০৫. কিরিবুরু মেঘাতুবুরু

কিরিবুরু মেঘাতুবুরু একদম গায়ে গায়ে লাগানো। কোথায় মেঘাতুবুরুর শেষ, কোথায় বা কিরিবুরুর শুরু, বোঝা মুশকিল। দুই লোহাখনির গেটও প্রায় মুখোমুখি, মাঝে বড়জোর দু-তিনশো মিটারের ব্যবধান।

রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে মিতিনের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিল টুপুর। মেঘাতুবুরুতে জায়গা পাওয়া যায়নি, তারা উঠেছে কিরিবুরুতে। স্টিল অথরিটির গেস্টহাউসে। মেঘাতুবুরুর চেয়ে কিরিবুরুতেই অবশ্য জনবসতি বেশি। দিব্যি সাজানোগোছানো টাউনশিপ। বাজারহাট, দোকানপাট, সিনেমা হল, কী নেই। চওড়াচওড়া মসৃণ পাহাড়ি রাস্তায় এই চড়াই তো এই উতরাই। পথের দু ধারে ইউক্যালিপটাসের সারি। অজস্র খুদে খুদে টিলা চারদিকে, তাদের মাথায় গায়ে সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর। এমন একটা মনোরম পাহাড়কে কেন যে পোকার পাহাড় বলা হয়?

পাহাড়ের মাথায় বলে কিরিবুরুতে ঠাণ্ডা আছে যথেষ্ট। সালোয়ার কামিজের ওপর সহেলির একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছে টুপুর। মিতিনের গায়েও গুজরাটি চাদর। এতাল বেতাল হাওয়ায় মাঝে মাঝেই তবু কেঁপে উঠছে মাসি বোনঝি।

হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল দুজনে। মিতিন জিজ্ঞেস করল, কী রে, এখনও অব্দি কেমন লাগছে টুরটা?

টুপুর বলল, দারুণ।

টেনশন হচ্ছে না?

কীসের টেনশন?

কাল আমরা সত্যিকারের জঙ্গলে ঢুকব। যদি থলকোবাদে গিয়ে পাগলা হাতিটার সামনাসামনি পড়ে যাস?

হাতিকে সামনে আসতে দেব কেন? হুড়মুড় করে জঙ্গল ভাঙছে টের পেলেই কোথাও একটা শেল্টার নিয়ে নেব।

তুই একটা হাঁদি। হাতি মোটেই জঙ্গল ভেঙে ভেঙে হাঁটাচলা করে না। সত্যি বলতে কী, হাতির চলাফেরা টেরই পাওয়া যায় না।

পাগলা হাতিরও না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। হাতি এমনিতেই খুব চালাক। অসম্ভব বুদ্ধিমান প্রাণী। পাগলা হওয়ার পর সে আরও ধূর্ত হয়ে ওঠে। যদি ইচ্ছে করে দাপাদাপি না করে, তা হলে পাঁচ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়ালেও তুই টের পাবি না। প্লাস, গায়ের রং গাছের গুঁড়ির সঙ্গে একেবারে মিশে থাকে। এই প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে একদম নিঃসাড়ে সামনে এসে। দাঁড়ায় আচমকাই।

টুপুর একটু ঘাবড়েই গেল, তুমি ভয় দেখাচ্ছ কেন মিতিনমাসি?

ভয় পাচ্ছিস বা কেন? সাবধানে হাঁটাচলা করবি। হুটহাট একাএকা কোথাও চলে যাস না, ব্যস, তা হলেই হল। মিতিন টুপুরের কাঁধে হাত রাখল, তবে কী জানিস, ওই হাতির চেয়েও সাঙ্ঘাতিক ওই লোকটা। বা লোকগুলো। যারা হাতি মারতে জঙ্গলে ঢুকেছে।

জঙ্গলে তো পাহারাদার থাকে। তারা কালপ্রিট ধরতে পারছে না?

এ কি তোর বেথুয়াডহরির পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট ফরেস্ট? ভেতরে ঢুকলে বুঝবি কাকে বলে অরণ্য। দশ-বিশটা লোকও যদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে জঙ্গলে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তাদের ঢুঁড়ে বার করা শার্লক হোমসেরও অসাধ্য।

তুমিও পারবে না?

আমি খুঁজব কেন? যাদের কাজ তারাই করুক। মিতিন আলগা টোকা দিল টুপুরের মাথায়, তোকে যা বলেছিলাম করছিস?

কী গো? ডে-টু-ডে ডায়েরি লেখা?

ইয়েস। যেখানে যা ঘটছে সব নোট করে রাখ।

আজকেরটা এখনও হয়নি। শোওয়ার আগে লিখব।

শর্টে বল তো কী কী নোট করবি আজ?

মিতিনমাসির কাছে টুপুর শিখেছে কোনও ঘটনাই উপেক্ষণীয় নয়। বহু তুচ্ছ ব্যাপারও বড় কিছু ঘটার ইঙ্গিত দেয়। অনেকটা পাহাড়ি এলাকার মেঘের মতো। এককুচি কালো মেঘ যে কতটা বৃষ্টি ঢালতে পারে সে তো টুপুর চাইবাসাতেই দেখেছে।

টুপুর সংক্ষেপে তার বিবরণী পেশ করল। ভেবে ভেবে। মনে করে করে। চাইবাসার হোটেলে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে মেঘাতুবুরুর সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

বিনা মন্তব্যে শুনছিল মিতিন। মাঝে-মাঝে ঘাড় তুলে আকাশটাকে দেখছিল। গাঢ় নীল রাতের আকাশ চাঁদোয়ার মতো ছেয়ে আছে মাথার ওপর। ঝিকঝিক করছে অজস্র তারা। পশ্চিম আকাশ থেকে চাঁদ অনেকটা হেলেছে পুবে। জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেন কানাভাঙা সোনার পিরিচ।

টুপুর আড়চোখে দেখল মিতিনকে, কী গো, কিছু বাদ পড়ল?

মোটরসাইকেলের লোক দুটোর টি-শার্টের কালার বললি না তো!

যে লোকটা মুরগি মারল, সে পরে ছিল মেটে রং। আর অন্যজনের যেন কী রং?

মনে নেই তো? সবুজ। বুকে সরু সাদা বর্ডার। মিতিন ফের প্রশ্ন করল, আর পুরুষোত্তম সিংহ সম্পর্কে তোর কী কমেন্ট?

বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস লাইফ। নিজের প্রশংসা শুনতে ভালবাসেন। নিজের কথা বলতেও। তবে…। টুপুর একটু থেমে থেকে বলল, শিকারি, অথচ অকারণে প্রাণীহত্যা করেননি, এটা কেমন অদ্ভুত নয়?

জিম করবেটের নাম শুনেছি?

যিনি ম্যানইটার্স অফ কুমায়ুন লিখেছিলেন? বইটা পড়েছি। কী সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক বাঘ শিকার করেছিলেন জিম করবেট! রুদ্রপ্রয়াগে… রানিখেতে…

তা হলে তো জানিসই জিম করবেট কোন দরের শিকারি ছিলেন। কিন্তু জঙ্গল বা পশুপাখিকে তিনি কম ভালবাসতেন না। বাঘকেও ভালবাসতেন তিনি। শুধু বাঘ মানুষখেকো হয়ে গেলেই…। মিতিন দুএক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, পুরুষোত্তম যে সত্যিই পশুপ্রেমিক তা তাঁর ঘরদোর দেখেই অনুমান করা যায়।

কীভাবে?

ঘরে কোথাও নিজের শিকারের নিদর্শন ছড়িয়ে রাখেননি। এখানে বাঘের চামড়া, ওখানে মোষের শিং, দেওয়ালে হরিণের মুণ্ড. বীরত্বের কোনও ফাঁপা আড়ম্বর নেই।

কিন্তু ভদ্রলোকের ছোট ছেলেটা যেন কেমন কেমন? টুপুর ফস করে বলে উঠল, মনে হচ্ছিল আমাদের দেখে একটুও খুশি হননি।

হুম। মনে হয় দুই ভাইয়ের সম্পর্ক ভাল নয়। দাদার পরিচিতদের ভাই পছন্দ করে না।

তা বলে অভদ্র ব্যবহার করবে?

ওটাই হয়তো ওর কথা বলার স্টাইল। ক্ষমতা, টাকাপয়সা, এসব হাতের মুঠোয় থাকলে ওরকম বহু লোকই ধরাকে সরা জ্ঞান করে।

হাতিটাকে নিয়েও কেমন কমেন্ট করছিল দেখলে? যেন হাতি মারা কোনও অন্যায় কাজই নয়!

হুম।

কথায় কথায় টুপুররা বাজারের দিকটায় চলে এসেছে। রাত নটা বাজে, অধিকাংশ দোকানেরই ঝাঁপ বন্ধ। শুধু একটা দুটো পান সিগারেটের স্টল খোলা আছে এখনও।

ডানপাশে এক মস্ত দিঘি। স্থানীয় মানুষের স্নানটানের জন্য বোধহয় কাটানো হয়েছিল কোনও সময়ে। মিতিন আর টুপুর দাঁড়িয়ে পড়ল দিঘির পাড়ে। জলে চাঁদের ছায়া। টুপুরের বিকেলটার কথা মনে পড়ছিল। আজ সানসেট যেন তেমন উপভোগ করা গেল না। জঙ্গলে ছাওয়া ধোঁয়া ধোঁয়া নীলচে পাহাড়ের পেছনে কখন যেন ঝুপ করে হারিয়ে গেল সূর্যটা। তবে হ্যাঁ, কিরিবুরুর লোহাখনিটা ভারী বিচিত্র। আস্ত পাহাড়খানাকে কেটে কেটে কী অতিকায় এক খাদান বানিয়ে ফেলেছে। ওটাকে নাকি বলে ওপেন-কাস্ট মাইন। কয়লাখনির মত গর্ত খুঁড়ে পৃথিবীর ভেতরে ঢুকতে হয় না, ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ভাঙো, আর লোহারা পাথরের চাঙড় তুলে দাও টিপলারে। লোহাখনির খাদানটাও কী টকটকে লাল। লোহার জন্যেই কি? খাদানের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ। ট্রলি বুলডোজার কাটার ক্রেন চলছে-ফিরছে এদিক-ওদিক। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন পিঁপড়ের জগৎ।

টুপুরের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ দিঘির পাড়ে পার্থর আবির্ভাব। হাঁফাচ্ছে পার্থ। হাঁফাতে হাঁফাতেই বলল, তোমরা এখানে? আমি তোমাদের সানসেট পয়েন্টে খুঁজতে গিয়েছিলাম।

মিতিন বলল, এই অন্ধকারে সানসেট পয়েন্টে?

ভাবলাম যদি গিয়ে থাকো।… বলে যাবে তো কোথায় যাচ্ছ। অন্যদের চিন্তা হয় না? একে একটা পাগলা হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে…

সে তো সারান্ডায়।

এটাও তো সারান্ডারই পার্ট। যদি ব্যাটা গুট গুট করে পাহাড়ে উঠে আসে?

পিচরাস্তা ধরে? লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে? মিতিন খিলখিল হেসে উঠল।

কেন? হাতির বুঝি পিচরাস্তায় হাঁটতে মানা? না কি হাতি লোকালয়ে ঢোকে না? পার্থ প্রতিবাদ জুড়ল, তা ছাড়া বেচারার এখন মাথা খারাপ। এখন কি আর ওর স্থানকালপাত্ৰজ্ঞান আছে?

উফ, তোমরা না ভয়েই গেলে। মিতিন হাসি থামাল, বুমবুম ঘুমিয়েছে?

শুয়েছে। বড়দির কাছে। বড়দি একটার পর একটা গল্প শোনাচ্ছে আর বুমবুম গুনছে, সেভেন হল, এইট হল… টোয়েন্টিফাইভ স্টোরি না শুনে সে আজ চোখ বুজবেই না।

টুপুর হি হি হাসল, মা তা হলে খুব টাইট খাচ্ছে?

আর তোমার বাবা টাইট দিচ্ছেন। একখানা মাংকিক্যাপ চড়িয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন গেস্টহাউসের রিসেপশনে। ম্যানেজারবাবুর এখন যাকে বলে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা।

ওমা, সে কী! কেন?

অবনীদা নাকি ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছেন। কম্বলে নাকি শীত কাটবে না, তাঁর এখনই লেপ চাই। ম্যানেজার অতিষ্ঠ হয়ে একজোড়া রেজাই আনার জন্য কোথায় যেন লোক পাঠালেন। পার্থ দাঁত ছড়িয়ে হাসল, আরও স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার কী জানো? অবনীদা রিসেপশনে বসে ঢুলছেন, কিন্তু কিছুতেই রুমে গিয়ে শোবেন না।

টুপুর লজ্জিত মুখে বলল, সত্যি, বাবাটা না বড্ড শীতকাতুরে। গত পুজোয় গ্যাংটকে স্লিপিংব্যাগ নিয়ে গিয়েছিল। হোটলের বিছানায় স্লিপিংব্যাগে ঢুকে ঘুমোত।

পার্থ হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতেই ফিরতে শুরু করেছে তিনজনে।

পার্থ টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, তোর মাসি কী বলছে? তোকে দিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ চলবে?

মিতিন ফুট কাটল, তুমি চালাতে পারলে টুপুরও পারবে।

আমি শুধু চালাই? আমিই তো রান করাই। আমি না থাকলে তোমার থার্ড-আই-এর তৃতীয় নয়নটি কানা।

তাই বুঝি? পরীক্ষা নেব?

নাও।

বলো তো পুরুষোত্তম সিংহ মানুষটি কেমন?

টিপিকাল জঙ্গলের ঠিকাদার। দুনম্বরি করে প্রচুর কামিয়েছেন।

মাইনাস ফাইভ। বুমবুমও এগুলো বলতে পারে।

ছেলে দুটোকেও মানুষ করতে পারেননি। একটা পাগল, একটা গোঁয়ার।

আর?

তারপর ধরো ভদ্রলোকের বাংলা বলা। পঞ্চাশ বছরেরও ওপর ভদ্রলোক দেশছাড়া, কিন্তু এখনও বাংলা উচ্চারণ কী পরিষ্কার!।

হুম। এটা অবশ্য একটা গুড অবজারভেশন। তবে কী জানো, মাতৃভাষা ভুলতে চাইলে ছ মাসেই ভোলা যায়। আর না চাইলে মৃত্যু অব্দি ভুলবে না। যেমন ধরো তোমার মাসতুতো ভাই রজত। মাত্র দেড় বছর রজত আমেরিকায় আছে, এখনই কেমন বিকৃত অ্যাকসেন্টে বাংলা বলে শুনেছ তো? অথচ তোমার রঘুজ্যাঠা চুয়াল্লিশ বছর কানাডায় থেকেও এখনও দিব্যি ঢাকাই ডায়লেক্টে গড়গড় করে কথা বলে যান।

তা ঠিক। পাৰ্থ স্বীকার করল, এটা ম্যান টু ম্যান ডিফার করে।

যাকগে, পুরুষোত্তমকে ছেড়ে কাজের কথা শোনো। দুটো জব্বর ইনফরমেশন জোগাড় করেছি।

কী?

পাগলা হাতিটাকে নিয়ে এখানেও জোর চর্চা চলছে। হাতিটাকে নাকি শেষ দেখা গেছে তিরিলপোসিতে। এবং তিরিলপোসি থলকোবাদ থেকে খুব দূরে নয়।

বাহ, সুখবর। বড়দি অবনীদার ঘরে আটকে থাকাটা পাকা হয়ে গেল। মিতিন হাসল, যাকগে, করমপদার খবরটা নিয়েছ? এখান থেকে কদ্দূর করমপদা?

ম্যানেজারবাবু তো বললেন কাছেই। থলকোবাদের রুটেই পড়ে। তবে রেঞ্জ আলাদা। করমপদা গুয়া রেঞ্জে। থলকোবাদ পড়ে সামটায়। এখান থেকে করমপদা মিনিট চল্লিশ।

মিতিন বলল, তো কাল সকালেই দিদিকে মধুবাবার দর্শন করিয়ে দেবে নাকি?

সেইজন্যই তো বলছি। গেস্টহাউসের ম্যানেজারও দেখলাম মধুবাবার গল্প জানেন। কিরিবুরু টাউনেও মধুবাবা নাকি এখন একটা ইভেন্ট। এখান থেকেও অনেকে গিয়ে মধুবাবাকে দর্শন করে এসেছে। এবং তারাও নাকি ভক্তিতে সব গদগদ।

মিতিন বলল, ভালই হল। আমরাও কাল যাওয়ার পথে একবার ঢুঁ মেরে নিচ্ছি।

পার্থ বলল, বড়দি তো শুনেই লাফাচ্ছেন। মধুবাবার নামে পাগলা হাতির ভয়টয় সব হাপিস।

টুপুরের মধুবাবাতে আগ্রহ নেই। বলল, আর তোমার সেকেন্ড ইনফরমেশনটা কী?

মেঘাতুবুরুতে ছুটে ছুটে সানসেট দেখতে যাওয়াটা নাকি আমাদের গোখখুরি হয়ে গেছে। ম্যানেজার বলছিলেন। আমাদের দেখা উচিত সানরাইজ। কপাল ভাল থাকলে, মানে মেঘ না থাকলে, সূর্যোদয় নাকি অনির্বচনীয়। পুব দিকটা পুরো খোলা তো। নীচে রুপালি সুতোর মতো বয়ে যাচ্ছে কারো নদী, জলে সোনালি আলো ঠিকরোচ্ছে…

পাৰ্থর রীতিমতো ভাব এসে গেছে। টুপুর মনে করার চেষ্টা করছিল মেঘাতুবুরুর পথে কারো নামে কোনও নদী সে পার হয়েছে কি না। মনে পড়ছে না। ছিঃ টুপুর, এটাও তোমার অবজারভেশনের ডিফেক্ট…

নির্জন পথঘাট। একটা চাপা গুমগুম শব্দ ভেসে আসছে। ডিনমাইট ফাটছে কি?

উহুঁ, আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। নিস্তব্ধতা চিরে ছুটে আসছে। এক মোটরসাইকেল। কিরিবুরু পেরিয়ে যেদিকে জঙ্গল, সেই দিক থেকে। ঘাচ করে সামনেই এক পান সিগারেটের দোকানে এসে দাঁড়াল।

আরে, ঝিনিকপানির সেই মোটরসাইকেলটা না? কিন্তু এখন আরোহী মাত্র একজন।

দোকানদার ঝাঁপ নামাচ্ছিল।

লোকটা মোটরসাইকেলে বসেই হেলমেট খুলে হেঁকে উঠল, অ্যাই, রুক রুক।

দোকানদার বলল, কেয়া লেংগে সাব?

সিগারেট লা। দো পাকিট। ফরেন। বড়িয়াওয়ালা।

ছুটে এসে লোকটাকে সিগারেট দিয়ে গেল দোকানদার। বলল, আউর কুছ চাহিয়ে?

সোডা লা। তিন বোতল।

বোতল তিনটে সাইড-কেরিয়ারে ভরছে লোকটা। সেই সময়েই মুখটা পরিষ্কার দেখতে পেল টুপুর। ফিসফিস করে বলল, মিতিনমাসি… যে লোকটা পেছনে বসে ছিল!

লোকটারও চোখ পড়েছে মিতিনদের ওপর। ঝটপট হেলমেট পরে নিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছে। চামড়ার জ্যাকেট থেকে পার্স বার। করে টাকা দিল দোকানদারকে। তারপর সোঁও করে বেরিয়ে গেল, মেঘাতুবুরুর দিকে।

টুপুর মোটরসাইকেলটার মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বলল, তার মানে লোকটা মেঘাতুবুরুতে থাকে?

মিতিন উত্তর দিল না। পার্থ বলল, সম্ভবত।

কিন্তু লোকটা একা কেন? অন্যজন গেল কোথায়?

পাৰ্থ খ্যাক খ্যাক করে হাসল, ওরা কি সারাক্ষণ নিতাই গৌর হয়ে ঘুরবে নাকি?

তবু…। টুপুর ঢোক গিলল, আচ্ছা, ওরা যদি এদিকেই থাকে, তা হলে ঝিনিকপানি থেকে মুরগি কিনছিল কেন? কম নয়, এখান থেকে ঝিনিকপানি তো ষাট-সত্তর কিলোমিটার দূর।

তুই তো বললি ওদের চাইবাসায় দেখেছি! ফিরছিল, তখন কিনে নিয়েছে।

তাই বলে অদ্দূর থেকে? কাছেপিঠে জামদাই তো ছিল।

ঝিনিকপানির মুরগির হয়তো কোনও স্পেশ্যালিটি আছে। হয়তো ছিবড়ে কম হয়, স্বাদটা মিষ্টি মিষ্টি..

টুপুর তেমন সন্তুষ্ট হল না জবাবটায়। মিতিনকে ঠেলল, ও মিতিনমাসি, বলো না, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না? ওরা চারদিকে ঘুরে ঘুরেই বা বেড়াচ্ছে কেন?

মিতিনকে চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল। অন্যমনস্কভাবে বলল, আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।

কী?

লোকটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি!

এই মূর্তিমানকে? পার্থ ভুরু কুঁচকোল।

না। ওর সঙ্গীটাকে। ঝট করে ওই মুখটা মনে পড়ে গেল। তখনই কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল।

কোথায় দেখেছ? চাইবাসায়? টাটায়? ট্রেনে? কলকাতায়?

মিতিন হতাশভাবে মাথা ঝাকাল, সেটাই তো মনে করতে পারছি না।