১৩. ভরা পূর্ণিমা

ভরা পূর্ণিমা। একটু আগে চাঁদ উঠেছে। চরাচরে এখন অপরূপ জ্যোৎস্নার মসলিন। সারান্ডার জঙ্গল সেজেছে রুপোলি সাজে। হালকা হালকা বাতাস বইছে। শাল সেগুন মহুয়ার বনে থিরথির কাঁপন।

ইনস্পেকশন বাংলোর লনে গোল হয়ে বসে গল্প করছিল টুপুররা। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর।

দূরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সহেলি বললেন, কী অপূর্ব লাগছে দেখতে, তাই না? ঠিক মনে হচ্ছে গোটা জঙ্গল যেন গয়নাগাঁটি পরে ঝলমল করছে। আহা, চক্ষু আজ সার্থক হল।

অবনী বললেন, আমার কিন্তু চক্ষু আগেই সার্থক হয়েছে। মিতিনের কেরামতি দেখে।

মিতিন লাজুক মুখে বলল, ধুস, কেরামতি কীসের? ঘটনার পরম্পরাগুলো স্টাডি করলেই ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। আর আমি তো বেশ কয়েকখানা সূত্রও পেয়ে গিয়েছিলাম।

টুপুর বলল, আমি বলব কী কী সূত্ৰ?

বল।

যেমন ধরো, ঝিনিকপানিতে মোটরসাইকেলের চালকটিকে দেখেই তোমার খুব স্ট্রাইক করেছিল। মনে হয়েছিল লোকটা খুব চেনা চেনা।

এটাকে কি ঠিক সূত্র বলা যাবে? মিতিন মৃদু হাসল, কারণ লোকটা তো আমার চেনা ছিল না। বহুকাল আগে খবরের কাগজে গৰ্জন রায়ের একটা ছবি বেরিয়েছিল, ছবির সেই মুখটাই আমার স্মৃতিতে ছিল আবছা-আবছা। আর তাই কোথায় দেখেছি, কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিলাম না। বরং বটল-ওপেনারটাকেই ক্লু হিসেবে ধরা যায়। এই ছোট্ট জিনিসটাই তো আমার স্মৃতিকে ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দিল।

পার্থ বলল, বট্‌ল-ওপেনার, মানে যেটা তুমি বাংলো থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলে?

হুম। মিতিন ঘাড় নাড়ল, বটল-ওপেনারটার গায়ে লেখা ছিল এলিফ্যান্ট ফেস্টিভ্যাল, নাইনটিন নাইনটিটু, কিনিয়া। ওটা দেখেই মনে পড়ে গেল কিনিয়ায় হস্তি-উৎসবের পরপরই কিনিয়ার নাকুরুতে গর্জন রায় নামের লোকটা ধরা পড়েছিল। কাগজে মোটামুটি ডিটেলেই বেরিয়েছিল খবরটা। যতদূর মনে আছে, হেডিং ছিল গজদন্ত পাচারের দায়ে বিদেশে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার গ্রেফতার। মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটাও চোখের সামনে ভেসে উঠল। আরে, সেই লোকই তো এই লোক! হাতি মারতে সারান্ডায় হানা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল গর্জন রায়! তাও গর্জন রায়ের বর্তমান খবরাখবর জানার জন্য মেঘাতুবুরু গিয়ে ফোন করলাম অনিশ্চয়বাবুকে। উনি আমার কাছে ঘন্টাখানেক সময় চেয়ে নিলেন। তারপর ইন্টারনেট আর পুলিশ ফাইল ঘেঁটে কনফার্ম করলেন বছর দেড়েক আগে কিনিয়ার জেল ভেঙে পালিয়েছে গর্জন রায়। অতএব সে ভারতে চলে আসতেই পারে। তোমাদের হয়তো মনে আছে, গত বছর নর্থ বেঙ্গলে দুটো হাতিকে মেরে গজদন্ত লুঠ করা হয়েছিল। সম্ভবত ভারতে গর্জন রায়ের এটাই প্রথম কীর্তি।

পার্থ বলে উঠল, গর্জন রায় নর্থ বেঙ্গলের লোক বলেই কি প্রথমে ওখান থেকে অপারেশন শুরু করেছে?

নিশ্চয়ই তাই। স্থানীয় জঙ্গলের টোপোগ্রাফি ভাল করে জানা না থাকলে সেখানে চোরাশিকার চালানো সম্ভব নয়।

কিন্তু মুকুল সিংহ এর মধ্যে এল কী করে?

আমারও এটা নিয়ে প্রথমে খটকা ছিল। মুকুল সিংহকে আপাত চোখে দেখে ভালমানুষ বলেই তো মনে হয়।

বটেই তো! অবনী বললেন, মুকুল সিংহ এর মধ্যে থাকবে, আমি কল্পনাই করতে পারিনি।

আমিও একে একে দুই, দুয়ে দুয়ে চার করলাম অনেক পরে। গৰ্জন রায়ের অতীত জীবন সম্পর্কে ভাবতে গিয়েই মুকুল সিংহর সঙ্গে তার যোগাযোগের সম্ভাবনাটা মাথায় খেলে গেল। গর্জন রায় আই-আই-টির ছাত্র ছিল, মুকুল সিংহ ওখানকারই স্টুডেন্ট হস্টেলের কর্মচারী। আমি শিওর গর্জন রায় যে হস্টেলে থাকত, মুকুল সিংহ সেই হস্টেলেরই স্টাফ।

তো? গৰ্জন রায় তো বহুকাল আগে পাশ করে গেছে, মুকুল সিংহর সঙ্গে তার যোগাযোগ হল কীভাবে?

মনে রেখো, গর্জন রায় একজন ক্রিমিনাল হলেও সে কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। তার মাথাও অত্যন্ত সাফ। এক বছর নর্থবেঙ্গলে বদমাইশি করেই সে বুঝতে পেরেছে এবারে তাকে জায়গা পালটাতে হবে। কারণ বন দফতর ওখানে এখন অ্যালার্ট হয়ে। গেছে। তা ছাড়া ওখানে তার চেনাজানার সংখ্যাও অনেক, অতএব ওখানে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। অন্য কোন জঙ্গলে অপারেশন শুরু করা যায় ভাবতে গিয়েই সম্ভবত মুকুল সিংহর কথা মাথায় আসে গৰ্জন রায়ের। মুকুল সিংহর বাড়ি যে প্রায় সারান্ডাতেই, এটাও যেমন জানত গর্জন, সঙ্গে সঙ্গে মুকুলের নেচারটাও তার অজানা ছিল না।

মুকুল সিংহর নেচার? মানে?

মুকুল সিংহ একজন পাঁড় জুয়াড়ি। ছেলেবেলা থেকেই কুসঙ্গের প্রতি তার টান প্রবল। কুসঙ্গে পড়ে একবার বাড়ি থেকেও পালিয়েছিল। খড়্গপুরে পাঠিয়েও ছেলের চরিত্র বদলাতে পারেননি পুরুষোত্তম। তবে তিনি শক্ত ধাতের মানুষ, বিজনেস বাঁচানোর জন্য মুকুলকে কাজকারবারের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেননি। মুকুলের যে কিছু একটা বদ নেশা আছে, এই সন্দেহটা আমার চাইবাসাতেই মাথায় উঁকি মেরেছিল। অনন্ত চ্যাটার্জির কথায়। জুয়াড়িরা অসম্ভব লোভী হয়, গৰ্জন রায় লোকচরিত্ৰ ভালই বোঝে, তাই মুকুলকেই সে সারান্ডা অভিযানের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। সে ভালই জানত সারান্ডা অঞ্চলে সিংহপরিবারের যথেষ্ট প্ৰতাপ আছে, আর তাই মুকুলের মাধ্যমে হাতির দাঁত পাচার তার পক্ষে সহজ হবে।

অবনী বললেন, কিন্তু মুকুল সিংহর জুয়ার নেশা আছে তুমি বুঝলে কী করে?

ওই যে বললাম একে একে দুই, দুয়ে দুয়ে চার করতে করতে। সেদিন রাতে সিংহমশাই নামটি শোনার পর থেকেই আমি ভাবতে শুরু করি এই সিংহটি কে হতে পারে। পুরুষোত্তম সিংহ? ভদ্রলোকের সুনাম যেমন আছে, বদনামও তো আছে। তারপর মনে হল যে মানুষ খ্যাতি আর সম্পদের চূড়ায় উঠে গেছেন, তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে হঠাৎ হাতির দাঁত চুরির কাজে নামতে যাবেন কেন? তাও আবার অন্য কারুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে? নাহ্, পুরুষোত্তমের চরিত্রের সঙ্গে একাজটা মেলানো যায় না। তাহলে দ্বিতীয় সন্দেহের লোক বিকাশ সিংহ। বিকাশ অত্যন্ত উদ্ধত ধরনের। দাম্ভিক। জঙ্গলেও তার নিয়মিত আনাগোনা। তার দিকেই সন্দেহের তীর যাওয়াটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে পাগলা হাতি মারাটাকে সে যখন তেমন অন্যায় বলে মনে করে না। পাশাপাশি আর একটা চিন্তাও মনে এল। বিকাশ তার দাদার তুলনায় জীবনে অনেক বেশি সফল, ব্যর্থ দাদার ওপর তার তো কিছুটা করুণাই থাকা উচিত। অথচ দাদার ওপর তার যথেষ্ট বিতৃষ্ণা, এমনকী সে দাদার বন্ধুবান্ধবদেরও পছন্দ করে না। নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে এর পেছনে। আগুন ছাড়া তো ধোঁয়া হয় না। বটল-ওপেনারটা হাতে আসার পর থেকে আই-আই-টির ব্যাপারটা তো মাথায় ঘুরছিলই, মুকুল সিংহর নেচারটা কনফার্ম করার জন্য আমি মেঘাতুবুরু থেকে চাইবাসার অনন্ত চ্যাটার্জিকেও ফোন করেছিলাম। সেদিনও অনন্তবাবু চেপে যেতে চাইছিলেন, পরে কিছুটা খুলে বলতে ওই টিপসটা আমায় দিয়ে দিলেন। মুকুল সিংহ আগে পরিবারের টাকাপয়সাও অনেক নষ্ট করেছে, এবং এই নিয়ে বিকাশের সঙ্গে তার বহু ঝগড়াঝাটিও হয়েছে এমন একটা ইম্পর্ট্যান্ট সংবাদও আমায় সাপ্লাই করলেন অনন্তবাবুই। ব্যস, আমার অঙ্কটাও অনেকটা এগিয়ে গেল। তারপর থলকোবাদ ফিরে যখন শুনলাম মুকুল সিংহ থলকোবাদে এসেছে, তখন তো হিসেব প্রায় কমপ্লিট।

টুপুর পুট করে বলে উঠল, হ্যাঁ, মুকুলবাবু খুব মিথ্যে কথা বলেন।

কী করে বুঝলি?

সেদিন থলকোবাদে এসে বললেন তাঁর পরিচিত ভদ্রলোকরা নাকি খড়্গপুর থেকে টানা জিপে এসেছেন। অথচ জিপের নাম্বারটা পশ্চিমঙ্গের নয়, ঝাড়খণ্ডের।

আগে বলিসনি কেন?

লজ্জা লজ্জা মুখে টুপুর বলল, তখন মাথায় আসেনি, এক্ষুনি মনে এল।

এই খুঁটিনাটিগুলোই তো আগে লক্ষ করা উচিত। মিতিন ভারিক্কি স্বরে বলল, গাড়ির নাম্বার ছাড়া আর কিছু মনে আসছে? মুকুলবাবুর সম্পর্কে?

টুপুর মাথা চুলকে বলল, আর কী বলো তো?

লোকটা বারবার আমাদের সারান্ডার জঙ্গলে থাকতে নিষেধ করছিল। হার্ডকোর ক্রিমিনাল তো নয়, কিছু টাকার লোভে এ-কাজে নেমেছে…তাই পাছে আমরা ওকে জঙ্গলে আবিষ্কার করে ফেলি এই অস্বস্তিটা ওর মনে কাজ করেছে। ইনফ্যাক্ট আমরা ওকে আদৌ সন্দেহ করছি কি না সেটা বুঝতেই ওর থলকোবাদে আসা।

পার্থ বলল, যাহ, শুধু এইজন্য থলকোবাদ আসবে কেন? অপারেশনের খোঁজখবর নিতেও জঙ্গলে এসেছিল।

সে তো বটেই। লিগিরদা থেকে নুনের বস্তা হাপিস হয়ে যাওয়ার খবরটা মুকুল পেয়েছিল। আর সে কাজটা আমরাই করেছি কি না, অথবা আমরা আদৌ কিছু টের পেয়েছি কি না বুঝে নিতে এসেছিল। গর্জন রায়ের মতো ঝানু তো নয়, তাই বোঝেনি ওর ওই হঠাৎ দর্শন দেওয়াটা বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।

সহেলি বললেন, মুকুল সিংহর ব্যাপারটা নয় বুঝলাম, কিন্তু গৰ্জন রায়ের মতো পাকা ক্রিমিনাল হঠাৎ মধুবাবা সেজে বসেছিল কেন বল তো?

এটা বোঝা তো খুব সহজ বড়দি। হাতি মারা হবে সারান্ডার জঙ্গলে, হাতির দাঁত চালান যাবে সারান্ডা দিয়ে, সুতরাং এদিকে তো ওর এক দেড় মাস ঘাঁটি গাড়া দরকার। উটকো লোকের মতো জঙ্গলে ঘোরাফেরা করলে লোকের মনে সন্দেহ হবেই, তাই ওই ভেক। মধুবাবা সেজে আদিবাসীদের মন জয় করে সবার চোখের সামনেও থাকল, এবং কেউ ওকে সন্দেহও করল না। করমপদা থেকে অপারেশনের প্রস্তুতি চালানোটাও তো অনেক সোজা।

পার্থ বলল, হা হা, ব্যাটা সাধু সেজে থাকলেও মুরগি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারত না। দাড়ি গোঁফ খুলে, গেরুয়া বসন ছেড়ে মোটরসাইকেলে করে মুরগির খোঁজে বেরোত।

শুধু মুরগি কেন, শিষ্যর বাড়ি যাওয়ার নাম করে গর্জনবাবু আর গর্জনবাবুর চ্যালারা মোটরসাইকেলে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াত। স্ফূর্তি করার ব্যাপারটা তো ছিলই, তবে খবর কালেকশনও ছিল অন্যতম কাজ। ঝিনিকপানিতে যেদিন ওদের সঙ্গে দেখা হল, পরে কিরিবুরুতেও, সেদিন শিওর ওদের একটা আরজেন্ট মিটিং ছিল। সম্ভবত জামদার কাছেপিঠেই। কারণ মুকুল সিংহও ছিল সেই মিটিং-এ। পরে গর্জনবাবু চ্যালাকে নিয়ে মেঘাতুবুরুতে রাতে একটু আসর জমাতে যান।

সত্যি, এখন সব একেবারে জলের মতো পরিষ্কার। পার্থ একটা হাই তুলল, চলো, গর্জন মুকুল ছেড়ে এবার আমরা শুতে যাই। কাল সক্কাল-সকাল তো আবার রওনা দিতে হবে।

ইস, কী ঝড়ের মত পাঁচটা দিন চলে গেল। সহেলি বললেন, আবার সেই কলকাতায় ফিরে হাঁড়ি ঠ্যালো।

অবনী বললেন, ছখানা বই এনেছিলাম, দুটোও তো শেষ হল না।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, জঙ্গল আর সমুদ্রের পরে আর কী কী আছে আপনার কাছে? পাহাড় ও মহাশূন্য?

প্রশ্নের ভঙ্গিতে মিতিন সহেলি হেসে কুটিপাটি।

টুপুর হাসছিল না। কারুর কথাও শুনছিল না। তার উদাস চোখ জ্যোৎস্নামাখা জঙ্গলে স্থির। বিষণ্ণ মনে হাতিটার কথা ভাবছিল টুপুর। হাতিটার সেই নিষ্প্রাণ চোখ দুটোর কথা সে ভুলতে পারবে না কোনওদিন। ইস্, কেন যে কিছু কিছু মানুষ এমন হৃদয়হীন হয়!