১. অফুরান উৎসব

দি নেকেড ফেস – সিডনি সেলডন
নগ্ন নির্জন মুখ – ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন

০১.

সকাল এগারোটা বাজতে দশ।

সারা আকাশ জুঠে হঠাৎ শুরু হয়ে গেছে অফুরান উৎসব। ধবধবে সাদা তুষারের কণা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে সমস্ত শহরের ওপর। রাস্তাগুলো ইতিমধ্যেই বরফ ঢাকা, নতুন করে এই তুষার-বৃষ্টি সে সহ্য করতে পারবে কি? ডিসেম্বরের হু-হুঁ শীতল ঠান্ডা হাওয়া। বড়োদিন উপলক্ষে যারা কেনাকাটা করতে এসেছে, তারা ছুটতে লাগেল।

লেক্সিংটন এভিনিউ। হলুদ বর্ষাতি গায়ে লম্বা রোগা লোকটা নিজস্ব ছন্দে হেঁটে চলেছে। জোরেই হাঁটছিল সে। ঠান্ডা এড়িয়ে এখুনি তাকে ঘরে নিশ্চিত নিরাপত্তায় ফিরতে হবে। লোকটা আনমনা, অনেকের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে তার, কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তার মনে একটাই চিন্তা-মেরির কাছে কত তাড়াতাড়ি খবরটা পৌঁছে দেবে সে।

অতীত মুছে গেছে। এতদিন রুদ্ধকারার অন্তরালে দিন কেটেছে একাকীত্বের যন্ত্রণায়। এখন সে পাখির মতো মুক্ত। নতুন করে জীবনটাকে আবার গড়ে তুলবে।

চোখ বন্ধ করে একবার ভাবরার চেষ্টা করল। এই খবরটা শুনে মেরির মুখের অবস্থা কী রকম হবে? উনষাট নম্বর স্ট্রিটের মুখে নিষেধের লাল আলোটা জ্বলে উঠল। অধৈর্য পথচারীদের পাশাপাশি থমকে থেমে দাঁড়াতে বাধ্য হল সে। একটু দূরে সান্তাক্লজের মূর্তি। ভাগ্যদেবতার উদ্দেশ্যে কিছু পয়সা প্রণামী দিতে হবে। অভ্যাসবশত ডান হাতটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিল সে। আর তখনই তার পিঠে কে যেন চাপড় মারল। চমকে উঠল সে। ভাবল, হয়তো কোনো মাতালের কাণ্ড।

কিন্তু কে মারল? বিস্ময়ের সঙ্গে ও লক্ষ্য করল, ওর হাঁটু দুটো যেন ভেঙে পড়েছে। নিজের দেহটা পথের ওপর আছড়ে পড়ছে। আচমকা আঘাতটা লেগেছে। সমস্ত শরীরে সেটা ছড়িয়ে পড়ছে। মুখের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া জুতোর মিছিল দেখতে পাচ্ছিল সে। হিমঠান্ডা ফুটপাথের ওপর পড়ে থাকা শরীরটা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। বুঝতে পারল সে, এই জায়গাটায় শুয়ে থাকা উচিত নয়। একটা আর্ত চিৎকার বের করার চেষ্টা করল। রক্তধারা মুখ থেকে বেরিয়ে এল। ধারাটা এগিয়ে গেল নর্দমার দিকে। যন্ত্রণাটা দুঃসহ। তবুও সে পরোয়া করল না। ওই শুভ সংবাদটার কথা আরও একবার মনে পড়ে গেল তার। এখন সে মুক্ত! মুক্তির খবর মেরির কানে পৌঁছে দিতে হবে। আকাশে চোখ ধাঁধানো সূর্য। চোখ দুটো বন্ধ করল সে। তুষারকণা আরও জোরে আক্রমণ করতে শুরু করেছে তাকে। ভাগ্যিস একটু বাদে সে হারিয়ে গেল অবচেতনার অন্ধকারে, তা না হলে …

.

০২.

অভ্যর্থনা কক্ষের দরজা খোলা। ক্যারল রবার্টস বসে আছে। দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল সে। পায়ের আওয়াজও। উদ্দেশ্যটা কী? অনুমান করতে পারে সে। ওরা দুজন। চল্লিশ ছাপিয়ে গেছে একজনের বয়স, বিশাল চেহারা, লম্বায় ছু-ফুটের বেশি হবে। নিমেদ শরীর, ইস্পাতের মতো পেশী, মাথাটা প্রকাণ্ড। কৌতুকহীন একজোড়া নীল চোখ। দ্বিতীয় লোকটার বয়স কম। মনে হয় ভোলামেলা প্রকৃতির। চোখদুটি ধূসর। চাউনিতে সতর্কতার ছাপ আছে। দুটো লোকের চেহারা একদম আলাদা। তবুও ক্যারলের মনে হল ওরা বোধহয় একই মায়ের পেটের দুই যমজ ছেলে।

ওরা দুজন পুলিশের লোক। ক্যারলের অনুভূতি এই খবরটা ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছে মাথার ভেতর। এটাই ক্যারলের সবথেকে বড়ড়া গুণ, যে কোনো লোককে দেখে সে পেশা বুঝতে পারে।

ওরা টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘাম গড়াতে শুরু করেছে। কী হল? চিক? কোনো গন্ডগোল নাকি? কিন্তু ছমাসে ও পথ মাড়ায়নি, নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিল। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেদিন চিক সব কিছু ছেড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে? স্যামির কিছু হয়েছে কি? তা কেমন করে সম্ভব? বিমানবাহিনীর কাজে স্যামি তো এখন বিদেশে? দাদার যদি কিছু হয়ে থাকে? তাহলে পুলিশের লোক আসবে কেন?

নাঃ, ঠিক ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। এখন ক্যারল হারলেমের বেশ্যা নয়। তার গায়ে কেউ ধাক্কা মারতে পারবে না। ওর পরিচয় আজ বিরাট। কিন্তু? আতঙ্ক ক্রমশ বাড়ছে কেন?

মনের মধ্যে এত তোলপাড়, মুখে সেটা ফুটিয়ে তোলেনি সে। নিখুঁত ছাঁদের পশমী পোশাক পরা এক বাদামী চামড়ার নিগ্রো তরুণী টেবিলের পেছনে বসে আছে। দেখে মনে হয় আজ বাদে কাল তার বিয়ে হবে। এক নজরে এর বেশি কিছুই বুঝতে পারা যাবে না। স্থির অকম্পিত গলায় ক্যারল প্রশ্ন তুলল–বলুন?

লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি ভালোভাবে তাকাল ক্যারলের দিকে। চোখ হঠাৎ আটকে গেল বগলের নীচে জামার ঘামে ভেজা অংশটাতে। তার মানে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। কিন্তু কেন? ডাক্তারের রিসেপসনিস্ট, ঘাবড়াবার কারণ কী? পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল। পিন দিয়ে গাঁথা চামড়ার পরিচয় পত্র।

ওয়ালেটটা ক্যারলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল–আমি লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি। উনিশ নম্বর থানা থেকে আসছি। আর এ হল ডিটেকটিভ অ্যাঞ্জেলি। আমরা দুজনেই হোমিসাইড ডিভিশনের।

তার মানে? ক্যারলের মুখ কুঁচকে গেছে। মনের ভাব সে আর আটকে রাখতে পারছে না। রাখা সম্ভব নয়। চিক কাউকে খুন করেছে? ডাকাতি করতে গিয়ে মারামারি? নাকি নিজেই গুলি খেয়ে মরে গেছে? অনেকগুলো সম্ভবনা। কোনটা সঠিক, কে জানে?

ঘামের দাগটা ছড়াতে শুরু করেছে। ক্যারল সজাগ হয়ে উঠল। বেশ বুঝতে পারছে সে। এটা ম্যাকগ্রেভির নজর এড়ায়নি।

কমবয়সী গোয়েন্দাটি বলল–আমরা ডাঃ জুড স্টিভেন্সের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোল ক্যারলের বুক থেকে। যাক বাবা, চিক বা স্যামির ব্যাপার নয়। কোনো রকমে সে বলল, মাফ করবেন, ওনার কাছে এখন পেশেন্ট আছে।

ম্যাকগ্রেভি বলল–আমরা বেশি সময় নেব না। আমরা কয়েকটা প্রশ্ন করব। সেই প্রশ্নগুলো এখানেও করা যেতে পারে, অথবা ইচ্ছে হলে উনি আমাদের হেড কোয়ার্টারে আসতে পারেন।

ক্যারল এবার আবার অবাক হয়েছে। নরহত্যা বিভাগের সঙ্গে ডাঃ স্টিভেন্সের কী দরকার? ডাঃ জুড কোনো অন্যায় করেন নি, তাহলে? তাকে কেন জবাবদিহি করতে হবে। চার বছর ধরে ক্যারল এখানে কাজ করছে। ডাঃ জুডের চরিত্র সম্পর্কে সে অনেকের থেকে ভালো খবর রাখে।

সূত্রপাত হয়েছিল কোথায়? আদালত কক্ষে…।

তখন রাত তিনটে। আদালত কক্ষের মাথার ওপর আলোগুলো বিবর্ণ দ্যুতিতে জ্বলছে। ঘরটা একেবারেই পুরোনো। বিরক্তির ছাপ চারদিকে। আতঙ্কের বাসি গন্ধ বাতাসকে ভরপুর করেছে। দেয়ালের গায়ে নোংরা জমতে জমতে পুরু আস্তরণ পড়েছে।

ক্যারলের বরাত দোষ, জজসাহেব মারফিককেই আবার দেখা গেল বিচারকের আসনে বসে থাকতে। দুসপ্তাহ আগে ক্যারল ওর বিচারে ছাড়া পেয়েছিল। সেটা ছিল ক্যারলের প্রথম অপরাধ অর্থাৎ বেজন্মাগুলো সেবারই প্রথম ক্যারলকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। এবার আর রেহাই নেই। ক্যারল জানে, জজ মারফিক তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলবে।

মকদ্দমার সময় এখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। লম্বা শান্ত চেহারার একজন লোককে সামনে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকটা জজসাহেবের সঙ্গে নীচু স্বরে কথা বলছে। হাতকড়া পরা অবস্থায় একটা মোটাসোটা কালো লোক অনবরত কেঁদে চলেছে। শান্ত লোকটা তার হয়ে সালিশি জানাচ্ছে। ক্যারল বুঝতে পারল। ক্যারল একা, ওর হয়ে লড়াই করবে কে?

লোকটা সরে গেল। এবার ক্যারলের নাম ডাকা হল। কাঁপুনি এড়াতে হাঁটু দুটোকে জুড়ে রাখল সে। আদালতের কেরানী জজসাহেবের দিকে অভিযোগ পত্রটি এগিয়ে দিল।

ক্যারলের দিকে তাকিয়ে জজ মারফিক তার সামনে রাখা কাগজটার ওপর চোখ রাখলেন।

–ক্যারল রবার্টস, রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করা এবং মরিজুয়ানাসহ ধৃত হওয়া, তাই তো?

গ্রেপ্তারের ব্যাপারটা নিয়ে প্রচণ্ড হৈ-হৈ হয়েছিল। পুলিশের লোকটা সামান্য ঠেলা দিয়েছিল। রেগে গিয়ে ক্যারল তার অণ্ডকোষে লাথি চালায়। হাজার হোক ও একজন আমেরিকান নাগরিক। বিনা অনুমতিতে ওর গায়ে হাত দেওয়া হবে কেন?

–কয়েক সপ্তাহ আগে আপনি এখানে এসেছেন, তাই না মিস ক্যারল? বিচারক অন্তর্ভেদী চাউনিতে ক্যারলকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে জানতে চাইলেন। ক্যারল আমতা আমতা করে জবাব দিল–হ্যাঁ স্যার।

–আমি এর আগে একবার প্রমাণের অভাবে আপনাকে মুক্তি দিয়েছিলাম?

–হ্যাঁ।

–আপনার বয়স।

–আজই ষোলো বছর পূর্ণ হল। আজ আমার শুভ জন্মদিন।

কথা বলতে বলতে ক্যারল হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল। থরথর করে কাঁপতে থাকল ওর পাতলা শরীর।

লম্বা শান্ত চেহারার লোকটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। চামড়ার অ্যাটাচিতে সে কীসব কাগজপত্র ভরে নিচ্ছিল। ক্যারলকে কাঁদতে দেখে সে বিচারকের আসনের দিকে এগিয়ে গেল।

জজ মারফিক বিরতি ঘোষণা করলেন। লোকটিকে নিয়ে তার ঘরে ঢুকলেন। পনেরো মিনিট কেটে গেল। ক্যারল দেখল, লোকটি অন্তরঙ্গভাবে জজসাহেবের সঙ্গে কথা বলছে।

জজসাহেব বললেন–আপনার ভাগ্য তো ভালো মিস ক্যারল। আপনি আর একটা সুযোগ পেতে চলেছেন। আরও তদন্তের জন্য কোর্ট আপনাকে ডাঃ স্টিভেন্সের ব্যক্তিগত হেফাজতে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

লোকটা তাহলে একজন হাতুরে ডাক্তার? ক্যারল মনে মনে ভাবছিল। যাইহোক তাতে ওর কিছুই আসে যায় না। ষোলো বছরের জন্মদিন ওর নয়, এ কথাটা ওরা জেনে ফেলার আগেই এই কোর্ট চত্বর থেকে ওকে পালাতে হবে।

ডাঃ জুড স্টিভেন্স নিজের গাড়িতে করে ক্যারলকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এলেন। একাত্তর নম্বর স্ট্রিটে। ইস্ট রিভারের সামনাসামনি ফ্ল্যাট বাড়িটা সুন্দরভাবে সাজানো। সদরের সামনে দারোয়ান আর লিফট চালক ডাক্তারকে অভিবাদন জানালেন। রাত তিনটের সময় একটি কালো চামড়ার মেয়েছেলেকে নিয়ে ডাক্তার ঢুকছেন অথচ কারও কোনো ভূক্ষেপ নেই। তার মানে? তার মানে স্টিভেন্স বোধহয় এমন কাজ অনেক দিন ধরেই করছেন।

এত সুন্দর ফ্ল্যাটে ক্যারল কোনেদিন ঢোকেনি। ড্রয়িং রুমটা সাদা ধবধবে রং করা। দুটি নীচু সোফা। মাঝখানে একটা পুরু কঁচ বসানো টেবিল। দাবার ছক সাজানো আছে। চারপাশের দেওয়ালে ঝুলছে আধুনিক তৈলচিত্র। একধারে ছোটো একটা টেলিভিশন। তার থেকে লবির চত্বর দেখা যাচ্ছে। বার কাউন্টার রয়েছে এককোণে, তার পাশে সারি সারি গ্লাস আর কারুকাজ করা সুরা পাত্র।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে ক্যারলের চোখে পড়ল নদীর বুখে ভাসমান নৌকোর । সারি। আঃ, মন কেড়ে নেওয়া ছবি।

জুড বললেন–কোর্টে গেলেই আমার খিদে পায়, কিন্তু জন্মদিন উপলক্ষে ছোট্টা একটা পার্টি হলে কেমন হয়।

ক্যারল রান্না ঘরে ঢুকল। মেক্সিকানদের ওমলেট, ফরাসিদের ভাজা আলু, ইংরেজদের নরম আঁঝরা কেক, চাটনি, সেই সঙ্গে কফি।

ভদ্রলোক বললেন–অবিবাহিত থাকার এই সুযোগ, যখন ইচ্ছে রান্না করা যায়।

তাহলে? লোকটা বিয়ে করেনি, ঠিকে কাজের লোকই নেই। ক্যারল মনে মনে হাসল। লোকটাকে ঠিক মতো খেলাতে পারলে অনেক লাভ হবে। পরিপাটি করে রান্না শেষ হল। জুড ক্যারলকে নিয়ে শোবার ঘরে এলেন। এঘরের দেওয়ালের রঙ নীল। বিরাট জোড়া খাটে যে চাদর তাতেও ডোরা কাটা নীল রং। একটা স্প্যানিশ ড্রেসিং টেবিল রয়েছে। কালচে কাঠের তৈরি। পেতলের কারুকাজ করা।

ভদ্রলোক বললেন–রাতটা আপনি এখানেই কাটিয়ে দিতে পারেন। একটা পাজামা আমি দিয়ে যাচ্ছি।

ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল ক্যারল। খুশিতে শিস দেবার ইচ্ছে হল তার। অনেক দিন বাদে একটা ভালো জ্যাকপটের বাজি ধরেছে সে। চোখ বন্ধ করে লোকটার মুখখানা ভাববার চেষ্টা করল। লোকটা কী চাইছে? ওর অনেক দিনের ইচ্ছে একটা মাদী জেল ঘুঘুর কালো পাছা দেখবে। ওর ইচ্ছেটা আমিই শেষ পর্যন্ত পূরণ করব।

ধারাস্নানের কলের নীচে আধঘন্টা নগ্নিকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ক্যারল। স্নান সেরে করে তার যৌবনোচ্ছুল দেহটার ওপর তোয়ালে জড়াল। বাইরে এল, দেখল বিছানার ওপর একটা পাজামা রাখা। আপন মনে হেসে উঠল সে। একটানে তোয়ালেটা খুলে মাটিতে ফেলে দিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় হেঁটে গেল বৈঠকখানার দিকে। সেখানে কেউ ছিল না। আরও এগিয়ে গেল সে। পাশের ছোট্ট ঘরটায় উঁকি দিল। বিরাট একটা টেবিলের পেছনে লোকটাকে দেখা গেল। ঘরটা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বইতে ঠাসা। মুচকি হাসি হেসে ক্যারল পা টিপে টিপে জুডের পেছনে এসে দাঁড়াল। ঘাড়ে আলতো একটা চুমু খেল। ফিসফিস করে বলল–এসো না, আমি তো আর থাকতে পারছি না।

জুডের মাথাটা ওর কবোষ্ণ বুকে ঠেসে ধরল।

জুড ওর এই আচরণে অবাক হয়ে গেছে।

ক্যারল আবার আদুরে কণ্ঠস্বরে বলল–আমরা দেরী করছি কেন?

জুড কোনোরকমে নিজেকে মুক্ত করলেন। ক্যারলের নগ্নিকা দেহের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। বললেন–এতেও কি তোমার শিক্ষা হয়নি? নিগ্রো হয়ে জন্মানোর জন্যে তুমি নিশ্চয়ই দায়ী নও। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বেশ্যা বৃত্তি করার ইচ্ছেটা কে মাথায় দিল?

ক্যারল হাত ছাড়িয়ে কয়েক ইঞ্চি সরে দাঁড়াল। ভুলটা কোথায় হয়েছে সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। শোয়ানোর আগে হারামজাদাটা কোনো নতুন খেলা খেলতে চাইছে। নাকি? দেখাই যাক, আরও একবার চেষ্টা করে।

জুডের দু-পায়ের সন্ধিস্থলে হাতটা এগিয়ে নিয়ে গেল ক্যারল। মৃদু একটা টোকা দিয়ে বলল–অনেক হয়েছে, এবার দেখি তুমি কেমন আমাকে সুখ দিতে পার।

জুড ক্যারলকে আলতো হাতে সরিয়ে দিলেন। পাশের একটা আরাম কেদারায় বসিয়ে দিলেন। এর আগে কোনো পুরুষ মানুষের এমন আচরণ কখনও দেখেনি ক্যারল। লোকটা কী? লোকটা কি মর্তকামী? নিজেকে সামলে নিয়ে ক্যারল বলল–তোমার মতলবটা কী; কেমন করে পেতে চাইছ আমাকে?

–বেশ আলোচনা শুরু হোক তাহলে।

কথা শুরু হল। সমস্ত রাত্রি ধরে চলল আলোচনা। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। একের পর এক প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ডাঃ স্টিভেন্স খুঁটিনাটি অনেক কিছু জেনে নিলেন। ভিয়েতনাম আর ইহুদি কলেজে দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষয়ে ক্যারলের মতবাদ শুনলেন তিনি। যখন-তখন এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা কী? ডাঃ স্টিভেন্স কী চাইছেন? তিনি কি তার এই কাজে সফল হয়েছেন?

সে রাতে হঠাৎ একসময় ক্যারল বুঝতে পারল, সে একদম নগ্নিকা। পাজামা গলিয়ে ফিরে এল সে। বিছানার ধারে বসে আরও অনেক কথা হল। এতদিন পর্যন্ত যেসব কথাগুলো

ওর মনের ভেতর জমা ছিল, সব হুড়হুড়িয়ে বেরিয়ে এল। অবচেতন মনের গভীরে যেসব স্মৃতি, তাদের রোমন্থন। তারপর? আঃ, ঘুম, নিশ্চিত নিদ্রার আমন্ত্রণ, তখন হালকা লাগছিল শরীরটাকে। মনে হয়েছিল তার, বিরাট একটা অপারেশনের পর শরীর থেকে সব বিষ বোধহয় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সকালে ব্রেকফাস্টের পর ডাঃ জুড স্টিভেন্স ক্যারলের হাতে একশো ডলারের নোট এগিয়ে দিয়েছিলেন।

ক্যারল ইতস্তত করে বলেছিল কাল আমি মিথ্যে বলেছিলাম, আমার জন্মদিন ছিল না।

জুড হেসেছিলেন–ভয় নেই। জজসাহেবকে একথাটা জানাতে যাচ্ছি না।

তারপর গলার স্বর পাল্টে বলেছিলেন–ইচ্ছে করলে টাকাটা নিয়ে তুমি এখান থেকে চলে যেতে পার। আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, আমার একজন রিসেপশনিস্টের দরকার ছিল। আশা করি, কাজটা তুমি ভালোই করতে পারবে।

অবিশ্বাসের চোখে ক্যারল তাকিয়েছিল ফ্যালফ্যাল করে, তারপর বলেছিল–ওই কাজটা কি আমি করতে পারব? আমি শর্টহ্যান্ড বা টাইপ কোনোটাই জানি না।

–সেটা স্কুলে ভর্তি হলেই শিখে নেওয়া যায়।

–হ্যাঁ, এটা আমি ভেবে দেখিনি। তবে কাজটা খুবই এক ঘেয়ে।

সেই হল চাকরি জীবনের শুরু। দেখতে দেখতে চারটে বছর কেটে গেছে। সেই কাজে আজও একইরকম ভাবে কাজ করে চলেছে।

এতক্ষণ ক্যারল অতীত স্মৃতির রোমন্থনে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল। এখন আবার রুঢ় বাস্তবের কঠিন ভূমিতে ফিরে এল সে। পলিশের লোক দুটো কী চাইছে? ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে কেন?

ম্যাকগ্রেভিকে অধৈর্য মনে হল। নিথর চোখে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল–বলুন মিস।

ক্যারল শান্ত শীতল কণ্ঠস্বরে জবাব দিল–আমার ওপর হুকুম দেওয়া আছে, পেশেন্ট থাকলে আমি যেন কখনও ওনাকে বিরক্ত না করি।

দেখল তার এই কথার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তারপর ফোন তুলে ইন্টারকমের বোম টিপল, ও প্রান্তে ডাঃ স্টিভেন্সের গলা পাওয়া গেল।

ক্যারল বলল–স্যার, দুজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওনারা, হোমিসাইড ডিভিশন থেকে আসছেন।

ক্যারল ভেবেছিল, এই কথা শুনে জুড হয়তো বিচলিত হবেন অথবা ভয়ার্ত। কোনোটাই হল না।

উনি শুকনো গলায় বললেন–ওনাদের অপেক্ষা করতে হবে। বলেই লাইনটা কেটে দিলেন।

দুই আগন্তুকের দিকে গর্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্যারল বলল–উত্তরটা আপনারা নিজের কানেই শুনলেন।

অ্যাঞ্জেলির প্রশ্ন–ওনার পেশেন্ট কতক্ষণ থাকবেন?

টেবিলে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ক্যারল বলল–আরও ধরুন মিনিট পঁচিশ। উনি আজকের শেষ পেশেন্ট।

ম্যাকগ্রেভি তাকাল অ্যাঞ্জেলির চোখের দিকে। ক্যারলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ঠিক আছে। আমরা অপেক্ষা করছি। চেয়ারে বসে পড়ে বলল, আপানকে কিন্তু বড় চেনা-চেনা বলে মনে হচ্ছে।

ক্যারল বুঝতে পারল, লোকটা টোপ ফেলার চেষ্টা করছে। সে অমায়িক হাসিতে মুখ উদ্ভাস করে বলল–হতে পারে, আমার মতো আরও কত মেয়েই তো ঘুরে বেড়াচ্ছে, শহরের পথে প্রান্তরে।

পঁচিশ মিনিট বাদে স্টিভেন্স তার ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ম্যাকগ্রেভিকে দেখে কেমন একটা ভাব ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি বললেন–আমাদের আগেই পরিচয় হয়েছে কি?

ম্যাকগ্রেভি ঘাড় নাড়ে-হ্যাঁ, আমি লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি, আর উনি ডিটেকটিভ ফ্রাঙ্ক অ্যাঞ্জেলি।

জুড অ্যাঞ্জেলির সঙ্গে করমর্দন করে বললেন–ভেতরে আসুন।

মেঝেতে বিছানো একটা সুন্দর গালিচা। লেখার কোনো টেবিল নেই, কয়েকটা আরাম কেদারার মতো চেয়ার আছে। পাশে ছোটো ছোটো চৌকি। একটা দরজা দিয়ে করিডরে যাওয়া যায়, ম্যাকগ্রেভি লক্ষ্য করল। দেয়ালে ডাক্তারের কোনো ডিপ্লোমা বাঁধিয়ে রাখা নেই। অবশ্য ডাঃ স্টিভেন্স সম্পর্কে ওরা আগে থেকেই খোঁজখবর দিয়েছে। ইচ্ছে করলে ডাঃ স্টিভেন্স তার ঘরের সবকটা দেয়াল সার্টিফিকেটে ভরিয়ে রাখতে পারতেন।

অ্যাঞ্জেলি বলে উঠল–এই প্রথম আমি একজন সাইকিয়াটিস্টের চেম্বারে ঢুকলাম। আহা, আমরাও যদি আমাদের ঘরটাকে এভাবে সাজাতে পারতাম।

–আমার পেশেন্টরা এখানে এসে একটু আরাম পায়। জুডের গলায় কোনো জড়তা নেই।

-হ্যাঁ, আমি একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট।

-মাফ করবেন, অ্যাঞ্জেলি বলল–দুটোর তফাত আমার জানা নেই।

–তফাত ঘন্টায় পঞ্চাশ ডলারের।

ম্যাকগ্রেভি তাকাল জুডের দিকে। আমার সহকারীর অভিজ্ঞতা খুব একটা বেশি নয়। মাঝে মধ্যে উল্টোপাল্টা কথা বলে বসে। আশা করি এর জন্য আপনি কিছু মনে করবেন না।

সহকারীহঠাৎ সব কথা মনে পড়ে গেল জুডের। একটা মদের দোকানে অভিযান চালাতে গিয়েছিল ম্যাকগ্রেভির সহকারী। গুলি খেয়ে মারা যায় সে। ম্যাকগ্রেভি নিজেও আহত হয়। সেবার আমোস জিফরেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে পাগল সাব্যস্ত করে উকিল বেকসুর মুক্তির দাবী করে। তখন জুডের ডাক পড়ে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে তিনি জিফরেনকে পরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষাতে ধরা পড়ে জিফরেন বদ্ধ উন্মাদ। তার শরীরের কিছুটা প্যারালিসিসে আক্রান্ত। মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে জিফরেন রেহাই পেয়ে যায়। তাকে উন্মাদ আশ্রমে পাঠানো হয়।

জুড বললেন, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। জিফরেনের মামলায় আমাদের কথা হয়েছিল। আপনার গায়ে তিনটে গুলির আঘাত ছিল। আপনার সহকারী মারা গিয়েছিলেন।

-হ্যাঁ, আপনার দৌলতে এক খুনি বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছিল।

জুড প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন–বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?

–আপনার কাছে কিছু তথ্যের জন্য এসেছিলাম। ম্যাকগ্রেভি অ্যাঞ্জেলির দিকে তাকাল। অ্যাঞ্জেলি হাতের প্যাকেটটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল–একটা জিনিস আপনাকে দিয়ে সনাক্ত করাব আমরা।

অ্যাঞ্জেলি প্যাকেট খুলল। হলুদ প্লাস্টিকের একটা বর্ষাতি বেরোল।

–এটা আপনি দেখেছেন ডাঃ স্টিভেন্স?

–জিনিসটা তো আমারই মনে হচ্ছে। জুডের গলায় বিস্ময়।

–আপনারই, অন্তত আপনার নাম এতে লেখা আছে।

–কোথা থেকে পেয়েছেন এটা?

–কোথা থেকে পাওয়া সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?

এবার আগন্তুক দুজনের মুখে লক্ষনীয় পরিবর্তন এসেছে। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই শিষ্টাচার বোধ।

ম্যাকগ্রেভির মুখের দিকে তাকিয়ে জুড পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বললেন–পুরো ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলুন।

–আমরা রেনকোটটা সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছে ডাঃ স্টিভেন্স। যদি এটা আপনার হয়ে থাকে, তাহলে আমরা জানতে চাই এটা কী করে হাতছাড়া হয়েছে?

ম্যাকগ্রেভি এবার স্পষ্টাস্পষ্টি জানতে চাইছে।

–এর মধ্যে রহস্যের কিছু নেই। সকালে যখন চেম্বারের আসব বলে বেরোচ্ছি, তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি রেনকোটটা পরিষ্কার করতে দোকানে দিয়েছি বলে মাছধরার রেনকোটটা গায়ে চাপিয়ে দিলাম। এখানে এসে দেখি, আমার একজন পেশেন্ট রেনকোট ছাড়াই এসেছে। তখন রীতিমতো তুষারপাত শুরু হয়েছে। যাবার সময়ে তাকেই এই রেনকোটটা দিয়েছিলাম। কেন? কী হয়েছে তার?

–কার কথা বলছেন আপনি? ম্যাকগ্রেভি জানতে চাইল।

–কেন আমার পেশেন্ট জন হ্যানসেন।

–বাঃ, আপনি দেখছি নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছেন। শান্ত গলায় বলল অ্যাঞ্জেলি। মিঃ হ্যানসেন আর কখনও নিজের হাতে রেনকোটটা আপনাকে ফেরত দিতে পারবেন না। কারণ উনি মারা গেছেন।

কথাটা শুনে জুডের মনে হল, তারা সারা শরীরে কে যেন বিদ্যুৎ-প্রবাহ দিয়ে আঘাত করছে। তিনি বললেন–মারা গেছেন?

–কেউ তাকে পেছন থেকে ছুরি মারে। ম্যাকগ্রেভি বলল।

জুড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ম্যাকগ্রেভি বর্ষাতিটা অ্যাঞ্জেলির হাত থেকে নিয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে ধরল, যাতে চেরা অংশটা জুডের নজরে পড়ে। কোটটার পিঠে অনেকখানি জায়গা জুড়ে মেহেদি রঙা একটা ছোপলাগা। জুডের গা গুলিয়ে উঠল।

কোনোরকমে ঢোঁক গিলে জুড বললেন–ওকে কে মারল?

–সেটাই তো আপনার কাছ থেকে শুনব বলে আমরা এসেছি ডাঃ স্টিভেন্স। এই ব্যাপারটা একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট সবথেকে ভালো জানতে পারেন। আপনি এ ব্যাপারে আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন, আশা করি।

থেমে থেমে অ্যাঞ্জেলি বলল।

জুড অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে জানতে চাইলেন কখন ঘটেছে এই ঘটনাটা?

ম্যাকগ্রেভি জবাব দিল–আজ সকাল এগারোটায় লেক্সিংটন এভিনিউতে আপনার অফিস থেকে এক ব্লক দূরে। বেশ কয়েক ডজন লোক হয়তো তাকে রাস্তায় পড়তে দেখেছিল। কিন্তু কেউই খেয়াল করেনি। বরফের ওপর রক্ত ঝরাতে ঝরাতে উনি মারা যান।

জুড টেবিল ক্লথের একটা কোণ খামচে ধরলেন।

–মিঃ হ্যানসেন এখানে ঠিক কটায় এসেছিলেন ডাঃ স্টিভেন্স?

অ্যাঞ্জেলি জানতে চাইল।

–ঠিক দশটায়।

–কতক্ষণ ছিলেন?

–প্রায় পঞ্চাশ মিনিট।

–তারপর বেরিয়ে গিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, ওনার পরে আমার অন্য পেশেন্ট ছিল।

–উনি কি আপনার রিসেপশন অফিস দিয়ে বেরিয়ে ছিলেন?

–না, আমার পেশেন্টরা রিসেপশন অফিস দিয়ে ঢেকে আর বেরোয় এই দরজা দিয়ে। তাই আমার পরবর্তী পেশেন্টের সঙ্গে আগের পেশেন্টের দেখা হয় না।

–তাহলে দেখা যাচ্ছে মিঃ হ্যানসেন আপনার এখান থেকে বেরোনোর কিছুক্ষণ পরেই মারা গেছেন। আচ্ছা, উনি কেন আপনার কাছে এসেছিলেন তা বলবেন কি?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে জুড ইতস্তত করতে থাকেন। তারপর বলেন–ক্ষমা করবেন। ডাক্তার আর পেশেন্টের আলোচনা প্রকাশ করা আমার পক্ষে উচিত নয়।

মনে রাখবেন, ওকে হত্যা করা হয়েছে। ম্যাকগ্রেভি বলল, আপনার সাহায্য পেলে আমরা হয়তো হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারি।

জুডের পাইপ নিভে গিয়েছিল। উনি আগুন ধরাবার ছুতোয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাববার সুযোগ পেয়ে গেলেন।

অ্যাঞ্জেলি জানতে চাইল–উনি কতদিন আপনার কাছে যাতায়াত করছেন?

–তিনবছর।

–ওনার সমস্যাটা কী ছিল?

আবার ইতস্তত করতে দেখা গেল ডাঃ স্টিভেন্সকে। আজ সকালে দেখা জন হ্যানসেনের মুখটা মনে পড়ে গেল। আবেগকম্পিত মুখ। চোখ দুটিতে হাসির উপস্থিতি।

–ও ছিল সমকামী। অবশেষে তিনি বললেন।

ম্যাকগ্রেভির গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যাঙ্গ–তাহলে এটা কোনো সুন্দরীর কারসাজি।

–সমকামী তিনি ছিলেন, আমি তাকে সারিয়ে তুলি। আজ সকালেই ওকে বলেছিলাম, আর আমার কাছে আসার প্রয়োজন নেই। উনি আবার সুখী দাম্পত্য জীবন শুরু করতে পারবেন। ওনার দুই ছেলে, মেয়ে আর স্ত্রী আছে।

–স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও? ম্যাকগ্রেভি জানতে চাইল।

–এই ধরনের ঘটনা অনেক দেখা যায়।

–কাজটা ওনার কোনো প্রাক্তন প্রেমিক করেছে কি? সামান্য বচসা থেকে ছুরি মারামারি হওয়াটা কি একেবারেই অসম্ভব?

ম্যাকগ্রেভির পরের প্রশ্ন।

জুড কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলেন–হতেও পারে? কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হচ্ছে না।

–কেন ডাঃ স্টিভেন্স? অ্যাঞ্জেলির কৌতূহল।

–কারণ গত একবছর ধরে হ্যানসেনের সঙ্গে কারোর যোগাযোগ ছিল না। বরং আমার : ধারণা কেউ বোকা বানিয়ে টাকা নিতে চেয়েছিল। সেরকম কিছু হলে হ্যানসেন ছেড়ে দেবার, পাত্র নয়।

গ্রেভি সিগারেট ধরাল–আপনার বোকা বানানোর থিয়োরিটাতে তো একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। ওনার মানিব্যাগ স্পর্শ করা হয়নি। একশো ডলারের ওপর ছিল মানিব্যাগের মধ্যে ।

কথাটা বলে সে সন্তর্পণে জুডের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে থাকে।

অ্যাঞ্জেলি বলল–কোনো উন্মাদের সন্ধান করলে মনে হয় আমাদের কাজটা সহজ হবে।

জুড জানলার কাছে এগিয়ে গেলেন–কেউ উন্মাদ হলেই যে তার লক্ষণ বোঝা যাবে, এমন কোনো অর্থ নেই। শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে আমরা বাইরে থেকে পাগলামি প্রমাণ করতে পারি না।

ম্যাকগ্রেভি কৌতূহলী চোখে জুডকে লক্ষ্য করল। বলল–মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু আপনার জানা আছে দেখছি। কতদিন ধরে আপনি এসব নিয়ে চর্চা করছেন?

–বারো বছর। কেন?

–না, তেমন কিছু নয়।

–আপনি তো রীতিমতো সুদর্শন পুরুষ। তাই ধরে নিন, যদি আপনার পেশেন্টদের মধ্যে কেউ আপনার প্রেমে পড়ে যায়, তাহলে সেটা কি অন্যায় হবে?

–আপনার প্রশ্নের অর্থ আমার কাছে ঠিক বোধগম্য হল না।

–আমার মনে হচ্ছে, আপনি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। আমরা দুজনেই লাইনের লোক, তাই না ডাক্তার। একজন সমকামী তরুণ সুদর্শন চিকিৎসকের সামনে তার সমস্যা বলতে এল।

ম্যাকগ্রেভির গলা ক্রমশ রহস্যময় হয়ে ওঠে-আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন যে, তিন বছরেও তার সঙ্গে আপনার কোনো মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি?

জুড ভাবলেশহীন মুখে তাকালেন–মানব চরিত্র সম্পর্কে আপনার কি এই ধারনা লেফটেন্যান্ট?

একটু বিচলিত না হয়ে ম্যাকগ্রেভি বলল–না, আমি শুধু অনুমান করছি। তাছাড়া আর কী কী হতে পারে তাও আপনাকে বলছি। আপনি যখন বললেন যে, আপনার কাছে আমার আর প্রয়োজন নেই, কথাটা হ্যানসেনের ভালো নাও লাগতে পারে। তিন বছর আপনার অধীনে ছিলেন। হয়তো এনিয়ে আপনাদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছিল।

এই অভিযোগ শুনে জুডের মাথা গরম হয়ে গেল। শেষ অব্দি অ্যাঞ্জেলি ব্যাপারটা সামাল দিল–আচ্ছা, আপনি কি এমন কাউকে জানেন, যার সঙ্গে হ্যানসেনের সম্পর্কটা ভালো ছিল না? অথবা এমন কেউ, যাকে উনি মোটেই পছন্দ করতেন না?

–সে রকম কেউ থাকলে নিশ্চয়ই তার নাম বলে দিতাম কারণ জন হ্যানসেন সম্পর্কে সব তথ্যই আমার জানা। কারোর প্রতি তার বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ ছিল না। কেউ তাকে অপছন্দ করেনি।

–আমরা ওনার ফাইলটা নিয়ে যাব।

–আমি দুঃখিত। ওটা দেওয়া সম্ভব নয়।

–দরকার হলে কোর্টের হুকুম আমরা আনতে পারি।

–তাই আনুন তা হলে। ওই ফাইলে যা আছে, তাতে আপনাদের কিছু কাজ হবে না।

–তাহলে ওটা আমাদের দিলে আপনার কী ক্ষতি হবে?

–হ্যানসেনের স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় আপনারা ভুল জায়গাতে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে, উনি একজন অচেনা অজানা লোকের হাতে খুন হয়েছেন।

ম্যাকগ্রেভি বলল–না, আমি তা বিশ্বাস করি না।

বর্ষাতিটা মুড়ে অ্যাঞ্জেলি তাতে দড়ি জড়িয়ে নেয়–আরো কিছু পরীক্ষা করে এটা আপানাকে ফেরত দেব।

–ওটা আমার প্রেয়োজন নেই। আপনারা রেখে দিতে পারেন।

ম্যাকগ্রেভি উঠে দাঁড়িয়ে করিডরের দরজাটা খুলল। বলল–আপনার সঙ্গে আবার। যোগাযোগ করব কেমন?

মাথা ঝাঁকিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। অ্যাঞ্জেলি তাকে অনুসরণ করল।

ক্যারল ঘরে ঢুকল। দেখল জুড তখনও দরজার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

ক্যারল বলল–কোনো গন্ডগোল হয়নি তো?

–জন হ্যানসেনকে কেউ খুন করেছে।

ক্যারল চমকে উঠল–খুন করেছে?

–হ্যাঁ, ছুরি মেরেছে।

–কী সর্বনাশ! কিন্তু কেন?

–সেটা পুলিশও জানে না।

–হয় ভগবান!

জুডের বেদনার্ত চোখ দুটো লক্ষ্য করে ক্যারল বলল–আমাকে দিয়ে আপনার কি। কোনো সাহায্য হবে?

–তুমি বরং আজ অফিস বন্ধ করে দাও। আমি মিসেস হ্যানসেনের সঙ্গে দেখা করে আসি। খবরটা আমি নিজেই তাকে জানাব।

–ব্যস্ত হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করছি।

–ধন্যবাদ।

জুড বেরিয়ে গেলেন।

আধঘন্টা বাদে ক্যারল ফাইল পত্র গুছিয়ে টেবিলের দেরাজে চাবি আঁটতে যাচ্ছে, তখন করিডরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। চোখ তুলে তাকাতেই ও দেখল একজন হাসতে হাসতে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

.

তিন

মেরি হ্যানসেনকে দেখতে যেন পটে আঁকা ছবি। ছোটোখাটো চেহারা, অপরুপ দেহ বল্লরী। সরলতার এই প্রতিমূর্তিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, খুবই অসহায়। অভিমানে গলে যাওয়া মোমের পুতুল। আসলে মনটা তার গ্রানাইট পাথরের মতো শক্ত।

জুড একবার মেরি হ্যানসেনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জন হ্যানসেনের চিকিৎসা শুরু হবার এক সপ্তাহ বাদে। স্বামীর চিকিৎসা হচ্ছে শুনে মেরি ক্ষেপে উঠেছিল। তাই বাধ্য হয়ে জুডকে আসতে হয়েছিল। জুড জানতে চেয়েছিল, ওনার চিকিৎসার ব্যাপারে আপনার আপত্তি কীসের।

–তার কারণ আমি বন্ধু-বান্ধবীদের জানাতে চাই না যে, আমি একটা বদ্ধ উন্মাদকে বিয়ে করেছি। আরো বলেছিল মেরি, ওকে বলুন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে। তারপর ও যা খুশি করতে পারে।

জুড বুঝিয়ে ছিলেন বিবাহ বিচ্ছেদের অর্থ হল স্বামীকে সত্যি সত্যি ধ্বংসের পথে এগিয়ে দেওয়া।

মেরি চেঁচিয়ে ওঠে- ধ্বংস হতে আর কী বাকি আছে? ওর এ রকম চরিত্র জানলে, আমি কি ওকে বিয়ে করতাম? মেয়ে-ছেলের বেহদ্দ একটা।

–আপনার স্বামীর ব্যাপারে কতগুলো জটিল মনোস্তাত্ত্বিক সমস্যা আছে মিসেস হ্যানসেন। তবে সেগুলো সারিয়ে তোলা যাবে। উনি নিজে একান্তভাবে চেষ্টা করছেন। আমার মনে হয় ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে আপনি ব্যাপারটা মেনে নিন।

সেদিন তিন ঘন্টা ধরে কথা বলেছিলেন ডাঃ জুড। একটা ব্যাপারে তিনি সফল হয়েছিলেন, বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে মেরিকে বিরত রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য এ ব্যাপারে মেরিকে যথেষ্ট কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, স্বামীর জীবন সংগ্রামের সাথে নিজেকে ধীরে ধীরে একাত্ব করে সে। জুড ঠিক করেছিলেন, কোনো দম্পতির একসঙ্গে চিকিৎসা করবেন না। কিন্তু মেরির ক্ষেত্রে তাকে নিয়ম ভঙ্গ করতে হয়েছিল। অবশ্য মেরিকে পাওয়াতে এই কাজটা তাড়াতাড়ি করতে পেরেছিলেন। স্ত্রী হিসাবে মেরির ব্যর্থতার কারণগুলো জানার পর জন হ্যানসেনের নিরাময় দ্রুত গতিতে এগোতে থাকে।

আর আজ উনি এসেছেন একটা শোক সন্তপ্ত সংবাদ জানাতে, কাজটা কত কঠিন ডাক্তার তা জানেন। কিন্তু খবরটা তো বলতেই হবে।

কথাটা শুনে মেরি এমন চোখে তাকাল যেন ডাক্তার ওর সঙ্গে রসিকতা করছেন। পরক্ষণেই বলল সে-ও তার আমার কাছে কোনোদিন ফিরে আসবে না? বলে আর্ত চিৎকার করে উঠল, আপনি বলছেন ও আর কোনোদিন এ বাড়িতে আসবে না? আহত–জন্তুর মতো ছটফট করতে করতে নিজের পোশাক ছিঁড়তে শুরু করল। গোলমাল শুনে। ছ-বছরের দুই যমজ শিশু ঘরে এসে ঢুকে পড়ল। জায়গাটা হয়ে উঠল ঠিক পাগলা গারদের। মতো।

জুড অনেক কষ্টে বাচ্চা দুটোকে শান্ত করলেন। পাশের বাড়ির এক প্রতিবেশীর কাছে ওদের পাঠিয়ে দিলেন। ফিরে এসে মেরিকে ঘুমের ওষুধ দিলেন। পারিবারিক চিকিৎসককে ডেকে পাঠালেন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্তে আসার পর ধীরে বেরিয়ে এলেন ওখান থেকে।

মনের আকাশে চিন্তার মেঘের আনাগোনা। জুড এলোপাথাড়ি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হ্যানসেন যখন তীব্র সংগ্রাম করে জয়ের সীমারেখায় পৌঁছে গেছেন, তখন এই হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল? কোনো সমকামী বন্ধুই কি প্রণয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এই কাজটি করেছে? ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। কিন্তু ডাক্তার মন থেকে তা মানতে পারছিলেন না। লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি জানিয়েছে, ওনাকে পাওয়া গেছে ডাক্তারখানা থেকে এক ব্লক দূরে। হত্যাকারী যদি প্রতিহিংসা পরায়ণ সমকামী বন্ধু হয়ে থাকে তাহলে কোনো নির্জন জায়গাতেই সে আক্রোশ মেটাতে পারত। জনসমক্ষে এমন কাজ কেন করল?

দূরে একটা টেলিফোন বুথ নজরে পড়ল ডাক্তার জুডের। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, আজ রাতে পিটার হ্যাডলি ও তার স্ত্রী নোরার সঙ্গে ডিনার খাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। ওই পরিবারের সঙ্গে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক। কিন্তু আজ রাতে উনি কোথাও যেতে পারবেন না।

গাড়ি থামিয়ে বুথে ঢুকলেন। হ্যাডলির টেলিফোন নম্বর ডায়াল করলেন।

নোরা ফোন ধরলেন–কী ব্যাপার এত দেরি আপনার? কোথা থেকে ফোন করছেন?

–নোরা, আজকের দিনটা আমাকে মাফ করে দাও। আজ আমি যেতে পারছি না।

–কক্ষনো নয়। জানেন আপনার সঙ্গে আলাপ করার জন্য একজন হাপিত্যেশ করে বসে আছে। ওঃ, যা দেখতে না ওকে।

–অন্য দিন আলাপ করতে বলো, নোরা। আজ সত্যি মেজাজ ভালো নেই। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

–দাঁড়ান এক মিনিট, চাইবার মজা টের পাওয়াচ্ছি।

পিটার হ্যাডলি ফোন ধরলেনকী খবর বন্ধু? জিজ্ঞাসা করি কোনো গন্ডগোল?

–না-না, সেরকম কিছু নয়। আজ অনেক কাজ পড়ে গেছে পিট, কাল দেখা হলে সব বলব।

–বন্ধু, তুমি এক মনোরম স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বস্তু থেকে বঞ্চিত হলে। এক কথায় বলা যায় অনবদ্য।

জুড হাসতে চেষ্টা করলেন–ঠিক আছে, অন্য কোনো সময় তার সঙ্গে দেখা করব। টেলিফোনে দ্রুত কিছু ফিসফিসানি শুনতে পেলেন। কোনো একটা গোপন পরামর্শ।

–নোরা আবার ফোন ধরলেন–ও আমার বড়ো দিনের ডিনারে আসবে। আপনি ওদিন। আসবেন তো?

–নোরা, এব্যাপারে পরে আলোচনা করব, কেমন? আজ ফোন ছাড়ছি।

কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলেন জুড।

অনেক কথাই মনে পড়ে গেল তার। কলেজের শেষ সোপানে পৌঁছে জুড বিয়ে করেছিলেন। এলিজাবেথ ছিল ওই কলেজে সমাজ-বিজ্ঞানের ছাত্রী। তারুণ্যের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ সমৃদ্ধ দিনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু নিয়তি বড়োই নিষ্ঠুর। তারপর এক বছর কাটেনি। বড়োদিনের দুর্ঘটনায় মারা গেল এলিজাবেথ। মারা গেল তাঁর অজাত সন্তান। এক নিমেষে সমস্ত পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল ডাক্তারের চোখের সামনে। তারপর থেকে তিনি মন দিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। আজ দেশের অন্যতম মনোবিজ্ঞানীতে পরিণত হয়েছেন। এর অন্তরালে আছে ওই শোক সন্তপ্ত স্মৃতি। কাউকে বড়োদিনের উৎসব পালন করতে দেখলে মাথার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটে যায় ডাক্তারের। তিনি চান, ওই দিনটা সকলে এলিজাবেথ এবং তার অজাত সন্তানের জন্য শোক স্তব্ধতায় কাটাক। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি।

সাধারণত তাকে দেখলে বাড়ির দারোয়ান মাইক হাসিমাখা মুখ নিয়ে অভিবাদন জানায়। আজ কিন্তু তার হাসিতে অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া ছিল না। নিশ্চয়ই কোনো পারিবারিক ঝামেলা পাকিয়েছে লোকটা। তিনি ভাবলেন প্রায়ই তার ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে কুশল প্রশ্ন করেন। কিন্তু আজ তাও ভালো লাগছে না। গাড়িটা গ্যারেজে পাঠিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন।

–ঠিক আছে স্যার, কিছু বলতে গিয়ে মাইক নিজেকে সামলে নিল।

জুড বাড়িতে ঢুকলেন। লবিতে ম্যানেজার বেন কাটজের সঙ্গে দেখা হল। চোখাচোখি হল। ভদ্রলোক হাত নেড়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

জুড মনে মনে ভাবলেন, আজ হল কী সকলের? নাকি আমার মন দুর্বল বলে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে সকলে?

লিফটের দরজায় পা রাখলেন তিনি।

লিফট চালক এডি এগিয়ে এসে অভিবাদন জানাল–গুড ইভিনিং ডাঃ স্টিভেন্স।

–গুড ইভিনিং এডি। ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিল এডি। –এডি কোনো গোলমাল হয়েছে কি?

এডি এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না।

জুড ভাবলেন, এও দেখছি এক রহস্যময় মানুষ। সমস্ত বাড়িটাই বোধহয় আজ ভুতুরে হয়ে উঠেছে।

লিফট থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। কিছু দূর এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তার মনে হল লিফটের দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনেননি কেন? ঘুরে তাকালেন। এডি এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তাড়াতাড়ি দরজা টেনে সে নিজেকে আড়াল করে দিল।

কাঠের দরজায় চাবি ঘুরিয়ে জুড ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে আলোগুলো জ্বলছে কেন? জুড অবাক হলেন। ম্যাকগ্রেভি বৈঠকখানার একটা দরজা জোর করে খুলতে চেষ্টা করছিল। ঠিক সেই সময় অ্যাঞ্জেলি শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

জুড জিজ্ঞাসা করলেন–আমার ফ্ল্যাটে আপনারা কী করছেন?

ম্যাকগ্রেভি শান্ত গলায় বলল–আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ডাঃ স্টিভেন্স।

জুড এগিয়ে এলেন। সদ্য খোলা ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিলেন। একটুর জন্য ম্যাকগ্রেভির আঙুলগুলো বেঁচে গেল।

–এখানে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে?

–আমাদের সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। অ্যাঞ্জেলি বলল।

–সার্চ ওয়ারেন্ট? আমার ফ্ল্যাটে?

–আমরা যদি কিছু প্রশ্ন করি, আপনি কি উত্তর দেবেন? ম্যাকগ্রেভি জানতে চাইল। উকিল ছাড়া ওগুলোর উত্তর দেওয়া বা না-দেওয়া সবকিছু আপনার মর্জির ওপর নির্ভর করছে। অ্যাঞ্জেলি আরও বলল–মনে রাখবেন, আপনি এরপর থেকে যা বলবেন, সে গুলো আপনার বিরুদ্ধে কোর্টে ব্যবহৃত হতে পারে।

ম্যাকগ্রেভি জানতে চাইল–আপনি কি উকিলকে খবর দিতে চান?

–প্রয়োজন নেই, জুডের গলায় রাগ, আমি আগেই জানিয়েছি জন হ্যানসেনকে রেইন কোটাটা ব্যবহার করার জন্য দিয়েছিলাম। সন্ধ্যেবেলা আপনারা ওটা আমার অফিসে এনেছেন। এর মধ্যে জিনিসটাকে আমি দেখিনি। হ্যানসেনকে হত্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আজ সারাদিন আমি নিজের কাছে ব্যস্ত ছিলাম। মিস রবার্টস-এর সাক্ষী।

ম্যাকগ্রেভি এবং অ্যাঞ্জেলি দৃষ্টি আদান-প্রদান করল।

অ্যাঞ্জেলি জানতে চাইল–আমরা আসার পর অফিস থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?

–মিসেস হ্যানসেনের বাড়িতে।

–ওটা আমরা জানি। তারপর?

সামান্য ইতস্তত করে জুড জবাব দিলেন–গাড়ি নিয়ে ঘুরছিলাম।

–কোথায়?

–কানেকটিকাট পর্যন্ত গিয়েছি।

–ডিনারে কোথায় খেয়েছেন?

–খাইনি। এখনও পর্যন্ত খাওয়ার সুযোগ হয়নি।

–মিসেস হ্যামসেনের বাড়ি থেকে বেরোনোর পর কেউ আপনাকে দেখেছে কি?

–মনে হয় না।

–গাড়িতে পেট্রল ভরতে নিশ্চয়ই কোথাও থামতে হয়েছিল?

অ্যাঞ্জেলি কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

–না, তার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যার পর আমি কোথায় গিয়েছি, তা আপনারা জানতে চাইছেন কেন? হ্যানসেন তো সকালেই মারা গেছেন।

–সন্ধ্যের পর অফিস থেকে বেরিয়ে আবার কি এখানে ফিরে এসেছিলেন–ম্যাকগ্রেভি জানতে চাইল।

–না।

–আপনার অফিসের দরজা খোলা ছিল।

–তার মানে? কে খুলেছে আমার অফিস?

–সেটা আমরা জানতে পারিনি। আপনাকে আমরা ওখানে নিয়ে যাব। কিছু হারিয়েছে কিনা, আপনি আমাদের তা জানিয়ে দেবেন।

–নিশ্চয়ই। কিন্তু খবরটা কে দিয়েছে আপনাদের?

–রাত্রের দারোয়ান, অ্যাঞ্জেলি বলল, আফিসে আপনি দামি কিছু রাখেন কি? টাকাকড়ি ওষুধপত্র এইসব?

–না, টাকা সামান্যই থাকে। কোনো মাদক ওষুধ আমি রাখি না। চুরি করার মতো কিছু নেই আমার অফিসে।

–বেশ, এবার চলুন।

লিফট চালক এডি ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়েছে। জুড সরাসরি তার দিকে তাকাল। ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরেছেন।

অফিসের তালা ভেঙে ঢোকার ব্যাপারে পুলিশ তাকে সন্দেহ করেনি, এ ব্যাপারে জুড–নিঃসন্দেহ। সম্ভবত ম্যাকগ্রেভি তার প্রাক্তন সহকারীর হেনস্তার কথা স্মরণ করেছে। কিন্তু সেটা তো পাঁচ বছর আগের ঘটনা। ম্যাকগ্রেভি কি এতদিন সুযোগের অপেক্ষাতে ছিল?

গেটের কয়েক ফুট দুরে গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল, পুলিশের জীপ। জুড নিঃশব্দে উঠে বসলেন।

লবির হাজিরা খাতায় সই করতে করতে জুড লক্ষ্য করলেন, দারোয়ান বিগলো অবাক চোখ তার দিকে তাকাচ্ছে। ম্যাকগ্রেভি আর অ্যাঞ্জেলির সঙ্গে পনেরো তলায় লিফটে উঠলেন তিনি। নিজের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে পোশাক পরা পুলিশ। ম্যাকগ্রেভিকে সেলাম ঠুকল।

জুড পকেট থেকে চাবি বের করলেন।

অ্যাঞ্জেলি এক ধাক্কায় পাল্লা খুলে দিল। জুড আগে পা বাড়ালেন।

বসার ঘরটা লন্ডভন্ড। দেরাজগুলো খোলা। মেঝেতে কাগজের হুড়োহুড়ি। দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি।

–ডাক্তার স্টিভেন্স, ওরা কীসের খোঁজে এখানে এসেছিল বলে আপনার মনে হয়?

ম্যাকগ্রেভি আচমকা প্রশ্ন করল–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হচ্ছে এখানে?

দরজা ঠেলে জুড ভেতর ঘরে ঢুকলেন। এই ঘরটা জুডের একান্ত ব্যক্তিগত। দুটি টেবিল উল্টে দেওয়া হয়েছে। আলো চুরমার হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। কার্পেটে রক্তের দাগ। ঘরে এক কোণে অদ্ভুতভাবে পড়ে আছে ক্যারল রবার্টসের সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেহ। হাত দুটো পিঠের পেছনে তার দিয়ে বাঁধা। বুক, মুখ আর দুটি উরুর সন্ধিস্থল অ্যাসিডে পোড়ানোনা। ডান হাতের আঙুলগুলো কেউ বা কারা দুমড়ে ভেঙে দিয়েছে। ঘেঁতলানো মুখে একটা রুমাল দলা করে খুঁজে দেওয়া।

জুডের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে অ্যাঞ্জেলি বলল–বসুন ডাঃ স্টিভেন্স।

জুড মাথা নাড়লেন। বেশ কয়েকটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। উত্তেজনায় থরথর করে তিনি কাঁপছেন। কে, কে একাজ করল?

–সেটাই আপনি আমাদের জানাবেন ডাঃ স্টিভেন্স, ম্যাকগ্রেভি বলল।

–ক্যারলকে কেউ এভাবে হত্যা করতে পারে কি? জীবনে ও কাউকে আঘাত দেয়নি।

–মিস্টার হ্যানসেন কাউকে আঘাত দেননি, অথচ তার পিঠে ছুরি মারা হল। ক্যারল রবার্টস কাউকে আঘাত দেয়নি, অথচ তার সারা দেহে অ্যাসিড ঢেলে রীতিমতো নিপীড়ন করার পর তাকে হত্যা করা হল-ম্যাকগ্রেভির গলায় কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। সে আবার বলতে থাকে–চার বছর মেয়েটি আপনার কাছে কাজ করছে। আপনি কি বলতে চাইছেন মনোবিজ্ঞানী হিসাবে আপনি ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেননি? আপনার এই মিথ্যে কথাটা আমাকে কি মানতে হবে?

জুড কঠিন গলায় বললেন–কৌতূহল আমার অবশ্যই ছিল। ওর এক পুরুষ বন্ধুকে আমি চিনতাম, যাকে ও বিয়ে করত।

–ঠিক। তার সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে।

–কিন্তু তার পক্ষে একাজ কখনওই সম্ভব নয়। ভালো ছেলে ছিল সে। ক্যারলকে ভীষণ ভালোবাসত।

–জীবিত অবস্থায় ওকে আপনি কখন শেষ দেখেছেন? অ্যাঞ্জেলি জানতে চাইল।

–ওটা আমি আগেই আপনাদের জানিয়েছি। মিসেস হ্যানসেনের সঙ্গে দেখা করতে যাবার ঠিক আগে আমি ক্যারলকে বলেছিলাম, অফিসের দরজা বন্ধ করতে।

–আজ কি আর পেশেন্ট আসার কথা ছিল?

–না।

–আপনি কি মনে করেন, এটা কোনো বদ্ধ উন্মাদের কাজ?

–নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু কেন?

–আমিও তাই ভাবছিলাম, ম্যাকগ্রেভি বলল।

ক্যারলের উলঙ্গ দেহটার দিকে তাকিয়ে জুড বললেন–আর কতক্ষণ ওকে এভাবে ফেলে রাখবেন?

অ্যাঞ্জেলি বলল–এখনই নিয়ে যাওয়া হবে। হোমিসাইড আর করোনার ডিপার্টমেন্ট কাজ সেরে ফেলেছে।

জুড বললেন–আমার জন্যই তা হলে মৃতদেহটা এইভাবে রাখা হয়েছিল?

–আচ্ছা, একটা প্রশ্ন আবার করছি, আপনার অফিসে এমন কোনো বস্তু আছে কি, যেটা কারোর পক্ষে…

ক্যারলকে দেখিয়ে ইঙ্গিত করল ম্যাকগ্রেভি।

–না।

–আপনার পেশেন্টদের রেকর্ড?

–সেরকম কিছু নেই।

–আপনি কিন্তু আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাইছেন না ডাঃ স্টিভেন্স। ম্যাকগ্রেভি বলল। কণ্ঠস্বর ঋজ ফুটেছে।

–ফাইলগুলো থেকে যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যেত তা হলে অবশ্যই জানাতাম। আমার পেশেন্টদের আমি ভালো করেই চিনি। আমার পেশেন্টদের মধ্যে কেউ ক্যারলকে এইভাবে হত্যা করতে পারে না। এটা বাইরের লোকের কাজ।

–কেউ ফাইলগুলোর খোঁজ করেনি আপনি কী করে জানলেন?

–ওগুলো স্পর্শ করা হয়নি। মুহূর্তের মধ্যে ম্যাকগ্রেভির চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল–সেকি?

–ওগুলো তো আপনি দেখেন নিও।

জুড উঠলেন। দেওয়ালের কাছে গিয়ে কাঠের তক্তা মারা একটা অংশে চাপ দিলেন। দেওয়ালটা দুভাগ হয়ে গেল। সারি সারি কয়েকটা তাক বেরিয়ে পড়ল। প্রত্যেকটা তাকে, অসংখ্য টেপ রয়েছে।

–আমার পেশেন্টদের সঙ্গে প্রত্যেকবার সাক্ষাতকারের বিবরণ আমি টেপে তুলে নিই। এটাই আমার ফাইল। ওগুলো এখানে রাখা থাকে।

–ধরুন, জায়গাটা জানার জন্য কেউ অত্যাচার করেছে?

–এই সব টেপে যা ভোলা আছে, তা কারোর কাজে লাগবে না। না-না, ওকে খুন করার অন্য উদ্দেশ্য আছে।

ক্যারলের নগ্ন দেহটার দিকে তাকিয়ে জুড ব্যর্থ আক্রোশে ফেটে পড়তে চাইলেন–কারা বা কে এই নৃশংস কাজ করেছে তা আমাদের জানতেই হবে।

–সেই রকমই তো ইচ্ছে, জুডের দিকে তাকিয়ে থাকে ম্যাকগ্রেভি।

.

অ্যাঞ্জেলিকে ম্যাকগ্রেভি বলল ক্যারল রবার্টসের পোস্টমর্টেম এইমাত্র শেষ হল।

ম্যাকগ্রেভি সাগ্রহে জানতে চাইল–ফলাফল।

–মেয়েটির পেটে বাচ্চা ছিল। তিনমাস প্রায়, গর্ভপাতের পথে সময়টা একটু বেশি।

–আপনার কি মনে হয় এর সঙ্গে খুনের কোনো সম্পর্ক আছে?

চেয়ার টেনে বসল ম্যাকগ্রেভি–ভালোই প্রশ্ন করেছ। এই কাজটা যদি ক্যারলের সেই বন্ধুটির হয়, আর যদি ওরা বিয়েই করবে বলে ঠিক করে থাকে, তা হলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। এ ঘটনা রোজই ঘটছে। কিন্তু যদি ওরা বিয়েতে রাজী না হয় তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ঘুরে যাচ্ছে তাই তো? বাচ্চাটা জন্মাচ্ছে, কিন্তু মেয়েটা স্বামীর পরিচয় দিতে পারছে না।

–কিন্তু চিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, ও ক্যারলকে বিয়ে করতে রাজী ছিল।

–জানি, ম্যাকগ্রেভি গম্ভীর হল। কিন্তু ধরো, চিক না হয়ে যদি অন্য কেউ সন্তানের বাবা হয়ে থাকে?

অ্যাঞ্জেলি এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলে না।

ম্যাকগ্রেভি বলতে থাকে–মনে করো সে লোকটা একজন খ্যাতনামা ডাক্তার। বিরাট পসার আছে তার। ক্যারল তাকে জানাল, ও গর্ভপাতে রাজী নয়। তার ইচ্ছে মা হবার। অথবা নিছক ব্ল্যাকমেল করার জন্য সে এভাবে কথাটা বলতে পারে। লোকটার পক্ষে এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব হল না। কারণ সে জানে, এককালের বাজারে মেয়েছেলে কী না করতে পারে? তার যাবতীয় মান-সম্মান ধুলোয় গড়াগড়ি দেবে। ব্যাপারটা একদিন প্রকাশ হবেই।

অ্যাঞ্জেলি বলল–কিন্তু স্টিভেন্স একজন ডাক্তার। সে অন্য পদ্ধতিতে খুন করতে পারত। কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক হত না।

ম্যাকগ্রেভি বলল–হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনো সন্দেহজনক সূত্র বেরিয়ে পড়ার সম্ভবনা ছিল। যেসব বিষাক্ত ওষুধ সে কেনে তার রেকর্ড দোকানে থাকে। দড়ি বা ছড়ি কিনলেও সেটা জানা যেত। কিন্তু এই সুন্দর সাজানো ঘটনাটা একবার ভেবে দেখত। একজন উন্মাদ বিনা কারণে অফিসে ঢুকল রিসেপশনিস্টকে খুন করল। এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি করল যাতে অফিস মালিক পরে পুলিশের কাছে এসে বলতে পারে, অবিলম্বে হত্যাকারীকে ধরে দিন স্যার।

–হ্যাঁ, বেশ জটিল কেস।

–হ্যাঁ, আমার বক্তব্য এখনও শেষ হয়নি। এবার তার রোগীর কথা–জন হ্যানসেন আর একটি উদ্দেশ্যহীন হত্যা। এটাও অজ্ঞাত উন্মাদ এক আততায়ীর হাতে। একই দিনে দু-দুটো ঘটনা। এদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি? ভেবে দেখলাম, শেষ পর্যন্ত থাকাটা অসম্ভব নয়। ক্যারল রবার্টস এসে স্টিভেন্সকে জানাল, সে বাবা হতে চলেছে। শুরু হল বাক বিতণ্ডা। ক্যারল ব্ল্যাকমেল করতে চেষ্টা করল। বলল, তাকে বিয়ে করতে হবে তা না হলে মোটা টাকা দিতে হবে। জন হ্যানসেন বাইরের অফিস ঘরে বসে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। স্টিভেন্স ব্যাপারটা জানত না। তারপর সে ঘরে ঢুকে ভয় দেখাল। খবরটা সে ফাঁস করে দেবে, যদি না স্টিভেন্স…

–এতে আপনার অনুমান, অ্যাঞ্জেলি প্রতিবাদের চেষ্টা করে।

–হতে পারে, কিন্তু সব মিলে যাচ্ছে। হ্যানসেন বাইরে বেরোতেই ডাক্তার এমন ব্যবস্থা করে ফেলল, যাতে সে আর মুখ খুলতে না পারে। ফিরে এসে ক্যারলের ব্যবস্থাও করে ফেলল সে। তারপর অ্যালিবাই ঠিক করতে মিসেস হ্যানসেনের সঙ্গে দেখা করল। কানেকটিকাট পর্যন্ত বেরিয়ে এল। সমস্ত সমস্যার সমাধান।

–আমি মানতে পারছি না। কোনোরকম বাস্তব প্রমাণ হাতে না পেয়েই আপনি একটা মার্ডার কেস খাড়া করতে চাইছেন।

অ্যাঞ্জেলি প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরে বলে উঠতে চায়।

–বাস্তব প্রমাণ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? দু-দুটি মৃতদেহ আমরা পেয়েছি। একটি অন্তঃসত্তা মহিলা, যে স্টিভেন্সের কাছে কাজ করত। অন্যটি তারই এক পেশেন্টের, যাকে ওই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। লোকটা সমকামী। স্টিভেন্সের কাছে আমি যখন টেপগুলো শুনতে চাইলাম, সে আমাকে অনুমতি দিল না। কাকে বাঁচাতে চেয়েছিল সে? আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোনো কিছুর সন্ধানে কেউ তার অফিসে আসতে পারে কিনা? এটা হলে আমরা একটা যুক্তি খাড়া করতে পারতাম। আমরা বলতে পারতাম, ক্যারল সেই জিনিসটা দেয়নি বলেই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার বদলে কী হল? আমরা শুনলাম, রহস্যজনক কোনো কিছু ওর অফিসে নেই। টেপগুলোর মূল্য অন্য কারো কাছে নেই। অফিসে কোনো মাদক দ্রব্য ডাক্তার রাখেনি। টাকা-পয়সা ছিল না। অর্থাৎ শেষপর্যন্ত একটা উন্মাদের সন্ধানেই ব্যস্ত থাকতে হবে সমস্ত পুলিশ বাহিনীকে। সুতরাং আর একটুও সময় নষ্ট করা উচিত নয়, ডাঃ স্টিভেন্সের দিকে কড়া নজর রাখতে হবে।

–তা হলে ওকে ফাঁদে ফেলতে আপনি বদ্ধপরিকর? অ্যাঞ্জেলি জানতে চাইল। I ম্যাকগ্রেভি বলল–তার কারণ অপরাধটা ওই করেছে।

–আপনি ওকে অ্যারেস্ট করছেন?

–আপাতত আমি সুতো ছেড়ে রাখছি। ওর প্রত্যেকটা গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে।

অ্যাঞ্জেলি চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ম্যাকগ্রেভির দিকে। ডাঃ স্টিভেন্স যদি কিছু না করেও থাকেন, তাহলে ম্যাকগ্রেভি তাঁকে রেহাই দেবে না। কিন্তু কিছুতেই অ্যাঞ্জেলি সেটা হতে দেবে না। ক্যাপ্টেন বারটেলির সঙ্গে কথা বলতেই হবে।

.

চার                               

পরদিন সকালে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ফলাও করে বেরোল ক্যারল রবার্টসের। লোমহর্ষক হত্যার বর্ণনা। জুড ঠিক করেছিলেন, রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্ত সাক্ষাৎকার বাতিল করে দেবেন। সারারাত তার ঘুম হয়নি। চোখ দুটো ভারী হয়ে পড়েছিল। রোগীদের তালিকাটা পড়তে গিয়ে দেখলেন বাতিল করলে দুজন তার ওপর ভীষণ রেগে যাবে। তিনজন মনঃক্ষুণ্ণ হবে। বাকি কজনকে বোঝালে অবশ্য বুঝবে। শেষ পর্যন্ত গভীরভাবে চিন্তা করে তিনি ভাবলেন, রুটিন না ভাঙাটাই উচিত। রোগীদের স্বার্থ তাতে রক্ষা করা যাবে, মনটাও কিছুক্ষণের জন্য অন্য কাজে ব্যস্ত থাকবে।

আগেই দপ্তরে পৌঁছলেন জুড। করিডরে সাংবাদিকদের ভিড়। দূরদর্শন কর্মী ইতিমধ্যেই এসে গেছে। আলোকচিত্রীরা ক্যামেরা নিয়ে রেডি। কাউকে তিনি ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন না। বিবৃতি দিতে অস্বীকার করলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তারা চলে গেল।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। নিজের ঘরের পাল্লা ঠেলতে গিয়ে মনটা সামান্য আনমনা হয়ে গেল। রক্তাক্ত কার্পেটটা পুলিশ সরিয়ে নিয়েছে। ঘরটা আগেকার মতোই স্বাভাবিক লাগছে।

তফাত শুরু একটাই, ক্যারল আর কোনোদিন এখান দিয়ে হাঁটবে না। ওর, প্রাণচঞ্চল শরীরটা আর কখনও তার দিকে চেয়ে ঝংকার তুলবে না।

প্রথম রোগী পৌঁছে গেছে। হ্যারিসন বার্কআন্তর্জাতিক ইস্পাত প্রতিষ্ঠানের সহ সভাপতি। জুড যখন বার্ককে প্রথম দেখেছিলেন তখন একটা প্রশ্ন তাঁর মনে জেগেছিল। চেহারার জোরেই কি লোকটা এত উঁচু পদ পেয়েছে? নাকি পদের দৌলতেই চেহারাতে জৌলুস এসেছে।

কৌচের ওপর সম্পূর্ণ দেহ এলিয়ে বার্ক বসেছিলেন। কেসটা মাস দুই আগে ডাঃ পিটার হ্যাডলির কাছ থেকে তাঁর কাছে এসেছে। মস্তিষ্ক বিকৃতির রোগী, প্রবণতা নরহত্যার দিকে।

সকালে যে খবরটা খবরের কাগজের পাতায় বেরিয়েছে তার কথা বার্ক একবারও বললেন না। এটাই ওনার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তিনি বললেন–আপনি আমার কথাগুলো সেদিন জানতে চাইলেন না। ওরা যে আমার পেছনে লেগেছ, তার প্রমাণ আমি নিয়ে এসেছি।

জুড সতর্ক হয়ে জবাব দিলেন–আমি ব্যাপারটা আপনার সঙ্গে খোলা মন নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। গতকালের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে।

বার্ক হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করলেন–ওরা আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে।

–আপনি আরাম করে বসুন না, জুড পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করলেন।

বার্ক বললেন–আমার প্রমাণগুলো আপনি তাহলে শুনতে চান না?

জুড বললেন–আমি আপনার বন্ধু, আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।

গত কয়েক মাসে লোকটার আচরণ একেবারে পাল্টে গেছে। বার্ক কাজে ঢুকেছিলেন সামান্য একজন পিওন হিসাবে। পঁচিশ বছরে তিনি প্রতিষ্ঠানের চুডোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। চার বছর আগে সাদাম্পটনের গ্রীষ্মবাসে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায়। তখন তিনি বাহামাতে রক্ষিতার কাছে ছুটি কাটাছেন। কেউ বোধহয় ভাবতে পারেনি, ওই ট্র্যাজিক ঘটনাটিকে তিনি মনের ভেতর স্থান দেবেন। সমস্ত ব্যাপারটার জন্য নিজেকে দায়ী করে নিলেন। সবসময় গভীর চিন্তায় ডুবে থাকলেন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আর দেখা সাক্ষাত করলেন না। এমন কী সন্ধ্যের পর বেরোনো বন্ধ করে দিলেন। সেই সময় একটা ছবি তার মনে ভেসে উঠেছিল। রক্ষিতার সঙ্গে বিছানাতে তিনি সঙ্গমে মত্ত। তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে পুড়ে মরছে। কেবলই তার মনে হত, তিনি কাছে থাকলে ওদের হয়তো বাঁচাতে পারতেন। চিন্তাটা একসময় আচ্ছন্নতার রূপ নিল। লোকে তার সঙ্গ এড়িয়ে চলতে লাগল।

বার্ক প্রচণ্ড চতুর। তিনি নিজের ঘরে বসে লাঞ্চ করতে লাগলেন। বছর দুয়েক আগে কোম্পানির একজন নতুন সভাপতির প্রয়োজন পড়ল। হ্যারিসন বার্কের নাম সেখানে প্রস্তাব করা হল না। বাইরে থেকে একজনকে আনা হল। আরও একবছর বাদে কার্যনির্বাহক সহ সভাপতি নামে একটি নতুন পদের সৃষ্টি করা হল। তাকে বার্কের ওপর বসানো হল। বার্ক বুঝতে পারলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলেছে। গোপনে তিনি গোয়ন্দাগিরি শুরু করলেন। রাতের অন্ধকারে টেপরেকর্ডার লুকিয়ে নিয়ে রাখলেন সদস্যদের দপ্তরে। কিন্তু বরাত মন্দ। ছ-মাস বাদে হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেলেন। দীর্ঘদিনের চাকরি আর পদমর্যাদা তাঁকে বরখাস্তের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

এরপর তাঁর কাজের চাপ কমাতে তাকে কিছু হালকা দায়িত্ব দেওয়া হল। বার্ক ভাবলেন, তাকে তাড়ানোর চক্রান্ত চলছে। আরও কিছুদিন বাদে তিনি বুঝতে পারলেন বাইরের লোকেরাও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তিনি রাস্তায় হাঁটলে কেউ তাকে অনুসরণ করে। টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। তার চিঠিপত্র খুলে দেখা হচ্ছে। খাবারে বিষ মেশানো হতে পারে। এই ভয়ে শান্তিতে খাওয়া ত্যাগ করলেন। ওজন কমতে শুরু হল। ডাক্তার পিটার হ্যাডলির সঙ্গে কোম্পানির সভাপতি তার যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বার্ক অবশ্য প্রতিবাদ করেন নি। ডাক্তার হ্যাডলি বার্কের সঙ্গে আধঘন্টা সময় কাটালেন। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তিনি বুঝতে পারলেন, এটা তার কেস নয়। তিনি টেলিফোনে জুডের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। জুডের নোটবইতে একটুও জায়গা নেই। কিন্তু ডাঃ হ্যাডলি কেসটার গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন। জুড অনুরোধটা মেনে নিতে বাধ্য হলেন।

সেই হ্যারিসন বার্ক এখন কৌচের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন।

জুড বললেন–আপনার প্রমাণগুলো বলুন।

–ওরা কাল রাতে তালা ভেঙে আমাকে খুন করতে ঢুকেছিল। কিন্তু আমি এখন যে ঘরটাতে শুই, তার প্রত্যেকটা দরজা ভেতর থেকে তালা লাগানো থাকে। ওরা ভেতরে ঢুকলেও আমার ঘরে ঢুকতে পারেনি।

–পুলিশকে জানিয়েছেন?

–জানিয়ে কী হবে? পুলিশ তো ওদের দলে।

–আপনি তথ্য দেওয়াতে আমি খুশি হলাম। আন্তরিক স্বরে জুড বললেন।

বার্ক জানতে চাইলেন–এতে আপনার কী সুবিধা হল?

–আপনার প্রত্যেকটি কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। টেপেও তুলে নেওয়া হচ্ছে, যাতে কেউ আপনাকে হত্যা করলে চক্রান্তটা প্রকাশ হয়ে পড়ে।

বার্কের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল–বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা। টেপ থাকলে ওদের আর রেহাই নেই।

–না-না, আপনি শুয়েই থাকুন।

বার্ক মাথা নেড়ে গা এলিয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে বললেন, আমি বড়োই ক্লান্ত, চোখ বন্ধ করতে সাহস হয় না। আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতে পারতেন।

ম্যাকগ্রেভির কথা মনে পড়ে গেল জুডের। মুখে বললেন–আপনার চাকর তালা ভাঙার শব্দ পেয়েছে?

–কেন আপনাকে বলিনি? দুমাস হল তাকে বিদায় করে দিয়েছি।

দিন তিনেক আগে উনি জানিয়েছেন, ওই দিন চাকরের সঙ্গে তাঁর হাতাহাতি হয়ে গেছে। অর্থাৎ সময়জ্ঞানটাও হারিয়ে ফেলেছেন মিঃ বার্ক। আপনি কি নিশ্চিত সেটা দুহপ্তা আগের । ঘটনা?

বার্ক বললেন–ভুল আমি কখনো করি না। আপনি কি মনে করেন এত বড়ো একটা ইস্পাত কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আমাকে এমনি বসিয়ে রাখা হয়েছে?

–আপনি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন কেন?

–আমার খাবারে সে বিষ মেশাচ্ছিল।

–কী ভাবে?

–শূয়োরের মাংস আর ডিমের প্লেটে আর্সেনিক মিশিয়ে দিয়েছিল।

–কী করে বুঝলেন?

–বিষের গন্ধ আমি খুঁকেই বুঝতে পারি।

হতাশা ছড়িয়ে পড়ল জুডের মধ্যে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত তিনি ভেবেছিলেন, বার্কের অসুখ সারিয়ে দেবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই কেসটা সমাধান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো কোনো মানুষের মন এমন বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় যে, সেই মানুষটি আর সাধারণ জীবনের উপত্যাকায় পা রাখতে পারে না।

কিছুক্ষণ বাদে তিনি বললেন মিঃ বার্ক, আপনাকে একটা কথা দিতে হবে। ওরা যদি আপনার বিরুদ্ধে লেগে থাকে, তার অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে, ওরা আপনাকে দিয়ে কোন মারাত্মক কাজ করিয়ে নিতে চাইছে। ওরা আপনাকে হয়তো উসকানি দেবে। কিন্তু আপনি আমাকে কথা দিন ওদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবেন না। আমার ধারণা, যদি এইভাবে আপনি নিজেকে নিস্পৃহ রাখেন, তা হলে ওরা আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

বার্ক বললেন–ঠিক বলেছেন তো। ঠিক আছে, এখন থেকে আরও বেশি বুঝে সমঝে চলব আমি।

বাইরের ঘরে দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। জুড হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। পরবর্তী রোগী পৌঁছে গেছে।

নিঃশব্দে টেপ রেকর্ডারের বোতাম বন্ধ করলেন তিনি, আজ এই পর্যন্ত থাক।

–সমস্তটা আপনি টেপ করেছেন?

–প্রত্যেকটা শব্দ। আজ আর অফিসে যাবেন না। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিন।

বার্ক বললেন–অফিসে না গেলে ওরা আমার চেম্বারের দরজা থেকে আমার নাম খুলে অন্য লোকের নাম আটকে দেবে। আমাকে অফিস যেতেই হবে।

জুডের মন আবার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তারপর হঠাৎ তার মেরুদন্ড বেয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল। হ্যানসেন আর ক্যারলের হত্যাকাণ্ডে কি বার্কের হাত থাকা সম্ভব? বার্ক এবং হ্যানসেন দুজনেই তার রোগী। ওদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকাটা মোটেই বিচিত্র নয়। কারণ গত দুমাসে হ্যানসেনের পরেই বার্কের সাক্ষাৎকারের সময় বাঁধা ছিল। দেখা হতেই পারে করিডরে, তা হলে? কিন্তু ক্যারল? ক্যারলের কাছে বার্ক ভীতিপ্রদ কিছু দেখেছিলেন কি? স্ত্রী এবং তিন ছেলেমেয়ের মৃত্যুর পর মানসিক দিক থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্যাপারটা সত্যি কি একটা দুর্ঘটনা ছিল?

পরবর্তী রোগিনীকে আহ্বান জানালেন–আসুন।

অ্যানি ব্লেক কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওকে দেখে আবার সেই হৃদয় মোড়ানো অনুভূতিটা অনুভব করলেন জুড। এলিজাবেথের পর কোনো মহিলা তাঁর হৃদয়কে এতখানি দোলা দিতে পারেনি।

অথচ দুজনের মধ্যে কোনো মিল নেই। এলিজাবেথের ছিল সোনালি চুল, ছিল ছোটো করে ছাঁটা বেনী আর নীল চোখ। অ্যানি ব্লেকের চুল কালো, চোখের রঙ অবিশ্বাস্য বেগুনি। গড়নটা এলিজাবেথের চেয়ে লম্বা। হয়তো আরও কয়েকটা সুন্দর চড়াই উত্রাই-এর সমরোহ। তার সজীব বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা সৌন্দর্যের মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যাকে অহংকার বলা যেতে পারে। দুটি চোখের ভেতর আছে অদ্ভুত প্রাণবন্ততা।

অ্যানির বয়স পঁচিশ। নিঃসন্দেহে জুড এর থেকে সুন্দরী স্ত্রীলোক জীবনে কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু সৌন্দর্য ছাড়াও অন্য একটা কিছু আছে, যা জুডকে আকর্ষণ করে। ওকে দেখে মনে হয় ওর সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তরের পরিচিতি।

তিন সপ্তাহ আগে অ্যানি প্রথম এসেছিল। সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেনি। ক্যারল দেখা করার অনুমতি দেয়নি। ক্যারল বুঝিয়ে বলেছিল, সেদিনের তালিকাটা ভর্তি আছে। নতুন কোনো রোগীকে তার মধ্যে ঢোকানো সম্ভব নয়। অ্যানি বলেছিল, ও কেবল অপেক্ষা করার অনুমতি পেলেই খুশি হবে।

দু-ঘন্টা পরেও তাকে একইভাবে সোফায় বসে থাকতে দেখে ক্যারল অস্বস্তিতে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ক্যারল নিজে উদ্যোগী হয়ে ওই প্রতীক্ষিত সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করে।

মেয়েটিকে প্রথমদিন দেখার পর থেকেই জুড মনের ভেতর একটা তাড়না অনুভব করতে থাকেন। প্রথম দিনের কথাবার্তা জুড এখন ভুলে গেছেন। শুধু মনে আছে, বসতে বলার পর ও বলেছিল, অ্যানি ব্লেক, বিবাহিতা। সমস্যার কথা জানতে চাইলে, প্রথমটায় দ্বিধা করে বলেছিল, এ বিষয়ে ও নিজেই নিশ্চিত নয়। এমন কী সত্যি কোনো সমস্যা আছে কিনা, তাও সে জানে না।

একজন চিকিৎসক বন্ধুর কাছে জুডের নাম শুনেছে। তাই দেখা করতে এসেছে। জুড সেই চিকিৎসক বন্ধুটির নাম জানতে চেয়েছিলেন। ও বলতে রাজী হয়নি। জুড অবশ্য আগেই তা অনুমান করেছিলেন।

এরপর তিনি বোঝালেন, অন্য কোনো মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে কিন্তু অ্যানি নাছোড়বান্দা। তাই রাজী না হওয়া ছাড়া জুডের কোনো উপায় ছিল না। মেয়েটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ওর সমস্যাটা খুবই সাধারণ। আলোচনায় বসে জুড দেখলেন ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। কথায় কথায় স্বামীর বিষয়ে প্রশ্ন করাতে মেয়েটি বলেছিল, ও খুব ভালো লোক। সাংসারিক জীবনে আমি খুবই সুখী।

জুড তখন প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলেন। আপনি কোথায় জন্মেছেন?

–রিভিরিতে, বোস্টনের কাছে ছোট্ট শহর।

–আপনার মা-বাবা বেঁচে আছেন?

–বাবা বেঁচে আছেন, আমার যখন বারো বছর, তখন মা মারা যায়।

–মা-বাবার সম্পর্ক নিশ্চয়ই ভালো ছিল?

–হ্যাঁ।

–কোনো ভাইবোন?

–না। আমিই একা। যার জন্য উচ্ছন্নে গেছি। বলে সে হেসেছিল। তার মধ্যে ছলনার চিহ্ন ছিল না।

প্রশ্নের মাধ্যমে জুড আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। অ্যানি বলেছিল, মার মৃত্যুর পর বিদেশে বাবার কাছে সে থাকত। বাবা ছিলেন স্বরাষ্ট্রদপ্তরের কর্মী। তিনি যখন আবার বিয়ে করে ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে গেলেন তখন অ্যানি বাবার সঙ্গে যায়নি। দোভাষীর কাজ নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করতে শুরু করল। মাতৃভাষা ছাড়া ফরাসি, ইতালিয়ান আর স্প্যানিশে কথা বলতে পারে সে। বাহামায় ছুটি কাটাতে গিয়ে হবু স্বামীর সঙ্গে আলাপ হয়। সে ছিল কারখানার মালিক। প্রথম দর্শনে লোকটাকে ভালো লাগেনি। লোকটা বারবার বিরক্ত করতে থাকে। বাহামা থেকে চলে আসার দু-মাস বাদে নিজে এসে যোগাযোগ করে। অ্যানি তখন তার প্রেমে একেবারে মশগুল। এরপর বিয়েতে আর দেরী হয়নি। ছমাস কেটে গেছে। ওরা এখন থাকে নিউজার্সির একটা জমিদার বাড়িতে।

আধ ডজন বৈঠকের পর অ্যানি সম্পর্কে জুড এইটুকু মাত্র জানতে পেরেছেন। আজও তিনি ওর সমস্যা সম্পর্কে এতটুকু আঁচ পাননি। এসব নিয়ে আলোচনাতে যেন আপত্তি আছে মেয়েটির।

কতবার ডাক্তার জানতে চেয়েছিলেন, স্বামীর সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আছে কিনা। দৈহিক দিক থেকে অসঙ্গতি? অন্য কোনো স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক? এমন কী জানতে চেয়েছিলেন যে, মেয়েটির সাথে অন্য পুরুষের সম্পর্ক আছে কিনা? উত্তর দিতে গিয়ে অ্যানি খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।

আরও অনেক প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন জুড। পানাভ্যাস যৌন প্রবৃত্তি, গর্ভাবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি তুলে অ্যানি উত্তর দিয়েছে। যখন কোনো ব্যাপারে চেপে ধরা হয়েছে, তখন বলেছে, একটু ধৈর্য ধরুন ডাক্তারবাবু। আমাকে নিজের মতো করে এগোতে দিন।

তারপর থেকে অ্যানির পছন্দ মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাবার সঙ্গে অ্যানি অন্তত এক ডজন দেশে ঘুরেছে। অনেক আশ্চর্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছে। অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি মেয়েটির। রসজ্ঞানও প্রচুর, জুড শুনছিলেন সেই বর্ণনাগুলি। এছাড়া দুজনের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পেলেন ডাক্তার। একই রকম বই তাদের ভালো লাগে। একই নাটক দেখেন তারা। মনের অবচেতন কোণে বহু বছর ধরে তিনি এমন একটি মেয়েকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত জুড ভাবলেন, আমি কি তা হলে অ্যানির প্রেমে পড়ে গেলাম?

অ্যানি ঘরে ঢুকল। জুড কৌচের পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন।

অ্যানি বলল–আজ নিজের জন্য আসিনি। আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা, তাই এসেছি।

জুড নির্বাক হয়ে অ্যানির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। গত দু-দিন ধরে তার সমস্ত অনুভূতিগুলি নিয়ে কে বা কারা ছিনিমিনি খেলা খেলেছে। সামান্য একটু সমবেদনার ছোঁয়া পড়তেই আলোড়ন উঠল। দুরন্ত আবেগের ঢেউ যেন জুডকে এপার ওপার করে দিল। ইচ্ছে হল সবকিছু উজার করে দেবেন। কিন্তু তা অসম্ভব। তিনি একজন চিকিৎসক। অ্যানি অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী।

অ্যানি দাঁড়িয়ে রইল। জুড কোনো কথা বললেন না।

অ্যানি বলল ক্যারলকে আমার খুবই ভালো লাগত। কে এমন কাজটা করল?

–জানি না।

–পুলিশ কাউকে সন্দেহ করেনি?

করেনি আবার, জুড মনে মনে ভাবলেন। যদি জানতে পারে–অ্যানিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বললেন, ওরা কতগুলো যুক্তি খাড়া করেছে।

–আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি। আমারও খুব খারাপ লাগছিল। আজ আপনি অফিসে আসবেন কিনা আমি ভাবছিলাম।

–আসবই না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসতে হল, যখন আপনি এলেন তখন একটু আলোচনা হোক না।

অ্যানিকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আলোচনার কিছু নেই।

জুডের হৃৎপিন্ডের গতি দ্রুত হয়েছে। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানালেন, হায় ভগবান, ও যেন না বলে বসে, এখন থেকে আর আপনার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে না।

–আগামী সপ্তাহে আমি স্বামীর সঙ্গে ইউরোেপ বেড়াতে যাচ্ছি। আপনার মহামূল্যবান সময় অযথা নষ্ট করে গেলাম। এর জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।

–না-না, এরকম ভাবে বলবেন না। জুড অনুভব করলেন, তার গলা কাঁপছে। হাত ব্যাগ খুলে কিছু খুচরো নোট বের করল অ্যানি। জুডের দক্ষিণা সবটাই নগদে মেটায়। অন্যদের মতো চেকে দেয় না।

জুড বললেন–আজ আপনি আমার বন্ধু হিসেবে এসেছেন, এর জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি চাই, আপনি আরও একবার এখানে আসুন।

–কেন? অ্যানি শান্ত চোখে তাকাল।

–আমি ভাবছিলাম, ব্যাপারটা আমরা আর একবার খতিয়ে দেখব। আর একটু আলোচনা করে দেখতে হবে আপনার সত্যি কোনো সমস্যা আছে কিনা।

দুষ্টুমি মাখানো হাসি হাসল অ্যানি।

–এবার এলে তা হলে স্নাতক উপাধিটা পেয়ে যাব বলছেন?

–সে যাই বলুন, জুড মুখে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করলেন, ওটা পাবার জন্য আসবেন

–আপনি চাইলে আসতেই হবে, অ্যানি উঠে দাঁড়াল, আমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানার সুযোগ আপনাকে দিইনি, কিন্তু আমি জানি আপনি খুব ভালো ডাক্তার। যদি কখনও সাহায্যের দরকার হয়, কথা দিচ্ছি, আপনার কাছে আসব।

অ্যানির বাড়ানো হাতটা ধরলেন জুড। উঃ, ঘন একটি আলিঙ্গন, সেই বিদ্যুৎ প্রবাহের শিহরণ। আশ্চর্য, অ্যানির এতটুকু প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলেন না।

–আমি শুক্রবারে আসব।

–শুক্রবার? আচ্ছা।

করিডরের দরজা খুলে অ্যানি বেরিয়ে গেল। আরাম কেদারাতে দেহটাকে এলিয়ে দিলেন। জুড। মনে হল, এই বিরাট পৃথিবীতে তিনি সত্যি সত্যি একা।

.

পাঁচ

সাতটার সময় শেষ রোগীটি চলে গেল। জুড মদের আলমারী খুললেন। কড়া স্কচ নিয়ে গলায় ঢেলে দিলেন। পাকস্থলীতে একটা তরল আগুনের পরশ পেলেন। হঠাৎ তার মনে হল, সকাল থেকে ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ কোনো কিছুই করা হয়নি। খাবার কথা মনে হতেই আরও অসুস্থ বোধ করতে থাকলেন। মনকে অন্যদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করলেন। খুন দুটো বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ একইভাবে বসে রইলেন। গত দুদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছায়াছবির মতো এগিয়ে চলেছে। অবশেষে কোনো সমাধানে আসতে পারলেন না। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন, আজ অনেক দেরী হয়ে গেছে।

চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। রাত নটা বেজে গেছে। লবিতে নামতে বরফ ঠান্ডা হাওয়ার কাঁপুনি লাগল মুখে। তুষারপাত শুরু হয়েছে। তুষারের কণাগুলো আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহরটাকে দেখাচ্ছে ক্যানভাসে আঁকা তেল ছবির মতো। আকাশ চুম্বী অট্টালিকার মাথা থেকে রাস্তার ধূসর আর সাদা তরল গড়িয়ে পড়ছে। লেক্সিংটন এভিনিউর একটি দোকানের কাঁচের জানলায় লেখা আছে–বড়োদিন। জুড সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।

পথঘাট একেবারে ফাঁকা। একজন পথচারী একলা হেঁটে চলেছে অনেক দূরে। হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। প্রেমিকা বা স্ত্রীর কাছে যাবার তাড়া আছে কি? অ্যানি এখন কী করছে? হঠাৎ জুডের অ্যানির কথা মনে পড়ল। হয়তো স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। নাকি শুয়ে পড়েছে ওরা?

প্রচণ্ড হাওয়ার ঝাঁপটা। একটা গাড়িও রাস্তায় বেরোয়নি। জুড মোড়ের আগেই রাস্তা পার হলেন। মাঝ বরাবর আসতেই একটা শব্দ শুনে ঘুরে তাকালেন। দশ ফুট দূরে বিরাট একটা কালো লিমুজিন। হেডলাইট নিভিয়ে তার দিকে তেড়ে আসছে। একটা পাঁড় গদর্ভ, জুড ভাবলেন। ফুটপাথের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে এলেন। তারপর দেখলেন, গাড়িটা তার দিকেই ছুটে আসছে। উপলব্ধি করলেন, ওটা জেনে শুনে তাকে চাপা দিতে চাইছে।

শেষ যে ঘটনা তিনি মনে করতে পেরেছিলেন তা হল, ভারী কোনো বস্তু তাঁকে আঘাত করেছিল। তারপর বজ্রপাতের মতো একটা শব্দ। অন্ধকার রাস্তাটা এক-মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে ওঠে। জুড সব কিছু জানতে পারলেন। জন হানসেন আর ক্যারল রবার্টসের মৃত্যুর রহস্যভেদ করতে পারলেন। জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল তার। ম্যাকগ্রেভিকে জানাতে হবে। আলো নিভে এল। নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেলেন তিনি।

উনিশ নম্বর থানাটাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় অতি প্রাচীন। রোদ-বাতাস-বৃষ্টিতে বোধহয় একটা ভাঙা বাড়ি। অঙ্গের প্লাসটার খসে গেছে। বাদামি ইট বেরিয়ে পড়েছে।

কার্নিসগুলো সাদা ঢিবি। পায়রার দল এই ঢিবিগুলো বানিয়েছে। একদিকে উনষাট থেকে। ছিয়াশি নম্বর স্ট্রিট। অন্য দিকে ফিফথ এভিনিউ থেকে রিভার সাইড-এই থানার এক্তিয়ারে পড়ে।

দশটার কয়েক মিনিট বাদে হাসপাতাল থেকে জানানো হল গাড়ি চাপা দিয়ে কেউ। একজন পালিয়ে গেছে। থানার কাজের চাপ সেদিন খুবই বেশি। আবহাওয়া খারাপ হলে। কী হবে, অনেকগুলো ধর্ষণ আর প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। ফাঁকা রাস্তায় লুটেরার দল বেরিয়ে পড়েছে। পথচারীদের হাতে যা আছে সর্বস্ব নিয়ে পালাচ্ছে।

বেশির ভাগ গোয়ন্দা তদন্তের কাজে রাস্তায় ব্যস্ত। বিভাগটা প্রায় ফাঁকা। ফ্রাঙ্ক অ্যাঞ্জেলি এক সার্জেন্টকে অগ্নি সংযোগের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিল।

অ্যাঞ্জেলি ফোনটা ধরল, সিটি হাসপাতালের এক নার্সের ফোন–লেফটন্যান্ট ম্যাকগ্রেভির সঙ্গে লোকটা দেখা করতে চাইছে। ম্যাকগ্রেভি তখন ইনফরমেশন সেন্টারে বসে আছে। অ্যাঞ্জেলি জানিয়ে দিল, ম্যাকগ্রেভি ফিরলে খবরটা তাকে বলা হবে।

রিসিভার নামানোর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকগ্রেভি ঘরে ঢুকল। অ্যাঞ্জেলি সব কিছু বলল। বলল–আমার মনে হয়, এখনই হাসপাতালে যেতে হবে।

–ও এখুনি মরছে না, আমি আগে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে চাই, অ্যাক্সিডেন্টটা কোথায় হয়েছে।

অ্যাঞ্জেলি ভাবতে থাকল, ক্যাপ্টেন বারটেলি তাদের কথাবার্তার কোনো ইঙ্গিত ম্যাকগ্রেভিকে জানিয়ে দেবে কিনা?

–লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি খুবই দক্ষ লোক, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অ্যাঞ্জেলি বলেছিল। কিন্তু পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার প্রভাব তার ওপর পড়েছে।

ক্যাপ্টেন বারটেলি বলেছিলেন–আপনি কি ডাঃ স্টিভেন্সকে জড়ানোর জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে চাইছেন।

–অভিযোগ তো আমি করছি না ক্যাপ্টেন, শুধু ব্যাপারটা আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।

–বেশ, আমি জেনে নিলাম।

ম্যাকগ্রেভির খুনের কথাবার্তা চলল তিন মিনিট। এর মধ্যে সারাক্ষণ ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করতে করতে সে কিছু লিখল। দশ মিনিট পর তারা হাসপাতালের দিকে রওনা হল।

.

জুডের ঘরটা ছতলায়। লম্বা, নির্জন করিডোরের শেষ প্রান্তে। নার্স সেই ঘরে দুজনকে পৌঁছে দিল।

ম্যাকগ্রেভি প্রশ্ন করল–সে কেমন অবস্থায় আছে জানেন?

মেয়েটি বলল–ওটা ডাক্তারবাবু ভালো বলতে পারবেন। লোকটা যে মরেনি, এটা ভগবানের দয়া। সম্ভবত মাথায় চোট লেগেছে, পাঁজরার হাড় ভেঙেছে, বাঁ হাতটা ভীষণভাবে জখম হয়েছে।

অ্যাঞ্জেলি জানতে চাইল-জ্ঞান আছে?

–হ্যাঁ, তবে ওকে বিছানায় শুইয়ে রাখাটাই সমস্যা। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উনি পাগল হয়ে উঠেছেন।

ওরা ঘরে ঢুকল। সব কটা বিছানা ভর্তি, এককোণে পর্দা টানা একটা খাট। ম্যাকগ্রেভি আর অ্যাঞ্জেলি সেদিকে এগিয়ে গেল।

জুড বিছানাতে শুয়ে ছিলেন। মুখ রক্তশূন্য। কপালে বিরাট প্লাস্টার। বাঁ হাতে প্লাস্টার।

ম্যাকগ্রেভি মুখ খুলল–আপনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে শুনলাম?

জুডের গলা অসম্ভব দুর্বল–কেউ আমাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

–কে সে? অ্যাঞ্জেলির প্রশ্ন।

–তা জানি না তো, ব্যাপারটা তাই।

জুড ম্যাকগ্রেভির দিকে ফিরে বললেন–ওরা জন হ্যানসেন বা ক্যারল, কাউকেই খুন করতে চায়নি, চেয়েছিল আমাকে মারতে।

হ্যানসেন মরেছে, কারণ তার গায়ে তখন হলুদ রেনকোটটা ছিল। ওরা নিশ্চয়ই ওই রেনকোটটা পরে আমাকে অফিসে ঢুকতে দেখেছিল।

–এটা হলে হতে পারে, আঞ্জেলি মন্তব্য করল।

ম্যাকগ্রেভি বলল–অবশ্যই, তারপর ওরা যখন জানতে পারে যে, ভুল লোককে মেরে ফেলা হয়েছে, তখন আপনার অফিস ঘরে ঢুকে আপনার পোশাক ধরে টানাটানি শুরু করে। ওগুলো খুলে ফেলার পর যখন আবিষ্কার করে, আপনি আসলে একটা মেয়েছেলে, তখন রেগে গিয়ে আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।

–ক্যারল মরল এই কারণে যে, ওরা আমাকে খুঁজতে এসে তাকে সামনে পেয়ে গিয়েছিল।

ওভারকোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা লেখা কাগজ বের করে আনল ম্যাকগ্রেভি।–যে থানা এলাকাতে অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে, সেখানকার ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।

–ওটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল না।

–পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী আপনি বেআইনিভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। আপনি কোণাকুণি রাস্তার মাঝখান দিয়ে পার হচ্ছিলেন।

–কোনো গাড়ি ছিল না।

–একটা গাড়ি ছিল। আপনি সেটা দেখতে পাননি। আপনি হঠাৎ রাস্তায় নেমে পড়তে সেই গাড়িটা ব্রেক কষে। চাকা পিছলে যেতে আপনার সঙ্গে ধাক্কা লাগে।

–ঘটনাটা সে ভারে ঘটেনি, তাছাড়া হেডলাইট নেভানো ছিল।

–আপনি বলতে চান, সেটাই হ্যানসেন এবং ক্যারল রবার্টসের হত্যার প্রমাণ?

–কেউ যে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

–এতে কাজ হবে না ডাক্তার।

–কীসে কাজ হবে না বলছেন?

–সেই ভুতুরে লোকটার সন্ধানে আমি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াব। আর, আপনি নিজের হাত থেকে সন্দেহটা ঝেড়ে ফেলবেন তাই তো?

ম্যাকগ্রেভির কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য ঝরছে–আপনার রিসেপসনিস্ট যে অন্তঃসত্ত্বা ছিল সে খবর আপনি জানেন?

জুড মাথাটা বালিশের আরো গভীরে ঢুকিয়ে দিলেন। তাহলে? তাহলে ক্যারল এই খবরটা তাঁকে জানাতে চেয়েছিল? তিনি কিছুটা অনুমান করেছিলেন। চোখ খুলে বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন–না। আমি জানতাম না। মাথাটা দপদপ করতে শুরু করেছে। গায়ের ব্যথাটাও ফিরে এল। বমির আবেগ চাপতে ঢোক গিলতে শুরু করলেন।

ম্যাকগ্রেভি বলল–সিটি হলে সরকারি নথিপত্রের ফাইলগুলো দেখছিলাম। যদি বলি আপনার অন্তঃসত্ত্বা রিসেপসনিস্টই আপনার কাছে কাজে ঢোকার আগে একটা পুরুষ খেকো মেয়েছেলে ছিল তাহলে কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন? ডাঃ স্টিভেন্স, ওর পাস্ট হিস্ট্রি আপনি জানতেন তো, উত্তর আপনাকে দিতে হবে না। আমি আপনার হয়ে উত্তর দেবোচারবছর আগে প্রকাশ্য রাস্তায় পুরুষ মানুষকে প্রলোভন দিয়ে ডাকার অভিযোগ ছিল ওর বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার হবার পর কোর্ট থেকে ওকে আপনি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ভাবুন তো? বাজারের একটা বেশ্যা মেয়েছেলেকে আপনি রিসেপসনিস্ট করে আনলেন কেন?

জুড গম্ভীর হয়ে বললেন–বেশ্যা হয়ে কেউ জন্মায় না, ষোলো বছরের একটা মেয়েকে। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিয়েছিলাম।

–সেই সঙ্গে নিজের যৌনতৃপ্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন এবং নিখরচায়, তাই তো? ম্যাকগ্রেভির ঠোঁটের কোণে এবার দুষ্টু হাসির চিহ্ন।

–আপনার মন ভীষণ সংকীর্ণ।

আরো একবার ম্যাকগ্রেভি হাসলো কৌতুকহীনভাবে–সে রাতে কোর্ট থেকে ওকে উদ্ধার করে কোথায় তুলেছিলেন?

–আমারই ফ্ল্যাটে।

–ওখানেই সে ঘুমিয়েছিল?

–হ্যাঁ।

ম্যাকগ্রেভি এবার দাঁত বের করে হাসলো। জবাব নেই আপনার। কোর্ট থেকে একটা সুন্দরী বেশ্যাকে তুলে নিয়ে গেলেন রাত কাটাবার জন্য। কিসের খোঁজে আপনি বেরিয়েছিলেন? দাবার সঙ্গীর? ওর সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থেকেছেন, একসঙ্গে শোননি, তাহলে আপনি কি সমকামী? আর যদি ব্যাপারটা তা হয়, যদি খাপে খাপে মিলে যায় তাহলে বলুন তো? হ্যাঁ, জন হ্যানসেন, আবার অন্যদিকে আপনি যদি ক্যারলের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে গল্প করে থাকেন তাহলে ওর শেষ পরিণতিটা আপনারই হাতে থাকছে, তাই নাকি? বলুন? এবার কি আপনার বানানো উন্মাদের গল্পটা আমাকে মেনে নিতে হবে?

ম্যাকগ্রেভি বেরিয়ে গেল। জুডের মনে হল কেউ বোধহয় তার মাথাটা ছিঁড়ে নিচ্ছে।

অ্যাঞ্জলি বলল–আপনার কিছু অসুবিধে হচ্ছে?

–ওরা আমাকে হত্যা করতে চায় আমাকে সাহায্য করতে হবে।

–আপনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য?

–আমার জানা নেই।

–আপনার কোনো শত্রু আছে?

–না।

–কারার স্ত্রী বা বান্ধবীর সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্ক আছে কি?

–না।

–ধরুন সম্পত্তির জন্য কেউ আপনাকে সরিয়ে ফেলতে চায়।

–না।

অ্যাঞ্জেলি বলল–আর আপনার রোগীরা, ওদের একটা লিস্ট দিন তো তদন্ত করে  দেখা যাক।

–সেটা সম্ভব নয়।

–আমি কেবল নামগুলো জানতে চাইছিলাম।

–দুঃখিত, আমি দাঁতের ডাক্তার বা হাতের রেখা বিশারদ হলে দিতে পারতাম। কিন্তু দেখতেই পারছেন ওরা ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়ে আমার কাছে আসে। আমার একটা গুড অব কনডাক্ট আছে। অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের ব্যাপার আছে। জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে ওরা বিব্রত হবে। আমার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। আর কোনোদিন ওদের আমি চিকিৎসা করতে পারবো না।

অ্যাঞ্জলি প্রশ্ন করলো–যে লোক মনে করে সবাই তাকে হত্যা করতে চাইছে সেই লোকটি নিশ্চয়ই অসুস্থ, তা আপনি মানেন তো?

জুড বলে ওঠেন–হ্যাঁ, তার মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটেছে। আপনি কি ভাবছেন আমি সেই দলের সদস্য?

–নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে একটু ভাবুন তো? আমি এখন বিছানায় শুয়ে আছি, আর আপনার মতো বলছি তাহলে কি হতো?

অ্যাঞ্জেলি বলতে থাকে, আমি যাই, ম্যাকগ্রেভি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

জুড বললেন আমি যা বলছি তা প্রমাণ করার একটা সুযোগ আমাকে দেবেন কি?

–কিভাবে? যেতে যেতে জানতে চাইলো অ্যাঞ্জেলি।

–যে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে, সে নিশ্চয়ই আবার সুযোগের সন্ধানে থাকবে। আমি চাই পরবর্তী সময়ে আপনারা তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলুন।

–দেখুন ডঃ স্টিভেন্স, যদি সত্যি সত্যি কেউ আপনাকে হত্যা করার চেষ্টা করে থাকে তাহলে পৃথিবীর সমস্ত পুলিশ বাহিনী আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। আজ অথবা কাল তারা সাফল্য পাবে। আপনি রাষ্ট্রপতি অথবা মহারাজ বা হ্যাঁরীসাহেব হোন না কেন, কোনো তফাৎ হবে না। আমাদের জীবনটা ঠিক একটা পাতলা সুতোর মতো, ওটা ছিঁড়তে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।

–তাহলে আপনারা কিছুই করতে পারবেন না, তাই তো?

–কেবল কয়েকটা ছোট্ট উপদেশ দেবো, আশা করি মানবেন। ফ্ল্যাটের দরজার তালাটা পাল্টাবেন। নতুন তালা লাগাবেন। জানলাগুলো বন্ধ করার পর দেখবেন ছিটকিনি লাগানো হয়েছে কিনা। অচেনা কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। এমন কি কোনো দোকান কর্মচারিকে পর্যন্ত নয়।

জুড মাথা নাড়লেন।

–দারোয়ান ও লিফট চালকের ওপর বিশ্বাস আছে তো?

–দারোয়ান দশ বছর ও বাড়িতে কাজ করছে। লিফটম্যানেদেরও আট বছর হয়ে গেল। ওদের আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।

অ্যাঞ্জেলি বলল–ওদের বলবেন চোখ খোলা রাখতে। ওরা সতর্ক থাকলে কেউ লুকিয়ে আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারবে না, আর অফিসের কি অবস্থা? নতুন কোনো রিসেপসনিস্ট নিচ্ছেন নাকি?

জুড ক্যারলের চেয়ারে অন্য একটি মেয়েকে কল্পনা করলেন। অসহায় গলায় বললেন না এখুনি কাউকে নিচ্ছি না।

–একজন পুরুষ মানুষকে ওই জায়গায় নিতে পারতেন।

–পরে ভেবে দেখবো।

যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে অ্যাঞ্জেলি বলল–আমার মাথায় একটা কথা এসেছে। যদিও সেটা সুদূর প্রসারী। ম্যাকগ্রেভির পার্টনারকে যে খুন করে…

–হ্যাঁ, জিফরেন।

–সে কি সত্যিই উন্মাদ ছিল?

–হ্যাঁ। ওরা তাকে স্টেটস হসপিটালে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মানসিক রোগগ্রস্ত অপরাধীদের ওখানে রাখা হয়।

–বিনা কারণে ওখানে পাঠানোর জন্য আপনার ওপর কোনো দোষারোপ করা হয়নি তো? লোকটা ছাড়া পেয়েছে কিনা আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। সকালের দিকে একবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

জুডের গলায় কৃতজ্ঞতা–ধন্যবাদ।

–ধন্যবাদের কিছু নেই, এটাই আমার কাজ। আর যদি জানতে পারি আপনি আমাকে ভাওতা দিয়েছেন তাহলে…

এক পা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়াল অ্যাঞ্জেলি–জিফরেন সম্বন্ধে খোঁজ নিচ্ছি। এ ব্যাপারটা ম্যাকগ্রেভিকে জানাবার দরকার নেই।

.

অ্যাঞ্জেলি চলে গেল। আবার একাকীত্বের যন্ত্রণায় দগ্ধ হলেন জুড। ব্যাপারটা ক্রমশ ধোঁয়াটে হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই তার গ্রেপ্তার হয়ে যাবার কথা। তিনি জানেন ম্যাকগ্রেভি এত সহজে রেহাই দেবেন না। সে চায় প্রতিহিংসা। এমনভাবে তা নিতে চায় যাতে সাক্ষ্য প্রমাণ সব কিছু থাকে। গাড়ি চাপা দেবার ব্যাপারটা কি দুর্ঘটনা? তুষারে চাকা পিছলে যাওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু হেডলাইটগুলো নেভানো ছিল কেন?

জুড নিশ্চিত, আক্রমণ করার জন্যই ওরা এসেছিল, ভবিষ্যতে আবার করবে। ভাবতে ভাবতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকালে পিটার আর নোরা হ্যাডলি হাসপাতালে এলেন। সকালবেলা রেডিওতে খবর শুনে তারা ছুটে এসেছেন।

পিটার হ্যাডলি বললেন–তোমাকে ভীষণ বিশ্রী দেখাচ্ছে।

নোরা জুডের হাতে একতোড়া ফুল তুলে দিলেন রাস্তায় আপনার জন্য কিনলাম।

পিটার সবকিছু জানতে চাইলেন। সব শুনে নোরা শিউরে উঠলেন। জুডের গলা খুঁজে এল। পুলিশ কিরকম চেষ্টা চালাচ্ছে পিটার জানতে চাইলেন।

কাগজে দেখা গেল লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি একজনকে গ্রেপ্তার করার জন্য স্থির করে রেখেছেন। এই ব্যাপারটাও পিটার জানতে চাইলেন।

বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হল। ক্যারলের প্রসঙ্গ প্রত্যেকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন। পিটার আর নোরা জানতেন না যে হ্যানসেনও ছিলেন জুডের রোগী। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে ম্যাকগ্রেভি তার নাম সংবাদপত্রে প্রকাশ করেননি।

হ্যারিসন বার্ক-এর কথাও পিটারকে জানানো হল।

পিটার হ্যাডলি উঠতে উঠতে বললেন–দুঃখিত, আমি ভেবেছিলাম কেসটা হয়তো তোমার আয়ত্তের বাইরে যায়নি। এখন দেখছি ওটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

–এখান থেকে বেরিয়ে কেসটা ছেড়ে দেবো।

–দরকার পড়লে আমাকে খবর দিও কেমন?

শুয়ে শুয়ে জুড ভাবতে থাকলেন অনেক কিছু। তাকে হত্যার প্রচেষ্টার পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি? এমন কি কেউ আছে যে মানসিক ভারসাম্যহীন? হ্যারিসন বার্ক আর আমোস জিফরেন আর কেউ? সহসা জুড অনুভব করলেন, মনটা ধীরে ধীরে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে। করার মতো কিছু একটা কাজ তিনি খুঁজে পেয়েছেন। হাসপাতাল থেকে এখুনি বেরোতে হবে।

ফোন তুলে নার্সকে জানালেন ডাঃ হ্যারিসের সঙ্গে দেখা করবেন।

দশমিনিট বাদে ডাঃ সিমূর হ্যারিস এলেন। ছোট্ট চেহারা, থুতনিতে খোঁচা দাড়ি। জুডের সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়।

–বাবাঃ, এই তো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে। চেহারার যা হল করেছে।

–আমি ভালোই আছি। এখান থেকে চলে যাব বলে আপনাকে ডেকেছি।

–কখন?

–এখনই।

ডাঃ হ্যারিস তাকালেন ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে–কেন আর কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেলে কি বাইবেল অশুদ্ধ হয়ে যেত? চাও তো কয়েকজন সুন্দরী নার্সদের পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার পরিচর্যার জন্য?

–ধন্যবাদ আমার যাওয়াটা খুবই দরকার।

–বেশ, নিজের ডাক্তারী নিজেই কর।

–মিস বেডপ্যাসকে বলছি তোমার পোশাকগুলো দিয়ে দিতে।

আধঘণ্টা বাদে মেয়েটি ট্যাক্সি ডেকে দিল। ঠিক সোয়া দশটাতে জুড পৌঁছে গেলেন তার অফিস ঘরে।