৮. সুপ্রিম কাউন্সিল

সুপ্রিম কাউন্সিল চেম্বার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের আওয়াজে জেগে উঠল ও। মাঝখানের দেয়ালে তা চাপা পড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ওর শ্রবণ শক্তি অনেক বেড়ে যাওয়ায় লর্ড আকেরের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শনাক্ত করতে পারল।

চট করে কাউচ ছেড়ে ইয়োসের স্পাই হোলের দিকে এগিয়ে গেল ও। ওটার ফুটো দিয়ে তাকাল। আটজন যোদ্ধা পূর্ণ রণ-পোশাক পরে মঞ্চের সামনে গভীর শ্রদ্ধা ও সমীহের ভঙ্গিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। দুই অলিগার্ক ওদের মুখোমুখি। সামনে হাঁটু গেড়ে বসা লোকগুলোকে বকাঝকা করছে লর্ড আকের।

কি বলছ, পালিয়ে গেছে! ওদের পাকড়াও করার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমি, আমার কাছে নিয়ে আসতে বলেছি। আর এখন কিনা বলছ ওরা তোমাদের ফাঁকি দিয়েছে। তোমরা মিশরিয় হওয়া সত্ত্বেও।

ময়দানে আমাদের দুই হাজার লোক রয়েছে। বেশি সময় মুক্ত থাকবে না ওরা। কথা বলছিল ক্যাপ্টেন ওনকা। আকেরের ক্রোধের মুখে হাঁটু গেড়ে বসে কুকড়ে গেছে সে।

দুই হাজার! জিজ্ঞেস করল আকের। আমাদের বাহিনীর বাকি সবাই কোথায়? গোটা সেনাদলকে এই বিদ্রোহ ঠেকাতে কাজে নামাতে বলেছিলাম আমি। আমি সেনাদলের নেতৃত্ব নিচ্ছি। বেঈমান তিনাত আনকুর আর ওর সাথের ষড়যন্ত্রীদের খুঁজে বের করব। সবকটাকে, শুনতে পাচ্ছ! বিশেষ করে কর্নেল মেরেন। ক্যাম্বিসেস আর সাথে করে জাররিতে আনা অচেনা লোকজনকে। আমি নিজে ওদের উপর অত্যাচার আর হত্যার ব্যাপারটা তদারকি করব। এমন নজীর তৈরি করব যে কেউ কোনওদিন ভুলবে না! অফিসারদের দিকে তাকাল সে। কিন্তু তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করল না কেউ।

পালের গোদাগুলোর ব্যবস্থা করার পর জাররিতে পা রাখা প্রত্যেকটা লোকের উপর প্রতিশোধ নেব। ধমকে উঠল আকের। ওরা বেঈমান। এই কাউন্সিলের হুকুমে ওদের সব সম্পত্তি দেবী আর রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হলো। পুরুষদের খনিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে-আমাদের দাসের অভাব চলছে। বয়স্কা মহিলা ও বার বছরের বেশি বয়সী শিশুদের দাসদের খোয়াড়ে পাঠাতে হবে। অল্পবয়সী বাচ্চাদের কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই গর্দান ফেলে দিতে হবে। কামনাযোগ্য যেকোনও মেয়েকে প্রজনন কর্মসূচির জন্যে খামারে পাঠাতে হবে। সেনাদলের বাকি সবাইকে এক করতে কতক্ষণ লাগবে, কর্নেল ওনকা!

তাইতা বুঝতে পারল ওনকাকে সম্ভবত সেনাদলের নেতৃত্বের অবস্থানে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, যেটা আগে তিনাতের ছিল।

আজ দুপুরের আগেই রওয়ানা দিতে তৈরি হয়ে যাব আমরা, মহান লর্ড, জবাব দিল ওনকা।

যন্ত্রণার সাথে শুনে গেল তাইতা। ওর পাহাড় সফরের সময় জাররির সবকিছু বদলে গেছে। এখন ফেন ও মেরেনেকে নিয়েই ওর বেশি ভাবনা। হয়তো এরই মধ্যে ওনকার হাতে পড়ে গেছে ওরা। ফেনের সাথে অবিলম্বে যোগাযোগ করতে হবে, তবে আকেরের পরিকল্পনার সিংহভাগ আড়িপেতে শুনে নেওয়াটাও ওর পক্ষে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

পিপহোলের কাছেই রইল ও, ওদিকে হুকুম দিয়ে চলল আকের। অভিজ্ঞ সেনাপতি সে, মনে হচ্ছে তার কলাকৌশল কাজে লাগবে। অবশ্য, মোকাবিলা করার মতো নিজস্ব পরিকল্পনা খাড়া করতে পারবে তাইতা। অবশেষে কর্নেলদের বাতিল করে দিল আকের, দুই অলিগার্ক একা হয়ে গেল। সক্রোধে টুলে বসল আকের।

বেকুব আর কাপুরুষরা ঘিরে রেখেছে আমাদের, অভিযোগ করল সে। আমাদের চোখের সামনে কেমন করে এমন একটা বিদ্রোহ ঘটতে পারল?

আমি যেন গালালার ম্যাগাস তাইতার গন্ধ পাচ্ছি, জবাব দিল এক-তাঙ। আমার মনে সন্দেহের লেশমাত্র নেই যে সে-ই এই বিক্ষোভে উস্কানি দিয়েছে। সোজা মিশর থেকে এসেছে সে আর তাকে জাররিতে স্বাগত জানানোর পর মাত্র দুশো বছরের মধ্যেই আবার বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে আমাদের দেশে।

দুইশো বার বছর, শুধরে দিল আকের।

দুশো বার বছর, সায় দিল এক-তাঙ, কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তির সুর। কিন্তু এইসব পণ্ডিতিতে কোনও ফায়দা হবে না। বিদ্রোহে উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে কী করা যেতে পারে?

আপনি জানেন তাইতা দেবীর বিশেষ অতিথি, তিনি তাঁর সাথে দেখা করতে পাহাড়ে গেছেন। ইয়োস যাদের ডেকে পাঠান তারা আর ফিরে আসে না। আমাদের ওর কথা ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই। ওকে আর কোনওদিনই দেখতে পাবেন না। যাদের সে জাররিতে নিয়ে এসেছিল অচিরেই তাদের পাকাড়াও করা হবে- থেমে গেল আকের, রাগী চেহারা পরিষ্কার হয়ে গেল। তার রক্ষিতা, যাকে সে ফেন নামে ডাকে, আমার বিশেষ সমাদর পাবে। ওর আভায় লালসার বিচ্ছুরণ দেখতে পেল তাই।

মেয়েটা কি যথেষ্ট বড় হয়েছে? জানতে চাইল এক-তাঙ।

আমার জন্যে ওরা সব সময়ই যথেষ্ট বড়, বলে একটা ইঙ্গিত করল আকের।

আমাদের যার যার আলাদা রুচি আছে, সায় দিল এক-তাঙ। এটা ঠিক, আমরা সবাই একই জিনিসে মজা পাই না। উঠে দাঁড়াল দুই অলিগার্ক, তারপর হাতে হাত রেখে বের হয়ে গেল। ডাইনীর খাস কামরায় চলে এলো তাইতা, তারপর দরজা আটকে ফেনের জন্যে প্রথমবারের মতো মন্ত্র উচ্চারণ করল। বলতে গেলে সাথে সাথে মনের চোখে তার নিদর্শন চলে এলো। চাপা মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও। আমি এসে গেছি।

আগেও তোমাকে ডেকেছিলাম। তুমি কি বিপদে আছো?

আমরা সবাইই বিপদে আছি, জবাব দিল সে। কিন্তু আপাতত নিরাপদ। দেশে এখন দারুণ ঝামেলা চলছে। তুমি কোথায়, তাইনা?

পাহাড় থেকে পালিয়ে এসেছি, এখন সুপ্রিম কাউন্সিল চেম্বারের কাছে গা ঢাকা দিয়ে আছি।

এমনকি ইথারেও তার বিস্ময় স্পষ্ট বোঝা গেল। ওহ, তাইতা, তুমি কোনওদিনই আমাকে অবাক করতে আর আনন্দ দিতে ব্যর্থ হও না।

আমাদের দেখা হলে কথা দিচ্ছি তোমার জন্যে আরও অনেক মজার ব্যবস্থা করব, কথা দিল ও। তুমি আর মেরেন কি আমার কাছে আসতে পারবে, নাকি আমাকেই তোমাদের খোঁজ করতে হবে?

আমরাও লুকিয়ে আছি, তবে তোমার কাছ থেকে মাত্র পাঁচ কি ছয় লীগ দূরে, জবাব দিল ফেন। বলো তোমার সাথে কোথায় দেখা করতে হবে।

দুর্গের উত্তরে পাহাড়ের পাদদেশ কুঁদে বানানো একটা সংকীর্ণ উপত্যকা আছে। পাহাড়ী পথ থেকে বেশি দূরে না। প্রাসাদের আনুমানিক তিন লীগ দূরে হবে। ঢোকার মুখটা পাহাড়ের ঢালের বাবলা গাছের একটা আকর্ষণীয় বাগান দিয়ে চিহ্ন দেওয়া। দূর থেকে দেখে ঘোড়ার মাথার মতো লাগে। এটাই সেই জায়গা, বলল তাইতা, তারপর ইথারে বনের একটা ছবি পাঠিয়ে দিল।

পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, জবাব দিল ফেন। সিদুদু চিনতে পারবে। না চিনলে আবার তোমাকে ডাকব। চট করে উপত্যকায় চলে যাও, তাইতা। এই জঘন্য জায়গা আর জাররিয়দের ক্রোধ থেকে পালানোর মতো বেশি সময় হাতে নেই।

দ্রুত খাসকামরায় অস্ত্র বা ছদ্মবেশের কোনও উপকরণ পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজ করল তাইতা। কিন্তু কিছুই পেল না। এখনও খালি পায়ে রয়েছে ও, পরনে মামুলি একটা টিউনিক, ধুলি-ময়লায় নোংরা, জ্বলন্ত লাভায় জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে। চট করে বাইরের দরজার কাছে এসে খালি দরবার হলে বের হয়ে এলো। তিনাত প্রথমবার যে পথে দুর্গে নিয়ে এসেছিল সেটা ধরে আবার বাইরে যাবার পথের পরিষ্কার স্মৃতি মনে আছে। করিডরে পা রেখে দেখল শাখা করছে ওটা। অলিগার্করা যাবার পর নিশ্চয়ই প্রহরীদের বিদায় করে দিয়েছে। দালানের পেছন দিকে চলল ও, পেছনের উঠোনের লম্বা ডাবল ডোরের কাছে পৌঁছে গেছে, এমন সময় ভরাট একটা কণ্ঠস্বর থামাল ওকে।

এই যে তুমি! দাঁড়াও, পরিচয় দাও।

তাড়াহুড়োয় চারপাশে আড়ালের জাদু তৈরি করতে ভুলে গিয়েছিল তাইতা। মুখে বন্ধুসুলভ হাসি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। এই বিশাল জায়গায় বোকা বনে গেছি, দয়া করে বাইরে যাবার পথটা বাৎলে দিলে খুশি হবো।

ওকে পথ দেখানো লোকটা ছিল দুর্গের পাহারাদারদের একজন, মাঝবয়সী পুরো ইউনিফর্ম পরা মারকুটে ধরনের সার্জেন্ট। তলোয়ার বের করে মারমুখী ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে তাইতার দিকে এগিয়ে এলো সে।

কে তুমি? আবার চিৎকার করে জানতে চাইল। চেহারা দেখে তো নোংরা চোর-বদমাশ বলে মনে হচ্ছে।

শান্ত হও, বন্ধু, হাসি মুখেই বলল তাইতা, শান্ত করার ভঙ্গিতে দুই হাত সামনে মেলে ধরল। কর্নেল ওনকার জন্যে জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছি।

কর্নেল আগেই চলে গেছেন, বাম হাত বাড়িয়ে দিল সার্জেন্ট। বার্তাটা আমাকে দাও, যদি মিথ্যা না বলে থাকো, আর সত্যিই তেমন কিছু যদি তোমার কাছে থাকে। ওটা যেন তিনি পান, দেখব আমি।

পাউচ হাতড়ানোর ভান করল তাইতা, কিন্তু লোকটা কাছে আসতেই ওর কব্জি আঁকড়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে বেসামাল করে দিল তাকে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সার্জেন্টও পাল্টা টান লাগাল। কিন্তু তাতে বাধা না দিয়ে উল্টে সামনে এগিয়ে গেল তাইতা, লোকটার বুকের উপর দুই হাতের কনুইসহ পড়ে যাবার কাজে লাগাল গতিটাকে। বিস্ময়সূচক আওয়াজ করে ভারসাম্য হারাল লোকটা, হেলে পড়ল পেছনে। চিতার ক্ষিপ্রতায় তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তাইতা, ডান হাত মুঠি পাকিয়ে চিবুকের নিচে জোরসে আঘাত হানল। সশব্দে ভেঙে গেল সার্জেন্টের কশেরুকা, নিমেষে মৃত্যু ঘটল তার।

তারপাশে হাঁটু গেড়ে বসে হেলমেট খুলে নিতে শুরু করল তাইতা, ওর পোশাকটাকেই ছদ্মবেশ হিসাবে কাজে লাগানোর ইচ্ছে, কিন্তু মাথা থেকে হেলমেটটা খোলার আগেই আরেকটা চিৎকার শোনা গেল। তলোয়ার বাগিয়ে আরও দুজন প্রহরী তেড়ে এলো ওর দিকে। হামলাকারীদের মোকাবিলা করতে লাশের হাত থেকে তলোয়ারটা ছিনিয়ে নিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়াল তাইতা।

ডান হাতে তলোয়ারটা নাচাল। ভারি পদাতিক বাহিনীর মডেল ওটা, কিন্তু পরিচিত ঠেকছে; হাতের মুঠিতে স্বস্তিকর লাগছে। অনেক বছর আগে ফারাওর রেজিমেন্টের অস্ত্রশস্ত্রের ম্যানুয়াল লিখেছিল ও, তলোয়ার চালনা ছিল ওর অন্যতম আবেগের বিষয়। তারপর বয়স ওর ডান হাতের শক্তি কেড়ে নিয়েছিল, কিন্তু এখন তা আবার ফিরে এসেছে, ঠিক ওর পায়ের ক্ষিপ্রতা ও দ্রুততার মতো। প্রথম আক্রমণকারীর ধাক্কাটা সামলে দুনম্বরের আক্রমণ বাউলি কেটে এড়িয়ে গেল ও। মাথা নিচু রেখেই লোকটার গোড়ালির পেছনে কোপ বসাল। নিপূণভাবে অ্যাকিলিসের বাঁধন কেটে দিল। পরক্ষণেই সোজা হয়ে হানাদাররা সামলে ওঠার আগেই বিস্ময়করভাবে ওদের মাঝখানে পাক খেতে শুরু করল। ওকে অনুসরণ করতে ঘুরে দাঁড়াল অক্ষত লোকটা, কিন্তু তাতে উল্টে নিজের পাঁজর উন্মুক্ত করে দিল। সুযোগটা লুফে নিয়ে ওর বগলতলায় ঢুকিয়ে দিল তলোয়ারের ডগা, পাঁজরের ফাঁকে পিছলে ঢুকে গেল ওটা। কব্জি ঘুরিয়ে ক্ষতস্থানের ভেতরেই পাক খাওয়াল ওটাকে, ফাঁকটাকে বড় করে তুলল। মাংসের টান থেকে মুক্ত করে নিয়ে এলো ওটাকে। কাশির সাথে রক্ত উগড়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ওর শত্রু। পাই করে ঘুরে পঙ্গু করে দেওয়া শত্রুর মোকাবিলা করবে বলে সরে গেল তটাটা।

আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে গেছে লোকটা, পিছু হটার প্রয়াস পেল সে, কিন্তু অচল পাটা সাড়াহীন থপথপ করে শব্দ করছে, পড়ে যাবার দশা হলো তার। ওর মুখে আঘাত করার ভান করল তাইতা, লোকটা চোখ বাঁচাতে ঢাল উঁচু করতেই ওর পেটে তলোয়ার চালিয়ে দিল, পরক্ষণেই ওটা বের করে এক লাফে পিছিয়ে এলো। অস্ত্র ফেলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল লোকটা। ফের সামনে বাড়ল তাইতা, লোকটার ঘাড়ের পেছনে ঠিক হেলমেটের নিচে তলোয়ার বসিয়ে দিল। উপুড় হয়ে লুটিয়ে পড়ল সেনাটি, অনড় হয়ে রইল।তাত

লাশ দুটোর উপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাইতা, তারপর প্রথম যাকে মেরেছে তার কাছে এলো। অন্যদের মতো এর ইউনিফর্মে রক্তের দাগ লাগেনি। ঝটপট তার পায়ের স্যান্ডেল খুলে নিজের নগ্নপায়ে ফিতে দিয়ে বেঁধে নিল। কোনওমতে লেগে গেল। তলোয়ারের বেল্ট ও খাপ কোমরে জড়িয়ে নিয়ে। তারপর হেলমেট ও জোব্বা তুলে নিয়ে পেছন দরজার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতেই গায়ে চাপাল ওগুলো। ওর ছেঁড়া, ময়লা টিউনিক ঢাকতে রক্ত লাল জোব্বাটা ঠিক করে নিল। দরজার দিকে এগোনোর সময় ওখানকার প্রহরীদের মন অবশ করে দিতে ভাব পাঠাল ও। ওদের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না ওরা, মার্বলের সিঁড়ি বেয়ে প্রাঙ্গণে চলে এলো ও।

ওনকার রেজিমেন্টের লোকজন ও ঘোড়ায় গিজগিজ করছে প্যারেডগ্রাউন্ড, অভিযানে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে ওরা। খোদ ওনকাকে দেখতে পেল তাইতা, চিৎকার করে নানা হুকুম ঝাড়ছে দলের ক্যাপ্টেনদের। ভিড়ে মিশে গিয়ে আস্তাবলের দিকে যাবার সময় ওনকার অনেকটা কাছে চলে এলো ও। ওনকা ওর দিকে তাকালেও চেনার কোনও অভিব্যক্তি দেখা গেল না তার মাঝে।

কারও চোখে ধরা না পড়ে আস্তাবল আঙিনায় পৌঁছে গেল তাইতা। এখানে রীতিমতো দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড শুরু হয়েছে। ফেরিয়াররা ঘোড়ার পায়ে নতুন নাল পরাচ্ছে। অস্ত্রনির্মাতারা গ্রিন্ডস্টোনে বর্শার ফলা ও তলোয়ার ধার করতে ব্যস্ত আর অফিসারদের ঘোড়া সাজাচ্ছে সহিসরা। সারি থেকে একটা ঘোড়া চুরি করার কথা ভাবল তাইতা, কিন্তু বুঝতে পারল তেমন কোনও মতলব হাসিল হওয়ার তেমন কোনওই সম্ভাবনা নেই। তাই প্রাসাদ চৌহদ্দীর পেছনের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল ও।

দুর্গন্ধ দালানকোঠার আড়ালে ল্যাট্রিনের কাছে নিয়ে এলো ওকে। ল্যাট্রিনের খোঁজ পাওয়ার পর কেউ ওকে দেখেনি নিশ্চিত হতে আশপাশে নজর চালাল। মাথার উপরের দেয়ালে পাহারা দিচ্ছে এক প্রহরী। বিকল্পের অপেক্ষা করতে লাগল ও। সেটা মিলবেই, কোনও সন্দেহ নেই ওর মনে। অচিরেই দুর্গের দিক থেকে ক্রুদ্ধ চিৎকার ভেসে এলো। হুইসল বেজে উঠল, ঢাকের শব্দ সৈন্য তলব করল। প্যাসেজে ফেলে আসা লাশ তিনটা আবিষ্কৃত হয়েছে। সেনাছাউনীর পুরো মনোযোগই এখন দুর্গের দিকে। প্যারাপেটের যেখানে পাহরা দিচ্ছিল সেখান থেকে দূরের প্রান্তের দিকে ধেয়ে গেল শাস্ত্রী। ওখান থেকে প্যারেডগ্রাউন্ডের উপর দিয়ে এমনি হাঁকডাকের কারণ বোঝার প্রয়াস পেল। ওর দিকে পেছন ফিরে আছে।

ল্যাট্রিনের চ্যাপ্টা ছাদে উঠে এলো তাইতা। এখান থেকে দেয়ালের চূড়া একদম হাতের নাগালে। এক দৌড়ে প্যারপেটের কিনারার উদ্দেশ্যে লাফ দিল ও। তারপর দুহাতে নিজেকে তুলে এনে একটা পা উপরে তুলে দিল। দেয়ালের চূড়ার উপর গড়ান দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়ল। দীর্ঘ পতন, কিন্তু পা তৈরি রেখে পতনের ধাক্কা সামাল দিল। চট করে এপাশ ওপাশ তাকাল। শাস্ত্রী এখনও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বনের ধারটা এখন অনেক কাছে, খোলা। প্রান্তরের উপর দিয়ে গাছপালার দিকে দৌড় লাগাল ও। এখানে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে স্থির করে নিল নিজেকে। তারপর হুট করে যাতে কারও চোখে ধরা না পড়ে, তাই ফোকর, লম্বা লম্বা ঘাস ও গুল্মের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে খাড়া পাদদেশ বেয়ে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর কিনারার উপর দিয়ে সাবধানে নজর চালাল। মেঘ-বাগিচার দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা রয়েছে ঠিক ওর নিচেই। জনহীন। দৌড়ে ওটা পার হলো। একটা গুল্মের কেঁপে গা ঢাকা দিল। এখান থেকে পরের ফাঁকা জায়গায় ঘোড়ার মাথার আকৃতির গাছপালা দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে খাড়া ঢাল বেয়ে উপত্যকায় নেমে এলো ও। পায়ের নিচে গড়ান খাচ্ছে আলগা পাথর। ভারসাম্য না হারিয়ে নিচে পৌঁছাল ও। পাহাড়ের পায়ের কাছ দিয়ে ছুটতে ছুটতে একটা খোলা জায়গায় হাজির হলো। উপত্যকার দুধার খাড়া, কিছুটা পথ সামনে এগিয়ে তারপর ঘুরে ঢোকার পথের দিকে নজর রাখার মতো একটা জায়গায় এলো, অপেক্ষা করতে লাগল।

সর্বোচ্চ বিন্দুতে উঠে এলো সূর্যটা, তারপর হেলে পড়তে শুরু করল দিগন্তে। উপত্যকার উল্টোদিকের পথে ধুলো দেখতে পেল ও। মনে হচ্ছে যেন এক বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী পুব দিকে ধেয়ে আসছে। এক ঘণ্টার মতো কেটে গেল। তারপর আগুয়ান ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এলো। সতর্ক হয়ে উঠে বসল ও। ওর ঠিক নিচে ছোট একদল ঘোড়াসওয়ার এসে থামল। সবার সামনে সিদুদু, একটা চেস্টনাট পনিতে চেপেছে। হাত তুলে তাইতার আত্মগোপনের জায়গাটা দেখাল সে। গোড়ার পেটে স্পর দাবিয়ে তাকে পেছনে ফেলে সামনে চলে এলো মেরেন। দুলকি চালে ওর পেছন পেছন এগোলে বাকি দলটা। মেরেনের সাথে সুন্দরী এক তরুণী, একটা ধূসর কোল্টের পিঠে সওয়ার হয়েছে সে। ওর লম্বা পা নগ্ন, কাঁধের উপর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে সোনালি চুল। ছিপছিপে গড়ন, কাঁধজোড়া গর্বিত ভঙ্গিতে বসানো। এমনকি দূর থেকেও তাইতা ওর ব্লিচ করা লিনেনের নিচে সুগঠিত বুকের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। হাওয়ার দমকে সোনালি চুল সরে গিয়ে চেহারা উন্মুক্ত করে দিল। লম্বা দম টানল তাইতা। ফেন, কিন্তু যাকে ও ভালোবাসত, চিনত তার চেয়ে ভিন্ন। এটা আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ় তরুণী, সৌন্দর্যের প্রথম কুঁড়িতে রয়েছে।

ধূসর কোল্ট হাঁকাচ্ছে ফেন, পেছনে লাগাম ধরে টেনে নিয়ে আসছে উইন্ডস্মোককে। ওর ডান পাশে রয়েছে হিলতো। খুব কাছ থেকে ওদের অনুসরণ করছে নাকোন্তো ও ইম্বালি-ও দূরে থাকার মাসগুলোতে অনেক কায়দা কানুন শিখে নিয়েছে ওরা। যেখানে বসে ছিল সেই চাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক্লিফ বেয়ে নামতে শুরু করল তাইতাতো। এক লাফে শেষ ফাঁকা জায়গাটা থেকে নেমে এলো ও। লাল জোব্বাটা ডানার মতো খুলে গেল চারপাশে। কিন্তু চামড়ার হেলমেটের ভাইজর আড়াল করে রেখেছে ওর চেহারার উপরের অংশ। ঠিক মেরেনের পথের উপরই নেমে এসেছে ও।

জাররিয় ইউনিফর্ম দেখে প্রশিক্ষিত যোদ্ধার রিফ্লেক্সে ভয়াল চিৎকার ছেড়ে ওর দিকে তেড়ে এলো মেরেন। তলোয়ার বের করে হাওয়ায় দোলাচ্ছে। কোনওমতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের অস্ত্র বের করার মতো সামান্য সময়টুকুই পেল তাই। স্যাডল থেকে সামনে ঝুঁকে ওর মাথা বরাবর তলোয়ার চালাল মেরেন। তলোয়ারের ফলায় আঘাত ঠেকিয়ে এক পাশে সরে গেল তাইতা। লাগাম টেনে ঘোড়াটাকে প্রায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে নিল মেরেন। ফের তেড়ে এলো ওর দিকে। মাথা থেকে হেলমেট ছিঁড়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল তাইতা। মেরেন! আমি তাইতা, চিৎকার করে বলল ও।

মিথ্যা কথা! ম্যাগাসের সাথে তোমার কোনও মিলই নেই! গতি থামাল না মেরেন। স্যাডল থেকে সামনে ঝুঁকে তলোয়ারের ফলা নিশানা করল। তাইতার বুক বরাবর স্থির হয়ে আছে ওটা। শেষ মুহূর্তে বাউলি কেটে সরে গলে তাইতা, ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় মেরেনের তলোয়ারের ফলা ওর কাঁধে আঁচড় বসিয়ে গেল।

ফেন সামনের দিকে ধেয়ে যাবার সময় ওর উদ্দেশে চিৎকার করল তাইতা, ফেন! আমি তাই।

না, না! তুমি তাইতা নও! ওর কী করেছ? পাল্টা আর্তনাদ করল ফেন। ওদিকে নিজের ঘোড়া ঠিক করে নিচ্ছে মেরেন। আবার হামলা শানাতে মাথা ঘুরিয়ে নিচ্ছে ওটার। কাঁধের উপর বর্শা ফেলে রেখেছে নাকোন্তো, মেরেনের উপর দিয়ে ছোঁড়ার সুযোগপাওয়া মাত্রই ছুঁড়ে দিতে তৈরি। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামল ইম্বালি, সামনে তেড়ে আসার সময় সবেগে হাঁকাতে লাগল যুদ্ধ কুড়োলটা। তলোয়ার বের করে তেড়ে এলো হিলতো। যার যার তুনে তীর সাজাচ্ছে ফেন ও সিদুদু।

রাগে রুবি পাথরের মতো চকচক করছে ফেনের চোখ। ওকে শেষ করে দিয়েছ তুমি, শয়তান! চিৎকার করে উঠল ফেন। তোমার কুৎসিত হৃৎপিণ্ডে একটা তীর পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

ফেন! আমার আত্মার চিহ্ন দেখ! তেনমাস ভাষায় তাগিদের সুরে বলে উঠল তাইতা। ঝট করে চিবুক উঠে এলো ফেনের। তারপরই তাইতার মাথার উপর আহত বাজপাখী উড়ে বেড়াতে দেখল ও। প্রবল ধাক্কায় হেঁচকি খেল। না! না! এটা ওই! তাইতা! আমি বলছি তলোয়ার সামলে রাখ! রেখে দাও, মেরেন! বাঁক নিল মেরেন, লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল।

ওয়ার্লউইন্ডের পিঠ থেকে ঝট করে নেমে তাইতার কাছে ছুটে গেল ফেন। দুই হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ভাঙা মনে কাঁদতে শুরু করল। ওহ! ওহ! ওহ! আমি ভেবেছি তুমি মরে গেছ। ভেবেছি ওরা তোমাকে মেরে ফেলেছে।

শক্ত করে ওকে বুকে চেপে রাখল তাইতা, কোমল ও আড়ষ্ট ঠেকল ওর দেহ। ওর দেহের সৌরভ ওর নাক ভরিয়ে দিল, ইন্দ্রিয়তে কাঁপন লাগল। বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। নীরবে প্রবলভাবে পরস্পরকে ধরে থাকল ওরা, এদিকে বিস্ময়ে ওদের দিকে চেয়ে রইল অন্যরা। হিলতো ওর স্বভাবসুলভ নিস্পৃহ ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করলেও তাতে সফল হলো না। নাকোন্তো ও ইদালি ডাইনীর ভয়ে চুপ মেরে গেছে। অশুভ আত্মার বিরুদ্ধে ডানে বামে থুতু ছিটাল ওরা।

এটা তিনি নন, বলে চলেছে মেরেন। অন্য যেকারও চেয়ে ম্যাগাসকে ঢের ভালো করে চেনা আছে আমার। এই তরুণ ছোকরা তা নয়।

অনেকক্ষণ বাদে পেছনে সরে দাঁড়াল ফেন, সামনে ধরে রাখল তাইতাকে। মুগ্ধ চোখে ওর চেহারা পরখ করল। তারপর ওর চোখের দিকে তাকাল। আমার চোখ বলছে তুমি সে নও, কিন্তু হৃদয়ে সুর উঠছে যে তুমিই। হ্যাঁ, এটা তুমি। নিশ্চয়ই তুমি। কিন্তু, হে প্রভু, কীভাবে এমন তরুণ আর বিস্ময়কর সুদর্শন হয়ে গেলে? ওকে চুমু খেতে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়াল ও। এই সময় অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়ল।

এক লাফে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ওদের সাথে যোগ দিতে ছুটে এলো মেরেন। ফেনের আলিঙ্গন থেকে তাইতাকে কেড়ে নিয়ে শক্ত করে জাড়িয়ে ধরল।

এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না! এ অসম্ভব! হেসে ফেলল সে। কিন্তু আমি নিজে সাক্ষী দিচ্ছি, দারুণ তলোয়ার চালাতে পারেন আপনি, ম্যাগাস, নইলে আপনাকে ফানা-ফানা করে ফেলতাম। উত্তেজিতভাবে ওকে ঘিরে ধরল ওরা।

ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সিদুদু। আপনার কাছে আমার অনেক ঋণ, ম্যাগাস। আপনি নিরাপদে আছেন দেখে খুশি হয়েছি। এর আগে আত্মার দিক থেকে সুন্দর ছিলেন আপনি, এখন দেহেও সুন্দর হয়ে উঠেছেন।

এমনকি নাকোন্তো ও ইদালি পর্যন্ত ওদের কুসংস্কারজাত ভয় জয় করে সবিস্ময়ে ওকে স্পর্শ করতে এগিয়ে এলো।

সজোরে চিৎকার করে উঠল হিলতো, আপনার ফেরার ব্যাপারে আমার মনে এক মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ জাগেনি। চোখে পড়ামাত্র বুঝে গিয়েছি, আপনিই এসেছেন। এমন ডাহা মিথ্যাচার আমলে নিল না কেউ।

বিশটা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় জবাব দাবি করল মেরেন। ওর ডান হাত আঁকড়ে থাকল ফেন। চকচকে চোখে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে।

অবশেষে ওদের রূঢ় বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনল তাইতা। এসবের জন্যে পরেও সময় পাওয়া যাবে। এখন তোমাদের এটুকু জানলেই চলবে যে, ইয়োস আর কোনওদিনই আমাদের বা আমাদের প্রিয় মিশরের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। শিস বাজিয়ে উইন্ডস্মোককে ডাকল ও। ওর দিকে তাকিয়ে ছিনালের ভঙ্গিতে চোখ পাকাল ওটা। সামনে এসে ওর ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগল। তুই অন্তত আমাকে চিনতে পেরেছিস, প্রিয়া আমার, ওটার ঘাড় জাড়িয়ে ধরে সোহাগ করল ও। তারপর ফের মেরেনের দিকে তাকাল। তিনাত কোথায়?

ম্যাগাস, আগেই কিতানগালে নদীর উদ্দেশে পথে নেমেছে ও। জাররিয়রা আমাদের পরিকল্পনার কথা জেনে গেছে। জলদি রওয়ানা দিতে হবে আমাদের।

উপত্যকা থেকে বেরিয়ে সমতলের দিকে যখন রওয়ানা দিল, তখন সূর্য পাটে যেতে বসেছে। বনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রীতিমতো অন্ধকার হয়ে এলো। ফের ওদের পথ দেখানোর দায়িত্ব নিল সিদুদু। তারা দেখে পথ পরখ করল তাইতা, বুঝতে পারল মেয়েটার এলাকা সম্পর্কে জ্ঞান ও দিক সংক্রান্ত ধারণা নির্ভুল। ফলে ফেন ও মেরেনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারল ও। তাইতাকে মাঝখানে রেখে পাশাপাশি আগে বাড়ল ওরা তিনজন। ওদের বিচ্ছিন্ন করা সময়টুকুতে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিল মেরেন, এই সময় ঘোড়ার স্পর পরস্পরের সাথে ঘষা খেয়ে চলল।

অবশেষে তাইতা বলল, প্রাসাদে থাকার সময় আকেরের যুদ্ধ সভায় আড়িপেতে ছিলাম। নিজে হাতে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব তুলে নিচ্ছে সে। ওর স্কাউটরা পুব দিকে আমাদের মূল দলের এগিয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে তাকে। তিনাতের কিতানগালে নদীর মাথায় জাহাজঘাটে পৌঁছানোর চেষ্টা করার কথা সে জানতে পেরেছে। ওখানে নৌকা দখল করবে সে। কারণ সে জানে নদী পথে জাররি থেকে সটকে পড়াই এখন আমাদের একমাত্র আশা। আমাকে বলল এই মুহূর্তে তিনাত ঠিক কোথায় আছে, আর কতজন লোক আছে ওর সাথে।

নয়শো জনের মতো লোক আছে ওর সাথে, কিন্তু পুরুষদের অনেকেই অসুস্থ ও খনির দুর্ব্যবহারের কারণে দুর্বল। লড়াই করার মতো শতিনেক লোক আছে ওর সাথে। বাকিরা মেয়ে ও শিশু।

তিনশো! বলে উঠল তাইতা। আকেরের সাথে আছে পাঁচ হাজার প্রশিক্ষণ পাওয়া যোদ্ধা। সে তিনাতের নাগাল পেলে বেশ ঝামেলায় পড়ে যাবে।

আরও খারাপ। তিনাতের ঘোড়ার অভাব রয়েছে। বাচ্চাদের কেউ কেউ অনেক ছোট। অসুস্থ আর শিশুদের নিয়ে ধীরে এগোতে হচ্ছে ওকে।

ওর উচিত নৌকো দখল করতে লড়াইয়ের জন্যে ছোটখাট একটা দল পাঠানো। এই অবসরে আমাদের অবশ্যই আকেরকে দেরি করিয়ে দিতে হবে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল তাইতা।

কিতানগালে গ্যাপে ওকে ঠেকানোর আশা করছে তিনাত। ওখানে পঞ্চাশ জন লোকই একটা গোটা সেনাদলকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে; অন্তত মহিলা ও অসুস্থরা নৌকায় না ওঠা পর্যন্ত, বলল মেরেন।

ভুলে যেয়ো না, আকেরের স্কাউটরা সিদুদুর মতোই এই দেশ চেনে, মনে করিয়ে দিল তাইতা। ওই গ্যাপ পাশ কাটানোর অন্য রাস্তার খবর নিশ্চয়ই জানা আছে ওদের। নৌকা-ঘাটে পৌঁছে যাবে ওরা। তার আসার অপেক্ষা না করে বরং আমাদেরই উচিত হবে তার প্রত্যাশার আগেই তাকে হামলা করা। তাই সিদুদুর নাম বলার সময় ওর দিকে তাকাল মেরেন। এমনকি চাঁদের আলোতেও ওর চেহারায় ফুটকি খেলছে। বেচারা মেরেন, বিখ্যাত প্রেমিক এখন খাপ খেয়ে গেছে, ভাবল তাইতা, মনে মনে হাসল, তবে মুখে বলল, আকেরকে ঠেকাতে এখনকার চেয়ে আরও বেশি লোক লাগবে আমাদের। আমি ওর অপেক্ষায় রাস্তা পাহারা দিতে রয়ে যাচ্ছি। মেরেন, ফেনকে তোমার সাথে নিতে হবে, যত তাড়াতাড়ি পারো তিনাতকে খুঁজে বের করতে–

আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না! বলে উঠল ফেন। তোমার এত কাছাকাছি এসেছি যেমনটা আর কোনওদিন পারব না।

আমি বার্তাবাহক নই, ম্যাগাস। আমাকে ওদের মতো করে দেখার চেয়ে খানিকটা বেশি সম্মান আশা করি আমি। ফেনের মতো আপনার সাথেই থাকছি আমি। হিলতোকে পাঠান, ঘোষণা করল মেরেন।

হাল ছাড়ার একটা ভঙ্গি করল তাইতা। কেউ কি বিনা তর্কে আমার নির্দেশ শুনবে না? রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।

মনে হয় না, সপ্রতিভভাবে জবাব দিল ফেন। তবে হিলতোর সাথে ঠাণ্ডা কণ্ঠে কথা বলে দেখতে পারো।

পরাজয় মানল তাইতা, হিলতোকে ডাকল। ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব ছুটে যাবে। কর্নেল তিনাত আনকুরকে খুঁজে বের করে ওকে বলবে আমি পাঠিয়েছি তোমাকে। বলবে আমাদের কিতানগালে নদীর দিকে যাওয়ার কথা আকের জানে, দ্রুত সেদিকে ছুটছে সে। জাররিয়রা ধ্বংস করে দেওয়ার আগেই লড়াকু একট দল পাঠাতে হবে তিনাতকে নৌকা ঘাটে নৌকা দখল করতে। আমাদের লোকজন ভালো একটা নৌকায় না ওঠা পর্যন্ত কিনাতগালে গ্যাপ দখল করে রাখতে বলবে ওকে। তবে ওর সেরা বিশ জন লোক পাঠাতে হবে আমার কাছে। হিলতো, তোমাকে অবশ্যই ওর লোকজন নিয়ে উপকূলের রাস্তা ধরে আমাদের সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত এগিয়ে আসতে হবে। এখন যাও! এখুনি! সালাম ঠুকল হিলতো, তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে দ্রুত চলে গেল।

আমাদের আসলে অ্যাম্বুশ পাতার মতো একটা জায়গা দরকার যেখানে আকেরের জন্যে ওত পেতে বসে থাকা যাবে। মেরেনের দিকে ফিরল তাইতা। আমরা কেমন জায়গা খুঁজছি জানো তুমি। সিদুদুকে জিজ্ঞেস করে দেখ তেমন জায়গা চেনে কিনা। স্পার দাবিয়ে সিদুদুর দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। মনোযোগের সাথে ওর অনুরোধ শুনল সে।

এমন একটা জায়গা চিনি, মেরেনের কথা শেষ হতেই বলল সিদুদু।

তুমি আসলেই বেশ চালাক, গর্বের সাথে ওকে বলল মেরেন। মুহূর্তের জন্যে পরস্পরের মাঝে হারিয়ে গেল ওরা।

তাহলে চলো, সিদুদু, বলল তাইতা। দেখাও মেরেনের কথা মতো সত্যিই চালাক কিনা তুমি।

ওদের পথ দেখাল সিদুদু, পথ ছেড়ে দক্ষিণ আকাশের একটা বিরাট তারাময় ক্রসের দিকে নিয়ে চলল। ঘণ্টাখানেকের ভেতর একটা নিচু গাছপালায় ভরা টিলার উপর লাগাম টেনে ধরল সে। চাঁদের আলোয় ওদের সামনে উন্মুক্ত উপত্যকার দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল।

ওই দেখা যায় ইশাসা নদীর ঘাট। জলের ঝিকিমিকি দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। কিতানগালে গ্যাপে পৌঁছাতে লর্ড আকেরের বেছে নেওয়া পথ ওদিক থেকে বাঁক নিয়েছে। পানি গম্ভীর হওয়ায় ঘোড়াগুলোকে সাঁতার কাটতে হবে। ক্লিফের চূড়া থেকে ওরা পানিতে নামার পর ওদের লক্ষ্য করে তীর আর পাথর ছুঁড়ে মারতে পারব আমরা। আরেকটা ঘাটে পৌঁছাতে ভাটির দিকে অন্তত পঞ্চাশ লীগ যেতে হবে ওদের।

সাবধানে নদীর ঘাট জরিপ করে মাথা দোলাল তাইতা। এর চেয়ে ভালো জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।

আগেই বলেছিলাম, বলল মেরেন। ভালো জায়গা চেনার মতো যোদ্ধার চোখ আছে ওর।

সিদুদু, সাথে তীর ধনুক রাখো, মাথা দুলিয়ে সিদুদুর কাঁধে ঝোলানো অস্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলল তাইতা। ব্যবহার জানো?

ফেন শিখিয়েছে, সহজ কণ্ঠে উত্তর দিল সিদুদু।

আপনার অনুপস্থিতিতে দক্ষ তীরন্দাজে পরিণত হয়েছে সিদুদু, নিশ্চিত করল মেরেন।

নদীর তীর ধরে ঘোড়াকে সাঁতরে নিয়ে এগোল ওরা, স্রোত বেশ খর। পুব পাড়ে পৌঁছে দেখল পথটা ক্লিফের ভেতর দিয়ে একটা সংকীর্ণ পাথুরে রেখা ধরে এগিয়েছে। কেবল এক সারিতে ঘোড়ার পক্ষে ওদিকে যাওয়া সম্ভব। ওটার উপরে উঠে গেল মেরেন ও তাইতা, তারপর ওখান থেকে নিচের জমিন নিরীখ করল।

হ্যাঁ, বলল তাইতা। কাজ হবে।

ওদের বিশ্রামের অনুমতি দেওয়ার আগে অ্যাম্বুশ পাতার পরিকল্পনা খতিয়ে দেখল ও, প্রত্যেককে নির্ধারিত ভূমিকা পুনরাবৃত্তি করতে বলল। কেবল তারপরই ঘোড়ার পিঠ থেকে জিন-লাগাম খসানোর অনুমতি দিল ওদের। ঘেঁতলানো ধুরা খাবারে ওগুলোর নাকের থলে ভরে ছেড়ে দিতে বলল।

বিনা আগুনের শিবির, কারণ আগুন জ্বালানোর অনুমতি দিতে রাজি হয়নি তাইতা। ধুরা পিঠা ও ভয়াবহ ঝাল মরিচে ভেজানো ঠাণ্ডা ছাগলের মাংসের রোস্ট খেল ওরা। খাওয়া শেষ হতেই বর্শা তুলে নিয়ে রাস্তায় পাহারা দিতে এগিয়ে গেল নাকোন্তো। ওকে অনুসরণ করল ইম্বালি।

এখন ওর মেয়েমানুষ সে, ফিসফিস করে তাইতাকে বলল ফেন।

তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, তবে অন্তত একটা চোখ পথের দিকে রাখার ব্যাপারে ওর উপর বিশ্বাস রাখতে হবে আমাকে, শুষ্ক কণ্ঠে বলল তাইতা।

ওরা প্রেমে পড়েছে, বলল ফেন। ম্যাগাস, তোমার মনে কোনও প্রেম ভালোবাসা নেই। ওয়ার্লউইন্ডের পিঠ থেকে বিছানাপত্র নামাতে চলে গেল ও। অন্যদের থেকে বেশ দূরে একটা পাথুরে আউটপের ছায়ায় শোয়ার মতো একটা জায়গা বেছে নিল ও। তারপর একটা পশমের কারোসের সাথে জমিনে বিছাল মাদুরটা।

তারপর তাইতার কাছে ফিরে এলো ও। এসো। হাত ধরে মাদুরের কাছে নিয়ে গেল ওকে, টিউনিক খুলতে সাহায্য করল, ওটাকে গোল করে নাকের কাছে ধরল। বেশ জোরাল গন্ধ, মন্তব্য করল ও। সুযোগ পেলেই ধুয়ে দেব। মাদুরের উপর ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। কারোস দিয়ে ঢেকে দিল ওকে। এবার নিজের টিউনিকও খুলে ফেলল। কারোসের নিচে ওর পাশে শুয়ে পড়ল ও। ওর শরীরে শরীর ঠেকাল।

তুমি ফিরে আসায় দারুণ খুশি হয়েছি, ফিসফিস করে বলল ও, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খানিক পরে নড়ে উঠল ও, ফিসফিস করে বলল, তাইতা।

কী?

আমাদের সাথে ছোট এক আগম্ভক রয়েছে।

এখন তোমাকে ঘুমাতে হবে। খানিক পরেই ভোর হয়ে যাবে।

একটু পরেই ঘুমাচ্ছি, অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল ও, এই সময় তাইতার সতর্ক হয়ে ওঠা শরীরে তল্লাশি চালাল ও। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, তাইতা, কোত্থেকে এলো ওটা? কেমন করে ঘটল?

অলৌকিকভাবে। ঠিক যেভাবে আমার চেহারা বদলে গেছে। সব পরে খুলে বলব। এখন ঘুমাতে হবে। তোমাদের পরিচিত হয়ে ওঠার আরও অনেক সময় মিলবে।

ঘুমে ঢলে পড়ল ফেন। কিন্তু তাইতার আরও খানিকটা বেশি সময় লাগল।

মনে হলো যেন কয়েক মিনিটও কাটেনি, ওকে জাগিয়ে তুলল নাকোন্তা। কী ব্যাপার? উঠে বসল তাই।

পশ্চিম থেকে ঘোড়সওয়ারের দল আসছে।

নদী পেরিয়েছে ওরা?

না। ওপাড়ে থেমেছে। মনে হয় এমনি অন্ধকারে নদী পেরুনোর ইচ্ছে নেই।

অন্যদের জাগিয়ে দাও, স্যাডল চাপাও ঘোড়ার পিঠে, তবে সবকিছু করবে চুপচাপ। নির্দেশ দিল তাইতা।

ভোরের ক্ষীণ ঝিলিক দেখা দিতেই ঘাটের ঠিক উপরে ক্লিফের কিনারায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল তাইতা। মেয়ে দুটো রয়েছে ওর দুপাশে। নদীর অন্য পাড়ে জাররিয় শিবিরে ব্যস্ততা চোখে পড়ছে। পাহারা দেওয়ার আগুনে লাকড়ি দিচ্ছে সৈনিকরা। মাংস পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে ওদের তিনজনের দিকে। লোক সংখ্যা গোণার মতো যথেষ্ট অলো ফুটেছে এখন। মোটামুটি তিরিশ জন সৈনিক শুনল তাইতা। রান্নার আগুনের কাছে রয়েছে কয়েকজন, অন্যরা আস্তবলের কাছে ঘোড়ার যত্ন নিচ্ছে। আরও কয়েক জন ঝোপে-ঝাড়ে যার যার ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত। অচিরেই ওদের চেহারা বোঝার মতো যথেষ্ট ফর্শা হয়ে এলো চারপাশ।

ওই যে ওনকা, ফিসফিস করে হিংস্র কণ্ঠে বলল সিদুদু। ওহ, ওই চেহারা আমার চেনা আছে।

তোমার মনের ভাব বুঝতে পারছি, পাল্টা ফিসফিস করে বলল ফেন। প্রথম সুযোগেই ওর সাথে ফয়সালা করব আমরা।

আমি সেই প্রার্থনাই করছি।

ওই যে আকের, আর ওর সাথে ওটা এক-তাঙ, ওদের দেখিয়ে বলল তাইতা। অন্যদের চেয়ে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে দুই অলিগার্ক। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ধূমায়িত বাটি থেকে খাচ্ছে। নিজেদের সামলাতে পারেনি। রেজিমেন্টের অনেক সামনে এসে পড়েছে। অচিরেই নদী পেরুতে শুরু করবে। আর সেটা করলেই সুযোগ মিলে যাবে আমাদের। যদি না পেরোয়, হিলতো যতক্ষণ আমাদের জন্যে রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে না ফিরছে ওদের পিছে ছায়ার মতো লেগে থাকব।

এখান থেকেই আকেরের বুকে তীর সেঁধিয়ে দিতে পারি আমি, চোখ সরু করে বলল ফেন।

অনেক লম্বা পাল্লা, সকালের হাওয়া সাধারণত বেইমানি করে, প্রিয়া আমার। ওর বাহুতে হাত রেখে ওকে বিরত রাখল তাইতা। সতর্ক করে দিলে সুবিধাটা ওদের হাতে চলে যাবে। চারজন লোককে বাছাই করে ওনকা ওদের সংক্ষেপে হুকুম দেওয়ার সময় চোখ রাখল ওরা। নদীর ঘাটের দিকে ইঙ্গিত করে কথা বলছে। সে। যার যার ঘোড়ার দিকে দৌড়ে গেল লোকগুলো, চেপে বসল পিঠে, তারপর দুলকি চালে নদীর কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইশারায় মেরেনকে ওদের কর্মকাণ্ডের কথা জানাল তাই।

চারটে ঘোড়া সঁতরে নদীর মাঝামাঝি আসার আগে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, পায়ের নিচে মাটির দেখা মিলতেই লাফিয়ে সামনে ছুটে এলো ওগুলো। পানি ছেড়ে উঠে এলো। পশম আর সরঞ্জাম থেকে পানি ঝরছে। সাবধানে আশপাশে নজর চালাল স্কাউটরা, তারপর সংকীর্ণ পথরেখা ধরে আগে বাড়ল। গা ঢাকা দিয়ে রইল মেরেন ও ওর লোকজন। যেতে দিল ওদের। নদীর ওপাড়ে তিনটা সারিতে দাঁড় করানো হয়েছে ওনকার বাকি লোকজনকে। যার যার ঘোড়ার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। অপেক্ষা করছে।

অবশেষে খুরের খটাখট শব্দ শোনা গেল, স্কাউটদের একজন পথরেখা ধরে ছুটে এসে দৌড়ে গেল নদীর পাড়ের দিকে। ওখানে থেমে মাথার ওপর হাত নেড়ে ইশারা করতে লাগল। এখানে সব পরিষ্কার! চিৎকার করে বলল সে। লোকজনকে চেঁচিয়ে হুকুম দিল ওনকা। ঘোড়ার পিঠে উঠে এক সারিতে নদীর ঘাটের দিকে এগোতে শুরু করল ওরা। পেছনের প্রহরীদের সাথে রয়ে গেল ওনকা, ওখান থেকে নদী পারাপার ভালো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু আকের ও এক-তাকে সামনের কাতারে দেখে অবাক হলো তাই। এটা আশা করেনি। ভেবেছিল কলামের মাঝখানে অবস্থান নেবে ওরা, যেখানে চারপাশের লোকদের প্রতিরক্ষার ভেতরে থাকতে পারবে।

ওদের কায়দামতো পেয়ে গেছি মনে হয়। উত্তেজনায় কঠিন ওর কণ্ঠস্বর। মেরেনকে তৈরি হতে ইঙ্গিত করল ও। কলামের মাথায় দুজন অলিগার্ক ঘোড়ার পেটে স্পর দাবিয়ে পানিতে নেমে এলো। মাঝামাঝি এসে সাঁতার কাটতে শুরু করল ওরা। স্রোতের ধাক্কায় ভাটির দিকে সরে যাওয়া সারিটা শক্ত গঠন ধরে রাখতে পারল না।

তৈরি হও! মেয়ে দুটোকে সতর্ক করল তাইতা। অলিগার্ক ও ওদের পেছনের তিন ঘঘাড়সওয়ারকে তীরে পৌঁছতে দাও, তারপর আর কেউ অনুসরণ করার চেষ্টা করলেই তীর ছুঁড়বে। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে, ওনকা ওর লোকজনকে ফের ভাগ করার আগেই আমরা অলিগার্কদের মূল দল থেকে আলাদা করে ফেলতে পারব, আমাদের দয়ার পাত্রে পরিণত হবে ওরা।

স্রোত বেশ শক্তিশালী, কলামের মাঝখানে বেশ বড় একটা ফোকর তৈরি হয়েছে।

তোমাদের তীর তৈরি করো! শান্ত কণ্ঠে নির্দেশ দিল তাইতা। পিঠের তুনের দিকে হাত বাড়াল মেয়েরা। আকেরের ঘোড়া জমিনের স্পর্শ পেতেই হাঁচড়ে পাছড়ে তীরে উঠে এলো। এবার সারিতে একটা ফোকর তৈরি হলো। কলামের অবশিষ্ট অংশ এখনও নদীর ওপারে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে।

এইবার! চিৎকার করে উঠল তাইতা। সামনে যারা আছে তাদের পেছনের ঘোড়াসওয়ারদের উদ্দেশে তীর ছোড়ো!

লাফিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফেন ও সিদুদু, দীর্ঘ বাঁকানো তীর বের করে আনল। অল্প পাল্লার লক্ষ্য, পয়েন্ট-ব্লাঙ্কই বলা চলে। ছিলায় ঢিল দিল ওরা, দুটি তীর নীরবে উড়ে গেল নিচের দিকে। দুটোই লক্ষ্য ভেদ করল। জিনের উপর পাক খেল এক সৈনিক, শাবাকোর ফ্লিন্টের তীরে ফলা পেটে বিধতেই আর্তচিৎকার করে উঠল। গলায় ফেনের তীর গ্রহণ করল তার পেছনের লোকটা। দুই হাত মাথার উপরে তুলে উল্টে জলে পড়ে গেল। লুটিয়ে পড়ল তার ঘোড়া, ওদের পেছন পেছন আসতে থাকা অন্য ঘোড়াগুলোর সাথে সংঘর্ষ বাধল। কলামের বাকি অংশকে একেবারে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিল। ঘোড়র পেটে স্পর দাবিয়ে পথরেখায় চলে এলো আকের ও এক-তাঙ।

ওহ, হ্যাঁ, দারুণ প্র্যাকটিস। মেয়েদের তারিফ করল তাইতা। আমি পালানোর নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওদের পেছনে লেগে থাকো। ওদের রেখে পথ ধরে দৌড়ে পথরেখায় নেমে এলো ও।

অলিগার্কদের পথরেখার মুখে ঢুকতে দিল মেরেন, তারপর অন্য দুই শিলুক আর ও পেছনের ঝোঁপ থেকে লাফিয়ে বের হয়ে এলো। এক-তাঙয়ের দিকে দৌড় লাগাল ইম্বালি, কুড়াল চালাল। একটা মাত্র কোপে অলিগার্কের বাম পা হাঁটুর উপর থেকে আলগা করে ফেলল। আর্তনাদ করে উঠল এক-তাঙ, ঘোড়াকে সামনে বাড়ার তাগিদ দিল। কিন্তু একটা পা খোয়া যাওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে একপাশ থেকে খসে পড়ল। পায়ের কাটা জায়গা থেকে ধমনীর উজ্জ্বল রক্ত ছলকে ছলকে বের হচ্ছে। ওর দিকে তেড়ে গিয়ে ফের কুড়োল চালাল ইম্বালি। এক-তাঙয়ের মুণ্ডটা ধড় থেকে লাফ দিয়ে পাথুরে পথে গাড়গাড়ি খেতে লাগল। সাড়াবিহীন আঙুলগুলো আরও খানিকক্ষণ ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে থাকল, তারপর মুক্ত হয়ে গেল। জমিনে কাত হয়ে লুটিয়ে পড়ল সে।

চিৎকার ছেড়ে ইম্বালির দিকে তেড়ে এলো এক-তাকে অনুসরণরত সেনাটি। বর্শা ছুঁড়ে দিল নাকোন্তা। সৈনিকের ঠিক পিঠের মাঝখানে লাগল ওটা। জমে গেল সে। বুক থেকে এক হাত সমান উঁচু হয়ে বের হয়ে আছে বর্শাটা। তলোয়ার ফেলে স্যাডল থেকে খসে পড়ল সে। সময় মতোই শেষ সৈন্যটির পেছনে চলে এলো মেরেন। ওকে আসতে দেখে খাপ থেকে তলোয়ার বের করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু ফলা বের করার আগেই লাফ দিয়ে উঠল মেরেন, পাঁজরে অস্ত্র চালিয়ে দিল। কাঁধ ও মাথার পেছনে ভর দিয়ে জমিন স্পর্শ করল সে। গলায় আরেকটা আঘাত হেনে খতম করে দিল তাকে। এবার আকেরের উদ্দেশে ধাওয়া করল। ওকে আসতে দেখল অলিগার্ক, ঘোড়ার পেটে স্পর দাবাল সে, পথরেখা বরাবর দূরে সরে গেল। মেরেন ও ইম্বালি পিছু ধাওয়া করল ওর, কিন্তু নাগাল পেল না।

উপর থেকে আকেরের সটকে পড়া দেখল তাইতা। পথ থেকে পাঁই করে ঘুরে মাথার উপরের ক্লিফের কিনারা বরাবর ঝেড়ে দৌড় লাগাল। ক্লিফের কিনারা থেকে লাফ দিয়ে নামতে থেমে তৈরি হলো। আকেরের ঘোড়া ওর নিচ দিয়ে ঝড়ের বেগে বের হয়ে যেতেই সজোরে অলিগার্কের পিঠের উপর নেমে এলো ও। ধাক্কার চোটে আকেরের হাতের লাগাম খসে গেল, স্যাডল থেকে প্রায় পড়ে যাবার দশা হলো তার। এক হাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরল তাইতা, ঝাঁকাতে শুরু করল তাকে। খাপ থেকে ড্যাগার বের করার প্রয়াস পেল আকের। কাঁধের উপর দিয়ে তাইতাকে আঘাত করতে চাইল। মুক্ত হাতে ওর কব্জি আঁকড়ে ধরল তাইতা। সুবিধা আদায়ের জন্যে যুঝতে লাগল ওরা।

পিঠের উপর বারবার ওজন বদলে যাওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে পথরেখার দেয়ালের সাথে বাড়ি খেল ঘোড়াটা, পেছনের দুই পা এক করে খাড়া হয়ে গেল। ওটার পাছার ওপর দিয়ে উড়ে নিচে পড়ল তাইতা ও আকের। ওরা জমিন স্পর্শ করার সময় আকের রইল ওপরে। তাইতার উপর শরীরের সমস্ত ভর চাপিয়ে দিল সে। পতনের ধাক্কায় আকেরের গলা ও অস্ত্র ধরা কব্জিটা আলগা হয়ে গেছে। সামলে নেওয়ার আগেই ঘুরল আকের, তাইতার গলায় ড্যাগার চালানোর চেষ্টা করল। ফের ওর কব্জি জাপ্টে ধরল তাইতা, ঠেকিয়ে রাখল তাকে। ড্যাগারের উপর শরীরের সমস্ত শক্তি চাপিয়ে দিল আকের। কিন্তু সফল হলো না। এখন তাইতার দেহে তরুণের অপার শক্তি, আর অনেক আগেই তারুণ্যের কাল পার হয়ে এসেছে আকের। প্রবল চাপে আকেরের হাত কাঁপতে শুরু করল। ভয়ের ছাপ পড়ল তার চোখে মুখে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল তাইতা। ইয়োস শেষ হয়ে গেছে, বলল ও। শিউরে উঠল আকের। হাত খসে গেল তার। গড়িয়ে তার উপরে উঠে এলো তাইতা।

মিথ্যা বলছ, চিৎকার করে উঠল আকের। উনি দেবী, একমাত্র সত্য দেবী।

তাহলে তোমার একমাত্র সত্যি দেবীকে আহ্বান জানাও এখন, লর্ড আকের। ওকে বলো গালালার তাই তোমাকে খুন করতে যাচ্ছে।

ভয় আর উদ্বেগে বিস্ফোরিত হলো আকেরের চোখ। আবার মিথ্যা বলছ, ঢোক গিলল সে। তুমি তাইতা নও। তাইতা বুড়ো মানুষ, এতক্ষণে তার পটল তোলার কথা।

তোমার ভুল হয়েছে। পটল তুলেছে ইয়োস, এবার তোমারও একই দশা হতে চলেছে। হাসি মুখেই আকেরের কব্জির উপর চাপ বাড়াল তাইতা, হাড়ের ভাঙনের শব্দ না শোনা পর্যন্ত চালিয়ে গেল ও। চিৎকার করে উঠল আকের, আঙুলের ফাঁক গলে ড্যাগার খসে পড়ল। উঠে বসল তাইতা, পাক খেতে শুরু করল, এমনভাবে ঘোরাতে লাগল তাকে যে অসহায় হয়ে গেল সে।

ঠিক সেই মুহূর্তে দৌড়ে এলো মেরেন। ব্যাটাকে শেষ করে দেব?

না, ওকে থামাল তাইতা। সিদুদু কোথায়? ওর বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি পাপ করেছে সে। ক্লিফের চূড়া থেকে নেমে আসা পথ ধরে মেয়েদের দৌড়ে আসতে দেখল ও। তাইতা যেখানে আকেরকে গেঁথে রেখেছে সেখানে চলে এলো ওরা।

তাইতা, আমাদের পালাতে হবে! লোকজন যোগাড় করে তীরের ওপাশ থেকে তেড়ে আসছে ওনকা! চিৎকার করে বলল ফেন। শুয়োরটাকে শেষ করে চলো চলে যাই।

ওকে পাশ কাটিয়ে সিদুদুর দিকে তাকাল তাইতা। এই লোকই তোমাকে ওনকার হাতে তুলে দিয়েছিল, ওকে বলল ও। তোমার বন্ধুদেরও পাহাড়ে পাঠিয়েছে। এবার তোমার বদলা নেওয়ার পালা।

দ্বিধা করল সিদুদু।

এই ড্যাগারটা নাও, আকেরের পড়ে যাওয়া অস্ত্র তুলে ওর হাতে তুলে দিল মেরেন।

দৌড়ে এসে আকেরের মাথা থেকে হেলমেট খুলে নিল ফেন। দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করে ধরে উল্টোদিকে মাথা ঘুরিয়ে গলা উন্মুক্ত করে দিল। তোমার ও পাহাড়ে পাঠানো সব মেয়েদের পক্ষে, চিৎকার করে বলল ও। গলাটা ফাঁক করে দাও, সিদুদু।

প্রতিজ্ঞায় কঠিন হয়ে উঠল সিদুদুর অভিব্যক্তি।

ওর চোখে মরণ দেখতে পেল আকের, নিজেকে বাঁচাতে যুঝতে লাগল সে, ফিসফিস করে বলল, না! দয়া করে আমার কথা শোনো। তুমি ছোট্ট বাচ্চা। এমন একটা জঘন্য কাজ জীবনভর যন্ত্রণা দেবে তোমাকে। কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল, প্রায় ছন্দহীন। তুমি বুঝতে পারছ না, দেবী আমাকে পাপমুক্ত করেছেন। তার নির্দেশ মানতে হয়েছে আমাকে। আমাকে এমন কিছু করতে পারো না তুমি।

বুঝতে পেরেছি, জবাব দিল সিদুদু, কাজটা আমি করতে পারব। ওর কাছে এসে থামল ও। আর্তনাদ করতে লাগল আকের। ঠিক কানের নিচে গলার টানটান চামড়ার উপর ড্যাগারের ডগা বসাল সিদুদু, তারপর গভীর দীর্ঘ একটা পোচ দিল। মাংস ফাঁক হয়ে গেল, ক্ষতস্থানের গভীরে মহাধমনী ফেটে গেল। দ্বিখণ্ডিত শ্বাসনালীর ভেতর থেকে মরণ চিৎকার বের হয়ে এলো। খিচুনির ভঙ্গিতে দাপাতে লাগল তার দুই পা। কোটরের ভেতর পাক খাচ্ছে চোখজোড়া। জিভ বের হয়ে এসেছে, রক্ত-ভেজা লালা ও থুতু বের করছে সে।

ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল তাইতা, গড়িয়ে গিয়ে জবাই করা শুয়োরের মতো নিথর পড়ে রইল সে। মুখ নিচের দিকে, নিজের রক্তের বিস্তারে পড়ে আছে। ড্যাগার ফেলে এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল সিদুদু। মৃত্যুপথযাত্রী অলিগার্কের দিকে তাকিয়ে আছে।

ওর পেছনে এসে দাঁড়াল মেরেন, এক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরল। কাজ শেষ, বেশ ভালোভাবেই শেষ হয়েছে, মৃদু কণ্ঠে বলল ও। ওর জন্যে করুণা দেখানোর কোনওই প্রয়োজন নেই। এবার আমাদের যেতে হবে।

ঘোড়র কাছে দৌড়ে যাবার সময় পেছনে নদীর ঘাটে ওনকা বাহিনীর চিৎকার কানে এলো ওদের। ঘোড়ার পিঠে চেপেই পথরেখা বরাবার ছুটল ওরা, সবার সামনে তাইতা ও উইন্ডস্মোক। টিলার চূড়ায় উঠে সামনে ছাড়িয়ে থাকা মুক্ত ঘেসো প্রান্তরে দিকে তাকাল ওরা। দূরের নীলে আরেকটা পাহাড়সারির অস্তিত্ব দেখতে পেল। ওগুলোর চূড়া চিরুণীর কাটার মতো খাঁজকাটা, তীক্ষ্ণ।

তারই ছায়ায় একটা ফোকরের দিকে ইঙ্গিত করল সিদুদু। ওখনেই কিতানগুলে গ্যাপ, কর্নেল তিনাতের সাথে যেখানে দেখা করার কথা আমাদের।

কত দূর হতে পারে? মেরেন জিজ্ঞেস করল।

বিশ লীগ, একটু বেশিও হতে পারে, জবাব দিল সিদুদু। ঘুরে নদীর ঘাটের দিকে তাকাল ও।

সৈন্যদলের সামনে ঘোড়াকে আঘাত করে আগে বাড়ছে ওনকা। অলিগার্কের লাশ দেখে রাগে চিৎকার করে উঠল সে। আরও জোরে তেড়ে এলো।

বিশ লীগ! তার মানে সামনে বেশ ভালোই দাবড়ানি রয়েছে, বলল মেরেন।

ঘোড়াগালো ঢালের কাছে নিয়ে এলো ওরা, তারপর সবেগে সমতলের দিকে ছুট লাগাল। ওদের পেছনের পাহাড়ের কিনারা থেকে ওনকা-বাহিনী হাজির হতে হতে সমতলে পৌঁছে গেল। বুনো সমবেত চিৎকার ছেড়ে নিচে নামতে শুরু করল ওরা, ওনকার হেলমেটের অস্ট্রিচ পুম অন্যদের থেকে আলাদা করেছে তাকে।

 এখানে সময় নষ্ট করার দরকার নেই, তাগিদ দিল তাইতা। চলো, সটকে পড়ি।

আধা লীগের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে সিদুদুর বাচ্চা ঘোড়াটা বাকি ঘোড়ার সাথে তাল মিলিয়ে ছুটতে পারবে না। ফলে ওর গতির সাথে নিজেদের গতি সমন্বয় করতে বাধ্য হলো ওরা।

সাহস রাখ! জোরে বলল ফেন। আমরা তোমাকে ফেলে যাব না।

আমার ঘোড়াটা কাহিল হয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি, কেঁদে বলল সিদুদু।

ভয় পেয়ো না, বলল মেরেন। ওটা লুটিয়ে পড়লেই তোমাকে আমার ঘোড়ার পেছনে তুলে নেব।

না! ফেনের ফিসফিসানিতে সহানুভূতি। তোমার ওজন অনেক বেশি, মেরেন। বাড়তি ওজন তোমার ঘোড়াটাকে মেরে ফেলবে। ওয়ার্লপুল আমাদের দুজনকেই বইতে পারবে। ওকে আমি নেব।

রেকাবের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল তাইতা। দ্রুত গতির ঘোড়াগুলো সামনে এগিয়ে যাওয়ায় ও ধীর গতির ঘোড়াগুলো পিছিয়ে পড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ধাওয়ার কাজটা। সামনের কাতারের তিন জাররিয় অশ্বারোহীর ভেতর ওনকার নকশাদার হেলমেটটা বেশি করে চোখে লাগছে। জোরে আগে বাড়ছে সে। ক্রমে মাঝখানের ফোকরটা কমিয়ে আনছে। উইন্ডস্মোককে আগে বাড়ার তাগিদ দিয়ে সামনের পাহড়সারির দিকে তাকাল তাইতা। এখন ফোকরটাকে ফুটিয়ে তোলা নচটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ওটা এত দূরে যে ওনকা ওদের ওপর চড়াও হওয়ার আগেই ওখানে পৌঁছতে পারার আশা করতে পারল না। পরক্ষণেই একটা কিছু ধরা পড়ল ওর চোখে। সামনের প্রান্তরের বুকে মলিন ধুলোর একটা আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। দ্রুততর হয়ে উঠল ওর হৃৎপিণ্ডের গতি। বাগ মানানোর চেষ্টা করল ও। মিথ্যে আশার সময় নেই এখন। নিশ্চিতভাবেই ওটা গেযেল বা যেব্রার পাল ছিল। কথাটা ভাবতে ভাবতেই ধূলির মেঘের নিচে ধাতুর ওপর সুর্যের আলো ঠিকরে যেতে দেখল। সশস্ত্র লোকজন! বিড়বিড় করে বললও। তবে কি ওরা জাররিয়, নাকি রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে ফিরে আসছে হিলতো। স্থির করার আগেই পেছনে ক্ষীণ চিৎকার শোনা গেল। ওনকার কণ্ঠস্বর শনাক্ত করতে পারল ও।

তোকে দেখেছি, কুত্তী! ধরতে পারলে তোর জরায়ু বের করে আনব। তারপর পুড়িয়ে গলায় ঠেসে দেব।

ওসব কথা কানে নিয়ো না, সিদুদুকে তাগিদ দিল ফেন। কিন্তু অশ্রু গড়িয়ে নামতে লাগল সিদুদুর গাল বেয়ে। ওর টিউনিকের সামনের দিকটা ভিজিয়ে দিল।

ওকে ঘৃণা করি! বলল সে। মনপ্রাণে ঘৃণা করি।

পেছনে ওনকার কণ্ঠস্বর আরও পরিষ্কার ও কাছে এসে পড়েছে। চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।

প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল সিদুদু।

ওর কথা শোনার দরকার নেই। কান বন্ধ করে রাখ, মনোযোগ অন্যদিকে সরাও। অনুরোধ করল মেরেন।

তুমি এসব কথা শোনার আগেই যদি মরে যেতাম, ফুঁপিয়ে উঠল সে।

এর কোনও অর্থ নেই, তোমাকে আমি ভালোবাসি। শুয়োরটাকে তোমার কোনওই ক্ষতি করতে দেব না।

ঠিক সেই মুহূর্তে সিদুদুর ঘোড়াটা লম্বা ঘাসের আড়ালে লুকানো একটা মংগুজ বারোতে সামনের বাম পা দিয়ে বসল। শুকনো ডালের মতো মড়াৎ করে ভেঙে গেল ওটার হাড়। ঘোড়ার মাথার সামনে দিয়ে উল্টে পড়ে গেল সিদুদু। নিমেষে মেরেন ও ফেন পাঁই করে ঘুরে ছুটে এলো ওর দিকে।

 তৈরি হও, সিদুদু। তোমাকে তুলে নিচ্ছি, চিৎকার করে বলল ফেন। কিন্তু গড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধাওয়াকারীদের দিকে পেছন ফিরে তাকাল সিদুদু। এতক্ষণে ওকে অনুসরণকারীদের চেয়ে অনেক দূর আগে চলে এসেছে ওনকা। আগ্রহের সাথে সামনে ঝুঁকে আছে সে, পূর্ণ গতিতে ঘোড়া ছোটাচ্ছে, এগিয়ে আসছে সিদুদুর দিকে।

তোমার চিরকালীন প্রেমিকের সাথে মিলিত হতে তৈরি হও, চিৎকার করে বলল সে।

কাঁধের উপর ধনুক নামাল সিদুদু, হাত বাড়াল তীরের দিকে।

খুশিতে হেসে উঠল ওনকা।দেখা যাচ্ছে আমাকে আনন্দ দিতে একটা খেলনা রয়েছে তোর কাছে। তোর মরার আগে খেলার আরও ভালো কিছু আছে আমার কাছে।

ওকে তীর ছুঁড়তে দেখতেই পেল না সে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ধণুক উঁচু করল ও। এখন চেহারা দেখার মতো যথেষ্ট কাছে এসে গেছে ওনকা। ওর চোখে ভীতিকর ক্রোধ দেখামাত্রই মুখের পরিহাসের হাসি মুছে গেল তার। ছিলা টানটান করে মুখের কাছে নিয়ে এলো সিদুদু। ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করল ওনকা। তীর ছেড়ে দিল সিদুদু। ওনকার ঠিক পাঁজরে গিয়ে বিধল ওটা। দুই হাতে ওটা বুক থেকে বের করার প্রয়াসে হাতের তলোয়ার ছেড়ে দিল সে। কিন্তু কাটাতারের ফলাটা গভীরে পৌঁছে গেছে। আতঙ্কিত হয়ে উঠল ঘোড়াটা, পাঁই করে ঘুরল ওটা, লুটিয়ে পড়ার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। ফের তীর ছুঁড়ল সিদুদু। ওর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল লোকটা। এবারের তীরটা লাগল পিঠের ঠিক নিচে। গভীরে ঢুকে কিডনি ভর্তা করে দিল। একটা মারণ ক্ষত তৈরি করল। তীরের দিকে হাত বাড়াতে বেঁকে গেল তার শরীর। ফের তীর ছুঁড়ল সিদুদু। বুকে লাগল ওটা, ফুটো করে দিল দুটো ফুসুফসই। আধা গোঙানি আধা দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ বের হলো ওনকার মুখ দিয়ে, তারপর তার ঘোড়াটা শরীরের নিচ থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে যেতেই পেছনে উল্টে পড়ে গেল সে। রেকাবে আটকে গেল ওনকার একটা পা, লাফিয়ে সামনে ছুটতে শুরু করল তার ঘোড়া, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল তাকে, ভীত জানোয়ারটার পেছনের দুই পা তার লাশে আঘাত করায় জমিনের উপর লাফাচ্ছে তার মাথা।

ধনুকটা ফের কাঁধে তুলে রাখল সিদুদু, তারপর ছুটন্ত ফেনের সাথে মিলিত হতে ফিরে তাকাল। নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ফেন। লাফ দিয়ে উঁচু হলো সিদুদু, ওদের হাত জুড়ে গেল। ওয়ার্লপুলের গতি কাজে লাগাল ফেন, পেছনে তুলে নিল ওকে। বসার পর পেছন থেকে বন্ধুর কোমর জড়িয়ে ধরল সিদুদু। স্পার দাবিয়ে ওয়ার্লপুলকে ঘুরিয়ে নিল ফেন।

পরের তিন জাররিয় বেশ কাছে এসে পড়েছে। ওনকার হত্যাকাণ্ডে রাগে ফুঁসছে। সামনাসামনি ওদের মোকাবিলা করল মেরেন। একজনকে ফেলে দিল, বাকিরা সংঘর্ষের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে বরং পালিয়ে বাঁচল। ওকে ঘিরে ধরল ওরা। সুযোগের অপেক্ষা করছে। কিন্তু মেরেনের তলোয়ার ঝিলিক তুলে পাইপাই করে ঘুরতে থাকায় সামনে বাড়তে পারছে না ওরা। এরই মধ্যে তাইতা ও দুই শিলুক ওর বিপদ টের পেয়ে পূর্ণ গতিতে ওকে সাহায্য করতে ছুটে আসতে শুরু করেছে।

ভালোই দেখিয়েছ! পরস্পরকে পাশ কাটানোর সময় ফেনের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল তাইতা। এখন গ্যাপের দিকে ছোট। আমরা তোমাদের পেছন থেকে কাভার দেব।

তোমাকে ফেলে যেতে পারব না, তাইতা, প্রতিবাদ করল ফেন।

ঠিক পেছনেই আছি আমি! কাঁধের উপর দিয়ে চিৎকার করে বলল ও, তারপর লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক জাররিয়কে জিনের উপর থেকে ফেলে দিল ও, অন্য জন দেখল দারুণভাবে সংখ্যার দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে, দলের বাকিরা এখনও অনেক দূরে। আত্মরক্ষার প্রয়াস পেল সে। কিন্তু তার বুকের একপাশে দীর্ঘ বর্শাটা সেঁধিয়ে দিল নাকোতো। তলোয়ার ধরা হাত লক্ষ করে যুদ্ধ কুঠার ঘোরাল ইম্বালি। কব্জির উপর থেকে কাটা পড়ল ওটা। সরে সহযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিতে ছুটে চলল, জিনের উপর দোল খাচ্ছে প্রবলভাবে।

ওকে যেতে দাও! নির্দেশ দিল তাইতা। ফেনকে অনুসরণ করো। জাররিয়দের অবিশিষ্ট লোকজন ক্রমে কাছে এগিয়ে আসায় দ্রুত দূরে সরে এলো ওরা। সামনে চলে এলো তাইতা। অচেনা অশ্বারোহী দলটা এখন অনেক কাছে। সরাসরি পরস্পরের দিকে ছুটে যাচ্ছে ওরা।

ওরা জাররিয় হয়ে থাকলে আমরা ঘোড়া সামলে ওদের সাথে মোলাকাতের অপেক্ষা করব। চিৎকার করে বলল তাইতা। জানোয়ারগুলোকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে ওদের পেছনে আশ্রয় নেবে ওরা। ওদের দেহ বর্ম হিসাবে কাজে লাগাবে।

নিবিড় মনোযোগের সাথে ওদের পরখ করল তাইতা। এখন ওর দৃষ্টি শক্তি এত প্রখর হয়ে গেছে যে মেরেন ও ফেনের বেশ আগেই পুরোভাগের সওয়ারিকে চিনে ফেলল ও। হিলতো! চিৎকার করে উঠল ও। ওটা হিলতো।

আইসিসের মিষ্টি বীচির কসম, ঠিক বলেছেন! চিৎকার করে উঠল মেরেন। দেখে মনে হচ্ছে তিনাতের অর্ধেক রেজিমেন্টই ফিরে এসেছে! হিলতোর অপেক্ষা করার জন্যে গতিবেগ খানিকটা কমাল ওরা। ফলে পিছু ধাওয়ারত জাররিয়রা দ্বিধায় পড়ে গেল। ওরা ভেবেছিল হস্তক্ষেপকারীরা ওদের দলেরই লোক। অনিশ্চিতভাবে থমকে দাঁড়াল ওরা।

হোরাসের আহত চোখের দোহাই, তোমাদের স্বাগত জানাই, হিলতো, পুরোনো বন্ধু। ওকে স্বাগত জানাল মেরেন। দেখতেই পাচ্ছ, তোমার তলোয়ারের ফলাকে বিশ্রাম দিতে বেশ কিছু বদমাশকে রেখে দিয়েছি আমরা।

কর্নেল আমার, তোমার দয়ার সীমা পরিসীমা নেই, হেসে বলল হিলতো। সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাব আমরা। তোমাদের সাহায্য লাগবে না। কর্নেল তিনাত আনকুর কিতানগালে গ্যাপের যেখানে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সোজা সেখানে চলে যাও। অল্পক্ষণের মধ্যেই তোমাদের অনুসরণ করব আমরা।

পেছনে তিনাতের লোকজনের নিবিড় দল নিয়ে দুলকি চালে ছুটে গেল হিলতো। নির্দেশ দিল সে, যুদ্ধের ফরমেশনে রেখা তৈরি করল। সোজা গিজগিজে জাররিয়দের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। ঝাঁপিয়ে পড়ল, ছিন্ন ভিন্ন করে দিল গোটা সারি। তারপর প্রান্তরের উপর দিয়ে ধাওয়া করে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে পাঠিয়ে দিল। আহত ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিতে দিতে ওদের কুচকাটা করল।

নীল পাহাড়ের দিকে সদলে ছুটে চলল তাইতা। ওয়ার্লউইন্ডের পিঠে সওয়ার মেয়ে দুটির সাথে যোগ দেওয়ার পর লাগাম টেনে ওদের পাশে চলে এলো মেরেন। ভূতের মতো তীর ছুঁড়তে পারো তুমি, সিদুদুকে বলল ও।

ওনকাই আমার ভেতর ভূত নিয়ে এসেছে, বলল সে।

মনে হয়, সোনার মুদ্রায়ই তোমার দেনা শোধ করেছ: এখন তুমি আর তোমার ভূত রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।

হ্যাঁ, মেরেন, চিন্তিত কণ্ঠে বলল সে। কিন্তু আমি কোনওদিন যোদ্ধা হতে চাইনি-এটা আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আমি বরং ভালো স্ত্রী ও মা হতে চাইব।

খুবই তারিফযোগ্য ইচ্ছা। আমি নিশ্চিত, তুমি এর ভাগ নিতে একজন ভালো মানুষের দেখা পাবে।

আশা করি, কর্নেল ক্যাম্বিসেস, চোখের পাতা নামিয়ে ওর দিকে তাকাল সিদুদু। খানিক আগে আমাকে ভালোবাসার কথা বলছিলে…

ওয়ার্লউইন্ড এরই মধ্যে ফেন বাধ্য করায় বাড়তি ওজন বইতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, গম্ভীরভাবে বলল মেরেন। আমার পেছনে তোমার বসার মতো জায়গা আছে। আমার কাছে আসতে চাও না?

যারপরনাই আনন্দের সাথে, কর্নেল। ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। অনায়াসে ওকে তুলে এনে পেছনে জিনের উপর বসিয়ে দিল মেরেন। দুই হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল সে। তারপর ওর দুধের মাঝখানে মাথা দাবাল। নিজের গায়ে ওর কম্পন টের পাচ্ছিল মেরেন। মাঝেমাঝেই সামলে ওঠার আগেই কান্নার দমকে ওর গোটা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল মেরেনের। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ওকে দেখেশুনে রাখতে, যত্ন নিতে ইচ্ছে করল ওর। তাইতা ও ফেনের পেছনে পেছন ছুটে চলল ও, ঠিক পেছনে রইল নাকোন্তো ও ইম্বালি।

*

পাহাড়ের পাদদেশের কাছে পৌঁছুনোর আগেই হিলতো ও তার স্কোয়াড্রন।মিলিত হলো ওদের সাথে। মেরেনের কাছে রিপোর্ট করতে আগে বাড়ল হিলতো। সাতজনকে মেরে ওদের ঘোড়া ছিনিয়ে নিয়েছি আমরা, বলল সে। বাকিরা আর লড়াই করতে পারবে না। ওদের পিছে না ছুটে চলে যেতে দিয়েছি। ওদের পেছনে শত্রুদের কেমন বাহিনী আসতে পারে আমার জানা নেই।

ভালোই দেখিয়েছ, হিলতো।

ছিনিয়ে নেওয়া ঘোড়াগুলোর একটা কি ছোট সিদুদুর জন্যে নিয়ে আসব?

না, ধন্যবাদ। আপাতত অনেক কাজ করেছ তুমি। যেখানে আছে সেখানেই অনেক নিরাপদে আছে ও। আমি নিশ্চিত, তিনাতের নাগাল পাওয়ার পর আমাদের আরও ঘোড়ার দরকার হবে। ততক্ষণ ওগুলো সামলে রাখ।

পাহাড়ের পাদদেশ ধরে গ্যাপের দিকে উঠে যাবার সময় শরণার্থীদের এক বিশাল মিছিলের শেষাংশের সাথে মিলিত হলো ওরা। বেশিরভাগই পায়ে হেঁটে চলছে, তবে বেশি অসুস্থ বা দুর্বলদের দুই চাকার ঠেলাগাড়ি বা পরিবারের সদস্য বা সহযাত্রীরা পালকিতে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাবার কাঁধে বসেছে ছোট বাচ্চারা, মেয়েদের কারও কারও পিঠে দুধের শিশুদের বেঁধে রাখা হয়েছে। বেশির ভাগই মেরেনকে চিনতে পেরে পাশ কাটানোর সময় ডেকে কথা বলল। মেরেন ক্যাম্বিসেস, আপনার উপর সকল দেবতার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। তিক্ত দুর্ভোগ থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন আপনি। আমাদের বাচ্চারা এবার মুক্ত হবে।

প্রজনন খোঁয়াড় থেকে ওদের উদ্ধার করা অল্পবয়সী মেয়েরা ফেন ও সিদুদুর সাথে বসে ওদের স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবেগের আতিশয্যে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমাদের অন্তিম পাহাড় থেকে উদ্ধার করেছ। দরদ ও সাহসের জন্যে আমরা তোমাদের ভালোবাসি। সিদুদু, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার উপর সকল দেবতার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ফেন।

তাইতাকে চিনতে পারেনি কেউ, যদিও মেয়েরা কৌতূহলের সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও চলাফেরার সময় কর্তৃত্বপূর্ণ উপস্থিতি সম্পন্ন এই তরুণকে দেখছে। ওদের এই আগ্রহ সম্পর্কে বেশ সজাগ ফেন, তো অধিকারের একটা ভাব নিয়ে ওর কাছে চলে এলো ও। এইসব ধীরতা ও ঘটনায় ওদের পাহাড়ের ওঠার গতি কমে এলো। চূড়ায় পৌঁছানোর আগেই ডুবে গেল সূর্য। আরও একবার কিতানগালে গ্যাপে এসে দাঁড়াল ওরা।

সীমান্ত দুর্গের প্রহরা মিনার থেকে ওদের আসতে দেখেছিল তিনাত। মই বেয়ে তরতর করে নেমে ওদের সাথে যোগ দিতে গেট দিয়ে দৌড়ে এলো। মেরেনকে স্যালুট করে ফেন ও সিদুদুকে আলিঙ্গন করল, তারপর তাইতার দিকে ফিরল। এই লোক কে? জিজ্ঞেস করল সে। ওকে বিশ্বাস করি না, কারণ বড় বেশি সুন্দর সে।

ওকে জানপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে, বলল মেরেন। সত্যি কথা হচ্ছে ওকে আগে থেকেই ভালো করে চেনো তুমি। পরে ব্যাখ্যা করব আমি, যদিও তখন আমার কথা বিশ্বাস করবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে।

তুমি ওর পক্ষে সাক্ষী দিচ্ছ, কর্নেল মেরেন?

আমার গোটা অস্তিত্ব দিয়ে, বলল মেরেন।

আমিও আমার গোটা সত্তা দিয়ে, বলল ফেন।

আমিও, বলল হিলতো।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভুরু কোঁচকাল তিনাত। দেখা যাচ্ছে এখানে আমি সংখ্যালঘু, কিন্তু তারপরও আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তুলে রাখছি।

তোমার কাছে ফের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, কর্নেল তিনাত, কোমল কণ্ঠে বলল তাইতা। আমাদের জাররিয়দের কবল থেকে উদ্ধার করার সময় তামাফুপায় ছিলাম আমি।

তামাফুপায় যাদের পেয়েছি, তাদের মধ্যে আপনি ছিলেন না, বলল তিনাত।

ওহ, তুমি ভুলে গেছ, মাথা নেড়ে বলল তাইতা। তাহলে নিশ্চয়ই মেরেনের চোখ অপারেশনের পর ওর সাথে আমাকে মেঘ-বাগিচা থেকে পথ দেখিয়ে আনার কথা তোমার মনে আছে। তখনই তুমি প্রথমবারের মতো তোমার আনুগত্য প্রকাশ করেছিলে, মিশরে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছ। আমরা যে ইয়োস ও তার ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম সেটা মনে আছে?

তাইতার দিকে তাকিয়ে রইল তিনাত। অভিব্যক্তি বিকৃত হয়ে গেছে। লর্ড তাইতা! ম্যাগাস! মেঘ-বাগিচার পাহাড়ে আপনি মারা যাননি? এটা কিছুতেই আপনি হতে পারেন না!

নিশ্চিতভাবেই পারি, এবং আমিই, বলে হাসল তাইতা। যদিও আমার চেহারার কিছু বিশেষ পরিবর্তনের কথা স্বীকার করছি।

আপনি তরুণ হয়ে গেছেন! এ অলৌকিক, অবিশ্বাস্য ঘটনা! কিন্তু আপনার কণ্ঠস্বর ও চোখ কথাটা সত্যি বলে মানতে বাধ্য করছে আমাকে। দৌড়ে কাছে এসে তাইতার হাত তুলে শক্ত করে ধরল সে। ইয়োস আর অলিগার্কদের কী দশা হয়েছে?

অলিগার্করা মারা গেছে, ইয়োসও আর আমাদের জন্যে হুমকি নয়। তোমাদের এখনকার অবস্থা কী?

এখানে জাররিয় সেনাছাউনীতে হামলা করেছিলাম আমরা। মাত্র বিশ জন লোক ছিল এখানে, কেউ রেহাই পায়নি। ওদের লাশ গোর্জে ফেলে দিয়েছি। দেখুন! শকুনের ঝাঁক এরই ভেতর খোঁজ পেয়ে গেছে। মাথার উপরে আকাশে চক্কর দিয়ে বেড়ানো মরাখেকো পাখিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল সে।

কিতানগালে নদীর ঘাটে নৌকা আর ওখানে পড়ে থাকা জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শখানেক লোক পাঠিয়েছি।

ভালো কাজ দেখিয়েছ, ওর তারিফ করল তাইতা। এবার নদীর ঘাটে যেতে হবে তোমাকে, ওখানকার কর্তৃত্ব নিতে হবে। জাহাজগুলো জড়ো করো, আমাদের লোকজন আসামাত্র ওদের তুলে নদীর ভাটিতে রওয়ানা করিয়ে দেবে, ভালো চালক দেবে সাথে, যাতে ওদের পথ দেখাতে পারে। নালুবালে হ্রদের তীরে গোটা বহর আবার জড়ো করবে, যেখানে নাকে শিংঅলা দানো শিকারে নেমেছিলাম আমরা।

ভালো করেই মনে আছে।

পাহাড় থেকে নামার পথে গোর্জের উপরের সেতুতে বিশজন কুড়োলঅলা লোক রেখে যাবে। সব লোক পার হওয়ার পর ওরা সেতুটা কেটে গোর্জে ফেলে দেবে।

আপনি কী করবেন?

মেরেন আর আমি এখানে দুর্গে হিলতোর সাথে তোমার পাঠানো কয়েকজন লোক নিয়ে অপেক্ষা করব। সেতু ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত জাররিয়দের ঠেকিয়ে রাখব।

আপনার যেমন নির্দেশ, লর্ড তাইতা, দ্রুত চলে গেল তিনাত, ক্যাপ্টেনদের উদ্দেশে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে।

মেরেনের দিকে ফিরল তাইতা। হিলতো, দুই শিলুক আর যে কজন লোকের ব্যবস্থা করতে পারো, শরণার্থীদের সাহায্য করতে পাঠিয়ে দাও। দ্রুত কাজ করার তাগিদ দিতে হবে ওদের। দেখ! জাররিয়দের মুল দলটা খুব বেশি দূরে নেই। ওরা যেপথে এসেছে সেপথে পাহাড়ের নিচের দিকে ইঙ্গিত করল ও। দূরে, একেবারে সেই সমতল ভূমিতে ধূলির মেঘ চোখে পড়ছে, অস্তগামী সূর্যের আলোয় রক্ত লাল, জাররিয় রথ ও আগুয়ান সেনাদলের কারণে উড়ছে ধুলো।

ছোট দুর্গ দ্রুত পরখ শেষে গ্যাপের গলার কাছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শনের জন্যে ফেনকে সাথে নিয়ে গেল তাইতা। একেবারেই মামুলি পর্যায়ের ব্যবস্থা। দেয়ালগুলো নিচু, যেনতেনভাবে মেরামত করা। অবশ্য, অস্ত্রাগার ও কোয়ার্টার মাস্টারের গুদাম বেশ ভালোভাবেই বোঝাই করা, রান্নাঘর ও গুদামঘরের মতোই।

এখানে শত্রুকে বেশিক্ষণ আটকে রাখব না, ফেনকে বলল ও। গতিই আমাদের প্রতিরক্ষা। শরণার্থীদের সংগ্রামরত রেখার দিকে তাকাল ওরা।

এগিয়ে যাবার মতো শক্তি ফিরে পেতে খাবার ও পানির প্রয়োজন হবে ওদের। সিদুদু ও তোমাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক অল্প বয়সী মেয়েদের খুঁজে বের করো, ওরা যাবার সময় যেখানে যা খাবার মেলে ওদের হাতে চালান করে দাও। বিশেষ করে যাদের সাথে ছোট বাচ্চা রয়েছে। তারপর ওদের নৌকাঘাটের দিকে পাঠিয়ে দেবে। থামতে দেবে না। বিশ্রাম নিতে দেবে না, তাহলে কিন্তু এখানেই মারা পড়বে সবাই।

দ্রুত এসে ওদের সাথে যোগ দিল মেরেন। মই বেয়ে প্রহরা মিনারে উঠে এলো সে আর তাইতা। এখান থেকে আরও উপরের একটা চাতালের দিকে ইঙ্গিত করল তাইতা, পথের মাথা দেখা যায় ওটা থেকে। যতজন যোগাড় করতে পারো সবাইকে নিয়ে ওখানে চলে যাও। ওদের বলো বড় বড় পাথরের চাঁই যোগাড় করে চাতালের কিনারায় বসাতে। জাররিয়রা ওই পথে আসলেই উপর থেকে পাথর গড়িয়ে দেব আমরা। তরতর করে মই বেয়ে নিচে নেমে গেল মেরেন, নিজের লোকদের খোঁজে নামল। এদিকে রাস্তায় ফেনের সাথে যোগ দিতে দ্রুত আগে বাড়ল তাইতা। মেয়েটা খাবার বানানোর জন্যে মেয়ে বাছাই করার সময় সমর্থ লোকজন বাছাই করে চাতালে মেরেনের সাথে কাজ করতে পাঠাল।

আস্তে আস্তে বিশৃঙ্খল অবস্থা কাটিয়ে উঠল ওরা। প্রত্যাহারের গতি বেড়ে উঠল।পেটে দানা পানি পড়ায় আবার চাঙা হয়ে উঠল লোকজন। পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকজনের সাথে আলাপ করল তাইতা, মেয়েদের হাসতে বাধ্য করে বাচ্চাদের ওদের কাঁধে তুলে দিল। সবাই নতুন প্রতিজ্ঞা নিয়ে সামনে বাড়ল। সন্ধ্যা মেলাতেই ফেনের সাহায্যকারীদের হাসি রাতকে মধুর করে তুলল। হিলতোর রেখে যাওয়া প্রহরীদের মশালের আলো স্পষ্ট করে তুলল কলামের পথ।

আইসিসের কৃপায়, মনে হচ্ছে অনায়াসেই জায়গামতো পৌঁছে যাব আমরা, মশালের আলোয় হিলতোর দীর্ঘ দেহ দেখে বলল ফেন। কলামকে সামনে বাড়তে গভীর কণ্ঠে তাগিদ দিচ্ছে ও।

ওর সাথে যোগ দিতে দৌড়ে গেল তাইতা।বেড়ে দেখিয়েছ, সুজন হিলতো, ওকে শুভেচ্ছা জানাল ও। জাররিয় ভ্যানগার্ড চোখে পড়েছে তোমার?

সন্ধ্যায় ওদের ওড়ানো ধুলো দেখার পর আর কিছুই চোখে পড়েনি। তবে খুব বেশি দূরে থাকার কথা নয় ওদের। হিলতোর দুই কাঁধে দুটা বাচ্চা বসে আছে। ওর লোকজনও একইভাবে বোঝাই।

পূর্ণ গতিতে এগিয়ে যাও, নির্দেশ দিল তাইতা, তারপর শূন্য ট্রাক ধরে ছুটে একা না হওয়া পর্যন্ত আগে বাড়ল ও, এক সময় পশ্চাদপসরণকারীদের আওয়াজ অনেক পেছনে পড়ে গেল। থেমে কান পাতল ও, নিচে ক্ষীণ একটা বিড়বিড় আওয়াজ কানে এলো। হাঁটু গেড়ে বসে পাথরে কান পাতল। এবার প্রবল হয়ে উঠল আওয়াজটা। রথ ও কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে আসা লোকজন। এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। দ্রুত ছুটে আসছে ওরা। হিলতো যেখানে কলামের শেষ মাথায় পরিদর্শন করছিল, দ্রুত সেখানে চলে এলো। দলের প্রায় শেষের দিকে এক মহিলা পিঠে বাচ্চা নিয়ে এগোচ্ছে। তার পেছনে আরও দুজনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে সে।

আমি ক্লান্ত, আমার পা আর চলছে না।

এবার কি আমরা বিশ্রাম নিতে পারব? আমরা ঘরে ফিরতে পারব?

বাড়িতেই যাচ্ছ, বলে দুটো বাচ্চাকেই কাঁধে তুলে নিল ও। শক্ত করে ধরে রাখ, ওদের বলল, তারপর মুক্ত হাতটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। এবার চলো। অচিরেই তোমাদের ও মাথায় নিয়ে যাব। উপর দিকে দ্রুত পা চালাল ও। পেছনে টেনে নিয়ে চলল মহিলাকে।

এই যে এসে গেছি, পাসের চূড়ায় পৌঁছে বাচ্চা দুটোকে মাটিতে নামিয়ে বলল ও। এই দুই সুন্দরী তোমাদের ভালো কিছু খাবার দেবে। ফেন ও সিদুদুর দিকে ওদের ঠেলে দিল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। বেচারা একেবারে কাহিল হয়ে গেছে, উদ্বেগে কাবু। এখন আর বিপদের কোনও কারণ নেই।

জানি না আপনি কে, তবে নিঃসন্দেহে আপনি ভালো মানুষ।

ওদের রেখে আবার হিলতোর কাছে ফিরে এলো ও। একসাথে শরণার্থীদের অবশিষ্টাংশ পাসের উপর দিয়ে নেমে যেতে দেখল ওরা, ওপাশের ঢাল বেয়ে নামছে। ইতিমধ্যে ভোর হতে শুরু করেছে। খাড়া ঢালের চাতালের মাথায় যেখানে মেরেন দাঁড়িয়ে আছে, মাথা তুলে সেদিকে তাকাল তাইতা। হাত নাড়ল মেরেন। ওর লোকেরা জড়ো করা আলগা পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছে।

প্রহরা মিনারের চূড়ায় যাও, ফেন ও সিদুদুকে নির্দেশ দিল তাইতা। একটু পরেই তোমাদের সাথে যোগ দিচ্ছি। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো তর্ক জুড়ে দেবে ফেন, কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও।

অচিরেই দুর্গের দিকে রথের চাকার ঘরঘর আওয়াজ ছুটে আসার শব্দ পেল তাইতা। ওদের সাথে মিলিত হতে ট্রাক ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলও। চাতালের উপর ওত পেতে থাকা মেরেনের লোকদের দিক থেকে ওদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চায়। সহসা সংকীর্ণ পথের বাঁক ঘুরে উদয় হলো প্রথম বাহনটা। ওটা এগিয়ে আসার সময় বাকিগুলোও উদয় হলো পেছনে। প্রতিটি বাহনের পাশে বারজন করে পদাতিক সৈনিক। খাড়া পথ ধরে উঠে আসার সময় রথের পাশ ধরে রেখেছে। সব মিলিয়ে আটটা রথ দেখা যাচ্ছে, শেষেরটার পেছনে একটা বিশাল পদাতিক বাহিনী আবির্ভূত হলো।

গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টাই করল না তাইতা, সামনের রথের দিক থেকে চিৎকার শোনা গেল। চালক চাবুক চালাতেই লাফ দিয়ে সামনে ছুটল ওটা। নড়ল না তাইতা। ওকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ে দিল এক বর্শাধারী, কিন্তু বিক্ষিপ্ত হলো না তাইতা। অস্ত্রগুলো পাথরের উপর পড়ে ঝনঝনিয়ে উঠছে, লক্ষ করল ও। আবার ওদের আসতে দিল ও। পরের বর্শাটা হয়তো ওকে শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু বাউলি কেটে ওটাকে ফাঁকি দিল। কাঁধের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল ওটা। মিনারের উপর থেকে চিৎকার শুনতে পেল ও। তাইতা, ফিরে এসো। নিজেকে বিপদে ফেলছ তুমি। ফেনের সতর্কবাণী উপেক্ষা করল ও। রথের দিকে লক্ষ রাখতে লাগল। অবশেষে পুরোপুরি মনোযোগ দিল ওরা: এখন আর ওদের ঘুরে পালানোর সুযোগ নেই। মেরেনের উদ্দেশে ইশারা করল ও। এখন চিৎকার করে বলে উঠল। ক্লিফের প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হলো ওর কণ্ঠস্বর: এখন! এখন! এখন!

কাজে লেগে গেল মেরেনের লোকজন। চাতালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল প্রথম দফার পাথরগুলো, খাড়া ঢাল বেয়ে লাফাতে লাফাতে নেমে এলো। অন্য পাথরও আলগা করে দিল ওগুলো, ফলে পাথর ধস নামল। তারই প্রবল আওয়াজ শুনতে পেল রথ চালকরা। হতচকিত চিৎকার করে বাহন ছেড়ে নিরাপদ জায়গার খোঁজে ছুট লাগাল। কিন্তু সংকীর্ণ পাসে পাথরের ধারা থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো কোনওই আশ্রয় নেই। পরিত্যক্ত রথের উপর পড়তে রাগল পাথরের ঝক। মানুষসহ পথের উপর থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওগুলোকে নিচের গোর্জে। পাথরের পতন শেষ হলে দেখা গেল আবর্জনার স্তূপে রুদ্ধ হয়ে গেছে পাসটা।

কিছু সময়ের জন্যে কোনও রথই আর এই পাস ব্যবহার করতে পারবে না, এমনকি পায়ে চলা লোকজনও এই বাধা ডিঙাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়বে। সন্তোষের সাথে আপনমনে বলল তাইতা। সকালের অবশিষ্ট সময়ের জন্যে ওদের আটকে রাখবে। ইশারায় মেরেনকে ওর লোকজনকে দুর্গে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিল ও। মিনারের মাথায় যখন উঠে এলো ও ততক্ষণে শরণার্থীদলের অবশিষ্টাংশও উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে ঢের আগেই উধাও হয়েছে।

ওকে দেখে দারুণ স্বস্তিতে প্রবলভাবে আলিঙ্গন করল ফেন। আমার অনেক প্রিয় তুমি, হে লর্ড। ফিসফিস করে বলল। তোমার চারপাশে বর্শা উড়তে দেখে আমার বুকের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল।

আমার জন্যে তোমার ভেতর এত সম্মান থাকলে জাররিয়দের বাকি দলটা আসার আগেই আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত তোমার।

পাহাড় থেকে ফিরে আসার পর দারুণ দক্ষ হয়ে উঠেছ, খুব ভালো লাগছে আমার, লর্ড। হেসে উঠল সে, রান্নাঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ফিরে আসার পর প্যারাপেটের উপর দিয়ে সামনে ঝুঁকে ধুরা পিঠা দিয়ে ডিম খেল। মেরেন আর ওর লোকেরা যে চাতাল থেকে পাথর ফেলেছিল সেটা দখল করার জন্যে জনা পঞ্চাশেক লোক পাঠিয়েছে জাররিয় কমান্ডার, দেখতে পেল ওরা। ওদের নিচে দূর পাল্লার তীরের হাত থেকে গা বাঁচিয়ে পথের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে সে। লোকটা লম্বা, ছিপছিপে, হেলমেটের চূড়ায় কর্নেলের প্রতীক উটপাখির পালক পরেছে।

ব্যাটার হাবভাব মোটেই ভালো ঠেকছে না, মন্তব্য করল তাইতা। লোকটার গায়ের রঙ শ্যামলা, কঠিন উঁচু হয়ে থাকা চিবুক, বাঁকানো নাক। ওকে চিনতে পারছ, সিদুদু?

পেরেছি, ম্যাগাস। কঠিন, নিষ্ঠুর লোক, আমরা সবাই তাকে ঘৃণা করি।

নাম?

কর্নেল সোকলোশ।

কর্নেল স্নেক, তরজমা করল তাইতা। নামের সাথীর সাথে অনেক মিল তার।

চাতালের নিয়ন্ত্রণ অধিকার করেই যোদ্ধাদের দুর্গের সামনের পাথরে ছাওয়া রাস্তা পরিষ্কার করতে পাঠিয়ে দিল সোকলোশ, একই সাথে যারা এখানকার প্রতিরক্ষায় আছে তাদের শক্তিরও পরীক্ষা নেবে।

কয়েকটা তীর পাঠাও ওকে লক্ষ্য করে, ফেনকে বলল তাইতা। ঝটপট তীর আলগা করে নিল মেয়ে দুটো। সিদুদুর তীরটা এক জাররিয়র মাথার ঠিক উপর দিয়ে চলে গেল, লোকটা মাথা নিচু করে দৌড়ে পালাল। আরেকজনের পায়ের গোছায় আঘাত লাগাল ফেন। নেকড়ের মতো অক্ষত পায়ের উপর পাক খেতে লাগল সে, অবশেষে সহযোদ্ধারা তাকে চেপে ধরে তীরের ফলাটা বের করে আনল। তারপর পথ ধরে ছুটে চলে গেল ওরা। দুজন আহতকে সাহায্য করছে। তারপর দীর্ঘ সময় নীরবতা বজায় রইল। এক সময় সশস্ত্র লোকদের বিরাট একটা দল বাঁক ঘুরে ট্র্যাক বরাবর দুর্গের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল।

মনে হচ্ছে এখন আমার নিচে যাবার সময় হয়েছে, বলল মেরেন। তারপর মই বেয়ে প্যারপেটে নেমে গেল। শত্রুপক্ষের পরের দলটা তীরের নাগালের মধ্যে আসামাত্র হিলতোকে ডাক দিল ওঃ তৈরি হও!

সমবেত হামলা! চিৎকার ছাড়ল হিলতো। তলোয়ার খাপে পুরে ধনুক আলগা করে নিল ওর লোকজন। নিশানা স্থির করো! ছুঁড়ো!

সকালের আকাশে উড়ে গেল নিক্ষিপ্ত তীরের ঝাঁক, যেন পঙ্গপালের ঝাঁক। জাররিয়দের উপর গিয়ে পড়ল ওগুলো। জাররিয়দের ঘোড়ার বর্মে ঝনঝন শব্দ তুলল ওগুলোর ফলা। কয়েক জন লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু বাকিরা কাছাকাছি ঘেঁষে মাথার উপর বর্ম তুলে ধরে ছামিয়ানার মতো তৈরি করে দুলকি চালে আগে বাড়ল আবার। বারবার হিলতোর লোকেরা তীরের আক্রমণ চালাতে লাগল, কিন্তু বর্মের ছত্রছায়ায় অক্ষত রয়ে গেল জাররিয়রা। দেয়ালের পায়ের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। পাথুরে গাঁথনির বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করল প্রথম দলটা, দ্বিতীয় দলটা ওদের কাঁধের উপর উঠে পিরামিড তৈরি করে ফেলল।

তৃতীয় সারির সৈনিকরা সেটাকে দেয়ালের চূড়ায় ওঠার সিঁড়ি হিসাবে কাজে লাগাল। তলোয়ার চালিয়ে, তীর ছুঁড়ে ওদের পিছু হটিয়ে দিল হিলতো-বাহিনী। অন্যরা তাদের জায়গায় দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল, একজনের তলোয়ারের ফলার সাথে আরেকজনের তলোয়ারের টক্কর লাগছে, ঠেলাঠেলি করছে ওরা। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছে লোকজন, একে অপরকে খিস্তি করছে। জাররিয় বাহিনীর একটা ছোট অংশ দেয়াল টপকে জোর করে প্যারাপেটের উপর উঠে এলো, কিন্তু ওরা সুযোগটা কাজে লাগানোর আগেই মেরেন, নাকোন্তো ও ইম্বালি হামলে পড়ল ওদের উপর। বেশিরভাগকেই দুভাগ করে ফেলল, দেয়াল থেকে ফেলে দিল অন্যদের।

মিনারের উপর ফেন ও সিদুদু তাইতার দুপাশে দাঁড়িয়ে সতর্কতার সাথে নিশানা বাছাই করছে, দেয়ালের নিচে জাররিয় ক্যাপ্টেন তার লোকজনকে আবার দলবদ্ধ করার চেষ্টা করার সময় ফেলে দিচ্ছে ওদের। তারপর যখন আক্রমণ মুখ থুবড়ে ব্যর্থ হলো, ওদের তীরের বৃষ্টি পলায়নের গতি বাড়াতে বাধ্য করল জাররিয়দের। নিহতদের লাশ দেয়ালের পায়ের কাছে ফেলে গেল শত্রুপক্ষ, কিন্তু আহতদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল।

দুপুরের আগে আরও দুই দফা আক্রমণ শানাল সোকলোশ। ওদের প্রথম হামলাটা যেভাবে পরল ঠেকাল মেরেন-বাহিনী, কিন্তু পরের হামলার সময় তিনটা আলাদা ডিটাচমেন্টে নিয়ে আগে বাড়ল জাররিয়রা, সাথে নিয়ে এলো তাড়াহুড়োয় তৈরি আক্রমণ মই।

যুগপতভাবে দেয়ালের মাঝখানে আর দুই প্রান্তে আক্রমণ চালাল ওরা। আগেই ক্ষীণ সারিতে ছড়িয়ে ছিল প্রতিরক্ষাকারীরা, কিন্তু এবার ত্রিমুখী হামলার মোকাবিলা করতে ওদের আরও ছোট ভাগে ভাগ করতে বাধ্য হলো মেরেন। মরিয়া লড়াই চলল। ওদের সাথে যোগ দিতে নেমে এলো তাইতা। অস্ত্রভাণ্ডারে পাওয়া তীরের বান্ডিলের সাথে মেয়েদের মিনারে রেখে এসেছে। সকালের বাকি সময়টায় দেয়ালের মাথায় অব্যাহত রইল লড়াই। অবশেষে ওরা যখন জাররিদের ছুঁড়ে ফেলে দিল, মেরেনের লোকদের তখন পর্যদস্ত অবস্থা। ওদের বার জন লোক খুন হয়েছে, বাকি দশ জন এমন মারাত্মক আহত হয়েছে যে লড়াই চালানোর অবস্থা নেই ওদের। বাকিদের বেশিরভাগই অন্তত পক্ষে ছোটখাট চোট পেয়েছে, ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে প্রায়। ট্র্যাকের দিক থেকে সোকলোশ ও তার ক্যাপ্টেনদের চিৎকার শুনতে পেল ওরা, আবার নতুন করে হামলার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে তারা।

ওদের আর বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব বলে মনে হয় না, প্যারাপেট বরাবর নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল মেরেন। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ফেন আর সিদুদুর দেওয়া চামড়ার পানির পাত্র থেকে পানি খাচ্ছে ওরা। তলোয়ার আর বর্শার ভোঁতা প্রান্তে ধার দিচ্ছে; ক্ষতস্থান বাঁধছে বা স্রেফ বিশ্রাম নিচ্ছে, ওদের চোখমুখ ফাঁকা, চোখে মলিন দৃষ্টি।

দালানকোঠায় আগুন লাগাতে তৈরি আছ তুমি? জানতে চাইল তাইতা।

মশাল তো জ্বালানোই আছে, নিশ্চিত করল মেরেন। দেয়ালের কেবল ভিত্তিই পাথরের তৈরি। মূল ভবন ও প্রহরামিনারসহ বাকি সব কিছুই কাঠের। আগুনের শিখা জাররিয়দের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার আগেই এইসব উপকরণ পাসের মুখ বন্ধ করে দেবে।

মেরেনকে রেখে প্যারাপেটের দূর প্রান্তে এলো তাইতা। এক কোণে বসে মাথার উপর জোব্বা টেনে দিল।

কৌতূহলের সাথে ওকে দেখছিল লোকেরা।

কী করছেন তিনি? জিজ্ঞেস করল একজন।

ঘুমাচ্ছেন, আরেকজন জবাব দিল।

উনি ধার্মিক মানুষ। প্রার্থনা করছেন।

ওর প্রার্থনার প্রয়োজন আছে আমাদের, মন্তব্য করল চার নম্বর।

তাইতা কী করতে চাইছে, জানে ফেন; কাছে এসে দাঁড়াল ও। নিজের শরীর দিয়ে ওকে আড়াল করে আপন মনস্তাত্ত্বিক শক্তিতে ওকে আরও শক্তি যোগানোর চেষ্টা করল।

অমন ভীষণ লড়াইয়ের পর নিজেকে স্থির করতে বেশ প্রয়াসের দরকার হলো তাইতার, তবে অবশেষে দেহের সীমানা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল, পাহাড়ের চূড়ায় উড়ে গেল ওর আসল সত্তা। রণক্ষেত্রের উপর নজর বুলিয়ে জাররিয় বাহিনীর জটলা দেখতে পেল, তিন হাজার বা তারও বেশি সৈন্য ট্র্যাক ধরে সমতলের দিকে যেতে সমবেত হচ্ছে। দুর্গের ঠিক নিচে, কিন্তু দেয়ালের কাছ থেকে বেশ দূরে পরের হামলা সংগঠিত হতে দেখল ও। এবার পাহাড় চূড়া পার হয়ে গেল ও। তাকাল কিতানগালে নদী ও হ্রদের দূরবর্তী নীলের দিকে।

নদীর মুখে নৌকা ঘাটে তিনাতের লোকদের দেখতে পেল। সেনাছাউলী দখল করে নিয়েছে ওরা। এখন নদীর জোরাল প্রবাহে নৌকো জুড়ে নামানোর প্রয়াস পাচ্ছে। এরই মধ্যে শরণার্থীদের প্রথম দলটা নৌকায় উঠে পড়েছে, বাকিরা বৈঠা টানার বেঞ্চে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু আরও শত শত লোক এখনও পাহাড়ী পথে নামছে। মাটির আরও কাছাকাছি নেমে এলো ও। পাহাড়ের শরীরকে বিভক্তকারী গোর্জের দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ চোখে। ওটার উপর দিয়ে চলে যাওয়া ঝুলন্ত সেতুটাকে ধূসর পাথরের বিশাল কাঠামোর বিপরীতে এতটুকুন মনে হচ্ছে। শরণার্থীদের শেষ দলটা গোর্জের উপর দিয়ে বিপদসঙ্কুল যাত্রা শুরু করতে নাজুক কাঠের তক্তার উপর উঠতে শুরু করেছে। তিনাতের লোকেরা দুর্বল ও প্রবীনদের সাহায়্য করছে, ওর কুঠারবাহিনী সেতুর পাইলন কেটে ওটাকে নিচের অসীম গহ্বরে ফেলে দিতে তৈরি হয়ে আছে। সজোরে পিছু হটল তাইতা, দেহের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তুলে নিল। তারপর মাথার হুড খুলে তড়াক করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

কী জানতে পেলে, তাইতা? শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল ফেন।

আমাদের বেশিরভাগ লোক গোর্জ পার হয়ে গেছে, জবাব দিল ও। এখন দুর্গ ছেড়ে গেলে আমরা ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে বাকিরাও সেতু পার হয়ে যেতে পারবে। ফেন, তুমি আর সিদুদু ঘোড়াগুলোকে তৈরি রাখ।

ওকে কাজটা করার জন্য রেখে প্যারাপেটের উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে মেরেনের কাছে চলে এলো ও। লোকজন জড়ো করো। দেয়ালে আগুন লাগিয়ে দাও, জাররিয়দের পরের হামলা শুরু হওয়ার আগেই পথে নেমে পড়ো।

লড়াইয়ের অবসান ঘটেছে জানতে পেরে লোকদের প্রাণশক্তি চড়ে উঠল। অল্প সময়ের মধ্যেই যার যার অস্ত্র ও আহতদের বয়ে দুর্গের পেছনের ফটক দিয়ে ঠিক পথে এগোতে শুরু করল ওরা। আগুন ধরানোর কাজ তদারক করতে রয়ে গেল তাইতা। জাররিয় সেনাছাউনী মেঝের আস্তরণ ও মাদুর হিসাবে উলুখাগড়া ব্যবহার করেছে। সেগুলোকেই এখন দেয়াল বরাবর ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। মেরেনের লোকেরা ওগুলোকে কোয়ার্টার মাস্টার স্টোরে পাওয়া তেলে আক্ষরিক অর্থেই ভিজিয়ে ফেলেছে। জ্বলন্ত মশাল ওগুলোর উপর ছুঁড়ে দিতেই আগুন ধরে গেল, নিমেষে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। কাঠের দেয়ালে এমন জোরাল আগুন ধরে গেল যে তোরণের দিকে ছুট লাগাতে বাধ্য হলো তাইতা ও মশালধারীরা।

আগেই ওয়ার্লউইভের পিঠে চেপে বসেছিল ফেন, উইন্ডস্মোকের লাগাম ধরে ওর অপেক্ষা করছে। একসাথে ট্রাক ধরে শেষ প্লাটুনের পেছন পেছন ছুটতে শুরু করল ওরা। মেরেন ও হিলতো রয়েছে ওটার নেতৃত্বে।

ঝুলন্ত সেতুর কাছে পৌঁছে তখনও অন্তত শখানেক শরণার্থী ওপারে যেতে পারেনি দেখে হতাশ হয়ে পড়ল ওরা। ভীড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে সামনে এগিয়ে গেল মেরেন, কারণ কী জানতে চায়। পাঁচজন বয়স্কা কিন্তু মুখরা মহিলা গোর্জের উপরের সংকীর্ণ সেতুতে পা রাখতে অস্বীকার যাচ্ছে। পথের উপর শুয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে ওরা, কেউ কাছে যাবার চেষ্টা করলেই লাথি হাঁকাচ্ছে তাদের।

মারতে চাও নাকি আমাদের! গজগজ করে চলেছে ওরা।

আমদের এখানেই ফেলে যাও। গর্তে ফেলার বদলে আমাদের বরং জাররিয়দের হাতে তুলে দাও। ওদের ভীতি সংক্রামক হয়ে দাঁড়াল। পেছনে যারা আসছিল, এখন তারা পিছু হটতে চাইছে; সারির পেছনের লোকদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাটের গুরুর কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে কাঁধে তুলে নিল মেরেন। এবার চলো। ওর কানে কামড়ে দিতে চাইল মহিলা, খামচে দেওয়ার চেষ্টা করল মুখে। কিন্তু দাঁত ওর ব্রোঞ্জের হেলমেটের উপর দাগ ফেলতে পারল না। সংকীর্ণ পথে ওকে নিয়ে দৌড় লাগাল মেরেন, পায়ের নিচে তক্তা থরথর করে কাঁপছে। দুপাশ যেন সীমাহীন। বয়স্কা মহিলা আবার আর্তনাদ করে উঠল। সহসা মেরেন। বুঝতে পারল ওর পিঠ ভিজে গেছে। ভয়ঙ্কর হাসিতে ফেটে পড়ল ও। বেশ খাটুনি গেছে। আমাকে শীতল করে দেওয়ায় ধন্যবাদ। উল্টো দিকে এসে মহিলাকে নামিয়ে দিল ও। ওর চোখজোড়া উপড়ে তোলার শেষ একটা প্রয়াস পেল সে। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে লুটিয়ে পড়ল পথের উপর। ওকে রেখে বাকিদের তুলে আনতে ফিরে গেল মেরেন। কিন্তু হিলতো ও অন্যরা ইতিমধ্যে গার্জের উপর দিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রত্যেকের কাঁধে এক জন করে বয়স্কা মহিলা, নিজেদের ছাড়িয়ে নিতে যুঝছে ওরা, পিঠের উপর চিৎকার করছে। ওদের পেছনে লোজন আরও একবার গোর্জের উপর দিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু দেরির জন্যে খেসারত গুনতে হলো ওদের। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল মেরেন, তাইতাকে কলামের একেবারে সামনের কাতারে দেখতে পেল।

দুর্গের দেয়ালের আগুন সোকলোশকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবে না। ওদের সবাইকে পার করার আগেই আবার আমাদের উপর হামলে পড়বে সে। সবাই পার হওয়ার আগে সেতুটা কাটার সাহস করেত পারব না আমরা, তাইতাকে বলল সে।

সংকীর্ণ পথে তিনজনই গোটা সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, বলল তাইতা।

হিলতো আর আমরা দুজন? জিজ্ঞেস করল মেরেন। সেথের পাছার পাকা ফোঁসকার দোহাই, ম্যাগাস, পরিস্থিতি কত পাল্টে গেছে ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আপনিই সবচেয়ে শক্তিশালি ও দক্ষ তলোয়ারবাজ।

আজকের দিনে এই কথাটা পরখ করার একটা সুযোগ পাব আমরা, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। তবে এটা নিশ্চিত করো যে আমাদের মধ্যে কেউ পড়ে গেলে যেন পেছন থেকে সুঠাম কেউ এসে তার জায়গা নেয়।

সেতুর উপর তখনও অন্তত পঞ্চাশজন ওদের পালা আসার অপেক্ষায় ছিল, এমন সময় পেছনে সোকলোশের হুঙ্কার শুনতে পেল ওরা: পায়ের দুমাদুম আওয়াজ, বর্ম আর খাপে রাখা অস্ত্রের ঝনঝনানি।

কাঁধে কাঁধে লাগিয়ে, পথের উপর অবস্থান গ্রহণ করল তাইতা, মেরেন ও হিলতো। মাঝখানে রয়েছে তাইতা, হিলতো বামে আর মেরেন বাইরের দিকে, ওর পাশেই সোজা গভীর গহ্বরের দিকে নেমে গেছে ক্লিফ প্রাচীর। নাকোন্তোসহ আরও বাছাই করা দশজন লোক ওদের পেছনে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রয়োজনে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। ট্র্যাকের আরেকটু সামনের দিকে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ফেন ও সিদুদু, তাইতা ও মেরেনের ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছে। যার যার ধনুক নামিয়ে নিয়েছে ওরা, তৈরি রেখেছে। স্যাডলের উপর উঁচু হয়ে বসে থাকায় তাই ও অন্যদের মাথার উপর দিয়ে সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

পথের বাঁক ঘুরে এগিয়ে এলো জাররিয় ব্রিগেডের সামনের সারিটা, পরক্ষণেই ওদের তিনজনকে মোকাবিলা করতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল। ওদের পেছনে অনুসরণকারী দলটা এগিয়ে এসে থামল। ওরা ফর্মেশন ঠিক করার আগে খানিকক্ষণের জন্যে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। তারপর নীরবে তিন রক্ষীর দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। প্রতিপক্ষের শক্তি আন্দাজ করার প্রয়োজনীয় . সময়টুকুই স্থায়ী হলো সেটা। তারপর সামনের কাতারের বিশালবপু সার্জেন্ট তলোয়ার দিয়ে ওদের দিকে ইঙ্গিত করে মাথা পেছনে হেলিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

তিন হাজারের বিরুদ্ধে তিনজন! হা! হা! হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হলো তার। ওহ! ভয়ে মরে গেলাম! বর্মের উপর তলোয়ারের ফলা ঘঁষতে শুরু করল সে। চারপাশের লোকজন ভীতিকর একঘেয়ে ছন্দে যোগ দিল তার সাথে। ঢাল দিয়ে শব্দ করতে করতে সামনে বাড়ল জাররিয়রা। ছিলা টানাটান করা ধনুকের তীরের উপর দিয়ে ওদের উপর নজর রাখছে ফেন। জাররিয়রা আক্রমণ শানানোর ঠিক আগ মুহূর্তে মুখের কোণ দিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে উঠল ও, দাড়িঅলা সার্জেন্টের উপর থেকে দৃষ্টি সরাল না, ঢালের কিনারার উপর দিয়ে লোকটার চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। মাঝখানেরটাকে কায়দা মতো পেয়েছি। তোমার দিকেরটাকে গাঁথ তুমি।

ব্যাটাকে চোখে ধরেছিল আমার, বিড়বিড় করে বলল সিদুদু।

মারো ওকে! বলে উঠল ফেন। একসাথে তীর ছুঁড়ল ওরা। তাইতার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল জোড়া তীর। জাররিয় সার্জেন্টের চোখে গিয়ে বিধল একটা, উল্টে পড়ে গেল সে, বর্মের ভারে পেছনের দুজনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লুটিয়ে পড়ল তারাও। সিদুদুর তীর তার পাশের লোকটার মুখে লাগল। দুটো দাঁত খসে পড়ল তার, গলার ভেতর দিকে গিয়ে স্থান করে নিল তীরের ফলা। ক্রোধে চিৎকার করে উঠল তার পেছনের সৈনিকরা। লাশ টপকে তাইতা ও ওর দুই সঙ্গীর দিকে তেড়ে এলো। এখন দুপক্ষই এত কাছাকাছি এসে পড়েছে যে মেয়ে ও নিজেদের লোকদের আঘাত করার আশঙ্কায় তীর ছোঁড়ার সাহস করে উঠতে পারছে না।

অবশ্য, একেকবারে মাত্র তিনজন জাররিয় সারির সামনে আসতে পারছে। ওর দিকে ছুটে আসা লোকটার আঘাত বাউলি কেটে সরে গেল তাইতা, তারপর তলোয়ারের নিচু করে চালানো কোপে তার দুটো পা আলগা করে দিল। লোকটা লুটিয়ে পড়তেই তার ব্রেসপ্লেটের ভেতর দিয়ে সোজা হৃৎপিণ্ডের ভেতর ফলা চালিয়ে দিল তাইতা। শত্রুর ফলা পাশ কাটাল হিলতো, তারপর পাল্টা হামলায় মেরে ফেলল তাকে। লোকটার হেলমেটের ভাইজরের নিচ দিয়ে উড়ে গেল ওটা। একসাথে হয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল ওরা তিনজন।

আরও জাররিয় নিহত সহযোদ্ধার লাশ টপকে তেড়ে এলো ওদের দিকে। মেরেনকে আঘাত করল একজন, বাউলি কেটে সরে গেল ও; প্রতিপক্ষের তলোয়ার-ধরা হাতের কব্জি আঁকড়ে ধরে ক্লিফের কিনারার উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল নিচে। আর্তনাদ করে নিচের পাথরে ধপাস করে পড়ল সে। দুই হাতে তলোয়ার উঁচু করে ধরল তাইতার দিকে এগিয়ে আসা পরের লোকটা, কাঠ কাটার ভঙ্গিতে ওর মাথা লক্ষ্য করে চালাল। তার তলোয়ারের আঘাত গ্রহণ করল তাইতা, তারপর চট করে সামনে এগিয়ে বাম হাতে ধরা ড্যাগারের ফলা সেঁধিয়ে দিল তার পেটে। ঠেলে পাঠিয়ে দিল নিজের দলের দিকে, টলতে টলতে সরে গেল সে। আরেকজনকে পঙ্গু করে দিল মেরেন, লোকটা পড়ে যাবার সময় সজোরে তার মাথায় লাথি হাঁকাল; ডিগবাজি খেয়ে ক্লিফের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল সে। এক আঘাতে পরের জাররিয়র হেলমেট কেটে দিল হিলতো, ফলে ব্রোঞ্জের চূড়া ভেদ করে খুলির গভীরে বসে গেল সেটা। তীরের আঘাত তলোয়ার ঠেকাতে পারল না। মট করে ভেঙে গেল সেটা, হিলতোর হাতে রয়ে গেল কেবল হাতলটা।

একটা তলোয়ার! আমাকে একটা নতুন তলোয়ার দাও, মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু পেছন থেকে কেউ তলোয়ার তুলে দেওয়ার আগেই ফের আক্রমণের মুখে পড়ে গেল ও। ড্যাগারের হাতলটা জাররিয়র মুখের দিকে ঠেলে দিল হিলতো, কিন্তু চট করে নিচু হয়ে গেল লোকটা, হিলতার দিকে ঠেলে দেওয়া হেলমেটের ভাইজরের দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল ওটা। জায়গামতোই লাগল আঘাতটা, কিন্তু শক্ত করে তার কোমর জড়িয়ে ধরল হিলতো, নিজের লোকের সারির ভেতর টেনে নিয়ে এলো। হিলতোর কজা থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে যুদ্ধ করার সময় ওর পেছনের লোকজন মেরে ফেলল তাকে। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে হিলতো; ওইদিন আর লড়াই করার উপায় রইল না ওর। ধরাধরি করে সেতুর কাছে নিয়ে গেল সহযোদ্ধারা, ওদের শরীরের উপর সমস্ত ওজন ছেড়ে দিল ও। তাইতার পাশে ওর জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করল নাকোন্তো। ওর দুহাতে একটা করে স্ট্যাবিং বর্শা রয়েছে। সেগুলো এমন নৈপূণ্য ও জোরে ঘোড়াতে শুরু করল যে ব্রোঞ্জের ডগা নৃত্যরত আলোর মতো ঝাপসা হয়ে গেল। পথের উপর মৃত ও মৃত্যুপথযাত্রী জাররিয়দের ফেলে সেতুর মাথার দিকে পিছিয়ে আসতে শুরু করল ওরা তিনজন, শরণার্থীদের চলার গতির সাথে নিজেদের গতি খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।

অবশেষে চিৎকার করে উঠল ফেন। সবাই পার হয়েছে। যুদ্ধের ডামাডোল ছাপিয়ে ভেসে গেল ওর সুরেলা কণ্ঠ। তাই যার সাথে লড়ছিল এক কোপে তাকে খতম করল, গলায় পোচ লাগাল একটা, তারপর পেছনে তাকাল। সেতু ফাঁকা।

কুঠারঅলাদের দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে দাঁড়াতে বলো। সেতু কেটে ফেল! ফেনের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল ও। ওকে নির্দেশ পুনরাবৃত্তি করতে শুনল। পরের শত্রুর মোকাবিলা করতে ঘুরে দাঁড়াল এবার। ওদের মাথার উপর দিয়ে সোকলোশের হেলমেটে লাগানো উটপাখির পালক দেখতে পাচ্ছে। লোকদের সামনে এগোতে ধমক দিচ্ছে সে। কিন্তু সহযোদ্ধাদের কচুকাটা হতে দেখেছে ওরা। ওদের পায়ের নিচের মাটি এখন রক্ত আর কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। পুরো রাস্তা লাশে ভরা। সাহস উবে যেতে শুরু করেছে ওদের। পেছনে আবার চোখ ফেরানোর মতো যথেষ্ট সময় পেল তাইতা। সেতুর কাঠ ও রশির উপর কুড়োলের আঘাতের আওয়াজ কানে আসছে। তবে ঘোড়ার পিঠে মেয়ে দুটি এখনও গোর্জের ওপাশে যায়নি। ওদের সাথে পুরুষের একটা ছোট দল সারির কোনও ফাঁক পূরণ করতে তৈরি হয়ে আছে।

পিছিয়ে যাও! ওদের নির্দেশ দিল তাইতা। সবাই, পিছিয়ে যাও। দ্বিধা করল ওরা। শত্রুর মোকাবিলায় এত অল্প লোক রেখে যেতে অনীহ। বলছি চলে যাও। এখানে আর বেশি কিছু করার নেই তোমাদের।

পেছাও! গর্জে উঠল মেরেন। জায়গা দাও আমাদের। আমরা আসার পর অনেক তাড়াতাড়ি ঘটবে সবকিছু।

ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল মেয়েরা, সেতুর তক্তার উপর আওয়াজ তুলল ওদের ঘোড়ার খুর। অন্যরা ওদের অনুসরণ করে সেতুর ওপারে দূর প্রান্তে পৌঁছাল। নাকোন্তো, মেরেন ও তাইতা এখনও জাররিয় বাহিনীর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে সেতুর উপর উঠে ঠিক মাঝখানে অবস্থান নিল। দুপাশেই গভীর খাদ। লোকেরা আসল খুঁটি কাটার সময় কুড়োলের আওয়াজের সাথে প্রতিধ্বনি তুলছে ক্লিফ।

ঝেড়ে দৌড়ে সেতুর উপর এলো শত্রুপক্ষের তিনজন। ওদের পায়ের নিচে কাঁপছে তক্তাগুলো। কেন্দ্রের তিনজনের ঢালে নিজেদের ঢালের বাড়ি খাওয়াল ওরা। তলোয়ার হাঁকিয়ে, ঠেলে দুই পক্ষই দোল খাওয়া সেতুর উপর টিকে থাকল। প্রথম জাররিয় সারিকে কতল করার পর অন্যরা ওদের জায়গা দখল করতে ধেয়ে এলো; রক্তের পুকরে পিছলে যাচ্ছে ওদের পা, হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মৃত সহযোদ্ধাদের উপর। ওদের পেছনে অন্যরা হামাগুড়ি দিয়ে সংকীর্ণ সেতুতে উঠে আসছে। তলোয়ারের ফলার সাথে তলোয়ারের ফলার সংঘর্ষ হচ্ছে। লুটিয়ে পড়ছে মানুষ, তারপর সেতুর কিনারা দিয়ে পিছলে নিচে পড়ে যাচ্ছে, মরণ চিৎকার উঠছে ওদের কণ্ঠে। কিন্তু পুরো সময় জুড়ে কাঠের গায়ে কুড়োল হাঁকানোর শব্দ ও চিৎকার নতুন করে প্রতিধ্বনি সূচনা করছে।

সহসা কুকুরের মাছি তাড়ানোর মতো থরথর কেঁপে উঠল গোটা সেতু। এক পাশে খসে পড়ে বেঁকে ঝুলতে লাগল। বিশজন জাররিয় আর্তনাদ ছেড়ে সোজা নিচের গহ্বরের দিকে ধেয়ে গেল। তাইতা ও মেরেন দোলায়মান সেতুর উপর ভারসাম্য বজার রাখতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কেবল নাকোন্তো খাড়া রইল।

ফিরে এসো, তাইতা! চিৎকার করে উঠল ফেন ও ওর চারপাশের অন্যরা। ফিরে এসো! সেতু ভেঙে গেছে! ফিরে এসো!

ফিরে যাও! মেরেনের উদ্দেশে গর্জে উঠল তাইতা, লাফ দিয়ে উঠেই আক্রোব্যাটের মতো ভারসাম্য বজায় রেখে দৌড় লাগাল। ফিরে যাও! নাকোন্তোকে নির্দেশ দিল ও, কিন্তু যুদ্ধের উন্মাদনায় লাল হয়ে আছে শিলুকের চোখ। শত্রুর উপর স্থির সেগুলো, তাইতার কথা শুনেছে বলে মনে হলো না। তলোয়ার দিয়ে তার পিঠে সজোরে আঘাত করল তাইতা। ফিরে যাও! যুদ্ধ শেষ! ওর বাহু শক্ত করে ধরে দূর প্রান্তের দিকে ঠেলে দিল ওকে।

যেন ঘোর থেকে বের হয়ে এসেছে, মাথা নাড়ল নাকোন্তো, তারপর মেরেনের পিছু পিছু দৌড় লাগাল। কয়েক গজ পেছনে থেকে অনুসরণ করল তাইতা। সেতুর শেষ মাথায় পৌঁছুল মেরেন, লাফ দিয়ে পড়ল পাথুরে পথের উপর, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে চাবুকের শব্দের মতো শব্দ করে সেতুকে আটকে রাখা মূল গাই রোপের একটা ছিঁড়ে গেল। তীক্ষ্ণ কোণে ঢেউ তুলে দুলতে শুরু করল ক্যাটওঅক, তারপর থামল আবার। জাররিয়দের যারা তখনও কোনওমতে খাড়া হয়ে ছিল, তারা আর টিকতে না পেরে একের পর একের কিনারার দিকে পিছলে গেল, তারপর টপাটপ খসে পড়ল। সেতুটা আবার কাঁপতে শুরু করার আগেই জমিনে পা রাখল নাকোন্তো।

সেতুটা প্রবলভাবে কেঁপে ওঠার সময়ও ওটার উপর ছিল তাইতা। কিনারার দিকে পিছলে গেল ও, আত্মরক্ষা করতে একদিকে ছুঁড়ে দিল তলোয়ারটা, তারপর নিজেকে মিশিয়ে দিল। প্ল্যাঙ্কের বাঁধনের ভেতর সংকীর্ণ ফোকর রয়েছে। আঙুল বাঁকা করে সেগুলোর সাহায্যে উপরে উঠে আসার সময় হাত রাখার মতো একটা জায়গা পেয়ে গেল। ফের কেঁপে উঠল সেতুটা। গড়িয়ে প্রায় ক্লিফের গায়ের কাছে এসে থামল আবার। গোর্জের উপর ঝুলছে ওর পাজোড়া, আঙুলের ডগা দিয়ে কোনমেতে ঝুলে আছে ও। পা রাখার মতো একটা জায়গার খোঁজ করতে লাগল ও। কিন্তু স্যান্ডেলের পায়াগুলো সংকীর্ণ ফোকরে ঢোকানোর পক্ষে বেশ বড়। হাতের শক্তি জড়ো করে নিজেকে টেনে ওপরে ওঠাল ও।

ওর ঠিক মাথার কাছে তার উপর এ্যাচ করে বিধল একটা তীর। গোর্জের উল্টোদিকে দাঁড়ানো জাররিয়রা ওকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছ। নিজেকে বাঁচনোর মতো অবস্থায় নেই সে। একের পর হাত চালিয়ে নিজেকে ওপরে ওঠাল। প্রতিবার একটা হাত ছেড়ে দেওয়ার সময় এক হাতে ঝুলে থেকে ওটার ওপরের কোনও একটা প্ল্যাঙ্কের ফোকর খুঁজছে ও। সেতুটা পাক খেয়ে যাওয়ায় প্ল্যাঙ্কগুলোর ভেতরের ফোকর আগেরটার চেয়ে পরেরটা অনেক সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। অবশেষে এমন একটা জায়গায় পৌঁছুল ও, যেখানে আর পরের ফোকরে আঙুল ঢোকাতে পারল না, তো অসহায়ের মতো ঝুলে রইল। পরের তীরটা এত কাছে এসে লাগল যে ওর টিউনিকের স্কার্টকে কাঠের সাথে গেঁথে দিল।

তাইতা! ফেনের কণ্ঠস্বর। মাথা ঘুরিয়ে ওপরে তাকাল ও। ওর থেকে দশ ফুট ওপরে ফেনের মাথা। চিৎ হয়ে বসে কিনারার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। হে, প্রিয় আইসিস, আমি তো ভেবেছি তুমি পড়ে গেছ, কেঁপে গেল ওর কণ্ঠস্বর। আরেকটু ধরে থাকো। চলে গেল ও। আরেকটা তীর এসে বিঁধল ঠিক ওর বাম কানের কাছে কাঠের গায়ে।

ধরো, এটা ধরো। ফাঁস বানানো একটা হল্টার দড়ির এসে পড়ল ওর পাশে। ওটার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল ও, ভেতরে মাথা গলিয়ে বগলের নিচে ফাঁসটাকে বসিয়ে নিল।

তৈরি? ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে আছে ফেনের চোখ। অন্য প্রান্ত উইন্ডস্মোকের স্যাডলের সাথে বাঁধা আছে। আমরা টেনে তুলছি তোমাকে। আবার অদৃশ্য হয়ে গেল ও। একটা ঝাঁকি খেয়ে টান টান হয়ে গেল দড়িটা। উপরে ওঠার সময় ঝুলন্ত সেতুর উপর হাত পা চালিয়ে নিজেকে রক্ষা করল ও। আরও তীর ছুটে এলো ওর দিকে, কাঠে বিধল। তবে গাছে উঠে পড়া চিতার নিচে একপাল নেকড়ের মতো ওর রক্তের নেশায় জাররিয়দের চেঁচামেচি শুনতে পেলেও একটা তীরও স্পর্শ করতে পারল না ওকে।

রাস্তার সমতলে ওঠার পর মেরেনের শক্তসমর্থ লোকজন ও নাকোন্তো ওকে নিরাপদে তুলে নিতে হাত বাড়িয়ে দিল। জমিনে এসে উঠে দাঁড়াল ও, অমনি উইন্ডস্মোকের লাগাম ছেড়ে ছুটে এলো ফেন। নীরবে ওকে আলিঙ্গন করল ও, স্বস্তির অশ্রু গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে। চকচক করছে।

*

সেদিন রাতে শরণার্থীদের কলামটাকে ট্রাক বারাবর এগিয়ে নেওয়া অব্যাহত ৬রাখল ওরা। ভোরের প্রথম আলোয় শেষ দলটাকে কিতানগালে নদীর তীরে নিয়ে আসতে পারল। নৌকাঘাটের গেটে ওদের অপেক্ষায় ছিল তিনাত। তাইতার সাথে যোগ দিতে দ্রুত ছুটে এলো সে। আপনাকে নিরাপদে থাকতে দেখে খুশি হয়েছি, ম্যাগাস, তবে লড়াইটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় দুঃখ লাগছে। শুনেছি দারুণ শক্ত লড়াই হয়েছে নাকি। জাররিয়দের পিছু ধাওয়ার আর কী খবর আছে?

গোর্জের সেতুটা ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে তাই বলে বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না ওদের। সিদুদু বলছে দক্ষিণে আরও চল্লিশ লীগ দূরে একটা সহজ পথ আছে। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি সোকলোশ ওটার খবর জানে। লোকজন নিয়ে ওই পথ ধরবে সে। আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত ছুটতে পারবে। অচিরেই ওকে আমাদের সামনে আশা করতে পারি।

দক্ষিণের পথটাই জাররিতে ঢোকার মূল রাস্তা। সোকলোশ অবশ্যই ওটার কথা জানে।

পথে লোক রেখে এসেছি যাতে ওর দিকে খেয়াল রাখতে পারে, বলল তাইতা। এইসব লোককে এখুনি নৌকায় তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে ঘোড়গুলোকে বোঝাই করল ওরা। তারপর অবশিষ্ট শরণার্থীদের।

শেষ কয়েক জন নৌকায় ওঠার আগেই পিকেটাররা ঘোড়া হাঁকিয়ে নৌকাঘাটে হাজির হলো। জাররিয়দের সামনের কাতারের লোকজন ঘণ্টাখানেকের ভেতর হামলে পড়বে আমাদের উপর।

মেরেন ও ওর লোকজন শরণার্থীদের শেষ দলটাকে জেটি বরাবর সামনে নিয়ে নৌকায় তুলে দিল। সবগুলো নৌযান ভরে ওঠার পরপরই বৈঠাঅলারা নদীর মূল স্রোতে নিয়ে এলো ওদের যান, তারপর স্রোতের দিকে গলুই ঘুরিয়ে নিল। ফ্লোটিলার শেষ নৌকায় হিলতোর খাটিয়াসহ উঠল ফেন ও সিদুদু। জাহাজঘাটায় বিশটা জাহাজ পড়ে রইল খালি, তাইতা পাড়ে রয়ে গেল ওগুলোর ধ্বংস তত্ত্বাবধান করবে বলে। ওগুলোর ভেতর জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে দিল ওরা, কাঠের গায়ে দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠলে টেনে পানিতে নামিয়ে আনল, এখানে দ্রুত পানির কাছে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সব। নৌকাঘাটকে ঘিরে রাখা প্রাচীর থেকে পাহারাদাররা কুড়ু শিংয়ের শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে সতর্ক করে দিল ওদের। শত্রুকে দেখা গেছে।

নৌকার জন্যে চূড়ান্ত সংঘাত হলো। মেয়ে দুটো যেখানে ওদের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল সেটার ডেকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তাইতা ও মেরেন। হাল ধরল মেরেন, বৈঠাঅলারা ডক থেকে নৌকাটাকে বের করে আনল। জাররিয় ভ্যানগার্ডের প্রথম দলটা যখন ঝড়ের বেগে নৌকাঘাটে হাজির হলো তখনও ওরা তীরের আওতায় রয়ে গেছে। স্যাডল থেকে নেমে তীরে ভীড় করে দাঁড়াল ওরা, ঝড়ের মতো তীরের বৃষ্টি শুরু করল, ওগুলোর কয়েকটা ডকের গায়ে বিধলেও চোট পেল না কেউ।

প্রশস্ত কিতানগালে নদীর স্রোত ধরার জন্যে গলুই ঘুরিয়ে নিল মেরেন, ওদের টেনে নিয়ে চলল ওটা, প্রথম বাঁক পার করে আনল। ওরা জাররিয় ম্যাসিফের ক্লিফের দিকে তাকানোর সময় দীর্ঘ স্টিয়ারিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল ও। ইয়োসের সাম্রাজ্য ছেড়ে আসার সময় আনন্দে আপুত থাকার কথা হলেও বরং নীরব ও গম্ভীর হয়ে আছে ওরা।

পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে আছে ফেন ও তাই। অবশেষে নীরবতা ভাঙল ফেন। কেবল তাইতাকে শোনাতে নিচু কণ্ঠে কথা বলল। তাহলে অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। পালাতে পেরেছি, কিন্তু ডাইনীটা বেঁচে আছে, এখন নীল নদী বইছে না।

খেলা এখনও শেষ হয়নি। ঘুটি এখনও টেবিলে সাজানো আছে, বলল তাইতা।

তোমার কথার মানে বুঝলাম না, মাই লর্ড। জাররি থেকে সটকে পড়ছি আমরা। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সরে এসেছি, ডাইনীটাকে জীবিত রেখে যাচ্ছি। মিশর ও ফারাওর কাছে নিয়ে যাবার মতো কিছুই নেই তোমার কাছে, স্রেফ কিছু কাহিল দর্শন পলাতক ও আমাদের নিজস্ব কিছু দাস। মিশর এখনও অভিশপ্তই আছে।

না, কেবল এইটুকুই সাথে নিচ্ছি না। ইয়োসের সমস্ত জ্ঞান ও নাক্ষত্রিক শক্তি রয়েছে আমার সাথে।

তাতে তোমার বা ফারাওর কী লাভ হবে, যদি মিশর খরায় শেষ হয়ে যায়?

আমি হয়তো ডাইনীর স্মৃতি তার রহস্য ও ষড়যন্ত্র বানচাল করার কাজে ব্যবহার করতে পারব।

তুমি কি এরই মধ্যে তার জাদুর রহস্য জেনে গেছ? ওর মুখের দিকে চেয়ে আশান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইল ফেন।

তা জানি না। ওর কাছ থেকে জ্ঞানের এক পাহাড় ও সাগর ছিনিয়ে নিয়েছি আমি। আমার অন্তস্তল ও চৈতন্য ভরে গেছে। এত বেশি সেই জ্ঞান যেন অসংখ্য হাড়অলা একটা কুকুর। এর বেশির ভাগই আমাকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। সম্ভবত এর কিছু অংশ এত গভীরে পুঁতে রাখা হয়েছে যে কোনওদিন আর উদ্ধার করতে পারব না। অন্তত তা আত্মস্থ করতে কিছু সময় লাগবে। তোমার সহায়তা লাগবে সেজন্যে। আমাদের দুজনের মন এমনভাবে খাপ খেয়ে গেছে যে কেবল তুমিই আমার কাজে সাহায্য করতে পারো।

আমাকে সম্মানিত করলে তুমি, ম্যাগাস, সহজ কণ্ঠে বলল ফেন।

ভাটিতে অনেকটা পথ ওদের ধাওয়া করল জাররিয়রা। নদীর তীর বরাবর চলে যাওয়া ট্র্যাক ধরে প্রবল বেগে ধেয়ে এলো যতক্ষণ না জলাভুমি ও নিবিড় বন ওদের একাজে ইস্তফা দিতে বাধ্য করল। স্রোতের টানে ভেসে চলল নৌবহর, চাঁদের পাহাড়ে ঝরা বৃষ্টির পানিতে ভরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে ওটা, শত্রুকে পেছনে ফেলে গেলে ওরা।

রাত নামার আগেই সেদিন স্কোয়াড্রনের সামনের সারির যানগুলো প্রথম জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছাল। অনেক মাস আগে এটা ওদের যাত্রা বিঘ্নিত করেছিল। কিন্তু এখন শাদা পানি প্রবল বেগে নিচে পাঠিয়ে দিল ওদের, ঝাপসা হয়ে গেল দুইপাশে তীর। জলপ্রপাতের শেষে নিচের তীরে জাররিয় সীমানাপ্রাচীর ও ছোট সেনাছাউনীর নিচে ঠেকার পর ওরা লক্ষ করল ফ্লোটিলার আগমন টের পেয়েই সৈনিকরা সটকে পড়েছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ব্যারাকগুলো, কিন্তু গুদামঘরগুলো অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য রসদে ভর্তি। বার্জগুলো রসদে বোঝাই করে আবার পুব দিকে আগে বাড়ল ওরা। নৌকায় ওঠার মাত্র দশদিনের মাথায় কিতানগালের মুখ দিয়ে বের হয়ে নালুবালে হ্রদের বিশাল বিস্তারে এসে পড়ল, তারপর উত্তরে বাঁক নিল, তীর অনুসরণ করে ঘুরে তামাফুপা পর্বতমালার দিকে এগিয়ে চলল।

যাত্রাটা রুটিনে পরিণত হতে হতে নিজের ও ফেনের জন্যে বৈঠার বেঞ্চির ঠিক সামনে ডেকের এক কোণে একটা জায়গা দখল করে নিল তাইতা। ছায়া ও গোপনীয়তার স্বার্থে ম্যাটিং পাল ডেকের উপর মেলে দিয়েছে। একটা মাদুরে বসে দিনের প্রায় পুরো সময়ই এক সাথে কাটায় ওরা, পরস্পরের হাত ধরে একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে তেনমাস ভাষায় ফিসফিস করে ওর সাথে কথা বলে তাইতা। ওর মনের ভেতর উপচে ভরা সব তথ্য ফেনকে জানানোর এটাই একমাত্র জুৎসই ভাষা।

ওর সাথে ফিসফিস করে কথা বলার সময়ই ফেনের মন ও নাক্ষত্রিক আত্মা বিস্তৃত হওয়ার ব্যাপারে তীক্ষ্ণভাবে সচেতন হয়ে উঠল তাইতা। ওর কাছে যতটুকু নিচ্ছে তার প্রায় সমান সমানই ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলছে ওকে। তাছাড়া ক্লান্ত করা তো দূরের কথা বরং অবিকিরত মানসিক কার্মকাণ্ড আরও প্রাণবন্ত করে তুলছে ওদের।

রোজ সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আগে নোঙর ফেলে নৌবহর, বেশির ভাগ যাত্রীই রাতের মতো তীরে নেমে পড়ে, কেবল পাহারা দিতে রেখে যায় অ্যাংকার ওয়াচকে। সাধারণত তাইতা ও ফেন দিনের আলোর এই সময়টুকুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তীর বরাবর ও বনের সীমানায় ঘুরে শেকড়, গুল্ম ও বুনো ফল যোগাড় করে। খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি মতো যথেষ্ট যোগাড় হলেই আবার নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে আসে। শিবিরের বাকি অংশ থেকে অনেকটা তফাতে বসানো হয়েছে ওটা। কোনও কোনও সন্ধ্যায় মেরেন ও সিদুদুকে ওদের তৈরি খাবার খেতে আমন্ত্রণ জানায় ওরা। তবে প্রায়ই নিজেদের ভেতরই মগ্ন থাকে, গভীর রাত অবধি গবেষণা করে।

যখন মাদুরে শুয়ে গায়ে কারোস পশমের চাদর টেনে নেওয়ার পর ফেনকে আপন বাহুতে টেনে নেয় তাইতা। জড়োসড়ো হয়ে ওর বুকে শুয়ে থাকে সে।

মরিয়াভাবে ওকে পেতে চায় তাইতা। ওর সদ্যপ্রাপ্ত সমগ্র পৌরুষ দিয়ে ওকে আকাক্ষা করে, কিন্তু অনেকদিক থেকেই মেয়েটার মতোই নিজেও এই ব্যাপারে নিষ্পাপ ও অভিজ্ঞতাহীন ও। কেবল মেঘ-বাগিচার সেই নিষ্ঠুর সংঘাতই ছিল ওর একমাত্র ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা যেখানে নিজের দেহ ধ্বংসের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিল ও, ভালোবাসার বাহন হিসাবে নয়। সেখানে এখনকার মতো তিক্তমিষ্টি আবেগের ছাপ ছিল না, রোজই এখন এই অনুভূতিটা প্রখরতর হয়ে উঠছে।

ফেন ওকে নিয়ে খেলা করার সময় ওরও একইভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তি ওকে সতর্ক করে বলে মেয়েটা নারীত্বের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেও চৌকাঠ পেরুনোর মতো অবস্থায় পৌঁছায়নি এখনও।

আমাদের সামনে সারা জীবন, সম্ভবত অনেকগুলো জীবন পড়ে আছে, নিজেকে সান্ত্বনা দেয় ও, তারপর জোর করে ঘুমিয়ে পড়ে।

*

হারানো মাতৃভূমির উদ্দেশে এগিয়ে চলেছে বৈঠার বেঞ্চির লোকগুলো, তাই প্রাণের টানে বৈঠা বাইছে ওরা। পরিচিত হ্রদের তীর দ্রুত পেছনে পড়ে যাচ্ছে, নৌবহরের পেছনে চলে যাচ্ছে লীগের পর লীগ পথ। অবশেষে এক সময় নীল হ্রদের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াল তামাফুপা পাহাড়সারি। নৌকার রেইলিংয়ের কাছে ভীড় করে দাঁড়াল ওরা, বিস্ময়ভরা নীরবতায় তাকিয়ে রইল সেদিকে। এই জায়গাটা ছিল অমঙ্গলে ভরা, সবচেয়ে সাহসী লোকটিরও এখানে এলে বুকে কাঁপন ধরে যেত। উপসাগরের মূল ভূমি পাশ কাটিয়ে নীলের মুখে বাঁধ হিসাবে দাঁড়ানো লাল পাথর দেখে তাইতার কাছে এগিয়ে এলো ফেন, স্বস্তির আশায় ওর হাত ধরল। এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ওগুলো। আশা করেছিলাম মালকিনের সাথে ওগুলোও শেষ হয়ে গেছে।

জবার দিল না তাইতা। হালে দাঁড়ানো মেরেনকে ডাকল তার বদলে। উপসাগরের মাথা দিকে ঘোরাও।

শাদা সৈকতে শিবির করল ওরা। সে রাতে কোনও উৎসব হলো না। সবার মেজাজই খারাপ, অনিশ্চিত। যাত্রা অব্যাহত রাখতে নীলের অস্তিত্ব বা ওদের মিশরের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট ঘোড়াও নেই।

সকালে সব নৌকা তীরে তুলে ধ্বংস করার নির্দেশ দিল তাইতা। এটা আশা করেনি কেউ। এমনকি মেরেন পর্যন্ত বাঁকা চোখে তাকাল ওর দিকে। কিন্তু ওর নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা ভাবল না কেউ। মালসামান নামানো হলে ফোকরের ডাওয়েল পিন খুলে ফেলা হলো, বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হলো খোলস।

সবকিছু, সবাইকে-নৌকা, মানুষ, মালপত্র-গ্রামে নিয়ে যাও, যেখানে মূলভূমির চূড়ায় খোঁড়া শামান কালুলু থাকত।

কিন্তু সেতো নদীর অনেক উপরে, বিভ্রান্ত মেরেন মনে করিয়ে দিল ওকে।

ওর দিকে হেঁয়ালি মাখা চোখে তাকাল তাইতা, নড়েচড়ে দাঁড়াল মেরেন। মহাদের অনেক উপরেও ওটা, অবশেষে বলল ও।

ব্যাপারটা কি গুরুত্বপূর্ণ, ম্যাগাস?

হতে পারে।

তাহলে এখুনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সবকিছু পাহাড়ে তুলতে টানা ছয়দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির প্রয়োজন হলো। অবশেষে কালুলুর গ্রামের কালো ধ্বংসাবশেষের মাঝখানে খোলের বিভিন্ন অংশ সাজিয়ে রাখার পর ওদের বিশ্রাম নিতে দিল তাইতা। নীলের শুষ্ক মুখ ও সেটার মুখে দাঁড়ানো অপ্রতিরোধ্য বাঁধের দিকে পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নির্বাচন করল তাইতা ও ফেন। ভোরে শুকনো আগাছার ছামিয়ানার নিচে বসে হ্রদের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা; নীল পানির বিশাল বিস্তার মাথার উপরের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের দলের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। বাঁধের বাধাহীন দৃশ্য এবং ওটার উপরের ব্লাফে ইয়োসের ক্ষুদে মন্দিরও দেখতে পায়।

তৃতীয় দিন সকালে তাইতা বলল, ফেন, আমরা এখন তৈরি। আমরা আমাদের শক্তি সংহত করেছি। এখন পূর্ণিমার অপেক্ষা করতে হবে।

এখন থেকে আর চারদিন, বলল ফেন।

তার আগে ডাইনীর বিরুদ্ধে আর একটা মাত্র হামলা চালাতে পারব আমরা।

তুমি যেকোনও সিদ্ধান্তের জন্যে আমি তৈরি, ম্যাগাস।

চারপাশে নাক্ষত্রিক প্রাচীর তৈরি করেছে ইয়োস।

সেজন্যেই ওর আস্তানায় থাকতে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।

শেষবারের মতো তার প্রতিরক্ষা পরখ করতে চাই আমি। কাজটা বিপজ্জনক হবে, তবে আমাকে ও তোমাকে অবশ্যই শক্তি একত্রিত করে বর্ম ভেদ করে তার শক্তঘাঁটি দখল করার চেষ্টা চালাতে হবে। হ্রদের কিনারে নেমে এলো ওরা। পরনের পোশাক ধুয়ে তারপর টলটলে জলে ম্লান করল। আচরিক ম্লান এটা: নোংরা ও বিশ্রী বস্তুতে অশুভ বিস্তার লাভ করে। সূর্যের আলোয় ওদের নগ্ন শরীর শুকোনের সময় ফেনের চুল আঁচড়ে বেণী বেঁধে দিল তাইতা। তাইতার সদ্য গজানো ঝলমলে দাড়ির যত্ন নিল ফেন। কাঁচা ডালে দাঁত মেজে সুবাসিত গাছের ডাল কুড়িয়ে পাহাড়ের ঢালে শিবিরে নিয়ে এলো। আশ্রয়ে পৌঁছার পর ওদের আগুনে গনগনে কয়লা বানালো ফেন, অগ্নিশিখায় পাতা ছিটিয়ে দিল তাইতা। তারপর পায়ের উপর পা তুলে হাতে হাত ধরে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসল, পরিষ্কার ও সজীবকারী ধোয়া বুকে টেনে নিতে লাগল শ্বাসের সাথে।

এবারই প্রথমবারের মতো যৌথ নাক্ষত্রিক আক্রমণের প্রয়াস পেয়েছে ওরা, কিন্তু নাক্ষত্রিক বলয়ে ওদের এই পরিবর্তন ছিল খুবই মসৃণ। আত্মায় আত্মা মিলিয়ে হ্রদের অনেক উপরে উঠে এলো ওরা, বনের উপর দিয়ে ভেসে চলল পুব দিকে। জাররিয়দের এলাকা ঘন মেঘের নিচে ঢাকা পড়ে থাকতে দেখল, কেবল চাঁদের পাহাড়ের চূড়াগুলোই ওগুলো ছুঁড়ে বের হয়ে এসেছে, ওগুলোর চূড়ার বরফ অপরূপ আভায় ঝিলিক মারছে। ওগুলোর বরফের নীড়ে বাসা বেঁধেছে মেঘ-বাগিচার গোপন জ্বালামুখ। ডাইনীর ঘাঁটির দিকে নামতে শুরু করল ওরা, কিন্তু কাছাকাছি আসতেই তাইতার উত্থানও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল, যেন বা কোনও মলাধারের ভেতর দিয়ে সাঁতার কাটছে। ওদের এগোনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল ওটার ওজন ও ঘনত্ব। মিলিত শক্তিতে ওটার দুর্বল করে তোলা প্রভাবের বিরুদ্ধে আগে বাড়তে লাগল ওরা। অবশেষে অনেক আত্মিক ক্ষয়ের পর বাধা ডিঙিয়ে ডাইনীর আস্তানার সবুজ চেম্বারে ঢুকল ওরা।

শেষবার যেখানে দেখে গিয়েছিল সেখানেই আছে ইয়োসের বিশাল মুটকীট, কিন্তু এখন প্রতিরক্ষা খোলস সম্পূর্ণ গঠিত হয়েছে; সবুজ, চকচকে, এক ধরনের প্রখর ঝিলিক দিচ্ছে। তাইতার উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে: ইয়োসের নানা রূপ দেখাতে ফেনকে এখানে নিয়ে এসেছে ও, কেবল ছায়াময় প্রকাশ নয়। এখন সময় হওয়ার পর ওরা ওদের সমস্ত শক্তি এক করে তার উপর প্রয়োগ করতে পারবে।

মেঘ-বাগিচা থেকে সরে এলো ওরা; পাহাড়ের উপর দিয়ে বন ও হ্রদ পেরিয়ে আবার ভৌত দেহে প্রবেশ করল। এখনও ওর হাত ধরে রেখেছে তাইতা। সে আবার সজীব হয়ে উঠতেই অন্তর্চক্ষু দিয়ে ওর দিকে তাকাল তাইতা। চুল্লী থেকে বেরুনো গলিত ধাতুর মতো জ্বলছে ওর আভা, ভীতি আর ক্রোধে তপ্ত হয়ে আছে।

ওই জিনিসটা! ওকে আঁকড়ে ধরল ফেন। ওহ, তাইতা, ভয়ঙ্কর, আমার কল্পনারও বাইরে। মনে হচ্ছে ওর খোলসের ভেতর মহাবিশ্বের সমস্ত অমঙ্গল আর বৈরিতা আশ্রয় নিয়েছে। ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে ওর চোখমুখ, ত্বক বরফ-শীতল।

শত্রুকে দেখেছ তুমি। এখন নিজেকে স্থির করতে হবে তোমাকে, প্রিয় আমার, বলল তাইতা। তোমার সমস্ত শক্তি ও সাহস এক করতে হবে। শক্ত করে ওকে ধরে রাখল তাইতা। আমার সাথে তোমাকে চাই আমি। তোমাকে ছাড়া ওর সাথে টিকে উঠতে পারব না।

প্রতিজ্ঞায় কঠিন হয়ে উঠল ফেনের চেহারা। তোমাকে আমি হতাশ করব না, তাইতা।

 তেমন কিছু তুমি করবে বলে ভাবিনি কখনও। পরবর্তী কয়েক দিন ইয়োসকে দেখার পর ফেনের টলে যাওয়া আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আবার চাঙা করে তুলতে সমস্ত নিগূঢ় শক্তি কাজে লাগাল তাই।

আগামী কাল পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, চক্রের সবচেয়ে শুভ পর্যায়। আমরা তৈরি, আর সময়ও হয়েছে। কিন্তু সকালে ফেনের গোঙানি আর কান্নার শব্দে জেগে উঠল তাইতা। ওর মুখে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কথা বলল। ওঠো, প্রিয়া আমার। এটা স্বপ্ন মাত্র। তোমার পাশে আছি আমি।

আমাকে ধরে রাখো, তাইতা। অনেক ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম। দেখলাম জাদুর শক্তি দিয়ে আমাকে আক্রমণ করেছে ইয়োস। আমার পেটে ড্যাগার বসিয়ে দিয়েছে। ফলাটা উত্তপ্ত, চকচক করছিল। আবার গুঙিয়ে উঠল সে। ওহ, এখনও ব্যথা টের পাচ্ছি। স্বপ্ন ছিল না ওটা। সত্যি। আমি আহত হয়েছি, ব্যথাটা খুবই মারাত্মক।

সতর্কতায় টানটান হয়ে উঠল তাইতার মন। তোমার পেটটা দেখি। ওকে আস্তে করে শুইয়ে হাঁটু পর্যন্ত তুলে দিল কারোসটা, ফর্শা চ্যাপ্টা পেটে হাত বোলাল।

কেবল ব্যথা না, তাইতা, ফিসফিস করে বলল ফেন। তার তৈরি করা ক্ষত থেকে রক্তপাত হচ্ছে।

রক্ত ঝরছে? ক্ষতটা কোথায়?

এখানে! দুই পায়ের মাঝখানে! এতদিন আর এমন হয়েছে কখনও?

কোনওদিন না, জবার দিল ফেন। এই প্রথম।

ওহ, আমার প্রিয়তমা। আস্তে করে ওকে কোলে তুলে নিল তাইতা। তুমি যা ভাবছ, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। ইয়োসের কাছ থেকে আসছে না ওটা। এটা সত্যির দেবতার উপহার, আশীর্বাদ। ইদালি কেন তোমাকে এর কথা বলেনি বুঝলাম না। পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছ তুমি।

বুঝতে পারছি না, তাইতা, এখনও ভয় পাচ্ছে ও।

এটা তোমার চাঁদ-রক্ত, তোমার নারীত্বের গর্বিত প্রতীক।

তাইতা বুঝতে পারল যাত্রার পরিশ্রম, ওর ভোগ করা দুর্ভোগ ও কষ্ট নিশ্চিতভাবে স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিলম্বিত করেছে।

কিন্তু ব্যথা কেন?

ব্যথাই নারীদের ভাগ্য। ব্যথায় তার জন্ম, ব্যথার ভেতরই আবার নতুন জন্ম। দেয় সে। চিরকাল তাই হয়ে আসছে।

এখন কেন? ঠিক যখন আমাকে তোমার প্রয়োজন তখনই কেন আমাকে এভাবে পড়ে যেতে হলো? বিলাপ করে উঠল ফেন।

ফেন, নারীত্বের জন্যে উল্লাস করতে হবে তোমাকে। দেবতারা তোমাকে সশস্ত্র করে দিয়েছেন। কুমারীর প্রথম চাঁদ-রক্ত দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাদুলি। আজকের দিনে তুমি যখন পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে উঠেছ, ডাইনীর বা মিথ্যার সমস্ত শক্তি এখন আর তোমার সাথে পেরে উঠবে না। ওকে লিনেনের প্যাড লাগানো শিখিয়ে দিল ও। মাদুর থেকে উঠে দাঁড়াল ওরা। আবার শরীর ধুয়ে হ্রদের খানিকটা পানি খেল, তবে কিছু খেল না।

খালি পেটে সিংহ আর সিংহী অনেক ভালো শিকার করতে পারে, বলল তাইতা। আশ্রয় ছেড়ে এলো ওরা, শিবিরের ভেতর হাঁটতে লাগল। উদ্বেগে ভার নীরবতায় ওদের পাশ কাটাতে দেখল লোকেরা। ওদের হাবভাব, আচরণে এমন কিছু ছিল যাতে ওরা বুঝে গেল ভীতিকর একাট কিছু এগিয়ে আসছে।

কেবল মেরেন এগিয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দিল। আমার সাহায্য লাগবে, ম্যাগাস?

সৎ মেরেন, তুমি সব সময়ই বিশ্বস্ত, কিন্তু আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে তুমি যেতে পারবে না।

ওর সামনে এক হাঁটু ভাঁজ করে বসল মেরেন। তাহলে আপনার আশীর্বাদ দিন আমাকে, আপনার কাছে মিনতি করছি।

মেরেনের মাথার উপর একটা হাত রাখল তাইতা। তার সম্পূর্ণই পেয়েছ তুমি, বলল ও। তারপর ফেন আর ও শিবির থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হ্রদের দিকে এগিয়ে গেল। বাতাস, স্থির, গুমোট, চারপাশ ঝিম মেরে আছে। জানোয়ারের ডাক নেই, পাখিরা ডাকছে না। আকাশ উজ্জ্বল, যন্ত্রণাকর নীল, কেবল হ্রদের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট এক টুকরো মেঘ, অনেক দূরে। তাই তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আস্তে আস্তে বদলে গিয়ে বেড়ালের থাবার চেহারা নিল ওটা।

এমনকি মুটকীটে থেকেও আমরা তার পক্ষে কতটা হুমকি টেরে পেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে ডাইনী, মৃদু কণ্ঠে ফেনকে বলল ও। ওর উপর হেলে পড়ল ফেন। হাঁটতে হাঁটতে ব্লাফের উচ্চতার শেষ মাথায় চলে এলো ওরা। শিশু নীলের মুখ রুদ্ধ করে রাখা বিশাল বাঁধ লাল পাথরের দিকে চোখ ফেরাল।

অমন বিশাল জিনিসকে নাড়ানোর মতো মানুষ বা প্রকৃতির অধীন কোনও শক্তি কি আছে? স্বগত উচ্চারণ করল ফেন।

মিথ্যার শক্তিতে ওটার উত্থান ঘটেছে। সত্যির শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা যেতেই পারে, ওর প্রশ্নের জবাবে বলল তাইতা, তারপর একসাথে ইয়োসের মন্দিরের দিকে চোখ ফেরাল।

তুমি তৈরি? জিজ্ঞেস করল ও, মাথা দোলাল ফেন। তাহলে ইয়োসকে মোকাবিলা করতে তার মন্দিরে যেতে হবে আমাদের।

ওখানে ঢুকলে কী ঘটবে, ম্যাগাস?

সেটা আমি জানি না। সবচেয়ে খারাপটাই আশা করতে হবে, তৈরি থাকতে হবে তার জন্যে। আরও একবার হ্রদের উপরিতলের দিকে তাকাতে একটু সময় নিল তাইতা। মসৃণ, চকচকে। ওটার অনেক উপরে ভাসছে ছোট মেঘ খণ্ড। এখনও বেড়ালের থাবার মতো। হাতে হাত রেখে মন্দিরের অভিশপ্ত ছাদের দিকে চলে যাওয়া পথে পা রাখল ওরা। অমনি ক্ষীণ হওয়া গুমোট বাতাসকে দোল দিল। শীতল ছোঁয়া লাগল ওদের গালে। লাশের আঙুলের মতো ঠাণ্ডা হ্রদের উপর দিয়ে বয়ে গেল হাওয়াটা, চকচকে তলকে আঁচড়ে দিল, তারপরই হারিয়ে গেল। উপরে উঠতে লাগল ওরা। চূড়ার আধাআধি দূরত্বে যাবার আগেই ফের এলো হাওয়াটা। মৃদু শিসের শব্দ তুলে ছোট মেঘটাকে দিগন্তে ছড়িয়ে দিল, হ্রদের বুকে গাঢ় নীল খাদের সৃষ্টি করল।

তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল বাতাসের শব্দ। তারপর ধেয়ে এলো ওদের দিকে। ওদের পোশাক ও তাইতার দাড়িতে টান লাগার সময় আর্তচিৎকার করতে লাগল। হাওয়ার ঝাপ্টায় যুঝতে লাগল ওরা, সমর্থনের জন্যে একে অপরকে ধরে রেখেছে। সহসা শাদা ঢেউ হয়ে নাচতে শুরু করেছে হ্রদের জল। দোল খাচ্ছে তীরের গাছপালা, চাবুকের মতো শপাং শপাং শব্দ তুলছে ডালপালা। অনেক কষ্টে উঠে চলল ওরা, অবশেষে মন্দিরের মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা হাঁ করে খোলা, একটা কজার উপর দোল খাচ্ছে, অন্য পাল্লাটা বাড়ি খাচ্ছে, দুলছে। আচমকা গর্জন তোলা হাওয়া দুটো পাল্লাই এমনভাবে কামড়ে ধরে সজোরে আটকে দিল যে পাশের সীমানা ফেটে কুকড়ে গেল।

গলার কাছে হাত তুলে সোনার চেইনে ঝুলন্ত লক্ট্রিসের মাদুলিটা মুঠি করে ধরল তাইতা। তাইতার তালিসমানের সোনার টুকরো মুঠি করে ধরল ফেন। তারপর মুক্ত হাতে থলেয় হাত দিয়ে ইয়োসের চুলের পুরু গোছাটা বের করে উঁচু করে ধরল তাইতা। কেঁপে উঠল ওদের পায়ের নিচের জমিন, এমন বিপুল বিক্ষোভে যে বন্ধ দরজার একটা পাল্লা কজা থেকে খুলে ওদের পায়ের কাছে উড়ে এসে পড়ল। ওটার উপর দিয়ে উক্ত পথে মন্দিরের বৃত্তাকার দহলিজে ঢুকে পড়ল ওরা। এখানে বাতাস ভারি, অশুভের মতো ভয়ঙ্কর। ঠেলে এগোনো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল, যেন গভীর জলার কাঁদা ভেঙে আগে বাড়ছে। ফেনকে স্থির করতে ওর কবাহুতে হাত রাখল তাইতা। পথ দেখিয়ে প্যাসেজওয়ে ধরে মন্দিরের উল্টোদিকে নিয়ে এলো ওকে। অবশেষে ফুল আকৃতির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, ওটার চৌকাঠ পুলিশ করা হাতির দাঁত, মালাকাইট ও বাঘের চোখের নকশা করা। কুমীরের চামড়ার দরজাটা বন্ধ। ইয়োসের চুলের রশিটা ওটার মাঝখানে ছোঁয়াল তাইতা। ধীরে ধীরে খুলে গেল পাল্লাটা, কাঁচক্যাচ করে উঠল কজাগুলো।

ভেতরের চাকচিক্য এতটুকু কমেনি, চকচক করছে মাৰ্বল আর আধা মূল্যবান পাথরের বিরাট পেন্টাগ্রামের প্রতীক। কিন্তু অপ্রতিরোধ্যভাবে মাঝখানের হাতির দাঁতের বর্মের দিকে চলে গেল ওদের চোখ। ছাদের ফোকর দিয়ে চুঁইয়ে আসা সূর্যরশ্মি ধীরে কিন্তু নির্ভুলভাবে পেন্টাগ্রামের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই দুপুর হয়ে যাবে।

মন্দিরের অন্য দরজাগুলোর গায়ে গুমড়ে মরছে বাতাস, ছাদের আস্তরণ আর কাঠে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। স্থির দাঁড়িয়ে আলোর স্থান বদল দেখতে লাগল ওরা। হাতির দাঁতের বৃত্তে প্রবেশ করলে সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছাবে মিথ্যার শক্তি।

ছাদের ফোকর দিয়ে বরফ-শীতল একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। গোখরা সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠল, চারপাশে বাদুর ও শকুনের ডানা ঝাপ্টানোর মতো শব্দ হলো। সূর্যরশ্মি হাতির দাঁতের বৃত্তে প্রবেশ করল। চোখে ধাঁধানো আলো গোটা অন্দর ভরে ফেলল, কিন্তু তাতে কুকড়ে গেল না ওরা বা চোখ আড়াল করল না। হাতীর দাঁতের ঠিক কেন্দ্রে ফুটে ওঠা ইয়োসের হিংস্র আত্মার প্রতাঁকের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাইনীর কটু গন্ধে চারদিকের পরিবেশ ভরে ওঠার সাথে সাথে সামনে পা বাড়াল তাইতা, চুলের গোছা উঁচু করে ধরল।

তাশকালোন! চিৎকার করে বলে উঠলও। চুলের গোছাটা ঢুকিয়ে দিল আইভরি বৃত্তে। আসকারতেও! সিলোনদেলা! ইয়োসের শক্তির কথাগুলো আবার তারই উপর চালিয়ে দিচ্ছে। সহসা বাতাস পড়ে গেল, সারা মন্দিরে নেমে এলো অজ্ঞাত ধরনের নীরবতা।

তাইতার পাশে এসে দাঁড়াল ফেন, টিউনিকের হেম উঁচু করে দুই পায়ের মাঝখান থেকে লিনেনের প্যাডটা খুলে নিয়ে ইয়োসের চুলের গোছার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল আইভরির বৃত্তে। তাশকালোন! আসকাবতেও! সিলোনদেলা! মিষ্টি পরিষ্কার কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করল ও। মন্দিরের ভিত্তিমূল কেঁপে উঠল, পৃথিবীর গভীর থেকে গুরুগুরু গর্জন ভেসে এলো। বাইরের দিকে খসে পড়ল সামনের দেয়ালের একটা অংশ। তারপর চুনসুরকির গুঁড়ো ছড়িয়ে ধসে পড়ল। ওদের পেছনে ছাদের একটা কড়িকাঠ ফেটে বাইরের দহলিজে গিয়ে পড়ল। সাথে নিয়ে গেল ছাদের খড়ের কিছুটা অংশ। আইভরি বৃত্তের ভেতর দিয়ে চলে গেল ওটা। ওদের মাঝখানের পাকা অংশের উপর দিয়ে ছুটে গিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিল ওদের। গহ্বরের কোনও তল নেই। যেন পৃথিবীর একেবারে পেটের ভেতর চলে গেছে।

তাইতা! আর্তনাদ করে উঠল ফেন। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ওরা, ফেন বুঝতে পারছে তাইতার কাছ থেকে পাওয়া ওর শক্তি এখন তেলের কুপির শিখার মতোই ক্রমে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ফাটলের কিনারে ছুটে এলো ও, বুভুক্ষের মতো ওকে টেনে নিতে চাইল ওটা।

তাইতা, আমি পড়ে যাচ্ছি। বাঁচাও! কিনারা থেকে ছুটে সরে যাবার চেষ্টা করল ও, হাতজোড়া ল্যাগব্যাগ করে ঝুলছে, কিনারা থেকে উঠে আসা টানে যন্ত্রণাদায়কভাবে বেঁকে গেছে ওর পিঠ।

ওদের দুজনের মিলিত নাক্ষত্রিক শক্তির পুরো মাত্রা বুঝতে পারেনি তাই। ভীষণ গহ্বরের উপর দিয়ে লাফিয়ে আস্তে ফেনের পাশে এসে নামল ও। ফাটলে পতনের আগেই ধরে ফেলল ওকে, এক ঝটকায় কোলে তুলে ওকে নিয়ে ফুলের আকারের দরজার দিকে দৌড়ে গেল। বুকের সাথে সেঁটে রেখেছে ওকে, ওর কাছ থেকে ইয়োসের কেড়ে নেওয়া শক্তি পূরণ করে দিচ্ছে। অন্দর ছেড়ে দহলিজ ধরে মন্দিরের বাইরের দরজার উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগল ও। ওদের সামনে দড়াম করে লুটিয়ে পড়ল ছাদের এক বিরাট কড়িকাঠ। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল ওরা। ওটা টপকে আবার দৌড় দিল ও। যেন হ্যারিকেনে আক্রান্ত ছোটখাট জাহাজের ডেকের উপর দিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে আরও অসংখ্য গভীর ফাটল দেখা দিচ্ছে। ওগুলো লাফিয়ে যাচ্ছে ও। পায়ের নিচের মাটি ঢেউ খেলছে। ঠিক সামনে বাইরের প্রাচীরের আরেকটা অংশ চুনসুরকির আলগা তূপে পরিণত হলো। কিন্তু তূপের উপর দিয়ে লাফিয়ে খোলা বাতাসে বের হয়ে এলো ও।

কিন্তু উপাদানের আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে রেহাই মিলল না। ঢেউ তোেলা মাটির উপর ভারসাম্য বজায় রাখতে টলমল পায়ে অবাক বিস্ময়ে চারপাশে নজর বোলাল তাইতা। হ্রদ অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেখানে টলটলে নীল পানি ছিল, এখন সেখানে বিশাল শূন্য বেসিন, তাতে আটকে পড়া মাছের ঝাঁক লেজ দাপাচ্ছে, পাক খাচ্ছে কুমীরের দল, আর সুবিশাল জলহস্তি কাদায় পা রাখার মতো জায়গা খোঁজার প্রয়াস পাচ্ছে। লাল পাথরের বাঁধ নগ্নভাবে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কল্পনাকেও হার মানায় ওটার আকার।

সহসা উথালপাতাল অবস্থার অবসান ঘটল। তার জায়গায় দেখা গেল স্থিরতা। যেন গোটা সৃষ্টি থমকে গেছে। কোনও শব্দ বা নড়াচড়া নেই। সাবধানে ফেনকে মাটিতে নামিয়ে দিল তাইতা, কিন্তু শূন্য হ্রদের দিকে তাকিয়ে ওকে আঁকড়ে থাকল ও। দুনিয়াটার হলো কী? ফ্যাকাশে শুকনো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শ্বাস ফেলল ও।

ওটা ছিল প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প।

ব্যাপারটা চুকে যাওয়ায় হাথোর আর আইসিসকে ধন্যবাদ।

চুকে যায়নি। ওগুলো ছিল স্রেফ প্রথম দফার ধাক্কা। এখন পূর্ণ শক্তির বিস্ফোরণ ঘটার আগের নীরবতা বিরাজ করছে।

হ্রদের পানির কী হলো?

পৃথিবীর ঢাকনার নড়াচড়ায় শুষে নিয়েছে, বলল তাইতা, তারপর একটা হাত ওঠাল। শোনো! জোরাল হওয়ার মতো প্রবল একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। পানি ফিরে আসছে! শূন্য বেসিনের উপর দিয়ে ইশারা করল ও।

দিগন্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পানির নীল পাহাড়, তাতে ক্রিমের মতো ফেনা, জমিনের উপর দিয়ে বিপুল অটল শক্তিতে ছুটে আসছে। একের পর বাইরের দ্বীপগুলো গিলে নিল ওটা, এগিয়ে আসতে লাগল, তীরের দিকে এগোনোর সময় আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। এখনও বেশ কয়েক লীগ দূরে থাকলেও ইতিমধ্যে ওটার চূড়া ওরা যে ব্লফের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেটার উচ্চতা ছাড়িয়ে গেছে যেন।

আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ওটা! ডুবে মরব! পালাতে হবে!

যাবার মতো কোনও জায়গা নেই, বলল তাইতা। আমার পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো।

ওদের চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা প্রাচীর গড়ে তুলছে তাইতা, টের পেল ফেন, সাথে সাথে ওর নিজস্ব মানসিক শক্তিও যোগ করল ওর সাথে।

আরেকটা প্রবল ঝাঁকুনি কাঁপিয়ে দিল জমিনকে, এত জোরে যে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ওরা। কিন্তু পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে আগুয়ান ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশের সব বজ্র যেন একসাথে ডেকে উঠেছে, এমন প্রবল আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, প্রচণ্ড আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল ওদের।

লাল পাথরের বাঁধটা গোড়া থেকে চূড়া পর্যন্ত দুভাগ হয়ে গেল। গভীর সব চিড়ে গোটা শরীর চৌচির হয়ে গেছে ওটার। ওটার মাথা ছাড়িয়ে গেল দানবীয় ঢেউ, পরক্ষণেই ফেনা আর লাফাতে থাকা ঢেউ নিয়ে নেমে এলো প্রবল বেগে। বিশাল পাথরের পিয়ার তলিয়ে গেল ওটার নিচে। তারপর একটার উপর আরেকটা পড়তে শুরু করল লাল পাথরের টুকরোগুলো, পানির প্রবল স্রোত জলোচ্ছ্বাসের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে চলল নীলের শূন্য তলদেশের দিকে। এমনভাবে ভেসে গেল যেন নুড়ি পাথরের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ফাটল দিয়ে বজ্রের আওয়াজে সবুজ ঢেউ তুলে হ্রদে এসে পড়তে লাগল। এত বিপুল পানি ধারণ করার মতো গভীরতা বা প্রশস্ততার কিছুই নেই নদীর তলদেশের, ফলে পানির ধারা তীর ছাপিয়ে দুপাশের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোও ছাড়িয়ে গেল। শেকড়সহ উপড়ে এসে ঢেউয়ের চাপে লুটিয়ে পড়ল, কাঠের টুকরোর মতো ভেসে চলল স্রোতের টানে। উত্তাল সাগরের মাথার উপরে ঘন মেঘের মতো পানির ছিটা ধেয়ে গেল আকাশের দিকে। রোদে লেগে নদীর উপরে বাঁকা হয়ে অসাধারণ রঙধনু হয়ে উঠল।

জলোচ্ছ্বাসের চূড়াটা ব্লাফের উপর দিয়ে ভাঙা মন্দিরের সামনে জড়োসড়া হয়ে বসা তাইতাদের দিকে ধেয়ে এলো। যেন ওদেরও গ্রাস করে নেবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে প্রবল স্রোতের টানে, কিন্তু ওদের কাছে আসার আগেই শক্তি ফুরিয়ে গেল ওটার। প্রবল শক্তির অবশিষ্টাংশ মন্দিরের ভাঙা দেয়ালের চারপাশে পাক খেতে লাগল, ওদের হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসে অবশেষে লুটিয়ে পড়ল। পরস্পরের বাহু আঁকড়ে ধরে নিজেদের অটল রাখল ওরা। পানির টান আকর্ষণ করলেও হ্রদে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারল।

আস্তে আস্তে সব কিছু আবার নিজেদের রূপ ফিরে পেল: জমিনের কম্পন থেমে গেল, হ্রদের জল স্থির হলো। কেবল গর্জন করে চলল সবুজ, প্রশস্ত নীল; ফোয়ারা ছিটিয়ে ধেয়ে চলল উত্তরে মিশরের দিকে।

নদী আবার জন্ম নিয়েছে, ফিসফিস করে বলল ফেন। ঠিক তোমার মতো, ম্যাগাস। নীল আবার নতুন হয়ে গেছে, তরুণে রূপান্তরিত হয়েছে।

মনে হচ্ছিল যেন এই অনন্য অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে ওরা কখনও ক্লান্ত হবে না। বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকল ওরা। তারপর কী মনে হতেই তাইতার বাহুডোরের বৃত্তের ভেতরে ঘুরে দাঁড়াল ফেন, চোখ ফেরাল পশ্চিমে। এত প্রবলভাবে চমকে উঠল ও, সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। কী ব্যাপার, ফেন?

দেখ! চিৎকার করে উঠল ও, উত্তেজনায় কাঁপছে ওর কণ্ঠস্বর। জাররিয়দের দেশ জ্বলছে! দিগন্তে ভেসে উঠছে ধোঁয়ার বিশাল মেঘ, ধূসর, ভীতিকর, টগবগ করে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে, সূর্য আড়াল করে ফেলেছে; পৃথিবীটাকে অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে। কী ওটা, তাইতা? ডাইনীর রাজধানীতে কী ঘটছে?

আন্দাজে কিছু বলা মুশকিল, স্বীকার গেল তাইতা। যুক্তি বা বিশ্বাস দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেয়ে অনেক বিশাল।

জাররিয়দের দেশের দিকে আরেকবার চোখ ফিরিয়ে এই বিপর্যয়ের কারণ ও পরিণতি বোঝার চেষ্টা করতে পারি না আমরা?

এখুনি সেটাই করতে হবে, সায় দিল তাইতা। এসো, তৈরি হয়ে নিই। গর্জনশীল নদীর উপরের বিরান পাহাড়ের কোলে বসল ওরা, হাতে হাত ধরল, তারপর নাক্ষত্রিক সমতলে যাত্রা করল। অনেক উপরে উঠে ভেসে চলল শক্তিশালী মেঘ ও তার নিচে বিছিয়ে থাকা জমিনের দিকে।

ওদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল জায়গাটা ধ্বংস হয়ে গেছে: দাউদাউ করে জ্বলছে গ্রামগুলো, বিষাক্ত ধোঁয়া আর ঝরে পড়া ছাইয়ে ক্ষেতখামার নষ্ট হয়ে গেছে। লোকজন ওখান থেকে ছুটে পালাচ্ছে, আগুন ধরে গেছে ওদের চুল, কাপড়চোপড়ে। মেয়েদের বিলাপ, শিশুদের কান্নার শব্দ শুনতে পেল ওরা, মরতে চলেছে ওরা। চাঁদের পাহাড়ের দিকে নেমে এলো ওরা, চূড়াগুলো উড়ে গেছে। ছিন্নভিন্ন জ্বালামুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর লাভা। ওগুলোর একটা অলিগার্কদের দুর্গে গিয়ে পড়েছে, আগুন ও ছাইয়ের নিচে চাপা দিয়েছে ওটাকে, যেন কোনওদিনই ওটার অস্তিত্ব ছিল না।

এই ধ্বংসলীলার ভেতর কেবল মেঘ-বাগিচার উপত্যকাই যেন অক্ষত আছে। মনে হচ্ছে; কিন্তু তারপরই ওদের মাথার উপর উঁচু হয়ে থাকা চূড়াটাকে ফুলে কেঁপে উঠতে দেখল ওরা, দোল খেল ওটা। চোখের সামনেই আরেকটা আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতে পাহাড়ের অর্ধেকটা উড়ে গেল। আকাশের দিকে ধেয়ে গেল কালো পাথরের পেল্লায় টুকরোগুলো। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মেঘ-বাগিচা। এককালে যেখানে ওটা দাঁড়িয়েছিল সেখানে মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে আছে বিরাট একটা জ্বালামুখ, লাভার নদী উগড়ে দিচ্ছে।

ডাইনী! তার কী হলো?

ওকে নিয়ে একেবারে চুল্লীর ভেতরে চলে এলো তাইতা। ওদের নাক্ষত্রিক সত্তা ভয়াবহ তাপ থেকে মুক্ত, অথচ স্বাভাবিক দেহ নিমেষেই ছাই হয়ে যেত। আরও নিচে ইয়োসের আস্তানার প্যাসেজ ধরে আগে বাড়ল ওরা, এটার কথা ভালোই মনে আছে তাইতার। ডাইনীর মুটকীটের কাছে চলে এলো ওরা। এরই মধ্যে সবুজ পাথরের দেয়াল চকচক করতে শুরু করেছে; টাইল খসে পড়ছে, প্রবল তাপে ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে।

খোলস থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। চকচকে মেঝে কালো হয়ে ফাটতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে পাক খেতে লাগল ওটা, নড়ছে। সহসা ফেটে গিয়ে আরও ভেতরের আঠার মতো হলুদ তরল বের হয়ে এলো, বুদ্বুদ উঠছে তার ভেতর থেকে, যেন উতড়াচ্ছে। অসহনীয় দুর্গন্ধ। এবার খোলসটা বিস্ফোরিত হলো, আগুন ধরে গেল তাতে; পুড়ে পাউডারের মতো ছাইয়ে পরিণত হলো ওটা। বিশ্রী তরলের অবশিষ্টাংশটুকুও উবে গেল, রেখে গেলে কেবল চকচকে সবুজ পাথরের উপর কালো দাগ। বিস্ফোরণে উন্মুক্ত হয়ে গেল গুহার ছাদটাও, জ্বলন্ত লাভা ফাটল দিয়ে সবেগে বের হয়ে ডাইনীর আস্তানা প্লাবিত করতে ধেয়ে গেল।

পিছিয়ে এলো তাইতা ও ফেন, উঠে এলো পাহাড়ের উপর। নিচে ধ্বংসলীলা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। ছাই ও লাভার নিচে চাপা পড়ে গেছে জাররি। অবশেষে যখন ইথারে ভর দিয়ে আবার আপন দেহে ফিরে এলো ওরা, কিছুক্ষণ যা দেখেছে, যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে সেসব নিয়ে কথাই বলতে পারল না। হাতে হাত ধরেই পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। অবশেষে অশ্রুতে ভলে উঠল ফেনের দুই চোখ, নীরবে কাঁদতে শুরু করল ও।

সব চুকে গেছে, ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল তাইতা।

ইয়োস মরেছে? জানতে চাইল ফেন। বলো, ওটা বিভ্রান্তি ছিল না। দয়া করে বলল, তাইতা, দিব্য দর্শনে যা দেখেছি সেটা সত্যি।

হ্যাঁ, সত্যি। একমাত্র সম্ভাব্য উপায়েই মারা গেছে সে। যে আগ্নেয়গিরি থেকে উত্থান ঘটেছিল তারই আগুনের শিখায় পুড়ে মরেছে। হামাগুড়ি মেরে ওর কোলে উঠে এলো ফেন। দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরল তাইতা। বিপদ কেটে যাওয়ায় ওর সব শক্তি উবে গেছে। এখন শঙ্কিত শিশুতে পরিণত হয়েছে ও। দিনের বাকি অংশটুকু সবুজ নীলের দিকে তাকিয়ে কাটাল ওরা। তারপর আকাশের পশ্চিমে উঁচু ধোয়া ও ধূলি-মেঘের আড়ালে সূর্য অস্ত যাবার মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল তাইতা, ফেনকে কোলে করে পাহাড়ী পথ ধরে গ্রামে নিয়ে এলো।

ওদের আসতে দেখে ছুটে এলো লোজন, উত্তেজনায় চিৎকার করছে বাচ্চারা, মহিলারা খুশিতে উলু ধ্বনি করছে। ওদের সাথে যোগ দিতে সবার আগে সামনে ছুটে এলো মেরেন। ফেনকে মাটিতে নামিয়ে দুহাত মেলে স্বাগত জানাল ওকে তাইতা।

ম্যাগাস! আপনার প্রাণাশঙ্কায় ভুগছিলাম আমরা, পঞ্চাশ কদম দূরে থাকতেই চেঁচিয়ে উঠল মেরেন। আপনার উপর আমার আরও আস্থা থাকা উচিত ছিল। জানা উচিত ছিল আপনার জাদুই জিতবে। নীল আবার বইতে শুরু করেছে! তাইতাকে সজোরে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল সে। আপনি নদী আর আমাদের মায়ের দেশকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আরেক হাত বাড়িয়ে ফেনকে আহ্বান করল ও। তোমরা দুজন এমন অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছ যার মাত্রাটুকু আমরা কেউই কোনওদিন বুঝতে পারব না। তবে মিশরিয়দের একশো প্রজন্ম এজন্যে তোমাদের ধন্যবাদ জানাবে। উল্লসিত জনতা ঘেরাও করে রেখেছে ওদের, এক রকম কোলে করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো ওদের। সেদিন সারারাত চলল নাচ ও হাসি, নাচ ও উল্লাস।

*

আবার দুই তীরের মাঝে নীলের সীমিত হয়ে আসতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লাগল। কিন্তু তারপরও রূপালি পেয়ালায় ফুঁসতে লাগল ওটা, তলায় লাল পাথরের চাঙরগুলো পিষে ফেলতে সগর্জন প্লাবন অব্যাহত রইল। শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল বুঝি কোনও দানব প্রচণ্ড রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। তাসত্ত্বেও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নৌকাগুলো নিচে বয়ে নিয়ে গিয়ে ফের বানানোর নির্দেশ দিল তাইতা।

আপানি এগুলো উপারে আনতে বাধ্য না করলে ঢেউয়ের ধাক্কায় শেষ হয়ে যেত, বলল মেরেন। তখন আপনার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম আমি, সেজন্য এখন কাছে ক্ষমা চাইছি, ব্যাপারটা যেন আপনি বুঝতে পারেন, ম্যাগাস।

উদার হস্তে দেওয়া হলো সব, হেসে বলল তাইতা। তবে আসল সত্যি হলো অনেক বছর ধরে যখনই তোমাকে কোনও ভালো পরামর্শ দিয়েছি, তোমার খোঁচায় পোষ না মানা ঘোড়ার মতোই অক্ষত হয়ে গেছি আমি।

নদী তীরে নৌকাগুলো আবার বানানোর পর পাহাড় চূড়ার কালুলু গ্রাম ছেড়ে নৌকাগুলো যেখানে রাখা হয়েছে তার কাছেই গাছপালায় ছাওয়া একটা আরামদায়ক মালভূমিতে শিবির খাটাতে চলে এলো ওরা। এখানে নীলের এমন একটা স্তরে নেমে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল ওরা, যাতে নিরাপদে যাত্রা করা যায়। এখনও শিবিরের মেজাজ উৎসব মূখর। জাররিয়দের আরও হামলা ও ইয়োসের বৈরী ক্ষমতা নিয়ে এখন আর শঙ্কিত হতে হবে না জানা থাকাটা প্রত্যেকের জন্যেই খুশির একটা অবিরাম উৎসে পরিণত হয়েছে। ওদের দীর্ঘ যাত্রার চূড়ান্ত পর্যায় শিগগিরই আবার শুরু হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আরও জোরাল হয়ে উঠেছে সেটা। প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার কথা সারাক্ষণ মনে পড়ছে ওদের।

নালুবালে হ্ৰদবাসী পালের একটা বিশাল মাদী জলহস্তি নীলের সদ্য উন্মুক্ত মুখের কাছে এসে পড়েছিল, স্রোতে আটকা পড়ে গেছে ওটা। এমনকি তার বিপুল শক্তিও জলপ্রপাতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারল না তাকে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল তার দেহ, আছড়ে পড়ল পাথরের উপর। মারাত্মক আহত অবস্থায় কোনওমতে নিজেকে তীরে তুলে আনল সে, ঠিক ঢালের নিচে। বর্শায় সজ্জিত পঞ্চাশজন লোক ছুটে গেলা ওটার দিকে, মরণোন্মুখ জানোয়ারটা পালাতে পারল না। ওটাকে মেরে সেখানেই ছাল খসিয়ে মাংস কেটে নিল ওরা।

সেদিন রাতে ওটার পেটের রসাল শাদা চর্বিতে জড়ানো মাংস পঞ্চাশটা ভিন্ন ভিন্ন আগুনের কয়লায় ঝলসে আরও একবার ভোজ-উৎসবে মেতে উঠল সবাই, সারা রাত নাচল ওরা। সবাই গোগ্রাসে খেলেও লবন মাখানো ও ধোঁয়ায় ঝলসানোর মতো প্রচুর মাংস রয়ে গেল। অনেক সপ্তাহ চলবে ওদের। এই সাথে মাগুর মাছে ভরে আছে নদী, জলের প্রবল ধাক্কায় বিভ্রান্ত, দিশাহারা হয়ে থাকায় তীর থেকেই অনায়াসে হারপুনে গেঁথে ফেলা যাচ্ছে ওগুলোকে; কোনও কোনওটা তো পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সমান হবে। জাররির সেনাছাউনী থেকে নেওয়া ধুরা শস্যেরও বিরাট একটা অংশ রয়ে গেছে ওদের কাছে। তাই তার একটা অংশ বিয়র বানাতে চোলাই করতে দিতে রাজি হলো তাইতা। নদী বৈঠা বাইতে দেওয়ার মতো স্তরে নেমে আসতে আসতে সবাই ফের যাত্রা শুরু করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ও উদগ্রীব হয়ে উঠল। এমনকি হিলতোও অনেকটা সেরে উঠেছে, বৈঠার জায়গায় অবস্থান নিতে তৈরি হয়ে গেল ও।

ওরা যখন জাররির উদ্দেশে পথে নেমেছিল তখনকার সেই মরা ধারা থেকে এখন বলদে গেছে নীল। প্রতিটি বাক, প্রতিটি ডুবো চর আর শৈলশ্রেণী বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে; তাই রাতে যাত্রা করার ঝুঁকি নিতে পারল না তাইতা। সন্ধ্যায় তীরে নৌকা ভেড়াচ্ছে ওরা, তারপর কাটা ঝোঁপের মজবুত প্রাচীর বানাচ্ছে। দীর্ঘ দিন সংকীর্ণ ডেকে বন্দি থাকার পর রাত নেমে আসা পর্যন্ত ঘোড়াগুলোকে ঘাস খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। শিকারী দল পাঠায় মেরেন যাতে যেমন শিকারই মিলুক না কেন নিয়ে আসতে পারে। অন্ধকার মেলালেই মানুষ আর পশুর দলকে প্রাচীরের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়। ঘোড়া আর টাটকা শিকারের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে কাঁটাঝোঁপের দেয়ালের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় সিংহ ও চিতার দল।

এত অসংখ্য মানুষ আর পশুকে জায়গা দিতে হচ্ছে বলে প্রাচীর বেশ জনাকীর্ণ হয়ে থাকে। অবশ্য, ওদের প্রতি বরাবরের সম্মান ও ভালোবাসার জন্যে সব সময়ই তাইতা ও ফেনের জন্যে একটা ছোট তবে আলাদা ঘেরাও করা জায়গার ব্যবস্থা থাকে। নিজেদের আশ্রয়ে একা হওয়ার পর প্রায়ই মাতৃভূমির প্রসঙ্গে বাঁক নেয় ওদের কথোপকথন। অন্য জীবনে ফেন উচ্চ রাজ্য ও নিম্নরাজ্যের যৌথ সিংহাসনে আরোহণ করলেও মিশর সম্পর্কে ওর সব জ্ঞান তাইতার কাছেই শেখা। দেশ ও দেশের মানুষের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, তাদের ধর্ম, শিল্পকলা, ও রেওয়াজ সম্পর্কে জানতে অধীর হয়ে আছে ও; বিশেষ করে অনেক অনেক দিন আগে জন্ম দেওয়া। সন্তানদের কথা, এখন যারা শাসন করছে সেই উত্তরসুরি সম্পর্কেই বেশি জানতে চায়।

ফারাও নেফার সেতির কথা বলো।

ওর সম্পর্কে যা জানার সবই জানা হয়ে গেছে তোমার, প্রতিবাদ করে তাইতা।

আবার বলল, নাছোড়বান্দা ফেন। ওর সাথে মুখোমুখি দেখা হওয়ার দিনটির অপেক্ষা করে আছি। কী মনে করো, আমি ওর দাদী ছিলাম, বুঝতে পারবে ও?

বুঝলে আমি অবাক হবো। তোমার বয়স তার থেকে অর্ধেকেরও কম; আর এত সুন্দর যে এমনকি সে হয়তো তোমার প্রেমেও পড়ে যেতে পারে, ওর সাথে ঠাট্টা করল তাইতা।

সেটা কোনওদিনই হবে না, সজীব কণ্ঠে জবাব দেয় ফেন। প্রথমত, সেটা হবে অবৈধ, কিন্তু তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমি তোমার।

তাই কি ফেন? সত্যিই কি তুমি আমার? বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখজোড়া মেলে ধরল ফেন। ম্যাগাস আর মোহন্ত হলেও অনেক সময় কেমন যেন আনাড়ীর মতো কথা বলো। আমি তোমার, আরেক জীবনে তোমাকে আমি কথা দিয়েছিলাম। নিজেই বলেছ তুমি।

অবৈধ সম্পর্কের কী জানো তুমি? প্রসঙ্গ পাল্টাল তাইতা। কে তোমাকে বলেছে সেটা?

ইম্বালি, জবাব দিল ফেন। তুমি বলোনি এমন সব কথা আমাকে বলেছে ও।

তা এই বিষয়ে কী বলেছে সে?

অবৈধ সম্পর্ক মানে রক্তের সম্পর্কিত মানুষের জিজিমা করা, জবাব দিল ফেন।

ফেনের নিষ্পাপ কণ্ঠ এমনি কর্কশ শব্দ শুনে শ্বাস আটকে ফেলল তাইতা। জিজিমা?সতর্ক কণ্ঠে জানতে চাইল ও। তার মানে কী?

মানেটা ভালো করেই জানো তুমি, তাইতা, দীর্ঘ কষ্ট প্রকাশসূচক একটা ভাব করে বলল ফেন। তুমি আর আমি সারাক্ষণই জিজিমা করছি।

ফের দমবন্ধ হয়ে গেল তাইতার। তবে এবার নিজেকে সামলে রাখল ও। সেটা কীভাবে?

খুব ভালো করে জানো তুমি। আমরা হাত ধরাধরি করে চুমু খেয়েছি। এভাবেই লোকে জিজিমা করে। স্বস্তির সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাইতা। ফেন বুঝতে পারল একথাটা ওকে বলেনি তাইতা।বেশ, ব্যাপারটা তা নয়, তাই না?

মনে হয়, কিংবা অন্তত আংশিক ঠিক না।

এবার ওর সন্দেহ পুরোপুরি চাঙা হয়ে উঠল। সন্ধ্যার বাকি সময়টা অস্বাভাবিক রকম চুপ থাকল সে। তাইতা জানে সহজে ওকে আর ঠেকানো যাবে না।

পরের রাতে উজানে যাত্রার সময় থেকে মনে থাকা একটা জলপ্রপাতের মাথার উপর শিবির করল ওরা। তখন নদীটা প্রায় শুকনো ছিল, কিন্তু এখন ওটার অবস্থান ফোয়ারার উঁচু স্তম্ভে চিহ্নিত হয়ে আছে, বনের মাথা ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে ওটা। তীরে পৌঁছানো দলটা সীমানা বানাতে কাটাঝোঁপ কাটার সময় তাইতা ও ফেন উইন্ডস্মোক ও ওয়ার্লউইন্ডের পিঠে সওয়ার হয়ে নদীর তীর বরাবর চলে যাওয়া জম্ভজানোয়ারের চলার পথ ধরে এগিয়ে গেল, মোষ ও হাতির পায়ের গভীর ছাপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে পথটা, নাদিতে ভরা। তীর ধনুক তৈরি রেখে সাবধানে এগিয়ে চলল ওরা। ট্রেইলের প্রতিটি বাঁকেই কোনও একটা পালের সামনে পড়ে যাবার আশা করছে। তবে কাছের বনে হাতির ডাক ও ডালপালা ভাঙার আওয়াজ কানে এলেও কোনও প্রাণী না দেখেই প্রপাতের মাথায় এলো ওরা। ঘোড়াগুলোকে ঘাস খেতে ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে আগে বাড়ল।

নদীর এই অংশটা যখন সংকীর্ণ পাথুরে গোর্জের গভীরে সামান্য একটা ধারা ছিল, তখনকার কথা ভাবল তাইতা। এখন উঁচু পাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাবার সময় শাদা ফেনা তুলে কালো পাথর থেকে লাফিয়ে উঠে আসছে জল। সামনে গর্জন করছে অদৃশ্য জলপ্রপাত, ওদের মুখে এসে পড়ছে জল-কণা।

ওরা যখন অবশেষে জলপ্রপাতের উপরের চাতালে এসে দাঁড়াল, দেখা গেল এখানে নীল নদ দুই শো কদম থেকে কমে স্রেফ বিশ কদমে পরিণত হয়েছে। নিচে প্রবল স্রোতধারা চমৎকার রংধনুর খিলানের ভেতর দিয়ে শত শত কিউবিট নিচের ফেনা ওঠা গোর্জে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

আমরা মিশরের মোহনায় আসার আগে এটাই শেষ জলপ্রপাত, বলল তাইতা। আমাদের পথের শেষ বাধা। দৃশ্যের চমৎকারিত্বে নিজেকে হারিয়ে ফেলল ও।

ফেনকেও সমান মুগ্ধ মনে হলো। কিন্তু আসলে ভিন্ন ভাবনায় ডুবে আছে ও। ঠোঁটে স্মিত হাসি, চোখে স্বপ্নীল দৃষ্টি নিয়ে তাইতার কাঁধে ভর দিল ও। শেষে যখন কথা বলল, ফ্যাসফ্যাসে শব্দ হলো, কথাগুলো নীলের পানির গর্জনে হারিয়ে গেল না। গতকাল ইম্বালির সাথে আবার লোকের জিজিমা করার ব্যাপারে কথা বলেছি। সবুজ চোখজোড়া ওর দিকে ফেরাল ফেন। আমাকে সব বলেছে ও। আমরা অমন কিছু করব, এটা কোনোদিন ভাবিনি।

ঠিকমতো উত্তর দিতে গিয়ে কিছুটা দিশাহারা বোধ করল তাইতা।এখন ফিরতে হবে, বলল ও। সূর্য ডুবতে বসেছে, অন্ধকার নামার পর আমাদের পথে থাকা উচিত হবে না, যেখানে আশপাশে সিংহ রয়েছে। পরে এনিয়ে কথা বলব আমরা।

*

ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে ফের নদীর কিনারা বারাবর আগে বাড়ল ওরা। সাধারণত ওদের কথোপকথনের ধারা অবিরাম চলতে থাকে, এক কথার সূত্র ধরে আরেক কথা চলে আসে। কিন্তু এই একবারের জন্যে হলেও কারও কিছুই বলার নেই, নীরবে জম্ভজানোয়ারের পথ ধরে এগিয়ে চলল ওরা। যখনই আড়চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে তাইতা, দেখা যাচ্ছে হাসছে ফেন।

ওরা সীমানা প্রাচীরের ভেতর ফেরার পর দেখা গেল মহিলারা রান্নার আগুনের চারপাশে ব্যস্ত হয়ে আছে। পুরুষরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আলাপ করছে আর বিয়র খাচ্ছে, সারাদিনের বৈঠা বাওয়ার কঠোর পরিশ্রম শেষে পরিশ্রান্ত পেশিগুলোকে বিশ্রাম দিচ্ছে। স্যাডল থেকে নামতেই ওদের সাথে যোগ দিতে ছুটে এলো মেরেন। আপনাদের খোঁজে আর একটু হলেই অনুসন্ধানী দল পাঠানোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছিলাম।

পথ রেকি করছিলাম আমরা, স্যাডল থেকে নেমে সহিসদের হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে বলল তাইতা। আগামীকাল নৌকোগুলো আলগা করে জলপ্রপাতের ওপাশে নিয়ে যেতে হবে আমাদের। নিচের ট্র্যাকটা অনেক খাড়া, সুতরাং সামনে অনেক খাটুনি অপেক্ষা করছে।

এই ব্যাপারে আলোচনা করতেই সব ক্যাপ্টেন ও হেডম্যানের সভা ডেকেছি। আমরা আপনার শিবিরে ফেরার অপেক্ষা করছিলাম।

আমি তোমার রাতের খাবার নিয়ে আসছি, বলল ফেন, তারপর পিছলে সরে গেল রান্নার আগুনের কাছে মেয়েদের দিকে।

সমাবেশের মাথার কাছে অবস্থান নিল তাইতা। কেবল নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা বা কর্মধারা নিয়ে আলোচনার করার জন্যেই এসব সভা আয়োজন করে না বরং প্রত্যেককে দলের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক বা গুরুত্বপূর্ণ যেকোনও বিষয় তোলার সুযোগও দেয় ও। এটা আবার এক ধরনের শৃঙ্খলা ও ন্যায় বিচারের আদালতও, এখানে দুষ্কৃতকারীদের জবাবদিহির জন্যে তলব করা যেতে পারে।

সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে ওকে এক গামলা স্টু আর এক কাপ বিয়র এনে দিল ফেন। যাবার সময় ফিসফিস করে বলল, আমি বাতি জ্বেলে তোমার অপেক্ষায় থাকব। আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার রয়েছে।

এ কথায় কৌতূহলী হয়ে দ্রুত সভার কাজ নিয়ে অগ্রসর হলো তাই। নৌকাগুলো সরিয়ে নেওয়ার কৌশল সম্পর্কে একমত হওয়ার পরই মেরেন ও তিনাতকে অল্প গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার ফয়সালা করার ভার দিয়ে চলে এলো ও। রান্নার আগুনের পাশের মহিলাদের পাশ কাটানোর সময় শুভরাত্রি জানাল ওরা। নিজেদের মধ্যে হাসতে লাগল, যেন কোনও মজার গোপন বিষয় নিয়ে মজা করছে। ঘেরাওয়ের শেষ প্রান্তে টাটকা কাটা ছাদ বানানোর ঘাসের পর্দার আড়ালে ওদের কুঁড়েটা বসিয়েছে মেরেন। খোলা পথে ভেতরে পা রাখতেই তাই দেখল ফেন সত্যিই কুপি জ্বালিয়ে রেখেছে। এরই মধ্যে মাদুরের উপর কারোসের নিচে শুয়ে পড়েছে। উঠে বসল ও, ওর কোমরের কাছে নেমে গেল পশমটা। কুপির আলোয় কোমল হয়ে জ্বলছে ওর বুক। ওর প্রথম চাঁদের পর থেকে পরিপূর্ণ, আরও সুগোল হয়ে উঠেছে ওগুলো।

যেমন ভেবেছিলাম, তারচেয়ে অনেক আগে এসে পড়েছ, কোমল কণ্ঠে বলল ফেন। টিউনিক খুলে এক কোণে ফেলে দাও। কাল ওটা ধুয়ে দেব। এবার বিছানায় এসো। কুপি নেভাতে উবু হলো তাইতা, কিন্তু ওকে থামাল ফেন। না, জ্বলুক। তোমাকে দেখতে চাই আমি। ফেন যেখানে শুয়ে আছে সেখানে চলে এলো তাইতা। ওর পাশে মাদুরের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বসেই রইল ফেন, ওর চেহারা পরখ করতে সামনে ঝুঁকলো।

তুমি এত সুন্দর, ফিসফিস করে বলল, আঙুল দিয়ে ওর কপালে এসে পড়া এক গোছা চুল সরিয়ে দিল। মাঝে মাঝে তোমার মুখের দিকে যখন তাকাই, তাইতা, এত খুশি লাগে, মনে হয় কেঁদে ফেলি। ওর ভুরুর বাঁকে হাত বোলাল ফেন, তারপর ঠোঁট। তুমি একেবারে নিখুঁত।

এটাই কি তোমার গোপন কথা?

আংশিক, বলে তাইতার গলা থেকে শুরু করে ওর বুকের পেশির উপর হাত বোলাল ও।

*

ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেরেন। হাতে ধরে রাখা বিয়রের পটটা ফেলে দিল। তরলটুকু আগুনে পড়ে ধোয়া আর ছাইয়ের মেঘ সৃষ্টি করল। খাপ থেকে এক টানে তলোয়ার বের করে যুদ্ধের ঢঙে বিকৃত চেহারায় ছুটে গেল তাইতার কুঁড়ের দিকে। সমান ক্ষিপ্রতা দেখাল নাকোন্তো। দুই হাতে একটা করে স্ট্যাবিং বর্শা নিয়ে মেরেনের পিছু পিছু ছুটল। ওরা ঘেরাওয়ের মাঝামাঝি যাওয়র আগেই সিদুদু আর ইদালি দৃঢ়ভাবে ওদের পথ আগলে দাঁড়াল।

সরে দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠল মেরেন। ওরা বিপদে পড়েছে। ওদের কাছে যেতে হবে আমাদের।

সরে যাও, মেরেন ক্যাম্বিসেস! ছোট মুঠি দিয়ে ওর বুকে ঘুসি মারল সিদুদু। তোমাদের সাহায্য লাগবে না ওদের। কেউই খুশি হবে না তোমাদের উপর।

নাকোন্তা, মুখ শিলুক কোথাকার! স্বামীর উদ্দেশে চিৎকার করল ইম্বালি। বর্শা তুলে রাখ। সারা জীবন কি কিছুই শেখনি? ওদের একা থাকতে দাও!

বিভ্রান্ত হয়ে থমকে দাঁড়াল দুই যোদ্ধা, সামনে দাঁড়ান মেয়েদের দিকে তাকাল একবার, তারপর বোকার মতো মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চেহারায় লজ্জা। নিশ্চয়ই…? শুরু করতে গেল মেরেন। ম্যাগাস আর ফেন না- বোকার মতো থেমে গেল ও।

অবশ্যই তাইতা, জবাব দিল সিদুদু। ঠিক তাই করছে ওরা। শক্ত করে ওর হাত ধরে ওকে আবার আগুনের পাশে নিজের টুলে নিয়ে এলো ও। তোমাকে আবার বিয়র এনে দিচ্ছি।

তাইতা আর ফেন, আমোদিত হয়ে মাথা নাড়ল সে। কে ভাবতে পেরেছিল?

তুমি বাদে সবাই, বলল সে। মনে হচ্ছে মেয়েরা কী চায় তার কিছুই জানো না তুমি। মেরেন কাঁপছে টের পেল সে, ওকে শান্ত করতে ওর বুকে একটা হাত রাখল। ওহ, মেয়েরা কী চায় খুব ভালো করেই জানো তুমি। আমি নিশ্চিত, মিশরের সব সেরা বিশেষজ্ঞ তুমি।

ধীরে ধীরে স্থির হলো মেরেন, সিদুদুর কথা ভাবল। মনে হয় ঠিকই বলেছ, সিদুদু, অবশেষে স্বীকার গেল। নিশ্চয়ই তুমি কি চাও আমার জানা নেই, জানলে আমার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তোমাকে দিতাম।

তা দিতে, জানি আমি, প্রিয় মেরেন। আমার প্রতি অনেক ভদ্রতা আর দরদ দেখিয়েছ তুমি। জানি তোমার সংযম কীভাবে তোমার ক্ষতি করেছে।

আমি তোমাকে ভালোবাসি, সিদুদু। তুমি সেই ঐগদের ধাওয়া খেয়ে বন থেকে ছুটে বের হয়ে আসার পর থেকেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।

আমি জানি, ওর কাছে ঘেঁষে এলো ও। তোমাকে খুলে বলেছি সব, জাররিতে আমার উপর কি ঘটেছে, সবই বলেছি। ওনকা দানোটা… থেমে গেল সে, তারপর আবার শান্ত কণ্ঠে বলল, অনেক ক্ষত রেখে গেছে সে।

ক্ষতগুলো কখনও সেরে উঠবে না? জানতে চাইল মেরেন। সারা জীবন তার অপেক্ষায় থাকব আমি।

তার দরকার হবে না। তোমার সাহায্যে একদম সেরে গেছে, এমনকি সামান্য চিহ্ন পর্যন্ত নেই। লাজুক ঢঙে মাথা হেলাল সে। তুমি হয়তো আমার মাদুরটা তোমার কাছে নিয়ে আসার অনুমতি দেবে, তবে আজ রাতে…।

দুটো মাদুরের দরকার নেই আমাদের। আগুনের আলোয় বিস্তৃত হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার চেহারা। আমারটা যথেষ্ট বড়। তোমার মতো ছোট্ট মানুষটির ঠিকই জায়গা হয়ে যাবে। নিজে উঠে সিদুদুকে টেনে দাঁড় করাল ও। ওরা আগুনের বৃত্ত ছেড়ে যাবার সময় ইম্বালি আর নাকোন্তো ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল।

এই বাচ্চারা! আমোদিত মাতৃসুলভ ঢঙে বলে উঠল ইম্বালি। চোখের সামনে কী পড়ে আছে সেটা ওদের দেখিয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবে এবার আমার কাজ শেষ হয়েছে। একরাতেই দুটো! নিজের উপর দারুণ খুশি আমি।

তাই বলে ধারেকাছের বাকি সবাইকে নিয়ে আবার মাথা ঘামাতে যেয়ো না, তাতে আবার তোমার চোখের সামনে যে আছে তাকে অবহেলা করে বসতে পারো, মেয়ে, কড়া কণ্ঠে ওকে বলল নাকোন্তো।

আহ, ভুল হয়ে গেছে। আমার কাজ শেষ হয়নি। বলে হেসে উঠল সে। আমার সাথে চলো, শিলুকদের মহান নেতা। তোমার বর্শা শানিয়ে দিচ্ছি। তাতে ভালো ঘুম হবে তোমার। হেসে উঠল সে। আর আমারও!

*

অগুনতি প্রজাতির হাতির পথ চলায় বিক্ষত একটা পথ চলে গেছে রিফট উপত্যকার ঢালের উপর দিয়ে, কিন্তু পথটা সংকীর্ণ হওয়ায় নৌকাগুলো নিচে বয়ে যাওয়া কাবা-লেগা জলপ্রপাতের নিচের অংশে নদীর কাছে নিয়ে যেতে পথটা চওড়া করতে অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হলো ওদের। অবশেষে নৌবহর আবার ভাসাতে পারল ওরা, জলধারার কেন্দ্রে চলে এলো। স্রোত জোরাল হওয়ায় দ্রুত উত্তরে টেনে নিয়ে চলল ওদের, কিন্তু বিপজ্জনকও। মোটামুটি সমান সংখ্যক দিনে ডুবো পাহাড়ের খোঁচায় পাঁচটা নৌকা খোয়াতে হলো ওদের। ছয়টা ঘোড়াসহ তিনজনের সলিলসমাধি হলো। সিমলিকি নিয়নযু হ্রদের খোলা জলে বের হয়ে আসতে আসতে প্রায় সবগুলো নৌকাই ক্ষতবিক্ষত, দুমড়ে মুচড়ে গেল। এমনকি নীল আবার বইতে শুরু করার এই স্বল্প সময়ের ভেতর নাটকীয়ভাবে ভরে উঠেছে এটার জলধারা। এখন আর অগভীর, কাদাময় নেই, রোদের আলোয় নীলে ঝলক খেলছে। উত্তরের বিস্তৃর্ণ জলের সীমানার ওপারে তীরের আবছা নীল রেখা কোনওমতে চোখে পড়ে, কিন্তু পশ্চিমে জমিনের লেশমাত্র নেই।

কাছের তীরে এখন অনেকগুলো গ্রাম চোখে পড়ছে, তবে ওরা এপথে যাবার সময় ছিল না এগুলো। এটা পরিষ্কার, ইদানীং এখানে বসতি গড়ে উঠেছে। কারণ সদ্য তোলা মাগুর মাছ ঝলসানোর তাকে বিছিয়ে রাখা হয়েছে, অগ্নিকুণ্ডে টাটকা আগুন জ্বলেছে। কিন্তু নৌবহরকে এগিয়ে আসতে দেখে সরে পড়েছে লোকজন।

এই গোত্রকে আমি চিনি। ওরা ভীতু জেলে, আমাদের জন্যে হুমকি হবে না, তাইতাকে বলল ইম্বালি। এখন বিপজ্জনক সময় যাচ্ছে, যুদ্ধংদেহী গোত্রগুলো ঘিরে রেখেছে ওদের। সেজন্যেই পালিয়ে গেছে ওরা।

নৌকার খোল মেরামতের জন্যে তীরে ওঠানোর নির্দেশ দিল তাইতা। ঢালের দায়িত্ব তিনাত ও মেরেনের হাতে দিয়ে নাকোন্তো ও ইম্বালিকে দোভাষী হিসাবে ফেনসহ অক্ষত নৌকায় করে হ্রদের পশ্চিম প্রান্ত ও সেমলিকি নদীর মুখের দিকে রওয়ানা হলো তাইতা। নীলের অন্য বিশাল শাখাঁটি আবার বইতে শুরু করেছে নাকি এখনও ইয়োসের বৈরী প্রভাবে রুদ্ধ হয়ে আছে, জানতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও। কারনাকে পৌঁছার পর ওকে অবশ্যই ফারাওকে এইসব বিষয় জানানোর মতো অবস্থায় থাকতে হবে, মিশরের মঙ্গলের জন্যে এসব জরুরি।

পুব থেকে একটানা বাতাস বইছে। তাতে বৈঠার বেঞ্চের মাঝিদের সাহায্য করার জন্যে তেকোণা পাল খাটাতে পারল ওরা। গলুইয়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নিচু ঢেউয়ের কারণে শাদা সৈকতের সীমারেখা পাথুরে জমিন ধরে তরতর করে এগোতে লাগল ওরা। দিগন্তে রইল নীল পাহাড়ের বাঁধ। পঞ্চম দিনে দক্ষিণ থেকে এসে হ্রদে মেশা প্রশস্ত খরতোয়া নদীর মুখে হাজির হলো ওরা।

এটাই সেমলিকি? ইস্বালার কাছে জানতে চাইল তাইতা।

এর আগ আর এতদূর আসিনি আমি। বলতে পারব না। জবাব দিল সে।

আমাকে নিশ্চিত হতে হবে। এখানকার কোনও বাসিন্দাকে খুঁজে বের করতে হবে। নৌকা দেখামাত্রই তীর বরাবর বসতির বাসিন্দারা পালিয়ে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হ্রদের জলে একটা জীর্ণ কুঁদে বানানো ক্যানু দেখতে পেল ওরা। ওটার বয়স্ক লোক দুটো এত ব্যস্ত ছিল যে নৌকাটা একেবারে পিছনে এসে হাজির হওয়ার আগে টেরই পেল না। এবার জাল ফেলে সৈকতের দিকে ঝেড়ে দৌড় লাগাল ওরা। কিন্তু গালিকে ফাঁকি দেওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না। শেষে হতাশার সাথে হাল ছেড়ে চুল্লীর আগুনে তুলে দিল নিজেদের।

দুই পাকা দাড়ি বুড়ো ওদের খেয়ে ফেলা হবে না বুঝতে পারলে স্বস্তিতে বকবক শুরু করে দিল। ইদালি ওদের প্রশ্ন করতেই সাথে সাথে নিশ্চিত করল এটাই সেমলিকি আর এই অল্প কদিন আগেও এটা শুকনো খটখটে ছিল। নদীর অলৌকিক পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার বর্ণনা দিল ওরা। পাহাড় আর পৃথিবী যখন কেঁপে উঠেছে, নড়েছিল, হ্রদের পানি আকাশের মতো উঁচু ঢেউয়ের ঘায়ে আছাড়িপাছাড়ি করছিল, এমন একটা সময় প্রবল জোয়ার তুলে নেমে এসেছে নদীটা, এখন অনেক বছর আগে যেভাবে বইত সেভাবেই বইছে। ওদের পুঁতি আর তামার বর্শার ফলা উপহার দিল তাইতা, তারপর ছেড়ে দিল দুই বুড়োকে। নিজেদের অবিশ্বাস্য ভাগ্যে দুজনই বিস্মিত।

এখানে আমাদের কাজ শেষ, ফেনকে বলল তাইতা। এবার আমরা মিশরে ফিরে যেতে পারব।

ওরা যখন নীলের মুখে ঢালে ফিরে এলো, দেখল মেরেন আর তিনাত ক্ষতিগ্রস্ত নৌকার খোলস মেরামতের কাজ সেরে ফেলেছে, সেগুলো ফের জলে ভাসানোর উপযোগী হয়ে গেছে। নোঙর ওঠানোর নির্দেশ দেওয়ার আগে দুপারের হাওয়া চড়ে ওঠার অপেক্ষা করল তাইতা। তেকোণা পাল তুলে বৈঠায় টান মেরে হ্রদের খোলা জলের উপর দিয়ে ভেসে চলল ওরা। পালের সবসেরা জায়গায় হাওয়া লাগায় সূর্যাস্তের আগেই উত্তর তীরে পৌঁছে গেল। নালুবালে আর সেমলিকি নুয়ানযি নামের দুটি মহা হ্রদের জলে পরিপূর্ণ নীলের শাখায় বের হয়ে এলো। দক্ষিণে আসার সময় পার হয়ে আসা এলাকার উপর দিয়ে উত্তরে নিয়ে চলল ওদের নদী।

ওদের যাত্রার পরবর্তী বাধা ছিল মারাত্মক সেতসি মাছির সেই এলাকা। অনেক আগেই ঘোড়ার অসুস্থতার মহৌষধ তোলাস পিঠার সবটুকু শেষ করে ফেলেছে ওরা। তাই সামনের নৌকার ডেকে বসার জন্যে তেড়ে আসা প্রথম মাছিটা দেখামাত্রই গতি বদলের নির্দেশ দিল তাইতা, নৌবহরকে নদীর মাঝখানে নিয়ে এলো। স্টার্ন ধরে এক লাইনে এগিয়ে চলল ওরা। অচিরেই স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে গেল যে, পতঙ্গগুলোকে এড়ানো গেছে। নদীর মাঝখানে নৌকার কাছে আসতে উন্মুক্ত জলে বের হয়ে আসবে না। তো অনাক্রান্ত অবস্থায় এগিয়ে যেতে লাগল ওরা। রাতে তীরে নামা দূরে থাক কোনও নৌকাকে তীরের ধারে কাছেও যেতে দিচ্ছে না তাইতা। অন্ধকারে ভেসে চলে ওরা আধখানা চাঁদের আলোয়।

আরও দুই দিন তিন রাত স্রোতের ঠিক মাঝখানে রইল ওরা। অবশেষে কুমারীর বুক আকৃতির জোড়া পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পেল দূরে, মাছির এলাকার উত্তরের সীমা নির্দেশ করছে ওটা। তবু নৌকাগুলোকে বিপদে ফেলার ঝুঁকি নিল না তাইতা। প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে তীরে যাবার নির্দেশ দেওয়ার আগে আরও অনেক লীগ ভেসে চলল। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল মাছির কোনও চিহ্ন নেই। আদারি দুর্গের পথ পরিষ্কার।

কর্নেল তিনাত প্রায় এগার বছর আগে ওখানে রেখে যাওয়া সেনাছাউনীর অবস্থা জানতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। তার ধারণা নির্যাতিতদের উদ্ধার করে আবার ওদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ওর দায়িত্বের ভেতর পড়ে। নৌবহর দুর্গের পাহাড়ের একই সমতলে আসার পর নোঙর করে ঘোড়াগুলোকে পাড়ে নামানো হলো।

যাত্রার ক্লান্তি থেকে কিছু সময়ের জন্যে নিস্তার পাওয়ায় আর শরীরে নিচে ফের ঘোড়ার অস্তিত্ব অনুভব করে ভালো লাগল ওদের। ফলে পাসের ভেতর দিয়ে গোড়ার পিঠে অন্যান্য ঘোড়সওয়ারের সাথে আগে বাড়ার সময় বেশ চাঙা হয়ে উঠল তাইতা, ফেন ও তিনাতের মেজাজ। দুর্গকে ঘিরে রাখা ঘেসো মালভূমি দেখতে পাচ্ছে ওরা।

তোলাসের কথা তোমার মনে আছে, ঘোড়ার কবিরাজ? জানতে চাইল ফেন। আবার তার সাথে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আছি আমি। আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে সে।

ঘোড়ার বেলায় জাদু দেখাতে পারে সে, সায় দিল তাইতা। উইন্ডস্মোককে তার খুবই পছন্দ হয়েছিল, ভালো জাতের ঘোড়া চিনতে পারে। মেয়ারের ঘাড়ে চাপড় দিল ও। ওর কণ্ঠ শোনার জন্যে কান বাকাল ঘোড়াটা। তোকে আমার কাছ থেকে হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল সে, তাই না? নাক দিয়ে আওয়াজ করল ঘোড়াটা, মাথা দোলাল। তুইও নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় চলে যেতি ওর সাথে, বিশ্বাসঘাতিনী, বুড়ী ছিনাল কোথাকার।

দুর্গের দিকে এগিয়ে চলল ওরা, কিন্তু বেশি দূরে যাবার আগেই একটা কিছু গড় বড় হয়ে গেছে বলে মনে হতে লাগল। মালভূমিতে কোনও ঘোড়া বা গরুছাগল নেই; দেয়ালের ওপাশ থেকে ধোঁয়া উঠে আসছে না। প্যারাপেটের উপর পতাকাও উড়ছে না।

আমার লোকজন সব গেল কোথায়? বলে উঠল তিনাত। রাবাত বিশ্বস্ত লোক। এতক্ষণে আমাদের তার দেখার কথা…এখনও এখানে থাকলে। উদ্বিগ্নভাবে আগে বাড়ল ওরা। শেষে চিৎকার করে উঠল তিনাত, দেয়ালগুলো খুব খারাপ অবস্থায় পড়েছে। গোটা জায়গাটাই মনে হচ্ছে খাখা করছে।

প্রহরা মিনার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, লক্ষ করল তিনাত, ঘোড়াগুলোকে আরও জোরে ছোটার তাগিদ দিল ওরা।

যখন দুর্গের তোরণে পৌঁছুলে, দেখা গেল হাঁ করে খোলা ওটা। প্রবেশ পথে থামল ওরা, ভেতরে নজর চালাল। আগুনে কালো হয়ে গেছে দেয়ালগুলো। রেকাবে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে প্যারাপেটের উদ্দেশ্যে সৈনিকসুলভ হুঙ্কার ছাড়ল তিনাত। কোনও জবাব মিলল না। অস্ত্র বের করে নিল ওরা। কিন্তু সেনাছাউনীর উপকারে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। গেটের ভেতরে ঢুকে আগে বাড়ার সময় প্রাঙ্গণের কেন্দ্রে রান্নার আগুনের ধারে ওদের দেহাবশেষ করুণভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখল ওরা।

চিমা! মানুষখেকোদের ভোজৎসবের আলামত দেখে বলল তাইতা। মজ্জা বের করতে হাত-পায়ের লম্বা হাড়গুলো আগুনে পুড়িয়েছে চিমারা, তারপর বড় আকারের পাথরে রেখে ফাটিয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ভাঙা টুকরোটাকরা। শিকারের ছিন্ন মাথাগুলোরও একই অবস্থা করেছে ওরা, আগুনে পুড়িয়ে কালো করে উটপাখির সেদ্ধ ডিমের মতো ফাটিয়েছে। মনের চোখে গোল হয়ে বসে উন্মুক্ত খুলি হাত বদল করতে দেখল ওদের তাইতা। আধা-সেদ্ধ মগজ হাত দিয়ে কুড়িয়ে তুলে মুখে ঠেসে দিচ্ছে।

খুলিগুলোর আনুমানিক একটা হিসাব করল তাইতা। মনে হচ্ছে ছাউনীর কেউই পালিয়ে বাঁচতে পারেনি। মেয়ে, শিশু, পুরুষ-সবাইকেই কায়দা করেছে চিমারা।

ত্রাস আর বিতৃষ্ণা প্রকাশ করার মতো ভাষা খুঁজে পেল না ওরা।

দেখ! ফিসফিস করে বলে উঠল ফেন। নিশ্চয়ই ছোট্ট বাচ্চা হবে। পাকা ডালিমের চেয়ে বেশি বড় হবে না খুলিটা। ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে ওর চোখজোড়া।

দেহাবশেষগুলো জড়ো করো, নির্দেশ দিল তাইতা। নৌকায় ফিরে যাবার আগে ওদের কবরের ব্যবস্থা করতে হবে।

দেয়ালের বাইরে ছোট করে গণকবর খুঁড়ল ওরা, কারণ কবর দেওয়ার মতো তেমন কিছু অবশিষ্ট ছিলো না।

তারপরও চিমাদের এলাকা দিয়ে যেতে হবে আমাদের, শীতল, অটল দেখাচ্ছে তাইতার চেহারা। দেবতারা প্রসন্ন হলে এই খুনে কুকুরগুলোর সাথে বোঝাঁপড়ার সুযোগ মিলে যাবে।

বিদায় নেওয়ার আগে কেউ বেঁচে আছে কিনা নিশ্চিত হতে দুর্গ ও এর আশপাশের এলাকায় তল্লাশি চালাল ওরা, কিন্তু নেই কেউ। নিশ্চয়ই অসতর্ক অবস্থায় হামলা করা হয়েছিল, বলল তাইতা। লড়াইয়ের কোনও আলামত নেই।

গম্ভীর নীরবতায় নদীর পাড়ে ফিরে এলো ওরা। পরদিন ফের যাত্রা শুরু করল। চিমাদের এলাকায় পৌঁছানোর পর দুপাশে একটি করে ঘোড়সওয়ারের দলকে নামার নির্দেশ দিল তাইতা।

চোখকান খোলা রেখে সামনে বাড়ো। তোমাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখব আমরা যাতে চিমারা টের না পায়। ওদের কোনও নিশানা পাওয়ামাত্রই আমাদের সতর্ক করতে ফিরে আসবে।

চতুর্থ দিন তিনাতের আশা পূরণ হলো। নদীর আরেকটা প্রশস্ত বাঁক ঘুরে স্কাউটসহ হিলতোকে দেখতে পেল ওরা, তীর থেকে ওদের উদ্দেশে হাত নাড়ছে। সামনের নৌকাটা তীরে ভিড়তেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল হিলতো, ঝটপট তাইতাকে স্যালুট করতে এগিয়ে এলো। ম্যাগাস, এখান থেকে অল্প দূরেই নদী তীরে চিমাদের একটা বিরাট বসতি রয়েছে। বুনোদের দুই বা তিনশো জড়ো হয়েছে ওখানে।

ওরা তোমাকে দেখতে পেয়েছে? জানতে চাইল তাইতা।

না। কিছুই সন্দেহ করেনি ওরা, জবাব দিল হিলতো।

ভালো, অন্য নৌকা থেকে মেরেন ও তিনাতকে তলব করল তাইতা, তারপর দ্রুত ওর আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করল। কর্নেল তিনাতের লোকদের হত্যা করা হয়েছে, সুতরাং ওর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার ও দায়িত্ব দুটোই রয়েছে। কর্নেল, আজ বিকেলে শক্তিশালী একটা বাহিনী নিয়ে তীরে যাবে-চিমাদের চোখে পড়ার হাতে থেকে বাঁচতে রাতে অভিযান চালাতে হবে। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বনের কিনারা আর গ্রামের মাঝখানে অবস্থান নেবে। ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে নৌকা নিয়ে গ্রামে এসে যাব আমরা। তারপর নাকাড়া আর তীরে বৃষ্টির ভেতর বাড়িঘর থেকে বের করে আনব চিমাদের। ওরা নিশ্চিতভাবেই গাছপালার দিকে ছুটে যাবে। তোমার লোকদের ওপর গিয়ে পড়ার সময় পেছনে চোখ থাকবে ওদের। কোনও প্রশ্ন আছে?

ভালো, সহজ পরিকল্পনা, বলল মেরেন। সায় দিয়ে মাথা দোলাল তিনাত।

বলে চলল তাই। চিমারা দৌড়ানো শুরু করলেই মেরেন আর আমি বাকি লোজন নিয়ে ওদের পিছু ধাওয়া করব। ওদের সাঁড়াশি আক্রমণে কায়দা করতে পারব বলে মনে হয়। এবার, আদারি দুগের ভেতর আমরা কি পেয়েছিলাম সেটা মনে রেখে কাউকে বন্দি করতে যাব না। প্রত্যেককে মেরে ফেলবে।

গ্রামের অবস্থান আর বিস্তার আগেই রেকি করে রেখেছিল হিলতো, গোধূলির সময় তিনাতের বাহিনীকে তীরে নিয়ে গেল সে। রাতের মতো তীরে ভেড়ানো রইল নৌকাগুলো। তাইতা ও ফেন সামনের ডেকে মাদুর বিছাল, তারপর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইল। মহাশূন্যের বিভিন্ন বস্তু সংক্রান্ত আলোচনা, কিংবদন্তী ও বিভিন্ন নক্ষত্র নিয়ে পৌরাণিক গল্প শুনতে পছন্দ করে ফেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব সময়ই একই প্রসঙ্গে ফিরে আসে। আবার আমার তারার কথা বলো, ম্যাগাস, লস্ত্রিসের তারা, অন্য জীবনে মারা যাবার পর যা হয়ে উঠেছিলাম আমি। কিন্তু একেবারে গোড়া থেকে শুরু করো। বলল, কীভাবে আমি মারা গিয়েছিলাম, কীভাবে আমাকে তুমি নানা রকম মলম মাখিয়েছিলে, আমার কবর সাজিয়েছিলে। একটা বিন্দুও বাদ দিতে দেয় না। সব সময়ই শেষে তাই ওর চুল কেটে লস্ত্রিসের মাদুলি বানানোর অংশে এলে নীরবে কাঁদতে থাকে। হাত বাড়িয়ে তালিসমানটা ধরে।

আমি তোমার কাছে আবার ফিরে আসবতা সব সময় বিশ্বাস করতে তুমি? জিজ্ঞেস করে ও।

সব সময়, রোজ রাতে অকাশে তোমার তারা উঠতে দেখে অপেক্ষায় থাকতাম কবে ওটা আকাশের বুক থেকে হারিয়ে যাবে। আমি জানতাম ওটাই হবে আমার কাছে তোমার ফিরে আসার লক্ষণ।

নিশ্চয়ই অনেক নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ণ ছিলে তুমি।

তুমি ছাড়া আমার জীবন শূন্য মরুর মতো, বলে তাইতা, আবার কাঁদে ফেন।

ওহ, আমার তাইতা, এত দুঃখের আর সুন্দর গল্প আর কখনও বলা হয়নি। দয়া করে এখুনি আমাকে ভালোবাসো, আমার সমস্ত আত্মা আর দেহ দিয়ে তোমাকে চাই আমি। তোমাকে আমার অন্তরে অনুভব করতে চাই, আমার অন্তস্তল স্পর্শ করো। আমাদের আর কখনওই বিচ্ছিন্ন হওয়া চলবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *