৬. শয়তানের দেখানো ইমেজ

গুহায় শয়তানের দেখানো ইমেজগুলো তাড়া করে ফিরছে তাইতাকে। প্রতিদিনই আবার বাগানে ফিরে গুপ্ত পুকুরের পাশে তার জন্যে অপেক্ষা করার উদগ্র একটা ইচ্ছা জোরাল হয়ে উঠছে। মনের সামনের দিকে ও জানে এই তাগিদ ওর নিজস্ব নয়। সরাসরি ইয়োসের কাছ থেকে আসছে।

তার সীমানায় পা রাখলেই শক্তিহীন হয়ে পড়ছি। সব সুবিধাই তার হাতে। সেরা কালো বেড়াল সে। আর আমি তার ইঁদুর, ভাবল ও।

তারপরই ওর অন্তরের কণ্ঠস্বর জবাব দিল। তাহলে কী, তাইতা, জাররিতে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসোনি তুমি? তোমার মহাপরিকল্পনার কী হলো? তাকে খুঁজে পাবার পর এখন কাপুরুষের মতো পিছিয়ে যাবে?

কাপুরুষতার পক্ষে আরেকটা অজুহাত খুঁজে বের করল ও। কেবল যদি বৈরী তীরগুলোকে ঠেকানোর মতো একটা বর্ম পেতাম।

মেরেনকে ওর অপিরপক্ক চোখের পূর্ণ ব্যবহার শেখাতে সাহায্য করে এইসব তাড়া করা ভীতি ও প্রলোভন থেকে মনকে বিক্ষিপ্ত রাখার প্রয়াস পেল তাই। প্রথমে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছিল হান্নাহ, এমনকি তখনও ওকে দিনের আলোর দিকে তাকাতে দেয়নি। বরং ঘরের ভেতর আটকে রেখেছে।

চোখের লেন্স এখনও আবছা, পাঁপড়ির রঙও ফ্যাকাশে ও দুধের মতো শাদা। ভালো চোখটার সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে না, বরং ইচ্ছামতো নড়াচড়া করছে। চোখটাকে স্থির করতে সাহায্য করল তাইতা: লক্ট্রিসের মাদুলিটা মেরেনের সামনে ধরে এপাশ-ওপাশ, ওপর-নিচ দোলাতে থাকে; একবার কাছে আনে আবার দূরে সরায়।

প্রথমে দ্রুত চেষ্টা করল নতুন চোখটা, পানি জমে উঠল তাতে, পাপড়িগুলো আপনাআপনি কেঁপে উঠতে লাগল। রক্তলাল হয়ে চুলকাতে লাগল। ইমেজগুলো আবছা, বিকৃত রয়ে যাবার অভিযোগ করতে লাগল মেরেন।

এ নিয়ে হান্নাহর সাথে আলোচনা করল তাইতা। আসল চোখের চেয়ে ভিন্ন রঙের এটা। আকার বা গতির সাথে খাপ খায়নি। একবার নিজেকে মানুষের মালি বরেছিলে তুমি। হতে পারে তোমার লাগানো চোখটা ভিন্ন জাতের।

না, ম্যাগাস। এই চোখটা মূল চোখের শেকড় থেকেই বড় করা হয়েছে। যুদ্ধে কাটা পড়া অংশগুলো বদলে দিয়েছি আমরা। এগুলো সম্পূর্ণ মনে হয় না। আপনার উত্তরসুরির চোখের মতো চারার কায়দায় শুরু হয়ে আস্তে আস্তে পরিপক্ক আকার পায়। মানুষের শরীরের সময়ের পরিক্রমায় নিজেকে আদি রূপের সাথে খাপ খাইয়ে বৃদ্ধি ঘটানোর ক্ষমতা আছে। নীল চোখের জায়গায় বাদামী চোখ বসানো হয় না। হাতের জায়গায় পা বসানো হয় না। আমাদের সবারই এমন এক ধরনের প্রাণশক্তি আছে যা নিজেকে নকল করতে পারে। বাচ্চারা দেখতে বাবা-মায়ের মতো কেন হয় কখনও ভেবেছেন? থেমে নিবিড়ভাবে ওর চোখের দিকে তাকাল সে। ঠিক একইভাবে একটা কাটা হাত খোয়া যাওয়া অঙ্গের হুবহু নকল দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। নষ্ট করে দেওয়া কাটা শিশ্ন মূলের মতোই হুবহু একই রকমভাবে বেড়ে উঠবে। প্রচণ্ড বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে রইল তাই। নিষ্ঠুর, আঘাত দেওয়ার মতো প্রসঙ্গটা ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে।

আমারই খুঁত নিয়ে কথা বলছে সে, ভাবল ও। আমার বিকৃতি সহ্য করার কথা সে জানে। লাফ দিয়ে উঠে কামরা ছেড়ে বের হয়ে গেল ও। টলমল পায়ে অন্ধের মতো হ্রদের কিনারে চলে এলো। সৈকতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। অসহায়, পরাস্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। অবশেষে, অশ্রু যখন আর চোখে বিধল না, দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এলো, বাগানের মাথার উপর আকাশছোঁয়া ক্লিফ প্রাচীরের দিক মাথা তুলে তাকাল ও। ইয়োস আশপাশে আছে বলেই মনে হচ্ছে। যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো শক্তি নেই আর, সম্পূর্ণ ক্লান্ত ও মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে ও।

তুমি জিতেছ, ভাবল ও। শুরুর আগেই অবসান ঘটেছে লড়াইয়ের। তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করছি আমি। এবার তার প্রভাব বদলে যাচ্ছে, টের পেল ও। এখন আর তাকে সম্পূর্ণ অশুভ ও বৈরী মনে হচ্ছে না, বরং দয়াময়, উদার ঠেকছে। ওর মনে হলো ওকে বেদনা আর অবেগসঞ্জাত যুদ্ধ থেকে মুক্তি দিতে চাইছে সে। ইচ্ছা করল বাগানে গিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে, নিজেকে তার করুণায় সমর্পণ করতে। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল ও, নিজের কাজ আর ভাবনার অসামঞ্জস্যতায় অবাক মানল। পিঠ সোজা করে চিবুক ওঠাল। উঁহু! জোরে ফিসফিস করল ও। এটা আত্মসমর্পণ নয়। এখনও যুদ্ধে জেতেনি তুমি। মাত্র প্রথম আঘাত দিয়েছ। লস্ত্রিসের মাদুলির দিকে হাত বাড়াল ও, নিজের ভেতর শক্তির প্রবাহ টের পেল। মেরেনের চোখ নিয়েছে সে। আমার পুরুষাঙ্গ নিয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে সমস্ত সুবিধা রয়েছে তার হাতে। শুধু যদি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো তার কোনও কিছু হাতে পেতাম, তার হামলার পাল্টা আক্রমণ শানাতে একটা অস্ত্র। তেমন কিছু পেলেই আবার তার বিরুদ্ধে নামব। রঙিন ক্লিফের নিচে বাগানের আকাশছোঁয়া ফুল গাছগুলোর দিকে তাকাল। নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই সেদিকে পা বাড়াল। অনেক চেষ্টায় সরে এলো ও। এখনই নয়। আমি তৈরি নই।

স্যানেটোরিয়ামে ফেরার সময় দৃঢ় হয়ে উঠল ওর পদক্ষেপ। দেখল মেরেনকে অন্ধকার সেল থেকে ওদের আগের অনেক প্রশস্ত ও আরামদায়ক কামরায় নিয়ে গেছে হান্নাহ। তাই ঘরে পা রাখতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মেরেন, ওর টিউনিকের হাতা আঁকড়ে ধরল। মহিলার খুলে দেওয়া একটা হিরোয়েগ্লাফিকের গোটা স্ক্রোল পড়েছি, নিজের সাম্প্রতিক সাফল্যে গর্বে ফেটে পড়ে বলল সে। কাল চিরকালের মতো ব্যান্ডেজ খুলে ফেলবে সে। তখন এটার রঙ অন্যটার মিলে গেছে আর কত নিপূণভাবে নড়াচড়া করে সেটা দেখিয়ে আপনাকে তাক লাগিয়ে দেব। আইসিসের মিষ্টি নিঃশ্বাসের দোহাই, শিগগিরই বরাবরের মতো তীরের গতি আন্দাজ করতে পারার ঘোষণা করছি। ওর বাঁচালতা উত্তেজনারই নিশ্চিত লক্ষণ। তারপর এই নারকীয় জায়গা থেকে পালাব আমরা। জায়গাটা আমি ঘৃণা করি। এখানে বাজে, বিতৃষ্ণা জাগানোর মতো একটা কিছু আছে। লোকজনও তাই।

কিন্তু ওরা তোমার কত উপকার করেছে ভেবে দেখ, যুক্তি দেখাল তাই।

কিছুটা হতচকিত দেখাল মেরেনকে। বেশির ভাগ কৃতিত্ব আমি আপনাকেই দিই, ম্যাগাস। আপনিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন, এই বিপদে আমাকে সাহায্য করেছেন।

সেরাতে নিজের মাদুরে লম্বা হয়ে শুয়ে ছোট শিশুর মতো ঘুমে ঢলে পড়ল মেরেন। ওর নাক ডাকার শব্দ আনন্দময় ও বেপরোয়া। দশকের পর দশক তাই তাতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে ওর কাছে একে ঘুমপাড়ানি গানের মতো লাগে।

চোখ বন্ধ করল ও, সাথে সাথে ওর মনে বপন করে দেওয়া নারকীয় শয়তানের স্বপ্নগুলো ফিরে আসতে লাগল। নিজেকে সচেতনতার স্তরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল ও। কিন্তু স্বপ্নগুলো বড়ই জোরাল। মুক্ত হতে পারল না। উষ্ণ নারীদেহের সৌরভ অনুভব করতে পারছে। ওর শরীরের সাথে মিলে যাওয়া রেশমী স্ফীতি আর গহ্বরগুলো টের পাচ্ছে। নিমন্ত্রণের মিষ্টি কণ্ঠস্বর কানে আসছে। দুষ্টু আঙুলের ছোঁয়া টের পাচ্ছে। উত্তপ্ত মিষ্টি মুখ গ্রাস করে নিচ্ছে। ওর হারানো অঙ্গে অসম্ভব শিহরণ কাড়াকাড়ার মতো বেড়ে উঠল। শেষ সীমায় পৌঁছে গেল। তারপর মিলিয়ে গেল। ওগুলোর প্রত্যাবর্তন চাইল ও। ওর গোটা শরীর নিস্তার পেতে চাইছে। কিন্তু ওর নাগালের বাইরে রয়ে গেল তা, ওকে পীড়ন ও ক্ষতবিক্ষত করে চলল।

আমাকে ছাড়ো! প্রবল প্রয়াসে নিজেকে মুক্ত করে আনল ও। জেগে উঠে দেখল ঘামে ভিজে গেছে। কানের কাছে তপ্ত আওয়াজ তুলছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

উল্টোদিকের দেয়ালের জানালা গলে চাঁদের এক চিলতে আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে। কম্পিত শরীরে উঠে দাঁড়াল ও। পানির জগের কাছে এসে ঢকঢক করে পানি খেল। এমন সময় নিজের বেল্ট আর পাউচের দিকে নজর গেল ওর, ঘুমোনোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় যেখানে রেখেছিল সেখানেই পড়ে আছে। চাঁদের আলো সরাসরি পাউচের উপর এসে পড়ছে। যেন বাইরের কোনও প্রভাব ওকে ওটার দিকে তাকাতে বাধ্য করছে। তুলে বাঁধন আলগা করল ও। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে জীবন্ত উষ্ণ একটা কিছু স্পর্শ করল। ওর আঙুলের ডগার নিচে নড়ছে ওটা। ঝটকা মেরে হাত বের করে ফেলল ও। এতক্ষণে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠেছে। পাউচের মুখটা ভোলা রেখে এমনভাবে ধরল যাতে চাঁদের আলো ভেতরটা আলোকিত করে তোলে। নিচে একটা কিছু জ্বলজ্বল করছে। তাকিয়ে রইল ও, লক্ষ করল আভাটা বায়বীয় একটা আকার পেল। পাঁচ আঙুলঅলা বেড়ালের থাবা।

খুব সাবধানে আবার থলের ভেতর হাত ঢোকাল তাইতা, মেরেনের চোখ থেকে হান্নাহর বের করা লাল পাথরের ক্ষুদে টুকরোটা তুলে আনল। এখনও উষ্ণ, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, কিন্তু বেড়ালের থাবা মিলিয়ে গেছে। শক্ত করে ধরে রাখল ওটা। সাথে সাথে স্বপ্নের ঝামেলা মিলিয়ে গেল।

কামরার কোণে রাখা তেলের কুপির কাছে এগিয়ে গেল ও, সলতে বাড়িয়ে দিল। সেই আলোয় পাথরের ছোট টুকরোটা পরখ করল। স্ফটিকের রুবি ঝলক জ্যান্ত মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে ওর বোধ জাগল যে পাথরটা ইয়োসের সত্তার খানিকটা ধারণ করে। মেরেনের চোখে এটা ঢোকানোর সময় নিশ্চয়ই নিজের জাদুর একটা অংশে মুড়ে দিয়েছিল।

এটাকে হ্রদের পানিতে প্রায় ছুঁড়েই দিয়েছিলাম। এখন আমি জানি কিছু একটা এটা নিতে অপেক্ষা করছে। পানির তলে দানবীয় ঘূর্ণী দেখার কথা মনে পড়ে গেল ওর। সেটা কুমীর বা মাছ যাই হয়ে থাকুক, বাস্তবে ওটা তারই আরেকটা প্রকাশ। মনে হচ্ছে, তুচ্ছ কণিকায় অনেক গুরুত্ব দিয়েছে সে। আমিও সমান গুরুত্বই দেব।

মাদুলির লকেটের ঢাকনা খুলে লস্ত্রিসের দুই জীবনের চুলের গোছোর পাশে রেখে দিল ও রুবি পাথরটা। এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী মনে হলো নিজেকে। এখন ওর বিরুদ্ধে নামবার জন্যে অনেক ভালোভাবে অস্ত্রে সজ্জিত হতে পেরেছি আমি।

*

সকালে ওর সাহস ও সিদ্ধান্ত অটল রইল। ওরা নাশতা সারার পরপরই হান্নাহ হাজির হলো মেরেনের নতুন চোখ পরখ করতে। ভুরুর রঙ আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে, আসলটার সাথে মিলে গেছে প্রায়। হান্নাহর আঙুল একপাশ থেকে অন্য পাশে বা উপর নিচে নড়ানোর সময় দৃষ্টি স্থির করার সময় দুটো চোখেই নড়াচড়াটা ধরতে পারল মেরেন।

সে চলে যাওয়ার পর ধনুক আর এম্বস করা চামড়ার তুন তুলে নিল মেরেন। তারপর হ্রদের পাশে খোলা মাঠে চলে এলো। একটা নিশানা স্থির করে দিল তাইতা, একটা ছোট খুঁটির উপর একটা রঙ করা চাকতি; তারপর ধনুকের জন্যে মেরেন নতুন তীর বাছার সময় ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সামঞ্জস্য আর ভারসাম্য পরখ করার জন্যে দুই হাতের মাঝখানে নিয়ে ঘোরাল ওটাকে।

তৈরি! বলে উঠল ও। নিশানা স্থির করল। ছিলা টেনে ধরে ছেড়ে দিল। শূন্যে ওড়ার পথে হ্রদ থেকে ধেয়ে আসা বাতাসে বেশ খানিকটা বেঁকে গেলেও লক্ষ্যবস্তুর মাঝখান থেকে মাত্র বুড়ো আঙুলের সমান দূরে গিয়ে আঘাত করল ওটা।

বাতাসের কথা মাথায় রেখো, বলে উঠল তাইতা। নেফার সেতির সাথে লালপথে চলাচলের সময় থেকেই এই তরুণকে তীর চালনা শিক্ষা দিয়েছে ও। মাথা দুলিয়ে সায় দিল মেরেন। তারপর দ্বিতীয় তীরটা টেনে ছেড়ে দিল। এটা ঠিক জায়গামতো বিধল।

পেছন ফেরো, নির্দেশ দিল তাইতা। নির্দেশ পালন করল মেরেন। লক্ষ্যবস্তু বিশ কদম কাছে নিয়ে এলো তাইতা। এবার সামনে ফিরে সাথে সাথে তীর ঘেঁড়ো।

বিশালদেহী মানুষ হিসাবে পায়ের উপর হালকা চালে ঘুরে ওর নির্দেশ পালন করল মেরেন। চোখ অন্ধ থাকার সময় খোয়ানো ভারসাম্য আর স্থিরতা আবার ফিরে পেয়েছে ও। হাওয়ার টানে খানিকটা বেঁকে গেল তীরটা, কিন্তু লক্ষ্য স্থির করার সময়ে সেটা মাথায় রেখেছিল ও। ওর ওঠানোটা ছিল নিখুঁত। ফের তীরটা গিয়ে ঠিক জায়গামতো বিধল। আস্তে আস্তে লক্ষ্যবস্তুকে দুই শো কদম দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল তাইতা। এমনকি এই দূরত্বেও চারটে তীরের মধ্যে তিনটাই একজন মানুষের চোখের সমান এলাকায় বিদ্ধ করতে সক্ষম হলো মেরেন। পরিচারকদের নিয়ে আসা মামুলি খাবার খেতে যখন বিরতি দিল, তাই বলল, আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে। হাত আর চোখকে এবার বিশ্রাম নিতে দাও। একটা ব্যাপার দেখতে হবে আমাকে।

ছড়ি তুলে নিল ও, লস্ত্রিসের মাদুলিটা চেইনের মাথায় গলায় ঝুলছে নিশ্চিত হয়ে তারপর দ্রুত পায়ে বাগানের গেটের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আগের পদক্ষেপ অনুসরণ করে শয়তানের গুহার দিকে এগোল ও। যতই কাছাকাছি হচ্ছে, আগ্রহের অনুভূতি ততই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল। অনুভূতিগুলো এতটাই অপ্রত্যাশিত যে তাইতা বুঝতে পারছে, বাইরের প্রভাবের কারণে দেখা দিচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি গুহায় পৌঁছে গেছে দেখে অবাক মানল ও। এই বিস্ময় বাগানে ওটাকে ওর কাছ থেকে গোপন রাখা হবে, ভেবেছিল ও। কিন্তু শেষ বার যেভাবে রেখে গিয়েছিল তেমনই আছে সব।

ঘেসো তীরে বসে পড়ল ও, তারপর অপেক্ষা করতে লাগল, জানে না কীসের জন্যে। সবকিছু শান্ত, স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। একটা সোনালি সানবার্ডের কাকলি শুনতে পেল ও। চোখ তুলে দেখল একটা লক্তলাল ফুলের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে ওটা, মধু টেনে নিতে খুব হিসাব করে দীর্ঘ বাঁকা ঠোঁটটা পাঁপড়ির পাত্রে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপরই রোদের ঝলকের মতো সাঁই করে উধাও হয়ে গেল ওটা। নিজেকে স্থির করে অপেক্ষা করতে লাগল তাইতা, ওর দিকে যাই এগিয়ে আসুক না কেন তার মোকাবিলা করতে সব শক্তি এক করছে।

একটা নিয়মিত টিপটিপ আওয়াজ শুনতে পেল ও, পরিচিত শব্দ, যদিও চট করে চিনে উঠতে পারল না। পেছনের রাস্তা থেকে আসছে ওটা। সেদিকে তাকাল ও। আওয়াজটা থেমে গেল, কিন্তু অল্প সময় বাদেই ফের শুরু হলো।

লম্বা একটা ছড়ি হাতে দীর্ঘ, কুঁজো একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। পাথুরে পথের উপর ওটার শব্দই শুনতে পাচ্ছিল তাইতা। লোকটার মুখে দীর্ঘ রূপালি দাড়ি, কিন্তু কুঁজো ও প্রবীন হলেও অনেক কম বয়সী তরুণের মতো ক্ষিপ্রতার সাথে চলাফেরা করছে। পুকুরের কিনারে চুপচাপ বসে থাকা তাইতাকে লক্ষ করেছে বলে মনে হলো না, পথ ধরে হ্রদের উল্টোদিকে চলে গেল। দূর প্রান্তে যাবার পর বসল। কেবল তখনই চোখ তুলে তাইতার দিকে সরাসরি তাকাল সে। নীরবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ থকে সব রক্ত সরে যাচ্ছে বলে মনে হলো, লস্ত্রিসের মাদুলিটা আঁকড়ে ধরল ও। বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে গেছে। পরস্পরের চোখের গভীরে দৃষ্টি দিল দুজন। দুজনই তার হুবহু যমজ চেহারা দেখতে পেল সামনে।

কে তুমি? অবশেষে ফিসফিস করে জানতে চাইল তাইতা।

আমিই তুমি, বলল আগন্তুক। কণ্ঠস্বর ওর নিজের হিসাবেই শনাক্ত করল তাইতা।

না, জোরে বলে উঠল তাইতা। আমিই আমি, তুমি লিজিয়ন। বেড়ালের থাবার কালো চিহ্ন বহন করছ তুমি। আমি সত্যির শাদা চিহ্নের স্পর্শ পেয়েছি। তুমি ভোরের ইয়োসের সৃষ্টি করা কল্পনা। আমি বাস্তবতা।

তোমার একগুঁয়েমি দিয়ে আমাদের দুজনকেই হতবাক করছ, কারণ আমরা দুজন এক, সমান, পুকুরের ওপারের লোকটা বলল। আমাকে অস্বীকার করার মানে নিজেকেই অস্বীকার করা। তোমাকে সেই সম্পদ দেখাতে এসেছি যা আমাদের দুজনেরই হতে পারে।

আমি দেখব না, বলল তাইতা, তোমার বিষাক্ত ইমেজগুলো আমার দেখা হয়ে গেছে।

না বলার সাহস করো না, কারণ তাতে তোমার নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হবে, বলল প্রতিবিম্ব। তোমাকে আমি যা দেখাতে যাচ্ছি কোনও মরণশীল মানুষ কোনওদিন দেখনি। পুকুরের দিকে তাকাও, তুমি যে আসলে আমি।

কালো জলের দিকে তাকাল তাইতা। কিছু নেই ওখানে, বলল ও।

সবই আছে, বলল অপর তাইতা। তুমি আর আমি, মানে আমরা সত্যিকার অর্থে সারা জীবন যা চেয়েছি। তোমার অন্তর্চক্ষু খোল, চলো একসাথে খুলি। তাই করল তাইতা, সাথে সাথে একটা আবছা দৃশ্য ভেসে উঠল ওর সামনে। যেন বন্ধ্যা বালিয়াড়ি ভরা সুবিশাল মরুভূমির দিকে তাকিয়েছে।

ওই মরুভূমি হচ্ছে সত্যির জ্ঞান বিহীন আমাদের অস্তিত্ব, বলল অপর তাইতা। সত্যি ছাড়া সবই বন্ধ্যা, একঘেয়ে। কিন্তু মরুভূমির ওধারে দেখ, আমার ক্ষুধার্ত আত্মা।

তাই করল তাইতা। দিগন্তে একটা বিশাল আলোক বিন্দু দেখতে পেল। একটা ঐশী আলো, একটামাত্র খাঁটি হীরা থেকে কেটে বের করা পাহাড়।

ওটাই সেই পাহাড় সব ভবিষ্যদ্বক্তা আর ম্যাগাস যার জন্যে যুদ্ধ করে। খামোকাই তা করে তারা। কোনও মরণশীল মানুষের পক্ষে ওই ঐশী আলোর নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। সব জ্ঞান আর প্রজ্ঞার পাহাড় ওটা।

অসম্ভব সুন্দর, ফিসফিস করে বলে উঠল তাইতা।

অনেক দূর থেকে ওটা দেখতে পাচ্ছি আমরা। মরণশীল মন ওটার চূড়ায় দাঁড়ালে কী সৌন্দর্য পাওয়া যাবে, কল্পনাও করতে পারবে না। তাইতা লক্ষ করল বুড়ো লোকটা খুশি আর শ্রদ্ধায় কাঁদছে। আমরা একসাথে ওই চূড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি, আমার অন্য সত্তা। কোনও মানুষ যা কোনওদিন পায়নি আমরা তা পেতে পারি। এরচেয়ে বড় পুরস্কার আর হতে পারে না।

উঠে ধীর পায়ে পুকুরের কিনারে এসে দাঁড়াল তাইতা। দৃশ্যের দিকে ভালো করে তাকাল ও, এমন একটা আকাক্ষা বোধ করল যা ওর অতীতের সব আকাঙ্ক্ষাকে ছাপিয়ে গেল। এটা কোনও গ্লানিকর কামনা নয়, কোনও খারাপ দৈহিক ইচ্ছাও নয়। এটা একেবারে পরিষ্কার, উন্নত ও খাঁটি, হীরক পাহাড়ের মতোই।

তোমার অনুভূতি বুঝতে পারছি, বলল নকল তাইতা। কারণ আমারও ওই একই অনুভূতি। উঠে দাঁড়াল সে। আমাদের আটকে রাখা, বন্দি করে রাখা এই প্রাচীন নাজুক দেহের দিকে একবার তাকাও। এর সাথে এককালে আমাদের সেই নিখুঁত রূপের তুলনা করো, যেটা আবার আমাদের হতে পারে। পানিতে তাকিয়ে আমাদের আগে কেউ দেখেনি কেউ আর কোনও দিন দেখবে না এমন একটা জিনিস দেখ। এর সবই আমাদের হাতে তুলে দিতে রাখা হয়েছে। এমন উপহার প্রত্যাখ্যান করা কি অপবিত্রতা নয়? হীরার পাহাড়ের দৃশ্যের দিকে ইঙ্গিত করল সে। দেখ, কীভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি আর কখনও ওটার দিকে চোখ ফেরাতে পারব? সিদ্ধান্ত আমাদের, তোমার আর আমার। ঝলমলে পাহাড়ের দৃশ্য কালো জলে মিশে গেল। তাইতাকে শূন্য, বেদনার্ত করে তুলল।

ওর হুবহু প্রতিবিম্ব উঠে পুকুরের কিনারা ঘুরে ওর কাছে এলো। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে হাত মেলে দিল সে। বিতৃষ্ণার একটা শিহরণ বোধ করল ও। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভ্রাতৃত্বমূলক ইঙ্গিতের সাড়া দিতে হাত ওঠোল। ওরা স্পর্শ করার আগেই একটা নীল ঝলক কড়কড় করে উঠল ওদের মাঝখানে। স্থির বিদ্যুতের ঝলকের মতো একটা ধাক্কা বোধ করল তাইতা। ওর অপর সত্তা হারিয়ে গেল ওর মাঝে। এক হয়ে গেল ওরা।

হীরার পাহাড়ের ঝলক জাদুর পুকুর ছেড়ে বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়ার অনেক পরেও রয়ে গেল ওর মনে।

নিচের গেটে ওর অপেক্ষায় ছিল মেরেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে আপনাকে খুঁজে মরছি, তাইতার সাথে যোগ দিতে ছুটে এলো সে। কিন্তু এ জায়গাটা বড্ড অদ্ভুত। কয়েক হাজার রাস্তা থাকলেও সবই আবার এখানে ফিরে এসেছে।

আমার খোঁজে এসেছ কেন? ডাইনীর বাগানের জটিলতা মেরেনের কাছে ব্যাখ্যা করা অর্থহীন।

কর্নেল তিনাত আনকুর খানিক আগে এসে পৌঁছেছে এখানে। ক্যাপ্টেন ওনকার কোনও লক্ষণ নেই। বলতে খুশি লাগছে যে সৎ কর্নেলের সাথে কথা বলার তেমন একটা সুযোগ হয়ে ওঠেনি আমার। এটাও বলতে পারব না যে তাতে অনেক ফায়দা হতো আমার। তার কখনওই তেমন কিছু বলার থাকে না।

একাই এসেছে সে?

না, অন্যরাও আছে, ছয়জন সৈনিক আর দশ মেয়ের একটা দল।

কী ধরনের মেয়ে?

অনেক দূরে থেকে দেখেছি আসলে-হ্রদের এই পাশে ছিলাম আমি। ওদের ভেতর অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ওদের অল্প বয়সী মনে হয়েছে, অবশ্য ঘোড়ার পিঠে ঠিকমতো বসতে পারছিল না। ভাবলাম ওদের আগমনের ব্যাপারটা আপনাকে আগেভাগে জানানো দরকার।

ঠিক করেছে তুমি, অবশ্য সেজন্যে তোমার উপর সব সময়ই নির্ভর করতে পারি আমি।

আপনার হয়েছে কী? আপনার চোখে মুখে কেমন যেন অদ্ভুত অভিব্যক্তি-ঘোর লাগা মৃদু হাসি আর স্বপ্নিল চোখ। কী অকাজ করছিলেন আপনি, ম্যাগাস?

এই বাগানগুলো খুবই সুন্দর, বলল তাইতা।

ওরা স্যানেটোরিয়ামে নিজেদের কোয়ার্টারে পৌঁছানোর পর একজন পরিচারককে অপেক্ষা করতে দেখল। ডাক্তার হান্নাহর কাছ থেকে আপনাদের জন্যে নিমন্ত্রণ নিয়ে এসেছি। আপনার মেঘ-বাগিচা ছেড়ে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে আজকের সন্ধ্যায় তিনি আপনাদের সাথে খাবেন বলে স্থির করেছেন।

ওকে গিয়ে বলো নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পেরে আমরা খুশি হয়েছি।

সূর্যাস্তের খানিক আগে আপনাদের নিতে আসব আমি।

সূর্যটা ক্লিফের চূড়ার ওপাশে কেবল ডুবেছে, এমন সময় আবার এলো সেই পরিচারক। ওদের বেশ কয়েকটা প্রাঙ্গণ আর আচ্ছাদিত গ্যালারির ভেতর দিয়ে নিয়ে গেল সে। গ্যালারি বরাবর অন্যদের দ্রুত এগিয়ে যেতে দেখল ওরা। কিন্তু কারও সাথে কোনও রকম সম্ভাষণ বিনিময় ছাড়াই এগিয়ে চলল। কয়েকজনকে মেরেনের অপারেশনের সময় ওদের সাথে থাকা পরিচারক হিসাবে শনাক্ত করতে পারল তাই।

এতক্ষণ এই দালানগুলো কতটা বিশাল সেটা লক্ষ করিনি কেন? কেন এগুলো জরিপ করার আগ্রহ বোধ করিনি? ভাবল ও। হান্নাহ ওদের বলেছিল বাগান আর দালানকোঠা শত শত বছরের পরিক্রমায় গড়ে তোলা হয়েছে। সুতরাং ওগুলোর বড় হওয়ায় বিস্ময় ছিল না। কিন্তু ওগুলো ওর কৌতূহল জাগিয়ে তোলেনি কেন? তারপর ওর মনে পড়ে গেল কীভাবে একটা ব্লকের মেয়েদের অনুসরণের চেষ্টা করেছিল ও, কিন্তু অব্যাহত রাখার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছিল।

গেট বা প্রহরীর কোনও প্রয়োজন নেই ওদের, বুঝতে পারল ও। অনাহুতদের দূরে সরিয়ে রাখতে, ওরা যেখানে কাউকে ঢুকতে দিতে চায় না সেখানে তাদের যাওয়া ঠেকাতে মানসিক প্রতিবন্ধকতা ব্যবহার করে-আমার বেলায় যেমন করেছে; আমার খোঁজে আসার সময় মেরেনের বেলায় যেমন করেছে।

একটা প্রাঙ্গণে ফোয়ারার পাশে নীরবে বসে থাকা অল্পবয়সী মেয়েদের একটা ছোট দলের পাশ দিয়ে এগোল ওরা। একজন বাঁশি বাজাচ্ছে, অন্য দুজন সিস্ট্রাম দোলাচ্ছে। বাকিরা মিষ্টি বিষাদের সুরে গান গাইছে।

আজ বিকেলেই এদের কয়েকজনকে দেখেছিলাম, ফিসিফিস করে বলল মেরেন। সূর্য এরই মধ্যে ক্লিফের ওধারে চলে গেলেও বাতাস এখনও উষ্ণ, কোমল। মেয়েদের পরনে হালকা পোশাক।

ওরা সবাই অন্তসত্তা, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।

জ্বালামুখে প্রথমদিন যাদের সাথে দেখা হয়েছিল তাদের মতে, সায় দিল মেরেন। মুহূর্তের জন্যে তাইতার মনে হলো কথাটার ভেতর গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকার কথা। কিন্তু চিন্তাটা পুরোপুরি ধরার আগেই প্রাঙ্গণ পেরিয়ে দূরের দলিজে উঠে এলো ওরা।

আপনাদের এখানেই রেখে যাচ্ছি আমি, বলল ওদের পথপ্রদর্শক, তবে খাওয়া শেষ হলেই আবার নিতে আসব। অন্য মেহমানদের নিয়ে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন ডাক্তার। দয়া করে ভেতরে যান। উনি আপনাদের অপেক্ষা করছেন।

শৈল্পিকভাবে সাজানো একটা বিশাল কামরায় পা রাখল ওরা। ঠিক মাঝখানে ক্ষুদে পুকুরে ভাসতে থাকা সাজানোর জাহাজে ভাসছে ছোট ছোট সব প্রদীপ। দেয়ালের বাস্কেটে বা মোজায়েকের মেঝেতে সাজানো সিরামিকের পাত্র আর মাটির পটে বেড়ে উঠছে ফুলের নকশা।

ওদের দিকে এগিয়ে এলো হান্নাহ। হাত ধরে অন্য অতিথিদের কাছে নিয়ে গেল। নিচু কাউচ বা কুশনের তূপে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে তারা। অন্য আরও দুজন ডাক্তারের সাথে গিব্বা রয়েছে ওখানে, দুজন পুরুষ আর একজন মহিলা। অমন উঁচু পদ আর মেঘ-বাগিচার অসাধারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করার অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কম বয়সী ঠেকছে ওদের। অন্য মেহমানটি হচ্ছে কর্নেল তিনাত। তাই ওর কাউচের দিকে এগিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়াল সে, গভীর সম্মানের সাথে অভিবাদন জানাল ওকে। হাসল না, কিন্তু সেটা আশাও করেনি তাই।

কয়েক দিনের মধ্যেই আপনাকে আর কর্নেল ক্যাম্বিসেসকে পাহাড়ের নিচে যেতে হবে, তাইতাকে বলল হান্নাহ। আপনাদের এসকর্ট ও গাইড হতে এসেছে কর্নেল তিনাত।

আমার জন্যে আনন্দ ও সম্মানের কাজ হবে সেটা, তাইতাকে নিশ্চিত করল তিনাত।

বাকি অতিথিরা মেরেনের নতুন চোখ পরখ করতে ওকে ঘিরে ধরেছে। অবাক মানছে। ডাক্তার হান্নাহ, তোমার অন্য সব সাফল্যের কথা জানি, বলল মহিলা। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটাই তোমার সাফল্যের সাথে বসানো প্রথম চোখ।

আরও ছিল, তবে সেগুলো তুমি আসার আগে, ওকে শুধরে দিল হান্নাহ। এখন আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে মানুষের শরীরের যেকোনও অঙ্গ বদলানোর ব্যাপারে সফল হতে পারব বলে মনে করছি। আজকের সন্ধ্যায় এখানে বেড়াতে আসা বীর কর্নেলরা তার পক্ষে সাক্ষী দেবে। তিনাতের দিকে তাকাল তিন অতিথি।

তুমিও কর্নেল! অল্প বয়সী মেয়েটা জানতে চাইল। জবাবে ডান হাত তুলে ধরল তিনাত, আঙুল দোলাল।

প্রথমটা এক বুনো যোদ্ধার কুড়োলের ঘায়ে কাটা পড়েছিল। এটা এসেছে ডাক্তার হান্নাহর দক্ষতার ফল হিসাবে। একই হাতে তাকে অভিবাদন জানাল সে। ওটা পরীক্ষা করতে মেরেনের চোখ পরীক্ষা করার মতো একই আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলো বাকি সার্জনরা।

শরীরের অঙ্গ আবার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনও সীমাবদ্ধতা আছে? জানতে চাইল একজন পুরুষ সার্জন।

হ্যাঁ, প্রথমত, অপারেশনের জন্যে অলিগার্কদের সুপ্রিম কাউন্সিলের অনুমোদন লাগবে; দ্বিতীয়ত, অবশিষ্ট অংশ কার্মক্ষম হতে হবে। আমরা মাথা বা হৃৎপিণ্ড বদল করতে পারব না, কারণ ওগুলো না থাকলে শরীরের বাকি অংশ বীজ বপনের আগেই মারা যাবে।

সন্ধ্যাটা তাইতার কাছে অনেক উপভোগ্য মনে হলো। সার্জনদের আলোচনায় এমন অনেক ডাক্তারি বিস্ময়কর ঘটনার কথা স্থান পেল যা এর আগে উচ্চারিত হতে শোনেনি। মেঘ-বাগিচার এক বা দুই বাটি অসাধারণ মদের কল্যাণে ওদের গাম্ভীর্য খসে পড়তেই মেরেন ও তিনাত অভিযান আর যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করা নানান বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলে ওদের আনন্দ যোগাল। খাবার শেষে গিব্বা বাঁশি বাজাল, তাইতা গান গাইল।

পরিচারক তাইতা ও মেরেনকে ওদের কোয়ার্টারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এলে খানিকটা অংশ ওদের সাথে এগোল তিনাত।

আমাদের কবে পাহাড়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবছ, কর্নেল? জানতে চাইল তাইতা।

আরও কয়েকটা দিন বাকি আছে। আমরা বিদায় নেওয়ার আগে অন্য কয়েকটা ব্যাপার সামাল দিতে হবে আমাকে। আপনাদের বিদায়ের আগে যথেষ্ট পূর্বাভাস দেব আমি।

আমি মুতাঙ্গি ছেড়ে আসার পর আমার সঙ্গীনী, মেয়েটাকে দেখেছ তুমি? জানতে চাইল তাইতা।ফেন নাম ওর। ওকে অনেক মনে পড়ছে।

তাকেও সমানভাবে আপনার প্রতি আকৃষ্ট মনে হয়েছে। এখানে আসার সময় গ্রাম হয়ে এসেছি আমি। আমাকে দেখে আমার ঘোড়ার পিছন পিছন ছুটে এসেছে আপনার খবর জানতে। আপনাকে নিয়ে যেতেই এখানে আসছি বললে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল সে। আপনাকে ওর সম্মান আর শ্রদ্ধা জানানোর দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে। দেখে খুবই ভালো আর খুশিতে আছে বলে মনে হয়েছে তাকে। চামকার মেয়ে, ওকে নিয়ে আপনার গর্ব করা উচিত।

আসলেও তাইতা, সায় দিল তাইতা। আমি সেজন্যে গর্বিত।

*

তাইতার সেরাতের স্বপ্নগুলো বেশ জটিল আর নানা স্তর বিশিষ্ট ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওর পরিচিত নারী-পুরুষরা ভীড় জমাল সেখানে। কিন্তু বাকি সবাই অচেনা, তারপরেও ওদের ছাবি এত সূক্ষ্মভাবে ওর মনে খোদাই হয়ে গেল যেন ওরা শত শত বছরের রক্তমাংসের মানুষ, কল্পনা ও মাকড়শার জালে বোনা নয়। স্বপ্নগুলো একই সুতোয় গাঁথা যেগুলো দিয়ে ওকে এক প্রত্যাশার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে: দারুণ বিস্ময়কর একটা কিছু ঘটতে চলেছে-এক অসাধারণ ভাণ্ডারের খোঁজ করছে ও, ওর হাতের নাগালেই রয়েছে সেটা।

এক ধরনের উৎফুল্ল ভাব নিয়ে দিনের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে জেগে উঠল ও, কিন্তু তার পেছনে কোনও কারণ খুঁজে পেল না। নাক ডেকে ঘূমাচ্ছে মেরেন, ওকে ওভাবেই রেখে আঙিনায় বের হয়ে এলো ও। শিশিরের মুক্তোয় ভরে গেছে। সূর্যটা সবে ক্লিফ বেয়ে উঠতে শুরু করেছে। কোনও চিন্তাভাবনা ছাড়াই, স্রেফ গলায় ঝোলানো মাদুলিটা একবার পরখ করে আবারও উপরের বাগানের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল ও।

বাগানে ঢোকার পরপরই প্রবল হয়ে উঠল ওর ভালো থাকার অনুভূতি। ছড়িতে ভর দিয়ে নেই ও, ওটা কাঁধের উপর ফেলে রেখেছে, দীর্ঘ স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। শয়তানের গুহার দিকে চলে যাওয়া পথটা অস্পষ্ট নয়। ওখানে পৌঁছে দেখল জায়গাটা নির্জন। কেউ নেই, নিশ্চিত হয়ে জীবিত প্রাণীর খোঁজে দ্রুত গোটা এলাকাটা তল্লাশি করল। এখানে আর কেউই ছিল না। ওর অন্য সত্তার হেঁটে বেরাবার জায়গাটার জমিন স্যাঁতসেঁতে, নরম হলেও মানুষের পায়ের ছাপের আলামত চোখে পড়ল না। কোনও কিছুরই কোনও মানে হচ্ছে না। নিজের মানসিক সুস্থতার উপর বিশ্বাস রাখাই ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে ওর পক্ষে। আপন মন ও ইন্দ্রিয়ের সাক্ষী মানতে পারছে না। ওকে পাগলামীর প্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। ডাইনী।

ধীরে ধীরে বাজনার ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠল ওঃ সিস্ট্রামসের রূপালি সুর এবং ডুগডুগির টানা আওয়াজ। মাদুলিটা শক্ত করে ধরে রাখল ও, আস্তে আস্তে গুহার মুখোমুখি হলো। কী দেখতে হবে ভেবে কিছুটা ভীত আবার কিছুটা উদ্ধত।

গুহার মুখ থেকে একটা ভাবগম্ভীর আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা বের হয়ে শ্যাওলায় ঢাকা চাতালের উপর দিয়ে এগিয়ে গেল। চারটে অদ্ভুত চিড়িয়া কাঁধের উপর একটা সোনা ও আইভরির পালকি বইছে। প্রথম বাহক হচ্ছে বিদ্যার দেবতা ইবাইস-মাথা থথ। দ্বিতীয়জন চমৎকার সোনালি বর্ম ও তীর ধনুকে সজ্জিত যুদ্ধের দেবতা আনুকে, তৃতীয় জন অসীম ও দীর্ঘায়ুর দেবতা হেহ; তার পরনের পোশাক রুবি পাথরের মতো সবুজ, চোখজোড়া ঝলমলে হলুদ, লক্ষ বছরের তালের পাতা বহন করছে সে। শেষজন হচ্ছে পৌরুষ ও উর্বতরার দেবতা মিন, শকুনের চামড়ার মুকুট পরেছে সে, তার সম্পূর্ণ উথিত পুরুষাঙ্গ মাৰ্বল খুঁটির মতো কুঁচকি থেকে বের হয়ে আছে।

আর পালকিতে দাঁড়িয়ে অসাধারণ একটা অবয়ব, যেকোনও স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ। তার পরনের স্কার্ট সোনার কাপড়ের, ব্রেসলেট ও অ্যাংকলেট খাঁটি সোনার, সোনা দিয়ে তৈরি ব্রেসপ্লেটে নীলকান্তমণি, টারকোয়েজ আর কামেলিয়ান বাসানো; ওটার মাথার উপর রাজকীয় গোখরা আর ভুরুতে শকুনের মাথাসহ মিশরের দ্বৈত মুকুট শোভা পাচ্ছে। অলঙ্কার বসানো বর্মের উপর আড়াআড়িভাবে অবয়বটার উপর রয়েছে শক্তির প্রতীকী কস্তনি।

ফারাও তামোসের জয় হোক! তাকে স্বাগত জানাল তাইতা। আমি তাইতা, আপনার জাগতিক দেহ আমিই পরিষ্কার করেছি, নব্বই দিবসের শোক কালে আপনার সেবা করেছি। আপনার শবদেহের মামিকরণের ব্যান্ডেজ বেঁধেছি। সোনার শবাধারে আপনাকে স্থাপন করেছি।

তোমাকে দেখেছি, চিনতে পারছি, গালালার তাইতা, এককালে ফারাওর চেয়ে কম ছিলে না তুমি, কিন্তু জীবিত যেকোনও ফারাওর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

আপনি জগতের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য গোটা মিশরের ফারাও ছিলেন। আপনার চেয়ে শক্তিশালী কেউ কোনওদিন আসবে না।

পুকুরের কাছে এসো, তাইতা। ওদিকে দিকে তাকিয়ে দেখ তোমার জন্যে কী ভাগ্য অপেক্ষা করে আছে।

কিনারের দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, পানির দিকে তাকাল। মুহূর্তের জন্যে মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। মনে হলো যেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। মহাসাগর, মরুভূমি আর অন্যান্য ছোটখাট পাহাড়সারি ওর অনেক নিচে বিছিয়ে আছে।

পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য দেখে নাও, বলে উঠল ফারাওর প্রতিমূর্তি। সব শহর আর মন্দির, সবুজ জমিন, বন জঙ্গল আর চারণভূমি দেখ। দেখে নাও সমস্ত খনি আর গহ্বর যেখান থেকে দাসের দল মূল্যবান ও চকচকে পাথর তুলে আনছে। দেখে নাও রত্ন ও অস্ত্রভাণ্ডার যেখানে বহুযুগের সম্পদ জমা হয়ে আছে। এসবই তোমার অধিকার আর শাসনের অপেক্ষায়। সোনালি কস্তনি নাড়লেন ফারাও। তাইতার চেখের সামনে দৃশ্যপট বদলে গেল।

সমতলের উপর দিয়ে কুচকাওয়াজ করে চলেছে বিশাল শক্তিশালী সেনাদল। সাগরের ঢেউয়ের মতো স্রোত তুলে এগিয়ে চলা যোদ্ধাদের ব্রোঞ্জের হেলমেটকে ছাড়িয়ে গেছে ঘোড়ার লেজের গোছা। বৰ্ম, ফলা আর বর্শাগুলো স্বর্গের তারার মতো ঝিলিক দিচ্ছে। যোদ্ধারা রথের পথে একবার হামলে পড়ছে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। কুচকাওয়াজ করে চলা পা আর চাকার ঘড়ঘড়ানি কাঁপিয়ে দিচ্ছে গোটা দুনিয়া। এই বিশাল সেনাদলের পেছন সারি তাদের সামনের সারির তোলা ধুলোর মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন তাদের শেষ নেই।

এই সেনাবাহিনী তোমার অধীনে থাকবে, বলে উঠলেন ফারাও। আবার অলঙ্কৃত কস্তনি নাড়লেন তিনি। ফের বদলে গেল দৃশ্য।

সকল সাগর-মহাসাগরের ছবি দেখতে পেল তাইতা। এই মহাপরাক্রমশালী বিস্তারের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে যুদ্ধজাহাজের বহর। গালি আর বৈঠার দ্বিগুন সারিঅলা বারমি রয়েছে, ওগুলোর পাল ড্রাগন আর শুয়োর, সিংহ, দৈত্যদানো এবং পৌরাণিক জীবজন্তুর ছবিতে ভরা। ঢাকের বাদ্য মাঝিদের ছন্দ বেঁধে দিচ্ছে, ওদের যুদ্ধ র‍্যামের দীর্ঘ ব্রোঞ্জের ডগার কাছে ফেনা তুলে পাক খাচ্ছে পানি। যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা এত বেশি যে মহাসাগরের দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত বিছিয়ে আছে।

দেখ, তাইতা! এই নৌবাহিনীর নেতৃত্বে থাকবে তুমি। কোনও মানুষ বা জাতি তোমার সাথে টিকতে পারবে না। সারা দুনিয়া আর এর সব মানুষের উপর কর্তৃত্ব। ফলাবে তুমি। কস্তনিটা সরাসরি ওর দিকে দোলালেন ফারাও। তাঁর কণ্ঠস্বর যেন গোটা পরিবেশ পরিপূর্ণ করে তুলল, সব ইন্দ্রিয় ভোঁতা করে দিল, আকাশের বজ্ৰধনির মতো।

এসব কিছুই তোমার হাতের মুঠোয়, গালালার তাইতা, সামনে ঝুঁকলেন ফারাও, তারপর কস্তনি দিয়ে মিনের কাঁধে স্পর্শ করলেন। দেবতার বিশাল দণ্ড বেঁকে উঠল। তোমার শক্তি আর বীর্জ হয়ে উঠবে অপরাজেয়।

এবার অনন্ত ও দীর্ঘ জীবনের দেবতা হেহর কাধ স্পর্শ করলেন তিনি, লক্ষ বছরের তালের পাতা নাড়লেন তিনি। তোমাকে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ দেহে চিরন্তন তারুণ্য দেওয়া হবে।

তারপর প্রজ্ঞা ও সকল জ্ঞানের দেবতা থথকে স্পর্শ করলেন তিনি। দীর্ঘ বাঁকানো ঠোঁট খুলল সে, কর্কশ গমগমে চিৎকার ছাড়ল। তোমাকে সকল প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর বিদ্যার অধিকার দেওয়া হবে।

ফারাও যখন শেষ স্বর্গীয় অবয়ব আনুকে-কে স্পর্শ করলেন, বর্মের উপর তলোয়ার দিয়ে আঘাত হানল সে। যুদ্ধে বিজয়ী হবে তুমি, সারা দুনিয়া, সাগর ও আকাশের উপর আধিপত্য করবে, সব মানুষ তোমাকে প্রণাম করবে। এসবই তোমাকে দেওয়া হচ্ছে, গালালার তাইতা। কেবল হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলেই। হলো।

ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো ফারাওর সোনালি প্রতিমূর্তি জ্বলন্ত চোখে সরাসরি তাইতার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভাবগম্ভীর জাঁকের সাথে বাহকরা গুহার অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে গেল পালকিটা। দৃশ্যটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে অবশেষে মিলিয়ে গেল।

ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ে ফিসফিস করে কথা বলে উঠল তাইতা, আর না। আমি আর প্রলোভন সহ্য করতে পারব না। এসব মহা মিথ্যার অংশ, কিন্তু কোনও মরণশীলের পক্ষেই তাকে রোখা সম্ভব নয়। সব রকম যুক্তিকে ছাপিয়ে আমার মন এসবকে সত্যি ভাবতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। আমার মাঝে ক্ষুধা ও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলছে, যা আমার বোধশক্তিকে ধ্বংস করে দেবে, আমাকে চিরন্তন জীবন থেকে বঞ্চিত করবে।

অবশেষে যখন গুহা ছেড়ে নেমে এলো, দেখল মেরেন ওর জন্যে বাগানের গেটে অপেক্ষা করছে। আপনাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি, ম্যাগাস। কেন যেন মনে হচ্ছিল আপনি বিপদে আছেন। আমার সাহায্য দরকার হতে পারে। কিন্তু বনের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলেছি।

সব ঠিক আছে, মেরেন। তোমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই, যদিও সব কিছুর উপর তোমার সাহায্যকে আমি মূল্য দিই।

মহিলা ডাক্তার আপনার খোঁজ করছিল। কেন আপনাকে চাইছে, জানি না, তবে আমার মন বলছে যে ওকে বেশি গভীরভাবে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।

তোমার পরামর্শ আমার মনে থাকবে। অবশ্য, সৎ মেরেন, এখন পর্যন্ত তো তোমার সাথে কোনও রকম খারাপ আচরণ করেনি সে, তাই না?

এমন হতে পারে তার ভালো আচরণের পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে আমরা যার খবর রাখি না।

*

ওরা শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ করার প্রায় সাথে সাথে কাজের কথা পাড়ল হান্নাহ। কর্নেল তিনাত আনকুত লর্ড আকেরের স্বাক্ষর করা সুপ্রিম কাউন্সিলের একটা ডিক্রি আমার হাতে দিয়ে গেছে। সেজন্যে আপনার দিক থেকে কোনও রকম অসুবিধা বা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আপনার উপর একটা পরীক্ষা চালিয়ে কাউন্সিলের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে। সেজন্যে কিছুটা সময় লাগতে পারে। সুতরাং আপনি আমার সাথে আমার কামরায় এলে কৃতজ্ঞ বোধ করব, যাতে এখুনি কাজ শুরু করতে পারি।

হান্নাহর কণ্ঠে হুকুমের সুর শুনে অবাক হলো তাইতা, যতক্ষণ না বুঝতে পারল যে সুপ্রিম কাউন্সিলের জারি করা যেকোনও ডিক্রিই জাররিতে কারনাকে বাজপাখির সীলমোহরঅলা ফারাওর নির্দেশের মতোই সমান গুরুত্ব বহন করে।

অবশ্যই, ডাক্তার। নির্দেশ পালন করতে পারলে খুশিই হবো।

স্যানেটোরিয়ামের অন্যতম দূরবর্তী ব্লকে ডাক্তার হান্নাহর কামরাগুলো চুনাপাথরের টালি দেওয়া। শদামাঠা, কোনওরকম ঠাসঠাসি নেই। দূরের দেয়াল বরাবর পাথরের তাকের সাথে দুই সারি কাঁচের পাত্র রাখা। প্রত্যেকটাতে পরিষ্কার তরলে মানুষের জ্বণ ভাসছে। স্পষ্টতই কোনও রকম সংরক্ষক দ্রব্য হবে। নিচের তাকে নয়টা জ্বণের নমুনা জরায়ু থেকে বের করে আনার সময় অনুযায়ী সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে ছোটটা ফিকে ব্যাঙাচির চেয়ে বড় হবে না, আর সবচেয়ে বড়টি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার ঠিক আগ মুহূর্তে বের করা।

একেবারের উপরের তাকের জ্বণগুলো মোটামুটি বিকৃত, কয়েকটার চোখ দুটোর বেশি, অন্যগুলোর বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নেই; একটার আবার ভয়ঙ্কর দর্শন দুটো মাথা রয়েছে। এমন সংগ্রহ কোনওদিন দেখেনি তাইতা। এমনকি সার্জন হিসাবে বিকৃত ও অপুর্ণাঙ্গ মানবদেহ দেখে অভ্যস্ত হলেও এমনি করুণ রেলিকসের

প্রদর্শনীতে রীতিমতো বিতৃষ্ণা জেগে উঠল ওর।

নিশ্চয়ই সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে ভিন্ন আগ্রহ রয়েছে তার, ভাবল ও, মেঘ বাগিচায় আসার পর থেকে এখানে অনেক বেশি অন্তসত্তা মেয়ে দেখার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কামরার বাকি অংশ একটা বিরাট পরীক্ষার টেবিল দখল করে রেখেছে, একটা মাত্র লাইম স্টোনের ব্লক থেকে কুঁদে বের করা হয়েছে ওটাকে। তাইতা বুঝতে পারল হান্নাহ সম্ভবত টেবিলটাকে অপারশেন ও সন্তান প্রসবের কাজে ব্যবহার করে থাকে। কারণ টেবিলের উপরে গর্ত করা রয়েছে, পায়ের কাছে একটা নালার ফুটো দিয়ে তরল বের হয়ে এসে নিচের মেঝেতে রাখা একটা গামলায় জমা হচ্ছে।

তাইতার কাছে ওর পেশাব-পায়খানার নমুনা চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা শুরু করল হান্নাহ। সামান্য থতমত খেয়ে গেল ও। একবাতানায় এক সার্জনের সাথে পরিচয় হয়েছিল ওর, বজ প্রক্রিয়া নিয়ে তার আবার বিকৃত দুর্বলতা ছিল। কিন্তু হান্নাহর পদমর্যাদার একজন একই রকম আগ্রহ দেখাবে বলে ভাবেনি। অবশ্য ওকে একটা কিউবিকলে নিয়ে যেতে দিল ও, এখানে তার একজন সহকারী একটা বড়সড় গামলা ও এক জগ পানি দিল ওকে যাতে তার অনুরোধ রক্ষার পর পরিষ্কার হয়ে নিতে পারে।

হান্নাহর কাছে ফিরে আসার পর ওর বর্জ্য পরখ করল সে, তারপর টেবিলের উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়তে বলল। তাইতা লম্বা হয়ে শোয়ার পর ওর বর্জ্য থেকে নাক, চোখ, আর মুখের দিকে মনোযাগ সরাল। একজন সহকারী তেলের কুপির আলো ওর চোখের দিকে পাঠাতে একটা রূপালি চাকতি ব্যবহার করল। এবার ওর বুকে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস আর হৃৎপিণ্ডর স্পন্দন শুনল সে।

আপনার হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুস ঠিক তরুণের মতো। আপনার দীর্ঘায়ু হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু নয়। ইশ, আমাদের সবাইকে যদি ফন্টের স্বাদ নিতে দেওয়া

হতো। তাইতার সাথে নয় বরং যেন আপনমনেই কথা বলছে সে।

ফন্ট? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

বাদ দিন, নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। এড়িয়ে গেল প্রসঙ্গটা। একজন বয়স্কা মহিলার অলস কথাবার্তাকে আমলে নেবেন না। চোখ তুলে না তাকিয়ে পরখ করে চলল সে।

অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। লক্ষ করল, মহিলার আভার কিনারাগুলো বিকৃত হয়ে আছে। ফন্টের কথা উল্লেখ করায় নিজের উপর বিরক্তির লক্ষণ। তারপরই বিকৃতিটা মিলিয়ে যেতে দেখল। আভা কঠিন হয়ে উঠল। ফন্ট সম্পর্কে ওর দিক থেকে আর কোনও প্রশ্ন আসার সম্ভাবনার প্রতি মনটাকে বন্দি করে ফেলল। নিশ্চয়ই গিল্ডের অন্যতম রহস্য হয়ে থাকবে এটা। সময় নেবে ও।

ওর বুক পরীক্ষা শেষ করল হান্নাহ, তারপর পিছিয়ে গেল; সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাল। এবার আপনার লিঙ্গের ক্ষত পরীক্ষা করতে হবে আমাকে, বলল সে।

নিজেকে বাঁচাতে সহজাত প্রবৃত্তির বশেই নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তাইতা।

ম্যাগাস, আপনি কায়মনোবাক্যে সম্পূর্ণ নিজের মাঝে মগ্ন একজন মানুষ। আপনার শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার বিশ্বাস আমি তা সারিয়ে তুলতে পারব। এমন কর্তৃপক্ষ আমাকে এই কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে আমার পক্ষে যা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। আপনি আমার বিরোধিতা করতে পারেন, সেক্ষেত্রে আমি সহকারীদের তলব করতে বাধ্য হবো, প্রয়োজনে আমাকে সাহায্য করার জন্যে কর্নেল তিনাত আনকুত ও তার লোকজনকেও ডাকব। কিংবা আমাদের দুজনের পক্ষেই ব্যাপারটা আপনি সহজ করে তুলতে পারেন। কিন্তু দ্বিধায় ভুগল তাই। আবার শান্ত কণ্ঠে কথা বলল হান্নাহ। আপনার প্রতি আমার কেবলই গভীর শ্রদ্ধা বোধ রয়েছে। আপনার অসম্মান করার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। বরং, আপনাকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে চাই। আপনার ক্ষত ঠিক করে দেওয়ার মতো আর কোনও কিছুই আমাকে অতটা সম্ভষ্টি যোগাতে পারবে না, যাতে আপনার মনের পূর্ণতার মতোই শারীরিক পূর্ণতার জন্যেও সারা জগতের শ্রদ্ধা লাভ করতে পারেন।

তাইতা বুঝতে পারছিল ওর সামনে আরেকটা প্রলোভনের বীজ তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু সেটাকে ঠেকানোর কোনও উপায় আছে বলে মনে হলো না। যেভাবেই হোক, সহযোগিতা করলে হয়তো ইয়োসের দিকে এক কদম এগিয়ে যেতে পারবে ও। চোখ বুজে কুঁচকির উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল ও। বুকের উপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখে শুয়ে রইল চুপচাপ। টিউনিক উঁচু করে আলতো করে পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করছে হান্নাহ, টের পেল। ওর মনে শয়তানের রোপন করা কামুক ছবিগুলো বিরামহীনভাবে উঠে আসতে লাগল। গুঙিয়ে ওঠা ঠেকাতে দাঁতে দাঁত চাপল ও।

আমার কাজ শেষ, বলল হান্নাহ। আপনার সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ। আগামীকাল আপনার বিদায় নেওয়ার সময় কর্নেল তিনাত আনকুরের হাতে কাউন্সিলের কাছে জবাব পাঠাব আমি।

আগামীকাল, ভাবল তাইতা। জানে এই স্বর্গরূপী নরক থেকে উদ্ধার পাওয়ার সংবাদে ওর খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু ঠিক উল্টো অনুভূতি হলো ওরা। চলে যেতে ইচ্ছা করছে না ওর, আবার ওকে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে অধীরভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। এখনও ওর মনে ছায়া খেলা খেলছে ইয়োস।

*

জ্বালামুখের দেয়ালের উপরে সূর্য উঠে আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। কিন্তু কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসার পর কর্নেল তিনাত ও তার দলবলকে অপেক্ষায় দেখল তাইতা ও মেরেন। ওদের মালপত্র বইছে মেরেন। নিজের ব্যাগ বে-র পিঠে তুলে দিয়ে উইন্ডস্মোকের কাছে চলে গেল ও, ওটার জিনের পেছনে বেঁধে দিল তাইতার মালপত্র। তাই কাছে যেতে হ্রেষারবে স্বাগত জানাল মেয়ারটা, প্রবলভাবে নাক দিয়ে ঠেলতে লাগল। ওর কাঁধে চাপড় দিল তাইতা। আমারও তোর কথা খুব মনে পড়েছে, কিন্তু ওরা বোধে হয় তোকে অনেক বেশি ধুরা খাইয়েছে, ওকে ভর্ৎসনা করল ও। হয় বেশি খেয়েছিস, নইলে তোর পেটে আবার বাচ্চা এসেছে।

স্যাডলে চেপে তিনাতের বাহিনীকে অনুসরণ করে খিলানের ভেতর দিয়ে প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে এগিয়ে হ্রদের চাতালের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। রাস্তাটা যেখানে বনের দিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছে স্যাডলে ঘুরে বসে পেছনে তাকাল তাইতা। স্যানেটোরিয়ামের দালানকোঠা জনশূন্য ঠেকল, যেন ওখানে কেউ নেই, কেবল ঝর্না থেকে মেঝের নিচে উষ্ণ পানি বয়ে নিয়ে যাওয়া ফুগুলোর ফোকর দিয়ে বাষ্প উঠে যাচ্ছে। ভেবেছিল হান্নাহ ওদের বিদায় জানাতে আসবে, না আসায় কিছুটা হতাশ হয়েছে ও। গত এক সপ্তাহে অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়েছে ওদের। নিজের পেশার প্রতি মহিলার অঙ্গীকার ও তার জ্ঞানের বহরের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠেছে ও। আবার সামনে চোখ ফেরাল ও, এসকর্টদের সাথে বনের ভেতরে ঢুকল।

ভ্যানগার্ডের সাথে সামনে রয়েছে তিনাত। ক্লিনিক ছেড়ে আসার পর মাত্র একবার ওদের সাথে কথা বলেছে সে-কেবল আনুষ্ঠানিক সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্যে।

ওরা বাইরের দুনিয়ার দিকে চলে যাওয়া জ্বলামুখের ভেতরের সুড়ঙের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে মেঘ-বাগিচায় থেকে যাবার ইচ্ছাটুকু ক্রমে মিলিয়ে যাওয়া টের পেলো তাইতা। আবার ফেনের সাথে দেখা হওয়ার কথা ভাবতে শুরু করল ও, মন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। প্রিয় কুচকাওয়াজের সুর ভাজছিল মেরেন, এক ঘেয়ে বেসুরো। তবে এটা তার খোশ মেজাজের নিশ্চিত লক্ষণ। হাজার হাজার লীগ একসাথে চলতে গিয়ে এই সুর শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাই এখন আর বিরক্ত বোধ করে না।

সুড়ঙের গেট দৃষ্টিসীমার এলে গতি কামিয়ে ওর পাশে চলে এলো তিনাত। এবার আপনার জোব্বা গায়ে চাপানো উচিত। টানেলে বেশ ঠাণ্ডা, বাইরে একেবারে বরফ হয়ে যাবার যোগাড় হবে। প্রবেশ পথে পৌঁছানোর সময় আমাদের অবশ্যই একসাথে থাকতে হবে। দূরে সরে যাবেন না। শিম্পাঞ্জিগুলোর মেজাজ মর্জি বোঝা ভার, বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওদের নিয়ন্ত্রণ করে কে? জানতে চাইল তাইতা।

জানি না। আগেও যখন এদিকে এসেছি কোনও দিন কোনও মানুষের ছায়াও দেখিনি। ওর আভা পরখ করে তাইতা বুঝতে পারল লোকটা সত্যি কথা বলছে।

সমতলে আসার পর শিম্পাঞ্জিদের বুনো দৃষ্টি এড়িয়ে গেল ও। লাফ দিয়ে সামনে এসে ওর পায়ের গন্ধ শুকল একটা। ভয়ে পিছু হটল উইন্ডস্মোক। আক্রমণাত্মক ঢঙে মাথা দোলাতে লাগল বাকি দুটো। তবে ওদের বের হতে দিল। তাসত্ত্বেও তাইতা বুঝতে পারল ওরা হিংস্রতার কত কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, কত সহজেই ওরা আক্রমণের উস্কানি পেতে পারে। আক্রমণ করে বসলে ওদের ঠেকানোর মতো কিছুই করার ছিল না ওর।

ওরা সুড়ঙের মুখে পৌঁছানার পর স্যাডলের উপর সামনে ঝুঁকল তাইতা, পাথরের গায়ে ঘষা খেল ওর জোব্বার টুপি। আগের মতোই সুড়ঙটাকে অন্তহীন ঠেকল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাতাসের ভীতিকর গর্জন কানে এলো ওদের, সামনে ধূসর মিটিমিটি আলো দেখতে পেল।

পাহাড়ের কঠিন, অসাধারণ আঁকে বের হয়ে এলো ওরা। মেঘ-বাগিচার প্রশান্ত সৌন্দর্য থেকে একেবারেই ভিন্ন। শিম্পাঞ্জির দল ওদের চারপাশে ভীড় করল, কিন্তু অনীহার সাথে ওদের পথ করে দিতে লাফিয়ে হেলেদুলে সরে গেল। পথে বের হয়ে এসে বাতাসের অত্যাচারের মুখে পড়ল ওরা। চামড়ার জোব্বায় নিজেদের জড়িয়ে নিয়ে বাতাসের ঝাপ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করে আগে বাড়তে মাথা নামাল ঘোড়াগুলো। পেছনে খাড়া হয়ে গেল লেজগুলো। বরফ শীতল বাতাসে ওদের নিঃশ্বাসে যেন বাষ্প বের হচ্ছে, বরফে পিছলে যাচ্ছে ওদের খুর।

তিনাত এখনও তাইতার পাশেই রয়েছে। এবার সামনে ঝুঁকে তাইতার কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো ও। এর আগে আপনার সাথে কথা বলতে পারিনি আমি, কিন্তু এখন বাতাসের ঝাপ্টা আমাদের কণ্ঠস্বর চাপা দেবে, বলল সে। আমার দলের কাকে আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জানি না। তবে এটা স্পষ্ট করেই বলা চলে যে স্যানেটোরিয়ামের কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না, হান্নাহ থেকে শুরু করে একেবারে সবেচেয়ে নিচের জনটি পর্যন্ত সবাইই অলিগার্কদের গুপ্তচর।

চামড়ার হুডের আড়াল থেকে ওকে নিবিড়ভাবে পরখ করল তাইতা। বুঝতে পারছি, তোমাকে একটা কিছু অস্থির করে রেখেছে, কর্নেল, এতদিনে আমার উপর তোমার আস্থা জন্মেছে।

আপনি আমাকে ফারাও আর দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বিদ্রোহী মিশরিয় হিসাবে দেখছেন ভেবে অস্থির হয়ে আছি আমি।

এটা তবে তোমার আসল পরিচয় নয়?

না। আমি আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এই ভুতুড়ে জায়গা থেকে পালাতে চাই, এই দেশের মানুষের মনের ভেতর শেকড় গেড়ে বসা মহা অশুভের কাবল থেকেও পালাতে চাই আমি।

আমাকে কিন্তু আগে একথা বলেনি।

না। তখন ওনকা ছিল খুব কাছে। তখন আমার পক্ষে সব কথা বলা সম্ভব ছিল না। এইবার তার চোখের আড়ালে আসতে পেরেছি। ওর একজন মেয়েমানুষ আছে, আমাদের পক্ষে সে। মুতাঙ্গিতে যাতে সে আপনার গাইড হতে না পারে সেজন্যে তার মদে একটা কিছু মিশিয়ে দিয়েছে সে। আমি স্বেচ্ছায় তার জায়গায় দায়িত্ব নিয়েছি।

ওনকার ভুমিকাটা কী?

সুপ্রিম কাউন্সিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সে। আমাদের সবার উপর নজর রাখতে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে, বিশেষ করে আপনার উপর। আপনার গুরুত্ব সম্পর্কে ওরা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। হয়তো আপনার জানা নাও থাকতে পারে, তবে পরিকল্পিতভাবেই আপনাকে জাররিতে নিয়ে আসা হয়েছে।

কী কারণে?

সেটা বলতে পারব না, আমার তা জানা নেই। দশ বছরেরও কম সময় আগে এখানে এসেছি, তবে অনেক জ্ঞানী-গুণীলোককে আসতে দেখেছি এখানে, যেন কাকতালীয়ভাবে উপস্থিত হয়েছে তারা। কিন্তু ওদের আসার কথা অলিগার্কদের জানা ছিল, যেমন আপনার আসার কথা জানত তারা। কেবল আপনার সাথে দেখা করতেই পাঠানো হয়নি আমাকে। শত শত বছর ধরে এভাবে কত জ্ঞানী লোককে জাররিতে নিয়ে আসা হয়েছে কল্পনা করতে পারবেন?

এখানকার সমাজে অনেকগুলো স্তর আছে বলে মনে হয়েছে, বলল তাইতা। তুমি ওদের আর আমাদের কথা বলছ, যেন আমরা ভিন্ন গোত্রের। ওরা কারা, আর আমরাই বা কারা? আমরা সবাই কি মিশরিয় নই? আমাকে তোমার দলের মনে করছ, নাকি আমি ওদের একজন?

সহজ কণ্ঠে জবাব দিল তিনাত। আপনাকে আমাদেরই একজন মনে করি এই কারণে যে এখন আমি জানি আপনি একজন ভালো ও সৎ মানুষ। আমার ধারণা আপনি বিশেষ গুণের অধিকারী। আপনি ক্ষমতাধর মানুষ। আমি বিশ্বাস করি আপনিই আমাদের উদ্ধারকর্তা যাকে অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী অশুভের হাত থেকে জাররিকে উদ্ধার করতে এখানে পাঠানো হয়েছে। আমি আশা করি, কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব হলে একমাত্র আপনিই সর্বকালের সেরা অশুভকে পরাস্ত ও ধ্বংস করতে পারবেন।

কী সেটা? জানতে চাইল তাইতা।

মূলত এই কারণেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল। আমার পরে আপনাকে পাঠানো হয়েছে, জবাব দিল তিনাত। আমার ধারণা কিসের কথা বলছি, আপনি সেটা বুঝতে পারছেন।

বলো আমাকে, জোর করল তাইতা।

মাথা দোলাল তিনাত। আমাকে এখনও বিশ্বাস না করে ভালোই করেছেন। নীল মাতার বুকে জল পাঠানো নদীগুলোর উপর বসানো বাঁধ খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে আপনাকে দক্ষিণে পাঠিয়েছেন ফারাও নেফার সেতি, যাতে আবার নদী মিশরের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়, আমাদের জাতিকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলে। এবং এই বাঁধ যে সৃষ্টি করেছে তাকেও ধ্বংস করাও আপনার দায়িত্ব।

তোমার সম্পর্কে আমার আগের কথাগুলোর দুঃখ প্রকাশ করছি। তুমি একজন বিশ্বস্ত সৈনিক, দেশপ্রেমিক। আমাদের দুজনের লক্ষ্যই এক এবং সেটা ন্যায়সঙ্গত। আমরা কীভাবে অগ্রসর হবো? তোমার প্রস্তাবটা কী?

আমাদের প্রথম চিন্তা হবে শত্রুকে শনাক্ত করা।

অলিগার্করা? জানতে চাইল তাইতা। অনুসন্ধানের অর্থ তিনাত কতটা বুঝতে পেরেছে জানতে চায়।

অলিগার্করা একা নয়। ওরা খুচরো লোক, পুতুল, সুপ্রিম কাউন্সিলের মঞ্চে নড়াচড়া করে ওরা। ওদের পেছনে নাটের গুরু আছে। অদৃশ্য জিনিস বা ব্যক্তি। ওরা তারই হুকুম পালন করে, এই নামহীন শক্তির পূজাই জাররি ধর্ম।

জিনিসটা কী হতে পারে তোমার কোনও ধারণা আছে? কোনও দেবতা, নাকি তোমার বিশ্বাস এটা মরণশীল কেউ?

আমি সৈনিক। মানুষ আর সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জানি। এই অশুভ সত্তার ব্যাপারটা বুঝি না। আপনি ম্যাগাস। অন্য জগৎ বুঝতে পারেন। আমার একান্ত আশা, আপনি আমাদের পথ দেখাবেন, পরামর্শ দেবেন। আপনার মতো একজন না থাকলে আমরা আর যোদ্ধা থাকব না, স্রেফ হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলে হয়ে যাব।

অলিগার্কদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নাওনি কেন?

কারণ আগেও তা করা হয়েছিল, দুই শো বার বছর আগে। জাররিতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম দিন সেটা সফল হয়েছিল। অলিগার্কদের আটক করে মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপরই ভয়ঙ্কর এক প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আক্রান্তরা মুখ, কান, নাক আর গোপন অঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়ে প্রবল যন্ত্রণায় মারা যায়। কেবল উদ্ধারকারীদেরই আক্রমণ করেছিল অসুখটা, যারা সুপ্রিম কাউন্সিলের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল, গোপন দেবতার উপাসনা করেছে, তাদের কিছুই হয়নি।

এই ঘটনার কথা তুমি জানো কী করে?

জাররির সব নাগরিকের জন্যে সতর্কবাণী হিসাবে সেই বিদ্রোহের ইতিহাস কাউন্সিলের দেয়ালে খোদাই করা আছে। জবাব দিল তিনাত। না, ম্যাগাস। আমরা যাকে উৎখাত করতে চাইছি তার ক্ষমতা ও তার সাথে সম্পর্কিত ঝুঁকি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল আমি। আপনাকে মাফুপায় দেখার পর থেকেই ক্রমাগত ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি। আমাদের সফল হওয়ার একমাত্র আশা হচ্ছে আমরা অলিগার্ক ও তাদের মানুষ সমর্থকদের ধ্বংস করার সময় আপনি যদি অশুভ শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন। জানি না আপনি খোদ অশুভ জিনিসটাকে ধ্বংস করতে পারবেন কিনা, তবে মিশরের সকল দেবতার কাছে প্রার্থনা করি যাতে আপনার প্রজ্ঞা ও জাদুকরী শক্তি দিয়ে আপনি যথেষ্টভাবে আমাদের জাররি থেকে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেন। আমি এও প্রার্থনা করি, যেন আপনি সেই ক্ষমতা ওই শক্তির নীলের বিভিন্ন শাখার উপর বসানো বাধটাকে ধ্বংস করার কাজেও লাগাতে পারেন।

লাল জোড়া-পাথরের দেয়ালটা একবার ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, মেরেন ও আমি। চেষ্টা করতে গিয়ে মেরেন চোখ খুইয়েছে।

তার কারণ আপনারা ধ্বংস করার কাজটাকে একটা জাগতিক সমস্যা মনে করেছিলেন। ওই পর্যায়ে আপনারা এর গভীরতর ভয়ঙ্কর তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। আমরা জানি আমাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু আমি ও আমার অনুসারীরা সেজন্যে জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি কি চেষ্টা করে দেখবেন? আমাদের নেতৃত্ব দেবেন?

সেজন্যেই জাররিতে এসেছি আমি, বলল তাইতা। তোমাদের সম্ভাবনা সত্যিই এত ক্ষীণ হয়ে থাকলে আমাদের সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। তুমি যেমন উল্লেখ করেছ, বন্দিত্ব এড়ানো সহজ হবে না। একা ও অলক্ষ্যে থাকার সম্পূর্ণ সুবিধা আদায় করতে হবে আমাদের। প্রথমত, এখন পর্যন্ত তোমরা যেমন প্রস্তুতি নিয়েছ, তার বিস্তারিত বলতে হবে আমাকে। তোমার সাথে কতজন নারী পুরুষ রয়েছে? কীভাবে তাদের মোতায়েন করেছ? তারপর তোমাকে বলতে পারব আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্ত কী।

এটা যুক্তিসঙ্গত কাজের ধারা।

যাত্রাটাকে সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে নিজেদের একা থাকার সমস্ত সুযোগ তৈরি করে দিতে দুর্বলতা ও ক্লান্তির ভান করতে লাগল তাইতা। বারবার বিশ্রামের দাবি করে চলল ও, এমনকি উইন্ডস্মোকের পিঠে চাপার পরেও ওটাকে ধীর গতিতে আগে বাড়াতে লাগল। স্পষ্টতই এই আলোচনার জন্যে প্রস্তুত থাকায় তিনাতও ওদের পরিকল্পনা ও বাহিনীর যুদ্ধ নির্দেশনা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিল ওকে।

সে শেষ করলে তাই বলল, আমার মনে হচ্ছে অলিগার্কদের উৎখাত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নও তোমরা, ওদের পেছনের শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তো আরও পরের কথা। তোমার কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তোমাদের সমর্থকদের বেশিরভাগই বিভিন্ন খনি ও কুয়ারিতে হয় বন্দি বা দাসত্ব করছে। যুদ্ধ করা পরের কথা, ওদের আমরা মুক্ত করার পর পথ চলতে পারবে কতজন?

এটা ঠিক, অলিগার্কদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াই করে পুরো দেশ দখলে রাখতে পুরো শক্তি জমায়েত করতে পারব না। এমনটা কখনওই আমার পরিকল্পনা ছিল না। আমার ইচ্ছা ছিল কোনও রকম নাশকতা বা বিপ্লবের ভেতর দিয়ে অলিগার্কদের বন্দি করা। তারপর ওদের জিম্মি করে বন্দিত্ব থেকে আমাদের সতীর্থদের মুক্ত করে জাররি থেকে নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। আমি জানি এটা একটা পরিকল্পনার একেবারেই সাধারণ একটা রূপরেখা। আপনার সাহায্য ছাড়া এই পরিকল্পনা ব্যর্থ ও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

মেরেনকে ওদের সাথে যোগ দিতে ডেকে পাঠাল তাইতা। মেরেন, তুমি জানো, আমার বিশ্বস্ত সাথী, সাহসী ও চতুর যোদ্ধা। ওকে তোমার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে গ্রহণ করার অনুরোধ জানাব তোমাকে।

দ্বিধা করল না তিনাত। আপনার সুপারিশ মেনে নিচ্ছি।

খাড়া পথ ধরে নেমে যাওয়ার সময় তিনজনে মিলে মৌলিক যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করল, সেটাকে বিস্তৃত করল, আরও শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করল। দ্রত কেটে গেল সময়, অচিরেই অনেক নিচে দুর্গের দালানকোঠা আর ছাদের দৃশ্য ফুটে উঠল চোখের সামনে। ঘোড়া থামিয়ে ভারি চামড়ার জোব্বা আর অন্যান্য পাহাড়ী পোশাক থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিতে নেমে পড়ল ওরা।

কথা বলার মতো আর অল্প সময় আছে আমাদের হাতে, তিনাতকে বলল তাইতা। কী করতে হবে তুমি আর মেরেন জানো। এখন আমার পরিকল্পনা খুলে বলছি। কর্নেল তিনাত, তুমি এতক্ষণ আমাকে যা বলেছ তার ভেতর সত্যির অংশ রয়েছে, আমি যা যা দেখেছি, জানতে পেরেছি তার সাথে মিলে যাচ্ছে। আমার চেয়ে আরও অনেক শক্তিশালী ভবিষ্যদ্বক্তা ও ম্যাগাস আমাকে যে অশুভ সত্তার কথা বলেছিল তুমি তার সম্পর্কে জানিয়েছ আমাকে। এই দেবী আদতে স্বর্গীয় বা অমর নয়। তবে এত বেশি প্রাচীন যে এর আগে কোনও মরণশীলের পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব জ্ঞানের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞান আয়ত্ত করতে পেরেছে। ভোরের মেয়ে ইয়োসের নাম ধরেছে সে। ক্ষমতার প্রতি তার রয়েছে দানবীয়, অনুতাপহীন ক্ষুধা। এসবই আমার ও মেরেনের খুব ভালো করে চেনা ম্যাগাস দিমিতারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। নিশ্চয়তার জন্যে সঙ্গীর দিকে তাকাল তাইতা।

মাথা দোলাল মেরেন। আসলেই মহান মানুষ ছিলেন তিনি, তবে আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ না করে পারছি না, ম্যাগাস। আপনার চেয়ে কোনওভাবেই বড় ছিলেন না।

প্রশংসায় আমোদিত হাসি দিল তাইতা। অনুগত মেরেন, আশা করি আমার সত্যিকারের দোষ কখনওই যেন ধরতে না পারো। অবশ্য, বলতে গেলে, দিমিতার সামনাসামনি ইয়াসের মোকাবিলা করেছেন। শক্তি ও প্রজ্ঞা সত্ত্বেও প্রথম মোকাবিলাতেই ওকে প্রায় শেষ করে দিয়েছিল ইয়োস, পরের হামলায় সফল হয়েছে। তার মৃত্যুর ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তবে ইয়োস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানোর মতো যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছেন, নীলে বাঁধ দেওয়ার পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মিশরকে এমন অবস্থায় নামিয়ে আনা যাতে জনগণ তাকেই একমাত্র ত্রাণকর্তা হিসাবে স্বাগত জানায়। তাহলে তার পক্ষে মিশরের দুই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নেওয়া সহজ হবে। মিশরের সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা হাতে পেলে চড়ুই পাখির ঝাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া বাজপাখির মতো পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উপর হামলে পড়বে সে। সবাইকে তার ইচ্ছার অধীনে নিয়ে আসা তার একমাত্র খায়েশ।

এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল তিনাত তবে এখন আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। ইয়োন্স নামের এই প্রাণীর সাথে কোথায় মোকবিলা করেছেন দিমিতার? সেটা কি জাররির ঘটনা?

না। অনেক দূরের এক দেশ, একসময় সেখানে থাকত সে। মনে হচ্ছে সেখান থেকেই পালিয়ে এখানে চলে এসেছিল সে। মাটির নিচের আগুন ও উত্তপ্ত নদী থেকে প্রাণশক্তি সঞ্চয় করতে হয় তাকে। দিমিতারের দেওয়া সূত্র জাররিতে নিয়ে এসেছে আমাকে। একসাথে স্যাডলের উপর ঘুরে লম্বা মুকুটঅলা পাহাড়ের দিকে তাকাল তিনজন।

অবশেষে কথা বলল তিনাত। এখানে তিনটা বিরাট আগ্নেয়গিরি আছে। কোনটা তার ঠিকানা?

মেঘ-বাগিচাই তার শক্তঘাঁটি, জবাব দিল তাইতা।

নিশ্চিত হচ্ছেন কীকরে?

আমি ওখানে থাকতে দেখা দিয়েছিল সে।

তাকে দেখেছেন? চিৎকার করে উঠল মেরেন।

ঠিক তাকে না, তবে তার নানা রূপের কয়েকটা নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল।

দিমিতারের মতো আপনাকে আক্রমণ করেনি, যে ম্যাগাসের কথা আপনি বলেছেন? জানতে চাইল তিনাত

না, কারণ আমার কাছে একটা কিছু চায় সে। সেটা আয়ত্তে এসে গেলেই কোনও রকম দ্বিধা ছাড়াই আমাকে ধ্বংস করে দেবে সে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমি নিরাপদ-কিংবা তার কাছে থাকা অবস্থায় যতখানি নিরাপদ থাকা সম্ভব।

আপনার কাছে সে কী চায়? জানতে চাইল তিনাত। মনে হচ্ছে সবই তো আয়ত্তে আছে।

আমার জ্ঞান আর বিদ্যা নিতে চায় সে, যা তার নেই।

বুঝলাম না। আপনি বলতে চাইছেন সে চায় আপনি তাকে শিক্ষা দেন?

আসলে সে ভ্যাম্পায়ার বাদুরের মতো, তবে রক্তের বদলে শিকারের সত্তা আর আত্মা শুষে নেয়। শত শত বছর ধরে হাজার হাজার ম্যাগাস ও ভবিষ্যদ্বক্তার বেলায় এমন করেছে সে। কর্নেল তিনাত, তুমি যাদের জাররিতে নিয়ে আসার কথা বলেছ ওদের পৌঁছে দেওয়ার পর কী ঘটেছে তাদের ভাগ্যে?

ক্যাপ্টেন ওনকা এই পথেই ওদের পাহাড়ে নিয়ে গেছে। তারপর ওদের কী হয়েছে জানি না। সম্ভবত মেঘ-বাগিচার কোথাও আছে তারা, স্যানেটোরিয়ামে থাকছে। হয়তো ডাক্তার হান্নাহর সাথে কাজ করছে।

তোমার কথা ঠিক হতেও পারে, তবে আমার মনে হয় না। আমার বিশ্বাস তাদের কাছ থেকে ডাইনী সমস্ত জ্ঞান আর প্রজ্ঞা কেড়ে নিয়েছে।

সত্রাসে ওর দিকে চেয়ে রইল তিনাত। পরের প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার সময় কণ্ঠের সুর পাল্টে গেল ওর-ভয়ের ছাপ সেখানে। তাহলে তাদের কী হয়েছে বলে মনে করেন, ম্যাগাস?

হ্রদের কুমীরগুলো দেখেছ না? ওদের বিরাট আকার লক্ষ করেছ?

হ্যাঁ, সেই একই ভীত কণ্ঠে বলল তিনাত।

আমার বিশ্বাস এটাই তোমার প্রশ্নের উত্তর।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তিনাত। তারপর জানতে চাইল, আপনি সেই ঝুঁকি নেবেন, ম্যাগাস?

একমাত্র এভাবেই আমার পক্ষে তার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। তাকে অবশ্যই সামনাসামনি দেখতে হবে, কেবল তার প্রকাশ নয়। তারপর হয়তো নিজের অজান্তেই আমাকে একটা সুযোগ করে দেবে সে। হয়তো আমাকে খাট করে দেখে সতর্কতায় ঢিল দেবে।

আপনি ব্যর্থ হলে আমার লোকজনের কী হবে?

তোমাদের সবাইকেই জাররি থেকে পালাতে হবে, নইলে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে।

আজীবন দাসত্বের চেয়ে মরণ অনেক ভালো, স্বভাবজাত গাম্ভীর্যের সাথে বলল তিনাত। তাহলে আপনি আবার মেঘ-বাগিচায় ফিরে যাবেনই?

হ্যাঁ। আমাকে ফের ডাইনীর আস্তানায় ফিরতে হবে।

কীকরে সেটা করবেন?

সুপ্রিম কাউন্সিলের হুকুমে। আমার বিশ্বাস ইয়োস আমাকে তার কাছে। পাঠানোর নির্দেশ দেবে। আমার আত্মার জন্যে মুখিয়ে আছে সে।

*

পাহাড়ের শেষ ঢাল বেয়ে নামার সময় আরেক দল ঘোড়সওয়ারকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখল ওরা। দল দুটো যখন কেবল কয়েক শো কদম দূরে, অচেনা ঘোড়সওয়ারদের একজন স্পার দাবিয়ে সামনে ছুটে এলো। সে কাছাকাছি আসতেই মেরেন বলে উঠল, এ যে দেখছি ওনকা।

 তোমার নতুন চোখটা পুরোনোটার মতোই ভালো কাজ দিচ্ছে, মন্তব্য করল তাইতা। তারপর অন্তর্চক্ষু দিয়ে আগুয়ান অশ্বারোহীর আভা পরখ করল। ওনকার আভা জ্বলজ্বল করছে, জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো টগবগ করছে।

ক্যাপ্টেন ক্ষেপে আছে, বলল তাইতা।

ভালো একটা কারণ দিয়েছি আমি তাকে, স্বীকার গেল তিনাত। আবার আলাদা হতে না পারলে আমাদের দুজনের পক্ষে আর কথা বলা সম্ভব হবে না। অবশ্য, আপনি আমাকে কোনও খবর পাঠাতে চাইলে মুতাঙ্গির ম্যাজিস্ট্রাট বিলতোর মারফত পাঠাতে পারবেন। আমাদের লোক সে। কিন্তু এখন ক্যাপ্টেন ওনকা রয়েছে আমাদের সাথে।

ওদের ঠিক সামনে এসে লাগাম টানল ওনকা। থামতে বাধ্য করল ওদের। কর্নেল তিনাত, আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছ বলে তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। উধ্বর্তনকে অভিবাদন জানাল না সে। কণ্ঠের পরিহাস প্রায় উপেক্ষা করার পর্যায়ে এসে ঠেকল।

দেখা যাচ্ছে অসুস্থতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছ তুমি, জবাব দিল তিনাত।

সুপ্রিম কাউন্সিল তোমার প্রতি আমার চেয়ে কম কৃতজ্ঞ। ম্যাগাসের এসকর্টের দায়িত্ব নিয়ে হুকুম অমান্য করেছ তুমি।

লর্ড আকেরের কাছে জবাবদিহি করতে পারলে খুশি হবো আমি।

তার দরকার হতে পারে তোমার। তার আগে ম্যাগাস গালালার তাইতাকে আমার হাতে তুলে দিতে বলেছেন তিনি। ডাক্তার হান্নাহর রিপোর্টও আমার হাতে তুলে দিতে হবে। আমি ওটা ওর কাছে নিয়ে যাব। দেরি না করে বাকি পর্যটকদের মেঘ-বাগিচায় নিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তোমাকে। ওকে অনুসরণ করে আসা দলটার দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওদের ডাক্তার হান্নাহর হাতে তুলে দিয়েই ফিরে আসবে। পাউচ থেকে ডাক্তার হান্নাহর প্যাপিরাস রোল বের করে ওনাকে দিল তিনাত। আড়ষ্টভাবে পরস্পরকে অভিবাদন জানাল ওরা। তাইতা ও মেরেনকে শীতল বিদায় সম্ভাষণ জানাল তিনাত, তারপর দ্বিতীয় কলামের সামনে অবস্থান নিতে পথ বেয়ে নেমে গেল, আবার পাহাড়ের পথে ফিরে যাবে।

অবশেষে তাইতার দিকে ফিরল ওনকা। শুভেচ্ছা, সম্মানিত ম্যাগাস। কর্নেল ক্যাম্বিসেস, শুভেচ্ছা। দেখতে পাচ্ছি তোমার চোখের অপারেশন সফল হয়েছে। আমার অভিনন্দন। তোমাদের মুতাঙ্গির কোয়ার্টারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে আমার প্রতি। সুপ্রিম কাউন্সিল তলব না করা পর্যন্ত ওখানেই থাকতে হবে তোমাদের। তলব আসতে কয়েক দিনের বেশি লাগবে না।

ওনকার আভা এখনও রাগে দপদপ করছে। ঘোড়ার পেটে লাথি দিয়ে ওটার গতি দুলকি চালের চেয়ে একটু বেশি বাড়িয়ে তুলল সে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ওরা।

দুটো দল পাশ কাটানোর সময় তিনাত বা ওনকা পরস্পরকে পাত্তা দিল না, এক দল উপরে উঠছে, আরেক দল নিচে যাচ্ছে। তাইতাও কর্নেল তিনাতকে উপেক্ষা করে তার সাথে মেঘ-বাগিচার দিকে আগুয়ান দলটার দিকে তাকাল। পূর্ণাঙ্গ পোশাক পরা ছয়জন সৈনিক, তিনজন সামনে, বাকি তিনজন পেছনে। ওদের মাঝখানে রয়েছে পাঁচজন অল্প বয়সী মেয়ে, সবাই কমনীয় চেহারার, প্রত্যেকের পেটেই বাচ্চা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেরেন ও তাইতার উদ্দেশে হাসল ওরা, কিন্তু কথা বলল না কেউ।

মুতাঙ্গি থেকে আধা লীগ দূরে থাকতে একটা বিশাল কোল্টের পিঠে চেপে ছোটখাট একটা অবয়ব বন থেকে সবেগে বের হয়ে এলো। সবুজ মাঠের উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে শুরু করল ওদের দিকে। তার দীর্ঘ সোনালি চুল বাতাসে পতাকার মতো উড়ছে।

এই যে ঝামেলার আগমন, যথারীতি ভালোই আছে, বলে হেসে উঠল মেরেন। এই দূরত্বেও উত্তেজনায় ফেনের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ওরা।

মনকে উষ্ণ করে তোলার মতো একটা দৃশ্য, বলল তাইতা। ওর দৃষ্টি কোমল, প্রেমময়।

ওর পাশে এসে লাগাম টেনে ধরল ফেন, মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা লাফ দিয়ে পার হলো। ধরো আমাকে! রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল।

বলতে গেলে প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায় এই আক্রমণের স্বীকার হয়েছে তাই। কিন্তু সামলে নিল ও, দুই হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরল ফেন, মুখ দাবাল গালে।

এইসব কায়দার পক্ষে এখন অনেক বড় হয়ে গেছ তুমি। আমরা দুজনই চোট পেতে পারতাম। প্রতিবাদ করল তাইতা। কিন্তু ফেনের মতো করেই জড়িয়ে ধরে রাখল ওকে।

আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম তুমি আর ফিরবে না। খুবই একঘেয়ে লাগছিল।

গ্রামের সব বাচ্চাকাচ্চা ছিল তোমার সাথে, মৃদু কণ্ঠে যুক্তি দেখাল তাই।

ওরা তো বাচ্চাই, তাইতার কণ্ঠলগ্ন থেকেই মেরেনের দিকে তাকাল ও।

তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল, সৎ মেরেন। হিলতো কীভাবে আমাকে তীর ছোঁড়া শিখিয়েছে দেখলে অবাক হয়ে যাবে। তোমার সাথে আমার তীর ছোঁড়ার একটা প্রতিযোগিতা হবে। বিরাট একটা পুরস্কার থাকবে তাতে- হঠাৎ থেমে গিয়ে যারপরনাই বিস্ময়ের সাথে মেরেনের দিকে তাকাল ও। তোমার চোখ! চিৎকার করে বলে উঠল। ওরা তোমার চোখ ঠিক করে দিয়েছে। তোমাকে আবার সুন্দর লাগছে।

শেষবার দেখার পর তুমি আরও বড় আর সুন্দর হয়ে উঠেছ, জবাব দিল মেরেন।

ওহ, দুষ্টু মেরেন! হেসে উঠল ফেন। আরও একবার ঈর্ষার একটা খোঁচা অনুভব করল তাইতা।

গ্রামে পৌঁছানোর পর হিলতো, নাকোন্তো ও ইম্বালি ওদের স্বাগত জানাতে পেরে দারুণ খুশি হয়ে উঠল। বাড়ি ফেরার উপহার হিসাবে হিলতো ও নাকোন্তো পাঁচটা বিরাট আকারের দারুণ মদের জগ আর একটা মোটাসোটা ভেড়া পাঠাল। ইম্বালি ও ফেন ধুরা আর সজি তৈরি করল। পরে অর্ধেক রাত জুড়ে আগুনের ধারে বসে ভোজ পর্ব সারল ওরা। পুনর্মিলন উদযাপন করল। মেঘ-বাগিচার একেবারেই ভিন্ন জগতের পর এখানকার পরিবেশ এতটাই ঘরোয়া ও পরিচিত লাগল যে এক মুহূর্তের জন্যে ইয়োসের ভীতি যেন দূরের ও ভিত্তিহীন মনে হলো।

অবশেষে আগুন ছেড়ে যার যার ঘরে চলে গেল ওরা। মেরেনকে নিয়ে ওকে ছেড়ে চলে যাবার পর প্রথমবারের মতো আবার এক হলো ফেন ও তাই।

ওহ, তাইতা, কী যে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম আমাকে আহ্বান জানাবে তুমি। সেকারণে তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারছিলাম না।

আমি দুঃখিত। ছোট্ট সোনা, তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। এক অদ্ভুত জায়গায় গিয়েছিলাম আমি, অদ্ভুত সব ব্যাপার স্যাপার ঘটছিল ওখানে। আমার নীরব থাকার কারণটা ভালো করেই জানা আছে তোমার।

ভালো কারণগুলোও খারাপ কারণের মতোই সহ্য করে যাওয়া কঠিন, মূল্যবান মেয়েলি যুক্তির সাথে বলল ফেন। হাসল তাইতা, ফেন টিউনিক খুলে গা ধোয়ার সময় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, তারপর একটা মাটির জগ থেকে পানি নিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে দেখল। মেয়েটা এত দ্রুত পরিপক্ক হয়ে উঠছে দেখে আবারও একটা খোঁচা বোধ করল ও।

উঠে টিউনিকে গা মুছল ফেন, তারপর শুকোনোর জন্যে লিন্টেলের উপর মেলে দিল। মাদুরের ওর পাশে এসে শুয়ে ওর বুকে একটা হাত তুলে দিয়ে নড়েচড়ে কাছে সরে এলো। তুমি যখন ছিলে না তখন খুব শীত আর একাকী লেগেছে, বিড়বিড় করে বলল।

এবার মনে হয় ওকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে না আমাকে, ভাবল ও। হান্নাহ হয়তো আমাকে পূর্ণাঙ্গ পুরুষে পরিণত করতে পারবে। হয়তো একদিন ফেন আর আমি স্বামী-স্ত্রী হতে পারব যারা একে কেবল মন নয়, বরং শরীর দিয়েও অন্যকে চেনে, ভালোবাসে। ফেনকে অসাধারণ নারী আর নিজেকে সুদর্শন, সক্ষম পুরুষ হিসাবে কল্পনা করল ও। পুকুরের জলে ইম্প ওর যেমন চেহারা ফুটিয়ে তুলেছিল। দেবতার দয়ায় আমরা সেই সুখের দেখা পেলে কি দারুণ একটা জুটিই না গড়ে তুলতে পারতাম। ফেনের চুলে হাত বোলাতে লাগল তাইতা, উঁচু গলায় বলল, তোমাকে এবার এতদিন যা যা জেনেছি সব বলছি। আমার কথা শুনছ তো, নাকি এখুনি ঘুমে ঢলে পড়ার অবস্থা হয়েছে?

উঠে কঠিন চোখে তাইতার দিকে তাকাল ফেন। অবশ্যই শুনছি। কী নিষ্ঠুর তুমি! তোমার কথা সব সময়ই মনোযোগ দিয়ে শুনি।

তাহলে আবার শোও, মন দিয়ে শুনে যাও। একটু বিরতি দিল তাইতা। তারপর আবার যখন কথা বলল, তখন আর হালকা থাকল না ওর কণ্ঠস্বর।

ডাইনীর আস্তানার খোঁজ পেয়েছি আমি।

আমাকে বলল ওটার কথা-সব-কিছুই লুকোবে না।

তো ওকে মেঘ-বাগিচার কথা বলল তাইতা, বলল জাদুময় গুহার কথা। স্যানেটোরিয়াম আর ওখানে হান্নাহ কী কাজ করে সে কথা বলল। মেরেনের চোখের অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল। তারপর একটু দ্বিধায় ভুগলেও শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে হান্নাহর পরিকল্পিত অপারেশনের কথাও বলল।

দীর্ঘসময় চুপ করে রইল ফেন, এক সময় তাই ভাবল মেয়েটা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরই আবার উঠে গম্ভীর চোখে তাকাল তাইতার দিকে। তার মানে তোমাকে ইম্বালির বলা সেই জিনিসটা দেবে?

হ্যাঁ। কথা শুনে না হেসে পারল না ও। মুহূর্তের জন্যে পুলকিত মনে হলো ফেনকে। তারপর দেবদূতের মতো হসে ফেলল। কিন্তু ওর সবুজ চোখের বাইরের কোণ বিব্রত ভঙ্গিতে উপরের দিকে বেঁকে গেল। তাকলে খুশিই হবো। শুনতে এত দারুণ মনে হয়।

ফেনের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল তাইতা। কিন্তু ওর অপরাধবোধটুকু ক্ষুরের ফলার মতোই তীক্ষ্ণ। গুহার ইম্প ওর মনে শয়তানকে গেঁথে দিয়েছে। কিন্তু এমন কিছু ভাবছে বলে আবিষ্কার করল যা দূরে ঠেলে রাখাই ভালো, কখনও মুখে আনতে হয় না। ওর সাথে থাকার সময় সাধারণ বাচ্চাদের তুলনায় ঢের দ্রুত বেড়ে উঠেছে ফেন। কিন্তু স্বাভাবিক শিশু নয় ও, এক মহান রানির অবতার; এই জগতের স্বাভাবিক রীতিনীতিতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না সে। ওর শরীর দ্রুত বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ওদের সম্পর্কও বদলে যাচ্ছে। দিনদিন ফেনের প্রতি ওর ভালোবাসা জোরাল হয়ে উঠছে, কিন্তু সেটা মেয়ের প্রতি পিতার ভালোবাসার মতো নেই আর। ওর দিকে ওই নতুন দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর সময় ওর পারস্যের বিড়ালের চোখের মতো বেঁকে যায় সবুজ চোখ। ছোট খুকিটি নেই ও, একটা মেয়ে; ওর নিষ্পাপ তলের ঠিক নিচেই রয়েছে একজন নারী, মুটকীটের ভেতর একটা প্রজাপতি। প্রথম খোলের গায়ে ফাটলগুলো দেখা দিচ্ছে, অচিরেই সেটা ফেটে প্রজাপতিটাকে ওড়ার সুযোগ করে দেবে। ওরা একসাথে হওয়ার পর প্রথমবারের মতো মেঘ-বাগিচার ডাইনীর কথা দুজনের মন থেকেই উধাও হয়ে গেল, সব কিছু বাদ দিয়ে পরস্পরের মাঝে মগ্ন হয়ে থাকল ওরা।

*

পরের দিনগুলোয় সুপ্রিম কাউন্সিলের তলবের অপেক্ষার অবসরে আবার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গেল ওরা। ভোর থেকে শুরু করে রাতের খাবারের অনেক পরেও গবেষণা করে চলে ফেন ও তাইতা। বিকেলে তীর ছোঁড়ার অনুশীলন করে বা আশপাশের বনে বাদারে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য বুনো শুয়োর শিকার করতে মেরেন ও অন্যদের সাথে বেড়িয়ে পড়ে। নাকোন্তো ও ইস্থালি হাউন্ডের মতো কাজ করে, পশুর দলকে ফাঁকায় বের করে আনতে পায়ে হেঁটে কেবল বর্শা ও কুড়োল নিয়ে গভীরতম ঝোপে ঢুকে পড়ে ওরা। বর্শা হাতে ওদের পথ দেখায় হিলতো। তীর চালিয়ে নতুন চোখো তীক্ষ্ণতা পরখ করে মেরেন, তারপর তলোয়ারের সাহায্যে মৃত পশুর ব্যবস্থা করে। সবচেয়ে বড় বয়স্ক শুয়োর খুঁজে বের করে ওরা, যেগুলো ভয়ঙ্কর, ভীতিহীন; গুঁড় দিয়েই মানুষকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। মাদী শুয়োরগুলো আকারে ছোট হলেও তীক্ষ্ণ ড় তাদের, মদ্দাগুলোর মতোই সমান আগ্রাসী হতে পারে-খেতেও ভালো। ফেনকে সাথে রাখে তাইতা, ওয়ার্লউইন্ডের পিঠে চেপে ছোট তীর-ধনুক নিয়ে কোনও বিরাট শুয়োরের পিছু ধাওয়া করতে ছুটে যেতে চাইলে সামলে রাখে ওকে। শুয়োরগুলো খাট গলার, পিপের মতো বুক। গায়ের পুরু চামড়া ভারি তীর ছাড়া বাকি সব অস্ত্র হয় ঠিকরে দেয় বা পিছলে পড়ে সেগুলো। কালো কেশরে চকচকে কুঁজো পিঠ ওয়ার্লইউভের রেকাবের কাছাকাছি উঠে আসে। মাথার ধাক্কায় যেকারও উরুর হাড় বের করে ফেলতে পারে ওরা, ছিঁড়ে ফেলতে পারে ফেমোরাল ধমনী।

তা সত্ত্বেও ঝোঁপ থেকে একটা মোটাসোটা মাদি শুয়োর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ হেঁড়ে বেরিয়ে আসতেই পিছিয়ে এসে চিৎকার ছাড়ল হিলতো ও মেরেন, ওটা তোমার জন্যে, ফেন!

শিকারটাকে চট করে একনজর দেখেই ওকে এগোতে দিল তাইতা। জানোয়ারের পেছন থেকে কোণাকুণিভাবে এগোেনোর সবক দিয়েছে ওকে, স্যাডল থেকে সামনে ঝুঁকে ছোট বাঁকানো ক্যাভালরি তীরের ছিলা টেনে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসাও শিখিয়েছে। প্রথম তীরটাই আসল, বলেছিল ও। সামনে বেড়ে সোজা হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দেবে।

মাদিটা আঘাত টেরে পেতেই নিমেষে ঘুরে দাঁড়াল ওটা, দৌড় শুরু করতে মাথা নোয়াল। চোয়ালের পাশ থেকে তীক্ষ্ণ শাদা দাঁত বেরিয়ে এসেছে। ওয়ার্লউইন্ডকে পরিষ্কার ঘুরিয়ে নিল ফেন, দৌড়াতে দিল মাদিটাকে। বাইরে নিয়ে আসছে ওটাকে যাতে তীরের ফলা বুকের আরও গভীরে বাসানো যায়। ধমনী, ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ড ভেদ করে যাবে ওটার ধারাল প্রান্তগুলো। সোৎসাহে চিৎকার করে ওকে উৎসাহ যোগাল তাইতা ও অন্যরা।

এবার পারস্য কায়দায় আঘাত! চিৎকার করে উঠল তাইতা। একবাতানার বিস্তৃর্ণ সমতলের ঘোড়সওয়ারদের কাছে কায়দাটা শিখেছিল ও, ওকে শিখিয়েছে। নিপূণভাবে তীরের দণ্ডের উপর মুঠি পাল্টে ফেলল ও, ডান হাতে ওটা ধরে বাম হাতে টেনে কাছে নিয়ে এলো যাতে কাঁধের উপর দিয়ে তীরটা তাক করা যায়। এবার হাঁটু দিয়ে ওয়ার্লউইন্ডকে সামলে রেখে মাদিটাকে নির্দিষ্ট দূরত্বে আসার সুযোগ করে দিতে গতি কমাল। স্যাডলের উপর না ঘুরেই মাদি শুয়োরের বুক ও গলা লক্ষ্য করে একের পর এক তীর পাঠাতে লাগল ও। হাল ছাড়ল না জানোয়ারটা। দৌড়ের উপর লুটিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত লড়াই করে গেল। পাঁই করে ওয়ার্লউইন্ড ঘুরিয়ে নিল ফেন, উত্তেজনায় চকচক করছে ওর চেহারা, হাসছে। শিকারের লেজ আর কান কেটে নিতে ফিরে এলো ও।

সূর্যটা তখনও দিগন্ত ছাড়িয়ে বেশি উপরে উঠে আসেনি, এমন সময় তাই ডাকল। আজকের মতো অনেক হয়েছে! কাহিল হয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলো, তোমাদেরও অবস্থাও একইরকম হওয়ার কথা। মুতাঙ্গিতে ফেরা যাক। গ্রাম থেকে দুই লীগেরও বেশি দূরে ছিল ওরা, নিবিড় বনের ভেতর দিয়ে গেছে রাস্তাটা। গাছের ছায়া পড়েছে রাস্তায় উপর, আলোছায়াময় পরিবেশ। একটা মাত্র সারিতে এগোচ্ছে ওরা। সবার সামনে তাইতা ও ফেন। নাকোন্তা ও ইম্বালি সবার পেছনে। ওদের হাতে নিহত পাঁচটা বুনো শুয়োরের মৃতদেহ পিঠে বেঁধে প্যাকহর্সগুলোকে টেনে আনছে।

আচমকা পথের ডান পাশে বনের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ টানা আর্তচিৎকারে চমকে উঠল ওরা। লাগাম টেনে যার যার অস্ত্র বাগিয়ে ধরল। ঠিক ওদের সামনে ছুটে বেরিয়ে এলো একটা মেয়ে। ওর পরনের টিউনিক কাদামাখা, শতচ্ছিন্ন। হাঁটুর চামড়া ছড়ে গেছে, পাজোড়া নগ্ন, কাটা গাছের আঘাতে আর পাথরে লেগে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মাথায় ঘন কালো চুল, পাতা আর সরু ডালপালা লেগে আছে। চোখজোড়া গভীর, বিরাট, আতঙ্কে বিস্ফারিত। কিন্তু এমনি আতঙ্কিত অবস্থায়ও সুন্দর লাগছে ওকে। গায়ের রঙ চাঁদের আলোর মতো ফিকে, ছিপছিপে, সুগঠিত শরীর। ঘোড়াগুলো দেখে ঘুরে দাঁড়াল সে। উড়ন্ত চড়ুই পাখির মতো দৌড়ে এলো ওদের দিকে। আমাকে বাঁচাও! আর্তচিৎকার করে উঠল.মেয়েটা। ওদের হাতে তুলে দিয়ো না! স্পর দাবিয়ে ওর দিকে ধেয়ে গেল মেরেন।

সাবধান! চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। একেবারে কাছে এসে পড়েছে ওরা! ঠিক সেই মুহূর্তে বন থেকে দুড়দাড় করে বেরিয়ে এলো দুটো বিশাল কুঁজো অবয়ব। চার হাত পায়ে দৌড়াচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে মেরেন ভাবল হয়তো বুনো শুয়োর হবে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল লম্বা হাতে ভর করে ধেয়ে আসছে ওগুলো, প্রতি পদক্ষেপে জমিনে মুঠি দিয়ে আঘাত হানছে।

শিম্পাঞ্জি! চিৎকার করে উঠল মেরেন, তুনে তীর জুততে জুততে বে-টাকে গতি বাড়ানোর তাগিদ দিল। মেয়েটার নাগাল পাওয়ার আগেই ওদের সর্দারটাকে বাধা দিতে দ্রুত ছুটছে। তীরটাকে শেষ সীমা পর্যন্ত পিছিয়ে এনে ছেড়ে দিল ও। জানোয়ারটার ঠিক বুকে গিয়ে বিধল ওটা। গর্জে উঠে তীরের ফলা ধরে টেনে বের করার চেষ্টা করল ওটা, যেন খড় ছিঁড়তে চায়। একই সময়ে বাটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বলা যায় চলার গতি কমল না ওটার, মেয়েটার মাত্র কয়েক গজ পেছনে থেকে ফের আগে বাড়তে শুরু করল। আরেকটা তীর ছুঁড়ল মেরেন। প্রথম তীরের গোড়াটা রোমশ ধড়ের যেখানে মাথা বের করে রেখেছে ঠিক সেখানে গিয়ে বিধল ওটা।

এখন সাহায্য করতে ধেয়ে আসছে হিলতো। সামনের জানোয়ারটাকে তীর ছুঁড়ে আবার আঘাত করল সে। মেয়েটার এত কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ওটা, যে গর্জন ছাড়তেই পাজোড়া ভেঙে পড়ল। মেয়েটাকে ধরতে হাত বাড়াল জানোয়ারটা। কিন্তু ওদের দুজনের মাঝখানে বে-কে নিয়ে এলো মেরেন, সামনে ঝুঁকে মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরে তুলে নিল জিনের সামনে। পরক্ষণে স্পর দাবিয়ে বে-কে নিয়ে সরে এলো। ওর পিছু ধাওয়া করল শিম্পাঞ্জিটা, ক্ষতস্থানের। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। শিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখে হিংস্র হয়ে উঠেছে। সঙ্গীর বেশ কাছেই ছিল দ্বিতীয় শিম্পাঞ্জিটা, দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে আনছে ওটা।

দীর্ঘ বর্মটা সামলে ধরে ওটাকে বাধা দিতে ছুটে এলো হিলতো। ওকে ছুটে আসতে দেখে মোকাবিলা করার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল শিম্পাঞ্জিটা। কাছাকাছি হতেই বর্শার ডগা নামাল হিলতো, ওর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিম্পাঞ্জিটা। শূন্যে উঠে গেল। বর্শায় ওটাকে বিধল হিলতো, বুকের ঠিক মাঝখান দিয়ে চালিয়ে দিল ব্রোঞ্জের ডগা। দণ্ডের একেবারে ক্রস আকৃতির গার্ড পর্যন্ত বিধে গেল। ফলে এক কিউবিটের চেয়ে বেশি গভীরে ঢোকা রহিত হলো। ভর আর গতিবেগ কাজে লাগাল হিলতো, আর্তচিৎকার করে উঠল শিম্পাঞ্জিটা। ওটাকে মাটিতে গেঁথে ফেলল ও।

প্রথম শিম্পাঞ্জিটা মারাত্মকভাবে আহত হলেও মেরেন ও মেয়েটাকে অবশিষ্ট সমস্ত শক্তিতে অনুসরণ করছে। মেয়েটাকে ধরে রাখতে হওয়ায় ধনুকে তীর পরাতে পারছে না ও। দূরত্ব কমিয়ে আনছে জানোয়ারটা। কী করতে যাচ্ছে, তাইতা টের পাবার আগেই ওয়ার্লউইন্ডকে ঘুরিয়ে নিল ফেন, সাহায্য করতে ধেয়ে গেল।

ফিরে এসো! সাবধান! ওর পেছনে চিৎকার করল তাইতা। খামোকা। বুকে ভাঙা বর্শার দণ্ড আর ক্ষতস্থানের রক্তক্ষরণ নিয়ে লাফিয়ে শূন্যে উঠে গেল শিম্পাঞ্জিটা, নেমে এলো মেরেনের ঘোড়ার পেছনে। চোয়াল বিশাল হাঁ করে রেখেছে, মেরেনের ঘাড়ের পেছনে কামড় বসাতে মাথা সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে। হামলা মোকাবিলা করতে পিছন ফিরল ও। বাম হাতের ভাঁজে মেয়েটাকে ধরে শিম্পাঞ্জির খোলা মুখে ডান হাত দিয়ে বর্শার বাটটা ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেলো, জোর করে পেছনে ঠেলে দিল ওটার মাথা। কাঠের গায়ে চোয়াল বসাল শিম্পাঞ্জিটা, চিবিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

সাবধান! আবার চিৎকার করল তাইতা। মেরেনের পাশে এসে ছোট তীরটাকে টানটান করে টেনে ধরল। মেরেনের গায়ে না লাগে যেন! ফেন শুনেছে বলে মনে হলো না। ঠিক কোণটা পাওয়ামাত্রই তীর ছুঁড়ে মারল ও। দুই হাতেরও কম ছিল দূরত্ব। কাঁধের একপাশে গিয়ে বিধে আরেক পাশ দিয়ে অর্ধেকটা বের হয়ে এলো ওটা। ক্রোধে চিৎকার ছেড়ে দুই হাতে ধরে তীরটা বের করার সময় বনের আগাছায় গাড়াগড়ি খেতে লাগল। ধই করে এগিয়ে গেল ইম্বালি, কুড়োলটা মাথার উপর তুলে সপাটে নামিয়ে আনল। খুলির পুরু হাড় ফাটিয়ে দিল, যেন ওটা ডিমের খোসা। প্যাক-হর্স ছেড়ে এলো নাকোন্তো, নিজেদের মতো করে ছুটে গেল ওগুলো। হিলতো যেখানে অন্য শিম্পাঞ্জিটাকে বর্শার ডগায় গেঁথে রেখেছে ইম্বালিকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেল সেখানে। খাট আসেগেই দিয়ে পর পর দুবার গলায় ঘাই মারল ও, মরার আগে অন্তিম গর্জন ছাড়ল শিম্পাঞ্জিটা। মেরেনের বে-র সাথে তাল মিলিয়ে ছুটছিল ফেন, কিন্তু এখন গতি কমাল ওরা। মেয়েটাকে কোমলভাবে বুকের সাথে সেঁটে রেখেছে মেরেন। ওর কাঁধে মুখ গুঁজে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়েছে সে। পিঠে হাত বুলিয়ে ওকে আশ্বাসের কথা বলতে লাগল মেরেন। সব ঠিক আছে, সুরী। কান্নার কোনও কারণ নেই। এখন তুমি নিরাপদ। আমি তোমাকে দেখব। ওর আত্মতুষ্ট হাসির কারণে উদ্বেগ আর সহানুভূতি প্রকাশের প্রয়াস কিছুটা মার খেল।

পাঁই করে ঘুরে ওর এক পাশে চলে এলো ফেন। আরেক পাশে এসে পৌঁছাল তাইতা। এই যে মেয়ে, বুঝতে পারছি না, তোমার কাছে বড় বিপদ কোনটা, বুনো শিম্পাঞ্জি নাকি তোমাকে ওদের হাত থেকে উদ্ধারকারী লোকটা, মন্তব্য করল তাইতা। শেষবারের মতো ফুঁপিয়ে উঠে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা, কিন্তু মেরেনের গলা ছাড়ল না। ওকে ছাড়ানোর চেষ্টাও করল না মেরেন। নাক বেয়ে জল গড়াচ্ছে মেয়েটার, চোখজোড়া অশ্রুভেজা। কৌতূহলের সাথে ওকে জরিপ করতে লাগল সবাই।

কাঁদলেও মেয়েটা সুন্দরী, ভাবল তাইতা। তারপর কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ওই জানোয়ারগুলোর পাল্লায় পড়ার সময় একা একা বনের ভেতর কী করছিলে?

আমি পালিয়েছি, ট্রগগুলো আমার পিছু নিয়েছে। হেঁচকি তুলে বলল মেয়েটা।

ট্রগ? জানতে চাইল মেরেন।

গভীর চোখে ওর চোখের দিকে তাকাল মেয়েটা। এটাই ওদের নাম। ভয়ঙ্কর প্রাণী। আমরা সবাই ভয় পাই ওদের।

তোমার জবাব অনেকগুলো প্রশ্নের পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু তার আগে এসো প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? বাধা দিয়ে বলল তাইতা। মেরেনের দিক থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে এনে তাইতার দিকে তাকাল মেয়েটা। আপনার খোঁজে আসছিলাম আমি, ম্যাগাস। আপনার সাহায্য লাগবে। আমার। একমাত্র আপনিই আমাকে বাঁচাতে পারবেন।

এবার আরেক দফা প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। সহজ একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে পারি? তোমার নাম কী, বাছা?

আমার নাম সিদুদু, ম্যাগাস, বলল মেয়েটা, প্রবলভাবে কেঁপে উঠল।

তোমার শীত করছে, সিদুদু, বলল তাইতা। তোমাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার আগে আর কোনও প্রশ্ন নয়। মেরেনের দিকে তাকাল তাইতা, চেহারা গম্ভীর রেখেই জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা তোমার জন্যে কোনও অসুবিধা বা অস্বস্তির কারণ সৃষ্টি করছে না তো? গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে ওকে? নাকি মাটিতে নামিয়ে হটিয়ে নিয়ে যাব?

ওর কারণে অসুবিধা হলেও মেনে নিতে পারব, সমান আন্তরিকতার সাথে বলল মেরেন।

তাহলে এখানে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। চলো, এগোই।

ওরা যখন গ্রামে পৌঁছুল তখন অন্ধকার মিলিয়েছে। বেশিরভাগ বাড়িঘরই অন্ধকারে ডুবে আছে, ওদের এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করেছে বলে মনে হলো না। আস্তাবলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভালোই সামলে নিল সিদুদু। কিন্তু কোনও ঝুঁকি নিতে গেল না মেরেন, কোলে করে বৈঠকখানায় নিয়ে এলো ওকে। ফেন ও ইম্বালি বাতি জ্বেলে চুলোয় শিকারের মাংসের স্টু গরম করার সময় সিদুদুর ক্ষতস্থান পরখ করল তাইতা। সবই অস্ত্রপচারের দাগ, চামড়া খসিয়ে কাঁটা বসানো হয়েছে। ওর সুডৌল থোড়মাংস থেকে শেষ কাটাটা বের করে ক্ষতস্থানে মলম মেখে দিয়ে হেলান দিয়ে বসে জরিপ করল ওকে। বিভ্রান্ত, অসুখী একটা মেয়ে। কিন্তু কষ্টে উত্তাল পরিস্থিতির নিচে ওর আভা পরিষ্কার, খাঁটি। সত্যিকারের মিষ্টি, নিষ্পাপ মানুষ, জগতের অশুভ ও নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করা হয়েছে ওকে।

এসো, বাছা, বলল ও, আমরা আর কোনও কথা বলার আগে তোমাকে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে হবে। ফেনের নিয়ে আসা স্টু আর ধুরা পিঠা খেল সে। রুটির শেষ টুকরো দিয়ে অবশিষ্ট টু মুছে মুখে দেওয়ার পর তাইতা ওকে মনে করিয়ে দিল, বলছিলে আমার খোঁজেই এদিকে আসছিলে তুমি।

হ্যাঁ, ম্যাগাস, ফিসফিস করে বলল সে।

কেন? জানতে চাইল তাইতা।

আপনার সাথে একা কথা বলতে পারি, আর কেউ যেখানে আমাদের কথা শুনতে পাবে না? লাজুক কণ্ঠে জানতে চাইল সে। নিজের অজান্তের মেরেনের দিকে তাকাল।

অবশ্যই। আমার ঘরে চলো। একটা তেলের কুপি তুলে নিল তাইতা। এসো আমার সাথে। মেয়েটাকে নিয়ে ফেনের সাথে যে ঘরে থাকছে সেখানে নিয়ে এলো। নিজের মাদুরে বসে ফেনের মাদুরটা দেখিয়ে দিল ওকে। পাছার নিচে পা ভাঁজ করে বসল সিদুদু, ছেঁড়া স্কার্ট ভদ্রভাবে ঠিকঠাক করে নিল। এবার বলো, আমন্ত্রণ জানাল তাই।

জাররির সবাই বলে আপনি বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক, সব ধরনের ভেষজ আর আরকের ব্যাপারে দক্ষ।

এই সবাই কারা, জানি না, তবে আমি সত্যিই শল্যচিকিৎসক।

আমি চাই আপনি আমার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো একটা কিছু দিন, ফিসফিস করে বলল সে।

হকচকিয়ে গেল তাইতা। এমন কিছু মোটেও আশা করেনি। কী জবাব দেবে স্থির করতে গিয়ে খানিকটা সময় লেগে গেল। অবশেষে শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল, তোমার বয়স কত, সিদুদু?

উনিশ, ম্যাগাস।

আমি আরও কম ভেবেছিলাম, বলল ও। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। তোমার পেটের বাচ্চাটার বাবা কে? তুমি তাকে ভালোবাসো?

তিক্ত, বিষাক্ত শোনাল মেয়েটার উত্তর। আমি তাকে ভালোবাসি না। ঘৃণা করি, তার মরণ চাই, হড়বড় করে বলে উঠল ও।

পরের প্রশ্নটা স্থির করার সময় মেয়েটাকে জরিপ করল তাইতা। তাকে যদি এতই ঘৃণা করে থাকো, তবে তার সাথে শুতে গেলে কেন?

আমি তা চাইনি, ম্যাগাস। আমার কোনও উপায় ছিল না। লোকটা খুবই নিষ্ঠুর, শীতল। আমাকে মেরেছে: আমার উপর উপগত হওয়ার সময় মাতাল ছিল,

আমাকে মেরে চোখের পানি বের করে দিয়েছে, রক্তপাত ঘটিয়েছে।

তাকে ছেড়ে চলে যাওনি কেন? জানতে চাইল তাইতা।

চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমাকে ধরতে ট্রগদের লেলিয়ে দিয়েছে। তারপর আবার মেরেছে। আমি আশা করেছিলাম মারতে গিয়ে বাচ্চাটাকেও হয়তো নষ্ট করে ফেলবে, কিন্তু পেটে আঘাত না করার বেলায় খুবই সতর্ক ছিল।

লোকটা কে? কী নাম তার?

কাউকে বলবেন না, কথা দিন? দ্বিধা করল সে, তারপর হড়বড় করে বলে ফেলল, এমনকি আমাকে বাঁচিয়ে বন থেকে নিয়ে এসেছে যে সেই ভালো মানুষটিকেও না? আমি চাই না সে আমাকে ঘৃণা করুক।

মেরেন? অবশ্যই তাকে কিছুই বলব না। তবে তোমার চিন্তার কিছু নেই। তোমাকে ও কোনওদিন ঘৃণা করবে না। তুমি খুবই ভালো সাহসী মেয়ে।

 লোকটার নাম ওনকা-ক্যাপ্টেন ওনকা। আপনি চেনেন তাকে। সেই আপনার কথা লেছে আমাকে। তাইতার হাত চেপে ধরল সে। দয়া করে বাঁচান আমাকে! মরিয়া হয়ে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। দয়া করুন, ম্যাগাস! মিনতি করছি! দয়া করে আমাকে বাঁচান! বাচ্চাটা নষ্ট করতে না পারলে আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। ওনকার জারজ সন্তানের জন্যে মরতে চাই না আমি।

পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করল তাইতা। সিদুদু ওনকার মেয়েমানুষ হলে এর কথাই তবে কর্নেল তিনাত বলেছিল, ওনকার খাবারে ওষুধ মিশিয়ে তাইতাকে মেঘ-বাগিচা থেকে নিয়ে আসতে পারার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সে। মেয়েটা এখন ওদের হেফাযতে, ওকে রক্ষা করতেই হবে। আগে তোমাকে পরীক্ষা করতে হবে, তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি। আমার সঙ্গী ফেনকে আমাদের সাথে যোগ দিতে ডেকে পাঠালে আপত্তি নেই তো?

মেরেনের পিঠ থেকে ট্রগটাকে ফেলে দেওয়া সোনালি চুলের সুন্দরী মেয়েটা? দয়া করে ওকে ডাকুন।

সাথে সাথে হাজির হলো ফেন। মেয়েটার কী লাগবে তাইতা বুঝিয়ে বলার পরপরই সিদুদুর পাশে বসে ওর হাত ধরল ও। ম্যাগাস এই পৃথিবীর সেরা শল্যচিকিৎসক, বলল ও। তোমার ভয়ের কোনওই কারণ নেই।

শুয়ে তোমার টিউনিক ওঠাও, ওকে নির্দেশ দিল তাইতা। হুকুম তামিল করার পর দ্রুত অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরখ করল ও। এই দাগগুলো ওনকার মারের কারণে হয়েছে? জিজ্ঞেস করল ও।

হ্যাঁ, ম্যাগাস, জবাব দিল সে।

তোমার হয়ে তাকে আমি খুন করব, বলল ফেন। ওনকাকে কখনওই ভালো লাগেনি আমার, তবে এখন তাকে ঘৃণা করছি।

সময় এলে নিজের হাতে তাকে মারব, ওর হাতে চাপ দিয়ে বলল সিদুদু। তবে তোমাকে ধন্যবাদ, ফেন। আশা করছি তুমি আমার বন্ধু হবে।

আমরা তো বন্ধু হয়েই গেছি, ওকে বলল ফেন।

পরীক্ষা শেষ করল তাইতা। এরই মধ্যে জরায়ুর সন্তানের ক্ষীণ আভা লক্ষ করতে পেরেছে ও। বাবার অশুভ প্রবৃত্তির ছাপ রয়েছে তাতে।

উঠে পোশাক ঠিক করে নিল সিদুদু। বাচ্চাটা আছে, তাই না, ম্যাগাস? ওর হাসি ম্লান হয়ে এলো, আবার হতাশ দেখাল ওকে।

এই পরিস্থিতিতে দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, হ্যাঁ।

গত দুটি চাঁদ বাদ গেছে আমার।

এখানে একমাত্র ভালো দিকটি হচ্ছে, খুব বেশি দূরে যাওনি তুমি। এমন প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের পক্ষে ভ্রণটাকে খসানো কঠিন হবে না। উঠে কামরার অন্য প্রান্তে চলে গেল ও, ওখানে ওর ডাক্তারির ব্যাগ রাখা। তোমাকে একটা আরক খেতে দেব। খুবই জোরাল ওষুধ, বমি হবে তোমার, নাড়িভুড়ি উঠে আসতে চাইবে। কিন্তু আবার সাথে সাথে জিনিসটাকে নিচে ঠেলে দেবে। একটা মুখ বন্ধ শিশি থেকে মাটির বাটিতে সবুজ পাউডারের ডোজ মেপে নিল ও। উত্তপ্ত পানি মেশাল। ঠাণ্ডা হয়ে এলেই খেয়ে নেবে, ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে, ওকে বলল ও।

জোর করে তরলটুকু খাওয়ার সময় সিদুদুর পাশে বসে রইল ওরা, একবারে এক ঢোক করে খাচ্ছে, তেতো স্বাদের কারণে মুখ বাঁকা করে ফেলছে। শেষ করার পর কিছুক্ষণ বসে রইল ও। হাঁপাচ্ছে, বমির বেগে বেঁকেচুরে যাচ্ছে। অবশেষে শান্ত হয়ে এলো ও। এবার ঠিক হয়ে যাব আমি, কর্কশ কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল।

আজ রাতে তোমাকে আমাদের সাথে এখানেই ঘুমাতে হবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল ফেন। আমাদের সাহায্য লাগবে তোমার।

একেবারে মাঝরাতের অন্ধকারে সিদুদুর গোঙানির শব্দ ওদের জাগিয়ে তুলল। মাদুর থেকে লাফিয়ে উঠে বাতি জ্বালল ফেন। উঠে দাঁড়াতে সাহায়্য করল সিদুদুকে, আড়ষ্ট হয়ে উবু হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে পাশের ছোট ঘরের রাতের পাত্রের কাছে নিয়ে গেল। সিদুদু পেট উগড়ে দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই জায়গামতো পৌঁছুতে পারল ওরা। প্রবল বেগে তরল উগড়ে দিল ও। ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ওর আড়ষ্টভাব ও যন্ত্রণা আরও প্রবল হয়ে উঠতে লাগল। পটের উপর চেষ্টা চালিয়ে গেল ও। ওর পাশে রইল ফেন। আড়ষ্ট ভাব চরম হয়ে উঠলে ওর পেট মালিশ করে দিল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওর ঘর্মাক্ত মুখ আর বুক ভেজা ন্যাকড়ায় মুছে দিচ্ছে। ঠিক চাঁদ অস্ত যাবার পর আগের সমস্ত খিচুনির চেয়েও মারাত্মক এক খিচুনিতে কেঁপে উঠল সিদুদুর পুরো শরীর। চরম অবস্থায় ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে উঠল ও। হে আইসিস মাতা, আমাকে বাঁচাও! আমার সব অপরাধ মাফ করো! লুটিয়ে পড়ল সে, পরিশ্রান্ত, পটের নিচে করুণ আকারের একটা রক্তাক্ত পিণ্ডের মতো পড়ে আছে। টাটকা পানি আর লিনেন কাপড়ে সিদুদুর শরীর পরিষ্কার করে দিল ফেন। ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে আবার মাদুরের কাছে নিয়ে এলো। পট থেকে জ্বণটাকে তুলে সাবধানে ধুয়ে নিল তাইতা, তারপর একটা টাটকা লিনেন কাপড়ে মুড়ে নিল। ছেলে না মেয়ে বোঝার মতো যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠেনি ওটা। জ্বণটা আস্তাবল প্রাঙ্গণে নিয়ে এলো ও, মেরেনকে ডাকল সাহায্য করার জন্যে, তারপর আঙ্গিনার কোণের একটা পাথর তুলে জমিনে একটা গর্ত খুড়ল ওরা। বান্ডিলটা পুঁতে রাখল সেখানে।

মেরেন পাথরের টুকরোটা আবার জায়গামতো বসানোর পর শান্ত কণ্ঠে তাইতা বলল, মা আইসিস, এই আত্মার দিকে খেয়াল রেখো। বেদনা ও ঘৃণায় এর ধারণ হয়েছিল। গ্লানি ও ভোগান্তিতে অবসান ঘটেছে। এই জীবনের জন্যে ছিল না সে। পবিত্র মাতা, তোমার কাছে মিনতি করি, পরকালে ছোট্ট প্রাণটাকে আরও করুণার সাথে দেখো।

নিজের ঘরে ফেরার পর অনুসন্ধিৎসু চোখে ওর দিকে তাকাল ফেন। চলে গেছে, বলল তাইতা। রক্তক্ষরণ অচিরেই থেমে যাবে, কয়েক দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে সিদুদু। চিন্তা বা ভয়ের কোনও কারণ নেই।

কেবল ওর গায়ে হাত তোলা বদ লোকটা বাদে, ওকে মনে করিয়ে দিল ফেন।

ঠিক। তবে সে একা নয়, আমাদের সবাইকেই ক্যাপ্টেন ওনকাকে সমঝে চলতে হবে। মাদুরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে সিদুদুর পরিশ্রান্ত চেহারা পরখ করল ও। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ও। ওর কাছে থেকো, ফেন। তবে যতক্ষণ সম্ভব ঘুমাতে দাও ওকে। আরও কিছু ব্যাপার দেখতে হবে আমাকে।

ঘর থেকে বের হয়েই নাকোন্তো ও ইম্বালিকে ডেকে পাঠাল তাইতা। আমরা যেখানে শিম্পাঞ্জিগুলোকে মেরেছি সোজা সেখানে চলে যাও, বনে ছাড়িয়ে দাও লাশগুলো, তারপর প্যাকহর্স খুঁজে বের করে শুয়োরগুলোকে ফেলে দাও। ঘোড়া তীরগুলো খুঁজে বের করো, ওখানে আমাদের উপস্থিতির সব রকম চিহ্ন মুছে ফেল। শেষ করে ফিরে এসো। ওরা চলে গেলে মেরেন আর হিলতোকে বলল, কর্নেল তিনাত বলেছিল সর্দার বিলতো মুতাঙ্গিতে তার এজেন্ট। তিনাতের কাছে সব খবর পৌঁছে দেবে সে। গোপনে বিলতের কাছে চলে যাও। তিনাতকে খবর দিতে বলবে যে, সিদুদু এখন আমাদের সাথে আছে আরও কিছু বরতে যাচ্ছিল ও, এমন সময় ওদের বাড়ির সামনের রাস্তায় অনেকগুলো ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ কানে এলো। গ্রামের ভেতরে জোরাল চিৎকার শোনা যেতে লাগল। তারপর আঘাতের আওয়াজ, নারীকণ্ঠের কান্নার শব্দ আর বাচ্চাদের চিৎকার কানে এলো।

দেরি হয়ে গেছে, বলল তাইতা। সৈনিকরা এসে গেছে। সিদুদুর খোঁজ করছে ওরা, কোনও সন্দেহ নেই।

ওকে লুকিয়ে রাখতে হবে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেরেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আস্তাবলের আঙ্গিনার পাথরে পেরেক বসানো জুতোর আওয়াজ ও তারপর দরজার গায়ে ধাক্কার আওয়াজ কানে এলো। খাপ থেকে তলোয়ারটা আধাআধি বের করে আনল মেরেন।

সুপ্রিম কাউন্সিলের নামে বলছি, খোল! ওনকার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।

তলোয়ার তুলে রাখ, শান্ত কণ্ঠে মেরেনকে বলল তাইতা। দরজা খুলে ঢুকতে দাও ওদের।

কিন্তু সিদুদুর কী হবে? ভেতরের ঘরের দরজার দিকে তাকাল মেরেন। ওর চোখে মুখে হতাশা।

ফেনের বুদ্ধির উপর ভরসা রাখতে হবে, জবাব দিল তাইতা। ওনকা সত্যিকার অর্থে সন্দিহান হয়ে ওঠার আগেই দরজা খুলে দাও। কামরার ওপাশে গিয়ে অর্গল খুলে দিল মেরেন। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওনকা।

আরে, ক্যাপ্টেন ওনকা যে! ওকে স্বাগত জানাল তাইতা। কী সৌভাগ্য, অপ্রত্যাশিতভাবে তোমার দেখা পেয়ে গেলাম!

অনেক কষ্টে চেহারা ঠিক রাখল ওনকা। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, ম্যাগাস, কিন্তু আমরা একটা নিখোঁজ মেয়ের খোঁজ করছি। মেয়েটার মাথায় গোলমাল আছে, সম্ভবত প্রলাপ বকছে।

কত বয়স তার, দেখতে কেমন?

বয়স কম, সুন্দরী। তাকে দেখেছেন?

দুঃখিত দেখিনি, মেরেনের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তাই। কর্নেল, এই বর্ণনার সাথে মেলে এমন কাউকে দেখেছ?

দেখিনি, মিথ্যা কথা বলায় তেমন পটু নয় মেরেন, সন্দিহান দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল ওনকা। ম্যাগাস ও তার ঘরে নাক গলানোর আগে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতে, জোর গলায় বলল মেরেন।

আবারও ক্ষমা চাইছি, বলল ওনকা, তবে মোটেই আন্তরিক দেখানোর চেষ্টা করছে না সে। কিন্তু ব্যাপারটা জরুরি, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। আমি কি ঘরের ভেতরটা একবার দেখতে পারি?

বুঝতে পারছি, তুমি যা চাইবে সেটাই করবে, হাসল তাইতা। জলদি শেষ করো, তারপর আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও।

ভেতর ঘরের দরজার দিকে ছুটে গেল ওনকা। পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকল।

ওকে অনুসরণ করে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল তাইতা। মেঝের মাঝখানে রাখা মাদুর আর কম্বলের তূপের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওনকা। তলোয়ারের ডগা দিয়ে ওল্টাল ওগুলো। কেউ নেই ওগুলোর তলায়। চোখ রাঙিয়ে কামরার চারপাশে তাকাল সে, তারপর চট করে কিউবিকলের কাছে গিয়ে রাতের পাত্রের দিকে চোখ চালাল। চোখমুখ কুঁচকে ফিরে এলো শোবার ঘরে। ফের চারপাশে নজর বোলাল। আগের বারের চেয়ে অনেক সাবধানে।

দোরগোড়ায় তাইতার পেছনে এসে দাঁড়াল মেরেন। খালি! বলে উঠল ও।

অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে? পাঁই করে ওর দিকে ঘুরল ওনকা।

মোটেই না, নিজেকে সামলে নিল মেরেন। আমি শুধু ম্যাগাসের কথাই নিশ্চিত করছি।

এক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইল ওনকা, তারপর আবার তাইতার দিকে মনোযোগ দিল। আপনি জানেন, আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করছি, ম্যাগাস। সমস্ত বাড়িঘর তল্লাশি শেষে আমার উপর নির্দেশ আছে আপনাকে দুর্গে নিয়ে যাবার, ওখানে অলিগার্করা আপনাকে স্বাগত জানাবেন। দয়া করে সাথে সাথে রওয়ানা দেওয়ার জন্যে তৈরি থাকবেন।

ঠিক আছে। এত গভীর রাতে ব্যাপারটা সুবিধাজনক নয়, কিন্তু সুপ্রিম কাউন্সিলের নির্দেশ মেনে নিচ্ছি।

ওরা চলে যাওয়ার সাথে সাথে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। কামরার দূরের কোণে দুটো আলাদা আভা জ্বলজ্বল করতে দেখল। আভাজোড়ার উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করতেই ফেন ও সিদুদুর অবয়ব ফুটে উঠল। বাম হাতের ভঁজে সিদুদুকে বাঁচানোর ঢঙে ধরে রেখেছে ফেন। অন্য হাতে তাইতার তালিসমানের সোনার টুকরোটা ধরে আছে। নিজের আভাকে ম্লান আভায় দমিয়ে রেখেছে ও। আতঙ্কে নাচছে সিদুদুর আভা, জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আড়াল করার মন্ত্র দিয়ে সেটা চেপে রাখতে। পেরেছে ফেন। ফেনের চোখের দিকে তাকিয়ে বায়বীয় সঙ্কেত পাঠাল ও। ভালো কাজ দেখিয়েছ। যেমন আছো সেভাবেই থাকো। নিরাপদ মনে করার পর মেরেনকে তোমাদের কাছে পাঠাব। ও তোমাদের আরও ভালো কোনও জায়গায় নিয়ে যাবে।

বার্তা পেয়ে ফেনের চোখজোড়া বিস্ফারিত হয়ে গেল। জবাব দেওয়ার সময় আবার সংকীর্ণ হয়ে এলো। তোমার কথামতোই করব। ওনকাকে বলতে শুনেছি সুপ্রিম কাউন্সিল তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমরা দূরে থাকার সময় তোমার জন্যে সতর্ক থাকব আমি।

আরও কয়েক মুহূর্ত ফেনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল তাইতা। ফেনের নিরাপত্তার কথা ভেবে মনের সমস্ত উদ্বেগ আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্ট করে গেল, ভালোবাসা আর নিরাপত্তার বোধ জাগানোর প্রয়াস পেলো। বিশ্বস্ততার সাথে হাসল ফেন, ওর আভা আবার স্বাভাবিক আগুনে সৌন্দর্য ফিরে পেলো। ডান হাতে তালিসমান ধরে ওর উদ্দেশে আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল ফেন।

লুকিয়ে থাকো, আবার কথাটা বলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলো ও।

বৈঠকখানায় একা অপেক্ষা করছিল মেরেন। কিন্তু ওনকা ও তার দলবলের বাড়ির পেছনে তাণ্ডবলীলা চালানোর শব্দ পেলো তাই। ভালো করে শোনো, মেরেন। ওর একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল তাইতা। ফেন আর সিদুদু এখনও আমার ঘরেই আছে। কথা বলার জন্যে মুখ খুলল মেরেন, কিন্তু হাত তুলে ওকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করল ও। নিজেদের উপর আড়াল করার মন্ত্র প্রয়োগ করেছে ফেন। আমি ওনকার সাথে অলিগার্কদের সমনের জবাব দিতে দুর্গের পথে রওয়ানা হয়ে যাবার পর ওদের কাছে যেতে পারবে। বিলতোর মারফত তিনাতের কাছে খবর পাঠাতে হবে তোমাকে। মেয়েদের অবস্থা কতটা নাজুক হয়ে দাঁড়িয়েছে, ওকে জানাবে। আমি দূরে থাকার সময় ওদের জন্যে আরও নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে ওকে। লম্বা সময়ের জন্যে দূরে থাকতে হতে পারে আমাকে। আমার ধারণা অলিগার্করা সাথে সাথে আবার আমাকে মেঘ বাগিচায় পাঠাবে। মেরেনকে উদ্বিগ্ন দেখাল। খুব জরুরি প্রয়োজনে বা আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেলে ফেনের সাথেই কেবল বায়বীয় যোগাযোগ রাখব আমি। তার আগে তুমি আর তিনাত জাররি থেকে পালানোর সব ব্যবস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছ?

হ্যাঁ, ম্যাগাস।

আরেকটা কথা, সৎ মেরেন। ইয়োসের সাথে না জেতার সমস্ত সম্ভাবনাই আছে আমার। অন্যদের মতো আমাকেও শেষ করে ফেলতে পারে সে। যাদের বন্দি করেছে। তেমন কিছু ঘটলে, সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ফেনকে জানাব। আমাকে উদ্ধার করার কোনও চেষ্টা করতে যাবে না। ফেন ও দলের বাকি সবাইকে নিয়ে অবশ্যই জাররি থেকে পালাবে। কারনাকে ফিরে যাবার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, কী ঘটেছে সব জানাবে ফারাওকে।

ঠিকাছে, ম্যাগাস।

জীবন দিয়ে ফেনকে পাহারা দেবে। জীবন্ত অবস্থায় ওকে ইয়োসের ফাঁদে পড়তে দেবে না। কী বোঝাতে চেয়েছি বুঝতে পেরেছ?

পেরেছি, ম্যাগাস। হোরাস আর ত্রয়ীর কাছে প্রার্থনা করি যেন তার কোনও দরকার না হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেন ও সিদুদুকে রক্ষা করব।

হাসল তাইতা। হ্যাঁ, আমার পুরোনো ও বিশ্বস্ত বন্ধু। হয়তো সিদুদুই সেই যার জন্যে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় আছো।

আমাকে রাজকুমারী মেরিকাকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে ও, যখন তার প্রেমে পড়েছিলাম, সহজ কণ্ঠে বলল মেরেন।

সিদুদুর বয়ে আনা সব আনন্দ এবং তারচেয়েও বেশি কিছু পাওয়ার যোগ্যতা তোমার আছে, ফিসফিস করে বলল তাইতা। যাকগে, এখন জলদি করো। ওই, ওনকা আসছে।

ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল ওনকা। বিরক্তি গোপন করার কোনওই চেষ্টা করছে না।

পেয়েছ? জানতে চাইল তাইতা।

আপনি জানেন, পাইনি, আবার শূন্য শোবার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ওনকা, সন্দিহান চেহারায় উঁকি দিল ভেতরে। তারপর প্রবল ক্রোধে মাথা নেড়ে ফিরে এলো তাইতার কাছে। আমাদের এখুনি দুর্গের পথ ধরতে হবে।

অলিগার্করা আমাকে মেঘ-বাগিচায় পাঠালে গরম কাপড় নিতে হবে আমার।

সে ব্যবস্থা করা হবে, বলল ওনকা। চলুন।

মেরেনের ঊর্ধ্ববাহুতে চাপ দিয়ে বিদায় জানাল তাইতা। সিদ্ধান্তে অটুট থাকবে, বুকে সাহস রাখবে। মৃদু কণ্ঠে বলল ও। তারপর ওনকার পেছন পেছন আস্তাবলের আঙ্গিনার দিকে পা বাড়াল। ওনকার এক লোক জিন পরানো একটা বে মেয়ার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। থমকে দাঁড়াল তাইতা। আমার মেয়ার উইন্ডস্মোক কই? জানতে চাইল ও।

সহিসরা বলেছে খোঁড়া হয়ে গেছে ওটা, ওটার পিঠে চাপা যাবে না, জবাব দিল ওনকা।

রওয়ানা দেওয়ার আগে ওকে দেখব।

সম্ভব নয়। দেরি না করে আপনাকে দুর্গে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে আমার উপর।

আরও কিছু সময় তর্ক করল তাইতা, কিন্তু ফায়দা হলো না। হতাশ দৃষ্টিতে মেরেনের দিকে তাকাল ও।

উইন্ডস্মোকের দিকে খেয়াল রাখব আমি, ম্যাগাস। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই।

অচেনা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল তাইতা, গেট হয়ে বের হয়ে গেল ওরা।

*

পরদিন মাঝসকালের দিকে অলিগার্কদের প্রাসাদে পৌঁছুল ওরা। আবারও তাইতাকে অ্যান্টি চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হলো। গরম পানির একটা বেসিন রয়েছে ওখানে, ওটার পানিতে হাত মুখ ধুয়ে নিল ও, প্রাসাদের এক ভৃত্য পরিষ্কার লিনেনের তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছিল। একই ভৃত্য মসলাদার মুরগির মাংস আর এক বাটি লাল মদের খাবার দিল ওকে।

তারপর ওকে সুপ্রিম কাউন্সিলের দরবারে নিয়ে যেতে পরিচারক হাজির হলো। যারপরনাই সম্মানের সাথে মঞ্চের ঠিক নিচে, কামরার সামনের দিকে একটা চেয়ারে বসানোর ব্যবস্থা করল ওকে। সাবধানে চারপাশে চোখ বোলাল তাইতা, তারপর চামড়ার পর্দার দিকে মনোযোগ দিল। ইয়োসের কোনও চিহ্ন পেলো না। এবার দীর্ঘ অপেক্ষার জন্যে নিজেকে স্থির করে নিল ও, শরীর শিথিল করে ফেলল।

অবশ্য অল্প খানিকক্ষণ পরে প্রহরীরা সার বেঁধে ঢুকে মঞ্চের নিচে অবস্থান নিল। অলিগার্কদের আগমন ঘোষণা করল পরিচারক। সুপ্রিম কাউন্সিলের সম্মানিয় প্রভুদের প্রতি দয়া করে সম্মান দেখান।

তাইতা আনুগত্য প্রকাশ করলেও পর্দার পেছন থেকে অলিগার্করা ঢোকার সময় চোখের পাতার আড়াল থেকে ওদের উপর নজর রাখল। আবারও লর্ড আকেরের নেতৃত্বে এসেছে ওরা। মাত্র দুজনকে দেখে বিস্মিত হলো তাইতা। লর্ড ক্যাইথরকে দেখা যাচ্ছে না। আকের ও তার সঙ্গী যার যার টুলে বসল, তৃতীয় টুলটা খালি রইল।

হাসল আকের। আপনাকে স্বাগত। দয়া করে বসুন, ম্যাগাস। আপনি সমগোত্রীয়দের মাঝেই আছেন।

একথায় বিস্মত হলো তাইতা। তবে সেটা প্রকাশ না করার চেষ্টা করল। সোজা হয়ে গদিতে হেলান দিল ও। তুমি মহানুভব, লর্ড আকের, বলল ও।

আবার হাসল আকের। তারপর পরিচারক ও প্রাসাদ প্রহরীদের দল নায়ককে তলব করল। আমরা একা থাকতে চাই। দয়া করে আমাদের ছেড়ে চলে যাও, তলব না করা পর্যন্ত আসবে না। অচেনা কেউ যেন আড়ি পেতে না শুনতে পারে সেদিকে খেয়াল রেখো।

বর্শার হাতল আঁকড়ে ধরল প্রহরীরা, তারপর সার বেঁধে বেরিয়ে গেল। ওদের অনুসরণ করল পরিচারক। পিছন ফিরে হাঁটছে, তার গোটা শরীর প্রণামের ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে আছে।

ওরা বেরিয়ে যাবার পর বিশাল দরজাগুলো বন্ধ হওয়ামাত্র আবার কথা বলল আকের। আমাদের গত সাক্ষাতের সময় আপনার সাথে অভিজাত এক-তাংয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিইনি। বসে থেকেই পরস্পরের উদ্দেশে মাথা নোয়াল তাইতা ও কাউন্সিল সদস্য।

এক-তাং ছোটখাট স্বাস্থ্যবান লোক, মাঝবয়সী, শিল্পীসুলভ চেহারা। কয়লার মতো কালো একজোড়া চোখ তার, দুর্বোধ্য।

বলে চলল লর্ড আকের, মেঘ-বাগিচার সার্জনদের কাছ থেকে অসাধারণ খবর পেয়েছি। আমাদের বলা হয়েছে যে কর্নেল ক্যাম্বিসেসের চোখের অপারেশন সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। কোনওভাবেই জুড়ির চেয়ে ভিন্ন হবার কোনও কারণ নেই ওটার।

আমাদের সার্জনরা পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রসর, কিন্তু আসল সাফল্য ধরা দিতে বাকি আছে এখনও, বলল আকের।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাথা কাত করল তাইতা, তবে চুপ করে থাকল।

পরে এই প্রসঙ্গে আবার আসব আমরা, রহস্যময় ভাব করে আকের বলল, স্পষ্টতই ওকে কৌতূহলী করে তোলার ইচ্ছা। তারপর অকস্মাৎ প্রসঙ্গ বদলাল।

আপনি লক্ষ করবেন লর্ড ক্যাইথর আজ নেই।

সত্যিই তাইতা, মাই লর্ড, তার অনুপস্থিতিতে আমি অবাকই হয়েছি।

বয়স হয়েছিল তার, বহু বছরের ভারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। দশ দিন আগে দূঃখজনকভাবে ঘুমের ভেতরই মারা গেছেন। কোনও কষ্ট ছাড়াই শান্তিতে মারা গেছেন।

আমাদের সবারই অমন সৌভাগ্য হলে ভালো হতো, বলল তাইতা। তবে তোমার সাথে আমিও তার মৃত্যুকে শোক প্রকাশ করছি।

আপনি সহানুভূতিশীল মানুষ, বলল আকের। কিন্তু আসল কথা, এখন মহা সভায় একটি শূন্য পদের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমরা, আন্তরিকভাবে একমাত্র সত্যি দেবীর কাছে পথ নির্দেশনার জন্যে প্রার্থনা করেছি, অচিরেই যার নাম আপনার কাছে প্রকাশ করা হবে।

এই আনুকূল্যে মাথা নোয়াল তাই।

বলে চলল আকের। আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে পরলোকগত সভাসদের শূন্য স্থানে আসীন হওয়ার মতো একজন সম্মানিত লোকই আছেন। আপনি। গালালার তাইতা।

আবার মাথা নোয়াল তাইতা, কিন্তু এইবার সত্যিই বাকহারা হয়ে গেল ও।

আন্তরিক কণ্ঠে বলে চলল আকের। মহাসভার সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে লর্ড তাইতা উপাধিতে ভূষিত করা হবে আপনাকে। আবার মাথা নোয়াল তাইতা। তবে আপনার নির্বাচনের বেলায় একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সভার সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ ও স্বাস্থ্যবান হওয়াটা বাধ্যতামূলক। লর্ড তাইতা, আপনার নিজের দোষের কারণে না হলেও একটা মারাত্মক ত্রুটিতে ভুগছেন যা আপনাকে এই পদের অয়োগ্য করে দিয়েছে। অবশ্য, এটা চূড়ান্ত কোনও ব্যাপার নয়। আপনার উত্তরসুরি কর্নেল ক্যাম্বিসেসকে মেঘ-বাগিচায় চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়েছিল, তবে সেটা তার যোগ্যতার বলে নয়। এই ধরনের অসাধারণ চিকিৎসার সুযোগ কেবল আমাদের সমাজের বিশেষ যোগ্য লোকদের জন্যেই তুলে রাখা। চিকিৎসার বিপুল খরচের একটা দাম ধরা কঠিন। পরে এ সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন। নিচু বা মাঝারি পদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সাধারণভাবে এই সুযোগ পায় না। সম্ভাবনার অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনাকে বিশ্বাস করানোর লক্ষ্যে কর্নেল ক্যাম্বিসেসকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই প্রদর্শনী না দেখানো হলে নির্ঘাৎ আপনি সংশয় প্রকাশ করতেন এবং খুব সম্ভবত অংশ নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন।

তোমার কথা সম্পূর্ণ ঠিক। তবে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে বেছে নেওয়ায় আমি খুশিই হয়েছি।

আমরাও, সায় দিল আকের, তবে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না। এখন আর সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক হচ্ছে, সার্জনরা আপনাকে পরীক্ষা করে দেখেছে। মহাসভার একজন অভিজাত ও নির্বাচিত সদস্য হিসাবে আপনি এই বিশেষ চিকিৎসার উপযুক্ত। মেঘ-বাগিচার সার্জনদের আপনার আগমনের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনাকে স্বাগত জানাতে তাদের প্রস্তুতি অনেক দূর এগিয়েছে। একারণেই আপনাকে জানাতে দেরি হয়ে গেছে। এমনি কাজের প্রস্তুতিতে সময় লাগে, তবে বীজ তোলা হয়ে গেছে। সার্জনরা আপনার অপেক্ষা করছে। আপনি কি সুযোগটা গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছেন?

চোখ বুজে আঙুলের ডগায় চোখ টিপে ধরে ভাবল তাইতা। আমাদের সম্পূর্ণ কাজটাই এর উপর নির্ভর করছে, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও। এছাড়া ইয়োসকে আক্রমণ করার মতো কাছাকাছি যাওয়ার অন্য কোনও রাস্তা নেই। অবশ্য ডাইনীর সুবিধার স্বার্থেই এই সভা সাজানো হয়েছে। আমার সফল হওয়ার সম্ভাবনা রেশমের সুতোর মতোই ক্ষীণ। পরিণতি জানার কোনও উপায় নেই, তবে অবশ্যই বিপদকে বেছে নিতে হবে। একমাত্র নিশ্চয়তা হচ্ছে ডাইনীর বিষে সবকিছু সিক্ত। সুতরাং এটা অশুভই নয় বরং মহাবিপর্যয়কর হবে। বিবেকের সাথে যুদ্ধ করার সময় হাত দিয়ে চোখের পাতা ডলতে লাগল ও। আমি কি কোনও বদমতলব যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করছি? কাজটা করলে সেটা কি ফারাও বা মিশরের স্বার্থে হবে নাকি ব্যক্তি তাইতা ও তার নিষ্ঠুর আত্ম-মূল্যায়নের স্বার্থে? দুটো কারণেই। এটা সত্যর পক্ষে মিথ্যার বিপক্ষে, তবে আমার ও ফেনের জন্যেও। পরিপূর্ণ পুরুম কেমন জানতে ইচ্ছে করে আমার। ওকে এমন আবেগের সাথে ভালোবাসতে চাষ আমার খোদ আত্মাকেই শেষ করে ফেলার হুমকি সৃষ্টি করেছে।

হাত নামিয়ে চোখ খুলল ও। আমি প্রস্তুত, বলল ও।

সাবধানতার সাথে জবাব দিয়ে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন আপনি, তবে আপনার সিদ্ধান্তে আমি খুশি হয়েছি। আজ রাতে আপনি আমাদের প্রাসাদের সম্মানিত অতিথি হবেন। সকালে পাহাড়ের উদ্দেশে নতুন জীবনের পথে যাত্রা করবেন।

*

পরদিন সকালে ওরা যখন রওয়ানা হলো তখন প্রচণ্ড তুফান চলছে। ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার সাথে সাথে নিষ্করুণভাবে তাপমাত্রা কমে আসতে লাগল। চামড়ার জোব্বায় গোটা শরীর ঢেকে ওনকার ঘোড়ার ছায়ামূর্তি অনুসরণ করছে তাইতা, পথের উপর ঘূর্ণী খাওয়া তুষার ও বরফের মেঘে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে ওটা। আগের চেয়ে বেশ দীর্ঘ লাগছে এবারের যাত্রা, তবে অবশেষে তুষার ঝড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙের মুখ উদয় হতে দেখল ওরা। এমনকি সুড়ঙ মুখের পাহারাদার ট্রগগুলোও বাতাসের ঝাপ্টায় উবু হয়ে আছে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তাইতার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল ওরা। তুষারে ভারি হয়ে গেছে ওদের চোখের পাতা। স্বস্তির সাথে ওনকাকে অনুসরণ করে সুড়ঙে ঢুকল ও, নাগালের বাইরে চলে এলো ঝড়ের।

পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা, স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার থেকে বের হয়ে উষ্ণ সূর্যের আলোর কম্পিত রশ্মির মাঝে হাজির হলো। সুড়ঙের বাইরের ঐগদের পাশ কাটিয়ে এসে নিচের মেঘ–বাগিচার নজরকাড়া দৃশ্য বিছিয়ে থাকতে দেখল। ওই মোহনীয় জ্বালামুখে বরাবরের মতোই চেতনা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠা টের পেল তাইতা। বনের ভেতর দিয়ে পরিচিত পথ ধরে এগোচ্ছে এখন, শেষ প্রান্তে ধোয়া ওঠা নীলাভ হ্রদের সৈকতে পৌঁছে গেল। বালুকাবেলায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে কুমীরগুলো। এই প্রথম ওদের জলের বাইরে দেখতে পেয়ে হতবাক হয়ে গেল তাইতা: যতটা ভেবেছিল তারচেয়েও অনেক বড়। ঘোড়ার এগিয়ে যাওয়ার আওয়াজে বাঁকা পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হলো ওগুলো, তারপর পানির কিনারায় গিয়ে নেমে গেল হ্রদের জলে, শান্ত ভঙ্গিতে ডুব দিল পানির নিচে।

ওরা আস্তবলের আঙ্গিনায় পৌঁছলে ভৃত্য ও সহিসের দল ওদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিল। সহিসরা ঘোড়ার দায়িত্ব নিল। প্রধান পরিচারক তাইতাকে মেরেনের সাথে ও যে ঘরে ছিল সেখানেই নিয়ে গেল ওকে। আবারও তরতাজা পোশাক বিছিয়ে দেওয়া হলো ওর জন্যে। অগ্নিকুণ্ডে টাটকা আগুন জ্বলছে। গরম পানির বড় বড় জগ তৈরি।

আশা করি সবকিছুই তৈরি ও আপনার পছন্দ মোতাবেক পাবেন, সম্মানিত ম্যাগাস। অবশ্যই আপনার কিছু প্রয়োজন হলে খালি ঘণ্টা বাজাবেন। ইশারায় দরজার পাশে ঝুলন্ত ঘণ্টার দড়িটা দেখাল সে। সন্ধ্যায় ডাক্তার হান্নাহ আপনাকে তার খাস কামরায় রাতের খাবার খাওয়ার দাওয়াত করেছেন। পেছন ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল প্রধান পরিচারক, এক কদম পর পরই গভীর শ্রদ্ধায় নত হচ্ছে। সূর্যাস্তের পর আপনাকে নিয়ে যেতে আসব।

গোসল সেরে বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়ল তাইতা, কিন্তু ঘুমাতে পারল না। ফের অস্থির উত্তেজনা ও অজানা এক ধরনের প্রত্যাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। আগের মতোই, বুঝতে পারছে ও, এই শিহরণ ওর নিজের ভেতর থেকে আসছে না, বরং বাইরের উৎস থেকে আসছে। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল ও, কিন্তু তেমন একটা সফল হলো না। প্রধান পরিচারক ওকে নিতে এলো যখন, টাটকা টিউনিক পরে অপেক্ষা করছিল তাইতা।

ওকে স্বাগত জানাতে দারজায় হাজির হলো ডাক্তার হান্নাহ, যেন ওরা পুরোনো বন্ধু। ওর অভিজাত শ্রেণীতে উত্তরণের খবর পৌঁছে গেছে তার কাছে, তাইতাকে লর্ড তাইতা সম্বোধন করল সে। সবার আগে মেরেনের খবর জানতে চাইল; মেরেনের অব্যাহত চমৎকার উন্নতির খবর দিলে দারুণ খুশি হয়ে উঠল। আরও তিনজন মেহমান ছিল নিমন্ত্রণে। ডাক্তার গিব্বা তাদের একজন। হান্নাহর মতোই আন্তরিকভাবে তাইতাকে সম্বোধন করল সে। বাকি দুজন অপরিচিত।

এ হচ্ছে ডাক্তার আসেম, বলল হান্নাহ। গিল্ডের একজন সম্মানিত সদস্য। অপারেশন ও ওষুধের বেলায় গুল্ম ও সজি ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ।

আসেম ছোটখাট মানুষ, প্রাণবন্ত বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। তার আভা থেকে তাইতা বুঝতে পারল লোকটা বিশাল জ্ঞানের অধিকারী একজন দীর্ঘায়ু, তবে মোহন্ত নয়।

ডাক্তার রেইয়ের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিই? ক্ষতিগ্রস্ত বা ছিঁড়ে যাওয়া স্নায়ু ও পেশী জোড়া লাগানোর বিশেষজ্ঞ। মানুষের শরীরের হাড়ের গঠন সম্পর্কে যেকারও চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে। বিশেষ করে খুলি আর দাঁত, মেরুদণ্ডের কশেরুকা ও হাত পায়ের হাড়। ডাক্তার আসেম আর ডাক্তার রেই আপনার অপারেশনে আমাকে সাহায্য করবে।

রেই দেখতে রুক্ষ, প্রায় পুরুষালী চেহারা। তার হাতজোড়া শক্তিশালী। তাইতা বুঝতে পারল মহিলা পেশাগত দিক থেকে চতুর, একগুঁয়ে মানসিকতার।

ওরা বোর্ড ঘিরে স্থির হয়ে বসার পর উল্লাসমুখর হয়ে উঠল পরিবেশ, আকর্ষণীয় হয়ে উঠল কথোপকথন। ওদের উন্নত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হলো তাই। ভৃত্যরা বাটিগুলো সব সময় ভরে রাখলেও সংযম বজায় রাখল ওরা, কেউই মদে চুমুক দেওয়া ছাড়া আর কোনও খাবার স্পর্শ করল না।

এক পর্যায়ে ওদের কথোপকথন পেশার নৈতিকতার প্রসঙ্গে বাঁক নিল। দূর প্রাচ্যের এক দেশ থেকে এসেছে রেই। কিন সম্রাট কীভাবে যুদ্ধে আটক বন্দিদের সার্জনদের হাতে তুলে দিতেন তার বর্ণনা দিল সে। বন্দিদের জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ ও পরীক্ষা করার উৎসাহ দিতেন তিনি। সমাবেশের প্রত্যেকেই স্বীকার গেল, সম্রাট নিশ্চয়ই দূরদৃষ্টির ও সমঝদার লোক ছিলেন।

মানুষের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাধারণ গৃহপালিত পশুর চেয়ে মাত্র এক ধাপ উপরে, যোগ করল হান্নাহ। প্রত্যেকেই জীবনের সব প্রয়োজনীয় উপকরণ পাচ্ছে নিশ্চিত করাই একজন ভালো শাসকের দায়িত্ব। আর বেশির ভাগ আরাম আয়েসই নির্ভর করে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা উপকরণের উপর। তবে ব্যক্তির জীবন পবিত্র মূল্যের বলে তাকে যেকোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে, এটা ভাবলে চলবে না তার। একজন জেনারেলের যেমন যুদ্ধে জেতার স্বার্থে সেনাদলকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে দ্বিধায় ভুগলে চলে না, তেমনি ম্রাটকেও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের নিরীখেই জীবন বা মৃত্যু সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তথাকথিত মানবতার কৃত্রিম মানদণ্ডের ভিত্তিতে নয়।

আমি সম্পূর্ণ একমত, তবে আরেকটু যোগ করতে বলতে চাই, বলল রেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ব্যক্তির মূল্যকে হিসাবে নিতে হবে। কোনও দাস বা নিষ্ঠুর সৈনিককে কোনওভাবেই একজন সাধক বা বিজ্ঞানীর সাথে এক পাল্লায় মাপলে চলবে না, যার জ্ঞানের পেছনে হয়তো শত শত বছর লেগে গেছে। দাস, সৈনিক ও নির্বোধদের জন্মই হয়েছে মরার জন্যে। সেটা যদি তারা ভালো উদ্দেশ্যে করতে পারে, তাহলেই ভালো। অবশ্য সমাজে সাধক ও বিজ্ঞানীদের মূল্য অনেক বেশি, তাদের সম্মান দেখাতে হবে।

তোমার সাথে আমি একমত, ডাক্তার রেই। জ্ঞান আর বিদ্যাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সারা দুনিয়ার সমস্ত সোনা-রূপার চেয়েও দামী, বলল ডাক্তার আসেম। আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তি প্রয়োগ ও মনে করার ক্ষমতা আমাদের অন্যান্য পশুর চেয়ে উন্নত করে তুলেছে, যাদের এইসব গুণের ঘাটতি রয়েছে তাদের সবার চেয়ে উপরে তুলে দিয়েছে। আপনার কী মত, লর্ড তাই?

এখানে কোনও স্পষ্ট বা নিশ্চিত সমাধান নেই, সাবধানে জবাব দিল তাইতা। আমরা এনিয়ে অন্তহীনভাবে তর্ক করে যেতে পারি। তবে আমি বিশ্বাস করি, সবার জন্যে যা ভালো তাকে অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে হবে। তাতে ঠাণ্ডা মাথায় বিসর্জনের প্রয়োজন হলেও। যুদ্ধে আমি লোকজনকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি জানি ওদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতখানি তিক্ত হতে পারে। কিন্তু মুক্তি বা কল্যাণের প্রশ্নে ওদের নির্দেশ দিতে দ্বিধা করিনি। ও কি বিশ্বাস করে সেটা নয়, ওরা যা শুনতে চাইছে সেটাই বলছে ও। মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ওরা, শিথিল হলো; ওর প্রতি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন আরও পরিষ্কার ও উন্মুক্ত হয়ে উঠল। যেন পরিচয় পত্র দেখানোয় ওরা বাধা সরিয়ে ওকে নিজেদের দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

ভালো খাবার ও মদ থাকা সত্ত্বেও বেশিক্ষণ বসল না ওরা। সবার আগে উঠে দাঁড়াল গিব্বা। কাল অনেক সকালে উঠতে হবে আমাদের, ওদের মনে করিয়ে দিল সে, হান্নাহকে ধন্যবাদ জানাতে উঠে দাঁড়াল সবাই। তারপর বিদায় নিল।

তাইতাকে বিদায় দেওয়ার আগে সে বলল, ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণ কাল সকালে ওরাই আমাকে সাহায্য করবে। আপনার উত্তরসুরির চেয়ে আপনার ক্ষত অনেক গভীর, ব্যাপক; সবচেয়ে বড় কথা, অনেক বছর কাজ করে ওরা সংহত হয়েছে। আমাদের হাতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি কাজ থাকবে। বাড়তি লোক আর অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হবে আমাদের। তাছাড়া, কর্নেল ক্যাম্বিসেসের মতো এবার আপনার কোয়ার্টারে কাজ করতে পারব না। যেখানে প্রাথমিক পরীক্ষা করেছি, সেখানেই অপারেশন করতে হবে। ওর হাত ধরে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল সে। কাল সকালে চূড়ান্ত পরীক্ষা ও আমাদের অপারেশনের কৌশল স্থির করতে অন্য সার্জনরা যোগ দেবে আমাদের সাথে। আপনার শন্তিময় রাত কামনা করছি, লর্ড তাইতা।

তাইতাকে আবার ওর শোবার ঘরে নিয়ে যেতে অপেক্ষা করছিল প্রধান পরিচারক। প্যাসেজ আর গ্যালারির জটিল গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথের দিকে তেমন একটা নজর না দিয়েই তাকে অনুসরণ করল তাইতা। সন্ধ্যার কথোপকথন নিয়ে ভাবছিল ও, এমন সময় কান্নার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ল। থমকে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল। খুব বেশি দূর থেকে আসছে না। মেয়ের কান্না, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কান্নার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে দারুণ মরিয়া অবস্থায় পড়েছে সে। প্রধান পরিচারক তাকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ না করে তাইতা থেমে গেছে বুঝতে পেরে ফিরে এলো।

মেয়েটা কে? জানতে চাইল তাইতা।

ওগুলো অন্দরের দাসদের ঘর। সম্ভবত কাউকে অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নির্বিকারভাবে কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। দয়া করে এসব নিয়ে মাথা ঘমাতে যাবেন না, লর্ড তাই। আপনার সামনে বাড়া উচিত।

ব্যাপারটা নিয়ে কথা বাড়ানোয় কোনও যুক্তি পেলো না তাই। লোকটার আভা বলে দিচ্ছে সে দুর্ধর্ষ, স্রেফ ঊর্ধ্বতনদের হুকুমই তামিল করছে।

পথ দেখাও, সায় দিল তাইতা, কিন্তু এবার চলার পথ ভালো করে খেয়াল করে চলল। আমাকে ছেড়ে যাবার পর তল্লাশি চালাতে ফিরে আসব, সিদ্ধান্ত নিল ও। কিন্তু দ্রুত কাঁদতে থাকা মেয়ের ব্যাপারে ক্ষীণ হয়ে এলো ওর আগ্রহ। কোয়ার্টারে পৌঁছানোর আগেই মনে থেকে সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেল ভাবনাটা। মাদুরে শুয়ে রইল ও, প্রায় সাথে সাথে সহজ, ঝামেলাহীন ঘুমে তলিয়ে গেল।

*

ও নাশতা সারার প্রায় সাথে সাথেই হাজির হলো প্রধান পরিচারক। হান্নাহর কামরায় নিয়ে এলো তাইতাকে। এখানে চারজন সার্জনই ওর অপেক্ষায় ছিল। সাথে সাথে কাজ শুরু করল ওরা। তাইতার পক্ষে ব্যাপারটা অদ্ভুত, ওর সাথে আলোচনা করার বদলে ওকে কসাইয়ের দোকানের মরা মাংসের টুকরোর মতো দেখা।

প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু করল ওরা, ওর পরিপাক ব্যবস্থার ফল, শ্বাসপ্রশ্বাসের গন্ধ, ত্বকের অবস্থা, পায়ের তলা তাচ্ছিল্য করছে না। ওর মুখ খুলে জিহ্বা, মাঢ়ী আর দাঁত পরখ করল ডাক্তার রেই। লর্ড তাইতার দাঁতগুলো ভালোই জীর্ণ ও ক্ষয়ে গেছে, ডাক্তার হান্নাহ। গোড়া ভালোভাবেই নষ্ট হয়ে গেছে। এর জন্যে নির্ঘাৎ যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে তাকে। তাই না, মাই লর্ড? তাইতার গোঙানি থেকে স্পষ্ট কিছু বোঝা গেল না। আবার খেই ধরল রেই, শিগগিরই ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করবে এগুলো, শেষ পর্যন্ত জীবনকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। যত জলদি সম্ভব এগুলো ফেলে দিতে হবে, নতুন করে মাঢ়ীতে দাঁত বুনতে হবে।

সাথে সাথে একমত প্রকাশ করল হান্নাহ। আমি এসব হিসাবে ধরেছি, সেজন্যে কুঁচকির ক্ষতিগ্রস্ত জায়গার পুনরুজ্জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় সত্তার চেয়ে বেশি পরিমাণ সংগ্রহ করে রেখেছি। ওর মাঢ়ীতে ব্যবহারের জন্যে যথেষ্ট পাবে।

অবশেষে ওর ক্ষতস্থানে পৌঁছল ওরা। ওর শরীরের নিম্নাংশের উপর ঝুঁকে পড়ল, নির্বীজ করা জায়গায় চাপ দিচ্ছে, স্পর্শ করছে। ক্যালিপার্স দিয়ে জায়গাটা মাপল রেই, ছোট ছোট সুন্দর করে আঁকা হিয়েরোেগ্লাফিক হরফে প্যাপিরাসের ক্কোলে টুকে রাখল। কাজ করার সময় বিক্ষত জায়গাটা নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ঢঙে বিস্তারিত আলোচনা চালিয়ে গেল ওরা।

ক্ষতিগ্রস্ত সব টিস্যু সরিয়ে ফেলতে হবে। কাঁচা মাংসের স্তরে ঢুকে রক্তনালী উন্মুক্ত করতে হবে যাতে বেড়ে ওঠার জন্যে বীজ দৃঢ় ভিত্তি পায়, ব্যাখ্যা করল হান্নাহ। তারপর রেইয়ের দিকে ফিরল। তুমি মূল স্নায়ুগুলো খুঁজে বের করে সেগুলোর অবশিষ্ট কার্যকারিতা বের করতে পারবে?

স্নায়ুর শেষ প্রান্ত খোঁজার জন্যে একটা ব্রোঞ্জের উঁচ ব্যবহার করল রেই। তার খোঁচাখুঁচির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া রীতিমতো অত্যাচার হয়ে দাঁড়াল। যন্ত্রণা তাড়াতে চট করে মন অবরুদ্ধ করে ফেলল তাইতা। ও কী করছে বুঝে গেল রেই, স্রেফ বলল, ব্যথা দমানোর ক্ষেত্রে আপনার শক্তিকে সম্মান করি, লর্ড তাইতা, তাতে আপনার অবস্থা বরং আরও ভালো হবে। অবশ্য, আমার পরীক্ষার সময় আপনাকে তা বাদ দিতে হবে। রুদ্ধ করে রাখলে আপনার শরীরের কোন অংশ মৃত এবং সরাতে হবে, আর কোন অংশটুকু আবার নির্মাণের জন্যে জীবিত আছে বুঝতে পারব না।

হান্নাহর স্ক্যালপেল চলাতে সাহায্য করতে তাইতার তলপেটে কালো কালি দিয়ে রেখা আর প্রতীক আঁকল সে। সে ওটা নামিয়ে রাখার আগেই শত শত ছোট যন্ত্রণাদায়ক সঁচের খোঁচায় রক্তাক্ত হয়ে গেল তাইতা। অত্যাচারের ফলে রীতিমতো ফ্যাকাশে, ঘর্মাক্ত হয়ে গেল ও। যখন সামলে নিল, তখন হান্নাহর উপসংহার নিয়ে আলোচনা করল চার সার্জন।

আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বীজ ব্যবহার করায় ভালোই হয়েছে। প্রথমে যেমন ভেবেছিলাম চিকিৎসার এলাকাটা তারচেয়ে অনেক বড়। নতুন দাঁতের জন্যে। কাজে লাগানো সূঁচের সংখ্যা হিসাবে ধরলে আমরা তোলা সব বীজই লাগবে মনে। হচ্ছে, বলল হান্নাহ।

আসলেও তাই। উন্মুক্ত এলাকাটা অনেক বড়। এর আগে আমরা যত জায়গা নতুন করে গঠন করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় নেবে সেরে উঠতে। ক্ষতস্থানকে দূষিত না করে কীভাবে প্রস্রাব আর বর্জ্য বের করার ব্যবস্থা করা যায়? জানতে চাইল গিব্বা।

পায়ুপথ এখানে আসবে না, যথারীতি কাজ করে যাবে। অবশ্য ইউরেথ্রায় একটা তামার নল বসাতে হবে আমাকে। প্রথম দিকে তা প্রস্রাব বহন করবে, কিন্তু বীজ টিকে গিয়ে উন্মুক্ত এলাকা ঢেকে ফেললে অঙ্গের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে সরিয়ে ফেলতে হবে।

নিজেই প্রসঙ্গ হলেও বস্তুগত আগ্রহ দেখাতে পারল তাইতা, মাঝে মাঝে কিছু পরামর্শও দিল, অন্যরা স্বাগত জানাল সেটা। প্রক্রিয়ার সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা শেষে শেষবারের মতো ওর সাথে কথা বলল আসেম: ব্যথা। কমানোর মতো ভেষজ আছে আমার কাছে, কিন্তু সম্ভবত তার দরকার হবে না। ডাক্তার রেই আপনাকে পরখ করার সময় আপনার ব্যথা সামলানোর কায়দা দেখে অবাক হয়েছি। আপনি কি অপারেশনের সময় সেই একই কায়দা ব্যবহার করতে পারবেন, নাকি ওষুধটা ব্যবহার করতে হবে?

ওষুধটা যে বেশ কার্যকর তাতে আমার সন্দেহ নেই, তবে নিজেই ব্যথা সামলাতে চাই আমি, বলল তাইতা।

দারুণ মনোযোগ দিয়ে আপনার এই কৌশল লক্ষ করব।

হান্নাহ যখন আলোচনার সমাপ্তি টানল তখন মাঝ বিকেলে হয়ে গেছে। নিজের কোয়ার্টারে ফিরে আসতে পারল তাইতা। হান্নাহর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সে বলল, ডাক্তার আসেমের বানানো বেদনা নাশক ওষুধটা একটা কাঁচের শিশিতে আপনার বিছানার পাশে রাখা থাকবে। এক বাটি উষ্ণ পানি দিয়ে খেয়ে নেবেন। আজ রাতে বা কাল সকালে আর কিছু খাবেন না। সকালে আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে কাজ শুরু করতে চাই আমি। যথেষ্ট সময় নিয়ে কাজ করতে হবে। কী। ধরনের অপ্রত্যাশিত সমস্যার মোকাবিলা করতে হতে পারে তার কোনও ধারণা নেই আমাদের। তেলের কুপির আলো আমাদের কাজের জন্যে যথেষ্ট হবে না।

আমি তৈরি থাকব, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।

*

পরদিন সকালে তাইতা যখন হান্নার কামরায় পৌঁছুল, ওর সার্জনদের দলটা সমবেত হয়ে কাজ শুরু করতে তৈরি। মেরেনের সাথে এর আগের দফা কাজের সময় চেনা দুজন নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট পোশাক খুলতে সাহায্য করল ওকে। সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়ার পর পাথরের টেবিলে তুলে দিয়ে চিত করে শুইয়ে দিল ওকে। পিঠের নিচে শীতল, কঠিন ঠেকল পাথরটা, তবে বাতাস প্রীতিকরভাবে উষ্ণ, মেঝের নিচের গরম পানির নলের কারণে তপ্ত হয়ে আছে। চার জন ডাক্তারই কোমর পর্যন্ত নগ্ন, ওদের পরনে কেবল শাদা নেংটি। হান্নাহ ও রেইয়ের শরীরের উর্ধ্বাংশ ও স্তন অন্য তরুণীদের মতোই দৃঢ়, সুডৌল, ওদের ত্বক মসৃণ, কোঁচকানো নয়। তাইতা আন্দাজ করল নিজেদের এমনি অবস্থায় ধরে রাখতে নিশ্চয়ই প্রাচীন দক্ষতা কাজে লাগিয়েছে ওরা। নারী জাতির চিরন্তন অহঙ্কারের কথা ভেবে মনে মনে হাসল ও। তারপর আপনমনে চিন্তা করল: এখানে ছুরির অপেক্ষায় শুয়ে থেকে ওদের চেয়ে কম অহঙ্কারী আমি? হাসি বন্ধ করল ও, শেষবারের মতো কামরার চারপাশে নজর বোলাল। কাছেই আরেকটা মাৰ্বল পাথরের টেবিলে অসংখ্য রূপা, তামা ও ব্রোঞ্জের সার্জিকাল সরঞ্জাম স্তূপ করে রাখা দেখতে পেল। তার ভেতর টেবিলের উপর শাদা পাথরের উপর অন্তত পঞ্চাশটা চকচকে স্কেলপেল সাজানো দেখে অবাক হয়ে গেল ও।

ওর আগ্রহ লক্ষ করল হান্নাহ। তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি আমি, ব্যাখ্যা করল সে। আপনার এবং আমার সুবিধার জন্যে। কামরার দূর প্রান্তে আরেকটা ওঅর্ক টেবিলে বসা দুজন টেকনিশিয়ানের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওরা দক্ষ কাটলার। ধার কমার সাথে সাথে স্কেলপেলে শান দেবে ওরা। কাজ শেষ হওয়ার আগেই ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করবেন আপনি। সহকারীদের দিকে ফিরল সে। সবকিছু তৈরি থাকলে আমরা কাজ শুরু করতে পারি।

তীক্ষ্ণ গন্ধঅলা তরলে তাইতার শরীরের নিমাংশ মুছে দিল দুই পুরুষ নার্স। সার্জনরাও একই তরলে কনুই অবধি হাত ধুলে নিল। তাইতার পাশে এসে দাঁড়াল ডাক্তার রেই। আগের দিন আঁকা তার নকশাগুলো মিলিয়ে গিয়ে কেবল আবছাভাবে ফুটে আছে। সেগুলো নতুন করে আঁকল সে। তারপর হান্নাহকে পথ করে দিতে সরে দাঁড়াল।

কাটাছেঁড়া শুরু করতে যাচ্ছি। লর্ড তাইতা, এবার দয়া করে ব্যথা সহ্য করার জন্যে নিজেকে স্থির করে নেবেন?

লস্ত্রিসের মাদুলি আঁকড়ে ধরল তাইতা, ওর নগ্ন বুকে পড়েছিল ওটা। এক ধরনের কোমল কুয়াশায় নিজের মন আচ্ছন্ন করে ফেলল ও, ওর উপর ঝুঁকে থাকা চেহারাগুলো মুছে গিয়ে এক সময় স্রেফ আবছা রেখায় পরিণত হলো।

অদ্ভুতভাবে ওর কানে অনুরণিত হয়ে চলল হান্নাহর কণ্ঠস্বর। মনে হচ্ছে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে আপনি প্রস্তুত?

হ্যাঁ, প্রস্তুত। শুরু করতে পারো। হান্নাহ প্রথম ছুরি চালানোর সাথে সাথে এক ধরনের টানের অনভূতি বোধ করল ও। তবে অসহনীয় নয়। নিজেকে এমন একটা পর্যায়ে নামিয়ে আনল ও, যখন হান্নাহর স্পর্শ আর স্ক্যালপেলের কামড়ের কেবল আবছা অনুভূতি টের পেলো। সময় গড়িয়ে চলল। স্পর্শকাতর কোনও জায়গায় হান্নাহ কাজ করার সময় দুএকবার প্রবল হয়ে উঠল যন্ত্রণা। কিন্তু আরও গভীরে নেমে গেল তাইতা। ব্যথা কমলেই নিজেকে আবার ঠিক তলের নিচে তুলে আনছে, ওদের আলোচনা শুনছে, ফলে ওদের কাজের ধারা সম্পর্কে ধারণা করতে পারছে।

খুব ভালো, স্পষ্ট সন্তুষ্টির সাথে বলল হান্নাহ। ক্ষতিগ্রস্ত সব টিস্যু সরিয়ে ফেলেছি। এবার ক্যাথেটার ঢোকাব। শুনতে পাচ্ছেন, লর্ড তাইতা?

হ্যাঁ, ফিসফিস করে বলল তাইতা, কানে প্রতিধ্বনি তুলল ওর নিজেরই কণ্ঠস্বর।

যেমন আশা করেছিলাম তারচেয়ে ঢের ভালোই এগোচ্ছে সবকিছু। এবার নল বসাচ্ছি আমি।

ওটার শরীরে প্রবেশ টের পেল তাইতা, কিঞ্চিত অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি, গোপন করার দরকার মনে করল না ও।

এরই মধ্যে আপনার ব্লাডার থেকে টাটকা প্রস্রাব বের হতে শুরু করেছে, বলল হান্নাহ। সবকিছু তৈরি আছে। আপনি আরাম করতে পারেন। ল্যাবেরেটরি থেকে বীজ আসার অপেক্ষা করছি আমরা।

তারপর অনেকক্ষণ নীরবতা বজায় থাকল। নিজেকে আরও গভীর স্তরে নিয়ে গেল তাইতা, এখন কেবল পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ও। নীরবতা অব্যাহত রইল। কিন্তু নিজের মাঝে কোনওরকম সতর্কতা বা তাগিদ টের পাচ্ছে না। তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর একটা অচেনা উপস্থিতি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল ও। একটা কণ্ঠস্বর কানে এলো, হান্নাহর কণ্ঠস্বর, জানা থাকলেও এখন ভিন্ন রকম শোনাচ্ছে: কোমল, ভয় বা অন্য কোনও জোরাল অনুভূতিতে কাঁপছে। এটাই আসল সত্তা, বলল সে।

নিজেকে ব্যথা সহ্য করার মতো একটা স্তরে তুলে আনল তাইতা। চোখের পাতা সামান্য খুলে চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল। নিজের শরীরের উপর হান্নাহর হাত দেখতে পাচ্ছে। একটা অ্যালাবাস্টার পট ধরে রেখেছে ওগুলো, মেরনের চোখের জন্যে বীজসহ ঠিক এই রকমই একটা পট দেখেছিল ও, তবে এটা তুলনামূলকভাবে বড়। ওর দৃষ্টিপথ থেকে নিচে নামিয়ে নিল ওটা হান্নাহ। অ্যালাবাস্টার পট থেকে হান্নাহ উপকরণ তোলার সময় চামচের সাথে কর্কশ সংঘর্ষের আওয়াজ পেল তাই। খানিক পরে কুঁচকির কাছে উন্মুক্ত জায়গায় শীতল অনুভূতি বোধ করল, বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার সময় হালকা ছোঁয়া পেল। তারপরই ভিন্ন কিছু ধরা পড়ল ওর আধখোলা চোখে।

প্রথমবারের মতো বুঝতে পারল দূর দেয়ালের কাছে একটা অচেনা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দে উপস্থিত হয়েছে ওটা, দীর্ঘ তবে মূর্তির মতো কাঠামো, আপাদমস্তক কোমল মসৃণ রেশমী পোশাকের আড়ালে রয়েছে সে। শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে মানুষটার বুকের ক্ষীণ ওঠানামাই একমাত্র নড়াচড়া। পর্দার নিচের দেহ উদ্ধতভাবে নারীসুলভ, নিখুঁত আকার ও গঠন।

এক ধরনের বিস্ময় আর ভয়ের অপ্রতিরোধ্য বোধে আক্রান্ত হলো তাই। অন্তর্চক্ষু খুলে দেখতে পেল পর্দার আড়ালের অবয়বের কোনও আভা নেই। ওটা ইয়োস, নিশ্চিত হয়ে গেল ও, কোনও ছায়াময় প্রকাশ নয়, বরং খোদ ইয়োস, যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছে ও।

উঠে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে ইচ্ছা হলেও ঘোর থেকে পূর্ণ সজাগ হয়ে ওঠার চেষ্টা করার পরপরই ব্যথা প্রবল হয়ে উঠে ওকে ফেরত পাঠাল। কথা বলতে চাইল ও, কিন্তু জিভ দিয়ে কোনও আওয়াজই বের হলো না। কেবল তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে ও। তারপর কপালের পাশে একেবারে কোমল একটা অনুভূতি হলো, আঙুল বোলানোর মতো। ওটা হান্নাহর হাত নয়, জানে। মনের ভেতর প্রবেশ করে ওর ভাবনা জানার চেষ্টা করছে ইয়োস। চট করে মানসিক বাধা তুলে তাকে হতাশ করল ও। কোমল স্পর্শ মিলিয়ে গেল। ওর বাধা টের পেয়েছে ইয়োস, দক্ষ তলোয়ারবিদের মতো জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। বদলা নিতে সে তৈরি, কল্পনা করল ও। ওর প্রতিরক্ষার প্রথম জটিল স্বাদ পেয়েছে সে। বুঝতে পারছে ইয়োসের উপস্থিতিতে ভীত ও শঙ্কিত হওয়া উচিত, তার শয়তানি, অশুভের বিরাট ওজনের কারণে বিতৃষ্ণা বোধ করা উচিত। কিন্তু তার বদলে জোরাল অস্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করছে। দিমিতার ওকে এই সৌন্দর্য আর তার দিকে চোখ ফেরানো সকল পুরুষের উপর তার প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল। নিজের প্রতিরক্ষা শক্ত রাখার চেষ্টা করল ও। কিন্তু তারপরও বুঝতে পারল তার সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করতে চাইছে ও।

ঠিক এই সময় টেবিলের পায়ের কাছে গিয়ে ওর দৃষ্টি রুদ্ধ করে দিল হান্নাহ। চিৎকার করে তাকে সরে যেতে বলতে চাইল ও, কিন্তু এখন ইয়োস সরাসরি চোখের সামনে না থাকায় ওর নিয়ন্ত্রণ ফিরে এলো। মূল্যবান আবিষ্কার এটা। ও জানতে পেরেছে, ইয়োসের দিকে তাকিয়ে থাকলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে সে। চোখ সরিয়ে নিলে আকর্ষণ, শক্তিশালী হলেও, অগ্রাহ্য করা যায়। চুপ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইল ও, ব্যথাটাকে এমন একটা পর্যায়ে উঠে আসতে দিল যাতে ওর মাঝে ইয়োসের জাগিয়ে তোলা পাশবিক লালসা প্রতিরোধ করা যায়। এখন উন্মুক্ত ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে হান্নাহ, হাতের স্পর্শের দিকে মনোযোগ দিল ও, গায়ে লিনেনের টুকরো বিছানো টের পেল। কাজ শেষে ওর পাশে এসে দাঁড়াল হান্নাহ। দূর দেয়ালের দিকে তাকাল ও। কিন্তু ইয়োস চলে গেছে। কেবল তার মানসিক সত্তার ক্ষীণ আভাস রয়ে গেছে, মূল্যবান সুগন্ধির মতো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যেন এক ধরনের ধাওয়াকারী মিষ্টিভাব।

টেবিলের মাথার কাছে হান্নাহর জায়গা দখল করল ডাক্তার রেই। ওর মুখ খুলে চোয়ালের মাঝখানে কাঠের গেঁজ বসিয়ে দিল। ওর প্রথম দাঁতের উপর ফোরসেপ বসানো টের পেয়ে উপড়ানোর চেষ্টার আগেই ব্যথা আড়াল করল ও। দ্রুততার সাথে দাঁতগুলো তুলে ফেলল দক্ষ রেই। তারপর উন্মুক্ত ক্ষতস্থানে বীজ বসানোর পর সেলাই করে মুখ বন্ধ করাও টের পেল।

*

তাইতাকে পাথরের টেবিল থেকে তুলে আস্তে করে হালকা খাটিয়ায় তুলে দিল দুই পুরুষ নার্স। ওকে নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে যাবার সময় পাশে পাশে এগোল হান্নাহ। ওর ঘরে পৌঁছালে ওকে নিরাপদে খাটিয়া থেকে আবার মাদুরে নামানো তদারক করল। ওর আরাম ও যত্নের ব্যবস্থা করল।

অবশেষে ওর পাশে মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসল। দিনরাত সারাক্ষণ একজন নার্স থাকবে আপনার পাশে। আপনার অবস্থার সামান্য অবনতি টের পাওয়ামাত্র আমাকে খবর দিতে ছুটে যাবে ওরা। আপনার কিছু লাগলে ওদের জানালেই চলবে। রোজ সকাল-সন্ধ্যা ব্যান্ডেজ পাল্টে কত দূর অগ্রগতি হলো দেখতে আসব। ওকে বলল সে। সামনে কী অপেক্ষা করছে সেটা আপনাকে বলার কোনও প্রয়োজন দেখছি না। আপনার উত্তরসুবির চোখে বীজ বপনের সময় আপনি উপস্থিত ছিলেন। আপনিও ঘটনার ধারা জানেন-তিনদিন মোটামুটি যন্ত্রণাহীন কাটবে, ছয়দিনের যন্ত্রণা, অবশেষে দশম দিনে স্বস্তি। তবে কর্নেল ক্যাম্বিসেসের চেয়ে আপনার ক্ষত ঢের বড় বলে যন্ত্রণাও বেশি হবে। সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনার সব দক্ষতার দরকার হবে।

আরও একবার হান্নাহর পূর্বাভাস নির্ভুল প্রমাণিত হলো। প্রথম তিনটা দিন কেবল ছোটখাট অস্বস্তি নিয়ে কেটে গেল, পেটের গভীরে এক ধরনের ভেঁতা ব্যথা, জলত্যাগের সময় জ্বলন্ত অনুভূতি; মুখের ব্যথাটা আরও বেশি। মাটীতে রেইয়ের সেলাইগুলো জিভ দিয়ে স্পর্শ না করে থাকা কঠিন হয়ে উঠল। কঠিন খাবার খেতে পারছে না ও, স্রেফ হালকা ভর্তা করা সজির ব্রোথ খাচ্ছে। অনেক কষ্টে কোনওমতে হাঁটতে পারছে। একজোড়া ক্রাচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওরা, কিন্তু রাতে নাইটসয়েল পট ব্যবহার করার প্রয়োজন হলে নার্সের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

হান্নাহ ড্রেসিং বদলাতে এলে তার কাজের সময় নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল একটা কোমল আঠাল একটা চল্টা ঢেকে রেখেছে ক্ষতস্থানটা। গাম-অ্যারাবিক গাছের বাকল কাটলে বা পুড়ে গেলে যেমন রস বের হয়ে আসে অনেকটা সেরকম লাগছে। ওটাকে না নাড়ানোর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করছে হান্নাহ, লিনেনের ব্যান্ডেজের সাথে যাতে না লাগে তাই ডাক্তার অসেমের দেওয়া একটা পিচ্ছিল মলমে ঢেকে দিল ওটা।

চতুর্থ দিন সকালে এমন প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে জেগে উঠল যে ব্যথা দমন করতে মানসিক শক্তি কাজে লাগানোর আগেই নিজের অজান্তে যন্ত্রণায় তীব্র আর্তনাদ করে উঠল ও। নার্সরা ছুটে এলো, সাথে সাথে ডাক্তার হান্নাহকে খবর দিল। সে আসার আগেই সমস্ত শক্তি এক করে যন্ত্রণাকে এমন মাত্রায় নামিয়ে আনল ও, যার ফলে বুদ্ধি ঠিক রেখে কথা বলতে পারল।

এটা খারাপ, বলল হান্নাহ। কিন্তু এমনটা হবে জানতেন আপনি।

এমন অভিজ্ঞতা জীবনেও হয়নি। মনে হচ্ছিল যেন গলন্ত সীসা পেটে ঢেলে দেওয়া হয়েছে, ফিসিফিস করে বলল তাইতা।

ডাক্তার আসেমকে মলম লাগিয়ে দিতে ডেকে পাঠাতে পারি।

না, জবাব দিল তাইতা। একাই মানিয়ে নেব।

আরও ছয় দিন, ওকে সতর্ক করল সে। বেশিও হতে পারে।

বেঁচে থাকব। যন্ত্রণাটা ভয়াবহ, অবিরাম। ওর সমস্ত অস্তিত্ব ভরে তুলেছে। ব্যথাটা। ইয়োস বা ফেনের কথা ভাবতে পারছে না। কেবলই যন্ত্রণা। জেগে থাকার সময়টুকুতে সর্বাত্মক প্রয়াসে যন্ত্রণা চেপে রাখতে পারছে ও। কিন্তু যখনই ঘুম হারিয়ে দিচ্ছে, ওর প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ছে, পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসছে আবার। ফুঁপিয়ে জেগে উঠছে ও, ব্যথার তীব্রতায় গোঙাচ্ছে। ডাক্তার আসেমকে তলব করার প্রলোভনের কাছে পরাস্ত হতে ইচ্ছে করে ওর, যাতে মাদক নিয়ে আসে সে, কিন্তু সম্পূর্ণ মানসিক ও শারীরিক শক্তি দিয়ে সেটা ঠেকায়। ঘোরের ভেতর নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি বেদনার চেয়ে অনেক বেশি। ইয়োস আর মিথ্যার বিরুদ্ধে ওর দৃঢ় মনের জোরই একমাত্র অবলম্বন।

ছয়দিনের দিন ব্যথা বিদায় নিল, কিন্তু সাথে সাথে সে জায়গা দখল করে নিল প্রচণ্ড চুলকানি, যন্ত্রণাকে প্রতিরোধ করার চেয়েও অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াল সেটা। ড্রেসিং ছিঁড়ে নখ দিয়ে মাংসে আঁচড় বসাতে ইচ্ছা করে ওর। কেবল হান্নাহ ব্যান্ডেজ বদলাতে আসার সময়টুকুতেই সামান্য নিস্তার পায়। প্যাঁচানো ব্যান্ডেজ খুলে উষ্ণ ভেষজ মলম লাগানোর সময় শান্তি আর আরাম লাগে।

এতদিনে ওর তলপেট ঢেকে রাখা চল্টাটা কঠিন ও কালো হয়ে অ্যাযুর হ্রদের কুমীরের চামড়ার চেহারা পেয়েছে। শান্তির সময়গুলো খুবই সংক্ষিপ্ত। ডাক্তার হান্নাহ টাটকা লিনেনে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ামাত্রই ফের পূর্ণ শক্তিতে শুরু হয় চুলকানি। প্রায় পাগল করে তোলে ওকে। এর কোনও শেষ নেই যেন। দিনের হিসাব গুলিয়ে ফেলল ও।

এক পর্যায়ে ওর কাছে এলো রেই। নার্স ওর চোয়াল হ করে রাখলে মাঢ়ী থেকে সেলাই খুলে নিল সে। ক্ষতস্থানের প্রবল যন্ত্রণার কারণে এর কথা ভুলেই গিয়েছিল ও। অবশ্য, ওগুলোর প্রত্যাহারের ফলে পাওয়া সামান্য স্বস্তি ওর অটলতা জোরাল করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক ধরনের স্বস্তির জোয়ার বোধ করল ও, গুঙিয়ে উঠল। ব্যথা ও চুলকানি চলে গেছে। এরপরের নেমে আসা শান্তি এতটাই আশীর্বাদময় যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও, পুরো এক রাত এক দিন স্থায়ী হলো এই উপশমের ঘুম। আবার জেগে উঠল যখন, দেখল ওর মাদুরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে হান্নাহ। ও ঘুমে থাকা অবস্থায় ব্যান্ডেজ খুলে নিয়েছে। এতই ক্লান্ত ছিল ও, মহিলা কী করছে, টেরটিও পায়নি। ও মাথা তুলে তাকাতেই কর্তৃত্বপরায়ণ হাসি দিল সে।

ভালো হয়ে ওঠার সময়টাই সব সময় সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়, তবে এখানে তার কোনও চিহ্ন নেই। আপনার গায়ে জ্বর নেই। রোপিত বীজ গোটা এলাকায় মিশে গেছে। যন্ত্রণার সাগর পার হয়ে তীরে পৌঁছে গেছেন আপনি। বলল সে। আপনার ক্ষতস্থানের গভীরতা ও বিস্তৃতির বিচারে আপনার সাহস ও শক্তি ছিল নজীরবিহীন, যদিও আপনার কাছ থেকে এরচেয়ে কম কিছু আশা করিনি। এখন ক্যাথেটার খুলে নিতে পারব আমি।

সহজেই পিছলে বের হয়ে এলো তামার টিউবটা, আবারও আনন্দদায়ক হয়ে উঠল স্বস্তিটুকু। বিপদটা ওকে কতটা দুর্বল, পরিশ্রান্ত করে দিয়েছে বুঝতে পেরে অবাক হলো ও। হান্নাহ আর নার্সকে বসতে সাহায্য করতে হলো ওকে। নিজের শরীরের দিকে তাকাল ও। আগে থেকেই ছিপছিপে ছিল, কিন্তু এখন কঙ্কালসার অবস্থা হয়েছে ওর। মাংস যেন মিলিয়ে গেছে, পাঁজরের প্রতিটি হাড় মুখ বের করে আছে।

দেখুন, চল্টাটা উঠে আসতে শুরু করেছে, ওকে বলল হান্নাহ। দেখুন, কেমন করে কিনারা থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসছে। দেখুন, নিচে কেমন সেরে উঠছে। পুরোনো ও নতুন চামড়ার মিলনস্থলে আঙুল বোলাল সে। নিখুঁতভাবে মিশে গেছে দুটো। পুরোনো ত্বক অনেকটা ক্রিপে কাপড়ের মতো কুঁকড়ে আছে। বেরিয়ে থাকা এক চিলতে নতুন ত্বক পলিশ করা আইভরির মতো মসৃণ, দৃঢ়। ওটার উপর জেগে ওঠা সূক্ষ্ম জমিন ক্রমশঃ গাঢ় হয়ে উঠছে। নিচে নাভী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। চল্টার মাঝখানে একটা ফোকর, যেখান থেকে কপারের ক্যাথেটার খুলে নিয়েছে হান্নাহ। জায়গাটা ডাক্তার আসেমের আরেকটা পুরু মলমে ঢেকে দিয়েছে হান্নাহ।

নিচের নতুন টিস্যু নষ্ট না করেই চল্টা উঠে আসায় কাজ দেবে এই মলম, ব্যাখ্যা করল সে। আবার ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগল।

তার কাজ শেষ হওয়ার আগেই ডাক্তার রেই এলো কামরায়, তাইতার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। ওর মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। কিছু ঘটছে এখানে? জিজ্ঞেস করল সে। আগের গুরুগম্ভীর, পেশাদারী হাবভাবের তুলনায় মেয়েটার আচরণ শিথিল, বন্ধুত্বসুলভ।

তার আঙুলের কারণে তাইতার কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল। একটা কিছু বেড়ে ওঠা টের পাচ্ছি। মাঢ়ীর নিচে কঠিন কিছু রয়েছে। স্পর্শ করলে ব্যথা লাগছে।

দাঁত ওঠার ব্যথা, হেসে উঠল রেই। এখন দ্বিতীয় শৈশব পার করছেন আপনি, মাই লর্ড তাইতা। তাইতার মুখের ভেতর দিকে হাত চালিয়ে হেসে উঠল আবার। হ্যাঁ, আক্কেল দাঁতসহ পুরো সেট। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা দেবে। তখন রস আর ব্রথ ছাড়াও শক্ত জিনিস চিবিয়ে খেতে পারবেন।

সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ফিরে এলো রেই। পলিশ করা রূপার একটা আয়না নিয়ে এসেছে সাথে। ওটার তলটা এত মসৃণ যে তাইতার মুখের ফুটিয়ে তোলা প্রতিবিম্ব কিঞ্চিত বিকৃত দেখাল। যেন আরব সাগর থেকে আসা মুক্তোর মালা, তাই প্রথমবারের মতো সদ্য গজানো দাঁতের দিকে তাকালে বলল সে। সম্ভবত অনেক বছর আগে গজানো সেই প্রথম সারি দাঁতের চেয়ে অনেক বেশি সমান ও সুন্দর। যাওয়ার আগে সে বলল, আয়নাটা আমার তরফ থেকে উপহার হিসাবে গ্রহণ করুন। আমি নিশ্চিত অল্প দিনের মধ্যেই ওটা দিয়ে আরও অনেক কিছু দেখতে পাবেন।

তাইতার তলপেটের চল্টার শেষ টুকরোগুলো সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার চাঁদ পূর্ণতা পেল, ক্ষয়ে গেল। এখন স্বাভাবিক খাবার খাচ্ছে ও, হারিয়ে যাওয়া মাংস ফিরে পাচ্ছে। রোজ দীর্ঘ ছড়ির সাহায্যে নৈপূণ্য ও শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে গড়ে তোলা অনেকগুলো ব্যায়াম করে ও। একটা খাবারের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে ডাক্তার আসেম যাতে প্রচুর পরিমাণ গুল্ম ও সজি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সবকিছুই বেশ উপকারী প্রমাণিত হচ্ছে। গালের চেপে যাওয়া অংশ ভরাট হয়ে উঠেছে, গায়ের রঙ এখন অনেক স্বাস্থ্যকর। ওর কাছে মনে হচ্ছে হারানো মাংসপেশীর জায়গায় নতুন জন্মানো পেশী অনেক বেশি দৃঢ় ও শক্তিশালী। অচিরেই ক্রাচ ছেড়ে থেমে বিশ্রাম ছাড়াই হ্রদের কিনারে হাঁটতে সক্ষম হয়ে উঠল ও। তবে ওকে একাকী স্যানিটোরিয়ামের বাইরে যেতে দেয় না হান্নাহ। পুরুষ নার্সদের একজন থাকে সাথে। শক্তি ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে লাগাতার নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞা মেনে নেওয়া দারুণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। ক্রমবর্ধমানহারে একঘেয়েমীতে ভুগতে শুরু করল ও, অস্থির বোধ করছে। হান্নাহকে জিজ্ঞেস করছে, কবে আমাকে সেল ছেড়ে বাইরে যেতে দেবে?

আপনি পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত অলিগার্করা আপনাকে এখানে রাখতে বলেছে। তবে, আপনার দিনগুলো নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। সময় কাটাতে সাহায্য করার মতো একটা জিনিস দেখাচ্ছি আপনাকে। ওকে স্যানেটোরিয়ামের লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল সে। মূল কমপ্লেক্স থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওটা। বড়সড় একটা দালান, পরস্পর লাগোয়া অসংখ্য কামরার সমষ্টি। চার দেয়ালের প্রত্যেকটায় একটা করে শেল্ফ একেবারে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। প্যাপিরাসের স্কুল ও মাটির ফলকে ঠাসা।

আমাদের শেল্ফে বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণার হাজারেরও বেশি লেখা রয়েছে, সগর্বে বলল হান্নাহ। বেশির ভাগই অনন্য, এগুলোর অন্যকোনও অনুলিপি নেই। অর্ধেক পড়ে শেষ করতেও স্বাভাবিক আয়ু লেগে যাবে। ধীর পায়ে কামরায় হেঁটে বেড়াতে লাগল তাইতা, চলার পথে হয়তো একটা স্কুল বা মটির ফলক তুলে নিচ্ছে, বিষয় বস্তুতে চোখ বোলাচ্ছে। মূল কামরার দরজা একটা ভারি ব্রোঞ্জের অর্গল দিয়ে আটকানো। তীর্যক দৃষ্টিতে হান্নাহর দিকে তাকাল ও।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাই লর্ড, ওই বিশেষ কামরায় প্রবেশাধিকার ও ওখানে রাখা সমস্ত সংস্করণের অধিকার কেবল গিল্ডের সদস্যদের জন্যে তুলে রাখা, বলল সে।

বুঝতে পারছি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা, তারপর যেসব ঘর পার হয়ে এসেছে পেছন ফিরে সেগুলোর দিকে তাকাল। এটাই নির্ঘাৎ সভ্য মানুষের সংগ্রহ করা জ্ঞানের সবচেয়ে মূল্যবান ভাণ্ডার।

আপনার ধারণার সাথে আমি একমত, মাই লর্ড। এখানে আপনাকে মুগ্ধ কার মতো অনেক কিছুই পাবেন। এসব আপনার মনকে চাঙা করে তুলবে, এমনকি হয়তো দার্শনিক চিন্তাভাবনার নতুন পথও খুলে দিতে পারে।

নিশ্চিতভাবেই সুযোগটা কাজে লাগাব আমি। পরে সপ্তাহগুলোয় ঘন্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটাল তাই। কেবল উঁচু ছাদ গলে নেমে আসা আলো পড়ার পক্ষে বেশি ক্ষীণ হয়ে এলেই মূল ভবনের নিজের কোয়ার্টারের পথ ধরে।

একদিন সকালে নাশতা শেষ হলে দরজার বাইরে এক আগন্তুক ওর সাথে দেখা করতে অপেক্ষায় আছে জানতে পেরে যুগপৎ বিস্মিত ও বিরক্ত হলো ও।কে তুমি? অধৈর্য সুরে জানতে চাইল। লাইব্রেরিতে গিয়ে মহাজাগতিক ভ্রমণ ও যোগাযোগের উপর লেখা স্ক্রোলটা পড়তে অধীর হয়ে ছিল ও। গত কয়েক দিনে ওর পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে ওটা।

ডাক্তার হান্নাহর হুকুমে এসেছি আমি, ক্রমাগত প্রণাম করে আর সেঁতো হেসে বলল বেটে লোকটা। আপনার নাপিত।

তোমার সন্দেহাতীত নিপূণ সেবার কোনওই প্রয়োজন নেই আমার, চট করে বলল তাইতা, ওকে ঠেলে বের হয়ে যেতে চাইল।

ওর পথ আটকে দাঁড়াল নাপিত। দয়া করে শুনুন, মাই লর্ড। ডাক্তার হান্নাহ খুব জোর করেছেন। আপনি ফিরিয়ে দিলে আমার খুব সমস্যা হবে।

দ্বিধা করল তাইতা। যতদূর মনে করতে পারে নিজের চেহারা নিয়ে কখনওই তেমন একটা মাথা ঘামায়নি ও। বলতে গেলে প্রায় কোমর পর্যন্ত নেমে যাওয়া লম্বা চুল আর রূপালি দাড়িতে হাত চালাল ও। নিয়মিত ধুয়ে আঁচড়ালেও লাগামহীন অবিন্যস্তভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছে। সত্যি বলতে ডাক্তার রেইর কাছ থেকে গোপন উপহার হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওর কাছে একটা আয়নাও ছিল না। সন্দিহান চোখে নাপিতের দিকে তাকাল ও। আমার ধারণা, আলকেমিস্ট না হলে এই তুচ্ছ জিনিসকে কোনওভাবেই সোনায় পরিণত করতে পারবে না তুমি।

দয়া করে অন্তত চেষ্টা করে দেখতে দিন, মাই লর্ড। নইলে ডাক্তার হান্নাহ নাখোশ হবেন।

বেঁটে নাপিতের ভীতি হাস্যকর। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর হান্নাহকে নিদারুণ ভয় পায়। ওর পক্ষে যতটা সম্ভব সৌজন্যের সাথে তাকে মেনে নিল তাইতা। বেশ, ঠিক আছে, কিন্তু জলদি।

ওকে টেরেসে নিয়ে গেল নাপিত। আগেই এখানে রোদে একটা টুল পেতে রেখেছিল সে। সরঞ্জাম হাতের কাছেই ছিল। প্রথম কয়েক মিনিট পেরুনোর পর তার কাজের কায়দা দারুণ আরামপ্রদ আবিষ্কার করল তাইতা। শিথিল হয়ে গেল ও। নাপিত চুল দাড়ি আঁচড়ে কাটার সময় লাইব্রেরিতে ওর অপেক্ষায় থাকা ফ্রোলের কথা ভাবতে লাগল তাইতা। আগের দিন পড়া বিভিন্ন অংশ মনে মনে উল্টেপাল্টে দেখল। আপনমনে সিদ্ধান্তে পৌঁছুল যে বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখকের জ্ঞান একেবারেই ভাসা ভাসা; সুযোগ পেলেই তাতে ওর নিজস্ব বাদ পড়া উপাদান যোগ করবে। তারপর ফেনের কথা ভাবতে শুরু করল ও। অনেক মনে পড়ছে ওকে। কেমন আছে ও, সিদুদুর কী হয়েছে, এসব ভাবল ও। রাস্তার পাথরে শরতের ঝরা পাতার মতো ঝরে চলা পাকা চুলদাড়ির দিকে নজরই নেই।

অবশেষে বেঁটে নাপিত মুখের সামনে একটা বিরাট আয়না ধরে চিন্তায় বাদ সাধল। আশা করি আমার কাজ আপনাকে খুশি করবে।

চোখ পিটপিট করল তাইতা। ধাতুর অমসৃণ সমতলের কারণে ওর প্রতিবিম্ব বিকৃত ও কাঁপতে লাগল; সহসা স্থির হয়ে এলো ওটা। যা দেখল তাতে রীতিমতো হতচকিত হয়ে গেল। ওর দিকে উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চেহারাটা চিনতে রীতিমতো কষ্ট হলো। যতদূর মনে করতে পারে, তার চেয়ে ঢের বেশি তরুণ দেখাচ্ছে। নাপিত ওর চুল কাঁধ পর্যন্ত হেঁটে তারপর চামড়ার ফিতেয় মাথার পেছনে ঝুঁটি বেঁধে দিয়েছে। ওর দাড়ি হেঁটে চৌকো আকার দিয়েছে সে।

আপনার খুলির আকার খুবই ভালো, বলল নাপিত। ভুরু চওড়া আর ঘন। দার্শনিকের মাথা। যেভাবে পেছনে আপনার চুল আঁচড়ে দিয়েছি, সবচেয়ে ভালোভাবে আভিজাত্যটুকু ফুটে উঠেছে। আগে আপনার দাড়ি চোয়ালের শক্তি আড়াল করে রেখেছিল। ছোট করে ছাঁটায়, আমি যেভাবে করেছি, তাতে সেটা বেড়ে গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।

তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে বেশ খুশিই ছিল তাইতা। সেই সময় তা খানিকটা পুরুষত্বহীনতা পুষিয়ে দিয়েছিল। এখন দেখতে পাচ্ছে, এত দিন পরেও, চেহারা পুরোপুরি খোয়ায়নি ও।

ফেন অবাক হয়ে যাবে, ভাবল ও। আনন্দের সাথে মৃদু হাসল। আয়নায় ঝিকিয়ে উঠল ওর নতুন দাঁত। চোখের অভিব্যক্তি দ্রুততর হয়ে উঠল। ভালো কাজ দেখিয়েছ, সায় দিল ও। এমন তুচ্ছ মাল দিয়ে এমন অসাধারণ কাজ সম্ভব ভাবিনি।

সেদিন সন্ধ্যায় হান্নাহ ওর সাথে দেখা করতে এলে চিন্তিত চেহারায় ওর চেহারার বৈশিষ্ট্য পরখ করল। অনেক আগেই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে প্রেম বিলাসে অযথা সময় নষ্ট না করে অন্য কাজের মতো কাজে মাথা খাটালেই ভালো, বলল সে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কোনও কোনও মেয়েমানুষ কেন আপনাকে সুদর্শন সুপুরুষ ভাবতে পারে, মাই লর্ড। আপনি অনুমতি দিলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের স্বার্থে সতর্কতার সাথে নির্বাচিত গিল্ডের কয়েকজন সদস্যকে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই যাতে আপনি কী পেয়েছেন তার একটা ধারণা পায়।

তুমি ও তোমার সহকর্মীরা যা পেয়েছে, শুধরে দিল তাইতা। অন্তত এটুকু সৌজন্য পাওনা আছো তুমি।

কয়েকদিন পরে হান্নাহর অপারেটিং রূমে এলো ও। তাড়াহুড়ো করে লেকচার রূমে পরিণত করা হয়েছে ওটাকে। পাথুরে টেবিলের সামনে টুলগুলো অর্ধবৃত্তাকারে বসানো হয়েছে। গিব্বা, রেই ও আসেমসহ আটজন নারীপুরুষ আসন গ্রহণ করেছে।

তাইতাকে টেবিলের কাছে নিয়ে এলো হান্নাহ, ছোট দর্শকমণ্ডলীর মুখোমুখি বসতে বলল ওকে। শুরু থেকে ওর সেবা করা সার্জনরা ছাড়া এদের সাথে আগে পরিচয় হয়নি তাইতার। মেঘ-বাগিচায় ওর দীর্ঘ দিন অবস্থানের কথা ভাবলে ব্যাপারটা বিস্ময়করই লাগে। নিশ্চয়ই স্যানিটোরিয়াম ওর ধারণার চেয়েও বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত; কিংবা অন্যান্য বিভাগগুলো মূল ভবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও লাইব্রেরির মতো বনে লুকানো। তবে সবেচেয়ে বেশি সম্ভাবনা, মেঘ-বাগিচার বেশির এলাকাই এখনও ইয়োসের অপ-শিল্পকর্মের কারণে ওর কাছে থেকে আড়াল করে রাখা। ছেলেমানুষি ধাঁধার মতো বাক্সের ভেতর বাক্স লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

নবাগতদের একজন মেয়ে। বাকিরা পুরুষ। সবাইকেই বিশিষ্ট ও গণ্যমান্য বিজ্ঞানী মনে হচ্ছে। তাইতাকে চরম তোষামুদে ভঙ্গিতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর ওর চিকিৎসার বর্ণনা দিল হান্নাহ। তাইতার পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত ফেলে মাঢ়ীতে নতুন দাঁতের বীজ বপন করার বর্ণনা দিল রেই। এরপর আমন্ত্রিত অতিথিদের এক এক করে নতুন দাঁত পরখ করতে বলল। গোটা পরীক্ষার সময় নিরাসক্ত চেহারায় বসে রইল তাইতা, ওদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিল। ওরা আবার টুলে বসলে ওর পাশে দাঁড়াল এসে হান্নাহ।

তাইতার নির্বীজকরণ ও ক্ষতের গভীরতার ব্যাখ্যা দিল। শ্রোতারা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। মেয়ে বিজ্ঞানী বিশেষভাবে আলোড়িত হয়ে স্পষ্ট ভাষায় সহানুভূতি জানাল।

তোমার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ, জবাব দিল তাইতা। তবে অনেক কাল আগের ঘটনা এটা। বছরের পরিক্রমায় সেই স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি চাপা দেওয়ার এক ধরণের কৌশল রয়েছে মানুষের মনের। সায় দিয়ে মাথা দোলাল ওরা।

প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন পরীক্ষা ও অপারেশনের প্রস্তুতির বিবরণ দিল হান্নাহ।

তাইতা ভেবেছিল গ্র্যাফটিংয়ের জন্যে ফসল তোলা ও বীজ লাগানোর ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করবে। এই ব্যাপারে অজ্ঞ রাখা হয়েছে ওকে, ব্যাখ্যা জানতে অধীর উৎসাহ বোধ করছে ও। কিন্তু হতাশার সাথে লক্ষ করল তেমন কোনও প্রয়াসই পেল না। সে। দর্শকরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল, ধরে নিল ও, সম্ভবত নিজেদের কাজেও একই কৌশল কাজে লাগায় ওরা। যাহোক, অপারেশনের বর্ণনা দিতে শুরু করল হান্নাহ: কীভাবে বিক্ষত টিস্যু একেবারে ভিত্তি থেকে কেটে সেখানে গ্রাফট বীজ বপন করেছে। সহকর্মীরা অসংখ্য অনুসন্ধানী, শিক্ষামূলক প্রশ্ন রাখল, বিস্তারিত উত্তর দিল সে। শেষে ওদের বলল, তোমরা সবাই জানেনা, লর্ড তাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের ম্যাগাস, তাছাড়া বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক ও নিজস্ব অবস্থানে একজন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষকও বটে। তার পুরুষাঙ্গের পুনর্গঠন ছিল অস্বাভাবিকভাবে একান্ত ও স্পর্শকাতর ব্যাপার। বলাবাহুল্য, অনেক যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। এসবই ছিল তাঁর মতো অসাধারণ ব্যক্তির মর্যাদা ও গোপনীয়তার উপর এক ধরনের বিশাল ভার। তাসত্ত্বেও তিনি আমাদের পরীক্ষা ও তার ফলাফল মূল্যায়ন করতে দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, আমরা মেনে নেব যে এটা. তার পক্ষে কোনওভাবেই সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। এ সুযোগ পাওয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।

অবশেষে তাইতার দিকে ফিরল সে। আপনার অনুমতি চাইছি, লর্ড তাই।

মাথা দুলিয়ে টেবিলের উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ও। এগিয়ে এসে হান্নাহর উল্টোদিকে টেবিলের পাশে দাঁড়াল গিব্বা। তাইতার টিউনিকের হেম ওঠাল ওরা। ভালো করে দেখতে আরও কাছে আসতে পারো, দর্শকদের বলল হান্নাহ। টুল ছেড়ে টেবিলের চারপাশে একটা অর্ধবৃত্ত তৈরি করে দাঁড়াল ওরা।

এমনি দর্শনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে ওদের পরীক্ষার অধীনে বিশেষ কোনও লজ্জা বোধ করল না তাইতা। হান্নাহ বক্তব্য শুরু করার পর কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকাল ও।

নতুন ত্বক কীভাবে ক্ষতস্থান ঢেকে ফেলেছে দেখতে পাবে। বয়ঃসন্ধির পুরুষের শরীরে যেমনটা আশা করা যায় এর পেলবতা ও স্থিতিস্থাপকতা ঠিক তেমনি। স্পর্শ করলে বুঝতে পারবে গোটা মাংসল ঢালটা কোমরের হাড়ের উপর মাংসের একটা আস্তরণ সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে বিকাশটা দশ বছরের বালকের মতো। অপারশেনের কয়েক সপ্তাহর মধ্যেই এই অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। টেবিলের উপর দিয়ে একমাত্র নারী দর্শকের দিকে তাকাল সে। ডাক্তার লাসুলু, নিজের হাতে পরীক্ষা করে দেখতে চাও?

ধন্যবাদ, বলল মহিলা। দেখে মনে হচ্ছে পঁয়ত্রিশের কোঠায় হবে তার বয়স, কিন্তু তাই ওর আভা পরখ করলে দেখা গেল ব্যাপারটা প্রতারণামূলক, আসলে আরও বেশি বয়স তার। গম্ভীর হাবভাব আসলে তার আসল স্বভাব তুলে ধরে না। এক ধরনের কামুক ভাব রয়েছে ওর। পরখ করল সে। হ্যাঁ, অবশেষে বলল। নিখুঁতভাবে গঠিত বলেই মনে হচ্ছে। আপনি কোনও শিহরণ বোধ করছেন, লর্ড তাইতা?

হ্যাঁ। কর্কশ শোনাল ওর কণ্ঠস্বর।

আপনার বিব্রত হওয়ার প্রয়োজন নেই, মাই লর্ড। আপনাকে অবশ্যই ডাক্তার হান্নাহর ফিরিয়ে দেওয়া পুরুষালি অংশ উপভোগ করতে হবে। এর মাঝে আনন্দ ও গৌরব পেতে হবে। কীভাবে আপনাকে খেলাচ্ছি বুঝতে পারছেন?

খুবই পরিষ্কার, আরও কর্কশ হয়ে উঠেছে তাইতার কণ্ঠস্বর। এই অনুভূতি ওর আগের যেকোনও অনুভূতিকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষুদে বাড়তি এই অংশটুকু যোগ হওয়ার পরের সংক্ষিপ্ত সময়ে ওটাকে খুবই সাবধানতা ও যত্নের সাথে ব্যবহার করে এসেছে ও। স্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক ডাকের কারণে একান্ত বাধ্য হলেই কেবল ব্যবহার করেছে। এমনকি তখনও ওর স্পর্শ ছিল আনাড়ী, অদক্ষ। ডাক্তার লাসুলুর মতো নৈপূণ্য বা দক্ষতার কিছুই ছিল না।

অঙ্গগুলো পুরোপুরি সংগঠিত হয়ে ওঠার পর কী রকম ফল আশা করছ? ডাক্তার হান্নাহকে জিজ্ঞেস করল ডাক্তার লাসুলু।

একটা বাচ্চা ছেলের বেলায় যতটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব তারচেয়ে বেশি নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। তবে আশা করছি, শেষ পর্যন্ত আদি অঙ্গের খুব কাছাকাছি একটা অনুকৃতি হয়ে উঠবে ওগুলো।

খুবই কৌতূহলোদ্দীপক, বিড়বিড় করে বলল ডাক্তার লাসুলু। তোমার কি মনে হয়, আগামীতে কোনও এক সময়ে আদি অঙ্গের চেয়ে উন্নত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্মাণ সম্ভব হতে পারে? যেমন ধরো, নিখুঁত নমুনা দিয়ে একটা থ্যাঁতলানো পা বা কাটা ঠোঁট বদলানো; অস্বাভাবিক ছোট শিশ্নকে বড় শিশ্ন দিয়ে পাল্টানো? কাজটা কি অসম্ভব?

অসম্ভব? না, ডাক্তার, কোনও কিছুই অসম্ভব নয়, যতক্ষণ না সেটা প্রমাণ করতে পারছ। আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারলেও আমার পরে যারা আসবে তারা নিশ্চয়ই সফল হবে।

আরও খানিকক্ষণ স্থায়ী হলো ওদের আলোচনা, তারপর কথা রেখে তাইতার দিকে মনোযোগ দিল লাসুলু। এখনও ওর অঙ্গে হাত বোলাচ্ছে। এখন তাকে খুশি মনে হচ্ছে। ওহ, বেশ ভালো, বলল সে। জিনিসটা কার্যকর। এটাই আসলে তোমার দক্ষতার প্রমাণ, ডাক্তার হান্নাহ। শেষ পর্যন্ত চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে মনে করো? নাকি সে সময় এখনও হয়নি? পূর্ণ মনোযোগর সাথে ওর শিশ্ন পরখ করল দুই মহিলা।

প্রশ্নটা নিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে ভাবল হান্নাহ। তারপর জবাব দিল। আমার ধারণা চরম পর্যায় যাওয়া সম্ভব হয়ে গেছে।

আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। ডাক্তার, তুমি কী বলে?

শীতল নৈর্ব্যক্তিক ঢঙে আলোচনা করে চলেছে ওরা। অবশ্য ডাক্তার লাসুলু হাতের সহজ সঞ্চালনে যেমন অনুভূতি সৃষ্টি করছে, রীতিমতো বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগল তাইতা। হাত বাড়িয়ে হাতটা সরিয়ে দিল ও। ধন্যবাদ, ডাক্তার, বলল ও।

আমরা সবাই ডাক্তার হান্নাহর শৈল্য চিকিৎসার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছি। আমি তো বটেই। তাসত্ত্বেও, তুমি যে পরীক্ষার কথা বলছ সেটা আরেকটু কম লোকের সামনে হলেই ভালো হবে। টিউনিকের স্কার্ট ঠিক করে উঠে বসল ও।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসল ডাক্তার লাসুলু। আপনার অনেক আনন্দ প্রত্যাশা করছি। তার চোখের চাহনি থেকে পরিষ্কার যে ডাক্তার হান্নাহর মতো ফুর্তির দর্শনে বিশ্বাস করে না সে।

*

এখন বিশাল লাইব্রেরিতে যাবার সুযোগ মেলায় দ্রুত কেটে যাচ্ছে তাইতার নসময়। হান্নাহ যেমন বলেছিল, ওখানে জমানো সম্পূর্ণ জ্ঞান রপ্ত করার জন্যে একটা মানুষের পূর্ণ আয়ু যথেষ্ট নয়। অদ্ভুতভাবে তালাবদ্ধ নিষিদ্ধ কামরার প্রতি কোনও কৌতূহল পুষে রাখেনি ও। রাতের ক্রন্দসী নারী ও অন্য অনেক অব্যাখ্যাত বিষয়ের মতো ভাবনাটা কেবল ওর স্মৃতির গভীরে কোথাও হারিয়ে গেছে।

পড়াশোনায় ব্যস্ত না থাকলে বেশির ভাগ সময়ই হান্নাহ, রেই ও আসেমের সাথে আলোচনায় সময় কাটায় ও। পালা করে ওকে অন্যান্য ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যায় ওরা, যেখানে আরও বেশ কিছু অনন্য সাধারণ পরীক্ষানিরীক্ষা করছে।

উন্নত প্রত্যঙ্গ দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত ডাক্তার লাসুলুর প্রশ্ন মনে আছে? জানতে চাইল ডাক্তার হান্নাহ। ধরুন, কল্পনা করা যাক, একজন সৈনিকের পা তাকে ঘোড়ার মতো দ্রুত ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাকে এক জোড়ার চেয়ে বেশি হাত করে দিতে পারলে কেমন হবে? এক হাতে তীর ছুঁড়বে, দ্বিতীয়টা দিয়ে যুদ্ধ কুড়োল হাঁকাবে, আর তৃতীয় জোড়া থাকবে তলোয়ার ঘোরানো আর বর্ম বইবার জন্যে। এমন একজন যোদ্ধার সামনে কিছুই টিকবে না।

চারখানা শক্তিশালী বাহু আর খুবই খাট পায়ের একজন দাসকে অনেক বেশি পরিমাণে সোনার ও্যর তুলে আনতে খনির একেবারে বদ্ধ স্টোপে পাঠানো যেতে পারে, বলল রেই। তার বুদ্ধিকে একটা ষাঁড়ের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হলে তো আরও ভালো। তাতে কঠোর পরিশ্রম নিয়ে মাথা ব্যথা থাকবে না তার, বিনা অভিযোগেই কঠিন অবস্থায় কাজ করে যাবে সে। ডাক্তার আসেম এমন এক ধরনের গুল্ম উৎপাদন করেছে যেটা এই ধরনের মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। সময় হলেই ডাক্তার হান্নাহ আর আমি হয়তো ভৌত উন্নতি ঘটাতে পারব।

নিঃসন্দেহে এইসব উদ্যানের প্রবেশ পথের সুড়ঙগুলোয় পাহারাদার প্রশিক্ষিত শিম্পাঞ্জিগুলো দেখেছেন, বলল হান্নাহ।

হ্যাঁ, দেখেছি, শুনেছি, ওদের নাম ট্রগ, জবাব দিল তাইতা।

বিরক্তির সাথে ওর দিকে তাকাল হান্নাহ। সাধারণ লোকদের মুখে তৈরি একটা শব্দ। আমরা যে নাম ব্যবহার করি সেটা হলো, ট্রোগলোলাইট। আসলে গেছো শিম্পাঞ্জির একটা দল থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে ওদের। দক্ষিণের বিশাল বনে থাকত ওরা। শত শত বছরের পরিক্রমায় বন্দি অবস্থায় প্রজনন, শৈল্য চিকিৎসা আর বিশেষ কিছু ভেষজের মাধ্যমে ওদের বুদ্ধি আর আগ্রাসনকে আমাদের কাছে কাজে লাগার মতো একটা পর্যায়ে তুলে আনতে পেরেছি আমরা। একই কায়দা ওদের নিয়ন্ত্রণকারী লোকদের বশে না আসা পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। অবশ্যই ওদের মনে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ও বর্বরসুলভ। ফলে ওরা মানুষের তুলনায় ঢের বেশি ইচ্ছামতো কাজ করার উপযোগি হয়েছে। অবশ্য, একই কৌশলে আমাদের কিছু বন্দি ও দাসদের উপর পরীক্ষা চালাচ্ছি আমরা। বেশ উত্তেজনাকর ফল পেয়েছি। একবার গিল্ডের সদস্য হয়ে গেলে আপনাকে খুশি মনেই ওদের দেখাব।

এইসব তথ্যে রীতিমতো অসুস্থ বোধ করছে তাইতা। এমন সব প্রাণী সৃষ্টির কথা বলছে ওরা, যারা আর মুনষ নেই, বরং অস্বাভাবিক দানবে পরিণত হয়েছে, ভাবল ও। কিন্তু নিজের শঙ্কা প্রকাশ না করার ব্যাপারে সতর্ক রইল ও। এই মানুষগুলো ইয়োসের অশুভ প্রভাবে প্রভাবিত। ওদের মেধাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে, তার বিষে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। মেরেন, নাকোন্তোদের মতো ভালো সৎ লোকজনের সঙ্গ থেকে কীভাবে দূরে সরে আছি আমি। কতদিন ফেনের ঝলমলে সারল্য থেকে দূরে রয়েছি।

কিছু সময় পরে ওরা লাইব্রেরি থেকে ফিরে আসার সময় কবে মেঘ-বাগিচা ছেড়ে অন্তত অল্প সময়ের জন্যে হলেও মুতাঙ্গি গ্রামে ফিরে যেতে পারবে, সেই প্রসঙ্গ হান্নাহর কাছে তুলল ও। আমার অবিরাম অনুপস্থিতিতে সঙ্গীসাথীরা নিশ্চয় নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আছে। ওদের আমার নিরাপত্তা ও সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত করতে চাই। তাহলে গিল্ডে যোগ দিতে আবার ফিরে আসতে পারব।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাই লর্ড, এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই, জবাব দিল সে। মনে হচ্ছে, সুপ্রিম কাউন্সিল চায় আপনি পুরোপুরি যোগ না দেওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকুন। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল সে। তবে মন খারাপ করবেন না, মাই লর্ড। আর এক বছরের চেয়ে বেশি হবে না সময়টা। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমাদের সাথে কাটানো সময়টুকু যতদূর সম্ভব ফলপ্রসু ও সুফলদায়ী করে তুলব।

মেরেন বা ফেনকে না দেখে আরও একটা বছর কাটানোর সম্ভাবনা শঙ্কিত করে তুলল তাইতাকে। তবে এই ভেবে সান্ত্বনা পেল যে, ওর সাথে ডাইনী যে খেলা খেলছে, অতদিন সময় নষ্ট করতে যাবে না সে।

বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে বেড়ে উঠত লাগল ওর নতুন অঙ্গ। ডাক্তার লাসুলুর পরামর্শ মনে রেখেছে ও। আপনাকে অবশ্যই ডাক্তার হান্নাহর দেওয়া পুরুষালী অঙ্গটি উপভোগ করতে হবে, ওটা থেকে আনন্দ ও গৌরব লাভ করতে হবে। নিজের মাদুরে একাকী রাতে নিজের মাঝে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করল ও। নিজের হাতে সৃষ্ট অনুভূতি এতই তীব্র যে স্বপ্নেও হানা দিতে লাগল। গুহার কামুক শয়তানগুলোর ওর মনে লেলিয়ে দেওয়া ছবিগুলো আরও বেশি জোরাল ও চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। এইসব স্বপ্নে সুন্দরী এক পরী এসে ধরা দিচ্ছে ওর কাছে।

উঠে বাতি জ্বালল ও। রেইয়ের দেওয়া রূপালি আয়নাটা পেয়ে আবার মাদুরে হাঁটু গেড়ে বসতে ফিরে এলো। বাতির আলোয় পুরুষাঙ্গের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল। পুকুরের জলে ইম্প যেমন দেখিয়েছিল ঠিক তেমনি নিখুঁত।

এখন স্বাভাবিক পুরুষদের তাড়িত করা তাগিদ বুঝতে পারছি। আমিও তাদের একজনে পরিণত হয়েছি। নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে লাসুলুর বলা সমস্ত আনন্দ ও খুশি বয়ে আনবে, আর উল্টে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করলে ঠিক ইয়োসের পরিকল্পনা মাফিক ধ্বংস করে দেবে আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *