেরার স্ক্রিনে ফুটে উঠল ইমেজ। মনোযোগ দিয়ে দেখল লাবনী। ওঁর মনে হলো, সত্যিই স্ক্রিনে প্রাচীন মিশরের প্যাপিরাসের ছবি। তবে এলএসডি স্ক্রিনে হায়ারোগ্লিফিক্স এতই ছোট, কিছুই পড়া গেল না। এগুলো স্কুলের পাতা?

ডানে তিনটে পাতা দেখাল বেলা। এদিকের তিনটে। কিন্তু এটা… বামেরটার ওপর আঙুল ঠুকল। এটার কথা আগে কখনও শোনেনি কেউ। অন্তত আইএইচএর কেউ জানে না। প্রথম তিন পাতায় লেখা, কী আছে হল অভ রেকর্ডসসের ভেতর এবং কীভাবে যেতে হবে ওখানে। …আর এটা বলছে ঠিক কোথায় আছে ওই কক্ষ।

সন্দেহ ও দ্বিধা নিয়ে বেলাকে দেখল লাবনী। তাতে কী লেখা?

ওখানে আছে, কীভাবে খুঁজে বের করতে হবে ওসাইরিসের পিরামিড।

কী? চমকে গেল লাবনী। কিংবদন্তীর আটলান্টিস ও শিবের গুহা নিয়ে বহু আর্কিওলজিস্টের টিটকারি সহ্য করেছে, তাই চট করে হেসে উড়িয়ে দিল না কথাটা। পিরামিড অভ ওসাইরিস? পড়েছি, ওটা স্রেফ পৌরাণিক কাহিনী। রূপকথার মত। প্রাচীন মিশরের লিখিত ভাষায় মাত্র কয়েকবার এসেছে ওটার কথা। ওসব পৌরাণিক গল্পে ছিল দেবতাদের কাহিনী। বাস্তবে কিছুই নেই।

আমিও বিশ্বাস করতাম না, বলল বেলা। কিন্তু ওসবে বিশ্বাস করেছে কেউ। সে চাইছে আইএইচএর আগেই হল অভ রেকর্ডস খুঁড়ে সরিয়ে নেবে ওই মানচিত্র।

এবার না হেসে পারল না লাবনী। ঠাট্টা করছ? একই সময়ে আইএইচএর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্ফিংসের নিচে খনন করছে অন্য কোনও দল? ভুলে গেলে, ওই জায়গা মিশরের সবচেয়ে ব্যস্ত টুরিস্ট আকর্ষণ? হাজার হাজার মানুষের চোখ এড়িয়ে কীভাবে খনন করা হচ্ছে ওখানে?

আমার কথা মিথ্যা নয়! জোর দিয়ে বলল বেলা। স্ফিংসের কম্পাউণ্ডের উত্তরদিকে একটা কূপ খুঁড়েছে কেউ। নিজ চোখে দেখেছি! ক্যামেরার স্ক্রিনে ইমেজ আনল ও। এই যে, তাদের প্ল্যানের ছবিও তুলেছি। নিজেই দেখুন!

একবার ছবিটা দেখল লাবনী। সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যা খুশি করতে পারবে না কেউ। মাটিতে শাবল ঠেকালেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে যে-কাউকে।

কিছুই হবে না, কারণ যারা দায়িত্বে আছে, তারাই ওই খননের সঙ্গে জড়িত! সিকিউরিটি চিফের নাম মাধু কামিল, ওদিকে খননের প্রধান লুকমান বাবাফেমি- তাদের নাক ডুবে আছে অপরাধে! স্ক্রিনে আরেকটা ছবি আনল বেলা। ওটা ব্লো-আউট। খুব কাছ থেকে ভোলা হয়েছে বিস্মিত এক লোকের মুখ। মাধু কামিল আর লুকমান বাবাফেমি কাজ করছে ওসাইরিয়ান টেম্পলের এক কর্মকর্তার নির্দেশে!

কপাল চুলকে নিল লাবনী। কী কারণে এসব আমাকে বলছ, বেলা? সত্যিই যদি ওই সাইটে ডাকাতির সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে ডক্টর ম্যান মেটযকে জানাচ্ছ না কেন? বা জানাতে পারো ইজিপশিয়ান পুলিশকে!

আসলে জানি না, কাকে বিশ্বাস করা যায়, আর কাকে নয়, বলল বেলা, এমনও হতে পারে, ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ডক্টর মেটয নিজেও।

ম্যান মেটয দাম্ভিক লোক, কিন্তু আমার মনে হয় না সে আইনের বাইরে যাবে, শুকনো গলায় বলল লাবনী।

কিছুই বিশ্বাস করেননি উনি। কেন যেন আমাকে অপছন্দ করেন। মিথ্যা গর্বে ভরা বেলুনের মত মনে হয়েছে আমার তাঁকে।

মৃদু হাসল লাবনী। ভুল বলেনি মেয়েটা। তা হলে মিশরের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আর্টিফ্যাক্ট চুরির বিষয়ে তারা অত্যন্ত কঠোর।

চাইলেও মিশরের পুলিশের কাছে যেতে পারব না।

 কেন?

ঝামেলা আছে। গেলেই গ্রেফতার করবে। তাদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছে, আমি নাকি স্ফিংসের টুকরো চুরি করেছি। তা ছাড়া, আঘাত করেছি ডক্টর বাবাফেমির মুখে।

কী বললে? চমকে গেছে লাবনী।

আমি কিছুই চুরি করিনি! জোর দিয়ে বলল বেলা। তবে গায়ের জোরে ক্যামেরার বাড়ি দিয়েছি লোকটার নাকে মুখে…

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল লাবনী। আমার মনে হয় যথেষ্ট শুনেছি।

প্রিয, দাঁড়ান একমিনিট! নিজেও দাঁড়িয়ে গেল বেলা। ঘরের দরজার কাছে সতর্ক হয়ে উঠেছে জনি। সন্দেহ নিয়ে দেখছে লাবনীকে। আমার কথাটা একটু শুনুন! ওরা ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে! আরেকটু হলে খুনই করে ফেলত! বাধ্য হয়ে পালাতে হয়েছে মিশর ছেড়ে!

আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কেন? সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতে আইএইচএর সঙ্গে।

কিছুই মানবে না, তারা। তাদের ধারণা, আমি একটা চোর! আপনাকে খুঁজে বের করতে চেয়েছি, কারণ আমার মনে হয়েছিল আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন। অপমানে কালচে হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ।

কেন যেন সহানুভূতি বোধ করছে লাবনী।

আতঙ্কে আছে বেলা মেয়েটা, অথবা হাইপারঅ্যাকটিভ ইমাজিনেশন রোগের রোগী। যা-ই হোক, হিরোইনকে খুঁজে বের করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ও। মনে ছিল অনেক আশা।

এখন আর আইএইচএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমার, বলল লাবনী, তুমিই বলেছ, তোমার কথা বিশ্বাস করবে না কেউ, তাই না? আমার কথাও অবিশ্বাস করবে ওরা। কথাটা বুঝতে পেরেছ? তবে একটা কথা মনে রেখো, আইএইচএতে অনেকেই আছেন, যাঁরা ভাল লোক। তোমার ভাবার কারণ নেই, চারপাশে ঘুরছে ভয়ঙ্কর শত্রু। অনায়াসেই মনের কথা আইএইচএর কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারো।

হয়তো তাই, অখুশি হয়ে মাথা দোলাল বেলা।

এখনই কিছু করতে হবে, তেমনও নয়, জনির দিকে তাকাল লাবনী। আবারও বসে পড়েছে ছেলেটা। বন্ধুর বাড়িতে ফিরে বিশ্রাম নাও। ঘুম দিয়ে উঠে আগামীকাল ফোন দেবে আইএইচএতে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কথাটা মানতে না পারলেও অনিচ্ছুক চেহারায় মাথা দোলাল বেলা। কসেকেণ্ড পর পা বাড়াল ওর বয়ফ্রেণ্ডের দিকে। ওদিকেই দরজা।

আবারও বসল লাবনী। ছেলেমেয়ে দুটো বিদায় নিলে বাড়ির পথে রওনা হবে। মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ, যদিও খুব বেশি নয় রোগের প্রকোপ। ওর মনে পড়ল, অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলে আবারও দেখবে সেই আপত্তিকর বিজ্ঞাপন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাবনী।

দরজার কাছে চলে গেছে বেলা ও জনি, এমনসময় হঠাৎ করেই আর্তচিৎকার ছাড়ল মেয়েটা।

বিস্মিত হয়ে ওদিকে তাকাল লাবনী।

এইমাত্র দরজা পেরিয়ে ঢুকেছে তেলমাখা চুলের এক লোক। পরনে সাপের চামড়ার জ্যাকেট। ছাগলা দাড়ি রেখে অদ্ভুত করেছে চেহারাটা। বেলার দিকে চেয়ে টিটকারির হাসি হাসল সে।

ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল বেলা। এ-ই সে! ওই দলের লোক! …কেউ আমাকে বাঁচাও!

আহা, আবারও দেখা, পিচ্চি মেয়ে, সামনে বেড়ে ভয়ঙ্কর হাসি হাসল লোকটা।

দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল ফুলিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল সাহসী জনি, কিন্তু পরক্ষণে ব্রাসের নাকল পরা হাতে পেটে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল বেচারা। ছটফট করছে তীব্র ব্যথায়।

হতবাক হয়ে গেছে কাস্টমাররা। জনিকে টপকে এগোল ভগলার। ঘুরেই এক দৌড়ে লাবনীকে পাশ কাটাল বেলা। ছুট দিয়েছে ঘরের পেছনের দিক লক্ষ্য করে।

ধীর পায়ে পিছু নিল খুনে বডিগার্ড। তাড়া নেই তার।

এই যে! লাবনীর চিৎকার শুনে ঘুরে তাকাল ভগলার। পরক্ষণে তার দিকে উড়ে গেল কাপ ভরা তরল। সরাসরি মুখে লাগল আগুনের মত গরম কফি। থুতনি ও চোয়াল বেয়ে নামছে বাদামি ফেনা।

মাসুদ রানার শেখানো বিদ্যে কাজে লাগাল লাবনী, জোর এক লাথিতে একটা চেয়ার পাঠাল লোকটাকে লক্ষ্য করে।

পিছাতে গিয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল ভগলার।

নিজেও টেবিল থেকে সরে গেছে লাবনী। তাড়া দিল: পালাও, বেলা!

.

০৪.

কাউন্টারের পেছনে এক ওয়েট্রেসকে পাশ কাটাল বেলা, একবার ঘুরে তাকাল পেছনে। মেঝেতে পড়ে আছে জনি।

থেমো না! বেলার পেছনে ছুটতে ছুটতে নির্দেশ দিল লাবনী।

ওদিকের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল বেলা।

পিছু নিতে চাইল লাবনী, কিন্তু ওকে ঠেকাতে এল ম্যানেজার। কিন্তু ধমক শুনে থমকে গেল। আরে, গাধা, আমি না, ওই লম্বু মইটাকে ঠেকাও! পুলিশে ফোন করো!

সামনে থেকে চেয়ার সরিয়ে তেড়ে এল সর্প-চর্ম।

কিন্তু সে কাউন্টার পেরোবার আগেই পেছনের দরজার ওদিকে গিয়ে কবাট লাগিয়ে দিল লাবনী। একপাশে দেখল কফির বিন ভরা বড় কয়েকটা বাক্স। দরজার সামনের মেঝেতে নিয়ে রাখল একটা। আপাতত ওটা ঠেকাবে গুণ্ডাটাকে।

স্টোররুমের পেছনে ফায়ার ডোরের কাছে পৌঁছে গেছে। বেলা। দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল গলিতে। আর তখনই ওকে জাপটে ধরল অজগরের মত পুরু দুটো হাত। হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ল দুজন।

ফাঁদ পেতে রেখেছে লম্বু মই!

দোকানের পেছনে অপেক্ষায় ছিল এই মোটা মোষ!

ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে বেলা।

ওদিকে ঘর থেকে বেরোবার আগে একপাশের তাক থেকে ভারী এক পাইরেক্স কফিপট নিয়েছে লাবনী। লাথি পড়তেই পেছনে সামান্য খুলে গেছে দরজা! বাক্স দুমড়ে গেলেও কফির বিন আটকে রেখেছে কবাট। ওই সরু ফাঁক দিয়ে এদিকের ঘরে ঢুকতে পারবে না সর্প-চর্ম।

ফায়ার এক্সিট পেরিয়ে গলিতে বেরোল লাবনী, একটু দূরেই দেখল চিত হয়ে পড়ে আছে বেলা। ওর বুকে চেপে বসেছে মোটা এক ন্যাড়ামাথা লোক।

টেকোর সাদা মাথায় ঠক্কাস শব্দে নামল লাবনীর হাতের ভারী কফিপট। বিস্ময়ের গর্জন ছাড়ল মোষ। পরেরবার চাদির ওপর কফিপট নাযিল হতেই ফেটে গেল ওটা। অদ্ভুত এক ঘোর নিয়ে লাবনীকে দেখল টেকো, তারপর আরে, কী হচ্ছে রে, বাবা! বলেই কাত হয়ে পড়ল ডাস্টবিনের পাশে। ঘুরতে চলে গেছে পরীদের দেশে!

ব্যাটা ঘুমিয়ে পড়েছে! জলদি ওঠো, বেলা! তাড়া দিল লাবনী।

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল বেলা। দারুণ দেখালেন তো, ডক্টর আলম!

যদি দেখতে আমার হাতের চায়ের কেতলির কাজ! এবার চলো, ভাগি! টেকোকে টপকে ছুট দিল লাবনী।

পাশেই উড়ে চলেছে বেলা। বুঝলাম না! এরা আমাকে খুঁজে পেল কী করে? কাউকে বলিনি কোথায় আছি! এমন কী বাবা-মাও জানেন না!

লিপিকে বলেছ, বলল লাবনী, ও হয়তো বলেছে আইএইচএর কাউকে। সে আবার বলেছে ম্যান মেট্যকে। ফলে ছড়িয়ে গেছে কথা। বড় রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা।

কিন্তু জানল কী করে যে আপনার সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসব?

সেটা আমি কী করে বলব, আমি কি ডিটেকটিভ?

মোড়ের কাছে থেমেছে একটা ট্যাক্সি। ছুটতে ছুটতে ওটার দিকে হাত নাড়ল লাবনী। ট্যাক্সি! এই যে!

আমরা ক্যাবে উঠব? বিস্ময় নিয়ে বলল বেলা।

তুমি হেলিকপ্টার না ডাকলে এটাই পালাবার একমাত্র উপায়! থেমে গেছে ক্যাব। কিন্তু ওদের জন্যে নয়, বুঝল লাবনী। দামি পোশাক পরা এক দম্পতি আছে রাস্তার ওপাশে। হাত বাড়িয়ে রেখেছে লোকটা। আরে, এটা আমাদের ক্যাব! গলা উঁচু করে জানাল লাবনী।

ক্যাবের পেছনের দরজার হ্যাণ্ডেল ধরেছে লোকটা। এই ক্যাব থেমেছে আমাদের জন্যে!

এটা ইমার্জেন্সি, স্যর, ক্যাবটা আমাদের খুব প্রয়োজন! অন্যদিকের দরজা খুলে ফেলেছে লাবনী। তাড়া দিল, বেলা! জলদি ওঠো!

আপনারা এসব কী শুরু করেছেন? চিলের ডাকের মত কর্কশ গলা ছাড়ল নোকটার স্ত্রী। ড্রাইভার, তুমি এদেরকে নেবে না!

আমি কোনও ঝামেলা চাই না, জানাল চিকন ড্রাইভার, কণ্ঠে ব্রাঘিলিয়ান সুর। জানালা দিয়ে গলা বের করে লাবনীকে বলল, থেমেছি এঁদের জন্যে, ওকে? পরের ট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা করুন। একটু পরেই…

তখনই বিস্ফোরিত হলো লাবনীর দিকের জানালার কাঁচ। গুঙিয়ে উঠল ড্রাইভার। বাম কাঁধে গেঁথেছে বুলেট। উইণ্ডশিন্ডে ছিটকে লেগেছে রক্তের অসংখ্য ফোঁটা। ঘুরে তাকাল লাবনী, গলির মুখে সর্প-চর্ম, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র!

নিশানা করছে…।

মাথা নিচু করো! চিৎকার ছাড়ল লাবনী। একইসময়ে গাড়ির মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বেলা। চুরমার হয়ে গেল পেছনের কাঁচ।

অ্যাসফল্টে শুয়ে পড়ল লাবনী। সামান্য ওপরে গাড়ির গায়ে লাগল আরেকটা বুলেট। খুবলে নিল লোহার পাত। আরেক জানালা চুরমার হতেই হিস্টিরিয়ায় ধরল দামি পোশাক পরা মহিলাকে। পালাতে শুরু করেছে আশপাশের পথযাত্রী।

হঠাৎ থেমে গেল গুলি।

সাপের চামড়ার হাতে ওটা রিভলভার বা সিক্সশুটার। রিলোড করতে হবে তাকে।

উঠে দাঁড়িয়েই ড্রাইভারের দিকের দরজা খুলল লাবনী। কুঁজো হয়ে সিটে বসে আছে ড্রাইভার। কাঁধের জখম থেকে ঝরছে রক্ত। ডানহাতে চেপে রেখেছে ক্ষত। সরুন ওদিকের সিটে! তার সিটবেল্ট খুলে ফেলল লাবনী।

আপনারা ক্যাবটা নিন, আপত্তি নেই, বিড়বিড় করলেন দামি পোশাক পরা ভদ্রলোক। স্ত্রীর কথা ভুলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলেন মোড়ের দিকে।

কিন্তু হাইহিলের খটাখট শব্দে তাকে পেছনে ফেললেন ঝগড়াটে বউ। গজগজ করছেন: মর, কাপুরুষ! বউকে ফেলে পালাতে চাস্! তুই মানুষ না পশু!

দুজনই হাওয়া হয়ে গেল মোড়ের ওপাশে।

ব্যাক সিটের ওপর দিয়ে তাকাল বেলা। আঙুল তাক করল গলির দিকে। ওই… ওই যে! এল!

কী এল? ধাক্কা দিয়ে ব্রাঘিলিয়ান ড্রাইভারকে পাশের সিটে সরাল লাবনী। বসে পড়েছে ড্রাইভিং সিটে। পেছন ফিরে দেখল, কেন এত ভয় বেলার। দ্বিতীয় আগ্নেয়াস্ত্র বের করেছে লম্বু মই। হায়, আল্লা!

গিয়ার সিলেক্টর ঠিক জায়গায় ফেলে মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল লাবনী।

ক্রিচ-ক্রিচ শব্দে কবার পিছলে গেল পুরনো, ন্যাড়া চাকা, হোঁচট খেয়ে রওনা হলো ট্যাক্সি। কম ক্ষতিকর হাইব্রিড গাড়ি এসে বাজার দখল করলেও, আজও নিউ ইয়র্কে রয়ে গেছে প্রাচীন কিছু ফোর্ড ক্রাউন ভিক্টোরিয়া। লাবনীর ট্যাক্সিও তাই, বহু আগেই বাতিল মাল হিসেবে ফেলে দেয়া উচিত ছিল। খটাং-খট-ই-হুঁই শব্দে সে-কথাই জানাচ্ছে ট্রান্সমিশন।

যতই অযত্ন হোক, অনায়াসেই পেছনে ফেলবে যে কোনও ছুটন্ত লোককে।

কিন্তু হার মানতে হবে বুলেটের কাছে!

মাথা নিচু! সতর্ক করল লাবনী। পেছনের সিটের সামনে ঘুপচি জায়গায় লুকিয়ে পড়ল বেলা। খটাং-খটাং শব্দে গাড়ির বডিতে বিঁধল কটা গুলি। একটা বুলেট ঠাস্ শব্দে লাগল গাড়ির মাঝের পার্টিশনে। এবড়োখেবড়ো ফাটল তৈরি হয়েছে বুলেটপ্রুফ প্লেক্সিপ্লাসে।

আমার ক্যাব শেষ হয়ে গেল! শারীরিক ব্যথা ছাপিয়ে গাড়ির দুঃখে গুঙিয়ে উঠল ড্রাইভার। দাঁতে দাঁত পিষে উঠে বসল সে। ক্ষত থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে চালু করল মিটার।

বিস্মিত হয়ে তাকে দেখল লাবনী। আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?

বিনে পয়সায় চড়তে দেব না, জানিয়ে দিল ড্রাইভার। এবার আমাকে নিয়ে চলুন হাসপাতালে!

পেছনে জোর আওয়াজ, তবে গুলি এল না। এইমাত্র পেছনের গলির সামনে ব্রেক কষে থেমেছে লাল এক ডজ র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। গলি থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এসে পিকআপ ট্রাকে উঠল ন্যাড়ামাথা মোষ। কড়া চোখে পলায়নরত ট্যাক্সি দেখছে লম্বু মই। হোলস্টারে রাখল খালি অস্ত্র। দৌড়ে এসে দরজা খুলে চেপে বসল গাড়ির পেছন সিটে। প্রায় গুলি ফাটার মতই বিকট আওয়াজ ছাড়ল ভি এইট ইঞ্জিন। ছিটকে রওনা হলো র‍্যাম পিকআপ ট্রাক।

ওই যান্ত্রিক দানবটাকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে দেখেছে লাবনী। এরা জানত বেলা যোগাযোগ করতে চাইছে। ওর সঙ্গে। তাই অপেক্ষা করেছে ধৈর্য ধরে। কিছুই না বুঝে লাবনী পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে সহজ শিকারের কাছে।

হাসপাতালের কথা ভুলে যান! বলল বেলা, এখন দরকার পুলিশ! কাছের পুলিশ স্টেশন কোটা?

জানি না, বলল ড্রাইভার। অবিশ্বাস নিয়ে তাকে দেখল লাবনী ও বেলা। মাত্র দুসপ্তাহ হলো এ শহরে এসে চাকরি নিয়েছি!

আপনি কি জানেন কাছের পুলিশ স্টেশন কোথায়? লাবনীর কাছে জানতে চাইল বেলা।

উম্, নাহ্!

আপনার বাড়ি না এদিকে?

নিউ ইয়র্ক বিপজ্জনক জায়গা, তাই বেশি ঘোরাঘুরি করি না। বাধ্য না হলে কোথাও… লাল বাতি পেরোবার সময় দুটো গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেল লাবনী। চলেছে উত্তরদিকে। মনে পড়ছে, পুলিশ স্টেশন আছে টোয়েন্টি-ফাস্ট স্ট্রিটে।

স্ট্রিট সাইন খুঁজছে বেলা। কিন্তু ওটা তো দশ ব্লক দূরে! সঙ্গে মোবাইল ফোন নেই আপনার?

তোমার নেই?

মোটা লোকটার ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে পার্স! আপনারটা দিন! নাইন-ওয়ান-ওয়ান-এ কল করব!

হ্যাঁ, কল করুন, সায় দিল ড্রাইভার, গুড আইডিয়া! আগে খবর দিন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে!

সামনের রাস্তা জুড়ে অসংখ্য গাড়ি। হর্ন বাজাতে শুরু করে উল্টোদিকের লেনে গাড়ি চালাল লাবনী। পাশ কাটিয়ে গেল ময়লাভর্তি এক গার্বেজ ট্রাক। আরেকটু হলে সামনা সামনি সংঘর্ষ হত এক গাড়ির সঙ্গে। তবে শেষ মুহূর্তে সরে গেল ওটার ড্রাইভার। ব্যাক সিটে পিছলে গেছে বেলা। অ্যাম্বুলেন্স নয়, পুলিশ চাই! ওরে! ওর নরম নিতম্বের নিচে কুড়মুড় শব্দ তুলেছে পেরেকের মত সেফটি গ্লাস।

হাঁ হয়ে গেল লাবনীর মুখ। বনবন করে ঘোরাতে শুরু করেছে স্টিয়ারিং হুইল। ব্রৈক কষে সামনে থেকে সরে গেল আরেকটা ট্যাক্সি। তবে আগে খসিয়ে নিয়ে গেছে লাবনীর গাড়ির বাম্পার। তুমুল বেগে ছুটছে ওদের ক্যাব। চারপাশে বেজে উঠছে নানান হর্ন। ভয়ে প্রায় খুন হয়ে যাওয়া ড্রাইভারকে সান্ত্বনা দিল লাবনী, সত্যিই সরি!

ফোন নেবে বলে হাতড়াচ্ছে পার্স, অন্যহাতে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে গাড়ি। পেছনে রাবার পোড়ার কর্কশ আওয়াজ শুনে রিয়ার ভিউ মিররে দেখল কয়েকটা স্পটলাইট। ওদের মতই ইন্টারসেকশন পেরিয়ে এসেছে ডজ র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। মোবাইল ফোন পেয়ে পার্টিশন মানি স্লটে ওটা রাখল লাবনী। নাও! কল করো!

নাইন-ওয়ান-ওয়ানে ডায়াল করল বেলা। অপারেটরকে সংক্ষেপে বলতে লাগল কী হয়েছে। ওদিকে অনেক গাড়ির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে লাবনী। যেভাবে হোক দূরে থাকতে হবে গুলি থেকে। পুলিশ থেকে বলেছে, সোজা টোয়েন্টি-ফার্স্ট স্ট্রিটের দিকে যেতে, কল কেটে দিল বেলা। ওখানে তৈরি থাকবে তারা।

আগেই না ধরে ফেলে, বলল লাবনী। এত চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না, ক্রমেই এগিয়ে আসছে পিকআপ ট্রাক। স্লটের মাধ্যমে আবারও মোবাইল ফোন লাবনীর কাছে দিতে চাইল বেলা। কিন্তু হাত তুলে মানা করল লাবনী। না! কল লিস্টে যাও! কল করবে মাসুদ রানাকে!

সে আবার কে?

আমার বন্ধু।

 সে কী করবে?

আরে, ডায়াল করো, বোকা মেয়ে! মাসুদ রানা জানে কীভাবে আমাদেরকে বের করতে হবে এই গাড্ডা থেকে! বুলেট বেগে পেরোল ওরা পরের ইন্টারসেকশন। দুশ্চিন্তা নিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাল লাবনী। হয়তো জানে!

.

বিস্মিত হয়েছে সুপার হিরো গিবন মুর। আগে থেকেই মিস্টার রানাকে চেনেন স্টেট গভর্নর। রানাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে বসিয়েছেন নিজের পাশে। একটু দূরের চেয়ারে বসতে হয়েছে নায়ককে। তাতে দুঃখ নেই তার। আফসোস অন্য জায়গায়। রানা সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে।

একদম চুপচাপ বসে আছে রানা।

গম্ভীর লোকটা যদি কথাই না বলে, কীভাবে তাকে অনুকরণ করে অভিনয় করবে সে?

অবশ্য একটু পর সব দুঃখ ভুলে গেল নায়ক। তাদের টেবিলে যোগ দিল দুর্দান্ত সুন্দরী চার যুবতী।

তারা মজে গেল মুরের কথায়। বলতে লাগল নায়ক, সবসময় নিজের স্টান্ট নিজেই করি।

চোখ বড় বড় করে শুনছে মেয়েরা।

ব্লাস্ট সিনেমায় ট্যাঙ্কারের ওপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি… তখনই বিস্ফোরিত হলো ওটা!

মুর জানাল না, ওই বিস্ফোরণ তৈরি করা হয়েছে কমপিউটারের প্রোগ্রামের মাধ্যমে। ওর গায়ের সব সেফটি গিয়ার মুছে দেয়া হয়েছে ডিজিটাল পেইন্ট দিয়ে।

মৃদু হাসিমুখে নায়কের কথা শুনছে রানা, তবে হঠাৎ করেই মনোযোগ সরিয়ে কোটের পকেট হাতড়াল। বাজতে শুরু করেছে ওর স্যাটেলাইট মোবাইল ফোন। দুসেকেণ্ড পর ওটা কানে ঠেকাল রানা।

থেমে গেছে সবার আলাপ। চোখ রানার ওপর।

হ্যাঁ, লাবনী, বলো? রানা জানে, ঠাট্টা করার মানুষ নয় লাবনী। আপাতত আছে কোনও গাড়িতে। গম্ভীর হয়ে গেল রানার মুখ। খুন করতে চাইছে? তুমি এখন কোথায়?

ইস্ট ভিলেজ, টুয়েলথ স্ট্রিটের কাছে। গলা চড়ে গেছে লাবনীর।

আবছাভাবে রানার কথা শুনছে আশপাশের সবাই।

হিসাব কষছে রানা। লাবনীর কাছ থেকে অন্তত এক শ ব্লক দূরে আছে ও। মাঝে কমপক্ষে পাঁচ মাইল ব্যবধান। দলে কজন তারা? আর্মড?

হ্যাঁ, আর্মড! কমপক্ষে তিনজন!

এবার সবাই শুনল গাড়ির চাকা হড়কে যাওয়ার অস্পষ্ট আওয়াজ। চিৎকার করে উঠেছে এক নারীকণ্ঠ! বাজতে শুরু করেছে একাধিক গাড়ির হর্ন।

তোমার সঙ্গে কে, লাবনী? জানতে চাইল রানা।

আইএইচএর এক মেয়ে আর ক্যাব ড্রাইভার লোকটার গায়ে গুলি লেগেছে!

রাগ ও ব্যথা ভরা পুরুষকণ্ঠের চিৎকার শুনল রানা।

অ্যাম্বুলেন্স ডাকছেন না কেন, মানুষ খুন করবেন?

রানাদের টেবিলে থমকে গেছে সবাই। হাতে ড্রিঙ্কের গ্লাস। ভুলে গেছে ঠোঁটে তুলতে বা নামিয়ে রাখতে।

বিস্ফারিত চোখে গভর্নর দেখছেন রানাকে। নিচু গলায় বললেন, পুলিশের সাহায্য নিতে পারবে না?

পুলিশের সাহায্য চেয়েছ? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ! পুলিশ স্টেশনের দিকেই যাচ্ছি! কিন্তু পেছনেই লোকগুলোর র‍্যাম পিকআপ ট্রাক!

কী যেন ভেবে নায়ক মুরকে দেখল রানা। ফোনে বলল, এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো, লাবনী। একটু পর যোগাযোগ করব।

কল কেটে দিল লাবনী।

কী করবেন ভাবছেন, মিস্টার রানা? জানতে চাইলেন গভর্নর। আমি কি কোনও সাহায্যে আসতে পারি?

আপাতত নয়। উঠে দাঁড়িয়ে নায়কের দিকে ফিরল রানা। আপনার ভ্যালে পার্কিং টোকেনটা দিন।

জী? অবাক হলো মুর।

 পার্কিং টোকেন, দেরি করবেন না।

কিছুই মগজে ঢুকছে না নায়কের। ওটা দিয়ে কী করবেন?

ডাকাতি নাকি? চাইলেই ল্যাম্বোরগিনি হাতে তুলে দেবে? বলে উঠল রানার পাশেরজন। কঠিন চেহারার ব্যবসায়ী। আট পেগ মদ গিলে হয়ে উঠেছে পুরো মাতাল।

নায়ক বের করে এনেছে টোকেন।

কিন্তু ওটা নেয়ার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে রানার হাত মুচড়ে ধরতে চাইল ব্যবসায়ী। বাড়াবাড়ি? দেখিয়ে দেব…

চতুর্থ শব্দটা আর বেরোল না তার মুখ থেকে, থুতনির নিচে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে দূরের মেঝেতে ছিটকে পড়ল সে।

মুরের হাত থেকে টোকেনটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা। আপনার গাড়িটা আপাতত দরকার, মুর।

ভিআইপি লাউঞ্জে বিদ্যুদ্বেগের আক্রমণ দেখে পাথর হয়ে গেছে সবাই।

আগে সামলে নিল মুর। এত খেপলেন কেন?

দীর্ঘ পদক্ষেপে দরজার দিকে চলেছে রানা।

টনক নড়তেই চেয়ার ছেড়ে পেছনে ছুটল মুর। আরে, মিস্টার রানা! কী করছেন? আমার গাড়ি কেন? দাঁড়ান দাঁড়ান!

ক্লাবের সদস্যরা বুঝেছে, ঝামেলায় পড়েছে হলিউডি নায়ক। ভিড় করে এল অনেকে, যেন মথ ঝাঁপ দেবে প্রদীপ শিখায়। তাদের কারণে সামনের পথ বন্ধ হতেই আটকে গেল গিবন মুর।

ওদিকে ক্লাব থেকে বেরিয়েই হেড-ভ্যালের হাতে টোকেন ও পঞ্চাশ ডলারের নোট দিয়েছে রানা।

মিস্টার মুরের গাড়ি। জলদি!

বুক পকেটে নোট রেখে ওয়াকি-টকিতে নির্দেশ দিল লোকটা।

অধৈর্য বোধ করছে রানা। তখনই আবারও বেজে উঠল ফোন। বাটন টিপে কানে ঠেকাল ও। হ্যাঁ, লাবনী?

ধাওয়া করে আসছে!

যত দ্রুত সম্ভব আসছি।

 কতক্ষণ লাগবে, রানা? গলা কেঁপে গেল লাবনীর।

পার্কিং গ্যারাজ থেকে এল ল্যাম্বোরগিনির ইঞ্জিনের কর্কশ, উঁচু গর্জন। বেশিক্ষণ না।

গ্যারাজ থেকে বেরোল মার্সেইল্যাগো। রাস্তার আলোয় ঝিকঝিক করছে কমলা বডি। এসে থামল ভিআইপি এন্ট্রান্সের সামনে। ওপরে উঠল ড্রাইভারের দরজা। ভ্যালেকে খুশি করতে আরেকটা পঞ্চাশ ডলারের নোট বাড়িয়ে দিল রানা।

এদিকে ফুটপাথে পৌচেছে নায়ক। গায়ের কাছ থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে ভক্তদেরকে। আরে! দাঁড়ান! থামান! ওটা আমার গাড়ি!

ড্রাইভারের নিচু সিট থেকে বেরিয়ে আসছে ভ্যালে। তবে যে বাউন্সার তাচ্ছিল্য করেছিল রানাকে, দুই লাফে এগিয়ে এল সে।

না এলেই ভাল করত। রানার ডান হাঁটু সরাসরি লাগল তার তলপেটে। একইসময়ে চোয়ালের ওপর পড়েছে কঠিন। এক ঘুষি। দুভাজ হয়ে গেল সে। পরের ঘুষি তাকে ফেলল সঙ্গীর গায়ে। হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ল দুই বাউন্সার। গোলমাল লেগেছে দেখে এ সুযোগে ছুট লাগাল একদল যুবক, হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগল দামি ক্লাবের ভেতর। চারপাশে তৈরি হলো চরম বিশৃঙ্খলা।

হতভম্ব ভ্যালেকে টান দিয়ে ল্যাম্বোরগিনি থেকে বের করেই ধরাশায়ী বাউন্সারদের ওপর ঠেলে ফেলল রানা। নিজে একলাফে চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। টেনে নিল ঊর্ধ্বমুখী দরজা। গিয়ার ফেলে রওনা হবে, এমন সময় গাড়ির সামনে প্রায় লাফিয়ে পড়ল মুর। থাবা মারছে হুডের ওপর। গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, মরে গেলেও আমার গাড়ি দেব না!

ইঞ্জিন রেভ করে গাড়ি কয়েক ইঞ্চি বাড়াল রানা। ভয়ের ছাপ পড়ল নায়কের মুখে, কিন্তু পিছিয়ে গেল না সে।

কৌশল পাল্টে নিল রানা। পেছনের সরু জানালা দিয়ে দেখল কাউকে পিষে দেবে না। তারপর রিভার্স গিয়ার ফেলে পিছিয়ে গেল ঝড়ের বেগে।

আরেকটু হলে ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ত মুর। রানা গাড়ি পিছিয়ে নিলেও সামনে বাড়ল সে। থেমে গেছে ল্যাম্বোরগিনি। খুলে গেল প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা।

এসব কী করছেন, মিস্টার রানা? বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল মুর।

আগেই শুনেছেন, আমার বান্ধবীকে খুন করতে চাইছে কেউ, বলল রানা, তাই চাই খুব দ্রুতগামী গাড়ি। হয় উঠে আসুন, নইলে সরে যান!

প্যাসেঞ্জার সিটে অবতরণ করল মুর। চোখে খুশির ছাপ। সত্যিই? ধাওয়া করবেন শয়তানদেরকে?

খুবই সিরিয়াসলি!

তাই? তো বসে আছেন কেন? চলুন মেয়েটাকে উদ্ধার করি!

রানা বুঝল, নিজেকে সত্যিকারের অ্যাকশন হিরো হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে স্বপ্নচারী নায়ক! খেয়ালও নেই অ্যাক্সিডেন্টে মরেও যেতে পারে!

 চলুন, রানা! দেরি কীসের!

বডির সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল রানা। ভি-১২ ইঞ্জিনের কানফাটা গর্জন ছেড়ে ছুট দিল ল্যাম্বোরগিনি। থার্ড অ্যাভিনিউ ধরে অসংখ্য গাড়ির মাঝ দিয়ে তুমুল বেগে চলেছে লাবনীর ট্যাক্সি, তবুও অনেক কাছে পৌঁছে গেছে র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। একবার পেছনে তাকাল লাবনী। ট্যাক্সির চেয়ে অনেক বড় দেখাল পিকআপটাকে। নিউ ইয়র্কের সড়কে বেমানান। পরিষ্কার বোঝা গেল, অত্যন্ত শক্তিশালী। যত্ন নেয়া হয় নিয়মিত।

বোধহয় গিয়ার বক্সের ভেতর খুলে আসছে কিছু পার্টস, নানান বিদঘুটে আওয়াজ তুলছে ক্রাউন ভিক্টোরিয়া।

নিজেও নানান আপত্তিসূচক আওয়াজ তুলছে ড্রাইভার। ঈশ্বরের দোহাই! এবার থামুন! ক্যাব নিয়ে নিন, আমাকে শুধু নামতে দিন!

আপনার নাম কী? জানতে চাইল লাবনী।

রবার্তো গ্যালিলিয়ো!

গ্যালিলিয়ো, প্রায় পৌঁছে গেছি পুলিশ স্টেশনের কাছে, বুঝতে পেরেছেন? মাত্র এক ব্লক দূরে! টোয়েন্টিয়েথ স্ট্রিটের ইন্টারসেকশনে জড় গাড়ি এড়াতে চাইল লাবনী। বেসুরো হর্ন বাজিয়ে রাস্তার রং সাইড ধরে চলেছে। গলা শুকিয়ে গেল ওর, বাম থেকে ছুটে আসছে একরাশ হেডলাইট! তবে ওগুলো হাজির হওয়ার আগেই পেরিয়ে গেল ট্যাক্সি। আবারও ডানদিকের লেনে ফিরল লাবনী।

পেছনে বাঁক নিল র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। ওটার বাম্পারের গুঁতো খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে ফুটপাথে গিয়ে থামল একটা গাড়ি। তাতে মোটেও কমেনি পিকআপের গতি। রেডিয়েটর গ্রিলের সামনের বুলবার সামলে নিয়েছে ধাক্কা।

মাথা ফিরিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করা গাড়িটা দেখল বেলা। সর্বনাশ!

শক্ত করে কিছু ধরো!

সামনেই পরের ইন্টারসেকশন…

 কিন্তু বামদিকে না ডানদিকে পুলিশ স্টেশন?

টোয়েন্টি-ফার্স্ট স্ট্রিট ওয়ান-ওয়ে। ম্যানহাটানের বুক চিরে গেছে পশ্চিমদিকে। ডানের রাস্তায় জ্যাম লেগেছে লাল বাতির কল্যাণে।

যাওয়া যাবে না ওদিকে।

বামে বাঁক নিল লাবনী। সাসপেনশনের ওপর ভর করে কাত হলো ট্যাক্সি। চাকা পিছলে সোজা ক্রসওয়াকের ওদিকে পার্ক করা এক পোর্শের দিকে চলেছে ওরা।

হায়, আল্লা! হায়, আল্লা! স্টিয়ারিং হুইল নিয়ে কুস্তি লড়ছে লাবনী। টের পেল, হড়কে গেছে পেছনের দিক। কড়া ব্রেক কষল ও। চরকির মত ঘুরতে শুরু করে অন্যান্য গাড়ির গায়ে গুতো দেবে ক্রাউন ভিক্টোরিয়া…

শেষ চেষ্টা হিসেবে উল্টো দিকে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল লাবনী।

মুচড়ে গিয়ে করুণ আর্তনাদ ছাড়ল পেছনের দুই চাকা। ঘুরে যেতে গিয়েও সামলে নিল ট্যাক্সি। তবে যথেষ্ট দ্রুত নয়, পোর্শের গায়ে ঘষা দিল ক্রাউন ভিক্টোরিয়ার লেজ। ভয়ঙ্কর কর্কশ শব্দে উপড়ে গেল ট্যাক্সির পেছনের বাম্পার।

গাড়ি সোজা করে নিল লাবনী। ড্রাইভার গ্যালিলিয়োর উদ্দেশে বলল, সরি!

নাক দিয়ে বিশ্রী আওয়াজ তুলল আহত লোকটা।

দূরে শুরু হয়েছে সাইরেনের আওয়াজ। দ-দপ্ করছে উজ্জ্বল আলো। পিছু নিয়েছে পুলিশের গাড়ি।

রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল লাবনী। এখন?

ওরা এসেছে ভুল দিকে!

দূরে পড়ে যাচ্ছে পুলিশ স্টেশন!

পেছনে চেয়ে খুশি হয়ে উঠল বেলা। গুড!

পুলিশের গাড়িকে পথ দিতে সরে যাচ্ছে সাধারণ সব গাড়ি। ইন্টারসেকশন পেরোল এনওয়াইপিডি প্যাট্রল কার। কিন্তু তখনই বাঁক ঘুরে চড়াও হলো র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। জোর গুঁতো মারতেই পোর্শের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ভারী পুলিশ কু্যার, ভেজা কার্ডবোর্ডের মত ভাঁজ করে ফেলল সুপারকারটাকে। পুলিশের গাড়ির সামনের চাকা ছিঁড়ে নিয়েছে পিকআপ। ধ্বংসাবশেষ থেকে পিছিয়ে এসে নতুন করে ধাওয়া করল ক্যাবটাকে। পিকআপের বুলবার থেকে ঝুলছে ভাঙা আবর্জনা।

খুশি উবে গেল বেলার। সর্বনাশ! বাবারে-বাবা!

ফোনটা এখনও আছে তোমার কাছে? জানতে চাইল লাবনী।

হ্যাঁ, কিন্তু…

 রানাকে আবারও ফোন দাও!

লাবনীর কল লিস্ট থেকে রানার নাম বের করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল বেলা, উনি কী করবেন?

অবাক হতে হবে তোমার। শুধু কল করো!

নম্বর পেয়ে ভুরু কুঁচকে কল দিল বেলা। দুসেকেণ্ড পর বলল, লাইন ব্যস্ত!

হায়, আল্লা! এখন? গাড়ির গতি আরও বাড়াল লাবনী।

.

ওয়ান হান্ড্রেড এইট স্ট্রিট থেকে বেরিয়েই দক্ষিণে বাঁক নিল ল্যাম্বোরগিনি। চওড়া চাকা ও ফোর-হুইল ড্রাইভ রাস্তায় সেঁটে রেখেছে ওটাকে। তবে তুমুল বেগে ঘোরার সময় জি-ফোর্স দরজার ওপর ছিটকে ফেলতে চাইছে রানাকে। সামনেই সোজা পশ্চিমে গেছে সেন্ট্রাল পার্ক, বামে ওটার বুক অন্ধকার অরণ্যের মত।

মার্সেইল্যাগোর গতি আরও বাড়তেই তীরবেগে পেছনে পড়তে লাগল রাস্তার বাতি ও জানালার আলো। সোজা হয়ে বসে সিটে হেলান দিল রানা। মোবাইল ফোন ওর কানে ধরে রেখেছে গিবন মুর। তা হলে সাহায্য করতে পারবেন?

সাধ্যমত চেষ্টা করব, বলল রানার পরিচিতা মহিলা পুলিশ অফিসার, কিন্তু সব ইউনিটকে সতর্ক করতে সময় লাগবে। তার আগেই থামিয়ে ফেললে, টিকেট পাবেন।

টিকেট নিয়ে ভাবছে না রানা। চেষ্টা করব না থামতে।

বা স্পিড বেশি হওয়ায় টিকেট দেবে। আপনি নিশ্চয়ই খুব স্পিডে যাচ্ছেন?

তা বলা যায়, স্বীকার করল রানা।

স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখাচ্ছে নব্বই মাইল।

আপনি এখন কোথায়?

হান্ড্রেড ফিফথ… ফোর… থার্ড…

মিস্টার রানা! আপনি কি জানেন কত বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন?

আপনি শুধু পুলিশ ইউনিটগুলোকে জানান, ভাল দলের মানুষ লাবনী আলম। ওর পেছনের লোকরা মন্দ দলের। বুঝতে পেরেছেন? বাই!

ফোন রেখে চামড়ার আর্মরেস্ট শক্ত হাতে ধরল গিবন মুর। তো, আগেও সুপারকার ড্রাইভ করেছেন, তাই না?

তাই তো মনে হয়। রানার চোখ রাস্তার ওপর।

যারা তৈরি করেছে, নিখুঁত করতে চেয়েছে এই গাড়ি। দুর্দান্ত গ্রিপ ও হ্যাণ্ডলিং। কমপিউটার গেমের মত নানান বাধা এড়িয়ে ছুটে চলেছে ল্যাম্বোরগিনি। তবে মাত্র একবার সামান্য ভুল হলে চুরমার হবে। ওটার কারণে খুনও হতে পারে নিরীহ মানুষ।

এর আগে কোটা চালিয়েছিলেন?

এটার সমানই ছিল গতি। ফেরারি ৪৩০।

মাথা দোলাল নায়ক। ভাল গাড়ি। আপনার?

না, অন্যের।

গতি কতটা তুলেছিলেন? দাঁড়ান-দাঁড়ান! বাস-বাস!

দেখেছি। সামনের দুটো ব্লক ফাঁকা। সাঁৎ করে বাস অতিক্রম করে আরও গতি তুলল রানা। ল্যাম্বোরগিনি ছুটছে ঘণ্টায় এক শ মাইল বেগে।

ফোঁস করে দম ফেলল নায়ক। তো ওই ফেরারি… ওটার কোনও ক্ষতি হয়নি বোধহয়?

হয়েছিল, মৃদু হাসল রানা। মুড়ির টিনের মত দুমড়ে গিয়েছিল। পেট ভাসিয়ে দেয়া কাতলা মাছের মত হাঁ করে বাতাস নিল মুর। খপ করে বন্ধ করল মুখ। চিন্তা করবেন না, আপনার ল্যাম্বো যত্নের সঙ্গে চালাব।

কোনও আঁচড় পড়বে না তো? ঠিক বলছেন?

আঁচড়ের চেয়ে বেশি কিছু হলে, গাড়ি নিয়ে দুশ্চিন্তার পর্যায়ে থাকবেন না আপনি। আর কিছু বলল না রানা। যা বোঝার বুঝেছে মুর। আবারও বাজল ফোন। প্লিয, কল রিসিভ করুন।

.

স্লটের ভেতর মোবাইল ফোন রাখা। চেঁচাল লাবনী, রানা, আমরা প্রায় খুন হয়ে যাচ্ছি! তুমি কোথায়?

আসছি, পৌঁছব একটু পরেই, জানাল রানা, এনওয়াই পিডির এক বন্ধুকে জানিয়ে দিয়েছি এদিকে কী ঘটছে। আমি আসছি দক্ষিণ থেকে। তুমি যাও আপটাউন লক্ষ্য করে। দেখা হবে। …তুমি এখন কোথায় আছ?

পার্কের ওপরের দিকে।

অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ টোয়েন্টিওয়ান স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এইমাত্র পড়েছে প্রশস্ত পার্ক অ্যাভিনিউতে।

পেছনের লোকগুলো?

আমাদের ঘাড়ের কাছে! চিৎকার করে উঠল বেলা।

মিথ্যা বলেনি। রিয়ার ভিউ মিররে পড়ছে পেছনের পিকআপের হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো। ছুটন্ত হিংস্র জন্তুর মত কর্কশ গর্জন ছাড়ছে র‍্যামের ইঞ্জিন। জানালা থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্তত দুজন। টেকো মোষ আছে সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে। ড্রাইভারের পেছনে সর্প-চর্ম, ঢ্যাঙা মই!  

দুজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র!

 সিটে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বেলা। সুট থেকে ঠাস্ করে নোংরা মেঝেতে পড়ল ফোন।

বুম! শব্দ তুলল রিভলভার।

 টানা ক্যাট-ক্যাট শব্দ তুলেছে টেক-নাইন মেশিন পিস্তল।

ক্যাবের গায়ে লাগল একরাশ গুলি। বুলেটপ্রুফ স্ক্রিনে নাক গুঁজল আরও দুটো বুলেট।

লাবনীর মাথার পেছনের প্লেক্সিগ্নাসে তৈরি হলো গর্ত। আরেকটা আঘাত লাগলে চুর-চুর হয়ে খসে পড়বে ওই কাঁচ।

স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে বামদিকে বাঁক নিল লাবনী। বিশ্রী আওয়াজে ডিভাইডারের মাঝের দুগাছের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল ক্রাউন ভিক্টোরিয়া। ঝাঁকি খেয়ে ব্যথায় কাতরে উঠল ড্রাইভার গ্যালিলিয়ো।

দুই গাছের মাঝের জায়গা দিয়ে ঢাকার সাধ্য নেই অপেক্ষাকৃত বড় র‍্যাম পিকআপের। ট্যাক্সি সিধে করে নিয়ে সরাসরি অগ্রসরমান সব গাড়ির দিকে চলল লাবনী। মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে ফুটপাথে গিয়ে উঠল একটা গাড়ি। এবার ঘুরে গিয়ে পশ্চিমে চলল ক্যাব।

পিছু ধাওয়া করতে হলে তীক্ষ্ণ বাঁক নিতে হবে ডজ র‍্যাম পিকআপ ট্রাককে। তাই করল ড্রাইভার। পিছলে গেল গাড়ির পেছনদিক। ভয়ে ঝট করে দেহের উর্ধাঙ্গ ভেতরে নিল মইয়ের মত ভগলার। আরেকটু হলে রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ত টেকো মোষ। কর্কশ আওয়াজ তুলে থেমে গেল পিকআপ। আবারও ঠিকভাবে সিটে বসল গানম্যানরা।

হঠাৎ এই বিরতির জন্য দুই গাড়ির মাঝে তৈরি হয়েছে বেশ ব্যবধান।

তবে তা যথেষ্ট নয়!

মনে মনে ম্যানহাটানের মানচিত্র দেখল লাবনী। বুঝতে চাইল, কীভাবে বাড়াবে দুই গাড়ির মাঝের দূরত্ব।

সবচেয়ে আগে কীভাবে পৌঁছুবে রানার কাছে?

সেক্ষেত্রে যেতে হবে ফিফথ এবং ব্রডওয়েতে, তারপর যেতে হবে উত্তরদিকে সিক্সথ অ্যাভিনিউ ধরে…

আবারও ধাওয়া করে ছুটে আসছে পিকআপ!

.

চাপা গোঁ-গোঁ গর্জন ছেড়ে দক্ষিণে ছুটে চলেছে ল্যাম্বোরগিনি। সেন্ট্রাল পার্কের পশ্চিমের তিনমাইল পার করছে বিদ্যুদ্বেগে। দীর্ঘ অ্যাভিনিউর নিচের অংশে প্রায় পৌঁছে গেছে রানা ও মুর। সামনেই কলাম্বাস সার্কেল। সারি সারি গাড়ির মাঝ দিয়ে যেতে যেতে নতুন করে গতি তুলছে রানা।

ইয়ে, মিস্টার রানা, সতর্ক করতে চাইল মুর, ঘোরার সময় গতি কমাতে হবে সামনের রাস্তা ওয়ান ওয়ে। সেন্ট্রাল পার্কের পশ্চিমে বাষট্টিতম সড়কে ঢুকছে দক্ষিণমুখী গাড়িঘোড়া। সামনের দুরক গেছে উত্তরদিকে।

ওসব নিয়ে ভাবছি না, বলল রানা। সময় নেই যে নতুন কোনও পথে এগোবে। ওর চোখ সামনের লেনের ওপর। সত্যিই কি পথ করে এগিয়ে যেতে পারবে?

এ ছাড়া উপায়ই বা কী ওর?

বাষট্টিতম সড়কের কাছে পৌঁছে সামনে আঙুল তাক করল নায়ক। মিস্টার রানা! খালি গাড়ি আর গাড়ি! ছুটে আসছে!

ল্যাম্বোরগিনি নিয়ে বাঁক নিল রানা।

অবশ্য বাষট্টিতম সড়কে না ঢুকে ঢালু ক্রসওয়াক পেরিয়ে উঠে পড়ল চওড়া ফুটপাথে। পাশেই পার্কের দেয়াল। ডানে সাঁই-সাঁই পেছনে পড়ছে পার্ক করা সারি সারি গাড়ি।

আপনি যাচ্ছেন ফুটপাথ দিয়ে সত্তর মাইল বেগে! ভয়ে গলা ধরে গেল মুরের।

তাই তো দেখছি! হর্ন বাজিয়ে ছুটছে রানা। নানান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সামনের লোকজন। মাঝ দিয়ে বুলেটের মত উড়ে চলেছে ল্যাম্বোরগিনি।

পুলিশ যদি ধরে, বলব কিডন্যাপ করেছেন আমাকে!

পাত্তা দিল না রানা, নিজ কাজে ব্যস্ত। সামনেই কয়েক লেনের কলম্বাস চত্বর। ওদেরকে ঘুরতে হবে উল্টো পথে।

নির্ঘাত খুন হবে বুঝে করুণ আর্তনাদ ছাড়ল গিবন মুর। পার্ক করা দুই পেডিক্যাবের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে ঝড়ের বেগে প্রায় উড়তে উড়তে মোড়ে পৌঁছল রানা। জোরাল ধুপ শব্দে রাস্তায় নামল গাড়ি। সামনের চারটে হেডলাইটের দিকে ছুটছে বাঙালি গুপ্তচর। চেহারা বিকৃত করে দাঁতে দাঁত চেপে ছুটন্ত বদ্ধ-উন্মাদটাকে দেখছে দুগাড়ির ড্রাইভার। দাঁড়িয়ে গেছে ব্রেক প্যাডেলের ওপর। গায়ের জোরে টিপে ধরেছে হর্ন বাটন। সাঁৎ করে বামে সরে প্রথমের গাড়িটাকে পেরোল সুপারকার। পরক্ষণে কাত হয়ে সরল ডানে। পাশ কাটাল দ্বিতীয় গাড়িটাকেও। দুই গাড়ির ব্যবধান এতই কম ছিল, মাঝের বাতাস সরে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে চাপা সুইপ! শব্দ।

সেন্ট্রাল পার্কের দক্ষিণে ঘুরেই ছুটন্ত ট্রাকটা দেখল রানা। ওটা সামনের পথ দখলের আগেই অ্যাক্সেলারেটর চেপে জায়গাটা পেরিয়ে গেল ও। আপাতত পথ খোলা।

কলাম্বাস চত্বরের কাছ থেকে এল পুলিশের সাইরেন। ধাওয়া করছে ল্যাম্বোরগিনিকে।

হায়, ঈশ্বর! পুলিশ! ঘুরে তাকাল মুর।

আপনার ব্লাস্ট সিনেমার মত, তাই না? বলল রানা। চলেছে সেন্ট্রাল পার্কের দক্ষিণে। এঁকেবেঁকে অন্যান্য গাড়ি এড়িয়ে ল্যাম্বোরগিনি পড়ল সেভেন্থ অ্যাভিনিউতে। সামনে টাইমস্ স্কয়ারের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তা পাবে।

আবারও গতি তুলছে রানা। ইঞ্জিনের গর্জনের ওপর দিয়ে শুনল আরেকটা কণ্ঠ।

লাবনী!

কানে ফোন দিন! বলল রানা।

ওর কানে স্যাটেলাইট ফোনটা ঠেকাল মহানায়ক।

যে-কোনও সময়ে ধরে ফেলবে, রানা!

তুমি কোথায়? সামনে গাড়ির জটলা দেখে লেন বদল করে এগোেল রানা। আমি সেভেন্থ-এ।

সেভেন্থ? হতাশায় গলা ভেঙে গেল লাবনীর। তা হলে আর জীবিত দেখতে পাবে না। ব্রডওয়ে ধরে এলে…

জানি কোথায় যেতে হবে, ভরসা দিতে চাইল রানা।

সামনে বিপদ, কথা বাদ দিন, মিস্টার রানা! দূরে আঙুল তাক করল মুর। ঝড়ের বেগে আসছে টাইমস্ স্কয়ার। বাড়ছে রাস্তায় গাড়ির ভিড়।

তুমি কোথায়, লাবনীর কাছে আবারও জানতে চাইল রানা।

সিক্সথ-এ। সামনে পড়বে থার্টিয়েথ।

রানার মনে পড়ল, দক্ষিণে টাইমস স্কয়ারে ব্রডওয়ে গিয়ে মিশেছে সিক্সথ অ্যাভিনিউতে হেরাল্ড স্কয়ারে। ঘুরেই থার্টিফোর্থ স্ট্রিট। সোজা যাও। আমি আসছি।

এসেই বা কী করবে? আগেই খুন হয়ে যাব!

না, এখন মরবে না, বলল গম্ভীর রানা। তুমি শুধু এগিয়ে যাও!

বিদ্যুদ্বেগে পেরোল ওরা টাইমস্ স্কয়ারের দক্ষিণের রাস্তা।

পেছনে ছোট এক পুলিশ স্টেশন।

ক্রুযার নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে পিছু নিল কজন পুলিশ অফিসার।

গতি হ্রাস না করেই ক্রস-ট্রাফিকে ঢুকল ল্যাম্বোরগিনি। একটা গাড়ির সামনের বাম্পার প্রায় ছুঁয়ে দিল সুপারকারের পেছনের বডি।

হায়, ঈশ্বর! মিস্টার রানা! আপনি বলেছেন আঁচড়ও পড়বে না! মুখ কালো করে ফেলেছে নায়ক।

হয়তো মিথ্যা বলেছি, বলল রানা। ভাল করেই জানে, আরেকটু হলে মরত ওরা বিধ্বস্ত গাড়ির ভেতর।

পেছনে পুলিশের কয়েকটা গাড়ি, ফোরটিসেকেণ্ড স্ট্রিট ধরে ব্রডওয়ের দিকে চলেছে রানা। তীরের গতি তুলে পৌঁছুল চওড়া রাস্তায়। লাবনীকে খুঁজছে ওর চোখ।

গেল কোথায়?

.

রানা, তুমি কোথায়? ভাবছে লাবনী।

হেরাল্ড স্কয়ারের নিচের অংশে পৌচেছে ওরা। ঝুঁকি নিয়ে ব্রডওয়ের দিকে তাকাল। পেরোল ইন্টারসেকশন। চলেছে সিক্সথ অ্যাভিনিউ ধরে। দূরে দেখল পুলিশের গাড়ির আলো। কিন্তু রিয়ার ভিউ মিররে, পেছনে আরও বড় বিপদ নিয়ে আসছে ডজ র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। পৌঁছে গেছে অনেক কাছে, তবে সংকীর্ণ রাস্তায় পারবে না ওভারটেক করতে।

আমার প্রিয় সব দোকান! চেঁচিয়ে উঠল বেলা।

বামে সারি সারি পাইকারি পোশাকের দোকান। ফোন ধরে রাখো, বলল লাবনী, রানা, আমরা তো খুন হয়ে যাচ্ছি! তুমি কোথায়?

প্রায় পৌঁছে গেছি, তুমি কোথায়?

থার্টিসিক্সথ স্ট্রিটের ইন্টারসেকশনে পৌচেছে ট্যাক্সি।

বাম থেকে আসছে একসারি গাড়ি। তবে ওগুলোকে ম্লান করে ব্রডওয়ে থেকে নেমে এল কমলা এক স্পোর্টকার।

রানা, তুমি কি কমলা গাড়িতে?

হ্যাঁ, কেন?

এইমাত্র পেরিয়ে গেছ! আমি যাচ্ছি সিক্সথ ধরে উত্তর দিকে!

বিড়বিড় করে কী যেন বলল রানা।

চেঁচিয়ে উঠল বেলা, ঘাড়ের কাছে এসে গেছে!

মাত্র ত্রিশ ফুট পেছনে হাঙরের মুখের মত পিকআপের সাদা গ্রিল। আবারও জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সর্প চর্মের দেহের ওপর অংশ। লোকটার হাতে রিভলভার। নিশানা করছে…।

ভয় পেয়ে বেপরোয়াভাবে বামে বাঁক নিয়ে থার্টিসেভেন্থ স্ট্রিটে ঢুকল লাবনী। তার আগে ওর দিকের দরজা ভেদ করে ঊরুর একটু ওপর দিয়ে ওদিকের দেয়ালে লেগেছে একটা বুলেট।

ফোনে বুলেটের গর্জন পরিষ্কার শুনেছে রানা। বুঝতে পারছে, আবার ফিরতে হবে ওকে। কিন্তু ব্রডওয়ের পথ আটকে দিতে পেছন থেকে আসছে এনওয়াইপিডির ক্রুযার। ডিসপ্যাচাররা সতর্ক করেছে, অতিরিক্ত বেগে ছুটছে আরও দুটো গাড়ি।

পেছনে আসছে পুলিশের আরও গাড়ি।

শক্ত করে কিছু ধরুন! নায়ককে সতর্ক করল রানা। পরের সেকেণ্ডে বাটন টিপে ডিঅ্যাকটিভেট করল ট্র্যাকশন কন্ট্রোল। ক্লাচ চেপে একহাতে বনবন করে ঘোরাল স্টিয়ারিং হুইল। অন্যহাতে টান দিয়েছে হ্যাণ্ড ব্রেক।

ফোর-হুইল ড্রাইভ ব্যবহার করেও প্রায় উড়ছিল ল্যাম্বোরগিনি, ট্র্যাকশন কন্ট্রোল নেই বলে চরকির মত ঘুরল এক শ আশি ডিগ্রি। গায়ের জোরে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরেছে রানা। ইঞ্জিন থেকে বেরোল বিকট গর্জন। পুড়তে শুরু করে একরাশ ধোয়া ছাড়ল চাকার রাবার, পরক্ষণে আবারও ছিটকে রওনা হলো মার্সেইল্যাগো। রাস্তার বুকে পড়ে রইল রাবারের কালো পুরু দাগ।

রানাকে ফাঁদে ফেলতে চাইলেও পুলিশ অফিসাররা বুঝল, থামবে না সামনের ওই বদ্ধপাগল। দুই ক্রুরের মাঝ দিয়ে বুলেটের বেগে ছিটকে বেরোল রানা। থেমে গেল পেছনের পুলিশের দুই গাড়ি, ঘুরে অনুসরণ করল ল্যাম্বোরগিনিকে। এবার আসছে একটার পেছনে আরেকটা।

আবারও রাস্তা আঁকড়ে ধরেছে ল্যাম্বোরগিনির চওড়া চার চাকা। তুমুল বেগে ছুটছে গাড়ি। নানানদিকে সরছে সামনের গাড়িগুলো। চারপাশে হেডলাইটের আলো, সেইসঙ্গে নানান স্কেলে হর্নের শব্দ। অস্বাভাবিক দ্রুত এগিয়ে আসছে থার্টিসেভেন্থ স্ট্রিট। গতি সামান্য কমিয়ে লাবনীর পেছনে যেতে ডানে বাক নিল রানা।

কিন্তু ইন্টারসেকশনে…

সরাসরি সামনে চলে এল হলদে এক ক্যাব।

ঝড়ের মেঘের মত এলো চুল চিনে ফেলল রানা। ওই একইসময়ে ওকেও চিনল লাবনী। হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ। সরাসরি ক্যাবের দিকেই টর্পেডোর মত আসছে কমলা ল্যাম্বোরগিনি!

চরকির মত স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল রানা। বাড়িয়ে দিয়েছে গতি। যেন থেমে গেল সময়। পরক্ষণে ক্যাবের নাকের সামনে দিয়ে ছিটকে বেরোল সুপারকার।

রিয়ার ভিউ মিররে চেয়ে হতবাক হয়ে গেল লাবনী। রানার পেছনে তেড়ে আসা পুলিশের ক্রুযারের পেটে গেঁথে গেছে র‍্যাম পিকআপ ট্রাকের নাক। হাজারো কাঁচের টুকরো নানানদিকে ছিটকে দিয়ে লাটিমের মত ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার একপাশে গিয়ে থামল কুমার।

ওই সংঘর্ষে পুরো রক্ষা পায়নি ডজ পিকআপ। বুলবার মুচড়ে গেঁথে গেছে রেডিয়েটরের গ্রিলে। বাঁকা হয়ে আকাশে উঠেছে হুড। পিকআপের পেছনে ধাওয়া না করে বিধ্বস্ত গাড়ির কাছে থামল আরেকটা পুলিশের কুর। সহকর্মীদের সহায়তায় নেমে পড়ল অফিসাররা।

কাণ্ডটা দেখলেন? ফোঁস করে শ্বাস ফেলল বেলা।

না দেখে উপায় কী! বলল লাবনী, রানার জন্যে পানির মত সোজা মারাত্মক সব কাণ্ড!

.

আপনি ঠিক আছেন তো? জানতে চাইল রানা। নায়কের কাঁপা হাত থেকে নিল মোবাইল ফোন।

হ্যাঁ, ভাল আছি! হায়, যিশু। আরেকটু হলে খুন হতাম!

থার্টিনাইথ স্ট্রিটে বাঁক নিল রানা। এবার টাইমস স্কয়ারের দিক থেকে গিয়ে পেছনে চলে যাব ওদের।

কিন্তু, মিস্টার রানা, ওদের একজনের কাছে মেশিন গান আছে!

ওটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, পা রাখুন মেঝেতে।

কোলে তুলে নিয়েছিল নায়ক, নামিয়ে রাখল পা।

ওদিকে খেয়াল নেই রানার। সামনে লোডিং ডকের দিকে পিছিয়ে আসছে এক ট্রাক। আটকে দিচ্ছে পুরো পথ। কড়া ব্রেক কষে হর্ন বাজাল ও, মহাবিরক্ত। এবার আপনাদের হলিউডি সিনেমার মত দুই লোক মস্ত এক কাঁচ নিয়ে পা টিপে টিপে রাস্তা পেরোতে শুরু করলেই…

সরে গেছে ট্রাক। ওটাকে পাশ কেটে সেভেন্থ অ্যাভিনিউর ইন্টারসেকশনের দিকে চলল রানা। চওড়া জাংশন পেরিয়ে উত্তরদিকে চলেছে লাবনীর ক্যাব। এবার একবার পিকআপের সামনে যেতে পারলে…

তবে রানা বাঁক নেয়ার আগেই গর্জন ছাড়তে ছাড়তে ছুটে গেল নাক মোচড়ানো র‍্যাম পিকআপ। দুসেকেণ্ড পর পিছু নিল ও। চোখের সামনে দেখছে চওড়া লাল টেইলগেট। দুপাশ দিয়ে পেরোচ্ছে একের পর এক গাড়ির হেডলাইট। ব্রডওয়ের মতই ওয়ানওয়ে রাস্তা সেভেন্থ। ওই পথে যাওয়া যাবে শুধু দক্ষিণে।

মার্সেইল্যাগোর খুব কাছে এক এসইউভি আসতেই গাল কুঁচকে ফেলল নায়ক। আমরা জীবনেও ওদেরকে পেরোতে পারব না!

ভুল। মাথা নাড়ল রানা। মনে রাখবেন আমরা আছি ল্যাম্বোরগিনিতে। নিচু গিয়ার ফেলল। মেঝের সঙ্গে চেপে ধরেছে অ্যাক্সেলারেটর।

বামে গাড়ির সারির মাঝে সরু এক জায়গা দেখেছে রানা। ওদিকেই ছিটকে চলল ল্যাম্বোরগিনি। দেখতে না দেখতে গতি উঠল রকেটের মত। র‍্যাম পিকআপটাকে পেছনে ফেলেই পরক্ষণে ব্রেক কষল রানা। চমকে গিয়ে গতি হ্রাস করল পিকআপের ড্রাইভার। একপাশ দিয়ে এগোতে চাইল সে, তারপর মগজে ঢুকল গুতো মেরে সরিয়ে দিতে পারবে ওই কমলা সুপারকারটাকে। গর্জন ছেড়ে এগোল পিকআপ।

ঝটকা দিয়ে এগোল ল্যাম্বোরগিনি।

যন্ত্রদানবের নাগালের সামান্য বাইরে রয়ে গেল রানা। আবারও টাইমস স্কয়ারের দিকে চলেছে লাবনীর ক্যাব। হেডলাইটের সাগরে ওটা একমাত্র লাল টেইললাইট।

কিন্তু ক্যাবের দিকে সরাসরি আসছে দ্রুতগামী বড় এক বাস!

দুর্বল কণ্ঠে বলল ক্যাব ড্রাইভার, বাস। সামনে বাস।

দেখেছি, বলল লাবনী।

ওই বাস, ব্রিটিশ-স্টাইলের ডাবল-ডেকার, ছাত নেই দোতলার। টুরিস্ট নিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় শহরের নানান সাইট।

সোজা আসছে ক্যাবের দিকে।

 একটা বাস আসছে!

দেখেছি! হেডলাইট অফ-অন করল লাবনী। টিপে ধরেছে হর্ন। গতি কমাবার ইচ্ছে নেই।

কী করছেন? এবার রেগে গিয়ে জানতে চাইল ট্যাক্সি ড্রাইভার।

ফাটল ধরা পার্টিশানের ওদিক থেকে দেখছে বেলা। আমরা তো অ্যাক্সিডেন্ট করে মরব!

থামবে বাস, থামতে হবে ড্রাইভারকে। ব্রেক প্যাডেলে পা রাখল লাবনী। তবে প্রয়োজন না হলে থামবে না।

এটা শেষ টুর, বাসে মাত্র কজন প্যাসেঞ্জার, তাদের নিরাপত্তার পুরো দায়-দায়িত্ব বাস ড্রাইভারের ওপর। লাবনী এবং ড্রাইভারের ভেতর চলছে জেদের প্রতিযোগিতা। তবে আগে হার মেনে নিল বাসের ড্রাইভার। কড়া ব্রেক করল সে, হড়কে গেল চাকাগুলো। সরসর করে চলেছে ক্যাবের দিকে বিশাল বাস!

এহহে! মরেই গেলাম? হাঁ হয়ে গেল লাবনী। প্রায় নব্বই ডিগ্রি কাত হয়ে আসছে মস্ত যন্ত্রদানব! সামনে ধাতু ও কাঁচের তৈরি ছুটন্ত এক রোডব্লক যেন!

অবশ্য, ডানদিকের লেনের এক ড্রাইভার টের পেয়েছে বিপদ, বাসটা এসে পেছনে গুঁতো দেয়ার আগেই গতি তুলে ভেগে গেল সে।

ওই মাঝের জায়গাটা ক্যাব নিয়ে দখল করল লাবনী। রাস্তার বাঁকে ধুম করে বাড়ি খেল ক্রাউন ভিক্টোরিয়া। টাইমস্ স্কয়ারের স্টেশন হাউসের দেয়ালে এনওয়াইপিডির লোগো ছিটকে এগিয়ে এল লাবনীর নাকের কাছে। ভীষণ ভয় পেয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল ও। সাইনবোর্ড ঘষে ফুটপাথের ওপর উঠে পড়ল গাড়ি। জানের ভয়ে নানাদিকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণরক্ষা করল কজন পথচারী। কিন্তু ক্যাবের সরাসরি সামনে পড়ছে এক হটডগ কার্ট!

আল্লা! মানুষ খুন করছে ভেবে প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী।

হটডগ কার্ট ফেলে ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে ওটার মালিক। ক্যাব গিয়ে উড়িয়ে দিল কার্ট ইন্টারসেকশনের মাঝে। নানান দিকে ছিটকে পড়েছে ফুটন্ত পানি ও শতখানেক হটডগ।

সামনের পথ খুলেছে। ব্রডওয়েতে পিছলে যেতে যেতে পেছনে তাকাল লাবনী।

.

থেমে গিয়ে এদিক-ওদিক দুলছে প্রকাণ্ড দোতলা বাস। আটকে দিয়েছে তিনটে লেন। বেরোবার পথ নেই দ্রুতগামী ল্যাম্বোরগিনির।

এবার খুন হলাম! গুঙিয়ে উঠল নায়ক।

না, সংঘর্ষ এড়াবার উপায় আছে!

অনুকরণ করতে হবে লাবনীকে!

প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ফুটপাথে উঠে এল ল্যাম্বোরগিনি। বামে বাঁক নিয়েছে রানা। বিদ্যুদ্বেগে পেরোল বাসের কোনা, আরেকটু হলে নতুন করে উড়িয়ে দিত হটডগ কার্ট।

ঘুরে তাকাল রানা।

কড়া ব্রেক কষলেও স্কিড করতে করতে বাসের গায়ে এসে তো দিল তীব্রগতি র‍্যাম পিকআপ ট্রাক। বিকট শব্দে মিসাইলের মত ঢুকল বাসের নিচতলায়। ওই বিস্ফোরণে ছিটকে গেল ভাঙা চেসিসের ধাতু ও উড়ন্ত সিট। বেশিরভাগ যাত্রী বাসের দোতলায়। দুচারজন ছিল নিচতলায়, পিকআপ ট্রাককে বাসের দিকে পিছলে আসতে দেখে, আগেই দুদিকের দরজা দিয়ে নেমে ভোঁ-দৌড় দিয়েছে তারা। এদিকে বাস ভেদ করে হঠাৎ থমকে গিয়ে টাইমস্ স্কয়ারে ধুম্ করে কাত হয়ে পড়েছে ডজ র‍্যাম পিকআপ।

এদিকে ব্রেক কষে কর্কশ শব্দে থেমেছে ল্যাম্বোরগিনি। কাঁচির মত দরজা খুলে নেমে পড়েছে রানা। বসে পড়ে চোখ রেখেছে সুপারকারের হুডের আড়াল থেকে। কাত হয়ে পড়ে আছে পিকআপ, ফাটা পাইপ থেকে তিরতির করে পড়ছে। ফিউয়েল। ভাঙা উইণ্ডশিন্ডে বেকায়দাভাবে গেঁথে আছে রক্তাক্ত, মৃত ড্রাইভার। তার এক সঙ্গী, মোটা এক টেকো লোক উড়ে গিয়ে পড়েছে হটডগ কার্টের কাছে। এখনও হাতে ছোটখাটো টেক-নাইন সাবমেশিন গান।

খুলে গেল ল্যাম্বোরগিনির ওদিকের দরজা। বেরিয়ে এল নায়ক গিবন মুর। রানা কিছু বলার আগেই টেকো লোকটার দিকে পা বাড়াল সে।

পিছিয়ে আসুন! চিৎকার করল রানা।

কিছুই পাত্তা দিল না নায়ক। দুর্বলভাবে নড়ছে আহত লোকটা। তার হাতে লাথি মেরে টেক-নাইন ছিটকে ফেলল মুর। জিনিসটা গিয়ে খটাং করে লাগল বিধ্বস্ত ডজ গাড়ির গায়ে।

জনগণের একজন হিসেবে গ্রেফতার করছি তোমাকে! লোকটার পিঠে পা রেখে পোয় দিল নায়ক। হাসছে রানার দিকে চেয়ে। পাবলিক অ্যারেস্ট সিনেমার মত, ঠিক না?

বিরক্ত হয়ে মার্সেইল্যাগো ঘুরে এগোল রানা। পাশ কাটিয়ে গেল হটডগ কার্ট। ওখানে ওয়াটার ট্যাঙ্কের নিচে পেটমোটা সিলিণ্ডারের ওপরে জ্বলছে নীল আগুন। আপনি সুস্থ তো, মুর?

এত ভাল আগে থাকিনি, ম্যান! দেখার মত সব কাণ্ড! বাসের ওপরতলা থেকে এল উজ্জ্বল ফ্ল্যাশ। এইমাত্র ছবি তুলেছে কেউ। তো এভাবেই আমরা রক্ষা করলাম…।

ফ্রিয! বাস ঘুরে এদিকে এসেছে এক পুলিশ অফিসার, হাতে উদ্যত পিস্তল। ধমকে উঠল সে, দুহাত ওপরে তুলে রাস্তায় শুয়ে পড়ো!

মাথার ওপর হাত তুলল রানা। তবে পুলিশ অফিসারকে পাত্তাও দিল না নায়ক। অত চিন্তা করবেন না, ম্যান। আমরা ভাল দলের লোক। তারই সিনেমার বড় বিলবোর্ডের দিকে দেখাল। ওটা দেখেছেন? ওই ছবিটা আমার!

মুরের হাত মুচড়ে ধরে ধমক দিল অফিসার, চোপ! শুয়ে পড়ো!

খুলে গেল র‍্যাম পিকআপের পেছন দরজা। খেপা ষাঁড়ের মত বেরোল মইয়ের মত লম্বু কিলিয়ান ভগলার। দেখেছে, সামনে তিন লোক। রিভলভার তুলেই নিশানা করল সে।

পুলিশ অফিসারের হাত থেকে নায়ককে ছুটিয়ে নিয়ে একটু দূরে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা।

গুলি করেছে ভগলার।

পুলিশ অফিসারের পেটে বিঁধল গুলি। চালু ফোয়ারার মত পেট থেকে বেরোল রক্তের ধারা। হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ল বেচারা। হাতের অস্ত্রটা খটাং শব্দে ঢুকল ইঞ্জিন চালু এক ক্যাবের নিচে। গাড়ি থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় দিল ট্যাক্সি ড্রাইভার।

নায়ককে টান দিয়ে তুলল রানা। ঝাঁপ দিল ক্যাবের হুডের ওদিকে। পরের সেকেণ্ডে মাথার ওপর দিয়ে গেল ভগলারের রিভলভারের বুলেট। পরের গুলি লাগল ট্যাক্সির উইণ্ডশিল্ডে। বিস্ফোরিত হলো ওটা। গাড়ির সামনের চাকার আড়ালে নায়ককে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল রানা। ওর চোখে পড়েছে, ক্যাবের পেছনে পড়ে আছে পুলিশের অস্ত্রটা।

ক্যাব লক্ষ্য করে আরও দুটো গুলি পাঠাল ভগলার। উড়িয়ে দিয়েছে দুই জানালার কাঁচ। ঝুঁকে রাস্তা থেকে তুলে নিল টেক-নাইন সাবমেশিন গান।

শরীর গড়িয়ে ক্যাবের পেছনে সরে এল রানা। খপ করে তুলে নিল পুলিশের অস্ত্রটা। গুক নাইনটিন অটোমেটিক। চাকার আড়াল নিয়ে পরীক্ষা করল ওটা।

কেঁচোর মত গতি তুলে শরীর মুচড়ে রানার দিকে আসছে নায়ক।

পিছিয়ে যান! চেঁচিয়ে উঠল রানা। পরক্ষণে বাধ্য হয়ে ডাইভ দিল মুরকে সরাতে।

ফুল অটো বাটন টিপে গুলি পাঠাল ভগলার। রানার পেছনে ক্যাবের দরজা খুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল একরাশ গুলি। সামনে বেড়ে ধাক্কা দিয়ে নায়ককে চিত করে ফেলল রানা। আরেকরাশ গুলি লাগল ক্যাবের সামনে। ফুটো করছে পাতলা স্টিলের বডিওয়ার্ক। ইঞ্জিন ব্লকে লেগে ঠং-ঠং শব্দে চ্যাপ্টা হচ্ছে গুলি।

গাড়ি মুহূর্তের জন্যে লুকাবার জায়গা, ভাল কাভার নয়, গুলি থেমে যেতেই চাপা স্বরে বলল রানা। অ্যাকশন মুভির স্কুলে শেখায়নি? ওদিকটা দেখার জন্যে উঁকি দিল ও। ফুরিয়ে গেছে সাপের চামড়ার জ্যাকেট পরা লোকটার অস্ত্রের গুলি। ছুঁড়ে ফেলে দিল টেক-নাইন। আবারও হাতে উঠে এসেছে রিভলভার। লম্বুর একটু দূরেই টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল মোটা, টেকো লোকটা। রক্তাক্ত মুখে ছড়ে যাওয়ার অসংখ্য দাগ।

মিস্টার রানা! ডাকল এক মহিলা।

ঘুরে রানা দেখল ইউনিফর্ম পরা পরিচিতা মহিলা পুলিশ অফিসারকে। আসছে ক্রল করে, পেছনে তার পার্টনার।

আবারও গুলি করল ভগলার। সবাইকে বাধ্য করছে মাথা নিচু রাখতে। তার সঙ্গীর হাতে এখন একটা পিস্তল। পিছিয়ে যেতে লাগল দুজন।

এখানে কী ঘটছে? রানার কাছে জানতে চাইল মহিলা পুলিশ অফিসার জিনা হাওয়ার্ড।

ওদের জিজ্ঞেস করুন, সশস্ত্র দুই গানম্যানকে দেখাল রানা। ওরাই খুন করতে চায় আমার বান্ধবী লাবনীকে।

ক্যাবের গায়ে বিঁধল আরেকটা গুলি। নানানদিকে ছিটকে গেল এ্যাপনেল। নিতম্বে একটা টুকরো বিধতে কেঁউ করে উঠল নায়ক।

এনওয়াইপিডি! গলা ছাড়ল জিনা হাওয়ার্ড, হাত থেকে অস্ত্র ফেলো!

ক্যাবের গায়ে লাগল কয়েকটা গুলি। রিভলভারের ভারী গর্জনের সঙ্গে তাল মেলাল কড়াৎ! শব্দে অটোমেটিক পিস্তল। কথা শুনে অস্ত্র ফেলার লোক নয় ভগলার বা টেকো। ট্যাক্সির বাম্পারের নিচ দিয়ে তাকাল রানা। আরও কয়েকজন পুলিশ পাল্টা গুলি করতেই পিছিয়ে যাচ্ছে লোকদুজন। এরই মধ্যে আহত হয়েছে এক অফিসার, ঝুঁকির ভেতর আছে সিভিলিয়ানরা, কাজেই লোক দুজনকে খুন করতে গুলি করছে পুলিশরা।

কিন্তু ওই দুজনের অন্তত একজনকে দরকার রানার।

জানতে হবে, কীজন্যে লাবনীকে খুন করতে চাইছে।

গাড়ির তলা দিয়ে টেকোর ডান গোড়ালি ফুটো করে দিল রানা। ধড়াস্ করে রাস্তায় পড়ল লোকটা। চিৎকার জুড়েছে খেক-শেয়ালের মত। ব্যথায় চোখ সরু করে ভগলারের দিকে তাকাল। উঠতে সাহায্য করো!

তার চোখে তাকাল ভগলার, তারপর বিনাদ্বিধায় গুলি করল সঙ্গীর মাথায়। তরমুজের মত বিস্ফোরিত হলো খুলি। চারদিকে ছিটকে গেল তাজা রক্ত।

যিশু! বিড়বিড় করল জিনা হাওয়ার্ড।

কাত হওয়া র‍্যাম পিকআপের আড়ালে চলে গেছে লম্বু।

মহিলা অফিসার এবার বুঝল, কী করতে চাইছে রানা। না! একমিনিট, মিস্টার রানা!

ততক্ষণে ট্যাক্সির আড়াল থেকে বেরিয়ে চিতার বেগে পিকআপের দিকে ছুট দিয়েছে রানা। হাতে তৈরি পিস্তল। ওর টার্গেট আছে ডজের পেছনে…।

ক্যাবের মতই ডজ গাড়ি বুলেটপ্রুফ নয়। নিচের দিকে অস্ত্র তাক করেছে রানা। সুযোগ পেলে গুলি করবে লোকটার পায়ে। পিকআপ ট্রাকের পেছনে কয়েকটা গর্ত তৈরি করে কেবিনে পৌঁছে গেল রানার গুলি।

লাফিয়ে পিকআপ ট্রাকের সামনে ডাইভ দিয়ে পড়ল ভগলার। ঘুরেই গুলি করল। তবে রানাকে লক্ষ্য করে গুলি করেনি সে।

লম্বু গানম্যানের বুলেট বিঁধল হটডগ কার্টের মোটা গ্যাস সিলিণ্ডারে বোমার মত ফাটল ওটা।

প্রচণ্ড কনকাশন ছিটকে ফেলল রানাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর জোরাল শকওয়েভ কেটে যেতে আবারও সচেতন হলো সবাই। কিন্তু ততক্ষণে ভগলার চলে গেছে ফোর্টিথার্ড স্ট্রিট ৭-ধরে বহু দূরে। ঠেলাধাক্কা দিয়ে ভিড়ের মানুষগুলোর ওদিকে হারিয়ে গেল সে।

জ্বলন্ত এক হটডগ বান নাকের কাছে, সরে উঠে দাঁড়াল রানা। ব্যথায় টনটন করছে শরীর। দৌড়ে এসে ওর সামনে থামল জিনা হাওয়ার্ড। আপনি ঠিক আছেন?

ওদের পাশ কাটিয়ে ছুট দিল কজন পুলিশ অফিসার। আহত অফিসারের শুশ্রূষা করতে রয়ে গেল কজন।

আপাতত মরছি না, ক্ষত-বিক্ষত মাথার মৃত লোকটাকে দেখল রানা।

আফসোস নিয়ে মাথা নাড়ল মহিলা অফিসার। চোখের সামনে এসব দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ঠাণ্ডা মাথায় খুন! তা-ও একদল পুলিশ অফিসারের সামনে! লোকটা ম্যানিয়াক!।

বলা যায় না, বলল রানা, হয়তো কাজে খুব দক্ষ। মনে হয় না আপাতত তাকে আর ধরতে পারবেন আপনারা।

দেখা যাক। অপমান বোধ করছে মহিলা অফিসার।

সামনে এসে থামল গিবন মুর। মুখ ফ্যাকাসে। ইয়ে… মিস্টার রানা… আবারও বাঁচিয়ে দিলেন আমাকে… রানার ডানহাতটা ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকাতে লাগল সে। জিনা হাওয়ার্ডের চোখ কপালে উঠল তাকে চিনতে পেরে। জীবনেও শোধ দিতে পারব না এ ঋণ! আপনি না থাকলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতাম! …প্রাণ রক্ষা করেছেন বলে কী দিতে পারি আপনাকে, মিস্টার রানা?

কিছুই লাগবে না।

কিছু তো নিতেই হবে! রানার হাত ছাড়ছে না নায়ক।

যদি চেয়ে বসি আপনার ল্যাম্বোরগিনি? মুরের চোখে তাকাল রানা। বুঝে গেল, দামি গাড়ির চেয়েও বহু বেশি কিছুতে রাজি নায়ক।.আবারও মাথা নাড়ল রানা। না, চাই না কিছু। মজা পেয়েছি আপনার গাড়ি চালিয়ে। আর সঙ্গে ছিলেন, সেজন্যে ধন্যবাদ।

কিন্তু… কমলা ল্যাম্বোরগিনির দিকে তাকাল নায়ক। কসেকেণ্ড পর বলল, সত্যিই অবিশ্বাস্য! বলেছিলেন আঁচড়ও পড়বে না, আর শেষে তা-ই করে দেখালেন!

ধিকিধিকি আগুনের হলদে আলোয় ঝিকঝিক করছে কমলা সুপারকার।

আমার কপাল ভাল, হাসল রানা।

বিধ্বস্ত র‍্যাম পিকআপ ট্রাকের ফিউয়েলের সরু এক রেখা পৌঁছে গেছে জ্বলন্ত হটডগের পাউরুটির কাছে।

আরে… বলতে শুরু করেই জোর ধাক্কা দিয়ে নায়ক ও জিনাকে রাস্তায় ফেলল রানা। নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের পাশে। পাউরুটির আগুন তিরতির করে এসে চেটে দিল পিকআপের ফিউয়েল ট্যাঙ্ক!

বিস্ফোরিত হলো ডজ র‍্যাম পিকআপ, আকাশে উড়াল দিল ভারী গাড়ির চেসিস। দুর্দান্ত, নিখুঁত এক সমারসল্ট মেরে সোজা নামল ল্যাম্বোরগিনি মার্সেইল্যাগোর পিঠে।

উঠে বসল রানা। যাহ্!

হতবাক হয়ে লাখ ডলারের চ্যাপ্টা ধাতব আবর্জনার দিকে চেয়ে রইল নায়ক। শেষে গেলই!

বাসের ওপর থেকে ছবি তুলল কে যেন!

নিশ্চয়ই ইস্যুরেন্স আছে? জানতে চাইল রানা।

একটু পর মাথা দোলাল নায়ক। হ্যাঁ। ঠিক, ক্ষতি হয়নি। তবে ইস্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে গাড়ি নেয়ার সময় এবার কমলা রঙের ল্যাম্বোরগিনি নেব না।

রানা! দূর থেকে ছুটে এল লাবনী। ওহ্, কী যে ভাল লাগছে, তুমি সুস্থ!

তোমার জন্যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বলল রানা।

খাঁটি বন্ধুর বাহুতে হাত রাখল লাবনী। ঘুরে দেখল পেছনের তুবড়ে যাওয়া ক্যাব। ওর কথা মেনে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছে বেলা। তবে ওই গাড়ির মধ্যে রয়ে গেছে একজন। মহিলা পুলিশ অফিসারের দিকে ফিরল লাবনী। ক্যাব ড্রাইভার গুলি খেয়েছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স লাগবে।

একটার বেশি চাই, বলল জিনা হাওয়ার্ড। মুখের কাছে তুলেছে রেডিয়ো। পরে স্টেশনে গিয়ে আপনাদের কাছ থেকে সব জেনে নেব।

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

.

০৫.

 পরদিন সকাল দশটা।

একটু আগে লাবনীর অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেছে রানা। ড্রইংরুমে বসে আছে ওরা, সামনে ধূমায়িত কফির মগ।

কপাল ভাল, তোমাকে ভাল করেই চেনে পুলিশ অফিসাররা, তার ওপর কাজে এসেছে সুপারক্রেজ গিবন মুরের উপস্থিতি, বলল লাবনী, নইলে বিপদে পড়তাম।

মেয়র বা স্টেট গভর্নর চাইতেন না মুর বা আমি গ্রেফতার হই, বলল রানা। কালকে তাদের সঙ্গে মুরের একগাদা ফোটো তুলেছে সাংবাদিকরা। ছবি এসেছে জাতীয় সব দৈনিক পত্রিকায়।

ঠিক, বলল লাবনী। সত্যিকারের হিরো হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে গিবন মুরকে।

গতকাল রাতে পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পথে সংক্ষেপে আলাপ করেছে ওরা। এবার জানতে চাইল রানা, একদম প্রথম থেকে বলল তো, কীভাবে শুরু হয়েছিল এসব।

টুং-টাং শব্দে বেজে উঠল ডোর বাযার।

বাটন টিপে স্পিকারে বলল লাবনী, ইয়েস?

ডক্টর আলম? আমি বেলা আবাসি।

চলে এসো দোতলায়, বলল লাবনী। বাটন টিপে খুলে দিল বাইরের দিকের দরজার তালা।

কয়েক সেকেণ্ড পর কলিংবেল না বাজিয়ে কবাটে নক করল কেউ।

কাম ইন, বেলা, বলল লাবনী।

দরজা ঠেলে ঢুকল মেয়েটা। থ্যাঙ্কস্, ডক্টর আলম। ওর পেছনে বন্ধ হলো কবাট। সুস্থ আছেন দেখে ভাল লাগছে।

হাতের ইশারায় পাশের সোফায় তাকে বসতে বলল। লাবনী। তুমি ভাল তো? কেমন আছে তোমার বন্ধু?

জনি? ভাল আছে। তবে মনের দিক থেকে কাহিল। ওর ধারণা ছিল, কেউ পেটাতে পারবে না ওকে।

আচ্ছা!

হ্যাঁ! গতরাতে উঠেছিলাম এক হোটেলে। ও, এই যে আপনার ফোন। পার্স থেকে নিয়ে লাবনীর হাতে মোবাইল ফোনটা দিল বেলা। পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর কী হলো?

জেরা করেছে পুরো তিনঘণ্টা। রানাকে দেখাল লাবনী। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিস্টার মাসুদ রানা। নামকরা মানুষ।

মাথা দোলাল বেলা আবাসি। নামকরা? কী করেন আপনি, মিস্টার রানা?

রানা কিছু বলার আগেই জানাল লাবনী, কী করে না, সেটাই বরং জিজ্ঞেস করো! মাসুদ রানা? রানা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির চিফ। আছে সাগরগামী মস্ত মস্ত সব জাহাজের বিশাল বহর। মেক্সিকো, উরুগুয়ে, পেরু এবং আরও বহু দেশে গেছে নানান অভিযানে। নামও করেছে। শখের আর্কিওলজিস্ট হিসেবে। দুহাতে লাখ লাখ ডলার সাহায্য দেয় দুস্থদের সংস্থায়। কয়েকবার হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করেছে জঙ্গল-পাহাড়-মরুভূমি ও সাগর টুড়ে। তাই অনেকে ওকে বলে: সত্যিকারের দুঃসাহসী বাঙালি অভিযাত্রী! বড় করে দম নিল লাবনী।

ওরেব্বান্স! ঢোক গিলল বেলা। আপনি কি সত্যিই মানুষ, নাকি…।

অন্তত জানোয়ার নই, মৃদু হাসল রানা। চট করে পাল্টে ফেলল প্রসঙ্গ: এবার বলো, কী হয়েছিল? মিশরের আর্টিফ্যাক্টের সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক? মিশরে একই লোক তাড়া করেছিল? গতকাল রাতে লাবনীকে অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেয়ার সময় বেলার বিষয়ে খানিকটা শুনেছে ও।

হ্যাঁ, ওই একই লোক। বিশ্রী চুল। তার চেয়েও খারাপ সাপের চামড়ার জ্যাকেট।

ওই একই জ্যাকেট… ভুরু কুঁচকে গেল রানার। ওই একই লোক ছিল গতকাল একটা কাল্টের অনুষ্ঠানে। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল মুর…।

ওসাইরিয়ান টেম্পল কাল্ট? সামনে ঝুঁকল বেলা।

হ্যাঁ।

ওখানে ছিল মুখে ভয়ঙ্কর ক্ষতওয়ালা এক লোক?

ছিল।

মাই গড! হাঁ হয়ে গেল বেলা। সে ছিল স্ফিংস কম্পাউণ্ডে! তার নির্দেশেই গোপনে খনন করছে ওরা!

তুমি জানো কারা ওরা, বা কী খুঁজছে? জানতে চাইল রানা।

তোমাকে না বলেছি আইএইচএর বিজ্ঞাপনের কথা? রানাকে বলল লাবনী, ওই একই জিনিস খুঁজছে তারা।

আইএইচএর আগেই ওটা চাই তাদের, বলল বেলা, হল অভ রেকর্ডস ডাকাতি করবে। পার্স থেকে ডিজিটাল ক্যামেরা নিল মেয়েটা। হাতের ইশারায় দেখাল লাবনীর ল্যাপটপ। ওটার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারি?

ড্রয়ার ঘেঁটে কানেক্টিং কেবল নিয়ে কমপিউটার ও ক্যামেরার মধ্যে সংযোগ দিল লাবনী, তারপর অন করল দুই ডিভাইস। একমিনিট পর ল্যাপটপ স্ক্রিনে পরিষ্কার দেখা গেল ক্যামেরার ইমেজ।

ও, তা হলে আইএইচএকে দেয়া হয়েছিল এই তিনটা স্কুল… বিড়বিড় করল লাবনী।

কিন্তু দেয়া হয়নি ওদিকের পাতাটা, চতুর্থ প্রাচীন স্কুল দেখাল বেলা। বড় করে নিল ছবি। এখানে বলা হয়েছে, উত্তরদিকে আছে হল অভ রেকর্ডসসের আরেকটি প্রবেশপথ। ওটা ব্যবহার করত ফেরাউনরা। ওখানে আছে বড় এক ধ্রুবতারা। রাজকীয় কাউকে বা দেবতা বোঝাতে ব্যবহার করা হতো প্রাচীন আমলে। পরের ছবিতে গেল বেলা। এবারেরটা স্ফিংসের কম্পাউণ্ডের ব্লুপ্রিন্ট। পরিষ্কার দেখল ওরা অন্য দুই সুড়ঙ্গ। অন্যরা ব্যবহার করত পুব টানেল।

ওটাই খুলতে চাইছে ম্যান মেটয, বলল লাবনী। এই স্ত্রলে এ ছাড়া আরও কিছু আছে?

প্রথম ছবিতে ফিরে ওটা নিচে নামাল বেলা। একটা কক্ষ আছে মানচিত্রের। এই যে! এখানেই আছে সেই যোডিয়াক। আগেই বলেছি, ওটার ভেতর আছে দিক-নির্দেশ, কীভাবে পৌঁছুতে হবে ওসাইরিসের পিরামিডে।

ভুল ধারণা করছ না তো? সন্দেহ নিয়ে বলল লাবনী।

কথাটা শুনে রেগে গেছে বেলা। এক সেকেণ্ড পর ওর মনে পড়ল কার সঙ্গে কথা বলছে। না, কোনও ভুল হচ্ছে না, ডক্টর আলম। আমিও অবাক হয়েছি। স্ক্রলে ওই পিরামিডের কথাই আছে। যোডিয়াকটা কোনও মানচিত্র।

স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে রানা ও লাবনী।

সত্যিই হল অভ রেকর্ডসসের কথা লেখা আছে প্রথম তিন স্ক্রলে। সেক্ষেত্রে চতুর্থ স্ক্রল নকল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

ওই পিরামিড হওয়ার কথা বিশাল আকারের, রানার দিকে তাকাল লাবনী। আবিষ্কৃত হলে একদম পাল্টে যাবে আমাদের চেনা প্রাচীন মিশরের ইতিহাস।

একদল গুণ্ডা ভাবছে ওই যযাডিয়াকের মাধ্যমে পৌঁছুবে ওসাইরিসের পিরামিডে, বলল বেলা, তবে মাঝখান থেকে ঝামেলা করেছি আমরা।

তাই চাইছে আমাদেরকে খুন করতে। প্যাপিরাসে চোখ ফেরাল লাবনী। আর কী লেখা আছে?

পড়তে লাগল বেলা, সমাধির মাঝে রয়ে গেছেন অমর দেবতা-রাজা। আর তার কাছেই আছে অমর হওয়ার পবিত্র পাউরুটি।

অত অমরই যদি হবে, ওই সমাধির ভেতর কেন ওসাইরিস? মৃদু হাসল রানা।

ব্যাপারটা জটিল, বলল গম্ভীর বেলা, প্রথমে খুন হন। আটকে ফেলা হয় কফিনের ভেতর। তখন নতুন করে ফিরে পেলেন জীবন। তাতে কী, পরেরবারও খুন হলেন। তবুও কী করে যেন রয়ে গেলেন অমর। কিন্তু এবার আর ফিরতে পারলেন না জীবিতদের জগতে।

বুঝতে পেরেছি, মুচকি হাসল লাবনী, ভারতের যি টেলিভিশনের বাংলা নাটকের আকর্ষণীয় চরিত্রের মত, যখন তখন নতুন করে ফিরে পায় প্রাণ! বড়লোক প্রযোজক বা ডিরেক্টরের কড়া ধমক খেয়ে তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দেন কলকাতার চিত্রনাট্যকাররা! তাদেরও তো পেট চালাতে হবে!

মৃদু কাশল রানা।

সরি? কী বলা হয়েছে বুঝতে না পেরে তাকাল বেলা।

বলার মত কিছুই না, বলল লাবনী, আগের কথায় ফেরা যাক: ওসাইরিসের গল্প বা পুরাণের কারণে তৈরি হয়েছিল প্রাচীন মিশরের ধর্ম। কিন্তু এই স্ক্রলে লেখা আছে, ওই যোডিয়াক থেকে কীভাবে খুঁজে নেয়া যাবে ওসাইরিসের পিরামিড?

প্যাপিরাসে চোখ বোলাচ্ছে বেলা। একটু পর বলল, না, ওসব জানতেন সেই আমলের পুরোহিতরা। অবশ্য, স্কুলে লেখা: ওই যযাডিয়াকের মানচিত্র অনুসরণ করলে যে কেউ পাবেন ওসাইরিসের সমাধি। রানা ও লাবনীর দিকে তাকাল মেয়েটা। ওসাইরিস ছিলেন সবচেয়ে প্রতাপশালী মিশরীয় সম্রাট। সম্পদের শেষ ছিল না। তাঁকেই অনুকরণ করত ফেরাউনরা। বলা হতো, মিশরীয় সব রাজাই মারা গেলে হয়ে উঠবে দেবতা। কিন্তু তারা কেউ কোনও দিক থেকে টক্কর দিতে চাইত না ওসাইরিসের সঙ্গে। এর বড় কারণ, স্বয়ং ওসাইরিস স্থির করতেন, কে যাবে পরের জগতে, আর কে যাবে না।

সেক্ষেত্রে হয়তো অন্যসব ফেরাউনের সমস্ত সম্পদের চেয়েও বেশি ছিল ওসাইরিসের, বলল লাবনী, যেসব সমাধি পাওয়া গেছে, সেখানে ছিল বিপুল আর্টিফ্যাক্ট। এখন সত্যি যদি কেউ ওসাইরিসের সমাধি খুঁজে পায়…

তো এটাই ওসাইরিয়ান টেম্পল কর্মকর্তাদের নরহত্যার মোটিভ। ল্যাপটপ দেখাল রানা। ইন্টারনেটে গিয়ে দেখো, কী লেখা আছে ওসাইরিয়ান টেম্পল সম্পর্কে।

ব্রাউযার খুলে ওসাইরিয়ান টেম্পল লিখে এন্টার টিপল লাবনী। ক্লাউড রেযান্ট থেকে বেছে নিল সেরা সাইট। ক্লিক করতেই স্ক্রিনে এল কাদির ওসাইরিসের হাসিমুখের পোর্ট্রেট। দাঁড়িয়ে আছে কালো কাঁচের মস্ত এক পিরামিডের সামনে।

গতকাল একেই দেখেছি, বলল রানা। মিশরে ছিল নামকরা মুভি স্টার।

কাদির ওসাইরিসের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ল লাবনী। একটু পর বলল, সিনেমা ছেড়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত দম্ভ অন্য কোনও ধর্মের অনুসারী হতে দেয়নি তাকে। নিজেই প্রতিষ্ঠা করে নতুন কাল্ট। পনেরো বছর আগে জন্ম নিল ওসাইরিয়ান টেম্পল। ওই সংগঠনের হেডকোয়ার্টার সুইটয়ারল্যাণ্ডে। অসংখ্য শাখা ছড়িয়ে গেছে পঞ্চাশটির বেশি দেশে। বাংলাদেশ বা অন্যান্য স্বল্প শিক্ষিত দেশের ভণ্ড পীরদের মতই রোজগার করছে দুহাতে। ভক্তের নাকে-মুখে ফুঁ দিলেও পয়সার অভাব নেই। তার চিলুমচির কফ মেশানো থুতু ঢকঢক করে খেয়ে নিচ্ছে অনেকে। লোকটা নিজের রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে বহু মানুষের ভেতর। এ ছাড়া, চড়া দামে বিক্রি করছে তুকতাক করা নানান জিনিসপত্র।

স্ক্রিনের এক জায়গায় চোখ পড়েছে বেলার। নাক কুঁচকে ফেলল। আরে! এটা তো নতুন খবর! জীবিত অবস্থায় অমর ছিল না ওসাইরিস। তবে মরে যাওয়ার পর সে চলে যায় পাতালে। তখন থেকেই সে হয়ে ওঠে অমর।

পরবর্তী পৃষ্ঠা পড়ে মন্তব্য করল লাবনী, প্রাচীন দেবতা রাজা ওসাইরিসের বিষয়ে লিখিত পুরাণ নিয়ে মাতামাতি করে না এ যুগের ওসাইরিস, করলে বিপদে পড়বে। দশমুখে প্রচার করছে, সব ঠিক লেখা হয়নি পুরাণে। তবে তার প্রতিটি বক্তব্য ধ্রুবতারার মতই সঠিক।

তাই লিখেছে দেখছি, বলল বিস্মিত বেলা। বিক্রি করছে নানান খাবার, ব্যায়ামের বই, ভিটামিন… কী নেই! এসবই নাকি দীর্ঘায়ু করবে। ধর্মের কপচানি দিয়ে প্রতিটি প্রোডাক্টের জন্যে একদল বোকার কাছ থেকে নিচ্ছে অন্তত পাঁচগুণ টাকা। সুপারমার্কেট থেকে কিনলে লাগত অনেক কম। কিন্তু ওই যে, প্রোডাক্টের ওপর পিরামিডের সিল, ওটার একটা দাম আছে না!

স্ক্রিনে আরেকটা পৃষ্ঠা খুলল লাবনী। ওপরে বড় করে লেখা: ওসাইরিয়ান টেম্পলে যারা ধর্মগুরু।

প্রথমেই গর্বিত কাদির ওসাইরিসের রঙিন ছবি। এরপর নিচে ছোট এক সাদা-কালো ছবি।

এই লোক প্রায় কাদির ওসাইরিসের মতই দেখতে।

 নাদির মাকালানি, পড়ল লাবনী, দেখতে একইরকম। হয়তো দুই ভাই এরা। একজন কাদির, আরেকজন নাদির।

অসম্ভব নয়, বলল রানা, এর গালে আছে ক্ষতচিহ্ন। তবে দুজনের বংশের নাম আলাদা। ওসাইরিস নামটা হয়তো পরে আত্মস্থ করেছে কাদির। রানা খেয়াল করল, নাদির মাকালানির ছবি স্ক্রিনে নিখুঁত। কোথাও কোনও ক্ষত নেই।

সোফায় হেলান দিয়ে বসল লাবনী। বেলা, ঠিক বলছ তো, এই লোকই ছিল স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে?

জীবনেও ভুলব না। এ সে-ই।

আর গতকাল রাতে লম্বা যে লোকটা খুন করতে চাইল আমাদেরকে, সে ছিল নাদির মাকালানির স্যাঙাৎ?

মাথা দোলাল বেলা।

 তার মানে, এরা চায় না মুখ খুলবে তুমি, বলল লাবনী।

আবারও মাথা দোলাল মেয়েটা। কর্তৃপক্ষকে জানাতে চেয়েছি, কিন্তু মিশরের কেউ শুনতেও চায়নি। যখন ফোন করলাম ডক্টর মেটযকে, সোজা বলে দিল, যেন আত্মসমর্পণ করি পুলিশের কাছে।

পুলিশ তো খুঁজছিল তোমাকে, কীভাবে বেরোলে মিশর থেকে? জানতে চাইল রানা।

শুনে ফেলি নাদির মাকালানির কথা, বলল বেলা। চোখ রাখা হয়েছিল প্রতিটি এয়ারপোর্ট ও বন্দরে। আমার সঙ্গেই ছিল পাসপোর্ট ও সামান্য টাকা। কায়রোয় ফিরে বাসে চেপে যাই ছোট এক শহরে। উপকূলে কয়েকজন যুবককে অনুরোধ করলে তারা নৌকায় করে আমাকে পৌঁছে দেয় জর্ডানের তীরে। ওখান থেকে বাস ধরে যাই আম্মানে। তারপর ওখান থেকে বিমানে চেপে সোজা আমেরিকায়।

মিশরের কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে আরেক দেশে ঢুকে পড়ার কাজটা সহজ ছিল না, ভাবল রানা। সাহস আছে মেয়ের। তারপর খুঁজে বের করলে কার কাছে যেতে হবে। যোগাযোগ করলে লাবনীর সঙ্গে।

আমি জানতাম, ডক্টর আলম সাহায্য করতে পারবেন। পরে সত্যিই তা-ই হলো। উনি সাহায্য না করলে আমাকে খুন করত ওই লোকগুলো। লাবনীর দিকে তাকাল বেলা। থ্যাঙ্কস, ডক্টর!

বুকে সাহস ছিল, তা-ই বেঁচে গেছ, বলল লাবনী, তবে ধরে নিতে পারো, কেটে গেছে বিপদ। গতকালকের ঘটনার পর পুলিশের ভয়ে নিউ ইয়র্কে থাকবে না ওই লোকগুলো। তোমার কাছে যেহেতু ছবি আছে, আইএইচএতে গিয়ে কথা বলতে পারব আমরা। অনিশ্চয়তা নিয়ে রানার দিকে তাকাল লাবনী। অবশ্য, যদি আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয় প্রফেসর ক্যাথারিন ট্রিপ।

শোনাই যাক না কী বলেন মহিলা, বলল রানা, ফোন করো।

ল্যাণ্ড ফোনের মাধ্যমে লিপি গোমেযকে ফোন করল লাবনী। জানাল, কথা বলতে চায় ক্যাথারিন ট্রিপের সঙ্গে। লাউড স্পিকার চালু করে রেখেছে। সব শুনবে রানা ও বেলা।

লিপি তিনবার অনুরোধ করার পর লাবনীর কল রিসিভ করল ক্যাথারিন ট্রিপ। শুরুতেই বলল, যা বলার বলে ফেললাম। তোমার কপাল খুব ভাল যে গতরাতের ঘটনার পর এখনও রয়ে গেছ জেলের বাইরে। খবরের কাগজে পড়েছি, মারা পড়েছে দুজন, আহত কয়েকজন, ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার ডলারের জিনিস। পুরো শহরের অর্ধেক মানুষকে জ্বালিয়ে মেরেছ। আরও কিছু করার বাকি আছে তোমার?

তিক্ততা হজম করে বলল লাবনী, ডক্টর ট্রিপ, খুব জরুরি কাজে ফোন করেছি। তা স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে খনন বিষয়ক।

কী বলবে বলল।

ডক্টর ম্যান মেট্য হল অভ রেকর্ডস উন্মোচন করার আগেই ওটা ডাকাতি করতে চাইছে একদল তস্কর।

ওদিকে নীরবতা। কয়েক সেকেণ্ড পর বোমার মত এল মহিলার অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠ: কী বললে?

ওসাইরিয়ান টেম্পল এসবে জড়িত। তাদের কাছে আছে চতুর্থ স্ক্রল। ওটা কখনোই পায়নি আইএইচএ। ওই স্কুলে আছে আরেকটা টানেলের কথা। এখন স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে ওই টানেল খুঁড়ছে একদল ডাকাত।

আবারও নীরব হলো লাইন, তারপর টিটকারির খেককে শব্দের হাসি রাগিয়ে দিল লাবনীকে।

অনেক ধন্যবাদ, লাবনী। আমার কথাই ঠিক হলো। পুরো বদ্ধ-উন্মাদ হয়ে গেছ! প্রথম থেকেই আমাদেরকে টাকা দিচ্ছে ওসাইরিয়ান টেম্পল, তা হলে তাদের কী ঠেকা পড়েছে দ্বিতীয় টানেল খুঁড়ে মরার?

সেটা বরং তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করুন, রাগ সামলে বলল লাবনী। কিন্তু চতুর্থ স্কুলের ছবি আছে আমার হাতে। এটাও জানি কেমন হবে ওই টানেল।

তো কোথায় পেলে ওই ছবি? হা-হা-হা-ওহ! কদিন আগে এক ওয়েব সাইটে লিখেছে: মিশরের হায়ারোগ্লিফে লেখা আছে ফ্লাইং সসারের কথা! হা-হা-হা-ওহ্!

ছবি পেয়েছি বেলা আবাসির কাছ থেকে।

বেলা আবাসি? ও, সেই ইন্টার্ন?

ঠিকই শুনেছেন।

যাকে সিনিয়রদের ওপর হামলা আর অ্যান্টিকুইটি চুরির দায়ে খুঁজছে মিশরীয় পুলিশ?

রাগে লাল হয়ে গেছে বেলা।

আমার ধারণা, ফাঁদে ফেলা হয়েছে ওকে, বলল লাবনী, গতকাল এতকিছু হয়েছে, কারণ ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল লোকগুলো। যাতে মুখ খুলতে না পারে মেয়েটা।

শীতল হয়ে গেল ক্যাথারিন ট্রিপের কণ্ঠ: লাবনী, তোমার প্যারানইয়া মেশানো ষড়যন্ত্রের থিয়োরি শোনার সময় আমার হাতে নেই। এরপর আর কখনও আমাকে ফোন দেবে না।

অন্তত ছবিগুলো দেখবেন না? আমি পাঠিয়ে দেব…

কোনও দরকার নেই, ফোন কেটে দিল মহিলা।

সত্যিকারের নীচ, বিড়বিড় করল লাবনী। তবুও আইএইচএর চিফের ই-মেইল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিল ছবি। আবারও ফোন করল লিপির কাছে।

বোধহয় কাজ হলো না? বলল মেয়েটা, এইমাত্র আমাকে বলে দিয়েছেন, যেন আর কখনও আপনার ফোন তাঁর কাছে না দিই।

ভাল হতো উনি আমার বক্তব্য শুনলে। যাই হোক, তবুও অ্যাটাচ করে পাঠিয়ে দিয়েছি কিছু ছবি। মনে হচ্ছে না দেখেই ডিলিট করে দেবেন। তাই আবারও পাঠাচ্ছি তোমার কাছে। যদি পারো, প্রিন্ট করে দিয়ে ক্যাথারিন ট্রিপের ইন-ট্রেতে। ব্যাপারটা খুবই জরুরি। তাঁর অন্তত দেখা উচিত ওই ছবিগুলো।

দেখি কী করতে পারি, বলল লিপি। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ভাল কথা, গতকাল টিভিতে দেখেছেন, কী ঘটেছে টাইমস স্কয়ারে?

খানিকটা শুনেছি, উদাস হয়ে গেল লাবনী। বাই, লিপি। আবারও ই-মেইল করে ছবি পাঠাল মেয়েটার কাছে। কাজ শেষ করে তাকাল রানার চোখে। আজও আইএইচএর চিফ থাকলে কাউকে না কাউকে বলতাম ছবিগুলো ভাল করে দেখতে।

নিশ্চয়ই অন্য উপায় আছে? বলল বেলা। ওসাইরিয়ান টেম্পলের লোক যোডিয়াক পেলে ঠিকই বের করে ফেলবে, কোথায় আছে ওসাইরিসের পিরামিড। কেউ জানবে না কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে। চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে দুর্দান্ত একটা সাইট! আপনি কি কিছুই করতে পারেন না, ডক্টর আলম?

মাত্র একটা উপায়ই দেখছি, বলল লাবনী, হাতেনাতে ধরতে হবে লোকগুলোকে। সেজন্যে যেতে হবে মিশরে। কিন্তু হামলার ভয় আছে। নিরাপত্তা পাব না কোথাও। রানার দিকে তাকাল লাবনী। অবশ্য, রানা যদি রাজি হয় যেতে…

চুপ করে আছে রানা।

টাকার চিন্তা করতে হবে না, বলল বেলা, বাবা-মার কাছ থেকে প্রতি মাসে যথেষ্ট টাকা পাই। আমার বাবা প্লাস্টিক সার্জন। মা সাইকিয়াট্রিট। যথেষ্ট বড়লোক তারা। সব খরচা আমিই দেব।

একমিনিট, বেলা, তুমি কিছুই বলোনি তোমার বাবা মাকে? জানতে চাইল রানা।

না, এখনও বলিনি, চোর-চোর চেহারা করল বেলা। চাইনি তারা জানুন যে দেশে ফিরে এসেছি।

কাজটা ঠিক করোনি, বলল লাবনী।

চাই না তাদের ওপরেও হামলা হোক! ক্ষতচিহ্নওয়ালা লোকটা বলেছিল, তার লোক চোখ রাখবে আমাদের বাড়িতে। ট্যাপ করবে ফোন। এভাবেই খুঁজে বের করবে আমাকে। তবে বাবা-মা যদি না-ই জানেন কী হয়েছে, চিন্তায় পড়বেন কেন? আমার কারণে বিপদ হবে না তাদের, আবার তাদের কারণে আমিও বিপদে পড়ব না।

কিন্তু তোমার বাবা-মা এরই ভেতর টের পেয়েছেন, গোলমাল আছে কোথাও, বলল লাবনী, আইএইচএ থেকে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করেছে। এদিকে পুলিশকে জানাতে বাধ্য হয়েছি, গতরাতে কী হয়েছে। ধরে নাও পুলিশ থেকে যোগাযোগ করবে আইএইচএতে। ওখান থেকে জেনে নিয়ে কল করবে পুলিশ তোমার বাবা-মার কাছে।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বেলা। ও! এটা তো ভাবিনি!

ফোন দেখাল লাবনী। দেরি না করে কল করো। তাঁদের জানাও, তুমি ঠিক আছ।

রিসিভার নিয়ে ডায়াল করল বেলা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, মম, হাই! …মম? …মম, শান্ত হও… আমি ঠিক আছি। খুব ভাল আছি! …হ্যাঁ, কোনও সমস্যা নেই! ও, তো আইএইচএ থেকে কল করেছিল? তিক্ত হয়ে গেল মেয়েটার চেহারা। না, ভুল বলেছে। অমন কিছুই হয়নি। মিথ্যা বলছে ওরা! রেগে উঠছে বেলা।…মম! …না, কোনওভাবেই বাড়ি ফিরতে পারব না! …এখনই নয়! তবে যত দ্রুত সম্ভব ফিরব। আগে জরুরি কাজ শেষ করতে হবে। …হ্যাঁ, খুব জরুরি! পরে সবই খুলে বলব। ও, আরেকটা কথা, তোমাদের যদি মনে হয় কেউ লুকিয়ে বাড়ির ওপর চোখ রাখছে, দেরি না করে পুলিশে ফোন দেবে। বুঝতে পেরেছ?

চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করেছেন বেলার মা। কথাগুলো পরিষ্কার শুনল রানা ও লাবনী।

ছিহ, মম! সত্যি বলছি, ভাল আছি! পরে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে, ঠিক আছে? …মম। …মম! বলেইছি, তো পরে কল দেব! এখন ফোন রাখছি! বাই। …হ্যাঁ, বাই!

ফোনের রিসিভার রেখে হাঁফ ছাড়ল বেলা। উফ! বাবা মা! ভাবাই যায় না কত হাজার প্রশ্ন তাঁদের পেটে থাকে! লজ্জা পেয়ে রানা ও লাবনীকে দেখল। সরি!

কীসের জন্যে সরি? জানতে চাইল রানা।

 তা তো জানি না!

বাড়ি ফিরে যাও, সেটাই ভাল, বলল রানা।

মাথা নাড়ল বেলা। জীবন থাকতে নয়! আমিও যেতে চাই আপনাদের সঙ্গে মিশরে!

জেদ ভরা মুখটা দেখে লাবনী বুঝল, ঠেকাতে পারবে না মেয়েটাকে। রানার দিকে তাকাল। আইএইচএর বর্তমান চিফ ক্যাথারিন ট্রিপের অফিসে গিয়ে অপমানিত হয়েছে, তার কারণ ওকে পাঠিয়েছিল রানা।

এখন থমথম করছে বাঙালি গুপ্তচরের চেহারা।

তুমি কি ছুটি পাবে, রানা? জানতে চাইল লাবনী। যাবে আমাদের সঙ্গে মিশরে? খুব খুশি হতাম!

অফিসে কল দেব, বলল রানা, যদি ছুটি পাই, অবশ্যই যাব। তবে বেলা ওর বাবা-মার পয়সা আমাদের পেছনে খরচ করবে, তা হতে দেব না।

আমিও একমত, সায় দিল লাবনী, আমার জমানো টাকা দিয়েই…

আমার খরচ নিজেই দেব, বলল রানা। ওর পকেট থেকে বেরোল স্যাটেলাইট মোবাইল ফোন। কী, যেন ভেবে নিয়ে কল দিল বিসিআই চিফ, মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কাছে।

কয়েক সেকেণ্ড পর এল জলদগম্ভীর কণ্ঠ: হ্যালো, রানা, কিছু বলবে?

ওই ভারী কণ্ঠ শুনে ঢোক গিলল রানা। জী, স্যর।

খুকখুক কাশলেন বিসিআই চিফ। চুপ করে আছেন।

জবাবদিহির সুরে বলল রানা, হঠাৎ মিশরে জরুরি এক কাজে…

হুম।

 আপাতত আমার ছুটি চলছে, স্যর।

হ্যাঁ, জানি। ছুটিটা একটু বাড়িয়ে নিতে চাও?

জী, স্যর।

বুঝতে পারছি আরও কিছু বলবে।

কবে থেকে পেটের কথা বুঝতে লাগলি রে, চুরুটখোর পীরবাবা? ভাবল রানা। মুখে বলল, প্রয়োজনে আমাদের মিশর দূতাবাসের সেকেণ্ড অফিসারের সাহায্য নেব?

ওখানে এখন আছে মিতালি গাঙ্গুলি, ভাল করেই চেনে তোমাকে। আপত্তির কিছু দেখছি না। …ছুটি নিতে পারো, তবে প্রয়োজনে তোমাকে ডেকে নেব।

জী, স্যর।

লাইন কেটে দিলেন রাহাত খান।

 ফোঁস করে হাঁফ ছাড়ল রানা।

উনিই তা হলে বিসিআই চিফ? জানতে চাইল লাবনী।

চুপ করে মাথা দোলাল রানা।

ভুরু কপালে তুলে মিষ্টি হাসল লাবনী। তোমাকে কাল ঘাম ঝরাতে দেখেই বুঝলাম, সবসময় সেরের ওপরে সোয়া সের থাকে!

আমরা তা হলে মিশরে যাচ্ছি? খুশি মনে বলল বেলা।

মাথা দোলাল রানা। ফ্লাইট বুক করব।

পরস্পরের দিকে চেয়ে হেসে ফেলল লাবনী ও বেলা।

.

০৬.

সত্যিই দেখার মত, বলল লাবনী।

আগেও বেশ কয়েকবার মিশরে এসেছে রানা, চুপচাপ দেখছে চারপাশ।

মহাকালের গ্রাসে বিলীন হয়েছে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের ছয়টি মহান কীর্তি, তবে রয়ে আছে গিজার মস্তবড় সব পিরামিড। খুফুর পিরামিড এবং অপেক্ষাকৃত ছোট অন্য দুই পিরামিডও এতই প্রকাণ্ড, বুকে বিস্ময় জাগে। ওই বিশাল আকারের জন্যেই সাড়ে চার হাজার বছর ধরে টিকে আছে ওগুলো। অবশ্য বহু আগেই খসে পড়েছে ম্যানকেউরের পিরামিডের ধবল লাইমস্টোন, এখন দাঁত বের করে হাসছে বালিপাথর ও গ্ল্যানেট।

লাবনীর মত মুগ্ধ নয় বেলা। চুল খুঁজেছে বেসবল ক্যাপের ভেতর। মুখের বেশিরভাগ ঢাকা পড়েছে বড় এক সানগ্লাসে। জমাট বাঁধা বালিতে পা ঠুকল ও। সবই ঘুরে দেখেছি। বিরক্ত হয়ে গেছি দেখতে দেখতে। …ডক্টর মেয়ের সঙ্গে কখন দেখা করবেন, ডক্টর আলম?

খোঁজ নিয়েছি, আপাতত এখানে নেই সে, বলল লাবনী।

টুরিস্ট পুলিশ বা কম্পাউণ্ডের সিকিউরিটি গার্ডদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে রানা ও লাবনীর সঙ্গে যায়নি বেলা।

আইএইচএ টিমের সঙ্গে দেখা করেছিল লাবনী, কিন্তু কম্পাউণ্ড ঘুরে দেখার অনুমতি দেয়নি তারা।

কায়রোয় টিভি শোতে অংশ নিচ্ছে। দুনিয়ার মানুষকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কী দুর্দান্ত কাজ করছে সে। আগামী কয়েক ঘন্টার ভেতর ফিরবে না।

কম্পাউণ্ডের উত্তরের রোড ধরে এগোল রানা, লাবনী ও বেলা। দেয়ালের ওপর থেকে নিচের কন্ট্রাকশন সাইট দেখাল মেয়েটা।

ওই শার্ট কোথায়? জানতে চাইল রানা।

দূরের এক তাবু দেখাল বেলা। ওই যে, ওটার ভেতর।

পযিশনটা মনে গেঁথে নিল রানা। বেলা যা বলেছিল, তার চেয়ে ভালভাবে পাহারা দেয়া হচ্ছে। টুরিস্ট পুলিশদেরকে বাদ দিলেও রয়েছে ইউনিফর্ম পরা দুজন গার্ড। তারা প্রাইভেট সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টরের লোক, চোখ রাখছে চারপাশে।

স্ফিংসের দিকে তাকাল বেলা। আগের চেয়ে বেশি লোক রেখেছে।

যাতে খনন এলাকায় কেউ যেতে না পারে, বলল রানা। এর ভাল দিকও আছে।

আছে? অবাক হয়েছে বেলা।

এদের কেউ কেউ নতুন। তারা তোমাকে চেনে না। দেয়ালের ওপরের দিকে হাত রাখল রানা। যেন বুঝে নিতে চাইছে পাথরের স্ল্যাবের ওজন কেমন।

কী করবে ভাবছ, রানা? জানতে চাইল লাবনী।

 এখনও কিছুই ঠিক করিনি, বলল রানা।

স্ফিংস থেকে মাত্র সিকি মাইল দূরে গ্রেট পিরামিডের বিশাল ভিত্তি। একেক দিক দৈর্ঘ্যে সাত শ পঞ্চাশ ফুটেরও বেশি। অর্থাৎ, পনেরো শ ফুটেরও বেশি দূরে উত্তরদিকের এন্ট্রান্স। এরই মধ্যে ওখানে জড় হয়েছে কয়েক ডজন টুরিস্ট। তাদের ওপর চোখ রাখছে একদল পুলিশ। দিনে মাত্র দুবার অল্প কজনকে ঢুকতে দেয়া হয় পিরামিডের ভেতর। নিউ ইয়র্কে বিমানে চেপে এগারো ঘণ্টা জার্নির পর কায়রো এয়ারপোর্টে নেমেছে রানারা। বেরিয়ে এসে জেদ ধরল লাবনী। ফলে আর বিশ্রাম হয়নি ওদের। টিকেট অফিস খোলার আগেই হাজির হয়েছে এখানে।

আগে লাবনী ও বেলাকে পিরামিডের পাথুরে স্তরে উঠতে দিল রানা, তারপর অনুসরণ করল।

পিরামিডের ভেতরে ঢুকে লাবনী বলল, ছবিতে যা দেখেছি, সে তুলনায় মেঝে অনেক খাড়া।

দুপাশে মসৃণ পাথুরে দেয়াল, সরু প্যাসেজ ত্রিশ ডিগ্রি নেমে ঢুকেছে পিরামিডের অভ্যন্তরে। ছাত এতই নিচু, বুকে হাঁফ লাগবে যে-কারও।

নেমে গেলে পৌঁছে যাবেন মূল সমাধির ভেতর, কিন্তু ওখানে কিছুই নেই, বলল বেলা, পিরামিড তৈরির এক পর্যায়ে অন্য এক সমাধিকক্ষ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ফেরাউন খুফু।

নিশ্চয়ই খুব খেপে গিয়েছিল আর্কিটেক্টরা। বিরক্ত হয়ে ভেবেছে: হারামি এখন অন্য কথা বলছে! এর চেয়ে বদমাশ লোক আর দেখিনি! বলল লাবনী।

ষাট ফুট যাওয়ার পর দুভাগ হলো প্যাসেজ। একটা গেছে নিচে। অন্যটা ওপরে। ওপরেরটার ছাত আরও নিচু।

বেলার পরামর্শে দ্বিতীয় প্যাসেজ বেছে নিল রানা ও লাবনী। বাইরে ফুরফুরে হাওয়া, কিন্তু সুড়ঙ্গের ভেতর গরমে আঁকড়ে আসছে বুক।

যেন শেষ হবে না খাড়াই পথ। লাবনী ও বেলার পেছনে প্রায় আধভাজ হয়ে হাঁটছে রানা। কাফ মাসলে বিশ্রী খিচ ধরতেই মহাবিরক্ত হয়ে বলল, ফেরাউনগুলো বেঁটে আর কুঁজো ছিল নাকি?

আর যা-ই হোক, জীবিত অবস্থায় ঢুকতে আসেনি, বলল লাবনী, তা ছাড়া, রাজাবাদশা, অন্যের দুঃখ বুঝবে কী করে?

কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটু প্রশস্ত হলো প্যাসেজ। ছাতও উঠে গেল তিরিশ ফুট ওপরে।

এটা গ্রেট গ্যালারি, বলল বেলা।

বিশাল সব লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি চেম্বার।

ধরে আসা কোমর সোজা করে জানতে চাইল রানা, নাম শুনেছি, কিন্তু কী কারণে তৈরি করেছিল?

কাঁধ ঝাঁকাল লাবনী। ধারণা করা হয়, মস্তবড় পাথরের খণ্ড তুলতে ব্যবহার করেছিল কাউন্টার ওয়েইট সিস্টেম… সেজন্যে… আসলে কেউ জানে না কেন তৈরি করেছিল। এটা পিরামিডের আরেকটা রহস্য। সামনের সমতল প্যাসেজ দেখাল লাবনী। নিচে বোধহয় রানির চেম্বার?

হ্যাঁ, সায় দিল বেলা। তবে কখনও কোনও রানি ছিল না। বাইরে তার ছোট পিরামিড। ভেতরে ফালতু অসমাপ্ত চেম্বার।

দক্ষতার দিক থেকে এসব পিরামিডের ধারেকাছেও আসবে না এ যুগের কোনও স্ট্রাকচার, বলল লাবনী। আর ওই আমলে এসব করেছে সামান্য সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।

বইয়ে পড়েছি, হাজার হাজার ক্রীতদাস ছিল সাহায্যের জন্যে, বলল রানা। খুন হয়েছে তাদের বেশিরভাগই।

না, মাথা নাড়ল বেলা। যারা পিরামিড তৈরি করেছে, প্রত্যেকে ছিল দক্ষ কারিগর। কাজের জন্যে যথেষ্ট বেতনও পেয়েছে। খুফু বা চেওন্সের পরের ফেরাউনরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ফেঁদেছে ক্রীতদাসের গল্প। ওরা জানত, চাইলেও তৈরি করতে পারবে না এরকম পিরামিড। তাই প্রচার করত: আমরাও খুফুর মত বিশাল পিরামিড বানাতাম, যদি তার মত লাখে লাখে ক্রীতদাস পেতাম। আসল কথা: অন্য ফেরাউনদের চেয়ে খারাপ ছিল না খুফু।

কেন এসব তৈরি করত, কেউ জানে না, আবারও বলল লাবনী। মিশর রাজ্যে প্রথমে ছিল ধাপ সমেত পিরামিড। তারপর ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষ হলে তৈরি করল মসৃণ দেয়ালের পিরামিড। প্রথমে ডাহশুরে লাল একটা তৈরি করেছিলেন সেফেরু, ওটাই সত্যিকারের প্রথম পিরামিড। তারপর তাঁর ছেলে গড়লেন আরও বড় পিরামিড। আমরা এখন আছি ওটারই ভেতরে।

ওপরের স্তরে উঠে হাঁফিয়ে গেছে লাবনী। টের পেল, মোটেও ক্লান্ত নয় রানা ও বেলা। সামনে সমতল প্যাসেজ গেছে সমাধির আরও গভীরে। কয়েক ফুট দূরেই দীর্ঘ এক চেম্বার। ওদিকের দেয়ালের ওপরে সরু প্যাসেজ।

ওই খাঁজটা কেন? জানতে চাইল রানা।

চোর ঠেকাবার জন্যে, জানাল বেলা, এই পিরামিডে বুবি ট্র্যাপ ছিল না, তবে ছিল ছাতে মস্ত এক ভারী পাথর ভল্টের দরজার মত। খুফুকে সমাধিস্থের পর ওপর থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিল ওটা। গেল আটকে পথ। আর ভেতরে ঢুকতে পারবে না লুঠেরার দল।

সামনের কক্ষে ঢুকল ওরা। কিছুই নেই ভেতরে। পেছন থেকে এসে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে গেল কয়েকজন টুরিস্ট।

তো কোথায় গেল ওই পাথর বা দরজা? জানতে চাইল রানা।

সব লুঠ করেছে সমাধি-লুঠেরারা, বলল বেলা, পাথর খণ্ড সরিয়ে পথ করে নিয়ে পৌঁছে যায় রাজার সমাধিকক্ষে। ওই যে, ওই পথে যেতে হবে।

লাবনী ও বেলার পিছু নিল রানা। কুঁজো হয়ে গেল ছোট এক টানেলে ঢুকে। একটু হেঁটে পৌঁছল ফেরাউন খুফুর সমাধিকক্ষে। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে এখানে রাখা হয়েছিল প্রতাপশালী সম্রাটের মৃতদেহ।

সমাধিকক্ষে প্রায় কিছুই নেই। কক্ষের দৈর্ঘ্য প্রায় চল্লিশ ফুট, চওড়ায় বিশ ফুট। ঘরের মাঝে পড়ে আছে বিশাল এক এ্যানেটের সারকোফাগাস। ঢাকনি নেই। হাওয়া হয়েছে সম্রাটের লাশ। দেয়ালেও কোনও কারুকাজ নেই।

তুতেনখামেনের সমাধির মত নয়, নইলে এখানে থাকত অনেক কিছুই,বলল বেলা।

একসময় ঠিকই ছিল খুফুর লাশ, বলল লাবনী, তাকে উপযুক্ত ভাবলে পাতাল জগতে স্থান দেবেন ওসাইরিস। তখন কাজে আসবে বলে সম্রাটের সুখের জন্যে রাখা হয়েছিল প্রয়োজনীয় সব রসদ। বিশেষ করে খাবার ও পানীয়। এ ছাড়া ছিল বিপুল পরিমাণের সোনা-রূপা ও অন্য সম্পদ।

সমাধিকক্ষে ঢুকেছে কজন টুরিস্ট। চারপাশ ঘুরে দেখছে।

সারকোফাগাসের পাশে গিয়ে কী যেন দেখছে লাবনী। একমিনিট পর বলল, মনে হয় না কখনও এটায় ছিল খুফুর মামি।

হাতঘড়ি দেখল রানা। একঘণ্টার বেশি হলো ঢুকেছি পিরামিডের ভেতর। সমাধিকক্ষ তো দেখা হলো, আর কিছু দেখবে?

চলুন, বেরিয়ে যাই, বলল বেলা, এতক্ষণে হয়তো ফিরে এসেছেন ডক্টর মেটয।

মাথা দোলাল লাবনী। ঠিক আছে, ফেরা যাক। যদিও মনে হয় না সে ফিরেছে।

ঢালু প্যাসেজে এবার কষ্ট হলো না নেমে যেতে। পঁচিশ মিনিট পর ওরা ফিরল স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে। খোঁজ নিল লাবনী, আসেনি ম্যান মেটয। তবে ওকে জানানো হলো, আশা করা যায় আধঘন্টার ভেতর ফিরবেন তিনি।

স্ফিংসের কাছে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। অবশ্য আধঘণ্টা নয়, পঞ্চাশ মিনিট পর এল ম্যান মেটযয। তাকে সরকারী সাদা গাড়ি থেকে নামতে দেখে হাসি-হাসি ভঙ্গি নিল বিরক্ত লাবনী। ওর কানের কাছে নিচু স্বরে বলল রানা, খেয়াল করেছ? পাশের লোকটা বেলার ফোটোয় ছিল। ক্যামেরা দিয়ে থোতা করেছে এরই মুখ।

ঠিক! ম্যান মেটযের সঙ্গী ডক্টর লুকমান বাবাফেমি। লাবনী খেয়াল করল, টেম্পল অভ স্ফিংসের চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণের ভ্যালি টেম্পল। ওখানে মাথায় হ্যাট ও চোখে সানগ্লাস পরে টুরিস্টদের ভিড়ে মিশে খনন সাইটের কাছে চলে গেছে বেলা। বেলার কথা ঠিক হলে ওই লোক চাইবে না কেউ যাক তাবুটার কাছে।

দেখা যাক তুমি ওদিকে যেতে চাইলে কী করে, বলল রানা।

ম্যান মেটযের দিকে চলল লাবনী। পিছু নিল রানা।

 হাই, মেটয! মেটয! হাই!

প্রথমে বিস্মিত হলো আর্কিওলজিস্ট, অনিশ্চিত। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল কে ডাকছে। নাক কুঁচকে গেল তার। লাবনী? আপনি এখানে কী করছেন?

ছুটি কাটাতে এসেছি, হালকা সুরে বলল লাবনী। আজ রাতেই তো আপনার দুর্দান্ত খনন টিভিতে দেখাবে, তাই না? ভাবলাম, একবার হ্যালো বলে যাই।

হল অভ রেকর্ডস উন্মোচিত হবে স্থানীয় সময় ভোর চারটেয়, সন্দেহের চোখে লাবনীকে দেখছে মেট। তার মনে হচ্ছে না ছুটিতে এসেছে মহিলা আর্কিওলজিস্ট। সবই ব্রডকাস্ট হবে।

অস্বস্তির অনুভূতি নিয়ে লাবনীকে দেখছে লুকমান বাবাফেমি। আপনার বান্ধবী, ডক্টর মেটয?

কলিগ, জোর দিয়ে বলল মেটয। বলতে পারেন প্রাক্তন কলিগ। লাবনী, ইনি এসসিএ-র রিপ্রেযেন্টেটিভ, ডক্টর লুকমান বাবাফেমি। আর ডক্টর, ইনি লাবনী আলম। আগে ছিলেন আইএইচএতে। আর এঁকে চিনলাম না। রানাকে দেখল মেট।

ইনি মাসুদ রানা, আমার বয়ফ্রেণ্ড, বলল লাবনী। বিব্রত বোধ করছে। খেয়াল করেছে, ওর ডক্টর পদবী উল্লেখ করেনি মেটয।

লাবনী এ বিষয়ে কিছু বলার আগেই বলে উঠল লুকমান বাবাফেমি, ডক্টর আলম! অফ কোর্স! সত্যিই দুঃখিত, প্রথমে চিনতে পারিনি! সরি!

চেনেননি, কারণ বোধহয় আমার হেয়ারস্টাইল, বলল লাবনী, ওটা পাল্টে ফেলেছি।

খুবই খুশি হলাম পরিচিত হয়ে। আন্তরিক হাসল লুকমান বাবাফেমি।

একই কথা খাটে আমার বেলায়, মিশরীয় লোকটার সঙ্গে করমর্দন করল লাবনী। আবারও বলল, ইনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাসুদ রানা।

আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু? বিড়বিড় করল মেটয, মাসুদ রানা? আগেও শুনেছি নামটা।…কোথায়?

চুপ থাকল রানা। ওর সঙ্গে করমর্দন করল ম্যান মেট্য ও লুকমান বাবাফেমি। ওদিকে স্ফিংসের একটু দূরের ধ্বংসাবশেষের দিকে চেয়ে আছে লাবনী। নরম সুরে বলল, ভাবছি মূল খনন এলাকা ঘুরে দেখতে পাব কি না। এটা কি সম্ভব?

সরি, বলল ম্যান মেটয। চেপে বসেছে ঠোঁটে ঠোঁট। ওদিকে যেতে পারবে শুধু অথোরাইড় পার্সোনেল।

এর কাছে অনুরোধ করে লাভ হবে না, যা বলার বলে দিয়েছে, তাই এবার লুকমান বাবাফেমির উদ্দেশে মধুঝরা কণ্ঠে বলল লাবনী, খুবই দুঃখজনক। এসসিএ কি পারে না আমার জন্যে সামান্য ব্যতিক্রম করতে, ডক্টর বাবাফেমি?

মৃদু মাথা নেড়ে বলল বাবাফেমি, আসলে উপায় নেই, ডক্টর আলম। একবার হল অভ রেকর্ডস খোলার পর সব ক্যাটালগ করা হলে, পরে সুযোগ দিতে পারব আপনাকে। তখনও খুব কঠোর সিকিউরিটির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। একটু দূরের গেটের গার্ডদের দেখাল সে। মাত্র কয়েক দিন আগে এই সাইটে ঝামেলা হয়েছে।

সেরকমই শুনেছি, বলল লাবনী।

আপনি শুনেছেন? ভুরু কুঁচকে ফেলল মেটয।

হ্যাঁ, এক মেয়ে, নাম বেলা আবাসি তাই না?

আগেই আলাপ করেছে রানা ও লাবনী, বেলার কথা তুলবে। লোক দুজনের প্রতিক্রিয়া খেয়াল করছে রানা।

মৌমাছির হুল বিধলে যেমন মুখ হয়, তেমনি করেছে ম্যান মেটয। লাবনীর কাছে সবই ফাঁস হয়েছে বলে লজ্জিত। গাল লালচে। তবে খুব অস্বাভাবিক লুকমান বাবাফেমির চেহারা। নিতম্বে ভোঁতা আস্ত গজাল ঢুকলে এমন করবে যে কেউ।

ওই মেয়ে স্ফিংসের একটা টুকরো চুরি করেছিল, তাই না? নিরীহ সুরে জানতে চাইল লাবনী।

হ্যাঁ… তার চেয়েও বেশি কিছু করেছে, হামলে পড়েছে আমার ওপর, রেগে গিয়ে বলল বাবাফেমি। একবার ডলে নিল নাকের ডগা।

লাবনীকে দেখে নিয়ে একটু কড়া সুরে জানতে চাইল মেট্য, এসব কোথায় শুনেছেন? নিশ্চয়ই এসব তথ্য ফাঁস করেছে প্রফেসর ট্রিপের রিসেপশনিস্ট লিপি গোমেযয?

না, তার কাছ থেকে কিছুই শুনিনি, লিপিকে আড়াল করল লাবনী। যা বলার বলেছে বেলা আবাসি।

ব্যথা যা ছিল মনে, সেটা হজম করছিল বাবাফেমি, কিন্তু লাবনীর শেষকথায় রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে হলো তার চেহারা। আপনি কথা বলেছেন তার সঙ্গে? কোথায়?

নিউ ইয়র্কে, অলস সুরে বলল লাবনী। এখানে কী ঘটছে, সেটা নিয়ে অদ্ভুত এক গল্প শোনাল।

বাবাফেমির চোখে তাকাল রানা।

যা শুনলাম, মনে হয়নি মিথ্যা বলেছে সে, বলল লাবনী। আর তারপর যা ঘটেছে, সেসবও প্রমাণ হিসেবে কম নয়।

কী ঘটেছে? জানতে চাইল ম্যান মেটয।

গোলাগুলি, গাড়ির ধাওয়া-ধাওয়ি, বিস্ফোরণ ইত্যাদি ইত্যাদি, বলল রানা।

যাই বলুক, মিথ্যা বলেছে ওই মেয়ে, খুব অস্বাভাবিক দ্রুত জানাল লুকমান বাবাফেমি।

নিচের রাস্তার দিকে তাকাল রানা। মিথ্যা বলছে কি না তা সহজেই প্রমাণ করা যায়। মেট্য, ওই যে ওদিকের তাঁবুটা দেখছেন, আমরা একবার ঘুরে আসতে চাই ওটার ভেতর থেকে। হয়তো ইন্টারেস্টিং কিছু দেখবেন ওখানে।

যেমন?

যেমন, ওখানে হয়তো আছে একটা শাফট, যেটা গেছে হল অভ রেকর্ডসসের দ্বিতীয় এক দরজার কাছে, বলল রানা। হয়তো আপনার আগেই ওই কক্ষে ঢুকতে চাইছে কেউ।

পুরো একমিনিট কড়া চোখে ওকে দেখল ম্যান মেটয, তারপর বলল, একেবারে ফালতু কথা বলছেন আপনি।

কিন্তু এসব যদি সত্যি হয়? জানতে চাইল রানা।

মিথ্যা, সন্দেহ নেই, সম্বোধন পাল্টে গেল মেটযের, লাবনী কী করেছে, সবই শুনেছি আমি প্রফেসর ট্রিপের কাছে। টিভির অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন দেখে মাথা খারাপ হওয়ার দশা তার। হিংসায় জ্বলেপুড়ে পাগল হয়ে উঠেছে। ভুলে গেছে নিজের সময়ে কম করেনি। টিভিতে দেখা যায়নি। তাকে? টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদে ছাপা হয়নি তার ছবি? বাঁকা হাসল ম্যান মেটয। এবার অন্য কারও ওপরে স্পটলাইট পড়তেই আর সহ্য হচ্ছে না তাই না?

আমাকে নিয়ে নয়, কথা হচ্ছিল আর্কিওলজিকাল ট্রের রক্ষা বিষয়ে, বলল লাবনী, আপনাকে এবং আইএইচএকে মস্তবড় অপমান থেকে রক্ষা করতে চাইছি আমরা।

বাতাসে হাতের ঝাপটা দিল মেট। বাদ দাও! কোনও কারণে আইএইচএ ছোট হয়ে থাকলে, তা হয়েছে তোমার জন্যে, লাবনী আলম! নিজেকে রক্ষা করতে মিথ্যার পর মিথ্যা বলছে বেলা আবাসি। তোমার পথেই হাঁটছে সে।

গম্ভীর হয়ে গেছে রানার মুখ। নিচু স্বরে বলল, আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। ভদ্রতা বজায় রাখুন।

নইলে কী করবেন? বাঁকা হাসল ম্যান মেটয।

যে-কোনও সময়ে রানা কিছু করে বসবে, সে ভয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল লাবনী, আমরা কিন্তু বলছি না যে আপনাকে কিছু বিশ্বাস করতে হবে। দেখুন না শুধু ওই তাঁবুর ভেতর? আমরা যদি ভুল বলে থাকি, মুখের ওপর হাসবেন। এর বেশি কিছু চাইছি না আপনার কাছে।

স্রেফ উন্মাদের পাল্লায় পড়েছি, বলল বাবাফেমি, ওদিকে কোনও শার্ট নেই। ডাকাতিও করছে না কেউ।

আপনি তাই বলছেন, কিন্তু এ কথা মিথ্যাও তো হতে পারে, বলল রানা।

রাগী চোখে ওকে দেখল মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। আপনি কোনও কারণ ছাড়াই আমাকে অপমান করছেন!

একবার তাঁবু থেকে ঘুরে এলেই জানা যাবে, আসলে কী হচ্ছে, বলল রানা। আপনার ভয় কীসের?

সিকিউরিটি গেটের দিকে হনহন করে চলল বাবাফেমি। না ঘুরে চাপা স্বরে বলল, ডক্টর মেট্য, যার খুশি অপমান করবে, সেজন্যে এখানে অপেক্ষা করব না! আপনার সঙ্গে দেখা হবে এক্সকেভেশন সাইটে! এরা বেয়াড়াপনা করলে ঘাড় ধরে মালভূমি থেকে বের করে দেব। গেটের সামনে যেতেই হাত তুলে তাকে থামতে ইশারা করল এক গার্ড। তার জানা নেই কে এই লোক। অবশ্য, পাশের গার্ড কী যেন বলতে পিছিয়ে গেল সে।

আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ম্যান মেটয। সত্যি তোমার জন্যে খারলাগছে, লাবনী। এত নিচে নেমে যাবে, ভাবতেও পারিনি। দুঃখ বোধ করব, না হাসব, জানি না!

অর্থাৎ, তুমি ওই তাঁবুর ভেতরটা দেখবে না? জানতে চাইল লাবনী। আপনি থেকে নেমে এসেছে তুমিতে।

ঘুরে রওনা হয়ে গেল ম্যান মেটয। ডক্টর বাবাফেমি, একটু অপেক্ষা করুন, আমিও আসছি!

এবার দুই গার্ড থামাল আর্কিওলজিস্টকে। আইডি দেখে তারপর পথ ছাড়ল।

এত নির্বোধ, উফ, বলল লাবনী, একবার ওখানে উঁকি দিলেই সব পরিষ্কার বুঝত!

সতর্ক করেছ, বলল রানা, একই কথা খাটে প্রফেসর ট্রিপের বিষয়ে। এরপর আমাদের কাজ হওয়া উচিত প্রমাণ করে দেয়া, ওরা ভুল করেছে।

এত বড় কাজ যারা হাতে নিয়েছে, হল অভ রেকর্ডসসের গেট মেট খোলার আগেই সরিয়ে ফেলবে সব প্রমাণ। কেউ জানবে না লুঠ হয়েছে অতিমূল্যবান কিছু। ভ্যালি টেম্পলের দিকে তাকাল লাবনী। ওদের দিকে চেয়ে হাত নাড়ছে বেলা। এবার আবার কী হলো?

কাছে যাওয়ার পর জানতে চাইল বেলা, তারপর? ম্যান মেটয তাঁবুর ভেতরে তল্লাসী করবে?

লুকমান বাবাফেমির ওপর পুরো বিশ্বাস আছে তার, বলল রানা।

ও।

ম্যান মেটয ঘৃণা করে আমাদেরকে, বলল লাবনী।

লাবনী ও রানা ব্যর্থ হবে, ভাবেনি বেলা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর মুখ। এখন? আর তো কিছুই করার নেই!

আমাদের কথা শুনবে না মেট, ডাকাতিতে জড়িত বাবাফেমি, ওদিকে ওই কম্পাউণ্ডে ঢুকতে পারব না আমরা, বলল লাবনী।

পকেট থেকে আইডি বের করল বেলা। এটা আছে আমার কাছে। গেটের গার্ডরা নতুন, বে না আমাকে। আমি হয়তো ঢুকতে পারব ওখানে।

তারপর কী করবে? জানতে চাইল লাবনী। নাদির মাকালানির লোক দেখলেই তো খুন কররে তোমাকে। যদি প্রাণে বেঁচে বেরিয়েও আসো, কোনও প্রমাণ হাতে তুলে দিলেই ম্যান মেট্যু,গ্রেফতার করাবে, রক্ষা পাবে না।

কিছুই কি করার নেই? বলল বেলা। আইএইচএ হল অভ রেকর্ডসসের গেট খুলবে মাত্র আঠারো ঘন্টা পর। অর্থাৎ, এরইমধ্যে সব সরিয়ে নেবে ডাকাতরা। যা করার করতে হবে আমাদেরই! যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে শয়তানের দলকে!

চাই না লুঠ হোক হল অভ রেকর্ডস, বলল রানা। তবে হাতে শক্ত প্রমাণ না পেলে অনুচিত হবে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া। আমাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। জেলেও পুরে দিতে পারে।

তো হাল ছেড়ে দেব? অবিশ্বাস নিয়ে বলল বেলা। পকেট থেকে নিল একটা ম্যাগাযিনের পাতা। তাকাল লাবনীর দিকে। সবাই বলেছিল আটলান্টিস নেই। আপনি প্রমাণ করেছেন, তা আছে। আপনি আবিষ্কার করেছেন শিবের গুহা। সেই আপনি হার মেনে নেবেন?

ওই দুবার পাশে ছিল ও, বাঙালি গুপ্তচরকে দেখাল লাবনী। ও না থাকলে…

তো আপনিও হেরে যাবেন এদের কাছে? রানার দিকে ফিরল বেলা। আপনার ব্যাপারে যা শুনেছি, সব কি মিথ্যা?

থাক, আমাকে উস্কে দেয়ার জন্যে গরম-গরম বক্তৃতা দিতে হবে না তোমার, মৃদু হাসল রানা, আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী কাজে নামব।

কীভাবে? বলল লাবনী, ওই কম্পাউণ্ডে পনেরোজন আর্কিওলজিস্ট, একদল টিভি ক্রু, আর তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে দলে দলে গার্ড! আমরা কিছুই করতে পারব না!

এরা সবাই সাইটে উপস্থিত থাকবে, এমন নয়, বলল রানা, ভোরে ব্যস্ত হবে আইএইচএর সদস্যরা। তাদের সঙ্গে যাবে টিভির ক্রুরা। কিন্তু তার আগে ঘুমিয়ে নেবে সবাই। তখন গার্ডও থাকবে কম। উঁচু দেয়াল দেখল রানা। আজও বণ্ডের দ্য স্পাই হু লাভড মি সিনেমার দৃশ্যের মত লাইট শো দেখায়?

মাথা দোলাল বেলা আবাসি।

সবার চোখ থাকবে স্ফিংসের দিকে, বলল রানা।

অবাক চোখে ওকে দেখছে লাবনী। তুমি ভাবছ…

হয়তো উপায় আছে, বলল রানা, তবে, বেলা, ধরা পড়ার ঝুঁকি নিতে হবে তোমার। রাজি আছ?

মানা করে দেয়ার জন্যে তরুণীর দিকে ফিরল লাবনী, কিন্তু আগেই বলে উঠল বেলা, অবশ্যই রাজি! কী করতে হবে?

প্রথম কাজ হবে ধরা না পড়ে ওই গেট পেরিয়ে যাওয়া, একটু দূরের গেট দেখাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দূরে তাকাল কায়রো শহরের দিকে। তবে তার আগে চাই সামান্য শপিং।

.

০৭.

 সাউণ্ড অ্যাণ্ড লাইট শো শুরু হওয়ার একটু পর আবারও কায়রো শহর ছেড়ে গিজায় ফিরল রানা, লাবনী ও বেলা।

স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঝিকঝিক করছে স্ফিংস, ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের দেখল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর চোখ পড়ল পেরিমিটারের বাইরে এক দালানের ওপর। লাবনী ও বেলাকে বলল, দেখেছ, স্ফিংস সরাসরি চেয়ে আছে ওই পিযা হাটের দিকে।

ওই পিযা হাট যখন ছিল না, তখনও স্ফিংস ছিল, বলল বেলা, আঠারো শ সাতান্ন সালে একলোক পেল প্রাচীন এক স্ক্রল। ওটা অনুযায়ী খাফ্রে যখন তৈরি করেননি তাঁর পিরামিড, তখনও নাকি ছিল স্ফিংস। চোখ সূর্যোদয়ের দিকে। বাধ্য হয়েই স্ফিংস থেকে সরে পুবে তাক করা হলো পিরামিডের মুখ।

এটা নিয়ে কারও কারও আপত্তি আছে, বলল লাবনী। সবই পরিষ্কার জানা যাবে হল অভ রেকর্ডস খোলা হলে।

তৃতীয় রাজবংশের ফেরাউনরা কিন্তু হল অভ রেকর্ডস সম্পর্কে কিছুই লেখেননি, বলল বেলা, এত আগের কীর্তি, হয়তো জানতেন না এখানে আছে ওটা। খাফ্রের সময়ের চেয়েও পুরনো বলেই হয়তো এত বেখাপ্পা আকারের স্ফিংস। শরীরের সঙ্গে মানানসই নয়, যেন বসিয়ে নিয়েছে বিড়ালের মাথা।

কম্পাউণ্ডের গেট থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

গেটের দিকে তাকাল বেলা। ওখানে দুজন ইউনিফর্ম পরা গার্ড। আগে কখনও এদেরকে দেখিনি।

 তুমি শিয়োর তো? জানতে চাইল রানা।

এরা দেখতে ভাল, শক্তপোক্ত শরীর। আগে দেখলে ভুলতাম না।

ভেবে দেখো, ঝুঁকিটা নেবে কি না, বলল লাবনী।

আমি তৈরি, হাসল বেলা। আইডি বের করে গেটের দিকে পা বাড়িয়েও থামল। খুলে নিল শার্টের ওপরের দুটো বোতাম।

এটা করলে কেন? জানতে চাইল লাবনী।

আইডি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার জন্যে। টাইট ব্রা আকাশমুখী করেছে বেলার দুই বিশাল স্তনকে। ঠোঁটে ফুটে উঠল লাজুক, মিষ্টি, লোভনীয় হাসি। কোমর দোলাতে দোলাতে গেটের সামনে গিয়ে থামল ও। ওপরে তুলে ধরেছে আইডি কার্ড।

রানা ও লাবনী একটু দূর থেকে খেয়াল করল, বেলার মুখের দিকে মনোযোগ নেই দুই গার্ডের। তাদের চার চোখ চাটছে উদ্যত দুই ফরসা স্তন। কয়েক সেকেণ্ড পর খেয়াল হতে গেট খুলে দিল ডানদিকের যুবক। তাকে দারুণ এক হাসি দিয়ে কম্পাউণ্ডের অভ্যন্তরে ঢুকল বেলা।

এবার রওনা হব আমরা, রাস্তা দেখাল রানা।

ভাবাই যায় না, ভুরু কুঁচকে বলল লাবনী, বুক দেখিয়ে মন জয় করে নিল!

হিংসে লাগছে তোমার? নিরীহ সুরে বলল রানা।

না। আরও গম্ভীর হলো রূপসী লাবনী। তবে দেখেছি তুমিও ড্যাবড্যাব করে দেখছিলে। ব্রার ভেতর ওগুলো কিন্তু নকল।

নকল? সত্যি? মুচকি হাসল রানা।

হ্যাঁ! কাঠির মত সরু শরীরে মস্তবড় দুই তরমুজ ঝুলিয়ে নিলেই হলো? তবে এটাও ঠিক, ওর বাবা প্লাস্টিক সার্জন। অঙ্কটা তো বুঝতেই পারছ। তা ছাড়া, ও তোমার ছোটবোনের মত।

আমার অন্তর ভাঙার জন্যে ধন্যবাদ। লাবনীর হাত ধরে রওনা হয়ে গেল রানা।

রাস্তার যে অংশ কন্ট্রাকশন সাইটের ওপরে, ওখানে পৌঁছে গেল ওরা। নিচে চেয়ে দেখল, ওই তাবুর কাছে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে দুই গার্ড। আরও দুজনের দিকে মনোযোগ গেল ওদের। ওই দুই লোক বেরিয়ে এসেছে তাবু থেকে। দুজনের মাঝে বড় একটা কেস। চলে গেল একটু দূরের গেট লক্ষ্য করে।

এরই ভেতর হল অভ রেকর্ডস ফাঁকা করতে শুরু করেছে এরা! বলল লাবনী।

তোমার ধারণা, ওই বাক্সে যোডিয়াক আছে? জানতে চাইল রানা।

হয়তো। বা ওটার অংশ। সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে সরাতে হলে কেটে ছোট করতে হবে। হায়, আল্লা, আমরা বোধহয় অনেক দেরি করে ফেলেছি!

তিন মিনিট পর আবার ফিরল লোক দুজন। এখন হাত খালি। আবার ঢুকল তাঁবুর ভেতর।

কাজ শেষ হয়নি ওদের, বলল রানা।

গুড, হয়তো ঠেকাতে পারব। বেলাকে দেখেছ?

ওপরের মন্দিরের এক দেয়ালের কাছে ওকে দেখল রানা। আড়াল থেকে দেখেছে বাক্স বয়ে নিয়ে গেছে দুই লোক। ওই যে, ওখানে বেলা, লাবনীকে দেখাল রানা। হাত তুলে ইশারা দিল। গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে কন্ট্রাকশন সাইটের দিকে চলল বেলা। এবার প্রার্থনা করো, লাবনী, আগের দুই গার্ডের মত যেন লোভী হয় এদিকের দুজন।

চামড়ার জ্যাকেট সরিয়ে শার্টের তলা থেকে বিশ ফুটি নাইলন দড়ি বের করছে রানা। ওটা আছে ওর কোমরে জড়ানো। হাতে করে আনলে সন্দেহ করত ঘুমন্ত টুরিস্ট পুলিশও। দড়ির প্যাঁচ খুলে লাবনীকে বলল রানা, রেডি হও, এবার দেখবে আমার আণ্ডারওয়্যারে কী আছে।

ভুরু কোঁচকাল লাবনী। একটা ক্রিকেট ব্যাট আর দুটো বল?

উঁহু, অন্য কিছু। আণ্ডারপ্যান্টের বিশেষ এক বাকলের তলা থেকে বেরোল লোহার হুক। মেটাল ডিটেক্টর খোঁজ পায়নি ওটার। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেল দড়ি ও হুক। ওদিকে ওপরের মন্দির থেকে নেমে মেরামতের সাইটের দিকে চলেছে বেলা। টেনে নিয়েছে গার্ডদের দৃষ্টি।

দেয়ালের কাছে বড় এক পাথরের স্ল্যাবে দড়ি পেঁচিয়ে নিল রানা। নার্ভাস চোখে হুক দেখছে লাবনী। এই দড়ি বা হুক সত্যি ওজন নেবে তো তোমার?

তোমারও, ভয় পেয়ো না, বলল রানা।

বেলা কমলা নেটিঙের কাছে যাওয়ার আগেই ওর দিকে এগোল গার্ডরা। চট করে রানা দেখল, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় কেউ আসছে না। দুসেকেণ্ড পর দড়ি ফেলে দেয়াল টপকে নামতে লাগল ও। গতি বাঁদরের। ওর মুখ দেয়ালের দিকে তাক করা। পাথরে ঘষা লেগে মৃদু কর্কশ আওয়াজ তুলছে হুক। কাঁধের ওপর দিয়ে নিচে তাকাল রানা। বেলার প্রায় কাছে পৌঁছে গেছে দুই গার্ড। ওর নিজের নামতে হবে আরও দশ ফুট… আট… ছয়…

থমকে গেছে বেলা। বাধ্য করছে লোকদুজনকে এগিয়ে আসতে।

শেষ ছয় ফুট বাকি থাকতেই লাফিয়ে নামল রানা। প্রায় কোনও আওয়াজই হলো না। ব্যাঙের মত বসেই পরক্ষণে আবার উঠে দাঁড়াল, একছুটে চলে গেল হঁটের উঁচু এক পাঁজার আড়ালে। এদিকে ক্যামেরা তুলে ধরেছে বেলা। আরেক হাতের ইশারায় দেখাল স্ফিংস। লাইট শো-র বর্ণনাকারীর জোরালো কণ্ঠের নিচে চাপা পড়ল বেলার কথা। বোধহয় গার্ডদের অনুরোধ করছে, যেন তাদের কেউ ছবি তুলে দেয় পেছনের স্ফিংসের সঙ্গে ওর।

মনে হলো না রাজি হলো দুই গার্ড। বামদিকের লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল আইডি দেখার জন্যে। নিঃশব্দে ওদিকে ছুট লাগাল রানা। ওদিকে কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে আবারও ওর দুই টুইন-টাওয়ার দেখাল বেলা।  এবারের দুই গার্ড অনেক সতর্ক। ডানদিকের লোকটা অধৈর্য হয়ে তুড়ি বাজাল। কই আইডি?

রানা পেছন থেকে গার্ডদের দিকে ছুটে আসছে, দেখতে পেয়েছে বেলা। ব্যস্ত হয়ে পকেট খুঁজতে লাগল। দশ সেকেণ্ড পর বের করল আইডি। প্রায় ছো দিয়ে ওর হাত থেকে ওটা নিল ডানদিকের গার্ড। ফ্ল্যাশলাইটের আলো তাক করল কার্ডের ওপর।

এদিকে প্লাস্টিকের নেটিং পেরিয়ে এল রানা। খেয়াল করল, হোলস্টারের খুব কাছে লোকদুজনের ডান হাত। এখন পায়ের শব্দ পেলে, বা পেরিফেরাল ভিশনে ধরা। পড়লে…

বেলার দিকে তাকাল গার্ড। আলো ফেলল ওর মুখে। ভুরু কুঁচকে গেল লোকটার।

চিনে ফেলতে শুরু করেছে সে…

হায়, ঈশ্বর! বেসুরো চিৎকার দিল বেলা। ঘুরেই তাকান পশ্চিমে। ওই দেখুন! পিরামিড!

কী হয়েছে দেখতে চরকির মত ঘুরল দুই গার্ড। ওই একইসময়ে তাদের পেছনে পৌঁছুল রানা। গায়ের জোরে দুহাতে দুই মাথা ধরে ঠুকে দিল। আওয়াজ হলো: ঠকাস্ লতা গাছের মত মাটিতে নেতিয়ে পড়ল দুই অচেতন গার্ড।

ভয় পেয়ে এক লাফে পিছিয়ে গেছে বেলা। হায়, ঈশ্বর মেরেই ফেলেছেন?

না, মরেনি, বলল রানা। হাত লাগাও আমার সঙ্গে।

মনে হলো সিনেমার মত ঘটল সব! কাজটা করলে কীভাবে?

 সহজ কাজ, দুটো মাথা জোগাড় করো, তারপর আচ্ছামত ঠুকে দাও। অচেতন এক গার্ডের দুই বগলের ভেতর হাত ভরল রানা, তারপর টেনে নিয়ে চলল। লোকট লাশ হয়ে গেছে কি না ভেবে একবার শিউরে উঠল বেলা তারপর সাহায্য করল রানাকে। ধুলোর উঁচু এক স্কুপের ওদিকে গার্ডকে সরিয়ে নিল ওরা।

প্রথম গার্ডকে লুকাবার পর তার সঙ্গীকে নেয়ার জন ফিরল রানা। মুখ তুলে দেখল দেয়াল। খুব দ্বিধা নিয়ে দড়ি বেয়ে নামছে লাবনী। দ্বিতীয় গার্ডকে সরাবার পর রান দেখল, প্রায় মাটির কাছে নেমে এসেছে ওর বান্ধবী।

দড়ি ধরে রেখে ঘুরে লাবনী দেখল, খুব কাছেই হাজি হয়েছে রানা।

পিছনেই বেলা, অবাক হয়ে বলল, সত্যিই দেখার মত মাসের পর মাস ব্যায়াম না করা শরীর নিয়েও…

ওপর থেকে এল মৃদু মটু আওয়াজ। অতিরিক্ত ওজ নেয়ায় ভেঙে গেছে ধাতব হুক। শেষ তিন ফুট ওপর থেবে ধুপ করে বালির ওপর পড়ল লাবনী। চমকে গেছে। যাহ্!

কেউ কারও ওজন নিয়ে কথা বলবে না, মুচকি হেসে নিষেধ করে দিল রানা।

হুঁ, নিজে নেমে দুর্বল করেছ হুক, নইলে… উঠে দাঁড়িয়ে নিতম্ব থেকে বালি ঝাড়ল লাবনী।

দড়ি মুড়িয়ে নিয়ে রওনা হলো রানা। জিনিসটা লুকিয়ে ফেলবে কোথাও।

নরকের এই দুটো কীসের তৈরি? বেলার বুকে তর্জনী দিয়ে খোঁচা দিল লাবনী। আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলো!

কেন, কাজ তো ভাল করে, আপত্তি আছে বলে শার্টের ওপরের দুই বোম আটকে নিল রেলা।

রানা কিন্তু বাংলাদেশ আর্মিতে ছিল, নকল জিনিস ঠিকই চিনবে। ওগুলো বেশি চোখা।

উনি আর্মিতে ছিলেন? অবাক হয়েছে বেলা। ও।

 বহুবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

 ইয়ে… তা ওঁর কোনও ছোট ভাইটাই নেই?

নেই। তোমার কপাল মন্দ। তাঁবুর কাছে গিয়ে কান পাতল লাবনী। ওর মনে হলো না ভেতরে কেউ আছে। সরিয়ে ফেলল একদিকের ফ্ল্যাপ। বেলার কথামতই, এক পাশে কাঠ জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি কিউবিকল।

সত্যিই কপাল মন্দ, বিড়বিড় করল বেলা। এখন আর একটু দূরের টেবিলে কিছুই নেই। ওটার ওপর ছিল সব প্ল্যান। সরিয়ে ফেলেছে। ঘুরে তাঁবুর দরজা থেকে দূরে তাকাল বেলা। ওই যে দুই লোক বাক্স নিয়ে গেল, তাদের একজন ছিল সিকিউরিটি চিফ মাধু কামিল। ওদের কাজ হয়তো প্রায় শেষ। দেরি করে ফেলেছি আমরা।

বেলার কথাই ঠিক। মালভূমির মেঝে খুঁড়ে নিচে গেছে একটা কূপ। তলা থেকে আসছে জেনারেটরের চাপা গর্জন। এ ছাড়াও, আছে আবছা কর্কশ আওয়াজ। ড্রিল মেশিন।

ফিরে এসেছে রানা। খুলে ফেলল কিউবিকলের দরজা। পা রাখল মইয়ের ওপরের ধাপে। এবার, চলো, গিয়ে দেখি কী করে এরা।

রানাকে একবার দেখে নিয়ে পনিটেইল বাঁধল লাবনী। গুরুর চুল বাঁধা দেখে হাসছে বেলা। স্পর্শ করল নিজের পনিটেইল। রানা নামতে শুরু করার পর মই বেয়ে নামতে লাগল ওরা।

সোজা বিশ ফুট নিচে ঢালু, পাথুরে মেঝেতে শেষ হয়েছে মই। দুপাশে পাথরের দেয়াল। চারপাশ দেখে নিল রানা। এদিকে নেই কেউ। ওর পাশে পৌঁছে গেল লাবনী ও বেলা।

উত্তরদিকে বালির দেয়াল। হাজার হাজার বছর পর নতুন করে খোলা হয়েছে দক্ষিণের সুড়ঙ্গ, হারিয়ে গেছে দূরে। প্রতি পনেরো ফুট পর পর ছাতে ঝুলছে জ্বলন্ত বাবু।

বৈদ্যুতিক বাতি বা সুড়ঙ্গ গেছে সোজা স্ফিংসের দিকে। বেলা যে নক্সা দেখিয়েছিল, ওটা নিখুঁত।

হল অভ রেকর্ডসসের পুবের সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ঢুকতে চাইছে আইএইচএ টিম। কিন্তু আগেই একদল ডাকাত খুলেছে উত্তর দিকের সুড়ঙ্গ। ওটা রাজকীয়। ওসাইরিয়ান টেম্পলের লোক ছাড়া কেউ জানে না ওটার অস্তিত্ব। ম্যান মেটয অন্য কোনও প্রবেশপথের কথা ভাবেইনি। মগজে ছিল ঠিক সময়ে খুলবে প্রাচীন সুড়ঙ্গ। টিভি ক্যামেরায় শত কোটি মানুষ দেখবে তাকে। লোকটা যে ধরনের ভুল করেছে, তাতে হয়তো মস্তবড় ক্ষতি হবে আর্কিওলজিকাল সমাজের।

রানা নাক কুঁচকে কী যেন শুঁকছে।

 ভুরু নাচাল লাবনী।

পাথর কাটছে, বলল রানা।

এবার গন্ধটা পেল লাবনী ও বেলা।

 পাথর কাটলে এমন গন্ধ হয়? জানতে চাইল লাবনী।

বাধ্য হয়ে আগে ওই কাজ করতে হয়েছে, বলল রানা।

জীবনে কী করোনি?

মৃদু হাসল রানা। রহস্যময় পুরুষ, বুঝতেই পারছ।

তাতে সন্দেহ কী!

ঈশ্বর! মনে হচ্ছে পাতালে নেমেছি। চারপাশ দেখছে বেলা। দেয়ালের বালি চিমটি দিয়ে তুলে দুআঙুলে ডলল। দেয়াল থেকে বালি সরে যাওয়ায় বেরিয়ে এসেছে লালচে পাথর। পিঙ্ক গ্র্যানেট। সম্ভবত এসেছে আসওয়ান এলাকা থেকে। রাজকীয় সুড়ঙ্গ। অন্য কারও জন্যে এত খরচ করত ফেরাউনরা।

ঠিক জিনিস চিনেছ? অনিশ্চিত সুরে বলল লাবনী।

অবশ্যই! মিশরীয় ব্যাপারে অনেক কিছুই জেনেছি দাদুর কাছ থেকে। তবে আইএইচএর অন্যদের চেয়ে কম জানি। রানার দিকে তাকাল বেলা। আমরা এবার কী করব?

পিছু নাও, বলল রানা, সতর্ক থাকবে। যে-কোনও সময়ে বিপদ আসতে পারে।

সুড়ঙ্গের তিনভাগের দুভাগ পেরোবার পর ওরা বুঝল, সামনে আছে গ্যাস চালিত জেনারেটর। ওটার একস্ট হোস পাইপ গিয়ে উঠেছে তাঁবুর ভেতর।

জেনারেটর পেরোবার সময় রানা দেখল, একসময়ে ধসে পড়েছিল সুড়ঙ্গ। পরে কাঠের বিম দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ছাত। যে-কোনও সময়ে আবারও নেমে আসতে পারে।

ধস নেমেছিল, বলল রানা। সাবধানে জায়গাটা পেরিয়ে গেল ওরা।

পেছনে আবারও ছাত ধসে যেতে পারে, ভয় পেয়ে বলল লাবনী।

মনে হয় না, দ্বিমত পোষণ করল রানা। নতুন করে ছাত মেরামত করেই কাজ ধরেছে এরা। অন্তত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।…কী করছ, বেলা?

চোখের সামনে ক্যামেরা তুলে বাটন টিপল মেয়েটা। প্রমাণ সংগ্রহ করছি।

ফ্ল্যাশ ব্যবহার করবে না! আলো দেখবে কেউ!

জানি, বস! ভিডিয়ো রেকর্ড করছি। খুদে যন্ত্রটার কন্ট্রোল নাড়াচাড়া করছে বেলা। ফিল্ম নিল ছাতের। এগোতে শুরু করেছে রানা ও লাবনী। আরে, একমিনিট!

কয়েক মিনিট হাঁটার পর সুড়ঙ্গের শেষমাথায় পৌঁছে গেল ওরা। সামনে চেম্বারের প্রবেশপথে বালিমাখা, কারুকাজ করা কয়েকটা পুরু পিলার। অনেক জোরালো শোনাল পাথর কাটা ড্রিল মেশিনের গর্জন।

ঘরের ভেতরে উঁকি দিল রানা। এখন আর ওদিকে জ্বলছে না সাধারণ বাল। জায়গায় জায়গায় হেভি-ডিউটি ট্রাইপড থেকে সূর্যের মত অত্যুজ্জ্বল আলো দিচ্ছে রাশি রাশি বাতি। সব আলো গিয়ে পড়ছে পশ্চিমের বড় এক আয়তক্ষেত্রাকার ঘরে। তবে ওখানে কেউ নেই। পশ্চিম দেয়ালের দরজার ওদিক থেকে এল পাথর কাটার আওয়াজ। ওদিকেও উজ্জ্বল আলোর বন্যা। চেম্বারে ঢুকে হাতের ইশারা করল রানা।

ওর পিছু নিল লাবনী ও বেলা।

সর্বনাশ, রানা, এসব কী দেখছি! চাপা স্বরে বলল লাবনী।

বেলা হতবাক।

মস্তবড় ঘরের একমাথা থেকে আরেক মাথা দুসারি পুরু, বৃত্তাকার পিলার। প্রতিটার গায়ে অসংখ্য হায়ারোগ্লিফ। দেয়ালেও একই জিনিস। নানান খোপে শুকনো মাটির বাক্স, ভেতরে সংগ্রহ করা হয়েছে প্যাপিরাস স্ক্রল।

এটাই হল অভ রেকর্ডস!

 মাত্র কদিন আগেও সবাই বলত, পৌরাণিক কাহিনী ওটা। আজ হয়ে উঠেছে জীবন্ত বাস্তব।

অবাক চোখে রানাকে দেখল লাবনী। গা শিরশির করছে ওর। কী কপাল, হাজার হাজার বছর পর যারা প্রবেশ করল হল অভ রেকর্ডসসের কক্ষে, তাদের ভেতর একজন ও নিজে!

প্রাচীন সব নিদর্শনের মাঝে দেখা যাচ্ছে আধুনিক মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতি। হুইলওয়ালা এক জ্যাকের ওপরে মস্তবড় এক পাথরের চাই। ওটা দিয়েই বন্ধ ছিল হল অভ রেকর্ডস। ডাকাতি শেষ হলে ওই পাথরের চাই আবারও ঠিক জায়গায় রাখবে ডাকাতের দল।

ধুলোভরা মেঝেতে বেশ কজনের নানান আকতির বুটের ছাপ। প্রবেশপথের পাশে ওয়ার্কবেঞ্চে একটা পোশাক দেখে লাবনীকে নিচু স্বরে বলল রানা, লাবনী, ওটা চিনতে পেরেছ?

মাথা দোলাল লাবনী। হু। সাপের চামড়ার জ্যাকেট।

চেম্বারের পুবে গেল রানার চোখ। আরেকটা দেয়ালের পাশে আরও কিছু পিলার। ওদিকে দ্বিতীয় এন্ট্রান্স। ওই পথে ঢুকবে আইএইচএর ম্যান মেটয এবং তার সহকারীরা।

কক্ষের আরেক পাশে চলে গেছে বেলা।

ওখানে রয়েছে ধুপ-ধুপ শব্দ তোলা কমপ্রেসর এবং একটি ইলেকট্রিকাল জাংশান বক্স। খাটো প্যাসেজ পেরিয়ে পরের কক্ষে গেছে পাওয়ার কেবল ও হোস। বেলা প্যাসেজে পা রাখতেই হাতের ইশারায় ওকে ফিরতে বলল রানা। নিজে চলে গেল রাজকীয় প্রবেশপথের ঠিক উল্টোদিকে।

পিছু নিয়েছে লাবনী। ওরা দেখল এপাশের এন্ট্রান্সের কাছে পায়ের জুতোর কোনও দাগ নেই। আলো নেই কাছের চেম্বারে। হল অভ রেকর্ডসসের আর সব জায়গা বাদ দিয়ে বিশেষ একটি অংশে মনোযোগ দিয়েছে লুঠেরার দল।

এদিকের ঘর ঘুরে গিয়ে মিশেছে ড্রিলের ঘরে, ওদিকে আবছা আলো দেখছি, বলল রানা। হাতে বেরিয়ে এসেছে ছোট পেনলাইট। সরু আলোয় দেখল, ওরা যে কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত সামনের কক্ষ ছোট। দেয়ালের অসংখ্য খুপরিতে মাটির বাক্স। রাখা হয়েছে প্রাচীন আমলের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক স্ক্রল। মহাকালের আগ্রাসনে ক্ষতি হলেও ধসে পড়েনি কক্ষ। অবশ্য, ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে একটা পিলারের একাংশ। মেঝেতে পড়ে আছে বড় কয়েক টুকরো পাথর।

ঘুরে ট্রাইপড দেখল রানা। পাশেই ওপরে উঠেছে চওড়া ধাপের সিঁড়ি। রানার দিকে তাকাল লাবনী। আমরা চাইলে ঢুকতে পারব স্ফিংসের দেহে।

আসলে ওটার বুকে, জানাল রানা।

ড্রিল মেশিনের কর্কশ শব্দের ওপর দিয়ে শুনল ওরা মানুষের কণ্ঠ।

যাবে, রানা? বলল লাবনী। খুব কৌতূহল হচ্ছে।

দেখে ফেললে কিন্তু বিপদ হবে।

ওদিকে আলো বেশি, এদিকে কম, দেখবে না।

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

বেলা আছে সিঁড়ির একদিকে কক্ষের কাছে। আলো বেশি ওখানে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠল রানা ও লাবনী। তবে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি থাকতেই লাবনীর হাত ধরল রানা। থেমে গেল ওরা। ওপরের কক্ষ ভালভাবেই দেখছে। দুজনেরই বুকে বইতে শুরু করেছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। রানা টের পেল, দাঁড়িয়ে গেছে ওর ঘাড়ের খাটো রোম।

ওপরের কক্ষে কজন লোক। সাপের চামড়ার জ্যাকেট না থাকলেও তাদের মধ্যে একজনকে পরিষ্কার চিনল ওরা। এর নাম বলেছিল বেলা আবাসি: ভগলার। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন নির্দেশ দিচ্ছে লুকমান বাবাফেমি। রানা ও লাবনী দেখল কীসের জন্যে এত ব্যস্ত এরা।

ওটা আছে ছাতে।

যোডিয়াক।

নক্ষত্রের মানচিত্র।

ব্যাসে ছয় ফুট।

পাথরে খোদাই নক্ষত্রগুলোর নাম প্রাচীন ইজিপশিয়ান দেবতাদের নামে উৎসর্গ করা।

লাবনী চেনে। দুএকটার নাম মনে পড়ল রানারও। প্যারিসে লুত্র জাদুঘরে এমনই একটা যোডিয়াক দেখেছে ও। তবে এটা আজও রঙিন। নেই যোডিয়াকের সম্পূর্ণ অংশ। ছাতে রয়ে গেছে গোটা জিনিসটার শুধু দক্ষিণ প্রান্তের ত্রিকোণ একাংশ। বৃত্তাকার যোডিয়াকটা যেখান থেকে নামিয়েছে, তার আশপাশে রুক্ষ-এবড়োখেবড়ো পাথর। ছাত থেকে নক্ষত্রের মানচিত্র সরাতে গিয়েই এই ক্ষতি। গগলস, ফেস মাস্ক ও ইয়ার প্রোটেক্টর পরে বৃত্তাকার এক করাত হাতে শেষাংশ কাটছে এক লোক।

ছাতের কাছে কাজ করছে মুখোশ পরা আরেকজন। তার হাতে অনেক কম আধুনিক যন্ত্রপাতি একটা হাতুড়ি ও বাটালি। দেখেই রানা বুঝল, কী করছে ওই লোক। করাতের তৈরি খোঁচা-খোঁচা পাথর হেঁটে ফেলছে সে। প্রমাণ থাকবে না ওখানে কোনও যোডিয়াক ছিল। আশপাশের দেয়ালের মতই হবে লাইমস্টোনের ছাত, হল অভ রেকর্ডসসের হাজারো সম্পদের ভেতর কেউ খেয়াল করবে না সামান্য রংচটা ছাত।

লাবনীর দিকে তাকাল রানা।

ঘৃণা নিয়ে লোকগুলোকে দেখছে লাবনী।

এবার দেখা গেল কার সঙ্গে কথা বলছে বাবাফেমি।

নাদির মাকালানি। কপাল থেকে শুরু করে ঠোঁট পর্যন্ত ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন। একসময়ে সহ্য করেছে প্রচণ্ড ব্যথা।

রানা বুঝল, যত ব্যথাই পেয়ে থাকুক ওই লোক, পৃথিবীর সেরা আর্কিওলজিকাল সম্পদ চুরি করছে সে। সেজন্যে তাকে কখনও অন্তর থেকে ক্ষমা করা যায় না।

বৃত্তাকার করাত থেমে যেতে বন্ধ হলো কর্কশ আওয়াজ। করাতওয়ালা ইশারা করল তৃতীয় একজনকে। এরই নাম মাধু কামিল। তাঁবু থেকে নিয়ে গেছে কেস বা বাক্স। ভেতরে ছিল যযাডিয়াকের টুকরো। খাড়া শাফটের কারণে আস্ত জিনিসটা ওপরে তুলতে পারবে না, তাই কেটে নিয়েছে নক্ষত্রের মানচিত্র, পরে সময়মত জুড়ে নেবে নতুন করে।

এখনও হয়তো ওটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব, ভাবছে রানা। চলো, বেরিয়ে যাই, লাবনীকে বলল ও।

পেছনে এসে থেমেছে বেলা আবাসি।

রানার কথা যেন শুনতেই পায়নি লাবনী, প্রায় ফিসফিস করে বেলাকে বলল, তোমার ক্যামেরাটা দাও। জিনিসটা হাতে পেয়ে জানতে চাইল, রেকর্ড করে কীভাবে?

লাবনী, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, জরুরি সুরে বলল রানা। হাতে বেশি সময় পাব না।

একটু পর যাচ্ছি? অনুরোধের কণ্ঠে বলল লাবনী। আগে হাতে প্রমাণ পেয়ে নিই।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। খুব বেশি ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে।

বেলা, রেকর্ড করব কী ভাবে?

বাটন টিপে দেবেন, তারপর থামাতে চাইলে আবারও টিপ দেবেন বাটনটা, বলল বেলা।

ঠিক আছে। বাতির স্ট্যাণ্ডের পাশে দাঁড়িয়ে রেকর্ডিং শুরু করল লাবনী। ইমেজ দেখছে এলসিডি স্ক্রিনে।

আরও সতর্ক হয়ে উঠল রানা। ভাল লাগছে না ওর এই ঝুঁকি নেয়া।

নাদির মাকালানি ও বাবাফেমি আবারও ঘুরে দেখছে যোডিয়াক। ক্যামেরায় ধরা পড়বে শুধু তাদের পিঠ।

বদমাশের বাচ্চারা, ঘুরে দাঁড়া, ফিসফিস করল লাবনী। একবার এদের চেহারা ক্যামেরায় পেলেই বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। বেশিক্ষণ লাগবে না টুরিস্ট পুলিশের কাছে যেতে। এরপর শয়তানের দল যাবে জেলে। বাকি জীবন বেরোতে হবে না ওখান থেকে।

কথা বলছে নাদির মাকালানি আর বাবাফেমি।

কান পেতে শুনতে চাইল রানা।

আরবি ভাষা। যোডিয়াক নিয়ে চলছে আলাপ, কিন্তু স্পষ্ট কিছুই শুনতে পেল না ও।

একটু পর সরিয়ে নেয়া হবে যোডিয়াকের শেষাংশ।

যোডিয়াকটার নিচে একটা ইকুইপমেন্ট নিল মাধু কামিল। নিউমেটিক জ্যাকের ওপরে প্যাড দেয়া সাপোর্ট ফ্রেম। চালু করল কন্ট্রোল, যন্ত্র থেকে এল কমপ্রেস করা বাতাস। বদ্ধ ঘরে শুরু হলো তীব্র হিসহিস আওয়াজ। ওপরে উঠছে জ্যাক। দুকানে হাত রেখে পিছিয়ে ক্যামেরার ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেল লুকমান বাবাফেমি।

ছাতে চোখ রেখেছে নাদির মাকালানি।

উঠে জ্যাকের ফ্রেমের প্যাড চেপে ধরছে যোডিয়াকের অংশটা। একটু পর প্রাচীন শিল্পের ওপর ভালভাবে এঁটে বসল স্পঞ্জ। থেমে গেল জ্যাকের হিসহিস।

নতুন করে শুরু হলো বৃত্তাকার করাতের কান ফাটিয়ে দেয়া আওয়াজ। পাথর কাটছে মুখোশ পরা লোকটা। প্যাড দিয়ে চেপে রাখা হয়েছে, মেঝেতে পড়বে না যোডিয়াকের শেষাংশ। অনায়াসেই কাটা হচ্ছে ওটাকে।

চিৎকার করে নাদিরকে কী যেন বলল কিলিয়ান ভগলার। দুজনই সরে গেল আড়ালে।

বিড়বিড় করে অভিশাপ দিল লাবনী। ক্যামেরায় তুলছে যোডিয়াকের টুকরোর ছবি। পরে দেখাবে কোথা থেকে চুরি হয়েছে জিনিসটা। নির্বোধ না হলে সবই বুঝবে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ।

হঠাৎ লাবনীর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে লাগল রানা। আরেক হাতে ইশারা করেছে বেলাকে।

আরে, কী হলো? তাড়া খেয়ে জানতে চাইল লাবনী।

বিশেষ একজন আসছে, লাবনীকে দুধাপ করে নামতে বাধ্য করছে রানা। মেয়েরা ভয় পাবে তাই বলেনি, ওই লোক ককেশিয়ান, হাতির মত শক্তিশালী, পেশিবহুল; তার চেয়েও খারাপ দিক: হাতে মারাত্মক এক চেইন সও। জঙ্গল সাফ করতে আসেনি। পাথর কাটতে ওই জিনিসের তুলনা নেই।

নিচের কক্ষের মেঝেতে নেমেই দৌড় দিল রানা, একহাতে লাবনীর হাত, অন্যহাতে বেলার কনুই।

লুকিয়ে পড়ল ওরা একটু দূরের অন্ধকার চেম্বারের কাছে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল শ্বেতাঙ্গ। গুটিয়ে নিচ্ছে পাওয়ার কেবল। চলল কক্ষের প্রবেশদ্বারের দিকে।

সব গুছিয়ে সরে পড়বে, নিচু গলায় বলল রানা, আমাদেরও কেটে পড়া উচিত।

বাটন টিপে রেকর্ডিং বন্ধ করেছে লাবনী।

রানার পিছু নিয়ে অন্ধকারে দুটো কক্ষ পেরোল মেয়েরা। অবশ্য, থামল ওরা প্রথম ঘরের প্রবেশপথের অনেক আগে।

সর্বনাশ! কী করে লোকটা! বিড়বিড় করল লাবনী।

মস্তবড় পাথরের চাঁই ধরে রাখা জ্যাক দেখছে শ্বেতাঙ্গ লোকটা।

এক দৌড়ে হরিণের বেগে বেরিয়ে যাব, অনুমতি নেয়ার সুরে রানাকে বলল বেলা।

কিন্তু ওর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে, মাথা নাড়ল রানা। সরু সুড়ঙ্গে ফুটো হবে পিঠ। বেরোতে হবে সবার অগোচরে।

আজ রানার ওপর অপ্রসন্ন ভাগ্যদেবী।

হেলতে দুলতে এন্ট্রান্স চেম্বারে ঢুকল কিলিয়ান ভগলার। দাড়ি থেকে ঝাড়ছে ধুলো। থেমে গেল বৃত্তাকার করাতের হুঙ্কার। শুরু হলো সাপের ফোঁস-ফোঁস। নামিয়ে নেয়া হচ্ছে জ্যাক।

কয়েক মিনিট পর আরেকটা কেস নামিয়ে আনল দুই লোক। তাদের পেছনেই আছে নাদির মাকালানি ও লুকমান বাবাফেমি।

জরুরি আর কিছু নেই তো? জানতে চাইল ভগলার, …এবার?

সব আগের মত রেখে বেরোতে হবে হল অভ রেকর্ডস থেকে, দামি রিস্টওয়াচ দেখল নাদির মাকালানি। হাতের ইশারায় দেখাল পুবের এন্ট্রান্স। মোটামুটি সোয়া পাঁচ ঘণ্টা পর ওই দরজা খুলবে আইএইচএ টিম। তার আগেই গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাব। …কতক্ষণ লাগবে রয়েল এন্ট্রান্স বুজে দিতে?

জ্যাক থেকে চোখ তুলল ধূসর চুলের হাতি। শুধু পাথরের ব্লক ঠিক জায়গায় রাখতে লাগবে পুরো একঘণ্টা।

তার উচ্চারণ থেকে রানা বুঝল, সে ডাচ।

একটা পায়ের ছাপও যেন না থাকে, নার্ভাস সুরে বলল বাবাফেমি। ধুলো ভরা মেঝেতে দেখছে অসংখ্য পদচিহ্ন।

এটা সমস্যা নয়, কমপ্রেসরের পাশে রাখা কয়েকটা গ্যাস সিলিণ্ডার দেখাল নাদির মাকালানি, কমপ্রেসড় এয়ার পরিষ্কার করবে মেঝে। আইএইচএ যখন ভেতরে ঢুকবে, ততক্ষণে থিতিয়ে যাবে, ধুলো। মাধু কামিলের পাশের লোকটার উদ্দেশে মাথা দোলাল সে। আম্মু তালাত, কাজ শুরু করো।

রেডি হও, চাপা স্বরে লাবনী ও বেলাকে বলল রানা। এরা ওপরে জিনিসপত্র গোছাতে গেলেই বেরিয়ে যাব।

কয়েক সেকেন্ড পর কাজ ধরল আবু তালাত। কমপ্রেস বাতাস মেরে উধাও করছে পদচিহ্ন। লালচে মেঘের মত ধুলো উড়ছে বলে দেরি না করে সরে গেল অন্যরা।

ধুলোর মাঝ দিয়ে পালিয়ে যাব? জানতে চাইল লাবনী।

আপাতত সম্ভব নয়, বলল রানা; দরজার পাশেই গণ্ডার। ভারী জ্যাক দেখছে ডাচ লোকটা। তবে এ সরে গেলেই…

হঠাৎ কাজ থামিয়ে দিল আবু। অবাক চোখে দেখছে এন্ট্রান্সের কাছের মেঝে।

লোকটা কেন এত চিন্তিত, বুঝে গেল রানা।

ওদের জুতোর ছাপ দেখেছে সে!

পেছাতে শুরু করো, পেছাও, চাপা স্বরে বলল রানা।

নতুন চিহ্ন অনুসরণ করে এন্ট্রান্সের সামনে থামল আবু। ওখান থেকে চোখ বোলাল ছায়ার ভেতর।

ভাঙা এক পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল রানা ও লাবনী। ভাঙা পাথরের ছোট এক স্কুপের আড়ালে সরে গেছে বেলা। এক সেকেণ্ড পর ওটার ওপর দিয়ে গেল আবু তালাতের ফ্ল্যাশলাইটের জোরালো আলো। মেঝেতে পড়ল বৃত্তাকার রশ্মি। চুপ করে কী যেন দেখছে লোকটা। তারপর নির্দিষ্ট দুসারি ছাপ অনুসরণ করল সে।

বেলা যেখানে লুকিয়ে পড়েছে, সোজা ওই ভাঙা পাথরের স্কুপের ওপর স্থির হলো আলো।

ভয় পেয়ে সামান্য পিছিয়ে কুঁকড়ে গেছে বেলা। কিন্তু ওর সোলের নিচে পড়েছে মাটির ভাঙা বাক্সের ছোট এক টুকরো। থমথমে পরিবেশে পরিষ্কার শোনা গেল মুড়মুড়-কটাং শব্দ।

চমকে গেছে তালাত। মেঝেতে এয়ার সিলিণ্ডার নামিয়ে রেখে কোমর থেকে বের করল রুপালি রঙের চকচকে এক ধারালো ছোরা। ঠোঁটে ঝুলছে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হাসি।

পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে বেলা।

 ওর দিকে এগিয়ে এল পায়ের আওয়াজ।

কী করবে ভাবছে বেলা, এমনসময় এক লাফে স্কুপের এদিকে হাজির হলো আবু তালাত। ঝট করে মাথার ওপর তুলল ছোরা, এবার নামিয়ে আনবে…

খটাং!

আবু তালাতের মাথায় নামল পাঁচ হাজার বছর আগের মাটির পুরু এক পোক্ত ঘটি!

এতই জোরে মেরেছে, ঝনঝন করে উঠেছে রানার কবজি। বিস্ফোরিত হয়েছে ঘটি।

চোখে হাজারো রঙিন নক্ষত্র দেখছে আবু। কাত হয়ে ধরাশায়ী হলো মেঝেতে। তখনই ঘাড়ে নামল রানার বেদম এক লাথি।

ঠুং! শব্দে মাথা ঠুকে গেল তালাতের। জিভ কেটে দরদর করে বেরোল রক্ত। আর নড়ছে না লোকটা।

সোজা হয়েই রানা শুনল, কড়া সুরে এন্ট্রান্স চেম্বারে বলে উঠেছে নাদির মাকালানিঃ আবু তালাত! তালাত! তালাত?

জবাব নেই।

দূরের দরজা দিয়ে দেখল রানা, ডাচ লোকটার দিকে ইশারা করল নাদির মাকালানি। ব্যাপারটা বুঝে এসো, লা ভার্নে।

একটা পিকঅ্যাক্স তুলে বীরযোদ্ধার ভঙ্গিতে তদন্তে নামল ডাচ গণ্ডার।

এসো! লাবনী ও বেলাকে তাড়া দিল রানা। একটু দূরের দরজা লক্ষ্য করে ছুটল ওরা।

এদিকের ঘরে ঢুকেই আবু তালাতের জ্বলন্ত ফ্ল্যাশলাইট চোখে পড়েছে লা ভার্নের। একটু দূরে অচেতন মিশরীয়। ঘুরেই আবছা আলোয় কয়েকটা ছায়ামূর্তিকে পালাতে দেখেছে। সে। আরে! অ্যাই, তোমরা কারা!

বাপু, আমরা কেউ না, মনে মনে বলল রানা। লাবনী ও বেলাকে নিয়ে ঢুকে পড়েছে পরের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে। নিভিয়ে দেয়া হয়েছে সিঁড়ির পাশে লাইটের স্ট্যাণ্ডের সব বাতি। ঝড়ের বেগে ওটা পাশ কাটাল ওরা। তার ফাঁকে সিঁড়ির দিকটা দেখল রানা। এখন বোধহয় যোডিয়াকের চেম্বারে কেউ নেই। কিন্তু ওদিক দিয়ে বেরোতে পারবে না কেউ।

প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে ওরা। ঢুকল শেষ ঘরে। চারটে পিলারের মাঝে খুপরির ভেতর দেখা গেল রেকর্ড করার মাটির সব ছোট বাক্স। পাশেই জ্বলন্ত বাতির স্ট্যাণ্ড। পুবের দেয়ালে দরজা দেখে ওদিকে ঢুকল ওরা। আবারও ফিরে এসেছে এন্ট্রান্স চেম্বারে।

তাতে মোটেও কাটল না বিপদ। হাতুড়ি হাতে ছুটে এল সিকিউরিটি চিফ মাধু কামিল। ভয় পেয়ে পেছাতে গিয়ে আরেকটু হলে রানার ভারসাম্য নষ্ট করে দিত লাবনী। ফুঁপিয়ে উঠল, সামনের পথ বন্ধ!

এদিকটাও! ফুঁপিয়ে উঠল বেলা। পেছন থেকে তেড়ে আসছে ডাচ গণ্ডার।

ওপরে ওঠো! তাড়া দিল রানা। একেকবারে তিনটে করে ধাপ ভেঙে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।

ওর পিছু নিল লাবনী ও বেলা।

একইসময়ে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছল ভার্নে ও কামিল। কয়েকটা করে ধাপ টপকাতে লাগল তারা। বুঝে গেছে, কোণঠাসা হয়েছে ওদের অসহায় তিন শিকার!

খুশিতে বাচ্চা ছাগলের মত লাফ দিতে দিতে ওপরে উঠছিল তারা, কিন্তু হঠাৎ করে ঘুরেই তিনগুণ বেগে নেমে যেতে লাগল।

পেছনে সিঁড়ির ওপরে হাজির হয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

রানার দুহাতে প্রচণ্ড বেগে ঘুরন্ত, বৃত্তাকার করাত! খ্যার খ্যার শব্দ তুলছে ওটা! কই, কী হলো, ধাওয়া করবি না? জানতে চাইল রানা। পলায়নরত দুই শত্রুকে তাড়িয়ে নিয়ে নেমে এল ঘরের মেঝেতে। আয়, কে নেবে মামাবাড়ির মোয়া?

শখ মিটে গেছে মাধু কামিলের, মাথার ওপরে হাতুড়ি ধরে রেখে তুমুল একদৌড়ে এন্ট্রান্স চেম্বারে ফিরল সে। কিন্তু রানাকে মোকাবিলা করতে ঘুরে দাঁড়াল লা ভার্নে। হাতে পিকঅ্যাক্স। রানার কবজির ওপরে ওটা নামাতে চাইল সে। ছুটিয়ে দেবে করাত। লাফিয়ে পিছিয়ে গেল রানা। এক সেকেণ্ড পর সই করে ওর মাথা লক্ষ্য করে এল লা ভার্নের চোখা পিকঅ্যাক্স।

একপাশে সরে প্রাণ বাঁচাল রানা। হাতের ঘুরন্ত স্টিলের ব্লেড বেকায়দা করেছে ভারী করাতটাকে। ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। তার ওপর দুপায়ের মাঝে এদিক ওদিক সরছে পাওয়ার কেবল। ওটা টেনে এগোল রানা, চোখ ডাচ শত্রুর ওপর। কুস্তিগীরের মত ঘুরছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। বুঝে গেছে রানা, বাঁচতে হলে চট করে সরে যেতে হবে।

লাফিয়ে সামনে বাড়ল ভানে।

চোখা লোহার দণ্ড থেকে বাঁচতে কোমর মুচড়ে সরল রানা। একইসময়ে ওপরে তুলেছে করাত। মুহূর্তের জন্যে আওয়াজ হলো: স্ক্রিযযট!

করাতের দাঁত কেটে দিয়েছে পিকঅ্যাক্সের হ্যাণ্ডেল।

 লোহার দণ্ড ছিটকে গিয়ে পড়ল ঘরের দূরে।

নিজের ওপর বিরক্ত রানা। করাত তাক করেছিল ভার্নের কবজি লক্ষ্য করে।

অবশ্য, যা চেয়েছে, তাই হলো– কাটা হ্যাণ্ডেল হাত থেকে ফেলে পিছিয়ে গেল ডাচ। ঘুরেই দৌড়ে গিয়ে ঢুকল এন্ট্রান্স চেম্বারে।

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। ঘুরন্ত করাতের ঘুস-ঘুস-খ্যার-খ্যার শব্দ ছাপিয়ে বলল, দৌড়ের জন্যে তৈরি হও! …এহহে!

কী হলো? জানতে চাইল লাবনী।

রানাকে কিছুই বলতে হলো না, নিজেই দেখল ওরা।

ওদিকের ঘরে ওয়ার্কবেঞ্চ থেকে সাপের চামড়ার জ্যাকেট তুলে নিয়েছে ভগলার। পরের সেকেণ্ডে তার হাতে দেখা গেল রিভলভার। তার চেয়েও খারাপ কিছু আছে। বিপদ ডেকে আনছে মাধু কামিল। ভার্নেকে পাশ কাটিয়ে ছুটে আসছে সে, হাতে চেইন সও!

.

০৮.

 মাধু কামিল ঘরে ঢুকতেই পিছিয়ে গেছে রানা, ঝুলছে ওর অস্ত্রের কে। বৃত্তাকার করাতের চেয়ে অনেক হালকা ও ছোট চেইন সও- ওটার ফলা দীর্ঘ!

লাবনী ও বেলা আলাদা হয়ে গেছে, টের পেল রানা। ঘরগুলোর মাঝ দিয়ে অন্যদিকে যাও! সিঁড়ির কাছে ঘরের দরজার কাছে লাবনী, ওদিকে রিভলভারের ভয়ে দৌড়াতে শুরু করে ঘরের মাঝে পৌঁছে পাথুরে মূর্তি হয়েছে বেলা। পরে টের পেয়েছে বিপদ। এখন পেছনে লাবনী, মাঝে রানা, ওদিকে বেলা। রানার দিকে এগোচ্ছে মাধু কামিল।

সরাসরি রানার পেট লক্ষ্য করে চেইন সওর ফলা চালাল লোকটা। ভারী অস্ত্র ধীর করেছে রানার নড়াচড়া। বৃত্তাকার করাত নিচে নামিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চাইল রানা।

কর্কশ কড়াং! শব্দে লাগল দুই অস্ত্রের ইস্পাত। চেইন সওর ধারালো ফলায় বৃত্তাকার করাতের দাঁত বসতেই প্রচণ্ড এক ঝটকা খেল রানার হাত। গোল করাত কাত হয়ে নেমে এল ওর পায়ের কাছে। যে-কোনও সময়ে পঙ্গু হবে রানা।

এদিকে ওর পেট লক্ষ্য করে আবারও চেইন সও চালাল কামিল। আহত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত হুঙ্কার ছেড়ে ভারী করাত ওপরে তুলল রানা। প্রচণ্ড শব্দে আবারও ঘষা খেল দুই ইস্পাতের ফলা। এবার এত জোরে লেগেছে, তাল হারিয়ে হুমড়ি খেল রানা। পায়ে লাগল জ্যাকের এয়ার হোস, কিন্তু পড়তে পড়তেও একেবারে শেষ সময়ে সামলে নিল ও।

বিজয়ীর হাসিমুখে সামনে বাড়ছে মাধু কামিল।

এই কক্ষে আবার এসে ঢুকেছে ভার্নে। দেখে ফেলল বেলাকে। ঘরের কোণে হাতদুটো ওপরে তুলে বিড়বিড় করছে বেচারি: ইয়ে… মাফ করে দিন! কুঁকড়ে গেছে ভয়ে।

বেলার কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েও থেমে গেল লাবনী। এ ঘরের দিকে ছুটে আসছে কিলিয়ান ভগলার, হাতে উদ্যত রিভলভার! পিছিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নিচের ধাপে পা বেধে আছাড় খেল লাবনী। ওর মাথা থেকে একটু দূরে মাটির তৈরি এক স্কুলের বাক্সে বিঁধল ভগলারের বুলেট।

পিছিয়ে এক বাতির স্ট্যাণ্ডের কাছে চলে গেছে বেলা। খুব কাছেই পৌঁছে গেছে ডাচ গণ্ডার। মাঝপথে বাধা দেয়ার জন্যে এগোল রানা। কিন্তু ও যদি হামলা করে ভার্নেকে, ওকে অনায়াসেই চেইন সও দিয়ে গেঁথে ফেলবে কামিল।

রানার চোখ গেল জ্যাকের হোসের ওপর। ভার্নের দিকে তাক না করে করাত ঘুরিয়ে চালাল হোসের বুকে। ফুস শব্দে কেটে গেল এয়ার লাইন। করাতের ফলা লাগতে বিকট খড় খড় আওয়াজ হলো পাথরে। তবে ওই আওয়াজ কিছুই না কমপ্রেস করা বাতাসের প্রচণ্ড হিসহিসের কাছে। কাটা পড়তেই পাগলা সাপ হয়ে উঠল হোস লাইন। নানানদিকে ছুটল ওটা।

হোস লাইনের ডগা ছিটকে লাগল ভার্নের চোয়ালে। গভীরভাবে কেটে দিল গাল। লোকটা সরার আগেই চোখে ঢুকল বালিভরা তীব্রগতি বাতাস। করুণ এক আর্তনাদ ছেড়ে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল সে। আপাতত অন্ধ। ভুলে গেছে বেলার কথা। ঠাস করে মাথা লাগল একটা পিলারে। হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল সে। গোঙাতে শুরু করেছে আহত পশুর মত।

শয়তানের কাটা লেজের মত নানাদিকে নাচছে সাপ সদৃশ হোস। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছে মাধু কামিল। বুঝে গেল, চাইলেও হামলা করতে পারবে না। গলা ফাটাল সে, বন্ধ করো কমপ্রেসর!

ওদিকে যাও! হাতের ইশারায় লাবনীকে অন্ধকার ঘর দেখাল রানা।

জেদ প্রকাশ পেল লাবনীর কণ্ঠে, তোমাকে ছাড়া যাব না!

আরে, বোকা মেয়ে, আমি পরে আসছি! ধমক দিল রানা। ওদিকের ঘরে, জলদি!

ছুটন্ত হোস হঠাৎ করেই লুটিয়ে পড়ল মরা সাপের মত। কমপ্রেসর বন্ধ করে দিয়েছে কিলিয়ান ভগলার। আবারও ছুটে এল ঘরের দরজায়, হাতে রিভলভার।

ঘুরেই দৌড় দিল লাবনী। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, তার পেছনের দেয়ালে নাক খুঁজল ম্যাগনাম রাউণ্ড।

আবারও হামলা করল কামিল। করাত সরিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইল রানা। দুই যন্ত্রের ফলা লেগে ছিটকে উঠল লাল-হলদে ফুলকি। ভীষণ ভয় পেয়ে একটা পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল বেলা। একটু দূরেই রানা ও কামিল। তবে কাজের জিনিস সিকিউরিটি চিফের করাতের দীর্ঘ ফলা। সামনে বেড়ে রানাকে ঘরের কোণে আটকে ফেলল লোকটা।

পায়ে ঘষা লাগতেই নিচে তাকাল বেলা। দুলছে-নড়ছে দুই করাতের কে। ওদিকে খেয়াল নেই রানা ও কামিলের। বেলার মনে পড়ল, যন্ত্রগুলোর কে এসেছে এন্ট্রান্স চেম্বার থেকে। ওখানে আছে বিদ্যুতের জাংশন-বক্স।

এখন যদি বেলা একবার অফ করে দেয় চেইন সও…

দুই কেবলই কমলা রঙের। তবে চেইন সওরটা বোধহয় একটু গাঢ় রঙের। কালচে লাইন খামচে ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল বেলা।

লাবনীর পিছু নেয়ার জন্যে দৌড় দেবে কিলিয়ান ভগলার, এমনসময় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল দুই করাতওয়ালার লড়াই। রানার দিকে রিভলভার তাক করল সে, কিন্তু একপাশে সরে লাইন অভ ফায়ারে চলে এল কামিল। সামনে বেড়ে হামলা করেছে রানার ওপর। বিরক্ত হয়ে ট্রিগারের ওপর থেকে আঙুল সরাল ভগলার। অপেক্ষা করছে অধৈর্য হয়ে। সুযোগ বুঝে গুলি করবে শত্রুর বুকে।

গোল করাত কাত করে কামিলের কনুই কেটে নিতে চাইল রানা। তবে অনায়াসেই হামলা ঠেকিয়ে দিল লোকটা। তার চেইন সও কামড় বসাল বৃত্তাকার করাতের কেসিঙের ওপর। প্ল্যাস্টিকের অসংখ্য ছোট ছোট টুকরো ছিটকে এসে লাগল রানার নাকে-মুখে। ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল ও। ভারী করাত তুলে ধরতে গিয়ে হয়ে উঠেছে ক্লান্ত। চোখের কোণে দেখল কিলিয়ান ভগলারকে। রিভলভারের নল তাক করছে ওর পিঠ বরাবর! সামনের দিকে চেইন সও ঠেলে দিল কামিল। বাধ্য হয়ে পেছাতে হলো রানাকে। মাথায় তাপ লাগতেই টের পেল, ওর ঠিক পেছনেই স্ট্যাণ্ডভরা জ্বলন্ত সব হাই পাওয়ারের বাতি।

কোণঠাসা হয়ে গেছে, বুঝে গেল রানা।

ওদিকে বেলা দেখল, আর আসছে না বৈদ্যুতিক কর্ড। গায়ের জোরে লাইন ধরে টান দিল ও।

জাংশন বক্স থেকে খুলে গেল যন্ত্রের প্লগ…

তাতে হঠাৎ করেই নীরব হলো রানার করাত!

না, চেইন সওর বৈদ্যুতিক তার গাঢ় রঙের নয়! ওটা ধুলোয় মাখা ছিল বলে ওরকম মনে হয়েছে! মারাত্মক ভুল করেছে বেলা। বৃত্তাকারকরাতের ধুলোভরা পাওয়ার কেবল টান দিয়ে খুলে দিয়েছে ও!

আরে! আঁৎকে উঠে বেলাকে দেখল বিস্মিত রানা। মেয়েটা উজবুকের মত চেয়ে আছে হাতের কেবলের দিকে। ভয়ঙ্কর খুনি লাশের কাছে ধরা পড়লে যেমন চেহারা করে, ওভাবে তাকাল রানার দিকে।

বিড়বিড় করল রানা, সেরেছে!

এখনও বনবন করে ঘুরছে গোল করাত, কিন্তু ক্রমেই কমছে গতি। নিজের কপাল দেখে খুব খুশি মাধু কামিল, পেয়ে গেছে সুযোগ! রানার বুক লক্ষ্য করে সামনে বাড়াল চেইন সওর ক্ষুরধার, ভয়ঙ্কর ফলা। ভারী, গোল করাতের মেশিন ওপরে তুলে নিজেকে বাঁচাতে চাইল রানা। কিন্তু চেইন সওর দাঁত লাগল ওর করাতের ফলার এক্সেল অ্যাসেমব্লিতে। চুরমার হলো ওটা। মৃত্যুবাহী ফ্রিসবির মত ঘরের আরেক দিকে ছিটকে গেল স্টিলের বৃত্তাকার করাত। লাগল গিয়ে এক পিলারের গায়ে, তারপর সাঁই করে গেল সুড়ঙ্গের দিকে ঠিক সময়ে ওটার গতিপথ থেকে সরে না গেলে কাটা পড়ত ভগলারের গলা। প্রাণের ভয়ে পেছনে। ডাইভ দিয়েছে সে। তার ওপর দিয়ে গিয়ে আরেক পিলারে লাগল করাতের ব্লেড। ওখানে না থেমে ঢুকে পড়ল এন্ট্রান্স চেম্বারে। কুঁজো হয়ে বসে পড়ল নাদির মাকালানি। ওরে! করুণ আর্তনাদ ছাড়ল লুকমান বাবাফেমি। তাদের দুজনের মাঝ দিয়ে গেছে স্টিলের মারাত্মক ফলা।

এদিকে বেকার যন্ত্রটা কামিলের দিকে ছুঁড়ল রানা। আশা করছে, ভুল করে চেইন সও দিয়ে ভারী যন্ত্র ঠেকাবে লোকটা। কিন্তু হুঁশিয়ার বান্দা কামিল, এসবের ভেতর গেল না সে, ঘুরেই লাফিয়ে সরে গেল মিসাইলের গতিপথ থেকে। আবার মুখোমুখি হলো। এবার বাগে পেয়েছে অরক্ষিত রানাকে!

চেইন সও দুলিয়ে সামনে বাড়ল কামিল। বাতির স্ট্যাণ্ডে ঠেকে গেল রানার পিঠ।

চওড়া হাসি সিকিউরিটি চিফের ঠোঁটে, সোজা রানার বুক লক্ষ্য করে করাত চালিয়ে দিল সে…

কিন্তু চেইন সওর কেবল ধরে হ্যাচকা টান দিয়েছে বেলা। হঠাৎ এই কাণ্ডে কামিলের করাতের ফলা সরল টার্গেট থেকে। করাতের ডগা ভেদ করল রানার কাঁধের কাছে চামড়ার জ্যাকেট। ত্বক চিরে বেরোল রক্ত। কিন্তু ওই সামান্য ক্ষত পাত্তা দিল না রানা। শত্রু ভারসাম্য হারাতেই তাকে ধরে কাঁধের ওপর দিয়ে থ্রো করল বাতির স্ট্যাণ্ডের ওপর।

চেইন সওর ডগা ফাটিয়ে দিল হাই পাওয়ারের কয়েকটা বাব। কেটে গেছে পাওয়ার লাইন। বিস্ফোরিত হলো বালবৈর পাতলা সব কাঁচ। ঝলসে উঠল ঝলমলে ফুলকি ও নীল শিখা। তীব্র বৈদ্যুতিক স্রোত বইল মাধু কামিলের দেহে। প্যারালাইযুড় হয়েছে লোকটা, টু শব্দ করতে পারল না। কাটা কলাগাছের মত হুড়মুড় করে পড়ল ট্রাইপডের ওপর। তার নাক-চোখ থেকে ভক-ভক করে বেরোল মশার কয়েলের মত নীলচে ধোয়া। পুড়ে ভাজা হচ্ছে জীবন্ত লোকটা!

প্রাণের ভয়ে লাফিয়ে সরে গেছে রানা। বেলাকে এক টানে দাঁড় করিয়ে বলল, চমৎকার রঙিন ফুলকি! তবে দেখার সময় নেই, চলো!

.

আঁধার ঘরের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে লাবনী। আবু তালাতের ফ্ল্যাশলাইটের আবছা আলোয় দেখল, এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে লোকটার। ধসে পড়া এক পিলার ঝড়ের বেগে টপকে যেতেই ঝট করে তাকাল সে। তখনই ওর পিঠ মাড়িয়ে চলে গেল লাবনী। ঠাস্ করে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল আবু তালাত।

সংক্ষিপ্ত প্যাসেজ পেছনে ফেলল লাবনী। দূরে দেখল, রয়েল এন্ট্রান্সের কাছে নাদির মাকালানি। কিন্তু ওর একটু দূরেই এক পিলারে ঠেস দিয়ে হাঁপিয়ে চলেছে বাবাফেমি। ফ্যাকাসে সাদা ভূত। চমকে গেল লাবনীকে দেখে। ডক্টর আলম?

ডক্টর বাবাফেমি, আপনার বোধহয় কিছু কৈফিয়ত দেয়া উচিত, জবাবে বলল লাবনী।

দুপা সামনে বাড়ল বাবাফেমি। আপনি যদি ভেবে থাকেন…

গায়ের জোরে লোকটার নাকে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে নাদির মাকালানির দিকে এগোল লাবনী। পেছনে শুনল, নাক চেপে ধরে কো-কোঁ করছে ভ্রষ্ট আর্কিওলজিস্ট। একটা পিলারের পাশে ক্রোবার দেখে তুলে নিল লাবনী, ধরেছে তলোয়ারের মত করে। ওর মনে হলো, কিছুই পাত্তা না দিয়ে কদর্য, বাঁকা হাসছে লোকটা। তোমার এত হাসি কীসের? বলল লাবনী। একটু দূরে পড়ে থাকা কেসটা দেখাল। ওটা নিয়ে বেরোতে পারবে না।

জবাব দিল না মাকালানি। আড়চোখে দেখছে ওকে। ঘাপলা আছে মনে হতেই সতর্ক হলো লাবনী। ঘুরে দেখল পশ্চিমের এক্সিট। ফিরে এসেছে কিলিয়ান ভগলার। তাক করছে রিভলভার…

লাবনী ছুট দিতেই বুলেটের আঘাতে পেছনের পিলার থেকে ছিটকে উঠল পাথরের টুকরো। কারুকাজ করা এক পিলারের আড়াল নিল ও।

কড়া সুরে বলল নাদির, খুন করো একে!

.

দ্বিতীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন চেম্বার থেকে গুলির আওয়াজ শুনেছে রানা। লুকিয়ে পড়ো, বেলাকে বলেই মৃদু আলোর ঘর লক্ষ্য করে ছুটল ও। এদিকে আবারও উঠে বসছে আবু তালাত। তার পিঠে পা দিয়ে টপকে গেল রানা। নতুন করে ভেঁচে গেল লোকটার মুখ। সেদিকে খেয়াল নেই রানার, মেঝেতে পড়ে থাকা ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখেছে ছোরা। তুলে নিল ওটা।

.

ওদিকে বাতির স্ট্যাণ্ডের নিচে কষে লাথি মেরেছে লাবনী। স্ট্যাণ্ডের ওপরের অংশ বেশি ভারী, হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল ওটা। ঝনঝন করে ভাঙল সব বা। আঁধার নামল ঘরের পুবে। বন্ধ এন্ট্রান্সের কাছে আরেকটা পিলার পেরোল লাবনী। জগিঙের ভঙ্গিতে পিছু নিয়েছে কিলিয়ান ভগলার।

এদিকে টলতে টলতে ঘরে ঢুকল লা ভার্নে। রক্তে মেখে আছে নাক-মুখ।

ঘরে কারা উপস্থিত, সেটা দেখে লাবনী পরিষ্কার বুঝল, এভাবে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না।

দৌড়ে ঘরে ঢুকেই ভগলারের অস্ত্রের নল লক্ষ্য করে রানা বুঝে গেছে, কোনদিকে আছে লাবনী।

অ্যাই যে! গলা ছাড়ল বিসিআই এজেন্ট।

ওকে দেখেছে ভগলার, ঘুরেই টিপে দিল ট্রিগার।

একটা পিলারের আড়াল নিয়েছে রানা, পাশ দিয়ে গেল বুলেট। দেয়াল থেকে খসে পড়ল পাথরের টুকরো।

যোডিয়াক সরাও! হাতের ইশারায় ভার্নেকে নির্দেশ দিল মাকালানি। তাড়া খাওয়া তেলাপোকার মত পিছলে তার পাশে পৌঁছুল বাবাফেমি।

শিকারের কাছে পৌঁছে গেছে কিলিয়ান ভগলার।

একটা পিলারে পিঠ ঠেকিয়ে অপেক্ষা করছে রানা, হাতে ছোরা। আমেরিকান খুনির কোল্ট পাইথন রিভলভার জাদু দেখাতে পারবে আর মাত্র দুবার। রানার হিসাব অনুযায়ী, আর দুটো বুলেট আছে ওই অস্ত্রে। এমন কী স্পিডলোডার ব্যবহার করেও কয়েক সেকেণ্ড লাগবে রি-আর্ম করতে। ওই সময়ে পাল্টা আক্রমণ করতে পারবে রানা।

অবশ্য, তার আগে খরচ করাতে হবে ওই দুই বুলেট।

কাছের দরজায় পায়ের আওয়াজ পেল রানা। শেষমেশ মেঝে ছেড়ে উঠতে পেরেছে আবু তালাত। রক্তাক্ত চেহারায় ভীষণ রাগ। টলতে টলতে আসছে রানার দিকেই।

বিরক্ত রানা টের পেল, বাধ্য হয়েই পিছিয়ে যেতে হবে ওকে। কিন্তু ওদিকে আছে ভগলার।

আবছা আলোয় আমেরিকান খুনির চোখে হত্যার ফুর্তি দেখল লাবনী। রানা! চিৎকার করে উঠেই পরক্ষণে গায়ের জোরে ক্রোবার ছুঁড়ল গানম্যানের দিকে।

ভারী দণ্ড লাগল লোকটার কাঁধে। ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়তেই বু! শব্দে বেরোল ৩৫৭ ম্যাগনাম বুলেট। নাকের কাছে এক পিলারে বুলেট লাগতেই বিরাট একলাফে পিছিয়ে গেল আবু তালাত। একইসময়ে আঁধারে ছুটে গিয়ে লাবনীর পাশে পৌঁছুল রানা।

তালাত! ভার্নে! যোডিয়াক সরাও! চিৎকার ছাড়ল নাদির মাকালানি। অধৈর্য হয়ে আরও রেগে উঠছে সে।

দ্বিধায় পড়েছে আবু তালাত, তবে কয়েক সেকেণ্ড পর গেল ঘরের আরেক পাশে। নিচু হয়ে তুলে নিল কেসের একদিক। অন্যদিক তুলে ধরল ভার্নে। একহাতে রক্তাক্ত নাক চেপে ধরে, ঘুরেই সুড়ঙ্গ ধরে দৌড় দিল লুকমান বাবাফেমি। কেস বয়ে তার পেছনে চলল তালাত ও ভার্নে।

চোখের সামনে যোডিয়াক নিয়ে যাচ্ছে দেখে রানাকে বলল লাবনী, শয়তানের দল সব নিয়ে যাচ্ছে! ছুরি দিয়ে কী করবে পিস্তলের বিরুদ্ধে!

ওটা পিস্তল নয়, রিভলভার, ভুল ধরিয়ে দিল রানা, শেষ গুলি ফুরিয়ে গেলে ওকে লড়তে হবে খালি হাতে। কিন্তু আমার হাতে থাকবে ছোরা।

খুব কাছে পৌঁছে গেছে ভগলার, কিন্তু তার উদ্দেশে চেঁচাল নাদির মাকালানি, কিল! চলো!

ওদের কী হবে?

যোডিয়াক হাতে পাওয়াই মূল কথা, এসো! সুড়ঙ্গ ধসিয়ে দেব। আটকা পড়বে ওরা!

পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও লাবনী।

বিড়বিড় করল রানা, ব্যাটা বলে কী!

তাই তো বলল! শুকনো গলায় বলল লাবনী।

সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল নাদির মাকালানি।

পিছু নিয়ে এন্ট্রান্সের কাছে চলে গেল ভগলার। পাশেই পাথরের মস্তবড় চাই। রিভলভার উঁচু করে রেখেছে লোকটা, রানা বা লাবনী বেরোলেই গুলি করবে।

ওই ঘটিগুলোর একটা দাও তো, লাবনী, বলল রানা।

অমূল্য আর্টিফ্যাক্ট ভাঙবে ভাবতে গিয়ে ফ্যাকাসে হলো লাবনী, তবে একটা বড় ফুলদানি ধরিয়ে দিল রানার হাতে।

ওজনটা বুঝে নিয়ে ওটা উঁচু করে ধরল রানা।

সুড়ঙ্গের দূর থেকে এল মাকালানির কণ্ঠ: কিল! চলে এসো!

গলার আওয়াজ অনুসরণ করে ঘুরে তাকাল কিলিয়ান ভগলার। আর তখনই লাফিয়ে বেরিয়ে এসেই ভারী ফুলদানি ছুঁড়ল রানা। পরক্ষণে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে দিল শরীর, চলে গেল পরের পিলারের আড়ালে। দুসেকেণ্ড পর গুলি করল ভগলার। ক্লে পিজিয়নের মত মাঝপথে চুরমার হলো উড়ন্ত ফুলদানি। কয়েকটা টুকরো লাগল গায়ে, তবে পাত্তা দিল না রানা। মগজে ঘুরছে শুধুমাত্র একটা চিন্তা: শেষ হয়েছে ছয়টা গুলি!

লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবছে, ভুল হয়নি তো, রিভলভারের বদলে ভগলারের হাতে হয়তো সেভেন শুটার…

নাহ্। ঘুরেই সুড়ঙ্গ ধরে ছুটল লোকটা।

ক্ষিপ্র চিতার বেগে পিছু নিল রানা, পাশ কাটাচ্ছে জ্বলন্ত সব বাতি। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, করেছে মস্তবড় ভুল! এইমাত্র জ্যাকেট থেকে দ্বিতীয় রিভলভার বের করেছে। ভগলার! থেমে ঘুরে দাঁড়াল সে!

একইসময়ে ঝাঁপ দিয়ে তাকে ট্যাকল করল রানা। ধুপ ধুপ শব্দ তুলছে জেনারেটর, ওটার পাশে হুড়মুড় করে পড়ল ওরা দুজন। অস্ত্র তুলল ভগলার, কিন্তু থাবা মেরে তার হাত থেকে রিভলভার ফেলে দিল রানা। অস্ত্রটা আবারও হাতে পেতে হাঁচড়েপাঁচড়ে এগোতে চাইল তেলতেলে চুলের খুনি, তবে কিডনির ওপরে রানার প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে পড়ে গেল।

কিন্তু লড়াই শেষ হয়নি। মেঝেতে ঘুরেই কনুই চালাল সে রানার বুকে। প্রচণ্ড ব্যথায় দম আটকে গেল ওর। আট মাস আগে বিপজ্জনক এক অ্যাসাইনমেন্টে পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছিল, সেখানে পড়েছে কনুইয়ের বেদম খোঁচা!

রানার দুর্বলতা বুঝে গেছে ভগলার। দ্বিতীয়বার মারল একই জায়গায়। পেছনের এক পিলারের ওপর পিঠ দিয়ে ধড়াস্ করে পড়ল রানা।

সুযোগ পেয়ে ধড়মড় করে উঠতে গেল ভগলার, কিন্তু তখনই তার শুকনো পাছায় খেল রানার জোরালো লাথি। টলে গিয়ে আবারও হুড়মুড় করে পড়ল লোকটা। মুখ তুলে দেখল, পায়ের কাছে হাজির হয়েছে নাদির মাকালানি।

মুখ তুলে চেয়েছে রানাও।

মেঝে থেকে আগেই রিভলভার তুলে নিয়েছে মাকালানি। সরাসরি তাক করল রানার বুকে। তবে ট্রিগার টিপে দেয়ার আগেই ঝাঁপ দিয়ে জেনারেটরের ওদিকে পড়ল রানা। কানের কাছে বুম! করে উঠল রিভলভার। প্রথম গুলি মেঝেতে লেগে পিছলে গেল সুড়ঙ্গের দূরে। দ্বিতীয় বুলেট লাগল জেনারেটরের বুকে। ভীষণ ঝাঁকি খেয়ে বিশ্রী আওয়াজ তুলল যন্ত্রটা। নষ্ট হয়েছে ভেতরের কলকজা। নিভে আবার টিপটিপ করে জ্বলে উঠল বাতি। তৃতীয় গুলি ফাটাল ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। মেঝের ওপর দিয়ে গলগল করে বয়ে গেল গ্যাসোলিন।

ঠোঁটে ভয়ঙ্কর হাসি নিয়ে ভগলারকে বলল মাকালানি, পিছিয়ে যাও!

কী করা হবে বুঝে খলখল করে হেসে উঠে মেঝে ছাড়ল আমেরিকান খুনি।

পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে তারা দুজনই।

সেরেছে! বিড়বিড় করল রানা।

বুলেটের আঘাতে মরবে, না জ্বলেপুড়ে, তাই স্থির করতে হবে এখন!

পরক্ষণে গুলি করল নাদির মাকালানি। তপ্ত সীসা জ্বেলে দিল ফিউয়েলের বাম্পকে দপ করে ধরেছে নীল আগুন!

মেঝে থেকে উঠেই আহত সিংহের মত ছুটল রানা। এক সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো জেনারেটর। দপ করে নিভে গেল সব বাতি। পেছনের কমলা আগুনের উজ্জ্বল আলোয় সবই দেখছে রানা। গোল এক বল তেড়ে এল ওর দিকে। পুড়তে শুরু করেছে গায়ের ত্বক ও মাথার চুল। ডাইভ দিয়ে মেঝের দূরে গিয়ে পড়ল রানা। তেলতেলে স্রোতের মত আগুনের হলকা গেল ওর ওপর দিয়ে ছাতের দিকে।

মিলিয়ে গেল বিস্ফোরণের ভোতা প্রতিধ্বনি। অন্য বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে রানা। সমস্যা হচ্ছে ছাতে ঠেক দেয়া কাঠের পিলার ও বিম কড়কড় আওয়াজে পুড়ছে ওগুলো!

মৃদু কুড়মুড় শব্দ ছাড়ল ছাতের পাথর…

ধসে পড়তে শুরু করেছে সব!

ধড়মড় করে উঠে অন্ধকার লক্ষ্য করে দৌড় দিল রানা। পেছনে বিকট এক আওয়াজ তুলে ধসে পড়ল ছাতের বড় এক অংশ। মস্ত এক লাফে এন্ট্রান্স চেম্বারে ঢুকল ও। ওকে ধাওয়া করেছে দম আটকে দেয়া ধুলো-বালির ঘন মেঘ।

একটু দূরে কোথাও খুকখুক করে কাশছে লাবনী। বিড়বিড় করে বলছে, ও, রানা! মরে যেয়ো না! প্লিয!

নাক-মুখ টি-শার্টে চেপে বলল রানা, ভাবলে কী করে যে খুন হবে দ্য গ্রেট মাসুদ রানা? এহূহে! গলা তো সাহারা মরুভূমির মত শুকিয়ে গেল!

রানা খুঁজতে শুরু করার আগেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল লাবনী। নাক গুঁজেছে রানার বুকের কালো অরণ্যে।  

ওকে একহাতে ধরে রাখল রানা।

থেমে গেছে ছাতের ধস। তবে ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরছে সুড়ঙ্গে বালি।

কী হয়েছিল? মুখ তুলে তাকাল লাবনী।

মাথা নাড়ল রানা। সহজ কথায়: জেনারেটর ফেটেছে। আগুন ধরে গেল। মেঝেতে নেমে এল ছাত।

তার মানে আটকা পড়েছি? চমকে গেছে লাবনী।

তাই তো মনে হচ্ছে।

তুমি ঠিক আছ তো, রানা? জানতে চাইল লাবনী।

প্রায়। তবে ছাগলা দাড়িওয়ালা ভগলারের শুঁটকি পাছায় কষে আরেক লাথ মারতে পারলে মিটত জীবনের প্রায় সব শখ-আহ্লাদ!

ওটা তোমার জীবনের…।

 হু। তখন তেমনই মনে হয়েছে।

ভাসমান ধুলোর মাঝে বলের মত বৃত্তাকার আবছা আলো এল ওদের দিকে। আবু তালাতের ফ্ল্যাশলাইট বেলার হাতে। ককিয়ে উঠল মেয়েটা, হায়, ঈশ্বর! বাতাস ফুরিয়ে গেলে মরব তো আমরা!

রানার বুক ছেড়ে সরে গেল লাবনী।

প্রকাণ্ড জায়গা, বলল রানা, যথেষ্ট অক্সিজেন আছে। ভয় নেই।

ভয় পাচ্ছি কই! করুণ সুরে বলল বেলা, ভয়ের কী আছে? মনেই নেই, আছি হাজার হাজার টনি স্ফিংসের নিচে! কেউ জানল না শেষ হয়ে গেলাম!

তোমার ফ্ল্যাশলাইট দাও তো, হাত বাড়িয়ে বেলার কাছ থেকে ওটা নিল রানা। আলো তাক করল সুড়ঙ্গের দিকে। বাতাসে ভাসছে ঘন ধুলোর মেঘ। পুরো বুজে গেছে সুড়ঙ্গ।

পাথর খুঁড়ে বেরোতে না পারলে মরব! বলল বেলা।

ভুলে গেলে? মৃদু হেসে কারুকাজ করা পিলারের মাঝে পুব এন্ট্রান্স দেখাল রানা। আমরা অপেক্ষা করব সঠিক সময়ে বিখ্যাত হওয়ার জন্যে!

.

সুড়ঙ্গের শেষমাথায় ভাঙা পাথর সরাবার আগে বিরতি নিল দাম্ভিক আর্কিওলজিস্ট ম্যান মেট্য। টিভি ক্যামেরার দিকে চেয়ে গলা মোটা করে নাটকীয় সুরে বলল, এবার আপনারা দেখবেন অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য…।

সংকীর্ণ প্যাসেজে আছে, মাত্র ছয়জন। তাদের কপাল ভাল, নিজ চোখে দেখছে কীভাবে উন্মোচিত হচ্ছে পাঁচ হাজার বছর আগের হল অভ রেকর্ডস। ক্যামেরার সাইক্লোপিয়ান কাঁচের চোখ একই দৃশ্য দেখাবে বিশ্বের কোটি কোটি উৎসুক দর্শককে। ম্যান মেটযের প্রতিটি কথা গিলরে তারা। একসময় এভাবেই চাঁদে পা দিয়ে পুলকিত হয়েছিলেন নিল আর্মস্ট্রং।

হাতঘড়ি দেখল মেট। ভোর চারটে ছিচল্লিশ মিনিট। নিউ ইয়র্কে রাত নয়টা ছিচল্লিশ। স্কেজুয়ালে ভুল হয়নি তার।

ক্রোবার হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকাল সে। আপনারা দেখছেন, এবার সরিয়ে নেয়া হবে এন্ট্রান্স থেকে শেষ পাথর। আরও ভারী করে তুলল কণ্ঠ, স্ফিংসের তলের গোপন সুড়ঙ্গে হল অভ রেকর্ডসসের প্রবেশপথে শেষ বাধা এই পাথর। পাঁচ হাজার বছর পর প্রথম মানুষ আমরা, যারা পা রাখব ওই রাজকীয় গ্রন্থাগার কক্ষে। কারও জানা নেই, কী সম্পদ রয়ে গেছে ওখানে। তবে এটা ঠিক, যা-ই থাকুক, তা আছে হাজারো বছর ধরে। এবার আমরা দেখব সেসবই!

ক্যামেরাম্যানের পেছন থেকে অধৈর্য হয়ে ইশারা করল প্রোগ্রাম প্রডিউসার লোগান ক্যাসপাস। তার অত্যন্ত মূল্যবান সময় নষ্ট করছে ম্যান মেটয।

গম্ভীর মুখে ক্রোবার ঢুকিয়ে পাথরের স্ল্যাবের ফাঁকে চাড় দিল আর্কিওলজিস্ট, খসে পড়ল একপাশের পাতলা আস্তর। আবারও ক্যামেরার দিকে তাকাল ম্যান মেটয। চলুন, দেখা যাক কী রয়েছে ওদিকে।

ক্রোবারের আরেক চাড় দিতেই নিচু গুড়গুড় শব্দে একটু সরে গেল পাথরের স্ল্যাব। উত্তেজিত হয়ে উঠল ম্যান মেটয। আবার কাজে নামতেই আরও খানিকটা সরল স্ল্যাব।

শেষপর্যন্ত উন্মোচিত হচ্ছে হল অভ রেকর্ডস!

প্রথমে দেখবে কে?

দুনিয়ার সেরা আর্কিওলজিস্ট ম্যান মেটয!

আইএইচএর এই বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে নেতৃত্ব দিতে কম লড়াই করেনি সে!

তার ওপর ঝামেলা করেছিল ওই লাবনী আলম!

মরুক বেটি!

স্ল্যাব আরেকটু সরতেই ওদিকে দেখা গেল নিকষ কালো আঁধার। গর্ত থেকে বেরোল সামান্য লালচে ধুলো।

বুক ধুকপুক করছে ম্যান মেটযের। আরও জোরে চাড় দিল। ছুটিয়ে ফেলল পাথরের স্ল্যাব। ওটা ঠেলে সরিয়ে ঘুরে তাকাল।

এগিয়ে এল ক্যামেরাম্যান।

 উজ্জ্বল আলো গিয়ে পড়ল কক্ষের ভেতর…

দেখা গেল কালিঝুলি মাখা লাবনী আলমের হাসিমুখ! পাশেই মাসুদ রানা ও বেলা আবাসি!

হ্যাঁ, কী, মেটয? খুশি-খুশি স্বরে বলল লাবনী। মেট্য ভাবল, বুলেটের বেগে পায়ের পাতা ভেদ করে পাথুরে জমির গভীরে গিয়ে ঢুকল তার হৃৎপিণ্ডটা! এসো, ওয়েলকাম টু দ্য হল অভ রেকর্ডস! তোমার আসতে এত দেরি কীজন্যে?

.

০৯.

 এরা প্রত্যেকে ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ আর্টিফ্যাক্ট লুঠেরা, কর্তৃপক্ষের উচিত অন্তত বিশ বছর এদেরকে জেলে আটকে রাখা! রাগ ঝাড়ছে লুকমান বাবাফেমি, তবে একইসময়ে কণ্ঠে রয়েছে চাপা ভীতি।

রানা, লাবনী ও বেলা জানে, লোকটার ভয় পাওয়ারই কথা। যদি প্রমাণ হয় যোডিয়াক চুরির সঙ্গে জড়িত, সোজা তাকে ভরা হবে বিশ বছরের জন্যে আঁধার কুঠরিতে।

কপাল মন্দ, রানাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। অন্তত এমন কিছু নেই, যেটা টিকবে আদালতে।

স্ফিংস থেকে বেরোলে কর্তৃপক্ষ আঁচ করেছে, হল অভ রেকর্ডসসে কিছু করছিল ওরা। অপরাধের ধরন বুঝতে না পারলেও সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরাসরি নিয়ে এসেছে মিনিস্ট্রি অভ কালচার-এ মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসে। বাদ পড়েনি উজবুক মেট ও ভীত লুকমান বাবাফেমি। প্রথম থেকেই ক্রোধ ঝাড়ছে আমেরিকান আর্কিওলজিস্ট। কর্তৃপক্ষের প্রতারিত ন্যায়নিষ্ঠ অফিসারের ভঙ্গি বাবাফেমির।

এরা যাই বলুক, এটা প্রমাণিত, আইএইচএকে কাঁচকলা দেখিয়ে হল অভ রেকর্ডসসের ভেতর আগে ঢুকেছে একদল লুঠেরা। বেলার ক্যামেরা থেকে সমস্ত ডেটা নেয়া হয়েছে কমপিউটারে। এখন দেখা হচ্ছে মন্ত্রী মহোদয়ের অফিসের বিশাল টিভি স্ক্রিনে। ফ্রি করা হয়েছে একটা দৃশ্য। ছাতে যোডিয়াকের অংশ। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাকালানি ও বাবাফেমি। কিন্তু যেহেতু যোডিয়াকের ঘরে উজ্জ্বল আলো, এবং তাদের পিঠ ক্যামেরার দিকে, তাই প্রায় দেখাই যাচ্ছে না দুজনকে।

এটা প্রমাণিত যে আমরা লুঠ করিনি হল অভ রেকর্ডস, বলল রানা। তাতে আপনাদের কোনও সন্দেহ আছে?

মাথা নাড়লেন মন্ত্রী ইউসুফ কোন্তার।

মাত্র গতকাল সকালে এসেছি এ দেশে, বলল লাবনী, কিন্তু ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে। তা করা হয়েছে স্ফিংসের কম্পাউণ্ডে। সুতরাং ধরে নেয়া যায় গিজার কারও হাত আছে এতে। বাবাফেমির দিকে তাকাল লাবনী। আপনি এতে একমত?

মন্ত্রী ইউসুফ কোন্তার বয়স্ক লোক, ঘোড়ার মুখের মত লম্বাটে মুখ। মন দিয়ে দেখছেন লাবনী ও বেলার, তোলা ফোটোগ্রাফ। ওই মৃত মাধু কামিল ছিল সিকিউরিটির দায়িত্বে। ধরে নেয়া যায়, লুঠেরাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সে।

প্রাইভেট কন্ট্রাক্টরদের দায়িত্ব দেয়া ছিল মস্তবড় ভুল, বললেন সুপ্রিম কাউন্সিল অভ অ্যান্টিকুইটির সেক্রেটারি জেনারেল শরিফ হামদি। আর্মি ডাকা দরকার ছিল। থাকা উচিত ছিল অ্যান্টিকুইটির স্পেশাল প্রোটেকশন স্কোয়াড।

আমার ধারণা, ডক্টর আলম ও তার ডাকাতের দলের পিছু নিয়েছিল মাধু কামিল, আর তখনই গ্রেফতার করতে গিয়ে খুন হয় সে, বলল বাবাফেমি।

এ কথা শুনে এমন কী ম্যান মেটযও অবাক হয়ে তাকে দেখল।

লুঠেরাদের ফেলে যাওয়া ইকুইপমেন্টের ফোটো হাতড়ে দেখছেন মন্ত্রী। একজনের কাজ নয় এটা। এক যুবতী, মিস্টার রানা বা এক বাচ্চা মেয়ে এসব করতে পারত না।

রানাকে একবার দেখে নিলেন। ভুলে যাননি মিশরের জাতীয় একাধিক জটিল সমস্যায় সাহায্য করেছে বাঙালি ওই যুবক। তখন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছে দুজনের।

আমি বাচ্চা মেয়ে নই, আপত্তি তুলল বেলা।

ওর বাহুতে হালকা চাপড় দিল লাবনী। ঠিক আছে।

মন্ত্রীর দিকে ফিরে বলল রানা, ছিল অন্তত দশজন। ভিড়িয়োতে আছে ছয়জন। আরও ছিল কনস্ট্রাকশন সাইটে দুগার্ড ও কম্পাউণ্ডের গার্ডরা। গিজার সবাইকে তদন্তের আওতায় নিলে, উচিত হবে একেবারে ওপরের পর্যায় থেকে। সন্দেহ করা।

লুকমান বাবাফেমির দিকে তাকাল লাবনী।

পাগলের মত কথা বলছে এরা! ফুঁসে উঠল বাবাফেমি, আমাকে অপরাধী হিসেবে দেখিয়ে আড়াল করতে চায় নিজেদেরকে!

বলুন তো, আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? বলল লাবনী, কীভাবে পেলেন নাকে ব্যথা? কী হয়েছিল? হাত তুলে আঙুলের ছড়ে যাওয়া কড়া দেখল ও। আরে, অবাক কাণ্ড, আমার হাতে দেখি নাক আকৃতির লাল দাগ!

মিস্টার মিনিস্টার, গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় অনধিকার প্রবেশের জন্যে লাবনী আলম বা তার সঙ্গের এই দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত, লালচে চেহারায় বলল ম্যান মেটয। কড়া চোখে দেখল লাবনীকে। আমার চূড়ান্ত সাফল্য সহ্য হলো না? তাই ধ্বংস করে দিলে আমার সুনাম? …প্রশংসা পেয়ে মধ্যমণি হতে হবে, তাই না?

আগে অন্তত মানুষ হও, মেট, ধমকের সুরে বলল লাবনী।

আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিলেন শরিফ হামদি। আমরা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের বিষয়ে কথা বলছি, ডক্টর মেটয, কাজেই দয়া করে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনবেন না। যোডিয়াকের ছবি দেখালেন তিনি। ডাকাতি হয়েছে জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। এবং তা হয়েছে আপনার নাকের ডগার তলা দিয়ে! সবাই জানতে চাইবে, কী কারণে আপনি জানলেন না ওখানে আছে আরেকটা সুড়ঙ্গ! আগেই তারা ওই সাইট থেকে মহামূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট সরায় কীভাবে?

যে কেউ এটাও ভাবতে পারে, সবই জানতেন আপনি, আবছা হুমকি আছে মন্ত্রী মহোদয়ের কথার ভেতর।

ভয় পেয়ে ফ্যাকাসে হলো ম্যান মেটযের মুখ। কিন্তু… এসব কিছুই জানি না আমি! নইলে এভাবে শেষ করে দেয় কেউ নিজের ক্যারিয়ার ঝুঁকি নেয় কেউ জেলে যাওয়ার?

টাকার জন্যে বহু কিছুই করে অনেকে, বলল লাবনী। ওর মনে হয়েছে, লুঠেরাদের সঙ্গে জড়িত নয় মেট, তবে তাকে কুঁকড়ে যেতে দেখে ভাল লাগল।

টাকার কথা শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন মন্ত্রী ইউসুফ কোন্তার। ডক্টর আলম, আপনার ধারণা এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওসাইরিয়ান টেম্পল?

অবশ্যই! বলল লাবনী, বামদিকের লোকটা নাদির মাকালানি।

সে যে-কেউ হতে পারে, চাপা স্বরে বলল বাবাফেমি।

ডানে তার ঘনিষ্ঠ দোস্ত, তাই না, ডক্টর বাবাফেমি? মৃদু হাসল রানা।

ডক্টর বাবাফেমির কথায় কিন্তু যুক্তি আছে, বললেন সেক্রেটারি জেনারেল শরিফ হামদি।

ওই লোক নাদির মাকালানি, জোর দিয়ে বলল লাবনী, এই ডাকাতির পেছনে আছে ওসাইরিয়ান টেম্পল।

ওই ধর্মের লোক নই, বিশ্বাসও করি না তাদের ধর্মপথ, তবে মিশরে বড় দাঁতব্য সংস্থা তারা, বললেন মন্ত্রী। কাদির ওসাইরিস শুধু যে মিশরের আর্কিওলজিকাল পোজেক্টে টাকা ঢেলেছেন, তা নয়, অঢেল অর্থের সাহায্য করেন স্বাস্থ্য ও কৃষি কার্যক্রমে। খুব জনপ্রিয় মানুষ। ভুরু কুঁচকে ফেললেন। এ দেশ ত্যাগ করে বর্তমানে বাস করেন প্রায় আয়করবিহীন স্বর্গ সুইটয়ারল্যাণ্ডে।

 নাটকীয়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল বাবাফেমি। লাবনী আলম বলতে চাইছে, এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত নাদির মাকালানি। এরপর কার কথা বলবে? প্রেসিডেন্ট?

হামদি জিজ্ঞেস করলেন, এরা কেন শুধু যোডিয়াক নিল? হল অভ রেকর্ডসসের আর সবকিছুর মূল্য তো ব্ল্যাক মার্কেটে কয়েক শ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবে বলে যোডিয়াক লুঠ করেনি, বলল লাবনী। ল্যাপটপে সংযুক্ত পাশের টিভিতে বেলার ভোলা একটা ছবি আনল। ওটা চতুর্থ প্যাপিরাস স্ক্রল। এটা ওসাইরিয়ান টেম্পল গোপন করেছে আইএইচএ থেকে। এখানে লেখা, ওই যযাভিয়াক ওসাইরিসের পিরামিডের মূল চাবি। ওটাই চেয়েছে লুঠেরা-দল। পিরামিডের ভেতরের সব সম্পদ চাই তাদের।

টিটকারির হাসি হাসল বাবাফেমি। ওসাইরিসের পিরামিড? মিনিস্টার, হামদি, আপনারা এখনও শুনছেন এই বদ্ধউন্মাদ মহিলার কথা? ওটা তো পুরাণের কল্পকাহিনী! বাস্তববুদ্ধি আছে এমন কেউ এসব শুনলে হাসবে!

আপনি যার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন, সে কিন্তু মনে করে সত্যিই আছে ওসাইরিসের পিরামিড! পাল্টা জবাব দিল লাবনী।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পেটমোটা, প্রায়-টাক পড়া বাবাফেমি। ফুঁসে উঠে বলল, বিদ্বেষমূলক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে এই কপট মহিলা আর্কিওলজিস্ট! কোনও প্রমাণ নেই, তবুও যা খুশি বলছে! ডক্টর আলম, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে আদালতে!

বসে পড়ো, বাবাফেমি, বললেন হামদি। আহত চেহারা করে বসের নির্দেশ মেনে বসল বাবাফেমি। ডক্টর আলম, দয়া করে এরপর থেকে প্রমাণ হাতে নিয়ে অভিযোগ তুলবেন। জটিল লুঠের ব্যাপারে তদন্ত করছি আমরা। যারা এসবে জড়িত, ঠিকই শাস্তি পাবে, এতে মনে কোনও সন্দেহ রাখবেন না। তবে যথেষ্ট প্রমাণ না পেলে উচিত নয় কোনও সিদ্ধান্তে যাওয়া।

আপনারা যখন ফুলস্কেল তদন্তে নামবেন, ততক্ষণে ডাকাতের দল সরিয়ে ফেলবে ওসাইরিসের পিরামিডের সব মূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট, মুখ খুলল রানা।

ডেস্কে দুহাত রাখলেন মন্ত্রী কোন্তার। আমরা কাজে নেমে পড়তে দেরি করব না। ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধরা হবে, বিচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে না কেউ। সবাইকে দেখে নিয়ে লাবনীর ওপর স্থির হলো তাঁর চোখ। পরক্ষণে কঠোর দৃষ্টিতে দেখলেন বাবাফেমিকে। রানা টের পেল, ঘুষখোর লোকটাকে সন্দেহ করছেন মন্ত্রী। ঠিক আছে, এবার যে যার মত যেতে পারেন। অনেক কাজ পড়ে আছে, ডক্টর হামদি।

রানা, লাবনী ও বেলাকে আঙুল তুলে দেখালবাবাফেমি। স্যর, গ্রেফতার করা হবে না এদেরকে?

এ ডাকাতিতে জড়িত বলে মনে হলে গ্রেফতার করতে হয় সবাইকেই, ধমকের সুরে বললেন ইউসুফ কোন্তার, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে গ্রেফতার করা উচিত আপনাকে! এঁরা মিথ্যা বলেননি, মিশরে এসেছেন গতকাল। কিন্তু হল অভ রেকর্ডসসে যাওয়ার ওই সুড়ঙ্গ নতুন করে খুঁড়ে নেয়া হয়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। এবার এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। আপনারা সবাই।

হাত তুলে দরজা দেখিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী। একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল প্রায় সবাই। তবে ডেস্কের কাছে রয়ে গেছে বেলা, কাকুতির সুরে বলল, এক্সকিউয মি, মিনিস্টার?

কড়া চোখে ওকে দেখলেন কোন্তার। বাচ্চা মেয়েটার চোখে অনুরোধ দেখে নরম হলো তার চোখের দৃষ্টি। তোমার জন্যে কী করতে পারি, পিচ্চি মেয়ে?

ল্যাপটপের দিকে দেখল বেলা। টিভির পাশেই হল অভ রেকর্ডস থেকে সংগ্রহ করা সব প্রমাণ। তার ভেতর রয়েছে ওর ক্যামেরা। আমি কি ফেরত পাব আমার ক্যামেরাটা?

আপাতত প্রমাণ হিসেবে রাখা হয়েছে, সরি, বললেন মন্ত্রী।

ও। থরথর করে কাঁপল বেলার নিচের ঠোঁট। আমার দাদা-দাদীর জন্যে ছবি আর ভিডিয়ো তুলেছি, সব ওখানে… গভীর বিষাদ ওর মুখে। তারা এ দেশ থেকেই গেছেন আমেরিকায়। আজও ভালবাসেন এ দেশকে প্রাণের চেয়েও বেশি। জানতে চেয়েছিলেন কেমন আছে…।

সরি, আবারও বললেন মন্ত্রী। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্যামেরা ফেরত দিতে পারব না। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তবে ওটার মেমোরি কার্ডের কপি দিতে পারি ডিভিডিতে। তাতে সবই দেখতে পাবেন তোমার দাদু ও দাদীমা।

খুশির হাসি হাসল বেলা। তাতেই হবে! অনেক-অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার কোন্তার।

কাউকে দিয়ে কপি করিয়ে দিচ্ছি, এবার হলো তো? স্নেহের সুরে বললেন মন্ত্রী। তাঁর নাতনি বয়সে বেলার সমানই।

অনেক ধন্যবাদ, দুর্দান্ত ভাল মানুষ আপনি, মিষ্টি হেসে বলল বেলা।

অদ্ভুত প্রশংসা পেয়ে নাখোশ হলেন না মন্ত্রী।

বেলা অফিস থেকে বেরোতেই লাবনী বলল, কী করছিলে ভেতরে?

হাসল বেলা। এখনও সম্ভব যোডিয়াকের ভিডিয়ো ক্লিপ পাওয়া।

আদায় করছ কীভাবে? জানতে চাইল লাবনী।

ডেস্কে মিস্টার কোন্তারের নাতনির ছবি দেখেননি? বলেছি, দাদা-দাদীর জন্যে ছবি তুলেছি। মন গলে গেল এই দাদুর। ক্যামেরা ফেরত পেলাম না, তবে ওটার পেটের সবই পাব।

মেমোরি কার্ডের সবই কমপিউটারে কপি করে, তারপর তাদের দরকারী ডেটা ডিলিট করে ডিভিডিতে ভরে তোমার অন্যসব ছবি দিতে পারে দাদা-দাদীর জন্যে, বলল বেরসিক লাবনী।

সেক্ষেত্রে ভিডিয়ো বা সব ছবি পাব না, বলল রানা। তবে ভদ্রলোক এত ভেবে কাজ করবেন বলে মনে হয় না। দেখা যাক।

ভিডিয়ো পেলেও লাভ হবে না, বলল লাবনী, এতক্ষণে এ দেশ থেকে সরিয়ে ফেলেছে যোডিয়াক। তা ছাড়া, আমরা দেখতে পেয়েছি ওটার মাত্র এক টুকরো। ওসাইরিসের পিরামিড, আবিষ্কার করতে হলে লাগবে পুরোটা। নাদির মাকালানির জন্যে সহজই হবে সব বুঝে নেয়া।

অত হতাশ হওয়ার মত কিছু দেখছি না, বলল রানা, একটু আগে আবিষ্কার করেছ হল অভ রেকর্ডস, তারপর জেলখানায় না গিয়ে বেরিয়ে এসেছ মুক্ত বাতাসে। এবার দেখা যাক, খুঁজে পাও কি না ওসাইরিসের পিরামিড!।

লোকগুলো যোডিয়াক কোথায় নেবে, তা নিয়ে আলাপ করছিল, উত্তেজিত সুরে বলল বেলা।

তবে করাতের আওয়াজে কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা, আগুনে পানি ঢালল লাবনী।

বারান্দা থেকে বহু দূরের নীলাকাশ দেখল রানা। আমি বোধহয় জানি, কার সাহায্য নিলে বেরোবে কোথায় গেছে যোডিয়াক।

তোমাকে আবারও দেখে খুব ভাল লাগছে, লাবনীকে জড়িয়ে ধরল সুন্দরী জাবাইরাহ্ আহদি। দেড় বছর আগের মতই এখনও ফুলে আছে পেট। নতুন করে সন্তান-সম্ভবা। নয় মাস আগে ইরানিয়ান সরকারের চাকরি নিয়ে মিশরে এসেছে। নতুন খরর কী? কী আবিষ্কার করলে এবার?

কিছুই না!

ভয়ঙ্কর অর্থ-পিশাচ, চরম নিষ্ঠুর, কবর-লুঠেরা আরাশ খানসারির কাছ থেকে আটলান্টিসের দরকারি এক আর্টিফ্যাক্ট কিনতে ইরানে গিয়ে মস্ত বিপদে পড়েছিল রানা, লাবনী ও মউরোস। তখন জাবাইরাহ্ আহদির সাহায্য নিয়েছিল ওরা। সেই অভিযানেই প্রথমবারের মত লাবনী জেনেছিল, দুনিয়া জুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশে আছে রানার বান্ধবী! তারা কোনও না কোনও বিপদে সাহায্য পেয়েছে বলেই কৃতজ্ঞ বাঙালি অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি। তাই সাহায্য করতে মুখিয়ে থাকে।

পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, পরের বিশটা ছেলেমেয়েরও বাবা, আমার স্বামী, খালিদ জামসি, কালো ঝোপ সদৃশ চুলের দুর্দান্ত সুপুরুষ মিশরীয় এক যুবককে দেখাল জাবাইরাহ্।

মুচকি হাসল যুবক। সব মিলে বাইশটা? সংসারের জন্যে যে টাকা চাইবে, পাগল হয়ে পালিয়ে যাব! রানা, লাবনী ও বেলার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল সে।

কাজের কথায় আসা যাক, বলল জাবাইরাহ্। রানা ফোনে বলেছে, স্ফিংসের নিচে পাঁচ হাজার বছরের এক দালানে আটকা পড়েছিল। ভুরু কপালে তুলল সে। এসব অবশ্য রানার জন্যে কিছুই না। মহাবিপদ না হলে নষ্ট হয়, ওর রাতের ঘুম!

আসলে বেলার কারণেই এখানে আসা, বলল লাবনী। ও জেনে গিয়েছিল, লুঠ হবে হল অভ রেকর্ডস। হাতের ডিভিডি-আর দেখাল। কথা রেখেছেন মন্ত্রী কোন্তার। কপি করিয়ে দিয়েছেন ক্যামেরার মেমোরি কার্ডের সব। এটার ভেতর ডাকাতির ভিডিয়ো আছে।

চোখদুটো জ্বলে উঠল জামসির। প্রত্নতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি নিলেও কাজ করে সে দৈনিক পত্রিকায়। তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল জাবাইরাহ্। আগেই বলেছি, ঘুণাক্ষরেও এসব লেখা চলবে না পত্রিকায়।

জামসি কী ধরনের সাহায্যে আসবেন? জানতে চাইল লাবনী।

এ কথায় মেসেঞ্জার ব্যাগ থেকে অ্যাপল ল্যাপটপ বের করল যুবক। কি-বোর্ডের বাটনগুলোয় সেঁটে রাখা নানান রঙের লেবেল। প্রফেশনাল ভিডিয়ো এডিটিং সফওয়্যারের শর্টকাট, মুচকি হাসল সে। এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, দুনিয়ার কোন কাজে আমি আসব না?

হোটেল ঘরে রানার বিছানায় বসে পুরো আধঘণ্টা ডিভিডির সব ভিডিয়ো নিয়ে কাজ করল মিশরীয় যুবক, তারপর সোজা করল পিঠ। টের পেল, কাঁধের ওপর দিয়ে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে ওর বউ, লাবনী ও বেলা।

জানতাম, আমার কোলনের গন্ধে পাগল হয়ে ছুটে আসে মেয়েরা, চওড়া হাসি দিল জামসি। তবে কাজ করতে হলে একটু বাতাসও পেতে হবে।

সরি, পিছিয়ে গেল লাবনী। কী দেখবে ভাৰতে গিয়ে কৌতূহলে মরছে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও টেবিল ফ্যানের কাছ থেকে সরল বেলা।

এখনও সফল হয়নি জামসি। শুধু সামান্য বড় করতে পেরেছে ইমেজ। বেলার ক্যামেরার ভিডিয়ো মোড ডিযাইন করা ইন্টারনেট-ফ্রেণ্ডলি ছোট ক্লিপের জন্যে। জিনিসটার সাধ্য ছিল না হাই-ডেফিনেশন ফুটেজ তুলৰে। উজ্জ্বল আলোয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে, এদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাদির মাকালানি ও বাবাফেমি।

রানা বুঝতে পারছে, যত শক্তিশালী সফটওয়্যার হোক, যতই চালু হোক ইউযার, ডিজিটাল ইনফর্মেশন না পেলে কিছুই করার নেই।

অবশ্য; আরেকটু পর অডিয়োর বিষয়ে কপাল খুলল জামসির। ইয়ারফোন পরে রেকর্ডিং অ্যাডজাস্ট শেষ করে ব্যবহার করছে ফিল্টার। করাতের আওয়াজ এখন সামান্য, একটা উইণ্ডোয় কম্পমান ওয়েভফর্ম দেখাল। পুরো গায়েব করতে পারছি না। তবে এখন শুনতে পাব তাদের কথা।

তুমি শুনলেই হবে? মুখ গোমড়া করল জামসির বউ। আমাদেরকে শুনতে দাও!

স্ত্রীর ধমকের ভয়ে নিজের কানের একটা ইয়ারফোন তার হাতে দিল জামসি। ওটা বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে নিয়ে কানে পুরল জাবাইরাহ্।

সবই দেখেছি, নালিশের সুরে বলল জামসি।

 কী দেখেছ?

এইমাত্র আমার ইয়ারবাড মুছে নিয়েছ।

চাই না তোমার কানের মোম আমার কানে ঢুকুক।

আমার কানে ওই জিনিস নেই!

হ্যাঁ, তোমরা বিবাহিত, তাতে সন্দেহ নেই, হাসল লাবনী।

অডিয়োতে কী বলছে ওরা? জানতে চাইল রানা।

কিছুক্ষণ শুনল জাবাইরাহ, তারপর বলল, ডানদিকের লোকটা বাবাফেমি, খুব চিন্তিত, সঠিক সময়ে পরিষ্কার করা যাবে কি না হল অভ রেকর্ডস। কেউ সন্দেহ করলে সব দোষ পড়বে তার কাঁধে। নালিশ করছে আসলে। আবার শুরু হলো অডিয়ো। চুপ করে শুনছে স্বামী-স্ত্রী।

আর কী বলছে লোকগুলো? জানতে চাইল বেলা।

 এখনও নালিশ চলছে! চুপ হয়ে গেল জাবাইরাহ্। একটু পর বলল, হ্যাঁ, বলছে ওসাইরিসের পিরামিডের ব্যাপারে। অন্য লোকটা, নাদির মাকালানি, সে বলছে ওটা অবশ্যই তাদেরকে পৌঁছে দেবে ওখানে। তারা… ভালভাবে শুনলাম না। ডিসপ্লের ওয়েভফর্ম লাফ দিয়েছে ড্রিল মেশিনের আওয়াজে। জামসি, পিছিয়ে যাও তো! …বলছে… গ্রহ আর নক্ষত্রের কথা… কিন্তু ঠিক শুনতে পাচ্ছি না। কীসের সঙ্গে যেন তুলনা করে দেখতে চায় যোডিয়াকের।

আবারও রেকর্ডিং চালু করল জামসি। আওয়াজ শুনতে শুনতে ভুরু কুঁচকে ফেলল বিরক্ত জাবাইরাহ্। অনেক আওয়াজ, তবে মনে হয় যোডিয়াকটা তুলনা করবে… ডেনডারা কনস্টেলেশনের সঙ্গে?

ডেনডারা নামে কোনও কনস্টেলেশন নেই, অন্তত আমি কখনও শুনিনি, বলল লাবনী।

ডেনডারা কোনও কনস্টেলেশন নয়, বলল বেলা। ওটা একসময়ে ছিল মিশরের ওপরদিকের প্রাদেশিক রাজধানী। ওখানেই আছে হাথোরের মন্দির… বুঝতে শুরু করেছে সব।

বুঝে গেছে লাবনীও। ওই লোক ডেনডারা এলাকার কথা বলেনি, বলেছে ডেনডারা যোডিয়াক!

ডেনডারা যোডিয়াক কী? জানতে চাইল রানা।

এবার বলল বেলা, ওটা টেম্পল অভ হাথোরের ছাতে একটা নক্ষত্রের মানচিত্র।

আগে মন্দিরের সিলিঙে ছিল আসল যোডিয়াক, বলল লাবনী, এখন আছে নকল। আসলটা লুঠ করেছিল সতেরো শ নব্বই সালে নেপোলিয়ন।

রেকর্ডিং পয করল জামসি। এরা তা হলে ডেনডারা যাচ্ছে? হয়তো ওদের আগেই ওখানে পৌঁছতে পারবেন।

মাথা নাড়ল লাবনী। তাতে কাজ হবে না। নকলটা প্রায় আসলের মত হলেও ওই দুটো এক জিনিস নয়। এরা চাইবে স্ফিংসের যোডিয়াকের সঙ্গে সত্যিকারের যোডিয়াক মিলিয়ে দেখতে।

ওটা আছে কোথায়, লুভর মিউযিয়ামে? আন্দাজ করল রানা।

হাসল লাবনী। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *