৯. জলের উপর দিয়ে

জলের উপর দিয়ে ভোরের আলো ও নদীর কুয়াশা ভেসে আসার সাথে সাথে (এক রেখায় ভাটির দিকে সামনে ভেসে চলল নৌবহর। বৈঠাগুলো চাপা দেওয়া, নীরবতা রীতিমতো অলৌকিক। ধনুক প্রস্তুত করে উপরের কিনারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে তীরন্দাজরা। কুয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ছাউনী দেওয়া ঘরের ছাদ। তীরের আরও কাছে এগিয়ে যেতে মাস্তুলে অবস্থানরত মেরেনকে ইশারা করল তাইতা। তীর থেকে একটা কুকুর ঘেঁকিয়ে উঠল। ডাক ছাড়ল করুণ সুরে। এছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। সকালের হাওয়ায় কাঁপছে কুয়াশার পর্দা। তারপর চিমাদের গ্রামটাকে উন্মুক্ত করতে একপাশে সরে গেল পর্দাটা।

তলোয়ার উঁচু করে ধরেই আবার সজোরে নামিয়ে অনল তাইতা। সঙ্কেত ছিল এটা। বাঁকা কুড়ু শিংয়ের শিঙ্গা তীক্ষ্ণ আওয়াজে বেজে উঠল। আওয়াজ শুনে শত শত নগ্ন চিমা কুঁড়ে ছেড়ে বের হয়ে এলো, চেয়ে রইল আগুয়ান নৌকাগুলোর দিকে। হতাশার আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল। ভীষণ আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে ছুটতে শুরু করল ওরা। অল্প কয়েকজন সশস্ত্র ছিল, কিন্তু বেশিরভাগই তখনও নিদ্রালু অবস্থায় ছিল। গাছের আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাবার সময় মাতালের মতো টলছে, পড়ে যাচ্ছে হুমড়ি খেয়ে। আবার তলোয়ার ধরা হাত ওঠাল তাইতা। ওটা নামিয়ে আনতেই ওদের দিকে তীরের একটা মেঘ ছেড়ে দিল তীরন্দাজরা। ছুটন্ত এক মায়ের পিঠে বাঁধা এক বাচ্চাকে তীরের আঘাতে স্থির হয়ে যেতে দেখল তাইতা। তারপর শেষ করে দিল মাকেও।

আমাদের তীরে নিয়ে চলো! গলুই কিনারা স্পর্শ করামাত্র হামলায় নেতৃত্ব দিল ও।

ঘেরাও হয়ে থাকা চিমাদের পিছু ধাওয়া করল বর্শা আর কুড়োলধারীরা। সামনের দিকে আরেক দফা ত্রাস আর হতাশার আর্তনাদ উঠল, হিলতোর পাতা কাঁদে গিয়ে পড়েছে ওরা। জীবন্ত মাংসে আঘাত হানতে লাগল তিনাত-বাহিনীর তলোয়ার; বের করে আনার সময় এক ধরনের ভেজা শব্দ করছে। কনুই পর্যন্ত কাটা হাত নিয়ে তাইতার দিকে ছুটে এলো এক চিমা। কাটা জায়গা থেকে সারা গায়ে রক্ত ঝরে পড়ায় পাগলের মতো আর্তনাদ করছিল সে। ওকে চকচকে লাল রঙে রঞ্জিত করে ফেলেছে। এক কোপে ওকে শেষ করে দিল তাইতা, খুলিটা মাঝখান থেকে দুভাগ করে দিল। এবার একটামাত্র আঘাতে তার পিছনে ছুটে আসা নগ্ন মেয়েটির বুকের ঠিক মাঝখানে আঘাত করে মারল। যুদ্ধের ক্রোধে সামান্যতম অনুশোচনা বা করুণা বোধ করছে না। পরের লোকটা নিজেকে বাঁচানোর ব্যর্থ প্রয়াসে খালি হাত মাথার উপর ওঠাল। এতটুকু করুণা ছাড়াই ওকে দুভাগ করে ফেলল তাইতা, যেভাবে হয়তো সেতুসে মাছি মারবে।

দুই সারি সশস্ত্র লোকের মাঝখানে আটকা পড়ে চিমারা জালে পড়া মাছের ঝকে মতো এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করল। প্রতিশোধ ছিল শীতল ও নিষ্ঠুর, হত্যালীলা ভবয়াবহ ও সম্পূর্ণ। অল্প কয়েক জন চিমা ব্রোঞ্জের ছোট হয়ে আসা বৃত্ত থেকে পালিয়ে নদীর কিনারে পৌঁছাতে পারল। কিন্তু ওদের অপেক্ষায় ছিল তীরন্দাজরা। অপেক্ষায় ছিল কুমীরগুলোও।

কেউ পালাতে পেরেছে? লাশ আর মরণোন্মুখে ভরা মাঠের মাঝখানে মিলিত হওয়ার পর তিনাতকে জিজ্ঞেস করল তাইতা।

কয়েকজনকে আবার কুঁড়েয় ফিরতে দেখেছি। ওদের পেছনে যাব?

না। এতক্ষণে অস্ত্র তুলে নিয়েছে ওরা, কোণঠাসা চিতার মতো ভয়ঙ্কর হয়ে থাকবে এখন। আমি আর আমার লোকদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারব না। কুঁড়ের ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া দিয়ে বের করে আনো ওদের।

সূর্য গাছপালার মাথার উপর উঠে আসতে আসতে সবকিছু চুকেবুকে গেল। তিনাতের দুজন সৈনিক সামান্য চোট পেয়েছে, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে চিমারা। হায়েনার দল ব্যবস্থা করবে বলে যেখানে পড়েছে সেখানেই লাশ ফেলে রাখল ওরা। নৌকায় ফিরে সূর্য দুপুরে পৌঁছানোর আগেই উত্তরে পাল ওড়াল।

এখন কেবল মহান সুদের জলাভূমিই আমাদের পথে বাধা হয়ে আছে, ফেনকে বলল তাইতা, সামনের ডেকে একসাথে বসে আছে ওরা। যে জলাভূমিতে তোমার দেখা পেয়েছিলাম আমি। তুমি ছিলে ছোট বুনো বর্বর, ওই গোত্রের সাথে ছিলে।

সব কিছু কতদিন আগের মনে হচ্ছে, বিড়বিড় করে বলল ফেন। স্মৃতি এখন ফিকে, ধূসর হয়ে এসেছে। ওই জীবনের চেয়ে বরং আগের জীবনের কথাই বেশি মনে করতে পারি। আশা করছি পশুর মতো লু-দের কারও সাথে আর দেখা হবে না। পুরো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে চাই। মাথা ঝাঁকিয়ে সোনালি চুলের গোছা পেছনে পাঠিয়ে দিল ও। এসো, আরও ভালো কোনও প্রসঙ্গে কথা বলা যাক, প্রস্তাব দিল ও। তুমি জানো ইম্বালির শরীরে ভেতরে একটা বাচ্চা বড় হয়ে উঠছে?

আচ্ছা! তাহলে ব্যাপার এই। নাকোন্তোকে ওর দিকে অন্যভাবে তাকাতে দেখেছি আমি। কিন্তু তুমি কীকরে জানলে?

ইম্বালিই বলেছে। অনেক গর্ব ওর। বলছে বাচ্চাটা নাকোন্তোর মতোই বিরাট যোদ্ধা হবে।

যদি মেয়ে হয়?

সেও যে ইদালির মতোই মহান যোদ্ধা হবে তাতে সন্দেহ নেই, হেসে ফেলল ফেন।

ওদের জন্যে ভালো খবর, তবে আমাদের জন্যে খারাপ।

খারাপ কেন? জানতে চাইল ও।

ওদের শিগগিরই হারানোর ভয় হচ্ছে। বাবা হতে যাচ্ছে বলে ভবঘুরে যোদ্ধা হিসাবে নাকোন্তোর দিন ফুরিয়ে আসছে। ইম্বালি আর বাচ্চা নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চাইবে সে। শিগগিরই ঘটবে সেটা। কারণ শিলুকদের দেশের কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা।

বন আর হাতির এলাকা ছেড়ে চ্যাপ্টা মাথার বাবলা গাছে ভরা সাভানাহয় ঢোকার সময় নদীর তীরের চেহারা বদলে যেতে শুরু করল। কফি রঙ চামড়ায় শাদা ছোপ ছোপ দাগঅলা উঁচু উঁচু জিরাফ গাছের মগডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে, ওদের নিচে তৃণভূমির মিষ্টি ঘাসে অ্যান্টিলোপ, কোব, তোপি, ইলান্দের পাল স্বাস্থ্যবান ডোরা কাটা যেব্রার পালের সাথে মিলেমিশে চরে বেড়াচ্ছে। পুনরুজ্জীবিত নীল ওদের আবার তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে ফিরিয়ে এনেছে।

আরও দুদিন এগোনোর পর বেশ কয়েক শো কুঁজঅলা পশুর পাল দেখতে পেল ওরা, ওগুলোর মাথায় হেলে পড়া শিঙ। আগাছার তীরে আলগা হয়ে চরে বেড়াচ্ছে। অল্পবয়সী ছেলেরা চরাচ্ছে ওদের। ওরা শিলুক, তাতে আমার সন্দেহ নেই, ফেনকে বলল তাইতা। নাকোন্তো বাড়ি ফিরেছে।

নিশ্চিত হচ্ছো কী করে?

ওরা কত লম্বা আর ছিপছিপে দেখ, ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি, ঠিক একপায়ে দাঁড়ানো ধ্যানমগ্ন সারসের মতো, অন্য পাটা থোেড় মাংসের কাছে তুলে রাখা। শিলুক না হয়ে পারে না।

নাকোন্তোও দেখেছে ওদের। ওর স্বাভাবিক নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হাবভাব উধাও হয়েছে। ডেকের সবাইকে হতবাক করে যুদ্ধের নাচে মেতে উঠেছে সে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করছে, আগাছার উপর দিয়ে ভেসে ওপাড়ে পৌঁছে যাচ্ছে সেই হাঁক। ওর কাণ্ড দেখে হাসছে ইম্বালি, হাত তালি দিচ্ছে, আরও বেশি চিৎকার করার উৎসাহ দিতে উলু ধনি করছে।

রাখালরা ওদের নিজস্ব ভাষায় কারও ডাকার আওয়াজ পেল। দৌড়ে তীরে এসে বিস্ময়ের সাথে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনকে চিনতে পারল নাকোন্তো, ডাকল ওদের: সিকুনেলা! তিষাইল!

সবিস্ময়ে সাড়া দিল ছেলেরা। আগন্তুক, কে তুমি?

আমি আগন্তুক নই। আমি তোমাদের চাচা নাকোন্তা, বিখ্যাত বর্শাধারী! পাল্টা চিৎকার করে বলল ও।

উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ছেলেরা, বড়দের ডাকতে চলে গেল গ্রামের দিকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই কয়েক শো শিলুক হাজির হলো নদীর পাড়ে, বিস্ময়ে নাকোন্তোর উদ্দেশে হাত নাড়ছে। তারপর বের হয়ে এলো বেঁটে নোম্ভ, গোটা সাড়ে চার কিউবিট, সামনে তার স্ত্রী ও ওদের নানা আকারের ছেলেপুলে।

মহানন্দে আলিঙ্গন করল নাকোন্তো ও নোম্ভ। তারপর মেয়েদের হুকুম দিল নো, দল বেঁধে গ্রামে ফিরে গেল তারা। অচিরেই আবার মাথার উপর উপচে পড়া বিয়রের বিশাল পাত্র নিয়ে ফিরে এলো।

নদীর পাড়ের উৎসব বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাকোন্তো এলো তাইতার কাছে। আপনার মতো মহান এক মানুষের সাথে অনেক দূরের পথ যাত্রা করেছি, এখন আর আপনি প্রবীন পুরুষ নন, বলল সে। বিশেষ করে লড়াইটা দারুণ ছিল, কিন্তু এটাই আমাদের একসাথে চলার শেষ। আপনি নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাচ্ছেন, আমাকেও আমার লোকদের কাছে ফিরে যেতে হবে।

বুঝতে পারছি। একটা ভালো মেয়ে পেয়েছ তুমি, তোমার সাথে মানাবে সে। তোমার সন্তানরা তোমার মতোই লম্বা চওড়া হোক এটাই আশা করি। তুমি যেন ওদের বাপের মতোই সমান দক্ষ বর্শা চলাতে শেখাতে পারো।

এটা ঠিক, আমার চেয়ে বয়সে ছোট বুড়ো বাবা। কিন্তু আমি পথ না দেখালে কীভাবে বিশাল জলাভূমিতে পথ খুঁজে পাবেন?

তোমার গোত্রের এমন দুজন তরুণকে বাছাই করবে তুমি যারা এখন তোমার সাথে আমার পরিচয়ের সময় তুমি যেমন ছিলে ঠিক সেরকম অবস্থায় আছে-যুদ্ধ আর অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে উন্মত্ত। পথ দেখানোর জন্যে ওদের আমার সাথে পাঠাবে তুমি। বিশাল সুদ-এ ওদের পথ দেখাতে দুই ভাস্তেকে বাছাই করল নাকোন্তো।

ওরা একেবারে অল্পবয়সী, ওদের জরিপ করে বলল তাইতা। খালগুলো চিনতে পারবে তো?

বাচ্চারা কি জানে না কীভাবে মায়ের দুধের কাছে যেতে হয়? হেসে ফেলল নাকোন্তো। আপনারা এখন যান, আমার বয়স যত বাড়বে তত আপনাদের কথা ভাবব আমি, সেটা সব সময়ই আনন্দের সাথে।

জাহাজের গুদাম থেকে পাঁচ শো গরু কেনার জন্যে যত ইচ্ছে পুঁতি নিয়ে নাও। শিলুকরা গরুবাছুর আর জন্ম দেওয়া ছেলে দিয়ে সম্পত্তির পরিমাপ করে। এক মুঠো ব্রোঞ্জের বর্শাও নাও, যাতে তোমার ছেলেরা সব সময়ই সশস্ত্র থাকে।

আপনার আর আপনার নীলের জলে ঝিলিক মারা সূর্যের আলোর মতো চুলের মেয়েমানুষ ফেনের তারিফ করি আমি।

আলিঙ্গন করল ফেন ও ইম্বালি, কাঁদল দুজনই। ঘাটের অর্ধেকটা দূরত্ব পর্যন্ত নৌবহরকে অনুসরণ করল নাকোন্তো ও ইম্বালি, নদীর তীর বরাবর দৌড়াচ্ছে, সামনের সারির নৌকার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে, হাত নেড়ে নাচছে, চিৎকার করে বিদায় জানাচ্ছে। অবশেষে থামল ওরা। স্টার্নে একসাথে দাঁড়াল ফেন ও তাইতা, ওদের দীর্ঘ অবয়ব ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যেতে দেখল।

*

সীমাহীন দিগন্ত অবধি বিছানো প্যাপিরাসের তীরের প্রথম মায়াবী দৃশ্য–দেখা দেওয়ামাত্র নাকান্তোর দুই ভাস্তে গলুইয়ে অবস্থান নিল, জলময় বুনো এলাকায় ঢোকার পর হালে অবস্থান নেওয়া মেরেনকে বিভিন্ন বাঁক আর মোড় সম্পর্কে ইশারা দিয়ে চলল।

নীল এখন প্রবল বেগে প্রবাহিত হওয়ায় জলাভূমিতে কেবল পানি আর পানি, কোথাও পা রাখার জায়গা নেই, ফলে দিনের পর দিন বৈঠা বেয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে ওরা। কিন্তু ওদের উত্তরে ঠেলে দেওয়া বাতাস স্থির, অবিচল রয়ে গেছে। তেকোণা পাল ফুলিয়ে তুলে আগাছা থেকে লাফিয়ে উঠে আসা হুল ফোঁটানো কীটপতঙ্গের ভেতর দিয়ে সবেগে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ওদের। প্রায়শই বাতাসের এই অস্বাভাবিক তুষ্টি নিয়ে ভাবছে ফেন। অবশেষে অনুমান করল তাইতা ইয়োসের কাছ থেকে আদায় করা ওর অসাধারণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এমনকি প্রকৃতির উপাদান গুলোকেও ইচ্ছামতো আচরণে বাধ্য করেছে।

এমনি পরিস্থিতিতে জলের উপর দিয়ে যাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠছে না। তাইতার কাছে তেমন কোনও দাবি দাওয়া নেই কারও, ফলে নৌকা চালানোর দায়িত্ব মেরেন ও নাকোন্তোর দুই ভাস্তে আর অন্যান্য ব্যাপার তিনাতের হাতে ছেড়ে দিতে পেরেছে ও। ফেন আর ও বেশির ভাগ সময়ই সামনের ডেকে নিজস্ব জায়গায় থাকে। ওদের আলাপের সিংহভাগ জুড়ে থাকে প্রথমত, ইয়োসের সাথে তাইতার সংঘাত ও দ্বিতীয়ত, দুর্গের আবিষ্কার ও তার অলৌকিক সম্পত্তি। ফেন ওর মুখে ইয়োসের বর্ণনা শুনতে কখনও ক্লান্ত হয় না।

তোমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী কি সেই?

না, ফেন। তুমিই সবচেয়ে সুন্দরী।

কথাটা কি আমার জিভটাকে বাধা দিতে বলছ নাকি মন থেকে?

তুমি আমার ছোট মাছ, তোমার সৌন্দর্য সোনালি দোরাদোর মতো, সব সাগরের সবচেয়ে মোহনীয় প্রাণী।

আর ইয়োস? তার কথা কী বলবে? সে কি সুন্দরী না?

খুবই সুন্দরী ছিল বটে, কিন্তু সেটা অনেকটা খুনে হাঙরের সৌন্দর্যের মতো। ওর ছিল ভয়ঙ্কর, আতঙ্ক জাগানো সৌন্দর্য।

সে যখন তোমার সাথে মিলিত হয়েছিল, তখনকার অনুভূতি আমার সাথে মিলনের সময়কার অনুভূতি কি একই রকম ছিল?

ঠিক জীবন ও মরণের মতোই আলাদা। ওরা বেলায় ব্যাপারটা ছিল শীতল, নিষ্ঠুর। তোমার বেলায় উষ্ণ, প্রেম ও সহানুভূতিতে ভরা। ওর বেলায় ভীষণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো, তোমর বেলায় তোমার ও আমার ভিন্ন ভিন্ন আত্মাকে মিলিয়ে বিভিন্ন অংশের তুলনায় অসীম, বিশাল সমগ্রতে পরিণত করার মতো।

ওহ, তাইতা, তোমাকে বিশ্বাস করতে যারপরনাই ইচ্ছে করছে। জানি, বুঝি কেন তোমাকে ইয়োসের কাছে যেতে হয়েছিল, ওর সাথে মিলিত হতে হয়েছে, কিন্তু তারপরেও ঈর্ষায় জ্বলে যাচ্ছি। ইদালি বলেছে পুরুষরা অনেক মেয়ের সাথে মজা লুটতে পারে। সে কি তোমাকে আনন্দ দেয়নি?

ওর বুনো আলিঙ্গন কতটা ঘৃণা করেছি, প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই। তার উচ্চারিত প্রতিটি কথা, তার দেহ ও হাতের প্রতিটি স্পর্শ আমাকে ভীত, বিতৃষ্ণ করে তুলেছে। এমনভাবে আমাকে দুষিত আর নোংরা করেছে সে, মনে হয়েছে আর কখনও পবিত্র হতে পারব না।

তোমার কথা শুনলে আমার ভেতর ঈর্ষা থাকে না। তোমার কষ্টের কথা ভেবে আমার মন সহানুভূতিতে ভরে ওঠে। তুমি কি কখনও ভুলে যেতে পারবে?

ফন্টের নীলে ধুয়ে আবার পরিচ্ছন্ন হয়েছি আমি। বয়স, পাপ ও অপরাধবোধের ভার আমার উপর থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।

আবার ফন্টের কথা বলল। নীলে আবৃত্ত হওয়ার সময় কেমন অনুভূতি হয়েছিল তোমার? আবার ওর পরিবর্তনের অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দিল তাইতা। শেষ করার পর খানিক ক্ষণ চুপ থেকে তারপর ফেন বলল, আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণে খোদ ইয়োসের মতোই ধ্বংস হয়ে গেছে ফন্ট।

এটাই পৃথিবীর স্পন্দিত ধমণী। প্রকৃতির স্বর্গীয় ক্ষমতা, যা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও ত্বরান্বিত করে। একে কখনও ধ্বংস করা যাবে না। কারণ তেমন কিছু ঘটলে সব সৃষ্টি বিনাশ হয়ে যাবে।

এখনও তার অস্তিত্ব থাকলে কী হয়েছে তার? কোথায় গেছে?

আবার পৃথিবীর মূলে চলে গেছে, ঠিক যেভাবে চাঁদ আর স্রোতের টানে সাগর দূরে ভেসে যায়।

তবে কি চিরকালের জন্যে মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এটাকে?

মনে হয় না। আমার ধারণা এক সময় ফের উঠে আসবে ওটা। হয়তো পৃথিবীর কোনও দূরপ্রান্তে এরই মধ্যে এসেও গেছে।

কোথায়, তাইতা? কোথায় আবার ফিরে আসবে ওটা?

আমি কেবল ইয়োস যতটুকু জানত ততটুকুই জানি। বিশাল কোনও আগ্নেয়গিরি আর জলের বিশাল আধারের সাথে সম্পর্কিত থাকবে এটা। আগুন, মাটি, বাতাস ও পানি; চার উপাদান।

কেউ কি আবার ফন্টের খোঁজ পাবে?

উত্তরের আগ্নেয়গিরি এরনার উদগীরণের ফলে জমিনের গভীরে চলে গেছে ওটা। সেই সময় ইয়োসের আস্তানার কাছে ছিল ওটা। আগুনের কারণে সরে পড়তে হয়েছিল তাকে। এক শো বছর ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাকে নীল নদ আবার কোথায় উঠে এসেছে তার সন্ধানে। চাঁদের পাহাড়ে এর খোঁজ পেয়েছিল। এখন আবার নিচে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওটাকে।

কতদিন তুমি তরুণ থাকবে, তাইতা?।

ঠিক করে বলতে পারব না। হাজার বছরেরও বেশি সময় তরুণ ছিল ইয়োস। তার গলাবাজি আর ওর কাছ থেকে আদার করা বিশেষ কিছু জ্ঞানের কল্যাণে সেটা জানতে পেরেছি।

এখন ফন্টে ম্লান করার পর একই ব্যাপার ঘটবে, বলল ফেন, হাজার বছর বেঁচে থাকবে তুমি?

সে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদ উঠে ওকে জাগাল ফেন। ওর নাম ধরে ডাকল। তাইতা, আমার জন্যে অপেক্ষা করো! ফিরে এসো! আমাকে ফেলে যেয়ো না। ওর গালে হাত বুলিয়ে দিল তাইতা, চোখের পাতায় চুমু খেয়ে আস্তে করে জাগিয়ে তুলল ওকে। ব্যাপারটা স্রেফ স্বপ্ন ছিল বুঝতে পেরে ওকে আঁকড়ে ধরল ফেন। তুমি, তাইতা। সত্যি তুমি? তুমি আমাকে ফেলে চলে যাওনি?

তোমাকে ফেলে কোনওদিনই যাব না আমি, নিশ্চিত করল ও।

যাবে। এখনও চোখজোড়া অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আছে তার।

কখনও না, আবার বলল তাইতা। তোমাকে ফিরে পেতে অনেক দিন লেগেছে আমার। তোমার স্বপ্নের কথা বলো, ফেন। চিমা বা ট্রগরা ধাওয়া করছিল তোমাকে?

চট করে জবাব দিল না ও। এখনও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। অবশেষে ফিসফিস করে কথা বলল। এটা হাস্যকর স্বপ্ন ছিল না।

আমাকে বলল ওটার কথা।

স্বপ্নে আমি বুড়িয়ে গেছি। আমার চুল পাতলা, শাদা হয়ে গেছে-চোখের সামনে ঝুলে থাকতে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার চামড়া কুঁচকে গেছে, হাতের হাড় জিরজিরে থাবার মতো। পিঠ কুঁজো হয়ে গেছে, পা ফুলে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে পড়েছে। তোমার পেছনে পেছনে কোনওমতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু এত জোরে হাঁটছিলে তুমি, তোমার সাথে তাল মেলাতে পারছিলাম না। পিছিয়ে পড়ছিলাম, এমন কোথাও চলে যাচ্ছিলে তুমি যেখানে তোমার সাথে আমি যেতে পারব না। ফের অস্থির হয়ে উঠল ও। চিৎকার করে তোমাকে ডাকছিলাম, কিন্তু শুনতে পাচ্ছিলে না তুমি। আবার কাঁদতে শুরু করল সে।

এটা কেবলই স্বপ্ন, দুহাতের বৃত্তের ভেতর ওকে শক্ত করে ধরে রাখল তাইতা, কিন্তু প্রবলভাবে মাথা নাড়ল ফেন।

এটা ছিল ভবিষ্যতের একটা ছবি। পেছনে না তাকিয়ে দ্রুত চলে গেছ তুমি। তুমি লম্বা, শক্তিশালী, ঋজু, তোমার পাজোড়া শক্তিশালী। তোমার চুল ঝলমলে, ঘন। হাত বাড়িয়ে এক গোছা চুল আঙুলে জড়াল সে। ঠিক এখনকার মতোই।

বোন আমার, খামোকা নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। তুমিও খুবই সুন্দর ও তরুণী।

হয়তো এখন। কিন্তু তুমি এমনই রয়ে যাবে, আর আমি বুড়িয়ে যাব, মরে যাব। তোমাকে আবার হারাতে হবে আমাকে। আমি আর শীতল তারায় পরিণত হতে চাই না। তোমার সাথে থাকতে চাই।

ওর আয়ত্তাধীন অনেক কালের সমস্ত প্রজ্ঞা দিয়েও ফেনকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনও ভাষা খুঁজে পেল না তাইতা। শেষে আবার ওর সাথে মিলিত হলো। ওর আলিঙ্গনে ধরা দিল ফেন, এক ধরনের মরিয়া উন্মাদনায়, যেন ওর সাথে মিশে যেতে চাইছে, শারীরিক দেহের সাথে সাথে আত্মায়ও মিশে এক হয়ে যেতে চাইছে, যেন এমনকি মরণও ওদের বিচ্ছিন্ন করতে না পারে। শেষে ভোরের ঠিক আগে। ভালোবাসা ও হতাশার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল ফেন।

*

সময়ে সময়ে দীর্ঘদিন আগে পরিত্যক্ত লু-দের গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছে ওরা। খুটির উপর কোনওমতে জ্বলছে কুঁড়েগুলো। ফুঁসে ওঠা পানিতে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছে। পানি বেড়ে ওঠায় বিশাল সুদের আশপাশের উঁচু এলাকার খোঁজে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে ওরা, ব্যাখ্যা করল ফেন। পানি কমে যাবার পরেই কেবল আবার মাছ ধরতে ফিরে আসবে।

ভালোই হয়েছে, বলল তাইতা। ওদের সাথে দেখা হয়ে গেলে নিশ্চিতভবাবেই যুদ্ধ করতে হতো। অথচ এই অভিযানে এমনিতেই আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের লোকেরা ঘরে ফিরতে অধীর হয়ে উঠেছে।

ঠিক আমার মতে, সায় দিল ফেন। যদিও আমার বেলায় এই জীবনে প্রথমবারের মতো ঘরে যাওয়া হবে।

সেরাতে আবার দুঃস্বপ্ন তাড়া করল ফেনকে। ওকে জাগিয়ে তুলল তাইতা, উদ্ধার করে আনল মনের অন্ধকার ত্রাস থেকে। এক সময় ওর হাতের উপর নিথর হয়ে না শোয়া পর্যন্ত ওকে সোহাগ আর চুমু খেয়ে চলল। কিন্তু তারপরেও জ্বরাক্রান্তের মতো কাঁপতে লাগল ফেন। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের আওয়াজের মতো ওর বুকের কাছে ধুকপুক করে চলল ওর হৃৎপিণ্ড।

সেই একই স্বপ্ন? মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল তাইতা।

হ্যাঁ, তবে আরও খারাপ, ফিসফিস করে বলল ফেন। এইবার বয়সের ভারে আমার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে আর তুমি এত দূরে চলে গেছ যে কেবল তোমার গাঢ় অবয়বই দেখতে পাচ্ছিলাম আমি, আবছায়ায় মিশে যাচ্ছ। ফেন আবার কথা বলার আগ পর্যন্ত দুজনই চুপ রইল। তোমাকে হারাতে চাই না, কিন্তু জানি অর্থহীন বাসনা আর দুঃখ করে দেবতারা আমাদের যে ভালোবাসার সময়টা দিয়েছেন তা নষ্ট করা যাবে না। আমাকে অবশ্যই শক্তিমতী ও সুখী থাকতে হবে। অবশ্যই একসাথে থাকার সময়টুকু উপভোগ করতে হবে-না ঘটা পর্যন্ত এই ভীষণ বিচ্ছিন্নতার কথা বলব না। আরও এক মিনিট নীরব রইল সে, তারপর এত নিচু কণ্ঠে কথা বলল যে বুঝতে কষ্ট হলো তাইতার। যতক্ষণ না ঘটছে, তবে অবশ্যই ঘটবে।

না, প্রিয় ফেন আমার, জবাব দিল তাইতা। এটা অনিবার্য নয়। আর কখনওই আমরা বিচ্ছিন্ন হবো না। ওর বাহুতে স্থির হয়ে গেল ফেন। বলতে গেলে শ্বাসই ফেলছে না, এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তাকে ঠেকাতে কী করতে হবে আমি জানি।

বলো আমাকে! দাবি করল ফেন। ব্যাখ্যা করল তাইতা। মনোযোগ দিয়ে শুনল ফেন। কিন্তু তাইতা শেষ করতেই একশো একটা প্রশ্ন শুরু করল। তাইতা সেগুলোর জবাব দেওয়ার পর বলল, সেটা অনন্ত কালের মতো হতে পারে। ওর সামনে তাইতার মেলে ধরা ছবির আওতায় হতাশ।

কিংবা হয়তো কয়েক বছর লাগতে পারে, বলল তাইতা।

ওহ, তাইতা, নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে আমার। কখন শুরু করতে পারব আমরা?

তার আগে আমাদের প্রিয় মিশরের যে ক্ষতি ইয়োস করে গেছে তার পুনর্বাসনের জন্যে অনেক কিছু করার বাকি রয়ে গেছে।

ততদিন পর্যন্ত ক্ষণ গুনে যাব আমি।

*

দিনের পর দিন হাওয়া স্থিতিশীল রইল, ফলে মাঝিরা মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে বৈঠা বেয়ে চলল, ওদের প্রাণশক্তি অফুরান, হাত আর শিরদাঁড়া অপরাজেয়, নাকোন্তোর ভাস্তেরা ওদের নির্ভুলভাবে বিভিন্ন খালের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রোজ দুপুরে মাস্তুলের ডগায় উঠে যায় তাইতা, সামনের বিস্তার জরিপ করে। ওর প্রত্যাশার ঢের আগেই দূরে অন্তহীন প্যাপিরাসের মাথার উপর প্রথম গাছপালার অবয়ব দেখতে পেল ও। গালির কীলের নিচে গম্ভীর হয়ে উঠেছে নীলের জল, দুপাশের আগাছার প ফাঁক হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বিশাল সুদে এসে পড়ল ওরা। সামনে পড়ে আছে বিশাল সমতল ভূমি, যার ভেতর দিয়ে দীর্ঘ সবুজ পাইথনের মতো চলে গেছে নীল, এক সময় হারিয়ে গেছে দূরের ধূলিময় ধোয়াশায়।

একটা খাড়া তীরের কাছে গালিগুলো নোঙর করল ওরা। অনেক দিন বাদে তাইতা ও ওর লোকজন শুকনো মাটিতে শিবির খাটানোর সময় ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিল। এক লীগ দূরে নোংরা সমতলের ওপাশে আটটা জিরাফের একটা পাল চ্যাপ্টা মাথার বাবলা গাছের একটা ঝাড়ে চরে বেড়াচ্ছে।

শিলুকদের ওখান থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকে আর টাটকা মাংস জোটেনি আমাদের কপালে, তিনাতকে বলল তাইতা। মাগুর মাছের বদলে অন্য কিছু খেতে পারলে সাবাই খুশি হবে। একটা শিকারী দল করার কথা বলছি আমি। ওদের যারীবা তৈরি শেষ হয়ে গেলে লোকজনকে বিশ্রাম নিয়ে মজা করতে দাও।

তাইতা, মেরেন আর মেয়ে দুটি ওদের ধনুকে তীর পরাল, ঘোড়ার পিঠে চেপে দীর্ঘ পাঅলা ডোরাকাটা জানোয়ারের উদ্দেশে আগে বাড়ল। ঘোড়াগুলো মনিবের মতোই ফের তীরে আসতে পেরে খুশি। ঘাড় সোজা করে রেখেছে ওরা, খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে ছোটার সময় লেজ দোলাচ্ছে। জিরাফের দল অনেক দূর থেকে ওদের আসতে দেখে বাবলা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে ছুটে গেল। প্রান্তরের উপর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটতে রাগল। ওদের পশমের গোছাঅলা দীর্ঘ লেজ পাছার উপর উঠে গেছে। ওদের দুপাশের পা একসাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, ফলে মনে হচ্ছে খুব ধীরে আগে বাড়ছে ওরা। কিন্তু নাগাল পেতে সর্বোচ্চ বেগে ঘোড়া হাঁকাতে হচ্ছে শিকারীদের। জিরাফগুলোর পেছনে পৌঁছার পর ওগুলোর খুরের ঘায়ে ওড়া ধুলোর মেঘে ঢুকে পড়ল, চোখ বাঁচাতে চোখ সরু করে ফেলতে বাধ্য হলো ওরা। পালের ঠিক পেছন পেছন ছুটতে থাকা একটা অল্পবয়সী মদ্দা জিরাফ বেছে নিল তাইতা, গোটা দলের জন্যে পর্যাপ্ত মাংস মিলবে ওটা থেকে। সেই সাথে নরম ও চর্বিদারও হবে।

ওটাই চাই আমাদের! চিৎকার করে বলে উঠল ও। ইঙ্গিতে অন্যদের দেখাল ওটা। পশুটার কাছাকাছি গিয়ে ওটার পায়ের পেছনে প্রথম তীর ছুঁড়ে মারল। মহাশিরা কেটে খোঁড়া করে ফেলার ইচ্ছা ওটাকে। টলে উঠে প্রায় পড়ে যাবার দশা। হলো জিরাফটার, কিন্তু আবার তাল সামলে আগে বাড়তে লাগল, তবে ভাঙা গতিতে। আহত পায়ের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখছে। অন্যদের ইশারা করল তাইতা। দু ভাগে ভাগ হয়ে দুপাশ থেকে পশুটার দিকে চেপে এলো ওরা। মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে ওটার জীবন্ত হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস লক্ষ্য করে ক্রমাগত তীর ছুঁড়ে চলল। কিন্তু যুদ্ধের ঢালের মতোই শক্ত ওটার চামড়া, স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোও অনেক গভীরে বসানো। প্রবল রক্তক্ষরণ নিয়ে দৌড়ে চলল জানোয়ারটা, লেজ দোলাচ্ছে, একেকটা তীর গায়ে বিধছে আর অমনি মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠছে।

আওতা কমাতে ক্ৰমে ওদের ঘোড়া কাছে নিয়ে আসতে লাগল অশ্বারোহীরা, যাতে ওদের তীরগুলো আরও কার্যকরভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। মেরেনের সামান্য পেছনে ছিল সিদুদু, মেয়েটার বেপরোয়াভাবে শিকারের দিকে ছুটে যাওয়া খেয়াল করেনি মেরেন, কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে অবশেষে দেখতে পেল ও।

বেশি কাছে চলে যাচ্ছ! ওর উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল মেরেন। পিছিয়ে যাও, সিদুদু! কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। জিরাফটা পেছন পায়ে প্রবল একটা লাথি হকাল ওকে। থমকে গেল ঘোড়াটা। সিদুদু আসন হারাল, ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে দড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও, গড়ান খেয়ে আরেকটু হলেই জিরাফের পায়ের নিচে চলে যাবার অবস্থা হলো। আবার লাথি হাঁকাল জিরাফটা, জায়গামতো লাগলে খুলি ফেটে চৌচির হয়ে যেত ওর, কিন্তু ফস্কে যাওয়ায় মাথার অল্প উপর দিয়ে চলে গেল। তারপর ওর গড়ানি থামলে মড়ার মতো স্থির পড়ে রইল ও। নিমেষে ঘোড়া ঘোরাল মেরেন, লাফ নিয়ে নেমে পড়ল।

মেরেন ওর দিকে ছুটে যাবার সময় মাতালের মতো উঠে বসে অনিশ্চিত হাসি দিল সিদুদু। যতটা মনে হয়, জমিন তারচেয়ে শক্ত, আলতো করে কপালের একপাশে হাত ছোঁয়াল সে। আমার মাথাও যতটা ভাবতাম তারচেয়ে নরম।

তাইতা বা ফেন, কেউই ওর পতন দেখেনি, জিরাফের পেছনে ধাওয়া করে চলল ওরা। ওটাকে মারার মতো গভীরে ঢুকেছে আমাদের তীর, ফেনের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল তাইতা। তলোয়ার দিয়েই ফেলতে হবে ওটাকে।

 জানের ঝুঁকি নিয়ো না, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল ফেন। কিন্তু সতর্কবাণী উপেক্ষা করল তাইতা। রেকাব থেকে এক ঝটকায় পা মুক্ত করে নিল।

উইন্ডস্মোকের মাথাটা ধরো, ফেনকে বলল ও। লাগাম ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। এবার দুই কাঁধের মাঝখানে ঝোলানো খাপ থেকে তলোয়ার বের করে এক লাফে নেমে পড়ল জমিনে। মেয়ারের গতি কাজে লাগিয়ে নিজেকে সামনে ছুঁড়ে দিল যাতে অল্প সময়ের জন্যে হলেও জিরাফের গতির সাথে পাল্লা দিতে পারে। প্রতি পদক্ষেপে ওটার পেছনের বিশাল পা তাইতার মাথা ছাড়িয়ে অনেকটা উপরে উঠে যাচ্ছে, বাউলি কেটে পাশ কাটাচ্ছে ও। কিন্তু জিরাফটা ওর একেবারে কাছে পা স্থির করে ওটার উপর নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিতেই চাপ পড়ে তাইতার কব্জির মতো পুরু টেন্ডন সগর্ব ভঙ্গিতে দাগঅলা চামড়ার ভেতরে ফুটে উঠল।

দৌড়ের উপরই দুই হাতে তলোয়ারের বাঁট শক্ত করে ধরে ঠিক গোড়ালির উপরে সপাটে ফলা চালাল ও, টেন্ডন বিচ্ছিন্ন করার ইচ্ছা। লাগাতে পারল, রাবার ছেঁড়ার মতো শব্দ করে কেটে গেল ওটা। পা দুমড়ে গেল, পাছার উপর পিছলে লুটিয়ে পড়ল জিরাফটা। নিজেকে আবার ওঠানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পাজোড়া অচল হয়ে গেছে। উল্টো তাল হারিয়ে গড়িয়ে একপাশে পড়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে তাইতার নাগালের ভেতর জমিনে লম্বা হয়ে গেল ওটার গলা। এক লাফে সামনে এগিয়ে গেল তাইতা, পেছনে ঢুকিয়ে দিল ফলাটা, কশেরুকার সংযোগ স্থল বিচ্ছিন্ন করে দিল প্রায়। জিরাফটা ফের লাথি হাঁকাতেই লাফিয়ে পিছিয়ে এলো ও। ওটার চারটে পাই অসাড় হয়ে এলো, স্থির হয়ে গেল তারপর। কেঁপে উঠল চোখের পাতা, বিরাট চোখের উপর নেমে এলো পাঁপড়িগুলো।

তাইতা মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় উইন্ডস্মোক নিয়ে ওর কাছে দৌড়ে এলো ফেন। অনেক ক্ষিপ্র তুমি। ওর কণ্ঠে বিস্ময়। কবুতরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া বাজপাখির মতো। লাফ দিয়ে নেমে তাইতার কাছে ছুটে এলো ও। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে মাথার চুল, পিছু ধাওয়ার রোমাঞ্চে উজ্জ্বল ওর চেহারা।

আর এতই সুন্দর যে যখনই তোমাকে দেখি আমার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দাও, ওকে দুহাতে সামনে ধরে রেখে বলল তাইতা, চেহারা পরখ করল। কেমন করে ভাবতে পারলে যে তোমাকে ফেলে চলে যেতে পারি?

এ নিয়ে পরে আবার কথা বলব আমরা, কিন্তু ওই যে মেরেন আর সিদুদু আসছে।

সিদুদুর ঘোড়াটাকে আবার পাকড়াও করেছে মেরেন। আবার সওয়ার হয়েছে। সিদুদু। কাছে আসার পর ওরা লক্ষ করল ওর পোশাক ছিঁড়ে গেছে। ধুলোয় ভরে আছে সারা শরীর, চুলে খড়কুটো লেগে রয়েছে। এক গালে চিড় ধরেছে। কিন্তু হাসছে সে।হো, ফেন, চিৎকার করে বলল সে। দারুণ খেলা না?

চারজন একসাথে বাবলা গাছের সবচেয়ে কাছের ঝোঁপের দিকে এগিয়ে গেল, ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিতে জিন থেকে নামল। পানির চামড়ার থলে পরস্পরের হাতে চালান করল ওরা। তৃষ্ণা মেটানোর পর কাঁধের উপর থেকে টিউনিক ফেলে দিয়ে তাইতাকে ক্ষতস্থান পরখ করার সুযোগ করে দিল সিদুদু। বেশি সময় লাগল না।

টিউনিক পরে নাও, সিদুদু। কোনও হাড়গোড় ভাঙেনি তোমার, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। কেবল নদীতে একদফা গোসল দরকার তোমার। কয়েক দিনের মধ্যেই আঘাতগুলো মিলিয়ে যাবে। এখন মেরেন আর তোমার সাথে একটা অসাধারণ মুহূর্ত নিয়ে আলাপ করতে চাই। ওদের শিকারে নিয়ে আসার এটাই আসল কারণ। ওদের একা পেতে চেয়েছে তাইতা, যাতে ওদের কাছে নিজের পরিকল্পনা খুলে বলতে পারে।

মেরেন ও সিদুদুকে অপেক্ষামান নৌবহরে ফিরে যেতে দেবার আগে সূর্য দুপুরের দূরত্বে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে ওদের মেজাজ বদলে গেছে, দুজনই উদ্বিগ্ন ও অসুখী।

কথা দাও চিরজীবনের জন্যে চলে যাবে না তুমি, আন্তরিকভাবে ফেনকে আলিঙ্গন করল সিদুদু। আমার কাছে বোনের চেয়েও অনেক বেশি প্রিয় তুমি। তোমাকে হারানো সহ্য করতে পারব না।

তোমরা আমাদের দেখতে না পেলেও এটা স্রেফ একটা সামান্য জাদু। আগেও অনেকবার ঘটতে দেখেছ। ওকে আশ্বস্ত করল ফেন।

এবার মেরেন কথা বলল, আপনার বুদ্ধির উপর আমার আস্থা আছে, ম্যাগাস, যদিও মনে হচ্ছে এককালে যতটা ছিল এখন তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। সেইসব সময়ের কথা আমার মনে আছে যখন আপনিই আমার কাণ্ডজ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাকেই আপনার সেবকের ভূমিকায় নামতে হবে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে দুপায়ের মাঝখানে যখন একটা কিছু ঝুলতে থাকে তখন লোকে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।

হেসে উঠল তাইতা। বেশ ভালো পর্যবেক্ষণ, সৎ মেরেন। কিন্তু খামোকা উদ্বিগ্ন হয়ো না। ফেন আর আমি জানি আমরা কী করতে যাচ্ছি। নৌকায় ফিরে যাও, নিজের কাজ করো।

নদীর উদ্দেশে ঘোড়া হাঁকাল মেরেন ও সিদুদু, কিন্তু বারবার স্যাডলে ঘুরে উদ্বিগ্ন চোখে পেছনে তাকাচ্ছে। চোখের আড়ালে যাবার আগে কমপক্ষে দশ-বার বার হাত নাড়ল।

এবার নিজেদের অদৃশ্য হওয়ার পটভূমি স্থির করতে হবে আমাদের, ফেনকে বলল তাইতা। স্যাডলের পিছনে বাঁধা ঘুমানোর মাদুর আনতে এগিয়ে গেল ওরা। বেডরোলের ভেতরে নিজেদের জন্যে টাটকা পোশাক নিয়ে এসেছিল ওরা। নোংরা, ঘামে ভেজা টিউনিক খুলে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে নগ্ন শরীরে শীতল বাতাসের স্পর্শ উপভোগ করল। পরিষ্কার টিউনিক তুলতে উবু হলো তাইতা, কিন্তু ওকে বাধা দিল ফেন। এমন কোনও তাড়াহুড়ো নেই, মাই লর্ড। অন্যরা আমাদের খোঁজে ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে। আমাদের উচিত এই মুহূর্তের সুযোগ নেওয়া, যখন পোশাকে আবদ্ধ হয়ে নেই আমরা।

মেরেন তিনাতকে আমাদের মারা যাবার কথা বললেই আমাদের লাশের খোঁজে গোটা বাহিনী ছুটে আসবে এখানে। আমাদের বহাল তবিয়তে দেখে ফেলতে পারে।

মেরেন কী বলেছে মনে আছে? পুরুষকে কীভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠে? বেশ, আমি বলি কি দুজনে মিলেই বেপরোয়া হই আমরা।

ব্যাপারটা ঠিক মতো শেষ করতে পারল ওরা। যখন কেবল আত্মগোপনে যাবার মঞ্চ তৈরি শেষ করে এনেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই নদীর দিক থেকে দ্রুত ছুটে আসা ঘোড়ার পায়ের ঘায়ে উড়ন্ত ধুলোর মেঘ চোখে পড়ল ওদের। নিঃশব্দে বাবলা গাছের বনে ফিরে এসে চুপ করে একটা গাছের গোড়ায় বসে রইল ওরা। পরস্পরের হাত ধরে চারপাশে আড়ালের জাদু বুনতে লাগল।

এক বিরাট অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে প্রবল বেগে ধুলোর মেঘ তুলে ছুটে এসে দৃষ্টি সীমায় উদয় হলো মেরেন ও তিনাত। উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ডকে বনের ধারে চরে বেড়াতে দেখেই ওদের দিকে বাঁক নিল। তাইতা ও ফেন যেখানে বসেছিল তার বিশ কদমের মধ্যে চলে এলো।

হায়, সেথের কুঁড়ি আর কলজের দোহাই, চিৎকার করে উঠল মেরেন। স্যাডলে রক্ত দেখতে পাচ্ছ! ঠিক তোমাদের যা বলেছি। জিনের দল ওদের পাকড়াও করে নিয়ে গেছে।

গাঢ় ছোপগুলো আসলে জিরাফের রক্ত, কিন্তু সেটি তিনাতের জানার কথা নয়। আইসিস আর ওসিরিসের দোহাই, খুবই করুণ ঘটনা। জিন থেকে নেমে পড়ল সে। ম্যাগাস ও তার সঙ্গীর খোঁজে গোটা এলাকায় তল্লাশি চালাও।

অল্পক্ষণের ভেতরই তাইতার ছেঁড়াফাটা রক্তাক্ত টিউনিক পেয়ে গেল ওরা। ওটা দুহাতে ধরে মুখ দাবাল মেরেন। তাইতাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাবা ছাড়া সন্তান হয়ে গেছি আমি, কেঁদে উঠল ও।

সৎ মেরেন অতিঅভিনয় করে ফেলছে বলে ভয় হচ্ছে, ফিসফিস করে ফেনকে বলল তাইতা।

ওর ভেতর এই গুণ থাকার কথা মনে হয়নি কখনও, সায় দিল ফেন। মন্দিরের উৎসবে হোরাসের ভুমিকায় দারুণ অভিনয় করতে পারবে।

কীভাবে ফারাওর কাছে ফিরে গিয়ে তাইতার অপহরণের কথা বলব? বিলাপ করছে তিনাত। অন্তত লাশ তো খুঁজে বের করতে হবে।

তোমাকে বলেছি তো, কর্নেল তিনাত। দুজনকেই জিনরা আকাশে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছি আমি, ওকে নিরস্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন।

কিন্তু তিনাত একগুঁয়ে আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারপরেও অনুসন্ধান চালাতে হবে আমাদের। বনের প্রতিটি ইঞ্চি চিরুণী তল্লাশি চালাব আমরা, জোর করল সে। আরও একবার লোকেরা প্রসারিত রেখায় ছড়িয়ে পড়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল।

সবার সামনে রয়েছে মেরেন ও তিনাত, ওদের মাত্র হাত খানেক দূরে হাঁটছে মেরেন। ভয়ঙ্করভাবে চোখ কুঁচকে আছে ওর, আপনমনে বিড়বিড় করছে। আরে তিনাত, বোকামি করো না। চলো নৌকায় ফিরে যাই, ম্যাগাস ওর জাদু নিয়ে থাকুন।

এই সময় এক সৈনিক ফেনের রক্তমাখা টিউনিকের খোঁজ পেতেই চিৎকার শুনতে পেল ওরা। ওর দিকে ছুটে গেল মেরেন, তিনাতের সাথে তর্ক জুড়ে দিতে শুনল ওকে, তল্লাশি বাদ দিতে রাজি করানোর চেষ্টা করছে ওকে। রক্তাক্ত পোশাকের প্রমাণ পাওয়ায় অবশেষে ক্ষান্ত দিল তিনাত। উইন্ডস্মোক আর ওয়ার্লউইন্ডকে নিয়ে জিরাফের লাশের কাছে ফিরে গেল ওরা, ছাল খসিয়ে মাংস কেটে নৌকায় নিয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াল তাইতা ও ফেন, অস্ত্রশস্ত্র তুলে তারপর উত্তর দিকে কোণাকুনি আবার নীলের তীরে আসার জন্যে এগোল।

তোমার সাথে একা হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে আমার, স্বপ্নিল ভাব নিয়ে বলল ফেন। আমরা কি আবার বিশ্রাম নিতে ওই গাছের ছায়ায় থামব?

মনে হচ্ছে তোমার ভেতর একটা সুপ্ত ড্রাগনকে জাগিয়ে দিয়েছি।

*

তাইতার অদৃশ্য হওয়ার মারাত্মক খবর শোনার পর গোটা দলটাই রীতিমতো এক শোকাবহ অবস্থায় পতিত হলো। পরদিন ওরা ঘোড়া বোঝাই করে আবার নদীর ভাটির দিকে রওয়ানা হওয়ার সময় শববাহী মিছিলের মতো লাগছিল ওদের। ওরা কেবল ম্যাগাসকেই হারায়নি, বরং ফেনও বিদায় নিয়েছে। ওর সৌন্দর্য ও কমনীয়তা দলের সবার কাছে সৌভাগ্যের কবচের মতো ছিল। সিদুদুর মতো অল্প বয়সী তরুণীরা বিশেষ করে যাদের ও অস্ত্রে গোলা ভরার কাজ থেকে মুক্তি দিয়েছিল তারা ওকে রীতিমতো পূজা করতে শুরু করেছিল।

জানি সত্যি না তারপরেও ওকে ছাড়া নিজেকে বিষাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে, মেরেনকে ফিসফিস করে বলল সিদুদু। কেন তাই এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলতে গেলেন?

নিজের আর ফেনের জন্যে নতুন জীবন গড়ে তুলতে হবে তাকে। তিনি যখন বয়স্ক আর রূপালি দাড়িধারী ছিলেন তাদের খুব অল্পজনই তাঁর জাদুকরী পরিবর্তনের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। ওরা তার নব জন্মের ভেতর কালো ডাকিনী বিদ্যার বৈরী ব্যাপারস্যাপার দেখতে পাবে। ফেন ভয় ও ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হবে।

তারমানে ওরা এমন কোথাও যাবে যেখানে আমরা ওদের অনুসরণ করতে পারব না।

আমারও সেই রকমই ভয়, তাই তোমাকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না, ওর কাঁধে হাত রেখে বলল মেরেন। এখন থেকে আমাদের দুজনকে নিজের পথ বেছে নিতে হবে। পরস্পরের মাঝে আমাদের অবশ্যই শক্তি আর লক্ষ্য খুঁজে পেতে হবে।

কিন্তু ওদের ভাগ্যে কী হবে? ওরা কোথায় যাবে? জোর করল সিদুদু।

তাইতা এমন এক জ্ঞানের সন্ধান করছেন আমরা যা বুঝব না। ওর সারাটা জীবনই একটা অনুসন্ধান। এখন তার জীবন অন্তহীন হয়ে গেছে বলে অনুসন্ধানও তাই। কী বলেছে সেটা মনে মনে উল্টেপাল্টে দেখল ও। তারপর আবার খেই ধরল, ওর পক্ষে এটা অন্তদৃষ্টির এক বিরল ঝলক। সেটা বিশাল আশীর্বাদ বা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওদের কি আর কোনওদিনই দেখতে পাব না আমরা? দয়া করে বলো, ব্যাপারটা অমন হবে না।

ওরা চলে যাবার আগে আবার ওদের দেখা পাব। এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যেতে পারে। আমাদের সাথে অমন নিষ্ঠুর আচরণ কখনওই করবে না। তবে একদিন চিরকালের মতো চলে যাবে ওরা।

কথা বলায় সময় পাশ দিয়ে পিছলে চলে যাওয়া তীরের দিকে নজর রাখছিল মেরেন, তাই চিহ্ন রেখে যাবার কথা বলেছিল, সেটা দেখার চেষ্টা করছে। অবশেষে তীর থেকে আলোর উজ্জ্বল একটা প্রতিফলন দেখতে পেল, পলিশ করা ধাতুর উপর রোদের প্রতিফলন। চোখের উপর হাত রেখে দেখার চেষ্টা করল সে। ওই যে, তীরে দিকে নৌকা ঘোরাল ও। মাঝিরা ওদের বৈঠা থামাল। ডেক আর শুকনো জমিনের মাঝের দূরত্বটুকু এক লাফে পার হয়ে গেল মেরেন, দৌড়ে গেল ডগার উপর খাড়া হয়ে থাকা তলোয়ারটার দিকে। বের করে নিল ওটা, মাথার উপর ঘোরাল। তাইতার তলোয়ার! তিনাতের উদ্দেশে বলল ও। পেছনের গালিতে ছিল সে। এটা একটা লক্ষণ!

ওর কাছে একটা শোর পার্টি পাঠাল তিনাত। দুই দিকে আধ লীগ এলাকা জুড়ে তল্লাশি চালাল ওরা। কিন্তু মানুষের উপস্থিতির আর কোনও চিহ্ন পেল না।

বুড়ো শেয়ালের মতোই চতুর তাইতা, ভাবল মেরেন। এমন নিখুঁতভাবে কায়দা করছে এমনকি আমি পর্যন্ত ধরা খেয়ে যাচ্ছি। আপনমনে হাসল সে। তবে অন্য লোকদের সাথে কথা বলার সময় চেহারা গম্ভীর করে রাখল। তল্লাশী চালিয়ে আর ফায়দা নেই। এইসব ব্যাপার আমাদের বোধের বাইরে। ম্যাগাস তাইতাই যদি হেরে গিয়ে থাকেন, তো আমরা কোন ছার? আমরাও পরাস্ত হওয়ার আগেই বরং নৌকায় ফিরে যাই। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীতি নিয়ে দ্রুততার সাথে পরমার্শটা গ্রহণ করল ওরা, ঝটপট আবার গালিতে আশ্রয় নিল। ওরা নিরাপদে আবার রওয়ানা দেওয়ার পরপরই যাত্রা অব্যাহত রাখার হুকুম দিল মেরেন। মাঝিরা বেঞ্চে নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করল। তারপর লীগ খানেক দূরত্ব নীরবে এগিয়ে চলল।

গলুইতে মূল বৈঠা হাঁকাচ্ছে হিলতো। হঠাৎ মাথা উঁচু করে গান ধরল সে। কর্কশ কিন্তু শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। যুদ্ধের ডামাডোল ছাপিয়ে লোকদের নির্দেশ দেয় ওরই কণ্ঠস্বর। নীরব নদীর ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল তার গানের সুর:

ভয়াল দেবী হাগ-এন-সা-কে প্রণাম, অনন্ত কাল অবধি যার আয়ু।
প্রথম পাইলনের রক্ষকতাকে জানাই প্রণাম।
পৃথিবীর একেবারে গভীরে তোমার বাস;
প্রতিদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে মরণ ঘটে তোমার।
ভোরে আবার জীবিত হয়ে ওঠো। রোজ তোমার নতুন করে পাওয়া
তারুণ্য নিয়ে উদিত হও লোনাসের ফলের মতো।
তাইতা শব্দের ক্ষমতা রাখেন;
তাকে প্রথম পাইলন অতিক্রম করতে দাও!

এটা মৃতের গীতিকা-এর একটা অধ্যায়, এক রাজার নামে বিলাপ। সাথে সাথে গোটা দল সুর তুলে নিল, বাকি অংশ গাইল:

তাকে সেখানেই যেতে দাও যেখানে আমরা যেতে পারব না।
অন্ধকার জগতের রহস্য জানার সুযোগ দাও তাঁকে।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হোরাসের প্রাজ্ঞ সাপে পরিণত হয়েছে তিনি।

পরের পঙক্তি গাইল হিলতো:

জগতের ধ্বংসকারী সেথকে প্রণাম;
আত্মার সর্বশক্তিমানকে জানাই প্রণাম, ভয়াল ভীতি জাগিয়ে তোলা ঐশ্বরিক আত্মা।
তাইতার আত্মাকে দ্বিতীয় পাইলন অতিক্রম করতে দাও।
শক্তির শব্দের অধিকারী তিনি।
তাইতাকে অসিরিসের শাপলা সিংহাসনে পৌঁছাতে দাও;
যার পেছনে আইসস আর হাথর দাঁড়িয়ে থাকেন।

কয়েকজন মহিলাসহ অন্যরা সুরেলা কণ্ঠে তাল মেলাল:

ওকে যেতে দাও যেখানে আমরা যেতে পারব না।
অন্ধকার জগতের রহস্য জানার সুযোগ দাও তাকে।
ওকে যেতে দাও!
ওকে যেতে দাও!

সামনের নৌকার স্টার্নে স্টিয়ারিং বেঠা ধরে দাঁড়ানো মেরেন গাইতে লাগল ওদের সাথে। ওর পাশে সিদুদুর কণ্ঠ কাঁপছে, সর্বোচ্চ লয়ে পৗঁছালে ওর আবেগের ভারে ভেঙে পড়ার অবস্থা হলো।

পেশিবহুল হাতে হালকা স্পর্শ টের পেল মেরেন। ওই হাতেই স্টিয়ারিং বেঠা ধরে রেখেছে ও। বিস্ময়ে চমকে উঠে চারপাশে তাকাল। কেউ নেই, কিন্তু স্পর্শ ছিল পরিষ্কার। তাইতার অধীনে থাকতে নবীশ হিসাবে ভালো করেই সরাসরি উৎসের দিকে না তাকানো শিখেছিল। তো দৃষ্টি একপাশে সরিয়ে দৃষ্টিসীমার সীমানায় একটা আবছা অবয়ব দেখতে পেল। ভালো করে নজর দিতেই মিলিয়ে গেল সেটা।

ম্যাগাস, আপনি এখানে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ও, ঠোঁটজোড়া নড়ল না।

ওর প্রশ্নের জবাব দানকারী কণ্ঠস্বরও সমান অস্পষ্ট। তোমার পাশেই আছি আমি, সিদুদুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফেন।

পরিকল্পনা মোতাবেক মেরেন যেখানে তলোয়ার উদ্ধার করেছে সেখানে নৌকা ভেড়ানোর পর নৌকায় উঠেছে ওরা। চেহারায় স্বস্তি ও খুশির ছাপ ফুটতে দিল না মেরেন; যাতে অন্যরা দেখে ফেলতে না পারে। দৃষ্টি সরিয়ে দৃষ্টিসীমার উল্টোদিকে আরেকটা আবছায়া অবয়ব দেখতে পেল ও, সিদুদুর খুব কাছে আবির্ভূত হয়েছে।

তোমার বাম পাশে আছে ফেন, সিদুদুকে সতর্ক করে দিল ও। উঁহু, দেখতে পাবে না। তোমাকে স্পর্শ করতে বলো ওকে। নিজের গালের উপর ফেনের অদৃশ্য আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চেহারা।

তীরে যারীবা খাটাতে যখন শেষ বিকেলে তীরে ভিড়ল ওদের বহর, জমায়েতের উদ্দেশে বক্তব্য রাখল মেরেন। সামনের গালির ফোর ডেকে একটা মন্দির বানাব আমরা, আমাদের সাথে থাকার সময় যেখানে ওরা থাকতে পছন্দ করত। এটা হবে একটা আশ্রয়, এখানে তাইতা আর ফেনের বিদেহী আত্মা অন্য জগতের পথে প্রথম পাইলন পাড়ি দেওয়ার আগে অস্তিত্বের এই বলয়ে নব্বই দিন বন্দি থাকার সময়টায় বিশ্রাম নিতে পারবেন।

ছোট জায়গাটা আগাছার মাদুরে ঘিরে ওখানে মেঝেতে মাদুর আর নিখোঁজ জুটির জিনিসপত্র রেখে দিল ওরা। রোজ সন্ধ্যায় ওটার ওপাশে খাবার, বিয়র ও পানির প্রসাদ রেখে আসে সিদুদু। সকাল নাগাদ সেগুলো খাওয়া হয়ে যায়। ম্যাগাসের বিদেহী আত্মা এখনও ওদের উপর নজর রাখছে জেনে দলটা অনেক উৎসাহিত হয়ে উঠেছে, ফলে নৌবহরের মেজাজ মর্জিও অনেক হালকা এখন। আবারও হাসল লোকেরা, কিন্তু ফোরডেকের মন্দির থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখল ওরা।

আবার উত্তরে বাতাসের আবাস কেবুইতে পৌঁছুল ওরা, নদীটা এখানে, যার উপর দিয়ে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে ওরা, তার সাথে পুবের পাহাড়সারি থেকে নেমে সত্যিকার নীলে পরিণত হতে অন্যান্য শক্তিমান ধারার সাথে মিশেছে। শেষবার দেখার পর খুব একটা বদলায়নি কেবুই, কেবল এর চারপাশের ক্ষেতি জমিগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে; শহরের মাটির প্রাচীরের গা ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে ঘোড়া ও গরুর পাল। সহসা এমনি বিরাট আকারের একটা নৌবহরের আবির্ভাব সেনাছাউনী ও শহরবাসীকে আশঙ্কিত, ভীত করে তুলল। মেরেন সামনের জাহাজের গলুইতে এসে বন্ধুসুলভ উদ্দেশ্যের কথা বলার পরেই কেবল গভর্নর নারা চিনতে পারলেন ওকে।

কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস যে! চিৎকার করে তীরন্দাজদের উদ্দেশে বললেন তিনি। ওদের দিকে তীর ছুঁড়ো না।

মেরেন তীরে পা রাখামাত্র ওকে আলিঙ্গন করলেন নারা। অনেক আগেই তোমাদের ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা, তাই ফারাও নেফার সেতির নামে সম্ভাব্য উষ্ণতম স্বাগত জানাই তোমাদের। তিনাতের সাথে এর আগে দেখা হয়নি নারার। কর্নেল লোত্তির নেতৃত্বাধীন অভিযাত্রী দল নারা গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগেই কেবুই অতিক্রম করে গিয়েছিল। তবে অভিযানের কথা তিনি জানতেন, তাকে জীবিত কমান্ডার হিসাবে দেওয়া মেরেনের বক্তব্য মেনে নিলেন তিনি। তবে ওরা নদীর তীরে আলোচনা করার সময় বারবার ভেড়ানো নৌকাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলেন নারা, যেন কারও আসার অপেক্ষা করছেন। শেষে নিজেকে আর সামলে রাখতে পররলে না। ক্ষমা করবে, কর্নেল, কিন্তু জানতে চাইছি সেই অসাধারণ মানুষটি, মহান ম্যাগাস গালালার তাইতার কী হয়েছে।

আপনাকে যে কাহিনী বলতে যাচ্ছি সেটা এমনই অদ্ভুত ও অনন্য যে সব কল্পনা আর বিশ্বাসকে হার মানায়। কিন্তু, সবার আগে, লোকজনকে তীরে এনে ওদের সুবিধা অসুবিধা দেখতে হবে। অনেক দিন ধরে নীলের বুকে আছে ওরা, কষ্টকর ও বিপজ্জনক দীর্ঘ যাত্রা করেছে সাম্রাজ্যের এই চৌকি পর্যন্ত আসতে। এই দায়িত্ব শেষ হলেই আপনার কাছে পূর্ণাঙ্গ ও আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন দাখিল করব আমি, যা আপনি কারনাকে ফারাওর দরবারে পেশ করবেন।

আমি ক্ষমা চাইছি, নারার সহজাত ভদ্রতা আবার ফিরে এলো। আমার আতিথেয়তায় ঘাটতি হয়ে গেছে। ওদের এখুনি তীরে চলে আসতে বলে। তারপর তোমাদের কাহিনী বলার জন্যে আরও জোর করার আগে তরতাজা হও আর নিজেদের সামলে নাও।

সেদিন সন্ধ্যায় দুর্গের সম্মেলন হলে মেরেন, তিনাত ও অন্য উচ্চপদস্থ ক্যাপ্টেনদের সম্মানে এক অভ্যর্থনা সভার আয়োজন করলেন নারা। শহরের অন্য গণ্যমান্য লোকেরা উপস্থিত থাকল। ওরা খাওয়াদাওয়া শেষ করলে ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ালেন নারা। স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাগত ভাষণ দিলেন। বক্তব্য শেষ করলেন সমবেত অতিথিদের উদ্দেশে মেরেনকে দক্ষিণ যাত্রার কাহিনী বয়ান করার অনুরোধ জানিয়ে। তোমরাই প্রথম ওই রহস্যময় অজানা দেশ থেকে ফিরে এসেছ। ওখানে কী ঘটেছে বলো। বলল, নীল মাতার জন্মস্থানে পৌঁছুতে পেরেছিলে কিনা। জলের ধারা মরে যাবার ঘটনাটা কীভাবে ঘটল সেটা বলো, তারপর কীভাবে আবার এমনি আকস্মিক প্রাবল্যে ভরে উঠল। কিন্তু সবার আগে বলো গালালার তাইতার কী হয়েছে।

সবার আগে কথা বলল মেরেন। অনেক দিন আগে এই পথে যাবার পর থেকে ওদের জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বলে গেল। কেমন করে তামাফুপায় নীলের মুখে পৌঁছেছিল বলল ও, নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়া লাল পাথর আবিষ্কারের কথা বলল। তিনাত ওদের উদ্ধার করে কীভাবে জাররিতে নিয়ে গিয়েছিল, বলল তাও, যেখানে অলিগার্কদের সর্বোচ্চ পরিষদের সামনে হাজির হতে হয়েছিল ওদের।

এবার কর্নেল তিনাত আনকুতকে আহ্বান জানাব কর্নেল লর্ড লোত্তির নেতৃত্বাধীন অভিযানের কী পরিণতি ঘটেছিল তার বিবরণ দিতে। সে ও তার জীবিত লোকজন জাররিতে গিয়ে কী পরিস্থিতি আবিষ্কার করেছিল। তিনাতকে মঞ্চ ছেড়ে দিল মেরেন।

স্বভাবজাতভাবে তিনাতের বক্তব্য তীর্যক, কোনও রকম অলঙ্কার বর্জিত। সোজাসাপ্টা সৈনিকসুলভ ভঙ্গিতে রানি লখ্রিসের শাসনামলে লর্ড আকেরের হাতে আদি জাররিয় সরকারের প্রতিষ্ঠার বর্ননা দিল সে। তারপর সেটা কীভাবে রহস্যময়ী জাদুকরী ইয়োসের হাতে ভীষণ নিষ্ঠুর স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিল বলল সেকথাও। সেজাসাপ্টা বক্তব্য দিয়ে নিজের বিবরণ শেষ করল সে। জাদুকরী ইয়োসই নীলের শাখাপ্রশাখায় বাঁধ সৃষ্টির জন্যে অশুভ জাদু ব্যবহার করেছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল মিশরকে পরাস্ত করে শৃঙ্খলে বন্দি করা। শ্রোতারা প্রতিবাদ আর নানা প্রশ্ন শুরু করায় শোরগোল শুরু হয়ে গেল।

বাধা দিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নারা, কিন্তু ওদের শান্ত করতে বেশ কিছুটা সময় লাগল তার। কর্নেল মেরেনকে আবার কথা বলার আহ্বান জানাচ্ছি। দয়া করে তার বক্তব্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনারা প্রশ্ন করা বন্ধ রাখুন। আমি নিশ্চিত সে আপনাদের অনেক উৎকণ্ঠারই জবাব দিতে পারবে।

তিনাতের চেয়ে ঢের বেশি বাগ্মী মেরেন। ম্যাগাস গালালার তাইতা ইয়োসের ঘাঁটিতে প্রবেশ করে তার মোকাবিলা করতে যাবার বিবরণ দেওয়ার সময় মুগ্ধ হয়ে শুনল ওরা। একা নিরস্ত্র অবস্থায় গেছেন তিনি, কিন্তু আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল তাঁর সাথে। এই দুই রহস্যের গুরুর আধ্যাত্মিক সংঘাতের বিশালতা কেউ কখনও জানতে পারবে না। আমরা কেবল জানি শেষ পর্যন্ত তাইতাই জয়ী হয়েছেন। ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়োস, সেই সাথে তার অশুভ সাম্রাজ্যও। নীল মাতার উপর তার তৈরি বাঁধ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে যাতে নদী আবার বইতে পারে। তাইতার শক্তিতে কেমন করে ওটা আবার জীবিত হয়ে উঠেছে দেখার জন্যে আপনাদের কেবল কেবুই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী দেখলেই হবে। কর্নেল তিনাতের সহায়তায় আমাদের লোজন, যাদের এতগুলো বছর জাররিতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তাদের মুক্ত করা হয়েছে। আজকের সন্ধ্যায় তারা আপনাদের মাঝে বসে আছে।

ওদের উঠে দাঁড়াতে বলো! বলে উঠলেন গভর্নর নারা। ওদের চেহারা দেখতে চাই আমরা যাতে আমাদের ভাই-বোনদের আমার মাতৃভূমিতে স্বাগত জানাতে পারি। এক এক করে তিনাতের রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ও অন্য অফিসাররা উঠে যার যার নাম আর পদমর্যাদা উল্লেখ করল, তারপর একটা ঘোষণা বাক্য উচ্চারণ করে বক্তব্য শেষ করল: আজ সন্ধ্যায় আমাদের সম্মানিত কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস ও কর্নেল তিনাতে আনকুরের মুখে যা যা শুনেছেন আমি তার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছি।

ওরা শেষ করার পর আবার কথা বললেন নারা। আজকের সন্ধ্যায় বর্ণনা করা অনেক বিস্ময়কর ঘটনার কথা শুনলাম আমরা, আমাদের বিস্ময়ে পরিপূর্ণ করে তুলতে যথেষ্ট। তবে আমি জানি এখন আমি সবার পক্ষেই কথা বলতে যাচ্ছি, আরও একটা প্রশ্ন আমাকে ভেতরে ভেতরে কুরেকুরে খাচ্ছে, সেটাই জিজ্ঞেস করছি। নাটকীয়ভাবে একটু বিরতি দিলেন তিনি। কর্নেল মেরেন ক্যাম্বিসেস, আমাদের বলো, ম্যাগাস তাইতার কী হয়েছে? কেন তিনি আর তোমাদের বাহিনীর নেতৃত্বে নেই?

মেরেনের চেহারা গম্ভীর। খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে, যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তারপর লম্বা করে দম নিল। ম্যাগাস আর আমাদের সাথে নেই, এই কথাটা বলার জন্যে আজকের দিনটা আমার জন্যে খুবই বেদনাদায়ক ও কষ্টকর। রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছেন তিনি। আমি আর কর্নেল তিনাত তাঁর অন্তর্ধানের জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আবার থামল সে, তারপর মাথা নাড়ল। লাশ খুঁজে না পেলেও আমরা তার কাপড় আর ঘোড়ার সন্ধান পেয়েছি তার টিউনিক রক্তে মাখামাখি ছিল, স্যাডলও। আমরা তাঁর অন্তর্ধানের জন্যে কেবল কোনও রহস্যময় অতিপ্রাকৃত ঘটনাকেই দায়ী করতে পারি। ধরে নিতে পারি ম্যাগাস মারা গেছেন।

শোকের একটা গোঙানি তার কথাগুলোকে স্বাগত জানাল।

নীরবে বসে রইলেন গভর্নর নারা, চেহারা ফ্যাকাশে, বিষণ্ণ। অবশেষে হলের অওয়াজ কমে এলে তার দিকে তাকাল সবাই। উঠে কথা বলতে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর বুজে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর শুরু করলেন তিনি।

দুঃখের সংবাদ। গালালার তাইতা ছিলেন শক্তিশালী ও ভালো মানুষ। ভারাক্রান্ত মনে ফারাও নেফার সেতির কাছে আমি তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছে দেব। কেবুই নোমের গভর্নর হিসাবে আমার ক্ষমতানুযায়ী নদীর তীরে নীল মাতার জীবনদায়ী জলেরপ্রবাহ আবার ফিরিয়ে আনায় গালালার তাইতার সম্মানে একটা সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দেব। আরও কিছু বলতে চাইলেন তিনি, কিন্তু মাথা নেড়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি ভোজের কামরা ছেড়ে যাবার সময় অতিথিরা অনুসরণ করল তাকে। রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।

পাঁচদিন পর শহরের অধিবাসী ও দক্ষিণ থেকে আগত অভিযাত্রীরা আবার নীলের দুটি শাখার সঙ্গম স্থলে দাঁড়ানো এক চিলতে জমিনে মিলিত হলো। গভর্নর নারা নির্মিত সৌধটা একটা মাত্র নীল গ্রানিট কুঁদে বের করা একটা স্তম্ভ। ওটার গায়ে খোদাই করা হয়েছে অসাধারণ নকশার হিরিওগ্রাফিক হরফে একটা লিপি। আজকের দিনের জন্যে ওটাকে তৈরি করতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে রাজমিস্ত্রিরা:

ফারাও নেফার সেতির নামে দুই রাজ্যে তার শাসনামলের ছাব্বিশতম বছরে এই স্তম্ভটি স্থাপন করা হলো, তিনি যেন চিরন্তন জীবন লাভ করেন।
এই স্থান হতে ম্যাগাস গালালার তাইতা নীল মাতার উৎস মুখ আবিষ্কারের লক্ষ্যে তাঁর ঐতিহাসিক অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন, মিশরিয় সাম্রাজ্য এবং এর সকল নাগরিকের কল্যাণে আশির্বাদপ্রাপ্ত নদীর প্রবাহ আবার উন্মুক্ত করে তোলার জন্যে।
তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি বলে এই বিপজ্জনক অভিযানে সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা যেন অব্যাহত থাকে!
দুঃখজনকভাবে গহীন বনে তিনি তিরোহিত হয়েছেন। আর কোনওদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় মিশরে না ফিরলেও তাঁর স্মৃতি ও তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা এই গ্রানিট স্তম্ভের মতোই দুই হাজার বছর টিকে থাকবে।
আমি নোম কেবুইয়ের গভর্নর নারা, দেবতাদের প্রথম পছন্দ ফারাও নেফার সেতির নামে তার প্রশংসায় এই কথাগুলো উত্তীর্ণ করছি।

সকালের রোদের আলোয় গ্রানিট স্তম্ভের চারপাশের জমায়েত হোরাস ও হাথরের উদ্দেশ্যে প্রশংসা সঙ্গীত গাইল, তাইতার বিদেহী আত্মাকে নিরাপদে তুলে নেওয়ার আবেদন জানাল তারা। তারপর দলবল নিয়ে অপেক্ষমান নৌকার উদ্দেশে রওয়ানা হলো মেরেন ও তিনাত। নৌকায় উঠে প্রত্যাবর্তনের শেষ পর্যায়ে ফের ওদের যাত্রা শুরু করল। ছয়টা বিশাল জলপ্রপাতের ভেতর দিয়ে আরও দুই হাজার লীগ দূরত্ব, তারপর মিশরের উর্বর ভূমি।

নীলের জল ফুলে ফেঁপে ওঠায় জলপ্রপাতগুলো এখন ভীষণ পানির দীর্ঘ শাদা সুড়ঙে পরিণত হয়েছে। তবে জাররিয় নৌকাগুলো ঠিক এই রকম পরিস্থিতির কথা ভেবেই বানানো হয়েছিল। আর মেরেও দক্ষ নদীর চালক। ভুল করলেই ওকে ঠিক পথ দেখাতে ঠিক ওর কনুইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য তাইতা। ওরা দুজনে মিলে তেমন মারাত্মক কোনও ক্ষতি ছাড়াই নৌবহর পার করে আনল।

পঞ্চম ও দ্বিতীয় জলপ্রপাতের মাঝখানে নদীটা বিশাল একটা বাঁক নিয়ে পশ্চিমের মরুভূমিতে মিলে যাওয়ায় যাত্রা পথে বাড়তি এক হাজার লীগ দূরত্ব যোগ হয়েছে। গভর্নর নারার পাঠানো রিলে রাইডাররা ওদের চেয়ে পাঁচ দিন এগিয়ে ছিল; ওরা জমিনের উপর দিয়ে চলে যাওয়া কাফেলার চলার পথ ধরে নদীর উপর দিয়ে সরাসরি পেরিয়ে যেতে পেরেছে। ওদের নিয়ে আসা সংবাদ আসৌন নোমের গভর্নর নৌবহর প্রথম জলপ্রপাত হয়ে মিশরের উপত্যকায় নেমে আসার অনেক আগেই পড়ে ফেলেছিলেন। এইখান থেকে অভিযান এক বিজয়ী প্রক্রিয়ায় পরিণত হলো।

নদীর দুপাশেই জমিন জীবনদায়ী জলে প্লাবিত হয়ে আছে। কৃষকরা ক্ষেতে খামারে কাজ করার জন্যে গ্রামে ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে সবুজ, প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে ওদের ফসল। নৌকাগুলো পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সাধারণ জনগণ ছুটে এলো পাড়ে, তালপাতার শাখা দোলাচ্ছে; জলের ভেতর জেসমিন ফুলের তোড়া ছুঁড়ে ফেলল ওরা, ফ্লোটিলার সাথে ভেসে চলল ওগুলো। আনন্দে কাঁদছে ওরা, পৃথিবীর দক্ষিণের বিস্তারের রহস্যময় অন্ধকার থেকে ফিরে আসা বীরদের উদ্দেশে প্রশংসার বাণী উচ্চারণ করছে।

প্রতিটি শহর পর্যটকদের কাছে আসার সাথে সাথে সেখানকার গভর্নর, অভিজাতজন ও পুরোহিতরা মিছিল করে মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের, ভোজে আপ্যায়িত করছে, ফুলের পাপড়ির বৃষ্টি ঝরানো হচ্ছে ওদের উপর।

ওদের সাথে তীরে নেমেছে তাইতা ও ফেন। এখনকার জীবনে প্রথমবারের মতো যে দেশ এক সময় শাসন করেছে ও, সেই দেশ দেখছে ফেন। মিশরের কেউই তাইতা বা ফেনকে ওদের এখনকার চেহারায় চিনবে না। তাই দীর্ঘ সময় ওদের আড়াল করে রাখা জাদুর মায়া তুলে নিল তাইতা। তবে নেকাবে চেহারা ঢেকে রাখল, যাতে কেবল ওদের চোখ দেখা যায়। তারপর জনতার ভিড়ে স্বাধীনভাবে মিশে গেল।

তাইতার মুখে চারপাশের সবকিছুর ব্যাখ্যা শুনতে গিয়ে ফেনের চোখ বিস্ময় আর আনন্দে ঝিলিক খেলছে। এতদিন অন্য জীবনের স্মৃতি ছিল আবছা, কাল্পনিক সেগুলো তাইতাই ওর মনে রোপন করেছিল। তবে এখন আপন দেশের মাটিতে দাঁড়ানোর পর সবকিছু ঝড়ের বেগে ফিরে এসেছে ওর মনে। শত বছর আগের চেহারা, কথা আর কর্মকাণ্ড মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনাপ্রবাহের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ওর মনে।

কোম কোম্বে মন্দির এলাকার বিশাল দেয়ালের নিচে নৌকা ভেড়াল ওরা। চুনাপাথরের চাঁইয়ের উপর দেব-দেবীদের বিশাল সব মূর্তি খোদাই করা। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রধান পুরোহিতিনী ও তার দলবল নদীর তলদেশে নেমে এলে ফেনকে নিয়ে হাথরের বিরান মন্দিরের করিডর ধরে ম্লান শীতল খাস মহলে নিয়ে চলল তাই।

এখানেই প্রথম এখনকার চেহারায় তোমার বিদেহী আত্মার দেখা পেয়েছিলাম, ওকে বলল তাইতা।

হ্যাঁ! ভালো করে মনে আছে সেটা, ফিসফিস করে বলল ফেন। এই জায়গার কথা পরিষ্কার মনে আছে। পবিত্র পুকুর হয়ে তোমার কাছে সঁতরে আসার কথা মনে করতে পারছি। আমাদের কথাগুলোও মনে আছে। যেন উচ্চারণ করার আগে মনে মনে মহড়া দিতে একটু থামল সে। আমাকে চিনতে পারছ না, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। কারণ আমি ফেন, মিষ্টি ছেলেমানুষি উচ্চারণে বলল সে, তাইতার হৃদয়ে অনুরণন তুলল সেটা।

ঠিক এই সুরেই কথাটা বলেছিলে, বলল তাইতা।

তুমি কী জবাব দিয়েছিলে মনে আছে? মাথা নাড়ল তাইতা। পরিষ্কার মনে আছে ওর, কিন্তু ফেনের মুখে শুনতে চাইছে।

তুমি বলেছ… ওকে নকল করতে কণ্ঠস্বর পাল্টে ফেলল ও। আগাগোড়াই তোমাকে চিনেছি আমি। তোমার সাথে প্রথম পরিচয়ের সময় যেমন ছিলে ঠিক তেমনই আছো। তোমার ওই চোখের কথা কোনও দিন ভুলতে পারব না। তখনকার মতো এখনও সারা মিশরের সবচেয়ে সবুজ আর সুন্দর চোখ ওগুলো।

মৃদু হাসল তাইতা। মেয়ে মানুষ আর কাকে বলে! কোনওদিন প্রশংসার কথা ভোলো না।

নিশ্চয়ই এমন চমৎকার প্রশংসা নয়, সায় দিল ফেন। তোমার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছিলাম আমি। কী ছিল সেটা মনে করতে পারো?

একমুঠো চুনো পাথরের গুঁড়ো, চট করে জবাব দিল ও। অমূল্য উপহার।

এখন দাম মেটাতে পারো। একটা চুমু দিলেই চলবে, বলল ফেন। কিংবা তোমার যতগুলো মনে চায়।

আমার মনে দশ হাজার সংখ্যাটা জেগে উঠেছে।

তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। এখুনি প্রথম একশোটা নেব আমি। বাকিগুলো কিস্তিতে শোধ করতে পারো।

*

ওরা যত কারনাকের কাছাকাছি আসছে ততই ওদের চলার গতি ধীর হয়ে আসছে। আনন্দমুখর জনসাধারণের বাধার মুখে পড়ছে ওরা। অবশেষে রাজকীয় বার্তাবাহক ফারাওর প্রাসাদ থেকে উজানের বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে হাজির হলো। নৌবহরের অধিনায়কের কাছে নির্দেশ নিয়ে এসেছে, দ্রুততার সাথে কারনাকের দরবারে উপস্থিত হতে হবে।

তোমার নাতী নেফার সেতি ধৈর্য ধরতে শেখেননি, ফেনকে বলল তাইতাকা, শুনে উত্তেজিতভাবে হেসে উঠল ও।

ওকে দেখতে আর কতদিন লাগবে! মেরেনকে জলদি ফেরার নির্দেশ দিয়েছে শুনে আমি খুশি হয়েছি। এখন নেফার সেতির বয়স কত হতে পারে?

সম্ভবত চুয়ান্ন বছর আর ওর রানি ও প্রধান স্ত্রী মিনতাকাও তেমন তরুণী নেই। তার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা হয় দেখাটা মজাদার হবে, কারণ চরিত্রের দিক থেকে তিনি অনেকটা তোমার মতোই। বুনো, বদমেজাজি। ক্ষেপে উঠলে তোমার মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন।

বুঝতে পারছি না, কথাটা প্রশংসা করে বললে নাকি এটা কোনও রকম অপমান, জবাব দিল ফেন। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত, ওকে আমার পছন্দ হবে, আমার নাতীপুতিদের মা।

আমার ধারণা তিনি বিপদে আছেন। এখনও ইয়োস আর ভুয়া পয়গম্বর সোয়ের প্যাঁচে পড়ে আছেন তিনি। ইয়োস মরে গেছে, তার সব ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু সোয়ে এখনও তাঁকে বন্দি করে রেখেছে। ওকে মুক্ত কারাই হবে আমাদের শেষ পবিত্র দায়িত্ব। এরপর তুমি আর আমি আমাদের নিজেদের স্বপ্নের পিছু নেব।

তো কারনাকে পৌঁছুল ওরা, শত দুয়ার আর অপরিমেয় বিস্ময়ের নগরী, প্রবহমান জলের কল্যাণে সবই আবার ফিরে এসেছে। এখানকার জনতা ওদের সাথে দেখা হওয়া অন্য যেকোনও জায়গার জনতার তুলনায় আরও নিবিড় ও উল্লাসমুখর। নগরীর তোরণ গলে স্রোতের মতো বের হয়ে এলো ওরা, ঢোল, শিংগা আর চিৎকারের অওয়াজ বাতাসে কাঁপন তুলল।

রাজকীয় বন্দরে দাঁড়ানো ছিল সরকারী পোশাক পরা পুরোহিত, অভিজাতজন ও জেনারেলদের এক অভ্যর্থনা কমিটি, ওদের সাথে অন্যান্য সঙ্গীরাও একই রকম জকাল পোশাক পরেছে।

মেরেন ও তিনাত তীরে নেমে আসতেই সুরেলা উৎসবমুখর সুর ধ্বনিত হলো শিংগায়। জনতার মাঝে প্রশংসার দারুণ সাড়া পড়ে গেল। প্রধান উযির পথ দেখিয়ে ওদের জন্যে তৈরি করে রাখা দুটো জাঁকালভাবে সাজানো রথের কাছে নিয়ে গেলেন। দুটো বাহনই সোনা ও মূল্যবান পাথরে ঢাকা, ফলে উজ্জ্বল রোদে ঝিলিক মারছে। ফারাওর নিজস্ব আস্তাবলের নিখুঁতভাবে মানানসই ঘোড়ার দল টানছে ওগুলোকে। একটা দুধ শাদা, অন্যটা সেগুন কাঠের মতো কালো।

লাফ দিয়ে পাদানীতে উঠে দাঁড়াল মেরেন ও তিনাত, ঘোড়ার পিঠে চাবুক চালাল। পাথরের স্ফিংক্সের সারির মাঝখান দিয়ে রাজকীয় পথে এগিয়ে চলল যুদ্ধের বর্ম আর জোব্বা পরা দুটি বীর সুলভ অবয়ব। ওদের সামনে রইল অশ্বারোহী একদল এসকর্ট, পেছনে রাজকীয় রক্ষীদের একটা দল। জনতার উল্লাসধ্বনি যেন কোনও ধারার মতো ওদের উপর এসে পড়ছে।

অনেক পেছনে তাইতা ও ফেন ছদ্মবেশে অনুসরণ করছে, চলমান প্রবল জনতার ভীড়ে পথ করে এগোচ্ছে ওরা। অবশেষে তোরণের কাছে পৌঁছুল ওরা। এখানে থেমে প্রাসাদ রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে বিশাল রাজকীয় দরবার কক্ষে ঢুকতে হাতে হাত রেখে মন্ত্র পড়ে নিজেদের আড়াল করে ফেলল। কামরা আকীর্ণ করে রাখা সভাষদ ও গণ্যমান্য লোকদের ভীড় থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে অবস্থান নিল।

শেষ প্রান্তের উঁচু মঞ্চে আইভরি সিংহাসনে পাশাপাশি বসে আছেন ফারাও নেফার সেতি ও তাঁর রানি। ফারাও পরেছেন নীল যুদ্ধ মুকুট-খেপরেশ-মাথার লম্বা টুপি যার দুপাশে দুটো খাঁটি সোনার চাকতি দিয়ে সাজানো দাঁতঅলা শিংয়ের মতো রয়েছে, হেলমেটের ভুরুর উপর রয়েছে উরাকাস: কোবরা আর শকুনের পরস্পর সংযুক্ত মাথা-উচ্চ ও নিম্ন রাজ্যের প্রতীক। প্রসাধন নেননি ফারাও, ধড় উন্মুক্ত পঞ্চাশটা যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার বুক ও হাতের পেশি এখনও পিচ্ছিল, কঠিন। ওর আভা পরখ করে তাইতা দেখতে পেল দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তা অটল এবং প্রয়াসের বেলায় ধৈর্যশীল। তাঁর পাশে রানি মিনতাকাও উরাকাস মাথায় দিয়েছেন, কিন্তু তার চুলে রূপালি ছোঁয়া লেগেছে, চেহারায় সন্তানদের জন্যে শোকের কান্না ও বিষাদের কারণে বলীরেখা পড়ে গেছে। তাঁর আভা বিভ্রান্ত, নিরাশ, সন্দেহ আর অবিশ্বাসে তাড়িত: গভীর ও চরম তার ভোগান্তি।

রাজ সিংহাসনের সামনে মেরেন ক্যাম্বিসেস ও কর্নেল তিনাত আনকুর দু পা ফাঁক করে মাথা নিচু করে আনুগত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। উঠে একটা হাত তুললেন ফারাও। গোটা জমায়েতে নিবিড় নীরবতা নেমে এলো। তিনি যখন কথা বললেন, একেবারে ভিত্তি থেকে উঁচু ছাদ পর্যন্ত উঁচু স্তম্ভগুলোয় প্রতিধ্বনিত হলো তাঁর কণ্ঠস্বর।

আমার দুই রাজ্য এবং বিদেশের উপনিবেশসমূহে সবাই জেনে রাখুক যে মেরেন ক্যাম্বিসেস ও তিনাত আনকুত আমার বিশেষ সুদৃষ্টি লাভ করেছে। থামলেন। তিনি, প্রধান উযির তেতেক তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা রূপার ট্রে বাড়িয়ে ধরলেন, তাতে প্যাপিরাসের একটা স্ক্রোল রাখা। ওটা নিয়ে ভাঁজ খুললেন ফারাও। সুরেলা কণ্ঠে পার্চমেন্ট থেকে পড়তে শুরু করলেন তিনি। এতদ্বারা সবাইকে অবগত করা যাচ্ছে যে আমি লর্ড তিনাত আনকুতকে অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্ত ভুক্ত করে তার সম্মানে এসনার ভাটিতে নীলের পাড়ে এক নদী সমান উর্বর জমি দান করে দিচ্ছি। এক নদী পরিমাণ দিয়ে দশ বর্গ লীগ জমি বোঝানো হয়, চাষযোগ্য বিশাল জমি। এক খোঁচায় তিনাত বিরাট ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু আরও আছে; বলে চললেন নেফার সেতি, এখন থেকে লর্ড তিনাত আনকুর আমার উচ্চরাজ্যের সেনা বাহিনীর একজন ফিল্ড জেনারেল হিসাবে বিবেচিত হবে। তার হাতে থাকবে ফাত এলাকার দায়িত্ব। এসবই আমার করুণা ও বদান্যতার কল্যাণে।

ফারাও করুণাময়! এক সাথে চিৎকার করে উঠল জমায়েত।

উঠে দাঁড়াও, লর্ড আনকুত, আমাকে আলিঙ্গন করো। ফারাওর নগ্ন ডান পাশের কাঁধের পাশে উঠে দাঁড়াল তিনাত। ফারাও নেফার সেতি নতুন ভূসম্পতির দলিল তার ডান হাতে তুলে দিলেন।

এবার মেরেনের দিকে ফিরলেন তিনি, তখনও তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল সে। তাকে আরেকটা রূপার ট্রে বাড়িয়ে দিলেন তেনতেক। ওটা থেকে আরেকটো স্ত্রোল তুলে জমায়েতকে দেখালেন ফারাও। এত দ্বারা সকলকে অবগত করা যাচ্ছে যে আমি লর্ড মেরেন ক্যাম্বিসেসকে অভিজাতকূলের কাতারে উন্নীত করেছি এবং তার সম্মানে নীলের তীরে তিন নদী সমপরিমাণ জমি দান করেছি। এখন থেকে লর্ড মেরেন নিম্ন রাজ্যের সেনাবাহিনীর মার্শাল জেনারেল পদমর্যাদার বলে গণ্য হবে। এছাড়া আমি তার প্রতি আমার বিশেষ অনুকম্পার নিদর্শন হিসাবে তাকে প্রশংসা ও বীরত্বের স্বর্ণ তুলে দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াও, লর্ড মেরেন।

মেরেন তার সামনে দাঁড়ালে তার কাঁধে প্রশংসা ও বীরত্বের স্বর্ণ পরিয়ে দিলেন ফারাও। আমাকে আলিঙ্গন করো, লর্ড মার্শাল মেরেন ক্যাম্বিসেস! বললেন তিনি, মেরেনের গালে চুমু খেলেন।

ফারাওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে তাগিদের সুরে মেরেন বলল, আমার কাছে তাইতার খবর আছে, কেবল আপনার জন্যে।

মুহূর্তের জন্যে মেরেনের কাঁধের উপর ফারাওর হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে এঁটে বসল, তারপরই মৃদু কণ্ঠে তিনি বললেন, তেনকে তোমাকে সরাসরি আমার কাছে নিয়ে আসবে।

গোটা জমায়েত নতজানু অবস্থায় রানির হাত ধরে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন ফারাও। তাইতা ও ফেন যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার মাত্র অল্প কয়েক কদম দূর দিয়ে চলে গেলেন তাঁরা, ওদের দেখতে পেলেন না। তেনতেকের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করল মেরেন, তার সাথে নিচু কণ্ঠে কথা বলল, ফারাও আপনাকে তলব করেছেন। আমাকে অনুসরণ করুন, মাই লর্ড মার্শাল। মেরেন পাশ কাটানোর সময় ফেনের হাত ধরে ওর পেছনে হাঁটতে শুরু করলেন তাই।

মেরেনকে রাজ দর্শনে নিয়ে এলেন তেনকে। কিন্তু মেরেন ফের অনুগতের মতো দাঁড়ালে নেফার সেতি এগিয়ে এসে আন্তরিক আলিঙ্গন করলেন তাকে। প্রিয় বন্ধু এবং লাল পথের সঙ্গী আমার, তোমাকে আবার ফিরে পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। শুধু যদি সাথে করে ম্যাগাসকে নিয়ে আসতে। ওর মৃত্যু আমার অন্তরে লেগেছে। এবার মেরেনকে সামনে ধরে ভালো করে ওর চেহারা দেখলেন। তুমি কখনওই আবেগ আড়াল করার দক্ষতা পেলে না। এখন কিসে জ্বালাচ্ছে তোমাকে? বলো।

বরাবরের মতোই তীক্ষ্ণ আপনার চোখ। কোনও কিছুই বাদ যায় না। আমার কাছে খবর আছে যা আপনাকে জানাব। জবাব দিল মেরেন। কিন্তু তার আগে বিরাট একটা ধাক্কা হজম করার জন্যে নিজেকে তৈরি রাখতে বলব আপনাকে। আপনাকে যা বলতে যাচ্ছি সেটা যেমন অদ্ভুত তেমনি বিস্ময়কর, প্রথম আমি এর মুখোমুখি হওয়ার পর আমার মনকে বিশ্বাস করাতে পারিনি।

আরে রাখো তো, মাই লর্ড, ওর দু কাঁধের মাঝখানে একটা ঘুসি মারলেন নেফার সেতি, টলে উঠল মেরেন।ঝেড়ে কাশো!

লম্বা করে শ্বাস টানল মেরেন, তারপর হড়বড়িয়ে বলল, তাইতা বেঁচে আছেন।

হাসি বন্ধ করলেন নেফার সেতি, অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন ওর দিকে। তারপর ভুরু কুঁচকে অন্ধকার করে ফেললেন চেহারা। আমার সাথে ঠাট্টা করলে তোমার বিপদ হবে, মাই লর্ড মার্শাল, শীতল কণ্ঠে বললেন তিনি।

আমি সত্যি কথাই বলছি, জাঁহাপনা, এমনি মেজাজে নেফার সেতি সবচেয়ে সাহসী জনেরও বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেন।

কথাটা সত্যি হলে, তোমার মঙ্গলের জন্যেই ভালো, মেরেন ক্যাম্বিসেস, তাহলে আমাকে বলো তাই এখন কোথায়।

আরেকটা জিনিস আপনাকে বলা দরকার, হে জাঁহাপনা ও মহামান্য, তাইতার চেহারাছবি অনেক বদলে গেছে। প্রথমে আপনি তাকে নাও চিনতে পারেন।

হয়েছে! চড়ে উঠল নেফার সেতির কণ্ঠস্বর। বলল সে কোথায়।

খোদ এই কামরাতেই আছেন তিনি, ভেঙে গেল মেরেনের কণ্ঠস্বর। আমাদের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর চাপাকণ্ঠে যোগ করল, অন্তত তাই আশা করি।

ড্যাগারের হাতলে হাত রাখলেন নেফার সেতি। আমার ভালো মানুষির সুযোগ নিয়েছ তুমি, মেরেন ক্যাম্বিসেস।

বুনো দৃষ্টিতে শূন্য কামরার এদিক ওদিক নজর বোলাল মেরেন। ফাঁকা হওয়ার উদ্দেশে কথা বলার সময় করুণ শোনাল ওর কণ্ঠস্বর। ম্যাগাস, ও ম্যাগাস! দেখা দিন, নিবেদন করছি! ফারাওর কোপের বিপদে আছি আমি! তারপর স্বস্তির সাথে বলে উঠল, দেখুন, জাঁহাপনা! কামরার উল্টোদিকে কালো গ্রানিট কুঁদে বের করা একটা লম্বা মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করল ও।

ওটা তাইতার মূর্তি, নিপূণ ভাস্কর ওশ খোদাই করেছে, বললেন নেফার সেতি, ক্ষুব্ধ তিনি। ম্যাগাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে এখানে রেখেছি ওটা, কিন্তু ওটা কেবলই পাথর, আমার প্রিয় রক্ত মাংসের তাইতা নয়।

নাহ, ফারাও। মূর্তির দিকে তাকান, কিন্তু ওটার ডান পাশে।

মেরেন যেখানে ইঙ্গিত করেছে সেখানে একটা কম্পিত স্বচ্ছ মেঘের মতো উদয় হলো, মরুভূমির মরীচিৎকার মতো। ওটার দিকে তাকানোর সময় চোখের পাতা পিটপিট করলেন ফারাও। ওটা কিছু না। বাতাসের মতাই হাল্কা। এটা কি জিন? ভূত?

আরও ঘন হয়ে এলো মরীচিকা, আস্তে আস্তে নিরেট আকার নিল। একজন পুরুষ! বলে উঠলেন নেফার সেতি। কিন্তু এ তো তাইতা নয়। একজন তরুণ, কমনীয় তরুণ। আমার তাইতা নয়। নিজেকে আড়াল করার জাদু জানে যখন নিশ্চয়ই কোনও জাদুকর হবে।

এটা জাদুই, সায় দিল মেরেন, কিন্তু সবচেয়ে ভালো ও অভিজাত ধরনের। খোদ তাইতার সৃষ্ট জাদু। এটাই তাইতা।

না! মাথা নাড়লেন নেফার সেতি। এই লোককে আমি চিনি না, আদৌ যদি সে জীবিত প্রাণী হয়ে থাকে।

দয়াময়, এটাই তরুণ ও পূর্ণাঙ্গ পরিণত ম্যাগাস।

এমনকি নেফার সেতি পর্যন্ত বাকহারা হয়ে গেলেন। কেবল মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি। চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে তাইতা।

মূর্তির দিকে তাকান, আবেদন জানাল মেরেন। ওশ যখন এটা বানিয়েছে তখন ম্যাগাসের বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু এমনকি এখন আবার তরুণ হয়ে উঠলেও মিলটুকু ভ্রান্তির অতীত। ভুরুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দেখুন, নাকের গঠন আর কান, কিন্তু সবার উপরে ওর চোখজোড়া দেখুন।

হ্যাঁ…হয়তো মিলটুকু দেখতে পাচ্ছি, সন্দিহান কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন নেফার সেতি। তারপর ওর কণ্ঠ দৃঢ় ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠল।হে, প্রেতাত্মা! তুমি সত্যিই তাইতা হয়ে থাকলে কেবল আমরা দুজন জানি এমন কিছু নিশ্চয়ই বলতে পারবে।

ঠিক তাইতা, ফারাও, সায় দিল তাইতা। এমন অনেক কিছুই আপনাকে বলতে পারি, তবে সবার আগে একটা কথা মনে পড়ছে। তখনকার কথা কি আপনার মনে আছে যখন আপনি ছিলেন নেফার মেমনন, দুই সাম্রাজ্যের ফারাও হননি। যখন আপনি আমার ছাত্র ও পোষ্য ছিলেন, আপনাকে আমি মেম ডাকতাম?

মাথা দোলালেন ফারাও। ভালো করেই মনে আছে। কর্কশ ফিসফিস শব্দে পরিণত হয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বর, দৃষ্টি কোমল। কিন্তু আরও অনেকেই এসব জানতে পারে।

আপনাকে আরও বলতে পারি, মেম। বলতে পারি আপনি ছোট থাকতে কীভাবে গেবেত নাগারার বুনো এলাকায় কবুতরের মূর্তি বসিয়ে বিশ দিন আপনার গডবার্ড রাজা বাজের ওগুলোর কাছে আসার অপেক্ষা করেছিলাম।

আমার গডবার্ড পুতুলের কাছে আসেনি কোনওদিন, বললেন নেফার সেতি, তাঁর আভার কেঁপে ওটা দেখে তাইতা বুঝতে পারল ওর জন্যে ফাঁদ পাতছেন ফারাও।

আপনার বাজপাখী এসেছিল, ওকে শুধরে দিল তাইতা। মিশরের দ্বৈত মুকুটের প্রতি আপনার রাজকীয় অধিকারের প্রমাণ সেই চমৎকার বাজপাখি।

আমরা ওকে বন্দি করেছিলাম, বিজয়ীর ঢঙে বললেন নেফার সেতি।

উঁহু, মেম। পুতুল অস্বীকার গেছে বাজপাখি, উড়ে গেছে।

শিকারে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম আমরা।

এবারও না, মেম। আপনার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। পাখিটাকে অনুসরণ করে গভীর বনে চলে গিয়েছিলাম আমরা।

ও, হ্যাঁ! তোতা পানির হ্রদ নাত্রোনে।

ফের না। আমরা গিয়েছিলাম বির উম্ম মাসারা পাহাড়ে। আমি দড়ি ধরে রাখার সময় আপনি বাচ্চা তুলে আনতে পাহাড়ের পুব দিকের দেয়াল বেয়ে বাজপাখির উঁচু বাসায় নেমে গেছেন। এতক্ষণে ওর দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকাতে শুরু করেছেন নেফার সেতি। আপনি ওই বাসায় পৌঁছানোর পর দেখলেন আপনার আগেই কোবরা পৌঁছে গেছে ওখানে। পাখিগুলো মরে গেছে, সাপের বিষাক্ত ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে।

ওহ, ম্যাগাস, তুমি ছাড়া এসব কথা আর কারও জানার কথা নয়। তোমাকে অস্বীকার করেছি বলে ক্ষমা করে দাও। সারা জীবন তুমি ছিলে আমার পরামর্শক ও পরিচালক, অথচ এখন তোমাকে উপেক্ষা করেছি। অনুতাপে আক্রান্ত হয়েছেন নেফার সেতি। ছুটে কামরার এপাশে এসে তাইতাকে শক্তিশালী আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন তিনি। অবশেষে যখন আলাদা হলেন ওরা, তাইতার মুখ থেকে চোখ সরাতে পরলেন না তিনি। তোমার পরিবর্তন আমার বোধের অতীত। বলো, কেমন করে ব্যাপারটা ঘটল।

সে অনেক কথা, সায় দিয়ে বলল তাইতা। কিন্তু তার আগে আমাদের মাথা ঘামানোর মতো আরও ব্যাপার আছে। প্রথমত, একজনকে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। হাত বাড়িয়ে দিল তাইতা। আরও একবার বাতাস কেঁপে উঠল, তারপর এক তরুণীর আকার নিল। নেফার সেতির দিকে তাকিয়ে হাসল ও।

আগেও যেমন অনেক বার করেছ, তোমার জাদু দিয়ে বিভ্রান্ত করছ আমাকে, বললেন নেফার সেতি। এই মেয়েটি কে? কেন ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছ?

ওর নাম ফেন, ডানদিকের পথের একজন পণ্ডিত।

বয়সে তো অনেক ছোট।

আরও অন্য জীবন পার করে এসেছে ও।

অসাধারণ সুন্দরী। কামুক পুরুষের চোখে ফেনের দিকে তাকালেন তিনি।

কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন একটা পরিচিত ভাব রয়েছে। ওর চোখজোড়া…ওই চোখজোড়া আমার চেনা। স্মৃতি হাতড়ালেন তিনি। এককালে খুব চেনা কারও চোখের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

ফারাও, ও আমার স্ত্রী।

তোমার স্ত্রী? তা কি করে হয়? তুমি তো থেমে গেলেন তিনি। মাফ করবে ম্যাগাস। তোমার সম্মানের উপর কোনও রকম আঘাত করতে চাইনি।

কথাটা সত্যি, ফারাও, এককালে আমি খোঁজা ছিলাম, কিন্তু এখন আমি পূর্ণাঙ্গ পুরুষ। ফেন আমার মেয়েমানুষ।

অনেক কিছু বদলে গেছে, প্রতিবাদ করলেন নেফার সেতি। একটা ধাঁধার সমাধান করতে না করতেই আরেকটা ধাঁধা সামনে তুলে ধরছ তুমি- আবার থেমে গেলেন তিনি, ফেনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওই চোখ। সবুজ ওই দুটি চোখ। আমার বাবার! ওই চোখজোড়া বাবার ছিল। এমন হতে পারে কিনা ফেন আমারই রাজবংশের কেউ?

আরে, মেম! ওকে মৃদু স্বরে ভর্ৎসনা করল তাইতা। প্রথমে তোমার সামনে মেলে ধরা রহস্য নিয়ে অভিযোগ করলেন, তারপরই দাবি করলেন আপনার সামনে আরও বোঝা নামিয়ে রাখছি। আপনার একটা সহজ কথা বলি, ফেন আপনার বংশের প্রত্যক্ষ ধারার মানুষ। আপনার রক্তই ওর রক্ত, তবে অনেক দিন আগের।

তুমি বললে অন্য জীবন পার করে এসেছে ও। সেটা কি সেই অন্য কোনও জীবনে?

ঠিক তাইতা, সায় দিল তাইতা।

খুলে বলো! নির্দেশ দিলেন ফারাও।

পরে এর সময় পাওয়া যাবে। অবশ্য, আপনি আর মিশর এখনও হুমকির মুখে রয়েছেন। আপনি এরই মধ্যে ডাইনী ইয়োসের কথা জানতে পেরেছেন, নীল মাতার প্রবাহ যে বন্ধ করে দিয়েছিল।

এটা কি সত্যি যে তুমিই তাকে তার আস্তানায় গিয়ে ধ্বংস করে এসেছ?

ডাইনী এখন আর বেঁচে নেই, তবে তার এক চ্যালা এখনও মুক্ত আছে। তার নাম সোয়ে। খুবই বিপজ্জনক লোক।

সোয়ে! এই নামে এক লোককে চিনি আমি। মিনতাকা এর কথা বলেছে। যাজক। এক নতুন দেবীর কথা বলে।

উল্টো বানান করলে তার নাম দাঁড়ায় ইয়োস। জাদুকরীই ছিল তার দেবী। আপনাকে ও আপনার বংশধারাকে ধ্বংস করে তারপর ডাইনীর জন্যে মিশরের সিংহাসন দখল করাই তার উদ্দেশ্য।

নেফার সেতির চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। আমার প্রধান স্ত্রী মিনতাকার কাছে পৌঁছে গেছে সোয়ে লোকটা। তাকে বিশ্বাস করে ও। ওকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দিয়েছে সে।

আপনি বাধা দেননি কেন?

আমি ওকে সম্মান করি। আমাদের মৃত বাচ্চাদের শোকে মিনতাকা ভেঙে পড়েছিল। সোয়ে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। এখানে আমি খারাপ কিছু দেখিনি।

অনেক খারাপ হয়ে গেছে, বলল তাইতা। আপনার ও মিশরের ক্ষতি। সোয়ে এখনও মারাত্মক হুমকি হয়ে আছে। ডাইনীর শেষ অনুসারী সে, এই পৃথিবীর বুকে তার উপস্থিতির শেষ আলামত। মহা মিথ্যার অংশ সে।

আমাকে কী করতে হবে? নীল আবার বইতে শুরু করার সাথে সাথে সোয়ে সটকে পড়েছে। তার কী হয়েছে জানা নেই আমাদের।

সবার আগে তাকে পাকড়াও করে আপনার সামনে নিয়ে আসতে হবে। রানি মিনতাকা এমন গভীরভাবে তার শৃঙ্খলে আটকা পড়ে আছেন যে তিনি তার সব কথাই বিশ্বাস করে বসে আছেন। আপনাকে তার হাতে তুলে দিতেন তিনি। খোদ সোয়ের মুখ থেকে না শুনলে তার মধ্যে খারাপ কিছুর অস্তিত্ব মানতে চাইবেন না তিনি।

আমার কাছে কী চাও? জানতে চাইলেন নেফার সেতি।

রানি মিনতাকাকে সরিয়ে নিতে হবে। পশ্চীম তীরের মেমনরের প্রাসাদের স্বাধীনতা প্রয়োজন হবে আমার। হাথরের মন্দিরে বলী দিতে তাঁকে আপনি আসুইতে নিয়ে যান। তাকে বলুন দেবী আপনার সামনে আবির্ভূত হয়ে আপনাদের বাচ্চা যুবরাজ খাবা আর ওর বোন উনাসের স্বার্থে দুজনের কাছেই এই বলী দাবী করেছেন, এখন যারা অন্য জগতে রয়েছে।

হাথরের কাছে বলী দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিলাম আমি, এটা ঠিক। পাঁচ দিনের মধ্যেই, পূর্ণিমার রাতে আমি আর রানি রাজ প্রাসাদ ছেড়ে যাব। আমার কাছে আর কী চাও তুমি?

লর্ড মেরেন ও আপনার সেরা যোদ্ধাদের ভেতর থেকে এক শো জন সৈনিক। মেরেনকে অবশ্যই আপনার বাজপাখির সীলমোহর বহন করতে দিতে হবে, ওকে আপনার সীমাহীন ক্ষমতা দেবে ওটা।

এসব সে পাবে।

*

রাজ দম্পতি বার্জে চেপে নৌকা ভাসানোর সাথে সাথে প্রহরীদের সাথে করে মানীল পেরিয়ে পশ্চিম তীরে চলে এলো মেরেন ও তাই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মিনতাকার আবাস মেমননের প্রাসাদের উদ্দেশে এগিয়ে চলল ওরা। ভোর বেলায় ওখানে পৌঁছাল।

হতবাক হয়ে গেল ওখানকার লোকজন। প্রাসাদের উযির বাড়ির প্রহরীদের একটা দল নিয়ে ওদের ঢোকার পথে বাধা দিতে চাইলেন। তবে প্রাসাদের রক্ষীরা ভোগ বিলাসে মত্ত জীবন কাটিয়ে নরম হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়ানো এক শশা কঠিন যোদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইল ওরা।

বাজপাখির সীলমোহর দেখাল মেরেন। ফারাও নেফার সেতির নির্দেশ তামিল করছি আমরা। সরে দাঁড়াও, আমাদের ঢুকতে দাও!

ওর কাছে বাজপাখির সীল আছে। হার মানলেন উযির, প্রাসাদ রক্ষীদের দিকে ফিরলেন তিনি। তোমার লোকদের ছাউনীতে নিয়ে যাও, আমি খবর না দেওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবে ওরা।

প্রবেশ পথের দহলিজে ঢুকল মেরেন ও তাই। মাৰ্বল পাথরের উপর আওয়াজ তুলছে ওদের পেরেক লাগানো স্যান্ডেল। এখন আর আত্মগোপনের জাদুতে নিজেকে আড়াল করে রাখেনি তাইতা, বরং কুমীরের চামড়ার একটা ব্রেসপ্লেট ও মানানসই হেলমেট পরেছে, ভাইজরটা নামিয়ে রেখেছে যাতে চেহারা আড়াল হয়। দেখে ভীষণ একটা চরিত্র বলে মনে হচ্ছে। ওকে দেখে সটকে পড়ল প্রাসাদ রক্ষী ও মিনতাকার পরিচারিকারা।

কোথায় তল্লাশি শুরু করব, ম্যাগাস? জিজ্ঞেস করল মেরেন। ব্যাটা কি এখনও এখানে লুকিয়ে আছে?

সোয়ে এখানেই আছে।

আপনাকে অনেক নিশ্চিত মনে হচ্ছে।

বাতাসে ইয়োসের বিশ্রী গন্ধ প্রকট হয়ে আছে, বলল তাইতা।

শব্দ করে গন্ধ শুঁকল মেরেন।

কোনও গন্ধ পাচ্ছি না।

তোমার দশ জন লোক রাখো আমাদের সাথে। বাকিদের সমস্ত দরজা আর গেট পাহারায় পাঠিয়ে দাও। শারীরিক কাঠামো আর আকার বদলানোর ক্ষমতা রাখে সোয়ে, সুতরাং কাউকে প্রাসাদ ছেড়ে যেতে দেওয়া যাবে না, পুরুষ, নারী বা প্রাণী যাই হোক। বলল তাইতা। নির্দেশ জারি করে দিল মেরেন। যার যার অবস্থানের উদ্দেশ্যে চলে গেল লোকেরা।

উদ্যেশ্যমূলকভাবে বিশাল আঁকালভাবে সাজানো কামরাগুলোতে ঘুরে বেড়াতে লাগল তাই। মেরেন ও ওর লোকজন খুব কাছে থেকে অনুসরণ করছে ওকে। সবার তলোয়ার বের করা। খানিক পর পর থেমে যেন হাওয়া পরখ করছে তাইতা। যেন শিকারের গন্ধ শুঁকে এগিয়ে চলেছে শিকারী কুকুর।

অবশেষে রানির অন্দরের বাগিচায় এলো ওরা, উঁচু স্যান্ডস্টোন পাথরের দেয়ালে ঘেরা, মেঘহীন আকাশের দিকে উন্মুক্ত একটা বড় সড় জায়গা। ফুলে ভরা গাছপালা আর মাঝখানে একটা ফোয়ারার চারপাশে রাস্তা ঘিরে বিছানো রয়েছে রেশমী গদিমোরা বেঞ্চি। সৈনিকদের আবির্ভাবে মিনতাকার পরিচরিকারা যেটা যেখানে ফেলে গেছে সেখানেই পড়ে আছে-লুটসহ আরও নানা রকম বাদ্যযন্ত্র। অল্প বয়সী মেয়েদের সৌরভ ভাসছে হাওয়ায়, মিশে গেছে কমলা রঙের ফুলের সুবাসের সাথে।

উক্ত এলাকার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট লতার আঁচা। একটু দ্বিধা না করে ওটার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা। নিশ্চিত, দ্রুত পদক্ষেপ। মাঝখানের গোলাপি মাৰ্বল প্রিন্থের উপর দাঁড়িয়ে আছে ধাতু কুঁদে খোদাই করা একটা মূর্তি। ওটার পায়ের কাছে কেউ সূর্যপদ্মের একটা গোছা ফেলে রেখেছে। বাতাস মিষ্টি করে তুলেছে ওগুলোর গন্ধ। শক্তিশালী মাদকের মতো বোধবুদ্ধি ঘোলা করে দিচ্ছে।

ডাইনীর ফুল, ফিসফিস করে বলল তাইতা। গন্ধটা স্পষ্ট মনে আছে আমার। এবার প্রিন্থের উপরের মূর্তিটা পরখ করল ও। প্রমাণ সাইজ। বোরকা ঢাকা নারীর আকৃতি। পর্দার ভাঁজ আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছে তাকে। হেমের নিচে নিখুঁত পাজোড়া এমন দক্ষতার সাথে খোদাই করা হয়েছে যে শীতল প্রাণহীন পাথরের বদলে বরং জীবন্ত মাংসের বলে মনে হয়।

ডাইনীর পা, বলল তাইতা। এই মন্দিরেই রানি মিনতাকা তার পূজা করেছেন। তাইতার নাকে পদ্মের গন্ধের চেয়ে জোরাল হয়ে লাগছে এখন অশুভ গন্ধ। লড মেরেন, তোমার লোকদের মূর্তিটা ভেঙে ফেলতে বলো, শান্ত কণ্ঠে নির্দেশ দিল তাইতা।

এমনকি অদম্য মেরেনও ডাইনীর মন্দিরকে ভরে রাখা প্রভাবে হতবাক হয়ে গেছে। চাপা কণ্ঠে নির্দেশ দিল ও।

তলোয়ার খাপে ভরে মূর্তির গায়ে কাঁধ ঠেকাল সৈনিকরা। শক্তিশালী ও বেপরোয়া লোক ওরা, কিন্তু উপড়ে ফেলার প্রয়াস ঠেকিয়ে দিল মূর্তিটা।

তাশকালোন! বলে উঠল তাইতা, আরও একবার ইয়োসের শক্তি তার উপরই প্রয়োগ করল। নড়ে উঠল মূর্তিটা, মাৰ্বল পাথরের উপর তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল মাৰ্বল পাথর, নিখোঁজ আত্মার মতো। সৈনিকদের চমকে দিল আওয়াজটা। ভয়ে পিছিয়ে এলো ওরা।

আসকারতো! ইয়োসের মূর্তির দিকে তলোয়ার তাক করল তাইতা। আস্তে আস্তে সামনে উল্টে পড়তে শুরু করেছে ওটা।

সিলোন্দেলা! চিৎকার করে বলল ও। পথের পাথরের উপর সপাটে উল্টে পড়ল মূর্তিটা, অসংখ্য টুকরোয় ভাগ হয়ে গেল। কেবল নিখুঁত পাজোড়া অক্ষত রইল। সামনে এগিয়ে গেল তাইতা, তলোয়ারের ডগা দিয়ে প্রতিটি পা স্পর্শ করল। আস্তে আস্তে ফেটে চৌচির হয়ে গেল ওগুলো, গোলাপি ধুলোয় পরিণত হলো অবশেষে। প্রিন্থের উপরে রাখা সূর্য পদ্মের গোছা নেতিয়ে যেতে লাগল, এক সময় শুকিয়ে কালো হয়ে গেল।

ধীর পায়ে প্রিন্থের ভিত্তি ঘিরে একটা চক্কর দিল তাইতা। কয়েক কদম পর পর মার্বলের উপর টোকা দিচ্ছে। পেছনের দেয়ালের কাছে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত দৃঢ়, নিরেট শোনাল আওয়াজটা। তারপর ক্ষীণ, ফাঁপা একটা প্রতিধনি বিলোল মাৰ্বল পাথর। পিছিয়ে গিয়ে পরখ করল তাইতা। তারপর আবার সামনে বেড়ে হাতের গোড়া দিয়ে ওটার ডান কোণে চাপ দিল। ভেতরে কোনও লেভার নড়ে ওঠার তীক্ষ্ণ শব্দ হলো। ট্র্যাপডোরের মতো গোটা প্যানেলটা খুলে গেল।

পরবর্তী নীরবতায় ওরা প্রিন্থের পেছনে খুলে যাওয়া কালো চৌকো ফোকরটার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন লোকের ঢোকার মতো যথেষ্ট বড় ওটা।

ইয়োসের মিথ্যে পয়গম্বরের আত্মগোপনের জায়গা, বলল তাইতা। দরবার হলের ব্র্যাকেট থেকে মশাল নিয়ে এসো। নির্দেশ পালন করতে দ্রুত ছুটে গেল প্রহরীরা। ওরা ফিরে এলে একটা মশাল নিয়ে খোলা মুখে ধরল তাইতা। মশালের আলোয় অন্ধকারে নেমে যাওয়া একটা সিঁড়ি দেখতে পেল ও। নির্দ্বিধায় সামনে ঝুঁকে ভেতের চোখ চালাল। মোট তেরটা সিঁড়ি, নিচে নেমে একজন দীর্ঘদেহী মানুষ না ঝুঁকেই হাঁটার মতো উঁচু একটা সুড়ঙে পরিণত হয়েছে। মেঝেটা সাধারণ স্যান্ডস্টোন টাইলসের। দেয়ালগুলো ছবি বা খোদাই কর্ম দিয়ে অলঙ্কৃত নয়।

আমার খুব কাছে থেকো, সড়ঙ দিয়ে দ্রুত এগোনোর সময় মেরেনকে বলল তাইতা। বাতাস, বাসী, ভারি; সঁতসেঁতে মাটি আর অনেক দিন আগে চাপা দেওয়া মৃত জিনিসের গন্ধে ভারি হয়ে আছে। দুবার সুড়ঙের মোড়ে হাজির হলো। তাইতা, কিন্তু চিন্তা করার জন্যে না থেমেই সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে পথ বেছে নিল ও। অবশেষে ওর সামনে আলোর একটা আভা দেখা গেল। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল ও।

একটা রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল ও, এখানে তেল, পানি আর মদের বিরাট বিরাট কলসী রাখা। ধুরা রুটির কাঠের ঝুড়ি আর ফল ও সজির ঝুড়ি রয়েছে। ছাদের হুক থেকে ঝুলছে পোড়ানো পা। কামরার ঠিক কেন্দ্রে অগ্নিকুণ্ডের ছাই থেকে ধোঁয়ার ক্ষীণ একটা রেখা সর্পিল গতিতে উঠে ছাদের ভেন্টিলেশন ফোকরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কাঠের টেবিলের উপর একটা জগ ও লাল মদের গামলাসহ অর্ধভুক্ত খাবার। একটা ছোেট তেলের কুপি আধো আলো বিলোচ্ছে চারপাশে। রান্নাঘর পেরিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালের দরজার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা। একটা সেলের দিকে নজর বোলাল, একটা মাত্র লণ্ঠনের আলোয় ম্লানভাবে আলোকিত হয়ে আছে ওটা।

কিছু পোশাক, টিউনিক, একটা জোব্বা ও এক জোড়া স্যান্ডেল অবহেলাভরে এক কোণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মেঝের মাঝখানে একটা মাদুর বিছানো, ওটার উপর শেয়ালের চামড়ার কারোস। কারোসের একটা কোণ ধরে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল তাইতা। ছোট একটা বাচ্চা শুয়ে ওটার নিচে, দুই বছরের বেশি হবে না বয়স; মনকাড়া ছোট ছেলে, ওর চোখজোড়া বিরাট, কৌতূহলী, তাইতার দিকে। চোখ তুলে তাকাল সে।

হাত বাড়িয়ে ছেলেটার মাথা স্পর্শ করল তাইতা। হিসহিস একটা শব্দ হলো, পোড়া মাংসের কটু গন্ধ পাওয়া গেল। চিৎকার করে দুমড়ে মুচড়ে তাইতার কাছ থেকে সরে যাবার চেষ্টা করল বাচ্চাটা। ওর চাঁদির উপর কাঁচা লাল ছ্যাকার দাগ। পড়েছে। তাইতার হাতের আউটলাইন নয়, বরং ইয়োসের বেড়াল থাবার চিহ্ন।

ছোট্ট মানুষটাকে আঘাত করেছেন আপনি, বলে উঠল মেরেন, প্রায় কোমল ওর কণ্ঠস্বর।

 ওটা কচি খোকা নয়, জবাব দিল তাইতা। এটা জাদুকরীর শেষ অশুভ ডালপালা। আবার ছেলেটাকে স্পর্শ করতে হাত বাড়াল ও। কিন্তু তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে হাঁছড়েপাছড়ে সরে গেল সে। গোড়ালী ধরে উল্টো করে তাকে ঝোলাল তাইতা। ওর হাতের মুঠোয় পাক খাচ্ছে, যুঝছে ওটা। মুখোশ খোলো, সোয়ে। তোমার মালকিন ডাইনী জমিনের নিচের আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। ওর কোনও শক্তিই আর তোমার কাজে আসবে না। ছেলেটাকে মাদুরের উপর ছুঁড়ে ফেলল ও। ওখানে শুয়ে কুঁইকুই করতে লাগল সে।

ওর ওপর ডান হাতের একটা ইশারা করল তাইতা, সোয়ের ফাঁকি দূর করে দিল। আস্তে আস্তে গড়ন আর চেহারা পাল্টে ডাইনীর দূতের রূপ ধারণ করল ছেলেটা; চোখজোড়া জ্বলছে তার, ঘৃণা আর বৈরিতায় বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা।

এখন চিনতে পারছ? মেরেনকে জিজ্ঞেস করল তাইতা।

সেথের মুখের দুর্গন্ধের কসম, এ যে দেখছি সোয়ে, দিমিতারের উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিল। শয়তানের বাচ্চাটাকে শেষবার ওর মতোই এক হায়েনার পিঠে সওয়ার হয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেছিলাম।

 ওকে বেঁধে ফেল, নির্দেশ দিল তাইতা। ফারাওর বিচারের মুখোমুখি হতে কারনাকে যাচ্ছে সে।

*

রাজ দম্পতির আসুইত থেকে কারনাকে ফিরে আসার পরদিন সকালে মিনতাকা মপ্রাসাদের খাস দরবার হলে ফারওর সাথে বসে আছেন। উঁচু জানালা গলে ঢুকে পড়েছে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। কিন্তু সেটা তাঁকে আমোদ যোগাচ্ছে না। তাকে ক্লান্ত, পর্যদস্ত মনে হচ্ছে। মেরেনের মনে হচ্ছে মাত্র কয়েকদিন আগে ওকে (শেষবার দেখার পর অনেক বয়স বেড়ে গেছে তার।

রানির চেয়ে উঁচু সিংহাসনে বসে আছেন ফারাও। বুকের কাছে বিচার ও সাজার প্রতীক সোনালি ফ্লেইল ক্রস করে রাখা। তাঁর মাথায় লম্বা লাল-শাদা দুই রাজ্যের মুকুট, শক্তিমান একজন হিসাবে পরিচিত শেন্ট। সিংহাসনের দুই পাশে তাঁর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার জন্যে দুই জন লিপিকার বসে আছে।

মেরেনকে স্বীকৃতি দিলেন ফারাও নেফার সেতি। লর্ড মার্শাল, তোমাকে যে কাজ দিয়েছিলাম সেটা শেষ করতে পেরেছ?

পেরেছি, শক্তিমান ফারাও। আপনার শত্রু এখন আমার হেফাযতে।

তোমার কাছে এর চেয়ে কম কিছু আশা করিনি। তবুও অনেক খুশি হয়েছি। তাকে এবার আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যে নিয়ে আসতে পারো।

মেঝের উপর বর্শার ফলা দিয়ে তিনবার আঘাত করল মেরেন। সাথে সাথে পেরেক লাগানো স্যান্ডেলের আওয়াজ উঠল মেঝেয়, দশজন প্রহরী সার বেঁধে কামরায় ঢুকল। ওদের সাথে থাকা বন্দিকে চেনার আগ পর্যন্ত শূন্য দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালেন রানি মিনতাকা।

সোয়ে দিগম্বর, শাদা ব্রিচ ক্লাউট ছাড়া গায়ে কিছু নেই। কব্জি ও গোড়ালিতে বাঁধা রয়েছে ভারি ধাতব শেকল। চেহারা ভেঙে পড়েছে তার, কিন্ত মুখটা উদ্ধত ভঙ্গিতে উঁচু করে রেখেছে। ঢোক গিললেন মিনতাকা, এক লাফে উঠে মহা বিস্ময় ও ভয়ের সাথে তাকালেন ওর দিকে। ফারাও, উনি একজন শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী পয়গম্বর; নামহীন দেবীর একজন ভৃত্য। উনি তো শত্রু নন! ওর সাথে। এমন আচরণ করতে পারি না আমরা।

ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকলেন ফারাও। সে আমার শত্রু না হলে তাকে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছ কেন? জানতে চাইলেন তিনি।

থতমত খেয়ে গেলেন মিনতাকা, এক হাতে মুখ ঢাকলেন। সিংহাসনে মিশে গেলেন তিনি। চেহারা ছাইয়ের মতো ফ্যকাশে হয়ে গেছে, চোখজোড়া ভীত।

আবার সোয়ের দিকে ফিরলেন ফারাও। তোমার নাম বলো! বন্দিকে নির্দেশ দিলেন তিনি।

স্পর্ধিত দৃষ্টিতে তাকাল সোয়ে। আমি নামহীন দেবী ছাড়া আর কারও কর্তৃত্ব মানি না, ঘোষণা করল সে।

তুমি যার কথা বলছ এখন আর সে নামহীন নেই। তার নাম ছিল ইয়োস। কোনওদিনই দেবী ছিল না সে।

সাবধান!  চিৎকার করে উঠল সোয়ে। আপনি ধর্মের অপমান করছেন। দেবীর অভিশাপ ক্ষিপ্র, নিশ্চিত।

তার বিস্ফোরণ উপেক্ষা করলেন ফারাও। তুমি এই জাদুকরীর সাথে নীল মাতার জলে বাঁধ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলে?

আমি কেবল দেবীর কাছেই জবাবদিহি করি, খেঁকিয়ে উঠল সোয়ে।

জাদুকরীর সাথে যোগসাজশে তুমি মিশরের উপর প্লেগ ডেকে আনতে অতিলৌকিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছিলে? আমাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করাই কি তোমার মতলব ছিল?

আপনি সত্যিকারের রাজা নন! চিৎকার করে বলল সোয়ে। আপনি ক্ষমতা দখলকারী, ধর্মদ্রোহী! ইয়োসই পৃথিবী ও এর সকল জাতির আসল শাসক!

তুমি আমার বাচ্চাদের হত্যা করেছ, রাজকীয় রক্তের যুবরাজ আর রাজকন্যাকে?

ওরা রাজরক্তের ছিল না, নিশ্চিত সুরে বলল সোয়ে। ওরা সাধারণ লোক। কেবল দেবীই রাজ রক্ত ধারণ করেন।

তুমি আমার রানিকে সম্মানের পথ থেকে বিচ্যুত করতে তোমার অশুভ প্রভাব কাজে লাগিয়েছ? জাদুকরীকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যে তোমাকে সাহায্য করতে ওকে বিশ্বাস করিয়েছ?

এটা আপনার সিংহাসন নয়। এটা ইয়োসের বৈধ সিংহাসন।

আমার রানির কাছে বাচ্চাদের আবার জীবিত করার কথা দিয়েছ? জানতে চাইলেন ফারাও। তলোয়ারের ফলার মতো শীতল, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর।

কবর কখনও নিজের ফল খায় না, জবাব দিল সোয়ে।

তার মানে তুমি মিথ্যা বলেছ। দশ হাজার মিথ্যা! তুমি মিথ্যা বলেছ, খুন করেছ আর আমার সাম্রাজ্য জুড়ে অসন্তোষ ও হতাশার বিস্তার ঘটিয়েছ।

ইয়োসের সেবায় মিথ্যা হচ্ছে সৌন্দর্যের বিষয়, হত্যা মহান কাজ। আমি মোটেই অসন্তোষ ছড়াইনি, সত্যি কথা প্রচার করেছি।

সোয়ে, নিজের মুখের কথায়ই তোমার অপরাধ প্রমাণিত হয়ে যায়।

আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না আপনি। আমার দেবী আমাকে রক্ষা করবেন।

ইয়োস ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমার দেবীর আর অস্তিত্ব নেই, গম্ভীর কণ্ঠে প্রকাশ করলেন ফারাও। মিনতাকার দিকে ফিরলেন তিনি। রানি আমার, যথেষ্ট শোনা হয়েছে?

নীরবে কাঁদছিলেন মিনতাকা। এমনই হতবিহ্বল হয়ে গেছেন যে মুখে কথাই সরছে না। তবে মাথা দোলালেন তিনি। লজ্জায় মুখ ঢাকলেন।

এইবার দরবারের একেবারে শেষ প্রান্তে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো অবয়বের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি। তাইতার শিরস্ত্রাণের ভাইজর নামানো। ফেনের মুখ পর্দায় ঢাকা। কেবল ওর সবুজ চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে।

ইয়োস কীভাবে ধ্বংস হলো বলো আমাদের, নির্দেশ দিলেন ফারাও।

শক্তিমান, আগুনে পুড়ে মারা গেছে সে, বলল তাইতা।

তাহলে তার চিড়িয়াও একই ভাগ্য বরণ করবে, এটাই তো মাননসই।

সেটা হবে অনেক আরামের মৃত্যু, তার যোগ্যতার চেয়ে ভালো। নিষ্পাপ লোকজনকে সে যেভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে তার চেয়ে অনেক ভালো।

চিন্তিতভাবে মাথা দোলালেন ফারাও। তারপর মিনতাকার দিকে ফিরলেন।

আমি তোমাকে আমার ও মিশরের দেবতাদের চোখে নিজেকে মুক্ত করার একটা সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছি।

ফারাওর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন মিনতাকা। কী করছি বুঝতে পারিনি। সে আমাকে কথা দিয়েছিল নীল আবার প্রবাহিত হবে, আমাদের বাচ্চারা আবার বেঁচে উঠবে, যদি আপনি দেবীকে মেনে নেন। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছি।

আমি যা বুঝতে পারছি, মিনতাকাকে দাঁড় করালেন ফারাও। তোমার জন্যে শাস্তি হচ্ছে আমার সাম্রাজ্য থেকে সোয়ে ও জাদুকরীর শেষ চিহ্ন মুছে যাওয়ার আগুনের মশালটা তুমিই জ্বালবে।

দুলতে শুরু করলেন মিনতাকা, চরম হতাশা ভর করল তার চেহারায়, তারপর যেন নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। আমি ফারাওর বিশ্বস্ত স্ত্রী ও প্রজা। তাঁর নির্দেশ মানাই আমার কর্তব্য। আমি সোয়ের পায়ের নিচে আগুন ধরাব, একদিন যাকে বিশ্বাস করেছিলাম।

লর্ড মেরেন, এই জঘন্য প্রাণীটাকে প্রাঙ্গণে নিয়ে যাও, ওখানে শূল রাখা আছে। রানি মিনতাকা তোমার সাথে যাবেন।

সেনাদল সোয়েকে মাৰ্বল সিঁড়ি বেয়ে প্রাঙ্গণে নিয়ে গেল। ওদের অনুসরণ করল মেরেন। ওর বাহুতে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছেন মিনতাকা।

আমার পাশে দাঁড়াও, ম্যাগাস, তাইতাকে নির্দেশ দিলেন ফারাও। আমাদের শত্রুর পরিণতির সাক্ষী থাকবে তুমি। এক সাথে প্রাঙ্গণে খোলা বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন তারা।

ওদের নিচের প্রাঙ্গণের মাঝখানে গাছের গুঁড়ি আর প্যাপিরাসের বান্ডিল দিয়ে তৈরি একটা তূপ দাঁড়িয়ে আছে। কুপির তেলে ভেজানো হয়েছে ওটাকে। চিতার উপরে বানানো মাঁচার দিকে চলে গেছে একটা কাঠের মই। পায়ের কাছে অপেক্ষা করছে দুজন তাগড়া চেহারার জল্লাদ। সোয়েকে প্রহরীদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে টেনে নিয়ে চলল ওরা। পা জোড়া কোনওমতে ধরে রেখেছে তাকে। শূলের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো তাকে। মই বেয়ে নেমে এলো ওরা। চূড়ায় রয়ে গেল সে। প্রাঙ্গণের দরজার কাছে রাখা জ্বলন্ত পাত্রের দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। অগ্নিশিখায় আলকাতরায় ভেজানো মশাল ডোবাল ও। মিনতাকার কাছে এনে তার হাতে তুলে দিল। মৃত্যুদণ্ডের চিতার পায়ের কাছে মিনতাকাকে রেখে সরে এলো ও।

মাথার উপরে বারান্দায় দাঁড়ানো ফারাওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। করুণ ওর অভিব্যক্তি। ওর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালেন ফারাও। এক মুহূর্ত বেশি ইতস্তত করলেন মিনতাকা। তারপর তেলে ভেজানো প্যাপিরাসের তূপে ঠেসে দিলেন জ্বলন্ত মশাল। চিতার পাশ ঘেঁষে একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটে আসতেই টলমল পায়ে সরে এলেন তিনি। আগুনের শিখা আর ধোয়া প্রাসাদের ছাদ ছাড়িয়ে গেল। অগ্নিশিখার মাঝখানে মেঘহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তচিৎকার করল সোয়ে। আমার কথা শুনুন, ইয়োস, একমাত্র দেবী! আপনার অনুগত ভৃত্য আপনাকে আহ্বান করছে। আমাকে অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার করুন। এই খুচরো ফারাও আর সারা বিশ্বকে আপনার ক্ষমতা আর পবিত্র শক্তি দেখান! তারপর আগুনের লেলিহান শিখার করকর আওয়াজে চাপা পড়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। ধোঁয়া ও তাপ গিলে নেওয়ায় শক্ত বাঁধনের উপর হেলে পড়ল সোয়ে। দাউদাউ শিখা ঢেকে ফেলল তাকে। মুহূর্তের জন্যে ফাঁক হয়ে কালো, বিকৃত অবয়বটা মেলে ধরল, এখন আর মানুষ বলে চেনার উপায় নেই, এখনও শূলে ঝুলে আছে। তারপর চিতাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। আগুনের কেন্দ্রে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সে।

মিনতাকাকে টেনে সিঁড়ি ঘরের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এলো মেরেন, তারপর পথ দেখিয়ে রাজকীয় দরবার হলে নিয়ে এলো। বয়স্কা, নাজুক নারীতে পরিণত হয়েছেন তিনি, সৌন্দর্য ও মর্যাদা তিরোহিত হয়েছে। ফারাওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি। হে প্রভু, আমার স্বামী, আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, ফিসফিস করে বললেন। আমি নির্বোধ নারী, যা করেছি তার কোনও অজুহাত হয় না।

তোমাকে ক্ষমা করা হলো, বললেন নেফার সেতি, তারপর যেন এরপর কী করতে হবে বুঝতে পারলেন না। রানিকে দাঁড় করানোর একটা ভঙ্গি করলেন, কিন্তু পরক্ষণেই পিছিয়ে গেলেন। তিনি জানেন এ ধরনের ঔদ্ধত্য স্বর্গীয় ফারাওর পক্ষে বেমানান। তাইতার দিকে চোখ ফেরালেন তিনি। তার পরামর্শ চাইছেন। ফেনের বাহু স্পর্শ করল তাইতা। মাথা দুলিয়ে পর্দা তুলল ও। সোনালি সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়ে পড়ল তার। এগিয়ে এসে মিনতাকার সামনে দাঁড়াল। আসুন, আমার রানি, বলল ও, মিনতাকার হাত ধরল।

মুখ তুলে ওর দিকে তাকালেন রানি। কে তুমি? কম্পিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন।

আমি সে যে আপনার জন্যে অনেক ভাবে, জবাব দিল ফেন। তুলে নিল ওকে।

ওর সবুজ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন মিনতাকা। সহসা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। আমার মনে হচ্ছে বয়সের তুলনায় তুমি অনেক ভালো আর প্রাজ্ঞ, বলে ফেনের আলিঙ্গনে ধরা দিলেন তিনি। ওকে নিবিড় করে ধরে রেখে ঘরে নিয়ে গেল তাকে ফেন।

ওই মেয়েটা কে? তাইতাকে জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি। জানার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। আমাকে বলো, ম্যাগাস। এটা রাজকীয় আদেশ।

ফারাও, সে আপনার দাদীমার অবতার, রানি লস্ত্রিস, জবাব দিল তাইতা। যাকে একবার আমি ভালোবেসেছিলাম, এখন আবার ভালোবাসছি।

মেরেনের নতুন ভূসম্পত্তির সীমানা নীল মাতার তীর বরাবর তিরিশ লীগ পর্যন্ত বিস্তৃত। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অন্যতম রাজকীয় প্রাসাদ আর বাজপাখি দেবতা হোরাসের প্রতি নিবেদিত একটা অসাধারণ সৌন্দর্য মণ্ডিত মন্দির। তিন হাজার বর্গা চাষী উর্বর জমিন চাষ করে, নদীর জলে সেঁচ করা হয় এসব জমিন। নতুন ভূস্বামী লর্ড মার্শাল মেরেনকে ফসলের এক পঞ্চমাংশ কর দেয় ওরা। দেড়শো দাস শ্রমিক আর দুই শো ফারাওর যুদ্ধ বন্দি প্রাসাদ বা সম্পত্তির নিজস্ব জমিদারিতে কাজ করে।

মেরেন ওর জমিদারির নাম রেখেছে কারিম-এক-হোরাস-হোরাসের আঙুর বাগান। সে বছর বসন্ত কালে ফসল বোনার পর পৃথিবী যখন চমৎকার সাজে সেজে উঠল, কারনাক থেকে নদীর ভাটিতে সব রাজকীয় সঙ্গী নিয়ে লর্ড মেরেন ও তার স্ত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলেন ফারাও।

মেরেন ও সিদুদু এক সাথে নদীর তীরে এলো। সেনাবাহিনীর মার্শালের রিগালা পরেছে মেরেন, হেলমেটে অস্ট্রিচের পালক, নগ্ন বুকে বীরত্ব ও প্রশংসার সোনার চেইন ঝুলছে। চুলে জেসমিন ফুল গুঁজেছে সিদুদু। পরনে ক্যাথে থেকে আমদানি করা শাদা মেঘের মতো পোশাক। নীলের জলের পাত্র ভাঙল ওরা, চুমু খেল। আর এদিকে লোকেরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, দেবতাদের আশীর্বাদ কামনা করল।

দশ দিন দশ রাত ধরে চলল উৎসব। প্রাসাদের ফোয়ারাগুলো মদে ভরে দিতে চেয়েছিল মেরেন, কিন্তু সিদুদু ওর স্ত্রী হওয়ার পর থেকেই এই ধরনের বাড়াবাড়ির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মেয়েটা কত দ্রুত ওর সংসারের সর্বময় কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে দেখে অবাক হয়ে গেছে মেরেন। তবে তাইতা ওকে সান্ত্বনা যুগিয়েছে। তোমার জীবনের সেরা স্ত্রীতে পরিণত হবে ও। ওর মিতব্যয়ীতাই তার প্রমাণ। অপচয়কারী স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর বিছানায় কাঁকড়া বিছের মতো।

রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাইতা ও মেরেনের সাথে চাঁদের পাহাড়ে ওদের অভিযানের কাহিনী মন দিয়ে শুনে যান নেফার সেতি। কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করার পর পুনরাবৃত্তির নির্দেশ দেন তিনি। সিদুদু, ফেন ও মিনতাকা বসে থাকেন ওদের সাথে। ফেনের প্রভাবে রানির চরিত্র পাল্টে গেছে। তিনি তার বিষাদ ও অপরাধ বোধের ভারমুক্ত হয়েছেন। আবার প্রশান্তি ও সুখে আলোকিত হয়ে উঠেছেন। এটা সবার কাছে পরিষ্কার যে আবার পরিপূর্ণভাবে স্বামীর আনুকূল্য ফিরে পেয়েছেন তিনি।

কাহিনীর একটা অংশ বিশেষভাবে তাদের, বিশেষ করে নেফার সেতিকে বিমোহিত করে। বার বার সেই অংশে ফিরে আসেন তিনি। আমাকে আবার ফন্টের কথা বলল,; তাইতার কাছে জানতে চান তিনি। একটা অংশও যেন বাদ না পড়ে। জ্বলন্ত লাভার হ্রদের উপর পাথরের সেতু পার হওয়ার ঘটনা দিয়ে শুরু করো।

তাইতা গল্পের শেষে পৌঁছলেও সন্তুষ্ট হন না তিনি। মুখে নেওয়ার সময় নীলত্বের স্বাদের কথা বলো, শ্বাস টানার সময় পানির মতো তোমার শ্বাসরুদ্ধ করল না কেন?; সেটা কি ঠাণ্ডা ছিল নাকি গরম?; ফন্ট থেকে উঠে আসার কতক্ষণ পরে ওটার বিস্ময়কর প্রভাব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিলে?; তুমি বললে তোমার পায়ের উপর লাভা পড়ায় পুড়ে যাওয়া পা সাথে সাথে ভালো হয়ে গেছে, হাত পায়ের শক্তি ফিরে এসেছে। ব্যাপারটা কি সত্যিই তাই?; আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ফন্ট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সেটা কি জ্বলন্ত লাভায় ডুবে গেছে? কী বাজে একটা ক্ষতি হবে সেটা। সেটা কি চিরকালের জন্যে আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে?

জীবনদায়ী শক্তি যোগানোর মতো ফন্টও চিরন্তন। যতদিন এই পৃথিবীতে জীবন আছে, ততদিন ফন্টও থাকবে, জবাব দেয় তাইতা।

বছরের পর বছর দার্শনিকরা এই জাদুকরী ফন্টের স্বপ্ন দেখে এসেছেন, আমার সব পূর্ব পুরুষ এর সন্ধান করেছে। চিরন্তন জীবন ও চিরন্তন তারুণ্য, কি নিষ্ঠুর সম্পদ এসব? ফারাওর চোখজোড়া প্রায় ধর্মীয় উন্মাদনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমার জন্যে এর সন্ধান এনে দাও, তাইতা। আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি না। তবে আবেদন জানাচ্ছি। আমার আর মাত্র বিশ কি তিরিশ বছর আয়ু বাকি আছে। বেরিয়ে পড়ো, তাইতা, আবার আমার জন্যে ফন্ট খুঁজে বের করো।

ফেনের দিকে তাকানোর প্রয়োজন হয়নি তাইতার। ওর কণ্ঠস্বর ওর মাথার ভেতর স্পষ্ট গুঞ্জন করে উঠেছে। প্রিয় তাইতা আমার, রাজার সাথে সাথে আমার আবেদনও যোগ করছি। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো। ফন্টের লুকানোর জায়গায় না পৌঁছানো পর্যন্ত চলো সারা দুনিয়া ছুঁড়ে বেড়াই। আমাকে সেই নীলে অবগাহন করতে দাও, যাতে আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি। সারা জীবন তোমাকে ভালোবেসে যেতে পারি।

ফারাও, তাঁর অধীর চেখের দিকে তাকায় তাই। আপনার আদেশ শিরোধার্য।

সফল হলে তোমার পুরস্কার হবে সীমাহীন। এই পৃথিবীর সমস্ত ধনরত্ন তোমাকে দান করব আমি।

এখন আমার কাছে যা আছে সেটাই যথেষ্ট। তারুণ্য ও বয়সের প্রজ্ঞা আছে আমার। আমার রাজা ও নারীর ভালোবাসা আছে। আপনাদের দুজনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই কাজটা করব আমি।

*

উইন্ডস্মোক হাঁকাচ্ছে তাইতা, ওয়ার্লউন্ডের পিঠে রয়েছে ফেন। দুজনই একটা ৩করে পুরোদস্তুর বোঝাই প্যাকহর্স টেনে নিয়ে চলছে। বেদুঈন পোশাক ওদের পরনে, তীর ধনুক ও তলোয়ার বহন করছে। মেরেন ও সিদুদু ওদের সাথে কারিম এক-হোরাসের শেষ প্রান্তের পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত এসেছিল; এখানেই বিদায় নিয়েছে ওরা। সিদুদু ও ফেন সহোদরাসুলভ চোখের পানি ফেলেছে, আর তাইতাকে আলিঙ্গন করে ওর গালে চুমু খেয়েছে মেরেন।

বেচারা ম্যাগাস! আপনার সেবা করার জন্যে আমি না থাকলে কেমন করে, চলবেন আপনি? কর্কশ শোনায় ওর কণ্ঠস্বর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, চোখের আড়ালে চলে যাবার পর এক দিনের মধ্যেই ফের ঝামেলায় পড়বেন। তারপর ফেনের দিকে তাকিয়েছে সে। ওর দিকে খেয়াল রেখো, আবার একদিন আমাদের কাছে ফিরিয়ে এনো।

ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে পাহাড়ের পেছনের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে তাইতা ও ফেন। মাঝ পথে থেমে পেছনে তাকিয়েছে ওরা-মাথার উপর দিগন্তে দাঁড়ানো দুটি ক্ষুদে অবয়বের দিকে। শেষবারের মতো হাত নেড়েছে মেরেন ও সিদুদু। তারপর ঘোড়া ঘুরিয়ে দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে গেছে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? জিজ্ঞেস করল ফেন।

প্রথমে সাগর, বিশাল প্রান্তর এবং তারপর উঁচু পাহাড়ী এলাকা পার হতে হবে আমাদের।

তারপর?

এক গহীন বনে, বিদ্যা ও প্রজননের দেবী সরস্বতীর মন্দিরে।

ওখানে কী পাওয়া যাবে?

একজন জ্ঞানী নারী, তোমার অন্তর্চক্ষু উন্মাচিত করবে সে যাতে তুমি আরও পরিষ্কারভাবে পবিত্র ফন্ট খোঁজে আমাকে সাহায্য করতে পারো।

কতদিন চলবে এই যাত্রা?

আমাদের যাত্রা হবে অন্তহীন, অনন্ত কাল একসাথে চলব আমরা, বলল তাইতা।

খুশিতে হেসে উঠল ফেন। তাহলে মাই লর্ড, এখুনি শুরু করতে হবে।

পাশাপাশি ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল ওরা, এগিয়ে চলল অজানার পথে।

-শেষ-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *