০৮. কালিঝরনা যাওয়ার রাস্তাটা

কালিঝরনা যাওয়ার রাস্তাটা কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস ছিল, তাই না?

রাস্তাটাই যা এনজয়েবল। ঝরনাটি অতি থার্ড ক্লাস। পাহাড়ের গা বেয়ে ছ্যার ছ্যার করে জল পড়ছে কি পড়ছে না, তলায় একটা কুচ্ছিৎ কালো মিনি ডোবা, ওটাকে কেউ ঝরনা বলে?

আহা রে, চৈত্রমাসের ঝরনায় আর কত জল থাকবে? হত এটা বর্ষাকাল, দেখতেন ওই ঝরনা দেখেই চোখ ফেরাতে পারছেন না।

অবনী তবু তর্ক করে যাচ্ছেন, তা হলে তোমার কালিঝরনা দেখতে বর্ষাকালেই এলে হত। কষ্ট করে আজ ভোরবেলা বিছানা থেকে টেনে তোলার কী দরকার ছিল?

মিতিন হাসতে হাসতে বলল, ভোরের জঙ্গলটাও তো দেখতে পেলেন। এটাও তো লাভ। তার ওপর ধরুন, সুমায়া দুটো বুনো শুয়োর দেখিয়ে দিয়েছে, পাঁচখানা চিতল হরিণ। ওগুলোও তো নিশ্চয়ই আপনার লাভের খাতাতেই যাবে। মনে করুন না, ঝরনাটা ফাউ।

পাৰ্থ ফুট কাটল, ইচ্ছে থাকলেও বর্ষাকালে আপনি আসবেন কী করে অবনীদা? জঙ্গল তো বর্ষাকালে বন্ধ থাকে। জুন থেকে অক্টোবর।

কেন? সহেলি প্রশ্ন জুড়লেন, বৰ্ষায় কি জীবজন্তুদের ভেকেশান চলে? তোমাদের অবনীদার কলেজের মতো?

অনেকটা তাই। পাহাড়ের সরু সরু নদীগুলোতে তখন বন্যা হয়। জঙ্গল ভেসে যায়, গাছটাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ, বাঘ ভালুক তখন মানুষদের শো দেবে কী করে? পার্থ ভুরু নাচাল, সাপ আর জোঁকদেরও তখন মহা আহ্লাদ। তারা মনের সুখে বনে খেলা করে।

নজরুল আর চুপ থাকতে পারলেন না। গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠলেন, আমি একবার বর্ষাকালে সারান্ডা এসেছিলাম। দিল্লির এক বড় অফিসার চাইবাসা থেকে স্পেশাল পারমিশান করিয়েছিলেন, তাঁকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে সে কী দুর্ভোগ। আগের দিন যে রাস্তা দিয়ে গেছি, পরের দিন দেখি সে রাস্তা আর নেই। রাস্তার চেসিস একেবারে ভেঙে চুরমার। রাত্তিরে মাত্র দুতিন ঘণ্টা বৃষ্টি, ব্যস অমনই নদী স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চাকা উঠিয়ে দিয়েছে রাস্তায়। ওই মরা ঝরনাও সেবার দেখেছিলাম। একদম টপ গিয়ারে চলছিল।

শুনলেন তো অবনীদা?

আমি শুনে কী করব? আমি তো কোনও সিজনেই জঙ্গলে আসতে চাই না ভাই। সে কী বা গ্ৰীষ্ম, কী বা শীত, কী বা বর্ষা। জঙ্গল দেখার জন্য কষ্ট করে জঙ্গলে আসার দরকার কী তাই তো বুঝি না। বই পড়েই তো সব জেনে ফেলা যায়। এই তো, আমাজনের বইটা পড়ে আমি আমাজনের জঙ্গল সম্বন্ধে সব জেনে গেলাম।

পার্থ জোরে হেসে উঠল, এটা বেড়ে বলেছেন। বই পড়ে জঙ্গলভ্রমণ! বিছানায় শুয়ে শুয়ে মানস ভ্রমণ!

হালকা গল্প, গম্ভীর মতামত, আর লঘু বাদানুবাদ করতে করতে চলেছে সকলে। ভোরবেলা কালিঝরনা দর্শন শেষ, এখন বিকেলে। লিগিরদার পালা।

থলকোবাদ থেকে লিগিরদা মাত্র আট কিলোমিটার। কিন্তু পথ বেজায় দুর্গম। গাড়িই চলছে আট কিলোমিটার স্পিডে। চড়াই উতরাই তেমন নেই বটে, কিন্তু জঙ্গল ভয়ঙ্কর ঘন। কোথাও রাস্তা বেজায় সরু। প্রায় শুড়িপথের মতো। গাছের নুয়ে পড়া ডালে আর লতাপাতায় ঘষা খেতে খেতে এগোচ্ছে জিপ।

টুপুর কথা বলছিল না। কথা শুনছিল না। সে যেন খানিকটা আনমনা। ভাবছে পাগলা হাতিটার কথা। সত্যি সত্যিই কি হাতিটা আসছে এদিক পানে? এক্ষুনি যদি জঙ্গল ভেঙে সামনে আবির্ভূত হয়, কী ঘটতে পারে? জিপটাকে উলটে দেবে? পিষে মেরে ফেলবে টুপুরদের? সুমায়া অবশ্য বলছিল হাতিটা নাকি ভাল করে হাঁটতে পারছে না। আহা রে, বেচারা গুলি খেয়ে না জানি কত যন্ত্রণা পেয়েছে! ব্যথায় একেবারে পাগলই হয়ে গেল?

মিতিনমাসিরও সাহসের বলিহারি যাই। হাতিটাকে কেয়ারই করছে না। নেহাত কাল মা প্রবল আপত্তি করল বলে নৈশ সফরে বেরনো হল না, কিন্তু সকাল থেকে মিতিনমাসিকে রোখে কে! নিজে তো বেরোলই, সবাইকে টেনে টেনে বার করেছে। জঙ্গল দেখতে এসে একটা হাতির ভয়ে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকব? আমরা তো হাতিটার কোন ক্ষতি করিনি, হাতি কেন আমাদের ক্ষতি করবে?

হাতিটাও কি মিতিনমাসির মতো করে ভাববে? না কি ও এখন বিশ্বসংসারের ওপরই খেপে আছে? যারা গুলি করেছে, তাদের কি খুঁজে খুঁজে বের করে শিক্ষা দিতে পারে না হাতিটা?

সুমায়া বসেছে একদম পিছনের সিটটায়। এতক্ষণ সে জঙ্গলই দেখছিল। হঠাৎ বলে উঠল, কাল আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

সহেলি কালবিলম্ব না করে বলে উঠলেন, কালকের প্রোগ্রাম তো ঠিক করাই আছে। দুপুরে খেয়ে উঠেই করমপদার মধুবাব।

আর সকালে?

সকালে দুপুরের জন্য তৈরি হব।

মিতিন বলল, তোমরা যদি না যাও, না যাবে। আমি কিন্তু কাল সকালে সুমায়ার সঙ্গে কুমডি ঘুরে আসব।

তোর বেশি বাড়াবাড়ি। কী আছে কুমডিতে?

একখানা বাংলো আছে।

বাংলোতে তো তুই এখনও আছিস, মিছিমিছি বিশ-পঁচিশ মাইল ঠেঙিয়ে আর একটা বাংলোয় যাওয়ার দরকার কী?

আহা, ওই পথের জঙ্গলটা দেখব না?

অনেক তো জঙ্গল দেখা হল, আর কেন?

বা রে, জঙ্গলের বিউটি এক এক জায়গায় এক একরকম না? দেখতে হবে না ঘুরে ঘুরে?

বুঝেছি। তুই বেঘোরে মরবি।

সহেলির কথা শেষ হতে না হতেই ঘচাং ব্রেক। গোটা গাড়ি থরথর কেঁপে উঠল, পরক্ষণে নিশ্চল।

পাৰ্থ সামনের সিটে বসেছিল। চেঁচিয়ে উঠল, সৰ্বনাশ, এ কী বিপত্তি?

বিপদ একটা ঘটেছে বটে। তবে পাগলা হাতি নয়, জিপের রাস্তা রোধ করে শুয়ে আছে এক ইয়া মোটা গাছের গুঁড়ি!

নজরুলের মাথায় হাত, কী হবে এখন?

সহেলি বললেন, চলুন, গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যাই।

নজরুল বললেন, সম্ভব নেই দিদি। এখানে রাস্তার যা হাল, গাড়ি ব্যাক করা যাবে না।

তা হলে উপায়?

সুমায়া লাফিয়ে নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। কোমরে হাত রেখে গুঁড়িটাকে জরিপ করল একটুক্ষণ। তারপর সুড়ৎ করে ঢুকে গেছে। বনে। মিনিট দু-তিনের মধ্যেই ফিরে এসে বলল, তরিকা একটা আছে। গুঁড়ির ওপরে বেশ কয়েকটা কাঠ ফেলে দিতে পারি।

নজরুল বুঝে ফেলেছেন প্রস্তাবটা। বললেন, হ্যাঁ, গোল গুঁড়ির ওপরটা যদি কাঠ ফেলে স্ল্যান্ট করে ফেলা যায়, তা হলে গাড়ি টপকে যেতে পারে।

কিন্তু ছোট কাঠ পাব কোথায়?

আছে। ওদিকে আছে। আমি দেখে এসেছি।

সুমায়াকে সাহায্য করতে পাৰ্থ, মিতিন নেমে পড়ল জিপ থেকে। টুপুরও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবনীও। সবাই মিলে ধরাধরি করে বেশ কয়েকখানা শুকনো কাঠের টুকরো এনে রাখল গুঁড়ির ওপর। নজরুল সুমায়াকে নিয়ে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে ফেললেন কাঠগুলো। দিব্যি একটা ঢেউখেলানো পথ তৈরি হয়ে গেল। ব্রিজের মতো।

ফের গিয়ে স্টিয়ারিং-এ বসেছেন নজরুল। একবারের চেষ্টায় পেরোতে পারলেন না গুঁড়ি, গাড়ির চাকা উঠেও নেমে এল। দ্বিতীয়বারেও ফেল। তৃতীয় চেষ্টায় ঝপাং করে গুঁড়ি পার।

বুমবুম দারুণ মজা পেয়েছে। হাততালি দিচ্ছে আনন্দে। সবাই মিলে আবার গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিয়েছে জিপ।

নজরুল স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, অত বড় গুড়িটা রাস্তায় কী করে এল বলুন তো?

পার্থ বলল, যেভাবে আসে। শেকড় উপড়ে পড়ে গেছে।

কোথায় শেকড়? ডালপাতাও তো নেই! ওটা তো স্রেফ গাছের কাণ্ড!

সুমায়া বলল, আমি পরশু লিগিরদা এসেছিলাম, তখন তো ওটা ছিল না!

তার পর হয়তো কাটা হয়েছে। কন্ট্রাক্টর হয়তো ফেলে রেখে গেছে।

মনে সামান্য সংশয় জাগলেও এ নিয়ে আর আলোচনা হল না বিশেষ। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে গেছে লিগিরদা।

জায়গাটা রীতিমতো রোমাঞ্চকর। একদিকে ভয়াল জঙ্গল, অন্যদিকে গভীর খাদ। মাঝে খানিকটা অঞ্চল কেমন ফাঁকা ফাঁকা। সেখানে একখানা ভগ্নপ্রায় ওয়াচ টাওয়ার বিরাজমান। কোনওকালে বোধহয় টাওয়ারে উঠে জীবজন্তু দেখা হত। লোহার সিঁড়ি এখন মরচে ধরে ক্ষয়ে গেছে, পা রাখতে ভয় হয়।

ওই সিঁড়ি বেয়েই বেড়ালপায়ে তরতরিয়ে উঠে গেল সুমায়া। ওপর থেকে ডাকছে, চলে আসুন। এখান থেকে বহু দূর তক দেখতে পাবেন।

অবনী জিজ্ঞেস করলেন, স্পেশ্যাল কী আছে?

সামটা নালা।

অ্যাঃ! নালা? পাহাড়ে এসে নালানর্দমা দেখব?

বড়িয়া নালা বাবু। ঝোরা কা মাফিক। জানোয়াররা পানি পিনে আসে। এই টাইমেই।

মুখে যতই গাঁইগুঁই করুন, অবনীর দেখার শখ ষোলো আনা। দেখে সমালোচনা করবেন, এটাই তাঁর স্বভাব। দোনামোনা করে বললেন, পারব উঠতে? খাড়া সিঁড়ি, মাথা ঘুরে যাবে না?

নীচে বিলকুল তাকাবেন না। আঁখ বন্ধ করে উঠুন।

সহেলি আর বুমবুম ছাড়া একে একে সিঁড়ি চড়ল সবাই। সিঁড়িগুলো অনেকটা ফাঁক ফাঁক, বুমবুম পা পাবে না। তাকে পাহারা দেওয়ার নাম করে সহেলিও রয়ে গেলেন।

ওয়াচ-টাওয়ারের মাথাটা খোলা। চাতাল মতন। সেখানে দাঁড়িয়ে সত্যিই একটা বিশাল রেঞ্জ দেখা যায় জঙ্গলের। মাথার ওপর আকাশ ঝকঝকে নীল। শেষ সূর্যের আলোয় বনের সবুজ রং ঝলমল করছে। তবে খাদের দিকে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব, ঝরনা বা নালাটা দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট।

পার্থ ক্যামেরার শাটার টিপে যাচ্ছিল। বলল, আলো আরও না কমলে নালা ঝরনা কিছুই বোঝা যাবে না।

অবনী বললেন, তখন বাঘ ভালুকের দর্শন মিললেও মিলতে পারে। ওরা তো শেষ বিকেলেই জল খেতে আসে।

তো আর একটু দাড়ানো যাক।

অপেক্ষা অবশ্য করা গেল না। সহেলি হঠাৎ নীচ থেকে আর্তনাদ করে উঠেছেন, অ্যাই মিতিন, অ্যাই পাৰ্থ, বুমবুম কোথায় পালিয়ে গেল!

শুনেই তড়িৎ গতিতে নীচে নেমে গেল সুমায়া। পিছনে হুড়মুড়িয়ে বাকিরাও সবাই মিলে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। খুঁজছে। গলা ছেড়ে ডাকছে বুমবুমকে।

প্রত্যুত্তর নেই। নিঝুম জঙ্গলে প্ৰতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে ডাকগুলো। মিতিনের মুখ শুকনো ক্রমশ, সহেলি টুপুর কাঁদো কাঁদো।

বেশ খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পাওয়া গেল বুমবুমকে। সুমায়াই দেখতে পেল। ওয়াচ-টাওয়ারের গজ পঞ্চাশেক দূরে একটা ছোট্ট পাথুরে টিলা, তার ভেতরে সার সার গুহা, বুমবুম একটা গুহায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। পার্থ উত্তেজিত স্বরে বলল, তুই এখানে কী করছিস? এই অন্ধকারে?

লুকিয়ে আছি। বুমবুমের রাগি জবাব, তোমরা আমায় ওপরে নিয়ে গেলে না কেন? আমি কেভ্‌ম্যান হয়ে যাব।

সুমায়া বলল, তুমি আমার পিঠে চড়ো, আমি তোমায় আভি নিয়ে যাচ্ছি।

মিতিন গোমড়া মুখে বলল, এক সেকেন্ড। এখানে এমন গুহা আছে আগে বলোনি তো?

কী বলব দিদি? ইসমে তো কুছু নেই। ঠাণ্ডার সময়ে কভি কভি জানোয়াররা এসে এখানে থাকে।

মিতিনের তবু ভুরুতে ভাঁজ। ঘুরে ঘুরে দেখছে গুহাগুলোকে। খুব বড় নয়, বেঁটে বেঁটে খুপরি। বেশিরভাগ খুপরি মাকড়সার জাল আর ধুলোময়লায় ভরা। তুলনায় বুমবুমের খুপরিটাই যা একটু পরিষ্কার।

মিতিনের ভুরুর ভাঁজ গাঢ় হল, এই গুহাটায় লোকজন ছিল মনে হচ্ছে?

টুপুর বলল, কী করে বুঝলে?

দেখছিস না, একটা গুহাই শুধু পরিষ্কার! এটা কেউ ঝাঁটটাট দিয়ে সাফ করে নিয়েছে।

হ্যাঁ, তাই তো! কে করল?

সহেলি বললেন, এখানে আর দাঁড়াতে হবে না বাবা। গাড়িতে ওঠো। কোত্থেকে কোন ডাকাত এসে পড়বে…

মিতিন যেন শুনেও শুনল না। খপ করে মাটি থেকে একটা আধপোড়া সিগারেটের টুকরো তুলেছে, ঠিকই ধরেছি। এখানে কেউ ছিল।

পার্থ সিগারেটের টুকরোটা হাতে নিয়ে দেখল, এটা তো দেখছি ফাইভ ফিটি ফাইভ।

অর্থাৎ বিদেশি সিগারেট। অবনী বললেন, মানে বেশ মালদার লোকই ছিল। ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল দেখার জন্য অনেকে জান লড়িয়ে দেয়। হয়তো সেরকমই কেউ..

তাই কি? মিতিন নিচু হয়ে মাটিটা দেখছে ভাল করে। একটা মোমবাতির টুকরোও পেয়েছে। মাথা না তুলেই বলল, একজন নয় অবনীদা, দু-তিনজন ছিল। এবং রাত্তিরবেলা। অন্তত তিনরকম। জুতার ছাপ রয়েছে ধুলোয়।

সহেলি ফের বললেন, ওরে, চলে আয়। এখানে আর থাকিস না।

মিতিনের ভ্রূক্ষেপ নেই! এগিয়ে গেছে খানিকটা। ছোট্ট একটা গুহার সামনে দাঁড়াল। পাথর রেখে বন্ধ করা আছে গুহার মুখ।

মিতিন সুমায়াকে বলল, একটু হাত লাগাও তো। সরাও পাথরটা।

সুমায়ার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে পার্থ। নজরুল আর অবনী সাহায্য করছেন তাদের। পাথর যথেষ্ট ভারী, সরাতে পরিশ্রম হল বেশ।

পাথর সরে যেতেই ভক করে একটা গন্ধ ঝাপটা মেরেছে তাকে। ঝাঁঝালো গন্ধ। বিদেশি অ্যালকোহলের।

মিতিন হাত বাড়িয়ে একটা ফাঁকা মদের বোতল বার করল ভেতর থেকে। একখানা বড় পলিথিনের বস্তাও দেখা যাচ্ছে। মাল ভর্তি।

সুমায়া গুঁড়ি মেরে ঢুকে গেল গুহায়। বস্তায় হাত ছুঁইয়ে জিভে ঠেকাল হাত। অবাক স্বরে বলল, আরে দিদি, এ তো নিমককা বোরা!

নুন! পাৰ্থর গলা দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে এল, পাহাড়ি গুহায়। নুনের বস্তা?

সহেলি বললেন, ডাকাতরা নুনের বস্তা নিয়ে ঘোরে, এ তো আমি জন্মে শুনিনি!

আমি কিন্তু ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারছি। মিতিন মাথা নাড়ল, সুমায়া, ওয়াচ টাওয়ারের ওপাশে একটা সল্টলিক আছে। না?

হাঁ। কিন্তু ওটা তো…

দেখেছি। সল্টলিকটা এখন আর চালু নেই।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, সল্টলিক কী?

অবনী বললেন, নুন চাটার গর্ত। মানুষের মতো জন্তু-জানোয়ারের শরীরেও নুনের প্রয়োজন আছে। আমরা রান্নায় নুন পাই, কিন্তু জন্তু-জানোয়ার খায় কাঁচা খাবার, নুন ছাড়া। আর তাই একটু নুনের জন্য তারা ছটফট করে বেড়ায়। সব জায়গাতেই বনদফতর জঙ্গলে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে নুন ঢেলে আসে, যাতে হাতি বাঘ ভালুক হরিণরা নুনটা পেয়ে যায়। সত্যি বলতে কী, জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ার দেখানোরও এটাই সবচেয়ে চালু পদ্ধতি।

কিন্তু যেসব জঙ্গলে সল্টলিক বানানো যায় না?

জন্তু-জানোয়ার সেখানে নুনের অন্য সোর্স খোঁজে। হয় মাটি চাটে, কিংবা কোনও পাহাড়ে যদি সামান্যতম নুনের সন্ধান পায় তো সেই পাথর চাটে।

মিতিন বলল, কিন্তু এখানে ব্যাপারটা কোন দিকে এগোচ্ছে বুঝতে পারছেন অবনীদা? একদল লোক সুপরিকল্পিতভাবে একটা দাঁতাল হাতিকে মারার চেষ্টা করছে। একবার তাদের টিপ ফসকেছে, তারা আর টারগেট মিস করতে রাজি নয়। এবং সেইজন্যই এই নুনের বস্তার আয়োজন। শয়তানগুলো এও জানে, পাগলা হাতি এদিকেই আসছে, তাই পাথর চাপা দিয়ে রেখে গেছে বস্তাটা। আজকালের মধ্যেই বস্তার নুন সল্টলিকে ফেলে দেবে। হাতি গন্ধে গন্ধে সল্টলিকে আসবেই। তখন…

সর্বনাশ! পার্থ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, এক্ষুনি তো তা হলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে খবর পাঠাতে হয়!

সন্ধে হতে আর বেশি দেরি নেই। আমরা থলকোবাদ পৌঁছে খবর পাঠাব, তারপর ওরা কখন আসবে…। মিতিন জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, তার আগেই হাতি খুন হয়ে যেতে পারে।

তা হলে উপায়?

আপাতত আমরা নুনের বস্তাটা খাদে ফেলে দিতে পারি। ওরাও তা হলে আর হাতিটাকে প্রলুব্ধ করে এখানে আনতে পারবে না।

কিন্তু হাতিটা তো ঘুরতে ঘুরতে এমনিই চলে আসতে পারে? তখনও তো খুন হতে পারে?

পাগলা হাতিকে মারা অত সহজ নয়। আচ্ছা আচ্ছা শিকারিদেরও কাঁপ ছটকে যায়। তারা বলে, জখমি শেরের চেয়েও জখমি হাতি অনেক বেশি ভয়ানক। এমনিতেই হাতি অসম্ভব অ্যালার্ট প্রাণী। আর রোগ বনে গেলে সে আরও সতর্ক হয়ে যায়। এই হাতিটা গুলি খেয়েছিল চার-পাঁচদিন আগে। অর্থাৎ তার জখম এখন অনেকটা ভরে এসেছে। নুনের লোভ দেখিয়ে অন্যমনস্ক না করতে পারলে ওই হাতিকে নিখুঁত নিশানায় গুলি করা খুব কঠিন। কী সুমায়া, ঠিক বলেছি?

সুমায়া ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল, হাঁ দিদি।

মিতিন বলল, অবশ্য সুমায়ার হিসেব যদি ঠিক হয়, তা হলে এখনই হাতি লিগিরদা পৌঁছচ্ছে না। তবু আমাদের চান্স নেওয়ার দরকার নেই। নুনের বস্তাটা বিদেয় করাই ভাল।

কিন্তু শয়তানগুলো বস্তাটা গুহায় রেখে গেছে কেন? টুপুর বলল, নুনটা তো সল্টলিকেই ফেলে দিয়ে যেতে পারত?

ওদেরও হিসেব আছে। বেশি আগে ঢাললে যদি অন্য জানোয়ার নুনটা চেটেপুটে সাফ করে দিয়ে যায়!

টেনেটুনে বের করা হল বস্তাটা। কম নয়, কুড়ি কেজি নুন। স্বাস্থ্যবান নজরুল বস্তার একদিক ধরেছে, অন্যদিক সুমায়া। পাহাড়ের প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে দিল খাদে।

জিপে ওঠার আগে মিতিন বলল, আপনি ঠিকই ধরেছিলেন নজরুলভাই। গাছের গুঁড়িখানা ওই শয়তানগুলোই রাস্তায় ফেলে রেখেছে। যাতে লিগিরদা ওয়াচ টাওয়ারে হুটহাট লোকজন চলে আসতে না পারে। এখন ফেরার সময়ে আমাদের সেট করা কাঠের টুকরোগুলো আমরা সরিয়ে দিয়ে যাব।

নজরুল বললেন, কিন্তু ওরা তো নুনের বস্তা নেই দেখেই বুঝে ফেলবে কেউ না কেউ এসেছিল?

তা বুঝুক। একটু ধাঁধাতেও থাক। আমরাই শুধু ওদের কথা ভেবে মরব কেন, ওরাও একটু ভাবুক। বলেই মিতিন সুমায়ার দিকে ফিরেছে, শোনো, থলকোবাদে গিয়ে কিন্তু কাউকে গল্প করবে না। অন্তত আজকের রাতটা। নইলে হাতিটাকে বাঁচানো যাবে না।

আবার ঢক করে মাথা নাড়ল সুমায়া, কেউ জানবে না দিদি। ঘরকা লোগ ভি না।

সিটে হেলান দিয়ে বসল মিতিন। চোখ বুজে ফেলল।

পার্থ গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে টেরচা চোখে মিতিনকে বলল, যাক, এখানে এসেও তোমার একটা কেস তবে জুটে গেল?

মিতিন মৃদু হাসল, দেখছি তো তাই। ভেবেছিলাম কদিন জঙ্গলে একটু নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাব। কপালে যদি না সয় ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?

নজরুল ঘুরে ঘুরে দেখছেন মিতিনকে। আমতা আমতা স্বরে প্রশ্ন করে বসলেন, দিদি, আপনি কি..?

চিনতে পারেননি এখনও? পাৰ্থ নজরুলের মুখের কথা কেড়ে নিল, উনি একটি মেয়ে-টিকটিকি।