০৬. ভাস্কৰ্য্য ও চিত্রকলা

০৬. ভাস্কৰ্য্য ও চিত্রকলা

ধীমানের ভাস্কৰ্য্য

মনের ভাব প্রকাশিত করিবার জন্য মানুষ অনেক রকমের কৌশল বিস্তার করিয়া থাকে। তাহাকে স্থায়িত্ব-প্রদানের আশায় পুরাকালে যে সকল কৌশল অবলম্বিত হইয়াছিল, স্থাপত্য, ভাস্কৰ্য্য ও চিত্র তন্মধ্যে একশ্রেণীর কৌশল বলিয়া কথিত হইতে পারে। তাহাও ভাষা; কেন না, তাহাও “ভাষতে অনয়া লোকঃ”–এই নিরুক্তির অন্তর্গত। সুতরাং পাষাণে যে সকল কারুকাৰ্য্য ও মূৰ্তিচিত্র অঙ্কিত হইত, তাহাকেও ভাষা বলিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে। তাহারও ব্যাকরণ আছে, রচনারীতি আছে, অলঙ্কার আছে;-পদ্য গদ্যেরও অসদ্ভাব নাই। যাঁহারা অক্ষরযোজনা করিয়া কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারাই সে কালের একমাত্র কবি ছিলেন না;–যাঁহারা বাটালি চালাইয়া পাষাণফলকে চিত্রাঙ্কন করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে কবিপদবাচ্য হইবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। তাঁহাদের নাম গোত্র বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে;–অনেক স্থলে তাঁহাদের কাব্যকাহিনীও বিলুপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু এখনও তাঁহাদের ও তাঁহাদের এই শ্রেণির কাব্যসৌন্দর্য্যের কিছু কিছু নিদর্শন বর্তমান আছে।

আমাদের চতুষ্পঠীতে “অভিজ্ঞানশকুন্তলে’র বড়ো আদর ছিল না; বরং ‘অনর্ঘরাঘবে”র “প্রবোধচন্দ্রোদয়ের কিছু কিছু আদর থাকিবার পরিচয় টীকা টিপপনীতে দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের চতুম্পাঠীর ছাত্রগণের মধ্যে একটি প্রবচন প্রচলিত ছিল :

রঘুরপি কাব্যং তদপি চ পাঠ্যম?

রঘুবংশ আবার কাব্য, তাহাও আবার পাঠ্য নাকি?–এই প্রবচন-বাক্যেই। আমাদের দেশের এক সময়ের সমালোচকবর্গের অভিপ্রায় ব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। স্যার উইলিয়ম জোন্স ‘শকুন্তলা’র ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত করিলেন,–গেটে তাহার প্রশংসাবাদে পাশ্চাত্য আকাশ প্রতিধবনিত করিয়া দিলেন;–আমাদের কালিদাস এইরূপে যখন জগতের কালিদাস হইলেন, তখন আমাদেরও নাসিকা কুঞ্চনের নিবৃত্তি হইয়া গেল! ভাস্কৰ্য্য এখনও সম্পূর্ণরূপে এই নাসিকা-কুঞ্চনের হাত হইতে অব্যাহতি লাভ করিতে পারে নাই। আমাদের ভাস্কৰ্য্য আবার ভাস্কৰ্য্য, –তাহার মধ্যে সৌন্দর্য্যের অনুসন্ধান করিয়া কি হইবে? এইরূপ অবজ্ঞার ভাব হইতে আমরা এখনও সম্পূর্ণরূপে মুক্তিলাভ করিতে পারি নাই। এ সময়ে আমাদের ধীমানকে আমাদের পক্ষে চিনিয়া লইবার সম্ভাবনা নাই। শ্ৰীযুত হাভেল তাঁহাকে চিনাইয়া দিবার চেষ্টা করেন নাই;–কেবল প্রসঙ্গক্রমে সেই মহাকবির নামোল্লেখ করিয়া গিয়াছেন।

এক শ্রেণির প্রাচ্য ললিতকলা পাশ্চাত্য প্রদেশেও প্রশংসা লাভ করিয়াছে। তাহার মূলপ্রকৃতির অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইয়া, সুযোগ্য সমালোচকগণ বুঝিতে পারিয়াছেন,–তাহা যতই সুন্দর হউক, এক ছাঁচে ঢালা। সেই ছাঁচটি কত পুরাতন,–কোথা হইতে সংগৃহীত, তাহারও অনুসন্ধান আরব্ধ হইয়াছে। যত দূর জানা গিয়াছে, তাহাতে তাহার ভাষা–তাহার ছন্দ–তাহার রচনাকৌশল–এক স্থান হইতে প্রসূত হইয়াছিল বলিয়াই বুঝিতে পারা গিয়াছে।

সে স্থান কোথায়? তাহা আমাদিগেরই গৃহের কোণে,-বরেন্দ্রের এক নিভৃত নিকেতনে,–পাল নরপালগণের বিজয়রাজ্যের ধবংসাবশেষের মধ্যে লুকাইয়া রহিয়াছে। তাহা মহাকবি ধীমানের জন্মভূমি,-বাঙ্গালীর গৌরবক্ষেত্র। সাহিত্যে “বরেন্দ্র প্রস্তর’ সম্বন্ধে হেমস্বামীর মন্তব্য লিপিবদ্ধ হইবার সময়ে ধীমান “নৃপতি” বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। ইহা সৰ্ব্বথা যুক্তিযুক্তই হইয়াছে। যাঁহাদের রাজ্য কতকগুলি পরগণার সমষ্টি ভিন্ন আর কিছু ছিল বলিয়া গৌরব লাভ করিতে পারে না, তাঁহারা যদি রাজা বলিয়া ইতিহাসে উল্লিখিত হইতে পারেন, তবে ধীমানকে রাজাধিরাজ বলিলেও অত্যুক্তি হইতে পারে না। ধীমান কোনও রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন নাই; কোনও ভূমিখণ্ডের করসংগ্রহকাৰ্যেও ব্যাপৃত ছিলেন না। তিনি মানব-মনের উপর ভাস্কর্যের রচনাকৌশলের যে মোহজাল বিস্তৃত করিয়াছিলেন, তাহাতেই তাঁহার দিগ্বিজয় সুসম্পন্ন হইয়াছিল। নেপাল, তিববত, চিন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া ও জাপানে তাঁহারই রচনারীতি অনুসৃত হইয়াছিল;–তাঁহারই কলালালিত্যবিকাশকৌশলে প্রাচ্য শিল্পের প্রবল গৌরব পাশ্চাত্য শিল্পজগতেও প্রতিষ্ঠালাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে।

ধীমান কে ছিলেন, সে কথা কেবল একখানি ইতিহাসেই উল্লিখিত আছে। তাহা কে জন বাঙ্গালী বৌদ্ধ শ্রমণের লিখিত। বাঙ্গালা ভাষায় তাহার সন্ধানলাভের উপায় নাই। ধর্মপ্রচারে উত্তরাখণ্ডে গমন করিয়া শ্ৰমণরাজ তদ্দেশের ভাষাতেই সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। ইংরাজী ভাষায় তাহার একাংশের অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতেই প্রসঙ্গক্রমে শিল্পের কথা,–তাহার সঙ্গে ধীমানের কথা, লিখিত হইয়া রহিয়াছে। এই বাঙ্গালী শ্রমণের নাম তারানাথ। তাঁহার নাম বঙ্গসাহিত্যেও সুপরিচিত।

শ্ৰীযুত হাভেল লিখিয়াছেন :

বেহার ও ওড়িশার নানা স্থানে যে সকল ভাস্কৰ্য্যকীর্তি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা ধরিয়া আরও তথ্যানুসন্ধান করিতে পারিলে, ধীমানের ও তাঁহার পুত্রের রচনারীতির পরিচয় আবিষ্কৃত হইতে পারে।

বরেন্দ্র প্রদেশে এখনও যে অসংখ্য ভাস্কৰ্য্যকীৰ্ত্তি পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার কথা এ পর্যন্ত সম্যক আলোচিত হয় নাই বলিয়াই, এরূপ সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ হইবার অবসর লাভ করিয়াছে। ধীমানের জন্মভূমি এখনও তাঁহার রচনাকৌশলের নানা নিদর্শন বক্ষে ধারণ করিয়া নীরবে কালযাপন করিতেছে। বরেন্দ্রতত্ত্বানুসন্ধান-সমিতি তাহারও অনুসন্ধানকার্যে ব্যাপৃত হইয়াছেন। যথাকালে তাঁহার ফল প্রকাশিত হইবে।

এই সকল ভাস্কৰ্য্যকীর্তিও যে ইতিহাসের উপাদান,–তাহা এখন সকল দেশেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকৃত হইতেছে। কিন্তু এই শ্রেণির উপাদানের আলোচনা কাৰ্যেও যে স্বাধীন তত্ত্বানুসন্ধানের প্রয়োজন আছে, সে কথা অস্মদ্দেশে এখনও ভাল করিয়া স্বীকৃত হইতেছে বলিয়া বিশ্বাস করিতে সাহস হয় না। এখনও পুস্তকালয়ে বসিয়া সুধীগণের কল্পনা জল্পনা পাঠ করিয়া, তাহারই একাংশের উপর নির্ভর করিবার প্রবৃত্তি প্রবল রহিয়াছে। অনেকেই ভাস্কৰ্য্যকীৰ্ত্তির সমালোচনায় হস্তক্ষেপ করিতেছেন। ইহা সুলক্ষণ হইলেও, অল্প লোকেই স্বাধীনভাবে তথ্যানুসন্ধানের ক্লেশস্বীকারে সম্মত। তজ্জন্য কেহ আমাদের ভাস্কর্যের মধ্যে মাগধ-শিল্পের, কেহ বা চিন শিল্পাদর্শের চিহ্ন আবিষ্কৃত করিতেছেন! আমাদের যাহা কিছু ছিল, না থাকিবার সম্ভাবনা ছিল, তাহার কোনও কিছুর মধ্যেই আমাদের স্বাতন্ত্র্য থাকিবার সম্ভাবনা ছিল না,–এই ধারণাই বাঙ্গালীর ইতিহাস-সংকলনের প্রধান অন্তরায় হইয়া রহিয়াছে। বহু বিষয়ে বাঙ্গালীর ইতিহাসে স্বাতন্ত্রের পরিচয় প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছে; কিন্তু এখনও তাহার প্রকৃত সমালোচনা আরব্ধ হয় নাই। এই সকল বিষয়ের মধ্যে বরেন্দ্র-ভাস্কৰ্য্য একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বরেন্দ্রদেশ বড়ো পুরাতন দেশ,–পুরাতন পৌণ্ড্র বর্ধনের অন্তর্গত,–অতি পুরাকাল হইতে বিবিধ শিল্পকৌশলের জন্য ভারতবিখ্যাত ছিল। এই প্রদেশে নানা যুগের, নানা শ্রেণির ভাস্কর্যকৌশলের নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়। ধীমানের রচনাকৌশলের বিশেষত্ব কিরূপ ছিল, তাহা জানিতে পারিলেই, এই সকল ভাস্কৰ্য-কীৰ্ত্তির মধ্যে ধীমানের কীৰ্ত্তির সন্ধান লাভ করা অনায়াসসাধ্য হইতে পারে। সে বিশেষত্ব আমরা কিরূপে জানিতে পারিব,–তাহাই এখনকার প্রধান জিজ্ঞাসার কথা। যাঁহারা প্রস্তর-শিল্পের বিষয়ে প্রবন্ধ-রচনায় হস্তক্ষেপ করিতেছেন, তাঁহারা এই বিষয়ে আপন আপন মন্তব্য প্রকাশিত করিলে, তথ্যানুসন্ধানের পথ পরিষ্কৃত হইতে পারে। তাঁহারা ইহাতে হস্তক্ষেপ করিবেন কি? আর কিছু না হউক, অনেক রচনাজঞ্জাল হইতে বঙ্গসাহিত্য মুক্তিলাভ করিতে পারিবে।

সাহিত্য, ভাদ্র, ১৩১৭

তথ্যসূত্র

১ Last Chapter of Taranath’s History of Budhism-translated by W.T. Heeley c.s., published in the Indian Antiquary, Vol. IV. p. 101.

২ Further research among the sculptures scattered about Behar and Orissa might lead to the identification of Dhiman’s and Bitpale’s work.

– Havell’s Indian Sculpture and Painting, p. 79.

.

ভারত-চিত্ৰচৰ্চ্চার নববিধানের “অন্তর-বাহির”

ফাল্গুনের ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় ভারত-চিত্ৰচৰ্চ্চার নববিধানের “অন্তর বাহির” বাহির হইয়াছে। মূল বক্তব্য এই যে,–শিল্পী এবং শিল্প শিল্প-শাস্ত্রের অতীত; তাহাকে মানিয়া চলিতে বাধ্য নয়। এ বক্তব্যটুকু অল্প কথায় সুব্যক্ত হইতে পারিত; কিন্তু তাহাতে অন্তর বাহির হইত না।

শিল্প-শাস্ত্র না মানিলে, তাহার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না। কারণ, শিল্পের সঙ্গে শিল্প শাস্ত্রের সম্বন্ধ কাহারও মানা-না-মানার উপর নির্ভর করে না। সংগীত-শাস্ত্র না মানিলেও, সঙ্গীত শব্দায়মান হইতে পারে; ব্যাকরণ না মানিলেও, রচনা অবলীলাক্রমে ছুটিয়া চলিতে পারে;–শিল্পশাস্ত্র না মানিলেও, শিল্পচর্চা রচনা বিকাশ করিতে পারে। কিন্তু তাহা সুধীসমাজে মৰ্যাদা লাভ করিতে পারে না। লোকে যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া মনের ভাবের ভাষণ করে, তাহার নাম ভাষা। তাহা সরব-নীরব-ভেদে দ্বিবিধ। শিল্প এক শ্রেণীর নীরব ভাষা। ভাষা মাত্রেই ব্যাকরণের সাহায্যে “ব্যাকার’ লাভ করে। শিল্পের ব্যাকরণ শিল্প-শাস্ত্র। তাহার অবস্থাও সেইরূপ। আগে ভাষা, তাহার পরে ব্যাকরণ;–আগে শিল্প, তাহার পরে শিল্প-শাস্ত্র। ভাষার সঙ্গে ব্যাকরণের সম্বন্ধের ন্যায়, শিল্পের সঙ্গে শিল্পশাস্ত্রের সম্বন্ধ অভেদ্য। একটিকে ছাড়িয়া অন্যটিকে গ্রহণ করা চলে না। কারণ ভাষা যাহার ভাব-সূত্র, ব্যাকরণ তাহারই ভাষ্যগ্রন্থ;–শিল্প যাহার সৌন্দৰ্য-সূত্র, শিল্প শাস্ত্র তাহারই ভাষ্য-বিকাশ। তাহার উদ্দেশ্য ব্যাকার,–বিশ্লেষ,–বিবৃতি-ব্যবস্থা। এই কারণে, ইংরাজী গ্রামার এবং আমাদের ব্যাকরণ এক শাস্ত্র নয়। উপযুক্ত প্রতিশব্দের অভাবে, আমরা ব্যাকরণকে গ্রামার বলিতেছি, শিল্প-শাস্ত্রকে ক্যানন বলিতেছি। তাহাতে আমাদের ব্যাকরণের বা শিল্প-শাস্ত্রের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয় । আমাদের শিল্প-শাস্ত্রকে শিল্প হইতে পৃথক করিয়া দর্শন করিবার উপায় নাই; –তাহাকে অমান্য করিবার উপায় নাই;–উপহাস করিবারও উপায় নাই। করিলে, পদে পদে উপহাসাস্পদ হইতে হয়।

ভারত-শিল্পের সকল নিদর্শন বর্তমান থাকিলে, নিদর্শন ধরিয়াই তাহার ভাষা বুঝিয়া লওয়া যাইতে পারিত; প্রয়োজন বোধ করিলে, তাহার ব্যাকরণও সঙ্কলন করিয়া লওয়া চলিত। সে পথ লুপ্ত হইয়াছে বলিয়া, ব্যাকরণকে উপেক্ষা করিয়া, প্রাচীন ভাষার মর্মবোধ অসম্ভব পড়িয়াছে। সুতরাং শিল্প-শাস্ত্রকে মানিতে হইবে; মানিবার জন্য জানিতে হইবে;–জানিবার জন্য বুঝিতে হইবে;–বুঝিবার জন্য অধ্যয়নশীল হইতে হইবে।

উপহাস যত সহজ, বুঝিবার চেষ্টা অর্থাৎ অধ্যয়ন করা সহজ নয়। কল্পনা অনেক অঘটন ঘটাইতে পারে, অনেক কলা-লালিত্য বিস্তার করিতে পারে, বিদ্যমানকে ঢাকিয়া ফেলিয়া, তাহার উপর অবিদ্যমানের আবরণ টানিয়া দিতে পারে। কিন্তু কল্পনার দৌড়ের সীমা আছে;–তাহা অধ্যয়নের অভাব পূরণ করিতে পারে না। সেখানে কল্পনার প্রবেশ নিষেধ।

ভারত-শিল্পশাস্ত্রে “সাদৃশ্যই” শিল্প; নহে “দৃশ্য” শিল্প নহে। কিন্তু ফটোগ্রাফ ‘দৃশ্য”, তাহা “সাদৃশ্য” হইতে পৃথক। তাহা সৃষ্টি নহে; অনু-কৃতি। অনু-কৃতি এবং প্রতিকৃতি এই দুইটি শব্দ দুইটি পৃথক উপসর্গ-যোগে একই ধাতু হইতে দুইটি পৃথক অর্থ দ্যোতিত করে। যথা :

ইবে প্রতিকৃতৌ।।

এই সূত্রে (৫৩৯৬) পাণিনী তাহার পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছেন। এই সূত্রোক্ত “ইব” আমাদের শিল্পের সর্বস্ব। ইহাকে বাদ দিলে, আমাদের শিল্প উড়িয়া যায়। ইহারই অন্য নাম “সাদৃশ্য”। অনু-যোগে “দৃশ্য”;–প্রতিযোগে ‘সাদৃশ্য”; –একটা নকল, আর একটা সৃষ্টি। এই পার্থক্য অতি পুরাকালেই অনুভূত, স্বীকৃত, ও ব্যাখ্যাত হইয়া, আমাদের শিল্প-শাস্ত্রকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দান করিয়াছিল। এইটুকু বুঝিলে অনর্থ উৎপন্ন হয় না; না বুঝিলে, পদে পদে অনর্থ। ‘অন্তর বাহির’ যে আমাদের শিল্প-শাস্ত্রের প্রকৃত মৰ্ম্ম গ্রহণ করিতে পারে নাই, তাহা বুঝিবার জন্য এই পুরাতন পাণিনী-সূত্রের একটু আলোচনা অবশ্যক। ইহার কাশিকা-বৃত্তি এইরূপ;

“ইবার্থে সৎ প্রাতিপদিকং বৰ্ত্ততে, তস্মাৎ কন-প্রত্যয়ো ভবতি। ইবার্থঃ সাদৃশ্যং। তস্য বিশেষণং প্রতিকৃতি গ্রহণং প্রতিকৃতিঃ প্রতিরূপকং প্রতিচ্ছন্দকম। অশ্ব ইবায়ং অশ্ব প্রতিকৃতিঃ। অশ্বকঃ। উষ্ট্রকঃ। গর্দভকঃ। প্রতিকৃতাবিতি কিং? গৌরিব গবয়ঃ।”

ইহার অর্থ এই যে,–যে শব্দে ইবার্থ দ্যোতিত হয়, তাহাতেই কন প্রত্যয় হয়। ইবার্থের অর্থ কি? সাদৃশ্য। তাহারই বিশেষণ প্রতিকৃতি শব্দ। প্রতিকৃতির আরও প্রতি শব্দ আছে। যথা,–প্রতিরূপক, প্রতিচ্ছন্দক। ইহাতে অশ্বের সাদৃশ্য আছে, এইরূপ লক্ষণযুক্ত বস্তুর নাম অশ্বক। তাহা অশ্ব নহে, অশ্ব-প্রতিকৃতি। এইরূপ অর্থে অশ্বক, উষ্ট্রক, গর্দভক শব্দ ব্যবহৃত হয়। এ সকল স্থলে প্রতিকৃতি বুঝায়। তাহা না বুঝাইয়া, ইব-শব্দে যদি তুল্যতামাত্র দ্যোদিত করে, তবে গরুর তুল্য এই অর্থে “গবয়” হইবে, কন-প্রত্যয় হইবে না। এই বৃত্তি স্পষ্টই বুঝাইয়া গিয়াছে, নানা অর্থে ইব-শব্দ ব্যবহৃত হয়, একটি অর্থ সাদৃশ্য, প্রতিকৃতি-শব্দ তাহারই বিশেষণ। যেখানে সেই রূপ অর্থ বুঝা সেখানে কন প্রত্যয় হয়। তাহার ফলে অশ্বের প্রতিকৃতি অশ্বক-নাম প্রাপ্ত হয়। তাহা অশ্ব নহে, অশ্বের আকারের অনুকৃতি নহে, তাহা শিল্প-সৃষ্ট সাদৃশ্য অর্থাৎ প্রতিকৃতি। সাদৃশ্য-বিজ্ঞাপক এই ইব-শব্দকে ছাড়িবার উপায় নাই; ইহাকে ছাড়িলে, আমাদের শিল্পের নাড়ি ছিঁড়িয়া যায়। কিন্তু অন্তর বাহির এই “ইবকে” ছাড়িয়া দিবারই উপদেশ দান করিয়াছে! উদাহরণ প্রত্যুদাহরণ তুল্যতার এবং সাদৃশ্যের পার্থক্য প্রদর্শন করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছে, তুল্যতা শিল্প নহে, সাদৃশ্যই শিল্প। “সাদৃশ্য” ইংরাজী সিমিলিটিউড” নহে,–তাহা ইবার্থঃ।

“সশ্বাসমিব যচ্চিত্রং তচ্চিত্রং শুভলক্ষণম।”

এই কারিকাংশের ব্যাখ্যায় অন্তর বাহিরে এক অট্টহাস্য ধবনিত হইয়া উঠিয়াছে। একটা বিলাতী নজীর উদ্ধৃত করিয়া বলা হইয়াছে,–to make a thing which is obviously stone wood or glass speak, is a greater triumph than to produce wax-works or peep-show। ইহার সহিত কাহারও বিরোধ নাই। কিন্তু ইহার উপর নির্ভর করিয়া বলা হইয়াছে, “শিল্পের প্রাণ হচ্চে কল্পনা; অবিদ্যমানের নিশ্বাস। চৌরঙ্গীর মার্কেটে যে মোমের পুতুলগুলো বিক্রি হচ্ছে তারা একেবারে “সশ্বাস ইব”–চোখ নাড়ে, ঘাড় ফেরায়, হাসে কাঁদে, পাপা মামা বলেও ডাকে। কিন্তু ইব পৰ্য্যন্তই তার দৌড়। কোন শিল্পী যদি শিল্প-শাস্ত্র লিখতে চায়, তবে এই ইব কথাটি তার চিত্রশব্দকল্পদ্রুম থেকে বাদ দিয়ে, তাকে লিখতে হবে–সশ্বাস মিব নয়, “সশ্বাসং যচ্চিত্রং তচ্চিত্রম।”

“ইব” কথাটা বাদ দিয়া শিল্প-শাস্ত্র রচনা করিলে, চৌরঙ্গীর মোমের পুতুলগুলিকে শিল্প বলিয়াই স্বীকার করিতে হইবে। “ইব” আছে বলিয়াই, তাহারা শিল্প নয়। কারণ, তাহারা “সশ্বাস ইব” নয়,–পুরাপুরী “সশ্বাস।” চিত্র কখন ‘সশ্বাস” হইতে পারে না; তাহা প্রাণি-ধৰ্ম্ম; অপ্রাণীতে অনভিব্যক্ত। সুতরাং চিত্র “সশ্বাস” হইতেই পারে না; চিত্র হইতে পারে–’সশ্বাস ইব।” চিত্র শ্বাসের আভাস দিতে পারে, শ্বাস দিতে পারে না। সুতরাং “কোন শিল্পী যদি শিল্প-শাস্ত্র লিখতে চায়, তবে এই ইব কথাটা তার চিত্রশব্দকল্পদ্রুম থেকে বাদ দেওয়া” চলিতে পারে না। “সশ্বাসং যচ্চিত্রং তচ্চিত্রং”–ইহা নববিধানের অন্তর বাহিরের নূতন কথা। ভারত-শিল্পশাস্ত্রের কথা–’সশ্বাসং ইব”। নববিধানী নমুনায় ইহা কতদূর পরিস্ফুট হইতেছে, তাহার সন্ধান লইতে হইলে, অধিকাংশ স্থলে দর্শকগণকেই “সশ্বাস’ হইয়া পড়িতে হয়, সেখানে “ইব” নাই, একেবারে “সশ্বাস”;–তাহার সঙ্গে ঋতুবিশেষে কিঞ্চিৎ গলদঘর্ম!

জ্ঞান-মার্গ স্বভাবতই বড় পিচ্ছিল। একবার পদস্খলন ঘটিলে, ক্রমে অধিক মাত্রায় কর্দমলিপ্ত হইতে হয়। কল্পনা সে বিড়ম্বনা হইতে রক্ষা করিতে পারে না। “বর্ণ-সঙ্কর’–কথার ব্যাখ্যায় অন্তর বাহিরে সেই দুর্দশা উপস্থিত হইয়াছে। শিল্প শাস্ত্রে “বর্ণ-সঙ্করতা” একটি চিত্রদোষ বলিয়া উল্লিখিত। তাহার প্রকৃত মর্মবোধের অভাবে, শিল্পশাস্ত্রকে অগ্রাহ্য করিবার উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। বলা হইয়াছে, –”বর্ণশঙ্কর না হলে মেঘলা আকাশে সূর্যোদয় এমন কি কোন কিছুই আঁকা চলে না। অমিশ্র বর্ণ সে এক ছবি দেয়, মিশ্ৰবৰ্ণ সে অন্য ছবি দেয়।” এইটুকু পড়িলে স্পষ্টই বুঝিয়ে পারা যা,এখানে বর্ণসঙ্কর-শব্দটি বর্ণ-মিশ্রণ অর্থেই গৃহীত হইয়াছে, এবং তাহার জন্যই শিল্প-শাস্ত্র নাস্তানাবুদ হইয়াছে। ইহার উপর টিপপনী চড়িয়াছে–”এটা একটা লোকের মত; মন্ত্রের মতো খুব সাচ্চা জিনিস নয়।” ব্যাখ্যা যথাযোগ্য হইলে, সিদ্ধান্ত ঠিক হইত। কিন্তু আমাদের শিল্প-শাস্ত্র যে যুগযুগান্তের শিল্পাচার্য্যদিগের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া এতকাল ধরিয়া এত বড় একটা “অসাচ্চা জিনিস” চালাইয়া আসিয়া, বর্তমান সালে কলিকাতার গলির মধ্যে ধরা পড়িয়া গিয়াছে, ইহা একটু বিস্ময়ের ব্যাপার বলিয়াই বোধ হয়। যে শিল্প শাস্ত্র একস্থানে বর্ণমিশ্রণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবস্থা লিপিবদ্ধ করিয়াছে, সেই শিল্প শাস্ত্রই যে অন্যত্র তাহার নিন্দা করিবে, এরূপ অব্যবস্থিতচিত্ততায় আস্থা স্থাপন না করিয়া সঙ্কর-শব্দের তাৎপর্য বোধের জন্য চেষ্টা করিলে, এরূপ অনর্থ উৎপন্ন হইত না। সঙ্কর সর্বত্র মিশ্রণ-অর্থ-দ্যোতিত করে না, জাতি-প্রসঙ্গেই মিশ্রণ-অর্থ দ্যোতিত করিয়া থাকে। এখানে বর্ণ-অর্থে যেমন জাতি বুঝিতে হইবে না, রঙ্গ বুঝিতে হইবে,–সঙ্কর অর্থেও সেইরূপ মিশ্রণ বুঝিতে হইবে না, অ-যথাবিন্যাস বুঝিতে হইবে। যেখানে যে রঙ্গের ব্যবহার যথাযোগ্য,–অমিশ্র রঙ্গ হউক বা মিশ্র রঙ্গ হউক,–সেখানে তাহার ব্যবহার না করিয়া, অন্যথাচরণ করিলে, অযথাবিন্যাস হয়,–তাহা যে একটি চিত্রদোষ, তাহা “একটা লোকের মত” নয়, বিজ্ঞানের সব্ববদিসম্মত সার সিদ্ধান্ত। তাহা “মন্ত্রের মতো সাচ্চা।” যাহাতে এই দোষ চিত্রকে দোষদুষ্ট করিতে না পারে, তজ্জন্য কোথায় কিরূপ রঙ্গের ব্যবহার যথাযোগ্য, শিল্পশাস্ত্রে তাহার নানা উদাহরণ উল্লিখিত হইয়াছে। একালের শিল্পাচার্যের কথা যাহাই হউক, সেকালের শিল্পাচাৰ্যদিগের এবিষয়ে অজ্ঞতা ছিল না। তাঁহারা এই কারকা শিখিতেন এবং শিখাইতেন;-বংশের পর বংশ সযত্নে নকল করিয়া রাখিতেন,–তজ্জন্যই এতকাল পরেও আমরা ইহার সন্ধান লাভ করিতেছি মূল কারিকাটি এই :

দৌৰ্ব্বল্যং স্থূলরেখত্ব মবিভক্তত্ব মেব চ।
বর্ণনাং সঙ্কর শ্চাত্র চিত্রদোষাঃ প্রকীর্তিতাঃ।।

ইহার সকল কথাই মন্ত্রের মতো সাচ্চা”,–বুঝিবার ত্রুটিতে সকল কথাই উপহাস লাভ করিয়াছে। অথচ আর একটি কারিকা উদ্ধৃত করিয়া বলা হইয়াছে,–”এইবার শিল্পের একটা মন্ত্র দেখ,–পরিষ্কার সত্য কথা” ভাষাটা যাদুকরের ভাষার মত হইলেও ভেলকী লাগ লাগ করিয়াও, লাগিতে পারিতেছে না। কারি কাটি এই :

রূপভেদাঃ প্রমাণানি ভাবলাবণ্য-যোজনম।
সাদৃশ্যং বর্ণিকাভঙ্গ ইতি চিত্রং ষড়ঙ্গকম।

এই কারিকা-মন্ত্রে যেগুলিকে “গুণ’ বলা হইয়াছে, প্রথমোক্ত তাহারই অন্যথাচরণকে “দোষ’ বলা হইয়াছে, রূপভেদ চাই; তাহার অন্যথাচরণ ঘটিলে, অ-বিভক্ততা ঘটিয়া থাকে। রূপভেদ যেমন চিত্রগুণ, অ-বিভক্ততা (অ-রূপভেদ) সেইরূপ চিত্রদোষ। এইরূপে এই দুইটি কারিকা এক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তই ভিন্ন ভাবে সংস্থাপিত করিয়াছে। একটিকে প্রশংসা করিয়া, “এইবার শিল্পের একটা মন্ত্র দেখ” বলিয়া ডাক হাঁক ছাড়িলে অন্যটির সম্বন্ধেও সেই একই কথা বলিতে হয়, নিন্দা করিবার উপায় থাকে না। এরূপ ক্ষেত্রে উপহাসের অশোভন দশন-বিকাশ অদৃষ্টের নিদারুণ পরিহাস!

চিত্রে সাদৃশ্য করণং প্রধানং পরিকীর্তিতম।

ইহা “একটা লোকের মত” নয়;–এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মতের সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায় না। ষড়ঙ্গক চিত্রের ইহা একটি অপরিহার্য অঙ্গ। যে কারিকাকে মন্ত্র বলিয়া মানিয়া লওয়া হইয়াছে, তাহাতেও ইহার উল্লেখ আছে। এই “সাদৃশ্য” যে ইব-শব্দের প্রতিশব্দ মাত্র, কারিকাকার তাহার ব্যাখ্যা করিয়া, সকল সংশয় নিরস্ত করিয়া গিয়াছেন। সাদৃশ্য-করণ কাহাকে বলে, তাহা বুঝাইবার জন্য শিল্প শাস্ত্র সমগ্র চিত্র-বস্তুকে দুইটি পৃথক ভাগে বিভক্ত করিয়া গিয়াছে। দৃষ্ট হউক আর অদৃষ্ট হউক, উভয়ের পক্ষেই সাদৃশ্য-করণ-তুল্যভাবে অপরিহার্য। সে সকল চিত্র-বস্তু বাস্তবজগতে বৰ্ত্তমান অপিচ সুপরিচিত, তাহার নাম “দৃষ্ট”। যাহা সৰ্ব্বথা কাল্পনিক অযথা বাস্তব-জগতে বৰ্ত্তমান থাকিলেও অ-পরিচিত, তাহার নাম ‘‘অ দৃষ্ট”। মনুষ্য, গে, অশ্ব, “দৃষ্ট”; দেবতা কল্পলতা সিংহ ‘‘অ-দৃষ্ট”। এই উভয় শ্রেণীর চিত্র-বস্ত্রই কোন না কোন স্থায়িভাবের আধার-রূপে দৃষ্ট অথবা কল্পিত। তাহাই ইহাদিগের “দৃশ্য।” তাহার সহিত ইবসংযোগের নাম “সাদৃশ্য”। তজ্জন্য ভারতচিত্র আকারানুকরণ নহে,–সৃষ্টি। সে সৃষ্টি স্বেচ্ছাচার নহে, তাহা সুসংযত সাদৃশ্য প্রকটন পদ্ধতি। বস্তু-কল্পনার স্বাধীনতা আছে; কোন বস্তু কিরূপ ভাব দ্যোতিত করিবে, তাহাতেও স্বাধীনতা আছে; কিন্তু সাদৃশ্য প্রকটন-পদ্ধতি বিধি-নিষেধ সুসংযত। সকল দেশের সকল যুগের সকল মানবের মধ্যে একটি একত্ব আছে, তাহা মানবত্ব। সকল শিল্পের মধ্যেও একত্ব আছে, তাহা শিল্পত্ব। কিন্তু বিকাশ ব্যবস্থার পার্থক্যে এক দেশের সহিত অন্য দেশের, এক যুগের সহিত অন্য যুগের, শিল্পের পার্থক্যের জন্য মানব-শিল্প বিভিন্ন নামে কথিত হইয়া আসিতেছে। ভারত-শিল্প এই কারণে একটি বিশিষ্টতার আধার। নববিধান সেই বিশিষ্টতার অনুসরণ করিতে অসম্মত। নববিধান কেবল বস্তু-কল্পনার ও ভাব দ্যোতনার স্বাধীনতা লইয়াই পরিতৃপ্ত থাকিতে চাহে না,–বিকাশ-ব্যবস্থাকেও স্বাধীনতা দান করিবার জন্য লালায়িত। তাহা অবশ্যই এক শ্রেণীর চিত্র-চৰ্চ্চা; কিন্তু ভারত-চিত্র চর্চা হইতে পৃথক। সুতরাং সে পুরাতন নামে পরিচিত হইবার পক্ষে নববিধানের ন্যায়সঙ্গত অধিকার দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহার জন্য নতুন নাম আবশ্যক। সেরূপ নামকরণ করিতে হইলে, বলিতে হয়, তাহার যথাযোগ্য নাম–ইঙ্গবঙ্গ-অঙ্গরঙ্গ।

ইহা বিচার-বিমুখ হইতে বাধ্য। তজ্জন্য অধিক সমালোচনা ইহাকে অধিক অসহিষু করিয়া তুলিবে। ইহা প্রকারান্তরে সমালোচনার অতীত বলিয়া ঘোষণা প্রচার করিতে লালায়িত। যে চিত্রকর নহে, সে চিত্র-সমালোচনার অনধিকারী, এই কথা আকারে ইঙ্গিতে ব্যক্ত করিয়া, ইহা আপনাকে আপন গণ্ডীর স্তুতি-নুতির মধ্যে ঢাকিয়া রাখিতে যত্নশীল। সেকালে দুই শ্রেণীর চিত্র সমালোচক ছিল। এক শ্ৰেণী আচাৰ্য-নামে, আর এক শ্রেণী বিচক্ষণ নামে কথিত হইত। আচাৰ্য্যগণ শিল্পী ও শিল্প-শিক্ষক;–বিচক্ষণগণ বিশেষ-দর্শন-পটু সমঝদার। সুতরাং অশিল্পী সমালোচকগণকে মৃদঙ্গের খোলের সঙ্গে তুলনা করিয়া, উপহাস করিলে, অন্তরটাই বাহির হইয়া পড়ে। কবি ভিন্ন অ-কবির পক্ষে কাব্য-সমালোচনার অধিকার থাকে না; এবং এই নজীর ধরিয়া, বিশ্বসাহিত্যের ভাল ভাল কাব্য-সমালোচনাকে অনধিকার চর্চা বলিয়া উপহাস করিতে হয়। সাঞ্জস্যই সকল রচনার অন্তরাত্মা। দেশকালপাত্রের সহিত তাহার অভেদ্য সম্বন্ধ। দেশকালপাত্র ছাড়িয়া, কেবল রচনা ধরিয়া, সকল ব্যঞ্জনা, সকল অভিব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম হইতে পারে না। কিন্তু অধ্যাপক হাভেল বলেন :

It has been always my first endeavour in the interpretation of Indian ideals, to obtain a direct insight into the artists’ meaning, without relying on modern Archeological conclusion, and without searching for the clue which may be found in Indian literature.

এই অহমিকাপূর্ণ অধ্যয়ন-বিমুখতা যে মূল মন্ত্র প্রচারিত করিয়াছে, তাহার প্রভাব নব-বিধান শিল্প-শাস্ত্রের আলোচনা অনাবশ্যক বলিয়াই স্থির করিয়াছে। তাহার পক্ষে ইহা অনাবশ্যক হইলেও, ইহার প্রয়োজন তিরোহিত হয় নাই। আর একদল শিল্প-সাধক নবাবতারণা-কণ্ডুয়ন পরিহার করিয়া, পুরাতন শিল্প-ধারাকে প্রবাহিত রাখিবার উদ্দেশ্যে, আশার দীপালোক-হস্তে পথের সন্ধানে বাহির হইয়াছেন। ইহারা নামগোত্রহীন নীরব সাধক, মৃদঙ্গের খোল বলিয়া উপহসিত হইবার অযোগ্য। ইহাদের জন্য ভারত-শিল্প-শাস্ত্রের আলোচনার প্রয়োজন আছে।

দেশের সব্বসাধারণের জন্যও আলোচনার প্রয়োজন আছে। যে সকল পাশ্চাত্য বিধি-ব্যবস্থা টিকিতে না পরিয়া, বিলীন হইয়া গিয়াছিল, তাহাদের ধবংসাবশেষের উপর আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কার মস্তকোত্তোলন করিয়া, এখন আবার ভূমিচুম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছে। ভারতবর্ষ পুরাতনকে সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই; কিন্তু তাহারও পরিবর্তনের যুগসন্ধিকাল উপস্থিত হইয়াছে। তাহার প্রভাবে আমাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে ইঙ্গবঙ্গ অঙ্গরঙ্গ প্রবেশ লাভ করিয়াছে; নববিধানী শিল্প তাহারই বাহ্য-বিকাশ মাত্র। যে শক্তি পুরাকালে ভারতবর্ষকে সমগ্র প্রাচ্য ভূমণ্ডলে ভাবের মাতৃভূমি বলিয়া মৰ্য্যাদা দান করিয়াছিল, তাহার মধ্যে শিল্প একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি। শিল্পের এই অন্তর্নিহিত মহাশক্তি ভবিষ্যতেও লোকের ধ্যান ধারণার গতিনির্দেশের সহায়তা সাধন করিবে। সুতরাং কেবল অতীতের জন্য নহে, ভবিষ্যতের জন্যও অতীতের আলোচনা আবশ্যক। এক শ্রেণীর বিলাতী শিল্প-গ্রন্থ শিল্পকে স্বেচ্ছাচারের মুক্তক্ষেত্রে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিতেছে; নববিধানের অন্তর বাহিরে তাহার কথাই প্রতিধবনিত। বিলাতী-বিধান তাহার অকৌলিন্যে অকুণ্ঠিত থাকিয়া, আপন অভিনবত্বের পরিচয় দান করিতেছে;–আমাদের নববিধান, সে পথ অবলম্বন না করিয়া, আপনাকে ভারত-শিল্প নামে পরিচিত রাখিবার জন্যই আড়ম্বর প্রকাশ করিতেছে। তজ্জন্য ইহা না ইঙ্গ, না বঙ্গ, –সুতরাং ইঙ্গ-বঙ্গ। ইহা আমাদের শিল্প-শাস্ত্রের বাঁধন ছিঁড়িয়া ছুটিয়া বাহির হইয়াছে; তাহার পক্ষ-সমর্থনের জন্যই বলিতে চাহিতেছে, আমাদের শিল্প-শাস্ত্র নানা মুনির নানা মত; সত্য-মিথ্যার আধার; শিল্প এবং শিল্পী তাহার অতীত; তাহাকে মানিয়া চলিতে বাধ্য নয়।

অবাধ্যের কথা স্বতন্ত্র। তাহার সম্বন্ধে শাস্ত্র অনাবশ্যক। সকল শাস্ত্র-শাসন উল্লঙঘন করিয়া, এক শ্রেণীর বাঙ্গালা রচনা অবলীলাক্রমে ছুটিয়া চলিতেছে; শিল্প সেরূপ উচ্ছঙ্খল রচনা-বিকাশ করিবে না কেন? তাহাকে কেহ বাধা দিতে চাহে না; কিন্তু তাহাকে সুধীসম্মত বিশুদ্ধ রচনা বলিয়া সকলে স্বীকার করিতে পারিতেছে না। যখন পারিবে, তখন একাকার,–তখন সমস্তই উদ্ধৃঙ্খল হইয়া, উদ্ধৃঙ্খলতাকেই রীতি বলিয়া মৰ্যাদা দান করিবে। কিন্তু তখনও পুরাতন রচনাগুলি ভাসিয়া যাইবে না। তাহার মর্মবোধের জন্য শাস্ত্রের প্রয়োজন থাকিয়া যাইবে। ব্যাকরণের সাহায্য না লইয়াও জীবিত ভাষা শিক্ষা করা যায়; মৃত ভাষার পক্ষে ব্যাকরণ অপরিহার্য। ভারত শিল্প যদি তাহার বিশিষ্টতা হারাইয়া, নববিধানী শিল্পে পর্যবসিত হয়, তখনও খাঁটি ভারত-শিল্পের নিদর্শন সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত হইবে না; এবং তাহাকে বুঝিবার জন্য তাহার ব্যাকরণের অর্থাৎ শিল্প-শাস্ত্রের প্রয়োজন থাকিয়া যাইবে। এই সকল কারণে, ভারত শিল্প-শাস্ত্রের আলোচনার সময় উপস্থিত হইয়াছে।

নববিধানের অন্তর-বাহির উপহাস-পরায়ণতার পরিচয় দিবার সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ অনুকম্পা-পরায়ণতার প্রক্ষেপ দিয়া লিখিয়াছে,–”শিল্প-শাস্ত্র ঘাঁটতেই যদি হয়, তবে গোড়াতেই আমাদের দুটো বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে,–কোনটা মত, কোনটা মন্ত্র, এ দুয়ের সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণাটি নিয়ে বিচার কৰ্ত্তে হবে। মত জিনিসটা একজনের, দশজনে তা মানতে পারে, নাও মানতে পারে; একের কাছে যেটা ঠিক, অন্যের কাছে সেটা ভুল, নানা মুনির নানা মত। মন্ত্রগুলি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।” অন্তর বাহির এ বিষয়ে বিলক্ষণ “সজাগ” থাকিয়া, মতের এবং মন্ত্রের পার্থক্যের যে সকল উদাহরণের উল্লেখ করিয়াছে, তাহা কিন্তু উপদেশের অনুরূপ মৰ্য্যাদা লাভ করিতে পারে নাই। শিল্প শাস্ত্রে নানা মুনির নানা মত হইলে, কথা ছিল না। মত থাকিলেই মত-ভেদ থাকে। কিন্তু যেটা মনঃপুত নয়, সেইটা মত; এবং যেটা মনঃপুত, সেইটা মন্ত্র, এরূপ ভাবে শিল্প-শাস্ত্রকে ভাগাভাগি করিতে গেলে, কিরূপ গোলযোগ ঘটে, অন্তর বাহিরে তাহা পুনঃ পুনঃ বাহির হইয়া পড়িয়াছে। শিল্প-শাস্ত্র, সূত্র ভাষ্য এবং উদাহরণযুক্ত শিল্প বিবৃতি। অধ্যয়ন ভিন্ন তাহার সমালোচনা চলিতে পারে না। যাবৎ নীরব, তাবৎ নিরাপদ;–কথা কহিবামাত্র ধরা পড়িতে হয়!

কলা-সমূহের মধ্যে চিত্র-কলাই শ্রেষ্ঠ বলিয়া উল্লখিত। তাহা লইয়া অনেক বাগবিতণ্ডার অবতারণাকরা হইয়াছে। ইহাকে মত বলিয়াই ব্যক্ত করা হইয়াছে; কিন্তু এ বিষয়ে যে সত্য সত্যই নানা মুনির নানা মত আছে, তাহার মান উল্লেখের চেষ্টা করা হয় নাই। শিল্প-শাস্ত্রে এমন কথা স্থান লাভ করিয়াছে কেন, তাহারও কোনরূপ রহস্য প্রদর্শিত হয় নাই। এখানে সিদ্ধান্ত মাত্রই উদ্ধৃত; তাহার হেতু কি, তাহা অন্য কারিকায় উল্লিখিত আছে। যথা :

কান্তি ভূষণ ভাবাদ্যা শ্চিত্রে যস্মাৎ স্কুটং স্থিতাঃ।
অতঃ সান্নিধ্য মায়াতি চিত্রজাসু জনার্দনঃ।

যে সকল কলার মধ্যে চিত্রকে শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে, তাহা এক জাতীয় কলা, সাদৃশ্য-বিজ্ঞাপক কলা,–চিত্র, ভাস্কৰ্য্য ইত্যাদি। সঙ্গীতাদি ভিন্ন জাতীয় কলার প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপিত হইতে পারে না। সাদৃশ্য-প্রকটন যে সকল শিল্পের লক্ষ্য, –কান্তি, ভূষণ, ভাবাদি যাহাতে পরিস্ফুট,–সর্বাপেক্ষা অধিক সুব্যক্ত,–তাহাই যে শ্রেষ্ঠ, তদ্বিষয়ে নানা মুনির নানা মত উৎপন্ন হইতে পারে না। চিত্রে এই সকল বিষয় বর্ণের সাহায্যে সর্বাপেক্ষা অধিক সুব্যক্ত হয় বলিয়াই চিত্রকে শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে। ইহা মত নহে, মন্ত্র। কিন্তু অন্তর বাহির ইচ্ছামত একটিকে মত, অন্যটিকে মন্ত্র বলিবার জন্যই লালায়িত। অতএব অলমতি বিস্তরেণ।

ভারতবর্ষ, বৈশাখ, ১৩৩০

তথ্যসূত্র

১ সঙ্করোহখানবস্থিতি : সঙ্কর-শব্দ অনবস্থিতি বোঝায়। যেখানে যাহার অবস্থিতি অসম্ভব, সেখানে তাহার অবস্থিতি কল্পনাকে সঙ্কর বলে। আকাশে মূৰ্তত্ব নাই; তাহাতে মূৰ্তত্ব-কল্পনা অনবস্থিতি। সিন্ধান্তমুক্তাবলীকার, ইহা বিশদভাবে বুঝাইয়া গিয়াছেন। সঙ্কর-শব্দ দেখিলেই সর্বত্র মিশ্রণ-অর্থ গ্রহণ করিতে হইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *